দশম অধ্যায়
কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা
বৃটিশ সরকার ১৯শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৬, ঘোষণা করেন যে, ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনান্তে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে তিনজন কেবিনেট মন্ত্রী সমন্বয়ে একটি বিশেষ মিশন ভারতে প্রেরণ করা হবে।
এ প্রসংগে হাউস অব কমন্সে ১৫ই মার্চ এক বিতর্ক চলাকালে প্রধানমন্ত্রী এটলী বলেন, বহু জাতি, ধর্ম ও ভাসার দেশ ভারতে যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার অপসারণ ভারতীয়দের দ্বারাই হবে। আমরা সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। ….তাই বলে আমরা সংখ্যাগুরুদের অগ্রগতিতে ভেটো প্রদান করার অনুমতি সংখ্যালঘুকে দিতে পারিনা।
প্রধানমন্ত্রীর উক্ত বক্তব্যে কংগ্রেস ভয়ানক উল্লসিত হয়। কিন্তু এতে লীগ মহলে সংশয় দেখা দেয় এবং জিন্নাহ মাকড়সার জালে মাছির আমন্ত্রণের দৃষ্টান্ত পেশ করে বলেন –If the fly refuses, it is said a veto is being exercised and the fly in intransigent (মাছি মাকড়সার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলে বলা হয় ভেটো প্রদান করা হচ্ছে এবং মাছি আপোসকামী নয়।)
-(Cabinet Mission and after, Muhammad Ashraf, p.1-3, Choudhury Mohammad Ali: Emergnce of Pakistan, p.52)
এর চেয়ে সুন্দর দৃষ্টান্ত কিছু হতে পারেনা। সংখ্যাগরিষ্ঠেতর একচ্ছত্র প্রাধান্য ও আধিপত্যের ফাঁদে পা দিতে সংখ্যালঘু রাজী না হলে সেটাকে ভেটোর সমতুল্য মনে করে বৃটিশ প্রধানমন্ত্র বলেন, তা করতে দেয়া যাবেনা। এতে এটলী তথা বৃটিশ সরকারের মনোভাব পরিস্ফুট হয়ে পড়ে।
যাহোক প্যাথিক লরেন্স (ভারত সচিব), স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস (প্রেসিডেন্ট অব দি বোর্ড অব ট্রেডস) এবং মিঃ এ, ডি, আলেকজান্ডারকে (ফার্স্ট লর্ড অব দি এডমিরাল্টি) নিয়ে গঠিত কেবিনেট মিশন ২৪শে মার্চ, ১৯৪৬ নতুন দিল্লী পৌঁছেন।
মিশন সদস্যগণ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীদের সাথে এবং আরও বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির সাথে দেখাসাক্ষাৎ ও মত বিনিময় করেন। দেশীয় রাজ্যের শাসকবৃন্দ ও মন্ত্রীদের সাথেও তাঁরা আলাপ আলোচনা করেন।
কেবিটেন মিশটে ক্রিপস আছেন জেনে আবুল কালাম আজাদ গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেন। কারণ তিনি ছিলেন কংগ্রেসীদের পুরাতন অন্তরংগ বন্ধু। ক্রিপস ইতিপূর্বে ভারতে এসে জনৈক ভারতীয় হিন্দু সুধীর চন্দ্রগুপ্তের অতিথেয়তা গ্রহণ করেন। (Moulana Abul Kalam Azad: ‘India Wins Freedom’, p.146)
আজাদ তেসরা এপ্রিল মিশনের সাথে দেখা করেন। স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে তিনি তাঁর যুক্তিতর্কের প্রাসাদ নির্মাণ করে রেখেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, একটি গণপরিষদ ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র তৈরী করবে এবং কংগ্রেসের দাবী হচ্ছে একটি ফেডারেল সরকার গঠনের যার হাতে থাকবে অন্ততঃ দেশ রক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক বিভাগ। ভারত বিভাগ কংগ্রেস কিছুতেই মেনে নেবেনা।
জিন্নাহ ৪ঠা এপ্রিল মিশনের সাথে দেখা করেন। ৭ই এপ্রিল আজাদ পুনরায় সাক্ষাৎ করেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই তাদের নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করে। মুসলিম লীগের বক্তব্য কংগ্রেস সভাপতিকে জানানো হয়।
কংগ্রেস চায় যে একটি মাত্র গণপরিষদ হবে যা নিখিল ভারত ফেডারাল সরকার এবং আইন সভার জন্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। কেন্দ্রীয় ফেডারাল সরকারের হাতে বৈদেশিক বিভাগ, প্রতিরক্ষা , যোগাযোগ, মৌলিক অধিকার, মুদ্রা, কাস্টম এবং পরিকল্পনা বিভাগ থাকবে।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভার মুসলিম লীগ সদস্যদের নিয়ে ৯ই এপ্রিল ১৯৪৬, যে কনভেনশন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে গৃহীত প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলা ও আসাম এবং পশ্চিমে পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে একটি সার্বভৌম স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা হোক এবং পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানের লোকদের নিয়ে তাদের নিজ নিজ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য দুটি পৃথক পৃথক গণপরিষদ গঠন করা হোক। এ প্রস্তাব অনুযায়ী মুসলিম লীগ কেবিটেন মিশনের নিকটে প্রস্তাব পেশ করেন যে পাকিস্তান গ্রুপের ছয় প্রদেশের জন্যে একটি এবং হিন্দুস্থান গ্রুপের ছয় প্রদেশের জন্যে অন্য একটি গণপরিষদ গঠন করা হোক।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একে অপরের প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। প্রধান বিতর্কিত বিষয়ছিল এই যে উপমহাদেশে একটি মাত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে, না দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। উভয় অবস্থাতেই সংখ্যালঘু সমস্য রয়েছে। কেবিনেট মিশন উভয় দলের মতপার্থক্য দূর করতে অপারগ হয়।
অবশেষে কেবিটেন মিষন এবং ভাইসরয় শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধান কল্পে ১৬ই মে এক বিবৃতি প্রকাশ করে। তাঁদের বিবৃতির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল ভারতে একটিমাত্র রাষ্ট্রের সংরক্ষণ। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কারণে বৃটিশ সরকার দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
কেবিনেট মিশস ২৪শে মার্চ ১৯৪৬, ভারতে আগমন করে এবং তিন মাসাধিক কাল অবস্থান করতঃ ২৯শে জুন ভারত ত্যাগ করে। বৃটিশ সরকারের ভারতে কেবিনেট মিশন প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একটি শাসনতান্ত্রিক সমাধান পেশ করা। কেবিনেট মিষনের সদস্যগণ এ বিষয়ে চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। তবে এ কথা সত্য যে সমস্যা সমাধানে তাঁরা বিশেষ করে সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য স্টাফোর্ড ক্রিপস কংগ্রেসের অন্তরংগ বন্ধু হওয়ার কারণে সমস্যা সমাধানে কংগ্রেস তথা হিন্দুজাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
মাওলানা আবদুল কালাম আজাদ বলেন, কেবিনেট মিশন ২৩শে মার্চ ভারতে আসেন। পূর্বে একবার স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতে আগমন করলে জে,সি,গুপ্ত তাঁর আতিথেয়তার ভার গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে বলেন যে, তিনি ক্রিপসের সাথে দেখা করার জন্য দিল্লী যাচ্ছেন। আমি তাঁর হাতে পুনরায় ভারতে আসার জন্যে ক্রিপসকে মুবারকবাদ জানিয়ে একখানি পত্র পাঠাই। (Abul Kalam Azad: India Wind Freedom, p.140)
তিনি আরও বলেন, ক্রিপসের ভারতে অবস্থান কালে বরাবর তাঁর সাথে আমার পত্রের আদান প্রদান চলতে থাকে। (Abul Kalam Azad:India Wins Freedom, p.172)
ইশতিয়াক হুসেন কোরেশী তাঁর The Struggle for Pakistan গ্রন্থের ২৬৬ পৃষ্ঠার পাদটিকায় উল্লেখ করেছেন-
Sudihir Ghosh, Gandhi’s Emissary (Bombay 1967) gives a reveling account of the backdoor secret negotiation between the Cabinet Mission and the Congres leaders. There were no such intimate contacts between the Muslim League and the British government relations worked against Muslim interests at every critical stage. The British had an eye on the future advantage to be reaped from friendship with the largest and more powerful community and were willing to go very far indeed to meet its desires.

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে বিষয়টি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরোধের মূল কারণ হলো পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্টার দাবী। এ ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবী যা কংগ্রেস এবং বৃটিশ সরকার মেনে নিতে মোটেই রাজী ছিলনা। কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে কংগ্রেস মুসলিম লীগকে ফাঁদে ফেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সকল চেষ্টা করেছে। তাদের ফাঁদে ফেলার এ চক্রান্তটি সূক্ষ্মদর্শী রাজনীতিবিদ কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্যক উপলব্ধি করে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব শর্তসাপেক্ষে গ্রহন করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের হঠকারিতার কারণে সকলই ভেস্তে যায়।
তিন মাসাধিককালব্যাপী কেবিনেট মিশনের তৎপরতা, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ভাইসরয়ের সাথে আলোচনার দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করে সংক্ষেপে বলতে চাই যে, একটি আপোষমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষেত্রে কংগ্রেস বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কারণ কংগ্রেসের অভিলাষ ছিল, ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের উপর একচেটিয়া প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব লাভ করা। ক্ষমতার অংশিদারিত্ব মুসলিম লীগকে দিতে কংগ্রেস কিছুতেই রাজী ছিলনা। এ সময়ে ক্রিপসের কাছে লিখিত পত্রে গান্ধী বলেন, যদি তোমাদের সাহস থাকে তাহলে আমি প্রথম থেকেই যা বলে আসছি তাই কর। ….কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে যে কোন একটি বেছে নাও। (Pyarelal, Mohatma Gandhi: The Lasy Phase vol.1, p.225; Chudhury Muhammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.62)
অবশেষে কেবিনেট মিশন ও ভাইসরয়, একটি শক্তিশালী ও প্রতিনিধিত্বমূলক মধ্যবর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে বিবৃতি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৬ই মে তাঁদের প্রকাশিত বিবৃতিতে চৌদ্দ জনের নাম ঘোষণা করা হয় যাঁদেরকে ভাইসরয় মধ্যবর্তী কেবিনেটের সদস্য হিসাবে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানান। তফসিলী সম্প্রদায়ের একজনসহ এতে থাকবে কংগ্রেসের ছয়জন, মুসলিম লীগের পাঁচজন, একজন শিখ, একজন ভারতীয় খৃষ্টান এবং একজন পার্শী।
উল্লেখ্য যে ১৬ই মে প্রকাশিত বিবৃতির ৮ অনুচ্ছেদে এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, দুটি প্রধান দল অথবা দুয়ের যে কোন একটি যদি উপরোক্ত পদ্ধতিতে একটি কোয়ালিমন সরকারে যোগদান করতে রাজী না হয়, তাহলে ভাইসরয় একটি মধ্যবর্তী সরকার গঠনের জন্যে সামনে অগ্রসর হবেন। ১৬ই মে প্রকাশিত বিবৃতি মেনে নিয়ে সরকারে যোগদান করতে যারা রাজী হবে তাদেরকে নিয়ে এ সরকার যথাসম্ভব প্রতিনিধিত্বশীল হবে।
এরপর সপ্তাহব্যাপী কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারী এবং হিন্দু প্রেসের পক্ষ থেকে কেবিটেন মিশন এবং ভাইসরয়ের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝড় সৃষ্টি করা হয়। গুজব রটনা করা হয় যে, কেবিটেটে মুসলমানদের শূন্য আসনগুলোতে মুসলিম লীগ সদস্যদের নেয়া হবে। কেবিনেটে মুসলমনাদের শূন্য আসনগুলোতে মুসলিম লীগ সদস্যদের নেয়া হবে। কেবিনেটে একজন জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেয়া না হলে গান্ধী দিল্লী ত্যাগ করবেন বলে হুমকি প্রদর্শন করেন, যদিও কংগ্রেস সভাপতি আবুল কালাম আজাদ লিখিতভাবে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে, এ নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি কোন জিদ করবেনা। গান্ধী ধমকের স্বরে বলেন, তাহলে গণপরিষদ একটি বিদ্রোহী সংস্থায় পরিণত হবে। ক্রিপস দৌড়ে গান্ধীর শরণাপন্ন হলে তিনি (গান্ধী) বলেন, কেবিনেট মিশনকে দু’দলের যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে, সংমিশ্রণের চেষ্টা চলবেনা।
-(Pyarelal, Mohatma Gandhi: The Last Phase vol.1, p.234-37, Chodhury Muhammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.62-63)
এক সপ্তার মধ্যেই কেবিনেট মিশন গান্ধীর কাছে আত্ম-সমর্পণ করে। ২২শে জুন ক্রিপসের বন্ধু সুধীর ঘোষ গান্ধীকে বলেন যে তিনি ক্রিপসের সাথে দেখা করেছেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস যোগদান করতে রাজী না হলে, শুধু মুসলিম লীগের উপর নির্ভর করা যায় না।
সুধীর ঘোষ পুনরায় ক্রিপসের সাথে দেখা করে গান্ধীকে গিয়ে বলেন, কেবিনেট মিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, কংগ্রেস যদি স্বল্পমেয়াদী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা মেনে নেয় তাহলে মধ্যবর্তী সরকার গঠনের জন্যে এ যাবৎ যা কিছু করা হয়েছে তা সবই নাকচ করে নতুনভাবে চেষ্টা করা হবে। তাঁরা গান্ধী এবং প্যাটেলকে দেখা করতে বলেছেন। গান্ধী প্যাটেল, (সর্দার বল্লব ভাই প্যাটেল) এবং সুধীর ঘোষকে নিয়ে কেবিনেট মিশনের সাথে দেকা করতে যান। প্যাটেল পূর্বেই প্যাথিক লরেন্সের সাথে কথা বলেছেন। প্যাথিক লরেন্স গান্ধীকে বলেন, আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনি মধ্যবর্তী সরকারের গোটা পরিকল্পনা যা নিয়ে আমরা এ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছি, নাকচ করে পরিস্থিতি নতুন করে বিবেচনা করতে চান। বেশ ভালো কথা।
অতঃপর কেবিনেট মিশন ও গান্ধীর মধ্যে যে বুঝাপড়া হয় তা ওয়ার্কিং কমিটিকে অবহিত করা হয়, অতঃপর ২৫শে জুন কংগ্রেস সভাপতি ভাইসরয়ের নিকটে লিখিত পত্রে জানিয়ে দেন যে, কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করছে।
কংগ্রেসের এবং গান্ধীর এ ধরণের মানসিকতার পরিচয় ভারত বিভাগের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত পাওয়া গেছে। উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় গান্ধী ও কেবিনেট মিশনের মনের কদর্য চেহারাটা ইতিহাসের পাতায় পরিস্ফুট হয়েছে।

লীগ প্রতিক্রিয়া
ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের যে আশার আলো দেকা গিয়েছিল, তা কেবিনেট মিশন এবং ভাইসরয়ে কর্তৃক তাঁদের কৃত ওয়াদা ভংগের কারণে নির্বাপিত হয়। এ পরিস্থিতি আলোচনার জন্যে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বোম্বাইয়ে লীগ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে জিন্নাহ বলেন, মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশনের সাথে আলোচনায় কংগ্রেসকে একটির পর একটি সুবিধা দান করেছে, (made concession after concession)। কারণ আমরা চেয়েছিলাম একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ও শাস্তিপূর্ণ মীমাংসায় উপনীত হতে যাতে করে শুধু হিন্দু ও মুসলমানই নয়, বরঞ্চ উপমহাদেশে বসবাসকারী সকল মানুষ স্বাধীনতা লাভের দিকে অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু কংগ্রেস তাদের নীচতাপূর্ণ বাকচাতুরী ও দরকষাকষির দ্বারা ভারতবাসীর বিরাট ক্ষতি করেছে। সমগ্র আলাপ আলোচনায় কেবিনেট মিশস কংগ্রেসের সন্ত্রাস ও ভীতির শিকারে পরিনত হয়। এসব কিচু এ কথাই নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, ভারতের সকল সমস্যার সমাধান একমাত্র পাকিস্তান।
আমি মনে করি আমরা যুক্তি প্রমাণের কিছু বাকী রাখিনী। এখন এমন কোন ট্রিবিউনাল নেই যার শরণাপন্ন আমরা হতে পারি। একন মুসলিম জাতিই আমাদের একমত্রা ট্রিবিউনাল।
অতঃপর অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে কেবিনেট মিমনের প্রস্তাব গ্রহণ প্রত্যাহার করা হয় এবং ভারত সচিবকে জানিয়ে দেয়া হয়।

একাদশ অধ্যায়
ডাইরেক্ট অ্যাকশন
উক্ত অধিবেশনে এ মর্মে আর একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, পাকিস্তান হাসিল করার উদ্দেশ্যে এবং বৃটিশের গোলামী এবং বর্ণহিন্দুর ভবিষ্যৎ প্রাধান্য থেকে মুক্তি লাভের জন্যে মুসলিম জাতির পক্ষে ডাইরেক্ট অ্যাকশন অবলম্বন করার সময় এসেছে। মুসলমানদের সংগঠিত করে প্রয়োজনীয় সময়ে সংগ্রাম করার লক্ষে কর্মসূচী প্রণয়নের অনুরোধ জানানো হয়। উপরন্তু বৃটিশের মনোভাব ও আচরণের প্রতিবাদে বিদেশী সরকার প্রদত্ত সকল খেতাব পরিত্যাগ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতি আবেদন জানানো হয়।
জিন্নাহ ৩১শে জুলাই আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা নয়। তিনি বলেন, একমাত্র মুসলিম লীগই সংবিধানের আওতায় থেকে সাংবিধানিক পন্থায় কাজ করেছে। কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনাকালে মুসলিম লীগ বৃটিশ সরকারকে কংগ্রেসের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত দেখতে পায়। তাদের ভয় ছিল এই যে, কংগ্রেসকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে তারা এমন এক সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে যা ১৯৪২ সনের সংগ্রাম অপেক্ষা সহস্র গুণে মারাত্মক হবে। বৃটিশের মেশিন গান আছে এবং ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারে। কংগ্রেস আর এক ধরনের অন্ত্রে সজ্জিত এবং তাকে তুচ্ছ মনে করা যায় না। অতএব আমরা এখন আত্মরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্যে সাংবিধানিক পন্থা পরিহার করতে বাধ্য হচ্ছি। সময়মত সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। (Cabinet Mission and After, Muhammad Ashraf, pp.311-19; Emergence of Pakistan-Choudhury Mohammad Ali-pp.69-70)
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জন্যে ১৬ই আগষ্ট নির্ধারিত হয়। তার দুদিন পূর্বে জিন্নাহ তাঁর প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, দিনটি ছিল ভারতের মুসলিম জনসাধারণের কাছে ২৯শে জুলাই মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করা, কোন প্রকার প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়ার জন্যে নয়। অতএব আমি মুসলমানদের প্রতি এ আবেদন জানাই তাঁরা যেন আমদের নির্দেশ পুরোপুরি মেনে চলেন, নিজেদের অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করেন এবং শত্রুর হাতের খেলনায় পরিণত না হন।

আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য
আমি জনসাধারণের মধ্যে এ অনুভূতি লক্ষ্য করলাম যে ১৬ই আগষ্ট মুসলিম লীগ কংগ্রেসীদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। ১৬ই আগষ্ট ভারতের ইতিহাসে একটি কালো দিবস। এ দিনে শত শত মানুষের জীবন হানি হয় এবং কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ লুণ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের মিছিলগুলি লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযোগ শুরু করে। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p. 168-169)
মাওলানা আজাদের প্রতি আমার আন্তরিক ও গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও বলবো তিনি হিন্দু কংগ্রেসের মনের কথাই বলেছেন। সেদিন তিনি দিল্লী ছিলেন। অতএব ঘটনা স্বচক্ষে না দেখে অপরের কথা শুনেই উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন।
তিনি তাঁর উক্ত গ্রন্থে বলেন, মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসটি ভিন্ন ধরনের বলে মনে হচ্ছিল। কোলকাতায় এ সাধারণ মনোভাব লক্ষ্য করলাম যে, ১৬ই আগষ্টে মুসলিম লীগ কংগ্রেসপন্থীদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাঁদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। বাংলার সরকার কর্তৃক ১৬ই আগষ্ট সরকারী ছুটি ঘোষণার ফলে অদিক মাত্রায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার আইন পরিষদের কংগ্রেস দল এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদে কোন ফল না হওয়ায় তাঁরা সংসদ ভবন থেকে ওয়াক আউট করেন। কোলকাতার জনমনে ভয়ানক উদ্বেগ বিরাজ করছিল এবং সে উদ্বেগ এ কারণে বেড়ে চলেছিল যে মুসলিম লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। (India Wins Freedom by Abul Kalam Azad pp.168-169)
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উপরোক্ত বক্তব্যে কোলকাতার লোমহর্ষক সাম্প্রদায়িক হানাহানির প্রকৃত কারণ চিহ্নিত হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে-
১। বাংলায় মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা প্রতিষ্ঠিত যা হ্নিদুদের জন্য ছিল অসহনীয়।
২। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাঁকে হিন্দুগণ মনে করতো হিন্দুবিদ্বেষী।
৩। ১৬ই আগষ্টের ক’দিন পূর্ব থেকেই এ মিথ্যা গুজন ছড়ালো যে মুসলিম লীগ তথা কোলকাতার মুসলমানগণ হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করবে। এ গুজব ছড়ানোর এ উদ্দেশ্য ছিল না যেন হিন্দুগণ কোলকাতার শতকরা প্রায় পঁচিশ মুসলমান নির্মূল করার জন্য তৈরী হয়।
আমি (অত্র গ্রন্থকার) সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত থাকলেও পাকিস্তান আন্দোলন মনে প্রানে সমর্থন করতাম। মুসলিম লীগ মহলের হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালানো হবে এরূপ কোন পরিকল্পনার হিন্দু বিসর্গও কানে আসেনি। আমি তখন ফ্যামিলিসহ কোলকাতায় থাকতাম, বাসায় আমার সাথে আমার স্ত্রী ও চার বছরের কন্যা মাত্র। গোলযোগের কোন আশংকা থাকলে তাদেরকে একাকী ফেলে ১৬ই আগষ্টে মুসলিম লীগের জনসভায় নিশ্চিন্ত মনে কিছুতেই যেতে পারতাম না।
গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত জনসবায় আমর মত আরো অনেকেই যোগদান করেন। আমরা জনসভায় উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাজা গজনফর আলী খান ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন।
মুসলিম লীগ কর্মীদের হাতে কোন অস্ত্র ত দূরের কথা, কোন লাঠি-সোটাও দেখতে পাইনি। তবে পাকিস্তান লাভের আশায় সকলকে হর্ষোৎফুল্ল ও উজ্জীবিত দেখতে পেয়েছিলাম।
রাজা সাহেবের পর সোহরাওয়ার্দী সাহেব মঞ্চে ওঠার পর মুসলিম লীগ মিছিলের এবং জনসভায় আগমনকারীদের উপর হিন্দুদের সশস্ত্র আক্রমণের সংবাদ আসতে থাকলো। অতঃপর আক্রান্ত মুসলমানদের অনেকেই রক্তমাখা জামাকাপড় নিয়ে সভায় হাজির হয়ে হিন্দুদের সশস্ত্র হামলার বিবরণ দিতে লাগলো। শ্রোতাদের হর্ষ বিষাদে পরিণত হলো। ভয়ানক উত্তেজনা, ভীতি ও আশংকা বাড়তে থাকলো। কোলকাতায় শতকরা বিশ থেকে পঁচিশ ভাগ মুসলমান। প্রায় সকলেই দরিদ্র। তাদের শতকরা প্রায় পাঁচ ভাগ বহিরাগত, বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে।
জনসভায় যোগদানকারীগণ বিভাবে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবে, তাদের অরক্ষিত পরিবারের অবস্থাই বা কি –এমন এক আশংকা সকলের চোখে মুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো। প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন। তাঁর বক্তৃতার কোন কথাই আমার মনে নেই। তবে জনতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে ‘হাম সব দেখ লেংগে’ বলে সকলকে শৃংখলার সাথে ঘরে ফিরে যেতে বল্লেন। আমরা কোন রকমে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে বাসায় ফিরলাম। কোলকাতার মুসলিম পল্লী পার্কসার্কাসে থাকতাম বলে বেঁচে গিয়েছি, নতুবা হিন্দুদের আক্রমণের শিকার অবশ্যই হতে হতো।
এ লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন কোলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান (Stateman) পত্রিকার সম্পাদক –Lan Stepens বলেন –‘সম্ভবত প্রথম দিনের মারামারিতে এবং নিশ্চিতরূপে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে মুসলমানদের জানমালের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়।
(lan Stephens, Pakistan, Londin, Ernest Bena, 1963, p.106; Choudhury Mohammad Ali The Emergence of Pakistan, p.76)
এসব ঘটনার দ্বারা এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ১৬ই আগষ্ট হ্নিদুদের উপর আক্রমণ করার কোন পরিকল্পনা মুসলিম লীগের ছিলনা। বরঞ্চ লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনকে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য কংগ্রেস মুসলিম নিধনের নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করে। তবে এর সুফল হয়েছে মুসলমানদের জন্যে। পাকিস্তান সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়েছে –যার সম্ভাবনা কিছুটা ক্ষীণ হয়েছিল কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের পর। জিন্নাহ খোলাখুলি ও অপকটে কোলকাতার নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন এবং নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট অ্যাকশনের পর
কোলকাতার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এক বিতর্কিত আলোচনার বিষয় হয়ে পড়ে। উপমহাদেশে মাঝে মধ্যে এখানে সেকানে হিন্দু মুসলমানে দাংগাহাংগামা হয়েই থাকে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্টে অনুষ্ঠি নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা ছিল তুলনাবিহীন। কোলকাতার মুসলমানদের নির্মূল করার এক সুচিন্তিত পরিকল্পনার অধীনে এ হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ভাইসরয় ২৪শে আগষ্ট মধ্যবর্তী সরকারের সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন।
তাদেরকে দুসরা সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ভাইসরয় ৬ই আগষ্ট নেহরুকে মধ্যবর্তী সরকার গঠনের আহবান জানান। ৭ই আগষ্ট কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সরকার গঠনে সম্মতি দান করে। ১৭ই আগষ্ট নেহরু ভাসরইকে বলেন যে তিনি মুসলিম আসনগুলো লীগ বহির্ভূত লোকদের দ্বারা পূরণ করে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করতে চান। ভাইসরয় এতে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন যে আপাততঃ কিছু সময়ের জন্যে মুসলিম আসনগুলো উন্মুক্ত রাখা হোক। নেহরু এ প্রস্তাবে রাজী না হয়ে তার নিজের প্রস্তাবে অবিচল থাকেন।
এ কথাটি পরে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে কংগ্রেসী মধ্যবর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের প্রাক্কালে বাইসরয় ব্রিটিশ সরকারকে বলেন যে, মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে রাজী না হওয়া পর্যন্ত শপথ অনুষ্ঠান মুলতবী রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী এটলী ভাইসয়ের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, এখন যে কোন বিলম্বকরণ প্রক্রিয়া কংগ্রেস নেতাদের মেজাজ তিক্ততর করবে এবং কংগ্রেস ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করবে। অতঃপর দিল্লী থেকে জারিকৃত এক সরকারী ইশতাহারে বলা হয় যে, নতুন কাউন্সিল দুসরা সেপ্টেম্বর কার্যভার গ্রহন করবে।
নতুন কাউন্সিলে (The New Executive Council) যোগদানকারী সদস্যগণ ছিলেনঃ নেহরু, প্যাটেল, রাজা গোপালচারিয়া, রাজেন্দ্র প্রসাদ, আসফ আলী, শরৎচন্দ্র বোস, জন ম্যাথাই, বলদেব সিং, স্যার শাফায়াত আহমদ খান, জগজীবন রাম, আলী জহির এবং সি এইচ ভবা। দুজন মুসলমান পরে নেয়া হেব। (The Indian Register, 1946, vol.2, p.228, Ishtiaq Hossain Qureshi The Struggle for Pakistan, pp.274-275)।
মেজাজ প্রকৃতির পরিপন্থী কাজ সমাধা করার পর ভাইসরয় সাম্প্রদায়িক দাংগায় বিধ্বস্ত কোলকাতা পরিদর্শন করেন। কোলকাতা ভ্রমণের পর তিনি নিশ্চিত হন যে, কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে কোন সমঝোতা না হলে সমগ্র ভারত ভয়ংকর গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে পড়বে। কোলকাতা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কংগ্রেস নেতাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে ২৭শে আগষ্ট গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলার এবং কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন এবং একটা ফর্মূলা পেশ করেন। ২৮শে আগষ্ট নেহরু ভাইসরয়কে জানিয়ে দেন যে ওয়ার্কিং কমিটি ফর্মূলাটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল একটি মীমাংসায় পৌঁছার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার এ প্রচেষ্টা কংগ্রেস ভিন্নভাবে গ্রহন করে। উপমহাদেশের উপর কংগ্রেসের একচেটিয়া প্রভূত্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে ওয়াভেলকে তার প্রতিবন্ধক মনে করেন এবং তার শাস্তি বিধানের জন্য উঠে পড়ে লাগেন। ওয়াভেলের সাথে আলাপ আলোচনার পর ফিরে এসে গান্ধী এবং নেহরু উভয়ে পত্র লিখতে বসে যান। গান্ধী প্রথমে এটলীর নিকেট এ মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন যে, ভাইসরয়ের মনের অবস্থা এমন যে শিগগির প্রতিকার হওয়া দরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে কোলকাতার ঘটনায় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। গান্ধী তাঁর স্থলে একজন যোগ্যতর ব্যক্তির দাবী জানান। গান্ধী ওয়াভেলকেও পত্রের দ্বারা শাসিয়ে দেন যে তিনি ভীতি প্রদর্শণ করে কংগ্রেসকে তার স্বমতে আনতে চান। তিনি আরও বলেন যে ভাইসরয় যদি সাম্পদায়িক সম্পর্কের অবনতিতে ভীত হয়ে পড়েন এবং তা দমন করার জন্যে শক্তি প্রয়োজ করতে চান, তাহলে বৃটিশের শিগগির ভারত ত্যাগ করা উচিত এবং ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কংগ্রেসের উপর অর্পণ করা উচিত।
অপরদিকে নেহরু বৃটেনে তার কতিপয় প্রভাবশালী বন্ধুকে পত্র দ্বারা জানিয়ে দেন যে, ভাইসরয় অত্যন্ত দুর্বল লোক এবং মানসিক নমনীয়তা হারিয়ে ফেলেছেন। জিন্নাহকে খুশী করার জন্যে তিনি ভারতে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন যে, ভাইসরয় স্যার ফ্রান্সিস মুডি এবং জর্জ এবেল এর পরামর্শ অনুযায়ী চলছেন এবং নেহরুর মতে এ দুজন হচ্ছেন প্রকট মুসলিম মনা (Rabidly pro-Muslim)। নেহরু তাদেরকে ইংলিশ মোল্লা বলেও অভিহিত করেন। মোট কথা নেহরুর পত্রাদির মর্ম হচ্ছে –‘ওয়াভেলকে যেতেই হবে’।
-(Leonard Mosley op. cit-pp.44 Gandhi’s letter to Wavel reproduct in full in Pyarelal’s Miahatma Gandhi The last Phase (Ahmedabad-1956); I.H.Qureshi The Struggle for Pakistan, p.276)।

দ্বাদশ অধ্যায়
একজেকিউটিভ কাউন্সিলে লীগের যোগদান
অন্তবর্তী সরকার নির্দিষ্ট সময়ে, অর্থাৎ দুসরা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, কার্যভার গ্রহণ করেন। কংগ্রেস খুবই উল্লসিত। পট্টভি সিতারামিয়া ঘোষণা করেন, ক’বছরের মধ্যেই ভারতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ আসুক না আসুক –তাতে কিছু যায় আসে না। কাফেলা চলতেই থাকবে। এখন আমাদেরকে এ ভূখন্ডের শাসন মনে করতে হবে। (I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan, p.277)
ভারতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ভারত এবং বৃটেনের বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করেন। জিন্নাহ ২৫শে আগষ্ট অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এক বিবৃতি দান করেন। তিনি ভাইসরয়ের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, মুসলিম লীগকে যে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছিল এবং যে সব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার সিদ্ধান্ত সে সবের সাথে অসামঞ্জস্যশীল। নতুন সরকার যে দিন কার্যভার গ্রহণ করেন সেদসি মুসলমানগণ সমগ্র ভারতে তাদের গৃহে ও দোকানে কালো পতাকা উড্ডীন করেন।
বৃটেনের স্যার উইনস্টোন চার্চিল সরকারী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা গৃহযুদ্ধ ব্যতীত সফল হবেনা। হিন্দুদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য ক্রিপস অন্যায়ভাবে তার প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন। পরে তিনি বলেন, বর্ণহিন্দু মিঃ নেহরুর উপর ভারত সরকারের দায়িত্ব অর্পণ মৌলিক ভুল হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম প্রণেতা লর্ড টেম্টল উড একটি মাত্র সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় সরকার গঠনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। লর্ড স্কার বরো ভবিষ্যদ্বানী করেন যে একটি দলেন হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে ভারত থেকে বৃটিশ সরকারের উপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করা হবে এবং তিনি আশা করেন যে তা প্রতিহত করা হবে। লর্ড ক্রাসবর্ণ জুন মাসে মুসলমানদের সাথে কৃত ওয়াদা ভংগ করে আগষ্টে কংগ্রেসকে সরকার গঠনের অনুমতি দেয়ায় সরকারের তীব্য সমালোচনা করেন। এভাবে বৃটেনের বিভিন্ন মহল থেকে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। (I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan, pp.277-278
অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর এক মাস অতিক্রান্ত হতে না হতে মুসলিম লীগ উপলব্ধি করে যে, সরকারের বাইরে অবস্থান মুসলিম স্বার্থের চরম পরিপন্থী। নীতিগতভাবে মুসলিম লীগ সরকারে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ নীতি বলবৎ থাকবে। তবে রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং সেইসাথে দেশে শত্রুভাবাপন্ন একটি হিন্দু সরকার প্রতিষ্ঠা লীগকে তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করে। যতোদিন মুসলিম লীঘ বাইরে থাকবে, ততোদিন মুসলমানগণ দুর্গতি ভোগ করতে থাকবে। আইন শৃংখলার অবনতি ঘটছে এবং বহু অঞ্চল থেকে মুসলমানদের নির্মূল হওয়ার আশংকা রয়েছে। কংগ্রেসের কোন মাথা ব্যথা নেই। হিন্দু সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে দুষ্কৃতিকারিগণ উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে। অতএব এমতাবস্থায় মুসলিম ভারত রক্ষার উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগকে অবশ্যই সরকারে যোগদান করতে হবে। জিন্নাহর মতে কোয়ালিশন সরকারের বাইরে থাকার চেয়ে ভেতরে থেকে ভালোভাবে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাস চালাতে পারবেন।
কোয়ালিশন সরকারে মুসলিম লীগকে পাওয়ার জন্যে ভাইসরয় স্বয়ং বড়ো আগ্রহান্বিত ছিলেন। কারণ তিনি ভবিষ্যৎ সংকট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ কারণে দীর্ঘ জটিল আলাপ আলোচনা চলতে থাকে একদিকে জিন্নাহ ও নেহরুর মধ্যে এবং অপরদিকে জিন্নাহ ও ভাইসরয়ের মধ্যে। অবশেষে ২৫ শে অক্টোবর ১৯৪৬, একজেকিউটিভ, কাউন্সিল নিম্নরূপে পুনর্গঠিত হয়ঃ-

কংগ্রেস
জওহরলাল নেহরু –(External Affairs and Common wealth Relations)
বল্লভ ভাই প্যাটেল –(Home, Information & Broadcasting)
মি. রাজা গোপালাচারিয়া –(Education & Arts)
আসফ আলী –(Transport & Railway)
জগজীবন রাম –(Labour)

মুসলিম লীগ
লিয়াকত আলী খান –(Finance)
আই আই চুন্দ্রিগড় –(Commerce)
আবদুর রব নিশতার –(Communications)
গজনফর আলী খান –(Health)
যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল –(Legislative)

সংখ্যালঘু
জন ম্যাথাই –(Industries & Supplies)
সি এইচ ভবা –(Works, Mines & Power)
বলদেব সিং –(Defence)
নেহরু কোয়ালিশস সরকারে মুসলিম লীগের যোগদান ভালো চোখে দেখেননি। তদুপরি দপ্তর বন্টনেও তিনি চরম একগুঁয়েমির পরিচয় দেন। ভাইসরয় চাচ্ছিলেন তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর যথা External Affairs, Home and Defence –এর যে কোন একটি মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। নেহরু এর চরম বিরোধিতা করেন। অবশেসে যে পাচটি দপ্তর মুসলিম লীগকে দেয়া হয় তার মধ্যে অর্থ (Finance) একটি। কংগ্রেস অর্থ বিভাগের দপ্তরটি মুসলিম লীগকে দিতে এ জন্যে রাজী হয়েছিল যে, তাদের বিশ্বাস ছিল এ দপ্তর চালাতে মুসলিম লীগ অপারগ হবে –বরঞ্চ চালাতে গিয়ে বোকা সাজবে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের এ সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তার সহকর্মীদের এ এক ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘India Wins Freedom’ গ্রন্থে এ বিষয়ে উপভোগ্য আলোচনা করেছেন তা উপভোগ করার জন্য পাঠকবৃন্দের জন্য পরিবেশন করছি।
মাওলানা আজাদ বলেনঃ
যেহেতু লীগ সরকারে যোগদান করতে সম্মত হয়েছে, কংগ্রেসকে সরকার পুনর্গঠিত করতে হবে এবং এতে মুসলিম লীগ প্রতিনিধিদের স্থান করে দিতে হবে। এখন প্রশ্ন কে কে সরকার থেকে সরে দাঁড়াবেন। মনে করা হলো যে, শরৎ চন্দ্র বসু, স্যার শাফায়াত আহমদ খান এবং সৈয়দ আলী জহির লীগ নমিনীদের স্থান করে দেয়ার জন্যে ইস্তাফা দেবেন। ভাইসরয়ের প্রস্তাব ছির যে স্বরাষ্ট্র বিভাগ মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। সর্দার প্যাটেল এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। আমার ধারণা মতে আইন শৃংখলা অবশ্যম্ভাবী রূপে একটি প্রাদেশিক বিষয় কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার যে চিত্রটি সামনে রয়েছে তাতে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের সামান্য কিছুই করার আছে। অতএব নতুন সরকার কাঠামোতে কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। এ কারণে আমি লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবের পক্ষেই ছিলাম। কিন্তু প্যাটেল একেবারে নাছোড়বান্দা। তিনি বল্লেন, আমি বরঞ্চ সরকার থেকে বেরিয়ে যাব কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়বনা।
আমরা তখন বিকল্প চিন্তা করলাম। রফি আহমদ কিদওয়াই প্রস্তাব করেন যে অর্থ মন্ত্রণালয় মুসলিম লীগকে দেয়া হোক। তিনি আরও বলেন, এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। কিন্তু এ একটি উচ্চমানের টেকনিকাল বিষয় এবং মুসলিম লীগের মধ্যে এমন কেউ নেই যে এ বিভাগ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবে। কিদওয়াইয়ের ধারণা মুসলিম লীগ এ দপ্তর গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। এতে কংগ্রেসের কোন ক্ষতি নেই। আর এ দপ্তর গ্রহণ করলে পরে তারা বোকা প্রমাণিত হবে।
প্যাটেল লাফ মেরে প্রস্তাবটির প্রতি তার অতি জোরালো সমর্থন জানান (Patel jumped at the proposal and gave it his strongest support)। আমি এ কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম যে অর্থ মন্ত্রণালয় হলো একটি সরকারের চাবিকাঠি এবং এ মুসলিম লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদেরকে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। প্যাটেল আমার বিরুদ্ধাচারণ করে বল্লেন যে, লীগ এ বিভাগ চালাতে পারবেনা এবং এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে বাধ্য হবে। আমি এ সিদ্ধান্তে খুশী হতে পারিনি। তবে সকলে যখন একমত, আমাকে তা মেনে নিতে হলো।
লর্ড ওয়াভেল জিন্নাহকে প্রস্তাবটি সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি পরের দিন জবাব দেবেন বলেন।
জিন্নাহরও সংশয় ছিল যে কেবিনেটে লীগের প্রধান প্রতিনিধি লিয়াকত আলী এ বিভাগটি চালাতে পারবেন কিনা। অর্থ বিভাগের কতিপয় মুসলমান অফিসার এ বিষয়টি জানার পর জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। তারা বলেন যে, কংগ্রেসের এ প্রস্তাব অচিন্তনীয় পাকা ফলের মতো এবং এতে লীগের বিরাট বিজয় সূচিত হয়েছে। ...অর্থ বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ফলে সরকারের প্রতিটি বিভাগে লীগের কর্তৃত্ব চলবে। তারা জিন্নাহকে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে তার ভয়ের কোন কারণ নেই। লিয়াকত আলীকে সর্বপ্রকারে সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি তারা দেন যাতে যথাযথভাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
কংগ্রেস শীঘ্রয় উপলব্ধি করেছিলেন যে অর্থ বিভাগ লীগকে দিয়ে বিরাট ভুল করা হয়েছে। (Abul Kalam Azad: India Wins Freedom, pp.177-179)
এ প্রসংযগে চৌধুরী মুহাম্মদ আলী বলেনঃ
জুন মাসে যখন সর্বপ্রথম একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তখন কায়েদে আজম লীগের সম্ভাব্য দপ্তরগুলো সম্পর্কে আমার সাথে আলোচনা করেন। তিনি স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা (Home & Defence) বিভাগ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি বল্লাম, আইন শৃংখলা ও পুলিশ প্রাদেশিক বিষয় যার উপর কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কংগ্রেস প্রদেশগুলো লীগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন পরোয়াই করবেনা। অনুরূপ মুসলিম লীগ প্রাদেশিক সরকারগুলো তার উপদেশ গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করবেনা। আমি বল্লাম যে প্রতিরক্ষা দপ্তর অবশ্যই লাভজনক। কিন্তু যদি লীগ প্রতিটি বিভাগে সরকারের নীতি-পলিসি প্রভাবিত করতে চায়, তাহলে তার অর্থ বিভাগ নেয়া দরকার। আমি তখন তাকে অর্থ বিভাগের কৌশলগত গুরুত্ব বুঝাতে পারিনি। কিন্তু এখন ঘটনাচক্রে অর্থদপ্তর লীগের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আমাকে যখন পুনরায় ডেকে পাঠানো হয় তখন অত্যন্ত জোরালোভাবে আমার পূর্ব পরামর্শের পুনরাবৃত্তি করি। লীগের প্রধান প্রতিনিধি হিসাবে লিয়াকত আলীর উপর অর্থ বিভাগ অর্পিত হওয়ায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। আমি সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার প্রস্তাব দিলা এবং কায়েদে আজম ও লিয়াকত আলী খান উভয়কেই সাফল্যজনক পরিণামের নিশ্চয়তা দান করলাম। আমার প্রস্তাব গৃহীত হলো এবং লিয়াকত আলী অর্থমন্ত্রী হলেন। (Chowdhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.84)।

কোয়ালিশন সরকার
লীগের প্রতি কংগ্রেসের পূর্ণ অনাস্থা ও বৈরাচরণেল কারণে কংগ্রেস চাইছিল নেহরুকে গোটা কেবিনেটের নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে। লীগ তা মেনে নিতে অস্বীকার করে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে লিয়াকত আলী খান স্পষ্টভাষায় বলেন, নেহরু কেবিনেটে কংগ্রেস দলের নেতা ব্যতীত আর কারো নেতান নন। সাংবিধানিক অর্থে সম্মিলিত দায়িত্ব অস্বীকার করলেও তিনি বলেন, লীগ মন্ত্রীগণ তাদের সহকর্মীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন শুধু মুসলমাদের স্বার্থেই নয়, বরঞ্চ ভারতের সকল অধিবাসীদের স্বার্থে।
সাম্প্রদায়িক হানাহানি বেড়েই চলছিল বিধায় ঐক্য ও সহযোগিতার অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব বাংলার নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় গোলযোগ শুরু হয় এবং মাস শেষ হবার পূর্বেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। গভর্ণর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ সরেজমিনে তদন্তের পর এ মন্তব্য করেন যে সেখানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণের কোন আক্রমণাত্ম অভিযান ছিলনা। গুন্ডাপ্রকৃতির লোকদের দ্বারা এ গোলযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। লেফটন্যান্ট জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস টুকার, জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং ইন চীফ কমান্ড, নিহতের সংখ্যা তিনশতের কম বলেন। কিন্তু বিকারগ্রস্ত হিন্দুপ্রেস ইচ্ছাকৃতভাবে ভয়াব্হ ও লোমহর্ষক কল্পকাহিনী রচনা করে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। এসব প্রচারনা বিহার ও ইউপি-র হিন্দুদের মধ্যে প্রতিশোধ গ্রহণের উদগ্র লালসা সৃষ্টি করে। [E.W.R. Lumby : The Transfer of Power in India -1945-47 (London George Allen and Unwin, 1954), p.120;Sir Francis Tuker, While Memory Server (London-Casell,1950) p.176; Choudhury Mohammad Ali The Emergence of Pakistan, p.85]।
নবেম্বরে পয়লা হপ্তার পরিকল্পিত উপায়ে বিহারে মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। ছ’চল্লিশের সকল ভয়ংকর দাংগার মধ্যে বিহারের হত্যাযজ্ঞ ছিল সর্বাপেক্ষা লোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক। এর সবচেয়ে কাপুরুষোচিত দিক হচ্ছে এই যে হিন্দু জনতা পরিকল্পনা অনুযায়ী সকল প্রস্তুতিসহ হঠাৎ মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব মুসলমান ও তাদের পূর্বপুরুষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের হিন্দু প্রতিবেশীর সাথে বসবাস করে আসছিল। এ দাংগায় নিহত নারী, পুরুষ ও শিশুর সংখ্যা ছিল সাত আট হাজার। (Sir Francis Tuker: While Momory Server, pp.181-82; Choudhury Mohammad Ali Emergency of Pakistan, p.86)।
ভাইসরয় এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবর্গ হিন্দু ও মুসলিম উপদ্রুত অঞ্চল সফর করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির জন্য আবেদন জানান। বিহারের ঘটনা জানা সত্ত্বেও গান্ধী নোয়াখালীর পথে তখন কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন। কংগ্রেসী মুসলমানগণ গান্ধীকে বার বার অনুরোধ করেন বিহার গিয়ে রক্তপিপাসু হিন্দুদের নিবৃত্ত করার জন্যে। এতদসত্ত্বেও গান্ধী বিহারমুখী না হয়ে নোয়াখালী গমন করে চার মাস অবস্থান করেন।
অবশেষে সাতচল্লিশের মার্চ মাসে বিচারে যাওয়ার জন্য গান্ধীকে রাজী করা হয়। এবার গান্ধীর চোখ খুলে যায়। প্রদেশের মন্ত্রীসভা ছলচাতুরী করে সবকিছু এড়িয়ে চলেন এবং তাদেরকে মোটেই অনুতপ্ত দেখা যায় না। জেনারেল টুকার বলেন, আমাদের অফিসারদের কাছে যেটা সবচেয়ে বিস্ময়কর মনে হয়েছে তা এই যে, হিন্দু মন্ত্রীগণ নৃশংস হত্যাকান্ডকে কি করে শান্তভাবে গ্রহণ করলেন। তারা বলেন যে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গান্ধী যখন বলেন যে, এখন পর্যন্ত কোন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি, তখন প্রধানমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিনহা ভয় প্রকাশ করে বলেন যে এর থেকে লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবে।
বিহার হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্যপ্রমাণ এতো মজবুত যে কারো পক্ষে বিভ্রান্তি সৃষ্টি সম্ভব নয়। পিয়ারীলাল তার ‘মহাত্মা গান্ধী দি লাস্ট ফেজ’ –গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন –The veil lifted. এতে তিনি বলেন যে, ছেচল্লিশের বিহারের দাংড়া অখন্ড ভারতের স্বপ্নসাধ ভেঙে দিয়েছে। এ হত্যাকান্ড হিন্দুর সহজাত শান্তিবাদ (Pacifism) –এর প্রতিও গান্ধীর বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। এ সময় থেকে তার মধ্যে একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পূর্ববর্তীকালে প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাংগায় তার প্রধান উদ্বেগ চিল হিন্দুদের রক্ষা করা। এখন তিনি মুসলমাদের রক্ষার জন্যেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সমগ্র ভারতের উপর হ্নিদুর রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সত্ত্বেও, তিনি রক্তপাত এড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার মানবিক আবেগ জাগ্রত হয়েছিল এবং জীবন দিয়ে এর মূল্য তাকে দিতে হয়।
বিহার হত্যাকান্ডের কিছুদিন পর ইউপি প্রদেশের গড়মুক্তেশ্বরে আর একটি মুসলিম নিধনযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে প্রতিবছর হিন্দু মেলা হয়। কিচু সংখ্যক মুসলমান ব্যবসায়ী মেলায় দোকানপাট খুলে বসে। হঠাৎ তাদের উপর হামলা করা হয়। জেনারেল টুকার বলেন,
প্রত্যেক মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের কোন সংবাদ লৌহ যবনিকা ভেদ করে বহির্জগতে পৌঁছতে পারেনি। প্রাদেশিক সরকার হিন্দু প্রশাসনযন্ত্রের সহযোগিতায় হিন্দুদের এ হত্যাকান্ডকে পর্দার আড়াল করে রাখেন। হিন্দু পত্র-পত্রিকায় ইচ্ছাকৃতভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয় যে, মুসলমানরা কয়েকগুণে প্রতিশোধ নিয়েছে। এটা করা হয় হিন্দুদের অপকর্ম ঢাকার জন্য। প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত প্যান্ট ঘোসনা করেন যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হবে। কিন্তু কোন কিছুই করা হয়নি। (Sir Francis Tuker: While Memory Server; pp.196-201; Chowdhury Mohammad Ali –Emergence of Pakistan, p.87)।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি