২. দা’ওয়াত ইলাল্লাহ
দাওয়াতের প্রাথমিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত আলোচনাঃ
আল্লাহ তায়ালা আরবের বিখ্যাত কেন্দ্রীয় শহর মক্কায় তাঁর এ বান্দা (মুহাম্মদ সঃ) –কে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নিযক্তি করেন এবং তাঁর নিজ শহর ও নিজ গোত্র কোরাইশদের মধ্যেই এ দাওয়াতী কাজের সূচনা করতে নির্দেশ দেন। এ কাজের সূচনাতেই যে সব হেদায়েতের প্রজোজন ছিলো তা তাকেঁ প্রদান করা হয় এবং সেগুলো ছিলো প্রধান তিন প্রকারের বিষয়বস্তু সমন্বিতঃ

একঃ এ বিরাট গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্যে নবী নিজেকে নিজে কিভাবে তৈরি করবেন এবং তিনি কোন্ পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ করবেন সেসব বিষয়ে তাকেঁ শিক্ষা দেয়া হয়।

দুইঃ প্রকৃত তত্ত্ব ও রহস্য সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য এবং নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে সমাজে সাধঅরণভাবে প্রাচলিত ভুল ধারণা সমূহের প্রতিবাদ করা হয়, যেসব ভুল ধারণার কারণে তাদের জীবন যাত্রা অত্যন্ত ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছিলো।

তিনঃ প্রকৃত জীবন-যাপন পন্থার প্রতি আহ্বান এবং খোদায়ী হেদায়াতের সে সব মৌলিক চরিত্র-নীতির বিশ্লেষণ, যেগুলোর অনুসরণে বিশ্বামানবতার চিরন্তন কল্যাণ ও সৌভাগ্য নিহিত রয়েছে।

দাওয়াতের সূচনা হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ের এসব পথ নির্দেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংক্ষপ্তি বাণীতে সমন্বিত ছিলো স্বচ্ছ ঝরঝর-অত্যন্ত মিষ্টি মধুর, অতিশয় প্রভাব বিস্তারকারী এবং যাদের লক্ষ্য করে তা বলা হচ্ছিল-তাদের রুচি অনুযায়ী উন্নত সাহিত্যিক ভুষণে সজ্জিত। ফলে তা শ্রোতাদের হৃদয়-মনে তীর শলাকারমতো বিদ্ধ হতো; সুমধুর ভাব সামঞ্জস্যের কারণে লোকেরা আত্মহারা হয়ে তা উচ্চারণ ও আবুতি করতে শুরু করতো।

সর্বোপরি তাতে স্থানীয় ভাবধারার বিশেষ প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। যদিও আলোচনা করা হতো চিরন্তন সত্যের কিন্তু তার সত্যতা প্রমাণের জন্যে যুক্তি-প্রমাণ, সাক্ষ্য ও উদাহরণ গৃহীত হতো নিকটস্থ পারিপার্শ্বিক সমাজ তেকেই, যে সবের সাথে শ্রোতৃমণ্ডলীর ছিলো নিগূঢ় পরিচিতি। তাদেরই ইতিহাস,তাদের জাতীয় ঐতিহ্য, তাদেরই দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণাধীন নিদর্শণ সমূহ এবং তাদেরই আকীদা বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র এবং সামজিক ক্রটিবিচ্যুতি সম্পর্কে তাতে আলোচনা হতো, যাতে করে তারা এর দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়।

দাওয়াতের এ প্রাথমিক অধ্যায় প্রায় তিন চার বছর পযন্ত দীর্ঘায়িত হয়। (এর মধ্যে তিন বছর ছিলো গোপন দাওয়াতের পর্যায়)। এ অধ্যায় নবী করীমের (সঃ) দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া তিন ভাবে প্রকাশিত হয়ঃ

১) কতিপয় সৎ ও সত্যপন্থী লোক এ দাওয়াত কবুল করে মুসলিম উম্মায় সংঘবদ্ধ হবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।

২) একটা বিরাট সংখ্যাক লোক মূর্খতা কিংবা স্বার্থপরতা অথবা বংশানুক্রমিক প্রচলিত প্রথার অন্ধ-প্রেমে মশগুল হয়ে তার বিরোধিতা করতে বদ্ধপরিকর হয়।

৩) কুরাইশ ও মক্কার পরিসীমা অতিত্রম করে এ নতুন দাওয়াতের আওয়ায অপেক্ষাকৃত বিশাল ক্ষেত্রে পদার্পণ করে।

এরপর থেকেই আরম্ভ হয় এ দাওয়াতের দ্বিতীয় অধ্যায়। এ অধ্যায়ে ইসলামী আন্দোলনের সাথে প্রাচীন জাহেলিয়অতের এক তীব্র প্রাণান্তকর দ্বন্দ্বের সূচনা হয়, যার জের আট ন’বছর কাল পর্যন্ত চলতে থাকে। শুধু মক্কাতে নয়, শুধু কুরাইশ গোত্রে নয়, আরবের অধিকাংশ অঞ্চলেই প্রাচীন জাহেলিয়াতের সমর্থকরা এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এ আন্দোলনকে নিস্তেজ ও নিস্তনাবুদ করে দেবার জন্যে তারা সর্বোতভাবে চেষ্টা করতে শুরু করে। মিথ্যা প্রোপাগাণ্ড, অপবাদ, দোষারোপ, সন্দেহ-সংশয় ও নানাবিধ কুট প্রশ্নের তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকে। জনগণের অন্তরে বিবিধ-প্রকার প্রচারণ ও প্ররোচনা সৃস্টি করতে থাকে। অপরিচিত লোকদেরকে নবী করীম (সঃ) –এর কথা শোনা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর চরম পাশবিক অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে যাবতীয় সর্ম্পক ছিন্ন করে। এভাবে তাঁদের উপর এতো অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালানো হয় যে, তাদের অনেক লোকই নিজেদের ঘর বাড়ী পরিত্যাগ করে দু’দুবার হাবশায় হিজরত করতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত তৃতীয়বার তাঁদের সকলকেই মদীনায় হিজরত করতে হয় কিন্তু এ তীব্র বিরোধিতা ও ক্রমবর্ধমান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ আন্দোলন ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে। মক্কায় এমন কোন বংশ ও পরিবার ছিল না, যেখান থেকে অন্তত এক ব্যক্তিও ইসলাম গ্রহণ করেনি। ইসলামের অধিকাংশ দুশমনের কঠিন দুশমনীর কারণ এ ছিলো যে, তাদের নিজেদেরই ভাই, ভাতিজা, পুত্র, জামাই, কন্যা, বোন এবং ভগ্নিপতির ইসলামী দাওয়াত শুধু কবুলই করেনি; বরং তারা ইসলামের আত্মোৎসর্গী, সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছিলো। তাদের নিজেদের কলিজার টুকরো সন্তানরাই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হয়ে উঠেছিলো। সর্বোপরি মজার ব্যাপার ছিলো যে, যারাই প্রাচীন জাহেলিয়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এ নতুন আন্দোলনে যোগদান করছিলো, তারা জাহেলী সমাজেও সর্বাপেক্ষা উত্তম লোক হিসাবে স্বীকৃতি ছিলো। আর এ আন্দোলনে যোগদানের ফলে তারা এত বেশী সৎ ও সত্যপন্হী এবং পবিত্র নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেছিলো যে,এ বিপ্লবী কাজটাই বিশ্ববাসীর দৃস্টিতে এ আন্দোলনের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা সুস্পষ্ট করে তুললো। এ সুদীর্ঘ ও কঠিন দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম চলাকালে আল্লাহ তায়ালা সময়, সুযোগ ও প্রয়োজনমতো তাঁর নবীর প্রতি এমন সব আবেগময়ী ভাষণ নাযিল করতে থাকেন, যেগুলোতে বর্তমান ছিলো দরিয়ার উচ্ছ্বসিত শ্রোতবেগ, সয়লাবের দুর্নিবার শক্তি আর আগুনের তীক্ষ্ম তেজস্বীতা। এসব ভাষণে একদিকে ঈমানদারদেরকে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্যসমুহের কথা বলে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে জামায়াতী যিন্দেগীর চেতনা পয়দা করা হয় এবং তাদেরকে তাক য়া, চারিত্রিকমাহাত্ন্য, পবিত্র স্বভাব ও পবিত্র জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সত্য দীন প্রচারের কর্মপন্থা তাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হয়। সাফল্যের ওয়াদা ও জান্নাতের সুসংবাদ দ্বারা তাদের সাহস যোগানো হয়। ধৈর্য্য, দৃঢ়তা ও উচ্চ সাহসিকতার সাথে আল্লাহর পথে জেহাদ ও সংগ্রাম করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয় ত্যাগ, কোরবানী ও আত্মোৎসগের্র এমন দুর্বার জজবা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দেয়া হয় যে, যাবতীয় বিপদ মুসীবত ও বিরুদ্ধতার গগণচুম্বী তরঙ্গমালার সঙ্গে মুকাবিলা করার জন্যে তারা তৈরী হয়ে যায়। অন্যদিকে বিরুদ্ধবাদী, সত্যবিমুখ ও গাফলতের ঘুমোঘোরে নিমজ্জিত লোকদের সেসব জাতির ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়, যাদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ভালভাবে জনা ছিলো। দিনরাত যেসব ধ্বংসাবশেষ অঞ্চলের উপর দিয়ে সফর ব্যাপদেশে তারা যাতায়াত করতো সেসব নিদর্শনের উল্লেখ করে তারেদকে উপদেশ দেয়া হয়। আসমান ও জমিনের যেসব সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দিনরাত চোখের সামনে প্রতিভাত হতো, যেগুলো তাদের যিন্দেগীতে তারা প্রতিটি মুহূর্তে অবলোকন করতো ও অনুভব করতো, সেসব প্রকাম্য নিদর্শনাবলী দ্বারাই তৌহিদ ও আখিরাতের প্রমাণ পেশ করা হয়। শিরক, সেচ্ছাচারিতা, পরকালের প্রতি অস্বীকৃতি এবং পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের ভ্রান্তি মন-মগজে প্রভাব বিস্তারকারী সুস্পষ্ট দলীল ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা হয়। অতঃপর তাদের যাবতীয় সন্দেহ সংশয় বিদূরিত করা হয়। তাদের প্রতিটি প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব দেয়া হয়। যেসব জটিল সমস্যায় মন জর্জরিত ছিল অথবা অন্যদের মনকে সংশায়িত করছিল সেগুলোর সুস্পষ্ট সমাধান পেশ করা হয়। চতুর্দিক থেকে অন্দ জাহেলিয়াতকে এমনভাবে অবরুদ্ধ করা হয় যে, বুদ্ধি ও বিবেকের জগতে অবস্থানের জন্যে তার বিন্দু পরিমান স্থঅন থাকল না। এর সাথে তাদেরকে আল্লাহর গজব ও অভিশাপ, কিয়ামতের ভয়ঙ্কর রূপ এবং জাহান্নামের কঠিন আযাব সম্পর্কে বয় প্রদর্শন করা হয়। তাদের খারাপ চরিত্র, ভ্রান্ত জীবন-যাপন পদ্ধতি, জাহেলী রসম রেওয়ায, সত্য বিরোধিতা এবং মুমিনদেরকে নির্যাতনের কারণে তাদেরকে র্ভৎসনা ও তিরস্কার করা হয়। নৈতিক চরিত্র ও সমাব্যবস্থার যেসব বড় বড় মূলনীতি আল্লাহর মনোনীত সত্যভিত্তিক সভ্যতার ভিত্তি সেগুলো বিস্তারিত ভাবে তাদের সামনে পেশ করে দেয়া হয়।

এ অধ্যয়টি এককভাবে বিভিন্ন মনযিল দ্বারা সমন্বিত, যার প্রতিটি মনযিলেই দাওয়াতী কাজ অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রশস্ত হয়ে উঠে। চেষ্টা সাধনা এবং বিরুদ্ধতাও তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলন বিভিন্ন মতাবলম্বী ও পরস্পর বিরোধী কর্মতৎপর অসংখ্য দল উপদলের সম্মুখীন হয়। তদনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বাণী সমুহের বিষয় বৈচিত্রও ব্যাপকতর হতে থাকে। ইসলামী দাওয়াতের এ বিরাট দায়িত্ব পালনের জন্যে নবী (স)-কে যে বিস্তারিত পথ নির্দেশ প্রদান করা হয় তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, মক্কার ঘোর বিরোধীতার যুগে কোন মহান চারিত্রিক শক্তি সম্মুখে অগ্রসর হবার পথ পরিস্কার করে এবং কোন প্রভাবশালী এ আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী লোকদেরকে সকল শক্তির সাথে টক্কর লাগাতে এবং সকল মুসীবত অকাতরে সহ্য করতে উদ্বুদ্ব্দ করে। নিম্নে এক একটি করে সেসব পথ নির্দেশ আমরা বর্ণনা করছিঃ

দাওয়াত দানে হিকমত ও মাওয়েযাগত পদ্ধতি
আরবী হবে————————–

‘হে নবী তোমার রবের পথে লোকদেরকে ডাকো ‘হেকমত’ এবং মাওয়েযায়ে হাসানার মাধ্যমে’। (আন নহল ১২৫)

এখানে বলা হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াত দানে দুটো পদ্ধতি খুব কড়াকড়ি ভাবে মেনে চলতে হবে। এক, হিকমাত। দুই, মাওয়েযায়ে হাসান।

“দাওয়াতে হিকমাত প্রয়োগের মানে হচ্ছে-বেওকুফদের মতে বোকামীর সাথ যেনো দাওয়াত দেয়া না হয়। বরং বুদ্ধিমত্তার সাথে শ্রোতার মানসিকতা ও সামর্থ এবং তার ধারণ ক্ষমতা বুঝে উপযুক্ত স্থান, সময় ও সুযোগ অনুযায়ী কথা বলতে হবে। সব ধরনের লোকদেরকে একই ডাণ্ডা দিয়ে সোজা করার চেষ্টা করা ঠিক নয়। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া হবে-প্রথমে তার রেগ নির্ণয় করতে হবে। অতঃপর এমন সব যুক্তি ও প্রমাণের সাহয্যে তার চিকিৎসা করতে হবে-যা তার মন-মানসিকতার গভীর থেকে সমস্ত রোগের উৎস মূর উপড়ে ফেলতে সমর্থ হবে।

‘মাওয়েযায়ে হাসানা’ বা উত্তম উপদেশের দুটি অর্থ রয়েছে। এক শ্রোতাকে শুধুমাত্র যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টাকে যথেষ্ট মনে করা যাবে না;বরং তার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। অন্যায় ও ভ্রান্তিকে শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে দিলেই চলবে না; বরং মানুষের মধ্যে জন্মগত ভাবে অন্যায়ের প্রতি যে র্ঘণঅ ও নফরত রয়েছে তাকে জাগ্রত করে তুলতে হবে এবং গেসুলোর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দিতে হবে। হেদায়াত ও আমলে সালেহর সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা যুক্তি ও বুদ্ধিগত প্রমাণই যথেষ্ট নয়-সাথে সাথে এগুলোর প্রতি শ্রোতার আকর্ষণ ও মহব্বত পয়দা করে দিতে হবে। দুই সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও একান্ত দরদের সাথে উপদেশ দান করতে হবে। শ্রোতা যেনো কখনো এমনটি মনে করতে না পারে যে, উপদেশদানকারী তাকে ক্ষুদ্র জ্ঞান করছে এবং নিজেকে বিরাট কিছু মনে করে তার সাথে বিদ্রুপ করছে। বরং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেনো শ্রোতা অনুভব করতে পারে যে-তার সংশোধনের জন্য উপদেশ দানকারীর অন্তরে সত্যিই দরদ ও সানুভূতিপূর্ণ আকুতি রয়েছে এবং প্রকৃত পক্ষে তিনি তার কল্যাণ কামান করেছেন”।

কথা ও আলোচনা ধরন তর্ক বহছ ও জ্ঞান বুদ্ধির দাপট দেখানোর প্রয়োজন হবে না। একাজে উগ্র আলোচনা, অপবাদ দেয়া ও চোট লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আলোচনা বা কথা বলার উদ্দেশ্যে যেনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে জব্দ করা কিংবা নিজের বাচালতার ঢাকঢোল পেটানো না হয়। বরং দাওয়াতী কাজে আলোচনা ও কথা-বার্তা হতে হবে সুমধুর। দাওয়াত দানকারীর চরিত্র হতে হবে উচ্চমানের ভদ্রতা ও শালীনতাপূর্ণ। নিজের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যুক্তিপূর্ণ ও প্রানাকর্ষিত দলিল প্রমাণ দিয়ে। কোনো অবস্থাতেই শ্রোতাদের মনে জিদ, গোস্বা ও উগ্রতা পয়দা হতে দেয়া যাবে না। অত্যন্ত সরল সোজাভাবে তাকে নিজের বক্তব্য-বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। যখন অনুভূত হবে, শ্রোতা বক্রতর্কে অগ্রসর হচ্ছে তখন তখনই তার সাথে আলোচনা বন্ধ করে দিতে হবে। যেনো সে ভ্রান্ত পথে আরো অধিক অগ্রসর হতে না পারে।

সত্যপথের ডাকার জন্যে প্রয়োজন ঠাণ্ডা মাথা ও পরিবেশগত উত্তমপন্থাঃ
আরবী হবে————

‘হে মুহাম্মদ! আমার বান্দাদের বলে দাও, তারা যেনো সর্বোত্তম ভাবে কথা বলে। আসলে শয়তান তাদের মধ্যে ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। তোমাদের রব তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক জানেন তিনি ইচ্ছে করলে তোমাদেরকে অনুগ্রহ করতে পারেন। আর তিনি চাইলে তোমাদের আযাবাও দিতে পারেন। আর হে নবী, আমরা তোমাকে লোকদের উপর উকীল বানিয়ে পাঠাইনি’। (বনী ইসরাঈল :৫৩-৫৪)

অর্থাৎ-ঈমানদার লোকেরা কাফির মুশরিক এবং তাদের দ্বীনের বিরুদ্ধেবাদীদের সাথে আলোচনা ও কথা বলার সময় মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও দ্রুত কথা বলবে না। বিরুদ্ধবাদীরা যতই অন্যায় অপসন্দনীয় কথা বলুকনা কেনো মুসলমানদেরকে কোনো অবস্থাতেই কোনো না-হক ও অন্যায় কথা মুখ দিয়ে বের করা যাবে না এবং রাগের মাথায় কোনো বাজে কথার প্রতি উত্তরে বাজে কথা বলা যাবে না। তাদের ঠাণ্ডা মাথায় পরিবেশ অনুযায়ী তুলাদণ্ডে মেপে কথা বলতে হবে। তাদের প্রতিটি কথা ন্যায় ও সত্য এবং তাদের মহান দাওয়াতের মর্যাদাসূচক।

আর কখনো যদি বিরুদ্ধবাদীদের কথার জবাব দিতে গিয়ে তোমাদের মধ্যে ক্রোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে বলে অনুভব করো এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করো- তখনই বুঝে নেবে যে, এ হচ্ছে শয়তানের কাজ। সে তোমাকে উস্কিয়ে দিচ্ছে যেনো দাওয়াতে দ্বীনের কাজটা বিনষ্ট হয়ে যায়। সে চায় তোমরাও তোমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মত সংস্কার সংশোধনের কাজ ত্যাগ করে সেরূপ ঝগড়া ফাসাদে লিপ্ত হয়ে যাও যেরূপ ঝগড়া ফাসাদে সে গোটা মানব জাতিকে লিপ্ত রাখতে চায়।

ঈমানদার লোকদের মুখ দিয়ে এমন দাবী কখনো বেরোতে পারবে না যে আমরা বেহেশতী আর অমুক লোক বা লোকেরা দোযখী। এ কাজের ফায়সালা তো আল্লাহর হাতে। স্বয়ং নবীর কাজও দাওয়াত দান পর্যন্ত সীমিত। লোকদের ভাগ্যের চাবিকাঠি তাঁর হাতে অর্পণ করা হয়নি যে, তিনি কারো জন্যে রহমতের আর কারো জন্যে আযাবের ফায়সালা করে দেবেন।

দাওয়াত দানকারীর মর্যাদা ও দায়িত্বঃ
আরবী হবে———-

‘দেখো তোমাদের কাছে তোমাদের রবের নিকট থেকে অন্তর্দৃষ্টির আলো এসে পৌঁছেছে। এমন যে লোক নিজের দৃষ্টি শক্তির সাহায্যে কাজ করবে সে নিজেরই কল্যাণ সাধন করবে। আর যে অন্ধত্ব গ্রহণ করবে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি তোমাদের উপর পাহারাদার নই’। (আনয়াম-১০৪)

‘আমি তোমাদের উপর পাহারাদার নই’ মানে আমার দায়িত্ব তো শুধু এতটুকু যে তোমাদের কাছে সে রৌশনী পেশ করে দেবো যা তোমাদের পরওয়ারদেগারের নিকট থেকে এসেছে। অতঃপর চোখ খুলে দেখা না দেখা তো তোমাদের কাজ। যারা চোখ বন্ধ করে রাখবে জোর পূর্বক তাদের চোখ খুলে দেবো এবং তারা যা দেখবে না তাদেরকে তা দেখিয়ে ছাড়বো-এমন দায়িত্ব আমাকে দেয় হয়নি।

আরবী হবে———

‘হে নবী! আপনার রবের নিকট থেকে অবতীর্ণ অহীর অনুসরণ করুন। তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। মুশরিকদের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না। যদি আল্লাহর ইচ্ছা হতো (এরা শিরক না করার) তবে এরা শিরক করতো না। আমি আপনাকে এদের উপর পাহারাদার নিযুক্ত করিনি। আপনি তাদের উপর কোনো হাবিলদারও নন’। (আনয়াম ১০৬-১০৭।)

এ কথার তাৎপর্য যে, আপনাকে দা’য়ী ও প্রচাররক বানানো হয়েছে, কোতোয়াল বানানো হয়নি। তাদের পিছে লেগে থাকার কোনো প্রয়োজন আপনার নেই। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে লোকদের সামনে এ রৌশনী আপনি পেশ করে দেবেন, সাধ্যানুযায়ী সত্য প্রকাশের হক আদায় করতে কোনো ক্রটি করবেন না। অতঃপর কেউ যদি এ সত্য কবুল করতে না চায়-তবে তা না করুক। লোকদের সত্যপন্থী বানিয় ছাড়ার দায়িত্ব আপনাকে অর্পন করা হয়নি। আর এমন কথা আপনার দায়িত্ব ও জবাবদিহির অন্তর্ভুক্তও নয় যে, আপনার নবুওয়াতের সীমানায় কোনো বাতিল পন্থীর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না। সুতরাং এ চিন্তায় আপনার মনকে পেরেশান করে তুলবেন না যে, অন্ধ লোকদেরকে কী করে দৃষ্টি শক্তি দেয়া যাবে যারা চোখ খুলে দেখতে চায় না-তাদেরকে কি করে দেখানো যাবে। যদি আল্লাহর ইচ্ছাই এ রকম হতো যে দুনিয়ায় কোনো বাতিল পন্থীর অস্তিত্ব থাকতে পারবে না তবে একাজ আপনার দ্বারা করানো আল্লাহর কি প্রয়োজন ছিল? তাঁর একটা তাকভীনি () ইশারাই কি সমস্ত মানুষকে সত্যপন্থী বানাতে পারতো না? কিন্তু শুরু থেকেই সেখানে উদ্দেশ্য এরূপ নয়। উদ্দেশ্য তো হচ্ছে মানুষকে হক ও বাতিল নির্বাচনের আযাদী দেয়া হবে। অতঃপর হকের রৌশনী তার সামনে পেশ করে তাকে পরীক্ষা করা হবে এ দুয়ের মাঝে সে কোনটা নির্বাচন করে। তাই আপনার জন্যে সঠিক কর্মপন্থা হচ্ছে যে রৌশনী আপনাকে দেখিয়ে দেয়া হলো, তার আলোকে আপনি সঠিক সোজা পথে চলতে থাকুন এবং যারা এ দাওয়াত কবুল করে নেবে তাদেরকে বুকে মিলিয়ে নিন এবং কখনো তাদের সঙ্গদান ত্যাগ করবেন না। পার্থিব দৃষ্টিতে তারা যতই নগণ্য মূল্যহীন হোক না কেনো। আর যারা এ দাওয়াত কবুল করবে না তাদের পিছে লেগে থাকবেন না। যে অশুভ পরিণতির দিকে তারা নিজেরাই যেতে চায়, যাওয়ার জন্যে চরম গোঁড়ামী অবলম্বন করে তাদেরকে সেদিকে যাবার জন্যে ছেড়ে দিন।

দ্বীন প্রচারের সহজ পন্থা
আরবী হবে———

‘আর হে নবী! আমি তোমাকে সহজ পন্থার সুবিধে দিচ্ছি। কাজেই তুমি উপদেশ দিয়ে যাও। যদি উপদেশ ফলপ্রসু হয়’।

অর্থাৎ হে নবী! দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো অসুবিধেয় ফেলতে চাইনে। বধিরদেরকে শুনানো আর অন্ধদেরকে পথ দেখানোর দায়িত্ব তোমার নয়। তোমাকে একটা সহজ পন্থা দিয়ে দিচ্ছি। তা হচ্ছে, তুমি উপদেশ দান করতে থাকো যতক্ষণ তুমি অনুভব করতে থাকবে যে, কেউ না কেউ এর দ্বারা উপকৃত হতে প্রস্তুত নয়। বাকী থাকলো এ কথা যে, এর দ্বারা উপকৃত হতে কে প্রস্তুত আর কে প্রস্তুত নয়? বস্তুত সাধারণ দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমেই এ প্রশ্নের জবাব প্রকাশিত হয়ে যাবে। তাই সাধারণ তাবলীগ ও প্রচার কাজ অবশ্যই জারি রাখতে হবে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে ঐ সমস্ত লোকদেরকে খুঁজে বের করা যারা এ নসীহতের দ্বারা উপকৃত হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করবে। বস্তুত এ সমস্ত লোকেরাই তোমার আন্তরিক লক্ষ্যস্থল হবার অধিকারী, আর শুধুমাত্র এ লোকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতিই তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এদের ছেড়ে ঐ সমস্ত লোকদের পিছে ব্যস্ত হবার কোনো প্রয়োজন নেই, অভিজ্ঞতার আলোকে যাদের সম্পর্কে জানতে পারবে যে, তারা এ নসীহত কবুল করতে ইচ্ছুক নয়।

দ্বীন প্রচারের দৃষ্টিকোণ গুরুত্বপূর্ণ লোক কারা
আরবী হবে————-

‘আর হে নবী! যারা রাতদিন তাদের পরওয়ারদিগারকে ডাকতে থাকে আর তাঁর সন্তোষ অনুসন্ধান নিরত থাকে, তুমি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিওনা। তোমার উপর তাদের হিসাবের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই আর তাদের উপরও তোমার হিসাবের কোনো যিম্মাদারী নেই। তা সত্ত্বেও যদি তুমি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দাও, তবে তুমি যালেমদের মধ্যে গণ্য হবে’। (আনয়াম-৫২)

প্রথম দিকে যারা হুজুর (সঃ)-এর প্রতি ঈমান এনছিলেন তাদের বহুসংখ্যক লোক দরিদ্র ও শ্রমজীবি ছিলেন। হুজুর (সঃ)-এর প্রতি কুরাইশদের বড় বড় সরদার ও স্বচ্ছল অবস্থার লোকদের অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে এ প্রশ্নটিও ছিল যে-তাঁর চতুরপার্শ্বে তো কেবল আমাদের কওমের দাস, মুক্তদাস ও নিম্নশ্রেণীর লোকেরাই একত্রিত হয়েছে। তারা টিপ্পনী কেটে বলতো-এ লোকের সঙ্গী-সাথী ও মিছিলে কেমন সম্মানিত লোকেরা! বেলাল, আম্মার, সোহাইব, খাব্বাব বাস্ এ লোকদেরকেই আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে মনোনীত করার মত খুঁজে পেলেন। অতপর তারা ঈমানদারদের অসচ্ছল অবস্থঅ নিয়ে বিদ্রূপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ঈমান আনার পূর্বে তাদের কারো কোন চারিত্রিক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকলে তা নিয়েও তারা বিদ্রূপের ঢেউ তুলতো যে, কালকে পর্যন্ত যার চরিত্র এমন ছিল, এমন এমন কাজ যে করেছে সেও দেখি এ মনোনীত দলের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আনয়ামেরই ৫৩ আয়াতে তাদের একথার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছেঃ এরাই কি সেসব লোক, আমাদের মধ্য থেকে যাদের প্রতি আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহ হয়েছে? এ আয়াতে এসব কথারই জবাব দেয়া হয়েছে। আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে, যেসব লোক সত্যানুসন্ধিৎসু হয়ে তোমার নিকট আসে- বড় বড় লোকদেরকে খাতির করতে গিয়ে তারেকে দূরে ঠেলে দিওনা। ইসলাম কবুল করার পূর্বে কেউ কোনো অপরাধ করে থাকলেও তার দায়-দায়িত্ব তো তোমার উপর বর্তাবে না।

হযরত ইবনে উম্মে মাকতুমের ঘটনা
হুজুর (সঃ) -এর মজলিসে একবার মক্কার কতিপয় সরদার, সমাজপতি উপবিষ্ট ছিল। হুজুর (সঃ) তাদের ইসলাম কবুল করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছিলেন।১ এরি মধ্যে ইবনে উম্মে মাকতুম নামক একজন অন্ধ হুজুর (সঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেন। এ সময় ব্যাঘাত সৃষ্টি করাটা হুজুর (সঃ)-এর অপসন্দ হওয়ায় তিনি তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সূরা আবাসা নাযিল হয়ঃ

আরবী হবে———

‘বেজার হলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ সে অন্ধ তাঁর নিকট এসেছে’। (আবাসা ১-২)

ভাষণের সূচনাভঙ্গি দেখে বাহ্যত মনে হয়, অন্ধ ব্যক্তির প্রতি অনাগ্রহ এবং বড় বড় সরদারদের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ প্রদর্শন করায় নবী করীম (সঃ)-এর প্রতি এ সূরায় শাসন ও তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গোটা সূরাটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে জানা যায় যে, এ সূরায় মূলতঃ কাফের কুরাইশ সরদারের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে-যারা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা এবং সত্য বিমুখতার কারণে নবী করীম (সঃ)-এর সত্য দাওয়াতকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছিল। আর হুজুর (সঃ) –কে দ্বীন প্রচারের সঠিক পন্থা শিক্ষা দেয়ার সাথে রেসালাতের দায়িত্ব পালনের প্রাথমিক অবস্থায় তিনি যেসব পন্থা অবলম্বন করছিলেন-তার ভ্রান্তিও বুঝিয়ে দেয়া হলো। তিনি যে একজন অন্ধ ব্যক্তির প্রতি অনাগ্রহ এবং কুরইশ সরদারদের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেছিলেন-তার কারণ এ নয় যে-তিনি এসব বড় লোককে সম্মানিত ও মর্যাদাবান এবং বেচারা অন্ধ ব্যক্কিকে নগণ্য ভাবছিলেন। এর কারণ এও নয় যে, মায়যাল্লাহ তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার নৈতিক বক্রতা বিদ্যমান ছিল-যার কারণ আল্লাহ তায়ালা এখানে তাঁকে শাসন ও তিনস্কার করেছেন। না এ ব্যাপার এসব কিছুই নয়; বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে যে, কোনো আদর্শের আহবায়ক বা দা’য়ী যখন তাঁর দাওয়তী কাজের সূচনা করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার লক্ষ্য তাকে যেনো সমাজের প্রভাবশালী লোকেরা এ দাওয়াত কবুল করে নেয়; যার ফলে প্র্রচার কাজ সহজতর হয়ে যায়। নতুবা সাধারণ প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের মধ্যেও যদি দাওয়ত ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েও যায়-তবু মূল ব্যাপারে তেমন কোনো পার্থক্য সূচিত হয় না। দাওয়াতের সূচনাকালে হুজুর (সঃ) প্রায় এ রকম কর্মনীতিই গ্রহণ করেছিলেন। ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও দ্বীনি দাওয়াতের উৎকর্য়ের প্রতি গভীর আন্তরিকতাই ছিল এর মূল কারণ। বড় লোকের সম্মান প্রদর্শন এবং ছোট লোকদের ঘৃণা করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালঅ তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে, ইসলামী দাওয়াতের সঠিক ও নির্ভুল পন্থা এটা নয়। বরং এ দাওয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে ঐসব লোকেরাই গুরুত্বের অধিকারী যারা সত্যানুসন্ধিৎসু-তারা যতই দুর্বল, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন ও অক্ষমই হোক না কেনো। পক্ষান্তরে যাদের মধ্যে সত্যানুরাগ নেই, সমাজে তারা যতই উচ্চমর্যাদার অধিকারী হোক না কেনো-এ আন্দোলনের দৃষ্টিতে তারা একেবারেই গুরুত্বহীন। সুতরাং ইসলামের আহ্বান্আপনি সকলের নিকটই পৌঁছাবেন বটে; কিন্তু আপনার লক্ষ্য ও আগ্রহের অধিকারী হবে সেসব লোক-যাদের মধ্যে এ মহাসত্য গ্রহণের সম্মতি পাওয়া যাবে। আর যারা নিজেদের অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কারণে মনে করে যে, তারা আপনার মুখাপেক্ষী নয়; বরং আপনিই তাদের মুক্ষাপেক্ষী কেবল এসব দাম্ভিক ও অহংকারী লোকদের নিকটই দাওয়াত পেশ করতে থাকা আপনার এ সুমহান দাওয়াতের উচ্চ মর্যাদার পক্ষে নিতান্তই অপমানকর। তার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

আরবী হবে——–

‘হে নবী! তুমি কেমন করে জানবে! সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো কিংবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশদান তার জন্যে কল্যাণকর হতো। যেলোক বেপরোয়া ভাব দেখায়, তুমি তার প্রতি লক্ষ্যারোপ করছো। অথচ সে যদি পরিশুদ্ধ না হয়, তবে তোমার উপর তার দায়িত্ব কি? আর যেলোক তোমার নিকট দৌড়ে আসে আর সে ভয়ও করে, তুমি তো তার প্রতি অনীহা প্রদর্শন করছো। কক্ষণও নয়। এটা তো একটা উপদেশ। যার ইচ্ছা সে এটা গ্রহণ করবে’।

এ সময় দ্বীন প্রচারের ব্যাপারে নবী করীম (সঃ) যে মূল তত্ত্বটাকে উপেক্ষা করছিলেন; এখানে তারই উল্লেখ করা হয়েছে এবং একথা বুজানোর জন্যেই আল্লাহ তায়ালা প্রথমে ইবনে উম্মে মাকতুমের সাথে নবী করীম (সঃ) –এর কৃত আচরণের তিরস্কার করেছেন। অতঃপর সত্য দ্বীনের প্রচারকদের নিকট প্রকৃত গুরুত্ব কোন জিনিসের হওয়া উচিত আর কোন জিনিসের নয়-তাই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক ব্যক্তির পরিচয় হচ্ছেঃ এই তার বাহ্যিক অবস্থা সুস্পষ্ট ভাবে বলে দেয় যে, সে সত্যানুসন্ধিৎসু, বাতিলের অনুসরণ করে খোদার রোষে নিপতিত হবার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। তাই সত্য পথের জ্ঞান লাভ করার জন্যে সে নিজেই নবীল নিকট এসে উপস্থিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে আর এক ব্যক্তির পরিচয় হচ্ছেঃ তার বাহ্যিক চাল-চলন ও আচরণই বলে দেয় যে, তার মধ্যে সত্যের প্রতি কোনো প্রকার অনুরাগ নেই। তাকে সত্য পথের পথনির্দেশ দেয়া হোক এমন প্রয়োজন থেকে সে নিজেকে অনেক উর্ধ্বে মনে করে। এ দুপ্রকার লোকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে তাতে লক্ষ্যণীয় বিষয় এটা নয় যে, কোন ব্যক্তি ঈমান আনলে দ্বীনের অনেক ফায়দা হতে পারে আর কারো ঈমান আনায় দ্বীনের উল্লেখযোগ্যা ফায়দা হতে পারে না। বরং লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে কোন ব্যক্তি হেদায়ত কবুল করে নিজেকে শোধরানোর জন্যে প্রস্তুত আর কোন ব্যক্তি এ অমূল্য সম্পদের মর্যাদাদানে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এবং এর মর্যাদা সম্পর্কে বিলকুল অনবহিত। প্রথম ব্যক্তি যদি অন্ধ, খঞ্জ, শক্তিহীন, নিঃস্ব-দরিদ্রও হয়ে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে দ্বীনের উৎকর্ষ লাভের ব্যাপারে বড় কোনো দায়িত্ব পালনেও যদি যোগ্য বলে বিবেচিত না হয়; তা সত্ত্বেও সত্য প্রচারকের জন্যে সেই হবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার প্রতিই তাঁকে লক্ষ্যারোপ করতে হবে। কারণ এ দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্যই তো হচ্ছে খোদার বান্দাদের সংশোধন। আর এ ব্যক্তির অবস্থা দৃষ্টে পরিস্কার বুঝা যায় যে, তাকে যদি নসীহত করা হয় তবে সে নিজেকে সংশোধন ও পরিবর্ত করে নেবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ সমাজে যতোই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী হোক না কেনো সত্য দ্বীনের প্রচারককে তার পিছে পিছে দৌড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তার বাহ্য আচরণ থেকে একথা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা গ্রহণে তার কোনো প্রকার ইচ্ছা ও আগ্রহ নেই। সুতরাং তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করা সময়ই নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। সে যদি নিজেকে শোধরাতে না চায়-তাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সত্য দ্বীন প্রচারকের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।

এখানে যে অন্ধ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, তিনি হচ্ছেন-প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) হাফেয ইবনে আবদুল বার ‘আল ইসতিয়ার’ গ্রন্থে এবং হাফেজ ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি ছিলেন হযরত খাদিজার (রাঃ) ফুফাতো ভাই। তার মা উম্মে মাকতুম এবং হযরত খাদীজার পিতা খুয়াইলিদ পরস্পর ভাই-বোন ছিলেন। হুজর (সঃ)-এর সাথে তাঁর এই আত্মীয়তার সম্পর্ক জানার পর তাকে তিনি দরিদ্র কিংবা কম মর্যাদার লোক মনে করে বিরক্তির সাথে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সম্মুখে উপস্থিত বড় লোকদের প্রতি লক্ষ্যারোপ করেছেন বলে সন্দেহ করার কোনোই অবকাশ নেই। কারণ, সম্পর্কের দিক থেকে তিনি তো নবী করীম (সঃ)-এর ভাই (ম্যালক) ছিলেন। বংশীয় লোক ছিলেন তিনি। কোনো প্রকার মর্যাদাহীন লোক তিনি ছিলেন না। বস্তুতঃ যে কারণে নবী করীম (সঃ) তার প্রতি উক্তরূপ আচরণ গ্রহণ করেছিলেন, তা কুরআনের ( ) (অন্ধ ব্যক্তি) শব্দ দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝা যায়। নবী করীম (সঃ) -এর অনাগ্রহ প্রকাশের মূল কারণ স্বরূপই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এখানে এ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এমুহূর্তে হুজুর (সঃ) -এর মনোভাব এরূপ ছিলো যে, এ সময় যে লোকগুলোকে আমি ইসলামের দিকে আনবার চেষ্টা করছি, তাদের একজন লোকও যদি হেদায়াত কবুল করে তবে তা ইসলামের শক্তিশালী হয়ে উঠার বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পক্ষান্তরে ইবনে উম্মে মাকতুম একজন অন্ধ ব্যক্তি। নিজ অক্ষমতার কারণে তিনি ইসলামের জন্যে ততোটা কল্যাণকর হতে পারেন না-যতোটা এ সরদারদের মধ্যে থেকে কেউ ইসলাম কবুল করলে আশা করা যায়। কাজেই এ সময়কার কথাবার্তায় ব্যাঘাত ঘটানো তার ঠিক নয়। তিনি যা কিছু জানতে ও বুঝতে চান তা পরেও কোনো একসময় জেনে নিতে পারেন।

দ্বীন প্রচারের হিকমত
আরবী হবে—–

‘আর আহলে কিতাবের লোকদের সাথে উত্তম-পন্থা ছাড়া তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়েঅনো’। (আনকাবুত-৪৬)

অর্থাৎ এ বিতর্ক যুক্তিসঙ্গত দলিল-প্রমাণ, সভ্য ও শালীন ভাষা এবং বুঝা ও বুঝানোর মাধ্যমে হতে হবে। যোনো যে ব্যক্তির সাথে কথা হচ্ছে তার চিন্তধারা সংশেঅধিত হতে পারে। শ্রোতার দিলের দরজা খুলে তাতে হক কথা প্রবেশ করিয়ে দেয়অ এবং তাক সত্য পথে নিয়ে আসার চেষ্টাই হতে হবে দ্বীন প্রচারকের মূল চিন্তা। প্রতিদ্বন্দ্বীকে খাটো করে দেখানোর উদ্দেশ্যে পাহলোয়ানের মতো লড়াই করা তার চলবে না। বরং তাকে এমন একজন বিজ্ঞ ডাক্তারের ন্যায় কাজ করতে হবে যিনি রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকেন যেনো তার কোনো ভুলের কারণে রোগীর রোগ আরো বেড়ে না যায় এবং তিনি চেষ্টা করেন যেনো ন্যূন কষ্ট পেয়ে রোগী আরোগ্য লাভ করেন। অবস্থানুযায়ী এখানে আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কের সময় কিরূপ আচরণ করতে হবে-তার হেদায়াত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ হেদায়ত বিশেষ ভাবে কেবল আহলে কিতাবদের ব্যাপারেই নয়; বরং দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে এ হচ্ছে এক সাধারণ হেদায়াত যা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে প্রদত্ত হয়েছে। যেমনঃ

আরবী হবে—-

‘তোমার রবের দিকে ডাকো হিকমাত ও উত্তম নসীহতের সাথে, আর লোকদের সাথে বিতর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (আন নহল-১২৫)

আরবী হবে—

‘ভাল আর মন্দ এক নয় (বিরুদ্ধবাদীদের হামলা) সর্বোত্তম পন্থায় দফা করো। তাহলে দেখবে-জানের দুশমনও প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে।‌’

আরবী হবে—-

‘মন্দ ও অন্যায়কে সর্বোত্তম পন্থায় দফা করো (তোমাদের বিরুদ্ধে) তারা যেসব কথা রটনা করছে-তা আমরা জানি।’ (আল মুমেনুন-৯২)

দাওয়াতে হকের সঠিক কর্মপন্থা
আরবী হবে——-

‘হে নবী, কোমল ও ক্ষমা সুন্দর নীতি অবলম্বন কর। ‘মারূফ’ কাজের নিদের্শ দিয়ে যাও এবং মুর্খদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। শয়তান কখনো যদি তোমাকে উস্কানী দেয়-তবে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। তিনি সব জানেন, সব শুনেন। প্রকৃত পক্ষে যারা মুত্তাকী, তাদের অবস্থা তো এরূপ যে, শয়তানের প্ররোচনায় কোনো খারাপ খেয়াল যদি তাদের স্পর্শ করেও তারা সাথে সাথে সাবধান ও সতর্ক হয়ে যায়। অতঃপর (তাদের সঠিক করণীয় কি) তা তারা সুস্পষ্টভঅবে দেখতে পায়। বাকী থাকলো তাদের (শয়তানের) ভাই বন্ধুদের কথা। এদের তো শয়তান বক্র পথে টেনে নিয়ে যায়। এবং এদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে তার কোনো ত্রুটিই করে না’। (আরাফ ১৯৯-২০২)

এ আয়াত সমূহে নবী করীম (সঃ) দাওয়াত ও তাবলীগ এবং হেদায়ত ও সংস্কার সংশোধনের হিকমাত সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শিক্ষা দেয়া হয়েছে; এর উদ্দেশ্য শুধু হুজুর (সঃ)-কে শিক্ষা দেয়ই নয়; বরং যেসব লোক হুজুর (সঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি হয়ে দুনিয়াবাসীদের সরল সঠিক পথ দেখঅতে প্রস্তুত হবে হুজুর (সঃ)-এর মাধ্যমে এমন সকল মানষকেই এ হিকমাত শিক্ষা দেওয়অ উদ্দেশ্য। ক্রমানুসারে এ শিক্ষা ও মূলনীতিগুলো নিম্নে পদত্ত হলোঃ

১। দা’য়ীয়ে হকের জন্যে সবচাইতে জরুরী গুণাবলীর একটি হচ্ছে তাকে কোমল, বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও উদারচিত্ত সম্পন্ন হতে হবে। নিজ সহকর্মীদের বেলায় তাকে কোমল ও প্রেমময় সাধঅরণ মানুষের বেলায় দরদী ও সহানুভূতিশীল এবং বিরোধীদের বেলায় অতিশয় সহিষ্ণু হতে হবে। কঠিন উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশেও তার মন মেজাজকে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কঠিন বিরুদ্ধবাদীদের কঠিন বিরোধিতা এবং নিজ সহকর্মীদের দুর্বলতা সমূহ বরদাশত করার মতো সহিষ্ণু হতে হবে। সম্পূর্ণ অসহনীয় কথাকেও উদারচিত্তে এড়িয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে যতোই শক্ত কথা, মিথ্যা, অপবাদ, জ্বালা যন্ত্রণা এবং নিতান্ত দুষ্কৃতিমূলক বাধা বিপত্তি আসুক না কেনো এ সবকিছুই তাকে উদার ও ক্ষমার দৃষ্টিতে হজম করতে হবে। কঠোরতা, কড়া ব্যবহার, তিক্ত কথা-বার্তা এবং প্রতিশোধ মূলক উত্তেজনা এ মহান কাজের পক্ষে বিষের মতো কাজ করে। এতে কাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে য়অয়, গড়ে উঠে না। এ জিনিসটাকে নবী করীম (সঃ) এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ আমার রব আমাকে আদেশ দিয়েছেন যে, ‘আমি ক্রোধ সন্তোষ উভয় অবস্থাতেই ইনসাফের কথা বলবো। যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবো। যে আমাকে আমার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে, আমি তাকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করবো। যে আমার প্রতি যুলুম করবে, আমি তাকে মাফ করে দেবো’। নিজের পক্ষ থেকে তিনি যাদেরকে দ্বীন প্রচার করতে পাঠাতেন, তাদেরকেও তিনি এরূপ হেদায়াতই দিতেনঃ

আরবী হবে—–

মানে-‘তোমরা যেখানেই যাবে, তোমাদের আগমন যেনো লোকদের কাছে সুসংবাদের বিষয় হয়-ঘৃণা ও অসন্তোষের ষিয় নয়। তোমরা লোকদের জন্যে সহজতা বিধানকারী হবে-কাঠিন্য ও কঠোরতা বিধানকারী নয়’। আর আল্লাহ তায়ালাও নবী করীমের (সঃ) এ গুণটারই প্রশংসা করে এরশাদ করেছেনঃ

আরবী হবে—–

‘অর্থাৎ-এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তুমি লোকদের প্রতি খুবই বিনম্র। নতুবা তুমি যদি পাষাণাত্মা ও রূঢ় ব্যবহারকারী হতে তবে এসব লোক তোমার চতুস্পার্শ্ব থেকে সরে যেতো’। (আল ইমরান-১৫৯)

২। দাওয়াতে হকের কামিয়াবী এ পন্থায় নিহিত রয়েছে যে, দাওয়াত দানকারী বড় বড়[ দর্শন ও সূক্ষ্মতত্ত্বের পরিবর্তে লোকদের সরাসরি মারূফ’ মানে-সোজা ও সুস্পষ্ট কল্যাণের শিক্ষা দেবে,যেসব কথাকে সাধারণ মানুষ ভাল কথা বলে জানে কিংবা যা ভাল কথা বলে মনে করার জন্যে-তাদের সাধারণ বুদ্ধিই(Common sence) যথেষ্ট হতে পারে। এ পন্থা গ্রহণের ফলে সত্য পথের দাওয়াত দানকারীর আবেদন সাধারণ ও সুধী সবাইকে প্রভাবিত করে। শ্রোতার কর্ণকুহ ভেদ করে দাওয়াত আপনিতেই তার মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। এমন ‘মারূফ’ দাওয়াতের বিরুদ্ধে যারা চিৎকার ও হাঙ্গামা করে-তার নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা এবং এ দাওয়াতের কামীয়াবীর ক্ষেত্র তৈরি করে। কারণ সাধারণত মানুষ যতোই হিংসা বিদ্বেষে নিমজ্জিত থাকুক না কেনো-তারা যখন দেখে যে একদিকে একজন ভদ্র ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী মানুষ সরল সঠিক কল্যাণের প্রতি দাওয়াত দিচ্ছেন-অপরদিকে অনেকগুলো লোক তার বিরোধিতায় সর্বপ্রকার নৈতিকতা ও মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে হীণ কার্যক্রম গ্রহণ করছে-তখন আপনিতেই তারা ধীরে ধীরে সত্যবিরোধীদের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে এবং সত্যের দাওয়াত দানকারীদের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। শেষ পযন্ত কেবল বাতিল সমাজ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই মুকাবিলার ময়দানে থেকে যায়, অথবা সেসব লোকেরাই বিরোধীতা করতে থাকে, যাদের অন্তরে অতীত লোকদের অন্ধ অসুসরণ কিংবা জাহেলী হিংসা বিদ্বেষ কোনো প্রকার সত্যপথ গ্রহণের যোগ্যতা ও সামর্থ্যই বাকী রাখেনি। এটাই হচ্ছে সে হিকমাত যা অনুসরণের ফলে আরবে নবী করীম (সঃ)-এর কামিয়াবী হাসিল হয়েছিল। এবং তার পরবর্তীতে অল্পকালের মধ্যে পার্শ্ববতী দেশসমূহে ইসলামের শ্রোতাধারা এমনভাবে প্রবাহিত হতে থাকলে যে, কোথাও শতকরা ১০০জন, কোথাও ৮০জন আবার কোথাও ৯০ জন অধিবাসী মুসলমান হয়ে যায়।

৩। দাওয়াতী কাজে সত্যানুসন্ধিৎসু লোকদের মারূফের প্রশিক্ষণ দেয়া যতোটা জরুরী এ ক্ষেত্রে তারা যতোই তর্ক বিবাদে জড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করুক না কেনো-দাওয়াত দানকারীকে এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেবল এমন লোকদের সম্বোধন করে কথা বলাই তার উচিত-যারা যুক্তি ও বুদ্ধির সাথে এ দাওয়াতকে বুঝার জন্যে প্রস্তুত হবে। কোনো জাহেল ব্যক্তি যদি কখনো জাহেলী আচররণ করতে শুরু করে এবং অর্থহীন তর্ক, ঝগড়া ও তিক্ত কথা-বার্ত বলতে আরম্ভ করে, তখন দা’য়ীয়ে হককে তার প্রতিপক্ষ সাজতে অস্বীকার করতে হবে। কারণ এ ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ার লাভ কিছুই নেই। আর তাতে লোকসান হচ্ছে এই যে দাওয়াত দানকারীর যে শক্তি দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও সংশোধনের জন্যে ব্যয় হওয়া উচিত ছিল-তা অর্থহীন কাজে বিনষ্ট হয়ে যায়।

৪। তিন নম্বরে যে হেদায়ত দেয়া হলো,সে প্রসঙ্গে আরো অধিক হেদায়াত হচ্ছে যে, দা’য়ীয়ে হক যখন বিরুদ্ধবাদীদের যুলুম, অত্যাচার, দুস্কৃতি ও মূর্খতা ব্যাঞ্জক প্রশ্ন ও অভিযোগের কারণে নিজের মন মেজাজ উত্তেজিত হচ্ছে বলে অনুভব করবে তখনই তাকে বুঝতে হবে-এটা শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তখনই তাকে খোদার পানাহ চাইতে হবে যেন তিনি নিজের বান্দাকে এ উত্তেজনায় সীমা লংঘন থেকে রক্ষা করেন এবং এমন বেসামাল হতে না দেন-যাতে দওয়াতে হকের ক্ষতি সাধিত হবার মতো কোনো তৎপরতা তার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। দাওয়াতের হকের কাজ সর্বাবস্থায় ঠাণ্ডা দিলেই হওয়া সম্ভব। সে পদক্ষেপই সঠিক হওয়া সম্ভব-যা উত্তেজনায় পরাজিত হতে নয়, বরং স্থান পরিবেশ ও সময় সুযোগ অনুযায়ী খুব বুঝে শুনে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু শয়তান যে, কখনো এ কাজের প্রসার চায় না ও সহ্য করে না সব সময়ই আপন ভাই-বন্ধুদের দ্বারা দাওয়াত দানকারীর উপর হামলা চালাবার চেষ্টা করে এবং এ হামলার জবাব দেবার জন্যে তাকে প্ররোচিত করতে থাকে যে, এ হামলার অবশ্যই জবাব দেয়অ চাই। শয়তানের এ প্ররোচনা যা সে দাওয়াত দানকারীর অন্তরে সৃষ্টি করে দেয়-অনেক সময় বড় বড় ধোকা ও ধর্মীয় পরিভাষার আবরণে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এর অভ্যন্তরে নিছক আত্মম্ভরিতা ছাড়া আর কিছু্ই থাকে না। এ জন্যে শেষ দুটি আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী লোকেরা তো নিজেদের অন্তরে কোনো শয়তানী তৎপরতা ও প্রভাব এবং খারাপ চিন্তা অনভব করতেই সাবধান ও সতর্ক হয়ে যায়। অতঃপর তারা পরিস্কারভাবে দেখতে ও বুঝতে পারে এমতাবস্থায় কোন নীতি ও কর্মপন্থা অবলম্বনে দাওয়াতে দ্বীনের পক্ষে কল্যাণকর হবে আর এমতাবস্থায় দাওয়াত দ্বীনের দাবীই বা কি। যারা আত্মপূজার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে এবং এ কারণে শয়তানদের সাথে যাদের ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক তারা কখনো শয়তানী প্ররোচনায় সম্মুখে টিকে থাকতে পারে না। তারা শয়তানী প্ররোচনায় পরাজিত হয়ে ভ্রান্ত পথে চলতে শুরু করে। অতঃপর শয়তান তার ইচ্ছা মাফিক তাদেরকে সর্বত্র তাড়িয়ে বেড়ায় এবং কোথাও তাদের এ চলার গতি বন্ধ হয় না। বিরোধিদের প্রতিটি গালির মুকাবিলায় তাদের কাছেও একটা গালি এবং বিরোধিদের প্রতিটি য়ড়যন্ত্র ও দুস্কৃতির মুকাবেলায় তাদের কাছেও একটা য়ড়যন্ত্র ও দুস্কৃতি মওজুদ থাকে।

এ আলোচনায় একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও আছে। তা হচ্ছে এই যে, তাকওয় সম্পন্ন লোকেরা সাধারণত নিজেদের জীবন পদ্ধতিতে অমুত্তাকী লোকদের চাইতে ভিন্নতর হয়ে থাকে। যারা প্রকৃতই আল্লাহকে ভঅ করেন এবং আন্তরিকভঅবে অন্যায় ও পাপ থেকে বাঁচতে চান তাদের অবস্থা তো এরূপ হয়ে থাকে যে, তাদের চিন্তার কোণে সামান্য বদখেয়ালও যদি ছায়া ফেলে-তখনই তাদের খটকা অনুভূত হয় ও কষ।ট লাগে। যেমন কষ।ট অনুভূত হয়েথাকে আঙ্গুলে কাঁটা বিধলে অথবা চোখে ধুলকণা পড়লে। যেহেতু তারা এসব বদখেয়াল, অন্যায় বাসনা ও খায়েশ এবং বদনিয়তে অব্যস্ত নয়-তাই এসব জিনিস তাদের স্বভাববিরোধী হয়ে থাকে। যেমন পায়ে কাটা ফুটলে, চোখে আবর্জনা প্রবেশ করলে কিংবা পরিচ্ছন্ন কাপড়ে ময়লার ছিটা লাগলে লাগলে পরিচ্ছন্ন মানসিকতার লোকদের অসুবিধা হয়ে থাকে। এ খটকা ও অসুবিধা অনুভূত হবার সাথে সাথে তাদের চোখ খুলে য়ায়, মন সতর্ক হয়ে উঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা এ ক্ষতিকর আবর্জনা ঝেড়ে ফেলতে লেগে যায়। এরা সেসব লোকদের মতো নয়, যারা না খোদাকে ভয় করে আর না অন্যায় ও পাপ থেকে বাঁচতে চয় এবং শয়তানের সাথে মনের মিল রয়েছে। এদের মনে বদখেয়াল খারাপ বাসনা ও অসৎ উদ্দেশ্য ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু এসব নোংরামিতে নিমজ্জিত থেকেও তারা কোনো প্রকার অসুবিধা ও অস্বাভাবিকতা নিজেদের মধ্যে অনুভব করে না। যেমন কোনো ডেগচীতে শুয়োরের মাংস রান্না হচ্ছে-কিন্তু তাদের চিন্তাতেই আসে না যে এতে কি রান্না হচ্ছে। অথবা কোনো মেথর, যার সারাটা দেহে ময়লা লেগে লতপত হয়ে আছেঠ, কিন্তু তার অনুভূতিই নেই যে তার দেহে কি জিনিস লেগে আছে।

তীব্র বিরুদ্ধতার পরিবেশে আল্লাহর পথে দাওয়াত
আরবী হবে——–

“এবং সে ব্যক্তির কথার চাইতে ভাল কথা কার হবে, যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং বললোঃ আমি মুসলমান?”

পূবের আয়াতে ঈমানদার লোকদের সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল এবং তাদের সাহস বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, অতঃপর এ আয়াতে সে প্রকৃত দায়িত্বের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষন ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে,যে উদ্দেশ্যে তারা মুসলমান হয়েছিল। পূর্বের আয়াতে তাদেরকে বলা হয় যে,আল্লাহর বন্দেগীল পথ গ্রহণ করা ও পথে দৃঢ় পতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর, তা থেকে বিভ্রান্ত না হওয়া এমন একটা নেক কাজ-যা মানুষকে ফেরেশতাদের বন্ধু ও জান্নাতের অধিকারী বানিয়ে দেয়। এখন তাদের পরবর্তী স্তরের কথা বলা হচ্ছে যার চাইতে উন্নত স্তর আর হতে পারে না। তা হচ্ছে-তোমরা নিজেরা নেক আমল করো এবং অন্যান্য লোকদের আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্ব গ্রহণের আহ্বান জানাও। তীব্র বিরুদ্ধতার পরিবেশ এবং যেখানে ইসলামের কথা বলা ও প্রকাশ করা নিজের উপর বিপদ ডেকে আনার শামিল সেখানেও বুক ফুলিয়ে বলোঃ ‘আমি মুসলমান’। আল্লাহ তায়ালার এ কথাটির পূর্ণ গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্যে সে পরিবেশ পরিস্থিতিকে চোখের সামনে রাখা জরুরী, যে পরিবেশে এ কথাগুলো বলা হয়েছিল। তখনকার পরিবেশ এইরূপ ছিল যে, ব্যক্তিই নিজের মুসলমান হবার কথা প্রকাশ করত সহসাই তার মনে হতো সে যোনো হিংস্র জন্তুদের জঙ্গলে প্রবেশ করছে, সেখানে প্রতিটি পশু তাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলবার জন্যে ছুটাছুটি করছে। তার চাইতে অগ্রসর হয়ে যে লোক ইসলাম প্রচারের জন্যে মুখ খুলতো সেতো যেনো হিংস্র পশুগুলোকে ডেকে বলতোঃ ‘এসো আমাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলো’। এ কঠিন অবস্থাতেই বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির আল্লাহকে নিজের রব হিসেবে মেনে নিয়ে সোজা পথ অবলম্বন করা নিঃসন্দেহে অতি বড় মৌলিক নেক কাজ। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরের নেক কাজ হচ্ছে, এ পরিবেশে ঘোষণা করে দেয়া যে, ‘আমি মুসলমান’ এবং ফলাফলের পোয়অ না করে খোদার বান্দাদের তাঁরই দাসত্ব গ্রহণের প্রতি দাওয়াত দান করা এবং কাজ করতে গিয়ে নিজের আমলকে এতটুকু পবিত্র রাখা, যেনো ইসলাম ও ইসলামের পতাকাবহীদের কোনো খূঁৎ বের করা সম্ভব না হয়।

উত্তম নেকী দ্বারা মন্দের মুকাবিলা করা
সামনে অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে———–

‘হ নবী ভাল আর মন্দ সমান নয়। মন্দের মুকাবিলা করো সে নকী দিয়ে-যা অতীব উত্তম। তাহলে দেখতে পাবে-তোমার সাথে যাদের ছিল চরম শত্রুতা তারা হয়ে গেছে তোমার পরম বন্ধু’।

এ আয়াতের পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে হলে সে পরিবেশ পরিস্থিতিকে চোখের সামনে রাখতে হবে-যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে নবী করীম (সঃ)-কে এবং তাঁর মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের এ হেদায়াত দেয়া হয়েছিল। তখন অবস্থা এরূপ ছিল যে, দাওয়াত হকের বিরুদ্ধতা চরম হটকারিতা ও কঠিন আক্রমণাত্মক ভূমিকা দ্বারা করা হচ্ছিল। তার বিরুদ্ধে নান হাতিয়অর ব্যবহার করা হচ্ছিল। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিটি ফৌজই তাঁর বিরুদ্ধে জনমনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করার কাজে নিরত ছিল। তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের নানা প্রকার কষ্ট, নির্যাতন ও পীড়া দেয়অ হচ্ছিল। যাতে অতিষ্ট হয়ে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সময় হুজুর (সঃ)-এর প্রচার কাজ বন্ধ করে দেবার জন্যে এরূপ কর্মসূচী তৈরী করা হয় যে, গণ্ডগোল ও হট্টগোলকারীদের একটা দল সব সময় তাঁর পিছে লাগিয়ে রাখা হতো। যখনই তিনি দাওয়াতে হকের জন্যে মুখ খুলতেন তখন তারা এমন হৈ-হট্টগোল ও চীৎকার শুরু করতো যে তাঁর কথাই কেউ শুনতে পেত না বস্তুত এটা ছিল খুবই নাজুক পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে বাহ্যত দ্বীন প্রচারের সমস্ত পথই বন্ধ দেখা যাচ্ছিল। ঠিক এরূপ অবস্থায়ই বিরদ্ধবাদীদের দাঁত চূর্ণ করার জন্যে হুজুর (সঃ)-কে এ হেদায়ত দেয়া হয়।

প্রথম কথাতেই বলা হয়েছে নেকী ও বদী তথঅ ভঅল ও মন্দ এক নয়। মানে বাহ্যথ তোমাদের বিরুদ্ধবাদীরা পাপ ও অন্যায়ের যতবড় তুফানই সৃষ্টি করুক না কেনো,তার মুকাবিলায় নেকী যতই দুর্বল, অসহায় অক্ষমই মনে হোক না কেনো;কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বদী ও অন্যায় তার নিজ সত্তার দিক থেকেই দুর্বল ও অসহায় আর এ জন্যেই শেষ পর্যন্ত মানুষ থাকে তার স্বভাব প্রকৃত অন্যায় ও পাপকে ঘৃণা না করে পারে না। পাপ ও অন্যায়ের সঙ্গী সাথীরাই শুধু নয়, তার পতাকাবাহীরা পর্যন্ত মনে মনে একথঅ অনুভব করে যে, তারা মিথ্যাবাদী, যালেম ও নিজেদের স্বার্থের জন্যে অন্যায়ভাবে হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটাই অন্যদের মনে তাদের প্রতি আস্থা জন্মানোর পরিবর্তে তাদের নিজেদের দৃষ্টিতে নিজেদের মর্যাদা বিনষ্ট করে। আর তাদের দিলের উপর একটা চোর বসে যায়-যা প্রতিটি বিরুদ্ধবাদী পদক্ষেপের সময়ই তাদের সাহস ও সংকলপকে ভিতরগত ভঅবে দলন করতে থাকে। এ অন্যায় ও পাপের মুকাবিলায় যদি সে নেকী দ্বারা যা বাহ্যিকভঅবে সম্পূর্ণ অসহায় অক্ষম বলে পরিলক্ষিত হয়-নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকে তবে শেষ পর্যন্ত তা জয়ী হবে। কারণ একে তো নেকীর মধ্যে এক বিরাট শক্তি নিহিত রয়েছে যা মানুষের দিলকে প্রভাবিত ও মোহময় করে তোলে। মানুষের নৈতিক চরিত্র যতোই খারপি ও বিকৃত হয়ে যাক না নেনো সে নিজের অন্তরে নেকীর মর্যাদা অনুভব না করে পারে না। আর নেকী ও বদী যখন সম্মুখে সমরে লিপ্ত হয়ে এবং উভয়েরই আচ্ছাদিত মনিমুক্ত সর্ব সাধঅরণেল সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে তখন দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব সংগ্রামের পর খুব কম লোকই এমন থাকতে পারে যারা অন্যঅয় ও পাপের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও নেকীর প্রতি আসক্ত ও উৎসর্গীকৃত না হবে।

দ্বিতীয় কথা বলা হয়েছে, পাপের মুকাবিলা মুধুমাত্র নেকী দ্বারা নয়; বরং এমন নেকী দ্বারা করতে হবে যা অতি উত্তম ও উচ্চ মানের। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তোমাদের সাথে অন্যায় আচরণ করলে তোমরা তাকে ক্ষমা করে দাও। এটা হবে নেক কাজ। আর উচ্চতম মানের নেকজাক হবে, যে ব্যক্তি তোমার অসদাচরণ করবে সুযোগ পেলেই তোমরা তার ইহসান ও উপকার করবে।

এর সুফল সম্পর্কে বলঅ হয়েছে, নিকৃষ্টতম শত্রুও শেষ পর্যন্ত প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে। কারণ এটাই মানব স্বভাব। কেউ গালি দিলে আপনি চুপ থাকুন। নিঃসন্দেহে এটা একটা নেকীর কাজ হবে। কিন্তু গালী দানকারী র মুখ এতে বন্ধ হবে না আর তার গালাগালের জবাবে যদি আপনি তার কল্যাণ কামনা করেন তবে যতবড় নির্লজ্জ বিরুদ্ধবাদীই হোক না কেনো তাকে লজ্জিত হতেই হবে। অতঃপর আপনার বিরুদ্ধে খারাপ কথা তার জন্যে আর সহজ ব্যাপার হবে না। এক ব্যক্তি আপনার ক্ষতি করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না, অথচ আপনি তার সমস্ত বাড়াবাড়ি সহ্য করে যাচ্ছেন। এত হয়তো সে নিজের দুস্কৃতির কাজে আরো সাহসী হবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে কখনো তার কোনো ক্ষতি হতে যাচ্ছে আর আপনি সে ক্ষতি হতে তাকে রক্ষ করলেন, তবে সে আপনার পায়ের উপর পড়ে থাকতে বাধ্য। কারণ এরূপ নেকীর মুকাবিলায় কোনো প্রকার দুস্কৃতি টিকে থাকাই সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও এ নিয়মটাকেই কোনো স্থায়ী বা সাধারণ নিয়মে পরিণত করে নেয়া ঠিক নয় যে এ উচ্চস্তরের নেকী প্রত্যেক জানের দুশমনকেই প্রাণের বন্ধু বানিয়ে দেবে। দুনিয়তে এমন নিকৃষ্ট আত্মার লোকও হয়ে থাকে যে, আপনি তাদের বাড়াবাড়ির জবাবে ক্ষমা এবং তাদের দুর্ব্যবহারের বিনিময়ে সদাচরণ করে যতোই পূর্ণতার মানবিকতা দেখান না কেনো তাতে তাদের দংশনের বিষ বিন্দুমাত্র কম হয় না। কিন্তু এরূপ চরম নিকৃষ্ট মানুষ এতই কম পাওয়া পায়-যতটা কম পাওয়া যায় পরম কল্যাণ-কামী মানুষ।

হকের দাওয়াতের সবরের গুরুত্ব
অতঃপর বলা হয়ঃ

আরবী হবে——–

‘এ গুণ কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটে, যারা ধৈর্যধারণ করে। আর এ মর্যাদা লাভ করতে পারে কেবল তারাই যারা বড়ই ভাগ্যবান’।

মানে এ প্রেসক্রিপশান যদিও খুবই কার্যকর; কিন্তু এর ব্যবহার ও প্রয়োগের কোনো হাসি-তামাশা ও খেলার ব্যাপার নয়। এ জন্যে বিরাট মনোবল ও বলিষ্ঠ আত্মার-প্রয়োজন। দৃঢ় সংকল্প বিরাট সাহসিকতা,ধৈর্য্যশক্তি ও আত্মসংযমের। সাময়িক ভাবে কেউ হয়তো অন্যায়ের মুকাবিলায় বিরাট কোনো নেকী করেও ফেলতে পারে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়; কিন্তু যেখানে কোনো ব্যক্তিকে বছরের পর বছর ধরে এসব বাতিলপন্থী দুষ্কৃতিকারীদের মুকাবিলায় দ্বীনে হকের খাতিরে ক্রমাগত ভাবে লড়ে যেতে হয়-যারা যে কোনো নৈতিকসীমা লংঘন করতে কোন প্রকার দ্বিধাবোধ করে না। এবং শক্তি ও ক্ষমতার নেশায় থাকে মত্ত হয়ে, সেখানে নিরন্তর পাপের মুকাবিলায় নেকী তথা উচ্চ মানের নেকী এবং একবারের জন্যেও সংযমের বাধ ভেঙ্গে না যাওয়া কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভবপর ব্যাপার নয়। এ কাজ সে ব্যক্তিই করতে পারে, যে প্রশান্ত মনে সত্য দ্বীনের উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার জন্যে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করছে; যে নিজের আত্মাকে জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেকের অনুগত করে নিয়েছে যে বিরুদ্ধবাদীদের কোনো দুস্কৃতি ও নোংরা আচরণই তাঁকে তাঁর এ মহান মর্যাদা থেকে নীচে নামাতে ও ধৈর্যহীন করতে কামিয়াব হতে পারে না।

আর এ যে বলা হলোঃ ‘এ মর্যাদা কেবল তারাই লাভ করতে পারে, যারা বড় ভাগ্যবান’। এটা হচ্ছে প্রকৃতিরই নিয়ম। অতি বড় উচ্চ মর্যাদার মানুষই এসব গুণাবলিতে গুণান্বিত হয়। আর যিনি এসব গুণের অধিকারী হয়ে থঅকেন, দুনিয়অর কোনো শক্তিই তাক সফলতার মনযিলে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নিকৃষ্টস্তরের লোকদের হীন আচরণ, জঘন্য ষড়যন্ত্র ও অমানুষিক কার্যকলাপ তাকে পরাস্ত করবে-এটা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।

শয়তানের প্ররোচনা থেকে খোদার আশ্রয়
অবশেষে বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে——

‘তোমরা যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্ররোচনা অনুভব করো, তবে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো’। (ঐ আয়াত-৩৬)

শয়তান যখন দেখে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বে হীনতার মুকাবিলায় ভদ্র ও শালীন আচরণ এবং অন্যায় ও বদীর মুকাবিলায় ন্যায় ও নেকীর আচরণ গ্রহণ করা হচ্ছে তখন সে কঠিন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সে চায় একবার হলেও কোনো ক্রমে সত্য পথের মুজাহিদরা, বিশেষ করে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা সর্বোপরি তাদের নেতা এমন কিছু ভুল করে বসুক, যার ভিত্তিতে জনগনেকে বলা যেতে পারে, দেখুন-অন্যায় এক তরফা হচ্ছে না। একপক্ষ থেকে অন্যায় কিছু খারাপ আচরণ হয়ে থাকলেও অপর পক্ষের লোকেরাও তো তেমন উচ্চমানের লোক নয়। অমুক অন্যঅয় কাজটি তো শেষ পর্যন্ত তারাও করে বসেছে।

সাধারণত মানুষের তো আর এতটুকু ক্ষমতা নেই যে, তারা এক পক্ষের বাড়াবাড়ি ও অপর পক্ষের জবাবী কাজের মাঝে তুলনা করে দেখবে। তারা যতক্ষণ দেখতে পাবে যে বিরুদ্ধবাদীদের সর্বপ্রকার হীন, নিকৃষ।ট ও অন্যায় আচরণের মুকাবিলায় এসব লোকেরা শালীনতা, ভদ্রতা, নেকী ও ন্যায়পরায়ণাতর পথ থেকে বিন্দু পরিমাণ সরছে না, ততক্ষণ তারা এদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে থাকবে। কিন্তু এদের দ্বারা যদি কোনে রূপ অন্যায় আচরণ হয়ে বসে কিংবা তাদের মর্যাদার তুলনায় কোন নীচু কাজ হয়ে যায়-তা অতিবড় কোনো বাড়াবাড়ির মুকাবিলায়ই হোক না কেনো, তখন তাদের দৃষ্টিতে উভয় পক্ষই সামান হয়ে য়ায়। এবং বিরুদ্ধবাদীরাও একটা শক্ত কথার জবাবে হাজারো গালি দেবার বাহানা পেয়ে যায়। এ নাজুক ব্যাপারটির ভিত্তিতেই এরশাদ হয়েছে যে, ‘শয়তানের ধোকা ও প্ররোচনা থেকে সতর্ক থাকো’। সে তোমার খুবই খঅয়েরখা ও দরদী বন্ধু সেজে তোমাকে প্ররোচিত ও উত্তেজিত করবে যে, অমুক বাড়াবাড়ি তো কিছুতেই সহ্য করা যেতে পারে না, ‘অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে’। ‘এ হামলার মুকাবিলায় তো লড়ে যাওয়া উচিত নতুবা তো তোমাদের কাপুরুষ বলা যাবে’। এমন প্রতিটি অবস্থঅয় তোমারা যখন নিজেদের মধ্যে অবাঞ্চিত-উত্তেজনা ও প্ররোচনা অনুভব করবে তখনই সতর্ক হয়ে যাবে যে, নিশ্চই এটা শয়তারেনর কাজ। সে তোমাদের ক্রোধান্ধ করে তোমাদের দ্বারা কোনো ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে চায়। সতর্ক হয়ে যাবার পর এমন ধঅরণ করে বসোনা যে, ‘আমি আমার উত্তেজন কন্ট্রোল করতে সক্ষম, শয়তান আমাকে দিয়ে কোনো ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে পারে না’। নিজের এরূপ বিচার ক্ষমতা এবাং সংকল্প শক্তির ধঅরণ শয়তানের আর একটা অতি ভয়ানক ধোকা এ সবের পরিবর্তে তোমাদেরকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। কারণ তিনি যদি তৌফিক দেন এবং হেফাযত করেন তবেই মানুষ ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষ পেতে পারে।

এ আয়াতের সর্বোত্তম তাফসীর হচ্ছে সে ঘটনা, যা ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁর মুসনাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেনঃ একবার নবী (সঃ)-এর উপস্থিতিতেই এক ব্যক্তি হযরত আবু বকরকে (রাঃ) অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকলো। হযরত আববকর (রাঃ) চুপচাপ তার গালাগাল শুনতে থাকলেন এবং নবী (সঃ) তা দেখে মুচকি হাসছিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত সিদ্দীক (রাঃ)-এর ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। জবাব তিনিও একটা শক্ত কথ তাকে বলে দিলেন। তাঁর মুখ থেকে সে কথাটা বের হতেই নবী করীম (সঃ) দারুন অসন্তোষ পয়ে পড়লেন যা তাঁর চেহারা মুবারকে পরিস্ফুট হয়ে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন। হযরত আবুবকরও উঠে তাঁর পিছু নিলেন এবাং পথিমধ্যে এ ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করে আরয করলেনঃ ‘লোকটা আমাকে গালি দিতে থাকলে আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন, আর আমি তার জবাব দিলে আপনি অসন্তউষ।ট হলেন’। হুজুর (সঃ) বললেন, যতক্ষণ তুমি চুপচাপ ছিলে, ততক্ষণ তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিলো এবং তোমার পক্ষ থেকে লোকটাকে জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু তুমি নিজেই যখন কথা বলে উঠেলে, তখন ফেরেশতার স্থলে শয়তান এসে বসলো। আমি তো শয়তানের সঙ্গে বসতে পারি না।

সত্যের দাওয়াত দানকারীকে নিঃস্বার্থ হওয়া
দাওয়াতে হকের ব্যাপারে দাওয়াত দানকারীর সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হওয়া তার আন্তরিকতা ও সত্য পরায়ণতার এক সুস্পষ্ট দলীল। কুরআন মজীদে বার বার বলা হয়েছে নবী আল্লাহর দিকে ডাকার যে কাজ করছেন তাতে তাঁর নিজের কোন স্বার্থ নেই; বরং তিনি তো নিজে আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণের জন্যেই নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন।

সূরা আনআমে এরশঅদ হয়েছেঃ

আরবী হবে——

‘হে নবী, আপনি বলে দিনঃ এ দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের জন্যে আমি তো তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছিনা। এ তো গোটা জগদ্বাসীল জণ্যে সাধারণ উপদেশ ও নসীহত মাত্র’। (আয়াত-৯০)

সূরা ইউসুফে বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে—-

আর হে নবী এ কাজের জন্যে তো আপনি তাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক দাবী করছেন না। এতো গোটা জগদ্বাসীর জন্যে এক সাধারণ নসীহত মাত্র’। (আয়াত-১০৪)

বাহ্যত এ ভাষণে নবী করীশ (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সম্বোধন কাফেরদের সমষ্টির প্রতিই করা হয়েছে। তাদের একথা বুঝানো উদ্দেশ্য যে, হে আল্লাহর বান্দারা এ হঠকারিতা কতইনা অন্যায়। নবী যদি নিজের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের জন্যে দাওয়াত ও তাবলীগের একাজ চালু করতেন কিংবা তিনি যদি নিজের জন্যে কিছু চাইতেন তাহলে তোমাদের অবশ্যই একথা বলার সুযোগ ছিলেঅ যে, আমরা কেনো এ মতলবী ব্যক্তি কথা মেনে নেবো? কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, তিন একান্তই নিঃস্বার্থপর। তোমাদের এবং গোটা দুনিয়ার কল্যাণের জন্যে তিনি নিঃস্বার্থভাবে একটা কথা পেশ করছেন, তার সাথে কোনো খামাখা কেউ জিদ করবে? খোলা মনমানসিকতা নিয়ে তাঁর কথা শুনো, মনে লাগলে তা মেনে নাও আর মনে না চাইলে মনে নিওনা।

সূরা মুমিনুনে বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে———

‘হে নবী, আপনি কি তাদের কাছে কিছু চাচ্ছেন? আপনার জন্যে আপনার রবের দানই উত্তম। আর তিনিই উত্তম রিযিক দানকারী’। (আয়াত-৭২)

অর্থাৎ ঈমানদারীর সাথে কোনো ব্যক্তি আপনার প্রতি এ অপবাদ দিতে পারবে না যে, আপনি কোন আত্ম-স্মর্থ হাসিল করার জন্যে এ তৎপরতা চালাচ্ছেন। আপনার চমৎকার ব্যবসায় ছিলো; অথচ এখন আপনি দারিদ্রে নিমজ্জিত। গোটা কওম আপনাকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতো, সকলেই ইযযত ও সম্মান করতো। এখন গালাগাল শুনছেন, পাথর নিক্ষেপ হচ্ছে এমনকি আপনার জীবন পযন্ত মারত্মক সংকটাবর্তে নিমজ্জিত। শান্তিতে বিবি-বাচ্চাদের সাথে আনন্দময় দিনাতিপাত করছিলেন। আর এখন এমন কঠিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আপতিত হয়েছ্নে যে, এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেবার সময় নেই। সর্বোপরি এমন কথ নিয়ে ময়দানে নেমেছেন যার কারণে গোটা দেশ আপনার শত্রু হয়ে গেছে। কে বলবে এটা একজন স্বার্থপর মানুষের কাজ? স্বার্থপর ব্যক্তি তো কওম ও কবিলার পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে তোড়ে-জোড়ে নেতৃত্ব লাভের কোশেশ করে। আপনার মতো তারা এমন কথা নিয়ে ময়দানে নামে না, যা আপনার কওমের স্বার্থর বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ; আর আপনি তো শুরু থেকেই সে জিনিসের শিকড় কেটে আসছেন যার ভিত্তিতে আরব মুশরিকদের উপর কুরাইশ কবিলার জমিদারী প্রতিষ্ঠিত।

সূরা সাবায় বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে——

‘হে নবী, আপনি বলে দিন; আমি যদি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চেয়েই থাকি; তবে তা তোমাদেরই জন্যে। আমার পারিশ্রমিকের যিম্মাদার তো আল্লাহ। আর তিনি প্রতিটি ব্যাপারের সাক্ষ্য’।

প্রথম বাক্যাংশের দুটি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, আমি যদি সত্যিই কোনো প্রতিফল চেয়ে থাকি তবে তা তো তোমাদেরই জন্যে। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আমি যদি সত্যিই কোনো প্রতিফল চেয়েই থাকি, তবে তা তোমাদেরই কল্যাণ ছঅড়া আর কিছু নয়। বাক্যের শেষাংশের তাৎপর্য হচ্ছে অভিযোগ ও অপবাদ দানকারীর যে অপবাদ ইচ্ছা দিতে থাকুক। আল্লাহই সব কিছু জানেন। আমি যে একজন নিঃস্বার্থ মানুষ, ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থে একাজ করছিনে-এ ব্যাপারে আল্লাহই সাক্ষ্য।

সূরা সোয়াদে বলা হয়েছেঃ

আরবী হবে—

‘হে নবী আপনি বলে দিন, এ দ্বীন প্রচারের জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না আর না আমি বানোয়াটকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। (আয়ায়-৮৬)

মানে আমি সে সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত নই, যারা নিজেরদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে মিথ্যা দাবী নিয়ে উথিত হয় এবং তারা যা নয় তা হয়ে বসার চেষ্টা করে। নবী কমীম (সঃ) এর মুখ দিয়ে একথাটা কেবল মক্কার কাফেরদের জানানোর জন্যেই বলা হয়নি; বরং এ কাফেরদের মধ্যে অতিবাহিত তাঁর নবুওয়াত পূর্ববর্তী চল্লিশটি বছরের যিন্দেগীই এর সাক্ষ্য হিসেবে মওজুদ রয়েছে। মক্কার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জানতো নবী করীম (সঃ) কোনো বানোয়অট লোক নন। গোটা কওমের একজন ব্যক্তিও তাঁর মুখ দিয়ে এমন কথা কখনো শুনেনি যাতে তিনি কিছু একটা হতে চান এবং নিজেকে প্রভাবশালী করবার চেষ্টা করছেন বলে সন্দেহ করবার কোনো অবকাশ থাকতে পারে।

সূরা আততুর এবং সূরা ক্কলম-এ বলঅ হয়েছেঃ

আরবী হবে—

‘হে নবী, আপনি কি এদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছেন যে এরা জোর পূর্বক আদায় করা জরিমানার বোঝার তলায় পড়ে নিস্পেসিত হচ্ছে?’ (তুর-৪০,ক্কলম-৪৬)

হুজুর (সঃ)-এর প্রতি নয়; মূলত কাফেরদের প্রতিই প্রশ্নটি করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে যে, রসূল (সঃ) তোমাদের কাছ থেকে যদি পারিশ্রমিক চাইতেন কিংবা ব্যক্তিগত কোনো ফায়দা হাসিল করবার জন্যে এসব তৎপরতা চালাতেন, তবে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাবার ব্যাপারে তোমাদের নিকট অন্তত একটা যুকিআতসঙ্গত কারণ থাকতো। কিন্তু তোমরা নিজেরাই জানো যে, তিনি তাঁর এ দাওয়াতের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ এবং কেবলমাত্র তোমাদের কল্যাণেল জন্যেই তিনি প্রাণপাত করছেন। তাহলে তোমরা যে শান্ত মনে তাঁর কথাও শুনতে প্রস্তুত নও, এর কি কারণ থাকতে পারে? এ প্রশ্নটাতে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপও নিহিত রয়েছে। সারা দুনিয়ার কৃত্রিম ধর্মনেতা এবং ধর্মীয় আস্তানাসমূহের সেবায়েতদের মতো আরবেও মুশরিকদের ধর্মীয় নেতা ও পণ্ডিত পুরোহিতরা প্রকাশ্যভাবে ধর্মীয় ব্যবসা চালাতো। এ প্রসঙ্গেই তাদের সামনে এ প্রশ্ন রাখা হয় যে, একদিকে এসব ধর্মীয় ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যভাবে তোমাদের নিকট নযর-নিয়ায এবং প্রতিটি ধর্মীয় কাজ পালন করার জন্যে পারিশ্রমিক আদায় করে থাকে। অপরদিকে এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে উপরন্তু নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য বরবাদ করে তোমাদেরকে অত্যন্ত যুক্তি প্রমাণ সহকারে দ্বীনের সোজা সঠিক পথ প্রদশর্ন করবার চেষ্টা করছেন। এখন বল, এটা তোমাদের সুস্পষ্ট বেআকলী ছাড়া আর কি যে, তোমরা এ মহান ব্যক্তি প্রষ্ঠ প্রদর্শন করছো এবং ঐসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতি দৌড়ে যাচ্ছো?

এ প্রসঙ্গে একটি মাত্র আয়াত আছে যেটি নিয়ে কিছুটা তর্কের অবকাশ আছে আয়াতটি হচ্ছেঃ

আরবী হবে—-

‘হে নবী এ লোকদের বলে দিনঃ এখানে আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রকার পারিশ্রমিকের দাবীদার নই। তবে নৈকট্যের ভালবাস অবশ্যই পেতে চাই’। (আশশূরা-২৩)

এখানে (নৈকট্য) শব্দটির সত্যিকার তাৎপর্য নিয়ে মুফাসরিদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে।

একদল এর অর্থ আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝেছেন। এবং আয়াতটির তাৎপর্য এরূপ বলে বর্ণনা করেছেন যে, এ কাজে আমি তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাইনা। কিন্তু এটা অবশ্যই চাই যে, ‘তোমরা (কুরাইশরা) তোমাদের ও আমার মধ্য্যকার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে। তোমাদের তো কর্তব্য ছিলো আমার কথা মেনে নেয়া। কিন্তু তা যদি না-ই মানো তবে অন্তুত সারা আরবের মধ্যে তোমরাই আমার দুশমনির জন্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করো না’। -এ হচ্ছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের তাফসীল যা বহু সংখ্যক রাবীর সূত্রে ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ইবনে জরীর, তাবরানী, বায়হাকী এবং এবনে সায়দ প্রমুখ উদ্ধৃত করেছেন। মুজাহিদ,ইকরামা, কাতাদা, সুদ্দি, আবু মালেক, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম, দাহাক, আতা ইবনে দীনার এবং অন্যান্য বড় মুফাসসীরগণও এ তাফসীরই করেছেন।

দ্বিতীয় দল কে (নৈকট্য) ও(নিকটত্ব) অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে একাজে আমি তোমাদের কাছে এতটুকু ছাড়া আর কিছুই চাই না যে, ‘তোমাদের মাঝে আল্লাহর নৈকট্যের ভঅব জাগ্রত হোক’ অর্থাৎ-তোমরা ঠিক হয়ে যাও। ব্যস এটাই আমার পুরস্কার। এ তাফসীল হযরত হাসান বসরী (রঃ) থেকে বর্ণিত। এর সমর্থনে কাতাদা থেকেও একটি কথার উদ্ধৃতি রয়েছে। এমনকি তাবরানীল বর্ণনায় এর সমর্থনে হযরত ইবনে আব্বাসেরও একটা মত উদ্ধৃত হয়েছে। কুরআনে মজীদেরই অন্য জায়গায় এ বিষয়টা নিম্নোক্ত ভাষায় এরশাদ হয়েছেঃ

আরবী হবে—-

‘এ লোকদের বলে দাও এ কাজে আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাইনা। আমার পারিশ্যমিক হচ্ছে এ যে, যার ইচ্ছ সে নিজের খোদার পথ গ্রহণ করবে’। (ফোরকান-৫৭)

তৃতীয় দল শব্দের অর্থ করেছেন (আত্মীয়-স্বজন)। তাদের দৃষ্টিতে আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে-‘তোমরা আমার নিকটাত্মীয়দের ভালবাসবে-এছাড়া এ কাজের আর কোনো পুরস্কারই আমি তোমাদের কাছে চাই না’। অতঃপর এ দলের কেউ কেউ মনে করেন। নিকটাত্মীয় বলতে আবদুল মুত্তালিবের গোটা বংশধরদেরই বুঝায়। আর কেউ কেউ কেবলমাত্র হযরত আলী, ফাতেমা (রাঃ) এবং তাঁদের সন্তানদের পর্যন্ত এটাকে সীমাবদ্ধ মনে করেন, হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) ও আমর ইবনে শুয়াইব (রাঃ) থেকে এ তাফসীরই বর্ণিত হয়েছে। আবার কোনো কোন বর্ণনায় এ তাফসীল ইবনে আব্বাস ও হযরত আলী ইবনে হুসাইন (যয়নুল আবেদীন) এর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ তাফসীল কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমতঃ মক্কায় যখন সূরা আশ-শূরা নাযিল হয়, তখন হযরত আলী ও ফাতেমার বিয়েই হয়নি, সন্তান হওয়ার তো দূরের কথা। আর আবদুল মুত্তালিবের বংশধররাও সকলেই তখনো নবী (সঃ) এর সঙ্গী-সাথী হয়নি, বরং তাদের অনেকেই প্রকাশ্যভাবে দুশমনদের সঙ্গী-সাথী ছিলো। আবু লাহাবের দুশমনী তো গোটা দুনিয়া জানে। দ্বিতীয়তঃ নবী (সঃ)-এর আত্মীয় কেবল আবদুল মুত্তালিবের বংশধররাই ছিল না। তাঁর মাতা, তাঁর পিতা ও সম্মানিতা স্ত্রীর (হযরত খাদীজা) সূত্রে কুরাইশদের সব ঘরেই তাঁর আত্মীয় এগানা ছিলো। এমনি করে কুরাইশদের সকল ঘরেই তাঁর মহোত্তম সাহাবিরা যেমন বর্তমান ছিলেন, তেমনি নিকৃষ্টতম দুশমনরাও বর্তমান ছিলো। এসব নিকৃষ্টতম লোকদের মধ্যে কেবল আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদেরকেই নিজেরআত্মীয় বলে আখ্যা দেয়া এবং তাদের জন্যে বিশেষ ভালবাসা পাবার আবেদন জানানো নবী করীম (সঃ) এর পক্ষে কি করে সম্ভব ছিলো? এ ব্যাপারে তৃতীয় কথাটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে একজন নবী যিনি অতি উন্নত মর্যঅদায় অবস্থান করে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দান করেন, সে উচ্চতম মর্যাদায় অভিষিক্ত থেকে এ মহান কাজের জন্যে পারিশ্রমিক চাওয়া যে, তোরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে মহব্বত করো-নিতান্তই নীচু স্তরের কাজ। কোনো সুরুচিসম্পন্ন ব্যাক্তি এমনকি কল্পনাও করতে পারে না যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে এমন কথা শিক্ষা দেবেন আর নবী কুরাইশদের সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলবেন। কুরআন মজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের যে সব কাহিনী আলোচিত হয়েছে, তাতে আমরা দেখতে প্ই প্রথ্যেক নবীই তাঁর জাতির লোকদের পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাইনা, আমার পারিশ্রমিক তো মহান্আল্লাহর দায়িত্ব রয়েছে। (ইউনুস-৭,২,হুদ-২৯,৫১,আশশূয়ারা ১০৯,১২৭,১৪৫,১৬৪,১৮০)। সূরা ইয়াসীনে নবীর সত্যতা যাচাইর মানদণ্ড হিসেবে বলা হয়েছে নবী তাঁর দাওয়াতী কাজে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হয়ে থঅকেন (আয়াত-২১)। স্বয়ং নবী (সঃ)-এর মুখ দিয়ে কুরআন মজিদে বার বার বলানো হয়েছেঃ আমি তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাইনা, এ সম্পর্কে উপরে উদ্ধৃত হয়েছে। অতঃপর এ কথা বলার কি অবকাশ আছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াত দানের যে কাজ আমি করছি তার বিনিময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালবাসো। এরপর যাখন আমরা দেখি এ ভাষণ্ঈমানদারদের নয় বরং কাফেরদের সম্বোধান করা হয়েছে, তখন এমন বক্তব্য আরো অধিক অযাচিত বলে দৃষ্টিগোচর হয়। উপর থেকে গোটা ভাষণেই কাফেরদের সম্বোধন করা হয়েছে আর সম্মুখের সম্বোধনও তাদেরই প্রতি। কথার এ প্রাসঙ্গিকতায় বিরুদ্ধবাদীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক চাওয়ার প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত কেমন করে সৃষ্টি হতে পারে? পারিশ্রমিক ঐসব লোকদের কছেই চাওয়া যায় যাদের দৃষ্টিতে কাজটা খুবই মূল্যবান এবং যাদের জন্যে তিনি তাদের এ মূল্যবান কাজটির সুব্যবস্থা করেছেন। কাফেররা হুজুর (সঃ) এর এ মহান কাজের কি মূল্যটা দিচ্ছিল যে, তিন তাদের বলতে পারেনঃআমি যে তোমাদের এ বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছি এর বিনেময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসো? বরং তারা তো উল্টা এ কাজটাকে বিরাট দোষ ও অপরাধ মনে করছিল, যার কারণে তার তাঁর প্রাণ পযন্ত নাশ করতে চেয়েছিল।

দাওয়াতী কাজের সূচনায় পরকালীন ধারণা বিশ্বাসের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান
মক্কা মুয়অযযমায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ করেন, তখন তাঁর এ কাজের ভিত্তি ছিলো ৩টি। প্রথমতঃ খোদয়ীর ব্যাপারে আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক মানা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বীয় রাসূল মনোনীত করেছেন। তৃতীয়তঃ একদিন এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, অতঃপর আর একটি পৃথিবী বানানো হবে। তখন আদি থেকে অন্ত পর্যন্তকার সমস্ত মানুষকে পুনরুন্খিত করা হবে এবং ঠিক সে দেহ ও শরীর সহ হাশরের ময়দানে উপস্থিত করানো হবে, যে দেহ ও শরীল নিয়ে কাজ করছিল। অতঃপর তাদের আকীদা বিশ্বাস ও যাবতীয় কাজ-কর্মের হিসেব নেয়া হবে। এ হিসেব-নিকেষে যারা ঈমানদার ও সৎ প্রমাণিত হবে-তারা চিরদিনের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করবে। পক্ষান্তরে যারা কাফের ও ফাসেক প্রমাণিত হবে, তারা চিরকালে জন্যে জাহান্নামবাসী হবে।

এ তিনটি কথার প্রথম কখাটি মেনে নেয়া যদিও মক্কাবাসীদের জন্যে কঠিন ব্যাপার ছিলো, কিন্তু অথাপি তারা আলআলাহর অস্তিত্বের অস্বীকারকারী ছিল না। আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ রব, সৃষ্টিকর্তা এবং রেযেকদাতা হিসেবেও তারর মানত এবং আল্লাহকে ছাড়া অন্য যাদের তারা উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল, সেগুলোকেও আল্লাহর সৃষ্টি বলেই তারা স্বীকার করতো। সুতরাং তাদের সাথে কেবলমাত্র বিরোধ ছিলো খোদার গুণাবলী ক্ষমতা ইখতিয়ার ও ইলাহর মূল সত্তায় ঐসব উপাস্যদের কোনো অংশীদারিত্ব আছে কি নেই-এ বিষয় নিয়ে।

দ্বিতীয় কথাটা মক্কার লোকেরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না। কিন্তু তাদের পক্ষে একথঅ স্বীকার করা অসম্ভব ছিলো যে, নবী করীম (সঃ) নবুওয়াতের দাবী করার পূর্বে সুদীর্ঘ চল্লিশটি বছর তাদের মাঝেই জীবন যাপন করেছিলেন এবং দীর্ঘ সময়ে তারা তাঁকে খখনো মিথ্যাবাদী, ধোকাবজ, কিংবা আত্মস্বার্থরক্ষার জন্যে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী হিসেবে দেখতে পায়নি। তারা তো সব সময় র্তাঁর বুদ্ধিমত্তা; বিচক্ষণতা, সুস্থমস্তিস্ক এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রের সমর্থক ও প্রশংসাকারী ছিলো। এ কারণে হাজারো টালবাহানা ও অভিযোগ রচনা সত্ত্বেও তা অন্য লোকদের বিশ্বাস করানো তো দূরের কথা স্বয়ং তাদের পক্ষেও তাদের এসব কথা সত্য বলে মেনে নেয়া সম্ভবপর ছিল না। কারণ, নবী করীম (সঃ) যখন সব ব্যাপারেই সত্যবাদী ও সত্যপন্থী তখন কেবলমাত্র রেসালাতের দাবীর ব্যাপারে মায়াযাল্লাহ! মিথ্যাবাদী কেমন করে হতে পারেন?

এমনি করে প্রথম দুটি কথা মক্কাবাসীদের এতো বেমী আপত্তিকর ছিল না। যতটা আপত্তিকর ছিল তৃতীয় কথাটি। একথাটি তাদের সম্মুখে পেশ করা হলে এটা নিয়েই তারা সর্বাধিক বিদ্রূপ করে। এ ব্যাপারটা শুনে তারা সবচাইতে বেশী বিস্ময় ও হয়রানী প্রকাশ করলো এবং তার এটাকে অযৌক্তিক ও অসম্ভব মনে করে বিভিন্ন স্থানে তা ধারণার অতীত, গ্রহণ অযোগ্য বলে প্রচার করতে লাগলো। অথচ ইসলামে আনার জন্যে তাদেরকে পরকালের প্রতি বিশ্বাসী বানানো ছিলো অপরিহার্য কারণ পরকালের সম্ভাব্যতা স্বীকার করে না নিলে হক ও বাতিলের নির্ভু চিন্তা পদ্ধতি গ্রহণ, ভাল-মন্দ নির্বাচনের মেরুদণ্ড পরিবর্তন ও দুনিয়া পূজার পথ পরিহার করে ইসলাম প্রদর্শিত পথে চলঅ তাদের পক্ষে একান্তিই অসম্ভব ছিলো। এ জন্যে মক্কা মুয়াযযমায় অবতীর্ণ প্রাথমিক যুগের সূরাগুলোতে সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে পরকাল বিশ্বাসকে মানষের অন্তরে পতিষ্ঠিত করে দেবার জন্যে। অবশ্য সেজন্যে দলিল প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রেও এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়-যাতে লোকদেরকেমনে তৌহিদের ধারণা আপনাতেই বসে যায়। মাঝে মধ্যে রাসূলে করীম (সঃ) ও কুরআন মজীদের সত্যতা প্রমাণের যুক্তি প্রমাণও সংক্ষেপে আলাচনা করা হয়েছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি