Chinese Philosophy: চীনা দর্শন
চীনের দর্শনের ইতিহাস ভারত ও গ্রীক দর্শনের ন্যায় সুপ্রাচীন। খ্রীষ্টাব্দের হাজার বছর পূর্বেও চীনে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের দার্শনিক আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সময়ে চীনে দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল বস্তুবাদী। কিছু সংখ্যক দার্শনিক সূত্র এই সময়ে প্রচলিত ছিল। এই দার্শনিক সূত্রগুলির বক্তব্য ছিল যে, বিশ্বপ্রকৃতির মূলে রয়েছে পঞ্চশক্তি যথা –পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু এবং মাটি। সমস্ত সৃষ্টি এই পঞ্চশক্তির সম্মেরনেরই ফল। পরবর্তীকালে ইকিং বা পরিবর্তনের গ্রন্থে এই সূত্রগুরি গ্রথিত হয়। ইকিং-এ বিশ্বপ্রকৃতির মূল হিসাবে পাঁচটির বদলে আটটি বস্তুর উল্লেখ দেখা যা। ইকিং –এর বাইরে ইন এবং ইয়াং বলে আরও দুটি সূত্রের কথাও জানা যায়। ইন-এর অর্থ হচ্ছে স্থিতি এবং ইয়াং-এর অর্থ গতি। এদেরকে অনেক সময় যথাক্রমে প্রকৃতির অন্ধকার এবং আলো; অস্তি এবং নাস্তি; পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায়। খ্রিষ্টাব্দ শুরু হওয়ার পূর্বে পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন চীনা দর্শন অধিকতর সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে।এই সময়ে চীনা দর্শনের বিভিন্ন প্রাচীন মতবাদ বা শাখা বিকাশ লাভ করে। এদের মধ্যে তাও দর্শণ এবং মোতিদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লাওজ এবং চুংজুকে তাও দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাতা বলা হয়। এঁরা বস্তুর অস্তিত্ব এবং চরিত্র ইত্যাকার দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করেন। অপরকে দার্শনিক মোতি এবং তাঁর অনুসারীগণ জ্ঞানের সমস্যা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। এ আলোচনায় ভাববাদী ব্যাখ্যারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কুংসুঙলুন নামক দার্শনিক ভাবকে বস্তুনিরপেক্ষ ভাবের মিল দেখা যায়। নীতিগত এবং রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কনফুসিয়াস এবং মেঙজুর মতের প্রসার ঘটে। প্রাচীন চীনা দর্শনের এ যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল প্রধানত আকাশ ‘মনের ভাব’, ধর্মশক্তি, চরিত্র, বস্তুর মৌলিক গুণ ইত্যাদি। কনফুসিয়াস ও মেঙজুর মতামতের বৈশিষ্ট্য ছিল, একজন যেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালো মনে করেছেন, অপরজন সেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে খারাপ মনে করেছেন। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকে চীনা দর্শনে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব অধিকতর স্পষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে। চীন ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রসারও এই যুগে ঘটতে থাকে। কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদ একটি তৃতীয় দার্শনিক মত হিসাবে অনুসৃত হতে শুরু করে। বৌদ্ধবাদীগণ জগৎকে মায়া বলে ব্যাখ্যা করেন। কনফুসিয়াস ও তাওবাদ ভাববাদী দর্শনের উদগাতা। কিন্তু কেবল ভাববাদী দর্শনই নয় –এই যুগের বিখ্যাত দার্শনিক হো চেন তিয়েন এবং ফানচেন জগৎ, অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা ইত্যাদি প্রশ্নে বস্তুবাদী মত প্রচার করেন। দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকে চীনের সমাজ পরিবর্তন তার ভাবাদর্শেও প্রকাশ পেতে শুরু করে। ভাব এবং বস্তুর প্রকৃতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস ও বুদ্ধের মতবাদের স্থানে নবকনফুসিয়াসবাদের উদ্ভব ঘটে এই সময়ে। এই যুগের অন্যতম দার্শনিক চুশী ‘লী’ এবং ‘চী’ অর্থাৎ ভাব এবং বস্তুর মধ্যে ভাবকে প্রধান বলে গণ্য করে ভাববাদের পক্ষ অবলম্বন করেন। চীনের আধুনিক পর্বের শুরু হিসাবে আফিং যুদ্ধের বৎসর অর্থাৎ ১৮৪০ সালকে উল্লেখ করা যায়। এই সময় থেকে চীনের সমাজ জীবনে নতুন আলোড়ন ও পরিবর্তনের ধারা বইতে শুরু করে। একদিকে বৈদেশিক শক্তি চীনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে আধুনিক জগতের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটতে শুরু করে। আবার অপরদিকে বিদেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধাত্মক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হতে আরম্ভ করে। চীন ক্রমান্বয়ে আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। কিন্তু ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুন সংগ্রামী বস্তুবাদী চিন্তাধারারও পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাণসেতুঙ এবং সানইয়াত সেনের ন্যায় অগ্রসরবাদী চিন্তাবিদ এবং নেতৃবৃন্দ প্রাচীন বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা কজরে সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচার এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেন।

Christianity: খ্রিষ্টধর্ম
পৃথিবীর প্রচলিত প্রধান ধর্মসমূহের একটি হচ্ছে খ্রিষ্টধর্ম। যিশু খ্রিষ্টের উপদেশ এবং তাঁর মূল অনুসারীদের নতুন গ্রন্থ বা নিউটেস্টামেন্টে রক্ষিত কাহিনী ও কথামৃত হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের ভিত্তি।
খ্রিষ্টান ধর্মের উদ্ভব ঘটে পূর্ব রোমান-সাম্রাজ্যে নির্যাতিত দাস এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে। রোমান সম্রাটদের দ্বারা দাসদের বিদ্রোহ পর্যুদস্ত হওয়ায় দাস এবং দরিদ্রের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়। কন্তু হতাশার মধ্যে তারা এই বিশ্বাসও পোষণ করতে থাকে, কোনো এক উদ্ধারকারী মর্তে আগমন করে সকল অত্যাচার থেকে তাদের মুক্ত করবে। এমন পরিস্থিতিতে যিশু অত্যাচারিত মানুষের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হন বলে এই ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস পোষণ করেন। এরূপ কাহিনী আছে যে, জুযিয়ার রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট ক্রুশে বিদ্ধ করে যিশুকে হত্যা করে। কিন্তু যিশু মৃত্যুর পরে পুনরায় সশরীরে পুনরুত্থিত হন এবং স্বর্গে আরোহন করেন। নির্যাতিতের কাছে অপর ধর্মসমূহের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মেরও এই আশ্বাস যে, যারা সততার সঙ্গে দুঃখ কষ্ট ভোগ করেও জীবনযাপন করবে স্বর্গে তাদের সুখ লাভ হবে। অপরাপর অনেক ধর্মের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যেও অনুসারীদের জাতি, অঞ্চল এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতির ভিত্তিতে মতামতের পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। এর ফলে কালক্রমে খ্রিষ্টান ধর্ম তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাথলিক ধর্ম, পূর্বাঞ্চলের মৌলবাদী খ্রিষ্টান ধর্ম এবং সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ষোড়শ শতকে ইউরোপের মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে সংগঠিত প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। (দ্র. প্রটেস্ট্যান্টবাদ ও মার্টিন লুথার)

Cicero: সিসেরো (খ্রি. পৃ. ১০৬-৪৩)
প্রাচীন রোমের বাগ্মী, দার্শনিক এবং রাজনীতিক। প্লেটো যেরূপ সংলাপের আকারে রচিত গ্রন্থে তার দর্শনকে প্রকাশ করেছিলেন, সিসেরাও তেমন পদ্ধতিতে তাঁর দর্শন লিপিবদ্ধ করেন। সিসেরোর দর্শন প্রধানত সমন্বয়বাদী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সিসেরোকে সন্দেহবাদের সমর্থক বলা যায়। তাঁর মতে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সিসেরোর এই শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রী, অভিজাততন্ত্রী এবং গণতন্ত্রী বৈশিষ্ট্যকে সম্মিলিত করা উত্তর বলে মনে করতেন। প্রাচীন রোমে, সিসেরোর জীবনকালে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের বিরোধ, লড়াই এবং পারস্পরিক হত্যা রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল। খ্রি. পূ. ৪৯-এ জুলিয়াস সিজারের হত্যার পরে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে তাতে খ্রি. পূ. ৪৩ সনে সিসেরো ক্ষিপ্ত জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

Class: শ্রেণী
Class Struggle: শ্রেণী সংগ্রাম
কোনো বৈশিষ্ট্য বা গুণের ভিত্তিতে যে-কোন সমষ্টিকে শ্রেণী বলে অভিহিত করা চলে। ‘শ্রেণী’ শব্দটি তত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের বাইরে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যুক্তিবিদ্যায় কোনো জাতিবাচক পদকে শ্রেণী বলা হয়। ‘মানুষ’, ‘পশু’, ‘বাঙালী’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’ –ইত্যাদি পদ শ্রেণীবাচক পদ। কোনো বিশেষ গুণের ভিত্তিতে একাধিক ব্যক্তি বা উপাদানের উপর প্রযোজ্য নাম। মার্কসীয় তত্ত্বে ‘শ্রেণী’ শব্দের প্রধান ব্যবহার অর্থনৈতিক ব্যবহার। জীবন ধারণের সম্পদের মালিকানা এবং অ-মালিকানার ভিত্তিতে কোনো সমাজের মানুষকে চিহ্নিত করার তত্ত্ব। মার্কসবাদের মতে মনুষ্যসমাজের আদিতে সামাজিক সম্পদের কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সে হিসাবে সেই আদি কালের মনুষ্যসমাজ শ্রেণীহীন ছিল বলে অনুমান করা চলে। জীভন যাপনের হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতির বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যখন সমাজের কোনো অংশের পক্ষে সম্ভব হয়, তখনই সমাজে এরূপ অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এবং তারপর থেকে সমাজ বিকাশের প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে সম্পদের এরূপ মালিকশ্রেণী এবং সম্পদের মালিকানাবিহনীন সম্পদহীন শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রাম কাজ করে আসছে বলে মার্কসবাদ মনে করে। এ হিসাবে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের বিখ্যাত ‘কমিউনিষ্ট ইশতেহারে’ উল্লেখ করেন যে, ‘মানবজাতির জ্ঞান ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস’। অবশ্য মার্কসবাদের অপর এক তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, মানুষের সমাজের বিকাশের পরিণতিতে ভবিষ্যতে সমগ্র সামাজিক সম্পদের উপর মানুষের সামাজিক মালিকানা যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এরূপ বৈষম্যমূল অর্থনৈতিক শ্রেণীর আর অস্তিত্ব থাকবে না।

Cognition: জ্ঞান প্রক্রিয়া
‘আমাদের জ্ঞান আছে, আমরা জ্ঞান আহরণ করি’ ইত্যাদি কথা আমরা সব সময়ই ব্যবহার করি। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ আদিকাল থেকে নিজের জীবন রক্ষা করে এসেছে, প্রকৃতিকে সে জয় করে চলেছে এবং মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। জ্ঞান বাদে মানুষ নাই। কিন্তু মানুষ কি করে জ্ঞানলাভ করে একটি দর্শনের একটি বিশেষ আলোচনার বিষয়। জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে ভাববাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলির মত খুব পরিচিত। তিনি এরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন যদিচ মানুষ বস্তু জগৎকে জানে বলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়, তবু যুক্তিগতভাবে মানুষ বস্তুকে আদৌ জানতে পারে না। মানুষ কেবল তার মনের ভাবকেই জানে। বস্তু কথাটিও মানুষের মনের ভাব। বস্তুর অস্তিত্ব মানুষের মন জানতে পারে না। মানুষের জ্ঞান কতকগুলি প্রধান এবং অপ্রধান ধারণা দ্বারা গঠিত। প্রধান বা মৌল ধারণাগুলি বিশ্বচরাচরের বিধাতা মানুষের মনে সৃষ্টি করেদেন। সেগুলির ভিত্তিতেই মানুষ তার জ্ঞানের জগৎ তৈরী করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ জ্ঞানপ্রক্রিয়ার এই ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে। এই মতানুযায়ী মানুষের জ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ফল। মানুষ তার জন্ম থেকে জৈবিক তাড়নাতেই বাইরের বস্তুকে নিজের জীবনের স্বার্থে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে আসছে। বস্তুকে সে নিজের হাতে-পায়ে চোখে-কানে অনুভব করছে। এই প্রক্রিয়ায় বস্তু মানুষের দেহে এবং মস্তিষ্কের কোষে বিভিন্ন সাড়ার সৃষ্টি করেছে। এই মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক বিকাশলাভ করেছে। মানুষের মধ্যে বস্তু সম্পর্কে অনুধাবনের, ব্স্তুর উপর গুণ আরোপ করার এবং গুণের সাহায্যে বস্তুকে স্মরণ রাখার শক্তি জন্মেছে। বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের এই জটিল সম্পর্কই যেমন জ্ঞানের প্রক্রিয়া তেমনি এই প্রক্রিয়া থেকেই মানুষের জ্ঞানের সৃষ্টি। জ্ঞান বিধিদত্ত কোনো সম্পদ নয়। জ্ঞানকে মানুষই সৃষ্টি করেছে এবং করছে। বস্তু-বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান এবং জগৎ বলে কিছু নেই। মানুষের জ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তব জগতের রহস্য উদঘাটন করা। বাস্তবকে জেনে জীবন রক্ষার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করা, পরিবর্তন করা। জ্ঞান কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। জ্ঞানের প্রশ্নের মানুষের সঙ্গে তার বাস্তব জগতের সক্রিয় সম্পর্ক সর্বদাই জড়িত। মানুষের বাস্তব জগৎ আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসাবে সংঘটিত। মানুষের জ্ঞানও তাই তার আর্থিক সামাজিক অবস্থার দ্বারা একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত অপরদিকে তেমনি মানুষের জ্ঞান দ্বারা বিশেষ পর্যায়ের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামো নিজেও নিয়ন্ত্রিত। ব্যবহার বাদে জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ সতত যেমন তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করছে তেমনি নিয়ত সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা তার পরিবেশকে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য পরিবর্তিত করার চেষ্টা করছে।

Coherence: সামঞ্জস্য, সামঞ্জস্যবাদ
দর্শনে সত্যের মাপকাঠি নিয়ে তর্ক আছে। একটা কথা বা বক্তব্য সত্য –এরূপ দাবির অর্থ কি? কেউ যদি বলে, সে ভূত দেখেছে তা হলে তার সে কথাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করি। কিন্তু ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এ কথাকে আমরা সত্য বলি। কিসের ভিত্তিতে একটি বাক্য বা বক্তব্যকে সত্য বলা হবে? সত্যের মাপকাঠির এই প্রশ্নে দর্শনে দুটি প্রধান তত্ত্বের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ‘থিওরি অব করেন্সপণ্ডেন্স’। একে বাংলায় সাদৃশ্যের তত্ত্ব বলা যায়। অপরটি হচ্ছে থিওরি অব কোহারেন্স। একে সামঞ্জস্যের তত্ত্ব বলা যায়। সাদৃশ্যের তত্ত্বের দাবি হচ্ছে যে, কোনো বক্তব্য অনুযায়ী বাস্তব জগতে যদি কোনো অস্তিত্ব থাকে তবে সে বক্তব্যকে সত্য বলা হবে। ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এই বক্তব্য অনুযায়ী চেয়ার কথার সদৃশ কোনো বস্তুর যদি অস্তিত্ব বক্তব্যের মুহুর্তে থাকে তবে ওখানে একটি চেয়ার আছে কথাটি সত্য হবে।
সামঞ্জস্যবাদ ভিন্নতরভাবে সত্য নিরূপণ করতে চায়। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাদাতাতের মতে একটি বক্তব্যের বরাবর বাস্তব অস্তিত্ব সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না। বিশ্লিষ্ট বা এ্যাবষ্ট্রাক্ট বক্তব্যের বরাবর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আমরা পাইনে। দয়া একটি মহৎ গুণ। কিন্তু দয়ার অস্তিত্ব কোথায়? দয়ালু মানুষ আছে বটে। কিন্তু মানুষ নিরপেক্ষভাবে স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পন্ন দয়াকে আমরা দেখতে পাইনে। কাজই সাদৃশ্যের তত্ত্ব সমস্ত সত্যের ব্যাখ্যা করতে পারে না। সামঞ্জস্যবাদ অনুযায়ী সত্যের জগৎ হচ্ছে একটা সামগ্রিক সত্তা। তার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সত্যই পরস্পর যৌক্তিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাই আমরা যখন কোনো কথা উচ্চারিত করি বা অভিমত পেশকরি তখন তার যথার্থতার বা সত্যের নিরূপণ হবে সত্যের সমগ্র সত্তার সঙ্গে সে সঙ্গতিময় কিংবা সঙ্গতিময় নয় তার বিচারে।

Comte, August: অগাস্ট কোঁতে (১৭৯৮-১৮৫৭ খ্রি.)
‘পজিটিভজম’ বা দৃষ্টবাদের প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতের দর্শন এবং তাঁর রচনাবীল দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রথতে তাঁর যুগ পর্যন্ত জ্ঞানের সমগ্র বিকাশের একটি ইতিহাস তৈরীর চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টায় ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা তিনি উপস্থিত করেন সে ব্যাখ্যাকে পজিটিভজম বা দৃষ্টবাদ বলে তিনি আখ্যাত করেন। অগাস্ট কোঁতে জ্ঞানের বিকাশে তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে জ্ঞানের বিকাশের আদিযুগ হচ্ছে ধর্মীয় যুগ। এই যুগে রহস্যের ব্যাখ্যায় মানুষ অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বা ঈশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুগ হচ্ছে দার্শনিক যুগ। এ যুগে দার্শনিক চরম কারণ বা চরম সত্তার অস্তিত্বের ভিত্তিতে মানুষ ও জগতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এটাকে কোঁতে ধর্মীয় যুগেরই প্রকারভেদ বলেছেন। জ্ঞানের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা দৃষ্ট প্রকৃতির যুগ। এ যুগে বিজ্হানের মাধ্যামে দৃষ্ট প্রকৃতিকে মানুষ চরম বলে স্বীকার করেছে। এ যুগে এসে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে, প্রকৃতির বাইরে ঈশ্বর বা চরম সত্তার অনুসন্ধান নিরর্থক। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা দৃষ্ট প্রকৃতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। দৃষ্ট প্রকৃতিই হচ্ছে চরমসত্তা। কাজেই বিজ্ঞান বা জ্ঞান প্রক্রিয়ার কর্তব্য হচ্ছে বাস্তব জগতের দৃষ্ট বিষয়ের বর্ণনা দান; অভিজ্ঞতার গভীরে অপর কোনো সত্তার অনুসন্ধান করা নয়। জ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস রচনার যে বিরাট চেষ্টা কোঁতে করেছেন সে চেষ্টায় তাঁকে আধুনিক ইতিহাসকারদের পথিকৃৎ বলা চলে। ধর্ম কিংবা দার্শনিক চরমসত্তার স্থানে প্রকৃতির প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টায়ও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয়। কিন্তু মানুষের স্থান কেবল তার দৃষ্ট বস্তুপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে –দৃষ্টের ভিত্তিতে অ-দৃষ্ট কোনো কিছু সম্পর্কে অনুমানের ক্ষমতা মানুষের নাই, এ মত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত সীমান্তের আর এক চরম মত। এর ফলে অগাষ্ট কোঁতের পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদকে চরম অভিজ্ঞতাবাদ বা ভাববাদের একটি প্রকারবিশেষ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক কোনো দর্শণ বলে গ্রহণ করা চলে না।

Communist Manifesto: কমিউনিস্ট ইশতেহার
মার্কস এবং এঙ্গেলস রচিত ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেসটো’ বা ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত হয়। লণ্ডনে নির্বাসিত সাম্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী ‘লীদ অব কমিউনিস্টস’ বা সাম্যবাদী সমিতি মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর উপর তাদের মতবাদ ব্যাখ্যা করে একটি ইশতেহার রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত করে। এই দায়িত্ব হিসাবে আজীনব পরস্পরের সঙ্গী মার্কষ এবং এঙ্গেলস ক্ষুদ্রাকারের হলেও অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যামূলকভাবে এই ইশতেহারটি রচনা করেন। কালক্রমে এই ইশতেহার শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী বিপ্লবী বিশ্বাসের অন্যতম মৌলিক দলিল হিসাবে পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অনূদিত হয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের পূর্বকার কল্পনাবাদী সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদ যথা –সেন্ট সাইমন, ফৌরিয়ার প্রভৃতির ব্যাখ্যা থেকে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য ‘কমিউনিস্ট’ শব্দের ব্যবগহার করেন। ইশতেহারের শীর্ষে তাঁরা ‘দুনিয়ার সকল দেশের শ্রমিক এক হও’ এই আহবার ঘোষণা করেন।
১। বুর্জোয়া এবং প্রলেটরিয়ানস বা সর্বহারা,
২। সর্বহারা এবং কমিউনিস্টগণ,
৩। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টগণ,
৪। বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধীদলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক।
এরূপ চারটি প্রধান শিরোনামে মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের সাম্যবাদী দর্শন ব্যাখ্যা করেন। শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী দলগুলিকে বিভিন্ন দেশে বেআইনী অবস্থায় গুপ্তভাবে তাদের আন্দোলনকে পরিচালনা করতে হত। ১৮৭২ সনে এর একটি জার্মান সংস্করণ এবং ১৮৮২ সনে প্রকাশিত হয় ইংরেজী সংস্করণ। মার্কস জীবিত থাকাকালে এসব সংস্করণের ব্যাখ্যামূলক ভূমিকা তাঁদের উভয় দ্বারা যুক্তভাবে রচিত হয়। মার্কসের মৃত্যুর পরে ১৮৮৮ সনের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকার একস্থানে এঙ্গেলস লিখেছিলেন “যদিও এই ম্যানিফেস্টো আমাদের যৌথ রচনা, তবুও আমার একথা বলা আবশ্যক যে, এই ইশতেহারের মূল যে বক্তব্য তা মার্কসেরই চিন্তাপ্রসূত। এবং এই মূল বক্তব্য হচ্ছে এই দর্শন যে, ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং বিনিময়ের প্রধান যে ব্যবস্থা তার উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় সে যুগের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধি বা ভাবগত ইতিহাস। এই মূল ভিত্তি দ্বারাই মাত্র এদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলত মানব জীবনের আদি গোষ্ঠীসমূহের জমির উপর যৌথ মালিকানার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে শোষক এবং শোষিতের মধ্যকার শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। এবং এই ইতিহাস এখন বিকাশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আজ এমন পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখানে আজকের যুগের শোষিত এবং নির্যাতিত প্রধান শ্রেণী তথা প্রলেটারিয়েট শ্রেণী তার শোষক এবং শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য থেকে নিজের মুক্তি সমগ্র সমাজের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী শোষনের বিলোপ সর্বকালের জন্য সাধন করা ব্যতীত অর্জন করতে পারে না”।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভাষা যেমন সুনির্দিষ্ট তেমনি তার মধ্যে সর্বহারা শ্রেণীর ভবিষ্যৎ অনিবার্য বিজয়ের আবেগময় বিশ্বাসের প্রকাশও সুস্পষ্ট। মানুষের সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়সমূহের উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ এবং সাম্যবাদী কর্মীদের করণীয়ের নির্দেশের পরিশেষে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অন্তিম অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপে রচনা করা হয়েছে; ‘কমিউনিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যকে গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। একথা তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল বিদ্যমান সকল সামাজিক অবস্থার জোরপূর্বক উৎসাদনের মাধ্যমেই সম্ভব। শাসক শ্রেণীগুলি কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কম্পিত হোক। তাদের নিজেদের শৃঙ্খলকে হারানো ব্যতীতত সর্বহারার হারাবার কিছু নেই। তাদের লাভ করার আছে সমগ্র পৃথিবী। সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হও”।

Communism, Primitive:আদিম সাম্যবাদ
সমাজতাত্ত্বিক গবেষক, বিশেষ করে মার্কসবাদীদের মতে মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগঠনের রূপ ছিল যৌথ এবং সাম্যবাদী। জীবন রক্ষার জন্য উৎপাদনের উপায়গুলো তখনো খুবই অনুন্নত। শ্রমের বিভাগও বিকাশ লাভ করে নি। নারী-পুরুষের কাজের মধ্যেও তেমন পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি। এই পর্যায়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক ছিল অপরিহার্যরূপে সামাজিক ও সমষ্টিগত। উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ সুচালো পাথর, বর্শা, বল্লম ইত্যাকার উৎপাদনী যন্ত্রগুলি ছিল গোত্র বা গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি এবং তার ব্যবহার ছিল সমষ্টিগত। উৎপাদিত বা সংগৃহীত খাদ্য সম্পদের ভোগও ছিল সমষ্টিগত। অবশ্য এই সামগ্রিক যৌথ ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যক্তিগত মালিকানা যে কিছুই ছিল না, এমন নয়। দেহাবরণ অবশ্যই ব্যক্তিগত ছিল। উৎপাদনী যন্ত্র যে আদৌ ব্যক্তিগত থাকতে পারতো না এমনও নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাস্তব পরিস্থিতি এমন ছিল যে, গোত্র বা গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ এবং যৌথ চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত ব্যক্তির পক্ষেও খাদ্র সংগ্রহ করে এবং বৈরী প্রকৃতি ও বন্যপশুর বা প্রতিদ্বন্দ্বী মানবগোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে জীবন রক্ষা সম্ভব ছিল না। এর পরে সামাজিক পরিশ্রমে বিভাগ শুরু হয়। পশুপালন এবং কৃষিকাজ দুটি আলাদা জীবিকার রূপ গ্রহণ করে। এই বিভাগের ভিত্তিতে সমাজের উৎপাদনী ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীর পরিমাণের তারতম্যে দ্রব্যবিনিময় শুরু হয় এবং সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাও সম্ভব হতে শুরু করে। কালক্রমে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পরিমাণের পার্থক্যে অসাম্য উদ্ভুত হতে থাকে। গোত্রে গোত্রে লড়াই বা যুদ্ধের পরিণামে পরাজিত গোত্রের মানুষ বিজয়ী গোত্রের দাস বলে গণ্য হয়ে উৎপাদনের এক অভাবিতপূর্ব উপায়রূপে বিজয়ী গোত্রের কাছে কিংবা বিজয়ী গোত্রের শক্তিমান ব্যক্তিদের কাছে দেখা দেয়। এবার সামগ্রিকভাবে সামাজিক কাঠামোতে সাম্যবাদ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দাস এবং উৎপাদনের যন্ত্রাদির ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎপাদন বৃদ্ধির যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয় পূর্বকার যৌথ ব্যবস্থাপনার অবস্থিতি যে সম্ভাবনার বিকাশের প্রতিশ্রুতি বা শৃঙ্খলের কাজ করতে থাকে। হস্তশিল্প থেকে কৃষিকাজের পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাগকে বিস্তৃততর করে উৎপাদন ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে আদি সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে শ্রেণীবিভক্ত সামজের উদ্ভব ঘটে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে দাস ও প্রভুতে বিভক্ত সমা জন্মলাভ করে।

Copernicus: কপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.)
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক কপারনিকাসের জন্ম হয়েছিল পোলাণ্ডে। সৌরজগতের বর্তমান সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কপারনিকাস। এতদিন পর্যন্ত সূর্য, চন্দ্র এবং পৃথিবীর আবর্তনের ব্যাখ্যায় টলেমীর পৃথিবী কেন্দ্রীক তত্ত্বই ছিল স্বীকৃত তত্ত্ব। টলেমীর তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবী হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র। পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য-চন্দ্র প্রভৃতির আবর্তন। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস; দার্শনিক এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যা কিংবা টলেমীর তত্ত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। সকেলই পৃথিবীকেই বিশ্বজগতের কেন্দ্র বলে মনে করেছে। এই প্রতিষ্ঠিত মতের ক্ষেত্রে কপারনিকাসের তত্ত্ব সাধারণ বিশ্বাসের একেবারে বিপরীত ছিল। প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের পৃথিবী আবর্তনের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে পূর্ণতর গবেষণায় কপারনিকাস দার্শনিকদের পৃথিবী ৩৬৫ দিনে যেমন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তেমনি নিজের মেরুদণ্ডের উপরও সে আবর্তিত হচ্ছে। কেবল পৃথিবী নয়, পৃথিবীর মতোই গ্রহ হচ্ছে মারস (মঙ্গল), মার্কারী (বুধ), ভেনাস (শুক্র), জুপিটার (বৃহস্পতি), স্যাটার্ন (শনি)। এরাও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে এদের সূর্য প্রদক্ষিণের কালেরও তফাৎ ঘটছে। মার্কারী ৮৮ দিনে, ভেনাস ২২৫ দিনে, মারস ৬৮৬ দিনে, জুপিটার ১২ বছরে এবং স্যাটার্ন ৩০ বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এভাবে তৈরি হয়েছে সৌরজগৎ। কপারনিসাকের পরবর্তী বৈজ্ঞানিকগণ বিশেষ করে কেপলার, (১৫৭১-১৭২৭ খ্রি.) গ্রহ-উপগ্রহগুলির পরিক্রমণ পথ আরো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত করেন। কিন্তু পৃথিবীকেন্দ্রীক ধারণার উপর প্রথম আঘাত হানার কৃতিত্ব কপারনিকাসের। মানুষ যেখানে এর পূর্বে পৃথিবীকে সর্ববৃহৎ বলে কল্পনা করেছে আর এই পৃথিবীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে, সেখানে কপারনিকাস মানুষের জ্ঞানের সীমাকে পৃথিবীর বাইরে বৃহত্তর বিশ্বে অবারিত করেছেন। ধর্মের অন্ধ এবং অনড় বিশ্বাসের শেকল থেকে বিজ্ঞানের মুক্তিদাতার ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। এ কারণে যাজক-সম্প্রদায় থেকে শুরু করে প্রচলিত ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী সকল মহলই কপারনিকাসের উপর সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।

Corce, Bendetto: বেনেদাতো ক্রোচে (১৮৬৬-১৯৫২ খ্রি.)
আধুনিককালের প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক। ক্রোচের দর্শন ভাববাদের প্রকার বিশেষ। অনেকে এ দর্শনকে ঐতিহাসিক ভাববাদ বলে আখ্যাত করেন। ক্রোচের রচনাসমূহের বিশ্লিষ্ট চিন্তার দুর্বোধ্য প্রকাশ করেছে। এসথেটিকস বা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত আধুনিককালের, বিশেষ করে ভাববাদী শিল্প আলোচনায় প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছে। ক্রোচের দর্শনের সাধারণ এবং সংক্ষিপ্ত ধারণা দানের চেষ্টায় বলা যায় যে, এ দর্শনের মূল হচ্ছে ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা। বস্তু এবং মনের মধ্যে প্রধান শক্তি কে? এ প্রশ্নে ক্রোচ-দর্শনের জবাব হচ্ছে যে, মনই হচ্ছে আসল শক্তি। আর মনের সত্তা বা অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে তার ক্রিয়ায়। মনের ক্রিয়ার বাইরে মন বলে কিছু নেই। মানসিক ক্রিয়াই মন। ক্রোচের মতে মনের ক্রিয়া দুরকম তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিক। তত্ত্বগত ক্রিয়ার মাধ্যমে মন বস্তুর সত্তাকে উপলব্ধি করে আপন সত্তায় তাকে লীন করে নেয় এবং প্রযুক্তিক ক্রিয়ায় মন সৃজনশীল হয়ে নতুন সত্তার সৃষ্টি করে। মনের ক্রিয়া ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা, কনসেপশান বা উপলব্ধি, বিশেষের এবং নির্বিশেষের ইচ্ছঅ –এই চার রকমে প্রকাশ পেতে পারে। এই চার রকম ক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষের শিল্প, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং আর্থিক কর্মপ্রবাহের উদ্ভব। এই চার প্রকার সৃষ্টির একটি অপরটির বিরোধী নয়। এরা পরস্পর পরিপূরক। ক্রোচের মতে শিল্পবোধ বা সৌন্দর্যানুভূতি হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান মাধ্যম। সৌন্দর্যবোধই হচ্ছে মানুষের আদিম বোধ। এ বোধ মানুষ বুদ্ধির মারফতে লাভ করতে পারে না। এ বোধ তার সহজাত বা সজ্ঞাজাত। কিস্তু সজ্ঞা কেবল মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্য বা শিল্পসৌকর্য কেবল অনুভূতি নয়। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে প্রকাশে। কোনো সৌন্দর্যানুভূতি অপ্রকাশিত থাকতে পারে না। প্রকাশই হচ্ছে মনের অনুভূতির ভাষা। মানুষের মুখের যে ভাষা তাও সেই সৌন্দর্যানুভূতিরই প্রকাশ। এদিক থেকে ভাষালোচনা এবং সৌন্দর্যালোচনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই।

Confucianism: কনফুসিয়াসবাদ
চীনের প্রাচীন সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা কনফুসিয়াসের উপদেশাবলীকে কনফুসিয়াসবাদ বলা হয়। কনফুসিয়াসের জীবনকাল ৫৫১ থেকে ৪৭৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ বলে ধারণা করা হয়। কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল। প্রাচীন সমাজে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যত পরিচিত নন তার চেয়ে চীন সমাজের সংরক্ষণকারী হিসাবেই তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থায় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক কিরূপ জীবন যাপন করবে এর প্রতিটি বিষয়ে কনফুসিয়াস তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা।
পৃথিবীর উপরে যদি কাউকে মান্য করতে হয় তা হলে মানুষ মান্য করবে ঈশ্বরকে, ঈশ্বরের বিধানকে। যে মানুষ মহৎ সে ঈশ্বরের বিধানেই মহৎ। যে-মানুষ অধম সে ঈশ্বরের বিধানেই অধম। এর কোনো পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে সেই বিধানকে সুসঙ্গতভাবে মেনে চলা। যে রাজা, সে ঈশ্বরের বিধানেই রাজা। ছোটর কর্তব্য হচ্ছে বড়কে মানা। রাজা-প্রজা, পতী-পত্নী, পিতা-পুত্র, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, এই প্রকারের সম্বন্ধের ভিত্তিতেই সমাজ গঠিত। বিধির বিধানে যে স্থানে যে অধিষ্ঠিত সেই স্থান অনুযায়ী দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা তার কর্তব্য। রাজার আদর্শ হবে উত্তম রাজা হবার এবং প্রজার আদর্শ হবে উত্তম প্রজারূপে তার দায়িত্ব পালন করা। কনফুসিয়াসের অনুসারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁর অভিমতকে ব্যাখ্যা করেন। তার ফলে কনফুসিয়াসবাদেও বিভিন্ন উপধারার উদ্ভব হয়। কনফুসিয়াসের অন্যতম শিষ্য মেঙজু মনে করতেন যে, সমাজে যে অসাম্য বিদ্যমান তা বিধাতারই বিধান। বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাখ্যায় কনফুসিয়াসের অপর এক অনুসারী সুনজু কিছুটা বস্তুবাদী মত প্রচারের প্রয়াস পান। তাঁর মতে ঈশ্বর প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির ঊর্ধ্বে কোনো সত্তা নয়। খ্রিষ্টাব্দের একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে চুশী এবং অন্য অনুসারীগণ নব কনফুসিয়াসবাদের প্রবর্তন করেন। তাঁদের মতে বিশ্বের মূলে রয়েছে ‘লী’ এবং ‘চী’র দ্বন্দ্ব। ‘লী’ হচ্ছে ভাব, আর ‘চী’ হচ্ছে বস্তু। ‘লী’র কারণেই মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের সৃষ্টি আর ‘চী’র কারণে মানুষ লোভ, মোহ ইন্দ্রিয় সুখ ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সুর্দীঘকাল স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চীনে তিনটি ভাবাদর্শের উদ্ভব দেখা যায়। এই তিনটির একটি হচ্ছে কনফুসিয়াসবাদ এবং অপর দুটি হচ্ছে তাও এবং বৌদ্ধ ধর্ম।

Culture: সংস্কৃতি
মানৃষের সর্বপ্রকার বৈষয়িক এবং আত্মিক সৃজন ও সম্পদের ব্যাপক অর্থবহ শব্দ। অনেক সময় সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, সামাজিক আচরণ ও নীতি –অর্থাৎ মানুষের ভাবগত সৃষ্টিকর্মকে কেবল সংস্কৃতি বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মানুষের সৃষ্টির সম্পূর্ণ অর্থে আর্থিক ও কারিগরি সৃজন কর্ম এবং তার ফসল অর্থাৎ উৎপাদনের যন্ত্র, কলকারখানা এবং উৎপাদিত বৈষয়িক সম্পদ ও সৌধকেও একটা মানব সমাজের সংস্কৃতি হিসাবে গণ্য করা উচিত। পার্থক্য হিসাবে ভাবগত সৃষ্টিকে ‘আত্মিক সংস্কৃতি’ এবং দেহগত সৃষ্টিকে ‘বৈষয়িক সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু এরূপ পৃথকীকরণও কেবলমাত্র আপেক্ষিকভাবে স্বীকার্য। আত্মিক ও বৈষয়িক সংস্কৃতির মধ্যে কোনো চরম পার্থক্য বা বিরোধের অবকাশ নাই। কোনো আত্মিক সংস্কৃতি দেহ এবং বৈষয়িক অবস্থা-নিরপেক্ষভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। আবার কোনো বৈষয়িক কর্মই মনের কল্পনা বাদে সাধিত হতে পারে না। সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক সৃষ্টি। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের ব্যক্তিগত এবং যৌথ ক্রিয়া-কাণ্ডের ফলে এর উদ্ভব। এ কারণে সমাজ-সংগঠনের বিশিষ্ট রূপ দ্বারা সমাজের সংস্কৃতির রূপ প্রধানত নির্দিষ্ট হয়। এক সমাজ থেকে আর এক সমাজের সংস্কৃতি এই ভিত্তিতেই পৃথক হয়। আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষের সমাজের ইতিহাস শ্রেণীভেদের অবস্থাহীন আদিম সাম্যবাদী সমাজ এবং তারপরে শ্রেণীভেদ সম্পন্ন দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে এ পর্যন্ত বিভক্ত হয়েছে। এই পর্যায় মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসকেও দাস সমাজের সংস্কৃতি, সামন্ত সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা হয়। এক একটা সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে সংস্কৃতির এই পরিচয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দাস বা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে তার অভ্যন্তরে বৈচিত্র, বিরোধ এবং বিভিন্নতাশূন্য একটি অখণ্ড সৃষ্টিকে বুঝায়। দাস সমাজে প্রভু এবং দাসের মধ্যে যে বিরোধ, সে বিরোধ প্রভুশ্রেণীর এবং দাসের বৈষয়িক ও মানসিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও অনুরূপ। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত মালিকানা, উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত সম্পদের ভোগ থেকে অধিকাংশকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থায় যে শ্রেণীগত বিরোধ, বৈষম্য, সংঘাত এবং ভাবভাবনার সৃষ্টি হয় তার প্রতিরূপ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি, বিশেষ করে তার আত্মিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে –অর্থাৎ যে সমাজে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ শোষক এবং শোষিত হিসাবে বিভক্ত নয়, সে সমাজের সংস্কৃতিতে মৌল কোনো আর্থিক সংঘাতের প্রতিফলনের অবকাশ নাই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতিও বৈচিত্রহীন নয়। বিরোধাত্মক বৈচিত্রের স্থানে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈচিত্র সাধিত হয় সমাজের বিভিন্নমুখী উন্নতি সাধনের বিচিত্র সৃজনকর্মের মাধ্যমে।

Cynic: উদাসীন
Cynicism: ঔদাসীন্য, উদাসীনতাবাদ
ইংরেজী ‘সিনিক’ এবং ‘সিনিসিজম’ শব্দ দ্বারা জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ সব কিছুর প্রতি একটা কঠোর ঔদাসীন্য বুঝায়। ইংরেজী সিনিক শব্দের উদ্ভব গ্রিক ‘কিওনস’ থেকে। ‘কিওনস’ বলতে কুকুর বুঝায়। আর তাই ‘কিনিকাল’ বা ‘সিনিকাল’ দ্বারা কুকুরের ন্যায় অদমনীয় মনোভাব বুঝাত।
কিন্তু এই শব্দের দার্শনিক তাৎপর্য গ্রিক দার্শনিক এ্যান্টিসথেনিস (খ্রি. পূ. ৪৩৫-৩৭০) এবং তাঁর অনুসারী ডায়োজেনিস, ক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিকদের জীবন দর্শণ এবং জীবনাচার থেকে উদ্ভুত। দাসদের শোষণের ভিত্তিতে গ্রিক গণতন্ত্র এককালে যে শৌর্য এবং বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের আত্মঘাতী সংঘর্ষে সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমাজে অবিশ্বাস, অন্তর্ঘাত এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে থাকে। সমাজের এই অস্থির অবস্থায় এমন একদল চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে যাঁরা মানুষের শান্তি সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিকাকাণ্ডে অংশগ্রহণে নয়, সমস্তরকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং জীবনের আরাম আয়েশ বিলাস ব্যসন সব কিছু পরিত্যাগের মধ্যে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। এই মনোভাবের প্রাথমিক লক্ষণ মহৎ ব্যক্তি সক্রেটিসের জীবনাচরণ এবং অভিমতের মধ্যে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নয়, জ্ঞানের অন্বেষণ এবং সহজ জীবনযাপনের মধ্যেই তিনি ব্যক্তির মহৎ কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সহজ জীবন যাপনের সক্রেটিসীয় নীতি সিনিকপন্থীগণ অধিকতর কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনকে বাহুল্য বলে বর্জন করার চেষ্টা করে। ‘অঞ্জলিদে যদি তৃষ্ণার পানি পান করা সম্ভব তা হলে পেয়ালা বাহুল্য। অতএব সে বর্জনীয়’। সিনিক দার্শনিক ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২৩) সম্পর্কে এরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডার একদিন ডায়োজেনিসের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ডায়োজেনিস তখন সূর্যালোকে উপবিষ্ট। সম্রাট আলেকজাণ্ডার সূর্যের রশ্মিকে আড়াল করে ডায়োজেনিসের নিকটবর্তী হয়ে যখন দার্শনিককে বললেন, ‘আমি আপনার কি উপকার করতে পারি?’ তখন দার্শনিক উত্তরে বললেন, ‘আপনি আমার উপর নিপতিত সূর্যের রশ্মিকে আড়াল না করে একটু সরে দাঁড়াতে পারেন।
সিনিক দার্শনিকদের সবকিছু বর্জন করার নীতির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। শোষণ এবং অনাচারপূর্ণ তৎকালীন গ্রিক সমাজের সবকিছু বর্জণ করে জ্ঞানের মধ্যে মুক্তি অন্বেষণের নীতিকে সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও শোষণের সমালোচনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সিনিকপন্থীগণ সমাজে দাস ও প্রভুর বৈষম্যকে স্বীকার করত না। সকল মানুষ সমান, এই মতাদর্শ তারা অনুসরণ করত। এই আদর্শ তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিকে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ প্রাচীর অতিক্রম করে বৃহত্তর মনুষ্য সমাজের মধ্যে বিস্তারিত করার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। সিনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাণ্টিসথেনিস ছিলেন প্লেটোর সমকালীন। তিনি এরূপ অভিমত পোষণ করতেন যে, যিনি জ্ঞানী তাঁর কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনীন আদর্শকে অনুসরণ করা। তিনি আরো মনে করতেন, জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ সভ্যতার কৃত্রিমতাকে বর্জন করে যত বেশী পশুর প্রাকৃতিক সহজ জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে তত সে স্বাভাবিক এবং উত্তজ জীবনের অধিকারী হবে। এ্যান্টিসথেনিস ‘সাইনো সারজেম’ নামক স্থানে তাঁর দর্শন প্রচার করতেন। এই স্থান থেকেও ‘সিনিক’ শব্দের উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে। বিভিন্ন গ্রিক দর্শনের সঙ্গে দর্শনের প্রচার স্থানের নাম যুক্ত হতে দেখা যায়। একাডেমীয়া স্থান থেকে প্লেটোর একাডেমী। লাইসিউম থেকে এ্যারিস্টটলের লাইসিউম দর্শনপিঠের প্রসিদ্ধি।

D
D’ Alembert: ডি, আলেম্বার্ট (১৭১৭-১৭৮৩ খ্রি.)
ফরাসি বিশ্বকোষিকদের অন্যতম দার্শনিক এবং গণিতশাস্ত্রবিদ ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট। বৈজ্ঞানিক হিসাবে বায়ু প্রবাহের উপর তিনি ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্বকোষ রচনার ক্ষেত্রে তিনি ডিডেরটকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। ধর্মের ক্ষেত্রৈ তিনি নিরীশ্বরবাদী না হলেও ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাণী লাভে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এরূপ অভিমত যাঁরা পোষণ করেন তাঁদের ইংরেজীতে ‘ডিস্ট’ বা ঈশ্বরবাদী কিন্তু ঈশ্বরের প্রত্যাদেশবাদী নয় বলে অভিহিত করা হয়। ডি’ আলেম্বার্ট খ্রিষ্ট ধর্মের ‘জেসুইট’ এবং ‘ক্যালভিনিস্ট’ উভয় সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেন।

Dadaism: দাদাবাদ, খেয়ালবাদ
প্রথম মহাযুদ্ধকালে ইউরোপ এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছুসংখ্যক শিল্পী ও সাহিত্যিকের মধ্যে উদ্ভুত এক প্রকার শিল্প ও সাহিত্য আন্দোলন। মহাযুদ্ধের বিভীষিকায় আকঙ্কগ্রস্ত এবং জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু সংখ্যক ফরাসী বুদ্ধিজীবী সুইজারল্যাণ্ডের জুরিক শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের নিজেদের মতের হতাশা এবং আতঙ্ককে শিল্প ও সাহিত্যে প্রকাশ করার জন্য তাঁরা অ-চিন্তিত এবং অসাধারণ মাধ্যমের আশ্রয় নেন। তাঁরা মনে করতেন সমাজে যুদ্ধ, ধ্বংস, অসাম্য, অত্যাচার –এসবের কারণ মানুষের নিজের চরিত্রে পাশবিক ব্যবহার। এটাকে স্বীকার করা ব্যতীত কোনো উপায়ন্তর নেই। সমাজ কোনো নীতি মেনে চলে না। শিল্পীর পক্ষেও তাই প্রচলিত কোনো নিয়ম-নীতি মেনে চলার প্রয়োজন নেই। মনে যা আসে তাই করো। শিল্পের মাধ্যম হিসাবে যা ইচ্ছা হয় তাই গ্রহণ করো। অক্ষরগুলো এ যাবৎ যেমন লেখা হয়ে আসছে, তেমন করে কেন লিখবো? অক্ষরগুলো উল্টিয়ে লিখলে ক্ষতি কি? এরূপ অরাজক মানসিকতা থেকে জাঁ ককতু, হানস আর্প, মার্সেল দুকাম্প প্রমুখ সাহিত্যিক ও শিল্পী, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত সমস্ত নিয়মনীতিকে লঙ্ঘন করার চেষ্টা করেন। কবি ও ঔপন্যাসিক জাঁ ককতুর মতে যে-কোন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মই বিশৃঙ্খলার অভিধানবিশেষ। দাদাবাদকে খেয়ালবাদ বলা হয়। বস্তুত ফরাসি ‘দাদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘খেয়াল ঘোড়া’। আধুনিক শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সার রিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ নামক যে আর একটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় দাদাবাদ তার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। দাদাবাদ বা শিল্পে অরাজকতার এই মনোভাব ১৯২২ সালের দিকে স্তিমিত হয়ে পড়ে।

Dante, Alighieri: দান্তে (১২৬৫-১৩২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের ইতালির কবি দান্তে তাঁর ‘ডিভাইন কমেডি’ গ্রন্থের জন্য ইতিহাসের সুবিখ্যাত। কিন্তু কেবল কাব্য ও সাহিত্যকর্মে তিনি নিয়োজিত ছিলেন না। তৎকালীন ইতালির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তিনি জড়িত ছিলেন। সেকালে ইতালির রাজনীতি পোপ সমর্থক এবং পোপ বিরোধী, এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মের ধর্মীয় গুরু পোপের সমর্থকরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিরোধী শক্তি বলে পরিগণিত হত। পোপের একচ্ছত্র এবং সমগ্র ইউরোপব্যাপী সাম্রাজিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের শাসক তথা রাজাগণও অভিমত পোষণ করতেন। রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য রাজার অধীনে কেন্দ্রীয় জাতীয় শাসনের তখন বাস্তব প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল। কবি দান্তের নিজ নগর ফ্লোরেন্স থেকে পোপ বিরোধী অভিমতের কারণে তাঁকে বহিস্কৃত হতে হয়। তাঁর এই নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনি অজর্ন করেন। এই অভিজ্ঞতাপ্রসূত তাঁর রাজনৈতিক অভিমত তিনি তাঁর রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘মনারকিয়া’ বা ‘রাজতন্ত্র’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন। সেকালের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বিভিন্ন যুক্তির পরিচয় থাকলেও এ গ্রন্থ একটি অগ্রসর চিন্তার বাহক হিসাবে কাজ করে। তখনো ইইরোপে বিগত রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে একটি সাম্রাজ্যের চিন্তা বিরাজ ককরত। অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপে এক সাম্রাজ্য এবং তার এক সম্রাট থাকবে। পোপের পক্ষের যুক্তি ছিল, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে রোমের পোপ হবেন এই সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র এবং ধর্মীয় ও জাগতিক সকল বিষয়ের শাসক। এক সাম্রাজ্যের প্রয়োজনের কথা কবি দান্তেও তাঁর ‘মনারকিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেন। কিন্তু জাগতিক ক্ষেত্রে পোপ নয়, রাষ্ট্রের শাসক ততা রাজা হবেন প্রধান –এই ছিল দান্তের অভিমত। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় আইন কানুন, বিধিবিধানের প্রভাব সত্ত্বেও ‘মনারকিয়া’র মধ্যে এইরূপ আধুনিক চিন্তারও প্রকাশ ঘটে যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ব্যক্তির মঙ্গল এবং রাষ্ট্রের পরিচালনাতে ব্যক্তিরও ভূমিকা থাকা আবশ্যক।

Darwin, Charles Rbbert: চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের অবিস্মরণীয় জীববিজ্ঞানী। জীবনের ঐতিহাসিক বিকাশবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাকৃতিক জগতের রহস্যভেদ করার প্রবল আগ্রহ চার্লস ডারউইন কিশোর বয়স থেকেই বোধ করতেন। জীবন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান লাভ করতে পারবেন মনে করে নিজের পাঠ্যকালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ্য হিসাবে নির্বাচন করে। এর পরবর্তীকালে চার্লস ডারউইনের জীবনের যুগান্তকারী ঘটনা হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকৃতির বিভিন্ন দিকে পর্যব্কেষণ ও গবেষনার জন্য ‘বিগল’ জাহাজকে বিশ্ব অভিযানে প্রেরণ এবং চার্লস ডারউইনকে উক্ত জাহাজে প্রকৃতি-বিজ্ঞানী হিসাবে নিয়োগ দান। ‘বিগল’-এর অভিযান ডারউইনের জীবনে অকল্পিত এক সুযোগ এনে দেয়। এ অভিযান ১৮৩১ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যণ্ত স্থায়ী হয়। এ অভিযানে ডারউইন পৃথিবীর এক প্রান্ত, দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ভাগের, তার অভ্যন্তরের, মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপের এবং পৃথিবীর অপর প্রান্ত নিউজিল্যাণ্ডের অসংখ্য জীব-জন্তুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। প্রাচীনকালের অনেক বৃহদাকার জন্তুর কঙ্কাল বা ফসিলও তাঁর পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে। সমস্ত জায়গা থেকে জীব-জন্তুর নানা প্রকার নমুনা তিনি সংগ্রহ করেন। এই সমস্ত জীব-জন্তুর সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য, তাদের গঠনের সরলতা-জটিলতা ইত্যাদির উপর গবেষণা করে চার্লস ডারউইন অবশেষে ১৮৫৯ সালে জীব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক গ্রহ্ণ ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ প্রকাশ করেন। তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য ছিল যে, পৃথিবীজে জীবনের যে বৈচিত্র্য রয়েছে সে বৈচিত্র্য কোনো একদিন একই সময়ে জগতে কোনো বিধাতা সৃষ্টি করে নি। জগতে জীবনের ক্ষেত্রে সতত পরিবর্তন চলছে। জীবনের গঠন জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। অতীতকালের অতিকায় জন্তু-জানোয়ারের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে, অথচ এসব প্রাণীর আজ অস্তিত্ব নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ডারউইন বললেন, জীবনের ক্ষেত্রে আদিকাল থেকে বাঁচার সংগ্রাম চলছে। প্রকৃতি-জগতে নানা পরিবর্তন সংঘটিত হয়। প্রাকৃতিক জগতের পরিবর্তন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে জীবন রক্ষা করার তাগিদ জীবমাত্রের মধ্যে স্বাভাবিক। এই প্রচেষ্টায় যারা বিফল হয়েছে তারা দেহে বিরাট হলেও জীবন রক্ষা করতে পারেনি এবং জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এই অভিমতের মূল তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, জীব-জগৎ সতত প্রবহমান পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজ থেকে জটিল হয়ে বিকাশ লাভ করেছে। এই তত্ত্বের পরিপূরক হিসাবে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মানুষের জন্ম এবং বিকাশ সম্পর্কে ডারউইন ‘ডেসেন্ট অব ম্যান’ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি দাবি করেন যে, মানুষের গঠনের সঙ্গে মনুষ্যেতর অনেক প্রাণীর সাদৃশ্য আছে। এ সাদৃশ্য থেকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মানুষ, মানুষের চেয়ে সহজতর গঠনের জীবন থেকে পরিবর্তনের চরম অবস্থায় বিকাশ লাভ করেছে। মানুষও ‘মানুষ’ হিসাবে কোনো ঊর্ধ্বলোক থেকে নিক্ষিপ্ত হয় নি। চার্লস ডারউইনের বিকাশবাদের এই তত্ত্বের তাৎপর্য বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য ছিল অপরিসীম। একটি বিরাট সামাজিক বিপ্লবের ন্যায় ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করে। কিন্তু বাস্তব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অন্ধ বিশ্বাসের উপর ক্রমে জয়ী হয়ে আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে জগতে যে সতত শক্তিতে শক্তিতে দ্বন্দ্ব চলছে এবং সেই দ্বন্দ্বের ভিত্তিতেই যে জীবন বিকাশ লাভ করে সে বিকাশে পরিবর্তন চরম আকার লাভ করে নতুন অস্তিত্বের সৃষ্টি করতে পারে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই তত্ত্বেরও স্বাভাবিক স্বীকৃতি লক্ষ করা যায়।

Decembrists: ডিসেম্বরপন্থী
১৮২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানকারীদের অনুসারীদের রুশ ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থী আখ্যায়িত করা হয়। রাশিয়ার জারের স্বৈরতন্ত্র এবং সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানকে রুশ ইতিহাসকারগণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচনা করেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ভি.আই. লেলিনের মতে রাজতন্ত্রের যুগে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থীদের স্থান অনন্য। ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের পরে। রুশ-ফরাসি যুদ্ধকালে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক অবস্থার সাক্ষাৎ পরিচয় লাভের সুযোগ পায়। ফলে উক্ত যুদ্ধের পরে রাশিয়ার অভ্যন্তরে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অধিকতর অনিবার্য রূপ লাভ করতে থাকে। সমাজের অভিজাত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিবাসীগণই সামরিক বাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাবোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক বাহিনীর এই সমস্ত অফিসার গুপ্ত সমিতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কিংবা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। প্রথম আলেকজাণ্ডর তখন রাশিয়ার সম্রাট। সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ তাঁর মৃত্যুকালে একটি অভ্যুত্থান মারফত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে। ১৮২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলেকজান্ডার মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বেশ পরিমাণ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এই অনিশ্চয়তার সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক বাহিনীর শাসনতন্ত্রবাদী অফিসারগণ ২৬ ডিসেম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেশে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং নিকোলাসের পরিবর্তে তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা কনস্টান্টাইনকে সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত করার দাবি জানায়। প্রথম আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পরে নিকোলাস সম্রাট হিসাবে অধিষ্টিত হন। সম্রাট নিকোলাস তাঁর অনুগত সাঁজোয়া বাহিনীর মারফত বিদ্রোহ দমন করে। সাঁজোয়া বাহিনীর আক্রমণে বহু অভ্যুত্থানকারী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়। জার সরকার ৫৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করে বিদ্রোহ হিসাবে বিচার করে। এদের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ৩১ জনকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এভাবে ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান পর্যুদস্ত হয়। ডিসেম্বর অভ্যুত্থান কেবল সামরিক বাহিনীর একটি অংশের আন্দোলন ছিল না। গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ তখন সমাজের বিভিন্ন অংশে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল। তখনকার রুশ সমাজের শিক্ষিত এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যাপকতম অংশ এই আন্দোলনে সমর্থন যোগাচ্ছিল। হারজেনের ন্যায় ইতিহাস-বিখ্যাত বিজ্ঞানীরও সমর্থন ছিল এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর। ডিসেম্বরপন্থী বলে তাই রুশ ইতিহাসে কেবল কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসারই পরিচিত নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম যুগের সমস্ত প্রগতিশীল অংশই এই নামে পরিচিত। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসাবে এই যুগের কবি-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-কর্মীদের মতামত রুশ ইতিহাসে আলোচিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বর আন্দোলনের অনেক সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকই সমাজ ও জীবনের ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী প্রগতিশীল মত পোষণ করতেন। হারজেন এবং তাঁর সাথীরা বস্তুকে প্রধান বলে বিবেচনা করতেন। চিন্তা মানুষের মস্তিষ্কেরই বিশেষ শক্তি, মন নামক অপর কোনো সত্তার নয়, এরূপ অভিমতও তাঁরা পোশষ করতেন। এঁদের অনেকে ধর্মকে শোষকের হাতে শোষণের অস্ত্র এবং শোষিতের সান্ত্বনার আশ্রয় বলে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিসেম্বরবাদীগণ বিপ্লবী ছিল না। তাদের অভ্যুত্থানের পেছনে ব্যাপক কোনো গণ-সংগঠন এবং গণ-ভিত্তি ছিল না। এ কারণে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান গণ-বিপ্লবে প্রসারিত না হয়ে সরকারের নিষ্পেষণযন্ত্রে সহজেই পর্যুদস্ত হয়ে যায়। কিন্তু পরাজিত হলেও ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান রাশিয়ার পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভূতভাবে প্রভাবান্বিত করেছে।

Declaration of Independence: স্বাধীনতার ঘোষণা
ইংল্যাণ্ডের শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার উপনিবেশসমূহ ১৭৭৬ সনে ৪ জুলাই তারিখে যে ঘোষণা দ্বারা স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করে তা ইতিহাসে স্বাধীনতার ঘোষণা তথা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা নামে খ্যাতি লাভ করেছে। ঘোষণাটির মধ্যে টমাস জেফারসন, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রভৃতি প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও রাজনীতিকগণ স্বাধীণতার যে যুক্তি উল্লেখ করেন সে যুক্তি মানুষের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার মৌলিক অধিকার তত্ত্বের তাৎপর্যে পূর্ণ। এই ঘোষণার মধ্যে দার্শনিক লকের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘টু ট্রিটিজেস অন সিভিল গভর্ণমেন্ট’ বা শাসনব্যবস্থার উপর দুটি নিবন্ধের গভীল প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘আমেরিকার তেরটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বসম্মত ঘোষণা’ শিরোনামে উচ্চারিত ঘোষণার মুখবন্ধে বলা হয়: ইতিহাসের গতিপথে যখন একটি জনসমষ্টির জন্য অনিবার্যরূপে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অপর একটি জনসমষ্টির সঙ্গে ছেদন করে প্রকৃতি এবং বিধির প্রদত্ত মানুষের সার্বভৌম এবং সমঅধিকারকে স্থাপন করার, তখন সেই সম্পর্ক ছেদনের যুক্তিকে প্রকাশিত করারও প্রয়োজন উপস্থিত হয়। সেই প্রয়োজনের বোধ থেকে আমরা ঘোষণা করছি পৃথিবীর সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান। এবং বিধাতা কতিপয় অবিচ্ছেদ্য অধিকারে ভূষিত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এবং এই অধিকারের অন্তর্গত হচ্ছে জীবন, স্বাধীণতা এবং সুখের অর্জন। মানুষের জীবন, স্বাধীণতা এবং সুখের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য গঠিত হয় সরকার। এবং এই সরকার তথা শাসকের ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রের শাসিত তথা জনসাধারণ। এবং সেই কারণেই যখন কোনো সরকার শাসিতের এই মৌলিক অধিকারসমূহের ধ্বংসকারী হয়ে দাঁঢ়ায় তখন জনসাধারণের অধিকার থাকে সেই সরকারকে বিলুপ্ত কিংবা পরিবর্তিত করে নতুন সরকার গঠিত করার।
আমেরিকার স্বাধীণতার ঘোষণাপত্র ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাবিদদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখনও যুক্তরাষ্ট্রে ৪ জুলাইকে সাধারণ ছুটির মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার দিবস হিসাবে পালন করা হয়।

Deduction: সিদ্ধান্ত, অনুমান, অবরোহ
এক কিংবা একাধিত প্রতিজ্ঞা বা যৌক্তিক দত্তবাক্য থেকে তাদের অন্তর্নিহিত সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো অনুমান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ইংরেজীতে ডিডাকশান বলে। দূরে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে; মনে হয় ওখানে আগুণ লেগেছে। এখানে ‘আগুণ লেগেছে’ এ সিদ্ধান্তটি ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এই দত্ত সত্যের ভিত্তিতে গৃহীত অনুমান। অনুমানকে যুক্তিশাস্ত্রে সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। কোনো সার্বিক বা সাধারণ সত্য থেকে কোনো বিশেষ সত্যের অনুমানকে অবরোহী অনুমান এবং বিশেষ সত্যের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণ বা সার্বিক সত্যে পৌঁছাকে আরোহী অনুমান বলা হয়। এই বিবাগ অনুযায়ী ‘সকল মানুষ মরণশীল; সক্রেটিস একজন মানুষ সুতরাং সক্রেটিসও মরণশীল’, এই পদ্ধতিটিকে আরোহী অনুমান এবং ‘রাম মরেছে, রহিম মরেছে, করিম করেছে, সুতরাং সকল মানুষ মরবে বা সকল মানুষ মরণশীল’, এই দৃষ্টান্তটিকে একটি আরোহী অনুমানের দৃষ্টান্ত বলা হয়। উপরোক্ত বিভাগ থেকে মনে হতে পারে যে, অবরোহী ও আরোহী অনুমান পরস্পর পৃথক এবং আরোহী অনুমানই কেবল বৈজ্ঞানিক এবং অভিজ্ঞতা-সিদ্ধ অনুমান, অবরোহী অনুমান অভিজ্ঞতাভিত্তিক অনুমান নয়। কিন্তু আবরোহী এবং আরোহী অনুমানের এরূপ ব্যাখ্যা ঠিক নয়। আরোহী এবং অবরোহী অনুমান পরস্পর নির্ভরশীল এবং সংযুক্ত। যুগব্যাপী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা দ্বারাই বিশেষকে ব্যাখ্যা করি; বিশেষ সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানলাভ করি। বিশেষের ভিত্তিতে নির্বিশেষে জ্ঞান লাভ এবং নির্বিশেষের প্রয়োগে বিশেষের অনুধাবন –জ্ঞানের এই দ্বিবিধ প্রক্রিয়া আদিকাল থেকেই মানুষ অনুসরণ করে আসছে। তবে এ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ প্রথমে বিস্তারিতভাবে করেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের কতকগুলি সূত্র ব্যাখ্যা করেন। এগুলিকে যুক্তিশাস্ত্রের এ্যারিস্টটলীয় বিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ বিধানগুল প্রধানত অবরোহী অনুমানের বিধান। এ জন্য অবরোহী অনুমানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এ্যারিস্টটলকে উল্লেখ করা হয়। অবরোহী অনুমানের সঠিকতা নির্ভর করে দত্ত সত্যের সঙ্গে অনুমিত সত্যের অন্তর্নিহিত সংযোগের উপর। দত্তবাক্য বা সত্যগুলি যদি পরস্পর সম্পর্কিত না হয় তা হলে তা থেকে কোনো সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে না। এ নিয়মের অপর একটি তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, অবরোহী অনুমানে দত্তবাক্য বা অনুমিত বাক্যের বাস্তব যথার্থতা বিচার্য বিষয় নয়। অবরোহী অনুমানের বিচার্য বিষয় হচ্ছে প্রতিজ্ঞা বা দত্তবাক্য যা আছে (সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন), তার ভিত্তিতে অনুমিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে কিনা। এ নিয়মে ‘সকল মানুষ অমর’ এ দত্তবাক্য থেকে ‘রহিম একজন মানুষ, সুতরাং রহিমও অমর’, এ সিদ্ধান্তে আমরা গ্রহণ করতে পারি। গ্রিসের ন্যায় ভারতীয় উপমহাদেশের অনুমান শাস্ত্রও অতি প্রাচীন। গ্রীক বৈজ্ঞানিক ইউক্লিডের জ্যামিতি অবরোহী অনুমানের প্রাচীন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টান্ত। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে কিছু সংখ্যক আধুনিক দার্শনিক ‘আঙ্কিক অনুমানের’ বিশ্লেষণ দ্বারা অনুমানের ক্ষেত্রে নতুনতর বিকাশ সাধন করেছেন।

Definition: সংজ্ঞা
ইংরেজী ‘ডেফিনিশন’ শব্দটি ল্যাটিন ‘ডিফিনিশিও’ শব্দ থেকে উদ্ভুত। ‘ডেফিনিশিও’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করা। যে বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে একটি বিষয় আর সেই বিষয় বলে পরিচিত হতে পারে না, কেবলমাত্র সেই বৈশিষ্ট্যই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে- অপর কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের জীবনে সংজ্ঞার আবশ্যকতা সমধিক। সংজ্ঞা একটি সংকেত বিশেষ। সংজ্ঞা দ্বারা আমরা নির্দিষ্ট বিষয়কে স্মরণ রাখি। বস্তুপুঞ্জকে সংজ্ঞা দ্বারা শ্রেণীবিভক্ত করি। সংজ্ঞাকরণের ক্ষমতা মানুষের জ্ঞানের বিকাশের একটি উন্নত স্তরের পরিচায়ক। মানুষ যখন তার মস্তিষ্ক দ্বারা বিশেষকে পর্যবেক্ষণ করে বিশেষে বিশেষে সম্ভব হয়েছে। সংজ্ঞাকরণের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ প্রথমে এ্যারিস্টটল করেছেন বলে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়। এ্যারিস্টটল সংজ্ঞাকরণের বিধান নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে, সংজ্ঞাকরণের অর্থ হচ্ছে, সংজ্ঞেয় পদের জাতি এবং সহজাতির সঙ্গে তার পার্থক্যসূচক গুণের নির্দেশ করা। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি মানুষকে ‘যুক্তিবাদী জীব’ বলে উল্লেখ করেছেন। মানুষ জীবের অন্তর্গত। অর্থাৎ জীব বা জন্তু হচ্ছে মানুষের জাতি এবং যুক্তিবাদিতা হচ্ছে তার সহজাতি কুকুর-বিড়াল ইত্যাদি পশুর সঙ্গে তার পার্থক্যসূচক গুণ। এই বিধান অনুযায়ী ব্যক্তিবাচক কোনো পদের সংজ্ঞা সম্ভব নয়। রহিম একটি ব্যক্তিবাচক পদ। একটি নাম। রহিম মানুষ হলে তাকে একজন মানুষ বলা যায় বটে –কিন্তু তাতে তার বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। যে বিশেষ গুণে রহিম করিম কিংবা যাদব নয়, যে গুণ রহিমকে একজন মানুষ বললেই স্পষ্ট হয় না। এ জন্য বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুর কোনো যৌক্তিক সংজ্ঞা হতে পারে না। সংজ্ঞা হতে পারে কেবলমাত্র জাতিবাচক পদের। কিন্তু যে জাতি পরিধিতে ব্যাপকতম কিংবা চরম, তারও সংজ্ঞা চলে না। কেননা চরম জাতিকে অপর কোনো বৃহত্তর জাতির অন্তর্ভুক্ত করে পরিচিত করা চলে না। মানুষকে জন্তুর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। জন্তুকে প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত করে পরিচিত করা চলে না। তাই এ্যারিস্টটলের বিধান অনুযায়ী চরম জাতি এবং ব্য্কিত বা বস্তুবিশেষের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।

Deism: ঈশ্বরবাদ
সৃষ্টির আদি কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস। এটি একটি দার্শনিক তত্ত্ব। ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য আছে। ধর্মীয় ঈশ্বর কেবল আদি স্রষ্টা নন। তিনি তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট প্রত্যাদেশ মারফত তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করেন। তিনি সৃষ্টির ধারক, বাহক, প্রতিপালক এবং বিচারক। দয়া-মায়া, কঠোরতা বিভিন্ন গুণে তিনি গুণান্বিত বলে মানুষ কল্পনা করে। তিনি সর্বশক্তিমান। এই প্রচলিত ধর্মীয় ঈশ্বরবাদের পরিবর্তে ইংল্যাণ্ডের হার্বার্ট (১৫৮৩-১৬৩৮ খ্রি.) দার্শনিক ঈশ্বরবাদের ব্যাখ্যা তৈরী করেন। দার্শনিক ঈশ্বরবাদের মতে সৃষ্টির আদি কারণ হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু ধর্মীয় ঈশ্বর এবং সৃষ্টির আদি কারণরূপ ঈশ্বর এক নয়। দার্শনিক ঈশ্বর বিশ্বজগতের আদি কারণ মাত্র। তিনি জগতের সর্বকালের ধারক, বাহক কিংবা নিয়ন্তা নন। সৃষ্ট হওয়ার পরে সৃষ্টির সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ব জগৎ তার আপন বিধান অনুযায়ী চলছে, ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী নয়। দার্শনিক ঈশ্বরবাদের প্রচারকালে এর একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। প্রচলিত অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস-বিজ্ঞানের বিকাশে প্রতিবন্ধকতার কাজ করছিল। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের স্বীকৃতিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এরূপ অবস্থায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিশ্বাস জাগতিক জ্ঞানের বিকাশে যাতে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকতে না পারে, সে জন্যই হার্বার্ট দার্শনিক ঈশ্বর তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। ঈশ্বরকে সামাজিকভাবে অস্বীকার করা চলে না, আবার ঈশ্বরকে জ্ঞানের পথে দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় করেও রাখা যায় না –দার্শনিক ঈশ্বরবাদ এই মানসিকতা থেকেই উদ্ভুত। এ তত্ত্ব অনুযায়ী যুক্তির মাধ্যমেই ইশ্বরকে স্বীকার করা যায়। আবার যুক্তিগতভাবে এও স্বীকার করতে হয় যে, আদি কারণের অধিক কিছুর জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন নায়। এভাবে ঈশ্বর ও বিজ্ঞান উভয়কে রক্ষা করা সম্ভব বলে শুধু হার্বার্ট নন, তাঁর পরবর্তী ভলটেয়ার, রুশো, লক, নিউটন, অনেক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এই যুগে এই অভিমত পোষণ করেছিলেন। আধুনিককালে ধর্মীয় ঈশ্বরবাদ এবং দার্শনিক ঈশ্বরবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ই মূলত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী তত্ত্ব বলে পরিচিত।

Democracy: গণতন্ত্র
আধুনিক রাষ্ট্রমাত্রেরই শাসন বা পরিচালব্যবস্থার আরাধ্য পদ্ধতি হচ্ছে গণতন্ত্র। শব্দগতভাবেও গণের তন্ত্র বা ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। যে শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে গণতন্ত্র বলে। আধুনিক শাসনব্যবস্থার প্রধান রূপ গণতন্ত্র হলেও, গণতন্ত্র কেবল আধুনিক সভ্যতারই অবদান এমন কথা বলা যায় না। সীমিতভাবে হলেও, প্রাচীন নগর রাষ্ট্র এথেন্সের অ-দাস বা প্রভুশ্রেণীর অধিবাসীরা প্রত্যক্ষ সভা সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করত বলে জানা যায়। গ্রিক শব্দ ‘ডেমস’ বা ‘সাধারণ’ থেকে ইংরেজী ‘ডিমোক্রাসী’ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বলে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করেন। এথেন্সের রাষ্ট্র পরিচালনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সাধারণ নাগরিকদের গণসম্মেলন বা একলেসিয়াতে গৃহীত হতো বলে প্রাচীন এথেন্সের গণতন্ত্রকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং আধুনিকখালের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পারিচালিত ব্যবস্থাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়।
প্রতিনিধিত্বমূলক আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ইউরোপে। ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সে প্রথমে সামন্তবাদ এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন লড়াই এবং সংগ্রামের শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিদ্যমান প্রধান অর্থনৈতিক বা উৎপাদনব্যবস্থার স্বার্থসাধকারী পরিচালন বা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যাণ্ডের সপ্তদশ শতকের এবং ফ্রান্সের অষ্টাদশ শতকের বিপ্লবসমূহের মধ্যে সেকালের উদীয়মান নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা পণ্য উৎপাদনকারী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাহিদারই প্রকাশ ঘটেছিল। এজন্য এই বিপ্লবসমূহকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাহিদারই প্রকাশ ঘটেছিল। এজন্য এই বিপ্লবসমূহকে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। এই নতুন শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রাপ্ত বয়স্কদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা বা পার্লামেণ্টের গঠন এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পরিচালনায় দেশের শাসন। শাসনব্যবস্থার এই কাঠামোগত রূপ একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা –প্রভৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এর মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহের রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন পরিচালনায় ব্যাপকতর জনসাধারণের চেতনা ও শক্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায় বলে কায়েমী স্বার্থ ও সংকীর্ণ চিন্তার বাহক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীর মুখপাত্র হিসাবে অনেক সময়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নাকচ করে সামরিক-চক্র শাসন কায়েক করেছে। অবশ্য এমন সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের এই অজুহাতটি উল্লেখযোগ্য যে প্রায়শ এরা বলে থাকে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে কিংবা দেশ গণতন্ত্রের উপযুক্ত হয় নি কিংবা দেশে আর্থিক ও আইন শৃঙ্খলার সংকট তীব্র হয়েছে, সে কারণে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় এরা বাধ্য হয়েছে এবং পরিণামে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হবে। অর্থাৎ সামরিক শাসকরাও গণতন্ত্রকে চূড়ান্তরূপে নাকচ করে দিবার ক্ষমতা রাখে না।
আধুনিক কালের রাজনৈতিক আলোচনায় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি আবার ব্যাখ্যামূলকভাবেও ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে আজ দুটি প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। এদের একটি ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। অপরটি হচ্ছে যৌথ বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই দুই ব্যবস্থার মুখপাত্রগণ সাধারণত প্রতিপক্ষীয় ব্যবস্থার পরিচালন বা শাসনকে যথার্থ গণতন্ত্র বলে স্বীকার করতে চায় না। মার্কসবাদীগণ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের প্রধান তথা পুঁজিবাদী শ্রেণীর শাসন বলে অভিহিত করে; সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জগণের গণতান্ত্রিক শাসন নয়। বিপরীতভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থকরা সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনব্যবস্থাকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা দলের ডিক্টেটরশীপ বলে অভিহিত করে থাকে। এরূপ বিতর্কের একটি তাৎপর্য এই যে, গণতন্ত্র যেমন একটি শাসনব্যবস্থা, তেমনি একটি আরাধ্য আদর্শও বটে। এ কারণে এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে অপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ‘গণতন্ত্র’ দ্বারা হুবহু অভিন্ন কোন শাসনব্যবস্থা বা কাঠামোকে বুঝান সম্ভব নয়।

Democratic Centralism: গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা
কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালন ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনীতি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং তত্ত্ব। ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা’ শব্দগতভাবে পরস্পর বিরোধী বলে বোধ হতে পারে। গণতান্ত্রিক বললে কেন্দ্রীকতা বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ববিহীন একটি অবস্থা, আবার কেন্দ্রীকতা বললে গণতন্ত্রের অভাব মনে হয়। আসলে নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিকতা উভয়ই সঙ্গতিবিহীন সমাজ। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ প্রবল শ্রেণীল নেতৃত্ব এবং শাসনে পরিচালিত হয়। সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের সে সমাজে যথার্থ গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক উদ্যোগ থাকে না। শাসক এবং প্রবল শ্রেণীর কেন্দ্রীকতাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক কথা শ্রেণীহীন সমাজে একদিকে যেখানে সমাজের সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন, তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষের সচেতন এবং সম্মতিসূচক অংশগ্রহণও আবশ্যক। এবং এ কারণেই কেন্দ্রীকতা এবং গণতন্ত্রের ভারসাম্য এবং সমন্বয় অপরিহার্য। এর যে-কোন একটি ব্যত্যয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নানা বিচ্যুতি এবং সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। এ দুটি উপাদানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি যেমন উপলব্ধি করা আবশ্যক, তেমনি বাস্তব জীবনে উভয়ের প্রয়োগের চেষ্টা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদীগণ লেনিনের এরূপ উক্তির উল্লেখ করেন যেখানে লেনিন বলেছেন “গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তর এবং ক্ষেত্রের উদ্যোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং পরিচালনাকে সংযুক্ত করে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি এবং বিকাশকে সম্ভব করে’।

Democritus: ডিমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত বস্তুবাদী দার্শনিক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের প্রথম বিশ্বজ্ঞানী হিসাবেও ডিমোক্রিটাস স্মরণীয়। পদার্থবিদ্যা, মনোবিদ্যা, ন্যায়, গণিত, চিকিৎসা, কৃষি, চিত্রশিল্প, সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র এবং সামরিক কৌশল –এরূপ বিচিত্র বিষয়ের উপর ২৯০ টি পুস্তক বা পুস্তকাংশ ডিমোক্রিটাস রচনা করেছিলেন বলে গবেষকগণ মনে করে। বিজ্ঞান ও দর্শনের সর্বপ্রথম বিশ্ব জগতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা লাভ করি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টির মূল শক্তি হচ্ছে অণুর এবং মহাশূন্যতা। অসংখ্য মৌলিক অণু মহাশূন্যতার মধ্যে নিরন্তর আবর্তিত হচ্ছে। এই আবর্তনের অণুতে অণুতে সংঘর্ষ ঘটছে; মহাশূন্যতার মধ্যে সংযোগও সাধিত হচ্ছে। এই সংঘর্ষ এবং সংযোগের মাধ্যমে সৃষ্ট হচ্ছে সমস্ত রকম বস্তুপুঞ্জ। বস্তুর সৃষ্টির পেছনে আবর্তিত অণু ব্যতীত ঈশ্বর বা অণুর অতীত অপর কোনো সত্তা নেই। সংযুক্ত অণুর বিয়োজনে সৃষ্ট বস্তুর ধ্বংস। অণুর নতুনতর সংযোগে ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তু আবার নতুনতন বস্তুরূপে সৃষ্ট হয়। অণুর মধ্যেই অণুর গতি। অণুর সঙ্গে অণুর পার্থক্য শুধু আকারে, অবস্থানে এবং পারস্পরিক সংযোগের প্রকারে। রঙ, স্বাদ কিংবা এরূপ অপর কোনো গুণ অণুর মধ্যে নেই। এ সমস্ত গুণ অণুর জটিল সংযোগক্রমে বস্তুর মধ্যে সৃষ্ট হয়। বিশ্ব চরাচরে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা অনুর কারণে অনিবার্যভাবে সংঘটিত হচ্ছে। বস্তুজগতে কারণহীনতা বলে কিছু নেই। আমাদের অজ্ঞানতা থেকেই আকস্মিকতা বা কারণহীনতার বিশ্বাস জন্মে। মানুষ আত্মাকে অ-বস্তু মনে করে। কিন্তু আত্মাও অণুর সংযোগ ফল। এ কারণে আত্মাও বস্তু, অ-বস্তু নয়। অণুর বিয়োজননে দেহের মৃত্যুর সঙ্গে আত্মারও মৃত্যু ঘটে। আত্মার অমরতা অযৌক্তিক কথা। বস্তুজগতের বাইরে দেবতাদেরও অপর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেবতাদের অস্তিত্ব থাকলে তারাও জন্ম-মৃত্যুর নিয়মে আবদ্ধ। দেবতাদের অস্তিত্বের যে বিশ্বাস সাধারণ মানুষ পোষণ করে, তার মূলে রয়েছে ধূমকেতু, ভূমিকম্প, উল্কাপাত, লাভার উদগীরণ ইত্যাকার বৃহৎ বৃহৎ প্রকৃতির ঘটনাপুঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও ভীতি। তৎকালীন দাসভিত্তিক অভিজাততন্ত্রের সামাজিক ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন ডেমোক্রিটাস। ডিমোক্রিটাসের বস্তুবাদের তত্ত্বকে আমরা পরবর্তী গ্রিক দার্শনিক এপিকুরাস এবং রোমান দার্শনিক লিউক্রেটিসারে বস্তুবাদের তত্ত্বকে আমরা পরবর্তী গ্রিক দার্শনিক এপিকুরাস এবং রোমান দার্শনিক লিউক্রেটিয়াসের মধ্যে অনুসৃত হতে দেখি।

Derozio: হেনরি ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.)
উনিশ শতকে বঙ্গে ইংরেজী শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে, বিশেষ করে কলকাতায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং মুক্তবুদ্ধির প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে নবজাগরণ সূচিত হয় তার অন্যতম প্রাণপুরুষরূপে স্মরণীয় হচ্ছেন হেনরি ডিরোজিও। ডিরোজিও এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু নিজেকে তিনি ভারতীয় বলে দাবি করতেন এবং বাংলার মণীষীগণও তাঁকে বাঙালীবলে গর্ববোধ করেন। মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে তিনি আকস্মিকবাবে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। কিন্তু তাঁর এই স্বল্পকালের জীবনও মহৎ কর্ম এবং বিচিত্র উদ্যোগে এরূপ পূর্ণ ছিল যে, সে জীবনের স্মরণে উত্তর কালের মন শ্রদ্ধা এবং বিস্ময়ে ভরে ওঠে। ডিরোজিও ‘ইতিহাস, দর্শণ এবং ইংরেজী সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন’। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত এবং যুক্তিবাদী। ১৮২৬ সনে তিনি হিন্দু কলেজে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। তাঁর চারিত্রিক উদারতা এবং সাহসন,ন সংস্কার-মুক্ত মন এবং জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর দখল তাঁকে তাঁর ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষকে পরিণত করে। তাঁর গৃহে ছিল ছাত্রদের অবাধ অধিকার। যুগের বিচারে নিষিদ্ধ দ্রব্য এবং চিন্তা উভয়েরই ছিল তাঁর গৃহে তাঁর তরুণ ছাত্রদের আপ্যায়নের উপাদান। তিনি তাঁর ছাত্রদের প্রচলিত সকল রকম সামাজিক, ধর্মীয় এবং বুদ্ধিগত সংকীর্ণতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত করে তুলতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত বিতর্ক এবং আলোচনা সমিতি বা সভাসমূহ যে যুদের কলকাতারবিদ্বৎ মহলের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ডিরোজিওর শিষ্যদের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বলা হতো। ডিরোজিও তরুণদের মধ্যে এরূপ বিদ্রোহের ভাব সৃষ্টি করাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন এবং প্রাচীনপন্থীদের বিরোধিতার কারণে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষকতা থেকে ১৮৩১ সনের এপ্রিল মাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং এই সনেই ১ জুন তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। (দ্র. সংসদ বাঙালি চিরতাভিধানঃ গোপাল হালদার: বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা।)

Descartes, Rene: দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রি.)
সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও গণিতশাস্ত্রবিদ বিজ্ঞানী। কর্মজীবনের দেকার্ত প্রতমে স্বদেশের সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত করেন এবং সেখানে প্রায় বিশ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিনি দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চা করেন। তাঁর বৈজ্ঞাননিক মতামতের জন্য হল্যাণ্ডের গোঁড়া ধর্মযাজকদের হাতে তাঁকে নানাপ্রকার নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। তাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য দেকার্ত অবশেষে সুইডেনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সুইডেনেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যামিতি এবং মেকানিক্স বা বলবিদ্যার ক্ষেত্রে দেকার্ত গতি এবং স্তিতির আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ম আবিস্কার করেন। সৌরজগতের সৃষ্টি সম্পর্কে বস্তুবাদী মত তখনো আশ্রুত। এ ক্ষেত্রেও দেকার্ত বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেবার প্রয়াস পান। বস্তুর ব্যাখ্যায় দেকার্ত এরূপ মত পোষণ করতেন যে, বস্তুর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার স্থানভিত্তিক বিস্তার। বস্তুর বিভিন্ন গুণের মধ্যে বিস্তারের ক্ষেত্রে বস্তু অনন্যনির্ভর। অর্থাৎ বস্তুর স্বাদ, গন্ধ, রঙ ইত্যাকার অন্যান্য গুণ মানুষের মনের উপর নির্ভরশীল হলেও বস্তুর বিস্তার মনের উপর নির্ভর করে না। দেকার্তের বস্তুবাদ অবিমিশ্র নয়। বস্তুর অস্তিত্ব যেমন তিনি স্বীকার করেছেন, তেমনি বস্তুর গতির প্রশ্নে তিনি ভাববাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে বস্তুর গতির আদি কারণ হচ্ছে ঈশ্বর। ঈশ্বর গতি ও স্থিতি উভয়ই বস্তুর মধ্যে তৈরী করেন এবং গতি ও স্থিতির পরিমাণের অপরিবর্তনীয়তাও তিনি রক্ষা করেন। দেকার্তের এ মতবাদকে দ্বৈতবাদ বলা যায়। মানুষের দেহ এবং মনের ব্যাখ্যায়ও দেকার্ত দ্বৈতবাদী। মানুষ হচ্ছে দেহ এবং মনের সম্মিলিত সংগঠন। দেহ হচ্ছে মনহীন বস্তু আর মন হচ্ছে বস্তুহীন সত্তা। দেহ আর মন চরিত্রগতভাবে পরস্পর বিরোধী। এই দুই বিরোধী সত্তা পাইনিয়াল গ্লাণ্ড নামক একটি তন্ত্রীয় মাধ্যমে মিলিত হয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। বেকনের ন্যায় দেকার্তও প্রকৃতির কার্যকারণ জ্ঞাত হয়ে প্রকৃতিকে জয় করা এবং মানুষের চরিত্রকে উন্নত করাই জ্ঞানের উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। সঠিক জ্ঞানলাভের কি পদ্ধতি হবে? এর জবাবে দেকার্ত তাঁর বিখ্যাত সন্দেহবাদের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভের জন্য এমন একটি ভিত্তি থেকে শুরু করতে হবে, যে ভিত্তি সর্বপ্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে। যে সূত্র সন্দেহযোগ্য তার মাধ্যমে সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে দেকার্ত প্রচলিত সমস্ত সূত্রের উপর সন্দেহ পোষণ করতে করতে ‘আমার নিজের অস্তিত্ব সন্দেহের ঊর্ধ্বে’ বা ‘কাজিটো আরগোসাম’ –এই সিদ্ধান্তে আসেন। ব্যক্তি সব কিছুতেই সন্দেহ করতে পারে, কিন্তু সে নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহ করতে পারে না। এ তত্ত্বের একটি অজ্ঞেয়বাদী তাৎপর্য আছে। কিন্তু দেকার্ত অজ্ঞেয়বাদী না হয়ে নিজের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, নিজের অস্তিত্ব সন্দেহাতীত, এই সূত্রকে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে গ্রহণ করে আমরা জগতের সুনিশ্চিত জ্ঞানমণ্ডল আবার তৈরী করতে পারি। দেকার্তের এই জ্ঞানতত্ত্ব সাধারণত র‌্যাশনালিজম বা যুক্তিতত্ব নামে পরিচিত। তাঁর মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বের মতো আরো কতকগুলি জন্মগত সুনিশ্চিত সূত্রগুলি ঈশ্বর মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে দেন। ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে এ সূত্রগুলি সন্দেহাতীত এবং সন্দেহাতীত সূত্রের ভিত্তিতে যুক্তি পরম্পরায় লব্ধ যে-কোন জ্ঞান সঠিক হতে বাধ্য। দেকার্ত তাঁর দর্শনে ও চিন্তায় যথার্থই দ্বৈতবাদী ছিলেন। এ কারণে একদিকে বস্তুবাদী মত দ্বারা তিনি যেমন গোঁড়ামীর বেড়াজাল বেঙে চিন্তার মুক্তিকে সাহায্য করেছেন, তেমনি অপরদিকে অতি-প্রাকৃতিক অস্তিত্বে জ্ঞানের মূল স্থাপন করে তিনি ইউরোপের আধুনিক দর্শনে ভাববাদী ধারারও প্রবর্তন করেন।

Determinism, Indeterminism: নির্ধারণবাদ, অনির্ধারণবাদ
জীবন ও জগতের সবকিছুই কার্যকারণের বিধান দ্বারা নির্ধারিত, এ তত্ত্বকে নির্ধরণবাদ বলা হয়। এর বিপরীতে, কোনো কিছুই কিছুর দ্বারা নির্ধারিত নয় কিংবা কোনো ঘটনা বা কার্য কিসের দ্বারা নির্ধারিত, তা ঈশ্বর বাদে কেউ জানে না এবং সে কারণে কোনো কিছু পূর্ব নির্ধারিত একথা মানুষ বলতে পারে না, এই বিশ্বাসকে অনির্ধারণবাদ বলা হয়। নির্ধারণবাদ এবং অনির্ধারণবাদ অনিবার্যতা এবং স্বাধীনতা কথাটিরই আর এক প্রকাশ। (দ্র. Freedom and Necessity: স্বাধীনতা এব অনিবার্যতা)।

Dewey, John: জন ডিউন (১৮৫৯-১৯৫২ খ্রি.)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ জন ডিউইকে আমেরিকান প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। তিনি তাঁর এই দর্শনে এই অভিমতের উপর জোর দেন যে, কোনো ভাবের যথার্থতার মাপকাঠি হচ্ছে বাস্তব জীবনে তাঁর প্রত্যাশিত ফল পাওয়া, না-পাওয়া। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে কোনো বাব বা তত্ত্ব ফলদায়ক না হলে সে তত্ত্বের কোনো মূল্য নেই। চিকাগোতে তিনি তার চিন্তাধারার পরীক্ষাগার হিসাবে শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার বিষয়ে তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘দি স্কুল এ্যাণ্ড সোসাইটি’, ‘দি চাইলড এ্যাণ্ড দি কারিকুলাম’ এবং ‘হাউ ইউ থিঙ্ক’। ‘ডিমোক্রসি এ্যাণ্ড এডুকেশন’ তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এর প্রকাশকাল ১৯১৬। শিক্ষার সমস্যার উপর রচিত তাঁর গ্রন্থসমূহে ডিউই শিশুদের শিক্ষাকে সমাজের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত করা, কর্মের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রদান, খেলাধুলার সঙ্গে শিক্ষার যোগ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত অভিমতসমূহকে প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বারা সমাজকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের প্রজ্ঞার যৌথ সম্মিলন ও প্রয়োগের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

Dhirendranath Datta: ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) ১৯৪৮ সনের ২৩শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার প্রন্তটি উত্থাপন করেছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনই। তিনি পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য ছিলেন। উর্দু এবং ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বলেই ১৯৪৮ সন থেকেই তিনি পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টির পাহারায় ছিলেন। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অকথ্য নির্যাতনের পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাই ধীরেন্ত্রনাথ দত্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ: এ কথা ইতিহাসগতভাবে উল্লেখ করার দাবী রাখে।

Dialectics: দ্বন্দ্ব, দ্বান্দ্বিকতা

Dialectical Materialism: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
প্রাকৃতিক জগৎ, মানুষের সমাজ এবং চিন্তার ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল বিধানসমূহের পরিচায় জ্ঞাপক তত্ত্ব। ইংরেজী ‘ডায়ালেটিকস’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘ডায়ালোগ’ থেকে উদ্ভুত। গ্রিক দর্শনে ডায়ালোগ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সমাধান সন্ধানের পদ্ধতিকে গ্রিক দার্শনিকরা ডায়ালোগ বলতেন। প্রশ্ন, উত্তর বা পাল্টা প্রশ্নের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের অবস্থা বিরাজমান। এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাধানের পৌঁছার প্রক্রিয়ায় একটা গতির আভাসও বিদ্যমান। বস্তুদ দ্বন্দ্ব, পরিবর্তন, গতি, এ কথাগুলি পরস্পরের ইঙ্গিতসূচক। যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে পরিবর্তন ও গতি আছে। প্রাচীন গ্রিসের একাধিক বস্তুবাদী দার্শনিক জগৎ সম্পর্কে তাঁদের ব্যাখ্যায় এই দ্বন্দ্ব গতি ও পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন। প্লেটো ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক হলেও তাঁর সংলাপসমূহ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির উত্তম দৃষ্টান্ত। দ্বন্দ্ব কেবল প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে নয়। তার সংলাপে এরূপ আবাবসও পাওয়া যায় যে, ‘ভাব’ বা চরম যে সত্তা তাকেও নির্দ্বান্দ্বিকভাবে সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যায় না। চরম সত্তা একদিক দিয়ে যেমন অস্তিত্ব, তেমনি অপর দিক দিয়ে সে অনস্তিত্ব, একদিকে সে যেমন নিজে যা তাই, তেমনি সে নিজে যা নয় তা-ও বটে। সে অপরিবর্তনীয়, আবার পরিবর্তনীয়। যে-কোনো অস্তিত্বের আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্বকে অস্তিত্বের মূল বলে স্বীকৃতিদাব এবং জগৎ, সমাজ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ব্যাপকতম প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিককালে মার্কসীয় দার্শনিকদের দ্বারা। এ দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বিখ্যাত। মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিকতার পূর্ণতম ব্যাখ্যা হেগেল-এর দর্শনে ঘটেছে বলে মনে করেন। তাঁদের মতে প্রাচীন দর্শনের পর হেগেলই সুস্পষ্টভাবে দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রকাশ করেছেন। হেগেলের মতে আমাদের চিন্তাই যে কেবল অস্তি, নাস্তি এবং নাস্তির নাস্তিত্বের মাধ্যমে নতুনতর অস্তির উদ্ভবের প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় তাই নয়, চরম সত্তাও অনুরূপ অস্তি ও নাস্তির দ্বন্দ্বের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে সৃষ্টি করে চলে। মার্কস এবং এঙ্গেলস হেগেলের দ্বান্দ্বিক গতিকে স্বীকার করেছেন, অপর দিকে তেমনি চরম সত্তাকে ভাব বরে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কাছে বস্তু চরম ভাবের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়ার প্রকাশবিশেষ, বস্তু চরম সত্তা নয়। মার্কস এঙ্গেলস হেগেলের ক্রিয়াশীল তেমনি চরম সত্তা হচ্ছে বস্তু, ভাব নয়। ভাব হচ্ছে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ক্রিয়াশীল বস্তুরই বিকাশবিশেষ। এদিক দিয়ে মার্কসবাদ হেগেলের দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিপক্ষ। কাজেই হেগেলীয় ডায়ালেকটিকস বা দ্বান্দ্বিকতা বস্তুর ক্রিয়াশীলতা এবং জ্ঞানের ক্রিয়াশীলতাকে একই সূত্রে আবদ্ধ করেছে। বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করা যায়: বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ম বিদ্যমান। দ্বন্দ্ব থেকে গতির সঞ্চার। দ্বন্দ্বহীন এবং গতিহীন কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই। দ্বন্দ্বমূলক গতিকে একটা বিশেষ অবস্থা থেকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, একটা বিশেষ অবস্থাকে যদি ‘অস্তি’ বলে বিবেচনা করা যায়, তা হলে দ্বন্দ্ব এবং গতির কারণে কালক্রমে ‘অস্তি’ নাস্তির সৃষ্টি করে, অস্তি ও নস্তির সংগ্রামে আবার কালক্রমে নতুনবাবে অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় যার মধ্যে অস্তি ও নাস্তির অভিনব এবং উন্নততর সম্মেলন সংঘটিত হয়। ইংরেজীতে এই তিনটি অবস্থা ‘থিসিস’, ‘এ্যান্টিথিসিস’ এবং ‘সিনথেসিস’ বলে পরিচিত। দ্বান্দ্বিক গতির আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, দ্বন্দ্বের মাধ্যমে পরিবর্তনের ক্রম সব সময় এক রকম থাকে না। পরিবর্তনের ক্রম বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে অবস্থার ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বস্তুর ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রয়োগ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং সমাজ ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দ্বারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আদি সাম্যবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজের উত্তরণকে মার্কসবাদীগণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। এই নীতিতে কালক্রমে পুঁজিবাদী সমাজ নতুনতন সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হবে বলেও মার্কস ও এঙ্গেলস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া এবং অন্য অনেক দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন এবং অপরদিকে পুঁজিবাদের পক্ষ থেকে তার তীব্র বিরোধিতা চলছে, একেও দ্বন্দ্বমূলক দর্শনের বাস্তব দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করা হয়।

Dialogue: সংলাপ
সাহিত্যিক রচনায় দুটি চরিত্রের মধ্যকর কথোপকথনকে সংলাপ বলে। সাধারণ কথোপকথন থেকে সংলাপের বৈশিষ্ট্য এই যে, সংলাপ পূর্বপরিকল্পিত এবং এর মাধ্যমে রচনাকারী কোনো একটা প্রতিচাদ্যকে ধারাবাহিকভাবে প্রমাণের স্তরে নিয়ে যান। কোনো সমস্যা বা প্রশ্নের উভয় দিক উপস্থাপনের জন্য সাহিত্যিকগণ সংলাপকে সব যুগেই একটি উত্তম কৌশল বলে বিবেচনা করেছেন। লেখক প্রশ্নের পরস্পরবিরোধী দুটি দিক দুই চরিত্রের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থিত করেন যাতে যুক্তির খণ্ডনে যুক্তি অগ্রসর হতে হতে এমন সিদ্ধান্ত সমুপস্তিত হয় যেখানে আর বিরোধের অবকাশ থাকে না। যে চরিত্র প্রতিপাদ্যের প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করেছে সে চরিত্রও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাকে স্বীকার করে। সংলাপমূলক রচনার উদ্ভব গ্রিক সাহিত্যে বলে অনেকে মনে করেন। সক্রেটিসকে প্রধান চরিত্র করে প্লেটো তাঁর সমস্ত দার্শনিক তত্ত্বকে সংলাপের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তাঁর রচনা কেবলমাত্র দার্শনিক এই বিতর্কের জন্যই নয়; তার নাটকীয়তা এবং রচনার মাধুর্যও অতুলনীয়। প্লেটোর সংলাপমূলক রচনাশৈলী কোনো উদ্ভাবন নয়। প্লেটোর পূর্বে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে তত্ত্ব পেশ করার রীতি প্রচলিত ছিল। সক্রেটিস কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তিনি অপর চরিত্রের সঙ্গে জীবন ও জগতের সমস্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন। এবং বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাত্ত্বিক বিষয় পেশ করার জন্য সংলাপের স্থানে নিবন্ধই প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সংলাপ একেবারে পরিত্যক্ত হয় না। বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক অন্যান্য শৈলীর সঙ্গে সংলাপের শৈলীও ব্যবহার করেছেন। ইংরেজী সাহিত্যে দর্শনের ক্ষেত্রে জর্জ বার্কলের ‘হাইলাস ও ফিলোনাস’ –এর সংলাপ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

Dicast: ডাইকাস্ট
প্রাচীন এথেন্স নগর-রাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্রীয় পদের নাম। ডাইকাস্টকে জুরী বা বিচার-ব্যবস্থা বলে মনে করা যায়। এথেন্সের যারা নাগরিক অর্থাৎ যারা দাস কিংবা ঋণের দায়ে নাগরিকতা থেকে বঞ্চিত হয় নি এমন নগরবাসীদের মধ্য থেকে প্রতি বছর ছহাজার বিচারকের একটি তালিকা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হতো। এই বিচারক বা ডাইকাস্টগণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিধানের ব্যাখ্যা এবং বিরোধমূলক ঘটনার বিচার করতেন। গোড়ার দিকে এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক না থাকলেও ডাইকাস্টদের জন্য পেরিক্লিস (খ্রি. পূ. ৪৯০-৪২৯) বেতন-দানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এথেন্সের রাজনীতিক দলাদলি ও বিরোধ দ্বারা বিশেভভাবে প্রভাবিত হত। নিরপেক্ষ বিবেচনা বা বিচারের পরিবর্তেথ ডাইকাস্টের সদস্যগণ তাদের মনোভাব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা অধিক পরিচালিত হতেন। এথেন্সের বিচার-ব্যবস্থার এই দুর্নীতিকে বিষয় করে রচিত গ্রিক নাট্যকার এ্যারিন্সোফেনিসের ‘ওয়াসপ’ বা বোলতা নামক নাটক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।

Dictatorship of the proletariat: সর্বহারার একনায়কত্ব
সর্বহারার একনায়কত্ব কথাটি মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের একটি ধারণা। মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বানুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত শাসক শ্রেণীর হাতে বিভিন্ন প্রকারে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার অস্ত্র। মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, মানব সমাজে রাষ্ট্র অতীতের সর্বযুগে বিদ্যমান ছিল না এবং ভবিষ্যতেও একদিন থাকবে না। আদিম সাম্যবাদী মানব সমাজে রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্ভব ছিল না। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির একটা পর্যায়ে সমাজ যখন উৎপাদনের উপায়ের কিছু সংখ্যক মালিক এবং উৎপাদনের উপায়হীন অধিক সংখ্যক মানুষে বিভক্ত হয়ে গেল, তখনি মাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। এই অবস্থায় উৎপাদনের উপায়ের একচ্ছত্র মালিকদের আইন প্রণয়নের এবং আইনভঙ্গকারীর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থার। প্রথম যুগের শ্রেণীবিভক্ত অর্থাৎ দাস সমাজের রাষ্ট্র আধুনিককালের রাষ্ট্র থেকে সহজতর হলেও মূলত উভয়ের চরিত্রই এক। রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য উৎপাদনের মালিকদের মৌলিক স্বার্থ প্রতিপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা। মার্কসবাদী তত্ত্বানুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ-এর প্রত্যেকটি পর্যায়েই রাষ্ট্র হচ্ছে শাসকশ্রেণীর একনায়কত্বের ধারক ও বাহক। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলা হলেও এর কোনো গণতন্ত্রই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৭ সালের বিপ্লবে রাশিয়ায় এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে অপর কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের রূপ কি? এ প্রশ্নের জবাবে মার্কসবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাকারী এবং নেতা ভি.আই. লেনিন বলেছেন যে, সমাজতন্ত্রও পরিপূর্ণরূপে শ্রেণীহীন রাষ্ট্র নয়। সমাজতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী। এ কারণে শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লব মারফৎ পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কোনো শ্রেণীই তার স্বার্থ বিনা প্রতিবাদে বা বিনা প্রতিরোধে প্রতিপক্ষকে ছেড়ে দেয় না। জীবনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবের পূর্বে যেমন, বিপ্লবের পরেও তেমনি প্রকাশ্য-পরোক্ষ, সশস্ত্র-নিরস্ত্র এবং ভাবগত নানাভাবে পুঁজিবাদ শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বহির্দেশের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তায় উচ্ছেদ করে পুনরায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা সমাজতান্ত্রিক দেশে চলতে থাকা সম্ভব। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নির্বিকার থাকলে চলে না। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য তাকেও সংগঠনগত সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন। এদিক থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও একটি শ্রেণী-রাষ্ট্র। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এবং শ্রমিকশ্রেণীর একক নেতৃত্ব রক্ষাকারী সংগঠন। এ কারণে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সংগঠনকে সর্বহারার বা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব বলা হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পার্থক্য এখানে যে, পুঁজিবাদ উচ্ছেদ হওয়ার করণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষিত এবং উৎসাদিত পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিরোধ বিলুপ্ত হলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকার প্রয়োজনও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সাম্যবাদী মানব সমাজে শ্রেণী হিসাবে কোনো বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করার কোনো রাষ্ট্রীয় সংগঠনের প্রয়োজন আদৌ থাকবে না। রাষ্ট্র বলতে এখন যা বুঝায়, তেমন শক্তি প্রয়োগকারী সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মার্কসবাদের এই রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব থেকে দেখা যায় যে, সর্বহারার একনায়কত্ব পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে পৌঁছার জন্য আবশ্যকীয় একটি অন্তর্বর্তী স্তরবিশেষ। ১৮৭০ সালে প্যারিস শহরে শ্রমিকরাও বিপ্লবের মাধ্যমে প্যারিকম্যুরন নামে একটি শ্রমিক-রাষ্ট্র কায়েম করেছিল। ফরাসী ধনীকশ্রেণী শক্তি প্রয়োগ করে সেদিন তাকে পর্যুদস্ত করে দেয়। কার্লমার্কস এবং এঙ্গেলস প্যারিকম্যুনের পরিণতি থেকে সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বহারার একনায়কত্বের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন।

Diderot: দিদেরত (১৭১৩-১৭৮৪ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্য ‘বিশ্বকোষ’ রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন মুক্তিবুদ্ধির যে পথিকৃতরা তাঁদের অন্যতম ছিলেন দিদেরাত। ইংল্যাণ্ডের প্রকাশিত সেকালের বিশ্বকোষের আদর্শে দিদেরস ফরাসি ভাষায় বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির উপর বিশ্বকোষ রচনার কথা চিন্তা করেন। এ কাজে তাঁর অপর এক সঙ্গী ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট। বিরাট প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে তাঁরা জ্ঞান প্রচারের এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে ১৭৫৯ সনে সামন্ততান্ত্রিক সরকার এ পরিকল্পনার কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমন অবস্থায় অনেক সঙ্গী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু দিদেরত পরাজয় স্বীকার করতে থাকেন। তাঁর এই অদম্য চেষ্টা ক্রমান্বয়ে তাঁকে ফরাসি বিদ্বৎ মহলে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসতে প্রতিষ্ঠিত করে। অভিজাত শ্রেণীর উদারপন্থী ব্যারণ এবং লেখক ডি হলবাক তাঁর পৃষ্ঠপোষক হন। বিশ বছরের চেষ্টায় ফরাসি বিশ্বকোষের যে ১৭টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল, সে জ্ঞানকোষ ফরাসি জনমানসে নতুন বৈজ্ঞানিক ও ইহজাগতিক এক দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। দারিদ্র্যের কারণে নিজের অপরিসীম পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত তার গ্রন্থাগারটিকে প্যারিস থেকে স্থানান্তর না করে প্যারিসে দিতেরতকে তার গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করেন। বিশ্বকোষ তৈরির উদ্যোগের পূর্বে দিদেরত ফরাসি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অন্যায় এবং কুসংস্কারকে ব্যঙ্গ করে যে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সরকার তা নিষিদ্ধ করে দিদেরতকে কারাগারে বন্দি করেছিলেন। কিন্তু কোনো নির্যাতন মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা দিদেরতকে দমিন করতে পারে নি। তাঁর জীবনকালেই তিনি ফরাসি দেশের অন্যতম অগ্রসর চিন্তানায়ক এবং লেখক স্বীকৃতি লাভ করেন।

Diagenes: ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ ৪১২-৩২৩)
ডায়োজেনিস ছিলেন গ্রিসের সিনিক বা উদাসীন দার্শনিক (দ্র. Cynic: উদাসীন) ডায়োজেনিস সিনি দর্শনের প্রবক্তা এ্যান্টিসথেনিসের শিষ্য ছিলেন। একবার সমুদ্রযাত্রায় জলদস্যুরা তাঁকে অপহরণ করে কোরিন্থে দাস হিসাবে বিক্রিয় করে। কোরিন্থে তিনি জীবনের বাকি অংশ অতিবাহিত করেন এবং তাঁর আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্বতাপালনমূলক দর্শনের প্রচার করেন। তাঁর সম্পর্কে নানা উপকথা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁর কি উপকার করতে পারেন এরূপ প্রশ্নকালে তিনি ব্যঙ্গসহকারে বলেছিলেন: আপনি দয়া করে আমার সূর্যের আলোকটুকু আড়াল না করে সরে দাঁড়াতে পারেন। ডায়োজেনিস মনে করতেন, জীবনের সার্থকতা ভোগে নয়, ত্যাগে এবং কষ্টভোগে, কৃচ্ছ্বতাসাধনে। কষ্ট এবং দুঃখভোগ উত্তম চরিত্র অর্জনের প্রকৃষ্ট উপায়। প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন এবং সহজ জীবনযাপনেই মাত্র মানুষের সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ। ডায়োজেনিস প্লেটোর ভাব বা নির্বিশেষে সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁর মতে বিকাশই একমাত্র অস্তিত্ব। নির্বিশেষে অস্তিত্বহীন।

Distribution of Terms: পদের বণ্টন
যুক্তিবিদ্যায় একটি যুক্তির মধ্যে বাক্যের একটি টার্ম বা পদের সংখ্যা বা ব্যাক্তার্থকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হল বাক্যের সেই পদটিকে বণ্টিত পদ বা ডিস্ট্রিব্যুটেড টার্ম বলে। অবরোহ যুক্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যুক্তির মধ্যে পদের বণ্টন এবং অ-বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক হয়। যৌক্তিক বাক্যকে সাধারণত চারভাগে ভাগ করা হয় যথা: সার্বিক এবং বিশেষ; হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক। একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য তার উদ্দেশ্য পদকে, সার্বিক না বাচক তার উদ্দেশ্য বিধেয় উভয় পদকে, বিশেষ না বাচক কেবল তার বিধেয় পদকে বণ্টন করে। কিন্তু বিশেষ হ্যাঁ বাচক কোনো পদকেই বণ্টন করে না। সকল মানুষ মরণশীল, এটি একটি সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য। এখানে উদ্দেশ্যপদ ‘মানুষ’ –এর সংখ্যা বা ব্যক্তার্থের সমগ্রের উপর বক্তব্যটি প্রযোজ্য বলে উদ্দেশ্য পদটি বণ্টিত। ‘কিছু মানুষ সৎ’ এটি একটি বিশেষ হ্যাঁ বাচক বাক্য। এখানে সকল মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সততার কথাটি প্রযোজ্য নয়, তেমনি সকল সৎ-এর উপরও এই বাক্যের ‘কিছু মানুষ’ পদটি প্রযোজ্য নয়। এ কারণে এই বাক্যের কোনো পদই বণ্টিত নয়। যুক্তির মধ্যে কোনো পদ বণ্টন না করে সিদ্ধান্তে তাকে বণ্টন করা হলে অবণ্টিত পদের বণ্টনজনিত ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

Divine Right: ঐশ্বরিক অধিকার
ঐশ্বরিক অধিকার একটি রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী রাজা বিধাতার প্রতিনিধি। রাজার আনুগত্য বিধাতার প্রতি। প্রজার আনুগত্য রাজার প্রতি। রাজার কোনো কাজের জন্য রাজা প্রজার নিকট দায়ী থাকবে না। সে দায়ী থাকবে বিধাতার নিকট। রাজার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে যুক্তিসঙ্গত এবং জোরদার করার জন্য এক সময়ে এই তত্ত্ব বিশেষবাবে ব্যবহৃত হতো। এই তত্ত্ব এরূপ চরম আকারে রাষ্ট্রীয় শাসনে প্রয়োগ করতে শুরু করেন যে, এর ফলে সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডে রাজার সঙ্গে পার্লমেন্ট ও জনসাধারণের বিরোধ তীব্র আকার গ্রহণ করেন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের বিশেষ প্রভাব ছিল। ফরাসি বিপ্লব এই তত্ত্বকে আঘাত করে বুর্জোয়া বিপ্লব সংঘটিত করে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে।
Dream: স্বপ্ন
স্বপ্ত বয়স নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রায় নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। ‘নিদ্রার মধ্যে চেতনার একটি প্রকাশ’ বলে স্বপ্নের একটি সংজ্ঞা দেওয়া চলে। সাধারণভাবে একথা সত্য যে, নিদ্রার মধ্যে দেহের সচেতন কার্যাবলী বন্ধ বা স্থগিত থাকে। নিদ্রার মধ্যে আমরা কোনো দ্রব্যকে চোখ দিয়ে দেখি না। হাত নেড়ে কোনো কাজ করি না। পা দিয়ে হাঁটি না। তাই মনে করা হয়, নিদ্রার মধ্যে মস্তিষ্ক বিশ্রাম করে নিজের ক্ষয়কে পূরণ করে জাগরিক হয়ে পুনরায় কার্যে নিবদ্ধ হয়। কিন্তু নিদ্রার মধ্যে মস্তিষ্ক যে একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকে না তারই পরিচয় বহন করে মানুষের স্বপ্ন। আমরা বলি মানুষ স্বপ্ন দেখে। অবশ্যই আমরা চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখি না। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সচেতন সময়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের একরূপ অভিজ্ঞতা ঘটে। ‘স্বপ্ন’ ব্যাপারটা পূর্বে ঐশ্বরিক এবং রহস্যজনক ব্যাপার বলে মনে করা হতো। যেমন প্রাচীনকালে তেমনি এখনো সাধারণ মানুষ তাদের স্বপ্নের তাৎপর্য উদঘাটনের জন্য ধর্মীয় পুরুষ তথা পীর দরবেশ সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু আধুনিককালে স্বপ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিকগণ, বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানীগণ বিশেষ গবেষণা সম্পাদন করার চেষ্টা করেছেন। সাধারণভাবে আজকাল স্বপ্নকে বাস্তব জীবনের অপূর্ণ কামনা বাসনার একরকম পূরণ বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে স্বপ্নের বিষয়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। শিশুদের বেশিরভাব স্বপ্নই তাদের সচেতন অবস্থার নানা আদর আবদার আঘাতের সঙ্গে জড়িত। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এরূপ সম্পর্ক সহজে ধরা না গেলেও, যে কামনা বাসনা মানুষ তার সচেতন সামাজিক জীবনে নানা বাধা নিষেধ সংকোচ ও সংস্কারে পূরণ করতে পারে না সেসব কামনা বাসনা প্রত্যক্ষরূপে না হলেও পরোক্ষ এবং নানা প্রতীকে নিদ্রার মধ্যে যে তাকে কিছুটা তৃপ্ত করতে পারে, এ অভিমত আজ সাধারণভাবে স্বীকৃত। স্বপ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিংশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে ইউরোপের চিকিৎসাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী সিগমণ্ড ফ্রয়েডের গবেষণা ও প্রকাশনায়। ফ্রয়েড এবং তাঁর অনুসারী মনোবিজ্ঞানীগণ মনকে চেতন, অবচেতন ভাগে ভাগ করে বিবেচনা করেন। তাঁদের মনের চেতন ভাগ তেমন বৃহৎ নয়। মানুষের আপাত বিস্মৃত এবং অবদমিত চিন্তা, ভাবনা, উদ্বেগ, কামনা অবচেতনা এবং অচেতনে নিক্ষিপ্ত হলেও তারা বিলুপ্ত হয়ে যায় না। প্রত্যেকটি কামনা একটি শক্তি বা এনারজিবিশেষ। যে –কোন ভাবে প্রকাশের মাধ্যমে তার পূর্তি না ঘটলে তার বিলোপ ঘটে না। ফ্রয়েড স্বপ্নকে মানুষের অবচেতন এবং অচেতন জগতের রহস্য উদ্ধারের একটি চাবিকাঠি বলে গণ্য করেন। এই তত্ত্বের উপরই আধুনিক মনঃসমীক্ষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

Dutt, Aswinkumar: অশ্বীনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩ খ্রি.)
বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অধিবাসী। অশ্বিনীকুমার তত্তের পৈতৃক বাড়ি এই জেলার বাটাজোড় গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন তাঁর পিতার কর্মস্থল পটুয়াখালীতে। পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাবজজ ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের নেতৃস্থানীয় পরিবার বরিশালের দত্ত পরিবার। অশ্বিনীকুমার দত্ত এম, এ, বি, এল ছিলেন। ছাত্রজীবনের পরে কিছুকাল তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই তিনি শিক্ষকতার চাকুরী পরিত্যাগ করে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর পিতা ব্রজমোহনের নামে তিনি বি, এম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮৪ সনে। ১৮৮৯ সনে ব্রজমোহন কলেজ বা বি.এম. কলেজকেও তিনি স্থাপন করেন। এই কলেজে তিনি পঁচিশ বছর কোনো বেতন গ্রহণ না করে অধ্যাপকের কাজ করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৮৮৭ সনে বাখরগঞ্জ (বরিশাল জেলার পুরাতন নাম) ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেসের প্রভাবশালী কর্মী ছিলেন। বরিশালের তিনি জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ১৯০৬ সনে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অশ্বিনীকুমার দত্তসহ কংগ্রেসের বহু নেতা আহত হন। ১৯০৮-১৯১০-এ অশ্বিনীকুমার কারাগারে বন্দি ছিলেন। তার কর্মকাণ্ড কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজসেবামূলক কার্যে তাঁর সাংগঠনিক শক্তি তিনি নিয়োগ করেন। তি ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করেছিলেন এবং সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করে যে সকল পুস্তক রচনা করেন –সে সকল পুস্তক তাঁকে একজন বিশিষ্ট সাধক এবং চিন্তাবিদ হিসাবে বৃহত্তর জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘প্রেম’, ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’, ‘ভারতগীতি’ প্রভৃতি বিখ্যাত। বরিশালে বিখ্যাত স্বদেশ প্রেমিক চারণ কবি ও গায়ক মুকুন্দ দাস (যজ্ঞেস্বর দাস) অশ্বিনীকুমারের অনুপ্রেরণায় নিজের মুদী দোকানের ব্যবসায় পরিত্যাগ করে ‘মুকুন্দ দাস’ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর সমাজসেবা অশ্বিনীকুমারকে দেশব্যাপী মহৎ আত্মার অধিকারী বলে প্রতিষ্ঠিত করে। বরিশাল শহরে আজ অবধি বি.এম. স্কুল; বি.এম কলেজ এবং অশ্বিনীকুমার টাউন হল তাঁর কর্মোদ্যোগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পাকিস্তান-শাসনকালে ষাটের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল মহল অশ্বিনীকুমারের অবদান অস্বীকার করে বরিশাল শহরের ‘অশ্বিনীকুমার টাউন হলে’র নাম পরিবর্তন করে ‘আয়ুব খাঁ টাউন হল’ রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময়ে এই প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে টাউন হলের নাম ‘অশ্বিনীকুমার টাউন হল’ হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।

E
Eckecticism: সারবাদ, সমন্বয়বাদ
তত্ত্বের ক্ষেত্রে কেউ যদি একাধিক তত্ত্বের অংশবিশেষ গ্রহণ করে সবটা মিলিয়ে একটা তত্ত্বের আকার দেবার চেষ্টা করেন, তা হলে তাঁকে সারবাদী বা সমন্বয়বাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়। জ্ঞানের রাজ্যে বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে একটি মাত্র তত্ত্বই উদ্ভুত হয় নি। একই সমস্যার ব্যাপারে বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক বিভিন্ন মত উপস্থিত করেছেন। বস্তু, জীবন, জগৎ প্রভৃতির মূল চরিত্র কি? এ প্রশ্নে বস্তবাদ মনে করে যে, বস্তুই সব কিছুর মূল। অপরপক্ষে ভাববাদ মনে করে মানুষের মনের ভাব কিংবা ব্যক্তির মন নিরপেক্ষ এক চরম ভাবই হচ্ছে সব কিছুর মূল। এ দুটো মত পরস্পর বিরোধী। সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ মনে করে আর্থিক উৎপাদনেরর ক্ষেত্রে ব্যক্তির অর্থাৎ পুঁজিসম্পন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার অবাধ স্বাধীনতা এবং উদ্যোগই কাম্য। সমাজতন্ত্রবাদ মনে করে উৎপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টির অধিকারই কাম্য, ব্যক্তিগত মালিকানা অসঙ্গত। এ দুটি মতও পরস্পর-বিরোধী। সাধারণত যে বস্তুবাদী, সে ভাববাদকে গ্রাহ্য করতে চায় না। যে পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে। যে-কোন তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা অনুসারীর পক্ষে এটাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ একটি তত্ত্ব সামগ্রিক তত্ত্ব হয়ে ওঠে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার দাবির ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষ সবসময়ে কোনো একটি তত্ত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে জীবন যাপন করে না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে এবং সমস্যার সাময়িক জবাবে বিভিন্ন তত্ত্বের, এমনকি পরস্পর-বিরোধী তত্ত্বের পছন্দমতো অংশ সে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। এ প্রবণতা কেবল সাধারণের ক্ষেত্রে নয়। ইতিহাসে প্রখ্যাত অনেক চিন্তাবিদের মধ্যেও বিভিন্ন মত সমন্বয়ের প্রয়াস দেখা যায়। বিভিন্ন মতের সমন্বয়কে একটা প্রবণতা হিসাবে ব্যাখ্যা করাই সঙ্গত। সর্বমতের সমন্বয় মারফত কোনো ঐক্যবদ্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব দাঁড় করানো সম্ভব নয়। যাঁরা এরূপ চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে মানুষের কল্যাণ সাধনের একটা সহজ আবেগই বেশি কাজ করে। তাঁরা মনে করেন, সত্য কোনো একটি তত্ত্বের মধ্যে নিহিত না থেকে সমস্ত তত্ত্বেই আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে পারে। সত্যসন্ধানীর কাজ হবে সমস্ত ক্ষেত্র থেকে অংশসমূহকে একত্র করে সত্যের একটি সমগ্র-সত্তা তৈরি করা। এরূপ ইচ্ছার মধ্যে কল্পনার প্রকাশই বেশী। ফলে, সমন্বয়বাদী তত্ত্বের একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সমন্বয়বাদীর মতে পুঁজিবাদ ও সমানতন্ত্রবাদ, বস্তুবাদ ও ভাববাদ একই সময়ে গ্রাহ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সমন্বয়বাদী মনে করে, সমাজতন্ত্রবাদ এবং পুঁজিবাদ মিলিয়ে সর্বসমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আধুনিককালের ন্যায় দর্শনের ইতিহাসে অতীতকালেও এরূপ সমন্বয়বাদী লেখক ও দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রাচীন রোমের বাগ্মী ও দার্শনিক সিসিরো (১০৬-৪৩ খ্রি পূ.) এরূপ সমন্বয়বাদী বলে প্রখ্যাত। সমন্বয়বাদের মনোভাব থেকে তিনি মতামত-নিরপেক্ষভাবে প্রাচীন গ্রিকদর্শনের সর্বপ্রকার দার্শনিক মতকে রোমকদের কাছে পেশ করার চেষ্টা করেন।

Economism: অর্থবাদ
শ্রমিক আন্দোলনে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিত্যাগ করে আংশিক আর্থিক দাবি আদায়ের প্রবণতাকে অর্থবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে আন্দোলনের মধ্যে অর্থবাদ একটি বিতর্কিত ধারা ছিল। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকগণ নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অর্থবাদের অভিযোগ আনেন। এঁদের মতে অর্থবাদের অনুসারীগণকে সমাজতন্ত্রবাদী বলা চলে না। কেননা, সমাজতন্ত্রবাদের আন্দোলন কেবলমাত্র শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোল নয়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শ্রমিকদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও আন্দোলন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন দ্বারা শ্রমিকদের মুক্তি সম্ভব নয়। রুশ বলশেভিক সংগঠনের মধ্যে কারা অর্থবাদী এবং তাদের মত কিরূপে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর, তার বিশ্লেষণ করে লেনিন ‘কি করণীয়’ নামক পুস্তক রচনা করেন। শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম আজ কোনো বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একে একটি আন্তর্জাতিক ধারা বলে অভিহিত করা চলে।

Economic Determinism: অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ
মার্কসবাদের সমালোচকগণ ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যাতা স্থুলভাবে ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’ বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে মার্কসবাদ ইতিহাসের মূল চালক-শক্তি হিসাবে কেবল আর্থনীতিক শক্তি তথা উৎপাদন ব্যবস্থার উপর জোর দেয়, মানুষের উপর ভাব তথা সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির প্রভাবকে অস্বীকার করে। মার্কসবাদীগণ এরূপ সমালোচনাকে মার্কসবাদের স্থূল ব্যাখ্যা মনে করেন। মার্কস-এঙ্গেলস তথা মার্কসবাদের প্রবক্তাদের মতে মানুষের জীবনে এবং তার ইতিহাসের বিকাশে মানুষেল জীবন ধারণ তথা তার জীবিকার ক্ষেত্রে বিদ্যমান এবং বিকাশমান উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদের সম্পর্ক মূল শক্তি হিসাবে কাজ করে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মানুষের জীবন স্থূলভাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎপাদনের উপায়কে উন্নত এবং পরিবর্তিত করার জন্যই মানুষের চিন্তা ভাবনা এবং তার থেকে উদ্ভুত বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস। উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে এগুলি দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ক যেমন সমাজের ভাবগত সৃষ্টিগুলির উৎস এবং তাদেরকে প্রভাবিত করে, মানুষের ভাবনা, চিন্তা, বিশ্বাস, আবিস্কারও উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ককে তেমনি প্রভাবিত এবং পরিবর্তিত করে। কাজেই এ তত্ত্বকে কেবল অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ কিংবা মানুষের ভাবকে অস্বীকারমূলক তত্ত্ব বলে আখ্যায়িত করা ভুল।

Eleatics: ইলিয়া-দর্শন
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে দক্ষিণ ইতালির ইলিয়া নামক দ্বীপটি প্রাচীন গ্রিক দর্শনচর্চার একটি কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জেনোফেন্স, পারমিনাইডিস, জেনো এবং মিলিসাস এই দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের দার্শনিক অভিমতসমূহ ইলিয়া দ্বীপের দর্শন নামে খ্যাতি লাভ করে। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে উপরোক্ত দার্শনিককের মতের একটি ঐক্য এই ছিল যে, এঁরা সকলেই মনে করতেন, সৃষ্টির মূল সত্তা অপরিবর্তনীয়। বস্তুর মধ্যে যে পরিবর্তন মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর এটা বাহ্য এবং মায়া। পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্য সৃষ্টির মূল সত্তার ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য নয়। বিচিত্র বাহ্যবস্তুর মূলে একটিমাত্র সত্তা বিরাজমান। ইলিয়া দার্শনিকদের এই একত্ববাদী চিন্তা প্রাচীন দর্শনের ভাববাদী ধারার সূচনা করে। এতদিন পর্যন্ত গ্রিসের হিরাক্লিটাস এবং অন্যান্য দার্শনিক সৃষ্টির মূলে একটি বদলে একাধিক সত্তার কল্পনা করেছেন। বিশেষ করে মাটি, জল, বায়ু এবং অগ্নি প্রভৃতিকে সৃষ্টির মূল বলে তাঁরা আখ্যায়িত করেছেন। এই বহুত্ববাদী চিন্তাকে ইলিয়া দার্শনিকগণ নাকচ করে এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সৃষ্টির মূল সত্তা এক, অবিভাজ্য, অপরিবর্তনীয় –স্থির এবং অসীম। ইলিয়া দর্শনের পরবর্তীযুগ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় শতকে প্লেটো এই চিন্তাকেই অধিকতর সূক্ষ্ম যুক্তির মাধ্যমে এক অ-বস্তুমূলক, অসীম, অক্ষয় এবং অজ্ঞেয় ভাবকে সমস্ত প্রকাশের মূল বলে ঘোষণা করেন। ইলিয়ার দার্শনিকগণ বস্তুর বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনকে অস্বীকার করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্যত ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক ইত্যাদি মাধ্যমের নির্ভরযোগ্যতাকে অস্বীকার করেন এবং জ্ঞানকে অতীন্দ্রিয় বিষয় বলে মনে করেন।

Einstein: আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫ খ্রি.)
আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত ‘রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রবক্তা। ধর্মগতভাবে আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদী। তাঁর পিতামাতা তার শিশু বয়সে জার্মানির মিউনিকে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার ইতালির মিলানে যান। শিক্ষা জীবন আঙ্কশাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। কিছুকাল একটি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে বার্লিনে একটি পরিবারে গৃহশিক্ষকতাও করেন। ১৯০৫ সনে আইনস্টাইন আলোর রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন অব লাইট, অণুর মাত্রা বা মলিক্যুলার ডাইমেনশনস, গতিময় পদার্থের তড়িৎ প্রবাহ বা ইলেকট্রো ডাইনামিকস অব মুভিং বডিস প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে নিবন্ধাদি প্রকাশ করেন। এই সূত্রে ম্যাক্স প্লাক্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘটে। ১৯০৯ সনে আইনস্টাইন জুরিকে তাত্ত্বিক পদার্থের বিশেষ অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সনে তিনি বার্লিনের কাইজার ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৩৩ সনে হিটলারের নাজিবাদের ইহুদী বিদ্বেষের কারণে উক্ত পদ থেকে অপসারিত হন এবং জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং নিউজার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ লাভ করেন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে একথা বলা যায় যে, আলোর বিকিরণ তত্ত্বে তিনি সময় এবং স্থানের আপেক্ষিকতা দ্বারা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন।
তাঁর মতে সময় এবং স্থান কোনো দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ সত্তা নয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব আধুনিক দর্শন এবং বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করেছে। বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের বাইরে সাধারণ পাঠকের জন্যও তিনি সমকালের বিভিন্ন সমস্যার উপর চিন্তা করেছেন এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন এবং সুস্পষ্ট। ১৯৩৩ সনে ফ্রয়েডের সঙ্গে যুক্তভাবে শান্তির উপর তিনি যে গ্রন্থ প্রকাশ করেন তার নাম ‘যুদ্ধ কেন?’ ‘হোয়াই ওয়ার’। ১৯৩৪ সনে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমার দর্শন’ নামক গ্রন্থ। প্রখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) তাঁর ইউরোপে গবেষণা কর্মে নিযুক্ত থাকা কালে আইনস্টাইনের সাহচর্যে আসেন। আইনস্টাইন ১৯২৪ সনে অধ্যাপক বসুর ‘প্ল্যাঙ্ক সূত্র এবং কোয়াণ্টাম প্রকল্প’ প্রবদ্ধটি পাঠ করে চমৎকৃত হন এবং সেটি নিজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি বোস আইনস্টাইন সংজ্ঞা নাম প্রসিদ্ধি লাভ করে।

Elements: মূল, মূল উপাদান, মৌল পদার্থ
দৃশ্যত বস্তু বিভিন্ন আকারের এবং বহু প্রকারের। দূর অতীতেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে এই বহুর পেছনে বহুর উৎস বা কারণ হিসাবে একটি মূলের সন্ধান করেছে। কিন্তু বিচিত্রের মূলে মাত্র একটি সত্তা আছে, এ সিদ্ধান্ত মানুষ শুরুতেই করতে পারে নি। তবে বাহ্যত যত প্রকার বস্তু দেখা যায়, সবই মূল নয়, এ ধারণা মানুষ বাহ্য বস্তুর দ্রুত পরিবর্তন, রূপান্তর বা বিলুপ্তি করার চেষ্টা করে। এরূপ চেষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিশেষভাবে প্রাচীন গ্রিস এবং ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকগণ ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ)-কে বিশ্বের মূল বলে মনে করতেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগ৯ণ বস্তুর বদলে তাপ-শৈত্য, আর্দ্রতা-শুষ্কতা প্রভৃতি বিপরীত গুণকে সমস্ত সৃষ্টির একক বলে কল্পনা করেছেন। এই সমস্ত বিপরীত ধর্ম বা গুণের সংযোগে সমস্ত রকম বস্তু বা সৃষ্টির প্রকাশ। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতকে গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস এবং এপিক্যুরাস বস্তুর মূলে অণুর অস্তিত্বের তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁদের মতে, অণু হচ্ছে বস্তুর সূক্ষ্মতম এবং অবিভাজ্য মৌলিক উপাদান। অণুর সংযোগই বস্তুর বৈচিত্রের সৃষ্টি। এ আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, বস্তুর মূল সম্পর্কে ধারণা মানুষের জ্ঞানের বিকাশের সাথে জড়িত। জ্ঞানের প্রাথমিক অবস্থাতে সৃষ্টির মূল উপাদান সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা ছিল, জ্ঞানের বিকাশ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সে ধারণা বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের একটা বিষয় লক্ষণীয়। বস্তুর মূল কি, অর্থাৎ বস্তুর প্রকৃতি স্থির করার গবেষণার মানুষ একদিকে যেমন জটিলতাহীন এবং অবিভাজ্য কোনো এককের সন্ধান লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে তেমনি গবেষণার বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে ক্রমান্বয়ে এই সত্য স্বীকারে বাধ্য করেছে যে, বস্তু এক অসীম জটিল অস্তিত্ব। কারণ, মানুষ মূলে অবিভাজ্য কোনো এককের আবিস্কার করতে আজো সক্ষম হয় নি। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধারণা ছিল যে, বস্তুর মূলে একক হিসাবে অপরিবর্তনীয় অবিভাজ্য কোনো উপাদান আছে। কিন্তু উনিশ শতকের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারসমূহ, বিশেষ করে পদার্থ-বিজ্ঞান বস্তুর সেই পুরাতন ধারণাকে একেবারেই নাকচ করে দিয়েছে। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের কাছে বস্তুর মূল বলে যে ইলেকট্রন, প্রোটেন এবং নিউট্রন বিবেচিত হয়, তাদের গঠনও অশেষ জটিলতাপূর্ণ। আধুনিক দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুরবাদ বস্তুর মূল সত্তাকে সদা দ্বান্দ্বিক বা বিরোধাত্মক ধারায় পরিবর্তনশীল অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করে। ভ্রাদিমির লেনিন তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে এরূপ উক্তি করেছিলেন যে, ‘এ্যাটমের ন্যায় ইলেকট্রন হচ্ছে অসীম সম্ভাবনাময় এবং বিশ্বজগতের কোনো শেষ নেই’।

Elite, Elitism: এলিট, অভিজাত, এলিটবাদ, নয়া-অভিজাতবাদ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাত্ত্বিকদের মধ্যে আলোচিত একটি তত্ত্ব হচ্ছে এলিট তত্ত্ব। ‘এলিট’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ। এ থেকে এলিটবাদকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা নয়া অভিজাতবাদ বলেও অভিহিত করা চলে। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবর্তন হিসাবে ইতালির ভিলফ্রেডো পারেটো (১৮৪৩-১৯২৩) এবং গায়টানো মসকা পরিচিত। এ সমস্ত চিন্তাবিদ প্রধানত অযুক্তি এবং শক্তিবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী। মানুষের চরিত্রের মধ্যে অযুক্তি এবং শক্তির প্রতি আকর্ষণমূলক প্রবণতার উপর এঁরা জোর প্রদান করেন। এঁদের মতে প্রকৃতি মানুষকে সমাজ হিসাবে তৈরি করে নি। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নানা গুণের ভিত্তিতে ‘এলিট’ বা শ্রেষ্ঠ এবং ‘অ-এলিট’ বা ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ হিসাবে বিভক্ত। এবং সমাজের নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র শাসন উভয় ক্ষেত্রে চিরকাল যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, চাতুর্য, কূট-কৌশল দৈহিক শক্তি ইত্যাদি গুণে শ্রেষ্ঠ তারা শাসন করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এরাই শাসন করবে। এই শ্রেষ্ঠ অংশ অবশ্যই সংখ্যালঘু। সংখ্যায় তারা অল্প। সেদিক থেকে অল্পরাই অধিকের উপর শাসন করে। এরূপ তত্ত্বের অপর এক সমর্থক রবার্ট মিশেল-এর মতে মানুষেল জীবনে অল্পের শাসন হচ্ছে নিয়মের অমোঘ বিধান। তাঁর এরূপ অভিমত ‘আয়রন ল অব অলিগার্কী’ বা ‘কতিপয়ের লৌহ বিধান’ বলে পরিচিত। প্রাচীনকালে প্লেটো-এ্যারিস্টটলও মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিগত গুণের উপর জোর দিয়ে মানুষের একাংশকে অভিজাত বলে অভিহিত করতেন। তার ভিত্তিতে ‘অভিজাততন্ত্র’ বলে এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকেও তাঁরা নির্দিষ্ট করেন। কিন্তু সে বর্তমান কালের এলিটবাদ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদ কেবল মহৎ গুণের দ্বারা বিভক্ত করা অর্থহীন। চোর কিংবা ডাকাতের দক্ষতাও দক্ষতা, রাজনীতিকদের মধ্যে বাগ্মী বা কৌশলী রাজনীতিকের দক্ষতাও দক্ষতা। এদিক থেকে মানুষেল যে-কোন পেশা বা গোষ্ঠীর মধ্যেই ‘শ্রেষ্ঠ’ ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ বলে ভাগ থাকে। এবং প্রত্যেকটি অংশের শ্রেষ্ঠরাই তথা অল্পরাই শাসন করে এবং অ-শ্রেষ্ঠ তথা সংখ্যাধিকেরা শাসিত হয়। শাসনের ক্ষেত্রে এলিটদের দুই নামে অভিহিত করা চলে। যারা শাসকমণ্ডলীল অন্তর্গত তারা ‘পাওয়ার এলিট’ বা ‘শাসক-এলিট’ এবং যারা ‘শাসনের বাইরে অবস্থিত’ তারা ‘অ-শাসক’ বা ‘নন পাওয়ার এলিট’ বলে অভিহিত। এর ভিত্তিতে এদের তত্ত্বে ‘এলিট সঞ্চালন’ বা সারকুলেশন অব এলিট’ কথাটি এসেছে। শাসনের বাইরে এলিটরা শাসনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কালক্রমে শাসক-এলিটরা অ-শাসক এলিট দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সমাজকে শ্রেষ্ঠ, অ-শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যাল্প ও সংখ্যাধিকে বিভক্ত করার তত্ত্ব কোনো মৌলিক বা বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব নয়। এর মাধ্যমে মানুষের সমাজের সংকটের চরিত্র অনুধাবনে তেমন কোনো সুবিধা হয় না। বাহ্যত বিবরণমূলক এবং নীৎসের শক্তিবাদের সমর্থক এ তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আশাবাদী চিন্তাকে নস্যাৎ করা। এর আক্রমণের প্রধান বিষয় হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী চেতনা। মার্কসবাদী শ্রেণী বিশ্লেষণকে এ তত্ত্ব নাকচ করার চেষ্টা করেছে। এবং শক্তিবাদী এই তত্ত্বের অনুসরণেই বিংশ শতকে ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সামন্তবাদী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীসমূহ ফ্যাসিবাদ, নাজীবাদ ও সমরবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায়।

Emergent Evolution: আকস্মিক বিকাশ, আকস্মিক বিবর্তন
দ্র: Accidental Evolution

Emotion: আবেগ, প্রক্ষোভ
ব্যক্তির মানসিক অবস্থাবিশেষ। ব্যক্তি তার পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি ও বস্তুর সঙ্গে সতত একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়া মানসিক অবস্থায় যখন কোনো ব্যতিক্রমের উদ্ভব ঘটায়, তখন তাকে মনের আবেগ বা প্রক্ষোভ বলে অভিহিত করা হয়। আবেগ মনোবিজ্ঞানের একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। এর মাধ্যমে আমরা পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি এবং বস্তুজগৎ বা ঘটনার সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রতিক্রিয়াজনিত একটা অবস্থাকে বুঝাই। ব্যক্তি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। কিন্তু ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেবল যান্ত্রিক নয়। ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সে ইচ্ছা-অনিচ্ছার আগ্রহ, তীব্রতাও কাজ করে। ব্যক্তির দৈহিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর প্রাচীন গ্রিসে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের জ্ঞানী এমপিডোকলিসকে আলোকপাত করতে দেখা যায়। যে-কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে আবেগের ভূমিকা মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সক্রিয় আবেগ এবং নিরানন্দ বা বিমর্ষতা উৎপাদক আবেগকে নিষ্ক্রিয় আবেগ বলা হয়। আবেগ শুধু মনের ব্যপার নয়। আবেগের ফলে মস্তিষ্ক এবং দেহের বিভিন্ন অংশে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেহের আভ্যন্তরিক এবং প্রতিক্রিয়া ব্যতীত মনের আবেগের উদ্ভব সম্ভব নয়। মন যখন আনন্দিত হয় দেহের রক্ত সঞ্চালন, পেশির সম্প্রসারণ, ক্রিয়াশীলতা প্রভৃতি তখন বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই সক্রিয় আবেগে মনের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর করতে দেহ অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। নিষ্ক্রিয় আবেগ দেহকে আড়ষ্ট করে তার প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এ কারণে নিরানন্দ, কোনো দুঃখজনক বা ভীতিজনক ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ব্যক্তি অনেক সময়ে যুক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করতে কিংবা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়।
দেহের সঙ্গে আবেগের আত্যন্তিক সম্পর্ক আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যান্ত্রিক উপায়ে নির্ধারণযোগ্য বিষয় বলে গণ্য করা হয়। আবেগকে বিশ্লেষণ করে তার অন্তর্ভুক্ত মেজাজ, আধান বা সঞ্চারণ, বৈশিষ্ট্য এবং অতিরাগ নির্দিষ্ট করা হয়। অতিরাগ আর মেজাজের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, মেজাজের স্থায়িত্ব আধান ও প্রতিক্রিয়া সঞ্চারী মানসিকতার চেয়ে অধিককাল স্থায়ী। প্রতিক্রিয়ার সিদ্ধান্তটি ক্ষণমুহুর্তের হতে পারে। বিশেষ মেজাজ অর্থাৎ আনন্দ-নিরানন্দজনক মানসিকতার মধ্যে বিশেষ সিদ্ধান্ত মুহুর্তের উদ্ভব হয়। অতিরাগ বা প্যাশনকে অধিকতর স্থায়ী আবেগ বলে মনে করা হয়। মানুষের আবেগ মহৎ কিংবা অমহৎ বলেও বিভক্ত হতে পারে। নীতিবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, আত্মোৎসর্গ, সমষ্টির জন্য ব্যক্তির স্বার্থ বিসর্জন, মর্যাদাবোধ ইত্যাদিও মানুষের মহৎ আবেগ। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উইল হেলম ভুনড-কে (১৮৩২-১৯২০ খ্রি.) বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। ভুনড-এর মতে ব্যক্তির যে-কোন প্রতিক্রিয়া বা আচরণেই একটি আবেগগত দিক আছে। আধুনিক মনোসমীক্ষার মতে আনন্দ, বেদনা, প্রেম-ভালবাসা, ঘৃণা বিদ্বেষ সবই আবেগ। এবং মানুষ যে কেবল সচেতন অবস্থাতেই আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাই নয়। কোনো আবেগকে দমন করার প্রচেষ্টাও যেমন ব্যক্তির জীবনে সেই আবেগের প্রভাব নির্দেশ করে, তেমনি কোনো অবদমিত আবেগ ব্যক্তির অগোচরে এবং তার অবচেতনে সক্রিয় থেকে তার কোনো বিশেষ বা সমগ্র জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে। অবদমিত যৌনানুভূতির ভিন্নতার প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনে অনেক সময়ে কার্যকর হওয়া এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মনসমীক্ষণবিদ ফ্রয়েডের গবেষণা মানুষের আবেগের জগৎকে মনোবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে।

Empedocles: এমপিডকলিস (৪৮৩-৪২৩ খ্রি.)
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম কবি, বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে এরূপ কাহিনী আছে যে, তিনি ইটনা পর্বতের গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ‘প্রকৃতি’ নামে তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কবিতার মধ্যেই এমপিডকলিস নিজের দার্শনিক অভিমতসমূহ প্রকাশ করেন। তাঁর দর্শনের মধ্যে পূর্বগামী দার্শনিক পাইথাগোরাস, হিরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডসের ভাবধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এঁরা সকলেই সেকালের বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। এঁদের সকলের মতামতই এমপিডকলিস কমবেশী গ্রহণ করেন। পারমিনাইডিসকে স্বীকার করে এমপিডকলিস বলেনঃ বস্তু হচ্ছে অ-সৃষ্ট অর্থাৎ বস্তুর কোনো স্রষ্টা নেই এবং বস্তুর কোনো বিলয় নেই। হিরাক্লিটার্স বলেছিলেন বস্তুর ক্ষেত্রে বিরামহীন গতি আর পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। বস্তু অ-সৃষ্ট এবং পরিবর্তনশীল এই দুই অভিশতকে সংযুক্ত করে এমপিডকলিস বলেন যে, দৃশ্যবস্তুপুঞ্জের মধ্যে পরিবর্তন আছে, তার সৃষ্টি এবং লয় দেখা যায় একথা সত্য; কিন্তু দৃশ্যবস্তু মূলত যে সত্তা বা উপাদানে গঠিত তার কোনো শুরু, শেষ বা পরিবর্তন নেই। বস্তুর মূলে রয়েছে চারটি সত্তা যথা, মাটি, পানি, বাতাস এবং আগুন। দৃশ্যবস্তুর সৃষ্টি, লয় এবং পরিবর্তন সাধিত হয় বস্তুর মৌলিক উপাদান মাটি, বায়ু, পানি আর আগুনের পারস্পরিক সংযোজন এবং বিয়োজনের মাধ্যমে। সংযোজন এবং বিয়োজন আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ, প্রেম, অ-প্রেম, ভালবাসা, ঘৃণা বস্তুর মূল উপাদানের মধ্যে সতত সংঘাতের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। সংযোজন, আকর্ষণ, প্রেম, ভালবাসা যেখানে জয়ী, সেখানে সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি। আর বিয়োজন, বিকর্ষণ, ঘৃণা যেখানে জয়ী সেখানে ক্ষয় এবং ধ্বংস। আকর্ষণ বিকর্ষণের তত্ত্বের ভিত্তিতে এমপিডকলিস প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর বৃত্তের তত্ত্বও তৈরি করেন। আকর্ষণ বা প্রেম জয়ী হতে হতে ক্ষুদ্রকে মহৎ করে, অসম্পূর্ণকে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এ অবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। সম্পূর্ণের মধ্যে আবার বিকর্ষণ, ঘৃণা বা অ-প্রেম উদ্ভুত হয়। ক্রমান্বয়ে ঘৃণা প্রেমকে পরাভূত করে বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে এবং সম্পূর্ণকে অসম্পূর্ণতে পর্যবসিত করে। এই তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির জগতের দ্বান্দ্বিক গতির স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু কেবল চক্রাকারে আবর্তন নয়। এমপিডকলিস এরূপও মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক জগতের একটা বিকাশও আছে। স্বধর্মী অস্তিত্বের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও সংযোজন বিকর্ষণের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অস্তিত্ব সৃষ্টি করে, বিকর্ষণকে পরাভূত করে, আকর্ষণ ও প্রেম সৃষ্টিকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করে চলে। এমপিডকলিসের এরূপ চিন্তার মধ্যে আধুনিক বিবর্তনবাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।

Empiricism: অভিজ্ঞতাবাদ
‘অভিজ্ঞতাবাদ’ হচ্ছে একটি জ্ঞান-তত্ত্ব। মানুষের জ্ঞানের উৎস কি এবং জ্ঞানের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা কি, এ বিষয়ে দর্শনে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতাবাদ বলতে এরূপ তত্ত্বকে বুঝায় যে, মানুষের ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তবে অভিজ্ঞতা কথাটি দর্শনে একটি ব্যাপক ব্যবহৃত শব্দ। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ উভয় তত্ত্বে অভিজ্ঞতার ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু ভাববাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এবং বস্তুবাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এক নয়।
জ্ঞানের উৎস কি, এটি দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্ন। সাধারণ ভাবকে জ্ঞানের উৎস বলা হয়। কোনো বিশেষ বস্তু সম্পর্কে আমরা যখন কোনো বক্তব্য প্রকাশ করি, তখন সেই বস্তুটির যে ভাব আমাদের মনে থাকে, সেই ভাবটি নিয়েই আমাদের বক্তব্য তৈরী হয়। ‘ওখানে একটি টেবিল আছে’ –এই বক্তব্যটি আমার মনে ‘টেবিলরূপ’ ভাব কিংবা ভাবসমূহের উপর একটি বক্তব্য। দর্শনে প্রথমে প্রশ্ন জাগে, মনের ভাবকে আমরা কিরূপে বা কোথা থেকে লাভ করি। এই প্রশ্নের চিরাচরিত জবাব দেকার্ত প্রমুখ যুক্তিবাদীগণ এভাবে দিয়ে আসছিলেন যে, মানুষের মনে জন্মগতবাবেই কতকগুলো মৌলিক ভাব থাকে। মানুষ এই মৌলিক ভাবগুলো বিধাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত হয়। আর জন্মগত এই মৌলিক ভাবগুলোর ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞানমণ্ডল তৈরি হয়। এক কথায় এ তত্ত্ব হচ্ছে মনসর্বস্ব তত্ত্ব। আর এ তত্ত্বে মনের ভাবের উৎস বস্তু বগতের ঊর্ধ্ব কোনো লোক। বাস্তব বা ব্সতু জগতের স্বাধীন অস্তিত্ব এ মতে অস্বীকৃত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি জ্ঞানের এ তত্ত্বকে ক্রমান্বয়ে অগ্রাহ্য করে তোলে। এবং এর জোরালো প্রতিবাদ আসে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), জন লক (১৪৩২-১৭০৪) প্রমুখ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকের কাছ থেকে সপ্তদশ শতকের জন লককেই অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান প্রবক্তা মনে করা হয়। ভাব এবং জ্ঞানের উৎস কি এ প্রশ্নে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ভাবের উৎস হচ্ছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। জন্মগতবাবে মানুষের মন আদৌ কোনো ভাব লাভ করে না। জন্মের সময়ে শিশুর মন একখানি ‘ট্যাবুলারাস’ বা ‘নিদাগ শ্লেট’ বৈ আর কিছু নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে এই ‘নিগদাগ শ্লেটে’ ভাবের দাগ এঁকে দেয়। আর সেই ভাবের দাগ দিয়েই মানুষ তার জ্ঞানজগৎ তৈরি করে। জন লকের ‘অভিজ্ঞতাবাদের’ এই বিবরণটি বিশেষ সংক্ষিপ্ত। আসলে তিনি অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন না। অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদ দ্বারা জ্ঞানের জটিল প্রশ্নের জবাব দানে অসমর্থ হয়ে তিনি মনের অন্তঃঅনুভূতিকেও ভাবের একটি উৎস বলে স্বীকার করেছিলেন।
এ আলোচনায় দেখা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদ দুরকমের হতে পারে ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদ এবং বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদ।
বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদের মত অনুযায়ী আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক –অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ হচ্ছে ভাবের বাহক এবং বস্তুজগৎ হচ্ছে ভাবের উৎসকেন্দ্র। ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের মূল। ইন্দ্রিয়ের বাইরে কোনো ভাবের সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই নিছক অভিজ্ঞতাবাদের দুর্বলতা এই যে, এরূপ তত্ত্ব দ্বারা মানুষের মনের সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ, অনুমান প্রভৃতি জটিল ক্ষমতার ব্যাখ্যা দান সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎস বটে, কিন্তু ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার স্তূপই জ্ঞানজগৎ নয়। মানুষের মন ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে ভেঙেচুরে তার জটিল যোগবিয়োগ বস্তু বগতের জ্ঞান তৈরী করেন। মানুষের মনের এই ক্ষমতাকেও স্বীকার করতে হয়। না হলে জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তূপে পর্যবসিত হয়।
ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদকে যুক্তিবাদ বলা হয়। ভাববাদের সমস্ত দার্শনিকই জ্ঞানের ব্যাপারে মূলত এই তত্ত্বকে অনুসরণ করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বার্কলের ন্যায় ভাববাদীর মতে মনের বাইরে জ্ঞেয় বলে কিছু নেই। মনের ভাবই জ্ঞানের একমাত্র বস্তু। আবার কাণ্ট এবং হেগেলের ন্যায় ভাববাদীদের মতে বস্তুজগৎ আছে বটে, আর সে বস্তুজগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির সূত্র হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক ইত্যাদি সূচক মনের এমত কতকগুলো ভাব যার উৎস হচ্ছে মানুষের অজ্ঞেয়, কিন্তু অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য এক সত্তা।

Empirio-Critism: নব অভিজ্ঞতাবাদ, ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদ
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপে ‘অভিজ্ঞতার সমালোচনা’ নাম দিয়ে আভানারিয়াস (১৮৪৩-১৮৯৬) এবং ম্যাক (১৮৩৮-১৯১৬) একটি দার্শনিক তত্ত্ব দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশেষ করে বস্তুর মৌল উপাদান সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের নবতম গবেষণাসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁরা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে আর স্বীকার করা চলে না। কাজেই বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে, যুক্তিগতভাবে একথাও ঠিক নয়। মানুষের জ্ঞান কতকগুলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগ ব্যতীত আর কিছু নয়। বাস্তব জগতে মানুষ যে কার্যকারণের বিধান আরোপ করে তাও মানুষের মানসিক ব্যাপার –বস্তুগত অভিজ্ঞতা নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘চিন্তার মিতব্যয়িতা এবং অবিচ্ছেদ্যতার সূত্র’ –অবতারণা করে এই মতবাদীগণ বলেন যে, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর অতি জোরের জন্য এই মতকে ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদও বলা চলে। তা ছাড়া জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতার যে ব্যাখ্যা এঁরা উপস্থিত করতে চেয়েছেন তা ইংল্যাণ্ডের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ভাববাদের ব্যতিক্রম বৈ নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পরে প্রতিক্রিয়ার পাল্টা আক্রমণের যুগে রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে এই চিন্তা প্রসারলাভ করাতে ভি.আই. লেনিন, ম্যাক এবং অ্যাভানারিয়েসের তত্ত্বকে তীব্রভাবে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে সমালোচনা করেন। লেনিনের মতে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সামাজিক জীবনে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির বিকাশের মুখে এ তত্ত্ব বিভ্রান্ত মধ্যবিত্তের ঈশ্বরবাদে প্রত্যাবর্তনের একটি আবরণ বিশেষ।

Encyclopadisis: বিশ্বকোষিকবৃন্দ
ফরাসিদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্য যাঁরা জ্ঞানকোষ রচনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের ‘এনসাইক্লোপিডিস্টস’ বা বিশ্বকোষিকবৃন্দ বলা হয়। যুক্তি, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যের উপর এই ফরাসি বিশ্বকোষের ১৭টি খণ্ড এবং তিনটি সংযোজনী খণ্ড ১৭৫১-১৭৮০ সনের মধ্যে প্রকাশিত হয়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের ভাব ও আদর্শগত পথ উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে এই বিশ্বকোষের এক এতিহাসিক অবদান ছিল। ডি. আলেম্বার্টের সহযোগিতায় চিন্তাবিদ এবং অদমনীয় উদ্যোগী পুরুষ ডিডেরট এই বিশ্বকোষ রচনা প্রচেষ্টার মূল শক্তি হিসাবে ১৭৭২ সন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। এই বিশ্বকোষিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অপর যাঁরা অন্তর্ভূক্ত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মণ্টেসক্যু, রুশো, ভলটেয়ার, হলবাক এবং হেলভেটিয়াস।

Engels, Fraderick: ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫ খ্রি.)
আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদী আন্দোলন এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস –এর নাম যুক্তভাবে উচ্চারিত হয়। চিন্তা, আদর্শ এবং সংগ্রামী আন্দোলনের ইতিহাসে যৌথ প্রয়াস এবং অবিচ্ছিন্ন সাথীত্বের এরূপ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। জার্মানিতে জন্ম হলেও এঙ্গেলস তাঁর সংগ্রামী জীবনের অধিকাংশকাল ইংল্যাণ্ডে অতিবাহিত করেন। ইংল্যাণ্ড আগমন করেন কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮-১৮৮৩) সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকে তাঁর আমরণ সংগ্রামী সাথীতে পরিণত হন। কার্ল মার্কস বিপ্লবী চিন্তা এবং আন্দোলনের জন্য জার্মানির তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সরকার কর্তৃক বহিষ্কৃত হয়ে ইংল্যাণ্ডে নির্বাসিতের জীবন যাপন করেছিলেন। কিমোর বয়স থেকেই এঙ্গেলস চিন্তাধারায় বস্তুবাদী এবং সংগ্রামী অগ্রসর মানুষের পক্ষভুক্ত ছিলেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান দার্শনিক শেলিং-এর ভাববাদী দর্শনকে সমালোচনা করে একখানি বই লিখেন। ১৮৪৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দ জার্মানীতে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শিল্পের শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলনের কাল ছিল। এই বিপ্লবী আন্দোলনের পরাজয়ের পরে তিনি দেশ ত্যাগ করে ইংল্যাণ্ড গমন করেন। ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশে ইংল্যান্ড তখন শীর্ষস্থানে ইংল্যাণ্ডের শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাস্তব জীবনের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা এঙ্গেলসকে ধনতন্ত্রবাদের মৌলিক বিরোধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহরূপে প্রত্যয়ী করে তোলে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এঙ্গেলস ‘ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’ নামে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কসের সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ রচনা করেন। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ ছিল তখনকার সাম্যবাদী দলগুলোর ঘোষণাপত্র। কমিউনিষ্ট ইশতেহার তখন থেকে কেবল বিপ্লবী দলের ঘোষণাপত্র নয়, মার্কসবাদী তত্ত্বের স্পষ্টতম এবং অতুলনীয় ঘোষণাসার হিসাবে পৃথিবীময় পরিচিতি আসছে। এঙ্গেলসের আর্থিক আনুকূল্য ব্যতীত মার্কসের পক্ষে ইংল্যাণ্ডে জীবন ধারণ করা এবং তাঁর সমাজবাদী গবেষণা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ত। পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণ ও সমালোচনার গ্রন্থরাজি হিসাবে মার্কসের ‘পুঁজি’ বা ‘ক্যাপিটাল’ সুবিখ্যাত। এ গ্রন্থসমূহের রচনাতে মার্কস এঙ্গেলসের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং বাস্তব সাহায্য লাভ করেন। মার্কসের মৃত্যুর পরে তাঁর ‘ক্যাপিটালের’ দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা কাজ এঙ্গেলস সমাধা করেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা, ‘এ্যাণ্টিডুরিং’, ‘লুডুউইগ ফয়েরবাক’, ‘পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থ এঙ্গেলস-এর মনীষার উদাহরণ। তাঁর অনবদ্য আকর্ষণীয় রচনা-রীতি মার্কসবাদের সামাজিক বিশ্লেষণ ও দার্শনিক অভিমতসমূহকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেক গ্রন্থেই তিনি মার্কসবাদের প্রতিপক্ষীয়দের অভিমতকে খণ্ডন করে ব্যাখ্যার মাধ্যমে মার্কসবাদের তত্ত্বে আপন মনীষার সংযোজন ঘটিয়েছেন। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ধারণাকে সমালোচ৬না করে দেখা নযে, দর্শনকে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বা এরূপ অতি-বাস্তব উচ্ছ্বাসমূল আখ্যাদান কৃত্রিম এবং অজ্ঞানতার পরিচায়ক। দর্শন কোনো রহস্যলো কনয়। দর্শনের ভূমিকা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাকে সংযুক্ত করে জানার কৌশল উদ্ভাবনে মানুষকে সাহায্য করা, কোনো অতি-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার নয়। তাঁর সমস্ত গ্রন্থেই তিনি যে-কোনো যুগ বা ব্যক্তির দর্শনের শ্রেণীচরিত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ব্যাখ্যা করে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, স্থুল বস্তুবাদ বা ইতোপূর্বকার যান্ত্রিক বস্তুবাদের সাথে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পার্থক্য আছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মনকে যেমন বস্তুর অতিরিক্ত স্বাধীন কোনো সত্তা বলে স্বীকার করে না, মনকে বস্তুর জটিল বিকাশের বিশেষ পর্যায় বলে বিচেচনা করে, তেমনি মনকে অস্বীকারও করে না। বস্তুর সঙ্গে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে সে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে। সমাজে বিকাশে মানুষের জীবিকার ভূমিকা প্রধান; কিন্তু ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকেও মার্কসবাদে নস্যাৎ করে না। জীবিকা যেমন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমনি আবার ব্যক্তিও তার মস্তিষ্ক ও মনের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা সেই বাস্তব জীবিকার অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা বহন করে। এঙ্গেলস-এর রচনাবলীতে বস্তু এবং গতি, সময় ও স্থানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, অজ্ঞেয়বাদের অসারতা, বস্তুর উপাদানের জটিল গঠন এবং তার উন্মোচিত অসীমতা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা এবং এ সব সমস্যায় তাঁর সুস্পষ্ট মার্কসবাদী অবদানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

Enthymeme: উহ্যবাক্য-যুক্তি, সংক্ষিপ্ত যুক্তি
সংক্ষিপ্ত যুক্তিকে ইংরেজিতে ‘এনথিমেমি’ বলে। একে উহ্যবাক্যযুক্তিও বলা চলে। যুক্তিবিদ্যার অনুমানের, বিশেষ করে অবরোহী অনুমানের প্রধান রীতি হচ্ছে একটি সাধারণ বাক্যের সঙ্গে একটি সাধারণ বা বিশেষ বাক্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি অনুমান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ইংরেজিতে একে সিলোজিজম বলা হয়।
সকল মানুষ মরণশীল
সক্রেটিস একজন মানুষ
সক্রেটিস মরণশীল
এই দৃষ্টান্তটি অবরোহ যুক্তির সিলোজিজম-এর একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমরা সব সময়ে এত সুশৃঙ্খল এবং ধারাবাহিকভাবে যুক্তি প্রদর্শন করি না। অনেক সময়ে মানুষ সংক্ষিপ্ত যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে। এরূপ সংক্ষিপ্ত যুক্তিতে পূর্ণাঙ্গ যুক্তির কোনো একটি অংশ উহ্য থাকতে পারে। উপরের যুক্তিটি যদি এভাবে বলা হয় যে
সকল মানুষ মরণশীল,
সক্রেটিস মরণশীল
তা হলে যুক্তিটিকে সংক্ষিপ্ত যুক্তি বলা হবে। এখানে দ্বিতীয় বাক্য ‘সক্রেটিশ একজন মানুষ’ উহ্য। এজন্য এরূপ যুক্তিকে উহ্যবাক্য-যুক্তিও বলা যায়। সিলোজিজমে সাধারণ যুক্তির অ-প্রধান বাক্য বলা হয়। সংক্ষিপ্ত যুক্তির মধ্যে প্রধান, অ-প্রধান কিংবা সিদ্ধান্ত যে-কোনো বাক্যকে উহ্য রেখেও কেউ যুক্তি প্রকাশ করতে পারে। ইংরেজিতে প্রধান বাক্য উহ্যসূচক যুক্তিকে প্রথম স্তরের এনথিমেমি বলা হয়। সিদ্ধান্ত বাক্য উহ্য থাকলে, সেটি তৃতীয় স্তরের এনথিমেমি এবং কেবলমাত্র একটি বাক্য দ্বারা যুক্তি গঠন করার চেষ্টা করা হলে তাকে চতুর্থ স্তরের এনথিমেমি বলে।

Epicurus: এপিক্যুরাস (৩৪১-২৭০ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিক এবং নীতিশাস্ত্রের এপিক্যুরিয়ানিজম বা প্রাচীন সুখবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাচীন গ্রিসে এপিক্যুরিয়ানিজম-এর প্রতিদ্বন্দ্বী মত ছিল স্টয়েসিজম বা বৈরাগ্যবাদ। এপিক্যুরাস একনিষ্ঠ জ্ঞান-গবেষক ছিলেন। ৩১০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তিনি মাইটিলেন নামক স্থানে তাঁর দর্শনাগারের প্রতিষ্ঠা করেন। সুখবাদ বলতে নির্বিচারে ইন্দ্রিয়াসক্তি এবং স্থূল সুখভোগের ধারণা এপিক্যুরাসের নীতিবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। কিন্তু এপিক্যুরাসের নিজের জীবনের মিতব্যবহার, সরল জীবন যাপন এবং সুখ সম্পর্কে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা এরূপ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে গ্রিসের সর্বস্থান হতে দর্শনশিক্ষার্থীগণ তাঁর শিক্ষাগারে এসে জমায়েত হতে থাকে। এদের মধ্যে প্রভুদের প্রাসাদের নর্তক এবং দাস সম্প্রদায়ের লোক, এমনকি মহিলাদের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়।
নীতিবাদই এপিক্যুরাসের দর্শনের মূল। তাঁর কারণ, এপিক্যুরাস মনে করতেন, জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের এমন নীতি স্থির করা যে নীতিতে মানুষ সত্যকার জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ সত্যকার শান্তিলাভে সক্ষম হবে। যথার্থ দর্শনের কাজ হবে মানুষের জীবনের যন্ত্রণা নিবারণ করা। মানুষের যথার্থ শান্তি কিসে? এ প্রশ্নের উত্তরের পূর্বে স্থির করতে হবে মানুষের কর্মের মূল চালক কি? এপিক্যুরাসেরমতে মানুষের কর্মের উৎস হচ্ছে সুখের আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের পরিহার। মানুষ স্ববাবগতভাবেই মুখের কামনা করে, সুখের অন্বেষণ করে এবং দুঃখকে পরিহার করতে চায়। কিন্তু যে- কোনো সুখই সুখ নয়। আপাতদৃষ্টিতে যা সুখময় মনে হবে, তা পরিণামে সুখদায়ক না হয়ে যন্ত্রণার কারণও হতে পারে। এজন্য মানুষকে বিবেচক হতে হবে এবং যথার্থ সুখের অন্বেষণ করতে হবে। তাকে কোনো কিছু উপভোগের ফলাফল চিন্তা করতে হবে। প্রজ্ঞা বা বিবেচনাই হচ্ছে মানুষের জীবনের হিতের মহৎ উপায়। মানসিক সুখ আর দৈহিক সুখ বলে সুখকে বিভক্তকরে দৈহিক সুখকে স্থূল আর মানসিক সুখকে বিমল ভাবার কোনো কারণ নেই। সব সুখের উৎস হচ্ছে দেহ। ক্ষুধার তৃপ্তিতেই সুখের শুরু। দেহের ক্ষুধা নিবৃত্ত না হলে মনের সুখ আদৌ আসতে পারে না। কিন্তু অবিমিশ্র মাত্রাতিরিক্ত দৈহিক সুখও যথার্থ সুখ নয়। কারণ অবিমিশ্র দৈহিক সুখ পরিণামে যন্ত্রণা ও ক্লেশের উদ্ভব ঘটায়। কাজেই দৈহিক সুখেরও পরিমাণ থাকতে হবে। বস্তুত পরিমিতি এবং ভারসাম্য বজায় রাখাই হচ্ছে মানুষের সর্বাধিক কর্তব্য। জীবনের যে ক্ষুধা অপরিহার্য এবং স্বাভাবিক কেবল তাকে তৃপ্ত করাই হবে মানুষের পক্ষে সঙ্গত। চরম সুখ, চরম উপভোগ নয়। চরম সুখ হচ্ছে সমস্ত প্রকার অভাব ও ক্লেশমুক্ত অবস্থা। এপিক্যুরাসের এই সুখতত্ত্ব যে আদৌ নির্বিচার ইন্দ্রিয় ভোগের তত্ত্ব নয়, একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বস্তুত এপিক্যুরাসের নীতি নির্দেশে যৌন ভোগ পরিহার করার উপদেশেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, এপিক্যুরাস তাঁর বস্তুবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে সুখকে জীবনের প্রধান কাম্য মনে করলেও তিনি পিরহোর বৈরাগ্যবাদ দ্বারা বিশেষ প্রবাবিত হয়েছিলেন আর তাই তাঁর নীতি দর্শনে তিনি মানুষকে জীবনের প্রয়োজন বৃদ্ধি করার বদলে সীমিত করার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর অনুসারীদের তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার নিরত হতে এবং তার মধ্যে জীবনের শান্তি লাভের আহবান জানিয়েছেন। এপিক্যুরাসের নীতিবাদ কোনো সামাজিক তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
সুখবাদ বা নীতি-তত্ত্ব এপক্যুরাসের দর্শনের কেন্দ্র হলেও তাঁর মনের জিজ্ঞাসা ছিল বিচিত্রমুখী। সত্যের মাপকাঠি কি, বস্তুর মূল সত্তা কি, আত্মা কীভাবে গঠিত, ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর মতামত সুস্পষ্ট ছিল। মানুষ দৃশ্য থেকে অদৃশ্য সম্পর্কে অনুমান করে। মানুষের কাছে দৃশ্য এবং প্রত্যক্ষ হচ্ছে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রত্যক্ষ বলে ইন্দ্রিয়ানুভূতি হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের যথার্থতা বা সত্যের পরিমাপক। মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়-লব্ধ অনুভূতির সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে মন বিশ্লেষণ, পরিমাপ, তুলনা, অনুমান ইত্যাদির ক্ষমতা অর্জন করে। বস্তুর সার বা মূলের প্রশ্নে ডিমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.) এর ন্যায় এপিক্যুরাসও অনুতত্ত্বের অভিমত প্রকাশ করেন। এপিক্যুরাসও মনে করতেন যে, বস্তুর মূলে আছে অিচিন্তনীয় রূপে সূক্ষ্মারকারের অবিভাজ্য সংখ্যাহীন অণু। অণু পরিবর্তনীয় এবং দুর্ভেদ্য। অসীম শূন্যে ঘূর্ণ্যমান অণুর আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগে সংখ্যাহীন বিচিত্র সৃষ্টির নিয়ত উদ্ভব এবং ধ্বংস সাধিত হয়। এপিক্যুরাস ছিলে নিরীশ্বরবাদী। তিনি বলতেন, মানুষকে ভূত, ভগবান এবং পরকালের ভীতি থেকে মুক্ত করতে পারলেই তাঁর মধ্যে সত্যকার সৎচরিত্রের সৃষ্টি সম্ভব হবে এবং মানুষ পরম শান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। ডিমোক্রিটাসের বিখ্যাত মনোবিদ্যারও বিকাশ ঘটে এপিক্যুরাসের হাতে। তিনি মানুষের মন বা আত্মাকে দুইভাগে বিভক্ত বলেমনে করেন। এক ভাগে হচ্ছে তার যুক্তির ভাগ। এ ভাগের অবস্থান মানুষের হৃদয়ে। মানুষের এ অংশে বিচিত্র প্রকারের অণু জটিল গতিতে সংযোজিত হয়ে মানুষের চিন্তা, ইচ্ছা, আবেগ প্রভৃতি বোধের সৃষ্টি করে। মনের অপর ভাগ হচ্ছে স্থূল বা অযুক্তির ভাগ। দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে এ ভাগের গঠন এবং এর অণুগুলি তত দৃঢ় সংযোজনে আবদ্ধ নয়। কিন্ত মানুষের এই দুই অংশ নিয়েই তার সমগ্র কাঠামো গঠিত। মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। দর্শনের ইতিহাসে এপিক্যুরাসের নাম সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম দার্শনিক হিসাবে প্রখ্যাত হয়ে আছে।

Epistemology: জ্ঞানতত্ত্ব
দর্শনের আলোচ্য বিষয়কে সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত করে দেখানো হয় জ্ঞানতত্ত্ব, পরাতত্ত্ব বা চরম সত্তার তত্ত্ব এবং নীতি বা মূল্যতত্ত্ব।
জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে জ্ঞান বলতে কি বুঝায়। জ্ঞান কি প্রকারে অর্জিত হয়? মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে কিংবা নেই ইত্যাদি। দর্শনের উল্লিখিত বিভাগগুলি তেমন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। জ্ঞানতত্ত্বেই যে কেবল জ্ঞানের প্রশ্ন নিহিত আছে, অপর বিভাগে নেই, একথা ঠিক নয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই জ্ঞানের প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু দর্শনের মূল প্রশ্নগুলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপরোক্ত বিভাগগুলি চিহ্নিত করা চলে।
দর্শনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় জ্ঞানের প্রশ্নেও কোনো একক এবং সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেই। বিশ্বরহস্যের আলোচনায় দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদী এবং বস্তুবাদী যে দুটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তারই অনুসরণে জ্ঞানের প্রশ্নেও দুটি প্রধান মত বিকাশ লাভ করেছে। একটি যুক্তিবাদী; অপরটি অভিজ্ঞতাবাদী। ‘যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্ব’ কথাটিতে ‘যুক্তি’ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যুক্তি বলতে এখানে মন বুঝান হয়। যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান ব্যাখ্যাতা হিসাবে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৪০)-এর নাম বিখ্যাত।
ইউরোপে মধ্যযুগ অতিক্রান্ত হলে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নকে আলোচ্য বিষয় করে তোলে। বাস্তবভাবে বিজ্ঞান মানুষকে বিশ্ব সম্পর্কে নানা জ্ঞানে শক্তিশালী করে তুললেও দার্শনিকগণ প্রশ্ন তোলেন, জ্ঞান বলতে কি বুঝায়? ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ কতকগুলি অনুভূতি লাভ করে। সেই অনুভূতির সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ যে কার্যকারণ, অতীত-ভবিষ্যৎ নানা বিষয় সম্পর্কে অনুমান গ্রহণ করে। জ্ঞানের প্রধান উপায় অনুমান। কিন্তু অনুমান মানসিক ব্যাপার। সেই অনুমান-দত্ত জ্ঞানের যথার্থতার নিশ্চয়তা কি? পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে –এ সিদ্ধান্ত মানুষের অনুমান। ইন্দ্রিয় মানুষকে অসংখ্য অনুভূতি দেয়। কিন্তু সেই অনুভূতিই কি জ্ঞান? বস্তুর অনুভূতি আর বস্তু কি এক? যদি এক না হয়, তা হলে অনুভূতির ভিত্তিতে বস্তু সম্পর্কে যে অনুমান গ্রহণ করা হয়, সে যে যথার্থ অর্থাৎ সিদ্ধান্ত বা অনুমান অনুযায়ী কোনো বস্তুর যে অস্তিত্ব আছে, তার প্রমাণ কি? জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলি যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়। রেনে দেকার্ত, জর্জ বার্কলে, ইমানুয়েল কাণ্ট প্রমুখ দার্শনিকের রচনায় জ্ঞানের এই প্রশ্নুগলির বিস্তৃত আলোচনা পাওয়াযায়। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবে এঁদের মতে জ্ঞান একান্ত করে মনের উপর নির্ভরশীল। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে সেই অনুভূতির বিন্যাস করে মন, কতকগুলি সাধারণ সূত্রের মাধ্যমে। আর এই সূত্রগুলির উৎস মানুসের বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়। স্থান, কাল, পাত্র, সম্পর্ক, কার্য-কারণ, নিয়মানুবর্তিতার বোধ ইত্যাদির সূত্র অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। এগুলি মানুষের জন্মগত এবং এদের উৎস অতিজাগতিক, অতিপ্রাকৃতিক, অদৃশ্য এবং অজ্ঞেয় কোনো সত্তা। কাজেই মানুষের জ্ঞানের নিশ্চয়তা ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতায় নয়। মানুষের জ্ঞানের নিশ্চয়তা নির্ভর করে বিধাতা কিংবা অজ্ঞেয় সত্তার উপর।
বেকন, হবস, লক প্রমুখ দার্শনিকগণও জ্ঞানের প্রশ্ন নিয়ে পূর্বোক্ত দার্শনিকদের ন্যায়ই বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। এঁদের জবাব অভিজ্ঞতাবাদ বলে পরিচিত। এঁদের মধ্যেও পরস্পরিক পার্থক্যের চেয়ে মিল এবং ঐক্যের সূত্র অধিক প্রবল। এঁদের মতে, জ্ঞানের উৎপত্তি মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতায়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের যেরূপ উৎস, তেমনি সমস্ত অনুমানের যথার্থতা কিংবা অযথার্থতার পরিমাপকও হচ্ছে অভিজ্ঞতা।
জ্ঞানের এই তত্ত্বে গোড়ার দিকে অনেক অসঙ্গতি ছিল। এই ধারার কোনো কোনো দার্শনিকের তত্ত্ব কেবল ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতিতে পর্যবসিত হয়েছে। কেউ কেউ অনুমান বা বিমূর্ত ধারনাকে ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হয়ে জন্মগত বা বিধিদত্ত ভাবেরও আশ্রয় গ্রহন করেছেন। ঊনবিংশ শতকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিকাশ জ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বে পরিণত করেছে। কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক, এঙ্গেলস, ভি.আই. লেনিন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবর্তক ও ব্যাখ্যাতাগণ জ্ঞানের সমস্যাটি ঐতিহাসিক বিকাশের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের মূল মাপকাঠি। কিন্তু অসংযুক্ত খণ্ড খণ্ড বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয়ানুভূতিই জ্ঞান নয়। মানুষের মন ও মস্তিষ্ক বস্তুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ভিত্তিতে বিকাশ লাভ করেছে এবং ক্রমাধিক পরিমাণে বাস্তব অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার সংযোজন, বিয়োজন, শ্রেণীকরণ ইত্যাদি বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতার উদ্ভব মানুষের মধ্যে ঘটেছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিকশিত মানুষের বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা –উভয় দিকের নিয়ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের জ্ঞান পর্যবেক্ষণ, আন্দাজ, অনুমান, প্রয়োগকরণ –মোটকথা প্রমাণ পরীক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে চলে। জ্ঞানের জন্য মানুষ বিধাতার দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের জীবন এবং বিম্বজগতের ন্যায় মানুষের জ্ঞানের কোনো সীমা মানুষের জন্য চিরস্থায়ীরূপে চিহ্নিত করা চলে না।

Essence and Appearance: মূল ও প্রকাশ
মূল ও প্রকাশ একটি দার্শনিক প্রশ্নের প্রকাশ। অস্তিত্ব বা সত্তার মূল চরিত্র এবং তার সৃষ্টি বা প্রকাশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং উভয়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ দর্শনের একটি আবহমান প্রয়াস। মানুষের প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতার সম্পর্কে জড়িত হয়, তাকে সে অপর কোনো কিছুর প্রকাশ মনে করে। গভীরতর কোনো অস্তিত্ব এবং সাধারণভাবে দৃশ্যমান তার প্রকাশের পার্থক্য-বোধ মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান বস্তু জগতের সতত পরিবর্তন থেকেই প্রথমে উদ্ভূত হয়। দৃশ্যমান জগতের অনেক কিছুই ক্ষণকালের। এই আছে, এই নাই। কিন্তু ক্ষণকালও আপেক্ষিক কথা।পরিবর্তমান জগতের কারুর স্থিরতা মুহুর্তকালের, কারুর স্থিরতা বা স্থায়িত্ব যুগব্যাপী। যে যত বেশী স্থায়ী তাকে তত বেশী মৌলিক এবং যে যত ক্ষণকালের তাকে স্থায়ী অস্তিত্বের প্রকাশমাত্র বলে মানুষ বিবেচনা করেছে। অধিকতর স্থায়ী বা স্থিরকে অধিক মূল্যদান মানুষের জীবনের প্রয়োজনের দিক থেকে স্বাভাবিক। ক্ষণকাল থেকে অধিককাল স্থায়ী অস্তিত্বের কল্পনার সঙ্গে মানুষ বস্তুর পরিবর্তনের হ্রাসবৃদ্ধিকেও যুক্ত করেছে। মানুষ মনে করেছে, যে বস্তু যত অধিককাল একরূপে স্থায়ী, তার পরিবর্তন ক্ষণকালের বস্তুর চেয়ে কম। এই পরিমাণ-বোধ থেকে মানুষ কল্পনা করার প্রয়াস পেয়েছে: এর চরম মূলে আছে যে অস্তিত্ব, সে-ই চিরস্থায়ী এবং সে অস্তিত্বের আদৌ কোনো পরিবর্তন নেই।
শুধু অপরিবর্তনীয় নয়। নিত্যকালের স্থায়ী অস্তিত্ব আদৌ বস্তু নয়। বস্তু সতত পরিবর্তিত হয়। প্রাচীন কালের প্লেটো কিংবা আধুনিক কালের কাণ্ট, হেগেল এঁরা চিরস্থায়ী কিংবা অপরিবর্তনীয় স্থির অস্তিত্বকে পরমভাব কিংবা অজ্ঞেয় সত্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে আবার চিরস্থায়ীকে একমাত্র সত্য এবং প্রকাশকে অসত্য বা মায়া বলে বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ মূল এবং প্রকাশের পার্থক্য অস্বীকার করে মুহুর্তের দৃশ্য প্রকাশকেই একমাত্র সত্য অস্তিত্ব বলে ঘোষণা করে মূলের অস্তিত্ব নাকচের প্রবণতা দেখিয়েছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অস্তিত্বের মূল এবং প্রকাশকে বৈজ্ঞানিক এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এই মত অনুযায়ী মূল এবং প্রকাশ পরস্পর নির্ভরশীল অস্তিত্ব। বীজ থেকে অঙ্কুর হয়। অঙ্কুর থেকে বৃক্ষ। এখানে বৃক্ষের মূল অঙ্কুর এবং অঙ্কুরের মূল বীজ –একথা বলা অসঙ্গত নয়। বস্তুত প্রত্যেক অস্তিত্বেরই দুটি দিক আছে: একটিকে অন্যটির তুলনায় মূল অথবা প্রকাশ বলা চলে। মূল এবং প্রকাশের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। মূল ব্যতীত প্রকাশ নেই। প্রকাশ বলতেই কোনো কিছুর প্রকাশ। আবার কোনো মূলই প্রকাশহীন হতে পারে। চরম স্থির মূল বলেও কোনো অস্তিত্ব নেই। বস্তু হচ্ছে চরম অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো প্রকাশ বা কোনো প্রকাশের অপরিবর্তনীয় নয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আবিস্কারকে স্বীকার করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলে যে, বস্তুর মূল যে, উপাদান ইলেকট্রন-নিউট্রন-প্রোটন, সে উপাদানও জটিল, নিয়ত গতিময় ও পরিবর্তনশীল।

Ether: ঈথার
মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত পদার্থ বিশেষকে পূর্বে ঈথার নামে আখ্যায়িত করা হত।
পৃথিবীর নিকটমণ্ডলে বাতাস আছে। কিন্তু যত ঊর্ধ্বে যাওয়া যায়, তত বাতাস হ্রাস পেয়ে এক পর্যায়ে শূন্য হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা প্রাচীন মানুষেরও ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্নের উদ্ভব হয় যে, পৃথিবীর অতি ঊর্ধ্বের বায়ুহীন স্তর কি পদার্থহীন শূন্যতা, না মাটি, জল, বায়ু, আগুন এই পরিচিত পদার্থের অতিরিক্ত অপর কোনো পদার্থের অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে। জগতের কোথাও বস্তুহীন শুন্যতা যে বিরাজ করতে পারে না, এ ধারণা কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের নয়, প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানীদের রচনাতেও এ ধারনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গ্রিকগণ প্রথমে মনে করত যে, পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকও বায়ুশূন্য নয়। তবে অতি ঊর্ধ্বের বায়ু অতিরূপে পরিশুদ্ধ। আর এ বায়ুর জীবন আছে এবং সে স্বর্গীয়। মহাশুন্যের ব্যাখ্যা প্রথমে দেন দার্শনিক এনাক্সাগোরাস (৫০০-৪২৮ খ্রি. পূ.)। তিনি বলেন, বিশ্বের বহির্মণ্ডলে ঈথার পরিব্যাপ্ত এবং শুন্যতা বলে বিশ্বের কোথাও কিছু নেই। ডিমোক্রিটাস তাঁর অণুতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেন, শুন্যতা যে নেই তা নয়। শূন্যতা ঈথাররূপ অণু দ্বারা পূর্ণ। এই ঈথার অণুর গতির মাধ্যমেই গ্রহ এবং তারকারাজির আবর্তন সম্ভব হচ্ছে। এ্যারিস্টটল ঈথারকে বায়ু, অগ্নি, পানি এবং মাটির সঙ্গে পঞ্চম পদার্থ বলে অভিহিত করেন। সপ্তদশ শতকের দার্শনিক এবং অঙ্কবিদ দেকার্ত বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্থানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্তানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তু পরিব্যাপ্ত। এ অভিমতের একটি গভীর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ছিল। এর ফলে কোনো স্থানকে আর মানুষের পক্ষে বস্তুশূণ্য বলে কল্পনা করা সম্ভব হলো না। স্থান মানে বস্তু, তবে মহাশূন্যের বস্তু থেকে সূক্ষ্মতর বলে কল্পনা করেছিলেন। পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে বাতাস নেই। কিন্তু সেই বায়ুশূন্য স্তর অতিক্রম করেও সূর্যের আলো পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে বাতাস নেই। কিন্তু সেই বায়ুশূন্য স্তর অতিক্রম করেও সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছে। আলো কোনো মাধ্যম ব্যতীত এই পথ অতিক্রম করতে পারে না। কাজেই মহাশূন্যে কোনো মাধ্যম অবশ্যই আছে। কিন্তু সে মাধ্যম জল, বায়ু বা ধাতব কোনো পদার্থ হতে পারে না বলে এই অনস্বীকার্য মাধ্যম ঈথার বলে আধুনিক বিজ্ঞানেও অভিহিত হয়েছে। তবে পদার্থ বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তে মহাশূন্যকে ঈথারমণ্ডল না বলে একটা বস্তুক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি