Philosophy of Antiquity : প্রাচীন দর্শন
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারাকে প্রাচীন দর্শন বলে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রাচীন দর্শনের বিকাশ ঘটে দাসের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক সমাজে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে। এবং খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রোমের দাসভিত্তিক সাম্রাজ্যে। দর্শনের এই প্রাচীন পর্যায়ের বিস্তার খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত ধরা যায়। এই প্রাচীন পর্যায়ের ইতিহাসের গোড়ার দিকে গ্রিক দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রকৃতিবাদী। সক্রেটিসের পূর্বে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন থেলিস, এ্যানাক্সিমেন্ডার, এ্যানাক্সিমেনিস এবং হিরাক্লিটাস। জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যায় এই সমস্ত দার্শনিক প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে এদের ব্যাখ্যায় নানাপ্রকার রূপক, উপাখ্যান এবং কল্পনার সাক্ষাৎ মিললেও এই যুগের দার্শনিকগণ সমস্ত অস্তিত্বের মূল হিসাবে জল, বায়ু, অগ্নি, মাটি প্রভৃতির একটি কিংবা একাধিক বস্তুকে গ্রহণ করেছেন। হিরাক্লিটাসের দর্শন কেবল বস্তুবাদি ছিল না। তাঁর মতে সকল অস্তিত্বের মধ্যে নিরন্তর পরিবর্তন চলছে। পরিবর্তন সত্য; আপাতদৃশ্য স্থিরতা কিংবা পরিবর্তনহীনতা সত্য নয়। কিন্তু অপরিণত বস্তুবাদী চিন্তার বিকাশে ক্রমাণ্বয়ে ভাববাদী বৈশিষ্ট্যেরও উদ্ভব ঘটতে থাকে। সক্রেটিস এবং প্লেটোর দার্শনিক আলোচনায় এক শক্তিশালী ভাববাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। দাস এবং অপরাপর শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন নাগরিকদের নগররাষ্ট্রে অসংগতি ও সংকট যত বৃদ্ধি পেতে থাকে তত সক্রেটিস, প্লেটো এবং এ্যরিস্টটলের ন্যায় প্রভু শ্রেণীভুক্ত চিন্তাবিদগণ তাঁদের রাষ্ট্র এবং সমাজকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দৃশ্যের পেছনে অদৃশ্য সত্তা, চরম উত্তম, ধর্ম, অবস্থার অপরিবর্তনীয়তা প্রভৃতি বিশ্লিষ্ট দার্শনিক ভাবসূত্রের জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। প্রাচীন দর্শনের বস্তুবাদী ধারার অধিকতর বিকাশ এমপিডকলিস, এ্যানাক্সোগোরাস লিউসিপাস এবং ডিমোক্রিটাসের চিন্তাধারায় দেখা যায়। বস্তুত দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে ভাববাদ ও বস্তুবাদের যে মূল দুটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার সূত্রপাত প্লেটো এবং ডিমোক্রিটাসের দর্শনেই ঘটে। লেনিন দর্শনের ইতিহাসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, দর্শনের ইতিহাসের মূল ধারার একটিকে প্লেটোর ধারা, অপরটিকে ডিমোক্রিটাসের ধারা বলেও আখ্যাত করা চলে।
Plato : প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৭ খ্রি. পূ)
প্লেটো ছিলেন গ্রিসের ভাববাদী দার্শনিক। তিনি সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন। সক্রেটিসের নিজের কোনো রচনার কথা জানা যায় না। কিন্তু প্লেটো সক্রেটিসকে নায়ক করে বিপুল সংখ্যক সংলাপমূলক দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে রিপাবলিক লজ, এ্যাপোলজি, ক্রিটো, ফিডো, পারমিনাইডিস, থিটিটাস প্রভৃতি সংলাপের নাম বিশেষ বিখ্যাত। প্লেটোর পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শনিকদের দর্শন ছিল প্র্রধানত প্রকৃতিবাদী। সে দর্শনে বস্তুর সত্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু প্লেটো তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করে ভাববাদী তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁর মতে দৃশ্য জগতের বস্তু সত্য নয়। দৃশ্য জগতের বস্তু হচ্ছে খন্ড সত্য। সমস্ত সৃষ্টির পিছনে এক সত্তা আছে যার চরিত্র বস্তুগত নয়। মূল সেই সত্তা হচ্ছে অ-বস্তু ও ভাব। দৃশ্য বস্তু হচ্ছে সেই ভাবের প্রকাশ। ভাব হচ্ছে অবিনশ্বর এবং অতিন্দ্রিয়। মূল সত্তা রূপ ভাবের কোনো সৃষ্টি কিংবা ক্ষয় নেই। স্থান এবং সময়ের উপরও সে নির্ভর করে না। এই ভাবকে প্লেটো আবার বিশ্বের আত্মা বলেও অভিহিত করেছেন। এই বিশ্ব আত্মার খন্ড প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আত্মার মধ্যে। আমাদের জ্ঞানের সঠিকতা নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মার পক্ষে বিশ্ব আত্মাকে আপন স্মৃতিকে ভাস্বর করে তোলার মধ্যে। জ্ঞানের মধ্যে প্লেটো একটা দ্বান্ধিক পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছেন। এই দ্বান্ধিক পদ্ধতির দুটি দিক। একদিকে আমরা ক্রমাধিক সাধারণীকরণের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্যে আরোহণ করি। অপরদিকে সর্বোচ্চ সাধারণ সত্য থেকে ক্রমান্বয়ে অল্প থেকে অল্পতর সাধারণ সত্যের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন বিশেষ সত্য বা ভাবে আরোহণ করি। গ্রিসের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল দাসের এবং অপরাপর শ্রমজীবি মানুষের শোষণ। প্লেটো নিজে ছিলেন অভিজাত শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ‘লজ’ বা বিধান এবং ‘রিপাবলিক’ নামক সংলাপে তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন তার ভিত্তিও তাই দাসের শ্রম। রাষ্ট্রের শাসক হবে তাই দার্শনিক সম্প্রদায়। তার রক্ষক হবে সেনাবাহিনী। দার্শনিক এবং সামরিকবাহিনী এরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সত্তার অধিকার ভোগকারী স্বাধীন নাগরিক। এদের নিচে অবস্থান হচ্ছে দাস এবং শ্রমজীবি কারিগরের। তারা শ্রম করে শাসন দার্শনিক এবং রক্ষক সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করবে। শাসক দার্শনিকদের জীবিকার জন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবার বা সম্পত্তি থাকবে না। কিন্তু তাই বলে তাদের কোনো কিছুর অভাবও থাকবে না। অভাবহীন অবকাশে তারা শাসনের কৌশল আয়ত্ত করবে এবং এইভাবে শাসন বিশেষজ্ঞ হয়ে শাসনক্ষমতার একমাত্র অধিকারী হবে। শিশুকাল হতে শাসকসম্প্রদায়ের সন্তানকে এক সার্বিক শিক্ষার মাধ্যমে শাসক হওয়ার উপযুক্ত গুণে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। প্লেটো যেভাবে রাষ্ট্রের শাসন, রক্ষণ এবং উৎপাদনমূলক কাজকে পৃথক করে এক এক সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শ্রমবিভাগের গুরুত্ব যে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু প্লেটোর শ্রমবিভাগ এবং আধুনিককালের শ্রমবিভাগ অবশ্যই পৃথক। প্লেটো্ তাঁর এই বিভাগকে কার্যত অনড় শ্রেণিবিভাগে যেমন পরিণত করেছিলেন, তেমনি এই বিভাগকে একটিকে অপর একটি থেকে উত্তম এবং অধম বলেও নির্দিষ্ট করেছিলেন। শাসনের কাজ হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। আর শ্রম দিয়ে উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও মূল্যায়নের দিক থেকে অধম কাজ। প্লেটোর ভাবগত দর্শন আর সমাজগত তত্ত্ব উভয়ই পরবর্তীকালের ভাববাদী চিন্তার বিকাশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।
Plekhanov : প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮ খ্রি.)
রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে জর্জি ভালেন্তিনোভিজ প্লেখানভের প্রসিদ্ধি। প্লেখানভের রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক জীবন অবশ্য নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। গোড়াতে তিনি একটি নারোদনিক সংগঠনের নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে রুশদেশ পরিত্যাগ করে যখন বিদেশে যান তখন তিনি মার্কস এবং এঙ্গেলস এর রচনাবলী পাঠ করেন এবং পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। এই পর্যায়ে তিনি নারোদবাদ বা সংস্কারবাদী জনতা দল পরিত্যাগ করে বিপ্লবী মার্কসবাদের আদর্শে শ্রমিকের মুক্তি নামক একটা দলের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর তত্ত্বগত রচনায় নারোদবাদ, আইনগত মার্কসবাদ, সংস্কারবাদ এবং বুর্জোয়া দর্শনকে খন্ডন করার চেষ্টা করেন। ১৯০৩ এর পরবর্তী পর্যায়ে মার্কসবাদের সঙ্গে প্লেখানভের মতদ্বৈধ দেখা যায়। মার্কসবাদের অনুসারীগণ বলেন যে, ১৯০৫ এর অভ্যুত্থান এবং প্রতিক্রিয়ার হাতে তার পরাজয়ের তাৎপর্য অনুধাবনে প্লেখানভ ব্যর্থ হন। পরিণামে তিনি বলশেভিকদের বিরোধীপক্ষ মেনশেভিকদের পক্ষ অবলম্বন করেন। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্যও তিনি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তা হলেও লেনিন এবং মার্কসবাদীগণ প্লেখানভের তাত্ত্বিক রচনাসমূহকে মার্কসবাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিশেষ মূল্যায়ন বলে মনে করেন। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে ‘ইতিহাসের অদ্বৈতবাদী ব্যাখ্যার বিকাশ’, ‘বস্তুবাদের প্রসঙ্গ’ ‘ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Plotinus : প্লটিনাস (২০৫-২৭০ খ্রি.)
প্লটিনাস গ্রিসের একজন ভাববাদী দার্শনিক। কিন্তু প্লটিনাসের জন্ম হয়েছে মিসরে এবং তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন রোম নগরে। প্লটিনাসকে নব প্লেটোবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। প্লটিনাসের ব্যাখ্যায় দর্শন অধিকতর রহস্যময় রূপ ধারণ করে। প্লটিনাসের মতে সৃষ্টি পরিক্রমার উৎস হচ্ছে এক ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বর হচ্চে মানুষের অনুধাবন বা বর্ণনার উর্ধে্ব। এই এক উৎস প্রথমে বিশ্বপ্রজ্ঞা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বপ্রজ্ঞা পরে জগতের আত্মা এবং ব্যক্তির আত্মা এবং ব্যক্তির দেহরূপে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির দেহ এবং জগতের বস্তুর কোনো সত্য অস্তিত্ব নেই। মানুষের কামনা হবে দেহের ভোগ, বাসনা, আকর্ষণ অতিক্রম করে দেহ হতে আত্মায় এবং আত্মা হতে বিশ্বপ্রজ্ঞায় আরোহণ করে পরিশেষে এক পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যাওয়া।
Plularism : বহুত্ববাদ
একত্ববাদের বিরোধী তত্ত্ব হচ্ছে বহুত্ববাদ। বহুত্ববাদের মতে অস্তিত্বের মূলে আছে বহু এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন সত্তা। এই বহুসত্তার মূলকে কোনো এক সত্তায় পরিণত করা সম্ভব নয়। বহুত্ববাদের একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে লাইবনিজের বহুমোনাডের তত্ত্ব।
Politics : রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি
রাষ্ট্রনীতি বলতে অবশ্য রাষ্ট্র সম্পর্কীয় নীতি বুঝায়। কিন্তু বহুলপ্রচলিত শব্দ রাজনীতি দ্বারা আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ বা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার আন্দোলন বুঝাই। এই অর্থে আমরা ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ‘স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন’ ইত্যাদি কথা ব্যবহার করি। রাজনীতি ব্যাপক অর্থে কেবল রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার দাবী নয়, রাষ্ট্র এবং সমাজের যে কোনো সমস্যা সমাধানের আন্দোলন বুঝাতে পারে। এই অর্থে শ্রমিকের এবং কৃষকের বা অপরাপর শ্রেণীর আর্থিক অসুবিধাসমূহ দূরীকরণের আন্দোলনও রাজনীতির অংশ। এ কারণে রাজনীতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট নীতির বদলে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষামূলক সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বুঝায়। তাই রাজনীতির প্রধান বাহন হচ্ছে সংগঠিত দল। শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষার জন্য দলগত প্রচেষ্টা আধুনিককালের সাধারণ সত্য হলেও এই প্রচেষ্টা আধুনিককালেরই বৈশিষ্ট্য নয়। উৎপাদনের উপায়ের ক্ষেত্রে সমাজ দ্বন্ধমান শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়ার সময় থেকেই দ্বন্ধমান শ্রেণীর সচেতন অংশ নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে আসছে। অনেক সময়ে একটা রাষ্ট্রের মধ্যে বহু রাজনীতিক দলের সৃষ্টি এবং কার্যক্রম দেখা যায়। কিন্তু রাজনীতির দলের সংখ্যার আধিক্য একথা বুঝায় না যে এই রাষ্ট্র এত অধিক শ্রেণিতে বিভক্ত। দলের সংখ্যা যতই হোকনা কেন মূলত তাদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান দ্বন্ধমান অর্থনীতিক শ্রেণীর স্বার্থই প্রতিফলিত হয়। বাইরে থেকে এই বৈশিষ্ট্য অনেক সময়ে আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, জীবিকার ভিত্তিতে অর্থনীতিক বিন্যাস নিয়ে তৈরি হয় সমাজের অন্তঃকাঠামো। আর এই অন্তঃকাঠামোর উপর গঠিত শাসনগত এবং রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহিঃকাঠামো। শোষিত শ্রেণীর রাজনীতিক লক্ষ্য থাকে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র দখলের মাধ্যমে পরিণামের উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা থেকে শোষক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করা। যে কোনো পর্যায়ের শাসক এবং শোষক শ্রেণীর রাজনীতির লক্ষ্যও থাকে নিজেদের দখলকৃত অবস্থানকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা। শ্রেণীহীন সমাজ হলে শ্রেণীভিত্তিক রাষ্ট্রের রাজনীতিক অবসান ঘটে এবং রাজনীতি সেখানে রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনীতিক শক্তি দখলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের পরিবর্তে সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য দিকের ক্রমিক উন্নতির জন্য মানুষের সমষ্টিগত কর্মকান্ডকে বুঝায়। এমন অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রের সংগঠিত কর্মকান্ডের আর প্রভেদ থাকে না।
Political Thought : রাষ্ট্র চিন্তা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
Political Thought, History of : রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস
রাষ্ট্র কি, রাষ্ট্রের উদ্ভব কিভাবে ঘটেছে, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের পার্থক্যের ভিত্তি কি, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক, রাষ্ট্র এবং সরকারের পার্থক্য, সরকারের প্রকারভেদ প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় সমস্যার আলোচনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় চিন্তা বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান জ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে রূপলাভ করেছে।
মানবজাতির প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলেই রাষ্ট্র সম্পর্কিত সমস্যার উপর সেই অঞ্চলের চিন্তাবিদগণ ইতিহাসের আদিকাল থেকে চিন্তা করে এসেছেন। এরূপ অনুমান করা স্বাভাবিক যে রাষ্ট্রমাত্রের সাংগঠনিক একক মানুষ হলেও এবং তার সমস্যা মূলত ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্কের সমস্যা হলেও এই সমস্যার প্রকাশ সব অঞ্চলে সর্বকালে একইভাবে ঘটে নি। মৌলিক ঐক্যের মধ্যেও অঞ্চল থেকে অঞ্চলে সমস্যা এবং সমস্যার সমাধানমূলক চিন্তার পার্থক্য বর্তমানের ন্যায় অতীতেও ছিল।
মানব সভ্যতাকে আজকাল সাধারণত পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য বা এশিয়া এবং ইউরোপীয় সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। এ বিভাগের কৃত্রিমতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এরূপ বিভাগের মূলে যে কিছু পার্থক্য রয়েছে তাও সত্য। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের প্রকৃষ্ট গবেষণা তুলনামূলকভাবে ইউরোপে এশিয়ার চেয়ে অধিক হয়েছে। ফলে এশিয়ার এবং আফ্রিকার মানুষের রাষ্ট্রীয় সত্তার বিকাশ এবং এশিয়া আফ্রিকার চিন্তাবিদদের রাষ্ট্রীয় চিন্তার পরিচয় এখনও প্রধানত অনুদঘাটিত এবং অজ্ঞাত। সে কারণে রাষ্ট্রীয় চিন্তার বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস বলতে সাধারণত ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ এবং সে অঞ্চলের চিন্তাবিদদের চিন্তার বিবর্তন এবং ইতিহাস বুঝায়।
ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম এবং উন্নতধরনের সূত্রপাত ঘটে প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রে এবং গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এ্যরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে।
প্রধানত ভৌগলিক কারণে গ্রিসে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এই সমস্ত নগর রাষ্ট্রের মধ্যে এথেন্স এবং স্পার্টা ছিল যথাক্রমে রাজনীতিক চিন্তা এবং গণতন্ত্রের বিকাশ এবং সামরিক শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের জন্য বিশিষ্ট। এথেন্সের সক্রেটিস এবং বিশেষ করে প্লেটো যখন রাষ্ট্রীয় সমস্যার উপর তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন তখন এথেন্সের গণতন্ত্রের গৌরব ও সমৃদ্ধি বিনষ্ট প্রায়। স্পার্টার সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে এথেন্স নানা রাজনৈতিক সংকটে আবিষ্ট। দাসের শোষনের ভিত্তিতে যে সভ্যতা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল সে সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকেই ন্যায়, অন্যায়, আনুগত্য, বিদ্রোহ, ব্যক্তির অধিকার ও ক্ষমতা, গুণ ও দাবি প্রভৃতি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আরম্ভ করেছে। প্লেটো এবং এরিস্টটল উভয় দার্শনিক এথেন্সের সেরা জ্ঞানীদের প্রধান ছিলেন। তাঁরা তাঁদের রচনাসমূহের মধ্যে সংকটগ্রস্থ এথেন্স তথা গ্রিক নগর রাষ্ট্রের পুরাতন রাষ্ট্রীয় আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পান। তাঁরা উভয়ে দাসপ্রথাকে সমর্থন করেছেন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে যে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা রচনা করেছেন তাতে একদল বিশেষভাবে শিক্ষিত ও দক্ষ শাসক বা দার্শনিককে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে উল্লেখ করেন যে, ন্যায় মানে হচ্ছে যার যে দায়িত্ব তার সে দায়িত্ব পালন করা। এ্যরিস্টটল প্লেটোর চেয়ে অধিক বাস্তববাদী ছিলেন। তিনি কোনো আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করার বদলে বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে সরকারের প্রকারভেদ করে প্রত্যেক প্রকার সরকারই কেমন করে স্থাযিত্ব বজায় রাখতে পারে তার পথ নির্দেশ করেন। এ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, উদ্ভব, রাষ্ট্রের অন্তর্গত শ্রেণীসমূহের বিশ্লেষণ, সরকারের প্রকারভেদ, কার্যকর রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক শর্ত এবং রাষ্ট্রের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের কারণ এবং তার নিবারণের উপায়ের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও সংজ্ঞাদানের চেষ্টা রয়েছে। এদিক থেকে এই গ্রন্থকে রাষ্ট্রীয় সমস্যার অন্যতম আদি বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্লেটো এ্যরিস্টটলের রাষ্ট্রীয় আলোচনার সুসংবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা সত্য যে, তাঁদের পক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত গ্রিক নগর রাষ্ট্রকে নতুন জীবন দান করা সম্ভব হয় নি। কিছুকালের মধ্যে সম্রাট আলেকজান্ডারের আক্রমণে েএবং পরবর্তীতে রোম সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। রোম নগরী প্রাচীন নগর রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সীমানায় সীমাবদ্ধ না থেকে কালক্রমে প্রাচীন ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যের আকার গ্রহণ করে। ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে সাম্রাজ্যের সুষ্ঠ শাসনই রোমের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা ছিল। এর ফলে ইতিহাসে রোমের অবদান সূক্ষ্মচিন্তা ও দর্শনের চেয়ে এক-কেন্দ্রিক শাসনের প্রয়োজনীয় আইন কানুন রচনা ও ব্যাখ্যা দান এবং সামরিক বাহিনী চলাচলের সড়ক নির্মাণেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপে যে দীর্ঘ পর্যায়ের সূত্রপাত ঘটে তাকে মধ্যযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই পর্যায়ে খ্রিষ্টধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে এবং পরবর্তীকালে রোমের পোপের নেতৃত্বে এক বৃহৎ যাজক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই যাজকতন্ত্র কেবল পারলৌকিক নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস পায়। সামন্ততন্ত্র যতদিন ইউরোপের প্রধান অর্থনীতিক ব্যবস্থা ছিল ততদিন খ্রিষ্টীয় যাজকতন্ত্র এবং সামন্ততন্ত্র সম্মিলিতভাবে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রের এবং কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা দান করতে থাকে। মধ্যযুগে রাষ্ট্রীয় চিন্তার প্রধান প্রশ্ন ছিল: পোপ বড় না রাজা বড়? এই প্রশ্নে যাজক সম্প্রদায়ভুক্ত চিন্তাবিদ সেন্ট বার্নার্ড, সেলিসবারি জন এবং সেন্ট টমাস এ্যকূইনাস রাজার বিরুদ্ধে ধর্ম তথা পোপের পক্ষ অবলম্বন করে পোপের সর্বাধিক ক্ষমতার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। কিন্তু যন্ত্রশিল্প এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে ইসলামের সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় এবং এর ফলে প্লেটো এ্যরিস্টটলের রচনার আরবি অনুবাদের ইউরোপ আগমন, ক্রুসেডে পোপের নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ ইত্যাদি ঐতিহাসিক কারণে পোপের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মান্ধ যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এককালে সমাজের বিকাশের ন্যায় প্রয়োজনীয় এবং প্রগতিশীল ছিল। ম্যাকিয়াভেলি(১৪৬৯-১৫২৭) বোদিন (১৫৩০-১৫৯৬) এবং হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রাজা বা শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধিকতর বিকাশ লাভ করে। এই সময়ের প্রধান চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইংল্যান্ডের বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২), জন লক (১৬৩২-১৭০৪) এবং বার্ক (১৭২০-১৭৯৭)ও ফরাসি দেশের রুশো(১৭১২-১৭৭৮) মন্টেসক্যূ(১৬৮৯-১৭৫৫)। লক এবং রুশো উভয়ই রাষ্ট্রের উদ্ভব ব্যাখ্যার জন্য সামাজিক চুক্তির উল্লেখ করেন। হবসও সামাজিক চুক্তির উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক চুক্তির যে ব্যাখ্যা হবস দেন তা যেমন লক ও রুশোর ব্যাখ্যার পৃথক, তেমনি আবার লক ও রুশোর ব্যাখ্যাও অভিন্ন নয়। হবস সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যা দ্বারা রাজা বা শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। লকের মতে, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব শাসকের উপর অর্পিত হলেও শাসক সার্বভৌম কোনো ক্ষমতা নয়। রুশো লকের এই গণতান্ত্রিক ভাবকে সম্প্রসারিত করে তাঁর সামাজিক চুক্তির ব্যাখ্যায় বলেন যে, চুক্তির মাধ্যমে জনসাধারণ যদি তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা কারোর নিকট অর্পণ করে থাকে তবে সে কোনো ব্যক্তিক শাসক নয়। সে হচ্ছে জনসাধারণেরই ‘সাধারণ ইচ্ছা’। জনসাধারণ ইচ্ছে করেই সাধারণ ইচ্ছার নিকট ব্যক্তিগত অধিকারকে অর্পণ করেছে। অর্থাৎ ব্যক্তি যেমন আর স্বাধীন শাসক হিসাবে কার্যকর থাকবে না(প্রাকৃতিক অবস্থায় সে যেরূপ ছিল) তেমনি আবার কোনো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যক্তিক শাসকেরও সে অধীন হবে না। সে তার এবং অপর সবার মিলিত সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা শাসিত হবে। কাজেই রাষ্ট্রে সরকার জনসাধারণের সাধারণ ইচ্ছার প্রতীক, জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো স্বাধীন সত্তা নয়। তার মানে, সরকার যখন জনসাধারণকে শাসন করে না, জনসাধারণই শাসন করে তখন কোনো ভিন্ন শাসক জনসাধারণকে শাসন করে না, জনসাধারণই জনসাধারণকে শাসন করে। যে ব্যক্তি তার শাসক অধিকার চুক্তির মাধ্যমে ত্যাগ করেছিল সেই আবার সাধারণ ইচ্ছার একক হিসাবে নিজেকে শাসন করার অধিকার লাভ করে। মন্টেসক্যূ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রবর্তক বলে খ্যাত। ঊনবিংশ শতকে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অর্থনীতিক ভিত্তি বিশ্লেষণ করে এবং অর্থনীতিকে রাষ্ট্রনীতির মূল ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নতুন চিন্তার যোগান দেন। হেগেলের দ্বন্ধমূলক ঐতিহাসিক পদ্ধতিকে বাস্তব সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বন্ধমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পর্যায় থেকে পুঁজিবাদী চিন্তাবিদগণও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেন। পুঁজিবাদের বিকাশ, তাঁর আভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সংকট, নতুন শক্তি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণীর জাগরণ ইত্যাদি চিন্তাবিদমাত্রকেই একথা স্বীকারে বাধ্য যে, বর্তমান রাষ্ট্রের ভূমিকা আর সুবিধাভোগী সংকীর্ণ কোনো শ্রেণীর ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষা নয়-রাষ্ট্রের ভূমকা আজ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংষ্কৃতিক সর্বপ্রকার সুবিধাকে বৃহত্তর, এমনকি সমস্ত জনসংখ্যার উপর তার শ্রেণী বা আর্থিক উপার্জনগত যোগ্যতা অযোগ্যতা নির্বিশেষে বিস্তারিত করে দেওয়া।
বর্তমানে রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থার দিক থেকে দুই শ্রেণীতে-পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক। এই দুই শ্রেণীর রাষ্ট্রের আর্থিক বুনিয়োদ একেবারে পৃথক বলে উভয় শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় সংগঠন অর্থাৎ তার সরকার, আইনসভা, রাজনীতিক দল, ব্যক্তিক অধিকার, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ইত্যাকার সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রশ্নই ভিন্ন প্রকারের। একই মাপকাঠি দিয়ে এদের উভয়কে পরিমাপ করা চলে না। সে বিচারে উভয়ের সমস্যার যথার্থ অনুধাবন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
Polytheism and Monotheism : বহু ঈশ্বরবাদ এবং একেশ্বরবাদ
বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসকে বহু ঈশ্বরবাদ এবং এক ঈশ্বরে বিশ্বাসকে একেশ্বরবাদ বলে।
আদি গোত্রভিত্তিক সমাজে অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে মানুষ প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন সজীব বা আজীব বস্তু কিংবা বস্তুর প্রতীককে পূজা করত। গোত্রতান্ত্রিক সমাজের ভাঙ্গনের পরে এবং সমাজ অধিকতর সংগঠিত রূপ নেওয়ার পর্যায়ে গোত্রপ্রতীক বা বস্তুর স্থানে শূণ্যে বা উর্ধ্বস্থানে অবস্থানকারী দেবতাকূলের উদ্ভব ঘটে। মানুষের সমাজে শ্রেণীগত পার্থক্য এবং সামাজিক সম্পর্কগত স্তরক্রম দেবতাদের জগতেও প্রতিফলিত হতো। কিন্তু তখনো সমাজ সুদৃঢ় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয় নি। তাই ছোটবড় বিভিন্ন পর্যায়ের দেবতাদের অস্তিত্ব মানুষের কল্পনায় বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন হিসেবে বজায় ছিল। কিন্তু কালক্রমে গোত্রসমাজ ভেঙ্গে দাস ও প্রভু সমাজের উদ্ভব হয়। দাসের শ্রম ও শোষণের ভিত্তিতে প্রভু শাসকগণ বৃহদাকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে। এই অবস্থার প্রতিফলনও মানুষের ধর্মীয় কল্পনার মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। দেবতাদের মধ্যেও এবার ছোটবড়র তারতম্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। যে দেবতা অধিক শক্তিশালী সে অধিক পূজ্য হতে থাকে। অবশ্য অন্যান্য দেবতাও সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে কম বেশি স্বীকৃতি পায়। সমাজে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক যুগে একচ্ছত্র সম্রাটের অধীনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামী এবং তাদের শাসিত অঞ্চলের স্থানে বৃহদাকারের রাষ্ট্র সংগঠিত হতে থাকে। ধর্মেও বহু দেবতাদের স্থানে এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ধর্মীয় ধারণায় প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। ইহুদি এবং খৃষ্টান ধর্মের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে ইসলামের মধ্যে এক স্রষ্টার কল্পনা প্রকাশিত হয়েছে।
Postmodernism : উত্তর আধুনিকতা
সময় বিশেষ করে সমাজের গতিপ্রবাহ সম্পর্কিত একটি সাম্প্রতিক প্রত্যয়ের প্রচলিত নাম হচ্ছে ‘উত্তর আধুনিকতা’। যখন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কথাটি সূর্যের মত প্রধান ছিল, তখন ‘রবীন্দ্রপূর্ব’ কথাটির সাধারণ বোধ্য অর্থ ছিল রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। কিন্তু যেমন বস্তু, তেমনি প্রত্যয়। কোন কিছুই স্থির বা অপরিবর্তিত নয়। সে কারণে বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রোত্তর বা রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কথাটিও চালু হয়েছিল। এ সব বিমূর্ত প্রত্যয় নিয়ে আলোচনায় নানা অসুবিধা দেখা দেয়। যা নিয়ে আলোচনা তা মূর্ত হলেও নানাজনের নানা মনোভাবভিত্তিক আলোচনা কেবল যে বিমূর্ত হয়ে দাঁড়ায় তাই নয়। বেশ কিছুটা নৈরাজ্যিক বা অনির্দিষ্টও হয়ে পড়ে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রোত্তর কথাটি অনিবার্য না হলেও তত দুর্বোধ্য নয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সামাজিক, বিশেষ করে সমাজের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে পোস্ট মডার্নিজম বা উত্তর আধুনিকতা কথাটি দেখতে বা শুনতে যত সহজ, তাকে ধরা তত সহজ নয়। ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিয়ে আমাদের পরিচিত বাংলাভাষার পরিমন্ডলে ‘উত্তর আধুনিকতা’ দ্বারা কেবল যে, ‘যা আধুনিক নয়’ বুঝার চেষ্টা করা যায়, তাই নয়। উত্তর আধুনিকতাবাদীদের একটি প্রবণতা হচ্ছে বস্তু জগৎকে বুঝার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি. ধারাবাহিকতা এমনকি কোনো কার্যকারণ বা ‘কজ এন্ড এফেক্ট’ রূপ কোনো অনিবার্যতার সম্পর্ককে অস্বীকার করার প্রবণতা। সব কিছু সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, কোনো কিছুই কোনো কিছুর সাথে সম্পর্কিত নয়। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কোনো কিছুই কোনো কিছুই নয় এরূপ একটি নেতিবাচক ভাবের প্রচার করা।
‘উত্তর আধুনিক’ তথা ‘পোস্ট মডার্নিজম’ কথাকে কারা কিভাবে প্রচলন করেছেন তা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট নয়। কেবল এটুকু বলা যায়, ইতিহাসে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তারও বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ উত্তর আধুনিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন অর্থহীন, তেমনি ভবিষ্যতের চিন্তাও অর্থহীন। অর্থাৎ ‘উত্তর আধুনিক’ একটি নতুন শব্দ বটে, কিন্তু শব্দটির কোনো সুনির্দিষ্ট এবং সাধারণভাবে গ্রাহ্য অর্থ এখনও নিশ্চিত হয় নি।
Pragmetism : প্রয়োগবাদ
প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদ আধুনিক দর্শনের একটি অন্তর্মুখী ভাববাদী তত্ত্ব। ইংরেজি প্রাগমেটিজম কথাটির উৎপত্তি ঘটেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রাগমা’ থেকে। ‘প্রাগমা’র অর্থ হচ্ছে কার্য সম্পাদিত বা কার্যকৃত। প্রয়োগবাদ সত্য নিরূপণ করে বিচার্য বিষয়ের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগিতার ভিত্তিতে। উইলিয়ামস জেমস প্রয়োগবাদের একজন প্রবক্তা। উইলিয়াম জেমসের মতে, আমরা কোনো কাজ করি কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কাজেই আমাদের কোনো বিশেষ কর্ম সত্য কিংবা মিথ্যা, যথার্থ কিংব অযথার্থ তার নিরূপক হবে সেই উদ্দেশ্য সাধনে তার ক্ষমতা, অক্ষমতার ভিত্তিতে। কোনো কার্য দ্বারা যদি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধিত হয় তা হলে কাজটি অবশ্যই সত্য। অবশ্য কোনো কিছুর কার্যোপযোগিতা দ্বারা প্রয়োগবাদীগণ প্রমাণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রমাণিত সর্বজনস্বীকৃত উপযোগিতাকে বুঝায় না। তাদের কাছে উপযোগিতার নির্ধারক হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব অভিমত। ব্যক্তি যদি মনে করে বিষয়টি উপযোগী তবে তা তার কাছে সত্য।
Predestination, Theory of : নিয়তিবাদ
নিয়তিবাদ হচ্ছে এই বিশ্বাস, পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে, মানুষের জন্ম, মৃত্যু, ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা সব কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা পূর্ব নির্দিষ্ট। সব ঘটনাই অনিবার্য, সব অস্তিত্বই অপ্রতিরোধ্য। নিয়তিবাদ স্বীকার করলে জগতের কিংবা মানুষের সমাজের নতুন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া কিংবা বিকশিত হওয়ার আর উপায় থাকে না। কেননা জগৎ ও সমাজ কোন্ দিকে যাবে তা ঈশ্বর পূর্বেই নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ব্যক্তি সে নির্ধারিত পথ জানে না। তাই তার কাছে ঘটনা নতুন বলে বোধ হয়। সে কারণেই সে মনে করে যে, তার নিজের ইচ্ছামতো ভবিষ্যতের জাগতিক বা সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারবে। জগতে কোনো অণুরই স্বাধীনভাবে অনির্দিষ্টপথে অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। নিয়তিবাদের তত্ত্ব মানুষকে পরিণামে সমস্যার পরিমন্ডলে অসহায় নিষ্ক্রিয় প্রাণীতে পরিণত করে। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের মধ্যে পৃথিবীর সবকিছু ঘটনাব কার্যকারণের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিশ্বে কোনো কিছুই যেমন ইচ্ছা তেমন ঘটতে পারে না। বিশ্বময় নিয়মের রাজত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানের নিয়মের রাজত্ব আর নিয়তিবাদ এক কথা নয়। নিয়তিবাদে ঘটনায় ঘটনায় কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। সব ঘটনার মূল কারণ বিধাতার কারণহীন ইচ্ছা।
Predicables : বিধেয়ক
এ্যরিস্টটল তাঁর যুক্তিশাস্ত্রে একটি যৌক্তিক বাক্যে উদ্দেশ্যপদের সঙ্গে বিধেয় পদের সম্পর্কের শ্রেণী নিরূপণের চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত যুক্তিশাস্ত্রে একটি বিধেয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে চার রকম সম্পর্কে সম্পর্কিত হতে পারে। বিধেয়র এই সম্ভাব্য সম্পর্ককে এ্যরিস্টটল প্রেডিকেবল বা বিধেয়ক বলেছেন। চার রকম বিধেয়কের নাম হচ্ছে জিনাস বা জাতি, স্পেসিস বা উপজাতি, ডিফারেনশিয়া বা লক্ষণ এবং প্রপ্রিয়াম বা উপলক্ষণ। ‘মানুষ হচ্ছে জীব’ এরূপ বাক্য বললে বিধেয়পদ ‘জীব’, উদ্দেশ্যপদ ‘মানুষ’ এর জাতি বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ‘জীব’ জাতির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মানুষ। ‘মানুষ যুক্তিবাদী জীব’ বাক্যটিতে ‘যুক্তিবাদী জীব’ বিধেয় পদটি মানুষকে অপরাপর জীব থেকে পৃথকভাবে সূচিত করছে। এ কারণে ‘যুক্তিবাদী জীব’ উদ্দেশ্যপদের ডিফারেনশিয়া বা লক্ষণ।
Primary and Secondary Qualities : মৌল এবং অমৌল গুণ
বস্তুর গুণ কোনটি মৌল এবং কোনটি অমৌল, এই পার্থক্য বিশেষ করে ইংরেজ দার্শনিক লকের(১৬৩২-১৭০৪)রচনায় দেখা যায়। লকের মতে আমরা বস্তুকে শক্ত, নরম, ছোট, বড়, নিরেট, শূণ্য, লাল, নীল, গরম, ঠান্ডা, সুস্বাদযুক্ত, বিস্বাদযুক্ত বলে অভিহিত করি। এরূপ বর্ণনায় সব গুণকেই বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বমান বলে মনে করা হয়। কিন্তু বস্তুর উপর আরোপিত সব গুণকে বস্তুর মধ্যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বময় বিবেচনা করা যায় না। লকের মতে যখন আমরা বস্তুকে শক্ত বা নিরেট বা গতিময় বা বিশেষ আকারবিশিষ্ট বলি তখন যথার্থই বস্তুর মধ্যে এই সমস্ত গুণের অস্তিত্ব দেখা যায়। কারণ এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির দেখা না দেখার উপর নির্ভর করে না । এই সমস্ত গুণ ব্যক্তির প্রধান বা মৌল গুণ। কিন্তু একটি বস্তুকে যখন লাল বা সবুজ, সুস্বাদযুক্ত, সুগন্ধিযুক্ত প্রভৃতি বলা হয় তখন এই গুণগুলি বস্তুর মধ্যে অস্তিত্বময় থাকে না। এই গুণগুলির অস্তিত্ব নির্ভর করে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদির উপর। এ কারণে ব্যক্তির এরূপ ইন্দ্রিয় বা মননির্ভর গুণ হচ্চে বস্তুর অমৌল গুণ। লকের পূর্বে গেলিলিও, দেকার্ত, হবস প্রভৃতি দার্শনিকদের রচনাতেও বস্তুর গুণের মধ্যে এই রকম মৌল এবং অমৌল কিংবা প্রধান এবং অপ্রধানরূপ পার্থক্য নিরূপণের প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে বস্তুর গুণের মধ্যে এরূপ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। বস্তুর শক্তত্ব বস্তুর মধ্যে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বময় বলেও যেমন সেই গুণকে মানুষের অনুভব করতে হয়, তেমনি বস্তুটি লাল বললেও ‘লাল’ গুণ কেবল মনের সৃষ্টি নয়। বস্তুর সঙ্গে দেহের ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক এবং মনের অনুভবের মাধ্যমেই গুণের সৃষ্টি। দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদ বস্তুর গুণের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য স্বীকার করলেও এরূপ মৌল অমৌলরূপ কৃত্রিম পার্থক্যকে স্বীকার করে না। প্রকৃতপক্ষে লকের এই পার্থক্যকরণে যে দুর্বলতা ছিল তার ভিত্তিতে ভাববাদী দার্শনিক বার্কলে এবং অজ্ঞেয়বাদী হউম লকের মৌল, অমৌল সকল গুণকেই মানসিক ভাব মাত্র বলে বর্ণনা করেছেন।
Primitive Communal System : আদি সাম্যবাদী ব্যবস্থা
সমাজের উৎপাদনী শক্তি বলতে উৎপাদনের য্নত্র, যন্ত্র ব্যবহারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ এবং শ্রমের স্বভাব বা আগ্রহ বুঝায়। বিভিন্ন উপাদান নিয়ে যে উৎপাদনী শক্তি তার মধ্যে যন্ত্রব্যবহারকারীর শ্রমিকে ভূমিকাই প্রধান। শ্রমিক একদিকে যেমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সম্পদ উৎপাদন করে তেমনি শ্রমের মাধ্যমে যন্ত্রের ক্রমাধিক উন্নতি তারাই সাধন করে, অর্থাৎ যন্ত্রের সঙ্গে শ্রমিকের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এবং অভিজ্ঞতা যনেত্রর উন্নতির মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। শ্রমশক্তির উৎপাদনী ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির মূলেও শ্রমিক। মানুষের সমাজের বিশেষ পর্যায়ের উৎপাদনী শক্তির অবস্থা প্রকৃতির উপর সেই সমাজের শক্তির পরিমাণের পরিচায়ক। উৎপাদনী শক্তি প্রতি মুহুর্তেই পরিবর্তিত ও উন্নত হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সাধারণত দেখা যায় যে, শ্রমের যন্ত্রের উন্নতি ঘটে প্রথমে। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত যন্ত্রের স্থলে উন্নততর যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। উন্নততর যন্ত্রের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ভিন্নতর শ্রম বা উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয়। অবশ্য একটিমাত্র উন্নত যন্ত্রের আবিষ্কারেই যে ভিন্নতর উৎপাদন সম্পর্কের আবশ্যক হয় এমন কথা বলা হচ্ছে না। ব্যাপকভাবে যন্ত্রের যখন উন্নতি ঘটে তখন দেখা যায় যে, পূর্বকার উৎপাদন সম্পর্ক যেমন উন্নততর যন্ত্র ব্যবহারে উপযুক্ত নয়, তেমনি পুরাতন সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপাদনও আর বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে এরূপ দ্বন্ধের নিরসন হয় বিপ্লবের মাধ্যমে নতুনতর উৎপাদন সম্পর্ক এবং সমাজ প্রতিষ্ঠায়।
Proof of the existence of God : বিধাতার অস্তিত্বের প্রমাণ
ধর্মের মূল হচ্ছে এই বিশ্বাস যে, বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে। কিন্তু ধর্মের মধ্যে এই দাবির কোনো যুক্তিগত প্রমাণ পাওয়া যায় না। ভাববাদী দর্শন বিভিন্ন যুক্তিদ্বারা বিধাতার অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে ধর্ম ও ভাববাদী দর্শন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভাববাদী দর্শন বিদাতার অস্তিত্বের পক্ষে তিনরকম যুক্তিগত প্রমাণ উপস্থিত করার চেষ্টা করেছে। যেমনঃ ১. জগতের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যুর প্রমাণ দেখা যায়। সবকিছুর সৃষ্টি এবং লয় আছে। সবকিছুর ক্ষেত্রে জন্ম এবং মৃত্যুর কথা যদি সত্য হয় তা হলেও সমগ্র জগৎ সম্পর্কেও একথা সত্য। অর্থাৎ জগৎকেও এক সময় সৃষ্ট হতে হয়েছে। সৃষ্ট হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে-সৃষ্টি, তার সত্তা থেকে পৃথক অপর কোনো সত্তার অস্তিত্ব থাকা। পৃথক সেই সত্তার কারণে অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছায় এবং চেষ্টায় সৃষ্টের অস্তিত্ব। বিধাতা হচ্ছেন জগতের বাইরের সেই কারণ মূল কারণরূপ সত্তা। এই যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে, বিশ্ব-যে কোনো বিশেষ বস্তুর ন্যায়ই সীমাবদ্ধ অর্থাৎ সসীম এক সত্তা। এবং যেহেতু সে সসীম, সে কারণে তার পক্ষে ভিন্নতর কোনো শক্তি ব্যতীত অস্তিত্বময় হওয়া সম্ভব হয় নি। দর্শনের এ প্রমাণে যুক্তির চেয়ে ধর্মের ন্যায় বিশ্বাসকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। বিশ্বজগৎ যে সসীম এটা ভাববাদী দর্শনের অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসমাত্র। এই যুক্তির প্রকারভেদ আমরা প্লেটো, এরিস্টটল এবং লাইবনিজ দর্শনের মধ্যে পাই। ২. বিশ্বস্রষ্টার দ্বিতীয় দার্শনিক প্রমাণ হচ্ছে ‘উদ্দেশ্যগত’ প্রমাণ। এ প্রমাণের ভিত্তি হচ্ছে এই যুক্তি যে, বিশ্বের সমস্ত ঘটনার মধ্যে উদ্দেশ্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকার অর্থ উদ্দেশ্যের পিছনে এক উদ্দেশ্যদাতা আছে, যার সচেতন চেষ্টাতেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কাজেই বিশ্ব যখন উদ্দেশ্যহীন নয় তখন বিশ্বের পিছনে অতিজাগতিক এক শক্তি আছে যার ইচ্ছাতে বিশ্ব উদ্দেশ্যময় হয়ে কর্মরত আছে। ৩. তৃতীয় প্রমাণ হচ্ছে : মানুষের মনে আদিকাল হতে বিশ্বস্রষ্টার একটা ভাব বর্তমান আছে। মানুষ মনে করে অসীম শক্তিশালী এবং সম্পূর্ণ এক স্রষ্টা আছে। যদি কোনো সত্তা না থাকে তা হলে মানুষের মনে এরূপ ভাব সৃষ্টি হতে পারতো না। কাজেই এরূপ অসীম শক্তিসম্পন্ন এবং সুসম্পন্ন এক স্রষ্টার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। অর্থাৎ যা মনে আছে তা অবশ্যই অস্তিত্বে আছে। বিধাতার অস্তিত্বের যে কোনো যুক্তির মূল দুর্বলতা হচ্ছে, একটি বিশ্বাসকে একইভাবে একদিকে সব অস্তিত্বের মূল বা কারণ এবং অপরদিকে সব অস্তিত্বকে সেই বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার চেষ্টা করা। িএর মধ্যে প্রতিপাদ্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করার অসঙ্গতি বিদ্যমান। বিধাতা সব অস্তিত্বের মূলে আছে। সব অস্তিত্ব বিধাতাই সৃষ্টি করেছেন। আবার সব অস্তিত্বই বিধাতার অস্তিত্বকে প্রমাণ করেছে। ভাববাদী জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বিধাতার অস্তিত্বকে এরূপভাবে প্রমাণ করার অসারতা উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে, বিধাতা হচ্ছেন অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব একটা বোধ। তাঁকে বিশুদ্ধ চিন্তা দ্বারা একজন অনুভব করতে পারেন কিন্তু বাস্তব জগতের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রমাণ করা চলে না। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিধাতাকে মানুষের কল্পনা বলে মনে করে। মানুষের এরূপ কল্পনার আবশ্যকতা ছিল কিংবা আছে বলা এক কথা, আর সেই প্রয়োজনের কারণে বিধাতাকে অস্তিত্বময় বলা আর এক কথা। বিশ্ব সসীম নয়। বিশ্বের বাইরে অ-বিশ্ব বা অ-বস্তু বলে কিছু কল্পনা করা চলে না। বিশ্ব হচ্ছে বস্তু। আর বস্তু হচ্ছে গতিময়। বস্তুর বৈচিত্র্য, মানুষ, মন সবই গতিময় বস্তুর রূপ।
Proposition : প্রতিজ্ঞা, যৌক্তিক বাক্য
যুক্তিশাস্ত্রে দুটি পদের মধ্যে একটি সম্পর্কের উল্লেখমূলক বাক্যকে যৌক্তিক বাক্য বলে। ইংরেজিতে যৌক্তিক বাক্যকে প্রপোজিশন বলা হয়। রহিম একজন মানুষ অথবা রহিম হয় একজন মানুষ, একটি যৌক্তিক বাক্যের দৃষ্টান্ত। এখানে ‘রহিম’ এবং ‘মানুষ’ বাক্যের দুটি পদ : উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদ। বাক্যটিতে এ দুটি পদের মধ্যে একটি সম্পর্কের উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজিতে ক্রিয়াপদকে যৌক্তিক পদের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদের মধ্যকার সংযোজক বা ‘কপুলা’ বলা হয়। বাংলায় অনেক সময় উদ্দেশ্য ও বিধেয় পদের মধ্যে ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে। যুক্তির মাধ্যমে ব্যবহৃত যৌক্তিক বাক্য প্রথমে মনের মধ্যে গঠিত হয়। মনের অপ্রকাশিত বাক্যকে মানসিক বাক্য বলা যায়। ইংরেজিতে একে জাজমেন্ট বলা হয়। উদ্দেশ্য এবং বিধেয় পদের মধ্যকার সম্পর্কটি হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক হতে পারে। আবার বিধেয় পদটি উদ্দেশ্য পদের সংখ্যা বা ব্যক্তার্থের সমগ্র কিংবা উহার অংশবিশেষ সম্পর্কে বিবৃত হতে পারে। সম্পর্কের এ প্রকারভেদের ভিত্তিতে যুক্তিশাস্ত্রের প্রচলিত বাক্য-বিন্যাসের ক্ষেত্রে যৌক্তিক বাক্যকে ১. হ্যাঁ বাচক, ২. না বাচক, ৩. সার্বিক এবং ৪. বিশেষ এই চারভাগে ভাগ করা যায়। ‘সকল মানুষ মরণশীল’ ইহা একটি সার্বিক হ্যাঁ বাচক বাক্য। এখানে ‘মরণশীল’ বিধেয় পদটি ‘মানুষ’ পদের সকল সংখ্যা সম্পর্কে হাঁ বাচকরূপে বিবৃত হয়েছে। ‘কোনো মানুষ অমর নয়।’ এখানে ‘অমর’ বিধেয় পদটি ‘মানুষ’ পদের সমগ্র সম্পর্কে না বাচকরূপে বিবৃত হয়েছে। এটি সার্বিক না বাচক বাক্য। ‘কিছু মানুষ সৎ’ এটি একটি বিশেষ হাঁ বাচক বাক্য। এবং ‘কিছু মানুষ সৎ নয়’ এটি একটি বিশেষ না বাচক বাক্য। যৌক্তিক বাক্যের এ প্রকারভেদকে সংক্ষেপে সা. হ্যাঁ; সা, না এবং বি. হ্যাঁ; বি, না রূপে উল্লেখ করা যায়।
Protagoras : প্রোটোগোরাস (৪৮১-৪১১ খ্রি.পূ)
প্রোটোগোরাস ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। প্রচলিত দার্শনিক মতামতের বিরোধী এবং জনপ্রিয় প্রচারকদের সফিস্ট বলা হতো। প্রোটোগোরাসের দর্শনের জন্য তাঁকেও একজন সফিস্ট বলে গণ্য করা হতো। দেবতাদের ব্যাপারে বা ‘অন দি গডস’ নামে তাঁর দেবতা বিরোধী রচনার জন্য প্রোটোগোরাসকে এথেন্স নগর হতে বহিষ্কার করা হয় এবং তাঁর গ্রন্থ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত প্রোটোগোরাসকে একজন অবিশ্বাসী এবং চরম প্রয়োগবাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু তাঁর রচনার এরূপ ব্যাখ্যাও করা যায় যাতে প্রোটোগোরাসকে চরম অবিশ্বাসী অর্থাৎ জগৎ, বস্তু কোনো কিছুতেই প্রোটোগোরাস বিশ্বাস করতেন না, একথা বলা যায় না। প্রোটোগোরাস বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর মতে, বস্তু অস্থির এবং সব কিছুর কারণ বস্তুতে নিহিত।
Protestantism : প্রোটেস্টান্টবাদ
গোঁড়া খ্রিষ্ট ধর্ম, ক্যাথলিক বা রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্ট ধর্ম এবং প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্ম-এই তিনটি হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে তিনটি প্রধান শাখা। ইউরোপের মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে সংস্কারবাদী আন্দোলনের যুগে প্রোটেস্টান্টদের উদ্ভব ঘটে। প্রোটেস্টান্টবাদ গোঁড়া খ্রিষ্টান ধর্মের ধর্মীয় পুরুষ, যিশু খ্রিষ্টের মাতার অলৌকিক উপাখ্যান কিংবা নরক ও স্বর্গের মধ্যবর্তী কোনো শোধনাগারের কল্পনাকে স্বীকার করে না। প্রোটেস্টান্টদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রোটেস্টান্টবাদ ঈশ্বর এবং ব্যক্তির মধ্যে অপর কোনো মাধ্যমের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। প্রোটেস্টান্টবাদের মতে ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক হচ্ছে প্রত্যক্ষ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতে ব্যক্তির পক্ষে যাজক বা গির্জার কোনো প্রয়োজন নেই। ব্যক্তির মুক্তি নির্ভর করে ঈশ্বরের উপর তার বিশ্বাস এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর। কোনো ধর্মজাযকের সুপারিশের উপর নয়। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের উপর খ্রিষ্ট যাজক সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র্য আধিপত্যের ক্ষেত্রে প্রোটেস্টান্টবাদের এই অভিমত বিরাট আঘাতস্বরূপ। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর রোমের পোপতন্ত্রের আধিপত্যে ভাঙ্গন শুরু হয়। পোপতন্ত্র রাষ্ট্রীয় শাসন এবং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হতে শুরু হয়। প্রোটেস্টান্টবাদ ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির সাক্ষাৎ সম্পর্কের কথা বলে ব্যক্তির নিজস্ব শক্তি এবং দায়িত্ববোধকে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। সামন্ততন্ত্র এবং ধর্মীয় কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীল বিধিবন্ধন থেকে ব্যক্তির মুক্তি সাধনে এবং বুর্জোয়া বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করণে প্রোটেস্টান্টবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Proudhon : প্রুধোঁ (১৮০৯-১৮৬৫ খ্রি.)
পিয়েরী জোসেফ প্রুধোঁ ছিলেন ফরাসি রাজনীতিক, দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ এবং অর্থনীতিবিদ। তাঁকে নৈরাষ্ট্রবাদের একজন প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। দর্শনের ক্ষেত্রে প্রুঁধো ছিলেন প্রধানত ভাববাদী। তিনি হেগেলের দ্বান্ধিকতাকে সরল এবং স্থুল করে কেবল কেবলমাত্র ভাল, মন্দের দ্বন্ধ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ইতিহাস হচ্ছে, প্রুধোঁর মতে ভাবের দ্বন্ধ ক্ষেত্র। প্রুধোঁর একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতিক উক্তি হচ্ছে : ‘প্রপারটি ইজ থেফট’ বা সম্পত্তি চুরির ধন। কিন্তু এমন উক্তি দ্বারা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে তিনি নাকচ করেন নি। এ উক্তির আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বড় পুঁজিবাদী সম্পদ। প্রুধোঁ কল্পনা করেন যে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে একের সঙ্গে অপরের ন্যায্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হলে পুঁজিবাদের অসঙ্গতি দূর হয়ে যাবে। প্রুধোঁর একখানি পরিচিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘ফিলসফি অব পভারটি’ বা ‘দারিদ্রের দর্শন’। মার্কস প্রুধোঁর এই গ্রন্থের সমালোচনা করে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন এবং তার নাম দেন ‘পভারটি অব ফিলসফি’ বা ‘দর্শনের দারিদ্র’।
Psycho-Analysis : মনঃসমীক্ষণ
সিগমন্ড ফ্রয়েড(১৮৫৬-১৯৩৯) প্রবর্তিত স্নায়বিক এবং মনোবিকারের বিশেষ নিরাময় পদ্ধতি এবং মনোজগতের বিশেষ বিশ্লেষণকে মনঃসমীক্ষণ বলা হয়। মনঃসমীক্ষণের মতে, মানুষের মন চেতন ও অচেতনে বিভক্ত। মনের চেতন অংশ সামাজিক বিধি নিষেধের প্রভাবে গঠিত। কিন্তু এই চেতন অংশের পরিমাণ বা পরিধি খুবই অল্প।প্রতিমুহুর্তে মানুষের মনের কামনা বাসনা এবং ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত থেকে যত ভাবের সৃষ্টি হয় তার খুব অল্প অংশ চেতনার জগতে অবস্থান করে। যৌন অনুভূতি হচ্ছে ব্যক্তির জীবনের প্রধান উদ্দীপক এবং অনুপ্রেরক। যৌন অনুভূতি বলতে যে কেবল দৈহিক অনুভূতি বুঝায় তা নয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালবাসা, সন্তানের প্রতি মায়ের মমতা, কন্যার উপর পিতার বাৎসল্য, সমাজে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা, সাহসী কাজ সম্পাদন দ্বারা অপরের প্রশংসা অর্জনের সুখানুভূতি প্রভৃতি সবই যৌনানুভূতির প্রকাশ। ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তির ইচ্ছা, অনিচ্ছা, কামনা, বাসনা প্রয়োজন খুব কমই পূর্ণ হয়। ব্যক্তি সমাজ ও পরিবেশকে দেখে তার নিজের কামনা বাসনার প্রতিরোধী শক্তি হিসাবে। ব্যক্তির অপূর্ণ বাসনা আপাত দৃষ্টিতে মরে গেলেও প্রকৃতপক্ষ এগুলি মরে যায় না। ব্যক্তির মনের অচেতন ভান্ডারে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে এবং প্রতিমুহুর্তে নিজেদের তৃপ্তির পথ অন্বেষণ করে। অপূর্ব এবং অবাঞ্চিত কামনা সচেতন এবং পরিচিতভাবে নিজেদের তৃপ্ত করতে পারে না। চেতনা সামাজিক প্রহরী হিসেবে অচেতনের দ্বারে প্রহরারত থাকে। অবদমিত অপূর্ণ কামনা নিরন্তর চেষ্টা করে প্রহরী চেতনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অচেতনের বদ্ধ গুহা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়াদিকে ভর করে নিজেদের তৃপ্ত করতে। যে কামনা স্বাভাবিকভাবে তৃপ্ত হতে পারে নি, সে কামনাই ব্যক্তির স্বরূপে কিংবা অরূপে, ব্যক্তির স্নায়বিক বিকারে আত্মপ্রকাশ করে এবং তৃপ্ত হতে চায়। মনঃসমীক্ষণে মানসিক বিকার মুখ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। মানসিক বিকার নিরাময়ের প্রধান পদ্ধতি হিসাবে মনঃসমীক্ষণ রোগীর স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবাধ স্মৃতিচারণের উপর জোর দেয়। মনঃসমীক্ষণবাদের মতে মনোবিকারের মূল কারণ অতৃপ্তি এবং অবদমন। কাজেই নিরাময় হিসাবে প্রয়োজন হচ্ছে অবদমিত কামনাকে ব্যক্তির চেতনার মধ্যে ফিরিয়ে আনা। ব্যক্তির চেতনা নিজের কামনাকে অবদমনের ফলে চিনতে না পারার কারণিই নিজের কামনার প্রকাশের সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ বাধে; ব্যক্তি তাকে সচেতনভাবে না স্বীকার করতে পারে, না তাকে নিজের স্নায়ুকোষ হতে বিতাড়িত করতে পারে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ব্যক্তি যদি দেখতে পায় যে, যে কামনাকে সে আবাঞ্চিত ও বৈরী কামনা বা শক্তি বলে মনে করছে সে কামনা তারই প্রয়োজনের সৃষ্টি, তা হলে এই স্বীকৃতিই অতৃপ্ত কামনার তৃপ্তি ঘটাতে সাহায্য করবে এবং ব্যক্তির চেতনার সঙ্গে অবদমিত কামনার বিরোধও দূরীভূত হবে। এককালে, বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে মনঃসমীক্ষণ বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ব্যক্তির মানসিক জগতের বিশ্লেষণের ফ্রয়েডের বিশেষ অবদানের কথা স্বীকার করেও বলা যায় যে, ফ্রয়েডের এই বিশ্লেষণ প্রধানত ভাববাদী এবং সমাজের বাস্তব অবস্থায় বিবেচনাহীন। ব্যক্তি সামাজিক জীব। সামাজিক পরিবেশ তার কামনা বাসনাকে তৈরি করে এবং তার তৃপ্তি, অতৃপ্তির কারণ হয়। ফ্রয়েডের এ তত্ত্ব ঠিক। এবং এর অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে তাই বলতে হয় যে, মনোবিকারের মূল সমাজ, ব্যক্তির মন নিজে নয়। তাই সামাজিক পরিবেশের আনুকূল্য বা প্রতিকূলতাকে কেন্দ্র ব্যক্তির মনোবিকারের বৃদ্ধি বা হ্রাসের, সৃষ্টি বা নিরাময়ের মূল কারণ এবং উপায় হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। সমাজের সঙ্গে সম্পর্কশূণ্যভাবে ব্যক্তির মনকে স্বাধীন সত্তা হিসেবে চিন্তা করলে তার বিকারের সার্থক নিরাময়ের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই কারণে মনঃসমীক্ষণ ও তার প্রাথমিক চমকের পরে আর তেমন কার্যকর অগ্রগতি সাধনে সক্ষম হয় নি। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবাদী অনুসারীদের মধ্যে ইয়ং এবং এ্যাডলারের নাম উল্লেখযোগ্য।
Pyrtho : পিরহো (৩৬৫-২৭৫ খ্রি.পূ)
প্রাচীন কালের গ্রিক দার্শনিক পিরহোকে সন্দেহবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। পিরহোর প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল নীতিশাস্ত্র এবং ব্যক্তির সুখ দুঃখের সমস্যা। তাঁর কাছে সুখ যেমন দুঃখশূণ্যতা, তেমনি তা ব্যক্তির নিস্পৃহতার মধ্যেও নিহিত। জ্ঞানের প্রশ্নে পিরহো সন্দেহবাদী ছিলেন। তাঁর অভিমতে, আমরা বস্তু বা সত্তা সম্পর্কে কিছু যথার্থভাবে জানতে পারি নে। সে কারণে কোনো কিছু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আমরা গ্রহণ করতে পারি নে। জীবনের সকল সমস্যার ব্যাপারে নিস্পৃহ এবং নিরুদ্বিগ্ন থাকাই হচ্ছে মনের শান্তির আসল উপায়।
Pythagoras : পাইথাগোরাস (৫৮০-৫০০ খ্রি.পূ)
পাইথাগোরাস ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। তাঁর অনুসারীগণকে পাইথোগোরিয়ান বলা হতো। অঙ্ক এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশে পাইথোগোরাস এবং তাঁর অনুসারীদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাইথোগোরাস এবং তার অনুসারীদের মতে বিশ্ব অস্তিত্বের মূল হচ্ছে সংখ্যা। তাঁর অনুসারীগণ সংখ্যার উপর অলৌকিক ক্ষমতাও আরোপ করতেন। সংখ্যা ছিল তাঁদের কাছে শক্তির প্রতীক। বস্তুত সংখ্যার এই দর্শন কালক্রমে এই রহস্যময় ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপ গ্রহণ করে এবং পাইথোগোরাস দক্ষিণ ইতালিতে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন গ্রিসে দাসের শোষণভিত্তিক সমাজে পাইথোগোরাসের রহস্যবাদী সংখ্যা দর্শন এবং ধর্ম অভিজাত শাসকশ্রেণীর হাতিয়াররূপে ব্যবহৃত হয়।
Quality and Quantity : গুণ এবং পরিমাণ
বস্তুর দুটি দিক। একটি তার গুণের দিক, অপরটি পরিমাণের। গুণ বলতে কোনো বস্তুর সত্তানির্ণয়ক বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র বুঝায়। গুণের বর্ণনার দ্বারা বস্তুকে বুঝার সঙ্গে বস্তুর বিরামহীন পরিবর্তনশীলতা এবং তার আপেক্ষিক স্থিরতার প্রশ্নটি জড়িত। কোনো বস্তুই স্থির নয়। অণুর সংগঠনে বস্তু। কিন্তু অণু গতিময়, তাই বস্তু গতিময়। এই অস্থিরতায় বস্তুকে কোনো নির্দিষ্ট মুহুর্তে ‘এই বস্তু’ কিংবা ‘ঐ বস্তু’-অর্থাৎ এই গুণসম্পন্ন বস্তু বা ঐ গুণসম্পন্ন বস্তু বলা অসম্ভব বলে বোধ হয়। তথাপি আমরা ব্যবহারিক জীবনে বস্তুকে বিশেষণ দ্বারা নির্দিষ্ট করি। বস্তুর বিশেষণের ভিত্তিতে বস্তুকে আমরা পর্যবেক্ষণ করি এবং তার পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এটা সম্ভব এই কারণে যে, বস্তুর পরিবর্তনশীলতা সত্ত্বেও আপেক্ষিকভাবে নির্দিষ্ট মুহুর্তে একটি সংগঠন অপর বস্তু বা সংগঠনের সঙ্গে তার সহস্র সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্টতায় স্থির থাকে। বস্তুর পরিবর্তনের সঙ্গে তার পরিমাণের প্রশ্নটিও জড়িত। মূলত বস্তুর পরিবর্তন ঘটে তার অণুর সাংগঠনিকতায়। অণুর সাংগঠনিতায় ক্রম পরিবর্তনে নতুন সাংগঠনিতার উদ্ভব ঘটে আর এই নতুন বিন্যাসই নতুন গুণসম্পন্ন বস্তু বলে দৃষ্ট হয়। প্রকৃতি বিজ্ঞানে এর সহজ দৃষ্টান্ত উত্তাপে কিংবা শৈত্যের পরিমাণ বৃদ্ধিতে পানির বাষ্প কিংবা বরফে রূপান্তরিত হওয়া। বস্তুর এই পরিবর্তনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, পরিবর্তনের পরিমাণ একটি বিশেষ আকার কিংবা মুহুর্ত প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বস্তুর বাহ্যিক গঠন অপরিবর্তিত বলে বোধ হয় এবং এই বাহ্যিক গঠনকে বিশেষ গুণ দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। পানিতে তাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পেতে একটি মুহুর্তে পানি পরিবর্তিত হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। পানিকে তরল পদার্থ বলে আমরা চিহ্নিত করি। অথচ তাপের মাধ্যমে পানি নিরন্তর তরল হতে বাষ্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তথাপি যেহেতু উত্তাপের বিশেষ মুহুর্তের পূর্ব পর্যন্ত পানির তরলতা পরিবর্তিত হয়ে যায় না, এ কারণে এই বস্তুটিকে তার নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা সত্ত্বেও একটা সময় পর্যন্ত পানি বলে অভিহিত করতে পারি। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে পানি, ততক্ষণ পর্যন্ত তার চরিত্র অবশ্যই তরল।
Quietism : শান্তিবাদ
শান্তিবাদ বলতে ইউরোপে সপ্তদশ শতকে ক্যাথলিকবাদের একটি ধর্মীয় এবং নৈতিক তত্ত্বকে বুঝানো হয়। শান্তিবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঈশ্বরের নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, কষ্টভোগ সবকিছুকে প্রতিরোধহীনভাবে গ্রহণ করা। শান্তিবাদকে এ দিক থেকে যে কোনো ধর্মের নিয়মিতবাদেরই প্রকাশ বলে বিবেচিত করা যায়। নিষ্কিৃয়তা এবং দুঃখ কষ্টের ব্যাপারে নিস্পৃহতার তত্ত্ব শপেনহারের দর্শনেও পাওয়া যায়।
Racialism : জাতিতত্ত্ব
জাতিতত্ত্ব একটি প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর সব জাতিরই সমানভাবে উন্নত হওয়ার অধিকার নেই। যে জাতির রক্ত বিশুদ্ধ তারাই উন্নত হতে পারে এবং অপর জাতির উপর তাদের শাসন করার অধিকার আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মানীতে এডলফ হিটলারের নাজি দল এই তত্ত্বের ভিত্তিতে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন। হিটলার ‘মাইনকেমফ’ নামক যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন তাতে এই স্থূল ও প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব তিনি জঙ্গি মনোভাব নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। হিটলার এবং তাঁর অপরাপর তাত্ত্বিকদের মতে জার্মান জাতি হচ্ছ বিশুদ্ধ আর্য জাতি হতে উদ্ভূত। এবং আর্য জাতি হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি। আর সকল জাতিকে শাসন করার অধিকার তাদের আছে। এই বিশুদ্ধ জার্মান জাতির একচ্ছত্র অধিকার বিস্তারের অজুহাতে হিটলার ইউরোপের দুর্বল জাতিগুলিকে গ্রাস করতে আরম্ভ করেন। এবং এর পরিণামে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিজেকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টায় উপজাতিতত্ত্ব এর আশ্রয় গ্রহণ করে। উন্নতির সম্ভাবনার ক্ষেত্রে জাতিতে জাতিতে জন্মগত কোনো পার্থক্য নেই। ঐতিহাসিক কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের ফলেই জাতিতে জাতিতে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সাম্রাজ্যবাদ এই পার্থক্যকে চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য জাতিতত্ত্বের সৃষ্টি করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্য, সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিস্তার এবং এর ফলে অঞ্চল এবং জাতি নির্বিশেষে পূর্বকার অনুন্নত জাতিসমূহের বিস্ময়কর সামাজিক, রাজনীতিক এবং অর্থনীতিক উন্নতি জাতিতত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছেন।
Radhakrishnan, Sarbapalli : সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞন (১৮৮৮-১৯৭৫ খ্রি.)
আধুনিক ভারতের অন্যতম ভাববাদী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞন আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষ পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন ব্যতীত তিনি অক্সফোর্ড, মস্কো, শিকাগো বিভিন্ন স্থানের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে দর্শনের অধ্যাপনা করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনও উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন ভারতে প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নির্বাচিত হন। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ঞনের রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দি রেইন ইন রিলিজিয়ন ইন কনটেমপরারি ফিলসফি’, ‘দি ফিলসফি অব দি উপনিষদ’, ‘দি রিলিজিয়ন উই নিড’, এ্যান আইডিয়ালিস্ট ভিউ অব লাইফ’ প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়।
Ramkrishna : রামকৃষ্ঞ (১৮৩৪-১৮৮৬ খ্রি.)
পরমহংস বলে রামকৃষ্ঞ তাঁর ভক্তজনদের দ্বারা আখ্যাত। রামকৃষ্ঞ পরমহংসের প্রকৃত নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের সংস্কারক। তিনি বেদান্তর ব্যাখ্যার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের বহু দেবতার জায়গায় এক ঈশ্বর তত্ত্বের প্রচার করেন। রামকৃষ্ঞ ঊনবিংশ শতাব্দীর বিকাশমান বাঙালী মধ্যবিত্তের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর প্রভাবের মূল ছিল একদিকে শাস্ত্রের উদার ব্যাখ্যা। অপরদিকে সমাজ সেবাকে ধর্মের মূল হিসেবে প্রচার করা। সত্তার মূলে নির্গুণ ব্রহ্ম। কিন্তু জগৎ মায়া নয়। মানুষ কলিযুগের মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। স্বার্থপরতা, অর্থগৃধ্নতা, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এই কলিযুগের স্বভাব। মানুষের সেবার মধ্য দিয়েই মানুষ কলিযুগের এই মনুষ্যত্ববিরোধী ও ঈশ্বরবিরোধী স্বভাবকে পরাভূত করতে সক্ষম হবে। রামকৃষ্ঞ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় সংগ্রামের কথা প্রচার করেন নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের যে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য সে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর হিন্দু ধর্মের উদারনীতিক, কুসংস্কারবিরোধী এক ঈশ্বরের তত্ত্ব অবশ্যই একটি সহায়ক শক্তির কাজ করেছে।
Ram Mohon Roy, Raja : রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.)
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের প্রগতিশীল ভারতীয় চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং জাতীয়তাবাদী নেতা।
রামমোহনের জন্ম হয় হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে। তিনি একটি প্রাচীন জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। তখনো ভারতে মুসলমানি শাসন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। আরবি এবং ফারসি ভাষা তখনো সমাজের উচ্চতর মহলে বেশ প্রচলিত। রামমোহন আরবি, ফারসি, সংস্কৃত এবং পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রামমোহন নিজে আন্তরিকভাবে যে খুব ধার্মিক ছিলেন তা নয়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব সামাজিক ও দার্শনিক চিন্তাধারাকে প্রকাশের জন্য হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিষ্টধর্মের উদারতামূলক ব্যাখ্যার তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতাকে তিনি সমালোচনা করেন এবং বেদ ও উপনিষদের ব্যাখ্যা করে বলেন যে, মূল শিক্ষার ও সভ্যতার প্রসার কামনা করেছিলেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান ব্যতীত ভারতবর্ষের জীবনের বন্ধ্যাত্ব ও কুসংস্কার দূরীভূত হবে না। কিন্তু ইংরেজি সভ্যতার প্রসার কামনা করলেও রামমোহন ইংরেজ শাসনকে ভারতবর্ষের মুক্তিদাতা এবং স্থায়ী শাসক হিসেবে চিন্তা করেন নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের অধীনে চাকুরী করার মাধ্যমে কিংবা অপরাপর উপায়ে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পত্তি অর্জন করলেও রামমোহন নিজের তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিবোধকে কখনো হারান নি। সমকালীন আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে এবং বিশেষ করে গণাতান্ত্রিক শক্তি বিকাশের মাধ্যমে রামমোহন বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন। ধর্মের উদারনীতিক ব্যাখ্যা এবং সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রামমোহন প্রচুর সংখ্যক পুস্তক পুস্তিকা ফারসি, আরবি, ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় রচনা করেন। তাঁকে আধুনিক গদ্যরীতির জনকও বলা হয়। ১৮৩০ সালে রামমোহন বিলাত যাত্রা করেন। বিলাতে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নিকট সতীদাহ বা স্বামীর মৃত্যুর পরে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দগ্ধ করার কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথাকে রদ করার আবেদন করেন। ইংল্যান্ডের উদারনীতিক দার্শনিক ও সমাজসেবীগণ রামমোহনের চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন এবং তাঁকে সংবর্ধিত করেন। দিল্লীল সম্রাটের পক্ষ হয়ে সম্রাটের ভাতা বৃদ্ধির জন্য তিনি ইংল্যান্ড গমন করেছিলেন। রামমোহন রায়ের রাজা উপাধি ভারতের তৎকালীন মোঘল সম্রাটের প্রদত্ত। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিস্টল শহরে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়।
Rationalism : অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ, যুক্তিবাদ, হেতুবাদ
১. অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ অনুযায়ী জ্ঞানের সার্বিক এবং অপরিহার্য সূত্রগুলি ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে লাভ করতে পারে না। এগুলি মানুষের মনের ব্যাপার। মন থেকেই ব্যক্তি এই সূত্রগুলি লাভ করে। স্থান, কাল, কার্যকারণ সম্পর্ক, ২+২=৪ প্রভৃতি সর্বজন স্বীকৃত সত্যসমূহ মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করে না। কারণ, অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের অস্তিত্ব দেখা যায় না। এ সমস্ত সত্য মানুষের মনে অভিজ্ঞতার পূর্বে থেকে জন্মগতভাবেই বিরাজমান। অভিজ্ঞতা মনের এই সূত্রগুলিকে পরিস্ফূটিত করে তুলতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা এদের সৃষ্টি করতে পারে না। অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদ তাই অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্বের বিরোধী। অভিজ্ঞতাউর্ধ্ব জ্ঞানবাদের উদ্ভব ঘটে প্রথমে আঙ্কিক সূত্রগুলির বিশ্লিষ্ট ও বস্তুনিরপেক্ষ সত্যতার সমস্যা আলোচনার ভিত্তিতে। ইউরোপে সপ্তদশ শতকে দেকার্ত, স্পিনাজো এবং লাইবনিজ এবং অষ্টাদশ শতকে কান্ট, ফিকটে, শেলিং এবং হেগেলকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে আমরা দেখতে পাই। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারণ বা সার্বিক সত্য এবং বিশেষ অভিজ্ঞতার পারস্পরিক সম্পর্ক একটি জটিল সমস্যা; এ সমস্যার আলোচনা এবং সমাধান অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্ব জ্ঞানতত্ত্ব একপেশে। অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব জ্ঞানবাদী দার্শনিকগণ সার্বিক সূত্রগুলিকে চরম সত্তায় পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। এর পরিণামে সার্বিক সূত্রগুলি একদিকে যেমন কেবলমাত্র মনের ভাবে পর্যবসিত হয় তেমনি তার মাধ্যমে অন্যদিকে ব্যক্তি চিন্তা এবং সত্য মিথ্যার ক্ষেত্রে যে কোনো অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণে মানুষের মনের জটিল ক্ষমতা এই উভয় সত্যকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. যুক্তিবাদ : জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, বিশ্বসৃষ্টি সর্বক্ষেত্রে যুক্তির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়াকে যুক্তিবাদ বলা হয়। যুক্তি বলতে প্রতিপাদ্য, উদাহরণ, প্রমাণ সিদ্ধান্ত ইত্যাদির পারম্পর্য এবং সঙ্গতি বুঝায়। যুক্তিবাদ অযুক্তিবাদের বিরোধী। অযুক্তিবাদ বলতে প্রধানত সজ্ঞা বা অনুভূতির মাধ্যমে সত্যোপলব্ধিকে বুঝানো হয়।
৩. ধর্মের ক্ষেত্র্রেও একশ্রেণীর ধর্ম ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে যুক্তিবাদ বা হেতুবাদের সাক্ষাৎ মেলে। এরা ধর্মকে বুদ্ধির কাছে গ্রাহ্য করার জন্য ধর্মের যে অভিমতগুলি যুক্তিগ্রাহ্য কেবল তাদেরকেই সত্য কিংবা সঠিক বলে গ্রহণ করার মত প্রকাশ করেন।
Reflexes : প্রতিবর্ত
কোনো উদ্দীপক বা উত্তেজকের সংস্পর্শে জীবন্ত দেহের কোনো স্নায়ু সচেতন ইচ্ছা ব্যতিরেকে যে প্রতিক্রিয়ামূলক আচরণ করে তাকে প্রতিবর্ত বলা হয়। কোনো ব্যক্তির আঙুলের ডগায় জ্বলন্ত দেয়াশলাই এর কাঠি ধরলে ব্যক্তি তার আঙুল অবিলম্বে সরিয়ে নেয়; চোখের উপর তীব্র আলো নিক্ষেপ করলে ব্যক্তি চোখের পাতা বন্ধ করে দেয়। তেঁতুল দেখলে কিংবা তেঁতুলের কথা মনে পড়লে ব্যক্তির জিহ্বায় লালা নিঃসরিত হয়-এগুলি প্রতিবর্তের দৃষ্টান্ত। প্রতিবর্তকে সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্ত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্ত। উপরের দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে আগুন থেকে আঙুলের সরে আসা কিংবা আলোর আঘাতে চোখের বন্ধ হওয়া অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের দৃষ্টান্ত। কিন্তু তেঁতুল দেখলে কিংবা তেঁতুলের কথা মনে হলে জিহবায় লালা নিঃসরিত হওয়া নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের দৃষ্টিান্ত। নিয়ন্ত্রিত এই কারণে যে, এই দৃষ্টান্তে ইন্দ্রিয়ের প্রতিক্রিয়া গোড়াতে সহজাত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ছিল না। কারণ গোড়াতে তেঁতুল বা টকজাতীয় দ্রব্য জিহবার সাক্ষাৎ সংস্পর্শে এলেই মাত্র একটি বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ক্রমে তেঁতুলের সাক্ষাৎ স্বাদ গ্রহণ ব্যতীত কেবলমাত্র চোখের দেখা কিংবা মনে করার মাধ্যমেও জিহবার সেই বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি দ্বারা প্রতিক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত প্রতিবর্তের সুবিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে রুশ বিজ্ঞানী পাভলভের কুকুর নিয়ে পরীক্ষা। উদ্দীপকের জবাবে স্নায়ুর প্রতিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করার জন্য পাভলভ কুকুরের ক্ষুধার উপর এই পরীক্ষাটি করেন। তিনি প্রথমে কুকুরের ক্ষুধার সময়ে তার স্নায়ুকে ক্রিয়াশীল করার জন্য তার সম্মুখে এক টুকরা মাংস ধরতেন এবং এই সঙ্গে একটি ঘন্টাধ্বনি করতেন। মাংস দেখামাত্র কুকুরের জিহবায় লালা নিঃসরিত হতো। মাংসের সঙ্গে ঘন্টাধ্বনি উদ্দীপকটিও কিছুদিন যাবৎ সংঘটিত করার পরে পাভলভ নির্দিষ্ট সময়টিতে মাংসের টুকরোটিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ঘন্টাধ্বনি করে কুকুরের স্নায়ুর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণে দেখেন যে, মাংসের টুকরো না থাকা সত্ত্বেও ঘন্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের জিহবায় লালা নিঃসরিত হতে শুরু করেছে। এভাবে পাভলভ প্রমাণ করলেন যে, স্নায়ুর বিশেষ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত করা যায়। উদ্দীপকের পরিবর্তন করা চলে। এক উদ্দীপক থেকে প্রতিক্রিয়া অপর উদ্দীপকে স্থানান্তরিত করা চলে। পাভলভের এই সিদ্ধান্ত মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদী এবং বস্তুবাদী বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
Reformation : সংস্কার আন্দোলন
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপে সামন্ততন্ত্র এবং খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া ক্যাথলিক মতবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল আন্দোলন সংস্কারবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত। সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাথমিক বুর্জোয়া বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। এই পর্যায়ে বিকাশমান বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে সামন্তশ্রেণীরও একটি অংশ যোগদান করে। সংস্কার আন্দোলন খ্রিষ্টধর্মকে সাধারণের জন্য সহজগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে এবং কুসংস্কার ও আচারের বদলে ব্যক্তির আন্তরিক বিশ্বাসকে মুক্তির উপায় বলে ব্যাখ্যা করে। সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্রের শাসনে গির্জার প্রভাব হ্রাস করে এবং গির্জাকে রাষ্ট্রের অধীনস্থ করে। সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ইউরোপীয় দেশসমূহে বুর্জোয়া বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের বিকাশ সহজতর হয়।
Relations of Production : উৎপাদন সম্পর্ক
‘উৎপাদন সম্পর্ক’ কথাটি মার্কসবাদী তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সমাজের অর্থনীতিক ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক বিদ্যমান সে সম্পর্কের একটি চেতনা নিরপেক্ষ সত্তা আছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন, বিনিময় ও বন্টনের ক্ষেত্রে গঠিত সামাজিক সম্পর্কই হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদন সম্পর্ক যে কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য প্রকাশ। মানুষ যেমন সামাজিক জীব, তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদনও একটি সামাজিক অর্থাৎ যৌথপ্রক্রিয়া। মানুষকে আদিকাল থেকেই উৎপাদনী যন্ত্র কমবেশি পরিমাণে যৌথভাবে ব্যবহার করতে হয়েছে। কিন্তু যন্ত্র বা উপায়সমূহের মালিকানা সামাজিক বা যৌথ হয় নি। উৎপাদনের উপায়গুলির মালিকানার চরিত্র অনুযায়ী উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়। আদিতে অনিবার্যভাবে উৎপাদনী প্রক্রিয়া যেমন যৌথ ছিল তেমনি উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানাও যৌথ ছিল। উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানার ভিত্তিতে উৎপাদিত দ্রব্যের অর্থাৎ উৎপাদিত সম্পদের মালিকানাও স্থির হয়। কাজেই উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা যেখানে যৌথ সেখানে উৎপাদিত সম্পদের মালিকানাও সমষ্টিগত এবং উৎপাদকের সামাজিক সম্পর্ক সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। যেখানে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা ব্যক্তিগত সেখানে উৎপাদিত সম্পদ ব্যাষ্টির, সমষ্টির নয় এবং উৎপাদকের মধ্যে যন্ত্রের মালিকানাহীন মানুষ যন্ত্রের মালিকদের উপর নির্ভরশীল। আদি সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদন উপায়ের মালিকানা যখন ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়ায় তখন মালিকরা প্রভু এবং মালিকানাহীন উৎপাদকেরা দাসে পরিণত হয়। মূলত সামাজিক সম্পর্কের এই বিন্যাস সামন্ততান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী উভয় সমাজের ক্ষেত্রে সত্য। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী যেখানে উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা দখল করতে সক্ষম হয়েছে সেখানে উৎপাদনের সম্পর্কও সামাজিক অর্থাৎ সমষ্টিগত রূপ গ্রহণ করেছে। এক উৎপাদন সম্পর্কের স্থানে অপর উৎপাদন সম্পর্কের স্থাপনা একচোটেই চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে না। এক সম্পর্ক থেকে আর এক উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যবর্তীকালে উভয় প্রকার সম্পর্কের অবস্থান সাময়িকভাবে থাকতে পারে। দাস সমাজের স্থানে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ দাস সমাজের ক্ষয় এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত দাস সমাজের সম্পর্কের রেশ চলতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজও আকস্মিকভাবে পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয় নি। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলেও সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি এবং তার সম্পর্ক আংশিকভাবে চলতে থাকে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উচ্ছেদের পরেও পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একটা মিশ্র অর্থনীতির অস্তিত্ব থাকতে পারে। অর্থনীতির কম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সম্পদ এবং শ্রমিকদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা কার্যকর থাকতে পারে। কালক্রমে অবশ্য পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতি এবং উৎপাদন সম্পর্ক পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং নতুন সম্পর্ক একমাত্র সম্পর্কে পরিণত হয়।
Religion : ধর্ম
ধর্ম বলতে জীবন এবং জগতের উপর অতিজাগতিক এক কিংবা একাধিক শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে বুঝায়। ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের সামাজিক চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়ের সূচক। চেতনার একটা পর্যায়ে মানুষ তার প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিবেশের পরিবর্তন, তার কোনো বস্তুর বিরাটত্ব কিংবা ক্ষুদ্রতা, জীবনের জন্য কোনো বস্তু ও প্রাকৃতিক শক্তিকে হিতকর কিংবা অহিতকর ভাবতে সক্ষম হয়। জীবন রক্ষার জন্য সূর্য, ঝড়, ঝঞ্জা, অগ্নি, বিদ্যুৎ পর্বত, বিরাটাকার পশু ইত্যাদিকে বশীভূত করার উপায়ের কথা মানুষ চিন্তা করে। মানুষের এই অসহায় অবস্থায় এবং প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রাথমিক রূপ হিসাবে প্রকৃতি এবং প্রতীকের উপর অলৌকিক শক্তি আরোপ এবং তাদের আরাধনা শুরু হয়। পৃথিবীর মানুষের মধ্যে একটিমাত্র ধর্ম বিকাশ লাভ করে নি। একাধিক ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তার আনুষঙ্গিক সংস্কার ও অনুষ্ঠানসমূহও বিকাশ লাভ করে আসছে। ধর্মের অতিজাগতিক শক্তির বিশ্বাস থাকলেও তার একটা জাগতিক ইতিহাস আছে। ধর্মের বিকাশের ইতিহাসে মানুষের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশ প্রতিফলিত হয়েছে। আদিম অসহায় অবস্থা অতিক্রম করে মানুষ অধিকতর সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করতে আরম্ভ করলে মানুষের ধর্মীয় কল্পনাও অধিকতর সংবদ্ধ ও সূক্ষ্ম আকার ধারণ করতে শুরু করে। গাছ, পাহাড়, পশু ইত্যাদির স্থানে সুউচ্চ পাহাড়ে কিংবা আকাশে বাসকারী এক দেবরাজ্যের কল্পনা করতে তারা শুরু করে। এই দেবতাদের সঙ্গে মানুষের নিজের চারিত্রিক মিল ছিল। মানুষের সমাজের ন্যায়ই দেবতাদের মধ্যে ছোটবড় ছিল। দেবরাজ্যেও মানুষের ন্যায় ঝগড়া বিবাদ, হিংসাবিদ্বেষ, প্রেম, আকর্ষণ ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল। মানুষের জীবনের ইতিহাসের তুলনায় একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহের উদ্ভব খুবই আধুনিক। অর্থনীতিক বিকাশের সাথে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উদ্ভব এবং সেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অধিকতর বিকাশে সমাজের অধিকতর ঐক্যবদ্ধ সংগঠন এবং তার রাজনীতিক কাঠামোতে একক নেতৃত্বের প্রয়োজনের পরিপূরক হিসেবে মানুষের মনে অতিজাগতিক এক ঈশ্বরের কল্পনা উদ্ভূত হতে থাকে। আধুনিককালের অর্থাৎ একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের একটি যোগসূত্র আছে। ভাববাদী দর্শন যুক্তি সহকারে ধর্মীয় বিশ্বাসকে অধিকতর গ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। জগতের উপর ঈশ্বর আছে এই বিশ্বাসের ন্যায় ভাববাদী দর্শনও বলে , কারণ ব্যতীত যেহেতু কোনো কাজ হয় না তখন জগতেরও এক আদি কারণ বিদ্যমান। ধর্ম ঈশ্বরের কোনো জন্ম, মৃত্যু বা পরিবর্তন স্বীকার করে না। কিন্তু ধর্মের জন্ম, মৃত্যু ও পরিবর্তন ঘটতে পারে। যত ধর্ম একদিন প্রচলিত ছিল তত ধর্ম আজ আর প্রচলিত নেই। ধর্ম অবশ্যই মানুষের বিশেষ প্রয়োজনের পরিপূরক। এ প্রয়োজনের উৎস হচ্ছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বৃহত্তর সংখ্যক শোষিত মানুষের অসহায় অবস্থা এবং তাদের স্বাভাবিক আশা আকাঙ্খা পরিপূর্ণ হতে না পারা। যে অন্যায় এবং অবিচার শোষিত মানুষ অসহায়ভাবে ইহজগতে ভোগ করে তার পরিপূরক হিসেবে তার কল্পিত স্বর্গলোকে অন্যায় ও অবিচারের পরিবর্তে ন্যায়বিচার ও সুখের চরম লাভ সে আশা করে। সাধারণ মানুষের এই কল্পনা শাসক ও শোষক শ্রেণীর দার্শনিক, ভাবুক, সাহিত্য ও রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্নভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও স্থায়ী করে রাখার প্রয়াস পায়। কেননা এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম রাখার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে। সমাজের আমুল পরিবর্তনে, শ্রেণীহীন সমাজের সংঘটনে এবং বিজ্ঞানের বিকাশে ব্যক্তির অসহায়তা যত অধিক দূরীভূত হবে অতিজাগতিক রক্ষাকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বের প্রয়োজন ব্যক্তি তত কম বোধ করবে এবং কালক্রমে ঈশ্বর হয়তো মানুষের মনকে ব্যাপৃত রাখার বিষয় হিসেবে গণ্য হবে না।
Renaissance : নবজাগরণ
সাধারণভাবে নবজাগরণ বলতে নতুন জাগরণ বুঝায়। কোনো দেশ বা জাতি যখন সৃষ্টির বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত হয় তখন তাকে কাটিয়ে উঠতে যে সমস্ত চিন্তা সহায়তা করে তাকে নব জাগরণ বা নব জাগরণের চিন্তা বলা হয়। কিন্তু ইংরেজি ‘রিনাইসেন্স’ বা নব জাগরণ দ্বারা ইউরোপীয় দেশসমূহে, বিশেষ করে ইতালীতে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষয়ের যুগে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে বিকশিত নতুন পুঁজিবাদী সমাজ সৃষ্টির সহায়ক প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে বুঝান হয়। দর্শনের উপর এ সময়ে ধর্মের প্রভাব প্রধান হয়ে থাকলেও আবার জগতের সঙ্গে ইউরোপের সাক্ষাৎ সংযোগের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের ঐতিহ্যের পরিচয় এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নতুন উদারনীতিক এবং মানবিক চিন্তাধারার উদ্ভবকে সম্ভব করে তোলে। দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কজার নিকোলাস, কামপানেলো প্রভৃতি দার্শনিকের রচনায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিকাশের নীতিতে যে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভব ঘটে তা ছিল ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত এবং বস্তুবাদী। এই যুগের দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) পৃথিবীর ব্যাখ্যায় কপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব; (২) লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং গ্যালিলিওর অঙ্কশাস্ত্রের উপর গবেষণা এবং প্রকৃতির ব্যাখ্যায় আঙ্কিক গবেষণার প্রয়োগ; (৩) জগৎ ঈশ্বরের উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, এই ধর্মীয় ধারণার স্থানে জগতের পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক বিধানসমূহের আবিষ্কার। এই সময়কার সামাজিক অর্থনীতিক পরিবর্তন সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারায়ও প্রতিফলিত হয়। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ব্যক্তি যেখানে ঈশ্বরের ইচ্ছার ক্রীড়নক ছিল সেখানে নতুন সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ব্যক্তির মর্যাদা ও ক্ষমতা স্বীকৃত হতে থাকে। ঐক্যবদ্ধ বৃহদাকারের জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে। রাষ্ট্রের উপর ধর্মীয় যাজকতন্ত্রের প্রভাবও হ্রাস পেতে থাকে। ম্যাকিয়াভেলী, বোদিন প্রভৃতি সমাজতাত্ত্বিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চিন্তাধারায় এই বিকাশের প্রতিফলন ঘটে। এই যুগে জার্মানির টমাস মুনজার (১৪৯০-১৫২৫) এর ন্যায় সমাজতন্ত্রের কল্পলোক সৃষ্টিকারী চিন্তাবিদেরও সাক্ষাৎ মিলে। এরা ধর্মীয় গ্রন্থের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দ্বারা সমস্ত সম্পদের উপর জনগণের সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
Revisionism : শোধনবাদ, সংশোধনবাদ
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে শোধনবাদ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। বাস্তব সমাজ জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের ব্যাখ্যায় মার্কসবাদ অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের প্রথম দুই দশক পর্যন্ত মার্কসবাদের নেতৃত্ব দেন লেনিন। তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন, উহার নেতৃত্ব দেন এবং ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত করেন। মার্কসবাদের প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা নিয়ে তার সঙ্গে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে বার্নসটইন, বাউয়ার, কাউটসকী, ট্রটসকী প্রমূখ সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। লেনিন এই সমস্ত নেতাদের মার্কসীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তাকে সংস্কারবাদ ও সুবিধাবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে এবং লেনিনের মৃত্যুর পরে সোভিয়েত ইউনিয়েনের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদের সঠিক ব্যাখ্যাতা এবং অনুসরণকারী বলে দাবি করে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে বেশ কিছু দেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা উহার অংশবিশেষের সঙ্গে সোভিয়েত কমউনিস্ট পার্টির তত্ত্বগত বিরোধ আত্মপ্রকাশ করে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুগোশ্লাভিয়ার নেতা টিটোর বিদ্রোহের মধ্যে এ বিরোধের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের দিকে। তখন মার্কসবাদ হতে বিচ্যূতিকে সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ ‘টিটোবাদ’ বলে আখ্যায়িত করতেন। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সহ অবস্থানের তাৎপর্য এবং সম্ভাব্যতা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দেশ কি নীতি অনুসরণ করবে এবং করবে না, তৃতীয় মহাযুদ্ধ অনিবার্য কিনা, প্রভৃতিপ্রশ্নে এই মতবিরোধ বেশ তীব্র আকার ধারণ করে এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি পরস্পরকে মার্কসবাদের সংশোধনবাদী বলতে আখ্যাত করতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই দুই প্রধান কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য মতপার্থক্য বেশ কিছুসংখ্যক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিরোধ ও বিভেদের সৃষ্টি করে এবং কিছু সংখ্যক দেশে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়েনের কমিউনিস্ট পার্টির পরেই অন্যতম বৃহৎ কমিউনিস্ট পার্টি বলে বিবেচিত হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভিমত ছিল চীনের মধ্যে আধুনিক সংশোধনবাদের চরম প্রকাশ ঘটেছে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে চীনের কমউনিস্ট পার্টিও অনমনীয়ভাবে অনুরূপ অভিমত পোষণ করত।
Revolution, Bourgeois : বুর্জোয়া বিপ্লব, ধনতান্ত্রিক বিপ্লব, পুঁজিবাদী বিপ্লব
সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে শ্রমিক ও যন্ত্রশিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠাকে বুর্জোয়া বিপ্লব বলা হয়। বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী বিপ্লব মানুষের সমাজের বিবর্তনে একটা পর্যায়কে সূচিত করে। ঐতিহাসিক এ পর্যায়ের পরিধি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হতে পারে। বস্তুত পৃথিবীব্যাপী এ পর্যায়ের শুরু সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির ক্ষয়ের যুগে ইউরোপে ষোড়শ শতকে জার্মানির কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে সূচিত হয়েছিল বলা যায়। অষ্টাদশ শতকে ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে এই বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ ভূখন্ডে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে আরো কয়েকটি দেশে অর্থনীতিক পরিবর্তনে বুর্জোয়া যুগের অবসান ঘটলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বুর্জোয়া পর্যায়ের অবসান এখনো ঘটে নি। অনেক দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের উচ্ছেদে পূর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। পুঁজিবাদী বিপ্লবের মূল ঐতিহাসিক ভূমিকা হচ্ছে, শিল্প কারখানার প্রতিবন্ধক বিকাশের শক্তিসমূহকে উচ্ছেদ করা। সামন্তবাদী অর্থনীতি উচ্ছেদের মাধ্যমে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা্ নানা রূপ গ্রহণ করতে থাকে। বিপ্লব সাধনকারী শক্তিতেও তারতম্য ঘটতে পারে। বৃহৎ কয়েকটি দেশে পুঁজিবাদী বিপ্লব সাধিত হওয়ার পরে অন্যান্য দেশে এই বিপ্লব সাধনে নতুনতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাদী দেশ আন্তর্জাতিকভাবে একচেটিয়া পুঁজিসঞ্চয় ও সরবরাহকারী দেশ হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করাতে সাম্রাজ্যবাদের অধীন এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলির বুর্জোয়া বিপ্লব নতুনতর চরিত্র গ্রহণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী যুগের পূর্বে পুঁজিবাদী বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিকাশমান ধনিকশ্রেণী বিপ্লবের অগ্রগামী শক্তি ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুগে শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় যে অভ্যুত্থান ঘটে তারও লক্ষ্য ছিল সামন্তবাদী জারতন্ত্রের উচ্ছেদ। কিন্তু এই বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণী নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবেও শ্রমিক এবং কৃষকশ্রেণী সশস্ত্র সংগ্রামের মারফত সামন্তবাদী জারতন্ত্রের পতন ঘটায়। উপনিবেশের বুর্জোয়া বিপ্লব এবং জাতীয় মুক্তি আন্দোলন মিলিত হয়ে এই নতুনতর শ্রেণীবিন্যাসকে স্পষ্টতর করে তোলে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বুর্জোয়া বিপ্লব সাধন করার ক্ষেত্রে জাতীয় বুর্জোয়ার একাংশ সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে জাতীয় মুক্তি এবং আর্থনীতিক উত্তরণের পথে প্রতিবিপ্লবী হিসেবে কাজ করে। শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণী এই নেতৃত্বমূলক ভূমিকার কারণে বুর্জোয়া বিপ্লব অনেক দেশে নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পর্যায়টিকে প্রধানত দুভাগে বিভক্ত করা চলে। ১. অবিমিশ্র বুর্জোয়া বিপ্লব : এ বিপ্লবের প্রধান ভূমিকা ধনিক শ্রেণীর। শ্রমজীবি জনসাধারণের ভূমিকা গৌণ। এরূপ বিপ্লবে আর্থনীতিক রূপান্তর ঘটলেও শ্রমজীবি জনতা বা গরিব কৃষকের অবস্থান কোনো উন্নতি সাধিত হয় না। ২. বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব : এই বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য এই যে, বিপ্লব সাধনে শ্রমিক এবং কৃষক জনতা জাতীয় শিল্পের বিকাশ ছাড়াও শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি এবং জমিতে কৃষকের স্বার্থসাধনকারী কৃষি সংস্কারের দাবিসহ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র ধনিকশ্রেণীর কবলিত হলেও শ্রমিকশ্রেণী তার রাজনৈতিক চেতনা, ঐক্য এবং সংগঠিত শক্তির প্রভাবে ধনিকশ্রেণীর সরকারকে নিজের স্বার্থে বেশ কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অধিকতর শক্তির কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব একাধিক দেশে সাধিত হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সমাজতান্ত্রিক দেশের নৈকট্য, জাতীয় বুর্জোয়ার দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে এরূপ গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব জনগণতন্ত্রের রূপ ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকে আসন্ন করে তুলতে পারে।
Revolution, October : অক্টোবর বিপ্লব (নভেম্বর বিপ্লব)
পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি ঘটনা তাদের বিপুলতার কারণে এবং সমাজের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন সাধনের উৎস হিসাবে বিপ্লব বলে পরিচিত হয়ে আসছে। এদের মধ্যে ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ, ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট এর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা, ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা ও যুদ্ধ, ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব এবং ১৯১৭ সনে অক্টোবর বিপ্লব বিশেষভাবে পরিচিত।
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (রাশিয়ার পুরাতন বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর) লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করে এবং শ্রমিক কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েত বা সমিতির শাসন প্রতিষ্ঠা করে। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক এই বিপ্লব অক্টোবর বা নভেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত।
বিশাল রুশদেশে সামন্ততান্ত্রিক শাসনের প্রধান ছিল জার। একদিকে সামন্ততান্ত্রিক জারের শাসন, অপরদিকে অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাটনের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্ষয়িষ্ঞু প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে বিকাশমান পুঁজিবাদী শক্তির সাধারণ দ্বন্ধ তীব্র হতে থাকে। এই বিরোধের প্রকাশ সামন্ততন্ত্র এবং জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে নানা সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠা এবং ঘটনার মধ্যে ঘটতে দেখা যায়। কেবল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন নয়, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলও সংগঠিত হয়। সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে কৃষক, শ্রমিক জনসাধারণ এবং নৌবাহিনীর নাবিকদের মধ্যে বিপ্লবাত্মক বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। যুদ্ধ জাহাজ ‘পটেমকিন’ এর নাবিকগণ নিজেদের জীবনযাত্রা এবং খাদ্যের উন্নয়নের দাবিতে ধর্মঘট ঘোষণা করে। বিদ্রোহী নাবিকদের সঙ্গে বন্দরের শ্রমিকরাও যোগদান করে। কিন্তু জার সরকার সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করে এই বিক্ষোভ দমন করে। পর্যুদস্তু হলেও ১৯০৫ সালের এই ঘটনা ১৯০৫ এর বিপ্লব নামে পরিচিত। লেনিন পরবর্তীকালে ১৯০৫ কে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পঞ্চমহড়া বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
১৯১৪ সালে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়াও এই যুদ্ধ জার্মানির প্রতিপক্ষ হয়ে লড়াই করে। কিন্তু রুশ বাহিনী যুদ্ধে বিপর্যস্ত হতে থাকে। যুদ্ধে প্রথম আড়াই বছরের মধ্যে রাশিয়ার পঞ্চান্ন লক্ষ সৈন্য নিহত হয়। ক্রমান্বয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের সমরাস্ত্র যোগান দেওয়াও সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। সরকারের মধ্যে অনৈক্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। জার তার মন্ত্রিসভাকে ঘন ঘন পরিবর্তন করে। কৃষকদের জমির দাবি এবং সৈনিকদের মধ্যে শান্তির দাবি তীব্র হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাডে ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ(ফেব্রুয়ারী) ব্যাপক ধর্মঘট এবং হাঙ্গামা শুরু হয়। সরকার সৈন্য বাহিনীকে ধর্মঘট দমন করতে পাঠালে সৈনিকেরা ধর্মঘটিদের সঙ্গে যোগদান করে। এই সময়ে রুশ ডুমা বা পার্লামেন্টও সরকার বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে। জার ডুমার অধিবেশন বন্ধ করে দেবার হুকুম দিলেও ডুমা সে হুকুম অমান্য করে এক অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করে। অবস্থাদৃষ্টে জার দ্বিতীয় নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করেন। পুরাতন রুশ বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে সংঘটিত এই ঘটনা ইতিহাসে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে অভিহিত। চরিত্রগতভাবে এই বিপ্লব ছিল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু অস্থায়ী সরকার জনসাধারণের শান্তি বা জমি এবং রুটির দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। তারা তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। কিন্তু সৈনিক, কৃষক এবং শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অস্থায়ী সরকারের প্রায় প্রতিদ্বন্ধী সরকার হিসেবে দেশব্যাপী সৈনিক, কৃষক ও শ্রমিকদের নির্বাচিত সমিতি বা সোভিয়েত সংগঠিত হতে থাকে। আসলে ১৯০৫ এর বিপ্লবের মধ্যেই সংগ্রামী জনতার এইরূপ সোভিয়েত প্রথম গঠিত হয়েছিল। লেনিন এতদিনে দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। বাইরে থেকে তিনি দেশের বলশেভিক দলের বিপ্লবী কাজ পরিচালনা করছিলেন। ১৬ এপ্রিল(১৯১৭) তিনি দেশে ফিরে এলে বলশেভিকদের নেতৃত্বে শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমিকদের সোভিয়েত কার্যত অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী সরকার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধ ও শান্তির ক্ষেত্রে সরকারের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য সকল প্রশ্নে সোভিয়েতগুলি অস্থায়ী সরকারের আদেশ অমান্য করতে থাকে। শক্তভাবে যুদ্ধ পরিচালনার অজুহাতে এবার অস্থায়ী সরকার সমস্ত বিক্ষোভ এবং দাবিকে দমন করার নীতি গ্রহণ করে। সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যে সমস্ত রেজিমেন্ট বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল তাদের ভেঙে দেওয়া হল। কৃষক আন্দোলন দমনেও কঠোরতর ব্যবস্থা গৃহীত হতে লাগল। এতদিন শ্রমিক কৃষক সৈনিকদের সোভিয়েতগুলিকে বরদাশত করা হলেও এখন থেকে সেগুলিকে সরকার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এমন অবস্থায় ১৬ জুলাই তারিখে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদের এক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ চেষ্টা সফল হয় না। এ চেষ্টা বলশেভিকদের দ্বারা পরিচালিত ছিল না। কেননা বলশেভিকদের মতে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে উচ্ছেদের পরিস্থিতি তখনো পরিপক্কতা লাভ করে নি। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরে অস্থায়ী সরকারের দমননীতি তীব্র হয়ে ওঠে। সরকার লেনিনকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে। লেনিন আত্মগোপন করেন। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কেরেনসকি এবং সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল কর্ণিলভের মধ্যে বিরোধ বাধে। জেনারেল কর্ণিলভও সেপ্টেম্বর মাসে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। জেনারেল কর্নিলভের উদ্দেশ্য ছিল অস্থায়ী সরকারের চরিত্র পুরোপুরি পাল্টে দিয়ে তাকে একেবারে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারে পরিণত করা। পেট্রোগ্রাডের বিপ্লবী সৈনিক ও শ্রমিকদের প্রতিরোধে কর্নিলভের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু অস্থায়ী সরকারের দুর্বলতা প্রকটতর হয়ে ওঠে। খাদ্য সংকট ও শান্তির কামনা জনসাধারণকে সরকারের যুদ্ধ পরিচালনা নীতির তীব্র বিরোধী করে তোলে। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় জনসাধারণ এর পক্ষ হতে কোনো সাড়াই আর সরকার পায় না। এমন অবস্থায় ৬ নভেম্বর তারিখে লেনিন বলশেভিক নেতৃত্বে পরিচালিত লালবাহিনীকে অস্থায়ী সরকারের দপ্তর পেট্রোগ্রাডের শীতপ্রাসাদ দখলের নির্দেশ দেন। ৭ নভেম্বর (নতুন বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী) সোভিয়েতসমূহের নিখিল রুশ কংগ্রেস বলশেভিক পার্টিকে সরকার গঠনের ক্ষমতা প্রদান করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সরকার হিসাবে জনতার কমিসার বা মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরেও বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে। লেনিন দেশের জন্য শান্তি, জমি এবং রুটি বা রুজির নীতি ঘোষণা করলেন। ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ করা হলো। প্রতিবিপ্লবী এবং যাজক প্রতিষ্ঠান গির্জার বিপুল সম্পত্তি সরকারের হাতে বাজেয়াপ্ত হলো। কৃষকদের জমির মালিক ঘোষণা করা হলো। শ্রমিকরা কারখানা দখল করতে শুরু করল। কৃষকদের মধ্যে জমি বিনামূল্যে বিলি করার নীতি গ্রহণ করা হল। ৫ ডিসেম্বর লেনিন যুদ্ধ থেকে রাশিয়ার সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করে যুদ্ধ বন্ধ কার্যকর করেন। ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ তারিখে জার্মানির সঙ্গে ব্রেস্ট লিটভস্ক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষি্ঠত সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান ঘোষণা করা হয়।
Revolution, Socialist : সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
পুঁজিবাদের উচ্ছেদের ভিত্তিতে কারখানা, যন্ত্র, জমি এবং প্রাকৃতিক অপরাপর সম্পদের উপর শ্রমিকশ্রেণীর সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য নিহিত। মার্কস এবং এঙ্গেল মানুষের সমাজের বিকাশ বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে পুঁজিবাদের পরবর্তী স্তরে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা পুঁজিবাদকে বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন যে, পুঁজিবাদের মূল অসঙ্গতি হচ্ছে –একদিকে উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদিত সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অপরদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার যৌথ চরিত্র। যৌথভাবে যে সম্পদ শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদন করে মালিক শ্রেণী ব্যক্তিগতভাবে তা ভোগ করে। পুঁজিবাদ শ্রমিককে পণ্য এবং শ্রমদাস হিসেবে ব্যবহার করে। শ্রমের বাজারে সর্বহারা বুভুক্ষ অসহায় শ্রমিকের সমস্ত শ্রমশক্তি দিন কিংবা সপ্তাহের চুক্তিতে পুঁজি এবং কারখানার মালিক নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে কিনে নয়ে। বিনিময়ের চুক্তি মোতাবেক শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরির সমপরিমাণ সম্পদই মাত্র উৎপন্ন করতে বাধ্য। কিন্তু তার অসহায়তার কারণে শ্রমিক তার প্রাপ্য নির্দিষ্ট মজুরির পরিবর্তে অধিকগুণ বেশি সময় পরিশ্রম করে এবং অধিকগুণ সম্পদ উৎপন্ন করে। মজুরের এই চুক্তি অতিরিক্ত শ্রমের ফল আত্মসাৎ করেই পুঁজিবাদ তার মুনাফা তৈরি করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এই অসঙ্গত অর্থনীতিক বুনিয়াদকে ভাবগত প্রচারে এবং শাসনের যন্ত্র দ্বারা স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া সর্বহারা একতার শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের শোষণগত বিরোধ ব্যতীত এক পুঁজিবাদীর সঙ্গে অপর পুঁজিবাদীর মুনাফার প্রতিযোগিতা এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে উৎপন্ন দ্রব্য অধিকতর লাভে বিক্রি করার জন্য বিশ্ববাজার দখল এবং বন্টনের উপর অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরোধও বিদ্যমান। এই সমস্ত বিরোধের পরিণামে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অপরিহার্য বলে মার্কস এবং এঙ্গেলস অভিমত প্রকাশ করেন। পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরকে বিশ্লেষণ করে লেনিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অত্যাসন্নতার কথা বলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূত্রসমূহের উল্লেখ করে লেনিন বলেনঃ ১. পুঁজিবাদের অসমান বিকাশের কারণে শ্রমিকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের েএবং পুঁজিবাদের দুর্বল অংশ বা এলাকায় আঘাত করে এক কিংবা একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত স্থানে একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবে এমন কোনো কথা নাই; ২. পৃথিবীর দেশ বা অংশবিশেষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র এই উভয় ব্যবস্থার সহঅবস্থানের প্রশ্নটি জন্মলাভ করবে; ৩. শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বেই মাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে; ৪. বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ব অপরিহার্য; ৫. সাম্রাজ্যবাদের সংকটকালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সর্বহারা মুক্তিকামী পরাধীন জাতির মুক্তি আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে এবং মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐক্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য নিশ্চিত করে তোলে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করতে পারে লেনিন তারও উল্লেখ করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আন্দোলন পর্যদুস্ত করে রাশিয়ার বিজয় লাভ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে বহু জাতির জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন এবং পূর্ব ইউরোপের কয়েকিট দেশে, চীনে ও কিউবায় সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধানকারী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সুনিশ্চিত করে তুলেছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও উৎপাদন উপায়ের মালিকানা শ্রমিকশ্রেণীর হস্তগত হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি প্রক্রিয়া বিশেষ এবং সম্পূর্ণ হওয়া সময়সাপেক্ষ। সমাজতন্ত্র উৎপাদনের এবং বন্টনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলে সাম্যবাদী সমাজ বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে। সাম্যবাদী সমাজে প্রতিটি মানুষ যেমন তার ক্ষমতা অনুযায়ী সমাজের জন্য শ্রম করবে তেমনি সমাজও তার সমস্ত প্রয়োজনকে পূরণ করবে।
RosenBerg Couple Murder : রোজেনবার্গ দম্পতির মর্মান্তিক হত্যাকান্ড
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি নামক দুটি নিরস্ত্র নগরের উপর আনবিক বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে। যুদ্ধ ছিল তখন সমাপ্তির পর্যায়ে। জাপান আত্মসমর্পণের পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। আণবিক বোমা নিক্ষেপের তখন কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আনবিক বোমার শক্তির একমাত্র অধিকারী এ কথা বুঝাবার জন্য জাপানের উপর আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে এবং মার্কিন কোনো মানবতাবোধ সম্পন্ন বিজ্ঞানী যেন আনবিক বোমা তৈরির কৌশল জানতে না পারে তার জন্য সেই সমস্ত মানবিকতাবোধ সম্পন্ন বৈজ্ঞানিককে গ্রেপ্তার করে হত্যা করার নীতি গ্রহণ করা হয়। মার্কিন যুদ্ধবাদী অধিনায়কদের ধারণা ছিল যে রাজনীতিক দল বা ব্যক্তিদের মধ্যে কমিউনিস্ট তথা সাম্যবাদী ব্যক্তিদের মধ্যে আণবিক বোমার অন্যায় ব্যবহার সম্পর্কে এরূপ ধারণা থাকতে পারে। তাই তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি দপ্তরে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করে, এমন মানবতাবাদী বিজ্ঞানী রাষ্ট্রযন্ত্রের কোথায় থাকতে পারে। এরূপ অনুসন্ধানের মাধ্যমে তারা রোজেনবার্গ দম্পতি নামক এক মানবতাবাদী বিজ্ঞান দম্পতির সন্ধান লাভ করে এবং এই বিষয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগে রোজেনবার্গ দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে এই দম্পতিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করে।
Rousseau, Jean Jacques : জাঁ জ্যাক রুশো(১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ফরাসি মুক্তবুদ্ধি পথিকৃতদের অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন জ্যাঁ জ্যাক রুশো। দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদ, সৌন্দর্যতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষণের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক হিসেবে রুশো খ্যাতি অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে একদল বিশ্বকোষিক সংঘবদ্ধভাবে কুসংস্কার এবং প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন। এদের মধ্যে ডিডেরট, ডি এ্যালেম্বার্ট, মন্টেসক্যূ, ভলটেয়ার, হেলভিটিয়াস এবং হলবাকের সঙ্গে রুশোর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের রচনাবলী ভাবগতভাবে ফরাসি বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।
রুশো জন্মগ্রহণ করেন সুইজারল্যান্ড এর জেনেভা শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র ঘড়ি নির্মাতা। ১৯৪২ সনে রুশোদ ৩০ বৎসর বয়সে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস গমন করেন। নিজের জীবনধারণের জন্য শৈশবকাল থেকে রুশো বিচিত্র জীবিকা অবলম্বন করেন। এভাবে তিনি জীবনে বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। প্যারিসে আসার পরে দিজন একাডেমী ঘোষিত একটি রচনা প্রতিযোগিতার প্রতি রুশোর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় (১৭৪৯)। একাডেমী ঘোষিত প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্প কি মানুষের জীবনকে উন্নত করেছে, না তাকে অধিকতার কলুষময় করেছে? রুশো এই প্রতিযোগিতার জন্য একটি প্রবন্ধ পেশ করেন। তাঁর এই প্রবন্ধ একাডেমী কর্তৃক সর্বোত্তম বিবেচিত হয় এবং তিনি প্রথম পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর এই রচনাতেই রুশোর রাষ্ট্র এবং সমাজদর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি প্র্রকাশ পায়। প্রচলিত চিন্তাধারার বিরুদ্ধতা করে রুশো তার এই প্রবন্ধেই দেখাতে চেষ্টা করেন যে, তথাকথিত সভ্যতার পূর্ব যুগেই অধিকতর স্বাভাবিক এবং যথার্থ ছিল। সভ্য মানুষের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, তার অন্তরের পরশ্রীকাতরতা, সন্দেহ, ভয়, হৃদয়হীনতা, আত্মম্ভরিতা, ঘৃণা এবং প্রতারণাকে আড়াল করে রাখার আচ্ছাদন বৈ আর কিছু নয়। রুশোর মতে ইতিহাসে সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে মানুষের জীবন তত কৃত্রিম ও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সভ্যতার পূর্বেই মানুষ সহজ ও স্বাভাবিক ছিল। রুশোর এই অভিমতের অধিকতর যুক্তিসহ সুবিস্তারিত প্রকাশ ঘটে তাঁর ১৭৬২ সনে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দি সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’র মাধ্যমে। লক এবং হবসের ন্যায় রুশোও এই অভিমত পোষণ করেন যে, রাষ্ট্রের সংগঠনের পূর্বে মানুষ একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করত। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ বা অবস্থা সম্পর্কে হবস মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ সর্বক্ষণ আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। কারণ মানুষ প্রধানত আত্মকেন্দ্রিক, আত্মসুখান্বেষী এবং পরদ্বেষী। কিন্তু আত্মঘাতী সংঘর্ষের চরম অবস্থা মানুষের মনে এই চেতনার সৃষ্টি করেছিল যে, কোনো শাসক বা শক্তির কাছে নিজেদের ব্যক্তিগত অধিকার সমর্পণ করে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং শাসকের বিধানমত জীবন যাপন না করলে ব্যক্তির পক্ষে নিরাপদ জীবন যাপন সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে মানুষ একসঙ্গে চুক্তির মারফত শাসক সৃষ্টি করে নিয়মবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রুশোও একথা স্বীকার করেন যে, মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু প্রাকৃতিক অবস্থার রূপ এবং চুক্তির প্রকার সম্পর্কে রুশো হবস থেকে পৃথক মত পোষণ করেন। রুশোর মতে, মানুষের চরিত্র মূলত স্বার্থপর নয়। প্রাকৃতিক অবস্থাতে মানুষ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল জীবই ছিল। অপরের প্রতি সহানুভূতি বোধ করা মানুষেরই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার এই বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। লকের মতোই একদিকে যেমন রুশো প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের চরিত্রকে একেবারে আদর্শ কল্পনা করেননি, তেমনি হবস এর ন্যায় তিনি মানুষকে অধমও ভাবেন নি। রুশোর মতে মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় স্বাভাবিক ও সাধারণ জীবন যাপন করতে চাইত। কিন্তু একটা পর্যায়ে সে দেখতে পেল যে, ব্যক্তির একার পক্ষে অপরের সঙ্গে সংযোগহীনভাবে প্রতিকুল শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপদ জীবন যাপন করা এবং নিজের অধিকারসমূহ প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এই বোধ থেকে মানুষ চুক্তি করে রাষ্ট্র অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন, বিধি নিষেধের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ চুক্তি সে অপর কোনো শাসক বা অধিনায়কের সঙ্গে করে নি কিংবা চুক্তি মারফত কোনো নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র শাসনকর্তা তৈরি করে নি। ব্যক্তি চুক্তি করেছে ব্যক্তির সঙ্গে অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে। চুক্তির মূলকথা হচ্ছে, একে অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। এমনিভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের (নিজের সঙ্গে নিজের) চুক্তিতে সৃষ্ট হয়েছে এক সাধারণ ইচ্ছা ও সাধারণ শক্তি। এই সাধারণ ইচ্ছাই রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের নিয়ামক। এ ইচ্ছা কোনো ব্যক্তিরই যথার্থ স্বার্থের বৈরী নয়। প্রত্যেকের ইচ্ছা দিয়ে এর সৃষ্টি বলে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই যেমন এই সাধারণ ইচ্ছাকে জবরদস্তি মনে করা চলে না-তেমনি এই সাধারণ ইচ্ছা ব্যক্তির যথার্থ স্বার্থের বিরোধী কোনো নিয়ম বা নিষেধ আকারেও প্রকাশিত হতে পারে না। রুশোর মতে, সামাজিক চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের একটা পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাকৃতিক জীবনে মানুষ যে স্বাধিকার ভোগ করত, সভ্যতার পর্যায়েও যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে মানুষ যেন নিরাপদভাবে সেই অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। হবস এবং রুশোর চুক্তির মধ্যে একটা সাদৃশ্য এই যে, উভয় ক্ষেত্রে মানুষ তার চুক্তি পূর্ব স্বাধীনতাকে সর্বোতভাবে অপর এক শক্তির কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে। কিন্তু হবস্ এর তত্ত্বে ব্যক্তি যেখানে একচ্ছত্র শাসকের নিকট শর্তহীনভাবে তার স্বাধীনতাকে ত্যাগ করেছে সেখানে রুশোর ব্যাখ্যায় ব্যক্তির আত্মসমর্পণ কোনো শাসকের কাছে নয়; এ আত্মসমর্পণ পরস্পরের কাছে। এখানে শাসকের কাছে অধিকার ত্যাগ করে ব্যক্তি কি লাভ করবে? শান্তি? রুশোর মতে শৃঙ্খলিত বন্দিও তো বন্দীশালায় নিরাপদ শান্তি লাভ করতে পারে কিন্তু তাই বলে সে শান্তি কি মানুষের কাম্য হতে পারে? কাজেই সামাজিক চুক্তি ব্যক্তির অধিকার বিনষ্টির জন্য নয়, তার রক্ষার জন্য। রুশোর মতে, মানুষ পারস্পরিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এই চেতনা হয়েছে যে, এককভাবে তার অধিকার ভোগ করা সম্ভব নয়। এই চেতনা থেকে সকলে সকলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তি তার কোনো যথার্থ স্বার্থ থেকে বঞ্চিত হয় নি। কারণ চুক্তিবদ্ধ এক ব্যক্তি এমন কোনো অধিকার অপর ব্যক্তিকে অর্পণ করে দিচ্ছে না যার পরিবর্তে ঠিক সে অধিকারই সে অপরের নিকট থেকেও লাভ করতে পারছে না।
দর্শনের ক্ষেত্রে রুশো ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং আত্মার অমরতা উভয়কেই স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু আবার বস্তুকেও তিনি শ্বাশ্বত বলেছেন। সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে রুশো সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার তীব্র সমালোচক ছিলেন। সামন্ততন্ত্রের শোষণ ও শ্রেণীবিন্যাসের উচ্ছেদ করে সকল মানুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে নতুন যে বিপ্লবী চেতনা দেশের ধনিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল বুর্জোয়া বিপ্লবের সে চিন্তাধারাকে রুশো সমর্থন করেছিলেন। সমাজের অসাম্য ও অবিচারের মূল ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্বকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করলেও রুশো ব্যক্তির জন্য অল্প পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার মতও পোষণ করতেন। শিক্ষার প্রশ্নেও রুশো প্রগতিশীল অভিমত পোষণ করতেন। তাঁর মতে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে এমন এক শিক্ষার প্রবর্তন করতে হবে যে শিক্ষা সকল নাগরিককে শ্রমের মর্যাদায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হবে।
রুশোর বিপ্লবী চিন্তায় ফরাসি সরকার এবং সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ রুষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের আশঙ্কায় তিনি এক সময় ফ্রান্স পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বার্ন প্রজাতন্ত্র তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় তিনি ইংরেজ দার্শনিক হিউমের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড গমন করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউমের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ উপস্থিত হয় এবং তিনি ফ্রান্সেই প্রত্যাবর্তন করেন।
রুশোর রচনাবলীর মধ্যে ‘দি সোস্যাল কন্টাক্ট’ বা ‘সামাজিক চুক্তি’ ব্যতীত তাঁর ‘কনফেশনস’ বা আত্মচরিত এবং ডিডেরটের সম্পাদনায় প্রকাশিত ফরাসি বিশ্বকোষে প্রকাশিত ‘ডিসকোর্স ইন পলিটিক্যাল ইকনমি’ এবং ‘এমিলি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
Roy, M.N. : মানবেন্দ্রনাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪ খ্রি)
বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মানবেন্দ্রনাথ রায় সেকালের স্বাধীন সংগ্রামী গোপন রাজনৈতিক বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। বহু রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত মানবেন্দ্রনাথ রায় বহুবার বিভিন্ন সরকার দ্বারা গ্রেফতার হন, কারাবন্দি হন এবং কোনো কোনো বন্দিদশা হতে পলায়ন করে ছদ্মনামে পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৭ সনে রুশ বিপ্লবের পরে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং কমিউনিস্ট রাজনীতিকের একজন নেতা হিসেবে পরিচিত হন। কিন্তু কালক্রমে কমিউনিস্ট পার্টি এবং আন্তর্জাতিকের মধ্যে মতবিরোধ ঘটলে এম.এন. রায় কমউনিস্ট আন্তর্জাতিক হতে বহিষ্কৃত হন। ইংরেজি ভাষায় প্রাঞ্জল রাজনৈতিক রচনাকার এম.এন. রায় তার নিজস্ব অভিমত ব্যাখ্যা ও প্রচার করার জন্য একাধিক ইংরেজি পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশ করা ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’, ‘নউ হিউম্যানিজম,’ ‘রিজন, রোমান্টিসিজম এন্ড রিভোল্যূশন’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এম.এন. রায় প্রচলিত মার্কসবাদী কমিউনিস্ট মতবাদ থেকে ভিন্নভাবে তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। তার চিন্তাধারা ‘র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম’ নামে পরিচিত।
Russell, Bertrand: বার্টান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)
বার্টান্ড রাসেল ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইংরেজ দার্শনিক এবং যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। রাসেলের জীবন যেমন দীর্ঘ, তেমনি বিচিত্র। তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, জীবনের কোনো নীতিকেই তিনি বিনা প্রশ্নে স্বীকার করেন নি এবং কোনো নীতিতে অবিচলও থাকেন নি। তাঁর প্রাঞ্জল রচনারীতি তাঁকে বিপুল মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলে। চিন্তা এবং রচনায় তিনি জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর কয়েকবছর পূর্বে প্রকাশিত আত্মজীবনীর কয়েকটি খন্ড তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্কোস সত্যকথনের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আত্মজীবনী ব্যতীত তাঁর প্রচুর সংখ্যক গ্রন্থের মধ্যে গণিত দর্শনের উপর লিখিত গ্রন্থসমূহ এবং ‘পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস’ বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। রাসেল হোয়াইটহেডের সাথে যুক্তভাবে গণিত দর্শনের উপর গবেষণা করেন। আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্রকে তিনি বিশেষভাবে উন্নত করেছেন। ‘লজিক্যাল সিম্বলস’ বা ন্যায়ের প্রতীককে তিনি ত্রুটিহীন করার চেষ্টা করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে রাসেরলে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি এই ছিল যে, তিনি দর্শনকে কাল্পনিক সমস্যার ততোধিক কাল্পনিক সমাধানের আকর না করে দর্শনকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাকারীতে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করতেন যে, দর্শন বিজ্ঞানের পরিমন্ডল থেকে সমস্যাকে আরোহণ করবে এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্বকে সামগ্রিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করাই হবে দর্শনের প্রধান কর্তব্য। দর্শন মানুষকে আকাশচারী কল্পনাবিলাসী নয়, দর্শন মানুষকে বৈজ্ঞানিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিকে পরিণত করবে। দর্শনের অপর কাজ হবে মানুষের ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তাকে ভাব প্রকাশের সঠিক বাহনে পরিণত করার চেষ্টা করা। জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে রাসেলকে সন্দেহবাদী বলা চলে। সাধারণ জীবনে তিনি শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন। কিন্তু প্রায় শতাব্দীকালের দীর্ঘ জীবনে তিনি দুটি মহাযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। যে মানবিক আদর্শের তিনি কল্পনা করেছেন ভিয়েতনামের নিরীহ নির্বিবাদী মানুষের উপর অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্বর নিধনযজ্ঞে তা ভস্মীভূত হতে দেখেছেন। এত দীর্ঘজীবনে ঘটনার উত্থান পতনে ব্যক্তির পক্ষে হতাশ হয়ে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু রাসেলের জীবনে বিস্ময়কর দিক এই যে, ‍বৃদ্ধ বয়সেও তিনি হতাশাগ্রস্ত না হয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রতিরোধের সংগ্রামী সৈনিকে পরিণত হন। তাঁর এই সংগ্রামী মনোভাবের কথা প্রকাশ করে ৯০ বছর বয়েসে রাসেল লিখেছিলেন, “সাধারণভাবে যে রকম আশা করা হয়, তার অতিক্রম করে আমি ক্রমান্বয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছি। অথচ আমি বিদ্রোহী হয়ে জন্মগ্রহণ করি নি। ১৯১৪ সন পর্যন্ত আমি কম বেশি দুনিয়ার সঙ্গে মানিয়ে চলেছি। তখনও অমঙ্গলজনক অবস্থা ছিল। কিন্তু তা হ্রাস পাবে বলে মনে করার যৌক্তিকতা তখনো ছিল। বিদ্রোহীর মন মেজাজ না থাকা সত্ত্বেও ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আমি ধৈর্য বজায় রেখে ঘটনার সাথে তাল রেখে চলতে পারলাম না। সংখ্যায় সামান্য হলেও এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের সাথে আমার মতের মিল আছে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাদের সাথে কাজ করে যাবো।”
Saankhya : সংখ্যা
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার নাম ছিল সাংখ্য। পৌরাণিক কাহিনীতে কপিল মুনিকে সাংখ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। সত্তার ধারণায় সাংখ্য ছিল দ্বৈতবাদী।
পুরুষ এবং প্রকৃতি : উভয়ই মৌলশক্তি। পুরুষ হচ্ছে চেতনা, প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু, প্রকৃতিজগৎ। সাংখ্য মতে পুরুষ দ্বারা ঈশ্বর বা স্রষ্টা বুঝায় না। পুরুষ হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত বা আবদ্ধ নিত্যকালের চেতনা। ব্যক্তি প্রকৃতির অংশ। ব্যক্তির পরিবর্তন আছে, কিন্তু পুরুষের কোনো পরিবর্তন নেই। প্রকৃতি নিয়ত কার্যকারণের বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃতির পরিবর্তনের মূলে আছে সত্ত্ব, তমঃ. রজঃ এই তিন গুণের সমন্বয়। সত্ত্ব হচ্ছে শ্রেষ্ঠ গুণ। স্বচ্ছতা এবং পবিত্রতা হচ্ছে এর বৈশিষ্ট্য। তমঃ হচ্ছে জাড্য বা জড়তা। এবং রজঃ হচ্ছে সক্রিয়তা। বিশ্ব জগৎ এই তিন গুণের সমাহারের সৃষ্টি। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগে বিশ্ব জগতের বিবর্তন শুরু। ব্যক্তির বিবর্তনও এই দুই মৌল শক্তির সংযোগের ফল। দেহের মধ্যে পুরুষ, প্রকৃতি এবং অহং এর স্থিতি। পুরুষের নির্দেশে দেহের ক্রিয়াশীলতা। দেহের বিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে কর্মের মাধ্যমে এমন বিশুদ্ধ অবস্থা লাভ করা যে অবস্থায় দেহের বন্ধন থেকে পুরুষ নিত্যকালের মুক্তিলাভে সক্ষম হবে।
Santayana, George : জর্জ সান্তায়ানা (১৮৩৬-১৯৫২)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিখ্যাত দার্শনিক এবং লেখক ছিলেন জর্জ সান্তায়ানা। কিন্তু জর্জ সান্তায়ানারা জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে এবং তিনি মারা যান ইতালির রোম শহরে ১৯৫২ সালে। তাঁর দর্শনকে ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম বা বৈচারিক বাস্তববাদ বলা হয়। জর্জ সান্তায়ানার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্চে : ‘লাইফ অব রিজন’ বা যুক্তির জীবন। তাঁর যুক্তির জীবনকে তিনি পাঁচ খন্ডে বিভক্ত করেন। খন্ডগুলির নাম এরূপ ১. সাধারণ বোধ যুক্তি, ২. সমাজ জীবনে যুক্তি, ৩. ধর্মে যুক্তি, ৪. আর্ট বা শিল্প কর্মে যুক্তি, ৫ বিজ্ঞানে যুক্তি।
Sartree, Jean Paul : জাঁ পল সার্ত্রে (১৯০৫-১৯৮০ খ্রি.)
জাঁ পল সার্ত্রে ছিলেন একজন বিখ্যাত ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার এবং উপন্যাসিক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সার্ত্রে ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ফ্যাসিবাদের পুনরুজ্জীবনের বিরুদ্ধে সার্ত্রে ছিলেন সোচ্চার এবং সংগ্রামী। সার্ত্রের দর্শনে অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা কিয়ার্কেগার্ড এবং মনঃসমীক্ষণের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রয়েডের চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সার্ত্রের দর্শনের মূল কথা হচ্ছেঃ সত্তার মূল হচ্ছে মানুষ নিজে। জগতের মধ্যে যুক্তি নেই। মানুষ কোনো বিধিবিধানের দাস নয়। মানুষ নিজের সত্তাকে নিজে তৈরি করে।
Scepticism : সংশয়বাদ
সংশয়বাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক তত্ত্ব। বিশেষ করে জ্ঞানের প্রশ্নে প্রাচীন গ্রিসে এই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। বিষয়ী বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- এই হচ্ছে সংশয়বাদের মূল কথা। খ্রিষ্টপূর্ব চতূর্থ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিক সমাজ যখন সামাজিক অস্থিরতায় সংকটগ্রস্ত তখন প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে সংশয় এবং অস্বীকারমূলক একটা মনোভাব জন্মলাভ করে। প্রাচীন সংশয়বাদের শক্তিশালি প্রকাশ ঘটে পিরহো, আরসেসিলাস, কারনিয়াডিস, ইনিসিডেমাস, সেক্সটাস এমপিরিকাস এবং অপরাপর দার্শনিকের মধ্যে। সফিস্টরা যখন প্রচলিত বিধিবিধান সম্পর্কে জনসাধারণের মনে প্রশ্নে উদ্রেক করেছিল তেমনি সংশয়বাদীগণ বলতে শুরু করে: জ্ঞানের প্রচলিত ধারণারই বা নিশ্চয়তা কি? জগৎ সম্পর্কে, বস্তু সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আছে বলে পন্ডিতগণ যে দাবি করেন তার কোনো ভিত্তি নেই। ব্যক্তি-নিরপেক্ষ কোনো জ্ঞান আছে বলে প্রমাণ করা যায় না। ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সমূহের সুস্থতা, অসুস্থতা, ব্যক্তির অভাব অভিযোগ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, প্রচলিত বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আচার আচরণ দ্বারা ব্যক্তির জ্ঞান প্রভাবান্বিত হয়। অথচ জ্ঞান বলতে পন্ডিতগণ এমন কিছুকে বুঝাতে চান যা ব্যক্তির মন বা পরিপার্শ্ব, তার অবস্থা বা ইতিহাস কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু ব্যক্তি এবং অবস্থা নিরপেক্ষ যখন সম্ভব নয় তখন বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। প্রাচীন সংশয়বাদীগণ বলতেন যে, জ্ঞানে অতৃপ্তি এবং অসন্তোষের বৃদ্ধি। তাই মনের শান্তির জন্য শ্রেয় হচ্ছে কোনো কিছু সম্পকে কোনো সিদ্ধান্তমূলক অভিমত আদৌ গ্রহণ না করা। সংশয়বাদ মধ্যযুগেও গোঁড়া ধর্মীয় এবং দার্শনিক অভিমতসমূহের প্রভাব হ্রাসে বিশেষ সাহায্য করেছে। মধ্যযুগে প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংশয়বাদী চিন্তা বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশকে সহজতর করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউম এবং কান্ট সংশয়বাদের যে তত্ত্ব প্রচার করেন তাতে জ্ঞান কেবলমাত্র সত্তার বাহ্য প্রকাশে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কান্টের দর্শনে সত্তার যথার্থ জ্ঞান অতীন্দ্রিয় বোধ বা ধর্মীয় অনুভূতির মাধ্যমেই মাত্র লাভ করা চলে।
Scholasticism : স্কলাসটিসিজম, সাম্প্রদায়িক বিদ্যাভিমান, ধর্মীয় দর্শন
ইউরোপের দর্শনের বিকাশে ‘স্কলাসটিসিজম’ শব্দের একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। ইউরোপীয় দেশসমূহে মধ্যযুগে যখন খ্রিষ্টধর্মের যাজকতন্ত্রের প্রভাব সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবলভাবে চলছে তখন শিক্ষায়তনগুলি ছিল গোঁড়া যাজক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই সমস্ত স্কুলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পন্ডিতদের প্রধান কর্তব্য হয় ধর্মের বিশ্বাস ও বিধিনিষেধকে যুক্তির সাহায্যে সত্য বা সঠিক বলে প্রমাণ করা। এই ধারায় ‘স্কলাসিটক’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই সকল স্কলাসটিক বা পন্ডিতগণ যে ধর্ম যাজক ছিল, তা নয়। কিন্তু এরা ধর্মকে দর্শনের মারফত রক্ষা করাকে নিজেদের প্রধান দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেছিল। ধর্মরক্ষাকারী এই পন্ডিতগণ প্রাচীন গ্রিসের বিশেষ করে প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের দার্শনিক মতকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে খ্রিষ্টধর্মের একটা যুক্তিগত ভিত্তি তৈরি করার চেষ্টা করে। এই ধর্মীয় দর্শনের প্রথমদিকে যে দার্শনিক সমস্যাগুলি আলোচিত হয় তার মধ্যে সাধারণ বা সার্বিকভাবের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিংবা নেই-প্রশ্নটির উল্লেখ করা যায়। খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে এ্যরিষ্টটলীয় দর্শনের সমন্বয় সাধনের প্রধান চেষ্টা করেন টমাস এক্যুইনাস। টামস এক্যুইনাস পরবর্তীকালে সেইন্ট বা স্বর্গীয় পুরুষ বলে ঘোষিত হন এবং রোমান ক্যাথলিক অর্থাৎ গোঁড়া যাজকতন্ত্রের দর্শনের মুখপাত্র হিসাবে পরিগণিত হন। মধ্যযুগের ধর্মীয় দার্শনিকদের মধ্যে টমাস এক্যুইনাস ব্যতীত এরিজোনা, আনসেলম, আবেলার্দ এবং অকামের উইলিয়ামের নাম উল্লেখযোগ্য। নবম শতাব্দীতে এরিজেনো অব প্লেটোবাদের ব্যাখ্যা করেন; আনসেলম সত্তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন; দ্বাদশ শতকে আবেলার্স সাধারণ বা সার্বিক ভাবের অস্তিত্বগত প্রশ্নের একটা সমাধানের চেষ্টা করেন এবং চতুর্দশ শতকে অকামের উইলিযাম বলেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসের ব্যাপার, যুক্তি দ্বারা প্রমাণের বিষয় নয়।
Schopenhauer, Arthur : আর্থার শপেনহার (১৭৮৮-১৮৬০ খ্রি.)
শপেনহার ছিলেন ঊনবিংশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর দর্শনের মূলে ছিল বাস্তব সমাজ এবং জগৎ সম্পর্কে অবিশ্বাস এবং হতাশা। ১৮৪৮ সালের জার্মানি শ্রমিক এবং কৃষক শ্রেণীর বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থানে পূর্ণ ছিল। শোষিত জনসাধারণের এই বিপ্লবী চেতনা এবং চেতনার সংঘটিত প্রকাশে পুঁজিপতিশ্রেণী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রতিক্রিয়ার পথ অবলম্বন করে। এই পর্যায়ে শাপেনহার তাঁর দর্শনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। শপেনহার তৎকালীন জার্মানির প্রতিক্রিয়ার মুখপাত্র হিসেবে বিবেচিত হন। পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করে, শপেনহারের ভূমিকা তখন অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শপেনহার বস্তুবাদের বিরোধিতা করেন। কান্টের দৃশ্যমানতার তত্ত্বকে গ্রহণ করে কান্টের দৃশ্যাতিরিক্ত স্বাধীন সত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে সব কিছুর মূলে এক অন্ধ ইচ্ছাশক্তির কল্পনা করেন। এই অন্ধ ইচ্ছাশক্তি কোনো যুক্তির অধীন নয়। অন্ধ ইচ্ছাশক্তি সবকিছুর পরিচালক। কাজেই এই তত্ত্বে প্রকৃতির বিধানের কোনো স্থান নেই এবং কোনো কিছুকে বৈজ্ঞানিকভাবে জ্ঞাত হওয়ারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। শপেনহার ইতিহাসের গতিকে স্বীকার করতেন না। অতীত যদি দুঃখময় হয়ে থাকে, ভবিষ্যতে মহৎ বা সুখময় কিছু আশা করার যুক্তি নেই। ব্যক্তির পক্ষে কামনা বাসনার কোনো অর্থ নেই। ব্যক্তির একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত কামনা বাসনা বিমুক্ত নির্বাণ লাভ। এই নির্মাণের তত্ত্ব শপেনহার বৌদ্ধদর্শনের কাছ হতে গ্রহণ করেন। শপেনহারের এই প্রতিক্রিয়াশীল ভাববাদ এবং হতাশাবাদী জীবনবাদ নিৎসের দর্শনের আদর্শগত পটভূমি রচনা করে দিয়েছিল।
Seal, Brojendar Nath : ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪-১৯৩৮ খ্রি.)
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাঙালি পন্ডিত এবং দার্শনিক। ছাত্রাবস্থাতেই ব্রজেন্দ্রনাথ এর তীক্ষ্ম বুদ্ধি এবং জ্ঞানের গভীরতা কথা গল্পের আকারে শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৮৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্রজেন্দ্রনাথ দর্শনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীকালে তিনি কুচবিহার কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৯৯ সালে ব্রজেন্দ্রনাথ রোমে প্রাচ্যবিদদের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের উদ্বোধন করেন। দীর্ঘদিন যাবত তিনি মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এর দায়িত্ব পালন করেন। এক সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বহু বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোনো রচনাতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখবেন না- এই কঠিন নীতি অনুসরণ করে চলতেন বলে ব্রজেন্দ্রনাথের রচনার সংখ্যা খুবই অল্প। কোনো রচনাই তিনি লেখামাত্র প্রকাশ করতে দিতেন না। িএজন্য অনেক পান্ডুলিপি পরিণোমে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
Secularism : ইহজাগতিকতা
আমাদের ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সেক্যুলারিজম’ কে ধর্মহীন, ধর্মশূণ্য ইতাদি বলে চিন্তা করার ধারণাটিই প্রবল। আসলে কথাটির উদ্ভব ও আলোচনার ক্ষেত্র ছিল ইউরোপের মধ্যযুগ।
একদিকে খ্রিষ্টধর্ম তথা পোপের আধিপত্য, অপরদিকে জাগতিক, রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ জাগতিক শাসনের উপর জোর দেওয়াটাই ছিল ‘সেকুলার’ শব্দের দ্বন্ধের ক্ষেত্র।
কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, গণহত্যার প্রভৃতির ক্ষেত্রে কাউকে সেক্যুলারিস্ট বলে তাকে অধার্মিক এমনকি নাসিত্ক বলে তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিকূল ও বৈরী মনোভাব তৈরির প্রবণতা দেখা যায়।
কোনো আবেগের বশবর্তী না হয়ে সেক্যুলারিস্ট ইংরেজি শব্দের বাংলা হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’ ব্যবহার করা সঙ্গত। অনেকে এক্ষেত্রে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দকে ব্যবহার করতে চান। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে নিরীহ বলে বোধ হলেও তারও শেষ অর্থ দাঁড়ায় ধর্মে ধর্মে নিরপেক্ষতা তথা কোনো বিশেষ শাসক বা শক্তির কোনো ধর্মীয় মতামত বা বিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ পক্ষ অবলম্বন না করার কথা প্রচার করা। কিন্তু এরূপ ব্যাখ্যা অর্থহীন। বাস্তব সমাজ জীবনে নিরপেক্ষতার কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করা যায় না। ইউরোপে ম্যাকিয়াভেলির পর থেকে রাজনৈতিক তত্তইবিদ তথা হবস, লক, রুশো এবং পরবর্তীতে মার্কসবাদ সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব, প্রতিপত্তিকে অস্বীকার করতে চেয়েছে।
সমাজ, জগৎ ও জীবনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমাত্রের সবকিছুর উর্ধ্বে এক অলৌকক শক্তির উপর বিশ্বাস থাকতে পারে। এরূপ বিশ্বাস বয়োঃপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। এজন্যই যুক্তিগতভাবে এরূপ কথা প্রচলিথ আছে : যার ধর্ম তার ধর্ম, কিংবা ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, কোনো ধর্মেরই কোনো রাষ্ট্রগত ভূমিকা থাকতে পারে না কিংবা থাকা সঙ্গত নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন নাগরিকদের যৌথভাবে গৃহীত নীতি ও পদ্ধতির বিষয়। মূলকথা : রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ধর্মের ভালো মন্দ বলে কোনো নির্ধারক ভূমিকা নির্দিষ্ট করা সঙ্গত নয়।
Seneca, Lucias Annaeus : সেনেকা (65-4 খ্রি.পূ.)
রোমের স্টয়েসিজম বা নিস্পৃহ মতবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন সেনেকা। সেনেকা সম্রাট নিরোর শিক্ষক ছিলেন। আবার পরিণামে নিরোই সেনেকাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। সেনেকা বহু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে নীতিশাস্ত্রের উপর রচিত ‘এপিসটলী মরালীস এ্যান্ড লুসিলিয়াম’ নামক গ্রন্থ অবিকৃত আকারে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেনেকা সম্রাট নিরোর শিক্ষক এবং উপদেষ্টা হিসাবে তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করেন। এই ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতায় তিনি একদিকে একচ্ছত্র সম্রাটের স্বেচ্ছাচার, অপরদিকে সাধারণ মানুষের নৈতিক অবনতি দেখে রাষ্ট্র এবং সমাজের উন্নতি সাধনের চেষ্টায় হতাশা বোধ করেন। এই হতাশা থেকে সেনেকা রাষ্ট্র বা সমাজের বিশেষ রূপের ঔচিত্য অনৌচিত্যের বিষয়ে নিস্পৃহ মনোভাব অবলম্বন করেন। সেনেকা ব্যক্তির জন্য নিজের সততা এবং নিস্পৃহতার চর্চা ব্যতীত শান্তির অপর কোনো পথ দেখতে পান নি। সেনেকা তাঁর নিজের দার্শনিক দৃষ্টিকে বিশেষ রাষ্ট্রে সীমা অতিক্রম করে বৃহত্তর মানবসমাজের উপর বিস্তার করেন। কোনো বিশেষ রাষ্ট্রসীমাতেই বিশ্ব যেমন আবদ্ধ নয়, তেমনি কোনো বিশেষ সমাজেই ব্যক্তি বন্দী নয়। ব্যক্তি বৃহত্তর মানব সমাজের অঙ্গীভূত। বিশ্বব্যাপী এক সত্তা এবং প্রজ্ঞা বিরাজমান। বিশেষ রাষ্ট্র বা তার শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা সেই বিশ্বপ্রজ্ঞাকে যেমন বিনষ্ট করতে পারে না, তেমনি সম্রাটের অত্যাচার কিংবা নির্বোধ জনতার অনাচারও বিশ্ব মানবতার হানি ঘটাতে পারে না। রাষ্ট্রের উন্নতি কিংবা মানুষের মুক্তি উভয়ই নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিকে ক্ষুদ্র সীমার বাইরে বৃহত্তর এবং অসীমের মধ্যে প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে। সেনেকার মধ্যে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
Sensation : বেদন, সংবেদন
বস্তুজগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সমূহের স্পর্শে ব্যক্তির মধ্যে যে চেতনা বা বোধের উদ্রেক হয় তাকে বেদন বা সংবেদন বলে। যে কোনো বস্তুকণাকে আমরা উদ্দীপক বলতে পারি। কোনো উদ্দীপক যখন সজীব মানুষের দেহের স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তখন স্নায়ুর অন্তগামী তন্ত্রী উত্তেজনাকে মষ্তিষ্কের চেতনাকেন্দ্রে বহন করে নিয়ে যায়। মস্তিষ্কের চেতনাকেন্দ্রে পৌঁছে উত্তেজনাটি বিশেষ বোধ বা অনুভূতির সৃষ্টি করে। বেদনের মূল তাই উদ্দীপক। উদ্দীপক বাদে বেদনের উদ্ভব ঘটে না। উত্তেজনা বা সংবেদনকে দৃশ্য, শব্দ, স্পর্শ, ঘ্রান প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
Separation of Powers : ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ
রাষ্ট্রযন্ত্রের সমগ্র ক্ষমতাকে আইন, শাসন এবং বিচার প্রধানত এই তিনভাগে বিভক্ত করাকে ক্ষমতার পৃথকীকরণ বা বিভাগকরণ বলা হয়। সামন্তবাদ এবং রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে বিকাশমান ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে হ্রাসকরণের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের এই ত্রিবিভাগীয় ক্ষমতাকে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্রকরণের আন্দোলন শুরু হয়। ইংরেজ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লকের রচনায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার বিস্তারিত আলোচনা সর্বপ্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে মন্টেসক্যূ এই তত্ত্বকে আরো সুনির্দিষ্ট করেন। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ আন্দোলনে অভিজাত শ্রেণীও রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে ধনিক শ্রেণীকে কিছুটা সমর্থন জুগিয়েছিল। স্বতন্ত্রীকরণ আন্দোলনের প্রধান জোর ছিল ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভায় মূল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে সীমিত করার উপর। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ আসলে শাসক শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘাত হ্রাসের প্রচেষ্টা মাত্র : ক্ষমতার এই বিভাগ বৃহত্তর শ্রমজীবি জনতার স্বার্থরক্ষা বা বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে না।
Shintoism : শিন্টোবাদ
প্রাচীন জাপানের ধর্মের নাম ছিল শিন্টো। জাপানের ইতিহাসের বিবর্তনে শিন্টোবাদেরও পরিবর্তন ঘটেছে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলনের ফলে শিন্টো ধর্মে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক আচার অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটে। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে পার্থক্য বুঝাবার জন্য অষ্টাদশ শতকের জাপানের প্রাচীন ধর্মকে শিন্টো বলে অভিহিত করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শিন্টোকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শিন্টো ধর্মে প্রাচীনকালে পশু, প্রাকৃতিক বিভিন্ন বস্তু এবং পূর্ব পুরুষের আত্মাকে পূজা করা হতো। এ পূজাকে বলা হতো কামী পূজা। কামী বা দেবতারা বস্তুজগতের এ সমস্ত দ্রব্যাদির মাধ্যমে জগতে আবির্ভুত হতো। জাপানের সম্রাট বা মিকাডো নিজেও একজন দেবতা। তিনি সমস্ত জাপানবাসীর পূর্ব পুরুষ। মিকাডো সূর্যদেব আমেতারাসুর বংশধর। মিকাডোর মাধ্যমেই ইহজগতের মানুষ দেবতাদের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকেই শিন্টোবাদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সম্রাটও আর দেবতা বলে গণ্য হন না।
Simon, Saint : সেইন্ট সাইমন (১৭৬০-১৮২৫ খ্রি.)
ক্লড হেনরী দ্য রুভরয় সেইন্ট সাইমন ছিলেন ফরাসি দেশের একজন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী। সেইন্ট সাইমনের জীবন ছিল বিচিত্র ঘটনাপূর্ণ। অভিজাত বংশের সন্তান সেইন্ট সাইমন ফরাসি বিপ্লবের সময় উগ্রপন্থী জ্যাকোবিনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামেও অংশগ্রহণ করেন। দার্শনিক চিন্তায় সেইন্ট সাইমন ভাববাদ এবং ঈশ্বরবাদের বিরোধিতা করে বস্তুবাদ এবং প্রকৃতিবাদের তত্ত্বকে সমর্থন করেন। মানুষের ইতিহাসকে তিনি সুনির্দিষ্ট বিধান দ্বারা পরিচালিত বলে মনে করতেন। ইতিহাসকে তিনি কেবল অতীতের বিষয় বলে মনে করতেন না। বিজ্ঞান যেমন মানুষের জীবনকে নানা জ্ঞানে ও সম্পদে সমৃদ্ধ করে, জীবনের ক্ষেত্রে তেমনি ইতিহাসেরও অবদান রয়েছে। ইতিহাসের গতি সম্মুখের দিকে। একটি সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ভিন্নতর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক ব্যবস্থার মূলে থাকে মানুষের নীতি, ধর্ম এবং বিজ্ঞানের উন্নতি। সেইন্ট সাইমন মনে করতেন মানুষের সমাজ তিনটি পর্যায় অতিক্রম করেছেঃ ধর্মীয় পর্যায়। দাস এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পর্যন্ত কল্প দার্শনিক। সামন্তবাদ এবং ধর্মীয় ব্যবস্থার পতন এই যুগের বৈশিষ্ট্য। মানুষের সমাজের তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পর্যায়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক শক্তি। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের সমাজ এই শেষ পর্যায়ে বিকাশ লাভ করবে। সেইন্ট সাইমন সমাজের বিকাশকে ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরপেক্ষ বাস্তব সত্য বলে বিবেচনা করতেন এবং এই বিকাশে সম্পদ ও শ্রেণীর যে বিশেষ ভূমিকা আছে তাও তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। সেইন্ট সাইমন সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলেছিলেন যে, সমাজের প্রতিটি স্তর তার পূর্ববর্তী স্তরের মধ্যে জন্ম লাভ করে। বৃহদাকারের শিল্প তখনো বিকাশ লাভ করে নি। কিন্তু সেইন্ট সাইমন অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, ভবিষ্যতের সমাজ হবে বৃহদাকারের শিল্পভিত্তিক। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সমাজের শ্রেণীবিভাগকে তিনি অপরিবর্তনীয় মনে করতেন। সমাজ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল সমন্বয়বাদী। তাঁর ধারণা ছিল ভবিষ্যত সমাজ বিকশিত হবে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে, সমাজের সকল মানুষের সহযোগিতার মাধ্যমে। শিল্পপতি, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, এবং ব্যাঙ্কপতি এরা সবাই যে সমাজের জন্য যে কেবল অপরিহার্য,তাই নয়। সেইন্ট সাইমনের মতে এদের স্বার্থের মাঝে কোনো দ্বন্ধ বা বিরোধিতা নেই। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ অগ্রসর হবে। এক কথায় বৃহদাকার শিল্প ভিত্তিক সমাজকে তিনি আদর্শ সমাজ বলে মনে করতেন। এই সমাজের পরিকল্পনা হবে দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য। মানুষ মাত্রেরই তার ক্ষমতানুযায়ী সমাজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে কাজ করার অধিকার থাকবে। ভবিষ্যত সমাজের কল্পনায় সেইন্ট সাইমনের একটি অভিমত ছিল যে, ভবিষ্যত সমাজের চরিত্র হবে শাসনমূলকের পরিবর্তে উৎপাদনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা। সেইন্ট সাইমন মহৎ হৃদয় কল্পনাপ্রবণ দার্শনিক ছিলেন। সমাজের মধ্যে সংঘাতকে তিনি স্বীকার করেন নি। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শ্রমিকের উপর অনুষ্ঠিত শোষণের মধ্যকার অসঙ্গতি যে মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে এবং এই বিরোধাত্মক সম্পর্ক যে কোনো শ্রেণীর কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়, এই সত্য সেইন্ট সাইমন স্বীকার করতে চান নি। তাঁর ধারণা ছিল বিজ্ঞানের মাধ্যমে সঠিক জ্ঞানের প্রসারেই সমাজের সব অসঙ্গতি দূরীভূত হবে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সঙ্গতিপূর্ণ প্রগতিশীল এক সমাজ আপনি সৃষ্টি হয়ে যাবে।
Slave Owing System : দাস ব্যবস্থা
দাস ব্যবস্থা-অর্থাৎ যে ব্যবস্থায় অধিক সংখ্যক মানুষ দাস এবং অল্পসংখ্যক মানুষ দাসের মালিক বা প্রভু। দাস ব্যবস্থা মানুষের সমাজের ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দাস ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। পৃথিবীর সব দেশেই এক যুগে দাস ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল। দাস ব্যবস্থার চরম বিকাশ দেখা যায় প্রাচীন গ্রিস এবং রোমান সাম্রাজ্যে। গ্রিস এবং রোমে দাসরাই ছিল প্রধান উৎপাদনী শক্তি। দাসের প্রভুরা ছিল শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণীর মধ্যে দাসের মালিক ব্যতীত জমির মালিক, তখনকার যন্ত্রাদি তৈরির কারখানার মালিক, অর্থ=ঋণদাতা সুদ গ্রহণকারী মহাজন এবং বাণিজ্যের সওদাগরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দুই প্রধান শ্রেণীর মধ্যবর্তী স্তরে ছিল কৃষক, হস্তশিল্পী, ভবঘুরে সর্বহারা এবং দুঃস্থ কারিগর। উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদনী দাসদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল দাস ব্যবস্থার উৎপাদনী শক্তির মূল ভিত্তি। মালিকশ্রেণী দাসদের পশুবৎ বিবেচনা করত। প্রভু শ্রেণীর দার্শনিক এ্যারিস্টটল দাস প্রথাকে রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য বলে যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর মতে দাস হচ্ছে প্রভুর সজীব যন্ত্র। অজীব যন্ত্রের সঙ্গে দাসের পার্থক্য এখানে যে, অজীব যন্ত্র প্রভুর আদেশ বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারে না; কিন্তু সজীব দাস প্রভুর আদেশ এবং ইচ্ছা ইশারামাত্র বুঝতে পারে এবং তা কার্যকর করতে পারে। কিন্তু দাস কখনো শাসক হতে পারে না। দাসের কর্তব্য হচ্ছে প্রভুর জন্য শ্রম করা। এবং প্রভুর কাজ হচ্ছে দাসের শ্রমের ফলে জীবিকার চিন্তামুক্ত যে অবকাশ সে লাভ করেছে সে অবকাশকে শাসনকার্যে ব্যয়িত করা। দাসকে পশুর ন্যায় খাটাবার ফলে দাসদের উৎপাদনে আগ্রহ ও শক্তি ক্রমাণ্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। তবুও দাসের সংখ্যা প্রচুর হওয়াতে দাসের পরিশ্রমের ভিত্তিতে গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলিতে এবং রোমে দর্শন, প্রাচীন বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি শাখায় সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। দাস এবং প্রভুতে সমাজ শ্রেণীবিভক্ত হওয়ার পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও উদ্ভব ঘটে। শোষিত দাস সর্বদা যে নীরবে নিজেদের ভাগ্য মেনে নিয়েছিল একথা সত্যি নয়। বরঞ্চ দাস সমাজের সমগ্র ইতিহাসই শ্রেণীসংগ্রমের ইতিহাস। গ্রিসে এবং রোমে বিভিন্ন সময়ে দাসদের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। রোমের দাস স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে খ্রি.পূ. ৭৩ সালে যে বিদ্রোহ ঘটে তা ব্যাপকতায় এবং দাসদের বীরত্বে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। দাসদের বিদ্রোহের সঙ্গে কৃষকদের সহানুভূতি এবং সাহায্যও যুক্ত থাকতো। দাসের শোষনের ভিত্তিতে সভ্যতার বিকাশ যখন আর সম্ভব হচ্ছিল না তখন দাস ব্যবস্থায় ভাঙ্গন শুরু হয় এবং কৃষিকাজের য্ন্ত্রপাতির উন্নতি দাস ব্যবস্থাকে সমাজে অগ্রগতির প্রতিবন্ধক শক্তিতে পরিণত করে। পরিণামে দাস ব্যবস্থার স্থানে সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হয়। তবে দাস ব্যবস্থার বিলোপ দাস সমাজ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে নি। সামন্তবাদী সমাজে দাসব্যবস্থার রেশ দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে ছিল। এখনো যে সমস্ত দেশে সামন্তবাদী অর্থনীতি টিকে আছে সেখানে দাসব্যবস্থার পরিচয়মূলক প্রথার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
Social Contract, Theory of : সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব
রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের বিধিবিধানের উৎপত্তি সম্পর্কিত একটি তত্ত্বের নাম হচ্ছে সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে বিকাশমান পুঁজিপতি শ্রেণী যখন রাজতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করে শাসন ক্ষমতায় নিজেদের অধিকার কায়েম করার চেষ্টা করে হবস, গ্যাসেন্দী, স্পিনাজো, লক এবং রুশোর রচনাবলীতে এই তত্ত্বের বিশেষ আলোচনা দেখা যায়। রাজতন্ত্র এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সে যুগের অগ্রসর বুর্জোয়া শ্রেণী সামাজিক চুক্তির তত্ত্বকে একটি আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সামাজিক চুক্তি তত্ত্বের প্রবক্তাগণ রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রশ্নে রাষ্ট্রের উদ্ভবপূর্ণ অবস্থার দুটি চিত্র অঙ্কন করেন। কউ মনে করেন যে, রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রশ্নে মানুষ পরস্পর আত্মঘাতী দ্বন্ধে লিপ্ত ছিল। এই দ্বন্ধের ফলে মানুষ বুঝতে পারে যে এই দ্বন্ধ বন্ধ না করলে সমাজের কোনো ব্যক্তির পক্ষেই বেঁচে থাকা এবং কোনো অধিকার ভোগ করা সম্ভব হবে না। এই উপলব্ধি থেকে মানুষ চুক্তিবদ্ধ হয়ে শাসক এবং রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করে। সামাজিক চুক্তির এই তত্ত্ব বুর্জোয়া বিকাশের যুগের তত্ত্ব হলেও এর আভাস প্রাচীনকালের গ্রীসের সফিস্টদের বক্তব্য এবং চীনের প্রাচীন দার্শনিক মোজুর দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়।


Socialism : সমাজতন্ত্র
কলকারখানা এবং জমি হচ্ছে রাষ্ট্রের উৎপাদনের উপায়। উৎপাদনের উপায়ের সমষ্টিগত মালিকানার ভিত্তিতে যে আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে সমাজতন্ত্র বলে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক মালিকানা দুটি রূপ গ্রহণ করতে পারেঃ রাষ্ট্রীয় মালিকানা এবং সমবায়মূলক ও যৌথ মালিকানা। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণীশোষনের অবস্থান থাকতে পারে না, জাতিগত বৈষম্য ও শোষণের অবসান ঘটে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে জাতিগত বৈষমে্যর মূল কারণ হচ্ছে উন্নত জাতির মালিকশ্রেণী অনুন্নত জাতিকে নিজেদের পণ্যের বাজার হিসেবে দেখে এবং তাদের উন্নতিতে নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন বলে বোধ করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শুধু শ্রেণীতে শ্রেণীতে নয়, শহরের সঙ্গে গ্রামের এবং মানসিক শ্রমের সঙ্গে দৈহিক শ্রমের সৃষ্টি বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে, শহর গ্রামকে জীবনের অশিক্ষিত পশ্চাদপদ অংশ বলে বিবেচনা করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি শহর ও গ্রামকে পরস্পরের পরিপূরক আর্থিক ও সামাজিক অঞ্চল হিসেবে উন্নত করে তোলে। সমাজতন্ত্রে সৌভ্রাতৃত্বমূলক দুটি প্রধান শ্রেণীর অস্তিত্ত্ব থাকে-কারখানার শ্রমিক শ্রেণী, যৌথ খামারের কৃষক শ্রেণী। গোড়ার দিকে বুদ্ধিজীবি বলে পুঁজিবাদের অবশেষ হিসেবে একটি শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বজনীনতার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবিরা আর পৃথক শ্রেণী বলে বিবেচিত হতে পারে না। যে শ্রমিক সেই বুদ্ধিজীবি; যে কৃষক সেও তার শিক্ষা ও সংস্কৃতির মানে বুদ্ধিজীবি। নাগরিকদের কার্যগত পার্থক্য থাকতে পারে; কেউ অফিসে, কেউ আদলতে, কেউ কারখানায় , কেউবা খামারে কর্মরত। সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় প্রতিদ্বন্ধী শ্রেণীকে পর্যুদস্তু করতে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের আবশ্যক। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রেরে প্রাথমিক সীমাবদ্ধতা এই যে, পুঁজিবাদী উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধী সকল শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায় না। প্রতিরোধী শক্তির অবশেষের জন্য সমাজতন্ত্র কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে না। জাতি বা বর্ণভেদেও কোনো বৈষম্য সমাজতন্ত্র স্বীকার করে না। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য সাম্যবাদের পৌছানো। সাম্যবাদের মূল নীতি : যার যেমন ক্ষমতা, সে তেমনভাবে শ্রম করবে এবং তার যেমন প্রয়োজন, তেমনভাবে তার প্রয়োজনের পূরণ হবে। সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে চরম রক্তক্ষয়ী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি ছিল সমাজতান্ত্রিক। বর্তমানে পৃথিবীর আরো অনেক দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
Socialism, Downfall of ? : সমাজতন্ত্রের পতন
১৯১৭ সালে বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার গঠন করে। গোড়ার দিকে ভি.আই. লেনিন এই সরকারের নেতৃত্ব দেন। ভি.আই. লেনিনের অকাল মৃত্যুর পরে (ভি.আই. লেনিন ১৮৭০-১৯২৪) জে.ভি. স্টালিন কমউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর পর্যন্ত সরকার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে স্টালিন সম্পর্কে রাশিয়া ও কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে নানা সমালোচনার উদ্ভব হতে থাকে। ১৯৫৬ সালে এই সমালোচনা কমি উনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভের বিখ্যাত বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ বিরোধের পরিণতিতে রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তি পার্টি এবং সরকারের ক্ষমতা দখল করে। ১৯৮৫ সালে গরভাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এ ঘটনাকে সমাজতন্ত্রের পতন বলে আখ্যায়িত করা হয়।
Socrates : সক্রেটিস (৪৬৯-৩৯৯ খ্রি.পূ.)
সক্রেটিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। তিনি ছিলেন এথেন্স নগর রাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি নিজে কিছু রচনা করেন নি। তাঁর দর্শন এবং জীবনকাহিনী জানা যায় তাঁর বিখ্যাত শিষ্য প্লেটোর রচনাবলী থেকে। প্লেটো সংলাপের আকারে তাঁর সমস্ত দার্শনিক পুস্তক রচনা করেন। প্লেটোর সকল গ্রন্থেরই নায়ক হচ্ছেন সক্রেটিস। সক্রেটিস পথে ঘাটে বাজারে সর্বদা তত্ত্বকথার আলোচনা করতেন। প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা কোনো কিছুকেই তিনি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করতেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞানের অন্বেষক। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং প্রচলিত ধর্ম এবং নীতি সম্পর্কে তরুণদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করার প্রবণতায় আতঙ্কিত হয়ে এথেন্স সরকার তাঁকে তরুণদের বিপথগামী করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা করে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ সম্পর্কে আর প্রশ্ন তুলবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে; অন্যথায় তাঁকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হবে-এথেন্স নগরের আদালত এই দন্ড ঘোষণা করে। তাঁর শিষ্যগণ তাঁকে গোপনে কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা গোপনে পলায়ন করে জীবনরক্ষা কোনোটিকেই গ্রহণ করলেন না, হেমলক পান করে অকম্পিত চিত্তে মৃত্যুকে বরণ করেন। তাঁর জীবনের এই উপাখ্যান প্লেটোর গ্রন্থসমূহ থেকে পাওয়া যায়। তাঁর জীবনত্যাগের এই কাহিনী তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। সক্রেটিসকে লোকে অনেক জ্ঞানী বলতেন। এই খ্যাতির বিশ্লেষণে তিনি পরিহাস করে বলেছিলনঃ আমাকে কেন লোকে জ্ঞানী বলে, আমি কতটুকু জানি, এই প্রশ্নের রহস্যভেদ করার জন্য আমি কতমানুষকে প্রশ্ন করেছি। যাকে প্রশ্ন করেছি, সেই –ই অক্লেশে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। দিনের পরিভ্রমণ শেষে আমি ক্লান্ত দেহে সিদ্ধান্ত নিয়েছি : এতসব ‘জ্ঞানীর’ মাঝে আমার যদি কিছু পার্থক্য থাকে তবে সে এই যে, আমি জানি যে আমি কিছু জানি না; কিন্তু এরা জানে না যে এরা কিছু জানে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝা যায় – তিনি মানুষের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ মনে করতেন। বিশ্বের মূল সত্তা সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে না। মানুষ কেবল সেই সত্তার সৃষ্ট ভাবকেই জানতে পারে। ভাব মানুষের মনের ব্যাপার। সক্রেটিসের পূর্বে গ্রিসের দর্শন ছিল প্রধানত বস্তুবাদী এবং প্রকৃতিবাদী। সক্রেটিস এবং প্লেটোর দর্শন মূলত ভাববাদী। সক্রেটিস এবং প্লেটোর কাছে ভাবই হচ্ছে সত্য। মানুষ ভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়। মানুষের মনের ভাব চরম ভাবের প্রকাশ।

Stalin, J.V. : জে.ভি. স্টালিন (১৮৭৯-১৯৫৩ খ্রি.)
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপ্লবের নেতা হিসেবে লেনিনের পরেই স্টালিনের নাম কমিউনিস্ট মতবাদের সমর্থকগণ দীর্ঘদিন যাবত উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর প্রথমে স্ট্যালিনবাদের সমালোচনা শুরু হয় এবং স্টালিন জনমনের অতিভক্তির বেদি থেকে একজন একনায়কতন্ত্রী নির্মম শাসক হিসেবে চিত্রিত হন। স্টালিন ১৮৭৯ সালে জর্জিয়ার একটি শ্রমজীবি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি শিক্ষায়তন হতে বহিষ্কৃত হন বিশৃঙ্খলার অপরাধে। জার সরকার তাঁকে দুইবার সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠায়। দুবারই সাইবেরিয়া হতে পলায়ন করে স্টালিন গোপন মার্কসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে স্টালিন জাতি সমস্যার আলোচনা করে ‘মার্কসবাদ ও জাতি সমস্যা’ নামক তাঁর রাজনীতিক নিবন্ধ আলোচনা করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সাম্যবাদী দলে মুখপাত্র ‘প্রাভদা’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। বিপ্লবের পরে লেনিনের প্রথম সোভিয়েত সরকারে স্ট্যালিনকে জাতিসমূহের কমিশনার বা মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ১৯২৪ সাসালে লেনিনের মৃত্যুর পর তিনি বলশেভিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রের ক্ষমতার বলয় তার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ১৯৪১ সালে এডলফ হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে স্ট্যালিন যুদ্ধ পরিচালনার সমগ্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে স্টালিন প্রতিআক্রমণে অগ্রসর হন। এই সময় সমগ্র বিশ্বে সোভিয়েত জনগণের প্রতিরোধ বিরাট বিস্ময়ের সৃষ্টি করে এবং সোভিয়েত এর সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্টালিনের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা শত্রু মিত্র সকলের স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ের পরেও স্টালিন দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা বজায় রেখে প্রাকযুদ্ধকালীন অবস্থা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে (১৯৫৬) তৎকালীন সম্পাদক ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিন চরিত্র সম্পর্কে এতাবৎকালের বিমুগ্ধতার ধুলস্যাৎ করে দেন।
Subconscious : অবচেতন
মনোবিজ্ঞানীগণ, বিশেষ করে ফ্রয়েড ও তাঁর অনুসারীগণ মনের চেতনাকে চেতন, অবচেতন ও অচেতন এই তিনভাগে বিভক্ত করেন। যখন আমরা মানসিকভাবে কিংবা ইন্দ্রিয় দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা বিষয়কে অবলোকন করি তখন সেই নির্দিষ্ট বস্তুতে আমাদের চেতনা সীমাবদ্ধ থাকবে। এজন্য চেতনার পরিধি বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। কিন্তু চেতনার যে পরিবেশ অর্থাৎ চেতনার মুহুর্ত এবং চেতনার বিষয়টিকে ঘিরে অপর যে সকল বস্তু এবং স্মৃতি অবস্থান করে সেগুলিকে বলা হয় অবচেতন। অবচেতনের বৈশিষ্ট্য এই যে, অবচেতন চেতনার বর্হিভাগে অবস্থান করলেও আমরা ইচ্ছা করলে তার যে কোনো একটিকে চেতনার কেন্দ্রেও নিয়ে আসতে পারি এবং আমাদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দুর উপর অবচেতন প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব প্রয়োগ করে। মনের অবচেতন অংশে আমাদের অবদমিত ইচ্ছাগুলি আশ্রয় গ্রহণ করে। অচেতনকে আমরা ইচ্ছা করলেই চেতনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি নে। অচেতন আমাদের ব্যক্তিত্বকে পরোক্ষভাবে প্রভাবান্বিত করে।
Sufficient Reason, Principle of : উপযুক্ত যুক্তি বা প্রমাণের তত্ত্ব
উপযুক্ত প্রমাণের তত্ত্ব যুক্তিশাস্ত্রের একটি মৌলিক নীতি। এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, আমরা কোনো বক্তব্যকেই উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতীত সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি নে। কোনো বক্তব্যের প্রমাণ বিভিন্নভাবে করা যেতে পারে। বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষায় একটা বক্তব্য প্রমাণিত হতে পারে। আবার প্রতিপাদ্য বক্তব্যটিতে অপর কোনো প্রমাণিত বা জ্ঞাত সত্যের অন্তর্ভুক্ত করে এর সত্যতাকে প্রমাণ করা যায়। মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়-এই বক্তব্যটি বাস্তব ক্ষেত্রে পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রমাণিত হওয়ার পরে সত্য বলে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ‘রহীমের মৃত্যু হবে’ কিংবা ‘রহীম মরণশীল’ এমন বক্তব্য আমরা ‘সকল মানুষ মরণশীল’ এবং ‘রহীম একজন মানুষ’ অর্থাৎ রহীমকে জ্ঞাত সত্য, স্বীকৃত সত্য, ‘সকল মানুষ মরণশীল’ এর অন্তর্ভুক্ত করে ‘রহীমের একদিন মৃত্যু হবে’ বক্তব্যটিকে সত্য বলে গ্রহণ করি। এখানে ‘রহীম একজন মানুষ’ এ প্রমাণই ‘রহীমের একদিন মৃত্যু হবে’ এ বক্তব্যের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হচ্ছে। উপযুক্ত প্রমাণের তত্ত্বটি দার্শনিক লাইবিনিজ সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা সহকারে রচনা করেন। উপযুক্ত প্রমাণের বিধানটি যুক্তির অন্যান্য মৌলিক বিধান যথা ‘পরস্পর বিরোধি কথা সত্য হতে পারে না’ কিংবা ন্যায্যপন্থার বিধান-অর্থাৎ কোনো দুটি বিকল্প যদি পরস্পর বিরোধাত্বক ও সামগ্রিক হয়, তা হলে তাদের যে কোনো একটি সত্য না হয়ে পারে না-এ বিধানের ন্যায় ব্যাপক বিধান। এ কারণে এ বিধানের প্রয়োগের পরিধি ব্যাপক এবং প্রয়োগের ক্ষেত্র সার্বিক।
Sufism : সুফিতত্ত্ব
ইসলামের রহস্যবাদী ব্যাখ্যাকে সুফিতত্ত্ব বলা হয়। এবং এই তত্ত্ব প্রচারকারী সম্প্রদায়কে সুফি বলা হয়। সুফিতত্ত্বে উদ্ভব ঘটে অষ্টম শতকে। গোড়ার দিকে সুফিতমবাদে সর্বেশ্বরবাদের ছাপ দেখা যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর সব কিছুই আল্লাহ, এরূপ অভিমত সুফিরা পোষণ করতেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারা, বিশেষ করে নব প্লেটোবাদ, ভারতীয় দর্শন এবং খ্রিষ্টীয় ভাবধারার মিশ্রণে সুফিবাদ গভীর রহস্যবাদে পরিণত হয়। আল্লাহই সব সৃষ্টির মূলে। এখন আর সব কিছুই আল্লাহ নয়; সব কিছুতেই আল্লাহর প্রকাশ ঘটেছে এ ব্যাখ্যা মুখ্য হয়ে ‍উঠে। আর তাই ধ্যানের মাধ্যমে অভিভূত অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সাধনাই হওয়া উচিত মানুষের একমাত্র সাধনা। সুফিতত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে দ্বাদশ শতকের পারস্যের আল-সুহরাওয়ার্দী, আরব দেশের আল-গাজ্জালী (একাদশ শতক), মনসুর হাল্লাজ, ইবন আল আরবি, রূমী এবং জামির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুফি সাধকগণ চারটি স্তরের মধ্য দিয়ে সাধক লাভ করেন-শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারিফাত।
Syed Ahmad Khan : সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম চিন্তাবিদ এবং আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চার ‍উদ্যোগী সংগঠক পুরুষ। ১৮৫৭ সালের ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তীতে সৈয়দ আহমদ খান ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করলেও তিনি মুসলিম সমাজের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান বিস্তারের উপর বিশেষ জোর প্রদান করেন। ধর্মের ব্যাখ্যাতেও তিনি উদারতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। উত্তর ভারতের মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দূতে জ্ঞান বিজ্ঞান এর জন্য তিনি একটি অনুবাদকেন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার ও আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে গাজীপুর কলেজ এবং আলীগড়ে সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি স্থাপন করেন। কালক্রমে এই প্রতিষ্ঠান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।” পরবর্তীতে পাকিস্তান বা মুসলমান প্রধান অঞ্চল নিয়ে ভারতে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির আন্দোলনের আদর্শগত সূত্রপাত ঘটে আলীগড়ে-একথা বলা যায়। নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে আধুনিকতা এবং চিন্তার উদারতা প্রচারের একনিষ্ঠ উদ্যোগের দিক থেকে সৈয়দ আহমদ খান রাজা রামমোহনের সঙ্গে তুলনীয়।
Tao, Taoism : তাও, তাওবাদ
তাও হচ্ছে প্রাচীন চীনের দর্শনের একটি মৌলিক সূত্র। তাও বলতে স্বভাব, প্রকৃতি এবং পরবর্তীকালে প্রাকৃতিক বিধান বুঝাত। একে নীতির সূত্র বা আদর্শ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। চীনের দর্শনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘তাও’ সূত্রের অর্থেরও বিকাশ ঘটেছে। চীনের ভাববাদী দার্শনিকগণ ‘তাও’ কে একটি ভাববাদী সূত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, আবার লাওজু, সুনজু, ওয়াংচাং প্রমুখ বস্তুবাদী দার্শনিক তাওকে বস্তুর প্রকৃতি এবং বস্তুর পরিবর্তনের নিয়ম বা বিধান বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
Tautology : শব্দান্তর সংজ্ঞা
প্রচলিত ইউরোপীয় যুক্তিশাস্ত্রে সংজ্ঞার ক্ষেত্রে টটোলজি বা শব্দান্তর সংজ্ঞা একটি ত্রুটির নাম। শব্দান্তর সংজ্ঞায় যে পদটির সংজ্ঞা দেবার কথা সে পদটির কোনো মৌলিক গুণের উল্লেখ না করে পদটিকে ভিন্নতর শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। এটি ত্রুটি এ কারণে যে, সংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞেয় পদটির অর্থ স্পষ্টরূপে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সংজ্ঞার মধ্যে যদি মূল পদটির শব্দান্তরে পুনরুল্লেখ থাকে কিংবা পদটির সমার্থক কোনো শব্দ দ্বারা সংজ্ঞার কাজ শেষ করা হয়, তা হলে পদটির অর্থ স্পষ্ট হতে পারে না। ‘দেহ হচ্ছে শরীর’, ‘বিদ্যা জ্ঞান’, ‘ভ্রান্তি হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা’-এগুলি শব্দান্তর সংজ্ঞার দৃষ্টান্ত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলা হয় বলে একে ‘চক্রক’ ত্রুটিও বলা হয়।

Technocracy : বিশেষজ্ঞতন্ত্র, প্রযুক্তিতন্ত্র
গণতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র নয়, বিশেষজ্ঞতন্ত্র। যারা যে বিষয় জানে, যে বিষয়ে যাদের দক্ষতা আছে, তারাই কেবল সে কাজ করতে পারে, অপরে করতে গেলে অনর্থ ঘটে। রাষ্ট্রের অরাজকতা এবং অস্থিরতার মূলে রয়েছে রাজনীতিবিদদের শাসন। এর স্থানে বিশেষজ্ঞদের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেই রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা এবং স্বাভাবিকতা প্রত্যাবর্তন করতে পারে। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ থর্সটাইন ভেবলেন। এ তত্ত্ব প্রকারান্তরে বিশেষজ্ঞের নামে একচেটিয়া পুঁজিবাদের শাসনকে স্থায়ী এবং জোরদার করার উদ্দেশ্য সাধন করে।
Thales : থেলিস (৬২৪-৫৪৭ খ্রি.পূ.)
থেলিস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। গ্রিসের উপাখ্যানে থেলিসকে সাত জ্ঞানীর এক জ্ঞানী বলে অভিহিত করা হয়। থেলিস ব্যাবিলন এবং মিশরের জোর্তিবিদ্যা এবং অঙ্কশাস্ত্র আয়ত্ত করেছিলেন বলেও কথিত আছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৫-৫৮৪ সালে যে সূর্য গ্রহণ হয়েছিল তার ভবিষ্যদ্বাণী থেলিস করেছিলেন। থেলিসের দর্শন ছিল স্বতস্ফূর্ত বস্তুবাদ। থেলিসের মনে প্রশ্ন জেগেছিল প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্যের মূল কি? থেলিস এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন : জলই হচ্ছে বস্তু জগতের মূল সত্তা।
থেলিস ছিলেন এশিয়া মাইনরের সমৃদ্ধশালী মাইলেটাস এর অধিবাসী। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উৎপত্তি গ্রিক ভূ-খন্ডে ঘটে নি। এর উৎপত্তি ঘটেছিল মাইটেলাস এ। থেলিস ব্যতীত এ্যানাক্সিমেন্ডার এবং এ্যানাক্সেমেনিসও ছিলেন মাইলেটাসের দার্শনিক। এই তিনজনের দর্শন নিয়ে গড়ে উঠেছিল মাইলেটাসের বা মাইলেশীয় দর্শন।
Thomas Aquinas St : সেইন্ট টমাস এক্যুইনাস
মধ্যযুগের রাষ্ট্রীয় দর্শনের ইতিহাসে তিনজন খ্রিষ্টধর্মীয় যাজক চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হচ্ছেনঃ ১. সেইন্ট বার্নার্ড (১০৯১-১১৫৩)। ইনি ক্লেয়ার ভর বার্নার্ড নামে পরিচিত। ২. সেলিসবারির জন (১১৫৫-১১৮০)। ৩. সেইন্ট টমাস এ্যকুইনাস (১২২৭-১২৭৪)।
ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান রাজনীতিক সমস্যা ছিল রাষ্ট্র এবং ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার সমস্যা। রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু পোপের অধিনায়কত্বে সমগ্র ইউরোপবাসী এক খ্রিষ্টীয় যাজক সাম্রাজ্য সংগঠিত হয়েছিল। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা, প্রার্থনার পৌরহিত্য ইত্যাদি এই সংগঠনের করণীয় হলেও ক্রমান্বয়ে এই সংগঠনের ক্ষমতা পারলৌকিক হতে ইহলৌকিক এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়ে বিস্তার লাভ করে। খ্রিষ্টীয় যাজক সংগঠন বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে মধ্যযুগের অন্যতম সমাজতান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত হয়। রোম নগরীতে এই শক্তিকেন্দ্র স্থাপিত হয়। যাজকতন্ত্র তার নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা রাজা কিংবা রাষ্ট্রীয় সরকারের উপর বিস্তারিত করার প্রয়াস পায়। এই প্রচেষ্টাতে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের, রাজার সঙ্গে পোপের পারস্পরিক বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। কে বড়? রাষ্ট্র না ধর্ম? পোপ না রাজা? এই প্রশ্নে উভয় পক্ষের যুক্তি, প্রতিযুক্তির ভিত্তিতে মধ্যযুগের দর্শন, বিশেষ করে তার রাষ্ট্রীয় দর্শন বিকাশ লাভ করে। সেইন্ট বার্নার্ড জাগতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। পোপ জাগতিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে যেরূপ ধর্মীয় সংগঠনকে জড়িত করেছিলেন এবং রাষ্ট্রশাসনে যেরূপ হস্তক্ষেপ করেছেন সেইন্ট বার্নার্ড তার নিন্দা করেন। তাঁর অভিমত ছিলঃ রাষ্ট্রীয় শাসন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। পুরোহিত ধর্মীয় কাজ সমাধা করবে। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পোপ অর্থাৎ পুরোহিতের হস্তক্ষেপ অনুচিত।
মধ্যযুগে রাষ্ট্রনীতিক দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাদাতা ছিলেন সেইন্ট টমাস এ্যাক্যুইনাস। তিনি ছিলেন ইতালির অধিবাসী। তাঁর রচনার মধ্যে ‘সুমমা থিউলজিকা’(১২৬৫-৭৩)ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। তিনি এরিস্টটলের ‘রাষ্ট্রনীতি’ বা ‘পলিটিক্স’ এর উপর আলোচনামূলক একখানি গ্রন্থও রচনা করেন। টমাস এ্যাক্যুইনাসের প্রধান লক্ষ্য ছিল যুক্তি এবং ধর্মের মধ্যে একটা সমঝোতা স্থাপন। প্রাচীন গ্রিসের চিন্তাধারার সঙ্গে ইতোমধ্যে ইউরোপ আবার পরিচিত হতে শুরু করেছে। ইসলামের সঙ্গে ধর্মীয় যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপ প্লেটো এরিস্টটলের আরবী অনুবাদের সাক্ষাৎ পরিচয় লাভ করেছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন এক ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের সঙ্গে ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের পরিচয় ঘটতে শুরু করে। পাছে এই পরিচয় খ্রিষ্ট ধর্মের ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে এই আশঙ্কায় এ্যাক্যুইনাস যুক্তির ভিত্তিতে ধর্মকে গ্রহণীয় করে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁর রচনায় রাষ্ট্রীয় সমস্যাসমূহের আলোচনাও কিছুটা বৈজ্ঞানিক আলোচনার রূপ গ্রহণ করে। তাঁর মতে চরম বিধান অবশ্যই প্রাকৃতিক এবং ঐশ্বরিক বিধান। কিন্তু রাষ্ট্রশাসনে মানুষের বিধানেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এক্যুইনাসের মতে আইন চার প্রকার। মানুষের তৈরি আইন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আইনের স্থান হচ্ছে সর্বনিম্নে। মানুষিক আইনের উপরে হচ্ছে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশমূলক আইন। প্রত্যাদিষ্ট বিধানের উপরে হচ্ছে বিধাতার ইচ্ছার মূর্ত প্রকাশ, প্রকৃতির বিধান। এই প্রাকৃতিক বিধানের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ্যকুইনাস উল্লেখ করেন মানুষের আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি, যৌন মিলনের আকাঙ্খা, অপত্যস্নেহ এবং সমাজবদ্ধভাবে বাস করার মানুষের সহজাত প্রবণতা। কিন্তু সর্বোপরি হচ্ছে এক অবিনশ্বর বিধান। বিশ্বসৃষ্টির মূল হচ্ছে বিধাতার এই অবিনশ্বর বিধান। চরম সত্য হচ্চে এই শাশ্বত বিধান। তাঁর মতে, জাগতিক সমস্যার শেষ মীমাংসাকারী হচ্ছে গির্জা বা ধর্ম। রাষ্ট্র শাসক রাষ্ট্রকে শাসন করতে ধর্মীয় বিধান কার্যকর করার জন্য। রাজা বা শাসক যদি ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন করে তা হলে ধর্ম এবং ধর্মীয় গুরুর অধিকার আছে তাকে সমাজচ্যূত করে জনসাধারণকে রাজার প্রতি আনুগত্য পোষণের দায়িত্ব থেকে মুক্তিদানের। বস্তুত পোপ এবং রাজার দ্বন্ধে পোপের বিজয়ের দার্শনিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এ্যাকুইনাসের রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

Time and Space : সময় ও স্থান
সাধারণভাবে বলা যায় যে, স্থান ও কাল হচ্ছে বস্তুর মৌলিক রূপ। কিন্তু স্থান ও কাল কথা দুটি যেমন গভীর অর্থবোধক তেমনি দর্শনের বিশেষ বিতর্কমূলক ভাব। আমরা প্রতিনিয়ত কথা দুটিকে ব্যবহার করি। আমরা বলি-এ বিশেষ ঘটনা এ সময়ে ঘটেছে। সব ঘটনা সময়ের মধ্যে ঘটে। আবার স্থানের ক্ষেত্রে বলি-চেয়ারটি ঐ স্থানে আছে; বাটিটি এই স্থান হতে ঐ স্থানে রাখ। অর্থাৎ বিভিন্ন খন্ড বস্তুর আধার হচ্ছে স্থান। স্থানের মধ্যে বস্তু। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনা সময়ের মধ্যে থাকে-এর অর্থ কি এই যে, সময় বাস্তব অস্তিত্বময় কোনো সত্তা? অথবা সময় হচ্ছে বাস্তব ভাব মাত্র? যদি ভাব হয়, তাহলে সে ভাব মনে কিভাবে আসে? সময়ের ভাব কি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আসে? না, সময়ের ভিত্তিতে আমরা অভিজ্ঞতাকে অনুধাবন করি? স্থান নিয়েও একই প্রশ্ন। বস্তু মাত্রকেই স্থানের পটভূমিতে বা স্থানের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে বুঝতে হয়। তা হলে ‘স্থান’ ভাবটি কি আমাদের জন্মগত এবং সকল অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব ভাব? প্রকৃতপক্ষে স্থান ও কাল দর্শনের অন্যতম মূল প্রশ্ন। বার্কলে, হিউম, কান্ট এঁরা সবাই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদের মতে স্থান ও কাল হচ্ছে মানুষের জন্মগত ও অভিজ্ঞতা উর্ধ্ব ভাব। এই দুটি ভাব না থাকলে মানুষের পক্ষে কোনো অভিজ্ঞতাকে বুঝা সম্ভব হতো না। সমস্ত অভিজ্ঞতার মূলে আছে স্থান ও কাল। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্থান ও কাল নয়। স্থান ও কালের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতা। স্থান ও কাল বস্তুরই অবিচ্ছেদ্য রূপ। স্থান ও কালের বাইরে কোনো বস্তু নেই। আবার বস্তুর বাইরেও স্থান ও কালের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।
Totemism : টোটেমবাদ
টোটেম হচ্ছে পবিত্র দ্রব্য বা পশু কিংবা তার প্রতীক। গাছ, গাছড়া, পশু ইত্যাদিকে পূর্বপুরুষ বা পূর্বপুরুষের প্রতীক বলে বিশ্বাস করা ছিল টোটেমবাদের বৈশিষ্ট্য। আদিম মানুষ বিশ্বাস করত রক্তের সম্বন্ধে সম্পর্কিত বিশেষ বিশেষ গোত্রের উদ্ভব ঘটেছে একটি বিশেষ পশু বা বিশেষ বৃক্ষ থেকে। কাজেই এই বিশেষ পশু বা বৃক্ষ হচ্ছে এ গোত্রের রক্ষক বা দেবতা। রক্তের বাইরে অপর সামাজিক সম্পর্কের তখনো বিকাশ ঘটে নি। পশু শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ তখনো জীবনধারনের প্রধান অবলম্বন। এই অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে টোটেমের বিশ্বাসে। অষ্ট্রেলিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিবাসীদের মধ্যে টোটেমাবাদের রেশ এখনো দেখা যায়। যে কোনো দেশের লোককথা ও সাহিত্যে পশুর মানুষে রূপান্তরিত হওয়া বা মানুষের পশু জন্মগ্রহণের যে কাহিনী পাওয়া যায় তাও পশুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে টোটেমবাদী বিশ্বাসের রূপ।
Trotsky : ট্রটস্কী (১৮৭৯-১৯৪০ খ্রি.)
বিখ্যাত রুশ বিপ্লবী নেতা। জারের আমলে প্রথম ১৮৯৮ সালে ট্রটস্কী তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার হন এবং তাকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হয়। নির্বাসন হতে পলায়ন করে ট্রটস্কী লন্ডন চলে যান। সেখানে লেনিনেরে সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯০৫ সালে পার্টির মধ্যে বিপ্লবের কর্মপন্থা নিয়ে মতবিরোধ হলে অধিকাংশ লেনিনের নেতৃত্বের বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন। ট্রটস্কী সংখ্যালঘিষ্ঠদের মেনশেভিক এর সাথে থাকেন। ১৯০৫ সালে আবারো গ্রেপ্তার হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন এবং আবারো পলায়ন করেন। ১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। পরে রাশিয়ায় ফিরে বলশেভিকদের সাথে মিলিতভাবে নভেম্বর বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত করায় ভূমিকা রাখেন। তিনি রাশিয়ার বৈদেশিক মন্ত্রী ছিলেন কিছুকাল। তিনি অস্থির প্রকৃতির ছিলেন তবে তাঁর বাকপটুতা বেশ বিখ্যাত ছিল। অনেক গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। বিপ্লবের পর লেনিনের সাথে তাঁর মতবিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি মনে করতেন বিপ্লবের কোনো বিরাম নেই এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একইকালে সমগ্র পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত হতে হবে। না হলে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশে বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হলেও টিকে থাকতে পারে না। লেনিন এর পরে স্টালিনের সঙ্গেও ট্রটস্কীর তত্ত্বগত এবং নেতৃত্বগত বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ১৯২৭ সালে তাঁকে পার্টি হতে বহিষ্কার করা হয় এবং ১৯২৯ সালে দেশ হতে নির্বাসন দেওয়া হয়। মেক্সিকোতে অবস্থানকালে ট্রটস্কী ১৯৪০ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পেছনে স্টালিনের হাত আছে বলে অনেকে মনে করেন।
Unconscious : অচেতন
অচেতনের দুটি অর্থ করা যায়। ১. মানুষের অচেতন কাজ। ব্যক্তি সচেতনভাবে যেমন কাজ করে তেমনি সে এমন অনেকগুলি কাজ করে যেগুলিতে তার চেতনা এবং বুদ্ধির ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়। যেমন, চোখের পাতা নড়া। চোখের পাতা আমরা সচেতনভাবেও নাড়তে পারি, একথা ঠিক। কিন্তু আমাদের সচেতন ইচ্ছা এবং চেষ্টা ছাড়াও চোখের পাতা নড়ে। আমরা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কেউ আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়কে উত্তেজক দ্বারা স্পর্শ করলে সে ইন্দ্রিয় প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু এ কাজ আমাদের চেতনা ও বুদ্ধি দ্বারা সংঘটিত নয়। যেমন ঘুমন্ত অবস্থায় জ্বলন্ত দিয়াশলাই এর কাঠি আঙ্গুলে ছোঁয়ালে আঙুল আত্মরক্ষার্থে আগুন থেকে সরে যায়। স্বপ্নের ঘোরে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকে অনেক সময় হাঁটে কিংবা অপর কোনো কাজ করে। একেও অচেতন কাজ বলা যায়। ২. দ্বিতীয় অর্থে অচেতন বলতে মনের বিশেষ একটি বিশেষ বিভাগকে বুঝানো হয়। ফ্রয়েডবাদীগণ মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করে তিনটি স্তরে বিভক্ত করে : চেতন, অবচেতন এবং অচেতন। মানুষের মনের চেতন স্তর খুবই সংকীর্ণ। মানুষের অভিজ্ঞতার খুব সামান্যই চেতন স্তরে বিরাজ করে। অভিজ্ঞতার কিছু থাকে চেতনার কাছাকাছি অবচেতনে। অবচেতনের স্মৃতি, বাসনা, ঘটনা মন ইচ্ছা করলেই চেতনের মধ্যে টেনে আনতে পারে। ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার অধিকাংশের উৎস হচ্ছে যৌনানুভূতি। ব্যক্তি যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে সমাজে বসবাস করে তার যৌন কামনাকে চরিতার্থ করতে পারে না। ফলে ব্যক্তির বাসনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতৃপ্তেই থেকে যায়। ব্যক্তির চেতনা পরিবেশকে মেনে নিয়ে অতৃপ্ত কামনাকে দমন করে। কিন্তু বাসনামাত্রই একটি শক্তি। তৃপ্ত কামনার শক্তি তৃপ্তিতে নিঃশেষ হয়। কিন্তু অতৃপ্ত কামনার শক্তি নিঃশেষ হয় না। অবদমিত কামনা অচেতনের কোঠা থেকে স্বপ্নের ঘোরে, শরীরের নতুন কোনো বিকারে কিংবা উপসর্গে কিংবা অপর কোনো দুর্বোধ্য আকারে চেতনাকে এড়িয়ে নিজেদের তৃপ্তি সাধন করতে চায়। কাজেই ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে অচেতন নিষ্ক্রিয় বা শক্তিহীন নয়। মনের এই ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চেয়ে ভাববাদী কল্পনার অধিক ব্যবহার বলে মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদী এবং অন্যান্য ধারা অভিমত পোষণ করে।
Universe : বিশ্ব
স্থান ও কালে বিস্তারিত সীমাহীন বৈচিত্রময় বস্তুর সামগ্রিক নাম হচ্ছে বিশ্ব। আধুনিক বিজ্ঞান তার বাস্তব পরিমাপের হিসেবে যে জগৎকে জ্ঞানের পরিধির মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সে জ্ঞান সীমাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সে আমাদের বিশ্বের অসীমতার ধারণাকে পূর্বের চাইতে অধিকতর বিস্তৃত করে দিয়েছে। (বিজ্ঞানের পরিমাপক পরিধি ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এক আলোকবৎসরের পরিমাণ হচ্ছে ৬,০০০,০০০,০০০,০০০ মাইল)। জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে আমরা যে সৌরমন্ডলে বাস করছি-সেটাই একমাত্র সৌরমন্ডল নয়। অসংখ্য তারকার প্রত্যেকটি তারকাই এক একটি সূর্য। প্রত্যেকেরই গ্রহ উপগ্রহের মন্ডল আছে। আবার বহু মন্ডলের স্তূপ নিয়ে রয়েছে মন্ডল স্তূপ। এই মন্ডলে স্তূপেরও স্তূপ আছে। বস্তুর বিভিন্ন সংগঠনের এই মন্ডলগুলি গঠিত। বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশের কিছুটার সঙ্গে পৃথিবী গ্রহের মানুষ পরিচিত হয়েছে। কিন্তু বস্তুর সাংগঠিনিক বৈচিত্র্য নিয়ন্ত্রণকারী কোনো নির্দিষ্ট বিধানকে মানুষ আজো আবিষ্কার করতে পারে নি।
Upanishad : উপনিষদ
প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ। বেদের ব্যাখ্যা উপনিষদ। শত শত বৎসর ধরে বেদসমূহের যে ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে তার সংকলনে তৈরি হয়েছে উপনিষদ। প্রাচীনতম উপনিষদের রচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব দশ থেকে ষষ্ঠ শতককে মনে করা হয়। উপনিষদে বেদের দেবতাদের নতুন দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হয়েছে। পুনর্জন্মের তত্ত্বকে মানুষে সৎ অসৎ কাজের সঙ্গে যুক্ত করে তার একটা নীতিগত যৌক্তিকতা দাঁড় করানো হয়েছে। পুনর্জন্মের বন্ধন হতে মুক্তিকামী মানুষকে ধ্যান করতে হবে সেই অনাদি অনন্ত ব্রহ্মকে যার সঙ্গে মানুষের আত্মা অভেদ। দেহের বারংবার জন্মের শৃঙ্খল হতে মুক্তি হচ্ছে আত্মার কাম্য। পুনর্জন্মের শৃঙ্খল হতে মুক্ত হয়ে আত্মা ব্রহ্মতে লীন হয়ে যায়। উপনিষদে বস্তুবাদী লোকায়ত দর্শনেরও আভাস পাওয়া যায়। কেননা লোকায়ত দর্শনকে খন্ডন করে উপনিষদকারগণ বেদের ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। উপনিষদ থেকেই দেখা যায় যে, লোকায়ত দর্শনের মতে-সৃষ্টির মূলে আছে ক্ষিতি, অপ, তেজ, ব্যোম, বায়ু, স্থান ও কালরূপ বস্তু। লোকায়ত দর্শন মানুষের মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছে।
Vedanta : বেদান্ত
বেদের অন্ত বেদান্ত। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি শাখা বেদান্ত নামে পরিচিত। বেদান্তে ধর্মীয় বিশ্বাস ও দার্শনিক ব্যাখ্যার সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। বেদান্ত সূত্রাকারে তৃতীয় ও চতূর্থ খ্রিষ্ট শতকে এই দর্শনের সুসংবদ্ধতা ঘটে। বেদান্ত দর্শনে দুটো ধারার বিকাশ ঘটেছে। একটি হচ্ছে অদ্বৈতবাদী অভিমত। খ্রিষ্টাব্দের অষ্টম শতকে শঙ্করাচার্য অদ্বৈততত্ত্বের যুক্তিগত ব্যাখ্যা রচনা করেন। অদ্বৈত মতে মূল সত্তা হচ্ছে এক ঈশ্বর। ঈশ্বর সংজ্ঞার অতীত। অদ্বৈত মতে, বিশ্বের বৈচিত্র্য মায়া, সত্য নয়। অবিদ্যার কারণেই মানুষের মনে এই মায়া বা বস্তুকে সত্য ধারণা ভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। সত্য জ্ঞানের পথ হচ্ছে সজ্ঞা বা অলৌকিক অনুভূতি। তিন প্রকার সত্তা-বস্তু, আত্মা এবং পরমাত্মা বা ঈশ্বর পরস্পর নির্ভরশীল। পরমাত্মা আমাদের দেহ ও মন- উভয়ের নিয়ন্তা। ধর্ম হিসেবে অদ্বৈত ধর্মের আরাধ্য হচ্ছে শিব এবং বিশিষ্ট অদ্বৈতের আরাধ্য বিষ্ঞু। বেদান্ত দর্শন প্রাচীন ভাববাদী দর্শনের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
Vivekananda : বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ভারতের অন্যতম চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং জাতীয়তাবোধ সঞ্চারকারী নেতা। বিবেকানন্দের পারিবারিক নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৮৮০-৮৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি দার্শনিক ও ধর্মীয় নেতা রামকৃষ্ঞ পরমসংহের প্রভাবে আসেন এবং সন্নাসধর্ম গ্রহণ করেন। এ সময় থেকে তিনি বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন। বিবেকানন্দ অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দ বিশ্বভ্রমণে বের হন এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এবং জাপানে বহু সুধী সমাবেশে ভাষণ দান করেন। ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ঞ মিশন নামে ধর্ম প্রচারকারী এবং জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র এই বর্ণভেদের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন যে, এগুলি সমাজের বিকাশের পর্যায়সূচক। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের শাসন শেষ হয়েছে। পুঁজিবাদী যে সমাজ চলছে, সে হচ্ছে বৈশ্যের সমাজ। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যৎ সমাজের রূপ হবে শূদ্রের সমাজ অর্থাৎ নির্যাতিত মানুষের সমাজ।
Voltaire : ভলটেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রি.)
ভলটেয়ার ছিলেন অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের বহুমুখী প্রতিভা। ভলটেয়ার একাধারে লেখক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং ফরাসিদের নবজাগরণের নেতা ছিলেন। ভলটেয়ার আপসহীনভাবে সামন্তবাদ এবং খ্রিষ্টীয় গোঁড়ামির বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিদ্রুপাত্মক রচনার ধার শাসকগোষ্ঠীর নিকট অসহনীয় ছিল। এজন্য ১৭১৭ সালে ও ১৭২৫ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁর মতে বিজ্ঞান সত্য, তথাপি বিশ্বের একজন মূল পরিচালক আছেন। তিনি ঈশ্বর। তবে ঈশ্বরের ব্যাখ্যায় তিনি ধর্মীয় ব্যাখ্যা অস্বীকার করতে চেয়েছেন। প্রকৃতি শাশ্বত বিধানের নিয়মে ক্রিয়াশীল। ঈশ্বর প্রকৃতি হতে আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত ক্রিয়াশীলতা ঈশ্বর। চেতনা বস্তুরই অন্তর্নিহিত চরিত্র। কিন্তু এ চরিত্রের বিকাশ ঘটেছে সজীব দেহে, অপর কোথাও নয়। জ্ঞানের প্রশ্নে ভলটেয়ার লকের অনুসারী ছিলেন। ভলটেয়ার ছিলেন বিকাশমান পুঁজিবাদী শ্রেণীর ভাবগত মুখপাত্র। কারণ তিনি সামন্তবাদের বিরোধিতা করেছেন; আইনের চোখে সকলে সমান একথা বলেছেনে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সম্পত্তির মালিকদের উপর করধার্যের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এগুলি সবই পুঁজিবাদী বিকাশের সহায়ক। তাঁর বিদ্রুপের প্রধান লক্ষ্য ছিল গোঁড়া যাজক সম্প্রদায়। তিনি খ্রিষ্টীয় গীর্জাকে মানুষের প্রগতির প্রধান শত্রু বলে মনে করতেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব, বিশেষ করে অন্যায়ের দন্ডদানকারী ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা সাধারণ মানুষের জন্য তিনি আবশ্যক বলে বোধ করতেন। ভলটেয়ার রচনা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফরাসি বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
Wang Chung : ওয়াং চুং (২৭-১০৪ খ্রি.)
ওয়াং চুং ছিলেন চীনের খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের বস্তুবাদী দার্শনিক। স্বর্গ কিংবা ঈশ্বর সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা, ভাববাদের এই তত্ত্ব তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে সবকিছুর মূলে আছে ‘চী’ বা বস্তুগত সত্তা। ‘চী’র সম্মেলনে সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি এবং ‘চী’র বিয়োজনে সমস্ত অস্তিত্বের ধ্বংস। তাঁর মতে মানুষের জ্ঞানের সূচনা তার ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে। সমাজের বিকাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে না। মানুষই সমাজের চালক শক্তি। সভ্যতা বৃত্তাকারে অগ্রসর হয়। একটি সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও ক্ষয় আছে। এই বৃত্তের পর আবার আর এক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে; সে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং পরিশেষে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। পৌনঃপুনিকভাবে সভ্যতার এই বৃত্তি পরিক্রম চলতে থাকে।
War : যুদ্ধ
যুদ্ধ মানুষের ইতিহাসের প্রাচীনতম ঘটনা। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, গোত্রে গোত্রে বিভাগ এবং পরবর্তীকালে দাস প্রভুর ভিত্তিতে শ্রেণীসমাজে বিভক্ত হওয়া থেকে অদ্যাবধি মানুষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে আসছে। যুদ্ধের এই ইতিহাস থেকে অনেক ভাববাদী দার্শনিক যুদ্ধকে মানুষের স্বভাবেরই প্রকাশ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আধুনিক পুঁজিবাদী সভ্যতার জঙ্গি দার্শনিকগণ যুদ্ধকে মানুষের মধ্যে মানুষের মধ্যে যোগ্যতম জাতির বেঁচে থাকার স্বাভাবিক উপায় হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু মার্কসবাদ যুদ্ধকে অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত বলে ব্যাখ্যা করে। মার্কসবাদের মতে যুদ্ধের কারণ মানুষের চিরন্তন প্রকৃতি নয় বা যোগ্যজনের বেঁচে থাকার ইচ্ছা নয়। দাস কিংবা সামন্তবাদী যুগে সম্রাটগণ যে যুদ্ধাভিযানে বের হয়ে দুর্বল দেশ বা জাতিসমূহকে ধ্বংস করে তাদেরকে দাসে পরিণত করত তার সঙ্গে সেই সময়কার অর্থনীতি সম্পর্কিত ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ শেষে বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বর্তমানকালে শান্তির শক্তি যেমন দুর্বল নয় তেমনি বিশ্বে সে সহযোগী শক্তিবিচ্ছিন্নও নয়। মুক্তিকামী এবং মুক্তিপ্রাপ্ত স্বাধীনভাবে উন্নয়নকামী দেশসমূহ শান্তির সহযোগী শক্তি। ফলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ যুদ্ধ বাধাবার পরিকল্পনায় যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে আজ আর সুনিশ্চিত নয়। এ কারণে মারণাস্ত্রের অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বযুদ্ধ আজ যে কোনো মুহুর্তের আশঙ্কা বলে অনেকে মনে করেন না। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যেমন শক্তিশালী, শান্তির শক্তিও তেমনি শক্তিশালী। এই শক্তির সমতা যুদ্ধ বাধার একটা প্রতিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। শান্তিকামী রাষ্ট্র এবং তার অনুসারী রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের মতে আজকের যুগে যুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা আবশ্যক। সীমাবদ্ধ যুদ্ধের মীমাংসা হতে পারে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের বিশ্ব ধ্বংস ব্যতীত আর কোনো মীমাংসা নেই। এবং সীমাবদ্ধ যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে কোথাও অবিমিশ্য বিজয় লাভ করে নি। আলজেরিয়া, মিশর, বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এ সত্যের প্রমাণ মিলবে। সীমাবদ্ধ যুদ্ধের ক্ষেত্রেও মুক্তিকামী জাতির হাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরাজয়ই একাধিক পরিমাণে নিশ্চিত হয়ে উঠছে।
Xenophanes : জেনোফেনস (আনুমানিক ৬-৫ শতক খ্রি.পূ.)
প্রাচীন গ্রিক দা্র্শনিক জেনোফেনস ইলিয় দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেন। জেনোফেনসকে কোলোফনের জেনোফস বলা হতো। তিনি কবি এবং বঙ্গ রচনাকারীও ছিলেন। মানুষ দেবতাদের নিজেদের মতই কল্পনা করে। সেই প্রাচীনকালেও করত। তখনো এক ঈশ্বরের কল্পনা আসে নি। মানুষের সমাজের মত দেবতাদেরও সমাজ ছিল। তাদের জন্ম ছিল। প্রেম, ভালবাসা, বিবাহ, হিংসাবিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ছিল। দেবতাদের মধ্যে ছোট, বড়, মাঝারি ছিল, ক্ষমতারও তারতম্য ছিল। অলিম্পিয়া পাহাড়ে তাদের বাস ছিল। এমনি ছিল মানুষদের বিশ্বাস। কিন্তু জেনোফেনস এভাবে ভাবতেন না। তিনি প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে প্রথম যিনি বললেন, দেবতারা মানুষের কল্পনা। মানুষের কল্পনা বলেই দেবতারা মানুষের মত। পশুদের ভাষা আমরা বুঝি না। কিন্তু পশুরা যদি দেবতা মানতো তাহলে পশুরাও নিজেদের দেবতাদের পশু বলেই কল্পনা করত। জেনোফেনস সক্রেটিসের পূর্ববর্তী অন্যান্য দার্শনিকদের ন্যায় ছিলেন প্রকৃতিবাদী। তিনি বস্তুর মূলে ক্ষিতি, অপ, তেজ প্রভৃতি বস্তুকে স্বীকার করে আবার চিন্তার মাধ্যমে সব সত্তার মূলে এক পরমসত্তার সিদ্ধান্তে পৌছেছিলেন। তাঁর পরমসত্তা অবিভাজ্য এবং অপরিবর্তনীয়। জেনোফেনস অবশ্য বহু এবং একের পারস্পরিক রূপান্তরের সমস্যাটির কোনো সমাধান দেন নি, কিন্তু বহু এবং একের স্বীকৃতি পরবর্তীকালে বহু এবং একের দ্বান্ধিক সম্পর্কের তত্ত্বের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
Yang Chu : ইয়াং চু (আনুমানিক ৩৯৫-৩৩৫ খ্রি.পূ.)
ইয়াং চু ছিলেন প্রাচীন চীনের একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁর বস্তুবাদ অবশ্য আদিকালের স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। ইয়াং চু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অমরতার তত্ত্বকেও তীব্রভাবে সমালোজনা করেন। ইয়াং চু বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতিজগতে যা কিছু ঘটছে সবই প্রকৃতির প্রয়োজনের বিধানে সংঘটিত হচ্ছে। প্রকৃতির প্রয়োজনের বিধান তাঁর কাছে ভবিতব্য বলে বোধ হতো। ইয়াং চুর মতে মৃত্যু এবং ধ্বংস জন্মের অনিবার্য পরিণাম। যা কিছু জন্মাবে তার অবশ্যই মৃত্যু এবং ধ্বংস থাকবে। কাজেই অমরতা অকল্পনীয়। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ইয়াং চু’র নীতি হচ্ছে, ব্যক্তি তার কামনা, বাসনা, ইচ্ছার পরিপূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে জীবনযাপন করবে। মৃত্যুর পরে কি ঘটবে সেই অজ্ঞেয় কিংবা অস্তিত্বহীন ভাগ্যের চিন্তায় বিমর্ষ না হয়ে বর্তমানের জীবনকে ভোগ করাই হবে ব্যক্তির অনুসরণীয় নীতি। প্রাচীন চীনের প্রতিষ্ঠিত কনফুসীয় সমাজনীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইয়াং চুর এই ব্যক্তিবাদের তত্ত্ব বিকাশ লাভ করেছিল।
Yoga : যোগ
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ভাববাদী ধারার অন্যতম ধারার নাম ছিল যোগ। যোগদর্শনের মূল কথা ছিল জন্ম, মৃত্যু এবং জাগতিক জীবনের বন্ধন থেকে পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জনের সাধনা। এই মুক্তির মাধ্যম ছিল দুটি : বৈরাগ্য এবং যোগ বা ধ্যান। জগৎ এবং জীবনকে মায়া বলে বিবেচনা করলেই মানুষের মনে জগৎ সম্পর্কে বৈরাগ্যের সৃষ্টি হবে আর যোগের মাধ্যমেই ব্যক্তি ঈশ্বর বা চরম সত্তাতে জ্ঞাত হতে পারবে। প্রাচীন শাস্ত্রকার পতঞ্জলি আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে যোগ প্রক্রিয়াসমূহকে ‘যোগ সূত্রের’ মধ্যে গ্রথিত করেছন বলে মনে করা হয়। ইন্দ্রিয়সমূহের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই মাত্র ব্যক্তি যোগ সাধনে সক্ষম, যোগসূত্রের এটাই মূল কথা।
Zeno of Citium : সাইটিয়ামের জেনো (আনুমানিক ৩৩৬-২৬৪ খ্রি.পূ.)
সাইটিয়ামের জেনো স্টয়সিজম বা নিস্পৃহবাদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাইপ্রাস দ্বীপের সাইটিয়াম শহরে জেনোর জন্ম। খ্রি.পূ. ৩০০ অব্দে জেনো এথেন্স নগরীতে তাঁর নিজের নিস্পৃহবাদের দর্শনাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দর্শনকে যুক্তি, পদার্থ এবং নীতি এই তিনভাগে ভাগ করেছিলেন। জেনো ‘স্টোয়া’ অর্থাৎ চিত্রিত বারান্দা গৃহ থেকে তাঁর দর্শন প্রচার করতেন বলে তাঁর দর্শন স্টয়সিজম এবং তাঁর অনুসারীদের স্টয়েক বলে অভিহিত করা হয়।
Zoroastriantism : জোরোয়াস্ত্রবাদ
প্রাচীন পারস্যের দ্বৈতবোধক ধর্ম ছিল জোরোয়াস্ত্রবাদ। উপকাহিনীর প্রেরিত পুরুষ জোরোয়াস্ত্র এই ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খ্রি.পূ. ৬০০ শতকে। জোরোস্ত্রবাদের মূল তত্ত্ব হচ্ছে সৎ এবং অসৎ এর দ্বন্ধ। সৎ এর দেবতা হচ্ছে আহরুমাজদা এবং অসৎ এর দেবতা হচ্ছে আহরিমান। সৎ হচ্ছে আলো, অগ্নি; অসৎ হচ্ছে অন্ধকার। সৎ এবং অসৎ এর এই দ্বন্ধ চিরন্তন। কিন্তু পরিণামে সৎ এরই বিজয় ঘটবে। জোরোয়াস্ত্রবাদের প্রভাব পরবর্তীকালে ইহুদী এবং খিষ্টধর্মের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ভারতের পারসি সম্প্রদায় জোরোয়াস্ত্রবাদের আধুনিক অনুসারী। পারসি সম্প্রদায় আবার প্রাচীন দ্বৈতবাদের সঙ্গে একশ্বরবাদকেও স্বীকার করেন। তাঁদের ধর্মগ্রন্থের নাম আবেস্তা (বা জেন্দআবেস্তা)।
‘দর্শনকোষ’ রচনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিশ্বকোষ এবং গ্রন্থের উপর নির্ভর করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নেরগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগঃ
১. Dictionary of Philosophy, Published by Progress Publishers, Moscow 1967, 1984
২. Encyclopedia Britannica
৩. Encyclopedia of Philosophy
৪. Encyclopedia of Americana : 1963
৫. Chamber’s Encyclopedia : 1967
৬. Encyclopedia of Religions and Ethics 1959
৭. Hitory of Western Philosophy : Bertrand Russell
৮. Everyman’s Encyclopedia
৯. বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু
১০. ভারতকোষ-বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলিকাতা

 

 


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি