ভূমিকা
(প্রথম বাংলা একাডেমী সংস্করণের)
কোনো এনসাইক্লোকডিয়া বা জ্ঞানকোষ একক প্রচেষ্টায় প্রস্তুত বরা সম্ভব নয়। এজন্য যৌথ প্রচেষ্ঠা আবশ্যক। ইংরেজী ভাষায় ছোটবড় আকারের নানা এনসাইক্লোপিডিয়ার প্রকাশ দেখা যায়। বাংলা ভাষায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে এরূপ জ্ঞানকোষ নাই। জ্ঞানকে সর্বজনীন করার জন্য জ্ঞানকোষ অপরিহার্য। এক্ষেত্রে আমাদের নিদারুণ দৈন্যই আমার মধ্য বর্তমান গ্রন্থ রচনার মানসিক তাগিদ সৃষ্টি করে। সে প্রায় ছ’বছর পূর্বের কথা। নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। তথাপি এক্ষেত্রে কিছু না করাকে নিজের মনে অপরাধ বলে বোধ হয়েছে। এই মানসিক বোধ থেকে এবং বন্ধুজনদের উৎসাহে কাজটি শুরু করি। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ একাডেমীর গবেষণা পত্রিকাকে ‘দর্শনকোষ’ খানি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেন ১৯৬৮ সনে। একাডেমী পত্রিকাতে প্রকাশিত হতে থাকলে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ছাত্রবন্ধু এবং জ্ঞানানুরাগী বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আমি আন্তরিক উৎসাহজনক সাড়া পেতে থাকি। তাঁরা সবাই ‘দর্শনকোষ’খানি সমাপ্ত করার তাগিদ দেন। তাঁদের এই তাগিদ এবং পরামর্শ আমার এই কাজে বিশেষ অনুপ্ররেণা যোগায়।
‘দর্শনকোষ’ নামে বর্তমান গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও দর্শনকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে দর্শন, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের অত্যাবশ্যকীয় পদ, তত্ত্ব, তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ এবং ঐতিহাসিক ব্যাক্তির উপর রচিত ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা চার শতের অধিক। জ্ঞানকোষের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নাই। বর্তমান কোষ আকারে খুব বৃহৎ নয়। কিন্তু এর অন্তর্ভক্ত বিষয়গুলিকে আমাদের জ্ঞান এবং শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে সযত্ন লক্ষ্য রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। ব্যাখ্যা কিংবা বিবরণের পরিধিও সীমাবদ্ধ। তার কারণ, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই বিষয়গুলিকে প্রাথমিকভাবে বাংরা ভাষায় উপস্থিত করা এবং পাঠকদের মনে বিষয়গুলির প্রতি কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি করা যাতে তাঁরা বৃহত্তর কোষ কিংবা গ্রন্থের মধ্যে তাঁদের জ্ঞানের পিপাসা নিবৃত করার চেষ্টা করেন।
কাজটি অগ্রসর হচ্ছিল। এমন সময়ে দেশের উপর পাকস্থানি দখলদার বাহিনীর অপ্রত্যাশিত এবং অচিন্তনীয় বর্বর হামলা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রিতে। এরপর যে-বর্বরতার অন্ধকার যুগ বাংলাদেশের বুকে নেমে আসে তাতে কত জ্ঞানী, গুনী, কবি, শিক্ষাবিদ, ছাত্র, শিক্ষক নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন তাঁর সংখ্যা আজো নিদিষ্ট হয় নি। সেই অন্ধকার পর্যায়েও আপন শক্তি ও সাধ্যমতো ‘দর্শনকোষে’র কাজটি চালাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পাকিস্থান সাময়িক বাহিনী আমাকে পরবর্তীকালে গ্রেফতার করে বন্দিনিবাসে নিক্ষেপ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বন্দিনিবাস থেকে মুক্ত হয়ে আমি আবার কাজ শুরু করি এবং গত বৎসরই কাজটি সমাপ্ত করে একাডেমীর কাছে পেশ করি।
জ্ঞানকোষ মাত্রেরই সংযোজন এবং সংশোধনের অবকাশ থাকে। নতুন বিষয় সংযোজনের কাজটি চালিয়ে যাব। সম্ভব হলে নতুন সংস্করণের পূর্বেই কোষের নতুন সংযোজন প্রকাশ করা হবে। ‘দর্শনকোষ’ রচনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত গ্রন্থ এবং বিশ্বকোষের উপর নির্ভর করা হয়েছে তার নাম অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দ এবং সুহৃদজনের বাছে অনুরোধ, তথ্য কিংবা তত্ত্বগত কোনো গুরুতর ভূল নজরে পড়লে তাঁরা যেন লেখককে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন।
‘দর্শনকোষ’ রচনার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে একাধিক সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা মনে পড়েছে। তাঁদের সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ‘দর্শনকোষ’ প্রকাশের ব্যাপারে যে আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সেজন্য তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রকাশন দপ্তরের পরিচালক জনাব ফজলে রাব্বি সহ-পরিচালক জনাব আবুল হাসনাত, গ্রন্থাগারিক জনাব শামসুল হক এবং বাংলা একাডেমীর অপরাপর বন্ধুরা এই ‘দর্শনকোষ’-এর সঙ্গে গোড়া থেকে এর উৎসাহদাতা এবং পরামর্শদাতা হিসাবে সংযুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ভাষা বিভাগের প্রধান জনাব আব্দুল হাই বাংলা একাডেমীতে নিযুক্ত থাকাকালে এই দর্শনকোষ রচনার ব্যাপারে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমীর মুদ্রণালয়ের কর্মীদের আগ্রহ এবং যত্ন ব্যতীত দর্শনকোষ প্রকাশে অধিকতর বিলম্ব ঘটত। তাঁদের মধ্যে মুদ্রণালয়ের অফিসার জনাব চৌধুরী আব্দুর রহমান, জনাব শামসুদ্দীন, জনাব মোহাম্মদ আফজাল হোসেন এবং অন্যান্য কর্মী তাঁদের যত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ‘দর্শনকোষ’কে মুদ্রণপ্রমাদ মুক্ত রাখতে। তথাপি অনিবার্যভাবে মুদ্রণপ্রমাদ কিছু রয়ে গেছে। আশা করি ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ অধিতকত শুদ্ধ এবং পূর্ণতরভাবে প্রকাশিত হবে।
গ্রন্থের মধ্যে বিষয়ের ইংরেজি নাম এবং বর্ণক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। কারণ, আমাদের শিক্ষিত মহলে এর বেশিরভাগ বিষয়ের ইংরেজি নাম এখনো পরিচিত এবং প্রচলিত। বর্তমানে প্রয়োজন এই বিষয়গুলির বাংলা ভাষায় ব্যাখ্যা। গ্রন্থেশেষে ইংরেজি এবং বংলা বর্ণক্রমের ভিত্তিতে বিষয়সূচি সংযুক্ত করা হয়েছে।
পরিশেষে আবার বলি কোন জ্ঞানকোষই সম্পূর্ণ নয়। কারণ, জ্ঞানের শেষে নাই। জ্ঞানকোষ মাত্রই আমাদের মনে কিছু তৃপ্তি এবং অনেক অতৃপ্তি এবং অশ্বেষার সৃষ্টি করে। আমার এ প্রচেষ্টা জ্ঞানপিপাসুর মনে কিছু তৃপ্তি এবং অনেক অতৃপ্তি এবং অন্বেষার সঞ্চার করতে পারে তা হলেই নিজের শ্রমকে সার্থক মনে করব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮ই ভাদ্র, ১৩৮০
২৫শে আগষ্ট, ১৯৭৩
।।২।।
যে ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতা নিয়েই ‘দর্শনকোষ’ রচনার দুঃসাহস দেখাতে হয়েছিল সে সীমাবদ্ধতাকে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণেও যে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি, তা এই গ্রন্থের অনুরাগী পাঠকবৃন্দের কাছে উল্লেখের প্রয়োজন হবে না। ‘দর্শনকোষ’ যে বহুদিন যাবৎ বই-এর দোকানে, এমনকি সড়কের উপরে কিংবা দুস্প্রাপ্য বস্তুর আধারেও অপ্রাপ্য হয়ে রয়েছে, এটি পাঠকদের প্রীতিরই স্মারক। ‘দর্শনকোষ’কে তাঁরা বর্জনীয় পদার্থ বলে গণ্য করেন নি, তাকে সংরক্ষণের বিষয় বলে বিবেচনা করেছেন। পথে ঘাটে তরুণ ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষার্থী, বন্ধুজন, সুহৃদ, শিক্ষাবিদ এবং পাঠকবৃন্দের তাগিত এবং দাবি ছিল, ‘দর্শনকোষ’-এর নতুন একটি সংস্করণের প্রধান কৃতিত্ব বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব মনজুরে মওলার, যিনি গ্রন্থখানির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সংকট সত্ত্বেও এর নতুন সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
‘দর্শনকোষ’ প্রকাশিত হওয়ার পরে স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রন্থকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তাঁর এমন উৎসাহদানে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বন্ধুবর মোহাম্মদ আবু জাফর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ মাসিকে ‘দর্শনকোষ’-এর একটি বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে এই গ্রন্থের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ কয়েকটি পরামর্শও প্রদান করেছিলেন। আমি সকৃতজ্ঞভাবে তাঁর আলোচনা পাঠ করেছি এবং তাঁর সুপরামর্শের দিকে খেয়াল রেখে যথাসাধ্য একে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। এ গ্রন্থের গুণগ্রাহী আলোচনা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক মোকাররম হোসেনও। তিনি আমার ধন্যবাদের পাত্র। চট্রগামের এক তরুণ পাঠক সাগ্রহে চিঠি লিখে গ্রন্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। এরূপ জানা অজানা পাঠকবর্গের অকৃপণ উৎসাহদান আমার মধ্যে ‘দর্শনকোষ’ রচনার একটা সতর্কতাবোধ সৃষ্টি করেছে। আমার জীবনকালে ‘দর্শনকোষ’-এর নতুনতর কোনো সংস্করণ হবে, এমন আশা করা, বিরাজমান পরিস্থিতিতে, কিছুটা দুরাশা। কিন্তু এ বিশ্বাস আমি পোষণ করি যে, ‘দর্শনকোষ’-এর উত্তরপুরুষরা জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে নানা জ্ঞানকোষ তৈরি দ্বারা এর সূচনার ধারাটি সমৃদ্ধ করে চলবেন। ইতিমধ্যে ‘সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ’, ‘ইতিহাসকোষ’, ‘জ্ঞানের কথা’, ‘চরিতাভিধান’ প্রভৃতি শিরোনামে ক্ষুদ্র বৃহৎ আকারের বিভিন্ন গ্রন্থ যে বাংলাদেশে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং নতুনতর উদ্যোগে যে আরো নানা ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হচ্ছে, এটি জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের লক্ষণ।
বর্তমান ‘দর্শনকোষ’ কেবল দর্শনশাস্ত্রের পদ কিংবা সমস্যার আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণভাবে এ গ্রন্থ একটি ক্ষুদ্র জ্ঞানকোষ। সে কারণে ক্ষমতানুযায়ী এবং গ্রন্থের আকারের সীমাবদ্ধতার মধ্যে এর বর্তমান পরিবর্ধিত সংস্করণে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় এক শত নতুন অন্তর্ভূক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তথাপি এ কোনো সুসম্পূর্ণ বিশ্বকোষ নয়। নতুন সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্তের পরে ’৮৫ সালের মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রকাশনা সমাপ্ত করার লক্ষ্যে গ্রন্থের সর্বদিকে দৃষ্টিপাতের সময় খুবই সংকীর্ণ ছিল। সে কারণে ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিমাণ হয়তো কম নয়। তথাপি যথাসাধ্য শুদ্ধ মুদ্রণ এবং অন্যান্য পরিপাট্যের প্রতি বাংলা একাডেমির পাঠ্য পুস্তক ডিভিশনের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ ইবরাহিম, তাঁর সহকর্মী জনাব ফজলুল হক সরকার, জনাব আবদুল ওয়াহাব এবং আহছানিয়া মিশন প্রেসের কর্মী জনাব মোহসীন যে সাগ্রহ তত্ত্বাবধান প্রদান এবং পরিশ্রম স্বীকার করেছেন তার জন্য তাঁরা সকলেই আমার কৃতজ্ঞতাভাজন। ‘হিপোক্রাটিসের শপথ’টি সংগ্রহ করে দিয়েছেন স্নেহভাজন ডা. এস. এ. মাহমুদ। তাঁকে আমার স্নেহাশীর্বাদ।
‘দর্শনকোষ’-এর অবশ্যই একটি দর্শন আছে। বলা চলে রচনাকার বা সংকলকের দর্শন। সেটি জটিল কোনো দর্শন নয়। সে কেবল এই সহজ বিশ্বাস যে, মানুষের সামাজিক জীবন নিয়ত বিকাশশীল। প্রবাহমান।কেবল যান্ত্রিকভাবে নয়। সচেতন, সংঘবদ্ধ, সমাজগত যৌথ প্রচেষ্টায় উত্তম থেকে অধিকতর উত্তম জীবন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিকাশমান প্রয়াস। মানুষের সমাজ জীবনের এমন বিকাশে শতবৎসরও কোনো হিসাবের কাল নয়। আসলে যেমন স্থান অসীম, তেমনি কাল অসীম। তাতে বর্তমানের কোনো সংকট, প্রতিবন্ধক কিংবা আশাভঙ্গ সেই অনিবার্য বিকাশের পরিচয়সূচক ব্যতীত তাকে রুদ্ধ করে দেওয়ার কোনো শক্তির প্রকাশ নয়। সেই বিশ্বাসে স্থির থেকেই বর্তমান নিবেদনের ইতি টানছি। এ গ্রন্থ বাংলা ভাষাভাষী জ্ঞানানুরাগী পাঠকবৃন্দের্ তাঁদের উদ্দেশ্যেই এ গ্রন্থ উৎসর্গিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৬

।।৩ ।।
‘দর্শনকোষ’-এর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সনে। বেশ কিছুদিন ধরে এ সংস্করণের কপি আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মীরাই ‘দর্শনকোষ’-এর নতুন সংস্করণের জন্য আমাকে তাগিদ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ছাত্র-ছাত্রী এবং অন্যান্য পাঠকবর্গ ‘দর্শনকোষ’খানি ক্রয়ের জন্য প্রায়শই একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু কপি নিঃশেষিত হওয়ার কারণে ‘দর্শনকোষ’ তাঁরা ক্রয় করতে পারেন না বলে তাঁদের উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিকগণ ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে ‘দর্শনকোষ’ পুনর্মুদ্রণের কথা বলেছেন। তাঁদের তাগিদ এবং বাংলা একাডেমীর অনুকূল সিদ্ধান্তে ‘দর্শনকোষ’-এর তৃতীয় সংস্করণটি এখন প্রকাশিত হলো। এ জন্যে আমি উভয়ের নিকট কৃতজ্ঞ।
বর্তমান সংস্করণে গ্রন্থের কলেবন তেমন বৃদ্ধি করা না গেলেও পূর্বতন সংস্করণের ক্রটি-বিচ্যুতি যথাসাধ্য সংশোধনের চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের অসামান্য লোকদার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব আজ প্রয়াত। তাঁর পরিচয়দানের দায়বদ্ধতা থেকে ‘দর্শনকোষ’-এর বর্তমান সংস্করণের উপযুক্ত স্থানে তাঁর উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমি যুক্ত করেছি।
যথাসাধ্য সংশোধনের মাধ্যমে সময়বোধক আলোচনাকে সমকালীন পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। সব ্বালোচনাতে তা হয়তো সম্ভব হয় নি। পাঠকবৃন্দ আশা করি সে দিকটি খেয়ালে রেখে আলোচনার বিষয়কে অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন।
শব্দের বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমী গৃহীত বানান পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে যে এই নিয়ম রক্ষিত হয়েছে এমন হয়তো বলা যাবে না।
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জ্ঞানানুরাগী পাঠকদের উদ্দেশে এই সংস্করণ উৎসর্গিত হলো্
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরদার ফজলুল করিম
ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫

 

 


দর্শনকোষ
A
Abelard, Pierre: পিয়ারে আবেলার্দ (১০৭৯-১১৪২ খ্রি.)
একাদশ ও দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের ফরাসি দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ। ‘ইউনিভার্সাল’ বা অনন্য-নির্ভর ভাবের অস্তিত্বের প্রশ্নে আবেলার্দ মন-নির্ভর ভাবের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে আবেলার্দের মন-নির্ভর ভাবের মতবাদ ভাবাদর্শের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ধর্মব্যাখ্যাও খ্রিষ্টান ধর্মের ‘গোঁড়া ক্যাথলিক মতের’ বিরোধী ছিল। আবেলার্দের ‘সিক এট নন’ ‘হাঁ এবং না’ নামক গ্রন্থখানি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এই পুস্তকে তিনি যাজক সম্প্রদায়ের প্রচারিত ধর্মীয় ব্যাখ্যার পরস্পর-বিরোধিতা প্রতিপন্ন করেন এবং ধর্মের প্রশ্নে যুক্তিকে অগ্রাধিকার দান করেন। প্রশ্নের ক্ষেত্রে সমাধান না থাকলেও তাঁর আলোচনার দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি মানুষের যুক্তিকে তীক্ষ্ণ এবং যুক্তিমূলক করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবেলার্দের অভিমত ছিল, ধর্মীয় বিশ্বাস-বহির্ভূত যে-কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য দ্বন্দ্বমূলক যুক্তিবাদী পদ্ধতি হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি। আবেলার্দের জীবনকালে তাঁর অভিমত অধিকাংশ দার্শনিকের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত না হলেও যুগের বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কারের মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। আবেলার্দ বলতেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বাদ দিলে এমন কিছু নাই যাকে ভুলের উর্ধ্বে মনে করা যয়ি। ধর্মযাজক কিংবা প্রেরিত পুরুষ কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়’।
আবেলার্দের এরূপ যুক্তিবাদী মতের জন্য গোঁড়া ক্যাথলিক সম্প্রদায় তাঁকে সমাজচ্যুত করেছিল।
Absolate: পরম বা চরম সত্তা
ভাববাদী দর্শনে ‘পরম সত্তা’ একটি মৌলিক ধারণা। এই দর্শনের ব্যাখ্যানুযায়ী পরম সত্তা হচ্ছে চরম সম্পূর্ণ এক অস্তিত্ব। সমস্ত খণ্ড অস্তিত্ব পরম সত্তার প্রকাশ। কিন্তু কোনো খণ্ড অস্তিত্ব আপন শক্তিতে পরম সত্তার কোনো হানি বা অপূর্ণতা ঘটাতে পারে না। পরম সত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণ। খণ্ড অস্তিত্বের সাধারণ সম্মেলনও পরম সত্তার সৃষ্টি নয়। পরম সত্তা সমস্ত সৃষ্টির মূল শক্তি। পরম সত্তা নির্বিশেষ সত্তা। সর্বপ্রকার বিশেষ-প্রকাশ-নিরেপেক্ষ সে। বস্তুবাদী দর্শন খণ্ড অস্তিত্ব বা বিশেষ-নিরপেক্ষভাবে কোনো পরম এবং নিরাকার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। পরম সত্তাকে বিভিন্ন ভাববাদী দার্শনিকের তত্বে বিভিন্ন নামে অবহিত হতে দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দর্শনে পরম সত্তা ‘দি আইডিয়া’ বা বস্তু নিরপেক্ষ ভাব বলে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফিকটে অহংবোধ ‘আমি’কে পরম সত্তা বলেছেন। হেগেলের দর্শনে পরম সত্তাকে এক সার্বিক এবং পরম ভাব বলে প্রকাশ করা হয়েছে। শপেনহার ‘ইচ্ছা শক্তি’কেই পরম সত্তা বলেছেন। বার্গসাঁ একে ইনটুইশন বা স্বজ্ঞা বলেছেন। ধর্মের ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে পরম সত্তা বলে অভিহিত করা হয়।
Absolute and Relative: নিরপেক্ষ এবং সাপেক্ষ
যুক্তিবিদ্যায় যে পদ অপর কোনো পদের উপর নির্ভরশীল নয় তাকে নিরপেক্ষ পদ বলে।, যেমন- মানুষ, পানি, মাটি। অপরদিকে যে পদের অর্থ অপর কোনো পদের উপর নির্ভরশীল তাকে রিলেটিভ আ আপেক্ষিক পদ বলে। যেমন- ছাত্র কিংবা শিক্ষক ছাত্র-শিক্ষককে যুক্তভাবে পরস্পর নির্ভরশীল পদ বা ‘কোরিলেটিভ টার্মস’ বলে। দর্শনে অনন্য- নির্ভর সত্তাকে এ্যাবসোলিউট এবং কোনো সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়; অপর কোনো সত্তার সঙ্গে সে যুক্ত নয়। অনন্য-নির্ভর সত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণ; তার কোনো পরিবর্তন নাই।
আপেক্ষিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। পারস্পারিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। পারস্পারিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তার উদ্ভব। সামগ্রিক সত্তার প্রতি অংশ অপর অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। সেই সংযোগের ভিত্তিতেই প্রতিটি অংশ বা খণ্ডের বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট হয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে অনন্যনির্ভর স্বাধীন এবং অপরিবর্তনীয় চরম বলে কিছু নাই এবং তেমন কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করাও চলে না। অস্তিত্বমাত্রই আপেক্ষিক। আপেক্ষিকের জটিল সম্মেলনে সে সামগ্রিক সত্তা সে তার অংশসহ নিরন্তর পরিবর্তমান ও বিকাশশীল।
Absolutism: নিরঙ্কুশতা
শাসনের অবাধ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ শাসন বলা হয়। নিরঙ্কুশ শাসনে জনসাধারণ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারে কোনোরূপ অংশগ্রহণ করার অধিকার ভোগ করে না। নিরঙ্কুশ শাসনের বিপরীত হলো গণতান্ত্রিক শাসন।
গণতান্ত্রিক শাসন-পদ্ধতিতে কোনো এক ব্যক্তি বা সম্রাট শাসনের একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করে না। নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণকে শাসন করে। গণতান্ত্রিক বা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার আধুনিককালের সর্বজন স্বীকৃত এবং কাম্য ব্যবস্থা বলে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিসে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অবশ্য প্রাচীন গ্রিসের এই গণতন্ত্রে দাসদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের পরবর্তীকাল থেকে আধুনিক পুঁজিবাদী বিপ্লব পর্যন্ত ইউরোপে এবং অন্যত্র সমন্ততান্ত্রিক যুগে রাজা বা সম্রাটদের একচ্ছত্র অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল।
Abstract and Concrete: বিমূর্ত এবং মূর্ত
যুক্তিবিদ্যায় যে পদ দ্বারা বস্তু-নিরপেক্ষভাবে কোনো গুণ বুঝায় তেমন পদকে গুণবাচক বা এ্যাবসট্রাক্ট পদ বলে। যথা, মনষ্যত্ব, দয়া, অন্ধত্ব। অপর পক্ষে যে পদ দ্বারা কোনো বস্তু বুঝায় তাকে বস্তুবাচক পদ বা কনক্রিট টার্ম বলে। যথা, গাছ, রহিম, ঢাকা শহর ইত্যাদি।
দর্শনে যা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য নয় তাকে বিমূর্ত এবং যা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য তাকে মূর্ত বলা হয়। মূর্ত এবং বিমূর্তের প্রশ্নে ইতিহাসে মত পার্থক্য দেখা যায়। ভাববাদী দর্শনে বিমূর্তকেই পরম বলে মনে করা হয়। বস্তুবাদী দর্শনে মূর্তের গুণাগুণকে মানসিকভাবে বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করাকে বিমূর্ত ক্ষমতা বলা হয়। উনবিংশ শতকে জার্মান দার্শনিক হেগেল মূর্ত এবং বিমূর্তের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুনতর ব্যাখ্যাসহ প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। হেগেল মূর্ত এবং বিমূর্তের একটি দ্বন্দ্বমূলক এবং নিত্য বিকাশমান সম্পর্কের কল্পনা করেন। হেগেলের নিকট বিমূর্ত মূর্তের বিপরীত কোনো ভাব বা বস্তু নয়। নিরন্তর বিকাশে মূর্ত বিমূর্তে পরিণতি লাভ করে। এই বিমূর্ত আবার মূর্তেও প্রকাশিত হয়। হেগেলের চরম বিমূর্ত অবশ্য একটি ভাববাদী ধারণা। সে ব্যাখ্যায় চরম বিমূর্তের আংশিক প্রকাশ। ইতিহাস, সমাজ, বস্তুজগৎ: সবই এরূপ ব্যাখ্যায় চরম বিমূর্তের মায়ারূপ প্রকাশ-স্থায়ী সত্য নয়। বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ করে মার্কসবাদী দর্শন হেগেলের মূর্ত-বিমূর্তের ব্যাখ্যায় পরস্পর-বিরোধিতা আরোপ করে। মার্কসবাদী দার্শনিকদের মত মূর্তের বিকাশ ও সামগ্রিকতাই যদি বিমূর্তের সৃষ্টি, তবে মূর্তবিচ্ছিন্নভাবে বিমূর্তের কোনো অস্তিত্ব নেই। তেমন ক্ষেত্রে মূর্তই চরম সত্য, বিমূর্ত নয়। এবং সমাজ, ইতিহাস, জগৎকে বিমূর্তের ভ্রান্তিকর খণ্ড প্রকাশ বলাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
মার্কসবাদী দর্শনের মতে ইন্দ্রিয়াদি অর্থ্যাৎ মানুষের জ্ঞান-মাধ্যমের গ্রাহ্য বস্তু, ভাব এবং ভাবনা অর্থ্যাৎজ্ঞান সাপেক্ষ জগৎই সত্য। জ্ঞান-সাপেক্ষ জগতের সামগ্রিক ধারণাই বিমূর্ত ধারণা। জ্ঞেন-জগতের উধ্বে কোনো অজ্ঞেয় বিমূর্ত সত্তা নেই। জ্ঞান-সাপেক্ষ-মূর্ত জগতের প্রতিটি অংশের সঙ্গে পারস্পারিক সম্পর্কে সম্পর্কিত।
সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘এ্যাবষ্ট্রাক্টের’ অর্থ হচ্ছে কোন কিছুর আংশিক বা অপূর্ণ ধারণা। ‘সাধারণ জ্ঞান’, ‘সাধারণ ধারণা’ এরূপ কথা দ্বারা এই ভাবটি ব্যক্ত করা হয়। এর বিপরীত ভাবে ‘কনক্রিট’ কথাটি ব্যবহৃত হয়। কনক্রিট বলতে কোনো কিছুর বস্তুগত বা নির্দিষ্ট ধারণাকে বুঝায়।
Abdul Gaffar Khan: আব্দুল গফফার খান (১৮৯১-১৯৮৮)
‘খান আব্দুল গফফার খান’রূপে ইনি পরিচিত। আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকার অধিবাসী। উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনকালে গান্ধীজির অহিংস নীতির অনুসারী বলে ‘সীমান্ত গান্ধী’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। পুশতুভাষী এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজেদের একটি বিশিষ্ট জাতি বলে বিবেচনা করে। ভারত বিভাগের ফলে পাকিস্থানভূক্ত হলেও খান আব্দুল গফফার খান তাঁর এলাকার আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ‘পাখতুনিস্তান’ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তিনি ‘খোদাই খেদমতগার’ নামক সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজ শাসনের কাল ব্যতীত পাকিস্তান আমলেও তাঁর স্বাধীনচেতা এবং পাখতুনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবির কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ প্রকৃতিগতভাবে দুর্ধর্ষ বলে পরিচিত। তাঁদের জনপ্রিয় নেতার মৃদুভাষণ, নম্র আচরণ এবং আপন নীতিতে অনমনীয়তা খান আবদুল গফফার খানকে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন করেছে। বয়সের দিক থকে শতবর্ষ পূরণের নিকটবর্তী বয়সেও তিনি রাজনৈতিক জীবন যাপন করেছেন এবং পাখতুনদের আত্মনিয়ন্ত্রনের সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি হিসাবে তাঁকে নেহেরু অ্যাওয়ার্ড (১৯৬৭) এবং ভারত রত্ন (১৯৮৭) প্রদান দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৮৮ সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
Abul Kalam Azad, Maolana: মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৪)
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা এবং ইসলাম ধর্মের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত। পিতা মওলানা খায়রুল দীন এবং পিতামহের সূত্রে মৌলানা আজাদের পরিবারের আরবের হেজাজ এবং মক্কার সঙ্গে সংযোগ ছিল। তাঁর পিতা একজন প্রখ্যাত পির ছিলেন এবং বোম্বে, কলকাতা এবং রেঙ্গুনে তার প্রচুর সংখ্যক মুরিদ ছিল।
আবুল কালামের শিক্ষা প্রধানত গৃহের মধ্যে পারিবারিক প্রথায় পরিচালিত হয়। কিন্তু কিশোরকাল থেকেই আবুল কালাম ছিলেন বিষ্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। “প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতির পাঠক্রমের সবগুলি শিক্ষণীয় বিষয় তিনি পিতার শিক্ষকতায় পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেন। ইহার পরে আজাদ গভীর ব্যক্তিগত অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদ্যায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ভাষাগুলির মধ্যে তিনি প্রথমে ফরাসি এবং পরে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন।” কিশোরকাল থেকেই তিনি কবিতা রচনা করতেন। এবং ‘আজাদ’ তাঁর কবিনাম। উর্দূ ভাষায় তিনি ক্ষমতাবান বাগ্মী ছিলেন। কিশোর বয়সে মাসিক সাহিত্যপত্র ‘লিসানাল সিদক’ সম্পাদনা করেন। ১৯১২ সনে কোলকাতা থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আল হেলাল’ তাঁর সম্পদনায় প্রকাশিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধকালে যুদ্ধ সম্পর্কে ‘আল হেলালের’ ব্রিটিশ সরকার বিরোধী মতের কারণে ব্রিটিশ সরকার প্রথমে পত্রিকা থেকে জামানত তলব করে এবং জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মৌলানা আজাদের মতামত সর্বদাই ইংরেজ সরকারের বিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামী চরিত্রের ছিল। তাঁর রাজনৈতিক মতের জন্য ১৯১৬ সনে তাঁকে কলকাতা থেকে বহিস্কার করা হয় এবং রাঁচিতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। ১৯২০-এ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মৌলানা আজাদ বঙ্গীয় প্রাদেশিক খেলাফত কনফারেন্সের সভাপতি হন। আমৃত্যু ভারতের সকল সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে ‘ভারতীয় জাতি’মূলক জাতীয়বাদী চেতনায় তিনি উদ্বুদ্ধ ছিলেন এবং ত্রিশের দশক থেকে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং বিভেদ বৃদ্ধি পেলে এবং মুসলিম লীগ মুসলমানদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বলে মুসলিম লীগ নেতা মি. জিন্নাহ দাবি করলেও মৌলানা আজাদ সাম্প্রদায়িক চিন্তা প্রবাহের বিরুদ্ধতা করেন এবং অবিচলভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ইংরেজের সঙ্গে স্বাধীনতার আলোচনাকালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪২-এর আগষ্ট মাসে ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে গান্ধীসহ কংগ্রেসের অপর সকল প্রখ্যাত নেতার সাথে মৌলানা আজাদ কারারুদ্ধ হন। “রাঁচীর নজরবন্দি থেকে জুন ১৯৪৫ পর্যন্ত তাঁর বন্দি জীবনের দৈর্ঘ্য মোট দশ বৎসর সাত মাস হয়।” স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭ সনে তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ধর্ম এবং রাজনীতিক অভিমতমূলক যে সকল গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন তার কোন সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা সহজ নয়। তাঁর মৃত্যুপূর্বকালে আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘ইণ্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বা ‘ভারতের স্বাধীনতালাভ’ গ্রন্থ তাঁর নির্দেশমতো মৃত্যুর পরে একটা নির্দিষ্টকাল অতিক্রম শেষে প্রকাশ করা হয়। এই গ্রন্থে তাঁর রাজনৈতিক নানা অভিমত নিঃসঙ্কোচে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্থান রাষ্ট্র যে অধিককাল দ্বন্দ্বহীনভাবে বজায় থাকতে পারবে না, এ ভবিষ্যদ্বাণীও তিনি উক্ত পুস্তকে প্রকাশ করেন।
Academy of Plato: প্লেটোর একাডেমী
গ্রিক ‘একাডেমীয়া’ শব্দ থেকে ইংরেজি একাডেমী শব্দেরউৎপত্তি। প্রাচীন গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের একটি বাগানকে একাডেমাসের বাগান বলা হয়। খ্রি. পূ. ৩৮৭ সনে প্লেটো এখানে দার্শনিক আলোচনার একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা করেন। পূর্বে এই বাগানে গ্রিক দেব-দেবীদের উদ্দেশে পশু উৎসর্গ করা হতো। এথেন্সের একাডেমীর ইতিহাসে তিনটি পর্যায়ের কথা জানা যায় (১) প্রথম পর্যায় বা প্লেটো পর্ব। প্লেটো পর্বে প্লেটোর পরে স্পুসিয়াস, জেনোক্রাটিস এবং পলেমনকে একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত দেখো যায়। (২) দ্বিতীয় পর্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আরসেসিলাস পরিচিত। এটাকে একাডেমীর মধ্যযুগ বলেও অভিহিত করা হয়। এই যুগে আলোচনার লক্ষ্য ছিল প্রাচীন স্টোয়িক বা প্রতিরোধহীন সমর্পণবাদকে খণ্ডন করা হয়। আরসেলিলাসের পরে আসেন ল্যাসিডিষ। (৩) তৃতীয় পর্যায়কে একাডেমীর নবপর্যায় বলেও অভিহিত করা হয়। এই পর্বের প্রধাস উদ্যোগী চিন্তাবিদ ছিলেন কারনিয়াডিস। কারনিয়াডিসের চিন্তাধারা পূর্বতন সন্দেহবাদের প্রকারবিশেষ।
প্লেটো ৩৪৭ খ্রি.পূ. অব্দে মারা যান। প্লেটোর মৃত্যুকাল পর্যন্ত দার্শনিক এ্যারিস্টটল একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে অন্যান্য দার্শনিক যাঁরা একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জ্যোতিৃর্বিদ ইউডোক্সাস এবং ফিলিপাস, গণিত শাস্ত্রবিদ থিটিটাস এবং একাধারে সমাজতত্ত্ববিদ, ভূগোলবিদ এবং বৈজ্ঞানিক হিরাক্লিডিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম যুগকেই একাডেমীর স্বর্ণযুগ বলা যায়। এই যুগে একাডেমীর সদস্যগণ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি মুক্তবুদ্ধি গবেষণা এবং দর্শন সম্পর্কিত আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই যুগে মতামতের দ্বন্দ্বে দেখা যায় যে, স্পুসিপাস প্লেটোর বস্তুনিরপেক্ষ ‘পরমভাব’-এর ধারণাকে খণ্ডন করে ‘আংকিক সংখ্যাই হচ্ছে একমাত্র নিত্যসত্য’- পাইথাগোরীয় সম্প্রদায়ের এই অভিমতকে সমর্থন করেছেন। পুসিপাস আরো দাবি করেন যে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা সত্যজ্ঞান লাভ করতে পারি। প্রাকৃতিক জগতের ইতিহাস বর্ণনাতেও স্পুসিপাসের আগ্রহ ছিল। একাডেমীর আদি যুগের অন্যতম দার্শনিক জেনোক্রাটিস প্লেটোবাদ এবং পাইথাগোরীয়বাদের মধ্যে একটি সমঝতোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি একদিকে প্লেটোর নিকট থেকে সমস্ত অনিত্য প্রকাশের পেছনে এক নিত্য সত্তার অস্তিত্বকে গ্রহণ করেন, অপরদিকে নিত্য এবং অনিত্যের সংঘাতে সংখ্যার উৎপত্তি হয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। খ্রিষ্টাব্দের চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে একোডেমীর মতাদর্শ নব-প্লেটোবাদ বলে পরিচিত হয়। ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান একাডেমীর আলোচনা নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেন। ইউরোপে নব জাগরণের যুগে (১৪৫৯-১৫২১) ফ্লোরেন্স শহরে ‘একাডেমী’ নামে আলোচনা ও গবেষণার নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। এই পর্যায়ে প্লেটোর রচনাবলীর উদ্ধার এবং অনুবাদ এবং এ্যারিস্টটলের দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যা গুরুত্ব লাভ করে।
‘একাডেমী’ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শব্দ। একাডেমী শব্দ দ্বারা সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞানের আলোচনা ও গবেষণার কেন্দ্রে বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝান হয়। এই অর্থে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ‘একাডেমী’ নামক প্রতিষ্ঠানকে কার্যরত দেখা যায়। বিশ্বের বিখ্রাত একাডেমীগুলির মধ্যে ফরাসি একাডেমী, ইংল্যাণ্ডের ব্রিটিশ একাডেমী, গ্রিসের একাডেমীয়া এথেন্স, জাপানের দি ন্যাশনাল একাডেমী অব জাপান, আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউইয়র্ক একাডেমী অব সায়েন্সস এবং রাশিয়ার একাডেমী অব সায়েন্সস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমীও একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান।
Accident, Accidens: অবান্তর লক্ষণ
যুক্তিবিদ্যায় বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। একটি পদের গুণ যদি এমন হয় যে, গুণটি কিংবা গুণসমূহ উক্ত পদের জাত্যর্থ বা কানোটেশনের অন্তর্ভূক্ত নয়, জাত্যর্থ থেকে উদ্ভূতও নয়-অর্থ্যাৎ উক্ত গুণকে পদের জাত্যর্থ থেকে অনুমান করা চলে না; কিন্তু গুণটিকে পদের মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দেখতে পাওয়া যায়, তা হলে এরুপ গুণটিকে পদের মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দেখেতে পাওয়া যায়, তা হলে এরূপ গুণকে উক্ত পদ বা টার্মের এ্যাকসিডেন্ট বা এ্যাকসিডেন্স বলা হয়। বাংলাতে এক ‘অবান্তর লক্ষণ’ বলা যায়। অনেক মানুষের ‘চুল কালো’, এই দৃষ্টান্তে চুল কালো বা কালো চুল থাকার গুণটি মানুষ পদের অবান্তর লক্ষণ। এ গুণটি ‘মানুষ’ হওয়ার অপরিহার্য গুণ হচ্ছে ‘জীবন্তু এবং যুক্তিবাদিতা’। অবান্তর লক্ষণ একটি পদের বিচ্ছেদ্য কিংবা অবিচ্ছেদ্য গুণ বলেও বিবেচিত হতে পারে। যে অবান্তর লক্ষণ পদের মধ্যে স্থায়ীভাবে দেখা যায়, তাকে অবিচ্ছেদ্য অবান্তর লক্ষণ বলে। যেমন কবি নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেছিলেন। একটি বিশেষ সনে জন্মগ্রহণ করার গুণটি উপরোক্ত পদটি অবিচ্ছদ্য অবান্তর লক্ষণ।
দর্শনশাস্ত্রেও ‘এ্যাকসিডেণ্ট’ বলতে অস্থায়ী, অনিত্য এবং অপরিহার্য গুণকে বুঝায়। এদিক থেকে নিত্যসত্তা বা পরম সত্তার বিপরীত হচ্ছে অনিত্যসত্তা বা এ্যাকসিডেণ্ট। পদের গুণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং অপরিহার্যের পার্থক্য প্রথম প্রকাশ করে দার্শনিক এ্যারিস্টোটল। ‘এ্যাকসিডেন্ট’ শব্দের ব্যবহার তার রচনাবলীতেই প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে মধ্যযুগের স্কলাসটিক বা ধর্মীয় দর্শনের মধ্যে ‘এ্যাকসিডেন্ট’-এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের দর্শনেও বস্তুর অপরিহার্য এবং অপরিহার্য গুণের আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে কোনো বিশেষ বস্তুই যেমন অপর কোনো বিশেষ বস্তু থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি বস্তুর কোনো গুণকে অপর কোনো বিশেষ বস্তু থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি বস্তুর কোনো গুণকে অপর কোনো গুণের সঙ্গে তুলনাক্রমে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ্য গুণ বলা চলে না।
Accidental Evoluation: আকষ্মিক বিকাম, আকষ্মিক বিবর্তন
জীবন এবং প্রকৃতির ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং বস্তুবাদের বিরোধীতা হিসাবে ‘আকষ্মিক বিবর্তনবাদ’-এর উদ্ভব দেখা যায়। এ মতের প্রধান ব্যাখ্যাদাতাদের মধ্যে স্যামুয়েল আলেকজাণ্ডার, এস. লয়েড মরগান, সি. ডি. ব্রড প্রমুখ দার্শনিকের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত দার্শনিককে ‘নব বাস্তবাদী’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এ ভাবধারা মূলত ভাববাদী দর্শনের প্রকারবিশেষ।
চার্লস ডারউইনে তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিস’-গ্রন্থে বলেছিলেন, জীবন ও প্রকৃতির ইতিহাস হচ্ছে ক্রমবিকাশের ইতিহাস। বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে জীবনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্ত প্রকার প্রাণীর বিকাশ ঘটেছে। জীবনের বিবর্তনে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক-শূন্য কোনো নতুনের আবির্ভাব সম্ভব নয়। ডারউইনের এই মত বস্তুবাদী মত। উল্লিখিত দার্শনিকগণ বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বকে জীবনের ব্যাখ্যায় যথেষ্ট মনে করেন না। এঁদের মতে জীবনের বিকাশের ইতিহাসে এমন সমস্ত পর্যায় এবং সৃষ্টির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যাকে বিবর্তনবাদের ধারাবাহিকতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। সৃষ্টির ধারা অনির্দিষ্ট। সে ধারার অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো নির্দিষ্ট করা যায় না। সৃষ্টি অগ্রসর হয় আকষ্মিক নতুন সত্তার উদ্ভাবের মাধ্যমে। সৃষ্টির অগ্রগতির বৈশিষ্ট্য ক্রমবিকাশ ক্রমবিকাশ নয়।, আকষ্মিক উদ্ভব এবং উৎক্রমণ। জগতের কোনো নতুন অস্তিত্বের সঙ্গে অতীতের কোনো অস্তিত্বের সাদৃশ্য নাই। জীবনের বিকাশের এই ব্যাখ্যা আকষ্মিক বিবর্তনবাদের একটি দিক। এ ছাড়া সমগ্র অস্তিত্বের নতুনতর ব্যাখ্যাদানের চেষ্টাও এই দর্শনের অনুসারীগণ করেছেন। এই দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা আলেকজাণ্ডার তাঁর ‘স্পেস, টাইম এণ্ড ডিটি’ গ্রন্থে এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ‘স্থান-কাল’ এই ধারণা। ‘স্থান-কাল’ ধারণাই সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি করেছে; বস্তু বা অস্তিত্ব থেকে ‘স্থান-কাল’ ধারণার সৃষ্টি হয় নি। মর্গান মনে করেন, জগতের অস্তিত্ব মাত্রই সপ্রাণ। প্রাণ ব্যতীত আদৌ কোন বস্তু বা অস্তিত্ব নাই।
Acosta, Uriel: উরিয়েল এ্যাকোস্টা (১৫৮৫-১৬৪০ খ্রি.)
ওলান্দাজ দার্শনিক। জন্ম পর্তুগাল, ১৫৮৫ কিংবা ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম জীবনে ক্যথলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। কিন্তু যুক্তিবাদকে নিজের দর্শন হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তী কালে ক্যাথলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ক্যাথলিক নির্যাতনের ভয়ে ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে হল্যাণ্ডে পালায়ন করেন। এই পর্যায়ে উরিয়েল এ্যাকোষ্টা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু মূল ইহুদি ধর্মের ভাবধারাসমূহকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় বিকৃত করেছে বলে তিনি ইহুদি যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে আত্মার অবিনশ্বরতার উপর ‘sbre a martali dade da alam do homen’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং দাবি করেন যে, দেহের মৃত্যুর পরে আত্মার অবিনশ্বরতা বলে কিছুই নাই। সনাতন মতের বিরুদ্ধচারণের জন্য উরিয়েল এ্যাকোস্টাকে ইহুদি সমাজ থেকে দু দুবার বহিস্কার করা হয়। একদিকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় এবং অপরদিকে ওলন্দাজ সরকারের নিগ্রহে উরিয়েল এ্যাকোস্টা আত্মহত্যা করেন। তাঁর অপর গ্রন্থের নাম ছির ‘Exemplar humane vitae’ এই পুস্তকে তিনি রাষ্ট্রীয় ধর্ম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টান, সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধিতা করেন। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত ওলন্দাজ দার্শনিক স্পিনোজা উরিয়েল এ্রাকোস্টার মতবাদে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেখক ক. এফ গুজকাউ-এর বিষদাত্মক নাটক ‘উরিয়েল এ্যাকোস্টা’ (১৮৪৭) উরিয়েল এ্যাকোস্টার জীবন-কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত।
Activists: কার্যবাদী, ক্রিয়াবাদী
রাজনৈতিক দলের মধ্যে লক্ষ্য সাধনের ক্ষেত্রে মতামতের পার্থক্যের উদ্ভব হয়। এরূপ মতামতের যদি কোনো উপদল দলের লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা কার্যের উপর অধিক জোর দেয় তবে তাদেরকে কার্যবাদী বা ক্রিয়াবাদী বলা হয়।
Activity: ক্রিয়া
মনোবিজ্ঞানে, মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। দশরএনর ব্যক্তির উদেশ্য সাধনার্থে গৃহীত কর্মবাদ বা প্রাগামেটিজমের তত্ব।
মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তি এবং বস্তুর পাস্পারিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি বস্তু বা পরিবেশকে ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস প্রায়। জীবনমাত্রেরই একটি স্বাধীন ক্রিয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সকল জীবের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার স্বাধীনতা এবং বিকাশের স্তর সমান নয়। এজন্য প্রাথমিক ধরনের ক্রিয়া এবং জটিল উচ্চতর ধরনের ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয়। মনুষ্যেতর জীবেরও কার্যক্ষমতা আছে। কিন্তু মনুষ্যেতর জীবের ক্রিয়ার মধ্যে মানুষের তুলতায় স্বাধীনতার পরিচয় কম। মনুষ্যেতর পশু-পক্ষীর ক্রিয়াকে পরিবেশই অধিক পরিমানে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষ পরিবেশ দ্বারা কেবল নিয়ন্ত্রিত হয় না; পরিবেশকে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে পরিবর্তিত করার জন্যে আপন মস্তিস্ক এবং ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকাণ্ড সম্পন্ন করে। মানসিকভাবে উদ্দেশ্য থাকা বা উদ্দেশ্যের সৃষ্টি করা কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই জটিল এবং উন্নতভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ক্রিয়া কথার মধ্যে একটি সামাজিক অর্থ নিহত আছে। কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। ব্যক্তির অর্থ সামাজিক পরিবেশের ব্যক্তি। সে কারণে ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে সামাজিক পরিবেশ এবং উক্ত পরিবেশের বিশেষ অবস্থা বিদ্যমান। মানুষের আদিতেও ব্যক্তির ক্রিয়া সামজিক পরিবেশের চাহিদা থেকেই শুরু হয়েছে। জৈবিক চাহিদা পূরনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সমষ্টিগতভাবে গ্রহণ করেছে। মস্তিস্ক চালনার ক্ষেত্রে মনুষ্যেতর জীবের তুলনায় মানুষ অধিকতর জটিল এবং স্বাধীনতা চরম মনে করা ভূল। সামাজিক পরিবেশ-নিরপেক্ষভাবে ব্যক্তি কেবলমাত্র মস্তিৃস্কের ইচ্ছানুযায়ী কোনো ক্রিয়া-কাণ্ডের সূত্রপাত করতে পারে না। এদিক থেকে ব্যক্তি পরিবেশ-নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তি ও পরিবেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক দ্বন্দ্বমূলক এবং পরস্পর-নির্ভরশীল। কেউই চরমরূপে স্বাধীন নয়।
মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্রিয়া দুরকম হতে পারে। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক। বাহ্যিক ক্রিয়ায় ব্যক্তি নিজের ইন্দ্রিয় সহযোগে বস্তুর উপর সক্রিয় হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বস্তুর মানসিক স্মৃতি ও ছবির উপর কল্পনার মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়। যে-কোনো বাহ্যিক ক্রিয়ার পূর্বে ব্যক্তি তাকে মানসিকভাবে পূর্বেই সম্পন্ন করা চেষ্টা করে। মুখে যে শব্দ উচ্চারণ করে অপর ব্যক্তির নিকট আমরা ভাব প্রকাশ করি, সে শব্দকে মানসিকভাবে প্রায়শই আমরা পূর্বে উচ্চারণ করে নিই। এরূপ ক্রিয়ার পৌনঃপুনিক চেষ্টায় মানসিক ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে স্বয়ংক্রিয় বা মনেরও অগচরে হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক ক্রিয়া পরিবেশকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ক্রিয়াই তত্ব হিসাবে প্রকাশিত হয়। তত্ব ও তার প্রয়োগমূলক ক্রিয়াও পরস্পর নির্ভরশীল। পরিবেশের আঘাত মস্তিস্ককে উপযুক্তরূপে পরিবর্তনের চিন্তায় সক্রিয় করে। মানসিকভাবে পরিকল্পিত ক্রিয়াকৌশল পরিবেশের উপর প্রয়োগের মারফত ব্যক্তি তার বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর করতে প্রয়াস পায়।
Adler, Alfred: আলফ্রেড এ্যাডলার (১৮৭০-১৯৩৮)
অষ্টিয়ার মনোবিজ্ঞানী। মনোসমীক্ষার প্রবর্তক সিগমণ্ড ফ্রয়েডের পরেই মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রে এ্যাডলারের খ্যাতি। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের প্রশ্নে দুজনার মত এক নয়। এ্যাডলারের মনোসমীক্ষাণ ব্যক্তিকেন্দ্রীক। এ্যাডলার ব্যক্তিকে একটি স্বয়ংসম্পর্ণ চরিত্র বলে মনে করেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব পরিবেশ দ্বারা গঠিত। মনোবিকার বা মানসিক রোগের মূল হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত। ব্যক্তি চাই পরিবেশকে জয় করতে। জয়ের এই প্রবণতা ব্যক্তির জন্মগত। শৈশবেই এর উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তি দৈহিক দুর্বলতা, মানসিক অক্ষমতা কিংবা অপর কোনো প্রতিকূল কারণে পরিবেশের সঙ্গে সংঘাতে জয়ী না হলে নিজের মনে সে বাস্তব অবস্থার পরিপূরক এর কপ্লজগতের সৃষ্টি করে। এভাবেই মানসিক রোগ কিংবা মসোবিকারের সূত্রপাত হয়। ব্যক্তি আপন কপ্ললোকে বাস্তব জগতের সর্বপ্রকার পরাজয়ের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে। যে দৈহিকভাবে দুর্বল সে কল্পনা জগতে নিজেকে অপরিমিত শক্তিশালী মনে করে। এর ফলে বাস্তবের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত অধিকতর বৃদ্ধি পায়। এ্যাডলারের তত্ত্ব অনুযায়ী মানসিক রোগীর রোগ দূরীকরণের জন্য ব্যক্তি শৈশবকাল এবং পরিবেশ উত্তমরূপে জানা আবশ্যক। কেন না, শৈশবকালে পরাজয়গুলিই রোগীর মনে বদ্ধমূল মনোবিকারের সৃষ্টি করে। রোগীকে এ অবস্থায় নিরাময় করবার প্রকৃষ্ট পথ হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতের বিপদ সম্পর্কে তাকে সচেতন করার চেষ্টা করা এবং যথাসম্ভব বাস্তব সঙঘাত থেকে তাকে দূরে রাখা। ফ্রয়েড যেখানে ব্যক্তির মূল জীবনবোধের পেছনে যৌন অনুভূতি এবং যৌন আকাঙ্ক্ষাকে আবিস্কার করেছেন, এ্যাডলার যেখানে ব্যক্তির জীবনবোধের পেছনে সামাজিক ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। ফ্রয়েড মানসিকভাবে সুস্থ অসুস্থ উভয় ব্যক্তির মনকে যৌনাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন। যৌনাকাঙ্ক্ষার উপর এই গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে এ্যাডলার ফ্রয়েডের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ্যাডলার ব্যক্তির যৌনবোধ অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর মতে যৌনবোধ বা অনুভূতি ব্যক্তির জটিল চরিত্রের মাত্র অনুভূতি। সর্বপ্রকার বোধ নিয়ে ব্যক্তির যে চরিত্র, তার বিবেচনা ব্যতীত ব্যক্তিচরিত্রের কোনো বিশেষ অনুভূতির সঠিক বিচার সম্ভব নয়। ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্রকে এ্যাডলার বলেছেন ব্যক্তির জীবনপ্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে এ্যাডলার একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ফ্রয়েডের সঙ্গে যখন তিনি যুক্ত হন, তখন ফ্রয়েড তাকেঁ মনোসমীক্ষণ সংঘের সভাপতি মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু মনোবিশ্লেষণে মতপার্থক্যের জন্য এ্যাডলার ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রয়েডের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে ‘মুক্তবুদ্ধি মনোসমীক্ষণবিদ সংঘের’ প্রতিষ্ঠা করেন। মতবিরোধের ফলে উভয় বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তিক্তরূপ ধারণ করে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-চরিত্রের নতুনতর বিচার এ্যাডলারের খ্যাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে জানার জন্য শৈশবকে জানার আবশ্যকতা এবং দুর্বলতাবোধ থেকে যে শৈশবকালেই ব্যক্তির জীবনে পরাজয়ের গ্লানি ও বিকার দেখা দিতে পারে এবং যে বিকার বদ্ধমূল হয়ে ব্যক্তিকে মানসিক রোগীতে পরিণত করতে পারে-এ্যাডলারের এই তত্ত্ব শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা বিচারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে গৃহীত হয়েছে। এ্যাডলারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের ইংরেজি নাম হচ্ছে ‘দি নিউরোটিক কনসটিটিউশন’ (১৯১২) এবং ‘ইনিডিভিডুয়াল সাইকোলজি’ (১৯২৪)।
Adler, Max: ম্যাকস এ্যাডলার (১৮৭৩-১৯৩৭)
অস্ট্রিয়ার রাজনীতিক লেখক এবং দার্শনিক। অস্ট্রিয়ার সোস্যাল ডিমোক্রাটিক পার্টির তাত্ত্বিক। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকাল থেকে এ্যাডলার সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির বামপন্থী গ্রুপকে সমর্থন করেন। ১৯৩০ সালে কার্লরেনার এবং রুডরফ হিলপারডিং-এর সঙ্গে যৌথভাবে এ্যাডলার ভিয়েনাতে একটি শ্রমিকদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদে এ্যাডলারের ভূমিকার একটি দিক হচ্ছে, একটি সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হিসাবে মার্কবাদের জ্ঞানতত্ত্বকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নব্য-কাণ্টীয় এবং আর্নেস্ট ম্যাকের পজিটিভিম দর্শন দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেলিন পরবর্তীকালে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসজিম’ গ্রন্থে ম্যাকের দর্শনকে ভাববাদী বলে সমালোচনা করেন।
Aenesidemus: এনিসিডেমাস (খ্রি. পূ. প্রথম শতক )
খ্রি. পূ. প্রথম শতকের গ্রিক দার্শনিক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাস সন্দেহবাদের সমর্থক ছিলেন। তিনি প্লেটোর একাডেমীর সদস্য ছিলেন। সন্দেহবাদের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাসকে তাঁর পূর্বগামী বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক পিরহোর (৩৬৫-২৭৫ খ্রি. পূ.) অনুসারী বলা যায়। এনিসিডেমাসের মতে কোনো কিছু সম্পর্কেই সন্দেহাতীত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, তর্কের ক্ষেত্রে যুক্তির অভাব ঘটে না। এক যুক্তি যাকে সত্য বলে দাবি করে, অপর যুক্তি তাকে অসত্য বলে প্রমাণ করতে পারে। কাজেই সত্য ও অসত্য নিয়ে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির লড়াই-এর চেয়ে শ্রেয় হচ্ছে মনের শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা। যুক্তির লড়াই মনের শান্ত অভিমতকে বিনষ্ট করে। সত্যাসত্যের লড়াই ছাড়াই মানুষ জীবনযাপন করে। ‘অন্য সবাই যেমন চলে আমারও তেমনি চলাই কর্তব্য।’ সাধারণের মত গ্রহণ করা এবং অপরিহার্য বিশ্বাস করাই জীবনে শান্তিলাভের প্রকৃষ্টতম পথ। এনিসিডেমাসের পরবর্তীকালে খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় শতকে সেক্সটাস এমপিকাস-রচিত ‘দেবতায় বিশ্বাসে বিপক্ষ-যুক্তি’ নামক গ্রন্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে কেবলমাত্র তাঁর রচনাই পাওয়া যায়। উপরোক্ত গ্রন্থের একস্থানে দার্শনিক সেক্সটাস এমপিরিকাস সন্দেহবাদী দর্শনকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আমরা সন্দেহবাদীরা জগতের প্রচলিত কিছু অমান্য করি না। কিন্তু প্রচলিত আচার-আচরণ তত্ত্বকে আমরা বিশ্বাসও করি না। বাস্তবে যা ঘটছে সে সম্পর্কে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বীকার কিংবা অস্বীকারের প্রশ্ন অবান্তর। দেবতাদের সবাই বিশ্বাস করে; তাদের নানা উপঢৌকন দেয়। মানুষ দেবতাদের উদ্দেশে নানা আচার-আচরণ করে। সে সমস্ত আচার আমরাও পালন করি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসে-কিংবা অবিশ্বাসী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে জোর করে কিছু বলার পক্ষপাতী আমরা নই।’ (বার্ট্রাণ্ড রাসেল হিস্টরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি-২৬২ পৃষ্ঠা)
এই ব্যাখ্যায় প্রাচীন সন্দেহবাদের একটি পরিচয় পাওয়া যায়। এনিসিডিমাসের দর্শন তৎকালীন গ্রিক সামাজিক অবস্থারও পরিচয়বাহক। গ্রিসের সমাজ-ব্যবস্থার পূর্বকার শক্তি ও সমৃদ্ধি তখন বিনষ্ট। সমাজ জীবনে অস্থিরতা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লেটো-এ্যারিস্টটলের দর্শন প্রতিপত্তি হারিয়েছে। এমন সামাজিক ও চিন্তাগত পরিবেশে গ্রিক সন্দেহবাদের উদ্ভব ঘটে।
জ্ঞানের বিপক্ষে এনসিডিডেমাস দশটি যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন বলে অনেকে ধারণা। যুক্তিগুলি এরূপ: (১) মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে ইন্দ্রিয় এবং অনুভূতি। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের বিচার এবং অনুভূতির সিদ্ধান্ত একরূপ হয় না। (২) ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দৈহিক এবং মানসিক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্যের কারণে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জ্ঞান পৃথক হয়। (৩) ব্যক্তির বিভিন্ন ইন্দ্রিয় একই বিষয় সম্পর্কে পরস্পর পৃথক ধারণা সৃষ্টি করে। (৪) ব্যক্তির দৈহিক এবং মনাসিক অবস্থার উপর জ্ঞানের রূপ নির্ভরশীল। দৈহিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়। (৫) বস্তু সম্পর্কে ধারণা ব্যক্তির সঙ্গে দৃষ্ট বস্তুর দূরত্ব এবং অবস্থানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ হয়। (৬) কোনো বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞান কখনোই প্রত্যক্ষভাবে লাভ করা যায় না। জ্ঞান প্রতি ক্ষেত্রেই মাধ্যম-নির্ভর। (৭) বস্তুর বর্ণ, গুত, পরিমাণ, তাপ ইত্যাদি চরিত্র পরিবর্তিত হলে বস্তুর জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়ে যায়। (৮) বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর পরিচয়ের পরিমাণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলে বিষয় সম্পর্কে বিষয়ীর জ্ঞানও পৃথক রূপ লাভ করে। (৯) যাকে জ্ঞান বলা হয় তা আসলে ব্যক্তিবিশেষের অনুমান এবং অভিমত মাত্র। (১০) বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরূপ অভিমত এবং আচার-আচরণের প্রকাশ দেখা যায়।
এই দশটি যুক্তির প্রত্যেকটি মৌলিক নয়। একটি ক্ষেত্রের যুক্তি ভিন্নতর প্রকাশে অপর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞানের নিশ্চয়তার বিপক্ষে এনিসিডেমাসের যুক্তিসমূহের মূল কথা হচ্ছে এই যে, সত্যের কোনো অনন্য-নির্ভর অস্তিত্ব নাই। বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্নরূপে একই সত্য প্রতিভাত হয়; ফলে কোনো সত্য সঠিক তা জানা সম্ভব নয়। জ্ঞানের অপরিহার্য মাধ্যম হচ্ছে ব্যক্তি। কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণা ব্যক্তির বিশেষ অবস্থা ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্পর্কেও এনিসিডেমাস অস্বীকার করেন। দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদী দর্শনের যে প্রকাশ দেখা যায়, তার যুক্তি মূলত এনিসিডেমাস দার্শনিকের যুক্তিরই অনুরূপ।
Aesthetics: সৌন্দর্যতত্ত্ব
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি, শিপ্লকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যাকে সাধারণত অন্তর্ভূক্ত মনে করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে নীতিশাস্ত্রেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে সমাজ-সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনে সৌন্দর্যতত্ত্বের ভূমিকা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে সৌন্দর্যানুভুতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আদিম অনুভূতি বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির মোকাবেলায় আদিমকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। এরুপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো কোনোটি মানুষের মনের আবেগময় প্রতিক্রিয়া। এই আবেগময় প্রতিক্রিয়ার মূলে মানুষের জীবন রক্ষার অচেতন জৈবিক প্রয়োজনই আদিকালে সমধিক কাজ করেছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা এবং শক্তির প্রকাশকে আপন জীবন রক্ষার সহায়ক কিংবা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্ত শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মনে জাগরূক রাখার সে চেষ্টা করেছে। এই আদিম বোধ থেকেই আদি শিল্পকার্যের সৃষ্টি। এই উৎস থেকে সামাজিক ভালোমন্দ বোধেরও উৎপত্তি।
মানুষের নিজের জীবনের মতোই সৌন্দর্যানুভূতির ইতিহাস দীর্ঘ। সভ্যতার জটিল বিকাশের ধারায় সৌন্দর্যতত্ত্বকেও প্রাথমিক যুগে সহজ এবং আধুনিককালে জটিল এবং অবাস্তবের লক্ষণযুক্ত দেখা যায়।
কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনের আবেগময় অনুভূতি এবং তার ভাষাগত প্রকাশ ব্যতীত শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত এবং অন্যান্য মানবিক সৃষ্টিকে সুন্দর কিংবা অসুন্দর এবং ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে বিচারের প্রয়াসকে সৌন্দর্যতত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্ব বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশেষ কোনো তত্ত্বকে বুঝায় না। এর দ্বারা উপরোক্ত বিষয়গুলির উপরে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ভাবধারার কথা বুঝায়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সামগ্রকি আলোচনায় সুন্দর এবং অসুন্দরের অথবা ভালৌ এবং মন্দের কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা মানদণ্ড আছে কিনা সে প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করা হয়।
সৌন্দর্য়তত্ত্বের উদ্ভব প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলন, মিসর, ভারতবর্ষ এবং চীনের দাস-প্রধান সমাজে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে গ্রিসের হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিসস্টটল এবং অপরাপর দার্শনিকের রচনায় সৌন্দর্যতত্ত্বের জটিলতর বিকাশের আমরা সাক্ষাৎ পাই। প্রাচীন রোমের দার্শনিক লুক্রেশিয়াস এবং হোরেসও সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। মধ্যযুগে সেণ্ট অগাস্টিন এবং টমাস একুইনাস প্রমুখ ধর্মতাত্ত্বিকগণ সৌন্দর্যতত্ত্বে রহস্যবাদের আমদানি করেন। তাঁদের মতে, জগতাতীত এক ঐশ্বরিক সুন্দরের অস্তিত্ব রয়েছে। সেই ঐশ্বরিক সুন্দরের মানদণ্ডেই জাগতিক বস্তুনিচয়ের সৌন্দর্য পরিমাপ করতে হবে। মধ্যযুগের এই রহস্যবাদের প্রতিক্রিয়া ঘটে পরবর্তীকালে নব-জাগরণের চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকগণের মধ্যে। এঁদের মধ্যে পেতরার্ক, আলবার্ট, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, দুরার,ব্রুনো এবং মণ্টেনের নাম বিখ্যাত। পাশ্চাত্যের নব-জাগরণের পরবর্তী জ্ঞানাস্বেষণের যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে বার্ক, হোগার্ত, ডিডেরক, রুশো, লেসিং প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। মানবতাবাদের এই ঐতিহ্যকে বহন করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে শিলার এবং গ্যেটে ঘোষণা করেন যে, সৌন্দর্য এবং শিল্পের উৎস হলো মানুষ এবং তার বাস্ত জীবন।
সৌন্দর্যতত্ত্বের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। সৌন্দর্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সৌন্দর্যতত্ত্বে তিনটি প্রশ্ন মূল (১) বস্তুজগতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বিকাশ; (২) মনোজগতে সৌন্দর্যানুভূতির ব্যাখ্যা, এবং (৩) শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের প্রবহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ধারাতে ক্রমাধিক পরিমাণে আনন্দজনক জীবনযাপনের তাগিদে সুন্দর, অসুন্দর, মহৎ, হীন, হর্ষ এবং বিষাদ প্রভৃতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাপকতার দিক থেকে সৌন্দর্যতত্ত্ব কেবল শিল্পকলার সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে না। শিল্পকলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি প্রয়োগগত দিক মাত্র। ব্যাপকভাবে সৌন্দর্যতত্ত্বের আলোচ্য হচ্ছে মানুষ। তার সৃজনশীল ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশে, মহতের জন্য জীবন উৎসর্গে, দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে যে আনন্দানুভূতি সে বোধ করে কিংবা বর্বরতার আঘাতে যে ঘৃণা তার মনে উদ্ভূত হয়, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্য।
Agent Provocateur: প্ররোচক, উস্কানিদাতা, দালাল
রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ অনেক সময়ে নিজ পক্ষীয় লোককে অন্য পক্ষের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের সমর্থকের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। এরূপ কৌশলের প্রধান উদ্দেশ্য হয় ছদ্মবেশী সমর্থক দ্বারা এমন কোনো ঘটনার সৃষ্টি করা যার ফলে উক্ত পক্ষের কোনো মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ এরূপ লোকের সন্ধান পলে তাকে প্ররোচক, উস্কানিদাতা বা দালাল বলে অভিহিত করে। ইংরেজি ‘এজেণ্ট প্রভোকেচার’ কথাটির মূল ফরাসি। এর অর্থ উস্কানিদাতা বা প্ররোচক। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, কোনো রাজনীতিক দল নিজের ব্যর্থতার দ্বায়িত্ব কল্পিত ‘প্ররোচকের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। শূধু প্রতিদ্বন্দ্বী দল নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক রাষ্ট্র কর্তৃক আর এক রাষ্ট্রকে আক্রমণের অজুহাতে সৃষ্টির জন্য প্ররোচক দ্বারা মারাত্মক ঘটনা ঘটাবার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
Agnosticism : অজ্ঞেয়বাদ
সাধারণভাবে অজ্ঞেয়বাদ বলতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জগৎ বা বিশ্বকে জানার অক্ষমতা বুঝায়। এদিক থেকে সন্দেহবাদ বা সংশয়বাদের সঙ্গে অজ্ঞেয়বাদের সাদৃশ্য আছে। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদ কথাটি সংশয়বাদের মত প্রাচীন নয়। অজ্ঞেয়বাদের ইংরেজি শব্দ এ্যাগনসটিসিজম-এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ বৈজ্ঞানিক টমাস হাক্সলীর রচনায়। ধর্মের ক্ষেত্রে বিধাতার অস্তিত্তকে জানা সম্ভব কি অসম্ভবের প্রশ্নে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব। উনিশ শতকে ধর্মের বিতকেৃ এরূপ একটা অভিমতের প্রকাশ দেখা যায় যে, জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাতে বিশ্বরাচরের কোনো বিধাতা আছে কিংবা নাই এরূপ কোনো সিদ্ধান্তে পৌছানই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেরূপ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্থ হচ্ছে মানুষ যে সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না, সেই সীমাকে অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি করা।
অজ্ঞেয়বাদের এই যুক্তি প্রধানত অষ্টাদশ শতকের কাণ্টীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করেই করা হয়। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদের শুরু হয় ইংরেজি দার্শনিক হিউমের মধ্যে। হিউম জ্ঞান সম্পর্কে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘এ্যান এনকোয়ারি কনসারনিং হিউম্যান আনডারস্ট্যাণ্ডিং’ নামে একখানি পুস্তক রচনা করেন। তাঁর এই গ্রন্থে প্রধানত তাঁর পূর্বগামী ভাববাদী ধারণার জবাব হলেও তাঁর যুক্তির মারফত, মানুষের আদৌ কোনো জ্ঞান সম্ভব কিনা, সে মৌলিক প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে জার্মান দার্শনিক কাণ্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাববাদকে হিউমের মৌলিক আঘাত থেকে রক্ষা করাই জন্যই তার ‘নু মেনা’ বা মূল সত্তা হিসাবে বস্তুকে জানার অসম্ভবতার তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর মতে মূল সত্তা হিসাবে বস্তুর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষ নিজের জ্ঞানসূত্র বা কাণ্টেগরি ব্যতিত কোনো কিছুর জ্ঞানই লাভ করতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানসূত্র মারফত দৈনন্দিন-দৃষ্ট বস্তুকেই মাত্র জানা যায়। অ-দৃষ্ট মূল বস্তুসত্তাকে জানা যায় না। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ ধর্মের ক্ষেত্রে কাণ্টের যুক্তি প্রয়োগ করে বিধাতাকে স্বীকার-অস্বীকারের বাইরে রেখে দেবার প্রয়াস পায়। ঊনবিংশ শতকে দর্শনের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব বৃহত্তর বাস্তব জীবনে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে-পুঁজিবাদ-বিরোধ শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ-বিরোধী শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং সামাজিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের শক্তিকে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত করে তুলছিল, তত বেশি ধর্ম এবং দর্শনের রাজ্যে ভাববাদের নতুনতর যুক্তি আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। এমন পরিস্থতিতে কাণ্ট যেমন দর্শনের ক্ষেত্রে জটিল যুক্তিজালে ভাববাদকে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছেন, তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদ বিধাতার অস্তিত্বকে জ্ঞানের বাইরে রেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ পরিণামে কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি। অজ্ঞেয়বাদীদের মতে কেবল যে, বিশ্ব-বিধাতাই অজ্ঞেয়, তাই নয়। মানুষের কাছে প্রাকৃতিক বিধান, সমাজের বিকাশের ধারা-সবই অজ্ঞেয়। তাই তাঁদের মতে বিজ্ঞান যে বিশ্বজগতের কোনো নির্দিষ্ট জ্ঞান আমাদের দিতে পারে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অজ্ঞেয়বাদকে অসার বলে অভিহিত করে। আধুনিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তাদের অন্যত্তম হচ্ছেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ্যাণ্টিডুরিং’-এ অজ্ঞেয়তাবাদকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে বস্তুকে মানুষ আদৌ জানতে পারে কিনা, এ প্রশ্ন নিয়ে মানুষের মাথা ঘামাবার দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ মানুষ বস্তুকে কেবল তাত্ত্বিকভাবেই জানছে না। বাস্তবভাবে সে বস্তুকে স্পর্শ করছে, বিশ্লেষণ করছে, তার অন্তর্নিহিত বিধি-বিধানকে জানছে এবং জ্ঞাত সেই বিধানকে প্রয়োগ করে বস্তুকে সে নতুনভাবে গঠনও করছে। এর পরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের অবকাশ থাকে না বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অভিমত পোষণ করে।
Agrippa: আগারিপা (খ্রি. দ্বিতীয় শতক )
খ্রিষ্টাব্দের আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের রোমান সংশয়বাদী দার্শনিক। কেউ কেউ আগরিপাকে গ্রিক দার্শনিক বলেও মনে করেন। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে আগরিপা অবশ্যই বিশিষ্ট ছিলেন। কারণ প্রাচীন যুগে ‘আগরিপা’ নামে একখানা পুস্তক রচিত হওয়ার কথা জানা যায়।
আগরিপা জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ‘পঞ্চ’ যুক্তির জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। সংশয়বাদী এনিসিডেমাসের সমস্যা ছিলো দশটি। আগরিপার সমস্যার মূলগতভাবে এনিসিডেমাসের সমস্যা থেকে পৃথক না হলেও আগরিপার সমস্যার ব্যাপকতা এনিসিডেমাসের চাইতে অধিক। জ্ঞানের কোনো নিশ্চয়তা নাই-এ অভিমত আগরিপা তাঁর পঞ্চযুক্তির মারফত যত জোরালোভাবে উপস্থিত করেছিলেন, প্রাচীন দর্শনে সেরূপ জোরালো অভিমত অপর কোনো সংশয়বাদী উপস্থিত করেন নি।
জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রমাণস্বরূপ আগরিপার পঞ্চযুক্তি নিন্মরূপ:
প্রথম যুক্তি পরস্পর-বিরোধীতা। বস্তুজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পরস্পর-বিরোধী। সাধারণ মানুষ এবং দার্শনিক এরা কেউ জ্ঞানের মাধ্যম সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেন না। কোনো পক্ষের মতে ইন্দ্রীয়দত্ত জ্ঞানই জ্ঞান। আবার অপর কোনোপক্ষ এরূপ অভিমত পোষণ করে যে ইন্দ্রীয় এবং অনুভূতি উভয়ের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান লাভ করি। পরস্পর-বিরোধী এই অভিমতের কোনো মীমাংসা নাই। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় যুক্তি বিরামহীন পশ্চাদ্ধবনের যুক্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমরা একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভর করি। একটি বিশেষ অনুমানের ক্ষেত্রে দত্ত সত্যকে সঠিক বলে ধারণা করি। কিন্তু সঠিক বলে গৃহীত সত্যেরও প্রমাণের আবশ্যক। সেরূপ প্রমাণের জন্য অপর একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উল্লেখ করি। কিন্তু এর প্রমাণের জন্য অপর আর একটি সত্যের আমরা বরাত দেই। বরাতের পরে এই বরাতের এই ধারা বিরামহীন। ফলে চুড়ান্তরূপে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছান আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বতঃসিদ্ধের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। যাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করা হয়, তা যে স্বতঃসিদ্ধ-তারও প্রমাণ আবশ্যক। কিন্তু প্রমাণ শুরু করলেই আমরা বিরামহীন বরাতের অন্তহীন পশ্চাদ্ধাবনের পক্রিয়ায় জড়িত হয়ে পড়ি। ফলত জ্ঞান এ-ক্ষেত্রে অসম্ভব।
তৃতীয় যুক্তি: আপেক্ষিকতা। বিষয়ী বা যে জানে তার সঙ্গে বিষয় বা জানা হয় তার সম্পর্ক অর্থ্যাৎ বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর সম্পর্ক জ্ঞানকে গঠিত করে। ফলে এই সম্পর্ক-বহির্ভূত অবস্থায় জ্ঞাত বিষয়ের চরিত্র কি তার জ্ঞানলাভ আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
চতুর্থ চুক্তি: হাইপথেসিস বা প্রকল্প। কোনো সিদ্ধান্তের জন্য সিদ্ধান্তের চেয়ে অধিকতর ব্যাপর একটি বিবৃতিকে আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি। একে আমার হাইপথেসিস বা প্রকল্প বলি। গৃহীত সিদ্ধান্তের সত্যাসত্যকে আমরা স্বীকৃত প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গতি-অসঙ্গতির ভিত্তিতে প্রমাণ করি। কিন্তু সে প্রকল্পের ভিত্তিতে আমরা একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করি, সেই প্রকল্পের প্রমাণের কোনো প্রশ্ন আমরা উত্থাপন করি নে; ফলে অপ্রমাণিতের ভিত্তিতে প্রমাণের অসঙ্গতি সৃষ্ট হয়।
পঞ্চম যুক্তি: চক্রাবর্তের সমস্যা। অনেক ক্ষত্রে স্বীকৃত প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য আমরা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করি। এতে সিদ্ধান্তের প্রমাণের জন্য প্রতিজ্ঞা এবং প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করার চক্রাবর্তের সৃষ্টি হয়; ফলে কোনোটি সম্পর্কেই আমরা কোনো জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম হই ন। চক্রাবর্তের দৃষ্টান্ত হিসাবে এই যুক্তিটির উল্লেখ করা যায়: মানুষ মরণশীল। সক্রেটিস একজন ভালো মানুষ। সুতরাং সক্রেটিস মরণশীল। পুনরায় সক্রেটিস মরণশীল। সক্রেটিস একজন মানুষ। সুতরাং সকল মানুষ মরণশীল।
আগারিপার পঞ্চযুক্তির সবগুলো হয়তো তাঁর নিজের মৌলিক কোনো উপস্থাপনা নয়। আগারিপার পূর্বগামী সংশয়বাদী দার্শনিকগণ নানাভাবে জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আগরিপার বেশিষ্ট্য এই যে, তিনি জ্ঞানের প্রশ্ন সংশয়কে যেরূপ স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, এরূপ সুনির্দিষ্ট প্রকাশ প্রাচীন সংশয়বাদের ইতিহাসে অপর কোনো দার্শনিকের মধ্যে দেখা যায় না।
Aggression: অন্যায় আক্রমণ, আগ্রাসন
একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর বিনা কারণে সশস্ত্র আঘাত হানলে তাকে আক্রমণ বা আগ্রসন বলা হয়। অন্যায় আক্রমণ কথাটির অর্থ সহজ হলেও যুদ্ধমান পক্ষের কেউই আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করতে চায় না। পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণকারী বলে অভিযুক্ত করে। একমাত্র নিরপেক্ষ কারুর পক্ষে বলা সম্ভব যে, এমন ক্ষেত্রে আক্রমণকারী কে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে তখন আর কেউ নিরপেক্ষ থাকে না। কেবল বিশ্বযুদ্ধ নয়। আধুনিক আন্তর্জাতিক জটিল রাজনীতিতেও নিরপেক্ষ কোনো রাষ্ট্র আছে, একথা বলা কঠিন। কোনো অবস্থায় কোনো কার্য আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে এর কোনো সংজ্ঞা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রেও গৃহীত হয় নি। ১৯৩৩ সালে আক্রমণের সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য আফগানিস্তান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ইরান. পোলাণ্ড, রুমানিয়া, তুরস্ক এবং রাশিয়া এই আটটি দেশের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে (ক) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (খ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যাতিরেকে আক্রমণ (গ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত অপর রাষ্ট্রের ভূখণ্ড, নৌযান বা বিমানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ (ঘ) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৌঅবরোধ সৃষ্টি এবং (ঙ) প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের বিদ্রোহত্মক কোনো সশস্ত্র বাহিনীকে আশ্রয় দান কিংবা তাকে সশস্ত্রভাবে সজ্জিত করতে সাহায্য করা এবং প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের দাবি সত্ত্বেও এরূপ বাহিনীকে বহিষ্কার করে দিতে অস্বীকার করাকে একের বিরুদ্ধে অপরের আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে।
Ajivika: আজীবিক
শব্দগত অর্থ আজীব আ +জীব+অ জীবনসাধন, জীবনোপায় জীবিকা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতাব্দিতে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের প্রচারের সমকালে ‘আজীবিক’ নামক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গোশাল’ বলে এক ব্যক্তি। গোশালে জন্ম বলেই তাঁর নাম গোশাল হয়েছিল এরূপ অনেকে মনে করেন। জীবন, ধর্ম, দেহ, আত্মা, বিশ্ব ইত্যাদি সমস্যা সম্পর্কে আজীবিক সম্প্রদায়ের অভিমত আজীবিকবাদ বলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে আখ্যাত হয়েছে।
প্রাচীণ ভারতীয় দর্শনে আজীবিকদের তত্ত্বের একটি গুরুত্ব আছে। এঁরা জীরন ও জগতের ব্যাখ্যায় আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এঁদেরকে অনুবাদী বলেও আখ্যঅয়িত করা হয়। আজীবিকদের মতে, বস্তু জগতের মূলে রয়েছে চারটি মৌলিক অণু, যথা- মৃত্তিকা, পানি, অগ্নি এবং বায়ু। জগতের যা কিছু সৃষ্টি তার এই চারটি মূল অণুর সম্মেলনেই গঠিত হয়। জীবন নিজে অণু নয়। জীবন এমন একটি শক্তি যার অণুর সম্মেলনকে অনুধাবন করতে সক্ষম। সৃষ্টির মৌলিক পদার্থ অণু শাশ্বত। অণুর বিভাজন নেই। অণু সৃষ্টির মূলে। কিন্তু নিজে সৃষ্ট নয়। অণুর ধ্বংসও সম্ভব নয়। মৌলিক অণুগুলি গতি নয়। এক অণু অন্য অণুতে রূপান্তরিত হতে পারে না। কিন্তু যে কোনো অণু যে কোনো অভিমুখে গতিশীল হতে পারে। বস্তুর যে গুণ তা একটি বিশেষ বস্তুর অণুর সংখ্যা এবং সম্মেলন প্রকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হয়। জীবন ও জগতের এই বিশ্লষেণ তেকে বুঝা যায়, আজীবিকগণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী মত পোষণ করতেন। সম্ভবত ইতিহাসে এঁরাই প্রথম অনুবাদী। আজীবিকদের অনুবাদী মতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস (খ্রি. পূ. ৪৬০-৩৭০) এবং এপিক্যুরাস (খ্রি. পূ. ৩৪১-২৭০) এর অনুবাদী তত্ত্বের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আজীবিকদের প্রতিষ্ঠাতা গোশাল সম্পর্কে এরূপ কথিত আছে যে, তিনি জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গোশাল জৈনধর্মের জন্মের প্রকারভেদ অস্বীকার করেন। তাঁর মতে জীবন মাত্রই, নিয়তির বন্ধনে আবদ্ধ। জন্মের কোনো প্রকারভেদ বা জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে, এ কথা গোশাল মানতেন না। গোশালের মতে জন্মান্তরের দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব কোনো সড়কেই জীবনের দুঃখ বা কর্মের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তির উপায় নেই। মানুষের জীবনের পথ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। কোনো সাধনা বা আচরণই জীবনের সেই নির্ধারিত পথকে পরিবর্তিত করতে পারে না।
গোশাল এবং আজীবিকগণ জীবনোপায় বা জীবনাচরণে সাধারণের ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা দিগম্বর থাকতেন এবং একটি দণ্ড হাতে চলতেন। এজন্য এঁদের ‘দণ্ডী’ও বলা হতো। এঁরা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু ভিক্ষা করেও প্রয়োজনের অধিক জমাতেন না।
সম্রাট অশোকের শাসনকাল ছিল খ্রি. পূ. ২৭৪-২৩২ সন। সম্রাট অশোকের নানা অনুশাসন প্রস্তর খণ্ডে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এরূপ একটি প্রস্তরলিপিতে আজীবিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ দেখা যায়। এই লিপিতে বলা হয়েছে যে, সম্রাটের এরূপ কর্মচারী বা মহামাত্রও নিযুক্ত রয়েছে যাদের দ্বায়িত্ব হচ্ছে আজীবিকদের বিষয়ে তত্ত্বাবধান করা।
Al-Farabi: আল – ফারাবী (৮৭৩-৯৫০ খ্রি.)
আল –ফারাবীর সম্পুর্ণ নাম হচ্ছে আবু নসর মুহাম্মদ আল -ফারাবী। দর্শনের ইতিহাসে ইনি আল –ফারাবী নামেই সুবিখ্যাত। ইসলামি দর্শনে আল –ফারাবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনি বলে মনে করা হয়। মুসলিম দার্শনিকগন মনে করতেন, আল –ফারাবীর শ্রেষ্ঠ যদি কেউ থাকেন তিনি হচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দী আল -ফারাবীকে নিঃসন্দেহে ইবনে সীনা এবং ইবনে রুশদ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছেন।
ক্রিষ্টাব্দের নবম এবং দশম শতকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে বাগদাদে গ্রিক দর্শনের বিশেষ চর্চা হতো। এই সময়ে গ্রিসের প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের রচনাবলীর আরবি অনুবাদ হতে থাকে। আল –ফারাবী প্রধানত শিক্ষালাভ করেন বাগদাদের এ্যারিস্টটল-এর দর্শন শিক্ষাদানকারী খ্রিষ্টান বিদ্যাকেন্দ্রে। প্লেটোর দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যাদাতা প্লাটিনাস-এর ব্যাখ্যার প্রভাবও আল –ফারাবীকে এত প্রভাবিত করেছিল যে, উপরোক্ত দর্শনের এই দুই স্তম্ভ আল –ফারাবী কাউকে বর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে আল –ফারাবী প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের সামঞ্জস্যের বিষয়ে একখানি পুস্তক রচনা করেন। আল –ফারাবী শিক্ষাগত জীবনে কেবল দর্শনের চর্চা করেন নি। তিনি সে-যুগের জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সঙ্গীতের বিচিত্র শাখাতে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
আল –ফারাবী প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এবং ‘লজ’ বা ‘বিধান’-এর উপর নিজের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। আল –ফারাবীর সমধিক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘উত্তম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভ্রান্তি সম্পর্কিত গ্রন্থ’। এ গ্রন্থ আদর্শ নগর বা ‘মদিনাল ফাজিলা’ বলেও আখ্যাত। গ্রন্থের নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায়, প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল -ফারাবীও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল -ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল –ফারাবী যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন। আল –ফারাবী কোনো চরম মত পোষণ করেন নি। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি পরস্পর-বিরোধী ধারাকে এক সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। এই আপসের প্রমাণ যেমন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে, তেমনি বিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। আল –ফারাবী একদিকে মনে করেছেন যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা; আর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর প্রকাশ। অপর দিকে আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করেও সৃষ্টি বা বিশ্বকে শাশ্বত বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। বিশ্বকে শাশ্বত মনে করার মধ্যে বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানকে স্বীকারের প্রবণতা আল –ফারাবীর চরিত্রে দেখা যায়। এদিক থেকে সে-যুগে তিনি প্রগতিশীল চিন্তাবিদের স্বাক্ষর রেখেছেন, একথা বলা যায়। ধর্মের ন্যায় তাঁর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের প্রকাশ ছিল। আল –ফারাবীর মতে রাষ্ট্রের রইস বা প্রধান থাকবে সবার উপরে। অপর সকলে তার বাধ্য হবে। সে নিজে কারু বাধ্য হবে না। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্র স্তরভেদ থাকবে। এক স্তর তার উপরের স্তরের আদেশ মান্য করবে। এবং অধঃস্তরের উপর আদেশ জারি করবে। অধঃতম স্তরের নাগরিক কেবল হুকুম মান্যই করবে অপর কাউকে সে হুকুম দিবে না। কারণ হুকুম দেবার মতো তার নিচে অধঃতর কোনো স্তর থাকবে না। মুসলিম সভ্যতার অর্থনীতিক বিকাশের তৎকালীন যুগে একনায়কতন্ত্রের এই ধারণা গোত্রতান্ত্রিক বহুধাবিভক্ত সামন্তবাদী সমাজকে এককেন্দ্রিক বৃহত্তর রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে সংহত করার অনুকূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। যুগের প্রেক্ষিতে এরূপ ভাবধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। চরম সত্য বা স্রষ্টার ব্যাখ্যায় আল –ফারাবী যেমন প্লেটোর ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন, মনোজগতের বিশ্লেষণে তেমনি তিনি এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যাকেই অধিকতর স্বীকার করেছেন।
আল –ফারাবীর রচনাসমূহ জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।
Alberuni: আলবেরুণী (৯৭৩-১০৫০ খ্রি.)
পৃথিবীরঅন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং জ্ঞানসাধক। জন্ম মদ্য এশিয়ার (রাশিয়ার) খোরেজাম বা খারিজমের খিবায় ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১০৪৮ কিংবা ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
‘আলবেরুণী’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। আসল নাম আবু রায়হান মুহম্মদ বনি আহমদ । তাঁর সমসাময়িকদের মধ্য ছিলেন বোখারার বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা (৮৯০-১০৩৭ খ্রি.)। জন্মসূত্রে আলবেরুণী পারসিক এবং শিয়া ছিলেন। ‘তাঁর সমালোচনার ক্ষমতা, সহনশীলতা, সত্যানুরাগ এবং মানসিক সাহস মধ্যযুগে অতুলনীয় ছিল। তিনি আরবি ভাষায় ভূগোল, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।’ গবেষকগণ তাঁর রচনার সংখ্যাকে বিপুল বলে অনুমান করেন। “১০৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক বন্ধুর জিজ্ঞাসার জবাবে লেখা আল-বেরুণীর একটি চিঠির নকল পাওয়া গেছে যাতে তিনি তখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত পুস্তক-পুস্তিকার একটি ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। তালিকা মতে ১৩৮ টি পুস্তকের নাম আছে। এ তালিকা তৈরির পরেও তিনি প্রায় সতের বৎসর জীবিত ছিলেন। পরবর্তী সতের বৎসর ধরে তিনি আরো যেসব বই লিখেছিলেন তা ধরলে এবং অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব বই-এর নাম পাওয়া যায় সেসব মিলিয়ে বর্তমান পণ্ডিতরা আলবেরুণীর রচিত ১৮০ টি পুস্তকের নাম পেয়েছেন। আলবেরুণীর গ্রন্থাবলী ১২ শতক থেকে ইউরোপে যতটা আদৃত হয়েছে, প্রাচ্যে ততটা হয় নি।”
বাংলাদেশে সাহিত্যিক সত্যেন সনে আলবেরুণীর ভারত আগমন এবং তাঁর জ্ঞান সাধনাকে ভিত্তি করে ‘আলবেরুণী’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন (১৯৬৯)। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের অতুলনীয় উপাদান হিসাবে আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পৃথিবীতে আজ সুপরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ঐতিহাসিক আবু মহামেদ হবিল্লাহ আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থটি মূল আরবি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন (১৯৭৪)।
আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের মূল আরবি নাম ‘কিতাব কি তাহকিক মালিল হিন্দ মাকুলাত মাকবুলাত কি আল আকল উমর যুলাত।’ বাংলঅ গদ্যে এর মানে : বুদ্ধি বিচারে যা গ্রহনযোগ্য আর যা গ্রহনযোগ্য নয়, হিন্দুদের সব রকম চিন্তা পদ্ধতির সঠিক বর্ণনা।
Book on an accurate description of all catagories of Hindu thought, those which are admissible to reason as well as those which are not. এডওয়ার্ড জাকাউ (Edward Zachau) কর্তৃক সম্পাদিত মূল আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে লণ্ডন থেকে। Alberuni’s India- এই নামে দুখণ্ডে এর ইংরেজি অনুবাদ এডওয়ার্ড জাকাউ প্রকাশ করেন ১৮৮৮। কিতাবুল হিন্দ নামেও আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পরিচিত।
গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে তার উত্তর পশ্চিম দখল করছিলেন (১০২২ খ্রি.)। সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়ার ক্ষূদ্র খারিজাম রাষ্ট্রও জয় করেছিলন। খারিজাম জয় করে সেখানকার গণ্যমান্য নাগরিক এবং জ্ঞানীদের তিনি তাঁর রাজ্য গজনীতে বন্দি করে এনেছিলেন (১০১৭ খ্রি.)। এই বন্দিদের মধ্যে খারিজামের আলবেরুণী ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক হয়তো আলবেরুণীই ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন। জ্ঞানসাধক আলবেরুণী তাঁর এই ভারত গমনকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সাক্ষাৎভাবে অধ্যয়নের বিরাট সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজের তথ্যাবলী গভীর অভিনিবেশ এবং আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আলবেরুণী ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনা সমাপ্ত করেন ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনী প্রত্যাবর্তন এবং সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পাঁচমাস পরে।
কিতাবুল হিন্দ্ বা ভারততত্ত্বে আলবেরুণী জটিল এবং বিচিত্র তত্ত্ব এবং তথ্য যেরূপ বিস্তারিতভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থিত করেছেন তা এক বিষ্ময়কর শক্তির ষ্মারক হিসাবে জ্ঞানের ইতিহাসে বিরাজ করছে। ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনার পূর্বে আলবেরুণী কপিলের সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শনসহ পৌলিশ সিদ্ধান্ত, ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত, বৃহৎসংহিতা, খণ্ডখাদ্যক, বরাহমিহিরের লঘুজাত কর্ম প্রভৃতি ছোটবড় ২২ টি ভারতীয় পুস্তক আরবিতে তর্জমা করেছিলেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ থেকে বুঝা যায়, তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তা ছাড়া ফার্সি, গ্রিক, হিব্রু এবং আরামিয় ভাষাতেও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। আলবেরুণীর মাতৃভাষা ছিল খোরেজামী বা প্রাচীন ইরানি ভাষার একটি আঞ্চলিক শাখা। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থ আরবি ভাষাতেই রচিত। কারণ তাঁর মাতৃভাষাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভাব প্রকাশের উপযোগী মনে করেন নি।
অধ্যাপক মহামেদ হবিবুল্লাহ বাংলা অনুবাদে দেখা যায় আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ প্রস্তাবনা ব্যতীত আশিটি অধ্যায়ে বিভক্ত। আলোচিত বিষয়ের আভাসদানের জন্যে কিছুসংখ্যক অধ্যায়ের শিরোনাম এখানে উল্লেখ করা গেল: ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস; ভাব এবং ইন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে হিন্দুদের ধারণা; কার্যকরণ- আত্মার সঙ্গে জড় পদার্থের সম্বন্ধ;সৃষ্ট জীবসমূহের শ্রেণীবিভাগ ও তাদের নাম; মূর্তি পূজার সূচনা ও বিগ্রহসমূহের বর্ণনা; হিন্দুদের ব্যকরণ ও ছন্দশাস্ত্র; ভারতীয় পরিমাণ বিজ্ঞান; ভারতীয়দের বর্ণমালা, বর্ণচিহ্ন ও অদ্ভুত রীতি; ভারতবর্ষের নদ-নদী; সমুদ্র নাগরাদির পারস্পারিক দূরুত্ব ও সীমানার সংক্ষিপ্ত বিবরণ; গ্রহ নক্ষত্রাদির নাম, চন্দ্রের কক্ষপথ ও অনুরূপ বিষয়; মেরু পর্বতের কথা; সমুদ্রে জোয়ার ভাটার পারস্পর; সূর্য-চন্দ্রের গ্রহণ; আদালতের মামলা মোকদ্দমা।
মোটকথা, এ এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এ গ্রন্থ দশম-একাদশ শতকের ভারতীয় জ্ঞান, সমাজ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের একটি পূর্ণ জ্ঞান কোষবিশেষ।
আলবেরুণী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের কাল নিরুপণের পদ্ধতি বিষয়ক ‘আসারূল বাকিয়া’; গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব কানুন আল মাসুদী কি হাইওআল নজুম’; ধাতুবিদ্যা বিষয়ক ‘কিতাবুল জামাহীর ফি মারেফাতুল জওয়াহীর’; চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক ‘কিতাব আল সায়দানা ফিল তিব্ব্’; এবং ভৌগলিক তথ্যমূলক গ্রন্থ ‘তাহদীদ ফি নেহায়াতুল আমাকিন’।
তাঁর রচনায় বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা আলবেরুনীর নিজের প্রস্তুত একটি তালিকার ভিত্তিতে নিন্মরূপ : জ্যোতিষ পদ্ধতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৮; বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক তথ্য, আয়তন , দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদি-১৫; গণিত পদ্ধতি-৮; সূর্যকিরণ ও ছায়ায় বৈজ্ঞানিক তথ্য-৪; জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি নির্মাণ বিষয়ে-৫; কাল ও সময় নির্ণয়-৫; জ্যোতিশাস্ত্রে শুভাশুভ ফলাফল নির্ণয়-১২; জ্যোতিষ গণনাবিধি-৭; উপন্যাস, কাব্য ও অতিপ্রাকৃত কিংবদন্তি বিষয়ক-১৩; ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ বিষয়ে -৬।
(দ্রষ্টব্য: আলবেরুণীর ভারততত্ব: আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ; আলবেরুণী: সত্যেন সেন।)

Al-Ghazali: আল –গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.)
আল গাজ্জালীর সম্পূর্ণ নাম ছিল আবু হামিদ মুহম্মদ আল –গাজ্জালী। খোরাসান বা ইরানের তুশের গাজলা গ্রামে জন্ম বলেই তিনি আল গাজ্জালী নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে আল –গাজ্জালী ইসলামের সর্বশ্রেষ্ট ব্যাখ্যাতা এবং রক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। আল –গাজ্জালীর দার্শনিক চিন্তাধারার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামকে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পরলোক, দোজখ ইত্যাদি কল্পলোক সম্পর্কে মানুষের মনে ভয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল। মুসলিম মুক্তবুদ্ধি মোতাজিলাদের দার্শনিক আলোচনা ও মতামতও মানুষের মনে বিশ্বাসের বদলে যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। অবস্থার এই বিকাশে আল –গাজ্জালী চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। মোতাজিলাবাদীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অধিকতর জোরালো যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পরাক্রমকে পরাস্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে আল –গাজ্জালী দর্শন চর্চা করেন। তারঁ এই লক্ষ্য অর্জনের চিন্তায় তিনি এত ব্যকুল হরেয় পড়েন যে, ৩৬ বছর বয়সে তিনি বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপনার পদ ত্যাগ করে সুফীজীবন যাপন করতে শুরু করেন। সুফী হয়ে তিনি মুসলিম জগতের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতার শেষে তিনি যুক্তির পথ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত করে ঘোষণা করেন যে, যুক্তির মাধ্যমে সত্যকার জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব-স্রষ্টার সন্ধান এবং বিশ্ব-রহস্য উদঘাটন কেবল অহি বা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমেই সম্ভব। এই সিদ্ধান্তে এসে তিনি ‘তাহফাতুল ফালাসিকা’ বা ‘দর্শনের ধ্বংস’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি শাশ্বত চরিত্র, বুদ্ধির শক্তি প্রভৃতি তত্ত্বের যাথার্থ্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রমাণের অসারতা প্রতিপন্নের চেষ্টা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, চরম সত্যের জ্ঞান প্রমাণ-ভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব নয়। আল –গাজ্জালী ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্বন্ধকেও অস্বীকার করেন। কোনো ঘটনাই অপর কোনো ঘটনার কারণ বা ফল নয়। দু’টি ঘটনার মধ্যে সমকালীনতা বা কালক্রম থাকতে পারে। অগ্নির সংঘটনের পরবর্তীকালেই কোনো দাহ্যবস্তুর দহনকে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু তাতে এমন প্রমাণিত হয় না যে, আগুন দাহ্যবস্তুর দহনের কারণ হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিম চিন্তার ক্ষেত্রে আসারীয় এবং মোতাজিলা নামে গোঁড়ামি এবং মুক্তবুদ্ধির যে দু’টি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আল –গাজ্জালী তার মধ্যে আসারীয় গোঁড়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বস্তুত যুক্তি এবং বুদ্ধিবাদের এরূপ শক্তিমান প্রতিপক্ষের সাক্ষাৎ খুব কমই মেলে। তাঁর চিন্তাধারা সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে প্রভূত পরিণামে সাহায্য করেছে বলেই ইতিহাসের বিশ্লেষণকারীগণ মনে করেন। এ জন্য আল –গাজ্জালীকে দার্শনিকের চেয়ে ধর্ম-রক্ষক হিসাবে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়। তৎকালীন ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের অস্থিরতা এবং জটিলতাই আল –গাজ্জালীর অভিমতকে আবশ্যকীয় করেছিল। ইউরোপেও পরবর্তীকালে জ্ঞান-বিরোধী সে সন্দেহবাদ এবং অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব দেখা যায় আল –গাজ্জালীর মাধ্যে তার পূর্বাভাস সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। বস্তুত আল -গাজ্জালীর দর্শনবিরোধী ভূমিকাই পাশ্চাত্যের সংশয়বাদী এবং অজ্ঞেয়বাদীদের চমৎকৃত করে। সাম্প্রদায়িক বিরোধের ক্ষেত্রেও আল –গাজ্জালী নিরপেক্ষ ছিলেন। আব্বাসীয় খলীফা আল –মোসতাজিরের আদেশে আল –গাজ্জালী শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। ইবনে রুশদ আল –গাজ্জালীর ‘দর্শনের ধ্বংস’ গ্রন্থের পাল্টা জবাব হিসাব ‘দর্শনের ধ্বংসের ধ্বংস’ নাম এককখানা গ্রন্থ লিখেছিলেন।
Aligrah Movement: আলীগড় আন্দোলন
১৮৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উচ্চবিত্ত এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার একটি ধারা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত লাভ করে। উত্তর ভারতের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত, ব্রিটিশ শাসনের কর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮) এই ধারার উদ্যোগী ব্যক্তি। সিপাহবিদ্রোহে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে ভারতবাসী, বিশেষ করে তার মুসলিম সম্প্রদায়ের যে বিদ্রোহাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল স্যার সৈয়দ আহমদ তাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করেন। তিনি মনে করেন মুসলমান সম্প্রদায়ের তথা তার উচ্চতর বিত্তবান অংশের উন্নতির উপায় ইংরেজি শিক্ষা বর্জন এবং ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতায় নয়। তাদের উন্নতির উপায় হচ্ছে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করা, তার মাধ্যমে পাশ্চাত্তের জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিচয় লাভ করা এবং ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলীগড়ে এ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি অনুবাদ সংস্থা তৈরি করে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানকে উর্দূ ভাষায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের সহযোগী হলেও ধর্ম এবং সামাজিক সমস্যার ব্যাখ্যা এবং অনুধাবনে তাঁর দৃষ্টি ছিল উদারতাবাদী এবং সংস্কারমূলক। কালক্রমে আলীগড় ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর তরুণদের নিকট জ্ঞানচর্চার অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতে থাকে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলীগড় গমন করেন এবং তাঁদের মধ্যে ভারতবর্ষের মুসলিম হিসাবে একটি ‘জাতিবোধের’ও সৃষ্টি হতে থাকে। এই আন্দোলন থেকে পরবর্তীকালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় (১৯২০)।
Al-Kindi: আল কিন্দী (৮০০-৮৭০ খ্রি.)
আবু ইউসুফ ইয়াকুব এবনে ইসহাক আল –কিন্দীর মৃত্যুকাল সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। ৮৭০ কিংবা ৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। বসরার মেসোপটেমিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে আল –কিন্দী জন্মগ্রহণ করেন। নবম শতাব্দীতে তিনি মুসলিম দার্শনিক, বিশেষ করে আরবি ভাষার দার্শনিকদের মধ্যে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। এই যুগে আরবি অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শনকে মুসলিম জগতে প্রচার করার যে ঐতিহাসিক চেষ্টা চলছিল তাতে আল –কিন্দীর ষ্মরণীয় আবদান রয়েছে। এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স বা তত্ত্বকথার আরবি অনুবাদের পরিকল্পনা আল –কিন্দী গ্রহণ করেছিলেন। আল –কিন্দীর রচনাবলীর খুব সামান্য অংশই রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে তার রচনাবলীর সংখ্যা প্রচুর। আল –কিন্দী এ্যারিস্টটলের অর্গানন-এর উপর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে আলোচনা করেছিলেন। অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকের ন্যায় আল –কিন্দী গ্রিক দর্শনের প্রধান দুই প্রবক্তা প্লেটো এবং এ্যারিসস্টলের ভাবধারায় বিরাটভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বস্তুত আল –কিন্দী প্লেটো, এ্যারিস্টটল এবং পাইথাগোরাস-তিনজন গ্রিক দার্শনিককেই সমধিক শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের মধ্যে তত্ত্বগত পার্থক্য এবং বিরোধ সত্ত্বেও আল –কিন্দী উক্ত গ্রিক চিন্তাবিদগণকে নিজের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।। আল –কিন্দী বিশ্ব-জগতের রহস্যোদঘাটনের জন্য কার্যকরণের বিধানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে বিশ্ব-চরাচরে কার্য-কারণের বিধান অমোঘ এবং সার্বিক। কার্য-করণের মাধ্যেমেই বিশ্বজগৎ আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। কার্য-করণের উপর এই জোর সত্ত্বেও আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে মনে করতেন যে, বুদ্ধিগত জ্ঞানের চেয়ে অহিগত জ্ঞান শ্রেয়। এতদ্ব্যতীত, যে সমস্ত মুসলিম দার্শনিক জগৎকে শাশ্বত বলেছেন এবং আল্লাহর ন্যায় শাশ্বত কাল থেকে জগৎ বিকশিত হয়ে আসছে বলে মনে করেছেন, তাঁদের মতের তিনি বিরোধিতা করেন। কাল-কিন্দীর মতে বিশ্বজগৎ শাশ্বত নয়। স্রষ্টা কোনো একদিন শূন্যাবস্থা থেকে বিশ্বকে সৃষ্টি করেছের। ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্বজগৎ বিধাতার হুকুমে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আল –কিন্দীর এ অভিমত মৌলিক নয়। ষষ্ঠ শতকের খ্রিষ্টান দার্শনিকগণ আলেকজান্দ্রিয়াতে এরূপ অভিমত পোষণ করতেন। আল -কিন্দী জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রকে একটি বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে পদার্থের ন্যায় নিরাময় প্রণালির ক্ষেত্রে আঙ্কিক অনুপাতের প্রয়োগ। ঔষধ প্রস্তুত প্রণালিতে অনুপাতের বিধান যে একটি গুরুত্তপূর্ণ বিধান, বাস্তবভাবে আল –কিন্দী তা পোমাণ করেন। আল্লাহকে আল –কিন্দী সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেছিলেন। বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে স্তরক্রমে তাঁর প্রতিচ্ছায়া পড়ে। এই স্তরক্রম্যের মধ্য দিয়ে আত্মা দেহের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে অমরতা প্রাপ্ত হয়। আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক বিরোধী অভিমত পোষণ না করলেও দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, অঙ্ক অর্থ্যাৎ জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় তাঁর আগ্রহ এবং অধ্যয়নের কারণে গোঁড়াপন্থী মুসলমানগণ আল -কিন্দীকে অবিশ্বাসী বিবেচনা করেন।
Alexander, Samuel: স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার (১৮৫৮-১৯৩৮)
স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার আধুনিককালের ব্রিটিশ দর্শনিকদের মধ্রে ‘নিওরিয়ারিস্ট’ বা নয়া বস্তুবাদী বলে পরিচিত। নয়া বস্তুবাদ প্রকৃত পক্ষে বস্তুবাদী দর্শনও নয়। ভাববাদের সে প্রকারবিশেষ। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের দার্শনিক অভিমতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তিনি স্থান এবং কালকে ভাব কিংবা জ্ঞানসূত্র না বলে মহাবিশ্বের মূল বস্তু মনে করেছেন। মহাবিশ্বের এই মৌলিক বস্তু অর্থ্যাৎ স্থান এবং কালকে তিনি আবার গতি হিসাবে চিন্তা করেছেন। তাঁর অভিমতটি মোটামুটি এরূপ যে, স্থান-কালের গতি কিংবা স্থানকালরূপ গতি থেকে অচিন্তনীয় জটিল পরিক্রমায় বস্তু, জীবন, মন, মূল্যবোধ, বিধাতার বাহক এবং বিধাতা-সমস্ত সত্তারই উদ্ভব হয়েছে। অচিন্তনীয় অধিকতর সত্তার উদ্ভব এই পরিক্রমায় হচ্চে এবং হবে। বিশ্বপুঞ্জের এই ব্যাখ্যায় বিবর্তনবাদের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তবে একে বিশিষ্ট করার জন্য স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার তাঁর বিবর্তনবাদকে ‘বিকাশমান বিবর্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নবতর সৃষ্টির আন্তপ্রেরণায় এই বিকাশমান বিবর্তন প্রবাহমান। স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের ইংরেজি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘স্পেস, টাইম এণ্ড ডিটি’ অর্থ্যাৎ স্থান, কাল এবং বিধাতা। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গিফোর্ড বক্তৃতাবলী হিসাবে প্রদত্ত এবং ১৯২০ সালে পুস্তকারের প্রকাশিত এই অভিমতের মাধ্যমে আলেকজাণ্ডার সুসংবদ্ধ আকারে তাঁর দর্শন প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি তাঁর পদ্ধতিকে অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা আখ্যা দেন। অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা বা এমপিরিক্যাল মেটাফিজিক্স বলতে তিনি বিজ্ঞানের সামগ্রিকতাকে যেমন বুঝাতে চান, তেমনি বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত বিজ্ঞান যে-সত্যে পৌছাতে পারে না, বিজ্ঞানোর্ধ্ব সেই সত্যের কথাও তিনি এর মারফত প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে মন এক দিক থেকে যেমন দেহ এবং দেহাভ্যস্তরের স্নায়ুমণ্ডলীর অতিরিক্ত কোনো সত্তা নয়, তেমনি অপরদিকে এ সত্তা বিকাশমান বিবর্তনের এক নতুন উদ্ভব। স্যামুয়েল আলেকজাণ্ডার তাঁর দর্শনে বিজ্ঞান এবং ধর্মের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় আলেকজাণ্ডারের দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান-বিরোধী অভিমতে পর্যবসিত হয়েছে। উপরোক্ত দার্শনিকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ‘আর্ট এ্যাণ্ড দি ম্যাটেরিয়াল’ (১৯২৫) এবং ‘বিউটি এ্যাণ্ড আদার ফরমস অব ভ্যালু (১৯৩৩)।
Alexandrian School of Philosophy: আলেক্সান্দ্রীয় দর্শন
গ্রিক সভ্যতার পতনের পর মিশরের আলেক্সান্দ্রীয়া শহর প্রায় হাজার বছর ধরে বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ পর্যন্ত বিস্তারিত কালকে উপরোক্ত কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ থেকে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে এর দার্শনিক চিন্তাধারার সমধিক বিকাশের যুগ বলা হয়। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ সে যুগের পাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের যোগসুত্র হিসাবে কাজ করেছেন। আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে দার্শনিক হিরোক্লিসের নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। হিরোক্লিসের জন্মকাল সম্ভবত ৪২০ খ্রিষ্টাব্দ। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ প্লেটোর দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্লেটোর দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা তাঁরা উপস্থিত করেছেন। হিরোক্লিসের দার্শনিক চিন্তায় প্লেটোর প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। সমস্ত অস্তিত্বের মূলে রয়েছে ‘ভাব’, এ অভিমত ছিল প্লেটোর। প্লেটোর ‘ভাব’-এর প্রতিফলন পাওয়া যায় হিরোক্লিসের ‘ডেমিয়ার্জ’ রূপ ধারণায়। হিরোক্লিসের মতে এউ ‘ডেমিয়ার্জ’ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি এবং সত্তার মূল। ‘ডেমিয়ার্জ’ আপন শক্তিতে শূন্যাবস্থা থেকে সমস্ত অস্তিত্বকে সৃষ্টি করে।
মূল’ডেমিয়ার্জ’ ক্ষুদ্রতর ডেমায়ার্জকে তার শক্তির বাহনরূপে ব্যবহার করে। এই বাহনদের মাধ্যমেই সকল অস্তিত্বের ভাগ্য ‘ডেমিয়ার্জ’ নিয়ন্ত্রিত করে। আরেক্সান্দ্রীয় দর্শনের ইতিহাসে হিপাসিয়া নামক একজন মহিলা দার্শনিকের নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এরূপ কথিত আছে যে, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী জনতা উক্ত হিপাসিয়াকে তাঁর চিন্তাধারার জন্য নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করে।
আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মের সঙ্গে দর্শনের মিলন ঘটাবার প্রয়াস। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের যুগে বিভিন্ন প্রকার পরস্পর-বিরোধী দার্শনিক তত্ত্ব মানুষের মনে একটি অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছিল। এই অবস্থাতে প্রাচ্যের ইহুদি ধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন, বিশেষ করে প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্বের সংযোগ ঘটে আলেক্সান্দ্রীয়া নগরে। দার্শনিক ফিলো খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে জীবিত ছিলেন। তিনি প্লেটোর দর্শনের সাহায্যে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। ফিলো প্লেটোর ‘ভাব’কে যেমন একদিকে গ্রহণ করেন তেমনি অপরদিকে তাকে বিশ্বচরাচর সৃষ্টিকারী এক বিশাল অগ্নিরূপে কল্পনা করেন। বিশ্বের প্রাণ-অপ্রাণ সমগ্র সত্তার মধ্যেই এই অগ্নির প্রকাশ ঘটেছে বলে ফিলো মনে করতেন।
Alienation: বিচ্ছিন্নতা
কোনো কিছুর গুণ বা শক্তিতে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করাকে দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলা হয়। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশে বিচ্ছিন্নতাবাদ যে একটা প্রতিবন্ধকরূপে কাজ করে, সে সত্যকে মাকর্সবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মাকর্স প্রথমে উদঘাটন করেন। তাঁর মতে মানব সমাজের ক্রমবিকাশে মানুষের শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির বিভিন্ন ফলাফল যেমন- অর্থের উৎপাদন, মুদ্রার আবিস্কার, উৎপাদনের সম্পর্ক ইত্যাদি সবকিছুর আধার হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু কালক্রমে শ্রমের এই ফলগুলোকে মূল আধার-নিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। শ্রম, মুদ্রা বা উৎপাদনের সম্পর্ক সব কিছুই যেন মানুষ-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা। মাকর্সবাদী মতে এরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদ সামাজিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে দেখা দেয়। মার্কসের মতে মানুষের আদি সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের ধারায় উন্নততর উৎপাদন বা জীবিকার্জনের উপায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পতির উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণের পার্থক্যের ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণীবিভাগের সৃষ্টি হয়। শ্রমেরও ক্রমাধিক পরিমাণে বিভাগ ঘটতে থাকে। শ্রমের এক বিভাগ অপর বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পর-বিরোধী হয়ে দেখা দেয়। যে হাতের কাজ করে সে আর মাথার কাজ অর্থ্যাৎ চিন্তার কাজ করতে পারবে না। এক শ্রম অপর শ্রমের চেয়ে শ্রেয় কিংবা হীন বলে বিবেচিত হতে থাকে। কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম এভাবে বিরক্ত হয়ে পড়ে।
Allama Abul Fazl: আল্লামা আবুল ফজল
জন্ম জানুয়ায়ী ১৪, ১৫৫১, জন্মস্থান আগ্রা, ভারত। আবুল ফজলের মৃত্যু ঘটে আগষ্ট ২২, ১৬০২।
আবুল ফজল একাধারে ঐতিহাসিক এবং সামরিক অধিনায়ক ছিলেন। আবুল ফজল সম্রাট আকবরের দরবারে ধর্মতাত্ত্বিকও ছিলেন। গোড়াতে আবুল ফজল পিতার শিক্ষালয়ে শিক্ষাগ্রহণের পরে সম্রাট আকবরের দরবারে অঙ্গীভূত হন।
প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবুল ফজলের সমালোচনায় সম্রাট আকবরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এবং ধর্মের গোড়ামীর স্থানে তাঁর মনে একাধিক ধর্মের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।
Altruism: পরার্থবাদ
ইংরেজি ‘অলট্রুইজম’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে তাঁর মতবাদের ব্যাখ্যায় এই শব্দের ব্যবহার করেন। ইগোইজম বা আত্মবাদের বিরোধীভাব হিসাবে পরার্থবাদ ব্যবহৃত হয়। পরার্থবাদ কথাটির সাধারণ অর্থ সুপরিচিত। এই অর্থে পরার্থবাদ দ্বারা অপরের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা বা ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব বুঝায়। আত্মবাদের ন্যায় পরর্থবাদকেও মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি বলে অগাস্ট কোঁতে মনে করেন। মা যখন সন্তানের জন্য কষ্ট স্বীকার করে তখন মা পরার্থপরতার পরিচয় দেয়। পরার্থপরতা যখন মানুষের একটি সামাজিক অনুভূতি তখন এই অনুভূতির চর্চা এবং উন্নতি সাধন দ্বারা মানুষের সমাজকে স্বার্থের সংঘাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে কোঁতে মনে করতেন। সমাজকে উন্নত করার মাধ্যম হিসাবে পরার্থবাদকে উক্ত দার্শনিক একটি নীতিগত তত্ত্ব হিসাবে দাঁড় করান। কোঁতের মতে স্বার্থপরতা কেবল মানুষের নয়। মনুষ্যেতর জীবের মধ্যেও এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এটা কেবল মৌলিক জৈবিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্যই পশু-পাখিও সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নিজে বিপদ বরণ করে।
American Civil War: আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অঞ্চলের সঙ্গে দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি অঙ্গরাষ্ট্রের সশস্ত্র সংঘর্ষ আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলে পরিচিত। এই গৃহযুদ্ধ ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আব্রাহাম লিংকন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট। তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার দাস প্রথা বিরোধী নীতি গ্রহণ করে। দাসপ্রথা বিলোপ কিংবা তাকে অব্যাহত রাখা, এই প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে মত বিরোধের ভিত্তিতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষনা করে দাস প্রথা সমর্থক রাষ্ট্রের একটি ‘কনফেডারেসী’ গঠন করে। দক্সিণ ক্যারোরিনা রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণ ক্যারোলিনার বাহিনী কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুর্গের উপর আক্রমন করে। ঐ সালে জুন মাস পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ পূর্ণ আকার গ্রহনণ করে। কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্রোহী দক্ষিণাঞ্চলকে বশীভূত করার জন্য সমুদ্রে অবরোধের সৃষ্টি করে। লোকবল, সৈন্যবল, শিল্প-শক্তি এবং সুসংগঠিত সরকারের শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং দাসপ্রথা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী কৃষি-প্রধান দক্ষিণাঞ্চলীয় রাষ্ট্রীয় জোটের চেয়ে অবশ্যই অধিক পরাক্রমশালী ছিল। তথাপি ১৮৬১ ও ৬২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সৈন্য বাহিনীকে দুইটি গুরুতর পরাজয়ের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু পরিণামে সরকারের নৌ অবরোধ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক অধিনায়ক জেনারেল গ্রাণ্ট এবং জেনারেল শারমানের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণীয় রাষ্ট্রজোট হতবল হতে শুরু করে। তাদের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক আকারে ছাউনীত্যাগ শুরু হয় এবং ১৮৬৫ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সেনাধ্যক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেণ্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার বিলোপ ঘোষণা করেন। এই প্রগতিশীল এবং মানবতাবাদী ভূমিকার জন্য দাস প্রথার সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীলদের গুপ্তঘাতকের হাতে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে আব্রাহাম লিংকন নিহত হন। দক্ষিণাঞ্চলকে পরিপূর্ণরূপে বশীভূত করার নীতি কেন্দ্রীয় সরকার ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখে।
American Civilization: আমেরিকার সভ্যতা
আমেরিকার সভ্যতা বলতে কি বুঝায়? এশীয় সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা এবং আফ্রিকার সভ্যতা- কথাগুলির একটি স্বাভাবিক অর্থ আছে। মহাদেশ হিসাবে বিভক্ত এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলতে প্রাচীনকাল থেকে এই সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীগণ যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করে এসেছে তাকেই এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু ‘আমেরিকার সভ্যতা’ বলতে আধুনিককালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা-এই মহাদেশের আদি অীধবাসীদের নিজেদের গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বুঝানো হয় না। অস্ট্রেলীয় মহাদেশের সভ্যতার ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। আমেরিকার সভ্যতা বলতে আধুনিককালে যাকে বুঝানো হয় তার সূচনা খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে নয়। এবং এ সভ্যতা গঠন করেছে এই অঞ্চলের আদি অধিবাসীগণ নয়। গঠন করেছে ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ইংরেজ, জার্মান, ইটালিয়ান প্রভৃতি জাতির ভাগ্যান্বেষীগণ। বস্তুত ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বাসের আমেরিকা ‘আবিস্কারের’ পর থেকে বিপুল আকারে ইউরোপীয় মানুষ আমেরিকায় আগমন করতে শুরু করে। কিন্তু কলম্বাস যখন আমেরিকার সন্ধান পান তখন বিরাট আমেরিকাভূখণ্ড জনশূন্য কিংবা সভ্যতাবিহীন ছিল না। আমেরিকার নিজস্ব অধিবাসীদের প্রতিষ্ঠিত সেই সভ্যতা ইউরোপীয় অধিবাসীদের আক্রমণ এবং গ্রাসের ফলে আজ বিলুপ্তপ্রায়। ইতিহাসের জাদুঘরে তার কেবলমাত্র কিছু রেশ এবং আভাস দেখা যায়। সভ্যতার হাতে সভ্যতার বিনষ্টির এ একটি বিষ্ময়কর এবং আধুনিক দৃষ্টান্ত।
এশিয়া মহাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যকার বেরিং প্রণালীর বিস্তার অনতিক্রমণীয় না হলেও বিপুল আয়তন আমেরিকা মহাদেশ, উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে ভৌগলিকভাবে মহাসমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। তার একদিকে আটলাণ্টিক মহাসমুদ্র। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসমুদ্র বিস্তারিত। প্রাচীনকালে মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকার সঙ্গে জল যোগাযোগ একেবারে ছিল না, এমন অনুমান করা চলে না।
গবেষকগণ অনুমান করেন, আমেরিকার আদি অধিবাসীগণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোত্র হিসাবে মহাদেশের বিভিন্ন বাসোপযোগী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে উত্তর অঞ্চল থেকে একটি শিকারী জনগোষ্ঠীকে মেক্সিকোতে এসে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়। এই নবাগত জনগোষ্ঠী স্থানীয় কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জীবনযাপন করতে শুরু করে। এদের মিলিত জীবনযাত্রা থেকে টোকটেক নামীয় একটি জাতির বিকাশ ঘটে। মেক্সিকোর টোলটেক জাতির সভ্যতার চিহ্ন তাদের তৈরি মৃৎপাত্র এবং পিরামিড শীর্ষের মন্দিরের মধ্যে পাওয়া গেছে।
এর কয়েক শত বছর পরে খ্রিষ্টীয় দশম শতকে উত্তর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই নবাগতগণ ছিল আজটেক। এরা টোকটেকদের পরাভূত করে। আজটেক জাতি ‘টেনোছিটলান’ নামে একটি শহরের পত্তন করে। আধুনিক মেক্সিকো শহরের পূর্বভিত্তি আজটেকদের টেনোছিটলান। আজটেকদের সভ্যতা পূর্বের চেয়ে উন্নত ছিল। স্বর্ণ এবং তাম্রের ব্যবহার, গণনার একটি পদ্ধতির আবিস্কার, বর্ষপঞ্জী তৈরির ক্ষমতা এবং চিত্রলিপির ব্যবহার এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ছিল।
আজটেকগণ ক্রমান্বয়ে তাদের বসতি মিক্সিকোর দক্ষিণ পূর্বের ইউকাতান উপদ্বীপে বিস্তারিত করে। ইউকাতানে তখন মায়াসভ্যতা নামে একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল।
আজটেকগণ মায়াসভ্যতাকেও পরাভূত করে। মায়াগণ প্রস্তরের নগর এবং মিশরের পিরামিডের ন্যায় প্রস্তরমন্দির তৈরিতে পারদর্শী ছিল। তারা বিরাটাকারের বাড়ি তৈরি করতে পারত। এ সমস্ত স্থাপত্যের বিচিত্র অঙ্গসজ্জার ধ্বংসাবশেষ তদের স্থাপত্য শিল্পের বিষ্ময়কর বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে। মায়াদের গঠিত নগরের মধ্যে চিতেনইটজা, মায়াপান, উকসমল প্রভৃতি নগর খ্যাতি লাভ করে। এই নগরগুলি নগররাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করেছিল। দশম শতাব্দী থেকে কয়েক শত বছর এই নগররাষ্ট্রগুলি পরস্পরের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ে নিযুক্ত ছিল। আমেরিকার নিজস্ব সভ্যতার মধ্যে মায়া সভ্যতাই সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিকশিত বলে খ্যাত। মায়াসভ্যতার ক্ষয়ের কাল হচ্ছে দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী। মায়াসভ্যতার সমাজ ব্যবস্থায় অভীজাত ও পুরোহিতদের প্রাধান্য ছিল। অভিজাতদের হাতে কোকোয়ার জমি, মৌমাছির চাষ এবং লবণের খনিগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল। অভিজাতদের অধীনে সংখ্যক দাসও থাকত। বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে বা বসতিতে মায়াগণ সে সংগঠিত জীবনযাপন করত তার মধ্যে গোত্রীয় জীবন-পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য প্রধান ছিল। কিন্তু বিকাশের পথে গোত্রীয় যৌথ জীবনের মধ্যে আর্থিক অসাম্যও ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হতে থাকে। যুদ্ধের বন্দি, দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ঋণবদ্ধ মানুষ এবং অনাথরা দাসশ্রেণীর প্রধান উৎস ছিল। মায়াদের মধ্যে এইকালে দাসসমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে।
মায়াসভ্যতাকে পরাভূত এবং তার বিকাশকে গ্রহণ করে আজটেকগণ সমগ্র মেক্সিকোতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আজটেকগণ সেচ ব্যবস্থা উন্নতি ঘটিয়ে কৃষিকার্যকে অধিকতর বিকশিত করে। নানা রকম ফল ও সবজি ব্যতীত তামাকের চাষেরও তারা প্রচলন করে। হস্তশিল্পের মধ্যে আসবাসপত্র তৈরি, বস্ত্রবয়ন এবং ধাতবশিল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজটেকগণ প্রস্তর বা ইট দ্বারা বাড়ি তেরি করতে পারত। তা ছাড়া খালখনন ও বাঁধ তৈরিতেও তারা দক্ষতা অর্জন করেছিল।
আজটেকণও গোড়ার দিকে গোত্রীয় জীবনযাপন করত। জমি যৌথ সম্পত্তি ছিল। নির্বাচিত সমরপতি যুদ্ধ ও শান্তি, উভয় সময়ে গোত্রের প্রধান বলে বিবেচিত হতো। কয়েকটি গোত্র মিলে আবার যৌথ জীবনযাপনের জন্য প্রধান সমরপতিকে কোনো বিশেষ গোত্র থেকে নির্বাচিত করত। আজটেকগণ যুদ্ধবাজ ছিল। প্রায়ই তারা অভিযান, যুদ্ধ এবং লুণ্ঠনে লিপ্ত থাকত। আর এই যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়ের মধ্যে ক্রমান্বয়ে তাদের গোত্রীয় সাম্যবাদী জীবনের ভাঙন ঘটে। যুদ্ধের সম্পদ ও দাস প্রধানত সমরপতিগণের অধীকারভুক্ত হয়। এভাবে আজটেকের দাসে পরিণত হয়। এবং দাস ব্যবস্থা আজটেক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকেও আজটেকদের যুদ্ধোম্মাদ জাতি হিসাবে দেখা যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার এণ্ডিজ পর্বত অঞ্চলে আর একটি সভ্যতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এখানে প্রাচীনকাল থেকে কুইচোয়া, আয়মারা এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী বাস করে আসছিল। এদের সভ্যতাএ বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে কুইচোয়ার গোত্রভূক্ত ইনকাগোত্র অন্যান্য গোত্রকে পরাভূত করে একটি বৃহদাকারের রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। এই রাষ্ট্রের অধিপতি নিজেকে ‘সাপাইনকা’ (একমাত্র ইনকা) বলে অভিহিত করত এবং নিজেকে সূর্যদেবের পুত্র বলে বিশ্বাস করত। ইনকাগণও কৃষি, পশূপালন ও নানাপ্রকার হস্তশিল্পে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ক্রমধিক সংযোগ এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার এ সমস্ত সভ্যতা অধিকতর বিকাশ করতে পারত। কিন্তু এই সভ্যতাসমূহের নিজেস্ব বিকাশ ধারা পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর উন্নততর মরাণাস্ত্রসজ্জিত ইউরোপীয় অভিযানকারীদের আক্রমন,লুণ্ঠন ও শোষণের দুর্বার আঘাতে রুদ্ধ হয়ে যায়।
American Philosophy: আমেরিকার দর্শন
সাম্প্রতিকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ আখ্যাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকা বলতে কেবল মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র বুঝায় না। সে কারণে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ কথাটি উপযুক্ত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত অধিবাসীদের দ্বারা গঠিত হয়েছে। এ জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউরোপ মহাদেশে ঊনবিংশ শতকে প্রচলিত ভাবধারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচলিত ছিল। দর্শনের ক্ষেত্রেও ইউরোপের বিভিন্ন ধারা এবং উপধারার সাক্ষাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে পাওয়া যায়। ইউরোপ থেকে ভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না বলে বিগত শতকে দর্শনের ইতিহাসে ‘মার্কিন দর্শন’ বলে কোনো বিশেষ দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় না। তথাপি অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপ ত্যাগকারী জনসমষ্টি একটি অনাবাদী ভূখণ্ডকে আবাদযোগ্য করে সভ্যতা গঠনে যে ভাবধারার আশ্রয় গ্রহণ করেছে তা বিশ্লেষণের যোগ্য। নতুন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং বৈজ্ঞানিকগণ যেভাবে সহায়তা করেছেন দার্শনিকগণও সেভাবে তাঁদের চিন্তাধারার মাধ্যমে এই গঠনকার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। গঠনমূলক এই যুগের চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তবতা। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো সমস্যার তাত্ত্বিক বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুগের দার্শনিকগণের মধ্যে প্রকট হয় নাই। বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁরা চিন্তা করেছেন। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে বাস্তব জীবনের স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই জীবনবোধে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদের জন্ম হয়।
১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা এই সময়ে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে জেমস ডিউই, পিয়ার্স, রয়েস, জর্জ সাণ্টায়ানা এবং আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের মতো মৌলিক চিন্তাবিদদের উদ্ভব ঘটে। উপরোক্ত দার্শনিকদের গ্রন্থরাজি এবং অভিমত দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। হোয়াইটহেডকে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মনে করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দর্শনে যে সমস্ত তত্ত্ব সমধিক আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে লজিকাল পজিটিভিটিম বা যৌক্তিক দৃষ্টবাদ এবং লিঙ্গুইসটিক ফিলোসফি বা ভাষা-দর্শনই প্রধান।
American War of Independence: আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬-১৭৮১)
ইউরোপের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমেরিকার বিপ্লব বলেও অভিহিত করা হয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইংল্যাণ্ডের অথনৈতিক বিকাশের একটি পর্যায়ের স্মারক। সপ্তদশ শতাব্দীতেই ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইংল্যাণ্ডে পশম ও সুতার বস্ত্রশিল্প, কয়লা উত্তোলন এবং লৌহ তৈরির শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করে। পশমশিল্পের বিস্তারের সঙ্গে ভূমি ও কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভেড়ার পশম ছিল পশমশিল্পের মূল কাঁচামাল। কুষিপণ্যের চেয়ে পশমের লাভ অধিক দেখে জমিদারগণ জমি থেকে ব্যপকভাবে কুষকদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিদারিকে মেষপালনের খামারে পরিণত করতে শুরু করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কৃষক ভূমিহীন নিঃস্ব মুজরে পরিণত হয়ে শহরে এবং শিল্পঞ্চলে জমায়েত হতে থাকে। এই নিঃস্ব জমিহীন কৃষকরা শিল্পের সস্তা মজুর হিসাবে শিল্প বিকাশের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করে। ইংল্যাণ্ডের এই বিকশিত শিল্পের জন্যে ক্রমান্বয়ে অধিক পরিমাণে বাজারের আবশ্যক হয়। এই বাজারের প্রয়োজনে শক্তিশালী নৌবহরের মালিক ইংল্যাণ্ডে উপনিবেশের জন্যে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭০১ থেকে ১৭১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সঙ্গে সাত বছরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সমস্ত যুদ্ধের ফলে ভারতে এবং উত্তর আমেরিকায় ইংল্যাণ্ডের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। উত্তর আমেরিকাতে ফরাসিগণ কানাডাকে ইংল্যাণ্ডের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু আমেরিকাতে এই বিজয় ইংল্যাণ্ডের শাসকদের জন্যে নতুন সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পঞ্চদশ মতকের শেষদিকে (১৪৯২) কলাম্বাসের আমেরিকা সন্ধান লাভের পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা ধরনের অধিবাসী ধনরত্নের আশায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতে আগমন করতে থাকে। ইউরোপীয়দের এই আগমন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বিরাট স্রোতের আকার ধারণ করে। এই সমস্ত অভিযানকারীগণ আমেরিকার আদি অধিবাসীদের তুলনায় মারণাস্ত্র এবং অন্যান্য কলাকৌশল অধিকতর উন্নত ও শক্তিশালী ছিল। বিশাল আমেরিকার বিপুল অংশ তখনো অনাবাদী অবস্থাতে ছিল। ইউরোপীয় অভিযাত্রীগণ একদিকে আমেরিকার আদি অধিবাসীগণকে ধ্বংস করে, অপরদিকে অনুধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ দখল এবং আবাদ করে ইউরোপীয় উপনিবেশ বা বসতি স্থাপন করতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেই আটলান্টিক উপকূলব্যাপী ইংরেজদের উপনিবেশ বিরাট আকার ধারণ করে। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কানাডা লাভের ফলে এই উপনিবেশ বৃদ্ধি পায়। এই সকল উপনিবেশের ইউরোপীয় অধিবাসীদের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে ত্রিশ লক্ষে পৌছে যায়। এই উপনিবেশের অধিবাসীগণ এখন আর ইউরোপ থেকে আগত কোনো অস্থায়ী বাসিন্দা নয়। এখন এরা নিজেদেরকে আমেরিকার অধিবাসী বলে গণ্য করে নিজেদেরকে ‘আমেরিকান’ বলে ঘোষণা করতে শুরু করে। এই সমস্ত উপনিবেশবাসীদের সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে তাদের মূলদেশ ইংল্যাণ্ডের শাসকদের শাসন ব্যবস্থা ও স্বার্থের বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টে রচিত শাসনবিধি দ্বারা ইংল্যাণ্ডের রাজা আমেরিকার উপনিবেশগুলিকেও শাসন করত। পার্লামেণ্টে আমেরিকার উপনিবেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছির না। উপনিবেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ পূর্ব থেকেই ইংল্যাণ্ডের এই শাসনবিধির প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার সাত বছরের যুদ্ধের পূর্বে তেমন পরিচালিত হয় নি। তার একটা কারণ ছিল, ফ্রান্স সম্পর্কে উপনিবেশের অধিবাসীদের ভয়। ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে গেলে, কানাডা থেকে ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সাত বছরের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় এবং কানাডা ইংরেজ উপনিবেশের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় আমেরিকার অধিবাসীদের সে ভয় এবার দূর হলো।
ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্ট এবার যখন পুরোনো কায়দায় আমেরিকার উপনিবেশগুলির উপর ট্যাক্স ধার্যের আইন পাশ করতে লাগল, উপনিবেশের অধিবাসীদের নিজস্ব শিল্প ও বাণিজ্য প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রকার বাধা নিষেধ আরোপ করে চলল তখন উত্তর আমেরিকার এই সমস্ত ইংরেজ উপনিবেশের অধিবাসীগণ বিদ্রোহাত্মক মনোভাব দেখাতে শুরু করল। এই সময়েই আমেরিকানগণ একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম ধ্বনি উচ্চারণ করে ‘নো ট্যাকসেশন উইদআউট রিপ্রেজেণ্টেশন: প্রতিনিধি নাই, তো ট্যাক্স নাই’ (১৭৬৭)। তারা সরকারের কর দিতে অস্বীকার করতে শুরু করল। ইংরেজ সরকার এর পাল্টা দণ্ডমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপনিবেশবাসীরা ইংল্যাণ্ডের প্রেরিত চা এবং অন্যান্য দ্রব্য বর্জন করার আন্দোলন শুরু করে (১৭৭৪)। ইংরেজ সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার বাণিজ্য নৌযানগুলিকে সমুদ্রপথে অবরোধ করে। এর জবাবে আমেরিকার উপনিবেশগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৭৭৪ সালে আমেরিকানগণ সশস্ত্রভাবে সরকারের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে রত হয়। ১৭৭৫ সনে লেকসিংটনে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সামান্য রাইফেলধারী কিছূ আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ সৈন্য ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৭৭৫-এর মে মাসে বিদ্রোহী উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন ফিলাডেলফিয়াতে আহূত হয়। এই সম্মেলনে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে জর্জ ওয়াশিংটনের (১৭৩২-১৭৯৯) অধিনায়কত্বে এক আমেরিকান বাহিনী গঠন করা হয়। ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলন ১৭৭৬-এর জুলাই ৪ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে এবং আমেরিকার ইংরেজ উপনিবেশগুলি নিজেদের ‘দি আমেরিকান স্টেইট’ বা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র (ইউ.এস.এ.) হিসাবে ঘোষণা করে। ইতিহাসে এই ঘোষণা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই ঘোষণা-পত্রের রচয়িতা ছিলেন টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)। এই ঘোষণার পরে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। গোড়ার দিকে ইংল্যাণ্ডের শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের বাহিনী টিকে থাকতে অক্ষম হয়। ইংরেজ সৈন্য আমেরিকানদের হাত থেকে নিউইয়র্ক দখল করে।
ক্রমান্বয়ে আমেরিকার এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত আমেরিকানগণ ফ্রান্স ও স্পেনের সাহায্য কামনা করে। ফরাসি জনমত তো বটেই, ফরাসি সরকারও এই সুযোগে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করে আমেরিকানদের অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে অগ্রসর হয়। স্পেনও সাত সাগরের একচ্ছত্র অধিপতি ইংল্যাণ্ডকে আঘাত করার সুযোগ গ্রহণে পিছিয়ে থাকলো না। স্বাধীনতাকামী আমেরিকানদের পক্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এবার একটি আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়ে গেল। এই জোটের আঘাতের মুখে ইংরেজশক্তি আর টিককে সক্ষম হলো না। তারা ইয়র্ক টাউনের যুদ্ধে ফরাসি ও আমেরিকানদের নিকট পরাজয় স্বীকার করে আমেরিকার উপনিবেশজোটের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হলো (১৭৮১)।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাদীনতাকামী মানুষের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ইংল্রাণ্ড, ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীমনা চিন্তাবিদদের মধ্যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকার সৈন্যগণকে ইংল্যাণ্ডের সাধারণ মানুষ ‘স্বাধীনতার সন্তান’ বলে গণ্য করতে শুরু করে। ইংল্যাণ্ডের চিন্তাবিদ সেইণ্ট সাইমন এবং পোলাণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা যোসিসকোসহ অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকাতে উপস্থিত হন। ১৭৮৯ সনের ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের ক্ষেত্রে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছিল।
Amphiboly: বাক্যের দ্ব্যর্থকতা
যুক্তির ক্রটিবিশেষ। যুক্তির মধ্যে একটি ব্যক্যকে যদি একাধিক অর্থে ব্যবহার করা হয় কিংবা বাক্যটি যদি এরূপভাবে গঠিত হয় যে তার একাধিক অর্থ করা সম্ভব, তা হলে সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে পাবে। এ কারণে একই যুক্তির মধ্যে একাধিক অর্থপূর্ণ কোন বাক্য ব্যবহারকে দ্ব্যর্থকতার দোষে দুষ্ট বলা হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এরূপ দ্ব্যর্থক বাক্য বা শব্দ ব্যবহার পরিহার করা সঙ্গত। কিন্তু দ্ব্যর্থক বাক্য সাহিত্যের কাব্য, নাটক প্রভৃতি শাখার প্রচুর পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসের দেবমন্দিরের ভবিষ্যদ্বক্তাগণ দ্ব্যর্থক ভাষাতেই তাদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করত। এরূপ অনেক ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রাচীন লিডিয়ার সম্রাট ক্রিসাস পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করার পূর্বে তাঁর ভাগ্য গণনার জন্য ডেলফির ভবিষ্যদ্বক্তার কাছ গিয়ে প্রশ্ন করেন এই অভিযানের ফলাফল কি হবে। ভবিষ্যদ্বক্তা বলেছিল: ‘আপনি একটি বিরাট সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধন করবেন।’ ভবিষ্যদ্বক্তার কথা সত্য হয়েছিল। ক্রিসাসের অভিযানে এক বিরাট সাম্রাজ্য অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সে সাম্রাজ্য পারস্য নয়; সে ছিল ক্রিসাসের নিজের সাম্রাজ্য।
Amritsar Massacre: অমৃতসর হত্যাকাণ্ড
প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সনে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সামরিক অধিনায়ক জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বন্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড অমৃতসর হত্যাকাণ্ড নামে বিখ্যাত। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে এ ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বলেও পরিচিত।
তখন ভারতবর্ষ ইংরেজ শাষনের অধীনে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগরিত হতে থাকে। এই আকাঙ্খার সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায়। গোড়ার দিকে এ প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল ইংরেজ শাসনাধীনে ন্যায়বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু ইংরেজ শাসনের তরফ থেকে, এ দাবির কোনো পূরণ ঘটে না। ইংরেজ শাসকেরা বলতে থাকে, ভারতবর্ষ অনুন্নত দেশ। ভারতবর্ষের মানুষ স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার উপযুক্ত নয়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের নিজস্ব প্রয়োজনে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাপর ঘটনার প্রভাবে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এবং দেশবাসীর চেতনায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে বৃহৎ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র রেলপথ স্থাপিত হতে থাকে। টেলিগ্রাফ তারও বসানো হয়। কিছু কিছু শিল্প কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। বিশেষ করে কাপড়ের কলের স্থাপনা ও বিস্তার ঘটে। আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রভাবও দেশবাসীর চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে। ১৯০৫ সালে একদিকে রাশিয়ার মতো বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি ক্ষুদ্র জাপানের মতো এশিয়া শক্তির নিকট রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। অপরদিকে রাশিয়ার ভেতরে নির্যাতিত জনসাধারণ সামন্ততান্ত্রিক জার সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লাবাত্মক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব পর্যদুস্ত হলেও পৃথিবীর পরাধীন জাতি এবং নির্যাতিত মানুষের উপর এর প্রভাব কম ছিল না। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার অর্থনৈতিক সংকটও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃহৎ বৃহৎ ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশকে দখল করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেবার নতুন প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ শুরু হয়। এরই ফলে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। জার্মানির বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ড এই যুদ্ধে জড়িত হয়। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের জন্য ভারতীয়দের সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। পরাধীন ভারতবাসীর মনের সন্দেহ এবং অনিচ্ছা দূর করার জন্য ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে যে, এই যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সকল জাতির শৃঙ্খলমুক্তি এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান। এরূপ ঘোষণায় বিশ্বাস করে ভারতবাসীরাও যুদ্ধে যোগদান করতে থাকে। অবিভক্ত ভারতের অন্যতম জননেতা গান্ধীজি এই সময়ে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে তাঁর কর্মস্থল স্থাপন করেন। তাঁরই উদ্যোগে প্রচুর সংখ্যক ভারতাবাসী সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরিত হতে থাকে।
কিন্তু ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও ভারতবাসী ইংরেজদের শাসনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না। যারা যুদ্ধে যোগদান করেছিল তাদেরকেও সৈন্যবাহিনী ভেঙ্গে বেকার করে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধশেষের মন্দা অর্থনীতিতে আঘাত করে। বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্ভিক্ষাবস্থা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা-মহামারীতে এককোটির অধিক মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন অবস্থায় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মণ্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার বলে কিছু সীমাবদ্ধ শাসন সংস্কারের ঘোষণা করে তেমনি অপরদিকে রাওলাট বিল পাশ করে ইংরেজবিরোধী সকল রকম বিক্ষোভ ও প্রতিবাদকে নির্মমভাবে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাওলাট আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীন এবং সংক্ষিপ্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দিত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
এরূপ অবস্থায় গান্ধীজী সত্যাগ্রহ বা অহিংস পন্থায় এই দমনমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদের কথা ঘোষণা করেন। এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে (১৯১৯) পাঞ্জাবে যাওয়ার পথে গান্ধীজী গ্রেপ্তার হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্পশ্রমিক এবং পাঞ্চাবের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। সরকার গান্ধীজীকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।কিন্তু তথাপি বিক্ষোভ ক্ষান্ত হয় না। এই বিক্ষোভ প্রধানত পশ্চিম ভারত এবং পাঞ্জাবে কেন্দ্রীভূত ছিল। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে সরকারি দপ্তর এবং যানবাহন আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। শ্বেতকর্মের ইউরোপীয় অফিসার ও অধিবাসীও জনতার ক্রোধের পাত্র হয়ে উঠে। তারাও আক্রান্ত হতে থাকে। ১৩ এপ্রিল দুজন রাজনীতিক নেতাকে অমৃতসরে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে জনতা সামরিক ছাউনি লক্ষ্য করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। ছত্রভঙ্গ জনতা শহরে ঢুকে রেলওয়ে স্টেশন ও দুটি ব্যাঙ্ক আক্রমণ করে ভষ্মীভূত করে। চারজন ইউরোপীয় অধিবাসী জনতার আক্রমণে নিহত হয়। একজন মহিলা মিশনারী নিখোঁজ হয়। সাময়িক ছাউনির ইংরেজ অধিনায়ক জেনারেল ডায়ার ক্ষিপ্ত হয়ে শহরে সবরকম জনজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি উদ্যানে বেশ কিছু লোক সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে জমায়েত হয়। উদ্যানটির মাত্র একটি নিষ্ক্রমণ পথ ছিল। জেনারেল ডায়ার এই জমায়েতের সংবাদ পেয়ে একদল গুর্খা এবং বালুচ বাহিনী এবং সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে উদ্যানের মুখে হাজির হন। তাঁর হুকুমে উদ্যানের মুখ সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তারপর কোনোরকম হুঁশিয়ারী না দিয়ে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সর্বমোট ১৬০৫ রাউণ্ড গুলি বর্ষিত হয়েছিল। উদ্যানটি জনতায় পূর্ণ ছিল। হতচকিত প্রাণরক্ষার জন্য পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পালায়নের কোন পথ ছিল না। নিজেদের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় হুড়োহুড়িতে এবং অবিরাম গুলিবর্ষণে চার শতাধিক লোক ঐ স্থানে নিহত হয়। সরকারী হিসাব সাধারণত কমের দিকে থাকে। সরকারি হিসাব মতে ৩৭৯ জন নিহত এবং ১২০০ জন আহত হয়। ডায়ারের এই চণ্ডনীতি পাঞ্জাব সরকার সমর্থন করে। ১৫ এপ্রিল পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করা হয়। এই সময় অমৃতসর এবং পাঞ্জাবের অীধবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। যে স্থান থেকে ইংরেজ মহিলাযাত্রী নিখোঁজ হয়েছিল সে স্থানে সকল মানুষকে চার হাত পায়ে পশুর মতো হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হয়। সান্ধ্য আইনের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম, ইংরেজ সামরিক অফিসারকে হাত তুলে সালাম না জানানো ইত্যাদি অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের দণ্ড দেওয়া হতে থাকে। দেশব্যাপী প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিপূর্বে ইংরেজ সরকারের নিকট থেকে যে ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন সে খেতাব একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে তিনি বর্জন করেন। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ফলে সরকার যদিও ‘হাণ্টার কমিশন’ নামে তদন্ত কমিশন এই ঘটনার উপর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তদন্ত কমিশনের সাধারণ সমালোচনামূলক রিপোর্টের ভিত্তিতে জেনারেল ডায়ারকে দ্বায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয় তথাপি কমিশনের নিকট ডায়ারের সদম্ভ উক্তিই যে ইংরেজ সরকারের মনোভাব প্রকাশ করেছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। জেনারেল ডায়ার নির্দ্বিদায় বলেছিলেন, “আমি যখন গুলিবর্ষণ শুরু করি তখন বিরামহীন ভাবেই করি। জনতা ছত্রভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত আমি গুলিবর্ষণ থেকে বিরত হয়নি। কারণ আমার মতে এই পরিমাণ ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ। আমার হাতে সেদিন যদি সৈন্য অধিকতর থাকত হা হলে নিহত ও আহতদের সংখ্যা অবশ্যই অধিকতর হতো। কারণ, কেবল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা নয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজন ছিল উপস্থিত এবং অনুপস্থিত পাঞ্জাবের সকলের মনে উপযুক্ত বাধ্যতাবোধ সৃষ্টি করা।”
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ১৯১৯ সারের অমৃতসর হত্যাকাণ্ড তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মাত্র তুলনীয়। এই সময় থেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি পরিকর্তন সংঘটিত হয়। এখন থেকে ভারতবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলন আপসহীনতার পথ গ্রহণ করতে থাকে। বলা চলে, জেনারেল ডায়ার সেদিন তার কামানের গর্জনে কেবল ইংরেজ বর্বরতাই ঘোষণা করেন নি, তিনি ভারতে ইংরেজ শাসনের অন্তিম কালেরও ঘোষণা করেছিলেন।
Analogy: উপমা, সাদৃশ্য, সাদৃশ্যানুমান
ইংরেজী ‘এ্যানালজি’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘এ্যানালজিয়া’ থেকে উদ্ভুত। এ্যানালজিয়ার অর্থ হচ্ছে অনুপাত। প্রাচীনকালে অনুপাতের সমতা বা সাদৃশ্য অঙ্কশাস্ত্রে সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কেবল অনুপাতের সমতা নয়, দুইটি বিষয়ের মধ্যে কিছু পরিমাণ গুণের সাদৃশ্যের ভিত্তিতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে। ইনডাকটিভ আ আরোহ যুক্তিতে সাদৃশ্যানুমান যুক্তির একটি পদ্ধতি। সাদৃশ্যানুমানের পদ্ধতিটি এরূপ ক এবং খ কে পারস্পারিকভাবে তুলনা করা হলো। দেখা গেল ক-এর ত,থ,দ,ধ নামক গুণ রয়েছে; খ-এরও থ,দ,ধ গুণ। ক-এর গুণের কিছু সংখ্যকের সঙ্গে খ-এর গুণের উক্ত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা চলে যে, খ-এর মধ্যে অপর অর্থ্যাৎ ‘ত’ গুণ গুণটিও থাকতে পারে।
সাদৃশ্যানুমানের এই গঠন থেকে বুঝা যায়, এরূপ সিদ্ধান্তে বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা থাকে না। সিদ্ধান্তটি সঠিক হতে পারেও আবার না-ও হতে পারে, এরূপ একটা অনিশ্চিত অবস্থার অবকাশ এরূপ অনুমানের মধ্যে থেকে যায়। এ কারণে সাদৃশ্যানুমানকে সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গৃহীত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু সাদৃশ্যানুমানকে পুরোপুরি বাতিল করাও চলে না। মানুষের জ্ঞানের অনুন্নত পর্যায়ে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান একটি অপরিহার্য পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। এরূপ অনুমানের উপর নির্ভর করে প্রাথমিকভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত গবেষণার পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সাদৃশ্যানুমান জ্ঞানের প্রাথমিক সুত্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সাদৃশ্যানুমান কম-বেশি পরিমাণে নিশ্চিত হতে পারে। নিশ্চয়তার পরিমাণ নির্ভর করে উপমিত বস্তুদ্বয়ের পারস্পারিক সাদৃশ্যের সংখ্যা এবং চরিত্রের উপর। সিন্ধান্তের নিশ্চয়তা বৃদ্ধির জন্য লক্ষ্য রাখতে হবে যেন উপমিত বস্তদ্বয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাদৃশ্য থাকে; উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের পরিমাণ বৈসাদৃশ্যের চেয়ে অধিক হয় উপমা দুইটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপমা বা সাদৃশ্যের অসতর্ক ব্যবহার ভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। জননী এবং জন্মভূমির মধ্যে কিছু সাদৃশ্র আছে। ‘জননী সন্তানকে লালন পালন করে; জন্মভূমিও তার অধিবাসীর জীবনধারণের আবাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সন্তান অসুস্থ হলে জননী তার শুশ্রুষা করে। সুতরাং জন্মভূমির অধিবাসী অসুস্থ হলে জন্মভূমিকে তার শুশ্রুষা করে হবে।’ এখানে জন্মভূমিকে জননীর সঙ্গে রূপকার্থে সদৃশ মনে করা হয়েছে। এরূপ সাদৃশ্যানুমান যথাযথভাবে সঠিক হতে পারে না।
সাদৃশ্যানুমানকে নিশ্চিত করার জন্য পরবর্তী পর্যায়ে উপযুক্ত গোবষণার ভিত্তিতে এর সত্যাসত্যতা পরীক্ষা করা আবশ্যক। নচেৎ, এরূপ অনুমান নিছক অপ্রমাণিত অনুমানেই সীমাবদ্ধ থাকে।
Analysis and Synthesis: বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ
উভয় শব্দ মানুষের মানসিক কিংবা দৈহিক একটি বিশেষ ক্রিয়ার কথা বুঝায়। বিশ্লেষণ বলতে একটি সমগ্রকে তার অন্তর্ভুক্ত অংশসমূহে বিভক্তকরণ এবং সংশ্লেষণ বলতে অংশসমূহের সম্মেলনের মাধ্যমে সমগ্র পুনর্গঠনকে বুঝায়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আদিকাল থেকে মানুষ এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে এসেছে। উভয় পদ্ধতি কোনো বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান লাভের জন্য অপরিহার্য। বিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমেই মানুষ এই সত্যে উপনীত হয়েছে যে,বস্তুজগতের কোনো বস্তুই একক নয়। এর প্রত্যকেটি এক একটি জটিল সত্তা। এ কারণে কোনো বস্তু বা সমস্যার যথার্থ জ্ঞান বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে যথাযথভাবে লাভ করা চলে না। পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য বিশ্লেষণের পরিপূরক পদ্ধতি হচ্ছে সংশ্লেষণ। বিবেচ্য বিষয় বা বস্তুকে বিশ্লেষণ করে যেমন তার অন্তর্ভূক্ত অংশসমূহকে স্পষ্টতররূপে বুঝতে হবে, তেমনি অংশসমূহকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের পারস্পারিক নির্ভরতার এ সম্পর্কের ভিত্তিতে মূল বস্তুটির সামগ্রিক রূপটিও উপলব্ধি করতে হবে। বিশ্লেষণ ব্যতীত সংশ্লেষণ সম্ভব নয়। আবার সংশ্লেষণ ব্যতীত বিশ্লেষণ সামগ্রিক জ্ঞানদানে অক্ষম। উভয় পদ্ধতি দ্বান্দ্বিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ উক্ত পদ্ধতি দুইটির পারস্পারিক নির্ভরতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এই দর্শনের মতে ভাববাদী দর্শনে বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের পারস্পারিক নির্ভরতাকে উপেক্ষা করা হয়। ভাববাদী দর্শনের বিশ্লেষণকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ্ধতি বলে মনে করা হয়।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাষা, যুক্তি, রসায়ন বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি প্রযুক্তি হচ্ছে। ইংরেজ দার্শনিক জি.ই. মূর এবং বার্ট্রাণ্ড রাসেল তাঁদের রচনাবলীতে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতির লজিকাল এ্যাটোমিজম বা ‘যৌক্তিক অণুবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে কেবল পদার্থ নয়, বিশ্বের সামাজিক, মানবিক, রাষ্ট্রনৈতিক যে-কোনো অস্তিত্বই মৌলিক এবং জটিলতাহীন কতকগুলি সত্তা দ্বারা গঠিত। তাঁর মতে দার্শনিকের কর্তব্য হচ্ছে যা-কিছু জটিল তাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার অন্তর্ভূক্ত সহজ সত্তা প্রকাশ করা।
Anarchism: নৈরাজ্যবাদ, নৈরাষ্ট্রবাদ
রাষ্ট্রহীন সমাজ-ব্রবস্থার প্রচারক একটি সমাজ দর্শন। ইংরেজি এ্যানার্কিজম শব্দের মূল হচ্ছে গ্রিক ‘এ্যানার্কস’ শব্দ। সপ্তদশ শতকের গৃহযুদ্ধের সময়ে ইংল্যাণ্ডে শব্দটির ব্যবহর দেখা যায়। ‘লেভেলারপন্থীদের’ তখন নৈরাজ্যবাদী বলে আখ্যায়িত করা হতো। ফরাসি বিপ্লবে শব্দটিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পারিক আক্রমণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যে-কোনো দল তাদের চাইতে বিপ্লবাত্মক মতাদর্শের লোক এবং দলকেই নৈরাজ্যবাদী বলে অভিহিত করত। ফরাসি দার্শনিক প্রুধোঁর রচনার মধ্যেই নৈরাজ্যবাদী মতের সম্যক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সম্পত্তি কি’ গ্রন্থে ‘নৈরাজ্যবাদ’ ব্যাখ্যা করেন। দাঁর মতে নৈরাজ্যবাদ যে-কোনো রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বিরোধী। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হচ্ছে ব্যক্তির বিকাশের প্রতিবন্ধক। মানুষের জীবনে শৃঙ্খল বিশেষ। অত্যাচারের যন্ত্র। মানুষের সমাজে রাষ্ট্র নিষ্প্রয়োজন। পারস্পারিক ইচ্ছা এবং চুক্তির মাধ্যমে গঠিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা মানুষের জীবনকে পরিচালিত করবে; আইন. অস্ত্রপ্রয়োগকারী বাহিনী, শাসন, সংগঠন ইত্যাদি দ্বারা গঠিত রাষ্ট্র নয়।
এই তত্ত্বের পরিপূরক সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সমস্ত রাষ্ট্রকাঠামোকে ধংস করে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এজন্য নৈরাজ্যবাদের সমর্থক কেউ কেউ বিপ্লবের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন বিপ্লব নয়, মানুষের সততার স্বাভাবিক বিজয়ের দ্বারা একদিন নৈরাষ্ট্রবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। আবার কেউ গুপ্তহত্যার মারফত ক্ষমতাসীনদের উট্ঠেদ করে উক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিমত পোষণ করেছেন। সাধারণত নৈরাজ্যবাদ বলেতে অরাজকতা বুঝায়। ব্যক্তিগত সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপও নৈরাজ্যবাদের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে নৈরাজ্যবাদের তথা নৈরাষ্ট্রবাদের সঙ্গে অরাজকতা বা সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক দেখা যায় না। নৈরাজ্যবাদ তত্ত্বের ইতিহাসে উক্ত মতের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা এবং প্রবক্তা হিসাবে ইংল্যাণ্ডের উইলিয়াম গডুইন (১৭৫৬-১৮৩৬ খ্রি.), ফ্রান্সের পিয়ের যোশেফ প্রুধোঁ (১৮০৯-১৮৬৫ খ্রি.), রাশিয়ার মাইকেল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.), প্রিন্স পিটার ক্রোপোটকিন (১৮৪২-১৯২১ খ্রি.) এবং রুশ লেখক কাউণ্ট লিও টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০ খ্রি.)-এঁদের নাম পাওয়া যায়।
মার্কসবাদও পরিণামে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থার আদর্শ পোষণ করে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে মার্কসবাদ একমত নয়। মার্কসবাদ নৈরাজ্যবাদকে পাঁতিবুর্জোয়া অবাস্তব দর্শন বলে অবিহিত করে। মার্কসবাদের মতে নৈরাজ্যবাদ শোষণহীন সমাজের কথা বললেও সমাজের শোষণের উদ্ভব এবং শোষণের চরিত্র সম্পর্কে নৈরাজ্যবাদের কোনো বাস্তব এবং যথার্থ বিশ্লেষণ নাই। নৈরাজ্যবাদের অন্যতম সমর্থক মাইকেল বাকুনিন তাঁর মত প্রচারের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের আন্তার্জাতিক মৈত্রী নামক একটি সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘ ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক-এ যোগদান করে। কিন্তু সমাজের ব্যাখ্যা এবং সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে মার্কসবাদীদের সঙ্গে বাকুনিনপন্থীদের বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে যায়।
Anaxagoras: এনাক্সাগরাস (৫০০-৪২৮ খ্রি.পূ.)
সক্রেটিসের র্পূববর্তী যুগের অন্যতম গ্রিক দার্শনিক। এই যুগের অপর গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে থেলিস, এনাক্সিমেনিস এবং এনাক্সিমেণ্ডারের নাম বিখ্যাত। আদি গ্রিক দার্শনিকদের বৈশিষ্ট্য ছিল জীবন এবং জগতের ব্যাখ্যায় বাস্তবতাবোধ। এনাক্সাগোরাসের দর্শনেও এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পরিপূর্ণ বস্তুবাদের বদলে তাঁর দর্শনে ভাববাদেরও প্রকাশ দেখা যায়।
এনাক্সাগোরাসের মতে বস্তুপুঞ্জ সংখ্যাহীন মূল বস্তুনিচয়ের দ্বারা গঠিত। বস্তু বা অস্তিত্বের অন্তর্ভূক্ত বস্তুনিচয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। একটির সঙ্গে অপরটির কোনো মিল নেই। আদিতে সত্তা স্থির ছিল। সেই স্থির অস্তিত্বে ‘নাউসের’ অনুপ্রবেশে অস্থিরতা এবং আবর্তের সঞ্চার হয়। এই আবর্তের ফলেই বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছ। এনাক্সাগোরাস যাকে ‘নাউস’ বলেছেন, তাকে মন বলা চলে।সক্রেটিসের পূর্বে সৃষ্টির মূলে মনের মৌলিক ভূমিকার কথা এনাক্সাগোরাসের ন্যায় অপর কেউ বলেন নি। নাউসের কারণেই এক বস্তু অপর বস্তু থেকে পৃথক হয়েছে। এবং বস্তুর প্রকারভেদ ঘটেছে। মন সমগ্র সত্তার সৃষ্টির কারণ হলেও মন কোনো অস্তিত্বের সঙ্গেই অভেদ আকারে সম্পৃক্ত নয়। এনাক্সাগোরাসের মতে আদি সত্তার মধ্যেও সংখ্যাহীন অস্তিত্ব রয়েছে। তার কারণ, কোনো অস্তিত্বই অনস্তিত্ব থেকে উদ্বূত হতে পারে না। সে জন্য প্রত্যেকটি উদ্ভূত অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত। মাথার চুল নিশ্চয়ই যা চুল নয় তা থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। সে অবস্থা থেকে চুলের উদ্ভব তার মধ্যে চুলের বৈশিষ্ট্য অবশ্যই নিহিত আছে।
এনাক্সাগোরাস মনে করতেন, পৃথিবী আকারে চেপ্টা এবং বায়ুর সমুদ্রে ভাসমান। চাঁদ আলো দেয় বটে-কিন্তু সে আলো সূর্য থেকে সে পায়। সূর্য, চন্দ্র, তারা এ সবগুলি উত্তপ্ত পাথর। কোনোটার আকার বড়, কোনোটার আকার ছোট। আমাদের চেতনার মূলে রয়েছে পরস্পরবিরোধী অবস্থার সম্পর্ক। কারণ একটি সদৃস অবস্থা আর একটি সদৃশ অবস্থাকে আলোড়িত করে তুলতে পারে না। আমরা যখন ঠাণ্ডা বোধ করি, তখন আমাদের শরীরের ভিতরের অবস্থা উঞ্চ এবং বাইরের অবস্থা ঠাণ্ডা বলেই আমরা শরীরের ভিতরে ঠাণ্ডা বোধ করি।
এনাক্সাগোরাসের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায়, তিনি প্রধাণত বস্তুবাদী ছিলেন। প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় অতিপ্রাকৃতিক কোনো শক্তিরই তিনি উল্লেখ করেন নি। সৃষ্টির মূল শক্তি মনকেও এনাক্সাগোরাস সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধ বলে কল্পনা করেছেন। ঐশ্বরিক অস্তিত্ব অস্বীকারের জন্য এনাক্সাগোরাসকে নাস্তিক বলে মনে করা হতো। তিনি দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না-এই অভিযোগ এথেন্সের তৎকালীন সরকার এনাক্সাগোরাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। জীবন রক্ষার্থে এনাক্সাগোরাসকে এথেন্স থেকে পালায়ন করতে হয়। ‘প্রাকৃতিক জগৎ’ সম্পর্কে এনাক্সাগোরাসের যে পুস্তক রচনা করেন তার কিছু অংশ অবলুপ্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে পরবর্তী যুগের জ্ঞানান্বেষণে আলোকবর্তিকার কাজ করেছে। এনাক্সাগোরাস আইওনিয়া দ্বীপের ক্লাজোমিনীর অধিবাসী বলে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৪ সালে তিনি আইওনিয়া পরিত্যাগ করে এথেন্স আগমন করেন এবং দীর্ঘ ত্রিশবৎসর এথেন্সে জীবন-জগৎ-অঙ্কশাস্ত্র-জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর অভিমতের ব্যাখ্যা করেন। পেরিক্লিস এবং ইউরিপাইডিস তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন যে, দর্শন-গুরু সক্রেটিসও এক সময়ে এনাক্সাগোরাসের শিষ্য ছিলেন।
Anaximander: এনাক্সিোমণ্ডার (খ্রি. পূ. ৬১০-৫৪৬)
Anaximander: এনাক্সিমেণ্ডার (খ্রি.পূ. ৬১০-৫৪৬)
আদি গ্রিক দার্শনিক থেলিসের শিষ্য। এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শন বস্তবাদী বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের ব্যাখ্যা দ্বন্দ্বমূলক চরিত্রে বিশিষ্ট। বস্তুজগৎ এবং প্রাণীজগতের বিবর্তনমূলক ব্যাখ্যার আভাসও এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শনে স্পষ্টরূপে পাওয়া যায়। গ্রিক ভূ-বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এনাক্সিমেণ্ডার বিজ্ঞানের ইতিহাসে ষ্মরণীয় হয়ে আছেন। পৃথীবির প্রথম মানচিত্র, মহাকাশের তারকারাজির নকশা, সূর্যের দৈনিক ও বার্ষিক পরিক্রমা অনুধাবনের জন্য সূর্যঘড়ি আবিস্কার এবং পৃথিবীর গোলক তৈরির আদি কৃতিত্ব এনাক্সিমেণ্ডারের। মহাবিশ্বে পৃথিবী যে স্থির হয়ে আছে তার কারণ এই যে, মহাবিশ্ব একটা বৃত্তস্বরূপ। পৃথিবী হচ্ছে সেই বৃত্তের কেন্দ্র। বৃত্তের সর্ববিন্দ থেকে পৃথিবীর সমদূরত্বেই পৃথিবীর স্থির অবস্থাকে নিশ্চিত করেছে। থেলিসের শিষ্য হলেও পৃথিবী সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের এই ব্যাখ্যা থেলিসের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্টত পৃথক। থেলিসের মতে পৃথিবী জলের সমৃদ্রে ভাসমান। প্রাকৃতিক জগতের বিকাশ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের অভিমতও সুনির্দিষ্টরূপে বৈজ্ঞানিক। পৌরাণিক কোনো কল্পনা কিংবা অতিপ্রাকৃতিক ঐশ্বরিক শক্তির আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চান নাই। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আপেরিয়ন বা অসীমতা থেকেই বিশ্বের শুরু। আপেরিয়ন বা সৃষ্টির মূলশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সম্মেলন। আপেরিয়ন থেকে অগ্নির সৃষ্টি। আদি অগ্নি বায়মুণ্ডলকে পরিবেষ্টিত করলে তা থেকেই সৃষ্ট হয়েছে চন্দ্র, সূর্য এবং তারকারাজি। নিসর্গজগতের এই সৃষ্টিসমূহ এক একটি অগ্নির চক্র হয়ে মহাবিশ্বে নিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মাঝে মাঝে অগ্নির হল্কা ছুঁড়ে দিচ্ছে। আদিতে বিশ্ব কেবল বাষ্পময় ছিল। সমুদ্র বাষ্পেরই সৃষ্টি। আদি বাস্পের অবশিষ্ট অংশই বাতাস এবং শুষ্ক পৃতিবীর রূপ গ্রহণ করেছে। এভাবে বিশ্বের যা-কিছু সৃষ্টি, আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ভূখণ্ড সবই আদি শক্তি তাপ এবং শৈত্যের চিরন্তন সংঘর্ষ এবং বিচ্ছুরণের ফল। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আদিশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সংঘর্ষকে স্বীকার করে নিলে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না। জীবনের বিকাশও তাপ এবং শৈত্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে। জীবনের আদি সৃষ্টি জলজ –প্রাণ হিসাবে ঘটে। পরবর্তী পর্যায়ে জীবন শুষ্ক ভূখণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করে। এনাক্সিমেণ্ডারের বিবর্তনবাদী এই মতে মানুষের রুপও আদিতে বর্তমানের ন্যায় ছিল না। বিশেষ করে মানব শিশু বর্তমানে যেরূপ দুর্বল প্রাণী তাতে প্রকৃতির আদি অবস্থায় বর্তমান রূপে সে নিশ্চয় রক্ষা পেতে পারত না। মানবশিশুর তুলনায় অপরাপর পশু শিশু অবস্থায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সে কারণে অনুমান করতে হবে যে, মানুষ আদিতে অবশ্যই অপর কোনো প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের গদ্যে লেখা গ্রন্থই আদি দার্শনিক গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত।
Anaximenes: এনাক্সিমেনিস (৫৮৮-৫২৫ খ্রি. পূ.)
গ্রিক দর্শনের আদি যুগকে প্রাকৃতিক দর্শনের যুগ বলা হয়। বাস্তব জগতে মানুষ বাস করে। তার আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্বা নিয়ত মানুষের জীবনকে আঘাত করছে। তাকে অসহায় করে তুলছে। মানুষ জীবনের তাগিদেই প্রাকৃতিক শক্তির মোকাবেলা করে। ঝড় শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে। বন্যার পানি বাঁধ বেঁধে ঠেকাবার চেষ্টা করে। সমুদ্রের সীমানার সন্ধান করে। প্রকৃতিকে নিজের বাধ্য করতে না পারলে মানুষের রক্ষা নাই। প্রকৃতিকে বাধ্য করার জন্য আবশ্যক হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। জগতের মূল কি? আলো, বাতাস, আর পানি? এরাই সৃষ্টির মূলে? এই জ্ঞান ব্যতিরেকে মানুষের পক্ষে প্রকৃতিকে বশ করা সম্ভব নয়। মানুষের সভ্যতা, ইতিহাস, দর্শন-সব কিছুর মূলে রয়েছে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন। আদি গ্রিক দর্শনের খ্যাতি এই কারণে যে, আদি গ্রিক দর্শন মানুষের জীবনের সকল প্রশ্নের যথাসম্ভব জবাব দিয়ে মানুষকে জ্ঞানের শক্তিতে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। এই যুগের থেলিস, এনাক্সিমেণ্ডার এবং এনাক্সিমেনিসের নাম শুধু দর্শনে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবিষ্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
সৃষ্টির মূল কি? এ প্রশ্নের জবাবে এনাক্সিমেনিস বলেছেন: বায়ু হচ্ছে বিশ্বের মূল শক্তি। বায়ুর শেষ নাই, সীমা নাই। বায়ু থেকেই সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি। ঈশ্বর আর দেবতা-তারাও বায়ুর প্রকাশ। বায়ুর চরিত্র হচ্ছে এই যে, বায়ু অস্থির। বায়ু সদাঘূর্ণ্যমান। আবর্তের মধ্যে বায়ুর রূপান্তর ঘটে। ঘূর্ণ্যমান বায়ু একদিকে যেমন গতির বেগে বাষ্পে পরিণত হে পারে, তেমনি অপরদিকে সে জমাট বাঁধা বায়ু আবহাওয়ার উৎপত্তি ঘটায়। আবহাওয়া থেকে সৃষ্টি হয় মেঘ। মেঘ থেকে সৃষ্টি হয় পানি। পানি জমাট বেঁধে হয় মাটির সৃষ্টি। মাটির মধ্যে তৈরি হয় প্রস্তর। এমনি করে পৃথিবীর সৃষ্টি।
মূলশক্তি বায়ুর সাথে এনাক্সিমেনিস বস্তুর তাপ এবং শৈত্যাবস্থার ভূমিকাকেও স্বীকার করেছেন। ঘূর্ণ্যমান বায়ুর কারণে যে অস্তিত্বের সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্য আছে তাপ এবং শৈত্য বায়ুর গুণবিশেষ।
আমাদের পৃথিবী হচ্ছে চেপ্টা। তার গভীরতা তেমন কিছু নাই। অন্তরীক্ষের নক্ষত্ররাজী অগ্নিপিণ্ড। এগুলি নিশ্চয় অন্তরীক্ষে আপন স্থানে কোনো কিছু দিয়ে আটকা আছে। সেই অবস্থায় আকাশের দৃশ্যমান অস্তিত্বগুলি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তারকারাজি অগ্নিগোলক। কেবল দূরত্বের কারণে তার তাপ আমাদের দগ্ধ করতে পারে না। দিনরাত্রির ভেদাভেদের কারণ নিশ্চয়ই এই যে, আবর্তিত হতে হতে চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্র পৃথিবীর সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতের আড়ালে গেলে আমরা ওদের দেখতে পাই না। জমাট বায়ু থেকে যেমন মেঘের সৃষ্টি, তেমনি জমাট বায়ুর কারণেই বৃষ্টি, শিলাবর্ষণ এবং বিদ্যুৎ ও বজ্রের উৎপত্তি।
বিশ্বে যে একটা নিয়মের ব্যাপার চলেছে। তা এনাক্সিমেনিসের দৃষ্টি এড়ায় নি। কিন্তু নিয়মের কারণেই নিয়ম এরূপ তত্ত্বে পৌছার অবস্থা তখনো জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে পৌঁছে নি। এনাক্সিমেনিস বললেন, কারণ বাদে কোনো কাজ হতে পারে না। নিয়মেরও নিশ্চয়ই কারণ আছে। আর সে কারণ হচ্ছে বায়ু। আমাদের আত্মা যেমন আমাদের দেহের সূত্রধর, তেমনি বায়ু সমস্ত বিশ্বকে ধারণ করে তার নিয়মের মূল বা সূত্র হিসাবে কাজ করেছে।
গ্রিকদর্শনের আদি যুগে বস্তুজগতের সৃষ্টি এবং সংগঠন সম্পর্কে যে অন্বেষা চলছিল, সে অন্বেষার ক্ষেত্রে এনাক্সিমেনিসের উপরোক্ত অভিমতসমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ‘ঘূর্ণ্যমান বায়ু পর্যায় বিশেষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, এবং নতুন অস্তিত্ব তৈরি করতে পারে’ এনাক্সিমেনিসের এই অভিমতের মধ্যে ‘সংখ্যা থেকে গুণে রূপান্তরের’ দ্বন্দ্বমূলক বৈজ্ঞানিক সত্যোপলব্ধির স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
Annexation: পররাজ্য গ্রাস
কোনো অঞ্চল কিংবা অপর কোনো রাষ্ট্র্রের কোনো অংশকে জোর দখল করাকে পররাজ্য গ্রাস বলে। এরূপ দখলের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দখলকারী রাষ্ট্র প্রয়োগ করে। অপর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাংশের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ পররাজ্যগ্রাসের একটি লক্ষণ হলেও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কোনো আশ্রিত বা অছিরাষ্ট্রকে এই পর্যায়ভুক্ত করা চলে না। অছিভুক্ত একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাও সাময়িককালের জন্য অপর রাষ্ট্রের হাতে দেওয়া যেতে পারে।
Animism: আত্মবাদ, সর্বপ্রাণবাদ
ল্যাটিন এ্যানিমা শব্দ থেকে ইংরেজি এ্যানিমিজম শব্দের উৎপত্তি। ‘এ্যানিমার’ অর্থ হচ্ছে আত্ম। আত্মার নিজস্ব থাকার অভিমতকে ‘আত্মাবাদ’ বলা চলে। এই অর্থে ‘আত্মাবাদ’ মানুষের প্রাচীনতম অভিমতগুলির অন্যতম। উৎপাদনের অনুন্নত এবং প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ যখন প্রকৃতির নিকট অসহায় ছিল তখন বাঁচার প্রয়োজনে প্রাকৃতিক নানা রহস্যের সন্ধান পাবার সে চেষ্টা করেছে। সে দেহ কিছুকাল পূর্বেও সচল ছিল সে দেহ মৃত্যুর কারণে এখন নিশ্চল। তা হলে মৃত্যু কি? মানুষ ভেবেছে, মৃত্যু হচ্ছে দেহ থেকে আত্মার তিরোধান। আদিকাল থেকে কথাটা আজো আমাদের মধ্যে চলে আসছে। এখনো আমরা মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করি। মানুষ নিদ্রা যায়। তখন আত্মা দেহে থাকে না। তাই মানুষের চেতনা থাকে না। কিন্তু আবার আত্মা দেহে প্রত্যাবর্তন করে। দেহে তাই চেতনার সঞ্চার হয়। মৃত্যুকালেও আত্মা দেহ ছেড়ে প্রস্থান করে। যে আত্মা আজ প্রস্থান করেছে, সে কাল হয়তো ফিরে আসবে। তাই প্রাচীনকালে মানুষ মৃতদেহ কবরে রেখে আসার সময়ে আত্মার জন্য প্রয়োজনীয় সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রীও রেখে আসত । আত্মা যখন আবার ফিরবে তখন সে নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত থাকবে। ক্ষুধার্ত আত্মা যেন নিরন্ন, উপবাসী না থাকে, তাই এই ব্যবস্থা। আত্মা একবার প্রস্থান করলে সহজে আবার না-ও ফিরতে পারে। সে পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন রয়েছে। তাই ভারত মহাসাগরে ‘বিপদ-দ্বীপে’র মানুষ এখনো বিভ্রান্ত আত্মাকে ধরার জন্য ফাঁদ ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। আত্মা যে-কোনো দেহ বা বস্তুতেই আশ্রয় নিতে পারে। যে- আত্মা মানুষের ছিল, সে-আত্মা স-জীব, যে-কোনো আধারে প্রবেশ করতে পারে। তাই ইট, পাথর, গাছ, লতা-পাতা, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছুরই আত্মা আছে। এ-কারণেই এ তত্ত্ব সর্বপ্রাণবাদ বলেও পরিচিত। জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের মূলেও এই বিশ্বাস। আত্মার স্বাদীন অস্তিত্ব ধর্মীয় বিশ্বাসেরই অপরিহার্য অংশরূপে স্বীকৃত। এই বিশ্বাস থেকে দেবদূত, ভূত, প্রেত ইত্যাদি অস্তিত্বের কথাও মানুষ কল্পনা করেছে। অশান্ত, বিভ্রান্ত কিংবা দুষ্ট আত্মাকে জয় করার প্রয়োজনে মানুষের আদিম অবস্থায় তুক-তাক মন্ত্র বা জাদুবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। সর্বপ্রাণ এবং আত্মাবাদ মানুষের আদিম সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ইংরেজ গ্রন্থাকার ই.বি টেইল তাঁর বিখ্যাত ‘প্রিমিটিভ কালচার’ পুস্তকে সর্বপ্রাণ এবং আত্মাবাদের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
Anselm: এনসেলম (১০৩৩-১১০৯ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক। এনসেলম ধর্মের সঙ্গে যুক্তির মিলন ঘটাবার চেষ্টা করেন। তৎকালে অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং গোঁড়ামির যে প্রবল ধারা খ্রিষ্টিয় সমাজে প্রচলিত ছিল, এনসেলম তার মধ্যে যুক্তির ভূমিকা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। যুক্তি মাত্রই ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে-প্রচলিত এই ধারণার তিনি বিরুদ্ধতা করেন।এনসেলম বলেন যে, যুক্তি বিশ্বাসকে বিনষ্ট করবে এমন কোনো কারণ নেই। যুক্তি ধর্মীয় বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করতে পারে। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে এনসেলম ঘোষণা করেন: ‘জ্ঞানের জন্যেই আমি বিশ্বাস করি।’ অন্ধবিশ্বাস জ্ঞানকে সাহায্য করে না। তাই অন্ধবিশ্বাস নয়, যুক্তির উপর ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এনসেলমের এই অভিমতের অনুসরণেই মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মের ক্ষেত্রেও যুক্তি-তর্ক প্রয়োগের একটি ঐতিহাসিক ধারার সূচনা হয়। এই ধারা স্কলাসটিসিজম নামে পরিচিত। এনসেলম বিধাতার অস্তিত্বের জন্য দার্শনিক প্রমাণ উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি দুখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এর একখানি গ্রন্থে তিনি জাগতিক অস্তিত্বের ভিত্তিতে বিধাতার অস্তিত্বের প্রমাণ দেন। অপর গ্রন্থে বিধাতার গুণাবলীর আলোচনা করেন।
Antagonistic and Non-Antagonistic Contradiction: আপসহীন এবং আপসমুলক বিরোধ
সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় মাকর্সপন্থীগণ আপসহীন এবং আপসমূলক বিরোধ কথা দুটি ব্যবহার করেন। মাকর্সবাদ তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে বিরোধী শক্তির সংঘাতের মাধ্যমেই সমাজ বিকাশ লাভ করে, সমাজের এক স্তরের স্থানে নতুন স্তর প্রতিষ্ঠালাভ করে। বিরোধ হচ্ছে সমাজ বিকাশের প্রাণশক্তি। একেবারে বিরোধশূন্য কোনো জীবন বা সমাজের কল্পনা মার্কসবাদের মতে অবাস্তব কল্পনা। মাকর্সপন্থীগণ বিরোধকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এক শ্রেণীর বিরোধকে তাঁরা বলেন, আপসহীন বিরোধ। অপর শ্রেণীকে তাঁরা আপসমূলক বিরোধ বলে আখ্যায়িত করেন। উৎপাদনের মারফতই মানুষ জীবন ধারণ করে। উৎপাদনের হাতিয়ার বা উপায়ের মালিকানার তারতম্যের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ সমাজের অধিবাসীগণ বিভিন্ন আর্থিক শ্রেনীতে বিভক্ত হয়। কোনো বিশেষ যুগের উৎপাদনের হতিয়ার যাদের একচ্ছত্র মালিকানায় কবলিত হয়, তারা শোষক এবং শাষকে পরিণত হয় এবং সে যুগে যাদের হাতে উৎপাদনের উপায়গুলি থাকে না তারা শোষিত এবং নির্যাতিত শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের পরে এই কারণেই সমাজে কোনো যুগে মানুষ প্রভু এবং দাসে বিভক্ত হয়েছে; কোনো যুগে ভূস্বামী এবং ভূমিদাসে এবং আর এক যুগে পুঁজিপতি এবং শ্রমিকে বিভক্ত হয়েছে। শ্রেণীতে শ্রেণীতে এরূপ বিরোধকে মাকর্সপন্থীগণ আপসহীন বিরোধ বলে বিবেচনা করেন। এরূপ বিরোধ আপসহীন এই কারণে যে, এদের উভয়ের স্বার্থ এরূপ পরস্পর-বিরোধী যে, এর কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। বিরোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে চরম অবস্থায় তীব্রতম সংঘর্ষে বা বিপ্লবের মাধ্যমে এর সমাধান ঘটে। অর্থ্যাৎ উৎপাদনের হাতিয়ারে নতুন মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটে, পূর্বতন মালিকশ্রেণী ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ক্রমান্বয়ে সমাজের আর্থিক কাঠামো থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই নিয়মে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস সমাজ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রুপান্তরিত হয়েছে। আধুনিককালে পুঁজিবাদী সমাজ সমাজতান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের উপর মালিকানা নিয়ে শ্রেণী-বিভাগের সৃষ্টি হবে এবং আপসহীন বিরোধের অবকাশ থাকবে, মার্কসবাদীগণ এরূপ অভিমত পোষন করেন না। সমাজতন্ত্রবাদে উৎপাদনের হাতিয়ার নিয়ে অর্থ্যাৎ উৎপাদনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপসহীন বিরোধের অবকাশ থাকে না। কিন্তু আপসমূলক বিরোধের অবকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজেও থাকবে। আপসমূলক বিরোধ বলতে তাঁরা পুরাতন ভাবধারার সাথে নতুন ভাবধারার বিরোধ, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও আঞ্চলিক অসাম্যের বিরোধ, কায়িক এবং মানসিক শ্রমের মূল্য নির্ণয়ের বিরোধ, গ্রাম ও শহরের আপেক্ষিক বিরোধ-ইত্যাদির কথা বুঝান। এ সমস্ত বিরোধ সমাধানের জন্য চরম সংঘর্ষ কিংবা বিপ্লবের আবশ্যক হবে না। শ্রেণীগত আর্থিক শোষণের বিলোপের পরে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষ যত অধিক পরিমাণে জয় করে মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করতে থাকবে, তত অধিক পরিমাণে আপসমূলক বিরোধগুলিরও সমাধান ঘটতে থাকবে। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে নতুনতর বিরোধের উদ্ভব ঘটবে কিন্তু সে বিরোধ আপসহীন নয়; সে বিরোধ আপসমূলক।
Anti-Duhring: এ্যাণ্টিডুরিং
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর একখানি গ্রন্থের প্রচলিত মান হচ্ছে ‘এ্যাণ্টিডুরিং’। আসলে এঙ্গেলস-এর গ্রন্থখানির মূল নাম হচ্ছে ‘হার ইউজেন ডুরিংস রিভোল্যুশন ইন সায়েন্স’ বা ‘হর ইউজেন ডুরিংকৃত বিজ্ঞানে বিপ্লব’। নামটির মধ্যে একটি ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে। কারণ ডুরিং নামক সমকালীন এক লেখক মাকর্সবাদের ভূল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। তাঁর সেই ভূল ব্যাখ্যার সমালোচনা হিসাবে এঙ্গেলস ১৮৭৬ সালে ধারাবহিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই সমস্ত সমালোচনামূলক প্রবন্ধের সংকলন উল্লিখিত নামে ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ্যাণ্টিডুরিং-এর মধ্যে এঙ্গেলস মাকর্সবাদের তিনটি মুল দিকের ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন ১. দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; ২. রাষ্ট্রনীতিক অর্থনীতি; ৩. বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের তত্ব। গ্রন্থের তিনটি ভাগে এই মূল বিষয়গুলির আলোচনা করা হয়। প্রথমভাগে এঙ্গেলস দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি দর্শনের মূল প্রশ্ন কি, বস্তুজগতের মূল বিধান, জ্ঞানের সমস্যা, স্থানকালের বস্তবাদী ব্যাখ্যা এবং বস্তুর গতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনায় এঙ্গেলস বিবর্তনের ডারউইনীয় তত্ত্ব, বিকাশে জৈবকোষের ভূমিকা, কাণ্টের বিশ্বতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের উপর তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। এই অংশে এঙ্গেলস সামাজিক নীতি, সাম্য এবং ব্যক্তির কার্যে স্বাধীনতা এবং অনিবার্যতার প্রশ্নও আলোচনা করেন। গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগে এঙ্গেলস রাষ্ট্রনীতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণকালে ডুরিং-এর তত্ত্বের সমালোচনা করেন। দ্রব্যমূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্য, পুঁজি, জমির খাজনা প্রভৃতি অর্থনীতিক প্রশ্নে মাকর্সবাদের তত্ত্বগুলি এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন। সমাজের বিকাশের মূল নিয়ামক কে? ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় শক্তি? না মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক? এই প্রশ্নে শক্তির তত্ত্বকে নাকচ করে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিয়ামক ভূমিকার কথা এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং অর্থনীতিক শ্রেণীর উদ্ভব এবং বিকাশকে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেন। গ্রন্থের তৃতীয়ভাগে এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেন এবং কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার পার্থক্য নির্দিষ্ট করে দেন। সমাজতন্ত্রে এবং সাম্যবাদে দ্রব্যের উৎপাদন এবং বন্টন কি রূপ গ্রহণ করবে, পরিবারের কি রূপান্তর ঘটা সম্ভব, শিক্ষা-ব্যবস্থা কীভাবে পুনর্গঠিত হবে, শহর ও গ্রামের মধ্যকার বিরোধ কীভাবে বিলুপ্ত হবে, দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের পার্থক্য কীভাবে নির্ধারিত হবে-সমাজতান্ত্রিক সমাজের ইত্যাকার সমস্যারও এঙ্গেলস আলোচনা করেন এবং তা সমাধানের সূত্র ব্যাখ্যা করেন। বস্তুত এ্যাণ্টিডুরিং মাকর্সবাদের একখানি মৌলিক গ্রন্থ। মাকর্সকাদের মূল প্রশ্নসমূহের প্রাঞ্জল আলোচনা গ্রন্থখানিকে জনপ্রিয় চিরায়িত সৃষ্টিতে পরিণত করেছে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি