হাদীস সংকলনের চূড়ান্ত পর্যায়
পূর্বের আলোচনা হইতে পাঠকদের নিকট একথা সুস্পষ্ট হইয়াছে যে, তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীসের চর্চা, প্রচার, সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ অধিকতর উন্নতি, বিকাশ সম্প্রসারণ ও উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। ইহার এক একটি বিভাগ স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মর্যাদা সহকারে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ এই শতকে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার দিকে পূর্বের তুলনায় অনেক ব্যাপক ভিত্তিতে মনোনিবেশ করিয়াছেন। হাদীস সংগ্রহকারিগণ হাদীসের সন্ধানে মুসলিম জাহানের প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পর্যটন করিয়াছেন, প্রত্যেকটি স্থানে উপস্থিত হইয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করিয়াছেন। সংগ্রহীত হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলিত করিয়া বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বৃহদাকারের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।

এই শমতকে মুসলিম সমাজে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যাহার ফলে হাদীস-বিজ্ঞান নামে স্বতন্ত্র এক জ্ঞান বিভাগের উদ্ভাবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হইয়া পড়ে। হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহার নাম হইতেছে ******************** ‘হাদীস পর্যালোচনা ও সামালোচনা বিজ্ঞান’। হাদীস পর্যালোচনা ও সমালোচনা বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করার জন্য উপরোক্ত পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক।

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজ

তৃতীয় শতকের মুসলিম সমাজক এক কথায় বহুবিধ ইসলাম বিরোধী ভাবধারা ও ফিতনা-ফাসাদে জর্জরিত বলিয়া অভিহিত করিতে হয়। খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম সময় হইতেই ইসলামের উপর মুহুর্মুহু যে প্রচণ্ড আঘাত আসিতে থাকে, উহাকে সামরিক পরিভাষায় ‘বহিরাক্রমণ’ বলা যাইতে পারে। বিশেষত হযরত উসমান (রা) ও হযরত আলী (রা)-এর সময়কালীন আঘাতসমূহকে এই পর্যায়ে গণ্য করা যায়। কিন্তু ইসলাম এই সকল বহিরাক্রমণকে উহার অন্তর্নিহিত প্রবণ শক্তি ও দৃঢ়তার বলে প্রতিহত করিয়া দেয়। পরবর্তীকালে ইসলামী খিলাফতকে চূর্ণ করিয়া দিয়া জাহিলিয়াতের সর্বপ্লাবী সয়লাবে ইসলামের নাম-নিশানা পর্যণ্ত ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু সাহাবা-উত্তরকালে একনিষ্ঠ তাবেয়ীনের অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনা ও অভিনিবেশের ফরে ইসলাম উহার আদর্শিক বুনিয়াদকে মজবুত ও অটল করিয়া রাখিতে সমর্থ হয়। ইসলামের দুশমনগণ বহিরাক্রমণের আঘাতে উহাকে খতম করিতে ব্যর্থ হইয়া উহার অভ্যন্তর হইতে গোপন ষড়যন্ত্রের সাহায্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। এই পর্যায়ে ইসলামের দুশমনগণ ইসলামের নামে এমন সব চিন্তু, মত, আকীদা ও বিশ্বাস সর্বসাধারণ মুসলমানের মধ্যে অবলীলাক্রমে প্রচার করিতে থাকে, যাহার ফলে তৈলহীন প্রদীপের মত ভিতর হইতেই নিঃশেষে ইসলামের চির নির্বাণ লাভের উপক্রম হয়।

মুসলিম সমাজে এই পর্যায়ে যেসব বাতিল চিন্তা ও মতবাদের উদ্ভব হয়, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম হইতেছে বল্গাহীন বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল প্রবণতা। বুদ্ধির কষ্টিপাথরে ইসলামের মৌলিক আকীদা বিশ্বাস পর্যন্ত ওজন ও যাচাই করা শুরু হয়। যাহা মানুষের সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ বুদ্ধি ও বিবেকের তুলাদন্ডে উত্তীর্ণ হয় না, তাহা প্রত্যাখ্যাত হইতে থাকে। ইহাতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক আকীদা- যাহার উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত – পরিত্যক্ত হইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃত হইতে থাকে।

ইহার পর কুরআন ‘মখলূক’ (সৃষ্ট) কি ‘গায়র মখলূক’ (অসৃষ্ট কাদীম) এই পর্যায়ে মুসলিম সমাকে আলোচনা ও বিতর্কের এক প্রচণ্ড তাণ্ডবের সৃষ্টি হয়। ফলে কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশসমূহ নিষ্ঠা সহকারে পালন করিয়া চলার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়, মানুষ এই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর বিতর্কে পড়িয়া বিভ্রান্ত ও গোমরাহ হইতে শুরু করে।

আব্বাসী যুগের শেষভাগে মুসলিম সমাজে নাস্তিকতাবাদ একটি আকীদা ও বিশ্বাস হিসাবে প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। এই সময়কার নাস্তিকতাবাদগণ প্রকাশ্যভাবে নিজেদেরকে মুসলিম বলিয়া দাবি জানাইত বটে; কিন্তু ভিতরে তাহারা গোটা ‘দ্বীন’কেই সম্পূর্ণরূফে অস্বীকার করিয়া চলিত। এই যুগের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত গ্রীক গ্রন্হাবলী আরবী ভাষায় অনুদিত হয় এবং মুসিলম সমাজে ইহা ব্যাপকভাবে পঠিত ও চর্চা হইতে শুরু হয়। ফলে নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মহীনতার চিন্তা এক বিজ্ঞানসম্মত মত হিসাবেই জনগণের নিকট গৃহীত হইতে থাকে।

প্রাচীনকালে অমূলক কিসসা-কাহিনীও এই সময় মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করিতে শুরু করে। স্বকপোলকল্পিত কাহিনীতে রঙ-চঙ লাগাইয়া জনগনের নিকট অধিকতর আকর্ষনীয় করিয়া তুলিবার জন্য সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করা হয়। উহাকে হাদীসের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি অনুযায়ী রূপ দিতে ও রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতেও দ্বিধাবোধ করা হইত না। ফলে কুরআন ও রাসূলের হাদীস হইতে সাধারণ মুসলমানের দৃষ্টি ফিরিয়া উহার বিপরীত দিকেই সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ হয়। বস্তুত এই সকল ব্যাপারই ছিল ইসলামের পক্ষে মারাত্মক ফিতনা এবং হাদীস জালকরণের ব্যাপক প্রবণতাই এই ফিতনার বাস্তব রূপ।

উল্লিখিত ফিতনাসমূহের প্রত্যেকটি পর্যায়ে বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, রাসূলের হাদীস হইতে সমর্থন গ্রহণের জন্য দূরন্ত চেষ্টা চালানো হইয়াছে। কিন্তু রাসূলের প্রকৃত হাদীসসমূহে যখন উহার একটির প্রতিও একবিন্দু সমর্থন পাওয়া যায় নাই, তখন তাহারা সকলেই- এই ফিতনাসমূহের প্রায় সকল ধারকই- নিজস্বভাবে কথা রচনা করিয়া রাসূলের নামে হাদীস বর্ণনাসূত্র (সনদ) জুড়িয়া দেওয়া হয় এবং উহাকে এমনভাবে পেশ করা হইতে থাকে, যেন সকলেই উহাকে রাসূলের মুখ নিঃসৃত বাণী বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লয়- অন্তত এই দিক দিয়া সন্দেহ করার কোন প্রকাশ্য কারণ না থাকে। ঠিক এই অবস্থায় প্রত্যেকটি হাদীস সমালোচনার কষ্টিপাথরে ওজন ও যাচাই করিয়া লওয়ার অপরিহার্য প্রয়োজন দেখা দেয় এবং হাদীস নামে বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাকে যাচাই পরীক্ষা করিয়া কোনচি প্রকৃতপক্ষে রাসূলের বাণী ও কোনটি নয়, তাহা নির্ধারণ করার জন্য কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য উপায় পদ্ধতি হিসেবে হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞান পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।[******************** গ্রন্হের ৩৬১ পৃষ্ঠা হইতে ৩৪২ পর্যন্ত আলোচনা ছায়া অবলম্বনে।] ইহার ফলে ইসলামকে খতম করার এই ভিতরের দিক হইতে আসা আক্রমণও শেষ পর্যন্ত চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সহজেই চিন্তা করা যায়, এই সময় যদি হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করার দিকে উক্ত রূপ গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য আরোপ করা না হইত, তাহা হইলে মিথ্যা হাদীসের স্তূপ মুসলিম মানসকে সর্বাত্মকভাবে আচ্ছন্ন ও পূর্ণমাত্রায় গোমরাহ করিয়া ফেলিত, তাহাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ নাই। উপরিউল্লিখিত প্রত্যেকটি ফিতনার সময় যখনই মুসলিমদের দৃষ্টি কুরআন হাদীস হইতে ভিন্নদিকে ফিরিয়া যাইতে শুরু করিয়াছে, তখনি সমাজে এমন সব মহান ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে, যাঁহারা প্রবল শক্তিতে হাদীস হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন, পুঞ্জীভূত আবর্জনা দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রকৃত হাদীসে রাসূলকে জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং মুসলিম মানসলোককে রাসূলের প্রকৃত হাদীসরে অম্লান আলো বিকিরণে সমুদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছেন। এই ব্যাপারে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যে ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়োজিত হইয়াছে, তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।

খিলাফতে রাশেদার পরে উমাইয়া বংশের লোক উমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা নির্বাচিত হইয়া হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের জন্য যে ব্যাপক ব্যবস্থা সরকারী পর্যায়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে এ কথা পুনরায় ঘোষণা করা যাইতে পারে যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা গৃহীত না হইলে রাসূলে করীমের বিপুল সংখ্যক দুনিয়ার বুক হইতে বিলীন হইয়া যাইত।

বনু আব্বাসীয়দের সময়েও যখন হাদীসের উপর সমূহ বিপদের ঘনঘটা সমাচ্ছন্ন হইয়া আসিয়াছিল তখনো একজন খলীফা (আসলে বাদশাহ) হাদীস সংরক্ষণ ও উহার সঠিক প্রচারে উদ্যোগী হন। তিনি হইতেছেন আল-মুতাওয়াককিল আলাল্লাহ (২৩২ হিঃ)। তিনি স্বভাবতই সুন্নাতে রাসূলের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই মুসলিম জাহানের সর্বত্র হাদীস সংরক্ষণ ও উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ পাঠাইলেন। এই সময়কার শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ আবূ বকর ইবনে শায়বা জামে রাসাফা’য় হাদীস শিক্ষাদান শুরু করেন। ফলে তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষার জন্য মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে প্রায় ত্রিশ সহস্র ব্যক্তি সমবেত হয়, অপর দিকে তাঁহারই সহোদর উসমান ইবনে আবূ বকর জামে আল মনসুর এ হাদীস অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁহার সম্মুখেও অনুরূপ সংখ্যক হাদীস শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়।

হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণের প্রতি আল-মুতাওয়াককিলের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখিয়া সমস্ত মুসলিম জনতার দিল আল্লাহর নিকট তাঁহার জন্য আকুল প্রার্থনায় উচ্ছাসিত হইয়া উঠে; তাঁহার প্রশংসা তাহারা বাকমুখর হইয়া উঠে, সকলেই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধ ও সম্মান প্রদর্শন করিতে থাকে। এমনকি এই সময় জনগনের নিম্নোক্ত কথাটি একটি সাধারণ উক্তিতে পরিণত হয়ঃ

******************************************************

খলীফা তো মাত্র তিনজনঃ মুরতাদগণকে দমন ও হত্যা করার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর, জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করণে উমর ইবনে আবদুল আযীয এবং হাদীস ও সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন এবং বাতিল পন্হীদের দমন ও ধ্বংস সাধনে আল মুতাওয়াককিল।[********************]

অপরদিকে হাদীস সংগ্রহ, সংকলন ও বাছাই-ছাঁটাইর পর সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরণের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই শতকের অপূর্ব গুরুত্ব, মর্যাদা এবং ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হইয়াছে। এই বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্য যে প্রতিভা ও দক্ষতা অপরিহার্য ছিল, আল্লাহর অনুগ্রহে তাহাতে ভূষিত হইয়াছে কয়েকজন ব্যক্তি আবির্ভূত হন। তাঁহারা হইতেছেন ছয়খানি সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ- প্রণেতা- ছয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদঃ

১. ইমাম বুখারী, ২. ইমাম মুসলিম, ৩. ইমাম নাসায়ী, ৪. ইমাম তিরমিযী, ৫. ইমাম আবূ দাউদ এবং ৬. ইমাম ইবনে মাজাহ। তাঁহাদের প্রত্যেকের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ জ্ঞান ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক একটি বিস্ময়।

এখানে আমরা প্রথমে এক একজন হাদীসবিদের জীবনালেখ্য সংক্ষেপে আলোচনা করিব এবং পরে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের বিস্তারিত পরিচয় স্বতন্ত্রভাবে পেশ করিব। এই আলোচনা হইতে এই শতকে হাদীসের চরম পর্যায়ের উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ সম্ভব হইবে।


ইলমে হাদীসের ছয়জন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি
ইমাম বুখারী (র)

ইমাম বুখারী (র)-এর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম। তিনি মুসলিম অধ্যুীষত এবং ইসলাম সংস্কৃতি ও সভ্যতার লীলাকেন্দ্র বুখারা নগরে ১৯৪ হিজরীর ‌১৩ ই শওয়াল শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালেই তাঁহার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের স্নেহময় ক্রোড়ে তিনি শৈশব লালিত পালিত হন। তিনি যখন মকতবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভে রত ছিলেন, সেই সময়েই তাঁহার মনে হাদীস শিক্ষালাভের উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। এ্ই সম্পর্কে ইমাম বুখারী (র) নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মতবের প্রাথমিক লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকার সময়ই হাদীস মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার মনে ইলহাম হয়।[********************]

এই সময় তাঁহার বয়স কত ছিল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছেনঃ ‘দশ বৎসর কিংবা তাহারও কম।[********************]

একাদশ বৎসর বয়সে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর বিস্ময়কর প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। এই সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই সময় (******************** ) সুফিয়ান আবূয যুবাইর হইতে ও আবূয যুবাইর ইবরাহীম হইতে- এই বর্ণনা সূত্রে হাদীস জনসমক্ষে প্রচার করা হইতেছিল। তদানিন্তন মুহাদ্দিস দাখেলীর নিকট এই সূত্র শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলিয়া উঠিলেনঃ

এই সূত্র ঠিক নহে, কেননা -******************** – ‘আবূয যুবাইর ইবরাহীমের নিকট হইতে কোন হাদীস আদৌ বর্ণনা করেন নাই।

মুহাদ্দিস দাখেলী একাদশ বৎসরের এই বালকের স্পর্ধা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তিনি বালককে ধমক দিলেন। তখন ইমাম বুখারী (র) বলিলেনঃ

******************************************************

আপনার নিকট মূল গ্রন্হ বর্তমান থাকিলে একবার তাহাই খুলিয়া দেখুন (ও আমার কথার সত্যতা যাচাই করুন)
# বুখারা নগর উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত। বর্তমানে এই নগরটি মধ্য এশিয়ার রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। মা- আরায়িন- নহর এলাকায় একটি প্রধান নগররূপে গণ্য- জীহুন নদীর তীরে। ইরানের সমরকন্দ হইতে ৩০০ কিলোমিটার দূরে।

ইমাম বুখারী বলিলেনঃ ‘এখানে এই সূত্রে ‘আবূয যুবাইর’ ভূল বলা হইতেছে, আসলে বর্ণনার সূত্র হইবে ‘যুবাইর ইবনে আদী ইবরাহীম হইতে- এইরূপ’।

অতঃপর মুহাদ্দিস দাখেলী মূল গ্রন্হ খুলিয়া দেখিলেন, বালক আবূ আবদুল্লাহর কথাই সত্য, মূল গ্রন্হে অনুরূপই লিখিত রহিয়াছে।[********************]

ইমাম বুখারী যখন ষোল বৎসর বয়স অতিক্রম করিয়াছিলেন তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইমাম অকী’র সংকলিত হাদীসগ্রন্হ সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন।[********************]

ইহার পর ইমাম বুখারী তাঁহার মা ও ভাই সমাভিব্যাহারে হজ্জে গমন করেন। ইহার পূর্বে তিনি বুখারায় অবস্থানকারী সকল মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ সমাপ্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সফর অনুষ্ঠিত হয় ২১০ হিজরী সনে।[********************] হজ্জে আগমন করিয়া তিনি একাধারে ছয় বৎসর পর্যন্ত হিজাযে অবস্থান করেন। তখন তিনি একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে হাদীস শিক্ষায় মনোযোগ দিয়াছিলেন, অনুরূপভাবে ইহার সঙ্গে সঙ্গেই তিন লেখনীও পরিচালনা করিয়াছিলেন পূর্ণমাত্রায়। ইমাম বুখারী তাঁহার এই সময়কার লেখন পরিচালনা ও গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আঠারো বৎসর অতিক্রম করিতেছিলাম, তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের বিচার-ফয়সালা সম্পর্কে একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করি। অতঃপর আমি মদীনায়ী রাসূলে করীম (স)-এর কবরের নিকটে বসিয়া ‘আততারীখুল কবীর’ গ্রন্হ রচনা করি। আর চন্দ্রদীপ্ত রাত্রিতে এই লেখনীর কাজ চালাইতাম।[********************]

হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইমাম বুখারী বহু দেশ ও শহর পরিভ্রমন করিয়াছেন। এক-একটি শহরে উপস্থিত হইয়া সম্ভাব্য সকল হাদীস তিনি আয়ত্ত করেন। তাঁহার পর তিনি অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এইভাবে বিশাল ইসলাম রাজ্যের উল্লেখযোগ্য কোন শহর এমন ছিল না, যেখানে তিনি উপস্থিত হইয়া হাদীস হাদীস সংগ্রহ করেন নাই। আল্লামা যাহবী এই প্রসঙ্গে বলেন, বাগদাদ, মক্কা, বসরা, কূফা, আসকালান, হিমস, দামেশক প্রভৃতি শহরের নাম উল্লেখ করিয়াছেন এবং কোন শহরের কোন মুহাদ্দিস হইতে ইমাম বুখারী হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাঁহার নামও লিখিয়া দিয়াছেন।[********************]

কিন্তু এই তালিকা সম্পূর্ণ নয় বলিয়াই মনে হয়। আল্লামা খতীব বাগদাদী ইমাম বুখারীর এই দেশ সফর সম্পর্কে এক কথায় বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইলমে হাদসের সন্ধানে সমগ্র শহরের সকল মুহাদ্দিসের নিকটই তিনি উপস্থিত হইয়াছেন।[********************]

তাঁহার এই পরিভ্রমন সম্পর্কে একটি ব্যাপক ধারণা দানের উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি সিরিয়া,মিসর ও জযীরায় দুই দইবার করিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বসরা গিয়াছি চারবার। হিজাযে ক্রমাগত ছয় বৎসর পর্যন্ত অবস্থান করিয়াছি। আর কূফা ও বাগদাদে যে আমি কতবার গমন করিয়াছি ও মুহাদ্দিদের খিদমতে হাযির হইয়াছি, তাহা আমি গণনা করিতে পারিব না।[********************]

ইমাম বুখারী (র) একবার সমরকন্দে উপস্থিত হইলেন। তখন প্রায় চারশত মুহাদ্দিস তাঁহার সম্মুখে সমবেত হন। তাঁহারা ইমাম বুখারীর হাদীস সম্পর্কে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের খ্যাতি পূর্বেই শুনিতে পাইয়াছিলেন। এই কারণে তাঁহারা ইমাম বুখারীকে পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন। তাঁহারা এই উদ্দেশ্যে কতকগুলি হাদীসের মূল বাক্যাংশ উহার সনদ সূত্র হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অপর একটি হাদীসের সনদের সহিত জুড়িয়া দিলেন এবং সনদগুলিও উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া রাখিলেন। অতঃপর ইহা ইমাম বুখারী (র)-এর সম্মুখে পাঠ করেন এবং উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করেন। ইমাম বুখারী (র)-র নিকট এই সমস্ত হাদীসই ছিল দর্পণের মত উজ্জ্বল। কাজেই কোথায় মূলকথা ও উহার সনদে ওলট-পালট করা হইয়াছে, তাহা তাঁহার বুঝিতে এতটুকু অসুবিধা হইল না, এতটুকু সময়ও লাগিল না। তিনি এক একটি হাদীস পাঠ করিয়া উহার দোষক্রটি উল্লেখ করিতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি হাদীসকে তিনি উহার আসল রূপে উহার নিজস্ব সনদসহ সজ্জিত করিয়া সমাগত মুহাদ্দিসগণের সম্মুখে পেশ করিলেন। মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর এই জওয়াবকে একান্তু সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিয়া পারিলেন না। ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেন, বাগদাদেও ইমাম বুখারীর প্রতি অনুরূপ প্রশ্ন করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত জবাব শুনিয়া মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হন।[********************]

ইমাম বুখারীর তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির কথা উল্লেখ করিয়া বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তিনি একবার মাত্র কিতাব পড়িতেন এবং একবার দেখিয়াই সমস্ত কিতাব মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন।[********************]

হাদীসে তাঁহার যে কি বিপুল,ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান ছিল, তাহা দুনিয়ার মুহাদ্দিসদের অকপট স্বীকৃতি হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। এখানে কয়েকজনের উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ

ইবনে খুযায়মা (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আসমানের তলে রাসূলের হাদীসের বড় আলিম এবং উহার বড় হাফেজ মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈলুল বুখারী অপেক্ষা আর কাহাকেও আমি দেখি নাই।[********************]

ইমাম মুসলিম একদিন ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন ও তাঁহার কপোলে চুম্বন করিলেন। বলিলেনঃ

******************************************************

আমাকে আপনার পদযুগল চুম্বন করার অনুমতি দিন হে সমস্ত উস্তাদের উস্তাদ মুহাদ্দিসদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং হাদসের ‘রোগের চিকিৎসক’।[********************]

ইমাম বুখারী অত্যন্ত ভদ্র, বীর ও পবিত্র স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আত্মসম্মানবোধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও নিতান্ত চেতনাসম্পন্ন। তিনি রাজা-বাদশাহর দরবারের ধারই ধারিতেন না, উহা হইতে বরং শত যোজন দূরে থাকিতেন চেষ্টা করিতেন প্রাণপণে।

এই সময় বুখারার শাসনকর্তা ছিলেন খালিদ ইবনে আহমদ আয-যাহলী। তিনি ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট লোক মারফত নির্দেশ পাঠাইলেনঃ

******************************************************

আপনি আপনার সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ ও ইতিহাস-গ্রন্হ লইয়া আমর নিকট আসুন, আমি আপনার নিকট হইতে উহার শ্রবণ করিতে চাহি।

ইমাম বুখারী (র) এই নির্দেশ মানিয়া লইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করিলেন এবং দূতকে বলিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

বাদশাহকে আমার এই কথা পৌঁছাইয়া দাও যে, আমি হাদীসকে অপমান করিতে ও উহাকে রাজা- বাদশাহদের দরবারে লাইয়া যাইতে পারিব না। তাঁহার এই জিনিসের প্রয়োজন হইলে তিনি যেন আমার নিকট মসিজিদে কিংবা আমর ঘরে উপস্থিত হন। আর আমর এই প্রস্তাব তাঁহার পছন্দ না হইলে কি করা যাইবে, তিনি তো বাদশাহ……….।

ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহাই ইমাম বুখারী ও বাদশাহর মধ্যে দূরত্ব ও মনোমালিন্য সৃষ্টির কারণ হইয়া দাঁড়ায়।[********************]

কিন্তু ইমাম হাকেম এই মনোমালিন্যের অন্য কারণ উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ আবদুল্লাহ যে কারণে বুখারা শহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান, তাহা এই যে, বাদশাহ খালিদ ইবনে আহমদ তাঁহাকে বাদশাহর প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সন্তানাদিগকেক ইতিহাস ও হাদীস-গ্রন্হ পড়াইবার আদেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম বুখারী এই আদেশ পালন করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন এবং বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, এই কিতাব আমি বিশেষভাবে কিছু লোককে শুনাইব ও কিছু লোককে শুনাইব না, তাহা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না।[********************]

অতঃপর ইমাম বুখারী (র) সমরকন্দের নিকটে অবস্থিত খরতংক নামক শহরে চলিয়া যান এবং আল্লাহর নিকট দ্বীন-ইসলামের এই কঠিন বিপদ হইতে তাঁহাকে রক্ষা করার জন্য আকুল আবেদন করেন। এই সময় রাত্রিকালে নামাযান্তে তিনি যে দোয়া করিতেন, তাহাতে তিনি বলিতেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ! এই বিশাল পৃথিবী আমার প্রতি সংকীর্ণ হইয়ায গিয়াছে অতএব এখন তুমি আমাকে তোমার নিকট লইয়া যাও।[********************]

ইমাম বুখারী এই খরতংক শহরে ২৫৬ হিজরী সনের ৩০শে রজব ৬২ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম বুখারী (র) ইহজগত ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন; কিন্তু পশ্চাতে বিশ্ব-মুসলিমের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে কয়েকখানি অমূল্য ও বিরাট গ্রন্হ। তাঁহার মহামূল্য গ্রন্হাবলীর মধ্যে দুইখানি বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ। একখানি ‘সহীহুল বুখারী’- হাদীস সংকলন এবং অপরখানি ‘তারীখুল কবীর’।[********************]

ইমাম মুসলিম (র)

ইমাম মুসলিম (র)-এর পূর্ণ নাম আবূল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি ২০৪ হিজরী সনে খুরাসান অন্তঃপাতী নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের সব কয়টি কেন্দ্রই গমন করেন। ইরাক, হিজায, সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি শহরে উপস্থিত হইয়া তথায় অবস্থানকারী হাদীসের বড় বড় উস্তাদও মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।

ইমাম বুখারী (র) যখন নিশাপুর উপস্থিত হন, তখন ইমাম মুসলিম (র) তাঁহার সঙ্গ ধারণ করেন। তাঁহার বিরাট হাদীস জ্ঞান হইতে তিনিও যথেষ্ট মাত্রায় অংশগ্রহন করেন। এই শহরে ইমাম বুখারী (র)-এর বিরুদ্ধে প্রবণ প্রচারণা চলিতে শুরু করিলে ইমাম মুসলিম ইহার প্রতিরোধ করিত চেষ্টিত হন। একদিন একটি ঘটনা ঘটিয়া যায়। তিনি তাঁহার হাদীসের উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আযলীর মজলিসে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সহিত উপস্থিত ছিলেন। মুহাদ্দিস যাহলী সহসা ঘোষণা করেনঃ

******************************************************

বিশেষ একটি মাসায়ালায় যে লোক ইমাম বুখারীর মত বিশ্বাস করে ও তাঁহার রায় কবুল করে, সে যেন আামার এই মজলিস হইতে উঠিয়া যায়।

ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে ইমাম মুসলিম উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া এই উস্তাদের নিকট হইতে শ্রুত ও গৃহীত হাদীসসমূহের লিখিত সম্পদ ফেরত পাঠাইয়া দিলেন। অতঃপর তিনি যাহলীর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন।[********************]

ইমাম মুসলিম হাদীস সম্পর্কে বিরাট ও বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি যে হাদীসের ইমাম ছিলেন। এ বিষয়ে হাদীসজ্ঞ ব্যক্তিগণ সম্পূর্ণ একমত।[********************] সেকালের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্সা ও গ্রহণ করিয়াছেন। এই পর্যায়ে আবূ হাতিম আর-রাযী, মূসা ইবনে হারুন, আহমদ ইবনে সালমা, ইয়াহইয়া ইবনে সায়েদ, মুহাম্মদ ইবনে মাখলাদ এবং ইমাম তিরমিযী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা ইমাম মুসলিমের বিরাটত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একমত। হাদীসে ইমাম মুসলিমের অতি উচ্চ মর্যাদা ও স্থানের কথা তাঁহারা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। উপরস্তু ইমাম মুসলিম (র)-এর মহামূল্য গ্রন্হাবলী ও তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্যের কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। তন্মধ্যে তাঁহার সহীহ মুসলিম, আল-মুসনাদুল কবীর ও আল-জামেউল কবীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম মুসলিম ২৬১ হিজরী সনে ৫৭ বৎসর বয়সে নিশাপুরে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম নাসায়ী (র)

ইমাম নাসায়ী (র)-এর পূর্ণ নাম আবদুর রহমান আমদ ইবনে শুয়াইব ইবনে আলী ইবনে বাহর ইবনে মান্নান ইবনে দীনার আন-নাসায়ী। খুরাসান অন্তঃপাতী নাসা নামক শহরে ২১৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।[********************]

ইমাম নাসায়ী (র) হাদীসরে বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি পনের বৎসর বয়সেই বিদেশ সফরে গমন করেন। প্রথমে তিনি কুতাইবা ইবনে সায়ীদুল বালখীর নিকট উপস্থিত হন এবং এক বৎসর দই মাস কাল তথায় অবস্থান করিয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। অতঃপর তিনি মিসর গমন করেন। মিসরে তিনি দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি কয়েকখানি গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করেন। এই গ্রন্হসমূহ জনগনের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে এই সময়ই হাদীস শ্রবণ করিতে শুরু করে।

মিসর হইতে বাহির হইয়া ৩০২ হিজরী সনে তিনি দামেশক উপস্থিত হন। এখানে তিনি হযরত আলী ও খান্দানের রাসুলের প্রশংসামূলক গ্রন্হ রচনা সমাপ্ত করেন। তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, উমাইয়া বংশের শাসন-প্রভাবে জনগণ হযরত আলী (রা) ও রাসূল (স)-এর খান্দানের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করিতে শুরু করিয়াছেন। তিনি এই প্রবণতা দূরীভূতকরণ কিংবা উহার প্রচণ্ডতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে দামেখকের জামে মসজিদে তিনি উহা পাঠ করিতে শুরু করিলে এক ব্যক্তি উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলঃ আপনি মুয়াবিয়ার প্রশংসাসূচক কিছু লিখিয়াছেন কি? ইমাম নাসায়ী বলিলেনঃ ‘মুয়াবিয়া সমান সমানে নিষ্কৃতি পাইলেই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁহার প্রশংসা করার কি আছে?

এই কথা বলা সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে হইতে আওয়াজ উঠিলঃ ‘এই লোক শিয়া, এই লোক শিয়া’। এই বলিয়া তাঁহাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। ইহাতে ইমাম নাসায়ী মারাত্মক আহত ও কাতর হইয়া পড়েন। তিনি বলিলেনঃ আমাকে তোমরা মক্কা শরীফ পৌঁছাইয়া দাও, যেন শেষ নিঃশ্বাস সেখানেই ত্যাগ করিতে পারি। তাঁহাকে মক্কায় পৌঁছানো হইলে তিনি তথায় হিঃ ৩০৩ সনে ৮৯ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁহাকে দাফন করা হয়।[********************]

ইমাম নাসায়ী হাদীস ও ইলমে হাদীস সম্পর্কিত বিষয়ে বহু মুল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ‘সুনানে কুবরা’ ও ‘সুনানে সুগনা’- যাহাকে ‘আল মুজতাবা’ও বলা হয়- প্রভৃতি তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্হ।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ (র)

ইমাম আবূ দাউদের পূর্ণ নাম সুলাইমান ইবনুল আশযাস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আস-সিজিস্তানী। কান্দাহার ও চিশত-এর নিকটে সীস্তান নামক এক স্থানে তিনি ২০২ হিজরী সনে (৮১৯ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন।[********************]

হাদীস শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে মিসর, সিরিয়া, হিজাজ, ইরাক ও খুরাসান প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন এবং তদানীন্তন সুবিখ্যাত মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, উসমান ইবনে আবূ সাইবা, কুতাইবা ইবনে সায়ীদ প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণই হইতেছেন তাঁহার ইলমে হাদীসের উস্তাদ।[********************]

হাদীসে তাঁহার যে অসাধারণ জ্ঞান ও গভীর পারদর্শিতা ছিল, তাহা এ যুগের সকল মনীষীই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন এবং তাঁহার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির প্রশংসা করিয়াছেন। সেই সঙ্গে তাঁহার গভীর তাকওয়া ও পরহেজগারীর কথাও সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছেন।

ইমাম হাকেম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ দাঊদ তাঁহার যুগে হাদীসবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহার এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি মিসর, হিজাজ, কূফা ও বসরা এবং খোরাসানে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসায়ী হাদীসে তাঁহার ছাত্র। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল একদিকে ইমাম আবূ দাউদ (র)-এর উস্তাদ, অপর দিকে ইমাম আহমদ (র)-এর কোন কোন উস্তাদ ইমাম আবূ দাউদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ নিজেও কোন কোন হাদীস ইমাম আবূ দাউদ হইতে গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।

তিনি ২৭৫ হিজরী সনের ১৬ই শাওয়াল বসরা নগের ইন্তেকাল করেন।

ইমাম তিরমিযী (র)

ইমা তিরমিযীর পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফেজ আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা ইবনে মুসা ইবনে জাহকুস সুলামী আত-তিরমিযী। তিতি জীহুল নদীর বেলাভুমে অবস্থিত তিরমিযী নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীসে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁহা বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাস্য ও অকাট্য দলিল হিসাবে গণ্য। তিনি তাঁহার সময়কার বড় বড় হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ করিয়াছেন। কুতাইবা ইবনে সায়ীদ, ইসহাক ইবনে মূসা, মাহমুদ ইবনে গালীন, সায়ীদ ইবনে আবদুর রহমান, মুহাম্মদ ইবন বিশ্বার, আলী ইবনে হাজার, আহমদ ইবনে মুনী, মুহাম্মদ ইবনুল মাসান্না, সুফিয়ান ইবন অকী এবং মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলুল বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ।[********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে অনেক প্রশংসাসূচক কথা বলিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁহাকে ইমাম বুখারীর খলীফা বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন। ইমাম বুখারী নিজেও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ সফর করিয়া হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। কূফা, বসরা, রাই, খুরাসান, ইরাকও হিজাযে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর পরিভ্রমন করিত থাকেন।

ইমম তিরমিযী তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। একারব শুনিয়াই তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করিয়া লইতে সমর্থ হইতেন। জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েকটি হাদীসাংশ তিনি শ্রবণ করিয়াছিলেন; কিন্তু সেই মুহাদ্দিসের সহিত তাঁহার কোন দিন সাক্ষাৎ ছিল না, তাঁহার মুখেও তাহা শ্রবণ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। ফলৈ তিনি মনে মনে সেই মুহাদ্দিসের সন্ধানে উদগ্রীব হইয়াছিলেন। একদিন পথিমধ্যে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইয়া তাঁহার নিকট হইতে সম্পূর্ণ হাদীস শ্রবণের বাসনা প্রকাশ করিলেন। তিনি তাঁহার অনুরোধক্রমে সমস্ত হাদীস পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকা অবস্থায়ই মুখস্থ পাঠ করিলেন, ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসসূহ ইমাম তিরমিযী এই হাদীসসমূহ ইতিপূর্ব কখনো শুনি তে পান নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই একবার মাত্র শ্রবণ করিয়া তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইলেন এবং তখনি একবার পাঠ করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান উস্তাদকে শুনাইয়া দিলেন। ইহাতে তাঁহার একটি শব্দেরও ভূল ছিল না।[********************]

ইমাম তিরমিযী বহু মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। আল জামেউত তিরমিযী, কিতাবুল আসাম, আলকুনী, শামায়েলুত তিরমিযী, তাওয়ারীখ ও কিতাবুয যুহদ প্রভৃতি তাঁহার যুগান্তকারী গ্রন্হ।[********************]

শেষ জীবনে ইমাম তিরমিযীর দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত হয়। তিরমিয শহরেই তিনি ২৭৯ হিজরী সনে সত্তর বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম ইবনে মাজাহ (র)

ইমাম ইবনে মাজাহর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়যিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আল কাজভীনী। হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাস সম্পর্কে তিনি অতীব বড় আলিম ছিলেন।

তিনি ২০৯ হিজরী সনে (৮২৮ খৃঃ) ‘কাজভীন’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই শহর তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর সময় বিজিত হওয়ার পর হইতেই ইসলামী জ্ঞানে-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে গণ্য। তৃতীয় হিজরী শতকের শুরু হইতেই ইহা ইলমে হাদীসের চর্চায় বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে; ফলে ইবনে মাজাহ বাল্যকাল হইতেই হাদীস শিক্ষার অপূর্ভ সুযোগ লাভ করেন। এই সময় কয়েকজন বড় বড় মুহাদ্দিস কাজভীন শহরে হাদীসের দারস দিতেন। তন্মধ্যে তিনি আলী ইবনে মুহাম্মদ আবুল হাসান তানাফেসী (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আমর ইবনে রাফে’ আবূ হাজার বিযলী (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), ইসমাঈল ইবনে তওবা আবূ সাহল কাজভীনী (মৃঃ ২৪৭ হিঃ), হারুন ইবনে মূসা ইবনে হায়ান তামীমী (মৃঃ ২৮৮ হিঃ) এবং মুহাম্মদ ইবনে আবূ খালেদ আবূ বকর কাজভীনী প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করেন।

অতঃপর তিনি মদীনা, মক্কা, কূফা, বসরা, বাগদাদ, ওয়াসাত, দামেশক, হিমস, মিসর, তিন্নীস, ইসফাহান, নিশাপুর প্রভৃতি হাদীসের কেন্দ্র স্থানসমুহ সফর করিয়া হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার হাদীসের উস্তাদ অগণিত। তাঁহার নিকট হইতেও বিপুল সংখ্যক হাদীস-শিক্ষাথী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।

তিনি বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হাদীসের ভিত্তিতে কুরআন মজীদের একখানি বিরাট তাফসীর গ্রন্হও তিনি রচনা করেন। ‘তারিখে মলীহ’ তাঁহার অপর একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ। ইহাতে সাহাবাদের যুগ হইতে গ্রন্হাকারের সময় পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। হাদীসে তাঁহার গ্রন্হ ‘আস সুনান’ সুবিখ্যাত ও সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভূক্ত এক বিরাট কিতাব। তিনি ২৭৩ হিজরী সনে (৮৮৬ খৃঃ০ সোমবার ৬৪ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]


ছয়খানি বিশিষ্ট হাদীসগ্রন্হ
হিজরী তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধে মুসলিম জাহানের দিকে দিকে বিক্ষিপ্ত ও বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত হাদীসসমূহ যখন ‘মূসনাদ’ আকারে সংগৃহীত ও গ্রন্হাবদ্ধ হইল, তখন পরবর্তীকালের মুহাদ্দিসগণ হাদীস যাচাই, ছাঁটাই-বাছাই ও সংক্ষিপ্ত আকারে কেবলমাত্র বিশুদ্ধ হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নের উদ্যোগী হইলেন। এই উদ্যোগের ফলেই এই শতকের মাঝামাঝি ও শেষার্ধে ছয়খানি সুবিখ্যাত সহীহ হাদীস গ্রন্হ জনসমক্ষে উপস্থাপতি হয়। এই ছয়খানি হাদীসগ্রন্হ সংকলনের ইতিহাস এবং প্রত্যেক খানি গ্রন্হের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য আমরা এখানে আলোচনা করিতে চাই।

সহীহুল বুখারী

এই ছয়খানি বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্হের মধ্যে সর্ব প্রথম উল্লেখযোগ্য, সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন ও সর্বাপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ হাদীসপূর্ণ গ্রন্হ হইতেছে ইমাম বুখারী সংকলিত ‘সহীহুল বুখারী’। ইমাম বুখারী এই গ্রন্হ প্রণয়নের প্রেরণা তাঁহার বিশিষ্ট উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর মজলিস হইতে লাভ করিয়াছিলেন।[********************] তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইসহাক ইবনে রাহওয়াইর নিকট উপস্থিত ছিলাম। মজলিসে উপস্থিত তাঁহার লোকজনের মধ্য হইতে কেহ বলিলেনঃ কেহ যদি রাসূল (স) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস ও সুন্নাতসমূহের সমন্বয়ে এমন একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিতেন, যাহা সংক্ষিপ্ত হইবে এবং বিশুদ্ধাতর দিক দিয়া চরম পর্যায়ে উন্নীত হইবে, তাহা হইলে খুবই উত্তম হইত এবং আমলকারীদের পক্ষেও শরীয়াত পালন করা সহজ হইত। সেইজন্য তাহাদিগকে মুজতাদিদের প্রতি মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হইত না।[********************]

এই কথা শ্রবণ করার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম বুখারী (র) –এর মনে এইরূপ একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের বাসনা জাগ্রত হইল। উপরিউক্ত কথাটি যদিও ছিল এক সাধারণ পর্যায়ের, সম্বোধনও ছিল মজলিসে উপস্থিত সকল লোকদের প্রতি নির্বিশেষে; কিন্তু উহার বাস্তবায়ন সম্পর্কে ইচ্ছা জাগ্রত হইল এমন ব্যক্তির হৃদয়ে, বুখারী শরীফের ন্যায় এক অতুলনীয় হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের মর্যাদা লাভ আল্লাহ তা’আলা যাহার ভাগ্যলিপি করিয়া দিয়াছিলেন।

ইমাম বুখারী (র) বলেনঃ

******************************************************

এই কথাটি আমার হৃদয়পটে মুদ্রিত হইয়া গেল এবং অনুতিবিলম্বে আমি এই কিতাব প্রণয়নের কাজ শুরু করিয়া দিলাম।[********************]

বুখারী গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্যেগী হওয়ার মূল ইমাম বুখারী হইতে অন্য একটি কারণেরও উল্লেখ করা হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে স্বপ্নে দেখিলাম। দেখিলাম আমি যেন তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান, আমার হাতে একটি পাখা যাহার দ্বারা আমি রাসূল (স)-এর প্রতি বাতাস করিতেছি ও মাছির আক্রমণ প্রতিরোধ করিতেছি। অতঃপর স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানকারী কাহারো নিকট ইহার ব্যাখ্যা জানিতে চাহিলাম। ব্যাখ্যাদানকারী বলিলেন যে, তুমি রাসূলের প্রতি আরোপিত সমস্ত মিথ্যার প্রতিরোধ করিবে। বস্তুত এই স্বপ্ন ও ইহার এই ব্যাখ্যাদানকারী কাহারো নিকট ইহার ব্যাখ্যা জানিতে চাহিলাম। ব্যাখ্যাদানকারী বলিলেন যে, তুমি রাসূলের প্রতি আরোপিত সমস্ত মিথ্যার প্রতিরোধ করিবে। বস্তুত এই স্বপ্ন ও ইহার এই ব্যাখ্যাই আমাকে এই সহীহ হাদীস সম্বলিত বিরাট গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করেন।[********************]

গ্রন্হ প্রণয়নে উদ্বদ্ধ হওয়ার মূলে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় দুই প্রকারে কারণের উল্লেখ হইলেও এই কারদ্বয়ের মধ্যে কোন মৌলিক বিরোধ নাই। ইহা খুবই সম্ভব যে, ইমাম বুখারী ইসহাক ইবন রাহওয়াইর মজলিস হইতে হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ণের প্রেরণা ও বাসনা লইয়া চলিয়া আসার পর তিনি উহারই অনুকূল ও উহারই সমর্থনে এই শুব স্বপ্নটিও দেখিয়াছিলেন। এই স্বপ্নও এই কথাই তাঁহাকে জানাইয়া দিল যে, তিনি যে, বিশুদ্ধ হাদীসের সমন্বয়ে একখানি গ্রন্হ প্রণয়নের সংকল্প করিয়াছেন, তাহা রাসূলের দরবারেও মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং তাঁহার এই কাজ প্রকৃতপক্ষে রাসূলে করীম (স)-কে উহার তীব্র শরাঘত হইতে প্রতিরক্ষার কাজ হইবে।

ইতিপূর্বে বিভিন্ন অধ্যায় ও পর্যায়ে হাদীসের যেসব বিরাট বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করা হইয়াছে, ইমাম বুখারী এই অভিনব গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে সেইসব গ্রন্হ হইতে যথেষ্ট ফায়দা গ্রহণ করিয়াছেন এবং তাঁহার নিজের সংগৃহীত হাদীসসমূহ হইতে তাঁহার স্থাপিত কঠিন শর্তের মানদণ্ডে ওজন করিয়া হাদীসের এক বিরাট ও অমুল্য গ্রন্হ প্রণয়ন করিলেন।[********************]

পূর্ববর্তী হাদীস গ্রন্হসমূহে সহীহ, হাসান ও যয়ীফ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার গুণের হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছিল। একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে উহা হইতে কেবলমাত্র সহীহ হাদীস বাছাই করিয়া লওয়া বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল; বং ইহা সম্ভব হইত কেবলমাত্র বিশিষ্ট পারদর্শী ও হাদীস-শাস্ত্রজ্ঞানে ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের পক্ষে। অনুরূপভাবে বিশেষ একটি বিষয়ে শরীয়াতের বিশেষ নির্দেশ সম্পর্কে সমস্ত হাদীস একত্র করা বড় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কেননা পূর্ববর্তী গ্রন্হাবলীর উদ্দেশ্যেই ছিল শুধুমাত্র রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসসমূহ সংগ্রহ করা ও ধ্বংসের করাল গ্রাস হইতে তাহা রক্ষা করা। কাজেই তাহাতে একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে সাজাইয়া দেওয়ার কাজ বড় একটা হয় নাই। ফলে উহা পাঠ করিয়া শরীয়াত সম্পর্কে রাসূলের বিস্তারিত কথা জানিবার কোন উপায় ছিল না। এই সমস্ত কারণই একত্র হইয়া ইমাম বুখারীকে নূতন প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে হাদীসের এক নবতর সকংলন প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল।[********************]

ইমাম বুখারী এই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ণের কাজ শুরু করেন ‘বায়তুল হারাম’- আল্লাহর ঘরের অভ্যন্তরে বসিয়া। পরে উহার বিভিন্ন অধ্যায় ও ‘তারজুমাতুল বার’ সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেন মদীনায় মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে মিম্বর ও রাসূলের রওযা মুবারকের মধ্যবর্তী স্থানে বসিয়া।[********************]

হাদীসসমূহ লিখিবার সময় ইমাম বুখারী (র) এক অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই সহীহ গ্রন্হে এক একটি হাদীস লিখিবার পূর্বে গোসল করিয়াছি ও দুই রাক’আত নফল নামায পড়িয়া লইয়াছি- ইহা ব্যতীত আমি একটি হাদীসও লিখি নাই।[********************]

প্রত্যেকটি হাদীস লিখিবার পূর্বে গোসল করা ও দুই রাক’আত নফল নামায পড়ার পদ্ধতি মক্কা ও মদীনা উভয় স্থানেই তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। এক একটি হাদীস লিখিবার পূর্বে তিনি সে সম্পর্কে সর্বতোভাবে সতর্কতাত অবলম্বন করিয়াছেন। হাদীসটি প্রকৃত রাসূলের হাদীস কি না এই সম্পর্কে দৃঢ়নিশ্চত না হইয়া তিনি একটি হাদীসও ইহাতে উদ্ধৃত করেন নাই। তিনি নিজেই এই সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি প্রত্যেকটি হাদীস সম্পর্কে আল্লাহর নিকট হইতে ইস্তেখারার মারফত না জানিয়া লইয়া, নফল নামায না পড়িয়া ও উহার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে দৃঢ়নিশ্চিত ও অকাট্যভাবে বিশ্বাসী না হইয়া উহাতে আমি একটি হাদীসও সংযোজিত করি নাই।[********************]

বস্তুত ইমাম বুখারীর এই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন পরিক্রমা যে কত কঠিন ও কঠোর সাধনার ব্যাপার ছিল, তাহা উপরিউক্ত সমূহ হইতে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইতেছে। একট চিন্তা করিলেই ইহার অন্তর্নিহিত বিরাট সত্য উপলদ্ধি করা যায়। এইরূপ অনন্যসাধারণ পরিশ্রম ও অক্নান্ত সাধনা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলিতে থাকে দীর্ঘ ষোলটি বৎসর পর্যন্ত। এ বিষয়ে ইমাম বুখারীর নিজের উক্তি হইলঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হ প্রণয়ন কাজটি পূর্ণ ষোল বৎসরে সম্পূর্ণ করিয়াছি।[********************]

ইমাম বুখারী (র) বুখারী শরীফ প্রণয়নের কাজ শুরু করেন মোট ছয় লক্ষ হাদীস সম্মুখে রাখিয়া। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রায় ছয় লক্ষ হাদীস হইতে আমি এই বুখারী গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করি।[********************]

এই ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্যে ইমাম বুখারীর নিজের সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল এক লক্ষ সহীহ হাদীস। ইমাম বুখারী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বলিতে পারিতাম।[********************]

বলা বাহুল্য ইহ সমগ্র সহীহ হাদীসের মোট সংখ্যা নহে এবং ইমাম বুখারী কেবল এই এক লক্ষ হাদীসই মাত্র মুখস্থ ছিল না, ইহা অপেক্ষা আরো অনেক হাদীসও তাঁহার মুখস্থ ছিল। তবে তাঁহার মুখস্থ হাদীসসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের সংখ্যাই হইতেছে এক লক্ষ। প্রায় দুই লক্ষ গায়ের সহীহ হাদীসও তাঁহার মুখস্থ ছিল।[********************]

ইমাম বুখারীর নিকট এই হাদীস প্রণয়নের সময়ে কতকগুলি হাদীস সঞ্চিত ছিল এবং সমস্ত সহীহ হাদীসই তিনি বুখারী গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছেন কিনা, এই সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত কথা হইতে সুস্পষ্ট ধারণা করা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আমার এই হাদীস গ্রন্হে কেবল সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীসই সংযোজিত করিয়াছি। এতদ্ব্যতীত আরো বহু সহীহ হাদীস আমি ছাড়িয়া দিয়াছি। গ্রন্হের আকার দীর্ঘ ও বিরাট হওয়ার আশঙ্কায় তাহা এই গ্রন্হে শামিল করি নাই।[********************]

এই সম্পর্কে ইমাম বুখারীর আর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হে কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংযোজিত করিয়াছি। আর আমি যাহা রাখিয়া দিয়াছি, তাহার সংখ্যা সংযোজিত হাদীসের তুলনায় অনেক বেশী। আর ইহা করিয়াছি গ্রন্হের বৃহদায়তন হইয়া যাওয়ার আশঙ্কায় মাত্র।[********************]

এইভাবে ইমাম বুখারী যে গ্রন্হখানি সুসংবদ্ধ করিয়া বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত করিলেন, উহার নামকরণ হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স)-এর যাবতীয় ব্যাপার- কাজকর্ম, সুন্নাত ও সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে নির্ভূল সনদযুক্ত হাদীসসমুহের সংক্ষিপ্ত পূর্ণাঙ্গ সংকলন।[********************]

ইমাম এই গ্রন্হখানিকে আমার ও আল্লাহার মধ্যবর্তী ব্যাপারের জন্য একটি অকাট্য দলিলরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।[********************]

ইমাম বুখারী (র)-এর এই উক্তি যে কত সত্য এবং হাদীসের এই গ্রন্হ যে দ্বীন-ইসলামের এক অক্ষয় স্তম্ভ, বুখারী শরীফ পাঠ করিয়াছেন এমন প্রত্যেক ব্যক্তিই তাহা অনুধাবন করিতে পারেন।

বুখারী শরীফে একাধিকবার উদ্ধৃত হাদীসসমূহ সর্বমোট হাদীস হইতেছে নয় হাজার বিরাশী (৯০৮২)-টি। উহার মুয়াল্লিক মুতাবি’আত বাদ দিলে হাদীসের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত হাজার তিনশথ সাতানব্বই (৭৩৯৭)-টি। আর একাধিকবার উল্লেখিত হাদীস বাদ দিয়া হিসাব করিলে মোট হাদীস হয় দুই হাজার ছয়শত দুই (২৬০২)-টি। অপর এক হিসাব মতে, এই পর্যায়ে হাদীসের সংখ্যা হয় দুই হাজার সাতশত একষট্টি (২৭৬১)-টি।[********************]

কিন্তু আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র) বুখারী শরীফের হাদীস সংখ্যা সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

বুখারী শরীফে সন্নিবেশিত সনদযুক্ত মোট হাদীস হইতেছে সাত হাজার দুইশত পঁচাত্তত (৭২৭৫)-টি। ইহাতে পুনরুল্লিখিত হাদীসসমূহ গণ্য। আর উহা বাদ দিয়া হিসাব করিলে হয় প্রায় চার হাজার হাদীস।[********************]

সংখ্যা গণনায় এই পার্থক্যের মূলে একটি প্রধান কারণ রহিয়াছেনঃ ইমাম বুখারীর এই মহামূল্য গ্রন্হের প্রণয়নকার্য যদিও ষোল বৎসরের মধ্যে সমাপ্ত হইয়াছিল, তথাপি ইহাতে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন, পরিবর্জনের কাজ ইহার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলিতে থাকে। এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট হইতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্র ইহা শ্রবণ করিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের নিকট রক্ষিত গ্রন্হের হাদীসের সংখ্যায় পার্থক্য সূচিত হইয়াছে। প্রথম পর্যায়ে ছাত্রদের নিকট সেই হাদীসসমূহই লিখিত রহিয়াছে, যাহা তখন পর্যন্ত ইহাতে সংযোজিত হইয়াছিল। পরে উহাতে পরিবর্তন করা হইয়াছে, গ্রন্তকার প্রাথমিক সংকলন হইতে কোন কোন হাদীস বাদ দিয়া অনেক নূতন হাদীস ইহাতে শামিল করিয়াছেন। ফলে এই পর্যায়ে যাঁহারা উহা শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট পূর্বের তুলনায় বেশী সংখ্যক ও নবসংযোজিত হাদীসও পৌছিঁয়াছে।[********************]

কথাটি নিম্নোক্ত আলোচনায় আরো সুস্পষ্টরূপে পরিস্ফূট হইবে। ইমাম বুখারীর নিকট হইতে তাঁহার এই হাদীসগ্রন্হ শ্রবণ করিয়াছেন শত সহস্র লোক। কিন্তু ইমাম বুখারীর যে কয়জন ছাত্রের সূত্রে ইহার বর্ণনার মূল ধারা চলিয়াছে, তাঁহারা হইতেছেন প্রধানতঃ চারজন।

১. ইবরাহীম ইবনে মা’কাল ইবনুল হাজ্জাজ আন-নাসাফী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)

২.‌ হাম্মাদ ইবনে শাকের আন-নাসাফী (মৃঃ ৩১১ হিঃ)

৩. মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আল-ফারবারী (মৃঃ ৩২০)

৪. আবূ তালহা মনসূর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে কারীমা আল বজদুভী (মৃঃ ৩২৯ হিঃ)

ফারবারী সহীহুল বুখারী গ্রন্হ ইমাম বুখারীর নিকট হইতে দুইবার শ্রবণ করিয়াছেন। একবার ফারবার নামক স্থানে ২৪৮ হিজরী সনে; যখন ইমাম বুখারী এখানে আগমন করিয়াছিলেন। আর দ্বিতীয়বার ২৫২ হিজরী সনে তিনি নিজে বুখারায় উপস্থিত হইয়া।[********************]

হাম্মাদ ইবনে শাকের বুখারী শরীফের যে সংস্করণ বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা ফারবারী বর্ণিত সংস্করণে দুইশত হাদীস অধিক রহিয়াছে। আর ইবরাহীম ইবনে মা’কাল বর্ণিত সংস্করণ অপেক্ষা উহাতে তিনশত হাদীস বেশি। ইহা হইতে সুস্পষ্টরূপৈ প্রমাণিত হয় যে, বুখারী গ্রন্হে ইমাম বুখারী ক্রমশ হাদীসের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছেন এবং প্রথম পর্যায়ের ছাত্রদের নিকট হইতে বর্ণিত সংস্করণে পরবর্তীকালের ছাত্রদের বর্ণিত সংস্করণের তুলনায় কম হাদীস ছিল।[********************]

ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করার পর উহা তদানীন্তন অপরাপর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের সম্মুখে পেশ করেন। তাঁহাদের মধ্যে প্রধান হইতেছেন আলী ইবনে মাদানী, আহম্মদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (র)। তাঁহারা প্রত্যেকেই গ্রন্হখানি দেখিয়া

******************************************************

ইহাকে খুবই পছন্দ করিলেন, অতি উত্তম গ্রন্হ বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং উহা একখানি বিশুদ্ধ গ্রন্হ বলিয়া স্পষ্ট ভাষায় সাক্ষ্য দিলেন।[********************]

বুখারী শরীফের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য ঘোষণা করিয়া প্রত্যেক যুগের আলিম ও মুহাদ্দিসগণ অনেক উক্তি করিয়াছেন। মওলানা আহমদ আলী উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের সমস্ত আলিম এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত যে, গ্রন্হবদ্ধ হাদীসের কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধিক সহীহ হইতেছে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হ। আর অধিকাংশের মতে এই দুইখানির মধ্যে অধিক সহীহ এবং জনগনকে অধিক ফায়দা দানকারী হইতেছে বুখারী শরীফ।[********************]

এই পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটিও সর্বজনপ্রিয় ও সকলের মুখে ধ্বনিতঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাবের পর আসমানের নীচে সর্বাধিক সহীহ গ্রন্হ হইতেছে সহীহুল বুখারী।[********************]

ইমাম নাসায়ী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের এই সমস্ত কিতাবের মধ্যে বুখারী গ্রন্হ অপেক্ষা অধিক উত্তম আর কোন গ্রন্হ নাই।[********************]

মুসলিম জাতি এই গ্রন্হখানির প্রতি অপূর্ব ও অতুলনীয় গুরুত্ব দান করিয়াছেন। মুসলিম মনীষিগণ ইহার অসংখ্য ও বিরাট শরাহ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। কাশফুজ্জুনূন প্রণেতা বলিয়াছেন, ইহার শরাহ গ্রন্হের সংখ্যা বিরাশিখানি। তন্মধ্যে ফতহুল বারী, কস্তালানী ও উমদাতুলকারীই উত্তম।[********************]

সহীহ মুসলিম শরীফ

ইমাম মুসলিমের সহীহ হাদীসগ্রন্হ হইতেছে ‘সহীহ মুসলিম’। ইমাম মুসলিম সরাসরি উস্তাদদের নিকট হইতে শ্রুত তিনলক্ষ হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই ও চয়ন করিয়া এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করিয়াছেন।[********************]

হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত হইলে পর তিনি ইহা তদানীন্তন প্রখ্যত হাফেজে হাদীস ইমাম আবূ যুরয়ার সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। ইমাম মুসলিম নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হখানি ইমা আবূ যুরয়া রাযীর নিকট পেশ করিয়াছি। তিনি যে যে হাদীসের সনদে দোষ আছে বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন, আমি তাহা পরিত্যাগ করিয়াছি (গ্রন্হ হইতে খারিজ করিয়া দিয়াছি), আর যে যে হাদীস সম্পর্কে তিনি মত দিয়াছেন যে, উহা সহীহ এবং উহাতে কোন প্রকার ক্রটি নাই, আমি তাহাই এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছি।[********************]

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম মুসলিম কেবলমাত্র নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়াই কোন হাদীসকে সহীহ মনে করিয়া তাঁহার এই গ্রন্হে শামিল করেন নাই বরং প্রত্যেকটি হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সমসাময়িক অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিকটও পরামর্শ চাহিয়াছেন এবং সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের শুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত হইয়াছেন, কেবল তাহাই তিনি তাঁহার এই অমূল্য গ্রন্হে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে তাঁহার নিজের উক্তিই অধিকতর প্রামাণ্য হইবে। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কেবল আমার বিবেচনায় সহীহ হাদীসসমূহই আমি কিতাবে শামিল করি নাই। বরং এই কিতাব কেবল সেইসব হাদীসই সন্নিবেশিত করিয়াছি, যাহার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ একমত।[********************]

এইভাবে দীর্ঘ পনেরো বৎসর অবিশ্রান্ত সাধনা, গবেষনা ও যাচাই-ছাঁটাই পরিচালনার পর সহীহ হাদীসসমূহের এক সুসংবদ্ধ সংকলন তৈয়ার করা হয়।[********************]

এই গ্রন্হে সর্বমোট বারো হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। একাধিকবার উদ্ধৃত হাদীসও ইহার অন্তর্ভূক্ত। আর তাহা বাদ দিয়া হিসাব করিলে মোট হাদীস হয় প্রায় চার হাজার।[********************]

এই হাদীস গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম মুসলিম (র) নিজেই দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণ দুইশত বৎসর পর্যন্তও যদি হাদীস লিখিতে থাকেন, তবুও তাহাদিগকে অবশ্যই এই সনদযুক্ত বিশুদ্ধ গ্রন্হের উপর নির্ভর করিতে হইবে।[********************]

ইমাম মুসলিমের এই দাবি মিথ্যা নয়, উহা এক বাস্তব সত্যরূপেই পরবর্তীকালের মুহাদ্দিসদের নিকট প্রতিভাত হইয়া উঠিয়াছে। আজ প্রায় এগারো শত বৎসরেরও অধিক অতিক্রান্ত হইয়াছে, কিন্তু সহীহ মুসলিমের সমান মানের কিংবা উহা হইতেও উন্নত মর্যাদার কোন গ্রন্হ প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নাই। আজিও উহার সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতা অম্লান হইয়া বিশ্বমানবকে বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন জ্ঞানের আলো দান করিতেছে। হাফেজ মুসলিম ইবনে কুরতবী সহীহ মুসলিম শরীফ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইসলামে এইরূপ আর একখানি গ্রন্হ কেহই প্রণয়ন করিতে পারে নাই।[********************]

শুধু তাহাই নয়, পরবর্তীকালের কয়েকজন যুগ-শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসের মতে বুখারী শরীফের তুলনায় মুসলিম শরীফ অধিক বিশুদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ।

কাযী ইয়ায একজন বড় মুহাদ্দিস। তিনি বলিয়াছেন যে, তাহার কয়েকজন হাদীসের উস্তাদ-যাঁহারা একজন অতি বড় মুহাদ্দিস, বুখারী অপেক্ষ মুসলিম শরীফকেই অগ্রাধিকার দিতেন।[********************]

হাফেজ ইবনে মানদাহ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি আবূ আলী নিশাপুরীকে- যাঁহার মত হাদীসের বড় হাফেজ আর একজনও দেখি নাই- এই কথা বলিতে শুনিয়াছি যে, আকাশের তলে ইমাম মুসলিমের হাদীস-গ্রন্হ অপেক্ষা বিশুদ্ধতর কিতাব একখানিও দেখি নাই।[********************]

এই উদ্ধৃতি হইতে এই কথাও প্রমাণিত হয় যে, হাফেজ ইবনে মানদাহর এই মত। আর আবূ আলী কি রকমের মুহাদ্দিস ছিলেন তাহা মুসতাদরাক গ্রন্হ প্রণেতা হাকেম নিশাপুরীর প্রদত্ত পরিচিত হইতে স্পষ্ট ধারণা জন্মে। তিনি আবূ আলীর পরিচয় দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রন্হ মুখস্থ করা, বিষয়বস্তুর উপর দক্ষতাপূর্ণ সতর্কতা, হাদীস পর্যালোচনা ও হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নে তিনি যুগের একক ও অবিসংবাদী ছিলেন।[********************]

ইমাম মুসলিমের সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হখানি তাঁহার নিকট হইতে বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার সূত্রে ইহা বর্ণনাও করিয়াছেন। কিন্তু ঠিক যাহার সূত্রে এই গ্রন্হখানি বর্ণনা ধারা সর্বত্র- বিশেষভাবে এতদুদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক যুগ পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, তিনি হইতেছেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবূ ইসহাক ইবারহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুফিয়ান নিশাপুরী। তিনি ৩০৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

এই সম্পর্কে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অবিচ্ছিন্ন সনদসূত্রে ইমাম মুসলিম হইতে এই গ্রন্হের বর্ণনা পরম্পরা এতদুদ্দেশ্যে ও সাম্প্রতিককালে কেবলমাত্র আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুফিয়ানের বর্ণনার উপরই নির্ভরশীল।[********************]
এই ইবরাহীম ইবনে সুফিয়ানের সহিত ইমাম মুসলিমের এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল। তিনি সব সময়ই ইমাম মুসলিমের সাহচর্যে থাকিতেন ও তাঁহার নিকট হাদীস অধ্যয়ন করিতেন।

ইমাম মুসলিমের আর একজন ছাত্র আবূ মুহাম্মদ আহমদ ইবন আলী কালানসী। তাঁহার সূত্রেও সহীহ মুসলিম বর্ণিত হইয়াছে; এই সূত্রে বর্ণনা পরম্পরা যেমন সম্পূর্ণ নহে, তেমনি তাহা বেশি দিন চলিতেও পারে নাই।

সুনানে নাসায়ী

ইমাম নাসায়ী প্রথমে ‘সুনানুল কুবরা’ নামে একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। তাহাতে সহীহ ও দোষমুক্ত উভয় প্রকারের হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছিল। অতঃপর উহারই এক সংক্ষিপ্ত সংস্করণ তৈরী করেন। উহার নাম ‘আসসুনানুস সুগরা’। ইহার অপর এক নাম হইতেছে ‘আল-মুজতবা’- সঞ্চয়িতা’।

এই শেষোক্ত সঞ্চয়নে ইমাম নাসায়ী ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের গ্রন্হ প্রণয়ন রীতির অনুসরণ করিয়াছেন। এই উভয়েল প্রবর্তিত রীতির সমন্বয় ঘটিয়াছে ইমাম নাসায়ীর এই গ্রন্হে। হাফেজ আবূ আবদুল্লাহ ইবনে রুশাইদ (মৃঃ ৭২১ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুনানে পর্যায়ে হাদীসের যত গ্রন্হই প্রণয়ন করা হইয়াছে, তন্মধ্যে এই গ্রন্হখানি অতি আনকোরা রীতিতে প্রণয়ন করা হইয়াছে। আর সংযোজন ও সজ্জায়নের দৃষ্টিতেও উহা এক উত্তম গ্রন্হ। উহাতে বুখারী ও মুসলিম উভয়েরই রচনারীতির সমন্বয় হইয়াছে। হাদীসের ‘ইল্লাহ’ ও ইহাতে এক বিশেষ অংশে উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

এই গ্রন্হখানির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম নাসায়ী নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘হাদীসের সঞ্চয়ন’–মুজতাবা নামের গ্রন্হখানিতে উদ্ধৃত সমস্ত হাদীসই বিশুদ্ধ।[******************** অবশ্য হাফেজ যাহবী এই সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষন করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ এই ‘আল-মুজতবা’ ইমাম নাসায়ীর কৃত নহে বরং তাঁহার ছাত্র ইবনে সামালী কৃত ********************]

বস্তুত ইমাম নাসায়ীর বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে প্রায় সকল শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসেরই মত এই যে, অন্যান্যের বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শুদ্ধতার দিক দিয়া উহা অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইবে।

হাফেজ ইমাম আবুল হাসান মুযাফেরী (মৃঃ ৪০৩ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণের বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে তুমি যখনি বিচার-বিবেচনা করিবে তখন একথা বুঝিতে পারিবে যে, ইমাম নাসায়ীর বর্ণিত হাদীস অপরে বর্ণিত হাদীসের তুলনায় শুদ্ধতার অধিক নিকটবর্তী হইবে।[********************]

ইমাম নাসায়ীর নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হ যদিও বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন, কিন্তু দশজন বড় মুহাদ্দিস এই গ্রন্হের ধারাবাহিক বর্ণনা করিয়াছেন।

ইমাম নাসায়ীর নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হ যদিও বহু ছাত্রই শ্রবণ করিয়াছেন, কিন্তু দশজন বড় বড় মুহাদ্দিস এই গ্রন্হের ধারাবাহিক বর্ণনা করিয়াছেন।

ইমাম নাসায়ীর এই গ্রন্হখানির শরাহ লিখিয়াছেন জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুল হাদীস আসসমদী (মৃঃ ১১৩৮ হিঃ)। সুয়ূতী লিখিত শরাহ গ্রন্হের নাম- ********************

সুনানে আবূ দাউদ

ইমাম আবূ দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই ও চয়ন করিয়া তাঁহার এই গ্রন্হ সংকলন করেন। ইহাতে মোট চার হাজার আটশত হাদীস স্থান পাইয়াছে। এই হাদীসসমূহ সবই আহকাম সম্পর্কিত এবং উহার অধিকাংশই ‘মশহূর’ পর্যায়ের হাদীস।[********************] এই সম্পর্কে তাঁহার নিজের উক্তি এইঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-এর পাঁচ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্দ করিয়াছিলাম। তন্মধ্য হইতে ছাঁটাই-বাছাই কারিয়া মনোনীত হাদীস এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিয়াছি।[********************]

মনে রাখা আবশ্যক যে, ইমাম আবূ দাউদ ফিকাহর দৃষ্টিভঙ্গিতে হাদীসসমূহ চয়ন করিয়াছেন। তিনি ইমা বুখারীর পরে অন্যান্য সিহাহ-সিত্তা প্রণেতাদের তুলনায় ফিকাহ সম্পর্কে অধিক ব্যাপক ও উজ্জ্বল দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। এই কারণে তাঁহার এই কিতাবখানি মূলত হাদীস সংকলন হইলেও কার্যত ফিকাহ শাস্ত্রের রীতিতে সজ্জিত হইয়াছে; ফিকাহর সমস্ত বিষয়ই ইহাতে আলোচিত হইয়াছে এবং সমসাময়িক ও পরবর্তি যুগের সকল ফিকাহবিদই তাঁহার সংকলিত হাদীস হইতে দলীল ও প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছেন। এই কারণেই ফিকাহবিগণ মনে করেনঃ

******************************************************

একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকাহর মাসয়ালা বাহির করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদের পরে এই সুনানে আবূ দাউদ গ্রন্হই যথেষ্ট।[********************]

ফিকাহর দৃষ্টিতেই তিনি উহার অধ্যায় নির্ধারণ করিয়াছেন এবং তাহাতে এমন কথার উল্লেখ করিয়াছেন, যাহা উহার নিম্নে উদ্ধৃত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় এবং কোন না কোন ফকীহ সেই হাদীস হইতে উক্তরূপ মত গ্রহণ করিয়াছেন। ফলে ফিকাহবিদদের নিকট এই কিতাবখানি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে।[********************]

এই বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই ইমাম হাফেজ আবূ জাফর ইবনে যুবাইর গরনাতী (মৃঃ ৭০৮ হিঃ) সিহাহ-সিত্তার সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে সুনানে আবূ দাউদ সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ফিকাহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সামগ্রিক ও নিরংকুশভাবে সংকলিত হওয়ার কারণে সুনানে আবূ দাউদের যে বিশেষত্ব, তাহা সিহাহ-সিত্তার অপর কোন গ্রন্হেরই নাই।[********************]

সুনানে আবূ দাঊদের ব্যবহারিক গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে ইমাম গাযযালী ও স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন যে, ‘হাদীসের মধ্যে এই একখানি গ্রন্হই মুজতাহিদের জন্য যথেষ্ট’।[********************]

মুহাদ্দিস যাকারিয়া সাজী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইসলামের মূল হইতেছে আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের ফরমান হইতেছে সুনানে আবূ দাউদ।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ তাঁহার এই গ্রন্হখানির সংকলনকার্য যৌবন বয়সে সমাপ্ত করিয়া লইয়াছিলেন। এই সময় হাদীসের জ্ঞানে তাঁহার যে কি দক্ষতা অর্জিত হইয়াছিল, তাহা ইবরাহীম আল- হারবীর নিম্নোদ্ধৃত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবু দাউদ যখন তাঁহার এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন তখন তাঁহার জন্য হাদীসকে নরম ও সহজ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, ঠিক যেমন নরম করিয়া দেওয়া হইয়াছিল হযরত দাউদ নবীর জন্য লৌহকে।[********************]

গ্রন্হ সংকলন সমাপ্ত করার পর তিনি উহাকে তাঁহার হাদীসের উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। ইমাম আহমদ উহাকে খুবই পছন্দ করেন ও উহা একখানি উত্তম হাদীস গ্রন্হ বলিয়া প্রশংসা করেন।[********************]

অতঃপর ইহা সর্বসাধারণের সমক্ষে উপস্থাপিত করা হয়। আর আল্লাহ তা’আলা উহাকে এত বেশি জনপ্রিয়তা ও জনগনের নিকট মর্যাদা দান করিয়াছেন, যাহা সিহাহ সিত্তার মধ্যে অপর কোন গ্রন্হই লাভ করিতে পারে নাই। এইদিকে ইঙ্গিত করিয়া ইমাম আবূ দাউদের ছাত্র হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে মাখলাস দুয়ারী (মৃঃ ৩৩১ হিঃ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ দাউদ যখন সুনান গ্রন্হখানি প্রণয়ন সম্পন্ন করিলেন এবং উহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া গুনাইলেন, তখনি উহা মুহাদ্দিসদের নিকট (কুরআ মজীদের মতই) অনুসরনীয় পবিত্র গ্রন্হ হইয়া গেল।[********************]

এই গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ সম্পর্কে ইমাম আবূ দাউদ নিজেই দাবি করিয়াছেনঃ

******************************************************

জনগণ কতৃক সর্বসম্মতভাবে পরিত্যক্ত কোন হাদীসই আমি ইহাতে উদ্ধৃত করি নাই।[********************]

ইমাম আবূ দাউদের নিকট হইতে তাঁহার এই গ্রন্হখানি ধারাবাহিক সূত্র পরম্পরায় প্রায় নয়-দশজন বড় বড় মুহাদ্দিস কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছেন।[********************]

ইমাম আবূ দাউদ ২৭৫ হিজরী সনে সর্বশেষ বারের তরে এই গ্রন্হখানি ছাত্রদের দ্বারা লিখাইয়াছিলেন এবং এই বৎসরই ১৬ই শাওয়াল শুক্রবার দিন তিনি অনন্ত ধামে যাত্র করেন।[********************]

জামে তিরমিযী

ইমাম তিরমিযীর হাদীসগ্রন্হ ‘জামে তিরমিযী’ নামে খ্যাত। উহাকে ‘সুনান

ও বলা হয়। কিন্তু প্রথমোক্ত নামই অধিকাংশ হাদীসবিদ গ্রহণ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার গ্রন্হখানি ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম বুখারী অনুসৃত গ্রন্হ প্রণয়ন রীতি অনুযায়ী তৈয়ার করিয়াছেন। প্রথমত উহাতে ফিকাহর অনুরূপ অধ্যায় রচনা করা হইয়াছে। তাহাতে ব্যবহারিক প্রয়োজনসম্পন্ন হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করিয়াছেন। কিন্তু সমগ্র গ্রন্হখানি কেবল ব্যবহারিক প্রয়োজন সম্বলিত হাদীস দ্বারাই পূর্ণ করিয়া দেন নাই বরং সঙ্গে তিনি বুখারী শরীফের ন্যায় অন্যান্য অধ্যায়ের হাদীসও উহাতে সংযোজিত করিয়া দিয়াছেন। ফলে গ্রন্হখানি এক অপূর্ব সমন্বয়, এক ব্যাপকগ্রন্হে পরিণত হইয়াছে। এই কারণে উহার ‘জামে তিরমিযী নাম সার্থক হইয়াছে। বিভিন্ন বিষয়ে জরুরী হাদীস উহাতে সুন্দরভাবে সজ্জিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। এই কারণে হাফেজ আবূ জাফর ইবনে যুবাই ( মৃঃ ৭০৮ হিঃ) সিহাহ-সিত্তা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম তিরমিযী বিভিন্ন বিষয়ের হাদীস একত্র করিয়া গ্রন্হখানি প্রণয়ন করায় যে বৈশিষ্ট্য লাভ করিয়াছেন, তাহাতে তিনি অবিসংবাদিত।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করিয়া তদানীন্তন মুসলিম জাহানের হাদীসবিদ লোকদের নিকট ইহা যাচাই করিবার জন্য পেশ করেন। এই সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই হাদীস সনদযুক্ত গ্রন্হখানি প্রণয়ন সম্পূর্ণ করিয়া উহাকে হিজাযের হাদীসবিদদের সমীপে পেশ করিলাম। তাঁহারা ইহা দেখিয়া খুবই পছন্দ করিলেন ও সন্তোষ প্রকাল করিলেনে। অতঃপর আমি উহাকে খুরাসানের হাদীসবিদদের খেদমতে পেশ করিলাম। তাঁহারাও ইহাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন, সন্তোষ প্রকাশ করেন।[********************]

ইমাম তিরমিযী তাঁহার এই গ্রন্হখানি সম্পর্কে নিজেই এক অতি বড় দাবি পেশ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহার ঘরে এই কিতাবখানি থাকিবে, মনে করা যাইবে যে, তাঁহার ঘরে স্বয়ং নবী করীম (স) অবস্থান করিতেছেন ও নিজে কথা বলিতেছেন।[********************]

বস্তুত হাদীসগ্রন্হ-বিশেষত সহীহ হাদীসসমূহের কিতাবের ইহাই সঠিক মর্যাদা এবং ইহা কেবলমাত্র তিরমিযী শরীফ সম্পর্কেই সত্য নহে, সকল সহীহ হাদীসগ্রন্হ সম্পর্কেই একথা প্রযোজ্য ও অকাট্য সত্য।

তিরমিযী শরীফ সাধারণ পাঠকদের জন্য একখানি সুখপাঠ্য ও সহজ বোধ্য হাদীসগ্রন্হ। শায়খুল ইসলাম আল হাফেজ ইমাম আবূ ইসমাঈল আবদুল্লাহ আনসারী (মৃঃ ৪৮১ হিঃ) তিরমিযী শরীফ সম্পর্কে এক আলোচনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার দৃষ্টিতে তিরমিযী শরীফ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হদ্বয় অপেক্ষা অধিক ব্যবহারোপযোগী। কেননা বুখারী ও মুসলিম এমন হাদীসগ্রন্হ যে, কেবলমাত্র বিশেষ পারদর্শী আলেম ভিন্ন অপর কেহই তাহা হইতে ফায়দা লাভ করিতে সমর্থ হয় না। কিন্তু ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযীর গ্রন্হ হইতে যে কেহ ফায়দা গ্রহণ করিতে পারে।[********************]

ইমাম তিরমিযী হইতে তাঁহার এই গ্রন্হখানি যদিও শ্রবণ করিয়াছেন বহু সংখ্যক লোক; কিন্তু উহার বর্ণনা পরম্পরা অব্যহত ও ধারাবাহিকভাবে চলিয়াছে মোট ছয়জন বড় বড় মুহাদ্দিস হইতে।[********************]

উপরে মোট পাঁচখানি প্রধান হাদীসগ্রন্হ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হইয়াছে। বিশ্বের হাদীসবিদ বড় বড় আলেমগণ এই পাঁচখানি হাদীসগ্রন্হের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশিষ্টতা অকপটে ও উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন এবং এই পর্যায়ে কাহারো কোন মতভেদ দেখা দেয় নাই। হাফেজ আবূ তাহের সলফী (মৃঃ ৫৭৬ হিঃ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল হাদীসবিদ আলিমগণ এই পাঁচখানি গ্রন্হের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত।[********************]

ষষ্ঠ গ্রন্হ কোনখানি?

কিন্তু এই পাঁচখানি গ্রন্হের পর ষষ্ঠ মর্যাদার গ্রন্হ যে কোনখানি তাহা লইয়া মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে।[********************] প্রাথমিক পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ এবং শেষ পর্যায়ের অনেক হাদীসবিদই প্রধান হাদীস গ্রন্হ হিসাবে উপরোক্ত পাঁচাখানিকেই গণ্য করিয়াছেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ের (মুতায়াখখেরীন) মুহাদ্দিসদের মধ্যে কেহ কেহ ইহার বিপরীত মত প্রকাশ করিয়াছেন। এই ছয়খানির মধ্যে ষষ্ঠ গ্রন্হ লইয়াও যথেষ্ট মতভেধ রহিয়াছে। কাহারো মতে সিহাহ সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হইতেছে ইবনে মাজাহ শরীফ, আবার কাহারো মতে মুয়াত্তা ইমাম মালিক। কিন্তু এই পর্যায়ের হাদীসবিদদের দৃষ্টিতে ‘মুয়াত্তা’র তুলনায় ‘ইবনে মাজাহ’ অনেক উন্নত ও জনসাধারণের পক্ষে ব্যবহারোপযোগী। বিধায় ইহাই হইতেছে সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ। হাফেজ আবুল ফযল ইবনে তাহের মাখদাসী (মৃঃ ৫০৭ হিঃ) সর্বপ্রথম সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে ‘ইবনে মাজাহর’ নাম ঘোষণা করেন।[********************] অতঃপর হাফেজ আবদুল গনী আলমাকদাসী ও এই কথাই মানিয়া লন।[********************] মুহাদ্দিস আবুল হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

শেষ পর্যায়ের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মত এই যে, ইবনে মাজাহ শরীফ-ই সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ।[********************]

কোন কোন মুহাদ্দিস সুনানে ইবনে মাজাহ অপেক্ষা সুনানে দারেমীকে অধিকতর উন্নত ও দোষমুক্ত হাদীসগ্রন্হ বলিয়া মনে করেন। তাঁহারা সিহাহ-সিত্তার ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে উহার নাম পেশ করিয়াছেন। কিন্তু এই সব কথার কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সুনানে ইবনে মাজাহ যেকোন দিক দিয়াই মুয়াত্তা ও সুনানে দারেমী অপেক্ষা উন্নত। তাই এই ষষ্ঠ গ্রন্হ হিসাবে সুনানে ইবনে মাজাহই উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (মৃঃ ৬৮১ হিঃ) ইবনে মাজাহ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার হাদীস গ্রন্হখানি সিহাহ-সিত্তার অন্যতম।[********************]

সুনানে ইবনে মাজাহ

সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীসের একখানি বিশেষ মূল্যবান গ্রন্হ। ইমাম ইবনে মাজাহ প্রণয়ন কার্য সমাপ্ত করিয়া উহাকে যখন তাঁহার উস্তাদ ইমাম আবূ যুরয়ার নিকট পেশ করিলেন, তখন উহা দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

আমি মনে করি, এই কিতাবখানি লোকদের হাতে পৌঁছিলে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রণীত সমস্ত বা অধিকাংশ হাদীসগ্রন্হই অপ্রয়োজনীয় হইয়া যাইবে।[********************]

বস্তুত ইমাম আবূ যুরয়ার এই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক ও সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। এই গ্রন্হখানি দুইটি দিক দিয়া সমস্ত সিহাহ-সিত্তা গ্রন্হাবলীর মধ্যে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। প্রথম, উহার রচনা, সংযোজন, সজ্জায়ন ও সৌকর্য। উহাতে হাদীসসমূহ এক বিশেষ সজ্জায়ন পদ্ধতিতে ও অধ্যায় ভিত্তিতে সাজানো হইয়াছে, কোথাও পুনারাবৃত্তি ঘটে নাই। অপর কোন কিতাবে কোন কিতাবে এই সৌন্দর্য দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা তৎপূর্বকালীন প্রায় সকল হাদীস গ্রন্হকেই জনপ্রিয়তা দিক দিয়া ম্লান করিয়া দিয়াছে। মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র) ‘ইবনে মাজাহ’ গ্রন্হের উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

প্রকৃতপক্ষে সজ্জায়ন-সৌন্দর্য ও পূনারাবৃত্তি ব্যতীত হাদীসসমূহ একের পর এক উল্লেখ করা এবং এবং তদুপরি সংক্ষিপ্ত প্রভৃতি বিশেষত্ব এই কিতাবে যাহা পাওয়া যায়, অপর কোন কিতাবে তাহা দূর্লভ।[********************]

হাফেজ ইবনে কাসীর (র) ইবনে মাজাহ প্রণীত গ্রন্হটি সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ গ্রন্হ, ফিকাহর দৃষ্টিতে উহার অধ্যায়সমূহ খুবই সুন্দর ও মজবুত করিয়া সাজানো হইয়াছে।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম ইবনে মাজাহর সুনান গ্রন্হ অত্যন্ত ব্যাপক হাদীস সমন্বিত এবং উত্তম।[********************]

এই গ্রন্হের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে এমন সব হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে, যাহা সিহাহ-সিত্তার অপর কোন গ্রন্হে উল্লিখিত হয় নাই। এই কারণে ইহার ব্যাবহারিক মূল্য অন্যান্য গ্রন্হাবলীর তুলনায় অনেক বেশি। আল্লামা আবুল হাসান সনদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই গ্রন্হকার ইহাতে হযরত মুয়ায ইবনে জাবালের রীতি অনুসরণ করিয়াছেন। অনেক কয়টি অধ্যায় তিনি এমন সব হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন, যাহা অপর প্রখ্যাত পাঁচখানি সহীহ গ্রন্হে পাওয়া যায় না।[********************]

‘হযরত মুয়াযের রীতি অনুসরণ করার’ অর্থ এই যে, হযরত মুয়ায (রা) প্রায়ই এমন সব হাদীস বর্ণনা করিতেন, যাহা অন্যান্য সাহাবীর শ্রুতিগোচর হয় নাই। ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁহার গ্রন্হে অন্যান্য গ্রন্হের মোকাবিলা এইরূপ অনেক হাদীস এককভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। আল্লামা আবূল হাসান সনদী বলেনঃ – ******************** ‘হযরত মুয়ায লোকদিগকে অধিক ফায়দা দানের উদ্দেশ্যে এই কাজ করিতেন’।[********************]

সুনানে ইবনে মাজাহ ইমাম মুহাদ্দিস আবূ যুরয়ার উক্তি এই প্রসঙ্গে আলোচনার সূচনায়ই উল্লিখিত হইয়াছে। আবূ যুরয়া এই গ্রন্হখানিকে খুবই পছন্দ করিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহ; কিন্তু ইহাতে তাঁহার দৃষ্টিতে যতটুকু ক্রটি ধরা পড়িয়াছে তাহাও তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে আবূ যুরয়ার উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

ইমাম আবূ যুরয়া বলিয়াছেনঃ আমি আবূ আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহর হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছি। কিন্তু উহাতে খুব অল্প হাদীসই এমন পাইয়াছি যাহাতে কিছুটা ক্রটি রহিয়াছে। ইহা ছাড়া আর কোন দোষ আমি পাই নাই। অতঃপর এই পর্যায়ে তিনি প্রায় দশটির মত হাদীসের উল্লেখ করিলেন।[********************]

(যদিও এই উক্তির সনদ সম্পর্কে হাদীস-বিজ্ঞানিগণ আপত্তি তুলিয়াছেন।)

সে যাহাই হউক, ইমাম ইবনে মাজাহ অপরিসীম শ্রম-সাধনা এবং যাচাই-বাছাইর পর এই গ্রন্হখানির প্রণয়নকার্য সম্পন্ন করেন। লক্ষ-লক্ষ হাদীস হইতে বাছাই করিয়া চার হাজার হাদীসকে বিভিন্ন অধ্যায়ে সাজাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচখানি গ্রন্হের তুলনায় ইহাতে যয়ীফ হাদীসের সংখ্যা বেশী হওয়ার কারণে ছয়খানি হাদীসগ্রন্হের মধ্যে উহার স্থান সর্বশেষে। মুহাদ্দিস সনদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যাহাই হউক, মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়া ইবনে মাজাহর গ্রন্হ অপর পাঁচখানি গ্রন্হের নীচেও পরে অবস্থিত।[********************]

এমনকি উহা আবূ দাউদ ও সুনানে নাসায়ীরও পরেই গণ্য। আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাউদ ও সুনানে নাসায়ীর পরে গণ্য হইবে।[********************]

কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, অপর পাঁচখানি হাদীসগ্রন্হে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি হাদীসও বুঝ এককভাবে ইবনে মাজাহর বর্ণিত প্রত্যেকটি হাদীস অপেক্ষা উন্নত ও বিশুদ্ধতায় অগ্রগণ্য। কেননা ইবনে মাজাহ গ্রন্হে এমন সব হাদীসও উদ্ধৃত হইয়াছে, যাহা সহীহ বুখারীর হাদীসসমূহ অপেক্ষা অধিক সহীহ।

সুনানে ইবনে মাজাহ মোট ৩২টি পরিচ্ছেদ পনেরো শত অধ্যায় এবং চার হাজার হাদীস উদ্ধৃত রহিয়াছে।[********************]

ইবনে মাজাহ গ্রন্হে প্রধানত চারজন বড় মুহাদ্দিস ধারাবাহিক বর্ণনা পরম্পরা সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ

১। আবূল হাসান ইবনে কাত্তান

২। সুলাইমান ইবনে ইয়াযীদ

৩। আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে ঈসা

৪। আবূ বকর হামেদ আযহারী।


চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস
হিজরীর চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীসের যে চর্চা ও উন্নয়ন সাধিত হয়, তাহা অতীত সকল কাজকে অতিক্রম করিয়া যায়। এই শতকেই অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস, হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বিজ্ঞানের ইমাম আবির্ভূত হন। বিশ্ব-বিশ্রুত ছয়খানি সহীহ হাদীস গ্রন্হেও এই শতকেই গ্রন্হাবদ্ধ হয় এবং সহীহ হাদীসসমূহ প্রায় সবই এই গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ হয়। প্রত্যেক হাদীসের সনদ, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর জীবন-ইতিহাস ও চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত ও পুংখানুপুংখ আলোচনা সম্বলিত বহু সংখ্যক গ্রন্হ এই শতকেই বিরচিত হয়। ফলে ইলমে হাদীস সর্বোতভাবে এক স্বয়ংসম্পুর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে।

চতুর্থ শতকে পূর্ব শতকেরই কাজ কর্মেরই জের চলিতে থাকে। তবে হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নে এই শতকে স্বতন্ত্রভাবে কোন কাজই সম্পাদিত হয় নাই এমন নহে। এই পর্যায়ে যাহা কিছু হইয়াছে তাহা প্রায় সবই পূর্ববর্তী হাদীসবিদদের নিকট হইতে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত হাদীসসমূহের ভিত্তিতে নূতন হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করা মাত্র। উপরন্তু তাহাতে সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করার কাজও বিশেষ সতর্কতা সহকারে সম্পাদিত হয়।

এই শতকের অনেক মুহাদ্দিসই পূর্ববর্তীদের গ্রন্হাবলীতে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করেন। উহাতে দীর্ঘ সনদ-সূত্রসমূহকে সংক্ষিপ্ত করা হয়। উহার সজ্জায়ন ও সংযোজনের কাজ পূর্ণ দক্ষতার সহিত সম্পন্ন করা হয়। তাঁহাদের প্রায় সকলেরই কাজ পূর্বগামী মুহাদ্দিসের কাজের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু তবুও এই শতকে এমন কয়েকজন বড়বড় মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে, যাঁহারা স্বাধীনভাবে পূর্বগামীদের রীতি অনুযায়ী স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। হাদীস বর্ণনা ও সনদ-সূত্র সন্ধানে তাঁহাদের গভীর পাণ্ডিত্য বর্তমান ছিল।[********************] তাঁহাদের সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা যাইতেছেঃ

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী (র)

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী চতুর্থ হিজরী শতকের একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি প্রধানত ইমাম বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্হ প্রণয়নের পর অবশিষ্ট সহীহ হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও উহার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। উহার নাম হইতেছে ‘আল মুস্তাদরাক’।

ইহা সর্বজনবিদিত যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম যে দুইখানি হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, ইলমে হাদীসের জগতে তাহাই সর্বাধিক সহীহ। কিন্তু তাঁহার অর্থ এই নয় যে, সমস্ত সহীহ হাদীসই এই গ্রন্হদ্বয়ে সন্নিবেশিত হইয়াছে, উহার বাহিরে আর কোন সহীহ হাদীস থাকিয়া যায় নাই। বস্তুত উক্ত গ্রন্হদ্বয়ের উল্লিখিত হাদীসসমূহ সহীহ, কিন্তু উহার বাহিরেও বহু হাদীস এমন রহিয়া গিয়াছে যাহা গ্রন্হদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত হাদীসসমূহের সমান পর্যায়ের সহীহ। উপরোক্ত ইমামদ্বয় কোন হাদীসকে সহিহ বলিয়া গ্রহণ করার জন্য যে শর্ত আরোপ করিয়াছিলেন এবং সহীহ হাদীস বাছিয়া লইবার জন্য যে মানদণ্ড স্থাপন করিয়াছিলেন সেই শর্ত ও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ আরো বহু হাদীস বাহিরে থাকিয়া গিয়াছিল। যাহা শুধু গ্রন্হদ্বয়ের আকার অসম্ভব রকমে বিরাট হইয়া যাওয়ার আশংকায় তাহাতে শামিল করা হয় নাই। ইমাম হাকেম এই ধরনের হাদীসসমূহ অনুসন্ধান করিয়া ও তুলাদণ্ডে ওজন করিয়া উহার সমন্বয়ে ‘মুস্তাদরাক’ নামে আলোচ্য গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[********************]

ইমাম হাকেম এতদ্ব্যতীত হাদীসের আরো কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্হ রচনা করেন। তাঁহার গ্রন্হাবলীর মোট খণ্ড হইতেছে এক হাজার পাঁচশত। তিনি হাদীসের সন্ধানে ইরাক ও হিজাযে দুইবার সফর করেন। এই সফরে তিনি বহু হাদীস সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করিয়াছেন। তিনি ৪০৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম দারে কুতনী (র)

দারে কুতনীর পূর্ণ নাম হইতেছে আলী ইবনে উমর ইবনে আহমদ। তিনি হাদীসের একজন যুগশ্রেষ্ঠ হাফেজ ও ইমাম। তিনি বহু সংখ্যক উস্তাদের নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন এবং তিনি উহার ভিত্তিতে তিনি বহু সংখ্যক উন্নতমানের গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। বিশেষত হাদীস যাচাই-পরীক্ষা করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী। তাঁহার গ্রন্হ ‘আল-ইলজামাত’ মুস্তাদরাক- এর মতই এক অনবদ্য হাদীস গ্রন্হ। তাঁহার আর একখানি কিতাবের নাম ‘কিতাবুস সুনান’।

তিনি ৩০৬ হিজরী সনে বাগদাদের প্রখ্যাত ‘দারেকুতন’ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি বাগদাদের সকল মহাদ্দিসের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন এবং পরে এই উদ্দেশ্যেই তিনি কূফা, বসরা, সিরিয়া, ওয়াসিত, মিসর ও অন্যান্য হাদীস কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন। তিনি শৈশবকাল হইতেই অসাধারণ স্মরণশক্তি ও অনুধাবন শক্তিতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তিনি ৩৮৫ হিজরী সনে বাগদাদেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইবনে হাব্বান (র)

তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে হাব্বান আহমদ ইবনে হাব্বান আবূ হাতেম আল-বসতী। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্থানসমূহ তিনি সফর করেন ও বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শ্রবণ করেন। ঐতিহাসিক ইবনে সাময়ানী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ হাতেম ইবনে হাব্বান ছিলেন হাদীস-জ্ঞানে যুগশ্রেষ্ঠ। তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত সুদূল পথ সফর করেন।[********************]

খতীব বাগদাদী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। তাঁহার বহুসংখ্যক হাদীস গ্রন্হও রহিয়াছে।[]

তাঁহার হাদীস সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ সফর করিয়া সম্ভবত এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছি।[********************]

এই শতকের প্রায় সকল মুহাদ্দিসের মত এই যে, বুখারী ও মুসলিমের পর যাঁহারা প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রথমে যদি ইবনে খুযাইমার নাম উল্লেখ করিতে হয়, তবে তাঁহার পরই উল্লেখ করিতে হয় ইবনে হাব্বানকে।[ ক. ********************]

ইবনে হাব্বান ৩৫৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইমাম তাবারানী (র)

ইমাম তাবারানীর পূর্ণ নাম হইতেছে আবূল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমদ আত-তাবারানী। তিনি তিনভাগে ‘আল-মু’জিম’ নামে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করেন। প্রতি ভাগের নাম যথাক্রমেঃ

১. ********************

২. ********************

৩. ********************

প্রথম ভাগে তিনি হযরত আবূ হুরায়রা ব্যতীত অপরাপর সাহাবীদের সনদ সূত্রে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা মুসনাদসমূহ তিনি স্বতন্ত্র এক খণ্ডে একত্রিত করেন। মু’জি-এর এই খণ্ডে তিনি প্রায় বিশ হাজার ও পাঁচশত হাদীস (মুসনাদ) একত্রিক করিয়াছেন। ইহাতে তিনি সাহাবীদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতা অবলম্বন করিয়াছেন।

তৃতীয় ভাগের গ্রন্হে তিনি তাঁহার প্রায় দুই হাজার উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ প্রত্যেক উস্তাদের নামের সনদে একত্রিত করিয়াছেন। বলা হয় যে, ইহাতে প্রায় ত্রিশ হাজার সনদে বর্ণিত হাদীস রহিয়াছে এবং তাহা ছয়টি স্বতন্ত্র খণ্ডে বিভক্ত।

দ্বিতীয় ভাগের গ্রন্হখানি একখণ্ডে সম্পূর্ণ। উহাতে এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে গৃহীত প্রায় পনেরো শত হাদীস একত্রিত করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম তাহাভী (র)

ইমাম তাহাভীর পূর্ণ নাম আবূ জা’ফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তাহাভী। তিনি এই শতকের একজন অন্যতম মুহাদ্দিস। তিনি ২২৮ হিজরী সনে মিসরে ‘তাহা’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই সময় কিছু ধর্মবিমুখ লোক ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতে থাকে। তাহারা অভিযোগ করে যে, ইসলামের আদেশ নিষেধসমূহ পরস্পর বিরোধী। এই কারণে ইমাম তাহাভীর বন্ধু-বান্ধবগণ তাঁহাকে হাদীসের এমন একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিবার জন্য অনুরোধ করেন, যাহা হইতে ইসলামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও ব্যবহারিক বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইবে। অতঃপর ইমাম তাহাভী হাদীসের এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

তিনি ৩২১ হিজরী সনে আশি বৎসরাধিক বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

এই শতকের অন্যান্য মুহাদ্দিসীন

তাঁহাদের ব্যতীত এই শতকে আরো কায়েকজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদের মধ্যে কাসেম ইবনে আসবাগ (মৃঃ৩৪০ হিঃ) এবং ইবনুস-সাকান (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা উভয়েই ‘সহীহ আলমুনতাকা’ নামে দুইখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]


চতুর্থ শতকের পরে হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়ন
চতুর্থ শথকের মুহাদ্দিস ও হাদীস-গ্রন্হ প্রণেতাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে। ইহারা প্রায় সকলেই প্রকৃত অর্থে ‘মুহাদ্দিস’ ছিলেন। তাঁহারা নিজেদের সংগৃহীত হাদীসের খ্যাতনামা উস্তাদদের নিকট হইতে শ্রুত হাদীসসমূহের সমন্বয়ে হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়ন করিতেন। গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে তাঁহারা পূর্ণ মাত্রায়ই তৃতীয় শতকের হাদীস গ্রন্হ প্রণেতাদের অনুসৃত রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া চলিয়াছিলেন। এইভাবে চতুর্থ শতকের সোনালী দিনগুলি অতিবাহিত হইয়া যায়।

কিন্তু ইহার পরবর্তী শতকে যে মুহাদ্দিসগণ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসদের সমান মানের প্রতিভাসম্পন্ন ছিলেন না। বিশেষত পূর্বগামীদের প্রণীত হাদীস গ্রন্হের অনুরূপ কোন মৌলিক গ্রন্হ প্রণয়ন করা আর কাহারো পক্ষেই সম্ভব হয় নাই। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে তাঁহাদের দক্ষতা, জ্ঞানের ব্যাপকতা ও গভীরতা এবং দৃষ্টির সূক্ষ্মতা প্রসারতা কিছুমাত্র নগণ্য ছিল না। এই শতকের মুহাদ্দিসগণ মৌলিকভাবে কোন হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করিতে সমর্থ না হইলেও তাঁহার পূর্ববর্তীদের মৌলিক গ্রন্হাবলীকে ভিত্তি করিয়া হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের নবতর পদ্ধতির প্রবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহারা বিভিন্ন গ্রন্হাবলীর হাদীসসমূহ একত্রিত করিয়া এবং উহাকে সুসংবদ্ধভাবে সজ্জিত করিয়া বিপুল সংখ্যক অভিনব গ্রন্হ সমাজ সমক্ষে উপস্থাপিত করিতে সক্ষম হইয়াছেন। আমরা এখানে এই পর্যায়ের কয়েকখানি প্রখ্যাত হাদীস সংগ্রহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করিতেছি।[********************]

বুখারী ও মুসলিমের হাদীস একত্রায়ন

বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম হইতে হাদীস চয়ন ও একত্র সংযোজনপূর্বক স্বতন্ত্র গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইসমাঈল ইবনে আহমদ নামক এক মুহাদ্দিস- যিনি- ‘ইবনুল ফুরাত’ নামে খ্যাত ছিলেন (মৃঃ ৪১৪ হিঃ) – এই ধরনের একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। মুহাম্মদ ইবনে নসর আল হুমাইদী আর আন্দালুসী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ) অপর একখানি হাদীস-গ্রন্হ রচনা করেন। হুসাইন ইবনে মাসঊদ আল-বগভী (মৃঃ ৫১৬ হিঃ) , মুহাম্মদ ইবনে আবদুল হক আল-আশবিলী (মৃঃ ৫৮২হিঃ) এবং আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-কুরতুবী (মৃঃ ৬৪২ হিঃ) প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও এই ধরণের একখানি হাদীস গ্রন্হ সংকলন করেন।[********************]

সিহাহ-সিত্তার হাদীস সঞ্চয়ন

কেবলমাত্র সিহাহ-সিত্তার গ্রন্হাবলী হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই পর্যায়ের যথেষ্ট হইয়াছে। এই গ্রন্হসমূহ সাধারণত ‘তাজরীদুস-সিহাহ-সিত্তা’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ নামেই পরিচিত। এই ধরনের গ্রন্হ প্রণেতাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১. আহমদ ইবনে রুজাইন ইবনে মুরাবীয়াত আল-আবদারী আস-সারকাসতী (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ)। তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হের নাম তাজরীদুস সিহাহ। তাঁহার এই গ্রন্হখানি সুন্দররূপে সজ্জিত ও সুসংবদ্ধরূপে প্রণীত হয় নাই। সিহাহ-সিত্তার অনেক হাদীসই ইহা হইতে বাদ পড়িয়া গিয়াছে। উত্তরকালে মুবারক ইবনে মুহাম্মদ ইবনুল আসরি আল-জাজরী নামে খ্যাত (মৃঃ ৬০৬ হিঃ)। এই গ্রন্হখানির সম্পাদনা ও সুসংবদ্ধকরণের কাজ করেন। অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে উহাকে সুন্দররূপে সাজাইয়া দেন এবং প্রথমে ইহাতে যেসব হাদীস শামিল করা হয় নাই, তাহা ইহাতে শামিল করিয়া দেওয়া হয়। ইহার কঠিন ও অপরিচিত শব্দসমূহের ব্যাখ্যাও দান করা হয় এবং উহার নামকরণ হয়ঃ ******************** ফলে ইহা একখানি সহজবোধ্য অমূল্য গ্রন্হে পরিণত হয়। মিসরে এই গ্রন্হখানি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা দশখণ্ডে বিভক্ত। জামে আজহারের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবদে রাব্বিহি ইবনে সুলাইমান ইহার ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন। তিনি উহার নাম রাখিয়াছেনঃ ********************

২. আবদুল ইবনে আবদুর রহমান আল-আশ-বেলী ইবনে খারাত নামে খ্যাত (মৃঃ ৫৮২ হিঃ) সিহাহ-সিত্তার সমন্বয়ে আর একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

বিভিন্ন গ্রন্হ হইতে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন

হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্হাবলী হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের কাজও এই পর্যায়ে যথেষ্ট হইয়াছে। কয়েকখানি গ্রন্হের নাম ও পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছে।

১. মাসাবীহুস-সুন্নাহ- ইমাম হুসাইন ইবনে মাসউদ আল বাগাভী (মৃঃ ৫২৬ হিঃ) ইহার সম্পাদনা করিয়াছেন। ইহাতে প্রথমে সহীহ, হাসান প্রভৃতি হাদীস সংযোজিত হয়। পরবর্তীকালের আলিম সমাজ এই হাদীস সংকলনখানির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব ও আগ্রহ প্রকাশ করেন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-খতীব ইহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত করেন। হাদীসের মূল বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম এবং যে গ্রন্হ হইতে ইহা সংগ্রহ করা হইয়াছে তাহারও উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রথমে প্রত্যেক অধ্যায়ে মাত্র দুইটি করিয়া পর্যায় (********************) সন্নিবেশিত ছিল; কিন্তু এক্ষণে উহাতে তৃতীয় পর্যায়ের (********************) হাদীস সংযোজিত হয়। ইহা ৭৩৭ হিজরী সনের ঘটনা। শেষ পর্যন্ত নামকরণ হয় মিশকাতুল মাসাবীহ (********************) বহু মুহাদ্দিসই ইহার ব্যাখ্যার বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।[********************]

২. জামেউল মাসেনীদ আল-আলকাব- ইহা আবুল ফারজ আবদুল ইবনে আলী আল জাওযীর (মৃঃ ৫৯৭ হিঃ) সংকলিত হাদীস গ্রন্হ। ইহাতে বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযী শরীফ হইতে হাদীস সংগ্রহ করা হইয়াছে।

৩. বহরুল আসানীদ- ইমাম হাফেজ আল-হাসান ইবনে আহমদ সমরকান্দী (মৃঃ ৪৯১ হিঃ) কর্তৃক ইহা সংকলিত। ইহাতে এক লক্ষ হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই গ্রন্হখানি সম্পর্কে বলা হয়ঃ

******************************************************

ইসলামের ইহার দৃষ্টান্ত নাই।[********************]

আহকাম ও নসীহতমুলক হাদীস সংকলন

এই পর্যায়ে আহকাম ও ওয়াজ-নসীহতমূলক হাদীস বিভিন্ন হাদীসগ্রন্হ হইতে সঞ্চয়ন করিয়াও বিভিন্ন হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করা হয়। তন্মধ্যে নিম্নোলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ

১. মুনতাকাল আখবার ফিল আহকাম‑ ইহা হাফেজ মাজদুদ্দীন আবুল বারাকাত আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবুল কাসেম আল হাররানীর সংকলিত। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামে খ্যাত। মনে রাখা আবশ্যক যে, তিনি প্রখ্যাত মুজাদ্দিদ ইবনে তাইমিয়া নহেন এবং তিনি মুজাদ্দিদ ইবনে তাইমিয়ার দাদ- পিতামহ। এই গ্রন্হ প্রণেতা ইবনে তাইমিয়াও একজন বড় মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি ৫৯০ হিজরী স নে জন্মগ্রহন করেন এবং ৬৫২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

এই গ্রন্হে বুখারী, মুসলিম, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও সুনানে আহমদ প্রৃভৃতি সহীহ ও সর্বজনমান্য গ্রন্হাবলী হইতে হাদীসসমূহ সংকলিত ও সংযোজিত হইয়াছে। ইয়ামেনের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে আলী শওকানী (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) ‘নায়লুল আওতার’ নামে নয় খণ্ডে ইহার ব্যাখ্যা লিখিয়াছেন।

২. আস-সুনানুল কুবরা ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বায়হাকী(মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) সংকলিত। ইবনে সালাহর মতে, হাদীসের দলীলসমূহ এই গ্রন্হে যত সামগ্রিকতা ব্যাপকতা সহকারে সন্নিবেশিত হইয়াছে, তত আর কোন গ্রন্হেই নহে। ইহাতে প্রয়োজনীয় কোন হাদীসই পরিত্যক্ত হয় নাই। ইমাম বায়হাকীর আর একখানি হাদীস সংকলন রহিয়াছে উহার নাম ********************। [********************] বলা হয়ঃ

******************************************************

ইসলামের এইরূপ আর একখানি গ্রন্হও প্রণয়ন করা হয় নাই।[********************]

৩. আল-আহকামুস- সগরা- ইহা হাফেজ আবূ মুহাম্মদ আবদুল হক আল-আশবেলী(ইবনে খারাত নামে খ্যাত) কর্তৃক সংকলিত। তিনি ৫৮২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ইহাতে একদিকে যেমন মুসলিম জীবনের ব্যবহারিক ও আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে, অনুরূপভাবে ওয়াজ-নসীহত এবং পরকাল সম্পর্কে সতর্কতামূলক হাদীসও সংযোজিত হইয়াছে।[********************]

৪. উমদাতুল আহকাম- ইহা ইমাম হাফেজ আবদুল গনী ইবনে আবদুল ওয়াহিদ আল-মাকদাসী দামেশকী(মৃঃ ৬০০ হিঃ) সংকলিত। বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে আহকাম সম্পর্কিত যে সব হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহই ইহাতে সংকলিত হইয়াছে।

৫. আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব- হাফেজ আবদুল আযীয ইবনে ইবদুল কভী ইবনে আবদুল্লাহ আল- মুনযেরী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ) সংকলিত। হাদীস সংগ্রহ ও উহার গুণাগুণ নির্ধারণ দৃষ্টিতে এই গ্রন্হখানি অতি উত্তম।


সপ্তম ও অষ্টম শতকে হাদীস চর্চা
পূর্ববর্তী আলোচনা প্রায় সাড়ে ছয়শত বৎসর পর্যন্ত বিস্তৃত। হিজরী সপ্তম শতকের শেষাধ্যে মুসলিম জাহানের উপর ধ্বংস ও বিপর্যয়ের এক প্রবণ ঝঞ্ঝা- বাত্যা প্রাবাহিত হইয়া যায়। ৬৫৮ হিজরী সনে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে তাতারদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় তাহারা ‘হলব’ ধ্বংস করিয়া দামেশকের দিকে অগ্রসর হয়। মিসরে তখন আইয়ুবী শাসন অবস্থিত; কিন্তু তাহাও তৈলহীন প্রদীপের মত নিস্প্রভ প্রায় হইয়া আসিয়াছিল। মামলুকদের কর্তৃত্বই সর্বত্র প্রধান ও প্রবল হইয়া উঠে। সপ্তম শতকের মুসলিম জাহানের উপর তুর্কী প্রাধান্য স্থাপিত হইতে শুরু করে। অপর দিকে সমগ্র মাগরিব (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা) এলাকায় মাগরেবী বার্বার জনগোষ্ঠীর শাসন সংস্থাপিত হয়।

এক কথায়, এই সময় সমগ্র মুসলিম জাহানের উপর সভ্যতার সূর্যাস্তকালীন অবস্থা বিরাজিত ছিল। মুসলিমগণ চরিত্র, ঈমান ও শৌর্য-বীর্য সকল দিক দিয়াই দুর্বলতর হইয়া পড়ে। তাহাদের পারস্পরিক প্রবল হিংসা-বিদ্বেশ, মতবিরোধ ও অবসাদ তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে নিস্প্রাণ ও মৃত্যু-প্রায় করিয়া দিয়াছিল। মুসলিমগণের এক দেশ হইতে অন্য দেশ পরিভ্রমণ ও বিরাট মুসলিম জনতার সহিত গভীর ঐক্য সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কোন প্রবণতাই কোথাও পরিলক্ষিত হইত না। এমন কি হাদীসের সন্ধানে যে মুসলিমদের দেশ পর্যটন ছিল এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গৌরবের বিষয়, এই শতকে জ্ঞান-কেন্দ্র ও দূরে দূরে অব্স্থানকারী মনীষী ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে জ্ঞানগত সম্পর্কসূত্র সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া গিয়াছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের চিন্তা ও মনীষা ভোঁতা হইয়া যাইতে লাগিল, জ্ঞান-পিপাসুদের মধ্যে দূর-দূরান্তর পরিভ্রমনের সুযোগে জ্ঞান আহরণের কোন তৎপরতাই ছিল না। ফলে হাদীস সংগ্রহ ও উহার বর্ণনা পরস্পরার ধারাবাহিকতার পথ রুদ্ভ হইয়া আসে। এক্ষণে কেবলমাত্র উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লওয়া ও কিছু সংখ্যক হাদীস তাঁহার নিকট হইতে লিখিয়া লওয়ার মধ্যেই হাদীস চর্চার সময় কাজ সীমাবদ্ধ হইয়া পড়ে। হাদীসের সন্দ এই সময় কেবলমাত্র এক ‘বরকত’ লাভের উপায়ে পরিণত হয়।

কিন্তু ইহা চূড়ান্ত এ একমাত্র কথা নহে। এই সময়ও কিছু সংখ্যক তেজস্বী মনীষীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁহারা হাদীস-সন্ধান ও সংগ্রহেনর প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত তৎপরতার পুনরুজ্জীবন সাধন করেন। তাঁহারা দূর দূর কেন্দ্রে পরিভ্রমণ করেন ও মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে তাঁহার সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিতে লাগিলেন। এই পদ্ধতিতে হাদীস শিক্ষাদান হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ইমলা’ (********************)। মুহাদ্দিস মসজিদের একপাশে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিনে আসন গাড়িয়া বসিতেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া চতুর্দিকে বসিতেন হাদীস শিক্ষার্থী লোকেরা। মুহাদ্দিস মুখে হাদীস পাঠ করিতেন, শিক্ষার্থিগণ তাহা নিজ নিজ কাগজে লিখিয়া লইতেন। এই পর্যায়ের মুহাদ্দিসের মধ্যে আল-হাফেজ আবুল ফযল জয়নুদ্দীন আবদুর রহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি যেমন হাদীসের যুগ-ইমামা ছিলেন, তেমনি ছিলেন বহু সংখ্যক মুল্যবান গ্রন্হের প্রণেতা। তিনি হাদীস লিখাইবার জন্য চার শতেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়াছেন। তাঁহার ছাত্র ইবনে হাজার বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ৭৯৬ হিজরী সনে হাদীস লিখাইতে শুরু করেন। ফলে রাসূলের হাদীস চর্চা বন্ধ হইয়া যাওয়ার পর তনি উহাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি চার শতেরও অধিক মজলিসের অনুষ্ঠান করেন এবং ইহার অধিকাংশ বৈঠকে তিনি কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যেই সুসংবদ্ধ ও সুরক্ষিত এবং কল্যাণাদানকারী হাদীসসমুহ লিখাইয়া দিয়াছেন।[********************]

তিনি ৮০৬ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।

এই পর্যায়ে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য মনীষী হইতেছেন শিহাবুদ্দীন আবুল ফযল আহমদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাজার আল-আসকালানী। তিনি হাদসের শুধু হাফেজই ছিলেন না, এই শতকের হাদীসের হাফেজদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। এই শতকে তাঁহার সমতুল্য মুহাদ্দিস আর কেহই ছিলেন না। তিনি ৮৫২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংগ্রহের জন্য দেশভ্রমণ ও দুনিয়ায় হাদীস চর্চার প্রাধান্য সামগ্রিকভাবে তাঁহার পর্যন্ত আসিয়া শেষ হইয়া যায়। তাঁহার সমসাময়িক যুগে তিনি ব্যতীত অপর কেউই হাদীসের হাফেজ হন নাই। তিনি বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ রচনা করিয়াছেন ও এক হাজারেরও অধিক মজলিস অনুষ্ঠান করিয়া হাদীস লিখাইয়াছেন।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানীর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্হ হইতেছে বুখারী শরীফের শরাহ ‘ফতহুল বারী’। ইহা বিরাট দশটি খণ্ডে বিভক্ত। ইহার ভূমিকা স্বতন্ত্র এক গ্রন্হ হিসাবে প্রকাশিত, উহার নামঃ ********************।[********************]

তাঁহার নিজস্ব একখানি হাদীস সংকলনও রহিয়াছে। তাহা হইতেছে ******************** ইহা আহকাম সংক্রান্ত হাদীসের এক বিশেষ সংকলন।

আলেম সমাজে এই গ্রন্হখানিও বিশেষভাবে সমাদৃত হইয়াছে।[********************]

ইবনে হাজারের ছাত্র ইমাম সাখাভীও এই পর্যায়েল এক উল্লেখযোগ্য প্রতিভা। তিনি তাঁহার বিখ্যাত ‘ফতহুল মুগীস’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ******************************************************

আমি মক্কা শরীফে হাদীস লিখিয়াছি। কাহেরার বিভিন্ন ও বহু সংখ্যক স্থানেও এই কাজ করিয়াছি এবং এখন পর্যন্ত যতগুলি মজলিসে হাদীস লিখাইবার কাজ করিয়াছি, তাহার সংখ্যা প্রায় ছয়শত হইবে।…………. আর সব কাজেরই মূল হইতেছে নিয়্যত।[********************]

কিন্তু হাদীস ‘ইমলা’ করানোর এই পদ্ধতিও আর বেশি দিন কার্যকর হইয়া থাকিতে পারে নাই। পরবর্তী সময়ের হাদীসবিদগণ পূর্ববর্তীদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ লইয়াই অধিক মশগুল থাকেন। উহা হইতে হাদীস সঞ্চয়ন, সংক্ষিপ্ত সংস্করণ রচনা, হাদীস গ্রন্হের ব্যাখ্যা প্রণয়ন প্রভৃতি কাজেই তাঁহারা মনোযোগ দান করেন। আর ইহাও মুসলিম জাহানের মাত্র কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং অতি অল্প সংখ্যক লোকই এই কাজে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন মাত্র।


বিভিন্ন দেশে হাদীস চর্চা
সপ্তম, অষ্টম ও উহার পরবর্তী শতকসমূহে মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীসের চর্চা, শিক্ষাদান ও প্রচার সাধিত হইয়াছে। এই সময়ে মাগরেবী দেশসমূহেই (উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায়) ইহার প্রসারতা সর্বাধিক ছিল। কিন্তু উহার পর দুইটি বিরাট মুসলিম দেশে হাদীস চর্চার ব্যাপকতা পরিলক্ষিত হয়, একটি মিসর এবং অপরটি হিন্দুস্থান (ভারতবর্ষ)। বাগদাদে তাতারী আক্রমণের ফলে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন মুসলিম মনীষা ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা। তাতারগণ বাগদাদের ইসলামী গ্রন্হাগার হইতে লক্ষ লক্ষ গ্রন্হ হরণ করিয়া লইয়া দজলা নদীতে নিক্ষেপ করে ও উহার উপর এই গ্রন্হস্তুপ দ্বারা পুল নির্মাণ করিয়া দেয়- যেন তাহাদের সৈন্যবাহিনী সহজেই নদী অতিক্রম করিতে পারে। ইহার পরই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎসকেন্দ্র বাগদাদ হইতে অন্যত্র স্থানান্তরিত হইয়া যায়। প্রথমে মিসর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান- বিশেষত ইলমে হাদীসে সমৃদ্ধ ও ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। এই সময়ে মিসরে হাদীসের যেরূপ চর্চা ও প্রসার হয় তাহাকে অনায়াসেই তৃতীয় হিজরী শতকের হাদীস চর্চার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কিন্তু অতঃপর এখানেও হাদীস চর্চার এই প্রচণ্ড মার্তণ্ড অস্তোন্মুখ হইয়া পড়ে। হাদীসের জ্ঞান-চর্চা অতঃপর অন্যান্য দেশের দিকে প্রবাহিত হয়। দেখা যায়, হাদীস জ্ঞানের সূর্য মিসরে অস্তমিত হইয়া ভারতের আকাশে উদিত ও ভাস্বর হইয়া দেখা দিয়াছে। ভারতে তখন প্রকৃতপক্ষেই হাদীস-চর্চার স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। ( বিস্তারিত আলোচনার জন্য এই গ্রন্হের ‘পাক ভারতে ইলমে হাদীস’ শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)

মিসরের এই পতন যুগেও হাদীসের চর্চা মোটেই হয় নাই, একথা বলা যায় না। বরং ইতিহাস আমাদের সম্মুখে এই সময়ও ইলমে হাদীসের বিরাট ও অবিস্মরনীয় খেদমতের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করে। মিসরে তখন মামলুকদেরই রাজত্ব কায়েম ছিল। এই মামলূক বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞান-স্পৃহা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। বহু বাদশাহ ছাত্র হিসাবে একালের মুহাদ্দিসদের সম্মুখে আসন গাড়িয়া বসিয়াছেন। রাজ ভাণ্ডার উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছেন হাদীস শিক্ষার বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে।

এই সময়ও মিসরে কয়েকজন হাদীসের ইমাম বর্তমান ছিলেন। হাদীসসমূহ উহার পূর্ণ ও বিশুদ্ধ সনদসহ তাঁহারা মুখস্থ করিয়াছেন। পিপাসুরা তাঁহাদের নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিতেন এবং হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে লোকেরা তাঁহাদের সম্মুখেই ভীড় জমাইত।

তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত হাদীসবিদগণ উল্লেখযোগ্যঃ

১. জাহের বরকুক ২. ইমাম আকমালূদ্দীন আল-বাবরতী ৩. ইবনে আবুল মজদ ৪. আল-মুয়াইয়িদ ৫. শামসুদ্দীন আদ-দেয়ারী আল-মুহদ্দিস।[********************]


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি