প্রথম পর্ব
হাদীস ও হাদীসের নামে জালিয়াতি

১.১. ওহী ও হাদীস
১.১.১. ওহী এবং মানবতার সংরক্ষণে তার গুরুত্ব
মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি মানবজাতিকে অত্যন্ত ভালবাসেন। মানুষকে তিনি সৃষ্টির সেরা হিসেবে তৈরি করেছেন। তাকে দান করেছেন জ্ঞান, বিবেক, যুক্তি ও বিবেচনা শক্তি যা তাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। মানুষের এই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ তার জ্ঞান, বিবেক ও বিবেচনা দিয়ে তার পার্থিব জগতের বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারে এবং নিজেকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে পারে, কিন্তু তার ইন্দ্রিয়ের বাইরের কিছু সে জানতে পারেনা। এজন্য ইন্দ্রিয়ের অতীত কোনো বিষয়ে মানুষের জ্ঞান, বিবেক বা যুক্তি দিয়ে সঠিক সমাধানে পৌছাতে অনুরূপভাবে সক্ষম হয়না। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারি।
জাগতিক বিষয়গুলি মানূষ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারে। কিভাবে চাষ করলে বেশি ফল ফসল হবে, কিভাবে বাড়ি বানালে বেশি টেকসই হবে, কিভাবে গাড়ি চালালে দ্রুত চলবে, কিভাবে রান্না করলে খাদ্যমানের বেশি সাশ্রয় হবে, কিভাবে ব্যবসা করলে লাভ বেশি হবে বা পুঁজির নিরাপত্তা বাড়বে, কিভাবে চিকিৎসা করলে আরোগ্যের সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা বা হার বাড়বে ইত্যাদি বিষয় মানবীয় অভিজ্ঞতা, গবেষণা, যুক্তি ও চিন্তার মাধ্যমে জানা যায়।
কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও আচার আচরণ বিষয়ক জ্ঞান কখনো অভিজ্ঞতা বা ঐন্দ্রিক জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায়না। আল্লাহর সম্পর্কে বিশ্বাস কিরূপ হতে হবে, কিভাবে নবী রাসূলগণের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, পরকালের সঠিক বিশ্বাস কি, কিভাবে আল্লাহকে ডাকতে হবে, কোন্ কর্ম করলে তাঁর রহমত ও বরকত বেশি পাওয়া যাবে, কিভাবে চললে আখিরাতে মুক্তির সম্ভাবনা বাড়বে, কোন্ পদ্ধতিতে চললে দ্রুত আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করা যাবে, কোন্ কাজ করলে বেশি সওয়াব অর্জন করা যাবে, কোন্ কর্মে পাপের ক্ষমালাভ হয় ইত্যাদি অধিকাংশ ধর্মীয় ও বিশ্বাসীয় বিষয় কখনোই অভিজ্ঞতা বা গবেষণার মাধ্যমে চূড়ান্তরূপে জানা যায়না বা এ বিষয়ক কোনো সমস্যা গবেষনা বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাধান করা যায়না।
এজন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে সৃষ্টির সেরা রূপে সৃষ্টি করার পরও তার পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী রাসূলগণ প্রেরণ করেছেন। তিনি যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কিছু মহান মানুষকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে তাঁর বাণী, ওহী বা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছেন। মানুষ যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক, গবেষণা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যেসব বিষয় জানতে পারেনা বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা সে সকল বিষয় ওহীর মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। এছাড়া মানুষ বুদ্ধি ও বিবেক দিয়ে যে সকল বিষয় ভাল বা মন্দ বলে বুঝতে পারে সে সকল বিষয়েও ভাল-মন্দের পর্যায়, গুরুত্ব, পালনের উপায় ইত্যাদি তিনি ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন।
ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের সংরক্ষণ ও তার অনুসরণ ব্যতীত মানব জাতি ও মানব সভ্যতার সংরক্ষণ সম্ভব নয়। স্বার্থের সংঘাত, হানাহানি ও স্বার্থপরতা দূর করে প্রকৃত ভালবাসা, সেবা ও মানবীয় মূল্যবোধগুলির বিকাশ করতে ওহীর জ্ঞানের উপরই নির্ভর করতে হবে। বিশ্বাস, সততা, পাপ, পূণ্য, স্রষ্টা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে ওহীর বাইরে মানবীয় বিবেক, অভিজ্ঞতা বা গবেষণার আলোকে যা কিছু বলা হয় সবই বিতর্ক, সংঘাত ও বিভক্তি বৃদ্ধি করে। কারণ এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সত্য কখনোই ওহী ছাড়া মানবীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে জানা যায়না। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের বিকৃতি বা বিলুপ্তির কারণেই বিভিন্ন জাতি বিভ্রান্ত হয়েছে।

১.১.২. ওহীর বিকৃতি বা বিলুপ্তির কারণ
কুরআন হাদীসের বর্ণনা ও বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ দুটিঃ
১. অবহেলা, মুখস্ত না রাখা বা অসংরক্ষণের ফলে ওহীলব্ধ জ্ঞান বা গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
২. মানবীয় কথাকে ওহীর নামে চালানো বা ওহীর সাথে মানবীয় কথা বা জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটানো।(খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ ১১-১৫)।
প্রথম পর্যায়ে ওহীর জ্ঞান একেবারে হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ওহী নামে কিছু জ্ঞান সংরক্ষিত থাকে, যার মধ্যে মানবীয় জ্ঞান ভিত্তিক কথাও সংরক্ষিত থাকে। কোন কথাটি ওহী বা কোন কথাটি মানবীয় তা জানার ব পৃথক করার কোনো উপায় থাকেনা। ফলে ‘ওহী’ নামে সংরক্ষিত গ্রন্থ বা জ্ঞান মূল্যহীন হয়ে যায়। পূর্ববর্তী অধিকাংশ জাতি দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ওহীর জ্ঞানকে বিকৃত করেছে। ইহুদী, খ্রীস্টান ও অন্যান্য অধিকাংশ ধর্মাবলম্বীদের নিকট ‘ধর্মগ্রন্থ’, Divine Scripture ইত্যাদি নামে কিছু গ্রন্থ সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলির মধ্যে অগণিত মানবীয় কথা, বর্ণনা ও মতামত সংমিশ্রিত রয়েছে। ওহী ও মানবীয় কথাকে পৃথক করার কোনো পথ নেই এবং সেগুলো থেকে ওহীর শিক্ষা নির্ভেজালভাবে উদ্ধার করার কোনো পথ নেই।

১.১.৩. দুই প্রকার ওহীঃ কুরআন ও হাদীস
কুরআন করীমে বারংবার এরশাদ করা হয়েছে যে, মহিমাময় আল্লাহ তাঁর মহান রাসূলকে দুইটি জিনিস প্রদান করেছেনঃ একটি ‘কিতাব’ বা ‘পুস্তক’ এবং দ্বিতীয়টি ‘হিকমাহ’ বা ‘প্রজ্ঞা’।(সূরা বাকারা ১২৯, ১৫১, ২৩১; সূরা আল ইমরান ১৬৪; সূরা নিসা ১১৩; সূরা আহযাব ৩৪; সূরা জুমুআহ ২)।
এই পুস্তক বা কিতাব হলো কুরআন করীম, যা হুবহু ওহীর শব্দে ও বাক্যে সংকলিত হয়েছে। আর হিকমাহ বা প্রজ্ঞা হলো ওহীর মাধ্যমে প্রদত্ত অতিরিক্ত প্রায়োগিক জ্ঞান যা হাদীস নামে সংকলিত হয়েছে। কাজেই ইসলামে ওহী দুই প্রকারঃ কুরআন ও হাদীস। ইসলামের এই দুই মূল উৎসকে রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওহীর জ্ঞানকে হুবহু নির্ভেজালভাবে সংরক্ষণের জন্য একদিকে কুরআন ও হাদীসকে হুবহু শাব্দিকভাবে মুখস্ত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয় এমন কোনো কথাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
১.১.৪. হাদীসের ব্যবহারিক সংজ্ঞা
হাদীস বলতে রাসূল(স) এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেছেন, করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় “যে কথা, কর্ম, অনুমোদন বা বিবরণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলে প্রচার করা হয়েছে বা দাবি করা হয়েছে” তাই “হাদীস” বলে পরিচিত। এছাড়া সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ এর কথা, কর্ম বা অনুমোদনকেও হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম, কথা বা অনুমোদনকে “মারফূ হাদীস” বলা হয়। কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মাউকূফ হাদীস” বলা হয় আর তাবেয়ীগণের কর্ম, কথা বা অনুমোদন হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে “মাকতূ হাদীস” বলা হয়। [ইরাকী, যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন(৮০৬হি), আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈদাহ, পৃ ৬৬-৭০; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৫২-৬৩; সাখাবী, মুহাম্মদ ইবনু আবদুর রাহমান(৯০২ হি), ফাতহুল মুগীস ১/৮-৯, ১৭৭-১৫৫; সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আবদুর রাহমান ইবনু আবী বকর(৯১১ হি), তাদরীবুর রাবী ১/১৮৩-১৯৪।]
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, যে কর্ম, কথা, অনুমোদন বা বর্ণনা রাসূলুল্লাহ(স) এর বলে দাবী করা হয়েছে বা বলা হয়েছে তাকেই মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলে গণ্য করা হয়। তা সত্যই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা কিনা তা যাচাই করে নির্ভরতার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের বিভিন্ন প্রকার ও পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। আমরা পরবর্তী আলোচনায় সেগুলি ব্যাখ্যা করব।
১.১.৫. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্বের বিষয়টি আলোচনা বাহ্যত নিষ্প্রয়োজনীয়। কুরআন করীমের অনেক নির্দেশ, রাসূলুল্লাহ(স) এর অগণিত নির্দেশ ও সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, ‘হাদীস’ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস ও ভিত্তি। বস্তুত মুসলিম উম্মাহর সকল যুগের সকল মানুষ এ বিষয়ে একমত। সাহাবীদের যুগ হতে শুরু করে সকল যুগে হাদীস শিক্ষা, সংকলন, ব্যাখ্যা ও হাদীসের আলোকে মানবজীবন পরিচালিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে গড়ে উঠেছে হাদীস বিষয়ক সুবিশাল জ্ঞান ভান্ডার। তবে কতিপয় ইহুদী, খৃস্টান প্রাচ্যবিদ ও মুসলিম উম্মাহর কোনো কোনো পন্ডিত বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্নভাবে হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্যে পক্ষে উপস্থাপিত দলীলসমূহকে আমরা চারভাগে ভাগ করতে পারিঃ
(১) কুরআন করীমের কিছু আয়াতের আলোকে দাবি করা হয় যে, ‘কুরআনেই সব কিছুর বর্ণনা’ রয়েছে। কাজেই হাদীস নিষ্প্রয়োজনীয়।
(২) হাদীসের বর্ণনা ও সংকলন বিষয়ক কিছু আপত্তি উথ্থাপন করে দাবি করা হয় যে, হাদীসের মধ্যে অনেক জালিয়াতি প্রবেশ করেছে। কাজেই তার উপর নির্ভর করা যায়না।
(৩) কিছু হাদীস উল্লেখ করে হাদীসের মধ্যে বিজ্ঞান বা জ্ঞানবিরোধী কথাবার্তা বা বৈপরীত্য আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা।
(৪) কিছু হাদীস থেকে তাঁরা প্রমাণ(!) পেশ করেন যে, রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ হাদীসের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে নিষেধ করেছেন।
এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা আমাদের গ্রন্থের পরিসরে সম্ভব নয়। তবে আমরা আমাদের এই গ্রন্থে হাদীসের জালিয়াতি ও সহীহ হাদীস থেকে জাল হাদীসকে পৃথক করার বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের সকল আলোচনা এবং সাহাবীদের যুগ থেকে আজ পর্য্ন্ত মুসলিম উম্মাহর সকল শ্রমের মূল ভিত্তিটিই হলো এই যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের অনুসরণ ছাড়া কুরআন পালন, ইসলাম পালন বা মুসলমান হওয়া যায়না। আমাদের জীবন চলার অন্যতম পাথেয় রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস। তবে আমাদের অবশ্যই বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস বাদ দিলে আর কোনোভাবেই কুরআন মানা বা ইসলাম পালন করা যায়না। হাদীসের বিরুদ্ধে এ সকল মানুষের উথ্থাপিত যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম যুক্তিটি আমরা আলোচনা করতে পারি। আমরা দেখতে পাব যে, কুরআন মানতে হলে হাদীস মানা আবশ্যক। নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুনঃ
(১) ‘ওহী’র মাধ্যমে যে নির্দেশনা মানব জাতি লাভ করে তার বাস্তব প্রয়োগ ও পালনের সর্বোচ্চ আদর্শ হন ‘ওহী প্রাপ্ত নবীগণ ও তাঁদের সাহচর্য্ প্রাপ্ত শিষ্য ও সঙ্গীগণ। তাঁদের জীবনাদর্শই মূলত অন্যদের জন্য ওহীর অুনসরণ ও পালনের একমাত্র চালিকা শক্তি। এজন্য সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্ম প্রচারক ও তাঁর শিষ্য, প্রেরিত ও সহচরদের জীবন, কর্ম ও আদর্শকে ধর্ম পালনের মূল উৎসরূপে সংরক্ষণ ও শিক্ষাদান করেন। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবন, কর্ম, ত্যাগ, ধৈর্য্, মানবপ্রেম, আল্লাহর ভয়, সত্যের পথে আপোষহীনত ….. ইত্যাদি হাদীস ছাড়া জানা সম্ভব নয়। একজন মুসলমানকে হাদীস থেকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থই হলো তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) এর বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। একে অতি সহজেই তাঁকে কুরআন থেকে এবং ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হয়।
(২) হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কুরআন এর পরিচয় লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুহাম্মদ(স) এর জীবন, পরিচয়, বিশ্বস্ততা, সততা, নব্যুয়ত ইত্যাদি কোনো তথ্যই হাদীসের মাধ্যম ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তিনি কিভাবে কুরআন লাভ করলেন, শিক্ষা দিলেন, সংকলন করলেন…….ইত্যাদি কোনো কিছুই হাদীসের তথ্যাদি ছাড়া জানা সম্ভব নয়।
(৩) হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কুরআন মানাও সম্ভব নয়।
কুরআন করীমে সকল কিছুর বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু তা সবই শুধুমাত্র ‘মূলনীতি’ বা ‘প্রাথমিক নির্দেশনা’ রূপে। কুরআন করীমের অধিকাংশ নির্দেশই ‘প্রাথমিক নির্দেশ’, ব্যাখ্যা ছাড়া যেগুলি পালন করা অসম্ভব। ইসলামের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম সালাত বা নামায। কুরআন করীমে শতাধিক স্থানে সালাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সালাতের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। বিভিন্ন স্থানে রুকু করার বা সেজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ‘যেভাবে তোমাদের সালাত শিখিয়েছি সেভাবে সালাত আদায় করা।’ কিন্তু কুরআন করীমের কোথাও সালাতের এই পদ্ধতিটি শেখানো হয়নি। ‘সালাত’ বা ‘নামায’ কী, কথন তা আদায় করতে হবে, কখন কত রাকায়াত আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাক‘আত কী পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাক‘আতে কুরআন পাঠ কিভাবে হবে, রুকু কয়টি হবে, সিজদা কয়টি হবে, কিভাবে রুকু ও সেজদা আদায় করতে হবে…ইত্যাদি কোনো কিছুই কুরআনে শিক্ষা দেওয়া হয়নি। কুরআনের সর্বশ্রেষ্ট নির্দেশকে আমরা কোনোভাবেই হাদীসের উপর নির্ভর না করে আদায় করতে পারছিনা। এভাবে কুরআন হাদীসের অধিকাংশ নির্দেশই হাদীসের ব্যাখ্যা ছাড়া পালন সম্ভব নয়।
(৪) কুরআন করীমে কিছু নির্দেশ বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। যেমন কোথাও মদ, জুয়া ইত্যাদিকে বৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কোথাও তা অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কাফির ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কোথাও সকল প্রকার বিরোধিতা এবং যুদ্ধ হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদীসের নির্দেশনা ছাড়া এ সকল নির্দেশের কোনটি আগে, কোনটি পরে এবং কিভাবে সেগুলি পালন করতে হবে তা জানা যায়না। এজন্য হাদীস বাদ দিলে এসকল আয়াতের ইচ্ছামত ও মনগড়া ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সহজ হয়ে যায়।
মূলত এজন্যই ইহুদী, খৃষ্টান, কাদিয়ানী, বাহাঈ প্রমুখ সম্প্রদায় হাদীসের বিরুদ্ধে ঢালাও অপপ্রচার চালান। তাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া। তারাও জানেন যে, হাদীসের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই কুরআন মানা যায়না। শুধুমাত্র সরলপ্রাণ মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার জন্যই তারা মূলত ‘কুরআনের’ নাম নেন।
(৫) আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ তাঁর রাসূল(স) কে দুইটি বিষয় প্রদান করেছেনঃ কিতাব(পুস্তক) ও হিকমাহ(প্রজ্ঞা)। স্বভাবতই কুরআনও প্রজ্ঞা ও হিকমাহ। তবে বারংবার পৃথকভাবে উল্লেখ করা থেকে আমার জানতে পারি যে, কুরআনের অতিরিক্ত প্রজ্ঞা বা জ্ঞান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল (স) কে প্রদান করেছিলেন এবং তিনি কুরআন ছাড়াও অতিরিক্ত অনেক শিক্ষা মানব জাতিকে প্রদান করেছেন এই প্রজ্ঞা থেকে। আমরা জানি যে, কুরআনের যে অতিরিক্ত শিক্ষা তিনি প্রদান করেছিলেন, তাই ‘হাদীস’ রূপে সংকলিত। ‘হাদীস’ ছাড়া তাঁর প্রজ্ঞা জানার ও মানার আর কোনো উপায় নেই। কাজেই কুরআনের নির্দেশ অনুসারেই আমাদেরকে কুরআন ও হাদীসের অনুসরণে জীবন পরিচালিত করতে হবে।
(৬) কুরআনে রাসূলুল্লাহ(স) এর আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনুগত্য ছাড়াও তাঁকে অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ
-“বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, এতে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসবেন, এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন।” (সূরা আল ইমরানঃ৩১)।
আমরা জানি যে, আনুগত্য অর্থ আদেশ নিষেধ পালন করা। আর কারো অনুসরণ করার অর্থ হলো হুবহু তাঁর কর্মের মত কর্ম করা। হাদীসের উপর নির্ভর না করলে কোনোভাবেই রাসূলুল্লাহ(স) এর অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কুরআন কারীমে আদেশ নিষেধ উল্লেখ করা হলেও কোথাও রাসূলুল্লাহ(স) কর্ম ও জীবনরীতি আলোচিত হয়নি। এজন্য শুধুমাত্র কুরআন দেখে রাসূলুল্লাহ(স) এর অনুসরণ করা কোনোমতেই সম্ভব নয়। কাজেই কুরআনের নির্দেশ অনুসারে আল্লাহর প্রেম ও ক্ষমা লাভ করতে হলে অবশ্যই হাদীসের বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ(স)এর অনুসরণ করতে হবে।
(৭) কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছেঃ
لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
-নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আল আহযাবঃ২১)।
ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ(স) এর বাস্তব জীবননীতি কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কুরআনের নির্দেশে রাসূলুল্লাহ(স) এর আদর্শ অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
(৮) কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যেঃ
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
-“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক।”(সূরা হাশরঃ৭)।
আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর সুদীর্ঘ নব্যুয়তী জীবনে অনেক অনেক শিক্ষা প্রদান করেছেন তাঁর সাহাবীগণকে। জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক দিকনির্দেশনা তিনি প্রদান করেছেন। এ সকল শিক্ষা ও নির্দেশনাও ‘রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন’ এর অন্তর্ভূক্ত। কাজেই ‘রাসূল যা দিয়েছেন’ সবকিছু গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস সংকলন, লিখন, বর্ণনা ও জালিয়াতি বিষয়ক তাঁদের অন্যান্য আপত্তির বিষয় আমরা এই পুস্তকের অন্যান্য আলোচনা থেকে জানতে পারব। তবে এখানে আমরা বুঝতে পারছি যে, কুরআনের নির্দেশনা অনুসারেই আমাদেরকে হাদীসের আলোকে জীবন গঠন করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হুবহু অনুসরণ করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ(স) এর আদর্শে জীবন গড়তে হবে এবং হাদীসের ভিত্তিতেই আমাদেরকে কুরআনের নির্দেশাবলী পালন করতে হবে। আমরা আরো দেখছি যে, হাদীস ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কুরআন পালন বা ইসলামী জীবন গঠন সম্ভব নয়।
হাদীসের এই গুরুত্বের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ মূলত একমত। আর এজন্যই হাদীসের নামে জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রতিরোধের সর্বোত্তম নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাঁরা। তাঁদের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতির আলোচনার আগে আমরা মিথ্যার পরিচয় ও ওহীর নামে মিথ্যার বিধান আলোচনা করব। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রার্থনা করছি।

১.২. মিথ্যা ও ওহীর নামে মিথ্যা
১.২.১. মিথ্যার সংজ্ঞা
প্রসিদ্ধ ও পরিজ্ঞাত বিষয় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। মিথ্যার সংজ্ঞা কি? সত্যের বিপরীতই মিথ্যা। যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। এমন কিছু বলা, যা প্রকৃতপক্ষে ঠিক নয় বা সত্য নয় তাই মিথ্যা।
১.২.১.১. ইচ্ছাকৃত বনাম অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
বিষয়টি স্পষ্ট। তবে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে মুসলিম আলিমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের আলেমগণ মনে করতেন যে, ভুল বশত যদি কেউ কিছু বলেন যা প্রকৃত অবস্থার বিপরীত তবে তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবেনা। শুধুমাত্র জেনেশুনে মিথ্যা বললেই তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলিমগণ এই ধারণার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের মতে না জেনে বা ভুলে মিথ্যা বললেও তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে।
ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী(৬৭৬হি) বলেনঃ “হক্ক পন্থী আলেমদের মত হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছায়, ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলাই মিথ্যা।” [নাবাবী, ইয়াহইয়া ইবনে শারাফ(৬৭৬ হি) শারহু সাহীহি মুসলিম ১/৯৪]
তিনি আরো বলেনঃ “আমাদের আহলুস সুন্নাহ-পন্থী আলিমগণের মতে মিথ্যা হলো প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলা, তা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ভুলে হোক। মু্‘তাযিলাগণের মতে শুধু ইচ্ছাকৃত মিথ্যাই মিথ্যা বলে গণ্য হবে।” (নাবাবী, শারহু সাহীহি মুসলিম ১/৬৯)।
১.২.১.২. হাদীসের আলোকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
হাদীসের ব্যবহার থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, অজ্ঞতার কারণে বা যে কোনো কারণে বাস্তবের বিপরীত যে কোনো কথা বলাই মিথ্যা বলে গণ্য।
১. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(রা) বলেনঃ আরবী(******)
-হাতিব ইবনু আবী বালতা‘আ(রা) এর একজন দাস রাসূল(স) এর নিকট আগমন করে বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল!নিশ্চয় হাতিব জাহান্নামে প্রবেশ করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা; কারণ সে বদর ও হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ছিল। (মুসলিম, আস সহীহ ৪/১৯৪২)।
এখানে রাসূলুল্লাহ(স) হাতিবের এই দাসের কথাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন। সে অতীতের কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা বলেনি। মূলত সে ভবিষ্যতের বিষয়ে তার একটি ধারণা বলেছে। সে যা বিশ্বাস করেছে তাই বলেছে। তবে যেহেতু তার ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবের বিপরীত সেজন্য আল্লাহর রাসূল(স) তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অতীত বা ভবিষ্যতের যে কোনো সংবাদ যদি বাস্তবের বিপরীত হয় তাহলে তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। সংবাদদাতার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অজ্ঞতা বা অন্য কোনো বিষয় এখানে ধর্তব্য নয়। তবে মিথ্যার পাপ বা অপরাধ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত।
২. তাবেয়ী সালিম ইবনু আবদুল্লাহ বলেন, আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনু উমারকে(রা) বলতে শুনেছিঃ আরবী(*****)
-এই হলো তোমাদের বাইদা প্রান্তর, যে প্রান্তরের বিষয়ে তোমরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বল(তিনি এই স্থান হতে হজ্জের ইহরাম শুরু করেছিলেন বলে তোমরা বল।) অথচ রাসূলুল্লাহ(স) যুল হুলাইফা প্রান্তরে মসজিদের নিকট হতে হজ্জের ইহরাম বেঁধেছিলেন। (মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩)।
স্বভাবতই ইবনু উমার(রা)এসকল সাহাবী তাবেয়ীগণকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার অভিযোগ করছেননা। রাসূলুল্লাহ(স) বিদায় হজ্জের সময় লক্ষাধিক সাহাবীকে নিয়ে হজ্জ করেন। তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে ‘যুল হুলাইফা’ প্রান্তরে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন সকালে সেখান থেকে হজ্জের এহরাম করেন। যুল হুলাইফা প্রান্তরের সংলগ্ন ‘বাইদা’ প্রান্তর। যে সকল সাহাবী কিছু দূরে ছিলেন তাঁরা তাঁকে যুল হুলাইফা থেকে এহরাম বলতে শুনেননি, বরং বাইদিয়া প্রান্তরে তাঁকে তালবীয়া পাঠ করতে শুনেন। তাঁরা মনে করেন যে, তিনি বাইদা থেকেই এহরাম শুরু করেন। একারণে অনেকের মধ্যে প্রচারিত ছিল যে, রাসূলুল্লাহ(স) বাইদা প্রান্তর থেকে এহরাম শুরু করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমার যেহেতু কাছেই ছিলেন, সেহেতু তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইদা থেকে এহরাম করার তথ্যটি ছিল অনিচ্ছাকৃত ভুল। যারা তথ্যটি প্রদান করেছেন তারা তাদের জ্ঞাতসারে সত্যই বলেছেন। কিন্তু তথ্যটি যেহেতু বাস্তবের বিপরীত এজন্য ইবনু উমার তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন।

১.২.১.৩. মিথ্যা বনাম ‘মাউদূ’(মাউযূ) ও ‘বাতিল’
(মূল আরবী উচ্চারণে আমরা মাউদূ বলতেই অভ্যস্ত। পক্ষান্তরে ফার্সী ও উর্দূ প্রভাবিত বাংলা ব্যবহারে আমরা মাউযূ বলে থাকি)।
হাদীসের পরিভাষায় ও প্রথম শতকে সাহাবী-তাবেয়ীগণের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত মিথ্যা কথাকে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলে অভিহিত করা হতো। আবু উমামাহ(রা), বলেন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ আরবী(*******)
-যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার নামে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।(তাবারানী, সুলাইমান ইবনু আহমদ(৩৬০ হি), আল-মু’জামুল কাবীর ৮/১২২)
যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি তা তাঁর নামে বলা হলেও সাহাবীগণ বলতেনঃ এই হাদীসটি মিথ্যা, মিথ্যা হাদীস বা অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করতেন। এই ধরনের মানুষদের সম্পর্কে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘সে মিথ্যা বলে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। [ইবনু আবু হাতিম, আবদুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ(৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৪৯, ৩৫০, ৩৫১, ৩/৪০৭, ৬/২১২, ৮/১৬, ৫২, ৩২৫; যাহাবী, মুহাম্মদ ইবনু আহমাদ(৭৪৮ হি) মীযানুল ই‘তিদাল ১/২৭১, ২৮৫, ২/৮০, ১০৯, ১২২, ২৪১, ৩/৪, ৫০, ৩৭৫, ৪৬৭, ৪৭৫, ৪/৩১, ৯১, ১৭৮, ১৯১, ৪২০, ৪২৮, ৪৩৭, ৫/৩, ২৯, ৫২, ৫৪, ৮৮, ১২৮, ১৬৯, ২০৭, ২২০, ৬/২৪, ৫৫, ১৩৮,২৪৬, ২৪৯, ৫৩৪, ৫৪৫, ৫৬৬, ৭/২১৯, ৩৪১, ৩৯৩, ৮/১৬২, ১৮২, ১৯৬; ইবনু হাজার আসকালানী, আহমাদ ইবনু আলী(৮৫২ হি), ফাতহুল বারী, ১৩/১১৩; আল-মুনাবী, মুহাম্মদ আবদুর রাউফ(১০৩১ হি), ফাইদুল কাদীর ১/৫৪০, ৩/২১৯, ৫/৩০০, ৬/১৫, ২১৬, ২২১, ৩৫৩।]
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে হাদীসের নামে মিথ্যার প্রসারের সাথে সাথে এ সকল মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করতে মুহাদ্দিসগণ মিথ্যার সমার্থক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। শব্দটি (আরবী*****)। শব্দটির মূল অর্থ নামানো, ফেলে দেওয়া, জন্ম দেওয়া। বানোয়াট অর্থে ও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। [ইবনু দুরাইদ, মুহাম্মদ ইবনুল হাসান(৩২১হি), জামহারাতুল লাগহ ৩/৯৫; জাওহারী, ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মাদ(৩৯৩ হি), আস-সিহাহ ৩/১২৯৯; ইবনু ফারিস, আহমদ(৩৯৫হি), মু‘জাম মাকাঈসুল লুগাহ ৬/১১৭-১১৮; ইবনুল আসীর, মুহাম্মদ ইবনুল মুবারক(৬০৬হি), আন-নিহাইয়াহ ৫/১৯৭, ১৯৮; ইবনূ মানযূর, মুহাম্মাদ ইবনুল মাকরাম(৭১১ হি), লিসানুল আরাব ৮/৩৯৬-৩৯৭; ফাল্লাতা, উমার ইবনু হাসান, আল ওয়াদউ ফিল হাদীস ১/১০৮]
ইংরেজীতেঃ To lay, lay Off, lay down, put down, set up…give birth, produce,…humiliate, to be low, humble(Hans Wehr, A Dictionary of Modern Written Arabic. P1076).
পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এই শব্দের ব্যবহারই ব্যাপকতা লাভ করে। তাঁদের পরিভাষায় হাদীসের নামে মিথ্যা বলাকে ‘ওয়াদউ’ এবং এ ধরনের মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউদূ’ বলা হয়। ফার্সী উর্দূ প্রভাবিত বাংলা উচ্চারণে আমরা সাধারণত বলি ‘মাউযূ’।
অনেক মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। উভয় প্রকার মিথ্যা হাদীসকেই তাঁরা মাউদূ হাদীস বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় আমরা মাউদূ অর্থ জাল বা বানোয়াট বলতে পারি।
মুহাদ্দিসগণ মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন দুইভাবে; অনেক মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন : “বানোয়াট জাল হাদীসকে মাউযূ হাদীস বলা হয়।” এখানে তাঁরা হাদীসের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
অন্যান্য মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেনঃ “যে হাদীস শুধুমাত্র কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস।” এখানে তাঁরা মাউযূ বা জাল হাদীসের সাধারণ পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, মুহাদ্দিসগণ মূলত তুলনামূলক নিরীক্ষার (Cross Examine) মাধ্যমে রাবীর সত্য মিথ্যা যাচাই করতেন।
কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘বাতিল’ ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘মাউযূ’ বা ‘মাউদূ’ বলে উল্লেখ করেছেন। মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের মাধ্যমে যদি প্রমাণ হয় যে, এই বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি, কিন্তু ভুল করে তাঁর নামে বলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা সেই হাদীসটিকে ‘বাতিল’ বলে অভিহিত করেন। আর যদি নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বর্ণনাকারী ইচ্ছাপূর্বক বা জ্ঞাতসারে এই কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে নামে বলেছে, তাহলে তাঁরা একে মাউযূ হাদীস নামে আখ্যায়িত করেন।
মিথ্যা হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ প্রথম পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার মিথ্যাকেই মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো যে কথা রাসূলে করীম(স) বলেননি বা যে কর্ম তিনি করেননি, অথচ তাঁর নামে কথিত বা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলি চিহ্নিত করে ওহীর নামে জালিয়াতি রোধ করা। বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাটি বলেছেন, নাকি ভুলবশত তা বলেছেন সে বিষয় তাঁদের বিবেচ্য বিষয় নয়। এ বিষয় বিবেচনার জন্য রিজাল ও জারহ ওয়াত্ তাদীল শাস্ত্রে পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। (আল মা’লামী, মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদ, পৃ ৫৭)।

১.২.২. মিথ্যার বিধান
ওহী বা হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনার আগে আমরা সাধারণভাবে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনা করতে চাই। মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের সহজাত প্রবৃতির একটা অংশ। এজন্য সকল মানব সমাজে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে মিথ্যাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদিগকে সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ ও কঠিন শাস্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সার্বক্ষণিক সত্যবাদিতার নির্দেশ দিয়ে এরশাদ হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ [٩:١١٩]
-হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হও।(সূরা তাওবাঃ ১১৯)
মিথ্যার ভয়ানক শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছেঃ
فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ [٢:١٠]
-তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাচারী। (সূরা বাকারাঃ ১০)
অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ
فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ [٩:٧٧]
-পরিণামে তিনি(আল্লাহ) তাদের অন্তরে কপটতা স্থির করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্য্ন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল তা ভংগ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।(সূরা তাওবাঃ ৭৭)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ [٤٠:٢٨]
-আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেননা (সূরা মুমিনঃ ২৮)।
অগণিত হাদীসে মিথ্যাকে ভয়ংকর পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদীসে আবুদল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
-সত্য পূণ্য। সত্য পূণ্যের দিকে পরিচালিত করে এবং পূণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষ সদা সর্বদা সত্য বলতে সচেষ্ট থাকেন তিনি এক পর্যায়ে আল্লাহর নিকট ‘সিদ্দীক’ বা মহা সত্যবাদী বলে লিপিবদ্ধ হন। আর মিথ্যা পাপ। মিথ্যা পাপের দিকে পরিচালিত করে আর পাপ জাহান্নামের দিকে পারিচালিত করে। যে মানুষটি মিথ্যা বলে বা মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে সে এক পর্যায়ে মহা মিথ্যাবাদী বলে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। [বুখারী, মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬ হি), আস-সহীহ ৫/২২৬১, মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬২ হি), আস-সহীহ ৪/২০১২, ২০১৩]।
হাদীস শরীফে মিথ্যা বলাকে মুনাফিকীর অন্যতম চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে যে, মুমিন অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু কথনো মিথ্যা কথা বলতে পারেনা। সা’দ ইবনু আবু ওয়াক্কাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী (*******)
-মুমিনের প্রকৃতিতে সব অভ্যাস থাকতে পারে, কিন্তু খিয়ানত ও মিথ্যা থাকতে পারেনা। [বাযযার, আবু বাকর আহমদ ইবনু আমর (২৯২ হি), আল মুসনাদ ৩/৩৪১, হাইসামী, আলী ইবনু আবী বাকর (৮০৭ হি), মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯২]

১.২.৩. ওহীর নামে মিথ্যা
মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। তবে তা যদি ওহীর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ও ক্ষতিকর। সাধারণভাবে মিথ্যা ব্যক্তিমানূষের বা মানবসমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর ওহীর নামে মিথ্যা মানব সমাজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক স্থায়ী ক্ষতি ও ধ্বংস করে। মানুষ তখন ধর্মের নামে মানবীয় বুদ্ধি প্রসূত বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়ে জাগতিক ও পারলৌকিক ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়।
পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর দিকে তাকালে আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। আমরা আগেই বলেছি যে, মানবীয় জ্ঞান প্রসূত কথাকে ওহীর নামে চালানোই ধর্মের বিকৃতি ও বিলুপ্তির কারণ। সাধারণভাবে এ সকল ধর্মের প্রাজ্ঞ পন্ডিতগণ ধর্মের কল্যাণেই এ সকল কথা ওহীর নামে চালিয়েছেন। তারা মনে করেছেন যে, তাদের এ সকল কথা, ব্যাখ্যা, মতামত ওহীর নামে চালালে মানুষের মধ্যে ‘ধার্মিকতা’, ‘ভক্তি’ ইত্যাদি বাড়বে এবং আল্লাহ খুশি হবেন। আর এভাবে তারা তাদের ধর্মকে বিকৃত ও ধর্মাবল্বীদেরকে বিভ্রান্ত করেছেন। কিন্তু তারা বুঝেননি যে, মানুষ যদি মানবীয় প্রজ্ঞায় এ সকল বিষয় বুঝতে পারতো তাহলে ওহীর প্রয়োজন হতোনা।
এর অত্যন্ত পরিচিত উদাহরণ খৃস্টধর্ম। প্রচলিত বিকৃত বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী ‘যীশুখৃস্ট’ তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে, ইহুদী ধর্মের ১০ মূলনীতি পালন করতে, খাতনা করতে, তাওরাতের সকল বিধান পালন করতে, শূকরের মাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকতে ও অনুরূপ অন্যান্য কর্মের নির্দেশ প্রদান করেন। মিথ্যাবাদী শৌল পৌল নাম ধারণ করে ‘খৃস্টধর্মের প্রচার ও মানুষের মধ্যে ভক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে’ প্রচার করতে থাকেন যে, শুধুমাত্র ‘যীশুখৃস্টকে’ বিশ্বাস ও ভক্তি করলেই চলবে, এ সকল কর্ম না করলেও চলবে। তিনি বলতেন, আমি প্রত্যেক জাতির কাছে আমার পছন্দ মত মিথ্যা বলি, যেন ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
এভাবে তিনি মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ক্রমান্বয়ে এই পৌলীয় কর্মহীন ভক্তিধর্মই খৃস্টানদের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানব সন্তান শিরক-কুফর ও পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু বিশ্বাসেই স্বর্গ, সেহেতু কোনোভাবেই ধর্মোপদেশ দিয়ে খৃস্টান সমাজগুলি থেকে মানবতা বিধ্বংসী পাপ, অনাচার ও অপরাধ কমানো যায়না।
ওহীর নামে মিথ্যা সবচেয়ে কঠিন মিথ্যা হওয়ার কারণে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে ওহীর নামে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলতে, সন্দেহজনক কিছু বলতে বা আন্দাজে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ উভয় প্রকার ওহী যেন কেয়ামত পর্য্ন্ত সকল মানুষের জন্য অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

১.২.৪. মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষার কুরআনী নির্দেশনা
‘ওহী’র নামে মিথ্যা বা অনুমান-নির্ভর কথা প্রচারের দুটি পর্যায়ঃ প্রথমত, নিজে ওহীর নামে মিথ্যা বলা ও দ্বিতীয়ত, অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ ও প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্যে কুরআন কারীমে একদিকে আল্লাহর নামে মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে কারো প্রচারিত কোনো তথ্য বিচার ও যাচাই ছাড়া গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
১.২.৪.১. আল্লাহর নামে মিথ্যা ও অনুমান নির্ভর কথা বলার নিষেধাজ্ঞা
কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার আল্লাহর নামে মিথ্যা বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে না জেনে, আন্দাজে, ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহর নামে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার অর্থ আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) আল্লাহর পক্ষ থেকেই কথা বলেন। কুরআনের মত হাদীসও আল্লাহর ওহী। কুরআন ও হাদীস, উভয় প্রকারের ওহীই একমাত্র রাসূলুল্লাহ(স) এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী পেয়েছে। কাজেই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কোনো প্রকার মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমাননির্ভর কথা বলার অর্থই আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা বা না-জেনে আল্লাহর নামে কিছু বলা। কুরআন কারীমে এ বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি।
১. কুরআন কারীমে বারংবার এরশাদ করা হয়েছেঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا
-আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সম্পর্কে যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে? (সূরা আল আনআমঃ ২১, ৯৩, ১৪৪; সূরা আরাফঃ ৩৭ সূরা ইউনূস ১৭)।
২. এরশাদ করা হয়েছেঃ
قَالَ لَهُم مُّوسَىٰ وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُم بِعَذَابٍ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَىٰ [٢٠:٦١]
-দূর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করোনা। করলে, তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। (সূরা তাহাঃ৬১)

৩. কুরআন কারীমে বারংবার না জেনে, আন্দাজে বা অনুমান নির্ভর করে আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন, বিধান ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে এরশাদ হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ [٢:١٦٨]
إِنَّمَا يَأْمُرُكُم بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ [٢:١٦٩]
-হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কার্যের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যা জাননা এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়। (সূরা আল বাকারাহঃ ১৬৮-১৬৯)
৪. অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ [٧:٣٣]
-“বল, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরীক করা –যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেননি এবং আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।” (সূরা আল আরাফঃ৩৩)
এভাবে কুরআনে ওহীর জ্ঞানকে সকল ভেজাল ও মিথ্যা থেকে রক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহিমাময় আল্লাহ, তাঁর মহান রাসূলুল্লাহ(স), তাঁর দ্বীন, তাঁরা বিধান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলা কঠিণভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

১.২.৪.২. যে কোনো তথ্য গ্রহণের পূর্বে যাচাইয়ের নির্দেশ
নিজে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল(স)এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের কোনো অনির্ভরযোগ্য, মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর বর্ণনা বা বক্তব্য গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। যে কোনো সংবাদ বা বক্তব্য গ্রহণে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে কুরআন কারীম। এরশাদ করা হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ [٤٩:٦]
-“হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।” (সূরা আল হুজুরাতঃ ৬)।
এই নির্দেশের আলোকে কেউ কোনো সাক্ষ্য বা তথ্য প্রদান করলে তা গ্রহণের পূর্বে সে জাতির ব্যক্তিগত সততা ও তথ্য প্রদানে তার নির্ভূলতা যাচাই করা মুসলিমের জন্য ফরয। জাগতিক সকল বিষয়ের চেয়েও বেশি সতর্কতা ও পরীক্ষা করা প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ(স) বিষয়ক বার্তা বা বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে। কারণ জাগতিক বিষয়ে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের সম্পদ, সম্ভ্রম বা জীবনের ক্ষতি হতে পারে। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বা ওহীর জ্ঞানের বিষয়ে অসতর্কতার পরিণতি ঈমানের ক্ষতি ও আখিরাতের অনন্ত জীবনের ধ্বংস। এজন্য মুসলিম উম্মাহ সর্বদা সকল তথ্য, হাদীস ও বর্ণনা পরীক্ষা করে গ্রহণ করেছেন।

১.২.৫. মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষায় হাদীসের নির্দেশনা
ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার বিকৃতি, ভুল বা মিথ্যা থেকে তাঁর বাণী বা হাদীসকে রক্ষা করার জন্য রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন প্রকার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ

১.২.৫.১. বিশুদ্ধরূপে হাদীস মুখস্ত রাখার ও প্রচারের নির্দেশনা
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর হাদীস বা বাণী হুবহু বিশুদ্ধরূপে মুখস্ত করে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জুবাইর ইবনু মুতয়িম(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-“মহান আল্লাহ সমুজ্জল করুন সেই ব্যক্তির চেহারা যে আমার কোনো কথা শুনল, অতঃপর তা পূর্ণরূপে আয়ত্ত্ব করল ও মুখস্ত করল এবং যে তা শুনেনি তার কাছে পৌছে দিল।” [তিরমিযী, মুহাম্মদ ইবনু ঈসা(২৭৯ হি), আস-সুনান ৫/৩৩-৩৪; আবু দাউদ, সুলাইমান ইবনে আশ‘আস(২৭৫ হি)]
এই অর্থে আরো অনেক হাদীস অন্যান্য অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত ও সংকলিত হয়েছে।
১.২.৫.২. রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার নিষেধাজ্ঞা
অপরদিকে কোনো মানবীয় কথা যেন তাঁর নামে প্রচারিত হতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নামে মিথ্যা বা অতিরিক্ত কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হযরত আলী (রা) বলেন, রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-তোমরা আমার নামে মিথ্যা বলবেনা, কারণ যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। [বুখারী, মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল(২৫৬ হি), আস-সহীহ ১/৫২, ফাতহুল বারী১/১৯৯]।
যুবাইর ইবনুল আউয়াম(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। (বুখারী, আস-সহীস ১/৫২)
সালামাহ ইবনে আকওয়া(রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-আমি যা বলিনি সে কথা যে আমার নামে বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। (বুখারী, আস-সহীস ১/৫২)
এভাবে ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ সহ প্রায় ১০০ জন সাহাবী এই মর্মে রাসূলুল্লাহ(স) এর সাবধান বাণী বর্ণনা করেছেন। আর কোনো হাদীস এত বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি।[নববী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ(৬৭৬ হি), শারহু সহীহ মুসলিম ১/৬৮, ইউনুল জাউযী, আল মাউযূ’আত]
১.২.৫.৩. বেশি হাদীস বলা ও মুখস্ত ছাড়া হাদীস বলার নিষেধাজ্ঞা
বেশি হাদীস বলতে গেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ(স)। বিশুদ্ধ মুখস্ত ও নির্ভূলতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোনো হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। আবু কাতাদাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) মিম্বরের উপরে দাঁড়িয়ে বলেনঃ আরবী(*****)
-খবরদার! তোমরা আমার নামে বেশি বেশি হাদীস বলা হতে বিরত থাকবে। যে আমার নামে কিছু বলে, সে যেন সঠিক কথা বলে। আর যে আমার এমন কিছু বলে যা আমি বলিনি তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে। [ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪; আলবানী, মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ সুনানি ইবনে মাজাহ ১/২৯, আল মুসতাদরাক ১/১৯৪]।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
“তোমরা আমার থেকে হাদীস বর্ণনা পরিহার করবে, শুধুমাত্র যা তোমরা জান তা ছাড়া।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৫/১৮৩)।
আবু মূসা মালিক ইবনু উবাদাহ আল গাফিকী(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) আমাদেরকে সর্বশেষ ওহীহত ও নির্দেশ প্রদান করে বলেনঃ আরবী(******)
-“তোমরা আল্লাহর কিতাব সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে ও অনুসরণ করবে। আর অচিরেই তোমরা এমন সম্প্রদায়ের নিকট গমন করবে যারা আমার নামে হাদীস বলতে ভালবাসবে। যদি কারো কোনো কিছু মুখস্ত থাকে তাহলে সে তা বলতে পারে। আর যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কিছু বলবে যা আমি বলিনি তাকে জাহান্নামে তার আবাসস্থল গ্রহণ করতে হবে।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)
এভাবে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর উম্মাততে তাঁর হাদীস হুবহু ও নির্ভূলভাবে মুখস্ত রাখতে ও এইরূপ মুখস্ত হাদীস প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে পরিপূর্ণ মুখস্ত না থাকলে বা সামান্য দ্বিধা থাকলে সে হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তিনি যা বলেননি সে কথা তাঁর নামে বলা নিষিদ্ধ ও কঠিনতম পাপ। ভুলক্রমেও যাতে তাঁর হাদীসের মধ্যে হেরফের না হয় এজন্য তিনি পরিপূর্ণ মুখস্ত ছাড়া হাদীস বলতে নিষেধ করেছেন। আমরা দেখতে পাব যে, সাহাবীগণ এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন।
১.২.৫.৪. মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের থেকে সতর্ক করা
নিজের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের বানানো মিথ্যা গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। মুসলিম উম্মাহর ভিতরে মিথ্যাবাদী হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তিবর্গের উদ্ভব হবে বলে তিনি উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আবু হুরাইরা(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আরবী(******)
-শেষ যুগে আমার উম্মাতের কিছু মানুষ তোমাদেরকে এমন সব হাদীস বলবে যা তোমরা বা তোমাদের পিতা-পিতামহগণ কখনো শুননি। খবরদার! তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে, তাদের থেকে দূরে থাকবে। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)।
ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকাহ(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-কেয়ামতের পূর্বেই শয়তান বাজারে-সমাবেশে ঘুরে ঘুরে হাদীস বর্ণনা করে বলবে: আমাকে অমুকের ছেলে অমুক এই এই বিষয়ে এই হাদীস বলেছে। (ইবনু আদী, আহমদ, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ১/১১৫)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা) বলেনঃ আরবী(******)
-শয়তান মানুষের রূপ ধারণ করে মানুষদের মধ্যে আগমন করে এবং তাদেরকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে। এরপর মিথ্যা হাদীস শুনে সমবেত মানুষগুলো সমাবেশ ভেঙ্গে চলে যায়। অতঃপর তারা সে সকল হাদীস বর্ণনা করে বলে : আমি এক ব্যক্তিকে হাদীসটি বলতে শুনেছি যার চেহারা আমি চিনি তবে তার নাম জানিনা। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)

১.২.৫.৫. সন্দেহযুক্ত বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা
রাসূলুল্লাহ(স) যাচাই না করে কোনো হাদীস গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদীস বলে গ্রহণ করে ও বর্ণনা করে তাহলে হাদীস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বানানোর জন্য নয়, শুধুমাত্র সত্য মিথ্যা যাচাই না করে হাদীস গ্রহণ করাই তার মিথ্যাবাদী বানানোর জন্য যথেষ্ট বলে হাদীসে বলা হয়েছে। উপরন্তু, যদি কোনো হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভূলতা সম্বন্ধে দ্বিধা বা সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি সে হাদীস বর্ণনা করে তাহলে সেও মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হবেও মিথ্যা হাদীস বলার পাপে পাপী হবে।
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*******)
-একজন মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকেই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।(মুসলিম আস-সহীহ ১/১০)।
সামুরাহ ইবনে জুনদুব(রা) ও মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(****)
-যে ব্যক্তি আমার নামে কোনো হাদীস বলবে এবং তার মনে সন্দেহ হবে যে, হাদীসটি মিথ্যা, সেও একজন মিথ্যাবাদী। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯)।

১.২.৬. হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান
১.২.৬.১. হাদীসের নামে মিথ্যা বলা কঠিনতম কবীরা গোনাহ
উপরে উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি যে, হাদীসের নামে মিথ্যা বলা ও মানুষের কথাকে হাদীস বলে চালানো জঘন্যতম পাপ ও অপরাধ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনোরূপ দ্বিধা বা সংশয় নেই। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহাবীগণ সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতামূলক ভুলের ভয়ে হাদীস বলা হতে বিরত থাকতেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলকেও তাঁরা ভয়ানক পাপ মনে করে সতর্কতার সাথে পরিহার করতেন। এছাড়া অন্যের বানানো মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করাকেও তাঁরা মিথ্যা হাদীস বানানোর মত অপরাধ বলে গণ্য করতেন।
উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) বলেনঃ এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলা কঠিনতম হারাম, ভয়ন্করতম কবীরা গোনাহ এবং তা জঘন্যতম ও ধ্বংসাত্মক অপরাধ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ একমত। তবে অধিকাংশ আলিমের মতে এই অপরাধের জন্য কাউকে কাফির বলা যাবেনা। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কোনো মিথ্যা বলবে সে যদি তার এই মিথ্যা বলাকে হালাল মনে না করে তাহলে তাকে কাফির বলা যাবেনা। সে পাপী মুসলিম। আর যদি সে এই কঠিনতম পাপকে হালাল মনে করে তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। তবে মুহাম্মদ আল জুআইনী ও অন্যান্য কতিপয় ইমাম এই অপরাধকে কুফরী বলে গণ্য্ করেছেন। জুআ্ইনী বলতেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলবে সে কাফির বলে গণ্য হবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে।
এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে যে কোনো মিথ্যাই সমভাবে হারাম, তা যে কোনো বিষয়েই হোক। শরীয়তের বিধিভিধান, ফযীলত, নেককাজে উৎসাহ প্রদান, পাপের ভীতি বা অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁর নামে কোনো মিথ্যা বলা কঠিনতম হারাম ও ভয়ঙ্করতম কবীরা গোনাহ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত রয়েছে। যাঁরা মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং যাঁদের মতামত গ্রহণ করা যায় তাঁরা সকলেই এই বিষয়ে একমত। (নববী, শারহু সহীহ মুসলিম ১/৬৯)।

১.২.৬.২. মাউযূ হাদীস উল্লেখ বা প্রচার করাও কঠিনতম হারাম
ইমাম নববী আরো বলেনঃ জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করাও হারাম, তা যে অর্থেই হোকনা কেন। তবে মিথ্যা হাদীসকে মিথ্যা হিসেবে জানানোর জন্য তার বর্ণনা জায়েয। (নববী, তাকরীব, তাদরীবুর রাবী সহ ১/২৭৪)।
অন্যত্র, তিনি বলেনঃ যদি কেউ জানতে পারেন যে, হাদীসটি মাউযূ অর্থাৎ মিথ্যা বা জাল, অথবা তার মনে জোরালো ধারণা হয় যে, হাদীসটি জাল তাহলে তা বর্ণনা করা তার জন্য হারাম। যদি কেউ জানতে পারেন যে, হাদীসটি মিথ্যা এবং তারপরও তিনি সেই হাদীসটি বর্ণনা করেন, কিন্তু হাদীসটির বানোয়াট হওয়ার বিষয় উল্লেখ না করেন, তবে তিনিও হাদীস বানোয়াটকারী বলে গণ্য হবেন এবং এ সকল হাদীসে উল্লেখিত ভয়ানক শাস্তির অন্তর্ভূক্ত হবেন। (নববী, শারহু সহীহ মুসলিম ১/৭১)।
ইমাম যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকী(৮০৬ হি) বলেনঃ মাউযূ বা জাল হাদীস যে বিষয়ে বা যে অর্থেই হোক, তা বলা হারাম। আহকাম, গল্প-কাহিনী, ফযীলত, নেককর্মে উৎসাহ, পাপ থেকে ভীতি প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো বিষয়েই হোকনা কেন, যে ব্যক্তি তাকে মাউযূ বলে জানতে পারবে তার জন্য তা বর্ণনা করা, প্রচার করা, তার দ্বারা দলীল দেওয়া বা তার দ্বারা ওয়ায করা জায়েয নয়। তবে হাদীসটি যে জাল বা বানোয়াট সে কথা উল্লেখ করে তা বলা যায়। (ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১২০-১২১)।

১.২.৬.৩. হাদীস বানোয়াটকারীর তওবার বিধান
হাদীসের নামে মিথ্যা বলা ও অন্যান্য বিষয়ে মিথ্যা বলার মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য হলো, হাদীসের নামে মিথ্যাবাদীর তাওবা মুহাদ্দিসগণেল নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কোনো কথাকে মিথ্যাভাবে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে উল্লেখ করেছেন বা প্রচার করেছেন এবং এরপর তিনি তাওবা, তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতেও পারেন, তবে মুহাদ্দিসগণের নিকট তিনি তাওবার কারণে গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবেননা। মুহাদ্দিসগণ কখনোই ঐ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস সত্য ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করবেননা।
পঞ্চম শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আহমদ ইবনু সাবিত খাতীব বাগদাদী(৪৬৩ হি) বলেনঃ যে ব্যক্তি মানুষের সাথে মিথ্যা বলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সে যদি তাওবা করে এবং তার সততা প্রমাণিত হয় তাহলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে বলে ইমাম মালিক উল্লেখ করেছেন। আর যদি কেউ হাদীস জাল করে, হাদীসের মধ্যে কোনো মিথ্যা বলে বা যা শুনেনি তা শুনেছে বলে দাবি করে তাহলে তার বর্ণিত হাদীস সত্য বা সঠিক বলে গণ্য করা যাবেনা। আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সে যদি পরে তাওবা করে তাহলেও তার বর্ণিত কোনো হাদীস সত্য বলে গণ্য করা যাবেনা। ইমাম আহমদ(২৪১ হি) কে প্রশ্ন করা হয়: একব্যক্তি একটিমাত্র হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলেছিল, তারপর সে তাওবা করেছে এবং মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করেছে, তার বিষয়ে কী করণীয়? তিনি বলেনঃ তার তাওবা তার ও আল্লাহর মাঝে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন। তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীস আর কখনোই সঠিক বলে গ্রহণ করা যাবেনা বা কখনোই তার বর্ণনার উপর নির্ভর করা যাবেনা। ইমাম সুফিয়ান সাওরী(১৬১ হি), আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক(১৮১ হি)ও অন্যান্য ইমামও অনুরূপ কথা বলেছেন।
ইমাম বুখারীর অন্যতম ওস্তাদ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর আল-হুমাইদী(২১৯ হি) বলেন, যদি কেউ হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে বলেঃ আমি অমুকের কাছে হাদীসটি শুনেছি, এরপর প্রমাণিত হয় যে, সে উক্ত ব্যক্তি হতে হাদীসটি শুনেনি, বা অন্য কোনোভাবে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার মিথ্যা ধরা পড়ে তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীসই আর সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা যাবেনা। খতীব বাগদাদী বলেন, ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে এই বিধান। [খতীব বাগদাদী, আহমাদ ইবনু আলী ইবনু সাবিত(৪৬৩ হি), আল কিফাইয়াতু ফী ইলমুর রিওয়াইয়া, পৃ. ১১৭-১১৮]।
শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী(১০৫২ হি) বলেনঃ যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জীবনে একবারও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলার কথা প্রমাণিত হয় তবে তার বর্ণিতে কোনো হাদীস সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হবেনা, যদিও সে তাওবা করে। (আব্দুল হক দেহলবী, মুকাদ্দিমাহ ফী উসূলিল হাদীস, পৃ. ৬৩-৬৪)।

১.২.৭. হাদীসের নামে মিথ্যা বলার উন্মেষ
আমরা জানি যে, সকল সমাজ, জাতি ও ধর্মে মিথ্যা ও মিথ্যাবাদী ঘৃণিত। সত্যবাদীতা সর্বদা ও সর্বত্র প্রশংসিত ও নিন্দিত। এজন্যই আরবের জাহেলী সমাজেও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় সত্যবাদিতা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ‘আল-আমীন’ ও ‘আস-সাদিক’: বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহচর সাহাবীগণকে অনুপম অতুলনীয় সত্যবাদিতার উপর গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সত্যবাদিতা ছিল আপোষহীন। কোনো কষ্ট বা বিপদের কারণেই তাঁরা সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। উপরন্তু তিনি ওহীর নামে ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন এবং এর কঠিন শাস্তির কথা বারংবার বলেছেন।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা তো দূরের কথা, সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত ভুল বা বিকৃতিকেও তাঁরা কঠিনতম পাপ বলে গণ্য করে তা পরিহার করতেন।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে কখনোই কোনো অবস্থায় তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ সাহাবী অনিচ্ছাকৃত ভুলে ভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কোনো হাদীসই বলতেননা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় মদীনার সমাজে কতিপয় মুনাফিক বাস করত। এদের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রচলন ছিল। তবে এরা সংখ্যায় ছিল অতি সামান্য এবং সমাজে এদের মিথ্যাবাদিতা জ্ঞাত ছিল। এজন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিলনা। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতোনা এবং তারাও কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার সাহস বা সুযোগ পাননি।
একটি ঘটনায় বর্ণিত হয় যে, এক যুবক এক যুবতীর পানিপ্রার্থী হয়। যুবতীর আত্মীয়গণ তার কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিতে অসম্মত হয়। পরবর্তী সময়ে ঐ যুবক তাদের কাছে গমন করে বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তোমাদের বংশের যে কোনো মেয়ে বেছে নিয়ে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুবকটি সেখানে অবস্থান করে। ইত্যবসরে তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি বলেন, যুবকটি মিথ্যা বলেছে। তোমরা তাকে জীবিত পেলে মৃত্যুদন্ড প্রদান করবে। ….তবে তাকে জীবিত পাবে বলে মনে হয়না। …..তারা ফিরে গিয়ে দেখেন যে, সাপের কামড়ে যুবকটির মৃত্যু হয়েছে।……..
এই বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য হলে এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এই বর্ণনাটির সনদ অত্যন্ত দূর্বল। কয়েকজন মিথ্যায় অভিযুক্ত ও অত্যন্ত দূর্বল রাবীর মাধ্যমে ঘটনাটি বর্ণিত। (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৪০১-৪০২; ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/৫৪)।
সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পরে যতদিন মুসলিম সমাজে সাহাবীগণের আধিক্য ছিল ততদিন তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সময়ের আবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ সময়ে অনেক সাহাবী মৃত্যুবরণ করেন। অগণিত নও মুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার উন্মেষ ঘটে। ক্রমান্বয়ে তা প্রসার লাভ করতে থাকে।
২৩ হিজরী সালে যুন্নুরাইন উসমান ইবনু আফফান(রা) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩৫ হিজরী পর্য্ন্ত প্রায় ১২ বৎসর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা থেকে বহুদূরে মিশর, কাইরোয়ান, কুফা, বাসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, খোরাসান ইত্যাদি এলাকায় বসবাস করতেন। সাহাবীগণের সাহচর্য্ থেকেও তারা বঞ্চিত ছিলেন।
তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী বিশ্বাস, চরিত্র ও কর্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারেন। এদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ধর্ম বা আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন মিথ্যা ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্রু সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলামের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন ও স্থায়ী মিথ্যা যে মিথ্যা ওহী বা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়। ইসলামের শত্রুরা সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ সময় এসকল মানুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশধরদের মর্যাদা, ক্ষমতা, বিশেষত আলী ইবনু আবী তালিব(রা) এর মর্যাদা, বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ ক্ষমতা, অলৌকিকত্ব, তাকে ক্ষমতায় বসানোর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে ও উসমান ইবনু আফফান(রা) এর নিন্দায় অগণিত কথা বলতে থাকে। এ সব বিষয়ে অধিকাংশ কথা তারা বলতো যুক্তি তর্কের মাধ্যমে। আবার কিছু কথা তারা আকারে ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামেও বানিয়ে বলতে থাকে। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে সরাসরি মিথ্যা বলার দুঃসাহস এ সকল পাপাত্মাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তখনো অগণিত সাহাবী জীবিত রয়েছেন। মিথ্যা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে মিথ্যার প্রবণতা গড়ে উঠতে থাকে।
৩য়-৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম ফকীহ, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনী জারীর তাবারী(৩১০ হি) ৩৫ হিজরীর ঘটনা আলোচনা কালে বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু সাবা ইয়ামানের ইহুদী ছিল। উসমান(রা) এর সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কূফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তখন সে মিশরে গমন করে। সে প্রচার করতে থাকে: অবাক লাগে তার কথা ভাবতে যে ঈসা(আ) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবে বলে বিশ্বাস করে, অথচ মুহাম্মাদ(স) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করেনা। ঈসার পুণরাগমনের কথা সে সত্য বলে মানে, আর মুহাম্মদ(স) এর পুনরাগমনের কথা বলতে তা মিথ্যা বলে মনে করে।…….. হাজারো নবী চলে গিয়েছেন। প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতের একজনকে ওসীয়তের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করে গিয়েছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রদত্ত ওহীয়ত ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি আলী ইবনু আবী তালিব। …….. মুহাম্মাদ(স) শেষ নবী এবং আলী শেষ ওসীয়ত প্রাপ্ত দায়িত্বশীল। ……যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওসীয়ত ও দায়িত্ব প্রদানকে মেনে নিলনা, বরং নিজেই ক্ষমতা নিয়ে নিল, তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে।……..[তাবারী, মুহাম্মাদ ইবনু জারীর(৩১০ হি), তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক ২/৬৪৭]।
এখানে আমরা দেখছি যে, আবদুল্লাহ ইবনু সাবা নিজের বিভ্রান্তিগুলিকে যুক্তির আবরণে পেশ করার পাশাপাশি কিছু কথা পরোক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে বলেছে। আলী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাকে দায়িত্ব প্রদান না করা জুলুম ইত্যাদি কথা সে বলেছে।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখবো যে, এই সময় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে সত্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে এই ধরণের দূর্বলতা দেখা দেওয়ায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের নামে মিথ্যা বলা প্রতিরোধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন।
প্রথম হিজরী শতকের শেষদিকে নিজ নিজ বিভ্রান্ত মত প্রমাণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে বানোয়াট হাদীস তৈরি করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাহাবীদের নামেও মিথ্যা বলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী(১-৬৭ হি) সাহাবীগণের সমসাময়িক একজন তাবিয়ী। ৬০ হিজরীতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন(রা) এর শাহাদাতের পরে তিনি ৬৪-৬৫ হিজরীতে মক্কার শাসক আবুদল্লাহ ইবনু যুবাইরের(১- ৭৩ হি)পক্ষ হতে কুফায় গমন করেন। কুফায় তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যায় জড়িতদের ধরে হত্যা করতে থাকেন। এরপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেকে আলীর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যার প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। এরপর তিনি নিজেকে ওহীর ইলহামপ্রাপ্ত, রাসূলুল্লাহ(স) এর বিশেষ প্রতিনিধি, খলীফা ইত্যাদি দাবি করতে থাকেন। অবশেষে ৬৭ হিজরীতে আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইরের বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।
তার এ সকল দাবীদাওয়ার সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনি একাধিক ব্যক্তিকে তার পক্ষে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলার জন্য আদেশ, অনুরোধ ও উৎসাহ প্রদান করেন।
আবু আনার হাররানী বলেন, মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী একজন হাদীস বর্ণনাকারীকে বলেন, আপনি আমার পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি হাদীস তৈরী করুন, যাতে থাকবে যে, আমি তাঁর পরে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করব এবং তাঁর সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। এজন্য আমি আপনাকে দশহাজার দিরহাম, যানবাহন, ক্রীতদাস ও পোশাক পরিচ্ছদ উপঢৌকন প্রদান করব। ঐ হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে হাদীস বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনো একজন সাহাবীর নামে কোনো কথা বানানো যেতে পারে। এজন্য আপনি আপনার উপঢৌকন ইচ্ছামত কম করে দিতে পারেন। মুখতার বলেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কিছু হলে তার গুরুত্ব বেশি হবে। ঐ ব্যক্তি বলেনঃ তার শাস্তিও বেশি কঠিন হবে। (ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ’আত ১/১৬-১৭)।
মুখতার অনেককেই এভাবে অনুরোধ করে। প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন বা হত্যা ও করেছেন। সালামাহ ইবনু কাসীর বলেন, ইবনু রাব’য়া খুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি একবার কূফায় গমন করি। আমাকে মুখতার সাকাফীর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার সাথে একাকী বসে বলেন, জনাব, আপনিতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগ পেয়েছেন। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কোনো কথা বলেন তা মানুষেরা বিশ্বাস করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি হাদীস বলে আমার শক্তি বৃদ্ধি করুন। এই ৭০০ স্বর্ণমুদ্রা আপনার জন্য। আমি বললামঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার পরিণতি নিশ্চিত জাহান্নাম। আমি তা বলতে পারবোনা। [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬ হি), আত-তারীখূল কাবীর ৮/৪৩৮; আত-তারীখুস সাবীর ১/১৪৭]।
সাহাবী আম্মার ইবনু ইয়াসীরের(রা) পুত্র মুহাম্মাদ ইবনু আম্মারকেও মুখতার তার পক্ষে তাঁর পিতা আম্মারের সূত্রে হাদীস বানিয়ে প্রচার করতে নির্দেশ দেয়। তিনি অস্বীকার করলে মুখতার তাকে হত্যা করে। [বুখারী, আত-তারীখুস সাগীর ১/১৪৭, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ৮/৪৩]।
প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিক থেকে প্রখ্যাত সাহাবীগণের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষত আলী ইবনু আবু তালিব(রা) এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা তাঁর কিছু অনুসারীর মধ্যে দেখা দেয়। তিনি আবু বাকর(রা) ও উমার(রা) কে মনে মনে অপছন্দ করতেন বা নিন্দা করতেন, তিনি অলৌকিক সব কাজ করতেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের বানোয়াট কথা তারা বলতে শুরু করে।
প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনু আবু মুলাইকা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ(১১৭ হি) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের (৬৮ হি)নিকট পত্র লিখে অনুরোধ করি যে, তিনি যেন আমাকে কিছু নির্বাচিত প্রয়োজনীয় বিষয় লিখে দেন। তখন তিনি বলেঃ আরবী(********)
-বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী যুবক। আমি তার জন্য কিছু বিষয় বিশেষ করে পছন্দ করে লিখব এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিব। তখন তিনি আলী(রা) এর বিচারের লিখিত পান্ডুলিপি চেয়ে নেন। তিনি তা থেকে কিছু বিষয় লিখেন। আর কিছু কিছু বিষয় পড়ে তিনি বলেনঃ আল্লাহর কসম, আলী এই বিচার কখনোই করতে পারেননা। বিভ্রান্ত না হলে কেউ এই বিচার করতে পারেনা।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩)।
অর্থাৎ আলীর কিছু অতি উৎসাহী ও অতি ভক্ত সহচর তাঁর নামে এমন কিছু মিথ্যা কথা এসব পান্ডুলিপির মধ্যে লিখেছে যা তাঁর মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করেছে, যদিও তারা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এগুলো বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে অন্য তাবেয়ী তাঊস ইবনু কাইসার (১০৬ হি) বলেনঃ আরবী(********)
-ইবনু আব্বাস(রা) এর নিকট আলী(রা) এর বিচারের পান্ডুলিপি আনয়ন করা হয়। তিনি এক হাত পরিমাণ বাদে সেই পান্ডুলিপির সব কিছু মুছে ফেলেন। (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
প্রখ্যাত তাবেয়ী আবু ইসহাক আস সাবীয়ী(১২৯ হি) বলেন, যখন আলী(রা) এর এ সকল অতিভক্ত অনুসারী তাঁর ইন্তেকালের পরে এসকল নতুন বানোয়াট কথার উদ্ভাবন ঘটালো তখন আলী(রা) এর অনুসারীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলেনঃ আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন। কত বড় ইলম এরা নষ্ট করল! (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
তাবিয়ী মুগীরাহ ইবনু মিকসাম আদ-দাব্বী(১৩৬ হি) বলেনঃ আরবী(******)
-[আলী(রা) এর অনুসারীদের মধ্যে মিথ্যাচার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে] আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ এর সাহচর্য্ লাভ করেছে এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ আলী(রা) হতে হাদীস বর্ণনা করলে তা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হতোনা। (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থে ও উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে এই প্রবণতা বাড়তে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে ক্রমেই মিথ্যাবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং মিথ্যার প্রকার ও পদ্ধতিও বাড়তে থাকে। আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে মিথ্যাবাদী জালিয়াতদের পরিচয়, শ্রেণীবিভাগ ও জালিয়াতির কারণসমূহ আলোচনা করব। তবে তার আগেই আমরা মিথ্যা প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্থা আলোচনা করতে চাই।
সাহাবীগণ ও তাঁদের পরবর্তী যুগগুলোর মুসলিম মনীষীগণ সকল প্রকার মিথ্যা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসকে পৃথক রাখতে অত্যন্ত কার্য্কর ও বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করেছেন। আমরা এখানে তাঁদের কর্মধারা আলোচনা করতে চাই।

 

১.৩. মিথ্যা প্রতিরোধে সাহাবীগণ
ওহীর জ্ঞানের নির্ভূল ও অবিমিশ্র সংরক্ষণের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশ, ওহীর নামে মিথ্যা বা আন্দাজে কথা বলার ভয়াবহ পরিণতি, হাদীসের নির্ভূল ও অবিমিশ্র সংরক্ষণে রাসূলুল্লাহ(স) এর বিশেষ নির্দেশ ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলার নিষেধাজ্ঞার আলোকে সাহাবীগণ হাদীসে রাসূল (স) কে সকল প্রকার অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা ইচ্ছাকৃত ভুল, বিকৃতি বা মিথ্যা থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তাঁরা একদিকে নিজেরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পরিপূর্ণ ও নির্ভূল মুখস্ত সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চিত না হলে তাঁরা হাদীস বলতেননা। অপরদিকে তাঁরা সবাইকে এভাবে পূর্ণরূপে হুবহু ও নির্ভূলভাবে মুখস্ত করে হাদীস বর্ণনা করতে উৎসাহ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। তৃতীয়ত, তাঁরা সাহাবী ও তাবিয়ী যে কোনো হাদীস বর্ণনাকারীর হাদীসের নির্ভূলতা বিষয়ে সামান্যতম দ্বিধা হলে তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার পরে গ্রহণ করতেন।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তাঁদের যুগে ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো সম্ভাবনা ছিলনা। মানুষের জাগতিক কথাবার্তা ও লেনদেনেও কেউ বলতেননা। সততা ও বিশ্বস্ততাই ছিল তাঁদের বৈশিষ্ট্য। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা আসাবধানতাজনিত সামান্যতম ভুল থেকে হাদীসে রাসূল(স) এর রক্ষায় তাঁদের কর্মধারা দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়।

১.৩.১. অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলা থেকে আত্মরক্ষা
আমরা জানি যে, মিথ্যা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। অনিচ্ছাকৃত ভুলও মিথ্যা বলে গণ্য। সাহাবীগণ নিজে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ‘মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নির্ভূলভাবে ও আক্ষরিকভাবে হাদীস বলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতার অগণিত ঘটনা হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
তাবিয়ী আমর ইবনু মাইমূন আল আযদী(74 হি) বলেনঃ আরবী(*********)
-আমি প্রতি বৃহস্পতিবার আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা)এর নিকট আগমন করতাম। তিনি তাঁর কথাবার্তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, এ কথাটা কখনো বলতেননা। এক বিকেলে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’, এরপর তিনি মাথা নিচু করে ফেলেন। আমি তাঁর দিকে তাঁকিয়ে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর জামার বোতামগুলি খোলা। তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে এবং গলার শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। তিনি বললেনঃ অথবা এর কম, অথবা এর বেশি, অথবা এর মত, অথবা এর কাছাকাছি কথা রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। (ইবনু মাজাহ, আস সুনান 1/10-11, আস-সুনান 1/88, আল মুসতাদরাক ১/194)।
তাবিয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা আবু আইশা (৬১ হি) বলেনঃ আরবী(***)
-একদিন আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন তিনি কেঁপে উঠেন এমনকি তাঁর পোশাকেও কম্পন পরিলক্ষিত হয়। এরপর তিনি বলেনঃ অথবা অনুরূপ কথা তিনি বলেছেন। (হাকিম, আল মুসতাদরাক 1/193)।
তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন(১১০ হি) বলেনঃ আরবী(****)
আনাস ইবনু মালিক(রা) যখন হাদীস বলতেন তখন হাদীস বর্ণনা শেষ করে বলতেন: অথবা রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেছেন (আমার বর্ণনায় ভুল হতে পারে)। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১)।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ জ্ঞাতসারে একটি শব্দেরও পরিবর্তন করতেননা। আক্ষরিকভাবে হুবহু বর্ণনা করতেন তাঁরা। তাবেয়ী সা’দ ইবনু উবাইদাহ সুলামী (১০৩ হি) বলেন: সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমর(৭৩ হি) বলেন: রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-“পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বা তাওহীদ, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদানের সিয়াম পালন এবং হ্জ্জ।” তখন এক ব্যক্তি বলে: “হজ্জ ও রামাদানের সিয়াম”। তিনি বলেন: “না, রামাদানের সিয়াম ও হজ্জ।” এভাবেই আমি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছি। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫)।
ইয়াফুর ইবনু রূযী নামক তাবেয়ী বলেনঃ আমি শুনলাম, উবাইদ ইবনু উমাইর (৭২ হি) নামক প্রখ্যাত তাবিয়ী ও মক্কার সুপ্রসিদ্ধ ওয়ায়িয একদিন ওয়াযের মধ্যে বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-“মুনাফিকের উদাহরণ হলো দুইটি ছাগলের পালের মধ্যে অবস্থানরত ছাগীর ন্যায়।” একথা শুনে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(৭৩ হি) বলেনঃ আরবী(****)
-দূর্ভোগ তোমাদের! তোমরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলবেনা। রাসুলুল্লাহ(স) তো বলেছেন: “মুনাফিকের উদাহরণ হলো দুইটি ছাগলের পালের মধ্যে যাতায়াতরত (wandering, roaming) ছাগীর ন্যায়।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫)।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও পরিপূর্ণ নির্ভূলতা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ সাহাবী রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। শুধুমাত্র যে কথাগুলি বা ঘটনাগুলি তাঁরা পরিপূর্ণ নির্ভূলভাবে মুখস্ত রেখেছেন বলে নিশ্চিত থাকতেন সেগুলিই বলতেন। অনেকে কখনোই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কিছু বলতেননা। সাহাবীগণের সংখ্যা ও হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীগণের সংখ্যার মধ্যে তুলনা করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। রাসূলুল্লাহ(স) এর কম বেশি সাহচর্য্ লাভ করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। নাম পরিচয় সহ প্রসিদ্ধ সাহাবীর সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। অথচ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার।
সাহাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত প্রসিদ্ধ সর্ববৃহৎ হাদীসগ্রন্থ মুসনাদ আহমদ। ইমাম আহমদ এতে মোটামুটি গ্রহণ করার মত সকল হাদীস ও যয়ীফ হাদীস সংকলিত করেছেন। এতে ৯০৪ জন সাহাবীর হাদীস সংকলিত হয়েছে। পরিচিত, অপরিচিত, নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা একত্রিত করলে ১৫৬৫ হয়।
এখানে আরো লক্ষ্যণীয় যে, হাদীস বর্ণনাকারী সহস্রাধিক সাহাবীর মধ্যে অধিকাংশ সাহাবী মাত্র ১ টি থেকে ২০/৩০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ১০০ টির বেশি হাদীস বর্ণনা করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। এঁদের মধ্যে মাত্র ৭ জন সাহাবী থেকে ১০০০ এর বেশি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বাকী ৩১ জন সাহাবী থেকে ১০০ হতে কয়েকশত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকার অনেক ঘটনা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে।
সাইদ ইবনু ইয়াযীদ(৯১ হি) একজন সাহাবী ছিলেন। ছোট বয়সে তিনি বিদায় হজ্জে রাসুলুল্লাহ(স) এর সাহচর্য্ লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সাহাবীগণের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলেনঃ আরবী(******)
-আমি আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ(রা), সাদ ইবনু আবী ওয়াক্কাস(রা) ও মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ(রা) প্রমূখ সাহাবীর সাহচর্যে সময় কাটিয়েছি। তাঁদের কাউকে রাসূলুল্লাহ(স) হতে হাদীস বলতে শুনিনি। তবে শুধুমাত্র তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহকে আমি ওহুদ যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে শুনেছি। (ইবনু আদী, আল কামিল ফী দুআফাইর রিজাইল ১/৯৩)।
তিনি আরো বলেনঃ “আমি সা’দ ইবনু মালিক(রা) এর সাহচর্যে মদীনা থেকে মক্কা পর্য্ন্ত গিয়েছি। এই দীর্ঘ পথে দীর্ঘ সময়ে তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে একটি হাদীসও বলতে শুনিনি।”
হিজরী প্রথম শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী শা’বী(২০৪ হি) বলেনঃ “আমি আবুদল্লাহ ইবনে উমারের(রা) সাথে একটি বৎসর থেকেছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ(স) হতে কিছুই বলতে শুনিনি।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ “আমি দুই বৎসর বা দেড় বৎসর আবদুল্লাহ ইবনে উমার(রা) এর কাছে বসেছি। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে মাত্র একটি হাদীস বলতে শুনেছি…….।” (বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫২; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/২৪৩)।
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইর(রা) বলেন, আমি আমার পিতা যুবাইর ইবনুল আওয়াম(রা) কে বললাম, অন্যান্য কোনো কোনো সাহাবী যেমন হাদীস বর্ণনা করেন আপনাকে তদ্রুপ হাদীস বলতে শুনিনা কেন? তিনি বলেনঃ “শুনে রাখ, ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমি কখনো তাঁর সাহচর্য্ থেকে দূরে যাইনি। কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, আমার নামে (ইচ্ছাকৃতভাবে) যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।(বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪)।
তাহলে যুবাইর ইবনু আওয়াম(৩৬ হি) এর হাদীস না বলার কারণ অজ্ঞতা নয়। তিনি নব্যূয়তের প্রথম কিশোর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর ইন্তিকালের পরে তিনি প্রায় ২৫ বৎসর বেঁচে ছিলেন। অথচ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ টিরও কম। মুসনাদে আহমদে তাঁর থেকে ৩৬টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ইবনু হাযাম উল্লেখ করেছেন যে, নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নামে বর্ণিত সকল হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৩৮ টি।(ইবনু হাযাম, আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত, পৃ.৯৫)।
আমরা দেখেচি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তিনি হাদীস বলা থেকে বিরত ছিলেন। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি জাহান্নাম। আর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা শব্দগত পরিবর্তন ও তাঁর নামে মিথ্যা বলা হতে পারে। এজন্য তিনি হাদীস বর্ণনা থেকে অধিকাংশ সময় বিরত থাকতেন।
অন্যান্য সাহাবীও অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে এভাবে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। তাবিয়ী আবদুর রহমান ইবনু আবী লাইলা(৮৩ হি) বলেনঃ “আমরা সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম(৬৮ হি) কে বললাম, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বর্ণনা করুন। তিনি বলেনঃ আমরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি এবং বিস্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে হাদীস বলা খুবই কঠিন দায়িত্ব।”
সাহাবী সুহাইব ইবনু সিনান(রা) বলতেনঃ “তোমরা এস, আমি তোমাদেরকে যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করবো। তবে কোনো অবস্থাতেই আমি ‘রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’ একথা বলবনা। (আনসারুল আশরাফ ১/১৮৩)।
তাবিয়ী হাশিম হুরমুযী বলেন, আনাস ইবনু মালিক(রা) বলতেন, “ আমার ভয় হয় যে আমি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে ফেলব। এই ভয় না থাকলে আমি অনেক কিছু তোমাদেরকে বলতাম যা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতেই হবে। (আহমদ, আল মুসনাদ ৩/১৭২)।
এভাবে সাহাবীগণ অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আনাস ইবনু মালিক ও আবু কাতাদাহ দুজনেই বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স)‘ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নামে হাদীস বলার শাস্তি বর্ণনা করেছেন।’ কিন্তু তাঁরা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তাঁর নামে হাদীস বর্ণনা পরিহার করেছেন। কারণ ভুল হতে পারে জেনেও সাবধান না হওয়ার অর্থ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের সুযোগ দেওয়া।’ অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে সর্বাত্মক সতর্ক না হওয়ার অর্থ ইচ্ছাকৃত বিকৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। কাজেই যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে সতর্ক না হওয়ার কারণে ভুল করল, সে ইচ্ছাকৃতভাবেই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলল। কোনো মুমিন রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিষয়ে অসতর্ক হতে পারেননা।

১.৩.২. অন্যের বলা হাদীস যাচাই পূর্বক গ্রহণ করা
এভাবে আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ নিজেরা হাদীস বর্ণনার সময় আক্ষরিকভাবে নির্ভূল বলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন এবং কোনো প্রকারের দ্বিধা বা সন্দেহ হলে হাদীস বলতেননা। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাঁদের দ্বিতীয় কর্মধারা ছিল অন্যের হাদীস বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা। অন্য কোনো সাহাবী বা তাঁদের সমকালীন তাবিয়ীর বর্ণিত হাদীসের আক্ষরিক নির্ভূলতা বা যথার্থতা(Accuracy) সম্বন্ধে সামান্যতম সন্দেহ হলে তাঁরা তা যাচাই না করে গ্রহণ করতেননা।
অর্থাৎ তাঁরা নিজে হাদীস বলার সময় যেমন ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন, তদ্রুপভাবে অন্যের বর্ণিত হাদীস সঠিক বলে গণ্য করার পূর্বে তাতে কোনো মিথ্যা বা ভুল আছে কিনা তা যাছাই করতেন। এই সূক্ষ্ম যাচাই ও নিরীক্ষাকে তাঁরা হাদীসের বিশুদ্ধতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলুল্লাহ(স)এর নির্দেশিত অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে করতেন। এজন্য এতে কেউ কখনো আপত্তি করেননি বা অসম্মানবোধ করেননি।

১.৩.২.১. নির্ভূলতা নির্ণয়ে তুলনামূলক পরীক্ষা
পূর্বের আলোচনা হতে আমরা জেনেছি যে, মিথ্যা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকারের হতে পারে। উভয় ধরনের মিথ্যা বা ভুল থেকে হাদীসকে রক্ষার জন্য সাহাবায়ে কেরাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তাঁদের যুগে কোনো সাহাবী মিথ্যা বলতেননা এবং নির্ভূলভাবে হাদীস বলার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করতেননা। তবুও তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর কোনো ভুল হতে পারে সন্দেহ হলেই তাঁর বর্ণনাকে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে তা গ্রহণ করতেন।
তুলনামূলক নিরীক্ষার প্রক্রিয়া ছিল বিভিন্ন ধরনের।
১. বর্ণিত হাদীস অর্থাৎ বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনাকে মূল নির্দেশদাতার নিকট পেশ করে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা(Accuracy) নির্ণয় করা।
২. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা(হাদীস) কে অন্য কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তির বর্ণনার সাথে মিলিয়ে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয় করা।
৩. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা(হাদীস) কে বর্ণনাকারীর বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার সাথে মিলিয়ে তার যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয় করা।
৪. বর্ণিত হাদীসটির বিষয়ে বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বা শপথ করিয়ে বর্ণনাটির যথার্থতা বা নির্ভূলতা নির্ধারণ করা।
৫. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা হাদীসটির অর্থ কুরআন ও হাদীসের প্রসিদ্ধ অর্থ ও নির্দেশের সাথে মিলিয়ে দেখা।
এ সকল নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী হাদীসটি সঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে ও বর্ণনা করতে পেরেছে কিনা যাচাই করতেন।
সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী সকল যুগে হাদীসের বর্ণনার নির্ভূলতা ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণে এ সকল পদ্ধতিতে নিরীক্ষাই ছিল মুহাদ্দিসগণের মূল পদ্ধতি। আমরা জানি যে, বিশ্বের সকল দেশের সকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্যের যথার্থতা ও নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য ও এই পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়। কোনো বর্ণনা বা সাক্ষ্যের বিশুদ্ধতা ও নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আমরা এখানে সাহাবীগণের যুগের কিছু উদাহরণ আলোচনা করব।

১.৩.২.২. মূল বক্তব্যদাতাকে প্রশ্ন করা
কোনো সাক্ষ্য বা বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের সর্বোত্তম উপায় বক্তব্যদাতাকে প্রশ্ন করা। রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবদ্দশায় কোনো সাহাবী অন্য কোনো সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের নির্ভূলতা বিষয়ে সন্দীহান হলে রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে নির্ভূলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। বিভিন্ন হাদীসে এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(রা) বিদায় হজ্জের বর্ণনার মধ্যে বলেনঃ আরবী(*******)
-[(বিদায় হজ্জের পূর্বে রাসূলুল্লাহ(স) আলী(রা) কে ইয়ামেন এর প্রশাসক রূপে প্রেরণ করেন। ফলে) আলী(রা) ইয়ামান থেকে মক্কায় হজ্জে আগমন করেন। তিনি মক্কায় এসে দেখেন যে, ফাতিমা(রা) উমরা পালন করে ‘হালাল’ হয়ে গিয়েছেন। তিনি রঙিন সুগন্ধময় কাপড় পরিধান করেছেন এবং সুরমা ব্যবহার করেছেন। আলী এতে আপত্তি করলে তিনি বলেনঃ আমার আব্বা আমাকে এভাবে করত নির্দেশ দিয়েছেন। আলী বলেনঃ আমি ফাতিমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ(স) এর কাছে অভিযোগ করলাম, সে যে রাসূলুল্লাহ(স) এর নির্দেশের কথা বলছে তাও বললাম এবং আমার আপত্তির কথাও বললাম। ….তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ ‘সে ঠিকই বলেছে, সে সত্যই বলেছে।(মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৮৬-৮৯২)।
এখানে আমরা দেখতে পাই যে, আলী(রা) ফাতেমার(রা) বর্ণনার যথার্থতা সম্পর্কে সন্দীহান হন। তিনি তাঁর সত্যবাদিতায় সন্দেহ করেননি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(স) এর বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝা ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হয়। অর্থাৎ তিনি অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে সন্দীহান হন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে নির্ভূলতা যাচাই করেন।
২. উবাই ইবনু কা’ব বলেনঃ আরবী(*******)
-একদিন রাসূলুল্লাহ(স) জুমু’আর দিনে খুতবায় দাঁড়িয়ে সূরা তাবারাকা(সূরা আল ফুরকান)পাঠ করেন এবং আমাদেরকে আল্লাহ নেয়ামত ও শান্তি সম্পর্কে ওয়ায করেন। এমতাবস্থায় আবু দারদা বা আবু যার আমার দেহে মৃদু চাপ দিয়ে বলেনঃ এই সূরা কবে নাযিল হলো, আমি তো এখনই প্রথম সূরাটি শুনছি। তখন উবাই তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন। সালাত শেষ হলে তিনি(আবু যার বা আবু দারদা) বলেনঃ আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সূরাটি কখন নাযিল হয়েছে, অথচ আপনি আমাকে কিছুই বললেননা! তখন উবাই বলেনঃ আপনি আজ আপনার সালাতের কোনোই সাওয়াব লাভ করেননি, শুধুমাত্র যে কথাটুকু বলেছেন সেটুকুই আপনার(কারণ খুতবার সময় কথা বললে সালাতের সাওয়াব নষ্ট হয়।) তখন তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট যেয়ে বিষয়টি বললেনঃ তিনি বলেন ‘উবাই সত্য বলেছে।।’(ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৫২-৩৫৩)

৩. আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস(রা) বলেনঃ আরবী(*******)
-আমাকে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধেক সালাত হবে। তখন আমি তাঁর নিকট গমন করলাম। আমি দেখলাম যে, তিনি বসে সালাত আদায় করছেন। তখন আমি তাঁর মাথার উপর আমার হাত রাখলাম। তিনি বললেনঃ হে আবদুল্লাহ ইবনু আমর, তোমার বিষয় কি? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আপনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধ সালাত হবে, আর আপনি বসে সালাত আদায় করছেন। তিনি বললেনঃ হ্যা, (আমি তা বলেছি), তবে আমি তোমাদের মত নই।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫০৭)।
এভাবে অনেক ঘটনায় আমরা হাদীসে দেখতে পাই যে, কারো বর্ণিত হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভূলতার বিষয়ে সন্দেহ হলে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করে যথার্থতা যাচাই করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীর সততার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেননা। মূলত তিনি বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝেছেন কিনা এবং নির্ভূলভাবে বর্ণনা করেছেন কিনা তা তাঁরা যাচাই করতেন। এভাবে তাঁরা হাদীসের নামে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ বা ভুলক্রমে বিকৃতি প্রতিরোধ করতেন।
১.৩.২.৩. অন্যদেরকে প্রশ্ন করা
সাক্ষ্য বা বক্তব্যের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতি বক্তব্যটি অন্য কেউ শুনেছেন কিনা এবং কিভাবে শুনেছেন তা খোঁজ করা। যে কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য তা সর্বজনীন পদ্ধতি। সকল বিচারালয়ে বিচারপতিগণ একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমেই রায় প্রদান করে থাকেন। একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের মিল বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করে এবং অমিল প্রামাণ্যতা নষ্ট করে।
রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তিকালের পর সাহাবীগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। কোনো সাহাবীর বর্ণিত কোনো হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভূলতা বিষয়ে তাঁদের কারো দ্বিধা হলে তাঁরা অনান্যা সাহাবীকে প্রশ্ন করতেন বা বর্ণনাকারীকে সাক্ষী আনতে বলতেন। যখন এক বা একাধিক ব্যক্তি বলতেন যে, তাঁরাও ঐ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) এর মুখ থেকে শুনেছেন, তখন তাঁরা হাদীসটি গ্রহণ করতেন। আবু বাকর সিদ্দীক(রা) এই পদ্ধতির শুরু করেন। পরবর্তী খলীফাগণ ও সকল যুগের মুহাদ্দিসগণ তা অনুসরণ করেন। এখানে সাহাবীগণের যুগের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
১. সাহাবী কাবীসাহ ইবনু যুআইব (৮৪ হি) বলেনঃ আরবী(*******)
-“এক দাদী আবু বাকর(রা) এর নিকট এসে মৃত পৌত্রের সম্পত্তিতে তার উত্তরাধিকার দাবী করেন। আবু বাকর(রা) তাকে বলেনঃ আল্লাহর কিতাবে আপনার জন্য(দাদীর উত্তরাধিকার বিষয়ে) কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ(স) এর সুন্নাতেও আপনার জন্য কিছু আছে বলে আমি জানিনা। আপনি পরে আসবেন, যেন আমি এ বিষয়ে অন্যদের প্রশ্ন করে জানতে পারি। তিনি এ বিষয়ে মানুষদের প্রশ্ন করেন। তখন সাহাবী মুগীরাহ ইবনু শু’বা(রা) বলেনঃ আমার উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ(স) দাদীকে (পরিত্যক্ত সম্পত্তির) এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করেন। তখন আবু বাকর(রা) বলেনঃ আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছেন? তখন অন্য সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ আনসারী(রা) উঠে দাঁড়ান এবং মুগীরার অনুরূপ কথা বলেন। তখন আবু বাকর সিদ্দীক(রা) দাদীর জন্য ১/৬ অংশ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।”[মালিক ইবনু আনাস (১৭৯ হি), আল মুআত্তা ২/৫১৩]।
এখানে আমরা দেখছি যে, আবু বাকর সিদ্দীক(রা)হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার শিক্ষা দিলেন। মুগীরাহ ইবনে শু’বার একার বর্ণনার উপরই তিনি নির্ভর করতে পারতেন। কারণ তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী এবং কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত নেতা ছিলেন। সমাজের যে কোনো পর্যায়ে তাঁর একার সাক্ষ্যই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবু বাকর(রা) সাবধানতা অবলম্বন করলেন। মুগীরার বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত হলেও তাঁর স্মৃতি বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে বা তাঁর অনুধাবনে ভুল হতে পারে। এজন্য তিনি দ্বিতীয় আর কেউ হাদীসটি জানেন কিনা প্রশ্ন করেন। দুজনের বিবরণের উপর নির্ভর করে তিনি হাদীসটি গ্রহণ করেন।
এজন্য মুহাদ্দিসগণ আবু বাকর(রা) কে হাদীস সমালোচনার জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা হাকিম নাইসাপূরী(৪০৫ হি) তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ “তিনিই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। (মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-আযামী, মানহাজুন নাকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন, পৃ ১০)।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি) সিদ্দীকে আকবারের জীবনী আলোচনাকালে বলেনঃ “তিনিই সর্বপ্রথম হাদীস গ্রহণ করার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেন।”
২. দ্বিতীয় খলীফা উমার(রা) এ বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরী সিদ্দীকে আকবরের অনুসরণ করেছেন। বিভিন্ন ঘটনায় তিনি সাহাবীগণকে বর্ণিত কোনো হাদীসের জন্য দ্বিতীয় কোনো সাহাবীকে সাক্ষী হিসেবে আনয়ন করতে বলতেন। এ জাতীয় কতিপয় ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
আবু সাঈদ খুদরী(রা) বলেনঃ আরবী(*******)
-আমি আনসারদের এক মজলিসে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় আবু মূসা আশআরী(রা) সেখানে আগমন করেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি অস্থির বা উৎকন্ঠিত। তিনি বলেনঃ আমি উমার(রা) এর ঘরে প্রবেশের জন্য তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করি। অনুমতি না দেয়ায় আমি ফিরে আসছিলাম। উমার(রা) আমাকে ডেকে বলেনঃ আপনার ফিরে যাওয়ার কারণ কি? আমি বললামঃ আমি তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করি, কিন্তু অনুমতি জানানো হয়নি। আর রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যদি তোমরা তিনবার অনুমতি প্রার্থনা কর এবং অনুমতি না দেওয়া হয় তাহলে তোমরা ফিরে যাবে।” তখন উমার(রা) বলেনঃ আল্লাহর শপথ, এই বর্ণনার উপর আপনাকে অবশ্যই সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (আবু মূসা বলেন): আপনাদের মধ্যে কেউ কি এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন? তখন উবাই ইবনে কা’ব (রা) বলেনঃ আমাদের মধ্যে যার বয়স সবচেয়ে কম সেই আপনার সাথে যাবে। (আবু সাঈদ খুদরী বলেন) আমি উপস্থিতদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক ছিলাম। আমি আবু মুসার(রা) সাথে যেয়ে উমারকে(রা) বললাম যে, রাসূলুল্লাহ(সা) একথা বলেছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩০৫; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৯৪)।
৩. তাবেয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর(৯৪ হি) বলেনঃ আরবী(*****)
-উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) মানুষদের কাছে জানতে চান, আঘাতের ফলে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হলে তার দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ(স) কি বিধান দিয়েছেন তা কেউ জানে কিনা? তখন মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন: আমি তাঁকে এ বিষয়ে একজন দাস বা দাসী প্রদানের বিধান প্রদান করতে শুনেছি। উমার(রা) বলেন: আপনার সাথে এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কাউকে আনয়ন করুন। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ বলেন: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ(স) অনুরূপ বিধান দিয়েছেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৩১; মুসলিম, আস –সহীহ ৩/১৩১১)।
৪. সাহাবী আমর ইবনু উমাইয়াহ আদ-দামরী(রা) বলেনঃ আরবী(*****)
-তিনি একটি চাদর ক্রয়ের জন্য তা দাম করছিলেন। এমতাবস্থায় উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) তাঁর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার বলেনঃ এটি কি? তিনি বলেনঃ আমি এই চাদরটি ক্রয় করে দান করতে চাই। এরপর তিনি তা ক্রয় করে তাঁর স্ত্রীকে প্রদান করেন এবং বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছিঃ ‘তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তাও দান বলে গণ্য হবে।’ তখন উমার বলেন: আপনার সাথে সাক্ষী কে আছে? তখন তিনি আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করেন এবং দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আয়েশা(রা) বলেনঃ কে? তিনি বলেনঃ আমি আমর। আপনি কি শুনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তাই দান? আয়েশা বলেনঃ হ্যাঁ। [বাইহাকী, আহমদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি)]
৫. ওয়ালীদ ইবনু আবদুর রাহমান আল-জুরাশী নামক তাবিয়ী বলেনঃ আরবী(*********)
“সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা) অন্য সাহাবী আবু হুরায়রা(রা) এর নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। সে সময় আবু হুরায়রা(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে হাদীস বর্ণনা করছিলেন। হাদীস বর্ণনার মধ্যে তিনি বলেনঃ ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে এবং সালাতে অংশগ্রহণ করে তবে সে এক কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। এক কীরাত ওহুদ পাহাড়ের চেয়েও বড়।’ তখন আবদুল্লাহ ইবনু উমার বলেনঃ আবু হুরাইরা আপনি ভেবে দেখুনতো আপনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কি বলছেন। তখন আবু হুরাইরা(রা)তাকে সাথে নিয়ে আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করেন এবং তাঁকে বলেনঃ হে উম্মুল মুমিনীন, আমি আপনাকে আল্লাহর নামে কসম করে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছেন যে, ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশগ্রহণ করে তবে সে এক কীরাত সাওয়াব অর্জন করে। আর যদি সে তার দাফনে উপস্থিত থাকে তাহলে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে।’ তিনি বলেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই শুনেছি।”(আহমদ, আল-মুসনাদ ২/২, আল মুসতাদরাক ৩/৫৮৪)।

১.৩.২.৪. বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার মধ্যে তুলনা করা
কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা নির্ণয়ের জন্য অন্য একটি পদ্ধতি হলো তাকে একই বিষয়ে একাধিক সময়ে প্রশ্ন করা। যদি দ্বিতীয়বারের উত্তর প্রথমবারের সাথে হুবহু মিলে যায় তাহলে তবে তার নির্ভূলতা প্রমাণিত হয়। আর উভয়ের বৈপরীত্য অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। সাহাবীগণ হাদীসের নির্ভূলতা নির্ণয়ে এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একটি উদাহরণ দেখুন।
তাবিয়ী উরওয়া ইবনু যুবাইর বলেনঃ আরবী(******)
-“আমার খালাম্মা আয়েশা(রা) আমাকে বলেনঃ ভাগ্নে, শুনেছি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস(রা) আমাদের এলাকা দিয়ে হজ্জে গমন করবেন। তমি তাঁর সাথে দেখা কর এবং তার থেকে প্রশ্ন করে শিখ। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। উরওয়া বলেনঃ আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করি। তিনি সে সব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ(স) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি যে সকল কথা বলেন, তার মধ্যে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নেবেননা। কিন্তু তিনি জ্ঞানীদের কব্জা করবেন(মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের গ্রহণ করবেন), ফলে তাদের সাথে জ্ঞানও উঠে যাবে। মানুষের মধ্যে মূর্খ নেতৃবৃন্দ অবশিষ্ট থাকবে, যারা ইলম ছাড়াই ফতওয়া প্রদান করবে এবং এভাবে নিজেরা বিভ্রান্ত হবে এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করবে।” উরওয়া বলেনঃ আমি যখন আয়েশাকে(রা) একথা বললাম তখন তিনি তা গ্রহণ করতে আপত্তি করলেন। তিনি বলেন: তিনি কি তোমাকে একথা বলেছেন যে, একথা তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন? উরওয়া বলেনঃ পরের বছর আয়েশা(রা) আমাকে বলেন: আবদুল্লাহ ইবনু আমর আগমন করেছেন। তুমি তাঁর সাথে আগমন করে তাঁর সাথে কথাবার্তা বল। কথার ফাঁকে ইলম উঠে যাওয়ার হাদীসটির বিষয়েও কথাও বলবে। উরওয়া বলেনঃ আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করি এবং তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি তখন আগেরবার যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই হাদীসটি বললেন। উরওয়া বলেনঃ আমি যখন আয়েশা(রা)কে বিষয়টি জানালাম তখন তিনি বলেনঃ আমি বুঝতে পারলাম যে, আবদুল্লাহ ইবনু আমর ঠিকই বলেছেন। আমি দেখেছি যে, তিনি একটুও বাড়িয়ে বলেননি বা কমিয়ে বলেননি।(মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৫৮-২০৫৯)।
এখানেও আমরা হাদীষ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের অকল্পনীয় সাবধানতার নমুনা দেখতে পাই। আয়েশা(রা) আবদুল্লাহ ইবনু আমরের সততা বা সত্যবাদিতায় সন্দেহ করেননি। কিন্তু সৎ ও সত্যবাদী ব্যক্তিরও ভুল হতে পারে। কাজেই বিনা নিরীক্ষায় তাঁরা কিছুই গ্রহণ করতে চাইতেননা। রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত কোনো হাদীস তারা নিরীক্ষার আগেই ভক্তিভরে হৃদয়ে স্থান দিতেননা।
১.৩.২.৫. বর্ণনাকারীকে শপথ করানো
বর্ণনা বা সাক্ষ্যের নির্ভূলতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে বর্ণনাকারী বা সাক্ষীকে শপথ করানো হয়। সত্যপরায়ণ ও আল্লাহভীরু মানুষ ইচ্ছাকৃত মিথ্যা কথা বলেননা। তবে তাঁর স্মৃতি তাঁকে ধোঁকা দিতে পারে বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের মধ্যে তিনি নিপতিত হতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করতে হলে তিনি কখনো পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলবেননা। এজন্য সত্যপরায়ণ ব্যক্তির জন্য শপথ করানো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভূলতা যাচাইয়ের জন্য কার্য্কর পদ্ধতি। তবে মিথ্যাবাদীর জন্য শপথ যথেষ্ট নয়। তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশ্ন (cross interrogation) এর মাধ্যমে তার বক্তব্যের যথার্থতা যাচাই করতে হয়।
সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন সত্যপরায়ণ অত্যন্ত আল্লাহভীরু মানুষ। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত ভুলের সম্ভাবনা দূর করার জন্য সাহাবীগণ কখনো হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীকে শপথ করাতেন। আলী(রা) বলেনঃ আরবী(*****)
-আমি এমন একজন মানুষ ছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ(স)থেকে কোনো কথা নিজে শুনলে আল্লাহ আমাকে তা থেকে তাঁর মর্জিমত উপকৃত হতে তাওফীক প্রদান করতেন। আর যদি তাঁর কোনো সাহাবী আমাকে কোনো হাদীস শুনাতেন তবে আমি তাকে শপথ করাতাম। তিনি শপথ করলে আমি তার বর্ণিত হাদীস সত্য বলে গ্রহণ করতাম।(তিরমিযী, আস-সুনান ১/৪৪৬)।
১.৩.২.৬. অর্থ ও তথ্যগত নিরীক্ষা
‘ওহী’র জ্ঞান মানবীয় জ্ঞানের অতিরিক্ত, কিন্তু কখনোই মানবীয় জ্ঞানের বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে হাদীসের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’ কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’র ব্যাখ্যা, সম্পূরণ বা অতিরিক্ত সংযোজন হতে পারে, কিন্তু কখনোই তা কুরআনের বিপরীত বা বিরুদ্ধ হতে পারেনা।
সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা এই মূলনীতির ভিত্তিতে বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে তাঁরা কুরআনের অতিরিক্ত ও সম্পূরক অর্থের জন্যেই হাদীসের সন্ধান করতেন। কুরআন কারীমে যে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তা হাদীসে আছে কিনা তা জানতে চাইতেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রদত্ত তথ্যের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। তাঁদের অর্থ নিরীক্ষা পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ
(১) হাদীসের ক্ষেত্রে প্র্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, তা রাসূলুল্লাহ(স) এ কথা বলে প্রমাণিত কিনা। যদি বর্ণনাকারীর বর্ণনা, শপথ বা অন্যান্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ছিল তাকে কুরআনের সম্পূরক নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা এবং তারই আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। ইতোপূর্বে দাদীর উত্তরাধিকার ও গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা বিষয়ে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। দাদীর বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয়নি। এক্ষেত্রে হাদীসের বিবরণটি অতিরিক্ত সংযোজন। অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে যে, অনুমতি চাওয়ার পরে “যদি তোমাদেরকে বলা হয় যে, ‘তোমরা ফিরে যাও’ তবে তোমরা ফিরে যাবে।”(সূরা নূরঃ২৮)।
এক্ষেত্রে হাদীসের নির্দেশনাটি বাহ্যত এই কুরআনী নির্দেশনার ‘বিরুদ্ধ’। কারণ তা কুরআনী নির্দেশনাকে আংশিক পরিবর্তন করে বলছে যে, তিন বার অনুমতি প্রার্থনার পরে ‘তোমরা ফিরে যাও’ বলা না হলেও ফিরে যেতে হবে।
সাহাবীগণ উভয় হাদীসকে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
(২) কোনো কথা রাসূলুল্লাহ(স) বলেননি বলে প্রমাণিত হলে বা গভীর সন্দেহ হলে, কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা না করেই তা প্রত্যাখ্যান করতেন। আমরা দেখেছি যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততায় ও নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ হলে তাঁরা কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা ছাড়াই সেই বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করতেন।
(৩) কখনো কখনো দেখা গিয়েছে যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততার কারণে বর্ণিত হাদীস বাহ্যত গ্রহণযোগ্য। তবে বর্ণনাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁরা সেই হাদীসের অর্থ কুরআনে কারীম ও তাঁদের জানা হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন এবং হাদীসটির অর্থ কুরআনে কারীম ও প্রসিদ্ধ সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিপরীত হলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এইরূপ অর্থ বিচার ও নিরীক্ষার কয়েকটি উদাহরণ দেখুনঃ
১. আবু আসসান আল আরাজ নামক তাবিয়ী বলেনঃ আরবী(****)
-দুই ব্যক্তি আয়েশা(রা) এর নিকট গমন করে বলেনঃ আবু হুরাইরা(রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন: নারী, পশু বা বাহন ও বাড়ি ঘরের মধ্যে অযাত্রা ও অশুভত্ব আছে। একথা শুনে আয়েশা(রা) এত বেশি রাগাণ্বিত হন যে, মনে হলো তাঁর দেহ ক্রোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বলেনঃ যিনি কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর কসম, তিনি এভাবে বলতেননা। রাসূলুল্লাহ(স)বলতেনঃ “জাহিলিয়্যাতের যুগের মানুষেরা বলতঃ নারী, বাড়ি ও পশু বা বাহনে অশুভত্ব আছে।” এরপর আয়েশা(রা) কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেনঃ (সূরা আল হাদীসঃ ২২)।“পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্য্য় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে।” (আহমদ, আল মুসনাদ ৬/১৫০, ২৪৬)।
এখানে আয়েশা(রা) আবু হুরাইরা(রা) এর বর্ণনা গ্রহণ করেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ(স) হতে যা শুনেছেন এবং কুরআনের যে আয়াত পাঠ করেছেন তার আলোকে এই বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
২. উমরাহ বিনতে আবদুর রাহমান বলেনঃ আরবী(*******)
-‘আয়েশা(রা) এর নিকট উল্লেখ করা হয় যে, আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা) রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘জীবিতের ক্রন্দনে মৃতব্যক্তি শাস্তি পায়।’ তখন আয়েশা(রা) বলেনঃ আল্লাহ ইবনু উমারকে ক্ষমা করুন। তিনি মিথ্যা বলেননি। তবে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন বা ভুল করেছেন(দ্বিতীয় বর্ণনায়ঃ শুনতে অনেক সময় ভুল হয়)। প্রকৃত কথা হলো, রাসূলুল্লাহ(স) এক ইহুদী মহিলার(কবরের) নিকট দিয়ে গমন করেন, যার জন্য তার পরিজনেরা ক্রন্দন করছিল। তিনি তখন বলেনঃ‘এরা তার জন্য ক্রন্দন করছে এবং সে তার কবরে শাস্তি পাচ্ছে।’ আল্লাহ বলেছেনঃ (সূরা আল আনআমঃ ১৬৪, সূরা ফাতির ১৮)। ‘এক আত্মা অন্য আত্মার পাপের বোঝা বহন করবেনা।’’’(মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৪০-৬৪৩)।
৩. ফাতিমা বিনতে কাইস(রা) নামক একজন মহিলা সাহাবী বলেন, তাঁর স্বামী তাঁকে তিন তালাক প্রদান করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেন যে, তিনি(ঐ মহিলা) ইদ্দতকালীন আবাসন ও ভরণপোষণের খরচ পাবেননা। তাঁর এই কথা শুনে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেনঃ আমরা আল্লাহর গ্রন্থ ও রাসূলে কারীম(স) এর সুন্নাত একজন মহিলার কথায় ছেড়ে দিতে পারিনা। কারণ আমরা বুঝতে পারছিনা যে, তিনি বিষয়টি মুখস্ত রেখেছেন না ভুলে গিয়েছেন। তিন তালাক প্রাপ্তা মহিলাও ইদ্দতকালীন আবাসন ও খোরপোশ পাবেন। মহিমাময় পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেনঃ(সূরা আত তালাকঃ১) তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ হতে বহিষ্কার করোনা এবং তারাও যেন বের না হয়, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়।”(মুসলিম, আস-সহীহ ২/১১১৮, আস-সুনান ২/২৯৭)।

১.৩.৩. ইচ্ছাকৃত মিথ্যার সম্ভাবনা রোধ করা
সাহাবীগণের যুগের প্রথম দিকে সাহাবীগণই হাদীস বর্ণনা করতেন। এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে অথবা পরবর্তী প্রজন্ম তাবিয়ীগণকে হাদীস শুনাতেন ও শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তেকালের ২০/২৫ বছরের মধ্যে একদিকে যেমন অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেন, তেমনি অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদান শুরু করেন। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এ সময় থেকে কোনো কোনো নও মুসলিম তাবেয়ীর মধ্যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণের বিষয়ে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।
এক সাহাবী অন্য সাহাবী হতে হাদীস বর্ণনা করলে শ্রোতা বা শিক্ষার্থী সাহাবী বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতায় কোনোরূপ সন্দেহ করতেননা বা তিনি নিজ কর্ণে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) হতে শুনেছেন বা অন্য কেউ তাকে বলেছেন সে বিষয়েও প্রশ্ন করতেননা। রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্য্ প্রাপ্ত সকল মানুষই ছিলেন তাঁরই আলোয় আলোকিত মহান মানুষ ও সত্যবাদিতায় আপোষহীন। তবে বিস্মৃতি, অনিচ্ছাকৃত ভুল বা হৃদয়ঙ্গমের অপূর্ণতা জনিত ভুল হতে পারে বিধায় উপরোক্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাঁরা বর্ণিত হাদীসের নির্ভূলতা যাচাই করতেন।
তাবিয়ী বর্ণনাকারীদের হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা উপরোক্ত নিরীক্ষার পাশাপাশি দুইটি অতিরিক্ত বিষয় যোগ করেন। প্রথমত, তাঁরা বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সত্যপরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনুসন্ধান করতেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁরা বর্ণনাকারী কার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছেন তা(Reference)জানতে চাইতেন।
তৃতীয় খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওসমানের(রা)খেলাফত যুগে(২৩-৩৫ হি) মদীনার কেন্দ্র হতে দূরে অবস্থিত নও-মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভ্রান্তি ও হানাহানি ঘটে এবং নও-মুসলিমদের মধ্যে সত্যপরায়ণতার কমতি দেখা দেয়। তখন হতেই সাহাবীগণ উপরোক্ত দুইটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন। প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন(১১০ হি) বলেনঃ “তাঁরা(সাহাবীগণ) সনদ বা তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতেননা। যখন(উসমানের খেলাফতের শেষ দিকে,৩০-৩৫ হি) ফিতনা-ফাসাদ ঘটে গেল তখন তাঁরা বললেনঃ তোমাদেরকে যারা হাদীস বলেছেন তাঁদের নাম উল্লেখ কর। কারণ দেখতে হবে, তারা যদি আহলুস সুন্নাত বা সুন্নাত পন্থীগণের অন্তর্ভূক্ত হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে। আর তারা যদি আহলুল বিদ‘আত বা বিদ‘আত পন্থী গণের অন্তর্ভূক্ত হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবেনা। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫)।
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস(রা) (৬৮ হি) বলেনঃ “আমরা তো হাদীস মুখস্ত করতাম এবং রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস (যে কোনো বর্ণনাকারী হতে) মুখস্ত করা হতো। কিন্তু তোমরা যেহেতু খানা খন্দক ও ভাল মন্দ সব পথেই চলে গেলে সেহেতু এখন(বর্ণনাকারীর বিচার নিরীক্ষা ছাড়া) কোনো কিছু গ্রহণ করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।
তাবিয়ী মুজাহিদ (১০৪ হি) বলেনঃ “বাশীর ইবনু কা’ব আল-আদাবী নামক একজন প্রাচীন তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের(রা) নিকট আগমন করেন এবং হাদীস বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। কিন্তু ইবনু আব্বাস তার দিকে কর্ণপাত ও দৃষ্টিপাত করলেননা। তখন বাশীর বলেনঃ হে ইবনু আববাস, আমার কি হলো! আপনি আমার হাদীস শুনেছেন কি? আমি আপনাকে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বর্ণনা করছি অথচ আপনি কর্ণপাত করছেননা। তখন ইবনু আব্বাস(রা) বলেনঃ একসময় ছিল যখন আমরা কাউকে বলতে শুনতাম ‘রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন’ তখনই আমাদের দৃষ্টিগুলি তার প্রতি আবদ্ধ হয়ে যেত এবং আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার প্রতি কর্ণপাত করতাম। কিন্তু যখন মানুষ খানাখন্দক ভাল মন্দ সব পথেই চলে গেল তখন থেকে আমরা আর মানুষদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করিনা, শুধুমাত্র সুপরিচিত ও পরিজ্ঞাত বিষয় ব্যতিরেকে। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩)।

১.৩.৪. হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণে সতর্কতার নির্দেশ
এভাবে সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পাশাপাশি তাঁরা অন্য সবাইকে এমন সতর্কতা অবলম্বন করতে উৎসাহ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। এক্ষেত্রে কোনোরূপ অবহেলা বা ঢিলেমি তাঁরা সহ্য করতেননা। তাঁরা বিনা যাচাইয়ে হাদীস গ্রহণ করতে নিষেধ করতেন। অনেক সময় কারো হাদীস বর্ণনায় অনিচ্ছাকৃত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে বা শ্রোতাদের মধ্যে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তাঁকে হাদীস বলতে নিষেধ করতেন। এখানে কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করছি।
১. আবু উসমান আন-নাহদী বলেন, উমর ইবনুল খাত্তাব(রা) বলেনঃ ‘‘একজন মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে সবই বর্ণনা করবে।’’ (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১১)।
২. আবুল আহওয়াস বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা) বলেনঃ ‘‘একজন মানুষের মিথ্যা বলার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে সবই বর্ণনা করবে।’’ (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১১)।
৩. সাহাবী আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা) এর পুত্র মদীনার প্রখ্যাত আলিম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবনু আবদুর রাহমান(৯৫ হি) বলেনঃ “উমার ইবনুল খাত্তাব(রা), আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা), আবু দারদা(রা), আবু মাসঊদ(রা) কে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁদেরকে বলেনঃ আপনারা রাসূলুল্লাহ(স) থেকে এত বেশি হাদীস বলছেন কেন? এরপর তিনি তাঁদেরকে মদীনাতেই অবস্থানের নির্দেশ দেন। তাঁর শাহাদাত পর্য্ন্ত তাঁরা মদীনাতেই ছিলেন।(তাবারানী, আল-মুজা’মুল আউসাত ৪/৮৬, নং ৩৪৪৯)।
এই তিনজন সাহাবী হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। উমার ইবনে খাত্তাব(রা) তাঁদের নির্ভূল হাদীস বলার ক্ষমতা বা যোগ্যতার বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ করেননি। কিন্তু বেশি হাদীস বললে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে। বিশেষত, কূফা বা সিরিয়ার মত প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে ইসলামী বিজয়ের সেই প্রথম দিনগুলিতে অধিকাংশ নও মুসলিম অনারব বসবাস করতেন, তাদের মধ্যে বেশি হাদীস বর্ণনা করলে অনেক শ্রোতা তা সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম ও মুখস্ত করতে পারবেননা বলে আশঙ্কা থাকে। এজন্য হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য উমার ইবনুল খাত্তাব তাঁদেরকে মদীনায় অবস্থানের নির্দেশ প্রদান করেন।
অন্য ঘটনায় আমরা দেখতে পাই যে, উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) নিজে কুরআন ও হাদীসের কিছু বিষয় হজ্জ মওসূমে মক্কায় জনসম্মুখে আলোচনা করতে চান। কিন্তু সাহাবী আবদুর রাহমান ইবনু আউফ(রা) তাঁকে বলেন যে, মক্কায় উপস্থিত অগণিত অনারব ও নও মুসলিম হজ্জ পালনকারী হয়ত আপনার কথা ঠিকমত বুঝতে পারবেননা। এতে ভুল বুঝা ও অপব্যাখ্যার সুযোগ এসে যাবে। কাজেই আপনি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার পর বিষয়গুলি আলোচনা করবেন। উমার(রা) এই পরামর্শ অনুসারে মক্কায় বিষয়গুলি আলোচনার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেন।(বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫০৩-২৫০৪)।

১.৪. জালিয়াতি প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহ
উপরের আলোচনা হতে আমরা স্পষ্টরূপে দেখতে পাই যে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, অনুধাবনগত বা অসাবধানতাজনিত সকল প্রকার মিথ্যা হতে বিশুদ্ধ হাদীসকে নির্ভেজালভাবে সংরক্ষণের জন্য সাহাবীগণ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তা একদিকে যেমন যৌক্তিক, প্রায়গিক, বৈজ্ঞানিক ও সূক্ষ্ম, অন্যদিকে তা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একক ও অনন্য। অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীগণ তাঁদের ধর্মের মূল শিক্ষা বা ওহী সংরক্ষণের জন্য এরূপ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যা প্রচারিত হয়েছে তাই সংকলিত করা হয়েছে। অবশেষে ওহীর সাথে মানবীয় জ্ঞানের মিশ্রণের মাধ্যমে ওহীর বিকৃতি ও অবলুপ্তি ঘটেছে।
তাবিয়ীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সাহাবীগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আপোষহীন ছিলেন। তাঁরা হাদীস এর সংরক্ষণ ও বানোয়াট কথা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসের বাছাই এর জন্য তাঁদের জীবনের সকল আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন।
এই পরিচ্ছেদে আমরা সংক্ষেপে তাঁদের মূলনীতিগুলো আলোচনা করবে।

১.৪.১. হাদীস শিক্ষা ও সংরক্ষণ
মহান আল্লাহ উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রথম যুগের মানুষদেরকে তাঁর মহান রাসূল(স) এর হাদীস সংরক্ষণের বিষয়ে একটি সঠিক ও সময়োপযোগী কর্মের তাওফীক প্রদান করেন। প্রথম হিজরী শতক থেকে সাহাবী, তাবিয়ী ও তৎপরবর্তী যুগের আলিমগণ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি গ্রামগঞ্জ, শহর ও জনপদ ঘুরে ঘুরে সকল হাদীস ও বর্ণনাকারীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন। হাদীস শিক্ষা, লিখে রাখা, শিখানো ও হাদীস কেন্দ্রিক আলোচনাই ছিল ইসলামের প্রথম তিন চার শতকের মানুষদের অন্যতম কর্ম, নেশা, পেশা ও আনন্দ।
তাবেয়ীগণের যুগ থেকে বা হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী পর্য্ন্ত সময়কালে আমরা দেখতে পাই যে, হাদীস বর্ণনাকারীগণ দুই প্রকারের। অনেক হাদীস বর্ণনাকারী বা ‘রাবী’ নিজ এলাকার ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে এবং সম্ভব হলে অন্যান্য দেশের কিছু মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন। এরপর তিনি হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষায় রত থেকেছেন। তাঁর নিকট হতে যে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছে তাকে সেই হাদীসগুলি শিক্ষা দিয়েছেন। এরা সাধারণভাবে ‘রাবী’ বা বর্ণনাকারী নামে পরিচিত।
অপরদিকে এই যুগগুলিতে অনেক মুহাদ্দিস নিজ এলাকার সকল ‘রাবী’র নিকট হতে হাদীস শিক্ষা ও লিপিবদ্ধ করার পরে বেড়িয়ে পড়েছেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি জনপদ সফর করতে। তাঁরা প্রত্যেকে দীর্ঘ কয়েক বছর বা কয়েক যুগ এভাবে প্রতিটি জনপদে গমন করে সকল জনপদের সকল ‘রাবী’ বা মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শুনেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন। একজন সাহাবীর বা একজন তাবেয়ীর একটিমাত্র হাদীস বিভিন্ন ‘রাবী’র মুখ হতে শুনতে ও সংগ্রহ করতে তাঁরা মক্কা, মদীনা, খোরাসান, সমরখন্দ, মারভ, ওয়াসিত, বাসরা, কূফা, বাগদাদ, দামেস্ক, হালাব, কায়রো, সান‘আ ইত্যাদি অগণিত শহরে সফর করেছেন। একটি হাদীসই তাঁরা শত শত সনদে সংগ্রহ করে তুলনার মাধ্যমে নির্ভুল ও ভুল বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।
একটি নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবরাহীম ইবনু সাঈদ আল জাওহারী আল বাগদাদী(২৪৭ হি)। তার সমসাময়িক মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনু জাফার ইবনু খাকান বলেনঃ আমি ইবরাহীম ইবনু সাঈদকে আবু বাকর সিদ্দীক(রা) হতে বর্ণিত একটি হাদীসের বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি তার খাদেমকে বললেনঃ গ্রন্থাগারে ঢুকে আবু বাকর সিদ্দীক(রা) এর হাদীস সংকলনের ২৩ তম খন্ডটি নিয়ে এস। আমি বললামঃ আবু বাকর(রা) থেকে ২০ টি হাদীসও সহীহ সনদে পাওয়া যায়না, আপনি কিভাবে তাঁর হাদীস ২৩ টি খন্ডে সংকলন করলেন? তিনি উত্তরে বললেনঃ কোনো একটি হাদীস যদি আমি কমপক্ষে ১০০ টি সনদে সংগ্রহ করতে না পারি তাহলে আমি সেই হাদীসের ক্ষেত্রে নিজেকে এতিম বলে মনে করি। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/১৫৪-১৫৫)।
হাদীস গ্রহণের সময় তাঁরা সংশ্লিষ্ট ‘রাবী’ কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তার বর্ণনার যথার্থতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে তার ব্যক্তিগত সততা, তার শিক্ষকগণ ও এলাকার অন্যান্য রাবীগণের বিষয়ে সেই এলাকার প্রসিদ্ধ আলেম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীগণকে প্রশ্ন করেছেন। এভাবে সংগৃহীত সকল তথ্য তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা সকল রাবী ও তাদের বর্ণিত সকল হাদীসের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন। এ সকল নিরীক্ষক ও সমালোচক হাদীস বিশেষজ্ঞগণ একদিকে রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারী এবং সাথে সাথে ‘নাকিদ’ বা হাদীস সমালোচক ও হাদীসের ইমাম বলে পরিচিত। ইসলামের প্রথম চার শতাব্দীতে এই ধরনের শতাধিক ইমাম ও নাকিদ আমরা দেখতে পাই। হাদীসে রাসূলের খেদমতে এদের পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। জ্ঞান ও সভ্যতার ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে এর সামান্যতম নজির নেই। এদের কর্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণের জন্যও শত শত পৃষ্ঠার গ্রণ্থ প্রণয়ণের প্রয়োজন।
এ সকল নাকিদ মুহাদ্দিস বা ইমাম এভাবে সকল হাদীস ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা চিহ্নিত করেছেন, মিথ্যাবাদীকে চিহ্নিত করেছেন, বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা ও সন্দেহজনক বর্ণনা থেকে পৃথক করেছেন। তাঁরা নিম্নের পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছেন।
১. সকল হাদীসের সনদ, সূত্র বা Reference সংরক্ষণ।
২. সনদের সকল রাবীর ব্যক্তিগত পরিচয়, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, উস্তাদ, ছাত্র, কর্ম, সফর ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ।
৩. রাবীগণের ব্যক্তিগত সততা, বিশ্বস্ততা ও সত্যপরায়ণতা যাচাই করা।
৪. বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা ও যাচাই করা।
৫. সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবী তার উর্ধ্বতন রাবীর নিকট হতে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন কিনা তা যাচাই করা।
৬. সংগৃহীত সকল হাদীসের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা থেকে নির্ভুল বর্ণনাগুলি পৃথক করা।
৭. সংগৃহীত তথ্যাদি ও তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল রাবীর মিথ্যাচার ধরা পড়েছে তাদের মিথ্যাচার উম্মাহর সামনে তুলে ধরা।
৮. সংগৃহীত সকল হাদীস সনদসহ গ্রন্থায়িত করা।
৯. রাবীদের নির্ভুলতা বা মিথ্যাচার বিষয়ক তথ্যাদি গ্রন্থায়িত করা।
১০. পৃথক গ্রন্থে বিশুদ্ধ হাদীস সংকলিত করা।
১১. পৃথক গ্রন্থে মিথ্যা ও জাল হাদীসগুলি সংকলিত করা।
১২. জাল বা মিথ্যা হাদীস সহজে চেনার নিয়মাবলি বের করা।
নিম্নে আমরা এ সকল বিষয়ে আলোচনা করব।

১.৪.২. সনদ সংরক্ষণ
আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদ বা তথ্য সূত্র বলার রীতি চালু করেন। যেন সূত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা যায়। পরবর্তী যুগগুলোতে সনদ সংরক্ষণের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়। হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তির প্রসিদ্ধি, সততা, মহত্ব, পান্ডিত্য ইত্যাদি যত বেশিই হোকনা কেন, তিনি কার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছেন এবং তিনি কোন সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তা উল্লেখ না করলে মুহাদ্দিসগণ কখনোই তার বর্ণিত হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেননি। উপরন্তু তিনি এবং তার সনদে বর্ণিত প্রত্যেক রাবী পরবর্তী রাবী থেকে হাদীসটি নিজে শুনেছেন কিনা তা যাচাই করেছেন। সনদের গুরুত্ব বুঝাতে অনেক কথা তাঁরা বলেছেন।
প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেনঃ “এই জ্ঞান হলো দ্বীন(ধর্ম)। কাজেই কার নিকট হতে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ তা দেখে নেবে।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৪)।
সুফিয়ান ইবনু উ‘আইনাহ(১৯৮ হি) বলেনঃ “একদিন ইবনু শিহাব যুহরী (১২৫ হি) হাদীস বলছিলেন। আমি বললামঃ আপনি সনদ ছাড়াই হাদীসটি বলুন। তিনি বলেনঃ তুমি কি সিঁড়ি ছাড়াই ছাদে আরোহন করতে চাও?” (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ২/১৬০)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনু সাঈদ আস সাউরী(১৬১ হি) বলেনঃ “সনদ মুমিনের অস্ত্র স্বরূপ।” (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ২/১৬০)।
উতবাহ ইবনু আবু হাকীম (১৪০ হি) বলেন, একদিন আমি ইসহাক ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু আবী ফারওয়া(১৪৪ হি) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ইবনু শিহাব যুহুরী(১২৫ হি)উপস্থিত ছিলেন। ইবনু আবী ফারওয়া হাদীস বর্ণনা করে বলতে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, …..। তখন ইবনু শিহাব যুহুরী তাকে বলেন, হে ইবনু আবী ফারওয়া, আল্লাহ আপনাকে ধ্বংস করুন! আল্লাহর নামে কথা বলতে আপনার কত্ত বড় দুঃসাহস! আপনি হাদীস বলছেন অথচ হাদীসের সনদ বলছেননা। আপনি আমাদেরকে লাগামহীন হাদীস বলছেন।(যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩৪৪)।
প্রসিদ্ধ তাবি তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক(১৮১ হি) বলেনঃ “সনদ বর্ণনা ও সংরক্ষণ দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা না থাকলে যে যা চাইত তাই বলত।”(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫)।
তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনু ইসহাক ইবনু ঈসা(২১৫ হি) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক(১৮১ হি) কে বললাম, একটি হাদীসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাতের সাথে পিতামাতার জন্য সালাত আদায় করা এবং তোমার সিয়ামের সাথে পিতামাতার জন্য সিয়াম পালন করা নেককর্মের অন্তর্ভুক্ত।’ তিনি বলেনঃ হাদীসটি আপনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ শিহাব ইবনু খিরাশ থেকে। তিনি বলেনঃ শিহাব নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ তিনি হাজ্জাজ ইবনু দীনার থেকে। তিনি বলেনঃ হাজ্জাজ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি, তিনি কার নিকট হতে শুনেছেন? আমি বললামঃ তিনি বলেছেন-রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন। ইবনুল মুবারক বললেনঃ হে আবু ইসহাক, হাজ্জাজ ইবনু দীনার ও রাসূলুল্লাহ(স) এর মাঝে বিশাল দূরত্ব রয়েছে, যে দূরত্ব অতিক্রম করতে অনেক বাহনের প্রয়োজন। অর্থাৎ হাজ্জাজ দ্বিতীয় হিজরীর শেষের দিকের একজন তাবে-তাবেয়ী। অন্তত ২/৩ জন ব্যক্তির মাধ্যম ছাড়া তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট পৌঁছাতে পারেননা। তিনি যেহেতু বাকী সনদ বলেননি, সেহেতু হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬)।
এভাবে প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সনদ (uninterrupted chain of authorities) উল্লেখ অপরিহার্য্ বলে গণ্য করেছেন। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে দুইটি অংশের সমন্বিত রূপকে বুঝায়। প্রথম অংশঃ হাদীসের সূত্র বা সনদ ও দ্বিতীয় অংশঃ হাদীসের মূল বক্তব্য বা মতন।
একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম মালিক ইবনু আনাস(১৭৯ হি) ২য় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস সংকলক। তিনি তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে বলেনঃ আরবী(*****)
-“মালিক, আবুয যিনাদ(১৩০ হি) থেকে, তিনি আ’রাজ(১১৭ হি) থেকে, তিনি আবু হুরাইরা(৫৯ হি) থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেনঃ এই দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সেই সময় দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ(স) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এই সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য।[মালিক ইবনু আনাস (১৭৮), আল মুআত্তা ১/১০৮]।
উপরের হাদীসের প্রথম অংশ “মালিক, আবযু যিনাদ থেকে…. আবু হুরাইরা থেকে” হাদীসের সনদ বা সূত্র। শেষে উল্লেখিত রাসূলুল্লাহ(স) এর বাণীটুকু হাদীসের ‘মতন’ বা বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলতে শুধু শেষের বক্তব্যটুকুই নয়, বরং সনদ ও মতন এর সম্মিলিত রূপকেই হাদীস বলা হয়। একই বক্তব্য দুইটি পৃথক সনদে বর্ণিত হলে তাকে দুইটি হাদীস বলে গণ্য করা হয়। অনেক সময় শুধু সনদকেই হাদীস বলা হয়।(ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৩/২৫৩)।

১.৪.৩. সনদ বনাম লিখিত পান্ডুলিপি
উপরের হাদীস ও হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত অনুরূপ অগণিত হাদীস হতে কেউ ধারণা করতে পারেন যে, সাহাবী, তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ীগণ সম্ভবত হাদীস লিপিবদ্ধ বা সংকলিত করে রাখতেননা, শুধুমাত্র মুখস্ত ও মৌখিক বর্ণনা করতেন। এজন্য বোধহয় মুহাদ্দিসগণ এভাবে সনদ উল্লেখ করে হাদীস সংকলিত করেছেন। অনেকেই ধারণা করেন যে, হাদীস তৃতীয় বা চতূর্থ হিজরী শতকেই লিপিবদ্ধ বা সংকলিত হয়েছে, এর পূর্বে তা মৌখিকভাবে প্রচলিত ছিল।
বিষয়টি কখনো তা নয়। হাদীস বর্ণনা বা সংকলনের পদ্ধতির সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অগভীর ভাসাভাসা জ্ঞানই এই কঠিন বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। বস্তুত হাদীস বর্ণনা বা সংকলনের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সূক্ষ্মতম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তাঁরা মৌখিক বর্ণনা ও লিখিত পান্ডুলিপির সমন্বয়ের মাধ্যমে হাদীস বর্ণনায় ভুলভ্রান্তি অনুপ্রবেশের পথ রোধ করেছেন। হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও সনদ বর্ণনায় সর্বদা মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির পাশাপাশি লিখনি ও পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করা হতো। অনুরূপভাবে হাদীস নিরীক্ষা ও জালিয়াতি নির্ধারণেও পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করা হতো।
১.৪.৩.১. হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও সনদ বর্ণনায় পান্ডুলিপি
সাহাবীগণ সাধারণত হাদীস মুখস্ত করতেন এবং কখনো কখনো লিখেও রাখতেন। সাহাবীগণের হাদীস লিখে রাখার প্রয়োজনও তেমন ছিলনা। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২০/৩০ টির বেশি নয়। রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে কাটানোর দিনগুলির স্মৃতি থেকে ২০/৩০ টি বা ১০০ টি, এমনকি হাজারটা ঘটনা বা কথা বলার জন্য লিখে রাখার প্রয়োজন হতোনা। তাছাড়া তাঁদের জীবনে আর কোনো বড় বিষয় ছিলনা। রাসূলুল্লাহ(স) এর স্মৃতি আলোচনা, তাঁর নির্দেশাবলী হুবহু পালন, তাঁর হুবহু অনুকরণ ও তাঁর কথা মানুষদের শোনানোই ছিল তাঁদের জীবনের অন্যতম কাজ। অন্য কোনো জাগতিক ব্যস্ততা তাঁদের মন মগজকে ব্যস্ত রাখতে পারতনা। আর যে স্মৃতি ও যে কথা সর্বদা মনে জাগরুক ও কর্মে বিদ্যমান তা তো আর পৃথক কাগজে লিখার দরকার হয়না। তা সত্ত্বেও অনেক সাহাবী তাঁদের মুখস্ত হাদীস লিখে রাখতেন এবং লিখিত পান্ডুলিপির সংরক্ষণ করতেন। (মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল খাতীব, আস-সুন্নাত কাবলাত তাদবীন, পৃ. ৩০৩-৩২১)।
সাহাবীগণের ছাত্রগণ বা তাবেয়ীগণের যুগে থেকে হাদীস শিক্ষা প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করা। অধিকাংশ তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীস শুনতেন, লিখতেন ও মুখস্ত করতেন। পান্ডুলিপি সামনে রেখে বা পান্ডুলিপি থেকে মুখস্ত করে তা ছাত্রদের শোনাতেন। তাঁদের ছাত্ররা শোনার সাথে সাথে তা নিজেদের পান্ডুলিপিতে লিখে নিতেন এবং শিক্ষকের পান্ডুলিপির সাথে মিলাতেন। তাবেয়ীগণের যুগ, অর্থাৎ প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ থেকে এভাবে সকল পঠিত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখা হাদীস শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এ বিষয়ক অগণিত বিবরণ হাদীস বিষয়ক গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। দু একটি উদাহরণ দেখুন।
তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আকীল(১৪০ হি) বলেনঃ “আমি এবং আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ আল বাকির(১১৪ হি) সাহাবী জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(৭০ হি) এর নিকট গমন করতাম। আমরা সাথে ছোট ছোট বোর্ড বা স্লেট নিয়ে যেতাম যেগুলিতে আমরা হাদীস লিপিবদ্ধ করতাম।” [রামহুরমুযী, হাসান ইবনে আবদুর রহমান(৩৬০ হি)]
তাবিয়ী আমির ইবনু শারাহীল শা’বী (১০২ হি) বলেনঃ “তোমরা যা কিছু আমার নিকট হতে শুনবে সব লিপিবদ্ধ করবে। প্রয়োজনে দেয়ালের গায়ে লিখতে হলেও তা লিখে রাখবে।”(প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৬)।
তাবিয়ী আবু কিলাবাহ আবদুল্লাহ ইবনু যাইদ(১০৪ হি) বলেনঃ “ভুলে যাওয়ার চেয়ে লিখে রাখা আমার কাছে অনেক প্রিয়।” (ইবনু রাজার, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
তাবিয়ী হাসান বসরী(১১০ হি) বলেনঃ“আমাদের নিকট পান্ডুলিপিসমূহ রয়েছে, যেগুলি আমরা নিয়মিত দেখি ও সংরক্ষণ করি।”(রামহুরমুযী, আল মুহাদ্দিস আল ফাসিল, ৩৭০-৩৭১)।
প্রসিদ্ধ তাবি তাবিয়ী আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) বলেনঃ “হাদীস শিক্ষার সময় পান্ডুলিপি আকারে লিখে না রাখলে আমরা মুখস্তই করতে পারতামনা।”(ইবনু রাজার,শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
এ বিষয়ক অগণিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে পৃথক গ্রন্থের প্রয়োজন।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, তাবেয়ীগণের যুগ থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার সাথে সাথে তা লিখে রাখতেন। হাদীস শিক্ষা দানের সময় তাবিয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণ সাধারণত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস পড়ে শেখাতেন। কখনো বা মুখস্ত পড়ে হাদীস শেখাতেন তবে পান্ডুলিপি নিজের হেফাজতে রাখতেন যাতে প্রয়োজনের সময় তা দেখে নেয়া যায়।
তাবিয়ীগণের যুগে বা তৎপরবর্তীযুগে কতিপয় মুহাদ্দিস ছিলেন যারা পান্ডুলিপি ছাড়াই হাদীস মুখস্ত করতেন ও বর্ণনা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা হাদীস বর্ণনায় দূর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, এরা পান্ডুলিপির উপর নির্ভর না করায় মাঝে মাঝে বর্ণনায় ভুল করতেন। বস্তুত মৌখিক শ্রবণ ও পান্ডুলিপির সংরক্ষণের মাধ্যমেই নির্ভরযোগ্য বর্ণনা করা সম্ভব। এজন্য যে সকল ‘রাবী’ শুধুমাত্র পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে বা শুধুমাত্র মুখস্তশক্তির উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করতেন তাঁদের হাদীস মুহাদ্দিসগণ দূর্বল বা অনির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের বর্ণনায় ভুল ও বিক্ষিপ্ততা ধরা পড়ে। এই জাতীয় অগণিত বিবরণ আমরা রিজাল ও জারহু ওয়াত তা’দীল বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে দেখতে পাই। দুই একটি উদাহরণ দেখুনঃ
আবু আম্মার ইকরিমাহ ইবনু আম্মার আল ইজলী(১৬০ হি) দ্বিতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হাদীস মুখস্তকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মুখস্ত হাদীসগুলিকে লিপিবদ্ধ করে পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষণ করতেননা, ফলে প্রয়োজনে তা দেখতে পারতেননা। এজন্য তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু ভুল পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী(১৫৬ হি) বলেনঃ “তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিলনা, এজন্য তাঁর হাদীসে বিক্ষিপ্ততা পাওয়া যায়।(যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১১৪)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিস জারীর ইবনু হাযিম ইবনু যাইদ(১৭০ হি)। তাঁর বিষয়ে ইবনু হাজার বলেনঃ “তিনি নির্ভরযোগ্য।….. তবে তিনি যখন পান্ডুলিপি না দেখে শুধুমাত্র মুখস্ত স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন তখন তাঁর ভুল হতো।” (ইবনু হাজার, তারকীবুত তাহযীব, পৃ. ১৩৮)।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল আযীয় ইবনু ইমরান ইবনু আব্দুল আযীয(১৭০ হি)। তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন এবং সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু আউফের বংশধর ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁকে দূ্র্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তাঁর বর্ণিত হাদীসের মাঝে ভুল ভ্রান্তি ব্যাপক। আর এই ভুলভ্রান্তির কারণ হলো পান্ডুলিপি ব্যতিরেকে মুখস্ত বর্ণনা করা। তৃতীয় হিজরী শতকের মদীনার মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক উমার ইবনু শাব্বাহ(২৬২ হি) তাঁর ‘মদীনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এই ব্যক্তির সম্পর্কে বলেনঃ “তিনি হাদীস বর্ণনায় অনেক ভুল করতেন; কারণ তাঁর পান্ডুলিপিগুলো পুড়ে যাওয়ার ফলে তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে মুখস্ত হাদীস বলতেন।”(ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৬/৩১২)।
ইবনু হাজার আসকালানীর ভাষায়ঃ “তিনি একজন পরিত্যক্ত রাবী। তাঁর পান্ডুলিপিগুলো পুড়ে যায়। এজন্য তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন। এতে তাঁর ভুল হতো খুব বেশি।” (ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব পৃ. ৩৫৮)।
তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাজিব ইবনু সুলাইমান আল মানবিজী(২৬৫ হি)। তিনি ইমাম নাসাঈর উস্তাদ ছিলেন। তিনি হাদীস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পান্ডুলিপি না থাকার কারণে ভুল হতো। ইমাম দারাকুতনী(৩৮৫ হি) বলেনঃ “তিনি হাদীস মুখস্ত বলতেন এবং স্মৃতির উপরেই নির্ভর করতেন। তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিলনা। এজন্য তাঁর হাদীসে ভুল দেখা দেয়।” (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৬৪)।
তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম ইবনু মুসলিম, আবু উমাইয়া(২৭৩ হি)। তাঁর সম্পর্কে তাঁর ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান(৩৫৪ হি) বলেনঃ “তিনি তুরতুসের অধিবাসী ছিলেন এবং নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তিনি মিশরে আগমন করেন এবং কোনো পান্ডুলিপি ছাড়া মুখস্ত কিছু হাদীস বর্ণনা করেন; যে সকল হাদীস বর্ণনায় তিনি ভুল করেন। এজন্য তাঁর বর্ণিত কোনো হাদীস আমি দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই। শুধুমাত্র যে হাদীসগুলি তিনি পান্ডুলিপি দেখে বর্ণনা করেছেন সেগুলিই গ্রহণ করা যায়। (ইবনু হিব্বান, মুহাম্মাদ(৩৫৪ হি), আস-সিকাত ৯/১৩৭)।
ইমাম শাফেয়ী(২০৪ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম আলিম। তিনি লিখেছেনঃ “যে মুহাদ্দিস এর ভুল বেশি হয় এবং তার কোনো বিশুদ্ধ লিখিত পান্ডুলিপি নেই তার হাদীস গ্রহণ করা যাবেনা।”
(শাফেয়ী, আল রিসালাহ, পৃ. ৩৮২)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে হাদীস শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য শিক্ষকের নিকট হতে মৌখিক শ্রবণ ও লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ উভয়ের সমন্বয়ের উপর নির্ভর করা হতো। সুপ্রসিদ্ধ ‘হাফিজ-হাদীসগণ’, যারা আজীবন হাদীস শিক্ষা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস মুখস্ত রেখেছেন, তাঁরাও পান্ডুলিপি না দেখে হাদীস শিক্ষা দিতেননা বা বর্ণনা করতেননা।
৩য় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আলী ইবনুল মাদীনী(২৩৪ হি) বলেনঃ “হাদীস মুখস্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাথীদের মাঝে আহমাদ ইবনু হাম্বল(২৪১ হি) এর চেয়ে বড় বা বেশি যোগ্য আর কেউই ছিলেননা। তা সত্ত্বেও তিনি পান্ডুলিপি সামনে না রেখে হাদীস বর্ণনা করতেননা। আর তাঁর মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” (যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/২১৩)।
অপরদিকে ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি) বলেনঃ “অনেকে আমাদেরকে স্মৃতি থেকে হাদীস শুনিয়েছেন এবং অনেকে আমাদেরকে পান্ডুলিপি থেকে হাদীস শুনিয়েছেন। যারা পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শুনিয়েছেন তাঁদের বর্ণনা ছিল বেশি নির্ভুল।”(ইবনু রাজাব, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ. ৫৭)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কে অত্যন্ত জরুরী মনে করতেন: প্রথমত হাদীসটি উস্তাদের মুখ থেকে শাব্দিকভাবে শোনা বা তাকে মুখে পড়ে শোনানো ও দ্বিতীয়ত পঠিত হাদীসটি নিজে হাতে লিখে নেওয়া ও তৃতীয়ত উস্তাদের পান্ডুলিপির সাথে নিজের লেখা পান্ডুলিপি মিলিয়ে সংশোধন করে নেওয়া। কোনো মুহাদ্দিস স্বকর্ণে শ্রবণ ব্যতীত শুধু পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শেখালে বা পান্ডুলিপি ছাড়া শুধু মুখস্ত হাদীস শেখালে তা গ্রহণ করতে তাঁরা আপত্তি করতেন। ইমাম আহমদ হাম্বলের পুত্র আবদুল্লাহ (২৯০ হি) বলেনঃ
“ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা’ঈন(২৩৩ হি) বলেনঃ ইমাম আব্দুল রাজ্জাক সান‘আনী (২১১ হি) আমাকে বলেন: তুমি আমার নিকট হতে অন্তত একটি একটি হাদীস লিখিত পান্ডুলিপি ছাড়া গ্রহণ কর। আমি বললাম: কখনোইনা, আমি লিখিত পান্ডুলিপির প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করে একটি অক্ষরও গ্রহণ করতে রাজী নই।”(আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/২৯৭)।
আব্দুর রাযযাক সান’আনীর মত সুপ্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসের নিকট থেকেও লিখিত ও সংরক্ষিত পান্ডুলিপির সমন্বয় ব্যতিরেকে একটি হাদীস গ্রহণ করতেও রাজী হননি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন!
এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতি দেখুন। তৃতীয় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হাদীস বিচারক ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেনঃ “যদি কোনো ‘রাবী’র হাদীস তিনি সঠিকভাবে মুখস্ত ও বর্ণনা করতে পেরেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয় তাহলে তার কাছে তার পুরাতন পান্ডুলিপি চাইতে হবে। তিনি যদি পুরাতন পান্ডুলিপি দেখাতে পারেন তবে তাকে ইচ্ছাকৃত ভুলকারী বলে গণ্য করা যাবেনা। আর যদি তিনি বলেন যে, আমার মূল প্রাচীন পান্ডুলিপি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমার কাছে তার একটি অনুলিপি আছে তাহলে তার কথা গ্রহণ করা যাবেনা। অথবা যদি বলেন যে, আমার পান্ডুলিপিটি আমি পাচ্ছিনা তাহলেও তাঁর কথা গ্রহণ করা যাবেনা। বরং তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে বুঝতে হবে। (খতীব বাগদাদী, আল-কিফাইয়াতু ফী ইলমির রিওয়াইয়া পৃ. ১১৭)।
১.৪.৩.২. সনদে শ্রুতি বর্ণনার অর্থ ও প্রেক্ষাপট
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই হাদীস লিখে মুখস্ত রাখা হতো। মুহাদ্দিসগণ লিখিত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস বর্ণনা করতেন, নিরীক্ষা করতেন, বিশুদ্ধতা যাচাই করতেন এবং প্রত্যেকেই তাঁর শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এখন প্রশ্ন হলো, তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে লিখিত পুস্তকের রেফারেন্স প্রদান না করে শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনার উপর কেন নির্ভর করতেন? তাঁরা কেন ‘আমাকে বলেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ দিয়েছেন’ ইত্যাদি বলতেন? তাঁরা কেন বললেননা, অমুক পুস্তকে এই কথাটি লিখিত আছে…… ইত্যাদি?
প্রকৃত বিষয় হলো সাহাবীগণের যুগ হতেই ‘পুস্তক’ এর চেয়ে ‘ব্যক্তির’ গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়েছে। পান্ডুলিপির নির্ভরতা ও এতদসংক্রান্ত ভুল ভ্রান্তির সম্ভাবনা দূর করার জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপির পাশাপাশি বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনাকারী উস্তাদ থেকে স্বকর্ণে শ্রবণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। এজন্য হাদীস শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থ বা পান্ডুলিপির রেফারেন্স প্রদানের নিয়ম ছিলনা। বরং বর্ণনাকারী শিক্ষকের নাম উল্লেখ করার নিয়ম ছিল। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদ্দাসানা আখবারানা’ অর্থাৎ ‘আমাকে বলেছেন’ কথাটির অর্থ হলো আমি তাঁর পুস্তক তাঁর নিজের কাছে বা তাঁর অমুক ছাত্রের কাছে পড়ে স্বকর্ণে শুনে তা থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছি। কেউ কেউ ‘আমি তাঁকে পড়তে শুনেছি’, বা ‘আমি পড়েছি’ এরূপ বললেও , সাধারণত ‘হাদ্দাসানা’ বা ‘আখবারানা’ বা ‘আমাদেরকে বলেছেন’ বলেই তাঁরা এক বাক্যে বিষয়টি উপস্থাপন করতেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, উপরে উল্লেখিত মুয়াত্ত গ্রন্থের সনদটির অর্থ এই নয় যে, মালিক আবুয যিনাদ থেকে শুধুমাত্র মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আ’রাজ থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন এবং তিনি আবু হুরাইরা থেকে মৌখিক বর্ণনা শুনেছেন। বরং এখানে সনদ বলার উদ্দেশ্য হলো এই সনদের রাবীগণ প্রত্যেকে তাঁর ওস্তাদের কাছ হতে হাদীসটি শুনেছেন, লিখেছেন এবং লিখিত পান্ডুলিপি মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন।
তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বুখারী (২৫৬ হি) এই হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা বলেছেন, মালিক থেকে আবু যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা বলেনঃ এই দিনের মধ্যে একটি সময় আছে কোনো মুসলিম যদি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সালাতরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ(স) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন যে, এই সুযোগটি স্বল্প সময়ের জন্য। (বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহীহ ১/৩১৬)।
এখানে ইমাম বুখারী মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসটি হুবহু উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু তিনি এখানে মুয়াত্তা গ্রন্থের উদ্ধৃত দেননি। বরং তিনি ইমাম মালিকের একজন ছাত্র থেকে হাদীসটি শুনেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বাহ্যত পাঠকের কাছে মনে হতে পারে যে, ইমাম বুখারী মূলত শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয় কখনোই তা নয়। ইমাম মালিকের নিকট হতে শতাধিক ছাত্র মুয়াত্তা গ্রন্থটি পূর্ণরূপে শুনে ও লিখে নেন। তাঁদের বর্ণিত লিখিত মুয়াত্তা গ্রন্থ তৎকালীন বাজারে ‘ওয়াররাক’ বা ‘হস্তলিখিত পুস্তক’ ব্যবসায়ীদের দোকানে পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী যদি এইরূপ কোনো পান্ডুলিপি কিনে তার বরাত দিয়ে হাদীসটি উল্লেখ করতেন তবে মুহাদ্দিসগণের বিচারে বুখারীর উদ্ধৃতিটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হতো। কারণ পান্ডুলিপি নির্ভরতার মধ্যে বিভিন্ন প্রকার ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি তাঁর মুখ থেকে আগাগোড়া শুনে ও পান্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে বিশুদ্ধ পান্ডুলিপি বর্ণনা করতেন যে সকল মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী সে সকল মুহাদ্দিসের নিকট যেয়ে মুয়াত্তা গ্রন্থটি প্রথম থেকে শেষ পর্য্ন্ত স্বকর্ণে শুনেছেন। ইমাম বুখারী তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীসগুলি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু কখনোই গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করেননি। বরং যাদের কাছে তিনি গ্রন্থটি পড়েছেন তাদের সূত্র প্রদান করেছেন। যেমন এখানে তিনি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামার সূত্র উল্লেখ করেছেন। এখানে তাঁর কথার অর্থ হলো ‘আমি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামার’ নিকট ইমাম মালিকের গ্রন্থটির মধ্যে এই হাদীসটি আমি স্বকর্ণে পঠিত শুনেছি।
৩য় শতাব্দীর অন্যতম মুহাদ্দিস ইমাম মুসলিমও (২৬২ হি) এই হাদীসটি মুয়াত্তা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে কুতাইবা ইবনু সাঈদ বলেন, মালিক থেকে, আবযু যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে , রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন……………..।”(মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আস-সহীহ ২/৫৮৩)।
এখানে ইমাম মুসলিমও একইভাবে পুস্তকের উদ্ধৃতি না দিয়ে পুস্তকটির বর্ণনাকারীর উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ৫ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বাইহাকী আহমদ ইবনুল হুসাইন(৪৫৮ হি) তাঁর ‘আস-সুনানুল কুবরা’ নামক হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।
তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে আলী ইবনু আহমদ ইবনু আবদান বলেন, আমাদেরকে আহমদ ইবনু উবাইদ সাফফার বলেন, আমাদেরকে ইসমাঈল কাযী বলেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নাবী বলেন, তিনি মালিক থেকে, তিনি আবুয যিনাদ থেকে, তিনি আ’রাজ থেকে, তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) শুক্রবারের কথা উল্লেখ করে বলেন……..।”(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯)।
সনদটি দেখে কেউ ভাবতে পারেন যে, ৫ম শতাব্দী পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করতেন। রাসূলুল্লাহ(স) হতে গ্রন্থাগার পর্য্ন্ত মাঝে ৮ জন বর্ণনাকারী। সকলেই শুধু মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপর নির্ভর করেছেন! কাজেই ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা খুবই বেশি!!
কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইমাম বাইহাকীর এই সনদের অর্থ হলোঃ ইমাম মালিকের লেখা মুয়াত্তা গ্রন্থটি আমি আলি ইবনু আহমদ ইবনু আবদান এর নিকট পঠিত শুনেছি। তিনি তা আহমদ ইবনু উবাইদ সাফফার নিকট পড়েছেন। তিনি পুস্তকটি ইসমাঈল কাযীর নিকট পাঠ করেছেন। তিনি পুস্তকটি আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা কা’নবীর নিকট পাঠ করেছেন। তিনি মালিক থেকে….। এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করলেন যে, তিনি মুয়াত্তা গ্রন্থটি বাজার থেকে ক্রয় করে নিজে পাঠ করে তার থেকে হাদীস সংগ্রহ করেননি। বরং তিনি মুয়াত্তার পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে এমন এক ব্যক্তির নিকট তা পাঠ করে শুনেছেন যিনি নিজে গ্রন্থটি বিশুদ্ধ পাঠের মাধ্যমে আয়ত্ত করেছেন…..এভাবে শেষ পর্য্ন্ত। বাইহাকী এই সনদটি আরো অনেকগুলি সনদে উল্লেখ করেছেন। সকল সনদেই তিনি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মূলত বলেছেন যে, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা গ্রন্থটি বিভিন্ন উস্তাদের নিকট বিভিন্ন সনদে বিশুদ্ধরূপে পড়ে শ্রবণ করেছেন।(বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/২৪৯)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, লিখিত পান্ডুলিপির সাথে মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির সমন্বয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ পান্ডুলিপি বা পুস্তকের বরাত প্রদানের পরিবর্তে শ্রবণের বরাত প্রদানের নিয়ম প্রচলন করেন। তাঁদের এই পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। বর্তমান যুগে প্রচলিত গ্রন্থের নাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি উল্লেখ করে ‘Reference’ বা তথ্যসূত্র দেওয়ার চেয়ে এভাবে শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে ‘Reference’ দেওয়া অনেক নিরাপদ ও যৌক্তিক। তৎকালীন হস্তলিখিত গ্রন্থের যুগে শুধুমাত্র গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রন্থ পাঠে ভুলের সম্ভাবনা, গ্রন্থের মধ্যে অন্যের সংযোজনের সম্ভাবনা ও অনুলিপিকারের ভুলের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু গ্রন্থাকারে মুখ থেকে গ্রন্থটি পঠিতরূপে গ্রহণ করলে এ সকল ভুল বা বিকৃতির সম্ভাবনা থাকেনা।
ইহুদী খৃস্টানগণ তাঁদের ধর্মগ্রন্থ লিখতেন পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে। এতে বাইবেলের বিকৃতি সহজ হয়েছিল। ইহুদী খৃস্টান পন্ডিতগণ একযোগে স্বীকার করেন যে, প্রচলিত বাইবেলের মধ্যে লক্ষ্য লক্ষ্য বিকৃতি বিদ্যমান। যেগুলিকে তাঁরা ভুল(erratum) বা পাঠের বিভিন্নতা(various readings)বলে উল্লেখ করেন।(T.H. Horne, An Introduction to the Critical Study and Knowledge of the Holy Scriptures 2/325.; রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক ২/৫৪২)।
এই বিকৃতি ও ভুলের প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পেরেছিলেন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির বিষয়ে গুরুত্বারোপের মাধ্যমে।
আমরা আরো বুঝতে পারছি যে, হাদীস তৃতীয় শতাব্দীতে বা পরবর্তীকালে সংকলিত হয়েছে মনে করাও ভুল। মূলত প্রথম শতাব্দী থেকেই হাদীস সংকলন করা হয়েছে।পরবর্তী সংকলকগণ তাঁদের গ্রন্থ পূর্ববর্তী সংকলকদের সংকলিত পুস্তকগুলি সংকলিত করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণ কখনোই হাদীস বর্ণনার তথ্য সূত্র হিসেবে পান্ডুলিপির উল্লেখ করেননি। বরং পান্ডুলিপির পাশাপাশি মৌখিক বর্ণনা ও শ্রুতির উপর তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

১.৪.৪. ব্যক্তিগত সততা যাচাই
বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসকে হাদীসের নামে কথিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা থেকে পৃথক করার জন্য মুহাদ্দিসগণের দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল সনদে উল্লেখিত সকল ‘রাবী’র ব্যক্তিগত তথ্যাদি সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তিগত সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। এ বিষয়ে তাঁরা নিজেরা ‘রাবী’র কর্ম পর্যবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনে সমকালীন আলিম, মুহাদ্দিস ও শিক্ষার্থীগণকে প্রশ্ন করতেন।
সাহাবীগণের সমকালীন ১ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী আবুল আলিফী রুফাই ইবনু মিহরান(৯০ হি) বলেনঃ কোনো স্থানে কোনো ব্যক্তি হাদীস বলেন বা শিক্ষাদান করেন জানলে আমি হাদীস সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার নিকট গমন করতাম। সেখানে যেয়ে আমি তার সালাত পর্যবেক্ষণ করতাম। যদি দেখতাম, তিনি সুন্দর ও পূর্ণরূপে সালাত প্রতিষ্ঠা করছেন তবে আমি তার নিকট অবস্থান করতাম এবং তার নিকট হতে হাদীস লিখতাম। আর যদি তার সালাতের বিষয়ে অবহেলা দেখতাম তবে আমি তার নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা না করেই ফিরে আসতাম। আমি বলতামঃ যে সালাতে অবহেলা করতে পারে সে অন্য বিষয়ে বেশি অবহেলা করবে।(ইবনু হাদী, আল-কামিল ১/১৩২)।
তাঁরা শুধু হাদীস বর্ণনাকারীর বাহ্যিক কর্মই দেখতেননা, তার আচরণ, আখলাক, সততা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদিও জানার চেষ্টা করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আসিম ইবনু সুলাইমান আল আহওয়াল(১৪০ হি) বলেন, আমি আবুল আলিয়া(৯০ হি) কে বলতে শুনেছি, তোমরা (দ্বিতীয় শতকের তাবিয়ীগণ) তোমাদের পূর্ববর্তীদের চেয়ে সালাম সিয়াম বেশি পালন কর বটে, কিন্তু মিথ্যা তোমাদের জিহবায় প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। (ইবনু আদী, আল কামিল ১/১৩৩)।
এছাড়া উক্ত রাবীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তার পান্ডুলিপির সাথে মুখের বর্ণনা মিলিয়ে তাঁর সততা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। নিজেদেরকে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মূলত সমকালীন আলিমদের মতামতের মাধ্যমে তারা রাবীর সত্যতা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন। ইয়াহইয়া ইবনু মুগীরাহ(২৫৩ হি) বলেনঃ আমি প্রখ্যাত তাবি তাবিয়ী জারীর ইবনুল আবদুল হামিদ(১৮৮ হি)কে তার ভাই আনাস ইবনুল আবদুল হামিদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেনঃ তার হাদীস লিখবেনা; কারণ সে মানুষের সাথে কথাবার্তায় মিথ্যা কথা বলে। সে হিশাম ইবনু উরওয়াহ, উবাইদুল্লাহ ইবনু উমার প্রমুখ মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিখেছে। কিন্তু যেহেতু মানুষের সাথে কথাবার্তায় তার মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে সেহেতু তার হাদীস গ্রহণ করবেনা।(ইবনু আবু হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ২/২৮৯)।
তবে সর্বাবস্থায় তাঁদের মূল সিদ্ধান্তের ভিত্তি হতো ব্যক্তির প্রদত্ত তথ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষা। এজন্য অগণিত ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, একজন মুহাদ্দিস কোনো একজন রাবী সম্পর্কে অনেক প্রশংসা শুনে কেবল ভক্তি ও আগ্রহ সহকারে তার নিকট হাদীস শিখতে গিয়েছেন। কিন্তু যখনই তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা ও ভুল দেখতে পেয়েছেন তখনই সে ব্যক্তির বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত পাল্টে গিয়েছে।

আবদুল্লাহ ইবনুল মুহাররির আল জাযারী ২য় শতকের একজন আলিম ও বুযুর্গ ছিলেন। খলীফা মানসূরের শাসনামলে(১৩৬-১৫৮ হি) তিনি বিচারকের দায়িত্বও পালন করেন। তবে তিনি হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত দূর্বল ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক(১৮১ হি)বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবনু মুহাররিকের নেক আমল, বুজুর্গী ও প্রসিদ্ধির কথা শুনে আমার মনে তার প্রতি এত ভক্তি জন্মেছিল যে, আমাকে যদি এখতিয়ার দেয়া হতো যে, তুমি জান্নাতে যাবে অথবা আবদুল্লাহ ইবনুল মুহাররিকের সাথে সাক্ষাত করবে, তাহলে আমি তার সাথে সাক্ষাতের পর জান্নাতে যেতে চেতাম। কিন্তু যখন আমি তার সাথে সাক্ষাত করলাম তখন তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে মিথ্যার ছড়াছড়ি দেখে আমার মনের সব ভক্তি উবে গেল। ছাগলের শুকনা লাদিও আমার কাছে তার চেয়ে বেশি প্রিয়।(ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১৩২)।

১.৪.৫. সাহাবীগণের সততা
এভাবে প্রতিটি হাদীস বর্ণনাকারীর ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ ব্যক্তিগত সততা ও বর্ণনার যথার্থতা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে নিরীক্ষা ও যাচাই করেছেন। ‘রাবী’র ব্যক্তিগত প্রসিদ্ধি, যশ, খ্যাতি ইত্যাদি কোনো কিছুই তাঁদেরকে এই যাচাই ও নিরীক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পাব যে, যাচাই ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে অনেক দেশবরেণ্য সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিকেও তাঁরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন সাহাবীগণ। একমাত্র সাহাবীগণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ ব্যক্তিগত সততা ও বিশ্বস্ততা নিরীক্ষা করেননি। তাঁরা সকল সাহাবীকে ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ বলে মেনে নিয়েছেন।
ইহুদী খৃস্টান পন্ডিতগণ ও শিয়াগণ মুহাদ্দিসগণের এ মূলনীতির সমালোচনা করেন। তাঁরা সাহাবীগণের সততায় বিশ্বাস করতেননা। বরং তারা সাহাবীগণকেই জালিয়াত বলে অভিযুক্ত করেন।
সাহাবীগণের সততা ও বিশ্বস্ততা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তাঁদের সততার বিষয়ে হাদীসের নির্দেশনাও আমি এখানে আলোচনা করব না। আমি এখানে যুক্তি, বিবেক ও কুরআনের আলোকে সাহাবীগণের সততার বিষয়টি আলোচনা করব।
(১) মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ সাহাবীগণের বিষয়ে মূলত ‘বিশ্বজনীন’ মানবীয় মূলনীতির ভিত্তিতে কাজ করেছেন। বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃত মূলনীতি হলো, যতক্ষণ না কোনো মানুষের বিষয়ে মিথ্যাচার প্রমাণিত হবে, ততক্ষণ তাকে ‘সত্যবাদী’ বলে গণ্য করতে হবে এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। ‘তার সাথে তার ভাইয়ের মামলা বা শত্রুতা আছে’ এই অভিযোগে অন্যান্য ক্ষেত্রে তার বর্ণিত সংবাদ বা তথ্য বাতিল করা যায়না। মুসলিম উম্মাহ এই নীতির ভিত্তিতেই সাহাবীগণের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ পরস্পরে যুদ্ধ করেছেন, বিভিন্ন বিরোধিতা ও জাগতিক সমস্যায় পড়েছেন, কিন্তু কখনো কোনোভাবে প্রমাণিত হয়নি যে, তাঁদের মধ্য থেকে কেউ কোনো অবস্থাতে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলেছেন। সাহাবীদের বিরুদ্ধে যারা বিষোদগার করেন, তাঁরা একটিও প্রমাণ পেশ করতে পারেননি যে, অমুক ঘটনায় অমুক সাহাবী হাদীসের নামে মিথ্যা বলেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ইতিহাসে সাহাবীদের বিরুদ্ধে অনেক কথা লিখিত রয়েছে। কিন্তু তাঁরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলেছেন বলে কোনো তথ্য প্রমাণিত হয়নি। কাজেই তাঁদের দেওয়া তথ্য গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো সাধারণ সন্দেহের ভিত্তিতে, হয়ত তিনি মিথ্যা বলেছেন এই ধারণার উপরে কারো সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করা যায়না।
(২) আমরা দেখেছি যে, সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণ ও বিচারের সময় তা নিরীক্ষা করতেন। অন্যান্য সাহাবীর বর্ণনা তাঁরা অনেক সময় যাচাই করেছেন। একটি ঘটনাতেও কারো ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা বা জালিয়াতি ধরা পড়েনি। বরং সাহাবীগণের সত্যবাদিতা, সততা ও এক্ষেত্রে তাঁদের আপোসহীনতা ইতিহাসখ্যাত। হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতা ছিল অতুলনীয়।
(৩) যে কোনো ধর্ম প্রচারক বা মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতার মত ও পরিচয় তাঁর সহচরদের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। এজন্য সকল ধর্মেই নবী, রাসূল বা ধর্ম প্রবর্তকদের সহচরদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। এদের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনোভাবেই নবী বা রাসূলের বাণী, বাক্য ও আদর্শ জানা সম্ভব নয়। সাহাবীগণের প্রতি সন্দেহ ও অনাস্থার অর্থই হলো রাসূলুল্লাহ(স)কে অস্বীকার করা এবং ইসলামকে ব্যবহারিক জীবন থেকে মুছে দেয়া। কারণ কুরআন, হাদীস বা ইসলাম সবই আমরা এ সকল সাহাবীর মাধ্যমে লাভ করেছি।
(৪) সাহাবীগণের সততায় অবিশ্বাস করার অর্থ রাসূলুল্লাহ(স) এর নব্যুয়ত অস্বীকার করা। যারা মনে করেন যে, অধিকাংশ সাহাবীই স্বার্থপর, অবিশ্বাসী বা ধর্মত্যাগী ছিলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে মনে করেন যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(স) একজন ব্যর্থ নবী ছিলেন(নাউজুবিল্লাহ)। লক্ষ মানুষের সমাজে অজ্ঞাত অখ্যাত দুই চারজন মুনাফিক থাকা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহচর্যে থেকেছেন এবং সাহাবী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তাঁদেরকেও যদি কেউ প্রবঞ্চক বলে দাবি করেন, তবে তিনি মূলত রাসূলুল্লাহ(স)এর ব্যর্থতার দাবি করেছেন।
একজন ধর্মপ্রচারক যদি নিজের সহচরদের হৃদয়গুলিকে ধার্মিক বানাতে না পারেন, তবে তিনি কিভাবে অন্যদেরকে ধার্মিক বানাবেন! তাঁর আদর্শ শুনে, ব্যবহারিকভাবে বাস্তবায়িত দেখে ও তাঁর সাহচর্য্ থেকেও যদি মানুষ ‘সততা’ অর্জন করতে না পারে, তবে শুধু সেই আদর্শ শুনে পরবর্তী মানুষদের সততা অর্জনের কল্পনা বাতুলতা মাত্র।
আজ যিনি মনে করেন যে, কুরআন পড়ে তিনি সততা শিখেছেন, অথচ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) এর কাছে কুরআন পড়ে, জীবন্ত কুরআনের সাহচর্যে থেকেও আবু হুরাইরা সততা শিখতে পারেননি, তিনি মূলত নবী মুহাম্মাদ(স)এর নব্যুয়তকেই অস্বীকার করেন। মানবীয় দুর্বলতা, ক্রোধ, দলাদলি ইত্যাদি এক বিষয় আর প্রবঞ্চনা বা জালিয়াতি অন্য বিষয়। ধর্মের নামে জালিয়াতি আরো অনেক কঠিন বিষয়। কোনো ধর্ম প্রবর্তক যদি তাঁর অনুসারীদের এই কঠিনতম পাপের পঙ্কিলতা থেকে বের করতে না পারেন, তবে তাকে কোনোভাবেই সফল বলা যায়না। কোনো স্কুলের সফলতা যেমন স্কুলের ছাত্রদের পাশের হারের উপর নির্ভর করে, তেমনি ধর্মপ্রচারকের সফলতা নির্ভর করে তার সাহচর্য্ প্রাপ্তদের ধার্মিকতার উপর।
(৫) সর্বোপরি কুরআনে বিশ্বাসী কোনো মুসলমান কখনোই সাহাবীদের সততায় সন্দেহ করতে পারেননা। কুরআনে বারংবার সাহাবীদের ধার্মিকতার সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ক অল্প কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি।
মহিমাময় আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ আরবী(*********)
-“মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এ মহাসাফল্য।(সূরা ৯ তাওবাঃ ১০০)।
এখানে সাহাবীগণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, প্রথম অগ্রগামী মুহাজিরগণ, দ্বিতীয়ত, প্রথম অগ্রগামী আনসারগণ এবং তৃতীয়ত তাঁদেরকে যারা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন। প্রথম দুই পর্যায়ের সাহাবীগণকে সফলতার মাপকাঠি ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকাংশ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী এই দুইভাগের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআন কারীমে অন্যান্য অনেক স্থানে সকল মুহাজির ও সকল আনসারকে ‘প্রকৃত মুমিন’ ও জান্নাতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।(সূরা আনফাল:৭২,৭৪ আয়াত, সূরা হাশর: ৮,৯,১০ আয়াত)।
হুদাইবিয়ার প্রান্তরে ‘বাইয়াতে রেদওয়ান’ সম্পর্কে এরশাদ করা হয়েছেঃ
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا [٤٨:١٨]
“মুমিনগণ যখন বৃক্ষতলে আপনার নিকট ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করল, তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।”(সূরা ৪৮ ফাতহঃ১৮)।
হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সকল সাহাবীই এই ‘বাইয়াতে’ অংশগ্রহণ করেছিলেন। একজন মুনাফিকও এতে অংশ নেয়নি।
তাবূকের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সাহাবীর প্রশংসায় এরশাদ হচ্ছেঃ
لَٰكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ [٩:٨٨]
“কিন্তু রাসূল এবং যারা তার সঙ্গে ঈমান এনেছে, তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে; তাদের জন্যই কল্যাণ আছে এবং তারাই সফলকাম।”(সূরা ৯ তাওবাঃ৮৮)।

হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সকল সাহাবীই এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একজন মুনাফিকও এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। রাসূলুল্লাহ(স)এর সকল সাহাবীর ঢালাও প্রশংসা করে ও তাঁদের ধার্মিকতা, সততা ও বিশ্বস্ততার ‘ঢালাও’ ঘোষণা দিয়ে এরশাদ করা হয়েছেঃ
وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ ۚ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ [٤٩:٧]
“কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। তিনি কুফরী, পাপ ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী।”(সূরা: ৪৯ হুজুরাতঃ ৭)।
অন্যত্র মক্কা বিজয়ের পূর্বে ও পরে ইসলামগ্রহণকারী উভয় প্রকারের সাহাবীগণকে ‘ঢালাওভাবে’ কল্যাণ বা জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ [٥٧:١٠]
“তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে, তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে, যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে এবং সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ উভয়েরই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”(সূরা ৫৭ হাদীসঃ ১০)।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সাহাবীগণ সকলেই মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং সংগ্রাম করেছেন।
সাহাবীগণের প্রশংসায়, তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, ঈমান ও জান্নাতের সাক্ষ্য সম্বলিত আরো অনেক আয়াত কুরআন কারীমে রয়েছে।

হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ সাহাবীগণের মধ্যে রয়েছেন আবু হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবনু উমার, আনাস ইবনু মালিক, আয়েশা, আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ, আবু সাঈদ খুদরী, আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আবদুল্লাহ ইবনু আমর, আলী ইবনু আবু তালিব, উমার ইবনুল খাত্তাব, উম্মু সালামাহ, আবূ মূসা আশ‘আরী, বারা ইবনু আযিব, আবূ যার গিফারী, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস, আবূ উমামা বাহিলী, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান, সাহল ইবনু সাদ, উবাদা ইবনুস সামিত, ইমরান ইবনুল হুসাইয়িন, আবূ দারদা, আবূ কাতাদা, আবূ বকর সিদ্দীক, উবাই ইবনু কা’ব মু‘আয ইবনু জাবাল, উসমান ইবনু আফফান প্রমুখ প্রসিদ্ধ সাহাবী।
তাঁরা সকলেই ছিলেন রাসূলুল্লাহ(স) এর প্রসিদ্ধ সহচর, মক্কা বিজয়ের আগে ইসলাম গ্রহণকারী, তাবূক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, বাইয়াতে রেদোয়ানে অংশগ্রহণকারী বা প্রথম অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার।
কুরআন যাকে সৎ, ঈমানদার ও সফলকাম বলে সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং কুরআন যার জন্য কল্যাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করছে তার সততার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার অর্থ কুরআনের সাক্ষ্য অস্বীকার করা।

১.৪.৬. তুলনামূলক নিরীক্ষা
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয় কিংবা বিশুদ্ধ হাদীসকে অশুদ্ধ হাদীস থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের অন্যতম পদ্ধতি ছিল সার্বিক নিরীক্ষা(Cross Examine)। এক্ষেত্রে মূলত তাঁরা সাহাবীগণের কর্মধারার অনুসরণ করেছেন।
১.৪.৬.১. তুলনামূলক নিরীক্ষার মূল প্রক্রিয়া
হযরত আবু হুরাইরা(রা)একজন সাহাবী। অনেক তাবিয়ী তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। এদের মধ্যে অনেক তাবিয়ী দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে থেকেছেন এবং অনেকে অল্প দিন থেকেছেন। কোনো সাহাবী বা মুহাদ্দিস একেক ছাত্রকে একেকটি হাদীস শিখাতেননা। তাঁরা তাঁদের নিকট সংগৃহীত হাদীসগুলি সকল ছাত্রকেই শিক্ষা দিতেন। ফলে সাধারণভাবে আবূ হুরাইরা(রা)বর্ণিত সকল হাদীসই তাঁর অধিকাংশ ছাত্র শুনেছেন। তাঁরা একই হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ আবু হুরাইরার(রা)সকল ছাত্রের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও সংকলিত করে সেগুলি পরস্পরের সাথে মিলিয়ে নিরীক্ষা করেছেন।
যদি দেখা যায় যে, ৩০ জন তাবেয়ী একটি হাদীস আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে ২০/২৫ জন হাদীসটি আবু হুরাইরা যে শব্দে বলেছেন হুবহু সেই শব্দে মুখস্ত ও লিপিবদ্ধ করেছেন। আর বাকী কয়জন হাদীসটি ঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে পারেননি। এতে তাদের মুখস্ত ও ধারণ শক্তির দূর্বলতা প্রমাণিত হল।
যদি আবু হুরাইরার কোনো ছাত্র তাঁর নিকট হতে ১০০টি হাদীস শিক্ষা করে বর্ণনা করেন এবং তন্মধ্যে সবকয়টি বা অধিকাংশ হাদীসই তিনি এভাবে হুবহু মুখস্ত রেখে বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করতে পারেন তাহলে তা তার গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। অপরদিকে যদি এরূপ কোন তাবেয়ী ১০০টি হাদীসের মধ্যে অধিকাংশ হাদীসই এরূপভাবে বর্ণনা করেন যে, তার বর্ণনা অন্যান্য তাবেয়ীর বর্ণনার সাথে মেলেনা তাহলে বুঝা যাবে যে তিনি হাদীস ঠিকমত লিখতেননা ও মুখস্ত রাখতে পারতেননা। এই বর্ণনাকারী তাঁর গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। তিনি ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল রাবী বলে চিহ্নিত হন।
ভুলের পরিমাণ ও মাত্রার উপর নির্ভর করে দুর্বলতার মাত্রা বুঝা যায়। যদি তার কর্মজীবন ও তার বর্ণিত এ সকল উল্টা পাল্টা হাদীসের কারণে প্রমাণিত হতো যে তিনি ইচ্ছাপূর্বক রাসূলুল্লাহ(স)থেকে বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশি কম করেছেন অথবা ইচ্ছাপূর্বক হাদীসের নামে বানোয়াট কথা বলেছেন তাহলে তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ রাবী বলে চিহ্নিত করা হতো। যে হাদীস শুধুমাত্র এই ধরণের মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারী একাই বর্ণনা করেছেন সেই হাদীসকে কোনো অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা হিসেবে গ্রহণ করা হতোনা। বরং তাকে মিথ্যা বা ‘মাউযূ’ হাদীস বলে চিহ্নিত করা হতো।
অনেক সময় দেখা যায় যে, আবু হুরাইরার(রা) কোনো ছাত্র এমন একটি বা একাধিক হাদীস বলছেন যা অন্য কোনো ছাত্র বলছেননা। এক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে নিরীক্ষা করেছেন। যদি দেখা যায় যে, উক্ত তাবিয়ী ছাত্র আবূ হুরাইরার সাহচর্যে অন্যদের চেয়ে বেশি ছিলেন, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ হাদীস তিনি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ ও মুখস্ত রাখতেন বলে নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁর সততা ও ধার্মিকতা সবাই স্বীকার করেছেন, সে ক্ষেত্রে তার বর্ণিত অতিরিক্ত হাদীসগুলিকে সহীহ(বিশুদ্ধ) বা হাসান(সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য) হাদীস হিসেবে গ্রহণ করা হতো।
আর যদি উপরোক্ত তুলনামূলক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হতো যে তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে অধিকাংশ হাদীস বা অনেক হাদীস গ্রহণযোগ্য রাবীদের সাথে কম বেশি অসামঞ্জস্যপূর্ণ তবে তার বর্ণিত এই অতিরিক্ত হাদীসটিও উপরের নিয়মে দুর্বল ও মিথ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
সাধারণত একজন তাবেয়ী একজন সাহাবী থেকেই হাদীস শিখেতেননা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক তাবেয়ী চেষ্টা করতেন যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক সাহাবীর নিকট হতে হাদীস শিখতে। এজন্য তাঁরা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের যে শহরেই কোনো সাহাবী বাস করতেন সেখানেই গমন করতেন। মুহাদ্দিসগণ উপরের নিয়মে সকল সাহাবীর হাদীস, তাদের থেকে সকল তাবেয়ীর হাদীস, তাঁদের থেকে বর্ণিত তাবে তাবেয়ীগণের হাদীস একত্রিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে ও বর্ণনাকারীগণের ব্যক্তিগত জীবন, সততা, ধার্মিকতা ইত্যাদির আলোকে হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপন করতেন।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ রাসূলুল্লাহ(স)এর নামে কথিত সকল হাদীস সংকলিত করেছেন। অপরদিকে ‘রাবী’গণের বর্ণনার তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের বর্ণনার সত্যাসত্য নির্ধারণ করে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। (জারহ তাদীল বিষয়ক সকল গ্রন্থেই এ বিষয়ক বিবরণাদি সংকলিত রয়েছে। বিশেষভাবে দেখুন: মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, কিতাবুত তাময়ীয, ইবনু আদী, আল কামিল ফী দু’আফাইর রিজাল, ড. মুহাম্মাদ মুসতাফা আ’যামী, মানহাজুন নাকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন।)
ইমাম তিরমিযী আবু ইসা মুহাম্মাদ ইবনু ইসা(২৭৫ হি) বলেন, আমাদেরকে আলী ইবনু হুজর বলেছেন, আমাদেরকে হাফস ইবনু সুলাইমান বলেছেন, তিনি কাসীর ইবনু যাযান থেকে, তিনি আসীর ইবনু দামুরাহ থেকে, তিনি আলী ইবনু আবু তালিব থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, মুখস্ত করবে, কুরআনের হালালকে হালাল হিসেবে পালন করবে ও হারামকে হারাম হিসেবে বর্জন করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার পরিবারের দশ ব্যক্তির বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের প্রত্যেকের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।”
হাদীসটি এভাবে সংকলিত করার পর ইমাম তিরমিযী হাদীসটির দুর্বলতা ও অগ্রহণযোগ্যতার কথা উল্লেখ করে বলেনঃ এই হাদীসটি গরীব(দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য)। এই একটিমাত্র সূত্র ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটি জানা যায়না। এর সনদ সহীহ নয়। হাফস ইবনু সুলাইমান(১৮০ হি) হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল।
ইমাম তিরমিযীর এই মতামত তাঁর ও দীর্ঘ তিন শতকের অগণিত মুহাদ্দিসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রদত্ত। তাঁদের নিরীক্ষার সংক্ষিপ্ত পর্যায়গুলি নিম্নরূপঃ
১. তাঁরা হাফস ইবনু সুলাইমান বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
২. হাফস যে সকল শিক্ষকের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের অন্যান্য ছাত্র বা হাফসের ‘সহপাঠী’ রাবীদের বর্ণনা সংগ্রহ করে তাঁদের বর্ণনার সাথে তার বর্ণনার তুলনা করেছেন।
৩. এই হাদীসে হাফসের উস্তাদ কাসীর ইবনু যাযানের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে হাফসের বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
৪. কাসীরের ওস্তাদ আসিম ইবনু দামিরাহ বর্ণিত সকল হাদীস তার অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে সংগ্রহ করে হাফসের এই বর্ণনার সাথে তুলনা করেছেন।
৫. আলী(রা) এর অন্যান্য ছাত্রদের সূত্রে বর্ণিত সকল হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন।
৬. আলী(রা) ছাড়া অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীসের সাথে এই বর্ণনার তুলনা করেছেন।
এই নিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেনঃ
ক. এই হাদীসটি এই একটিমাত্র সূ্ত্র ছাড়া কোনো সূত্রে বর্ণিত হয়নি। অন্য কোনো সাহাবী থেকে কেউ বর্ণনা করেননি। আলীর অন্য কোনো ছাত্র হাদীসটি আলী থেকে বর্ণনা করেননি। আসিমের অন্য কোনো ছাত্র তা তার থেকে বর্ণনা করেননি। কাসীরের অন্য কোনো ছাত্র তা বর্ণনা করেননি।
এভাবে তাঁরা দেখেছেন যে দ্বিতীয় হিজরীর শেষ প্রান্তে এসে হাফস ইবনু সুলাইমান দাবী করেছেন যে, এই হাদীসটি তিনি এই সূত্রে শুনেছেন। তাঁর দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য কোনো সাক্ষী পাওয়া গেলনা।
খ. এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাদীসটি গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। কারণ সাধারণভাবে এরূপ ঘটেনা যে, আলী(রা) বর্ণিত একটি হাদীস তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আসীম ছাড়া কেউ জানবেননা। আবার আসিম একটি হাদীস শেখাবেন তা একমাত্র যাযান ছাড়া কেউ জানবেননা। আবার যাযান একটি হাদীস শেখাবেন তা হাফস ছাড়া কেউ জানবেননা।
গ. এখন দেখতে হবে যে, হাফস বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের অবস্থা কি? মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, হাফস তার ওস্তাদ যাযান ও অন্যান্য সকল উস্তাদের সূত্রে যত হাদীস বর্ণনা করেছেন প্রায় সবই ভুলে ভরা। এজন্য তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাফস যদিও কুরআনের বড় কারী ও আলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি হাদীস বর্ণনায় দূর্বল ছিলেন। তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না বললেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল বলতেন খুব বেশি। এজন্য তাঁরা তাকে দুর্বল ও পরিত্যক্ত গণ্য করেছেন। (মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আত-তাময়ীয পৃ. ১৬৯)।
হাদীস বর্ণনাকারী বা ‘রাবী’র বর্ণনার যথার্থতা নির্ণয়ের এই সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনেকেই বুঝতে পারেননা।ফলে মুহাদ্দিস যখন কোনো ‘রাবী’ বা হাদীসের বিষয়ে বিধান প্রদান করেন তখন তারা অবাক হয়েছেন বা আপত্তি করেছেন। কেউ বলেছেন, এ হলো রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বিচারের ধৃষ্টতা। কেউ বলেছেনঃ এ হলো অকারণে, না জেনে বা আন্দাজে নেককার মানুষদের সমালোচনা। বর্তমান যুগেই নয়, ইসলামের প্রথম যুগগুলিতেও অনেক মানুষ এই ধারণা পোষণ করতেন। (মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, আত-তাময়ীয, ১৬৯)।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, ‘রাবী’ ও ‘হাদীসের’ সমালোচনায় হাদীসের ইমামগণের সকল বিধান ও হাদীস বিষয়ক মতামত এই নিরীক্ষার ভিত্তিতে। কোনো মুহাদ্দিস যখন কোনো রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন যে, তিনিঃ নির্ভরযোগ্য, পরিপূর্ণ মুখস্তকারী, মুখস্তকারী, সত্যপরায়ণ, চলনসই, দুর্বল, অনেক ভুল করেন, আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী, হাদীস বানোয়াটকারী ইত্যাদি তখন বুঝতে হবে যে, তার এই ‘সংক্ষিপ্ত মতামতটি’ তার আজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম, হাদীস সংগ্রহ ও তুলনামূলক নিরীক্ষার ফল।
অনুরূপভাবে যখন তিনি কোনো হাদীসের বিষয়ে বলেনঃ হাদীসটি সহীহ, যয়ীফ, আপত্তিকর, বানোয়াট, মুরলাস, সহীহ হলো যে হাদীসটি সাহাবীর বাণী………..ইত্যাদি তাহলেও আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি তাঁর আজীবনের সাধনার নির্যাস আমাদেরকে দান করলেন।
এভাবে আমরা মুহাদ্দিসগণের কর্মধারা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এবার আমরা এই কর্মধারার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি আলোচনা করব।

১.৪.৬.২. নিরীক্ষামূলক প্রশ্নাবলী
মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের মাধ্যমে রাবীর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা যাচাই করার চেষ্টা করতেন। এ বিষয়ক ২/১টি ঘটনা দেখুনঃ
১. দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন তাবেয়ী উফাইর ইবনু মা’দান বলেনঃ “উমর ইবনু মুসা আল ওয়াজিহী আমাদের নিকট হিমস শহরে আগমন করেন। আমরা হিমসের মসজিদে তার নিকট(হাদীস শিক্ষার্থে) সমবেত হই। তিনি বলতে থাকেনঃ আপনাদের নেককার শাইখ আমাদেরকে হাদীস বলেছেন। আমরা বললামঃ নেককার শাইখ বলতে কাকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেনঃ খালিদ ইবনু মাদান। আমি বললামঃ আপনি কত সনে তাঁর নিকট হাদীস শুনেছেন। তিনি বললেনঃ আমি ১০৮ হিজরীতে তাঁর নিকট হাদীস শিক্ষা করি। আমি বললামঃ কোথায় আপনার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। তিনি বলেনঃ আরমিনিয়ায় যুদ্ধের সময়। আমি বললামঃ আপনি আল্লাহকে ভয় করুন এবং মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকুন। খালিদ ইবনু মা’দান ১০৪ হিজরী সনে মৃত্যু বরণ করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর মৃত্যুর ৪ বছর পরে আপনি তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। অপরদিকে তিনি কখনোই আরমিনিয়ায় যুদ্ধে যাননি। তিনি শুধুমাত্র বাইযান্টাইন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।(ইবনু আবু হাতীম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ৬/১৩৩, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৫/২১৭)।
এভাবে এই রাবীর মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যক্ত ও মিথ্যাবাদী ‘রাবী’রূপে চিহ্নিত করেছেন। আবু হাতেম রাযী বলেনঃ উমর ইবনু মূসা পরিত্যক্ত, সে মিথ্যা হাদীস তৈরি করত। বুখারী বলেনঃ তার বর্ণিত হাদীস আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য। ইবনু মাঈন বলেনঃ লোকটি নির্ভরযোগ্য নয়। ইবনু আদী বলেনঃ লোকটি বানোয়াটভাবে হাদীসের সনদ ও মতন তৈরি করত। দারাকুতনী, নাসাঈ প্রমূখ মুহাদ্দিস বলেনঃ সে পরিত্যক্ত। (প্রাগুক্ত)।
২. আবুল ওয়ালীদ তাইয়ালিসী হিশাম ইবনু আবদুল মালিক(২২৭ হি) বলেনঃ “আমি আমির ইবনু আবী আমের আল খাযযায এর নিকট থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছিলাম। একদিন হাদীসের সনদে তিনি বললেনঃ ‘আমাদেরকে আতা ইবনু আবু রাবাহ(১১৪ হি) বলেছেন’। আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি কত সালে আতা থেকে হাদীস শুনেছেন? তিনি বললেনঃ ১২৪ হিজরী সালে। আমি বললামঃ আতা তো ১১৩/১১৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন।”
এভাবে তাঁর বর্ণনায় মিথ্যা ধরা পড়ে। এই মিথ্যা ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। ইমাম যাহাবী(৭৪৮ হি) বলেনঃ যদি তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একথা বলে থাকেন তাহলে তিনি একজন মিথ্যাবাদী ও বানোয়াট হাদীস বর্ণনাকারী। আর যদি তিনি ভুলক্রমে আতা ইবনুস সাইব(১৩৬ হি) নামের অন্য তাবিয়ীকে আতা ইবনু আবু রাবাহ বলে ভুল করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে যে, তিনি একজন অত্যন্ত অসতর্ক, জাহিল ও পরিত্যাজ্জ রাবী।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৪/১৮)।
৩. প্রথম হিজরী শতকের একজন রাবী সুহাইল ইবনু যাকওয়ান আবু সিনদী ওয়াসিতী। তিনি আয়েশা(রা) হতে হাদীস শুনেছেন বলে দাবি করতেন। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের মাধ্যমে তার মিথ্যাচার ধরা পড়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেন, আমাদেরকে আব্বাদ বলেছেনঃ সুহাইল ইবনু যাকওয়ানকে আমরা বললামঃ আপনি কি আয়েশা(রা)কে দেখেছেন? তিনি বললেনঃ হ্যা, দেখেছি। আমরা বললাম, বলুনতো তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তিনি বলেনঃ তাঁর গায়ের রং কালো ছিল। সুহাইল আরো দাবি করেন যে, তিনি ইবরাহীম নাখেয়ীকে দেখেছেন, তাঁর চোখ দুটি ছিল বড় বড়।
সু্হাইলের এই বক্তব্য তাঁর মিথ্যাচার ধরিয়ে দিয়েছে। কারণ আয়েশা(রা) ফর্সা ছিলেন। আর ইবরাহীম নাখয়ীর চোখ নষ্ট ছিল।(ইবনউ আদী, আল কামিল ৪/৫২১-৫২২)।

১.৪.৬.৩. শব্দগত ও অর্থগত নিরীক্ষা
হাদীসের সংগ্রহ ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের শব্দ, বাক্য বিন্যাস ও অর্থের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। বর্ণিত হাদীসটির মধ্যে ব্যবহৃত শব্দাবলী, বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদি রাসূলুল্লাহ(স) এর ভাষা ও ভাবের সাখে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা লক্ষ্য রাখতেন। বর্ণিত হাদীসটির অর্থ মানবীয় যুক্তি, জ্ঞান, বিবেক বিরোধী কিনা, অথবা কুরআন ও হাদীসের সুপরিচিত বক্তব্যের স্পষ্ট বিরোধী কিনা তা বিবেচনা করতেন। ফলে অনেক সময় বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা প্রমাণিত হওয়া সত্বেও তাঁর বর্ণিত হাদীসকে তাঁরা মিথ্যা বা বানোয়াট বলে প্রত্যাখ্যান করতেন। পরবর্তী আলোচনায় পাঠক এ বিষয়ক অনেক উদাহরণ দেখতে পাবেন।
১.৪.৬.৪. ‘রাবী’র ওস্তাদকে প্রশ্ন করা
মুহাদ্দিসগণ কোনো রাবীর নিকট হতে হাদীস সংগ্রহের পর চেষ্টা করতেন তিনি যে ওস্তাদের সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তাঁর কাছে যেয়ে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্ণনাটি যাচাই করার। এজন্য প্রয়োজনে তাঁরা হাজার মাইল পরিভ্রমণের কষ্ট স্বীকার করতেন। উক্ত শিক্ষকের মৃত্যুর কারণে তার নিকট প্রশ্ন করা সম্ভব না হলে তাঁরা তার অন্যান্য ছাত্রের বর্ণনা সংগ্রহ করে তুলনা করতেন। এই জাতীয় একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন তাবেয়ী হাদীস বর্ণনাকারী ‘রাবী’ হাসান ইবনু উমারাহ আল বাজালী(১৫৩ হি)। তিনি বড় আলিম ও ফকীহ ছিলেন এবং কিছুদিন বাগদাদ এর বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। সমকালীন নাকীদ বা সমালোচক হাদীসের ইমামগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তার দুর্বলতা প্রমাণ করেন। এ বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, নাকিদ ও ইমাম আল্লামা শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ(১৬০ হি) বলেনঃ “হাসান ইবনু উমারাহ আমাকে ৭ টি হাদীস বলেন। তিনি বলেন যে, তিনি হাদীসগুলি হাকাম ইবনু উতাইবাহ(১১৩ হি) এর নিকট হতে শুনেছেন, তিনি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে শুনেছেন। আমি হাকাম ইবনু উতাইবাহ এর সাথে সাক্ষাত করে সেগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেনঃ এগুলির মধ্যে একটি হাদীসও আমি বলিনি। (ইবনু আদী, আল কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ২/২৮৩)।
আবু দাউদ তায়ালিসী সুলাইমান ইবনু দাউদ(২০৪ হি) বলেনঃ শু’বা আমাকে বলেনঃ আমাকে হাসান ইবনু উমারাহ বলেন, আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহ বলেছেন, আবদুর রহমান ইবনু আবু লাইলা বলেছেন, আলী(রা) বলেছেনঃ “উহুদের শহীদগণকে গোসল দেওয়া হয়, কাফন পরানো হয় এবং জানাযার সালাত আদায় করা হয়।” এরপর আমি হাকামের নিকট গমন করে উহুদের শহীদগণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেনঃ তাঁদের গোসল করানো হয়নি এবং কাফন পরানো হয়নি। আমি বললামঃ তাহলে হাসান ইবনু উমারাহ যে আপনার সূত্রে এইসব কথা বর্ণনা করেছে? তিনি বলেনঃ আমি কখনোই তাকে এই হাদীস বলিনি।”(প্রাগুক্ত ২/২৮৪)।
আবু দাউদ তায়ালিসী আরো বলেনঃ আমাকে শু’বা বললেনঃ তুমি জারীর ইবনু হাযিম(১৭০ হি) এর নিকট গমন করে তাকে বলঃ আপনার জন্য হাসান ইবনু উমারাহ হতে হাদীস বর্ণনা জায়েয নয়; কারণ সে মিথ্যা বলে। তায়ালিসী বলেনঃ আপনি কিভাবে তা জানলেন? তিনি বলেনঃ তিনি আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহর সূত্রে অনেক হাদীস শুনিয়েছেন যেগুলোর কোনো ভিত্তি আমি পাইনি।
তায়ালিসী বলেনঃ আমি বললামঃ সেগুলি কি? শু’বা বলেনঃ আমি হাকামকে বললামঃ জারজ সন্তানের বিষয়ে আপনার মত কি? তিনি বলেনঃ তাদের জানাযা পড়া হবে। আমি বললামঃ এই হাদীস কার হতে বর্ণিত? হাকাম বলেনঃ হাসান বসরী থেকে বর্ণিত। অথচ হাসান ইবনু উমারাহ বলছেনঃ তাকে হাকাম হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে আলীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৩-২৪)।
এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শু’বা হাসান ইবুন উমারাহ এর বর্ণিত হাদীসগুলি তার উস্তাদের নিকট পেশ করে হাসানের বর্ণনার অযথার্থতা ও তার ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা প্রমাণ করলেন। এইরূপ অগণিত ঘটনা আমরা রিজাল গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই। মূলত মুহাদ্দিসগণের সফরের একটি বড় অংশ ব্যয় করতেন সংকলিত হাদীসসমূহ ‘রাবী’র ওস্তাদের নিকট পেশ করে সেগুলোর যথার্থতার কাজে।

১.৪.৬.৫. বিভিন্ন বর্ণনাকারীর বর্ণনার তুলনা
মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার অন্যতম দিক ছিল রাবীর সতীর্থ বা সহপাঠিগণের বর্ণনা সংগ্রহ ও তুলনা করে তার যথার্থতা নির্ণয় করা। তুলনা ও নিরীক্ষার এই প্রক্রিয়া ছিল তাঁদের সার্বক্ষণিক হাদীস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সেই হাদীসকে স্মৃতিতে সংরক্ষিত অন্যদের বর্ণিত হাদীসগুলির সাথে তুলনা করতেন। এরপর প্রয়োজন ও সুযোগ অনুসারে অন্যান্য রাবীগণকে প্রশ্ন করতেন, তাঁদের বর্ণনার সাথে এই বর্ণনার তুলনা করতেন এবং প্রয়োজন মত পান্ডুলিপির সাথে মেলাতেন।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবু দাউদ তায়ালিসী(২০৪ হি) বলেন, আমরা একদিন আমাদের উস্তাদ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের(১৬০ হি) নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় সমসাময়িক রাবী হাসান ইবনু দীনার সেখানে আগমন করেন। শু’বা তাকে বলেনঃ আপনি এখানে বসুন। তিনি বসেন এবং হাদীস থেকে বলেনঃ আমাদেরকে হামীদ ইবনু হিলাল বলেছেন, তিনি মুজাহিদ(২১-১০৪ হি) থেকে, তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবকে(২১ হি) বলতে শুনেছেন……। হাদীসটি শুনে শু’বা অবাক হয়ে বলেনঃ মুজাহিদ উমার থেকে কোনো হাদীস শুনেছেন? এ কিভাবে সম্ভব?এ সময় হাসান ইবনু দীনার উঠে চলে যান। অন্য একজন রাবী আবুল ফাদল বাহর ইবনু কুনাইয আস সাক্কা(১৬০ হি) সেখানে আগমন করেন। শু’বা তাকে বলেনঃ আবুল ফাদল, আপনি হামীদ ইবনু হিলাল থেকে কোনো হাদীস শুনেছেন? তিনি বলেন, হ্যা, শুনেছি। আমাদেরকে হামীদ ইবনু হিলাল বলেছেন, আমদেরকে বনু আদী গোত্রের আবু মুজাহিদ নামের একজন আলিম বলেছেন, তিনি উমার ইবনুল খাত্তাবকে বলতে শুনেছেন…….। তখন শু’বা বলেনঃ তাহলে এই হলো আসল বিষয়।(ইবনু আদী, আল কামিল৩/১১৭)।
হাসান ইবনু দীনার তার হাদীস বর্ণনায় ভুল করেছেন। প্রসিদ্ধ রাবী মুজাহিদের জন্ম উমার ইবনুল খাত্তাব(রা) এর শাহাদাতের দুই এক বছর পূর্বে। তিনি উমরের নিকট হতে কোনো হাদীস শুনেননি। তিনি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে রাবীর নামে ভুল করেছেন। বাহার আস সাক্কা এর বর্ণনার সাথে তুলনা করে শু’বা বুঝতে পারলেন হাসান ইবনু দীনারের ভুল কোথায়। তিনি হামীদ ইবনু হিলালের উস্তাদের নাম ঠিকমত মনে রাখতে পারেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না বললেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেন। তিনি হাদীস নির্ভুলরূপে মুখস্ত রাখতে বা বর্ণনা করতে পারেননা।
তৃতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি) মূসা ইবনু ইসমাঈল(২২৩ হি) এর নিকট গমন করে হাম্মাদ ইবনু সালামাহ ইবনু দীনারের(১৬৭ হি)বর্ণিত হাদীসগুলির পান্ডুলিপি পাঠ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মূসা বলেনঃ আপনি এই পান্ডুলিপিগুলি আর কারো কাছে শুনেননি? ইয়াহইয়া বলেনঃ আমি ইতোপূর্বে হাম্মাদের ১৭ জন ছাত্রের কাছে তাদের নিকট সংকলিত হাম্মাদের বর্ণিত হাদীসগুলির পান্ডুলিপি পড়ে শুনেছি। আপনি ১৮ তম ব্যক্তি যার কাছে আমি হাম্মাদের বর্ণিত হাদীসগুলি পড়তে চাই। মূসা বলেনঃ কেন? ইয়াহইয়া বলেনঃ কারণ হাম্মাদ ইবনু সালামাহ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুই/এক স্থানে ভুল করতেন; এজন্য আমি তার ভুল ও তার ছাত্রদের ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে চাই। যদি দেখি যে, হাম্মাদের সকল ছাত্রই একইভাবে বর্ণনা করেছেন তাহলে বুঝতে পারব যে, হাম্মাদ এভাবেই বলেছেন এবং এক্ষেত্রে ভুল হলে তা হাম্মাদেরই ভুল। আর যদি দেখি যে, ছাত্রদের বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে তাহলে বুঝতে পারব যে, এক্ষেত্রে ভুল ছাত্রের নিজের।এভাবে আমি হাম্মাদের নিজের ভুল এবং তাঁর ছাত্রদের ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব।(যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৭/৪৫৬)।
মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষার অগণিত উদাহরণ ও ব্যাখ্যা ইমাম মুসলিম বিস্তারিতভাবে তার ‘আত-তাময়ীয’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাষায় একটি উদাহরণ এখানে পেশ করছি। তিনি বলেনঃ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুল হাদীসের সনদে বা মতনে হতে পারে। মতনে ভুলের একটি উদাহরণ। আমাকে হাসান হুলওয়ানী ও আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ দারিমী বলেছেন, আমাদেরকে কাসীর ইবনু যায়ীদ বলেছেন, আমাদেরকে ইয়াযীদ ইবুন আবী যিয়াদ বলেছেন, কুরাইব ইবনু আবী মুসলিম(৯৮ হি)থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস থেকে, তিনি বলেনঃ আমি আমার খালা(নবী পত্নী)মাইমুনার ঘরে রাত্রি যাপন করি। …রাসূলুল্লাহ(স) রাত্রে উঠে ওযূ করে (তাহাজ্জুদের) সালাতে দাঁড়ান। তখন আমি তাঁর ডান পার্শ্বে দাঁড়াই। তিনি আমাকে ধরে তাঁর বাম পার্শে দাঁড় করিয়ে দেন।……”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এই হাদীসটি ভুল। কারণ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ সহীহ বর্ণনায় এর বিপরীত কথা বর্ণনা করেছেন। তারা উল্লেখ করেছেন যে, ইবনু আব্বাস রাসূলুল্লাহ(স) এর বামে দাঁড়িয়েছিলেন এরপর তিনি তাকে তাঁর ডানদিকে দাঁড় করিয়ে দেন। …..আমি এখানে কুরাইব ইবনু আবু মুসলিম থেকে তাঁর অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা এবং এরপর ইবনু আব্বাস থেকে ইবনু আব্বাসের অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা উল্লেখ করব, যারা কুরাইবের সতীর্থ ছিলেন এবং তাঁরই অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
১. আমাদেরকে ইবনু আবী উমর বলেন, আমাদেরকে সুফিয়ান সাওরী বলেছেন, আমর ইবনু দীনার থেকে, কুরাইব থেকে ইবনু আব্বাস থেকে, তিনি মাইমূনার গৃহে রাত্রি যাপন করেন। রাসূলুল্লাহ(স) রাত্রে উঠে ওযু করে সালাতে দাঁড়ান। ইবনু আব্বাস বলেনঃ আমি তখন উঠে রাসূলুল্লাহ(স) যেভাবে নামায পড়েন সেভাবে ওযু করে তাঁর নিকট আগমন করি এবং তাঁর বামে দাঁড়াই। তিনি তখন আমাকে তাঁর ডান দিকে দাঁড় করিয়ে দেন।
২. মাখরাহ ইবনু সুলাইমান কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে বর্ণনা করেছেন।
৩. সালামা ইবনু কুহাইল কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে।
৪. সালিস ইবনু আবীল জা’দ কুরাইব থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে অনুরূপভাবে।
৫. হুশাইম আবু বিশর থেকে সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে ইবনু আব্বাস থেকে।
৬. আইয়ুব সাখতিয়ানী, আবদুল্লাহ ইবনু সাঈদ জুবাইর থেকে, তার পিতা সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
৭. হাকাম ইবনু উতাইবাহ সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে।
৮. ইবনু জুরাইজ আতা ইবনু আবী রাবাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
৯. কাইস ইবনু সাঈদ আতা ইবনু আবী রাবাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
১০. আবু নাদরাহ(মুনযির ইবনু মালিক)ইবনু আব্বাস থেকে।
১১. শা’বী ইবনু আব্বাস থেকে।
১২. তাঊস ইকারামাহ থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে।
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এভাবে কুরাইব থেকে এবং ইবনু আব্বাসের অন্যান্য ছাত্রদের থেকে সহীহ বর্ণনায় প্রমাণিত হলো যে, রাসূলুল্লাহ(স) ইবনু আব্বাসকে তাঁর বামে দাঁড় করিয়েছিলেন বলে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে ভুল। (মুসলিম, আত-তাময়ীয, পৃ. ৬২-৬৩)।
পাঠক, এখানে ইমাম মুসলিমের নিরীক্ষার গভীরতা ও প্রামাণ্যতা লক্ষ্য করুন। তিনি এই একটি হাদীস ইবনু আব্বাস থেকে ১৩ টি সূত্রে সংকলিত করে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক বর্ণনাকে ভুল বা মিথ্যা বর্ণনা থেকে পৃথক করলেন।
তিনি প্রথমে উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ নামক ‘রাবী’র সূত্রে বর্ণনা করলেন যে, কুরাইব তাকে বলেছেন, ইবনু আব্বাস তাকে বলেছেন, তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর ডানে দাঁড়ান এবং তিনি তাকে বামে দাঁড় করিয়ে দেন। এরপর তিনি ইয়াযিদের ওস্তাদ ‘কুরাইবের’ অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনার সাথে তা মেলালেন। কুরাইবের অন্য তিনজন প্রসিদ্ধ ছাত্র মাখরামাহ, সালামা ও সালিমের বর্ণনা ইয়াযিদের বর্ণনার বিপরীত। তাঁরা তিনজনই বলেছিলেন যে, কুরাইব বলেছেন, ইবনু আব্বাস বামে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ(স) তাকে ডানে দাঁড় করান। এতে প্রমাণিত হলো যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ হাদীসটি মুখস্ত রাখতে পারেননি।
ইমাম মুসলিম এখানেই থামেননি। তিনি এরপর কুরাইব ছাড়াও ইবনু আব্বাসের অন্য ৫ জন ছাত্র: সাঈদ ইবনু জুবাইর, আতা ইবনু আবী রাবাহ, আবু নুদরাহ, শা’বী ও ইকরামাহ থেকে হাদীসটির বিবরণ সংকলিত করে তার সাথে উপরের বর্ণনাটির তুলনা করেছেন। এই ৫ জনের বর্ণনাও প্রমাণ করে যে, ইয়াযিদ ইবনু আবী যিয়াদ হাদীসটির ভুল বর্ণনা দিয়েছেন। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হলো যে, ইবনু আব্বাস তাঁর সকল ছাত্রকে বলেছেন যে, তিনি প্রথমে বামে দাঁড়িয়েছিলেন, পরে রাসূলুল্লাহ(স) তাকে ডানে দাঁড় করিয়ে দেন। ইবনু আব্বাসের সকল ছাত্রের ন্যায় কুরাইবও তাঁর ছাত্রদের এই কথায় বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু ইয়াযিদ তাঁর স্মৃতির দুর্বলতার কারণে হাদীসটি ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন।
এইরূপ ব্যাপক তুলনা ও নিরীক্ষা মুহাদ্দিসগণ প্রতিটি হাদীসের ক্ষেত্রে করতেন। হাদীস ও রাবীর বিধান বর্ণনায় তাঁদের প্রতিটি মতামতই এইরূপ গভীর ও ব্যাপক তুলনা ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে প্রদত্ত।
আরেকটি উদাহরণ দেখুন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের মিশরের একজন প্রসিদ্ধ আলিম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন আবু আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনু লাহী’য়া উক্ববা আল হাদরামী আল গাফিকী(১৭৪ হি)। তিনি একজন প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন এবং অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত সকল হাদীস তুলনামুলক নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে পেয়েছেন যে, তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ভুলের পরিমাণ খুবই বেশি। নাকিদ মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলি তাঁর নিকট থেকে বা তাঁর ছাত্রদের নিকট হতে সংকলিত করেছেন। এরপর তিনি যেসকল ওস্তাদের সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের অন্যান্য ছাত্রদের থেকে হাদীসগুলি সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন। এরপর এ সকল বর্ণনার সনদ ও মতনের তারতম্য দেখতে পেয়ে ‘ইবনু লাহীয়াহ’ কে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছেন।
ইবনু লাহীয়াহ এর মারাত্মক ভুলের উদাহরণ হিসেবে ইমাম মুসলিম বলেনঃ আমাদেরকে যুহাইর ইবনু আরব বলেছেন, আমাদেরকে ইসহাক ইবনু ঈসা বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীয়াহ বলেছেন, মূসা ইবনু উকবাহ(১৪১ হি) আমার কাছে লিখে পাঠিয়েছেন, আমাকে বসুর ইবনু সাঈদ বলেছেন, যাইদ ইবনু সাবিত(রা) থেকে, তিনি বলেছেনঃ “রাসূলুল্লাহ(স) মসজিদের মধ্যে হাজামত করেন বা সিংগার মাধ্যমে দেহ থেকে রক্ত বের করেন।” ইবনু লাহীয়াহ এর ছাত্র ইসহাক ইবনু ঈসা বলেনঃ আমি ইবনু লাহীআকে বললামঃ তাঁর বাড়ির মধ্যে কোনো নামাজের স্থানে? তিনি বললেনঃ মসজিদে নববীর মধ্যে।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ হাদীসটির বর্ণনা সকল দিক হতে বিকৃত। এর সনদ ও মতন উভয় ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল রয়েছে। ইবনু লাহীয়াহ এর মতনের শব্দ বিকৃত করেছেন এবং সনদে ভুল করেছেন। এই হাদীসের সহীহ বিবরণ আমি উল্লেখ করছি।
আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম বলেন,আমাদেরকে বাহায ইবনু আসাদ বলেন, আমাদেরকে উহাইব ইবনু খালিদ ইবনু আজলান(১৬৫ হি) বলেন, আমাকে মূসা ইবনু উকবাহ বলেন, আমি আবুন নাদর সালিম ইবনু আবু উমাইয়াহ(১২৯ হি) কে বলতে শুনেছি, তিনি বুসর ইবনু সাইদ থেকে, তিনি যাইদ ইবনু সাবিত থেকে বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ(স)মসজিদের মধ্যে চাটাই দিয়ে একটি ছোট ঘর বানিয়ে তার মধ্যে কয়েক রাত সালাত আদায় করেন…..।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ “আমাকে মুহাম্মাদ ইবনুল মাসাল্লা বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফর বলেছেন, আমাদেরকে আবদুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনু আবী হিনদ আল ফারাযী (১৪৫ হি) বলেছেন, আমাদেরকে আবুন নাদর সালিম বলেছেন, তিনি বুসর ইবনু সাঈদ থেকে, তিনি যাইদ ইবনু সাবিত থেকে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ(স) চাটাই দিয়ে মসজিদের মধ্যে একটি ঘর বানিয়ে নেন…।”
ইমাম মুসলিম বলেনঃ এভাবে আমরা সঠিক বর্ণনা পাচ্ছি উহাইব ইবনু খালিদ(১৬৫ হি) থেকে মূসা ইবনু উকবাহ থেকে, আবুন নাদর থেকে। এছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনু আবী হিনদ আল ফারাযী(১৪৫ হি) দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আবুন নাদর থেকে যে বর্ণনা করেছেন তাও উল্লেখ করলাম। ইবনু লাহীয়া এখানে হাদীসের মতন বর্ণনায় ভুল করেছেন তার কারণ তিনি হাদীসটি মূসার নিকট হতে স্বকর্ণে শুনেননি। শুধুমাত্র লিখে পাঠানো পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করেছেন যা তিনি উল্লেখ করেছেন। (এজন্য তিনি বা ঘর বানিয়েছেন শব্দটিকে বা রক্ত বাহির করেছেন বলে পড়েছেন।) যারা মুহাদ্দিসের নিজের মুখ হতে স্বকর্ণে না শুনে বা মুহাদ্দিসকে নিজে পড়ে না শুনিয়ে শুধুমাত্র লিখিত পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করেন তাদের সকলের ক্ষেত্রেই আমরা এই বিকৃতির ভয় পাই।
আর সনদের ভুল হলো, মূসা ইবনু উকবাহ হাদীসটি আবুন নাদর সালিম এর নিকট হতে গ্রহণ করেছেন। আবুন নাদর হাদীসটি বুসর ইবনু সাঈদ থেকে শিখেছেন। কিন্তু ইবনু লাহিয়াহ সনদ বর্ণনায় আবুন নাদর এর নাম উল্লেখ না করে বলেছেনঃ মূসা হাদীসটি বুশর থেকে শুনেছেন। (মুসলিম, আত-তাময়ীয, পৃ. ১৮৭-১৮৮)।
এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম মুসলিম দুই পর্যায়ে তুলনা করেছেন। প্রথমত ইবনু লাহীয়াহর উস্তাদ মূসার অন্য ছাত্র উহাইবের বর্ণনার সাথে ইবনু লাহীয়াহর বর্ণনা তুলনা করেছেন। উভয় বর্ণনা প্রমাণ করেছে যে, ইবনু লাহিয়াহ সনদ বর্ণনায় ও মতন উল্লেখে মারাত্মক ভুল করেছেন।

১.৪.৬.৬. বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার মধ্যে তুলনা করা
সাক্ষ্য বা বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের অন্যতম পদ্ধতি বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ে প্রশ্ন করা। এই পদ্ধতি সাহাবীগণ ব্যবহার করতেন হাদীস বর্ণনাকারীর বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের জন্য। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এখানে ২ টি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
১. উমাইয়া শাসক মারওয়ান ইবনুল হাকাম(৬৫ হি) এর সেক্রেটারী আবুয যুআইযাহ বলেন, একদিন মারওয়ান আমাকে বলেনঃ আবু হুরাইরা(রা) কে ডেকে আনাও। আবু হুরাইরা উপস্থিত হলে তিনি আবু হুরাইরাকে বিভিন্ন বিষয়ে হাদীস জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। আর আমাকে পর্দার আড়ালে বসে সেগুলি লিখতে নির্দেশ দিলেন। এরপর একবৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মারওয়ান পুনরায় আবু হুরাইরাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে পর্দার আড়ালে আগের বছরে লেখা পান্ডুলিপি নিয়ে বসতে বলেন। তিনি আবু হুরাইরাকে সেই বিষয়গুলি সম্পর্কে আবার প্রশ্ন করেন এবং আবু হুরাইরা গত বছরে বলা হাদীসগুলি পুনরায় বলেন। আমি মিলিয়ে দেখলাম যে, তিনি একটুও কম বেশি করেননি বা কোনো শব্দ আগে পিছেও করেননি।”(হাকিম, আল মুসতাদরাক ৩/৫৮৩)।
২. উমারাহ ইবনুল কা’কা বলেনঃ আমাকে ইবরাহীম নাখয়ী (৯৬ হি)বলেনঃ তুমি আমাকে আবু যুর’আ ইবনু আমর ইবনু জারীব থেকে হাদীস বর্ণনা কর। আবু যুর’আর নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ হলো, আমি তাকে একটি হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন করি। এরপর দুই বৎসর পরে আমি তাকে হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। দ্বিতীয়বার তিনি হুবহু প্রথমবারের মতই বর্ণনা করেন, একটি অক্ষরও বেশি কম করেননি। (ইবনু হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ১২/১০৯)।

১.৪.৬.৭. স্মৃতি ও শ্রুতির সাথে পান্ডুলিপির তুলনা
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, তাবেয়ীগণের যুগ থেকে ‘রাবী’ ও মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে প্রত্যেক শিক্ষকের নিকট হতে শিক্ষা করা হাদীসগুলি পৃথকভাবে পান্ডুলিপি আকারে লিপিব্ধ করে সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা পান্ডুলিপির সাথে মুখস্ত বর্ণনার তুলনা করে নির্ভুলতা যাচাই করতেন। প্রয়োজনে তাঁরা পান্ডুলিপির হস্তাক্ষর, কালি ইত্যাদি পরীক্ষা করতেন। এখানে বর্ণিত হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে পান্ডুলিপির সাহায্য গ্রহণের কয়েকটি নযির উল্লেখ করছি।
(১) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন মুহাদ্দিস খলীফা ইবনু মূসা বলেন, আমি গালিব ইবনু উবাইদুল্লাহ আল জাযারী নামে একজন মুহাদ্দিসের নিকটে হাদীস শিক্ষা করতে গমন করি। তিনি আমাদেরকে হাদীস লেখাতে শুরু করে তার পান্ডুলিপি দেখে বলতে থাকেনঃ আমাকে মাকহুল(১১৫ হি) বলেছেন…, আমাকে মাকহুল বলেছেন…., এভাবে তিনি মাকহুলের সূত্রে হাদীস লেখাতে থাকেন। এমন সময় তাঁর প্রশ্রাবের বেগ হয়, তিনি উঠে যান। তখন আমি তার পান্ডুলিপির উপর নযর করে দেখি সেখানে লেখা রয়েছেঃ আমাকে আবান ইবনু আবী আইয়াশ(১৪০ হি) বলেছেন, আনাস থেকে, আবান বলেছেন, অমুক থেকে….। তখন আমি তাকে পরিত্যাগ করে সেখান হতে উঠে আসলাম। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৮)।
অর্থাৎ, এই রাবী তার হাদীসগুলি আবানের নিকট হতে শুনেছেন ও লিখেছেন। তবে আবান মুহাদ্দিসগণের নিকট দুর্বল বলে ও অনির্ভরযোগ্য বলে পরিচিত। এজন্য তিনি হাদীস পড়ার সময় তার নাম বাদ দিয়ে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাকহুলের নামে হাদীসগুলি বলেছিলেন। খলীফা সুযোগ পেয়ে তার মুখের বর্ণনার সাথে লিখিত পান্ডুলিপির তুলনা করে তার জালিয়াতি ধরে ফেলেন।
(২) দ্বিতীয় শতকের নাকিদ ইমাম, আবদুর রহমান ইবনু মাহদী (১৯৮ হি) বলেন, একদিন সুফিয়ান সাওরী (১৬১ হি) একটি হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ হাদীসটি আমাকে বলেছেন হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান(১২০ হি), তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ আত তাইমী(মৃত্যু ১০০ হিজরীর কাছাকাছি) নামক তাবিয়ী থেকে তিনি সালমান ফারসী(৩৪ হি) থেকে।
আবদুর রহমান বলেনঃ আমি বললামঃ হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান তো এই হাদীস রিবয়ী ইবনু হিরাশ(১০০ হি) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি সালমান ফারসী থেকে। (অর্থাৎ, আপনার সনদ বর্ণনায় ভুল হয়েছে, হাম্মাদের উস্তাদ আমর ইবনু আতিয়্যাহ নয়, বরং রিবয়ী ইবনু হিরাশ।) সুফিয়ান সাওরী বলেছেনঃ এই সনদ কে বলেছেন? আমি বললামঃ আমাকে হাম্মাদ ইবনু সালামাহ(১৬৭ হি) বলেছেন, তিনি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান হতে এই সনদ উল্লেখ করেছেন। সুফিয়ান বললেনঃ আমি যা বলছি, তাই লেখ। আমি বললামঃ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজও (১৬০ হি) আমাকে এই সনদ বলেছেন। তিনি বললেনঃ আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি বললামঃ হিশাম দাসতুআয়ীও (১৫৪ হি) আমাকে এই সনদ বলেছেন। তিনি বললেনঃ হিশাম? আমি বললামঃ হ্যাঁ। তিনি কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললেন, আমি যা বলছি তাই লিখ। আমি হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমানকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ আমি আমর ইবনু আতিয়্যাহ থেকে হাদীসটি শুনেছেন।
আব্দুর রাহমান বলেনঃ আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস এসে গেল যে, এখানে সুফিয়ান সাওরী ভুল করলেন। অনেকদিন যাবত আমি এই ধারণা পোষণ করে থাকলাম যে, এই হাদীস বলতে সুফিয়ান সাওরী ভুল করলেন। এরপর একদিন আমি আমার ওস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফার গুনদার (১৯৩ হি) এর মাধ্যমে শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের যে হাদীসগুলি শুনেছিলাম সেগুলির লিখিত পান্ডুলিপির মধ্যে দেখলাম যে, শু’বা বলেছেন, আমাকে হাম্মাদ ইবনু আবী সুলাইমান বলেছেন, তাকে রিবয়ী ইবনু হিরাশ বলেছেন, সালমান ফারসী থেকে। শু’বা বলেছেনঃ হাম্মাদ একবার বলেন যে, তিনি আমর ইবনু আতিয়্যাহ হতে হাদীসটি শুনেছেন।
আবদুর রহমান বলেনঃ পান্ডুলিপি দেখার পর আমি বুঝতে পারলাম যে, সুফিয়ান সাওরী ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর নিজের মুখস্তের বিষয়ে তাঁর গভীর আস্থা থাকার কারণে অন্যান্যদের বিরোধিতাকে তিনি পাত্তা দেননি। (ইবনু আবী হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৬৪-৬৫)।
(৩) দ্বিতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) বলেন, যদি মুহাদ্দিসগণ শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ(১৬০ হি) থেকে বর্ণিত হাদীসের সঠিক বর্ণনার বিষয়ে মতভেদ করেন তাহলে মুহাম্মাদ ইবনু জা’ফর গুনদার(১৯৩ হি) এর পান্ডুলিপিই তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করবে। গুণদার এর পান্ডুলিপির বর্ণনাই সঠিক ও নির্ভুল বলে গৃহীত হবে।(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/২৭১)।
(৪) তৃতীয় শতকের তিনজন মুহাদ্দিস, মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম ইবনু উসমান আর রাযী(২৭০ হি), ফাদল ইবনু আব্বাস ও আবু যুরু’আ রাযী উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল করিম(২৬৪ হি) একত্রে বসে হাদীস আলোচনা করছিলেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম একটি হাদীস বলে যাতে ফাদল আপত্তি উঠান। তিনি অন্য একটি বর্ণনা বলেন। দুজনের মধ্যে হাদীসটি নিয়ে বচসা হয়। তাঁরা তখন আবু যুরআকে সালিস মানেন। আবু যুরআ মতামত প্রকাশে অনীহা করেন। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিম চাপাচাপি করতে থাকেন। তিনি বলেনঃ আপনার নীরবতার কোন অর্থ নেই। আমার ভুল হলে তাও বলেন। আর তাঁর ভুল হলে তাও বলেন। আবু যুর’আ তখন তাঁর পান্ডুলিপি আনতে নির্দেশ দেন। তিনি ছাত্র আবুল কাসিমকে বলেন, তুমি গ্রন্থাগারে ঢুকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারি বাদ দিবে। এরপরের সারির বই গুণে প্রথম থেকে ১৬ খন্ড পান্ডুলিপি রেখে ১৭ তম খন্ডটি নিয়ে এস। তিনি যেয়ে বর্ণনা অনুসারে পান্ডুলিপিটি নিয়ে এসে আবু জুরআকে প্রদান করেন। আবু যুরআ পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে হাদীসটি বের করেন। এরপর তিনি পান্ডুলিপিটি মুহাম্মাদ ইবনু মুসলিমের হাতে দেন। মুহাম্মাদ পান্ডুলিপিতে সংকলিত হাদীসটি পড়ে বলেনঃ হ্যাঁ, তাহলে আমারই ভুল হয়েছে। আর ভুল তো হতেই পারে।”(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩৩৭: ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৭/৩০)।
(৫) তৃতীয় হিজরীর একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল রাহমান ইবনু উমর আল ইসপাহানী রুস্তাহ(২৫০ হি)। তিনি একদিন হাদীসের আলোচনা কালে আবু জুরআ রাযী(২৬৪ হি) ও আবু হাতিম রাযী মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস(২৭৭ হি) উভয়ের উপস্থিতিতে একটি হাদীস বর্ণনা করে বলেনঃ আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু মাদী বলেছিলেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সালিহ থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যোহরের সালাত ঠান্ডা করে আদায় করবে; কারণ উত্তাপের কাঠিণ্য জাহান্নামের প্রশ্বাস থেকে।” একথা শুনেই প্রতিবাদ করেন আবু যুর’আ রাযী। তিনি বলেনঃ আপনি(তাবিয়ী আবু সালিহ এর উস্তাদ সাহাবীর নাম আবু হুরাইরা উল্লেখ করে) ভুল বললেন। সকলেইতো হাদীসটি আবু সাঈদ খুদরীর সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আব্দুর রাহমান এর মনে খুবই লাগে। তিনি বাড়ি ফিরে নিজের নিকট রক্ষিত পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে আবু যুরআর কাছে চিঠি লিখে বলেনঃ “আমি আপনাদের উপস্থিতিতে একটি হাদীস আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণনা করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন যে, আমার বর্ণনা ভুল, সবাই হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রে বর্ণনা করেন। কথাটি আমার মনে খুবই আঘাত করেছিল। আমি বিষয়টি ভুলতে পারিনি। আমি বাড়িতে ফিরে আমার নিকট সংরক্ষিত পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখানে দেখলাম যে, হাদীসটি আবু সাঈদের সূত্রেই বর্ণিত। যদি আপনার কষ্ট না হয় তাহলে আবু হাতীম ও অন্যান্য সকল বন্ধুদের জানিয়ে দিবেন যে, আমার ভুল হয়েছিল। আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুন। ভুল স্বীকার করে লজ্জিত বা অপমানিত হওয়া(ভুল গোপন করে) জাহান্নামের আগুনে পোড়ার চেয়ে উত্তম।(ইবনু আবী হাতিম, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৩৬)।
(৬) তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস সুলাইমান ইবুন হারাব(২২৪ হি) বলেনঃ আমি যখন আমার সমসাময়িক প্রসিদ্ধ ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনু মা‘য়ীন(২৩৩ হি) এর সাথে বিভিন্ন হাদীস আলোচনা করতাম, তখন তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, এই হাদীসটি ভুল। আমি বলতামঃ এর সঠিক রূপ কি হবে? তিনি বলতেন তা জানিনা। তখন আমি আমার পান্ডুলিপি দেখতাম। আমি দেখতে পেতাম যে, তাঁর কথাই ঠিক। পান্ডুলিপিতে হাদীসটি অন্যভাবে লিখা হয়েছে।(ইবনু আবী হাতিম, প্রাগুক্ত ১/৩১৪)।
(৭) ইমাম আহমদ হাম্বল(২৪১) কে প্রশ্ন করা হয়ঃ আবুল ওয়ালিদ কি পরিপূর্ণ নির্ভরযোগ্য? তিনি বলেনঃ না। তাঁর পান্ডুলিপিতে নোকতা দেওয়া ছিলনা এবং হরকত দেওয়া ছিলনা। তবে তিনি শু’বা ইবনুল হাজ্জাজের নিকট থেকে যে হাদীসগুলি শুনেছিলেন ও লিখেছিলেন সেগুলি তিনি বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন।(আহমদ ইবনু হাম্মাল, আল ইলাল ওয়া মা’রিফাতুর রিজাল ২/৩৬৯)।
(৮) তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইয়াকূব ইবনু হুমাইদ ইবনু কাসিব(২৪০ হি)। ইমাম আবু দাউদ(২৭৫ হি) বলেন, ইয়াকূব এর বর্ণিত হাদীসগুলির মধ্যে অনেক হাদীস দেখতে পেলাম যেগুলি অন্য কেউ এভাবে বর্ণনা করেননা। এজন্য আমরা তাকে তার মূল পান্ডুলিপি দেখাতে অনুরোধ করি। তিনি কিছুদিন যাবত আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেন। এরপর তিনি তার পান্ডুলিপি বের করে আমাদেরকে দেখান। আমরা দেখলাম তার পান্ডুলিপিতে অনেক হাদীস নুতন তাজা কালি দিয়ে লেখা। পুরাতন লেখা ও নতুন লেখার মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে। আমরা দেখলাম অনেক হাদীসের সনদের মধ্যে রাবীর নাম ছিলনা, তিনি সেখানে নতুন করে রাবীর নাম বসিয়েছেন। কোনো কোনো হাদীসের ভাষার মধ্যে অতিরিক্ত শব্দ বা বাক্য যোগ করেছেন। এজন্য আমরা তার হাদীস গ্রহণ করা হতে বিরত থাকি। (যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৭/২৭৬-২৭৭; সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/১৫৯)।
(৯) চতূর্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু আহমদ আব্দুল্লাহ ইবনু আদী(৩৬৫ হি) বলেনঃ মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুল আশ‘আশ নামক এক ব্যক্তি মিশরে বসবাস করতেন এবং হাদীস বর্ণনা করতেন। আমি হাদীস সংগ্রহের সফরকালে মিশরে তার নিকট গমন করি। তিনি আমাদেরকে একটি পান্ডুলিপি বের করে দেন। পান্ডুলিপিটির কালি তাজা এবং কাগজও নতুন। এতে প্রায় এক হাজার হাদীস ছিল, যেগুলি তিনি হযরত আলীর বংশধর মূসা ইবনু ইসমাঈল ইবনু মূসা ইবনু জা’ফর সাদিক ইবনু মুহাম্মাদ বাকির ইবনু যাইনুল আবিদীন ইবনু হুসাইন ইবনু আলী থেকে তাঁর পিতা পিতামহদের সূত্রে রাসূলুল্লাহ(স) থেকে শুনেছেন বলে দাবি করেন। এর প্রায় সকল হাদীসই অজ্ঞাত, অন্য কেউ এই সনদে বা অন্য কোনো সনদে তা বর্ণনা করেনি। কিছু হাদীসের বা মতন অন্যান্য সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়, তবে এই সনদে নয়। তখন আমি সনদে উল্লেখিত মূসা ইবনু ইসমাঈল সম্পর্কে আলী বংশের সমকালীন অন্যতম নেতা হুসাইন ইবনু আলীকে প্রশ্ন করি ।তিনি বলেনঃ এই মূসা ৪০ বছর যাবত মদীনায় আমার প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি কখনোই কোনোদিন বলেননি যে, তিনি তাঁর পিতা পিতামহদের সূত্রে বা অন্য কোনো সূত্রে কোনো হাদীস তিনি শুনেছেন বা বর্ণনা করেছেন। ইবনু আদী বলেনঃ এই পান্ডুলিপির হাদীসগুলির মধ্যে আমরা কোনো ভিত্তি খুঁজে পাইনি। এগুলি তিনি বানিয়েছিলেন বলে বুঝা যায়। (ইবনু আদী, আল কামিল ৬/৩০১-৩০২; ইবনুল জাউযী, আদ দুআফা ৩/৪৩, ৯৭)।
১.৪.৭. নিরীক্ষার ভিত্তিতে হাদীসের প্রকারভেদ
নিরীক্ষার ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে মূলত তিনভাগে ভাগ করেছেনঃ সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস, হাসান বা ভাল অর্থাৎ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ও যয়ীফ বা দুর্বল। যয়ীফ হাদীস দুর্বলতার কারণ ও দুর্বলতার পর্যায়ের ভিত্তিতে বিভিন্নভাবে বিভক্ত।
এখানে সাধারণ পাঠকের অনুধাবনের জন্য এগুলি সহজ ব্যাখ্যার চেষ্টা করব। মনে করুন একজন বিচারক একজন হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিরীক্ষা করে দেখেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো সে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় এক ব্যক্তিকে খুন করেছে। প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে তিনি সম্ভাব্য চার প্রকার রায় প্রদান করতে পারেনঃ ১. মৃত্যুদন্ড, ২. যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৩. কয়েক বছরের কারাদন্ড বা ৪. বেকসুর খালাস। মোটামুটিভাবে হাদীসের নির্ভরতার ক্ষেত্রেও এই পর্যায়গুলি রয়েছে।
১.৪.৭.১. সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫টি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়। ১. ‘আদালত’: হাদীসের সকল রাবী পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত,
২. ‘যাবত’: সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত,
৩. ‘ইত্তিসাল’: সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত,
৪. ‘শুযূয মুক্তি’: হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত এবং
৫. ‘ইল্লাত মুক্তি’: হাদীসটির মধ্যে সূক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬)।
প্রথম তিনটি শর্ত সনদ কেন্দ্রিক এবং শেষোক্ত দুইটি শর্ত মূলত অর্থকেন্দ্রিক। এগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে সাধারণ পাঠকের জন্য আমরা বলতে পারি যে, প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির বিষয়ে যতটুকু নিশ্চয়তা অনুভব করলে একজন বিচারক মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিতে পারেন, বর্ণিত হাদীসটি সত্যিই রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন বলে অনুরূপভাবে নিশ্চিত হতে পারলে মুহাদ্দিসগণ তাকে ‘সহীহ’ বা বিশুদ্ধ হাদীস বলে গণ্য করেন। নিরীক্ষার মাধ্যমে যে সকল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস এই মানের নির্ভুল বা সহীহ বলে গণ্য করা হয় তাদের নির্ভরযোগ্যতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ আরবীতে নির্ভরযোগ্য, প্রামাণ্য ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।

১.৪.৭.২. ‘হাসান’ বা সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য হাদীস
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাসান হাদীসেও উপরোক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য্। তবে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে যদি সামান্যতম দূর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদের রাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, প্রত্যেকে হাদীসটি উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ নেই। তবে সনদের কোনো রাবীর নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা বা ‘যাবত’ কিছুটা দুর্বল বলে বুঝা যায়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এইরূপ ‘রাবী’র বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বলে গণ্য।(ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ.৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)।
পরিভাষার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে আমরা সাধারণ পাঠকদের জন্য বলতে পারি যে, যে পর্যায়ের প্রমাণাদির ভিত্তিতে একজন বিচারক খুনের অভিযোগে অভিযুক্তকে বিস্তারিত শাস্তি দেন, কিন্তু মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন শাস্তি প্রদান করেননা, সেই পর্যায়ের প্রমাণাদির ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ একটি হাদীসকে ‘হাসান’ বলে গণ্য করেন। যে সকল বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ আরবীতে সত্যপরায়ণ, অসুবিধা নেই, চলনসই ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন।

১.৪.৭.৩. ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল হাদীস
যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলির মধ্যে কোনো একটি অবিদ্যমান থাকে, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী বা তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে থেকে সরাসরি বা স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা…..ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে বিদ্যমান থাকলে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ বলে গণ্য।(ইরাকী, আত তাকয়ীদ, পৃ.৬২; ফাতহুর মুগীস পৃ.৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)।
শর্ত পাঁচটির ভিত্তিতে যয়ীফ হাদীসকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন মুহাদ্দিসগণ। সেগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে আমরা বুঝতে পারি যে, কোনো হাদীসকে যয়ীফ বলে গণ্য করার অর্থ হলো, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। বর্ণনাকারীদের দুর্বলতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমনঃ দুর্বল, কিছুই নয়, মূল্যহীন, অজ্ঞাত পরিচয়, জঘন্য উল্টাপাল্টা হাদীস বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী ইত্যাদি।
‘যয়ীফ’ বা দুর্বল হাদীসের দুর্বলতার তিনটি পর্যায় রয়েছে।
১.৪.৭.৩.১. কিছুটা দুর্বল
বর্ণনাকারী ভুল বলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ তিনি যতগুলো হাদীস বলেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছাকৃত ভুল বলতেননা বলেই প্রমাণিত। এরূপ ‘যয়ীফ’ হাদীস যদি অন্য এক বা একাধিক পর্যায়ের কিছুটা যয়ীফ সূত্রে প্রমাণিত হয় তাহলে তা হাসান বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে গণ্য হয়।
১.৪.৭.৩.২. অত্যন্ত দুর্বল(যায়ীফ জিদ্দান, ওয়াহী)
এইরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীর সকল হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ বা সকল হাদীসই অগণিত ভুলে ভরা, যে ধরনের ভুল সাধারণত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয় তার চেয়েও মারাত্মক ভুল, তবে তার বর্ণিত হাদীস পরিত্যক্ত, একেবারে অগ্রহণযোগ্য বা অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করা হবে। এরূপ দুর্বল হাদীস অনুরূপ অন্য দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয়না।
১.৪.৭.৩.৩. মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস
যদি প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র(সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কম বেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস।(বিস্তারিত দেখুনঃ হাকিম নাইসাপুরী(৪০৫ হি), মারি’ফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ. ১৪-১৭. ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত তাকয়ীদ ওয়াল ইদাহ, পৃ.২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)।

১.৪.৮. গ্রন্থাকারে হাদীস সংকলন ও সংরক্ষণ
জালিয়াতি ও মিথ্যা থেকে হাদীসকে হেফাজতের জন্য মুহাদ্দিসগণের অন্যতম কর্ম ছিল গ্রন্থাকারে সনদসহ সকল হাদীস সংকলন করা। আমরা দেখেছি যে, তাবিয়ীগণের যুগ বা প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই শিক্ষা, মুখস্ত ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে হাদীস লিখে রাখার প্রচলন ছিল। তবে নির্দিষ্ট নিয়মে গ্রন্থাকারে হাদীস সংকলন শুরু হয় দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে। তৃতীয় হিজরী শতকে এই কর্ম পূর্ণতা লাভ করে। পরবর্তী দুই শতাব্দীতেও সনদসহ হাদীস সংকলনের ধারা চালু থাকে এবং কিছু গ্রন্থ সংকলিত হয়। প্রত্যেক যুগের মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তীযুগের মুহাদ্দিসগণের সংকলিত হাদীসগুলি সনদসহ সংকলিত করেন। এছাড়া তাঁরা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সফর ও হাদীস সংগ্রহ অভিযান চালিয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত সকল হাদীস সংগ্রহ ও সনদ সহ সংকলিত করেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এসকল গ্রন্থ সংকলিত হয়ঃ
১. সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করা।
২. শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলন করা।
৩. বর্ণনাকারীদের বিবরণসহ তাঁদের বর্ণিত হাদীস সংকলন করা।
৪. শুধুমাত্র অনির্ভরযোগ্য বা বানোয়াট হাদীস সংকলন করা।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ৪ শতাব্দী পর্য্ন্ত হাদীস সংকলনের যে ধারা চালু থাকে এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত ও প্রচারিত সকল হাদীস সংকলিত করা। যাতে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষাভিত্তিক বিধানের আলোকে এগুলির মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভুল হাদীস বেছে নিতে পারেন। অনেকে বর্ণনাকারী রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবীর নামের ভিত্তিতে হাদীস সংকলিত করতেন। সবারই মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীস নামে প্রচলিত সব কিছু সংকলিত করা।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ হাদীস গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকারের হাদীস সংকলিত হয়েছে। এখানে অজ্ঞতার কারণে অনেকে ভুল ধারণায় পড়েন। উপরের পরিচ্ছেদগুলিতে আলোচিত সাহাবী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসদের হাদীস বিচার, সনদ যাচাই, নিরীক্ষা ইত্যাদি থেকে অনেকে মনে করেন যে, মুহাদ্দিসদের এসকল বিচার ও নিরীক্ষার মাধ্যমে যাদের ভুল বা মিথ্যা ধরা পড়েছে তাদের হাদীসতো তারা গ্রহণ করেনন এবং সংকলনও করেননি। কাজেই কোনো হাদীসের গ্রন্থে হাদীস সংকলনের অর্থই হলো এসকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেই উক্ত মুহাদ্দিস হাদীসগুলিকে তাঁর গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।
এই ধারণাটি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রকৃত অবস্থার একেবারেই বিপরীত। কয়েকজন সংকলক বাদে কোনো সংকলকই শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেননি। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আলিম ও ইমাম হাদীস সংকলন করেছেন সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সকল প্রকার হাদীস সনদসহ একত্রিত করার উদ্দেশ্যে; যেন রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত বা প্রচারিত সবকিছুই সংরক্ষিত হয়। তাঁরা কোনো হাদীসই রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বা কাজ হিসেবে সরাসরি বর্ণনা করেননি। বরং সনদসহ, কে তাদেরকে হাদীসটি কার সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা মূলত বলেছেন, “অমুক ব্যক্তি বলেছেন যে, ‘এই কথাটি হাদীস’, আমি তা সনদসহ সংকলিত করলাম।” হাদীস প্রেমিক পাঠকগণ এবার সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস বেছে নিন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তার সনদের আলোচনা করেছেন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তা সনদের আলোচনা করেছেন এবং দুর্বলতা বা সবলতা বর্ণনা করেছেন।
অল্প কয়েকজন সংকলক শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল বুখারী(২৫৬ হি) ও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী(২৬১ হি)অন্যতম। তাঁদের পরে আবদুল্লাহ ইবনু আলী ইবনুল জারূদ(৩০৭ হি), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক ইবনু খুযাইমা(৩১১ হি), আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ, ইবনুশ শারকী(৩২৫ হি), কাসিম ইবনু ইউসুফ আল বাইয়ানী(৩৪০ হি), সাঈদ ইবনু উসমান, ইবনুস সাকান(৩৫৩ হি), আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান আল বুসতি(৩৫৪ হি), আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল্লাহ হাকিম নাইসাপূরী(৪০৫হি), যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহিদ আল মাকদিসী(৬৪৩ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস শুধুমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করে ‘সহীহ’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। (কাত্তানী, আর-রিসালাতুল মুসতাতরাফা, পৃ.২০-২৬)।
কিন্তু পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থদ্বয়ের সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাকী কোনো গ্রন্থেরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয়নি। বরং কোনো কোনো গ্রন্থে যয়ীফ, বাতিল ও মিথ্যা হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম হযরত ইমাম শাহ ওয়ালীওল্লাহ দেহলভী(১১৭৬ হি/১৭৬২ খ্রী.) হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এই তিনখানা গ্রন্থের সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এ সকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনটি গ্রন্থঃ সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী। ইমামা আহমাদ এর মুসনাদ ও প্রায় একই পর্যায়ের।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিস এর আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এ সকল গ্রন্থ হতে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছেঃ মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফে ইবনু আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনু হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(সুনানে কুবরা, দালাইলুন নবুওয়্যাত, শুয়াবুল ঈমান, …………ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(শারহ মায়ানাল আসার, শারহ মুশকিলিল আসার,….ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ(আল মু’জামুল কবীর, আল মু’জামুল আওসাত, আল মু’জামুস সাগীর,……..ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকদের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।
চতূর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলি হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রণ্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন পর্যায়ের হাদীস সংকলন করেছেনঃ (১) যে সকল হাদীস পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারণে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, (২) যে সকল হাদীস কোনো অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, (৩)লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়াযেদের ওয়াযে প্রচারিত বিভিন্ন কথা, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে স্থান দেয়নি, (৪) বিভিন্ন দুর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, (৫)যে সকল ‘হাদীস’ মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদীদের গল্প বা পূর্ববর্তী যামানার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা, সেগুলিকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোনো বর্ণনাকারী হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৬)কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতীয় কথা যা ভুলক্রমে কোনো সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, (৭) হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূর্বক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, অথবা (৮) বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এ ধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ইবনে হিব্বানের আদ দুয়াফা, ইবনে আদীর আল কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল আসফাহানী, ইবনে আসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদ ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এই পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল বা বানোয়াট।
পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐ সকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গ্রন্থে পাওয়া যায়না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যূত ভাষাজ্ঞানী পন্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্রুটি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের কথাও এমন সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ(স)এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূরপ্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সূত্রের(সনদের) তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্রুটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।
শাহ ওয়ালউল্লাহ(রাহ) বলেনঃ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থের উপরই শুধু মুহাদ্দিসগণ নির্ভর করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ইলমুর রিজাল ও ইলাল শাস্ত্রে পন্ডিত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ছাড়া কেউ উপকৃত হতে পারেননা, কারণ এ সকল গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্য হতে মিথ্যা হাদীস ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের পার্থক্য শুধু তাঁরাই করতে পারেন। আর চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ সংকলন করা বা পাঠ করা এক ধরনের জ্ঞান বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। সত্য বলতে, রাফেযী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সকল বিদ’আতী ও বাতিল মতের মানুষেরা খুব সহজেই এ সকল গ্রন্থ থেকে তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বের করে নিতে পারবেন। কাজেই, এ সকল গ্রন্থের হাদীস দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করা বা কোনো মতের পক্ষে দলীল দেওয়া আলেমদের নিকট বাতুলতা ও অগ্রহণযোগ্য। (শাহ ওয়ালীওল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/৩৮৫-৩৯১)।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় এবং সহীহ হাদীসকে দুর্বল ও মাউযূ হাদীস থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের দৃঢ়তা ছিল আপোষহীন ও অনমনীয়। দুনিয়ার বুকে কোনো যুগে কোনো ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ বা আলিম কখনো বলেননি যে, কোনো হাদীসের গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণিত থাকলেই হাদীসকে সহীহ বলা যাবে। অমুক আলিম যেহেতু হাদীসটি সংকলন করেছেন, কাজেই হাদীসটি হয়তো সহীহ হবে।
তেমনিভাবে সংকলক যত মর্যাদাসম্পন্নই হোক, তাঁর সংকলিত কোনো হাদীসের মধ্যে দুর্বলতা বা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার সম্ভাবনা থাকলে তা স্পষ্টরূপে বলতে কোনো দ্বিধাই তাঁরা কখনোই করেননি। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষাকে তাঁরা সকল ব্যক্তিগত ভালবাসা ও শ্রদ্ধার উপরে স্থান দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের নামে সকল মিথ্যা ও ভুল চিহ্নিত করে বিশুদ্ধ হাদীসকে ভুল ও মিথ্যা ‘হাদীস’ থেকে পৃথক রাখার এই প্রবল দৃঢ়তার কারণেই মুহাদ্দিসগণ কখনোই কারো দাবী বিনা যাচাইয়ে মেনে নেননি। তাঁরা কখনোই মনে করেননি যে, অমুক মহান ব্যক্তিত্ব যেহেতু হাদীসটিকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন, সেহেতু তাঁর মতামত বিনা যাচাইয়ে মেনে নেওয়া উচিত।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম সহ উপরের সকল ‘সহীহ’ হাদীসের গ্রন্থে সংকলিত প্রতিটি হাদীসের সনদ পরবর্তী কয়েক শতাব্দী যাবৎ মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষা পদ্ধতিতে বিচার ও যাচাই করেছেন। এই বিচারের মাধ্যমেই তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন যে, বুখারী ও মুসলিম তাঁদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে সংকলিত সকল হাদীস ‘সহীহ’ বলে মেনে নেওয়ার কারণ এই নয় যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসগুলিকে সহীহ বলেছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত মর্যাদা এখানে একেবারেই মূল্যহীন। প্রকৃত বিষয় হলো, তাঁরা হাদীসগুলিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে মুহাদ্দিসগণ তাঁদের সংকলিত হাদীসগুলির সনদ যাচাই করেছেন এবং তাঁদের দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
অন্য আরো লেখক শুধুমাত্র সহীহ বা সহীহ ও হাসান হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেছেন। কেউ কেউ সহীহ ও যয়ীফ হাদীস সংকলন করবেন ও জাল ও মাঊদু হাদীস বাদ দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ তাঁদের দাবি কখনোই বিনা যাচাইয়ে মেনে নেননি। বরং তাঁদের সংকলিত সকল হাদীস যাচাই করে তাঁদের গ্রন্থাবলীর বিষয়ে বিধান প্রদান করেছেন। এ সকল যাচাইয় দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ লেখক ও সংকলকই তাঁদের ঘোষণা ও সংকল্প পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারো দাবিই মুহাদ্দিসগণ বিনা যাচাইয়ে গ্রহণ করেননি।

১.৪.৯. গ্রন্থাকারে রাবীগণের পরিচয় সংরক্ষণ
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী হতে মুহাদ্দিসগণ সনদসহ সকল হাদীস সংকলন করেন, যেন সনদ পর্যালোচনা করে বিশুদ্ধ হাদীসকে মিথ্যা বা ভুল থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংকলনের পাশাপাশি রাবীগণের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক তথ্যাবলী গ্রন্থাকারে সংকলন করতে থাকেন; যেন এ সকল তথ্যের আলোকে হাদীসগ্রন্থগুলিতে সংকলিত হাদীসগুলির সনদ বিচার করা যায়। এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নেও ক্রম বিবর্তন ঘটে।
২য় হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণে প্রথমে নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সকল বর্ণনাকারীর বিবরণ একত্রে সংকলন করতে শুরু করেন। ইমাম লাইস ইবুন সা’দ(১৭৫ হি), আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক(১৮১ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস দ্বিতীয় হিজরীর মাঝামাঝি হতে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করেন। এ সকল গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল রাবীর জীবনী, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক বিধান সংকলিত হয়েছে। পরবর্তী শতকগুলোতে এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার ধারা অব্যাহত থাকে। তৃতীয় হিজরী শতকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল, আলী ইবনুল মাদানী, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ও পরবর্তী যুগের অগণিত মুহাদ্দিস এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ শুধুমাত্র মুহাদ্দিসগণ ও মিথ্যাবাদী রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। দ্বিতীয় শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল কাত্তান(১৯৮ হি) সর্বপ্রথম ‘আদ-দুআফা’ নামে এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। পরবর্তী শতকগুলোতে এ জাতীয় গ্রন্থ রচনার ধারা অব্যাহত থাকে। এ সকল গ্রন্থে দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীগণ, তাদের বর্ণিত কিছু হাদীস ও তাদের বিষয়ে ইমামদের মতামত সংকলন করা হয়েছে। এগুলির পাশাপাশি তৃতীয় হিজরী শতক থেকে কোনো কোনো মুহাদ্দিস শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা শুরু করেন।
বস্তুত, রাবীগণের বিবরণ সংগ্রহ ও সংকলন মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণের একটি অতুলনীয় কর্ম। প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে পরবর্তী ৬০০ বৎসর যাবত মুহাদ্দিসগণ মুসলিম দেশের প্রতিটি জনপদ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক রাবীর নাম, বংশ, জন্ম, মৃত্যু, শিক্ষা, কর্ম, শিক্ষক, ছাত্র ইত্যাদি ব্যক্তিগত সকল তথ্যসহ তাঁর বর্ণিত হাদীসের নিরীক্ষা ও নিরীক্ষার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামত ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে সংরক্ষণ করেছেন। হাদীসে রাসূলকে বিকৃতি ও জালিয়াতি থেকে সংরক্ষণ করার জন্য তাঁরা এভাবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের তথ্য সংরক্ষণ করছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এর কোনো নযির নেই। এ সকল তথ্যের ভিত্তিতে যে কোনো যুগে যে কোনো গবেষক যে কোনো হাদীসের সনদ বিচার ও নিরীক্ষা করতে সক্ষম হন।

১.৪.১০. জাল হাদীস গ্রন্থাকারে সংরক্ষণ
১.৪.১০.১. মিথ্যাবাদী রাবীদের পরিচয় ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা
হাদীসের নামে মিথ্যা চিহ্নিত করার জন্য অন্যতম পদক্ষেপ ছিল মিথ্যাবাদীদের জালিয়াতি পৃথকভাবে সংকলন করা।এক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতি ছিল দুর্বল ও মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারীদের বিষয়ে সংকলিত গ্রন্থগুলি।
ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলো ছিল ইসলামী জ্ঞান ও বিশেষত হাদীস চর্চার স্বর্ণযুগ। হাজার হাজার শিক্ষার্থী হাদীস শিক্ষা করতেন। শত শত মহাদ্দিস, ইমাম সমাজে বিদ্যমান। সবাই সনদসহ হাদীস শুনতেন ও শেখাতেন। সনদের মধ্যে উল্লেখিত কোনো ব্যক্তির পরিচয় জানা না থাকলে জেনে নিতেন। সেই যুগে মিথ্যাবাদী রাবীদের নাম ও পরিচয় জানা থাকলেই তাদের মিথ্যা ও জালিয়াতি থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব ছিল। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে সংকলিত অনেক হাদীস গ্রন্থই বিষয়ভিত্তিক না সাজিয়ে বর্ণনাকারী রাবী বা সাহাবীগণের নামের ভিত্তিতে সাজানো হতো। কারণ রাবীর ভিত্তিতেই হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া সবাই সকল হাদীস পড়তেন। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ের হাদীস পড়ার প্রবণতা তখন ছিলনা।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, দ্বিতীয় হিজরী ৬ষ্ঠ হিজরী পর্য্ন্ত ৪ শতাব্দী যাবৎ হাদীসের নামে প্রচারিত ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে অন্যতম কর্ম ছিল দুর্বল ও মিথ্যাবাদী রাবীদের বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা করা। এ সকল গ্রন্থে এ সকল রাবীদের নাম, পরিচয়, তাদের বর্ণিত কিছু ভুল বা মিথ্যা হাদীস, তাদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষার ফলাফল ও মতামত সংকলিত করা হতো।
১.৪.১০.২. মিথ্যা বা জাল হাদীস সংকলন
৬ষ্ঠ হিজরী শতক পর্য্ন্ত এই জাতীয় গ্রন্থগুলিই ছিল হাদীসের নামে, মিথ্যাচারী ও তাদের মিথ্যাচার সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস। ৬ষ্ঠ শতকের পরও এই জাতীয় গ্রন্থ রচনা অব্যাহত থাকে। তবে জাল হাদীস চিহ্নিত করণ প্রক্রিয়ায় নতুন ধারার সৃষ্টি হয়।
কালের আবর্তনে হাদীস চর্চাসহ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলিস উম্মাহর মধ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়। বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানার আগ্রহ কমতে থাকে। স্বল্প সময়ে ও স্বল্প চেষ্টায় যে কোনো জিনিস শিখে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। রাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত গ্রন্থ থেকে মিথ্যা হাদীস জেনে নেওয়ার সময় ও আগ্রহ হ্রাস পায়। এজন্য মুহাদ্দিসগণ বিষয়ভিত্তিক জাল ও বানোয়াট হাদীস সংকলন শুরু করেন যেন পাঠক সহজেই কোনো বিষয়ে কোনো হাদীস জাল কিনা তা জেনে নিতে পারেন। ৫ম হিজরী শতক থেকে এই জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু হয়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ইবনুল জাউযীর কর্মের মাধ্যমে এই ধারা বিশেষভাবে গতিলাভ করে। বর্তমান যুগ পর্য্ন্ত তা অব্যাহত আছে। প্রথম দিকে মুহাদ্দিসগণ এ সকল মাঊদূ হাদীস সনদ সহকারে উল্লেখ করে সনদ আলোচনার মাধ্যমে এগুলির মিথ্যাচার প্রমাণ করতেন। পরবর্তী সময়ে সনদ উল্লেখ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র বানোয়াট হাদীসগুলি একত্রে সংকলন করা হয়।
এ সকল গ্রন্থের মধ্যে কিছু বিষয়ভিত্তিক বিন্যস্ত। কিছু গ্রন্থে হাদীসের প্রথম অক্ষর অনুসারে(Alphabetacilly) সাজানো হয়। অধিকাংশ মুহাদ্দিস শুধুমাত্র মাঊযূ হাদীস একত্রিত করেন।কোনো কোনো মুহাদ্দিস সমাজে প্রচলিত হাদীস সমূহ একত্রিত করে সেগুলোর মধ্যে কোনটি সহীহ ও কোনটি বানোয়াট তা বর্ণনা করেন। কেউ কেউ বানোয়াট হাদীস ছাড়াও দুর্বল হাদীস ও সংকলিত করেছেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই বিষয়ে গত ৯ শতাব্দীতে অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এখানে এই জাতীয় প্রধান গ্রন্থগুলি ও লেখকদের নাম উল্লেখ করছি।
১. আল মাউদূআত, আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ইবুন আলী আন-নাক্কাশ(৪১৪ হি)।
২. যাখীরাতুল হুফফায, মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি)।
৩. আল-আবাতীল ওয়াল মানাকীর, হুসাইন ইবনু ইবরাহীম আল-জূযকানী(৫৪৩ হি)।
৪. কিতাবুল কুসসাল ওয়াল মুযাককিরীন, আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী, ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৫. আল-মাউদূআত, আবুল ফারাজ, ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৬. আল ইলালুল মুতানাহিয়া, আবুল ফারাজ ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি)।
৭. আল আহাদীসুল মাউদূআহ ফীল আহকামিল মাশরূআ, আবু হাফস উমার ইবনু বাদর আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
৮. আল মুগনী আন হিফযিল কিতাব, উমার আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
৯. আল উকূফ আলাল মাউকূফ, উমার আল মাউসিলী(৬২২ হি)।
১০. আল-মাঊদূআত, হাসান ইবনু মুহাম্মাদ আস-সাগানী(৬৫০ হি)।
১১. আদ-দুররুল মুলতাকিত, আস-সাগানী(৬৫০ হি)।
১২. আহাদীসুল কুসসাস, আহমাদ ইবুন আব্দুল হালীম, ইবনু তাইমিয়া(৭২৮ হি)।
১৩. মুখতারাসুল আবাতীল, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ যাহাবী(৭৪৮ হি)।
১৪. তারতীবু মাউদূআতি ইবনিল যাওযী, যাহাবী(৭৪৮ হি)।
১৫. আল মাঊদূআত ফিল মাসাবীহ, উমার ইবনু আলী আল কাযবীনী(৭৫০ হি)।
১৬. আল-মানারুল মুনীফ, ইবনু কাইয়িম আল জাউযিয়্যাহ(৭৫১ হি)।
১৭. আল আহাদীস আল্লাতী লা আসলা লাহা ফিল এহইয়া, আব্দুল ওয়াহাব ইবনু আলী আস-সুবকী(৭৭১ হি)।
১৮. আত-তাযকিরা ফিল আহাদীসিল মুশতাহিরা, মুহাম্মাদ ইবনু বাহাদুর আয-যারকাশী(৭৯৪ হি)।
১৯. তাবঈনুল আজাব ফী মা ওরাদা ফী শাহরী রাজাব, ইবনু হাজর আসকালানী আহমাদ ইবনু আলী(৮৫২ হি)।
২০. আল-মাকাসিদুল হাসানাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান সাখাবী(৯০২ হি)।
২১. আল-লাআলী আল-মাসনূআহ, জালালুদ্দীন আব্দুর রাহমান সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২২. আত-তাআক্কুবাত আলাল মাউদূআত, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৩. আদ-দুরারুল মুনতাশিরাহ, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৪. তাহযীরুল খাওয়াস মিন আহাদীসিল কুসসাস, সুয়ূতী(৯১১ হি)।
২৫. আল গাম্মায আলাল লাম্মায, আলী ইবনু আব্দুল্লাহ আস-সামহুদী(৯১১ হি)।
২৬. তাময়ীযূত তাইয়ীবি মিনাল খাবিস, আব্দুর রাহমান আয যাবীদী(৯৪৪ হি)।
২৭. আশ-শাযারাহ ফীল আহাদীসিল, মুশতাহিরাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আলী আদ-দিমাশকী(৯৫৩ হি)।
২৮. তানযীহুশ শারীয়াহ, আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ইরাক(৯৬৩ হি)।
২৯. তাযকিরাতুল মাউদূআত, মুহাম্মাদ তাহির ফাতানী(৯৮৬ হি)।
৩০. আল আসরারুল মারফূআহ, মুল্লা আলী কারী(১০১৪ হি)।
৩১. আল মাসনূ ফী মা’রিফাতুল মাঊদী, মুল্লা আলী কারী(১০১৪ হি)।
৩২. মুখতাসারুল মাকাসিদ, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী(১১২২ হি)।
৩৩. আল জাদ্দুল হিসসীস ফী বায়ানি মা লাইসা বিহাদীস, আহমদ ইবনু আব্দুল কারীম আমিরী(১১৪৩ হি)।
৩৪. কাশফুল খাফা ওয়া মুযিলুল ইলবাস, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আল আজলূনী(১১৬২ হি)।
৩৫. আল কাশফুল ইলাহী আন শাদীদিদ দা’ফি ওয়াল মাউদূ ওয়াল ওয়াহী, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আত-তারাবলুসী(১১৭৭ হি)।
৩৬. আন-নাওয়াফিহুল আতিরাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ আস-সান‘আনী(১১৮১ হি)।
৩৭. আন-নুখবাতুল বাহিয়্যাহ, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ আস-সাবনাবী(১২৩২ হি)।
৩৮. আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, মুহাম্মাদ ইবনু আলী শাওকানী(১২৫০ হি)।
৩৯. আসনাল মাতালিব, মুহাম্মাদ ইবনু সাইয়িদ দারবীশ(১২৭৬ হি)।
৪০. হুসনুল আশার, মুহাম্মাদ দারবীশ(১২৭৫ হি)।
৪১. আল আশারুল মারফূআহ, আব্দুল হাই লাখনাবী(১৩০৪ হি)।
৪২. আল লু’লু আল মারসূ, মুহাম্মাদ ইবনু খালীল আল মাশীশী(১৩০৫ হি)।
৪৩. তাহযীরুল মুসলিমীন, মুহাম্মাদ ইবনুল বাশীর আল মাদানী(১৩২৯ হি)।
বর্তমান শতকেও এ বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। প্রিয় পাঠক, এখন আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, একই বিষয়ে এত গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা কি?
আসল বিষয় হলো দ্বিতীয় হিজরী শতক শুরু হওয়ার পর হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রচেষ্টা কখনো থামেনি। পরবর্তী অনুচ্ছেদে জালিয়াত ও জালিয়াতির পরিচিতির আলোচনায় আমরা এসকল বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারব। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা যেমন অব্যাহত থেকেছে, তেমনি সে সকল মিথ্যাকে চিহ্নিত করা ও বিশুদ্ধ হাদীস থেকে তা পৃথক করার প্রচেষ্টাও অব্যাহত থেকেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে নতুন নতুন কথা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়েছে। তখন সেই দেশের প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ গবেষণার মাধ্যমে সেগুলির সত্যতা ও অসত্যতা নির্ণয় করেছেন। এ সকল কথা কোনো হাদীসের গ্রন্থে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে কিনা, সনদের গ্রহণযোগ্যতা কিরূপ, এই অর্থে অন্য কোনো হাদীস বর্ণিত হয়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয় তাঁরা নির্ণয় করেছেন। এছাড়া পূর্ববর্তী গবেষকদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল থাকলে তা পরবর্তী লেখকগণ আলোচনা করেছেন। এভাবে এ বিষয়ে লেখনী ও গবেষণার ধারা অব্যাহত থেকেছে।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, গত দেড় হাজার বছরে সকল যুগে ও সকল শতকে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ হাদীসে রাসূলের হেফাযতে জাগ্রত প্রহরায় সদা সতর্ক থেকেছেন। তাঁরা সদা সর্বদা চেষ্টা করেছেন রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের নামে মিথ্যাচারের সকল প্রচেষ্টা চিহ্নিত করে হাদীস নামের মিথ্যা কথার খপ্পর থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করার। মহান আল্লাহ এ সকল মানুষদেরকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।

১.৫. মিথ্যার কারণ ও মিথ্যাবাদীদের প্রকারভেদ
হাদীসের নামে মিথ্যার উদ্ভব আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, ইসলামের গোপন শত্রুরা মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সর্বপ্রথম হাদীসের নামে মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে ছড়াতে থাকে। ওহীর উপরেই ধর্মের ভিত্তি। এজন্য ওহীর মাধ্যমে কোনো কথা প্রমাণিত করতে পারলেই তা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কুরআন যেহেতু অগণিত মানুষের মুখস্ত, এজন্য কুরআনের নামে সরাসরি মিথ্যা বা বানোয়াট কিছু বলার সুযোগ কখনোই ছিলনা। এজন্য হাদীসের নামে মিথ্যা বলার চেষ্টা তারা করেছে।
ক্রমাণ্বয়ে আরো অনেক মানুষ বিভিন্ন প্রকারের উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে থাকে। এছাড়া অনেক মানুষ অজ্ঞতা, অবহেলা বা অসাবধানতাবশতঃ হাদীসের নামে মিথ্যা বলেন। কারো মুখে কোনো ভাল কথা, কোনো প্রাচীন প্রাজ্ঞময় বাক্য, কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কাছে শুনে কারো কাছে ভাল লেগেছে। পরবর্তীতে তা বলার সময় রাসূলুল্লাহ(স)এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন। এভাবে বিভিন্ন কারণে হাদীসের নামে জালিয়াতি চলতে থাকে।
আমরা দেখেছি যে, মিথ্যা দুই প্রকারঃ ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ মূলত স্মৃতির বিভ্রাট, হাদীস মুখস্তকরণে অবহেলা বা হাদীস গ্রহণে অসতর্কতা। আর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ অধিকাংশে ধর্মের ক্ষতি বা উপকার(!)করা।
আমরা জানি যে, ওহীর সম্পর্ক ধর্মের সাথে। কাজেই ওহীর নামে মিথ্যা বলার সকল উদ্দেশ্যই ধর্মকেন্দ্রিক। কেউ ধর্মের নামে ধর্মের ক্ষতি করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে কামাই রুজি করার জন্য বা নিজের ফাতওয়া, দল বা বংশকে শক্তিশালী করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। কেউ ধর্মের নামে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হাদীস বানিয়েছেন। কেউ নিঃস্বার্থভাবে (!) মানুষদের ভালকাজে উৎসাহদান ও খারাপ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করার জন্য হাদীস বানিয়েছেন। এ সকল কারণ আমরা তিন শ্রেণিতে ভাগ করতে পারিঃ ১. ধর্মের ক্ষতি করা, ২. ধর্মের উপকার করা ও ৩. নিজের জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।
মিথ্যার কারণ ও মিথ্যাবাদীদের প্রকরণ সম্পর্কে ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রাহমান(৬৪৩ হি) বলেনঃ হাদীস বানোয়াটকারী জালিয়াতগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারক একদল মানুষ যারা নেককার ও দরবেশ বলে সমাজে পরিচিত। এরা তাদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির জন্য সাওয়াবের আশায় বানোয়াট কথা হাদীসের নামে সমাজে প্রচার করতেন। এদের বাহ্যিক পরহেযগারী, নির্লোভ জীবন যাপন ইত্যাদি দেখে মানুষ সরল নামে এদের কথা বিশ্বাস করে এসকল বানোয়াট কথা হাদীস বলে গ্রহণ করতো। এরপর হাদীসের অভিজ্ঞ ইমামগণ সূক্ষ্ম নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াত ধরে ফেলেন ও প্রকাশ করে দেন। ………….সাওয়াবের উদ্দেশ্যে নেককাজের ফজীলত ও অন্যায় কাজের শাস্তি বিষয়ক মিথ্যা ও বানোয়াট কথাকে হাদীস নামে প্রচার করাকে এধরনের কেউ কেউ জায়েয মনে করত। (ইরাকী, আত তাকঈদ পৃ. ১২৮-১২৯, সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮১-২৮৪)।
আল্লামা যাইনুদ্দীন ইরাকী(৮০৬ হি) বলেনঃ হাদীস জালকারীগণ তাদের জালিয়াতির উদ্দেশ্য ও কারণের দিক থেকে বিভিন্ন প্রকারের।
১. অনেক যিনদীদেরকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য হাদীস বানিয়েছে। হাম্মাদ ইবনু যাইদ বলেছেনঃ যিনদীকগণ রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে দশ হাজার হাদীস তৈরি করেছে।
২. কিছু মানুষ নিজেদের ধর্মীয় মতামত সমর্থন করার জন্য হাদীস জাল করেছে।
৩. কিছু মানুষ খলীফা ও আমীরদের পছন্দসই বিষয়ে হাদীস জাল করে তাদের প্রিয়ভাজন হতে চেষ্টা করেছে।
৪. কিছু মানুষ ওয়াজ ও গল্প বলে অর্থ কামাই করার মানসে হাদীস জাল করেছে।
৫. কিছু মানুষ নিজে ভাল ছিলেন, কিন্তু তাদের পুত্র বা পরিবারের কোনো সদস্য তাদের পান্ডুলিপির মধ্যে মিথ্যা হাদীস লিখে রাখতো। তারা বেখেয়ালে তা বর্ণনা করতেন।
৬. কেউ কেউ নিজেদের ফতোয়া বা মাসআলার দলীল প্রতিষ্ঠার জন্য হাদীস বানাতেন।
৭. কেউ কেউ নতুনত্ব ও অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন অপ্রচলিত সনদ ও মতন তৈরি করতেন।
৮. কিছু মানুষ এভাবে মিথ্যা হাদীস তৈরি করাকে দ্বীনদারী বলে মনে করতেন। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারণে মনে করতেন যে, মানুষদের ভাল করার জন্য ও ভাল পথে ডাকার জন্য মিথ্যা বলা যায়। এরা নেককার, সংসারত্যাগী বুযুর্গ হিসেবে সমাজে পরিচিত। হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে এদের ক্ষতিই সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ তারা এই কঠিন পাপকে নেককর্ম ও সাওয়াবের কাজ মনে করতেন। কাজেই কোনোভাবেই তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখা যেতনা। আর তাদের বাহ্যিক তাকওয়া, নির্লোভ জীবন ও দরবেশী দেখে মানুষরা প্রভাবিত হতেন এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করতেন ও প্রচার করতেন। এজন্যই ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল কাত্তান(১৯৮ হি) বলতেন, হাদীসের বিষয়ে নেককার বুযুর্গ চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী আমি দেখিনি। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৭-১৮)।
তিনি নেককার বুযুর্গ বলতে বুঝিয়েছেন সেইসব জাহিলকে যারা নিজেদের নেককার মনে করেন এবং বুযুর্গীর পথে চলেন, কিন্তু হালাল হারাম বুঝেননা। (ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১২২-১২৪)।
আমরা এখানে হাদীসের নামে জালিয়াতির প্রধান কারণগুলি ও এতে লিপ্ত মানুষদের বিষয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করব।
১.৫.১. যিনদীক ও ইসলামের গোপন শত্রুগণ
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অর্ধশতকের মাঝে ইসলামী বিজয়ের মাধ্যমে এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রবেশ করে। এসব দেশের অনেক অমুসলিম নাগরিক স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। অনেকে তাদের পূর্ব ধর্ম অনুসরণ করতে থাকেন। ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ হতে তাঁদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে কিছু মানুষ তাদের পূ্র্ব ধর্ম ও মতামতের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেন। তারা সমাজে মুসলিম বলে গণ্য হলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো ও তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের বিশ্বাস ও কর্ম নষ্ট করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ শ্রেণীর মানুষদেরকে ‘যিনদীক’ বলা হতো। এরা তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য অগণিত মিথ্যা কথা সমাজে হাদীস হিসাবে প্রচার করতো। আমরা দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু সাবার নেতৃত্বে এই শ্রেণীর মানুষেরাই প্রথম বানোয়াট হাদীস প্রচার শুরু করে।
এ সকল ভন্ড যিনদীক কখনো বা ‘আলীর(রা)’ এর ভক্ত সেজে তাঁর ও তাঁর বংশের পক্ষে বানোয়াট হাদীস প্রচার করত। কখনো বা সূফী দরবেশ সেজে মানুষকে ধোঁকা দিত এবং পারসিক বা ইহুদী খৃস্টানদের বৈরাগ্য ও সন্নাস মার্কা দরবেশীর পক্ষে হাদীস বানাতো। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী বিশ্বাস নষ্ট করা ও তাকে হাস্যাষ্পদ ও অযৌক্তিক হিসেবে পেশ করা।
এখানে লক্ষণীয় যে, তারা সনদসহ হাদীস বানাতো। তৎকালীন সময়ে সনদছাড়া হাদীস বলার কোনো উপায় ছিলনা। তারা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও নির্ভরযোগ্য রাবীগণের নাম জানতো। বিভিন্ন সহীহ হাদীসের সনদ তাদের মুখস্ত ছিল। এসকল সনদের নামে তারা হাদীস বানাতো।
এগুলো দিয়ে সাধারণ মানুষদের ধোঁকা দেওয়া খুবই সহজ ছিল। তবে ‘নাকিদ’ মুহাদ্দিসগণের কাছে এই ধোঁকার কোনো কার্য্কারিতা ছিলনা। তাঁরা উপরে বর্ণিত নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের জালিয়াতি ধরে ফেলতেন। যেমন একজন বলল যে, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল কাত্তান বলেছেন, তিনি সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি ইবনু সিরীন থেকে, তিনি আনাস ইবনু মালিক থেকে তিনি রাসূলুল্লাহ(স) থেকে……….। তখন তাঁরা উপরের পদ্ধতিতে সনদে বর্ণিত সকল রাবীর অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণিত হাদীসের সাথে এর তুলনা করতেন। পাশাপাশি এই ব্যক্তির অন্যান্য বর্ণনা ও তার কর্ম বিচার করে অতি সহজেই জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
এদের বানানো একটি হাদীস দেখুনঃ
মুহাম্মাদ ইবনু শু’জা নামক এক ব্যক্তি বলেছে, আমাকে হিব্বান ইবনু হিলাল, তিনি হাম্মাদ ইবনু সালামা থেকে, তিনি আবুল মাহযাম থেকে তিনি আবু হুরাইরা থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মহান প্রভুর সৃষ্টি কী থেকে? তিনি বলেনঃ তিনি একটি ঘোড়া সৃষ্টি করেন, এরপর ঘোড়াটিকে দাবড়ান। ঘোড়াটির দেহ থেকে যে ঘাম নির্গত হয় সেই ঘাম হতে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করেন।(নাউজুবিল্লাহ) (ইবনুল জাউযী, আল-মাউদূআত ১/৬৪)।
আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, মহান আল্লাহ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বাসকে হাস্যাষ্পদরূপে তুলে ধরা ও মুসলিম বিশ্বাসকে তামাশার বিষয়ে পরিণত করাই এই জালিয়াতির উদ্দেশ্য।
এ সকল জালিয়াত অনেক সময় তাদের জালিয়াতের কথা বলে বড়াই করত। আব্দুল করীম ইবনু আবীল আরজা দ্বিতীয় হিজরী শতকের এইরূপ একজন জালিয়াত। ধর্মদ্রোহিতা, জালিয়াতি ইত্যাদি অপরাধে তার মৃত্যুদন্ড প্রদানের নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রশাসক মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান ইবনু আলী। শাস্তির পূর্বে সে বলে, আল্লাহর কসম, আমি চার হাজার বানোয়াট হাদীস জালিয়াতি করে মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে দিয়েছি। (ইবনুল জাউযী, আল-মাউদূআত ১/১৫)।
তৃতীয় আব্বাসীয় খলীফা মাহদী (শাসনকাল ১৫৮-১৬৯ হি) বলেন, আমার কাছে একজন যিনদীক স্বীকার করেছে যে, সে ৪০০ হাদীস বানোয়াট করেছে যেগুলি এখন মানুষের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে। (ইবনুল জাউযী, আল-মাউদূআত ১/১৫)।

১.৫.২. ধর্মীয় ফিরকা ও দলমতের অনুসারীগণ
সাধারণত মানুষ নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে চায়না। সেই প্রাচীন যুগ হতে বর্তমান যুগ পর্য্ন্ত অগণিত মানুষ নিজের বুদ্ধি, বিবেক, বিচার ও প্রজ্ঞা দিয়ে ‘ওহী’র দুর্বলতা! ও অপূর্ণতা!! দূর!!! করতে চেষ্টা করেছে ও করছে। সকলেরই চিন্তা ওহীর মধ্যে কেন এই কথাটি থাকলোনা। এই কথাটি না হলে ধর্মের পূর্ণতা আসছেনা। ঠিক আছে, আমি এই কথাটি ওহীর নামে বলি। তাহলে ধর্ম পূর্ণতা লাভ করবে!!!
এদের মধ্যে অনেকে নিজে কোনো মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ তৈরি করেছে বা অনুসরণ করেছে এবং এই মতের পক্ষে ‘ওহী’ জালিয়াতি করেছে। রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তিকালের পরে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হতে না হতেই মুসলিম সমাজে নও মুসলিমদের মাঝে পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলামের গোপন শত্রুদের অপপ্রচার ও বিভিন্ন সমাজের সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদির প্রভাবে নতুন নতুন ধর্মীয় মতবাদের উদ্ভব ঘটে। আলী(রা) ও সকল সাহাবীর বিরুদ্ধে জিহাদ ও মনগড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠার উন্মাদনা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় খারিজী মতবাদ। আলী(রা) এর ভক্তি ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে মুসলমানদের মধ্যে ইহুদী, খ্রীস্টান ও অগ্নিপূজকদের মতবাদ ছড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় শিয়া মতবাদ। মহান আল্লাহর মর্যাদা রক্ষার ভুয়া দাবীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কাদারীয়া’ মতবাদ, যাতে তাকদীর বা মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে মহান আল্লাহর জ্ঞানকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর ক্ষমতা প্রমাণের বাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাবারিয়া’ মতবাদ, যাতে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতাকে অস্বীকার করা হতো। মহান আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠার মনগড়া দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাহমিয়া’, ‘মুতাজিলা’ ইত্যাদি মতবাদ, যেখানে মহান আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকার করা হতো।
রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহাবীগণ কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা হুবহু আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস ও পালন করেছেন। সাহাবীগণকে ভালবাসতে হবে আবার রাসূলুল্লাহ(স) এর বংশধরদেরকেও ভালবাসতে হবে। উভয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই, নেই কোনো বাড়াবাড়ির অবকাশ। মানুষের ভাগ্যের বিষয়ে আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ যেমন সত্য, তেমনি সত্য মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা।উভয় বিষয়ের সকল আয়াত ও হাদীস সহজভাবে বিশ্বাস করেছেন তাঁরা। এগুলির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য তাঁরা দেখেননি।
কিন্তু নতুন মতের উদ্ভাবকগণ কুরআন হাদীসের কিছু নির্দেশনা মানতে গিয়ে বাকীগুলি অস্বীকার করেছেন বা ব্যাখ্যা করেছেন। প্রত্যেকে নিজের মতকেই সঠিক বলে মনে করেছেন। প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেছেন যে, তার মতই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (স) পক্ষে এবং এই মতের পক্ষে হাদীস বানানোর অর্থ হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(স) পক্ষে হাদীস বানানো। কিছু বানোয়াট বা মিথ্যা কথাকে ওহীর নামে বা হাদীসের নামে বলে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ‘সঠিক পছন্দের!! মতকে’ শক্তিশালী করা যায় তাহলে অসুবিধা কি?! এতো ভাল কাজ বলে গণ্য হওয়া উচিত। এজন্য তাদের কেউ কেউ যখন তাদের মতের পক্ষে স্পষ্ট কোনো হাদীস পাননি তখন প্রয়োজনে নিজেদের পক্ষে ও বিপক্ষবাদীদের বিপক্ষে হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। ফিকহী ও মাসআলাগত মতভেদ এর ক্ষেত্রেও কখনো কখনো মিথ্যা হাদীস তৈরী করা হয়েছে।(ফালাতা, উমার ইবনু হাসান, আল-ওয়াদউ ফিল হাদীস ১/২২৩-২৬৩)।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী অগ্রগামী ছিলেন শিয়াগণ। নবী বংশের ভক্তির নামে তারা অগণিত বানোয়াট কথা ধর্মবিশ্বাসের অংশ বানিয়েছিলেন। এরপর সেগুলির সমর্থনে অগণিত হাদীস বানিয়ে প্রচার করেছেন। নবীদের পরে সকল মানুষের মধ্যে আলীর শ্রেষ্ঠত্ব, আলীর অগণিত অলৌকিক ক্ষমতা, আলীর পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসা, আলী বংশের মাহাত্ম্য, তাঁকে ও তাঁর বংশধরদেরকে বাদ দিয়ে যারা খলীফা হয়েছেন তাঁদের যুলুম ও শাস্তি, যারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন তাঁদের ভয়ন্কর পরিণতি ও শাস্তি, যারা তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানেননি বা অন্যান্য সাহাবীদেরকে ভালবেসেছেন তাদের ভয়ন্কর শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথাকে তারা হাদীস নামে প্রচার করেছেন।
তাঁদের জালিয়াত এত ব্যাপক ছিল যে, তাদের আলেমগণও সে কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। ৭ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত শিয়া আলীম, আলী(রা) এর বক্ততা সংকলন ‘নাহজুল বালাগাত’ এর ব্যাখ্যাকার ইবনু আবীল হাদীদ আব্দুল হামীদ ইবনু হিবাতুল্লাহ(৬৫৬ হি) বলেনঃ ফযীলত বা মর্যাদা জ্ঞাপক হাদীসের ক্ষেত্রে প্রথম মিথ্যাচারের শুরু হয়েছিল শিয়াদের দ্বারা। তারা প্রথমে তাদের নেতার পক্ষে বিভিন্ন হাদীস জালিয়াতি করে প্রচার করেন। বিরোধীদের সাথে প্রচন্ড শত্রুতা ও হিংসা তাদেরকে এই কর্মে উদ্বুদ্ধ করে।……(মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল খাতীব, আস-সুন্নাতু কাবলাত তাদবীন পৃ. ১৯৫)।

১.৫.৩. নেককার সংসারত্যাগী সরল বুযুর্গগণ
রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা কথা বলা ও প্রচার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন ও ঘৃণ্য ভুমিকা পালন করেছে কুরআন ও সুন্নাতের শিক্ষার বিষযে অজ্ঞ কিছু ধার্মিক মানুষের ‘মানুষকে ভাল পথে নেওয়ার আগ্রহ।’ কুরআনের ফযীলত, বিভিন্ন সূরার ফযীলত, বিভিন্ন সময়ে বা দিনে বিভিন্ন প্রকারের সালাতের ফযীলত, বিভিন্ন প্রকার যিকির এর ফযীলত ইত্যাদি সর্বপ্রকারের নেককর্মের ফযীলত, বিভিন্ন পাপ বা অন্যায় কাজের শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য হাদীস বানানো হয়েছে এই উদ্দেশ্যে।(ফাল্লাতা, আল ওয়াদউ ১/২৬৩-২৬৯)।
জাল হাদীস তৈরী ও প্রচারের ক্ষেত্রে এ সকল নেককার মানুষরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। এদেরকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। কিছু নেককার মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন। এরা এদের সরলতার নামে হাদীসের নামে যা শুনতেন তাই বিশ্বাস করতেন এবং বর্ণনা করতেন। অনেক সময় কোনো সুন্দর কথা বা জ্ঞানের বাক্য শুনলে তারা তা অসতর্কভাবে হাদীস বলে বর্ণনা করতেন। আর কিছু নেককার বলে পরিচিত মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলতেন।
১.৫.৩.১. নেককারগণের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
সূফী দরবেশ আল্লাহওয়ালা মানুষেরা সরলমনা ভাল মানুষ। সবাইকে সরল মনে বিশ্বাস করা ও দয়া করাই তাঁদের কাজ। আর মুহাদ্দিসগণের কাজ হচ্ছে দারোগার কাজ। দরবেশ এর শুরু বিশ্বাস দিয়ে আর দারোগার শুরু অবিশ্বাস দিয়ে। কোনো মানুষ যদি তার কোনো বিপদের কথা বলে, বা কোনো অপরাধের জন্য ওজর পেশ করে তখন সাধারণত সরলপ্রাণ মানুষেরা তা বিশ্বাস করে ফেলেন। কিন্তু একজন দারোগা প্রথমেই অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করেন। তিনি তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করেন, সে ধোঁকা দিচ্ছে না সত্যি বলছে। এরপর তিনি তা বিশ্বাস করেন।
কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফের অগণিত নির্দেশের আলোকে সাহাবীগণের যুগ থেকে সাহাবীগণ ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ ওহী বা রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সদাজাগ্রত প্রহরী বা দারোগার দায়িত্ব পালন করছেন। সূক্ষ্ম নিরীক্ষা ও যাচাই ছাড়া তাঁরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বলা কোনো কথা সঠিক বলে গ্রহণ করেননি।
পক্ষান্তরে সরলপ্রাণ সংসারত্যাগী ‘যাহিদ’ দরবেশগণ অধিকাংশ সময় রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কোনো কথা শুনামাত্র আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কেউ মিথ্যা বলতে পারেন কখনো তাঁরা তা চিন্তা করেননি। তাঁরা যা শুনেছেন সবই ভক্তের হৃদয়ে শুনেছেন, সরল বিশ্বাসে মেনে নিয়েছেন, আমল করেছেন ও অন্যকে আমল করতে উৎসাহ দিয়েছেন। এজন্য তাবে-তাবেয়ীগণের যুগ হতেই মুহাদ্দিসগণ এ ধরনের নেককার দরবেশদের হাদীস গ্রহণ করতেননা। ইমাম মালিক(১৭৯ হি) বলতেনঃ মদীনায় অনেক দরবেশ আছেন, যাদের কাছে আমি লক্ষ টাকা আমানত রাখতে রাজি আছি, কিন্তু তাঁদের বর্ণিত একটি হাদীসও আমি গ্রহণ করতে রাজি নই।(ড. আমীন আবু লাবী, ইলমু উসূলিল জারহী ওয়াত তা’দীল, ১৬৬-১৬৭)।
ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান(১৯৮ হি) বলেনঃ “নেককার বুযুর্গরা রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিষয়ে যত বেশি মিথ্যা বলেন অন্য কোনো বিষয়ে তাঁরা এমন মিথ্যা বলেননা।” ইমাম মুসলিম(২৬১ হি) এই কথার ব্যাখ্যা বলেনঃ “এই সকল নেককার মানুষেরা ইচ্ছা করে মিথ্যা বলেননা, কিন্তু বেখেয়ালে তাঁরা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন। কারণ তাঁরা হাদীস সঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে পারেননা, উল্টে পাল্টে ফেলেন, অধিকাংশ সময় মনের আন্দাজে হাদীস বলেন, ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন।”(মুসলিম আস-সহীহ ১/১৭-১৮)।
ইবনুস সালাহ(৬৪৩ হি), নববী(৬৭৬ হি), ইরাকী (৮০৬ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার একটি উদাহরণ পেশ করেছেন। এই অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ তাঁর সুনানে সংকলন করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমাদেরকে ইসমাঈল ইবুন মুহাম্মাদ আত-তালহী বলেছেন, আমাদেরকে সাবিত ইবনু মূসা আবু ইয়াযীদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির(রা) থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যার রাতের সালাত অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্য্ময় হবে।”(ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪২২)।
মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে জানতে পেরেছেন যে, এই কথা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বানোয়াট কথা। তবে তা ইচছাকৃত মিথ্যা না অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা এ বিষয়ে তাঁরা মতভেদ করেছেন।
ইবনু মাজহার উস্তাদ ইসমাঈল ও অনেক মুহাদ্দিস এই হাদীসটি আবু ইয়াযিদ সাবিত ইবনু মূসা ইবনু আব্দুর রাহমান(২২৯ হি) থেকে শুনেছেন ও লিখেছেন। একমাত্র তিনিই এই হাদীসটির বর্ণনাকারী। তিনি দাবি করেন যে, শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ(১৭৮ হি) তাকে এই হাদীসটি বলেছেন।
মুহাদ্দিসগণ শারীকের সকল ছাত্রের হাদীস, শারীকের উস্তাদ সুলাইমান ইবনু মিহরান আল আ’মাশ(১৪৭ হি) এর সকল ছাত্রের হাদীস, আ’মাশের উস্তাদ আবু সুফিয়ান তালহা ইবনু নফি’ এর সকল ছাত্রের হাদীস এবং জাবির(রা) এর অন্যান্য ছাত্রের হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে এই হাদীসটি একমাত্র সাবিত ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেননি। তাঁরা দেখেছেন যে, সাবিত ‘শারীক’ এর এমন কোনো ঘনিষ্ট ছাত্র বা দীর্ঘকালীন সহচর ছিলেননা যে, সাবিত আর কাউকে হাদীসটি না বলে শুধুমাত্র তাকেই এই হাদীসটি বলেছেন। এভাবে সামগ্রিক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, সাবিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন।
সাবিত ইবনু মূসা তৃতীয় হিজরী শতকের একজন নেককার আবিদ ও সংসারত্যাগী দরবেশ ছিলেন। তাঁর ধার্মিকতার কারণে সাধারণভাবে মুহাদ্দিসগণ তাঁর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করতেন। তবে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেন যে, তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশ কিছু হাদীস ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণিত। তিনি যে সকল উস্তাদের সূত্রে হাদীসগুলি বলেছেন, সে সকল ওস্তাদের দীর্ঘদিনের বিশেষ ছাত্র বা অন্য কোনো ছাত্র সেই হাদীস বলছেননা। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাঁকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি) সাবিত সম্পর্কে বলেনঃ ‘তিনি মিথ্যাবাদী’।(যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯, ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১৪)।
পক্ষান্তরে আবু হাযিম রাযী(২৭৭ হি), ইবনু আদী(৩৬৫ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস সাবিতের এই মিথ্যাকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, সাবিত মূলত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেননা। সাধারণ আবিদ ছিলেন। তিনি সর্বমোট ৭/৮টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এগুলির মধ্যে দুইটি হাদীস বাদে বাকীগুলি তিনি ঠিকমত বর্ণনা করেছেন। এতে মনে হয় তাঁর ভুল অনিচ্ছাকৃত। এজন্য তাঁরা তাকে স্পষ্টভাবে ‘মিথ্যাবাদী’ না বলে ‘দুর্বল’ বলেছেন। (ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৯৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯)।
কোনো কোনো মুহাদ্দিস সাবিতের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার কারণ উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নুমাইর(২৩৪ হি) বলেন, হাদীসটি বাতিল। সাবিত বুঝতে না পেরে হাদীসটি বলেছেন। শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ হাসি মশকরা করতে ভালবাসতেন। শারীক ইবুন আব্দুল্লাহ হাসি মশকরা করতে ভালবাসতেন। আর সাবিত ছিলেন নেককার আবিদ মানুষ। সম্ভবত, শারীক যখন হাদীস বলছিলেন তখন শারীক সেখানে উপস্থিত হন। শারীক বলছিলেনঃ আমাদেরকে আ’মাশ, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির(রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ(স) থেকে। এমতাবস্থায় সাবিত সেখানে প্রবেশ করেন। সাবিতকে দেখে শারীক হাদীস বলা বন্ধ করে তার সরলতা মন্ডিত উজ্জল চেহারা লক্ষ্য করে বলেনঃ ‘যার রাতের সালাত অধিক হয়, দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্য্ময় হয়। শারীকের এই কথা সাবিত অসাবধানতাবশত উপরের সনদে বর্ণিত হাদীস মনে করেন। এভাবে তিনি শারীকের একটি কথাকে ভুলবশত রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে ইবনু সালাহ, নববী, ইরাকী ও অন্যান্য কোনো মুহাদ্দিস এই হাদীসটিকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছেন। (ইবনু আদী, আল কামিল ২/৯৯, যাহাবী; মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৮; ইরাকী আত তাকয়ীদ, পৃ. ১২৯; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১২৭,১২৮)।

১.৫.৩.২. নেককারগণের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
নেককার বলে পরিচিত কিছু মানুষ এর চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বলতেন। হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে এরাই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক।
তারা যে সকল বিষয়ে হাদীস বানিয়েছেন, তার অনেক বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু এ সকল নেককার মানুষ অনুভব করেছেন যে, এ সকল সহীহ হাদীসের ভাষা ও সেগুলিতে বর্ণিত পুরস্কার ও শাস্তিতে মানুষের আবেগ আসেনা। তাই তারা আরো জোরালো ভাষায়, বিস্তারিত কথায়, অগণিত পুরস্কার ও কঠিনতম শাস্তির কথা বলে হাদীস বানিয়েছেন, যেন মানুষেরা তা শুনেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে তাঁরা ‘ওহীর’ অপূর্ণতা (!) মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে পূরণ(!) করতে চেয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল যে, তাদের ধার্মিকতার(?) কারণে সমাজের অনেক মানুষই এসকল জালিয়াতির খপ্পড়ে পরতেন। তাঁরা এগুলিকে হাদীস বলে বিশ্বাস করেছেন। শুধুমাত্র নাকিদ মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের জালিয়াতি ধরেছেন।
শয়তান এদের বুঝিয়েছিলেন যে, আমরাতো রাসূলুল্লাহ(স) এর বিরুদ্ধে নয়, পক্ষেই কথা বলছি। এ সকল মিথ্যা ছাড়া মানুষদের হেদায়াত করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা শুধু জায়েযই নয় বরং ভাল কাজ।
শয়তান তাদের বুঝতে দেয়নি যে, তাদের সকল চিন্তাই ভুল খাতে প্রবাহিত হয়েছে।মিথ্যা ছাড়া মানুষকে ভাল পথে আনা যাবেনা একথা ভাবার অর্থ হলো, ওহী মানুষকে হেদায়াত করতে সক্ষম নয়। কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীস তার কার্য্কারিতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই আজগুবি মিথ্যা দিয়ে মানুষকে হেদায়াত করতে হবে! কি জঘন্য চিন্তা!
তাদের এসব মনগড়া কথা যে ওহীর পক্ষে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে সে কথা দাবী করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা যে কথাকে ইসলামের পক্ষে বলে মনে করছে তা সর্বদা ইসলামের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে। আজগুবি গল্প, অল্প কাজের অকল্পনীয় সাওয়াব, সামান্য অন্যায় বা পাপের ঘোরতর শাস্তি, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক অলৌকিক কাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট ফযীলতের কাহিনী ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যূত করেছে। অগণিত কুসংস্কার ছাড়িয়েছে তাদের মধ্যে। নফল ইবাদতের সাওয়ারে বানানো মনগড়া কল্পকাহিনী মুসলিম উম্মাহকে ফরয দায়িত্বে ভুলিয়ে দিয়েছে। অগণিত মনগড়া আমল মুসলমানদেরকে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত কর্ম ও দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বানোয়াট হাদীসগুলি আলোচনার সময় এসবের অনেক উদাহরণ দেখতে পাব।
ওহীর পক্ষে মিথ্যা বলার কারণেই যুগে যুগে সকল ধর্ম বিকৃত হয়েছে। ওহীর পক্ষে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃস্টধর্মের বিকৃতিকারী পৌল নামধারী শৌল এবং তার অনুসারী খৃস্টানগণ। এরা ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, যীশুর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও অধিক সংখ্যক মানুষকে সুপথে আনয়ন করার জন্য ওহীর নামে মিথ্যা বলেছে। এরা ভেবেছে যে, আমরা ঈশ্বরের বা যীশুর পক্ষে বলছি, কাজেই এই মিথ্যায় কোনো দোষ নেই। কিন্তু তারা মূলত শয়তানের খেদমত করেছে। এজন্য মহিমাময় আল্লাহ কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
আরবী(********)
-“বল হে কিতাবীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে অন্যায় বাড়াবাড়ি করোনা; এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরলপথ থেকে বিচ্যূত হয়েছে তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করোনা।”(সূরা ৫ মায়িদাঃ ৭৭)।
মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এই ধরনের পথভ্রষ্ট খেয়াল খুশীমত ওহী বানানো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে। তবে সনদ ও সনদ নিরীক্ষা ব্যবস্থার ফলে এদের জালিয়াতি ধরা পড়ে গিয়েছে।
এ সকল ‘নেককার জালিয়াতগণ’ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীস তৈরি করতেন।
ক. কিছু মানুষ কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআনের বিভিন্ন সূরা তিলাওয়াতের ‘অগণিত’ কাল্পনিক সাওয়াব বর্ণনা করে হাদীস তৈরি করতেন।
খ. অন্য অনেকে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত বিভিন্ন নেক আমলের সাওয়াব বর্ণনায় হাদীস বর্ণনা করতেন। যেমন তাসবীহ, যিকির, তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি ইবাদতের জন্য সহীহ হাদীসে অনেক সাওয়াব বর্ণিত আছে। তারা মনে করতেন যে, এ সকল হাদীস মানুষের চিত্ত আকর্ষণ করতে পারেনা। এজন্য এসকল বিষয়ে আকর্ষণীয়(!) হাদীস তৈরি করতেন। অনুরূপভাবে সুন্নাতের পক্ষে ও বিদয়াতের বিপক্ষে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। এ সকল জালিয়াত সেগুলিতে খুশি হতে পারেননি। তাঁরা সুন্নাতের সাওয়াব, মর্যাদা এবং বিদ’আতের পাপ ও বিদ’আতীদের কঠিন পরিণতি ও ভয়ঙ্কর শাস্তির বিষয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছেন।
গ. কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকারের নেক আমল তৈরি করে তার ফযীলতে হাদীস বানাতেন। যেমন বিভিন্ন মাসের বিশেষ পদ্ধতির সালাত, সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্য বিশেষ সালাত, আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা, রাসূলুল্লাহ(স) কে স্বপ্নে দেখা, জান্নাতে নিজের স্থান দেখা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ সালাত। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ‘দুরুদ’, ‘যিকির’, ‘দোয়া’, ‘মুনাজাত’ ইত্যাদি বানিয়ে সেগুলির বানোয়াট ফযীলত উল্লেখ করে হাদীস তৈরি করেছেন। এরূপ অগণিত ‘ইবাদত’ তারা তৈরি করেছেন এবং এগুলির ফযীলতে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অগণিত সাওয়াব ও ফযীলতের কাহিনী বলেছেন।
ঘ. অনেক মানুষের অন্তর নরম করার জন্য সংসারত্যাগ, লোভ, ত্যাগ, ক্ষুধার ফযীলত, দারিদ্র্যের ফযীলত, বিভিন্ন কাহিনী, শাস্তি, পুরস্কার ও অনুরূপ কল্পকাহিনী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে চালিয়েছেন।
এখানে এই ধরনের দু’এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি উল্লেখ করছি। এ সকল মানুষ মুহাদ্দিসগণের নিকট তাদের মিথ্যা সনদগুলি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত। তবে তাঁদের নিরীক্ষামূলক প্রশ্নের সামনে অনেক সময় স্বীকার করতো যে, তারা হাদীস জালিয়াতি করছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রখ্যাত আলিম, আবিদ ও ফকীহ আবু ইসমাহ নূহ ইবনু আবু মারিয়াম(১৭৩ হি)। হাদীস, ফিকহ, ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তার চৌকস পান্ডিত্যের কারণে তাকে ‘আল-জামি’ বলা হতো। খলীফা মানসূরের সময়ে (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে খোরাসানের মারভ অঞ্চলের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। তাকে সেই এলাকার অন্যতম আলীম বলে গণ্য করা হতো। মু’তাযিলা, জাহমিয়া, আহলুর রাই ফকীহ ও বিদ’আতী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ছিলেন।
এত কিছু সত্ত্বেও তিনি হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বলতেন। তিনি কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে কিছু হাদীস বর্ণনা করতেন। মুহাদ্দিসগণ তাকে প্রশ্ন করেনঃ আপনি ইকরিমাহ থেকে আবু ইবনু আব্বাস থেকে কুরআনের প্রত্যেক সূরা ফযীলতে যেসব হাদীস বলেন তা আপনি কোথায় পেলেন? ইকরিমাহ এর ঘনিষ্ঠ ছাত্রগণ বা অন্য কোনো ছাত্র এই হাদীস বর্ণনা করেননা, অথচ আপনি কিভাবে তা পেলেন? তখন তিনি বলেনঃ আমি দেখলাম, মানুষ কুরআন ছেড়ে দিয়েছে। তারা আবু হানীফার ফিকহ ও ইবুন ইসহাকের মাগাযী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য আমি তাদেরকে কুরআনের দিকে ফিরিয়ে আনতে এই হাদীস বানিয়েছি। (ইবনুল জাউযী, আল-মাউদূআত ১/১৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৭/৫৫-৫৭)।
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আবিদ, আলিম ও ওয়ায়িয আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু গালীব গুলাম খালীল(২৭৫ হি)। তিনি রাজধানী বাগদাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংসারত্যাগী আবিদ বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি সর্বদা শাক-সব্জি খেতেন, অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ওয়ায করতেন। ‘আহলুর রাই’ বলে কথিত (হানাফী) ফকীহগণের বিরুদ্ধে, মু’তাযিলা, শিয়া, কাদারিয়া, জাবারিয়া ও অন্যান্য বিদ’আতী মতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। সাধারণের মধ্যে তার ওয়াজের প্রভাব ছিল অনেক। শ্রোতাদের মন নরম করতে ও তাদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তিনি নিত্য নতুন গল্পকাহিনী হাদীসের নামে জালিয়াতি করে বলতেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নামে সনদ তৈরি করে তিনি মিথ্যা হাদীসগুলি বলতেন।
আবু জা’ফার ইবনুশ শুআইরী বলেন, একদিন গুলাম খালীস হাদীস বলতে গিয়ে বলেন, আমাকে বাকর ইবনু ঈসা(২০৪ হি) বলেছেন, তিনি আবু উওয়ানা থেকে………। আমি বললাম, বাকর ইবনু ঈসা তো অনেক পুরাতন মানুষ। ইমাম আহমদ(২৪১ হি) ও তাঁর পর্যায়ের মানুষেরা তার নিকট হতে হাদীস শুনেছেন। আপনি তাকে জীবিত দেখেননি। একথা বলার পর তিনি চুপ করে চিন্তা করতে থাকেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আমার বিরুদ্ধে কিছু বলে ফেলেন কিনা। এজন্য আমি বললামঃ হতে পারে যে, আপনার উস্তাদ বাকর ইবনু ঈসা অন্য আরেক ব্যক্তি। তিনি চুপ করে থাকলেন। পরদিন তিনি আমাকে বললেনঃ আমি গতরাতে চিন্তা করে দেখেছি, বসরায় আমি বাকর ইবনু ঈসা নামের ৬০ ব্যক্তির নিকট হতে হাদীস শুনেছি।(যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/২৮৫)।
মিথ্যার বাহাদুরী দেখুন! হাদীসের ‘নকিদ’ ইমামদের নিকট এই ধরনের ‘ঠান্ডা’ মিথ্যার কোনো মূল্য নেই। বসরায় কোন যুগে কতজন রাবী ছিলেন নামধামসহ তাদের বর্ণিত হাদীস তার সংগ্রহ ও সংকলিত করেছেন।এজন্য এরা অনেক সময় জালিয়াতি স্বীকার করতে বাধ্য হতো।
চতুর্থ শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনু আদী(৩৬৫ হি)বলেন হাদীস সংগ্রহের সফরে যখন হাররান শহরে ছিলাম তখন আবু আরূবার মজলিসে আবু আবদুল্লাহ নাহাওয়ান্দী বলেন, আমি গুলাম খালীলকে বললাম, শ্রোতাদের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তারকারী যে হাদীসগুলি বলছেন সেগুলি কোথায় পেলেন? তিনি বলেনঃ মানুষের হৃদয় নরম করার জন্য আমি এগুলি বানিয়েছি।(ইবনু আদী, আল কামিল ১/১৯৫)।
এ সকল নেককার মানুষের জালিয়াতির ক্ষতি সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রের সকল ইমামই আলোচনা করেছেন। ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে ইবনুস সালাহ, নববী ও ইরাকীর বক্তব্য দেখেছি। এ বিষয়ে আল্লামা সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী হানাফী(৮১৬ হি) লিখেছেনঃ “মাওযূ বা বানোয়াট হাদীসের প্রচলনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন দুনিয়াত্যাগী দরবেশগণ, তাঁরা অনেক সময় সাওয়াবের নিয়্যতেও মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলেছেন।”(আবদুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী ফী মুখতাসারিল জুরজানী, ৪৩৩ পৃ)।
ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২ হি) বলেনঃ “বর্ণিত আছে যে, কোনো কোনো সূফী সাওয়াবের বর্ণনায় ও পাপাচারের শাস্তির বর্ণনায় মিথ্যা হাদীস বানানো ও প্রচার করা জায়েজ মনে করতেন।”(মোল্লা আলী কারী, শারহু শারহি নুখবাতুল ফিকর, পৃ. ৪৫১)।
সুয়ূতী(৯১১ হি) বলেন, জালিয়াতের উদ্দেশ্য অনুসারে জালিয়াতগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ছিলেন কিছু মানুষ যাদেরকে সংসারত্যাগী নির্লোভ নেককার মনে করা হতো। তাঁরা তাঁদের বিভ্রান্তির কারণে আল্লাহর নিকট সাওয়াব পাওয়ার আশায় মিথ্যা হাদীস বানাতেন। …………..(২য় শতকের প্রখ্যাত দরবেশ) আবু দাউদ নাখয়ী সুলাইমান ইবনু আমর রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ে ও দিনের পর দিন নফল সিয়াম পালনে ছিলেন অতুলনীয়। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতেন।……আবু বিশর আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ আল মারওয়াযী খোরাসানের অন্যতম ফকীহ, আবিদ ও সুন্নাতের সৈনিক ছিলেন।
সুন্নাতের পক্ষে এবং বিদ’আত ও বিদ’আতপন্থীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে মনে করতেন। ……..ওয়াহাব ইবনু ইয়াহইয়া ইবুন হাফস(২৫০ হি) তার যুগের অন্যতম নেককার আবিদ ও ওয়ায়িয ছিলেন। ২০ বৎসর কারো সাথে তিনি কোনো জাগতিক কথা বলেননি। তিনিও হাদীসের নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলতেন। (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮১-২৮৩)।
আল্লামা আলী কারী (১০১৪ হি) লিখেছেনঃ অত্যধিক ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত সংসারত্যাগী দরবেশগণ শবে-বরাতের নামায, রজব মাসের নামায ইত্যাদি বিভিন্ন ফযীলতের বিষয়ে অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করেছেন। তাঁরা মনে করতেন, এতে তাঁদের সওয়াব হবে, দ্বীনের খেদমত হবে। বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে নিজেদের এবং অন্যান্য মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন এই সকল মানুষ। তাঁরা এই কাজকে নেককাজ ও সাওয়াবের কাজ মনে করতেন, কাজেই তাঁদেরকে কোনোভাবেই বিরত রাখা সম্ভব ছিলনা। অপরদিকে তাঁদের নেককর্ম, সততা, ইবাদত বন্দেগী ও দরবেশির কারণে সাধারণ মুসলিম ও আলিমগণ তাঁদের ভালবাসতেন ও অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের কথাবার্তা আগ্রহের সাথে গ্রহণ করতেন ও বর্ণনা করতেন। অনেক সময় ভাল মুহাদ্দিসও তাঁদের আমল আখলাকে ধোঁকা খেয়ে তাঁদের বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীস অসতর্কভাবে গ্রহণ করে নিতেন। (মুল্লা আলী কারী, শারহু শারহি নুখবাতুল ফিকর, পৃ. ৪৪৭-৪৪৮)।

১.৫.৪. আমীরদের মোসাহেবগণ
উপরে ব্যাখ্যাত উদ্দেশ্যগুলি মূলত ধর্মীয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়াও জাগতিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অনেক মানুষ হাদীস বানিয়েছে অর্থ কামাই, সম্মান বা সুনাম অর্জন, রাজা-বাদশাহদের দৃষ্টি আকর্ষণ, দরবারে মর্যাদা লাভ, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তারা হাদীস বানিয়েছে।
শাসক-প্রশাসকদের কাছে যাওয়ার ও তাদের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য মানুষ অনেক কিছুই করে থাকে। দ্বিতীয় হিজরী শতকে কোনো কোনো দুর্বল ঈমান ‘আলিম’ খলীফা বা আমীরদের মন জয় করার জন্য তাদের পছন্দ মোতাবেক হাদীস বানানোর চেষ্টা করেছেন। এই ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস যুহাইর ইবুন হারব(২৩৪ হি) বলেনঃ তৃতীয় আব্বাসী খলীফা মুহাম্মাদ মাহদী(রাজত্বকাল ১৫৮-১৬৯ হি) এর দরবারে কয়েকজন মুহাদ্দিস আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন গিয়াস ইবনু ইবরাহীম আন-নাখায়ী। খলীফা মাহদী উন্নত জাতের কবুতর উড়াতে ও কবুতরের প্রতিযোগিতা করাতে ভালবাসতেন। খলীফার পছন্দের দিকে লক্ষ্য করে গিয়াস নামক ঐ ব্যক্তি তার সনদ উল্লেখ করে বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ ‘তীর নিক্ষেপ, ঘোড়া ও পাখি ছাড়া আর কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই।’ একথা শুনে মাহদী খুশী হন এবং উক্ত মুহাদ্দিসকে ১০ হাজার টাকা হাদীয়া প্রদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু যখন গিয়াস দরবার ত্যাগ করছিলেন তখন মাহদী বলেন, আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি মিথ্যা বলেছেন। আমি আপনাকে মিথ্যা বলতে প্ররোচিত করেছি। তিনি কবুতরগুলি জবাই করতে নির্দেশ দেন। তিনি আর কখনো উক্ত মুহাদ্দিসকে তার দরবারে প্রবেশ করতে দেননি।(খতীব বাগদাদী, আহমদ ইবনু আলী, তারীখ বাগদাদ ১২/৩২৩-৩২৪)।
এখানে লক্ষণীয় যে, মূল হাদীসটি সহীহ, যাতে ঘোড়দৌড়, উটদৌড় ও তীর নিক্ষেপে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। [তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা(২৭৯ হি), আস-সুনান ৪/২০৫]। এই ব্যক্তি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য সেখানে পাখি শব্দটি যোগ করেছে।
পঞ্চম আব্বাসী খলীফা হারুন আর রাশীদ(শাসনকাল ১৯৩-১৭০ হি) রাষ্ট্রীয় সফরে মদীনা আগমন করেন। তিনি মসজিদের নববীর মিম্বারে উঠে বক্ততা প্রদানের ইচ্ছা করেন। তাঁর পরনে ছিল কাল শেরওয়ানী। তিনি এই পোশাকে মিম্বারে নববীতে আরোহন করতে দ্বিধা করছিলেন। মদীনার মশহুর আলিম ও বিচারক ওয়াহব ইবনু ওয়াহব আবুল বুখতুরী তখন বলেনঃ আমাকে জা’ফর সাদিক বলেছেন, তাঁকে তাঁর পিতা মুহাম্মাদ আল বাকির বলেছেন, জিবরাঈল (আ)কালো শেরোয়ানী পরিধান করে রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট আগমন করেন। (খতীব বাগদাদী, তারিখ বাগদাদ ১৩/৪৫২)।
এভাবে তিনি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালালেন। আবুল বুখতুরী হাদীস জালিয়াতিতে খুবই পারদর্শী ছিলেন।
১.৫.৫. গল্পকার ওয়ায়েযগণ
ওয়াযের মধ্যে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ, মনোরঞ্জন, তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার ও নিজের সুনাম, সুখ্যাতি ও নগদ উপার্জন বৃদ্ধির জন্য অনেক মানুষ ওয়াযের মধ্যে বানোয়াট কথা হাদীস নামে বলেছেন। মিথ্যা ও জাল হাদীসের প্রসারে এসকল ওয়ায়েয ও গল্পকারদের ভূমিকা ছিল খুব বড়। হাদীসের নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলতে এদের মিথ্যা কথা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতা ছিল খুব বেশি। তাদের অনেকেই শ্রোতাদের অবাক করে পকেট খালি করার জন্য শ্রোতাদের চাহিদা মত মিথ্যা বানিয়ে নিতেন দ্রুত। এছাড়া কোনো জালিয়াতের জাল হাদীস বা গল্প কাহিনী আকর্ষণীয় হলে অন্যান্য ওয়ায়িয জালিয়াতরা তা চুরি করত এবং নিজের নামে সনদ বানিয়ে প্রচার করত।(ফাল্লাতা, আল ওয়াদউ ১/২৭২-২৭৯)।
এদের বুদ্ধি ও দুঃসাহসের নমুনা দেখুন। তৃতীয় হিজরী শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি) ও ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল(২৪১ হি)। তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথমার্ধে বাগদাদে ও পুরো মুসলিম বিশ্বে তাঁদের পরিচিতি। তাঁরা দুজন একদিন বাগদাদের এক মসজিদে সালাত আদায় করেন। সালাতের পরে এজন ওয়ায়িয ওয়ায করতে শুরু করেন। ওয়াযের মধ্যে তিনি বলেন, আমাকে আহমাদ ইবনু হাম্বাল ও ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন দুজনেই বলেছেন, তাঁদেরকে আব্দুর রাযযাক, তাঁকে মা’মার, তাঁকে কাতাদাহ, তাঁকে আনাস বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যদি কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে তবে এর প্রত্যেক অক্ষর থেকে একটি পাখি তৈরি করা হয়, যার ঠোঁট স্বর্ণের, পালকগুলি মহামূল্যবান পাথরের……..। এভাবে সে আজগুবি গল্প ও অনেক সাওয়াবের কাল্পনিক কাহিনী বর্ণনা করে।ওয়ায শেষে উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকেই তাকে কিছু কিছু ‘হাদীয়া’ প্রদান করেন।
ওয়ায চলাকালীন আহমদ ও ইয়াহইয়া অবাক হয়ে একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করেন, এ হাদীস কি আপনি ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন? উভয়েই বলেন, জীবনে আজই প্রথম হাদীসটি শুনেছি। ওয়ায শেষে মানুষের ভীড় কম পেয়ে ইয়াহইয়া লোকটিকে কাছে আসতে ইঙ্গিত করে। লোকটি কিছু হাদীয়া পাবে ভেবে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে। ইয়াহইয়া তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ হাদীসটি তোমাকে কে বলেছে? লোকটি জবাব দিল, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমদ ইবনু হাম্বাল। তিনি বলেন, আমিতো ইয়াহইয়া আর ইনি আহমদ। আমরা দুজনের কেউই এ হাদীস জীবনে শুনিনি, কাউকে শেখানোতো দূরের কথা। মিথ্যা যদি বলতেই হয় তবে অন্য কারো নামে বল, আমাদের নামে বলবেনা। তখন লোকটি বলে, আমি সবসময় শুনতাম যে, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন লোকটি আহম্মক, এখন তার প্রমাণ পেলাম। ইয়াহইয়া বললেন, কিভাবে? সে বলে, আপনারা কি মনে করেন যে, দুনিয়াতে আপনারা ছাড়া আর কোনো ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও আহমদ ইবনু হাম্বাল নেই? আমি আপনার সাথী আহমদ ছাড়া ১৬ জন আহমদ ইবনু হাম্বাল এর কাছে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছি। একথা শুনে আহমদ ইবনু হাম্বাল মুখে কাপড় দিয়ে বলেন, লোকটিকে যেতে দিন। লোকটি দুজনের দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। (ইবনুল জাউযী, আল মাউদূয়াত ১/২১-২২)।
৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আবু হিতাম মুহাম্মাদ ইবনু হিব্বান আল বুসুতী(৩৫৪ হি) বলেনঃ আমি আমার হাদীস সংগ্রহের সফরকালে সিরিয়ার ‘তাজরোয়ান’ নামক শহরে প্রবেশ করি। শহরের জামে মসজিদে সালাত আদায়ের পরে এক যুবক দাঁড়িয়ে ওয়ায শুরু করে। ওয়াযের মধ্যে সে বলে, আমাকে আবু খালীফা বলেছেন, তাঁকে ওয়ালীদ বলেছেন, তাঁকে শু’বা বলেছেন, তাঁকে কাতাদাহ বলেছেন, তাঁকে আনাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, যদি কেউ কোনো মুসলিমের প্রয়োজন পূরণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে এত এত পুরস্কার প্রদান করেন…..এভাবে সে অনেক কথা বলে। তার কথা শেষ হলে আমি তাকে ডেকে বললাম, তোমার বাড়ি কোথায়? সে বলেঃ আমি বারদায়া এলাকার মানুষ। আমি বললা, তুমি কি কখনো বসরায় গিয়েছ? সে বললঃ না। তাহলে কিভাবে তুমি আবু খালীফা থেকে হাদীস বর্ণনা করছ, অথচ তুমি তাঁকে কখনো দেখনি? যুবকটি বললঃ এ বিষয়ে প্রশ্ন করা ভদ্রতা ও আদাবের খেলাফ। এই একটি মাত্র সনদই আমার মুখস্ত আছে। আমি যখনই কোনো হাদীস বা কথা কারো কাছে শুনি, আমি তখন সেই কথার আগে এই সনদটি বসিয়ে দিয়ে কথাটি বর্ণনা করি। ইবনু হিব্বান বলেন, তখন আমি যুবকটিকে রেখে চলে আসলাম।(ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত ১/২২)।
৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবুল ফারাজ ইবনুল জাউযী(৫৯৭ হি) বলেন, আমার এলাকায় একজন ওয়ায়িয আছেন। তিনি বাহ্যত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু মানুষ। কাজে কর্মে দরবেশী ও তাকওয়া প্রকাশ করেন। তার বিষয়ে আমার দুজন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আলিম বন্ধু বলেছেন, এক আশুরার দিনে ঐ লোকটি বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, যে আশুরার দিনে এই কাজ করবে তার এই পুরস্কার, যে এই কাজ করবে তার এই পুরস্কার……..এভাবে অনেক কাজের অনেক পুরস্কার বিষয়ক হাদীস তিনি বলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলা, এই হাদীসগুলি আপনি কোথা হতে মুখস্ত করলেন? তিনি বলেনঃ আল্লাহর কসম, আমি কখনো এই হাদীসগুলি শিখিনি বা মুখস্ত করিনি। এই মুহুর্তেই এগুলি আমার মনে এল এবং আমি বললাম।(ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত ১/২০)।
ইবনুল জাউযী বলেন, আমার সমকালীন একজন ওয়ায়িয এ সকল মিথ্যা হাদীস দিয়ে একটি বইও লিখেছে। সেই বইয়ের একটি জাল হাদীস নিম্নরূপঃ একদিন হাসান(রা) ও হুসাইন (রা) খলীফা উমার(রা) এর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। উমার(রা) ব্যস্ত ছিলেন। হাতের কাজ শেষ করে মাথা উঠিয়ে তিনি তাঁদের দুজনকে দেখতে পান। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদেরকে চুমু থান, প্রত্যেককে ১০০০ মুদ্রা প্রদান করেন এবং বলেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি আপনাদের আগমন বুঝতে পারিনি। তাঁরা দুজনে ফিরে যেয়ে তাঁদের পিতা আলী(রা) এর নিকট উমরের(রা) আদব ও বিনয়ের কথা উল্লেখ করেন। তখন আলী(রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছি, উমার ইবনুল খাত্তাব ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। তাঁরা দুজনে উমারের(রা) কাছে ফিরে যেয়ে তাঁকে এই হাদীস শোনান। তখন তিনি কাগজ ও কালি চেয়ে নিয়ে লিখেনঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, জান্নাতের যুবকদের দুই নেতা আমাকে বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের পিতা আলী মুরতুযা থেকে, তাঁদের নানা নবী মুসতাফা(স) থেকে, তিনি বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। উমার ওসীয়ত করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁর কাফনের মধ্যে বুকের উপরে কাগজটি রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ওসীয়ত মত কাজ করা হয়। পরদিন সকালে সকলে দেখতে পান যে, কাগজটি কবরের উপরে রয়েছে এবং তাতে লিখা রয়েছেঃ হাসান ও হুসাইন সত্য বলেছেন, তাঁদের পিতা সত্য বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) সত্য বলেছেন, উমার ইসলামের নূর ও জান্নাতবাসীদের প্রদীপ।
ইবনুল জাউযী বলেন, সবচেয়ে দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হলো, এই জঘন্য মিথ্যা ও আজগুবি কথা লিখেই সে সন্তুষ্ট থাকেনি। আমাদের যুগের অনেক আলিমকে তা দেখিয়েছে। হাদীসের সনদ ও বিশুদ্ধতাবিষয়ক জ্ঞানের অভাব আলিমদের মধ্যেও এত প্রকট যে, অনেক আলিম এই জঘন্য মিথ্যাকেও সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। (ইবনুল জাউযী, আল মাউদূআত ১/২০-২১)।

১.৫.৬. আঞ্চলিক, পেশাগত বা জাতিগত বৈরিতা
বিভিন্ন বংশ, জাতি, দেশ বা শহরের মানুষেরা নিজেদের প্রাধান্য বা মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক সময় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। আরব জাতি ও আরবী ভাষার পক্ষে , ফার্সী ভাষা ও পারসিক জাতির বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে। অনুরূপভাবে ফার্সী ভাষার পক্ষে ও আরবী ভাষার বিপক্ষে হাদীস জালিয়াতি করা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণের বা পেশার পক্ষে বা বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে। এ সকল বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছেঃ ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা হলো ফার্সী ভাষা।’ ‘আল্লাহ যখন ক্রোধান্বিত হন তখন আরবীতে ওহী নাযিল করেন, যখন সন্তুষ্ট থাকেন তখন ফার্সীতে ওহী নাযিল করেন।’ ‘আরশের আশেপাশে যে সকল ফেরেশতা রয়েছেন তাঁরা ফার্সী ভাষায় কথা বলেন।’ অনুরূপভাবে তাঁতীদের বিরুদ্ধে, স্বর্ণকারদের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য পেশার বিরুদ্ধে কুৎসা ও নিন্দামূলক হাদীস তৈরি করা হয়েছে পেশাগত হিংসাহিংসির কারণে।
বিভিন্ন শহর, দেশ বা জনপদের ফযীলতে বা নিন্দায় হাদীস বানানো হয়েছে। বলতে গেলে তৃতীয় হিজরী শতকের পরিচিত প্রায় সকল শহর বা দেশের প্রশংসায় বা নিন্দায় হাদীস বানানো হয়েছে। মক্কা, মদীনা ইত্যাদি যে সকল শহরের ফযীলতে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলির জন্যও অনেক চিত্তাকর্ষক জাল হাদীস বানানো হয়েছে। (বিস্তারিত দেখুনঃ ইবনুল জাউযী, আল-মাউদূআত ১/৩৫৭-৩৭৩, ২/১৪৭-১৬১; ফাল্লাতা, আল ওয়াদউ ১/২৬০-২৬৩)।
১.৫.৭. প্রসিদ্ধির আকাঙ্খা
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, তৎকালীন যুগে সনদ ও মতন ছিল হাদীসের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সনদ ও মতনের সম্মিলিত রূপকেই হাদীস বলা হত। এই সমন্বিতরূপের হাদীস মুহাদ্দিসগণের কাছে সুপরিচিত ছিল। অনেক সময় কোনো মুহাদ্দিস প্রসিদ্ধির বা স্বকীয়তার জন্য এই সমন্বিত রূপের মধ্যে পরিবর্তন আনতেন। এক সনদের হাদীস অন্য সনদে বা এক রাবীর হাদীস অন্য রাবীর নামে বর্ণনা করতেন। মিথ্যার প্রকারভেদের মধ্যে আমরা মিথ্যা সনদ বানানোর বিষয়ে দু একটি উদাহরণ উল্লেখ করব, ইনশাল্লাহ।

১.৬. মিথ্যার প্রকারভেদ
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদীসের নামে মিথ্যা’ বলার বিভিন্ন প্রকার ও পদ্ধতি রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে আমরা সেইগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ।
১.৬.১. সনদে মিথ্যা
‘সনদ’ ও ‘মতন’ এর সম্মিলিত রূপই হাদীস। হাদীস বানাতে হলে সনদ জালিয়াতি অত্যাবশ্যক। আবার অনেক সময় সনদ জালিয়াতিই ছিল জালিয়াতের মূখ্য উদ্দেশ্য। মিথ্যাবাদীগণ তাদের উদ্দেশ্য ও সামর্থ্য অনুসারে সনদে জালিয়াতি করত। এসব জালিয়াতি কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
১.৬.১.১. বানোয়াট কথার জন্য বানোয়াট সনদ,
সনদ ছাড়া কোনো হাদীস গ্রহণ করা হতোনা। কাজেই একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালাতে হলে তার সাথে একটি হাদীস বলতে হবে। অধিকাংশক্ষেত্রে জালিয়াতগণ নিজেদের মনগড়াভাবে বিভিন্ন সুপরিচিত আলিমদের নামে সনদ বানিয়ে নিত। অথবা তাদের মুখস্ত কোনো সনদ বিভিন্ন বানোয়াট হাদীসের আগে জুড়ে দিত। আমরা ইতোপূর্বে আলোচিত বিভিন্ন বানোয়াট হাদীসে তা দেখতে পেয়েছি। এভাবে অধিকাংশ বানোয়াট হাদীসের সনদও মনগড়া। একটি উদাহরণ দেখুনঃ
ইমাম ইবনু মাজাহ বলেন, আমাকে সাহল ইবনু আবী সাহল ও মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বলেছেন তাদেরকে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ আবুস সালাত হারাবী বলেছেনঃ আমাকে আলী রেযা, তিনি তাঁর পিতা মূসা কাযিম, তিনি তাঁর পিতা জাফর সাদিক, তিনি তাঁর পিতা মুহাম্মাদ বাকির, তিনি তার পিতা আলী যাইনুল আবেদীন, তিনি তাঁর পিতা ইমাম হুসাইন(রা), তিনি তাঁর পিতা আলী(রা) হতে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “ঈমান হলো অন্তরের মা’রিফাত বা জ্ঞান, মুখের কথা ও বিধিবিধান অনুসারে কর্ম করা।”
তাহলে অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও কর্মের বাস্তবায়নের সামষ্টিক নাম হলো ঈমান। কথাটি খুবই আকর্ষণীয়। অনেক তাবেয়ী ও পরবর্তী আলিম এভাবে ঈমানের পরিচয় প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইবনু হাম্বাল প্রমুখ এই মত গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা বলেনঃ ঈমান মূলত মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতির নাম। কর্ম ঈমানের অংশ নয় বরং দাবি ও পরিণতি। ঈমান ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। এই হাদীসটি সহীহ হলে তা ইমাম আবু হানীফার মতের বিভ্রান্তি প্রমাণ করে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় হাদীসটি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পাঠক লক্ষ্য করুন। এই হাদীসের রাবীগণ রাসূলুল্লাহ(স) এর বংশের অন্যতম বুযুর্গ ও শিয়া মাযহাবের ১২ ইমামের ৭ জন। এজন্য সহজেই আমরা সরলপ্রাণ মুসলমানরা ধোঁকা খেয়ে যাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ(স) এর সুন্নাতের হেফাজতে নিয়োজিত মুহাদ্দিসগণকে এভাবে প্রতারণা করা সম্ভবপর ছিলনা। তাঁরা তাঁদের নিয়মে হাদীসটি নিরীক্ষা করেছেন। তাঁরা তাঁদের নিরীক্ষায় দেখেছেন যে, সনদে উল্লেখিত ৭ প্রসিদ্ধ ইমাম এর কোনো ছাত্র এই হাদীসটি বর্ণনা করেননি এবং অন্য কোনো সনদেও হাদীসটি বর্ণিত হয়নি।
শুধুমাত্র আব্দুস সালাম আবুস সালাত দাবি করলেন যে, ইমাম আলী রেযা(২০৩ হি) তাকে এই হাদীসটি বলেছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর ইন্তিকালের ২০০ বছর পরে এসে আবুস সালত নামের এই ব্যক্তি হাদীসটি প্রচার করেছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, আব্দুস সালাম আবুস সালাত নামক এই ব্যক্তি অনেক হাদীস শিক্ষা করেছেন ও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে অনেক ভুল। তিনি এমন সব হাদীস বিভিন্ন মুহাদ্দিস বা আলিম এর নামে বলেন যা তাদের অন্য কোনো ছাত্র বলেননা। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি হাদীস ঠিকমত মুখস্ত রাখতে পারতেননা। তবে তিনি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বলতেন কিনা তা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিধা রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও কতিপয় ইমাম বলেছেন যে, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ভাল ছিলেন বলেই দেখা যায়। শিয়া হলেও বাড়াবাড়ি করতেননা। কিন্তু তিনি অগণিত উল্টাপাল্টা ও ভিত্তিহীন(মুনকার) হাদীস বলেছেন যা আর কোনো বর্ণনাকারী কখনো বর্ণনা করেননি। তবে তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা বলতেননা বলে বুঝা যায়। অপরপক্ষে আল জুযানী, উকাইলী প্রমুখ ইমাম বলেছেন যে, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন। (বিস্তারিতঃ ইবনু হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ৬/২৮৫-২৮৬, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ৩৫৫)।
যারা তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে মন্তব্য করেছেন, তাঁরা হাদীসটিকে বাতিল, ভিত্তিহীন, খুবই যয়ীফ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। আর যারা তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে দেখেছেন, তাঁরা হাদীসটিকে মাওযূ বা বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন। (আল-বুসীরী, যাওয়াইদ ইবনু মাজাহ, পৃ.৩৭)।
অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনুল কাইয়িম মুহাম্মাদ ইবুন আবু বাকর(৭৫১ হি) হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং আমলকে ঈমানের অংশ বলে গণ্য করতেন। তাঁর মতে ঈমান হলো অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও বিধিবিধান পালন। তিনি এই মতের পক্ষে দীর্ঘ আলোচনার পরে বলেন, তবে এই বিষয়ে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ বর্ণিত যে হাদীসটি ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন, সে হাদীসটি মাউযূ, তা রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা নয়।(ইবনুল কাইয়েম, হাশিয়াত আবী দাউদ ১২/২৯৪)।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই সনদের সকল রাবী অত্যন্ত প্রসিদ্ধ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এ হলো জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশক্ষেত্রে জালিয়াতগণ তাদের জালিয়াতি চালানোর জন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সনদ তৈরি করতো। তাদের এই জালিয়াতি সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিলেও নিরীক্ষক মুহাদ্দিসদের ধোঁকা দিতে পারতোনা। কারণ সনদে জালিয়াতের নাম থেকে যেতে। জালিয়াত যাকে উস্তাদ বলে দাবী করত, তার নাম থাকত। উস্তাদের অন্যান্য ছাত্রের বর্ণিত হাদীস এবং এই জালিয়াতের বর্ণিত হাদীসের তুলনা ও নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
জালিয়াতির আরেকটি উদাহরণ দেখুন। ইসমাঈল ইবুন যিয়াদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের এজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি বলেনঃ আমাকে সাওর ইবনু ইয়াযিদ (১৫৫ হি) বলেছেন, তিনি খালিদ ইবনু মা’দান থেকে(মৃ. ১০৩ হি), তিনি মু’আয ইবনু জাবাল থেকে বর্ণনা করেছেন, আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা কি বিনা ওযূতে কুরআন স্পর্শ করতে পারব? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ, তবে যদি গোসল ফরয হয়ে থাকে তাহলে কুরআন স্পর্শ করবেনা। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাহলে কুরআনের বাণী ‘পবিত্রগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করেনা’ (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৭৯) এর অর্থ কি? তিনি বলেনঃ এর অর্থ হলো- কুরআনের সাওয়াব মুমিনগণ ছাড়া কেউ পাবেনা।”
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এই হাদীসটি বানোয়াট। হাদীসের ইমামগণ ইসমাঈল ইবু যিয়াদ(আবী যিয়াদ) নামক এই ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করে অন্যান্য সকল বর্ণনার সাথে তুলনামূলক নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন যে, এই ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস কোনোটিই সঠিক নয়। তিনি একজন ভাল আলিম ছিলেন এবং মাওসিল নামক অঞ্চলের কাযী বা বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি শু’বা(১৬০ হি), ইবনু জুরাইজ(১৫০ হি), সাওর(১৫৫ হি) প্রমুখ তৎকালীন বিভিন্ন সুপরিচিত মুহাদ্দিসের নামে এমন অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা তারা কখনো বলেননি বা তাদের কোনো ছাত্র তাদের থেকে বর্ণনা করেননি।
যেমন এখানে সাওর এর নামে হাদীসটি বলেছেন তিনি। সাওর দ্বিতীয় হিজরী শতকের সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। তাঁর অগণিত ছাত্র ছিল। অনেকে বছরের পর বছর তাঁর কাছ হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। কোনো ছাত্রই তাঁর কাছ হতে হাদীসটি বর্ণনা করেনি। অথচ ইসমাঈল তার নামে হাদীসটি বললেন। অবস্থা দেখে মনে হয় তিনি ইচ্ছাপূর্বক এভাবে বানোয়াট হাদীস বলতেন। ইমাম দারকুতনী, ইবনু আদী, ইবনুল হিব্বান, ইবনুল জাউযী ও অন্যান্য ইমাম এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তাকে দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী বলেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীস, যা একমাত্র তিনিই বর্ণনা করেছেন, অন্য কেউ বর্ণনা করেননি, এরূপ সকল হাদীসকে তাঁরা মাওযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
এই ইসমাঈল বর্ণিত আরেকটি বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যা তিনি রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস হিসেবে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি বলেনঃ আমাকে গালিব আল কাত্তান, তিনি আবু সাঈদ মাকরাবী থেকে তিনি আবু হুরাইরা(রা) হতে বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা হলো ফার্সী ভাষা, আর জান্নাতের অধিবাসীদের ভাষা হলো আরবী ভাষা।” (ইবনু আদী, আল কামিল ১/৫১০-৫১১, ইবনু হিব্বান, মাজরুহীন ১/১২৯)।
১.৬.১.২. প্রচলিত হাদীসের জন্য বানোয়াট সনদ
আমরা দেখেছি যে, অনেক সময় জালিয়াতের উদ্দেশ্য হতো নিজের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তারা প্রচলিত মতন বা বক্তব্যের জন্য বিশেষ সনদ তৈরি করত। এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
ইমাম মালিক দ্বিতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণের অন্যতম ইমাম। তিনি তাঁর উস্তাদ নাফী থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের সূত্রে রাসূলুল্লাহ (স) থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এজন্য “মালিক, নাফি থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে” অত্যন্ত সহীহ ও অতি প্রসিদ্ধ সনদ। এই সনদে বর্ণিত সকল মুহাদ্দিসগণের নিকট সংরক্ষিত।
তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল মুনইম ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে মালিক বলেছেন, তিনি নাফি থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “হে আল্লাহ! আমার উম্মতের জন্য তাদের সকলের সময়ে বরকত দান করুন।” [খালীলী, খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ (৪৪৬ হি), আল ইরশাদ, পৃ. ৭]।
৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ আল খালীলী (৪৪৬ হি) বলেনঃ এটি একটি মাউদূ বা বানোয়াট হাদীস। আব্দুল মুনইম নামক এই ব্যক্তি ছিল একজন মিথ্যাবাদী জালিয়াত। ইমাম আহমদের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন, আমি একদিন তোমার পিতাকে বললামঃ আমি আবদুল মুনইম ইবনু বাশীরকে বাজারে দেখলাম। তিনি বলেনঃ বেটা, সেই মিথ্যাবাদী জালিয়াত এখনো বেঁচে আছে? এই হাদীস এই সনদে একেবারেই ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন। কখনোই কেউ তা মালিক থেকে বা নাফি থেকে বর্ণনা করেনি। এই হাদীস মূলত সাখার আল গামিদী নামক সাহাবী রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণনা করেছেন।(খালীলী, আল ইরশাদ, পৃ. ৭)।
এখানে আমরা দেখছি যে, আল্লামা খালীলী হাদীসটিকে মাওযূ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আবার তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন যে্, হাদীসটি অন্য সাহাবী থেকে বর্ণিত। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, এই সনদে এই হাদীসটি মাউদূ। এই সনদ ও মতনের সম্মিলিত রূপটি বানোয়াট। তিনি সংক্ষেপে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার ফলাফলও বলে দিয়েছেন। ইমাম মালিকের অগণিত ছাত্রের কেউ এই হাদীসটি তাঁর সূত্রে এই সনদে বর্ণনা করেননি। একমাত্র আব্দুল মুনইম দাবি করেছে যে, ইমাম মালিক তাঁকে হাদীসটি বলেছেন। আর আব্দুল মুনইম এর বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীসের আলোকে মুহাদ্দিসগণ তার মিথ্যাচার ধরেছেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, এই হাদীসের মতনটি মিথ্যা। মতনটি অন্য বিভিন্ন সনদে সাখর আল গামিদী ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় তা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। (তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৫১৭, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৭৫২)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, আব্দুল মুনইম একটি প্রচলিত ও সহীহ মতন এর জন্য একটি সুপ্রসিদ্ধ সহীহ সনদ জাল করেছে। আর সেই যুগে প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য এইরূপ বানোয়াট সনদের কি গুরুত্ব ছিল তা আমাদের যুগে এসে অনুধাবন করা অসম্ভব। মুহাদ্দিসগণ সাখার আল গামিদীর সূত্রে হাদীসটি জানতেন। কিন্তু তাঁরা যখনই শুনেছেন যে, অমুক শহরে এক ব্যক্তি মালিকের সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তখন তাঁরা তার কাছে গিয়েছেন, তার হাদীস লিখেছেন ও নিরীক্ষা করেছেন। যখন নিরীক্ষার মাধ্যমে লোকটির জালিয়াতি ধরা পড়েছে তখন তারা তা প্রকাশ করেছেন। আবার অন্যান্য মুহাদ্দিস তার কাছে গিয়েছেন। মোটামুটি লোকটি বেশ মজা অনুভব করছে যে, কত মানুষ তার কাছে হাদীস শুনতে আসছে! কিভাবে সে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে!! কিন্তু তার জালিয়াতি যে ধরা পড়বে তা নিয়ে সে মাথা ঘামায়নি। কোনো জালিয়াতই ধরা পড়ার চিন্তা করে জালিয়াতি করেনা।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি এভাবে হাদীস বর্ণনায় কিছু জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বাল এর মত প্রসিদ্ধ ইমামও তার কাছে হাদীস শিখতে গমন করেন। ইমাম আহমদ পরবর্তীকালে বলতেনঃ “ইবরাহীম ইবনুল হাকামের কাছে হাদীস শিখতে বাগদাদ হতে ইয়ামেনের এডেন পর্য্ন্ত সফর করলাম। সফরের টাকাগুলি ‘ফী সাবিলিল্লাহ’ চলে গেল।”(ইবনুল জাউযী, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৩০)।

১.৬.১.৩. সনদের মধ্যে কম বেশি করা
রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা যেভাবে শুনতে হবে ঠিক অবিকল সেভাবেই বলতে হবে। সনদের মধ্যে কোনোরূপ কম বেশি বলাও তাঁর নামে মিথ্যা বলা। মুহাদ্দিসগণ এজন্য প্রচলিত সনদের মধ্যে কম বেশি করাকে বানোয়াটি ও জালিয়াতি বলে গণ্য করেছেন। মাউকূফ বা মাকতূ হাদীসকে অর্থাৎ সাহাবীর কথা বা তাবিয়ীর কথাকে মারফূ হাদীসরূপে বা রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা রূপে বর্ণনা করা, মুরসাল বা মুনকাতি হাদীসকে মুত্তাসিলরূপে বর্ণনা করা, সনদের কোনো একজন দুর্বল বর্ণনাকারীর পরিবর্তে অন্য একজন প্রসিদ্ধ বর্ণনাকারীর নাম ঢুকানো বা যে কোনো প্রকারে হাদীসের সনদের মধ্যে পরিবর্তন করা হাদীসের নামে মিথ্যাচার বলে গণ্য। এ ধরনের মিথ্যাচার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত বলে গণ্য। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী অগ্রহণযোগ্য, দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য। এ বিষয়ে দুই একটি উদাহরণ দেখুন।
আবু সামারাহ আহমদ ইবনু সালিম ২য়-৩য় হিজরী শতকের একজন ‘রাবী’। তিনি বলেনঃ আমাদেরকে শরীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যাহ থেকে তিনি আবু সাঈদ খুদরী থেকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “আলী সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
হাদীসের ইমামগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, এই আবু সালামাহ আহমাদ ইবনু সালিম অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন আলিম ও মুহাদ্দিস থেকে তাদের নামে এমন সব হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ বর্ণনা করেননি। তার একটি মিথ্যা বা ভুল বর্ণনা হলো এই হাদীসটি। এই হাদীসটি শারীক ইবনু আব্দুল্লাহর অন্যান্য ছাত্রও বর্ণনা করেছেন। এছাড়া শারীকের উস্তাদ আ’মাশ থেকে শারীক ছাড়াও অন্য অনেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারা বলেছেন, আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যাহ থেকে বলেছেন, হযরত জাবির বলতেনঃ “আমরা আলীকে আমাদের মধ্যে উত্তম বলে মনে করতাম।”
তাহলে আমরা দেখেছি যে, আবু সালামাহ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তিনটি বিষয় পরিবর্তন করেছেন।
প্র্রথমত, হাদীসটি আতিয়্যাহ জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ আবু সালামাহ আতিয়্যার উস্তাদের নাম ভুল করে আবু সাঈদ খুদরী বলে উল্লেখ করেছেন। এভাবে তিনি সনদের মধ্যে সাহাবীর নাম পরিবর্তন করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি হাদীসটির সনদ বা মতনও পরিবর্তন করেছেন।
তৃতীয়ত, তিনি সনদের মধ্যে পরিবর্তন করে জাবির এর কথাকে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে চালিয়েছেন।
হাদীসটি মূলত জাবিরের(রা) নিজের কথা, অথচ তিনি একে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর এটিই হলো সবচেয়ে মারাত্মক পরিবর্তন। কারণ এখানে রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেননি তা তাঁর নামে বলা হয়েছে, যা অত্যন্ত বড় অপরাধ। কোনো সাহাবী, তাবেয়ী বা বুযুর্গের কথা বা জ্ঞানমূলক প্রবাদকে রাসূলুল্লাহ (স) এর কথা হিসেবে উল্লেখ করা মাওযূ বা বানোয়াট হাদীসের একটি বিশেষ প্রকার। আমরা একটু পরেই বিষয়টি আবার উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।(ইবনু আদী, আল কামিল ১/২৭৭-২৭৮)।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী।তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করতেন। তবে সনদের মধ্যে। তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিস আব্বাস ইবনু আব্দুল আযীম বলেনঃ ইবরাহীম ইবনুল হাকাম তার পিতার সূত্রে তাবিয়ী ইকরিমাহ থেকে রাসূলুল্লাহ(স) হতে কিছু হাদীস শিক্ষা করেন ও লিখেন। এই হাদীসগুলি তার পান্ডুলিপিতে এভাবে মুরসাল রূপেই লিখিত ছিল, কোনো সাহাবীর নাম ছিলনা। পরবর্তী সময় তিনি এগুলিতে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, আবু হুরাইরা প্রমুখ সাহাবীর (রা) নাম উল্লেখ করে বর্ণনা করতেন। এই সনদগত মিথ্যাচারের ফলে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। (ইবনু আদী, আল কামিল ১/২৪১-২৪২)।
১.৬.১.৪. সনদ চুরি বা হাদীস চুরি
হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদীদের একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো-চুরি। ‘হাদীস চুরি’ অর্থ হলো, কোনো মিথ্যাচারী রাবী অন্য একজন রাবীর কোনো হাদীস শুনে সেই হাদীস উক্ত রাবীর সূত্রে বর্ণনা না করে বানোয়াট সনদে তা বর্ণনা করবে। চুরি কয়েক প্রকারে হতে পারেঃ
ক. ‘চোর’ জালিয়াত মূল সনদ ঠিক রাখবে। তবে যার নিকট হতে হাদীসটি শুনেছে তার নাম না বলে তার উস্তাদের নাম বলবে এবং নিজেই সে উস্তাদের নিকট শুনেছে বলে দাবী করবে।
খ. চোর জালিয়াত মূল সনদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন করবে। সনদের মধ্যে একজন রাবীর নাম পরিবর্তন করে সে নতুন সনদ বানাবে।
গ. চোর জালিয়াত হাদীসটির মতন এর মত নতুন সনদ বানাবে। একজন দুর্বল বা মিথ্যাচারী রাবীর বর্ণিত কোনো হাদীস তার মুখে বা কোনো স্থানে শুনে তার ভাল লাগে। হাদীসটির আকর্ষণীয়তার কারণে তারও ইচ্ছা হয় হাদীসটি বলার। তবে হাদীসটি মূল জালিয়াতের নামে বললে তার সম্মান কমে যায়। এছাড়া এতে আকর্ষণীয়তা ও নতুনত্ব থাকেনা। সেজন্য সে এই জাল হাদীসটির জন্য আরেকটি জাল সনদ তৈরি করবে।
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে চুরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দুর্বল বা জাল হাদীস অনেক সময় ১০/১৫ টি সনদে বর্ণিত থাকে। এতগুলি সনদ দেখে অনেক সময় মুহাদ্দিস ধোঁকা খেতে পারেন। তিনি ভাবতে পারেন, হাদীসের সনদগুলি দুর্বল হলেও যেহেতু এতগুলি সনদে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু হয়ত এর কোনো ভিত্তি আছে। এক্ষেত্রে তাকে দুইটি বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। প্রথমত, তাকে দেখতে হবে যে, প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী রাবী আছে কিনা। যদি দেখা যায় যে, হাদীসটি নির্দিষ্ট কোনো যুগে নির্দিষ্ট কোনো রাবীর বর্ণনায় প্রসিদ্ধি লাভ করে। সেই যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে সেই রাবীর হাদীস বলে চিহ্নিত করেছেন। এরপর কোনো কোনো দুর্বল বা জালিয়াত রাবী তা উক্ত রাবীর ওস্তাদ থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে বুঝা যাবে যে, পরের রাবীগণ ‘চুরি’ করেছেন।
এখানে চুরির কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
আমরা ইতোপূর্বে নেককারদের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার উদাহরণ হিসেবে তৃতীয় হিজরী শতকের মাশহুর আবিদ সাবিত ইবনু মূসা(২২৯ হি) বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছি, যে হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘যার রাতের সালাত(তাহাজ্জুদ) অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্য্যময় হবে।’ এই হাদীসটি সর্বপ্রথম সাবিতই বলেন। মুহাদ্দিসগণ সাবিতের মুখে হাদীসটি শোনার পরে বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, সাবিত ছাড়া ইতোপূর্বে কেউ হাদীসটি বলেননি। কিন্তু এই হাদীসটি সাবিতের মাধ্যমে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভের পরে কোনো দুর্বল বা মিথ্যাচারী রাবী এই হাদীসটি সাবিতের উস্তাদ শারীক থেকে বা অন্যান্য সনদে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ এগুলিকে চুরি বলে চিহ্নিত করেছেন। এ সকল চোর জালিয়াতের একজন আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর আবুল হাসান আসকারী, তিনি সাবিতের পরের যুগে দাবী করেন যে, তিনিও হাদীসটি শারীক থেকে শুনেছেন। ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনু আদী বলেন, আমাকে হাসান ইবনু সুফিয়ান বলেছেন, আমাকে আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর বলেছেন, আমাদেরকে শারীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, আবু সুফিয়ান থেকে জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি রাত্রে সালাত(তাহাজ্জুদ) আদায় করে তবে দিনে তার চেহারা সৌন্দর্য্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেন হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসা হতে প্রসিদ্ধ। তার থেকে পরবর্তীতে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করেছে। আব্দুল হামীদ তাদের একজন। (ইবনু আদী, আল কামিল ৫/৩২২)।
চতুর্থ হিজরী শতকের একজন জালিয়াত রাবী হাসান ইবনু আলী ইবনু সালিহ আল আদাবী। আল্লামা ইবনু আদী বলেনঃ আমি লোকটির নিকট হতে হাদীস শুনেছি ও লিখেছি। লোকটি হাদীস জাল করত ও চুরি করত। একজনের হাদীস অন্যজনের নামে বর্ণনা করত। এমন সব লোকের নাম বলে হাদীস বলতো যাদের কোনো পরিচয় জানা যায়না।
এরপর তিনি এই হাসান ইবনু আলীর হাদীস চুরির অনেক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনু আদী বলেনঃ আমাকে হাসান ইবনু আলী আদাবী বলেন, আমাদেরকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ ‘যার রাতের সালাত অধিক হবে, দিবসে তার চেহার সৌন্দর্য্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেনঃ হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসার হাদীস। সাবিতের পরে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করে বিভিন্ন রাবীর নাম দিয়ে চালিয়েছে। এই সনদে হাসান ইবনু আলী আল আদাবী হাদীসটিকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদের নামে চালাচ্ছে। অথচ হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ প্রসিদ্ধ ও সত্যপরায়ণ রাবী ছিলেন, তিনি কখনোই এই হাদীসটি শারীক থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করেননি। তাঁর পরিচিত কোনো ছাত্র হাদীসটিকে তাঁর থেকে বর্ণনা করেননি। (ইবনু আদী, আল কামিল ২/৩৩৮-৩৪১ আরো দেখুন ৬/৩০৩)।
২য় শতকের একজন দুর্বল রাবী ‘হুযাইল ইবনুল হাকাম’। তিনি বলেন, আমাকে আব্দুল আযীয ইবনু আবী রাওয়াদ(১৫৯ হি) বলেছেন, তিনি ইকরিমাহ থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস থেকে, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “প্রবাসের মৃত্যু শাহাদাত বলে গণ্য।” হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী এই হুযাইল নামক রাবী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত সন্ধান ও নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, এই হাদীসটি একমা্ত্র এই ব্যক্তি ছাড়া কোনো রাবী আব্দুল আযীয থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে বর্ণনা করেননি।
এই যুগের অন্য একজন রাবী ইবরাহীম ইবনু বাকর আল আ’ওয়ার। তিনি এসে দাবী করলেন যে, তিনি হাদীসটি আব্দুল আযীয থেকে শুনেছেন। তিনিও বললেনঃ আমাদেরকে আব্দুল আযীয বলেছেন, ইকরিমাহ থেকে ইবনু আব্বাস থেকে ………। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করলেন যে, ইবরাহীম নামক এই ব্যক্তি হাদীসটি চুরি করেছেন। তাঁরা দেখলেন যে, ইবরাহীম আব্দুল আযীয হতে হাদীস শুনেননি। যখন হুযাইল হাদীস বলতেন তখনও তিনি বলেননি যে, তিনিও হাদীসটি শুনেছেন। হুযাইলের সূত্রে যখন হাদীসটি মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে তখন তিনিও হাদীসটি হুযাইলের সূত্রে জানতে পারেন। এখন হুযাইলের সূত্রে হাদীসটি বললে তার মর্যাদা কমে যাবে! এজন্য তিনি হুযাইলের সনদ চুরি করলেন। হুযাইলের উস্তাদকে নিজের উস্তাদ দাবী করে তিনি হাদীসটি বলতে শুরু করলেন। (ইবনু আদী, আল কামিল ১/২৫৭)।
১.৬.২. মতনে মিথ্যা
জালিয়াতির প্রধান ক্ষেত্র হলো হাদীসের ‘মতন’ বা মূল বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচলিত মিথ্যা কথা মূলত দুই প্রকারের হতে পারেঃ জালিয়াত নিজের মনগড়া কথা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বলবে অথবা প্রচলিত কোনো কথাকে তাঁর নামে বলবে। উভয় প্রকারের মিথ্যা কথা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে।
১.৬.২.১. নিজের মনগড়া কথা হাদীস নামে চালানো
অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে, মিথ্যাবাদী রাবী নিজের মনগড়া কথা হাদীস নামে চালাচ্ছে। আল্লামা সুয়ূতী (৯১১ হি) উল্লেখ করেছেন যে, মাউযূ বা মিথ্যা হাদীসের মধ্যে এই প্রকারের হাদীসের সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াত প্রয়োজন ও সুবিধা অনুসারে একটি বক্তব্য বানিয়ে তা হাদীস নামে চালায়। (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮৭)।
উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন উদাহরণের মধ্যে আমরা এই প্রকারের অনেক জাল হাদীস দেখতে পেয়েছি। কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে বানানো, দেশ, জাতি, দল, মত ইত্যাদির পক্ষে বা বিপক্ষে বানানো জাল হাদীসগুলি সবই একই পর্যায়ের।
১.৬.২.২. প্রচলিত কথা হাদীস নামে চালানো
অনেক সময় দুর্বল রাবী বা মিথ্যাবাদী রাবী ভুলক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর কথা, অথবা কোনো প্রবাদ বাক্য, নেককার ব্যক্তির বাণী, পূর্ববর্তী নবীদের নামে প্রচলিত কথা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো কথা, কোনো প্রসিদ্ধ পন্ডিতের বাণী বা অনুরূপ কোনো প্রচলিত কথাকে ‘হাদীসে রাসূল’ বলে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা ইরাকী(৮০৬ হি) এই জাতীয় মাউদূ হাদীসের দুইটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। প্রথম উদাহরণ ‘দুনিয়ার ভালবাসা সকল পাপের মূল।’ আল্লামা ইরাকী বলেন, এই বাক্যটি মূলত কোনো নেককার আবিদের কথা। ঈসা(আ) এর কথা হিসেবেও প্রচার করা হয়। তবে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই।
আর দ্বিতীয় উদাহরণ ‘পাকস্থলী রোগের বাড়ি আর খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ সকল ঔষধের মূল।’ কথাটি চিকিৎসকদের কথা। হাদীস হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই। (সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮৭)।
উপরে ‘সনদের মধ্যে কম বেশি করা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে আমরা এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখেছি। এই প্রকারের মিথ্যা বা জালিয়াতির আরো অনেক উদাহরণ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখতে পাব। এখানে আমাদের দেশে আলেমগণের মধ্যে প্রচলিত এইরূপ একটি হাদীসের কথা উল্লেখ করছি।
আমাদের দেশে প্রচলিত হাদীস বলে একটি কথাঃ “মুসলিমগণ যা ভাল মনে করবেন তা আল্লাহর নিকট ভাল।”
আমাদের দেশে সাধারণভাবে কথাটি হাদীসে নববী নামে পরিচিত। কথাটি মূলত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা) এর। একে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে বর্ণনা করলে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। ইবনু মাসউদ(রা) বলেনঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হৃদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি মুহাম্মাদ(স) এর হৃদয়কে সমস্ত সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বোত্তম সর্বশ্রেষ্ঠ হৃদয় হিসেবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁকে নিজের জন্য বেঁছে নেন এবং তাঁকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এরপর তিনি মুহাম্মাদ(স) এর হৃদয়ের পরে অন্যান্য বান্দাদের হৃদয়গুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। তখন তিনি তাঁর সাহাবীগণের হৃদয়গুলিকে সর্বোত্তম হিসেবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবীর সহচর ও পরামর্শদাতা বানিয়ে দেন, তাঁরা তাঁর দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করেন। অতএব মুসলমানগণ [অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ(স) এর সহচর পরামর্শদাতা পবিত্র হৃদয় সাহাবীগণ) যা ভালো মনে করবেন তা আল্লাহর নিকটও ভাল। আর তাঁরা যাকে খারাপ মনে করবেন তা আল্লাহর নিকটও খারাপ।(আহমাদ, আল মুসনাদ ১/৩৭৯, হাকিম, আল মুসতাদরাক ৩/৮৩)।
কোনো কোনো ফকীহ বা আলিম ভুলবশত কথাটি হাদীসে নববী বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সকল গ্রন্থ তালাশ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ(স) হতে বর্ণিত হয়নি। আল্লামা যাইলায়ী আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ (৭৬২ হি), ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), ইবনু হাজার আসকালানী আহমাদ ইবনু আলী (৮৫২ হি), সাখাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান (৯০২ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদের(রা) কথা হিসেবে হাসান সনদে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা হিসেবে কোথাও বর্ণিত হয়নি।

১.৬.৩. অনুবাদে, ব্যাখ্যায় ও গবেষণায় মিথ্যা
হাদীসের নামে মিথ্যার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। প্রচলিত বই পুস্তক ও ওয়ায নসীহত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমরা সাধারণত হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে ১০০% ঢালাও স্বাধীনতা প্রদান করে থাকি। হাদীসের মূল বক্তব্যকে আমরা আমাদের পছন্দমতো কম বেশি করে অনুবাদ করি, অনুবাদের মধ্যে আমাদের অনেক মতামত ও ব্যাখ্যা সংযোগ করি এবং সবকিছুকে ‘হাদীস’ নামেই চালাই। অথচ সাহাবায়ে কেরাম সামান্য একটি শব্দের হেরফের এর কারণ গলদঘর্ম হয়ে যেতেন!
কুরআন ও হাদীসের আলোকে কিয়াস ও ইজতিহাদ ইসলামী ফিকহের অন্যতম উৎস। যে সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীস স্পষ্ট কোনো বিধান দেওয়া হয়নি কিয়াস ও ইজতিহাদের মাধ্যমে সেগুলির বিধান নির্ধারণ করতে হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ(স) উম্মাতকে সালাত শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজটি ফরজ, কোনটি মুস্তাহাব ইত্যাদি বিস্তারিত বলেননি। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ তা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। অনুরূপভাবে মাইক, টেলিফোন, প্লেন ইত্যাদি বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে কিছু বলা হয়নি। কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলীর আলোকে কিয়াস ও ইজতিহাদের মাধ্যমে এগুলির বিধান অবগত হওয়ার চেষ্টা করেন মুজতাহিদ।
তবে কিয়াস বা ইজতিহাদ দ্বারা কোনো গাইবী বিষয় জানা যায়না বা ইবাদত বন্দেগী করা যায়না। হজ্জের সময় ইহরাম পরিধানের উপর কিয়াস করে সালাতের মধ্যে ইহরাম পরিধানের বিধান দেয়া যায়না। অনুরূপভাবে মসজিদুল হারামে সালাতের ১ লক্ষগুণ সাওয়াবের কিয়াস করে তথায় যাকাত প্রদানের সাওয়াব ১ লক্ষগুণ বৃদ্ধি হবে বলা যায়না। অথবা আমরা বলতে পারিনা যে, রামাদানে যাকাত দিলে ৭০ গুণ সাওয়াব এবং রামাদানে মসজিদে হারামে যাকাত প্রদান করলে ৭০ লক্ষ গুণ সাওয়াব।
এখানে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি। ইমাম তিরমিযী তাঁর সুনানগ্রন্থে জিহাদের ফযীলতের অধ্যায়ে নিম্নের ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসটি সংকলন করেছেন। খুরাইম ইবনু ফাতিক (রা)বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “যদি কেউ আল্লাহর রাস্তায় কোনো ব্যয় করেন তবে তার জন্য সাতশত গুণ সাওয়াব লেখা হয়।”
ইমাম ইবনু মাজাহ সংকলিত একটি যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে “যদি কেউ নিজে বাড়িতে অবস্থান করে আল্লাহর রাস্তায় খরচ পাঠিয়ে দেয়, তবে সে প্রত্যেক দিরহামের জন্য ৭০০ দিরহাম (সাওয়াব) লাভ করবে। আর যদি সে নিজে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এই জন্য খরচ করে তবে সে প্রত্যেক দিরহামের জন্য ৭ লক্ষ দিরহাম (সাওয়াব) লাভ করবে। এরপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেনঃ ‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা বৃদ্ধি করে দেন।”(ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৯২২)।
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী ইবনু আবী ফুদাইক। তিনি বলেন, “খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি হাসান বসরীর সূত্রে হাদীসটি বলেছেন। মুহাদ্দিসগণ খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ নামক এই ব্যক্তির বিশ্বস্ততাতো দূরের কথা তার কোনো পরিচয়ও জানতে পারেননি। এজন্য আল্লামা বুসিরী বলেনঃ “এই সনদটি দুর্বল; কারণ খলীল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয়।”
তাবিয়ী মুজাহিদ বলেনঃ আবু হুরাইরা(রা) একবার সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন। শত্রুর আগমন ঘটেছে মনে করে হঠাৎ করে ডাকাডাকি করা হয়। এতে সকলেই ছুটে সমুদ্র উপকূলে যান।তখন বলা হয় যে, কোনো অসুবিধা নেই। এতে সকলেই ফিরে আসলেন। শুধু আবু হুরাইরা দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন একব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেন, আবু হুরাইরা, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে বলতে শুনেছিঃ “আল্লাহর রাস্তায় এক মুহুর্ত অবস্থান করা লাইলাতুল কাদরে হজরে আসওয়াদের নিকট কিয়াম(সালাত আদায় করা) করার চেয়ে উত্তম।” (ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১০/৪৬২)।
উপরের হাদীসগুলিতে আল্লাহর পথে ব্যয়, অবস্থান ইত্যাদির সাওয়াব উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম একমত যে, এখানে আল্লাহর রাস্তায় বলতে অমুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধ বা জিহাদ বুঝানো হয়েছে। সকল মুহাদ্দিসই হাদীসগুলিকে জিহাদ বা যুদ্ধের অধ্যায়ে সংকলন করেছেন। এখানে আমরা অনুবাদে যদি ‘আল্লাহর রাস্তায়’ বলি বা ‘জিহাদ’ বলি তবে হাদীসগুলির সঠিক অনুবাদ হবে।
অন্য একটি সহীহ হাদীস কাব ইবনু আজরা(রা) বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(স) এর নিকট দিয়ে গমন করে। সাহাবীগণ লোকটির স্বাস্থ্য, শক্তি ও উদ্দীপনা দেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায়(জিহাদে) থাকত! তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ যদি লোকটি তার ছোট ছোট সন্তানদের জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তবে সে আল্লাহর রাস্তাতেই রয়েছে। যদি সে তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তাতেই রয়েছে। যদি সে নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তাতেই রয়েছে।” (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৫)।
এখানে অর্থ উপার্জনের জন্য কর্ম করাকে ‘আল্লাহর রাস্তায় থাকা’ বা ‘আল্লাহর রাস্তায় চলা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যান্য হাদীসে ইলম শিক্ষা, হ্জ্জ, সৎকাজে আদেশ, ঠান্ডার মধ্যে পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদে সালাতের অপেক্ষা করা, নিজের নফসকে আল্লাহর পথে রাখার চেষ্টা করা ইত্যাদি কর্মকে জিহাদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা উপরের হাদীসগুলির সঠিক ও শাব্দিক অর্থ বর্ণনা করার পরে বলতে পারি যে, বিভিন্ন হাদীসে হালাল উপার্জন, ইলম শিক্ষা, সৎকাজে আদেশ, হজ্জ আদায় ইত্যাদি কর্মকেও ‘আল্লাহর রাস্তায় কর্ম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কাজেই আমরা আশা করি যে, এইরূপ কর্মে রত মানুষেরাও এ সকল হাদীসে উল্লেখিত জিহাদের সাওয়াব পেতে পারেন।
কিন্তু আমরা যদি সেরূপ না করে সরাসরি বলি যে, ‘হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, হালাল উপার্জনে এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকা হাজরে আসওয়াদের নিকট লাইলাতুল কদরের সালাত আদায় অপেক্ষা উত্তম’, অথবা ‘সৎকাজে আদেশের জন্য র্যালি বা মিছিলে একটি টাকা ব্যয় করলে ৭০ লক্ষ টাকার সাওয়াব পাওয়া যাবে’….তবে তা মিথ্যাচার বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) কখনোই এভাবে বলেননি।
অনুরুপভাবে উপরের হাদীসগুলিতে আল্লাহর পথে যুদ্ধে ব্যয় করলে ৭০০ বা ৭ লক্ষ গুণ সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছেঃ “সালাত, সিয়াম ও যিকর(এগুলির সাওয়াব) আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার চেয়ে সাতশত গুণ বর্ধিত হয়।”
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, এ হাদীসে স্পষ্ট অর্থ হলো, ঘরে বসে সালাত, সাওম ও জিকির পালন করলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য অর্থ ব্যয়ের চেয়েও সাতশত গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। কেউ কেউ এখানে কিছু কথা উহ্য রয়েছে বলেও মনে করেন। তাঁরা বলছেন, এই হাদীসের অর্থ হলো, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত অবস্থায়’ সালাত, সিয়াম ও যিকর পালন করলে সেগুলির সাওয়াব আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয়ের চেয়ে সাতশত গুণ বর্ধিত হয়।(হাশিয়াতু ইবনুল কাইয়িম ৭/১২৭)।এখানে আমাদের দায়িত্ব হলো হাদীসটি শাব্দিক অর্থ বলার পরে আমাদেরকে ব্যাখ্যা পৃথকভাবে বলা।
এখানে বিভিন্নভাবে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন কেউ গুণভাগ করে বলতে পারেন যে, ‘জিহাদে যেয়ে অর্থ ব্যয় করলে ৭ লক্ষ গুণ সাওয়াব। আর ঘরে বসে যিকর করলে তার ৭ শত গুণ সাওয়াব। এর অর্থ হলো ঘরে বসে যিকর করলে ৪৯ কোটি নেক আমলের সাওয়াব।’ তিনি যদি উপরের হাদীসগুলির সঠিক অনুবাদ করার পর পৃথকভাবে এই ব্যাখ্যা করেন তবে অসুবিধা নেই। কিন্তু তিনি যদি এই কথাটিকে হাদীসের কথা বলে বুঝান তবে তিনি হাদীসের নামে মিথ্যা বললেন। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) কখনোই এভাবে বলেননি। তিনি আল্লাহর পথে খরচের চেয়ে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি বলতে মূল সওয়াবের সাথে ৭০০ গুণ নাকি ৭০০ গুণের ৭০০ গুণ বুঝাচ্ছেন তাও স্পষ্ট করে বলেননি। কাজেই তিনি যা স্পষ্ট করে বলেননি, তা তাঁর নামে বলা যায়না। তবে পৃথকভাবে ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে।
অনুরূপভাবে যদি কেউ বলেন যে, ‘হাদীসশরীফে বলা হয়েছে, হালাল উপার্জনের জন্য কর্মরত অবস্থায়, হজ্জের সফরে থাকা অবস্থায়, ইলম শিক্ষারত অবস্থায়, দাওয়াতে রত অবস্থায়, সৎকাজের আদেশের জন্য মিছিলে থাকা অবস্থায় বা নফসকে শাসনরত অবস্থায় যিকর করলে ৪৯ কোটি গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়’ তবে তিনিও হাদীসের নামে মিথ্যা বললেন।
হাদীসের নামে মিথ্যা বলার একটি প্রকরণ হলো, অনুবাদের সময় শাব্দিক অনুবাদ না করে অনুবাদের সাথে নিজের মনমতো কিছু সংযোগ করা বা কিছু বাদ দিয়ে অনুবাদ করা। অথবা রাসূলুল্লাহ(স) যা বলেছেন তার ব্যাখ্যাকে হাদীসের অংশ বানিয়ে দেওয়া। আমাদের সমাজে আমরা প্রায় সকলেই এই অপরাধে লিপ্ত রয়েছি। আত্মশুদ্ধি, পীর মুরিদী, দাওয়াত-তাবলীগ, রাজনীতিসহ মতভেদীয় বিভিন্ন মাসলা মাসাইল এর জন্য আমরা প্রত্যেক দলের ও মতের মানুষ কুরআন ও হাদীস থেকে দলীল প্রদান করি। এই দলীল প্রদান খুবই স্বাভাবিক কর্ম ও ঈমানের দাবি। তবে সাধারণত আমরা আমাদের এই ব্যাখ্যাকেই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে চালাই।
রাসূলুল্লাহ(স) দ্বীন প্রচার করেছেন আজীবন। দ্বীনের জন্য তিনি ও তাঁর অনেক সাহাবী চিরতরে বাড়িঘর ছেড়ে ‘হিজরত’ করেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই দাওয়াতের জন্য সময় নির্ধারণ করে বিভিন্ন এলাকায় সফরে বাহির হননি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে হিজরত না করলেও অন্তত কিছুদিনের জন্য বিভিন্নস্থানে যেয়ে দাওয়াতের কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা এই কর্মের জন্য যদি বলি যে, তিনি দাওয়াতের জন্য ‘বাহির’ হতেন, তবে পাঠক বা শ্রোতা নির্ধারিত সময়ের জন্য বাহির হওয়া বুঝবেন। অথচ তিনি কখনোই এভাবে দাওয়াতের কাজ করেননি। এতে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে।
যদি আমরা বলি যে, ‘রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ মিলাদ মাহফিল করতেন’ তবে অনুরূপভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। কারণ তাঁরা কখনোই শুধু ‘মিলাদ’ আলোচনা বা উদযাপনের জন্য কোনো মাহফিল করেননি। তবে রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর জন্ম বিষয়ক দুই চারিটি ঘটনা সাহাবীদেরকে বলেছেন। এ সকল হাদীস সাহাবীগণ তাবেয়ীগণকে বলেছেন। এগুলির জন্য তাঁরা কোনো মাহফিল করেননি বা এগুলিকে পৃথকভাবে আলোচনা করেননি। আজ যদি কোনো মুসলিম ‘আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা’ ছাড়া অবিকল রাসূলুল্লাহ(স) ও সাহাবীগণের পদ্ধতিতে এসকল হাদীস বর্ণনা করেন, তবে কেউই বলবেননা যে, তিনি মিলাদ মাহফিল করেছেন। এতে আমরা বুঝি যে, মিলাদ মাহফিল বলতে যে অর্থ আমরা সকলেই বুঝি সেই কাজটি তিনি করেননি।
এজন্য্ আমাদের উচিত, রাসূলুল্লাহ(স) কি করেছেন বা বলেছেন এবং তা থেকে আমরা কি বুঝলাম তা পৃথকভাবে বলা। আমরা দেখেছি যে, একটি শব্দ হেরফের এর ভয়ে সাহাবীগণ কিভাবে সন্ত্রস্ত হয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
১.৭. মিথ্যার পরিচয় ও চিহ্নিতকরণ
১.৭.১. মিথ্যা চিহ্নিতকরণের প্রধান উপায়
১.৭.১.১. জালিয়াতের স্বীকৃতি
মিথ্যা হাদীসের পরিচিতি ও চিহ্নিত করনের পদ্ধতি উল্লেখ করে আল্লামা ইবনুস সালাহ(৬৪৩ হি) বলেনঃ হাদীস মাঊদূ বা জাল কিনা তা জানা যায় জালিয়াতের স্বীকৃতির মাধ্যমে অথবা স্বীকৃতির পর্যায়ের কোনো কিছুর মাধ্যমে। মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় বর্ণনাকারীর অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জালিয়াতি ধরতে পারেন। কখনো বা বর্ণিত হাদীসের অবস্থা দেখে জালিয়াতি ধরেন। অনেক বড় বড় হাদীস বানানো হয়েছে যেগুলির ভাষা ও অর্থের দুর্বলতা সেগুলির জালিয়াতির সাক্ষ্য দেয়। (ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ. ১২৮)।
আল্লামা নববী, ইরাকী, সাখাবী, সুয়ূতী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও মিথ্যা বা জাল হাদীস চিহ্নিত করার পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করেছেন।
১.৭.১.২. সনদবিহীন বর্ণনা
সাধারণভাবে জালিয়াতের স্বীকৃতি পাওয়া যায়না। এজন্য মুহাদ্দিসগণ এর উপর নির্ভর করেননা। তারা সনদ বিচার বা তুলনামূলক নিরীক্ষা ও নিরীক্ষামূলক প্রশ্নাবলীর মাধ্যমে ‘স্বীকৃতির পর্যায়ের তথ্যাদি’ সংগ্রহ করে সেগুলির ভিত্তিতে জালিয়াতি নির্ণয় করেন। এজন্য নিরীক্ষাই হলো জালিয়াতি নির্ণয়ের প্রধান পন্থা। প্রধানত দুইটি কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে বানোয়াট, ভিত্তিহীন, জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেন। প্রথমত, হাদীসের সনদে মিথ্যাবাদীর অস্তিত্ব ও দ্বিতীয়ত, হাদীসের কোনো সনদ না থাকা।
মূলত, প্রথম কারণটিই জালিয়াতি নির্ধারণের মূল উপায়। দ্বিতীয় পর্যায়টি ইসলামের প্রথম অর্ধ সহস্র বৎসরে দেখা যায়নি। হিজরী ৪র্থ/৫ম শতক পর্য্ন্ত কোনো মানুষই সনদ ছাড়া কোনো হাদীস বলতেননা বা বললে কেউ তাতে কর্ণপাত করতেননা। এজন্য জঘন্য জালিয়াতকেও তার মিথ্যার জন্য কোনো সনদ তৈরি করতে হতো। পরবর্তী যুগগুলোতে ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে কিছু কিছু কথা হাদীস নামে প্রচারিত হয় যেগুলো লোকমুখে প্রচারিত হলেও কোনো গ্রন্থ বা পুস্তিকায় সনদসহ পাওয়া যায়না। স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ একবাক্যে সেগুলিকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও জাল বলে গণ্য করেছেন।
রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচারিত সকল প্রকারের মিথ্যা বা ভিত্তিহীন কথাকে প্রতিহত করা এবং তাঁর নামে প্রচলিত কথার উৎস ও সূত্র নির্ণয় করার বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ ছিলেন আপোষহীন। এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, ৭ম/৮ম হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্য্ন্ত অগণিত জানবাজ মুহাদ্দিস তাঁদের জীবনপাত করেছেন এ সকল প্রচলিত কথার সূত্র বা উৎস সন্ধান করতে। দ্বিতীয় শতাব্দী হতে শুরু করে পরবর্তী প্রায় অর্ধসহস্র বৎসর ধরে লেখা অগণিত হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, জীবনী ইত্যাদি সকল প্রকার পুস্তক পুস্তিকার মধ্যে তাঁরা এগুলো সন্ধান করেছেন। এই সন্ধানের পরেও যে সকল হাদীস নামে প্রচলিত কথার কোনো সনদ তাঁরা পাননি সেগুলিকে তাঁরা ভিত্তিহীন, সূত্রবিহীন, বানোয়াট বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।
১.৭.১.৩. মিথ্যাবাদীর বর্ণনা
জাল বা মিথ্যা হাদীস চেনার অন্যতম উপায় হলো যে, হাদীসটির সনদে এমন একজন রাবী রয়েছেন, যাকে মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন এবং একমাত্র তার মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়নি। এজন্য জাল বা মিথ্যা হাদীসের সংজ্ঞায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেনঃ “ যে হাদীস শুধুমাত্র কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বর্ণনা করেছে তা মাঊদূ হাদীস।”
এই মিথ্যাবাদী রাবীর উস্তাদ বা পূর্ববর্তী রাবীগণ এবং তার ছাত্র বা পূর্ববর্তী রাবীগণ বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য হলেও কিছু যায় আসেনা। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখতে পান যে, এই ব্যক্তি উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছে তাঁর অন্য কোনো ছাত্রই হাদীসটি বর্ণনা করছেননা বা অন্য কোনো সূত্রে ও হাদীসটি বর্ণিত হয়নি, তাহলে তাঁরা নিশ্চিত হন যে, এই মিথ্যাবাদী তার উস্তাদের নামে সনদটি বানিয়ে মিথ্যা হাদীসটি প্রচার করেছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুহাদ্দিস এই মিথ্যাবাদীর নিকট হতে হাদীসটি সংগ্রহ করেছেন নিরীক্ষা, পর্যালোচনা বা সংকলনের জন্য।
১.৭.১.৩.১. মিথ্যাবাদীর পরিচয়
যে সকল রাবী মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করেন বলে মুহাদ্দিসগণ বুঝতে পেরেছেন তাদেরকে তাঁরা বিভিন্ন প্রকার বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। কখনো তাদেরকে স্পষ্টত মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো বা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত না বলে অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, প্রথম তিন শতাব্দীর মুহাদ্দিসগণ সাধারণত সহজে কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে চাইতেননা। বিশেষত, যে ব্যক্তির বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন বলে ধারণা করেছেন তার বিষয়ে কিছু নরম শব্দ ব্যবহার করতেন। মিথ্যাবাদী রাবীগণের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষাকে আমরা সংক্ষেপে নিম্নোক্ত কয়েক ভাগে ভাগ করতে পারিঃ
১. সরাসরি মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত বলে উল্লেখ করাঃ রাবীর মিথ্যাচারিতা বোঝাতে মুহাদ্দিসগণ বলে থাকেন মিথ্যাবাদী, জঘন্য মিথ্যাবাদী, মিথ্যা বলে, দাজ্জাল, জঘন্য জালিয়াত, জাল করে, অভিযুক্ত, একটি হাদীস জাল করেছে, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, মিথ্যার একটি স্তম্ভ, অমুক মুহাদ্দিস তাকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, অমুক তাকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন………ইত্যাদি।
২. বাতিল হাদীস বা বালা মুসিবত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করাঃ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর অন্যতম- বাতিল হাদীস বর্ণনা করে, তার কিছু বাতিল হাদীস রয়েছে, তার কিছু বালা মুসিবত আছে, তার বর্ণিত বালা মুসিবতের মধ্যে অমুক হাদীসটি…….,…এই হাদীসের বিপদ অনেক……খবীস হাদীস বর্ণনা করে…….হাদীস চুরি করে…….
৩. মুনকার(আপত্তিকর) বা মাতরূক(পরিত্যক্ত) বলে উল্লেখ করাঃ ‘মুনকার’ অর্থ অস্বীকারকৃত, আপত্তিকৃত, অন্যায়, গর্হিত ইত্যাদি। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন অর্থে রাবীকে এবং হাদীসকে মুনকার বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে দুর্বল হাদীস বা দুর্বল রাবীকে মুনকার বলেছেন। কেউ কেউ মিথ্যাবাদী রাবীকে মুনকার বলেছেন। বিশেষত, ইমাম বুখারী রাবীগণের ত্রুটি উল্লেখের বিষয়ে অত্যন্ত নরম শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি সরাসরি কাউকে মিথ্যাবাদী বলে উল্লেখ করেননি। বরং অন্য মুহাদ্দিস যাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, তিনি তাকে ‘মুনকার’ বলেছন, অথবা ‘মাতরূক’ বা ‘মাসকূত আনহু’, ‘মানযূর ফীহ’ অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’, ‘তাঁর বিষয়ে আপত্তি রয়েছে’ বলেছেন।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি পরিভাষা ‘মাতরূক’, অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’ বা ‘পরিত্যাজ্য’। সাধারণত মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল রাবীকে ‘পরিত্যক্ত’ বলেন। তবে ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুতনী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মাতরূক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষত ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসাঈ কাউকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলার অর্থই হলো যে, তাঁরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেছেন।
অনুরূপভাবে মুহাদ্দিসগণ যদি বলেন যে, অমুকের হাদীস বর্ণনা করা বৈধ নয়-তাহলেও তার মিথ্যাচারিতা বুঝা যায়।
৪. তার হাদীস কিছুই নয়, মূল্যহীন—বলে উল্লেখ করা
কেউ কেউ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে রাবীকে বা তার বর্ণিত হাদীসকে মূল্যহীন, কিছুই নয়, এক পয়সাতেও নেওয়া যায়না বা অনুরূপ কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ীর কথা প্রনিদান যোগ্য। ইমাম ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া মুযানী(২৬৪ হি) বলেনঃ একদিন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আমি বলি যে, লোকটি মিথ্যাবাদী। ইমাম শাফেয়ী(২০৪ হি) আমাকে বলেন, তুমি তোমার কথাবার্তা পরিশিলীত কর। তুমি ‘মিথ্যাবাদী’ না বলে বল ‘তার হাদীস কিছুই নয়’।
৫. পতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, অত্যন্ত দুর্বল………ইত্যাদি বলে উল্লেখ করাঃ কিছু শব্দ দ্বারা মুহাদ্দিসগণ রাবীর কঠিন দুর্বলতা ব্যক্ত করেছেন। যেমন: পতিত, অত্যন্ত দুর্বল, একেবারেই বাতিল, ধ্বংসপ্রাপ্ত, তার হাদীস চলে গেছে, উড়ে গেছে……ইত্যাদি। এ সকল রাবীর হাদীস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না হলেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। অনেক মুহাদ্দিস এই পর্যায়ের রাবীর হাদীসকেও জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।

১.৭.১.৩.২. মিথ্যা হাদীসের বিভিন্ন নাম
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, জাল বা মিথ্যা হাদীসকে মাঊযূ বলা হলেও, জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের আরো কিছু প্রচলিত পরিভাষা রয়েছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১. বাতিলঃ আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা ‘জাল’ না বলে বাতিল বলেন। বিশেষত, অনেক মুহাদ্দিস রাবীর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে নিশ্চিত না হলে হাদীসকে ‘মাউযূ’ বলতে চাননা। এক্ষেত্রে তাঁরা ‘বাতিল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ হাদীসটি মিথ্যা ও বাতিল তবে রাবী তা ইচ্ছেকৃতভাবে জাল করেছে কিনা নিশ্চিত নয়।
২. সহীহ নয়ঃ জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের অন্যতম পরিভাষা হলো ‘হাদীসটি সহীহ নয়’। এই কথাটি কেউ কেউ ভুল বোঝেন। তাঁরা ভাবেন, হাদীসটি সহীহ না হলে হয়তো হাসান বা যয়ীফ হবে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। জাল হাদীস আলোচনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যখন বলেন যে, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়, তখন তাঁরা বুঝান যে, হাদীসটি অশুদ্ধ, বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে ফিকহী আলোচনায় কখনো কখনো তাঁরা ‘সহীহ নয়’ বলতে ‘যয়ীফ’ বুঝিয়ে থাকেন।
৩. কোনো ভিত্তি নেই, কোনো সূত্র নেইঃ মুহাদ্দিসগণ জাল ও মিথ্যা হাদীস বুঝাতে অনেক সময় বলেন, হাদীসটির কোনো ভিত্তি নেই, সূত্র নেই। এদ্বারা তাঁরা সাধারণভাবে বুঝান যে, হাদীসটি জনমুখে প্রচলিত একটি সনদবিহীন বাক্য মাত্র, এর সহীহ, যয়ীফ বা মাঊদূ কোনো প্রকারের কোনো সনদ বা সূত্র নেই এবং কোনো গ্রন্থে তা সনদ সহ পাওয়া যায়না। কখনো কখনো জাল বা বাতিল সনদের হাদীসকেও তাঁরা এভাবে ‘এর কোনো ভিত্তি নেই’ বলে আখ্যায়িত করেন।
৪. জানিনা, কোথাও দেখিনি, পাইনিঃ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীস সংকলিত হয়ে যাওয়ার পরে, কোনো প্রচলিত বাক্য যদি সকল প্রকারের অনুসন্ধানের পরও কোনো গ্রন্থে সনদসহ পাওয়া না যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে, কথাটি বাতিল ও ভিত্তিহীন। যে সকল মুহাদ্দিস তাঁদের জীবন হাদীস সংগ্রহ, অনুসন্ধান, যাচাই ও নিরীক্ষার মাধ্যমে অতিবাহিত করেছেন, তাঁদের কেউ যদি বলেন, এই হাদীসটি আমি কোথাও দেখিনি, কোথাও পাইনি, আমি চিনিনা, জানিনা, পরিচিত নয়……….তবে তাঁর কথাটি প্রমাণ করবে যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
৫. গরীব(অপরিচিত), অত্যন্ত গরীবঃ গরীব শব্দের অর্থ প্রবাসী, অপরিচিত বা অনাত্মীয়। যে হাদীসটি সকল পর্যায়ে শুধুমাত্র একজন রাবী বর্ণনা করেছেন মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে সাধারণত ‘গরীব’ হাদীস বলা হয়। এই পরিভাষা অনুসারে গরীব হাদীস সহীহ হতে পারে, যয়ীফও হতে পারে।
কিন্তু কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল হাদীস বোঝাতে এই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের বিষয়ে বলেছেন ‘জানিনা, ভিত্তিহীন……..’, সেগুলির বিষয়ে তাঁরা বলেছেন ‘গরীব’ বা ‘গরীবুন জিদ্দান’ অর্থাৎ অপরিচিত বা অত্যন্ত অপরিচিত। ইমাম দারাকুতনী, খতীব বাগদাদী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস এভাবে এই পরিভাষাটি কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন। এই পরিভাষাটি বেশি ব্যবহার করেছেন ৮ম শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফাকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ যাইলায়ী (৭৬২ হি)।

১.৭.২. ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষা
বর্ণনাকারীর বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের পাশাপাশি মুহাদ্দিসগণ বর্ণনার অর্থও যাচাই করেছেন। কুরআন কারীম, সুপ্রসিদ্ধ সুন্নাত, বুদ্ধি-বিবেক, ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠিত সত্য বা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যে সুস্পষ্ট বিরুদ্ধ কোনো বক্তব্য তাঁরা হাদীস হিসেবে গ্রহণ করেননি।
হাদীসের বিষয়বস্তু, ভাব ও ভাষাও অভিজ্ঞ নাকিদ মুহাদ্দিসগণকে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে।আজীবন হাদীস চর্চার আলোকে তাঁরা কোনো হাদীসের ভাষা, অর্থ বা বিষয়বস্তু দেখেই অনুভব করতে পারেন যে, হাদীসটি বানোয়াট। বিষয়টি খুব কঠিন নয়। যে কোনো বিষয়ের গবেষক সেই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। একজন নজরুল বিশেষজ্ঞকে পরবর্তী যুগের কোনো কবির কবিতা নিয়ে নজরুলের বলে চালালে তা ধরে ফেলবেন। কবিতার ভাব ও ভাষা দেখে তিনি প্রথমে বলে উঠবেন, এ তো নজরুলের কবিতা হতে পারেনা! কোথায় পেয়েছেন এই কবিতা? কিভাবে??
অনুরূপভাবে যে কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট গবেষক সেই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি লাভ করেন, যা দিয়ে তিনি সেই বিষয়ক তথ্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক বিচারের যোগ্যতা লাভ করেন।
হাদীস শাস্ত্রের প্রাজ্ঞ ইমামগণ, যাঁরা তাঁদের পুরো জীবন হাদীস, শিক্ষা, মুখস্ত, তুলনা, নিরীক্ষা ও শিক্ষাদান করে কাটিয়েছেন তাঁরাও রাসূলুল্লাহ(স) এর আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, পুরস্কার বর্ণনা, শাস্তি বর্ণনা, শব্দ চয়ন, বিষয়বস্তু, ভাব, অর্থ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভ করেন। এর আলোকে তাঁরা তাঁর নামে প্রচারিত কোনো বাক্য বা হাদীস শুনলে সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে পারেন যে, এই বিষয়, এই ভাষা, এই শব্দ বা এই অর্থ রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস হতে পারে বা পারেনা। এর পাশাপাশি তাঁরা অন্যান্য নিরীক্ষার মাধ্যমে এর জালিয়াতি নিশ্চিত করেন।
মুহাদ্দিসগণের হাদীস সমালোচনা সাহিত্যের সুবিশাল ভান্ডারে আমরা অগণিত উদাহরণ দেখতে পাই যে, হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী গণ্য না হওয়া সত্ত্বেও হাদীসের ভাষা, ভাব ও অর্থের কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘পরিত্যক্ত’, জাল বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
মুহাদ্দিসগণের এ বিষয়ক কর্মধারা আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এক্ষেত্রে তাঁরা সাহাবীগণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, কোনো হাদীসের বিচারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে প্রমাণিত কিনা তা যাচাই করা। প্রমাণিত হলে তা গ্রহণ করতে হবে, অপ্রমাণিত হলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং কোনোরূপ দ্বিধা থাকলে তা অতিরিক্ত নিরীক্ষা করতে হবে। এভাবে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষায় হাদীসের তিনটি পর্যায় রয়েছে।
১.৭.২.১. মূল নিরীক্ষায় সহীহ বলে প্রমাণিত
যদি বর্ণনাকারীগণের সাক্ষ্য ও সকল প্রাসঙ্গিক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর কর্ম, বাণী বা অনুমোদন, তবে তা ‘ওহী’র নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এখানেও ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ এর বিচার করতে হবে, যেখানে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষার প্রক্রিয়া বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্যণীয়ঃ
প্রথমত, এই পর্যায়ের প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত বা অর্থগত দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা পাওয়া যায়না। কারণ শব্দগত বা অর্থগতভাবে অসংলগ্ন হাদীস বর্ণনা করা, অথবা বুদ্ধি, বিবেক, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীতে কোনো হাদীস বর্ণনা করাকেই রাবীর দুর্বলতা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অনেক সৎ ও প্রসিদ্ধ রাবী এইরূপ হাদীস বর্ণনা করার ফলে দুর্বল বলে বিবেচিত হয়েছেন এবং তাঁদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এজন্য সনদ ও সাধারণ অর্থ নিরীক্ষায় (৫টি শর্ত পূরণকারী) ‘সহীহ’ বলে প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত ও অর্থগত দুর্বলতা পাওয়া যায়না।
দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবেক, বুদ্ধি বা আকল এর নির্দেশনা আপেক্ষিক। একজন মানুষ যাকে বিবেক বিরোধী বলে গণ্য করেছেন, অন্যজন তাকে বিবেক বা বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন। এজন্য মুসলিম উম্মাহর মূলনীতি হলো, কোনো কিছু ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হলে তা মেনে নেওয়া। যেমন কুরআন কারীমে চুরির শাস্তি হিসেবে হস্তকর্তনের বিধান রয়েছে। বিষয়টি কারো কাছে বিবেকবিরুদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু মুমিন কখনোই এই যুক্তিতে এই বিধানটি প্রত্যাখ্যান করেননা। বরং বুদ্ধি, বিবেক ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এই বিধানের যৌক্তিকতা বুঝতে চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন।
তৃতীয়ত, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন। স্বভাবতই কুরআন ও হাদীসে বিজ্ঞান বা ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয়নি। তবে প্রাসঙ্গিকক্রমে এ জাতীয় কিছু কথা আলোচিত হয়েছে। ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত কোনো বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ যদি কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক তথ্যের বিপরীত হয়, তবে তাঁরা কখনোই সেই বক্তব্যকে ভুল বা মিথ্যা মনে করেননা। যেমন কুরআন কারীমের কোনো আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা মনে হতে পারে যে, পৃথিবী সমতল বা সূর্য্ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। এক্ষেত্রে মুমিনগণ এসকল বক্তব্যের সঠিক অর্থ বুঝার চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও একই নীতি তাঁরা অনুসরণ করেন।
চতুর্থত, নিরীক্ষায় প্রমাণিত কোনো ‘সহীহ হাদীস’ এর সাথে অন্য কোনো ‘সহীহ হাদীস’ বা কুরআনের আয়াতের মূলত কোনো বৈপরীত্য ঘটেনা। বাহ্যত কোনো বৈপরীত্য দেখা দিলে মুহাদ্দিসগণ ঐতিহাসিক ও পারিপার্শ্বিক তথ্যাদির বিপরীতে ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণের মাধ্যমে সেই বৈপরীত্য সমাধান করেছেন। কিন্তু কখনোই ঢালাওভাবে শুধু বাহ্যিক বৈপরীত্যের কারণে কোনো প্রমাণিত তথ্যকে অগ্রাহ্য করেননি। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ(স) কোন স্থান হতে হজ্জের ‘তালবিয়া’ পাঠ শুরু করেন সে বিষয়ে একাধিক ‘সহীহ’ বর্ণনা রয়েছে, যেগুলি বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। মুহাদ্দিসগণ এই বাহ্যিক বৈপরীত্যের সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক ও পারিপার্শিক তথ্যাদি বিবেচনা করেছেন, যা আমরা এই পুস্তকের প্রথমে আলোচনা করেছি।
এভাবে কোনো হাদীস ডকুমেন্টারি পরীক্ষায় ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হওয়ার পরেও যদি বাহ্যত অন্য কোনো হাদীস বা আয়াতের সাথে তার বৈপরীত্য দেখা যায়, তবে মুহাদ্দিসগণ সেই বৈপরীত্যের ইতিহাস, কারণ ও সমাধান অনুসন্ধান করেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন।
১.৭.২.২. মূল নিরীক্ষায় মিথ্যা বলে প্রমাণিত
যদি কোনো কথা বা বক্তব্যের বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর বাণী নয়, বরং বর্ণনাকারী ভুলে বা ইচ্ছায় তাঁর নামে মিথ্যা বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে সেই বক্তব্যটির ভাষা বা অর্থ বিবেচনা করা হয়না। কোনোরূপ বিবেচনা ছাড়াই তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। অধিকাংশ জাল হাদীসই এই পর্যায়ের। জালিয়াতগণ সাধ্যমত সুন্দর অর্থেই হাদীস বানাতে চেষ্টা করেন।
১.৭.২.৩. মূল পরীক্ষায় দুর্বল বলে পরিলক্ষিত
যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ, তবে তিনি তাঁর বর্ণনায় কিছু ভুল করতেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁর দুর্বলতার মাত্রা অনুসারে বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান বা যয়ীফ বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া কোনো বর্ণনাকারীর পরিচয় জানা না গেলেও হাদীসটি সাধারণভাবে দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। এই পর্যায়ের অনেক হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন। জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে এরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলির সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত না থাকলেও সেগুলিকে জাল বলা হয়েছে। আবার এই জাতীয় কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। বাহ্যিক সনদের কারণে কেউ কেউ তা দুর্বল বা ‘হাসান’ বললেও, অর্থের কারণে অন্যরা তা জাল বলে গণ্য করেছেন। এখানে দুইটি উদাহরণ উল্লেখ করছিঃ
(১) আনাস(রা) এর সূত্রে ‘আরশ’ এর বর্ণনায় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আনাস বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(স) কে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি জিবরাঈলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি মীকাঈলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি ইসরাফীলকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি রাফীকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি লাওহে মাহফূযকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আমি কলমকে মহিমাময় প্রভুর আরশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বলেন, আরশের ৩ লক্ষ ৬০ হাজার খুঁটি আছে,…. ইত্যাদি……।
হাদীসটির সনদে ‘মুহাম্মদ ইবনু নাসার’ নামক একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন, যাকে স্পষ্টত মিথ্যাবাদী বলা হয়নি। তবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। ইবনু হাজার বলেনঃ “এই হাদীসটির মিথ্যাচার সুস্পষ্ট। হাদীস সাহিত্যে যার দখল আছে তিনি কখনোই এই বিষয়ে দ্বিমত করবেননা।”(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/২১১)।
(২) তাবি-তাবিয়ী ফুদাইল ইবনু মারযূক (১৬০ হি) বলেছেন, ইবরাহীম ইবনু হাসান থেকে, ফাতিমা বিনতুল হুসাইন ইবনু আলী(১০০ হি) থেকে, আসমা বিনতু উমাইস(রা) থেকে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) এর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। এ সময়ে তাঁর মস্তক ছিল আলী(রা) এর কোলে। এজন্য আলী আসরের সালাত আদায় করতে পারেননি। এমতাবস্থায় সূর্য্ ডুবে যায়। তিনি আলীকে বলেনঃ তুমি কি সালাত আদায় করেছ? তিনি বলেনঃ না। তখন তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ, আলী যদি আপনার এবং আপনার রাসূলের আনুগত্যে থেকে থাকেন তবে তাঁর জন্য আপনি সূর্য্ ফিরিয়ে দিন। আসমা বলেনঃ আমি দেখলাম, সূর্য্ ডুবে গেল। এরপর ডুবে যাওয়ার পরে তা আবার উদিত হলো।”
এই সনদে আসমা বিনতু উমাইস প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী। ফাতিমা বিনতুল হুসাইন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। ফূযাইল ইবনুল মারযূক সত্যপরায়ণ রাবী, তবে তিনি ভুল করতেন। ইবরাহীম ইবনু হাসান কিছুটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না। তবে যেহেতু কেউ তাকে অগ্রহণযোগ্য বলে স্পষ্টত কিছু বলেননি, এজন্য ইবনু হিব্বান তাকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, সনদ বিচারে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বাহ্যিক সনদের দিকে তাকিয়ে এইরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাসীর, যাহাবী ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটির ‘মতন’ বা ‘মূলপাঠ’কে জাল বলে গণ্য করেছেন।
তাঁদের বিস্তারিত আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো, সূর্য্ অস্তমিত হওয়ার পরে উদিত হওয়া একটি অত্যাশ্চর্য্ ঘটনা। আর মানবীয় প্রকৃতি অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনা বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বোধ করে। এজন্য স্বভাবতই আশা করা যায় যে, অন্তত বেশ কয়েকজন সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। কিন্তু একমাত্র আসমা বিনতে উমাইস(রা) ছাড়া অন্য কোনো সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হয়নি। এইরূপ ঘটনা সূর্য্গ্রহণের চেয়ে অধিক আশ্চর্য্জনক বিষয়। আমরা দেখি যে সূর্য্ গ্রহণের ঘটনা অনেক সাহাবী হতে বর্ণিত, অথচ এই ঘটনাটি এই একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত।
এরপর আসমা(রা) এর ২০ জনেরও অধিক প্রসিদ্ধ ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। এইরূপ একটি অত্যাশ্চর্য্ ঘটনা তাঁর অধিকাংশ ছাত্রই বর্ণনা করবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু বস্তুত তা ঘটেনি। শুধুমাত্র ফাতেমার সনদে তা বর্ণিত হচ্ছে। ফাতেমার ছাত্র বলে উল্লেখিত ‘ইবরাহীম ইবনু হাসান’ অনেকটা অজ্ঞাত পরিচয় তিনি ফাতেমার নিকট হতে আদৌ শুনেছেন কিনা তা জানা যায়না। অনুরূপ আরেকটি সনদেও ঘটনাটি আসমা বিনতে উমাইস(রা) হতে বর্ণিত। সেই সনদেও দুইজন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী ও একজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। এতবড় একটি ঘটনা এভাবে দুই একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ বলবেননা তা ধারণা করা কষ্টকর।
অন্যদিকে ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বর্ণনার সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ(স) নিজে ও আলী(রা) সহ অন্যান্য সকল সাহাবী আসরের সালাত আদায় করতে ব্যর্থ হন। সূর্যাস্তের পরে তাঁরা কাযা সালাত আদায় করেন। অন্যদিন ঘুমের কারণে রাসূলুল্লাহ(স) সহ সাহাবীগণের ফজরের সালাত এভাবে কাযা হয়। এই দুইদিনে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(স) ও আলী(রা)সহ সাহাবীগণের জন্য সূর্য্ কে ফেরত আনা বা নেওয়া হলোনা, অথচ এই ঘটনায় শুধু আলীর জন্য তা করা হবে কেন? আর ওযরের কারণে সালাতের সময় নষ্ট হলে তো কোনো অসুবিধা হয়না। এছাড়া আলী(রা) রাসূলুল্লাহ(স) এর সাথে জামাতে সালাত আদায় করবেননা, আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্য্ন্ত এক/দেড় ঘন্টা যাবত ওহী নাযিল হবে ইত্যাদি বিষয় স্বাভাবিক মনে হয়না।
এই জাতীয় আরো অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, এই ‘মতন’টি ভুল বা বানোয়াট। এ সকল অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণ কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করেছেন।(ইবনু ইরাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮-৩৮২; আলবানী, যায়ীফাহ ২/৩৯৫-৪০১)।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিভিত্তিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের পদ্ধতি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সুক্ষ্ম। যে কোনো বিচারালয়ে বিচারক বুদ্ধিভিত্তিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণকে ডকুমেন্টারি প্রমাণের পরে বিবেচনা করেন। কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে অপরাধীর মোটিভ ও যৌক্তিকতা স্পষ্টভাবে দেখতে পারলেও পাশাপাশি প্রমাণাদি না থাকলে তিনি শুধুমাত্র মোটিভ বিবেচনায় শাস্তি দেননা। অনুরূপভাবে কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে যদি তিনি অনুভব করেন যে, তার জন্য অপরাধ করার কোনো যৌক্তিক বা বিবেকসংগত কারণ নেই, কিন্তু সকল ডকুমেন্ট ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি সুস্পষ্টরূপে তাকে অপরাধী বলে নির্দেশ করছে, তখন তিনি তাকে অপরাধী বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। মুহাদ্দিসগণও এভাবে সর্বপ্রথম ‘ডকুমেন্টারি’ প্রমাণগুলির নিরীক্ষা করেছেন এবং তারপর ভাষা, অর্থ ও তথ্য বিবেচনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার কিছু মূলনীতি আমরা দেখতে পাব, ইনশাল্লাহ।
১.৭.৩. মিথ্যা হাদীস চিহ্নিতকরণে মতভেদ
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এই মতভেদ সীমিত ও খুবই স্বাভাবিক। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হাদীসের নির্ভূলতা যাচাই করা অবিকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণের নির্ভুলতা প্রমাণ করার মতই একটি কর্ম। বিভিন্ন কেসে আমার বিচারকগণের মতভেদ দেখতে পাই। এর অর্থ এই নয় যে, বিচারকার্য্ একটি অনিয়ন্ত্রিত কর্ম এবং বিচারকগণ ইচ্ছামাফিক মানুষদের ফাঁসি দেন বা একজনের সম্পত্তি অন্যজনকে প্রদান করেন। প্রকৃত বিষয় হলো, সাক্ষ্য প্রমাণের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বিচারকগণ মতভেদ করতে পারেন। হাদীসের নির্ভুলতা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কিছু সংখ্যক হাদীসের বিষয়ে তাঁদের মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। ১. পরিভাষাগত মতভেদ ও ২. প্রকৃত মতভেদ।
১.৭.৩.১. মতভেদ কিন্তু মতভেদ নয়
অনেক সময় মুহাদ্দিসগণের মতভেদ একান্তই পরিভাষাগত। উপরে আমরা দেখেছি যে, মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত রাবীর পরিচয় জ্ঞাপনে এবং জাল হাদীস চিহ্নিতকরণে মুহাদ্দিসগণ একই পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। এতে কখনো কখনো দেখা যায় যে, একটি হাদীসকে একজন মুহাদ্দিস ‘মুনকার’ বা ‘বাতিল’ বলেছেন এবং অন্যজন তাকে ‘মাঊদূ’ বলেছেন।
এইরূপ একটি পরিভাষাগত বিষয় ‘যয়ীফ’ শব্দের ব্যবহার। ইলমু হাদীসের পরিভাষায় সকল প্রকার অগ্রহণযোগ্য হাদীসকেই ‘যয়ীফ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যয়ীফ হাদীসের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে এক প্রকারের হলো জাল বা মাউদূ হাদীস। কোনো হাদীসকে যয়ীফ বলে আখ্যায়িত করার অর্থ হাদীসটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। তা জাল হতে পারে নাও হতে পারে।
আমরা দেখতে পাই যে, অনেক মুহাদ্দিস হাদীস সংকলন ও নিরীক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষত বৃহদাকার গ্রন্থাদির ক্ষেত্রে অনেক হাদীস দুর্বল বা জয়ীফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল দুর্বল হাদীসের কোনো কোনো হাদীসকে অন্যান্য মুহাদ্দিস ‘মাউযূ’ বা জাল বলে উল্লেখ করেছেন। বিষয়টি বাহ্যত মতভেদ হলেও তা প্রকৃত মতভেদ নয়। কোনো মুহাদ্দিস যদি বলেন যে, হাদীসটি যয়ীফ তবে মাউযূ নয় এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেন যে, হাদীসটি মাউযূ, তবে তা মতভেদ বলে গণ্য হবে। কিন্তু যে সকল মুহাদ্দিস সাধারণত ‘মাউযূ’ পরিভাষা ব্যবহার করেননি, বরং সকল ‘অনির্ভরযোগ্য’ হাদীসকে সংক্ষেপে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি মতভেদ বলে গণ্য নয়।
১.৭.৩.২. প্রকৃত মতভেদ
কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের প্রকৃত মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। এই জাতীয় অধিকাংশ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের মতভেদ ‘যয়ীফ বনাম মাউযূ’। কোনো মুহাদ্দিস বলেছেন, হাদীসটি মাউযূ নয় বরং যয়ীফ বলে গণ্য। পক্ষান্তরে কেউ কেউ তাকে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। অল্প কিছু হাদীসের ক্ষেত্রে ‘সহীহ বনাম মাউযূ’ মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো কোনো মুহাদ্দিস একটি হাদীসকে মাউযূ বলে গণ্য করেছেন, কিন্তু অন্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলে গণ্য করেছেন। এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো একজন এর মতকে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন। বিষয়টি অনেকটা বিচারের রায়ের ক্ষেত্রে মতভেদ ও আপীলের মত।
১.৭.৩.৩. মতভেদের কারণঃ
কয়েকটি কারণে এই জাতীয় মতভেদ হয়ে থাকে।
১.৭.৩.৩.১. সনদের বিভিন্নতা
অনেক সময় একজন মুহাদ্দিস এক বা একাধিক সনদের ভিত্তিতে একটি হাদীসকে জাল বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানতে পারেননি যে, হাদীসটি অন্য কোনো সনদে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য একজন মুহাদ্দিস অন্য এক বা একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেন।
১.৭.৩.৩.২. রাবীর মান নির্ধারণে মতভেদ
‘রাবী’র বর্ণিত হাদীসগুলির তুলনামূলক নিরীক্ষা হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের মূল মাপকাঠি। আর এ কারণেই রাবীর বর্ণনা বিচারে কিছু মতভেদ হয়। এদিক থেকে আমরা রাবীগণকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। (১) পূর্ণ গ্রহণযোগ্য রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সকল মুহাদ্দিসগণ একমত, (২)পূর্ণ অনির্ভরযোগ্য রাবীগণ, যাদের দুর্বলতা বা জালিয়াতির বিষয়ে নিরীক্ষক মুহাদ্দিসগণ একমত এবং (৩) মতভেদীয় রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার মান নির্ধারণে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন।
যে সকল রাবী কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ দেখেছেন যে, তাঁদের বর্ণিত হাদীসে বেশ কিছু উল্টাপাল্টা ও ভুল বর্ণনা রয়েছে এবং কিছু সহীহ বর্ণনাও রয়েছে এদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মতভেদ করেছেন। তাদের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে শুদ্ধ ও ভুল বর্ণনার হার, কারণ ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ মাঝে মাঝে মতভেদ করেছেন।
এছাড়া অনেক সময় কোনো কোনো মুহাদ্দিস আংশিক তথ্যের উপর নির্ভর করে রায় দিয়েছেন, যা অন্য কোনো মুহাদ্দিস সামগ্রিক তথ্যের উপর নির্ভর করে বাতিল করেছেন। যেমন একজন বর্ণনাকারীর কিছু হাদীস বিশুদ্ধ বা ভুল দেখে একজন মুহাদ্দিস তাকে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। অন্য মুহাদ্দিস তাঁর সকল বর্ণিত হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্য বিধান প্রদান করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ পর্যালোচনা করেছেন এবং মতামত প্রদানকারীদের বিভিন্ন মতামতের ভারসাম্য, বিচক্ষণতা, গভীরতা ইত্যাদির ভিত্তিতে মতবিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিমালা নির্ণয় করেছেন। (ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১৫১-১৭০)।
১.৭.৩.৩.৩. মুহাদ্দিসের নীতিগত বা পদ্ধতিগত মতভেদ
কখনো কখনো রাবী বা হাদীসের বিধান প্রদানে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কেউ কেউ বেশি ঢিলেমি ও কেউ বেশি কড়াকড়ি করেছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ এ সকল বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে তাদের মতভেদ নিরসন করেছেন। যেমন, চতুর্থ শতকের মুহাদ্দিস ইবনু হিব্বান আবু হাতিম মুহাম্মাদ আল বুসতী(৩৫৪ হি), ৬ষ্ঠ শতকের মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী(৫৯৭ হি) ভিত্তিহীন কঠোরতার জন্য অভিযুক্ত। পক্ষান্তরে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী ইবনু ঈসা(২৭৯ হি), ৪র্থ-৫ম শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ হাকিম নাইসাপুরী (৪০৫ হি), ১০ম শতকের মুহাদ্দিস জালালুদ্দিন সুয়ূতী(৯১১ হি) প্রমুখ ঢিলেমির জন্য পরিচিত ছিলেন। এখানে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
(১) ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযীর কড়াকড়ি জাত ভুলের উদাহরণ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী আফলাহ ইবনু সাঈদ আনসারী(১৫৬ হি) বলেন, আমাদেরকে উম্মু সালামার গোলাম আব্দুল্লাহ ইবনু রাফি বলেছেন, আমি আবু হুরাইরা(রা) কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ “তোমার জীবন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে খুব সম্ভব তুমি এমন কিছু মানুষ দেখতে পাবে যাদের হাতে গরুর লেজের মত(ছড়ি বা বেত) থাকবে। (নিরীহ মানুষদের সন্ত্রস্ত করবে বা আঘাত করবে।) তারা সকালেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যে থাকবে, বিকেলেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যেই থাকবে।
এই হাদীসটিকে ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযী বানোয়াট ও জাল বলে গণ্য করেছেন। তাদের দাবি, এই হাদীসের বর্ণনাকারী আফলাহ ইবনু সাঈদ হাদীস উল্টাপাল্টা বলতেন, জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামতের আলোকে দেখেছেন যে, ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযীর এই মত সম্পূর্ণ ভুল। কোনো মুহাদ্দিসই কখনো বলেননি যে, আফলাহ জাল হাদীস বর্ণনা করেন। এমনকি কেউ বলেননি যে, আফলাহ দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য। মুহাম্মদ ইবনু সাদ(২৩০ হি), ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন(২৩৩ হি), আবূ হাতিম রাযী(২৭৭ হি), নাসাঈ (৩০৪ হি)ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে নির্ভরযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ইবনু হিব্বান বা ইবনুল জাওযী কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেননি যে, আফলাহ অন্য রাবীদের বিপরীত উল্টাপাল্টা কোনো হাদীস বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি এই হাদীসটি আফলাহ ছাড়াও অন্য নির্ভরযোগ্য রাবী আবু হুরাইরার সূত্রে বর্ণিত করেছন। কাজেই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ এবং ইবনু হিব্বান ও ইবনুল জাওযী ভুল বলে প্রমাণিত।(মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮০)।
(২)ইমাম তিরমিযীর ঢিলেমিজাত ভুলের উদাহরণ। তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে মুসলিম ইবনু আমর আবু আমর আল হাযযা মাদানী বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু নাফী আস সাইগ বলেন, তিনি কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে তার পিতা থেকে তার দাদা(আমর ইবনু আউফ) থেকে বলেন, “নবী আকরাম দুই ঈদে প্রথম রাকায়াতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৭ এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৫ তাকবীর বলেছেন। (তিরিমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬)।
হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম তিরমিযীর বলেনঃ কাসীরের দাদার হাদীসটি হাসান। এই বিষয়ে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে এই হাদীসটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। (তিরিমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬)।
এভাবে তিনি এই হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, তার মতে এই বিষয়ে এটিই হলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হাদীস।
মুহাদ্দিসগণ ইমাম তিরমিযীর এই প্রবল মতের বিরোধিতা করেছেন। কারণ, মুহাদ্দিসগণ এই হাদীসের বর্ণনাকারী কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত দুর্বল রাবী বলে গণ্য করেছেন। উপরন্তু অনেকেই তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনু হাম্বাল বলেনঃ সে অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেনঃ সে দুর্বল। ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ লোকটি জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল। ইমাম শাফেয়ী বলেনঃ সে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদীদের একজন। ইমাম নাসাঈ ও দারাকুতনী বলেনঃ সে পরিত্যক্ত, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বলার অভিযোগে অভিযুক্ত। ইবনু হিব্বান বলেনঃ সে তার পিতা থেকে দাদা থেকে একটি মিথ্যা হাদীসের পুস্তিকা বর্ণনা করেছে। শুধুমাত্র সমালোচনার প্রয়োজন ছাড়া কোনো গ্রন্থে সে সকল হাদীস উল্লেখ করাও জায়েয নয়। ইবনু আব্দুল বারর বলেনঃ এই ব্যক্তি যে দুর্বল সে বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য হয়েছে।(ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩৭৭)।
এজন্য আবুল খাত্তাব উমর ইবনু হাসান ইবনু দাহিয়া(৬৩৩ হি) বলেনঃ “ইমাম তিরমিযী তাঁর গ্রন্থে কত যে মাউযূ বা বানোয়াট ও অত্যন্ত দুর্বল সনদকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এই হাদীসটিও সেগুলির একটি।[যাইলায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ(৭৬২ হি)]।
(৩) ইমাম হাকীম এর মুসতাদরাক এর উদাহরণ। হাদীসকে সহীহ বলার ক্ষেত্রে হাকীমের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। তিনি তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে অনেক জাল হাদীসকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন।
একটি উদাহরণ দেখুনঃ হাকিম বলেন, আমাদেরকে আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু উকবা শাইবানী কুফায় অবস্থানকালে বলেছেন, আমাদেরকে কাযী ইবরাহীম ইবনু আবিল আনবাস বলেছেন, আমাদেরকে সাঈদ ইবনু উসমান আল খাররায বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল মুয়াযযিন বলেছেন, আমাদেরকে কাতার ইবনু খালীফাহ বলেছেন, আবুত তুফাইল থেকে, তিনি আলী ও আম্মার(রা) থেকে: তাঁরা উভয়ে বলেনঃ “নবী ফরয সালাতসমূহে জোরে জোরে (সশব্দে) ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করতেন এবং তিনি সালাতুল ফযরে কুনুত পাঠ করতেন……।”
ইমাম হাকিম হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, “এই হাদীসটির সনদ সহীহ। এর রাবীদের মধ্যে কেউ দুর্বল বলে গণ্য হয়েছেন বলে জানিনা।”(হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/৪৩৯)।
ইমাম যাহাবী, যাইলায়ী, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস হাকিমের এই সিদ্ধান্ত ভুল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী বলেন, এই হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, মাউযূ বা জাল বলেই প্রতীয়মান হয়। সনদের দুইজন রাবী অত্যন্ত দুর্বলঃ (১)সাঈদ ইবনু উসমান আল খাররায এবং (২) তার উস্তাদ আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল মুয়াযযিন। (হাকিম, আল মুসতাদরাক ১/৪৩৯)।
এইরূপ আরো উদাহরণ আমরা দ্বিতীয় পর্বে দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ।
(৪)দশম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী। ইলম হাদীসের বিভিন্ন ময়দানে তাঁর খেদমত রয়েছে। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর গ্রন্থাবলীর উপর নির্ভর করেন। তিনি তাঁর প্রণীত ও সংকলিত ‘আল জামি’ আস-সগীর’, ‘আল জামি’ আল-কাবীর’ ‘আল খুসাইসুল কুবরা’ বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এ সকল গ্রন্থে সহীহ ও যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন তবে কোনো জাল হাদীস নয়। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ সকল গ্রন্থে কিছু জাল হাদীসও দেখতে পেয়েছেন। বিশেষত, ইমাম সুয়ূতী নিজেই জাল হাদীসের বিষয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন। বেশ কিছু হাদীস ইমাম সুয়ূতী জাল বলে চিহ্নিত করে জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থে সংকলন করেছেন। আবার তিনি নিজেই সেগুলিকে ‘আল জামি’ আস-সগীর’, ‘আল জামি’ আল-কাবীর’ ‘আল খুসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থাদিতে সংকলিত করেছেন।
একটি উদাহরণ দেখুন। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী(৪২৭ হি) ও আহমদ ইবনু আলী খাতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি) একটি হাদীস সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইসহাক ইবনুস সালত হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এই ইসহাক ইবনুস সালত বলেন, আমাদেরকে ইমাম মালিক ইবনু আনাস বলেছেন, আমাদেরকে আবুয যুবাইর মাক্কী বলেছেন, আমাদেরকে জাবিন ইবনু আব্দুল্লাহ(রা) বলেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ(স) হতে এমনি তিনটি (অলৌকিক) বিষয় দেখেছি যে, তিনি কুরআন আনয়ন না করলেও আমি তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করতাম। (একবার) আমরা এক দূরবর্তী মরূভূমিতে গমন করি। তখন নবী(স) ইসতিনজার পানি হাতে নিলেন। তিনি দুইটি খেজুরগাছ দেখে আমাকে বললেন, হে জাবির, তুমি গাছ দুটির নিকট যেয়ে তাদেরকে বল, তোমরা একত্রিত হও। এতে গাছ দুইটি এমনভাবে একত্রিত হয়ে গেল যেন তার একই মূল হতে উৎপন্ন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) ইসতিনজা সম্পন্ন করলেন। আমি তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে তাকে দিলাম। আর আমি বললাম, তাঁর পেট থেকে যা বের হয়েছে তা হয়ত আল্লাহ আমাকে দেখাবেন এবং আমি তা ভক্ষণ করব। কিন্তু আমি দেখলাম যে, মাটি পরিস্কার সাদা। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ইসতিনজা করেননি? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তবে আমাদের নবীগণের বিষয়ে যমীনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমাদের থেকে মলমূত্র যা নির্গত হবে তা আবৃত করে ফেলতে……।”
ইমাম মালিক ছিলেন দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। অগণিত মুহাদ্দিস তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা করেছেন। মূলত, সেই সময়ের সকল মুহাদ্দিসই তাঁর নিকট হতে হাদীস শিখেছেন। অনেকেই বছরের পর বছর তাঁর সান্যিধ্যে থেকে হাদীস শিখেছেন। এ সকল অগণিত ছাত্রের কেউই এই হাদীসটি বর্ণনা করেননি। অনুরূপভাবে তাবিয়ী আবুয যুবাইর বা সাহাবী জাবির (রা) থেকেও অন্য কোনো সূত্রে তা বর্ণিত হয়নি। একমাত্র ইসহাক ইবনুস সালত নামক এই ব্যক্তি দাবি করেছেন যে, ইমাম মালিক তাকে হাদীসটি বলেছেন। এই ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল ও বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী বলে চিহ্নিত হয়েছেন। আরো লক্ষণীয় হলো, এই ইসহাকের বর্ণনাও তৃতীয় বা চতুর্থ শতকে কোনোরূপ প্রসিদ্ধি বা পরিচিতি লাভ করেনি। ৫ম শতকে কেউ কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেননি। জুরজানী ও খতীব হতে ইসহাক পর্য্ন্ত সনদও অন্ধকারাচ্ছন্ন। এজন্য খতীব বাগদাদী, হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিসের মতামতের আলোকে ইমাম সুয়ূতী নিজেই হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন এবং জাল বিষয়ক ‘যাইলুল লাআলী’ নামক গ্রন্থে তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
আবার তিনি নিজেই রাসূলুল্লাহ(স) এর মুযিজা, অলৌকিকত্ব ও বৈশিষ্ট্যাবলী বিষয়ক ‘আল-খুসাইসুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি দাবী করেছেন যে, এই গ্রন্থে তিনি কোনো মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করবেননা। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এই স্ববিরোধিতা ও হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে তাঁর ঢিলেমেরি কথা উল্লেখ করেছেন।(হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, তারীখ জুরজান, পৃ. ৫২৬, সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০)।
১.৮. মিথ্যা হাদীস বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি
১.৮.১. হাদীস গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
অজ্ঞতা বশত অনেকে মনে করেন যে, কোনো হাদীস কোনো হাদীস গ্রন্থে সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহীহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহীহ। যেমন কোনো হাদীস যদি সুনাসু ইবনু মাজাহ বা মুসান্নুফূ আবদুর রাযযাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো, হাদীসটি নিশ্চয় সহীহ, নইলে ইবনু মাজাহ বা আব্দুর রাযযাকের মত অত বড় মুহাদ্দিস তা গ্রহণ করলেন কেন? অন্তত, ইবনু মাজাহ বা আবদুর রাযযাকের মতে হাদীসটি সহীহ, নইলে তিনি তাঁর গ্রন্থে হাদীসটির স্থান দিতেননা।
আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এই ধারণাটির উভয় দিকই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দিসই তাঁদের গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ সকল প্রকার হাদীসই সংকলন করেছেন। তাঁরা কখনোই দাবি করেননি বা পরিকল্পনাও করেননি যে, তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করবেন। কাজেই কোনো হাদীস সুনানে ইবনু মাজাহ বা মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক-এ সংকলিত থাকাতে কখনোই বুঝা যায়না যে, হাদীসটি সহীহ বা ইবনু মাজাহ বা আবদুর রাযযাক এর মতে সহীহ।
ইবনু হিব্বান, ইবনু খুযাইমা, ইবনুস সাকান, হাকিম ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিস তাঁদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেছেন, তাঁদের গ্রন্থে কোনো হাদীস সংকলিত হলে আমরা মনে করব যে, হাদীসটি উক্ত মুহাদ্দিসের মতে সহীহ। তবে এতে প্রমাণিত হয়না যে, হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে সহীহ। আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, কোনো মুহাদ্দিসের দাবিই উম্মাহর অন্যান্য মুহাদ্দিস নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করেননি। এজন্য আমরা অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিরীক্ষার আলোকে হাদীসটির বিধান বর্ণনা করব।
আমাদের সমাজে ‘সিহাহ সিত্তাহ’(সিহাহ সিত্তাহ পরিভাষাটি ভারতীয় ব্যবহার।এই ছয়টি গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা সুপরিচিত। তবে গ্রন্থগুলি ‘সহীহ’ নয়। বরং ২টি গ্রন্থ সহীহ এবং বাকিগুলি সুনান। এজন্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে সুপরিচিত পরিভাষা হলো ‘আল কুতুবুস সিত্তা’ ‘পুস্তক ছয়টি’। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও সিহাহ সিত্তা পরিভাষাটি প্রচলিত নয়) নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২টি সহীহ গ্রন্থঃ ‘‘সহীহ বুখারী’’ ও “সহীহ মুসলিম” ছাড়া বাকি ৪টির সংকলক ও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁরা তাঁদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাঁদের গ্রন্থগুলির অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারণে পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে তাঁদের গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করেছেন, সাথে সাথে তাঁরা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দুর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেছেন। আল্লামা আবদুল হাই লাখনবী(১৩০৪ হি)এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেনঃ ‘এই চার গ্রন্থে সংকলিত সকল হাদীস সহীহ নয়। বরং এ সকল গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও বানোয়াট সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে। (আল আজইবাতুল ফাযিলা লিল আসইলাহ আল আশারাতিল কামিলা পৃ. ৬৬)।
ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহর (রহ) বিবরণ দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী: এই তিনটি গ্রন্থকে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন, যে সকল গ্রন্থের হাদীসসমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি ‘সুনান ইবনি মাজাহ’কে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেননি। এর কারণ হলো, ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইয়াজীদ ইবনু মাজাহ আল কাযবীনী(২৭৫ হি) সংকলিত ‘সুনান’ গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত করেননি। হিজরী ৭ম শতক পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অতিরিক্ত এই তিনটি সুনান গ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু তাহির মাকসিদী, আবুল ফাদল ইবনুল কাইসুরানী(৫০৭ হি) এগুলির সাথে সুনান ইবনু মাজাহ যোগ করেন।
তাঁর এই মত পরবর্তী দুই শতাব্দী পর্য্ন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেননি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আবদুর রাহমান(৬৪৩ হি), আল্লামা আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-না্বাবী(৬৭৬ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসেবে উপরের ৫টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবুন মাজাহ কে তাঁরা এর মাঝে গণ্য করেননি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কিক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মাদ (৬০৬ হি)ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ইমাম মালিকের মুআত্তাকে গ্রহণ করেছেন।
সুনান ইবনি মাজাহকে উপরের তিনটি সুনানের পর্যায়ভুক্ত করতে আপত্তির কারণ হলো ইমাম ইবনু মাজাহর সংকলন পদ্ধতি এই তিন গ্রন্থের মত নয়। উপরে তিন গ্রন্থের সংকলক মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন। বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে কিছু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম ইবনু মাজাহ তৎকালীন সাধারণ সংকলন পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, এ সকল যুগের অধিকাংশ সংকলক সনদসহ প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করতেন। এতে সহীহ, যয়ীফ, মাউদূ সব প্রকারের হাদীসই তাঁদের গ্রন্থে স্থান পেত। সনদ বিচার ছাড়া হাদীসের নির্ভরতা যাচাই করা সম্ভব হতোনা। ইমাম ইবনু মাজাহও মূলত এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তিনি সহীহ বা হাদীস সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি সহীহ ও হাসান হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ ও কিছু মাউযূ বা বানোয়াট হাদীসও সংকলন করেছেন। তিনি এসকল যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো মন্তব্য করেননি।
৮ম হিজরী শতক থেকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস সুনানে ইবনি মাজাহকে ৪র্থ সুনান গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। মুআত্তা ও সুনান ইবনি মাজাহ এর মধ্যে পার্থক্য হলো, মুআত্তা গ্রন্থের হাদীস সংখ্যা কম এবং এই গ্রন্থের সকল সহীহ হাদীস উপরের ৫টি গ্রন্থের মধ্যে সংকলিত। ফলে এই গ্রন্থটিকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করলে অতিরিক্ত হাদীস জানা যাচ্ছেনা। পক্ষান্তরে সুনান ইবনি মাজাহ এর মধ্যে উপরের ৫টি গ্রন্থের অতিরিক্ত সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে। এজন্যই পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ এই গ্রন্থটিকে ৪র্থ সুনান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইমাম ইবনু মাজাহ এর সুনান গ্রন্থে মোট ৪৩৪১টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাঁচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী প্রায় দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম হিজরী শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ ইবনু আবী বাকর আল-বূসীরী(৮৪০ হি) ইবনু মাজাহর এ সকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বূসীরী ১৪৭৬ টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন, যেগুলি উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, শুধুমাত্র ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। এগুলির মধ্যে প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।(ইবনুল কাউসূরানী, শুরুতুল আইম্মাহ আস-সিত্তাহ পৃ. ১৩, ২৪-২৬)।

১.৮.২. আলিমগণের গ্রন্থ বনাম জাল হাদীস
হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকহ, ওয়ায, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে আরো অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারণত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতাবশত ধারণা করেন যে, এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয় যাচাই বাছাই করেই হাদীসগুলি উল্লেখ করেছেন। সহীহ না হলে কি আর তিনি হাদীসটি লিখতেন?
এই ধারণাটিও ভুল, ভিত্তিহীন এবং উপরের ধারণাটির চেয়েও বেশি বিভ্রান্তিকর। সাধারণত প্রত্যেক ইলমের জন্য পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত সময় দিতে পারেননা। মুফাসসির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সূফী, ওয়ায়িয ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদীসের নিরীক্ষা, যাছাই বাছাই ও পর্যালোচনার গভীরতায় যেতে পারেননা। সাধারণভাবে তাঁরা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ, জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপরে নির্ভর করেন। এজন্য তাঁদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন, সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নবাবী তাঁর “তাকরীব” গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ূতী তাঁর “তাদরীবুর রাবী” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীসে বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোনো কোনো মুফাসসির, যেমন- আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আস সালাবী নিশাপূরী(৪২৭ হি) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে, তাঁর ছাত্র আল্লামা আলী ইবনে আহমাদ আল ওয়াহিদী নিশাপূরী(৪৬৮ হি) তাঁর “বাসীত”, “ওয়াসিত”, “ওয়াজীয” ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাশেম মাহমূদ ইবনে উমর আয-যামাখশারী (৫৩৮ হি) তাঁর কাশশাফ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আল বাইযাবী(৬৮৫ হি) তাঁর “আনওয়ারুত তানযীল” বা “তাফসীরে বাইযাবী” গ্রন্থে এসকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এই কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ূতী বলেনঃ “ইরাকী(৮০৬ হি)বলেছেন যে, প্রথম দুইজন-সা’লাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখপূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।” ফলে তাঁদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারণ তাঁরা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মাউযূ বা মিথ্যা হাদীস সনদসহ উল্লেখ করলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাউযূ না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েয নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন-যামাখশারী ও বাইযাবী –এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারণ, তাঁরা সনদ উল্লেখ করেননি, বরং রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে সরাসরি ও স্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। (জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৩৪১)।
মোল্লা আলী কারী কোনো কোনো বানোয়াট হাদীস উল্লেখপূর্বক লিখেছেনঃ “কুতুল কুলুব”, “এহইয়াউ উলূমুদ্দীন”, “তাফসীরে সা’লাবী” ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ আছে দেখে ধোঁকা খাবেননা।(মুল্লা আলী কারী, আল-আসরারুল মারফুয়া, পৃ. ২৮৯)।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্লেখ করে বলেনঃ “আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্লেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপারে। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরূপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন, কিন্তু সেগুলি জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ‘ফাতওয়া’ বিষয়ক পুস্তকাদি। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমাদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, এসকল পুস্তকের লেখকগণ যদিও ‘কামিল’ ছিলেন, তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অসতর্ক ছিলেন।(আবদুল হাই লাখনবী, আন-নাফি আল কাবীর, পৃ. ১২-১৩)।
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিকহ, তাফসীর, তাসাঊফ, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নিরীক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর আল মারগীনানী (৫৯৩ হি) তাঁর লেখা ফিকহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ “হেদায়া”য় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসাবে ফিকহ মাসায়েল নির্ধারণ ও বর্ণনার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোনো হাদীসের সহীহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে যাননি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসূফ যাইলায়ী হানাফী(৭৬২ হি), আল্লামা আহমাদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী(৮৫২ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদীস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষণা করে এর মধ্য থেকে সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস নির্ধারণ করেছেন।
অনুরূপভাবে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী(৫০৫ হি) তাঁর প্রসিদ্ধ “এহইয়াউ উলুমিদ্দীন” গ্রন্থে ফিকহ ও তাসাউফ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকীহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেননা। এজন্য হাদীসের সনদ বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদল আব্দুল রহীম ইবনে হুসাইন আল-ইরাকী(৮০৬ হি) ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাঁর উল্লিখিত হাদীসসমূহের সনদ ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষণ করে সহীহ, জাল ও বানোয়াট হাদীসুগলি নির্ধারণ করেছেন। এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা ওয়াহাব ইবনু আলী আস-সুবকী (৭৭১ হি) ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থে উল্লিখিত কয়েকশত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম ‘আল আহাদীস আল্লাতী লা আসলা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া’, অর্থাৎ ‘এহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহ’।

১.৮.৩. কাশফ ইলহাম বনাম জাল হাদীস
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর প্রিয় ওলী-রূপে প্রসিদ্ধ আলিমগণের বিষয়ে। যেহেতু তাঁরা ‘সাহেবে কাশফ’ বা কাশফ সম্পন্ন ওলী ছিলেন, সেহেতু আমরা ধারণা করি যে, কাশফের মাধ্যমে প্রদত্ত তথ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তো তাঁরা আর লিখেননি। কাজেই তাঁরা যা লিখেছেন বা যা বলেছেন তা বিশুদ্ধ বলে গণ্য হবে।
আল্লামা সুয়ূতী(৯১১ হি), আব্দুল হাই লাখনবী(১৩০৪ হি)প্রমুখ আলিম এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁরা ইমাম গাযযালীর ‘‘এহইয়াউ এলুমিদ্দীন” ও অন্যান্য গ্রন্থে, হযরত আবদুল কাদির জিলানী লিখিত কোনো কোনো গ্রন্থে উল্লেখিত অনেক মাউযূ বা বানোয়াট হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেনঃ এত বড় আলেম ও এত বড় সাহেবে কাশফ ওলী, তিনি কি বুঝতে পারলেন না যে, এই হাদীসটি বানোয়াট? তাঁর মত একজন ওলী কিভাবে নিজ গ্রন্থে মাউদূ হাদীস উল্লেখ করলেন? তাঁর উল্লেখের দ্বারা কি বুঝা যায়না যে, হাদীসটি সহীহ? এই সন্দেহের জবাবে তাঁরা যে ব্যাখ্যাগুলি উল্লেখ করেছেন সেগুলির ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ

১.৮.৩.১. বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লেখেন
বস্তুত সরলপ্রাণ বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লিখেন।এজন্য কোনো বুযুর্গের গ্রন্থে তাঁর সুস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া কোনো হাদীস উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত হয়েছেন। মূলত তাঁরা যা পড়েছেন বা শুনেছেন তা উল্লেখ করেছেন মাত্র। তাঁরা আশা করেছেন হয়তো এর কোনো সনদ থাকবে, হাদীসের বিশেষজ্ঞগণ তা খুঁজে দিবেন।
১.৮.৩.২. হাদীস বিচারে কাশফের কোনো ভূমিকা নেই
হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোনোই অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ হতে দেয়া নেয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামতো প্রয়োগের কোনো বিষয় নয়। আল্লাহ তা’য়ালা কাশফের মাধ্যমে হযরত উমারকে (রা) শত শত মাইল দূরে অবস্থিত সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁরই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু লু’লুর কথা টের পেলেননা হযরত উমার(রা)।
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফায়সালা হয়না। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে, কখনোই একটি ঘটনাতেও তাঁরা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁরা হক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেননি। খুলাফায়ে রাশেদীন-আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তি সন্দেহ হলে তাঁরা সাক্ষী চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তাঁরা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তাঁর বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেননি।কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেননি। পরবর্তী প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও বানোয়াট নির্ধারণের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্ণনাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তাঁরা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে সুন্নাত, বিদয়াত ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতা।

১.৮.৩.৩. কাশফ, ইলহাম সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়
ইসলামী আকীদার গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, কাশফ বা ইলম কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার মাপকাঠি নয়। ৬ষ্ঠ শতকের অন্যতম হানাফী আলিম উমার ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী(৫৩৭ হি) তাঁর “আল আকাইদ আল নাসাফিয়্যাহ” ও ৮ম শতকের প্রখ্যাত শাফেয়ী আলিম সা’দ উদ্দীন মাসউদ ইবনু উমার আত-তাফতাযানী (৭৯১ হি) তাঁর “শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ”তে লিখেছেনঃ “হকপন্থীদের নিকট ‘ইলহাম’ যা ‘ফয়েযরূপে প্রদত্ত ইলকা’ নামে পরিচিত তা কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার মাধ্যম হতে পারেনা।”(মুজাদ্দিদে আলফেসানী, মাকতুরাত শরীফ ১/১, পৃ. ৮৮, ১৭৮, ১৯৫, ১৯৬…..)।
কোনো কোনো অনভিজ্ঞ বুযুর্গ স্বপ্ন, কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির ভিত্তিতে ‘হাদীসের’ বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের দাবি করলেও অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ বুযুর্গগণ এর কঠিন বিরোধিতা করেছেন। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও সংস্কারক মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রাহ) হক্ক-বাতিল বা বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা জানার ক্ষেত্রে কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির উপর নির্ভর করার কঠিন আপত্তি ও প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বারংবার উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন-হাদীসই কাশফ, ইলহাম ইত্যাদির সঠিক বা বেঠিক হওয়ার মানদন্ড। কাশফ কখনোই হাদীস বা কোনো মতামতের সঠিকত্ব জানার মাধ্যম নয়।
১.৮.৩.৪. সাহেবে কাশফ ওলীগণের ভুলত্রুটি
বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে এমন অনেক কথা লিখেছেন যা নিঃসন্দেহে ভুল বা অন্যায়।হযরত আবদুল কাদের জিলানী(৫৬১ হি) লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ও ফেরকায়ে নাজীয়ার আলামত বলে গণ্য করেছেন এবং ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গণ্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোনো মুসলমানের উচিত নয় যে সে বলবেঃ “নিশ্চয় আমি মুমিন”, বরং তাঁকে বলতে হবে যে, “ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন।” ইমাম আবু হানীফা(রাহ) ও তাঁর অনুসারীগণ যেহেতু ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি স্বীকার করেননা, আমলকে ঈমানের অংশ মনে করেননা এবং ‘ইনশা আল্লাহ আমি মুমিন’ বলাকে আপত্তিকর মনে করেন, সেজন্য তিনি তাঁকে ও তাঁর অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন। [আব্দুল কাদের জিলানী, গুনিয়াতুত তালিবীন(অনুবাদ-নুরুল আলম রঈসী), পৃ. ৬, ৭, ১৪৯, ১৫১,১৫২, ১৫৫, ২১১, ২২৭]।
ইমাম গাযযালী লিখেছেন যে, গান বাজনা ও নর্তন কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদ‘আতে হাসানা। তিনি গান বাজনার পক্ষে অনেক দুর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।(আবু হামিদ গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/২৯২-৩৩২)
এরূপ অগণিত উদাহরণ তাঁদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই, তাঁরা যদি কোনো হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষণা দেন তারপরও তার সনদ বিচার ব্যতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবেনা। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা, সকল বানোয়াট কথাকে চিহ্নিত করা দ্বীনের অন্যতম ফরজ। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বর্ণনা করলেও তাঁকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই, এক্ষেত্রে কোনো শিথিলতার অবকাশ নেই।
১.৮.৪. বুযুর্গগণের নামে জালিয়াতি
এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় নেককার বুযুর্গ ও ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে প্রচুর। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়ঃ
(১) জালিয়াতগণ ধর্মের ক্ষতি করার জন্য অথবা ধর্মের ‘উপকার’ করার জন্য জালিয়াতি করত। বিশেষ করে যারা ধর্মের অপূর্ণতাকে(!) দূর করে আরো আকর্ষণীয় ও জননন্দিত করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের জালিয়াতিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। আর উভয় দলের জন্য বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের জন্য রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে জালিয়াতি করার চেয়ে ওলী-আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি করা অধিক সহজ ও অধিক সুবিধাজনক ছিল।
(২) বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি অধিকতর সুবিধাজনক এজন্য যে, সাধারণ মানুষদের মাঝে তাঁদের নামের প্রভাব ‘হাদীসের’ চেয়েও বেশি। অনেক সাধারণ মুসলমানকে ‘হাদীস’ বলে বুঝানো কষ্টকর। তাকে যদি বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ(স) অমুক কাজ করেছেন, করতে বলেছেন……তবে তিনি তা গ্রহণ করতেও পারেন আবার নাও পারেন। কিন্তু যদি তাকে বলা হয় যে, আব্দুল কাদের জিলানী বা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বা……অমুক ওলী এই কাজটি করেছেন বা করতে বলেছেন তবে অনেক বেশি সহজে তাকে ‘প্রত্যায়িত’ (Convinced) করা যাবে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি তা মেনে নিবেন। ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর সোনালী দিনগুলির পরে যুগে যুগে সাধারণ মুসলিমদের এ অবস্থা। কাজেই বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি বেশি কার্য্কর ছিল।
(৩) ওলী-আল্লাহদের নামে জালিয়াতি সহজতর ছিল এজন্য যে, হাদীসের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সতর্ক প্রহরা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছিলেন, এক্ষেত্রে তা কিছুই ছিলনা বা নেই। কোনো নিরীক্ষা নেই, পরীক্ষা নেই, সনদ নেই, মতন নেই, ঐতিহাসিক বা অর্থগত নিরীক্ষা নেই- যার যা ইচ্ছা বলছেন। কাজেই অতি সহজে জালিয়াতগণ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারতেন।
(৪) হাদীস জালিয়াতির জন্যও এ সকল বুযুর্গের নাম ব্যবহার ছিল অত্যন্ত কার্য্কর। এ সকল বুযুর্গের নামে বানোয়াট কথার মধ্যে অনেক জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। এ সকল বুযুর্গের প্রতি ‘ভক্তির প্রাবল্য’-র কারণে অতি সহজেই ভক্তিভরে এ সকল বিষ ‘গলাধঃকরণ’ করেছেন মুসলমানরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে জালিয়াতগণ।
১.৮.৪.১. কাদেরীয়া তরীকা
আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ) হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের(দ্বাদশ খ্রিস্টীয় শতকের) প্রসিদ্ধতম ব্যক্তিত্ব। একদিকে তিনি হাম্বলী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি প্রসিদ্ধ সাধক ও সূফী ছিলেন। তাঁর নামে অনেক তরীকা, কথা ও পুস্তক মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত। এ সকল তরীকা, কথা ও পুস্তক অধিকাংশ বানোয়াট। কিছু কিছু পুস্তক তাঁর নিজের রচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলির মধ্যে অনেক বানোয়াট কথা ঢুকানো হয়েছে। এখানে আমরা তাঁর নামে প্রচলিত কাদেরীয়া তরীকা ও ‘সিররুল আসরার’ পুস্তিকটির পর্যালোচনা করব।
প্রচলিক কাদেরীয়া তরীকার আমল, ওযীফা, মুরাকাবা ইত্যাদি পদ্ধতির বিবরণ আব্দুল কাদির জিলানী(রাহ) এর পুস্তকে পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ) এর ওফাতের প্রায় দুইশত বছর পরে তাঁর এক বংশধর ‘গাওসে জিলানী” ৮৮৭ হিজরী সালে (১৪৮২ খ্রিস্টাব্দ) ‘কাদেরিয়া তরিকা’-র প্রচলন করেন। বিভিন্ন দেশে ‘কাদেরিয়া তরিকা’-র নামে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর নিজের লেখা প্রচলিত বইগুলিতে যে সকল আমল, ওযীফা ইত্যাদি লিখিত আছে প্রচলিত ‘কাদেরিয়া তরিকা’র মধ্যে সেগুলি নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরিকার সূত্র বা ‘শাজারা’ থেকে আমরা দেখি যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী(১১৭৬ হি/১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ)থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘আল কাওলুল জামীল’ গ্রন্থে কাদেরীয়া তরীকার যে বিবরণ দিয়েছেন তার সাথে সাইয়্যেদ আহমেদ বেলব্রীর(১২৪৬ হি) ‘সিরাতে মুস্তাকিমের’ বিবরণে পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুইজনের শিখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরিকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি তাঁর নিজের প্রবর্তিত ও কোনটি তাঁর নামে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত তা জানার কোনো উপায় নেই।
১.৮.৪.২. সিররুল আসরার
হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ) নামে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পুস্তক ‘সিররুল আসরার’। পুস্তকটিতে কুরআন-হাদীসের আলোকে অনেক ভালো কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস ও বানোয়াট কথা পুস্তকটিতে বিদ্যমান। অবস্থাদৃষ্টি দেখা যায়, পরবর্তীকালের কেউ এ বইটি লিখে তাঁর নামে চালিয়েছে। কয়েকটি বিষয় এ জালিয়াতি প্রমাণ করেঃ
১. এ পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে লেখক ‘ফরিদ উদ্দীন আত্তার’ এর বিভিন্ন বাণী ও কবিতার উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। যেমন এক স্থানে বলেছেনঃ “হযরত শাইখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার(রহঃ) বলেন…..”(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ.২৭)। এখানে লক্ষণীয় যে, ফরিদ উদ্দীন আত্তার(রহঃ) ৫১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬২৬ হিজরীত ইন্তিকাল করেন। আর আব্দুল কাদির জিলানীর জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ৪৭১ হিজরী ও ৫৬১ হিজরীতে। ফরীদ উদ্দীন আত্তার বয়সে তাঁর ৪০ বছরের ছোট এবং তাঁর ইন্তিকালের সময় ফরিদউদ্দীন আত্তারের তেমন কোনো প্রসিদ্ধি ছিলনা। কাজেই ‘হযরত শাইখ……’ ইত্যাদি বলে তিনি আত্তারের উদ্ধৃতি প্রদান করবেন এ কথা কল্পনা করা যায়না।
২. এই পুস্তকে শামস তাবরীয- এর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। লেখক বলেনঃ “হযরত শাস তাবরীয(রঃ) বলেছেন……….………..(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ.২৭)।
উল্লেখ্য যে, শামস তাবরীয ৬৪৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম সঠিকভাবে জানা হয়নি। তবে ৫৬০ হিজরী এর পরে তাঁর জন্ম বলে মনে হয়। অর্থাৎ আব্দুল কাদির জিলানী(রাহঃ) এর মৃত্যুর সময় শামস তাবরীয এর জন্মও হয়নি। অথচ তিনি তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।
৩. এই পুস্তকে বারংবার জালালুদ্দীন রুমীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে। যেমন লেখক বলেছেনঃ আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী তাঁর অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন………..(আব্দুল কাদের জিলানী, সিররুল আসরার, পৃ. ২৫, ২৯)। লক্ষ্যণীয় যে, জালালুদ্দীন রুমী (৬০৪-৬৭৬ হি) আব্দুল কাদির জিলানীর ইন্তিকালের পরে প্রায় অর্ধশত বৎসর পরে জন্মগ্রহণ করেন! রুমীর জন্মের অর্ধশত বৎসর পূর্বে তাঁর মসনবীর উদ্ধৃতি প্রদান করা হচ্ছে!!
এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, এই পুস্তকটি পুরোটাই জাল, অথবা এর মধ্যে অনেক জাল কথা পরবর্তীতে ঢুকানো হয়েছে। এই পুস্তকটির মধ্যে অগণিত জাল হাদীস ও জঘন্য মিথ্যা কথা লিখিত রয়েছে। আর আব্দুল কাদির জিলানী(রাহঃ) এর নামে এগুলো খুব সহজেই বাজার পেয়েছে।
১.৮.৪.৩. চিশতীয়া তরীকা
আমাদের দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী(৬৩৩ হি), কুতুব উদ্দীন বখতীয়ার কা’কী (৬৫৩ হি), ফরীদ উদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্কর(৬৬৩ হি) ও নিযাম উদ্দীন আউলিয়া(৭২৫ হি) রাহিমাহুমুল্লাহ। এদের নামেই চিশতীয়া তরীকা প্রচলিত। এছাড়া এদের নামে অনেক কথা, কর্ম ও বই পুস্তকও প্রচলিত। এগুলির মধ্যে এমন অনেক কথা রয়েছে যা স্পষ্টতই মিথ্যা ও বানোয়াট। এখানে চিশতীয়া তরীকা ও এঁদের নামে প্রচলিত দু একটি বইয়ের বিষয়ে আলোচনা করব।
ভারতের বিভিন্ন দরবারের চিশতীয়া তরীকার আমল, ওযীফা ইত্যাদির মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। উপযুক্ত বুযুর্গগণের নামে প্রচলিত পুস্তকাদিতে এ সকল ‘তরীকা’ বা পদ্ধতির কিছুই দেখা যায়না। আবার এ সকল পুস্তকে যে সকল যিকর-ওযীফার বিবরণ রয়েছে সেগুলিও প্রচলিত চিশতীয়া তরীকার মধ্যে নেই। চিশতীয়া তরীকার ক্ষেত্রেও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বিবরণের সাথে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাঁদের দুইজনের শেখানোর পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত চিশতীয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি অরিজিনাল আর কোনটি বানোয়াট তা জানার কোনো উপায় নেই।

১.৮.৪.৪. আনিসুল আরওয়াহ, রাহাতিল কুলুব……….ইত্যাদি
এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলি ‘উস্তাদ বা পীরের সাহচর্য্যের স্মৃতি ও আলোচনা’ হিসেবে রচিত। খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী তাঁর উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তাঁর দীর্ঘ সাহচর্য্যের বিবরণ ‘আনিসুল আরওয়াহ’ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতীয়ার কাকী তাঁর উস্তাদ মঈন উদ্দীন চিশতীর সাথে তার সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘দলিলুল আরেফীন’ পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তাঁর উস্তাদ কুতুব উদ্দীন এর সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘ফাওয়ায়েদুস সালেকীন’ পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তাঁর উস্তাদ ফরীদ উদ্দীন এর সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘রাহাতিল কুলব’ পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীর খসরু তাঁর উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্য্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ‘রাহাতুল মুহিব্বীন’ পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলি পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তাঁরা কিছু লিখেছিলেন সেগুলির মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তক গুলিতে কুরআন হাদীস ভিত্তিক অনেক ভালো কথা আছে। পাশাপাশি অগণিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলি ভরা। এ ছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যাবলী উল্টাপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তাঁর মাজালিসগুলির তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলি উল্টাপাল্টা লেখা। যাতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, পরবর্তীকালে এঁদের নামে এগুলি জালিয়াতি করা হয়েছে। শাওয়ার মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ই জিলক্বদ সোমবার লেখা হয়েছে। অর্থাৎ জিলক্বদ এর শুরুও সোমবারে। শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব।(খাজা মঈন উদ্দীন, আনিসুল আরওয়াহ(ফাওয়ায়েদুস সালেকীন) পৃ. ১৩৫, ১৪৩, ১৪৪)।
আবার পরের মাজলিশ হয়েছে ৫ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলক্বাদ এর শুরু সোম, মঙ্গল, বুধবার যেদিনই হোক, কোনোভাবেই ৫ই জিলহ্জ্জ বৃহস্পতিবার হয়না। আবার পরের মাজলিশ ২০শে জিলহ্জ্জ শনিবার! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কি করে? (প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭, ১৪৯)।
২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭ শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার(নিযাম উদ্দীন আওলিয়া, রাহাতুল মুহিব্বীন, পৃ. ২৪, ৪৩, ৮৩, ৮৮), এইরূপ অগণিত অসঙ্গতি যা প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী(রাহ) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে তাঁর পীর মঈন উদ্দীন চিশতীর নিকট মুরীদ হন। এরপর কয়েক মাজলিশ তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তাঁর সহচরদের নিয়ে আজমীরে আগমন করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হিজরী এর পরে হযরত মঈন উদ্দীন চিশতী ভারতে আগমন করেন। হযরত বখতীয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থানকালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বিরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দী অবস্থায় অর্পণ করলাম। এর কয়েকদিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বিরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে। [আনিসুল আরওয়াহ(দলিলুন আরেফীন ও ফাওয়ায়েদুস সালেকীনসহ পৃ. ৬২, ১১৯, ১৩৮]।
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে তারাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মঈন উদ্দীন এর আজমীর আগমনের ১০ বৎসর পূর্বে ৬০৩ হিজরীতে শাহাবুদ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মঈন উদ্দীন(রাহঃ) অনেক আগে ভারতে আগমন করেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ,দলিলুন আরেফীন, ফাওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জালিয়াতি হয়েছে ব্যাপক। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোনো পথ নেই। জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে জালিয়াত পুস্তক লিখে সেগুলির মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে, এবং তাঁদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এ সকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারণ মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে?! এভাবে জালিয়াতগণ একঢিলে দুই পাখি মেরেছে।

১.৮.৫. জাল হাদীস বনাম যয়ীফ হাদীস
পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, জাল হাদীস যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের একটি প্রকার। জাল হাদীসের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিসগণ যেরূপ কঠোরতা অবলম্বন করেছেন, যয়ীফ হাদীসের বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিস তদ্রুপ কঠোরতা অবলম্বন করেননি। দুইটি ক্ষেত্রে তাঁরা যয়ীফ হাদীসের ব্যবহার বা উল্লেখ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেনঃ (১) আকীদা বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং (২) শরীয়াতের আহকাম বা বিধানাবলীর ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। শুধু তাই নয়, আকীদা বা বিশ্বাস প্রমাণের ক্ষেত্রে মূলত ‘মুতাওয়াতির’ বা বহু সাহাবী ও তাবিয়ী বর্ণিত হাদীস, যা সাহাবীগণের মধ্যেই বহুল প্রচারিত ছিল বলে প্রমাণিত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। কারণ শুধু কুরআন কারীম ও এইরূপ ‘মুতাওয়াতির হাদীস’ দ্বারাই ‘একীন’ বা ‘দৃঢ়বিশ্বাস’ প্রমাণিত হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সহীহ বা হাসান হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। (সুযূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৩২; ইবনু জামায়াহ, আল মানহালু রাবী, পৃ. ৩২)।

১.৮.৫.১. যয়ীফ হাদীসের ক্ষেত্র ও শর্ত
পক্ষান্তরে তিনটি বিষয়ে ‘অল্প যয়ীফ’ হাদীস বলা অনেকে অনুমোদন করেছেন।
(১) কুরআন কারীমের ‘তাফসীর’ বা শাব্দিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, (২) ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বর্ণনার ক্ষেত্রে, (৩) বিভিন্ন নেক আমলের ফযীলত বা সাওয়াব বর্ণনার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাঁরা নিম্নরূপ শর্তগুলি উল্লেখ করেছেনঃ
(১) যয়ীফ হাদীসটি অল্প দুর্বল হবে, বেশি দুর্বল হবেনা।
(২) যয়ীফ হাদীসটি এমন নেক আমলের ফযীলত বর্ণনা করবে যা সহীহ হাদীসের আলোকে ভালো ও জায়েয।
(৩) যয়ীফ হাদীসের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একথা মনে করা যাবেনা যে, রাসূলুল্লাহ(স) সত্যি এ কথা বলেছেন। সাবধানতামূলকভাবে আমল করতে হবে। অর্থাৎ মনে রাখতে হবে যে, হাদীসটি নবী(স) এর কথা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবে যদি সত্য হয় তাহলে এই সাওয়াবটা পাওয়া যাবে, কাজেই আমল করে রাখি। আর সত্য না হলেও মূল কাজটি যেহেতু সহীহ হাদীসের আলোকে মুস্তাহাব সেহেতু কিছু সাওয়াবতো পাওয়া যাবে। (বিস্তারিত দেখুনঃ আব্দুল হাই লাখনবী, যাফরুল আমানী, পৃ. ২০৯-২২৪)।
যয়ীফ হাদীসের ক্ষেত্রে কোনো কোনো মুহাদ্দিসের এই মতটি ভুল বুঝে অনেক সময় এর মাধ্যমে সমাজে জাল হাদীসের প্রচলন ঘটেছে। বস্তুত, বিভিন্ন মুসলিম সমাজে প্রচলিত অধিকাংশ জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস এই পথ দিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়েছে। সমাজে অগণিত জাল হাদীসের প্রচলনের পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছেঃ
(১) অযোগ্য ও ইলমহীন মানুষদের ওয়ায, নসীহত ও বিভিন্ন দ্বীনি দায়িত্ব পালন,
(২) সাধারণ আলিমদের অবহেলা ও অলসতা,
(৩) প্রসিদ্ধ ও যোগ্য আলিমদের ঢিলেমি,
(৪) হেদায়াতের আগ্রহ এবং
(৫) ইতিহাস, সীরাত ও রাসূলুল্লাহ(স) এর মুযিজা বর্ণনার আগ্রহ।

১.৮.৫.২. হেদায়াত ও ফযীলতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
জাল হাদীস প্রচলনের ক্ষেত্রে শেষের কারণদ্বয় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। হেদায়াতের আগ্রহে অনেক যোগ্য আলেম ওয়ায, ফাজায়েল, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করেছেন। এ সকল যয়ীফ হাদীসের মধ্যে অনেক জাল হাদীস তাঁদের পুস্তকে স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এগুলির জালিয়াতি বা দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেননি। ফলে সাধারণ পাঠকগণ এগুলিকে ‘সহীহ হাদীস’ বলেই গণ্য করেছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কুরআনের এত আয়াত, এত সহীহ হাদীস সবকিছু উল্লেখ করার পরও বোধ হয় মানুষের মনে হেদায়াতের কথাটি ঢুকানো গেলনা। কিছু যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য কথা না বললে বোধ হয় মানুষের মনে আসর করা যাবেনা। কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত শাস্তির কথা এবং কুরআনে ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত পুরস্কার, সাওয়াব ও ফযীলতের কথা বোধ হয় মানুষের মনে সত্যিকার আখেরাতমুখিতা, আল্লাহ ভীতি ও আমলের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। এজন্যই তাঁরা বোধ হয় আয়াতে কুরআনী ও সহীহ হাদীসের পরে এ সকল যয়ীফ বা ভিত্তিহীন কথাগুলি উল্লেখ করেন।
১.৮.৫.৩. ইতিহাস ও সীরাতে যয়ীফের নামে জাল হাদীস
ইতিহাস, সীরাত ও যয়ীফ বর্ণনার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সকল বিষয়ের লেখকই সেই বিষযে সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ করতে চান। তথ্য সংগ্রহের এই আগ্রহের ফলে প্রথম যুগ হতেই অনেক আলিম কিছুটা দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে এই আগ্রহের ফলে সীরাতুন্নবী গ্রন্থগুলির মধ্যে অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীস অনু্প্রবেশ করেছে।
ইতোপূর্বে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনা থেকে জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচলিত সকল হাদীসই ৪র্থ-৫ম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তী যুগে অতিরিক্ত যা কিছু সংকলিত হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগে বানানো জাল ও ভিত্তিহীন কথা। এই প্রকারের গ্রন্থগুলিকে তিনি ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস, সীরাত ও মুযিজা বিষয়ক গ্রন্থগুলির অবস্থাও আমরা এ থেকে বুঝতে পারবো। প্রথম ছয়শত বৎসরে সংকলিত এই জাতীয় গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হলোঃ ইবনু ইসহাকের(১৫০হি) ‘সীরাহ’, ওয়াকেদীর(২০৭ হি) মাগাযী, ইবনু হিশামের(২১৮ হি)সীরাহ, ইবনু সা’দ (২৩০ হি)এর তাবাকাত, খালীফা ইবনু খাইয়াতের(২৪০হি) তারিখ, বালাযুরির(২৭৯ হি) ফুতুহুল বুলদান, ফিরইয়াবীর(৩০১ হি) দালাইলুন নবু্ওয়াত, তাবারীর(৩১০ হি) তারীখ, মাসঊদীর(৩৪৫ হি) তারীখ, বাইহাকীর(৪৫৮ হি) দালাইলুন নবুওয়াত ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে প্রচুর ‘অত্যন্ত যয়ীফ’ হাদীস ও কিছু জাল হাদীস গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আমারা দেখতে পাই যে, পরবর্তী যুগের লেখকগণ আরো অনেক কথা সংগ্রহ করেছেন যা এ সকল গ্রন্থে মোটেও পাওয়া যাচ্ছেনা।
পরবর্তীযুগের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলির অন্যতম হলো সুয়ূতীর(৯১১ হি) আল খাসাইসুল কুবরা, কাসতালানীর(৯২৩ হি) আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামীর(৯৪২ হি) সুবুলুল হুদা বা সীরাহ শামিয়াহ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন কিন্তু জাল হাদীস উল্লেখ করবেননা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যেগুলিকে তাঁরা নিজেরাই অন্যত্র জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম হলো আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন হালাবীর(১০৪৪ হি) সীরাহ হালাবিয়াহ, যারকানীর(১১২২ হি) শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ কোনো বাছবিচারই রাখেননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি পারা যায় তথ্যাদি সংকলন ও বিন্যাস করা। এজন্য কোনোরূপ বিচার ও যাচাই ছাড়াই সকল প্রকার সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ ও সনদবিহীন বিবরণ একত্রিত সংমিশ্রিত করে বিন্যাস করেছেন। ফলে অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা এগুলিতে স্থান পেয়েছে। আর জাল হাদীসের মধ্যে নতুনত্ব ও আজগুবিত্ব বেশি। এজন্য এ সকল পুস্তকে সহীহ হাদীসের পরিবর্তে জাল হাদীসের উপরেই বেশি নির্ভর করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন কারীম ও অসংখ্য সহীহ হাদীস দিয়ে রাসূলুল্লাহ(স) এর নুবুওয়াত, মুজিযা ও মর্যাদা প্রমাণ করা বোধহয় সম্ভব হচ্ছেনা, অথবা এ সকল মিথ্যা ও জাল বর্ণনাগুলি ছাড়া বোধহয় তাঁর মর্যাদার বর্ণনা পূর্ণতা পাচ্ছেনা!!
এ পর্যায়ের গ্রন্থগুলির লেখকগণ অধিকাংশ বর্ণনারই সূত্র উল্লেখ করেননি। যেখানে সূত্র উল্লেখ করেছেন, সেখানেও তাঁদের অবহেলা অকল্পনীয়। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। সীরাহ হালাবিয়ার লেখক বলেনঃ “আমি ‘তাশরীফাত ফিল খাসাইস ওয়াল মুজিযাত’ নামক একটি বই পড়েছি। এই বইটির লেখকের নাম আমি জানতে পারিনি। এই বইয়ে দেখেছি, আবু হুরাইরা(রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম(স) হযরত জিব্রাঈল(আ)কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? ……হাদীসটি বুখারী সংকলন করেছেন। (হালাবী, আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন, সীরাহ হালাবীয়া ১/৪৯)।
এই হাদীসটি বুখারী তো দূরের কথা কোনো হাদীস গ্রন্থেই নেই। এই অজ্ঞাত নামা লেখকের বর্ণনার উপর নির্ভর করে গ্রন্থকার হাদীসটি উদ্ধৃত করলেন। একটু কষ্ট করে সহীহ বুখারী বা ইমাম বুখারীর লেখা অন্যান্য গ্রন্থ খুঁজে দেখলেননা। এভাবে তিনি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে একটি জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচলনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমাদের দেশের আলিমগণ “সীরাহ হালাবিয়া” জাতীয় পুস্তকের উপরই নির্ভর করেন, ফলে অগণিত জাল কথা তাদের লেখনীতে বা বক্তব্যে স্থান পায়। প্রসিদ্ধ আলেম ও বুযুর্গ আব্দুল খালেক(রাহ) তাঁর ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মূলত এই ‘সীরাহ হালাবিয়া’(সীরাত-ই-হালাবী) গ্রন্থটির উপরেই নির্ভর করেছেন। স্বভাবতই তিনি গ্রন্থাকারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কোনো তথ্যই যাচাই করেননি। ফলে এই মূল্যবান গ্রন্থটির মধ্যে আমরা অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস দেখতে পাই।
আমরা দেখেছি যে, যয়ীফ হাদীসের উপর আমল জায়েয হওয়ার শর্ত হলো, বিষয়টি বিশ্বাস করা যাবেনা, শুধু কর্মের ক্ষেত্রে সাবধানতামূলক কর্ম করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, বিশ্বাস ও কর্ম বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। কারণ যয়ীফ হাদীসের উপর যিনি আমল করেছেন তিনি অন্তত বিশ্বাস করেছেন যে, এই আমলের জন্য এই ধরনের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ(স) এর জীবনী ও মুজিযা বিষয়ক বর্ণনার ক্ষেত্রে একজন মুমিন কিছু শুনলে তা বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, এ সকল ‘যয়ীফ’ বা ‘জাল’ কথাগুলি তাঁর ঈমানের অংশে পরিণত হয়। এভাবে তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি হয় যয়ীফ বা জাল হাদীসের উপর।
১.৮.৬. নিরীক্ষা বনাম ঢালাও ও আন্দাযী কথা
জাল হাদীসের ক্ষেত্রে জঘন্যতম ও সবচেয়ে মারাত্মক বিভ্রান্তি হলো, নিরীক্ষা ব্যতিরেকে ঢালাও মন্তব্য। আমরা ইতোপূর্বে বারংবার উল্লেখ করেছি এবং পূর্বের সকল আলোচনা থেকে নিশ্চিতরূপে বুঝতে পেরেছি যে, ওহী বা ধর্মীয় শিক্ষার বিশুদ্ধতা রক্ষা ও সূত্র সংরক্ষণ মুসলিম উম্মাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তাঁদের ধর্মগ্রন্থ, ধর্ম প্রচারক বা প্রবর্তকের শিক্ষা ও নির্দেশাবলীর বিশুদ্ধতা রক্ষায় এইরূপ সচেষ্ট হয়নি।
সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগের মুসলিম আলিম ও মুহাদ্দিসগণ রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে প্রচারিত প্রতিটি কথা চুলচেরা নিরীক্ষা, পর্য্যবেক্ষণ ও যাচাই করে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেক ‘প্রাচ্যবিদ’, তাঁদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত অনেক মুসলিম ও অনেক অনভিজ্ঞ বা অজ্ঞ মুসলিম চিন্তাবিদ বা গবেষক হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করেন। হাদীস যেহেতু জাল হয়েছে, কাজেই কোনো হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, অথবা অমুক হাদীসের অর্থ সঠিক নয় কাজেই তা জাল বলে গণ্য হবে……ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন, মুহাদ্দিসগণ সম্ভবত শুধু সনদই বিচার করেছেন, অর্থ, শব্দ, বাক্য, ভাব ইত্যাদি বিচার ও নিরীক্ষা করেননি। এগুলি সবই ভিত্তিহীন ধারণা ও উর্বর মস্তিষ্কের বর্বর কল্পনা মাত্র। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা পদ্ধতির সাথে পরিচয়হীনতা এর মূল কারণ। এর চেয়েও বড় কারণ ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ইসলাম থেকে মানুষদের বিচ্যূত করার উদগ্র বাসনা।
ইহুদী খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ পন্ডিতগণ, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি অমুসলিম সম্প্রদায় ও শিয়া সম্প্রদায় ছাড়াও কিছু ‘জ্ঞানপাপী’ পন্ডিত হাদীসের বিরুদ্ধে এরূপ ঢালাও মন্তব্য করেন অথবা মর্জিমাফিক অর্থ বিচার করে হাদীস ‘জাল’ বলে ঘোষণা করেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করতে চান, কিন্তু ইসলাম পালন করতে চাননা। এরা সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, হালাল ভক্ষণ, পবিত্রতা অর্জন ইত্যাদি কোনো কর্মই করতে রাজি নন। কুরআনে উল্লেখিত এসব বিষয়কে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দিতে চান। কিন্তু ভয় হলো হাদীস নিয়ে। হাদীস থাকলে তো ইচ্ছামত ব্যাখ্যা অচল। রাসূলুল্লাহ(স) এর ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এজন্য তারা নির্বিচারে হাদীসকে জাল বলে বাতিল করে দিতে চান।
আশা করি, এ গ্রন্থের আলোচনা থেকে পাঠক এ সকল মানুষের মতামতের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক। তাঁরা সনদ, শ্রুতি, পান্ডুলিপি, ভাষা, অর্থ, ও প্রাসঙ্গিক সকল প্রমাণের আলোকে যে সকল হাদীসকে সহীহ বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলির বিশুদ্ধতা ও যথার্থতা সম্পর্কে তথ্য প্রমাণবিহীন ঢালাও সন্দেহ একমাত্র জ্ঞানহীন মুর্খ বা বিদ্বেষী জ্ঞানপাপী ছাড়া কেউই করতে পারেনা। আর এই নিরীক্ষার ভিত্তিতে যে সকল হাদীসকে তাঁরা জাল ও বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলিকে গায়ের জোরে হাদীস বলে দাবি করাও রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার ভয়ঙ্কর দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে তথ্য ভিত্তিক নিরীক্ষার দরজা সর্বদা উন্মুক্ত।
১.৮.৭. জাল হাদীস বিষয়ক কিছু প্রশ্ন
আমরা প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করেছি। দ্বিতীয় পর্বে আমরা আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক জাল হাদীস ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করব। এ সকল জাল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা পাঠের সময় পাঠকের মনে বারংবার কয়েকটি প্রশ্ন জাগতে পারে। প্রশ্নগুলির উত্তর পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি। তবুও এখানে প্রশ্নগুলি আলোচনা করতে চাই।
আমরা দেখতে পাব যে, মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীসের মধ্যে এমন অনেক কথা আছে যা অত্যন্ত সুন্দর, অর্থবহ, মূল্যবান ও হৃদয়স্পর্শী। তখন আমাদের কাছে মনে হবে, কথাটি তো খুব সুন্দর, একে বানোয়াট বলার দরকার কি? অথবা এত সুন্দর ও মর্মস্পর্শী কথা হাদীস না হয়ে পারেনা। অথবা এই কথার মধ্যে তো দোষ নেই, এর বিরুদ্ধে লাগার প্রয়োজন কি? ইত্যাদি।
এর উত্তরে আমাদের বুঝতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ (স) এর শিক্ষা ও বাণীকে অবিকল নির্ভেজালভাবে হেফাজত করা উম্মাতের প্রথম দায়িত্ব। তিনি বলেননি, এমন কোনো কথা তাঁর নামে বলাই জাহান্নামের নিশ্চিত পথ বলে তিনি বারবার বলেছেন। কাজেই কোনো বাণীর ভাব বা মর্ম কখনোই আমাদের কাছে প্রথমে বিবেচ্য নয়। প্রথম বিবেচ্য হলো, তিনি এই বাক্যটি বলেছেন কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা। কোনো কথার অর্থ যত সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী হোক সে কথাটিকে আমরা রাসূল(স) এর কথা বা হাদীষ বলতে পারিনা যতক্ষণ না বিশুদ্ধ সনদে তাঁর থেকে বর্ণিত না হয়। রাসূলুল্লাহ(স) যে কথা বলেছেন বলে আমরা নিশ্চিতরূপে জানি না সে তাঁর নামে বর্ণনা করার কঠিনতম অপরাধ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, আমরা প্রায়ই দেখব যে, আমরা যে সকল হাদীসকে বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছি, এ সকল হাদীসকে অনেক বুযুর্গ তার গ্রন্থে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে কেউ হয়তো বলতে পারেন, অমুক আলেম বা বুযুর্গ এই হাদীস বলেছেন, তিনি কি তাহলে জাহান্নামী?
আমরা দেখেছি যে, বুযুর্গগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে অনেক। এ সকল হাদীস বুযুর্গগণ সত্যিই বলেছেন নাকি জালিয়াতগণ তাঁদের নামে চালিয়েছে তা আমরা জানিনা। যদি তাঁরা বলেও থাকেন, তবে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, একজন বুযুর্গের অসংখ্য কর্মের মধ্যে কিছু ভুল থাকতে পারে। তাঁদের অসংখ্য ভাল কাজর মধ্যে এ সকল ভুল ভ্রান্তি কিছুই নয়। মূলতঃ তাঁরা মুজতাহিদ ছিলেন। মুজতাহিদ তাঁর সঠিক কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে দ্বিগুণ পুরস্কার পান। আর তিনি তার ভুলের জন্য একটি পুরস্কার পান। (সহীহ বুখারী)। এছাড়া আল্লাহ বলেছেনঃ “পূণ্য কাজ অবশ্যই পাপকে দূর করে দেয়।”(সূরা হুদঃ ১১৪ আয়াত)। তাই যিনি অনেক পূণ্য করেছেন তাঁর সামান্য ভূল পূণ্যের কারণে দূরীভূত হয়ে যাবে।
কোনো বুযুর্গ বা সত্যিকারের আল্লাহ ওয়ালা মানুষ কখনোই জেনে শুনে কোনো জাল বা মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে বলতে পারেননা। না জেনে হয়তো কেউ বলে ফেলেছেন। কিন্তু তাই বলে আমরা জেনেশুনে কোনো জাল হাদীস বলতে পারিনা। আমাদের দায়িত্ব হলো, কোনো হাদীসের বিষয়ে যদি আমরা শুনি বা জানি যে, হাদীসটি জাল তবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তা বলা ও পালন করা বর্জন করব। যদি এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ হয় তবে আমরা মুহাদ্দিসগণের তথ্যাদির আলোকে ‘তাহকীক’ বা গবেষণা করে প্রকৃত বিষয় জানতে চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন, অন্য কারো কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেননা। কাজেই আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বা সন্দেহজনক কিছু বলা থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে।
তৃতীয় প্রশ্ন যা আমাদের মনে আসবে তা হলো, এতসব বুযুর্গ কিছূ বুঝলেননা, এখন আমরা কি তাঁদের চেয়েও বেশি বুঝলাম? এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো, এই গ্রন্থে আলোচিত জাল হাদীসগুলিকে জাল বলার ক্ষেত্রে আমার মত অধমের কোনো ভূমিকা নেই। এখানে আমি মূলত পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মতামত বর্ণনা করেছি। পাঠক তা বিস্তারিত দেখতে পাবেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি