অনুবাদকের কথা
আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী লিখিত আরবী গ্রন্থ ‘আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম’- এর বাংলা অনুবাদ ‘ইসলামের হালাল-হারামের বিধান’ বাংলাভাষী সুধীমণ্ডলীর কাছে উপস্থিত করতে পেরে আমি আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহ তা’য়ালার শোকর আদায় করছি। এ নগণ্য ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’য়ালা আল্লামা কারযাভী লিখিত ‘ফিক্‌হুয্‌-যাকাত’-এর দুইটি বিরাট খন্ডের বাংলা অনুবাদ ইতিপূর্বে পেশ করার তওফীক দিয়েছেন। সেজন্যে শোকর আদায় করার মতো ভাষা আমার জানা নেই।

বস্তুত ইউসুফ আল-কারযাভী বর্তমান শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামী ফিকাহ্‌বিদ- একথা শুধু আমার নয়, একালের বহু বিখ্যাত মনীষীই তা অকপটে স্বীকার করেছেন। তা যেমন তাঁর লিখিত সব কয়টি বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, তেমনি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘ইসলামের যাকাত বিধান’-এর দুইটি খণ্ড ও তাঁর লিখিত অমর গ্রন্থ ‘আল ঈমান ওয়াল হায়াত’ অবলম্বনে আমার লিখিত ‘উন্নত জীবনের আদর্শ’ও পাঠকদের কাছে নিঃসন্দেহ করে তুলেছে।

গ্রন্থকারের বর্তমান গ্রন্থখানিও যেমন ব্যাপক আলোচনাপূর্ণ তেমনি এর তুলনা দুনিয়ার আরবী, উর্দু ও অন্যান্য কোন ভাষায়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রন্থকার নিজেই বলেছেনঃ হালাল-হারাম বিষয়ে এ গ্রন্থখানি বিশ্ব ইসলামী সাহিত্যে সর্বোচ্চ সংযোজন। গ্রন্থকারের এ দাবি যে একশ’ ভাগ সত্য, তা এর পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন। আলোচ্য বিষয়ের বিভিন্ন অংশ ফিক্‌হ’র কিতাবসমূহে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে রয়েছে, কিন্তু তা প্রাচীন পদ্ধতিতে লেখা বলে আধুনিক কালের লোকদের পক্ষে তা থেকে বক্তব্য উদ্ধার করা কঠিন। একটি নির্দিষ্ট শিরোনামে পূর্ণ ব্যাপকতা, যৌক্তিক মানে ও আধুনিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ই এই প্রথমবার একত্রে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ফলে গ্রন্থখানি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিষয়াদির ‘বিশ্বকোষ’ হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছে। এ কারণেই সারা দুনিয়ার মনীষীগণের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। এর মূল আরবী গ্রন্থের বহু কয়টি সংস্করণ প্রকাশ এবং তুর্কী ও ইংরেজী ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশ ও তার বিপুল চাহিদা এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে।

গ্রন্থখানিতে আলোচিত বিষয়াবলীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তওহীদ ও রিসালাত-এর সাথে সাথে হালাল-হারামের মাস্‌লাসমূহ সমানভাবে মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। হালাল-হারামের পার্থক্য ব্যতীত না ঈমান ও ইসলাম গ্রহণযোগ্য হতে পারে, না কোন ইবাদতই আল্লাহ্‌র কাছে একবিন্দু কবুল হতে পারে। আমি মনে করি, হালাল-হারাম এর পার্থক্য রক্ষা করে না চললে মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা পেতে পারে না বরং মানুষের পশুর স্তরে নেমে যাওয়া অবধারিত। গ্রন্থকার পূর্ণ ব্যাপকতা সহকারে বিষয় সংশ্লিষ্ট সকল দিক ও সকল শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উপস্থাপিত করেছেন সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে।

এ গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল ইসলামী চিন্তা কেন্দ্রসমূহে এ সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধান কার্য চালানো হচ্ছে। এক কথায় বললে বলা যায়, এসব হচ্ছে আধুনিক মনের জিজ্ঞাসা এবং গ্রন্থ সেই আধুনিক জিজ্ঞাসারই সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ জবাব। এসব বিষয়ে আরও বহু ইসলামী চিন্তাবিদ গবেষণা চালিয়েছেন, কিন্তু এ গ্রন্থকার যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উচ্চমানের ব্যাপক তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক গবেষণার ফসল উপস্থাপিত করেছেন, তা দৃষ্টান্তহীন বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি চিন্তা ও বিবেচনা ও অগ্রাধিকার দানের ক্ষেত্রে পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।

গ্রন্থখানির এ উচ্চমানতার দিকে লক্ষ্য করেই আমি এর অনুবাদ করেছি। আমি মনে করতে পারছি যে, দ্বীন-ইসলামের সম্পূর্ণ পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক আদর্শ বাঙলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজের কাছে উপস্থাপনের যে কঠিন দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত, বর্তমান গ্রন্থখানি সেই দায়িত্ব পালন পর্যায়ে এক মহান সংযোজন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ বিরাট গ্রন্থখানি প্রকাশ করেও সেই দায়িত্ব পালন করছে। এ গ্রন্থে গৃহীত সব কয়টি সিদ্ধান্তে অনুবাদকের সম্পূর্ণরূপে একমত হওয়ার কোন শর্ত অবশ্যই নেই।

মুহাম্মাদ আবদুর রহীম

১ মে, ১৯৮৪ ইং

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

গ্রন্থকারের ভূমিকা
ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে মিসরের জামে আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্রে একটি পরিকল্পনা গ্রহীত হয়। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলিম ও অমুসলিমদের সম্মুখে ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষার ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করাই এ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। এ মহতী পরিকল্পনায় কার্যত অংশগ্রহণের জন্যে জামে আযহার কর্তৃপক্ষই আমাকে আহ্‌বান জানিয়েছিলেন।

সন্দেহ নেই, গ্রন্থ প্রণয়ন সংক্রান্ত এ পরিকল্পনা অত্যন্ত মূল্যবান এবং আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রয়োজনীতা অপরিসীম। এ ধরণের একটি পরিকল্পনা নিয়ে বহু পূর্ব থেকে কাজ করা আবশ্যক ছিল। কেননা বস্তুতই ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলিম জনগণ ইসলাম সম্পর্কে খুব সামান্যই জানেন। আর সে সামান্য জ্ঞানও নানাবিধ বিকৃতি ও সংশয়ে জর্জরিত। এরই কাছাকাছি সময়ে আমার এ আযহারী বন্ধু আমেরিকা পরিভ্রমণ করে আমাকে লিখলেন যে, এসব দেশে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক মুসলিম মদ্য ব্যবসা ও পানশালা (Bar) চালিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। কিন্তু মুসলিমদের জন্যে এ কাজ যে সম্পূর্ণ হারাম ও কঠিন গুনাহ, সে বিষয়ে এদের একবিন্দু চেতনা নেই।

তিনি আরও লিখেছেন, মুসলিম পুরুষরা খ্রীস্টান ও ইয়াহূদী- এমনকি নাস্তিক, পৌত্তলিক, মূর্তিপূজারী (Heathen, Idolater)-দের কন্যা স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছে, মুসলিম কন্যাদের বিয়ে করতে প্রস্তুত হচ্ছে না।

আর মুসলিমদের অবস্থা যখন এই, তখন অমুসলিমদের অবস্থা কি হতে পারে, তা বলাই নিষ্প্রয়োজন। তারা তো ইসলামের একটা বাহ্যিক বীভৎস রূপই দেখতে পাচ্ছে। ইসলামের অন্তর্নিহিত প্রকৃত সত্য ও সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হওয়ার কোন সুযোগই তারা পাচ্ছে না। ফলে তারা ইসলামের ও মুসলিমদের (মুসলিম হওয়ার দাবিদারদের) প্রতি সকল শ্রদ্ধা-ভক্তি নিঃশেষে হারিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে ইসলামের দুশমন খ্রীস্টান মিশনারীরা ও হিংসুক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই তাদের সামনে ইসলামের এ বিকৃত চেহারা তুলে ধরে আসছে আবহমান কাল থেকে। এ জন্যে তারা দিনরাত অত্যন্ত হীন চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে আবহমান কাল থেকে। অথচ দুনিয়ার মুসলিম চিন্তাবিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অচেতন ও অনবহিত হয়ে রয়েছেন।

তাই এক্ষণে যদি আমাদের চিন্তাবিদদের চেতনা জেগে থাকে ও এ মহতী কার্যক্রমের পরিকল্পনা নেয়া হয়ে থাকে, তবে তা অত্যন্ত মুবারক ও সময়োপযোগী হয়েছে, যা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন হয় না। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ইসলামী দাওয়াতের এ মহামূল্য কাজে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এ কাজ কেবল যে ‘জামে আযহার’ (আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়) কেন্দ্রিক হওয়া উচিত তা-ই নয়, তা তার বাইরে সমগ্র মুসলিম জাহানেও হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।

উক্ত ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে এ গ্রন্থকারকে একখানি গ্রন্থ রচনা করতে বলা হয়। তার শিরোনাম দেয়া হয়ঃ ‘আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম’- ইসলামে হালাল হারামের বিধান।

সেই সঙ্গে বলে দেয়া হয় যে, গ্রন্থখানি যেন বিস্তারিত আলোচনা-সম্বলিত ও সহজবোধ্য ভাষায় রচিত হয় এবং তাতে দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মমত ও সাংস্কৃতির দৃষ্টিকোণের সাথে তুলনামূলক আলোচনা পেশ করা হয়।

প্রথম দৃষ্টিতে ‘হালাল-হারাম’ বিষয়টি যদিও সহজ মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। বিশেষত এজন্যেও যে, এ বিষয়ের ওপর দ্বীনী সাহিত্যে এখন পর্যন্ত কোন গ্রন্থ লিখিত হয় নি, না প্রাচীনকালে, না আধুনিক কালে। বিষয়টির উপকরণসমূহ যদিও তাফসীর, হাদীস ও ইসলামী ফিকাহ্‌র বিস্তারিত অধ্যায়সমূহে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে এবং পাঠকগণ সেসব অধ্যয়নকালে বিভিন্ন পর্যায়ে তার সাথে পরিচিত হন, কিন্তু সে সমস্ত উপকরণ একখানি গ্রন্থে একত্রে সন্নিবেশিত করা কিছুমাত্র সহজ কার্য নয়।

তা ছাড়া বিষয়টি এমন যে, লেখককে এমন বহু ব্যাপারেই একটা চূড়ান্ত ও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, যেসব ব্যাপারে প্রাচীনকালের মনীষীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। উপরন্তু সেসব বিষয় মুহাদ্দিসদের রায় সর্বতোভাবে এক এবং অভিন্নও নয়। আর হালাল-হারামের ব্যাপারে বিভিন্ন মতের মধ্য থেকে একটি মাত্র মতকে অগ্রাধিকার দিতে হলেও বিস্তারিতভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করতে হয়। শুধু তাই নয়, এ পর্যায়ের আলোচনায় আলোচনাকারীকে ঐকান্তিক নিষ্ঠা সহকারে সত্যের সন্ধানে আত্ননিয়োগ করতে হয় এবং সেজন্যে প্রাণপণ পরিশ্রম করাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ইসলাম বিষয়ে একালের লেখক, গবেষক ও গ্রন্থকারদের দুভাগে ভাগ করা যায়ঃ

এক ভাগের লোকদের সম্পর্কে বলা যায়, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সাংস্কৃতির চাকচিক্যে তাদের চোখ ঝলসে গেছে। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সাংস্কৃতিকে তাঁরা এক বিরাট দেবতারূপেই গণ্য করেছেন। তার প্রতি তাঁরা পূর্ণ আনুগত্য জানিয়ে তারই পূজা, উপাসনা ও আরাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন। তাঁরা সে দেবতার সম্মুখে পূজার উপাচার ও ভেট-উপঢৌকনও পেশ করছেন একনিষ্টভাবে। তার সম্মুখে এঁদের দৃষ্টি ভীত-সন্ত্রস্ত ও অবনত হয়ে আছে। তাঁরা পাশ্চাত্য-সভ্যতা-সংস্কৃতি উৎসারিত সব কিছুকেই চূড়ান্ত সত্য ও চিরকালীন অনুসরণীয় মনে করে নিয়েছেন। তার সাথে মতবিরোধ করতে বা তা থেকে ভিন্নতর মত গ্রহণ করতে ও বিপরীত মতকে খণ্ডন করতে তাঁরা আদৌ প্রস্তুত নন। এ পর্যায়ে কোন বিষয়ের সাথে যদি মিল ঘটে যায়, তাহলে তাঁরা উল্লসিত স্বপ্নে চিৎকার করে উঠেন। আর যেখানেই বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়, সেখানেই কোন-না-কোনরূপে সামঞ্জস্য বা সমন্বয় সাধনে ব্রতী হন অথবা ইসলামের দিক দিয়ে কৈফিয়তের সুরে কথা বলতে শুরু করেন কিংবা ইসলামের দৃষ্টিকোণকে বিকৃতি করে এমন একটা ব্যাখ্যা পেশ করেন, যার সাথে ইসলামের আদৌ কোন মিল নেই। তাতে তাদের এ ধারণাই প্রকট হয়ে উঠে যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি ও দর্শনের বিরুদ্ধে ইসলামের যেন কিছু বলবার নেই। প্রতিকৃতি, ছবি, প্রতিমূর্তি, জীবের ভাস্কর্য, সুদী ব্যবসায় ও ভিন্ন স্ত্রীলোকের সাথে নিভৃত নিবিড় সাক্ষাতকার, নারীদের নারীত্ব থেকে বিদ্রোহ এবং পুরুষদের স্বর্ণ-রৌপ্যের ভূষণ বা অলঙকারাদির ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে তাদের বক্তব্য থেকে আমি এ মনোভাবেরই স্পষ্ট পরিচিতি আঁচ করতে পেরেছি। ইসলামে তালাক ও এক সঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের যে অনুমতি রয়েছে, সেক্ষেত্রেও তাদের মনোভাব কিছুমাত্র ভিন্নতর নয়। মনে হচ্ছে, তাদের বিশ্বাস, পাশ্চাত্য যা হালাল করেছে তা অবশ্যই হালাল, যা হারাম করেছে তা অবশ্যেই হারাম হবে অথচ ইসলাম একটা স্বতন্ত্র জীবন দর্শন, তা মহান আল্লাহ্‌র নাযিল করা বিধান আর আল্লাহর বিধানই সর্বোপরি ও সর্বজয়ী হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়। ইসলামকেই অনুসরণ করতে হবে, তা কাউকে বা অন্য কিছুকে অনুসরণ করতে পারে না- একথা তারা সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন। আল্লাহ্‌ই হচ্ছেন মাবুদ আর সব বান্দা। মাবুদ কখনই বান্দাকে অনুসরণ করতে, তার অধীন হয়ে থাকতে রাজী হতে পারেন না। স্রষ্টা কোন্‌ কারণে সৃষ্টি কাছে নতি স্বীকার করবেন? আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

প্রকৃত সত্য- মহান আল্লাহ-যদি লোকদের খামখেয়ালীর অনুসরণ করে চলে, তাহলে তো নভোমণ্ডল, পৃথিবী ও তাতে যা কিছু রয়েছে তা সব কিছুই কঠিনভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

………… (আরবী)…………..

বল, তোমরা আল্লাহর সাথে যাদের শরীক করছ, তাদের মধ্যে কেউ কি পরম সত্যের পথ প্রদর্শন করে। আর বল, যিনি পরম সত্যের পথ প্রদর্শন করেন তিনি অনুসৃত হওয়ার বেশি অধিকারী, না যা আদৌ কোন পথ দেখায় না- তাকেই বরং পথ দেখাতে হয়,- এ ব্যাপারে সে-ই বেশি অধিকারসম্পন্ন।

এ হচ্ছে লেখক গ্রন্থকারদের এক শ্রেণী সম্পর্কিত কথা। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা তো হালাল হারামের বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট মতের ওপর অবিচল হয়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁরা হয়ত কোন কিতাবের ভাষ্যের ওপর নির্ভর করেছেন অথবা ধারণা করেছেন ওটাই ইসলাম হবে। ফলে তাঁরা তাঁদের বদ্ধমূলক ধারণা থেকে একবিন্দু সরে দাঁড়াতেও প্রস্তুত নন। এমন কি, এ বিষয়ে শরীয়াতের দলিল-প্রমাণের পরীক্ষা-পর্যালোচনা করে দেখতেও তাঁরা সম্পূর্ণ নারাজ অথচ স্বমত ও ভিন্ন মতের দলিল-প্রমাণসমূহ তুলনামূলকভাবে পরীক্ষণ ও আলোচনা-পর্যালোচনা করলেই প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হতো।

এ শ্রেণীর লোকদের কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, বাদ্যযন্ত্র, সঙ্গীত, দাবা খেলা, নারী শিক্ষা, মেয়েদের মুখমণ্ডল বাহুদ্বয় অনাবৃত রাখা প্রভৃতি সম্পর্কে আপনাদের মত কি? তাহলে তাঁরা বলে বা লিখে দেবেন ‘হারাম’। এক্ষেত্রে পূর্বকালীন মনীষীবৃন্দ কি ভূমিকা গ্রহণ করতেন বা কথা বলার কি ধরণ বা ভঙ্গি অনুসরণ করতেন, তাও তাঁরা ভুলে গেছেন। কেননা যে জিনিস বা কাজ সম্পর্কে চূড়ান্ত ও নিঃসন্দেহভাবে জানা যায়নি যে, তা হারাম, তাঁরা কখনই তাকে হারাম বলতেন না। বরং তাঁরা বলতেন, আমি এটা পছন্দ করি না বা আমি এটা ঘৃণা করি ইত্যাদি। এ প্রেক্ষিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এ দুই শ্রেণীর কোন বিশেষ একটি শ্রেণীর মধ্যে নিজেকে শামিল করব না। কেননা আমার দ্বীনই আমাকে পাশ্চাত্যের বান্দা- অন্ধ অনুসরণকারী হতে দেয় না। কেননা আমি তো মহান আল্লাহ্‌কেই আমার রব্বরূপে স্বীকার করেছি, ইসলামকে আমার জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিধানরূপে মেনে নিয়েছি এবং বিশ্বাস করেছি মুহাম্মাদ সা.- ই আল্লাহর শেষ রাসূল।

দ্বিতীয়ত, আমার বিবেক-বুদ্ধি যেহেতু এখনও জাগ্রত, সচেতন, এ কারণে কোন একটি ফকীহ্‌ মাযহাবকেই আমি সকল বিষয়ের চূড়ান্ত বলে স্বীকার করে নিতে পারি না। কেননা তা যেমন নির্ভুল হতে পারে, তেমনি তো ভুল হওয়ার আশংকা থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। ইমাম ইবনুল জাওজী বলেছেন, অন্ধ অনুসরণকারী এক অনির্ভরযোগ্য ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। আর তাতে বিবেক-বুদ্ধিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে রাখা হয়। বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা-বিবেচনা শক্তি মানুষের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত একটি মহৎ গুণ। তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণের নীতি গ্রহণ করা হলে এ মহৎ গুণের যাবতীয় কল্যাণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা হয়। যার হাতে আলোর মশাল রয়েছে সে যদি তা নিভিয়ে অন্ধকারে পথ চলতে শুরু করে, তবে তার এ হাস্যকর আচরণ কোনক্রমেই যুক্তিসঙ্গত বিবেচিত হতে পারে না।

এ কারণে আমি নিজেকে বিশেষ কোন মাযহাবী গোষ্ঠীর সাথে জড়িত করিনি। কেননা আমার মতে প্রকৃত সত্য বিশেষ একটি মাযহাবী মতের মধ্যে সীমিত হয়ে থাকে নি। দুনিয়ার প্রচলিত এসব মাযহাবের ইমামগণ নিজেদের নির্ভুল নিষ্পাপ হওয়ার দাবিও করেননি কখনও। আসলে তাঁরা ছিলেন সত্যানুসন্ধানের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টাকারী মুজতাহিদ। আর কোন ভুল করে থাকলেও তারা এক গুণ সওয়াব পাবেন, আর যদি নির্ভুল ইজতিহাদী মত প্রকাশে সক্ষম হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরা দ্বিগুণ সওয়াব পাবেন। বস্তুতঃ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিষ্ঠাপূর্ণ ও অনাসক্ত সত্যানুসন্ধানের এটাই হচ্ছে ঘোষিত মর্যাদা।

ইমাম মালিক র. বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

নবী করীম সা. ব্যতীত অন্যান্য সব মানুষেল মর্যাদাই হচ্ছে এই যে, তার কথার কিছু অংশ গ্রহণও করা যায়, বর্জনও করা যায়।

ইমাম শাফেয়ী র. বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

আমার মত নির্ভুল, তবে ভুল হওয়ার আশংকা আছে। আর আমার ছাড়া অন্যান্যদের মত ভুল, তবে নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

সে সুবিজ্ঞ মুসলিম জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা-পর্যালোচনা করার এবং তন্মধ্য থেকে কোন একটি মতকে অগ্রাধিকার দেয়ার যোগ্যতা ও উপকরণের অধিকারী, তার পক্ষে মাযহাব সমূহের মধ্য থেকে বিশেষ কোন একটি মাযহাবের নিকট বন্দী হয়ে থাকা কিংবা বিশেষ কোন ফিকাহ্‌ বিশারদের মতের অন্ধ অনুসারী হওয়া কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। বরং তার তো দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে চলার নীতি অবলম্বন করা কর্তব্য। তখন যে দলিলটি নির্ভুল হবে, যার প্রমাণ অকাট্য হবে, সেটিকেই অনুসরণ করে চলবে। আর যার সনদ দুর্বল, দলিলের অকাট্যতা অপ্রমাণিত তা সহজেই পরিত্যক্ত হবে। অতএব এরূপ একটি মত গৃহীত হয়ে থাকলে তাও অবশ্যই পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। হযরত আলী রা. নীতিকথা হিসেবে বলেছিলেনঃ

………… (আরবী)…………..

লোকদের দেখে সত্যকে চিনবার ও জানবার চেষ্টা কর না। বরং সত্যকে সত্য হিসেবেই জানতে ও চিনতে চেষ্টা কর এবং তারই ভিত্তিতে খোঁজ কর সেই সত্যের ধারক লোকদের।

জামে আযহারের সংস্কৃতি পরিষদের নির্দেশ পালন করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছি। প্রতিটি বিষয়কেই আমি দলিলের ভিত্তিতে পরীক্ষা করতে এবং তুলনা করে মৌল কারণের দৃষ্টিতে কোন একটি মতকে অগ্রাধিকার দিতে চেষ্টা করেছি। এ পর্যায়ে আমি আধুনিক যুগের চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-তথ্যকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি। সর্বক্ষেত্রেই আমি ইসলামের দৃষ্টিকোণকে স্বর্ণোজ্জ্বল ও অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ ভিত্তিকই পেয়েছি। আর এটাই স্বাভাবিক। কেননা ইসলাম তো বিশ্বমানবতার দ্বীন। আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

আল্লাহর রঙ। আর আল্লাহর রঙের তুলনায় অধিক উত্তম রঙ আর কি হতে পারে?

হালাল-হারামের ব্যাপারটি একটি চিরন্তন ব্যাপার। প্রাচীনকাল থেকেই প্রতিটি জাতির জীবনে এ প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে হারামের পরিমাণ ও তার প্রকৃতি পর্যায়ে যে মতভেদ রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। অবশ্য তার কারণও ভিন্ন রয়েছে। এ পর্যায়ের দৃষ্টিকোণ প্রতিটি জাতির প্রাথমিক পর্যায়ের আকীদা-বিশ্বাস ও আবহমানকালের সংস্কার ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট।

উত্তরকালে বড় বড় আসমানী দ্বীন শরীয়াতের বিধানসমূহ উপস্থাপিত করেছে। আর তাতে হালাল-হারামের ব্যাপারটি অবশ্যই উপস্থিত রয়েছে। দ্বীনের প্রতি ঈমান গ্রহণের পর ব্যাপারটি নিছক সংস্কার বা গোষ্ঠগত প্রচলন কিংবা রেওয়াজের ব্যাপার হয়ে থাকে নি। তখন তা মানবীয় আদর্শের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু তখন হালাল-হারাম নির্ধারণের অনেক ক্ষেত্রেই সমসাময়িক সমাজ দৃষ্টি ও প্রবণতার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। অবস্থার পরিবর্তনে হালাল-হারামেরও পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের পরিবর্তনের প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইয়াহূদীদের সমাজে অনেক হারামই ছিল সাময়িক। সে হারাম-সীমালংঘন করার অপরাধে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে শাস্তি দিয়েছেন। যদিও এ হারাম কোন চিরন্তন ব্যাপার ছিল না। হযরত ঈসা আ. বনী ইসরাঈলদের লক্ষ্য করে যে কথা বলেছিলেন, কুরআনে তা উদ্ধৃত হয়েছে এ ভাষায়ঃ

………… (আরবী)…………..

আমার পূর্ববর্তী তওরাতের সত্যতা ঘোষণাকারী এবং আমি তোমাদের জন্যে হালাল করে দেব এমন কিছু কিছু জিনিস, যা তোমাদের প্রতি হারাম করে দেয়া হয়েছিল।

পরে দ্বীন-ইসলাম যখন অবতীর্ণ হল, তখন মানবতা পূর্ণতা লাভ করেছে, তা নবুয়্যাত ও রিসালাতের সর্বশেষ অবদান গ্রহণের জন্যে উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। তখন আল্লাহ তা’আলা ইসলামের সর্বশেষ শরীয়াতের শাশ্বত ও চিরস্থায়ী বিধান নাযিল করলেন। সূরা আল-মায়িদার আয়াতে বিভিন্ন হারাম খাদ্যের উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা’আলা একথাই ঘোষণা করেছেন নিম্নোদ্ধৃত ভাষায়ঃ

………… (আরবী)…………..

আজ তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত দান সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত করলাম এবং তোমাদের জন্যে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম।

বস্তুত ইসলামে হালাল-হারামের চিন্তা অত্যন্ত সহজ-সরল ও সুস্পষ্ট। নভোমন্ডল ও পৃথিবী আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে আমানতের বোঝা বহনে অক্ষমতা ও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, এ ব্যাপারটি সে আমানতেরও অংশ। কেননা তা মানুষ নিজের স্কন্ধে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিল। আর তা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত আইন-বিধান পালন ও পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব বহনের আমানত। এ এক কঠিন ও দুর্বহ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব গ্রহণের ভিত্তিতেই মানুষকে সওয়াব কিংবা আযাদ দেয়া হবে কিয়ামতের দিন। মানুষ যাতে এ আমানতের বোঝা যথাযথভাবে বহন করতে পারে এবং এতদসংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের সমর্থ হয় সেজন্যেই আল্লাহ তা’আলা মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং জীবন বিধানরূপে নাযিল করেছেন তাঁর মহান গ্রন্থাবলী। এমতাবস্থায় মানুষের এরূপ প্রশ্ন করার অধিকার নেই যে, তাদের জন্যে হালাল-হারাম বিধান কেন দেয়া হল, কেন তাদের উন্মুক্ত ও বল্গাহারা করে ছেড়ে দেয়া হয় না? বস্তুত এ হচ্ছে আল্লাহ্‌র পরীক্ষণ ব্যবস্থার পরিশিষ্ট। এটা কেবল মানুষের ওপরই প্রবর্তিত। আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে কেবলমাত্র মানব জাতিকেই এজন্যে বাছাই করে মনোনীত করা হয়েছে। কেননা মানুষ ফেরেশতাদের ন্যয় নিছক ‘আত্মা’ নয়, নিছক লালসা-কামনা সর্বস্বও নয় জন্তু-জানোয়ারের মতো। মানুষ এ দুটির সমন্বয়- অতীব ভারসাম্যপূর্ণ সৃষ্টি। মানুষ তার এ সমন্বিত সত্তা উন্নীত করে ফেরেশতাদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারে, হতে পারে তার চাইতেও উত্তম ও উন্নত। সে সঙ্গে অধঃপতনের নিম্নতম পংকে ডুবে গিয়ে জন্তু-জানোয়ার কিংবা তার চাইতেও নীচে ও নিকৃষ্ট অবস্থায় উপনীত হতে পারে।

অপর এক দৃষ্টিতে এ হালাল-হারামের ব্যাপারটি ইসলামী শরীয়াত বিধানের আকাশে সদা আবর্তনশীল। মানুষের কল্যাণ বিধান এবং ক্ষতি ও দুর্ভাগ্য মোচনের ভিত্তির ওপর তা প্রতিষ্ঠিত। এর দ্বারা মানুষের জীবনকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সহজতর করাই উদ্দেশ্য। এ বিধান যেমন একদিকে সমস্ত বিপর্যয় প্রতিরোধ করে, তেমনি সমস্ত কল্যাণকে সক্রিয় করে তোলে। সমগ্র মানবতার সার্বিক কল্যাণ বিধানই তার চরম লক্ষ্য। তার আত্মার কল্যাণ, দেহের কল্যাণ, বিবেক-বুদ্ধির সুস্থতা এ বিধান পালনেই নিহিত। মানুষ বিভিন্ন জাতি, বর্ণ, দেশ-কাল প্রভৃতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও এ বিধান থেকেই কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম।

এ বিধান দ্বীন-ইসলামের অবিচ্ছিন্ন অংশ। এ দ্বীন নাযিল হয়েছে সমগ্র মানুষের জন্যে সার্বিক কল্যাণের ও রহমতের বাহন হিসেবে। এ কথা আল্লাহ তা’আলা বলেছেন তাঁর সর্বশেষ রাসূলকে সম্বোধন করেঃ

………… (আরবী)…………..

সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি রহমতরূপেই তোমাকে পাঠিয়েছি।

রাসূল সা. নিজেও বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

নিঃসন্দেহে আমি সুপরিশীলিত রহমত মাত্র।

এ রহমতের ফল হিসেবেই আল্লাহ তাঁর এ সর্বশেষ উম্মতের উপর থেকে সর্বপ্রকার কষ্ট, কঠোরতা ও কৃচ্ছ সাধনার নিয়মাদি তুলে নিয়েছেন। ‘সব কিছু বৈধ- কোন কিছুই নিষিদ্ধ হয়’, এ নীতির কদর্যতা থেকেও তাদের মুক্ত করেছেন। মূর্তিপূজারী ও কোন কোন কিতাবী ধর্ম-পালনকারী গোষ্ঠী আবার কৃচ্ছ সাধনা ও কষ্ট-কঠোরতার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে সকল প্রকার পাক-পবিত্র জিনিসকে নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছে এবং বহু প্রকার জঘন্য ঘৃণ্য কাজ বা জিনিসকে নিজেদের জন্যে ‘হালাল’ করে নিয়েছে। আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ

………… (আরবী)…………..

আমার রহমত প্রতিটি জিনিসকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি অবশ্য তা নির্দিষ্ট করে দেব সেসব লোকদের জন্যে, যারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে, যাকাত দেয় এবং যারা আমাদের আয়াতসমূহের প্রতি ঈমানদার তারাই উম্মী নবীকে অনুসরণ করে চলে। তাদের কাছে রক্ষিত তওরাত ও ইঞ্জিলে তাঁর কথা লিখিত দেখতে পায়। এ নবীই তাদের ভাল ভাল কাজের আদেশ করে, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে, তাদের জন্যে ভাল ভাল ও পবিত্র জিনিসসমূহ হালাল ঘোষণা করে, তাদের জন্যে হারাম ঘোষণা করে সব নিকৃষ্ট ও জঘন্য বীভৎস কাজ বা দ্রব্যসমূহ এবং তাদের ওপর যে বোঝা ও শৃঙ্খল আবহমানকাল থেকে চেপে বসে আছে, তা থেকে তাদের মুক্ত করে।

হালাল-হারামের ব্যাপারে ইসলামী বিধান যে দুটি আয়াতের ওপর ভিত্তিশীল, তার উল্লেখ এ গ্রন্থের শুরুতে দেয়া হয়েছে।

শেষ কথা হচ্ছে, হালাল-হারাম বিষয়ে লিখিত এ ক্ষুদ্র পরিসর গ্রন্থখানির গুরুত্ব স্বীকৃত হতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আধুনিক মুসলিম গ্রন্থ প্রণয়ন পর্যায়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে মনে করি। এ গ্রন্থ মুসলিম জীবনের বহু সমস্যার সমাধান করবে এবং বহু ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিষয়াদি সংক্রান্ত প্রশ্নের সঠিক জবাব জনসমক্ষে উপস্থাপিত করবে। মুসলিমদের জন্যে হালাল কি, হারাম কি এবং তার নিহিত প্রকৃত কারণ ও যুক্তি কি, তা সব বিস্তারিতভাবে এ গ্রন্থের মাধমে জানা যাবে বলে আমার দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে।

সর্বশেষে জামে আযহারের ভাইস চ্যান্সেলর ও ইসলামী সংস্কৃতি পরিষদের প্রতি শুকরিয়া না জানালে আমার দায়িত্ব পালন হবে না। কেননা তাঁদের কথানুযায়ীই আমি এ গ্রন্থ পণয়নে উদ্যোগী হয়েছি।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি