প্রকাশকের বথা

ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতা ও সমগ্র বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল প্রায় আট’শ বছর । বর্তমান সভ্যতার অগ্রগতিতে ইসলামি সভ্যতার অগ্রগতিতে ইসলামি সভ্যতার অবদান কম নয় মোটেই। অষ্টম শতকের ইউরোপের অন্ধকার যুগে মুসলিম স্পেনের জ্ঞান বিজ্ঞানের উজ্জ্ব আলোকবর্তিকায় অবগাহন করে ইউরোপ নবজীব লাভ করে এবং শুরু হয় ইউরোপের নব উত্থান।
নৈতিকতা এবং আচরণ- এ দুই-ই মানব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামে এ বিষয়গুলো সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতা ও আচরণের চর্চা উপাদানগুলোর চর্চা ব্যক্তিজীবন এবং সমাজ জীবকে সুন্দর, সাবলীল ও গতিময় করে। এসবের আর্থিক মূল্য খুব বেশি না হলেও সামাজিক মূল্য অপরিসীম। ইসলাসি সমাজে নৈতকতা ও আচরণের ছোট খাট বিষয়কেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় বলে ইসলামি সমাজ এবং সংস্কৃতি সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও শোভা লাভ করেছে। যে সমাজ এবং সংস্কৃতিক সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও শোভা লাভ করেছে। যে সমাজে নৈতিকতার কোন বাছ-বিচার নেই, সে সমাজ অত্যন্ত বিশৃংখল। বইটির লেখক মারওয়ান ইবরাহীম আল কায়সি ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি গ্রন্ধাবদ্ধ করে পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে ইসলামি কৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনে যথার্থ অবদান রেখেছে।
সংস্কৃতির পরিধি বিরাট। লেখকের এ পুস্তিকাটি মূলতঃ তাঁর দেশের সাংস্কৃতিক আবহে লেখা। এ জন্য বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে কোন কোন বিষয় বৈদাদৃশ্য মনে হতে পারে। কিন্তু মূল ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়- এ বিষয়টি পাঠককে বিবেচনায় রাখতে হবে।
বইটির অনুবাদক সাংবাদিক শেখ এনামুল হক সাহেব অনেক পরিশ্রম করে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে এ বইটি তুলে ধরার সুযোগ করে দিযেছেন। এ জন্য আমরা তাঁকে মোবারকবাদ জানাই। অনুদিত পাণ্ডলিপি সম্পদানার কাজটি করেছেন ড. মঈনুদ্দীন আহমদ খান সাহেব। এ জন্য আমরা তার কাছেও কৃতজ্ঞ। ব্যাপক পাঠক- চাহিদার প্রেক্ষিতে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হলো। এতে আমরা পূর্বের ভুলত্রুটি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করেছি। যাদের ‍উদ্দেশ্যে আমাদের এ প্রচেষ্টা, বইটি তাঁদের কাজে আসলে আমাদের প্রয়াস সার্থক হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন। আমীন ।
প্রফেসর ড. লুৎফর রহমান
ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিআিআইটি
সেপ্টেম্বর, ২০১০।

অনুবাদকের কথা

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত শিক্ষা ও সংস্কৃতিক আলোকে বিশ্ব সভ্যতা বিনির্মাণে মুসলমানদের ভূমিকা আজ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। ইসলামি সভ্যতার সেই স্বর্ণযুগের আলোকে নতুন করে বিশ্ব সভ্যতা পুনর্গঠনে মুসলমানদের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বহু দিন হল। প্যান ইসলামি যুগের স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম জামাল উদ্দিন আফগানির স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষআ আজ মুসলিম বিশ্বে জোরদার।
ইসলারেম শাশ্বত আদর্শে সমাজ গঠনের ঢেউ লেগেছে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র। মুসলমানরা আজ ইসলামি জীবন বিধানের আলোকে নিজেদের জীবন রাঙিয়ে তোলার জন্য উন্মুখ। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সুদমুক্ত ব্যাংক বীমা আজ বিশ্বের সর্বত্র বাস্তবরূপ লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বসভ্যতার পুনর্গঠনেও ইসলাম যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ড. মারওয়ান ইব্‌রাহিম আল কায়সির লিখিত Morals and Manners in Islkam A Guide to Islamick Adab বা “ইসলামে নৈতিকতা ও আচরণ; ইসলামি আদাবে দিক নির্দেশনা”-নামে বইটি বাংলাভাষায় এ ধরনের বই নেই। বললেই চলে। সুতরাং গ্রন্থখানি বাংলাভাষী পাঠকদের ইসলামি জ্ঞানের দিগন্তকে আরো প্রসারিত করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
শেখ এনামুল হক ১৯৯৮ ইং

মুখবন্ধ

ইতিহাসের সূচনা থেকেই মানব সমাজ এমনকি প্রাথমিক পর্যাযের গোত্রীয় সমাজেও ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্ক পরিচালনার বিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয় সমাজে প্রচলিত পতে হোতেপ-এর নির্দেশনাবলিতে (The Instructions of path Hotep) সুষ্ঠু আচরণ সম্পর্কে পুত্রের প্রতি পিতার নির্দেশনাবলি জানা যায়। প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব বিধিবিধান ও আচরণ মেনে চলেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের আচরণবিধি ব্যাপক পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি কোন এক জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রেও একই সমযে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা পরিবর্তি হয়েছে। মুসলমানদের বেলায়ও এটা সত্য যে, মুসলিম বিশ্বের দৈনন্দিন জনজীবনের বিভিন্ন স্তর ইসলামি আদবের বিভিন্ন দিক এখনও প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তথাপি, এটাও সত্য যে, বহিরাগত ভাবধারা ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার করেছে। ইসলমি ভাবধারার সাথে স্বল্প যোগাযোগের ফলেই এ ধরনের প্রভাব পড়েছে। তবে এ বিষয়ে কোন প্রকার উপযুক্ত গ্রন্থ না থাকায় বিদেশী ভাবধারা প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। এ ধরনের গ্রন্থ না থাকায় বিদেশী ভাবধারা প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। এ ধরনের গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনের নিরিএখই এই রচনার প্রয়াস। সম্ভাব্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কাছে ইসলামি আদবের বিস্তারিত দিক তুলে ধরা এর উদ্দেশ্য।
পাশ্চাত্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক এবং অব্যাহত পারস্পরিক আন্তঃযোগাযোগের ফলে মুসলমানদে দৈনন্দিন জীবনে পশ্চিমা আচরণের কতিপয় ধারার আমাদানি ঘটেছে। কিন্তু এই আন্তঃযোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আগেই নতুন নতুন ধ্যান-ধারাণার সঙ্গে পরিচিতির দরুণ ইসলামি জীবনধিান অনৈসলামিক ভাবধারার প্রভাবাধীনে পড়ে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইসলামের মৌলিক সূত্র আল-কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে মুসলমানদেরকে তাদের আচরণকে ইসলামিকরণ করতে হবে। তাদেরকে প্রকৃত ইসলাম ও ঐতিহাসিক ইসলাম এবং ইসলাম ও অইসলামের মধ্যকার পার্থক্য জানতে হবে। প্রাথমিক ইসলামে প্রচলিত অনেক আচার-আচরণ, যা এখনও মুসলমানদের মধ্যে বিরাজ করছে, তাদের চিহ্নত করতে হবে। এই দায়িত্ব পালনের পর, যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে অনপ্রবিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রাধান্য থেকে ইসলামি সমাজকে মুক্ত করার পথ সুগম করতে হবে।
সবকালে এবং সর্বত্র মুসলিম শিশুদেরকে ইসলামি আদম অনুসারে জীবন যাপনের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপর নেই। আশা করা যায়, এই গ্রন্থখানি ইনশাআল্লাহ উল্লিখিত শূন্যতা পূরণে সহায়ক হবে এবং বিশেষ পরিস্থিতি বা সময়ে কি ধরনের আদম লেহাজ প্রদর্শন করা উচিত সেজন্য একটি সহজবোধ পুস্তিকা হিসেবে এটি কাজ করবে। প্রসঙ্গের () সুবিধার জন্য প্রতিটি অধ্যায় পয়েন্টভিত্তিক সাজানো হয়েছে এবং সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন পরিচ্ছেদের সাধারণ আলোচ্যসূচির ক্ষেত্রে বেশকিছু পয়েন্টের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
সবশেসে এই গ্রন্থের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে পরামর্শ দিলে লেখক পাঠকদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন।
১৯৮৬ ইং। ড. মারওয়ান ইবরাহীম আল-কায়সি
মানবিক বিভাগ
ইয়ারমুক বিশ্ববিদ্যালয়, ইরবিদ, জর্দান।

প্রথম অধ্যায়ঃ সূচনা
‘আদব’ একটি আরবি পরিভাষা যার অর্থ হচ্ছেঃ প্রথা। জনগণের কাছে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত অভ্যাস, যা এক ধরনের লেহাজ বা আচরণ নির্দেশ করে।[F. Gabriely, Encyclopaedia of Islam New, Edition London, Luzac and co; 1960, Vol. I. , p. 175.]
ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম দু’শতাব্দীর মধ্যে ‘আদব’ (adab) পরিভাষাটিতে নৈতিক ও সামাজিকতার সম্পর্ক ছিল। মূল ‘দব’ এর অর্থ হচ্ছে: বিস্ময়কর জিনিস অথবা প্রস্তুতি বা ভোজ। এই অর্থে ‘আদব’ এর ল্যাটিন সমার্থক হচ্ছে urbane, যার অর্থ সভ্যতা, সৌজন্য, নগরীর কৃষ্টি। এর বিপরীত অর্থ: বেদুঈদনদের অশিষ্টতা।[প্রাগুক্ত।] সুতরাং কোন কিছুর আদব এর অর্থ হচ্ছে, ঐ জিনিসের ভাল দিক। আদবের বহুর বচন হচ্ছে : adab । সুতরাং Adab al-Islam এর অর্থ হচ্ছে: ইসলামের স্বীকৃত সদাচরণ, যা তার শিক্ষা এবং নির্দেশাবলি থেকে উৎসারিত। এটিকে এই অর্থে আলোচনা করা হবে।

উৎস
ইসলাম ছাড়া অন্যান্য সংস্কৃতিতে আচরণ নির্ধারিত হয় স্থানীয় পরিস্থিতির দ্বারা এবং এজন্য এসব অবস্থার পরিবর্তনের সাথে তার সম্পর্ক থেকে যায়। W.G. Sumner এর মতে পৌনঃপুনিক প্রয়োজনে ব্যক্তির জন্য আচরণ এবং গোষ্ঠীর জন্য প্রথার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এসবের ফলাফল বা পরিণতি কখনও সচেতন কিছু হিসেবে প্রতিভাত হয়না। [W.G. Sumner, Folkways, New York: Blaisdell PublishingCo. ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৬৫, পৃঃ-৪১।]
এই অর্থে ইসলামি আচরণ ও প্রথা ‘অসচেতন’ নয়। এগুলো ইসলামের দু’টো মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গৃহীত। সুন্নাহ হচ্ছে : রাসূলের (সা.) কথা, কাজ ও পরোক্ষ অনুমোদনের সমষ্টি, কড়াকড়ি অর্থে খোদার অনুপ্রেরণায় যা অনুপ্রাণিত।
কুরআন ও সুন্নাতে বিভিন্ন যুগে মানব সমাজে উদ্ভূত নানা সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যাপক নীতিমালা রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিনিময় ও গতানুগতিক আচরণের বিধান রয়েছে। ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক ও আইনগত আচরণের মধ্যে সীমিত নয়; এতে মানব জীবনের ও সম্পর্কের সকল শাখায় মানদণ্ড ও মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রথার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এই সার্বিক বিষয়ের অংশ হিসেবে ইসলামের ব্যাপকলক্ষ্যবস্তু থেকে ইসলামি আদম গৃহীত এবং তার ব্যাপক ধারণা ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত।
ইসলামের ‘আদব’-কে সামগ্রিক বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধারণা করা বা রূপায়ণ করা যাবেনা। বরং ইসলারেম অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাদের অন্তঃসম্পর্কের দিকটি সব সময়েই স্মরণে রাখতে হবে। একইভাবে ইসলামি আদবের আওতায় বিভিন্ন বিষয়কে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা চলবে না এজন্য যে, এগুলোও ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এ ব্যাপারে একটি বাস্তব উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। মুসলমানকে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে হয়, যাতে করে সে ফজরে নামাজের জন্য শিগগিরই জাগতে পারে।
ইসলামের আদম কায়দার ব্যাপারে যে ওহির আদেশ রয়েছে- এর ধর্মীয় রূপ যথাযথ আনুগত্যের সৃষ্টি করে। এর ধর্মীয় প্রকৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এসব আদব কায়দা পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন বাধ্যতামূলক। ইসলামি আদবের প্রধান প্রধান নীতি থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইসলামের সুনির্দিষ্ট আদব ‘হারাম’ থেকে হালাল নির্বাচনে কমবেশি নমনীয়তা রয়েছে। প্রথমটি আইনের দ্বারা স্বীকৃত; দ্বিতীয়টি মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের অনুমোদন ব্যতিরেকে অপরাধীদের কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক বিচার বা শাস্তি দেয় না। তৃতীয় পর্যায়ের আদব লেহাজ রয়েছে এমন ধরনের যা লঙ্ঘন করলেও তা গ্রাহ্য করা হয় না।
ইসলামি আদবের ওহির উৎস থেকে একথা প্রতীয়মান হয় না যে, এই পদ্ধতি হবে কঠোর ও অনমনীয়। ইসলাম এমন কোন আদর্শ নয়- যা মানব-অভিজ্ঞতার অগম্য অথবা বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রয়োগের যোগ্য নয়। বরং এই পদ্ধতির প্রকতি এমন যে, এটা বহু ক্ষেত্রে নমনীয়দ; আবার অনেক ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে সুস্থিত। ইসলাম যার ধারক; সেই মানবিক যুক্তিবিন্যাসে নমনীয়তার উপাদন নিহিত এবং এগুলোকে তার সাধারণ সূত্রের মধ্যে গণ্য করা যায়।
ইসলারেম দুটি মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাহতে বিভিন্ন বিস্তারিত বিধান ছাড়াও সাধারণ নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; যাতে জীবনের দিক তথা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক- প্রভৃতি সকল বিষয়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে। এসব সাধারণ নীতিমালার কোনটাই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের আওতায় নেই। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। নিত্য নতুন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন সমস্যার বিধিামালা প্রণয়নের জন্য ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামের ব্যবস্থা রয়েছে। ইজতিহাদ হচ্ছে: ইসলামের মূল ভাবধারার অনুসরণে এবঙ অপরবির্তনীয় সাধারণ নীতিমালার আওতায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছার লক্ষ্যে ব্যক্তির নিজস্ব যুক্তির সুশৃঙ্খল প্রয়োগ। সুতরাং ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব, যোগ্যতাসম্পন্ন পণ্ডিতদের বিশ্বাস ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা আঞ্জাম দিতে পারে। ইসলামের শিক্ষা বাস্তাবিকপক্ষে মানবপ্রকৃতি ও মানবিক প্রয়োজনের সাথে সুপরিচিত। ইসলাম জীবনের বাস্তবতাকে স্বীকার করে সর্বাধিক বাস্তব উপায়ে তার মোকাবেলা করে।
অতএব, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির উপযোগী করে ইসলামের সাধারণ নীতিমালাকে বাতিল অথবা সমন্বয় সাধানের প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামি আদবের বাস্তবতা ও ব্যবহারিক দিক সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সকল মুসলমানের জন্য রমজানের পুরো মাস রোজা রাখা ফরজ। তথাপি ইসলম (মুসাফিরদের সমস্যার কথা বিবেচনা করে।) মুসাফিরদের রোজা রাখা মওকুফ করেছে, তবে সফর শেষ হবার পর এই রোজা পূরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রসূতি বা যে সব মহিলার মাসিক হয়েছে এবং যারা মারাত্মকভাবে পীড়িত তাদেরকে এই রোজা পালন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। তথাপি কতিপয় হাদিস মোতাবেক মুসাফিরদেরকে কোন কোন ওয়াক্ত একত্রে মি েপড়ার এবঙ চার রাকাত নামাজের ‘কসর’ হিসেবে দু’রাকাত পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় গ্রুপের রীতি ও পরিস্থিতি অনুসারে আদবের সংক্ষিপ্ত, চূড়ান্ত ও বিস্তারিত প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। তবে শর্ত হলোঃ পোশাক পরিচ্ছদ ও খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত প্রধান নীতিমালা মেনে চলতে হবে। ইসলামি আদবের উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ দৈনন্দিন জীবন সুশৃঙ্খল, ছন্দময়, মর্যাদাপূর্ণ ও পবিত্র করা। দৈনন্দিন জীবনকে জটিল করে তোলার জন্য এগুলো কোন লোক দেখানা বা আইনানুগ প্রথা নয়।

বৈশিষ্ট্য : বোধগম্যতা ও নৈতিকতা
ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের জীবনের প্রতিটি দিক নির্ধারণ করে দিয়েছে। অমুসলমানদের পক্ষে এই অপরিহার্য বিষয়টি অনুধাবন করা খুবই জটিল ব্যাপার। বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে ইসলাম তার সকল আচরণ ও ব্যবহার যাচাই করার মানদণ্ড দিয়েছে। ইসলাম অন্যান্য ব্যক্তির সাথে, সার্বিকভাবে সমাজের সাথে, প্রাকৃতিক জগতের সাথে তার সম্পর্ক এবং খোদ নিজের ব্যাপারেও তার সম্পর্ক নির্ধারণ করে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির যথেচ্ছাচার অথবা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির যথেচ্ছাচার অথবা সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বল্গাহীন দাবির বিপরীতে বহু দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূ, শুধু ইসলাম- অনুমোদিত পন্থায় খাদ্য প্রস্তুতি বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা যায়, কোন মুসলমান শূকরের গোস্ত খেতে পারেনা। একজন মুসলিম মহিলার প্রকাশ্যে হাঁটুর নিম্নভাগের পা উন্মুক্ত রাখা উচিত নয়, কারণ ইসলামে তার অনুমতি নেই। মদের ন্যায় যে সব পণ্য মুসলমানদের জন্য নিষেধ; সেগুলো উপহার হিসেবেও বিনিময় করা যাবেনা। কোন মুসলমান বিবাহ উৎসবে আমন্ত্রিত হলে, তাকে সে দাওাত কবুল করতে হবে (অবশ্য যদি সে শারীকিরভাবে সুস্থ থাকে), কেননা তার জন্য এরূপ করা বাধ্যতামূলক। মৃত্যুশয্যায় পোশিক (উল্লিখিত) ইচ্ছা ইসলামি শিক্ষার বিরোধী হলে তা পূরণ করা যাবে না। যেমন মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের মধ্যে অতিরিক্ত সম্পদ বরাদ্দ অথবা তার দেহ পুড়িয়ে ফেলার অনুরোধ পুরণ করা যাবে না।
ইসলারেম আদব হচ্ছে: একটি সমন্বিত বিধান। সামজিক আচরণের প্রতিটি দিক এর অন্তর্ভুক্ত। এটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা তথা ইসলামের অংশ। ইসলামের বিভিন্ন অংশ যেমন একটি অখণ্ড জীবনব্যবস্থা তথা ইসলামের অংশ। ইসলামের বিভিন্ন অংশ যেমন একটি অখণ্ড সত্তা গড়ে তোলে, তেমনি বাদবাকী বিচ্ছিন্ন করে ইসলামি আদবের প্রয়োগ তার সর্বাত্মক রূপায়ণ ঘটাবে না; এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। এই গ্রন্থালোচিত আচরন ও প্রথাসমূহকে মুসলমানদের জন্য উপযোগী বিবেচনা করা হয়েছে। যাদের সত্যিকার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামে অনুমোদিত শুদ্ধ আচরণের নীতি অবলম্বন করবে। ইসরারেম বিভিনন দিক যেমন আদর্শি, আধ্যাত্মিক, আইনগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- প্রভৃতি পরস্পর সমন্বিত এবং একে অপরের পরিপূরক। দৃষ্টান্ত হিসেবে বা যায়, মুসলমানদের ঈমান এবং অপরিহার্য বিষয় যে, ঈমনি চেতনায় বাইরের চাপ ছাড়াই ইসলামের নৈতিক, আইনগত ও অন্যান্য বিধান মেনে চলার অনুপ্রেরণা যোগায়। একইভাবে এসব বিধিবিধান স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পালনের মাধ্যমে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়; অধ্যাত্মচেতনা থেকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের পথ উন্মুক্ত করে দেয় এবং দু’টিকে একটি শক্তিশারী স্থিতিশীল সম্পর্কের বাঁধনে সংযুক্ত করে। আরো সুনির্দিষ্টবাবে ইসলারেম একক শক্তির বিকাশ দেখা যাবে, মহিলাদের ক্ষেত্রে আচরণেল ব্যাপারে। ইসলামি সমাজ মুসলিম মহিলাদের ব্যাপারে ইসলামি ধারণার অনুসরণে এই আচরণবিধি প্রণীত।
ইসলামি আদবের ব্যাপকতার পাশাপাশি সৌজন্যের (Etiquette) সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তুলনীয়। **৪ ইসলামের আচরণ বিভিন্ন উপলক্ষে ‍শুধু সৌজন্যের বিধিমালা নয়, বরং সাধারণ কর্মকাণ্ড থেকে ব্যাপক সামাজিক উৎসবের সার্বিকব মানবিক সম্পর্কের আওতাভুক্ত। পশ্চিমা ‘etiquette’ এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে: (রাজকীয় পরিষদবর্গ ছাড়িয়ে তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছলেও) উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সুরক্ষা করা। **৫ এর বিপরীতে ইসলামি আদবের সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে: তার ধর্মীয় চরিত্র ও প্রকৃতি অনুধাবন। মানুষের দৈনন্দিন কর্মপদ্ধতিতে খোদার স্মরণ থেকেই এর উৎপত্তি; এর উদ্দেশ্য হচ্ছে: খোদার স্মরণ (যিকির) অব্যাহত রাখা এবং সঠিক পথে চলতে সহায়তা করা। ইসলামের আচরণের
৪. ফরাসি শব্দ Une etiuette থেকে etipuette এর উৎপত্তি। এর অর্থ হচ্ছে: নতুন নতুন পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্র আচরণের একটি ব্যাপক বিধিমালা, আদলতে যার মোকাবেলা করা যেতে পারে। Academic American Encyclopedia, Dunbury: Grolier Inc, 1942, Vol. 7, P-258,
৫. Dsther & Aresty, Encyclopedia American, Danbury, Americab Corporation, 1979, Vor.10, 0-635
সকল ঘটনায় খোদার রহমহত তালাশ করা এটা থেকে সুস্পষ্ট হয়। ঘুম থেকে জেগে ওঠে শোওয়ার সময় পর্যন্ত মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের সবক করতে হয় খোদার নাম নিয়ে। খাবার গ্রহণ, পানি পান, নতুন কাপড় চোপড় ক্রয় অথবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সময় খোদার প্রতি শুকরিয়া ও তার প্রশংসা করতে হয়। এমনকি এস্তেঞ্জা করার আগেও তাকে খোদার নাম নেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পায়খানায় প্রবেশের সময় এই দোয়া পড়ার কথা বলা হয়েছে: “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে শয়তান ও অশ্লীলতা থেকে আশ্রয় চাই।” পায়খানা ছেড়ে আসার সময়ও তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। সফরকালে খোদার যিকর করা এবং পূর্ণতা ও নির্দেশনার জন্য খোদার রহমত কামনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসলামের দু’টি বড় উৎসব হচ্ছে (দু’টি প্রধান ফরজ কাজ)- রমজান মাসে রোজা রাখা এবঙ মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্ব সমাপনান্তে সামাজিক উৎসব পালন।
জাতির আত্মবিশ্বাস ও শক্তির স্তম্ভ হচ্ছে নৈতিকতা, যা ইসলামি আদবের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এর পাশাপাশি কোন জাতির পত ও ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্নীতি ও নৈতিকতা বিরোধী কাজ। নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপের ফলে প্রায়ই ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে আপাতঃদৃষ্টিতে কঠোর অথবা মৌলবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। একজন লেখক বলেছেন, নৈতিকতার কোন কোন ব্যাপারে ইসলাম আমাদের কালের বিশেষ কতিপয় জীবনব্যবস্থার চাইতে অধিকতর কঠোর ও অধিকতর বিশুদ্ধ। **৬ তবে কোন জাতির সুস্থতার ক্ষেত্রে নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ যৌন সম্পর্ক এবং বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দুর্নীতির সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়ে মান নির্ধারক ইসলাম সঠিক দায়িত্ব পালন করেছে। ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক মানবিক পুণ্যের বিনিময়ে বস্তুগত আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা যাবে না। তাছাড়া রাজনতিকেও (অনৈসলামিক চিন্তাধারায় এটা অনৈতিকতার সাথে সম্পর্কহীন গণ্য করা হয়) ইসলামের লক্ষ্য তথা মানবিক চরিত্র ও মানবতার বিকাশের উপযোগী হতে হবে।
৬. Mohommad Hamidullah, Introduction to Islam, the Holy Quran Publishing House, 1977, P-155]
মানবতার আদর্শ ‘আমলে সালেহ’ বা পূণ্যকর্মের উপর স্থাপিত। এই পরিবাষাটি ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে যে অর্থের ধারক, তার বাইরেও তা বিস্তৃত। ইসরামি আকিদা ও আইনের অনুমোদিত মানবিক কার্যক্রমের (অপরে সঙ্গে সম্পর্কের, সজীব ও নির্জীব পরিবেশের ক্ষেত) বহুদিক এর আওতাভুক্ত। এক্ষেত্রে মহানবীর (সা.)-এর জীনব থেকে বহু বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যেছে; যেমন- দু’জনের মধ্যে ন্যায়বিচার করা, কাউকে ঘোড়া চড়তে (বা গাড়িতে উঠতে) সাহয্য করা, উত্তম বাক্য বিনিময় করা, পথ কন্টকমুক্ত করা, বেওয়ারিশ কুকুর ও বিড়ালকে পানি পান করানো, অন্যকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাতে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করা ইত্যাদি। এমনকি স্ত্রীর সাথে প্রেমপূর্ণ ভাষায় কথা বলাও উত্তম কাজ হিসেবে বিবেচিত। আদর্শ মুসলিম ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিনয়, সৌজন্য এবং সহজ সরল আচরণ। আচার ব্যবহারে কোন প্রকার গৌরব ও ঔদ্ধত্য মেনে নেয়া যায়না। করণ তাকওয়া এবং সৎকর্ম ছাড়া কোন মানুষের ওপর অন্য মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
একইভাবে যে পোশাক পরলে অহংকার প্রদর্শিত হয়, সামাজিক মর্যাদা ভড়ং ধরা পড়ে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খাদ্য গ্রহণে নম্র ও ভদ্র পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক। খাবার গ্রহণ কালে সোফায় হেলান দেওয়া নিষিদ্ধ। খাবার গ্রহণকালে বসে খাওয়া বিনম্রতার লক্ষণ। গৃহের আসবাবপত্র সাজানোর মধ্যেও ভদ্রতা ও সংযমের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে বিছানা পাতা যাবেনা। হাঁটার সময় প্রফুল্ল থাকা, স্বাগত সম্ভাষণ ও বক্তৃতাকালে কোন প্রকার বড়ত্বের বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত নয়।
ইসলাম বৈষয়িক ও ধর্মীয় জীবনের সকল পর্যায়ে পরিমিত ও স্বাভাবিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছে। উগ্রপন্থা, বাড়াবাড়ি, খামখেয়ালিপনা, অস্বাভাবিক আচরণ, অস্থিরতা এবং জটিলতাকে পরিহার করতে হবে। ইসলামি আদবে কোন কোন আনুষ্ঠানিকতার ওপর গুরুত্ব দানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম সমাজের বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে তার ব্যবহার সহজতর করে তোলা। আচর আচরণের স্বাভাবিকতারকে সামাজিক উত্তেজনা হ্রাস এবং সামাজিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে হিসেবে গণ্য করা হয়।
পশ্চাত্যের আদব কায়দার উৎপত্তি ইউরোপের রাজদরবারে। রাজদরবার ও অভিজাত শ্রেণীর সাথে ব্যবহারের জন্যই এর উদ্বাবন করা হয়েছে। **৭ সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে আদবকায়তার বিষয়টি জানাজানি হয়ে পড়লে তার অর্থের তাৎপর্য হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে গ্রুপ থেকে গ্রুপে পাশ্চাত্যের আদবকায়তা কম-বেশি হয়। তথাকথিত ‘হাই সোসাইটির’ সদস্যরা অপেক্ষাকৃত স্বল্পবিত্তের লোকদের তুলনায় আদবকায়দার জটিল ও অনমনীয় ধারা অনুসরণ করে। এর ফলে শ্রেণীভেতে পদ্ধতি থেকেই যাচ্ছে।
ইসলামে আদবের প্রসঙ্গটি ভিন্ন। এ উদ্দেশ্য সামাজিক শ্রেণীর অনুসারে সমাজের বিভক্তি নয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মারফত জারিকৃত বিধিমালা কেন বিশেষ গ্রুপের দ্বারা প্রণীত নয় অর্থাৎ ধনী ও ক্ষমতাশালী লোকদের দ্বারা অন্য গ্রুপের অধিকার ‘সংরক্ষিত’ বিবেচনা করা কোন কারণ নেই। এ অধিকার মুসলিম সমাজের সকলের জন্য উন্মুক্ত। ইসলামে আদবকায়দার রকমারি নিয়মের কোন অস্তিত্ব নেই।
মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের ঐক্য প্রকাশের বাহন হিসেবে ইসলামি আদবের ভূমিকা স্পষ্ট; কিন্তু ইসরামি আদব মুধু আচরণের সংগতি বা সামঞ্জস্য বজায় রাখা নয়; বরং তা হচ্ছে সঠিক আচরণের সংগতি বা সামঞ্জস্য বজায় রাখা। ইসলামে সদাচরণের ধারণাকে সৎ কাজের ধারণা থেকে পৃথক করা যাবে না, যেমন যাবেনা ঈমান ও এবাদতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা। একটি সমৃদ্ধশালী আদর্শ সমাজে ঈমান ও সৎ কাজের অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ এখানে দায়িত্ব পারস্পরিক ও ভাগাভাগি করে নিতে হয়। আর পরকালে বেহেশতে দাখিল হওয়ার জন্য ঈমান ও সৎবকর্ম হচ্ছে মু্ক্তি ও নাজাতের অপরিহার্য শর্ত। পবিত্র কুরআন শরীফের বহু সংখ্যক আয়াতে প্রকৃত মুসলানের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ঈমান ও সৎকর্মকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে।

লক্ষ্য
ইসলামে যেটা কেন্দ্রীয় ও অপরিহার্য, তা নির্ধারিত হয় ইসলামের লক্ষ্যের সাথে তার বিস্তৃত সম্পর্কের দ্বারা। এর মধ্যে রয়েছে
৭. Amy Vanderbilt, The World Book Encyclopedia, Chicao; Field Enterprises Educational Corporation, 1972. Vol. L. P-297
মানব সমাজের উৎকর্ষ বা সভ্যতা, সুখ ও সমৃদ্ধির বিকাশ, বস্তুগত ও নৈতিক উন্নতি ইত্যাদি। পরীক্সা নিরীক্ষা করে দেখা যাবে যে, ইসলামে হালাল ও হারামের বিধান রাখা হয়েছে তা কোন স্বেচ্ছাচারী ফরমান নয়, বরং তা হচ্ছে এক সুশৃংখল আদেশ নির্দেশের সমাহার যার উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ (খোদার প্রতি মানুষের বাধ্যতা ও আনুগত্য পরীক্ষা ছাড়াও) ব্যক্তিক, পারিবারিক অথবা সামাজিক পর্যায়ে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ পন্থায় মানুষের অগ্রগতি সাধন। ইসলামি আদবের বিস্তারিত বিষয়গুলো অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা, ব্যক্তির প্রতি বৈরীভাবাপন্ন কিংবা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রকৃত প্রয়োজনে প্রতি অসম্পৃক্ত নয়। বরং এসব বিষয় সমাজের সকল স্তরেও প্রাত্যাহিক জীবনে বিভিন্ন মৌলিক কর্মকাণ্ডে সমাধান যুগিয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কেন্দ্রীয় এবং অপরিহার্য বিষয়ে মনোনিবেশ করা এবং বিভ্রান্ত মানুষকে উদ্ধার করা। এগুলো উদ্দেশ্য থেকে উপায়কে পৃথক করে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পদ কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ব্যক্তি ও সমাজকে সহায়তা করে। ইসলামি আদবের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলিক মানবীয় প্রয়োজন ও কর্যক্রমের তালিকা তৈরি করে সাধারণ বিষয়টির ব্যাখ্যার সহায়ক হতে পারে নিম্নোক্ত বিষয়াবলিঃ
১. পোশাক পরিধানকারীক প্রাথমিকভাবে আবহাওয়ার দৌরাত্ম থেকে তা রক্ষা করে এবং তার শরীরের গোপন অঙ্গ ঢেকে রাখে।
২. গৃহায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে আবহাওয়ার দৌরাত্ম থেকে আশ্রয়লাভ এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্ত ও নিরূপদ্রব জীবন যাপন।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং রোগ-বালাই থেকে মানুষকে রক্ষা করা।
৪. স্বামীর সামনে মহিলাদের আকর্ষণীয় ও প্রিয় হওয়ার মাধ্যম হল প্রসাধনী ও মেক-আপ।
৫. বক্তৃতা হচ্ছে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা বিনিময়ের অপরিহার্য কাজ সম্পন্ন করে।
৬. হাস্যরস উত্তেজনা হ্রাস করে এবং বিভিন্ন সমাবেশে জনগণের চিত্ত বিনোদনে সহায়তা করে।
৭. উপহার হচ্ছে শুভেচ্ছার বহিঃপ্রকাশ এবং এর ফলে অপরের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
৮. বিভিন্ন লোককে ভোজে দাওয়াত দান, তাদের সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়ার ফলে সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি হয় ও তা জোরদার করে।
সামাজিক সম্পর্কেও এর বেশ মূল রয়েছে। কারণ এই সম্পর্কের ফলে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা রেধ হয় বা তা সীমিত করে। সামাজিক আচারের প্রয়োজন, কারণ সমাজের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থাগুলো সুন্দর সমন্বয় সাধন করে থাকে।
১০. কবরস্থান মূলতঃ মৃতদের সম্মানে নির্মিত। তবে তা জীবিতদেরকে পচনশীল মৃতদেহ থেকে রক্ষা করে।
১১. মানুষের পাশাপাশি জীবজন্তুকে প্রধানতঃ খাদ্য, শ্রম ও পরিবহনের কাজে লাগানো হয়। তাদেরকে মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়; যেমন- বিভিন্ন পশুর মধ্যে লড়াই বাধিয়ে উপভোগ করা।
এটি সততই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের আদবের বাধাবিপত্তি ছাড়া এসব মাধ্যম পরিণতিতে পর্যবসিত হত, যা উপরোক্ত মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারনাকে নস্যাত করে দিত। পোশাক, ঘরবাড়ি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উপঢৌকন ইত্যাদি ব্যক্তির বা সমাজের সম্পদের অপচয় ঘটায়; কেননা জনগণ (এসবের প্রকৃত কাজের ক্ষেত্র ভুলে গিয়ে) অন্যদের সামনে তাদের ব্যাপক ক্রয়ক্ষমতার প্রমান করার অর্থহীন প্রচেষ্টায় টাকা পয়সা খরচে লিপ্ত। বিশ্বে পণ্যের অপচয় করার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির এবং তাদের সমাজের সাফল্য- যে সমাজে তাদের অধিবাস। ব্যক্তির চিত্তবিনোদন বা আনন্দের প্রতি গুরুত্বদানের ফলে তা কি রকম লক্ষ্যে পরিণত হয়- পাশ্চত্য দেশসমূহের বিরাট জনগোষ্ঠী এবং মুসলিম দেশসমূহের ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠী যে হারে সম্প ব্যয় করছে, তা থেকেই সেটা প্রতীয়মান হবে। কিন্তু খোদায়ী আইনের মানুষের প্রতি মানুসের যে দায়িত্ব তা এড়িয়ে যাবার মূল্য দিতে হচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা (রূহ) হারানোর মাধ্যমে; তারা আত্মা হারাচ্ছে অস্থিরচিত্তে এক পলায়নবাদ থেকে অন্য পরায়নবাদের আশ্রয় নিতে গিয়ে। তারা সর্বদাই চাচ্ছে উত্তেজনাকর সুখ অর্জন বা বিক্ষূব্ধচিত্তের অধিকারী হতে। যখনই তারা একাকীত্বের শিকার হচ্ছে, তখনই তাদের মন যাচ্ছে গভীর শূন্যতায় ভরে এবয় তারা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।
ইসলামি আদবের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের প্রতিভার এ ধরনের অপ্রীতিকর অপচয় পরিহার করা এবং মানুষকে তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বিত করে তার সেই প্রতিভাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করা। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক এমনকি চিকিৎসার পরিভাষার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানের জীবনচারণে থাকবে ব্যাপক প্রজ্ঞা-সেটি ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা থেকেও। এর তাৎপর্য হচ্ছে সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য, ব্যক্তি এবং সমাজকে অত্যন্ত সচেতন ও বিবেচনার সাথে এসব বিধির প্রয়োগ করতে হবে। যে কোন প্রয়োগের বেলায়, সদয় ও সুবিবেচনা, এই দুটো বিষযের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। ইসলামের মূল অর্থ হচ্ছে- (আত্মসমর্পণ বা আনুগত্য) শান্তি; মুসলমান হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে খোদার ফরমানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, খোদা ও তাঁর সৃষ্টিকুলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তদুপরি মহানবী (সা.) তাঁকেই প্রকৃত মুসলমান বলেছেন, যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্যা নিরাপদ থাকে।

দয়া ও ভদ্রা
রাসূল (সা.)-এর হাদিসে বলা হয়েছে, মুসলমানদের ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে দয়া প্রদর্শন প্রয়োজন। ইসলামি আদবের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিটি বিষয়ে সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে লোকদের প্রশিক্ষণ দান।
এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উদাহরণগুলো উল্লেখযোগ্যঃ
১. কথা বলার সময় স্পষট করে বলতে হবে, যাতে করে সংশ্লিষ্ট লোকজন শুনতে পায়, তবে উচ্চকন্ঠে নয়।
২. খারাপ অথবা আপত্তিকর ভাষা পরিহার করতে হবে।
৩. অট্টহাসি অথবা অপ্রীতিকর শব্দ কাম্য নয়। নির্মল হাসি হাসতে হবে।
৪. কাঁদার সময় সংযম পালন করতে হবে; হৈ চৈ করে বা বুক চাপড়ে কাঁদা উচিত নয়।
৫. পানাহারের বেলায় ভদ্র পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
৬. ‍মুসলমানকে অবশ্যই তার ক্রোধ সংবরণ কবরতে হবে, সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করা চলবে না।
৭. পিতামাতা তাদের সন্তানদের চমৎকার অর্থপূর্ণ নাম রাখবেন এবং জটিল ও অর্থ নেই এমন নাম রাখা থেকে বিরত থাকবেন।
৮. প্রেম, ভালবাসার ক্ষেত্রে সহৃদয়তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়।
৯. লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সহাস্যে সম্ভাষণ করা।
১০. অন্যের সাথে আলোচনায় প্রীতিকর চাহনি সদাচরণ হিসেবে বিবেচিত।
১১. অন্যের সমালোচনার বেলায় ‍মুসলমানদের ভদ্র হতে হবে।

অন্যদর প্রতি বিবেচ্য বিষয়
কারো ক্ষতি করা বা তার উদ্দেশ্যে শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক অথবা নৈতিক নির্যাতন পরিত্যাগ করতে হবে। মহানবীর (সা.) ভাষায়, কারো ক্ষতি করা অথবা কারো ওপর প্রতিশোধ নেয়া উচিত নয়। **৮
কারো সাথে ঘৃণাচ্ছলে কথা বলা সত্যিকার মুসলমানদের আচরণ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে সদাচণ অনেকখানি নির্ভর করে অন্যের প্রতি সুবিবেচনা প্রসূত ব্যবহারের ওপর। এ ক্ষেত্রে ইসলামি আদবের অবদান অনেক। এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ দ্রষ্টব্য :
১. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কারো বিশ্বাসের নিন্দা বা গালাগাল দেওয়া নিষিদ্ধ।
২. রাস্তায় চলাচলে ক্ষেত্রে ব্যবহারের নীতি হবে থুথু না ফেলা, চেঁচাচেঁচি না করা। অপরের ক্ষতি করা, বাধাদান অথবা বিরক্ত করা চলবে না।
৩. কোন মুসলমানকে কেউ গালিগালাজ করলে এবং তার দোষত্রুটি প্রকাশ করলেও তাকে গালি দেওয়া অথবা তার ভুলত্রুটির কথা বলা ঠিক নয়।
৪. অন্যের সাথ ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, অভদ্র বা তির্যক কথা বলা নিষিদ্ধ। কটাক্ষ করা,চোগলখুরি করা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আন্দাজ, অনুমানের মাধ্যমে চরিত্র হনন ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৫. খাবার গ্রহণকালে অপ্রীতিকর ভাবভঙ্গি দেখানো উচিত নয়, কারণ এতে অন্যেরা বিরক্ত হতে পারে।
৬. তিনজন এক সাথে থাকলে দু’জন একান্তে আলোচনা করা উচিত নয়; কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি আহত হতে পারে।
৭. মৃতদেরকে গালিগালাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ এতে তারেদ জীবিত আত্মীয়রা মনে আঘাত পায়।
[**৮ Al-Nawawi`s Forty Hadith Translated by Ezzeddin Ibrahim, Dammascus, Fl-Duran Publishing House. 1979, 106 ]
৮. অন্যদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের আরাম, আয়েশ ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন ব্যক্তিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তার কাপড় ও মুখে দুর্গন্ধ না থাকে। পিঁয়াজ বা রসুন খাওয়ার পর কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ না করাই শ্রেয়।
৯. মসজিদে দু’জনের মধ্যে জোর করে স্থান করে নেওয়া অথবা কোথাও যাবার কালে অন্যের চেয়ে এগিয়ে যাওয়াকে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ এর ফলে তারা বিরক্ত হবে।
১০. স্থির পানিতে, গাছের ছায়ায়, রাস্তায় বা কোন সরকারি স্থানে পেশাব, করা নিষেধ, কারণ এর ফলে অন্যেরা এগুলোর সাধারণ ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে অথবা এর ফলে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
১১. পায়ের জুতো ও মোজা খুলে এমনস্থানে রাখতে হবে। হাই তোলার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে। কথা বলার সময় বড় আওয়াজে কথা বলা উচিত নয়, হয়তো অনেকে এজন্য বিরক্ত হতে পারে। এমনকি বসার সময়ও খেয়াল রাখতে হবে, যারা অন্যরা বিরক্ত না হয়। কখনও অন্যের প্রতি শরীরের পিছনের অংশ ঘুরিয়ে বসা হয়, এটাও ঠিক নয়।

সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় ইসলামি আদবের ভূমিকা
ইসলামি আদবের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ সুস্থ সামাজিক সম্পর্কে প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখা। আদর্শ মুসলিম ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রয়োজনীয় গুণাবলী হচ্ছে সততা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ওয়াদা রক্ষা করা, ক্রোধ সংবরণ করা, ধৈর্য, ভদ্রতা, মমত্ববোধ ইত্যাদি। এসব গুণ মানুষের মধ্যে অনাস্থার ভাব দূর করে আস্থা সৃষ্টি করে- যা সুষ্ঠু সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ভিত্তি যুগিয়ে থাকে।
ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা উচিত অথবা নিজের জন্য যতখান ভাবা হয় অন্যের জন্যেও তা ভাবা আবশ্যক। মুসলমানদেরকে পারস্পরিক দায়িত্বশীল হতে হবে এবং একজনকে অপরের বাস্তব সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।
ইসলামি আদব লেহাজে আনুষ্ঠানিকতার স্থান সামান্যই । এর ফলে অবাধ সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাজ প্রশাসম আরো গতিশীল হয়, বৈঠকাদিও যাতায়াতের পথ সুগম হয়। কারণ ইসলামের বিচ্ছিন্নতা নেই। মুসলমানদের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে এজন্য যে, এর ফলে সামাজিক সম্পর্ক জোরদার হয় এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মনস্তাত্ত্বিক কুফল থেকে ব্যক্তি রক্ষা পায়। তদুপরি মুসলমানদেরকে অবাধে দেখা সাক্ষাতের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। মেহমানদারির ব্যাপারে কর্তব্য হচ্ছে মেহমানের প্রতি অতিথিপরায়ণ ও উদার হওয়া। খাবারের দাওয়াত গ্রহণ করাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং বিয়ের ওয়ালিমায় যাওয়াকে অবশ্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রোগীদের দেখতে যাওয়া, জানাযায় শরীক হওয়া, শোকাহত পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া, আশ্বস্ত করা, তাদের খাদ্য সরবরাহ করা, সমাজের অন্যান্য লোকদের সাথে উপহার বিনিময় করা, সাক্ষাতে বা বিদায় নেবার সময় মোসাহাফা করা, বিযে বা জন্মের ন্যায় খুশির দিনে শরীক হওয়া- এগুলো সামাজিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে এ ধরনের বিনিময়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মুসলমানদের বলা হয়েছে, সময়ে সময়ে ভোজের আয়োজন করতে এবং এ উপলক্ষে লোকদের দাওয়াত দিতে। বিয়ে, জন্ম এবং কুরবানীর দিনের ন্যায় দিনগুলোতে ভোজনের আয়োজন করার নির্দেশ দেওয়া হযেছৈ। সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য সত্ত্বেও একত্রে ভোজনের ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়ে। এজন্য যেসব ভোজের মজলিশে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয় এবং গরিবদের বাদ রাখা হয়- এ ধরনের ভোজকে ইসলাম নিকৃষ্টতম ভোজ হিসেবে গণ্য করে। ব্যক্তিগত স্বার্থমু্ত সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ হবে মূলতঃ খোদার সন্তুষ্টির জন্য। অনুরূপভবে, প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কারো দেওয়া উপহার মুসলমানদের গ্রহণ করা উচিত নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থাৎ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অথবা কোন কিছুর প্রত্যাশার বিনিময়ে দাওয়াত দেওয়া হলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে ব্যাপক মেলামেশার জন্য সামাজিক জীবন যাপনের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে আদায় কারার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সমাজের বহু মানুষ এবং নানা বর্ণের মানুষ দিনে একাধিকবার মেলামেশার সুযোগ পায়। শুক্রবার জু’মার নামাজ আদায় করার জন্য মুসলমানরা মসজিদে সমবেত হয় এবং দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলমানদের ওপর এটা ফরজ। এছাড়া বছরে দু’টি আরো উৎসব রয়েছেঃ একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আযহা। তাছাড়া বিশ্বের সকল স্থান থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মুসলমান মক্কা শরীফে পবিত্র হজ্জ্ব পালনের জন্য সমবেত হয়।
মসজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুসলমানরা মসজিদে সমাজ ও দেশের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। মসজিদ জনগণের মিলন কেন্ত্র হিসেবে পরিচ্ছন্ন রাতে হবে এবং এরকম রাখা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। মসজিদের পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলার উপর সেখানকার সামাজিক বৈঠকের সাফল্য নির্ভর করে।
অপরের সঙ্গে আলোচনা করার সময় ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলমানদের প্রত্যহ গোসল করতে হয়। তাছাড়া যখনি সম্ভব, প্রকাশ্য সমাবেশে (যে কোন শুক্রবার জুমার জামায়াত, দু’টি ঈদ উৎসব) যোগ দেওয়ার আগে পরিচ্ছন্ন কাপড়, আতর ইত্যাদি ব্যবহারে করা উচিত। বিশেষ করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেগুলোর ব্যবহার সর্বাধিক যেমন হাত ও মুখমন্ডল সর্বোপরি মুখ ও দাঁত পরিষ্কার রাখতে হয়। কারণ মত বিনিময় ও অন্যান্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা এ সময়ে নজরে পড়ে।

ইসলামি আদবের ধর্মীয় দিক
ইসলাম খোদার বিশুদ্ধ এককত্ববাদ বা তৌহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আদিম অথবা পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভাবিত সব রকম বহুত্ববাদ ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে। শরীয়াহ হচ্ছে এই ধারণাগুলোরই বহিঃপ্রকাশ এবং খুঁটিনাটি সবকিছু শরীয়াহ থেকে উদ্ভূত। ইসলামি আদব তৌহিদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং তার মৌল নীতির প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন জানায়।

কয়েকটি উদাহরণ
১. খোদা ব্যতীত অপর কারো দাস বুঝায় যেমন আব্‌দ আল নবী (নবীর দাস) এমন নামকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২. খোদার কর্তৃত্বাধীন যেমন বায়ু বৃষ্টি, প্রভৃতি প্রাকৃতিক নির্দর্শনকে অভিশাপ দেওয়া নিষিদ্ধ। একইভাবে কারো ভাগ্য দুর্বাঘ্যের জন্য খোদাকে দোষারোপ করার ‍নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৩. বক্তব্য বা বিস্ময়সূচক ‍উক্তি যা তৌহিদের বিরোধী যা খোদার শরীকানা স্বীকার করে বলে ধারণা করা হয়, তা নিষিদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খোদা যা ইচ্ছা করেন অথবা খোদা ও তুমি ছাড়া আমার কোন সাহায্যকারী নেই- এ ধরনের বক্তব্যদান সম্পূরণ নিষিদ্ধ।
৪. কুরবাণী শুধু আল্লাহর জন্যই করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে তার নাম নেয়া না হলে অথবা অন্য কারো নামে জবাই করা হলে ঐ প্রাণীর গোশত হারাম হবে এবং কুরবানী বাতিল হবে।
৫. কারো মৃত্যু হলে ইসলাম বিরোধী বক্তব্যদান যেমন, আমাদের এখন কি হবে অথবা লোকটি অকালে মৃত্যবরণ করেছে ইত্যাদি বলা নিষেধ।
৬. খোদার নাম বা ছিফাত ছাড় অন্য কারো নামে বা বস্তুর শপথ করা নিষিদ্ধ।
৭. আল্লাহ ছাড়া অপর কারো নামে মানব বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তা পূরণ করা যাবেনা।
৮. আল্লাহর ইচ্ছার বাহিঃপ্রকাশ ছাড়ান অন্য কারো প্রতি ভরসা করা নিষিদ্ধ বরং বলতে হবে ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ চাহেন ত)।
৯. কোন মানুষকে সেজদা করা যাবেনা। কারণ সেজদা শুধু নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকেই করতে হবে।
১০. কোন কিছু অশুভ আশঙ্কা করে সফর থেকে বিরত থাকা ঠিক নয়, কারণ তা তকদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী।
১১. ইসলামের নির্দেশিকত কবরস্থান জিয়ারতের উদ্দেশ্য হচ্ছে মৃতদের কথা স্বরণ করে আল্লাহর প্রতি জীবিতদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা এবং অন্যদের প্রতি সদাচারে মাত্রার উন্নতি সাধন করা।
১২. কাবা শরীফ পৃথিবীতে খোদার পয়লা মসজিদ। হযরত ইবরাহীম (আ) ও তৎপুত্র হযরত ইসমাঈল (আ) মক্কায় উহা নির্মাণ করেন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা নামাজে কিবলামুখী হয়। এটা মুসলিম ঐক্য ও ইসলামি মুসলমানরা নামাজে কিবলামুখী হয়। এটা মুসলিম ঐক্য ও ইসলামি ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু ‍মুসলমানদের নামাজের চেয়ে এর পারিপার্শ্বিক অবস্থানের গুরুত্ব অনেক বেশি। জীবজন্তু জবাই করার সময় পশ্চিমমুখী হয়ে জবই করা হয়। মুসলমানদের লাশ কবরে শায়িত করা হয় কিবলামুখী করে। এমনকি পায়খানা বা টয়লেটের ডিজাইন কিবলার সাথে সম্পর্কিত। এস্তেঞ্জার সময় মুসলমানদের কিবলামুখী না হওয়অ বা কিবলাকে পিছনে ফেলে না বসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ইসলামি আদব কায়দার অবদান সম্পর্কে এই গ্রন্থে পর্যয়ক্রমে আলোচনা করা হবে। মান নির্ধারক ইসলামের আদব লেহাজ নিষ্ঠার সাথে মেনে চললে বহু বিদ্‌য়াত দূর করা সম্ভব। মূল ও প্রকৃত ধর্মীয় ইসলামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন কোন আকিদা বা আচরণ যুক্ত করাকে বিদয়াত বলে।
নবী করিম (সা.) বিদয়াত প্রথ্যাখ্যান করে বলেছেন, “যে কেউ আমাদের ধর্মের মধ্যে নতুন কোন কিছুর সংযোজন করলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। **৯ এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর সংযোজন থেকে সাবধান থেকো; কারণ প্রতিটি বিদয়াত হচ্ছে পাপ এবং প্রত্যেক পাপ দোযখের দিকে টানবে।”
ইসলামের সঙ্গে কোন কিছুর সংযোজন করাকেই বিদয়াত বলে এবং তা বাতিল। ইসলামি জিন্দেগির বিভিন্ন পর্যায়ে বিদয়াতের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত নেতিবাচক এবং পরিণামে ইসলামের সহজ সরল বিধান জটিল প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয় যদ্দরুণ মুসলিম জিন্দেগির দু’একটি বিশেষ দিক ছেড়ে দিতে হয় বা বাতিল করতে হয়। বিদ্‌য়াতকে ইজতিহাতের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে মিল করা ঠিক নয়। কারণ ইজতিহাদ হচ্ছে ইসলামের বিধি বিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির ব্যবহার। যোগ্যতাসম্পন্য ওলামায়ে কেরাম-ই এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
আগেই বলা হয়েছে, মুসলমানদের আচার ব্যবহারে বহু অনৈসলামিক বিষয় যুক্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হলো।
১. ইসলামে কতিপয় ধর্মীয় উৎসব চালু হয়েছে; যেমন মহানীর (সা.) জন্মদিন (মিলাদ), তাঁর ঊর্ধ্বাকাশে আরোহন (মিরাজ) এবং তাঁর দেশত্যাগ (হিজরত)।
[ **৯ Al-Nawaw`s Froty Hadith. P-40 ]
২. কবর স্থানে লাশ নিয়ে যাবার সময় উচ্চঃস্বরে যিকির করা এবং জোরে কুরআন তেলওয়াত করা।
প্রত্যেক জামাতে নামাজ আদায়ের পর মোসাফাহা করা।
৪. কারো মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষ থেকে খাবার তৈরি করে তা অন্যকে খাওয়ানো। অথচ প্রকৃত ইসলমি আকিদা হলো, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্জনকে খাবার তৈরি করে শোকাহত পরিবারকে খাওয়ানো; কারণ এ সময় তারা শোকে মুহ্যমান থাকে।
৫. কবর বাঁধানো ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করণ।

ইসলামি আদবের মনস্তাত্ত্বিক দিক
ইসলামি আদবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনস্তাত্ত্বিক দিকের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাখা বিধেয়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি দৃষ্টান্তঃ
১. মহিলাদের মাসিকের সময় তালাক দান করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ এ সময় মহিলারা মনস্তাত্ত্বিক চাপে দিন কাটায়।
২. স্বাস্থ্যগত সবিধা ছাড়াও ইসলামে পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পরিচ্ছন্নতার ফলে শরীর ও মন সতেজ থাকে। নামাজের আগে অজু করা, যৌনসঙ্গমের পর গোসল করা, সন্তান প্রসব ও মাসিকের পর গোসল করার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। যারা লাশের গোসল করান তাদেরকেও গোসল করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শের তাৎপর্য হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে গোসল করার ফলে জনগণ মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকে।

ইসলামি আদবের মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যগত দিক
ইসলাম মুসলমানদের সর্বদা পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকার শিক্ষা দিয়ে থাকে। বিশ্বস্ত মেডিক্যোল সূত্রে প্রিমাণিত হয় যে, শরীর, স্থান ও পোশাক পরিচ্ছদের প্রাত্যহিতক পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা শরীরের সুস্থতা রক্ষায় ব্যাপক অবদান রাখে। পরিচ্ছন্ন থাকার ফলে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
মুসলমানদের নামাজের পূ্র্বে প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে প্রত্যহ কয়েকবার অজু করতে হয়। শরীরের যে অংশ ধূলাবালির উন্মুক্ত থাকে জন্য তা-ই প্রধানত ধৌত করতে হয়।
ইসলাম নখ কাটার বিধান এজন্য করেছে যে, হাতের যে অংশের সাহায্যে প্রতিনিয়ত খাবার খাওয়া হয় ও পানি পান করা হয়- এবং করমর্দন করতে হয়- সেগুলোকে ময়লা ও অশুচি থেকে রক্ষা করার জন্যে। বগলের চুল ও গোপনাঙ্গের চুল কাটার বিধান করেছে ইসলাম। এটি সোয়েট গ্লাণ্ডস (Swat Glands) কে কাজ করতে সহায়তা করে এবং সুইট গ্লাণ্ডসের ক্ষতি করতে পারে, এমন সব জীবাণুর বংশবৃদ্ধিতে তা বাধা দেয়। মুসলমানকে তার কাপড় চোপড় ও নিজেকে মলও পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। পেশাবের ইউরিয়া ও অন্যান্য নাইট্রোজেনের যৌগ বিদ্যমান। এগুলো জীবণুর তৎপরতায় এ্যামোনয়িাম রূপান্তরিত হয় এবং ‍দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। মলমূত্র থেকে সংক্রমণের মাধ্যমে Pinworm (oxy uriasis), Viral hepatitis, Scabies এবং Taniasisi-প্রভৃতি রোগ বিস্তার লাভ করে।
মুসলমানদের অতিরিক্ত আহার করা উচিত নয় বরং উদরপূর্তির আগেই আহার বন্ধ করা উচিত- এ ধারণা চিকিৎসাগত, সামাজিক ও নৈতিক কল্যাণ থেকে উৎসারিত। পাকস্থলীতে রয়েছে সম্প্রসারণশীল Receptors , এটি স্ফীত হলে ব্যথা ও অস্বস্তি ও অন্যান্য রোগের সৃষ্টি হতে পারে। পানি পানকালে মুসলমানদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে পাত্রে (বা গ্লাসে) নিঃশ্বাস না ফেলতে; কারণ আভ্যন্তরীণ বাতাসের চাইতে পানিতে বিদ্যমান বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অনেক কম এবং দেহের সঞ্চালন তন্ত্রগুলোতে অধিকহারে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি শরীরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
মুসলমানরা দুধ পানের ফলে যে কল্যাণকর সুবিধা পেয়ে থাকে, তার জন্য খোদার শুকরিয়া প্রকাশ করে থাকে। **১০ দুধ আদর্শ পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে পরিচিত। এতে প্রধানতঃ ভিটামিন-ডি, ক্যালসিয়ামন, ফসফেটসট অনেক ভিটামিন ও খনিজ ছাড়াও পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেটম, চর্বি ও প্রোটিন বিদ্যমান। এগুলোর আভাবে শিশুদের শরীর গঠনে অসুবিধা ও বড়দের রক্তমূন্যতা (Oesteomalacis) দেখা যায়।
ইসলামের বিধান অনুসারে পশু জবাই করার ফলে রক্তমুক্ত গোশত পাওয়া যায়। রক্তে বহু সূক্ষ্ম জীবাণূ বাস করে, যা বহু রোগের উৎস হতে পারে। স্বাস্থগত
[ **১০ মিশকত ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৬৫]
দিক ছাড়াও বহু লোক রক্ত মিশ্রিত গোশত দেখে অথবা গোশতের মধ্যে রক্ত নিঃসৃত হতে দেখে বিরক্ত বা পীড়িত হয়ে পড়ে।
ইসলামে শূকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। শূকর আবর্জনা ও উচ্ছিষ্টসহ যে কোন খাদ্য খেয়ে থাকে। এ ব্যাপারে স্যাকর (Sakr) বলেন, শূকরের দেহে বহু সংখ্যক জীবাণূ, পরজীবি ও ব্যাকটিরিয়া থাকে এবং এই মাংস খাওয়ার পর এসব রোগ মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এসব জীবাণূর মধ্যে রয়েছেঃ ফিতা ক্রিমি, বক্র ক্রিমি, Hookworm, Faciolopsis, Paragonimus, Clonorchis Senesis Erysipelothrix ও Rhusphtahiae. **১১ তিনি আরো বলেন, সর্বাধিক জীবাণুবাহক শূকর হচ্ছে বহু মারাত্মক ও জটিল রোগের উৎস। এর মধ্যে রয়েছে আমাশয়, ফিতা ক্রিমি, বক্র ক্রিমি, হুজওয়ার্ম, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, আন্ত্রিক প্রতিবন্ধক (Intestinal Obstruction). মারাত্মক প্যানক্রিয়াটিটিস (Acute Pancreatits), যকৃতের প্রসারণ (Enlargement), Trichinosos , ডায়রিয়া, শারীরিক দুর্বলতা, মারাত্মক জ্বর- যদ্দরুণ শিশুদের বিকাশ ব্যাহত হয়, টাইফয়েড, অঙ্গহানি, হৃদরোগ, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব এবং আকস্মিক মৃত্যূ ইত্যাদি **১২
ইসলামে মদ্যপান নিষিদ্ধ। এর কিছুটা উপকারী দিক থাকলেও এর ফরে যে মাদকাসক্তির সৃষ্টি হয়, তাতে নৈতিক ও শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তদুপরি অধিক মদ্যপানের ফলে পাস্থলীতে জ্বালা ও পেপটিক আলসার হয়। এর ফলে যকৃতের প্রদাহ, লিভার সিরোসিস এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে যকৃত বিকল হয়ে যায়।
মুসলমানরেদ হাঁচি আটকে রাখা ঠিক নয়, বরং এ জন্য খোদার শোকর করা উচিত। উপরের শ্বাস-প্রশ্বাসের অঞ্চল থেকে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির জ্বালা হতে এর উৎপত্তি এবং এর ফলে জ্বালাতনকারী পদার্থ বের হয়ে যায়। হাঁচি ঠেকিয়ে রাখলে জ্বালাতনকারী পদার্ধ রয়ে যায় এবং প্রদাহের সৃষ্টি করে। তাঁচির সময়
[**১১ A. H. Sakr Possible Reasons for its Prohibition, Published by the Author. 1975, P-15]
[ **১২ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৮]
মুখ ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে করে কোন ব্যক্তির ডপরের শ্বাস প্রশ্বাস অঞ্চলে বিদ্যমান জীবণুর সঞ্চালন রোধ করা যায়।
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য খতনা করা ফরজ এবং পাশ্চাত্য বিশ্বের কোন কোন দেশে মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডেই বর্ধিত হারে খতনা করা হচ্ছে। লিঙ্গের অগ্রত্বক কেটে না ফেলা হলে ময়লা ও জীবাণূ জমতে পারে, ফলে ব্যাক্টিরিয়ার বিকাশ হতে পারে। একারণে নারীদের যৌনাঙ্গে ক্যান্সার সদৃশ পরিবর্তন হতে পারে।
মহিলাদের মাসিকের সময় যৌনসঙ্গম ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে দুটো কারণেঃ
১. মাসিকের সময় গর্ভাশয়ের সংকীর্ণ অংশ উন্মুক্ত হয়ে যায়; ফরে সঙ্গমের দরুণ জরায়ুও ডিম্বনালীতে ব্যাক্টেরিয়া প্রবেরে পথ সুগ হয়। পরিণামে প্রদাহ ও আঠালো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ফলে বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
২. পুরুষ তার যৌনাঙ্গে রক্ত দেখার পর তারও শরীরে নেতিবাচক দৈহিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। িএর ফলে তার স্ত্রীর সঙ্গে যথানিয়মে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে তার মনে বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হতে পারে।
পায়ুপথে সঙ্গমের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কারণ হচ্ছেঃ এটা এক যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া এবং এর ফলে মলত্যাগে ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পুরুষের যৌনাঙ্গ মলসিক্ত হতে পারে, আর এই মল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণূ থাকতে পারে, যার ফলে পুরুষের যৌনাঙ্গ সংক্রমিত হতে পারে।
মাসিকের সময় মহিলাদের যৌন হরমনসমূহ বিঘ্নিত হয়- পরিণামে মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় দেখা যায় এবং তা প্রতিভাত হয় স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও দৌর্বল্যে। মাসিকের সময় মহিলাদের আচরণে যে পরিবর্তন দেখা যায়, তার কারণ এখানেই নিহিত। এজন্য এসময় মেয়েদের নামাজ ও রোজা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
ইসলামি বিধান মোতাবেক মৃতদেহকে শিগগিরই কবর দিতে হয়। এর ফলে যে পচনের ক্ষতির ব্যাপারে মুসলমানরা সজাগ, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় এই বিপদের আশঙ্কা আরো বেশি। কারণ সেখানে লাশ শীতর রাখার সুযোগ সুবিধা নেই।
প্রহরী ও শিকারী কুকুর ছাড়া কুকুর প্রতিপালনের অধিকার মুসলমানদের দেওয়া হয়নি। তবে এসব কুকুরকেও বাড়ির বাইরে রাখতে হবে। কুকুরের মুকের লালায় জলাতঙ্ক রোগের জূবাণূ রয়েছে, যা কুকুরের কামড় অথবা চামড়ায় কোন ঘাযের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। কুকুরের অন্ত্রে এক প্রকার কৃমি (Echinococcus) থাকে, যা কুকুরের মল দ্বারা দূষিত খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। এর ফলে যকৃত এবং ফুসফুসে প্রাথমিকভাবে মলকোষ গড়ে ওঠায় সম্ভাবনা থাকে।

জাতীয় অর্থনীতে ইসলামি আদবের ভূমিকা
সুস্থ অর্থনীতির বিকাশে ইসলামি আদব মেনে চলা অপরিহার্য। বাহুল্য ব্যয় করা ইসলামে নিষিদ্ধ, মিতব্যয়িতা অবলম্বন করা প্রয়োজন; এমনকি সেটিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। শান্তি ও যুদ্ধ-এই উভয়কালেই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যের ধারক হিসেবে অ্থ-তৎক্ষণিক ক্রয়ক্ষমতা এবং বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। **১৩ সার্বিকভাবে জাতির অর্থনৈতিক শক্তি থাকা অপরিহার্য। কোন ব্যক্তি তার ইচ্ছামত যাচ্ছে তাই ভাবে যেকোন পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার অধিকারী নয়। কেননা এর ফলে জাতীয় শক্তির ধ্বংস নেমে আসে। ইসলামি আদব মিতব্যয়িতার জন্য ‍মুসলমানদেরকে ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপ্ত করে। অন্য কথায় বলা যায়, অমিতব্যয়িতা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক ‍মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই; আর শয়তান হচ্ছে আল্লাহর কাছে চির অকৃতজ্ঞ।” **১৪
এখানে ইসলামি জীবনধারার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো। এতে সুস্থ অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যাপারে ইসলাম কতখানি গুরুত্ব দেয়, তা অনুধাবন করা যাবে।
১. পানাহারে মিতব্যয়িতা অবলম্বন করতে হবে। সামান্য পরিমাণ খাদ্যও অপচয় করা যাবে না। অপচয়ের প্রতি নিষেধাজ্ঞার ফলে বিপুল পরিমাণ জাতীয় সম্পদ সাশ্রয় হবে এবং অধিকতর প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের দিকে তা পরিচালনা করা যায়।
[**১৩Encyclopaedia Britannica,, Londob: William Bentou: Vol. 15. 1971, P-701]
[**১৪ The Holy Quran,, M.M. Pickthall অনুদিত [New York:Muslim World League সূরা মায়িদাঃ আয়াত ৩]
২. পোশাক পরিচ্ছদেও মিতাচার প্রয়োজন। পোশাকই যেন উদ্দেশ্যে পরিণত না হয়। সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। পোশাকের ব্যাপারে বিপুল অর্থ ব্যয় করা চলবে না।
৩. আসবাবপত্র ও অন্যান্য গৃহস্থালী সামগ্রী মধ্য মানের মূল্যে কেনা উচিত। বাড়ির আসবাপত্র, তৈজসপত্র বা অন্য কোন সামগ্রীর ক্ষেত্রে স্বর্ণের বা রৌপ্যের ব্যবহার চলবে না। তাছাড়া রেশম বা রেশমি কারুকার্য খচিত পোশাক বা আসবাপত্র ব্যবহার করা যাবে না।
৪. জমকালো ভবন নির্মাণ নির্মাণে অর্থের ব্যয় করা চলবে না। এমনকি মসজিদ নির্মাণেও অমিতব্যয়ী হওয়া চলবে না। উভয় ক্ষেত্রে অলংকারণও পরিহার করতে হবে।
৫. ইসলামি বিধান আদর্শ বিয়ে হয় সবচেয়ে কম খরচে এবং এক্ষেত্রে বাহুল্য ব্যয় হয় না।
৬. দাফন কাজে মিতব্যয়ী হতে হবে। এক্ষেত্রেও অমিত্যব্যয়য়িকা নিষিদ্ধ। বিশেষ বাধ্যকতা বা স্বাস্থগত কারণ ছাড়া কফিন বাক্স ব্যবহার করা চলবে না।
৭. ইসলামে অতিথি আপ্যয়ণের প্রতি বিশে গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাহুল্য ব্যয় করতে নিষেঘধ করা হয়েছে।
৮. শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়ের জন্য একঘন্টা ছাড়া শুক্রবারে কাজ বন্ধ করার কথা ইসলামে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। প্রয়োজনীয় কাজ অব্যাহত রাখতে হবে; কেননা এক দিনেরও জন্যও কাজ বন্ধ রাখা হলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে। শুক্রবার কাজ পরিত্যাগ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়নি; ইসলামে সাবাথ-এর অনুপস্থিত। তবে মুসলমানদের কোন ছুটির দিন হলে তা শনিবার বা রোববার হওয়া উচিত নয়, শুক্রবার হতে হবে।
৯. মুসলমানের ওপর অর্পিত কোন কাজের দক্ষতা ও সম্পূর্ণতা দান করা কর্তব্য বলে ইসলাম বিবেচনা করে। হাদিসে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা রেখেছেন। [আল নববীর ৮০ হাদিস, ৬৪ পৃঃ] কর্মোদ্যোগ ও গুণগত মানের সমন্বয়ে একটি সফল অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব।

বিয়ে, পরিবার ও ইসলামি আদব
পরিবার এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে যা থেকে নতুন বংশধরদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অস্তিত্ব থাকে না। পারিবারিক ব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি সমাজের সার্বিক চরিত্র এবং তা সভ্য না অনগ্রসর- সেটা নির্ধারণ করে। **১৬
বিয়ে এবং পরিবারের গুরুত্ব এত বেশি বলে, কুরআনের বহু আয়াতে এবং বিভিন্ন হাদিসে এ দটো বিষয়ের ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। এসবের মধ্যে সফল বিয়ে এবং নৈতিকভাবে ‍দৃঢ় ও স্থিতিশীল একটি সমাজ গঠনে প্রয়োজনীয় ভিত্তিও বিস্তারিতভাবে পেশ করা হয়েছে।
১. মুসলমানদের যুবক বয়সে বিয়ে করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে নতুন নতুন আত্ময়ি সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মীয় পরিজনের পরিধি বাড়ানো হয়। শিশুকে দুধমাতার মাধ্যমে স্তন্যদানেরও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ এর ফলে নতুন আত্মীয়ের মাধ্যমেও পরিধি বৃদ্ধি পায়। এদের বলা হয় ‘দুধমাতার আত্মীয়।’
২. সহজসাধ্য কর্তব্য হিসেবে মুসলমানদের বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামি বিধান মতে সবচেয়ে আদর্শ বিবাহে বর-কনের ওপর বোঝা কম পড়ে।
৩. ইসলামে বিবাহ উৎসব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কারণ বিয়ে একটি সামাজিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৪. সাধারণবাবে ইসলামে গান গাওয়া নিষেধ হলেও বিয়ের সময় অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
৫. বিয়েতে ভোজের মজলিশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষ উপলক্ষে দাওয়াত গ্রহণ সম্ভব হলে, তা প্রত্যাখ্যান না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
[ **১৬ Sayyid Qutb. Milestones, I.I. F. So. 1977 pp. 183-4 ]
ইসলামে বিবাহ বন্ধন সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মজবুত বন্ধনের ওপর স্থাপিত না হলে বিয়ে সফল হয়না। বিয়ের সাফল্যের জন্য নিম্নোক্ত পরামর্শ দেওয়া হয়েছেঃ
১. বিয়ে করার ব্যাপারে নারী ও পুরুষের পূর্ণ পারস্পরিক সম্মতি।
২. নারী ও পুরুষের একই ধরনের সামাজিক পটভূমি ও সমতা প্রয়োজন। জীবন সম্পর্কে, জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা এবঙ মতপার্থক্য উত্তরণের ব্যাপারে একই ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ প্রয়োজন। ইসলামি আকিদা ও শরিয়তে এগুলোর বিধান রাখা হয়েছে। সুতরাং আদর্শ স্বামী-স্ত্রী হচ্ছে তারা যারা ইসলারেম প্রতি সর্বাধিক অনুগত।
৩. বিয়ের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে ইসলামের পরামর্শ, ইসলাম সম্পর্কে একে অপরের জ্ঞান ও আমলের ব্যাপারে নারী পুরুষকে পর্যাপ্ত জানতে হবে। তাছাড়া একে অপরকে দেখেও নিতে হবে।
৪. ইসলামে অস্থায়ী বা মুতা বিয়ের ধারণার কোন স্থান নেই। ইসলামে ‍শুধু স্থায়ী বিয়েল ধারণাই স্বীকৃত।
৫. বিয়েতে সকল শর্ত পূরণের জন্য চুক্তি সম্পাদনকে ইসলাম সর্বোত্তম কাজ এবং নৈতিকতার সর্বোচ্চ বিকশ হিসেবে উল্লেখ করছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, মুসলমানদের যেসব উল্লেখযোগ্য শর্ত পূরণ করতে হয়, সেগুলো বিযের চুক্তির (কাবিননামা) অন্তর্ভুক্ত। [মিশকাত, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭১।]
৬. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলে তা কারো হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
৭. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে সফল করে তুলতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমঝোতা, সহযোগিত , প্রেম ও ভালবাসার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
ইসলামি আদবের পর্যালোচনা করলে ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। নিম্বোন্ক্ত পন্থায় ইসলামি আদবে স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে:
১. পরস্পরের বিয়ে না হলে পুরুষকে মৃত নারীর লাশ ধৌত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ‍মৃত পুরুষের ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য। ‍মৃত স্ত্রীকে স্বামী কবরে স্থাপন করার অধিকার রাখেন।
২. স্বামী-স্ত্রী ছাড়া রক্তের সম্পর্কের ভাই বোন অথবা পিতামাতা, পুত্র-কন্যা হলেও নারী পুরুষকে একে অন্যের গোপনাঙ্গ দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
৩. মহিলাদের ভাই বা পিতাসহ কোন আত্মীয়দের জন্য তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ নিষিদ্ধ। তবে কোন বিধবা তার মৃত স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক প্রকাশ করতে পারবে।
ইসলামি আদবে পিতা-মাতা ও সন্তানের সম্পর্কে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মহানী (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই বেহেশত মাতার পদতলে।” অপরে প্রতি সদাচরণ যদি শিষ্টাচারের প্রতীক হয়, তাহলে পিতামার ক্ষেত্রে তা করা ফরজ। সপ্তম অধ্যায়ে আলোচিত ‘পিতামাতার প্রতি ছেলেমেয়েদের কর্তব্য’ শিরোনামে ছেলেমেয়েদের প্রতি বিরাট দায়িথ্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু পিতামাতও ছেলেমেয়ের মধ্যেই মজবুত আত্মীয়তা, স্নেহ-ভালবাসা ও দায়িত্ব সীমিত থাকা উচিত নয়, তা সকল আত্মীয়ের বেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রথমতঃ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতে হবে; যাতে করে তাদের অবহেলা করা হচ্ছে বলে তারা অনুভব করতে না পারে। দ্বিতীয়তঃ আর্থিকভাবে যারা অধিকতার স্বচ্ছল, তাদের উচিত দুঃস্থ আত্মীয়দের সাহায্য করা। কোন মুসলমান ঋণী অবস্থায় মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনদের যত তাড়াতাড়ি হোক সে ঋণ পরিশোধ করা উচিত।
মা ছাড়া দাই এর সাহায্যে শিশুর দুধ পানের ব্যবস্থা করা হলে, আত্মীয়দের পরিধি বেড়ে যায়। এটাকে পারস্পরিক দায়িত্ব হিসেবে স্বাগত ও স্বীকৃতি জানানো উচিত।
ইসলামি আদবে পারিবারিক চেতনা ও দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; কারণ পরিবার হচ্ছে সার্বিক মানবিক অনুভূতির প্রাথমিক ভিত। সুতরাং সুস্থ ও সুস্থিত সমাজের উত্তম ভিত হচ্ছে সুস্থ ও স্থিতিশীল পারিবারিক জীবন।

ইসলামে যৌনাচরণ বিধি
আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির অংশ হিসেবে ইসলাম যৌনতার স্বীকৃতি দেয়। তার সৃষ্ট সব কিছুই তার বিধান মোতাবেক আচরণ করলে খারাপ বা ভুল হতে পারে না।
সন্তেহ নেই, ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং সার্বিকভাবে সমাজের এক অপরিহার্য বিষয় যৌনতার বিকাশ নিবিড়ভাবে গড়ে উঠে। যৌনজীবনে বঞ্চনার ফলে অপরিচ্ছন্ন থাকলে মানসিক স্বাস্থ্যে বিপন্ন হয়, সুসম্পর্ক ব্যাহত হয় এবং সমাজে দক্ষতার অভাব ঘটে। বিবাহের মাধ্যমে যৌন জীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত না করলে যৌনপ্রবৃত্তি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। এটা তখন ব্যক্তি, বিয়ে ও পারিবারিক প্রথা এবং সার্বিকভাবে সমাজের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে কাজ করবে। মূলতঃ যৌনতা ব্যক্তিকে তার বেপরোয়া পরিণতি থেকে রক্ষ করতে পারে; অপরদিকে এর বেপরোয়া গতি সমাজ জীবন যে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল তা বিপন্ন করতেপারে। **১৮
সুতরাং যৌনাচারকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটা অবশ্য কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়; সমাজে যে সব উপায়-উপকরণের সাহায্যে ব্যক্তির যৌন আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তাদের সহযোগিতা ছাড়া এটা অসম্ভব মনে হতে পারে। নিম্নোক্ত আচরণবিধি অনুসরণের মাধ্যমে ইসলাম এই সমস্যার সমাধান পেশ করেছেঃ
১. সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বিবাহকে সহজ করতে হবে এবং বিবাহের সময় হওয়ার সাথে সাথেই বিয়ে করার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
২. বিবাহ-বহির্ভূত যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার ব্যাপারে যে সকল কারণ উত্তেজনা সৃষ্টি করে তা বন্ধ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ইসলামি আদব গুরুত্বপূর্ণ:
ক। মহিলাদের শরীর এমন যে, তা দৃষ্টে পুরুষদের মধ্যে যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এজন্য ইসলাম সবসময় নগ্নতা এবং নারীর সম্ভ্রমহানির সব রকম পথ নিষিদ্ধ করেছে। পুরুষদের দৃষ্টি থেকে নারীদের রক্ষা এবং তাদের সৌন্দর্যকে পুরুষদের সামনে প্রকাশ না করার জন্য মুখমণ্ডল ও হাত
[ **১৮ G.P. Murdock. Social Structure (New Yourk: Macmillan & co. 1949G, P. 260]
ছাড়া সমগ্র দেহ ঢেকে রাখার লক্ষ্যে ইসলাম এক ধরনের পোশাক নির্ধারণ করে দিয়েছে। সন্দেহ নেই, পোশাক আন্তঃব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি জানিয়ে দেয়, এর মধ্যে যৌন আকর্ষণ অন্যতম।
খ) নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন করে দিতে চায়, যেন যৌন উত্তেজনা হ্রাস পায়।
গ) মুসলিম মহিলাদের গৃহের বাইরে প্রসাধনী সামগ্রী দিয় মুখমণ্ডল সুশোভিত করা অথবা সগন্ধী ব্যবহার করে ভিন্ন পুরুষের সংযম বিপন্ন করা উচিত নয়। এ ধরনের প্রসাধনীর ব্যবহার বাড়িতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তা স্বামীর সামনেই করা যাবে।
ঘ) পুরুষদের ব্যবহৃত প্রকাশ্য গোসলখানায় মহিলাদের গোসল করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ঙ) স্বামী অথবা মহরম পুরুষ (যার সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ) ছাড়া অন্য কোন লোকের সাথে কোন নারী কথা বলার সময় বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয় হবেনা বরং তা বস্তুনিষ্ঠ ও সংক্ষিপ্ত হবে।
চ) পুরুষদের পোশাক ও ব্যক্তিগত আচরণ শোভন হওয়া প্রয়োজন। তবে কোন মুসলমান যদি কোন মহিলর প্রতি তাকিয়ে ফেলে, তাহলে সে তার চক্ষু ফিরিয়ে নেবে, দ্বিতীয়বার তাকানো নিষিদ্ধ।
ছ) ইসলামি আদবে যৌন সম্পর্কে গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বামী-স্ত্রী উভয়কে একে অপরে রহমতস্বরূপ ও পরস্পরের ভূষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের যৌন জীবন নিয়ে অন্যদের তামাশা করা নিষিধ্ধ করা হয়েছে।
যৌন আচরণ সম্পর্কিত উল্লিখিত বিধিসমূহ এবং অন্যান্য বিষয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ বিবাহের আওতায় নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক থাকা সুবিধা লাভ এবং বিবাহের উপযোগিতা থেকে সমাজের ফায়দা লাভ ও পারিবারিক সম্পর্ক নিশ্চিত করা।

ইসলামি আদব এবং নারীর মর্যাদা
ইউরেপ যখন তমসাচ্ছন্ন যুগে নিমজ্জিত ছিল, তখন নারীর আত্মার প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক হোত আত্মা মানবিক কি-না। ইসলাম তার পূর্বেই নারী ও পুরুষকে একই উৎস থেকে আসার কথা জানিয়েছে এবং খোদা ও সমাজের কাছে তারা উভয়ে সমানাধিকার সম্পন্ন এবং ভাল ও মন্দ কাজের জন্য পুরষ্কার ও শাস্তির ঘোষণা শুনে ছে। ইসলামি আইন নারী ও পুরুষের জন্য সমান। ইসলামে নারীর অধিকার রয়েছে সম্পত্তি সংরক্ষণের এবং তা আবাদ করার অধিকার রয়েছে। **১৯ যদিও নারীর প্রকৃত কেত্র হচ্ছে মৃতৃত্ব, মানব বংশের লালন-পালন এবং নিজ বাড়িতে হেফাজত, তথাপি ক্রয়-বিক্রয়, ধার দেওয়া ও নেওয়া, বিনিয়োগ করা- ইত্যাদি আর্থিক লেনদেন করা থেকে তাকে বিরত রাখা হয়নি। ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবে নারীদেরকে এ ধরনের কর্ম সম্পাদনে পুরোপুরি ক্ষমাসম্পন্ন এবং আইননানুগভাবে উপযুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে।
মদ্যপান, ব্যভিচারী, খোদাদ্রোহীতা অথবা হত্যার মত যে কোনো অপরাধের জন্য ইসলামি আইনে শাস্তির ব্যাপারে নারী ও পুরুষের কোন পার্থক্য করা হয়নি।
ইসলামে মহিলাদের তাদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার এবং বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অধিকার দিয়েছে। ইসলামি বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে মুসলিম নারীদের সমাকালীন অবস্থা থেকে ইসলামে নারীর ধারণা ও অবস্থানকে প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করা অথবা যুক্তিতর্ক পেশ করা সঠিক হবেনা। এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভুল ধারণা দূর করবেঃ
১. পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণের সুসংবাদের মতই কন্যা সন্তানের জন্মকে স্বাগত জানাতে হবে। পুত্র সন্তানের জন্ম হলে শুভেচ্ছা জানানো এবং কন্যা সন্তানের জন্ম হলে মুখ গোমরা করে থাকা ইসলামি শিক্ষার বিরোধী। ইসলাম কন্যা সন্তানদের বিশেষ যত্ন নেয়ার তাগিদ দিয়েছে।
২. নবী করিম (সা.) নারীদের সহিত ভদ্রতা ও শ্রদ্ধার সাথে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাদেরকে নিকৃষ্ট না ভেবে সমানরূপে গণ্য করতে হবে।
৩. মহিলাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
[ **১৯ Qub. Islam The Misumderstood Religion. Damascus: The Holy Quran Publishing House. 1977. P-97]
ইসলামের বিবাহ প্রথায় একজন অভিভাবক থাকার অর্থ এ নয় যে, বিবাহের ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আছে। নারীর এককভাবে অধিকার রয়েছে কোন চাপমুক্ত থেকে বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কারার। যদি কোন মেয়েকে তার সম্মতি ছাড়া বাগদান করা হয়, তাহলে এই বাগদান সে অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখে।
৪. মা হিসেবে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত সম্মানজনক। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, মহানবীর (সা.) উক্তি. ‘বেহেস্ত মাতাদের পদতলে।’ কোনো মুসলমান সর্বাধিক শ্রদ্ধা করবে তার মাকে। পিতার চাইতে মাতার মর্যাদা সন্তানের কাছে তুলনামূলকভাবে বেশি।
৫. একজন বিবাহিত মহিলা তার পারিবারিক নাম বহাল রাখতে পারে এবং তার স্বামীর পক্ষে তা পরিত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটাও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শামিল।
৬. যৌনতার নিদর্শনগুলো আড়াল করার জন্য ইসলাম কতিপয় আদব লেহাজ প্রবর্তন করেছেঃ পুরুষ কর্তৃক মহিলাদের পোশাক ও চলাফেরার ঢং নকল করা নিষেদ্ধ।
৭. মহিলাদের কর্মকাণ্ড ইসলামি শিক্ষার বিরোধী না হওয়া পর্যন্ত ইসলামে মহিলাদের ব্যক্তিত্ব সংরক্ষণ এবং বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্বামীকে অনুমতি দেওয়া হয়নি স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব বিনাশ করে তার সাথে মিশিয়ে ফেলার।
৮. মহিলাদের মাসিকের সময় সহৃদয় ও নম্র আচরণ করতে হবে। স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনক্রমে ভালবাসতে না পারে, তাহলে ঐ স্ত্রী তাকে তালাক দিতে পারে।
৯. উত্তম স্ত্রীকে বিশ্বে সর্বোত্তম সম্পদ হিসেবে ইসলাম গণ্য করেছে। বিবাহিত জীবনের স্ত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসার পরিচালনা এবং টাকা কড়ির নিয়ন্ত্রণ করা তার দায়িত্ব।
১০. ইসলাম চায় মুসলিম মহিলারা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় মেনে চলুক এবং পোশাক পরিচ্ছদ, জুতা পরিধান, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অমুসলিম মহিলাদের অনুকরণ না করুক। এ ধরনের অনুকরণ দুর্বলতার প্রতীক।
১১. ইসলামি সমাজে মহিলাদের পোশাকের কতিপয় উদ্দেশ্য রয়েছে। এর মধ্যে তার সম্মান ও মর্যাদার সংরক্ষণ অন্যতম। নারী ও পুরুষের পোশাকের পার্থক্যের কারণ হচ্ছে পুরুষ ও নারীর আকৃতির ভিন্নতা। একই কারণে কোন মহিলার উচিত নয় তার স্বামী বা কোন মহরম (যার সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ) পুরুষ ছাড়া ভ্রমণ করা।

ইসলামি আদব ও শৃঙ্খলা
ব্যক্তির আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং ‍যুক্তির প্রতি সাড়া দেওয়ার লক্ষ্যে ইসলামি আদব কায়দা মানুষকে সুসভ্য ও শিক্ষিত করে তোলে। এর ফলে ধৈর্যধারণ, আত্মন্তুষ্টি ও স্বনির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়; অপরিহার্য না হলে অন্যের সহযোগিতা না চাওয়ার ব্যাপারে ইসলাম শিক্ষা দিয়ে থাকে।
ইসলামের অন্যতম প্রশংসিত গুণ হচ্ছে মানুষের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ এবং তীব্রতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করা। মহানবীর (সা.) ভাষায়, সবচেয়ে ক্ষমাশালী ব্যক্তি সেই, যে ক্রোধ সংবরণ করতে পারে। উত্তম মুসলমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিয়মানুবর্তিতা ও আত্ম-শৃঙ্খলা। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেয় এবং রমযান মাস আত্মসযম শিক্ষা দেয়।
শৃংখলার সুফল হচ্ছেঃ (ক) মিতাচার ও (খ) সময়ের সদ্ব্যবহার। মিতাচার বা সংযম ইসলামি আদবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর ফলে একটি সুষম ও ভারসম্যপূর্ণ জীবনের সৃষ্টি হয়। মানুষের সেবার জন্য এটা প্রয়োজন (কারণ যে ব্যক্তি অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট অথবা মেকি আচরণে অভ্যস্ত, সে কেমন করে এর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে অন্যের সেবা করবে?) এবং আল্লাহর আদেশ মেনে চলতেও এটা প্রয়োজন। সময় হচ্ছে জীবনের মূল্য মূল্যায়নের একটি মানবিক মাপকাঠি। কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি করা হবে তা হচ্ছেঃ সময়কে সে কিভাবে কাজে লাগিয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছেঃ প্রতিটি মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করা এবং প্রতিটি শস্যকণার হিসাব রাখা। এটা করতে হবে তার নিজের স্বার্থের এবং সমগ্র জাতির স্বার্থে।
উল্লিখিত নীতির সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখে ইসলামি আদব প্রণীত হয়েছে। নীচে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হলোঃ+
১. মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় সূর্যোদয়ের আগে সুবহে সাদেক থেকে এবং শেষ হয় এশার নামাজের পরপরই অর্থাৎ সূর্যাস্তের প্রায় দেড় ঘন্টা পর।
২. নিছক সময় ক্ষেপণের জন্র মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে; অবশ্য মুসলমানদেরকে একে অন্যের সঙ্গে অহরহ দেখা সাক্ষাৎ করার দাগিত দেওয়া হলেও তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপ করার মাধ্যমেই দেখা সাক্ষাৎকে ফলপ্রসূ করতে হবে।
৩. খাওয়ার সময় অহেতুক দীর্ঘ সময় ব্যয় করা অনুচিত।
৪. কথাবার্তায় সংযম প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলা অথবা বলার খাতিরেই কথা বলার বদ অভ্যাস সময়ের অপচয় মাত্র। চুপ থাকা বাঞ্ছনীয়।

মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন
উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসলাম ব্যক্তির নিরাপত্তার প্রশ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নীচে কতিপয় পরিচিত আদবের বিবরণ দেয়া হলো। এই লক্ষ্যে অর্জনে যে কোন আচরণের সহায়ক অথচ ইসলামি নীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়, এমন বিষয় ইসলামি আদবের অংশ। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুপারিশ করা হচ্ছেঃ
১. ঘুমাবার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, দরজা-জানালা বন্ধ করা হয়েছে, খাবার বস্তু ও পানির পাত্র ঢাকা এবং আগুনের সব উৎস বন্ধ করা হয়েছে।
২. যে বাড়ির ছাদে পরিস্থিতিতেও কাউকে পাওয়া যায়না, এমন স্থানে ঘুমানো উচিত নয়। তাছাড়া বালিশ, লেপ-তোশক পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, সেখানে কোন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ লুক্কায়িত আছে কি-না।
৩. পাত্র থেকে পানি পান করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে ঐ পাত্রে ক্ষতিকর কোন কিছু পড়েনি।
৪. একা একা নয়, বরং যতদূর সম্ভব দলবদ্ধভাবে সফর করা উচিত। যাবনাহন এমনভাবে পার্ক করা যাবে না, যাতে অন্যের অসুবিধা বা বিপদের কারণ হয়।
৫. জুতো পরার আগে পরীক্ষা করা দরকার, রাতে অথবা অব্যবাহর কালে কোন ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ সেখানে লুক্কায়িত রয়েছে কি-না।
৬. কতিপয় প্রাণী যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর- ক্ষতিকর বিধায় মেনে ফেলতে হবে।

মুসলমানদের ঐক্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণে ইসলামি আদব
ইসলামি আদবের অন্যতম সাফল্য হচ্ছেঃ বিভিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্ত, ভিন্ন ভাষাভাষী এবং বিশ্বের বিভিন্নাঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিম জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠা। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গৃহীত ইসলামি আদব লেহাজের ধর্মীয় প্রকৃতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এজন্য পাকিস্তান সফরকারী একজন মরোক্কোবাসী সেখানকার জনগণের আচরণ বুঝতে অসুবিধায় পড়েনা, অথবা বিদেশ বিভূই বলেও মনে হয়না। মিশরের মুসলিম মহিলারা ইসলামি পোশাক পরিহিতা তুর্কি মহিলাদের দেখে বিস্মিত হয় না। ইসলামি সমাজের সস্যরা প্রতিদিন বিভিন্ন উপলক্ষে তাদের সংহতি প্রকাশ করে জানিয়ে দেয় যে, তারা যেসব পন্থায় কাজ করে, তা তাদের ঐতিহ্যের অংশ। ইসলামি আদব মুসলমানদের মধ্যে অভিন্ন সমঝোতা গড়ে তোলে; গঠন করে একটি সার্বজনীন সংস্কৃতি। স্থানীয় সংস্কৃতি এক ইসলামি সম্প্রদায় থেকে অপর সম্প্রায়ে ভিন্ন হতে পারে। নামাজ পড়া ও শুভেচ্ছা জানানো, প্রধান প্রধান ‍উৎসব, পানাহারে বিধি নিষেধ (যেমন মদ্য পান) হালাল ও হারাম ও হারাম মেনে চলা- প্রভৃতি সার্বজনীন ইসলামি ঐক্যের উপকরণ। প্রতিটি অঞ্চলে মুসলিম শালীন পোশাক পরিধান করে এবং বেশির ভাগ মুসলিম দেশে যথাযথ ইসলামি পোশাক পরে। স্থানীয় বৈচিত্র্যধর্মী সংস্কৃতি (যেমন খাবারের ক্ষেত্রে পাক-ভারত উপমাহাদেশে জনপ্রিয় বিরিয়ানী অথবা পোশাকের ক্ষেত্রে ভারতে মুসলিম নারীদের মধ্যে চালূ শাড়ী) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণঃ এর ফলে এক অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের পার্থক্য বুঝা যায়। কুরআনের ভাষায় আমারেদ বিভিন্ন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে আমরা একে অপরকে চিনতে পারি। এসব বিষয় বিশেষ কোন এলকার মুসলমানদের চরিত্র ও পরিচয় মুছে দেয়না। ইসলামি আদবের একটি গুরুত্বপুর্ণ বিধান হচ্ছেঃ অমুসলমানদের আচার আচরণের অনুকরণে নিষেধাজ্ঞা পালন। এর সাথে অবশ্য হস্তশিল্প, প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞানান্বেষণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। ইসলামি জ্ঞানান্বেষণকে সবসময় উৎসাহিত করে এসেছে। সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ব্যাপারে আচর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা সুস্পষ্ট যে, মুসলিম জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আচার আচরণ তাদের নিজস্ব ইসলঅমি চরিত্র দ্বারাই পার্তক্য করা যেতে পারে।
মুসলমানদের জীবনে অমুসলমানদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের অর্থ এ নয় যে, ইসলামি সত্তা মুছে গেল। এর কারণ হচ্ছে ইসলামি জীবনব্যবস্থা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে, মুসলমানরা সহজেই তা থেকে ছাড়া পেতে পারেনা এবং এটা গভীরভাবে প্রোথিত হওয়ার কারণ হচ্ছে এটা ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ের দাবি অনুযায়ী কোন অস্থায়ী উদ্ভাবনা নয়- বরং মানুষে মানুষে, মানুষ ও খোদার মধ্যে মানবিক সম্পর্কের অপরিবর্তনীয় বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আন্তঃসম্পর্কিত আচরণ ও আদর্শের স্থিতিশীল কাঠামো।
কেই এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করলে, সোভিয়েত ইউনিয়নে খৃস্টবাদ ও ইসলামের বিভিন্ন পর্যয় পর্যালোচনা করে দেখুন। উভয় ধর্মই রুশ কম্যুনিজমের আদর্শ কর্তৃক সমভাবে ঘৃণিত ও নির্যাতিত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনৈক্য সত্ত্বেও সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের সাথে পূর্বের সোভিয়েত অঞ্চলের মুসলমানদের সাংস্কৃতিক মিল ও ইসলামি ঐক্য একটি প্রমাণিত বাস্তবতা।

মুসলমানদের আচার ও প্রথার ব্যাপারে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি
মুসলিম ভূখণ্ডে বসবাসরত অমুসলিমদের প্রতি মুসলমানদের প্রদর্শিত সহিষ্ণুতা তুলানাহীন। ইসলামি রাষ্ট্রের আওতায় প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ হতে হবে স্বাধীন ইচ্ছা ও আস্থার মাধ্যমে।
ইসলামে প্রত্যেক অমুসলমানের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মান পুরোপুরি সংরক্ষিত। তদুপরিত ইসলাম তার অমুসলিম নাগরিকদের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা ও সীমিত বিচার সংক্রান্ত কর্তৃত্ব দিয়েছে। অমুসলমোনদের রয়েছে নিম্নোক্ত অধিকারসমূহঃ
১. বিশ্বাস ও ধর্মীয় উপাসনার পূর্ণ স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার স্বাধীনতা।
২. ইসলাম বিরোধী হলেও বিবাহ ও তালাকের বিধিসহ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন।
২. অর্থনৈতিক লেনদেন এবং বেসামরিক ক্ষেত্রে মুসলিম নাগরিকদের ন্যায় তাদের সাথে অভিন্ন আচরণ করা হবে। তবে মদ্যাপানের ন্যায় কয়েকটি বিশেষ বিষয় এর বাইরে থাকবে। প্রকাশ্যে মদ্যপান না করা হলে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে না।
৪. সামাজিক প্রথার ব্যাপারে অমুসলিমগণ তাদের স্বতন্ত্র চরিত্র সংরক্ষণে পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। এক্ষেত্রে পোশাকের ধরন (যদি তা ইসলামি আইনের বিরোধী না হয়), খাবার পদ্ধতি ও খাদ্য প্রকরণের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়।
অমুসলিমদের ওপর নিজস্ব ‘আদব’ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ইসলামের অসম্মাতি, ধর্মীয় বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়েছে।
অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারে মুসলমানদের ওপর কতিপয় বিধি নিষেধ রয়েছে। এসব বিধি নিষেধের নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে।–
অমুসলমোনদের ধর্মীয় উৎসব মুসিলম ধর্মবিশ্বাসের কোন অংশ নয়, যদিও ইসলামের শিক্ষা হচ্ছেঃ তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা না দেওয়া। এজন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত নয়।
ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন তো দূরের কথা, এসব বিধি নিষেদ সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে ভারসাম্য প্রকাশ করে এবং মুসলমানদের ঈমান, কর্মকাণ্ড ও আদবের স্বাতন্ত্র্য ও স্থিতিশীলতা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
অমুসলিম দেশসমূহে অথবা অমুসলিম কর্তৃপক্ষের অধীনে মুসলমানদের প্রতি যে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের সহিষ্ণুতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের পর খৃস্টানদের ধর্ম বিচার সভা (Courts of the Ibquisition) যে সব মুসলমান ধর্ম পরিত্যাগ করতে এবং খৃস্টান হতে অসম্মতি জানিয়েছিল, তাদের সকলকে পুড়িয়ে হত্যা করে। ‍মুসলানদেরকে বাধ্য করা হয় তাদের নাম, পোশাক, রীতিনীতি পরিবর্তন করতে এবং খৃস্টানদের ন্যায় আচরণ করতে।
ইতিহাস থেকে এ প্রসঙ্গে ইহুদিদের উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। খৃস্টনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের পোশাক, নামধাম ও প্রথা পরিবর্তন করে খৃস্টানদের অনুসারী হতে বাধ্য করা হয়। অথচ মুসলিম বিশ্বে তাদের সাথে আচণ করা হয় অনন্য সহিষ্ণুতার সঙ্গে। ইহুদিদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা ও প্রথা মেনে চলার অনুমতি দেওয়া হয়। স্পেনে মুসলিম শাসনকালে ইহুদি সাহিত্যের স্বর্ণযুগ সৃষ্টি হয়। মুসলমানরা স্পেনে ছেড়ে গেলে ইহুদিদেরও খৃস্টানদের অনুসারী হতে বাধ্য করা হয়।
আচরণে এই পার্থক্যের প্রমাণ আজো দেখতে পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বে যেসব ইহুদি বাস করতো তারা এখন সেখানে থাকুক বা ইরাইলে হিজরত করুক, তাদের ইহুদি নাম রয়ে গেছে। অথচ যারা পাশ্চাত্য বিশ্বে বাস করেছে অথবা এখনও বাস করছে তাদের রুশ, ইংরেজি, জার্মান বা ফরাসি নাম রয়েছে।

ইসলামি আচরণের প্রধান প্রধান বিধির পর্যালোচনা
ইসলামি দিবসের এমন একটি ‍প্রকৃতি রয়েছে, যা অমুসলিম দেশসমূহের দিবসে যেভাবে দেখা হয় ও পালন করা হয়, তা থেকে আশ্চর্যজনকরূপে পৃথক। দিবসের সূচনা হয় খুব ভোরে (ফজরের নামাজের পর) এবং শেষ হয় রাতের এশার নামাজের পর। ইসলামি পঞ্জিকাবর্ষ চান্দ্র মাস নির্ধরিত চাঁদ অনুসার হওয়ার ফলে, মাসগুলো বছরের চক্রাকারে ঘোরে। মুসলমানদের কাছে সময় অত্যন্ত মূল্যবান এবং তাদেরকে দূরদর্শিতার সঙ্গে প্রতিদিন ছক কেটে চলতে হয়। দৈনন্দিন সমস্যা ও ‍অসুবিধা এক পাশে রেখে পাঁচবার নির্ধারিত সময়ে নামায পড়তে হয়। নামায পড়ার মাধ্যমে এসব সমস্যার জটিলতা হ্রাস ও তা যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাপিত হয়। তবে যেহেতু এর প্রেক্ষিতে হচ্ছেঃ ইসলাম, সেজন্য দিবস জুড়ে তার বাস্তবায়ন হয়। ঘুম থেকে জাগার পর থেকেই ইসলাম মুসলমানদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে এবং তা অব্যাহত থাকে রাতে অবসর নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অবশ্য এই প্রভাব বলয়ের মাত্রায় কমবেশি হয়ে থাকে। এই বিভিন্নতাকে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ
১. কোন্‌ কোন্‌ বিষয়ের অনুমতি রয়েছে- অধিকাংশ কাজ এই শ্রেণীতে পড়ে।
২. কোন্‌ বিষয়ে ‍সুপারিশ করা হয়েছে।
৩. কোন্‌ বিষয়ে অনুমোদান নেই বা বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
৪, কোন্‌টি বাধ্যতামূলক।
৫. কোন্‌টি নিষিদ্ধ।
মজার কথা এই যে, মানুষের কর্মকাণ্ডের অত্যন্ত ক্ষুদ্রাংশ বাধ্যতামূলক ও নিষিদ্ধের শ্রেণীতৈ পড়ে। এই পাঁচ শ্রেণীর বিভিক্তি রেখা নমনী। এক ধরনের শর্তে যা নিষিদ্ধ, তা অন্য ব্যতিক্রমা শর্তাধীনে অনুমোদিত, এমনকি বাধ্যতামূলক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মুসলানদের শূকর খাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি কো মুসলিম অনাহারের সম্মুখীন হয় এবং শূকরের মাংস ছাড়া জীবন বাঁচানোর কোন পথ না থাকে, তাহলে তার জন্য এই মাংস খাওয়া বৈধ।
মুসলমানদের আচরণ যেসব বিধি দিয়ে পরিচালিত, সেগুলো নিছক স্বেচ্ছাচারী নির্দেশে তাড়িত নয়। সেগুলো পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর থেকে উৎসারিত। এগুলো মানুষের প্রতি আল্লাহর রহমতস্বরূপ এসেছে। কোন মুসলিম তার নিজস্ব অবস্থান অথবা বাইরের চাপে উদ্ভূত পরস্থিতির কারণে, অনিবার্য ও বাধ্য হয়ে, যদি ইসলামি বিধান লংঘন করে, তাহলে তাকে পাকড়াও করা হবেনা।
বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ইসলামি বিধি বিধান পালন সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক নয়। তার পরেও ইসলামি পরিবেশে শিশুদের গড়ে ওঠার এবং পরে যাতে ইসলামি বিধান পালন করতে পারে, তার সুযোগ ‍সৃষ্টি করার জন্য তাগিত দেওয়অ হয়েছে।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামি আচার আচরণ যেসব বিধি ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পরিচালিত তার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপঃ
১. প্রত্যেক ব্যাপারে বিচার বিবেচনা বরা (তাড়াহুড়া না করা) প্রয়োজন।
২. অন্যের সাথে আচার ব্যবহারে প্রত্যেক মুসলমানকে ভদ্র ও সহৃদয় হতে হবে।
৩. মুসলিম জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হবেঃ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা; শরীর, স্থান ও পোশাকের পবিত্রতা।
৪. সৌন্দর্যশীলতা, রুচিশীলতা এবং শৃংখা মুসলিম জীবনের জন্য মূল্যবান এবং যতদূল সম্ভব এসব গুণ অর্জন করতে হবে।
৫. ইসলামের মতে, সৌজন্যের সাথে কোন সৎ কাজ করলে সেটা আরো সৌন্দর্যময় হয়। অপরদিকে ধৃষ্টতা কোন কাজের ভাল দিক ধ্বংস করে।
৬. প্রত্যেক মুসলমানের কাজে বিনয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, ঔদ্ধত্যের নয়।
৭. কোন মুসলমানের এমন কাজ করা উচিত নয়, যার ফলে তার নিজের অথবা অন্যের শারীরিক, মানসিক বা নৈতিক ক্ষতি হয়।
৮. মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে অহেতুক কথা বলার চেয়ে নীলবতা অবলম্বন করাই শ্রেয়।
৯. অপরের কাছ যেরূপ আচরণ প্রত্যাশা করা হয়, অন্যদের সাথে সেরূপ ব্যবহার করতে হবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করা হয়, পরের জন্য তাই করতে হবে। অন্যের সঙ্গে বিচার বিবেচনা ছাড়া সদাচরণ সম্ভবনয়।
১০. কোন মুসলমান নিজে যা করতে পছন্দ করে না, তা করতে অন্যকে আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারেনা।
১১. কোনকিছু গ্রহণ, দান, করমর্দন, খাবার, পানি পান ও হাঁটা প্রবৃতি কাজে ডান হাত এং পায়খানায় গিয়ে বাম হাত ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
১২. খাবার গ্রহণ, পানি পান এবং পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে অহংকার বা ঔদ্ধত্য না থাকলে তা অনুমোদিত। বাহুল্য ব্যয়কে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
১৩. অমিতব্যয়িতাকে ঘৃণা করা হলেও এর অর্থ এ নয় যে, কোন মুসলমান জীবন উপভোগ করতে পারবে না অথবা তার অর্থ বা সম্পত্তি থাকবে না। তার ওপর আল্লাহর রহমতের নিশানা থাকা প্রয়োজন।
১৪. উদার হওয়া এবং কৃপণ না হওয়া একটি গুণ।
১৫. মুসলমানদের জীবন খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তার কোনরূপ কষ্ট থাকুক বা না থাকুক। ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাথে ‍কৃতজ্ঞ হতে হবে।
১৬. প্রত্যেক মুসলমানকে সব সময় আস্তিক হতে হবে।
১৭. জীবনের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানকে হতে হবে সংযমী ও স্বাভাবিক। ইসলামে অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কোন স্থান নেই।
১৮. মুসলমানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে এবং শুধু জরুরি প্রয়োজনের সময়েই অন্য মুসলমানের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
১৯. ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিক অনুরকরণ বা নকল করা নিষিদ্ধ।
২০. আনুগত্য এবং অপরের আদেশ বা ইচ্ছার বাস্তবায়ন ইসলামি শিক্ষার বিরোধী নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিত হবে।
২১. পোশাক-পরিচ্ছদ, হাঁটা-চলা ইত্যাদি নারী কর্তৃক পুরুষ অথবা পুরুষ কর্তৃক নারীর বেশ ধরা নিষিদ্ধ। লিঙ্গগত চিহ্ন বজায় রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
২২. ইসলামি আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছেঃ শৃঙ্খলার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ভারসাম্য ও সমন্বয় করা।
২৩. ইসলামি আদবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ নমনীয়তা ও সহিষ্ণুতা। ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে, কোন বিশেষ ধরনের আচরণ সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি তা মার্জিত (অন্যের প্রতি বিবেচনা প্রসূত) এবং শ্রদ্ধাপূর্ণ (ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি নির্বিরোধ) হয়। এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছেঃ এই আচরণ হারাম বা নিষিদ্ধ শ্রেণীতে পড়বে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি