লেখকের কৈফিয়ত
১৪০১ হিজরীর রমজান ও শাওয়াল মাসে (১৯৮১ খৃঃ) মুসলিম তরুণদের পুনর্জাগরণ সম্পর্কিত আমার দু’টি প্রবন্ধ ‘আল-উম্মাহ’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আমি এই জাগরণের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকের ওপর আলোকপাত করি। এটি এখন ব্যাপকভাবে মুসলিম পর্যবেক্ষক, ধর্মপ্রচারক, সুধীজনের বিবেচ্য বিষয়। আমি ঐ প্রবন্ধে মুসলিম তরুণদের পুনর্জাগরণের জোয়ারকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে তাদের সাথে পিতৃসুলভ মনোভাব নিয়ে আলাপ-আলোচনা পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমার মতামত মুসলিম বিশ্বে এমন ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় যে, আমার লেখাগুলো কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়। অনেক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমার প্রবন্ধগুলো গুরুত্বের সাথে পাঠ করে, যদিও এতে আমি তাদের অনেকেরই সমালোচনা করেছি।

আমি আনন্দের সাথে এখানে উল্লেখ করছি যে, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইসলামী সংস্থা ১৯৮১ সালে তাদের গ্রীষ্মকালীন শিবিরে আমার মতামতগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে। তারা ঐ লেখাগুলো ছাপিয়ে প্রকাশ করে এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করে। এতে তাদের প্রশংসনীয় সচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়; সেই সাথে মধ্যপন্থার প্রতি তাদের সমর্থনসূচক মনোভাবের প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আমি এখানে সাম্প্রতিক মুসলিম তরুণ ও ক্ষমাতাসীনদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টিকারী ঘটনা প্রবাহের ওপর আলোচনায় লিপ্ত হতে চাই না। এই আশঙ্কায় নয় যে, আমার আলোচনা উত্তেজনা প্রসারের কারণ হবে, বরং ‘‌আল-উম্মাহ’ ম্যাগাজিনের অবস্থানগত দিক বিবেচনা করেই আমাকে এই নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে। কারণ, এই পত্রিকাটি বিশেষ একটি গ্রুপের নয়, বরং সমগ্র উম্মাহর স্বার্থ সমুন্নত করার মহান দায়িত্বে নিয়োজিত। আমি এখানে মূলত ধর্মীয় চরমপন্থা বা গোঁড়ামীর বিষয় নিয়ে আলোচনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। কারণ এ থেকে উদ্ভুত ঘটনাবলী দীর্ঘ ও উত্তপ্ত আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর এহেন বাক-বিতন্ডায় স্রেফ জ্ঞানী-গুনীরাই জড়িয়ে পড়ছেন না, ইসলাম সম্পর্কে এমন অজ্ঞ ব্যক্তিরাও এতে সোৎসাহে শামিল হচ্ছেন ইসলামের প্রতি যাদের শত্রুতা, অবহেলা ও বিদ্রুপ সুবিদিত। কয়েক বছর আগে আল-আরাবী পত্রিকার পক্ষ থেকেও “ধর্মীয় চরমপন্থা” স্বরুপ ও বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন করে আমাকে লেখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ১৯৮২ সালের জানুয়ারী মাসে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে আমার কতিপয় বন্ধু আমাকে এই বলে দোষারোপ করলেন যে, আমি নাকি এমন এক বিষয়ে কলম ধরেছি যেখানে বাতিলের পক্ষে হককে বিকৃত করা হচ্ছে। অবশ্য আমার বন্ধুরা আমার প্রবন্ধের মর্ম বা বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন না তুললেও, সম্প্রতি ধর্মীয় চরমপন্থার বিরুদ্ধে যে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা সংশয়ের আবর্তে দোল খাচ্ছেন। এই অভিযান আসলেই চরমপন্থাকে প্রতিহত করতে অথবা চরমপন্থীদের মধ্যপন্থার দিকে পরিচালিত করতে চায় কিনা সে ব্যাপারে তারা স্থির নিশ্চিত নন। তাদের আশংকা ইসলামী পুনর্জাগরণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিতে রুপান্তরিত হওয়ার পূর্বে একে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্যে এসব প্রচারাভিযান শুরু করা হয়েছে। বন্ধুরা বলছেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ইস্যুতে সরকারের বিরোধিতায় লিপ্ত হলেই সরকার ধর্মনিষ্ঠ তরুনদের প্রতি দৃষ্টি দিতে শুরু করেন। এর একটি প্রমাণ এই যে, ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী আসলে গোঁড়া ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন, উদ্দেশ্য অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে এদেরকে ব্যবহার করা। অত:পর তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে গেলে তারা ঐ ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে উৎখাত করেন। এই হিসেবে বন্ধুদের যুক্তি হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের ও ধর্মীয় গ্রুপগুলোর মধ্যেকার সংঘর্ষের কারণগুলো ধর্মীয় চরমপন্থা বা গোঁড়ামীর ভিত্তি হিসেবে খাড়া করা যায় না। তারা আরো মনে করেন যে, মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা ইসলামী আন্দোলনকেই সবচেয়ে মারত্মক শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। এরূপ কর্তৃপক্ষ চরম ডান অথবা চরম বামের সাথে আঁতাত গড়তে পারে, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের সাথে কখনো নয়।

কখনো কখনো তারা এই আন্দোলনের সাথে সংঘর্ষে অস্থায়ীভাবে বিরতি দেন আবার কখনো কখনো তাদের রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাতের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনকেও জড়িয়ে ফেলার অপচেষ্টা চালান। পরিশেষে কর্তৃপক্ষ ও প্রতিপক্ষ দেখতে পান যে, তাদের উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। অতএব ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের আঁতাত গড়তে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহর মুকাবিলায় তারা তোমার কোন উপকার করতে পারবে না; যালিমরা একে অপরের বন্ধু; আর আল্লাহ্ তো মুত্তাকীদের বন্ধু।”(৪৫:১৯) বর্তমান ঘটনাবলীই এর সত্যতা বহন করে। মিসরে ইসলামী গ্রুপগুলোকে চরমপন্থী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তারা নরম ও মধ্যপন্থী দৃষ্টি গ্রহণ করতে শুরু করে। এর কৃতিত্ব অবশ্য বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ ও ধর্মপ্রচারকদের প্রাপ্য। তারা ঐ গ্রুপগুলোকে ওপর তাদের চিন্তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। ফলত এখন অধিকাংশ ইসলামী গ্রুপের মধ্যে নরম ও মধ্যপন্থার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। বিম্ময়ের ব্যাপার, চরমপন্থার প্রাধান্যের সময় ক্ষমতাসীনরা চুপচাপ ছিলেন; কিন্তু মধ্যপন্থী প্রবণতা জোরদার হওয়ার সাথে সাথে তারা ঐ গ্রুপগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।

এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি যে অসতর্ক ছিলাম তা নয়, বরং এসব অবস্থা সামনে রেখেই ‘আল-আরাবী’তে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধের গোড়াতেই আমি লিখেছিলাম:

‘আল-আরাবী’ যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘ধর্মীয় চরমপন্থার’ মত বিষয়ে আলোচনার আহবান জানিয়েছে তার গুরুত্ব আমি দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করি। এসত্ত্বেও সমসাময়িক ঘটনাবলীতে এর প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে প্রথমে আমি বিষয়টি নিয়ে লেখার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। বিশেষ করে আমার এই আশংকা ছিল যে, আমি যা কিছু লিখব তার অপব্যাখ্যা হতে পারে অথবা আমার কিংবা পত্রিকাটির ইচ্ছার বিপরীতে অন্য কোন উদ্দেশ্যে এর অপপ্রয়োগ হতে পারে।

বস্তুত বর্তমানে লেখক ও বক্তারা ধর্মীয় চরমপন্থাকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছে। আমি দুর্বলের বিরুদ্ধে সবলের পক্ষ নিতে চাই না। আর এটাও সত্য যে, বিরোধী বা প্রতিপক্ষের তুলনায় ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ শক্তিশালী অবস্থানে থাকেন। বলাবাহুল্য, ইসলামপন্থীরা আত্মপক্ষ সমর্থনেরও অধিকার পান না। সংবাদ মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তো নেই-ই, এমনকি মসজিদের প্লাটফরমকেও এ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সুযোগ নেই।

আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব আরেকটি কারণে জোরদার হয়েছে যে, গত কয়েক দশক ধরে ইসলাম বিরোধীরা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে রাশি রাশি অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছে। তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল, গোঁড়া, শত্রু, বিদেশের দালাল ইত্যাদি অভিযোগে ‘ভূষিত’ করা হয়। অথচ কোন পর্যবেক্ষকেরই এটা বুঝতে বাকী থাকে না যে, পূর্ব ও পশ্চিমের উভয় পরাশক্তি বলয় ইসলামপন্থীদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার সকল সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

যা হোক, অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, বিষয়টি একটি বিশেষ দেশের নয় বরং সারা মুসলিম জাহানের সমস্যা। নীরবতা অবলম্বন করলেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে না। আলোচনায় শামিল না হওয়াটাই বরঞ্চ জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নের মতোই অনৈসলামী কাজ। সুতরাং আমি নিজেকে আল্লাহ কাছে সোপর্দ করে প্রকৃত সত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি হাদীসে বলেছেন: ‘নিয়তের ওপরই কর্মের ফলাফল নির্ভর করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি সেই ফলই পাবে যার নিয়ত সে করেছে।” (বুখারী ও মুসলিম)

অনেক লেখক অজ্ঞতাবশত অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কিংবা বিষয়টির প্রকৃতি সম্পর্কে অগভীর ধারণার দরুন মুক্তকচ্ছের মতো বক্তব্য রেখে গেছেন। এমতাবস্থায় এই অভিযানে অংশ নিয়ে মুসলিম চিন্তাবিদদের সত্য প্রকাশে ব্রতী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

তাছাড়া ধর্মীয় চরমপন্থা বিষয়টির প্রতি আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহ আমার সংকল্পকে আরো জোরদার করেছে। কয়েক বছর আগে আমি তাকফীরের (কাউকে কাফির ঘোষণার প্রবণতা) বাড়াবাড়ি সম্পর্কে ‘আলমুসলিমুল মুয়াসির’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। “মুসলিম তরুণদের পুনর্জাগরণ” শীর্ষক আমার আরেকটি প্রবন্ধ ‘আল-উম্মাহ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আমি যখনি মুসলিম তরুণদের সাথে মুখোমুখী কিংবা শিবির ও সেমিনারে আলোচনার সুযোগ পেয়েছি তখনি তাদেরকে মধ্যপন্থার প্রতি আহবান জানিয়েছি এবং বাড়াবাড়ির পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি। অবশ্য ‘আল-আরাবী’তে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলাম তা ছিল সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একটি ফরমায়েশী লেখা।

এসব কাণে আমি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার তাগিদ অনুভব করি। বিশেষত ধর্মীয় চরমপন্থার বাস্তবতা, কারণ ও প্রতিকার প্রসঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হওয়া দরকার এবং তা হওয়া দরকার ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে। যারা বিষয়টিকে বিকৃত ও অসদুদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায় তাদের তৎপরতা সত্ত্বেও আমি এগিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “মধ্যপন্থীরা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত জ্ঞানের পতাকা বহন করে নিয়ে যাবে। তারাই জ্ঞানকে বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার হাত থেকে রক্ষা করবে।”

হাদীসটি এই ইঙ্গিত দেয় যে, আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্যে বিজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে সত্য গোপন নয়, প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। অতএব যারা বিষয়টির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদেরকেও এ দায়িত্ব পালন করা উচিত। বাড়াবাড়ির জন্যে কেবল তরুণদের দায়ী করা সঙ্গত নয়। যারা ইসলামের শিক্ষা পালনে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করেন অথচ নিজেদেরকে নির্দোষও ভাবেন তারাও সমভাবে দায়ী। নামধারী মুসলমানরা- তা পিতামাতা, শিক্ষক-পন্ডিত অথবা যে কেউ হোন- নিজ নিজ দেশেই ইসলাম, ইসলামপন্থী ও ইসলাম প্রচারকদেরকে প্রায় অস্পৃশ্য করে রেখেছেন। এটা আশ্চর্যের ব্যাপার, আমরা চরমপন্থার সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠি, কিন্তু আমাদের নিজস্ব গোঁড়ামি অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে অবহেলা ও শিথিলতার প্রশ্নে নির্বিকার। আমরা তরুণদেরকে গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি পরিহার করার উপদেশ দিই এবং তাদেরকে নমনীয় ও সুবিবেচক হতে বলি, কিন্তু প্রবীণদেরকে কখনো বলি না যে, আপনারাও মুনাফেকী, মিথ্যাচার, প্রতারণা তথা সর্বপ্রকার স্ববিরোধিতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করুন। আমরা তরুণদের কাছ থেকে সব কিছু দাবী করি, কিন্তু তাদেরকে যা নসিহত করি নিজেরা তা পালন করি না, যেন সব অধিকার আমাদের আর কর্তব্যের দায়ভার সবটাই যেন তরুণদের। অথচ দায়িত্ব ও কর্তব্য সকলের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। আজ আমাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, প্রচন্ড সাহস সঞ্চয় করে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের নিজেদের দুষ্কর্মের দরুনই তরুণরা ধর্মীয় চরমপন্থার আশ্রয় নিয়েছে। আমরা কুরআন তিলাওয়াত করি, কিন্তু এর আহকাম মেনে চলি না, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)- এর প্রতি ভালবাসার দাবী করি, কিন্তু কার্যত তাঁর সুন্নাহ পালন করি না। আরো মজার ব্যাপার আমারা ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম বলে ঘোষণা করি, কিন্তু আইন-কানুন প্রণয়নের সময় ইসলামের নাম গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্ববিরোধী ও মুনাফেকী আচরণের জন্যেই তরুণরা আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেরাই ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করছে। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে পিতামাতাদের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। আলিমরা উদাসীন, শাসকরা বৈরী আর পরামর্শদাতার ছিদ্রান্বেষী। অতএব তরুণদের প্রতি শান্ত, সংযত ও সুবিবেচক হওয়ার উপদেশ দেয়ার আগে আমাদের নিজেদেরকে ও সমাজকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সংস্কার করতে হবে। চরমপন্থা নির্মূল ও তরুণদের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণেকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার ব্যাপারে সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তব্য ও ভূমিকার প্রতি কর্তৃপক্ষ ও চিন্তাশীল লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

অনেকে মনে করেন, সকল প্রকার চরমপন্থা ও বিচ্যুতিসহ যা কিছু ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তার জন্যে সরকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই দায়ী। বস্তুত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য হলেও এদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে তারা অক্ষম; কেননা ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ তাদের নীতির প্রতি প্রশংসা ও সমর্থন আদায়ের মতলবে এসব প্রতিষ্ঠানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। অথচ সকলে একথা স্বীকার করবেন যে, মুসলিম বিশ্বের এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেলে তরুণদের পথ নির্দেশ ও জ্ঞান প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই স্বাধীনতার অভাবে এগুলো প্রানহীন কংকালে পর্যবসিত হয়েছে।

আবার এটাও আমাদেরকে স্মরন রাখতে হবে যে, উপদেষ্টাদের প্রতি যদি তরুণদের আস্থা না থাকে তবে সেসব উপদেষ্টার উপদেশ অর্থহীন। পারষ্পরিক আস্থা না থাকলে প্রতিটি উপদেশ বাগাড়ম্বরের নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে সরকার নিযুক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শরীয়তের শিক্ষার যে যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এগুলো আসলেই সরকারের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। তারা যদি সত্যিকার অর্থে সমাজে তাদের প্রভাব রাখতে চায় তবে সর্বপ্রথম তাদের ঘরকেই আগে সাজাতে হবে। এজন্যে তাদেরকে সদা অস্থির রাজনৈতিক কুচক্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়া চলবে না। তাদের প্রধান কাজ হবে এমন এক দল ফকীহ গড়ে তোলা যারা হবে ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ও যুগসচেতন অর্থাৎ কুরআনের ভাষায় “যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয় এবং তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।” (৩৩ : ৩৯) বস্তুত আমাদের বর্তমান সমাজে এরূপ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সৎ মনীষীর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কেবল এরাই ইসলামী পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে সঠিক পথ নির্দেশ দিতে পারেন। যেসব লোক ইসলামী পুনর্জাগরণ থেকে দূরে সরে আছেন অথবা এর আশা-আকাঙ্খা উপলব্দি না করে এবং হতাশা ও দুর্ভোগের অংশীদার না হয়েই কেবল সমালোচনা করে চলেছেন তারা কখোনোই এই আন্দোলনের ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে না। আমাদের একজন প্রাচীন কবি লিখেছেন : “যারা নিঃস্বার্থ যাতনা ভোগ করে তারা ছাড়া আর কেউ তীব্র আকাঙ্খার তীক্ষ্ম বেদনা উপলব্ধি করতে পারে না।” ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যাদের হৃদয়ে আকাঙ্খা নেই তারা আসলেই আত্মকেন্দ্রিক আর এসব লোকের কোনো অধিকার নেই ইসলাম অনুরাগীদের ভুল ধরার অথবা তাদের সংশোধনের জন্যে নসিহত করার। যদি তারা গায়ের জোরে এই অধিকার প্রয়োগ করতে চায় তাহলে কেউ তাদের কথায় কর্ণপাত করবে না।

উপসংহারে, আমার পরামর্শ হচ্ছে যারা তরুণদের উপদেশ দিতে আগ্রহী তাদেরকে পাণ্ডিত্যাভিমান পরিহার করে আইভরি টাওয়ার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধুলির ধরণীতে নেমে এসে তরুণদের সাথে মিশতে হবে। যুব সমাজের আশা-আকাঙ্খা, সংকল্প, উদ্দীপনা ও সৎ কর্মগুলোর যথাযথ মূল্যায়ণপূর্বক তাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য করতে হবে যাতে তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া যায়।

ড. ইউসুফ আল-কারজাভী


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি