“এই বিশ্ব-চরাচরে যাহা কিছু আছে সবকিছুই ধ্বংসশীল- একমাত্র তোমার মহামহিমান্বত প্রভুর আস্তিই চিরস্থায়ী।”- (আল-কোরআন)

মৃত্যুশয্যায়ও আমার স্নেহময়ী আমার তাকিদ ছিল, যেন নিজেকে মানুষরূপে গড়িয়া তোলার চেষ্টা করি। আমার সেই তাকিদই আমাকে আজকের এই সাধনা- পথে প্রেরণা দিয়াছে। আজ নগন্য এই কর্মপ্রচেষ্টার সওগাতটুকু তাঁহরই জান্নাতী রীহের উদ্দেশ্যে নিবেদন করিতেছি।
-অনুবাদক

রেহ্‌লাতে রসূল (সা.)
(আরবী*********)
“যখন আল্লাহর সাহায্য আসিল এবং বিজয়; এবং তুমি দেখিলে মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করিতেছে। এখন তুমি আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ কর এবং গোনাহের জন্য ক্ষমা চাও। নিশ্চয় তিনিই তওবা করুল করেন।”
বিদায় হজ্বের প্রস্তুতি উপরোক্ত সূরা নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানবতার নবী হযরত রসূলে খোদা (সা) অনুমান করিতে পারিলেন, শেষ বিদায়ের সময় ঘনাইয়া আসিয়াছে। ইতিপূর্বে তিনি আল্লাহর ঘর পবিত্র করার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়াছিলেন, আগামীতে আর কোন মোশরেক আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করিতে পারিবে না। কোন ব্যক্তিকে উলঙ্গ অবস্থায় আল্লাহর ঘর তোয়াফ করিতেও দেওয়া হইবে না।
হযরত রসূলে খোদা (সা) হিজরতের পর আর হজ্ব পালন করার সুযোগ পান নাই। হিজরী দশ সনে আগ্রহ জন্মিয়াছিল, আখেরাতের পথে রওনা হওয়ার পূর্বে সমস্ত উম্মতের সহিত মিলিত হইয়া শেষবারের মত হজ্ব করিয়া নিবেন। বিপুলভাবে আয়োজন করা হইল যেন কোন ভক্তই এই পবিত্র সফরে সাহচর্যের সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত না হয়। হযরত আলী (রা) কে ইয়ামন হইতে ডাকিয়া আনা হইল। আশেপাশের সকল জনপদে লোক প্রেরণ করিয়া এই পবিত্র ইরাদার কথা প্রচার করিয়া দেওয়া হইল। উম্মুল মোমেনীনদের সকলকে সঙ্গে চলার সুখবর দেওয়া হইল। হযরত ফাতেমা (রা)ও প্রস্তুতির নির্দেশ পাইলেন।
২৫শে জিলক্বদ মসজিদে নবনীতে জুমার নামায হইল। এই জামাতেই ২৬ তারিখ রওয়ানা হওয়ার কথা ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইল। ২৬ তারিখে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইতুল্লার পথে যাত্রার খশীতে রসূলে খোদার (সা) পবিত্র চেহারা উদ্ভাসিত হইয়া উছিল। গোসল শেষ করিয়া নূতন পোশাক পরিধান করিলেন এবং জোহরের নামায পড়ার পর আল্লাহর মহিমা কীর্তন করিতে করিতে নদীনা হইতে বাহির হইলেন। হাজার হাজার আত্মত্যাগী উম্মত প্রিয়নবী (সা) এর সঙ্গে চলিলেন। এই পবিত্র কাফেলা মদীনা হইতে ছয় মাইল দূরে যুলহোলায়ফা নামক স্থানে আসিয়া প্রথম মঞ্জিল করিল।
পরদিন সকালে আল্লাহর রসূল (সা) পুনরায় গোসল করিলেন। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) নিজ হাতে তাঁহার পবিত্র বদনে আতম মাখিয়া দিলেন। দ্বিতীয় বার রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আর একবার আল্লাহর প্রিয় নবী আল্লাহর দরবাদে দাঁড়াইলেন এবং নেহায়েত কাতরভাবে দুই রাকাত নামায আদায় করিলেন। অতঃপর সোয়ারীর উপর আরোহণ করতঃ এহরাম বাঁধিলেন এবং আল্লাহর মহিমা কীর্তনসূচল ‘লাব্বাইক’ তারানা শুরু করিলেনঃ (আরবী**********)
পবিত্র মুখের মহিমা গানের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার খোদা-পুরস্তের মুখে উহার প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। আকাশের মহাশূন্য আল্লাহর মহিমা কীর্তন ভরিয়া উঠিল। পাহাড়-প্রান্তর তওহীদের তারানায় মুখরিত হইয়া উঠিল। হযরতহ জাবের (রা) বলেন, হুজুর সারওয়ারে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অগ্রে-পশ্চাতে, দক্ষিণে-বাবে, যে পর্যন্ত দৃষ্টি যাইত, কেবলমাত্র মানুষই দেখা যাইতেছিল। যখন হযরতের উষ্ট্র কোন উচ্চ টিলার উপর আরোহণ করিত, তখন তিনি তিন বর উচ্চ কণ্ঠে তকবীর ধ্বনি করিতেন। পবিত্র কণ্ঠের তকবীরের সঙ্গে সঙ্গে অগণিত কণ্ঠে তাহা প্রতিধ্বনিত হইয়া এই পবিত্র কাফেলার মধ্যে যেন আল্লাহর মহিমা কীর্তনের প্লাবন বহিয়া যাইত। দীর্ঘ নয় দিন এই পবিত্র কাফেলার যাত্রা চলিল।
জিলহজ্ব মাসের চতুর্থ দিবসের সূর্যোয়ের সঙ্গে সঙ্গে মক্কার ঘর-বাড়ী দেখা যাইতেছিল। হাশেমী খান্দানের ছোট ছোট শিশুরা তাহাদের মহান স্বজনের আগমনবার্তা শুনিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিতেছিল। নিষ্পাপ শিশুরা যেন রসূলে খোদার পবিত্র মুখের মধুর হাসির সাহিত মিলাইয়া যাওয়ার জন্য আত্মহারা হইয়া উঠিয়া উঠিতেছিলেন। অপরদিকে আল্লাহর রসূলও যেন স্নেহ-প্রীতির এক জীবন্ত তসবীর হইয়া উঠিতেছিলেন। কচি শিশুদের দেখিবামাত্র বাহন হইতে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কাহাকেও বা উটের অগ্রে এবং কাহাকেও বা পশ্চাতে বসাইয়া লইতে লাগিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পবিত্র খানায়ে কাবা চোখে পড়িল। কাবার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর রসূল বলিতে লাগিলেন, “আয় আল্লাহ, কাবার মর্যাদা আরও বাড়াইয়া দাও।”
সর্বপ্রথম তিনি কাবা শরীফ তোয়াফ করিলেন। অতঃপর মাকামে ইব্রাহীমে গমন করতঃ শোকরানা আদায় করিলেন। এই সময় পবিত্র মুখে আল্লাহর কালাম- (আরবী****) এবং মাকামে ইব্রাহীমকে সেজদার স্থান নির্দিষ্ট কর, -উচ্চারিত হইতেছিল। কাবা যিয়ারতের পর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে চলিয়া গেলেন। সাফা প্রান্ত হইতে কাবা গ্রহ চোখে পড়িলে পবিত্র মুখে জলদগম্ভীর স্বরে তকবীর ও তওহীদের কলেমা উচ্চারিত হইতে লাগিল-
(আরবী******)
তরজমা- “আল্লাহ, এবং কেবল আল্লাহই একমাত্র উপাস্য। কেহ তাহার শরীক নাই। সমস্ত রাজ্য তাঁহার, প্রশংসা তাঁহারই জন্য। তিনিই জীবন দান করেন, তিনি মৃত্যু ঘটান। তিনি সকল কিছুর উপরই সর্বশক্তিমান। তিনি ব্যতীত কেহ উপাস্য নাই। তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করিয়াছেন- তিনি তাঁহার বান্দাকে সাহায্য করিয়াছেন- এবং তিন একাই সকল আক্রমণকারীকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছেন।”
আল্লাহর রসূল (সা) অতঃপর ৮ই জিলহজ্ব মিনাতে অবস্থান করিলেন। ৯ই জিলহজ্ব ফজরের নামায শেষ করতঃ তথা হইতে রওয়ানা হইয়া ওয়াদিয়ে নামেরা নামক স্থানে আসিয়া বিশ্রাম করিলেন। দিনের শেষভাগে আসিয়া আরাফাতের ময়দানে পদার্পণ করিলেন। আরাফাতে তখন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার খোদাপূরস্ত মানব সন্তানের তকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হইতেছিল। আল্লাহর রসূল (সা) একটি উষ্ট্রীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া প্রভাতী সূর্যের ন্যায় আরাফাতের পর্বত চূড়ায় উদিত হইলেন। পর্বত প্রান্তরে হযরত বেলাল, সমস্ত আস্হাবে ছুফফা, আশার-মোবাশশারা ও সহস্র সহস্র উম্মত অবস্থান করিতেছিলেন। তখনকার দৃশ্য দেখিয়া মনে হইতেছিল, উম্মতের অভিভাক যেন তাঁহার উম্মতকে প্রাণ ভরিয়া দেখিয়া লইতেছেন এবং প্রকৃত মোহাফেজ আল্লাহর হাতে তাঁহার দায়িত্ব বুঝাইয়া দিতেছেন।
শেষ খুৎবা
এই উম্মতের জন্য আল্লাহর রসূলের শেষ যে অশ্রুবিন্দু প্রবাহিত হইয়াছিল, তাহা বিদায় হজ্বের খুৎবায় পুঞ্জীভূত হইয়া রহিয়াছে। এই সময় রাজ্য ও সম্মপদ প্লাবনের মত মুসলমানদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছিল। রসূলুল্লাহর (সা) ভাবনা ছিল, সম্পদের প্রাচুর্য তাঁহার অবর্তমানে উম্মতের ঐক্যবন্ধন ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিবে। এই জন্য উম্মাতের ঐক্যবন্ধন সম্পর্কেই আলোচনার সূত্রপাত করিলেন। নবীসুলভ সবটুকু আবেগ যেন ইহার উপরই ব্যয় করিলেন। প্রথমতঃ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় ঐক্য কায়েম রাখর আবেদন জানাইলেন। অতঃপর বলিতে লাগিলেন, “দুর্বল শ্রেণীকে অভিযোগ করার সুযোগ দিও না, যেন ইসলামের এই প্রাচীরে কোন প্রকার ফাটল সৃষ্টি হইতে না পারে।” তৎপর মোনাফেকী তথা পরস্পরের মন কষাকষির বিস্তারিত উম্মতের ঐক্য বন্ধনের সূল ভিত্তিবস্তু কি, তাহাও ভালভাবে বলিয়া দিলেন। শেষ অসিয়ত করিলেন- এই বাণী এবং শিক্ষা যেন পরবর্তী যুগের মানুষের নিকট প্রচার করার সুব্যবস্থা করা হয়। খুৎবা শেষ করিয়া আল্লাহর রসূল (সা) তাঁহার দায়িত্ব হইতে মুক্তি পাওয়ার জন্য উপস্থিত লোকজনের নিকট সাক্ষ্য গ্রহণ করতঃ আল্লাহকে এমনভাবে ডাকিতেহ শুরু করিলেন যে, উপস্থিত সকলের অন্তর গলিয়া গেল। চক্ষু ফাটিয়া অশ্রুর বন্যা বহিল, দেহের পিঞ্জরে আত্মা যেন ছটফট করিয়া শান্তির জন্য কাতর স্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল।
আল্লাহর মহিমা কীর্তনের পর খুৎবার সর্বপ্রথম হৃদয়স্পর্শী কথা ছিলঃ
“লোকসকল, আমার ধারণা, আজকের পর আমি এবং তোমরা এইরূপ জামায়াতে আর কখনও একত্রিত হইব না।”
এতটুকু শুনিয়াই এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য এবং গুরুত্ব সকলের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠিল। অতঃপর যাঁহারা এই নিদারুণ বাণী শুনিলেন, তাঁহাদের সকলের অন্তহরই কাঁপিয়া উঠিল। এইবার আসল কথা শুরু করিলেন-
“লোকসকল! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের মানসম্ভ্রম পরস্পরের নিকট ততটুকুই পবিত্র, যতটুকু পবিত্র আজকের এই (জুমার) দিন, আজকের এই (জিলহজ্ব) মাস এবং এই (মক্কা) শহর!”
“লোকসকল, শেষ পর্যন্ত একদিন না একদিন তোমাদিগকে আল্লাহ সর্বশক্তিমানের দরবারে উপস্থিত হইতে হইবে। সেখানে তোমাদে কৃতকর্মের হিসাব করা হইবে। সাবধান! আমার পর ভ্রান্ত হইয়া একে অপরের মস্তক কর্তন করিতে শুরু করিও না!”
রসূলে পাকের (সা) বেদনা-বিধুর অসিয়তের প্রতিটি কথা তাঁহার পবিত্র জবান হইতে বাহির হইয়া শ্রোতাদের অন্তর ছেদন করিয়া গেল। অতঃপর তিনি উম্মতের মজবুত প্রাচীরে ভবিষ্যতে যে ছিদ্রপথ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। অর্থাৎ ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধ ভূলিয়া হয়ত সবল কর্তৃক দুর্বল ও অসহায় শ্রেণীর উপর নির্যাতন হইতে পারিত। এদিক লক্ষ্য করিয়াই তিনি বলিলেন-
“লোকসকল, স্ত্রীদের সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে ভয় করিও। তোমরা আল্লাহর নামের শপথ করিয়া তাহাদিগকে দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছ এবং আল্লাহর নাম লইয়া তাহাদের দেহ নিজেদের জন্য হালাল করিয়াছ। স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার,- তাহারা অপরকে সঙ্গসুখ প্রদান করিতে পারিবে না। যদি তাহারা এইরূপ করে, তবে তাহাদিগকে এমন শাস্তি প্রদান করিতে পার যাহা প্রকাশ না পায়। আর তোমাদের উপর স্ত্রীলোকের অধিকার হইতেছে, তাহাদিগকে তোমরা যথাসম্ভব স্বাচ্ছন্দ্যের সহিত খাইতে ও পরিতে দিবে।”
“হে লোকসকল, তোমাদে দাস-দাসী!! যাহা নিজে খাইবে তাহাই তাহাদিগকেও খাইতে দিবে। যাহা নিজে পরিধান করিবে, তাহাই তাহাদিগকে পরাইবে।”
আরবের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূল কারণ ছিল দুইটি। ঋণের বিপুল পরিমাণ সুদ আদয়ের পীড়াপীড়ি ও কোন নিহত ব্যক্তির রক্তের প্রতিশোধস্পৃহা। একে অপরের নিকট পুরুষানুক্রমিক সুদের দাবী করিত এবং সেই সূত্রেই ঝগড়া শুরু হইয়া রক্তের দরিয়া প্রবাহিত হইত। একে হয়ত অপরকে হত্যা করিত, আর এই দুইটি ঝগড়ার সূত্রেরই অবসান ঘোষণা করিলেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলিলেনঃ
“লোকসকল, আজ আমি বর্বর যুগের সকল প্রথা পদদলিত করিতেছি। গত যুগের সকল হত্যা সম্পর্কিত ঝগড়ার সমাপ্তি ঘোষণা করিতেছি। সর্বপ্রথম আমি আমার স্বগোত্রীয় নিহত ব্যক্তি রবিয়া ইবনে হারেস,- যাহাকে হোযায়ল গোত্র হত্যা করিয়াছিল, তাহা ক্ষমা করিয়া দিতেছি। জাহেলিয়াত যুগের সকল সুদের দাবী বাতিল ঘোষণা করিতেছি এবং সর্বপ্রথম আমার সগোত্রের হযরতহ আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের প্রাপ্য সকল সুদের দাবী পরিত্যাগ করিতেছি।
সুদ ও রক্তের দাবী সম্পর্কিত প্রথার অবসান ঘোষণা করিয়া পারস্পরি ক সম্পর্কের দুর্বল আর একটিচ দিকের প্রতি মনোযোগ দিলেন এবং উত্তরাধিকার, বংশ পরিচয়, জামানত প্রভৃতি হইতে উৎপন্ন ঝগড়ার প্রতি সকলেরর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিতে লাগিলেন-
স্বয়ং আল্লাহ প্রত্যেক হকদারের অধিকার নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীদের কাহারও সম্পর্কে কোন প্রকার অসিয়ত করার আর কোন প্রয়োজন নাই। সন্তান যাহার ঔরস হইতে জন্ম লাভ করে, তাহার অধিকার তাহাকেই দিতে হইবে। ব্যভিচারীর জন্য রহিয়াছে প্রস্তরের শাস্তি। আর তাহার জওয়াবদিহি করিতে হইবে আল্লাহর নিকট। যে সন্তান পিতা ব্যতীত অন্য লোকের সহিত মালিকানার পরিচয় দেয়, তাহাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। স্ত্রীরা যেন স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর সম্পদ ব্যয় না করে। ঋণ সর্বাবস্থায়ই পরিশোধ। ধার করা বস্তু ফেরত দিতে হইবে। উপহারের প্রতিদান দেওয়া উচিত। জরিমানার জন্য জামিনদার দায়ী হইবে।”
আরববাসীদের ঝগড়া-বিবাদ ও তাহার সকল উৎসমূল চিরতরে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইল। অতঃপর আল্লাহর রসূল (সা) শতাব্দী পর আরব-অনারব, গোরা-কালো, শ্বেত, কৃষ্ণ প্রভৃতি যে আন্তর্জাতি বিদ্বেষের সম্ভাবনা ছিল, সেই দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন :
“লোকসকল, তোমাদের সকলের খোদা এক, তোমাদের সকলের আদি পিতাও এক ব্যক্তি। সুতরাং কোন আরবরে অনারবের উপর; কোন কৃষ্ণের সাদার উপর, অথবা কোন সাদার কৃষ্ণের উপর কোন প্রকার জন্মগত প্রাধান্য নাই। সম্মানী সেই ব্যক্তি, যিনি খোদাভীরু। প্রত্যেক মুসলিম একে অন্যের ভাই। আর বিশ্ব-মুসলিম মিলিয়া এক জাতি।”
অতঃপর ইসলামী ঐক্যের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন- “লোকসকল, আমি তোমাদের জন্য এমন একটি বস্তু রাখিয়া যাইতেছি, যদি তাহা তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া রাখ, তবে তোমরা কখনও বিভ্রান্ত হইবে না। ঐ বস্তুটি হইতেছে আল্লাহর কোরআন।
উম্মতের ভবিষ্যত ঐক্য বন্ধনের বাস্তব কর্মপন্থা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিলেন-
“শোন, আমার পর আর কোন নবী আসিবেন না। না অন্য কোন নূতন উম্মতের সৃষ্টি হইবে। সুতরাং তোমরা সকলে মিলিয়া আল্লাহর এবাদত করিও। পাঁচ ওয়াক্তের নামায সম্পর্কে দৃঢ় থাকিও। রমযানের রোযা রাখিও। হৃষ্টচিত্তে সম্পরেদ যাকাত আদায় করিও। আল্লাহর ঘরে হজ্ব করিও। তোমাদের শাসকর্তাদের নির্দেশ মান্য করিও এবং আল্লাহর বেহেশতে স্থান গ্রহণ করিও।” সর্বশেষ বলিলেন-(আরবী*******)
-“তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হইবে। তখন তোমরা কি বলিবে?”
প্রত্যুত্তরে জনতার মধ্য হইতে আবেগপূর্ণ আওয়াজ উঠিল: (আরবী*******) হে আল্লাহর রসূল, আপনি সকল হুকুমই পৌঁছাইয়া দিয়াছেন।
(আরবী****) এবং আপনি রেসালাতের সকল দায়িত্ব পূর্ণ করিয়াছেন।
(আরবী*****)-এবং হে আল্লাহর রসূল, আপনি ভাল-মন্দ সব পৃথক করিয়া দিয়াছেন।
এই সময় হযরতের পবিত্র অঙ্গুলি আকাশের দিকে উত্থিত হইল। একবার অঙ্গুলি আকাশের দিকে উঠাইতেছিলেন এবং অন্যবার জনতার দিকে নির্দেশ করিয়া বলিতেছিলেন : (আরবী*************)
যে আল্লাহ, মানুষের সাক্ষ্য শোন!
হে আল্লাহ, তোমার সৃষ্ট জীবদের স্বীকৃত শোন!
হে আল্লাহ্‌! তুমি সাক্ষী থাক!!
অতঃপর বলিলেন : “যাহারা উপস্থিত আছে তাহারা যেন যাহারা উপস্থিন নাই তাহাদের নিকট আমার এই বাণী পৌঁছাইয়া দেয়। হয়ত বা আজকের উপস্থিত শ্রোতাদের চাইতেও অধিক সংখ্যক লোক এই বাণীর প্রতি অধিকতর আগ্রহী হইবে।”
দ্বীনের পূর্ণতা
আল্লাহার রসূল (সা) খুৎবা সমাপ্ত করার সঙ্গে সঙ্গেই জিবরীল (আ) দ্বীন ইসলামের পূর্ণতার মুকুট লইয়া আসিলেন। কোরআনের আয়াত নাযিল হইল: (আরবী**************)
-“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করিয়া দিলাম, তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং দ্বীন ইসলামের উপর আমার সন্তুষ্টির সীলমোহর দিয়া দিলাম।
সরওয়ারে কায়েনাত আল্লাহর প্রিয় রসূল (সা) যখন জনতার সম্মুখে দ্বীন ও আল্লাহর নেয়ামতের পূর্ণতার কথা ঘোষণা করেন, তখন তাঁহার নিজের সোয়ারিটির মূল্য এক হাজার টাকার বেশী ছিল না। খুৎবা শেষ হওয়ার পর হযরত বেলাল আজান দিলেন এবং হুজুর (সা) জোহর ও আসরের নামায একত্রিত করিয়া আদায় করিলেন। নামাযান্তে তথা হইতে তাঁবুতে ফিরিয়া আসিলেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া আল্লাহর দরবারে দো’য়া করিতে লাগিলেন। সূর্যাস্তের পূর্বে রসূলে খোদার (সা) উট যখন জনতার মধ্য দিয়া পথ কাটিয়া চলিতেছিল, তখন তাঁহার সহিত খাদেম হযরত উসামা একই উটে আরোহী ছিলেন। ভীড়ের চাপে জনতার মধ্যে চাপা অস্বস্তির সৃষ্টি হইতেছিল। এই সময় রসূলে খোদা (সা) নিজ হাতে উটের লাগাম টানিয়া লোকদিগকে বলিতেছিলেন,-
ওগো, আরামের সহিত
ও গো, শান্তির সহিত
মুজদালাফায় আসিয়া মাগরিবের নামায সমাপ্ত করিলেন এবং বিশ্রামের জন্য সকল বাহনের উট ইত্যাদি ছাড়িয়া দিলেন। এশার নামায শেষ করিয়া আরামের সহিত শুইয়া পড়িলেন। মোহাদ্দেসগণ বর্ণনা করেন, -“সমগ্র জীবনে এই একদিনই আল্লাহর রসূল তাহাজ্জুদের নামায পড়েননাই।”
১০ই জিলহজ্ব শনিবার দিবস তিনি জামরার দিকে রওয়ানা হইলেন। এই সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁহার পিতৃব্য-পুত্র হযরত ফজল ইবনে আব্বাস (রা)। তাঁহার উট এক পা এক পা করিয়া অগ্রসর হইতেছিল। চারিদিকে জনতার বিপুল ভীড়। জনসাধারণ বিভিন্ন মাসআলা জিজ্ঞাসা করিতেছিল, আর তিনি ধীর শান্ত স্বরে ঐগুলির জওয়াব দিয়া চলিতেছিলেন! জামরার নিকটে আসিয়া হযরত ফজল কতিপয় কংকর তুলিয়া দিলেন; রসূলে খোদা উহাই নিক্ষেপ করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন : লোকসকল, ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিও না। তোমাদে পূর্বেকার বহু জাতি এইভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।
কিছুক্ষণ পর পর যেন তাঁহার উম্মতের নিকট হইতে আসন্ন বিরহ-ব্যথার বেদানা ফুটিয়া উঠিতেছিল। এই সময় তিনি বলিতেছিলেন : “এই সময় হজ্বের মাসআলা শিক্ষা করিয়া লও। অতঃপর আর হজ্বের সুযোগ আসিবে কিনা সেই কথা আমি বলিতে পারি না।”
মিনার ময়দান
প্রস্তর নিক্ষেপের পর রসূলে খোদা (সা) মিনার ময়দানে চলিয়া গেলেন। তিনি একটি উষ্ট্রীর উপর সোয়ার ছিলেন। হযরত বেলালের হাতে ছিল উহার লাগাম। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ এখণ্ড কাপড় উটাইয়া তাঁহার উপর ছায়া দিতেছিলেন। অগ্রে-পশ্চাতে, দক্ষিণে-বামে মোহাজের, আনসার, কোরায়শ ও অন্যান্য কবিলার অগণিত লোকেরা কাতার দরিয়ার মত প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছিল; আর রসূলে খোদার উষ্ট্রটি যেন মূহের কিশতির মত নাজাতের সেতারার ন্যায় ভাসিয়া চলিয়াছিল। এমন মনে হইতেছিল যে, প্রকৃতির মহান বাগবান কোরআনের জ্যোতিঃ সিঞ্চন করিয়া সত্য ও নিষ্ঠার যে নূতন দুনিয়া আবাদ করিয়াছিলেন, তাহা এতদিনে প্রাণবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। আল্লাহর রসূল এই নতুন দিনের কথা উল্লেখ করিয়াই বলিলেন- “আজকালের বিবর্তন দুনিয়াকে আবারও ঐ বিন্দুতে আনিয়া দাঁড় করািইয়াছে, যেখনা হইতে দুনিয়া সৃষ্টি হইয়াছিল।” অতঃপর জিলকদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব মাসের মর্যাদার কথা উল্লেখ করতঃ জনতাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
মানবতার নবী- আজ কোন দিন?
মুসলিম জনতা- আল্লাহ এবং তাঁহার রসূলই ভাল বলিতে পারেন।
মানবতার নবী- (কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর) আজ কোরবানীর দিন নয় কি?
মুসলিম জনতা- নিঃসন্দেহে আজ কোরবানীর দিন।
মানবতার নবী- ইহা কোন্‌ মাস?
মুসলিম জনতা- আল্লাহ এবং তাঁহার রসূলই ভাল বলিতে পারেন।
মানবতার নবী- (সামান্য নীরবতার পর) ইহা কি জিলহজ্ব মাস নয় কি?
মুসলিম জনতা- নিশ্চয়ই জিলহজ্ব মাস।
মানবতার নবী- ইহা কোন্‌ শাহর?
মুসলিম জনতা- আল্লাহ এবং তাঁহার রসূলই ভাল বলিতে পারেন।
মানবতার নবী- (দীর্ঘ নীরবতার পর) ইহা সম্মানিত শহর নয় কি?
অতঃপর বলিলেন :-
মুসলমানগণ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান তদ্রূপ পবিত্র, যেরূপ পবিত্র আজকের এই দিন, বর্তমান এই মাস এবং আজকের এই শহার। তোমরা আমার পর ভ্রান্ত হইয়া একে অপরের মস্তক কর্তন করিতে শুরু করিও না। লোকসকল, তোমাদিগকে আল্লাহর দরবারে হাজির হইতে হইবে। তিনি তোমাদিগকে তোমাদে কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিবেন। যদি কেহ অপরাধ করে তবে সে নিজেই সেই অপরাধের জন্য দায়ী হইবে। পুত্রের অপরাধের জন্য পিতার এবং পিতার অপরাধের জন্য পুত্রের কোনই দায়িত্ব নাই। তোমাদের এই শহরে ভবিষ্যতে কখনও শয়তানের পূজা হইবে, এই ব্যাপারে শয়তান নিরাশ হইয়া গিয়াছে। তবে তোমরা অবশ্য ছোট ছোট ব্যাপারে যদি তাহার অনুসরণ করিতে থাক তবে সে অনন্দিত হইবে।
লোকসকল, তওহীদ, নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্বই হইতেছে বেহেশতে প্রবেশের উপায়। আমি তোমাদিগকে সত্যবাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছি। এখনকার উপস্থিত লোকেরা, যাহার এখানে উপস্থিত নাই, তাহাদের পর্যন্ত এই বাণী পৌঁছাইতে থাকিবে।
বক্তৃতা শেষ করিয়া আল্লাহর রসূল (সা) মিনার ময়দান হইতে কোরবানীর স্থানে কশরিফ আনিলেন। নিজ হাতে ২২টি উট কোরবানী করিলেন এবং হযরত আলীর দ্বারা আরও ৩৭টি কোরবানী করাইলেন। কোরবানীকৃত সবগুলি পশুর গোষত ও চামড়া লোকদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিলেন। মুণ্ডিত সমস্ত চুল উপস্থিত জনসাধারণ পবিত্র স্মৃতি হিসাবে বণ্টন করিয়া নিলেন। সেখান হইতে উঠিয়া খানায়ে কা‘বায় চলিয়া গেলেন এবং তোয়াফ করিলেন। যমযমের পানি পান করিলেন এবং মিনার ময়দানে ফিরিয়া আসিলেন। জিলহজ্বের ১২ তারিখ পর্যন্ত মিনার ময়দানে অবস্থান করিলেন। ১৩ জিলহজ্ব শেষ তোয়াফ করিয়া আনসার-মোহাজে সমভিব্যহারে মদীনার পথে প্রত্যাবর্তন করিলেন। পথিমধ্যে ওয়াদিয়ে খোম নামক স্থানে পৌঁছিয়া সাহাবীগণকে একত্রিত করিয়া বলিতে লাগিলেন :
“লোক সকল, আমিও মানুষ। হইতে পারে শীঘ্রই আল্লাহর ডাক আসিয়া পড়িবে এবং আমকেও তাহা কবুল করিতে হইবে। আমি তোমাদের জন্য দুইটি দৃঢ় ভিত্তি রাখিয়া যাইতেছি। একটি আল্লাহর কিতাব, যাহাতে হেদায়েত ও আলো রহিয়াছে। উহা দৃঢ়তার আকর্ষণ কর। দ্বিতীয় ভিত্তিটি হইতেছে আমার আহলে বায়ত বা বংশধরগণ। আমি আমার আহলে বায়ত সম্পর্কে তোমাদিগকে খোদার ভয় পোষণ করিতে উপদেশ দিয়া যাইতেছি।”
এই উপদেশে যেন আল্লাহর রসূলের বংশধর সম্পর্কে তিনি উম্মতকে পথ প্রদর্শন করিতেছিলেন। যেন কোন সাধারণ ব্যাপারে উত্তেজিত হইয়া কেহ রসূলের অতি ছোট বংশধরের সহিতও কোন প্রকার অশোভন আচরণ করিতে উদ্যত না হয়।
মদীনার নিকটবর্তী হইয়া রসূলুল্লাহ (সা) যুল-হোলায়ফা নামক স্থানে অবস্থান করিলেন। দ্বিতীয় দিন সহিসালামতে মদীনায় প্রবেশ করেন।
পরপারের প্রস্তুতি
মদীনায় পৌঁছিয়া আল্লাহর রসূল (সা) (আরবী*******) এই আয়াতের উপর আমল করিতে বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করিলেন। আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার ঔৎসুক্য যেন দিনদিনই প্রবলতর হইয়া উঠিতেছিল। সকাল সন্ধা কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্মরণে কাটাইয়া দেওয়ার অতৃপ্ত বাসনা যেন আরও তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল।
পবিত্র রমযানে তিনি সবসময়ই দশ দিনের এতেকাফ করিতেন! হিজরী দশ সনে বিশ দিনের এতেকাফ করিলেন। একদিন হযরত ফাতেমা জাহরা (রা) আগমন করিলে তাঁহাকে বলিলেন, “প্রিয় বৎস, আমার শেষ দিন নিকটবর্তী বলিয়া মনে হইতেছে।”
এই সময় ওহুদের ময়দানের শহীদগণের মর্মান্তিক শাহাদাত এবং বীর্তব্যঞ্জক আত্মত্যাগের কথা স্মরণ হইলে পর শহীদানের মাজারে গমন করিলেন। নিতান্ত আবেগের সহিত তাঁহাদের জন্য দোয়অ করিলেন। পুনরায় জানাজার নামায পড়িলেন। শেষে শহীদদের নিকট হইতে এমনভাবে বিদায় চাহিতে লাগিলেন যেমন কোন স্নেহময় মুরব্বী স্নেহের শিশুদিগকে আদর করিয়া বিদায় নেন। শহীদানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া মসজিতে নবনীর মিম্বরে উপবেশন করিলেন এবং সাহাবীগণকে উদ্দেশ করিয়া বেদানাবিধুর বণ্ঠে বলিতে লাগিলেনঃ
“বন্ধুগণ, এখন আমি তোমাদিগকে ছাড়িয়া আখেরাতের মনজিলে চলিয়া যাইতেছি, যেন আল্লাহর দরবারে তোমাদের জন্য সাক্ষ্য দিতে পারি। আল্লাহর শপথ, এখান হইতে আমি আমার হাউজ দেখিতে পাইতেছি। যার বিস্তৃতি ‘আয়লা’ হইতে
‘হায়ফা’ পর্যন্ত। আমাকে সমগ্র দুনিয়ার ধনভাণ্ডারের চাবি দেওয়া হইয়াছে। এখন আর আমি এই ভয় করিতেছি যে, তোমরা দুনিয়ায় অত্যধিক লিপ্ত হইয়া না যাও এবং এই জন্য পরস্পর খুনাখুনি শুরু না কর। এমতাবস্থায় তোমরাও তদ্রূপই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া যাইবে যদ্রূপ তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।”
কিছুক্ষণ পর পবিত্র অন্তরের মধ্যে হযরত যায়েদ বিন হারেসার স্মরণ আসিল! তাঁহাকে সিরিয়া সীমান্তের আরবগণ শহীদ করিয়া ফেলিয়াছিল। আল্লাহর রসূল বলিলেন, উসামা ইবনে যায়েদ যেন সৈন্যসহ যাইয়া পিতার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
এই সময়টিতে সাধারণতঃ জীবনসঙ্গী শহীদদের কথাই তাঁহার বেশী করিয়া স্মরণে আসিত।
এক রাত্রে জান্নাতুল বাকীতে সমাধিস্থদের কথা স্মরণ হইল। উহা সাধারণ মুসলমানদের সমাধিভূমি ছিল। পরলোকগত সাথীদের প্রতি হৃদয়ের চানে অর্ধেক রাতের সময়ই জান্নাতুল বাকীতে চলিয়া গেলেন এবং তথায় শায়িতদের জন্য নিতান্ত দরদের সহিত দোয়া করিলেন। সাথীদের উদ্দেশে বলিলেন, “আমিও শীঘ্রই তোমাদের সহিত মিলিত হইতেছি।”
আর একদিন মুসলমানদিগকে মসজিতে নববীতে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সম্মিলিত জনতাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন:
মুসলমানগণ, তোমরা আমার সাদর সম্ভাষণ গ্রহণ কর। আল্লাহ তোমাদের জন্য অফুরন্ত নেয়ামত নাজিল করুন। তোমাদিগকে সম্মান ও উন্নতি প্রদান করুন। তোমাদের জন্য শান্তি সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করিয়া দিন। এখন হইতে একমাত্র আল্লাহই তোমাদের রক্ষক ও পরিচালক। আমি তোমাদিগকে তাঁহার প্রতি ভয় পোষণ করার আবেদন জানাইতেছি। দেখিও, আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর বন্দাদের মধ্যে অহংকার এবং প্রাধান্যের বড়াই করিও না। আল্লাহর এই বাণী তোমরা সর্বাবস্থায়ই স্মরণ রাখিও- (আরবী****)
-“উহা আখেরাতের আশ্রয়স্থল। আমি উহা তাহাদিগকেই দান করি যাহারা ‍দুনিয়াতে অহংকার ও বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা না করে। আখেরাতের কামিয়াবী কেবলমাত্র খোদাভীরুদের জন্য।”
অতঃপর বলিলেণ- (আরবী*******)
‘অহংকারীদের আশ্রয় কি দোযখে নহে’। সর্বশেষ বলিলেন, তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হউক এবং তাহাদের সকলের উর যাহারা ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে আমার উম্মতে আসিয়া শামিল হইবে।
রোগের সূচনা
২৯শে সফর সোমবার দিন কোন এক জানাযা হইতে প্রত্যাবর্তন পথে মাথা ব্যাথার মধ্য দিয়া রোগের সূচনা হয়। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, রসূলে খোদার (সা) মাথায় একটি রুমাল বাঁধা ছিল। আমি উহার উপর হাত রাখিলাম; মাথা এত বেশী উত্তপ্ত হইয়াছিল যে, হাতে তাহা সহ্য হইতেছিল না। দ্বিতীয় দিবসেই রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এই জন্য মুসলিম জননীগণ সকলেন মিলিয়া তাঁহাকে হযরত আয়েশার ঘরে অবস্থানের ব্যবস্থা করিলেন, কিন্তু শরীর এত দুর্বল হইয়া গিয়াছিল যে, স্বয়ং হযরত আয়েশার ঘর পর্যন্ত যাইতে সমর্থ হইলেন না। হযরত আলী এবং হযরত আব্বাস (রা) মিলিয়া দুই বাহু ধরিয়া অত্যন্ত কষ্টের সাথে তাঁহাকে হযরত আয়েশার ঘর পর্যন্ত লইয়া আসিলেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) বলেন, আল্লাহর রসূল (সা) কখনও অসুস্থ হইলে এই দোয়া পড়িয়া দম করতঃ সর্বশরীরে হাত মুছিয়া দিতেন। (আরবী***********)
-“হে মানুষের প্রভু, সংকট দূর করিয়া দাও। হে আরোগ্যদাতা, আরোগ্য করিয়া দাও। তুমি যাহাকে নিরাময় কর সেই আরোগ্য লাভ করিয়া রসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে ফুঁক দিয়া সেই হাত শরীরের সর্বত্র ফিরাইয়া দিতে চাহিলাম, কিন্তু তিনি হাত টানিয়া নিলেন এবং বলিতে লাগিলেন- (আরবী************)
-“হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা কর এবং তোমার সান্নিধ্য দান কর।”
শেষ বিদায়ের পাঁচ দিন পূর্বে
শেষ বিদায়ের পাঁচ দিন পূর্বে বুধবার দিবস পাথরের একটি জলপাত্রে উপবেশন করতঃ মাথায় সাত মশক পানি ঢালিতে বলিলেন। ইহাতে শরীর কিছুটা সুস্থ হইয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে চলিয়া আসিলেন এবং বলিতে লাগিলেন : “মুসলমানগণ, তোমাদের পূর্বে এমন সব জাতি অতিবাহিত হইয়াছে, ডাহারা তাহাদের পয়গম্বর ও সৎ] ব্যক্তিদের কবরকে সেজদার স্থানে পরিণত করিয়াছিল। তোমরা কখনও এইরূপ করিও না।” পুনরায় বলিলেন, “ঐ সমস্ত ইহুদী নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত, যাহারা তাহাদের পয়গম্বরদের কবরকে সেজাদার স্থানে পরিণত করিয়াছে। আমার পর আমার কবরকে এইরূপ করিও না যাহাতে পূজা শুরু হইবে। মুসলমানগণ, ঐ জাতি আল্লাহর অভিশাপে পতিত হয়, যাহারা নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করে। দেখ, আমি তাহাদিগকে এইরূপ করিতে বারণ করিতেছি। দেখ, পুনরায় আমি সেই কথাই বলিতেছি!! হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকিও! হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকিও!
আল্লাহ তাঁহার এক বান্দাকে দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল সম্পদ অথবা আখেরাত কবুল করার এখতিয়ার দিয়াছিলেন, কিন্তু সেই বান্দা কেবলমাত্র আখেরাত কবুল করার এখতিয়ার দিয়াছিলেন, কিন্তু সেই বান্দা কেবলমাত্র আখেরাত কবুল করিয়া লইয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া হযরত আবু কবর (রা) কাঁদিতে শুরু করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, হে আল্লাহর রসূল, আমাদের পিতা-মাতা, আমাদের জীবন, আমাদে সম্পদ সবকিছু আপনার জন্য উৎসর্গ হউক! লোকেরা আশ্চার্যান্বিত হইয়া হযরত আবু বকরকে দেখিতে লাড়িলেন। তাঁহারা মনে করিলেন, আল্লাহর রসূল এক ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করিতেছেন, ইহার মধ্যে আবার রোদনের কি কারণ ঘটিল? কিন্তু এই কথা তিনিই বুঝিয়াছিলেন, শুনিবা মাত্রই যাঁহার চক্ষু অশ্রু প্লাবিত হইয়া উঠিয়াছিল।
হযরত সিদ্দিকের এই আন্তরিকতা দেখিয়া আল্লাহর রসূলের (সা) অন্তরে অন্য কথা উদিত হইল। তিনি বলিতে লাগিলেন, যে ব্যক্তির সম্পদ ও সাহচর্যে আমি সবচাইতে বেশী কৃতজ্ঞ, তিনি আবু বকর। আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাহাকেও যদি বন্ধুত্বের জন্যে নির্বাচিত করিতে পারিতাম, তবে তিনি হিইতেন আবু বকর, কিন্তু কেবলমাত্র ইসলামের বন্ধনই আমার বন্ধনই আমার বন্ধত্বের মাপকাঠি এবং উহার আমি যথেষ্ট মনে করি। মসজিদের সহিত সংযুক্তহ রাস্তা আছে, একমাত্র আবু বকরে রাস্তা ব্যতী িআর তাগারও রাম্দা অবশিষ্ট রাখিও না।
আল্লাজর রসূল (সা) রুগ্ন হওয়ার পর মদীনার আনসারগণ সকলেই রোদগন করিতেছিলেন। হযরত আবু বকর ও হযরত আব্বাস (রা) পথ দিয়া যাওয়ার সময় আনসারগণকে রোদন করিতে দেখিলেণ। রোদনের কারণ জিজ্ঞাসা করার পর তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, আল্লাহর রসূলের (সা) সাহচর্যেরে স্মৃতি আমাদিগকে ব্যথিত করিয়া তুলিয়াছে। আনসারদের এই অবস্থা আল্লাহর রসূলের কর্ণগোচর হইয়াছিল। তিনি বলিতে লাগিলেন, লোকসকল, আমি আমর আনসারদের সম্পর্কে তোমাদিগকে অন্তিম উপদেশ দিতেছি। সাধারণ মুসলমান দিন দিনই বর্ধিত হইবে, কিন্তু আমার আনসারগণ থাকিবেন নিতান্টত অল্প। ইহারা আমার শরীরের আচ্ছাদন এবং জীবন-পথের অবলম্বন। তাহারা তাহাদের কর্তব্য শেষ করিয়াছেন, তাঁহারা তাহাদের কর্তব্য শেষ করিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের প্রাপ্য বাকী রহিয়াছে। যে ব্যক্তি উম্মতের ভাল-মন্দের জন্য দায়ী হইবেন, তাঁহার কর্তব্য হইবে আনসারদের যথার্থ মর্যাদা দান করা এবং যদি কোন আনসার দ্বারা কোন ভুল সংঘটিত হয় তবে তাহাকে ক্ষমা করা।
আল্লাহর রসূল (সা) নির্দেশ দিয়াছিলেন, হযরত উসামা যেন সৈন্য সহকারে সিরিয়া সীমান্তে যাইয়া স্বীয় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এই নির্দেশ শুনিয়া মোনাফেকরা বলিতে লাগিল একজন সাধারণ যুবককে মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া সাম্যের নবী বলিতে লাগিলেন-
“আজ উসামার নেতৃত্বে তোমাদের আপত্তি দেখা দিয়াছে। কাল তাহার পিতার যায়েদের নেতৃত্বেও তোমরা আপত্তি করিয়াছিলে। আল্লাহর শপথ, সেও এই পদের জন্য যোগ্য ছিল, এও এই পদের জন্য সর্বাপেক্ষা যোগ্য ব্যক্তি। সেও আমার নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিল, এও আমার অত্যন্ত প্রিয় পাত্র।” অতঃপর বলিলেন-
“হালাল ও হারাম নির্দেশ করার ব্যাপারি আমার বরাত দিও না। আমি ঐ সমস্ত বস্তুই হামার করিয়াছি, স্বয়ং আল্লাহ যে সমস্ত বস্তু হারাম করিয়াছেন।”
অতঃপর তিনি আহলে বায়তের প্রতি মনোযোগ দিলেন, যেন নবী-বংশের অহমিকায় পতিত হইয়া তাঁহারা আমল ও পরিশ্রমবিমুখ হইয়া না যান। তাঁহাদের উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন : “হে রসূল –কন্যা ফাতেমা; হে রসূলে খোদার ফুফী সাফিয়া, কিছু পাথেয় সঞ্চয় করিয়া লও। আমি তোমাদিগকে আল্লাহর দরবারে জবাবাদিহি হইতে বাঁচাইতে পারিব না।”
এই হৃদয়-বিদারী খুৎবাই আল্লাহর রসূলের শেষ খুৎবা। মসজিদে নববীর সমাবেশে অতঃপর আর তিনি কোন খুৎবা দিতে উঠেন নাই। খুৎবা শেষ হওয়ার পর আল্লাহর রসূল (সা) হযরত আয়েশার হাজরায় তশরীফ আনিলেন। রোগযন্ত্রণা তখন এমন তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল যে, অস্থিরভাবে পবিত্র চেহারা চাদর দ্বারা ঢাকিয়া ফেলিতেছিলেন, কখনও বা চাদর সরািইয়া দিতেছিলেন। এই অস্থির অবস্থার মধ্যেই হযরত আয়েশা (রা) তাঁহার পবিত্র মুখ হইতে এই কথা উচ্চারিত হইতে শোনেন- “ইহুদী ও খৃষ্টানদের উপর ‘আল্লাহর অভিশাপ হউক; উহারা পয়গম্বরগণের সমাধিকে উপসাপনা মন্দিরে পরিণত করিয়াছে।”
শেষ বিদায়ের চার দিন পূর্বে
ওফাতের চার দিন পূর্বে শুক্রবার দিন আল্লাহর রসূল (সা) হযরত আয়েশাকে তাঁহার পিতা হযরত আবু বকর (রা) ও ভ্রাতা আবদুর রহামনাকে ডাকিয়া আনিতে নির্দেশ দিলেন। এই সময়ই বলিতে লাগিলেন: “দোয়াত কলম নিয়া আস। আমি তোমাদিগকে এমন ফরমান লিখিয়া দিব, যাহার পর আর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হইবে না।” ব্যাধির তীব্রতার দনুনই আল্লাহর রসীলের (সা) অন্ত এইরূপ খেয়াল উদয় হইয়াছিল। হযরত ওমর ফারুক (রা) এই সময় মত প্রকাশ করিলেন, এমতাবস্থায় আল্লাহর রসূলকে অধিক কষ্ট দেওয়া সমীচণি হইবে না। শরীয়তের এমন কোন দিক নাই, যাহার উপর কোরআন পাক পূর্ণভাবে আলোকপাত না করিয়াছে। কোন কোন সাহাবী ওমরের (রা) এই মতের সহিত একমত হইতে না পারিয়া বিতর্ক শুরু করিলেন। এমতাবস্থায় শোরগোল যখন বাড়িয়া চলিল, তখন কেহ বলিলেন, এই ব্যাপারে রসূলুল্লাহ (সা)-কো পুনরায় জিজ্ঞাসা করিয়া লওয়া প্রয়োজন! এই সময় রসূলুল্লাহ (সা) বলিতেহ লাগিলেন, “আমাকে ছাড়িয়া দাও; আমি এখন যেখানে অবস্থান করিতেছি তাহা তোমরা আমাকে আমাকে যেখানে আহ্বান করিতেছ তাহা হইতে শ্রেয়।” এই দিনই আর তিনটিচ অন্তিম নির্দেশ দিলেন:
১. আরবে যেন কোন অংশীবাদী না অবস্থান না করে।
২. রাষ্ট্রদূত ও পররাজ্যের প্রতিনিধিবর্গের যেন যথাযোগ্য মর্যাদা ও যত্ন করা হয়।
৩. কোরআন সম্পর্কেও কিছু বলিয়াছিলেন, কিন্তু উহা বর্ণনাকারী ভুলিয়া যান।
তীব্র ব্যাধিত আক্রাপন্ত হইয়াও রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ এগারো দিন পর্যন্ত মসজিদে রীতিমতই আগমন করিতেছিলেন। বৃহস্পতিবার দিন মাগরিবের নামাযও স্বয়ং পড়াইলেন। এই নামাযে সূরা মুরসালাত’ তেলাওয়াত করিয়াছিলেন। এশার সময় একটু হুশ হইলে জিজ্ঞাসা করিলেন, নামায শেষ হইয়াছে কি? বলা হইল, না। মুসলমানগণ আপনার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন। এমতাবস্থায় পানি উঠাইয়া গোসল করিলেন একং নামাযে শামিল হইবার জন্য রওয়ানা হইলেন, কিন্তু এরম মধ্যেই তিনি বেহুশ হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পর আবার চক্ষু খুলিলে জিজ্ঞাসা করিলেন, নামায হইয়া গিয়াছে কি? নিবেদন করা হইল “ইয়া রসূলুল্লাহ মুসলমানগণ আপনার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন।” এই কথা শুনিয়া তিনি আবার উঠিতে চাহিলেন, কিন্তু পুনরায় বেহুশ হইয়া পড়িয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর চক্ষু খুলিলে সেই একই প্রশ্ন করিলেন। জওয়াব দেওয়া হইল: মুসলমানগণ হুজুরের অপেক্ষা করিতেছেন। এই বার উঠিয়া শরীরে পানি দিলেন, কিন্তু উঠিয়া যাইয়াই আবার বেহুশ হইয়া গেলেন। হুশ হইলে নির্দেশ দিলেন, আবু বকর নামায পড়াইয়া দিন। হযরত আয়েশা বলিলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আবু বকর অত্যন্ত কোমল অন্তরের লোক। আপনার স্থানে দাঁড়াইয়া হয়ত স্থির থাকিতে পারিবেন না, কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা) আবার নির্দেশ দিলেন, আবু বকরই নামায পড়াইবেন। হযরত আয়েশার ধারণ ছিল, রসূলুল্লাহ আলাইহে ও সাল্লামের পরলোক তাঁহাকে হয়ত অপয়া মনে করিবে। বর্ণিত আছে, এই সময় হযরত আবু কবকর (রা) উপস্থিত না থাকায় কেহ কেহ হযরত ওমরকে সম্মুখে ঠেলিয়া দিতে চাহিলেন। এই কথা জানিতে পারিয়া রসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত দৃড়তার সহিত বলিতে লাগিলেন, না, না, না, আবু বকরই নামায পড়াইবেন।
আল্লাহর রসূলের (সা) মিম্বর কিছুদিন পূর্ব হইতেই শূন্য হইয়া গিয়াছিল। আজ জায়নামাযও শূন্য হইয়া গেল্ হযরত আবু বকর (রা) রসূলে খোদার (সা) স্থানে দণ্ডায়মান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে উপস্থিত সকলের অন্তরে নৈরাশ্যের কালো পর্দা নামিয়া আসিল। সকলের চোখেই সমানভাবে অশ্রু প্লাবন দেখা দিল। স্বয়ং হযরত আবু বকরের পদযুগল কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু রসূলের নির্দেশ ও আল্লাহর অনুগ্রহ থাকায় কোন প্রকারে তিনি এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। এইভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায়ই হযরত আবু বকর (রা) সতেরো ওয়াক্তের নামাযে ইমামতি করিলেন।
বিদায়ের দুই দিন পূর্বে
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) জোহরের নামায পড়াইতেছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর রসূল (সা) মসজিদে আসিতে মনস্থ করিলেন এবং হযরত আলী ও হযরত আব্বাসের (রা) কাঁধে হাত রাখিয়া জামাতে তশরীফ আনিলেণ। ‍উপস্থিত নামাযীগণ অত্যন্ত অস্থিরতার সহিত রসূলুল্লঅহ (সা)-এর আগমন লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। হযরত আবু বকর (রা) পর্যন্ত ইমামের স্থান হইতে পশ্চাতে সরিয়া আসিতে লাগিলেন, কিন্তু রসূলুল্লাহ (সা) হাতে ইশারা করিয়া তাঁহাকে সরিয়া আসিতে বারণ করিলেন এবং স্বয়ং তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া নামায আদায় করিতে লাগিলেন। হযরত আবু বকর (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একতেদা করিতেছিলেন; এইভাবে নামাজ সমাপ্ত হইলে পর হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশার রা) ঘরে ফিরিয়া আসিলেন।
বিদায়ের একদিন পূর্বে
কুল-মানবের জীবন-দীশারী আল্লাহর রসূল (সা) দুনিয়ার বাঁধন হইতে মুক্ত হইতেছিলেন। সেই দিন সকালে উঠিয়া সর্বপ্রথম সকল ক্রীতদাস-দাসীকে মুক্তি দিলেন। সংখ্যায় ছিল তাহার চল্লিশ জন। এরপর ঘরের মাল-সামানের প্রতি দৃষ্টি দিলেন। আল্লাগর নবীর ঘরে তখন সর্বমোট সঞ্চয় ছিল মাত্র সাতটি স্বর্ণমুদ্র। হযরত আয়েশাকে বলিলেন, এইগুলি গরীবদের মধ্যে বন্টন করিয়া দাও। আমর লজ্জা হয়, রসূল তাহার আল্লাহর সহিত মিলিত হইতে যাইবেন আর তাহার ঘরে দুনিয়ার সম্পদ জমা হইয়া থাকিবে! এই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকল কিছু নিঃশেষে বিলাইয়া দেওয়া হইল। সেই রাত্রে আল্লাহর রসূলের ঘরে বাতি জ্বালাইবার মত এক ফোঁটা তৈলও আর অবশিষ্ট ছিল না। একজন প্রতিবেশী স্ত্রীলোকের নিকট হইতে সামান্য তৈল ধার করিয়া আনা হইয়াছিল। ঘরে কিছু অস্ত্র পড়িয়াছিল। এইগুলিও মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়া হইল। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের বর্মটি ত্রিশ সা’ গমের মূল্য বাবত এক হহুদীর ঘরে বন্ধক ছিল।
দুর্বলতা তখন ক্রমশই বর্ধিত হইয়া চলিয়াছিল। কোন কোন দরদমন্দ আসিয়া ঔসধ সেবন করাইতে চাহিলেন, কিন্তু আল্লাহর রসূল (সা) ঔষধ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলেন। এই সময় সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িলেন। পরিচার্যাকারীগণ মুখ খুলিয়া কিছু ঔষধ পান করাইয়া দিলেন। হুশ ফিরিয়া আসিলে পর ঔষধের কথা জানিতে পারিয়া বলিতে লাগিলেন, “যাহার ঔষধ পান করাইয়াছে; তাহাদিগকে ধরিয়া এই ঔষধ পান করাইয়া দাও। কারণ, যাহার জন্য ইহারা এহেন প্রচেষ্টা চালাইয়াছিল, তিনি তাহার মহান আল্লাহর চুড়ান্ত আহ্বান করুল করিয়া ফেলিয়াছিলেন। এখন এখানে দাওয়া বা দোয়া প্রয়োগের আর কোন সুযোগ অবশিষ্ট ছিল না।”
বিদায়ের দিন
৯ই বরিউল আউয়াল সোমবার দিন শরীর যেন একটু ভাল বলিয়া মনে হইতেছিল। মসজিদে তখন ফজরের নামায হইতেছে। আল্লাহর রসূল হুজরা ও মসজিদের মধ্যবর্তী পর্দা একটু সরাইয়া দিলেন। তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখে ছিল তখন রুকু-সেজাদরত নামাযীদের বিস্তৃত কাতার। সরওয়ারে আলম তাঁর জীবন-সাধনার এই পবিত্র দৃশ্য প্রাণ ভরিয়া দেখিতেছিলেন। আনন্দাতিশয্যে একটু হাসিয়া উছিলেন। লোকদের ধারণা হইল, বোধ হয় তিনি মসজিদে তশরীফ আনিতেছেন। সকলেই যেন একটু অধীর হইয়া উঠিলেন। কেহ কেহ নামায ছাড়িয়া পিছাইতে শুরু করিলেন। হুজুর (রা) হাতে ইশারা দিয়া সকলকে শান্ত করিলেন এবং পবিত্র চেহারার শেষ ঝলক দেখাইয়া হুজরার পর্দা ফেলিয়া দিলেন। মুসলিম জনতার জন্য আল্লাহর রসূলের এই দর্শন ছিল শেষ দর্শন। এই ব্যবস্তা বোধ হয় খোদ বিশ্বনিয়ন্তার পক্ষ হইতেই করা হইয়াছিল, যেন নামাযের সঙ্গী-সাথীগণ দুনিয়ার শেষ দর্শন লাভ করার সুযোগ পান।
৯ই রবিউল আওয়াল সকাল হইতেই আল্লাহর রসূলের অবস্থা আশ্চর্য রকমভাবে পরিবর্তিত হইতেছিল। দিনের সূর্য ঊর্ধ্বগগনে উদিত হইতেছিল; আর নবুওয়তের সূর্য ধীরে ধীরে অস্তাচলের পথে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছিল। আল্লাহর রসূলের উপর বে-হুশীর কাল মেঘ যেন বার বার আসিয়া তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিতেছিল। ক্ষণে ক্ষণে বেহুশ হইয়া যাইতেছিলেন আবার সঙ্গে সঙ্গেই হুশ ফিরিয়া আসিতেছিল। আবার বেহুশ হইয়া পড়িতেছিলেন। এই কষ্টের মধ্যে প্রিয়তমা কন্যা হযরত ফাতেমাকে স্মরণ করিলেন। হযরত ফাতেমা পিতার এই অবস্থা দেখিয়া নিজেকে সামলাইতে পারিলেন না। তিনি পিতার শরীর জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। কন্যাকে এইভাবে ভাঙ্গিয়া পড়িতে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, “প্রিয় বৎস, কাঁদিও না। দুনিয়া হেইতে যখন আমি চলিয়া যাইব, তখন ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন বলিও। ইহার মধ্যেই প্রত্যেরেক জন্য বান্ত্বনার বাণী নিহিত রহিয়াছে।” হযরত ফাতেমা (রা) জিজ্ঞাসার করিলেনস, ইহাতে আপনার কি সান্ত্বনা আসিবে? বলিলেন, হাঁ, ইহাতে আমার সান্ত্বনা নিহিত আছে।
প্রিয় নবীর ব্যাধির তীব্রতা যিই বর্ধিত হইতেছিল, হযরত ফাতেমার অন্তর্দাহ ততই যেন বাড়িয়া উঠিতেছিল। রাহমাতুল লিলআলামীন প্রিয় কন্যার এই অবস্থা অনুভব করিতে পারিয়া কিছু বলিতে চাহিলেন। হযরত ফাতেমা (রা) তাঁহার মুখের নিকট কান পাতিলে তিনি বলিতে লাগিলেন- “কন্যা! আমি আজ দুনিয়া ত্যাগ করিতেছি।” এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হযরত ফাতেমা (রা) কাঁদিয়া উঠিলেন। আল্লাহর রসূল পুনরায় বলিলেন, “আমার আহলে বায়াতের মধ্যে সর্বপ্রথম তুমিই আমার সহিত আসিয়া মিলিত হইবে।” এই কথা শোনামাত্র হযরত ফাতেমা (রা) হাসিয়া উঠিলেন। মনে করিলেন, এই বিচ্ছেদ অল্প দিনের।
মানবতার নবীর অবস্থা ক্রমেই নাজুক হইয়া উঠিতেছিল। অবস্থা দেখিয়া হযরত ফাতেমা (রা) মর্মবিদারী কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “হায় আমর পিতার কষ্ট! তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলিলেন ফাতেমা; আজকের দিনের পর আর তোমার পিতা কখনও অস্থির হইবেন না।”
হযরত হাসান ও হোসাইন (রা) একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। তাঁহাদের কাছে ডাকিয়া সান্ত্বনা দিলেন, চুম্বন করিলেন এবং তাঁহাদের মর্যাদা রক্ষা ‍করার জন্য সকলকে অছিয়ত করিলেন। মুসলিম জননীগণকে ডাকিয়া আনিলেন এবং তাঁহারদিগকেও উপদেশ দান করিলেন। এই সময়ই বলিতে লাগিলেন, (আরবী******)
“তাঁহাদের সহিত যাঁহাদিগকে আল্লাহ নেয়ামত দান করিয়াছেন।”
কখনওবা বলিলেন- (আরবী*****)
হে আল্লাহ, শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
অতঃপর হযরত আলীকে ডাকিলেন। তিনি আসিয়া রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র মস্তক কোলে ‍তুলিয়া লইলেন, তাঁহাকেও নসীহত করিলেন। সর্বশেষ আল্লাহর প্রতি মনোযোগ দিলেন এবং বলিতে- (আরবী*****)
“নামায, নামায; এবং তোমাদের ক্রীতদাস-দাসীগণ……..।”
তখন হইতেই মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হইয়াছিল। হযরত রাহমাতুল লিলআলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম অর্ধশায়িত অবস্থায় হযরত আয়েশার গায়ে হেলান দিয়া রহিয়াছিলেন। নিকটেই পানির পেয়ালা রাখা ছিল। উহাতে হাত রাখিতেছিলেন এবং পবিত্র চেহারা মুছিয়া দিতেছিলেন। পবিত্র চেহারা কখনও লাল হইয়া উঠিতেছিল, কখনও ফ্যাকাশে হইয়া যাইতেছিল। যবান মোবারক ধীরে ধীরে চলিতেছিল। তিন উচ্চারণ করিতেছিলেন- (আরবী*******)
-“আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য নাই, মৃত্যু সত্য কষ্টদায়ক।”
হযরতহ আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা) একটি তাজা মেসওয়াক লইয়া আসিলে পর রসূলে খোদা সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উহার প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করিলেন। হযরত আয়েশা (রা) বুঝিলেন, মেসওয়াক করার ইচ্ছা হইয়াছে। তিনি হযরত আবদুর রহমান (রা) হইতে মেসওয়াকখানা লইয়া নিজ মুখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে নরম করিয়া দিলেন। রসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মেসওয়াক করার পর তাঁহার চেহারা উজ্জ্বলতা আরও বাড়িয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর রসূল দুই হাত উর্ধ্বে তুলিলেন। মনে হইল যেন কোথাও রওয়ানা হইয়াছেন। মুখে উচ্চারিত হইল…… (আরবী********)
“এখন আর কিছুই নহে; শুধু শ্রেষ্ঠ বন্ধু আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য চাই।” তৃতীয় বার উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই হাত নীচে পড়িয়া গেল। চোখের পুত্তলী উপরের দিকে উঠিয়া গেল এবং পবিত্র রূহ চিরতরে এই দুনিয়া ছাড়িয়া বিদায় গ্রহণ করি।। (আরবী****)
উহা ছিল রবিউল আউয়াল মাস। হিজরী ১১ সনের সোমবার দিবস চাশতের সময়। রসূলে করীম (সা) –িএর বয়স হইয়াছিল তখন চান্দ্রমাসের হিসাবে ৬৩ বৎসর ৪ দিন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্ন ইলাইহে রাজেউন।
শোকের ছায়া
রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ওফাতের খবর শুনিয়া মুসলমানদের যেন কলিজা ফাটিয়া যেল, পা যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল। চেহারার জ্যোতি নিভিয়া গেল। চক্ষু রক্তাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল। আকাশে আর মাটিতে যেন ভীতি দেখা দিল। সূর্যের আলো যেন অন্ধকার হইয়া আসিল। অশ্রুর প্লাবন যেন আর বাঁধ মানিতেছিল না। কয়েকজন সাহাবী বেদানা সহ্য করিতে না পারিয়া লোকালয় ছাড়িয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। কেহ কেহ জনশূন্য প্রান্তরের দিগকে ছুটিয়া গেলেন। যিনি বসিয়া ছিলেন তিনি বসিয়াই রহিলেন। যিনি দণ্ডায়মান ছিলেন তিনি যেন বসিবার মত শক্তি হারাইয়া ফেলিলেন। সমজিদে নববী কেয়ামতের পূর্বেই যেন কেয়ামতো ভয়ানক রূপ ধারণ করিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) তশরীফ আনিলেন এবং চুপচাপ হযরত আয়েশার হুজরায় চলিয়া গেলেন। তথায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের লাশ মোবারক রক্ষিত ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) পবিত্র চেহারা হইতে চাদর তুলিয়া কপাল চুম্বন ককিরলেন। অতঃপর চাদর ফেলিয়া দিয়া ক্রন্দন করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন,- “হুজুর, আমার পিতামাতা আপনার নামে উৎসর্গ হউন। আপনার জীবন ছিল পবিত্র, আপনার মৃত্যুও তদ্রূপ পবিত্র হইয়াছে। আল্লাহর শপথ, এখন আপনার উপর আর দ্বিতীয় মৃত্যু আসিবে না; আল্লাহ্‌ আপনার জন্য যে মৃত্যু লিখিয়া রাখিয়াছিলেন তাহার স্বাদ অদ্য আপনি গ্রহণ করিয়াছেন। এখন আর কোন কালেও মৃত্যু আপরাকে স্পর্শ করিতে পারিবে না।”
তথা হইতে হযরতআবু বকর (রা) মসজিদে নববীতে তশরীফ আনিলেন। দেখিতে পাইলেন, হযরত ওমর (রা) অধীর হইয়া ঘোষলা করিতেছেন,- “মোনাফেকরা বলে, হযরত মোহাম্মদ (সা) ইন্তেকাল করিয়াছেন। আল্লাহর শপথ, তাঁহার মৃত্যু হয় নাই। তিনি হযরত মূসার ন্যায় আল্লাহর সান্নিধ্যে আহূহ হইয়াছেন। হযরত মূসা চল্লিশ দিন অদৃশ্য থাকিয়া ফিলিয়া আসিয়াছিলেন। তখনও হযরত মূসা সম্পর্কে এইরূপ প্রচার করা ইয়াছিল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। আল্লাহর শপথ! মোহাম্মদ রসূলুল্লাহ (সা)ও তাঁহারও ন্যায় পুনরায় ‍দুনিয়ায় ফিরিয়া আসিবেন এবং যাহারা তাঁহার উপর মৃত্যুর অপবাদ দিতেছে, তাহাদের হাত-পা কাটিয়া শাস্তি দিবেন।”
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ওমর ফারুকের কথা শুনিয়া বলিলেন, ওমর শান্ত হও! চুপ কর, কিন্তু হযরত ওমর (রা) যখন কেবল বলিয়অিই চলিয়াছিলেন, তখন তিনি বিশেষ বিচক্ষণতার সহিত তথা হিইতে একটু সরিয়া অন্য জায়গায় দাঁড়াইয়া বক্তৃতা শুরু করিলেন। উপস্থিত জনসাধারণও একে একে তাঁহার দিকে চলিয়া আসিতে লাগিলেন। তিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর মহিমা কীর্তন করিয়া বলিতে লাগিলেন:
লোকসকল, যাহারা মোহাম্মদ (সা)-কে পূজা করিতে তাহারা জানিয়অ রাখ, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে! আর যাহারা আল্লাহর এবাদত কর তাহারা জানিয়া রাখ: তিনি চির জীবিত, কখনও তাঁহার মৃত্যু হইবে না। এই কথা খোদ কোরআন পাকে স্পষ্টভাবে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে : (আরবী*******)
-“মোহাম্মদ (সা)রসূল ব্যতীত কিছুই নহেন, তাঁহার পূর্বেও অনেক রসূল অতিবাহিত হইয়া গিয়াছেন; তিনি যদি মৃত্যুমুখে পতিত হন, অথবা শহীদ হইয়া যান, তবে কি তোমরা আল্লাহর দ্বীন হইতে সরিয়া যাইবে? যে ব্যক্তি সরিয়া দাঁড়াইবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতিই করিতে পারিবে না; আল্লাহ কৃতজ্ঞদের প্রতিফল তান করিবেন।”
কোরআনের এই আয়াত শ্রবণ করিয়া মুসলমানগণ চমকিয়া উঠিলেন। হযরত আবদুল্লাহ (রা) বলেন, “আল্লাহর শপথ, আমাদের এমন মনে হইতেছিল যে, এই আয়াত ইতপূর্বে নাহিলই গয় নাই।” হযরত ওমর (রা) বলেন, “হযরত আবু বকরের মুখে এই আয়াত শ্রবণ করিয়া আমার পা যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল। দাঁড়াইয়া থাকার শক্তি আমার ছিল না। আমি ঢলিয়া পড়িলাম। আমার বিশ্বাস হইল, সত্যিই আল্লাহর রসূল ইন্তেকাল করিয়াছেন।”
হযরত ফাতেমা (রা) শোকে অধীর হইয়া বলিতেছিলেন- “প্রিয় পিতা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়অ বেহেশ্‌তে চলিয়া গিয়াছেন। হয়! কে আজ জিবরীল আমীনকে এই দুঃখের খবর শুনাইবে।
ইলাহী, ফাতেমর রূহকেও মোহাম্মদ মোস্তফার (সা) রূহের নিকট পৌঁছাইয়া দাও।! ইলাহী, আমাকে রসূলের দীদার সুখ দান কর।
ইলাহী, আমাকেও তাঁহার সাথে যাওয়ার সৌভাগ্য দান কর। ইলাহী, আমাকে রসূলে আমীনের শাফায়াত হইতে বঞ্চিত করিও না।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকার মনে-প্রাণে শোকের ঘনঘটা ছাইয়া গিয়াছিল। তাঁহার মুখে বিলাপের সুরে রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মহান চরিত্র মাধুর্যের কথা উচ্চারিত হইতেছিল:
“হায়, পরিতাপ! সেই নবী, যিনি সম্পদের মধ্যে দারিদ্র্য বাছিয়া লইয়াছিলেন। যিনি প্রাচুর্য দূরে নিক্ষেপ করিয়া দারিদ্র্য গ্রহণ করিয়াছিলেন।
হয়! সেই ধর্মগত-প্রাণ রসূল যিনি উম্মতের চিন্তায় একটি পূর্ণ রাতও আরামের সাথে শুইতে পারেন নাই।
হায়! সেই মাহান চরিত্রের অধিকারী, যিনি অষ্টপ্রহর প্রবৃত্তির সহিত লড়াই করিয়া গিয়াছেন।
হায়! সেই আল্লাহর নবী, যিনি অবৈধ বস্তুর প্রতি কখনও চোখ তুলিয়া দেখেন নাই।
আহা! সেই রাহমাতুললিল আলামীন, যাঁহার দয়ার দ্বার সর্বক্ষণ দরিদ্রের জন্য খোলা থাকিত। যাঁহর মতির মত দাঁত ভাঙ্গিয়া দেওয়ার পরও তিনি তাহা সহ্য করেন। যাঁহর নূরের পেশানী ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু তিনি ক্ষমার হস্ত সংকুচিত করেন নাই।
হায়! আজ আমাদের এই দুনিয়া সেই মহৎ সত্তার অস্তিত্ব হইতেই শূন্য হইয়া গেল।”
দাফন-কাফন
মঙ্গলবার দিন দাফন-কাফনের প্রস্তুতি চলিল। ফজল বিন আব্বাস, উসামা ইবনে যায়েদ পর্দা উঠাইলেন। আনসারগণের একদল দরজার নিকট আসিয়া বলিতে লাগিলেন,- আমরা হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের শেষ সেবায় অংশ দাবী করিতেছি। হযরত আলী (রা) আওস ইবনে খাওলা আনসারীকে ভিতরে ডাকিয়া নিলেন। তিনি পাত্র ভরিয়া পানি আনিয়া দিতে লাগিলেন। হযরত আলী (রা) লাশ মোবারক বুকে জড়াইয়া পড়িয়া ছিলেন। হযরত আব্বাস (রা) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) লাশ মোবারকের পার্শ্ব পরিবর্তন করিতেছিলেন, হযরত উসামা (রা) উপর হইতে পানি ঢালিয়া দিতেছিলেন। হযরত আলী (রা) গোসল দিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন :-
“আমার পিতামাতা কোরবান হউন, আপনার মৃত্যুতে এমন সম্পদ হারাইয়াছি যা আর কোন মৃত্যুতেই হয় নাই।”
“অদ্য হইতে নবুওয়ত, গায়েরেব খবর এবং ওহী নাযিল হওয়ার পথ রুদ্ধ হইয়া গেল।”
“আপনার মৃত্যু সমস্ত মানবতার জন্য সমান বেদনাদায়ক বিপদ।”
“আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ না দিতেন এবং ক্রন্দন করিতে বারণ না করিতেন, তবে প্রাণ খুলিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতান, কিন্তু তবুও এই ব্যথা চিকিৎসাতীত থাকিত। এই আঘাত কিছুই মুছিত না।”
“আমাদের এই ব্যথা অন্তহীন, আমাদের এই বিপদ প্রতিকারের অতীত।”
“আয় হুজুর! আমার পিতামাতা আপনার উদ্দেশে উৎসর্গ হউন, আপনি যখন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হইবেন, তখন আমাদের কথা স্মরণ করিবেন। আমাদিগকে ভুলিবেন না।”
গোসলান্তে তিন খণ্ড সূতির সাদা কাপড় দ্বারা কাফন দেওয়া হইল। যেহেতু অসিয়ত ছিল, তাঁহার কবর যেন এমন স্থানে রচনা করা না হয়, যেখানে ভক্তগণ সেজদা করার সুযোগ পায়। এই জন্য হযরত আবু বকরের পরামর্শ অনুযায়ী হযরত আয়েশার হজরায়- যেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছিলেন, সেখানেআ কবর তৈয়ার করা হইল। হযরত তাল্‌হা (রা) ‘লাহাদ’ ধরনের কবর খুঁড়িলেন। মাটি আর্দ্র ছিল। এই জন্য যে বিছানায় তিনি ইন্তেকাল করিয়াছিলেন সেই বিছানাই কবরে বিছাইয়া দেওয়া হইল।
প্রস্তুমি সমাপ্ত হইলে পর মুসলিম জনতা জানাযার জন্য দলে দলে সমবেত হইলেন। লাশ মোবারক হুজরার ভিতর রক্ষিত ছিল। এই জন্য মুসলমানগণ ছোট ছোট দলি বিভক্ত হইয়অ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের জানাযা আদায় করিতে যাইতেছিলেন এবং জানাযা সমাপ্ত করিয়া ফিরিতেছিলেন। এই জানাযার নামাযে কেহ ইমাম ছিলেন না।! প্রথম নবী পরিবারের লোকগণ জানাযা পড়িলেন
। অতঃপর মোহাজেরীন এবং আনসারগণ; স্ত্রী, পুরুষ ওশিশুগণ পৃথক পৃথকভাবে জানাযা পড়িলেন।
জানাযার ভীড় সারাদিন ও সারারাত ধরিয়া চলিল। এই জন্য দাফনের কাজ বুধবার দিন অর্থাৎ ইন্তেকালের ৩৬ ঘন্টা পর সমাপ্ত হইল। পবিত্র লাশ হযরত আলী, হযরত ফযল ইবনে আব্বাস, হযরত উসামা ইবনে যায়েদ এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মিলিয়া কবরে নামাইলেন। এইভাপবে শেষ পর্যন্ত এই দুনিয়ার !চাঁদ, দ্বীনের সূর্য এবং কোটি কোটি মানবের হৃদয়ের ধন দুনিয়াবসীর দৃষ্টিপথ হইতে চিরতরে মাটির আবরণে ঢাকিয়া দেওয়া হইল।” ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
পত্যিক্ত সম্পদ
সীরাতুন নবীর লিখক কি সুন্দরই না লিখিয়াছেন,- আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম জীবৎকালেই াব ঘরে কি রাখিতেন যে, মৃত্যুর পর তাহা পরিত্যক্ত হইবে! পূর্বেই তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন- (আরবী*****) “আমরা নবীগণের কোন উত্তরাধিকারী নাই। যাহা আমরা ছাড়িয়া যাই তাহা ছদকা বলিয়া গণ্য।”
আমর ইবনে হুযাইরেস (রা) হইতে বর্ণিত আছে,- “হুজুর (সা) মৃত্যুর সময় কোন কিছু ছাড়িয়া যান নাই। স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্র, দাস-দাসী ইত্যাদি কিছুই নাই। কেবলমাত্র তাঁহর েোহণের একটি সাদা খচ্চর, ব্যবহারের অস্ত্র এবং সামান্য ভূমি ছিল, যাহা সাধারণ মুসলমানগণের মধ্যে দান করিয়া দেওয়া হয়।”
কতগুলি স্মরণীয় বস্তু সাহাবী গণ রক্ষা করিয়াছেন। হযরত আবু তালহার নিকট পবিত্র দাড়ির একগুচ্ছ কেশ ছিল। হযরত আনা ইবনে মালেকের নিকট পবিত্র দাড়ি ব্যতীত একজোড়া জুতা এবং একটি কাঠের ভাঙ্গা পেয়ালা ছিল। তরারি ‘জুলফিকার’ হযরত আলীর নিকট রক্ষিত ছিল। হযরত আয়েশার নিকট যে কাপগ পরিধান থাকা অবস্থায় রসূলে খোদা (সা) ইন্তেকাল করিয়াছিলেন তাহা রক্ষিত ছিল। পবিত্র সীলমোহরও যষ্টি হযরত আবু বকর সিদ্দিকের হাতে সমর্পণ করা হয়।
এ ছাড়া গোটা মানবতার জন্য তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত ছাড়িয়া গিয়াছেন, তাহা হইতেছে আল্লাহর কিতাব কোরআন পাক। তিনি এরশাদা করেন-
(আরবী*********)
-“হে লোকসকল, আমি তোমাদের মধ্যে এমন এক বস্তু ছাড়িয়া চলিয়াছি, ‍যদি তাহা ‍দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, তবে কখনও তোমরা বিভ্রান্ত হইবে না। উহা হইতেছে আল্লাহর কিতাব কোরআন।”

হযরত আবু বকর সিদ্দিকের ইন্তেকাল
হযরত আবু বরক সিদ্দিক (রা) রসূলে খোদার (সা) ইন্তেকালের পর মাত্র দুই বৎসর তিন মাস জীবিত ছিলেন। হযরত ইবনে ওমর (রা) বলেন, “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বিরহ-ব্যথা তিনি সহ্য করিতে পারেন নাই। দিন দিনই কৃশ-দুর্বল হইয়া যাইতেছিলেন। এইভাবেই তিনি দুনিয়া হইতে শেষ বিদায় গ্রহণ করেন।” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনিই সকলকে সান্ত্বনার বাণী শুনাইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার নিজ অন্তরের দাহ একটুও শান্ত হয় নাই। একদিন বৃক্ষ শাখে একটি পাখীকে নাচিয়া বেড়াইতে দেখিয়া একটু উত্তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস সহাকারে বলিতে লাগিলেন, “হে পাখী, কত ভাগ্যবান তুমি। গাছের ফল খাও আর শীতল ছায়ায় আনন্দে কালাতিপাত কর। মৃত্যুর পরও তুমি এমন স্থানে যাইবে, যেখানে কোন প্রকার জবাবাদিহির দায়িত্ব নাই। পরিতাপ! আবু বরকও যদি এমন ভাগ্যবান হইত!” কখনও কখনও বলিতেন “আফসোস! আমি যদি তৃণ হইতাম আর চতুষ্পদ জন্তু আমাকে খাইয়া ফেলিত।” এই সমস্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত উক্তি হইতে অনুমান করা যায়, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চির-বিদায়ের পর হযরত আবু বকরের হৃঙদয়ের ব্যথা কতটুকু উৎকট হইয়া উঠিয়াছিল।
পীড়ার সূচনা
ইবনে হেশাম বলেন, হযরত সিদ্দিকে আকবরের নিকট কিছু গোশ্ত উপহার আসিয়াছিল। তিনি হাঁরেস ইবনে কালদাসহ তাহা খাইতেছিলেন। এমতাবস্থায় হপরেস বলিলেন- “আমীরুল মোমেনীন, আর খাইবেন না। আমার মনে হয় উহাতে বিষ মিশ্রিত রহিয়াছে।” সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খাওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন, কিন্তু এই দিন হইতেই তাঁহাররা উভয়ে পীড়া অনুভব করিতে শুরু করেন। হিজরী ১৩ সালের ৭ই জুমাদাল উখরা সোমবার দিন তিনি গোসল কিরয়াছিলেন। ইহাতেই ছাণ্ডপ লাগিয়া জ্বর শুরু হইল। এই জ্বর আর সারিল না।শরীরে যে পর্যন্ত শক্তি ছিল রীতিমত মসজিদে আসিয়া নামায পড়ােইতে ছিলেন, কিন্তু রোগ যখন তীব্র হইয়া উঠিল, তখন হযরত ওমরকে ডাকাইয়া বলিলেন, “এখন হইতে আপনি নামায পড়াইতে থাকিবেন।”
কোন কোন সাহাবী আসিয়া বলিলেন, “যদি অনুমতি দেন বতে চিকিৎসক ডাকিয়া আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।” জওয়াব দিলেন, চিকিৎসক আমাকে দেখিয়া ফেলিয়াছেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি বলিলেন? হযরত সিদ্দিক বলিলেন,- (আরবী*****
তিনি বলিয়াছেন, “আমি যাহা চাই তাহাই করি।”-(কোরআন)
হযরত ওমরের নির্বাচন
শরীর যখন খুব বেশী দুর্বল হইয়া গেল, তখন রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের খলিফা নির্বাচনের কথা বিশেষভাবে ভাবিতে শুরু করিলেন। তিনি চাইতেন মুসলমানগণ যেন যে কোন প্রকার আত্মকলহ হইতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে। এই জন্য তিনি বিশেষ চিন্তাশীল সাহাবীগণের মতামত গ্রহণ করতঃ নিজেই খলিফার নাম প্রস্তাব করার মনস্থ করিলেন। প্রথম তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ওমর সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তিন বলিলেন, আপনি তাঁহার সম্পর্কে যত ভাল ধারণাই পোষণ করুন না কেন, আমার ধারণা তাহার চাইতেও ভাল। তবে তিন একটু কঠোর প্রকৃতির লোক। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, তাঁহার কঠোরতা ছিল এই জন্য যে, আমি ছিলাম কোমল। যখন তাঁহার উপর দায়িত্ব আসিবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি কোমল হইয়া যাইবেন। এই কথা শুনিয়া হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) চলিয়া গেলেন। অতঃপর হযরত ওসমানকে ডাকাইয়া মতামত জিজ্ঞাসা করিলেন। হযরত ওসমান (রা) বলিলেন, আপনি আমার চাইতে ভাল জানেন। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, তবুও আপনার মাতামত কি? জওয়াবে হযরত ওসমান (রা) বলিলেন, আমি এতটুকু বলিতে পরি, ওমরের চাইতে ভিতর অনেক ভাল এবং তাহার চাইতে যোগ্য ব্যক্তি এখন আমাদের মধ্যে আর কেহ নাই।
হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ এবং উসাইদ ইবনে হোযাএররর নিকটও অনুরূপভাবে পরাপমর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। হযরত উসাইদ (রা) বলিলেন, “ওমরের অন্তর পবিত্র। তিনি সৎকর্মশীলদের বন্ধু ও অসৎদের শত্রু। আমি তাঁহার চাইতে শক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি আর দেখিতেছি না।”
হযরত সিদ্দিক (রা) অনুরূপভাবে বহু লোকের নিকট হযরত ওমর (রা) সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করিতেছিলেন। সমগ্র মদীনায় প্রচারিত হইয়া গিয়াছিল, হযরত আবু বকর (রা) হযরত ওমর (রা)- কে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত করিতে চান। খবর শুনিয়া হযরত তালহা (রা) তাঁহর নিকট আগমন করিয়া বলিতে লাগিলেন, আপনি জানেন, আপনার জীবদ্দশায়ই ওমর (রা) লোকদের সহিত কত কঠোর ব্যবহার করেন, আর এখন যদি তিনি খলিফা ইয়া যান তবে না জানি কি করিতে শুরু করিনঃ আপনি আল্লাহর দরবারে চলিয়া যাইতেছেন, ভাবিয়া দেখন, আপনি আল্লাহর নিকট উহার কি জওয়াব দিবেন। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, আমি খোদাকে বলিব “আমি তোমার বান্দাদের উপর ঐ ব্যক্তিকেই নিযুক্ত করিয়া আসিয়াছি, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন।”
অসিয়তনামা
পরামর্শ গ্রহণ শেষ করিয়া তিনি হযরত ওসমানকে ডাকিয়া বলিলেন, “খেলাফতের অসিয়তনামা লিখিয়া ফেলুন।” কতটুকু লেখা হওয়ার পরিই হযরত সিদ্দিক (রা) বেহুশ হইয়া পড়িলেন। ইহা দেখিয়া হযরত ওসমান (রা) নিজ তরফ হইতই লিখিয়া দিলেন, “আমি ওমরকে খলিফা নিযুক্ত করিয়া যাইতেছি।” কিছুক্ষণ পর হুশ হইলে হযরত ওসমানকে বলিলেন, যে পর্যন্ত লেখা হইয়াছে আমাকে পড়িয়া শোনান। হযরত ওসমান (রা) সবটুকু পাঠ করিয়া শুনাইলে তিনি আল্লাহু আকবার বলিয়া উঠিলেন এবিং বলিতে লাগিলেন, “আল্লাহ তোমাদিগকে শুভ পরিণাম দান করুন।”-(আর-ফারুক্)
অতঃপর অসিয়তনামা হযরত ওসমান এবং একজন আনসারীর হাতে দিয়া দিলেন যেন মসজিদে নববীতে মুসলমানদের পাঠ করিয়া শুনাইয়া দেওয়া হয়। অতঃপর স্বয়ং অত্যধিক দুর্বলতার সত্ত্বেও ঘরের বারান্দার দিকে চলিয়া আসিলেন। তাঁহার বিবি হযরত উম্মে রুম্মান তাঁহর দুই হাত ধরিয়া রাখিয়াছিলেন, নীচে লোক সমবেত হইয়াছিল। তাঁহাদের উদ্দেশ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “যাঁহাকে আমি খলিফা নির্বাচিত করিব, তাঁহাকে কি তোমরা গ্রহণ করিবে? আল্লাহর শপথ, আমি চিন্তা করিদে বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করি নাই। তহাহা ছাড়া আমি আমার কোন নিকট-আত্মীয়কেও নির্বাচিত করি নাই। আমি ওমর ইবনে খাত্তবকে আমার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচিত করিতেছি। আমি যাহা করিয়াছি তাহা মানিয়া লও।”
অসিয়তনামাটি ছিল নিম্নরূপ” “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম : ইহা আবু বকর ইবনে আকু কোহাফার অসিয়তনামা; যাহা তিনি শেষ মুহূর্তে যখন দুনিয়া হইতে বিদায় গ্রহণ করিতেছেন এবং আখেরাতের প্রথম মুহূর্তে যখন তিনি পরপারে প্রবেশ করিতে উদ্যত, তখন লিপিবদ্ধ করাইতেছেন। ইহা ঐ সময়কার উপদেশ, যখন অবিশ্বাসীও বিশ্বাস স্থাপন করে, অসদাচারীও সংযত হয় েএবং মিথ্যাবাদী পর্যন্ত সত্যের সম্মুখে মাথা ঝুঁকাইয়া দেয়। আমি আমার পরে তোমাদের জন্য ওমর ইবনে খাত্তাবকে আমীর নিযুক্ত করিয়া যাইতেছি! সুতরাং তোমরা তাঁহার নির্দেশ মান্য করিও এবং তাঁহার অনুগত থাকিও। এই ব্যাপারে আমি আল্লাহ, আল্লাহর রসূল, ইসলাম এবং স্বয়ং আমার দায়িত্বের কথা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিয়াছি. কোন ত্রুটি করি নাই। যাহারা অত্যাচার করিবে তাহার শীঘ্রই স্বীয় পরিণাম ফল দেখিতে পাইবে। ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু।”
অন্তিম উপদেশ ও দোয়া
অতঃপর তিনি হযরত ওমরকের নির্জনে ডাকিয়া কতগুলি প্রয়োজনীয় উপদেশ দিলেন এবং আল্লাহর দরবারে হাত উঠাইয়া বলিতে লাগিলেন:
“হে খোদা, আমি এই নির্বাচন এই জন্য করিয়াছি যেন মুসলমানদের মঙ্গল হয়। আমার ভয় ছিল, শেষ পর্যন্ত তাহারা আত্মকলহ ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হইয়া না যায়! হে প্রভু, আমি যাহা বলিতেছি তুমি তাহা ভালভাবেই জান। আমার চিন্তভাবনা এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিয়াছিল। এই জন্য আমি এমন এক ব্যক্তিকে আমীর নিযুক্ত করিয়াছি, যিনি সবচাইতে দৃঢ় ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং মুসলমানদের সবচাইতে বেশী হিতাকাঙ্ক্ষী। আয় আল্লা, আমি তোমার নির্দেশেই মর-দুনিয়া ত্যাগ করিতেছি। এখন তোমার বান্দারা তোমার হাতেই সমর্পিতি হইতেছি। ইহারা তোমার বান্দা। ইহাদের ভাগ্যের ডোর তোমারই হাতে। হে আল্লা, মুসলমানদের জন্য সৎ শাসনকর্তা দাও। ওমরকে খলিফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত কর এবং তাঁহার প্রজাদিগকে তাঁহার যোগ্যতা দ্বারা উপকৃত কর।”
হযরত আবু বকরের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বেলায়েরেত মহৎ গুণেই খেলাফতের এই কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান হইয়া গেল। পূর্বাপর গোটা মুসলিম সমাজের অভিমত, হযরত ওমরকে খেলাফতের জন্য নির্বাচন ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য হযরত আবু বকরের এমন এক বিরাট অবদান, কেয়ামত পর্যন্ত যাহার আর কোন নজির মিলিবে না। হযরত ওমর (রা) মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যেই যাহা করিয়াছিলেন, এক কথায় বলিতে গেলে, ইসলামের যে শক্তি ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন অবস্থায় বিদ্যমান ছিল, সেই সবগুলিকে সংহত করিয়া আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন।
দুনিয়ার হিসাব নিকাশ
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা) আমাকে বাগানের বিশ সের খেজুর দিয়াছিলেন, যখন তাঁহার রোগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তখন বলিতে লাগিলেন, প্রিয় বৎস, আমি সর্বাবস্থায়ই তোমাকে সুখী দেখিতে চাই। তোমাদের দারিদ্র্য দেখিয়া আমার দুঃখ হয়। তোমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেখিলে আমি আনন্দিত হই। বাগানের যে খেজুর তোমাকে দিয়াছিলাম, যদি তুমি তাহা লইয়া গিয়া থাক তবে ভাল, অন্যথায় আমার মৃত্যুর পরই হযা আমার পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইবে। তোমার আরও দুই ভাই-বোন রহিয়াছে। এমতাবস্থায় এই খেজুরগুলি কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক নিজেরদের মধ্যে বন্টন করিয়া নিও।
হযরত আয়েশা (রা) বলিলেন, “মাননীয় পিতা, আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিব। ইহার চাইতে অধিক সম্পদও যদি হইত, তবুও আপনার নির্দেশমত তাহা আমি ত্যাগ করিতাম।”
মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে বলিলেন, “বাইতুল মাল হইতে আমি এই পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃত্তি গ্রহণ করিয়াছি, তাহার হিসাব কর।” হিসাব করার পর জানা গেল, গোটা খেলাফত আমলে মোট ছয় হাজার দেরহাম বা পনের শত টাকা গ্রহণ করিয়াছেন। বলিলেন, “আমার ভূমি বিক্রয় করিয়া এখনই এই অর্থ পরিশোধ করিয়া দাও।” তৎক্ষণাৎ ভূমি বিক্রয় করতিঃ বাইতুল মালের টাকা পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইল। এইভাবেই আল।লঅহর রসূলের হিজরতের বন্ধুর এক-একটি পশম বাইতুল মালের দায়িত্ব হইতে মুক্ত করা হইল। বাইতুল মালের টাকা পরিশোধ করার পর বলিলেন, “অনুসন্ধান করিয়া দেখ, খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমর সম্পত্তি কোন প্রকার বৃদ্ধি পাইয়াছে কিনা? অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল, খলিফা হওয়ার পর তাঁহার একটি হাবশী ক্রীতদাস, যে শিশুদের দেখাশোনা এবং মুসলিম জাগণের তরবারি পরিষ্কার করার জাক করিত, পানি আনার একটি উষ্ট্রী এবং এক টাকা চারি আনা মূল্যের একটি চাদর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে। হিসাব শুনিয়া নির্দেশ দিলেন, আমার মুত্যুর পর ইইগুলি পরবর্তী খলিফার নিতট পৌছাইয়া দিও।
ইন্তেকালের পর উপরোক্ত বস্তুগুলি হযরত ওমরের নিকট উপস্থিত করা হইলে তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন এবং বলিতে লাগিলেন “হে আবু বকর, আপনি আপনার স্থলাভিষিক্তদের দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিন করিয়া গেলেন।”
শেষ নিঃশ্বাসের সময়
হযরত আব বকরের জীবনের শেষ দিন ইরাকে যুদ্ধরত মুসলিম বাহিনীর সহকারী সেনাপতি মুসান্না মদীনায় পৌঁছিলেন। এই সময় আমীরুল মোমেনীন মৃত্যু যন্ত্রণার চরম অবস্থা অতিক্রম করিতেছিলেন। মুসান্নার আগমন সংবাদ জানিতে পারিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মুসান্না যুদ্ধক্ষেত্রের সকল খবর বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিলেন এবং বলিলেন, “পারস্য সম্রাট কেসরা ইরাকে নূতন সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন।” সমস্ত খবর শুনিয়া এই অবস্থাতেই হযরত ওমরকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওমর, আমি যাহা বলিতেছি, মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর এবং সেই অনুযায়ী কাজ কর। আমর মনে হয় অদ্যই আমার জীবন শেষ হইয়া যাইবে। যদি দিনের বেলায় আমার দম বাহির হয় তবে সন্ধার পূর্বেই এবং যদি রাত্রে হয় তবে সকাল হওয়ার পূর্বেই মুসান্নার সহিত সৈন্য প্রেরণ করিবে।” অতঃপর বলিলেন, “ওমর, যে কোন বিপদ মুহূর্তেও আল্লাহর নির্দেশ অথবা ইসলামের কোন কাজ পরবর্তী দিবসের জন্য মুলতবি রাখিও না। হযরত রসূলুল্লাহ (সা)- এর মৃত্যুর চাইতে বড় বিপদ আমাদের জন্য আর কি হইতেহ পারিত? কিন্তু তুমি দেখিয়াছ, ঐ দিনও আমার যা করণীয় ছিল তাহা আমি করিয়াছি। আল্লাহর শপথ, ঐ দিন যদি আমি আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর করিতে যাইয়া অবহেলা করিতাম, তবে আল্লাহ আমাদের উপর ধ্বংসের শাস্তি অবতীর্ণ করিতেন; মদীনার ঘরে ঘরে কলহের আগুন জ্বলিয়া উঠিত। আল্লাহ যদি ইরাকে মুসলিম বাহিনীকে কৃতকার্য করেন, তবে খালেদের বাহিনীকে সিরিয়া সীমান্তে পাঠাইয়া দিও। কেননা, সে বিচক্ষণ এবং ইরাকের অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তি।”
ইন্তেকালের সময় হযরত আবু বকর (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, “হযরত মোহাম্মদ (সা) কোন দিন ইন্তেকাল করিয়াছিলেন?” বলা হইল, সোমবার দিন। তখন তিনি বলিলেন, আমার আকাঙ্ক্ষা যেন আজই আমি বিদায় হই। যদি আল্লাহ আমার এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন, তবে আমাকেও রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র কবরের নিকটে সমাহিত করিও।
ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাসের সময় নিকটবর্তী হইতেছিলেন। হযরত আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত মোহাম্মদ (সা)-কে কয়টি কাপড়ে কাফন দেওয়া হইয়াছিল? আয়েশা (রা) বলিলেন, তিন কাপড়ে। তিনি বলিলেন, আমাকেও তিন কাপড়ে কাফন দিও। এখন আমার শরীরে যে দুইটি চাদর আছে এইগুলি ধুইয়া দিও, আর একটি কাপড় বাহির হইতে ব্যবস্তা করিও। হযরত আয়েশা (রা) সমবেদনার সুরে নিবেদন করিলেন,- “আব্বাজান! আমরা এত দরিদ্র নই যে, নতুন কাফন কিনিতে সমর্থ হইব না।”
হযরত আবু বকর (রা) বলিলেন, “কন্যা, মৃতদের চাইতে জীবিতদের কাপড়ের বেশী প্রয়োজন। আমার জন্য এই পুরাতন কাপড়ই যথেষ্ট হইবে।”
মৃত্যুর মুহূর্ত একটু একটু করিয়া নিকটবর্তী হইতেছিল। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) এই অস্তাচলমুখী চাঁদের শিয়রে বসিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতেছিলেন। দুঃখ বেদনায় ভরা এক একটি কথা তাঁহার কণ্ঠনালী হইতে অশ্রুর বন্যার সহিত ভাসিয়া আসিতেছিল। বসিয়া বসিয়া তিনি কবিতা আবৃত্তি করিতেছিলেন- যাহার মর্ম হেইল-
“জ্যোতিষ্কের মতো এমন অনেক উজ্জ্বল চেহারাও রহিয়াছে, যাহার নিকট মেঘমালাও পানি ভিক্ষা করিত; তিনি ছিলেন এতিমদের আশ্রয়স্থল এবং বিধবাদের পৃষ্ঠপোষক।”
কবিতা শুনিয়া হযরত সিদ্দিক (রা) চক্ষু খুলিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, “বৎস, এই কথা একমাত্র রসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কেই খাটে।” হযরত আয়েশা (রা) দ্বিতীয় একটি কবিতা আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, যাহার মর্ম হইল-
“তোমার বয়সের শপথ, মৃত্যুর ঊর্ধ্বশ্বাস যখন আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন ধন-সম্পদ কোন কাজে আসে না।”
হযরত আবু বকর (রা) বলিলেন, এই কথা বল- (আরবী*******)
-“মৃত্যু যন্ত্রণার সঠিক সময় আসিয়া উপস্থিহ হইয়াছে, উহা ঐ সময় যাহা হইতে তোমরা পলাইতেছিল।”- (কোরআন)
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, মৃত্যুর সময় আমি আমার পিতার শিয়রে বসিয়া নিম্নের মর্ম সম্বলিত কবিতাটি আবৃত্তি করিয়াছিলাম-
“যাহার অশ্রু সর্বদা, বদ্ধ রহিয়াছে একদিন তাহাও প্রবাহিত হইবে। প্রত্যেক আরোহীর কোন না কোন গন্তব্যস্থান রহিয়াছে। প্রত্যেক পরিধানকারীকেই কাপড় দেওয়া হইয়া থাকে।!”
ইহা শুনিয়া আমর পিতা বলিতে লাগিলেন, কন্যা, এই ভাবে নয়, সত্য কথা এইরূপ যেইরূপ আল্লাহ বলিয়অছেনঃ (আরবী******)
মৃত্যু যন্ত্রণার সময় উপস্থিত হইয়াছে, উহা ঐ নিদারুণ সময় যাহা হইতে তোমরা পলায়ন করিতে।
ইন্তেকাল
এই কথা বলিতে বলিতে হযরত আবু বকরের পবিত্র জীবনের সমাপ্তি হইয়াছিল- (আরবী******)
-“হে আল্লাহ, আমাকে মুসলমান হিসাবে মৃত্যু দাও এবং তোমার সৎ বান্দাদের সহিত মিলিত করা।”
হিজরী ১৩ সনের ২৩ জুমাদাল আখের সোমবার দিন এশা ও মাগরেবের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁহার পবিত্র রূহ এই পাপ দুনিয়া হইতে উঠিয়া যায়। এই সময় তাঁহর বয়স হইয়াছিল ৬৩ বৎসর। তাঁহার খেলাফত ছিল দুই বৎসর তিন মাস এগার দিন।
স্ত্রী হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রা) গোসল দেন। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর শরীরে পানি ঢালিয়া দেন। হযরত ওমর জানাযার নামায পড়ান। রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র সমাধিঘর সংলগ্ন স্থানে কবর খনন করা হইল।
রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের স্কন্ধ বরাবর মাথা রাখিয়া হযরত আবু বরক (রা)-এর কবর রচনা করা হয়। হযরত ওমর, হযরত তালহা, হযরত ওসমান এবং জযরক আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) পবিত্র লাশ কবরে নামাইলেন। এইভাবে রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর উম্মতের সবচাইতে জনপ্রিয়, সর্বজ নমান্য ব্যক্তিকে দুনিয়ার আকাশ হইতে চিরতরে ডুবাইয়া দেওয়া হইল। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

হযরত ওমরের শাহাদাত
রসূলে খোদার (সা) শেষ বিদায়ের পর ইসলাম ও মুসলিম জাতির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ছিল এক পর্বতপ্রমাণ দায়িত্ব। এ সহ্যাতীত বোঝা ইসলামের দুই জন নিষ্ঠাবান সন্তান মিলিতভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের প্রথম ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ও দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা)। হযরত সিদ্দিক (রা) একাধারে রসূলে খোদার (সা) বিচ্ছেদ-ব্যথায় তিলে তিলে নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছিলেন, অপরদিকে ইসলাম ও মুসলিম জাতির দায়িত্বের গুরুভার তাঁহার মস্তক বিগলিত করিয়া দিতেছিল। ইহার ফল হইল, রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর তিনি মাত্র দুই বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। তাহার পর এই দায়িত্বের বোঝা সিম্পূর্ণরূপে হযরত ওমরের কাঁধে আসিয়া পতিত হয়। হযরত ওমর ফারুক (রা) কেমন প্রাণপণ সাধনা করিয়া খেলাফরেত দায়িত্বভার পালন করিয়াছিলেন নিম্নের কয়েকটি ঘটনা হইতে তাহার অনুমান করা যাইবে।
হরমুজান ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি। পারস্য সম্রাট ইয়াজদেগারদ তাঁহাকে আওয়াজ ও ইরান প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধ বাধিলে পর হরমুজান এই শর্তে অস্ত্র ত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন, তাহাকে ছহিছালামতে মদীনায় পৌঁছাইয়া দেওয়া হইবে। হযরত ওমর (রা) তাঁহার সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত করিবেন অম্লান বদনে তাহাই মানিয়া লইবেন। যুদ্ধ থামিয়া গেল। হরমুজান বিপুল সমারোহে মদীনায় রওয়ানা হইলেন। ইরানের কতিপয় বড় বড় শোভিত করিলেন, মখমলের বহুমূল্য আবা পরিধান করিলেন। কটিদেশে বহুমূ্যে তরবারি ঝুলাইয়া রাজকীয় শান-শওকতে মদীনায় প্রবেশ করিলেন। মসজিদে নববীর নিকট পৌঁছিয়া লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমীরুল মোমেনীনের সহিত কোথায় দেখা হইবে? ইরানীদের ধারণ ছিল, যে ব্যক্তির দাপটে সমগ্র দুনিয়ায় বিপ্লবের বাতাস বহিয়া চলিয়াছে, তাঁহার দরবার নিশ্চয়ই নিতান্ত জাঁকজমকপূর্ণ হইবে। একজন বেদুইডন হাতের ইশারায় দেখাইয়া বলিলেন, এই তো আমীরুল মোনেনীন। আমীরুল মোমেনীন ওমর (রা) তখন মসজিদের বারান্দায় শুইয়া ছিলেন। ইয়ারমুকের ময়দানে যখন ত্রিশ সহস্র রোমীয় সৈন্য পাঘে বেড়ি লাগাইয়া মুসলিম বাহিনীর সহিত লড়াই করিতেছিল, তখন হযরত ওমরের অবস্থা কিরূপ ছিল? বিশ্বস্ত বর্ণনা, যতদিন যুদ্ধ চলিয়াছিল, ততদিন হযরত ওমর (রা) একরাত্রিও শান্তির সহিত শুইতে পারেন নাই। যুদ্ধ শেষে যখন বিজয়ের খবর আসিল, তখন আল্লাহর উদ্দেশে সেজদায় পড়িয়া অশ্রু প্রবাহিত করিতে থাকেন।
কাদেসিয়ার যুদ্ধে পারস্য সম্রাট রাজ্যের সর্বশক্তি যুদ্ধের ময়দানে নিয়োগ করিয়াছিলেন। একদিন যুদ্ধেই দশ হাজার ইরানী ও দুই হাজার মুসলিম সৈন্য হতাহত হন। যুদ্ধ চলাকালে হযরত ওমরের অবস্থা ছিল, প্রত্যহ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মদীনার বাহিরে কোন বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া কাদেসিয়ার সংবাদবাহী কাসেদের পথ চাহিয়া থাকিতেন। কাসেদ যেদিন বিজয়ের সংবাদ লইয়া আসে, সেইদিনও তিনি মদীনার বাহিরে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। যখন জানিতে পারিলেন, হযরত সাদের কাসেদ যুদ্ধের খবর লইয়া আসিয়াছে, তখন তিনি খবর জিজ্ঞাসা করিতে শুরু করিলেন। কাসেদ উট দৌড়াইয়া যাইতেছিল আর খবর বলিতেছিল। হযরত ওমরও উটের রেকাব ধরিয়া কাসেদের পিছু পিছু দৌড়াইতে ছিলেন। শহরের অভ্যন্তরে পৌঁছার পর কাসেদ যখন শুনিতে পাইল, তাহার উটের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া আসা লোকটিকে মদীনাবসীগণ অতি সম্ভ্রমে আমীরুল মোমেনীন বলিয়া সম্বোধন করিতেছে, কথন কাসেদের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। ইনিই আল্লাহর রসূলের খলিফা। কাসেদ বিনীতভবে নিবেদন করিল, “আমিরুল মোমেনীন, আপনি পূর্বেই কেন আমাকে পরিচয় দেন নাই? তাহা হইলে তো আমাকে এই ধৃষ্টতা প্রদর্শন করিতে হইত না।” ওমর (লা) বলিলেন, এই কথা বলিও না। আসল কথা বলিয়া যাও। কাসেদ বলিয়া যাইতে লাগিল, আর তিনি পূর্ববৎ উটের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটিয়া বাড়ী পৌঁছিলেন।
খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বসাধারণ মুসলমানকে মসজিদে নববীতে ডাকিয়া আনিয়া বলিতে লাগিলেন, “মুসলগণ, তোমাদের সম্পদে আমার ঠিক ততটুকু অধিকার রহিয়াছে, যতটুকু কোন এতীমের প্রতিপিালকের জন্য এতীমের সম্পদে থাকে। আমার যদি সামর্থ্য থাকে, তবে তোমাদের নিকট হইতে কোন প্রকার পারিশ্রমিক নিব না। যদি অসমর্থ হইয়া পড়ি, তবে কেবলমাত্র খাওয়া-পরার খরচ গ্রহণ করিব। ইহার পরও তোমরা আমার প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখিও যেন অপব্যয় অথবা সঞ্চয় করিতে না পারি।” রোগে মধুর প্রয়োজন পড়িলে মসজিদে লোক সমবেত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাইসব, যদি আপনরা অনুমতি দে, তবে বাইতুল মালের ভাণ্ডার হইতে সামান্য মধু গ্রহণ করিয়া ব্যবহার করি। জনসাধারণ তাঁহার আবেদন মঞ্জুর করিলে পর তিনি তাহা গ্রহণ করেন।
রাত ভরিয়া তিনি নামায পড়িতেন এবং ক্রন্দন করিতে থাকিতেন। অনেক সময় ক্রন্দন করিতে করিতে দগম বন্ধ হইয়া আসিত। অশ্রু বহিতে বহিতে পবিত্র চেহারায় দুটি কাল দাগ পড়িয়া গিয়াছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ (রা) বর্ণনা করেন, একাদ হযরত ওমর (রা) নামায পড়াইতেছিলেন। কেরাত পড়িতে পড়িতে যখন আয়াতে পাক (আরবী*****) পর্যন্ত পৌছিলেন, তখন হঠাৎ এমন জোরে ক্রন্দন করিতে শুরু করিলেন যে, লোকেরা অস্থির হইয়া উঠিল।
ইমাম হাসান (লা) হইতে বর্ণিত আছে, হযরত ওমর (রা) নামায পড়িতেছিলেন, এমতাবস্থায় (আরবী******) এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছিয়া এমনভাবে কাঁদিতে শুরু করিলেন যে, তাঁহার দুই চক্ষু লাল হইয়া গেল! কোন কোন সময় লোকের সন্দেহ হইত, হয়ত দুশ্চিন্তায় তাঁহার অন্তর ফাটিয়া যাইবে। সঙ্গে সঙ্গে হয়ত তিনি মৃত্যুবরণ করিবেন। কোন কোন সময় অবস্থা এত শোচনীয় হইয়া যাইত যে, লোকেরা তাঁহাকে দেখিতে আসিত।
এক সাহাবী ঐ সমস্ত সৎকর্মাবলীর বিবরণ দিতেছিলেন, যাহা তিনি রসূলুল্লাহর (সা) সঙ্গে থাকিয়া করিয়াছিলেন। শুনিতে শুনিতে অধীর হইয়া হযরত ওমর (রা) বলিতে লাগিলেন, যাঁহার হাতে আমার জীবন সেই পবিত্র সত্তা শপথ, আমি মনে করি, যদি পুরস্কার কিছু নাও পাওয়া যায়, তবু অন্ততঃ আজারেব হাত হইতে মুক্তি পাওয়া গেলেন যথেষ্ট হইবে।
একদা রাস্তা দিয়া যাইতেছিলেন। কি মনে করিয়া মাটি হইতে একটি তৃণখণ্ড উঠাইলেন এবং আক্ষেপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরিতাপ! আমি যদি এই তৃণ খণ্ডাটির ন্যায় নগণ্য হইতাম! হায়, আমি যদি জন্মই না নিতাম! আমার মাতা যতি আমাকে প্রসবই না করিতেন! অন্য এক সময় বলিতেছিলেন, যদি আকাশবাণী হয় যে, এক ব্যক্তি ব্যতীত দুনিয়ার সকল লোকের গোনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তবু আমার ভয় দূর হইবে না। আমি মনে করিব, বোধ হয় সেই হতভাগ্য মানুষাটি আমি!
এই সমস্ত চিন্তা তাঁহার জীবিকাগত অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় করিয়া দিয়াছিল। তিন রোম ও ইরান সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করিয়াছিলেন। এতদ্‌সত্ত্বেও তাঁহার নিঃস্বতা ও উপবাপস দূর হয় নাই। সাধারণ লোক পর্যন্ত উহা উপলব্ধি করিত, কিন্তু তিনি সর্বদা অম্লান বদনে আল্লাহর ইচ্ছাই মানিয়া লইতেন। একদিন তাঁহার কন্যা মুসলিম জননী হযরত হাফসা (রা) সাহসে ভর করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, পিতা, আল্লাহ আপনাকে উচ্চ মর্যদা দান করিয়াছেন, আপনার পক্ষে ভাল খাবার এবং ভাল পোশাক হইতে দূরে থাকার প্রয়োজন কি? তিনি জওয়াবে বলিলেন,- বৎস, মনে হয় তুমি রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দারিদ্র ও নিঃস্বতার কথা ভুলিয়া গিয়াছ। আল্লাহর শপথ, আখেরাতে আনন্দ লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত আমি তাঁহার পদাংক অনুসরণ করিয়া চলিব। এই কথা বলিয়া তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দারিদ্রের কথা বর্ণনা করিতে লাগিলেন। শুনিয়া শেষ পর্যন্ত হাফছা (রা) রোদন করিতে শুরু করেন।
একবার ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান (রা) তাঁহাকে দাওয়াত করিয়াছিলেন। খাইতে বসিয়া কিছু উৎকৃষ্ট খাদ্য দেখিতে পাইয়া হাত উঠাইয়া বলিতে লাগিলেন, “যাঁহর হাতে আমার জীবন তাঁহার শপথ, তোমরা যদি রসূলুল্লাহর (সা) পথ পরিত্যাগ কর, তবে বিভ্রান্ত হইয়া যাইবে।
হযরত আহওয়াস (রা) হইতে বর্ণিত আছে, একদা হযরত ওমরের সম্মুখে ঘৃতে পাক করা গোশ্‌ত দেওয়া হইল। তিনি খাইতে অস্বীকার করিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, এখনই তোমরা দুই তরকারি একত্রিত করিয়া ফেলিলে। একটি ঘৃত আর একটি গোশত। একটিতে যখন খাওয়া চলিত তখন দুইটি একত্রিত করিয়া ফেলার কি প্রয়োজন ছিল?
সাহাবীগণ তাঁহার শরীরে কখনও গরম কাপড় দেখেন নাই। তাঁহার জামায় একত্রে বারটি পর্যন্ত তালি লাগাইয়াছিলেন। মাথায় ছেঁড়া জীর্ণ পাগড়ি থাকিত। ছেঁড়া ফাটা ‍জুতা পায়ে দিতেন। এই অবস্তায় পারস্য বা রোম সম্রাটের দূতদের সাক্ষাত দান করার সময় মুসলমানগণ লজ্জিত হইয়া পড়িতেন, কিন্তু তাঁহার মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যাইত না।
একবার হযরত আয়েশা ও হযরত হাফছা (রা) মিলিতভাবে বলিলেন, আমীরুল মোমেনীন, আল্লাহ আপনাকে মর্যদা দান করিয়াছেন, বড় বড় সম্রাটের দূত আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন; এমতাবস্থায় আপনার জীবনযাত্রর একটু পরিবর্তিত হওয়া উচিত। জওয়াবে তিনি বলিলেন, আক্ষেপের বিষয়, তোমরা উভয়ে রসূলে খোদার (সা) সম্মানিতা সহধর্মিনী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে দুনিয়ার প্রতি উৎসাহিত করিতেছ! তাঁহর নিকট তো একটি মাত্র কাপড় থাকিত, দিনের বেলায় তিনি তাহা বিছাইতেন, রাত্রে গায়ে দিতেন। হাফ্‌ছা, তোমরা কি স্মরণ নাই, একদা তুমি রসূলুল্লাহর (সা) বিছানা বদলাইয়া দিয়াছিলে আর সেই বিছানায় শুইয়া তিন ভোর পর্যন্ত নিদ্রিত রহিলেন। নিদ্র হইতে জাগিয়া তোমাকে বলিয়াছিলেন, হাফছা, তুমি এ কি করিলে? আমার বিছানা বদলাইয়া দিলে আর আমি সকাল পর্যন্ত ঘুমাইয়অ রহিলাম। দুনিয়ার আরাম-আয়েশে আমার প্রয়োজন কি? বিছানা নরম করিয়া দিয়া তুমি কেন আমাকে অচেতন রাখিলে?
একবার জামা ছিঁড়িয়া গেলে তিনি তালির উপর তালি লাগাইতেছিলেন। হযরত হাফ্‌ছা (রা) উহাতে বারণ করিলে বলিতে লাগিলেন,- হাফছা, আমি মুসলমানদের সম্পদ হইতে ইহার অধিক ভোগ করিতে পারি না।
জিনিসের দর-দাম যাচাই করার জন্য কখনও কখানও তিনি বাজারে যাইতেন। তখন পথে পড়িয়া থাকা পরাতন রশি, খেজুরের বীচি ইত্যাদি উঠাইয়া লোকের বাড়ীতে ছুঁড়িয়অ দিতেন; যেন উহা পুনরায়অ ব্যবহার করা চলে।
একদা উৎবা ইবনে ফারদাত তাঁহর নিকট আগমন করিলেন। সিদ্ধ গোশ্‌ত এবং শুকনা রুটি তাহার সম্মুখে দেওয়া হইয়াছিল; আর তিনি জোর করিয়া তাহা গলাধঃকরণ করিতেছিলেন। উৎবা থাকিতে না পারিয়া বলিতে লাগিলেন, আমীরুল মোমেনীন, আপনি যদি খাওয়া-পরায় আরো কিছু বেশী খরচ করেন, তবে ইহাতে মুসলিম জাতির সম্পদ মোটেই কমিয়া যাইবে না। ওমর (রা) বলিলেন- আফসোস, তোমরা আমাকে আরামপ্রিয়তা প্রতি উৎসাহিত করিতেছ। রবী ইবনে ‍যিয়াদ বলিলেন- আমীরুল মোমেনীন, আল্লাহ আপনাকে যে মর্যাদা দান করিয়াছেন, তাহাতে আরাম-আয়েশ অবশ্যই করিতে পারেন। এই বার তিনি রাগান্বিত হইয়া বলিতে লাগিলেন-“আমি জাতির আমানতদার, আমানতে খেয়ানত জায়েয আছে কি?”
খলিফা তাঁহার বিরাট পরিবারের জন্য বাইতুল মাল হইতে রোজ মাত্র দুই দেরহাম গ্রহণ করিতেন! একবার হজ্বের সফরে সর্বমোট ৮০ দেরহাম খরচ হইল। ইহাতে তিনি অনুতাপ করিতেছিলেন, আমার দ্বারা অপব্যয় হইয়া গেল। বাইতুল মালের উপর যাহাতে চাপ না আসে এই জন্য তিনি ছেঁড়া জীর্ণ কাপড়ে পর্যন্ত তালি দিতেন।
একদিন খলিফা জুমার খুৎবা দেওয়ার জন্য মিম্ব দাঁড়াইলেন। হযরত হাসান (রা) শুনিয়া দেখিলেন, তাঁহর জামায় মোট ১২টি তালি দেওয়া রহিয়াছে। আবুল উসমান বলেন, আমি খলিফার পাজামা দেখিয়াছি, উহাতে চামড়ার তালি দেওয়া ছিল।
একবার বাহরাইন হইতে গনীমতের মাল আসিল। উহাতে মেশ্ক ও আম্বর ছিল। খলিফা এমন একজন দক্ষ ওজনবিশারদ খোঁজ করিতেছিলেন, যিনি অত্যন্ত নিপণতার সহিত এই সব বণ্টন করিতে পারেন। বিবি আসিয়া নিবেদন করিলেন, আমি এই কাজ করিতে পারিব। খলিফা বলিলেন, আকেলা, আমি তোমার দ্বারা এই কাজ করাইতে পারিব না। মেশ্ক্ আম্বর বণ্টন করার সময় তোমার হাতে যাহা লাগিয়া থাকিবে তাহা যদি শরীরে ঘষিয়া ফেল. তবে আমাকেই উহার জবাবদিহি করিতে হইবে।
একদা দ্বিপ্রহরের রৌদ্রে মাথার উপর চাদর ফেলিয়া খলিফা মদীনার বাহিরে কোথাও গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসার সময় এক ক্রীতদাসকে গাধার উপর আরোহণ করিয়া আসিতে দেখিলেন। পরিশ্রান্ত খলিফা আরোহণের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে ক্রীতদাস গাধা হইতে নামিয়া বাহন গাধাটি তাঁহাকে দিয়া দিল। খলিফা বলিলেন, তুমি বসিয়া থাক, আমি তোমার পশ্চাতে আরোহণ করিয়া যাইতেছি। শেষ পর্যন্ত এইভাবেই তাঁহারা মদীনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। মদীনাবাসীগণ আশ্চার্যন্বিত হইয়া দেখিলেন, আমীরুল মোমেনীন এক ক্রীতদাসের পশ্চাতে গাধায় আরোহণ করিয়া আসিতেছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কয়েক বারই তাঁহকে সরকারীভাবে সফর করিতে হইয়াছে, কিন্তু কোন সময়ই তিনি তাঁবু পর্যন্ত সঙ্গে নেন নাই। বরাবরই গাছের নীচে বসিয়া বিশ্রাম করিতেন এবং মাটিতে বিছানা বিছাইয়া শয়ন করিতেন। দ্বিপ্রহরে বিশ্রামের প্রয়োজন হইলে বৃক্ষ শাখায় কম্বল টানাইয়া ছায়া করিয়া লইতেন।
হিজরী ১৮ সনে আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সময় হযরত ওমরের অস্থিরতা ছিল বেদনাদায়ক। গোশ্ত ঘৃত প্রভৃতি সর্বপ্রকার ভাল ভাল খাদ্য তিনি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। একদিন তাঁহার পুত্রের হাতে তরমুজ দেখিতে পাইয়া ভীষণ রাগান্বিত হইলেন। বলিতে লাগিলৈন- মুসলিম জনসাধারণ আনাহারে মরিতেছে আর তুমি ফল খাইতেছ! ঘৃত ত্যাগ করিয়া জয়তুন তৈল ব্যবহরের ফলে একদিন পেটে পীড়া দেখা দিল। তিন পেটে আঙ্গুল রাখিয়া বলিতে লাগিলেন, যে, পর্যন্ত দেশে দুর্ভিক্ষ বিদ্যমান থাকে, তোমাকে ইহাই গ্রহণ করিতে হইবে।
ইকরেমা ইবনে খালেদ বলেন, একদা মুসলমানদের এক প্রতিনিধিদল যাইয়া খলিফাকে বলিলেন, যদি আপনি একটু ভাল খাদ্য গ্রহণ করেন তবে আল্লাহর কাজে আরও শক্তি পাইবেন। তিন জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহা কী তোমাদের ব্যক্তগত ধারণা, না মুসলিম সাধারণের সম্মিলিত অভিমত? বলা হইল, ইহা মুসলিম সাধারণেরই অভিমত। তখন বলিলেন, আমি তোমাদের সমবেদানার জন্য কৃতজ্ঞ। তবে আমি আমর অগ্রগামীদ্বয়ের রাজপথ পরিত্যাগ করিতে পরি না। তাঁহাদের সান্নিধ্য আমর জন্য এখানকার আরামের চাএত বেশী লোভনীয়!
যে সমস্ত লোক যুদ্ধের ময়দানে চলিয়অ যাইতনে, খলিফা তাহাদের বাড়ী বাড়ী যাইয়া খোঁজন নিতেন, প্রয়োজনীয় বাজার সওদা পর্যন্ত নিজ হাতে আনিয়া দিতেন। সৈন্যদের কোন চিঠি আসিলে স্বয়ং বাড়ী বাড়ী যাইয়া বিলাইয়া দিতেন। বাড়ীর লোকেরা যে খবর দিত তাহা নিজ হাতে লিখিয়া চিঠির জওয়াব দিতেন।
হযরত তাল্হা (রা) এর বর্ণনা, একদিন প্রত্যূষে আমার ধারণ হইল, সম্মুখের কুটিরে হযরত ওমর (রা) তশরীফ আনিয়াছেন। আবার মনে হইল, আমীরুল মোমেনীন এখানে কি করিতে আসিবেন? খবর লইয়া জানা গেল, এখানে একজন অন্ধ বৃদ্ধা বাস করেন, হযরত ওমর (রা) প্রত্যেহ খবর লওয়ার জন্য আগমন করিয়া থাকেন।
এই ছিল হযরত ওমরের নিত্যকার কর্ম তালিকা। আল্লাহর প্রতি সীমাহীন ভয়’ মুসলমানদের অসীম সেবা এবং দিনরাত্রে অন্তহীন ব্যস্ততা লাগিয়াই থাকিত। তদুপরি এক রাত্রিও আরাম করিয়া শুইতেন না বা এক বেলাও তৃপ্তির সহিত আহার করিতেন না। ফল এই দাঁড়াইল, তাঁহার সুঠাম দেহ দিন দিন দুর্বল হইয়া চলিল, শক্তি হ্রাসপ্রাপ্ত হইল। শরীর ধীরে ধীরে কৃশ হইয়া গেল। বার্ধক্যের বহু পূর্বেই বৃদ্ধের ন্যায় সামর্থ্যহীন হইয়া পড়িলেন। এমতাবস্থায় অধিকাংশ সময় বলিতেন, যদি কোন ব্যক্তি খেলাফতের এই গুরুদায়িত্ব বহন করিতেন, তবে খলিফা হওয়ার চাইতে বরং দেহ হইতে আমার মস্তক পৃথক করিয়া দেওয়াকেই আমি আনন্দের সহিত গ্রহণ করিতাম।
হিজরী ২৩ সনে কেরমান, সজেস্তান, মাকরান, ইস্পাহান প্রভৃতি স্থান বিজিত হয়। তখন ইসলামী রাষ্ট্রের আয়তন মিসর হইতে বেলুচিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া গিয়াছিল। এই বৎসরই তিনি শেষবারের মত হজ্ব করিলেন। হজ্ব হিইতে প্রত্যাবর্তনের পথে একস্থানে প্রচুর পরিমাণ কঙ্কর একত্রিত করতঃ উহার চাদর বিছাইয়া শুইয়া পড়িলেন এবং উপর দিকে দুই হাত তুলিয়া বলিতে লাগিলেনঃ
“খোদাওয়অন্দ, এখন আমর বয়স বাড়িয়া গিয়াছে। আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজারা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে। এখন তুমি আমাকে এমনভাবে উঠাইয়া লও যেন আমার আমল বরবাদ না হয় এবং আমর বয়সের সীমা স্বাভাবিকতা গণ্ডি অতিক্রম না করে।”
শাহাদাতে পটভূমি
একদা কা‘ব আল-আহ্বার খলিফাকে বলিলেন, আমি তাওরাতে দেখিয়াছি, আপনি শহীদ হইবেন। খলিফা বলিলেন, এ কি করিয়া সম্ভব, আরব থাকিয়াই আমি শহীদ হইব?
সঙ্গে সঙ্গে দোয়া করিলেন, “হে আল্লাহ, আমাকে তোমার পথে শহীদ কর এবং তোমার প্রিয় রসূলের (রা) মদীনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সুযোগ দাও।”
একদিন জুমার খুৎবায় বলিতে লাগিলেন- আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি, একটি পাখী আসিয়া আমার মাথার উপর ঠোকর মারিয়াছে। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা হইতেছে আমার মৃত্যু নিকটবর্তী। আমার জাতি দাবী করিতেছে, আমি যেন আমার স্থলাভিষিক্ত নির্বাচিত করিয়া যাই। স্মরণ রাখিও, আমি মৃত্যু বা খেলাফত কোনটিরই মালিক নই। আল্লাহ স্বয়ং তাঁহার দ্বীন ও খেলাফরেত রক্ষক। তিনি উহা কখনও বিনষ্ট করিবেন না।
যুহরী বলেন, হযরত ওমর (রা) নির্দেশ দিয়াছিলেন, কোন প্রাপ্তবয়স্ক মোশরেক মদীনায় প্রবেশ করিতে পারিবে না। এই ব্যাপারে কুফার শাসনকর্তা হযরত মুগীরা ইবন শো‘বা (রা) তাঁহাকে লিখিয়া জানাইলেন, এখানে ফিরোজহ নামক এক বিচক্ষণ যুবক রহিয়াছে। সে সূত্রধর ও লৌহ শিল্পের খুব ভাল কাজ জানে। আপনি যদি তাজাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি দেন, তবে সে মুসলমানদের অনেক কাজে লাগিতে পারে। হযরত ওমর (রা) তাহাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ফিরোজ মদীনায় প্রবেশ করিয়াই খলিফার নিকট অভিযোগ করিল, হযরত মুগীরা (রা) আমার উপর অযথা কর ধার্য করিয়া রাখিয়অছেন, আপনি তাহা হ্রাস করিয়া দিন।
হযরত ওমর (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, কত কর ধার্য করা হইয়অছে?
ফিরোজ জবাব দিল- দৈনিক দুই দেরহাম
হযরত ওমর (রা) বলিলেন,-তোমার পেশা কি?
ফিরোজ বলিল, -কাষ্ঠ চিত্র ও লৌহ শিল্প।
ওমর (রা) বলিলেন,- পেশার তুলনায় এই পরিমাণ কর মোটেই অধিক নহে।
ফিরোজের পক্ষে এই উত্তর সহ্যাতীত ছিল। সে ক্রোধে অধীর হইয়া বাহিল হইয়া গেল এবং বলিতে লাগিল- আমীরুল মোমেনীন আমি ব্যতীত আর সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করেন। কিছুদিন পর হযরত ওমর (রা) ফিরোজকে পুনরায় ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- আমি শুনিতে পাইলাম, তুমি এমন এক প্রকার চক্র তৈয়ার করিতে পার যাহা বায়ুর সাহায্যে চলিতে পারে। ফিরোজ একটু ব্যঙ্গ করিয়া জওয়াব দিল- আমি আপনার জন্য এমন চক্র তৈয়ার করিব যাহা এখানকার লোক কখনও ভুলিবে না। ফিরোজ চলিয়া গেলে পর ওমর (রা) বলিলেন- এই যুবক আমাকে হত্যার হুমকি দিয়া গেল।
দ্বিতীয় দিন ফিরোজ একটি দুইধারী খঞ্জর আস্তিনে লুকাইয়া প্রত্যুষে মসজিদে উপস্থিত হইল। মসজিদের কিছু লোক নামাযের কাতার ঠিক করিতে নিযুক্ত ছিলেন। নামাযের কাতার যখন ঠিক হইয়া যাইত তখনই সাধারণতঃ হযরত ওমর (রা) তশরীফ আনিতেন এবং ইমামত করিতেন। এই দিনও তদ্রূপ হইল। কাতার ঠিক হইয়া যাওয়ার পরই ওমর (রা) ইমামতের জন্য অগ্রসর হইলেন। নামায শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজ আসিয়া উপর্যুপরি খড়গ দ্বারা ছয়টি আঘাত করি।, তন্মধ্যে একটি আঘাত নাভির নীচদেশে মারাত্মকরূপে বিঁধিয়া গেল।
দুনিয়া এই মারাত্মক মুহূর্তেও খোদাভীতির এক নূতন দৃশ্য দেখিল। আহত হযরত ওমর (লা) যখন ঢলিয়া পড়িতেছিলেন, তখন তিনি হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফকে হাতে ধরিয়া ইমামের স্থানে দাঁড় করাইয়া দিলেন এবং স্বয়ং সেই স্থানে পড়িয়াই কাতরাইতে লাগিলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ এই অবস্থায়ই নামায পড়াইলেন। আমীরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা) সম্মুখে পড়িয়া কাতরাইতে ছিলেন। ফিরোজ আরো কয়েকজনকে আহত করিয়া শেষ পর্যন্ত ধরা পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আত্মহত্যা করিয়া ফেলিল।
আহত হযরত ওমর ফারুককে উঠাইয়া গৃহে আন হইল। সর্বপ্রথম তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহার আততায়ী কে? লোকেরা বলিল, ফিরোজ! এই কথা শুনিয়া পবিত্র চেহারা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তুপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া মুখে বলিতে লাগিলেন, আল্লাহর শোকর আমি কোন মুসলমানের হাতে নিহত হইতেছি না।
লোকেরা ধারণা ছিল, আঘাত তত মারাত্মক নহে, হত সহজেই আরোগ্য হইয়া যাইবেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন চিকিৎসকও ডাকা হইল। চিকিৎসক খেজুরের রস এবং দুধ পান করাইলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উহা আঘাতের স্থান দিয়া বাহির হইয়া আসিল। ইহাতে মুসলমানদের মধ্যে নৈরাশ্য দেখা দিল। সকলেই বুঝিলেন, হযরত ওমর (রা) আর দুনিয়ায় থাকিবেন না।
এমন মনে হইতেছিল, হযরত ওমর (রা) যেন একা আহত হন নাই, সমগ্র মদীনাবাসীই আহত হইয়াছেন, মুসলিম খেলাফত আহত হইয়া গিয়াছে। সর্বোপরি পবিত্র ইসলাম যেন আহত হইয়া পড়িয়াছে। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে লোকে তাঁহাকে দেখিতে আসিত এবং পঞ্চমুখে তাঁহার প্রশংসাকীর্তন করিত। তিনি তখন বলিতেছিলেন, আমার নিকট যদি আজ সমগ্র দুনিয়ার স্বর্ণও মওজুদ থাকিত, তবে তাহাও কেয়ামতে ভীতি হইতে মুক্তি পাইবার জন্য বিলাইয়া দিতা।
খলিফা নির্বাচন সমস্যা
হযরত ফারুকে আজম (রা) যে পর্যন্ত মুসলমানদের চোখের সম্মুখে ছিলেন, সেই পর্যন্ত তাঁহাদের অন্তরে নূতন খলিফা নির্বাচনের কোন খেয়ালই উদয় হয় নাই। তাঁহার মনে করিতেন, ইসলামের এই আদর্শ সেবকই বোধ হয় দীর্ঘকাল ধরিয়া রসূলের উম্মতের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া যাইবেন। হযরত ফারুক (রা) যখন শয্যা গ্রহণ করিলেন তখনই তাহাদের অন্তরে অসহায় ভাব এবং নিদারুণ নিঃসঙ্গতা অনুভূত হইতে শুরু করিল। এই মুহূর্তে সকল মুসলমানেরই ভাবনা ছিল, অতঃপর কে মুসলিম জাতির অভিভাবক হইবেন? যত লোক খলিফাকে দেখিতে আসিতেন, সকলেই একই অনুরোধ করিতেছিলেন, “আমীরুল মোমেনীন, আপনার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করিয়া যান।” খলিফা মুসলমানদের এই তাকিদ শুনিতেছিলেন এবং নিরুত্তর হইয়া ভাবিতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বলিলেন, তোমরা কি চাও, মৃত্যুর পরও এই সমস্যা হইতে এমনভাবে দূরে থাকি, যেন আমর পাপগুলির সহিত অর্জিত পুণ্য সমতা রক্ষা করিতে পারে।
হযরত ফারুকে আজম (রা) অবশ্য দীর্ঘকাল হিইতেই খেলাফত-সমস্যার উপর চিন্তা করিতেছিলেন। লোকে রা অনেক সময় তাঁহাতে একান্তে বসিয়া ভাবিতে দেখিয়াছে। প্রশ্ন করিলে বলিতেন, আমি খেলাফতের সমস্যা নিয়া ভাবিতেছি। বার বার ভাবনার পরও তাঁহার বিচক্ষণ দৃষ্টি কোন বিশেষ ব্যক্তির উপর নিবদ্ধ হইতেছিল না। অনেক সময়ই তাঁহার মুখ হইতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বাহির হইয়া আসিত। বলিতেন, আফসোস! এই গুরুদায়িত্ব বহন করার মত কোন লোক যে আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না।
এক ব্যক্তি নিবেদন করিলেন, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে কেন খলিফা নিযুক্ত করিতেছেন না? জবাবে তিনি বলিলেন, আল্লাহ তোমরা সর্বনাশ করুন। আল্লাহর শপথ, আমি কখনও তাহার নিকট এইরূপ কামনা করি নাই। আমি কি এমন এক ব্যক্তিকে খলিফা নিযুক্ত করিব, যাহার মধ্যে স্বীয় স্ত্রীকে ঠিকমত তালাক দেওয়ার যোগ্যতাও বিদ্যমান নাই।
এই প্রসঙ্গে আরো বলিলেন : আমিআমার সাথীগণকে খলিফা হওয়ার লোভে নিমগ্ন দেখিতেছি। যদি আবু হোযাইফার মুক্তি দেওয়া ক্রীতদাস সালেম অথবা আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ জীবিত থাকিতেন, তবে আমি তাহাদের সম্পর্কে কিছু বলিয়া যাইতে পারিতাম। এই উক্তি হইতে মনে হয়, খেলাফতের সমস্যা হইতে দূরে থাকিয়াই তিন দুনিয়া পরিত্যাগ করিতে চাহিতেন, কিন্তু মুসলমানদের তাকিদ দিনিই বর্ধিত হইতেছিল। শেষে তিনি বলিলেন, “আমার মৃত্যুর পর ওসমান, আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আউফ এবং সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তিন দিনের মধ্যে যাঁহাকে নির্বাচিত করিবেন, তাঁহাকেই যেন খলিফা নিযুক্ত করা হয়।”
আখেরাতের প্রস্তুতি
শেষ মুহূর্তে তিনি পুত্র আবদুল্লাহকে ডাকিয়া বলিলেন, আবদুল্লাহ, হিসাব করিয়া দেখ আমার উপর কি পরিমাণ ঋণ রহিয়াছে। হিসাব করিয়া বলা হইল, ৮৬ হাজার দেরহাম। বলিলেন, এই ঋণ আমার পরিবারের সম্পত্তি দ্বারা গ্রহণ করিও। যদি তাহাতেও না হয় তবে কোরায়শ গোত্র হইতে সাহায্য চাহিও।
হযরত ওমরের জনৈক ক্রীতদাস নাফে (রা) হইতে বর্ণিত আছে, তাঁহার উপর ঋণ কেন থাকিবে? মৃত্যুর পর তাঁহার এক এক উত্তরাধিকারী এক লক্ষ টাকার সম্পত্তি পাইয়াছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, হযরত ওমরের একটি গৃহ হযরত আমির মোয়াবিয়ার নিকট বিক্রয় করিয়া তাঁহার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করা হইয়াছিল। ঋণ পরিশোধের পর বলিলেন, তুমি এখনই মুসলিম জননী হযরত আয়েশার নিকট যাও এবং তাঁহর নিকট আবেদন জানাও, ওমর তাঁহর পূর্ববর্তী দুই বন্ধুর নিকট সমাহিত হইতে চাহে। তাঁহাকে অনুমতি দেওয়া হউক। আবদুল্লাহ৯ ইবনে ওমর (রা) খলিফার এই আবেদন হযরত আয়েশার নিকট পৌঁছাইলেন। আয়েশা (রা) সমবেদনায় বিগলিত হইয়া বলিলেন, এই স্থান আমি নিজের জন্য রক্ষিত রাখিয়াছিলাম, কিন্তু আজ আমি ওমরকে নিজের উপর প্রাধান্য দিতেছি। পুত্র যখন তাঁহাকে হযরত আয়েশার মঞ্জুরীর খবর শুনাইলেন, তখন নিতান্ত খুশী এই শেষ আরজুয পূর্ণ হওয়ার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন।
তখন হইতে মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হইল। এই অবস্থায়ই লোকদিগতে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন- যে ব্যক্তি অতঃপর খলিফা নির্বাচিত হইবেন, তাঁহাকে পাঁচটি দলের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। ইহারা হইতেছেনঃ মোহাজের, আনসার, বেদুঈন, যে সমস্ত আরব অন্যান্য স্থানে যাইয়া বসবাস শুরু করিয়াছেন, এবং যিম্মী প্রজা। তৎপর প্রত্যেক দলের অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ দিলেন। যিম্মী বা সংখ্যালঘু প্রজাদের সম্পর্কে বলিলেন, “আমি পর্বর্তী খলিফাকে অসিয়ত করিয়া যাইতেছি, তিনি যেন আল্লাহর রসূলের যিম্মাদার মর্যাদা রক্ষা করেন। যিম্মীদের সঙ্গে কৃত সমস্ত অঙ্গীকার যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। তাহাদের শত্রুদের যেন দমন করা হয় এবং তাহাদের সাধ্যাতীত কোন কষ্ট নে না দেওয়া হয়।”
মৃত্যুর সামান্য পূর্বে স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহকে বলিলেন, আমার কাফনে যেন কোন প্রকার আড়ম্বর করা না হঃয়। আমি যদি আল্লাহর নিকট ভাল বলিয়া বিবেচিত হই তবে ভাল পোশাক এমনিতেই পাইব্ আর যদি মন্দ বিবেচিত হই তবে ভাল কাঠন কোন কাজে আসিবে না।
পুনরায় বলিলেন , “আমার জন্য যেন দীর্ঘ ও প্রশস্ত কবর খনন না করা হয়। কারণ, আল্লাহর নিকট যদি আমি অনুগ্রহপ্রাপ্তির যোগ্য হই, তাহা হইলে স্বাভাবিকভাবেই আমার কবর বিস্তৃত হইয়া যাইবে। আর যদি অনুগ্রহপ্রাপ্তির যোগ্য না হই, তবে কবরের বিস্তৃতি আমাকে শাস্তির সংকীর্ণতা হইতে কিছুতেই মুক্তি দিতে সক্ষম হইবে না। আমার জানাযার সহিত যেন কোন নারী গমন না করে, কোন প্রকার অতিরঞ্জিত গুণাবলী দ্বারাও যেন আমারকে স্মরণ করা না হয়। জানা প্রস্তুত হইয়া যাওয়ার পর যথসম্ভব শীঘ্র যেন আমাকে কবরে রাখিয়া দেওয়া হয়। আমি যদি রহমত পাওয়ার যোগ্য হই, তবে আমাকে আল্লাহর রহমতের মদ্যে সথা সম্ভব তাড়াতাড়ি প্রেরণ করাই উচিত হইবে। আর যদি আযাবের যোগ্য হই, তবুও একটি মন্দ লোকের বোঝা যতশীঘ্র নিক্ষেপ করা যায় ততই মঙ্গল।” এই বেদনাময় অসিয়তের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহর শেষ মুহূর্ত ঘনাইয়া আসিল। অত্যন্ত স্বাভাবি অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এটা ২৩ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসের একেবারের শেষ দিকের ঘটনা। তখন তাঁহর বয়স হইয়াছিল ৬৩ বৎসর। হযরত সোয়াওয়াব জানাযার নামায পড়ান। হযরত আবদুর রহমান. ওসমান, হযরত তালহা, হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) মুসলিম জাহানের এ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পার্শ্বে চিরনিদ্রায় শোয়াইয়া দেন। ইন্না ল্লিাহি ওয়া ইন্ন ইলাইহে রাজেউন হযরত ওমর ফারুকের শাহাদাত মুসলমানদের হৃদয়ে যে বেদনার সৃষ্টি করিয়াছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। প্রত্যেক মুসলমান প্রাণ ভরিয়া তাঁহাদের এই মহান নেতার জন্য অশ্রু বিসর্জন করিয়াছিলেন। হযরত উম্মে আয়মান (রা) বলেন,- “যেই দিন হযরত মওর (রা) শহীদ হইলেন, সেই দিন হইতেই ইসলাম দুর্বল হইয়া গিয়াছে।”
হযরত আবু উমামা (রা) বলেন,- “হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত ওমর (রা) যেন ইসলামের পিতামাতা ছিলেন,- তাঁহাদের বিদায় হইয়া যাওয়ার পর ইসলাম যেন এতীম হইয়া গেল। আল্লাহ বলেন, -তাঁহার মরিয়া যান নাই, বরং জীবিত আছেন এবং সর্বদা জীবিত থাকিবেন।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি