অধ্যায়ঃ ৫

মানবতার বন্ধুর সামরিক তৎপরতাঃ নীতি-কৌশল ঘটনাবলী-শিক্ষা

ইসলামী আন্দোলন সিনাই উপত্যকা থেকেই আবির্ভূত হোক, কিংবা ফারানের ঘাঁটি থেকে, তার পথ সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়েই অতিক্রান্ত হয়ে থাকে।
ইসলামের বিপ্লবী আন্দোলন যুক্তির বলে মানুষের হৃদয় জয় করছিল, গোত্রীয় উচ্ছৃংখলতার বিপরীত একটা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলছিল, অসংগঠিত মানবগোষ্ঠীগুলোকে সংঘবদ্ধ করছিল, এবং নৈরাজ্যবাদী ও আইন মেনে চলতে নারাজ একটি সমাজের স্থলে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাষ্ট্র তৈরি করছিল। ইসলামী আন্দোলন মানুষের সুপ্ত জ্ঞানগত শক্তির ভেতরে নতুন করে প্রেরণার সঞ্চার করছিল।
জাহেলিয়াতের অন্ধকারে জ্ঞানের মশাল জ্বালাচ্ছিল, আল্লাহভক্তির হারানো প্রাণশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করছিল এবং নৈতিক মূল্যবোধের নিভে যাওয়া প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করছিল। প্রাচীন জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার ওপর বিরক্ত বিশ্বকে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষিত নিষ্পেষিত শ্রেণীসমূহকে সামাজিক ন্যায়বিচারের বেহেশতী পথ দেখাচ্ছিল, আর তার কোলে বেড়ে উঠছিল মানবতার উৎকৃষ্টতম নমুনা।
এর বিপরীত দিকে অবস্থান করছিল সেই জাহেলিয়াত, যার কাছে কোন প্রেরণাদায়ক আদর্শ ছিলনা, যা নৈরাজ্য ও বিশৃংখলাকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছিল, যা স্বার্থপরতার ভিত্তিতে সমাজ পরিচালনা করছিল, যা ধর্মকে হাস্যকর করে তুলেছিল এবং তার ভিত্তিতে পবিত্র ব্যবসা চলছিল। সমাজে যেটুকু প্রাচীন নৈতিক মূল্যবোধ অবশিষ্ট ছিল, তাও এই জাহেলিয়াতের হাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। মোটকথা, সে স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ইনসাফ ও উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। নিজের এই দুর্বলতার কারণেই সে পিছপা হতে হতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। তার যুক্তিপ্রমাণ তখন নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার হিংস্রতার হাতিয়ার ভোতা হয়ে গেছে। তার ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে এবং তার লোকেরা নিকৃষ্টতম মানুষে পরিণত হচ্ছে।
জাহেলিয়াতের প্রধান হোতারা নিজেদের পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সা.ও তাঁর সাথীদেরকে মক্কা থেকে বের করে দিয়ে একটা মারাত্মক আঘাত হেনেছিল বটে। তবে অনতিবিলম্বেই তারা বুঝতে পেরেছিল, আকাবার বায়য়াত দ্বারা রসূল সা.আনসারদের যে সহযোগিতা পেয়ে গিয়েছিলেন তার অর্থ এই যে, এখন মদিনা ইসলামী আন্দোলনের একটা মজবুত ঘাঁটিতে পরিণত হবে, সেখানে একটা সরকার গঠিত হবে এবং ইসলামী সমাজ এমন এক শক্তিতে পরিণত হবে, যার পথ রোধ করা আর কখনো সম্ভব হবেনা।
তাছাড়া মদিনা পৌঁছে যখন রসূল সা.মদিনার ইহুদী ও অন্যান্য গোত্রের সাথে রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করলেন, তখন কোরায়েশদের জন্য বিপদাশংকা আরো বেড়ে গেল। এর অব্যবহিত পরই রসূল সা.প্রতিরক্ষা শক্তি সংগঠিত করা শুরু করেন। সেই সাথে মদিনা রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা এবং সন্নিহিত এলাকাগুলোতে শত্রুর গতিবিধি তদারক করার জন্য টহলদারী হিসেবে সেনাদল প্রেরণ করতেও আরম্ভ করেন। এতে কোরায়েশদের চোখে ভেসে উঠলো আরো বহু ভীতিপ্রদ আশংকা। তাদের সিরিয়ামুখী বানিজ্যপথ মদিনার নিকট দিয়েই প্রবাহিত। ফলে সমগ্র বাণিজ্য ব্যবস্থাটাই অচল হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিল। বরঞ্চ সা’দ ইবনে মুয়াযকে যখন আবু জাহল ওমরা করতে বাধা দিল, তখন তিনি পরিষ্কার হুমকি দিলেন যে, এমন করলে তোমাদের বানিজ্যের পথ বন্ধ করে দেয়া হবে। রসূল ও তাঁর সাথীরা ইতিপূর্বে কোরায়েশদের জালে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি তাদের কবল থেকে মুক্ত। আগে শুধু দাওয়াত দিতেন। এখন তিনি ক্ষমতার গদিতেও আসীন। আগে মজলুম ছিলেন এবং প্রত্যেক জুলুম নীরবে সহ্য করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখন তিনি জুলুমের প্রতিকার ও প্রতিরোধ করার যোগ্য হয়ে গেছেন। বস্তুত ইসলামের দাওয়াতের বিরোধিতার বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে কোরায়েশরা যে পর্যায়ে পৌছেছিল, তার পরবর্তী ধাপ যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া আর কিছু হতে পারতোনা। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ওপর নিষ্ঠুরতম নির্যাতন চালানো ও রসূল সা.এর হত্যার পরিকল্পনা করার পর তাদের ভেতরে অনিবার্যভাবে একটা খুনী ও রক্তপিপাসু মানসিকতা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। এদিকে রসূল সা.নতুন যুগ সৃষ্টির মানসে মদিনায় যে সামান্য পুঁজি সঞ্চিত করেছিলেন, তা যদি লুন্ঠিত হয়ে যায়, তবে তার অর্থ হবে এ যাবত যেটুকু সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা সব পন্ড হয়ে যাওয়া এবং ইসলামী রাষ্ট্রের ফলে ফুলে সুশোভিত হওয়ার আশা পুরোপুরি নস্যাৎ হয়ে যাওয়া। এই রাষ্ট্রের বিকাশ ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সময়ের গতির প্রতি লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরী ছিল। প্রত্যেক বিপদাশংকাকে যদি সঠিক সময় অনুভব করা না হয় এবং সময়মত তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না করা হয়, তবে কোন নেতৃত্বের এর চেয়ে বড় অযোগ্যতা ও অক্ষমতা কল্পনা করা যায়না। অনুরূপভাবে এটাও জরুরী যে, যে পদক্ষেপের জন্য যেটা সর্বোত্তম সময়, এবং সর্বোত্তম সময়ের মধ্যেও যেটা সর্বপ্রথম সময়, পদক্ষেপটা সেই সময়েই নেয়া উচিত। নচেত বিদ্যুত গতিতে প্রবহমান সময় কখনো কারো পথ চেয়ে থাকেনা। প্রত্যেক দাওয়াত ও আন্দোলনের শুধু নিজের দিকে তাকালেই চলেনা, বরং নিজেকে প্রতিপক্ষের শক্তির সাথে তুলনা করে দেখতে হয় যে, কে কখন কতখানি আগে বা পিছে চলছে। বিশ্বমানবের পরম সুহৃদ মহানবী সা.ও তাঁর বিচক্ষন সাথীরা ভালোভাবেই জানতেন, হিজরতের পরে এখন সামনে জেহাদই অবধারিত পরবর্তী ধাপ। তারা বুঝেছিল যে, বাঁচতে হলে এখন কোরায়েশদের সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। তাই মোহাজেরদের পুনর্বাসন ও মদিনার নতুন শক্তির ভারসাম্য বহাল হওয়ার অব্যবহিত পরই রসূল সা.একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে সর্বোতভাবে মনোযোগ দিলেন।

যুদ্ধ ও জেহাদের ইসলামী দৃষ্টিভংগি

এখানে আমি একটা মৌল তত্ত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করা জরুরী মনে করছি। মৌল তত্ত্বটা এইযে, যে কোন রাষ্ট্রের অপরাধ দমনের জন্য পুলিশ ও আদালতের ব্যবস্থা যেমন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তেমনি জেহাদও তার একটা স্বাভাবিক কাজ। কিন্তু একটা নবীন রাষ্ট্র, একটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজ এবং স্বতন্ত্র যুগ সৃষ্টিকারী একটা সরকারের জন্য একটা কঠোর জেহাদী যুগ অতিবাহিত করা শুধু স্বাভাবিক নয় বরং অনিবার্যও বটে। বিশেষত যখন কোন নতুন সমাজ ব্যবস্থা কোন বিপ্লবী মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তখন প্রাচীন বিপ্লব বিরোধী শক্তিগুলো যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে রূখে আসবে, তা অবধারিত। এ ধরণের বিপ্লব বৈরী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে শুধু প্রতিরক্ষাই যথেষ্ট হয়না, বরং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া ছাড়া কোন বিপ্লবের পক্ষে নিজের বর্তমান সীমানা ও মান বজায় রাখা সম্ভব নয়। কাজেই ইসলামের জেহাদ তত্ত্ব নিছক আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নয় যে কেবল কেউ আক্রমণ চালালেই বাধ্য হয়ে তার মুখোমুখী হতে হয়। বরঞ্চ ইসলাম এই নির্দেশও দেয় যে, ইসলামী বিপ্লবের আহবায়কগণ একদিকে তাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি ইঞ্চি জমি, তার যাবতীয় সহায় সম্পদ এবং নাগরিকদের প্রাণ ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের জান ও মালের সর্বাত্মক কুরবানী দিতে প্রস্তুত থাকবে। অপরদিকে আল্লাহর কোটি কোটি বান্দাকে জুলুম শোষণ, অজ্ঞতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও নৈতিক অধোপতন থেকে উদ্ধার করার মাধ্যমে বিপ্লবের পূর্ণতা সাধনের জন্য বিপ্লব বিরোধী শক্তিগুলোকে উৎখাত করবে। কোন বিপ্লবী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে এ কাজ না করে গত্যন্তর থাকেনা। [প্রসংগত এখানে এ কথা বলা খুবই জরুরী মনে হচ্ছে যে, সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক কাজ যে কোন পর্যায়েই করা হোক না কেন, তার জন্য কোন না কোন ভাবে শক্তি প্রয়োগ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মা বাপ যেমন ছেলেমেয়েদের কল্যাণের জন্য এবং সরকার যেমন দেশবাসীর ভালাইর জন্য যুক্তি, সদুপদেশ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শক্তিও প্রয়োগ করে থাকে, তেমনি গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক বিপ্লবের পতাকাবাহীরাও কিছু না কিছু শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়ে থাকে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, আরবের জাহেলী যুগে গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থার যে কাঠামো ও পদ্ধতিই চালু থাকনা কেন, এবং জনগণ তার আওতায় যে অবস্থায়ই কাটাক না কেন, তা পাল্টাবার অন্যদের কী অধিকার ছিল? সংস্কার ও গঠনমূলক উদ্দেশ্য নিয়ে কোন বিপ্লব সংগঠিত করা, অতপর তার পূর্ণতা সাধন এবং এ ব্যপারে শক্তি প্রয়োগ করাকে আদৌ বৈধ কাজ বলে মেনে নেয়া যায় কি? এই প্রশ্নকে যদি কিছুমাত্র আমল দেয়া হয়, তাহলে কোন পিতা বা মাতাকে কিসের ভিত্তিতে এ অধিকার দেয়া যাবে যে, তারা তাদের সন্তানদের মগজে কোন বিশেষ ধারণা ঢুকাতে পারবে, কোন বিশেষ ধরনের আদব আখলাক, চালচলন ও রীতিনীতি তাকে জোর করে শেখাবে, কোন বিশেষ নৈতিক চেতনা তার ওপর জোরপূর্বক প্রয়োগ করবে? কিভাবেই বা কোন সরকারকে নাগরিকদের কোন কোন কাজে বাধা দান ও কোন কোন কাজ করতে বাধ্য করার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকার দেয়া হবে? কোন্ অধিকারে সে অজ্ঞতা, দুস্কম, অপরিচ্ছন্নতা ও চারিত্রিক অসততার বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক কৌশল প্রয়োগ করবে এবং যে শক্তি এই কৌশল প্রয়োগে বাধা দেবে, তাদের বাধা অপসারণ করবে? সংস্কার ও গঠনমূলক কাজ করতে কোন বাধা আসবেনা এবং সেই বাধা দুর করতে শক্তি প্রয়োগ করার দরকার হবেনা- এটা কোন ক্ষেত্রেই কল্পনা করা যায়না। আপনি যদি বাধা দানকারী শক্তিগুলোকে অবাধ সুযোগ দিয়ে দেন, তাহলে কোন সংস্কারমূলক বা গঠনমূলক কাজ করাই সম্ভব হবে না। সংস্কার ও গঠনমূলক প্রতিটি কাজের পক্ষে খোদ মানুষের স্বভাবপ্রকৃতি সর্বশক্তি নিয়ে বর্তমান থাকে। একটি দেশ বা জাতিকে পতিত দশা থেকে উদ্ধার পূর্বক কল্যাণের পথে চালিত করার জন্য যখন কোন গঠনমূলক বিপ্লব সংঘঠিত হয়, তখন মানুষের স্বভাব প্রকৃতি তথা সহজাত মনোবৃত্তি, সদিচ্ছা ও বিবেক তার পক্ষে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করে। এই সাক্ষ্যপ্রমাণই ঐ বিপ্লবের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। তখন যে প্রশ্নটার জবাব আবশ্যক তা এই যে, মানুষের স্বভাব প্রকৃতির দাবী যেহেতু অস্পষ্ট, সেহেতু কোন বিপ্লব গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক, না বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসাত্মক, সেটা যাচাই বাছাই করার অকাট্য পন্থা কী? এর জবাব এইযে, এই অকাট্য পন্থাটা হলো, মহানবীর (সা) দেয়া আদর্শ আল্লাহর বিধান। মানুষের অসংখ্য গালভরা বুলির মধ্যে কোনটি কল্যাণকর ও কোনটি অকল্যাণকর, তা পরখ করার হলো, নির্ভুল পথ হলো ওহির প্রদর্শিত পথ। আরব জাতিকে নৈরাজ্য থেকে সুসংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পর্যায়ে নিয়ে আসা, গোত্রে গোত্রে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা একক জাতি সত্তায় রূপান্তরিত করা, লক্ষ লক্ষ মানুষকে জ্ঞান ও সচ্চরিত্রের অলংকারে সজ্জিত করা এবং তাদেরকে শক্তি, নিরাপত্তা ও ইনসাফের একটা নবযুগ উপহার দেয়া এমন একটা মহান ও পবিত্র কাজ যে, এর জন্য যদি শক্তি প্রয়োগ বৈধ না হয়, তাহলে মানবেতিহাসে শক্তি প্রয়োগের আর কোন ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ স্থান আর অবশিষ্ট থাকেনা।] আল্লাহর যদি তাওফীক দেন তবে এ বিষয়টি আমরা বিশদভাবে আলোচনা করবো পুস্তকের সেই খন্ডে, যাতে রসূল সা.এর যুগের সামরিক অভিযানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার ইচ্ছা রয়েছে।
এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কুটিল মানসিকতা নিয়ে একটা বিভ্রান্তির বিতর্ক তোলা হয়েছে। আর এর কারণে আত্ম বিস্মৃত মুসলমানদের পাশ্চাত্যমনা অংশটিও নিদারুণ ভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছে। আপত্তিকারীরা সামরিক অভিযানগুলোর এরূপ অর্থ করেছে যে একটা ধর্ম বলপ্রয়োগে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য সামরিক আক্রমণগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এটা নিছক একটা ধর্মের ব্যাপার ছিলনা। এটা ছিল সর্বাত্মক বিপ্লবী আন্দোলন। এ বিপ্লব জান ও মালের বহু মূল্যবান কোরবানীর বিনিময়ে মানবতার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছিল এবং স্বার্থপর বিপ্লব বিরোধীরা এ বিপ্লবকে পূর্ণ সফলতার মুখ দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। এখানে লক্ষ্য ছিল একটা রাষ্ট্র গড়া। এই রাষ্ট্রের পত্তন করার জন্য এর নির্মাতারা তেরো বছর যাবত চরম নির্যাতন সহ্য করেছে, অতঃপর ঘরবাড়ী জায়গা জমি সব ত্যাগ করে এসেছে এবং একেবারেই সর্বহারা হয়ে নিজেদের এমন একটি ক্ষুদ্র ভূখন্ডে সীমিত করে নিয়েছে, যেখানে তারা নিজেদের পছন্দসই জীবনপদ্ধতি অনুসারে জীবন যাপন করতে পারবে এবং সারা দুনিয়ার মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ দেখাতে পারবে।
মহা সমারোহে ইতিহাসের এই নয়া সোনালী অধ্যায়টা উদ্বোধন করার আয়োজন চলছিল।কিন্তু মদিনার ইহুদী, মোনাফেক, মক্কার কোরায়েশ, তাদের তাবেদার গোত্রগুলো, এবং বাইরের কতিপয় বড় বড় শাসক-সবাই মিলে এই আয়োজনকে অংকুরে বিনষ্ট করতে চাইছিল। তারা মুসলমান বিপ্লবীদেরকে এই সুযোগই দিতে চাইছিল না যে, এই বিপ্লবকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দিক। এ কথা সত্য যে ইসলাম ধর্ম ইসলামী আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল (অবশ্য ধর্মের যে বিকৃত অর্থ আজকাল প্রচলিত, তা থেকে ভিন্ন অর্থে) কিন্তু এর সাথে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মিলিত হয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এ জন্যই দেখা যায়, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মের সীমিত পরিসরে অমুসলমানদেরকে পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। সে ধর্মকে চাপিয়ে দেয়ার জন্য তরবারী ধারণ করেনি, বরং আন্দোলন, সামগ্রিক জীবন বিধান ও ইসলামী রাষ্ট্রের স্বার্থে তরবারী ধারণ করেছিল। তার আসল সমস্যা ছিল নিজের পবিত্র রাজনৈতিক কাঠামোর স্থায়িত্ব ও সুস্থ বিকাশ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, কেননা তাতেই সমগ্র আরব জাতি ও সমগ্র মানব জাতির কল্যাণ নিহিত ছিল। মুসলমানদের সর্বব্যাপী সংগ্রাম সংঘাতের পরিমন্ডল ছিল রাজনৈতিক। সততা ও খোদাভীরুতার নৈতিক ভিত্তির ওপর রাজনীতি করার এক নতুন চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করতে শুরু করেছিল। আর এই মহৎ কাজটাকেই পন্ড করে দিতে চেয়েছিল কোরায়েশ, ইহুদী ও বেদুইন গোত্রগুলো। এ পরিস্থিতিতে এই নিরর্থক বিষয়টা আলোচনায় আসেই বা কিভাবে যে, রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা ধর্ম প্রচারের জন্য তরবারী ব্যবহার করেছিলেন কিনা? এ প্রশ্নই বা ওঠে কিভাবে যে, রসূল সা. এর সামরিক অভিযানগুলো আত্মরক্ষামূলক ছিল, না আক্রমণাত্মক? তথাপি আমাদের স্পর্শকাতর মুসলমানরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে রাজী হয়ে গেছে। পশ্চিমাদের অন্যায় ও অর্থহীন যুক্তিকে মেনে নিয়ে তারা ভেবেছে, এতে নিজেদের ইতিহাসের পাতা থেকে তথাকথিত কিছু কলংকের দাগ মুছে ফেলা যাবে। সমস্ত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তারা প্রাচ্যবিদদের দরবারে করজোড় ওযর ব্যক্ত করতে আরম্ভ করেছে। তারা ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও সীমিত ধারণা অন্তরের অভ্যন্তরে বদ্ধমূল করে নিয়েছে এবং জেহাদ তত্ত্বকেও বিকৃত করে ফেলেছে। তাদের পশ্চিমা গুরুদের অবস্থা এইযে, তাদের ধর্মীয় নেতারা নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এবং তাদের রাজারা নিছক রাজ্য বিস্তারের জন্য যে জঘন্য যুদ্ধগুলো করেছে, তা তাদের কবিতায় ও সাহিত্যে আজও গৌরবের বিষয় বিবেচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন স্বাধীন দেশকে গোলাম বানানোর জন্য যে অন্যায় পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে, তাকে তারা সব সময় গর্বের বিষয় বলে মনে করে। তাদের নৌ দস্যুতার অপরাধ যদি উপনিবেশ গড়ার কাজে সহায়ক হয়, তাহলে তাকে তারা হিরো বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র যদি চতুর্মুখী হুমকিতে পরিবেষ্টিত হয়ে নিজের নতুন শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সংরক্ষণ করা, কয়েকটা ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধ করা এবং ঐক্য, শৃংখলা, শান্তি, নিরাপত্তা, সুবিচার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ন্যায় দুর্লভ সম্পদে সজ্জিত হবার জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তাহলেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগনামা তৈরী করা ও অপরাধ প্রমাণ করার জন্য পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ মানের প্রতিভাধারীরা নিরলস পরিশ্রম করে যেতে থাকে। এই সব দাবীদার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের আদালতে মামলা চালানোর সময় এখন ঘনিয়ে এসেছে। তাদের ধাপ্পাবাজী ও জালিয়াতির মুখোস উন্মোচনের জন্য চার্জশীট তৈরী করার সময় এখন সমাগত। আমাদের এই জাতীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য ইতিহাস ও সীরাত শাস্ত্রের যুবক ছাত্রদেরকে এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
ইসলামে জেহাদ তত্ত্ব আদৌ প্রচলিত প্রতিরক্ষার ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরী হয়নি। তবে তা এই অর্থে প্রতিরক্ষামূলক যে, তার উদ্দেশ্য ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সমাজের সংরক্ষণ, যে আদর্শের ভিত্তির ওপর ইসলামী বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত, সেই আদর্শকে সংরক্ষণ করাই তার উদ্দেশ্য। এমন যে কোন কার্যকর নাশকতাবাদী শক্তির প্রতিরোধ তার লক্ষ্য, যা ইসলামী বিপ্লবের অর্জিত সাফল্যকে ধ্বংস করতে চায় এবং তার পূর্ণতা অর্জনের পথে অন্তরায়, এবং এমন যে কোন অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থাকে সমূলে উৎখাত করা তার উদ্দেশ্য, যা সভ্যতার বিকাশ ও অগ্রগতি এবং মানবতার কল্যাণ সাধনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

কোরআনের সমর দর্শন

এখানে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। তবে কোরআনের কয়েকটি অতীব জরুরী অংশের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজনঃ
“যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়, তাদেরকে অস্ত্র ধারণের অনুমতি দেয়া হলো। কেননা তারা যুলুমের শিকার। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। তাদেরকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শুধু এই কারণে বাড়ীঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, “আল্লাহই আমাদের একমাত্র প্রভু।” আল্লাহ যদি (এভাবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে) কিছু লোককে (যারা বিকৃত ও বিপথগামিতার হোতা) অন্য কিছু লোকের দ্বারা (যারা গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজের পতাকাবাহী) ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করতেন, তাহলে (অপশক্তির দাপট বেড়ে যাওয়ার কারণে) সংসার বিরাগীদের আশ্রম, খৃস্টানদের গীর্জা, ইহুদীদের এবাদতখানা ও মুসলমানদের মসজিদ, যাতে আল্লাহর নাম খুব বেশী উচ্চারিত হয়ে থাকে, ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহ শুধু তাদেরকেই সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর কাজে সহযোগিতা করে। নিশ্চয়ই (তাদেরকে সাহয্য করতে) আল্লাহ সর্বতোভাবে ক্ষমতাবান ও বিজয়ী। তারা এমন লোক, আমি তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন করলে তারা (আত্মপূজা ও ধ্বংসাত্মক কাজের পরিবর্তে) নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, সৎকাজের আদেশ দেবে, খারাপ কাজ প্রতিহত করবে এবং সকল বিষয়ের চূড়ান্ত পরিণতি আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।”(হজ্জঃ ৩৯, ৪০, ৪১)
“আল্লাহর পথে (তাঁর ন্যায়সংগত বিধানের বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের জন্য) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তবে বাড়াবাড়ি করোনা। [এখানে বিস্তারিত তাফসীর আলোচনা করার অবকাশ নেই। তবে ততটুকু আভাস দেয়া জরুরী যে, বাড়াবাড়ী করতে নিষেধ করার অর্থ হলো, অশান্তিকামী ও নৈরাজ্যবাদীদেরকে দমন করতে গিয়ে শান্তিকামীদের ওপরও যেন শক্তি প্রয়োগ না করা হয়। দ্বিতীয়ত, সামরিক তৎপরতা একান্ত প্রয়োজনের সীমার বাইরে না চালানো উচিত। তৃতীয়ত, যুদ্ধের সময় ইসলামের নৈতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধ আইন মেনে চলা উচিত]।
যারা বাড়াবাড়ি করে, তাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। শত্রুদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর এবং যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করেছিল, সেখান থেকে তোমরাও তাদেরকে বের কর। কেননা ফেতনা (সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় প্রতিরোধ ও বাধা দান) হত্যার চেয়েও খারাপ। মসজিদুল হারামের চত্তরে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করোনা। তবে তারা যখন (মসজিদুল হারামের মর্যাদা রক্ষা না করে) তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তখন তোমরাও যুদ্ধ কর। তারপর যদি তারা সত্যিই (হারাম শরীফের সীমানার ভেতরে) তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরাও (কোন দ্বিধা সংকোচ না করে) তাদের সাথে যুদ্ধ কর। এ সব কাফেরকে (ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদেরকে) এভাবেই উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যায়। এরপর যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু আছেনই। (অন্যথায়) তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ইসলামী বিধান কায়েম করার পথ থেকে সকল বাধা অপসারিত না হয়ে যায় এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর বিধানের অনুসারী না হয়ে যায়। এরপর যদি তারা বাধা দেয়া থেকে বিরত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে না। তবে অত্যাচারীদের কথা স্বতন্ত্র।’’ (সূরা বাকারাঃ ১৯০-১৯৩)
‘‘তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা আল্লাহর পথে, এবং বিশেষ করে ঐসব অসহায় নরনারী ও শিশুকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করনা, যারা দোয়া করে যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এই জনপদ থেকে উদ্ধার কর, যার অধিবাসীরা অত্যাচারী। আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে কাউকে রক্ষক বানিয়ে পাঠাও এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে সাহায্যকারী বানিয়ে পাঠাও।’’ (সূরা নিসাঃ ৭৫)
‘‘এরপর যদি তারা চুক্তি করে তা ভংগ করে এবং তোমাদের ধর্মের ওপর টিটকারী দেয়, (এবং এভাবে প্রমাণ করে দেয় যে তারা ষড়যন্ত্র করতে বদ্ধপরিকর) তাহলে তোমরা ঐ সব ইসলাম বিরোধী শক্তির নেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও। তাদের দৃষ্টিতে তাদের চুক্তি ও অংগীকারের কোন মূল্য নেই। হয়তো তারা বিরত হবে। যারা তাদের চুক্তি লংঘন করে, রসূলকে (মদীনা থেকে) বের করে দেয়ার চক্রান্ত আঁটে, এবং তোমাদের ওপর সর্বপ্রথম আক্রমণ চালায়, তাদের সাথে কি তোমরা লড়বেনা? (সূরা তওবাঃ ১২)
‘‘তোমরা যদি (জেহাদের জন্য) বের না হও তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। এবং তোমাদের স্থলে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাবেন, তার কোন ক্ষতিই তোমরা করতে পারবেনা। আল্লাহ সব কিছুই করতে সক্ষম।’’ (সূরা তওবাঃ ৩৯)
ইসলামের জেহাদ তত্ত্ব ও রসূল সা. এর অনুসৃত সমর নীতি সম্পর্কে কোরআনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার যোগ্য আয়াত রয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলোর মধ্য থেকে কেবলমাত্র সেই আয়াতগুলোরই উদ্ধৃতি দিয়েছি, যা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং যা থেকে শুধু মৌলিক তত্ত্বই পাওয়া যায়। এ আয়াতগুলোতে যে ক’টি বিষয় বুঝানো হয়েছে, তা নিম্নরূপঃ
১. সামগ্রিকভঅবে মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন ভোগ করে আসছিল এবং রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করে সামষ্টিক যুলুমের সর্বশেষ আঘাত হানা হয়েছিল। প্রতিপক্ষ শুরু থেকেই নিপীড়নমূলক আচরণ করে আসছিল। কেননা মুসলিম সমাজকে তারা তিষ্টাতেই দিচ্ছিলনা। সত্যনিষ্ট লোকেরা আল্লাহকে প্রভূ ও প্রতিপালক মেনে নিয়ে তার নির্দেশের অধীন জীবন গড়ে তুলুক- সে সুযোগই তারা দিতে চাইছিলনা। তারা আকীদা বিশ্বাস ও মতামত পোষণ, স্বাধীন চিন্তাধারা প্রকাশ, সত্যের দিকে মানুষকে ডাকা এবং সংগঠন গড়ার স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করে নিয়েছিল। এক নাগাড়ে কয়েকটি বছর ধরে তারা নিরীহ, ভদ্র শান্তিপ্রিয় ও ধৈর্যশীল বিপ্লবী মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত হিংস্র আঘাত হেনে হেনে আপন জন্মভূমিতে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
২. ইসলাম তার বিরোধীদেরকে বক্তব্য অনুধাবন ও আপন আচরণে পরিবর্তন আনার সর্বাধিক সুযোগ দিয়ে থাকে এবং এই সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই সে তার অনুসারীদেরকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এক সুদীর্ঘ যুগ অতিবাহিত করায়। কিন্তু তার এই ধৈর্যশীল অনুসারীরা চিরদিন কেবল মযলুম ও নির্যাতিতই হতে থাকবে এবং অত্যাচারীদের দর্প ও অহংকার বৃদ্ধি করতে থাকবে, এটা সে কখনো বরদাশত করতে পারেনা। মানব সমাজে কিছু সংখ্যক হিংস্র নরপশুকে লালন পালন করার জন্য সস্তা শিকার যোগাড় করে দেয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। সে ধৈর্যশীলদেরকে গড়ে তোলেই এ জন্য যে, তারা যুলুমবাজদেরকে উচ্ছেদ করে মানব জাতির জন্য মু্ক্তির পথ উন্মোচিত করুক।
৩. নির্যাতন নিপীড়ন ও যুলুম শোষণকারী ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলোর মূলোৎপাটন সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কাজ। কেননা এই নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলোকে যদি বলপ্রয়োগে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ না করা হয় এবং তারা স্থায়ীভাবে কাজ করার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়- তাহলে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, শান্তিপ্রিয়তা ও আল্লাহ প্রীতিমূলক সমস্ত মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য।
৪. ইসলামের বৈপ্লবিক মতাদর্শ প্রয়োজনের সময় অস্ত্রের শক্তির প্রয়োগ করে সেই সব লোকের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায়, যারা বিশৃংখলা, অজ্ঞতা, দুষ্কর্ম-দুর্নীতি ও অন্যায় অত্যাচারের পৃষ্ঠপোষক। অতঃপর এমন লোকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে চায়, যারা আল্লাহর আনুগত্য, নামায ও যাকাত ব্যবস্থা কায়েম করবে, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার বিস্তার ও বিকাশ ঘটাবে এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধ করবে।
৫. ‘‘যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তাদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর’’- এ কথার অর্থ এটা নয় যে, শত্রুরা তোমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দেয়ার পরই আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ কর। এখানে যে বিষয়টির দিকে ইংগিত দেয়া হয়েছে তা হলো, ইসলামের শত্রুদের মধ্যে যারা বিরোধিতায় ও প্রতিরোধে সক্রিয় নয়, তাদের পেছনে তৎপর হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা তোমাদের কাজে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি করে এবং আক্রমণ চালিয়ে তোমাদেরকে ও তোমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর তারা কখন কার্যত হামলা চালাবে, সেই মুহূর্তটির অপেক্ষায় বসে থাকা জরুরী নয়। বরঞ্চ তাদেরকে যেখানেই বাগে পাওয়া যায়।, সেখানেই খতম করা যেতে পারে। এর সপক্ষে সুস্পষ্ট ও অকাট্য যুক্তিও দেয়া হয়েছে যে, খুনখারাবি মূলতঃ কোন ভাল কাজ নয়। তবে ইসলামী আন্দোলন, সংগঠন, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানো, গোলযোগ ও হাঙ্গামা এবং অবরোধ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা বহু গুণ বড় অন্যায় কাজ। ইসলামের শত্রুদেরকে এ কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হলে তারা ইসলামেরই মূলোৎপাটন করে ছাড়বে। এজন্য বৃহত্তর অন্যায় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সশস্ত্র জেহাদের উদ্যোগ ও সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। সত্য ও ন্যায়ের পথে প্রতিরোধ ও অবরোধ সৃষ্টিকারীদেরকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল না করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ দ্বীন চালু না হওয়া পর্যন্ত এই সশস্ত্র সংগ্রাম সর্বশক্তি নিয়োগ করে চালিয়ে যেতে হবে।
৬. একদিকে যদিও ধর্মীয় পবিত্র স্থান, সময় ও রীতিনীতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে ধর্মভীরুতার এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেও মুসলমানদেরকে রক্ষা করা হয়েছে যে, শত্রুরা যদি এই সব পবিত্র জিনিসের সম্মান ও মর্যাদা পদদলিত করে মুসলমানদেরকে যবাই করতে থাকে, তবুও তারা টু শব্দটিও করবেনা এবং নিষিদ্ধ ও পবিত্র স্থান ও মাসের সম্মান রক্ষা করা বাধ্যবাধকতাকে গুরুত্ব দিয়ে অকাতরে বিনা প্রতিরোধে যবাই হতে থাকবে। বলা হয়েছে, তারা যদি কোন স্থান ও সময়ের মর্যাদাহানি করে আক্রমণ চালায় তবে সেই আক্রমণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে।
৭.মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব শুধু নিজেদের জানমাল সম্ভ্রম রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং অন্য কোন এলাকায়ও যদি দূর্বল ও অসহায় লোকেরা নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে থাকে এবং তারা অত্যাচারীদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকে, তবে তাদের ফরিয়াদে সাড়া দেয়া ইসলামী সরকারের কর্তব্য। অর্থাৎ ইসলামী শক্তিকে গোটা মানব জাতির মুক্তিদাতা ও ত্রাণকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। ধর্ম ও সভ্যতার উত্তম মূল্যবোধগুলোকে সংরক্ষণ করা তার ব্যাপকতর ও আসল কর্তব্য।
৮. যুলুম অন্যায় দূর করার জন্য চুক্তি করাও একটা শান্তিপূর্ণ উপায়। রসূল সা. এই উপায়টাও সর্বতোভাবে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভংগকারীদের সম্পর্কে কোরআন কঠোর নির্দেশ দিয়েছে যে, শক্তি প্রয়োগ করে তাদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। বিশেষতঃ যারা প্রতিশ্রুতি ভংগ করে ইসলামী কেন্দ্রকে ধ্বংস করা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা বা প্রশাসনকে উৎখাত করা ও বিরাজমান শৃংখলাকে ধ্বংস করে অরাজকতা সৃষ্টির চক্রান্ত করে এবং প্রথম উস্কানী দেয়, তারা যদি খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা নাও করে থাকে, তথাপি তাদের এ জাতীয় প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে এক একটা যুদ্ধ ঘোষণা মনে করতে হবে এবং তাকে বিনা প্রতিরোধে চলতে দেয়া যাবেনা।
৯. এ প্রসংগে মুসলিম সরকারকে যে বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে সেটি হলো, সামরিক তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য নিরীহ ও নিরস্ত্র জনসাধারণকে হতাহত করা নয়, বরং ইসলামী বিপ্লবের বিরোধী ও কুফরী শক্তির মূল হোতাদেরকে খতম করা।
১০. জেহাদের ফরয আদায়ে শৈথিল্য ও উদাসীনতার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, জেহাদে উদাসীন হলে তোমাদের এই রাষ্ট্র, সরকার ও ক্ষমতা- সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমরা যদি সাহস করে এগিয়ে না যাও, তবে বিরোধীরা তোমাদের ওপর চড়াও হবে, এবং তোমাদেরকে হটিয়ে ও পদদলিত করে নিজেদের শাসন চালু করে ফেলবে। তখন তোমরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে এবং টু শব্দটিও করতে পারবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতে তোমাদের কেমন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে ভেবে দেখ।

ইসলামী যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরণ

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইসলামী জেহাদ তত্ত্বকে ভালো করে বুঝে নেয়া ছাড়া ইসলামী বিপ্লবের সংগঠকদের ও ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরণ ও প্রকৃতি বুঝা সম্ভব নয়। যে মূল কথাটা বুঝা দরকার তা হলো, আরবের দুটো ঐতিহাসিক শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। একটা শক্তি বাতিল ও অত্যাচারমূলক জাহেলী শাসন ত্রাসন থেকে জনগণভকে মুক্তি দিয়ে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নব যুগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। আর অপর শক্তিটি গতানুগতিক জাহেলী সমাজ ব্যবস্থাকে যেমন আছে তেমনভাবেই বহাল রাখার নিমিত্তে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল। উভয়ের আদর্শে ও উদ্দেশ্যে কোন ধরণের স্থায়ী সমঝোতা বা আপোষ যেমন সম্ভব ছিলনা, তেমনি লেনদেন করেও দুইপক্ষের মধ্যে কোন সহাবস্থানের অবকাশ ছিল না। অবস্থাটা ছিল এ রকম যে, ‘‘হয় তোমরা থাকবে, না হয় আমরা থাকবো।’’ অথবা, সুপরিচিত ইংরেজী প্রবাদ অনুসারে এভাবেও বলা যেতে পারে যে, ‘‘তুমি আগে ওকে মেরে ফেল, নচেত ও তোমাকে মেরে ফেলবে।’’ ব্যাপারটা অনেকাংশে এ রকম ছিল যে, একজন কর্মঠ কৃষক অনেক পরিশ্রম করে একটা পতিত জমিতে আবাদ করে তাতে ফলের বাগান বানালো। ঐ এলাকার পাশেই ছিল অরণ্য। সেখান থেকে বুনো পশুরা এসে বাগান নষ্ট করে ফেলতে প্রবল ছিল। এমতাবস্থায় সে যদি বুনো পশুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে তার বাগান উজাড় হবে। আর যদি বাগানকে রক্ষা করতে চায়, তবে বুনো পশুদের প্রতি তাকে নিষ্ঠুর হতেই হবে। ইতিহাসে যখনই কোন সর্বাত্মক বিপ্লব ঘটেছে, তখনই এ ধরণের আপোষহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিয়ে ইসলামী যুদ্ধগুলো আত্মরক্ষামূলক ছিল কি ছিল না, সেই বিতর্কে যাওয়ার আর প্রায়োজন হয় না। মুসলমানরা তলোয়ার প্রয়োগ করে মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে- এই কাণ্ডজ্ঞানহীন অপপ্রচারের পথও বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি এরও প্রয়োজন থাকে না যে, এক একটা লড়াই নিয়ে আলাদা আলাদা পর্যালোচনা চালিয়ে তার তাৎক্ষণিক কারণগুলো চিহ্নিত হবে এবং জেনেশুনে অপপ্রচারে লিপ্ত লোকদেরকে আশ্বাস দেয়া হবে যে, ইসলামী সরকারকে এ যুদ্ধটা অনন্যোপায় হয়ে লড়তে হয়েছিল। এ মূল দায়িত্ব প্রতিপক্ষের ওপরই বর্তে।
আজ যখন আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের পূর্ববর্তী কিছু কিছু বিজ্ঞজন বিভিন্ন যুদ্ধের, বিশেষত বদর যুদ্ধের কারণ পর্যালোচনা ও পরিস্থিতির একটা বিশেষ চিত্র অংকন করার জন্য ব্যাপকভাবে মাথা খাটিয়েছেন, তখন ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে, এত চুলচেরা বিশ্লেষণকারকেরা এমন সহজ সরল কথাটা কেন বুঝলেন না, যা একবার মাত্র বলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায় এবং আর কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দরকার পড়েনা? নবী জীবনী নিয়ে লেখা তাদের মূল্যবান গ্রন্থাবলী পড়ে এরূপ ধারণা পাওয়া যায় যে, আসল কারণটা কী ছিল বা ছিলনা, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেয়ার অধিকার যেন পাশ্চাত্যবাসীর। আমরা যেন শুধু তাদের দরবারে আমাদের সাফাই পেশ করারই অধিকার রাখি, এর চেয়ে বেশী নয়।’ আমরা বিচার বিবেচনার এই রীতিটা পাল্টে ফেলতে চাই। আমাদের দ্বীন, আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের নবী জীবনী বুঝা ও বুঝানোর সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত ক্ষমতা আমাদের, অন্য কারো নয়। আমাদের দ্বীন ও আমাদের রসূল আমাদেরকে চিন্তাগবেষণা ও বিচার বিবেচনার যে মানদণ্ড ও মাপকাঠি দিয়েছেন, সেটাই আমাদের সব কিছু বুঝার সর্বোত্তম মাপকাঠি। আমরাই আমাদের অবস্থা যাচাই করার সবচেয়ে বেশী হকদার। পশ্চিম বা উত্তর দক্ষিণ- যে দিকেরই লোক হোক না কেন, আমাদেরকে আমাদের ধর্ম ও আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার তারা কেউ নয়। বরঞ্চ আমাদের কাছ থেকেই তাদের জেনে নেয়া উচিত আমাদের ধর্ম ও ইতিহাসের কোন্ জিনিসটার মর্ম কী? আমাদের অতীতের কীতিকলাপের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা এবং আমাদের পরিভাষার অর্থ বুঝানো আমাদেরই দায়িত্ব, অন্য কারো নয়। আমাদের ধর্ম, আমাদের ইতহিাস ও আমাদের নবীর জীবনেতিহাস যাচাই করার জন্য প্রাচীন খ্রীষ্টীয় গীর্জা অথবা আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরী করা মানদণ্ড আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ঐ সব বাতিল মানদণ্ডে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে যাঁচাই করে দেখাতে আমরা প্রস্তুত নই।

মদিনার সামরিক কর্মকাণ্ডের ধরণ

ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক কর্মকাণ্ডকে দুই সাম্রাজ্যের পারস্পরিক সংঘাত কিংবা দুই ধর্মীয় উপদলের সংঘর্ষ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এখানে আলেকজান্ডার ও নেপোলিয়নের মত বিশ্বজয়ের কোন পরিকল্পনা যেমন ছিলনা, তেমনি ছিলনা হল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মত স্বাধীন দেশগুলোর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কোন উচ্চাভিলাষ। এখানে একই দেশ ও একই জাতির লোকদের মধ্যে এই নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল যে, এক পক্ষ জাতির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছিল, আর অপর এক পক্ষ তাকে ব্যর্থ করে দেয়ার মতলবে তার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মল, নিষ্কলংক ও ন্যায়নিষ্ঠ এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে কোরায়েশ, ইহুদী ও বেদুঈন গোত্রগুলো নিছক নেতিবাচক অন্ধ ভাবাবেগের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গিয়ে জঘন্যতম অপকর্ম, অপরাধ, চক্রান্ত ও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। বহু বছরব্যাপী গোয়ার্তুমিপূর্ণ কর্মকাণ্ড চালানোর পর এখন পরবর্তী একটামাত্র পদক্ষেপই তাদের নেয়া বাকী ছিল, সেটা হলো প্রকাশ্য সশস্ত্র আগ্রাসন চালিয়ে ময়দানে নামা এবং সম্ভব হলে চিরতরে এই বিরোধের অবসান ঘটানো। কোরায়েশ আগে আগে এবং অন্যরা পেছনে পেছনে চললো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরই অস্তিত্ব খতম হয়ে গেল। এই যুদ্ধগুলোর সাথে সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে সেই সব সংঘর্ষের সাদৃশ্য রয়েছেন, যা রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারী বিপ্লব থেকে শুরু করে অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে অথবা ফরাসী বিপ্লবের নামে রাজভক্তদের ও বিপ্লবীদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। অথবা আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মতও বলা যেতে পারে। মক্কা ও মদিনার যুদ্ধগুলো মূলতঃ এক ধরণের গৃহযুদ্ধই ছিল। এই গৃহযুদ্ধের সর্বপ্রথম কারণ ছিল এই যে, একদিকে রসূল সা. পৈতৃক জাহেলী ব্যবস্থার অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করে আল্লাহর নির্দেশে একটা নির্ভুল কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিলেনর। অপর দিকে কোরায়েশ তাকে তার বিবেক ও মতের স্বাধীনতা প্রয়োগ করে কাজ করতে দিতে চাইছিলনা। জাহেলিয়াতের হোতারা বলপ্রয়োগে সহিংস পন্থায় যুবকদের সচেতন বিবেকবুদ্ধিতে স্বাধীন মত ও বিশ্বাস থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। আর এই সচেতন বিবেক নিজের স্বাভাবিক অধিকার অর্জন করতে ও অন্যদেরকে তা দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিল।
মদীনার প্রাথমিক ইসলামী রাষ্ট্রের দশ বছরের সামরিক তৎপরতার এই ধরণটা প্রাণক্ষয়ের পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায়। এ কথা না মেনে উপায় থাকে না যে, রসূল সা. ন্যূনতম রক্তপাতের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। নামমাত্র প্রাণক্ষয়ের মাধ্যমে তিনি দশ লক্ষ বর্গমাইল ভূখণ্ডের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখান। বিপ্লবের চূড়ান্ত সাফল্যের স্তরে পৌঁছা পর্যন্ত সর্বমোট ২৫৫ জন মুসলিম শহীদ ও ৭৫৯ জন কাফের খুন হয়। (রহমাতুল্লিল আলামীনঃ কাযী সুলায়মান মানসুর পুরী, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬৫) লক্ষ কোটি মানুষের কল্যাণের পথ উন্মুক্ত করার জন্য মাত্র ৭৫০ জন বিরোধীকে হত্যা করতে হয়। অপবাদ রচনাকারীদের উচিত এই পরিসংখ্যানের আলোকে নিজেদের ধ্যান-ধারণাকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রেখে দেখা। এই যুদ্ধগুলো যদি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে করা হতো, তাহলে তাতে শুধু যে ইহুদী ও খৃস্টানদের মত জঘন্যতম নৃশংসতা চালানো হতো তা নয়, বরং এর চেয়ে অনেক বেশী সংখ্যক মানুষকে এক একটা যুদ্ধেই হত্যা করা হতো। রসূল সা. যদি দিগ্বিজয়ের উচ্চাভিলাষী হয়েই যুদ্ধে নামতেন, তাহলে বড় বড় সমর নায়করা যেভাবে অকাতরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে, তেমনি তিনিও আরবের মরুভূমিতে রক্তের ঢল বইয়ে দিতে পারতেন। দুটো প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সংঘর্ষ হলেও তাতে অনেক বেশী লোক ক্ষয় হতো, অনুরূপভাবে যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা যেখানে ৬৫৬৪ ছিল, সেখানে তাদের মধ্যে থেকে মাত্র দু’জন বন্দীকে তাদের প্রমাণিত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয় হয়। সর্বমোট ৬৩৪৭ জন বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ গ্রন্থের লেখক অনেক গবেষণার পর বলেছেন যে, মাত্র ২১৫ জন বন্দীর পরিণাম সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। হয়তো পরবর্তীকালে জানা যাবে। খুব সম্ভবত তারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম সমাজে বিলীন হয়ে গেছে। মদিনায় প্রকৃত পক্ষে একটা বিকাশমান ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রকে আভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং একই ভূখণ্ডের আত্মীয় অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাত বেধে গিয়েছিল। অত্যন্ত স্বল্প পরিসর সময়ে তিন চারটে বড় বড় যুদ্ধে অতি সামান্য প্রাণক্ষয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আসলে এ নিষ্পত্তিটা জনমতের ব্যাপকতর গণ্ডীতেই হচ্ছিল।
ভাববার বিষয় যে, রসূল সা. এর স্থলে যদি অন্য কোন সমরনায়ক হতো, তাহলে এটা কি সম্ভব হতো, সে বদরের ময়দানে নিজ সৈনিকদেরকে নির্দেশ দিত যে, বনু হাশেমের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করোনা, কেননা তারা স্বেচ্ছায় আসেনি, বাধ্য হয়ে এসেছে, আব্বাস বিন আব্দুল মোত্তালেবকে হত্যা করোনা, আবুল বুখতারী বিন হিশামকে হত্যা করোনা? (ভুলক্রমে আবুল বুখতারীকে হত্যা করা হয়েছিল।) এটা কি কল্পনা করা যায় যে, বদরের বন্দীদের ছটফটানিতে অস্থির হয়ে মদিনার বিজয়ী শাসকের চোখের ঘুম আসেনা এবং রাতের অন্ধকারে গিয়ে তাদের বাঁধন ঢিলা করে দেন? এটা কি হতবুদ্ধিকর ব্যাপার নয় যে, ঠিক যুদ্ধ চলার সময়ে তিনি মক্কার লোকদের আবেদনে সাড়া দিয়ে খাদ্যশস্যের অবরুদ্ধ চালান ইয়ামামা থেকে ছাড়িয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন এবং আরো পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা দুর্ভিক্ষপীড়িত মক্কাবাসীকে নিজের পক্ষ থেকে পাঠালেন? উপরন্তু মক্কা বিজয়ের দিন যে ব্যক্তির বিজয়পতাকা আকাশে উড়ছিল, তিনি যদি মুহাম্মাদ সা. ছাড়া আর কেউ হতেন এবং তার লক্ষ্য ইসলামের বিজয় ছাড়া অন্য কিছু হতো, তবে কি সে পারতো ১৫/২০ বছরের পাশবিক নির্যাতনের মর্মন্তুত কালো ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে ‘‘আজ তোমাদের ওপর কোন অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত-’’ এ ঘোষণা দিতে? কখখনো নয়। অন্য কেউ হলে মক্কার অলিগলি কোরায়েশদের রক্তে ভেসে যেত।
আসলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রসূল সা. কে যুদ্ধের ময়দানে নামতে হয়েছিল। কেননা এই পথ শাহাদাতের বধ্যভূমির ওপর দিয়েই চলে গেছে। কিন্তু তিনি ভূখণ্ড জয়ের পরিবর্তে মানুষের হৃদয় জয় করতে চেয়েছিলেন। তিনি তরবারী দিয়ে মানুষের দেহকে অনুগত করার পরিবর্তে যুক্তি দিয়ে মনমগজকে ও সুন্দর স্বাভাবিক চরিত্র দিয়ে মনকে বশীভূত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর আসল যুদ্ধ ছিল জনমতের ময়দানে। এই ময়দানে তাঁর শত্রুরা ক্রমাগত পরাভূত হয়েছিল। বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদের সাথে রসূল সা. কে যে সংঘাতে লিপ্ত হতে হয়েছিল, সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

রসূল সা. এর সমর কৌশল

রসূল সা. এর সমরকৌশলের মূল কথা ছিল, শত্রুর রক্ত ঝরানোর চেয়ে তাকে অসহায় করে দেয়াকে অগ্রাধিকার দান, যতক্ষণ না সে সহযোগিতা করে অথবা প্রতিরোধ ত্যাগ করে। রসূল সা. এর পবিত্র জীবন চরিতের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণকারী উপমহাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী রসূল সা. এর সামরিক কৌশলকে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
‘‘আসলে রসূলুল্লাহ সা. শত্রুকে ধ্বংস করার পরিবর্তে বাধ্য করা পসন্দ করতেন।’’ (আহদে নব্বীকে ময়দানহায়ে জং, পৃঃ ৪৪)
অন্যত্র তিনি লিখেছেনঃ
‘রসূল সা. এর রাজনীতির লক্ষ্য কোরায়েশকে ধ্বংস করা ছিল না, বরং সম্পূর্ণরূপে অক্ষত রেখে অক্ষম ও পরাভূত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য।’ (আহদে নববী মে নিযামে হুকুমরানঃ পৃঃ ২৪৯)
রসূল সা. এর অনুসৃত কলাকৌশলগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়ে ও ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনা করে লেখক তাঁর এই অভিমতকে নিখুঁতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই কৌশলের আওতায় রসূল সা. নিম্নরূপ বাস্তব কর্মপন্থা অবলম্বন করেনঃ
‘‘তিনি নিজের প্রতিরক্ষা শক্তিকে সংখ্যা, সংঘবদ্ধতা, পরিশ্রম, সামরিক প্রস্তুতি ও চারিত্রিক প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে দ্রুত বিকশিত করেছেন, অতঃপর তাকে একটা যন্ত্রের মত সদা সক্রিয় রেখেছেন এবং তা দ্বারা বিরোধীদেরকে তিনি ভীত সন্ত্রস্থ করে রেখেছেন।
মক্কাবাসীর বাণিজ্যপথকে অবরোধ (Blockade) করে তাদেরকে নিস্তেজ করে দিয়েছেন।
সমঝোতা ও চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্রকে ক্রমান্বয়ে শত্রুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের সাথে নিয়ে নিয়েছেন।
সামরিক অভিযানের জন্য তিনি রকমারি কৌশল করেছেন। কখনো অবলম্বন করেছেন শত্রুকে প্রস্তুত হবার সুযোগ না দিয়ে অতর্কিত আক্রমণের পন্থা (যেমন মক্কা বিজয়)। কখনো অপ্রত্যাশিত পথ অবলম্বন করে এবং অভিযানের গন্তব্যস্থলকে গোপন রেখে বিরোধীদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছেন (যেমন বনুল মুস্তালিকের যুদ্ধ)। কখনো নিজের যুদ্ধের নীলনকশা আগে থেকে নিজের পক্ষে করে রেখেছেন (যেমন বদরের যুদ্ধ), আবার কখনো এমন কোন নতুন প্রতিরক্ষাকৌশল অবলম্বন করেছেন, যার পূর্বাভিজ্ঞতা শত্রুর ছিলনা (যেমন খন্দক যুদ্ধ)।
মদিনা রাষ্ট্রের গোটা দশ বছরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উল্লিখিত মৌলিক নীতির সুস্পষ্ট উদাহরণ। উপরন্তু আমরা যখন এর সাথে রসূল সা. এর সেই মহানুভব ও উদার দৃষ্টিভংগিকে যুক্ত করি, যা কোন বিজেতাসুলভ নয়, বরং মিশনারীসুলভ প্রেরণায় উজ্জীবিত ছিল, এবং যা একজন হানাদার সমরনায়কসুলভ ক্রোধ ও আক্রোশের পরিবর্তে একজন দীক্ষাগুরুসুলভ গভীর হিতকামনা ও সমবেদনার প্রতীক ছিল, তখন বিভিন্ন মহল থেকে তোলা আপত্তি ও অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে হয়। অথচ ওগুলোর সাফাই দিতে গিয়ে পশ্চিমানুগতরা সমগ্র ঘটনা স্রোতকেই বিকৃত করতে বসেছে। রসূল সা. এর হৃদয়ে মানবতার সংস্কার ও সংশোধনের যে মনোভাব সক্রিয় ছিল, তা ব্যক্ত করার জন্য আমরা কয়েকটা ঘটনার দিকে ইংগিত দিচ্ছি।
মক্কায় যখন যুলুম নির্যাতন চরম আকার ধারণ করলো এবং কোরায়েশদের আক্রোশ অতিমাত্রায় আগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করলো, তখন সেই নারকীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রধান হোতা ছিল দু’জন- আবু জাহল ও ওমর ইবনুল খাত্তাব। এমন কট্টর দুশমনদের ব্যাপারে কোন দুনিয়াদার রাজনীতির চরম রুষ্ট মনোভাব পোষণ না করে এবং মনে মনে তার ধ্বংস কামনা না করে পারতোনা। কিন্তু হিংস্রতার আগুনে নিরন্তর দগ্ধ হয়েও রসূল সা. কাতর কণ্ঠে দোয়া করতেন, আল্লাহ যেন এই দু’জনের অন্তত কোন একজনকে ইসলাম গ্রহণের তওফীক দেন। এই দোয়া থেকে প্রমাণিত হয়, মানবতার এই সংগঠন নিজের শত্রুদের ধ্বংসের চেয়ে তাদের সংশোধনের বিষয় অগ্রাধিকার দিতেন এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে ভালো আশা পোষণ করতেন। হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর দোয়া সফল হয়।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো, তায়েফের অধিবাসীদের হিতকামনার অপরাধে তাদের হাতে রসূলের লাঞ্ছিত ও আহত হওয়ার ঘটনা। কোন দুনিয়াবী রাজনীতির পতাকাবাহীর কাছ থেকে এ ক্ষেত্রে এ ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না যে, তার হৃদয় তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত, এবং সম্ভব হলে সে গোটা শহরকে তৎক্ষণাত উল্টে দিত। অন্যথায় সারা জীবন তাদের ওপর রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ থাকতো এবং ক্ষমতা হাতে পাওয়ার প্রথম সুযোগেই এমন অসভ্য শহরটাকে ধ্বংস করে দিত। তায়েফের এই নির্যাতনে রসূল সা. এর সাথী মর্মাহত হয়ে ঠিক এই ধারায়ই চিন্তা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এই নরপশুদের জন্য বদদোয়া করুন। এমনকি জিবরীলও তাঁর প্রচ্ছন্ন মনোভাব পরীক্ষা করার জন্য জানান যে, তাঁর ইংগিত পেলে পাহাড়ের ফেরেশতারা মক্কা ও তায়েফকে পাহাড়ের মাঝে পিষে ফেলে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু রসূল সা. বললেন, না, ওরা অজ্ঞতার কারণে ভুল পথে চলছে। ওরা যদি ঈমান নাও আনে, তবে ওদের বংশধররা সত্যের দাওয়াত কবুল করে এক আল্লাহর অনুগত হয়ে যাবে।
তৃতীয় ঘটনা ওহুদের ময়দানের। মুসলমানদেরকে যখন কিছু ভুলত্রুটির কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কতার সংকেত স্বরূপ পরাজয় বরণ করানো হলো এবং স্বয়ং রসূল সা. গুরুতর আহত হলেন, তখন এক চরম তিক্ততার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে দৃশ্যত সঙ্গতভাবেই মর্মাহত কোন কোন সাহাবী রসূল সা. কে অনুরোধ করলেন, আপনি মোশরেকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করুন, তাদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। তিনি জবাব দিলেন, আমাকে অভিশাপকারী করে পাঠানো হয়নি। আমাকে পাঠানো হয়েছে বার্তাবাহক ও সুসংবাদদাতা হিসাবে। এই বলে তিনি শত্রুদের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতির লোকদেরকে সুপথ দেখাও। কেননা তারা জানেনা।’’ অর্থাৎ কোরায়েশদের কাছ থেকে আঘাতের পর আঘাত খেয়েও তার মধ্যে এমন আকাংখা জন্মেছিল যে, ওরা ধ্বংস হয়ে না যাক। বরং যুদ্ধাবস্থায়ও তিনি এই আকাংখার সোচ্চার থাকেন যে, তারা হেদায়াত লাভ করুন।
খয়বর অভিযানকালে কামুস দুর্গ জয়ের জন্য রসূল সা. হযরত আলী রা. কে বিশেষ পতাকা দিয়ে বললেনঃ
‘‘হে আলী, তোমার দ্বারা যদি একজন মানুষও হেদায়াত পায়, তবে সেটা তোমার জন্য মস্ত বড় নিয়ামত হবে।’’
অর্থাৎ শত্রুর শারীরিক ক্ষতি সাধন ও রক্তপাত করাই আসল উদ্দেশ্য নয়, বরং যত বেশী সম্ভব, মানুষের মন মগজে পরিবর্তন আসুক এবং তারা নয়া জীবন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করুক- এটাই অগ্রগণ্য।
এই কয়েকটা ঘটনা আমরা কেবল নমুনা হিসাবেই গ্রহণ করেছি, নচেত এমন প্রমাণের অভাব নেই যা রসূল সা. এর মৌলিক দৃষ্টিভংগি স্পষ্ট করে দেয়। যুদ্ধবাজ লোকেরা অত্যন্ত তাড়াহুড়ো প্রিয় ও রগচটা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে মানবতার বন্ধু রসূল সা. কে আমরা অত্যন্ত শান্ত, দৃঢ় সংকল্প ও উচ্চাভিলাষী দেখতে পাই। তাঁর রাজনীতিতে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে কৌশল ও কল্যাণকামিতা সক্রিয়। রাজনৈতিক কুশলতা ও বিচক্ষণতার এর চেয়ে বড় অলৌকিক প্রমাণ আর কী হতে পারে যে, তিনি মদিনায় যাওয়ার অব্যবহিত পরই বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি পত্তন করে ফেললেন। কোন বৈপ্লবিক মতবাদের ওপর এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েই এভাবে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দৃষ্টান্ত সম্ভবত সমগ্র মানবেতিহাসেও পাওয়া যাবে না। একমাত্র এটাই ছিল সঠিক অর্থে রক্তপাতহীন (Bloodless) বিপ্লব, যার গোঁড়ায় কোন মানুষের এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি এবং একটা লাশও পড়েনি। এমন হতবুদ্ধিকর ঘটনা স্বয়ং নবুওয়াতের অসাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত করে।
এ কথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় সামরিক তৎপরতা কোরায়েশ ও ইহুদী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল, যারা তাকে যুদ্ধের ময়দানে জোর করেই টেনে নিয়েছিল। কোরায়েশ ও ইহুদী ছাড়া অবশিষ্ট আরবরা সবাই নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে কর্মব্যস্ত ছিল। সামান্য কিছু এলাকা ছাড়া সমগ্র আরবের কোথাও যুদ্ধ হয়নি। বরঞ্চ আরবের সাধারণ জনতা উভয় শক্তির উদ্দেশ্য, চরিত্র ও রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ নীরব দর্শক হয়ে পর্যবেক্ষণ করতো। যখন মুসলিম শক্তি সর্ব দিক দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে দিয়েছে, তখন বিভিন্ন অঞ্চল ও গোত্রের প্রতিনিধি দল এগিয়ে এসে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ সত্যটাও কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ না করে ছাড়েনি যে, সব ক’টা বড় বড় যুদ্ধ যথা বদর, ওহুদ ও খন্দক- শত্রুরা নিজেরাই হানাদার হয়ে মদিনার আশপাশে এসে করেছে। এভাবে তারাই রসূল সা. কে বাধ্য করেছে যেন শত্রুর শক্তির উৎসগুলোকে তিনি পদানত করে নেন। এ জন্য কোরায়েশ ও তাদের বশংবদদের শক্তি খর্ব করার জন্য মদিনার দিক থেকে মাত্র একবারই চূড়ান্ত অভিযান চালানো হয় এবং মক্কা বিজয়ের পর হুনায়েন ও তায়েফের যুদ্ধ প্রতিপক্ষের শক্তি সম্পূর্ণরূপে খতম করে দেয়। অপর দিকে ইহুদীদের শক্তির কেন্দ্রগুলোকেও উৎখাত করা হয় ন্যূনতম প্রাণক্ষয়ের মাধ্যমে।

একটা ব্যাপক ভুল বুঝাবুঝি

হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে ‘গুয্ওয়া’ ও ‘সারিয়া’ নামে সামরিক অভিযান সমূহের যে লম্বা তালিকা দেখতে পাওয়া যায়, তার কারণে অমুসলিমদের তো কথাই নেই, স্বয়ং অনেক মুসলমানও সাংঘাতিক রকমের ভুল বুঝাবুঝিতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অথচ ‘গুয্ওয়া’ ও ‘সারিয়া’ হাদীস ও মাগাযীর (ইসলামের সামরিক ইতিহাস) গ্রন্থাবলীর বিশেষ পরিভাষা। এই পরিভাষা দুটোর প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা অর্থ নির্দিষ্ট রয়েছে। সামরিক প্রতিরক্ষামূলক অভিযান, টহল বা প্রহরা, বিদ্রোহী ও অপরাধীদের দমন, শিক্ষা বিস্তার ও দাওয়াত দান, কিংবা চুক্তি সম্পাদন ইত্যাকার রকমারি প্রয়োজনে যখনই কোন সেনাদল (তা সে মাত্র দু’জনেরই হোক না কেন) পাঠানো হতো তখন তাকে ‘সারিয়া’ বলা হতো। আর যে সেনাদলের সাথে রসূল সা. নিজে শরীক থাকতেন, তাকে বলা হতো ‘গুয্ওয়া’। এ ধরণের সেনাদলের কার্যত কোন সংঘর্ষে বা অন্য কোন ধরণের তৎপরতায় জড়িত হতে হোক বা নাহোক, উভয় অবস্থায় তাকে সারিয়া অথবা গুয্ওয়া বলা হতো। ছোটখাটগুলো বাদ দিলে উল্লেখযোগ্য বড় বড় সামরিক অভিযান মাত্র কয়েকটাই থাকে। যেমন বদর, ওহুদ, আহযাব বা খন্দক, খয়বর ও মক্কা (হোনায়েনসহ)। উল্লেখ্য যে, তবুক ও সন্নিহিত অঞ্চলে যে ‘জায়শে উসরাত’ (‘কষ্টকর অভিযান’) পাঠানো হয়েছিল, তার একমাত্র কারণ ছিল সিরিয়ার বিদেশী সরকারের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশংকা এবং তার ধরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি এখন সংক্ষেপে এই সামরিক অভিযানগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টার ওপর দৃষ্টি পড়ে তা হলো, সংঘর্ষের সূত্রপাত কিভাবে হলো। এর জবাব দেয়ার জন্য আমি আগে উভয় পক্ষের অবস্থান ও ভূমিকা পর্যালোচনা করবো।

কোরায়েশের আগ্রাসী মানসিকতা

কোরায়েশের মানসিকতা একটা ঘটনা থেকে আপনা আপনিই চিহ্নিত হয়ে যায়। তারা যখন রসূল সা. কে সামষ্টিকভাবে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল, তখন মক্কার নেতারা আলোচনা করার সময় নিজেদের মানসিকতা খোলাখুলিভাবেই ব্যক্ত করেছিল। একটা প্রস্তাব এসেছিল রসূল সা. কে লোহার নির্মিত কারাগারে দরজা তালাবদ্ধ করে আটকে রাখা হোক, যাতে তিনি ভেতরে ছটফট করে মরে যান। এ প্রস্তাব শুনে নাজ্দ থেকে আগত এক প্রবীণ ব্যক্তি-শায়খ নাজদী বললো, ‘‘তোমরা যদি ওকে কারাবন্দী কর, তাহলে তার দাওয়াত লোহার কারাগারের বদ্ধ দরজা ভেদ করে দূর দিগন্তে ছড়িয়ে পড়বে এবং তাঁর সাথীদের ওপর তার প্রভাব পড়বে। এমনকি এটাও বিচিত্র নয় যে, তারা তাকে বের করে নিয়ে যাবে। তারপর তারা তোমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী হয়ে তোমাদের পরাজিত করবে।’’ আর একটা প্রস্তাব ছিল এই যে, ‘‘আমরা মুহাম্মাদ সা. কে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেব। তাড়িয়ে দেয়ার পর সে কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে তা দিয়ে আমাদের কী কাজ? সে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেই হলো, আমরা নিজেদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিলেই হলো এবং আমাদের পারস্পরিক প্রীতি বহাল হলেই হলো।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৪) এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য শায়খ নাজদী এর যে পর্যালোচনা করলো তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মজলিসে তা গৃহীত হয়েছিল। শায়খ নাজদী বললোঃ
‘‘না, আল্লাহর কসম, এটা তোমাদের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। তোমরা কি তার ভাষার মিষ্টতা ও লালিত্য দেখতে পাওনা, যা দিয়ে সে জনগণের মনে নিজের প্রভাব বদ্ধমূল করে? আল্লাহর কসম, তোমরা যদি এটা কর, তাহলে তোমরা তার কবল থেকে কিছুতেই মুক্তি পাবেনা। সে আরবের যে কোন গোত্রে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে পারে, তারপর নিজের কথা দিয়ে জনগণের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, লোকেরা তার অনুসারী হয়ে যেতে পারে, সেই অনুসারীদের সাথে নিয়ে সে তোমাদের ওপর চড়াও হতে পারে, তোমাদের জনপদে প্রবেশ করতে পারে এবং তোমাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তোমাদের সাথে যেমন খুশী আচরণ করতে পারে। কাজেই অন্য কোন কৌশল অবলম্বন কর।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৪)
শায়খ নাজদীর এ কথাগুলো পড়লে অনুমান করা যায়, সে কত চালাক এবং ধড়িবাজ ছিল। সে রসূল সা. এর ব্যক্তিত্বকে বুঝে নিতে মোটেই ভুল করেনি। সেই সাথে এই সমস্ত আলোচনা থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মক্কার কর্তাব্যক্তিরা তেরো বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে রসূল সা. এর ব্যক্তিত্ব, স্বভাব, বাণী ও চরিত্র মাধুর্যকে তখন একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিপদ ও মারাত্মক হুমকি মনে করতে শুরু করেছিল। এ সময় তাদের ঔদ্ধত্য এতদূর পৌঁছে যায় যে, মানবতার এই মুক্তিদূত পৃথিবীর কোন একটা ভূখণ্ডে গিয়েও জীবিত থাকুক এবং কোথাও গিয়ে নিজের দাওয়াতী কাজ চালাতে সক্ষম হোক-এটা বরদাশত তারা করতে প্রস্তুত ছিলনা। নচেত তারা জানতো, তারা যে অত্যাচার চালিয়েছে এবং মুসলিম যুবকদেরকে তাদের বাড়ীঘর থেকে তাড়িয়ে যে অপরাধ করেছে, তার হিসাব একদিন তাদেরকে দিতে হবে। তারপর তারা যেভাবে রসূল সা. কে হত্যা করার ব্যাপারে একমত হলো এবং তিনি প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তাঁকে ধরার জন্য যে ছুটোছুটি করা হলো এবং বড় আকারের পুরস্কার ঘোষণা করা হলো, তা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাধ্যে কুলালে তারা রসূল সা. কে এক মুহূর্তও বেঁচে থাকার সুযোগ দিতে চাইছিলনা। তাঁর অস্তিত্বই তাদের জন্য হুমকি এবং তাঁর জীবনই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কোরায়েশদের এই মনোভাব রসূল সা. তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারবেনা না এর কোনই কারণ ছিল না।
এই ঘটনার আরো একটু পেছনে চলে যান। আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াতের সময় হযরত আব্বাস আনসারদের এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘‘যে উদ্দেশ্যে তোমরা রসূল সা. কে দাওয়াত দিচ্ছ, সে উদ্দেশ্যে যদি সফল করতে পার, এবং তার যে বিরোধিতা করা হবে তার যদি মোকাবিলা করতে পার, তাহলে তোমরা যে কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করেছ সেটা গ্রহণ করা সঠিক হবে।’’ তাছাড়া ঐ বায়য়াতের ভাষায় এই উদ্বোধনী কথাগুলোও খুবই তাৎপর্যবহ ছিলঃ ‘‘তোমরা তোমাদের সন্তান ও পরিবার পরিজনকে যেভাবে রক্ষা করে থাক, সেইভাবে আমাকেও রক্ষা করবে।’’ তারপর আনসারদের জবাব লক্ষ্যণীয়ঃ ‘‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমরা যুদ্ধবাজ লোক’’। অতঃপর তাদের এই প্রশ্ন তোলা যে, ‘‘আপনার কারণে আমাদের বহু চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে, এরপর এমন হবে না তো যে, আপনার জন্য আমরা এত কষ্ট ভোগ করবো, আপনি জয়ী হবেন, তারপর আমাদেরকে ছেড়েছুড়ে আপনি নিজ পরিবারে ফিরে যাবেন?’’ এবং রসূল সা. কর্তৃক ‘‘আমি তোমাদের এবং তোমরা আমার’’ বলে আশ্বাস দেয়া খুবই তাৎপর্যবহ। অতঃপর আব্বাস বিন উবাদা আনসারী কর্তৃক নিজ সাথীদেরকে এই বলে হুশিয়ার করে দেয়াও গভীর তাৎপর্যমণ্ডিতঃ ‘‘তোমরা সারা বিশ্বের সাদা কালো সকল মানুষের সাথে যুদ্ধের ঝুঁকি নিচ্ছ। সাবধান এমন যেন না হয় যে, তোমাদের অনেক সম্পদ বিনষ্ট এবং গোত্রের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিহত হতে দেখে তোমরা রসূলকে সা. শত্রুর হাতে সোপর্দ করে দেবে। সব কিছু এখনই ভেবে চিন্তে স্থির করে নাও।’’
এসব কথাবার্তার তাৎপর্য এই যে, কোরায়েশ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছিল, তার আলোকে শুধু রসূল সা. ও হযরত আব্বাসই নন, বরং দূর দূরান্ত থেকে আগত আনসাররাও দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, তারা যে বায়য়াত করবেন, তা যুদ্ধ ঘোষণারই নামান্তর।
এই বায়য়াতের বৈঠকের কথাবার্তা এক শয়তান আড়ি পেতে শুনে কোরায়েশদের জানিয়ে দিল। তারপর কোরায়েশের বাঘা বাঘা নেতারা আনসারদের আবাসস্থানগুলোতে যেয়ে যেয়ে বলতে লাগলো, ‘‘শুনেছি তোমরা মুহাম্মাদের সা. সাথে সাক্ষাত করেছ এবং তাকে আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাও। এও শুনেছি যে, তোমরা তার হাতে হাত দিয়ে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার চুক্তি করেছ। অথচ আরবের অন্য যে কোন গোত্রের তুলনায় তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা আমাদের কাছে ঢের বেশী অপছন্দনীয়। অর্থাৎ আনসাররা যদি রসূল সা. কে মক্কা থেকে বের করে নিয়ে যায় এবং তাকে নিজেদের কাছে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখে, তাহলে মক্কাবাসী তাকে যুদ্ধ ঘোষণা গণ্য করবে। সেটা যদি মদিনাবাসী সত্যিই করে তবে সে ক্ষেত্রে কোরায়েশ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট। এভাবে আগাম যুদ্ধ ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হলো। তবে কিছু লোক তো এ ঘটনা জানতোনা। যারা জানতো, তারা ব্যাপারটা চেপে রাখলো।
এরপর যখন বায়য়াতকারী আনসাররা মক্কা থেকে চলে গেল, তখন কোরায়েশরা এ বিষয়টা নিয়ে পরামর্শ করলো। শেষ পর্যন্ত স্থির হলো, ওদের পিছু ধাওয়া করা দরকার। মদিনার হজ্জ কাফেলা ভালোয় ভালোয় চলে গেল। তবে সা’দ বিন উবাদা ও মুনযির বিন আমরকে মক্কাবাসী ধরে আনলো এবং মারপিট করলো। এ ঘটনা থেকেও বুঝা যায়, রসূল সা. মক্কা থেকে অক্ষতভাবে বেরিয়ে যান- এটা তাদের কাছে কতখানি অসহনীয় ছিল এবং রসূল সা. কে নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার অঙ্গীকারকারীদের ওপর তাদের কত ক্রোধ ছিল।
এছাড়া আবিসিনিয়ার মোহাজেরদেরকে ফিরিয়ে আনা এবং মদিনাগামী মোহাজেরদেরকে প্রথম দিকে হিজরত থেকে ঠেকানোর যে চেষ্টা কোরায়েশরা করেছিল তা থেকেও বুঝা যায়, অন্য কোন ভূখণ্ডে ইসলামী আন্দোলন শেকড় গাড়ুক, সেটাও তাদের মনোপুত ছিলনা। এ ধরণের যে কোন সম্ভাবনাকে প্রতিহত করতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল।
এই সব ঘটনা থেকে এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হিজরতের আগেই কোরায়েশদের পক্ষ থেকে এমন যে কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছিল, যে রসূল সা. কে নিজের কাছে আশ্রয় দেবে এবং ইসলামী আন্দোলনের ফসল তাদের ভূখণ্ডে ফেলতে দেবে। ইসলামী বিপ্লবের সংগঠকরা এত বেকুফ ছিলনা যে, তারা এই চ্যালেঞ্জকে উপেক্ষা করবে।
অবশেষে এই অলিখিত যুদ্ধের ঘোষণার খবর লিখিতভাবে একটা ষড়যন্ত্রমূলক চিঠির মাধ্যমে মক্কা থেকে মদিনায় পৌঁছে গেল। মদিনার বিশ্বাসঘাতকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর হাতে পৌঁছা এই চিঠিতে মদিনার আনসার ও ইহুদী সবাইকে এই মর্মে হুমকি দেয়া হয়েছিল যে, হয় তোমরা স্বেচ্ছায় মুহাম্মাদকে সা. মদিনা থেকে বের করে দাও, নচেত আমরা মদিনা আক্রমণ করে তোমাদের হত্যা করবো এবং তোমাদের স্ত্রীদেরকে প্রমোদ সংগিনী বানাবো।
এরপর ইহুদীদের সাথে যোগসাজশ করে কোরায়েশরা সরাসরি মুসলমানদের জানালো, ‘‘তোমরা মক্কা থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পেরে উল্লেসিত হয়োনা। আমরা মদিনায় এসে তোমাদের মজা দেখাবে।’’
এই সময়ই আবু জাহল সা’দ বিন মায়াযকে কা’বার তওয়াফ করতে বাধা দেয় এবং খোলাখুলিভাবে বলে যে, তোমরা কা’বার চত্তরে পা রাখবে এটা আমি পছন্দ করিনা।
তথাপি এ সময় মক্কা থেকে অনবরতই দুষ্কৃতি ও লুটপাট চালানোর জন্য ছোট ছোট সেনাদল বেরুতে লাগলো। রসূল সা. এ খবর জানা মাত্রই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে টহল গ্রুপ পাঠাতে লাগলেন। একাধিকবার মদিনার এ সব টহল গ্রুপ মক্কার ঐ সব সেনাদলকে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়েই তারা পালিয়ে গেছে।
হিজরতের ত্রয়োদশ মাসে ঘটলো এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। কিরয বিন জাবের ফেহরী মদিনায় এসে ডাকাতি করলো এবং মদিনার চারণ ক্ষেত্র থেকে রসূল সা. এর পালিত পশু, সরকারী উট ও অন্যান্য লোকদের পশু হাঁকিয়ে নিয়ে চলে গেল। এই ঘটনার সুষ্পষ্ট লক্ষ্য ছিল এই যে, আমরা তিন শো মাইল দূর থেকে এসেও তোমাদের রাষ্ট্রের সম্পত্তি এভাবে লুটপাট করে নিয়ে যেতে পারি।’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৩৮, আসহাহুস্ সিয়ার; পৃঃ ১২৫, রহমাতুল্লিল আলামীন, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৪০)
রসূল সা. স্বয়ং একটা ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করলেন এবং যায়েদ বিন হারিসাকে মদিনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করে গেলেন। (বদরের নিকটবর্তী) ওয়াদিয়ে সাফওয়ান পর্যন্ত গিয়েও তাদেরকে ধরতে পারলেন না। এ ঘটনা শত্রুর এমন একটা ধৃষ্টতা ছিল, যাকে কোন ক্রমেই বরদাশত করা যায় না। যে সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুমাত্র বীরত্ব ও সাহসিকতা আছে এবং যাদের মধ্যে নিজেদের স্বাধীনতা ও নিজেদের জন্মভূমির প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা আছে, তারা এ ধরণের স্পর্ধাকে সহ্য করতে পারেনা। এটা ডাকাতি হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ছিল আক্রমণের সমার্থক। এবার মদিনার সামনে প্রতিভাত হলো একটা অনিবার্য যুদ্ধের যুগ এবং একটা রক্তঝরা ভবিষ্যত।
মদিনার ওপর মক্কার আক্রমণ দ্বিতীয় হিজরী পর্যন্ত বিলম্বিত হওয়ার পেছনে কোন গুরুতর কারণ ছিল। কোন বাধার সম্মুখীন না হয়ে থাকলে কোরায়েশরা এরও আগে হামলা চালাতো এবং মদিনার নয়া ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতির সময় দিত না। মক্কা ও মদিনার মাঝখানে ছিল বনু কিনানা গোত্রের এলাকা। এদের সাথে কোরায়েশদের বহু পুরনো শত্রুতা ছিল। বনু কিনানা প্রথমত তাদের এলাকা দিয়ে কোরায়েশকে যেতেই দেবেনা বলে আশংকা ছিল। আর যেতে দিলেও দ্বিতীয় আশংকা ছিল, বনু কিনানা মক্কাকে অরক্ষিত দেখে আক্রমণ করে বসতে পারে। অন্তত পক্ষে, কোন নাযুক মুহূর্তে তারা মক্কার সাথে মদিনায় হামলারত কোরায়েশী বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে- এ আশংকা বিদ্যমান ছিল। সুরাকা ইবনে মালেক মাদলাজী কিনানী এই মধ্যবর্তী এলাকার সরদার ছিল। সে যখন জানতে পারলো, কোরায়েশ এসব আশংকার কারণে মদিনায় হামলা করতে পারছে না, তখন মেস উপযাচক হয়ে মক্কা যেয়ে কোরায়েশদের সহযোগিতার আশ্বাস দিল। এই গাটছড়ার পরিণামেই বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, কোরায়েশ মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোন হামলার অপেক্ষায়ও ছিল না, সামরিক আগ্রাসন চালাতে কোন ফাঁকফোকরেরও সন্দানে ছিল না। তাদের মধ্যে আগ্রাসনের মনোভাব ও সংকল্প পুরো মাত্রায় সক্রিয় ছিল। (বহমাতুল্লিল আলামীন)

মদিনার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

এবার আসুন দ্বিতীয় পক্ষের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
যখন আমরা রসূল সা. ও তাঁর বিপ্লবী সংগঠনের অবস্থা যাচাই করি, তখন প্রত্যেক দিক দিয়ে এই মর্মেই সাক্ষ্যপ্রমাণ পাই যে, তাঁদের কাছে সবচেয়ে অনাকাংখিত বিষয় ছিল যুদ্ধ। একে তো তারা ছিল অচেনা জায়গায় আগত চালচুলোহীন ও সহায়সম্বলহীন একটা দল, তদুপরি এই দলের অর্ধেক লোকই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য নিজেরাই সচেষ্ট ছিল। উপরন্তু ইসলামী বিপ্লবের সংগঠকদের সামনে একই সাথে হাজির হয়েছিল একটা নতুন পরিবেশকে ইসলামী বিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তোলা, বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করা, তাদের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দান এবং সর্বোপরি একটা নতুন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার সকল বিভাগের প্রশাসনকে গড়ে তোলার কর্মসূচী। এগুলোর মধ্যে প্রতিটা কর্মসূচী দীর্ঘ সময়ব্যাপী অখণ্ড মনোযোগ ও শ্রম দাবী করে। এমন কঠিন সমস্যাবলীতে পরিবেষ্টিত একটা ক্ষুদ্র দল কখনো যুদ্ধ চাইতে পারে না। কিন্তু অন্য দিকে তাদের ছিল একটা বিরাট আন্ত মানবিক মিশন। সারা দুনিয়ার মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা ছিল তাদের পবিত্র লক্ষ্য। জীবনের বৃহত্তম সত্য- অর্থাৎ এক আল্লাহর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বের মশাল জ্বেলে গোটা সভ্যতাকে উদ্ভাসিত করে দেয়ার জন্য তারা নিজেদের জীবনের সকল সুখ শান্তি কুরবানী করে দিয়েছিলেন। ধৈর্য ও অন্যকে অগ্রাধিকার দানের ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর গুণগুলো অর্জন করে তারা সামনে এগুচ্ছিলেন। ইসলামের মহাসত্যই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র পুঁজি। তারা সংখ্যায় ছিল নিতান্তই কম এবং মদিনার রাষ্ট্রটাও ছিল একেবারেই নবীণ। এই পুঁজিটুকুর সাথেই জড়িত ছিলেন তাদের সমগ্র ভবিষ্যত। তারা এ রাষ্ট্রটাকে সংরক্ষণের জন্য যে স্বাভাবিক আগ্রহ লালন করতেন, তা ছিল আকাশে চিল উড়তে দেখে মুরগী কর্তৃক সব কিছু ভুলে নিজ বাচ্চাদেরকে পালক ও পাখনা দিয়ে ঢাকার ব্যাকুলতা ও উদগ্র বাসনার মতই। তারা তাদের শুকিয়ে যাওয়া জীর্নশীর্ণ দেহ নিয়েও পাহাড়ের সাথে টক্কর দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সকল স্বাদ, আনন্দ ও স্বার্থ ভুলে গিয়ে এমন প্রতিটা শক্তির ডানা ভেঙ্গে দিতে তারা প্রবল আবেগ ও উদ্যম পোষণ করতেন, যে শক্তি তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাঁকা চোখে দেখে থাকে। তারা মদিনার প্রাণোচ্ছল বাতাসে ও বাগানে এবং ভ্রাতৃত্বের অনুপম পরিবেশে এসেও কখনো এক মুহুর্তের জন্য মক্কার সেই দুঃখবেদনাকে ভুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উদাসীনভাবে ঘুমাননি। তাদের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও মক্কার রাঘব বোয়ালদের তরবারীর ওপর থেকে সরেনি, যার কোন নিশ্চয়তা ছিল না যে কখন তারা তাদের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে না রসূল সা. কোন উদাসীনতা দেখিয়েছেন, আর না তাঁর সাথীরা দায়িত্ব পালনে কসুর করেছেন। তারা কোন যোগী বা সন্যাসী ছিলেন না, বরং অত্যন্ত বিচক্ষণ ও কর্মঠ লোক ছিলেন এবং একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চাইছিলেন। এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী লোকদের মধ্যে বিরোধীদের শক্তির জবাব পাল্টা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দেয়ার প্রয়োজনীয় মেধা ও বুদ্ধির অভাব ছিল না।

রসূল সা. এর প্রতিরক্ষা কৌশল

আসুন এবার দেখা যাক, রসূল সা. কী কী প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
মদিনায় রসূল সা. এর সাথে আগত মোহাজেরগণ শুধু নিজেদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার স্থান খুঁজবেন এমন লোক ছিলেন না। তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে আসার উদ্দেশ্যও কোন অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ ছিল না। বরঞ্চ তারা এসেছিলেন একটা উচ্চতর ও মহত্ত্বর লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্যকে ভুলে গিয়ে তারা নিজেদের আখের গোছানো ও অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণের কাজে নিয়োজিত হননি। রসূল সা. সৃশৃংখল পন্থায় তাদের পুনর্বাসিত করেছিলেন এবং আনসারদের সাথে তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তাদেরকে মসজিদ ভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে সাংগঠনিক শৃংখলার আওতায় নিয়ে আসেন। এবাদত, ওয়ায, কোরআন শিক্ষা ও অন্যান্য পন্থায় তাদের মানসিক, বাস্তব ও নৈতিক প্রশিক্ষণের কাজ তাৎক্ষণিকভাবে শুরু করে দেন এবং অত্যন্ত দ্রুততা ও ক্ষীপ্রতার সাথে এ কাজের বিস্তার ও বিকাশ ঘটান। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এভাবে সেই সহায়সম্বলহীন মোহাজেররা আনসারদের সাথে মিলিত হয়ে এক দুর্জয় শক্তিতে পরিণত হন এবং এই শক্তি ক্রমশ দৃঢ়তর হতে থাকে। অন্য কথায় বলা যায়, মানবীয় শক্তিতে অগ্রাধিকার দিয়ে তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে।
আনুসঙ্গিকভাবে এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানো খুবই জরুরী। সেটা হলো, মক্কার মত মদিনাও প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে অত্যন্ত উপযোগী স্থান ছিল। উপরন্তু মদিনার ভৌগলিক অবস্থানও এত চমৎকার ছিল যে, তা সিরীয় ও ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর একেবারেই সামনে অবস্থিত ছিল। আরবের শ্রেষ্ঠতম বাণিজ্যিক সড়কের পাশেই এবং সমুদ্র থেকে মাত্র ৭০/৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। এ শহর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার এক মজবুত দুর্গ স্বরূপ ছিল। একটুখানি সচেতনতা, অধিবাসীদের সংঘবদ্ধতা ও প্রতিরক্ষার যুতসই কৌশল তাকে আরো শক্তিশালী বানাতে পারতো। মদিনা শহরটা প্রায় দশ মাইল লম্বা ও দশ মাইল চওড়া ময়দানে বিস্তৃত ছিল এবং খানিক দূরে দূরে বিভিন্ন গোত্রের ছোট ছোট বস্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এ এলাকাকে ‘মদিনার উদর’ এবং ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ এলাকা বলা হতো। এই অসমান মাঠের মাঝখানে ‘সালা’ নামক পাহাড় এবং আরো কয়েকটা ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে। ঈর ও সূর পর্বত দ্বয় একে ঘিরে রেখেছে। গোত্রীয় বস্তিগুলোতে আজাম ও আতাম নামক মজবুত প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ রয়েছে। এ ধরণের ব্যুহ এক সময় একশো পর্যন্ত ছিল।
মদিনার যে অংশটি ‘মদিনাতুন্নবী’ নামে পরিচিত ছিল, তা অবস্থিত ছিল মদিনার মধ্যখানে। এই অংশে মসজিদে নববী, নবী পরিবারের বাসস্থান এবং রাজধানী অবস্থিত। এর দক্ষিণে ছিল নিবীড় বাগান, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কোবা পল্লী ও আওয়ালী পল্লী ও তৎসহ বাগবাগিচা। পূর্ব দিকে কোবা থেকে ওহুদ পর্যন্ত পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল ইহুদী মহল্লাগুলো। দক্ষিণ পশ্চিম দিকেও বহু সংখ্যক জনবসতি ও বাগবাগিচা ছিল। মদিনার প্রাচীন প্রাচীরের বাবুশ্শামী নামক দরজার কাছেই অবস্থান করতো বনু সায়েদা গোত্র (যাদের চাদঘেরা চত্তরে প্রথম খলিফার নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল।) তারও সামনে ‘সালা’ পাহাড়ের ওপর বাস করতো বনু হারাম গোত্র। উত্তর পশ্চিমে ‘ওয়াদী আল-আকীকে’র কিনারে বীরে রোমা পর্যন্ত বহু সংখ্যক বাগান ছিল, দক্ষিণে উঁচু উঁচু পাহাড় ছিল এবং বহু উচ্চ ভূমি ও সমতল ভূমির মধ্য দিয়ে দুর্গম পথ চলে গিয়েছিল। মদিনার পূর্বে ও দক্ষিণে পাথুরে মাঠ ছিল। সে মাঠ না ছিল সামরিক শিবির স্থাপনের উপযোগী, আর না ছিল রণাঙ্গন হবার যোগ্য। কেবল উত্তর দিকে দিয়ে শহরের রাস্তা সামরিক দিক দিয়ে উন্মুক্ত ছিল। তাই বদর ও ওহুদের যুদ্ধ করার জন্য কোরায়েশরা ঐ দিকটাই পছন্দ করলো। কিন্তু মক্কার সৈন্যদের উত্তর দিক দিয়ে যেয়ে হামলা করা সামরিক দিক দিয়ে জটিল ব্যাপার ছিল এবং মদিনার জন্য ছিল উপকারী।
কিন্তু মদিনার অবস্থান ও তার পরিবেশগত উপযোগিতা কাজে লাগাতে হলে তার সমগ্র জনশক্তিকে একটা শৃংখলার মধ্যে আনা অপরিহার্য ছিল। এ উদ্দেশ্যে রসূল সা. এর দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃতিত্ব ছিল এই যে, চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ইহুদী, আওস, খাজরাজ ও অন্যান্য গোত্রকে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভেদাভেদ সত্ত্বেও একটা শৃংখলার আওতায় এনে ফেললেন। একেবারেই অজানা ও অচেনা পরিবেশে গিয়ে পরস্পর বিরোধী মানুষদের কয়েক মাসের মধ্যে একই রাজনৈতিক এককে তথা রাষ্ট্রের নাগরিকে পরিণত করে ফেলা তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দক্ষতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তাঁর কুশলতার আরো বড় সাক্ষর এই যে, এই রাজনৈতিক এককের বা রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিচার, আইন রচনা, যুদ্ধ পরিচালনা ও সমালোচনার যাবতীয় ক্ষমতা রসূল সা. এর হাতে অর্পণ করা হয়েছিল এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মৌল চেতনা তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। এই রাজনৈতিক দলীলে অংশ গ্রহণকারী সকলকে এই মর্মে অংগীকার করানো হয় যে, আরব গোত্র সমূহের সাথে যে সব মোশরেক ও ইহুদী যোগদান করবে, তারা মুসলমানদের অনুসারী এবং যুদ্ধের সময় তাদের সহযোগী হবে। তারা মক্কার কোরায়েশদের জীবন ও ধনসম্পদের রক্ষকও হবেনা, এবং মুসলমানরা যখন কোরায়েশদের ওপর আক্রমণ চালাবে, তখন মুসলমানদেরকে বাধাও দেবেনা। এতে এ কথাও স্বীকার করিয়ে নেয়া হয় যে, যুদ্ধ ও সন্ধির ব্যাপারটা হবে সামষ্টিক। যে কোন যুদ্ধ সবার জন্য যুদ্ধ হবে, এবং সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া সবার জন্য অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক। তবে প্রত্যেক মিত্র নিজ নিজ অংশের যুদ্ধের ব্যয় নিজেই নির্বাহ করবে। ইহুদীদের সাথে এ বিষয়টা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্থির হলো যে, মুসলমানরা যাদের সাথে আপোষ ও সন্ধি করবে, ইহুদীরাও তাদের সাথে আপোষ ও সন্ধি করবে। মদিনার রক্ষনাবেক্ষণে তারা সমানভাবে অংশ গ্রহণ করবে। মুসলমানদের ওপর কেউ আক্রমণ চালালে ইহুদীরা মুসলমানদের সাহায্য করবে। এর জবাবে ইহুদীদের ওপর কেউ যদি আক্রমণ চালায়, তাহরে মুসলমানরা তাদেরকে সাহায্য করবে। (আহদে নববী মেঁ নিযামে হুকুমরানীঃ ড. হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী)
মদিনার সাংবিধানিক দলীলের এতদসংক্রান্ত ধারাগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রসূল সা. কোরায়েশদের পক্ষ থেকে সামরিক আগ্রাসনের সুস্পষ্ট আশংকা অনুভব করছিলেন এবং তার মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিকভাবে যথাযথ আগাম প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করছিলেন।
মদিনাকে হারাম তথা নিরাপদ শহর বা City of peace ঘোষণা করা ছিল একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ সিদ্ধান্তটাও ঐ সাংবিধানিক দলীলে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে এর তাৎপর্য ছিল এই যে, সমগ্র পরিবেশটা পবিত্র এবং এই পরিবেশকে সম্মান দেখানে তার অধিবাসীদের অপরিহার্য কর্তব্য। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য এই ছিল যে, কোরায়েশরা যেমন একটা নিরাপদ শহরে সংরক্ষিত ছিল, তেমনি রসূল সা. মদিনা রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকেও একটা নিরাপদ বাসস্থান দিলেন। তাই এ দিক দিয়ে মক্কা ও মদিনার অবস্থা ছিল সমান সমান। এতে মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে এই মর্মে প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা যদি মদিনার পবিত্রতা লংঘন করে তার অধিবাসীদের ওপর বাড়াবাড়ি কর, তাহলে তোমরাও মক্কার নিরাপত্তা ও পবিত্রতার বেষ্টনীর মধ্যে অক্ষত থাকতে পারবে না।
মদিনার নিরাপত্তা বেষ্টনী ইসলামী সরকারের সদর দফতর বা রাজধানীর সীমানাও চিহ্নিত করে দিয়েছিল। ঐ সীমানাকে স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করার কাজে রসূল সা. বিশেষভাবে মনোযোগ দেন। তিনি হযরত কা’ব ইবনে মালেককে আদেশ দেন, মদিনার চতুসীমায় উঁচু উঁচু মিনার নির্মাণ করাও। এই আদেশ অনুসারে তিনি যাতুল জায়েশের (যা নাকি বায়দার মাঝখানে অবস্থিত হুফায়রা পাহাড়ের সাথে অবস্থিত। এটা মক্কা মদিনার রাস্তায় বিদ্যমান) এর টিলার ওপর, হুশাইরিব (যাতুল জায়েশের সাথে যুক্ত) আর মাখীযের পাহাড়ের ওপর (সিরিয়ার পথে) হুফাইয়াতে (মদিনার উত্তর দিকের জংগলে) এবং যুল উশাইর নামক স্থানে (হুফাইয়ার কিনারে অবস্থিত) আর তীম পাহাড়ে (মদিনার পূর্ব দিকে) জায়গায় জায়গায় প্রতীকী স্তম্ভ নির্মাণ করেন, যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। এই চিহ্নিত বেষ্টনী প্রায় এক মনযিল লম্বা ও এক মনযিল চওড়া। (আহদে নববীকে ময়দানহায়ে জং- ড. হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ ১১-১২)
মদিনার অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বহাল করার পর রসূল সা. অবিলম্বে পার্শ্ববর্তী গোত্রগুলোর দিকে মনোযোগ দিলেন। মদিনার দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা এবং লোহিত সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে তিনি একাধিকবার সফর করেন। সর্বপ্রথম তিনি ভ্রমণ করেন দুয়ান নামক স্থানে। এটা মক্কার পথে আবওয়া থেকে সাত মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানে তিনি বনী হামযার সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। অনুরূপভাবে ইয়ামবুর আশপাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোর সাথেও দ্রুত চুক্তি সম্পাদন করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এলাকায় তিনি প্রথম হিজরীতে জুহায়না গোত্রের সাথে, দ্বিতীয় হিজরীর শুরুর দিকে বনু যামরা, বনু যুরয়া, বনু রাবয়া এবং দ্বিতীয় হিজরীর শেষের দিকে বনু মাদলাজের সহযোগিতাও পেয়ে গেলেন। কোন কোন গোত্রের সাথে তো যৌথ প্রতিরক্ষার চুক্তিও সম্পাদিত হলো যে, তারা আক্রান্ত হলেও মুসলমানরাও তাদেরকে এবং মুসলমানরা আক্রান্ত হলে তারাও মুসলমানদেরকে সাহায্য করবে। কোন কোন চুক্তিতে শুধু এতটুকু বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় যে, রসূল সা. এর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা চলবে না। কোন কোনটায় শুধু নিরপেক্ষতার স্বীকৃতি আদায় করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে যদি কোন শত্রুর লড়াই চলে, তবে চুক্তিবদ্ধ গোত্র নিরপেক্ষ থাকবে। এর অর্থ দাঁড়ালো এই যে, রসূল সা. এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় যথেষ্ট নমনীয়তা ছিল। (আহদে নববীকে ময়দান হায়ে জং)
এই মৈত্রীর পরিবেশ এই সব গোত্রের ভেতরে ইসলামের প্রসারের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, এবং এর কারণে এসব গোত্রে যে ইসলামী আন্দোলনের প্রচুর সমর্থক ও কর্মী গড়ে উঠেছিল, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
পরবর্তীকালে রসূল সা. এর রাজনীতির এই কৌশল একটা স্বতন্ত্র নীতিতে পরিণত হয় এবং তিনি এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক এলাকায় সফর করেন। সামরিক অভিযানের জন্যই হোক কিংবা টহলের উদ্দেশ্যেই হোক, যখনই তিনি মদিনা থেকে বেরুতেন, মৈত্রীর সম্পর্ক সম্প্রসারণ সব সময়ই তার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এখানে আমি বিশদ বিবরণ দিচ্ছি না। এর সুযোগ পরবর্তীতে আসবে। তবে সংক্ষেপে এতটুকু বলবো যে, শত্রুকে দুর্বল করা, ইসলামী আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নেয়া, নিজস্ব প্রতিরক্ষা নীতিকে সবল করা এবং রাষ্ট্র সীমা সম্প্রসারণের একটা অত্যন্ত প্রাভাবশালী পন্থা ছিল এই মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন।
এই সব কৌশলের পাশাপাশি ইসলামী বিপ্লবের আহ্বায়ক রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা এই বাস্তবতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, একটা ঝ্ঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরের মাঝখানে কোন রকমে মাথা গুজে থাকার জন্য যে ক্ষুদ্র দ্বীপটা তারা পেয়েছিন, তার অস্তিত্ব সর্বদাই হুমকির সম্মুখীন। তাই হয় ঝড়ের গতি উল্টে দিয়ে সমুদ্রকে বসে আনতে হবে, নচেত এই দ্বীপও একটা বুদবুদের মত চিরতরে সমুদ্রে হারিয়ে যাবে। তাঁরা অত্যন্ত ক্ষীপ্রতার সাথে নিজেদেরকে একটা সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিলেন। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলনের নিত্য নতুন দাবীগুলোকে এত নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতেন যে, নতুন ধাপগুলোতে যাওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের মধ্যে যোগ্যতার সৃষ্টি করে নিতেন। মদিনায় যখন জেহাদের ডাক এল, তখন তারা এক সেকেন্ডের জন্যও নিজেদের সাবেক অবস্থা থেকে নতুন ভূমিকায় স্থানান্তরিত হতে দ্বিধা সংকোচ বোধ করেননি। তাদের মধ্যকার কেউ কখনো এ কথা ভাবেনি যে, আমরা তো দাওয়াতদানকারী ও বক্তা, যুদ্ধবিগ্রহের সাথে আমাদের কিসের সম্পর্ক? ওটাতো দুনিয়াবী রাজনীতিবিদ ও রাজ্যজয়ীদের কারবার। আমাদের ন্যায় সংস্কারকদের এসব শোভা পায় নাকি? রাজনীতি ও শাসন, কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ তো ধর্মপ্রাচারকদের কাজ হতে পারে না!
প্রচারকদের কাজ তো পড়ে থেকে মার খেতে থাকা এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। মদিনার ইসলামী দল যদি এ রকম চিন্তা করতো, তাহলে ইসলামী আন্দোলন ওখানেই খতম হয়ে যেত। তাকে খতম করার জন্য বাইরের কোন শক্তির প্রয়োজন হতোনা।
এই মুষ্টিমেয় সংখ্যক সাহাবী নিজেদের দ্বীন প্রচারেও দক্ষ ছিলেন, আবার এই দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়ও সর্বোত্তম আত্মনিবেদিত সিপাহী ছিলেন। তাঁরা নিজেদেরকে সুসংগঠিত সৈনিকে রূপান্তরিত করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যে মদিনা একটা নিরপদ শহর, একটা বিদ্যালয় এবং ইসলামী সভ্যতা চর্চার কেন্দ্রভূমি ছিল, সেই মদিনা একটা মজবুত সামরিক ঘাঁটিতে ও পরিণত হলো।
আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল সা. এর ওপর একজন সেনাপতির দায়িত্ব এসে পড়লো। এ দায়িত্ব তিনি এত সুষ্ঠুভাবে পালন করেন যে, কেবল এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেই অসংখ্য বড় বড় বই লেখা হয়ে যাবে।

টহল দানের ব্যবস্থা ও তার উদ্দেশ্য

মদিনা রাষ্ট্রের মহান রাষ্ট্রপ্রধান হিজরতের মাত্র চার ছ’মাস পরই আশপাশের এলাকায় টহল দানের জন্য সেনাদল পাঠানো শুরু করেন। বদর যুদ্ধের পূর্বে নিম্নোক্ত সেনাদলগুলো পাঠানো হয়ঃ
১. সেনাপতি হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে ৩০ জন সৈনিকের একটা দল সাইফুল বাহর নামক স্থান অভিমুখে পাঠানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা। আবু জাহল তিনশো লোক নিয়ে মদিনা থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানদের চৌকিরত দেখে ফিরে গেল। (এ ছিল রমযান, হিজরী-১)
২. আবু উবাইদা বিন হারিসের নেতৃত্বে ৬০ সদস্যের সেনাদল মক্কাবাসীর সামরিক অবস্থা জানার জন্য পাঠানো হয়। শত্রুর ২০০ লোককে ইকরামা অথবা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ছানিয়াতুল মাররা নামক জায়গায় পাওয়া যায়। এই সেনাদল টহল দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসে। (এটা ছিল শাওয়াল, হিজরী-১)
৩. সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বের ৮০ সদস্যের একটা সেনাদল টহল দানের জন্য জাহফা পর্যন্ত পাঠানো হয়। তারা কোন আক্রমণ ছাড়াই ফিরে আসে। (জিলকদ, হিজরী-১)
৪. রসূল সা. স্বয়ং ৭০ ব্যক্তিকে নিয়ে আবওয়া অঞ্চলে গমন করেন। কোরায়েশদের বাণিজ্য পথ আবওয়ার ভেতর দিয়েই যায়। রসূল সা. আমর বিন ফাহ্শী যামরীর সাথে চুক্তি সম্পাদন করে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই ফিরে আসেন। (সফর, হিজরী-২)
৫. রসূল সা. স্বয়ং ২০০ সৈনিককে নিয়ে বুয়াতের দিকে (ইয়াম্বুর নিকট রাজভী পাহাড়ের এলাকা) যান। পথিমধ্যে উমাইয়া বিন খালফের নেতৃত্বে একশো ব্যক্তির এক কোরায়েশী কাফেলার সাক্ষাত পান। তবে কোন চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। (এটা ছিল রবিউল আওয়াল, হিজরী-২)
৬. কিরয বিন জাবের আল ফেহরী মদিনার পশু ডাকাতি করে নিয়ে গেলে রসূল সা. ৭০ জন সৈন্য নিয়ে ধাওয়া করেন। কিরয প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে এই ধাওয়া করা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মদিনা এক সদাজাগ্রত ও সদা তৎপর শক্তি। (রবিউল আউয়াল, হিজরী-২)
৭. রসূল সা. ১৫০ ব্যক্তির এক বাহিনী নিয়ে যুল উশাইর (মক্কা ও মদিনার মাঝখানে ইয়াম্বুর নিকট) চলে যান এবং সেখানে বনু মাদলাজ ও বনু যামরার সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন। (জমাদিউস সানী, হিজরী-২)।
৮. আব্দুল্লাহ বিন জাহসের নেতৃত্বে ১২৫ ব্যক্তির এক সেনাদল নাখলার দিকে টহল দিতে পাঠানো হয়। এই বাহিনী কোরায়েশের এক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। (রজব, হিজরী-২)
এই সমস্ত সেনা অভিযান সংঘর্ষের উদ্দেশ্যে পাঠানো হতোনা। বরং নাখলায় তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির প্রভাবে মদিনার স্থিরীকৃত নীতির বিরুদ্ধে যে সংঘর্ষ ঘটে, তাতে রসূল সা. অসন্তোষ প্রকাশ করেন, বন্দীদেরকে মুক্তি দেন এবং নিহত ব্যক্তির জন্য রক্তপণ দেন। এ সব অভিযানের আরো বড় বড় কিছু উদ্দেশ্য ছিল। যেমনঃ
মদিনা রাষ্ট্রের সীমান্ত প্রহরা, শত্রুর গতিবিধি তদারক করা, কোরায়েশ ও অন্যান্য গোত্রকে জানিয়ে দেয়া যে, মদিনায় এখন যথারীতি সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং মদিনাই তার রাজধানী। মুসলিম বিপ্লবী দলের স্বেচ্ছাসেবকগণের আশপাশের এলাকা, জনপদ সমূহ ও তার ভেতরকার অবস্থা, রাস্তাঘাট ও জলাশয় সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া। সেনাপতিত্ব করা, সেনাপতি থাকা অবস্থায় দায়িত্ব পালন করা, পারস্পরিক দায়িত্ব বণ্টন, সময় ভাগ করা, কৌশল উদ্ভাবন করা। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদির প্রশিক্ষণ। কেননা এ ছাড়া কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলতে পারেনা। তাছাড়া কোরায়েশদের এটা জানিয়ে দেয়াও উদ্দেশ্য ছিল যে, এখন তাদের অর্থনীতি মদিনার নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। মুসলমানরা যখন ইচ্ছা, তাদের বাণিজ্যিক পথ অবরোধ করে তাদের কাফেলার চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। উল্লেখ্য, রসূল সা. বাল্যকালে বসরা ও মদিনায় এবং যৌবনে পুনরায় সিরিয়া সফর করেছিলেন। এই সময় তিনি মদিনার ভৌগলিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝে নিয়েছিলেন এবং কোরায়েশদের বাণিজ্যিক পথ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হয়েছিলেন। এই পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভীতি প্রদর্শন ও চাপ দেয়ার নীতি উদ্ভাবনে তিনি কোন জটিলতার সম্মুখীন হননি। অপরদিকে রসূল সা. কোরায়েশদের একজন হওয়ায়, বিশেষত ব্যবসায়ী হওয়ায় কোরায়েশদের উপার্জনের সবচেয়ে বড় উপায় তাঁর জানা ছিল। তায়েফ, ইয়ামান ও নাজরানের বাণিজ্যের কথা বাদ দিলেও কেবল সিরিয়া ও ইরাকের ব্যবসায় থেকে কোরায়েশদের প্রতি বছর আড়াই লাখ আশরাফী উপার্জিত হতো। (তাফহীমুল কুরআন)
এই সেনাদলগুলোকে যে প্রশিক্ষণমূলক পরিকল্পনার অধীনে পাঠানো হতো, তাতে সৈনিকদের যুদ্ধ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করা হতো, যাতে তারা একটা কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে যন্ত্রের মত সচল ও সক্রিয় হতে পারে, তাদের কাতারবন্দীর ট্রেনিং হয়, পতাকা ও সামরিক প্রতীক সমূহের ব্যবহার শেখে, কঠিন পরিস্থিতিতেও নামায রোযা ও শরীয়তের অন্যান্য বিধান মেনে চলার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এই সাথে তিনি খবর সংগ্রহের এক জোরদার ব্যবস্থারও প্রচলন করেন। এর কারণে তিনি মক্কা ও আশেপাশের গোত্রগুলো ও সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখতে পারতেন। এই সাথে তিনি রাজধানী ও সরকারের কেন্দ্রীয় দফতরের হেফাজত ও প্রহরার ব্যবস্থাও করেন।
এই ছিল দো’তরফা পরিস্থিতি, যার কারণে কোরায়েশরা বদরের যুদ্ধ সংঘটিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

দুটো বাস্তব কারণ

একটা যুদ্ধের জন্য পরিস্থিতি যে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল, তাতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। কিরয বিন জাবের ফেহরীর ডাকাতি মদিনার জন্যে নিঃসন্দেহে একটা যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ ছিল। কেননা কোন জ্যান্ত জাগ্রত সরকার নিজ সীমানার অভ্যন্তরে বহিরাগতদের এমন অপরাধজনক অনুপ্রবেশকে আক্রমণ ছাড়া অন্য কোন অর্থে গ্রহণ করতে পারেনা। ওপর দিকে নাখলার ঘটনা ঘটে গেল। ঐ ঘটনা যদিও সীমান্ত সংঘর্ষের মতই ছিল, যা সরকার ও সেনাপতিদের অনুমতি ছাড়াই দু’দেশের সৈনিকদের মধ্যে সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য মক্কাবাসী অপপ্রচার চালানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। তারা ব্যাপক হৈ চৈ করলো যে, দেখলে তো, নতুন ধর্মের ধ্বজাধারীরা নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতাও পদদলিত করে ফেললো! এদিকে রসূল সা. ঐ ঘটনায় আটক বন্দীদের ছেড়ে দিলেন, নিহত ব্যক্তির রক্তপণ পরিশোধ করলেন এবং নিজেকে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে ঐ ঘটনার দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত করলেন। কিন্তু সাথে সাথে কুরআন মক্কাবাসীর প্রচারণাকে এই বলে খণ্ডন করলো যে, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ ভালো নয় ঠিকই, কিন্তু তোমরা যে মানুষকে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণে বাধা দিয়ে চলেছ, তাদেরকে হারাম শরীফ থেকে বের করে দিয়েছ, এবং মানবতার সংস্কার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছ, সেটা যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডের চেয়েও খারাপ কাজ। তোমাদের এই অপকর্মের মূলোৎপাটনের জন্য যদি মুসলমানরা অস্ত্র ধারণ করে, তবে সেটা হবে তাদের একটা কল্যাণমূলক কাজ। নাখলার ঘটনার একটা ভালো দিক ছিল এইযে, কোরায়েশরা সম্বিত ফিরে পেয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, যাদেরকে তারা সর্বহারা করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং যাদেরকে তারা ভাবতো বিড়ালের মুখের সহজ গ্রাস, তারা ঢিলটির জবাব পাটকেলটি দিয়ে দিতে সক্ষম। তবুও মক্কার প্রচারবিদরা ক্রোধের আগুন জ্বালাতে নাখলার ঘটনার থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করলো।

কোরায়েশদের তিনটে প্রয়োজন

মদিনার উপর আক্রমণ চালাতে কোরায়েশদের সামনে তিনটে বড় বড় সমস্যা ছিল। এক, বনু কিনানার সহযোগিতা পাওয়া। দুই, যুদ্ধ করার জন্য লড়াকু যোদ্ধা সরবরাহ। তিন, যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ। প্রথম সমস্যাটার সমাধান কিভাবে হলো, তা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় সমস্যাটার সমাধান হলো এভাবে যে, আহাবশীদের সাথে কোরায়েশদের চুক্তি সম্পাদিত হলো। মক্কার কাছেই হুবশী নামক একটা পাহাড় রয়েছে। ঐ পাহাড়ের কাছে বসবাসকারী বনু নযীর, বনু মালেক ও মুতাইয়িরীন প্রমুখ গোত্র পরস্পরে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করে। তাদেরকে আহাবীশ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মক্কার অধিবাসীদের তুলনায় আহাবীশদের যোদ্ধাসুলভ যোগ্যতা অনেক বেশি ছিল। তারা শুধু মৈত্রীর ভিত্তিতে নয়, বরং ভাড়াটে সৈনিক হিসেবেও কাজ করতো। অবশ্য তাড়াহুড়োর কারণে বদর যুদ্ধে তাদেরকে সাথে নেয়া সম্ভব হয়নি। বদরযুদ্ধের ফলাফল দেখে কোরায়েশ নেতাদের এই ভুলের জন্য অনুতপ্ত হতে হয়েছিল। ওদিকে (বারো শাখা বিশিষ্ট) ইহুদী গোত্র বনুল মুসতালিকের সাথে কোরায়েশদের সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। (রহমাতুল্লিল আলামীন)
তৃতীয় সমস্যার সমধান করা হলো এভাবে যে, কোরায়েশদের যে বাণিজ্যিক কাফেলা বাণিজ্যোপলক্ষে সিরিয়া যাচ্ছিল, তাকে মক্কাবাসী বিপুল পরিমাণ পুঁজি সরবরাহ করলো। এমনকি গৃহবধূরা পর্্যন্ত নিজ নিজ অলংকারাদি ও অন্যান্য সঞ্চয় এনে দিল। আবু সুফিয়ানের সাক্ষ্য এইযে, মক্কায় এমন কোন নারী বা পুরুষ ছিল না যে এই কাজে অংশ গ্রহণ করেনি। (সীরাতুন্নবী, শিবলী, ১ম খণ্ড, পৃ ২৯২) উদ্দেশ্য ছিল সর্বাধিক পুঁজি বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ পরিমাণ মুনাফা লাভ করা এবং এই উপার্জন দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়া।

বাণিজ্য কাফেলা ছিল যুদ্ধের অগ্রবর্তী বাহিনী

এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যুদ্ধের অন্যান্য প্রস্তুতির পাশাপাশি (যার সংবাদ রসূলুল্লাহ সা. তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যেতেন) এই কৌশল অবলম্বনের অর্থ ছিল এইযে, কোরায়েশদের এই বাণিজ্য কাফেলা সামরিক অভিযানেরই অগ্রবর্তী বাহিনী ছিল। অন্য কথায় বলা যায়, এ কাফেলা ইসলামী আন্দোলনের গলা কাটার জন্য সোনার তরবারী যোগাড় করতে বেরিয়েছিল। পরিস্থিতি যখন এমন হয়, তখন আজও পৃথিবীর কোন সুসভ্য সরকারও নিজের সীমান্ত ঘেষা স্থল, নৌ ও আকাশ পথ দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরাপদে চলাচল করতে দিতে পারেনা। বিমান গুলী করে ভূপাতিত করা হয়, সামুদ্রিক জাহাজকে আটক করা বা টরপেডো দিয়ে ধ্বংস করা হয়, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়, ডাক চলাচলে বাধা দেয়া হয় এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। শুধু মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের কাছেই এ নজিরবিহীন আবদার কেন করা হয় যে, তার প্রতিপক্ষকে তার বুকে ছুরি চালানোর অবাধ অনুমতি দেয়া উচিত ছিল? তা না দেয়াতে তার প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমকে কেন লুঠতরাজ নাম দেয়া হয়? একথা যখন সবার জানা যে, চুক্তিভিত্তিক মৈত্রী না থাকার কারণে যে সব এলাকা মদিনার আওতাধীন, সে সব এলাকা দিয়েই বাণিজ্যিক পথ গিয়েছে, তখন কোন্ কারণে ইসলামী সরকারের পক্ষে স্বীয় এলাকা দিয়ে শত্রুপক্ষকে চলাচল করতে দেয়া সমীচীন হতো?
মদিনায় এই কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর যে আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তার জন্য সাফাই দেয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। তাকে কোন পর্যায়েই রাজনৈতিক বা প্রতিরক্ষামূলক পাপ মনে করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এই কাফেলার ওপর আক্রমণ করার কোন ইচ্ছা যদি মুসলমানদের থেকে থাকে তবে তা ছিল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। আবু সুফিয়ানের মনে যদি এ ধরণের আশংকা জন্মে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। এরূপ আশংকাযুক্ত পরিবেশে মদিনার কোন একটা পদক্ষেপের কারণে আগে ভাগেই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, কাফেলার ওপর হামলার প্রস্তুতি চলছে। ওদিকে আবু সুফিয়ান সিরিয়া যাওয়ার সময়ও মদিনার পরিবেশ যাচাই করে গিয়েছিল এবং ফেরার পথে খুবই সন্তর্পণে পা ফেলছিল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর সে যখন অনুভব করলো, রহস্যময় তৎপরতা চলছে এবং বিপদ একেবারেই আসন্ন, তখন সে সামরিক সাহায্য চাওয়ার জন্য মক্কায় দূত পাঠিয়ে দিল এবং কাফেলার পথ পরিবর্তন করলো। দূত মক্কায় পৌঁছে আরবদের বিশেষ ভংগীতে উটের কান কাটলো, নাক চিরলো, উটের পিঠের আসন উল্টে দিল, জামা ছিড়ে ফেললো এবং ঐতিহ্যগত নিয়মে নগ্ন হয়ে চিল্লাতে লাগলোঃ “ওহে, মক্কাবাসী, তোমাদের কাফেলাকে মুহাম্মাদের সা. কবল থেকে বাঁচাতে বেরিয়ে এসো, এত দেরী করোনা যে, তোমাদের পৌঁছার আগেই কাফেলা ধ্বংস হয়ে যায়।” এই পরিচিত নাটুকে পদ্ধতির হাঁকডাক সমগ্র মক্কায় প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই এক বিশাল বাহিনী তৈরী হয়ে গেল। এ বাহিনীতে আবু লাহাব ছাড়া সমস্ত প্রবীণ নেতারা সশরীরে উপস্থিত ছিল এবং সবাই ছিল সশস্ত্র। বাহিনির নেতাদের লক্ষ্য শুধু কাফেলাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা ছিলনা, বরং তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তারা প্রথম সুযোগেই মুসলিম শক্তিকে নির্মূল করে চিরদিনের মত এ উপদ্রব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল।
এ সময় মুসলিম শক্তি যদি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা দেখাতো, চুপচাপ বসে থাকতো, এবং সামরিক তৎপরতা না চালাতো, তবে তার ফলে কাফেলাকে নিরাপদে মক্কায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো পেতই, অধিকন্তু কোরায়শী বাহিনীও মদিনার এলাকায় ঢুকে, বাহাদুরী দেখিয়ে নিরাপদে ফিরে যেত। আর এর ফল দাঁড়াতো এই যে, এই নবীন ইসলামী রাষ্ট্রটার প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। মদিনার মোনাফেক ও ইহুদী শক্তির দর্প ও অহংকার আরো বেড়ে যেত, আশেপাশের গোত্রগুলোর চোখে ইসলামী রাষ্ট্রের আর কোন গুরুত্ব থাকতোনা এবং মৈত্রীর সম্প্রসারণ তো দুরের কথা, তার মুষ্টিমেয় সংখ্যক নাগরিকের জান, মাল ও সম্ভ্রম রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়তো। সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত শক্তিকে এমন বহু স্তর অতিক্রম করতে হয় যে, নিজের জনসংখ্যা ও সম্পদের স্বল্পতা এবং কঠিন সমস্যাবলী সত্ত্বেও তাকে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। এ ধরনের সুযোগ খুব কমই আসে। যখন তা আসে, তখন তার উপযুক্ত সদ্ব্যবহার ও তখনকার দায়িত্ব সাহসিকতার সাথে পালন না করলে, এমন শোচনীয়ভাবে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হতে হয় যে, বহু বছর কেটে গেলেও তার আর প্রতিকার করা যায় না। বরঞ্চ কখনো এমনও হয় যে, সময়ের পেছনে পড়ে গেলে চিরদিনের জন্য গোটা কাজই পণ্ড হয়ে যায়। এ ধরনের ঐতিহাসিক সংঘাতের সময় যখন এসে পড়ে, তখন শুধু সৈনিকের সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদের পরিমাণ দেখে পদক্ষেপ গ্রহণের ও অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়না। বরং তখন এটাই ভেবে দেখা হয় যে, সময়ের দিক থেকে পেছনে পড়ে গেলে ইতিহাসের প্রবাহ মাথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে না যায়। আসলে এরূপ পরিস্থিতিতেই নেতৃত্বের মানও যাঁচাই হয়ে যায়, অনুসারীদেরও যোগ্যতা নির্ণয় হয়ে যায়। মদিনায় এ ধরনেরই একটা ঐতিহাসিক মূহুর্ত এসে পড়েছিল। ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র যদি পর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী হতো, তাহলে কাফেলাকেও নিরাপদে যেতে দেয়া উচিত হতোনা, আর কোরায়েশ বাহিনীকেও উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতে তার কসুর করা সমীচীন হতোনা। কিন্তু একই সাথে এই দুটো কাজ সম্পন্ন করা তার সাধ্যাতীত ছিল। তাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, যে কোন একটাকে পর্যুদস্ত করা চাই্। আল্লাহ চেয়েছিলেন, যুদ্ধ হলে তা যেন এমনভাবে হয় যে, সত্যকে সত্য এবং বাতিলকে বাতিল বলে প্রমাণ করতে পারে এবং কুফরীর মূল উৎপাটিত হয়ে যায়।
রসূল সা. স্বীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থা দ্বারা কাফেলা ও বাহিনী উভয়ের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ওয়াদিয়ে যাফরানে পরামর্শ সভা ডাকলেন। তিনি সভার সামনে সমগ্র পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরলেন এবং জানতে চাইলেন, মুসলিম বাহিনীর একটা বড় রকমের ঝুঁকি নেয়ার শক্তি ও সাহস আছে কিনা। [আমাদের সময়কার সীরাত লেখকদের মধ্যে এ ব্যাপারে তীব্র মতবিরোধ ঘটেছে যে, রসূল (সা.) মদিনাতেই মোহাজের ও আনসারদের বিশেষ বৈঠক আহবান করে কাফেলাকে বাদ দিয়ে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে বেরিয়ে ছিলেন, না মদিনা থেকে বেরুবার সময় কাফেলার উপর আক্রমণ এবং পড়ে ওয়াদিয়ে যাফরানে পৌঁছে যখন জানলেন কাফেলা ভিন্ন পথ ধরে চলে গেছে তখন ওখানেই জরুরী বৈঠক ডেকে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন? এই বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ হলো প্রাচ্যবিদদের পক্ষ থেকে এই মর্মে ঘৃণ্য অভিযোগ আরোপ যে, মদিনার সরকার (নাউযুবিল্লাহ) লুটতরাজ চালিয়ে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সচেষ্ট ছিল। এ জন্য তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থাবলীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, রসূল (সা.) বাহিনী নিয়ে কাফেলাকে আক্রমণ করার জন্য বের হননি, বরং মদিনায় বসেই পরামর্শ করে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ দৃষ্টিভঙ্গির সর্বপ্রধান প্রবক্তা ছিলেন মাওলানা শিবলী নু’মানী। তিনি মনে করেন কোরআনও তার মতের সমর্থক। অথচ কোরআন, নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সমূহ ও ঘটনা প্রবাহ কোনটাই তাঁর মতের সমর্থক নয় এবং যে অভিযোগ থেকে এই বিতর্কের উৎপত্তি, তাও সঠিক নয়। যথাস্থানে আমরা এ আলোচনা সবিস্তারে করবো ইনশাল্লাহ। আসলে দ্বিতীয় দৃষ্টিভংগীটাই সঠিক।] তিনি নিজে সাহস ও হিম্মত রাখতেন যে, যা কিছু শক্তিসামর্থ আছে, তাকে জীবন মরন সংগ্রামে লাগিয়ে দেয়া হোক। তিনি পরামর্শ সভার সামনে দুটো সম্ভাবনাই তুলে ধরলেন যে, একদিকে কোরায়েশ বাহিনী অপরদিকে বাণিজ্যিক কাফেলা রয়েছে। এর যে কোন একটার ওপর আক্রমণ করা হোক। বিরাট সংখ্যক সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ প্রস্তাব সমর্থন করলেন। কোরআনের ইংগিত অনুসারে এই দলে এমন কিছু লোক অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ অবলম্বন করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং আর্থিক স্বার্থটা তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ববহ ছিল। রসূল সা. পুনরায় প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। এর অর্থ ছিল এইযে, তিনি কাফেলার ওপর আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন না। এই ইংগিতকে বুঝতে পেরে মোহাজেরদের মধ্য থেকে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও মিকদাদ বিন আমর নিজেদের শর্তহীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বললেন, আপনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে যেদিকেই পদক্ষেপ নেবেন, আমরা আপনার সাথে থাকবো। আমরা বনী ইসরাঈলের মত এ কথা বলে বসে থাকবোনা যে, তুমি ও তোমার খোদা গিয়ে লড়াই কর, আমরা এখানে বসে রইলাম। রসূল সা. পুনরায় তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। এর অর্থ ছিল তিনি আনসারদের দৃষ্টিভংগী জানতে চাইছিলেন। আকাবার চুক্তিতে তাদের কাছ থেকে শুধু এই মর্মে অংগীকার নেয়া হয়েছিল যে, মদিনার ওপর আক্রমণ হলে তারা প্রতিহত করবে। তারা রসূল সা. এর সাথে কেবল কাফেলার ওপর আক্রমণের জন্যই বেরিয়েছিল। কিন্তু পরের পরিস্থিতি পুরোদস্তুর যুদ্ধ অনিবার্য করে তুললো। কাজেই তাদের মনোভাব জানা তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাঁর এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আনসারদের পক্ষ থেকে সা’দ বিন মু’য়ায পরিপূর্ণ ঈমানী আবেগ নিয়ে বললেন, আপনি নিজের মর্জী অনুযায়ী কাজ করুন। আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত।
শেষ পর্্যন্ত দ্বিতীয় হিজরীর ১২ই রমযান মদিনা রাষ্ট্রের শাসক সা. সশরীরে তিন শতাধিক লড়াকু সৈনিক সাথে নিয়ে (৮৬ মোহাজের, ১৭০ খাজরাজী এবং ৬১ আওসী- মোট ৩১৭ জন, যদিও সাধারনভাবে প্রচলিত সংখ্যা ৩১৩) শহর থেকে বেরুলেন। রসূল সা. এমন বিচক্ষণতার সাথে রওনা হলেন যে, দু’দিকেই আক্রমণ চালানোর ইচ্ছা প্রতীয়মান হয়। এক দৃষ্টি কাফেলার দিকে ছিল, যাতে আবু সুফিয়ান বুঝতে পারে, পথ বিপজ্জনক। অপর দৃষ্টি কোরায়েশ বাহিনীর দিকে ছিল। কিন্তু কাফেলা কোন্ দিকে, বাহিনী কোন্ দিকে এবং উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু, তা জানা প্রয়োজন ছিল। উভয়টা একত্রিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা এবং কাফেলা পেছনে থেমে রইল, না সমুদ্রের কিনারের দিকে চলে গেল, তাও জানা যাচ্ছিলনা। অবশেষে সাফরা নামক জায়গায় গিয়ে তিনি বিছবিছ বিন আমর আল জুহানী এবং আদী বিন আর রাগবাকে কাফেলার খোঁজ নিতে বদরের দিকে পাঠালেন। আর নিজে ওয়াদিয়ে যাফরানে উপনীত হলেন। জানা গেলো যে, কাফেলা বদরের পথ ত্যাগ করে সমুদ্র তীরের দীর্ঘ পথ ধরে এগিয়ে গেছে এবং অনেক দূর চলে গেছে। অগত্যা রসূল সা. বদরের দিকে রওনা হলেন।
ওদিকে আবু সুফিয়ান উপকূলীয় এলাকায় পৌছার পর নিজেকে নিরাপদ পেয়ে কোরায়েশী বাহিনীকে বার্তা পাঠালো, আমি ও আমার কাফেলা এখন বিপদমুক্ত। কাজেই তোমরা ফিরে এস। কিন্তু আবু জাহল তখন অন্য রকম স্বপ্নে বিভোর। সে বদরে যেতে ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাতে মরিয়া হয়ে উঠলো। মোহরা ও আদি গোত্রের সরদারদের সাথে করে আনা হয়েছিল কাফেলাকে মুসলমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। তাই তারা ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো। তাদের কথা যখন শোনা হলোনা, তখন তারা নিজেদের লোকজন নিয়ে ফিরে গেল। হাকীম বিন হিযাম এবং উতবা আবু জাহলকে যুদ্ধ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আবু জাহল তাদের অনুরোধ শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। যারা শান্তির পক্ষে ওকালতি করছিল, তাদেরকে সে প্রচন্ডভাবে গালাগালি করলো এবং সেই সাথে নাখলার ঘটনায় নিহত হাযরামীর ভাই আমেরের ভাবাবেগকে উস্কে দিল। আমের হৈ চৈ করে একটা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিল। অবশেষে কোরায়েশ বাহিনী বিপুল রণসাজে সজ্জিত হয়ে বদরের ময়দানে এসে উপনীত হলো।
রসূল সাঃ সাহাবীদের পরামর্শে অপেক্ষাকৃত সুবধিাজনক জায়গা দখল করলেন এবং যথোচিত যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাহিনীকে কিভাবে বিন্যস্ত করা হবে, তা স্থির করলেন। শত্রবাহিনীর সংখ্যা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে গোপন তথ্য সংগ্রহ করলেন। যখন কোরায়েশ বাহিনীর প্রত্যেক যোদ্ধার নামধামসহ পরিচয় জানতে পারেলেন, তখন সাথীদের বলরলন, “মক্কা নিজের কলিজা-গুর্দাগুলোকে তোমাদের সামনে হাজির করেছে।” শত্রুবাহনীর যোদ্ধা সংখ্যা ছিল এক হাজার। এর মধ্যে ছয় শো বর্ম পরিহিত ও একশো সওয়ারী ছিল। তাদের সাথে ছিল অজস্র উট, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ। যোদ্ধাদের মনোরঞ্জন এর জন্য ছিল বহু সংখ্যক মদের মটকা ও গান গাওয়ার জন্য গায়িকার দল। এর মোকাবেলার তিনশোর সামান্য কিছু বেশী সহায় সম্বলহীন লোককে ময়দানে নামিয়ে দেয়া ছিল এক অকল্পনীয় দুঃসাহসিকতা। সামরিক বাহিনী সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আরো বহু সংখ্যক উপাদান নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। রসূল সা: ভালো করেই জানতেন, তিনি যে সৈনিকদেরকে ‘তিনজনের মোকাবেলায় একজন’ অনুপাতে ময়দানে নামাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে নির্যাতিত সুলভ তেজবীর্য, রয়েছে নিজ নিজ মতাদর্শের সত্যতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে অবিচল আস্থা এবং তারা সাংগঠনিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় শ্রেষ্ঠতর। তাদের মধ্যে এই চেতনা ছড়িয়ে আছে যে, প্রশ্ন শুধু একটা যুদ্ধে হার জিতের নয়, বরং গোটা আন্দোলন টিকে থাকবে কি ধ্বংস হয়ে যাবে তার। তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কিছুই পূঞ্জীভূত হয়ে গিয়েছিল বদরের ময়দানে। সর্বোপরি, আল্লাহর সাহায্যের ওপর তাদের ছিল অখন্ড বিশ্বাস। এই আল্লাহর সাহায্যই ছিল তাঁদের দৃর্ষ্টিতে আসল নিস্পত্তিকারী শক্তি। তারপর আল্লাহর সাহায্য সম্ভবত একবোরেই আসন্ন হয়ে উঠলো তখন, যখন রসূল সা: অশ্রুভেজা চোখে, সকাতর কন্ঠে ও বেদনাবিধুর ভাষায় দোয়া করলেনঃ
“হে আল্লাহ, এই সেই কোরায়েশ, যারা নিজেদের আভিজাত্যের অহংকারে মাতোয়ারা হয়ে ছুটে আসছে শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তারা তোমার বান্দাদের তোমার আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে রাখবে এবং তোমার রসূলকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করবে। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, সেটা এখন পাঠিয়ে দাও। হে আল্লাহ, কালই ওদেরকে ধ্বংস করে দাও।” তারপর তিনি এ কথাটাও বললেন, “হে আল্লাহ, আজ যদি এই ক’টা প্রাণ খতম হয়ে যায়, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত আর তোমার এবাদত হবেনা। “ রসূল সাঃ এর মত ব্যক্তিত্ব যখন নিজের আন্দোলনের গোটা পূঁজি ময়দানে হাজির করে এমন মর্মস্পর্শী দোয়া দ্বারা আল্লাহর আরশে করাঘাত করেন তখন ফেরেশতাদের বাহিনী না নেমে কিভাবে পারে? তাই এ পর্যায়ে যথার্থই বিজয়ের সুসংবাদ এসে গেল।

বদরের যুদ্ধের ফলাফল

কালের গোটা ইতিহাস সম্ভবত বদরে ক্ষুদ্র ময়দানে পুঞ্জীভূত হয়ে গিয়েছিল। এই ইতিহাসকে সচলকারী দু’ধরনের শক্তি নিজ নিজ চেতনা ও প্রেরণায় পুরোপুরি উজ্জীবিত হয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। পৈত্রিক ধর্ম, প্রাচীন রসম রেওয়াজ, নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করার জন্যে এক পক্ষের মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। আর অপর দিকে ছিল দিগন্ত প্রসারী এক আলোর বন্যা, যা মদিনার আকাশ থেকে উদ্ভাসিত নতুন প্রভাতকে মানবতার সমগ্র জীবনক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল এবং যার দৃষ্টিতে জাহেলিয়াতের অন্ধকারের বক্ষ বিদীর্ণ করা ছিল এক পবিত্র কর্তব্য। এ যুদ্ধে পিতাপুত্র, চাচা ভাতিজা, ভাই ভাই, শ্বশুর জামাতা- সবাই রক্তের সম্পর্ককে ভুলে গিয়ে নিজ জীবনাদর্শের রক্ষণাবেক্ষণেল জন্য পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আনসাররা নিজেদেরকে সমগ্র আরবের তীর ও তরবারীর শিকার হতে হবে জেনেও মন প্রাণ দিয়ে রসূল সা: এর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এটা ছিল এক সুকঠিন পরীক্ষা। রসূলের প্রিয় সাথীগণ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করে দিলেন, তারা ইসলামী আন্দোলনের সাচ্চা ও নিঃস্বার্থ পতাকাবাহী। অকল্পনীয় ফলাফলের দিক দিয়ে মানবেতিহাসে এ যুদ্ধের কোন জুড়ি নেই। বলা যেতে পারে, ইতিহাসে এটা ছিল আবাবীলের ঝাঁকের হাতে হস্তিবাহিনীর বিধ্বস্ত হওয়ার আর এক দৃষ্টান্ত। ১৭ই রমযান যুদ্ধ হলো। ইসলামী বাহিনীর ২২ জন বীর যোদ্ধা নিজেদের আদর্শের জন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তারা শ্রেষ্ঠতম সত্যের একনিষ্ঠ সাক্ষী। অপর দিকে তারা শত্রুর ৭০ জন যোদ্ধাকে হত্যা করলো এবং নিজেদের কাউকে তাদের হাতে বন্দী হতে না দিয়ে আরো ৭০ জনকে যুদ্ধবন্দী বানালো। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ গনীমতের সম্পদও তাদের হস্তগত হলো। উতবা, শায়বা, আবু জাহল, আবুল বুখতারী, যাময়া ইবনুল আসওয়াদ, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ ইবনুল হুজ্জাজ সহ বহু সংখ্যক নামকরা কোরায়েশ সর্দার মুসলিম মোজাহেদদের তরবারীর গ্রাসে পরিণত হলো। তাদের নেতৃত্বে লড়াইরত শত্রু সৈন্যদের কাতারকে কাতার লন্ডভন্ড হয়ে গেল। প্রকৃত পক্ষে এই প্রথম যুদ্ধেই কোরায়েশদের কোমর ভেঙ্গে গেল এবং তাদের শক্তির গর্ব চূর্ণ হয়ে গেল। এই যুদ্ধের ফলেই ইসলামী আন্দোলন সহসা মাথা উঁচু করে ভবিষ্যতের নতুন জগতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের যোগ্যতা অজর্ন করলো। এ কারণেই আল কুরআনে বদর যুদ্ধের দিনকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা হক ও বাতিলের ছাঁটাই বাছাইয়ের কষ্টিপাথর বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রকৃত পক্ষে এই যুদ্ধই নিষ্পত্তি করে দেয় যে, কোরায়েশদের প্রিয় জাহেলী ব্যবস্থাই টিকে থাকবে এবং টিকে থাকার যোগ্য, না মুহাম্মদ সা: এর উপস্থাপিত ইসলাম টিকে থাকার অধিকারী। এ জন্যই কুরআন তার পর্যালোচনায় বলেছে, ঐ দুই আদর্শের মধ্যে এখন সেই আদর্শেরই টিকে থাকার অধিকার আছে, যার কাছে নিজের টিকে থাকার বৈধতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। আর জনগণও এ দুটোর যে আদর্শকেই গ্রহণ করতে চায়, প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে। তারপর ইচ্ছা করলে ধ্বংসের গভীর গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে, আর ইচ্ছা করলে ইসলামের সুউচ্চ মার্গে উন্নীত হবে।
বান্দীদেরকে মাথা পিছু চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। (কোন কোন সরদারের কাছ থেকে আরো বেশী মুক্তিপণ নেয়া হয়।)
এভাবে কোরায়েশকে আড়াই লাখ দিরহামের চেয়েও বেশী অর্থদন্ড দিতে হয়। এই অর্থনৈতিক আঘাত তাদের শক্তিকে আরো অধোপতিত করে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বদরের এই অপ্রত্যাশিত (কোরায়েশদের দৃষ্টিভংগী অনুসারে) ফলাফলের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল এই যে, আরব গোত্রগুলোর দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল। এই শক্তি ভবিষ্যতের আশাভরসার কেন্দ্রস্থল রুপে বিবেচিত হবার যোগ্য হয়ে গেল। (এক বণনা অনুসারে) মদিনার কতিপয় ইহুদী গোত্র বদর যুদ্ধের পরই মদিনার সাংবিধানিক চুক্তিতে শরীক হয়েছিল তার আগে নয়। মদিনার বিপুল সংখ্যক অধিবাসী এ যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করে। বদর যুদ্ধের পরই ইসলাম সঠিক অর্থে একটা সর্বস্বীকৃত ও জননন্দিত ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “স্মরণ কর ঐ সময়টাকে, যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে খুবই কম। পৃথিবীতে তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো এবং তোমরা শংকিত থাকতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তারপর আল্লাহ তোমাদেরকে আশ্রয়স্থল যোগাড় করে দিলেন, নিজের সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে সবল করলেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবিকা দিলেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।” (সূরা আনাফাল-২৬)
এ আয়াত আসলে সকল যুগের ইসলামী আন্দোলনের দুটো প্রধান যুগকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। একটা হলো, সংখ্যার স্বল্পতা, দুর্বলতা ও ভয়ভীতির যুগ। আর অপরটা প্রাবল্য, ক্ষমতা, বিজয়, সাফল্য ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার যুগ। ইসলামে প্রথম যুগটা যেমন স্বাভাবিক ও অনিবার্য, তেমনি দ্বিতীয়টাও স্বাভাবিক ও অবধারিত। এ ধরনের সূচনার যৌক্তিক পরিণতি এটাই। কিন্তু ইসলামের যে ধারণা ব্যাক্তি ও জাতিকে চিরস্থায়ীভাবে প্রথমোক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে, তাতেই তো সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত করে এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল যুগের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোন পথ উম্মুক্ত করেনা, তা রসূলের সা. শেখানো ইসলাম নয়, বরং তা থেকে বিচ্যুতি ও বিকৃতির কারণেই সে ধারণা সৃষ্টি হয়।
এ পর্যায়ে কাফেরদেরকে উপদেশ সহকারে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি সুস্পষ্ট দিদ্ধান্ত চেয়ে থাক, তবে এই নাও, সে সিদ্ধান্ত তোমাদের সামনে এসে গেছে। এখন ফিরে আস। সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি পুনরায় সেই বোকামী কর, তবে আমিও পুনরায় তোমাদেরকে উচিত শিক্ষা দেব। ...........” (সূরা আনাফাল, ১৯) তারপর মুসলিম জাতিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে দেখেন শত্রুর কোমরের বাধন খুলে দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। বরং তাদের হাত অবশ ও অচল করে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হও, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধের সূচনা করেছেঃ “এখন তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ফেতনা ফাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং সবাই একমাত্র আল্লাহর অনুগত না হয়ে যায়।” (আনফাল- ৩৯) অর্থাৎ যুদ্ধের যে আগুন কোরায়েশরা জ্বালিয়েছে, তাকে তখন পুরোপুরি নেভানো ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ পূর্ণতা লাভ করতে পারেনা।

দুটো শক্তির পার্থক্য

বদরের যুদ্ধকে আল্লাহ তায়ালা যে কারণে ‘ইয়াওমূল ফুরকান” তথা ‘হক ও বাতিলের মধ্যে প্রভেদ ও ছাটাই বাছাই করার দিন’ নামে আখ্যায়িত করছেন, যে কারণে বলা হয়েছে, ‘এই নাও, সিদ্ধান্ত এসে গেছে। যে কারণে সুরা আলে-ইমরানে বলা হয়েছে, উভয় বাহিনীর সংঘর্ষে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, এবং যে কারণে বলা হয়েছে, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে শিক্ষা রয়েছে’, সেকারণটা আসলে এই যে, এই দুই বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে বিরাট আদর্শিক ও নৈতিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটা বাহিনী পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য, এবং গোত্রীয় ও বংশীয় ভোদাভেদ ভুলে গিয়ে নিছক আল্লাহর পথে মানব জাতির সঠিক কল্যান সাধনের নিমিত্তে প্রাণপণ সংগ্রামে নামে আর অপর বহিনী নিজেদের নেতৃত্বে, আধিপত্য, বংশীয় আভিজাত্য, রাজনৈতিক স্বার্থ ও অন্ধ ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে সামনে অগ্রসর হয়। এ বাহিনী আল্লাহর সামনে বিনীয় সহকারে, নামায রুকু ও সিজদায় মগ্ন থেকে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে ময়দানে নামে। একটা বাহিনী বিরাট বিরাট ভোজসভা, মদের আসর, গানবাজনার জলসা ও নর্তকীদের নৃত্য ইত্যাদি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে আসে। আর অপর বাহিনী ময়দানে আসে সংখ্যার স্বল্পতা, ও অস্ত্রশস্ত্রের অপ্রতুলতার পাশাপাশি ঈমান, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও চরিত্রের দিক দিয়ে অধিকতর মজবুত ও শক্তিশালী অবস্থায়। একটা বাহিনী সংখ্যায় বড় এবং সাজসরঞ্জামে শক্তিশালী, কিন্তু নৈতিক শক্তির বিচারে নিতান্ত হীনবল ও অকর্মন্য। এরপর আল্লাহ উভয়ের মধ্যে হারজিতের এত স্পষ্ট ফায়সালা করে দেন যে, অন্ধরাও দেখতে পায়, কোন পক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যোগ্য আর কোন পক্ষ ফলে ফুলে সুশোভিত হয়ে টিকে থাকার যোগ্য। কয়েকটা ঘটনা লক্ষ্য করলে এ পার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবু হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও আবু হিয়াল নামক দু’জন মুসলিম যুবক এই সময় মক্কা থেকে মদিনায় আসছিলেন। পথিমধ্যে কাফেররা তাদের গতিরোধ করে বলে, আমরা তোমাদের মুহাম্মাদের সা. সাহায্য করতে যেতে দেবনা। তারা যুদ্ধে শরীক না হবার অংগীকার করে অব্যাহতি পান। রসূল সা. এর কাছে এসে পুরো ঘটনা শুনালেন। সংখ্যা স্বল্পতার কারণে মুসলমানদের জন্য এ সময়টা এত নাজুক ছিল যে, একটা পিঁপড়ে সাহায্য পাওয়া গেলে ও মূল্যবান বিবেচিত হতো। তথাপি রসূল সা. সিদ্ধঅন্ত দিলেন যে, তোমরা যে ওয়াদা করে এসেছে, তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সাহায্য করবেন। ইতিহাসে এমন গৌরবোজ্জ্বল দুষ্টান্ত ক’টা পাওয়া যাবে?
বদর যুদ্ধে নিহত কোয়ায়েশ নেতাদের লাশ রসূল সা. একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে দাফন করেন। কোন লাশের অবমাননা হতে দেননি।
গণীমত অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে প্রচলিত রীতি ছিল এই যে, যার হাতে যা পড়তো, তা তারই হয়ে যেত। এই রীতির কারণে বিজয়ের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই উচ্ছৃংখলতা, লুটপাট ও হাতাহাতি হতো। কিন্তু কুরআন গণীমতের সম্পদের ব্যাপারে নতুন বিধি জারী করলো। এই বিধির মূল কথা ছিল, গণীমতের সমস্ত জিনিস আল্লাহ ও তাঁর রসূলের। কাজেই এ সম্পদ বন্টন করা ইসলামী সরকারের কাজ। এই নতুন বিধির আলোকে সমস্ত গনীমতের মাল সেনাপতির সামনে স্তুপ করে রাখা হতো। তারপর তা থেকে এক-পঞ্চমাংশ ইসলামী রাষ্টের সামষ্টিক প্রয়োজন পুরণের জন্য রেখে বাকীটুকু সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করা হতো।
জাহেলী ব্যবস্থায়, যুদ্ধবন্দীরা বিজেতা পক্ষের করুণার পাত্র হতো। সাধারণত তাদের ওপর যুলুম নির্যাতন ও অসদাচারণ করা হতো এবং তাদেরকে দাস দাসীতে পরিণত করা হতো। এমনকি আজকের সভ্য যুগেও যুদ্ধ বন্দীদের সাথে পাশবিক আচরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রসূল সা. যুদ্ধ বন্দীদের কে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। তাদেরকে আরামে রাখার নির্দেশ দিলেন। কোন কোন সাহাবী এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে নিজে খেজুর খেয়ে বন্দীদেরকে পেটপুরে উন্নতমানের খাবার খাওয়াতো। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইরের ভাই বদর যুদ্ধের যুদ্ধবন্দী আবু উমাইর জানিয়েছে যে, যে আনছারীর কাছে আমাকে রাখা হয়েছিল, তারা নিজেরা খেজুর খেয়ে আমাকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতো। এই ব্যবহারে আমি খুবই লজ্জা পেতাম। যে সব বন্দীর কাপড় চোপড় কম থাকতো, তাদেরকে কাপড় দেয়া হতো। হযরত আব্বাস অপেক্ষাকৃত লম্বা আকৃতির লোক হওয়ার কারণে কারো জামা তার গায়ে লাগছিলনা। এ জন্য মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর জন্য নিজের জামা পাঠিয়েছিল। এই অনুগ্রহের বদলা হিসাবেই রসূল সা. আব্দুল্লাহর কাফনের জন্য নিজের জামা দিয়েছিলেন। বন্দীদের মধ্যে সোহায়েল বিন আমরও ছিল। সে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে জোরদার ভাষণ দিয়ে বেড়াতো। হযরত ওমর রা. পরামর্শ দিলেন, এ ব্যাটার সামনের দাঁতগুলো ভেঙ্গে দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে আর ভাষণ দিতে জোর না পায়। অন্য কেউ হলে নিজের কাছে রক্ষিত একজন অসহায় বন্দীর সাথে যত খারাপ আচরণ সম্ভব হয়, করতে দ্বিধা করতোনা। কিন্তু রসূল সা. বললেন, আমি যদি কারো শরীরের কোন অংশ বিকৃত করি, তাহলে আমি নবী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার দেহের ঐ অংশ বিকৃত করে শাস্তি দেবেন।
বিজয়ী শক্তি সাধারণত অহংকার মত্ত হয়ে অত্যন্ত অশালীন ও অভদ্র হয়ে যায়। কিন্তু রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের মধ্যে তেমন কোন ন্যাক্যারজনক আচরণের হদিস মেলেনা। এমনকি যখন রসূল সা. আবু জাহলের নিহত হওয়ার খবর পেলেন এবং তার মাথা তাঁর সামনে আনা হল, তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন।
বিজয়ী শক্তি যখন মদিনার দিকে মার্চ করলো তখনও না কোন গান বাজনার ব্যবস্থা করা হলো, না মদিনায় পৌঁছে কোন আনন্দোৎসব করা হলো। কেবল সবার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। এ বিজয় আল্লাহর পুরস্কার- এই অনুভূতির ভিত্তিতেই সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
মুসলিম সৈন্যরা যাতে শক্তির নেশায় বিভোর হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মানসিক ও নৈতিক দুর্বলতা গুলো দূর করতে সচেষ্ট হয়, সে জন্য তাদের সেনাপতি রসূল সা. কুরআনের আয়াতের আলোকে তাদের মনযোগ আকর্ষণ করেন। তাদের সামরিক তৎপরতার ওপর সমালোচনা সুলভ পর্যালোচনা করে অবাঞ্ছিত দিকগুলো তুলে ধরেন। এভাবে তাদের মধ্যে অধিকতর গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজের জন্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করা হয়।
সমস্ত সামরিক কর্মকান্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয় জেনেও প্রথম যুদ্ধটার প্রতি একটু বেশী মনোযোগ দিয়েছি। এর উদ্দেশ্য হলো,এদ্বারা পাঠক যেন সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা অর্জন করতে পারে,যা ছাড়া পরবর্তী যুদ্ধগুলো বুঝা সম্ভব নয়। (তথ্যসূত্রঃ তাফহীমুল কুরআন-সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, সূরা আনফালের ভূমিকা ও টীকা,সীরাতুন্নবী,শিবলী নুমানী। আসাহুস সিয়ার। আহদে নববীকে ময়দানহায়ে জং। হাদীসে দেফা)।

বদর যুদ্ধের পর

যদিও বদর যুদ্ধে ইসলামী রাষ্ট্রের একটা ক্ষুদ্র বাহিনী রসূল সা.এর নেতৃত্বে কোরায়েশকে পরাজিত করে একটা সমুচিত শিক্ষা দিয়েছে,কিন্তু সেই সাথে ভবিষ্যতে সংঘাত-সংঘর্ষের একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অনিবার্য হয়ে উঠল। মক্কার তলোয়ার একবার খাপ থেকে বেরিয়ে আসার পর এবার শান্তি প্রতিষ্ঠার একটামাত্র উপায়ই অবশিষ্ট রইল। সে উপায়টা হলো,এই তলোয়ারকে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে এবং এই তলোয়ার উত্তোলনকারী হাতকেও অবশ করে দিতে হবে। আহত শত্রু লেজকাটা সাপের মত প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে থাকে। এ কথা যদিও দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে,কোরায়েশ নেতৃত্ব সদাতৎপর,বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সরদারদের উপস্থিতি সহসাই শূন্যের কোটায় নেমে গেছে,তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে এবং তাদের দীর্ঘকালের অর্জিত প্রভাব প্রতিপত্তি প্রথমবারের মত উৎখাত হতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু এটাও ইতিহাসের একটা স্বতসিদ্ধ মূলনীতি যে,ধর্মীয়,রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য যারই হাতে থাকে,সে তা রক্ষা করার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে। বিশেষত যে সব ব্যক্তি বা শ্রেণী পুরুষানুক্রমিকভাবে সমাজের ওপর আধিপত্য অর্জন করে,তারা তাদের ধড়ে প্রাণ থাকতে এমন কোন শক্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ দিতে চায়না,যার বিকাশ বৃদ্ধির ফলে তাদের নেতৃত্বের অবসান অনিবার্য হয়ে ওঠবে। তারা টিকে থাকার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করে থাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তাই রসূল সা. ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন,বদরের বিজয় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কত বড় দায় দায়িত্ব বহন করে এনেছে। তিনি জানতেন,কোরায়েশ তার সমগ্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে,নিজের পুরনো মৈত্রীর বন্ধনগুলোকে এবং নিজের সমগ্র অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েও নিজের এই সামরিক পতাকাকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করবে। যে পতাকা উড়িয়ে সে সর্বপ্রথম মক্কার বাইরে এসেছে,তাকে ভূলুন্ঠিত অবস্থায় রেখে সে মক্কায় গিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারেনা। এ পরিস্থিতিতে কার্যত গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কজের আহ্বায়ক এবং সত্য ও ইনসাফের পতাকাবাহীকে গঠনমূলক কাজের পাশাপাশি নিজের ক্ষুদ্র দলটাকে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক ও নিত্য নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখতে বাধ্য থাকতে হলো। এ জন্যই বদর যুদ্ধের পর রসূল সা. কে ক্রমাগত সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হয়। বদর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর মাত্র সাতদিন পরই রসূল সা.কে একটা সামরিক অভিযানে ‘মাউল কাবার’ নামক স্থানে যেতে হয়। কেননা ওখান থেকে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে,বনু সুলাইম ও বনু গিতফান নামক গোত্র দুটোর কিছু লোক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কিছু শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ সামনে এলনা। তিন দিন অবরোধ রাখার পর তিনি ফিরে গেলেন। পরে আবার ঐ লোকদের জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া গেল। তাদেরকে দমন করতে গালেব বিন আব্দুল্লাহ একটা সামরিক দল নিয়ে গেলেন। সামান্য কিছু সংঘর্ষ হলো এবং নৈরাজ্যবাদীরা পালিয়ে গেল। রসূল সা.যখন বদরের যুদ্ধ উপলক্ষে মদিনার বাইরে ছিলেন, তখন বনু কাইনুকা চুক্তি ভঙ্গ করে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে বসলো। তাই বলে এত বড় ঘটনাকে উপেক্ষাও করার উপায় ছিলনা। উপেক্ষা করার অর্থ হতো ভবিষ্যতের জন্য মদিনাকে ধ্বংসের সম্মুখীন করা। এ জন্য ২য় হিজরীর শওয়াল মাসে রসূল সা.তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি দ্বারা এক ধরনের পুলিশী অভিযান চালালেন এবং তাদের ইচ্ছা অনুসারে শালিশী করানো হলো। সেই শালিশী অনুসারে এই গোষ্ঠীটাকে মদিনার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
বদর যুদ্ধের দু’মাস পর (জিলহজ্জ মাসে) আবু সুফিয়ান দু’শো লোক নিয়ে মদিনা অঞ্চলে এল। সে গোপনে সালাম বিন মুসকামের সাথে সাক্ষাত করে যুদ্ধ বাধাবার ষড়যন্ত্র করতে চাইল। কিন্তু সাফল্যের কোন উপায় না দেখে আরীয নামক স্থানে কিছু গাছগাছালি নষ্ট করে এবং জনৈক আনসারীকে হত্যা করে পালালো। রসূল সা. তার পিছু ধাওয়া করে কারকারাতুল কাযর পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু লুটেরার দল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। পালাতে গিয়ে তারা নিজেদের বোঝা হালকা করার জন্য কিছু ছাতুর বস্তা ফেলে দিয়ে চলে গেল এবং তা মুসলিম বাহিনীর দখলে এল। এ কারণে এই অভিযান ‘গুয়ওয়ায়ে সাওয়ীক’ নামে পরিচিতি হয়ে যায়। জিলহজ্জের বাকী ক’দিন মদিনায় কাটলো। কিন্তু ৩রা হিজরীর মুহাররম মাসে জানা গেল, বনু সালাবা ও বনু মাহারেব হামলা করার জন্য সমবেত হচ্ছে। মাসের শেষে রসূল সা.নাজদে গেলেন এবং প্রায় পুরো সফর মাস ঐ এলাকায় অবস্থান করলেন। শত্রুরা মোকাবিলায় এলনা এবং কোন সংঘর্ষ ছাড়াই তাঁরা ফিরে এলেন। এতদিন অবস্থান করার উদ্দেশ্য ছিল ঐ এলাকায় মৈত্রী সম্পর্কের বিস্তার ঘটানো,যাতে কোরায়েশরা ওদিক দিয়ে বাণিজ্যের পথ না পায়। এ অভিযানকে ‘গুজওয়ায়ে যি আমার’ এবং গুযওয়ায়ে আনমারও বলা হয়ে থাকে।
রবিউস সানী মাসে কোরায়েশদের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশংকা দেখা দিল। তাই মদিনায় ইবনে উম্মে মকতুল রা.কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে রসূল সা.সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করতে বুহরান পর্যন্ত পৌঁছলেন এবং জমাদিউল উলা পর্যন্ত সীমান্ত রক্ষার জন্য সামরিক শিবির স্থাপন করে রাখলেন। ওখান থেকেও তিনি কোন সংঘর্ষ ছাড়াই ফিরে এলেন। ৩য় হিজরীতে আবারো কোরায়েশদের একটা বানিজ্যিক কাফেলা বেরুলো। তাদের সম্ভাব্য গমন পথে সতর্কতামূলক সামরিক তৎপরতা চালানো হলো। যায়েদ বিন হারেসা জমাদিউস সানীতে একশো সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। কাফেলার পথপ্রদর্শক কুরাত বিন হাইয়ান গ্রেফতার হয়ে মুসলিম দলের অন্তর্ভুক্ত হলো। এক লাখ দিরহাম মূল্যের রৌপ্য কাফেলার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হলো।
এভাবে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ওহুদ যুদ্ধের দিকে গড়ালো।

দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ

মানবেতিহাসে যখনই দুটো ইতিবাচক ও নেতিবাচক আদর্শিক শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে এবং তাদের একটা মানবজাতিকে কল্যাণ ও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে ও অপরটা পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত বিধিব্যবস্থা বহাল রাখতে চায়,তখন এ ধরনের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ওহুদ যুদ্ধে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের যে সংঘর্ষ ঘটে,তাতেও এ ধরনেরই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। কোরায়েশরা বদর যুদ্ধে যে সব অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল,তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিটা ছিল তন্মধ্যে খুবই গুরুতর। আড়াই লাখ দিরহামেরও বেশী কেবল বন্দীদের মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল। তদুপরি কাফেলার লম্বা রাস্তা ঘুরে আসতেও ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল এবং মুনাফার পরিমাণ আগের চেয়েও কম হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু ভবিষ্যতের জন্য ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থায়ীভাবে হুমকীর সম্মুখীন হয়ে রইল। কোরায়েশের বাণিজ্যিক কাফেলার কাছ থেকে এক লাখ দিরহামের রৌপ্য মুসলমানরা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। ভারত ও ইউরোপের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যা কিছু চলাচল ও মালামাল পরিবহন হতো,তা ইয়েমেন ও মক্কার পথ ধরেই হতো এবং মক্কার কোরায়েশদের পথ ধরেই হতো। আর মক্কার কোরায়েশরা নিজেদের চুক্তিভিত্তিক আচরণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রহরা ট্যাক্স বসিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতো। তায়েফ ও অন্যান্য এলাকার বাণিজ্যিক আয়ের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র সিরিয়ার পথ দিয়ে কোরায়েশরা বাৎসরিক আড়াই লাখ আশরাফী আয় করতো। এবার মক্কার আকাশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মেঘ জমে উঠলো। এরূপ পরিস্থিতিতে বদরের প্রতিশোধের ইচ্ছাটা ভেতরে ভেতরে পেকে উঠতে লাগলো।
নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি খুব দ্রুতই শুরু হয়ে গেল। সিরীয় কাফেলার অর্জিত মুনাফা তার কাছ থেকে পুরোপুরি আদায় করে সামরিক তহবিলে জমা দেয়া হলো। আমর জামহী ও মুসাফে’র ন্যায় নামজাদা কবিরা তাদের কবি প্রতিভাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের আগুন উস্কে দিল। মক্কার মহিলারা তাদের হারানো ভাই ও ছেলের শোকে দিশেহারা হয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা করতে লাগলো। যেমন কেউ কেউ প্রতিজ্ঞা করলো পরবর্তী যুদ্ধে মুসলিম শহীদদের রক্তপান করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কার্যত কোরায়েশ বাহিনীর সাথে বড় বড় অভিযাত পরিবারের বিশিষ্ট মহিলারা রণাঙ্গনের দিকে যাত্রা করতে লাগলো। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলো হিন্দ(উতবার মেয়ে,আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমীর মোয়াবীয়ার মা), উম্মে হাকীম(আবু জেহেলের ছেলে ইকরামার স্ত্রী), ফাতেমা(হযরত খালেদের বোন), বারযা(তায়েফের নেতা মাসউদ সাকাফীর মেয়ে, রীতা(আমর ইবনুল আসের স্ত্রী, হান্নাস(হযরত মুসয়াব বিন উমাইরের মা) প্রমুখ।
কোরায়েশগণ নিজেদের স্বেচ্ছাসৈনিকদের প্রস্তুত করা ছাড়াও এবার আহাবীশদেরকেও সাথে নিতে ভুল করলোনা। তাছাড়া আমর ইবনুল আ’স,আব্দুল্লাহ ইবনুয্ যাবয়ারলী, হীরা ইবনে আবি ওহাব, মোসেফ বিন আবদে মানাফ এবং আমর বিন আব্দুল্লাহ জাহমীকে পাঠালো বিভিন্ন আরব গোত্রকে মদিনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এভাবে বিপুল শক্তি অর্জিত হয়ে গেল। সাতশো বর্মপরিহিত ও দু’শো অশ্বারোহী সৈনিকসহ তিন হাজার সৈন্যের বাহিনী নিজেই এক ত্রাস সৃষ্টিকারী ছিল। পুরো এক বছর ব্যাপী প্রস্তুতির পর এই বিশাল সামরিক বাহিনী মক্কা থেকে রওনা হলো। তারা মদিনার চারণভূমিতে পৌঁছে নির্দ্বিধায় নিজেদের পশুগুলোকে ঘাসপাতা খাইয়ে মোটা করলো এবং কয়েকদিন রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে বুধবারে ওহুদে গিয়ে শিবির স্থাপন করলো। রসূলের সা.চাচা হযরত আব্বাস আন্তরিকভাবে তাঁর অনুগত ও অনুরক্ত এবং ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। শত্রুদের অভ্যন্তরীণ অবস্থার ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি বিশেষ অনুমতিক্রমে মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে কোরায়েশদের এসব প্রস্তুতির খবর রসূল সা.কে জানালেন। তদুপরি রসূল সা.নিজস্ব বিশেষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৫ই শওয়াল জানতে পারলেন, কোরায়েশী বাহিনী মদিনার কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি এও জানতে পারলেন যে,আরীযের চারণক্ষেত্র তাদের পশুগুলো খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। উপরন্তু কোরায়েশ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ও তার শক্তি সামর্থ সম্পর্কে সঠিক ধারণা সংক্রান্ত রিপোর্টও তিনি পেয়ে গেলেন। মদিনায় রাতের বেলা প্রহরীর ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে করা হলো। সকাল বেলা তিনি সাহাবীদের পরামর্শ চাইলেন। অধিকাংশ মোহাজের ও আনসার নেতৃবর্গ শহরে বসেই মোকাবেলা করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি-এমন যুবকরা উৎসাহ উদ্দিপনার আতিশয্যে শহরের বাইরে যেয়ে যুদ্ধ করার জন্য অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করলো। রসূল সা.উভয় দৃষ্টিভংগী জানার পর বাড়ীতে চলে গেলেন এবং বর্ম পরিধান করে ফিরে এলেন। এ দ্বারা বুঝা গেল যে,তিনি মদিনার বাইরে যেয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তাবটাই গ্রহণ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও মদিনার ভেতরে বসে লড়াই করার পক্ষপাতী ছিল। সবাই এও জানতো যে,তার সাথে কোরায়েশদের যোগসাজশ রয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ওহুদ যুদ্ধের আগেই কোরায়েশ তার সাথে দহরম বহরম পাতিয়ে নিয়েছিল। রসূল সা.এ বিষয়টা জানতেন বলেই কোন আলোচনা না করেই দ্বিতীয় দৃষ্টিভংগীটা নীরবে মেনে নিলেন। শুক্রবার জুমুয়ার নামাযের পর তাঁর নেতৃত্বে এক হাজার মুসলমান সৈন্য রওনা হলো। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও সাথে গেল। তার প্রথম প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর সে একটা দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাব দিল যে,একটা স্বতন্ত্র যুদ্ধ ফ্রন্ট খোলা হোক। এ প্রস্তাবও যখন রসূল সা. প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন এই কুচক্রী হতাশ হয়ে পড়লো। সে শওত নামক স্থান থেকে তিনশো সৈন্য ভাগিয়ে নিয়ে ফিরে চলে গেল। তার অভিযোগ এই ছিল যে,আমাদের কথা যখন মানাই হয়না এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় যখন আমাদের কোন অংশই নেই,তখন আমরা কেন যুদ্ধ বিগ্রহ করবো। এই বিশ্বাসঘাতকতা মূলক কাজের প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়লো। উদাহরণ স্বরূপ,বনু সালমা ও বনু হারেসা গোত্র ভগ্ন মনে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু প্রাজ্ঞ মুসলিম নেতারা তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করলেন এবং তাদের মনোবল বাড়িয়ে দিলেন।
মদিনার বাইরে গিয়ে ময়দানে নামার আগে রসূল সা.সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। একাধিক কিশোরও জেহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে রওনা হলো। রসূল সা.তাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তবু এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য তাদের চেষ্টার অবধি ছিলনা। কিশোর রাফে বিন খাদীজ পায়ের পাতার সামনের অংশের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো,সে যুদ্ধ করার যোগ্য। আর অপর কিশোর সামুরা কুস্তিতে রাফেকে পরাজিত করে নিজের শক্তি প্রমাণ করলো। একটা নির্মল সততাপূর্ণ পরিবেশে লালিত পালিত হওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রাণোৎসর্গের মানসিকতা উঠতে পেরেছিল। মুসলিম নারীদের ওপর যদিও জেহাদ ফরয ছিলনা। কিন্তু আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত নাযুক পরিস্থিতি দেখে তাদের মধ্যেও স্বতস্ফূর্ত আবেগের জোয়ার সৃষ্টি হলো। অবশেষে হযরত আয়েশা রা., উম্মে সালীত(হযরত আবু সাঈদ খুদরীর মা), উম্মে সুলাইম(হযরত আনাসের মা)ও উম্মে আম্মারা সহ বেশ কয়েকজন মহিলা মুসলিম বাহিনীর সাথে রওনা হয়ে গেলেন। তারা রণাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। মুসলিম বাহিনীর মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল সাতশো। এদের মধ্যে একশো ছিল বর্মধারী। নিজেদের চেয়ে বারগুণ অধিক সংখ্যক সৈন্য ও সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছিল নিছক ঈমানী শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে।
রসূল সা.ওহুদ পাহাড়টাকে পেছনে রেখে রণাঙ্গনের অত্যন্ত চমৎকার নকশা তৈরী করলেন। মুসায়াব বিন উমাইয়ের হাতে দিলেন ইসলামী পতাকা। যুবাইর বিন আওয়ামকে একটা সেনাদলের সেনাপতি এবং হযরত হামযাকে বর্মহীন সৈন্যদের সেনাপতি নিয়োগ করা হলো। পেছন দিকে আইনাইন পাহাড় (জাবালে রুমাত)এর সুড়ংগে পঞ্চাশজন তীরান্দাজ সৈন্যকে নিযুক্ত করা হলো। এই সৈন্যদের নেতা বানানো হলো আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে। কোরায়েশরাও বদরের অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলমানদের অনুসৃত সুশৃংখল যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করলো। ডানদিকের যোদ্ধা দল (মাইমানা), বামদিকের যোদ্ধাদল (মাইছারা), অশ্বারোহী যোদ্ধা দল ও তীরান্দাজ যোদ্ধাদল প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সেনাপতির অধীনে সংঘবদ্ধ করা হলো।
যুদ্ধের সূচনা হিসাবে হিন্দার নেতৃত্বে চৌদ্দ জন কোরায়েশ মহিলা ঢোল বাজিয়ে সামরিক গান গাইতে আরম্ভ করলো। যুদ্ধের উদ্দীপনা সৃষ্টিতে এই গানের সুর কত জোরালো, তা নিম্নের কবিতা থেকেই আঁচ করা যায়ঃ
(আরবী******)
(আরবী******)
“তারকার কণ্যা মোরা,নিপুণ চলার ভংগি,সামনে যদি এগিয়ে যাও জড়িয়ে নেব বুকে,আর যদি হটে যাও পিছে,পৃথক হয়ে যাবো চিরদিনের তরে।” এক পক্ষে চলছিল এরূপ কবিসুলভ প্রণয়োদ্দীপক কামোদ্দীপক সরস সুড়সুড়ি,আর অপর পক্ষে আল্লাহর সন্তোষ কামনা ছাড়া আর ছিলনা কিছুই।
সহসা ময়দানে নামলো আবু আমের নামক ভন্ডপীর। আনসারগণ তার ভন্ডামী সম্পর্কে অবহিত ছিল। কোরায়েশদের জাহেলী,পৌত্তলিক ও চরম বিকারগ্রস্ত সংস্কৃতির সাথে তার সাদৃশ্য ছিল। তাকে দেখা মাত্রই মুসলমানরা বলে উঠলো,“ওহে পাপিষ্ঠ,তোকে আমরা চিনি!” মানবেতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল যে,এই আবু আমেরের ছেলে হযরত হানযালা নিজের পিতার ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য রসূল সা.এর কাছে অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রসূল সা. এর দয়া ও করুনা অনুমতি দিলনা। পুত্রের হাতে পিতা খুন হবে এটা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। এরপর তালহা হাক ডাক শুরু করলো। হযরত আলী তৎক্ষণাত এগিয়ে গিয়ে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। এরপর তার পুত্র উসমান নিজেদের বীরত্বের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে এগিয়ে এল। তার পেছনে একদল গায়িকা গান গাইছিল। হযরত আলীর তরবারী তাকেও এক নিমেষে খতম করে দিল। এরপর শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ।
মুসলমানদের গোটা বাহিনী নিজেদের সংখ্যা ও সাজ সরঞ্জামের ঘাটতি ঈমানী জযবা ও উদ্দীপনা দ্বারা পূরণ করেছিল। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা বাহকরা জাহেলিয়তের অন্ধকারের সাথে এভাবেই লড়াই করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে হযরত হামযা, হযরত আলী ও হযরত আবু দুজানার প্রানপন লড়াই ছিল সবচে দর্শনীয়। শেষ পর্যন্ত জাহেলিয়তের পুজারীদের পরাজয় ঘটলো এবং তাদের গায়িকারা পালিয়ে চলে গেল। মুসলিম বাহিনী বুঝতে পারলো, তারা বিজয়ী হয়েছে। তাই তারা শত্রুদের ভবিষ্যতের জন্য নিসম্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদপত্র ও অন্যান্য জিনিস দখল করা শুরু করলো। রণাঙ্গনের শৃংখলা ভেঙ্গে গেল এবং অরাজকতা ছড়িয়ে পড়লো। সৈন্যরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার প্রতি অমনযোগী হয়ে পড়লো। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, সর্বাধিক নাযুক পাহাড়ী সুড়ঙ্গটাকেও তীরন্দাজরা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। অথচ তাদেরকে কড়াকড়ি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, জয় বা পরাজয় যাই ঘটুক, তোমরা কোন অবস্থায় এই জায়গা থেকে সরবেনা। রসূল সা. এর ভাষা ছিল এ রকমঃ ‘তোমরা যদি দেখতে পাও, পাপীরা আমাদের দেহের গোশ্‌ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তবুও তোমরা এখান থেকে নড়বেনা।’
কিন্তু মুসলমানরা এ সব নির্দেশ ভুলে গিয়ে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এ ব্যস্ততার অত্যন্ত ভয়ংকর ফলাফল তাদেরকে ভোগ করতে হলো। তাদের অর্জিত বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো। কোরায়েশ বাহিনীতে তখনো খালিদ বিন ওলীদের ন্যায় বিচক্ষণ ও দুর্ধর্ষ বীর ছিল। সে দূর থেকে রণাঙ্গনের এলোমেলো পরিবেশ দেখতে পেয়ে কয়েকজন অশ্বারোহীকে নিয়ে পাহাড়ের পিছন থেকে সেই প্রহরীহীন পাহাড়ী সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বসলো। তারপর কোরায়েশ বাহিনীর আরো যোদ্ধা আক্রমণে শরীক হলো। বিজয়ের আনন্দের ভেতর থেকে সহসা মাথার ওপর তরবারী দেখে মুসলমানদের টনক নড়লো। ওদিকে শত্রুরা স্বয়ং রসূল সা. এর আক্রমণ করার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলো। তিনি দৌড়ে দৌড়ে মুসলমানদের ডাকতে লাগলেনঃ ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা! আমার কাছে এসো।’ কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। এক সময় তাঁর চার পাশে মাত্র এগারজন সাহাবী রয়ে গেল। সুযোগ বুঝে আব্দুল্লাহ বিন কুমাইয়া তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। এতে তাঁর শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে কয়েকটা টুকরো চোয়ালের ভিতর ঢুকে গেল। আর একবার শত্রুদের আক্রমণে তিনি গর্তের মধ্যে পড়ে যান এবং কিছু আঘাতও পান। মুষ্টিমেয় ক’জন সাথী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতার প্রাণ বাঁচাতে যেরূপ বেপরোয়াভাবে লড়াই করলেন, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। এহেন প্রলয়ংকরি সংঘর্ষে রসূল সা. এর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, বরং চৌকসভাবে আত্মরক্ষা করা এবং উবাই ইবনে খালফের ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আহত করা অসাধারণ বীরত্বের নিদর্শন। তবু এ সময় রসূল সা. এর আহত হওয়া গর্তে পড়ে গিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া এবং তাঁর সাথে চেহারায় সাদৃশ্য সম্পন্ন সাহাবী জুময়ার ইবনে উমাইরের শহীদ হওয়ার কারণে বিরোধীরা রসূল সা. এর মৃত্যুর গুজব রটানোর সুযোগ পেয়ে যায়। এতে মুসলমানদের মধ্যে অধিকতর অস্থিরতা ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবের দু’ধরনের ফল ফললো। হযরত ওমর রা. অস্ত্র ফেলে দিয়ে বললেন, রসূল সা. যখন শহীদ হয়ে গেছেন, তখন আর যুদ্ধ করে কী হবে? রসূল সা. এর ভালোবাসা তাঁর মধ্যে এতোটাই প্রবল ছিল যে, তাঁর দৃষ্টিতে তাঁর মত অমূল্য রত্ন হারানোর পর যত বড় বিজয়ই অর্জিত হোক, তা আর বিজয় মনে হয়না। হযরত আনাস আনসারীর বাবা ইবনে নযর তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘রসূল সা.-এর পর আমরা বেঁচে থেকে কী করবো?’ তারপর এমন প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করলেন যে, প্রায় ৮০টা আঘাত খেয়ে শহীদ হলেন। এই বিশৃংখল অবস্থার কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ স্বপক্ষীয় ভাইদের হাতেও হতাহত হয়েছেন। হযরত হুযায়ফার পিতা মুসলমানদের হাতেই শহীদ হয়ে যান।
এরপর পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগলো। প্রত্যেক মুসলিম সৈনিক নিজ নিজ স্থানে তরবারী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং রসূল সা. কে দেখার জন্য ব্যাকূল ছিল। সর্বপ্রথম হযরত কা’ব ইবনে মালেক রসূল সা. কে দেখতে পান। তিনি সবাইকে ডেকে রসূল সা. এর জীবিত থাকার খবর জানিয়ে দেন। এই সুখবর যখন সবার কাছে গেল, তখন সবাই কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। শত্রুর ভীড় কমলে রসূল সা. পাহাড়ের চূড়ায় চলে গেলেন। আবু সুফিয়ান সেদিকে অগ্রসর হলে সাহাবীগণ পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হটিয়ে দিলেন। এবার শত্রুরা শংকিত হলো, অতর্কিতভাবে যে বিজয় তারা অর্জন করেছে, তা আবার হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই মক্কার বাহিনী দ্রুত সঠকে পড়তে লাগলো।
আবু সুফিয়ান পার্শ্ববর্তী একটা পাহাড়ে আরোহণ করে রসূল সা. সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য সংগ্রহ করতে চেষ্টা করলো। সে উচ্চস্বরে রসূল সা., আবু বকর ও ওমরের নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, এরা কেউ জীবিত আছে নাকি?
এদিক থেকে কোন জবাব দেয়া হলো না কৌশলগত কারণে। তখন সে বলে উঠলো, “সবাই মরেছে।”
হযরত ওমর রা. আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, “ওরে আল্লাহর শত্রু। আমরা সবাই জীবিত।” আবু সুফিয়ান শ্লোগান দিলঃ
“হুবাল, তুমি শির উঁচু করে থাকো।”
এদিক থেকে পাল্টা শ্লোগান দেয়া হলোঃ
“আল্লাহই চির পরাক্রান্ত, সর্ব শ্রেষ্ঠ!”
আবু সুফিয়ান আবার হাঁক দিলঃ
“আমাদের সাথে উয্‌যা আছে। তোমাদের উয্‌যা নেই”
এদিক থেকে জবাব দেয়া হলোঃ
“আল্লাহ আমাদের মনিব, তোমাদের কোন মনিব নেই।”
আসলে এই ছোটখাটো শ্লোগানগুলোর মধ্য দিয়ে সেই দুটো মতবাদ সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, যে দুটো মতবাদের টক্করে ইতিহাসের এত বড় তাণ্ডব সৃষ্টি হয়েছিল। এই যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ এবং ৪০ জন আহত হন। অপরদিকে শত্রু বাহিনীর মাত্র ৩০ ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্ভব হয়। রসূল সা. এর চাচা হযরত হামযার ন্যায় বীর সেনানী, তাঁর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ, নামকরা সাহাবীদের মধ্যে মুসয়াব ইবনে উমাইর, হানযালা ইবনে আবি আমের, রাফে বিন মালেক বিন আজলান (শেষোক্ত তিনজনই আকাবার উভয় বায়য়াতে শরীক ছিলেন) আব্দুল্লাহ বিন আমর খাযরাজী, আমর বিন জামূহ এবং সংখ্যক বদরযোদ্ধা সাহাবী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সত্যের বৃক্ষকে নিজেদের রক্ত সিঞ্চন করে গেলেন।
অবশেষে যখনই মুসলিম বাহিনী নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, এবং হাই কমান্ডের সাথে তাদের যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত হলো, তখন শত্রুসেনারা দ্রুত পিছু হটে রণাঙ্গন থেকে চলে গেল। এভাবে আকস্মিক বিজয়ের আড়ালে লুকানো দুর্বলতার মুখোস খুলে গেল এবং মুসলিম বাহিনী আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।
মুসলমানরা নিজেদের একটা পদস্খলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু তারা পরাজিত হয়নি, তাদের শক্তিও ভেঙ্গে পড়েনি। তাই রসূল সা. এর নির্দেশে ৭০ জন মোজাহেদের এক বাহিনী কোরায়েশী বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো। ওদিকে আবু সুফিয়ান রওহাতে পৌঁছে যখন পরিস্থিতি পর্‍্যবেক্ষণ করলো, তখন সে ভীষণ অনুতপ্ত হলো। সে বুঝলো যে, ওহুদে অর্জিত বিজয়ের সুফল সে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ময়দানেই ফেলে এসেছে। মদিনার শক্তি ধ্বংস করার লক্ষ্যটা তাদের অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। এখন সে হারানো লক্ষ্য পুনরুদ্ধারের কথা ভাবতে লাগলো। কিন্তু গুড়ে বালি! এখন তো সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। যাকে বলে চোর চলে যাওয়ার পর মাথায় বুদ্ধি আসার মত অবস্থা! রসূল সা. আগেই এ আশংকা পোষণ করেছিলেন। তিনি মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁর সমগ্র বাহিনীকে সাথে নিয়ে মদিনা থেকে ৮ মাইল দূরে হামরাউল আসাদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন। ইতিমধ্যে খুযায়া গোত্রের (যারা ইসলাম গ্রহণ না করলেও ইসলামী সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল) নেতা মা’বাদ স্বয়ং গিয়ে আবু সুফিয়ানকে ভয় দেখালো “মুহাম্মাদ সা. এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছে।” এ খবর শুনে আবু সুফিয়ান আতংকগ্রস্ত হয়ে দ্রুত চলে গেলো।

ওহুদ যুদ্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক

এক্ষণে আমরা এই যুদ্ধের বিশেষ বিশেষ লক্ষণীয় দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি দেবঃ
(১) শৃংখলা যে কোন আন্দোলনের আসল শক্তি। সব ধরনের যুদ্ধ ও সংঘাতে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ও মৌলিক। শৃংখলার ভিত্তি যে নৈতিক গুণটার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁর নাম ধৈর্য। অর্থাৎ ভয়ভীতি ও লাভ লোকসানের পরোয়া না করে স্থির ও অবিচল থাকা যায়। ইসলামী সংগঠন এ সময় প্রশিক্ষণাধীন ছিল এবং বিশেষত রণাঙ্গনের ইসলামী চরিত্রের মজবুত করার জন্য এখনো ব্যাপকতর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি। কেননা ওহুদের আগে মাত্র একটা যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছিল। কোন মানবীয় সংগঠন কোন আদর্শের ভিত্তিতে নতুন সমাজ গড়ে তোলার সময় পদস্খলন থেকে একেবারে মুক্ত থেকে পূর্ণ সাফল্য ও পরিপক্কতা লাভ করতে পারেনা। কিন্তু এই সামান্য একটা পদস্খলনের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের এমন একটা বাস্তব শিক্ষা দিয়ে দিলেন, যা কেবল উপদেশের মাধ্যমে বদ্ধমূল করা যায় না। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে এ কথাটাও স্পষ্ট করে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালার প্রাকৃতিক আইন একেবারেই নিরপেক্ষভাবে ও বেপরোয়াভাবে কাজ করে থাকে। এ আইন ভংগ করলে নিতান্ত সৎ লোকও শাস্তি থেকে রেহাই পায় না।
এই যুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে কোরআন মুসলমানদের মধ্যে তখনো বিদ্যমান ভুলত্রুটি ও দুর্বলতার কঠোর সমালোচনা করে। তাদেরকে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দেয়। (আল ইমরান-১২৫) ধন-সম্পদের যে বাছবিচারহীন লালসা সুদী লেনদেনের প্ররোচনা দিয়ে থাকে এবং যুদ্ধের ময়দানে গনীমত লাভের জন্য অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে, সেই লোভ লালসা পরিহার করার নির্দেশ দেয়। তাদেরকে পরোক্ষভাবে বুঝায় যে, সুদখোরী ও লোভাতুর মানসিকতা নিয়ে ধৈর্য ধারণ, শৃংখলা রক্ষা ও কোন উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐতিহাসিক লড়াই করা যায় না। এই মানসিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে সুদ সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়। (আল ইমরানঃ ১৩০) তাদেরকে বলা হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের ঝাণ্ডা তারাই বহন করতে পারে, যারা সুদ ও ধন সম্পদের মোহে অন্ধ না হয়ে বরঞ্চ ধন সম্পদ মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং ভাবাবেগে প্রবাহিত না হয়ে ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। (আল ইমরান- ১৩৪) এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী স্বার্থ অর্জনের জন্য কাজ করবে, সে দুনিয়ায় যা কিছু পাবে, তা-ই হবে তার চূড়ান্ত প্রাপ্তি। আখেরাতে তার কিছুই প্রাপ্য থাকবেনা। আর যে ব্যক্তি নিজের পার্থিব স্বার্থের ক্ষতি করে আখেরাতের কল্যাণ করতে চাইবে, তার কাজের উপযুক্ত মূল্য দেয়া হবে। (আল ইমরান-১৪৫) তাদেরকে এ কথাও বুঝানো হয় যে, একটা আঘাত খেয়েই তোমরা মর্মাহত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে থেকনা। আজ যদি তোমরা আঘাত খেয়ে থাক, তবে কাল শত্রুরাও তোমাদের হাতে আঘাত খেয়েছে। যে কোন সংঘাত সংঘর্ষে চড়াই-উৎরাই বা জয় পরাজয় তো থাকবেই। কিন্তু নিশ্চিত থাকো যে, চূড়ান্ত বিজয় তোমাদেরই হবে। (আল ইমরান, ১৩৯-১৪০) এরপর তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সতর্ক করা হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত কোন সস্তা পণ্য নয়। এ সৌভাগ্য কেবল তারাই লাভ করতে পারে, যারা আল্লাহর পথে জান ও মাল উৎসর্গ করতে পারে এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারে। ছাঁটাই বাছাই করে সাচ্চা ঈমানদার ও সত্যের সাক্ষ্য দানের যোগ্য লোক নির্ধারণ কেবল এই সব কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। (আল ইমরান, ১৪০-৪২) (ওহুদের ময়দানে রসূল সা. এর শাহাদাতের গুজবের ফলে সৃষ্ট) চরম হতাশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ নন, তিনি একজন রসূল মাত্র। অতীতের নবী রসূলগণ যেমন মারা গেছেন, তেমনি মুহাম্মাদকেও সা. একদিন না একদিন তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতেই হবেই। সুতরাং তাঁর তীরোধানে তোমরা ইসলামী আন্দোলন সংগ্রামের সমস্ত কর্মসূচী সিঁকেয় তুলে রাখবে এবং হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে-এটা কিভাবে বৈধ হতে পারে। (আল ইমরানঃ ১৪৪) বস্তুত রসূল সা. এর প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসার কারণেই অমন হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। আরো বলা হয়েছে যে, পূর্বতন নবীগণের সাথে জেহাদ করে যারা জীবন উৎসর্গ করেছে এবং বাতিলের সামনে মাথা নোয়াতে প্রস্তুত হয়নি, তাদের আদর্শের অনুসারী হয়ে তোমাদের গড়ে ওঠা উচিত। কেননা আল্লাহ ঐ ধরনের ধৈর্যশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (আল ইমরানঃ ১৪৬) এই মৌলিক শিক্ষাগুলো দেয়ার পর মুসলিম বাহিনীকে শৃংখলা ভংগ করার কারণে যে মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল, কোরআন তার ছবি তুলে ধরেছেঃ
“আল্লাহ সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি তোমাদের দিয়েছিলেন, তা তিনি পূর্ণ করেছেন। প্রথমে আল্লাহর হুকুমে তোমরাই তাদের হত্যা করছিলে। কিন্তু পরে যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং পরস্পর দ্বিমত পোষণ করলে, তখন আল্লাহ তোমাদের লোভনীয় জিনিস তোমাদের দেখানো মাত্রই তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে। কেননা তোমাদের কিছু লোক দুনিয়ার জন্য লালায়িত ছিল এবং কিছু লোক আখেরাতের অভিলাষী ছিল। তখন আল্লাহ তোমাদেরকে কাফেরদের মোকাবিলায় পিছু হটিয়ে দিলেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। তারপরও আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন। কেননা মোমেনদের ওপর আল্লাহ খুবই অনুকম্পাশীল।
স্মরণ কর, যখন তোমরা পালিয়ে যাচ্ছিলে, কারো দিকে ফিরে তাকানোর হুঁশ পর্যন্ত তোমাদের ছিল না এবং রসূল সা. পেছন থেকে তোমাদের ডাকছিল। তখন আল্লাহ তোমাদের এই কাজের প্রতিফল এভাবে দিলেন যে, তোমাদেরকে দুঃখের পর দুঃখ দিলেন, যাতে ভবিষ্যতের জন্য তোমরা শিক্ষা পাও এবং তোমরা যা হারাও বা তোমাদের ওপর যা কিছু বিপদ আসে, তাতে তোমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হও। আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।” (আল ইমরানঃ ১৫২-১৫৩)
রসূল সা. এর মুখ দিয়ে ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তৎপরতা ও ভূমিকা সম্পর্কে কৃত এই সমালোচনা ও পর্যালোচনা লক্ষ্য করুন এবং ভাবুন যে, দুনিয়ার সাম্রাজ্য লোলুপ সমরনায়ক শাসকদের থেকে এ সমালোচনার প্রকৃতি ও মেযাজ কত পৃথক। এতে না দেয়া হয়েছে সৈনিকদেরকে যা হচ্ছে তা করার অবাধ অনুমতি, না করা হয়েছে তাদেরকে আত্ম প্রবঞ্চনায় নিক্ষেপ করার চেষ্টা, এবং না করা হয়েছে ঘটনাবলীর ভুল ব্যাখ্যা করার কোন কসরত। এ ছিল একটা বেপরোয়া কঠোর সমালোচনা। আলাহর ভয় ছিল এ সমালোচনার মূলমন্ত্র এবং নৈতিক প্রশিক্ষণই ছিল এর উদ্দেশ্য।
(২) এই যুদ্ধে রসূল সা. এর মুষ্টিমেয় সংখ্যক সহচর যেরূপ জীবন বাজি রাখা ভালোবাসা ও আন্তরিক ত্যাগী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তা মুসলিম উম্মাহকে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পথে জানমাল কুরবানী করার পবিত্র প্রেরণা জোগাতে থাকবে। আসলে যে কোন আন্দোলনই হোক না কেন, তার প্রথম আহবায়ক ও সর্বোচ্চ নেতার ব্যক্তিত্ব তার প্রধান শক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনে আহবায়ক ও নেতার জন্য গভীর ভালোবাসার দাবী করা হয়েছে। বিশেষত এই পদে যখন নবী ও রসূলের ব্যক্তিত্ব বিরাজমান থাকে, তখন তার জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ আত্মোৎসর্গের মনোভাব অত্যন্ত জরুরী। ইসলামী আন্দোলন কোন অবস্থায়ই তার আহবায়ক ও নেতাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেনা। আন্দোলন ও তার আহবায়ক-উভয়ের শক্তি, পরাক্রম ও প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। যে দল নিজের আহবায়ক ও নেতাকে উপেক্ষা করে, তাকে প্রভাবহীন করে অথবা নিছক “আমাদের একজন” আখ্যায়িত করে শুধুমাত্র আন্দোলনের নীতিমালাকে বিজয়ী করে নিয়ে যেতে চায়, সে দল একেবারেই একটা অন্ধ ও অবিবেচক দল। আন্দোলনের জন্য নীতি ও নেতৃত্ব উভয়ই অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য উপাদান। নীতি ও আদর্শের উপর অটুট ঈমান ও প্রত্যয় আর নেতার জন্য গভীর ভালোবাসা ও আত্মোৎসর্গের মনোভাব একে অপরের উপর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। রসূল সা. এর সাহাবীগণ তাঁর সত্তা ও ব্যক্তিত্বের উপর জানমাল ও যথাসম্ভব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতেন। এর প্রথম কারণ, তিনি রসূল সা.। আর দ্বিতীয় কারণ, তারা জানতেন ও বুঝতেন যে, তাঁর অস্তিত্ব গোটা আন্দোলনের প্রাণ। এ জন্য তাঁর প্রাণ রক্ষা, তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির প্রসার ঘটানোর জন্য তাঁরা জীবন উৎসর্গ করতেন। ওহুদ রণাঙ্গনে তাঁরা রসূল সা. এর নির্ভেজাল ও একনিষ্ট ভালোবাসার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন।
শত্রুরা যখন দলে দলে হানা দিতে লাগল, তখন রসূল সা. উচ্চস্বরে বললেন, “আমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কে প্রস্তুত আছে?” যিয়াদ বিন সাকান এ আওয়াজ শুনে কয়েকজন আনসারকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন এবং একে একে সাতজন রসূল প্রেমিক প্রাণোৎসর্গ করলেন। যিয়াদকে মুমূর্ষু অবস্থায় রসূল সা. এর কাছে আনা হলে তিনি অতি কষ্টে মাথা বাড়িয়ে রসূল সা. এর পা স্পর্শ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন কুমাইয়া যখন তরবারি দিয়ে রসূল সা. কে আঘাত করলো, তখন মহিলা সাহাবী উম্মে আম্মারা এক লাফ দিয়ে রসূলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন এবং নিজের ঘাড়ে গভীর জখম নিলেন। তিনি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানোর কারণেই এই আঘাত রসূল সা. কে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবু দুজানা, রসূল সা. কে নিজের শরীর দিয়ে ঢালের মত ঢেকে ফেলেন। তাঁর শরীরে অসংখ্য তীর এসে বিদ্ধ হয়। তালহা শত্রুর তরবারি হাত দিয়ে ঠেকান। তাঁর এক হাত কেটে নিচে পড়ে যায়। আবু তালহা, রসূল সা. এর সামনে ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং এত জোরে তা দিয়ে আঘাত করেন যে, দুতিনটে ধনুক ভেঙ্গে যায়। একজন সহজ সরল মুসলমান খেজুর খেতে খেতে ঘটনাক্রমে এসে পড়ে। এ অবস্থা দেখে তার মধ্যেও লড়াইয়ের আবেগ সৃষ্টি হয়। সে রসূল সা. কে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি লড়াই করে মারা যাই, তাহলে আমার পরিণাম কি হবে?” রসূল সা. বললেন, “জান্নাত”। সে বললো, “তাহলে এই খেজুর খেতে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” এই বলে খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুমুলভাবে যুদ্ধ শুরু করে দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদী কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। যে আন্দোলনে নেতার প্রতি এমন তীব্র ভালোবাসা সক্রিয় থাকে, সে আন্দোলনকে স্তদ্ধ করে এমন শক্তি কারো নেই। সা’দ বিন রবীও একটা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রসূল সা. যেহেতু নিজেও তাঁর সাথীদের প্রতি গভীর স্নেহ পোষণ করতেন, এবং প্রত্যেকের উপর তাঁর মনোযোগ ও দৃষ্টি থাকত, এ জন্য যুদ্ধ শেষে এক এক করে প্রত্যেকের অবস্থা জানতে চাইলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “সা’দ বিন রবী কোথায়?” খোঁজ নেয়া হলে দেখা গেল, তিনি একদিকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে কাঁতরাচ্ছেন। শেষ মুহূর্তে রসূল সা. এর জন্য সালাম, মহব্বত ও দোয়ার হাদিয়া পেশ করলেন এবং সাথীদেরকে অসিয়াত করলেন যে, “তোমরা সবাই বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রসূল সা. কে স্পর্শ করারও সুযোগ পায়, তবে আল্লাহর কাছে তোমাদের কোন ওজর আপত্তি গ্রাহ্য হবেনা।” নিজের ব্যথা বেদনার দিকে লক্ষ্য নেই, প্রিয়জনদের কথাও খেয়াল নেই, নিজের ধন-সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাভাবনা নেই, সমস্ত চিন্তাভাবনা শুধু ইসলামী আন্দোলন ও তার আহবায়ককে নিয়ে।
(৩) মক্কার ইসলাম বিরোধী বাহিনী তাদের ঘৃণ্য মানসিকতা প্রকাশার্থে মুসলিম শহীদদের লাশগুলোর অবমাননা করল। বিশেষত তাদের মহিলারা তাদের মান্নত পূরণ করার জন্য লাশগুলোর পেট চিরলো ও তাদের নাক, কান কেটে মালা বানিয়ে গলায় পরলো। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মহিলা বাহিনীর সর্দারনী হিন্দা হিংস্রতার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। সে হযরত হামজার মুখমন্ডল বিকৃত করল এবং বুক চিরে কলজে বের করে চিবালো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশেরও মুখমন্ডল বিকৃত করা হলো। স্বয়ং আবু সুফিয়ান ধনুক দিয়ে হযরত হামজার মুখে আঘাত করতে লাগলো আর বলতে লাগলো, “নাও এখন মজা উপভোগ কর।” অপর দিকে রসূল সা. মুসলিম বাহিনীকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন যে, শত্রুদের লাশের অবমাননা ও মুখমন্ডল বিকৃত করোনা। ইসলামী আন্দোলনের মূলনীতিতে মানবতার মর্যাদা সমুন্নত রাখার শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইসলাম তার অনুসারীদের এ অনুমতি দেয় না যে, অন্য কেউ ইতরসুলভ আচরণ করলে জবাবে সেও তা করতে পারবে।
আবু সুফিয়ান যখন তার লোকদের এসব তৎপরতার কথা শুনলো তখন সানন্দে এগুলোকে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু তার এক সঙ্গী এর সমালোচনা করায় তার টনক নড়লো। সে ভাবলো, এসব কাজ করতে গিয়ে কোথাও ইটের বদলে পাটকেল না খেতে হয় এবং জনমতের কাছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে না যায়। আবু সুফিয়ান যখন যুদ্ধের শেষে পাহাড়ের উপর এল, তখন এই অনুভূতির কারণেই সে বলল যে, “এসব ঘটনা আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘটানো হয়নি। তবে আমি এগুলোতে ব্যথিতও নই।”
আজ এটা অনুমান করা সহজ নয় যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির এই পাশবিক আচরণ জনমনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল কিনা। তবে একটা ঘটনা জানা যায় যে, শাহাদাতপ্রাপ্ত হযরত হামজার লাশের মুখমন্ডলে আবু সুফিয়ানকে ধনুক দিয়ে আঘাত করতে দেখে জালীস বিন যুবান কিনানী নামক জনৈক মুশরিক নিজ গোত্রের লোকদের বলেছিল, “ওহে বনী কেনানা, কুরায়েশের বড় সর্দার নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে কী আচরণ করছে দেখছ?” এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান সচেতন হয়।
(৪) রসূল সা. মুসলমানদেরকে রণাঙ্গনের যে মার্জিত ও সুসভ্য আচরণ পদ্ধতি শেখাচ্ছিলেন, তার একটা ঝলক আবু দু’জানার ঘটনায় লক্ষ্য করা যায়। আবু দু’জানা যখন শত্রু সেনাদের কাতারের পর কাতার লন্ডভন্ড করে সামনে এগুতে থাকেন, তখন হামজার কলজে চিবানো হিন্দ তাঁর সামনে পড়ে যায়। হিন্দ যুদ্ধে শরীক ছিল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার আবেগ ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। তাই তাকে হত্যা করা দোষের কাজ হতোনা। আবু দু’জানাও তার মাথা তাক করে তরবারি উঁচু করেছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাত তিনি এই ভেবে সচকিত হয়ে তরবারি নামিয়ে ফেললেন যে, রসূল সা. এর দেয়া তরবারি দিয়ে কোন নারীর প্রাণ সংহার করা সমীচীন নয়।
(৫) মুসলিম নারীরা ওহুদ যুদ্ধের সময় যেভাবে ঈমানদারী, বীরত্ব, ধৈর্য ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন, তা থেকে বুঝা যায়, রসূল সা. পরিচালিত আন্দোলন নারীদেরকে নিষ্ক্রিয় রাখেনি, বরং তাদেরকে সক্রিয় করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দেখুন।
উম্মে আম্মারার কথা আমরা কিছু আগেই আলোচনা করেছি যে, একজন মহিলা হয়েও তিনি কিভাবে রসূল (সা.) এর জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
হযরত হামজার বোন সাফিয়া মর্মবিদারী ঘটনাবলী শুনে যখন মদিনা থেকে ওহুদের রণাঙ্গনে এসে পৌঁছলেন, তখন রসূল সা. হামজার ছেলে যুবায়েরকে বললেন, ওকে তোমার আব্বার লাশের কাছে যেতে দিও না। কেননা সে ঐ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারবেনা। সাফিয়া বললেন, “আমি সব কিছু শুনেছি। সত্য ও ন্যায়ের পথে এ ত্যাগ বড় কিছু নয়।” তাঁকে অনুমতি দেয়া হল। সাফিয়া অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লাশ দেখলেন, মাগফেরাতের দোয়া করলেন এবং চলে আসলেন।
আমর বিন যামূহের স্ত্রী ও খাল্লাদ বদরীর মা হিন্দ আনসারীর জন্য এটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। তাঁর বাবা ও স্বামী দুজনই শাহাদাৎ বরণ করেন। কিন্তু তিনি এ সমস্ত আঘাতকে অতি কষ্টে সামলে নিয়ে বারবার কেবল এই কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন যে, “আল্লাহ্‌র রসূল সা. নিরাপদে আছেন ত?” যখন নিশ্চিত হলেন যে, তিনি ভালো আছেন, তখন বেএখতিয়ার বলে উঠলেন, “হে রসূল, আপনি সুস্থ ও নিরাপদ থাকলে আর কোন মুসিবতই অসহনীয় নয়।”
হয়রত আয়েশা, উম্মে সুলায়েম ও উম্মে সলীতের ন্যায় সম্ভ্রান্ত পর্দানশীন মহিলারাও দুর্যোগকালে দৌঁড়ে দৌঁড়ে মসক ভরে পানি এনে আহত সৈনিকদের পান করিয়েছিলেন। মুসলমানদের বিপর্যয় ও রসূল সা. এর শাহাদাতের ভুল খবর শুনে হযরত ফাতেমাও ওহুদে হাজির হয়েছিলেন। তিনি রসূল সা. এর ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে দেন এবং পট্টি বেঁধে দেন।
(৬) মানবতার বন্ধু রসূল সা. যখন নিজের তরবারি আবু দুজানাকে দিয়েছিলেন, তখন আবু দুজানা মাথায় লাল রুমাল বেঁধে তরবারি দুলিয়ে হেলে দুলে চলতে চলতে শত্রুর কাতারের দিকে অগ্রসর হলেন। এ দৃশ্য দেখে রসূল সা. বললেন, “এ ধরণের চালচলন আল্লাহ্‌র খুবই অপছন্দ। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে তিনি এটা পছন্দ করেন।” এভাবে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুঝিয়ে দিলেন। জীবনের সাধারণ কর্মকান্ডে কোনভাবেই অহংকার প্রদর্শন করা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই অনভিপ্রেত। কিন্তু শত্রুদের সাথে সংঘর্ষ চলার সময় অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। বিনয় খুবই ভালো জিনিস। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানেও একটা উত্তম নৈতিক বিধির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুর সামনে বিনয় প্রকাশ করা অত্যন্ত নির্বোধ সুলভ কাজ। যে নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ধর্মীয় মানসিকতা সততাপ্রীতির নামে কিছু কিছু নৈতিক মূল্যবোধকে বেখাপ্পাভাবে বিপরীত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। রসূল সা. এই একটি বাক্য দ্বারা সেই মানসিকতার বিলুপ্তি ঘটালেন। শুধু রণাঙ্গনেই নয় বরং তৎকালের অন্যতম রাজনৈতিক প্রচারমাধ্যম রূপে বিবেচিত হত কবিতা ও বাগ্মীতা। তিনি মুসলিম কবি ও বাগ্মীদের দিয়ে গর্ব ও অহংকার প্রকাশ করাতেন। অনুরূপভাবে উমরাতুল কাযার সময়ও রসূল সা. সাহাবাদেরকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে শক্তি প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন আর সাফা ও মারওয়ায় দৌঁড়ানোর সময় বুক টান করে পা উঠানো এবং হেঁটে চলার পর দৌঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে এটাই একটা সুন্নত তথা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এ সময় তিনি এ মর্মে দোয়া করেন, যে ব্যক্তি আজ কাফেরদের সামনে শক্তি প্রকাশ করবে, আল্লাহ্‌ তার প্রতি অনুগ্রহ করুন। বস্তুত সংঘাত-সংঘর্ষের যেকোন পর্যায়ে বিনয় প্রকাশ ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যে ব্যক্তি নৈতিক মূল্যবোধ ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ স্থান, কাল ও পাত্রের পার্থক্য বুঝে করতে পারেনা, সে এক ধরণের পাগলামিতে আক্রান্ত। এ ধরণের পাগলামি দিয়ে আর যাই চলুক, ইসলামী আন্দোলন চলতে পারেনা।
(৭) সততা ও সত্যনিষ্ঠতা এমন শক্তি, যা মানুষকে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করে। মদিনায় ওমর বিন সামেত নামে একজন সৎ যুবক বাস করত। মুসলমানদের সাথে তার আচরণ ছিল সমর্থন ও সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু সে তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। ওহুদের যুদ্ধ তার সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুললো। সে ঈমান আনলো এবং কাউকে কিছু না বলে তরবারি নিয়ে যুদ্ধে শরীক হল ও শাহাদাৎ লাভ করলো। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে বনু আব্দুল আশহাল গোত্রের লোকেরা তাকে সনাক্ত করল। তারা ওর খবরাদি জানতে চাইলে সে বললো!, “আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের প্রেমে সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে লড়াই করছি।” রসূল সা. সুসংবাদ দিলেন, জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও সে জান্নাতবাসী হবে। আরেকটা উদাহরণ বনু সা’লাবা নামক ইহুদী গোত্রের সদস্য মুখাইরীকের। সে সত্যিকার ইহুদী ধর্মের অনুসরণ করতে গিয়ে রসূল সা. এর পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। শুধু নিজে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত থাকলোনা, অন্যান্য ইহুদীদেরকেও যুদ্ধ করার আহবান জানাল। তার স্বগোত্রীয় ইহুদীরা ধর্মীয় ওজর পেশ করলো যে, আজ ত শনিবার যুদ্ধে যাওয়া অবৈধ। কিন্তু মুখাইরীক বলল, আজ কোন শনিবার নেই। অবশেষে সে একাই রণাঙ্গনে পৌঁছল, যুদ্ধ করল ও জীবন উৎসর্গ করলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের আরেকটা উদাহরণ কিযমানের। রসূল সা. তার দোজখবাসী হবার আগাম খবর দিয়েছিলেন। সে মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। যুদ্ধ শেষে তাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে লোকের তার প্রশংসা করলো যে, তুমি তো অসাধারণ শৌর্যবীর্য দেখালে। সে বললো, আমি তো কেবল আমাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষার্থে লড়েছি। হতভাগা সৈনিকটা ক্ষতস্থানের ব্যথা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। আল্লাহ্‌ তাকে দিয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করালেন, আবার সে নিহতও হল এবং তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। আল্লাহ্‌ এমন শোচনীয় পরিণতি থেকে মুমিনদের রক্ষা করুন।
(৮) আমরা আগেই ইঙ্গিত করেছি যে, এই সময় জাহেলিয়াতের নেতিবাচক শক্তি ভীষণ দম্ভে বিভোর ছিল এবং কুফরি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার উদ্দীপনায় অতিমাত্রায় উজ্জীবিত ছিল। কোরায়েশের পতাকা উত্তোলনকারীরা যদিও এক একে নিহত হল এবং কেউ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা, কিন্তু নতুন লোকেরা সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের স্থানগ্রহণ করতে লাগল। অবশেষে যখন সাওয়ার নামক এক ব্যক্তি ঝান্ডা তুললো, তখন এমন একটা তরবারির আঘাত খেল যে, তাতে তার দু’খানা হাতই কেটে পড়ে গেল। ঝান্ডা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সে ঝান্ডার উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল এবং “আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি” বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কিছুক্ষণ ঝান্ডা মাটিতেই পড়ে রইল। অবশেষে উমরা বিনতে আলাকামা নাম্নী জনৈক মহিলা বীরোচিতভাবে সামনে অগ্রসর হয়ে ঝান্ডা তুলে নিল। এ থেকে বুঝা যায়, ইতিবাচক বিপ্লবী শক্তির আবির্ভাবে রক্ষণশীল শিবিরেও কিছুকালের জন্য উদ্দীপনা বিরাজ করে। ওহুদে সেটাই ঘটেছে। সেখানে মক্কার রক্ষণশীল কুফরি কায়েমী শক্তি তার সর্বশেষ দাপট ও প্রতাপ দেখিয়েছে।
(৯) এই যুদ্ধে মুসলিম শিবিরের বস্তুগত দৈন্যদশা ও রিক্ততার অনেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। মোট সত্তর জন শহীদের লাশ পড়ে ছিল। কিন্তু তাদের জন্য কাফনের ব্যবস্থা করাও কঠিন ছিল। মুসয়াব বিন উমাইরের লাশের উপর শুধু মাথার দিকে কাপড় দেয়া যাচ্ছিল। কিন্তু পা ঢাকা হয়েছিল আযখার ঘাস দিয়ে। পরবর্তীকালে এই পরিস্থিতির কথা যখনই মনে পড়ত, মুসলমানদের চোখে পানি এসে যেত। এই অবস্থা থেকেই আন্দাজ করা যায়, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ করা কত কষ্টকর, অনিচ্ছাকৃত অথচ অনিবার্য পদক্ষেপ ছিল, এবং পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে ছাড়া কোন মতেই তাদের এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর ছিলনা। কিন্তু বাধ্য হয়ে যখন এ কাজ করতেই হল, তখন তারা নিজেদের জীবন দর্শনের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়, নিজেদের মহান লক্ষ্যের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা এবং রসূল সা. এর অকৃত্রিম সাহচর্য দ্বারা সব রকমের ঘাটতি পূরণ করে নিলেন।
(১০) কোরআন মুসলমানদেরকে তাদের সমস্ত ত্রুটি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করা এবং তার সংশোধনে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দানের সাথে সাথে তাদের মধ্যে সৈনিকসুলভ গুণাবলীও সৃষ্টি করে। তাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, রণাঙ্গনে নৈতিক শক্তিই হয়ে থাকে আসল নিষ্পত্তিকারী শক্তি। এই নৈতিক শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ধৈর্য। তাদেরকে এও শিক্ষা দেয়া হয় যে, হক ও বাতিলের লড়াইতে তারা যেন বংশীয়, গোত্রীয় ও জাতিগত ভাবাবেগ এবং পার্থিব স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে শিঁকেয় তুলে রাখে। আর একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তোষ, সত্য ও ন্যায়ের বিজয় এবং আখিরাতের সাফল্যকে অগ্রাধিকার দেয়। কোরআন তাদের হৃদয়ে এ কথাও বদ্ধমূল করে যে, জয় পরাজয়ের ফায়সালা সর্বাবস্থায়ই নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহ্‌র হাতে নিবদ্ধ। একমাত্র তাঁরই সাহায্য কোন শক্তিকে বিজয়ী করতে সক্ষম। কাজেই তাঁরই আইন এবং তাঁরই সন্তোষকে সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়টাকেই সূরা আল ইমরানের ২৭ ও ২৮ নং আয়াতে একটা দোয়ার আকারে শিখানো হয়েছে :
“বল: হে আল্লাহ্‌, রাজাধিরাজ, তুমি যাকে চাও রাজত্ব দাও, যার কাছ থেকে চাও রাজত্ব ছিনিয়ে নাও, যাকে চাও সম্মানিত কর এবং যাকে চাও অপমানিত কর। কল্যাণ তোমারই এখতিয়ারাধীন। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান। তুমি রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করাও। প্রাণহীনের মধ্য থেকে প্রাণীকে এবং প্রাণীর মধ্য থেকে প্রাণহীনকে বের কর, আর যাকে চাও বিনা হিসাবে জীবিকা দাও।”
তাদের মন থেকে মৃত্যুভীতি দূর করা হয়েছে এই বলে যে, মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর অনুমতিক্রমে আসবেই। তাই জীবন বাঁচানোর খাতিরে কর্তব্য পালনে ত্রুটি করলে আয়ু দীর্ঘতর হবেনা। সুতরাং মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে কাজ করে যেতে হবে। এই মূল্যবান শিক্ষা গুলোর পাশাপাশি আরো যে শিক্ষাটা দেয়া হলো তা এই যে, যারা সত্যের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আল্লাহর পথে প্রাণোৎসর্গ করে, তাদের মৃত্যু সাধারন লোকদের মতো মৃত্যু নয়। তাদের মৃত্যু অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। কাজেই তাদেরকে সাধারন মৃত লোকদের মত মৃত ভেবনা ও মৃত বলোনা। তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নবজীবন লাভ করে, তাদের আত্মাগুলো জ্যোতির্ময় জীবিকা লাভ করে, আল্লাহর মহা মূল্যবান উপহার ও পুরস্কার তারা আনন্দিত এবং তাদের সমমনা সাথীদের ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত। এ ভাবে শাহাদাতের একটা উচ্চাঙ্গের তাৎপর্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ফলে আল্লাহর পথে সংঘটিত মৃত্যুর অর্থ এত পাল্টে গেছে যে, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে তার জন্য দোয়া করতে শুরু করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রাসুল সা. এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে, শহীদদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য সুর করে, চিৎকার করে বা বুক চাপড়ে কাঁদা চলবেনা। একটা সত্যনিষ্ঠ বিপ্লবী আন্দোলন যখন গড়ে উঠে, তখন তা ঐ বিপ্লবী আন্দোলনের সাথেই মানানসই বিশেষ ধরনের পরিভাষার প্রচলন করে, তার ভিতরে বিশেষ ধরনের তাৎপর্য সন্নিবেশিত করে এবং প্রচলিত ধ্যান ধারনার মর্ম পাল্টে দেয়। এই সমস্ত শিক্ষা থেকে বুঝা যায়, ইসলামে যুদ্ধ কোন দুনিয়াবি বা বৈষয়িক কাজ নয়। বরং এটা খালেস আল্লাহর ইবাদত ও নির্ভেজাল ধর্মীয় দাবী।
(১১) কিছু সংখ্যক মোনাফেক ময়দানে বসেছিল। যুদ্ধের আগে যেমন একটা চরম নাজুক মুহূর্তে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ও সংগঠনের ঐক্যে ফাটল ধরানোতে তাদের যথেষ্ট হাত ছিল, তেমনি যুদ্ধের পরেও তারা অনেক কানা ঘুষা করেছিলো যে, অমুক অমুক কাজ করলে এমন বিপর্যয় ঘটতোনা। তারা এও বলাবলি করছিল যে, নেতৃত্বে যদি আমাদের কিছু দখল থাকতো, তবে ওহুদ যুদ্ধের এমন ফল দেখা দিতনা। পেছনের সুড়ংগে যে তীরন্দাজ দল ছিল, তাদের মনও পরিস্কার ছিলনা। মদিনায় যখন তাদেরকে জিজ্ঞাস করা হল যে, তোমরা অবস্থান পরিবর্তন করলে কেন, তখন তারা নানা রকম খোঁড়া অজুহাত পেশ করলো। ঐ সব অজুহাত শুনে রসুল সা. বললেন, ‘ওসব কিছুনা। আসলে তোমরা আমার সম্পর্কে ভূল ধারনায় লিপ্ত ছিলে যে, আমি তোমাদের সাথে খেয়ানত করবো এবং আমি তোমাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিবনা’। কোরআন এই ভূল ধারনা দূর করর জন্যই বলেছেঃ “কোন নবীর কাছ থেকে এই প্রত্যাশা করা ঠিক নয় যে, তিনি খেয়ানত করবেন”।( আল ইমরান-১৬১)
(১২) শত্রুরা যখন রাসুল সা. কে আহত করে দিলো, তখন জনৈক সাহাবী তাকে পরামর্শ দিলেন, আপনি এই পাষণ্ডদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করুন যেন আল্লাহ্‌ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। রাসুল সা. জবাবে বললেন, “আমাকে বিশ্ববাসীর জন্য অভিসম্পাত স্বরূপ নয়, অনুগ্রহ স্বরূপ পাঠানো হয়েছে”। তারপর দোয়া করলেন, ‘ হে আল্লাহ্‌ আমার জাতিকে সুপথে চালিত করো। তারা (আমাকে, আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এবং জীবন ও জগত সংক্রান্ত তথ্য সমূহ) জানেনা”। আমরা আগেই বলেছি, এই জবাবে ও এই দোয়ায় রসুল সা. এর সেই দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে, যার আলোকে তিনি বিরোধীদেরকে বিবেচনা করতেন। তিনি যে কোন প্রকার ব্যক্তিগত প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করতেননা, তা সুস্পষ্ট। তিনি তাদের ধ্বংস নয় বরং তাদের সংশোধন চাইতেন। তাদের সামরিক কর্মকান্ডের জবাবে তিনি যদি অস্ত্র ধারন করে থাকেন, তবে তিনি নেহাত বাধ্য হয়েই তা করেছেন। কেননা তা না করে তাঁর উপায়ান্তর ছিলনা।

ওহদের পর

যদিও মুসলমানরা ওহুদ যুদ্ধে প্রথমে বিজয়ী ও পরে সাময়িক বিপর্যয়ের শিকার হয়, কিন্তু সর্বশেষ পাল্লা তাদের দিকেই ঝুকতে আরম্ভ করেছিল। বিশেষ করে কোরায়েশ কর্তৃক বিজয়কে অসম্পূর্ণ রেখে সটকে পড়া, মুসলিম বাহিনী কর্তৃক তাদের পিছনে ধাওয়া করা, এবং আবু সুফিয়ান কর্তৃক আর একবার ফিরে আসার ইচ্ছা করার পরও মক্কায় চলে যাওয়া মুসলিম বাহিনীর হিম্মত বাড়াতে সহায়ক হয়েছিল। আসলে কোরায়েশ বাহিনী এই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালা না করেই একে স্থগিত রেখে চলে গিয়েছিল। দু’পক্ষের কেউই অপর পক্ষকে সুস্পষ্টভাবে পরাজিত করতে পারেনি। এই ধরনের পরিস্থিতির অর্থ এটাই হয়ে থাকে যে, “বাকিটা পরে দেখা যাবে”। কোরায়েশের পক্ষ থেকে আবু সুফিয়ান পরিষ্কার ভাষায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে গিয়েছিল যে, আগামি বছর বদরের ময়দানে আবার টক্কর দিতে আসবো। বদরের যুদ্ধের যেমন একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বেরিয়ে এসেছিল, ওহুদের যুদ্ধের তেমন কোন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পাওয়া যায়নি। চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পরবর্তি সময়ের জন্য মুলতবি হয়ে গিয়েছিল।
মুসলিম বাহিনী বিজয়ী না হলেও তা পরাজয়ও ছিলনা। কিন্তু তবু বদরের যুদ্ধের যে প্রভাব আশেপাশের এলাকায় পড়েছিল, তাতে কিছু না কিছু ঘাটতি দেখা গিয়েছিল এবং রক্ষনশীল মোশরেক গোত্র গুলোর আশা আকাঙ্ক্ষা পুনরায় জাহেলী শক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করেছিলো। কোন কোন অপরাধপ্রবন অপশক্তির বিদ্রোহী আচরন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। মদিনার চারপাশের উশৃংখল গোত্রগুলো নতুন করে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা ঔদ্ধত্যের সাথে চালাতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানদের সংগঠন এত সংহত ও চৌকস ছিল এবং নেতৃত্ব এত মজবুত ছিল যে, তা প্রতিটি অপতৎপরতা তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিহত করে পরিস্থিতিকে ক্রমান্বয়ে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে। এভাবে জনগনকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ইসলামী সরকার যথেষ্ট প্রানবন্ত, সে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, নাগরিকদের জানমালের হেফাজত ও রাষ্ট্রের অখন্ডতা রক্ষায় কোন ত্রুটি করবেনা। তবু ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব পুনর্বহালে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল।
যেসব বিদ্রোহী শক্তি ওহুদ যুদ্ধের পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তাদের মধ্যে কুতুনের তালহা বিন খুয়াইলিদ ও সালমা বিন খুয়াইলিদই অপতৎপরতার সূচনা করেছিলো। তারা বনু আসাদ গোত্র কে মদিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী তৎপরতা চালাতে প্ররোচিত করে। বিশুদ্ধতর অভিমত সম্ভবত এটাই যে, এক ধরনের সশস্ত্র ডাকাতির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। চতুর্থ হিজরীর মুহররম মাসের চাঁদ উঠার সাথে সাথেই এ পরিকল্পনার খবর জানা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে এই বিপদ প্রতিহত করার জন্য আবু সালমা মাখযূমীর নেতৃত্বে দেড়শো যোদ্ধার একটা বাহিনী পাঠানো হলো। তারা কুতুন পৌছামাত্রই ডাকাত দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। তাদের ছেড়ে যাওয়া পশুর পাল ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করলো এবং স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণ করে দিলো। ৫ই মুহাররম তারিখে অপর এক দিক থেকে খবর এলো যে, বনু খুযায়েল গোত্রের খালিদ বিন সুফিয়ান মদীনা আক্রমন করার জন্য একটা বাহিনী তৈরি করেছে। আবদুল্লাহ বিন আনিস জুহানী আনসারীকে এদের মোকাবেলায় পাঠানো হলো। আবদুল্লাহ বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে খালিদের মাথা কেটে নিয়ে এলেন। সম্পূর্ণ একাকী এক বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব প্রদর্শনের পুরুস্কার স্বরূপ রাসুল সা. তাকে নিজের লাঠি প্রদান করলেন।
এর দু’তিন সপ্তাহ পর পুনরায় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। সফর মাসের প্রথম দিকে আযাল ও কারা গোত্রের লোকেরা একটা ষড়যন্ত্র পাকিয়ে মদিনায় এলো। তারা রসূল সা. এর কাছে আবেদন জানালো, আমাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক মুসলমান হয়ে গেছে। তাদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য আপনি কয়েকজন লোক পাঠান। রসুল সা. দশজন জ্ঞানি গুনী লোক পাঠালেন (এ সংখ্যা সহিহ বুখারীর বর্ননা অনুযায়ী প্রদত্ত। ইতিহাস ও সীরাত লেখকদের বর্ননা অনুসারে তারা সাত জন ছিল)। এদের আমীর ছিলেন মুরছাদ ইবনে আবুল মুরছাদ। বনু হুযায়েলের আবাসস্থল রজীতে পৌঁছা মাত্রই তারা খুবায়েব ও যায়েদ ছাড়া সবাইকে হত্যা করে ফেললো। খুবায়েব ও যায়েদকে তারা মক্কার কোরায়েশদের কাছে বিক্রি করে দিলো। কোরায়েশরা উভয়কে শুলে চড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এ ঘটনা থেকে বেশ বুঝা যায় যে, ওহুদ যুদ্ধের পর বিরোধীদের স্পর্ধা ও ধৃষ্টতা কত বেড়ে গিয়েছিলো। একটা ক্ষুদ্র দলের একাধিক মূল্যবান ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে সফরে গিয়ে পথিমধ্যেই নৃশংসভাবে শহীদ হলেন। এতে রসূল সা. যে মনে কত বড় আঘাত পেয়েছিলেন, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। যাদেরকে ইসলামের জ্ঞান দানের লক্ষ্যে তারা গিয়েছিলেন, সেই নরপশুরা তাদের কাছ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ তো দূরের কথা, বিনা অপরাধে তাদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটলো বীর মাউনায়। আবু বারা আমার বিন মালেক নাজদ অঞ্চল থেকে এসে রসূল সা. এর সাথে দেখা করলো। রসূল সা. তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে দাওয়াত গ্রহণও করলোনা প্রত্যাখ্যানও করলো না। তবে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে পরামর্শ দিলো যে, আপনি আপনার সাথীদের একটা দল নাজদে পাঠান। আশা করা যায় লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করবে। রসূল সা. নাজদ সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করলেন। রাজীর ঘটনা মাত্র কয়েকদিন আগেই ঘটেছে। আবু বারা হেফাজতের দায়িত্ব নিলো। নজদ এলাকায় ইসলামী সরকারের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্প্রসারিত করা বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থের তাগিদেই জরুরী হয়ে পড়েছিল, তাই রসূল সা. আবু বারার কথায় বিশ্বাস করে সত্তর জনের একটা দল(এ সংখ্যা বুখারিতে উদ্ধৃত, ইবনে ইসহাকের মতে ৪০ জন) পাঠিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর হাফেজ, ক্বারি ও প্রচারকরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এদের নেতা ছিলেন মুনযির বিন আমর। এই দাওয়াতী প্রতিনিধি দল যখন বীরে মাউনা নামক স্থানে পৌছাল, তখন সেখান থেকে হারাম ইবনে মিলহান বনু আমের গোত্রের সর্দার আমের বিন তুফায়েলের নিকট রসূল সা. এর চিঠি নিয়ে গেলেন। আমের বিন তুফায়েল চিঠি পড়ার আগেই নিজের লোককে ইংগিত দিয়ে তাকে হত্যা করিয়ে ফেললো। এরপর সে বনু আমের গোত্রে ঘোষণা করে দিলো যে, “ তোমরা যে যেখানেই থাক, মদিনা থেকে আগত প্রতিনিধি দলের উপর আক্রমন চালাতে চলে এসো”। কিন্তু বনু আমের আবু বারার প্রতিশ্রুতি ভংগ করতে রাজি হলোনা। তখন এই নৈরাজ্যবাদী বনী সুলাইয়েম গোত্রের শাখা রা’য়ান, যাকওয়ান, উসাইয়া ও বনু লিহয়ানকে দাওয়াত দিলো। তারা প্রস্তুত হলো এবং মদিনার দাওয়াতী প্রতিনিধি দলকে ঘেরাও করে ফেললো। প্রতিনিধি দল বললো, “আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এখানে থাকতেও চাইনা। আমরা আরো সামনে এগিয়ে যেতে ইচ্ছুক। তাই আমাদের উপর আক্রমন করোনা”। কিন্তু নরঘাতকরা কোন কথাই শুনলনা। তারা ৬৯ জন কে শহীদ করে ফেললো। ৭০ তম সদস্য কা’ব বিন যায়েদ রক্তাত্ত দেহ নিয়ে লাশের স্তুপে লুকিয়েছিলেন এবং কোন মতে প্রানে বেঁচে মদিনায় পৌঁছে সমস্ত ঘটনা রসূল সা. কে জানালেন। শত্রু পরিবেষ্টিত একটা নবীন দলের এ পরীক্ষা কত মর্মান্তিক ভেবে দেখুন। তাঁর ৬৯ জন সুশিক্ষিত ও সুযোগ্য ব্যক্তি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে একইসাথে শাহাদাত প্রাপ্ত হন। রসূল সা. স্পর্শকাতর এ ঘটনার পর নিদারুনভাবে ব্যথিত ও শোকাতুর হন। তিনি এই হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য এক মাস যাবত ফজরের নামাজে তাঁর প্রিয় সাহাবীদের খুনিদের জন্য বদদোয়া করেন। এই বদদোয়ার পরিভাষাগত নাম কুনুতে নাযেলা।
এই নরপশুদের পাশবিক কর্মকান্ডের বিপরীতে বিশ্ব মানবতার ত্রানকর্তা মহানবী সা. এর আচরণটাও লক্ষ্য করুন। ৭০ জন প্রতিনিধির মধ্যকার একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি আমর বিন উমাইয়া মদিনায় ফেরার পথে এক জায়গায় দু’ব্যক্তিকে গাছের ছায়ার নিচে ঘুমন্ত দেখতে পান। ঐ দুই ব্যক্তি তাঁর কাছে খুনিদের দোসর মনে হওয়ায় তিনি তাদেরকে হত্যা করে ফেলেন। তাঁর এই ধারনা ভুল ছিল এবং তারা উভয়ে মিত্র গোত্রের সদস্য ছিল। রসূল সা. এর জন্য রক্তপণ দিয়ে তাঁর খুনের খেসারত দিলেন। কেননা প্রচলিত জুলুমের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফের রাজত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যই রসূল সা. এত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
মদিনা অভ্যন্তরীণভাবে স্থিতিশীল না থাকলে এই সব বাহ্যিক জটিলতা সংশোধন সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এখানে কিছু কুচক্রী অপশক্তি বিদ্যমান ছিল এবং তারা নিজেদের জমিজমা, ধনসম্পদ, বড় বড় দুর্গের সুবাদে খুবই প্রভাবশালী ছিল। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসে চরম বিশ্বাসঘাতক সুলভ ষড়যন্ত্র চালাত এবং মুসলমানদের প্রত্যেক কাজে বাধা দিত। বিশেষত ইহুদি গোত্রগুলো মদিনার ঐক্য সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও প্রতিদিন বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা চালাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটির অধিকারী ছিল বনু নযীর গোত্র। তারা হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমীতে মত্ত হয়ে বেপরোয়াভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ওহুদ, রজী ও বীরে মাঊনার ঘটনাবলীর পর তাদের ধৃষ্টতা এত বেড়ে গিয়েছিলো যে, এহেন নাজুক মুহুর্তে রসূল সা. কে হত্যা করার জন্যও তারা প্রকাশ্যে চেষ্টা চালায়। ( এ বিষয়ের উল্লেখ আগেই করেছি)। অতীতের অপকর্মগুলোর পর নতুন করে এই প্রকাশ্য অপচেষ্টা চালাতেও যখন ইহুদীদের বিবেকে বাধলোনা, তখন তাদের সম্পর্কে একটা চুড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে পড়লো। রসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রাণহানি এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। [কারণ একে তো ইসলামী আন্দোলন স্বভাবতই হিংস্র ও জঙ্গিবাদী নয়। উপরন্তু বিষয়টা কিন্তু দুনিয়ার একটা স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের। ইসলামী আন্দলনকে এই গোষ্ঠীর প্রভাবাধীন এলাকারই কাজ করতে হতো। নচেত তাদের অপরাধ এতো জঘন্য ছিল যে, তাদের বেঁচে থাকারও অধিকার ছিলনা।] এ জন্য শুধু নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার নোটিশ দিয়ে তাদেরকে দশ দিনের মধ্যে মদিনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চরম পত্র দিয়ে দিলেন। বেরিয়ে না গেলে তাদের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করা হবে-এ কথাও জানিয়ে দিলেন। মোনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই পর্যাপ্ত সাহায্য দেয়ার অঙ্গিকার করে তাদেরকে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করলো। বনু নযীর তার প্ররোচনায় পড়ে ইসলামী সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে দিলো যে, আমরা তোমাদের চরম পত্রের পরোয়া করিনা। যা করতে চাও করো। অগ্যতা চতুর্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে রসূল সা. মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে অভিযানে বেরুলেন এবং বনু নযীরকে অবরোধ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অঙ্গিকার রক্ষা করলনা এবং কেউ তাদের সাহায্যে ছুটে এলোনা। অসহায় হয়ে তারা তাদের জনপদকে খালি করে দিলো। রসূল সা. এর অনুগ্রহে তারা শুধু প্রানে রক্ষাই পেলনা বরং উটের পিঠে চড়িয়ে তাদের মূল্যবান জিনিস পত্রও নিয়ে গেলো। এই চরম উত্তেজনার পরিবেশেও বনী নযীরের ভেতর থেকে দু’জন ভাগ্যবান ব্যক্তি বেরিয়ে এলো, যারা আপন গোত্রের অযৌক্তিক ও অন্যায় আচরনের সাথে সাথে রসূল সা. এর দাওয়াতের সত্যতা ও যথার্থতাও উপলব্ধি করলো এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। তারা ছিল ইয়ামীন বিন উমায়ের ও আবু সা’দ বিন ওহাব।
এ সময় মুসলিম বাহিনী কিছু গাছগাছালি কাটতে বাধ্য হয়। এটা তেমন গুরুতর ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু পাশ্চাত্যের প্রচারনাবিদরা এখান থেকেও অপপ্রচারের মালমশলা খুঁজে বের করেছে। এটা ছিল অনিবার্য সামরিক তৎপরতা। আজকালও কোন কোন সেনাবাহিনীকে রাস্তা বানানো, শত্রুর গোপন ঘাটি ধ্বংস করা ও অন্যান্য প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে এ জাতীয় কাজ করতে হয়। এমনকি পুলিশকেও অপরাধী পাকড়াও করতে অনেক সময় এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। দালান কোঠা ভেংগে ফেলতে হয় এবং ক্ষেত খামার ও বাগ বাগিচায় প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করতে হয়।
চরম বিপদসংকুল অবস্থায়ও দুষ্কৃতকারীদের দমন করার মাধ্যমে রসূল সা. শুধু নিজের সমস্যাবলীই কমাননি বরং আশেপাশের লোকদের উপর নিজের প্রতাপ ও ভাবমূর্তি অম্লান রেখেছেন। তারা বুঝেছে যে, ইসলামি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পুরোপুরিভাবেই বহাল আছে।
আবু সুফিয়ান ওহুদের ময়দানে যে আস্ফালন দেখিয়ে এসেছে, সে অনুসারে একটা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আক্রমন চালানোর জন্য বেরুলো। এবার তার বাহিনীতে ছিল দু’হাজার পদাতিক ও ৫০ জন আরোহী। রসূলও সা. খবর পাওয়ার সাথে সাথে দেড় হাজার পদাতিক ও দশজন আরোহী নিয়ে বদরের ময়দানে উপস্থিত হলেন। সেখানে শিবির স্থাপন করে একটানা আটদিন কোরায়শী বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে মাত্র এক মঞ্জিল দূরে দাহরান বা উসফান নামক জায়গায় এসে ফিরে গেল। কেননা অনাবৃষ্টির কারণে ঐ বছরটা তার কাছে যুদ্ধের উপযোগী মনে হয়নি। আবু সুফিয়ানের ফিরে যাওয়ার খবর শুনে শেষ পর্যন্ত রসূল সাঃ মদিনায় ফিরে গেলেন।
৪র্থ হিজরীর মুহাররম মাসে (মতান্তরে জমাদিউল উলাতে) বনু গিতফান গোত্রের দুটো শাখা গোত্র বনু মোহারেব ও বনু সা’লাবার পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে- এ কথা জানা মাত্রই রসূল সাঃ চারশো (মতান্তরে সাতশো) সেচ্ছাসেবক যোদ্ধার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলার জন্য একটা বাহিনী প্রস্তুত ছিল সত্য। কিন্তু তারা কার্যত যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়নি। এই সময়কারই ঘটনা। গুরস নামক এক মোশরেক নিজ গোত্রের কাছে এই সংকল্প প্রকাশ করে বাড়ী থেকে বের হয় যে, আমি মুহাম্মাদ সাঃ কে হত্যা করেই বাড়ী ফিরবো। সে যখন এল, রসূল সাঃ একাকী একটা গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তাঁর তলোয়ার গাছের ডালে ঝুলছিল। গুরস ঐ তলোয়ার খানাই হাতে নিয়ে উত্তোলন করে বললো, “বল এখন তোমাকে কে বাঁচাতে পারে।” রসূল সাঃ সম্পূর্ণ নির্ভয়ে বললেন, “আল্লাহ বাঁচাতে পারেন।”
দু’মাতুল জানদাল বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর মিলনস্থল ছিল, আবার সেখানে খৃষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মপ্রচারক এবং রাজনৈতিক গোয়েন্দারাও সক্রিয় ছিল। অন্যদিকে বনু নযীর খয়বর প্রভৃতি জায়গায় যেয়ে আশ্রয় নেয়ার কারণে মদিনার বিরুদ্ধে তাদের নানা রকম ষড়যন্ত্র করার আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিল। বিশেষত এ ঘটনাটা খুবই রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন যে, মক্কার কোরায়েশ ও খয়বরের ইহুদীদের যোগসাজসের আওতাধীন খৃষ্টান নেতা উকায়দার মদিনার জন্য খাদ্যশস্য বহনকারী কাফেলাগুলোকে উত্যক্ত করা শুরু করে। রসূল সাঃ জানতে পারলেন, দু’মাতুল জানদালে শত্রুরা তাদের বাহিনী একত্রিত করে মদিনায় আক্রমন করতে চায়। ৫ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে রসূল সাঃ এক হাজার সৈন্য নিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে ঐ জায়গা অভিমুখে রওনা দিলেন। দু’মাতুল জানদালের উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর রওনা হবার খবর পৌঁছামাত্রই শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। রসূল সাঃ আর সামনে এগুনোর প্রয়োজন অনুভব করলেন না। তিনি পথিমধ্যে মিত্র সংগ্রহের জন্য কাজ করলেন। এই পর্যায়ে আইনিয়া বিন হাসীনের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হলো। পরে ৭ম হিজরীতে হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ একটা দাওয়াতী রাজনৈতিক অভিযান নিয়ে গেলেন এবং কালব গোত্রের মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হলো। এরপর নবম হিজরীতে তবুক অভিযানের সময় এ এলাকার ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়।
এবার বনুল মুসতালিক সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল যে, তারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বুরাইদা আসলামীকে পাঠিয়ে তদন্ত করানো হলেও ঘটনা সত্য বলেই প্রমাণিত হলো। অগত্যা রসূল সাঃ ৩রা শা’বান সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। অত্যন্ত দ্রুতগতিতেই তিনি মুরাইদীতে (জলাশয়) গিয়ে পৌঁছলেন। বনুল মুস্তালিকের সরদার হারেস বিন যিরার যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু রসূল সাঃ অতর্কিতে সেখানে উপস্থিত হওয়ায় তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। থেকে গেল শুধু তার নিজ গোত্রের লোকজন। প্রথম আঘাতেই হারেসের বাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হলো। বহুসংখ্যক পশু গনীমতের সম্পদ হিসেবে হস্তগত হলো এবং গোত্রের সকল নারীপুরুষ যুদ্ধবন্দীতে পরিণত হলো। এই সব বন্দীর মধ্যে ছিলেন জুয়াইরিয়া নাম্নী এক মহিলা। তিনি রসূল সাঃ এর সামনে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে বললেন, আমি মুসলমান অবস্থায় হাজির হয়েছি। রসূল সাঃ তাঁর সম্মতিক্রমে তাকে বিয়ে করলেন। এর ফল হলো এই যে, মুসলিম বাহিনি বনুল মুসতালিকের সমস্ত বন্দীকে এই বলে মুক্ত করে দিল যে, আমরা রসূল সাঃ ‘র আত্মীয়স্বজনকে বন্দী রাখতে পারিনা।
এই যুদ্ধেই ইসলামের বিজয়ের দৃশ্য দেখে মোনাফেকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা প্রথমে পানি নিয়ে ঝগড়া বাধায় এবং মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টির প্রয়াশ পায়। ফেরার পথে মোহাজেরদেরকে মদিনা থেকে বের করে দেয়ার জন্য আনসারদেরকে উত্তেজিত করতে থাকে। এই সফরেই হযরত আয়েশা কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে থাকে অপবাদের কবলে পড়তে হয়। এ সব কাহিনী ইতিপূর্বে বর্ণনা করে এসেছি।
ওহুদ যুদ্ধের পর খন্দক যুদ্ধের আগে এই সব ছোট খাট ঘটনা ঘটে। ইসলামী রাষ্ট্রকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, আইন শৃংখলা বহাল করা ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই এ সব পদক্ষেপ গ্রহন করতে হয়। এ সবের মধ্যে কেবল শিক্ষক প্রতিনিধি সংক্রান্ত ঘটনাবলী ছাড়া অন্য সব ঘটনায় কখনো শুধু সীমান্তে সৈন্য পাঠানো হয়, আর কখনো নিছক পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নির্ভেজাল সামরিক সংঘর্ষ খুবই কম ঘটেছিল এবং খুবই ক্ষুদ্র আকারের ছিল। ওগুলোকে অনর্থক গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলে পাঠকের মনে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। আসল অবস্থা ছিল এই যে, আরবের সমাজ বিভিন্ন ছোট বড় গোত্রে বিভক্ত ছিল। আর প্রত্যেকটা গোত্র, এমনকি গোত্রের শাখাগুলোও নিজ নিজ বলয়ে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক একক ছিল। কখনো এওকটা গোত্র বিদ্রোহ করতো, আবার অন্যটা আক্রমণ বা ডাকাতি করতে উদ্যত হতো। একটার দুস্কৃতি বন্ধ করলে আর একটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। এ পরিস্থিতে যখনই একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হতো, তখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট বড় গোত্রগুলোর সাথে সংঘাত সংঘর্ষের ঝুঁকি না নিয়ে কখনো তাতে সাফল্যের কোন সম্ভাবনা ছিলনা।

তৃতীয় বড় যুদ্ধ – খন্দক

ওহুদের যুদ্ধে যদিও কোরায়েশ মুসলমানদেরকে এক হাত দেখানোর একটা সুযোগ ঘটনাক্রমে পেয়ে গিয়েছিল এবং দৃশ্যত তারা এর মধ্য দিয়ে বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েও নিয়েছিল। কিন্তু তারা ভালো করেই বুঝেছিল যে, আসলে তারা ওহুদের ময়দান থেকে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফেরেনি। তারা এও বুঝতে পেরেছিল যে, এখন তারা তাদের বর্তমান ক্ষমতার জোরে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে পরাভূত করতে সক্ষম নয়। তাই তারা এক বছরের বিরতিতে আরো বেশী প্রস্তুতি গ্রহণ ও সৈন্য সংগ্রহের পরে যুদ্ধ করার সংকল্প নিয়ে ওহুদ থেকে বিদায় নিয়েছিল। এ সংকল্প আবু সুফিয়ান প্রকাশও করেছিল। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মক্কা থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বের হওয়ার পর পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে তারা ফিরে গেল। কোরায়েশ ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্যটা হলো, কোরায়েশের জাহেলী শিবির স্বীয় প্রাণশক্তির দিক দিয়ে স্থবির ও দুর্বল ছিল তার মধ্যে বিকাশ ও বৃদ্ধি লাভের কোণ যোগ্যতা ছিলনা। বরঞ্চ তার কিছু কিছু শক্তি সব সময় তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের পাল্লায় পড়ছিল। মদিনার ইসলামী শক্তি ছিল একটা আদর্শবাদী, দাওয়াতী ও গণমুখী শক্তি। তাই এটা ছিল সদা সক্রিয়, কর্মব্যস্ত, বিকাশমান ও সম্প্রসারণশীল। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে সময়ের আবর্তন মদিনার পক্ষে লাভজনক প্রমাণিত হচ্ছিল। নৈতিক প্রশিক্ষণ ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধি, চুক্তিভিত্তিক মৈত্রী সম্পর্ক, প্রতিরক্ষামূলক শক্তি, জনশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমি স্বত্ত্বের প্রসার-সব দিক দিয়েই মদিনা ক্রমেই স্ফীত, সম্প্রসারিত ও শক্তিমান হয়ে চলছিল। ইসলামী রাষ্ট্র কোরায়েশদের বাণিজ্যিক পথ কার্যত বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মক্কা অর্থনৈতিক সংকটে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র ওহুদ যুদ্ধের পর দু’বছর বহু জটিলতার শিকার হওয়া সত্বেও যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। পক্ষান্তরে কোরায়েশ যে যুদ্ধকে এক বছরের জন্য স্থগিত করেছিল, সে যুদ্ধ এক বছর বিলম্বিত হওয়ার কারণে তা এখন তাদের কাছ থেকে আরো বেশি আগ্রাসী শক্তি সঞ্চয়ের দাবী জানাচ্ছিল। একা কোরায়েশদের পক্ষে প্রয়োজনীয় এত শক্তি যোগান দেয়া সহজসাধ্য ছিলনা। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের রকমারি শ্ত্রুরা পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কারণে পারস্পরিক ঐক্যের পথ খুঁজে নিয়েছিল। মদিনা থেকে বিতাড়িত যেসব ইহুদী খয়বর ও ওয়াদিওল কুরাতে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা কোরায়েশকে মদীনায় হামলা করতে প্ররোচিত করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াচ্ছিল। মদিনার জন্য খাদ্যশস্য বহনকারী কাফেলাগুলোর পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের অপতৎপরতার সূচনা করে। এইসব নির্বাসিত ইহুদী যখন ওহুদ যুদ্ধের ফলাফল জানতে পারলো এবং আবু সুফিয়ানের পুনরায় আক্রমণ চালানোর সংকল্পের কথা শুনলো, তখন তাদের উদ্যম ও উৎসাহ আর দেখে কে। তারা জনশক্তির অধিকারি বনুগিতফানকে খয়বরের খেজুরের পুরো এক বছরের উৎপন্ন ফসল এবং ভবিষ্যতেও একটা নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার অংগীকার করে মদিনার ওপর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করলো। এতখানি কাজ সম্পন্ন করার পর তারা মক্কায় একটা প্রতিনিধিদল পাঠালো। এই প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভূক্ত ছিল সালাম বিন আবিল হাকীক, সালাম বিন মুশকাম, হুয়াই বিন আখতাব, কিনানা বিন রবী (বনু নযীর), হাওযা বিন কয়েস ও আবু আম্মারা (বনু ওয়েল) প্রমুখ বড় বড় ইহুদী নেতারা। তারা কোরায়েশকে নিশ্চয়তা দিল যে, তোমরা আক্রমণ চালালে আমরা মুহাম্মদ সাঃ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তোমাদের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা দিতে থাকবো। এই প্রতিনিধিদল মক্কা থেকে পুরোপুরি কৃতকার্য হয়ে ফিরলো এবং ফেরার পথে বনু গিতফান ও অন্যান্য গোত্রের সাথেও দেখা করলো। কোরায়েশরাও তাদের মিত্র ও সমর্থকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালালো এবং আহাবীশদেরকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো। মোটকথা, এবার জাহেলী শক্তি সমগ্র আরব থেকে তার সমর্থক শক্তি যোগাড় করলো।
আবু সুফিয়ানের সেনাপতিত্বে চার হাজার সৈন্য মক্কা থেকে রওনা হলো। এতে অন্তর্ভূক্ত ছিল তিন হাজার ঘোড়া ও এক হাজার উট। এই বাহিনী যখন মাররুয যাহরান পৌঁছলো, তখন কোরায়েশের অন্যতম মিত্র বনী সুলায়েম, বনু আসাদ, ফাযারা, আশজা ও বনু মাররা প্রভৃতি গোত্র নিজ নিজ এলাকা থেকে থেকে বেরিয়ে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে যুক্ত হলো। বনু গিতফান উয়াইনা বিন হিসনের নেতৃত্বে বেরুলো। এভাবে কোরায়েশী বাহিনীর লোকসংখ্যা সর্বমোট কততে দাঁড়ালো, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে ৬ থেকে ৭ হাজার, কারো মতে ১০ হাজার এবং কারো মতে ২৪ হাজার। তবে অধিকাংশের মতে সংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং এটাই অগ্রগন্য মত।
রসুল সাঃ যখন দুমাতুল জানদাল সফরে ছিলেন, তখনই এসব প্রস্তুতির কথা জেনে ফেলেছিলেন। এ জন্য তিনি দ্রুত ফিরেও এসেছিলেন। পরামর্শ সভা বসলো। স্থির হল যে মদিনায় বসেই হামলা প্রতিহত করা হবে। শহরের প্রতিরক্ষার জন্য ইরানী পদ্ধতিতে পরীখা বা খন্দক খনন সংক্রান্ত হযরত সালমান ফারসীর পরামর্শ গ্রহণ করা হলো। এর একটা উপকারিতা এই ছিল যে, অভিনব এই প্রতিরক্ষা কৌশল আরব হানাদারদের বেকায়দায় ফেলে দিতে সক্ষম ছিল। তা ছাড়া একটা উঁচু ও মজবুত প্রাচীর দ্বারা যে কাজ সমাধা হতে পারতো, সেই কাজ নিছক শারিরিক পরিশ্রম দ্বারাই সমাধা করা যেত। এই পদ্ধতিতে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য দ্বারা বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনাকে ঠেকানো সম্ভব ছিল। রসুল সাঃ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিজেই পরিখার নকশা স্থির করতে বেরুলেন। মদিনা শহরটা তিন দিক থেকেই বাড়ী-ঘর ও প্রাচীর ঘেরা বাগবাগিচায় আবদ্ধ ছিল। তাই ঐ তিন দিক পরিখা খননের কোনই প্রয়োজন ছিলনা, পরিখার প্রয়োজন ছিল শুধু উত্তরের খোলা দিকে। স্থির হলো, হাররায়ে শারকী ও হাররায়ে গারবী (পূর্বের প্রস্তরময় প্রান্তর ও পশ্চিমের প্রস্তরময় প্রান্তর) কে যুক্ত করে এমন একটা অর্ধবৃত্তাকার পরিখা সিলা পর্বতের পশ্চিম কিনার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে হবে। এই আংশটার খনন কার্যত সামরিক ব্যবস্থাপনায় করানো হলো। তবে কোন কোন গোত্র নিজ নিজ বাড়ীঘরের রক্ষণাবেক্ষণের খাতিরে নিজস্ব উদ্যোগে পরিখা আরো বাড়িয়ে নিল। ফলে পরিখা দক্ষিণে ঈদগাহের (মসজিদে গামামার) পশ্চিম দিক দিয়ে টেনে নিয়ে কোবার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত লম্বা করা হলো। যে তিন হাজার মুসলিম মোজাহেদের উপর পরবর্তীতে সরাসরি যুদ্ধ করার দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তারাই খন্দক খননে স্বেচ্ছা শ্রমিকের ভূমিকা পালন করলো। দশ দশ জনের এক একটা গ্রুপ বানানো হলো এবং প্রত্যেক গ্রুপকে দশ গজ করে খন্দক খননের কাজ অর্পন করা হলো। খন্দক আনুমানিক দশ গজ চওড়া করা হয়েছিল। কেননা কোন কোন ঘোড় সওয়ার শত্রুসেনা খন্দকের ওপর দিয়ে ঘোড়াকে লাফিয়ে পার করতে গিয়ে ভেতরে পরে মারা গিয়েছিল। খন্দকের গভীরতাও সম্ভবত পাঁচ গজের কম ছিলনা। আর এর দৈর্ঘ ছিল সাড়ে তিন মাইল। মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরা মাত্র তিন সপ্তাহে এত বড় কাজ কিভাবে সম্পন্ন করলো, তা ভাবতেও বিষ্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয়। প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন করতে ও তা স্থানান্তর করতে হয়েছে। সরঞ্জামাদির ব্যাপারে অবস্থা ছিল এই রকম যে, মাটি কাটা ও খনন করার কিছু কিছু উপকরণ চুক্তির আওতায় বনু কুরায়যার কাছ থেকে ধার নেয়া হয়েছিল। ঝুড়ি-টুকরীর অভাবে সাধারণ মুসলমানরা তো দুরের কথা, আবু বকর ও ওমরের রাঃ মত ব্যক্তিরাও চাদরে ও আঁচলে ভরে ভরে মাটি তুলছিলেন। খন্দকের সাথে জায়গায় জায়গায় উঁচু উঁচু পর্যবেক্ষণ মঞ্চ বানানো হয়েছিল। ঐ সব মঞ্চ থেকে খন্দকের সকল অংশ এক সাথে তদারক করা যেত।
খন্দক খননের কাজ কোন মতে হতে না হতেই ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সম্মিলিত শত্রুবাহিনী মদিনার উপকন্ঠে এসে পৌঁছলো। কোরায়েশ কিনানা ও আহাবিশ সৈন্যরা ওয়াদিয়ে আকীকের কাছাকাছি রওমার কূপের কাছে শিবির স্থাপন করলো। গিতফান ও বনু আসাদ পূর্বদিকে ওয়াদিউন নুমানের কাছে যাম্বু নকমা নামক জায়গা থেকে নিয়ে ওহুদ পর্বত পর্যন্ত ছড়িয়ে শিবির স্থাপন করলো। অন্যদিকে মুসলিম বাহিনী সিলা পর্বতকে পেছন দিকে রেখে কেন্দ্রীয় শিবির স্থাপন করলো, এখানে যে স্থানটায় রসুল সাঃ এর শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার স্মৃতি হিসাবে সেখানে আজও মসজিদুল ফাতহ বিদ্যমান।
ইসলামের শত্রুরা যদিও বিপুল সংখ্যায় কাতারবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই খন্দক বা পরিখা তাদের জন্য এক নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিল। এ ধরনের প্রতিরোধব্যুহ তারা আর কখনো দেখেনি। এই কৌশল সম্পর্কে তারা একেবারেই অজ্ঞ ছিল। তাদের ঘোড়া ও উট খন্দকের বহিসীমান্ত পর্যন্তই কার্যোপযোগী ছিল। দু’একজন ঘোড় সওয়ার সৈনিক অতি উৎসাহে লাফিয়ে খন্দক পার হবার চেষ্টা করতে গিয়ে খন্দকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তারা বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসতো। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর সৈনিকরা কোন রকম শৈথিল্য না দেখিয়ে তৎক্ষণাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়াতো এবং তীর নিক্ষেপকারী শত্রুদের মুখ ফিরিয়ে দিত। তরবারী ও বর্শা একেবারেই অকর্মণ্য ছিল। প্রতিদিনই উভয় পক্ষ থেকে কিছু কিছু তীর নিক্ষেপণ চলতো। কয়েকদিনের অবরোধে বিরক্ত হয়ে একদিন শত্রুবাহিনী খুব জোর দেখালো। কখনো এখান থেকে এবং কখনো ওখান থেকে হামলা করলো, কিন্তু কোনই লাভ হলোনা। অবশেষে কোরায়েশ বাহিনীর খ্যাতনামা প্রবীন ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা ওমর বিন আবদু উদ আবেগে মাতোয়ারা হয়ে ছুটলো। সে আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা, হুবাইরা বিন আবু ওহব এবং যিরার ইবনুল খাত্তাবকে উস্কে দিল এবং বনু কিনানার কিছু লোককে সাথে নিয়ে নিল। অবশেষে একটা সুবিধাজনক জায়গা দেখে ঘোড়াকে লাফিয়ে পার করলো। তার পিছু পিছু দু’একজন সাথীও খন্দক পার হয়ে গেল। অন্যরা সবাই খন্দকের কিনারে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে গিয়ে সে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিল। হযরত আলী তার মোকাবিলায় এগিয়ে এলেন এবং সামান্য আঘাত খেয়ে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এই একটা দিন মুসলিম বাহিনীর জন্য এত কঠিন ছিল যে, বিভিন্ন দিক থেকে আগত শত্রুদেরকে প্রতিহত করতে গিয়ে চার ওয়াক্ত নামাজ কাযা হয়ে গেল।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়াটা মুসলমানদের জন্য উদ্বেগজনক ছিল। কিন্তু শত্রুরাও এতে বিচলিত ছিল। অনেক সলাপরামর্শের পর একটা চুড়ান্ত হামলা করার জন্য স্থির করা হলো যে, ইহুদী গোত্র বনু কুরায়যাকে রসুল সাঃ এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তারা ভেতর থেকে হামলা চালাবে। আবু সুফিয়ানের অনুরোধে হুয়াই বিন আখতাব এ দায়িত্ব গ্রহণ করলো। সে বনু কুরায়যার সর্দার কা’ব বিন আসাদের সাথে দেখা করলো এবং নিজের বক্তব্য পেশ করলো। কা’ব প্রথমে তো অস্বীকার করলো। সে বললো, আমি মুহাম্মদ সা. কে সব সময় ওয়াদা পালন করতে দেখেছি। কাজেই তাঁর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করা অত্যন্ত অমানুষিক কাজ হবে। কিন্তু হুয়াই বিন আখতাব সর্বাত্মক জোর দিয়ে অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলো এবং বললো, “আমরা অগণিত সৈন্য নিয়ে এসেছি। সমগ্র আরব জাতি আমাদের সাথে চলে এসেছে। গোটা বাহিনী মুহাম্মাদের সা. রক্তের নেশায় বিভোর। এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক নয়। এখন ইসলামের অন্তিম সময় উপস্থিত।” মোটকথা, প্ররোচনার কৌশলটা সফল হলো। আর বিষয়টা তাৎক্ষনিকভাবে মুসলমানদের কানে চলে গেলো। রসূল সা. ব্যাপারটার সত্যাসত্য তদন্ত করলেন। তদন্তেও সঠিক প্রমানিত হলো। সাহাবাদের একটা দল যখন বিষয়টা সত্য বলে সাক্ষ্য দিল, তখন রাসূল সা. এর মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হলো, “আল্লাহু আকবার! হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকিল।” (“আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি উৎকৃষ্টতম অভিভাবক।”)
রণাঙ্গনের ব্যাপকতা, অবরোধের দীর্ঘস্থায়ীত্ব, সৈন্য স্বল্পতা, সাজ সরঞ্জামের অভাব, ক্ষুধার প্রচণ্ডতা, সেই সাথে নিদ্রাহীনতা, মোনাফেকদের নানা রকমের খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে রণাঙ্গন থেকে সটকে যাওয়া এবং ব্যাস্ততার আতিশয্যে নামায পর্যন্ত ক্বাযা হয়ে যাওয়া- এ সব কোন মামুলী পরীক্ষা ছিলনা। উপরন্তু যখন মদিনার অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা ছড়িয়ে পড়লো এবং দেড় হাজারেরও বেশী যোদ্ধা পুরুষ যোগান দিতে সক্ষম বনু কুরায়যার অতর্কিতভাবে গৃহশত্রু বিভীষণের ভুমিকায় নেমে যাওয়ার মত পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, তখন তিন হাজার মরণপণ মোজাহেদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা আজ অনুমান করা কঠিন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. জানান, এ খবরটা জানার পর আমাদের মধ্যে আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আমাদের বাড়ীতে নারী ও শিশুদের উপর হামলা হতে পারে। এই আশংকার কারণে আমরা বারবার পাহাড়ের উপর উঠে দেখতাম, কোন ঘটনা ঘটে গেল নাকি। নিজেদের বাড়ীঘর শান্ত দেখলে আল্লাহর শোকর আদায় করতাম। রাসূল সা. তিনশো মোজাহিদের একটা বাহিনী মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাঠালেন। এই সময়কার পরিস্থিতির চিত্র কোরআন যেভাবে তুলে ধরেছে, তা হলোঃ
“স্মরণ কর, যখন শত্রুরা ওপর থেকেও এবং নিচ থেকেও তোমাদের দিকে অগ্রসর হলো, যখন তোমাদের চক্ষুগুলো স্থির হয়ে গেল এবং হৃদয়গুলো মুখের কাছে এসে গেল, আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের মনে নানা রকমের ধারণা ঘুরপাক খেতে লাগলো।”
(আহযাব-১০)
বস্তুত এই ঘটনায় মুসলমানদের যে ধরনের কঠিন পরীক্ষা হয়েছিল, তেমন পরীক্ষা পূর্ববর্তী বড় বড় দুটো যুদ্ধের কোনটাতেই হয়নি। ওহুদ যুদ্ধে অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে সত্য। কিন্তু যা কিছুই হয়েছে, একদিনে হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের দুঃখকষ্ট ছিল দীর্ঘস্থায়ী, আর হানাদার শুধু কোরায়েশরা ছিলনা, আরো অনেকে ছিল। মুসলমানদের দুঃখ কষ্ট দেখে রসূল সা. এই কৌশল উদ্ভাবন করলেন যে, শত্রু বাহিনীর কোন না কোন অংশকে আপোষমূলক চেষ্টাতদবির দ্বারা রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড অর্থলোলুপ বনু গিতফানের দুই সরদারকে তিনি ডেকে আনালেন এবং কথাবার্তা বললেন। তাদেরকে তিনি মদিনার মোট উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে আপোষ রফা করাবার প্রস্তাব দিয়ে সমঝোতায় উপনীত হলেন এবং চুক্তির খসড়াও তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু সাক্ষর দেয়ার আগে তিনি সাদ বিন মুয়ায ও সাদ বিন উবাদা (আওস ও খাজরাজের সরদার) এর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী মনে করলেন। তিনি তাদের উভয়কে বুঝালেন যে, “তোমারা এত বিপুল সংখ্যক শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছ যে, তাদেরকে প্রতিহত করা সহজ নয়। তাই শত্রুর শক্তি খর্ব করার এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।” উভয়ের আত্মাভিমান জেগে উঠলো। তারা বললো, “হে রসূল, আমরা যখন কাফের ছিলাম তখনো তো এইসব গোত্র আমাদের ধনসম্পদ এভাবে নিতে পারেনি। আর আজ যখন আমরা ইসলাম গ্রহণ করে আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছি, তখন তাদের হাতে আমাদের সম্পদ এভাবে সোপর্দ করবো? আল্লাহর কসম, এটা কখনো হতে পারেনা। আমাদের এমন চুক্তির দরকার নেই।” রসূল সা. এই জবাব শুনে যারপর নাই খুশী হলেন। তিনি চুক্তির খসড়াটা হযরত সাদের কাছে দিলে সা’দ তা ছিড়ে ফেললেন।
তথাপি পরিস্থিতির জটিলতা যথাস্থানে বহালই ছিল। আল্লাহ তায়ালা সহসা একটা সমাধান বের করে দিলেন। এটা ছিল একটা বিস্ময়কর ঘটনা এবং ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতার উজ্জ্বলতম নিদর্শন। এহেন প্রলয়ংকরী মুহূর্তে সহসা নঈম ইবনে মাসঊদ সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি রসূল সা. এর কাছে এসে বললেন, “হে রসূল, আমি মুসলমান হয়ে গেছি।” এই বলে তিনি প্রকাশ্যে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে নিজের বিশুদ্ধ আকীদা ঘোষণা করলেন। তারপর বললেন, “এখনো যেহেতু শত্রুরা আমার ইসলাম গ্রহণের খবর জানেনা। সুতরাং যদি অনুমতি দেন, তবে আমি কোরায়েশ ও বনু কুরায়যার ঐক্য ভাঙ্গার জন্য কিছু কাজ করতে পারি।” রসূল সা. অনুমতি দিলেন। নঈম বনু কুরায়যার কাছে গেলেন। তাদের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তার পর তিনি তাদের বললেন, ‘যদি বিজয় অর্জিত হয় তাহলে তো ভালো কথা। কিন্তু পরাজয় যদি কপালে জোটে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখ। পরাজিত হলে কোরায়েশ ও গিতফান সবাই চলে যাবে এবং তোমরা একাই মুহাম্মদ সা. এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে। কাজেই তোমরা কোরায়েশ ও গিতফানকে বল, তারা যেন তাদের কয়েকজন লোককে তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে রেখে দেয়। এই শর্ত পূর্ণ করলে তাদের সাথে সহযোগিতা কর, নচেত ওদের থেকে পৃথক হয়ে যাও।’ এরপর নঈম কোরায়েশ নেতাদের কাছে গেলেন। তাদেরকে বললেন যে, আমার কাছে কিছু তথ্য রয়েছে, যা তোমাদেরকে জানানো আমি জরুরী মনে করছি। বনু কুরায়যা এখন মত পাল্টে ফেলেছে। এর প্রমাণ আপনারা অচিরেই পেয়ে যাবেন। তারা আপনাদের কাছে কিছু লোক যিম্মী হিসেবে চাইবে। ফলে কোরায়েশ বনু কুরায়যাকে জানালো যে আমরা এই দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আর সহ্য করতে পারছিনা। এখন তোমরা যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা কর, তবে একটা চূড়ান্ত হামলা চালাবো। বনু কুরায়যা তাদের কিছু লোক যিম্মী রাখার দাবী জানালো। এবার কোরায়েশ নঈমের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলো। বনু কুরায়যার ওপর তাদের আর আস্থা থাকলোনা। এই কৌশলের ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতির চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।
ইসলামের শত্রুদের ঐক্যে ফাটল ধরার কারণে তারা ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করতে লাগলো। প্রায় এক মাস হয়ে গেল, তারা বাড়ী থেকে বেরিয়েছে। কাজকর্মের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। অনেক টাকা পয়সা ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। অথচ তাতে কোন ফায়দা হলোনা। এদিকে এত বিশাল বাহিনী ও তার পশুদের রসদের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলো। কোরায়েশদের রসদের একটা বিরাট অংশ পথিমধ্যে একটা মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হলো। তাছাড়া আবহাওয়াও প্রতিকূল হয়ে গেল। ঠাণ্ডা সহ্যের বাইরে চলে গেল। এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর প্রভাব খুবই মারাত্মক হয়ে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছার সামান্য একটা ইংগিত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করে দেয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, প্রাকৃতিক উপাদান যুক্ত হয়ে অনেক সময় অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় সত্যের পাল্লাকে ভারী করে দেয়। এক রাতে সহসা এমন ঝড় এল যে, হানাদারদের তাবু উৎপাটিত হয়ে গেল, চুলো নিভে গেল, হাড়িপাতিল ও তৈজসপত্র সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, পশুরা ভড়কে গেল। এক কথায়, তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা একেবারেই বরফ হয়ে গেল। তারা ভীষণ আতংক গ্রস্ত হয়ে যুদ্ধ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলো। এই গায়েবী সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন তোমাদের বিরুদ্ধে সৈন্যসামন্ত সমবেত হলো, আর আমি তাদের ওপর ঝড় পাঠিয়ে দিলাম এবং সেই গায়েবী বাহিনী পাঠালাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি।” (সূরা আহযাব-৯)
সৈন্যদের মধ্যে সর্বব্যাপী ত্রাস, হতাশা দেখে আবু সুফিয়ান বুঝতে পারলো যে, তাদের পক্ষে আর বেশী দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই অকস্মাৎ তারা মদিনা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রসূল সা. বললেন, “এখন কোরায়েশদের আক্রমণের যুগ শেষ হলো।” অর্থাৎ তাদের নিজেদের একক শক্তির ধার তারা বদর ও ওহুদে পরীক্ষা করেছে। আর খন্দকে তারা সারা আরব থেকে মিত্রদেরকে সাথে নিয়ে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়েছে। এ আক্রমণও বিফলে গেল। এখন যেহেতু এত শক্তি একত্রিত করা তাদের পক্ষে আর ভবিষ্যতে সম্ভব হবেনা, কাজেই কোরায়েশ আর কিভাবে ভবিষ্যতে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে? পরবর্তীকালের যুদ্ধে তো আরো বেশী শক্তির প্রয়োজন হবে।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেই খুব কম প্রানহানি হয়েছে। মুসলিম বাহিনীতে হয়েছে অনেক কম। তাদের মোট ৬ ব্যক্তি শহীদ হন। তবে এদের মধ্যে হযরত সা’দ ইবনে মুয়াযের ন্যায় অসাধারণ ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি তীরের আঘাতে আহত হন এবং কয়েকদিন পর ইন্তিকাল করেন।

খন্দক যুদ্ধের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

এ যুদ্ধের শিক্ষামূলক বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
১- সবচেয়ে বেশী ঈমান বৃদ্ধিকারী বিষয় ছিল মুসলিম সেচ্ছাসেবকদের মরণপণ উৎসাহ উদ্দীপনা। তারা শুধু যে এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে পরম ধৈর্য্য ও অটুট মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, বরং খন্দক খননের কাজটা এমনভাবে সম্পন্ন করলেন যেন জ্বিনদের কোন বাহিনী পৃথিবীটাকে ধরে উল্টে দিল। তারা ইসলামী গান গাইতে গাইতে এ কাজ করেছেন।
(আরবী********)
“আমরা সেই সব লোক, যারা মুহাম্মাদের হাতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে আজীবন জেহাদ করে যাবো।”
অপর এক দল গেয়ে ওঠে:
(আরবী********)
“শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে আমাদেরকে সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তা মানিনা।” বিশেষত ‘মানিনা’ ‘মানিনা’। এই শব্দটা যখন সমস্বরে জোরদার আওয়াজে গাওয়া হতো, তখন এক দুর্গম সংকল্প আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতো।”
তাদের এই উৎসাহ উদ্দীপনার একটা কারণ ছিল এইযে, তারা সারা জীবন সংগ্রাম করে এ যাবত যা কিছু অর্জন করেছে, তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র ছিল তাদের কাছে সর্বাধিক প্রিয় বস্তু। এর জন্য তারা তাদের জানমাল সব কিছু উৎসর্গ করাকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করতো। মানবজাতির ইহপরকালীন সর্বময় মংগল সাধনের পবিত্র সংগ্রাম ও সাধনা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ। আর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল এইযে, তাদের প্রিয়তম নেতা তাদের সাথে কর্মক্ষেত্রে শুধু সশরীরে উপস্থিতই ছিলেন না, বরং সক্রিয়ভাবে প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করছিলেন। খননের কাজ যখনই শুরু হলো, রসূল সা. নিজের বাড়ী থেকে কর্মক্ষেত্রে চলে এলেন এবং সন্নিহিত একটা পাহাড়ে তাঁর থাকার জন্য তাঁবু স্থাপন করা হলো। বর্তমানে এই স্থানটাতে ‘মসজিদুয্‌ যুবাব’ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দশ দশ জন করে যে গ্রুপ গঠিত হয়েছিল, তেমনি একটি গ্রুপে রসূল সা. নিজেও সদস্য ছিলেন। এটা একটা সুপ্রসিদ্ধ ব্যাপার যে, হযরত সালমান ফারসী অন্য যে কোন ব্যক্তির চেয়ে দশগুণ বেশী কাজ করতে সক্ষম ছিলেন। এ জন্য প্রত্যেক গ্রুপ তাঁকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতো। এই টানাপোড়নের নিস্পত্তি রসূল সা. এভাবে করলেন যে, তিনি বললেন: ‘সালমান আমাদের পরিবারের গ্রুপের সদস্য।’ এভাবে হযরত সালমানকে সম্মানিতও করা হলো এবং বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দের আশংকা ও দূর হলো। রসূল সা. মাটি কাটা ও বহন করা উভয় কাজই করলেন। এমনকি কোদালে কঠিন পাথর বেধে গেলে সেই পাথর ভাঙ্গার জন্যও তিনি নিজে হাজির হতেন। তিনি নিজ হাতে এ রকম দু’টো পাথর ভেঙ্গেছেন বলে বর্ণিত আছে।
২- এই যুদ্ধের সময় মুসলমানদের অভাব অভিযোগ ও দৈন্যদশা কত তীব্র ছিল, তা আমি আগেই বলে এসেছি। খননের সরঞ্জাম বনু কুরায়যার কাছ থেকে ধার নেয়া হয়েছিল। মাটি বহনের জন্য ঝুড়ির পর্যন্ত সংস্থান ছিলনা। এ জন্য প্রত্যেকে নিজ নিজ কাপড় ব্যবহার করতো। সেই সাথে খাদ্য দ্রব্যেরও ছিল নিদারুন সংকট। যেহেতু তিন হাজার লোক এক নাগাড়ে দু’তিন সপ্তাহ খননের কাজে এবং আরো দু’তিন সপ্তাহ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং সমস্ত কৃষি ও বাণিজ্যিক তত্পরতা বন্ধ ছিল, তাই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়া অবধারিত ছিল। মুসলিম মোজাহেদরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেও একাধারে তিনদিন ধরে উপোষ করেছে। এটাও সবাই হাসিমুখে সহ্য করেছে। কারণ এই উপোষে মুসলমানদের নেতা রসূল সা. নিজেও অংশীদার ছিলেন। বরং তিনি অন্যদের চেয়েও বেশী ক্ষুধা সহ্য করেছেন। কেউ এসে যখন দেখিয়েছে যে, সে ক্ষুধার যন্ত্রনায় পেটে পাথর বেঁধে নিয়েছে, তখন রসূল সা. কাপড় সরিয়ে দেখিয়েছেন যে তিনি দুটো পাথর বেঁধেছেন, ত্যাগ ও কুরবানীর এই গুন ততক্ষণই বহাল থাকে, যতক্ষন দলের সবাই তাতে অংশ গ্রহন করে। কিন্তু কিছু লোক যদি নিজেকে ত্যাগের উর্দ্ধে রেখে ত্যাগ ও কুরবানীর দায়িত্ব শুধু অন্যদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে, তাহলে এ গুন পুরো দল থেকেই উধাও হতে আরম্ভ করে। বিশেষত ইসলামী দলের নেতা ও দায়িত্বশীলদের উচিত যেন এই গুণটিতে অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী থাকতে চেষ্টা করে।
৩- সাধারণভাবে সমাজে শৃংখলা বজায় রাখা এমনিতেও ইসলামী আন্দোলনের অপরিহার্য দাবী। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তো সর্বাত্মক শৃংখলা ছাড়া শত্রুর মোকাবিলা কার্যকরভাবে করাই সম্ভব নয়। রসূল সা. প্রথম যুদ্ধ থেকেই সামরিক শৃঙ্খলার শিক্ষা দিয়েছিলেন। খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত এসে অভিজ্ঞতা অনেক ব্যাপকতর হয়েছিল। তাই খন্দকের যুদ্ধে শৃংখলার দিকটা যথেষ্ট মজবুত ছিল। খন্দকের খনন কার্য পূর্ণ শৃংখলা ও কর্মবন্টনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। তাছাড়া এ কাজের তত্বাবধান ও রণাঙ্গনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পর্যবেক্ষণ মঞ্চ তৈরী করা হয়েছিল এবং পালাক্রমে প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এমনকি মুসলিম মোজাহেদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় বিনিময়ের জন্য সংকেতও নির্ধারিত ছিল। বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতা তদন্তকারী দল ফিরে এসে যখন অভিযোগের সমর্থনে রিপোর্ট দেয়, তখন সেই দলও সাংকেতিক পন্থায় রিপোর্ট দেয়। তদন্তকারী দলের সদস্যরা শুধু বলেছিল “আযাল ও কারা”। অর্থাৎ আযাল ও কারার লোকেরা শিক্ষক দলের সাথে যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, বনু কুরায়যাও তদ্রুপ করেছে। এতদসত্ত্বেও একটা ক্ষেত্রে রাতের অন্ধকারে ভুলবশত মুসলিম মোজাহেদদের দুটো গ্রুপে সংঘর্ষ ঘটে যায় এবং এক ব্যক্তি শাহাদাত বরণ করেন। খনন কার্য শুরু হওয়ার পর থেকে শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কেউ রসূল সা. এর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেনি।
৪- রসূল সা. বনু গিতফানের সাথে আপোষমূলক চুক্তি করার যে পথ বের করেছিলেন, তা থেকে জানা যায় যে, ইসলামী আন্দোলনকে বিপজ্জনক বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার এবং শত্রুর শক্তি খর্ব করার জন্য কখনো যদি কিছুটা পিছু হটতে হয় কিংবা কিছুটা নমনীয় হতে হয়, তবে সেটা তেমন অকল্পনীয় ব্যাপার হবেনা। দীর্ঘ দ্বন্দ-সংঘাতে জড়িত হয়ে যে রকমারি লোকজনের সাথে পরিচয় ঘটে, তাদের সাথে মাঝে মাঝে আপোষমূলক লেনদেন করার প্রয়োজন হতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের বহু জটিল প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং সে সব প্রয়োজন মেটাতে তাকে বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতেই হয়। পরিস্থিতিকে বুঝা ও তা থেকে সর্বোত্তম পথ খুঁজে বের করার যোগ্যতা যে কোন দক্ষ ও সুক্ষ্মদর্শী নেতৃত্বের অপরিহার্য গুন হওয়া উচিত। নীতি ও আদর্শ এক জিনিস, কর্মপদ্ধতি অন্য জিনিস। নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে কোন নমনীয়তা ও আপোষহীনতার কোনই অবকাশ থাকেনা। কিন্তু কর্মপদ্ধতিতে থাকে। যারা নীতির ন্যায় কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলাকে সব অবস্থায় ব্যবহার করতে চায়, তারা ইতিহাসে কোন উল্লেখযোগ্য কীর্তি সম্পাদনে প্রায়ই সক্ষম হয়না।
এ কথা স্বতন্ত্র যে, মদিনার আনসারগণ তাদের ঘাড়ে একটা অসহনীয় বিপদ এসে পড়েছে ভেবে ঘাবড়ে যেতে পারে এই আশংকায় রসূল আগে ভাগেই তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন, আর এ কারণেই তিনি গিফতানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওস ও খাজরাজের নেতৃদ্বয় দৃঢ়তা প্রদর্শন করায় তিনি সান্ত্বনা পেয়ে যান।
৫-এই সমঝোতা প্রস্তাবকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার আগে রসূল সা. আনসার নেতাদের সাথে পরামর্শ করার মাধ্যমে শুরাতন্ত্রকে সুসংহত করে দিলেন। রণাঙ্গণেও তিনি এককভাবে কোন বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন না।
৬-নঈম বিন মাসউদ শত্রুদের ভেতরে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য যে ভূমিকা পালন করেন তা রসূল সা. এর অনুমতি নিয়েই করেছিলেন। রসূল সা. “যুদ্ধ এক ধরনের প্রতারণা” এই মূলনীতির ভিত্তিতেই ঐ কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে জানা যায় যে, (অলংঘনীয় নৈতিক সীমারেখার আওতার মধ্য থেকেই)দ্বন্দ্ব সংঘাতে বা যুদ্ধ বিগ্রহে বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। বরঞ্চ ক্ষেত্র বিশেষে তা অনিবার্য হয়েও পড়তে পারে। চরম বিপদসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যদি সরলতার সাথে নীরব ও নিস্ক্রিয় দর্শক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা হয় এবং কৌশলের পথ অবলম্বন করা না হয়, তবে মহা সর্বনাশও ঘটে যেতে পারে। ইবনে ইসহাকের একটা দূর্বল বর্ণনা হিসেবে না ধরলে নঈম ইবনে মাসঊদ একটা মিথ্যে কথাও না বলে এবং কোন নৈতিকতার সীমা লংঘন না করে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে একটা অসাধারণ কাজ সমাধা করেছিলেন।
৭-রসূল সা. এর গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সাহাবী হযরত সালমান ফারসী বর্ণনা করেন, খনন কার্য চালানোর সময় প্রকান্ড এক পাথরের দেখা পেয়েছিলাম যা আমি কোন ক্রমেই ভাংতে পারিনি। রসূল সা. নিকটেই ছিলেন। আমার কাছ থেকে কোদাল নিয়ে তিনি আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগলেন। প্রথম আঘাতের পর তিনি বললেন, আমার জন্য ইয়ামান বিজিত হলো দ্বিতীয় আঘাত হেনে তিনি বললেন, সিরিয়া ও মরক্কো আমার সামনে মাথা নুইয়েছে।তৃতীয়বারে বললেন, প্রাচ্য অঞ্চল (ইরান) আমার দখলে এসেছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী দু’দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এ দ্বারা বুঝা যায় যে, রসূল সা. প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের স্তরগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। আর এই ধারনার স্বপক্ষে তার কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহিও আসতো। দ্বিতীয়ত চরম প্রতিকূল পরিবেশেও যখন শক্তি সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং বিপদ মুসিবত সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়ে ছিল, তখনো তিনি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতেন যে, ইসলামের বিজয় অবধারিত।
বরঞ্চ আমরা এ কথাও না বলে পারিনা যে, মক্কী যুগ থেকে মাদানী যুগ পর্যন্ত রসূল সা. এর মুখে ইসলামের হাতে আরব বিশ্ব ও অনারব বিশ্ব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে-এই কথাটা এতবার উচ্চারিত হতে দেখা যায় এবং তা সর্বমহলে এত বেশী কথিত যে, এটা ইসলামী আন্দোলনের একটা স্থায়ী শ্লোগানের রূপ ধারণ করে। এ বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করবো। বিভিন্ন দুর্যোগের মুহূর্তে এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে গিয়ে মুয়াত্তাব বিন কুশাইর নামক এক মোনাফেক বলেছিলো যে, একদিক মুহাম্মদ সা. রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সম্রাজ্যের চাবিকাঠি আমাদের হাতে দিয়ে দেন, অপরদিকে আমাদের বাস্তবতা এই যে, আমাদের কোন ব্যক্তি ভয়ে পায়খানায় যাওয়ার জন্যও বাড়ীর বাইরে যেতে পারেনা।
৮-এই যুদ্ধে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে যদিও ‘নারী ও শিশুদেরকে দুর্গের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এ সময়ও মুসলিম নারীগণ উচ্চাংগের ভূমিকা পালন করেছিলেন। রশীদা নামি এক মহিলা কিছু ওষুধপত্র ও ব্যান্ডেজের সরঞ্জামাদি নিয়ে রণাঙ্গনে চলে এসেছিলেন এবং তিনি আহতদের অনেক সেবা করেছিলেন। হযরত সা’দ বিন মুয়াযের ক্ষতস্থানেও তিনি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। নারীদের একটা শিবিরের আশে পাশে জনৈক ইহুদী যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। রসূল সা. এর ফুফু হযরত সফিয়া ওখানেই ছিলেন। অসুস্থতার কারণে হযরত হাসসান ইবনে ছাবেতকে ওখানে রাখা হয়েছিল। হযরত সফিয়া হাসসানকে বললেন ঐ লোকটাকে ধরে ধোলাই দিতে। অসুস্থ হাসসান অপারগতা প্রকাশ করলে দুঃসাহসী নারী হযরত সফিয়া নিজেই একটা কাঠ নিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন। তারপর তার মাথাটাও কেটে দুর্গের বাইরে ছুঁড়ে মারলেন, যাতে অন্যান্য দুস্কৃতকারীরা সাবধান হয়ে যায়। এ ঘটনার পর আর কোন শত্রু ওদিকে যাওয়ার সাহস পায়নি। হযরত আয়েশা যে দুর্গে ছিলেন, সেই দুর্গে হযরত সা’দ বিন মুয়াযের মাও ছিলেন। হযরত আয়েশা রা. দুর্গ থেকে বেরিয়ে পায়ের আওয়ায শুনে তাকিয়ে দেখেন সা’দ বিন মুয়ায একটা বর্শা নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে চলেছেন রণাঙ্গানের দিকে। চলার পথে একমনে কবিতা আবৃত্তি করে চলেছেনঃ
‘একটু থামো, আরো একজন যুবক যুদ্ধে শরীক হোক,
মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন মৃত্যুকে
ভয় করা কী প্রয়োজন?’
সা’দের মা যখন ছেলের কবিতা শুনলেন, তখন উচ্চস্বরে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি চলে যাও সা’দ। তোমার তো অনেক দেরী হয়ে গেছে।’ একটু পরই যখন সা’দ তীরবিদ্ধ হলেন এবং সে আঘাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন, তখন সা’দের কবিতার মর্ম বাস্তব রূপ লাভ করল।
একজন মুসলমান মায়ের আবেগ দেখলেন তো!
৯-খন্দক যুদ্ধের লোমহর্ষক পরিস্থিতিতে নিপতিত নিষ্ঠাবান মুসলমানরা বিপদ মুসিবতের এই তান্ডব দেখে কিছুমাত্র ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার পরিবর্তে স্বতস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠলোঃ “এতো অবিকল সেই পরিস্থিতি, যার সম্মুখীন হতে হবে বলে আল্লাহ ও তার রসূল আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।” বস্তুতঃ এরূপ বিপদসংকুল পরিস্থিতি অতিক্রম না করে পৃথিবীতেও যেমন সত্যের বিজয় সম্ভব নয়, তেমনি আখেরাতেও জান্নাতের নাগাল পাওয়া যায়না। সূরা আহযাবে এরূপ নিবেদিত প্রাণ মোমেনদের প্রশংসা করা হয়েছে। এরাই আন্দোলনের আসল প্রাণশক্তি ও আসল মূলধন।
১০-রসূল সা. সম্পর্কে এ কথা সবার জানা যে, তিনি মুসলমানদেরকে একটা স্বতন্ত্র সভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের মনে এই মূলনীতি খুব ভালোভাবে বদ্ধমূল করেছিলেন যে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংগনে বিজাতীয় অনুকরণ অবাঞ্ছিত। তার পরিবর্তে নতুন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিজস্ব আদর্শের আলোকে গঠন করতে হবে। নিজস্ব ইসলামী অভিরুচি অনুসারে প্রতিটি সাংস্কৃতিক ধারাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। কিন্তু যখন আমরা রসূল সা. কে পরিখা তৈরীর ইরানী প্রতিরক্ষা কৌশলকে খোলা মনে গ্রহণ করতে দেখি, তখন বুঝা যায় যে, বস্তুগত উপায় উপকরণ, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কারিগরি তথ্যের আদান প্রদানকে সমগ্র মানবজাতির জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কোন এক সময় যে সব উপায় উপকরণ, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কারিগরি তথ্য ও রীতিনীতি কার্যকর থাকবে সেগুলোকে সকল যুগে, সকল সংস্কৃতিতে ও সকল পরিস্থিতিতে অবিকল সেইভাবে কার্যকর করা অপরিহার্য মনে করতে হবে, এটা জরুরী নয়। এ সব জিনিসকে শরীয়ত বা সুন্নাত নামে আখ্যায়িত করতে হবে, এটাও জরুরী নয়। এ সব ব্যাপারে অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতি থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করা উচিত। একটা ইসলামী রাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বের জন্য ইসলামের দৃষ্টিতেই এটা অপরিহার্য কর্তব্য যে তারা সমকালীন সর্বাধিক প্রভাবশালী উপায় উপকরণকে কাজে লাগাবে, কারিগরি বিদ্যা ও প্রযুক্তিতে নিজ জনগণকে এগিয়ে নেবে এবং সর্বাধিক সফল প্রযুক্তি অন্যদের কাছ থেকেও শিখবে, নিজেরাও উদ্ভাবন করবে।

খন্দক যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত

খন্দক যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের মধ্যবর্তী এই দু’বছরে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও ছোট ছোট সামরিক অভিযান সংঘটিত হয়। পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া খুবই জরুরী।
ইহুদী জাতির নৈতিক ও মানসিক বিকৃতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ ছিল বনু কুরায়যা গোত্র। কু-প্রথা ও কু-কর্ম ছিল তাদের মজ্জাগত স্বভাব ও সর্বব্যপী চরিত্র। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তার নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সব ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে এবং গোলযোগ সৃষ্টি করে আসছিল। তবে খন্দক যুদ্ধে খোলাখুলি চুক্তি লংঘন করে হানাদার শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বাধা ছিল তাদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা সুলভ কাজ। এ অপরাধের সাথে জড়িতদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া কোন যুগে ও কোন দেশেই অন্যায় বা যুলুম বলে বিবেচিত হতে পারেনা। তারা রসূল সা., ইসলামী দল, ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার কোন চেষ্টাই বাদ রাখেনি। তাই তাদেরকে সমুচিত শাস্তি না দেয়ার কোনই যুক্তি ছিলনা। হানাদার কোরায়েশ ও তাদের মিত্রদের বাহিনীগুলো বিদায় হওয়ার পর রসূল সা. ও মুসলমান সেচ্চাসেবকগণ সকালে খন্দকের ঘাঁটিগুলো ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে গেলেন। অস্ত্র রেখে রসূল সা. গোসল করলেন। ঠিক এই সময়ে তাঁর কাছে ওহি এল, বনু কুরায়যার দিকে রওনা হয়ে যাও। এখনো মোজাহেদরা যুদ্ধের পোশাকও খোলেনি, এমতাবস্থায় তাদেরকে একটা নতুন অভিযানে ডাকা হলো। মুসলিম বাহিনী এই বিশ্বাসঘাতক গোত্রটাকে অবরোধ করলো। এ অবরোধ অব্যাহত থাকলো এক নাগাড়ে ২৫ দিন। ঠিক এই নাজুক মুহূর্তেও তারা দুর্গের ওপর থেকে রসূল সা. কে গালি দিল। অবশেষে বনু কুরায়যা অস্থির হয়ে উঠলো। তাদের সরদার কা’ব বিন আসাদ উৎকন্ঠা থেকে উদ্ধর পাওয়ার জন্য কয়েকটা প্রস্তাব মুসলমানদের কাছে পেশ করলো। কিন্তু মুসলিম বাহিনী এর কোনটাই গ্রহণ করলোনা। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা বিনাশর্তে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পন করলো। রসূল সা. তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে তাদেরই সম্মতিক্রমে সা’দ বিন মুয়াযকে সালিশ নিয়োগ করলেন। উভয় পক্ষ থেকে সা’দকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হলো। সা’দ ইহুদীদের কিতাব তাওরাতের বিধান অনুসারে রায় দিলেন যে, বনু কুরায়যার সকল যুবক পুরুষকে হত্যা করা হোক। এভাবে একটা কুচক্রী গোষ্ঠীর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি খর্ব করা হলো। উল্লেখ্য যে, এহেন চরম তিক্ততার মুহূর্তেও বনু কুরায়যার এক ব্যক্তি উমর বিন সা’দ ইসলাম গ্রহণ করে। এই সৎ ব্যক্তি বনুকুরায়যাকে চুক্তি লংঘন করতে বারবার নিষেধ করেছিল। কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত করেনি।
এ ঘটনার পর ইসলামের দুর্ধর্ষ কুচক্রী শত্রুদের একজন আবু রাফে আব্দুল্লাহ বিন আবুল হাকীক(যাকে সাল্লামও বলা হতো) সিরিয়ার কতিপয় খাজরাজী যুবকের হাতে নিহত হয়। সে খন্দক যুদ্ধে কাফেরদের পক্ষে সৈন্য সংগ্রহের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছিল।
মুহাম্মদ বিন মুসলিমা আনসারী যখন ৩০ ঘোড়া সওয়ার জওয়ানকে সাথে নিয়ে সীমান্ত টহলে নিয়োজিত ছিলেন, তখন তার সাথে নাজদ অঞ্চলের সরদার ছামামা বিন আছালের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। ছামামাকে মদিনা অভিমুখে যেতে দেখে ঐ সেনাপতি তাকে গ্রেফতার করেন এবং রসূল সা. এর কাছে নিয়ে আসেন। সে রসূল সা. কে বললোঃ “হে মুহাম্মদ, আমাকে যদি তুমি হত্যা কর, তবে তুমি জানবে যে হত্যার যোগ্য ব্যক্তিকেই হত্যা করেছ। আর যদি ছেড়ে দাও, তবে জানবে যে, অনুগ্রহের কদর দিতে জানে এমন ব্যক্তিকেই ছেড়ে দিয়েছ। আর যদি তুমি অর্থ সম্পদ চাও তবে পরিমান বল দেয়া হবে।” রসূল সা. তাকে সসম্মানে ছেড়ে দিলেন। সে এই অনুগ্রহে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইসলাম গ্রহণ করার পর সে অকপটে স্বীকার করলো যে, “আজকের পূর্বে আমার কাছে মুহাম্মদ সা. এর চেহারার চেয়ে ঘৃণিত আর কারো চেহারা ছিলনা, আর আজ তাঁর চেহারার চেয়ে প্রিয় কোন চেহারা আমার কাছে নেই।” এভাবে নাজদের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঞ্চলে ইসলামের জন্য পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।এই ছামামাই মক্কায় গিয়ে কোরায়েশকে চ্যালেঞ্চ করেছিল যে, এখন তোমরা এক দানাও খাদ্যশস্য পাবেনা।
হযরত খুবায়েব সহ সাত সদস্যের শিক্ষক দলকে হত্যাকারী রজীবাসীকে শাস্তি দেয়ার জন্য রসূল সা. দু’শো ঘোড়াসওয়ার জওয়ানকে নিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তারা পালিয়ে গেল এবং কোন সংঘর্ষ ছাড়াই তিনি ফিরে এলেন। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে রসূল সা. দশজনকে টল দিতে ‘কুরাউন নাঈম’ পর্যন্ত পাঠালেন, যাতে কোরায়েশরা বুঝতে পারে যে, মদিনা অত্যন্ত সজাগ।
মদিনা থেকে এক মনযিল দূরে বনু গিতফানের অঞ্চলের দিকে ‘যী কিরদ’ নামক একটা জলাশয় রয়েছে। এর কাছেই মদিনার সরকারী উট ও গবাদি পশুর চারণ ক্ষেত্র ছিল। উসফানের এক ব্যক্তি সেখানে রাখাল হিসেবে নিয়োজিত ছিল। রসূল সা. রাবাহ নামক এক ভৃত্যকে খোঁজখবর নেয়ার জন্য পাঠালেন। সালমা ইবনুল আকওয়া সামরিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনিও (কেন্দ্রস্থলে যাচ্ছিলেন। সকাল বেলা তারা যখন পথিমধ্যেই ছিল, তখন উয়াইনা বিন হিসন ফিযারী (বা আবদুর রহমান বিন উয়াইনা) ও তার সাথী একদল ডাকাত উটগুলোকে লুন্ঠন করলো এবং হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। ডাকাত সরকারী রাখালকে হত্যা করলো এবং তার স্ত্রীকেও অপহরণ করে নিয়ে চললো। সালমা ইবনুল আকওয়া এই নৃশংস হত্যা ও লুটপাটের দৃশ্য দেখে মদিনার দিকে মুখ ফিরিয়ে “ইয়া সাহাবা” বলে উচ্চস্বরে হাঁক দিলেন এবং রাবাহকে সাহায্য আনার জন্য পাঠালেন। এদিকে নিজে একাকী ডাকাতদের ধাওয়া করে ছুটে গেলেন। ডাকাতদের পেছন থেকে হাঁক দিয়ে তীর মেরে মেরে এক এক ডাকাতকে ধরাশয়ী করতে করতে তিনি এগিয়ে গেলেন। তীরের আঘাতে যখনই একজন ডাকাত ধরাশয়ী হয়, তখন তিনি চিৎকার করে বলেন, “আমি ইবনুল আকওয়া। আজ পরীক্ষার সময় যে, কে তার মায়ের বুকের দুধ কতটা খেয়েছে।” পথটা ছিল পর্বত সংকুল এবং আশপাশে ছিল গাছগাছালি। ডাকাতরা পেছনে তাকাতেই ইনি আত্মগোপন করতেন এবং তীর নিক্ষেপ করতেন। অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল প্রয়োগ করছিলেন। একবার পাথর মেরে ডাকাতদের এত পর্যুদস্থ করে ফেললেন যে, তারা দিশেহারা হয়ে প্রথমে অপহৃত উটগুলো ছেড়ে দিল, তারপর দেহের বোঝা কমানোর জন্য চাদর ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলতে লাগলো। ওদিকে মদিনা থেকে সালমার সাহয্যের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মেকদাদ বিন আমরকে পাঠিয়ে, অতপর রসূল সা. স্বয়ং একটা সেনাদল নিয়ে রওনা হলেন। কয়েকজন মুসলিম সৈনিক ডাকাতদের একবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলে ডাকাতরা আরো দ্রুতগতিতে ছুটতে লাগলো। এই মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে মেহরায় বিন নাযলা ওরফে আখরমকে হয়তো শাহাদাতের নেশায় পেয়ে বসেছিল। তিনি একাকী ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করে অনেক দূরে চলে গেলে ডাকাতরা তার সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিল। আখরাম শহীদ হলেন। এরপর আবু কাতাদা একজন বড় ডাকাতকে হত্যা করলেন। হযরত সালমা বিন আকওয়া আরো ধাওয়া করতে থাকলেন এবং ঘোড়াগুলো কেড়ে নিয়ে ফিরে এলেন। এসে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে বললেন, আপনি একশো সৈনিক যদি আমার সাথে দিতেন, তবে আমি ওদের সবাইকে খতম করে আসতাম। রসূল সা. বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে বিজয়ী করেছেনই, তখন এবার নমনীয় হও।” এই সাহাবীদের বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখুন। প্রত্যেকের মধ্যে যেন বিদ্যুত প্রবাহিত। তাদের ভূমিকা ও চরিত্র সাধারণ দাঙ্গাবাজ লোকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্যের জন্য প্রাণপ্রণ সংগ্রাম করতেন। সেই লক্ষ্যের সাথে তাদের এমন প্রেম ছিল যে, কোন পুরস্কার প্রপ্তির প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তারা জীবনের ঝুঁকি নিতে পারতেন এবং যে যুদ্ধেই নামতেন, প্রতিপক্ষকে চোখ না দেখিয়ে ছাড়তেন না।
একটা টহল দল উক্কাশা বিন হিসন আযদীর নেতৃত্বে সীমান্ত প্রহরা দিতে বেরুলেন। গুজব রটেছিল যে, বনী আসাদ গোত্র মদিনা আক্রমণ করার জন্য সমবেত হচ্ছে। মুসলিম সেনাদল যখন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছল তখন ষড়যন্ত্রকারীরা নিজ নিজ বাড়ীঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। চারণভূমি থেকে মুসলিম সৈন্যরা তাদের দু’শো উট বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এলেন।
৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে মুহাম্মদ বিন মোসলেমার নেতৃত্বে একটা শিক্ষামূলক ও দাওয়াতী দল বনু সালাবা গোত্রের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারা যিল কুচ্ছা’ নামক স্থানে পৌঁছলে রাতের বেলা ঘুমন্ত অবস্থায় তাদেরকে শহীদ করে দেয়া হয়। কেবল দলনেতা মুহাম্মদ বিন মোসলেমা নিদারুন আহত অবস্থায় বেঁচে যান। একজন মুসলমান তাকে ঘাড়ে করে মদিনায় পৌঁছে দেয়। রবিউস সানী মাসে হযরত আবু উবায়দা রা. চব্বিশজন সৈন্য নিয়ে অপরাধীদেরকে শস্তি দিতে রাতের বেলা রওনা হলেন এবং খুব ভোর বেলা আক্রমণ চালালেন। নৈরাজ্যবাদীরা পালিয়ে গেল এবং তাদের সকল সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো।
যায়েদ বিন হারেসা একটা টহল দল নিয়ে (বাতনে নাখলার কাছে অবস্থিত) জামুহের দিকে গেলেন। এখানে ছিল বনু সুলাইমের পল্লী। তারা পরস্পরে যুদ্ধরত দু’টো পক্ষ। একে অপরের ক্ষতি সাধনের কোন সুযোগই হাত ছাড়া করতোনা। তাছাড়া হালিমা নাম্নী এক মহিলা তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরিও করেছিল। টহল দল হালকা ধরনের আক্রমণ চলিয়ে তাদের কতিপয় ব্যাক্তিকে গ্রফতার ও কিছু গবাদী পশু হস্তগত করলো। পরে রসূল সা. গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তিদের সবাইকে মুক্তি দিলেন। কেননা হালিমা ভূল তথ্য জানিয়েছিল।
যায়েদ বিন হারেসা (নিজে বাদে) ১৪ জনের একটা ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে যিল কুচ্ছার অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য বনু সালমার জলাশয়ের দিকে চলে গেলেন। অপরাধীরা পালিয়ে যায়। তাদের ২০টা উট বাজেয়াপ্ত করা হয়। দুমাতুল জান্দালের রাজনৈতিক অর্থেনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বের বিষয় আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয় গুরুত্বসম্পন্ন এ জায়গাটা এখনো ঝুঁকির মধ্যে ছিল। রসূল সা. প্রথমে ওদিকে মনোযোগ দিলেও ইপ্সিত লক্ষ্য পূর্ণ না করেই ফিরে এসছিলেন। এবার হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফকে দাওয়াতী কাজে দুমাতুল জান্দাল পাঠানো হলো। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রথমে স্থানীয় বড় গোত্রের খৃষ্টান নেতা আসম বিন আমর কালবী এবং তার সাথে সাথে গোটা খৃষ্টান গোত্র মুসলমান হয়ে গেল। গোত্রের নেতা স্বীয় কন্যা তামাযুরকে হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফের সাথে বিয়ে দিল। এভাবে সে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে নিজের রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে নিল।
ফিদক থেকে মদিনায় খবর এলো যে, বনু সা’দ বিন বকর গোত্রটি সামরিক শক্তি সংগ্রহ করেছে, যাতে ইসলামী সরকারের ক্ষথি সাধনে খয়বরের ইহুদীদেরকে সাহায্য করা যায়। হযরত আলী দুশো সৈন্য নিয়ে অতি সন্তর্পনে রওনা দিলেন। রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনে লুকিয়ে থাকতেন। পথিমদ্যে বন সা’দের এক দূতকে খয়বরের দিকে যাত্রারত অবস্থায় পাকড়াও করা হল। সে খয়বরের ইহুদীদের কাছে বার্তা নিয়ে যাচ্ছিল যে, খয়বরের সমস্ত খেজুর বনু সা’সাদকে দিলেই তবে সাহায্য দেয়া হবে। হযরত আলী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে দিলেন। তারা পালিয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর কো্ন ক্ষয়ক্ষতি হলো না। উপরন্তু তারা বনু সা’দের পশুগুলো ধরে নিয়ে এলেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল এই যে, যায়েদ বিন হারেসা নিজের ও অন্যান্য সাহাবীর পুজি নিয়ে সিরিয়ায় বাণিজ্য সফরে যান। ফেরার পথে ওয়াদিউল কুরায় বনুবদর তাদের কাফেলায় ডাকাতি করে। কাফেলার লোক সংখ্যা কম ছিল। তাই ডাকাতরা 9 জনকে শহীদ করে ফেলে একজনকে আহত করে সমস্ত পণ্যদ্রব্য ছিনিয়ে নিল। অবশেষে দু’মাস পর হযরত আবু বকরের নেতৃত্বে অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য একটা সেনাদল পাঠানো হয়। এত কতিপয় ডাকাতি নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়।
আকল ও উরাইনা নামক দুটো গোত্রের কিছু লোক মদিনায় এসে মুসলমান হয়। কিন্তু নতুন আবহাওয়ায় তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মদিনার বাইরে সরকারী ব্যবস্থায় তাদেরকে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। সুস্থ হলে তারা সরকারী রাখালকে পাড়াও করলো, তার চোখে উত্তপ্ত লোহার শলাকা ঢুকালো, অতপর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পশুগুলোকে নিয়ে পালিযে গেল। রসূল সা. কারজ বিন খালেদ ফেহরীর নেতৃত্বে ২০জন ঘোড় সওয়ার সৈনিকের একটি দল তাদেরকে ধরে আনার জন্য পাঠালেন। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো এবং তাদের ইসলাম পরিত্যাগ, ডাকাতি, হত্যা যুদ্ধ ও নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের দায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলো। তাদের কাছ থেকে ন্যায় সংগতভাবে প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। নচেত একটা সুসংগঠিত ও জনসমর্থনপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে যদি যে কোন লোক এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখাতে থাকে, তাহলে সবকিছু তামাশায় পরিণত হয়ে যেতে বাধ্য এবং একদিনের জন্যও কোন প্রশাসন চালানো সম্ভব নয়।
এ সময়কার সবচেয়ে বড় ঘটনা তথা রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পরিস্থিতির ওপর সবচেয়ে সুদূর ‍প্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা ছিল হোদাইবিয়ার সন্ধি। রসূল সা. ৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে হোদাইবয়া নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। ওখানে কোরায়েশদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করে তিনি সবচেয়ে বড় শত্রুর দিক থেকে নিশ্চিত হয়ে যান এবং দাওয়াতী ও গঠনমূলক কাজ করার জন্য ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। তাছাড়া মদীনার সন্নিহিত অঞ্চলে নৈরাজ্যবাদীদের উচ্ছেদ করা সহজ হয়ে যায়।
হোদাইবিয়া থেকে রসূল সা.জিলহজ্জ মাসে মদিনায় ফিরে আসেন এবং কয়েকদিন পর ৭ই মুহাররম খয়বর রওনা হয়ে যান। খয়বর ইসলাম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় একটা রাজনৈতিক ঘাঁটিও ছিল এবং সামরিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রও ছিল। খয়বর এর ইহুদীরা শুধু যে ওহুদ যুদ্ধের সময় ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতামুলক আচরণ করেছিল তাই নয়, বরং খন্দক যুদ্ধেও তারা অত্যান্ত সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল। খয়বরের যুদ্ধ একটা অসাধারণ ও বড় আকারের যুদ্ধই ছিল। কিন্তু আমি এটা এক একটা মামুলি অভিযান হিসেবে গন্য করেছি এ জন্য যে, এটা বদর, ওহুদ ও খন্দকের পর্যায়ের যুদ্ধ নয় এবং তার ধারাবহিকতাও নয়। এটা একটা ভিন্ন ধরনের সামরিক কার্যক্রম। যেহেতু ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত তখনো আন্তর্জাতিক যুগে প্রবেশ করেনি এবং কোরায়েশ ও আরব জনগনের মত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও অন্যান্য ধর্মের লোকদেরকে এ দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে সম্বোধন করা হয়নি, তাই খয়বরের ইহুদীদের সাথে এ দাওযাত গ্রহণ না করার কারণে কোন সংঘাত বাধেনি, সংঘাত বেধেছিল তাদের রাজনৈতিক অপরাধের কারণে। এ জন্য তাদের সাথে আচরণ করা হয়েছে রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে। তারা যখন যুদ্ধে হেরে গেল, তখন তাদের এলাকাকে বিজিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হলো এবং তাদেরকে প্রজার মর্যাদা দেয়া হলো। রসূল সা. এ ধরনের আচরণ শুধু খয়বরেই চালু করেছিলেন আর কোথাও নয়। যাহোক, কোরায়েশদের দিক থেকে নিরাপদ হয়ে যাওয়ার পর খয়বরে আক্রমণ চালানোর পথে আর কোন বাধা থাকলোনা। এত শুধু সেই সব লোককেই অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হলো, যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জেহাদের আবেগ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে। উল্লেখ্য যে, এই অভিযানে মুসলমান মহিলারাও রসূল সা. কে না জানিয়ে যোগদান করেছিল। পরে রসূল সা, যখন জানতে পারলেন, তখন তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমরা কেন এসছে? তারা যখন জানালো যে তারা মুসলিম যোদ্ধাদের সেবা করার জন্য এসেছে, তখন তিনি সম্মতি দিলেন। এমনকি পরে যুদ্ধলব্ধ গণিমতের অংশও তাদেরকে দিয়েছিলেন। মদিনায় সিবা বিন আরাফতাকে অস্থায়ী শাসনকর্তা নিযুক্ত করে চৌদ্দশো সৈন্য সাথে দিয়ে রসূল সা. রওনা হলেন। ‘রজী’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। মুসলিম সৈন্যরা যখন খয়বরের ইহুদীদের সামনে হঠাৎ করেই আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন তারা পালিয়ে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলো। তারপর শুরু হলো যুদ্ধ। উভয় দিক থেকে তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ চলতে লাগলো। অবশেষে মুসলমানদের জয় হলো। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নাতাত দুর্গ আক্রমেণর মধ্যে দিয়ে। এবার অবরোধ করা হলো সা’ব দুর্গকে। মুরাহহাব নাম ইহুদী মুসলমানদের কে চ্যালেঞ্জ করলো। আমের ইবনুল আকওয়া তার সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হলেন। তথাপি এ অবরোধ সফল হলো। সবচেয়ে মজবুত ছিল কামূস দুর্গ। রসূল সা. প্রচন্ড মাথা ব্যাথার কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তিনি বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে হযরত আলীকে রা. এই অভিযানে পাঠালেন। ইহুদী বীর মুরাহহাব যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে এগিয়ে এলো। মুহাম্মদ বিন মোসলেমা নিজের ভাই এর হত্যার প্রতিশোধের ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং মুরাহহাবের পা কেটে ফেললেন। তার হযরত আলীর রা. তরবারী তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিল। মুরাহহাবের পর এল তার ভাই ইয়াসির। তার সাথে সম্মখে সময়ে এলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম এবং তাকে খতম করে দিলেন। ২০দিন অবরোধের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গ মুসলমানদের দখলে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে এই দুর্গ জয় করা হয় বলে তাঁকে ‘খয়বর বিজয়ী’ বলা হয়ে থাকে। ইহুদীরা যখন এই দুর্গ থেকে পালায়, তখন ইসলামের কুখ্যাত শত্রু ইহুদী নেতা হুয়াই বিন আখতাবের কন্যা সফিয়া তার দুজন চাচাতো বোন সহ বন্দী হয়ে আসেন। তিনি একজন গণ্যমান্য গোত্রপ্রধানের কন্যা বিধায় সাহাবীদের সাথে পরামর্শক্রমে রসূল সা. তাকে নিজের পারিবারিক হেফাজতে রাখেন। এরপর ইহুদীরা আযযুবাইর দুর্গে সমবেত হয়। এখানে তিন দিন অবরুদ্ধ থাকার পর বেরিয়ে এসে তারা তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দশজন ইহুদী নিহত হয় এবং কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। শেষ পর্ন্ত এই দুর্গ বিজিত হয়। এবার তিনটে দুর্গ অবশিষ্ট রইল। তা হচ্ছে আল কুতাইবা, আল ওয়াতীহ ও আস-সালেম। ইহুদীদের সমস্ত জনবল ও অর্থবল ঐ তিনটে দুর্গে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনী চৌদ্দ দিন অবরোধ অব্যাহত রাখলো। অবশেষে কামান চালিয়ে পাথর বর্ষন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অবরুদ্ধরা যখন জানতে পারলো, তখন আর কোন উপায়ান্তর ছিলনা। তারা আপোষ-আলোচনা চালালো। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা শুধু জীবন নিয়ে পালাতে পারবে। কিন্তু তারা যখন আবেদন জানালো যে, তাদেরকে ক্ষেত ও বাগানের কাজে লাগানো হোক এবং থাকতে দেয়া হোক, তখন রসূল সা. মহানুভবতা দেখালেন এবং সম্মতি দিলেন। অর্ধেক উৎপন্ন ফসলের বিনিময়ে তাদের সাথে বন্দোবস্ত হলো। ফিদিকাবাসী যখন এ বন্দোবস্তের কথা জানলো, তখন তারাও এর জন্য আবেদন জানালো। তাদেরকেও একই ধরনের বন্দোবস্ত দেয়া হলো। এই কার্যক্রমের সময় দুজন ইহুদী যুবক হুয়াইসা ও মাহীসা ইসলাম গ্রহণ করে।
নাতাত দুর্গে অবরোধ চলাকালে খয়বরবাসীর মধ্যে থেকে জনৈক নিগ্রো রাখাল আসওযাদের মধ্যে মানসিক ভাবান্তর উপস্থিত হয়। সে ইহুদীদের কাছে জিজ্ঞেস করে, কার সাথে যুদ্ধ হচ্ছে? তরা বললো, নবুয়তের দাবীদারের সাথে। এই কথা শুনেই তার মনে কৌতুহল জাগে এবং সে রসূল সা. এর কাছে এসে জানতে চায়, আপনার দাওয়াত কী? রসূল সা. ইসলামের তাওহীদের বিস্তারিত বিবরণ তাকে অবহিত করেন। আসওয়াদের মনমগজ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে,ইহুদীদের ছাগল ভেড়ার পাল আমার দায়িত্বে রয়েছে। এগুলো কি করি? রাসুল স. ইচ্ছে করলে ইহুদীদের ছাগল ভেড়া দখলে নিয়ে মুসলিম সৈন্যদের রসদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই পরিস্থিতিতে আসওয়াদ রাখালকে আমানতদারী বজায় রাখার নির্দেশ দেন। সে রসূলের নির্দেশ অনুসারে ছাগল ভেড়াগুলোকে দুর্গের কাছে নিয়ে যেয়ে পাথর মেরে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। তারপর সে রসূল সা. এর কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, আমি যদি যুদ্ধ করে মারা যাই, তাহলে আখেরাতে আমার কী হবে? রসূল সা. তাকে বললেন, জান্নাত পাবে। সে আন্তরিকতার সাথে যুদ্ধ করলো ও শাহাদাত লাভ করলো।

জনৈক নওমুসলিম বেদুঈন খয়বরের যুদ্ধে শরীক হলো। তার জন্য যখন গনীমেতের অংশ নির্ধারণ করা হলো, তখন সে বললো, “হে রসূল, আমি এ জিনিসের লোভে আপনার পেছনে ‍আসিনি, আমি এসেছি যাতে সত্যের পথে জান দিতে পারি এবং জান্নাত পাই।“ রসূল সা, তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, তোমার সে উদ্দেশ্যও সফল হবে। অতপর সেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো এবং শাহাদাত লাভ করলো।
খয়বর বিজয়ের অল্প পর যখন আকস্মিকভাবে হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (হযরত আলীর ভাই) তার বহু সংখ্যক সাথী সমেত আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এসে রসূল সা. ও অন্যান্য মুসলিম ভাইদের সাথে মিলিত হলেন, তখন খয়বর বিজয়ের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে গেল।
বনু সুলাইম অধ্যূষিত অঞ্চলের খনিগুলোর মালিক হুজ্জাজ বিন আলাত সালামী খয়বরের অবরোধ কালেই মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি খয়বর বিজয়ের পূর্নতা প্রাপ্তির আগে রসূল সা. এর কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে দ্রুত মক্কায় যান এবং সেখানে অবস্থানরত হযরত আব্বাসকে খয়বর বিজয়ের আগাম সুসংবাদ জানান।
খয়বরের বিষয়টি নিস্পত্তি হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম সৈন্যরা ওয়াদিউল কুরা অভিমুখে রওনা হলো। ওটাও ছিল ইসলামের শত্রুদের একটা জঘন্য আখড়া। ওখানে ইহুদীদের পাশাপাশি কিছু আরবও থাকতো। মুসলিম সৈন্যরা যাওয়া মাত্রই সামনের দিক থেকে পাথর বর্ষণ করা হলো এবং মুদায়াম নামক একজন ক্রীতদাস আহত হলো। রসূল সা. এর পক্ষ থেকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতে লাগলো। কিন্তু ওদিক থেকে এক একজন যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো এবং মুসলিম সৈন্যদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে মারা পড়তে লাগলো। এভাবে এক নাগাড়ে এগারো জন আসলো। রাত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকলো। পরদিন ভোর বেলা চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো। অতপর পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত সমূহ অনুসারে ওয়াদিউল কুরার অধিবাসীদেরকেও ক্ষেতখামারে ও কৃষি কাজে নিযুক্ত করা হলো এবং তাদের জন্য তাদের মধ্য থেকেই শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলো। তায়মার ইহুদীরা যখন এখানকার বন্দোবস্তের কথা জানতে পারলো, তখন তারা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং তাদেরকেও তাদের ভূমিতে কৃষি কাজে নিযুক্ত করা হলো।
এই বিজয়াভিযানের ফলে যে বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি মুসলমানদের দখলে আসে, তার মধ্য থেকে ফিদিক ও খয়বরের ভূমিকে সরকারী খাস ভূমিতে (State Land) পরিণত করা হয়। এ ভূমির লব্ধ সম্পত্তি থেকে রাষ্ট্রের শাসকবর্গ তাদের ওপর নির্ভরশীল লোকজন এবং সমাজের দরিদ্র লোকদের ভরণ পোষণ চালানো হতো। এই খাস জমি সম্পর্কেই কিছু মতভেদ দেখা দিয়েছিল রসূল সা. এর ইন্তিকালের পর। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এবং দূরদর্শী সাহবীগণ ঐ জমিগুলোকে যথারীতি সরকারী খাস জমি হিসেবেই বহাল রাখেন। অন্যান্য জমি মুসলমানদের মালিকানায় অর্পিত হয় এবং তার ফসল তাদের মধ্যে বন্টিত হয়।
হযরত ওমরের নেতৃত্বে একটা টহলদার সেনাদল বনু হাওয়াযেনকে সতর্ক করতে যায়। ফলে বনু হাওয়াযেন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বশীর বিন ওয়ারিক (বা উসাইর বিন রাযাম) নামক জনৈক ইহুদী সম্পর্কে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে সে বনু গিতফানকে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিচ্ছে। আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা একটা সেনাদল নিয়ে গেলেন এবং বশীরকে কোন প্রকারে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাযী করালেন মদিনায় গিয়ে রসূল সা. এর সাথে আলাপ আলোচনা করতে। মুসলমানরা যেহেতু সংখ্যায় ত্রিশ জন ছিল, তাই সেও সতর্কতাবশত ত্রিশজন লোক সাথে নিল এবং প্রত্যেকটা উটের ওপর একজন ইহুদী ও একজন মুসলমান যৌথভাবে আরোহন করলো। বশীর রাতের অন্ধকারে আব্দুল্লাহর তরবারীতে হাত দেয়া মাত্রই তিনি চমকে উঠে উটের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন এবং তরবারী কোষমুক্ত করে ওর মুখোমুখী হলেন। উভয় নেতাকে এ অবস্থায় দেখে উভয়ের সাথীরাও লড়াই শুরু করে দিল এবং শেষ পর্যন্ত একত্রিশজন ইহুদী সবাই একে একে নিহত হলো।
সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসে কথা। বনু গিতফান, বনু মুহারিব, বনু ছালাবা ও বনু আনমার- এই চারটে গোত্র মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলো শোনা গেল। রসূল সা. ৪০০ লড়াকু মুসলমানকে সাথে নিয়ে অভযানে বেরুলেন। আক্রমনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ অভিযানকে বলা হয় “যাতুর রিকা অভিযান”।
হোদাইবিয়ার সন্ধির পর মুসলমানদের জন্য বাণিজ্যিক সড়ক উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আবু জান্দাল কোরায়েশদের আটকাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মক্কা ছেড়ে পালালেন, তখন ঐ সন্ধি চুক্তির একটা কঠোর ধারার দরুন মদিনা না যেতে পেরে সমুদ্রোপকূলবর্তী একটা সিরীয় পাহাড়ে থাকতে লাগলেন। পরে আবু বছীর ও অন্যান্য মুসলমানরাও তার সাথে যোগ দিতে লাগলো। এভাবে মুসলমানদের রীতিমত একটা সেনাদল গঠিত হয়ে গেল সিরীয় ভূমিতে। তারা কোরায়েশদের একটা কাফেলার ওপর আক্রমন চালিয়ে তার মালামাল কেড়ে নিল। কিন্তু রসূল সা. তাদেরকে মালামাল ফেরত দিতে নির্দেশ দিলে তারা তৎক্ষনাত নির্দেশ মান্য করলো। এবার কোরায়েশ বুঝলো ও অনুতপ্ত হলো যে, সন্ধি চুক্তিতে অমন কঠোর ধারা যুক্ত করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে রসূল সা. আবু জানদালকে মদিনায় ডেকে নেন।
বনু মালুহ বশীর বিন সুয়াইদের সাথীদের হত্যা করলে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য আব্দুল্লাহ লাইসী একটা সেনাদল নিয়ে গেলেন। সামান্য সংঘর্ষ হলো এবং শত্রুদের কিছু জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হলো।
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবার থেকে রসূল সা. এর দূত দিহ্য়া কালবী উপঢৌকনাদী নিয়ে মদীনায় ফিরছিলেন। হুনাইদ বিন ইওয়ায জাফরী ডাকাতি করে তার কাছ থেকে সমস্ত উপঢৌকন ছিনিয়ে নেয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এহেন জঘন্য আক্রমণ পরিচালনাকারী হুনায়েদকে শাস্তি দিতে যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে একটা সেনাদল প্রেরিত হলো। সংঘর্ষে হুনায়েদ নিহত হলো। তবে তার সাথীরা তওবা করে ইসলাম গ্রহণ করলো।
বনু কিলাব বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. বিদ্রোহ দমন করতে সসৈন্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সংঘর্ষের পর শত্রু সেনারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল।
জুহাইনা অঞ্চলে বিদ্রোহের আশংকা দেখা দিলে সে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে উসামা ইবনে যায়েদকে একটা সেনাদলসহ পাঠানো হলো। তিনি প্রথমে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ হলো। এই সময় হযরত উসামা সুহাইক বিন মিরদাসকে ধাওয়া করলে সে কালেমা তাইয়েবা পড়লো। কিন্তু উসামা মনে করলেন, সে পরাস্ত হয়ে জান বাঁচাবার ফন্দি এঁটেছে। তাই তাকে তিনি হত্যা করলেন। পরে ঘটনা শুনে রসূল সা. মর্মাহত হন। কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সংশোধন করা হত্যা করা নয়।
খয়বরের ইহুদীদেরকে সাহায্যকারী ফাযারা ও আযরা নিবাসীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য বশীর বিন সা’দ খাজরাজীকে ক্ষুদ্র একটা সেনাদলসহ পাঠানো হয়। সামান্য সংঘর্ষেই প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়।
বনু সুলাইম মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এই মর্মে তথ্য অবহিত হওয়ার পর ইবনে আবিল ইওজাকে পঞ্চাশজন সৈন্যসহ পাঠানো হয়। এখানো শত্রুর সংখ্যা বেশী ছিল।
তারা হামলা করে সমগ্র মুসলিম সেনাদলকে শহীদ করে ফেলে। কেবল সেনাপতি আহত অবস্থায় মদীনায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। বনু কুয়াযায় বিদ্রোহ দমনের জন্যও অত্যধিক ক্ষুদ্র সেনাদলসহ কা’ব বিন উমাউর আনসারীকে পাঠানো হলে তারা পুরো মুসলিম দলকে শহীদ করে। কোন একজন সাহাবীও জীবিত ফিরে আসতে পারেনি।
ইসলাম বিরোধী একাধিক শক্তিকে সাহায্য দিয়েছিল বনু হাওয়াযেন। তাদের সম্পর্কে জানা গেল যে, মদীনা থেকে পাঁচ মনযিল দূরে তারা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুজা বিন ওহব আসাদীর নেতৃত্বে একটা ক্ষুদ্র দল পাঠানো হলো। কিন্তু তাদেরকে কোন সংঘর্ষে যেতে হয়নি।
এ সময়ে বড় আকারের যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় তা হচ্ছে মূতার যুদ্ধ। এটি সংঘটিত হয় ৮ম হিজরীর জমাদিউল আওয়াল মাসে। তবে এ যুদ্ধটা পুরোপুরি একটা বিদেশী শক্তির সাথে সংঘটিত বলে সে সম্পর্কে আমি তবুকের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করবো।
কয়েস বিন রিফায়া সম্পর্কে জানা গেল যে, সে আক্রমণের জন্য সৈন্য সমাবেশ করছে। এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মাত্র দু’জনের একটা দলসহ আবু হাদারায়া আসলামীকে পাঠানো হলো। নিছক সুক্ষ্ণ কৌশলে ভীত সন্ত্রস্ত করে তিনি শত্রু সৈন্যদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন এবং তাদের পশুগুলোকেও বাজেয়াপ্ত করে আনেন। এখানে কোন সংঘর্ষই ঘটেনি।
বনু কুযামা সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল যে, তারা অন্যদের সাথে গাঁটছাড়া বেধে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনশো সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলায় চলে গেলেন আমর ইবনুল আ’স। যাতুস্ সালাসিল নামক এই জায়গা ওয়াদিউল কুরার পরেই অবস্থিত। এ জায়গাটা বহু বছর যাবত ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক ছিল। যথাস্থানে পৌঁছে জানা গেল যে, শত্রুদের জনবল অনেক বেশী। আমর ইবনুল আ’স দূতের মারফত আরো সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহের নেতৃত্বে আরো দুশো সৈন্য তৎক্ষণাত পৌঁছে গেল। আক্রমণ চালানো সাথে সাথে শত্রু সেনারা পালিয়ে গেল। তাদের ফেলে যাওয়া কিছু গবাদি পশু হস্তগত করা হলো।
আবু কাতাদা ও মুহাল্লাম বিন জুসামা একবার টহল দেয়ার সময় ঘটনাক্রমে আমের ইবনুল আজবাত আশজায়ী কয়েক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করলো। তারা মুসলমানদের মত সালাম করলো। কিন্তু মুহাল্লাম তাদের সালামকে একটা আত্মরক্ষার কৌশল মনে করলেন এবং শত্রু ভেবে সবাইকে হত্যা করলেন। এই ঘটনায় কোরআন তাদেরকে নিম্নরূপ ভর্ৎসনা করেঃ
বলা হয় টহল দিতে বেরুলে লোকজনকে চিনে নিও এবং কেউ সালাম দিলে অনর্থক তাকে অমুসলিম গণ্য করোনা। রসূল সা. কঠোরভাবে সতর্ক করেন। পরে নিহতে গোত্রের সরদার হত্যার পণের দাবী নিয়ে আসে। রসূল সা. তৎক্ষণাত ৫০টা উট দিয়ে দেন এবং অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে বাকী ৫০টা পরে নিতে রাজী করেন।
৮ম হিজরীর রজব মাসে রসূলের সা. নির্দেশে আবু উবায়দা উবনুল জাররাহ তিনজন সৈনিকসহ সাইফুল বাহর গেলেন এবং কেবল সমুদ্রের তীর পর্যন্ত টহল দিয়ে কয়েকদিন উপকূলবর্তী এলাকায় কাটিয়ে ফিরে এলেন। সম্ভবত সড়কের পর্যবেক্ষণ করা ও কোরায়েশকে এ কথা বুঝানোই উদ্দেশ্য ছিল যে, ইদানিং মদিনা এ দিকেই মনোনিবেশ করেছে। উল্লেখ্য যে, হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি কোরায়েশ কর্তৃক ভঙ্গ করার পর মুসলমানদের এইসব তৎপরতা মক্কা বিজয়ের দ্বরোদঘাটন করে।

চতুর্থ বৃহৎ অভিযান-মক্কা বিজয়

এ যাবত আমি কোরায়েশ ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী শক্তির বড় বড় আক্রমণের বিবরণ দিয়েছি। এ বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বদর ওহুদ ও খন্দক এই সব কটা যুদ্ধে জাহেলী শক্তিগুলোই মদিনায় এসে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং সব কটা সংঘর্ষ মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের আশেপাশেই সংঘটিত হয়েছে। এ সব সংঘর্ষে মদিনার সরকার নিছক আত্নরক্ষামূলক ভূমিকা অবলম্বন করেছিল। খন্দকের যুদ্ধের পর রসূল সা. নিজের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার আলোকে অত্যন্ত নির্ভুলভাবেই ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, এখন কোরায়েশের আগ্রাসী অভিযানের অবসান ঘটেছে। তিনি এই আভাসও দেন যে, এখন থেকে ইনশায়াল্লাহ আমরাই কোরায়েশদের উপর হামলা চালাবো। মধ্যবর্তী সময় যখন হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং কোরায়েশরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালানো থেকে বিরত থাকে। তখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রসূল সা. একদিকে মদিনার বিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন, অপরদিকে উত্তর দিকে ইহুদীরা তাদের শক্তির যে মজবুত কেন্দ্রগুলো স্থাপন করেছিল এবং যে গুলোকে সামরিক চক্রান্ত তৈরির আখড়ায় পরিনত করেছিল, সেগুলোকে উৎখাত করেন। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গোত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহ, সামরিক প্রস্তুতি ও ষড়যন্ত্রকে এমন দ্রুত ও কঠোরভাবে প্রতিহত করেন যে, মদিনার পরিবেশ অনেকাংশে নিরাপদ ও পরিষ্কার হয়ে যায়। খন্দকের যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এই বিরতির সময় ইসলামী রাষ্ট্রের দোর্দন্ড প্রতাপ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলাম নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সকলকে মেনে নিতে বাধ্য করে। সকলেই অনুভব করতে আরম্ভ করে যে, সত্য, ন্যায় ও সুবিচারের এই উদিয়মান শক্তিকে উৎখাত বা প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। সর্ব শ্রেনীর জনতা উপলদ্ধি করে যে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আর কোরায়েশদের হাতে নেই। বরং মুহাম্মদ সা. এর হাতে চলে গেছে।
এখন শত্রুর হাত থেকে পুরোপুরি ও স্থায়ীভাবে মুক্তি লাভের একটা মাত্র উপায়ই অবশিষ্ট রয়েছে। সেটা হলো, শত্রুর আসল আখড়ার মুলোৎপাটন এবং জাহেলিয়াতের নেতৃত্বের প্রদীপ তার নিজ বাড়িতেই নিভিয়ে দেয়া। এ জন্য প্রতিরক্ষার সংগ্রামকে পূর্ণতা দানের জন্য একদিন না একদিন আক্রমণাত্মক অভিযান চালানো অবধারিত ও অনিবার্য ছিল। এটা ছিল কোরায়েশদেরই কর্মফল যে, তারা নিজেরাই হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে দু’পক্ষের মধ্যকার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রাচীর গুড়িয়ে দিয়েছিল।
আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, বনু বকর ও বনু খুযায়ার মধ্যে আগে থেকেই শত্রুতা চলে আসছিল এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের অবিরাম ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু মাঝখানে সহসা ইসলামী আন্দোলন একটা উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কোরায়েশ ও অন্যান্য পৌত্তলিক গোত্র নিছক ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। তাদের পারস্পরিক শত্রুতার আগুন সাময়িকভাবে চাপা পড়ে গেল। অবশেষে যখন হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হলো, তখন তার একটা ধারার সুযোগ গ্রহন বনু খুযায়া রসূল সা. এর সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করলো। পক্ষান্তরে বনু বকর মৈত্রী স্থাপন করলো কোরায়েশদের সাথে। কিছুদিন নীরবে কেটে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরানো শত্রুতার বারুদ বিস্ফোরণ ঘটলো। বনু বকর এই আপোষের যুগটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করলো। কেননা এ সময় অন্য কোন দিক থেকে সংঘাতের আশংকা ছিলনা। তারা বনু খুযায়া গোত্রের একজনকে হত্যা করলো। তারপর জোরদার হামলা চালিয়ে ব্যাপক নির্যাতন নিপীড়ন চালালো। এমন কি হারাম শরীফে আশ্রয় গ্রহনকারী খুযায়ীদেরও তারা অব্যাহতি দিলনা এবং উপসনারত অবস্থায়ও তাদেরকে ক্ষমা করলোনা। বনু বকরের এই রক্তপাতে কোরায়েশরা তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছিল। এই নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিকে পদদলিত করলো। বনু খুযায়ার পক্ষ থেকে আমর ইবনে সালেম রসূল সা. এর কাছে গিয়ে বনু বকরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানালো। অতপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়ে অত্যাচারের বিবরণ দিল। মৈত্রীচুক্তির আলোকে রসূল সা. এর জন্য বনু খুযায়াকে সাহায্য করা অপরিহার্য্য হয়ে হয়ে পড়লো। রসূল সা. কোরায়েশের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তিনটে দাবী জানালেন। এক, নিহত ব্যক্তির জন্য বনু খুযায়াকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাও। দুই, বনু বকরের সমর্থন পরিহার কর। তিন, প্রথম দুটো দাবীর বিক্ল্প হিসাবে হোদায়বিয়ার চুক্তি বাতিল হবার ঘোষণা দাও। কোরায়েশরা ভারসাম্য আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তারা জানালো যে, হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বাতিল করাই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু পরে এ জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল।
এবার কোরায়েশ নেতারা দুশ্চিন্তায় পড়লো। লড়াই করার ক্ষমতা তারা আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। কয়েকটা যুদ্ধে তাদের মূল্যবান বীরযোদ্ধারা মারা গিয়েছিল এবং তাদের সামরিক শক্তির অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সামরিক শক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিলো। তাদের অর্থনীতিরও বারোটা বেজে গিয়েছিল। তাদের সাহায্যকারী ইহুদীরা প্রায় সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। পক্ষান্তরে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র দাওয়াতী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজের প্রভাব এত ব্যাপক করে ফেলেছিল যে, মক্কার আশেপাশেও ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক গোত্রসমূহের একটা বৃত্ত গড়ে উঠেছিল। মৈত্রীর পরিধিও বিস্তৃত করা হয়েছিল। আর নৈরাজ্যবাদী ও বিদ্রোহী শক্তিগোলোকে কঠোরভাবে দমন করে বিশাল এলাকা জুড়ে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করত নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছিল। এরপর কোরায়েশের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা, আত্মরক্ষা করাও কঠিন ছিল। হোদায়বিয়ার সন্ধিই ছিল তাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। এই রক্ষাকবচও তারা নিজেরাই বাতিল করে দিয়ে মদিনাকে যেন আহবান জানালো, এস, আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি দিয়ে যাও।
অবশেষে মক্কার সবচেয়ে বড় কাফের নেতা আবু সুফিয়ান দিশেহারা হয়ে সন্ধি নবায়নের উদ্দেশ্যে মদিনা রওয়ানা হলো। সেখানে সে এমন প্রতিকুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো যে, তা বোধহয় তার কল্পনায়ও কখনো আসেনি। সে নিজের মেয়ে উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে হাবীবার ঘরে গিয়ে বিছানায় বসতে উদ্যত হওয়া মাত্রই মেয়ে ছুটে এসে বিছানা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি মোশরেক থাকা অবস্থায় রসূলের সা. পবিত্র বিছানায় বসতে পারেন না।” তারপর সে একে একে হযরত আবু বকর, ওমর ও আলীর ন্যায় শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতাদের সাথে যেয়ে যেয়ে সাক্ষাত করে এবং প্রত্যেকের কাছে সাহায্য চায়। এমনকি সে হযরত ফাতেমাকে ও রসূল সা. এর কাছে সুপারিশ করার অনুরোধ জানালো। এতেও যখন সে সফল হলোনা, তখন শিশু ইমার হাসানকে সুপারিশ করার অনুমতি দিতে ফাতেমা রা. কে অনুরোধ করলো। কোন কিছুতেই যখন কাজ হলোনা, তখন সে অনন্যোপায় হয়ে হযরত আলীর পরামর্শ মোতাবেক মুসলমানদের সাধারন সভায় নিজের পক্ষ থেকে এক তরফা সহাবস্থানের ঘোষণা করে রসূল সা. এর পক্ষ থেকে কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই মক্কায় ফিরে গেল। মক্কাবাসী তার সফরের বিবরণ জানতে চেয়ে যখন এক তরফা সহাবস্থানের ঘোষণার কথা শুনলো, তখন সবাই বললো,“এতো আলী রা. তোমার সাথে তামাসা করেছে।” লক্ষ্য করুন, পতন্মোখ নেতিবাচক লোকদের বুদ্ধিবিবেকও কিভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
রসূল সা. কালবিলম্ব না করে ঘোষণা করে দিলেন, মুসলিম সেচ্ছাসেবক দল তৈরী করা হোক। তিনি নিজের ঘরেও অস্ত্র তৈরী করার আদেশ দিলেন। তবে কোথায় কোন দিকে এবারের যুদ্ধ যাত্রা করা হবে, সেটা কাউকেই জানতে দিলেন না। এমনকি হযরত আয়েশাও তা জানতে পারলেন না। অথচ তিনি নিজ হাতেই হযরত রসূল সা. এর জন্য অস্ত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ লোক হয়তো ধারণা করেছিল যে এবার মক্কায় আক্রমণ করা হবে। কেননা এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য আর কোথাও নিয়ে যাওয়ার কোন কারণ ছিলনা।
বদর যোদ্ধা হাতেব ইবনে আবি বালতায়ার পরিবার পরিজন তখনো মক্কায় কাফেরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং কোন গোত্র তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহন করেনি। এ জন্য তিনি তাদের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মদিনার প্রস্তুতির পূর্ণ বিবরণ সম্বলিত একটা গোপন চিঠি কোরায়েশদের কাছে পাঠালেন, যাতে তারা তার এই অনুগ্রহের বদলা হিসেব মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর পরিবারকে যে কোন রকম কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকে। এই সাথে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, এই গোপন তথ্য সরবরাহ করা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর বিজয় সুনিশ্চিত এবং তার চিঠি ইসলামের কোন বড় রকমের ক্ষতি করতে পারবেনা। এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতি ও মানসিক অবস্থার চাপে পড়ে কখনো অত্যন্ত সৎ লোকের পক্ষ থেকেও মারাত্মক পদস্খলন ঘটে যেতে পারে। রসূল সা. ওহির মাধ্যমে এ চিঠির খবর জানতে পারেন। তাঁর প্রেরিত গোয়েন্দারা মক্কা গমনরত এক মহিলাকে রওযায়ে খাখ নামক স্থানে গিয়ে পাকড়াও করে তার কাছ থেকে ঐ চিঠি উদ্ধার করেন। এত বড় ভ্রান্তি রসূল সা. শুধু এজন্য ক্ষমা করেন যে, হাতেব নিষ্ঠাবান, ঈমানদার, সৎ ও বদরযোদ্ধা সাহাবী ছিলেন এবং এই পদস্খলনটা ছিল তার মানবীয় দুর্বলতা থেকে উদ্ভুত।
রসূল সা. দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে ১০ই রমযান মদিনা থেকে রওয়ানা হলেন। তিনি একজন অসাধারণ কুশলী সমরনায়ক হিসাবে এমন পেচালো রাস্তা ধরে অগ্রসর হন যে, কোরায়েশের যে টহলদার দলটি পর্যবেক্ষনের জন্য বেরিয়েছিল, তারা ঘূর্ণাক্ষরেও কোথাও মুসলিম বাহিনীর সন্ধান পেলনা। এদিকে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকলো, আর ওদিকে মুসলিম বাহিনী সাবইকে হতবাক করে দিয়ে মক্কার উপকন্ঠে গিয়ে হাজির হলো।
রসূল সা. যখন হাজফা পৌঁছলেন, তখন তার চাচা আব্বাস সপরিবারে এসে তাঁর সাথে মিলিত হলেন। তারপর যখন আবওয়াতে পৌঁছনেল, তখন আবু সুফিয়ান বিন হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিব (ইনি রসূল সা. এর আপন চাচাতো ভাই ও বিবি হালিমার মাধ্যমে দুধ ভাই) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ( রসূলের সা. ফুফাতো ভাই ও উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার সৎ ভাই) হাজির হয়ে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়ে ইসলামের বিরোধীতায় রসূল সা. কে এত কষ্ট দিয়েছিলেন যে, রসূল সা. তার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করলেন। আবু সুফিয়ান হতাশ হয়ে বললো, যদি ক্ষমা না পাই, তবে আমি আরবের অগ্নক্ষরা মরুভূমিতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে যাবো এবং সবাই মিলে ক্ষুধায় পিপাসায় মরে যাবো। হযরত উম্মে সালমা রা. ভাই এর জন্য সুপারিশ করলেন। আর হযরত আলী উভয়কে পরামর্শ দিলেন, হযরত ইউসুফের ভাই এর ভাষায় ক্ষমা চাও। তাই তারা গিয়ে বললোঃ
“আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে আমাদের ওপর অগ্রগণ্য করেছেন, আর আমরা অপরাধী ছিলাম”। এ কথা শুনে রসূল সা. এর মন গলে গেল। তিনিও হযরত ইউসুফের জবাবেরই পুনরাবৃত্তি করলেনঃ
“আজ তোমাদের ওপর কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি দয়াশীলদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দয়ালু”।
‘মারুয যাহরান’ পৌঁছে যখন সেনা শিবির স্থাপন করা হলো, তখন রসূল সা. বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে আদেশ দিলেন যেন প্রত্যেক সৈনিক রাত্রে নিজের জন্য আলাদা আলাদা আগুন জ্বালায়। আবু সুফিয়ান বিন হারব, হাকীম বিন হিযাম ও বুদাইল বিন ওয়ারাকার ন্যায় শীর্ষস্থানীয় নেতারা যখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেরুলো, তখন পাহাড়ের ওপর থেকে দশ হাজার চুলো জ্বলতে দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবলো, “কি সর্বনাশ, এত বড় সেনাবাহিনী চলে এসেছে মক্কার দোড়গোড়ায়। হযরত আব্বাস তাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কন্ঠ চিনতে পেরে আবু সুফিয়ানকে কাছে ডাকলেন এবং কথাবার্তা বললেন। হযরত আব্বাস বললেন, “হযরত মুহাম্মাদ সা. আজ তার সমগ্র বাহিনী নিয়ে চলে এসেছেন। আজ কোরায়েশের উপায় নাই”। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলো, “এখন বাঁচার উপায় কি?” আব্বাস রা. বললেন, “আমার সাথে আমার খচ্চরের ওপর বসে পড়। রসূল সা. এর কাছে গিয়ে কথা বলবে”। খচ্চর সামনের দিকে অগ্রসর হবার সময় কদমে কদমে সৈনিকেরা জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, “কে যাচ্ছে?” হযরত আব্বাস নিজের পরিচয় দিতেই পথ ছেড়ে দেয়া হতে লাগলো। নিকটে গেলে হযরত ওমর রা. দেখে ফেললেন এবং আবু সুফিয়ানকে চিনতে পেরে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “ওহে আবু সুফিয়ান, আজ তোকে মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে”। বলেই হত্যার অনুমতি নেয়ার জন্য রসূল সা. এর কাছে ছুটে যেতে লাগলেন। হযরত আব্বাসও খচ্চর জোরে ছুটালেন। হযরত ওমর রা. আগে আগে পৌঁছে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন, আর হযরত আব্বাস বললেন, “আমি আবু সুফিয়ানকে আশ্রয় দিয়ে এনেছি”।
এই পর্যায়ে আবু সুফিয়ানের সাথে রসূল সা. এর নিম্নরূপ কথোপকথন হলোঃ
রসূল সা. : “কি হে আবু সুফিয়ান, এখনো কি তোমার বিশ্বাস আসেনি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই?”
আবু সুফিয়ানঃ “আর কোন মা’বুদ থাকলে আজ আমাদের রক্ষা করতো”।
রসূল সা.: “আমি যে আল্লাহর রসূল, সে ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ আছে?”
আবু সুফিয়ানঃ “এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ আছে”।
হযরত আব্বাস আবু সুফিয়ানের মনস্তাত্মিক দুর্বলতাকে বুঝতে পেরে বললেন, “আরে ওসব বাদ দাও, সোজাসুজি ইসলাম গ্রহণ করে নাও”। সকাল পর্যন্ত মক্কার প্রধান নেতা পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মুসলমান হয়ে গেল। এদিকে ইসলামী সেনা শিবির মক্কায় সেনাবাহিনী পৌঁছার আগে আবু সুফিয়ানকে এমন সুকৌশলে আটক করে রেখেছিল যে, সে বুঝতেই পারেনি, সকাল বেলা শহরে প্রবেশের জন্য মুসলিম বাহিনী ‘কাদা’র পথ ধরে মার্চ করে গেল। হযরত আব্বাস রসূলের সা. নির্দেশে আবু সুফিয়ানকে একটা পাহাড়ের ওপর নিয়ে দাঁড় করালেন, যাতে সে মুসলিম বাহিনীকে এক নজর দেখতে পারে। প্রথমে বনু গেফার, তারপর একে একে জুহায়না, বুযায়েম, সুলায়েম এবং সবার শেষে আনসারী বাহিনীগুলো নিজ নিজ পতকা বহন করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। আবু সুফিয়ান প্রতিটি বাহিনীর পরিচয় জিজ্ঞেস করছিল। সা’দ বিন উবাদা যখন সামনে দিয়ে গেলেন তখন সৈনিক সুলভ আবেগে উজ্জীবিত হয়ে বলে উঠলেন....... “আজ তুমুল যুদ্ধের দিন’’...... “আজ কা’বার চত্তর উম্মুক্ত করার দিন”। তাঁর এই বিশেষ আবেগ ও বিশেষ শ্লোগানের পেছনে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাস সক্রিয় ছিল। সবার শেষে রসূল সা. কে বহনকারী প্রাণীটি অত্যন্ত সরল ও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে গেল। তাঁর সামনে যুবায়ের ইবনুল আওয়াম পতাকা বহন করে যাচ্ছিলেন। রসূল সা. যখন সা’দ বিন উবাদার স্লোগানের খবর শুনলেন, তখন তিনি মুহুর্তমাত্র বিলম্ব না করে তাঁর কাছ থেকে পতাকা নিয়ে তাঁর ছেলের হাতে অর্পণ করলেন। অতপর তিনি বললেন, “আজকের দিন কা’বার শ্রেষ্ঠত্বের দিন, এবং সদাচার ও ওয়াদা পালনের দিন”। এই একটা কথার মধ্য দিয়েই রসূল সা. তাঁর বিজয়োৎসবের নীতি স্পষ্ট করে দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, তাঁর বিজয়োৎসব হবে আগাগোড়া দয়া ও ক্ষমার মহিমায় উজ্জ্বল। তারপর ঘোষণা করে দেয়া হলো, “ যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, যে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে এবং যে অস্ত্র বহন করবেনা, তার প্রাণ নিরাপদ। তবে কেউ যদি কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে, সে শাস্তি পাবে”। আবু সুফিয়ান স্বয়ং মক্কায় উচ্চস্বরে এ ঘোষণা দিতে দিতে এগিয়ে যেতে লাগলো। তার মুখ দিয়ে রসূল সা. এর ঘোষণা উচ্চারিত হতে শুনে তার স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎতা তার গোঁফ টেনে ধরে চিল্লাতে লাগলো, “হে বনু কিনানা, এই হতভাগাকে মেরে ফেলো। ও কী বলছে?” হিন্দা আবু সুফিয়ানকে গালি দিতে লাগলো।
তা শুনে লোকজন সমবেত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ান তাকে বুঝিয়ে বললো, এখন এসব কথা বলে কোন লাভ হবেনা। এখন কারো ক্ষমতাই নেই যে, মুহাম্মদের সা. অগ্রযাত্রা ঠেকায়। অতপর যখন রসূল সা. শহরে প্রবেশ করলেন তখন সারা দুনিয়ায় বিজয়ীদের ঠিক বিপরীত বিনয়াবনত মস্তকে প্রবেশ করলেন। তাঁর কপাল যেন বাহক জন্তুটির পিঠ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তিনি মুখে সূরা আল ফাতাহ আবৃত্তি করে যাচ্ছিলেন।
ওদিকে ইকরামা ইবনে আবু জাহল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং সুহায়েল ইবনে আমর খান্দামা নামক পাহাড়ে কোরায়েশের কয়েকজন নির্বোধ গুন্ডাপান্ডাকে একত্রিত করে নানা রকম অপকর্ম সংঘটিত করতে প্ররোচিত করলো। হিমাস বিন কয়েস বিন খালেদও তাদের সাথে মিলিত হলো। দু’জন সাহাবী কারয বিন জাবের ফেহরী, এবং খুনায়েস বিন খালেদ বিন রবী বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন পথ ধরে যাচ্ছিলেন। এই গুন্ডাপান্ডারা তাদের উভয়কে শহীদ করে ফেললো। হযরত খালেদ ঘটনা জানতে পেরে তৎক্ষণাত তাদেরকে উচ্ছেদ করলেন। মোট বারোজন নিহত হলো। হিমাস সমেত কয়েকজন পালিয়ে গেল। এ ধরনের আরো একটা ক্ষুদ্র প্রতিরোধকামী জমায়েত শহরে দেখা গেল। রসূল সা. জানতে পেরে হযরত আবু হুরায়রার মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে তলব করলেন। তাদেরকে ঐ দৃশ্যটা দেখিয়ে বললেন, “দেখছ ওদের ফাজলামী?” অর্থাৎ একদিকে তো দয়া ও ক্ষমার বন্যা বয়ে যাচ্ছে এবং বিজয়ী শক্তি এক ফোঁটা রক্তও ঝরাতে চাইছেনা। অপর দিকে এই সব দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা বিজয়ী বাহিনীকে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য করছে। অনন্যোপায় হয়ে রসূল সা. হুকুম দিলেন, “ ওরা বাধা দিতে চেষ্টা করলে ওদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হোক”। রসূল সা. এর এই আদেশের খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান ছুটে এসে কাতর কন্ঠে বললো, “ হে রসূলুল্লাহ! সা. কোরায়েশের শক্তি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন যেন না হয় যে, পৃথিবী থেকে তাদের নাম নিশানাই মুছে যাবে”। অতপর হালকা আক্রমণ করা হয় এবং তাতেই দুষ্কৃতিকারীরা মার খেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
রসূল সা. এই দয়ার্দতা দেখে আনসারদের মধ্য থেকে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে আরম্ভ করে যে, “ ঐ দেখ, শেষ পর্যন্ত গোত্রের প্রেম রসূল সা. এর ওপর প্রবল হয়েই গেছে!” আসলে রসূল সা. এর প্রতি ভালোবাসার অতিশয্যেই তারা সব সময় এই আশংকায় অস্থির থাকতেন যে, রসূল সা. মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ছেড়ে মক্কবাসীর সাথে থাককে আরম্ভ করেন কিনা এবং তারা তাদের প্রিয়তম ব্যক্তিত্বের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যান কিনা। আনসারদের এই আশংকার কথা জানতে পেরে রসূল সা. তাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ “আল্লাহর কসম, তোমরা যা আশংকা করছ, তা সত্য নয়। আমি আল্লাহর বান্দা ও রসূল। আমি আল্লাহর কাছে ও তোমাদের কাছে হিজরত করেছিলাম। এখন তোমরাই আমার জীবন মরণের সাথী”। এ কথা শুনে আনসরাদের মন আবেগাল্পুত হযে উঠলো। তারা তাদের ধারণার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং রসূল সা. তা গ্রহণ করলেন।
লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, শহরে আপনি কোথায় অবস্থান করবেন? নাকি, পৈতৃক বাসস্থানে? রসূল সা. খুবই ব্যথাতুর কন্ঠে জবাব দিলেন, “আকীল আমাদের জন্য ঘর রেখেছেই বা কোথায় যে, তাতে থাকবো? রসূল সা. এর পতাকা হুজুনে ( জান্নাতুল মুয়াল্লাতে) স্থাপন করা হলো এবং ওখানেই তিনি অবস্থান করবেন বলে স্থির হলো। প্রথমে তিনি সেই ঐতিহাসিক স্থান ‘খায়েফে’ গেলেন, যেখানে তার পুরো গোত্র সহ অবরোধকালীন দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। তারপর হারাম শরীফে পৌঁছলেন। ঘনিষ্ঠতম সাহাবীদের কয়েকজন সাথে ছিলেন। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। হাতে ধনুক নিয়ে হারাম শরীফে স্থাপিত প্রতিটি মূর্তির কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, “হক এসে গেছে এবং বাতিল অপসৃত হয়ছে। বাতিলকে তো অপসৃত হতেই হবে”। ধনুকের ইশারায় এক একটি মূর্তি পড়ে যেতে লাগলো। তারপর কা’বার চাবি আনিয়ে দরজা খোলালেন। ভেতরে হযরত ইবরাহিম ও হযরত ইসমাইল আ. এর ছবি আঁকা ছিল। তাদের উভয়ের হাতে জুয়ার তীর ছিল। ঐ সব মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আল্লাহ কাফেরদের ধ্বংস করুন। এরা উভয়েই আল্লাহর নবী ছিলেন। তরা কখনো জুয়া খেলেননি। এরপর রসূল সা. এর নির্দেশে দীর্ঘকাল ধরে আশেপাশের স্থাপিত অন্যান্য মূর্তিগুলোও ভেঙ্গে ফেলা হলো। এরপর তিনি কিছুক্ষণ নামায ও যিকরে মশগুল হলেন। মসজিদুল হারামের সামনে তখন বিপুল জনসমাগম ঘটেছে। জনতা নিজেদের ভাগ্যের ফায়সালা শুনতে উদগ্রীব। রসূল সা. তাদেরকে সম্বোধন করে ভাষণ দিলেনঃ
“এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তিনি নিজের বান্দাকে সাহায্য করেছেন। তিনি একাই সমস্ত কাফের সৈন্যদেরকে পরাস্ত করেছেন। আজ সমস্ত অহংকার, আভিজাত্য, রক্তের দাবীদাওয়া এবং সমস্ত আর্থিক দাবী আমার পায়ের নীচে। তবে কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি সরবরাহের পদগুলো বহাল থাকবে”।
“হে কুরায়েশ! এখন আল্লাহ তোমাদের জাহেলিয়াতের অহংকার ও বংশীয় আভিজাত্যের সমস্ত দর্প চূর্ণ করে দিয়েছেন। কেননা সকল মানুষ আদমের বংশধর। আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে”। অতপর তিনি কোরআনের আয়াত পড়লেনঃ
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তোমাদেরকে গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেছি শুধু এ জন্য যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। কিন্তু আল্লাহর কাছে কেবল সেই সম্মানিত, যে অধিকতর সৎ ও সংযত। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সর্ববিষয়ে ওয়াকিফহাল”।
এরপর একটা আইনগত ঘোষণা দিলেনঃ
“আল্লাহ মদের কেনাবেচা হারাম করেছেন”।
তারপর রসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ
“তোমরা কি জান আমি আজ তোমাদের সাথে কেমন আচরন করবো?”
এ বাক্যটা শোনার সাথে সাথে সম্ভবত কোরায়েশদের চোখের সামনে তাদের কৃত যুলুম নির্যাতন, হিংস্রতা ও বর্বরতার দুই দশকের কালো ইতিহাস একটা সিনেমার ছবির মত ভেসে উঠেছিল। তাদের বিবেক হয়তো অনুশোচনায় বিদীর্ণ হবার উপক্রম হয়েছিল। হয়তো চরম অসহায়ত্ব ও অনুতাপের অনুভূতি নিয়েই তারা বলে উঠেছিলঃ
“একজন মহানুভব ভাই এবং মহানুভব ভ্রাতুস্পুত্রের মত”। জবাবে রসূল সা. ঘোষণা করলেনঃ
“তোমাদের ওপর আজ আর কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত”।
কোরায়েশদের যুলুম নিপীড়ন ও আগ্রাসী যুদ্ধের ইতিহাস দৃষ্টিপথে থাকলে কেউ কি এ ধরনের জবাব আশা করতে পারে? তবে যে ব্যক্তি রসূল সা. এর দয়া ও করুণা সম্পর্কে অবহিত সে তাঁর কাছ থেকে এরূপ জবাবই প্রত্যাশা করতো। আর কেউ হলে অহংকারের সাথে মক্কায় প্রবেশ করতো, এক একটা ঘটনার প্রতিশোধ নিত, বেছে বেছে বিরোধীদের মধ্যে যারা অতীতে বিন্দুমাত্রও বাড়াবাড়ি করেছে, তাদেরকে হত্যা করত, বিজিত শহরে গণহত্যা সংঘটিত করতো, মানুষের ধন সম্পদ ও নারীদের সতীত্ব নির্বচারে লুন্ঠিত হতো। কিন্তু বিজেতা যেহেতু মানবতার শ্রেষ্ঠ দরদী ও ত্রাণকর্তা ছিলেন, তাই তিনি ভূমি দখলের সাথে সাথে মানুষের হৃদয়ও জয় করার চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি মোহাজেরদেরকে নিজ নিজ ঘরবাড়ী ও ধন সম্পদের মালিকানাও ত্যাগ করতে বলেন। যে উসমান বিন তালহাকে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা কালে তিনি কাবা শরীফের দরজা খুলে দিতে অনুরোধ করলে সে কঠোরভাবে অস্বীকার করেছিল, মক্কা বিজয়ের পরও কা’বার চাবি কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য সেই ওসমানের হাতেই সমর্পন করলেন। অতপর রসূল সা. অতীতের দিকে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে অতীতের একটা কথোপকথন উসমানকে স্বরণ করিয়ে দিলেনঃ “একদিন এই চাবি আমার নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমি যাকে তা দিতে চাইবো, দেবো”। উসমান এত দূর-দৃষ্টি কোথায় পাবেন যে, এ কথার মর্ম বুঝবে? তাই সে বললো, “ সেই দিনের আগে বোধহয় কোরায়েশরা সবাই মরে যাবে”। রসূল সা. বললেন, “না, সেই দিনটা হবে কোরায়েশদের জন্য সত্যিকার সম্মানের দিন”। এই কথোপকথনকে লক্ষ্য করলে মনে এই ধারণাই জন্মে যে, রসূল সা. এর পরিবর্তে আর কেউ হলে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য অবশ্যই কা’বার চাবি উসমানের কাছ থেকে নিয়ে অন্য কারো হাতে অর্পন করতেন। কিন্তু রসূল সা. কা’বার চাবি হস্তগত করার জন্য বনু হাশেমের পক্ষ থেকে হযরত আলীর রা. ন্যায় ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তির আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিরদিনের জন্য সাবেক ব্যক্তিগণের হাতেই থাকতে দেন। রসূল সা. চাবি দেয়ার সময় যখন রসিকতার ছলে উসমান বিন তালহাকে বহু বছর আগের সেই কথাবার্তা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন সে বললো, “নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রসূল”। রসূল সা. বললেন, “ আজকের দিন সদাচার ও প্রতিশ্রুতি পূরনের দিন”।
এরপর রসূল সা. এর আদেশে হযরত বিলাল রা. কা’বার ওপর আরোহন করে আযান দিলেন। এ আযান ছিল ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের ঘোষণা স্বরূপ। যে কা’বা শরীফে আল্লাহর বান্দাদের জন্য আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অপরাধে পরিগণিত হয়েছিল, এবং এই অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গিয়ে রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা সীমাহীন যুলুম নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই কা’বার ছাদের ওপর থেকে আজ আযান ধ্বনিত হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর কোন শক্তি তাকে রুখতে পারছেনা। এ সময় আবু সুফিয়ান বিন হারব, ইতাব বিন উসাইদ এবং হারেস বিন হিশামের ন্যায় শীর্ষ নেতারা কা’বার নিকটবর্তী এক কোনে বসে নিজেদের পরাজয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছিল। ইতাব ক্ষোভের সাথে বললো, ‘ভালোই হয়েছে যে, আমার বাবা উসাইদ এই আযানের শব্দ শোনার জন্য জীবিত থাকেনি।' রসূল সা. পরক্ষণেই তাদের কাছে এলেন এবং তারা যা যা বলেছিল, তা হুবহু তাদের সামনে তুলে ধরলেন। এতে কোরায়েশদের এই শীর্ষ নেতৃবর্গ লজ্জা পেল।
এরপর রসূল সা. মক্কা বিজয়ের শোকর আদায় কল্পে উম্মে হানীর ঘরে গিয়ে গোছল করে আট রাকাত নামায পড়লেন।
বিজয়ের পরদিন রসূল সা. সাফা পর্বতের ওপর থেকে আরো একটা ভাষণ দিলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর সংক্ষেপে হারাম শরীফের মর্যাদা বর্ণনা করলেন, এই মর্যাদাকে চিরদিনের জন্য বহাল করলেন এবং তার নিয়ম বিধি সমূহ বর্ণনা করলেন। প্রসংগত উল্লেখ যে, এত বড় বৈপ্লবিক বিজয় উপলক্ষেও মক্কায় জানমালের নিরাপত্তার শাশ্বত বিধান মাত্র একদিনের জন্য লংঘিত আর তাও একান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। কেননা রসূল সা. এর সম্মতি ছাড়াই মক্কার কতিপয় কান্ডজ্ঞানহীন গুন্ডাপান্ডা দু'জন মুসলিম সৈনিককে হত্যা করে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল তাদের মুলোচ্ছেদ করতে। এই অতি ক্ষণস্থায়ী বাধ্যবাধকতা শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দিন থেকে রসূল সা. হারাম শরীফের মর্যাদা ও পবিত্রতা পুনর্বহাল করার ঘোষণা দেন।
সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা তো দেয়াই হয়েছিল। সে ঘোষণা জনগণকে এত অভিভূত ও মুগ্ধ করেছিল যে, কারো মধ্যে প্রতিরোধের স্পৃহাই আর থাকেনি। তবে বিশেষ বিশেষ অপরাধ সম্পর্কে তিনি নামসহ ঘোষণা করে দেন যে, তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাক হত্যা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, মক্কা দখল করা ও তার আইন শৃংখলা বহাল করার জন্য কয়েকদিন সামরিক আইন চালু ছিল। অর্থাৎ যাবতীয় ক্ষমতা সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। [যে এলাকায় যুদ্ধ চলতো, সেখানে সাধারণ বেসামারিক নিয়মশৃংখলা পুরোপুরিভাবে বহাল হওয়ার আগে ইসলামী আইন অনুসারে সামারিক কর্তৃপক্ষের হাতে কিছুটা কড়া অস্থায়ী প্রশাসন চালু করা হতো। এ ধরনের প্রশাসনে কিছু কিছু আইন ও বিধি সাধারণ কর্তৃপক্ষের হাতে কিচুটা কড়া অস্থায়ী প্রশাসন চালু করা হতো। এ ধরনের প্রশাসনে কিছু কিছু ও বিধি সাধারণ বেসামরিক প্রশাসন থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমার মতে, এ ধরনের প্রশাসনকেই আধুনিক পরিভাষায় সামরিক আইন বা মার্শাল ল' বলা হয়। সামরিক আইন সাধারণভাবে প্রত্যেক সুসভ্য সরকারর অধীনে এবং বিশেষভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধরত অঞ্চলে শুধু অনিবার্য প্রয়োজনের আওতায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য চালু হয়ে থাকে, আর তাও বিজিত অমুসলিম শত্রুদের ওপর। আজকাল সামারিক আইনের নামে কোন দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক নিজ দেশেরই জনগণকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে র্দীঘ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য শাসনকার্য পরিচালনা করাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা। মক্কা বিজয়ের সময়কার যে ব্যবস্থাকে আমরা ‘সামরিক আইন' নামে আখ্যায়িত করেছি, আজকালকার সামারিক আইনের সাথে তার কোন মিল নেই। এ যুগের প্রচলিত সামরিক আইন ও সামরিক শাসন ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।] এবং রসূল সা. সেনাপতি হিসাবেই নির্দেশ জারী করেছিলেন যে, অমুক অমুক অপরাধীকে যেখানেই পাওয়া যাবে, হত্যা করা হবে। আধুনিক পরিভাষায় এটা ‘‘দেখামাত্র গুলি করার’’ আদেশের অনুরূপ। অপরাধীদের এই তালিকায় কয়েকজন পুরুষ ও নারীর নাম ছিল। কিন্তু রসূল সা.-এর সাধারণ ক্ষমা এদের মধ্যে থেকেও অধিকাংশের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সর্বোচ্চ চারজন অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। একটি সুচিন্তিত অভিমত এইযে, মাত্র একজন অপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এর নাম হলো আব্দুল উয্যা বিন হানযাল। এই ব্যক্তি প্রথমে মুসলমান হয়। অন্য একজন মুসলমান সাথীসহ তাকে যাকাত সদকা আদায় করতে পাঠানো হয়। পথিমধ্যে সাথীর সাথে ঝগড়া হয় এবং তাকে হত্যা করে সে সদকার জন্তুগুলোকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া বহু ফৌজদারী অপরাধে সে জড়িত ছিল।
সাফওয়ান বিন উমাইয়া এ ধরনের আরো একজন গুরুতর অপরাধী। সে ইসলামী ছিল আন্দোলনের কট্টর শত্রু। প্রথমে পালিয়ে ইয়েমেন যাওয়ার পথে জেদ্দায় পৌঁছে। উমাইর বিন ওহব জামহী রসূল সা. এর কাছ থেকে তার জন্য ক্ষমা মঞ্জুরী নিয়ে তাকে জেদ্দা থেকে ফিরিয়ে আনে। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে।
ইকরামা বিন আবু জাহলও ইয়ামানে পালিয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতুল হারিস (আবু জাহলের ভাই এর মেয়ে) নিজে মুসলমান হয়ে যায় এবং নিজের স্বামীর জন্য রসূল সা. এর কাছ থেকে ক্ষমার মঞ্জুরী গ্রহণ করে। তারপর নিজে ইয়েমেনে গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন। ইকরামা যখন নিজের জন্য ক্ষমা প্রাপ্তির খবর পেল, তখন সে আবাক হয়ে যার যে, তার মত কট্টর শত্রুকেও রসূল সা. ক্ষমা করে দিলেন! তিনি হাজির হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
আবদুল্লাহ বিন সা'দ বিন আবি সারাহ এক সময় মুসলমান ছিল এবং ওহির লেখক হবারও সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু মুরতাদ হয়ে শত্রুদের সাথে সহযোগীতা করতে থাকে। এমনকি সে এ কথাও প্রচার করতে থাকে যে, ওহি তো আসলে আমার কাছে আসতো। মুহাম্মদ সা. আমার কাছে শুনে তা লিখিয়ে নিতেন। অপরাধ ছিল সংগীন। কিন্তু হযরত উসমানের পক্ষ থেকে বারবার সুপারিশ করার কারণে রাসূল সা. সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার পর সে মুসলমান হিসেবে বহাল থাকে।
মুকাইয়াস বিন সাবাবা বা বর্ণচোরা হিসেবে ইসলামী দলের ভেতরে প্রবেশ করে। পরে সে প্রতারণার মাধ্যমে জনৈক সাহাবীকে হত্যা করে পালিয়ে আসে। এই হত্যাকান্ডের কারণ ছিল এই যে, মাকাইয়াসের ভাই ভুলক্রমে এই আনসারী সাহাবীর হাতে নিহত হয়। রসুল সা. এজন্য দিয়াত তথা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেন। তা স্বত্ত্বেও সে আনসারী সাহাবীকে হত্যা করে। মুরতাদ হওয়া ও ধোকাবাজী করা ছাড়াও নিছক এই হত্যাকান্ডের জন্যও তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যেত।
হাববার ইবনুল আসওয়াদ ছিল সেই ব্যক্তি, যে অন্যান্য ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড ছাড়াও রসুল সা. এর মেয়ে হযরত জয়নরেব ওপর হিজরতের দিন হামলা করে এত কষ্ট দিয়েছিল যে, তার গর্ভপাত ঘটে গিয়েছিল। সে প্রথমে পলাতক ছিল। পরে নিজেই হাজির হয়ে বিনয়ের সাথে অপরাধ স্বীকার করে এবং রসূল সা. এর কাছে প্রবল অনুশোচনা প্রকাশ করে। সেই সাথে সে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা. ঘোষণা করেন যে, আমি হাব্বারকে ক্ষমা করে দিলাম।
হযরত হামযার খুনী ওয়াহশী রাসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি তার কাছে হামযা হত্যার বিবরণ শোনেন। তিনি তাকে মাফ করে দেন। তবে তাকে পরামর্শ দেন, তুমি আমার সামনে এসনা। এতে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়। এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পরও নানা ধরনের গুনাহর কাজ বিশেষত মদখুরি থেকে মুক্তি পায়নি।
খ্যাতনামা জাহেলী কবি আব্দুল্লাহ বিন যিবয়ার এক সময় কবিতার অস্ত্র প্রয়োগ করে ইসলামের সাথে শত্রুতা করতো এবং মানুষকে উস্কে দিত। সে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

কবি কা'ব বিন যুহায়েরও ইসলাম ও রসূল সা. এর বিরুদ্ধে বহু নিন্দামূলক কবিতা লিখেছিল। হিজরী নবম সালে নিজের ভাই এর সাথে এসে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘‘বানাত্ সুয়াদ’’ শীর্ষক এক ঐতিহাসিক চমকপ্রদ কবিতা ইসলামের পক্ষে রচনা করেন। রসূল সা. তাকে শুধু ক্ষমাই করেননি, বরং নিজের চাদরও পুরস্কার দেন।
মক্কায় অবস্থানকালে একবার রসূল সা. কা'বা শরীফের তাওয়াফ করছিলেন। এই সময় ফুযালা বিন উমাইর তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে আসে। রসূল সা. নিজেই তার কাছে এগিয়ে যান এবং তার মনের ইচ্ছাটা তাকে জানান। ফুযালা এভাবে ধরা পড়ে ভীষণ লজ্জা পায়। তিনি তাকে ক্ষমা চাইতে বলেন এবং তার বুকের ওপর হাত ঘোরান। সংগে সংগে তার দুনিয়া পাল্টে যায়। হত্যার ইচ্ছা পোষণকারী এক অপরাধীকে এভাবে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত আর কোথাও পাওয়া যাবেনা।
মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিল হিন্দ বিনতে উতবা। সে ইসলামের সক্রিয় বিরোধীতা তো করেছেই, এমনকি হযরত হামযার লাশকে বিকৃতও করেছে এবং তার কলিজা পর্যন্ত চিবিয়েছে। নিজের চেহারা লুকানোর জন্য নিকাব পরে রসূল সা. এর সামনে হাজির হয়। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছিল। কিন্তু এ অবস্থায়ও ধৃষ্টতা সহাকারে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন রাসূল সা. এর কাছে করেছিল। রসূল সা. এর সাথে তার কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ :
হিন্দঃ হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাদের কাছ থেকে কী কী অংগীকার গ্রহণ করেছেন?
রসূল সাঃ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করোনা।
হিন্দঃ এ অংগীকার আপনি পুরুষদের কাছ থেকে তো নেননি। তবুও আমি এটা মেনে নিলাম।
রসূল সাঃ চুরি করবেনা।
হিন্দঃ আমি আমার স্বামী আবু সুফিয়ানের সম্পত্তি থেকে কখনো কখনো দু'চার দিরহাম নিয়ে থাকি। জানিনা এটাও জায়েজ, না নাজায়েজ।
রসূল সাঃ নিজের সন্তানদের হত্যা করবেনা।
হিন্দঃ আমরা তো শৈশবে তাদের লালন পালন করেছি। বড় হলে বদরের ময়দানে আপনারাই তাদের হত্যা করেছেন। এখন তাদের কী হবে, সেটা আপনারাই জানেন।
এটা কী ধরনের ইসলাম গ্রহণ, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কথাবার্তার ভেতরে এমন ঔদ্ধত্য ও বেআদবী অন্য কেউ হলে সহ্য করতোনা। রসূল সা. এর সীমাহীন ধৈর্যকে সে অপব্যবহার করেছিল মাত্র।
ইবনে হানযালের দাসী ছিল কারতানা। সে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক গান গেয়ে বেড়াতো। মক্কা বিজয়ের সময় সে পালিয়ে যায়। পরে তাওবা করে ও ইসলাম গ্রহণ করে।
কয়েজন নারী ও পুরুষ সম্পর্কে হাদীস ও সীরাতের রেয়ায়েতসমূহে যথেষ্ট মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে তাদের কেউ মৃত্যুদন্ড পেয়েছে বলে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।
তবে এমন কট্টোর শত্রুদের জন্য এমন পূর্ণাংগ বিজয়ের সময় সাধরণ ক্ষমা ঘোষণা করার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর কোন বিজেতার জীবনে পাওয়া যায় না।
মক্কার ভূমি দখল করার চেয়েও বড় বিজয় ছিল এই যে, রসূল সা. সাফা পাহাড়ে উঁচু জায়গায় বসে ছিলেন, আর লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিল। তাদের কাছ থেকে তাওহীদ ও রিসালাতের মৌলিক তত্ত্ব মেনে নেয়া ছাড়াও বিশেষভাবে কিছু প্রচলিত খারাপ কাজ ও খারাপ প্রথা থেকে সংযত থাকার অংগীকার গ্রহণ করা হচ্ছিল। বায়য়াতের বিশেষ বিশেষ অংগীকারগুলো ছিল এরকম :
* আমি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করবোনা, তার সত্তায়, গুণাবলীতে, এবাদাতে ও অধিকারে কোনটাতেই নয়।
* চুরি করবোনা, ব্যভিচার করবোনা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবোনা, শিশু মেয়েদেরকে হত্যা করবোনা, কারো ওপর অপবাদ আরোপ করবোনা।
* ভালো কাজে যথা সাধ্য রসূর সা. এর আদেশ মেনে চলবো।
পনেরো দিন বা তার দু'একদিন কম বা বেশী মক্কায় অবস্থানের পর যখন রসূল সা. বিদায় নিলেন, তখন জনগণকে ইসলামী জীবন পদ্ধতি, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, ইসলামী চরিত্র, ইসলামী আইন ও ইসলামী সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়ার কাজে হযরত মুয়ায ইবনে জাবালকে নিযুক্ত করে রেখে গেলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ নিজের হাতে ইসলামী শাস্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। ফাতেমা বিনতে আবুল আসাদ নাম্নী এক মহিলার চুরি প্রমাণিত হলে তিনি অনেকের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেও তার হাত কেটে দেয়ার সেই ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করেন। হোনায়েন ও তায়েফের যুদ্ধ জয়ের পর রসূল সা. মক্কায় ফিরে এসে ইতাব বিন ইসায়েদকে সহকারী শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং তার জন্য দৈনিক এক দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন।

মক্কা বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

১. মক্কা বিজয় ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ বিজয়ের পর ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভের সমস্ত বাধা অপসারিত হয়। আরবের প্রাচীন জাহেলী নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থল ছিল মক্কা। এই কেন্দ্রের পতন না ঘটা পর্যন্ত ইসলামী বিপ্লবের সামনে অগ্রসর হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। জাহেলী নেতৃত্বের পতাকা যখন অবনমিত হলো, তখন আর জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার টিকে থাকার সাধ্য থাকলোনা এবং জাহেলিয়াতের চার পাশে জনগণের সমবেত সম্ভাবনাও রইলনা।
মক্কা বিজয় জনসাধারণের বহু জটিলতা দূর করে দেয়। অনেকগুলো গোত্র শুধু এ কারণেও ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি যে, তাদের সাথে কোরায়েশদের হয় মৈত্রীর সম্পর্ক ছিল, নচেত অর্থনৈতিকভাবে তারা কোরায়েশদের নিকট মুখাপেক্ষী বা ঋণগ্রস্থ ছিল। কেউবা তাদের সামাজিক প্রাধান্য ও ধর্মীয় পৌরহিত্যের দাপটের কাছে অসহায় ছিল। কোরায়েশের এই দাপট যখন শেষ হয়ে গেল, তখন তাদের পথ কে আটকায়। তাদের পথ আবিষ্কার হয়ে গেল।
জাহেলী সমাজের কোন কোন স্তরে এই ধারণা বিস্তার করেছিল যে, মক্কায় শুধু সে-ই বিজয়ী থাকতে পারে, যাকে আল্লাহ সাহায্য করেন। যে সত্যের পথে প্রতিষ্ঠিত নয়, সে আল্লাহর সাহায্যও পায়না এবং মক্কায় তার জয়ডংকাও বাজেনা। এ ধরনের ধারণা বিশ্বাস বিশেষত আবরাহার আক্রমণের পর আরো জোরদার হয়ে ওঠে। লোকেরা ভাবতে থাকে যে, কোরায়েশ আল্লাহর প্রিয় জনগোষ্ঠী। লোকেরা রসূল সা. কোরায়েশের বিরোধে হস্তক্ষেপ না করে বলতোঃ
‘‘মুহাম্মদ সা. কে ও তার গোত্রকে নিজ নিজ অবস্থায় থাকতে দাও। সে যদি তাদের ওপর বিজয়ী হয়, তবে বুঝতে হবে, সে যথার্থই নবী। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মক্কা বিজয়ের পর জনতার স্রোত বাধভাঙ্গা জোয়ারের মতো ইসলামের দিকে ধাবিত হতে থাকে। শুধু মক্কাবাসী নয় বরং আশপাশের এলাকার গোত্রগুলো থেকেও দলে দলে লোকেরা ছুটে এসে সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের সেবক ও মুহাম্মদের সা. অনুসারী হওয়াকে তার পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করতে থাকে।
ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য এরপর ময়দান একেবারেই পরিষ্কার ও বাধামুক্ত হয়ে গেল। তখন প্রত্যেক মুসলমান ইসলামের প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হলো। বাধা দেওয়ার কেউ রইলনা।
২- রসূল সা. যখন মক্কা অভিযানে বের হন, তখন প্রথম থেকেই এমন কৌশল আবলম্বন করেন, যাতে আদৌ কোন রক্তপাত না হতে পারে। তিনি নিজের উদ্দেশ্যও কারো কাছে ব্যক্ত না করে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কোরায়েশকে কোন প্রস্তুতি গ্রহণ এবং কোন দিক থেকে কোন সাহায্য গ্রহণের আদৌ কোনো সুযোগ না দিয়ে সহসাই মক্কার উপকণ্ঠে গিয়ে উপনীত হন। এভাবে যে বিরোধী শক্তি আগেই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, এই আকস্মিকতায় তারা একেবারেই হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের মানসিক পরাজয় তো আরো আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। উপযুক্ত কৌশল অবলম্বন করে সবার আগে তাকেই ভীতসন্ত্রস্থ করে দেয়া হয়। আবু সুফিয়ানের নতি স্বীকার করার কারণে আর কারো পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করার কোন অবকাশ থাকলোনা। রসূল সা. যে একজন সেনাপতিকে শুধু একটু উস্কানীমূলক ও উত্তেজনাপূর্ণ শ্লোগান দেয়ার কারণে সেনাপতিত্ব থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাও এই উদ্দেশ্যেই করেছিলেন। তিনি মক্কাবাসীকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, আজকের দিন কা'বার মর্যাদা পুনর্বহালের দিন, তথা পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার দিন।
৩. রসূল সা.-এর নিজের ওপর এবং নিজের প্রিয় সাথী ও আপনজনদের ওপর দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে নিকৃষ্টতম নির্যাতন পরিচালনাকারী, ঠাট্টাবিদ্রুপকারী, নোংরা বর্জ্য নিক্ষেপকারী, পথে কাটা বিস্তারকারী, আটককারী, হত্যার ষড়যন্ত্রকারী, দেশ থেকে বিতাড়ণকারী এবং বিনা উস্কানীতে আক্রমণকারী ইসলামের কট্টর শত্রুদের সমস্ত বর্বরোচিত অপরাধকে সম্পূর্ণরূপে ভূলে গেলেন এবং সাধরণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। কঠোরতার পরিবর্তে নমনীয় ও কোমল আচরণের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় অপেক্ষা রাখেনা। তিনি কোন দুনিয়াবী বিজেতা ছিলেন না যে, শক্তি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কিছু লোককে বশীভূত করা এবং ডান্ডার জোরে হুমকি ধমকির মাধ্যমে তাদেরকে নিজের হুকুমের গোলাম বানানোই যথেষ্ট হবে। তিনি ছিলেন একটা দাওয়াত, একটা মিশন, একটা নৈতিক আন্দোলন, এবং একটা পবিত্র ও নির্মল শাসন ব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার পতাকাবাহী। তিনি যদি লোককে নিছক ধরে বেঁধে জবরদস্তিমূলকভাবে নিজের অনুগত বানাতেন, তাহলে তাতে তাঁর ঐ উদ্দেশ্য সফল হতোনা। তাঁর প্রয়োজন ছিল এমন একদল মানুষের, যাদের মনমগর্জে পরিবর্তন এসেছে। আর মনমগজের পরিবর্তন একমাত্র ক্ষমা, দয়া, অনুগ্রহ ও কোমলতার মাধ্যমেই সম্ভব। তাঁর উদ্দেশ্য কেবল তখনই সফল হতো পারতো, যখন মক্কাবাসী তাদের অতীতের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে রাজী হতো। একটা সত্য আদর্শ ও গঠনমূলক বিপ্লব বাস্তবায়ন যাঁর লক্ষ ও মূলমন্ত্র, তাঁর জন্য অন্য কোন বিজেতাসুলভ নীতি মানানসই হতোনা।
আরো একটা বাস্তবতাকেও রসূল সা. গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। সেটি হলো, কোরায়েশ অতীতে যা-ই করুক না কেন, আরব জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তারাই সবচেয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও উপযুক্ত জনগোষ্ঠী। সারা আরবে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোত্রগুলোর মধ্যে তারা একটু অটুট সেতুবন্ধন স্বরূপ ছিল যে, তাদেরকে যদি বিনষ্ট করে দেয়া হয়, তবে সহজে এর কোন বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবেনা। নীতিগতভাবে ইসলামের এ নীতি অকাট্য সত্য ও একে মেনে নেয়া অপরিহার্য যে, ঈমান ও সততায যে যাত অগ্রগামী, নেতৃত্বের জন্যও সে ততই যোগ্য। কিন্তু ঈমানদারী ও সততার সাথে সাথে নেতৃত্বের মানসিক ও বাস্তব যোগ্যতাও তো সুস্পষ্ট যৌক্তিক প্রয়োজন। এ কাজের জন্য প্রভাব প্রতিপত্তি দরকার, শাসনকার্য পরিচালনা ও সামরিক অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা আবশ্যক, কৌশল জ্ঞান, কল্যাণ চেতনা ও প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যক, ভাষা ও অন্যান্য ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর দক্ষতা চাই এবং মানুষের সাধারণ মনস্তত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা চাই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিরা কেবল তখনই সফলতা লাভ করতে পারে, যখন তাদের শ্রেষ্ঠত্ব আগে থেকে জনগণের কাছে স্বীকৃত এবং তাদের শেকড় থাকে জনমতের অনেক গভীরে। কোন নেতৃত্ব শূ্ণ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কোরায়েশের নেতৃত্বের যোগ্যতা জাহেলিয়াতের অনুসারী ছিল বলেই ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত ছিল। কিন্তু ঐ নেতৃত্ব ইসলামের অনুসারী হয়ে ইমানদারী ও সততার গুণাবলীর অর্জন করলেই তা মহামূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়ে যায়। রসূল সা. বিজয়োত্তরকালে কোরায়েশদের সাথে আচরণের যে নীতি নির্ধারণ করেন, তা এই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করেন যেন ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আন্দোলন কোরায়েশদের কাছ থেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতা ও প্রশাসন লাভ করতে পারে। বলপ্রয়োগ ও অবমাননাকর আচরণ দ্বারা যদি তাদেরকে দমন ও দলন করা হতো, তবে তাদের দ্বারা এই প্রয়োজনটা পূরণ হতোনা।
৪. বিজয়ীর বেশে মক্কা প্রবেশকালে রসূল সা. খোদাভীতির যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, কোন দুনিয়াদার রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে তা প্রত্যাশা করা যায় না। তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন, অথচ ঢাকঢোল বা তবলা দামামা বাজেনি, গর্ব ও অহংকারের প্রদর্শনী হয়নি, বড় বড় কৃতিত্বের দাবী নিয়ে গলাবাজী করা হয়নি, বরঞ্চ জনতা ঠিক তার বিপরীত দৃশ্য দেখেছে। ‘সিজদারত অবস্থায়' প্রবেশের আদেশ পালন করে আল্লাহর দরবারে মাথা নত করা হয়েছে। আল্লাহর প্রশংসাসহ গান গাওয়া হয়েছে। মুখে যদি কোন শ্লোগান উচ্চারিত হয়ে থাকে, তবে তাও ছিল আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের শ্লোগান। আযান, নামায ও দোয়া মক্কার পরিবেশে আলোর বন্যা বইয়ে দিয়েছে। নিজের কোন দুনিয়াবী স্বার্থ উদ্ধার করা হয়নি, বরং মোহাজেরদের যে সমস্ত সম্পত্তি কোরায়েশরা জোর পূর্বক ও জুলুম নির্যাতনের ম্যধ্যমে হস্তগত করেছিল, তাও কোরায়েশদের অধিকারেই থাকতে দেয়া হলো। দুঃখের বিষয় যে, রসূল সা. কিছু কিছু বিবেকহীন সমালোচক রসূল সা. এর ইসলামী আন্দোলনের খোদাভীতিমূলক দিকগুলোকে নিছক স্বার্থপরতামূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছে। এমনকি কেউ কেউ একে খোলাখুলি লোক দেখানো ভড়ং বলেও প্রমাণ করতে চেয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ!) তারা তখন ভেবে দেখেনি যে, যারা লোক দেখানো ভড়ং করে, তারা সর্বাত্মক সাফল্য লাভ করলে মুখোস খুলে যায় এবং তাদের আসর রূপটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ না করুন, এট যদি কোন রাজনৈতিক ভেলকিবাজী হতো, তাহলে মক্কা বিজয় এমন সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়তো এবং ‘আল্লাহ বড়' আল্লাহ বড়' বলে যারা গলা ফাটাচ্ছিল, সহসাই দেখা যেত যে তারা নিজেদের বড়াই জাহির করা শুরু করে দিয়েছে। অথচ এখানে অবস্থা ছিল এ রকম যে, রসূল সা. তার বিজয়োত্তর প্রথম ভাষণে সাফল্যের সমস্ত কৃতিত্ব আল্লাহর বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন ও বিজয়ী করেছেন।
৫. মক্কা বিজয়ের সময় রসূল সা. শুধু রাজনৈতিক অপরাধই ক্ষমা করেননি, বরং কোন কোন ব্যক্তির এমন সব ফৌজদারী অপরাধও মাফ করে দেন, যার জন্য তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া জরুরী ছিল। এ সব দৃষ্টান্তের আলোকে আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক যুগের পরিস্থিতিকে ভেবে দেখতে হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে শাস্তি কমানো বা মাফ করার ক্ষমতা কতখানি দেয়া যেতে পারে।

মক্কা বিজয়ে পূর্ণতা প্রাপ্তি

মক্কার আশে পাশে কোরায়েশদের পুরানো সমর্থক ও সহযোগী এবং প্রায় একই ধরনের প্রভাব প্রতিপত্তি ও দাপটের অধিকারী যে গোত্রগুলো বাস করতো, মক্কা বিজয়ের সাথে সাথে সেই দুর্ধর্ষ গোত্রগুলোকেও যদি শায়েস্তা না করা হতো, তবে মক্কা বিজয়ের সঠিক অর্থে বিজয় বলেই গণ্য হতোনা, আর হলেও তা টেকসই হতোনা। মক্কার জাহেলী নেতৃত্বের নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রতাপ যেটুকু ছিল, সেটুকুকে জোরদার করার ব্যাপারে বনু হাওয়াযেন, তায়েফবাসী ও বনু সাকীফেরও প্রচুর অবদান ছিল। এরা বলতে গেলে একই গাছের ভিন্ন ভিন্ন ডালপালা ছিল। সাধারণ আরবদের মোকাবিলায় মক্কার পার্শ্ববর্তী এই সব গোত্রও নেতৃত্বের মর্যাদা ভোগ করতো। অবশ্য কোরায়েশদের সামনে তারা ছিল দ্বিতীয় স্তরের নেতৃত্বের সারিতে। মক্কার সাথে তাদের মিত্রতাপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্কও ছিল যথেষ্ট প্রাচীন, আর অর্থনৈতিক সম্পর্কও ছিল নিবীড় ও গভীর। সামরিক প্রয়োজনেও তারা পরস্পরের সাথী ছিল, আবার সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও তারা উঁচু স্তরের লোক ছিল। মক্কা বিজয় যে বিনা রক্তপাতে সম্পন্ন হয়েছিল, সেটা নেহাৎ অলৌকিকভাবেই হয়েছিল। নচেত বনু হাওযাযেন, বুন সাকীফ ও তায়েফবাসী সম্মিলিতভাবে কোরায়েশকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসার কথা ছিল। তা যদি সত্যিই ঘটতো, তবে মক্কার ইতিহাসে চরম রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হতো। কিন্তু রসূল সা. এর পরিকল্পনা এ নিপুণ ও দক্ষতাপূর্ণ ছিল যে, মক্কাবাসী আশপাশ থেকে কোন সাহায্যই পায়নি। একেবারেই একাকী ও অতর্কিতভাবে মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়েছে।
হাওয়াযেন গোত্রের নেতারা আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিল যে, কী ঘটতে যাচ্ছে। যে সংঘাতের সূচনা বদরে হয়েছে, তার শেষ পরিণতি যে এখানো বাকী রয়েছে, তা তারা বুঝতে পেরেছিল। কোরায়েশের পক্ষ থেকে হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি ভংগ, রসূল সা. এর পক্ষ থেকে প্রেরিত নতুন শর্তাবলী, প্রস্তাব রক্ষাকারী দূতকে ফেরত পাঠানো এবং এরপর আবু সুফিয়ানের চুক্তি নবায়নের চেষ্টায় ব্যর্থতা -এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা শুভ লক্ষণ ছিলনা। এ জন্য হাওয়াযেন গোত্রের নেতারা সারা বছর শক্তি সংগ্রহের কাজে ব্যাপৃত ছিল। তারা বিভিন্ন গোত্রের সাথে যোগাযোগ করে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কিন্তু যখন সময় এল, তখন রাসূল সা. এর রহস্যপূর্ণ কার্যকলাপকে তারা ভুল বুঝলো। বনু হাওয়াযেন ভাবলো, রসূল সা. তাদেরকে লক্ষ্য করেই যাবতীয় যুদ্ধ প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। তাই তারা নিজেদের অঞ্চলেই সেনা সমাবেশ ঘটালো এবং মহা ধুমধামে প্রস্তুতি চালাতে লাগলো।

কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ তাদের অনুমানের বিপরীত অন্য রকমের রূপ ধারণ করলো। তারা তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নিজ জায়গায় বসে রইল। আর মক্কার পতনের ন্যায় বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা অত্যন্ত সহজে সংঘটিত হয়ে গেল। মক্কা বিজয়ে অন্যান্য গোত্রের প্রতিক্রিয়া হলো এই যে, তাদের পক্ষ থেকে লোকেরা দলে দলে রসূল সা. এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। কিন্তু বনু হাওয়াযেন ও বনু সাকীফের প্রতিক্রিয়া হলো অন্য রকম। কেননা একেতো তাদের বিপুল জনবল, অর্থনৈতিক শক্তি ও সামারিক দক্ষতায় তারা সংগঠিত ছিল। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত শত্রুতামূলক আচরণ করতে করতে তাদের এমন হঠকারি মেজাজ গড়ে উঠেছিল যে, তারা নিজেদের কর্মসূচীকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বাধ্য ছিল। তারা তাদের শেষ লড়াই লড়বার জন্য তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী আওতাস বা হোনায়েনে সৈন্য সমবেত করলো। শুধুমাত্র বনু কাব ও বনু কিলাব পুরোপুরি নিরপেক্ষ ভূমিকা অবলম্বন করলো।
রসূল সা. বনু হাওয়ানের প্রস্তুতির কথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আবি হাদরুকে গোয়েন্দা হিসেবে পাঠালেন এবং সঠিক তথ্য জেনে নিলেন। এবার যুদ্ধ প্রস্তুতির পালা। সামরিক প্রয়োজন পূরণের জন্য রসূল সা. আবদুল্লাহ বিন রবীয়ার কাছ থেকে তিন হাজার দিরহাম এবং মক্কার বিশিষ্ট নেতা সাফওয়ান বিন উমাইয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিশেষত ১০০ বর্ম ধার নিলেন। এ থেকে অনুমিত হয় যে, রসূল সা. কোন অসাধারণ সামারিক প্রস্তুতি নিয়ে বের হননি। আগে থেকেই কোন রক্তপাতের চিন্তা তার ছিলনা। কেবল ঘটনাস্থলেই নতুনভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছিল। কেমন নজীরবিহীন ঘটনা! যে বিজেতা কোরায়েশকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্তু করেছেন, তিনি তাদের কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্র জবরদস্তিমূলকভাবেও আদায় করতে পারতেন। এত উঁচু পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েও তিনি নৈতিকতার প্রতি এত লক্ষ্য রাখতেন যে, যা কিছুই নিলেন ধার হিসেবেই নিলেন। ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্টই হলো তার এই নৈতিক চেতনা।
৮ম হিজররি শাওয়াল মাসে ১২ হাজার মুসলিম সৈন্য মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করলো। এই মুসলিম সৈন্যদের মনে এবার এরূপ মনোভাব জাগ্রত হলো যে, আমরা এখন মক্কা বিজয়ী সেনাবাহিনী। আমাদের জনবল বিপুল। অস্ত্রবলও আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশী। এ ধরনের আত্মম্ভরী মনোভাব যে মানুষকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এটা ছিল তাদের মানবীয় দুর্বলতা। তাদের খেয়াল ছিল না যে, তারা সেই বিশ্ব সম্রাটের সৈনিক, যিনি এক তিল পরিমাণ অহংকার সহ্য করেন না। অহংকার ও আত্মম্ভরিতা মানুষের ও আল্লাহর মাঝে লোহার প্রাচীর স্বরূপ। এর কারণে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। অথচ আল্লাহর সাহায্য যে কোন ইসলামী লড়াই এর প্রাণ হয়ে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য এই আত্মম্ভরিকতার এমন কঠোর শাস্তি দেয়া হলো যে, তা ঐতিহাসিক স্মৃতিতে পরিণত হলো। কোরআন এ ঘটনাকে স্থায়ী শিক্ষার উৎসে পরিণত করেছে।
ঘটনা ছিল এই যে, মুসলিম সেনাবাহিনীর মধ্যে এবার মক্কা থেকে একদল নতুন ধরনের সৈনিক যোগ দিয়েছিল। খালেদ বিন ওলীদের নেতৃত্বে পরিচালিত অগ্রবর্তী বাহিনীতেও নও মুসলিম তরুণরা ভর্তি হয়েছিল। তারা আবেগে এতই উদ্দীপ্ত ছিল যে, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রেও সজ্জিত হয়ে যায় নি। তাছাড়া মক্কার দু'হাজার ‘‘তোলাকাবা মুক্ত লোক’’ও ছিল, যারা ইসলামী সরকারের অনুগত ছিল বটে, তবে এখনো সঠিকভাবে তাদের ইসলামী চরিত্র গড়ে উঠেনি। ওদিকে প্রতিপক্ষের লোকেরা ছিল যুদ্ধবিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী, বিশেষত তীর নিক্ষেপ তাদের সমকক্ষ সারা আরবে কেউ ছিল না। তারা রণাঙ্গনের সবচেয়ে ভালো জায়গা আগেই দখলে নিয়েছিল এবং প্রত্যেক পাহাড়ে, পাহাড়ের গর্তে, গিরিপথে তীরন্দাজ বাহিনী গোপনে বসিয়ে রেখেছিল।
হামলার শুরুতেই যখন সকল দিক থেকে তীর নিক্ষেপ হতে লাগলো, তখন অগ্রবর্তী বাহিনী ছত্রভংগ হয়ে গেল। সেই সাথে মুসলিম সৈন্যরা ঘাবড়ে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। এক সময় এমন অবস্থা হলো যে, রসূল সা. এর পাশে কেউ ছিল না, তিনি সম্পূর্ণ একাকী দাঁড়িয়েছিলেন। এটা রসূল সা. সামরিক জীবনের কয়েকটি বিরল ও নাজুক মুহূর্তের অন্যতম, যখন তার সংকল্পের দৃঢ়তা, বীরত্ব, আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর নির্ভরতা নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে সাথীদেরকে ডাকলেন এবং বাহন জন্তুর পিঠ থেকে নেমে গম্ভীর স্বরে বলতে লাগলেনঃ
‘‘আমি সত্য নবী, এতে নেই কোন মিথ্যার লেশ। [আরবী*********]
আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌত্র জানো বেশ।’’ [আরবী*********]
হযরত আববাস নিকট থেকেই ডাক দিলেনঃ ‘‘ওহে আনসারগণ! ওহে গাছের নিচে বসে বায়য়াত গ্রহণকারীগণ!’’ এ আওয়ায শুনেই বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা চারদিক থেকে ছুটে এল এবং অমিত বিক্রমী নেতা রসূল সা. এর চার পাশে সমবেত হলো। এরপর তারা এমন বীরোচিতভাবে যুদ্ধ করলেন যে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে গেল। শত্রুর ৭০ জন মারা গেল। তাদের পতাকাবাহক মারা গেলে। তাদের গোটা বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে গেল। পরাজিত কাফের বাহিনীর একাংশ আওতাস দূর্গে গিয়ে আত্মগোপন করলো। আবু আমের আশয়ারী ক্ষুদ্র একটা দল নিয়ে সেখানে গেলেন। শত্রুরা ছিল কয়েক হাজার। আবু আমের আশায়ারী নিজে শহীদ হলেন। তবে তার দল জয় লাভ করলো।
তায়েফ অত্যন্ত সুরক্ষিত জায়গা ছিল। কেননা তার চারপাশে ছিল প্রাচীর। এই প্রাচীর মেরামত করা হয়েছিল এবং সারা বছরের প্রয়োজনীয় রসদ আগে থেকে সেখানে সঞ্চিত করা হয়েছিল। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। রসূল সা. এর আসল লক্ষ্য ছিল এই কেন্দ্রীয় জায়গাটি দখল করা। কিন্তু তিনি এমন কৌশল অবলম্বন করলেন যে, তায়েফবাসীকে বনু হাওয়াযেনের সাহায্যে থেকে প্রথমে বঞ্চিত করলেন। কিন্তু হেরে যাওয়া লোকেরা এখানেই সমবেত হয়েছিল। তায়েফের ওপর আক্রমণ এমন একটা দিক দিয়ে করা হলো, যেদিক থেকে আক্রমণ হওয়ার কথা তায়েফবাসী কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথমে হযরত খালেদ একটা সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পরে রসূল সা. স্বয়ং গোটা বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন। এটা ছিল প্রথম ঘটনা, যখন দুর্গ ভাঙ্গার জন্য কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। (উল্লেখ্য যে, রসূল সা. জুরাশ নামক স্থানে দুর্গ ভাঙ্গার ভরী অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য অন্য কয়েকজন মুসলিম যোদ্ধাকে পাঠিয়েছিলেন। জুরাশ ছিল এই জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কেন্দ্র। সম্ভবত এই কেন্দ্র ইহুদীদের দখলে ছিল)। কিন্তু ভেতর থেকে সৈন্যদের ওপর ব্যাপক তীর বর্ষণের সাথে সাথে দূর্গভাঙ্গা অস্ত্রগুলোর ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে গরম লৌহ শলাকা নিক্ষেপ করা হতে লাগলো। বহু মুসলিম যোদ্ধা আহত হলো এবং তাদেরকে পিছু হটতে হলো।
এই পরিস্থিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রসূল সা. নওফেল বিন মুয়াবিয়ার মতামত তলব করলেন। তিনি এক মজার জবাব দিলেন। সে বললো, “শেয়াল গর্তে ঢুকে গেছে। চেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে নিয়ন্ত্রণে আসবেই। আর যদি তাকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তেমন কোন ক্ষতির আশংকাও নেই।‘’ এই জ্ঞানগর্ভ পরামর্শের ভিত্তিতে রসূল সা. মনে করলেন, গোটা আরব যেখানে ইসলামের অধীনে এসে গেছে, সেখানে তায়েফ ভিন্ন মতাবলম্বী তো হতে পারে না। তাকে যদি এখনই বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা হয় তাহলে দুটো ক্ষতি হবে। আর যদি ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি তায়েফবাসীর মধ্যে সেচ্ছা ভিত্তিক আনুগত্যের প্রেরণা জাগাবে। তাদের মনের দরজা ইসলামের বিপ্লবী মতাদর্শের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাই তিনি ইসলাম ও তায়েফবাসী উভয়ের বৃহত্তম কল্যাণার্থে অবরোধ প্রত্যাহার করে নিলেন। রসূল সা. রক্তপাত এড়িয়ে চলতে কত যত্নবান ছিলেন, এটা তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ। সাথীরা বললো, “হে রাসূল, আপনি তায়েফবাসীর জন্য বদদোয়া করুন।’ রাসূল সা. দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ সকীফকে সঠিক পথ দেখাও এবং তাদেরকে আমাদের সাথে যুক্ত করে দাও।” যে তায়েফবাসী একদিন রাসূল সা. কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, তাদের জন্য তিনি এ দোয়া করলেন। এ দোয়াও তাঁর এই দয়ালু হৃদয়ের পরচিায়ক, যে হৃদয় একান্ত বাধ্য না হলে কোথাও শক্তি প্রয়োগকরার পক্ষপাতী ছিল না। তবে সে হৃদয় ক্ষমাও দয়া বিতরণে কখনো কার্পণ্য করেনি।
জারানায় ২৪ হাজার উট, ৪০ হাজার ছাগল এবং ৪ হাজার উকিয়া রৌপ্য গণিমত হিসেবে হস্তগত হয়। এর মধ্য থেকে কোরআনের বিধান অনুসারে এক পঞ্চমাংশ সামাজের অভাবী শেণীর জন্য ও সমষ্টিক প্রয়োজনের জন্য বাইতুলমালে জমা করা হয়। আর বাদবাকী সব সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এভাবে গণিমত হস্তগত করা একদিকে যেমন শত্রুপক্ষরে আর্থিক ও সামরিক শক্তি হ্রাস করার একটা উৎকৃষ্ট পন্থা, অপর দিকে তেমনি শত শত বছর ধরে সঞ্চিত সম্পদকে এই প্রথম বারের মত অবাধ বিতরণের সুযোগ পাওয়া গেল এবং ধনী ও গরীব গোত্রসমূহের পুরানো অর্থনৈতিক বৈষম্য দুর হবার অবকাশ সৃষ্টি হলো।
কোরআন যাকাতরে অর্থ বিতরণের জন্য ‘চিত্ত আকর্ষণ’ বা ‘তালীফুল কালব’ শীর্ষক একটা খাত বরাদ্দ করেছে। (এর পারিভাষিক অর্থ হলো, ইসলাম ও মুসলমানদরে বৃহত্তর স¦ার্থে যে সমস্ত ব্যক্তিকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সহনশীল বা সহানুভূতিশীল করা প্রয়োজন, তাদেরকে প্রয়ােজনীয় অর্থ দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা-অনুবাদক) এই খাতের আওতায় রাসূল সা. মক্কার অধিবাসীদেরকে ও তাদের নেতৃবৃন্দকে মুক্ত হস্তে অনেক অর্থসমম্পদ দান করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের মনের জ¦ালা প্রশমতি করা। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাশ থেকে পাতালে নক্ষিপ্তি হয়েছিল এবং গোটা সামাজিক পরিবেশ তাদের কাছে সম্পূর্ণ পরর্বিততি হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় তাদের মত দুস্থ ও অসহায় পৃথিবীতে আর কেউ ছিলনা। রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ জন হয়েও যখন তারা পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতো, আর আনসার ও মোহাজেররা রাসূল সা. এর ডান হাত ও বাম হাত হিসেবে অবস্থান করতেন, তখন তাদের অনুভুতি কেমন হতে পারে তা সহজেই বুঝা যায়। আল্লাহর আদালত দীর্ঘ দু’দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত মামলার রায় ঘোষাণা করলো। এ মামলায় কােরায়শেরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও হেরে গেল। তাই তাদের চেয়ে বড় র্দুদশাগ্রস্ত মানুষ সেদিন আর কেউ ছিলনা। তাদের পরাজয়ের গ্লানী ও হতাশা ভোলানোর ব্যবস্থা যদি না করা হতো, তাহলে তদের হতাশা থেকে বারবার চাপা প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠতো এবং তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোক দেখানো আনুগত্যের আড়ালে ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ভেতরে ভেতরে সাবোটাজ করতে থাকতাে। আবু সুফিয়ান, হাকীম বিন হিযাম, নাযর বিন হারিস, সাফওয়ান বিন উমাইয়া ও আকরা বিন উমাইয়া ও আকারা বিন হারিসের মত শীর্ষস্থানীয় কোরায়েশ নেতারা আজ সেই ব্যক্তির কাছ থেকেই দান গ্রহণ করছে, যাকে তারা বহু বছর ধরে গাল দিয়েছে, মিথ্যুক বলেছে, ব্যংগ বদ্রিুপ করেছে, শারীরিক কষ্ট দিয়েছে, অবরোধ করেছে, হত্যা করতে চেয়েছে, ঘর বাড়ী ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে, এবং হিজরত করে চলে যাওয়ার পরও তাঁর বরিুদ্ধে আগ্রাসী আক্রমণ চালিয়ে তাকে এক মুর্হূত শান্তিতে ও নিরাপদে থাকতে দেয়নি। এমন বিস্ময়কর দৃশ্য কে কোথায় দেখেছে? মানবতার সেবার এমন ক’টা দৃষ্টান্ত ইতিহাসে পাওয়া যাবে?
বদান্যতা ও মহানুভবতার এমন উত্তাল সমুদ্র কােরায়শে নেতাদের ওপর আছড়ে পড়ছে দেখে আনসারদের কারো কারো মনে কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো। তাদের মধ্যে কিছু কিছু হীন ভাবাবগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তারা ভাবলো, বংশীয় স¦জন প্রীতি ও মাতৃভমির টানেই হয়তো রাসূল সা. তাদেরকে এত খাতির তোয়াজ করছেন এবং আমাদেরকে অবহেলা করছেন। কেউ কেউ মুখ ফুটে বলে ফেললো, “ইসলামের রক্ষণাবক্ষেণরে জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করার বেলায় তো আমরাই আছি এবং আমাদের তরবারী দিয়ে এখনও রক্তের ফোঁটা টপকাচ্ছে। কন্তিু দান দক্ষণিার বেলায় আমাদের ওপর কোরায়েশরাই অগ্রাধিকার পেল।
যাদের মাথায় এ ধরনের চন্তিাভাবনা কিলবিল করছিল, তারা এ কথা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করলোন্া যে, রাসূল সা. নিজ পরিবারভূক্তদেরকে এই দান দক্ষণিা দিচ্ছেননা। নিজের নিকটাত্মীয় মোহাজেরদেরকেও দিচ্ছেননা এবং নিজেও নিচ্ছেন না। এমতাবস্থায় কোরায়েশদের সাথে যদি একটু বিশেষ ধরনের আচরণ করা হয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই তার পেছনে ্েকান বৃহত্তর কল্যাণ রয়েছে।
বিষয়টা যখন রাসূল সা. এর কানে গেল, তখন একটা শামিয়ান টানানো হলো এবং সেখানে এবং সেখানে আনসারদেরকে ডাকা হলো। রসূল সা. তাদের সামনে মর্মস্পর্শী সংক্ষপ্তি ভাষণ দিলেন। (এই ভাষণ ইতি পূর্বে উদ্ধৃত করা হয়েছে।) এ ভাষণের শেষ বাক্যটা ছিল এ রকম: “হে আনসার! তোমাদের কাছে কি এটা পছন্দনীয় নয় যে, অন্যরা উট ছাগল নিয়ে যাক, আর তোমরা মুহাম্মদ সা. কে সাথে নিয়ে যাও?” এ ভাষণ শুনতে শুনতে আনসারদের চোখের পানিতে দাড়ি ভিজে যাচ্ছিল। শেষের বাক্যটি শুনতে তারা চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমাদের জন্য শুধু মুহাম্মদই সা. যথেষ্ট।’’ এরপর তিনি কোমল ভাষায় তাদেরকে বুঝালেন কোন্ কোন্ কারণে কোরায়েশদের মনলোভনের প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল।
এ দিকে ছ’ হাজার যুদ্ধবন্দী তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অপক্ষোয় ছিল। রাসূল সা. পুরো দু’সপ্তাহ অপক্ষো করলেন যে, কেউ এসে তাদের সম্পর্কে কোন বক্তব্য পেশ করে কিনা। এ জন্য তিনি গণিমতের ভাগবাটোয়ারাও স্থগিত রেখেছিলেন। কন্তিু কেউ যখন এলনা, তখন ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেল। ভাগবাটোয়ারার পর রসূল সা. এর দুধমাতা হালীমা সা’দিয়ার গোত্রের মান্যগণ্য লোকদের একটা দল তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে এল। দলনেতা যোহায়ের অত্যন্ত মর্মস্পশী ভাষায় তাদের গোত্রের যুদ্ধবন্দীদের সম্পর্কে বললোঃ
“যে মহিলারা এখানে ছাপড়ায় আটক রয়েছে, তাদের ভেতর আপনার ফুফুরাও আছে, খালারাও আছে। আল্লাহর কসম, আরবের কোন রাজাও যদি আমাদের গোত্রের কোন মহিলার দুধ পান করতো, তবে তার কাছওে আমরা অনেক কিছু আশা করতাম। তবে আপনার কাছ থেকে আমরা আরো বেশী আশা করি।”
রাসূল সা. তাদের বুঝালনে যে, আমি নজিইে দীর্ঘ সময় অপক্ষোয় ছিলাম যে, কোন দাবীদার আসে কিনা। শেষ র্পযন্ত কেউ না আসায় বাধ্য হয়ে বন্টন করে দিয়েছি। এখন যে সব বন্দীকে বনু হাশেমের লোকদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে, তাদেরকে তো আমি এই মুহূর্তেই তোমার হাতে অর্পন করছি। অন্যদের জন্য নামাযের পর মুসলমানদের বৃহত্তম সমাবেশে তুমি বক্তব্য রাখবে। নামাযের পর যোহায়ের তার বক্তব্য পেশ করলো। রসূল সা. বললেন, “আমি শুধু আমার গোত্র (বনু হাশেম) সম্পর্কে দায়িত্ব নিতে পারি। তবে সকল মুসলমানকে আমি সুপারিশ করছি।” তৎক্ষণাত সকল আনসার ও মোহাজের বলে উঠলোঃ “আমাদের অংশও আমরা মুক্ত করে দিচ্ছি।” কেবল বনু সুলায়েম ও বনু ফাযারার কাছে বিজিত শক্রদের আটককৃত যুদ্ধবন্দী বিনা মূল্যে স্বাধীন করে দেয়ার ব্যাপারটা অভিনব মনে হলো এবং তারা ইতস্তত করতে লাগলো। অবশেষে রসূল সা. বন্দীপ্রতি ৬ টি করে উট দিয়ে বাদবাকী বন্দিদেরকেও মুক্ত করিয়ে আনলেন। এভাবে ৬ হাজার যুদ্ধবন্দীর সবাই মুক্ত হয়ে গেল। বহু বন্দীকে রাসূল সা. পোশাকও দিলেন। সাধারণ বিজেতাদের যা কল্পনারও বাইরে, সেটাই এখানে সংঘটিত হলো। বন্দীদেরকে মুক্তিপণ ছাড়াইমুক্ত করে দেয়া হলো। কেননা লোকদেরকে হত্যাকরা বা গোলাম বানানো তার আসল উদ্দেশ্য ছিলনা। আসল উদ্দেশ্য ছিল সত্য দ্বীনের প্রতষ্ঠিা এবং মানুষের মনকে তার জন্য প্রস্তুত করা।
এই কাজ সম্পন্ন করে তিনি ওমরা করলেন এবং ইতাব বিন উসাইদকে মক্কার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে মদিনায় চলে গেলেন।

মক্কা বিজয়ের পর

আমার মতে, মক্কা বিজয়ের পরবর্তী হোনায়েন যুদ্ধে ইসলাম বিরোধী নাশকতাবাদী শক্তি অভ্যন্তরীণভাবে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। এ যুদ্ধের পর আরবের ভাগ্যে ইসলামী বিধান চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। অন্য কারো জন্য সামনে অগ্রসর হবার কোন সুযোগ অবশিষ্ট থাকেনি। এরপরও ছোট ছোট কয়েকটা সামরিক ব্যবস্থা বক্ষিপ্তি দুস্কৃতিকারীদের দমন ও আইন শৃংখলা পুনর্বহালের জন্য গ্রহন করতে হয়েছিল। তবে সেগুলো তেমন গুরুত্বর্পূণ ঘটনা নয়।
বনু তামীম গোত্র অন্য কয়েকটা গোত্রকে প্ররোচিত করে ইসলামী সরকারের রাজস্ব আদায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। উয়ইনা বিন হিসনকে ৫০ জন অশ্বারোহী সৈন্য সমেত পাঠানো হয়। হামলা হওয়া মাত্রই বনু তামীম পালিয়ে যায়। কয়েকজনকে বন্দী করে মদিনায় আনা হয় এবং পরে মুক্তি দেয়া হয়।
খাসয়াম গোত্র (তাবালা অঞ্চলের অধীবাসী) বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিল। কাতবা বিন আমেরের নেতৃত্বে ২০ জন সৈন্যের একটা সেনাদল তাদের দমনের জন্য পাঠানো হয়। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায়। কিছু লোককে বন্দী করা হয়। কিন্তু রসূল সা. পরে তাদেরকে ছেড়ে দেন। হযরত দাহাককে বনু কিলাবের কাছে পাঠানো হয়। তাঁর সাথে ছিল একই গোত্রের আসীদ বিন সালমাও। এ দলটা ছিল প্রধানত দাওয়াতী ও শক্ষিামূলক দল। গোত্রের লোকেরা তাদের বরিুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। আসীদের পিতা নিহত হয়। এ সম্পর্কে আর কোন বস্তিারতি বিবরণ জানা যায়নি।
একবার জানা গেল আবিসিনিয়ার কিছু নৌদস্যু জেদ্দায় সমবেত হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা কারশী (বা আলকামা বিন মুজাযযাজ) তিনশো সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে রওনা হতেই দস্যুরা পালিয়ে যায়।
নবম হিজরীর রবিউস সানী মাসে হযরত আলী রা. কে দেড়শো অশ্বারোহী সৈন্য সমেত বনী তাঈ গোত্রে পাঠানো হলো এবং নির্দেশ দয়ো হলো ওখানকার বড় মন্দিরটাকে ধ্বংস করে দিতে। এখানে বিষয়টার একটু বশ্লিষেণ প্রয়োজন। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র ছিল। এ রাষ্ট্র যে মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ তার বিরোধী আকীদা পোষণ করলে তা ঐ রাষ্ট্র বরদাশত করতে পারতো। কন্তিু এই মৌলিক আকীদা বিশ্বাস তথা তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসের পরিপন্থী কোন সামাজিক প্রতিষ্টানকে সে কিভাবে চলতে দিতে পারে? এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে প্রাগৈতিহাসিক আরবের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় সেখানকার মূর্তিগুলো ছিল জীবন্ত প্রেরণার উৎস স্বরূপ। ঐ সব মূর্তির অস্তত্বি কল্পনা করতেই এমন মানসিক ভাবাবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হতো, যা জাহেলী সমাজের লোকদেরকে উস্কানী দিয়ে দিয়ে ইসলামী সরকারের বরিুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করতো। এই সব মূর্তির নামে বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রক্ষোপটে জাহেলী যুগের মন্দিরগুলোকে সামষ্টিক প্রতষ্ঠিান হিসাবে বহাল রাখা এবং পৌত্তলিক চন্তিাধারাকে বারবার অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টির সুযোগ দেয়া কোনমতেই যুক্তিসংগত কাজ হতোনা। এই মূর্তিগুলো প্রকৃত পক্ষে একটা বিশেষ ধরনের মানসিকতার প্রতীক এবং একটা বাতিল জীবন ব্যবস্থার নিদর্শন ছিল। তাই বনী তাঈ গোত্রের মন্দির ধ্বংসের এই পদক্ষপেকে কোন স্বীকৃত ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষপেরে পর্যায়ভুক্ত বলা যাবেনা, বরং এটা ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তত্বিরে বরিুদ্ধে হুমকি সৃষ্টিকারী প্রবণতা থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার একটা অনিবার্য পদক্ষপে ছিল। ব্যাপারটা কার্যত কেবল আর্দশকি পর্যায়েই যে সীমাবদ্ধ ছিল; তাও নয়। তাই গোত্র পৌত্তলিক আকীদা বিশ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়ে কিছ বিদ্রোহী মনোভাবও পোষণ করতে আরম্ভ করেছিল। মদিনার সাথে টক্কর দেয়ার চন্তিাভাবনা তাদের ভেতরে যথেষ্ট পেকে উঠেছিল। এর অকাট্য প্রমাণ এইযে, হাতেম তাঈ এর খ্যাতনামা পরিবারে তার ছেলে আদী ইবনে হাতেম স্বয়ং এ উদ্দেশ্যে বহু সংখ্যক বাহক পশু ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রেখেছিল। আদীর মত ঐ গোত্রে আরো অনেকেই যে এধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল তা বিচিত্র কিছু ছিলনা।
যাহোক, হযরত আলী রা. কুল্স নামক স্থানে পৌঁছে সকাল বেলাই আক্রমণ চালালেন। আদী বিন হাতেম কিছু শক্তি সংগ্রহ করে আনার উদ্দেশ্যে সিরিয়া পালিয়ে গেল। গোত্রের লোকেরা সামান্য প্রতিরোধ করেছিল। তাদের মন্দির ভেংগে ফেলা হলো। আদীর বোনসহ আরো কয়েকজনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হলো এবং কিছু পশু ও অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করা হলো। আদীর বোন রসূল সা. এর কাছে নিজের র্মমন্তুদ দুঃখরে কাহিনী বর্ণনা করলো। সে বললোঃ “আমার বাবা মারা গছেনে। আমার প্রহরী আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমি বৃদ্ধা ও দুর্বল। কোন কাজ করার ক্ষমতা নেই। আমার ওপর অনুগ্রহ করুন। আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবে। রাসূল সা. এই মহিলার ইচ্ছা অনুযায়ী তার জন্য বাহক পশুর ব্যবস্থা করলেন এবং তাকে মুক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন। এই মহিলা বাড়ী গিয়ে তার ভাইকে রাসূল সা. এর মধুর স্বভাব ও আচরণের কথা জানালো। সে বললো, “অবিকল আমাদের পিতার মত আচরণ দেখে এলাম। অমুক এলে তার প্রতি এরূপ অনুগ্রহ দেখানো হলো, অমুক এলে তাকে এরূপ বদান্যতা প্রদর্শন করা হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। রাসূল সা. এর সাথে যুদ্ধ করার চন্তিা ছেড়ে দাও। নিজে যাও। দেখাবে কত উপকার লাভ করবে।” এর অল্প কিছুদিন পরই আদী ইবনে হাতেম মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করলো।

দুটো আর্ন্তজাতিক যুদ্ধ

রসূল সা. এর জীবদ্দশায় যে আসল কাজটা সম্পন্ন হয়েছিল, তা ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও ইসলামী বপ্লিবরে পূর্ণতা সাধনের কাজ কন্তিু তিনি আশপাশের দেশগুলোর শাসকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আন্দোলনের আর্ন্তজাতকি যুগের সূচনা করেন। তিনি বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করেন। একজন দূতের নাম হলো হারেস বিন উমায়ের আয্দী। তাঁকে সিরিয়ার খৃষ্টান শাসকের নিকট পাঠানো হয়। কন্তিু খৃষ্টান শাসক শুরাহবীল বিন আমের গাসসানী রাসূল সা. এর এই দূতকে পথিমধ্যেই হত্যা করে। এ কাজটা ছিল মৌলিক মানবীয় চরিত্র ও সমকালীন প্রচলিত আর্ন্তজাতকি আইনের এমন জঘন্য লংঘন, যাকে কোন সরকার নীরবে বরদাশত করলে সে সরকারের কোন মান মর্যাদা অবশিষ্ট থাকতোনা। এ জন্য ৮ম হিজরীতে রসূল সা. স্বীয় মুক্ত গোলাম যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণ করেন। এক ব্যক্তি গোলামীর অবস্থা থেকে উন্নীত হয়ে কিভাবে সেনাপতি হয়ে গেল এবং ইসলামী বপ্লিবরে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো, সেটাই এ ঘটনায় পরিষ্ফুট হয়েছে। এই যায়েদ বিন হারেসার ছেলে উসামাকেও রসূল সা. জীবনের শেষ অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। এই বাহিনীকে বিদায় জানাতে রাসূল সা. স্বয়ং সানিয়াতুল ওদা র্পযন্ত যান। বাহিনী যখন মুয়ান নামক স্থানে পৌছলো, তখন জানা গেল যে, রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াস সিরিয়া সফরে এসেছে এবং ঐ অঞ্চলের প্রায় এক লাখ খৃষ্টান সৈন্য তার সাথে রয়েছে। ইতিপূর্বে মুসলিম বাহিনীর মদনিায় প্রত্যাবর্তনের যে প্রস্তাব বিবেচনাধীন ছিল, সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে যুদ্ধ করার সদ্ধিান্ত নেয়া হলো। সামনে অগ্রসর হতেই মাশারেফ নামক স্থানে শক্রর এক বিরাট বাহিনীর সাথে সাক্ষাত হলো এবং তুমুল লড়াই হলো। যায়দে বিন হারেসা শহীদ হলেন। এরপর পতাকা বহন করলেন হযরত জাফর। জাফরের ডানহাত কেটে গেলে বাম হাত দিয়ে পতাক ধরলেন। বাম হাতও কেটে গেলে বুকের ওপর রাখলেন। অবশেষে ৯০টি আঘাত খেয়ে শাহাদাত লাভ করলেন। এরপর রাসূল সা. এর নির্দেশিত ধারাবাহিকতা অনুসারে পতাকবাহী হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা। তনিওি যখন শহীদ হলনে তখন র্সবসম্মত রায়ে সনোপতি হলনে খালদে ইবনুল ওলীদ। তিনি এমন দুর্ধষতার সাথে যুদ্ধ করলেন যে, তার হাতে একে একে ৯ খানা তরবারী ভেঙ্গে গেল। অবশেষে শক্রসৈন্য পিছু হটতে বাধ্য হলো। হযরত খালেদ বাহিনীকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন। মোট ১২ ব্যক্তি এই যুদ্ধে শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে মূল্যবান ব্যক্তিবর্গ অর্ন্তভুক্ত ছিলেন।
মুসলমানরা সাময়কিভাবে এই বিজয়কে যথেষ্ট মনে করলেন। কেননা শক্রর সৈন্য সংখ্যা খুবই বেশী ছিল, স্থানটা ছিল বিদেশ এবং পরিস্থিতি ছিল একেবারেই অপরিচিত। রসদের ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল এবং বাড়তি সৈন্য আনারও কোন আশা ছিলনা। এ জন্য এই বাহিনী মদিনায় ফিরে এল। রসূল সা. ও মুসলমানগণ মদিনা থেকে বেরিয়ে এসে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। কেউ কেউ কৌতুক করে এই বাহিনীকে “ফেরারী” বলে আখ্যায়িত করলে রাসূল সা. বললেন, না “ফেরারী” নয় এরা “কেরারী” অর্থাৎ তারা পুনরায় যুদ্ধে যাবে। হযরত খালেদ রা. এই যুদ্ধে যে কৃতিত্ব দেখান. সে অনুসারে তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ তথা ‘আল্লাহর তরবারী’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
এই পর্যায়ে দ্বিতীয় অভিযান ছিল তাবুক অভিযান।
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীর রজব মাস চলছে। সিরিয়া থেকে আগত এক কাফেলা খবর দিল যে, রোম স¤্রাটের সৈন্যরা মদিনায় আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোম সা¤্রাজ্য তৎকালীন দুনিয়ার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে বস্তিৃত ছিল। কছিুদনি আগে এ সা¤্রাজ্য ইরানকেও ঘায়েল করেছিল। রসূল সা. ও মুসলমানগণ সারা পৃথিবীতে ঈমান ও সততার আলো ছড়ানোর জন্য মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে একটা আলোর মিনার হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। অনেক পরিশ্রমের গড়া এই ইসলামী রাষ্ট্রকে তারা ধ্বংস হতে দিতে পারেন না। কেননা এই রাষ্ট্রই ছিল তাদের দ্বীন দুনিয়া, তাদের ধন সম্পদ ও আত্মীয় স্বজন সব কিছু। তাই তাৎক্ষণকি প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেল। স্থির হলো যে, কায়সারের সৈন্যরা আরবের ভূমিতে প্রবেশের আগেই অতর্কিতে আক্রমণ চালানো হবে, হাতে এই ভুখন্ডে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে না পারে। সময়টা ছিল প্রচন্ড গরম, ভয়াবহ র্দুভক্ষি ও শোচনীয় দারিদ্রের। রাসূল সা. যুদ্ধের চাঁদার জন্য আবেদন জানালেন। মুসলমানরা এ আবেদনের এমন স্মরণীয় জবাব দিল যে, তা বিশ্বমানবতাকে চিরদিন মূল্যবান প্রেরনা যোগাতে থাকবে। হযরত উসমান রা. ৯০০ উট, ১০০ ঘোড়া, ও এক হাজার দিনার দান করলেন। হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা. ৪০ হাজার দিরহাম দিলেন। হযরত ওমর রা. নিজের সহায় সম্পদের বেশী অর্ধেক হাজির করলেন। হযরত আবু বকর ছিদ্দিক রা. পুরো ঘর খালি করে নিজের যথা সর্বস্ব এনে জমা দিলেন। দানের প্রতিযোগিতায় তাঁর পাল্লা সবার চেয়ে ভারী হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার সম্ভবত একজন দরিদ্র দিনমজুর আনসারী করেছিলেন, যিনি সারা দিন পানি বহন করে পাওয়া মজুরী দু’ভাগ করে অর্ধেক পরিবারের জন্য রেখে বাকী অর্ধেক রসূল সা. এর কাছে হাজির করে দেন। রসূল সা. তাঁর দেয়া জিনিসগুলোকে অন্যদের দেয়া সমস্থ মূল্যবান জিনিসের ওপর ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুসলিম মহিলারা জেহাদের ফান্ডে নিজেদের অলংকারাদি র্পযন্ত দিয়ে দিয়েছিলেন।
দশ হাজার ঘোড়াসমেত ৩০ হাজার সৈন্য তাবুক অভিযানে রওনা হয়। মদিনার উপকন্ঠে ছানিয়াতুল বিদা নামক স্থানে বসেই সৈনিকদের শ্রেণী বিন্যাস, সেনাপতি নিয়োগ ও পতাকা বন্টনের কাজ সুসম্পন্ন করা হয়। তাবুক পৌঁছার পর জানা গেল, শক্ররা আরবের ওপর হামলা করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করেছে। আসলে তাদেরকে কে যেন ভুল খবর দিয়েছিল যে, মদিনার নবী সা. মারা গছেনে। (নাউজুবল্লিাহ) এজন্য তারা ভেবেছিল যে এখন হামলা করার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেছে। পরে যখন তারা জেনেছে, নবীও জীবিত আছেন এবং মদিনাও জীবিত, তখন তাদের আগ্রাসী উচ্চাভিলাষ স্তব্ধ হয়ে গেছে। যাহোক, এই সামরিক অভিযানের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল খুবই সন্তোষজনক। রাসূল সা. একমাস র্পযন্ত তবুকে সেনা শিবির বহাল রেখে অবস্থান করেন। এই সময় চতুর্দিকে রাজনৈতিক প্রভাব বস্তিাররে কাজ সাফল্যজনকভাবে চলতে থাকে। আয়লার শাসনকর্তা এসে সাক্ষাত করে এবং জিযিয়া দিতে সম্মত হয়ে আপোষমূলক সম্পর্কের সূচনাকরে। জারাবা ও আযরাদের অধিবাসীরা ও এসে জিযিয়া দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে। দুমাতুল জান্দালের সমস্যা বহু দিন ধরে রসূল সা. এর কাছে গুরুত্বর্পূণ ছিল। হযরত খালেদ ইবনে ওলীদকে চারশোরও বেশী সৈন্যসহকারে জুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দারের কাছে পাঠানো হয়। সে ও তার ভাই শিকার করছিল। তার ভাই মারা গেল এবং উকায়দার গ্রেফতার হলো। জিযিয়ার ভিত্তিতে তার সাথে সন্ধি হয়। রাসূল সা. তাকে দুমাতুল জান্দাল, আইলা, তায়মা ও তবুকের জন্য মদিনার সরকারের পক্ষ থেকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং এই মর্মে লিখিত সনদ অর্পণ করেন। কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত খালেদ সুকৌশলে বিনাযুদ্ধে দুমাতুল জান্দালের দূর্গ দখল ও মূল্যবান গণমিত অর্জন করেন। রসূল সা. তাবুক থেকে প্রত্যাবর্তন করলে মদিনায় তাঁকে জাকজমকপূর্ণ সম্বর্ধনা জানানো হয়। এই অভিযান সম্পর্কে মোনাফেকরা যে সব চক্রান্ত চালায়, সেগুলো আমি ইতিপূর্বে একটা অধ্যায়ে উল্লখে করেছি। প্রচুর সংখ্যক (প্রায় ৮০ জন) মোনাফেক মদিনায় বসেছিল। তাদেরকে যখন তবুকে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তারা নানা রকম মনগড়া ওজুহাত খাড়া করে। রাসূল সা. তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তবে কিছু কিছু নিষ্ঠাবান মুমিন ও থেকে গিয়েছিল। আবু খায়সামা এদেরই একজন গণ্য হয়েছেন। তিনি মদিনায় থেকে গেলেও সহাসাই তার ভেতরে সম্বিত ফিরে আসে। রসূল সা. রওনা হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর একদিন প্রচন্ড গরমে স্ত্রীর সাথে গাছগাছালির শীতল ছায়ায় আরাম করতে এলেন। সেখানে তিনি পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও ভোজনের আয়োজন করে রেখেছিলেন। সহসা খেয়াল হলো এবং স্ত্রীকে বললেন, “হায়, রসূল সা. রোদে ধূলায় ও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন, আর আমি আবু খাইসামা কিনা সুশতল ছায়ায় সুন্দরী স্ত্রীর সাথে মজার মজার খাবার খাচ্ছি! এটা কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত নয়’ আল্লাহর কসম আমি স্ত্রীদের কক্ষে যাবনা। আমার জন্য সফরের আয়োজন করা হোক।” উট আনিয়েই তাতে চড়ে রওনা হয়ে গেলেন এবং অনেক দূর গিয়ে তিনি বাহিনীর সাথে মিলিত হলেন। কন্তিু তিনজন মুমিন কা’ব বিন মালেক, হিলাল ইবনে উমাইয়া এবং মুরারা ইবনে রবী যাই যাই করেও যেতে পারেননি। তাদেরকে রাসূল সা. না যাওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে তারা স্পষ্ট ভাষায় বলনে, আমাদের ক্রটি হয়ে গেছে। রাসূল সা. আল্লাহর পরবর্তী নির্দেশ না আসা র্পযন্ত তাদেরকে সমাজ থেকে পৃথক এবং নিজ স্ত্রী থেকে দূরে থাকার আদশে দেন। এটা ছিল এক ধরনের নির্জন কারাবাসের শাস্তি। তাদের হাত পায়েও শেকল পড়ানো হয়নি, তাদেরকে কোন আলাদা কারাকক্ষওে আটকানো হয়নি। সামষ্টিক জীবন থেকে আকস্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী হয়ে যাওয়া খুবই কঠিন শাস্তি। তাও এমনভাবে যে সমস্ত কড়াকড়ি স্বয়ং আসামীকেই নিজের ওপর প্রয়োগ করতে হয়। কন্তিু তারা আনুগত্যের এমন বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা ইতিহাসে র্স্বণাক্ষরে লেখা থাকবে। এমনকি বিষয়টা গাসসানী খৃস্টান শাসক যখন জানতে পারলো, তখন সে একটা চমৎকার মনস্তাত্বকি সুযোগ ভেবে কা’ব বিন মালেককে চিঠি লিখে যে, “তোমাদের নবী তোমাদের ওপর যুলুম করেছে। অথচ তোমরা খুবই মূল্যবান লোক। তোমরা আমাদের কাছে চলে আসলে আমরা তোমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেব।” এটা ছিল একটা কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু কা’ব এই চিঠিকে চুলোর মধ্যে নক্ষিপে করেন। অবশেষে পুরো ৫০ দিন পর ওহি নাযিল হয়ে তাদের আন্তরকিতা ও নিষ্ঠার দরুন তাদের তওবা কবুল করার কথা ঘোষণা করে। এতে মদিনায় আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সর্ব দিক থেকে লোকেরা মোবারকরাদ সহ ঐ তিনজনকে সুসংবাদ দিতে দিতে ছুটে আসে। হযরত কা’ব তাঁর তওবা কবুল হওয়ার আনন্দে অধিকাংশ সম্পদ ছদকা করে দেন। এ রকমই ছিল ইসলামী আন্দোলনের গড়া মানুষের চরিত্র।
তবুক সফরকালেই আব্দ্লুাহ যুলবিজাদাইন ইন্তকিাল করেন। রাসূল সা. এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন এই যুবক। তিনি খুবই বপ্লিবী আবেগ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তরুণ বয়সেই তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল এবং তার মন প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চাচার ভয়ে নিজের মনোভাব চেপে রাখেন। অবশেষে রসূল সা. যখন মক্কা জয় করে ফিরে এলেন, তখন তিনি তার চাচাকে বললেন: “প্রিয় চাচাজান, ‘’আমি বহু বছর ধরে অপক্ষোয় ছিলাম কখন আপনার মনে ইসলামী চেতনা জাগ্রত হয়। কন্তিু আপনি যেমন ছিলেন তেমনি রয়ে গেলেন। এখন আমাকে মুসলমান হওয়ার অনুমতি দিন।”
পাষাণ হৃদয় চাচা জবাব দিল: তুমি যদি মুহাম্মদের সা. দাওয়াত গ্রহন কর তবে আমি তোমাকে সমস্ত সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবো। এমনকি তোমার পরনরে কাপড়ও কেড়ে নেব।”আব্দুল্লাহ বললেন, “চাচা, আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। মূর্তিপূজা এখন আমার আর ভাল লাগেনা। কাজেই এখন আমি অবশ্যই মুসলমান হব। আপনার সমস্ত সহায় সম্পদ আপনি নিয়ে নিন।” এই বলে পরনের কাপড় র্পযন্ত খুলে দিলেন। তার মা তার শরীর ঢাকবার জন্য একটা কম্বল দিল। কম্বল দুভাগ করে তিনি অর্ধেক দিয়ে লুংগি বানালেন এবং অর্ধেক দিয়ে দেহের ওপরের অংশ ঢাকলেন। এই অবস্থায় তিনি মদিনায় রাসূল সা. এর কাছে হাজির হলেন এবং ‘আসহাবে সুফফা’ দলে যোগদান করলেন। এই বপ্লিবী যুবক জেহাদের আবেগে উদ্দীপিত হয়ে রাসূল সা. এর সাথে তবুক রওনা হলেন। সেখানে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ইন্তকোল করেন। রাতের অন্ধকারে তাঁর দাফন কাফন সম্পন্ন হয়। হযরত বিলাল রা.বাতি উঁচু করে ধরলেন। রসূল সা. স্বয়ং এবং আবু বকর ও ওমর রা. কবরে নামেন। রসূল সা. তাদেরকে বলেন, “তোমাদের ভাই এর সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখ।” রাসূল সা. স্বহস্তে তার কবরে ইট রাখেন। অতপর দোয়া করেন, “হে আল্লাহ, আজ সন্ধা র্পযন্তও আমি তার উপর সন্তুষ্ট ছিলাম। তুমিও তার উপর সন্তুষ্ট থাক।”
আব্দুল্লাহর এত কদর দেখে ইবনে মাসউদ রা. আক্ষপে করে বলেছিলেন, “হায়, এই কবরে যদি আমি যেতে পারতাম!”

মূল্যায়ন

এই অধ্যায়ে আমি মদিনার ইসলামী সরকারের গৃহীত সব ক’টা সামরিক পদক্ষপে বর্ণনা করেছি। এই যুদ্ধ-বগ্রিহগুলাে এবং যে পরিস্থিতিতে এগুলো করা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল, তা মনে রাখলে এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ থাকেনা যে, রসূল সা. সংঘর্ষ এড়িয়ে গঠনমূলক কাজ করতে বদ্ধপরিকর থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ইসলামের শক্ররা নেহাৎ জোর করেই যুদ্ধের ময়দানে টেনে এনেছিলো। যে ব্যক্তি ক্ষমতার মসনদের পরিবর্তে কেবল সত্যও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ছেয়েছিলেন, যিনি তরবারীর জোর প্রভাব প্রতিপত্তি সৃষ্টির পরিবর্তে যুক্তি ও চরিত্র দ্বারা গোটা দুনিয়াকে জয় করতে চেয়েছিলেন, যিনি প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমা এবং হিংসা ও বলপ্রয়োগের পরিবর্তে ন্যায্য ব্যবহার ও সদাচারের পথ অবলম্বন করেছিলেন এবং যিনি রক্ত ঝরানো তরবারীর পরিবর্তে চুক্তি লিপিবদ্ধকারী কলম দিয়ে মীমাংসার নীতি প্রবর্তন করেছিলেন, সেই মহামানবকে তারা আট নয় বছরের মধ্যে একটা মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এহেন পরিস্থিতিতেও রসূল সা. ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দেয়ার সেই অসাধারণ গঠনমূলক কাজ কিভাবে সম্পন্ন করলেন, ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয়। রসূল সা. এর গঠনমূলক কাজের বস্তিারতি বিবরণ আমি এ পুস্তকরে একটা পৃথক অধ্যায়ে তুলে ধরবো ইনশায়াল্লাহ।
বস্তুত রসূল সা. এ দিক দিয়ে মানবতার সবচেয়ে বড় উপকারী বন্ধু ছিলেন যে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার র্বাতা প্রথমে সারা আরবে এবং পরে সারা পৃথিবীতে পৌঁছানোর জন্য তলোয়ারের ভেতর থেকেও নিজস্ব স্বাতন্ত্র পথ খুজে নেন। চরম দাঙ্গাবাজ শক্রদের প্রতিরোধবুহ্য ভেঙ্গে ন্যায় ও সত্যের বিধানকে প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণতা দান করেন। নচেত অন্য কেউ যদি হতো, সে শক্রর যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ শুনে নিজস্ব সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হতো। তাহলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার স্মৃতি ইতিহাস থেকে মুছে না গেলেও তাকে আমরা বড় জোর মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে উপস্থিত দেখতে পেতাম, একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার আকারে তাকে আমরা কল্পনা করতে পারতাম না। সে ক্ষেত্রে ইসলাম দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মের মতই ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ নিছক একটা আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ধর্ম হিসেবে টিকে থাকতো। সমাজ ও রাষ্টের সাথে তার কোন সংশ্রব থাকতোনা। এ ধরনের ইসলামের আওতায় যত উচ্চাংগরে সাধু সজ্জনই তৈরী হোক না কেন, তারা প্রত্যেক কুফরি, বাতিল, অত্যাচারী ও শোষক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অত্যন্ত অনুগত ও বশ্বিস্ত সহযোগীতে পরিণত হতো। সে ক্ষেত্রে মানব সমাজ সামাজিক যুলম শোষণ ও দুনীতি উচ্ছেদের কোন প্রেরণা রসূল সা. এর কাছ থেকে পেতনা।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বিশ্ববাসী ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মঙ্গল নিশ্চিত করার লক্ষে রসূল সা. কত দুঃখ কষ্ট ও যুলুম নিপীড়ন সহ্য করেছেন, কত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে শক্রদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং যুলুমবাজ ও দুর্নীতিবাজ শক্তিকে দমন করেছেন, ছত্রভঙ্গ গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, তাদেরকে জাহেলী নেতৃত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন, তাদেরকে শক্ষিা দিয়েছেন ও পরিশুদ্ধ করেছেন। শান্তরি পরিবেশ গড়ে তুলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন, সমাজকে ভ্রাতৃত্ব ও সুবিচারের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছেন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরামর্শ ভিত্তিক করন গণতান্ত্রিক যুগের সূচনা করেছেন।
এটাও রসূল সা. এর সর্বোচ্চ বচিক্ষণতা ও কর্মকুশলতার পরিচায়ক যে, এত যুদ্ধ করলেন এবং এত সেনাদল পাঠালেন, কন্তিু তাতে সর্বনিম্ন পরিমাণ রক্তপাত ঘটেছে ও সর্বনিম্ন পরিমান প্রাণ নাশ হয়েছে। এত কম রক্ত ঝারিয়ে আরবের মত বিশাল ভূখন্ডে সর্বপ্রথম একটা আদর্শবাদী একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা মানবেতিহাসে একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আজ আমাদের প্রতিটি মানুষ, সত্যটা জানুক বা না জানুক, তাঁর অনুগ্রহের কাছে ঋণী। তিনি যদি মুষ্টিমেয় সংখ্যক দলকে সাথে নিয়ে যুলুমের বিরুদ্ধে রুখে না দাাঁড়াতেন, তা হলে আমরা জীবনে সফলতা লাভের যে মূলনীতি, যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং যে নৈতিক ঐতিহ্য তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি, মনুষ্যত্বের যে দৃষ্টান্ত তাঁর মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে সর্বোত্তম ভারসাম্যপূর্ণ রূপকাঠামো তিনি নর্মিাণ করে দেখিয়েছেন, সেই সব অমুল্য সম্পদ আমাদের কপালে কোনকালেও জুটতোনা। রসূল সা. তাঁর যে উৎকৃষ্টতম ও প্রিয়তম সাথীদেরকে পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে কুরবানী করেছেন, তাদেরই রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীতে নতুন প্রভাতের সূচনা হয়েছে। আল্লাহ মুহাম্মদ সা. ও তাঁর অনুসারীদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন!


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি