অধ্যায়ঃ ৬

আলো ছড়িয়ে পড়লো সবখানে

ইসলামী আন্দোলন অগ্রযাত্রার প্রাণশক্তি

এ বিশ্বে অনেকেই তরবারীর জোরে বহু ভূখন্ডের মালিক হয়েছে। অনেক রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র নিছক অস্ত্রবল ও বাহুবলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বার্থ সংক্রান্ত টানাপোড়েনের অনেক ফায়সালা রণাঙ্গনেও হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের যে কোন বিপ্লবী আন্দোলনকে নিজের ভাগ্যের ফায়সালা সব সময় জনমতের আওতায় থেকেই করতে হয়। মানুষের হৃদয় যতক্ষণ ভেতর থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে কোন দাওয়াতের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত না হয় এবং নিজের চরিত্র ও মানসিকতাকে তার আলোকে গড়ে তুলতে রাজি না হয়, ততক্ষণ নিছক বলপ্রয়োগ করে সমর্থন আদায় করা লাভজনক হতে পারেনা। বরঞ্চ সেটা হয় তার মারাত্মক ধ্বংসের কারণ। তাই প্রত্যেক আদর্শবাদী আন্দোলনের আসল প্রকৃতি ও মেজাজ হয়ে থাকে আবেদন ও শিক্ষামূলক। আর তার পরিচালকেদের মধ্যে সক্রিয় থাকে মুরব্বী সুলভ ও গুরুজন সুলভ স্নেহ মমতা ও প্রেরণা। আদর্শবাদী আন্দোলনের দৃষ্টিতে জীবন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তুল্য এবং সমাজের সব মানুষ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র স্বরুপ। এই ছাত্রদের সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করার জন্য এবং দুর্বৃত্তদের সংশোধন এবং কু-প্রভাব থেকে সমাজের ভদ্র ও মধ্যমপন্থী শ্রেণীর লোকদের নিরাপদে রাখার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও মাঝে মাঝে গৃহীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সামগ্রিক পরিবেশ সব সময় ছাত্রদের জন্য স্নেহ-মমতা ও করুণার পরিবেশ হয়ে থাকে এবং উস্তাদের শাস্তিমূলক পদক্ষেপেও মুরুব্বীসুলভ মনোভাবই প্রধান্য বিস্তার করে থাকে। সত্যের বানী ও সততার দাওয়াত নিয়ে আল্লাহর যে পবিত্র বান্দারা ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁরা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দুস্কৃতি, দুর্নীতি ও অসততার উচ্ছেদের জন্য যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তরবারীকে আংশিকভাবে শিক্ষা দানের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাদের সামগ্রিক কাজ সব সময় মুরব্বী ও স্নেহময় শিক্ষকের মনোভাব নিয়ে অবিকল শিক্ষাদানের ভংগীতেই অব্যাহত থেকেছে। তারা যে আসল যুদ্ধটা করেছেন, তা যুক্তির অস্ত্র দিয়ে জনমতের বিশাল ও বিস্তৃত রণাঙ্গনেই করেছেন। সব সময় তাদের নীতি এই ছিল যে, কেউ যদি নতুন জীবন লাভ করতে চায় তবে সে য্নে তা যুক্তির মাধ্যমেই লাভ করে, আর যদি কেউ জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের জন্য মৃত্যু পছন্দ করে, তবে সে যেন যুক্তির আলোকেই মৃত্যু বরণ করে।
রসূল সা.- এর সামরিক পদক্ষেপগুলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,বদর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত (খয়বরবিজয়সহ) মোট পাঁচটি বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে এই সব ক’টা যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। তন্মদ্ধে প্রথম তিনটে তো হয়েছে শত্রুরা আগ্রাসন চালিয়ে মদিনার ওপর হানা দেয়ার কারণে। মদিনা থেকে সৈন্য নিয়ে গিয়ে নিজের উদ্যোগে রসূল সা. বড়জোর দুটো অভিযানই চালিয়েছেন একটা মক্কা বিজয়ের (হোনায়েন যুদ্ধসহ) অভিযান অপরটা খয়বর বিজয়ের অভিযান।
আর এই দুটো অভিযানেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সময়ের দিক দিয়ে দেখলে বদরের যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মোট ছয় বছরের ব্যবধান। রসূল সা. তাঁর মহান শিক্ষামূলক, প্রচারমূলক, গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজে মোট ২৩ বছর সময় কাটিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র ছ’টা বছর ছিল এমন, যখন শিক্ষা মূলক কাজের পাশাপাশি বিরোধীদের যুদ্ধাংদেহী মনোভাব ও আচরণের মোকাবিলাও করতে হয়েছে। সর্বাধিক অতিরঞ্জিত করেও যদি অনুমান করা হয়, তবুও মনে হয়, সব ক’টা যুদ্ধে সর্বমোট ১৫ হাজারের চেয়ে বেশী লোক রসূল সা. এর মোকাবিলায় আসেনি এবং তাদের মধ্য থেকে মাত্র ৭৫৯ জীবনকে পথ থেকে সরানোর মাধ্যমে আরবের কয়েক লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণরুপে শুধরে যায়। দশ বছর ইতিহাসে অত্যন্ত ক্ষুদ্র সময়। এত অল্প সময়ে আরবের ন্যায় মরুভূমিকে মানুষের জীবনের সঠিক কল্যানের লক্ষ্যে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী, চরম উচ্ছৃঙ্খল, হিংস্র ও দাঙ্গাবাজ গোত্র ও ব্যক্তিবর্গকে এর আওতাভূক্ত করা, তারপর তাদেরকে সুমহান নৈতিক শিক্ষা দানে সাফল্য অর্জন করা এবং শুধু শিক্ষা দেয়া নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্য তাদেরকে শিক্ষক ও উস্তাদে পরিণত করা সম্ভবত রসূল সা. - এর নবুয়তের সবচেয়ে বড় বাস্তব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অলৈৗকিক প্রমাণ।
সুতরাং এ বিষয়টি সকল সন্দেহ ও বিতর্কের উর্ধ্বে যে, ইসলামের বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব সংঘাতের নিষ্পত্তিতে যুদ্ধ ব্গ্রিহের যতটুকু অবদানই থাকুক না কেন, জনমতের অবদানই ছিল সর্বাধিক এবং জনমতের অংগনই ছিল নিষ্পত্তির আসল অংগন। কিছুটা আধ্যাত্মিক ভাষায় যদি বলি তবে বলা যায়, মানুষের হৃদয় জয় করাই ছিল রসূল সা.- এর আসল বিজয় ও আসল সাফল্য‌। আরবের লক্ষ লক্ষ নর নারীকে তিনি যদি জয় করে থাকেন, তবে তাদের হৃদয়ই জয় করেছেন এবং তা করেছেন ‍যুক্তি ও চরিত্রের অস্ত্র দিয়ে। এ বিষয়টা যে, সর্বদিক থেকে নিত্য নতুন প্রতিবন্ধকতার মুখেও অল্প দিনের মধ্যে দশ বারো লক্ষ বর্মাইল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক আদম সন্তানকে ইসলামের অনুসারী বানানো কিভাবে সম্ভব হলো? আসল ব্যাপার হলো, দাওয়াত যদি সত্য ও সঠিক হয়, আন্দোলন যদি মানব কল্যানের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় এবংএর পতাকাবাহীরা যদি ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান হয়, তবে বিরোধিতা ও প্রতিরোধ বিপ্লবী কাফেলার জন্য অধিকতর সহায় হয়ে থাকে। প্রত্যেক বাধা এক একটা পথ প্রদর্শক হয়ে আসে।
এই জন্যেই যদিও সংখ্যালঘু দিয়েই সত্যের সূচনা হয়ে থাকে, কিন্তু তা সংখ্যাগুরুকে জয় করে থাকে। আসুন, এবার দেখা যাক, ইসলামী আন্দোলন কোন্ কোন্ শক্তিকে ব্যবহার করে জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভে দ্রুত সাফল্য লাভ করেছিল।

যুক্তি প্রমাণের শক্তি

ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল যুক্তি প্রমাণের শক্তি। ইসলামী আন্দোলনের পরিবর্তে রসূল সা. পীর মুরুদীর কোন ব্যাবস্থা চালু করতেন, তাহলে শ্রোতাদের বিবেক বুদ্ধিকে অবশ করে দিতেন। প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মত নিছক ব্যাক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ কোন ধর্ম যদি প্রবর্তন করতেন, তাহলে অলীক কল্পনা ও ভিত্তিহীন ধ্যানধারণার প্রতি মানুষের ঝোঁক ও আগ্রহ বৃদ্ধি করতেন, আর বৈরাগ্যবাদী আধ্যাত্মিক দরশন শিক্ষা দানের কোন ব্যাবস্থা যদি চালু করতেন, তাহলে তো চোখ কান ও মুখ সম্পুর্ণরূপে বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু রসূল স. যে ইসলামী আন্দোলন চালু করেন, তাতে এমন সচেতন লোকদের প্রয়োজন ছিল, যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্যের ভিত্তিতে পুরো একটা সভ্যতাকে গড়ে তুলতে ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে। এজন্যই ইসলামী আন্দোলন যখন শুধু দাওয়াত পর্যায়ে ছিল, তখন সে মানুষের সুপ্ত বিবেকবুদ্ধিকে জাগিয়ে তুললো। চোখ খুলে দেখতে ও কান খুলে শুনতে উদ্ভুদ্ধ করলো। বিশ্বপ্রকৃতিকে নিয়ে চিন্তাগবেষণা করতে উৎসাহ যোগালো। মানব সত্তার অভ্যন্তরের ও তার পারিপার্শিক জগতের পরিস্থিতির সুক্ষ পর্যালোচনা করার শিক্ষা দিল। নিত্য নতুন প্রশ্ন তুলে চিন্তাধারাকে শানিত ও গতিশীল করলো। অন্ধ অনুকরণের বন্ধন ছিন্ন করলো। অর্থহীন রসম রেওয়াজের বিলুপ্তি ঘটালো। অতীত পূজা ও পুরুষানুক্রমিক রীতি প্রথার অন্ধ নুগত্য বাতিক করল। পশুর মত নির্বোধ মানুষের ভেতর থেকে বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষ সৃষ্টির কৌশল উদ্ভাবন করলো। অন্ধ বোবা ও বধির শ্রেণীর লোকদের ঠোকা দিয়ে সচেতন করে তুললো এবং বিবেকবুদ্ধির মরিচা দুর করে দিল। এক কথায়, ইসলামী আন্দোলনের সর্বপ্রধান কৃতিত্ব হলো, তা মানুষের ওপর জাহেলিয়াতের চাপিয়ে দেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতার অবসান ঘটায়। এর ফলে যাদের বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত ও সচেতন হয়, তাদের সামনে সে জীবনের মৌলিক সত্যগুলোকে পেশ করে এবং নিজের শানিত যুক্তিপ্রমাণ দ্বারা তাদের প্রভাবিত করে এবং সত্যগুলোর প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস গড়ে তোলে।
ইসলামী আন্দোলন যখন একমাত্র আল্লাহ্‌কেই সৃষ্টিকর্তা, মালিক, জীবিকাদাতা, হুকুমদাতা ও সুপথ প্রদর্শক হিসেবে পেশ করলো, তখন এমন বলিষ্ঠ যুক্তি সহকারে পেশ করলো যে, এর বিপরীত ভিত্তিহীন ও অলীক কল্পনার হাতিয়ারগুলো ভোতা ও অকার্যকর হয়ে গেল। সে মানুষের বিবেচনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে দাওয়াত দিল যে, আকাশ ও পৃথিবীর বিচিত্র সৃষ্টি, গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন, ঋতু ও আবহাওয়ার বিবর্তন, বৃষ্টি ও বাতাসের নিয়মবিধি, তরুলতার জন্ম ও বিকাশ বৃদ্ধির দৃশ্য, পশুপাখীর বংশবৃদ্ধি ও লালনপালন, মানবগোষ্ঠী সমূহের বৈচিত্র, সভ্যতা সমূহের উত্থান পতন এবং আপন সত্তা সমূহের গভীরতা পর্যবেক্ষণ করো ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। দেখবে, সর্বত্র অটল আইন-কানুন চালু রয়েছে। সৃষ্টি জগতের প্রতিটি অংশে একটা সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল শাসন কার্যকর রয়েছে। ছোট কিংবা বড় প্রতিটি ঘটনার কোন না কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও পরিণতি নির্দিষ্ট রয়েছে। বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী বস্তু পরস্পর সহযোগী ও পরিপূরক হিসেবে কাজ করে চলেছে। সমগ্র সৃষ্টির কারখানায় একধরনের সমন্বয় ও একাত্মতা বিরাজ করছে। একের মধ্যে বাঁধা রয়েছে অনেক। প্রতিটি জিনিস গতিশীলও বিকাশমান। কোথাও স্থবিরতা ও গতিহীনতা নেই। প্রতিটি বস্তু উৎকর্ষের দিকে ধাবমান। প্রতিটি উপকরণ ও কার্যকারণ কোন গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলের জম্ম দিয়ে চলেছে। অতঃপর প্রতিটি ফলাফল আবার আরেকটি ফলাফলের জন্য উপকরণে পরিণত হচ্ছে। প্রাকৃতিক জগতের এই আইন, এই শৃঙ্খলা, এই সমন্বয়, এই সহযোগিতা, এই ঐকতান এবং এই বিকাশ ও বিবর্তনের ধারা আপনা আপনি একটা আকস্মিক দুর্ঘটনার আকারে উদ্ভুত হয়নি। জিনিসগুলো নিজের পরিকল্পনা নিজে করেনা, নিজেকে নিজে সৃষ্টি করে না এবং পরস্পর পরামর্শের মাধ্যমেও পরস্পরকে সহযোগিতা করেনা। বরং সর্বোচ্চ, সদাসক্রিয়, স্বয়ম্ভূ, সার্বভৌম, মহাজ্ঞানী ও বিজ্ঞানময় স্রষ্টা আল্লাহই এগুলোর একমাত্র পরিচালক, ব্যবস্থাপক, শাসক ও আইন রচয়িতা হিসেবে কাজ করে চলেছেন। মহাবিশ্বের সকল শক্তি ও বস্তু তাঁরই গুণগানে নিয়োজিত। সকল বস্তু তাঁরই সামনে সিজদারত। সকল সৃষ্টি তাঁরই প্রাকৃতিক আইনের অনুগত। বিশালাকায় সূর্য থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুপরমাণু পর্যন্ত প্রতিটি জিনিস তাঁরই দরবারে মাথা নুইয়ে রেখেছে। ইসলাম এ কথাও বলেছে যে, এত বড় সৃষ্টির এই বিশাল কারখানায় যদি একাধিক মালিক ও ব্যবস্থাপক থাকতো, তাহলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যেত এবং যে পারস্পরিক সহযোগিতা, একাত্মতা, ঐক্যতান তোমরা মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান দেখতে পাচ্ছ, তা কোনক্রমেই কায়েম থাকতোনা। বিশ্ব প্রকৃতির এই বিশাল পুস্তকের পাতায় পাতায় শুধু তাঁর অস্তিত্বের নয়, বরং সেই সাথে তাঁর একত্ব ও তাঁর গুণাবলীর অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই মহাবিশ্ব সর্বোতভাবে আল্লাহ্‌র আইন ও বিধানের আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ এবং এর প্রতিটি অণুপরমাণু তাঁর সামনে ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত দাস। কোন সৃষ্টির পক্ষে আল্লাহ্‌র সামনে আনুগত্য, দাসত্ব বা আত্মসমর্পণের ভূমিকা ছাড়া অন্য কোন ভূমিকা অবলম্বনের অবকাশ নেই। মানুষ যদি আল্লাহ্‌র অনুগত হয়, তবে সে সমগ্র বিশ্বজগতের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। তাদের সমাজ ও সভ্যতা ঠিক তেমনি নিরাপত্তা ও সহযোগিতার প্রতীকে পরিণত হবে, যেমন রয়েছে বস্তুর জগতে। আর যদি তারা আল্লাহ্‌র অবাধ্য তথা কাফের হয়, তাহলে বিশ্বপ্রকৃতির সাথে তাদের সমাজ সভ্যতা বেখাপ্পা, বেমানান ও সংযোগহীন হয়ে যাবে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে যে ভারসম্য, ঐকতান ও সহযোগিতা বিরাজমান রয়েছে, মানব সমাজে তা থাকবেনা। অথচ এরই কারণে বিশ্বের সকল সৃষ্টি শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে উন্নতি, উৎকর্ষ ও বিকাশ লাভ করেছে। এ বিশ্বে মানুষের জন্যেও শান্তি ও নিরাপত্তার পথ এটাই যে, সে আল্লাহ্‌র দ্বীন ও আল্লাহ্‌র আইনের অনুগত থাকবে। মানুষ আল্লাহরই সৃষ্টি, তাঁরই দেয়া জীবিকায় লালিত পালিত, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গ, এবং অঙ্গের প্রতিটি অণুপরমাণু মুসলিম হিসেবে আল্লাহ্‌র প্রাকৃতিক আইনের আনুগত্যের অটুট শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সুতরাং মানুষের জন্য জীবন যাপনের কোন সরল ও সঠিক পথ যদি থেকে থাকে, তবে তা আল্লাহ্‌র দাসত্ব ও আনুগত্যেরই পথ। মানুষ জম্ম সূত্রেই আল্লাহ্‌র দাস ও গোলাম এবং দাসত্বের অনুভূতি ও চেতনা তার মনমগজে আজম্ম লালিত।
ইসলামী আন্দোলন একই বলিষ্ঠটা ও তেজস্বিতাসহ অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এ কথাও প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হেদায়াত বা দিক নির্দেশনা লাভ করা প্রত্যেক সৃষ্টিরই প্রয়োজন। কেননা তিনিই সকল জিনিসের ভাগ্যবিধাতা এবং মহাকাশে বিচরণশীল প্রতিটি বস্তুর কক্ষপথ ও গতিবিধি নির্ধারক। তিনিই বিভিন্ন জিনিসকে বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য দান করেন। প্রত্যেক শক্তিকে তার উপযুক্ত কাজে নিয়োগ করেন। প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য কর্মপন্থা স্থির করেন। অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় মানুষও আল্লাহ্‌র দিকনির্দেশনার ঠিক তেমনি মুখাপেক্ষী, যেমন আলো, বাতাস ও পানি মুখাপেক্ষী। আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টিকে নিজের পথনির্দেশনা জানানোর জন্য ওহীর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। এই ওহী নিষ্প্রাণ পদার্থের জন্য প্রাকৃতিক বাধ্যবাধকতা, উদ্ভিদের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধির ক্ষমতা এবং জীবনের জন্য সহজাত প্রক্রিয়া। কিন্তু মানুষ যেহেতু চেতনা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী, তাই তার জন্য ওহীর সেই পূর্ণাঙ্গ রূপই নির্ধারিত হয়েছে, যা দ্বারা তার বিবেকবুদ্ধি ও চেতনাকে সম্বোধন করা হয়।
ইসলামী আন্দোলন স্বীয় আদর্শিক দাওয়াতের এ অংশটাকেও যুক্তির বলেই গ্রহণযোগ্য করেছে যে, এই বিশ্ব জগতে যখন কারণ ও ফলাফলের নিয়ম চালু রয়েছে, তখন মানুষের নৈতিক কর্মকাণ্ডেরও এই সর্বব্যাপী নিয়মের আওতায় একটা পরিণতি ও ফলাফল থাকা অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাসে যে প্রতিফল বিধান কার্যকর রয়েছে, সেটা দেখিয়ে সে প্রমাণ করেছে যে, মানুষের সামাজিক কর্মকাণ্ডও এই বিধানের আওতাধীন হওয়া অনিবার্য। এই সাথে সে এটাও দেখিয়েছে যে, মানুষের সীমিত পরিসরের ইহকালীন জীবনে সীমিত প্রতিফল বিধানের অধীন পরিপূর্ণ কর্মফল প্রকাশ পায়না। এমনকি অনেক সময় একটামাত্র কর্মধারারও পূর্ণতা অর্জিত হয়না। তাছাড়া অনেক সময় মানুষকে একেবারে বিপরীত ফলাফলও ভোগ করতে হয়। সুতরাং আল্লাহ্‌র এই সুবিচারপূর্ণ ব্যবস্থার কাছ থেকে আশা করা উচিৎ যে, পার্থিব জীবনের পর একটা নতুন জীবনের আবির্ভাব ঘটবে এবং তখন মানুষকে তার পূর্ণ কর্মফল ভোগ করতে হবে। সর্বত্র ক্রিয়াশীল আল্লাহ্‌র এই ন্যায় বিচারের যৌক্তিক দাবী এই যে, যে যেমন কাজ করবে, সে তার তেমনই ফল ভোগ করবে। এভাবে সে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, আখেরাতের বিচার এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের ধারণা দিয়েছে।
এইসব মৌলিক সত্যকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করার জন্য ইসলাম মানবজাতির সমগ্র অতীত ইতিহাস তুলে ধরেছে। এক একটা জাতির ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেছে এবং দেখিয়েছে, যেসব জাতি ও গোষ্ঠী ঐ সত্য গুলোকে মেনে নিয়ে সেগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলেছে, তারা সফলতা লাভ করেছে। আর যারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। যে সব ব্যক্তি ঐ সত্যগুলোকে গ্রহণ করেছে, তাদের মন মগজ আলোকিত হয়েছে এবং তাদের চরিত্র দেদীপ্যমান হয়েছে। আর যারা ঐ সত্যের বিরোধিতা করছে, তাদের অধপতন ঘটেছে। সে দেখিয়েছে যে, এই মহাসত্যের দাওয়াত প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জাতির সামনে যারা পেশ করেছে, তারা মূলত একই ধরনের স্বভাব চরিত্রের অধিকারী। তারা শুধু পেশ করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং তাকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা এবং জানমালের সর্বাধিক ত্যাগ ও কুরবানী সহকারে চেষ্টা সাধনা করেছে।
ইসলামী আন্দোলনের এই মৌলিক দাওয়াত তার সমস্ত অকাট্য যুক্তিপ্রমাণ সহকারে কোরআনে সবিস্তারে বিবৃত হয়েছে। চমৎকার বর্ণনা ভঙ্গিতে একে বারবার পেশ করা হয়েছে। সাথে সাথে বিরোধীদের আপত্তি, ব্যংগবিদ্রুপ ও উপহাসেরও জবাব দেয়া হয়েছে শান্তশিষ্ট ও স্বাভাবিক ভাষায়। তারপর কোথাও উপদেশ দেয়া হয়েছে, কোথাও সতর্ক করা হয়েছে, কোথাও হুমকি দেয়া হয়েছে, কোথাও লজ্জা দেয়া হয়েছে, কোথাও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, কোথাও কোমলতা ও নম্রতা দ্বারা মানুষের মনকে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। মোটকথা বিভিন্ন ভংগীতে মানুষের মনমগজকে এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে যে, বুদ্ধিমান ও সচেতন লোকদের জন্য পালানোর কোন পথ রাখা হয়নি।
বস্তুত বিজয় যদি তরবারীর জোরেই অর্জন করা হবে, তাহলে যুক্তিপ্রমাণ পেশ করার উপর এত গুরুত্ব দেয়ার কী দরকার ছিল যে, কোরানের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী জায়গা জুড়ে এর অবস্থান?
সত্য কোথা হলো, ইসলামী আন্দোলনের ক্ষুরধার যুক্তির সামনে শ্রোতাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। যারা ভাগ্যবান, তারা একে খোলা মনে গ্রহণ করেছে। আর যারা বুদ্ধির বক্রতার কারণে গ্রহণ করেনি, তারা যুক্তির প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে হিংস্র প্রতিরোধে নেমেছে। যেই আন্দোলন শ্রোতাদেরকে এই পর্যায়ে পৌছে দেয়, সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত জয়লাভ না করে ছাড়েনা।

হিতাকাংখী সুলভ আবেদনের শক্তি

কোরআনের যুক্তিগুলো শুধু যুক্তি নয়, বরং তার সাথে সাথে মন গলিয়ে দেয়া, পলায়নপর লোকদের আকৃষ্ট করে কাছে ডেকে আনা এবং বদ্ধ হৃদয়কে খুলে দেয়ার আবেদনও যুক্ত হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের এ জাতীয় আবেদনগুলো পাষাণ হৃদয় মানুষকেও মোমের মত গলিয়ে দিত। কোরআন খুললেই দেখা যাবে তার প্রতিটি বাক্যে কীভাবে যুক্তির আলোর সাথে আবেগের উষ্ণতা মিশ্রিত রয়েছে। এ জন্যই তো ইসলামের বড় বড় পাষাণ হৃদয়ের শত্রুও সত্যের সেবকে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া এর সাহিত্যিক মান এতো উন্নত ও জাদুকরী শক্তি সম্পন্ন যে, তা তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আরব কবি সাহিত্যিকদের পর্যন্ত হতবাক করে দিয়েছিল। কোরআনের এ ধরনের প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য ও হৃদয় জয়কারী কিছু আবেদন এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
“(হে নবী, আমার পক্ষ থেকে তাদের) বলঃ হে আমার বান্দারা যারা নিজের উপর যুলুম করেছ, আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা। নিশ্চই আল্লাহ্‌ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা তোমাদের প্রভুর দিকে ফিরে আসো এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর, যে সময় তোমাদের ওপর আযাব এসে যাবে এবং তোমরা কোন সাহায্য পাবে না সেই সময় আসার আগেই। আর এই সর্বোত্তম হেদায়েতের অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সময়ের পূর্বেই হেদায়েতের অনুসরণ কর যখন তোমাদের উপর আকস্মিকভাবে আযাব আসবে, অথচ তোমরা টেরও পাবেনা। তখন কোন ব্যক্তি আক্ষেপ করে বলবে, হায় আফসোস! আমার এই ত্রুটির জন্য যা আমি আল্লাহর সামনে করেছি এবং আমি বিদ্রূপ করেছিলাম। অথবা সে (হতাশ হয়ে) বলবে, আল্লাহ যদি আমাকে হেদায়েত করতেন, তবে আমি পরহেজগার হয়ে যেতাম। অথবা যখন সে আযাব দেখবে, তখন বলবে, আবার যদি আমি সুযোগ পাই, তাহলে আমি সৎ লোক হয়ে যাবো।” (সূরা আয যুমার, ৫০-৫৮)
এই কটা আয়াতে সংক্ষেপে সেই মৌলিক সত্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে, যা রাসুল (সা) এর দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে যুক্তিও প্রদর্শন করা হয়েছে, তার পাশাপাশি মন গলানো আবেদনও রয়েছে। এতে সুসংবাদও আছে, সতর্কবাণীও আছে। কোরআনের এ ধরনের রকমারি আবেদন অনেক রয়েছে। মাটির তৈরি মানুষ এহেন বৈপ্লবিক ভাষার শক্তি সামনে তিষ্ঠাতে পারতোনা, বিশেষত এ ধরনের আহবান যখন প্রতিদিন সকালে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় আসতো। তেইশ বছর ধরে এভাবে ওহীর সয়লাব আসতে থাকে। এ ধরনের আরো কয়েকটা আবেদন লক্ষ্য করুনঃ
“হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের সাবধান করে দেইনি যে, শয়তানের দাসত্ব করো না? সে তো তোমাদের প্রত্যক্ষ শত্রু। আমি কি বলিনি যে, আমারই দাসত্ব কর? কেননা এটাই সঠিক পথ। তথাপি সে তোমাদের অনেককে বিপথগামী করেছে। তবুও কি তোমরা বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?” (সূরা ইয়াসিনঃ ৬০-৬২)
“(হে নবী) বলে দাওঃ হে জনগণ তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সত্য এসে গেছে। কাজেই যে ব্যক্তি সুপথপ্রাপ্ত হবে, সে নিজের কল্যাণের জন্যই সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যে বিপথগামী হবে, সে নিজের ক্ষতির পথই প্রশস্ত করবে। তোমাদের ভালো মন্দের ব্যাপারে আমি দায়িত্বশীল নই।”(সূরা ইউনুসঃ ১০৮)
যারা বিরোধিতার ফ্রন্ট খুলে বসেছিল, তাদেরও সর্বোত্তম অনুভূতির কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। মোশরেক হোক বা আহলে কিতাব হোক, প্রত্যেক গোষ্ঠীর উত্তম মানুষদের উত্তম ভংগীতে আহবান জানানো হয় এবং তাদের সর্বোত্তম ভাবাবেগকে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি মোনাফেকদেরও সংশোধনের আহবান জানানো হয়। এ পর্যায়ের উদাহরণগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে পেশ করা হল।

মক্কার মোশরেকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ

“আল্লাহ একটা জনপদের উদাহরণ দিচ্ছেন। ঐ জনপদের লোকেরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। চারদিক থেকে তার জীবিকা আসছিল পর্যাপ্ত পরিমাণে। তারপর তার অধিবাসীরা আল্লাহর নেয়ামতের নাশোকরী করলো। তাই আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের ফল স্বরূপ তাদের ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতার স্বাদ আস্বাদন করালেন। তাদের মধ্য থেকেই একজন নবী এসেছিল। কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করলো। তাই আযাব তাদের পাকড়াও করলো। তারা আসলে জুলুমবাজ ছিল।” (সূরা আন-নাহলঃ ১১২-১১৩)

আহলে কিতাবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ

“হে আহলে কিতাব! আমার রসূল তোমাদের কাছে এসে গেছে। তোমরা যে সব জিনিস গোপন কর, তার অনেকগুলো এই রসূল প্রকাশ করে। আর অনেকগুলো জিনিস থেকে তোমাদের অব্যাহতি দেয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। তার মাধ্যমে আল্লাহ এমন সব লোককে শান্তির পথে চালিত করেন, যারা তার মর্জি মোতাবেক চলে এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে তাঁর বিশেষ নির্দেশ মোতাবেক আলোতে নিয়ে আসে। আর তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।” (সূরা আল-মায়েদাঃ ১৬)
“হে নবী! বলঃ হে আহলে কিতাব, নিজেদের ধর্ম নিয়ে অন্যায় বাড়াবাড়ি করোনা। যারা পথভ্রষ্ট, যারা অন্যদেরকে বিপথগামী করে এবং সোজা পথ থেকে দূরে সরে যায়, তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করোনা।” (সূরা আল মায়েদাঃ ৭৭)
“হে আহলে কিতাব! নবী রসুলদের আগমনের ধারায় দীর্ঘ বিরতির পর আমার রসূল তোমাদের কাছে এসেছে। সে প্রকৃত সত্য কে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরে। যেন তোমরা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা আসেনি। এখন তোমাদের কাছে সতর্কবাণী ও সুসংবাদদাতা এসেছে।” (সূরা আল-মায়েদাঃ ১৯)
“আমি বনী ইসরাইল সম্পর্কে কিতাবে ফয়সালা করে দিয়েছি যে, তোমরা পৃথিবীতে দু’বার অরাজকতা ছড়াবে এবং খুবই মারাত্মকভাবে অহংকার করবে। সুতরাং, হে বনী ইসরাইল! প্রথম প্রতিশ্রুতির সময় যখন সমাগত হলো, তখন আমি তোমাদের উপর আমার যুদ্ধংদেহী বান্দাদের চাপিয়ে দিলাম। তারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। বস্তুত সেই ওয়াদা পূরণ হওয়ারই কথা ছিল। এরপর আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে আরো একটি সুযোগ দিলাম এবং ধনসম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে তোমাদের শক্তিশালী করলাম ও তোমাদের সংখ্যা বাড়ালাম। (তোমাদের পুনর্বার সুযোগ দিলাম এ জন্য যে) তোমরা ভালো কাজ করলে নিজেদেরই উপকার সাধন করবে, আর মন্দ কাজ করলে তাও নিজেদের জন্যই করবে। তারপর যখন দ্বিতীয় ওয়াদার সময় এল, যাতে তারা তোমাদের মুখমণ্ডলকে (দুঃখ ও লাঞ্ছনার কালিমা দ্বারা) কলংকিত করতে পারে, (বায়তুল মাকদিসের) মসজিদে প্রথমবার যেভাবে ঢুকেছিল, সেইভাবে ঢুকতে পারে এবং যেখানে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়, সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে, (তখন তো তোমরা তার স্বাদ ভালোভাবেই উপভোগ করলে)। (এখন মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অভ্যুত্থান ঘটায় তোমাদের সামনে আরো একটা চূড়ান্ত সুযোগ হাজির হয়েছে, তাই) তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের উপর অনুগ্রহ করতে চান। তবে তোমরা যদি পুনরায় আগের মতই কাজ কর, তাহলে আমিও আগের মতই শিক্ষা দেব। আর (আখিরাতে) আমি অবাধ্য লোকের ঠিকানা বানিয়েছি জাহান্নাম।” (সূরা বনী ইসরাইলঃ ৪-৮)
“(হে নবী,) বলঃ হে আহলে কিতাব, এসো তোমাদের ও আমাদের মধ্যে যে কথাটা অবিসংবাদিত, সেই কথাটা আমরা মেনে নেই। সেই কথাটা হল এই যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেরাই পরস্পরকে প্রভুর আসনে বসাব না।” (আল ইমরান-৬৪)

খৃস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ

“আর যারা বলে, আমরা নাসারা, তাদেরকে তুমি (ইহুদীদের চেয়ে) মুসলমানদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে নিকটতর পাবে। কেননা তাদের মধ্যে বহু আলেম ও দরবেশ রয়েছে, যারা দাম্ভিক নয়। তারা যখন রসূলের কাছে নাযিল হওয়া বাণী শোনে, তখন তুমি তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে দেখবে। তারা বলে, হে আমাদের প্রভু, আমরা ঈমান এনেছি। কাজেই আমাদের নাম সত্যের সাক্ষীদের সাথে লিখে নাও।” (আল মায়েদা)

মোনাফেকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ

“তারা (মোনাফেকরা) কি দেখে না যে, তারা প্রতি বছর একবার কি দু’বার পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়? তবুও তারা তওবাও করে না এবং শিক্ষাও গ্রহণ করে না। আর যখনই কোন সূরা নাযিল হয়, তখন তারা একে অন্যের দিকে তাকায় আর জিজ্ঞেস করে, কেউ কি তোমার দিকে তাকাচ্ছে? অতঃপর সে উঠে চলে যায়। তাদের মনকে আল্লাহ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। কারণ তারা বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে না। শোনো, তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল তোমাদের কাছে এসেছে। তোমাদের যে কোন কষ্টই তার মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকে। তোমাদের প্রতি সে অত্যন্ত উদগ্রীব। মুমিনদের প্রতি সে অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহময়।” (সূরা তওবাঃ ১২৬-১২৮)
এ ধরনের আরো অনেক মর্মস্পর্শী বক্তব্যে কোরআন পরিপূর্ণ। হৃদয়ে বদ্ধমূল হওয়ার মত, বিবেকে সাড়া জাগানোর মত এবং চেতনাকে উদ্দীপিত ও শাণিত করার মত এ ধরনের আরো কত চমকপ্রদ কথা যে কোরআনের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে, তা বলে শেষ করা কঠিন। বস্তুত কোরআন যে কত শক্তিশালী গ্রন্থ এবং সত্যের দাওয়াত যে কত প্রতাপশালী তা উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকেই আঁচ করা যায়। সত্যের এই তীব্র আলোকরশ্মীগুলো যখন একের পর এক নাযিল হয়েছে, তখন মধ্যপন্থী মানুষের পক্ষে চিন্তা ও কর্মের অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরে থাকা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। যুক্তির সাথে আবেগময় আবেদন যখন মিলিত হয় তখন এই শক্তির সম্মিলনে এমন দোধারী তলোয়ার তৈরী হয়, যা পাথরও কেটে ফেলতে পারে। তাছাড়া কোরআনের পাশাপাশি রসূল সা. এর বাণীগুলোও বিভিন্ন ভাষণ বা বৈঠকি বক্তব্যের আকারে অনবরতই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ সব বাণী হাদীস গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত রয়েছে। ছোট ছোট বাক্যে এত ব্যাপক তাৎপর্যবহ, প্রভাবশালী ও জাগরণ সৃষ্টিকারী বক্তব্য পৃথিবীতে আর কোন ব্যক্তি দিতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলনের কবি, সাহিত্যিক ও বক্তাদের বিপ্লবী বক্তব্যগুলিও জনমনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আজও সেকালের হাসসান বিন ছাবেত ও কা’ব বিন মালেকের ইসলামী কবিতাগুলো পড়ে দেখলে বুঝা যায়, তা জনতার আবেগের সমুদ্রে কী সাংঘাতিক ঢেউ তুলেছিল! মোট কথা, সত্যের বাণীই ছিল আসল অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যার সামনে বাতিলের টিকে থাকার সাধ্যই ছিল না। “বাতিলের উচ্ছেদ অবধারিত” কোরআনের এই শাশ্বত বাণীটির প্রকৃত মর্মার্থ এখানেই নিহিত।

সমালোচনার শক্তি

ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত যুক্তির সাথে শুধু আবেদনেরই সমাবেশ ঘটায়নি, বরং আবেদনের সাথে সাথে তীব্র সমালোচনাও করেছে। সুফীবাদী মতাদর্শে তো দাওয়াতের একটাই পদ্ধতি চলে। অর্থাৎ অনুরোধ, আবেদন, তোষামোদ ও মিনতি করার পদ্ধতি। যেখানে ব্যক্তির সংকীর্ণ ব্যক্তিগত জীবনের পরিশুদ্ধির মধ্যেই দাওয়াত সীমাবদ্ধ এবং সামষ্টিক জীবনের সংস্কার ও পুনর্গঠনের কোন প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে বিনীত আবেদন নিবেদনের বাইরে আর কোন পদ্ধতির প্রয়োজনই বা কী? সুফীবাদী মতাদর্শ ও ব্যক্তিমুখী ধর্মগুলিতে শুধুমাত্র এতটুকু লক্ষ্য রাখা হয় যেন শিষ্যদেরকে কিছু আকীদা বিশ্বাস ও কিছু ব্যক্তিগত গুণাবলী শিক্ষা দেয়া হয় এবং তাদেরকে অপশক্তি থেকে আত্মরক্ষা করার উপদেশ দেয়া হয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ সামষ্টিক অপশক্তি ও দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং বিকৃত পরিবেশের সাথে টক্কর দেয়ার কোন প্রেরণা তাদের মধ্যে জন্মে না। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের মসনদে বসে যুলুমবাজরা দোর্দণ্ড প্রতাপে শোষণ ত্রাসণ চালিয়ে যায় তো যাক, আর তাদের বেদীতে মানবতা যবাই হতে থাকে তো থাক। এ সব দুনিয়াবী ঝামেলায় আল্লাহর পাগল সুফী দরবেশদের কী করার আছে? এ ধরনের সংকীর্ণ আধ্যাত্মিক ব্যবস্থায় এটাই মানুষের সবচেয়ে বড় সদগুণ বিবেচিত হয় যে, সে দুনিয়াবী কায়কারবার ও রাজনীতির ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে। সবার সাথেই সমান বিনয় ও তোষামোদী আচরণ করবে। মুসলমানদের সাথে “আল্লাহ আল্লাহ” আর ব্রাহ্মণের সাথে “রামরাম” জপ করতে থাকবে। সবার সাথেই নম্র ব্যবহার করবে, কারো সাথেই কঠোরতা প্রয়োগ করবে না। এ ধরনের মতাদর্শে যেহেতু মানুষকে সংঘাত সংঘর্ষে নামানোর কোন পরিকল্পনাই থাকে না, বরং তাকে সমাজ ও সভ্যতামুখী তৎপরতা থেকে বের করে নিভৃত স্থানে ও খানকায় নিয়ে বসানোই লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাই সমালোচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা সমালোচনা তো মানস জগতে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তাই সংকীর্ণ আধ্যাত্মিকতা ও ব্যক্তিগত পরিসরে সীমিত ধার্মিকতার দৃষ্টিতে কারো বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অপেক্ষাকৃত নিন্দনীয় কাজ বিবেচিত হয়ে থাকে। অনেকটা তাকওয়া বিরোধী কাজের মতই গণ্য হয়ে থাকে, যা কিনা আত্মার শান্তি বিঘ্নিত করে।
কিন্তু যে মতাদর্শ ও দাওয়াত সভ্যতার বিপ্লব সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়, তার বাহকদের চিন্তার কারখানায় যুক্তি ও আবেদনের মত সমালোচনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সত্যের প্রতিষ্ঠাই যথেষ্ট নয়, বরং বাতিলের বিলুপ্তি সাধনও জরুরী। কেননা বাতিলের বিলুপ্তি ছাড়া সত্যের প্রতিষ্ঠাও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা ও তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করা পরস্পর নির্ভরশীল। একটা না করে অপরটা করা যায় না। পাশাপাশি অসৎকাজ প্রতিহত না করলে সৎকাজের আদেশ দেয়া ফলপ্রসূ হয় না। এখানে ‘ইল্লাল্লাহ’ বলবার আগে ‘লা-ইলাহা’ বলতেই হয়।
ইসলামী আন্দোলনের অভ্যুদয় যখনই ঘটে, তখন তা জনগণের চিন্তাধারা পাল্টে দেয়ার জন্য প্রচলিত সভ্যতা সংস্কৃতি, সামাজিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিশেষত প্রচলিত চিন্তাধারা, আকীদা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কঠোর সমালোচনা করে। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আধিপত্যশীল শ্রেণীগুলো, যারা জনগণকে নিজেদের দাসত্বের জালে আবদ্ধ করে আয়েশী জীবন কাটায়, তাদের মুখোশ খুলে না দিয়ে সে পারে না। সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যাদের হাতে নিবদ্ধ, সাধারণ জনতার কাছে তাদের আসল পরিচয় ফাঁস করে দেয়া ছাড়া তার উপায়ান্তর থাকে না। অন্যায়কে অন্যায়, বাতিলকে বাতিল এবং ভুলকে ভুল না বলা পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের চাহিদাও সৃষ্টি হয় না এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও জন্মে না। যে কোন নবীর দাওয়াত ও কার্যবিবরণী দেখুন। দেখবেন, তাতে শুধু যে সমাজের খারাপ ধ্যান ধারণা ও পরিস্থিতির সমালোচনা করা হয়েছে তা নয়, বরং প্রত্যেক নবী তৎকালীন প্রতাপশালী শাসকদেরকে তাদের দরবারে যেয়েই বিপথগামী বলেছেন। ইসলামী আন্দোলনে সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত গঠন প্রণালী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক দেশে ও জাতিতে কিছু “রাঘব বোয়াল অপরাধী” থাকে যারা প্রতারণার রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের মতলব উদ্ধার করে। (সূরা আল আনয়াম, ১২৪) তাদেরকে স্বপদে বহাল রেখে তাদের সংশোধন সম্ভব নয়।
জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও ইতিহাসে নতুন স্বর্ণালী অধ্যায়ের উদ্বোধনকল্পে যখন আরবে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটলো, তখন সে সর্বপ্রকারের মিথ্যা, যুলুম ও অসততার নির্মম সমালোচনা করলো। তৎকালে যত রকমের লোক জাহেলী সমাজব্যবস্থা ও তাগুতী পরিবেশের রক্ষক, সমর্থক ও সহযোগী হয়ে সমাজের ওপর চেপে বসেছিল এবং যারা নিজেদের মর্যাদা ও কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য মানবজাতির কল্যাণ বিধানকারী এই দাওয়াতের কণ্ঠরোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, ইসলাম অভাবনীয় দুঃসাহসিকতার সাথে তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছিল এবং তাদের চমকপ্রদ পোশাকে আবৃত অপকর্মগুলোকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে তুলে ধরেছিল। এভাবে মানবতাবিরোধী কুফরি শক্তির আসল পরিচয় সমাজের কাছে স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে এবং জনমতে সচেতনতা বিস্তার লাভ করতে থাকে। আর সেই সাথে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও তীব্রতর হতে থাকে। ইসলামী আন্দোলনের সমালোচনা সোচ্চার জনগণের ভেতর সুষ্ঠু চিন্তা, উপলব্ধি, যাচাই-বাছাই, তুলনামূলক পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণের যোগ্যতা সৃষ্টি ও বিকশিত করে। দাওয়াতের এই দিকটাই হক ও বাতিল, ভালো ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের বাছবিচার করে। এ দ্বারাই সুপথ ও বিপথগামিতার মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। বাতিল শক্তির যুলুম নির্যাতন তো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মুখবুজে সহ্য করতে থাকে। কিন্তু যুলুমবাজদের জঘন্য চরিত্রের ওপর থেকে সুদৃশ্য আভরণ খুলে ফেলতে তারা কোন ভুল করেনি। তাদের তৎপরতা সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে দিয়ে পরিচালিত হতো না। জাহেলী ব্যবস্থার সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে তারা কখনো এ আশ্বাস দেয়নি যে, তোমরা নিশ্চিন্তে তোমাদের পদমর্যাদায় বহাল থেকে পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ চালিয়ে যাও। আমরা আল্লাহওয়ালা মানুষ। আমরা তোমাদের কাজে হস্তক্ষেপ এবং তোমাদের স্বার্থে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবো না। আমরা তো কেবল আল্লাহর নাম জপ করবো এবং মানুষকে তাঁর কলেমা শেখাবো। এভাবে ইসলাম বিরোধী নেতৃত্বের সামনে সবিনয়ে কিছু চাটুকারসুলভ কথাবার্তা বলে তাদের যুলুম থেকে অব্যাহতি লাভ নিশ্চিত করার পর সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকামী এই বিপ্লবী কলেমা উচ্চারণ করা তাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না।
ইসলামী আন্দোলন তার প্রধান আহবায়কের পবিত্র মুখ দিয়েই সর্বপ্রথম এই তিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে। ওহির ভাষার অস্ত্র দিয়েই সমাজের রোগাক্রান্ত অংগে অপারেশন চালিয়েছে। এই সমালোচনা শুধু আদর্শ ও মূলনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রতিরোধরত প্রভাবশালী শক্তি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ-সবই এর আওতায় এসেছে। এই সমালোচনা দৈনন্দিন ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটেই করা হতো এবং শত্রুপক্ষের কৃত কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনাও সাথে সাথেই করা হতো। এভাবেই গণসচেতনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কাজ যদি না করা হতো, তবে কিছু পুণ্যবান ও মনোমুগ্ধকর সৎ ব্যক্তি তৈরী হওয়া হয়তো সম্ভব হতো, সমকালীন দুনিয়া হয়তো তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতো এবং অনাগতকালেও হয়তো তাদের স্মৃতি মানুষকে অভিভূত করতো। কিন্তু সমাজ পরিবেশ জাহেলিয়াতের অন্ধকারে যেমন আচ্ছন্ন ছিল, তেমনি থেকে যেত। মুসলিম জনগণের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা এবং সংগ্রামী প্রবণতা কখনো সৃষ্টি হতো না। হেরার গুহার মধ্যেই ইসলাম সীমাবদ্ধ থেকে যেত। আরব জয় করে ফের মক্কায় প্রবেশ করা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না।
মানবতার মুক্তিদূত রসূল সা. কোরআনের ভাষায় সমালোচনা করে সমকালীন সমাজপতিদেরকে শুধু যে যুক্তি প্রমাণের দিক দিয়ে দেউলে প্রমাণ করেছেন তা নয়, বরং জগতবাসীর সামনে এটাও ফাঁস করে দিয়েছেন যে, বড় বড় পদমর্যাদা ও নেতৃত্বের আসনে আসীন প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত নোংরা ও ঘৃণ্য চরিত্র নিয়েও সমাজের ওপর কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। এই সমালোচনার ফলেই জনগণ বুঝতে পেরেছে, ইসলামী আন্দোলনের সাথে সহযোগিতা করে এই সব ঘৃণ্য অপশক্তিকে সক্রিয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ না করা পর্যন্ত জনজীবনে সৌন্দর্য, শৃংখলা ও সৌষ্ঠব ফিরে আসার কোনই সম্ভাবনা নেই।
ইসলাম কোরায়েশ ও মোশরেকদের সমালোচনা যখন করেছে, তখন তাদের পৌত্তলিক কৃষ্টি, তাদের কু-সংস্কার ও অলীক ধ্যান-ধারণা, তাদের হাস্যকর ধর্মীয় রীতিপ্রথা, তাদের হীন ও নিকৃষ্ট চরিত্র এবং তাদের নেতৃত্বের দম্ভ ও আস্ফালন সব কিছুরই মুখোশ খুলে দিয়েছে। তাদের প্রাণপ্রিয় উপাস্যদের অসহায়ত্ব তুলে ধরার জন্য উদাহরণ দিয়ে বলেছে যে, এই সব উপাস্যরা মিলিত হয়েও একটা মাছি পর্যন্ত তৈরী করতে পারে না। এমনকি একটা মাছি যদি তাদের কোন জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তবে ওরা সেটা ফিরিয়ে আনতেও সক্ষম নয়। হযরত ইবরাহীমের উত্তরাধিকারী হওয়া নিয়ে তাদের যে গর্ব ও দম্ভ ছিল, কোরআন সেই দম্ভ চূর্ণ করেছে এভাবে যে, হযরত ইবরাহীমের গোটা জীবনেতিহাসকে বারবার তাদের সামনে বিবৃত করে তাঁর আসল পরিচয় তুলে ধরেছে। কোরআন বলেছে, যে মহান কাজ সমাধা করার জন্য তিনি নিজের গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, ঘরবাড়ী ত্যাগ করেছিলেন, নিজের জন্য সংরক্ষিত পুরোহিতের গদিতে লাথি মেরেছিলেন, নমরুদের সামনে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আগুনে পুড়ে মৃত্যুদণ্ড লাভের লোমহর্ষক রায় পেয়েছিলেন, তারপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আগুন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আল্লাহর মোহাজের হয়ে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন, তারপর তিনি একটা জনহীন মরুপ্রান্তরে নিজের দাওয়াত ও আল্লাহর এবাদতের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে তোমরা নিজেদের অর্থোপার্জন ও ধর্মীয় পৌরহিত্যের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছ, সেই মহান কাজের ধারে কাছেও না গিয়ে তার উত্তরাধিকারী হবার গালভরা দাবি তোলা কোরায়েশদের পক্ষে সম্পূর্ণ বেমানান। আপাদমস্তক শেরক ও জাহেলিয়াতে ডুবে থেকে কোন অধিকারে তারা তাওহীদের সেই মহান আহবায়কের উত্তরাধিকারী সাজে এবং তাঁর নাম মুখে আনে? কোরআন দেখিয়েছে কিভাবে তারা হারাম হালালের মনগড়া শরীয়ত বানিয়ে নিয়েছে। পূজার বেদিতে বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করার কী অদ্ভুত সব নিয়ম তৈরী করে নিয়েছে, পাশা ও জুয়া খেলাকেও কিভাবে ধর্মীয় পবিত্রতার মর্যাদা দিয়ে রেখেছে, কিভাবে তারা মেয়ে জন্ম নিলে লজ্জায় পালিয়ে বেড়ায়, কিভাবে তারা সীমাহীন নিষ্ঠুরতা নিয়ে মেয়ে সন্তানকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে, আর ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে বলে আখ্যায়িত করতে তাদের কিছুমাত্র লজ্জাবোধ হয় না। এভাবে তাদের প্রতিটি অর্থহীন ও হাস্যকর কার্যকলাপকে তাদের সামনে তুলে ধরে কোরআন বলেছে, তোমরা মসজিদুল হারাম ও কা’বা গৃহের অভিভাবকত্ব নিয়ে গর্বিত। অথচ নিজেদের কুফর ও শেরকের কারণে তোমরা তার যোগ্য নও। তোমরা জনগণকে আল্লাহর পথ থেকে ও কা’বা শরীফ থেকে ফিরিয়ে রাখ, নিজেদের ভাইদেরকে মাতৃভূমি থেকে বের করে দাও এবং ইসলামের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি কর।
কোরআন যখন আহলে কিতাবের সমালোচনা করেছে, তখন তাদের শত শত বছরের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিয়ে বলেছে, তোমরা হযরত মূসা আ. কে পদে পদে যন্ত্রণা দিয়েছ, বারবার তার নাফরমানী করেছ, বারবার ভ্রষ্টতা ও বিকৃতির পথে পা বাড়িয়েছ, কলহ কোন্দলে লিপ্ত থেকেছ, দাঙ্গাহাঙ্গামা করেছ, বাছুর পূজা করেছ, জেহাদ থেকে পালিয়েছ, পরস্পরের রক্তপাত করেছ, আত্মীয় স্বজনকে দেশান্তরিত করেছ, তাদের ওপর যুলুম ও আগ্রাসন চালিয়েছ, আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করেছ, সত্য কথাকে লুকিয়েছ, দরবেশ ও আলেমদেরকে খোদার আসনে বসিয়েছ, এমনকি স্বহস্তে মনগড়া কথা লিখে বলেছ যে এটা আল্লাহর কালাম, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছ, নিজেরাও আল্লাহর পথে চল না, অন্যদেরকেও চলতে দাও না, কেউ যদি মানব কল্যাণের জন্য কাজ করতে চায়, তবে তাকে সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে বাঁধা দাও। মুহাম্মদ সা. এর আগমনের পূর্বে তোমরা আল্লাহর কিতাবে লেখা প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে সবাইকে সুসংবাদ দিতে যে, শেষ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই নবী যখন সত্যই এল, তখন তোমরা সবাই তার বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে গেলে। মুসলমানরা নানা দিক দিয়ে তোমাদের নিকটতর, তারা তোমাদের নবীদেরকে এবং পূর্ববর্তী সকল কিতাবকে মান্য করে। অথচ তোমরা মোশরেকদের সাথে দহরম মহরম পাতাও। তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব থাকা সত্ত্বেও তোমরা এ সব অপকর্মে লিপ্ত থেকেছ।
গাধার পিঠে আল্লাহর কিতাবের স্তুপ থাকলেও সে যেমন তার কিছুই পরোয়া করে না, তোমরাও তেমনি আচরণ করছ। তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে সত্যবাদী হতে, তাহলে তোমরা আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে। তোমরা যতক্ষণ আল্লাহর কিতাবকে অবজ্ঞা করতে থাকবে, ততক্ষণ তোমাদের এ দাবির কোন মূল্য নেই যে, তোমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তোমাদের চরিত্রের এমন অধোপতন ঘটেছে যে, একটা মুদ্রাও যদি তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয়, তবে তা ফেরত পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এই আচরণের কারণে তোমরা আল্লাহর গযবের শিকার হয়েছ এবং তোমাদের জন্য লাঞ্ছনা ও মিসকিনী বরাদ্দ হয়েছে।
এরপর মোনাফেকদের সমালোচনা যখন করা হয়েছে, তখন তাদের সর্বাত্মক মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদেরকে তাদের ত্রুটি দেখিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে, তোমরা প্রতিটি জিনিসকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে থাক, তোমরা যখন নির্জনে মিলিত হও, তখন ইসলামী আন্দোলনের অবস্থা ও ঘটনাবলীর বিরুপ সমালোচনা করে থাক, জনসমক্ষে এলে তোমাদের হাবভাব পাল্টে যায়, পরস্পরকে ইশারা ইংগিতে কথা বল, কখনো নীরব হয়ে যাও, কখনো যুদ্ধ বিগ্রহের খবরে তোমাদের চোখ ভয়ে ছানাবড়া হয়ে যায়। কখনো চুপে চাপে সটকে পড়। মুসলমানদের সাথে থাকার সময় এক রকম আর কাফেরদের সাথে থাকার সময় আর এক রকম কথা বল। সকল ব্যাপারে তোমাদের ভূমিকা মুসলমানদের সামষ্টিক ভূমিকা থেকে ভিন্নতর হয়ে থাকে। অন্যেরা যদি ওহির বাণী থেকে জীবনের জন্য শিক্ষা পায় এবং প্রবোধ পায়, তাহলে তোমরা তাতে খুবই বিরক্ত হও। অন্যদের কাছে রসূল সা. এর সত্তা হলো পরম ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। অথচ তোমরা তাঁর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা পসন্দ কর। অন্যরা উৎসাহের সাথে নামায পড়ে। আর তোমরা নামাযের জন্য আস এমন বিরক্তির সাথে, যেন তোমাদেরকে ধরে বেঁধে আনা হয়েছে। অন্যান্য মুসলমানরা ইসলামের জন্য যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করতে উদগ্রীব থাকে। অথচ তোমরা নিজেরাও আল্লাহর পথে ব্যয় করো না, অন্যদেরকেও করতে বাধা দাও। অন্যেরা স্বতঃস্ফূর্ত ঈমানী আবেগের বশেই জেহাদ করতে যায়। তোমরা সব সময় কেবল জান বাঁচাতে চাও এবং নানা রকম খোঁড়া অজুহাত দিয়ে পালাতে চেষ্টা কর। অন্যেরা যে ঘটনায় খুশি হয়, তাতে তোমরা হও অসন্তুষ্ট। অন্যেরা যে ঘটনায় কষ্ট পায়, তোমরা তাতে আনন্দিত হও। সাধারণ মুসলমানদের সাথে কোনভাবেই তোমাদের মিল হয় না। এভাবে ইসলামী আন্দোলন মোনাফেকদের চিহ্নিত করেছে।
যে সব জাহেলী কবি ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কুৎসা সম্বলিত কবিতা লিখতো, এবং খোদ রসূল সা. সম্পর্কে নিন্দা রটাতো, অতি সংক্ষেপে তাদের এমন বিবরণ দেয়া হয়েছে, যা তাদের ব্যাপারে পুরোপুরি সত্য ও বাস্তব এবং তা দেখে একজন সাধারণ আরবও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নৈতিক অধোপতনের মাত্রা বুঝতে পারতো। জাহেলী কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, একমাত্র বিপথগামী লোকেরাই তাদের অনুসারী। তারা তাদের নীতিহীনতার কারণে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং মুখে যা ভালো কথা বলে, তদনুসারে কাজ করে না।
ইসলামী আন্দোলন সমকালে বিশেষ বিশেষ ঘৃণ্য চরিত্রের লোকদেরকেও অত্যন্ত উঁচু মানের সাহিত্যিক বর্ণনা দ্বারা চিহ্নিত করেছে এবং সমাজে তা দ্বারা গণচেতনা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে, যাতে করে যে কেউ তাদেরকে দেখতে পারে, বুঝতে পারে ও বাস্তবতার জগতে নিজেরাই তাদেরকে চিনতে পারে। কোথাও এদের মধ্য থেকে এমন ব্যক্তিকে দেখিয়েছে যে অত্যধিক বাগাড়ম্বর দ্বারা মানুষকে হতচকিত করে দেয়। কিন্তু কর্মের জগতে নিজের ভালো ভালো কথাকে বেমালুম ভুলে গিয়ে মানব সমাজে নিত্য নতুন গোলযোগ ছড়ায় এবং ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। কোথাও এমন ব্যক্তিকে দেখিয়েছে, যে গোত্রীয় ও নেতৃসুলভ আভিজাত্যের অহংকারে মাতোয়ারা থাকে এবং অতিমাত্রায় সম্ভ্রম সচেতন। কেয়ামতের দিন তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। আবার কোথাও সেই মানবীয় চরিত্রটাকে তুলে ধরা হয়েছে, যে লোভের আতিশয্যে কুকুরের মত হয়ে গেছে, যাকে তাড়া দিলেও জিভ বের করে, আর তাড়া না দিলেও জিভ বের করে। এ সব চরিত্র সমাজে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান ছিল। এই সমালোচনার কারণে তাদের হীনতা ও নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা জনগণের জন্য মোটেই কষ্টকর থাকেনি।
এ সমালোচনা নিছক তাত্ত্বিক ছিল না, বাস্তব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এতে ইসলামী আন্দোলনের মঞ্চ থেকে বিরোধী শক্তিকে সম্বোধন করে কথা বলা হতো। বক্তাও জানতেন কাকে বলছে, আর শ্রোতারাও জানতো কার সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এ সমালোচনা আকাশ থেকে মাইক যোগে করা হতো না বরং রসূল সা. এর মুখ দিয়ে প্রচারিত হতো। মুসলমানরা এগুলো সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে দিত। তাই তাদের আবেগ অনুভূতিও এর অন্তর্ভুক্ত হতো এবং তাদের অন্তরাত্মা এর সাথে মিলে একাকার হয়ে যেত। এ সমালোচনা বাস্তব ঘটনা প্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই করা হতো আর শ্রোতারাও তাকে চলতি ইতিহাসের সাথে খাপ খাইয়ে নিত। জনগণ বুঝতো, এটা আমাদের মধ্যে নব আবির্ভূত গঠনমূলক বিপ্লবী আন্দোলনেরই বক্তব্য। এ সমালোচনা প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং তা বিপ্লব বিরোধীদের ওপরই আঘাত হানছে। জনগণ উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনা ও উভয় পক্ষের তুলনামূলক পর্যালোচনা করার সুযোগ পেত। এভাবেই তাদের চেতনা গড়ে উঠেছে।
যুক্তি প্রমাণ উপলব্ধির সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা আবেগকে উদ্দীপিত করে না। আবেদন আবেগকে নাড়া দিয়ে দাওয়াতে উষ্ণতার সৃষ্টি করে। তবে আবেদন ইতিহাসে কার্যকর সংগ্রামের সৃষ্টি করে না। একমাত্র সমালোচনাই এমন শক্তি যা যুক্তি ও আবেদনের সাথে মিলিত হয়ে যখন কাজ করে, তখন সভ্যতার সকল উপাদান একসাথে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একমাত্র সমালোচনাই সমাজ জীবনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সার কথা হলো, ইসলামী আন্দোলন মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে যুক্তি, আবেদন ও সমালোচনা- এই তিন ধরনের উপকরণকে কাজে লাগিয়েছে এবং তেইশ বছর ধরে অবিরাম কাজে লাগিয়েছে। এই তিনটে শক্তিই বিরোধীদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা যুক্তির দিক দিয়ে দুর্বল, উদ্দেশ্যের প্রতি আবেগ সৃষ্টিতে পশ্চাদপদ এবং চরিত্রের দিক দিয়ে খুবই নিম্নস্তরের। এ কারণে বিরোধীদের মধ্যে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি এবং নিজেদের হীনতার অনুভূতি অবচেতনভাবে বেড়ে গেছে। অপর দিকে জনগণও উভয় পক্ষকে সর্বদিক দিয়ে যাচাই বাছাই করে উভয়ের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে। ইসলামী আন্দোলনের আসল শক্তি ছিল এটাই এবং এটাই আরবের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীর মন জয় করেছিল। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলন যদি সত্যকেন্দ্রিক না হতো, জনগণের মনকে আকৃষ্ট করতে না পারতো, আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদেরকে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করতে না পারতো এবং যুক্তি, আবেদন ও সমালোচনা দ্বারা নিজের শক্তি ও পরাক্রমের স্বীকৃতি আদায় করতে না পারতো, তাহলে মুসলমানরা রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রেও জয়লাভ করতে পারতো না, রণাঙ্গনেও বিজয় অর্জন করতে পারতো না। এই সব ময়দানেও যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা এ জন্যই হয়েছে যে, জনমতের বিশাল অঙ্গনে ইসলামের অগ্রযাত্রা ছিল অত্যন্ত বিজয়মুখী।

মুসলমানদের নৈতিক শক্তি

যে কোন দাওয়াত, যদি শুধু শাব্দিক দাওয়াত হয় এবং তার সাথে নৈতিক জোর না থাকে, তবে তা যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন এবং সাময়িকভাবে যতই যাদুকরি প্রভাব সৃষ্টি করে ফেলুক না কেন শেষ পর্যন্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলির মত বাতাসে মিলিয়ে যায়। ইতিহাসের ওপর কেবল কথা দ্বারা প্রভাব বিস্তার করা যায় না। শুধু কথা দিয়ে কোন কালেই কোন বিপ্লব সাধিত হয় না। কথা দ্বারা তখনই কিছু প্রভাব সৃষ্টি হয়, যখন কাজের মাধ্যমে তার কিছু অর্থ নির্ণীত হয়। ভাষার যাদু সাবানের মত সুদর্শন ফেনা ও রংগীন বুদবুদ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এই সব বুদবুদ মাটির একটা কণাকেও তার জায়গা থেকে সরাতে সক্ষম হয় না। বরং তা সংগে সংগেই বিলীন হয়ে যায়।
যুক্তি যখন আচরণ ছাড়াই আসে, আবেদন যখন আন্তরিকতাহীন হয় এবং সমালোচনা যখন নৈতিক দিক দিয়ে শূন্যগর্ভ হয়, তখন তা মানুষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় না। নৈতিক শক্তিই কোন আন্দোলনকে প্রভাবশালী ও কার্যকর করে। কর্মের সাক্ষ্য ছাড়া মুখের সাক্ষ্য নিষ্ফল হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে “মানুষ যা করে না, তা যখন বলে, তখন তা আল্লাহর কাছে প্রচণ্ড বিরাগভাজনের কারণ হয়ে থাকে।”
ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত নিছক তাত্ত্বিক বা যুক্তিভিত্তিক দাওয়াত ছিল না। ইসলামের দাওয়াত ছিল পুরোপুরি কর্মের আহবান। এ দাওয়াত এক বিশেষ ধরনের নতুন মানুষ তৈরী করার জন্য এসেছিল। প্রথম দিন থেকেই সে তার এই ইপ্সিত মানুষ তৈরীর কাজ শুরু করেছিল। এই মানুষের চিন্তাধারা, চারিত্রিক গুণাবলী এবং মনোমুগ্ধকর আচরণই তার যুক্তিকে যথার্থ গুরুত্ববহ, তার আবেদনকে সত্যিকার আর্কষণীয় এবং তার সমালোচনাকে কার্যকর করেছিল। ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি করা এইসব নতুন মানুষ নিজেরাই একটা অকাট্য যুক্তি ছিল। তারাই সবচেয়ে শক্তিশালী আবেদন ছিল। এই মানুষগুলোর সমগ্র সত্তা পুরানো সমাজব্যবস্থা, পাশবিক প্রকৃতির মানুষ, বিকারগ্রস্ত জাহেলী পরিবেশ, স্থবির সমাজ, এবং তার অযোগ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা সর্বাত্মক মূর্তিমান সমালোচনা ছিল। এই জ্যান্ত যুক্তি, জ্যান্ত আবেদন ও জ্যান্ত সমালোচনার কোন জবাব জাহেলিয়াতের কাছে ছিল না। এসব জ্যান্ত যুক্তির কাছে জাহেলিয়াত ছিল একেবারে অসহায়। সেই নতুন মানুষ, যার সবচেয়ে পূর্ণাংগ নমুনা ছিলেন স্বয়ং রসূল সা. এবং যার প্রেরণায় আরো বহু মানুষ তৈরী হচ্ছিল, এক বাস্তব ও অকাট্য সত্য ছিল। সে সত্যের সামনে চোখ বন্ধ করে রাখাও তার আলোরই তীব্রতার প্রমাণ বহন করতো। যারা এ সত্যকে অস্বীকার করতো, প্রত্যাখ্যান করতো এবং তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো, তারাও তাদের আচরণ দ্বারা এর শ্রেষ্ঠত্বই ঘোষণা করেছিল। মক্কায় এই নতুন মানুষ তার ব্যক্তিগত রুপ বিকশিত করেছিল, আর মদিনায় এসে সে নিজের সামষ্টিক রুপ দেখিয়েছিল।
ইসলামী আন্দোলন ও রসূল সা. এই নতুন মানুষ তৈরীর আসল কাজ থেকে কখনো উদাসীন হননি, অন্যদের সংশোধনের উৎসাহে ইসলাম এ কাজকে ভুলে যায়নি। অন্যদের সংশোধনের চেয়ে আত্মশুদ্ধির গুরুত্বই এখানে বেশি ছিল। অন্যের সমালোচনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আত্মসমালোচনা। বাইরে পরিবর্তন আনার আগে তার কাছে নিজের ভেতরে পরিবর্তন আনা ছিল অধিকতর জরুরী।
যে সমাজের দৃষ্টিতে উপার্জন করা ও পানাহার করার চেয়ে উচ্চতর ও মহত্তর কোন লক্ষ্য ছিল না। যার প্রতিটি মজলিস ছিল এক একটি মদ্যশালা, এক একটি জুয়ার আড্ডা এবং এক একটি নৃত্যক্লাব। যেখানে বীরত্ব কেবল দাঙ্গা ফাসাদ, হত্যা, লুটতরাজ ও প্রতিশোধ গ্রহণেই ব্যবহৃত হতো। যেখানে সমাজ একটা জংগলে পরিণত হয়েছিল, সেই জংগলে মানুষরুপী হিংস্র জন্তু গর্জন করে বেড়াতো এবং ভদ্র ও দুর্বল লোকেরা তাদের সহজ শিকারে পরিণত হতো, সেখানে রসূল সা. একদল সৎ, শুদ্ধ ও সুসভ্য মানুষকে সাথে নিয়ে আবির্ভূত হলেন। এই দলটা প্রথম দিন থেকেই সমাজে খুব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল এবং সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। মানবতার এই নতুন নমুনাগুলোকে লোকেরা অবাক হয়ে দেখতো এবং তাদেরকে সমাজের অন্য সবার থেকে সর্বদিক দিয়েই ভিন্নতর ও বৈশিষ্টমণ্ডিত বোধ করতো। এই দলটির আবির্ভাব ও বিকাশ বৃদ্ধি সম্পূর্ণরুপে তাদের সামনেই হয়েছিল। তাদের শিক্ষাদীক্ষা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জনগণ খুব ভালোভাবেই দেখেছে।
সর্বশ্রেণীর মানুষ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় দেখতো, ইসলামের কলেমা একের পর এক ভালো ভালো লোকদের আকৃষ্ট করে চলেছে। সহসা এক একজন মানুষ নিজের বিবেকের চাপে বাধ্য হয়ে এই বিপ্লবী আন্দোলনের কাছে আত্মসমর্পণ করতো। যে ব্যক্তি কয়েকদিন আগেও মুহাম্মাদ স. এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছে, সে সহসাই মাথা নত করে দিয়েছে, যেন কেউ যাদু করেছে। আর যে ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে তৎক্ষণাত শুভ পরিবর্তন আসতে থাকে। তার বন্ধুতা ও শত্রুতা পাল্টে যায়। তার আদত অভ্যাস ও রুচিতে বিপ্লব এসে যায়। তার ব্যস্ততা ভিন্নরুপ ধারণ করে। ইতোপূর্বে যে সব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল, সেগুলো পাল্টে গিয়ে নতুন বিষয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। আর সে সাথেই সে অত্যন্ত সক্রিয় ব্যক্তিতে রুপান্তরিত হয়। তার মধ্যে একটা নতুন শক্তির উন্মেষ ঘটে। তার সুপ্ত যোগ্যতা ও প্রতিভা জেগে ওঠে। তার বিবেক নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। তার মধ্যে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। যে ব্যক্তি কাফের থেকে মুসলমান হতো, তার ভেতর থেকে যেন একেবারেই নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটতো। সে নিজেও অনুভব করতো, আমি পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম এবং নতুন। পরিবেশও তাকে দেখে অনুভব করতো, সে পাল্টে গেছে। খুনী সন্ত্রাসী ইসলাম গ্রহণ করে জীবনের রক্ষক হয়ে যেত। চোর ইসলাম গ্রহন করে আমানতদারে পরিণত হতো, ব্যভিচারী ইসলাম গ্রহণ করে নারীদের সম্ভ্রমের রক্ষকে পরিণত হতো। ডাকাত ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও সমঝোতার মূর্ত প্রতীক হয়ে যেত। বদমেজাজী ও বক্র স্বভাবের লোক ইসলামের ছায়াতলে এসে সহনশীল বিনয়ী ও অমায়িক মানুষ হয়ে যেত। সুদখোর এসে দানশীল হয়ে যেত। নির্বোধ ও মেধাহীন লোক এসে উচ্চ প্রতিভা ও যোগ্যতার পরিচয় দিত। নিম্ন সামাজিক স্তর থেকে এসে মহত্বের উচ্চ স্তরে উন্নীত হতো, যেন সে অন্য কোন জগতের প্রাণী। মনে হতো যেন মাটি দিয়ে তৈরী নয় বরং অন্য কোন উপাদানে গঠিত।
আল্লাহর এবাদতে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত, রসূলের প্রেমে পাগল, সত্যের একনিষ্ঠ সেবক, সৎকাজের উদ্যোক্তা, কল্যাণের আহবায়ক, অন্যায় ও অসত্যের দুশমন, যুলুমের কট্টর বিরোধী, রুকু ও সিজদায় বিনীত, অভিনিবেশ সহকারে কোরআন পাঠকারী, দিনের বেলায় সংগ্রামে লিপ্ত, রাতের বেলায় আল্লাহর সাথে একনিষ্ঠ সংলাপে নিয়োজিত, মিসকীনদের খাদ্য দানকারী, পথিকের আতিথেয়তাকারী, এতিম ও বিধবার সেবক, আড্ডাবাজি ও অবৈধ খেলাধুলা থেকে সংযম অবলম্বনকারী, বিলাসিতা ও আমোদ ফূর্তি থেকে আত্মরক্ষাকারী, বেহুদা তর্ক বিতর্ক থেকে সংযত, গাম্ভীর্য ও আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন জীবনের প্রতীক, জনারণ্যে একাকী এবং আপন জনপদে প্রবাসী- এ সব অসাধারণ গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা সমগ্র আরবের মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়ে পারে কিভাবে?
ইসলামের নিশানবাহী, ইসলাম প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত এই নিঃস্বার্থ সৈনিকেরা ছিল আন্দোলনের অবৈতনিক সার্বক্ষণিক কর্মী। তারা আখেরাতের কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের দুনিয়াবী স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে অভ্যস্ত ছিল। নিজের পবিত্র লক্ষ্যের জন্য মস্তিষ্কের যাবতীয় যোগ্যতা, শরীরের যাবতীয় শক্তি, পকেটের টাকা কড়ি, এমনকি প্রয়োজনের সময় নিজের ও নিজের সন্তানদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে তারা কুণ্ঠিত হতো না। তাদের না ছিল জীবিকার চিন্তা, না ছিল দৈহিক নিরাপত্তার দিকে খেয়াল, না ছিল রাতের ঘুমের চিন্তা, না ছিল স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে মনোযোগ দেয়ার কোন অবসর, না ছিল খেলাধুলা ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ। তাদের একমাত্র পেশা, একমাত্র ব্যস্ততা, একমাত্র চিত্ত বিনোদন ও আমোদ ফূর্তির উপকরণ ছিল ইসলামকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম। তারা হাসিমুখে শত্রুদের গালি শুনেছে, বীরত্বের সাথে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ সহ্য করেছে, আনন্দের সাথে উপোষ করেছে এবং হাসিমুখে নির্বাসনে গেছে। যখন ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রার ধৈর্য্য ধারণ করেছে, সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে দৃপ্ত মনে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, আহাদ আহাদ বলতে বলতে তপ্ত বালুতে শুয়ে পড়েছে, আবেগময় কবিতা আবৃত্তি করতে করতে শূলে চড়েছে, আহত হয়ে পড়ে গিয়েও উড়ন্ত আত্মা শেষ বারের মত উচ্চারণ করেছেঃ
*****আরবী*****
“কা’বার প্রভুর শপথ, আমি সফল হয়েছি।”
এই যাদের নৈতিক চরিত্র ও ভূমিকা, তাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা হবে না কেন? তাদের সামনে বিশ্ব মাথা নোয়াবে না কেন?
এই মুসলিম চরিত্র প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, তা কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই চরিত্রের দীক্ষাগুরু বধ্যভূমি থেকে বিদায় হবার সময় নিজের হত্যাকারীদের গচ্ছিত আমানত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন। এই চরিত্র লাভকারীরা ব্যভিচারের অপরাধ সংঘটিত করার পর উপযাচক হয়ে অপরাধের স্বীকারোক্তি করেছে এবং ইসলামী আদালতের কাছ থেকে নিজের জন্য মৃত্যুদণ্ড আদায় করে ছেড়েছে, যাতে করে তারা আল্লাহর কাছে পবিত্র অবস্থায় উপস্থিত হতে পারে। এই চরিত্রকে ইসলাম গ্রহণের কয়েক মিনিট পরই যখন জনৈকা সুন্দরী যুবতী তার প্রমোদসংগী হবার আহবান জানিয়েছে তখন সে এই বলে ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছে যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হতে পারিনা। এক জেহাদী সফরে মুসলিম বাহিনী উয্দ গোত্রের আবাসের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় জনৈক মুসলিম সৈনিক একান্ত প্রয়োজনে তাদের ওখান থেকে একটা বদনা এনেছিল। কিন্তু মুসলিম চরিত্রই তাকে তা ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল। এ ধরনের শত শত দৃষ্টান্ত যে সমাজে প্রতিদিন সংঘটিত হতো, সে সমাজে তো প্রতিদিনই ভূমিকম্প সংঘটিত হতো।
আনসাররা নিজেদের ঘরবাড়ী ও ধনসম্পত্তি সমান দুই ভাগ করে অর্ধেক নিজের জন্য রেখে অর্ধেক নিজের মোহাজের ভাইকে দিয়ে যে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা দেখে কি তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষ হতভম্ব হয়নি? এমন বিস্ময়কর সাম্য কি জনমনকে আকৃষ্ট না করে পেরেছে, যা একজন নগন্য দাস অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে, দরিদ্র লোকেরা ধনীদের সাথে এবং বাস্তুচ্যুত লোকেরা মদিনার স্থানীয় বাসিন্দদের সাথে একই কাতারে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে? প্রত্যেকে গুরুত্ব পেয়েছে, প্রত্যেকে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছে, প্রত্যেকের মতের মূল্য দেয়া হয়েছে, প্রত্যেককে দায়িত্ব বহনের ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ যেন এমন এক পরিবার, যার সকল সদস্য সুখ দুঃখ সমানভবে ভাগ করে নেয় এবং চিন্তা ও চেতনায় ও কাজ কর্মে সমানভাবে অংশ গ্রহণ করে। ক্ষুধার সময় এলে তাতে সবচেয়ে অংশ গ্রহণকারী হন দলনেতা। সচ্ছলতা এলে দলনেতাই হন তাতে সবচেয়ে কম অংশ গ্রহণকারী। জাহেলী দৃষ্টিকোণ থেকে যারা উঁচু ও নিচু, তাদের মধ্যে বিয়ে শাদী হতে দেখে সমাজ অভিভূত হয়েছে। রসম রেওয়াজের ভারী বোঝা হালকা করার যে সহজ সরল পন্থা ইসলাম উদ্ভাবন করেছিল, তার দিকে জাহেলী সমাজের সাধারন মানুষের মন আকৃষ্ট না হয়ে পারেনা। কত ভালোবাসাপূর্ণ, হালকা, সাদাসিদে, শান্তিপূর্ণ জীবন ছিল! সত্যিকার অর্থে তা ছিল ‘হায়াতান তাইয়্যেবা পবিত্র জীবন’।
মুসলমানদের মধ্যে কী ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটছে, তাও সমাজ প্রত্যক্ষ করেছে। তারা দেখেছে, ইসলাম গ্রহণকারীদের মনমগজে বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে মেধার বিকাশ ঘটে চলেছে। সারা আরব অবাক হয়ে দেখেছে, তাদের মধ্যে কেউ আইনশাস্ত্রে, কেউ কৃষিতে, কেউ ব্যবসায় বাণিজ্যে, কেউ যুদ্ধ বিদ্যায়, কেউ প্রশাসনে, কেউ কূটনীতিতে, মোটকথা প্রত্যেকেই কোন না কোন বিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করে এক নতুন ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে।
এই চরিত্রের ছবি এঁকে কোরআন বারাবার ইসলামের শক্রদেরকেও জনগণকেও বুঝিয়েছে যে, দেখ, সত্যের আদর্শ থেকে মানবতার যে নমুনা তৈরী হয়, তা কত সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ নমুনা। শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা এভাবেই সম্ভব। এই চরিত্রকে ইসলাম নিজের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অতপর বারবার এর তুলনা জাহেলী চরিত্রের সাথেও করেছে। আহলে কিতাব ও মোনাফেকদের চরিত্রের সাথেও করেছে। দুটোকে পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছে যে, তোমরা নিজেরাই বল কোন্টা ভাল। বাস্তবতার ময়দানে এভাবেই তুলনা হচ্ছিল। তাছাড়া জীবনের প্রতিটি অংগনেও আপনা থেকেই তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ চলছিল।
সংঘাত-সংঘর্ষের পরিস্থিতি একই সাথে দুটো উল্লেখযোগ্য ফলাফল বয়ে আনে। দ্বন্দ-সংঘাতে পড়লে কিছু লোকের চরিত্র গড়ে ওঠে আবার কিছু লোকের চরিত্র ভেঙ্গে তলিয়ে যায়। ইসলামী আন্দোলন সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে যাতে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে পড়ে মুসলমানের চরিত্রে আরো সুন্দর, সুষমা মন্ডিত ও পরিশোধিত হয়। প্রশিক্ষণ পরিশুদ্ধি ও শিক্ষাদানের কঠোর ব্যবস্থার কারণে মুসলিম চরিত্রের ক্রমেই উন্নতি হয়েছে। অপর দিকে জাহেলী চরিত্র দ্বন্দ্ব সংঘাতে ক্রমশ অধোপতনের দিকে ধাবিত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তলিয়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিম চরিত্রকে বারবার ধৈর্যের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সহনশীলতার শক্তি ও নীতির ওপর অবিচল থাকার যোগ্যতা গড়ে তোলা হয়েছে। কখনো কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে, উস্কানিতে পড়ে উত্তেজিত হয়োনা। কখনো উপদেশ দেয়া হয়েছে, জাহেলী শক্তির নিশানবাহীদের সাথে জড়িয়ে পড়োনা, হতাশ হয়োনা, খারাপ ব্যবহারের জবাব ভালো ব্যবহার দ্বারা দাও, যুলুম ও বাড়াবাড়িকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখ, কারো সাথে শক্রতার কারণে বেইনসাফী করোনা, দুনিয়াদারদের সংশোধনের আশা পোষণ করোনা এবং তাদের পেছনে নিজের সময় নষ্ট করোনা, শক্রদের প্রাচুর্য ও জাঁকজমক দেখে ঘাবড়ে যেওনা, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিওনা। তাদের প্রতিটি মনস্তাত্মিক উত্থান পতনের ওপর দৃষ্টি রাখা হয়েছে এবং সাথে সাথে তাদের কিসে ভালো হবে তা বুঝানো হয়েছে। রসূল সা. নিজে তাঁর জামায়াতের প্রত্যেক সদস্যের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন এবং উত্তম সুযোগ বুঝে কখনো উপদেশ দিয়ে, কখনো ধমক দিয়ে, কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং কখনো সন্তোষ প্রকাশ করে মুসলিম চরিত্রের বিকাশ সাধন করেছেন। যার মধ্যে যেমন যোগ্যতা দেখেছেন, যার যেমন মেযাজের গঠন দেখেছেন, তাকে তারই প্রয়োজন মোতাবেক পরামর্শ দিয়েছেন। আর যার মধ্যে যেমন দুর্বলতা দেখেছেন, তার সামনে ইসলামের ঠিক সেই ধরনের দাবী তুলে ধরেছেন। তা ছাড়া সামষ্টিক তৎপরতার ক্ষেত্রে মুসলিম জামায়াত যে ধরনের আচরণ প্রদর্শন করেছে, তার ওপর প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পর কড়া সমালোচনা করেছেন। বদর ওহুদের যুদ্ধই হোক, বা হোদাইবিয়ার সন্ধিই হোক, কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাই হোক, কিংবা অপবাদের ঘটনা হোক, প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক ঘটনার পর একদিকে তিনি শক্রদের তৎপরতার বিবরণ জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন, অপর দিকে নিজের জামায়াতের বেপরোয়া সমালোচনা করে তাদের ভুলক্রটিও ধরে দিয়েছেন একং তার প্রতিকারের উপায়ও বলে দিয়েছেন। তাঁর সাথীরা যদি তাদের শক্রর সাথে অন্যায় কিছু করে তাহলে তাদের সে অন্যায়কে ঢেকে রাখতে বা সঠিক প্রমাণ করতে চেষ্টা করেননি। বরং শক্রর সামনে ভুল স্বীকার করেছেন, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়ে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। নাখলার ঘটনার জন্য তিনি সাহাবীগণকে তিরস্কার করেছেন। হযরত খালেদ যুদ্ধের সময় উচ্চস্বরে কালেমা পাঠকারীকে আন্তরিকতার সাথে নয় বরং প্রাণ রক্ষার্থে পাঠ করেছে ভেবে সন্দেহ বশত হত্যা করলে রসূল সা. তার ঐ কাজকে অপছন্দ করেছেন এবং তার দায়দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছেন। ইসলাম রসূল সা. ব্যতীত বাদবাকী সাহাবীগণকে নিষ্পাপ ও নির্ভুল বলে আখ্যায়িত করেনি। শুধু সামগ্রিকভাবে তাদেরকে পবিত্র, সৎ ও সংশোধনযোগ্য বলে অবিহিত করেছেন। মুসলিম চরিত্রকে সে সামগ্রিকভাবে জাহেলী চরিত্রের চেয়ে স্পষ্টতই উৎকৃষ্টতর, মহত্তর ও বিকাশমান বলেছে।
প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও বিরাজমান পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করা কোন খেলা নয়। এটা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ কাজ। এতে অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং খুবই ঠান্ডা ও উত্তেজনাহীন মস্তিস্ক নিয়ে কাজ করতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশের শক্তি অগ্রসরমানদেরকে কোমর ধরে পেছনে টানতে থাকে এবং সংশোধনকামীদেরকে নতুন করে বিগড়ে দিতে চায়। তাদের মনের ভেতর প্রভাব বিস্তার করার জন্য ফাঁক ফোকর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে, যাতে নিজের বাতিল আকিদা বিশ্বাস, রসম রেওয়াজ ও আদত অভ্যাসকে কোন রকমে পুনরায় তার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যায় এবং মানসিক গোলামী ও আপোষের কোন পথ খুঁজে বের করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। প্রতিকূল পরিবেশেও লড়াই করতে করতে যখন প্রবল শক্তিধর মানুষের শক্তি ও হিম্মত থেতিয়ে যায় এবং নিষ্ঠাবান লোকদেরও পা পেছন দিকে সরতে আরম্ভ করে, তখন মানষ বিপ্লবী ধ্যান-ধারণাকে ছেড়ে পুরানো ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। মূলনীতি ও আকীদা বিশ্বাসে না হলেও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, চালচলন ও বেশভূষায় বিজাতীয় প্রভাব গ্রহণ করতে প্রস্তত হয়ে যায়। শুধু এতটুকু পথ খুলে গেলেই বিদ্যমান পরিবেশ তাকে ক্রমশ প্রশস্ত করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার সব কিছুই নিজের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে নেয়। এক প্রজন্মের যুগে যদি সমাপ্ত করা না যায়, তবে পরবর্তী প্রজন্মের যুগে সমাপ্ত করে। কিন্ত ইসলামী আন্দোলন মুসলিম চরিত্র গঠন করার সময় এই বিপদের কথা পুরোপুরি খেয়াল রেখেছে। তাই সে চরিত্রকে ইস্পাত কঠিন রূপ দিয়েছে এবং সংরক্ষণের সর্বাত্মক ব্যবস্থা করেছে। একদিকে তাকে ‘আশিদ্দাউ আলাল কুফফার’ অর্থাৎ ইসলাম বিরোধীদের মোকাবিলায় দুর্জয় শক্তি গড়ে তোলার এবং অন্যদিকে ‘রুহামাউ বাইনাহুম’ অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দয়ালু হবার শিক্ষা দিয়েছে। বিজাতির অনুকরণ, বিজাতির মানসিক গোলামী এবং বিজাতির সাথে গোপন আন্তরিক সম্পর্ক রাখতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। মুসলমানদের মধ্যে এই মানসিক স্থিতি ও অবিচলতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই নও মুসলমানদেরকে হিজরত করে মদিনায় চলে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আর কোথাও যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক একত্রিত হতো এবং তাদের কাছ থেকে ‘বেদুঈন সুলভ’ বায়য়াত গ্রহণ করা হতো (অর্থাৎ হিজরতের শর্ত আরোপ করা হয়না এমন বায়য়াত) তবে তাদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হতো যে, মোশরেকদের কাছ থেকে দূরে থাক এবং তাদের সাথে বন্ধুতা ও বিয়েশাদীর সম্পর্ক স্থাপন করোনা। নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তোল। অমুসলিম পিতামাতার আনুগত্যের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, পিতামাতা যদি ইসলাম পরিত্যাগ করার আদেশ দেয়, তবে কখনো তা মানা চলবেনা। ইসলামের বিরুদ্ধে কারো আনুগত্য চলেনা। এই চরিত্রের দৃঢ়তা এত বেশী ছিল যে, তা ইরানের জাঁকজমকপূর্ণ সভ্যতা দেখেও প্রভাবিত হয়নি এবং রোমের বিলাসবহুল জীবন দেখেও হীনমন্যতায় আক্রান্ত হয়নি। মুসলমানরা বড় বড় রাজ দরবারে নিজেদের বেদুঈন সুলভ চালচলন নিয়েই মূল্যবান কার্পেট পদদলিত করে মাথা না ঝুঁকিয়েই হাজির হয়েছে এবং পূর্ণ সাহসিকতার সাথে নিজ বক্তব্য পেশ করেছে। এই চরিত্রকে যখন মানসিকভাবে পুরোপুরি মজবুত ও স্থিতিশীল করা হয়েছে এবং সব ধরনের হীনমন্যতার উর্ধে তুলে দেয়া হয়েছে, তখন রণাঙ্গনেও তারা বীরত্ব ও দৃঢ়তার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে যে, এ চরিত্র সংখ্যায় কম ও সাজসরঞ্জামে অপ্রতুল হলেও তাকে ধ্বংস করা এবং তার অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা সম্ভব নয়।
অসংখ্য কট্টর দুশমন মুখে ব্যংগ বিদ্রুপ, গালাগাল, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার ইত্যাদি করা সত্ত্বেও মনে মনে এই মুসলিম চরিত্রের প্রতি নিশ্চয়ই ঈর্ষা করতো, মুসলমানদেরকে নিজেদেও চেয়ে উত্তম মনে করতো। আফসোস করতো যে, আমরাও যদি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম। বিভিন্ন সময় বিরোধীরা তা স্বীকারও করেছে। ওহুদ যুদ্ধের পর যখন পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আবু সুফিয়ান হজরত ওমরকে জিজ্ঞেস করলো, মুহাম্মদ সা. কি নিহত হয়েছেন? হজরত ওমর জবাব দিলেন, আল্লাহর কসম তিনি জীবিত এবং তোমাদের কথা শুনছেন। তখন আবু সুফিয়ান বলেছিল, আবু কায়মা যদিও বলেছে যে মুহাম্মদ সা. নিহত হয়েছে, কিন্তু আমরা তোমাদেরকে ওর চেয়ে সত্যবাদী মনে করি। অনুরূপভাবে, হোদাইবিয়ার সন্ধির পর কোরায়েশ দূত উরওয়া ইবনে মাসউদ মুসলমানদের অভ্যন্তরে যে দৃশ্য দেখেছে এবং যেভাবে তা কোরায়েশ নেতাদের কাছে ব্যক্ত করেছে, তা থেকে প্রমাণিতত হয়, অমুসলিমরা সব সময়ই মুসলমানদেরকে নৈতিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করতো। ইসলামের কট্টর বিরোধী হয়েও আবু সুফিয়ান রোম সম্রাটের সামনে মুহাম্মদ সা. ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছিল তাও সাক্ষ্য দেয় যে, শক্রতা করা সত্ত্বেও শক্ররা মুহাম্মদ সা. ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব খোলাখুলিভাবে স্বীকার করতো। মদিনার তহশীলদার যখন খায়বারের ইহুদীদেও কাছে রাজস্ব আদায় করতে গেল, তখন তার বন্টনের নির্ভুলতা দেখে তারা সাক্ষ্য দেয় যে, এটাই যথার্থ ন্যায়বিচার, যার ওপর আকাশ ও পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে।
প্রতিনিয়ত আরবের কোণে কোণে নবগঠিত মুসলিম সমাজের আশ্চার্য হাল হাকীকত নিয়ে আলোচনা চলতো। আন্দোরনের নেতা ও কমীদের নিয়ে কথাবার্তা হতো। মোটকথা, দু’জন মানুষ একত্রিত হলেই মুহাম্মদ সা., ইসলামী সমাজ, ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার সরকারের সুকীর্তি ও সুখ্যাতিই হতো প্রথম ও প্রধান আলোচ্য বিষয়।
ইসলামী আন্দোলনের এই নৈতিক শক্তিই তার যুক্তি ও আবেদনকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতো। এটা ছিল মুসলিম চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের গণস্বীকৃতি এবং এই গণ-স্বীকৃতিই সবৃস্তরের মানুষকে ইসলামের অনুগত বানিয়ে দিত। ইসলামের দুর্বার আকর্ষণ কিভাবে চারদিকের জন মানুষকে আকৃষ্ট করছিল, তার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি।
প্রথমে মক্কী যুগ প্রসংগে আসা যাক। খ্যাতনামা কবি তোফায়েল দাওসী যখন মক্কায় এলেন, তখন কোরায়েশরা তাকে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতে নিষেধ করে। অবশেষে তিনি নিজেই সাক্ষাত করেন এবং কেবল কয়েকটা আয়াত শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আমর বিন আবাসা রাসূল সা. এর সুখ্যাতি শুনে সাক্ষাত করতে আসেন এবং ইসলামে দীক্ষিত হন। রাসূলের সা. বাল্যবন্ধু দামাদ বিন সা’লাবা পরামর্শদাতা হয়ে আসেন এবং রাসূলের মুখ থেকে কয়েকটা কথা শুনেই ইসলাম গ্রহণ করেন। একটা মরুচারী দস্যু গোত্রের যুবক আবু যর ইসলামের সুখ্যাতি শুনে মক্কায় আসেন এবং বিরোধী পরিবেশ থেকে কোন রকমে গা বাঁচিয়ে রসূলের সা. সাথে দেখা করেন, দাওয়াতী বক্তব্য শোনেন এবং সত্যকে গ্রহণ করেন। তাঁর ভেতরে সহসা এক আবেগ জেগে ওঠে এবং তিনি কা’বার সামনে গিয়ে সত্যের বাণী ঘোষণা করেন। তারপর এই সত্য প্রেমের অপরাধের শাস্তি ভোগ করেন। এভাবে যারা ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে এক একজন দাওয়াতদাতা হয়ে যায়। কারো কারো দাওয়াতে তার পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে যান। সুয়াইদ বিন সামেত রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং গভীরতম প্রভাবে প্রভাবিত হয়। আয়াস বিন মুয়াযও মদিনা থেকে এসে রসূল সা.এর দাওয়াতের সমর্থক হয়ে যান এবং মদিনায় ইসলামের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। নাজরান থেকে ২০ জন খৃষ্টানের এক প্রতিনিধিদল এসে রসূল সা. এর কাছ থেকে ইসলামের জ্ঞান লাভ করে এবং কোরায়েশদের অনেক অপচেষ্টা সত্ত্বেও তারা ইসলামের আলো বুকে ধারণ করে বিদায় হয়। আবিসিনিয়ায় যারা হিজরত করে গিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে কিছু সংখ্যক ইয়ামানবাসী ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করে এবং তাদের মাধ্যমে স্বয়ং বাদশাহ নাজ্জাশীর মনও ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। মদিনায় আওস ও খাজরাজের লোকেরা তো রসূল সা. এর আগমনের আগে থেকেই দ্রুত গতিতে ইসলাম গ্রহণ করছিল। রসূল সা. হিজরত করে আসার পর তো এমন একটি বাড়ীও অবশিষ্ট ছিলনা, যেখানে ইসলমের আলো পৌঁছেনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, খ্যাতনামা ইহুদী আলেম আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রসূল সা. এর একটা সহজ সরল মামুলী ক্ষুদ্র ভাষণ শুনে এতই অভিভূত হয়ে যান যে, শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই ভাষণটা ছিল এইঃ “হে মানব সকল, তোমরা সমাজে শান্তির বা সালামের বিস্তার ঘটাও, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখ এবং গভীর রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়।” অনুরূপভাবে, আবু কায়েস সারমা বিন আবি আনাস নামাক খৃষ্টান দরবেশ ইসলামী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। জুবাইর ইবনে মুতয়িম এসেছিলেন বদরের যুদ্ধ বন্দীদেরকে মুক্ত করতে। এই সময় রসূল সা. এর মুখে কয়েকটি আয়াত শুনেই হেদায়াত লাভ করেন। কোরায়েশদের দাস আবু রাফে দূত হঢে মদিনায় এসে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে যায়। সে ফিরে যেতে চাইছিলনা। রাসূল সা. বুঝালেন যে, দূতকে রেখে দেয়া যায়না। তুমি আগে মক্কায় ফিরে যাও। তারপর যদি মনে চায় মদিনায় চলে এস। আবু রাফে মক্কায় গিয়ে পরে আবার মদিনায় হিজরত করে চলে আসে। বনু কুরায়যার অপরাধের কারণে তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হলে তাদের মধ্যকার আমর বিন সা’দ ইসলাম গ্রহণ করে।
ইয়ামামার নেতা ছামামা বিন আছাল হানাফী বন্দী হয়ে আসেন এবং রসূলের সা. আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ওহদ যুদ্ধ চলছে। ঠিক সেই সময় বনু আব্দুল আশহাল গোত্রের আমর বিন ছাবেত ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সাথে সাথে রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করে শাহাদাত লাভ করেন। খন্দক যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতে নাঈম বিন মাসউদ ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। আবুল আ’স মদিনায় এসে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। খয়বরের ইহুদীদের যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে তাদের এক রাখাল আসওয়াদ জিজ্ঞেস করে, কার সাথে এবং কোথায় যুদ্ধ হবে? সে যখন যখন জানতে পারলো, মুহাম্মাদ সা. এর সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত খালেদ ও আমর ইবনু আ’স হোদাইবিয়ার সন্ধি ও মূতার যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় কোরায়েশদের দল ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা জাহেলিয়াতের ঘাঁটি থেকে লড়াই করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সহসাই ইসলামী আন্দেলন তাদের আকৃষ্ট করে। ফুযালা মক্কা বিজয়ের সময় এবং শায়বা হুনায়েন যুদ্ধের সময় রাসূল সা. কে হত্যা করার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু নিজেরাই সত্যের তরবারীতে ঘায়েল হয়ে গেলো। হাওয়াযেন ও বনু সা’দ গোত্রের লোকেরা এসে ইসলাম গ্রহণ করলে রসূল সা. মালেক বিন আওফের কথা স্মরণ করলেন এবং তাঁর ইসলাম গ্রহণের আশা ব্যক্ত করলেন। রসূল সা. এর মনোভাব জানতে পেরে মালেক বিন আউফ গোপনে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তাঈ গোত্রের ওপর মুসলিম বাহিনী জয় লাভ করলে হাতেম তাঈ এর মেয়ে বন্দিনী হয়ে মদিনায় এল। সে রসূল সা. এর কাছে সদাচারের আবেদন জানালো। রসূল সা. তার আবেদন গ্রহণ পূর্বক তাকে বাহনের ব্যবস্থা করে বিদায় করলেন। সে ইসলামের বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষিপ্ত নিজের ভাই আদী বিন হাতেমকে পুরো ঘটনা জানিয়ে মদিনায় উপস্থিত হবার উপদেশ দিল। আদী এল এবং সচোক্ষে পরিস্থিতি যাচাই করে যখন বুঝলো যে, রসূল সা. সত্যই আল্লাহর রসূল, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করলো। কবিতার মাধ্যমে ইসলমের বিরুদ্ধে ও রসূলের সা. বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কবি কা’ব বিন যুহায়ের স্বেচ্ছায় মদিনায় আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ইতিহাস খ্যাত কবিতা “বানাত্ সুয়াদ” রচনা ও আবৃত্তি করেন। আব্দুল্লাহ যুলবিজাদাইনকে দেখুন। এই যুবক ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হলেও নিজের চাচার ভয়ে কিছুদিন যাবত তা গোপন করে রেখেছিল। যখন দেখলো চাচার অনুমতি পাওয়ার আশা নেই, তখন চাচা, তার ধনসম্পত্তি, তার দেয়া পোষাক পরিচ্ছদ ও ঘরোয়া পরিবেশকে বিদায় জানিয়ে কম্বল পরিধান করে মদিনায় আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। বাহরাইনের আব্দুল কায়েস গোত্রের জনৈক ব্যবসায়ী মুনকিয বিন হাব্বান বাণিজ্যিক সফরে এসে কয়েকদিন মদিনায় অবস্থান করেন। বিদেশে ইসলামী আন্দোলনকে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রসূল সা. এর ছিল। সেই অনুসারে মুনকিযের সাথে নিজেই এগিয়ে গিয়ে দেখা করলেন ও দাওয়াত দিলেন। মুনকিয ইসলাম গ্রহণ করলেন। বাড়ী গিয়ে পিতাকে দাওয়াত দিলে তার পিতাও ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে তার গোত্রের সাধারণ লোকেরাও ইসলাম গ্রহণ করে। বেশ কিছু লোক এমনও ছিল, যারা রাজত্ব নেতৃত্ব ও বড় বড় পদমর্যাদা ত্যাগ করে আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করেন।
এসব উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, ইসলামের জন্য ময়দান কিভাবে পর্যয়ক্রমে অনুকূল ও উর্বর হয়ে উঠেছিল। প্রথমে একজন, তারপর দু’চারজন, তারপর শত শত, তারপর হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করতে করতে পুরো একটা দুনিয়া গড়ে ওঠে।
একটা বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে তো দ্রুত ও সার্বজনীনভাবে দলে দলে ইসলাম গ্রহণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এখারে কেবল সেই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির কথাই উল্লেখ করছি, যারা নিজ নিজ পরিবেশে অগ্রণী হয়েছিলেন। এদের একজন যখন ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখন তারা নিজ নিজ গোত্র এবং এলাকায়ও দাওয়াত দাতা হয়ে যেতেন। তারা নিজেদের কথা ও কাজ দ্বারা অন্য অনেককে এমনকি পুরো এক একটা গোত্রকেও আকৃষ্ট করতেন। তাছাড়া খোদ মদিনার দাওয়াতী কেন্দ্রের তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক কর্মীদের তৎপরতা বহু লোককে তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতো কিংবা তার সমর্থক ও সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। এ ধরনের সহানুভূতিও ইসলামী আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়ে থাকে। এ ধরনের সমর্থক ও সহানুভূতিশীল লোকেরা বিরোধীদের মধ্যে বসেও ইসলামের পক্ষে কথা বলতে পারতো এবং তাদের কথা শুনতে কারো মধ্যে কোন ধরনের বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতা বাধা হয়ে দাঁড়াতোনা। এ ধরনের সমর্থক ও সহানুভূতিশীল লোক কোরায়েশ, ইহুদী ও বেদুঈনদের মধ্যেও ছিল এবং প্রধানত তারাই হোদাইবিয়ার সন্ধির সময় কোরায়েশদেরকে চুক্তি সই করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ ধরনেরই এক ব্যক্তি ওহুদ যুদ্ধের পর আবু সুফিয়ানকে ফিরে এসে পুনরায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে নিষেধ করেছিল। এ ধরনেরই এক ব্যক্তি রাসূল সা. ‘আবু তালেব গিরী উপত্যকায়’ (শিয়াবে আবু তালেব) বন্দী থাকাকালে তাঁদের কাছে খাদ্যের একটা চালান যেতে বাধা দেয়ার বিরোধিতা করেছিল। এ ধরনের লোকেরাই এই অন্যায় বয়কট চুক্তির অবসান ঘটিয়েছিল। ইহুদী হয়েও যে মুখাইরিক ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থে জীবন দিয়েছিল, সেও এই ধরনেরই এক ব্যক্তি ছিল। মোটকথা, ইসলাম গ্রহণকারীদের পাশাপাশি এ ধরনের সমর্থক - সহানুভূতিশীলদেরও একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি হতে থাকে। ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের পথ সুগম করার পেছনে এই গোষ্ঠীরও কিছুটা অবদান ছিল। এদের অধিকাংশই পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করে। সারকথা হলো, ইসলামী বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আহবায়কদের গোষ্ঠী সারা আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। মদিনা ছিল তাদের সবার প্রেরণার উৎস। তার কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সত্যান্বেষীরা ইসলামের সর্বত্র কলেমার জ্যোতি নিজ নিজ বৃত্তে পৌঁছে দিচ্ছিল। মদিনা ছিল যেন সূর্য, আর তার আশ পাশে বহুদূর পযন্ত ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ তার কাছ থেকে আলো লাভ করে পরিবেশকে করছিল আলোকিত।
এখানে আমি সংক্ষেকে এমন কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরেছি, যা দ্বারা বুঝা যাবে যে, এক বা গুটিকয় ব্যক্তি কিভাবে পুরো এক একটা গোত্রকে বা অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছে। একটা উদাহরণ, সম্ভবত সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বল উদাহরণ হলো মদিনার যুবক সুয়াইদ বিন সামেত মক্কায় যেয়ে রসূল সা. এর কাছ থেকে কালেমায়ে তাইয়েবার আলো অর্জন করে এবং তারপর তার কাছ থেকে মদিনার অনেকে প্রভাবিত হয়। এভাবে এক পর্যায়ে মদিনা ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। তোফায়েল দাওসী যদিও নিজের মেজাজের কারণে পুরো গোত্রকে তাড়াতাড়ি প্রভাবিত করতে পারেননি, কিন্তু তার কারণে ইয়ামানে ইসলামী আন্দোলন পরিচিতি লাভ করে। আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের দ্বারা প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য কারো প্রেরণা ছাড়াই আশয়ার গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। দামাদ বিন সা’লাবার দাওয়াতে তার পুরো গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত আবু যর গিফারী ইসলামের বিপ্লবী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে মক্কা থেকে ফিরলে তার দাওয়াতে তাঁর গোত্রের অর্ধেক লোকই ইসলাম গ্রহণ করে। বাকী অর্ধেক রসূল সা. মদিনায় যাওয়ার পর
মুসলমান হয়। তারপর গিফার গোত্রের কাছ থেকে আসলাম গোত্রেও ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে পুরো গোত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়। মুনকিয বিন হাব্বানের মাধ্যমে বাহরাইনে ইসলামের বিস্তার ঘটে। কিছুকাল পর মুনকিয ১৪ জন সাথী নিয়ে মদিনায় এসেছিলেন। মোটকথা, ব্যাপারটা ইনজীলের সেই উক্তিটার মতই প্রতিভাত হয় যে, ‘আল্লাহর রাজত্বের (সত্যের দাওয়াতের) উদাহরণ খামিরের মত। এক মহিলা আটার সাথে একটু খামির মিশিয়ে দিলে আটাই খামিরে পরিণত হয়।”
ইসলাম যেখানেই পৌঁছতো এবং কিছু লোক তা গ্রহণ করতো, সেখানেই অনিবার্যভাবে একটা সমাজই তৈরী হতো। মসজিদ শুধু নামাজের ঘর হতোনা, বরং ইসলামের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হতো। তা হতো একাধারে শিক্ষাঙ্গন, পরামর্শস্থল, সামাজিক সমাবেশস্থল ও মেহমানখানা। মসজিদ হতে আসলে ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক এবং মসজিদের অস্তিত্ব গোটা এলাকায় এ কথা ঘোষণা করে দেয়ারই নামান্তর হতো যে, এ জায়গা এখন “ইসলামের ঘাঁটি।” এ জন্য রসূল সা. সদ্য মুসলমান হওয়া গোত্রগুলোকে মসজিদ বানানোর নির্দেশ দিতেন। আর সৈন্যদেরকে নির্দেশ দিতেন, যে এলাকায় আযানের শব্দ শোনা যায়, সেখানে যেন অস্ত্র চালানো বন্ধ রাখা হয়। এ নির্দেশ আসলে আরো মসজিদ নির্মাণের উৎসাহ প্রদানের শামিল। মুসলিম বসতিতে লোকেরা তাদের নতুন বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের একটা উপযুক্ত পন্থা হিসাবে মসজিদ বানাতো। সেখান থেকে আযানের আকারে ইসলামী আকিদা প্রচার করা হতো এবং জামায়াতে নামায আদায়ের মাধ্যমে ইসলামী সংঘবদ্ধতার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। রসূল সা. এর উৎসাহ দানের ফলেই তাঁর জীবদ্দশাতেই মসজিদ নির্মিত হতে থাকে। বাহরাইনে শুরুতেই একটা মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদে নববীর পর প্রথম জুমা এখানেই পড়া হয়। মসজিদগুলো জনগণের প্রতিষ্ঠান হতো এবং তা সরকারী অভিভাবকত্বে চলতো। মদিনা থেকে যাদেরকে কোন এলাকায় কর্মকর্তা বানিয়ে পাঠানো হতো, তারাই হতো সেখানকার মসজিদের ইমাম। যে সব গোত্র মদিনার প্রশাসনের আওতার বাইরে থাকতো, তারা তাদের মসজিদের ইমাম নিয়োগের ব্যাপারে রসূল সা. এর পরামর্শ নিত। অতপর রসূলের নির্দিষ্ট করে দেয়া মাপকাঠি অনুসারে ইমাম নিয়োগ করতো। যে সব জায়গায় রাসূল সা. কোন যুদ্ধে বা সফরে থাকাকালে অবস্থান করেছেন, বা নামায পড়েছেন বা কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, সে সব জায়গায় অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।

চুক্তি ও সমঝোতার শক্তি

জনগণের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের যে ব্যাপক কাজ উপরোক্ত প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয় তার সাথে আরো কিছু বড় বড় সহায়ক পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল মদিনার রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণ। এই প্রভাব সম্প্রসারণের কাজটা অনেকাংশে সমাধা করা হয় চুক্তি ও মৈত্রী সম্পর্কের মাধ্যমে। চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে রাসূল সা. কর্তৃক সরকারের প্রভাব বলয় সম্প্রসারণ এবং এ ব্যাপারে অস্বাভাবিক মনোযোগ দান থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যতদূর সম্ভব, যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন এবং চারদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছিলেন, যাতে করে এধরনের শান্ত পরিবেশে দাওয়াতের কাজ ভালোভাবে করা যায় এবং সামরিক উত্তেজনা মাঝখানে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। যেখানে ইসলাম, ইসলামী রাষ্ট্র ও শান্তি রক্ষার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে, সেখানে তো তিনি কোন রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেননি। কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে অব্যাহতি লাভ করা যদি সম্ভব হতো এবং শান্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে যদি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রক্ষণাবেক্ষণ, স্থিতিশীলতা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার বাধাহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, তাহলে তিনি সন্ধি ও সমঝোতার পথ কখনো পরিহার করেননি। খোদ ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তরবারীর শক্তি দিয়ে নয়, বরং সাংবিধানিক চুক্তির জোরে সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও তার প্রভাব সম্প্রসারণের জন্য তিনি মিত্রতার সম্পর্ককে এত ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যে, তার তুলনায় সামরিক ব্যবস্থার অনুপাত ছিল নিতান্তই কম।
চুক্তি ও মৈত্রী ভিত্তিক সম্পর্ক গড়া সহজ কাজ নয়। বিশেষত, ধর্মীয় মতভেদ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ যখন বিদ্যমান থাকে, পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলো মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে এবং ব্যাপারটা যদি সাধারণভাবে একেবারেই পূর্ব পরিচয়বিহীন গোত্র ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে এ কাজে অত্যধিক রাজনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। শ্রোতার অবস্থা, মানসিকতা ও শক্তি সম্পর্কে জানা, সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোন বিশেষ সময়ে বিরাজমান শক্তির ভারসাম্যকে উপলব্ধি করা, বিরোধী জনগোষ্ঠী সমূহের প্রভাব প্রতিপত্তি পর্যবেক্ষণ করা, এমন শর্ত চিহ্নিত করা, যা কোন প্রতি পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে আলাপ আলোচনাকে প্রভাবশালী করা ইত্যাকার বহু অত্যাকশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রকৃত পক্ষে রসূল সা. এই ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, নেতাসুলভ দক্ষতা ও কূটনৈতিক যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তার নজীর কোথাও পাওয়া যায়না। নজীর পাওয়া যায়না এ জন্য যে, রসূল সা. এত সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে ইসলামী আদর্শের, নিজের নৈতিক মূলনীতির এবং নিজের রাজনৈতিক মর্যাদার এক বিন্দু পরিমাণও ক্ষতি হতে দেননি। নচেত কূটনৈতিক অংগনে যেমন মারাত্মকভাবে নৈতিকতার অপমৃত্যু ঘটানো হয়, তার কারণে ‘ডিপ্লোমেসী” শব্দটার দুর্নাম রটে গেছে। স্বয়ং রাজনীতি আজ একটা অবাঞ্ছিত ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতির কোন চরিত্র নেই, এর কোন শেষ কথা নেই। রাজনীতি এমন এক ট্যাংক, যা যেদিকে চলে সমস্ত মানবিক মূল্যবোধ পদদলিত করতে করতে চলে। কিন্তু রসূল সা. ডিপ্লোমেসি ও রাজনীতির অর্থ একেবারেই পাল্টে দিয়েছেন। এ কাজ দুটোকে শুধু নোংরামী থেকেই মুক্ত ও পবিত্র করেননি, বরং তাতে সততা ও এবাদতের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করেছেন। ইসলামী নীতিমালা অনুসারে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো, তাতে অসাধারণ সাফল্য লাভ করা এবং এর মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত গোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে নিজের চারপাশে সমবেত করা আজ পুস্তকাদিতে পড়ার সময় সহজ কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু আরবের মরুভূমিতে বাস্তবে এসব কাজ যিনি করছিলেন, তিনিই জানতেন যে, তা কত কঠিন কাজ ছিল।
চুক্তিভিত্তিক মৈত্রীর এই প্রক্রিয়ায় শুধু যে মুসলিম প্রচারকদের যাতায়াত, জনগণের সাথে অবাধ মেলামেশা এবং চুক্তিবদ্ধ গোত্রের লোকজনের মদিনার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপকতর প্রসারের পথ সুগম হয়েছিল তা নয়, বরং তা এদিক দিয়েও ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছিল যে, এর কারণে ইসলামী নেতৃত্বের কাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। সীমিত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্ট পূন্যবান মানুষদের প্রতি জনসাধারণ যতই ভক্ত ও অনুরক্ত হোক না কেন এবং তাদের পবিত্রতায় যতই আস্থাশীল হোক না কেন, সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি কখনো তাদের হাতে অর্পণ করেনা। সামষ্টিক জীবনের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চিরকাল সেই সব লোকের হাতেই অর্পিত হয়েছে, যাদের সম্পর্কে জনগণের ধারণা রয়েছে যে, তারা সামষ্টিক দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা ও দক্ষতার অধিকারী। অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, জনগণ কোন দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে যে, তারা তো খুবই ভালো মানুষ, অনেক ভালো কাজ করে, জনসেবা করে ইত্যাদি। কিন্তু তাদের এই প্রশংসার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, দুনিয়ার কায়কারবারের জন্য ঐ ভালো মানুষেরা খুবই অযোগ্য। জনসাধারণের প্রশংসা শুনে এই শ্রেণীর লোকেরা প্রায়শ এরূপ ভ্রান্ত ধারণায় লিপ্ত হয় যে, আমাদের পক্ষে জনমত খুবই ভালো। তৎকালীন মুসলিম সংগঠন যদি এমন মানবীয় চরিত্র তৈরী করতো, যা ধর্মীয় দিক দিয়ে অত্যন্ত পুন্যবান ও পরহেজগার বটে, কিন্তু দুনিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীতে কোন প্রকার যোগ্যতা প্রদর্শন করতে অক্ষম, তা হলে জনগণের প্রতিক্রিয়া এই হতো যে, ওরা ভালো মানুষ, ভালো ভালো কথা বলে এবং মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের দ্বারা নতুন কোন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও সমাজের নেতৃত্ব দানে তারা সক্ষম হবে - এমন আশা কখনো জনগণ করতে পারতোনা। ইসলামী আন্দোলন এমন “আল্লাহ ওয়ালা” লোক তৈরী করার জন্য আসেনি, যারা ব্যক্তি হিসেবে শুধুই আল্লাহ ওয়ালা, ভালো মানুষ ও সরলমতি, কিন্তু সামষ্টিক জীবনে কর্তৃত্বশীল হবার মত রাজনৈতিক দক্ষতার অধিকারী নয়, যাদেরকে জনগণ বিকল্প ও উন্নততর নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন বলে গ্রহণ করেনা এবং যাদের দ্বারা কোন উজ্জ্বলতর ভবিষ্যত তৈরী হবে বলে আশা করতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের সৃষ্টি করা মুসলিম নেতা ও কর্মীরা যতবেশী খোদাভক্ত ও খোদাভীরু ছিল, ততই রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দক্ষতার অধিকারীও ছিল। এ ব্যাপারে তারা নিজ নিজ কাজের মধ্যে দিয়েই নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। সমকালীন জনতা এভাবে পর্যায়ক্রমে রসূল সা. ও তাঁর নেতৃত্বে কর্মরত মুসলিম শক্তির নেতৃত্বসুলভ যোগ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হতে থেকেছে, মদিনা তাদের আশার কেন্দ্রবিন্দু হতে থেকেছে এবং এর ফলে তাদের মনও ক্রমাগত ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হতে থেকেছে। মোটকথা, দ্বীনের দাওয়াত ও রাজনৈতিক প্রভাবের সম্প্রসারণ- এই দুটো কাজ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং এতদোভয়ের সম্মিলিত প্রাণশক্তিই ইসলামী আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল দুর্বার অগ্রযাত্রার দিকে। আসুন, এই মূল তত্ত্বকে মনে রেখে রসূল সা. এর প্রতিষ্ঠিত সুদূর প্রসারী চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্কগুলোর পর্যালোচনা করি। এ সম্পর্কগুলো তিনি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন, যদিও তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল।

১. আকাবার চুক্তি

চুক্তিভিত্তিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় আকাবার চুক্তির কথা। এ চুক্তি একাধারে ধর্মীয় অঙ্গীকার এবং রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞাও। আকাবার প্রথম বৈঠকে রসূল সা. এর হাতে হাত দিয়ে মদিনার একদল টগবগে যুবক রসূল সা. এর রিসালাতের প্রতি ঈমান আনয়নের স্বীকৃতি দেয়। দ্বিতীয় বৈঠকে রসূল সা. এর রাজনৈতিক নেতৃত্বের আনুগত্যের ওয়াদাও অন্তর্ভুক্ত হয়। মক্কা থেকে মিনা যাওয়ার পথে রাস্তার দু’দিকে পাহাড়ের সমান্তরাল উঁচু প্রাচীর অবস্থিত। মিনা থেকে এক ফার্লং আগে বাম দিকের পাহাড়ে অর্ধবৃত্তাকার একটা ছোট উপত্যকা দেখতে পাওয়া যায়। এটাই সেই সুরক্ষিত জায়গা, যেখানে রাতের নিস্তব্ধ অন্দ্বকারে আকাবার চুক্তি সংঘটিত হয়। মদিনায় ইহুদীদের উপস্থিতির কারণে আনসাররা ঐশী ধর্মের সাথে এবং নবুয়তের ধারাক্রমের সাথে মোটামুটি পরিচিত ছিল। প্রতিশ্রুত শেষ নবী সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো তাদের জানা ছিল। ইহুদীরা যে তাদেরকে বিভিন্ন সময় ভয় দেখাতো, “সেই প্রতিশ্রুত শেষ নবী এলে আমরা তাকে সাথে নিয়ে তোমাদের পরাভূত করবো”, এ কথাও তাদের মনে ছিল। এভাবে আনসারদের মধ্যে একদিকে যেমন ঐশী হেদায়াতের চাহিদা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, অপরদিকে অবচেতনভাবে এই আবেগও জন্মে দিয়েছিল যে, প্রতিশ্রুত সেই নবী এলে আমরাই সর্ব প্রথম তার প্রতি ঈমান আনবো। এই সাথে আওস এবং খাজরাজের মধ্যে পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যে ধারা চলে আসছিল, তাতে তারা ক্লান্ত হয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার একটা সুযোগের জন্য অপেক্ষমান ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল এইযে, সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিবেশের কারণে দুই গোত্র একে অপরের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলনা। তৃতীয় কোন শক্তি তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। এ সমস্ত কারণে মদিনার বুদ্ধিমান ও শান্তিপ্রিয় লোকেরা যখনই রসূল সা. এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হলো এবং রসূল সা. এর দাওয়াত শুনার সুযোগ পেল, অমনি তাদের মন ঐ দাওয়াত গ্রহণের জন্য উৎসুক ও উদগ্রীব হয়ে উঠল। নবুয়তের খবরাখবর তো তাদের কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষ আলোচনায় তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। রসূল সা. এর সুদর্শন চেহারা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব তাঁর দাওয়াতী বক্তব্যের সাথে যুক্ত হয়ে সেই মানসিক বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দিল। সেই মুহূর্তটা ছিল একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন কতিপয় আনসার ( প্রথম বায়াতের সময় ) কোরায়েশদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে রওনা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য সফল হলে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পূর্ন অন্য রকম হতো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাদের ইচ্ছা পাল্টে যায়। তারা কোরায়েশদের চিন্তা মন থেকে দূর করে দিয়ে মক্কার সেই উদীয়মান সূর্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যে সূর্য ইতিহাসের উদয়াচল থেকে নতুন আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করে দিগন্ত উদ্ভাসিত করছিল।
প্রথম বারের বায়য়াতে রসূল সা. কয়েকটি আকীদাগত ও নৈতিক বিয়য়ে অংগীকার গ্রহণ করেন। তারা আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করবেনা, চুরি করবেনা, ব্যভিচার করবেনা, সন্তানদের হত্যা করবেনা, কারো বিরুদ্ধে কোন অপবাদ আরোপ করবেনা এবং সৎকাজের ব্যাপারে রসূল সা. এর আদেশ অমান্য করবেনা- এই মর্মে তাদের অংগীকার গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় বায়য়াতে আনসারগণ যে ক’টা কথা সংযোজন করেন তা হলোঃ “আমরা সর্বাবস্থায় রসূল সা. এর আদেশ শুনবো ও আনুগত্য করবো, চাই পরিস্থিত অনুকূল হোক কিংবা বিপদ সংকুল হোক, কোন আদেশ আমাদের পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, অথবা কোন আদেশ আমাদের মতের বিরুদ্ধে যাক। আমরা আমাদের নেতার সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবোনা এবং কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবোনা।
এই সংক্ষিপ্ত অংগীকারের মাধ্যমে মুহাম্মদ সা. ও আনসারদের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং খোলাখুলিভাবে এই দল একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত হলো। রসূলের সা. নেতৃত্বকে তারা সর্বতোভাবে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হিসাবে গ্রহণ করলো। তারা এই মর্মেও প্রতিজ্ঞা করলো যে, নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া বা পদমর্যাদা ছিনিয়ে নেয়ার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবেনা। পরামর্শের মূলনীতি এরূপ স্থির হয়ে গেল যে, প্রত্যেক বিষয়ে যা সঠিক ও ন্যায়সংগত, তাই উপস্থাপন করা হবে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ব্যাপারে অংগীকার করা হলো যে, আমাদের উপর যে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হবে, তা সারা দুনিয়ার সমালোচনাকে উপেক্ষা করেও বাস্তবায়িত করবো। এটা এমন একটা অংগীকার ছিল যে, এরপর এই দলের কর্তৃত্বে যে কোন ভূ-খন্ড আসুক না কেন, তার ওপর অন্য কোন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব না থাকলে এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পুরোপুরি তার হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে সেই দল তাক্ষণাত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে।
এই বিষয়গুলোর সাথে সাথে আরো স্থির হয় যে, রসূল সা. মদিনায় হিজরত করার পর চুক্তিবদ্ধ আনসারগণ রসূল সা. ঠিক এমনিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যেভাবে তারা আপন স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। অন্যকথায় বলা যায়, মদিনার ইসলামী দলের সাথে রসূল সা. এর প্রতিরক্ষামূলক ঐক্যের চুক্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এদিক দিয়ে আকাবার চুক্তির রাজনৈতিক মূল্য আরো বেড়ে গিয়ে ‘বিপ্লবী’ হয়ে যায়।
এরপর রসূল সা. এর নির্দেশে মদিনার আনসারদের ইসলামী সংগঠনের পক্ষ থেকে বারোজন প্রতিনিধি বা নকীব নিযুক্ত করা হয়, যারা রসূল সা. এর কাছে দায়ী থাকবে। ইসলামী দাওয়াতের বিস্তার ও সম্প্রসারণ ছাড়াও রাজনৈতিক দায়িত্বও তাদের ওপর অর্পণ করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকরের বর্ণনা অনুযায়ী রসূল সা. এই নকীবগণকে বলেন, “তোমরা তোমাদের জনগণ সম্পর্কে ঠিক সেইভাবে দায়িত্বশীল থাকবে, যেমন হযরত ঈসার সামনে তার সঙ্গী হাওয়ারীগণ দায়িত্বশীল ছিল। আর আমিও আমার জনগোষ্ঠি অর্থাৎ মক্কাবাসী সম্পর্কে দায়িত্বশীল। ( সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৬-৫৭, আহদে নববীকে ময়দানহায়ে জং, ডক্টর হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ ৭-১০)
নকীবদের নিযুক্তির পর মদিনার যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরী হয়, তা শুধু ধর্মীয় ছিলনা, বরং তা হয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক এবং বিপ্লবীও। এ ধরনের অবকাঠামোর স্বতস্ফূর্ত ও স্বভাবসুলভ দাবী, তা যেন যত শীঘ্র সম্ভব, বরং প্রথম সুযোগেই রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। বাস্তবেও হলো তাই, রসূল সা. এর হিজরতের কয়েক মাস পরই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
এ থেকে বুঝা গেল, ইসলামী আন্দোলন প্রাথমিক দাওয়াতের যুগ পূর্ণ করে রাষ্ট্রীয় যুগে প্রবেশ করেছিল চুক্তিরই মাধ্যমে, সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়।

২. সাংবিধানিক চুক্তি

রসূল সা. এর নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম চুক্তি ছিল মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি পত্তনকারী চুক্তি। সম্ভবত সারা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন একটা রাষ্ট্রও কমবেশী শক্তি প্রয়োগ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়নি, একটা আদর্শিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তো আরো বেশী অসম্ভব। কেননা তার মূল আদর্শ গোটা পরিবেশে অসাধারণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে থাকে এবং একটা অজানা পরিবেশ ও রকমারি মানুষের সহযোগিতা নিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে প্রচন্ড সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে ওঠে। মদিনার এই সাংবিধানিক চুক্তি রসূল সা. এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও নেতা সুলভ দক্ষতার এমন উদাহরণ তুলে ধরে, যার তুলনা কোথাও নেই। এই চুক্তির পক্ষগুলোর মধ্যে মোহাজেরগণ, আনসারদের প্রধান দুটি গোত্র আওস ও খাজরাজের মুসলিম মোশরেক ও ইহুদী ব্যক্তিগণ এবং পরষ্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত ইহুদী গোত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত।
আসলে রসূল সা. নিজের মামা বাড়ির দেশ হিসাবে মদিনাকে শিশুকাল থেকেই চিনতেন। শিশুকালে সেখানে গিয়েছেন এবং অবস্থান করেছেন। তারপর ইসলামের আহ্বায়ক হিসেবে মক্কার জীবনেরই শেষ দু’তিন বছর মদিনার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এরপর সেখানকার অধিবাসীদের পারষ্পরিক সম্পর্ক ও অন্যান্য বিষয়ে সাম্প্রতিকতম তথ্যাদি সরাসরি জানার যেটুকু কমতি ছিল, তিনি হিজরত করে মদিনায় আসার পর সেই কমতিও দূর হয়ে গিয়েছিল। গোটা মদিনার জনসংখ্যা তখন আনুমানিক পাঁচ হাজার ছিল এবং তারও প্রায় অর্ধেক ছিল ইহুদী। এই অধিবাসীদের মধ্যে আনসার ও মোহাজের সমেত মুসলমানদের সংখ্যা পাঁচশোর বেশী ছিলনা। এই সক্রিয়, সদাজাগ্রত, সচেতন ও সুসংগঠিত সংখ্যালঘুকে সাথে নিয়েই রসূল সা. পাঁচহাজার অধিবাসীকে নিজ নেতৃত্বের আওতায় নিয়ে আসেন। আনসারদের দুটো প্রধান গোত্র ১২টি শাখাগোত্রে বিভক্ত ছিল এবং তাদের মধ্যে ছিল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সাধারণ অধিবাসীরাও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত ছিল। কেননা আরব ও ইহুদী উভয় জনগোষ্ঠীই দু’ভাগে বিভক্ত থাকতো এবং সব সময় কোন না কোন ব্যাপারে দু’পক্ষের কোন্দল লেগেই থাকতো। এভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কোন্দল-কলহে সব ক’টা জনগোষ্ঠীই অতিষ্ঠ ও শান্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। শান্তির এই সার্বজনীন পিপাসা মেটাতে একটা গঠনমূলক নেতৃত্বের চাহিদা তীব্র হয়ে উঠেছিল। নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্য অল্প কিছুদিন আগেই আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে মুকুট পরানোর আয়োজন চলছিল। কিন্তু সহসা রসূল সা. ও তাঁর দাওয়াতের কথা শুনে আনসারদের মনোযোগ সেদিকেই আকৃষ্ট হয়।
ইহুদীদের অবস্থাও এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের দুটো বড় গোষ্ঠী অভ্যন্তরীণভাবে দশটা উপগোত্রে বিভক্ত ও পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।
স্বজাতির বাসভূমি থেকে দূরে অবস্থিত এই ইহুদীরা নিজেদের অস্তিত্ব নিপাতের আশংকায় জর্জরিত ছিল। তারপর সহসা যখন রসূল সা. আনসারদেরকে নিজের সাথে যুক্ত করে নিলেন এবং তাদের সাথে ইহুদীদের সাবেক মৈত্রী সম্পর্ক ছিন্ন হতে লাগলো, তখন ইহুদীরা অনুভব করলো, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রসূল সা. আল্লাহর ওহীর আওতায় ইহুদীদের মনকে জয় করা ও তাদের উত্তম ভাবাবেগকে আকৃষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার ফলে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার জন্য পরিবেশ অনুকূল হয়ে যায়। মদিনার সর্বশ্রেণীর অধিবাসীকে জানা, তাদের স্বার্থ, সমস্যা ও মনস্তত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হওয়া এবং সবাইকে একই লক্ষ্যের দিকে চালিত করার মত বিরাট রাজনৈতিক কীর্তি এত অল্প সময়ে সমাধা করা রসূল সা. কে রাজনৈতিকভাবে এত উঁচু মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যে, তা ভাবতে গেলেও আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। মুসলিম দল এমনিতেই আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার দিক দিয়ে মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে একটা অত্যন্ত অটুট ও সুদৃঢ় সংগঠনের অধিকারী ছিল। তদুপরি আকাবার বায়য়াত তাকে একটা রাজনৈতিক বিপ্লবী দলে পরিণত করেছিল। তাছাড়া আদর্শবাদী দল হওয়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিকাশ ও বিবর্তনের যোগ্যতাও তার ছিল, তাই এ দল সহজেই মদিনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। আনসার গোত্রগুলোতে কোন বিকল্প আদর্শও ছিলনা। নেতৃত্বও ছিলনা। কেননা তাদের সরদারদের বেশীর ভাগ আগেই ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েগিয়েছিল। এ সব গোত্রের ভেতরে যে সব মোশরেক বা ইহুদী ব্যক্তি ছিল, তারা সংখ্যায় নেহাত কম না হলেও কোন বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিলনা। তারা ছিল নীরব এবং নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের অনুসারী। একটা দুটো আরব বা ইহুদী গোত্র মুসলমানদের সামনে তেমন গুরুত্বের অধিকারী ছিলনা। মদিনার অধিবাসীদের এই বিন্যাস রসূল সা. এর কর্ম পরিকল্পনার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তাই তিনি প্রাথমিক সমস্যাবলীর সমাধান করে কয়েক মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলেন। আলোচ্য চুক্তি ইউরোপীয় ওরিয়ন্টালিস্টদের পর্যালোচনা অনুসারে ৫৩টা ধারা সম্বলিত। ঐতিহাসিক রেকর্ডের আলোকে এই চুক্তি সম্পর্কে একটা বিষয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই চুক্তিটা হিজরী ১ সালে পুরোপুরিভাবে লিপিবদ্ধ হয়। অন্যদের মতে, এর একাংশ ১ সালে এবং অপরাংশ বদর যুদ্ধের পর লিপিবদ্ধ হয়। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে ১ থেকে ২৩ নং ধারা এবং ২৪ থেকে ৪৭ নং ধারা পর্যন্ত এর দুটো পৃথক অংশ। আমরা যদি এই দ্বিতীয় মতটাকে গ্রহণ করি, তাহলে এতেও রসূল সা. এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার নিদর্শন দেখতে পাই। রসূল সা. প্রথমে মোহাজেরগণ ও সমস্ত আনসার (অমুসলিমসহ) দের নিয়ে রাজনৈতিক অবকাঠামো গঠন করেন। এরপর ইহুদী গোত্রগুলো নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখে দূর্বল ও বিপন্ন অনুভব করে থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তারা একেবারেই ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় পতিত হয়েছিল। তারপর তারা যখন মুসলমানদেরকে বদরের ময়দান থেকে বিজয়ী হয়ে ফিরতে দেখলো, যা তারা আশাই করতে পারেনি, তখন তারা হয়তো ভেবেছে যে, সময় থাকতে এখনো আমাদের মদিনার অবকাঠামোতে উপযুক্ত স্থান গ্রহণ করা উচিত।
এই সাংবিধানিক চুক্তি সম্পর্কে ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকীর মন্তব্য হলো, ইতিহাসে কোথাও এর নজীর নেই। এটি অত্যন্ত উচ্চাংগের রাজনৈতিক দক্ষতার সাথে ও অত্যন্ত সতর্ক দালিলিক ভাষায় লিখিত। এতে রসূল সা. নিজের ইপ্সিত আদর্শিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোর পক্ষে সর্বশ্রেণীর ও সকল সম্প্রদায়ের লোকদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। এই দলীলের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য গুলো নিয়ে আলোচনা করা এখানে প্রাসংগিক হবে বলে মনে হয়, যাতে এর রাজনৈতিক মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
এই দলীল শুরু করা হয়েছে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” দিয়ে। এর শিরোনাম হলোঃ “এই লিখিত দলীল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে জারীকৃত।”
এভাবে এর সূচনাতেই ইসলামের মৌলিক রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। এই দলীলের ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক অবকাঠামো গঠিত তার কেন্দ্রীয় উপাদান মুসলমানদেরকেই রাখা হয়েছে। যেমন প্রারম্ভেই বলা হয়েছেঃ
“কোরাইশ এবং ইয়াসরেব মুমিন এবং মুসলমান এবং যারা তাদের অনুসরণ করে এবং যারা তাদের অনুগামী হয় আর যারা তাদের সংগে জেহাদে অংশ নেয় (তাদের সকলের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্যে)”
এতে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মক্কা থেকে আগত ও মদীনার মুমিনগণ। বাদবাকীরা তাদের অনুসারী হিসেবে নাগরিকত্ব লাভ করবে। ইহুদী গোত্রগুলোকে চুক্তির অংশীদার করে “মুমিনদের সংগে” শব্দ প্রয়োগ করে রাজনৈতিকভাবে একই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (ধারা ২৫ থেকে ৩৫ পর্যন্ত)।
এতে আরো বলা হয়েছে যে, ‘মুমিনরা পরষ্পরের ভাই’ (ধারা-১৫)। যুদ্ধ ও সন্ধিতে সকল মুসলমানকে সমান অংশীদার ঘোষণা করা হয়েছে (ধারা- ১৭)। মুসলমানদেরকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা কিসাস (হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ড প্রদান) বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং খুনীকে কখনো আশ্রয় না দেয়। তাই বলে কেউ যেন বাড়াবাড়ি না করে এবং যে বাড়াবাড়ি করে তার ওপর যেন প্রতিশোধ নেয়া হয় (ধারা- ১৯, ২১, ৩২)। কোন মুমিন কোন কাফেরের বদলায় কোন মুমিনের প্রাণ সংহার করতে পারবেনা। কোন মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফেরকে সাহায্যও করতে পারবেনা (ধারা- ১৪)। যে কোন নগন্য মুসলমানও যে কোন ব্যক্তিকে আশ্রয় দিতে পারে এবং তাকে আল্লাহর অর্পিত দায় হিসেবে সবাইকে বহন করতে হবে (ধারা- ১৫)। যখন কোন মতভেদ হয়, তখন আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সা. এর কাছ ফায়সালা নিতে হবে (ধারা- ২৩)। খোদাভীরু মুমিনদের কর্তব্য, তারা যেন প্রত্যেক পাপাচার, অপরাধ ও অত্যাচারের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হয় ( ধারা- ১৩)। প্রাথমিক অংশে সংবিধানের আদর্শিক প্রেরণাকে উজ্জীবিত করার জন্য বারবার বলা হয়েছে যে, অমুক অমুক (মুসলমান) গোত্রকে ফিদিয়া ইত্যাদির ব্যাপারে ‘ন্যায় নীতি’ ও ‘ইনসাফ’ অবলম্বন করতে হবে। আর তা করতে হবে “মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে এর যে অর্থ প্রচলিত আছে সেই অর্থে” (ধারা ৩ থেকে ১২)। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী পরিভাষা ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ এই সংবিধানের অন্তভূক্ত করা হয়েছে (ধারা-১৯)। অনুরুপভাবে ‘যুলুম’, ‘গুনাহ’ ও ‘সৎকাজ’ এই তিনটে পরিভাষাও এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছে (ধারা-৩৬ )। সংবিধানে এ কথাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে যে, খোদাভীরু ও সংযমী মুমিনরা সবচেয়ে সঠিক পথে আছে (ধারা-২০ )। ‘সাহায্য পাওয়া মজলুমের অধিকার, এই কথা দ্বারা একটা বিশুদ্ধ ইসলামী মূলনীতি তুলে ধরা হয়েছে, যা একটা আন্তমানবিক মূলনীতিও বটে। এই মূলনীতির পক্ষে সকল পক্ষের স্বীকৃতি আদায় করা হয়েছে এবং একথাও বলা হয়েছে যে, এই সংবিধানের বক্তব্যগুলোকে যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও আনুগত্যবোধ সহকারে পালন করবে, আল্লাহ তার সহায় থাকবেন (ধারা-৪২,৪৬ ও ৪৭ )।
এই দলীলে রাজনৈতিক বিষয়গুলো কত সুস্পষ্টভাবে নিস্পত্তি করা হয়েছে, তাও দেখুন। দলীলে সাক্ষরদাতাদের আবাসিক এলাকা অর্থাৎ মদিনা শহরের প্রায় একশো বর্গমাইল সম্বলিত মধ্যবর্তী এরলাকাকে (মদিনার ভৌগলিক পরিচিতি ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে।) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভূ-খন্ড (Territory) বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকে পবিত্র এলাকা হিসাবেও ঘোষণা করা হয়েছে (ধারা-৩৯)। আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারা আমাদের অনুসারী হবে, তারা যাবতীয় নাগরিক অধিকার সহকারে সাহায্য ও সমানাধিকার লাভ করবে। যে ধারাটায় এ কথা বলা হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা প্রতিফলিত হয়েছে। এ ধারায় একাধারে ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ দেয়া হয়েছে, আবার যে কোন রাজনৈতিক সংকটের প্রতিবিধানও করা হয়েছে (ধারা-১৬ )। এই চুক্তির সাক্ষরদাতাদের সকলকে একটা রাজনৈতিক একক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছেঃ *********** (ধারা-১)। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন এর ২৩নং ধারা, যাতে যে কোন মতভেদের নিস্পত্তির অধিকার দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূল মুহাম্মদ সা. কে আর কোন কলহ বিবাদ বা হত্যাকান্ড সংঘটিত হলে তাও আল্লাহ ও আল্লাহ রসূল মুহাম্মদ সা. এর নিকট উপস্থাপন করতে হবে (ধারা-৪২ )। কোন আঘাত বা হত্যার বদলা গ্রহণে বাধা দেয়া যাবে না (ধারা-৩৬)। অত্যাচারীর অত্যাচার ও হত্যাকারীর অপরাধের দায়দায়িত্ব শুধু অপরাধীর নিজের ওপর বা তার পরিবারের ওপর পড়বে ( আগে অপরাধীর গোত্র গোষ্ঠী সমেত দায়ী হতো) অন্য কারে ওপর নয় (ধারা-২৫,২৬)। রাজনৈতিক অবকাঠামোর প্রাথমিক একক ধরা হয়েছে প্রতিটি গোত্রকে এবং এটাকে মেনে নিয়েই তার ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা নীতির ব্যাপারে স্থির হয়ে যে, ইয়াসরিবের ওপর আক্রমণ হলে স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোর জন্য পারস্পরিক সাহায্য করা জরুরী হবে (ধারা-৪৪)। চুক্তির স্বাক্ষরকারী কোন পক্ষের সাথে যদি কেউ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে স্বাক্ষরকারীকে আন্তরিকতা সহকারে সাহায্য করা সাক্ষরকারীদের সকলের কর্তব্য (ধারা-৩৭ )। এই দলীল একটি ধারার মাধ্যমে প্রতিরক্ষার কর্তৃত্বও রসূল সা. এর হাতে অর্পণ করেছে। এতে বলা হয়েছে, রসূল সা. এর অনুমতি না নিয়ে কেউ কোন সামরিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হবেনা (ধারা-৩৬)। কোন পক্ষের নিজস্ব ধর্মীয় লড়াইতে শরীকদের কোন দায়দায়িত্ব থাকবেনা (ধারা-৪৫ )। শরীকদেরকে কোন সন্ধির জন্য ডাকা হলে সকলের সাথে তারাও সন্ধি করবে (ধারা-৪৫ )। কোরায়েশদের সাথে যে কোন মৈত্রীর সম্ভাবনা্ চুড়ান্তভাবে রোধ করার জন্য এ কথাও সবাইকে স্বীকার করানো হয়েছে যে, মদিনার কোন মোশরেক অমুসলিম নাগরিক) কোরায়েশদের জান ও মালের নেরাপত্তা দেবেনা এবং এ ব্যাপারে কোন মুমিনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেনা (ধারা ২০ )। কোরায়েশকে এবং কোরায়শের আশ্রয়দানকারীকে আশ্রয় দেয়া হবেনা (ধারা ৪৩ ) সামরকি ব্যয় নির্বাহ সম্পর্কে অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে রসূল সা. এই ধারা সংযোজন করেন যে, প্রত্যেক পক্ষ নিজ নিজ যুদ্ধের ব্যয় নিজই নির্বাহ করবে ( ৩৭-৪৪ )। কেননা তিনি জানতেন, ইহুদীরা নিজেদের অংশ দিতে কার্পণ্য করবে এবং সমষ্টিক তহবিল তাদের হাতে গেলে তারা তহবিল তছরুপ করবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে খুনের অর্থদন্ড ও যুদ্ধবন্দীর মুক্তিপণ প্রদানের দায়িত্ব আরবের প্রচলিত রীতি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির গোত্রের ওপর অর্পণ করা হয়। তদ্রুপ যে ঋণগ্রস্থ ব্যাক্তি ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তার ঋণের ভারও সমষ্টিক করে দেয়া হয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য বলা হয়, মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ধর্ম আর ইহুদীদের জন্য ইহুদীদের ধর্ম রইল (ধারা-২৫)। আসলে মুসলমান জাতি তো ধর্ম ও রাজনীতি উভয় দিক নিয়েই একটা মাত্র একক ছিল এবং তাদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত ছিল। কিন্তু খালেস রাজনৈতিক যোগযোগের ক্ষেত্রে সকল শরীক দলকে নিজ নিজ ধর্মের অনুসরণের স্বাধীনতা দেয়া হয়। (সীরাতে ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃ-১১৯-১২৩, আহদে নববী কা নেযামে হুকুমরানী, ডাঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ)৭৬-১১১।
এবার উল্লিখিত ধারাওয়ারি বক্তব্যগুলোকে দলীলের সংক্ষিপ্ত সার হিসাবে পর্যালোচনা করুন এবং প্রতিটি অংশ নিয়ে ভাবুন যে রসূল সা. কত নৈপুন্য ও বিচক্ষণতার সাথে নিজের আদর্শকে মদিনার বহুজাতিক ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের ভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত সামরিক ও বিচার বিভাগীয় সকল দিক দিয়েই নিজের নেতৃত্ব ও কর্তত্বকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কোরায়েশদের মোকাবিলা করা সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব স্থির করলেন এবং সবাইকে তা মেনে নিতে সম্মত করলেন। উপরন্তু বহু সংখ্যক সম্ভাব্য আশংকার পথ আগে ভাগেই রোধ করলেন। উল্লেখ্য যে, এই চুক্তি একটা সাংবিধানিক দলীলের মর্যাদা রাখতো। এতে সাক্ষরকারীদের কারো যখন ইচ্ছা এই চুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা চুক্তি ভংগ করার অধিকার ছিলনা। এরূপ করলে তার সেই নাগরিক অধিকারই বিলুপ্ত হয়ে যেত, যা এই ইসলামী রাষ্ট্রের সীমার ভেতরে এই চুক্তির ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে যে সব ইহুদী গোত্র পরবর্তীকালে এই চুক্তিকে সম্পূর্নরুপে পদদলিত করে, তাদের বিরুদ্ধে অবিকল সেই পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়, যা বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের প্রাপ্য।
প্রসংগত এখানে এই দলীলের আলোকে হিজরত ফরয হওয়ার তাৎপর্য বুঝে নেয়া দরকার। মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি যে মুসলিম জাতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই জাতি অধিকতর মজবুত হোক- এটাই ছিল হিজরত ফরয হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ কথা সত্য যে, আরবের গোত্রীয় ব্যবস্থায় বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ওখানে দু-একজন করে মুসলমান পড়ে থাকলে তাদের পরিণতি এমনও হতে পারতো যে, কিছু কিছু প্রতিরোধ ও সংঘাত করার পর অবশেষে একদিন জাহেলী সমাজ ব্যবস্থায় বিলীন হয়ে যাবে অথবা যুলুম নির্যাতননের কবলে মারা পড়বে। এ কারণেও প্রত্যেক মুসলমানকে কুড়িয়ে এনে সংঘবদ্ধ করা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এই সাথে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও সব জায়গা থেকে সকল বিচ্ছিন্ন মুসলমানের মদিনায় এসে সমবেত হওয়া জরুরী ছিল। পরে যখন এ দুটো প্রয়োজনের একটাও অবশিষ্ট রইলনা, তখন ঘোষণা করা হলো যে, “পূর্ন বিজয় অর্জিত হওয়ায় আর হিজরতের প্রয়োজন নেই।” অর্থাৎ সমগ্র আরব উপদীপ যখন ‘ইসলামের দেশ’ (দারুল ইসলাম) হয়ে গেল, মদিনার কর্তৃত্বের অধীন এসে গেল এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য কোন এলাকাতেই কোন অবরোধ বা বাধাবিঘ্ন অবশিষ্ট থাকল না, তখন মদিনায় হিজরত করার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হলো।
এই চুক্তির ভিত্তিতে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো এবং মুহাম্মাদ সা. এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রথমবারের মত মুসলমানরা পাঁচ হাজার লোক অধ্যুষিত একশো বর্গমাইল এলাকায় অবাধে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সুযোগ পেল। সেখানে ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতাও দাওয়াতের কাজে আপনা থেকেই সহায়ক ছিল। উপরন্তু ইসলামী সরকারের উপস্থিতি মুসলমানদের জন্য মদিনার আশপাশেও দাওয়াত বিস্তারের সহায়ক হলো।

৩. বিভিন্ন গ্রোত্রের সাথে চুক্তি

মাদিনাকে একটা রাজনৈতিক একক বানানো ও ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টার পাশাপাশি রসূল সা. আশপাশের গোত্রগুলোকেও সংঘবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। দু-তিনবার সাহাবায়ে কেরামের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করলেন। হিজরতের দ্বাদশ মাসে অর্থাৎ সফর মাসে রসূল সা. সশরীরে ওয়াদ্দান (মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে একটা জায়গা) গমন করেন। এখানে তিনি বনু হামযা বা বনু যামরা গোত্রের সাথে একটা চুক্তি সম্পাদন করেন। ঐ গোত্রের পক্ষ থেকে আমর বিন ফাহশী আয যামরী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। (ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃঃ ৪-২২৩; যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৪ ; রহমাতুল্লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৮)।
এর আগে মোহাজেরদের একটা দল পার্শ্ববর্তী স্থান ‘ঈস’ পর্যন্ত গিয়েছিল এবং তাতে মৈত্রী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। (রসূলে আকরাম সা.কী সিয়াসী যিন্দিগী, ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী, পৃঃ ৩৫৯) তারপর ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে (হিজরতের ত্রয়োদশ মাস) রসূল সা. পুনরায় বুয়াত (ইয়ামবু এলাকায় জুহায়নার অন্যতম পাহাড়) এলাকা সফর করেন। এখানকার জনগণের সাথেও সফল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। (রহমাতুল্লিল আলামীন,১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৯, যাদুল মায়াদ, পৃঃ ঐ) এরপর জমাদিউস সানীতে (ইয়ামবু এলাকার) যুল উশায়রা সফর করেন। সেখানে দীর্ঘদিন বনু মুদলাজ ও তাদের মিত্র বনু যামরার সাথে আলাপ আলোচনা চলে এবং তাদের সাথেও চুক্তি সম্পন্ন হয়। (ইবনে হিশাম,২য় খন্ড, পৃঃ ২৩৯; রহমাতুল্লিল আলামীন,১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৯)।
পূর্বতন ঐতিহাসিকদের কারো কারো অভিমত হলো, এই সব চুক্তির ফলে এ সব গোত্র ও এলাকা প্রকৃতপক্ষে মদিনার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হয়েছিল। এর প্রমাণ হলো, ঐ সব চুক্তির কিছু কিছু অংশ এবং পরিভাষার সাংবিধানিক (অর্থাৎ মদিনা) চুক্তির সাথে মিল রয়েছে। কিন্তু জিরতের একবারে প্রাথমিক যুগ সম্পর্কে এ অভিমত যদি মেনে নাও নেওয়া হয়, তথাপি এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পরবর্তীকালে জুহাইনা গোত্রের আগেই ইসলাম গ্রহণ করে। এক হাজার ব্যক্তির এক বিশাল প্রতিনিধি দল মদিনায় এসে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। তারা বিভিন্ন যুদ্ধেও অংশ নেয়। এই গোত্রের বিভিন্ন শাখার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের যোগাযোগের যে রেকর্ড রয়েছে, তা এরই প্রমাণ বহন করে। উদাহরণ স্বরূপ, বনুল জুরমযকে (জুহায়নার শাখা) রসূল সা. লিখিতভাবে শান্তি ও নিরাপত্তার সনদ প্রদান করেন। জুহায়নার অপর এক শাখা বনু শামাখ বা শাখকে তাদের পুরো এলাকা স্থায়ীভাবে জাইগীর হিসেবে বরাদ্দ করে দেন। অনুরুপভাবে আওসাজা বিন হারমাল জুহানীকেও তিনি তার বাসস্থান যুলমিররার নিকটে জাইগীর প্রদান করেন। আবু বসীর ও তার সাথীদের জন্য যখন হোদাইবিয়ার চুক্তির কারণে মদিনা যাওয়ার সুযোগ রইলনা, তখন তারা মক্কা থেকে হিজরত করে এই উপকুলীয় এলাকায় এসে ছিলেন। বিচিত্র নয় যে, আজুসার ন্যায় সরদারগণ তাদেরকে সাহায্য করতো এবং তারা স্থানীয় লোকদের সহায়তা নিয়েই কোরায়েশী কাফেলাগুলোর প্রতিরোধ করতো। (সিয়াসী জিন্দেগী, ডঃ হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী)
সম্পর্কের আরো অগ্রগতি হলো এবং পারস্পরিক মেলামেশার কারণে দাওয়াতের কাজ অব্যাহত থাকলো। এর ফল দাড়ালো এই যে, গোত্রগুলো সামগ্রিক ভাবে ইসরামী আন্দোলনের নিশানাবাহী হয়ে গেল। উকবা জুহানীর ইসলাম গ্রহণের বিবরণ আমাদের জানা। রসূল সা. এর জীবনের শেষভাগে বনী জুরমুয, বনীল হারকা এবং আমর ইবনে মা’বাদের সাথে একটা নতুন শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হরো। এতে অন্যান্য মুসলিম গোত্রের ন্যায় শর্ত আরোপিত হলো যে, নামায ও যাকাত ঠিক মত আদায় করতে হবে। গনীমতের এক পঞ্চমাংশ যথারীতি দিতে হবে, ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে এবং ঋণের সুদ পরিত্যাগ করতে হবে। মদিনায় জুহাইনা গোত্রের নামে একটি মসজিদও নির্মিত হয়ে গিয়েছিল নবুয়তের যুগেই। এ থেকে বুঝা যায়, বিপুল সংখ্যক জুহায়না গোত্রীয় মুসলমান হয়ে মদিনায় এসেছিল।
যে ক’টি গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক অনেক আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বনু গিফার তাদের অন্যতম। এ গোত্রটি তার অন্যতম সদস্য ও আদর্শ যুবক আবু যর গিফারী দ্বারা প্রভাবিত হয়। বদর যুদ্ধের কাছাকাছি সময় তারা রসূল সা. এর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তির মুল কথাটা ছিলঃ “তারা মুসলমান এবং তাদের দায় দায়িত্বও মুসলমানদের মতই।“ এই চুক্তির একাংশে যদিও এই গোত্রের অমুসলিম সদস্যদের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, কিন্তু আমার মতে, এই গোত্র প্রকৃত পক্ষে মদিনার সামাজিক অবকাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছিল। কাজেই তাদের এলাকাকে মদিনার আওতাধীন মনে না করার কোন কারণ নেই।
বনু যামরার এক শাখা বনুগিফার এবং আরেক শাখা বনু আবদ ইবনে আদী। এই শেষোক্ত গোত্র হারাম শরীফের সীমানার মধ্যেই বাস করতো। এই শাখা কোরায়েশদের সাথে বাধ্য হয়ে সমঝোতার সম্পর্ক বজায় রাখলেও মুসলিম সরকারের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। শুধুমাত্র একটি বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে তারা রসূল সা. এর সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করে। বাদ যাওয়া বিষয়টি ছিল কোরায়েশদের সাথে যুদ্ধ করা।
বনু আশজা’ গোত্রটা ছিল বনু গিতফান গোত্রের একটা শাখা। তারাও বাণিজ্যিক মহাসড়কের সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করতো। মহাসড়ক অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে যখন কোরায়েশদের বাণিজ্যই থেমে গেল, তখন তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলো। কেননা এ সব গোত্র বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর সেবা করেই জীবিকা উপাজন করতো। অর্থনৈতিক সংকটে বাধ্য হয়ে তাদের প্রতিনিধিদল মদিনায় আসে। অতরপর খন্দক যুদ্ধের আগেই তারা ইসলাম গ্রহণ করে চুক্তি সাক্ষর করে। তাদের পক্ষ থেকে চুক্তিতে সাক্ষর করেন নঈম বিন মাসউদ। নঈম বিন মাসউদ খন্দক যুদ্ধের সময়ই ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হন। এই জন্যই চুক্তির সময় সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি। তবুও চুক্তির ভিত্তি কেমন ছিল, সেটা একটা বাক্য থেকেই বুঝা যায়। বাক্যটা হলোঃ
*********** “সাহায্য করা ও হিত কামনা করার ব্যাপক ভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো।” এই গোত্রের একটা শাখা বনু আমের কাফেলাগুলোর যাত্রা বিরতিতে সহায়তা করার বষিয়ে একচেটিয়া অধিকারের লাইসেন্স রসূল সা. এর কাছ থেকে লাভ করে। বনু আমের গোত্রের জনৈক সরদারকেও খন্দক যুদ্ধের আগে জায়গীর দেয়া হয়।
এবার উল্লেখ করবো খন্দক যুদ্ধের পর যে সব মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয় তার কথা। খুযায়া গোত্রটা ইয়ামানের কাহতানের বংশধর ছিল এবং এর অনেক শাখা ছিল। মক্কার পাশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করতো। একমাত্র বনুল মুসতালিক ছাড়া এ গোত্রের অধিকাংশ শাখা মুসলমানদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতো। এর অন্যতম কারণ ছিল, জনাব আব্দুল মুত্তালিব তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। এই গোত্র হোদাইবিয়ার চুক্তির সুযোগ গ্রহন করে প্রকাশ্যে কোরায়েশকে পরিত্যাগ করে মদিনার ইসলামী সরকারের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে। এই মৈত্রীর সুবাদেই একদিকে এই গোত্র রসূল সা. কে আহযাব যুদ্ধ তথা খন্দক যুদ্ধের ব্যাপারে কোরায়েশদের প্রস্তুতির খবরাখবর জানায়। অপর দিকে রসূল সা. মক্কা বিজয়ের পূর্বে তাদেরকে একটা চিঠি দিয়ে আশ্বাস দেন যে, তাদের কোন অসুবিধা হবেনা। তিনি এই খবরও জানান যে, বনু কিলাব ও বনু হাওয়াযেন ইসলাম গ্রহন করেছে। কিন্তু সময় হওয়ার আগেই এই দুটি গোত্র বনু বকরের যুলুম নিপীড়নের শিকার হয় এবং এই যুলুম নিপীড়নই মক্কা বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
খুযায়া গোত্রেরই একটা শাখা ছিল বনু আসলাম। তাদের নামে রাসূল সা. এর প্রদত্ত যে নিরাপত্তা সনদ পাওয়া যায়, তা থেকে বুঝা যায়, তারা অপেক্ষাকৃত আগেই ইসলাম গ্রহন করেছিল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে গিয়েছিল। এদের একাংশ মদীনায় হিজরত করে এসে বসতি স্থাপন করে। এদের সরদার আলহাসীন বিন আওসকে রসূল সা. জায়গীরও দিয়েছিলেন। এটা মৈত্রী সম্পর্কের দৃঢ়তারও প্রমাণ, আবার এ দ্বারা এটা মদীনার সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংযুক্তিও প্রমাণিত হয়।
তবুকের উত্তরাঞ্চলে জুযাম, কুযায়া ও আযরা নামক গোত্রগুলো বসবাস করতো, তারা তাদের বিরোধী তৎপরতা দ্বারা ইসলামী সরকারের জন্য বেশ খানিকটা সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তারা মদীনার দূতের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। তারপর তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহিত হয়। ভূলক্রমে কিছু নিরাপরাধ লোকও এই ব্যবস্থার কবলে পড়ে। তারা মদীনায় এসে ফরিয়াদ জানায় এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। এভাবে সম্পর্কের পথও উন্মুক্ত হয়। রসূল সা. এর যে সব চিঠিপত্র পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একটা রিফায়া বিন যায়দ জুযামীর নামে লিখিত। এতে অত্যান্ত কঠোর চরমপত্র দেয়া হয়েছে। এই সরদারকে সম্বোধন করে লেখা চিঠিতে তার পুরো গোত্রকে হুশিয়ারী প্রদান করা হয়েছে, হয় তারা ইসলামের দাওয়াতকে গ্রহন করে আল্লাহ ও রসূলের দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাক, নচেত দাওয়াত প্রত্যাখান করলে দু’মাস নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে। পরিস্থিতি এভাবে গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত যে আকার ধারণ করে তা ছিল এই যে, রসূল সা. তাবুক থেকে ফেরার পর ৯ম হিজরীতে মালেক বিন আমের জুযামী মদীনায় এসে রসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং নিরাপত্তার সনদ লাভ করে। এই সনদে শুধুমাত্র মুসলিম গোত্রগুলোর উপযোগী শর্তাবলীর উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ তারা ইসলাম গ্রহন করেছিল। অনুরূপভাবে কুযায়া গোত্রের জনৈক সরদার বারীদা বিন আলখাসীর কোন এক অভিযান কালে রসূল সা. এর সাথে মদীনার বাইরে দেখা করে এবং রসূল সা. এর কাছে নিজ গোত্রের ইসলাম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরাপত্তা সনদ অর্জন করে।
৬ষ্ঠ হিজরীতে কালব গোত্রের কাছে রসূল সা. আব্দুর রহমান বিন আওফকে একটা দাওয়াতী অভিযানে পাঠান। এর ফল যেমন আশা করেছিলেন, তেমনই হয়েছিল। ঐ গোত্রের সরদার নিজের আনুগত্য প্রকাশ ও সম্পর্ক স্থিতিশীল করার মানসে নিজ কন্যাকে আব্দুর রহমান বিন আওফের সাথে বিয়ে দেন। একইভাবে রসূল সা. দুমাতুল জুনদুলের আশেপাশের মালব গোত্রের নও মুসলম সরদার হারেসা বিন বুতুনের নামেও একটা নিরাপত্তা সনদ জারী করেন। দুমাতুল জুন্দুলের শাসক উকাইদিরের সাথেও শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না ইসলাম গ্রহণ ছাড়াই জিজিয়া দিতে সম্মত হওয়ায় সরদারীতে বহাল থাকতে পেরেছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে সে বিদ্রোহী হয় এবং হযরত খালেদের হাতে নিহত হয়। পরে তার দূর্গ ও জমি উক্ত কালবি সরদার হারেসা বিন কুতুনের কর্তৃত্বে সমর্পণ করা হয়।
তায়েফবাসীর সার্বজনীন ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সারদ বিন আব্দুল্লাহ ইয়ামানী ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করে। রসূল সা. তাকে ঐ অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা পরিচালনার জন্য সেনাপতিত্ব প্রদান করেন। রসূল সা. এর অনুমতিক্রমে সে জারাসের দূর্গ অবরোধ করে। এই অবরোধের ফলে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং আবু সুফিয়ানকে তায়েফের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
ওমান নগরীতে বসবাসকারী গোত্র বনু ইজদের কাছে রসূল সা. এর দাওয়াতী চিঠি নিয়ে ৮ম হিজরীতে যান আমর ইবনুল আ’’স। ওবায়েদ এবং জাফর নামক দুই ব্যক্তি তাদের সরদার ছিল। বনু ইজদ ইসলাম গ্রহণ করে।
ব্যাপকভাবে প্রতিনিধি দল আগমনের বছর যে সব গোত্র স্বেচ্ছায় প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে অথবা কমের পক্ষে মদীনার সরকারের আনুগত্য অবলম্বন করে, সে সব গোত্রের সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।
এ ছাড়া সামরিক অভিযানের ফলে যেখানে কোন গোষ্ঠী আনুগত্য বা সন্ধি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সেখানে তাৎক্ষনাত সে সুযোগ দেয়া হয়েছে। মদীনার রাষ্ট্রের স্থায়ী নীতি এই যে, যুদ্ধরত কোন ব্যক্তি যখনই সন্ধির আকাংখা ব্যক্ত করবে, তখনই তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। একাধিক গোত্র যুদ্ধের ময়দানে নামার পর হয় রাজনৈতিক বশ্যতা ও অধীনতা মেনে নিয়েছে, নতুবা ইসলাম গ্রহণ করেছে। খয়বর ও সন্নিহিত এলাকার অধিবাসী ইহুদীদের ঘটনা এ প্রসংগে উল্লেখযোগ্য। তারা বিজিত হবার পর যখন ওখানেই থাকতে চাইল, তখন শর্ত স্থির করে থাকতে দেয়া হলো।
এই সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করলে স্বীকার না করে উপায় থাকেনা যে, সংঘর্ষ এড়িয়ে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলা মদীনা সরকারের কর্মকান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল। এ জন্য একটি বিভাগ ছিল। রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা এই বিভাগের জন্য বহু তৎপরতা চালান ও সফর করেন। এসব তৎপরতা ইসলামী রাষ্ট্রের শান্তপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গির জ্বলন্ত প্রমাণ। তা ছাড়া এ ব্যাপারে একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্রের দাবী ও চাহিদা জানা থাকা সত্ত্বেও রসূল সা. নীতি নির্ধারণে এত উদারতা দেখিয়েছেন যে, যে সকল গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের পক্ষ থেকে শুধু রাজনৈতিক মৈত্রীও মেনে নিয়েছেন। আর একাধিক ক্ষেত্রে অমুসলিম শাসক বা সরদারদেরকে নিজের পক্ষ থেকে নিযুক্ত করেছেন বা স্বপদে বহাল রেখেছেন। এর উদ্দেশ্যও এটাই ছিল যে, সংঘাতের সম্ভাবনা যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। পরে অবশ্য অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যে, অন্তত পক্ষে যে জমিটুকু ইসলামী আন্দোলনের মূল আবাসভূমির পর্যায়ে আছে, তার পারিপাশ্বিকতাকে পবিত্র ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য তাকে বিরোধী লোকজন থেকে মুক্ত করতে হবে। নচেত তাদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বনাশ ঘটিয়ে ছাড়বে।
যে মৈত্রী সম্পর্কগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো, তার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম যেখানেই পৌঁছেছে, সেখান থেকেই মদীনার রাষ্ট্র আপনা থেকেই রাজনৈতিক আনুগত্য লাভ করেছে। অনুরূপভাবে, যেখানেই রাজনৈতিক মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেও অনতিবিলম্বেই ইসলামের পতাকা উড্ডিীন হয়েছে। এর কারণ স্পষ্ট। গোত্রগুলো যখন মদীনার মুসলমানদের সাথে বেশী করে মেলমেশার সুযোগ পেয়েছে, তখন তারা ইসলামী জীবন বিধানের চমকপ্রদ বৈশিষ্ট স্বচোক্ষে দেখে অভিভুত হয়ে গেছে, আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাও তাদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ করার জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পেয়েছে। ধর্ম ও রাজনীতি এই ঐক্যের কারণেই দশ বারো লাখ বর্গমাইল এলাকাকে মাত্র কয়েক বছরে ইসলামের রঙে রঞ্জিত করা সম্ভব হয়েছে।

হোদাইবিয়ার সন্ধি

রসূল সা. পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হোদাইবিয়ার সন্ধি এমন একটা ঘটনা, যার ফলে ঘটনাপ্রবাহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ঘটনার ফলে ইসলামী আন্দোলন এক লাফে সার্বজনীনতার পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবার সুযোগ পায়। এই ঘটনা দ্বারা রসূল সা. এর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, নিকৃষ্টতম ও নিষ্টুরতম যুদ্ধরত শত্রুকে তিনি কত সহজে সমঝোতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং কয়েক বছরের জন্য তাদের হাত বেঁধে দিয়েছেন।
বিদ্রোহ এবং বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে নির্বাসিত ইহুদিরা যখন খয়বর, তায়মা ও ওয়াদিউল কুরাতে গিয়ে নিজেদের আখড়া গড়ে তুললো, তখন মদীনা এক সাথে দুই শত্রুর মুখে উপনীত হলো। কোরায়েশ ও ইহুদীদের ঐক্য বিপুল সংখ্যক আগ্রাসী সৈন্যকে মদীনার সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। খন্দক যুদ্ধ থেকে ভালোয় ভালোয় উত্তীর্ণ হবার পর রসূল সা. এর সামনে যে জটিল সমস্যা দেখা দেয়, তা হলোঃ এই দুই শত্রুর ঐক্যকে কিভাবে ভাঙ্গা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মক্কার দিকে আক্রমণ চালাতে গেলে খয়বরের ইহুদীরা ও বনু গিতফান মদীনায় হামলা চালিয়ে বসতে পারে। রসূল সা. অত্যান্ত নির্ভূলভাবে অনুমান করতে সক্ষম হন যে, এই দুই শত্রুর মধ্যে খয়বরের ইহুদী আখড়াই এক আঘাতে তছনছ করে দেয়া যায়। আর সেই সাথেই মক্কার কোরায়েশদেরকে সহজেই সন্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আসলেই কোরায়েশদের শক্তি ভেতর থেকে খোখ্লা হয়ে গিয়েছিল। বাইরে থেকে ওরা যতই হাম্বিতাম্বিই করুক, প্রতিরোধের ক্ষমতা তেমন একটা তাদের ছিলনা। তাছাড়া মক্কা ও তার আশেপাশে রসূল সা. এর কিছু সমর্থকও ছিল। তাঁর কিছু কিছু পদক্ষেপ এই সমর্থকদেরকে আরও চাঙ্গা করে তুলেছিল। রসূল সা. দুর্ভিক্ষের দিনগুলোতে মক্কায় খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ পাঠিয়ে সেখানকার দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এ কারণে আবু সুফিয়ান বলেছিল, এখন মুহাম্মদ সা. আমাদের লোকদেরকে এভাবে বিপথগামী করতে চাইছে। রসূল সা. আরও একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাহলো, মক্কার সবচেয়ে বড় নেতা আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবীবা রা. কে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়ে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুফল বয়ে এনেছিল। যাহোক, এখন যে ভাবেই হোক, আরও একটা পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল এবং রসূল সা. সে জন্য সর্বাধিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ওদিকে বড় রকমের সমস্যা এও ছিল যে, মুসলমানরা প্রায় ৬ বছর যাবত মক্কা ছেড়ে এসেছে। বাপারটা শুধু জন্মভূমির প্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং হযরত ইবরাহিম আ. এর দাওয়াতের কেন্দ্র কা’বা শরীফের সাথেও জড়িত। মুসলমানরা এই ইবরাহীমী দাওয়াতেরই নবায়ন করছে। কাজেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয় যে, চিরদিনের জন্য এই আদর্শিক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যাবে। কোরায়েশ এখনও পর্যন্ত মক্কায় যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেনা এবং দৃশ্যত এই দ্বন্দের নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। এ কারণে মুসলমানদের ভাবাবেগ ক্রমেই অস্থির ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইসলামী জামায়াতের অধিকার যে হারাম শরীফের ওপর রয়েছে, সে কথা প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
ইতিমধ্যে রসূল সা. স্বপ্নে হজ্জ করার ইংগিত পেলেন। এই ইংগিত পাওয়া মাত্রই তিনি তাঁর অতুলনীয় প্রজ্ঞা বলে সর্বোত্তম সময়ে সর্বোত্তম কর্মসূচি গ্রহন করলেন এবং সর্বোত্তম উপায়ে তার বাস্তবায়ন করলেন। তিনি একটি বিরাট দল সাথে নিয়ে হজ্জের পবিত্র মাসে ওমরা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে যারা যেতে চেয়েছিল, কেবল তাদেরকেই তিনি সাথে নিলেন। এ ধরনের ১৪শো মুসলমান তাঁর সঙ্গী হলো। তিনি নুমায়লা ইবনে আবদুল্লাহ লাইসীকে মদীনার ভারপ্রাপ্ত শাসকের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন এবং মুসলমানদের একটা বিরাট অংশকে মদিনার হেফাজতর উদ্দেশ্যে রেখে গেলেন। কুরবানীর সত্তরটি উট সাথে নিলেন। কোন সমরাস্ত্র নেয়া হলোনা। অত্যান্ত নীরবে যাত্রা শুরু হলো। যুল হুলায়ফাতে পৌছে কুরবানীর জন্তুগুলোকে চিহ্নিত করা হলো।
এই সফর একদিকে ধর্মীয় সফর ছিল। অপর দিকে এতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকও আপনা থেকেই আন্তর্ভুক্ত ছিল। ধর্ম ও রাজনীতির এই সমন্বয় ও সমাবেশ আমরা রসূল সা. এর গোটা জীবনেতিহাসেই বিদ্যমান দেখতে পাই। তাছাড়া হজ্জের সফরে পার্থিব কর্মকান্ড বা রাজনৈতিক তৎপরতাকে অন্তর্ভূক্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ। তাই কোরায়েশদের জন্য এই হজ্জ যাত্রা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল। হারাম শরীফের এই অভিযাত্রীদেরকে যদি ঠেকানো না হয় তাহলে তার অর্থ হবে, মুসলমানদের জন্য মক্কা চিরতরে উন্মুক্ত হয়ে গেল। তাছাড়া নগরবাসীর মনে রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের হারাম শরীফে আগমনের খুবই গভীর প্রভাব পড়ার সম্ভবনা ছিল। ইসলামী বিপ্লবের এই আহবায়কদের আগমনে ইসলামী আন্দোলন মক্কা বাসীদের মনে পুনরুজ্জীবিত হতো। জনগনও বলাবলি করতো যে, কোরায়েশদের সেই দোর্দান্ড প্রতাপ শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী সময় সন্ধি চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায় মক্কার প্রতিনিধি সোহায়েল বিন আমরের বক্তব্য থেকেও এটা পরিস্ফুট হয়ে গেছে। সে বলেছিল, আমরা যদি আপনাদেরকে কা’বা শরীফে ঢুকতে দেই, তাহলে সমগ্র আরববাসী বলবে, আমরা আপনাদের শক্তির ভয়ে পথ খুলে দিয়েছি।
রসূল সা. পথিমধ্যেই সব কথা জেনে ফেলেছিলেন। বশীর বিন সুফিয়ান নামক জনৈক খুজায়ী গোয়েন্দা উসফান নামক স্থানে এসে জানায় যে, কোরায়েশ প্রতিরোধের আয়োজন করছে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, মুহাম্মাদকে সা. কখনো মক্কায় প্রবেশ করতে দেবেনা। তাঁকে বাধা দেয়ার জন্য খালেদ একদল আশ্বরোহী বাহিনী নিয়ে কুরাইল গামীম পর্যন্ত এসেছে। একথা শুনে রসূল সা. বললেনঃ “এ হচ্ছে কোরায়েশদের দুর্ভাগ্য। ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা যদি মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াতো এবং আমাকে সমগ্র আরববাসীর সাথে বোঝাপড়া করতে একলা ছেড়ে দিত, তাহলে তাদের কি অসুবিধা ছিল? আরবরা যদি আমাকে খতম করে দিত, তাহলে তাদের আশাই পূরণ হতো। আর যদি আমি জয় লাভ করতাম, তাহলে তারা ইচ্ছা করলে সবাইকে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতো। নচেত তাদের শক্তি রয়েছে এবং তখন যুদ্ধ করতে পারতো। তারা যদি আমাকে এ সুযোগ না দেয়, তাহলে আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে যে মহাসত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যাবো, হয় এই মহাসত্য বিজয়ী হবে, নচেত আমার মাথা কাটা যাবে”। এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি সন্ধির সম্ভাবনার আভাষও দিলেন, চরম পত্রও দিলেন এবং কোরায়েশের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রতিও ইংগিত দিলেন।
অপর দিকে হজ্জযাত্রীদের কাফেলাকে ঠেকানো গেলেও কোরায়েশদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়। দুর্নাম রটে যায় যে, তারা একটা ধর্মীয় অধিকার প্রয়োগে বাধা দিয়েছে। আবার প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করলেও অভিযোগ আসে যে, নিষিদ্ধ মাসের বিধিনিষেধ ভংগ করেছে। রসূল সা. এর পক্ষ থেকে যে হারাম শরীফের পবিত্রতার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তারা যে শুধু ওমরার জন্য নিরস্ত্র অবস্থায় সফর করছেন, সে কথা সবাই জেনে গিয়েছিল। তাদের সাথে কোন অস্ত্র না থাকা এবং তাদের কুরবানীর জন্য চিহ্নিত জন্তুগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে তাদের সফরটা কি ধরনের? এই কথা বলা যায়, কোরায়েশরা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল। এই নাজুক মুহুর্তে তাদের সর্বোচ্চ নেতা আবু সুফিয়ান ছিল প্রবাসে। কোরায়েশ যত আস্ফালনই করুন, সন্ধি করা ছাড়া যে তাদের গত্যান্তর নেই, সে কথা অনুমান করার মত বিচক্ষণতা একমাত্র রসূলেরই সা. এর ছিল। নির্ভুল অনুমানের বিচক্ষণতাই পরিস্থিতি পাল্টে দিতে সক্ষম। এ ভাবেই একজন কর্মবীরের প্রজ্ঞা এবং অর্ন্তদৃষ্টির সঠিক মান জানা যায়।
কোরায়েশ পুরানো জিদ ও হঠকারিতার বসে দ্রুত গতিতে মিত্র গোত্রগুলোকে, বিশেষত আহাবীশদেরকে বালদাহ নামক স্থানে সমবেত করলো।
সংগে সংগে দূতিয়ালী তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। সর্বপ্রথম খুযায়া গোত্রের সরদার বুদাইল বিন ওয়ারকা (যিনি ইসলামের প্রতি সহনুভূতিশীল ছিলেন) কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাথী নিয়ে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন। রসূল সা. তাকে জানালেন, “আমরা শুধু ক’বা শরীফ যিয়ারত করতে এসেছি। যুদ্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কোরায়েশরা যুদ্ধের নেশায় মত্ত। অথচ যুদ্ধে তাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবেনা। কয়েক বছরের জন্য কোরায়েশ যদি আমাদের সাথে সন্ধি করে তবে ক্ষতি কী?’’ এভাবে রসূল সা. তাঁর আসল বক্তব্য শুরুতেই তুলে ধরলেন। বুদাইল গিয়ে কোরায়েশদের সাথে কথা বললেন। তিনি বললেন, তোমরা তাড়াহুড়ো করোনা। মুহাম্মাদ সা. যুদ্ধ করতে আসেননি, নিছক যিয়ারতের জন্য এসেছেন। বদমেজাজী যুবকরা তো কোন কথাই শুনতে রাযী ছিলনা। তবে বয়স্ক লোকেরা সব কথা শুনলো। তারপর তারা আহাবীশ নেতা উলাইস বিন আলকামাকে পাঠালো। সে যখন কুরবানীর জন্তুর পাল মাঠে বিচরণ করতে দেখলো, তখন তার ভাবান্তর ঘটলো। সে কোরায়েশদের কাছে গিয়ে খোলাখুলি বললো, এসব তীর্থযাত্রীকে বাধা দেয়া ঠিক নয়। আমরাও এ উদ্দেশ্যে আসিনি। আহাবীশ নেতাকে এই বলে শান্ত করা হলো যে, অন্তত আমাদের শর্তগুলো মানিয়ে নেয়ার সুযোগ দাও। এরপর কোরায়েশ উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে প্রতিনিধি করে পাঠালো। উরওয়া এসে বললো, ‘‘হে মুহাম্মদ! সা. আপনি যদি নিজেরই গোত্রের লোকদেরকে ধ্বংস করে দেন, তবে সেটা কোন প্রশংসনীয় কাজ হবে না। আপনি যে সব বখাটে লোকদের একত্রিত করে নিয়ে এসেছেন, তারা কয়েক দিন পর সটকান দিলে আপনি একাকী হয়ে পড়বেন। এ কথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রেগে গেলেন এবং কিছুটা কঠোর ভাষায় উরওয়াকে ধমক দিলেন। আরবদের প্রচলিত নিয়মে অন্তরঙ্গ ভংগীতে কথা বলতে বলতে যখনই উরওয়া রসূল সা. এর দাড়ির কাছে হাত নিয়ে যাচ্ছিল, অমনি প্রতিবার হযরত মুগীরা ইবনে শুবা তরবারীর ছুঁচালো অংশ দিয়ে তার হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। রসূল সা. উরওয়ার সামনেও নিজের বক্তব্য তুলে ধরলেন। উরওয়া এখানে যে পরিবেশ দেখে, তাতে গভীরভাবে অভিভূত হয়ে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে সে বলে, ‘‘নেতার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের যে দৃশ্য আমি দেখেছি, তা কোন রাজা বাদশার দরবারেও দেখিনি। মুহাম্মাদের সা. সাথীরা তার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত নয়। তার হাতের ইশারায় তারা মরতে প্রস্তুত। তাঁর সামনে কেউ উঁচু স্বরে কথা পর্যন্ত বলেনা।’’ উরওয়ার এই প্রতিক্রিয়া দ্বারা বুঝা যায়, দল কর্তৃক নেতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্য পোষণই ইসলামী আন্দোলনের শক্তির আসল উৎস। ভালোবাসা ও আনুগত্য পোষণই ইসলামী আন্দোলনের শক্তির আসল উৎস। ভালোবাসা ও আনুগত্য মিলিত হয়ে দুর্জয় শক্তির জন্ম দেয়। কোন দলের ভেতরে এ ধরণের পরিবেশ থাকলে তা বিরোধীদেরকে দূর্বল ও আতংকগ্রস্থ করে দেয়। এখানে নিছক কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মত পরিবেশ বিরাজ করে না যে, একে অপরের যুক্তি খণ্ডনের কাজে লেগে থাকে। সভাপতিও সদস্যদের প্রতি কোন আন্তরিক সম্পর্ক পোষণ করেনা, সদস্যরাও বোধ করেনা সভাপতির প্রতি কোন হৃদয়ের টান। কেবল গঠনতন্ত্র ও নিয়মবিধির বাহ্যিক আনুগত্য করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়। নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার, গীবত, নিন্দা, কানাঘুষা ও নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র চলে যে সব দলে, সেখানে কেমন নোংরা পরিবেশ বিরাজ করে, ভাবতেও অরুচি বোধ হয়। ইসলামী সংগঠনের ভেতরকার পরিবেশ হীতকামনা, আনুগত্য, নিষ্ঠা ও ভালোবাসার পরিবেশ। এখানে প্রত্যেক সদস্যের ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব থাকে। তবে নেতা সবার জন্য ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন। কেননা তা নাহলে পরস্পরের মধ্যে দয়া ও ভালোবাসার পরিবেশ যেমন সৃষ্টি হয়না, তেমনি ইসলামী সংগঠন ইস্পাত কঠিন প্রাচীরেও পরিণত হয় না। হোদায়বিয়ার ময়দানের ইসলামী সংগঠনের এ বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় উদ্ভাসিত ছিল। তাই এ দৃশ্য উরওয়ার মনকে অভিভূত করেছিল আর এই প্রতিক্রিয়াই সে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে ব্যক্ত করেছিল।
আলাপ আলোচনার এই ধারাকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে রসূল সা. খারাশ ইবনে উমাইয়াকে কোরায়েশের কাছে পাঠালেন। মক্কার অরাজক ও উচ্ছৃংখল পরিবেশ এমনিতেই বিদ্যমান ছিল। রসূল সা. এর যে উটে চড়ে খারাশ মক্কায় গিয়েছিল, উচ্ছৃংখল লোকেরা সেই উটটাকে মেরে ফেললো। সে নিজেও অতি কষ্টে জান বাঁচিয়ে ফিরে এল। এরপর হযরত উসমান রা. কে পাঠানো হলো। উচ্ছৃংখল লোকদের একটা দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেরিয়েছিল। তারা মুসলমানদের যত্রতত্র উস্কানি দিল এবং তীর ও পাথর ছুঁড়ে মারলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো। তবে রসূল সা. বৃহত্তর কল্যাণের তাগিদে তাদেরকে ছেড়ে দেন। মোট কথা, কোরায়েশদের যুদ্ধাংদেহী লোকেরা কোন না কোনভাবে যুদ্ধ বাধাতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু আল্লাহ ‘‘উভয় পক্ষের হাতকে সংযত রাখলেন।’’ ফলে শান্তির পরিবেশটা অক্ষুণ্ন থাকলো এবং শান্তি রক্ষার চেষ্টা জয়ী হলো। হযরত উসমানকে রা. কোরায়েশরা আটকে রাখলো এবং তাঁর ফিরে আসতে খুব দেরী হয়ে গেল। অশুভ ও অবাঞ্ছিত ঘটনাবলীর কারণে পরিবেশ এমন ছিল যে গুজব রটে গেল, হযরত ওসমান রা. কে শহীদ করে ফেলা হয়েছে। রসূল সা. সংগে সংগে মুসলমানদের সমবেত করলেন এবং প্রয়োজনে আমরণ লড়াই করার অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, ‘‘ঘটনা সত্য হলে আমরা এদের সাথে লড়াই না করে ঘরে ফিরবোনা।’’ হযরত উসমানের জীবন সেদিন অত্যধিক মূল্যবান হয়ে গিয়েছিল। কেননা রসূল সা. এর ভাষায় পরিস্থিতি ছিল এ রকম যে, ‘‘উসমান আল্লাহ ও তার রসূলের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গেছে।’’ তিনি নিজের এক হাতকে উসমানের হাত বলে আখ্যায়িত করে তার ওপর নিজের পক্ষ থেকে অন্য হাত রেখে বললেন, ‘‘অংগীকার কর।’’ তাঁর সাথীরা এমনিতেই আবেগে অধীর ছিলেন। তারা আন্তরিকতার সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে বায়য়াত ও অংগীকার করতে লাগলেন। এই আকস্মিক মুহূর্তটা ঈমান বৃদ্ধি ও চরিত্র গঠনের উপযুক্ত মুহূর্ত ছিল এবং এ সময় মুসলমানরা নিজেদেরকে এত উচ্চ মানে উন্নীত করে যে, রসূল সা. বলেন, ‘‘আজকের দিন তোমরা সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’’ এই মুহূর্তের ঈমানী জযবা ও আন্তরিকতার দরুন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেন। শুধু একজন মোনাফেক জিফ বিন কায়েস এই মুহূর্তের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। সত্যের সৈনিকদের জীবনে এরূপ অনেক মুহূর্ত আসে এবং নিষ্ঠাবান লোকদের আত্মা তা থেকে শক্তির সঞ্চয় করে। চৌদ্দশো মুসলমান আমরণ লড়াই এর এই প্রতিজ্ঞার পুরস্কার এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে গেলেন। কোরায়েশরা খবর পেয়ে তৎক্ষণাত হযরত ওসমানকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। কেননা আসলে তারাও লড়াই এড়িয়ে চলতে চাইছিল।
মক্কা থেকে মিকরায বিন হাফ্স এলো। রসূল সা. মানুষ চেনায় কত দক্ষ ছিলেন দেখুন। দূর থেকে দেখেই বলে দিলেন, ‘‘ঐ যে এক ধাপ্পাবাজ আসছে।’’ অর্থাৎ তিনি জানিয়ে দিলেন, ঐ লোক দ্বারা সুষ্ঠুভাবে কোন কিছুর মীমাংসা সম্ভব হবেনা।
অবশেষে কোরায়েশ সোহায়েল বিন আমরকে পাঠালো। তাকে দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, তারা সন্ধির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। শর্ত নিয়ে জরুরী কথাবার্তা হলো। অবশেষে চুক্তি লেখার জন্য হযরত আলীর রা. ডাক পড়লো।
এমন নাযুক মুহূর্তে চুক্তি লেখা হচ্ছিল যে, কথায় কথায় উত্তেজনা সৃষ্টির উপক্রম হতো। চুক্তির শুরুতে যখন রসূল সা. ‘‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’’ লেখার নির্দেশ দিলেন, তখন সোহায়েল বললো, ‘‘রহমান রহীম’’ আবার কী? আমাদের নিয়ম অনুসারে শুধু ‘‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’’ (হে আল্লাহ তোমার নামে) লেখা হোক। রসূল সা. এ দাবীও মেনে নিলেন। এরপর বললেন, লেখ, ‘‘নিম্নলিখিত চুক্তি আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ ও সুহায়েল বিন আমরের মধ্যে সম্পাদিত হলো।’’ সোহায়েল আপত্তি তুলে বললো, আমি যদি আপনাকে আল্লাহর রসূল মানতাম, তাহলে আপনার সাথে যুদ্ধ করতাম নাকি? আপনি শুধু নিজের নাম ও নিজের বাপের নাম লিখান। হযরত আলী ‘‘আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ’’ লিখে ফেলেছেন। এখন ‘‘আল্লাহর রসূল’’ শব্দটা কেটে দেয়া তার কাছে মারাত্মক বেআদবী হবে ভেবে কাটতে পারলেন না। রসূল সা. কাগজটা নিয়ে নিজের হাতে ঐ কথাটা কেটে দিলেন এবং তার পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখে দিলেন।
সোহায়েরের এই সব ধৃষ্টতা দেখে রসূল সা. এর সাথীরা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু রসূল সা. এর সম্মানার্থে সংযম অবলম্বন করছিলেন। এবার নিম্নোক্ত শর্তাবলী লেখা হতে লাগলোঃ
- উভয় পক্ষ থেকে দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতি ও সন্ধি মেনে চলবে।
- মুসলমানরা এ বছর ফিরে যাবে এবং আগামী বছর কা’বার যিয়ারত করতে আসবে। তখন কোষবদ্ধ তরবারী নিয়ে মাত্র তিনদিন হারাম শরীফে কাটাবে।
- আরবের গোত্রগুলো দুই পক্ষের যার সাথে ইচ্ছা মৈত্রী স্থাপন করতে পারবে।
- কোরায়েশদের বাণিজ্যিক কাফেলা মদিনার সীমানা অতিক্রম করার সময় পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে।
- কোরায়েশদের কেউ যদি বিনা অনুমতিতে মদিনা চলে যায়, তবে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর যদি কোন মুসলমান মক্কায় আসে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবেনা।
শেষোক্ত শর্তটা মুসলমানদের মধ্যে নিদারুণ অস্থিরতার সৃষ্টি করলো। পুরো মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি দিলে বুঝা যাবে, মুসলমানদের মধ্যে এ ধরণের অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রথমত এই পর্যায়ে এ ধরণের একটা আপোষ চুক্তিই অত্যন্ত বিরল ঘটনা ছিল। যে কোরায়েশ এতগুলো মানুষকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত করেছে, যারা মুসলমানদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, যারা আজও তাদেরকে হারাম শরীফে ঢুকতে দিচ্ছেনা এবং কুরবানীর জন্তুগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, এহেন যুলুমবাজ আগ্রাসী মোশরেকদের সাথে এমন আকস্মিকভাবে সন্ধি ও সমঝোতা স্থাপন করা মুসলমানদের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। তারা কাফেরদের ব্যাপারে এ যাবত একটা মূলনীতি শিখেছে যে, ‘‘আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতা ও হিংসার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে’’ এবং ‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে লড়াই চালিযে যাও, যতক্ষণ ফেৎনা ও অরাজকতা নির্মূল না হয়ে যায় এবং আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না হয়ে যায়।’’ তাদের কেবল এই সোজাসুজি ফর্মুলাটাই জানা ছিল যে, আল্লাহর কলেমা বা বাণীই ঊর্ধে থাকা উচিত, আর কাফেরদের কথা থাকা উচিত নীচে। হক্ব ও বাতিলের মধ্যে আপোষের অবকাশ থাকতে পারে, তা তাদের জানা ছিল না। আসলে আদর্শকে যদি নিছক তাত্ত্বিক ও দার্শনিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু তাকে যদি বাস্তবতার জগতে নিয়ে এসে তা নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে সময়, সুযোগ এবং স্বপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিগুলোর অবস্থার আলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। চোখ বুঁজে একই গতিতে সোজা পথে চলতেই থাকবেন এটা সম্ভব হয় না। কোথাও থামতে হয়, কোথাও দু’কদম ঘুরে যেতে হয় এবং কোথাও নতুন রাস্তা খোঁজার জন্য দু’কদম পিছিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন ধরণের শত্রুকে পর্যায়ক্রমে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে এক এক সময় তাদের এক একজনের সাথে সাময়িকভাবে আপোষ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইতিহাসের এই ব্যাপক বাস্তব তথ্য কেবল রসূল সা. এর সামনেই দৃশ্যমান ছিল, মুসলিম সংগঠনের দৃষ্টি এতদূর পৌঁছতে সক্ষম ছিল না। তদুপরি তাদের সামনে যখন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ এবং ‘রসূলুল্লাহ’ শব্দগুলো কেটে দেয়া হলো, তখন তাদের আবেগে ঝড়তুফান সৃষ্টি না হয়ে পারেনি। উপরন্তু যখন সেই অসম ও অবিচারমূলক শর্ত আরোপ করা হলো, তখন তাদের ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখা কঠিন হয়ে গেল। রসূল সা. এই চুক্তির দ্বারা যে বড় বড় সমস্যার সমাধানে পথ খুঁজছিলেন, সেগুলো কোরায়েশরাও জানতোনা। মুসলমানরাও তা বুঝতে পারেনি। বড় বড় আন্দোলনের তৎপরতাকালে কখনো কখনো এমন নাযুক মুহূর্তও আসে, যখন দল ও নেতার মাঝে ভবিষ্যতের সমস্যাবলীর উপলব্ধির দিকে দিয়ে মানসিক ব্যবধান বেড়ে যায়। নেতার দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে, আর দল অপেক্ষাকৃত নিকটের বিষয়গুলো নিয়েই চিন্তা করে। এ ধরণের ক্ষেত্রগুলোই সংকটজনক হয়ে থাকে এবং এইসব বিরল ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয়। এরূপ ক্ষেত্রে শুধু সেই নেতৃত্বই আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, যা জনমতের সর্বোচ্চ আস্থা সহযোগিতা লাভ করে এবং যার কোন বিকল্প না থাকে। এ ধরণের আন্তরিকতাপূর্ণ ও স্থিতিশীল নেতৃত্ব দলকে কেবল নিজের নৈতিক শক্তির বলেই গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। আর দল পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতি দেখেই নেতার গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।
সমস্যা দেখা দিল এই যে, ঠিক এই জঠিল পরিস্থিতিতেই কোরায়েশ প্রতিনিধি সোহায়েলের ছেলে আবু জুনদুল শেকল পরা অবস্থায় মক্কা থেকে এসে হাজির হলো। তাকে মারপিট ও নির্যাতন করা হয়েছিল। সে রসূল সা. ও সাহাবীদের সামনে নিজেকে পেশ করলো। সোহায়েল বিন আমর বললো, প্রস্তাবিত শর্ত অনুসারে আবু জুনদুলই প্রথম ব্যক্তি, যাকে আপনার ফেরত পাঠাতে হবে। রসূল সা. বললেন, এখনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। কাজেই আবু জুন্দুলের ব্যাপারটা এর আওতার বাইরে থাকতে দাও। সোহায়েল বললো, তাহলে কোন আপোষ হতে পারে না। এরপর রসূল সা. কোমল ভাষায় বুঝিয়ে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, ওকে আমার খাতিরে আমার সাথে মদিনায় যেতে দাও।’’ সোহায়েল মানলো না। বাধ্য হয়ে রসূল সা. বৃহত্তর স্বার্থে এই অন্যায় আব্দার মেনে নিলেন। এবার আবু জুন্দুল সমবেত মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললো, ‘‘মুসলমান ভাইয়েরা, তোমরা আমাকে মোশরেকদের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছ। অথচ ওরা আমাকে ঈমান থেকে ফেরানোর জন্য আমার ওপর নির্যাতন চালাবে।’’ আবু জুন্দুলের এ আবেদন ঐ পরিবেশে অত্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ছিল। কিন্তু রসূল সা. তখন অতুলনীয় ঠান্ডা মেজাজের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন। আবু জুন্দুলকে নম্র ভাষায় বুঝালেন, ‘‘আমরা চুক্তিতে একটা কথা স্বীকার করে নিয়েছি। এখন চুক্তি ভঙ্গ করতে পারি না। তোমার ও অন্যান্য মযলুমদের জন্য আল্লাহ তায়ালা একটা মুক্তির পথ বের করবেন। একটু ধৈর্য ধারণ কর।’’ মুসলমানদের অস্থিরতা ও উত্তেজনা ক্রমেই চরম আকার ধারণ করছিল। মুসলমানদের সবার মনে যেটুকু কোরায়েশ বিরোধী উত্তেজনা সঞ্চিত ছিল, তার সবটুকু বোধহয় একা হযরত ওমরের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে তাঁকে দিশেহারা করে তুলছিল। এটা হযরত ওমরের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ব্যাপার ছিলনা। সত্যের দরদ ও ইসলামী আত্মাভিমানই তাঁকে অস্থির করে তুলছিল। এই অস্থিরতা নিয়েই তিনি প্রথমে হযরত আবু বকরের সাথে এবং পরে রসূল সা. এর সাথে নিম্নরূপ আলোচনা করেনঃ
হযরত ওমর রা.- ‘‘হে রসূলুল্লাহ, আপনি কি আল্লাহর রসূল নন?’’
রসূলুল্লাহ সা.- ‘‘অবশ্যই। আমি আল্লাহর রসূল।’’
হযরত ওমর- তাহলে আমরা কি মুসলমান নই?
রসূল সা.- ‘‘কেন নও?’’
হযরত ওমর- তবে তারা কি মোশরেক নয়?
রসূলুল্লাহ সা.- কেন নয়?
হযরত ওমর- তাহলে আমরা ইসলামের ব্যাপারে নতি স্বীকার করে চুক্তি করবো কেন?
রসূল সা.- আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল। আমি তার কোন হুকুম অমান্য করিনি। আল্লাহও আমাকে তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত করবেন না।
হযরত ওমর এই পর্যায়ে চুপ হয়ে গেলেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর ভাবাবেগ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শান্ত হলোনা। চুক্তি লেখা হলো এবং তার ওপর হযরত ওমর সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দিয়ে আনুগত্যের এক অবিস্মরণীয় নজীর স্থাপন করলেন। শর্তগুলোর ব্যাপারে মন সন্তুষ্ট না হলেও রসূলুল্লাহ সা. যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না- এই মনোভাবটাই তিনি তুলে ধরলেন স্বাক্ষর দেয়ার মাধ্যমে।
হোদাইবিয়ার এই সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রসূল সা. সাহাবীদেরকে কুরবানী করতে ও মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে আদেশ দিলেন। কিন্তু অস্থিরতা, দুঃখ ও বেদনার কারণে কেউ নড়াচড়াই করলোনা। দ্বিতীয়বার নির্দেশ দিলেন। তাতেও কাজ হলোনা। তৃতীয়বার নির্দেশ দিলেন। তখনও সেই অবস্থাই বহাল রইল। এ থেকেই বুঝে নেয়া যায় যে, স্বয়ং রসূল সা. এর হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দলটির মধ্যে কি ধরণের মানসিক সংকট ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। মানবীয় তৎপরতার ক্ষেত্রে কত বিচিত্র রকমের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তাও এই ঘটনা থেকে জানা যায়। এ অবস্থা দেখে রসূল সা. মর্মাহত হয়ে নিজ তাবুতে চলে এলেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার কাছে অনুযোগ করলেন, লোকদের কী হলো যে, আমি যে হুকুম দিলাম, তা কার্যকর হলোনা। হযরত উম্মে সালমা রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ চুক্তির শর্তপালনে তারা মর্মাহত। আপনি বাইরে বেরিয়ে নিজের কুরবানী করুন ও চুল কামান।’ রসূল সা. উঠে বাইরে গিয়ে কুরবানী করলেন ও চুল কামালেন। এই বাস্তব পদক্ষেপ পুরো জামায়াতের লোকদের আনুগত্যের ওপর বহাল করে দিল। কিন্তু তবুও অবস্থা এমন ছিল যেন তারা পরস্পরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। যাহোক, এটা ছিল সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার এবং অচিরেই তা কেটে গেল।
এ থেকেই বুঝা যায়, যুদ্ধ এগিয়ে সমঝোতা ও আপোষের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য রসূল সা. কত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখী হতে কুণ্ঠিত হননি এবং নিজের প্রাণপ্রিয় দলের অত্যন্ত গভীর, পবিত্র ও আন্তরিক ভাবাবেগকে পর্যন্ত এই উদ্দেশ্যে কুরবানী করেছেন।
তিনি এই চুক্তি দ্বারা বেশ বড় বড় কয়েকটা সুবিধা লাভ করলেন। প্রথমতঃ মুসলমান, মোশরেক ও সাধারণ আরবদের মধ্যে অবাধ মেলাবেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেল। লোকদের আসা যাওয়া শুরু হলো। বহু বছর যাবত যে সব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাত ছিলনা, তারা একত্রে উঠাবসার সুযোগ পেল। মক্কায় রসূল সা. ও মুসলমানদের সম্পর্কে মোশরেকরা যেসব বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল, মুসলমানরা তা জানবার ও দূর করার সুযোগ পেতে লগলো। তারা মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলো। নিজেদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, নৈতিক, বৈষয়িক ও জ্ঞানগত উন্নতির বিষয় সাধারণ মানুষকে অবহিত করার সুযোগ পেতে লাগলো। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ঘরে ঘরে খোলামেলা আলোচনা হতে লাগলো। সন্ধি পরবর্তী এই শান্তির সময়টাতে ইসলাম এত দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করলো যে, বিগত আঠারো ঊনিশ বছরে সামগ্রিকভাবে যত লোক ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, হোদাইবিয়ার সন্ধির পরবর্তী মাত্র দু’বছরেই তার চেয়ে অনেক বেশী লোক স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমনকি খালেদ ইবনে ওলীদ ও আমর ইবনুল আসের ন্যায় কর্মবীর যুবকও এই সন্ধির পরই ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
দ্বিতীয় যে সুবিধাটা অর্জিত হয়েছিল তা হলো, যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মুক্তি পেয়ে মুসলমানদের মানসিক ও নৈতিক সংশোধন এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কাজ সমাধা করার জন্য একাগ্রতা অর্জিত হলো। অভ্যন্তরীণ অংগনে নিরাপত্তা লাভের পর বিদেশী সরকারগুলোকে দাওয়াত দেয়ারও সুযোগ পাওয়া গেল।
তৃতীয় সুবিধা পাওয়া গেল এই যে, মদিনার সরকার খয়বরের ইহুদী বিদ্রোহ নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোরায়েশদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। হোদাইবিয়ার সন্ধির অব্যবহিত পরই ইসলামী সরকার এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে সক্ষম হলো।
চতুর্থ সুবিধা অর্জিত হলো এই যে, আরবের সবগুলো গোত্র স্বাধীন হয়ে গেল। যে গোত্রের ইচ্ছা হবে, মদিনার সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে পারবে। এটা এমন একটা নব উন্মুক্ত দরজা ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে বহু নতুন লোক ইসলামের অভ্যন্তরে প্রবেশ অথবা মুসলমানদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে পারতো। অথচ কোরায়েশরা তাতে কোন বাধা দিতে সক্ষম ছিল না। বনু খুযায়া গোত্র এই সুযোগেই ইসলামী সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এটাও চতুর্থ সুবিধারই আওতাভুক্ত যে, মাত্র এক বছর পর অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে মুসলমানরা মক্কায় গিয়ে কা’বা যিয়ারত করে এবং কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তা ছিল পরিপূর্ণ নির্ভীকতার পরিবেশ।
সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, কোরায়েশের মত কট্টর দুশমনদের সন্ধিতে উদ্বুদ্ধ করাটাই ছিল রসূল সা. এর রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মো’জেযা। একটা শর্তে দৃশ্যত কিছুটা নতি স্বীকার করে রসূল সা. তাতে সাফল্য ও সুযোগ সুবিধা লাভ করেণ, যা কোরায়েশ ঐ সময় কল্পনাও করতে পারেনি। তাদের সমর্থক ইহুদীদের সামরিক ঘাঁটি খয়বরের যে অচিরেই পতন ঘটবে এবং কোরায়েশ একলা হয়ে যাবে, তা কি তারা ভাবতেও পেরেছিল? অপরদিকে ইসলাম এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করবে, এমনকি খোদ মক্কা শহরে তার এত প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে, কোরায়েশদের শক্তি বর্তমান মানের চেয়ে নীচে নেমে যাবে, সেটাই বা কে অনুমান করতে পেরেছিল? আসলে এই চুক্তি ইসলামকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মক্কা জয় করার বিপ্লবী ক্ষমতা যুগিয়েছিল।
মদিনায় ফেরার সময় পথিমধ্যে সূরা ফাতাহ নাযিল হয়, যাতে অতীতের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা ও ভবিষ্যতের সুযোগ সুবিধার আভাস দিয়ে মুসলমানদেরকে আল্লাহ সুসংবাদ দেন যে, তোমরা অচিরেই এমন একটা যুদ্ধে জয় লাভ করবে (খয়বরের যুদ্ধ), যাতে তোমাদের হাতে অনেক গণিমতের সম্পদ আসবে, তারপর তোমাদের অভাবনীয় সাফল্য ও বিজয় অর্জিত হবে, যা এতদিন ছিল সম্পূর্ণরূপে তোমাদের আয়ত্বের বাইরে। এতে আরো বলা হয়, যদিও মক্কার মোশরেকদেরকে তোমরা আজও পরাজিত করতে সক্ষম এবং তারা অবশ্যই পালিয়ে যেত, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন বহু নরনারী রয়েছে, যারা কোরায়েশদের অজান্তেই ইসলামকে মেনে নিয়েছে এবং তারা মনে মনে তোমাদের সমর্থক। এখন যুদ্ধ বেধে গেলে তারা বাধ্য হয়ে তোমাদের মোকবিলায় আসতো এবং তোমরা তাদেরকে চিনতে না পারার কারণে আঘাত করতে। সুতরাং এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগহ ছিল যে, তিনি দুই পক্ষকে সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করেছেন। বিশেষত কাফেরদের দিক থেকে যখন জাহেলী আত্মাভিমানের অত্যন্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রদর্শনী করা হয়েছে এবং ‘রহমানুর রহীম’ ও ‘রসূলুল্লাহ’ শব্দ ক’টিও তাদের সহ্য হয়নি, আর যখন আবু জুন্দুলের ব্যাপারে চরম হঠকারিতা প্রদর্শন করা হয়েছে। এক পক্ষ যখন এ ধরণের বাঁকা পথ অবলম্বন করে, তখন অন্য পক্ষও নম্র ও ঠান্ডা পন্থা অবলম্বন করতে পারেনা। কিন্তু আল্লাহপাক যে রসূল সা. ও মুসলমানদের ওপর স্থিরতা নাজিল করেছেন, তোমাদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছেন, এবং তোমাদেরকে খোদাভীতি ও সংযমের ওপর বহাল রেখেছেন, সেটা ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ। তোমরা মোশরেকদের মোকাবেলায় এ ধরণেরে আচরণেরই উপযুক্ত ছিলে। নচেত তোমরাও যদি উত্তেজিত হয়ে যেতে, তাহলে সংঘর্ষ বেধে যেত এবং সহজে যে সুযোগ ও সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল, তা হাতছাড়া হয়ে যেত।
সূরা ফাতাহ শুরু হয়েছেঃ ‘‘ইন্না ফাতাহ্না লাখা ফাতহাম মুবিনা’’ ‘‘আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি’’ এই কথাটা দিয়ে। হযরত ওমর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি যথার্থই সুস্পষ্ট বিজয়? রসূল সা. বললেন, ‘হা, এটা সুস্পষ্ট বিজয়।’ বস্তুত ঘটনা প্রবাহের আলোকে বুদ্ধি বিবেকের প্রশান্তি ও তৃপ্তি অনেক পরে এসেছিল। এ সময় হযরত ওমর ইসলামের পক্ষে আন্তরিক সমর্থন পোষণ করার কারণে যে ভাবাবেগের অভিব্যক্তি ঘটান, তার জন্য দীর্ঘ দিন নফল এবাদত করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকেন। এটাই আন্তরিকতার লক্ষণ। অপরদিকে হযরত আবু বকরের অবস্থা ছিল এই যে, সর্বব্যাপী অস্থিরতার সময়ও তিনি স্থির ও শান্ত থাকেন। মানবীয় সংগঠনের সদস্যদের মেজাজের এই বৈচিত্র্য সংগঠনকে একটা বিশেষ ধরণের বিন্যাস ও ভারসাম্য দান করে। এর এক প্রান্তে থাকে সিদ্দীকী গাম্ভীর্য আর অপর প্রান্তে থাকে ফারুকী তেজস্বিতা ও কঠোরতা।
এবার শুনুন, চুক্তিতে যে ধারাটি যুক্ত করে তারা জয়ের আনন্দে বোগল বাজানোর উপক্রম করেছিল, সেই ধারাটিই কিভাবে তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। প্রথমত এর কারণে মক্কায় গোপনে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। কেননা চুক্তি অনুসারে তাদের মদিনায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ ছিল। আর এ কারণে কোরায়েশদের শক্তি ভেতর থেকে খোক্শা হয়ে যেতে লাগলো। অপরদিকে একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গেল। ইসলাম গ্রহণকারী আবু বছীর কোন রকমে পালিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে পৌঁছলো। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোরায়েশরা দু’জন লোক পাঠালো। রসূল সা. চুক্তি পালনের নীতিতে অটল থেকে আবু বছীরকে ফেরত দিলেন। আবু বছীরকেও তিনি এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য একটা না একটা পথ বের করে দেবেন। অনন্যোপায় হয়ে আবু বছীর ফিরে গেল। পথিমধ্যে তিনি কোরায়েশদের পাঠানো দু’ব্যক্তির একজনকে বাগে পেয়ে তারই তরবারী দিয়ে হত্যা করে পুনরায় মদিনায় চলে এলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও নালিশ করতে মদিনায় এল। আবু বছীর রসূল সা. কে বুঝালেন যে, আপনিতো আপনার ওয়াদা পালন করেছেনই এবং আমাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করেছেন। কিন্তু আমি নিজেকে মোশরেকদের খপ্পরে ফেলে নিজের ঈমানকে বিপন্ন করতে চাইনি। কাজেই আমি নিজ দায়িত্বেই এ কাজ করেছি। আপনার ওপর এর কোন দায়দায়িত্ব বর্তেনা। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। রসূল সা. বললেন, ‘‘এই ব্যক্তি যদি কিছু লোক জোগাড় করতে পারে, তাহলে তো যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে।’’ আবু বছীর ভাবলো তাকে বুঝি আবার মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। তাই তিনি গোপনে মদিনা থেকে বেরিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী ঈস নাম স্থানে পৌঁছে গেলেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করলেন। পরে আবু জুন্দুলও ওখানে এসে গেল। এরপর মক্কা থেকে অন্যরাও বেরিয়ে সমুদ্রতীরে চলে যেতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে এখানে সত্তর জনের এক বাহিনী গড়ে উঠলো।’ মক্কাবাসীর সাথে তাদের আদর্শিক বিরোধও ছিল, আবার ব্যক্তিগতভাবে যুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে প্রতিশোধ স্পৃহাও ছিল। তারা মদিনা রাষ্ট্রের নাগিরকও ছিল না যে, তাদের ওপর চুক্তি পালনের দায়দায়িত্ব বর্তাবে। তাদের এটা ছিল একটা ‘‘স্বাধীন ইসলামী ফ্রন্ট।’’ তারা কোরায়েশদের বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর ওপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করলো। এতে কোরায়েশরা বেকায়দায় পড়ে গেল। অবশেষে তারা নিজেরাই দরখাস্ত করে চুক্তি থেকে তাদের প্রিয় শর্তটা বাদ দেয়ালো। এরপর রসূল সা. এই যুবকদেরকে মদিনায় ডেকে নিলেন। ওদিকে মক্কা থেকে নওমুসলিমদের হিজরতের পথও উন্মুক্ত হয়ে গেল।
একটা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হলো তখন, যখন মক্কার বিশিষ্ট সরদার উকবা ইবনে আবি মুয়াইতের মেয়ে উম্মে কুলসুম হিজরত করে মদিনায় এল। তাকে ফিরিয়ে নেয়া জন্য তার দু’ভাই আম্মারা ও ওলীদ উপস্থিত হলো। বিষয়টা রসূল সা. এর কাছে আনা হলো। তিনি আল্লাহর নির্দেশে উম্মে কুলসুমকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করলেন। একজন মুসলিম মহিলাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করা আর একজন মুসলিম পুরুষকে সোপর্দ করা এক কথা নয়। রসূলের সা. এই অস্বীকৃতির একটা নৈতিক মূল্য ছিল। তাই দু’ভাই যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল, তখন কোরায়েশ ব্যাপারটাকে মেনে নিল। যেহেতু রসূল সা. সূরা মুমতাহিনার নির্দেশের অধীন এই অস্বীকৃতির সাথে সাথে আরো কয়েকটা সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, যেমন প্রত্যেক মুসলানকে তার মক্কায় থেকে যাওয়া কাফের স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে এবং উভয় দিক থেকে মোহর দিতে হবে, তাই সামগ্রিকভাবে এ সিদ্ধান্তটা কোরায়েশের ভালো লেগেছিল।
এই হলো সেই ঐতিহাসিক হোদায়বিয়ার সন্ধি, যা ফলাফলের দিক থেকে একটা মহাবিজয় ছিল। এই চুক্তি করতে কোরায়েশকে উদ্বুদ্ধ করা এবং এ সংক্রান্ত সব কটা জটিল স্তর অতিক্রম করা রসূল সা. এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতাসুলভ প্রজ্ঞারই পরিচায়ক ছিল। এদ্বারা পরবর্তীকালের মুসলমানরাও কেয়ামত পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করতে থাকবে। এ সন্ধি রসূল সা. এর রাজনৈতিক দক্ষতার এক অতুলনীয় নমুনা এবং তাঁর এক অসাধারণ কীর্তি।

ওমরাতুল কাযা

হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিতে স্থিরীকৃত ছিল যে, এ বছর মুসলমানরা ফিরে যাবে এবং পরের বছর এসে যিয়ারত করে যাবে। সে অনুসারে ৭ম হিজরীতে রসূল সা. সাথীদের নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। এই সফরও প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে তা রাজনৈতিক। এর ফলে পরিবেশে গভীর প্রভাব বিস্তৃত হয় এবং এ কারণে ইসলামের প্রভাব শুধু মক্কাতেই বেড়ে যায়নি, বরং সমগ্র আরবেও মুসলমানদের অবাধে মক্কায় প্রবেশের কারণে চমকপ্রদ মানসিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
একশো ঘোড়া ও ষাট (মতান্তরে আশি) উট সহ দু’হাজার ব্যক্তি রওনা হলো। অস্ত্রশস্ত্র কোষবদ্ধ অবস্থায় নেয়া হলো। চুক্তি অনুযায়ী কোরায়েশরা তিন দিনের জন্য হারাম শরীফকে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হলো। কিছু কিছু কট্টর বিরোধী শহর ছেড়ে দূরবর্তী পাহাড়ে চলে গেল, যাতে এই দৃশ্য দেখতে না হয়। কিন্তু সাধারণ মক্কাবাসী, নারী ও শিশুরা কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে বিপ্লবী ইসলামী শক্তির ওমরা আদায়ের দৃশ্য দেখছিল।
প্রবেশের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রসূল সা. এর বাহক জন্তুর লাগাম ধরে একটা বিপ্লবী গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই গানের কথাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ
‘‘সেই সত্তার নাম নিয়ে প্রবেশ করছি, যার দ্বীন ছাড়া আর কোন দ্বীন নেই। সেই সত্তার নামে প্রবেশ করছি, মুহাম্মাদ সা. যার রসূল।’’
‘‘হে কাফেরের বাচ্চারা, তাঁর পথ থেকে সরে দাঁড়াও। দয়ালু আল্লাহ স্বীয় কিতাবে শিক্ষা দিয়েছেনঃ
যে লড়াই তাঁর পথে করা হয়, সেটাই সর্বোত্তম লড়াই। হে আমার রব, আমি তোমার কথার ওপর ঈমান রাখি।’’
গানের মধ্য দিয়েই ইসলামের দাওয়াত দেয়া হচ্ছিল। অথচ বহু বছর যাবত মক্কা এ দাওয়াতের শব্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। এতে জেহাদের কথাও শোনানো হচ্ছিল। আল্লাহর সেই অতিপ্রিয় নাম ‘রহমান’ও এতে উচ্চারিত হচ্ছিল, যা কোরায়েশ মোটেই সহ্য করতে পারতো না। এতে মুহাম্মদ সা. এর রিসালাতের কথাও ঘোষিত হচ্ছিল। ইসলাম বিরোধী শক্তিকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় বলা হচ্ছিল, রসূলের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এবং বাঁধা দেয়া বন্ধ কর। সেদিন মক্কায় বাধা দেয়ার মত কেউ ছিলনা। হোদায়বিয়ার সন্ধি হাত ও মুখ বন্ধ করে রেখেছিল।
রসূল সা. তাঁর দলের লোকদের হুকুম দিলেন বুক টান ও ঘাড় উঁচু করে চলতে এবং ছড়িয়ে ছড়িয়ে তাওয়াফ করতে, যাতে করে এই অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুধা ও জ্বরের কারণে মোহাজেররা দূর্বল হয়ে গেছে। কেননা আজ শত্রুকে ঘাবড়ে দেয়া প্রয়োজন। রসূল সা. বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি আজ কাফেরদের সামনে শক্তি প্রকাশ করবে তার ওপর আল্লাহর রহমত হোক।’’ এ উদ্দেশ্যেই তিনি রুকনে ইয়ামানী থেকে রুকনে আসওয়াদ ধারণ ও চুম্বন করা পর্যন্ত নম্র ও ধীর গতিতে (হেঁটে) চলতেন এবং এই অংশে থাকাকালে দর্শক জনতা তওয়াফকারীদের দেখতে পেতনা। তারপর পরবর্তী পথে হালকা দৌঁড় দিতেন এবং এই অংশেই তওয়াফকারীদের দেখা যেত। এ থেকে বুঝা গেল যে, বিরোধী মহলে ইসলামের মোজাহেদদের যে কোন ধরণের দুর্বলতা, চাই তা শারীরিকই হোক না কেন, তা যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য চেষ্টা করা উচিত, বরং জাঁকজমক ও শক্তি প্রদর্শন দ্বারা বিরোধীদেরকে ভীত সন্ত্রস্থ করা উচিত। এটা ইসলামী রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল যে, হারাম শরীফে এবং তওয়াফের সময়ও তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এই শক্তি প্রদর্শনীকে অহংকার ও দাম্ভিকতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা উচিত নয়। বরঞ্চ এটা সওয়াবের কাজ। এরূপ পরিস্থিতিতে যদি বিনয় প্রদর্শন করা হয়, তাহলে তার ফল ফলবে উল্টো। এই সব ছোট খাট সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রসূল সা. সমকালীন রাজনৈতিক চাহিদার ওপর কত গভীর দৃষ্টি রাখতেন এবং তা পূরণ করার ওপর কত বেশী গুরুত্ব দিতেন। এই রাজনীতি তাঁর ব্যক্তিগত পদমর্যাদার জন্য নয় বরং ইসলামী ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার খাতিরেই অপরিহার্য ছিল। এ জন্য এটা ছিল পুরোপুরি ধর্মীয় কাজ এবং এর প্রতিটি তৎপরতাই ছিল এবাদত।
ভেবে দেখুন, সত্য দ্বীনের আহ্বায়কদের এই সমাবেশকে যখন মক্কার জনতা দেখছিল, তখন নারী পুরুষ ও শিশুদের মনে কি ধরণের ধ্যান-ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা নিশ্চয়ই ভাবছিল, মক্কা থেকে যে ইসলামের সূচনা হয়েছিল, তারই ফসল আজ তাদের সামনে উপস্থিত। তারপর হেরাগুহা, সূর গুহা, আরকামের বাড়ী, শিয়বে আবু তালেব এবং আন্ নাদওয়ার মত ঐতিহাসিক স্থানগুলো তাদের সামনে মাথা তুলে বলছিল, দেখ, এই পূণ্যবানদের দল কত বড় মহান। তোমরা এদের তুলনায় কত নিকৃষ্ট ও হীন রয়ে গেছ।
মক্কার অলিগলির প্রতিটি ধুলিকণা বলছিল, এই হচ্ছে সেই ধৈর্যশীলদের দল, যাদেরকে তোমরা বিনা অপরাধে বছরের পর বছর কষ্ট দিয়েছ। দেখ আজ তাঁরা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে। কাবার চত্তর হযরত আবু যর গিফারীর প্রথম প্রকাশ্য কালেমা উচ্চারন ও গণপিটুনি,মক্কার মরু প্রান্তরে হযরত বিলালের আহাদ আহাদ উচ্চারণ ও লোহমোর্ষক নির্যাতন এবং দারুণ নাদওয়া রসূল সাঃ এর হত্যার ষড় যন্ত্রের স্মৃতি যেন একে একে তুলে ধরছিল আর বলছিল তোমাদের নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের শিকার সেই মহামানবের দাওয়াত আজ চারদিকে কত পরিবর্তন এনেছে তাকিয়ে দেখ! তের বছরের ইতিহাস চারদিক থেকে স্মৃতির ঢল নামাচ্ছিল। বদর ও ওহোদে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের আত্মা হয়তো রক্তিম আলখেল্লা পরে তাদের সামনে ভেসে উঠছিল এবং তাদেরকে মিনতি জানাচ্ছিল, ওহে মক্কাবাসী, তোমরাও জেগে ওঠো, তোমরাও নিজেদেরকে পরিবর্তন কর,সামনে এগিয়ে যাও এবং এই বহমান পুন্যপ্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে দাও।
একদিকে মুসলমানদের এবাদত দেখে জনতা অভিভূত হয়েছে। অপরদিকে তাদের নৈতিক মান দেখেও মুগ্ধ হয়েছে। কেননা,এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ তিন দিন ধরে মক্কা নগরীতে অবস্থান করেছে। অথচ চরম শত্রুতা থাকা স্বত্তেও কোন মক্কাবাসীর জানমালের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়নি। মোশরেকরা যেভাবে তাদের ঘরবাড়ী তালা বদ্ধ করে বাইরে চলে গিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই তা অক্ষত ও নিরাপদ থেকেছে।
ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে যারা ঈমান লুকিয়ে মক্কায় অবস্থান করছিল, এ দৃশ্য দেখে নিশ্চয় তাদের চোখ জুড়িয়ে গেছে তাদের ভাবাবেগে নতুন শক্তির দোলা লেগেছে। তাদের মধ্যে নতুন আশা উজ্জীবিত হয়েছে। আর বিরোধীরা নিজেদেরকে চরম কোণঠাসা অনুভব করেছে। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ।
তিন দিন ধরে মক্কা নগরীতে পুণ্যবানদের এই সমাবেশ রইল। চতুর্থ দিন সোহায়েল বিন আমর ও খুয়াইতিব বিন উযযা রসূল সাঃ এর কাছে এসে বললঃ ‘তিন দিন তো হয়ে গেছে। এখন আমার ভূখন্ড ছেড়ে চলে যান’। রসূল সাঃ তখন কতিপয় আনসারদের সাথে কথা বার্তা বলছিলেন। সা’দ বিন উবাদা সোহায়েল এর কথা বলার ভঙ্গিটা সহ্য করতে পারেননি। তিনি বললেনঃ ‘ শালা, এই ভূখন্ড তোর ও নয়, তোর বাপেরও নয়। আমরা কখনো যাবনা’। রসূল সাঃ উত্তপ্ত পরিবেশকে স্বাভাবিক করার জন্য কিছুটা রসালো বাচনভংগী অবলম্বন করলেন। তিনি এই সময় উম্মুল মুমেনিন হযরত মায়মুনাকে বিয়ে করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, ‘ দেখ আমি এখানে একটা বিয়ে করলাম। এ উপলক্ষে একটা ভোজের আয়োজন করলে মন্দ কি? আমরাও খাবো, তোমরাও শরীক হবে’। কিন্তু এতে তাদের মেজাজের রুক্ষতার কোন পরিবর্তন এলনা। তারা বললঃ ‘ আমাদের ভোজটোজের দরকার নাই। তোমরা বিদায় হও’। অগ্যতা তারা আর কি বলবেন। দেখলেন, গোটা পরিবেশটাই নষ্ট হচ্ছে। তাদের একগুঁয়েমির কারণে রসূল সাঃ তাঁর দলকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। রওনা হওয়ার সময় হঠাৎ হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের শিশু মেয়ে “ইয়া আমিন, ইয়া আমিন” (চাচা,চাচা) বলে দৌড়ে এসে রসূল সাঃ কে জড়িয়ে ধরল। সে কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য। রসূল সাঃ ঐ শিশুকে সাথে নিলেন এবং তার খালার কাছে অর্পণ করলেন। এই খালা ছিল যায়েদ বিন হারেসার স্ত্রী।
স্মরণ করা যেতে পারে, হোদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন কালে রসূল সাঃ কে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, “আপনি তো বলেছিলেন আমরা হারাম শরীফে যাব এবং তাওয়াফ করবো। সেটা তো হলনা”। রসুলা সাঃ জবাবে বলেছিলেন, আমি কখন বলেছিলাম যে এই বছরই তাওয়াফ করবো? বস্তুত হদায়বিয়ার সন্ধির বছর অর্থাৎ ষষ্ঠ হিজরীতে হারাম শরীফে যাওয়া ও তাওয়াফ করা সম্ভব হলেও, এ বছরের মতন জাঁকজমক সাথে হতোনা,হতো রক্ত পাতের মধ্যে দিয়ে। স্বাভাবিক পরিবেশে জাঁকজমকের সাথে ওমরা আদায় করা অত্যন্ত বরকতপূর্ণ কাজ।
পরে এ ঘটনাটা নিয়ে যখন আরবের অন্যান্য গোত্রের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, তখন জনমত যে আগের থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তা সন্দেহাতীত ভাবে বলা চলে। লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, যে মক্কা থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা এবার বুকটান ও ঘাড় উঁচু করে ঢুকেছে। যে কোরায়েশরা মুসলমানদের ধরা পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, সেই কোরায়েশ তাদের সাথে সন্ধি করে তাদের অক্ষমতা প্রমাণ করে দিয়েছে। অতএব জনগণ অবশ্যই এ ধারণায় উপনীত হয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ মদীনার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। এতে জনমতের কাছে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কথায় বলা যায়, ওমারাতুল কাযাও ইসলামের বিকাশ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।

জনমতের ওপর জেহাদের প্রভাব

ইতিপূর্বে আমরা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করেছি যে, ইসলামী আন্দোলন ও জাহেলিয়াতের মধ্যে আসল বোঝাপড়া যুদ্ধের ময়দানে নয় বরং জনমতের ব্যাপকতর ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আঠারো বিশ বছর ধরে সেই বোঝাপড়া চলেছে এবং এই ব্যাপকতর ময়দানেই চূড়ান্ত ফয়সালাও হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে, এই চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়ার ব্যাপারে সশস্ত্র জেহাদের কোন অবদানই ছিলনা।
সংস্কার সংশোধন ও পূনর্গঠনে শক্তিশালী দাওয়াতী বক্তব্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ন প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু সামষ্টিক জীবনে আজ পর্যন্ত এমন কোন বিপ্লব সংগঠিত হয়নি, যার উদ্যোক্তারা নিজেদেরকে বাস্তব ময়দানেও বলিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ ও বিজয়ী প্রমাণ করতে এবং পথের বাধা দূর এবং অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রতিরোধ খতম করার জন্য প্রয়োজনীয় মূহুর্তে সাফল্যের সাথে শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়না। ধর্ম তো মনব জীবনের একটা ক্ষুদ্র জায়গার সাথে সম্পৃক্ত। স্রেফ এই ধর্ম নিয়েই যদি চলতে চান, তাহলে ওয়াজ, নসিহত ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা চেয়ে বেশী কোন তৎপরতার প্রয়োজন হয়না। মাথার উপরে যে ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাই থাক না কেন, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেভাবেই চলুক না কেন, মানুষের মনে কিছু ভাল আকিদা বিশ্বাস ঢুকানোর অবকাশ ও থাকতে পারে। তাদেরকে কিছু জপতপ,মন্ত্র তন্ত্র,ওযিফা,দোয়া ইত্যাদি শিখানো যেতে পারে এবং বিনয়, নম্রতা, দয়া, সহানুভূতি ইত্যাকার সদগুণ দিয়েও কিছুটা সজ্জিত করা যেতে পারে। একটা বাতিলপন্থী ও শোষণ নিপীড়নমূলক সমাজ ও রষ্ট্রিও ব্যবস্থার আওতাধীন তৎপরতা চালাতে গিয়ে এবং ঐ ব্যবস্থার তৈরি করা চরম মানবতা বিরোধী পথে জীবিকা উপার্জন ও স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বিবেকে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষতকে সুফিবাদী পদ্ধতির ব্যক্তি কেন্দ্রিক সংস্কার ও সংশোধন প্রক্রিয়া ও তার তৈরি পীরি মুরিদীর প্রতিষ্ঠান গুলো নানা রকমের প্রলেপ দেয়। নিকৃষ্টতম সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষুদ্র গৃহ নির্মানকারী ধর্মগুলো আসলে মানুষের পলায়নপর মনোবৃত্তিরই সৃষ্টি। সামষ্টিক জীবনে বড় বড় অপরাধ সংগঠিত করা এবং লোমহর্ষক নির্যাতন চালানোর পর সে ব্যক্তিগত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার জোরে নিজের খোদাকে ও বিক্ষুব্ধ বিবেককে সন্তুষ্ট করে। কিন্তু যে ধর্ম মানব রচিত বিধানের সাথে আল্লাহ্‌ জিকির ও ধ্যানের লেজুড় লাগিয়ে সন্তুষ্ট হয়না বরং গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করতে চায়, তার কাজ নিছক আবেদন,নিবেদন কেন্দ্রিক ওয়াজ নসিহত, নিভৃত কোণে বসে আধ্যাত্মিক সাধনা ও জনসেবার সীমিত তৎপরতায় সমাধা হয়না, বরং তার জন্য বাতিলের খাঁচা ভাঙ্গা, জুলুমবাজির প্রতিরোধ করা, ও শান্তি ও ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা সম্বলিত নতুন সভ্যতার ভিত্তি পত্তন করা জরুরী হয়ে থাকে। সামষ্টিক জীবনে পরিবর্তন আনা বিনা বাধায় অসম্ভব। আর বাঁধা দূর করার জন্য কেবল ওয়াজ নসিহত যথেষ্ঠ হয়না। যাদের প্রতিষ্ঠিত কায়েমি স্বার্থকে উৎখাত করা হয় এবং যাদের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়, তারা ধ্বংসাত্মক কাজে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কোন আন্দোলন দ্বারা তাদেরকে শক্তি প্রয়োগ করে পথ থেকে না হটানো পর্যন্ত সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন কখনো সফল হতে পারেনা।
ইসলাম যখন আবির্ভুত হল এবং আরবের জাহেলী সমাজ ব্যবস্থা যে মৌলিক জীবনাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছিল, তার ভিত্তিমূলে আঘাত হানল, তখন শুরুতেই জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার ধারক বাহকরা বুঝতে পারলো যে, এতো একটা সর্বাত্মক আঘাত। সমগ্র ভবনটাকে ভেঙ্গে নতুন ভবন গড়ার জন্য এ আঘাত হানা হয়েছে। এ কারণেই ইসলামী আন্দোলনের সর্বাত্মক বিরোধীতা করা হয়েছে এবং এর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। মৌলিক বিপ্লব এবং সর্বাত্মক পরিবর্তনের এরূপ দাওয়াত ও আন্দোলনের যখনই অভ্যুদয় ঘটে, তখন সমাজ সাধারণত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটা অংশ চলমান সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত চলে এবং অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যৎ কে দেখতে পায়। এরা হয়ে থাকে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ও সবচেয়ে কর্মচঞ্চল লোক। এদের সংখ্যা সব থেকে কম হয়ে থাকে এবং এরা ক্রমান্বয়ে বিপ্লবী দাওয়াতকে গ্রহণ করে। তাদের বিপরীতে থাকে প্রাচীন ব্যবস্থার নেতৃত্ব দানকারী ও বড় বড় স্বার্থের প্রতিভূ শ্রেনী। এই শ্রেণীটি কাল বিলম্ব না করে সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা তাদের প্রভাবাধীন শ্রেণী গুলোর মধ্যে থেকে বিপুল সংখ্যক সমর্থক বের করে নেয়। এই দুই শ্রেনীর মধ্যে প্রথমটা হয় বিকাশমান সংখ্যালঘু। আর শেষেরটা সংকোচনশীল বিভাজনরত সংখ্যাগুরু। উভয় শ্রেণীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত চলে। সক্রিয় শ্রেণী দু’টো চিন্তাগত ও রাজনৈতিক আখড়ায় এসে মল্লযুদ্ধ শুরু করে। আর সাধারণ জনতা বাইরে নিরব দর্শক হয়ে দেখতে থাকে কখন কার জয় পরাজয় হয় এবং খেলার শেষ ফল কি দাঁড়ায়? এই তৃতীয় শ্রেণীর যত মেধাবী ও সক্রিয় লোক থাকে, তারাও ধীরে ধীরে যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ শেষ ফলের অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্যে অনেকেই হয় প্রাচীন ব্যবস্থার অন্ধ পূজারী। তারা ভাবতেও পারেনা তাদের প্রাণপ্রিয় পুরনো ব্যবস্থা কখনো পর্যুদস্ত হতে পারে। তারা যতক্ষন সেই ব্যবস্থার ধবংসের লক্ষন দেখতে না পায়, ততক্ষন তাদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন আসতেই পারেনা। এই শ্রেণীর মধ্যে বহু সংখ্যক লোক এমন হয়ে থাকে যারা নবাগত শক্তির যুক্তি ও চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়। কেউ কেউ নবাগত শক্তি জয় লাভ করুক এমন প্রত্যাশাও করে। তবে প্রতিষ্ঠিত পুরনো শক্তির ভয়ে তারা ভীত থাকে। কেউ কেউ বিপ্লবের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে সামনে অগ্রসরও হতে চায়। কিন্তু সাবেক নেতৃত্ব তাদেরকে এমন ভাবে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে রাখে যে, তারা নড়াচড়া করতেই সাহস করেনা। এমন লোকের সংখ্যাও কম নয় যারা দুই মতাদর্শের মধ্যে যেটা বিজয়ী হয় সেটা হোক এবং যেটা পরাজিত হয় তাকে বাতিল মনে করে। বিশেষত, দাওয়াত টা যখন ইসলামের হয়, তখন এই চিন্তাধারা জনগণের মধ্যে আর ব্যাপক ভাবে ছড়ায়। জনগণের এই মানসিক অবস্থাই কোন সংস্কার মূলক ও সংগঠন মূলক দাওয়াত গ্রহনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বন্দ্ব সংঘাতের তীব্রতা হ্রাস বৃদ্ধির ফলে এই মানসিক অবস্থায় যেভাবে পরিবর্তন আসতে থাকে, সেই অনুপাতে দাওয়াতের গতি বিঘ্নিত বা সচ্ছন্দ হয়। সুতরাং যে কোন নতুন দাওয়াতের পতাকাবাহীদের জন্য পথ তখনই উন্মুক্ত হয় যখন তারা, দ্বন্দ্ব সংঘাতে যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারে এবং প্রতিরোধকারীদের উপর প্রবল জোরদার ও কার্যত আঘাত হানতে পারে। ফলে জনগণ একদিকে মনে করে যে, পুরনো নেতৃত্বকে হঠানো এবং পুরনো শৃঙ্খল ভাঙ্গা কোন অসম্ভব কাজ নয়, অপরদিকে তারা নতুন শক্তি সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারে যে তারা জুলুমবাজ, জাহেলী শক্তিকে আঘাত করার মতন শক্তি রাখে। জনমতের অংগনে যখনই এই ধরণের একটা মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখনই সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক দাওয়াতের জন্য জনমন পুরোপুরি উম্নুক্ত হয়ে যায়।
মদিনার ইসলামী সরকার ইহুদী ও কোরায়েশদের সামরিক হুমকির জবাব যে সাহস ও দৃপ্ততার সাথে দিয়েছে, তার উদ্দেশ্য তরবারীর জোরে রনাঙ্গনে কিছু লোককে ইসলামে দীক্ষিত করা ছিলনা। বরং উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধংদেহী প্রতিরোধ থেকে আত্মরক্ষার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের সাহস যেন বাড়ে এবং মদিনার বিপ্লবী শক্তির উপর যেন তাদের আস্থা জন্মে। এটাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ইসলামী আদর্শের কাছ থেকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ লাভের আশা এবং জাহেলী ব্যবস্থার টেকসই অস্থিতিশীল না হওয়ার ধারণা জনমনে সৃষ্টি হোক- এটাই ছিল এর লক্ষ্য।
সর্বপ্রথম যখন বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হল, তখন চারদিক থেকে সকলের দৃষ্টি পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল যে, দেখা যাক কে হারে কে জেতে? সবাই যখন দেখল মুষ্টিমেয় মুসলমান সৈন্য, যাদের কাছে ন্যূনতম সামরিক সরঞ্জাম ও ছিলনা, তাদের নিজেদের চেয়ে তিন গুন বেশী সংখ্যক বিশাল বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাভুত করলো এবং আবু জেহেলসহ মক্কার বড় বড় নেতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো, তখন সমগ্র আরবে এই হতবুদ্ধিকর ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হয়ে পারেনি। ঘরে ঘরে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তা জনমনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই ঘটনায় প্রথম বারের মতন এই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, মদিনার ইসলামী শক্তি শুধু সারা জীবন মার খেয়ে খেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আত্মার শান্তি লাভ করার জন্য সাধু সন্যাসী হয়ে যাওয়া লোকদের দ্বারা গঠিত নয় বরং ঐ শক্তির হাতে একদিন না একদিন দেশের সামগ্রিক চেহারাই পালটে যাবে।
তার পর ওহুদের যুদ্ধ ‘কাহ কারে নাহি পারে, সমানে সমান’ পর্যায়ে থাকায় তার ব্যাপারে পতিক্রিয়া ও মধ্যম ধরণের ছিল। এরপর সংঘটিত হল খন্দকের যুদ্ধ। আরব সমাজ দেখল যে, চারদিক থেকে বিরাট বিরাট বাহিনী সর্বনাশা সয়লাভের মত ছুটে আসছে। তারপর মাসখানেক মদীনা অবরোধ করে রাখার পর এমনভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো যেন ভূমির একটা স্তূপ কে কেউ ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনা দ্বারা জনমনে যে বিশ্বাস জন্মেছিল তা ছিল এই যে, মুসলিম শক্তির শেকড় এতো মজবুত যে, শত্রুদের সম্মিলিত আক্রমনেও তার ক্ষতি হয়না।
এই সব বড় বড় যুদ্ধের পাশা পাশি ছোট ছোট গোত্রীয় নেতৃত্বের দিকেও মদিনা যথাযথ মনোযোগ দিয়েছে। এসব স্থানীয় নেতৃত্ব দেশজোড়া জাহেলী নেতৃত্বের লেজুড় ছিল এবং এক এক করে এই ধরণের সমস্ত লেজুড়কে ছিন্ন করা ছাড়া জনগণকে এই নেতৃত্ব থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব ছিলনা। এর কিছু কিছু লেজুড় তো দাওয়াতের তোড়েই ভেসে গিয়েছিলো। বাকি লেজুড়কে চুক্তি ও মৈত্রী ভিত্তিক সম্পর্কের দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বাদবাকী লেজুড় গুলো যেদিক থেকেই মাথা তুলেছে, ইসলামী সরকার তৎক্ষণাৎ সেদিকে মনোনিবেশ করেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্রোহী চোর, ডাকাত, নাশকতাবাদী কুচক্রীদের বিরুদ্ধে এমন সময়োচিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যে, যেমনটি আকাশের দুয়ারে আড়িপাতায় চেষ্টারত শয়তানকে আগুনের তীর নিক্ষেপ করে আপ্যায়ন করা হয়। মদিনার চারপাশে আইন শৃংখলাকে সর্বতোভাবে ভাবে বহাল করা এবং নিশ্ছিদ্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা হয়। নচেৎ চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বেদুঈন গোত্রগুলো যদি বিন্দু মাত্র ফাঁক ফোকর পেত,তবে মদিনার সুসংঘবদ্ধ সরকারের অভিজ্ঞতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। ইতিহাসের রেকর্ড দেখলে বুঝা যাবে যে, হিজরতের প্রথম বছর থেকে শুরু করে মক্কা বজয় পর্যন্ত সমগ্র সময়টা নিত্যনতুন বিদ্রোহ, অরাজকতা ও নাশকতা দ্বারা পরিপূর্ণ। কাল ওদিকে সামরিক সমাবেশ হয়েছে, তো আজ এদিকে ডাকাতচক্র মাথা তুলেছে। একদিন এদিকে কোন দল লুটপাট চালিয়েছে তো পরের দিন মদিনার অন্য কোন প্রান্তে কোন অজানা আততায়ীর দল নিরীহ নাগরিকদের জানমালের ক্ষতি সাধন করে উধাও হয়েছে। এদিকে কোন যুদ্ধ বাধানোর ষড়যন্ত্র চলছে তো ওদিকে কোন বিদ্রোহী পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু মদিনা খুবই সতর্ক ছিল। কোথাও প্রহরী টহল দিচ্ছে, কোথাও সেনাদল পাঠানো হচ্ছে আবার কোথাও আইন শৃংখলা স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশের গ্রুপ রওনা হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি আরবদের মধ্যে এই ধারণা জন্মিয়ে দিয়েছিল যে, মুসলিম শক্তি কোন বোবা, বধির, অন্ধ শক্তি নয় বরং তা একটা জীবন্ত, জাগ্রত ও কর্মচঞ্চল সরকার। এই সরকার চতুর্মূখী লড়াই চালিয়ে একসাথে বহু সংখ্যক শত্রুর সাথে লড়ছে এবং একদিন না একদিন সে জয় লাভ করবেই।
এরপর যখন মদিনায় ইহুদীদের দাপট চূর্ণ করে দেয়া হলো এবং তারপর উপযুক্ত সময়ে খয়বরের শত্রুদের দুর্গও গুড়িয়ে দেয়া হলো, তখন জনমত কিভাবে এই সব ঘটনার মধ্য দিয়ে দাওয়াত গ্রহণ করার দিকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে গেছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
তারপর মক্কা বিজয়ের সাড়া জাগানো ঘটনা আরব জাতিকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঝাঁকি দিয়ে জাহেলিয়াতের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং ইসলামী আন্দোলন নবজাগরণের আযান দিয়ে ডেকে বলেছিল যে, “ওঠো, চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে, তখন কোন অন্ধেরও বুঝতে বাকী ছিলনা যে, জাহেলিয়াত ধ্বংসের সম্মুখীন।” আসলেই জাহেলিয়াত সবার চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে গেল। সেই সাথে সবাই বুঝে নিল যে, কোরায়েশের প্রাচীন জাহিলী নেতৃত্বের যুগও শেষ হয়ে এসেছে। একজন নির্বোধ বেদুঈনও বুঝে ফেলেছে, মুহাম্মাদ সা. এর আনীত বিধানই জ্ঞান, চরিত্র, সজীবতা, শক্তি, উন্নতি, পুনর্গঠন, শান্তি, শৃংখলা ও ইনসাফের নিশ্চয়তা দানকারী একমাত্র বিধান। জনতা তাদের মনমগজের জানালা খুলে দিয়েছে যেন ইসলামী আন্দোলনের আলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
এসব সামরিক তৎপরতা নিরেট সামরিক তৎপরতা ছিলনা, বরং এ সবের ভেতর দিয়ে ইসলামের দাওয়াতও প্রচার করা হতো। লড়াইগুলো নিছক তীর তলোয়ারের লড়াই ছিলনা বরং আকিদা, আদর্শ ও চরিত্রেরও লড়াই ছিল। এ সব লড়াইতে মুসলমানরা এক নতুন শ্লোগান ‘আল্লাহু আকবর’ চালু করেছিল। যুদ্ধের ময়দানেও তারা রুকু সিজদার সমাবেশ ঘটিয়েছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করলেও তারা শত্রুর সামনে আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ মাথা নোয়াতেও কসূর করতোনা। তাছাড়া এসব যুদ্ধের নিয়ম শৃংখলাও ছিল অভিনব ধরণের। রণাঙ্গণে তারা শাহাদাত, জান্নাত, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও চিরন্তন জীবনের আকিদা বিশ্বাস নিয়ে এসেছিল। এগুলোর বাসনায় প্রত্যেক মুসলমান সৈনিক মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে এগিয়ে যেত এবং হাসতে হাসতে আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবন উৎসর্গ করতো। তাদের এক চমকপ্রদ সামরিক চরিত্রও ছিল। অন্যরা গানবাদ্যের তালে তালে যুদ্ধ করতো। আর ইসলামী আন্দোলনের জানবাজ সৈনিকরা তাওহীদের শ্লোগানের আওয়াজের সাথে মার্চ করতো। অন্যরা মদ খেয়ে বাহাদুরি দেখাতো। আর মুসলিম সৈনিকরা কর্তব্যবোধের পবিত্র শরবত খেয়ে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতো। অন্যরা যুদ্ধলব্ধ গণিমতের লোভে বীরত্ব দেখাতো। আর রসূল সা. এর অনুসারীরা স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রক্তাপ্লুত প্রান্তরে লুটোপুটি খেত। অন্যরা জাতি, গোত্র ও বংশের আভিজাত্যে প্ররোচিত হয়ে আক্রমন চালাতো, কিন্তু আল্লাহর সৈনিকরা শুধু সত্য ন্যায় ও ইসলামের খাতিরে লড়াই করতো। অন্যরা লড়াই এর সময় চরম পাশবিক ও নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। শত্রুকে আগুনে পোড়ানো, বেঁধে হত্যা করা, লাশের অবমাননা করা, নিহতদের মাথার খুলিতে মদ খাওয়া, কলিজা চিবানো, নারী ও শিশুদের যবাই করা, গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে দেয়া, ইত্যাদি বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড ছিল তাদের নিত্যকার অভ্যাস। কিন্তু ইসলামী শক্তি এমন নজীরবিহীন বাহিনী ময়দানে নিয়ে এসেছিল, যারা লড়াই এর সময়ও মানবতার নৈতিক সীমারেখার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। তারা কাউকে কখনো অমানুষিক পন্থায় হত্যা করতোনা। লাশের অবমাননা করতোনা। নারী ও শিশুদের ওপর বাহাদুরী দেখাতোনা। বরং এসব ক্ষেত্রে নৈতিকতা বিবর্জিত শত্রুদের অন্যায় আচরণের ধৈর্য ধারণ করে নিজেদের পক্ষ থেকে উত্তম আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতো। অন্যেরা বন্দীদের সাথে পশুসুলভ আচরণ করতো। কিন্তু মুসলিম বাহিনী তাদেরকে নিজেদের নাগরিকদের সাথে ভাই ভাই বানিয়ে রাখতো। অন্যেরাচুক্তি সম্পাদন করে তা ভঙ্গ করতো। কিন্তু মুসলিম শক্তি অত্যন্ত নাজুক মুহূর্তেও এবং চরম ক্ষতি স্বীকার করেও চুক্তি রক্ষা করতো। কাউকে আশ্রয় দিলে বা কারো দায়িত্ব নিলে সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতো। অন্যেরা বিজিত জনপদে ঢুকে বেসামরিক জনতার ওপর জুলুম নির্যাতন চালাতো। কিন্তু মুসলিম শক্তি তার সৈনিকদেরকে ঘরে ঢুকে কোন নাগরিককে হত্যা করা, কারো ব্যক্তিগত সহায় সম্পদ লুণ্ঠন বা আত্মসাত করা, এমনকি শত্রুর বেসামরিক নাগরিকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা তোলা পর্যন্ত হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যদের জন্য যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল একটা পার্থিব কাজ। কিন্তু ইসলাম এ কাজকে একটা উচ্চাংগের এবাদত ঘোষণা করেছে।
রসূল সা. এর নির্দেশে রণাঙ্গনেও শত্রুর সামনে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতো। শত্রুর সামনে তিনটে বিকল্প পথ খোলা রাখা হতো। হয় ইসলাম গ্রহণ করে ভাই ভাই হয়ে যাও, নচেত রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার কর, নচেত রণাঙ্গনে মোকাবেলা কর। অথচ অন্যদের মধ্যে এমন কোন আদর্শিক দাওয়াত থাকতোনা। তাদের পক্ষ থেকে দুটো পথই খোলা রাখা হতো। হয় আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। নচেত যুদ্ধের ময়দানে এস।
দুই পক্ষের মধ্যের এই বিরাট পার্থক্য যুদ্ধের ময়দানে খুবই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিত। আর এই পার্থক্য বুঝতে পেরে সমগ্র আরব জাতি বিমোহিত ও প্রভাবিক হতো। অর্থাৎ মদিনার ইসলামী সংগঠনের একদিকে দ্রুত গতিতে বিকাশ লাভ করা এবং অপরদিকে নিজেদের চরিত্র দ্বারা নিজেদের আদর্শের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করা-এই দুই ধরণের সাফল্য সামরিক অভিযানগুলোর মাধ্যমে আরবের জনমতের ওপর প্রতিফলিত হতো। এই দু’ধরণের সাফল্য যতটা সত্যের দাওয়াতের পথ সুগম করতো, ততটাই লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকতো। এই সাফল্য হোদায়বিয়ার সন্ধির পর তীব্রতর হয়েছে। এজন্য এ সময় জনগণ ইসলামের দিকে অধিকতর দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়েছে। আর মক্কা বিজয়ের পর এই সাফল্য পুরোপুরিভাবে বিজয়ীর বেশ ধারণ করে। তাই সমগ্র আরব এক সাথে এই সংস্কারমূলক আন্দোলনের আওতাভুক্ত হয়ে যায়। এই দু’টি যুগে জনগণ যেরূপ দ্রুতগতিতে ইসলাম গ্রহণ করেছে তা দেখে বুঝা যায়, কোরায়েশ নেতৃত্ব জনগণের পথে কত বড় অন্তরায় ছিল। আর এই অন্তরায় সরে যাওয়া মাত্রই মানসিক বিপ্লব ঘটে গেছে। যেখানেই কোন কায়েমী স্বার্থের বিজয়ী শ্রেণী এভাবে অন্তরায় সেজে বসে থাকে, সেখানে জনগণের মধ্যে ওয়াজ নসিহতের এবং দাওয়াত ও তাবলীগের প্রভাব তেমন ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারেনা। সামগ্রিক পরিবেশকে পরিবর্তন করার জন্য এ ধরণের বাধা দূর করা প্রয়োজন। আর এ জন্য সর্বাত্মক রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের পূর্ণতা রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপরই নির্ভরশীল।

সরকার স্বয়ং বিপ্লব শিক্ষা দিত

অতঃপর যেসব এলাকা সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলোর ইসলাম গ্রহণ, চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন অথবা রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে মদিনার ইসলামী সরকারের কর্তৃত্বাধীন হয়েছিল, তাদেরকে যেভাবে আছে সেইভাবেই থাকতে দেয়া হতোনা। বরঞ্চ তাদের কাছে ইসলামের বিস্তারিত দাওয়াত ও শিক্ষা পৌঁছানো হতো এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। ব্যাপারটা এ রকম ছিলনা যে, ডান্ডা ঘুরিয়ে ও শক্তির প্রদর্শনী করে কোন এলাকাকে দখল করা হতো এবং তারপর মানুষকে ভেতর থেকে পরিবর্তন ও সংশোধন না করে গরু ছাগলের মত তাড়িয়ে বেড়ানো হতো। সব কিছু যদি তরবারী দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করা হতো এবং ডান্ডার জোরেই যদি সব কিছুর পরিবর্তন করা হতো, তাহলে এই স্বৈরাচার মাত্র কয়েক দিন চলতো। তারপর মানুষ বিদ্রোহ করতো। আর মানুষের অসন্তোষ ও বিক্ষোভের বিস্ফোরণ যদি একবার ঘটতো, তাহলে সমস্ত অর্জিত সাফল্য বিনষ্ট হয়ে যেত। বস্তুত শক্তি প্রয়োগের পরিমাণ ইসলামী আন্দোলনে অন্য যে কোন ব্যবস্থার তুলনায় কম ছিল এবং দাওয়া, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশী।
আদর্শবাদী সরকার মাত্রই প্রচারকেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং তার সমস্ত তৎপরতায় এই উদ্দেশ্যটাই অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে যে, যে আকীদা ও আদর্শের ওপর তার জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তা যেন জনগণ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে ও অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে। এই সরকারের সব ক’টা বিভাগকে তার নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও ঐ কেন্দ্রীয় দায়িত্বও পারন করতে হয়। এ ধরণের সরকার এমন প্রতিটি জিনিস প্রত্যাখ্যান করবে, যা তার মৌলিক আদর্শের ক্ষতি সাধন করে। সে এমন অলাভজনক জিনিসকেও গ্রহণ করবে যা জনগণের মনমগজে তার মৌলিক মতাদর্শকে বদ্ধমূল করে। তাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে থাকে, জনগণ নতুন আদর্শের সাথে একাত্ম হয়ে যাক, একাত্ম থাক আন্তরিকতার সাথে। যা করণীয় তা করুক এবং যার বিলোপ সাধন করা দরকার তার বিলোপ সাধন করুক।
মদিনার ইসলামী সরকার একদিকে যেমন কঠিনতম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও আশপাশের অঞ্চলে দাওয়াতী ও প্রচারমূলক দল পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। অন্ততপক্ষে চারটে ক্ষেত্রে মদিনা থেকে দাওয়াতী কাজে গমণকারীদেরকে ঘাতকরা শহীদ করে দেয়। দাওয়াতের কাজে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার শহীদ হয়েছেন এমন সাহাবীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বরং বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশী। চরম নাজুক ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও এই মৌলিক কর্তব্য পালনে শৈথিল্য দেখানো হয়নি। বরং অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়েও তা চালু রাখা হয়েছে। কিছু কিছু সাহাবীকে মদিনায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরই গোত্রে দাওয়াতের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। এ ধরণের কিছু সাহাবীদের নাম হলোঃ (১) তোফায়েল বিন আমর দাওসী (দাওস গোত্র), (২) আমুরা বিন মাসউদ (সাকীফ গোত্র), (৩) আমের বিন শাহর (হামদান, (৪) যিমাম বিন ছা’লাবা (বনু সা’দ), (৫) মুনকিয বিন হাববান (বাহরাইন), (৬) ছামামা বিন ইছাল (নাজদ)। এছাড়া কিছু কিছু গোত্র বা ব্যক্তির কাছে বিশেষ বিশেষ দাওয়াতদাতাকে নিযুক্ত করে পাঠানো হয়। যেমন হযরত আলীকে হামদান, হুযায়মা ও মাযহাজে, মুগীরা ইবনে শু’বাকে নাজরানে, দাবার বিন নাথনীসকে ইয়ামানে বসবাসকারী পারস্যবাসীর কাছে, মাহীসা বিন মাসউদকে ফিদকে, আহনাফকে সুলাইম গোত্রে, খালেদ বিন ওলীদকে মক্কায়, আমর ইবনুল আ’সকে ওমানে এবং মোহাজের বিন আবি উমাইয়াকে ইয়ামানের যুবরাজ হারেস বিন ফিলালের কাছে পাঠানো হয়।
কিন্তু ইসলামী সরকার এর চেয়ে অনেক বেশী দাওয়াতী ও প্রচারমূলক কাজ আদায় করেছে বেসরকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে। ইসলামী সরকারের কর্মচারীরা নিজেদেরকে পেশাদার চাকুরীজীবী মনে করতেন না এবং তারা অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে চাকুরী গ্রহণও করতেন না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকতো আল্লাহর বাণী ও বিধানকে সমুন্নত করা এবং মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা। এ কাজ নিছক বেতনলোভী লোকদের দিয়ে করানো যেতনা। এটা কেবল ইসলামী বিপ্লবের নিঃস্বার্থ সেবকদের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল। তারা না কোন পদের লোভী ছিলেন, না গ্রেড ও পদোন্নতির চিন্তায় বিভোর থাকতেন। পদ ও দায়িত্বই তাদেরকে ডাকতো এবং ন্যূনতম বেতনেই তারা উচ্চতর দায়িত্ব পালন করতেন। এখানে একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। আত্তাব বিন উসাইদকে দৈনিক এক দিরহাম বেতনে মক্কার গভর্ণর নিয়োগ করা হয়। তিনি বক্তৃতায় নিজেই বলেন, “যে ব্যক্তি দৈনিক এক দিরহাম পেয়েও ভুখা থাকে, আল্লাহ তাকে ভুখাই রাখুন।” (ইবনে হিশাম) তারা সব কিছুর আগে নিজের প্রিয় আকিদা ও আদর্শের আহ্বায়ক ছিলেন। মদিনার সরকার যাদেরকে কোথাও গভর্নর, বিচারক, তহশীলদার বা অর্থবিভাগীয় কর্মকর্তী নিয়োগ করতো, তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাওহীদের দাওয়াতদাতা, ইসলামের শিক্ষাগুরু এবং নৈতিকতার প্রশিক্ষক হতেন। তাদেরকে যখন তাদের বিভাগীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হতো, তখন রসূল সা. তাদেরকে এই মৌলিক দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতেন। হযরত মুয়ায বিন জাবালকে ইয়ামানে আর্থিক, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ন্যস্ত করে যখন পাঠানো হলো, তখন তাকে এ কথাও বলা হয় যে, “জনগণকে কোরআন শিক্ষা দিও এবং ইসলামের বিধিমালা শিক্ষা দিও।” তারপর তাকে বিশেষভাবে আহলে কিতাবদের প্রয়োজন অনুসারে দাওয়াতের পন্থা বুঝিয়ে দেয়া হয়। তাকে বলা হয়, “তাদেরকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দিও। এটা মেনে নিলে নামায শিখিও। তারপর যাকাতের শিক্ষা দিও।” এই সব কর্মকর্তাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নিজ নিজ সদর দফতরে নামাযের ইমাম হতেন। তবে বড় বড় জনপদে যেখানে দায়িত্ব বণ্টন না করে উপায়ই থাকতোনা, সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে সাথে নামাযের জন্যও আলাদা ইমাম নিয়োগ করা হতো। যেমন আত্তাব বিন উসাইদকে মক্কায়, উসমান বিন আবিল আসকে তায়েফে এবং আবু জায়েদ আনসারী ওমানে ইমাম নিযুক্ত হন।
বেসামরিক অফিসারদের সংখ্যা প্রচুর। তাই তাদের তালিকা দেয়া হচ্ছেনা। কিন্তু এই সংখ্যা ও এদের নিয়োগ এলাকা দেখলে বুঝা যায় যে, ইসলামী সরকারের বেসামরিক বিভাগ (সিভিল সার্ভিস) ইসলামের দাওয়াত বিস্তারে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া এই সব দাওয়াতদাতা আপন দায়িত্ব পালনের সময় প্রচলিত অর্থে শুধু অফিসার ছিলেন না। আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক হওয়া, জাঁকজমক, জুলুম ও বাড়াবাড়ি, জনগণ থেকে দূরে থাকা, মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস সম্পর্কে উদাসীনতা, রাস্তায় বেরুলে অন্য সবাইকে হাঁকিয়ে দূরে তাড়িয়ে দেয়া, দারোয়ান ও পাইক পেয়াদার মাত্রাতিরিক্ত ভীড় জমানো, বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ, লুটপাট, ঘুষ খাওয়া, চাটুকার পরিবেষ্টিত থাকা, সরকারী অর্থের অপচয় করে ইচ্ছেমত পুরস্কার দেয়া, মদের আড্ডা জমানো, নৃত্যগীতের জলসা বসানো-এসব কিছু থেকে তারা থাকতো যোজন যোজন দূরে। এসব বেসামরিক অফিসার একেবারেই ভিন্ন ধরণের অফিসার ছিলেন। তাদের শাসন জনগণের কাছে ছিল এক অভিনব অভিজ্ঞতা। স্বল্প বেতনভোগী, সাদাসিদে জীবন যাপনকারী, সততার সাথে দায়িত্ব পালনকারী, প্রজাদের প্রতি সদয়, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি পরায়ন, খোদাভীরু এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী আপন চরিত্র দ্বারা জনগণের হৃদয় জয় করতেন। তারা যখন মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, তখন সে দাওয়াত শ্রোতার অন্তরের অন্তস্থলে প্রবেশ করতো। হযরত আবু মূসা আশয়ারীকে যোবায়েদ ও এডেন অঞ্চলের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। সেখানকার সবাই তার দাওয়াতে অতি দ্রুত মুসলমান হয়ে যায়। অনুরূপভাবে জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালীকে ইয়ামানের রাজবংশের দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। তিনি এতটা প্রভাব বিস্তার করেন যে, তারা সবাই ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেয়। আর এই আনন্দে তিনি ৪ হাজার ক্রীতদাসকে মুক্তি দেন।
মোটকথা, সরকারের বেসামরিক বিভাগগুলো অত্যন্ত নিবিষ্ট চিত্তে ও একাগ্রতার সাথে অবিশ্রান্তভাবে দাওয়াত ও প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এই ব্যাপক ভিত্তিক দাওয়াতী ও শিক্ষামূলক কাজেরই ফল ছিল এই যে, আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যেও শুধু রাজনৈতিক নয় বরং মানসিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেল এবং এরই সাথে নৈতিক দিক দিয়েও আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হলো। শেষ পর্যন্ত আরবের গোটা সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধারণ করলো।

জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

আরবের বিপুল সংখ্যক বেদুঈন অধিবাসী ছিল সাধারণভাবে দরিদ্র। অধিকাংশ মরুচারী গোত্র ছিল যাযাবর। পালিত পশু থেকে প্রাপ্ত যতকিঞ্চিত জীবিকা ছাড়া সশস্ত্র ডাকাতি ও লুটপাটই ছিল তাদের প্রধান উপজীব্য। শহর থেকে অনেক দূরে স্থায়ী নিবাসের অধিকারী কিছু বেদুঈন গোত্রও ছিল। তবে তারাও ছিল খুবই দরিদ্র। এসব গোত্রের শেখ ও সরদাররা অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনার বেশীর ভাগ সুফল নিজেরাই একচেটিয়াভাবে ভোগ করতো এবং সাধারণ মানুষকে করতো তা থেকে বঞ্চিত। শহর বলতে মক্কা, মদিনা, তায়েফ, সানা, হাদরামাউত ইত্যাদিকেই বুঝাতো। এগুলি বড় শহর ছিলনা। এগুলোর অধিবাসীরা সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে সামগ্রিকভাবে তারা ছিল সচ্ছল ও সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যেও উঁচু নীচু শ্রেণী ছিল। উঁচু শ্রেণী নীচু শ্রেণীকে শোষণ করতো। মদিনায় ইহুদীরা ব্যবসায় ও কৃষ্টিতে প্রাধান্য বিস্তার করা ছাড়াও সুদী কারবারের জাল পেতে রেখেছিল। অনুরূপভাবে, মক্কা ও তায়েফের বড় বড় বিত্তশালী লোকেরাও অর্থোপার্জনের অন্যান্য পন্থার পাশাপাশি সুদী কারবারও করতো। উচ্চ পর্যায়ের কিছু কিছু পরিবার চরম বিলাসী জীবন যাপন করতো। গানবাদ্য, মদখুরি, প্রেমপ্রণয় ও ব্যভিচার ছিল তাদের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অথচ আরবের সাধারণ মানুষের অভাবের কোন সীমা পরিসীমা ছিলনা।
অভাবের তাড়নায় তারা মৃত প্রাণীর গোশত পর্যন্ত খেত। পবিত্র অপবিত্র ও হালাল হারামের আদৌ কোন বাছবিচার করতোনা। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান সমস্যারই যেখানে সমাধান হতোনা, সেখানে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য উচ্চতর সমস্যার প্রশ্নই তো অবান্তর। চিকিৎসার জন্য দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা, যাদুটোনা, এবং জ্যোতিষী ও ফকীরদের কাছে ধর্না দেয়া হতো। শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সীমিত। শহুরে উচ্চ পরিবারের মুষ্টিমেয় লোকের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকতো শিক্ষাদীক্ষার কার্যক্রম। সেখানকার একটা মৌলিক ও বাস্তব সমস্যা ছিল খাদ্য সমস্যা। যে জাতি বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ সব সময় “কী খাবো” এই প্রশ্ন নিয়েই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকে, তকে কোন উচ্চতর ও মহত্তর বিষয়ের জ্ঞান দান করাও যায়না এবং মহত্তর উদ্দেশ্যে তারা কোন স্মরণীয় কাজও সমাধা করে যেতে পারেনা। যারা অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার তাদের বঞ্চনার প্রতিকার না করে কেবল ওয়ায নসিহত ও সদুপদেশ দিয়ে কেউ তাদেরকে ব্যাপকভাবে কোন আন্দোলনে সক্রিয় করতে পারেনা। কোন মতাদর্শ যদি অস্ত্রের বলে ক্ষমতাও দখল করে, কিন্তু মানুষের প্রাথমিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে না পারে, তাহলে নিছক নৈতিক সংশোধন ও পুনর্গঠনের উপদেশ গ্রহণে সাধারণ মানুষ কখনো প্রস্তুত হতে পারেনা। বরঞ্চ এ ধরনের সংস্কার ও সংশোধন ও পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে একটা আপদ মনে করে তা থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মানবতাকে জয় করতে পারবে কেবল তখনই, যখন তা আখেরাতের সাথে সাথে দুনিয়াতেও সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এবং নৈতিক সংস্কার ও সংশোধনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও করতে পারবে। নিছক অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা যেমন মানবতাকে নৈতিক দিক দিয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার শামিল, তেমনি নৈতিক সংস্কারের কাজকে জীবনের অর্থনৈতিক দাবী ও চাহিদা থেকে পৃথক করে গ্রহণ করাও নৈতিক সংস্কার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়ার নামান্তর। ইসলাম উভয় প্রয়োজনকে একই সাথে পূরণ করে। রসূল সা. যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, তা একদিকে যেমন হৃদয়কে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত করে, আত্মাকে নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করে, অপরদিকে তেমনি পেটের খাদ্য সরবরাহের জন্য ও সে সর্বোত্তম ব্যবস্থা করে। শুরুতেই ইসলামের সংক্ষিপ্ততম নৈতিক বিধানে “ইতয়ামু মাছাকীন” অর্থাৎ দরিদ্রকে আহার করানোর বিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া অনাথ, বিধবা ও মোসাফেরকে সাহায্য করাও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল।
আরব ছিল একটা স্বল্প উৎপাদনশীল দেশ। খনিজ, শিল্প, কিংবা গবাদি পশু সকল ধরনের সামগ্রীই ছিল নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত। সম্পদের এই সব উৎসকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা ছিল খুব জটিল সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না করে জীবনের অন্যান্য বড় বড় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিলনা। ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান, (যা পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়েছিল) মধ্যম পরিস্থিতিতে সম্পদকে সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আবর্তনশীল রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই বিধান বাস্তবায়নেরও আগে সম্পদের এই উৎসগুলো ছিল সবচেয়ে জটিল সমস্যা। একমাত্র জেহাদী তৎপরতার মাধ্যমে এই সমস্যার এমন সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়েছে যে, আর কোন বিকল্প উপায়ে এমন সাফল্যজনক সমাধান সম্ভব হতোনা।
সেই প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পরাজিত শত্রুরা অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম গনীমত হিসাবে হস্তগত করা একটা সর্বস্বীকৃত অধিকার বিবেচিত হয়ে আসছে। যুদ্ধ থামানোর জন্য মানুষ হত্যা করার চাইতে কার্যযকর ও অব্যর্থ কৌশল হলো প্রতিপক্ষকে অস্ত্র, সাজ সরঞ্জাম ও রসদ থেকে বঞ্চিত করা। তা ছাড়া প্রতিপক্ষের সামরিক অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়াও এর অন্যতম সাফল্যজনক কর্মপন্থা। ইসলামও গনীমতের অধিকার বহাল রেখেছে এবং সেজন্য বিশেষ ধরনের নৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখানে আমাদের পক্ষে কোন তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কার্যযত এই অঙ্গিকার প্রয়োগ করে ইসলামী বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় সঞ্চিত সম্পদকে বন্ধনমুক্ত ও আবর্তনশীল করেছে। জনগণের কাছ থেকে শোষণ করা ইহুদী, সুদখোরদের সম্পদ গনীমতের বিধি অনুসারে গতিশীল হয়েছে। সাকীফ গোত্রের পুঞ্জীভূত সম্পদ তাদের মালিকানার আওতামুক্ত হয়ে সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুরূপভাবে মদিনার আশপাশের যে সব বিদ্রোহী গোত্র অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে, তাদের ধনাঢ্য নেতা ও সরদারদের সম্পদের একটা বিরাট অংশ মুসলিম বাহিনী তাদের অধিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এবং সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে তাকে আবর্তনশীল করেছে।
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনীমত) সম্পর্কে জাহেলী যুগের রীতি ছিল, যুদ্ধের ময়দানে যে যা পেত, সে তা নিয়ে কেটে পড়তো। কেউ চুরি করতো, কেউ প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত করতো, আর যে যত বড় ও ক্ষমতাশালী হতো, সে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ততই বড় ও উত্তম গ্রাস করতো। ইসলামী সমরনীতি সম্পূর্ণ অভিনব এক নৈতিকতার উদ্ভব ঘটালো। এই নীতি অনুসারে সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ প্রথমে পাই পাই করে একত্রিত করা হতো। একটা সূঁচও বাদ পড়তোনা। তারপর সেনাপতির নির্দেশে তা বিলি বন্টন করা হতো। এই সম্পদ থেকে বিশ শতাংশ চলে যেত ইসলামী কোষাগারে তথা বাইতুলমালে। এর প্রধান অংশ দরিদ্র ও অভাবীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। এভাবে দেশের সম্পদের একটা অবাধ আবর্তন শুরু হলো। এরপর ক্রমান্বয়ে আর্থিক বিধিবিধান চালু হওয়ার সাথে সাথে এর প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়েছে।
এরপর ইসলামী রাষ্ট্র ভূসম্পত্তি, পশু ও বানিজ্যিক পূঁজির মালিকদের কাছ থেকে মুসলমান হয়ে থাকলে যাকাত, অমুসলমান হলে খাজনা ও জিযিয়ার আকারে রাজস্ব আদায় করেছে। এই রাজস্ব থেকে বিশেষত যাকাত থেকে একটা বিরাট অংশ দরিদ্র শ্রেণীগুলোর জন্য নির্দিষ্ট করেছে। প্রতি বছর শস্য, খেজুর ও পালিত পশুর একটা বিরাট অংশ ধনিকদের কাছ থেকে গরীবদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান শুধু আইনের জোরেই করা হয়নি। নৈতিক উপায়েও তার সুরাহার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রসূল সা. মদিনার কেন্দ্রীয় সমাজে সামাজিক সাম্যের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সৌভ্রাতৃত্বের (Economic Brotherhood) অত্যন্ত সাফল্যজনক অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। সমগ্র আরববাসী দেখতে পাচ্ছিল যে, আপন ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত লোকজন, সর্বস্বহারা ক্রীতদাস, ক্ষুধা জর্জরিত বেদুঈন, এবং আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা যুবকদের একটি গোষ্ঠীর ইসলাম গ্রহণ করার পর রাতারাতি বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটে যাচ্ছে। একদিকে তারা বড় বড় অভিজাত সমাজপতিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং অকল্পনীয় দুঃসাহসিকতার সাথে চরম দাম্ভিক ও অহংকারী প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। অপরদিকে তাদের সমস্ত দুঃখকষ্ট ও অভাব অভিযোগ দূর হয়ে যাচ্ছে। তারা আশ্রয় পাচ্ছে, কাজ পাচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছে, পরিবহনের জন্তুও পাচ্ছে এবং বিয়ে শাদী করে সংসারীও হচ্ছে। আর ইসলামী সৌভ্রাতৃত্বের এই কল্যাণময় প্রভাব শুধু মদিনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ক্রমান্বয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং একদিন সমগ্র আরববাসী তার সুফল ভোগ করেছে।
এই অনুপম সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সৌভ্রাতৃত্বের নয়া ব্যবস্থাকে আরবের জনগণ দূর থেকে দুনিয়ার বেহেশত হিসেবেই দেখেছে ও অনুভব করেছে। আর এই বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য যে তাওহীদের চাবিই যথেষ্ট, তাও তারা জানতো। এমতাবস্থায় নিকৃষ্টতম সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের যাতাকলে যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিত লোকদের মনে যদি এই বেহেশতে প্রবেশ করার আগ্রহ জন্মে, তবে তাতে অবাক হবার কী আছে?
রসূল সা. আরবের সাধারণ মানুষের সমস্যার দিকে লক্ষ্য করে ব্যক্তিগতভাবে ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বদান্যতা ও দানশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসাবেও পরম উদারতা ও মহানুভবতার নীতি অবলম্বন করেছেন। ব্যক্তিগত মালকানায় কখনো কোন সম্পদ সঞ্চিত হয়ে থাকতে দেননি। বরং যত শীঘ্র সম্ভব, তা স্থানীয় ও বহিরাগত অভাবীদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। বাইতুলমালে কখনো কোন অর্থ পড়ে থাকতে দেননি, বরং যখনই কোন অভাবী ব্যক্তি সামনে এসেছে, তাকে যা কিছু দিতে পেরেছেন দিয়েছেন। রসূল সা. এর কাছে আসল গুরুত্ব ছিল মানুষের। সম্পদকে তিনি মানবতার সেবক মনে করেছেন। এমনকি অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, বাইতুলমালে এবং নিজের কাছে কিছু না থাকায় সাহায্য প্রার্থীকে দেয়ার জন্য ঋণ গ্রহণ করেছেন। (শামায়েলে তিরমিযী)
তাঁর দানশীলতার খ্যাতি শুনে দুস্থ পল্লীবাসী ও মরুচারী বেদুঈনরা দূর দূরান্ত থেকে মদিনায় ছুটে আসতো এবং তাঁর অবারিত দানে কৃতার্থ হয়ে ফিরতো। এ ঘটনা সুবিদিত যে, একবার জনৈক বেদুঈন এলো এবং রসূল সা. এর চাদর টেনে ধরে ধৃষ্টতার সাথে বললো, “হে মুহাম্মদ, সা. এই সমস্ত সম্পদ তো আল্লাহর। তোমার মা বাপের সম্পত্তি থেকে কিছু দিতে হচ্ছেনা। দাওনা আমার উটের পিঠ বোঝাই করে।” দয়ার সাগর রসূল সা. এক মহূর্ত চুপ থেকে তারপর শান্তভাবে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, এই সব সম্পদ আল্লাহর, আমি তাঁরই বান্দা।” তারপর ঐ বেদুঈনকে এক উট বোঝাই জব ও এক উট বোঝাই খেজুর দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সে খুব খুশী হয়ে বিদায় হলো। আর একবার বাহরাইন থেকে এত বেশী পরিমাণ রাজস্ব এল, যার সামান্য রাজস্ব আর কখনো মদিনায় আসেনি। রসূল সা. মসজিদে নব্বীর চত্তরে তা স্তুপ করে রাখলেন। অতঃপর যারা আসতে লাগলো, তাদেরকে একে একে দিতে থাকলেন। তারপর কাপড় ঝেড়ে উঠে বাড়ী চলে গেলেন। এ ধরনের দানের ঘটনা মদিনায় প্রায়ই হতো এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত লোকেরা এসে উপকৃত হতো। এ সব লোক নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ইসলামী সরকারের বদান্যতার কাহিনী বর্ণনা করতো আর সে সব কাহিনীতে অভিভূত হয়ে কত লোক যে ইসলামে দীক্ষিত হতো, কে তার ইয়ত্তা রাখে।
মহানবী সা. বদান্যতার আরো একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এক ব্যক্তি এসে নিজের আর্থিক দুর্গতি বর্ণনা করে কেঁদি ফেললো এবং সাহায্য চাইল। রসূল সা. অদূরে পাহাড়ে বিচরনত এক পাল ছাগল তাকে দিয়ে দিলেন। লোকটা এই অভাবনীয় দান পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ গোত্রে গিয়ে বলতে লাগলো, “তোমরা মুসলমান হয়ে যাও। মুহাম্মদ সা. এমন দান করেন যে, গরীবের আর কোন দুঃখ অবশিষ্ট থাকেনা।” (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া)। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলেন, “রসূল সা. আমাকে তিনশো বকরী দান করেছেন। এর ফলে আমার মনের অবস্থা এমন হলো যে, আগে আমার কাছে তাঁর চেয়ে অপ্রিয় কেউ ছিলনা। আর এখন তাঁর চেয়ে প্রিয় কেউ নেই।” এ প্রসঙ্গেই নিম্নের চরণটি আবৃত্তি করা হয়ঃ (*****আরবি******)
“তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি দান করতে
গিয়ে নিজে নিস্ব হয়ে যাওয়ার
ভয় করেন না, চাই যত লোকই তাঁর কাছে
আসুক এবং আসতে থাকুক।”
দানশীলতার এই সর্বব্যাপী খ্যাতির ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, হোনায়েনের গনীমত বন্টন করে তিনি যখন ফিরছিলেন, তখন তাঁর কাছে জনৈক বেদুঈন এল এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ আমাকেও কিছু দিন। রসূল সা. পেরেশান হয়ে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন যে, “এই জংগলে যত গাছ আছে, ততগুলো উটও যদি আমার থাকতো, তবে আমি তার সবই তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। তোমরা আমাকে কার্পণ্য করতেও দেখতেনা, আমার ভেতরে অবাস্তব কথা বলার মনোভাব এবং সাহসের অভাবও দেখতেনা।” (বোখারী শরীফ)
হীনমনা লোকেরা এই বদান্যতাকে টাকার জোরে হৃদয় জয় করা এবং ঘুষ দিয়ে সমর্থক বানানোর চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপার মোটেই তা নয়। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পতিত লোকদেরকে উদ্ধার করা এবং তাদেরকে হীনমন্যতা থেকে মুক্তি দেয়া ইসলামের অন্যতম নীতিগত ও আদর্শগত দাবী। মানব সমাজের যে শ্রেণীগুলো উচ্চতর শ্রেণীর অত্যাচারে ও শোষণের দরুন এমন নিদারুণ অভাবে জর্জরিত হয় যে, তারা জীবনের উচ্চতর ও মহত্তর আদর্শিক চাহিদার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়না, এমন শোচনীয় সংকটে পতিত লোকেরা তো আল্লাহর কাছেও কৃপা লাভ করে। আরবের অধিকাংশ মানুষ এ ধরনের পরিস্থিতিরই শিকার ছিল। তাদের কলেমা তাইয়েবার মত খাদ্যবস্ত্রেরও প্রয়োজন ছিল। ইসলামের অর্থনৈতিক ভ্রাতৃত্বের কল্যাণে মদিনাবাসী সম্ভবত প্রথমবারের মত শরীরের মৌলিক প্রয়োজনের ঊর্ধে উঠে জীবনের আধ্যাত্মিক চাহিদার কথা ভাববার এবং মহৎ নৈতিক মূল্যবোধগুলো লালনের অবকাশ পেয়েছিল। অর্থনৈতিক সংস্কার ইসলামের বিস্তৃতির পথ সুগম করেছিল। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিকাশ পরে অর্জিত হয়েছিল যখন তার সমস্ত আইন কানুন ও নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছিল। কিন্তু তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখেই জনগণ মদিনার প্রতি আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, এখান থেকে আমরা শুধু সত্যের আলো নয়, বরং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও পাবো।

রাষ্ট্রনায়কের সুদূর প্রসারী সম্পর্ক

কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যাই থাক না কেন এবং সে যত উচ্চস্তরের আদর্শিক কাজই করুক না কেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপকতা তাকে সাফল্য লাভে অনেকখানি সহায়তা করতে পারে। সাধারণ কায়কারবার থেকে শুরু করে আদর্শবাদী বিপ্লব পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন সামষ্টিক কাজে এমন লোক খুব কমই সাফল্য লাভ করতে পারে, যার সাধারণ মানবিক সম্পর্কে দৌড় খুবই সংকীর্ণ, যে ঘরকুনো ও অসামাজিক। বংশীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা, বৈবাহিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও মৈত্রী, সুখদুঃখের সাহচর্য, পারস্পরিক সাক্ষাত ও সালাম কালাম ইত্যাদি মানুষের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা বাড়ায়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক অবচেতনভাবে বহু বড় বড় আদর্শিক কাজের ধারা পাল্টে দেয় এবং এর কারণে বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গৃহীত হয়ে থাকে। এক কথায় বলা যায়, সাধারণভাবে মানুষের নেতৃ্ত্বদানে সেই ব্যক্তিই সফল হয়ে থাকে, যার সম্পর্কের পরিধি ব্যাপক, নিজে এই সম্পর্ককে আরো ব্যাপক ও প্রশস্ত করে এবং প্রত্যেক সম্পর্কের দাবী পূরণ করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে যখন আমরা রসূল সা. এর সুমহান ব্যক্তিত্বের প্রতি নজর দেই তখন তার সব ধরনের সম্পর্কের পরিধি অত্যন্ত প্রশস্ত দেখতে পাই। সেই সাথে তার বন্ধুত্ব ও সাধারণ ব্যক্তিগত সম্পর্কও ক্রমবর্ধমান দেখতে পাই। এই সব সম্পর্ক থেকে কোন এক পর্যায়ে তাকে বিদায় নিতে ইচ্ছুকও দেখা যায়না এবং কোন উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের মত সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তার কোন অনীহা ও অবজ্ঞাও চোখে পড়েনা। বরং সকল সম্পর্ককে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বজায় রাখেন, তার অধিকার ও দাবী পূরণ করেন এবং তাকে স্থিতিশীল রাখেন। বহুদূরের আত্মীয়তার সম্পর্ককেও তিনি এত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন যে, তিনি মুসলিম বাহিনীকে মিশর জয় করার সময় সেখানকার অধিবাসীদের সাথে সদ্ব্যাবহার করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, হযরত ইসমাইল আ. এর মাতা হযরত হাজেরা একজন মিশরীয়। তাই তোমাদের ওপর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সুরক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়। রসূল সা. এর এই সুপ্রশস্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইসলামী আন্দোলনের বিকাশ ও ইসলামী দাওয়াতের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।
এই সম্পর্কগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। এতে বুঝা যাবে কিভাবে তা ইসলামী আন্দোলনের সহায়ক হয়েছিল এবং তা কিভাবে ইসলামী বিপ্লবকে সহজতর করেছিল। আমরা তাঁর সম্পর্ককে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করবোঃ

১. বংশীয় সম্পর্ক

রসূল সা. এর বংশীয় ধারা নিম্নরূপঃ
মুহাম্মদ সা. (১) ইবনে আব্দুল্লাহ (২) ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (৩) ইবনে হাশিম (৪) ইবনে আব্দুল মানাফ (৫) ইবনে কুসাই (৬) ইবনে কিলাব (৭) ইবনে মুররা (৮) ইবনে কা’ব (৯) ইবনে লুই (১০) ইবনে গালেব (১১) ইবনে ফেহের (১২) ইবনে মালেক (১৩) ইবনে নাযর (১৪) ইবনে কিনানা (১৫) ইবনে খুযায়মা (১৬) ইবনে মুদরাকা (১৭) ইবনে ইলিয়াস (১৮) ইবনে মুযার (১৯) ইবনে নাযার (২০) ইবনে মুসাদ (২১) ইবনে আদনান (২২) ইবনে উদ্ (২৩) ইবনে মুকওয়াম (২৪) ইবনে নাখুর, ইবনে তায়যাহ, ইবনে ইয়ারাব, ইবনে ইয়াশজার, বিন নাবিত, বিন ইসমাইল, বিন ইবরাহীম।
রসূল সা. জানিয়েছেন যে, আদনানের পরে হযরত ইসমাইল আ. পর্যন্ত নামগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। ঐতিহাসিকগণ ঐ নামগুলো সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আদনানের সাথে রসূল সা. এর সম্পর্ক একুশতম বংশীয় স্তরে অবস্থিত। সময়ের ব্যবধান ১১৫৮ বছরের। আরব গোত্রগুলোর সাথে রসূল সা. এর সম্পর্ক কোন না কোন স্তরে গিয়ে মিলিত হয়।
আদনানের ছেলে উক্ (মুয়াদের ভাই) ইয়ামানের গাসসান নামক অঞ্চলে গিয়ে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং আশয়ারী গোত্রে বিয়ে করে। এই অঞ্চলে ইসলাম খুব দ্রুত প্রসার লাভ করে। ইয়ামানের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে আশয়ারীদের দলও ছিল। নাযার (২০ নং পূর্ব পুরুষ) এর চার ছেলে ছিল। তন্মধ্যে আনমারের সন্তানরা নাজদ ও হেজাজে বসতি স্থাপন করে। আয়াদের সন্তানেরা ছুগুরে ও তার আশপাশে বসবাস করে। আর মুযার (১৯ নং) এবং রবীয়া আরবের মধ্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
এবার সেইসব খ্যাতনামা গোত্রের পরিচয় নেয়া যাক, যারা রসূল সা. এরই সমগোত্রীয় এবং এসব গোত্রের নাম সীরাত, ইতিহাস ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ রয়েছেঃ
বনু তামীম- তামীম বিন মারদ বিন উদ বিন তানজা বিন ইলিয়াস (১৮) এর বংশধর।
বনু গিতফান- গিতফান বিন গিতফান বিন সা’দ বিন ইলিয়াস (১৮) এর বংশধর।
বনু যুবিয়ান- যুবিয়ান বিন বুয়াইয বিন রায়েশ বিন গিতফান- ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু হাওয়াযেন- হওয়াযেন বিন মানসূর বিন ইকরামা বিন হাসফান বিন কায়েস ঈলান বিন ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সা’দ- সা’দ বিন বকর বিন হাওয়াযেন........ ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সাকীফ- সাকীফ বিন হাওয়াযেন......... ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সালীম- সালীম বিন মানসুর........ ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু হুযায়েল- হুযায়েল বিন মুদারিকা- (১৭ নং)।
বনু হাওন- হাউন বিন খুযাইমা (১৬ নং)।
ওয়াইশী- ওয়াইশ বিন কারাহ বিন হাউন বিন খুযাইমা।
আযালী- আযাল বিন কারা.................. খুযাইমা পর্যন্ত।
বনু আসাদ- আসাদ বিন খুযাইমা................ খুযাইমা পর্যন্ত।
বনু নাযার- নাযার বিন কিনানা (১৫ নং)।
বনু কিনানা- ঐ।
বনু মুসতালিক- মুসতালিক (খুযাইমা) বিন আবদ মানাত বিন কিনানা (১৫ নং)।
আল আহাবীশ- আহাবীশ বিন কিনানা।
বনু মালেক- মালেক (১৩নং) বিন নাযার বিন কিনানা।
কুরাইশ- ফেহের বা কুরাইশ (১২ নং) বিন মালেক।
বনু মুহারিব- মুহারিব বিন ফেহের।
বনু তাইম- তাইম বিন গালেব (১১ নং) বিন ফেহের।
বনু আওফ- আওফ বিন লুয়াই (১০ নং) বিন গালেব।
বনু আমের- আমের বিন লুয়াই।
বনু হারস- হারস বিন লুয়াই।
বনু হাসীস- হাসীস বিন কা’ব (৯ নং) বিন লুয়াই।
বনু সাহম- সাহম বিন কা’ব।
বনু জুমাহ- জুমাহ বিন কা’ব।
বনু আদ্দী- আদ্দী বিন কা’ব।
বনু কিলাব- কিলাব (৭ নং) বিন মুররা (৮ নং)।
বনু তাইম- তাইম বিন মুররা (৮ নং)
বনু মাখযূম- মাখযূম বিন মুররা।
বনু কুসাই- কুসাই (৬ নং) বিন কিলাব।
বনু যুহরা- যুহরা বিন কিলাব।
আসদী- আসাদ বিন আব্দুল উয্যা বিন কুসাই (৬ নং)।
মুত্তালিবী- মুত্তালিব বিন আব্দ মান্নাফ (৫ নং)।
বনু উমাইয়া- উমাইয়া বিন আব্দুশ্ শামস বিন আবদ মানাফ।
নাওফিলিউন- নওফিল বিন আবদ মানাফ।
বনু হাশেম- হাশেম বিন আবদ মানাফ।
এই সুদীর্ঘ বংশীয় ধারাক্রম এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, রসূল সা. এর বহু উঁচুস্তরের ঘনিষ্ঠ সাহাবীগণ এর সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন হযরত ওমর রা. এর বংশধারা যাররাহ বিন আদ্দী বিন কা’ব (৯ নং) এবং হযরত আবু উবাইদা বংশীয় সম্পর্কে জাররাহ বিন আদ্দীর সাথে যুক্ত। রসূল সা. এর মাতা হযরত আমেনা ওহব বিন আবদ মানাফ বিন যোহরা বিন কিলাব (৭ নং) এর বংশধর। একই কিলাব বিন মুররার ভাই তাইমের বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হযরত আবু বকর। আশারায়ে মুবাশ্শারা অর্থাৎ জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর অন্যতম সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস মালেক বিন উহাইব বিন মানাফের মাধ্যমে রসূল সা. এর সাথে সম্পৃক্ত। কা’বা শরীফের চাবি রক্ষক উসমান বিন তালহা আব্দুদ্দার বিন কুসাই (৬ নং) এর বংশোদ্ভূত। আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত আরেকজন হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম বিন খুয়াইলিদ বিন আসাদ বিন আবদুল উয্যা বিন কুসাই (৬ নং) এর বংশধর। অনুরূপভাবে হযরত খাদীজা তাহেরা খুয়াইলিদ বিন আসাদ বিন আব্দুল উয্যা বিন কুসাই এর মেয়ে। ওয়ারাকা বিন নাওফেল বিন খুয়াইলিদ তাঁর ভাই। হারেস বিন মুত্তালিব বিন আবদ মানাফের (৫ নং) তিন ছেলে আবু উবাইদা (বদরের শহীদ) তুফাইল ও হাদীস বিখ্যাত সাহাবী। ইমাম শাফেয়ীর বংশধারাও মুত্তালিবের সাথেই যুক্ত। হযরত ওসমান উমাইয়া বিন আবদুশ শামস বিন আবদ মানাফের বংশধর।
রসূল সা. এর চাচা ক’জন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। দু’জনের বিবরণ জানাই যায়না। এক চাচা দিরাই আগেই মারা যান। তাঁর চাচাদের মধ্যে নিম্ন লিখিত ব্যক্তিবর্গ খুবই উল্লেখযোগ্য। এরা ইসলামের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত এবং এদের বিবরণও সংরক্ষিত রয়েছে।
এক চাচা হারেস ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেই মারা যান। তাঁর চার ছেলে নওফেল, আব্দুল্লাহ, রবীয়া ও আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এই রবীয়া বিন হারেসের হত্যার প্রতিশোধ বা ক্ষতিপূরণের দাবী ছেড়ে দিয়েই রসূল সা. সর্বপ্রথম মক্কা বিজয়ের সময় ঘোষণা করেন, জাহেলী যুগের সকল খুনের প্রতিশোধ বা ক্ষতিপূরণের দাবীর আজ বিলোপ সাধন করা হলো।
এক চাচা ছিলেন আবু তালেব, যিনি রসূল সা. এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেন। ইসলামী আন্দোলনের বাইরে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে মন প্রাণ দিয়ে সর্বাত্মক সাহায্য করেন। আজ এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা, যার আবু তালেবের সুযোগ্য সন্তান হযরত আলী, জাফর ও আকীলের নাম জানা নেই। আবু তালেবের দুই মেয়ে উম্মে হানী এবং জুমানাও ইসলাম গ্রহণ করেন। মে’রাজের ঘটনা উপলক্ষে হযরত উম্মে হানী বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।
এক চাচা ছিলেন হযরত হামযা, যিনি ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর লাশের সাথে হিন্দা অত্যন্ত হিংস্র আচরণ করে। এই চাচাই রসূল সা. এর সাথে কৃত আবু জাহেলের অশুভ আচরণের প্রচণ্ড প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এক চাচা ছিলেন হযরত আব্বাস। তিনি শুরু থেকেই অভিভাবক সুলভ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত, আকাবার বায়য়াতের আলোচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আনসারদেরকে তাদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তিনি সতর্ক করেন। তাছাড়া মক্কায় থেকে গিয়ে তিনি রসূল সা. কে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করেন। যখন সংঘাত সংঘর্ষের স্পর্শকাতর সময়টা পার হয়ে গেল, তখন তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করে মদিনায় যাত্রা করেন।
এক চাচা যুবায়ের ইসলামের আবির্ভাবের আগেই ইন্তিকাল করেন। অত্যন্ত সদাশয় লোক ছিলেন এবং হিলফুল ফুযুলের প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
এক চাচা ছিল আবু লাহাব। এই চাচা ইসলামের শুধু কট্টর বিরোধীই ছিলনা, বরং বিরোধী শিবিরের সক্রিয় সেনাপতিও ছিল। তার স্ত্রীও ইসলামের ঘোর দুশমন ছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে রসূল সা. কে কষ্ট দেয়া ব্যাপারে সবার আগে থাকতো। আবু লাহাব অত্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি ভোগ করে। সে প্লেগে মারা যায়। তিন দিন পর্যন্ত তার লাশ পড়ে থেকে পঁচতে থাকে। কেউ ধারে কাছেও যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেয়ালের ওপার থেকে পাথর নিক্ষেপ করে লাশ ঢেকে দেয়া হয় এবং ঐ পাথরের স্তুপকেই কবরে পরিণত করা হয়। আবু লাহাবের স্ত্রীর গলায় রশীর ফাঁস লেগে শোচনীয়ভাবে মৃত্যু ঘটে। আবু লাহাবের দুই ছেলে কাফের অবস্থায় মারা যায় এবং দুইজন হোনায়েন যুদ্ধের সময় রসূল সা. এর আনুগত্য অবলম্বন করে। তার কন্যা দিরা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করে।
রসূল সা. এর ফুফুদের মধ্যে একজন ছিলেন কুষায়ের বিন রবীয়া (আবদে মানাফের বংশধর) এর স্ত্রী উম্মে হাকীম রায়দা। তার সন্তান আমের মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। আমেরের ছেলে আব্দুল্লাহ বিন আমেরও সাহাবী হন এবং হযরত উসমানের খেলাফত আমলে খোরাসানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। এই উম্মে হাকীমেরই মেয়ে আরওয়া ছিলেন হযরত উসমানের মাতা। অপর ফুফু ছিলেন উমাইমা। তার বিয়ে হয়েছিল জাহশ বিন রুবাবের সাথে। তার এক মেয়ে উম্মে হাবীবা আব্দুর রহমান বিন আওফের স্ত্রী ছিলেন। অপর মেয়ে হামনার প্রথম বিয়ে মুসয়াব ইবনে উমাইরের সাথে এবং দ্বিতীয় বিয়ে তালহা বিন আব্দুল্লাহর সাথে হয়। দ্বিতীয় বিয়ে থেকে জন্ম নেয়া দুই সন্তান মুহাম্মাদ ও ইমরান ইসলামী আন্দোলনের বীর সেনানী হন। আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে নিজের মামা হযরত হামযার সাথে সমাহিত হন। তৃতীয় ফুফু ছিলেন আতেকা, যিনি বদর যুদ্ধের আগে একটা স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন নিয়েই কোরায়েশ মহলে এই বলে অনেক ঠাট্টা বিদ্রুপ করা হয় যে, ‘‘এখন বনু হাশেমের মেয়েরাও নবুওয়াত দাবী করা শুরু করেছে।’’ চতুর্থ ফুফু ছিলেন হযরত সাফিয়া। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় হারেস বিন হারব ইবনে উমাইয়ার সাথে এবং দ্বিতীয় বিয়ে হয় আওয়াম বিন খুয়াইলিদের সাথে। এই বিয়ে থেকেই জন্ম নেন আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম সদস্য যুবায়ের। সায়েব ইবনুল আওয়ামও তাঁর গর্ভজাত সন্তান। সায়েব বহু জেহাদে অংশ নিয়েছেন। হযরত হামযার লাশ পড়ে থাকতে দেখে এবং তার সাথে অমানুষিক আচরণ দেখে তিনি ধৈর্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পঞ্চম ফুফু বাররা আব্দুল আসাদ বিন হিলালের স্ত্রী ছিলেন। আবু সালমা তাঁরই সন্তান ছিলেন। এই আবু সালমা উম্মুল মুমীনীন উম্মে সালমার প্রথম স্বামী ছিলেন। আর এক ফুফু আরওয়ার স্বামী ছিল উমাইর উহাইব। তার সন্তান তুলাইব যখন তাকে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানান তখন তিনি প্রচণ্ড আবেগের বশে বলেনঃ ‘তোমার জন্য তোমরা মামার ছেলে সর্বাধিক সেবা ও সাহায্যের হকদার। আল্লাহর কসম, আমরা নারীরা যদি পুরুষদের মত ক্ষমতাশালী হতাম, তা হলে আমরা তাকে রক্ষা করতাম এবং তার শত্রুদেরকে সমুচিত জবাব দিতাম।’’
এ কথাগুলোর পেছনে ঈমানী জযবাও সক্রিয় ছিল, একজন ফুফুর অকৃত্রিম স্নেহও ছিল। রসূল সা.- এর বংশজাত সম্পর্কের আরো কিছু দিক রয়েছে। তবে এখানে আমরা শুধু তাঁর যে সব আত্মীয়তার সম্পর্ক ইসলামী আন্দোলনের সাথে কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কিত ছিল সেগুলোই তুলে ধরেছি। এ কথা সত্য যে, সংঘাত সংঘর্ষ মৌলিক ও আদর্শিক হওয়ার কারণে বড়ই কঠিন ও জটিল ছিল। কোরায়েশরা এ ক্ষেত্রে খুবই দীর্ঘস্থায়ী মজবুত বিরোধী শিবির খুলে রেখেছিল। কিন্তু আত্মীয়তার এই সম্পর্কগুলো ভেতরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বনু হাশেম সার্বিকভাবে অন্যদের তুলনায় অধিকতর সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করে। আত্মীয়তার কারণেই আবু জাহলের জুলুম দেখে হযরত হামযার মাথায় খুন চড়ে যায় এবং তিনি জাহেলিয়াত ছেড়ে রসূল সা. এর সঙ্গী হয়ে যান। অবরোধের সময় আবু জাহল শিয়াবে আবু তালেবের দিকে খাদ্য যেতে বাধা দিলে আবুল বুখতারী তাতে আপত্তি জানায়। হযরত আব্বাস নীরবে মক্কায় থেকে সহযোগিতা করেন। কোরায়েশদের বৈঠকাদিতেও মাঝে মাঝে আত্মীয়তার কারণে কেউ কেউ রসূল সা. এর পক্ষপাতিত্ব দেখাতে থাকে। কেউ কেউ রসূল সা. মক্কার বাইরে গিয়ে আরবদের মধ্যে কাজ করে সফল হয়তো হোকগে এই মর্মে মত দেয়। সে ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য কোরায়েশদেরই সাফল্য হবে বলেও মন্তব্য করা হয়। তারপর বহু বছরের জেদাজেদীর পর মক্কা বিজিত হলে লোকেরা রসূল সা. কে ‘‘একজন মহানুভব ভাই এবং মহানুভব ভাই এর ছেলে’’ বলে আখ্যায়িত করে। এই আত্মীয়তা অন্য দিক দিয়েও প্রভাব বিস্তার করে। রসূল সা. এর আপনজনের যুদ্ধবন্দী হয়ে এসে রাতের বেলা বন্ধনগুলোর ব্যাখ্যায় আহ্ উহ্ করতে থাকলে তাঁর ঘুম হারাম হয়ে যায়। মক্কায় দুর্ভিক্ষ হলে তাঁর মন গলে যায় এবং খাদ্য শস্য ও নগদ সাহায্য পাঠান। মক্কা জয় করার পর তাঁর অধিবাসীদেরকে মুক্ত হস্তে দান করেন।

২. মদিনায় মাতুল সম্পর্ক

রসূল সা. এর পিতা জনাব আব্দুল্লাহর মা ফাতেমা বিনতে ওমর মদিনার খ্যাতনামা গোত্র বনু নাজ্জারের বংশোদ্ভূত ছিলেন। তারও আগে তাঁর পরদাদা হাশেমও খাজরাজ গোত্রের এক মহিলা হিন্দ বিনতে আমর বিন সা’লাবাকে বিয়ে করেছিলেন। এ কারণে রসূল সা. এর পিতা আব্দুল্লাহ মদিনায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ঘটনাক্রমে এক বাণিজ্যিক সফরে মদিনাতেই তাঁর পিতার ইন্তিকাল হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি সমাহিত হন। রসূল সা. এর মাতা আমেনা আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাত করা ও স্বামীর কবর দেখার উদ্দেশ্যে তাঁকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সাথে নিয়ে মদিনায় যান। সেখানে তিনি একমাস অবস্থান করেন। দারুন নাবেগাতে থাকতেন। হিজরত করে যখন মদিনায় যান, তখন ৪৭ বছর আগের সেই স্মৃতি তাঁর মনে পড়ে যায়। বৈঠকাদিতে কখনো কখনো বলতেন, মামা বাড়ীতে আনিসা নামে একটা মেয়ে তার খেলার সাথী ছিল। দুর্গের একটা পাখি বসতো আর ছেলে মেয়েরা তাকে উগিয়ে দিত। ঐ ঘরে আমার মা অমুক জায়গায় বসতো এবং পিতার কবর অমুক জায়গায় ছিল। রসূল সা. একথাও জানিয়েছিলেন যে, বনু নাজ্জারের একটা পুকুরে তিনি ভালো সাঁতার কাটা শিখেছিলেন। ঐ সফরের মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর মায়ের ইন্তিকাল হয়।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, পরবর্তীকালে যখন মদিনার সাথে ইসলামী আন্দোলনের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে, তখন এই সম্পর্ক নিশ্চয়ই তাতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মদিনার লোকেরা, বিশেষত বনু নাজ্জারের লোকেরা তাঁকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মনে করতো এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বনু নাজ্জার অধিকতর উৎসাহী ছিল। ঐ গোত্রের ছোট ছোট মেয়েরা গান গেয়ে তাঁকে স্বাগতম জানাচ্ছিল।

৩. দুধ খাওয়ার সম্পর্ক

জন্ম হবার পর রসূল সা. দিন কয়েক আবু লাহাবের দাসী সাওবিয়ার দুধ পান করেন। স্থায়ী দুধমাতা হবার সৌভাগ্য লাভ করেন বনু হাওয়াযেনের হালীমা সা’দিয়া। হালীমার বড় মেয়ে হাযযাফা (ডাক নাম আশ্শাম্মা) শিশুকালে রসূল সা. এর সেবা করেছিলেন। হোনায়েন যুদ্ধে হাযযাফা যখন বন্দীনী হয়ে এল, সামরিক প্রহরীদেরকে বললো, ‘‘আমি তো তোমাদের নেতার বোন। রসূল সা. এর কাছে তাকে আনা হলে তিনি আনন্দের সাথে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তার সামনে তিনি চাদর বিছিয়ে দেন। তিনি আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং বলেন, তুমি ইচ্ছা করলে আমার এখানেও থেকে যেতে পার, আর ইচ্ছা করলে তোমাকে তোমার গোত্রে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। সে গোত্রে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে রসূল সা. তাকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে বিদায় জানান। সে ইসলামও গ্রহণ করেছিল।
এই দুধমায়ের সম্পর্কের দোহাই দিয়েই বনু হাওয়াযেন গোত্র হোনায়েন যুদ্ধের পর নিজেদের বন্দী মুক্তির আবেদন জানায়। তিনি বনু হাশেমের সমস্ত বন্দীকে তৎক্ষণাত মুক্ত করে দেন এবং তাঁর দেখাদেখি সাহাবীরাও নিজ নিজ বন্দীদের ছেড়ে দেন।

৪. নিজের মেয়েদের বিয়ে

যয়নবের বিয়ে মক্কাতেই আবুল আসের সাথে সম্পন্ন হয়। আবুল আসের মা হযরত খাদীজার সৎ বোন ছিলেন। অর্থাৎ রসূল সা. তার খালু ছিলেন। যয়নব ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন। তার পরে তার স্বামী আবুল আসও ইসলাম গ্রহণ করে ও মদিনায় আসে। তাদের সাবেক সম্পর্ক বহাল থাকে। স্বামী স্ত্রীতে গভীর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। এমনকি মক্কাবাসী তালাক দিতে চাপ দেয়া সত্ত্বেও আবুল আস যয়নবকে তালাক দেয়নি। এই কারণে আবুল আসকে কাফের থাকা কালে মুসলমানদের অনুমতি নিয়ে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয় এবং তার থেকে দখলীকৃত বাণিজ্যিক পণ্য ফেরত দেয় হয়।
রুকাইয়ার বিয়েও মক্কায় হযরত ওসমানের সাথে সম্পন্ন হয়। এই দম্পতিই সর্বপ্রথম একত্রে হিজরত করেন। দ্বিতীয় হিজরীতে রুকাইয়া মারা গেলে ৩য় হিজরীতে রসূল সা. আল্লাহর নির্দেশে উম্মে কুলসুমকেও হযরত ওসমানের সাথে বিয়ে দেন। পর পর দুই মেয়ে বিয়ে করার কারণে তাকে ‘যিন্নুরাইন’ বলা হয়। হযরত ফাতিমাকে রসূল সা. হযরত আলীর সাথে বিয়ে দেন। আবুল আ’স ব্যতীত ইসলামী আন্দোলনের এই দু’জন শীর্ষস্থানীয় নেতা রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ সাথী বংশীয় সম্পর্ক ছাড়াও বৈবাহিক সম্পর্ক সূত্রে রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। এই আত্মীয়তা ইসলামী আন্দোলনের বিরাট কাজ পরিচালনায় সহায়ক হয়েছিল।

৫. রসূল সা. এর বৈবাহিক সম্পর্ক

যেহেতু রসূল সা. এর বৈবাহিক সম্পর্ক বিষয়ে উগ্র ইসলাম বিদ্বেষী পাশ্চাত্য দার্শনিকরা অনেক আপত্তি তুলেছেন, তাই আমাদের ভেতরকার একটা মহল এই বাস্তব ব্যাপারটাকে নিয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে যান। তারা ভাবেন, রসূল সা. এতগুলো বিয়ে করলেন, আর ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দিল, এ লজ্জা রাখি কোথায়? এ জন্য সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দিতে চাই।
সর্বপ্রথম যে কথাটা মনে বদ্ধমূল করা প্রয়োজন তা হলো, মানবেতিহাসের প্রথম যুগটা ছিল বংশবৃদ্ধির যুগ। সেই যুগটাকে আমরা রসূল সা. এর যুগ পর্যযন্ত বিস্তৃত দেখতে পাই। বিস্তীর্ণ ভূখন্ড তখন জনশূন্য ও অনাবাদী পড়ে থাকতো। জীবিকার উপকরণ উৎপাদনের ক্ষেত্রও খোলা পড়ে থাকতো। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মানবজাতির মধ্যে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেরণা অত্যন্ত জোরদার ছিল। এ জন্য সে যুগের যে কোন সভ্যতা বা ধর্মের দিকে তাকানো হোক না কেন, বহু বিবাহ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত শরীয়তের বিধানগুলিও এর অনুমতি দিয়েছে। বহু নবী একাধিক বিয়ে করেছেন মাত্র দু’একজন দেখা যায়, গৃহ সংসার পরিত্যাগ করে সার্বক্ষণিক দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ নবীই সাংসারিক জীবন যাপন করেছেন এবং সর্বাত্মকভাবে করেছেন। রসূল সা. বংশবৃদ্ধি ও বহু বিবাহের এই যুগেরই শেষভাগে অবস্থান করেন। তাঁরই সময় থেকে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু বিবাহের সংখ্যা সীমিত করার নির্দেশ আসে। [এই সীমাবদ্ধতা করণের নির্দেশে একাধিক বিয়ের শেষ সীমা চার পর্যযন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেই সাথে ন্যায়বিচারের কড়া শর্ত আরোপ করে এক বিবাহের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু একাধিক কারণে রয়েছে এবং থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, সর্বপ্রথম কারণ এই যে, ইসলাম যৌনতার স্বেচ্ছাচার ও ব্যভিচারকে সর্বতোভাবে বন্ধ করতে চায় এবং এজন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। এরূপ ব্যবস্থায় সেই সব লোকের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা জরুরী ছিল, যারা অধিকতর যৌন ক্ষমতার অধিকারী। এই বাস্তব প্রয়োজনকে পাশ্চাত্য দেশে উপেক্ষা করার ফল হয়েছে এই যে, এক স্ত্রীর সাথে বহু উপপত্নী রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপরন্তু বেশ্যাবৃত্তির ব্যবস্থাও প্রচলিত হয়েছে এবং তা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়াই এখন কঠিন হয়েছে। এমনকি “অবাধ প্রেম প্রণয়” নামে সম্মত ব্যভিচারের এমন তান্ডব চলছে যে, তার তুলনায় বিচার করলে ইসলামের বহু বিবাহ ব্যবস্থা অবশ্যই বহুগুণ শ্রেয় মনে হবে। দ্বিতীয় কারণ এই যে, ক্ষেত্র বিশেষে সন্তানের আকাংখা একাধিক বিয়ে করতে বাধ্য করে। তৃতীয় কারণ এক স্ত্রীর স্থায়ী রোগব্যাধি হতে পারে। এরূপ পরিস্থিতিতে রুগ্ন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বিপদে নিক্ষেপ না করে স্বামী তার স্বাভাবিক চাহিদা চরিতার্থ করতে পারে। চতুর্থ কারণ এই যে, অনেক সময় গোত্রীয় ও পারিবারিক রাজনীতি, শক্তিবৃদ্ধি, প্রতিশোধের ধারাবাহিকতা, উত্তরাধিকারের ঝামেলা এবং এতিম ও বিধবাদের পুনর্বাসনের সমস্যার সমাধান বিয়ের মাধ্যমেই হতে পারে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, প্রাচীন বা আধুনিক কালে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা অর্জনের একমাত্র পন্থা হিসেবে একাধিক বিয়ে অনেক সময় ফলপ্রসু হয়েছে।] রসূল সা. যে সব বিয়ে করেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতি ভিত্তিতেই করেছেন।
দ্বিতীয়ত রসূল সা. এর অধিকাংশ বিয়ে যৌন আকাংখা নিবৃত করার উদ্দেশ্যে নয় বরং ইসলামী আন্দোলন, দেশ ও জাতির কল্যাণের খাতিরেই করেছেন। এ সব বিয়ে প্রধানত রাজনৈতিক ছিল। রসূল সা. স্বয়ং বলেছেন, “আমার কোন স্ত্রীলোকের প্রয়োজন নেই। (দারামী) অর্থাৎ নিছক যৌন তাড়না আমাকে কোন স্ত্রী গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেনা। প্রকৃত পক্ষে রসূল সা. সঠিক অর্থে দুটো বিয়েই করেছেনঃ একটা হযরত খাদীজার সাথে এবং দ্বিতীয়টা হযরত আয়েশার সাথে। অন্যান্য বিয়ের পেছনে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক দাবী কার্যযকর ছিল। এইসব দাবী পূরণের খাতিরে রসূল সা. নিজের ব্যস্ততম জীবন ও অত্যন্ত দরিদ্র অর্থনীতির ওপর বিরাট বোঝা চাপিয়ে মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এখানে লক্ষণীয়, যে যুবক ২৫ বছর বয়স পর্যযন্ত অতুলনীয় সংযম, শালীনতা ও লজ্জাশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, আর তাও একটি সমাজে যেখানে মদ ও ব্যভিচার সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, যে যুবক ২৫ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর সাধারণ ভোগবাদী অভিরুচি অনুসারে কোন উঠতি যৌবনা তরুণীর পরিবর্তে ৪০ বছরের এক বিধবাকে নির্বাচন করে শুধু এ জন্য যে, এটা তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনে অধিকতর সহায়ক এবং তারপর জীবনের শ্রেষ্ঠ ২৫টি বছর সেই একই মহিলার সাথে কাটিয়ে ৫০ বছর পূর্ণ করে, তার সম্পর্কে কি এমন হীন ধারণা পোষণ করা যায়, যা আপত্তি উত্থাপনকারীরা পোষণ করে থাকে? আরো লক্ষণীয় যে, বিয়ের আধিক্যের সময়টা তাঁর জীবনে ৫৫ থেকে ৫৯ বছরের মাঝে অবস্থিত এবং আরবের মত গরম দেশে এই বয়সে যৌন আবেগ থিতিয়ে যেতে আরম্ভ করে। ওদিকে স্ত্রীদের বয়স দেখুন, দু’জন ছাড়া সবার বয়স বিয়ের সময় ২০ বছরের ওপরে ছিল। আর পাঁজনের বয়স তো ৩৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল। প্রশ্ন এই যে, রসূল সা. এর জন্য যুবতী ও সুন্দরী মেয়ের কি অভাব ছিল?
এ ধরনের আপত্তি উত্থাপনকারীদের ভাবা উচিত ছিল যে, তিনি নিজের ঘাড়ের ওপর কত বড় দায়িত্ব চাপিয়ে নিয়েছিলেন। তার না ছিল দিনের বেলায় এক মুহূর্তের স্বস্তি, আর না ছিল রাতে এক মুহূর্তের বিশ্রাম। তিনি মানুষকে পর্দার ন্যায় মহান ও কল্যাণকর বিধান দান করেছিলেন (এই বিধান নিয়েও ইউরোপীয়ানরা নাক সিটকায়) এবং মানুষকে নিজের দৃষ্টি ও মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বেশীরভাগ সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাবলী নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেটে যেত এবং রাতেও নিভৃত সময়গুলোতে নামায পড়তে পড়তে তাঁর পা ফুলে যেত। এহেন ব্যক্তি সম্পর্কে কিভাবে ঐ সব আজে বাজে কথা ভাবা যায়?
তাছাড়া ভোগবাদী রাজা বাদশাহ ও বিজেতাদের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও তাঁর মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়না। তিনি যুলুমবাজ এবং স্বৈরাচারীও নন। মদ, গানবাজনা ও মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছেদেও তার কোন আগ্রহ নেই। বরঞ্চ তিনি মানব সমাজকে এই সব ভোগবাদী আমোদ প্রমোদ থেকে পবিত্র করেছেন। তিনি না স্ত্রীদেরকে আরাম আয়েশের উপকরণে সরবরাহ করে করে দিয়েছেন, না তাদেরকে রেশম ও স্বর্ণের অলংকার দিয়ে সজ্জিত করেছেন। বরঞ্চ নিজের দরবেশ সুলভ জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট তাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন। তাদেরকে তিনি এতটা আদর সোহাগ কখনো করেননি, যাতে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন আন্দোলনের স্বার্থের চেয়েও অগ্রাধিকার লাভ করে, কিংবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নীতিও পরিত্যাগ করার প্রয়োজন পড়ে। বরঞ্চ এরূপ ক্ষেত্রে তাদেরকে তিনি কঠোরভাবে শাসিয়েছেন। এক পর্যায়ে তো ভরণপোষণের মান উন্নত করার দাবী তোলায় তাদেরকে তিনি খোলাখুলিভাবে বলে দেন যে, এই দরিদ্রাবস্থায় আমার সাথে থাকতে পারলে থাকো, নচেত আমি বিদায় করে দিতে প্রস্তুত। এই সব পরিস্থিতি একত্রে মিলিত হয়ে কি এই নিরর্থক আপত্তিকে খন্ডন করেনা?
রসূল সা. এর একাধিক বিয়ের পেছনে যে বিশেষ প্রয়োজনগুলো কার্যকর ছিল তা নিম্নরূপঃ গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে বংশীয় আভিজাত্যের বৃত্ত খুবই সীমাবদ্ধ এবং এর সীমারেখাগুলো খুবই মজবুত রাখা হয়। গোত্রীয় মানস আপন ও পরের মধ্যে অত্যন্ত তীব্রভাবে ভেদাভেদ করে। এহেন পরিস্থিতিতে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত গোত্র পরস্পরের সাথে যুক্ত করার জন্য যেখানে বিশ্বজোড়া মতবাদের প্রয়োজন, সেখানে নেতার ব্যক্তিত্বও এমন হওয়া চাই, যা সবার কাছে না হলেও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ গোত্রের কাছে প্রিয় ও আপন। আরবে কার্যত সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক কাজ করা এমন কোন ব্যক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিলনা, যার নিজস্ব কোন মর্যাদাবান গোত্র নেই। তবে ঐ কাজকে সাফল্যের পর্যায়ে নেয়ার জন্য আন্তঃগোত্রীয় সম্পর্কের প্রয়োজন ছিল এবং এই রাজনৈতিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্র বিশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল।
উদাহরণ স্বরূপ, উম্মুল মুমিনীন হযরত জুয়াইরিয়ার কথাই ধরুন। ইনি বনুল মুসতালিক গোত্রের মহিলা ছিলেন। গোটা গোত্র ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ডাকাতি ও লুটতরাজের জন্য কুখ্যাত। স্বয়ং হযরত জুয়াইরার পিতা ছিল ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকাত সর্দার। এই গোত্র প্রথম দিন থেকেই ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কট্টর শত্রুতা শুরু করে। তারা কোন শৃংখলাও মানতে প্রস্তুত ছিলনা, কোন আপোষ চুক্তিতেও সম্মত ছিলনা। তবে প্রত্যেক ব্যাপারে ইসলামী সরকারের কট্টর বিরোধিতা করতে সবসময় প্রস্তুত থাকতো। অবশেষে এই শক্তিকে সামরিক ব্যবস্থা দ্বারা দমন করা হয়। হযরত জুয়াইরিয়া বন্দিনী হয়ে আসেন। অতপর রসূল সা. এর সাথে যখন তার বিয়ে হলো, তখন ঐ গোত্রের সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দেয়া হলো। মুসলিম সৈন্যরা মনে করলো, ওরা এখন রাসূল সা. এর শ্বশুরালয়ের আত্মীয়, ওদেরকে বন্দী করে রাখা যায়না। এই বিয়ের বরকত দেখুন, গোত্রের প্রতিটি লোক ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে শান্তিপ্রিয় ও আইনশৃংখলার অনুগত হয়ে গেল। কেননা মদিনার শাসক এখন তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এমতাবস্থায় এ সব কাজ আর করা যায়না।
অনুরূপভাবে উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনার ব্যাপারটা ধরুন। নাজদ অঞ্চলটা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা কোরায়েশদের জন্য ইরাক যাতায়াতের একটা বানিজ্যিক পথ নাজদ অঞ্চলের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অথচ সেখানে ইসলামের দাওয়াত একেবারেই অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল। এখানকার লোকেরা ৭০ সদস্য বিশিষ্ট একটা দাওয়াতী দলকে শহীদ করে দিয়েছিল। তাছাড়া নাজদবাসী একাধিকবার ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও করেছিল। হযরত মায়মুনা নাজদের সরদারের স্ত্রীর বোন ছিলেন। রসূল সা. এর সাথে তার বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পরিবেশ পাল্টে গেল এবং নাজদ মদিনার প্রভাবাধীন হতে লাগল। তাছাড়া তাঁর একাধিক বোনের বিয়ে হয় অত্যন্ত মান্যগণ্য সরদারদের সাথে।
উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার ব্যাপারটাও তদ্রুপ। ইনি কোরায়েশের প্রধান সরদার আবু সুফিয়ানের মেয়ে ছিলেন। এই বিয়ের পর আবু সুফিয়ান আর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে ময়দানে আসেননি। এই বিয়ে আবু সুফিয়ানের শত্রুতার তেজই শুধু কমায়নি, বরং তা অনেকাংশে মক্কা বিজয়ের পথও সুগম করেছে।
অনুরূপভাবে হযরত সফিয়ার কথা বিবেচনা করুন। ইনি একজন শীর্ষস্থানীয় ইহুদী সরদার হুয়াই বিন আখতারের মেয়ে। তার সাথে রসূল সা. এর বিয়ে হওয়ার পর ইহুদীদের বিরোধিতার তেজ এমনভাবে থিতিয়ে যায় যে, তা আর মাথা চাড়া দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনি। হযরত সফিয়া রসূল সা. এর অনুমতিক্রমে ইহুদী আত্মীয়দেরকে আর্থিক সাহায্যও করতেন।
হযরত হাফসার বিয়ের পটভূমিকায় অন্যান্য কার্যকারণ ছাড়া এটাও ছিল অন্যতম যে ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য রসূল সা. যে ক’জন বিশিষ্ট সহচরকে নিজের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন, তন্মধ্যে চারজন ছিলেন প্রধান। এদের মধ্যে আবু বকরের মেয়ে হযরত আয়েশাকে রসূল সা. বিয়ে করেন, হযরত আলীর সাথে নিজের মেয়ে ফাতেমার বিয়ে দেন, হযরত উসমানের সাথে পর পর দুই মেয়ের বিয়ে দেন এবং হযরত ওমরের মেয়ে হাফসাকে নিজে বিয়ে করেন। হযরত ওমরকে এই আত্মীয়তার বৃত্তের বাইরে রাখা যেতনা। এভাবে ভবিষ্যতের নেতাদেরকে তিনি আস্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেন।
হযরত সওদা বিনতে যামায়া ছিলেন মদিনার বনু নাজ্জারের মেয়ে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় সাকরান বিন আমরের সাথে। এই সাকরানের ভাই ছিলেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে কোরায়েশদের প্রতিনিধি সোহায়েল বিন আমর। সাকরান মারা গেলে রসূল সা. সোহায়েলের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার খাতিরে তার বিধবা ভ্রাতৃবধু ৫০ বছর বয়স্কা সওদাকে বিয়ে করেন। হযরত খাদীজার ইন্তিকালের পর এই বিয়ে করে রসূল সা. নিজের একাকীত্বও ঘুচান।
রসূল সা. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে আরো একটা অনিবার্য প্রয়োজন পূরণ করার দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। সেটি হলো পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের মধ্যে মহিলাদের দ্বারাই দাওয়াতী কাজের প্রচলন এবং এজন্য কিছু মহিলা নেতা ও কর্মী সৃষ্টি। ইসলামী পর্দা ব্যবস্থাকে বহাল রেখে এ প্রয়োজন পূরণ করতে হলে তাঁর জন্যে একাধিক বিয়ে করা জরুরী ছিল এবং নিজের স্ত্রীদেরকে ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা মহিলাদের মধ্যে বিস্তারের কাজে নিয়োগ করা অপরিহার্যয ছিল। এই প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই কোরআনে রসূল সা. এর স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে। হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা ও হযরত উম্মে সালমা মহিলাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনী শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। অন্যান্য স্ত্রীগণ নৈতিক দিক দিয়ে নিজেদেরকে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে নারী সমাজের কাছে তুলে ধরেন।
কখনো কখনো রসূল সা. কে দ্বিতীয় পক্ষের মন রক্ষার জন্যও বিয়ে করতে হয়েছে। যেমন নিজের ফুফাতো বোন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশকে তিনি অনেক অনুরোধ করে যায়েদ বিন হারেসার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এ দ্বারা বংশীয় অভিজাত্যের সংকীর্ণ সীমারেখাগুলো ভাঙ্গাই কাম্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত এই বিয়ে ব্যর্থ হয় এবং তালাক সংঘটিত হয়। এর ফলে হযরত যয়নবের মর্মাহত হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখেনা এবং তাতে রসূল সা. নিজেকে কিছুটা দায়ী বলে অনুভব করেন। এই সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান ছিল যয়নবকে রসূল সা. এর বিয়ে করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা ছিল একটা ভ্রান্ত জাহেলী কুসংস্কার। তখনকার সমাজে পালিত পুত্রকে আপন পুত্রের মতই দেখা হতো। যায়েদ বিন হারেসাকে রসূল সা. নিজ পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই তার পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা অবৈধ ও রীতিবিরোধী মনে করা হতো। আল্লাহ এই রীতির বিলোপ সাধন করে যয়নবকে রসূল সা. এর সাথে বিয়ে দেন।
একটু আগে আমি উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ানকে বিয়ে করার রাজনৈতিক স্বার্থকতা বর্ণনা করেছি। কিন্তু ঐ বিয়ের পেছনেও ভগ্নমনকে প্রবোধ দেয়ার একটা ইচ্ছা সক্রিয় ছিল। তার বিয়ে হয়েছিল ওবায়দুল্লাহর সাথে এবং তারই সাথে তিনি হিজরত করে আবিসিনিয়া চলে যান। সেখানে স্বামী খৃষ্টান হয়ে যায় এবং মদে অভ্যস্ত হয়ে মারা যায়। উম্মে হাবীবা ইসলামের ওপর অবিচল থেকেছেন। কিন্তু প্রবাসকালে স্বামীর ইসলাম ত্যাগ ও মৃত্যু তার জন্য মর্মঘাতী ব্যাপার ছিল। তাই রসূল সা. আমর বিন উমাইয়া আয-যামরীকে বিশেষ দূত হিসাবে নাজ্জাশীর কাছে পাঠান এবং তার মাধ্যমে তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। উম্মে হাবীবা এত খুশী হন যে, সুসংবাদদাতা শাহী দাসীকে নিজের অলংকার দিয়ে পুরুস্কৃত করেন। বাদশাহ নাজ্জাশী নিজেই বিয়ে পড়ান। উম্মে হাবীবা নিজের মামাতো ভাই খালেদ বিন সাঈদকে নিজের উকীল নিয়োগ করেন। নাজ্জাশী নিজে চারশো দিনার মোহরানা দিয়ে দেন এবং ভোজের আয়োজন করেন। কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, মদিনায় পুনরায় বিয়ে পড়ানো হয় এবং ওলিমা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুরূপভাবে উম্মুল মাসাকীন যয়নব বিনতে খুযায়মা ইবনুল হারেস হেলালিয়া (বনু বকর) রসূল সা. এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশের স্ত্রী ছিলেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাওয়ার পর রসূল সা. তাকে বিয়ে করেন। এটা ছিল পুরোপুরি পারিবারিক ঘটনা এবং ভগ্নমনকে প্রবোধ দেয়ার পাশাপাশি এখানে পারিবারিক দিকটাও লক্ষ্য রাখা হয়েছিল।
রসূল সা. সর্বমোট এগারোটা বিয়ে করেন। এর চেয়ে বেশী বিয়ের কথা যে সব বর্ণনায় রয়েছে, তা নির্ভরযোগ্য নয়। এঁদের মধ্যে হযরত খাদীজা হিজরতের পূর্বে (নবুয়তের দশম বছর) এবং যয়নব বিনতে খুযায়মা বিয়ের মাত্র তিন মাস পর ৩য় হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। রসূল সা. এর শেষ বয়সে এক সাথে ৯ জন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হযরত সওদা চরম বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার কারণে দৈহিক কামনা বাসনার ঊর্ধে ছিলেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসার কারণে রসূল সা. আর কোন বিয়ে করেননি। সাধারণ মুসলমানদের তুলনায় আইনে তিনি একটা বিষয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। সাধারণ মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ ছিল, চারটের বেশী কোন স্ত্রী থাকলে তাকে তালাক দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু রসূল সা. কে অতিরিক্ত স্ত্রীদেরকে কাছে রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এই ব্যতিক্রমের কারণ ছিল এই যে, রসূল সা. এর স্ত্রীগণকে দ্বীনী প্রয়োজনের আলোকে উম্মুল মুমিনীন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ স্ত্রীগণের আওতা ভুক্ত করা হয়েছিল। তখন তাদের কাউকে যদি রাসূল সা. তালাক দিতেন, তবে তারা একেবারে আশ্রয়হীন হয়ে যেত।
এবার রসূল সা. এর বিয়েগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব লক্ষ্য করুন। এ সব বিয়ের কল্যাণে রসূল সা. একদিকে মক্কায় গোত্রসমূহ ও মোহাজেরদের সাথে এবং অন্যদিকে সাধারণ গোত্রগুলোর সাথে যে সখ্যতা গড়ে ওঠে, তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য আমি সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলোর নাম উল্লেখ করছিঃ
(১) বনু আসাদ বিন আবদুল উয্যা (২) বনু আমের (৩) বনু তামীম (৪) বনু আদী (৫) বনু মাখযুম (৬) বনু উমাইয়া (৭) বনু আসাদ বিন খুযায়মা (৮) বনু মুসতালিক (৯) আরব ইহুদী সম্প্রদায় (১০) বনু কিলাব (১১) বনু কান্দা।
এই সব গোত্রের এলাকাগুলোকে যদি ভৌগলিক বিভক্তির আলোকে দেখা হয় তাহলে বুঝা যায় যে, রসূল সা. এর ব্যক্তিত্ব প্রকৃত পক্ষে আন্তগোত্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় গোত্রের জন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের রূপ ধারণ করেন এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে সর্বব্যপী ঐক্যের চাহিদা জন্মেছিল, তা পূরণ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এই বৈবাহিক সম্পর্কগুলো বিদ্রোহাত্মক প্রবণতাকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছিল। এমনকি যুগ যুগ কাল থেকে চলে আসা বহু শত্রুতাও এর দ্বারা খতম হয়ে গিয়েছিল। এখন ভেবে দেখা উচিত যে, সমগ্র বিশ্বমানবতার কাম্য যে সুবিচার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিশ্বজোড়া ভ্রাতৃত্ব, তা অর্জনের জন্য যদি আরবের গোত্রীয় পরিবেশে বহুবিবাহ সহায়ক হয়, তবে তা কেন করা হবেনা? আর তা নিয়ে এত হৈ চৈ এরই বা কারণ কী?
প্রকৃতপক্ষে সুক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, এটা ছিল রসূল সা. এর বিরাট ত্যাগ ও কুরবানী যে, তিনে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের অসংখ্য ব্যস্ততার পাশাপাশি শেষ বয়সে নিজের ঘাড়ে এত বেশী দাম্পত্য বোঝা চাপিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিজের দরিদ্র দশায় এত কষ্টে পরিবারের ভরণ পোষণের দাবি পুরণ করেছেন। এটা কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কল্পনায়ও আসতে পারেনা যে, উল্লিখিত সার্বিক পরিস্থিতিতে বিয়ে করার পর কোন মানুষের পক্ষে আমোদ ফূর্তিতে কাটানো দূরে থাক, একটা মুহূর্ত শ্রান্তির জীবন যাপন করাও সম্ভব হতে পারে। এ জন্যই বলেছি, রসূল সা. নিজের মহত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের খাতিরে এতগুলো বিয়ে করে আসলে মস্ত বড় ত্যাগ ও কুরবানীরই পরিচয় দিয়েছেন।
বলতে গেলে এর দ্বারা রসূল সা. এর যে সর্বব্যাপী ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয়ের পথ সুগম ও তাকে ত্বরান্বিত করেছে এবং জনগণের ইসলামের দিকে অগ্রসর হওয়াকে সহজতর করে দিয়েছে।

জনতার স্বতস্ফূর্ত অগ্রযাত্রা

যে কোন বিপ্লবী আদর্শবাদী আন্দোলনের ন্যায় রসূল সা. পরিচালিত আন্দোলনকে দু’টো বড় পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে ইসলামী আন্দোলন নিজে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে ডাকতো। আর দ্বিতীয় পর্বে জনতা স্বউদ্যোগে ও স্বতস্ফূর্তভাবে সামনে এগিয়ে এসেছে এবং ইসলামের দরজায় করাঘাত করে বলেছে, আমরা ভেতরে আসতে চাই। এই শেষোক্ত পর্বটা সম্প্রসারণের পর্ব। এই পর্ব যখন আসে তখন সমস্ত প্রতিরোধের অবসান ঘটে এবং সমস্ত নেতিবাচক মনোভাব ময়দান ছেড়ে পালায়। কিন্তু এই পর্বে পৌঁছা পর্যন্ত রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণ অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। একদিকে তাত্ত্বিক দাওয়াতের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, যুক্তি প্রমাণের শক্তি আমাদেরই পক্ষে। অপর দিকে নৈতিকতার ময়দানে অকাট্যভাবে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, ইসলামের তৈরী মানবতা ও মনুষ্যত্বের মডেলই শ্রেষ্ঠতম মডেল। তৃতীয় দিকে রাজনৈতিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও কুশলতার দিক দিয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কিভাবে সমকালীন সমাজের সাথে লেনদেন করতে হয় তা আমরা জানি। চতুর্থ দিকে যুদ্ধের ময়দানেও দেখিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিরোধের প্রাচীর কিভাবে ভাংতে হয় এবং যুলুমবাজদের কিভাবে উৎখাত করতে হয় তা, আমাদের জানা আছে। রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা মানুষের মনে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়েছেন, ঝাকি দিয়েছেন ও দোলা দিয়েছেন, মানুষের ভাবাবেগকে পক্ষে টেনেছেন, ভাগ্যবান আত্মাগুলোকে স্বমতে দীক্ষিত করে বুকে টেনে নিয়েছেন, শান্তিপ্রিয় গোত্রগুলোকে সন্ধি ও শান্তি চুক্তির আওতাভুক্ত করেছেন এবং যে শত্রুরা যুদ্ধ চায় তাদের দাপট চূর্ণ করে পথ পরিস্কার করেছেন। এত সব কিছু করার পরই সেই সময়টার সমাগম ঘটেছিল যখন জনগণ চারদিক থেকে নতুন আশার কেন্দ্রবিন্দু মদিনার দিকে ছুটে এসেছে।
এ পর্বটা বা যুগটার সূচনা হয় “আমুল উফুদ” বা “প্রতিনিধিদল সমুহের আগমনের বছর” থেকে অর্থাৎ যে বছর ইসলাম গ্রহণের জন্য, রাজনৈতিক আনুগত্যের অঙ্গীকার করার জন্য অথবা নিছক অনুসন্ধান চালিয়ে পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ও বিভিন্ন গোত্র থেকে প্রতিনিধি দল এসেছিল, সেই বছর থেকে। এই সময় সর্বত্র ইসলামের পিপাসা লেগে গিয়েছিল, এবং একটা সাড়া ও চাঞ্চল্য পড়ে গিয়েছিল। এ সময়টা মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে তিন বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরী জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বলা যেতে পারে যে, এ সময়টা ছিল বিশ্বমানবতার মুক্তিদূতের সা. রোপন করা ফসল ফলনের মৌসুম। আমরা যদিও সংক্ষিপ্ত করতে চাই। কিন্তু নবী জীবনের এ অধ্যায়টা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিনিধিদলগুলো নিয়ে আলোচনা না হলেই নয়। কেননা প্রতিনিধি দলগুলোর আগমন, আলাপ আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। এ বিবরণ থেকে এও জানা যাবে যে, রসূল সা. এর কাছে কিভাবে জনতার ঢল এসেছিল। সীরাতের বিভিন্ন পুস্তুকে মদিনায় আগত প্রতিনিধিদলের সংখ্যা কমের পক্ষে ১৫ এবং সর্বাধিক ১০৪ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এই সব দলের মধ্য থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দলের বিবরণ দেব। আর এর মধ্যে থেকেও মাত্র কয়েকটি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেব। উল্লেখ্য যে, প্রতিনিধি দলের আগমন যদিও মক্কা বিজয়ের পর ৮ম হিজরীতে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু একটা দুটো দলের আগমন ৫ম হিজরী থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা সেই সময় থেকেই শুরু করছিঃ

১. মুযাইনা গোত্রের প্রতিনিধি দল

এটি একটি সুবৃহত গোত্র। কিছুটা ওপরে গিয়েই কোরায়েশদের সাথে তাদের বংশধারা মিলে গেছে। প্রখ্যাত সাহাবী নুমান বিন মুকরিন এই গোত্রেরই লোক। হিজরী ৫ম বছর এই গোত্রের প্রায় চারশো লোক রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে। সম্ভবত এটাই ছিল সর্ব প্রথম মদিনায় আগমনকারী প্রতিনিধি দল। মদিনা থেকে ফেরার সময় তাদেরকে পাথেয় হিসেবে প্রচুর খেজুর দেয়া হয়।

২. বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধি দল

এ দলটিও প্রাথমিক যুগে খুবই জাঁকজমকের সাথে এসেছিল। গোত্রের বড় বড় নেতা আকরা বিন হাবেস, যাবারকান, আমর ইবনুল আহতাম, নঈম বিন ইয়াযীদ এবং উয়াইনা বিন হিসন ফাযারী ও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দলের আগমনে মদিনায় উৎসবের আমেয অনুভুত হয় এবং চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তারা মসজিদে প্রবেশের সময় অনেকটা অমার্জিতভাবে রসূল সা. এর কক্ষের কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকছিলঃ “ও মুহাম্মদ, মুহাম্মদ! সা. বাইরে এস।” এই ঘটনা উপলক্ষে সূরা হুজরাত নাযিল হয় এবং মুসলমানদের ভদ্র ও মার্জিত আচরণ শিক্ষা দেয়া হয়। তারা যদিও ইসলাম গ্রহণের মনোভাব নিয়েই বাড়ী থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু আরবীয় আভিজাত্যবোধে তাদের স্বভাবে তখনো অক্ষুন্ন ছিল। তারা অভিলাষ প্রকাশ করলো যে, উভয় পক্ষের বাগ্মী ও কবিদের মধ্যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা অনষ্ঠিত হোক। আসলে আরবের অভিজাত শ্রেণীর গোত্রগুলোর স্বভাবই এ রকম ছিল যে, বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভার দিক দিয়ে কাউকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর না দেখে তার নেতৃত্ব তারা মেনে নিতে পারতোনা। তাই রসূল সা. মেধার প্রতিযোগিতার এই প্রস্তাব মঙ্গলজনক হবে ভেবে মেনে নিলেন।
বনু তামীম গোত্রের নামকরা বক্তা ছিল আতারিদ বিন হাজের। সে নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা, ধনবল ও জনবল ইত্যাদির প্রশংসা করে এক মনোজ্ঞ ভাষণ দিল। ভাষণের শেষে বললো, “যারা আমাদের সমকক্ষ হবার দাবীদার, তারা এ ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরুক।”
রসূল সা. এর ইংগিতে ইসলামী আন্দোলনের এক বক্তা ছাবেত বিন কায়েস পাল্টা ভাষণ দিতে উঠলেন। তিনি এক উদ্দীপনাময় ভাষণে ইসলামী আন্দোলনের গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তার দাওয়াতের দিকটাকে জোরদার করে প্রকাশ করলেন এবং এটাকেই ইসলামী সমাজের গৌরবের প্রধান উৎস বলে অভিহিত করলেন।
এরপর বনু তামীমের খ্যাতনামা কবি যাবারকান বিন বদর একটা কবিতা আবৃত্তি করলো। তার একটা বাক্য হলো।
“আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ। কেউ আমাদের সমকক্ষ নয়। আমাদের মধ্যে রাজা রয়েছে। আমরা উপাসনালয় নির্মাণ করি।”
এ সময় ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কবি হাসসান বিন ছাবিত ‍উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে ডেকে আনা হলো। রসূল সা. বললেন, “ওঠো হাসসান, এই কবির কবিতার জবাব দাও।” জবাবে হাসসান যে কবিতা পাঠ করলেন তা ইবনে হিশাম উদ্ধৃত করেছেন। প্রতিনিধিদল স্বীকার করলো, তাদের বক্তা ও কবির চেয়ে রসূল সা. এর কবিতা ও বক্তা শ্রেষ্ঠ। অতপর সমগ্র দল ইসলাম গ্রহণ করলো।

৩. বনু আবদুল কায়েস প্রতিনিধি দল

মুনকিয ইবনে হাব্বানের মাধ্যমে বাহরাইনে ইসলাম প্রচারের কাজ আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ক্রমেই ইসলামের প্রসার ঘটতে লাগলো। ৫ম হিজরীতে ১৩ জনের এক প্রতিনিধি দল মদিনায় এল। রসূল সা. এর প্রশ্নের জবাবে তারা যখন বললো, আমরা রবীয়ার গোত্রের লোক, তখন, তখন তিনি তাদেরকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানালেন। তারা বললো, “আমরা অনেক দূরবর্তী এলাকার অধিবাসী। পথিমধ্যে মুযার পৌত্তলিকরা বাস করে। নিষিদ্ধ চার মাসে ছাড়া চলাফেরা করা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটা কথা বলে দিন, যা আমরা ও আমাদের গোত্রের সবাই পালন করবো। রসূল সা. তাওহীদ, নামায, রোযা ও গনিমতের এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর পথে দেয়ার আদেশ দিলেন, মদ বানাতে নিষেধ করলেন এবং বাহরাইনে এ কাজে ব্যবহৃত চার রকমের পাত্রের নামোল্লেখ করে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। প্রতিনিধি দল বাহরাইনের অনৈসলামিক সামাজিক প্রথা সম্পর্কে রসূল সা. এর নির্ভুল জ্ঞান দেখে অভিভূত হয়ে গেল। আমূল পরিবর্তনকারী একটি আন্দোলনের নেতা দাওয়াতের আওতাভুক্ত এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান না রাখলে কাজই চালাতে পারেনা। রসূল সা. নিজের ব্যক্তিগত সফর এবং মক্কা ও মদিনায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত লোকদের কাছ থেকে এ সব জ্ঞান লা্ভ করেছিলেন।
এই প্রতিনিধি দলে জারূদ ইবনুল আলা নামক একজন খৃষ্টানও ছিল। সে বললো, আমি একটা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। তা ছেড়ে আপনার ধর্ম গ্রহণ করলে আপনি কি নিরাপত্তা দিতে পারবেন? (অর্থাৎ আখেরাতে কোন বিপদ ঘটবেনা তো?) রসূল সা. বললেন, “হ্যাঁ, আমি নিরাপত্তা দিচ্ছি। কেননা আমি যে ধর্মের আহবান জানাচ্ছি তা তোমাদের চেয়ে উত্তম।” জারূদ তৎক্ষণাত মুসলমান হয়ে গেল। তার স্বধর্মীয় সাথীরাও ইসলাম গ্রহণ করলো।

৪. বনু সা’দ গোত্রের প্রতিনিধি

এই গোত্র যিমাম বিন সা’লাবাকে প্রতিনিধি করে মদিনায় পাঠালো। এই উষ্ট্রারোহী প্রতিনিধি বেদুঈনদের মত হাবভাব নিয়ে মসজিদে নববীতে ঢুকে সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞেস করলোঃ তোমাদের মধ্যে আব্দুল মুত্তালিবের ফরবন্দ কে? সবাই রসূল সা. এর দিকে ইংগিত করলো। সে কাছে গিয়ে বললো, “ওহে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। কয়েকটা কথা খোলাখুলি জিজ্ঞেস করবো। কিছু মনে করবেনা”। রসূল সা. তাকে অনুমতি দিলেন। সে কসম খাইয়ে খাইয়ে তাওহীদ, রিসালাত নামায রোযা ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো যে, আপনি কি এ সবের শিক্ষা দিয়ে থাকেন? রসূল সা. এক একটি করে জবাব দিলেন। সমস্ত জবাব পাওয়ার পর বললো, আমার নাম যিমাম বিন সা’লাবা। আমার গোত্র আমাকে পাঠিয়েছে। আমি যাচ্ছি। আপনি আমাকে যা যা বললেন তা আমি হুবহু মেনে নিলাম একটুও কম নয়, বেশীও নয়। আমার গোত্রকেও শুধু এগুলোই জানাবো।” তারপর উটে চড়ে রওনা হয়ে গেল। তার যাওয়ার পর রসূল সা. বললেন, “এই ব্যক্তি যদি সত্যি বলে থাকে, তবে সে জান্নাতে যাবে।”
গোত্রে ফিরে গিয়ে সে জোরে শোরে দাওয়াত দিল এবং বললো, “ওহে জনগণ! আমি আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। লাত ও উযযার কোন মূল্য নেই। লোকেরা তাকে ভয় দেখালো যে, “সাবধান, এ ধরনের কথাবার্তার কারণে তোমার ওপর দেবদেবীর অভিশাপ না পড়ে এবং উন্মাদ কিংবা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে না যাও।” যিমাম বললো, “আল্লাহর কসম, ওরা কোন লাভও করতে পারেনা, লোকসানও নয়।” সন্ধ্যার আগেই সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করলো।

৫. আশয়ারী গোত্রের প্রতিনিধি দল (ইয়ামান)

আশয়ারী ইয়ামানের একটা সম্ভ্রান্ত গোত্র। আবু মূসা আশয়ারী রা. এই গোত্রের লোক ছিলেন। মক্কী যুগে তোফায়েল বিন আমর দাওসী ও আবিসিনিয়ার মোহাজেরদের মাধ্যমে তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। এসব দাওয়াতের প্রভাবিত তিন ব্যক্তি হিজরতের সংকল্প নিয়ে রসূল সা. এর কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ ও ইসলামী আন্দোলনকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে মদিনা রওনা হল।
সফর ছিল সামুদ্রিক। পথিমধ্যে প্রতিকূল বাতাসের কবলে পড়ে জাহাজ আবসিনিয়ার তীরে গিয়ে ভিড়লো। এখানে তারা প্রথম হিজরতকারী দলের সাক্ষাৎ পেলো। কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার পর তারা হযরত জাফরের সাথে কতিপয় নও মুসলিম আবসিনীয়কে সাথে নিয়ে মদিনায় রওনা হল। ৭ম হিজরীতে খয়বর বিজয়ের সময় তারা রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়। তারা এতো আবেগাপ্লুত ছিল যে মদিনার সীমানায় এসেই তারা এই বলে গান গাইতে থাকে-
“আগামী কালই আমরা আমাদের প্রাণ প্রিয় মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের সাথে মিলিত হব”।
রসূল সা. খবর পেয়ে তাঁর সাথীদের কাছে বললেন ‘তোমাদের কাছে ইয়ামান থেকে কিছু লোক আসছে, (সম্ভবত) তারা অত্যন্ত কোমল হৃদয় সম্পন্ন লোক। ইয়ামানবাসী ঈমানেও পরিপক্ক, কৌশলেও নিপুণ’।
এর পর তাদের সাথে সাক্ষাত হল, আলাপ আলোচনা হল, প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠিত হল। তাদের ইসলাম গ্রহনে মদিনায় এক নতুন সাড়া পড়ে গেলো।

৬. দাওস গোত্রের প্রতিনিধি দল(ইয়ামান)

আমরা আগেই বলেছি, তোফায়েল দাওসী মক্কার প্রাথমিক যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। গোত্রে ফিরে তিনি খুব জোরে শোরে দাওয়াতের কাজ শুরু করতে থাকেন, তাঁর পিতা ও স্ত্রী তো তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করেন। গোত্রের অন্যরাও কিছুটা প্রভাবিত হন। কিন্তু গোত্রে নৈতিক অধঃপতন ও ব্যভিচার ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তোফায়েলের মাত্রাতিরিক্ত তেজস্বীতা ও আবেগের কারণে তাঁর দাওয়াতি কাজ তেমন অগ্রগতি হয়নি। তাই রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করলেন এবং গোত্রের বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ তুলে দোয়া চাইলেন। রসূল সা. তাঁকে কোমল ও নম্র পন্থায় দাওয়াত দিতে বললেন এবং দাওস গোত্রের সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। এবার তোফায়েল ফিরে গিয়ে দাওয়াত দিতে শুরু করলে নতুন পথ খুলে গেলো। ৫ম হিজরীতে অনেক গৃহে ইসলামের আলো প্রবেশ করলো। ৭ম হিজরীতে এই গোত্রের ৮০ টি পরিবার হিজরত করে মদিনায় এসে গেলো। এই হিজরতকারীদের মধ্যে হযরত আবু হোরায়রার মতো ব্যক্তিত্ব ও ছিলেন।

৭. সুদা গোত্রের প্রতিনিধি দল

এই গোত্রের যায়েদ বিন হারেস সুদাই সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং গোত্রে ফিরে গিয়ে যথেষ্ট দাওয়াতের কাজ করেন। ৮ম হিজরিতে ১৫ ব্যক্তির এক প্রতিনিধি দল সমগ্র গোত্রের পক্ষে হয়ে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে। সা’দ বিন উবাদা তাদের মেহমানদারী করেন। তিনি তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাই শুধু করেননি বরং তাদের পোশাকের ব্যবস্থাও করেন। তারা রসূল সা. কাছে ইসলামী আন্দোলনে যোগদানের অঙ্গীকার করেন এবং গোত্রের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানান। এই প্রতিনিধি দল ফেরত যাওয়ার পর দ্রুত গতিতে দাওয়াতের কাজ চলে। বিদায় হজ্বের সময় এই গোত্রের প্রায় একশো ব্যক্তি মক্কায় এসেছিল।
এই ছিল মক্কা বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে আগত প্রতিনিধি দল গুলোর বিবরণ। মক্কা বিজয়ের পর তো চারদিক থেকে জনতার সয়লাব আসতে থাকে। ৯ম ও ১০ম হিজরিতে যেসব প্রতিনিধি দল মক্কায় আসে এবার তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হচ্ছেঃ

৮. সাকীফ প্রতিনিধি দল(তায়েফ)

রসূল সা. যখন বিজয়ের সফর থেকে মদিনায় ফিরে যান, তখন উরওয়াহ বিন মাসুউদ সাকাফি উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ ও বনী সাকিফ গোত্রে ইসলামের বিস্তার ঘটানোর সংকল্প প্রকাশ করেন। রসূল সা. সাকীফ গোত্রের স্বভাবগত দাম্ভিকতার প্রেক্ষাপটে তাঁকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন এবং আশংকা প্রকাশ করেন যে, তারা তোমাকেই হত্যার চেষ্টা করতে পারে। হযরত উরওয়ার নিজের ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তির উপর যথেষ্ট আস্থা ছিল। তাই তিনি অনেক অনুনয় বিনয় করে রসূল সা. এর কাছে থেকে দাওয়াতী কাজের অনুমতি গ্রহণ করলেন। মদিনা থেকে ফিরে গিয়েই তিনি নিজের বাড়ীর ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নিজের ইসলাম গ্রহনের কথা ঘোষণা করলেন। কিন্তু নিজের ধারণার বিপরীত তিনি চতুর্দিক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হতে দেখলেন। এরই একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। বনু সাকীফ এই যালেম সুলভ অপকর্মটা করলো বটে, তবে এটা তাদের বিবেক কে একটা প্রচন্ড ঝাঁকিও দিলো। তারা পরিস্থিতিকে ঠান্ডা মাথায় পর্যালোচনা করতে বাধ্য হল। মাস খানেক পর তারা একটা বৈঠক আহবান করলো, এ বৈঠকে পরিস্থিতির বাস্তব পর্যালোচনার পর তারা যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলো তা হল, ইসলামের অনুগত হয়ে যাওয়া সমগ্র আরব জাতির সাথে কি আমরা একাই মোকাবেলা করতে সক্ষম? অবশেষে স্থির হল, মদিনায় একজন দূত পাঠানো হবে। কিন্তু একজন দূতের পরিবর্তে পুরো একটা প্রতিনিধি দলই পাঠানো হল। উসমান বিন আবিল আস, আস বিন আওফ, বাহায বিন খাফশা( বনু মালেকের প্রতিনিধি), হাকাম ইবনে ওমর, এবং শুরাহবীল ইবনে গায়লান(মিত্র গোত্র গুলোর প্রতিনিধি) দলের অন্তর্ভুক্ত হল। তায়েফের সরদার আবদ ইয়ালীল তাদের দলনেতা হয়ে মদিনায় গেলো। স্মরণ করা যেতে পারে ১২বছর আগে যে ব্যক্তিটি রসূল সা. এর দাওয়াত শুনতেই চায়নি এবং শহরের বখাটে ছেলেদেরকে তাঁর পিছনে লাগিয়ে দিয়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করিয়েছিল, সেই ব্যক্তিই এই আবদ ইয়ালীল।
রসূল সা. তবুক থেকে মদিনায় ফিরে আসার পর এই প্রতিনিধি দল মদিনায় পৌঁছলো। তাদের জন্য মসজিদে নববীর কাছেই শিবির স্থাপন করা হল। খালেদ বিন সাঈদ উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচক নিযুক্ত হল।
এই আলোচক অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত পেশ করলো। একটা শর্ত এই ছিল, তাদের ‘লাত’ মূর্তি কে তিন বছরের মধ্যে ভাঙ্গা যাবেনা। তারপর এই সময় কে কমাতে কমাতে তারা এক মাসের পর্যায়ে নিয়ে এলো। ওটা যে নিছক একটা স্থবির পাথর তা তাদের মন তখন মানতে চাইছিলনা। তারা এই আশংকাও প্রকাশ করলো যে, তাদের মূর্তি যদি জানতে পারে যে তাকে ভাঙ্গা হবে, তবে তা সমগ্র দেশবাসীকে মেরে ফেলতে পারে। হযরত ওমর রা. এতক্ষন চুপচাপ থেকে কথা শুনছিলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি আবদ ইয়ালীল কে বললেন “কি সব মূর্খতাপ্রসূত কথাবার্তা বলছ? তোমাদের এসব উপাস্য পাথর ছাড়া আর কিছু নয়।” আবদ ইয়ালীল উত্তেজিত হয়ে বলল “ওহে খাত্তাবের ছেলে, আমরা তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি। আমরা কথা বলছি আল্লাহর রসূলের সাথে।” রসূল সা. যখন এই সমস্ত শর্তের একটাও রাখলেননা, তখন তারা অগত্যা এই শর্ত দিলো যে, মূর্তি যদি ভাংতেই হয় তবে তা আমাদের দিয়ে যেন ভাঙ্গানো না হয়। রসূল সা. তাদের এই শর্ত মেনে নিলেন। অতঃপর মূর্তি ভাংতে আবু সুফিয়ান বিন হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বা কে নিযুক্ত করা হল। এর পর তারা শর্ত দিলো যে আমাদের নামায পড়া থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। রসূল সা. বললেন, ‘যে ধর্মে নামায নেই, তাতে কোন কল্যান নেই।’
প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য এ আবেদনও জানালো যে, ‘হে আল্লাহর রসূল আমাদেরকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। ব্যভিচার না করে তো আমাদের উপায়ই থাকে না’। তারপর তারা বলতে লাগলো “আমাদের জন্য সুদী কারবারের সুযোগটা উন্মুক্ত রাখা হোক আর মদ খাওয়ার অনুমতিও দেয়া হোক”।
ভাবখানা এই যেন রসূল সা. একটা দোকান খুলে বসেছেন। যার যতটুকু সদাই কেনার দরকার কিনবে বাকি টুকু কিনবেনা। রসূল সা. এই দাবি গুলোর জবাবে কোরআনের আয়াত পড়ে পড়ে জানিয়ে দিতে লাগলেন যে, এসব স্বয়ং আল্লাহ্‌ তায়ালার বিধান, কারো মন গড়া বিধান নয়। যখন এসব অন্যায় শর্ত প্রত্যাখাত হল, তখন প্রতিনিধি দল পরামর্শ ক্রমে সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আমরা যদি ইসলামী আইন না মানি তবে আমাদের পরিনতিও একদিন মক্কাবাসির মত হবে। তাই বাধ্য হয়ে তারা মাথা নোয়ালো ও চুক্তি লেখানো হলো। রসূল সা. শুধু দুটো ব্যপারে তাদের কিছুটা রেয়াত দিলেন প্রথমত কিছু দ্বীনের জন্য তাদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হবে না এবং তাদেরকে জেহাদে অংশ গ্রহনে বাধ্য করা হবেনা। কিন্তু ইসলাম যখন তাদের অন্তরে বদ্ধমূল হতে লাগলো তখন একে একে সব দাবীই তারা স্বতস্ফূর্ত ভাবে পূরণ করতে লাগলো। বলা বাহুল্য রসূল সা. আশাও করেছিলেন তাই।
প্রতিনিধি দলের উসমান ইবনে আবিল আস ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান যুবক। তিনি অবসর সময়ে পড়া শুনা করে ইসলাম ও ইসলামী বিধানের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতেন। তাকেই আমীর নিযুক্ত করা হলো। তারা তায়েফ ফিরে গিয়ে প্রথমে নাটকীয়ভাবে চরম বিরোধী মনোভাব পেশ করতে লাগলো যে, মুহাম্মদ সা. আমাদের উপর অত্যন্ত অগ্রহনযোগ্য শর্তাবলী পেশ করেছে। কাজেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। দুদিন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর উত্তেজনা পূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করতে লাগলো। অবশেষে তায়েফ বাসী আপনা থেকেই বলতে লাগলো “ আমরা মুহাম্মদ সা. এর সাথে কেমন করে লড়বো। সমগ্র আরব তো এখন তাঁর আদেশেই চলছে। যাও,সে যা যা বলে মেনে নাও। এভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করার পর প্রতিনিধি দল আসল কথা খুলে বলল। তারা বলল আসলে আমরা মুহাম্মদ সা. কে খোদাভীতি, সততা, সত্যবাদিতা ও দয়ায় খুবই উঁচুমানে উন্নীত পেয়েছি। আমাদের সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।
মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আবু সুফিয়ান ও মুগীরাকে প্রতিনিধি দলের সাথেই তায়েফে পাঠানো হলো। তারা যখন মূর্তি ভাঙ্গার কাজ শুরু করলো তখন আবাল বৃদ্ধ বনিতা এটা দেখার জন্য রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলো যে, ভাঙ্গার কাজে লিপ্তদের কপালে কি ঘটে? কোন কোন মহিলা ভয়ে কেঁদেই ফেললো। তারা ভেবেছিল যে, হয়তো আকাশ ভেঙ্গে মাটিতে পড়বে। তাদের কেউ কেউ কবিতা আবৃতি করে করে বলল “ ঐ সব কাপুরুষদের জন্য কাঁদো, যারা নিজেদের দেবমূর্তিকে শত্রুর হাতে সঁপে দিয়েছে এবং কোনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।”
যে তায়েফ (মক্কার মতই) একদিন রসূল সা. কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, সেই তায়েফেই আজ রসূল সা. এর ইংগিতে তাদের জাহেলী ব্যবস্থাকে তাদেরই চোখের সামনে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হচ্ছিলো।
লক্ষ্যনীয় যে, তায়েফ (মক্কার মতোই) জাহেলী ব্যবস্থার একটা প্রাচীন ঘাঁটি ছিল। রসূল সা. অবরোধ আরোপ করার পর শুধু এই ভেবে অবরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন যে, ইসলামের দেশজোড়া পরিবেশের মধ্যে থেকে বনু সাকীফ নিজেদের জন্য আলাদা দ্বীপ বানিয়ে তো আর টিকে থাকতে পারবেনা। কাজেই রক্ত পাতের কি দরকার? মক্কা যদি সত্যের সামনে মাথা নত করে থাকে, তাহলে মক্কার অধীন তায়েফ কতদিন মাথা না নুইয়ে থাকতে পারবে? রসূল সা. এর পরিবর্তে যদি অন্য কোন যুদ্ধবাজ বিজেতা হতো, তাহলে একবার সৈন্য নিয়োগ করে অন্তত নিজের মর্যাদার খাতিরে যুদ্ধের বিজয়কে চূড়ান্ত করতো, এবং তায়েফে রক্তের বন্যা বইয়ে দিতো। কিন্তু রসূল সা. যেহেতু অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া রক্তপাত পছন্দ করতেন না, তাই তিনি অবরোধ তুলে নিলেন এবং অভিযান অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, পরে যখন সাকীফ ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করবে, তখন স্বেচ্ছায় আনুগত্যের পথ অবলম্বন করবে এবং একটা গঠন মূলক ও সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য এটাই অধিকতর ফলপ্রসূ হতে সক্ষম। পরবর্তীতে হয়েছিলোও তাই।

৯. বনু হানফিয়ার প্রতিনিধি দল

এরা ইয়ামামা অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। ছুমামা বিন ইছালের মাধ্যেমে তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিলো। এর পর তারা মদিনায় এসে রসূল সা. সাথে সাক্ষাত করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে।
কুখ্যাত ভন্ড নবী মুসাইলিমা কাযযাবও এই দলের সাথেই এসেছিল।। সে অনেক আজে বাজে কথা বলতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে বললো মুহাম্মদ সা. যদি স্থির করেন যে, আমাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করবেন, তবে আমি ইসলাম গ্রহণ করবো। আসলে নবূয়তে মুহাম্মদীর অসামান্য সাফল্য দেখে এই ব্যক্তি লোভাতুর হয়ে উঠেছিলো। সে ভেবেছিল, কিছু সাহিত্যিক বক্তব্যকে অহী বলে চালিয়ে দেয়া যাবে এবং তারপর নবুয়ত দাবী করলে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু সে একথা বুঝতে পারেনি যে, সেই চারিত্রিক শক্তি সে কোথায় পাবে, যা ২০ বছর ধরে সব রকম বিরোধিতার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চলে এসেছে? এসব চিন্তা ভাবনার কারণেই তার মাথায় ব্যবসায়িক বুদ্ধি এসেছিল। তার বক্তব্য ছিল যে, হয় আমার সাথে বানিজ্যিক সমঝোতা করো, নচেত আমি নিজেই নবুয়তের দোকান খুলে বসবো।
রসূল সা. তার মানসিকতা ধরে ফেলেছিলেন। তাঁর হাতে খেজুরের একটা শীষ ছিল। সেটা দেখিয়ে তিনি বললেন, আমি তো এই শীষটা দেয়ার শর্তেও কারো বাইয়াত নিতে চাইনা। অর্থাৎ ইসলাম কোন দোকান নয় যে তার মাধ্যমে কেউ ব্যক্তিগত উপার্জনের সুযোগ নেবে। সত্যকে সত্য মেনে নিয়ে কেউ আসে তো আসবে। কোন শর্ত আরোপ করা চলবেনা।
প্রতিনিধি দল বিফল হয়ে ফিরে গেলো। ফিরে গিয়ে মুসায়লিমা সত্যই নবুয়তের দাবী তুললো। তার ধর্মে নামায মাফ এবং মদ ও ব্যভিচার হালাল ছিল।

১০. বনু তাঈ গোত্রের প্রতিনিধি দল

‘তাঈ’ গোত্রের প্রতিনিধি দল যায়েদ আল খাইলের নেতৃত্বে উপস্থিত হয়। রসূল সা. তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। সরদারসহ সমগ্র দল ঐ দাওয়াত সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন। যায়েদ আল খাইল একাধারে কবি ও বক্তা ছিলেন। তাছাড়া তিনি একজন বীর যোদ্ধাও ছিলেন। রসূল সা. তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন “ আরবের যত লোকেরই প্রশংসা আমার সামনে করা হয়েছে, বাস্তবে দেখতে গিয়ে তাকে ঐ প্রশংসার চেয়ে কম গুনের অধিকারী পেয়েছি। কিন্তু যায়েদ আল খাইল তার ব্যতিক্রম। কেননা তাঁর যা কিছু প্রশংসা শুনেছি তাঁর ভেতরে তার চেয়ে বেশি গুনাবলী দেখতে পেয়েছি।”
আদী ইবনে হাতেমও এই গোত্রেরই নেতা ছিলেন। ধর্মে তিনি খৃষ্টান ছিলেন। রসূল সা. এর বিরুদ্ধে তার মনে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা পুঞ্জীভূত ছিল। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সহসা মুসলিম বাহিনী ইয়ামান অঞ্চলে পৌঁছে গেলে তিনি পালিয়ে সিরিয়া চলে গেলেন। তার বোন গ্রেফতার হয়ে মদিনায় নীত হলে রসূল সা. এর ব্যবহার ও অন্যদের সার্বিক চরিত্রিক সততা দেখে অত্যন্ত অভিভূত হন। তিনি আদীকে পীড়াপীড়ি করলেন যেন মদিনায় যায় এবং রসূল সা. এর সাথে দেখা করে। কারো কারো মতে আদী তাঈ গোত্রের প্রতিনিধিদের সাথেই মদিনায় গিয়েছিলেন। মদিনায় পৌঁছে তিনি যেই প্রশ্নটির সমাধান খুঁজছিলেন তা হল মহাম্মদ সা. একজন রাজা না নবী! মদিনায় এসে মসজিদেই রসূল সা. এর সাথে তার সাক্ষাত হল, তারপর তিনি মসজিদ থেকে বেরুলেন এবং আদীকে নিজ বাড়ির দিকে নিয়ে চললেন। পথি মধ্যে এক বুড়ি রসূল সা. এর সাথে কথা বলতে চাইল। তিনি তাকে অনেক খানি সময় দিলেন এবং মনোযোগের সাথে তার কথা শুনলেন। বাড়িতে গিয়ে নিজে মেঝের উপর বসে আদীকে গদির উপর বসালেন। এই দুটো জিনিস দেখে আদী নিশ্চিত হল যে তিনি আল্লাহর রসূল, নিছক দুনিয়াবি রাজা বাদশাহ নন। তারপর রসূল সা. এর কথা বার্তা তাকে আরো নিশ্চিত করলো।
আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে রসূল সা. বুঝে নিলেন আদীর মনে আর কি কি জটিলতা রয়েছে। অতঃপর তিনি সেগুলো এক এক করে পরিস্কার করলেন। পৃথিবীতে এক ধরণের লোক থাকে, যারা সত্যকে দ্রুত উপলব্ধি করে। কিন্তু তার সফলতার বাস্তব সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমান আছে কিনা এবং দ্রুত কোন ফল লাভ হতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে চায়। আদী ছিলেন এই ধরণের ব্যক্তি। রসূল সা. তার মনের এই অবস্থাটা ধরতে পেরে বললেন, তুমি হয়তো ইসলামের অনুসারীদের বর্তমানে দরিদ্র দেখেই ইসলাম গ্রহনে ইতস্তত করছ। আল্লাহর কসম, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন মুসলমানদের মধ্যে সম্পদের ফোয়ারা ছুটবে এবং এতো প্রাচুর্য দেখা দেবে যে, সম্পদ নেয়ার লোকই পাওয়া যাবে না। আর যদি মুসলমানদের সংখ্যা কম ও তার শত্রুদের সংখ্যা বেশী দেখে তুমি দ্বিধান্বিত হয়ে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহর কসম, সেই দিন আসন্ন যখন এক মহিলা একাকিনী ঊটে সওয়ার হয়ে কাদেসিয়া থেকে এই মসজিদ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হবে এবং সম্পূর্ণ নিরাপদে পৌঁছে যাবে। হয়তো বা তুমি অমুসলিমদের ক্ষমতা ও প্রতাপ বেশী দেখে ইসলাম গ্রহনে উৎসাহ পাচ্ছনা। কিন্তু আল্লাহর কসম তুমি স্বয়ং অচিরেই শুনতে পাবে, মুসলমানরা ব্যবিলনের প্রাসাদ গুলো দখল করে নিয়েছে। এই দিক দিয়ে যখন আদীর সন্দেহ দূর হল, তৎক্ষণাত তিনি নিজেকে ইসলামী আন্দলোনের হাতে সমর্পন করলেন। উপরোক্ত আলাপ আলোচনা থেকে যে কয়টা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় তা হলঃ
- ইসলাম শুধু নৈতিক সংশোধন ও সংস্কারের আহবান জানায় না বরং তার কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেমন অন্তর্ভূক্ত রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক বিপ্লবও। আখেরাতের কল্যানকে সে পার্থিব সুখ সমৃদ্ধি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহন করে না।
- রসুল সা.ইসলামী আন্দোলনের দূরতম ভবিষ্যত সম্পর্কে আগাম ধারণা রাখতেন। কোন্ কোন্ স্তর অতিক্রম করে কোথায় পৌঁছতে হবে,সেটা শুরুতেই তাঁর সামনে স্পষ্ট থাকতো।
- ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে জনগণকে এই মর্মে আশ্বস্ত করা অত্যন্ত জরুরী যে, আন্দোলনের বাস্তব সাফল্যের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং ইপ্সিত ইসলামী বিপ্লব কোন আকাশ কুসুম কল্পনা নয় বরং তা আগামী দ্বীনের সূর্যোদয়ের মতোই অবধারিত বাস্তবতা। এটা না করতে পারলে জনগণের একটা বিরাট অংশ ইসলামের দাওয়াত কে ধ্রুব সত্য জেনেও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
- ইসলামী আন্দোলন যদি সাফল্য ও পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে তার অনিবার্য ফল দাঁড়াবে এই যে, (১) অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের বিপুল উন্নয়ন ও তার সুফলের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত হওয়ার কারণে কোন অভাবী ও পরমুখাপেক্ষী লোকের অস্তিত্বই থাকবেনা, (২) রাজনৈতিক দিক দিয়ে এতো শক্তি মান ও স্থিতিশীল সরাক্র গঠিত হবে যে, শত্রুরা তাকে সহজেই গ্রাসযোগ্য মনে করবেনা। বরঞ্চ এই সরকার তার বিরোধী মহলের সমস্ত দর্প চূর্ণ করতে সক্ষম হবে, (৩) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা এমন মানে উন্নীত হবে যে, কোন মহিলাও যদি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একাকিনী ভ্রমন করে এবং মানুষের লোকালয়ের কাছ দিয়ে যায় তবে তার জান, মাল ও সম্ভ্রম কোন দিক দিয়েই হুমকির সন্মুখীন হবে না। এই হচ্ছে একটা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক গুনবৈশিষ্ট্য।

১১. বনুল হারস-এর প্রতিনিধি দল

এই প্রতিনিধি দলটি ছিল নাজরান অঞ্চলের। এই সব এলাকায় হযরত খালেদ ইবনে ওলিদ( ১০ম হিজরিতে) ব্যক্তিগত ভাবে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান। তিনি তাদেরকে বলেন তোমরা ইসলাম গ্রহণ করলে নিরাপত্তা পাবে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করে। হযরত খালেদ তাদেরকে ইসলামের আকিদা বিশ্বাস ও আহকামের শিক্ষা দানের জন্য কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং চিঠির মাধ্যমে রসূল সা. কে সাফল্যের খবর জানান। মদিনা থেকে চিঠির জবাবে বলা হয়, এখন ফিরে এসো এবং ঐ গোত্রের কিছু গণমান্য লোককে সাথে করে নিয়ে এসো। এই আদেশ তৎক্ষণাৎ প্রতিপালিত হয়। [ হযরত খালেদের এই চিঠির হুবহু উদ্ধৃতি ইবনে হিশাম দিয়েছন। এতে হযরত খালেদ নিজের অবস্থানের কারণ বর্ণনা করে রসুল সা. এর আদেশের বরাত দেন। এ প্রসংগে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে ইসলামের আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাঃ এর সুন্নাহর শিক্ষা দিচ্ছি’। এরপর তিনি আবার বলেন ‘এ কাজ আমি রসূল সা. এর আদেশ অনুসারেই করছি’। এরপর পুনরায় লিখেছেন যে, “ আমি তাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিচ্ছি, আল্লাহর কিতাব ও রসূল সা. এর সুন্নাহর শিক্ষা দিচ্ছি’। এই চিঠিটা পড়ার সময় মনে হল, সাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ধরণের যেসব দলীল পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটাই রসূল সা. এর সুন্নাহকে ইসলামের একটা মৌলিক উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তাকে মেনে নেয়া অপরিহার্য গন্য করে।]
এই গোষ্ঠীটি সেই জাহেলী যুগেও কিছু উত্তম নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলতো প্রতিনিধি দলটি যখন এলো তখন রসূল সা. তাদেরকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সব সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে জয় লাভ করে থাকো এবং কখনো পরাজিত হও না, এর কারণ কি?” তারা বলল “আমরা কারো বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় আগ্রাসী পদক্ষেপ নেইনা। এবং নিজেদের পক্ষ থেকে কোন জুলুম শুরু করিনা। যখন লড়াই করার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেই, তখন তা থেকে কেউ সরে আসিনা ও অনৈক্য সৃষ্টি করিনা। বরং ঐক্য বজায় রাখি”। রসূল সা. তাদের এই কৌশলকে সমর্থন জানালেন।
প্রতিনিধি দলের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কায়েস বিন হাসীনকে গোত্রের আমীর নিয়োগ করা হল।

১২. নাজরানের প্রতিনিধি দল

মানবতার পরম হিতৈষী মহামানব সা.কলম দিয়েও ইসলামী দাওয়াতের অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা দলের কাছে তিনি চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন এ ধরণের একটা চিঠি তিনি নাজরানের খৃষ্টানদের কাছেও পাঠিয়েছেন। এ চিঠিতে তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষায় নিম্নরুপ দাওয়াত দেনঃ
“ইবরাহিম, ইসহাক ও ইয়াকূবের মা’বুদ আল্লাহর নামে শুরু করছি। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর বান্দাদের দাসত্ব পরিত্যাগ করে আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করা এবং আল্লাহর দাসদের প্রভুত্ব পরিত্যাগ করে আল্লাহর প্রভুত্বের অনুগত হবার আহবান জানাচ্ছি। এ দাওয়াত যদি মানতে না চাও, তবে তোমাদের জিজিয়া দেয়া (অর্থাৎ রাজনৈতিক আনুগত্য করা) অবশ্য কর্তব্য। সেটাও যদি অমান্য করো তবে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো”। বিশপ চিঠি পড়েই ভয়ে কাঁপতে লাগলো। সে প্রথমে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করলো। তারপর সমগ্র এলাকার জনগণকে ডাকল। এলাকার তিহাত্তরটি জনপদ ছিল এবং লোক সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে, এক লাখ লড়াকু যে কোন সময়ে বেরিয়ে আসতে পারতো। প্রধান প্রধান খৃষ্টান নেতাদের ধারণা ছিল, ইসমাঈল আ. এর বংশধরদের মধ্যে থেকে যে শেষ নবীর আগমনের কথা, ইনিই হয়তো তিনি। গণ পরামর্শের পর স্থির হলো, প্রধান প্রধান খৃষ্টীয় নেতাদের একটি দল মদিনায় যাবে, চিঠির লেখকের সাথে কথা বার্তা বলবে এবং পরিস্থিতি যাচাই করবে। এই দলে শুরাহবীল, আবদুল্লাহ ও হাব্বারকে নিয়োগ করা হলো। এটি ছিলো রাজনৈতিক আনুগত্য জ্ঞাপনকারী, কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দানকারী, এবং এর বিনিময়ে নিরাপত্তা ও অধিকার সংক্রান্ত একটা ফরমান বা ঘোষণা পত্র পেয়ে প্রত্যাবর্তনকারী প্রথম প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দল নিরাপত্তা সনদ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলে বিশপ ও প্রধান সরদাররা তাদের অভ্যর্থনা জানাতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যান। তারা সনদকে পথিমধ্যেই বিশপের হাতে তুলে দেন এবং বিশপ পথ চলতে চলতে তা পড়তে থাকেন। তার চাচাতো ভাই বশীর বিন মুয়াবিয়াও সনদটি এমন তন্ময় হয়ে পড়তে লাগলো যে, ঊটের উপর থেকে নীচে পড়ে গেলো। নিচে পড়ে গিয়ে বেএখতিয়ার হয়ে বলে ফেললো “যে ব্যক্তির কারণে আমরা এতো মুসিবতে পড়ে গেছি, তার সর্বনাশ হোক”। কথাটা যে সে রসূল সা. কে ইঙ্গিত করে বলেছে তা সুস্পষ্ট। তাই বিশপ তাকে কঠোরভাবে বলল “এ কী বলছো তুমি? আল্লাহর কসম, সেতো আল্লাহর প্রেরিত নবী” আর যায় কোথায়? কথাটা শোনা মাত্রই বশীরের মধ্যে বিপ্লব এসে গেলো। সে বলল “ তাহলে আল্লাহর কসম, আমি এক্ষুনিই তার দরবারে উপস্থিত হচ্ছি’। বিশপ তার পিছনে পিছনে ঊটনী হাঁকিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো এবং তাকে বলতে লাগলো “আরে আমার কথা শোন। আমার কথার অর্থটা বুঝে নাও। আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে কথাটা বলে ফেলেছিলাম”। বশীর কোন কথাই শুনলোনা। বললো “ তুমি একজন বিশপ। তুমি যা বলেছ তা ভুল হতে পারেনা”। সংকল্পে অনড় বশীর রসূল সা. এর কাছে পৌঁছে ইসলাম গ্রহণ করে তবেই ক্ষান্ত হলো এবং মদিনাতেই বসবাস করতে লাগলো। পরবর্তীকালে আল্লাহ্‌ তাঁকে শাহাদাতের সৌভাগ্যদান করেন।
করয বিন আলকামা সম্পর্কেও প্রায় এ ধরনেরই ঘটনা বর্ণিত আছে।
প্রতিনিধি দল স্থানীয় সরদার সহ নাজরান ফিরে গেলে সেখানকার আরেকজন সংসার বিরাগী খৃষ্টান দরবেশ সমস্ত ঘটনা শুনে অভিভূত হলো। নতুন নবীর আবির্ভাবের কথা শুনে সেও আবেগোদ্দীপ্ত হয়ে মদিনায় চলে গেলো। নিজের একটা পেয়ালা, একটা চাদর, একটা লাঠি রসূল সা. কে উপহার হিসেবে দিয়ে নিজের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করলো। তারপর রসূল সা. এর অনুমতি নিয়ে ফিরে আসার ওয়াদা করে নাজরান গেল। কিন্তু রসূল সা. এর জীবদ্দশায় আর ফিরে আসতে পারেনি।
কনস্টান্টিনোপলের রাজার ভক্তি ভাজন ও খৃষ্টান জনগণের মধ্যে ব্যাপক সুখ্যাতির অধিকারী নাজরানের বিশপ আবুল হারেস পনুরায় একটা প্রতিনিধি দল নিয়ে মদিনায় গেলো। খৃষ্টান মুফতী ও বিচারক আয়হাম, আব্দুল মসিহ আকের ও ২৪ জন বিশিষ্ট নেতা এ দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য এই বিশপ মূলত বনু বকর বিন ওয়ায়েলের বংশোদ্ভূত একজন আরব ছিল। কিন্তু খৃষ্টান হওয়ার পর সে ধর্মীয় জ্ঞান ও ইবাদতের দিক দিয়ে এতো উন্নতি লাভ করে যে, সে স্বয়ং খৃষ্টানদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নেতায় পরিণত হয়।
তারা দিন কয়েক মদিনায় কাটালো। খৃষ্ট ধর্ম অনুসারে তারা মসজিদে নববীতে নামায পড়তে চাইলে কোন কোন সাহাবী তাতে বাঁধা দেন, কিন্তু রসূল সা. অনুমতি দেন।
তাদের আগমনে স্থানীয় ইহুদিরা ভীষণভাবে তৎপর হয়ে উঠলো এবং এর ভেতর অনর্থক নাক গলিয়ে নানা রকম কূটতর্ক তুললো। ত্রিত্ববাদ ও হযরত ঈসা আ. এর মর্যাদা নিয়ে আলোচনা হলো। প্রত্যেক ব্যাপারেই কোরআনের আয়াত দিয়ে তাদের জবাব দেয়া হলো। সাথে সাথে ইহুদীদের সংশয়ও উস্কে দিলো যে রসূল সা. ঈসা আ. এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে নিজের উপাসনা করিয়ে নিতে চান। এর জবাব ও আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল সা. কোরআনের আয়াত পড়ে শুনিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ্‌ যাকে কিতাব, শাষন ব্যবস্থা ও নবুয়ত দান করেন তাঁকে কখনো জনগণের উদ্দেশ্যে একথা বলার অনুমতি দেয়া হয়নি যে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার বান্দা হয়ে যাও। তারপর ইহুদি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে এই বিতর্ক ও চলে যে, হযরত ইবরাহিম আ।। কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ইহুদীদের দাবী ছিল যে তিনি ইহুদী ছিলেন। আর খৃষ্টানদের দাবী ছিল যে তিনি খৃষ্টান ছিলেন ( নাউজুবিল্লাহ)। কোরআন অত্যন্ত সাদাসিদে ভাষায় এবং তর্কাতীত ভঙ্গীতে এই বিতর্কের মীমাংসা করে দেয় যে, “হে আহলে কিতাব, তোমরা ইবরাহীম আ. সম্পর্কে অনর্থক তর্কে লিপ্ত হও কেন? অথচ তাওরাত ও ইনজিল উভয়ে তার পরে নাযিল হয়েছিল। ( এই দুই খানা গ্রন্থ থেকেই ইহুদী ও খৃষ্টান এই দুই জাতির উদ্ভব ঘটেছিল)। তিনি তো ইহুদীও ছিলেননা, খৃস্টানও ছিলেন না। বরং একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। তিনি কখনো মোশরেক ছিলেন না। ইবরাহীমের নীতির যথার্থ অনুসারী শুধু রসূল সা. ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীগণ”! স্বয়ং হযরত ঈসা আ. এর মর্যাদা কোরআনে এই বলে তুলে ধরা হয়েছে যে, “ আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদম আ।। এর মতোই”।
নাজরানের প্রতিনিধি দলের মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুটা অনড় মনোভাব হয়তো ছিল। অনেক সময় সদুদ্দেশ্য নিয়েও মানুষ পুরানো ধ্যানধারণার প্রতি অনুগত থাকে। কিন্তু ইহুদীদের কুমতলবপূর্ণ যোগসাজশ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। নিষ্প্রয়োজন কূটতর্ক ও কূট তর্কজনিত হঠকারিতা সত্য গ্রহনে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল। এই জন্য কোরআন তাদের সামনে নিষ্পত্তির একটা চরম পন্থা তুলে ধরেছে। সেটি হোল ‘মুবাহালা’। রসূল সা. কে নির্দেশ দেয়া হলো যে, তাদেরকে বলে দাও, “ এসো আমরা আমাদের স্ত্রীদেরকে ও সন্তানদেরকে ডেকে নেই এবং নিজেরাও ময়দানে নামি। অতঃপর আল্লাহর কাছে নিজেদের সম্পর্কে ফয়সালা কামনা করি এবং মিথ্যুকদের উপর অভিশাপ বর্ষন করি।” বস্তুত কোন সত্যবাদীর উপর যখন মিথ্যাচারের অপবাদ আরোপ করা হয়, তখন তাঁর পক্ষে এর চেয়ে কষ্টদায়ক ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এরূপ পরিস্থিতিতেই আল্লাহ্‌ তায়ালা নিষ্পত্তির এই পন্থা নির্ধারন করেন যে, উভয় পক্ষ প্রকাশ্য জনতার সামনে আল্লাহর ফয়সালা চাইবে। পরদিন রসূল সা. নিজের প্রানপ্রিয় মেয়ে ফাতেমা, জামাতা আলী ও নিষ্পাপ দৌহিত্রদেরকে নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। মদিনাবাসির জন্য এটা ছিল অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা ও একটা বিরাট ঘটনা যে, সত্যের একজন আহবায়ক তাঁর গোটা পরিবার পরিজনকে মোবাহালার ময়দানে নিয়ে এসেছেন। কত দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছিল! খৃষ্টান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঘাবড়ে গেলো যে, উনি যদি সত্যি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে এই মোবাহালায় আমাদের নাম নিশানাও মুছে যাবে। তারা এই বিতর্কে আর অগ্রসর না হয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রস্তাব দিলো এবং জিযিয়ার পরিমাণ নির্ধারনের ভারও রসূল সা. এর উপরই ছেড়ে দিলো। পরদিন এই মর্মে আদেশনামা লিখে দেয়া হলো যে, খৃষ্টানরা পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক স্বায়ত্ব শাসন ভোগ করবে। তাদের লোকজন ও ধন সম্পদ যে অবস্থায় রয়েছ সেই অবস্থায় বহাল থাকবে। তাদের বর্তমান অধিকারগুলোর কোন রদবদল করা হবেনা। তাদের ধর্মীয় পুরোহিতদের( বিশপ ও সন্যাসী) মধ্যে কোন পরিবর্তন করা হবেনা। ধর্মীয় সম্পত্তিগুলোর মালিকানা ও অধিকার থেকেও কাউকে বঞ্চিত করা হবে না। জাহেলী যুগের অপরাধগুলোর ওপর আর পাকড়াও করা হবেনা। মুসলিম বাহিনী তাদের ভূমিতে প্রবেশ করবেনা। দুনিয়াবী রাজা-বাদশাহদের মতন তাদের জনগনকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হবেনা। জালেম ও মাজলুমের মাঝে ইনসাফ করতে হবে। কেউ সুদ খেলে তার দায় দায়িত্ব কেউ নিবেনা। একজন অপরজনের পাপের ফল ভোগ করবেনা। এতো বড় জনসংখ্যার উপর বাৎসরিক মাত্র দুই হাজার উকিয়া পরিমাণ পোশাক পরিচ্ছদ কর হিসেবে ধার্য হলো।
নাজরানের এ দুটি প্রতিনিধি দল সংক্রান্ত বিবরণ খানিকটা মিশ্রিত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রতিনিধি দলের আগমনের উপলক্ষেই অধিকতর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু রসূল সা. এর নিরাপত্তা সূচক ঘোষণাপত্র সম্ভবত প্রথম দলই পেয়েছিল। কেননা দ্বিতীয় ঘোষণা পত্রে রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে ধর্মীয় বিষয়ের উপস্থিতি অধিকতর। এতে প্রধানত ধর্মীয় পুরহিতদের সম্বোধন করা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে নাজরান বাসীকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও খৃষ্টীয় ব্যবস্থায় কোন হস্তক্ষেপ না করার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলো। এই ঘোষণা পত্র থেকে প্রমানিত হয় যে, রসূল সা. রাজনৈতিক পরিমন্ডলে শুধু শাসন ব্যবস্থার আনুগত্য চাইতেন এবং সেটা পেলেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কোন সম্প্রদায়কে তার ধর্ম পালন থেকে বিরত রাখতেন না, কারো উপর ইসলামী আকীদা বিশ্বাস জোরপূর্বক চাপিয়েও দিতেন না। বরঞ্চ সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতেন। ইসলামী আন্দোলন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঈমান ও মতামতের পরিবর্তন কেবল মাত্র যুক্তির বলেই করতো, তবে সে তার সামষ্টিক বিধানকে রাজনৈতিক শক্তি দ্বারাই প্রয়োগ করতো। লক্ষ্য করুন, প্রথম ঘোষণা পত্রে সুদখোরীকে নিরাপত্তার বাইরে রাখা হয়েছে এবং তা একটা বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজ। ধর্ম তার আসল আলোচ্য বিষয়ই ছিল না। কেননা তা ধর্মের চেয়ে আরো বড় জিনিস। রসূল সা. এর জারী কৃত এই ঘোষণা পত্র চিরদিনের জন্য উম্মতের অবশ্য পালনীয় আইনের মর্যাদা রাখে। এই ঘোষণা প্ত্র থেকে এটাও প্রমানিত হয় যে, ইসলাম অন্যান্য ধর্ম পালনকারী সংখ্যা লঘুদের প্রতি কত উদার। পৃথিবীর আর কোন আইন, বিধান ও সভ্যতা সংখ্যা লঘুদের প্রতি এমন উদারতা দেখিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত পেশ করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল মদিনা থেকে বিদায় নেয়ার সময় রসূল সা. কে অনুরোধ করলো যে, আপনার কোন বিশ্বস্ত কর্মকর্তাকে জিযিয়া আদায় করে আনার জন্য আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। রসূল সা. উবায়দা ইবনুল জাররাহকে পাঠালেন এবং তাকে ‘ আমীনুল উম্মাহ বা উম্মাহর বিশ্বস্ত ব্যক্তি’ খেতবে ভূষিত করেন। হযরত আবু উবায়দা কর আদায়ের সাথে ঐ এলাকায় ইসলামী দাওয়াতের বিস্তৃতির জন্যও সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ফলে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, নাজরানের অধিবাসীরা দুটি প্রধান প্রধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলঃ
খৃষ্টান ও উম্মী (নিরক্ষর)। খৃষ্টানরা রাজনৈতিক আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়ে নিষ্পত্তি করে। কিন্তু উম্মীরা ইসলাম গ্রহণ করে। সম্ভবত প্রথম প্রতিনিধি দল নবম হিজরীর শেষভাগে এবং ২য় প্রতিনিধি দল দশম হিজরীর প্রথম ভাগে এসেছিল।

১৩. বনু আসাদের প্রতিনিধি দল

বনু আসাদ নামক গোত্রটি যাবতীয় সামরিক তৎপরতায় কোরায়েশদের সহযোগী ছিল। ৯ম হিজরীতে এই গোত্রের প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর কাছে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানায়। তবে এই জানানোর ভঙ্গিতে আরবদের স্বভাবগত দাম্ভিকতার কিছু রেশ ছিল। তারা খানিকটা কৃতিত্ব প্রদর্শনের ভঙ্গিতে রসূল সা. কে বললো “ আপনি তো কোন প্রচারক দল আমাদের কাছে পাঠাননি। আমরা আপনা থেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছি।” এই মনোভাব রদ করার জন্য রসূল সা. এর কাছে বাণী এলোঃ “নিজেদের ইসলাম গ্রহণকে একটা অনুগ্রহ হিসেবে আমার কাছে পেশ করোনা। বরঞ্চ এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তিনি তোমাদেরকে ইসলামের পথে চালিত করেছেন।” তার পর এই প্রতিনিধি দল পাখি দ্বারা ভাগ্য জানা ও ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা এবং পাথর নিক্ষেপ করে পন্য চিহ্নিত করা ( অর্থাৎ মূল্য নির্ধারনের পর নেতা কর্তৃক দূর থেকে পন্য বা জিনিসের দিকে পাথর ছুড়ে মারা এবং যে পন্যটির গায়ে পাথর লাগে, সেটি নিজের জন্য মনোনীত করা) সম্পর্কে ইসলামের বিধান জানতে চায়। রসূল সা. এসবের বিরোধিতা করেন। সবার শেষে তারা জানতে চায়, চিঠি লেখা জায়েয কিনা? রসূল সা. বললেন এটা তো কোন একজন নবীই চালু করেছেন। এর চেয়ে ভাল বিদ্যা আর কি হতে পারে।
হযরত আবু বকর সিদ্দিকের খেলাফত আমলে এই গোত্রের তালহা বিন খুয়াইলিদ নামক এক ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবী তুলেছিল।

১৪. বনু ফাযারার প্রতিনিধি দল

বনু ফাযারা একটি শক্তিশালী ও অহংকারী গোত্র ছিল। এই গোত্রেরই সদস্য উয়াইনা বিন হিসন একটা প্রতিনিধি দল নিয়ে রসূল সা. তবুক থেকে ফেরার পথে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা. তাদের কাছে এলাকার সাধারণ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তারা জানায় দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। দুর্ভিক্ষের দরুন ফসল, গবাদি পশু, বাগবাগিচা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং শিশুরা অপুষ্টিতে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। তারা রসূল সা. এর কাছে দোয়া চাইল। রসূল সা. বৃষ্টির জন্য দোয়া করলেন এবং দোয়া কবুল হলো।

১৫. বনু আমেরের প্রতিনিধি দল

এটা ছিল আরবের প্রখ্যাত গোত্র কায়েস আইলানের শাখা। এদের তিন জন নামকরা সরদার ছিলঃ আমের বিন তুফায়েল, আরবাদ বিন কায়েস, ও জাব্বার বিন সালমা। এই তিন সরদারের মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল পদলোভী। বিশেষত আমের আগেই নানা রকমের দুষ্কর্মের সাক্ষর রেখেছে। এবারো তারা রসূল সা. কে হত্যা করার এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র পাঁকিয়ে এসেছিল। প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়ে তাঁকে “সাইয়েদুনা” (আমার প্রভু) বলে সম্বোধন করলেন। রসূল সা. তার কথা বলার এই ভঙ্গীর বিরোধিতা করে বললেন “ সাইয়েদ বা প্রভু শুধু আল্লাহ্‌, আর কেউ নয়।” এরপর তারা আরো কিছু চাটুকার সুলভ কথা বার্তা বললে রসূল সা. পুনরায় সতর্ক করে বললেন “কথা বলার সময় আমাদের সাবধান থাকা উচিত যেন শয়তান আমাদেরকে বিপথগামী করতে না পারে।” চাটুকারিতা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য কত সযত্ন প্রয়াস। আমের বিন তোফায়েল রসূল সা. এর আন্দোলনকে নিছক ক্ষমতা লাভের রাজনীতি ও সাম্রাজ্য গড়ার চেষ্টা বলে মনে করেছিলো। এজন্যে তারা যথারীতি দর কষাকষির জন্য শর্ত দিলঃ
১. আপনি বেদুঈনদের উপর শাসন চালাবেন আর আমাকে শহরে শাসন চালাতে দেবেন।
২. নচেত, আপনার পরে আমাকে শাসক নিয়োগ করুন।
৩. অথবা আমি গিতফানকে সাথে নিয়ে মদিনায় হামলা চালাবো।
আমের আরবাদকে বলেই রেখেছিল যে, আমি রসূল সা. কে কথায় মশগুল রাখবো, তুমি সুযোগ বুঝে কাজ সমাধা করবে। কিন্তু রসূল সা. এর ভাব গাম্ভীর্যের প্রভাবে সে হতভম্ব হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। উভয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলো। রসূল সা. উভয়ের মনের ভাব বুঝতে পেরে দোয়া করলেনঃ “ হে আল্লাহ্‌! ওদের ক্ষতি থেকে বাঁচাও।” এর অনতিকাল পরেই আমের প্লেগের কবলে পড়ে মারা যায় এবং আরবাদ বিন কায়েস বজ্রাঘাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

১৬. বনু আযরা গোত্রের প্রতিনিধি দল

নবম হিজরীর সফর মাসে এই গোত্রের বারো ব্যক্তি রসূল সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়। হামযা বিন নোমান এদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তারা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে “ আমরা আযরার বংশধর।” মায়ের দিক থেকে আযরা ছিল কুসাইয়ের ভাই। রসূল সা. পরম আনন্দের সাথে “ আহলান ওয়া সাহলান” বলে তাদের স্বাগত জানালেন। তারা সবাই সর্বান্তকরণে ইসলাম গ্রহণ করলো। রসূল সা. তাদেরকে সুসংবাদ শুনালেন, সিরিয়ায় রোম সাম্রাজ্যের রাজত্ব বিলুপ্ত হবে এবং হিরাক্লিয়াস পালিয়ে যাবে। রসূল সা. তাদেরকে জ্যোতিষিদের কাছ থেকে ভবিষ্যতের খবর জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করলেন এবং একমাত্র হযরত ইবরাহীমের শেখানো কুরবানী ছাড়া অন্য সমস্ত কুরবানী পরিত্যাগ করতে বললেন। যাওয়ার সময় প্রতিনিধি দলকে রীতি মোতাবেক পাথেয় দেন।

১৭. বাল্লী গোত্রের প্রতিনিধি দল

এই গোত্রের বসতি এলাকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই গোত্রের প্রতিনিধিরা তাদের নেতা রুয়াইফি বিন ছাবেতের সাথে রসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা তিন দিন মদিনায় অবস্থান করে। অতপর রওনা দেয়ার সময় রসূল সা. তাদের খেজুর ও পথ খরচ দেন।

১৮. কান্দা গোত্রের প্রতিনিধি দল

এটি ইয়ামান অঞ্চলের একটি গুরুত্ব পূর্ণ গোত্র ছিল। এই গোত্রের ৬০ বা ৮০ ব্যক্তি মূল্যবান রেশমী কাপড় পরে হযরত আশায়াস বিন কায়েসের নেতৃত্বে মদিনায় পৌঁছে। রসূল সা. তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মুসলমান হয়ে গিয়েছ? তারা জবাব দিলো, হাঁ। রসূল সা. বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে এই রেশম পরে এসেছো কেন?’ প্রতিনিধি দল তৎক্ষণাত রেশমের পোশাকগুলো খুলে ফেলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ঈমানী দৃঢ়তার দুর্লভ দৃষ্টান্ত পেশ করলো।

১৯. আযদ গোত্রের প্রতিনিধি দল

বনু আযদ গোত্র ও ইয়ামানের অধিবাসী ছিল। সাদ বিন আবদুল্লাহ আযদীর নেতৃত্বে তাদের দল রসূল সা. এর দরবারে আসে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত সারদ গোত্রের আমীর নিযুক্ত হন।

২০. জারশের প্রতিনিধি দল

ইয়ামানের অধিকাংশ এলাকা তখন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তুর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী লোকও ছিল। জাহাশ শহরটিও ছিল বিদ্রোহীদের দখলে। হযরত সারদ আযদীর নেতৃত্বে একদল মুসলিম বাহিনী দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আরোপ করে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে। জারাশ মুসলিম বাহিনীর দখলে আসার পর তার প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে।

২১. হামাদানের প্রতিনিধি দল

এই প্রতিনিধ দল একশো বিশ ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত ছিল। মালেক বিন নামত, আবু সাওর, মালেক বিন আনফা সালমানী, উমায়ের বিন মালেক খারেকী (অথবা আমর ইবনে মালেক), যিমাম বিন মালেক প্রমূখ শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি বর্গ অন্তর্ভূক্ত ছিল। মালেক বিন নামত রসূল সা. এর দরবারে কবিতা পাঠের মাধ্যমে তাঁর প্রশংসা করেন। রসূল সা. তাঁকেই গোত্রের মুসলমানদের আমীর নিযুক্ত করেন। হামাদান অঞ্চলে প্রথমে হযরত খালেদকে দাওয়াতী অভিযানে পাঠানো হয়। কিন্তু ৬ মাস পর্যন্ত কোন সাফল্য আসেনি। এরপর রসূল সা. একটি চিঠি দিয়ে হযরত আলী রা. কে পাঠান। হযরত আলী সেখানে গিয়ে জনসমাবেশে চিঠিটা পড়ে শোনান। লোকেরা তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত আলী একটি চিঠির মাধ্যমে রসূল সা. কে এর বিবরণ লিখে জানালে তিনি সিজদায় গিয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করেন এবং মাথা তুলে বলেন “আসসালামু আলা হামাদান।” (হামাদানের উপর সালাম বর্ষিত হোক)

২২. ফারওয়া জুযামীর দূতের আগমন

ফারওয়া ছিলেন মুয়ান অঞ্চলের রোম সম্রাজ্যে কর্তৃক নিযুক্ত গবর্ণর। এখানে সিরিয়া ও আরব উভয় অঞ্চলের অংশ ছিল। তাঁর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছলে তিনি নিজের পদ এবং জীবন উভয়কে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করে ইসলামে প্রবেশ করেন। একজন দূত পাঠিয়ে রসূল সা. কে নিজের ইসলাম গ্রহণের খবরও জানান এবং রসূল সা. কে একটা সাদা খচ্চর উপহার পাঠান। রোম সরকার এ খবর জানার পর তাঁকে গ্রেফতার করে আফরা নামক স্থানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। আল্লাহ্‌ তাঁর এই বান্দাকে এমন মজবুত ঈমান দিয়েছিল যে, তিনি গবর্নরের আসন থেকে উঠে হাসতে হাসতে শূলের কাষ্ঠে গিয়ে দাঁড়ান।

২৩. তুজীব গোত্রের প্রতিনিধি দল

[এই গোত্রেরই একজন দুষ্কৃতিকারী কিনানা বিন বিসর হযরত ওসমান রাঃ এর খুনী ছিল। এই নামেরই কাছা কাছি আরেকটি গোত্রের নাম তাজওয়াব, যা হিময়ার রাজবংশোদ্ভূত। হযরত আলী রাঃ এর খুনী ইবনে বিলহাম শেষোক্ত গোত্রের লোক।]
এটি ইয়ামানের কান্দা গোত্রের একটি শাখা। এরা আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং ইসলামের দাবী অনুসারে জীবন গড়ে তুলেছিল। তেরো ব্যক্তির এক প্রতিনিধি দল যাকাতের সম্পদ ও পশু সাথে নিয়ে মদিনায় আসে। তারা এসে বলে আমাদের সম্পদে আল্লাহর যে অংশ রয়েছে, তা নিয়ে এসেছি। রসূল সা. বললেন এসব সম্পদ ফিরিয়ে নিয়ে যাও এবং এলাকার লোকদের মধ্যে বন্টন করে দাও। তারা বললো, স্থানীয় লোকদের দেয়ার পর যা অবশিষ্ট ছিল তাই নিয়ে এসেছি। এ কথা শুনে হযরত আবু বকর রা. স্বতস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন হে রসূল সা.। তুজীবের প্রতিনিধি দলের মতো আরবের আর কোন প্রতিনিধি দল আসেনি। রসূল সা। বললেন, ‘হেদায়েত আল্লাহ্‌ তায়ালার হাতে নিবদ্ধ। তিনি যার জন্য কল্যান চান, তার মন ঈমান দিয়ে ভরে দেন’।
তারা রসূল সা. এর কাছে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলো এবং তার লিখিত জবাব নিয়ে গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে গেলো।
এই দলে বনী উবদীর এক যুবক ছিল। প্রতিনিধি দল তাদেরকে নিজেদের জিনিসপত্র ও পশুদের তদারকিতে নিয়োজিত রেখে গিয়েছিলো। রসূল সা. তাকে বিশেষভাবে ডাকেন। সে বলল, আমার একটাই অনুরোধ, আপনি আমার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন। রসূল সা. তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করলেন। পরবর্তীকালে যখন ইয়ামানে ইসলাম পরিত্যাগের হিড়িক পড়ে, তখন এই যুবক তার পুরো গোত্রকে ইসলামের ওপর সামাল দিয়ে রাখে।
রসূল সা. এই দলকেও উপহার স্বরূপ প্রত্যাবর্তনের পথখরচ দেন।

২৪. বনু সাদ হুযাইমের(কুযায়া) প্রতিনিধি দল

এই গোত্রের কয়েক ব্যক্তি একটি প্রতিনিধি দলের আকারে রসূল সা. কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা।।
এর নির্দেশে হযরত বিলাল রা. এই দলকে পথখরচ হিসেবে কিছু রুপো উপহার দেন। তাদের ফিরে যাওয়ার পর সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।

২৫. বাহরা গোত্রের প্রতিনিধি দলের ইসলাম গ্রহণ

এটাও ইয়ামান অঞ্চলের একটা বিশেষ গোত্র। তেরো ব্যক্তির একটা দল মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। কয়েকদিন অবস্থান করে ইসলামের বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের পর তারা ফিরে যায়। তাঁদেরকেও রীতি মোতাবেক পথখরচ দেয়া হয়।

২৬. যী মাররা গোত্রের প্রতিনিধি দল

সরদার হারেস ইবনে আওফ এর নেতৃত্বে এই গোত্রের ১৩ জন মদিনায় পৌঁছে। তারা নিজেদের পরিচয় দান প্রসঙ্গে রসূল সা. কে জানান আমরা লুয়াই বিন গালেবের বংশধর এবং আপনার সাথে আমাদের বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে। রসূল সা।। তাদের কাছে তাদের এলাকা সম্পর্কে জানতে চান। তারা সেখানকার দুর্ভিক্ষের এক করুন চিত্র তুলে ধরেও তাঁর দোয়া চায়। রসূল সা. তৎক্ষণাৎ দোয়া করেন। গোত্রে ফিরে গিয়ে তারা জানতে পারে যে, রসূল সা. যেদিন দোয়া করেছিলেন।, ঠিক সেই দিনই বৃষ্টি হয়েছিলো, এবং জমীন শস্যশ্যামল হয়ে উঠলো। ইসলামের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য তারা কয়েকদিন মদিনায় থাকেন এবং তারপর বিদায় হন। তাদেরকে পথখরচ দেয়া হয়।

২৭. খাওলান গোত্রের প্রতিনিধি দল

দশ ব্যক্তির সমন্বয়ে এই প্রতিনিধি দলটি আগেই ঈমান এনে পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে রসূল সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়। জাহেলিয়াতের যুগে তারা ‘আম্মে উনস’ নামক দেবতার পূজো করতো। তারা জানায়, এখন শুধু প্রবীণ লোকেরা ঐ দেবতার পূজো করে। তারা গিয়েই ঐ দেবমূর্তি ভেঙ্গে ফেলবে। অতীতে এই দেবতার নামে কত বড় বড় কুরবানী দেয়া হতো এবং কী কী অনুষ্ঠান করা হতো, তাও তারা জানায়। অবস্থাকালে তারা ইসলামী জীবন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে। বিদায়কালে তাদেরকে পথখরচ দেয়া হয়।

২৮. মোহারেব গোত্রের প্রতিনিধি দল

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এই গোত্রটি অত্যন্ত বদমেজাজী ও অসচ্চরিত্রের ছিল। প্রাথমিক যুগে যখন রসূল সা. গোত্রে গোত্রে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, তখন এই গোত্রের কাছেও দাওয়াত পৌঁছান। কিন্তু তারা অত্যন্ত অশোভন আচরণ করে। দশ ব্যক্তির সমন্বিত একটি দল তওবা করে রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়। এক সমাবেশে একবার রসূল সা. এক ব্যক্তিকে দেখে চিনতে পেরে তার দিকে অভিনিবেশ সহকারে তাকালেন। লোকটি বুঝতে পারলো এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে হয়ে বললো, ‘হে রসূল, আপনি বোধহয় আমাকে চিনে ফেলেছেন। উক্কায বাজারে আপনি একবার আমার সাথে দেখা করেছিলেন। আমি তখন আপনার সাথে খুবই অন্যায় আচরণ করেছিলাম এবং আপনার দাওয়াত খুবই অশোভন পন্থায় প্রত্যাখান করেছিলাম। হে রসুলুল্লাহ! আমার সাথীদের মধ্যে কেউ আমার চেয়ে আপনার কট্টর দুশমন ছিলনা। কিন্তু আল্লাহর শোকর যে তিনি আমাকে ঈমান ও আনুগত্যের তৌফিক দিয়েছেন।’ অতপর সে রসূল সা. কে তার পূর্ববর্তী জীবনের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার অনুরোধ জানায়। বরসূল সা. তাকে বললেন ‘ইসলাম গ্রহণের ফলে কুফরি অবস্থায় কৃত যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’

২৯. গাসসান গোত্রের প্রতিনিধি দল

গাসসান যদিও বংশগতভাবে আরব গোত্র ছিল। কিন্তু খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার কারণে রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে আরব অঞ্চলের উপর শাসন চালাতো। ১০ম হিজরীতে এই গোত্রের তিন ব্যক্তি মদিনায় এসে রসূল সা. হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা জানায় আমাদের গোত্রের লোকেরা বর্তমানে যে পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে, তা পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করবেনা। রসূল সা. তাদেরকে পথ খরচ দিয়ে বিদায় করলেন। তারা গিয়ে আবার দাওয়াত দিলো। কিন্তু তাও বিফলে গেলো। তিনজনই পরিস্থিতির চাপে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা গোপন রাখলেন। এদের একজন ইয়ারমুক যুদ্ধের সময় হযরত আবু উবাইদার সাথে সাক্ষাত করেন এবং ইসলামের উপর নিজের অবিচল আস্থার কথা ব্যক্ত করেন। অন্য দু’জন তার আগেই মারা গিয়েছিলেন।

৩০. সালামান গোত্রের প্রতিনিধি দল

হাবীব ইবনে ওমর সহ এ গোত্রের সাত ব্যক্তি সমন্বিত প্রতিনিধি দল মদিনায় আগমন করে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রসূল সা. বলেন, সময়মত নামায পড়া সর্বোত্তম সৎ কাজ। তারাও দুর্ভিক্ষাবস্থার বর্ণনা দিয়ে দোয়া চায়। রসূল সা. দোয়া করেন। পরে জানা যায় যে, তাদের অঞ্চলে ঐ দিনই বৃষ্টি হয়েছিলো।

৩১. বনী ঈস গোত্রের প্রতিনিধি দল

এরাও ছিল ইয়ামান অঞ্চলের লোক। তাদের গোত্রও এসেছিল দশম হিজরীতে। তারা প্রশ্ন করলোঃ ‘আমরা ইসলাম প্রচারকদের কাছ থেকে শুনেছি, যে হিজরত করেনা তার ইসলাম কবুল হয়না। আমাদের অবস্থা এই যে গৃহপালিত পশু আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। ওগুলো সাথে নিয়ে হিজরত করা কঠিন। তাই হিজরত যদি করতেই হয় তবে আমরা সেগুলো বিক্রি করে চলে আসি’। ঈমানী জযবা ও প্রেরণা দেখুন যে, একটু ইশারা করলেই নিজেদের জন্মভূমি ও সহায় সম্পদ ছেড়ে চলে আসতে প্রস্তুত। রসূল সা. বললেন, যেখানে থাকো, আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাকো। প্রাথমিক যুগে যখন ইসলামের কেন্দ্রকে শক্তিশালী ও সারা দেশে দাওয়াতের কাজ করার জন্য লোক তৈরির প্রয়োজন ছিল, তখন হিজরত করে কেন্দ্রে চলে আসা ফরয করা হয়েছিলো। সে স্তর পার হয়ে গেছে। এখন আন্দোলনের শক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে থাকুক এবং নিজ নিজ এলাকায় দাওয়াতের বিস্তৃতি ঘটুক – এটা কাম্য বিধায় হিজরত এখন আর জরুরী নেই। এই দ্বিতীয় যুগটার সাথেই এই নির্দেশ যুক্ত যে, ‘বিজয়ের পর আর হিজরতের আবশ্যকতা নেই’।

৩২. গামেদ গোত্রের প্রতিনিধি দল

দশম হিজরীতে গামেদ গোত্রের দশ ব্যক্তি সম্বলিত প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে। তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরকে কোরআন শেখানোর জন্য রসূল সা. উবাই ইবনে কা’বকে নির্দেশ দেন। তারপর তাদেরকে পথখরচ দিয়ে বিদায় দেন।

৩৩. বনুল মুনতাফিক গোত্রের প্রতিনিধি দল

এই গোত্র থেকে নাহীক বিন আসেম ও লাকিত বিন আমের নামক প্রতিনিধিদ্বয় মদিনায় আগমন করে। তারা যখন মসজিদে নববীতে আসেন তখন রসূল সা. খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবা শেষ হলে লাকীত দাঁড়িয়ে কেয়ামত ও বেহেশত দোযখ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে। রসূল সা. তার বিশদ জবাব দেন। তারপর নবীগণ ও পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্নও সে করে। গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান রসূল সা. রাখেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে সরাসরি বলেন, অদৃশ্য জ্ঞান শুধু আল্লাহই রাখেন।

৩৪. আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দল

আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, যারা ৫ম হিজরীতে এসেছিল। এই গোত্রের দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল মদিনায় এসেছিল ১০ম হিজরীতে। এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০ জন।

৩৫. তারেক বিন আবদুল্লাহ ও তার সাথী

তারেক বিন আবদুল্লাহ ইতিপূর্বে একবার আলমাজায বাজারে রসূল সা. কে ইসলামের দাওয়াত দিতে দেখেছিলেন। তখন তাঁর পিছে পিছে তাঁর আপন চাচা আবু লাহাব ছুটছিল আর লোকদের বলছিল “তোমরা ওর কথা শুনোনা, ও মিথ্যাবাদী” (নাউজুবিল্লাহ)। এই তারেক বিন আবদুল্লাহ পরবর্তীকালে রাবযা থেকে কয়েকজন সাথী নিয়ে খেজুর কিনতে মদিনায় এলো। তারেকের অবস্থান স্থলের কাছ দিয়ে রসূল সা।। যাচ্ছিলেন। তিনি তারেকের পরিচয় ও আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। অতঃপর খেজুরের বিনিময়ে তার কাছ থেকে একটা উট কিনে নিলেন। ওয়াদা করে এলেন যে উটের মূল্য বাবদ খেজুর এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে তারেক ও তার সাথীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো যে, না জেনে শুনে বাকীতে উট দিয়ে দিলাম। দাম পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। তারেকের কাফেলার সহযাত্রী জনৈকা সম্ভ্রান্ত মহিলা বললেন ‘এই ব্যক্তির উজ্জ্বল চেহারা আমি দেখেছি। সে কখনো ধোঁকাবাজ হতে পারে না। সে যদি উটের দাম না দেয় তবে আমি উটের দাম দিয়ে দেব’। কিছুক্ষন পরই এক ব্যক্তি খেজুর নিয়ে এলো। সে উটের দাম বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর আলাদা এবং উপহার স্বরূপ আরো কিছু খেজুর আলাদাভাবে দিলো। এভাবে রসূল সা. কাফেলার মন জয় করে ফেললেন। পড়ে তারা যখন শহরে এলো, তখন রসূল সা. মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন ও সদকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। এভাবে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পথ সুগম হয়ে গেল।

৩৬. বনু যুবায়েদ গোত্রের প্রতিনিধি আমর বিন মাদীকারাব

বনু যুবায়েদ গোত্র যখন ইসলাম সংক্রান্ত প্রচারণা শুনতে পেল, তখন তারা তাদের সরদার আমর বিন মাদীকারাবের কাছে গিয়ে বললঃ ‘ আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, হেজাযে মুহম্মদ সা. নামে একজন নবী হয়ে এসেছে। আপনি গিয়ে একটু খোঁজ নিন। দেখুন খবরটা সত্য নাকি মিথ্যে। সে যদি আপনার মতে যথার্থ নবী হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সবাই তার উপর ঈমান আনবো’। আমর বিন মাদীকারাব এল এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। তবে রসূল সা. এর ইন্তেকালের পর সে মুরতাদ হয়ে যায়।

৩৭. হিময়ার রাজবংশের দূত

হিময়ার ছিল একটা রাজ পরিবার। তার পক্ষ থেকে জনৈক দূত একটা চিঠি নিয়ে এল। এই চিঠিতে হারস বিন আবদ কিলাল, নঈম বিন আবন কিলাল, নোমান যুরুয়াইন, মায়াফির ও হামদানের ইসলাম গ্রহণের খবর লেখা ছিল। রসূল সা. এই চিঠির বিস্তারিত জবাব লিখে একটা চিঠি হিমিয়ারের রাজ পরিবারের নামে পাঠলেন। এতে তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও বিধান সমূহ লিখে দিলেন। মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করা, অমুসলিমদের থেকে জিযিয়া কর আদায় করার নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেন। তাছাড়া জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার সমর্থন করে লিখলেন, যারা ইহুদী বা খৃষ্টান থাকতে চায় তাদের ধর্ম বল প্রয়োগে পাল্টানো যাবেনা। চিঠিতে এ কথাও লিখলেন যে, ‘যুরয়া যীন ইয়াযানের নিকট আমাদের প্রতিনিধি মুয়ায বিন জাবাল, আবদুল্লাহ বিন যায়েদ, মালেক বিন উবাদা, উকবা বিন নামর, মালেক বিন মুররা ও আরো কিছু লোক পাঠানো হচ্ছে। এই দলের নেতা মুয়ায বিন জাবাল। এই দল আমার নির্দেশ পৌছাবে এবং যাকাত ও জিযিয়া আদায় করে নিয়ে আসবে।

৩৮. নিখা গোত্রের প্রতিনিধি দল

নিখাও ইয়ামানেরই একটা গোত্র। অধিকাংশ বর্ণনা মোতাবেক এটা সর্বশেষ প্রতিনিধি দল, যা একাদশ হিজরীর মুহররম মাসে মদিনায় আসে। এই দলের সদদ্য সংখ্যা ছিল দুইশো। আসলে এরা সবাই হযরত মুয়ায ইবনে জাবালের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। ইসলাম গ্রহণ করার পর রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাতের দুর্বার আকাংখার কারণে তারা মদিনায় আসে। এখানে এসে তারা রসূল সা।। কাছে তাদের ইসলাম গ্রহণের রিপোর্ট দেয়। দলের জনৈক সদস্য নিজের স্বপ্নের তাবীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর ফিরে যায়।
উল্লেখিত প্রতিনিধি দল গুলো এমন ধারাবাহিক ভাবে এবং এতো বিপুল সংখ্যায় আসতে থাকে যে, তা থেকে সূরা নাসরের “ আল্লাহর দ্বীনে লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে” এই আয়াতাংশের প্রকৃত মর্মার্থ স্পষ্ট হয়ে যায়। আসল ব্যাপার এই যে, মানুষ মাত্রই ইসলামের প্রতি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফুর্ত ঝোঁক অনুভব করে থাকে। তদুপরি রসূল সা. কোরআনের অতুলনীয় ও অকাট্য যুক্তি ও মনমগজ দখল কারী বাচন ভঙ্গীর মাধ্যমে ইসলামকে তুলে ধরেছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি নিজের পবিত্র জীবন ও বাস্তব চরিত্র দ্বারা ইসলামের সত্যতার এমন পূর্ণাংগ রূপ পেশ করেছিলেন যে, মানুষ তাতে দীক্ষিত ও প্রভাবিত না হয়েই পারেনি। সাধারণ মানুষের সামনে ইসলাম গ্রহণের পথে একটাই বাধাই অবশিষ্ট ছিল। সেটা হল সাবেক জাহেলী নেতৃত্ব। এই বাঁধা অপসারিত হওয়ার পর যখন সুনিশ্চিত ভাবে জানা গেল যে, মদিনার ইসলামী শক্তি একটা অজেয় শক্তি এবং তা দ্বারা মানবজাতির কোন অকল্যান সংঘটিত হবার ভয় নেই, বরং প্রতিনিয়ত নিরেট কল্যানই সাধিত হচ্ছে, তখন সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাদের বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে গেল। তারা নিজেদের ভেতর থেকেই সত্যের এই আলোয় অবগাহনের তীব্র পিপাসা অনুভব করলো। আর এই পিপাসায় অস্থির হয়েই মদিনার দিকে ছুটলো এবং সেখানে তারা আপন পিপাসা নিবৃত করলো।
এভাবেই চারদিকে আলোর বন্যা ছড়িয়ে পড়লো এবং অন্ধকার দূর হয়ে গেল।

আন্তর্জাতিক দাওয়াতের সূচনা

রসূল সা. এর হাতে গড়া যে দলটি ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার সৌভাগ্য লাভ করেছিলো, তার কর্ম ক্ষেত্র শুধু দেশীয় ও জাতীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিলনা, বরং তা এমন ‘খায়রা উম্মাহ’ বা শ্রেষ্ঠ দল ছিল, যাকে সারা পৃথিবীর ও সর্বকালের ‘মানবজাতির কল্যানার্থে’ আবির্ভূত করা হয়েছিলো। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকে সত্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফ ও সৌভ্রাতৃত্বের বিধান বাস্তবায়নের পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। শুধু আরবদের সংস্কার, সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘবদ্ধ করাই তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল না, বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা এবং যাবতীয় উপায় উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীর সকল জাতি ও দেশকে ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের আহবান জানানো। ঐ রাজতান্ত্রিক যুগে আল্লাহর যে কোটি কোটি বান্দা ছোট ছোট শ্রেনী ও পরিবারের গোলামীর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, যাদের না ছিল বিচার স্বাধীনতা, না ছিল অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং না ছিল কোন রাজনৈতিক অধিকার। তাদের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত অবস্থা সম্পর্কে কোন সংস্কার মূলক আন্দোলন কিভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে। পারস্য সম্রাটের কাছে লেখা চিঠিতে রসূল সা. নিজেই স্বীয় দাওয়াতের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলকে এই বলে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, “ আমি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আল্লাহর প্রেরিত দূত বা রসূল।”
বস্তুত আল্লাহ তায়ালা রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় পুরোহিতদের কাছে অসংখ্য আঞ্চলিক জাতি সত্তায় বিভক্ত মানবতার জন্য আন্তর্জাতিক যুগের উদ্বোধন খোদ রসূল সা. এর হাতেই করিয়েছেন। একটি মাত্র সত্য ও ন্যায়ের কালেমা সমস্ত ভৌগলিক, বংশীয়, ভাষাগত ও রাজনৈতিক বিভাজনকে উপেক্ষা করে অতি দ্রুত গতিতে সমকালীন সুসংবন্ধ দুনিয়ার তিনটি মহাদেশেই ছড়ীয়ে পড়েছে। শেষ নবী মুহাম্মদ সা. কে ঠিক এমন সময় এই আন্তর্জাতিক দাওয়াতে নিযুক্ত করা হয়েছে, যখন বারুদ, ছাপাখানা, বাষ্পীয় শক্তির আত্ম প্রকাশের দিন খুব বেশি দূরে ছিলনা। সমগ্র পৃথিবী নতুন উপায় উপকরণের বলে একটা শহরে পরিণত হতে যাচ্ছিল। পাঁচ সাতশো বছর বিশ্ব ইতিহাসের বিশাল অঙ্গনে তেমন গুরুতবপূর্ণ কিছু নয়। রসূল সা. এমন সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন, যার মাত্র কয়েক শতাব্দী পর বস্তুগত দিক দিয়ে দুনিয়ার সীমান্তগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিল। এই সময়টার আগমনের উপযুক্ত সময় পূর্বে ইসলামের সত্য বিধান কায়েমের আন্তর্জাতিক দাওয়াত প্রচলিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানবজাতি ক্রমশ বস্তুগত দিক দিয়ে যতই পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর হবে, মানসিক, আদর্শিক, ও নৈতিক দিক দিয়েও ততই একই সূত্রে গ্রোথিত হতে থাকবে। মধ্যবর্তী এই সময়টা দাওয়াতের সম্প্রসারন ও বিশ্বের জাতিগুলোকে নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত করার ব্যাপারে যথেষ্ট হতোনা। এ কথা সত্য বটে যে, আন্তর্জাতিক যুগের ধারা সে সময় মুসলিম বিপ্লবী শক্তির আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে বস্তুবাদী শক্তির খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল। কেননা ইসলামী শক্তি তখন পর্যন্ত ইতিহাসে নিজের একটা প্রভাবশালী ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখলেও তার বিপ্লবী দাওয়াতের তেজ ও উদ্দীপনা বজায় রাখতে পারেনি। কিন্তু তা স্বত্বেও নতুন যুগ ইসলামী আন্দোলনের কাছ থেকে পেয়েছিল মানবতার প্রতি সন্মান প্রদর্শন, মানবিক সাম্য, গনতান্ত্রিক চেতনা, বুদ্ধি বৃত্তিক ও নীরিক্ষা ধর্মী জ্ঞান বিজ্ঞানের যথাযথ মর্যাদা উপলব্ধি, প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অধিকারকে সন্মান প্রদর্শন, মতামত প্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতা, সংখ্যা লঘুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, ন্যায় বিচারের মৌলিক নীতিমালা এবং আরো কিছু উচ্চতর মূল্যবোধ। এসব জিনিস বস্তুবাদী মানসিকতার আওতায় এসে বিকৃতি ও অস্পষ্টতার শিকার হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় ভালো ও কল্যানের যেটুকু পাওয়া যায়, সেটুকু বিশ্ব মানবতার করুনা রসূল সা. এরই অবদান। কোন কোন সত্য নিষ্ঠ প্রাচ্যবাদী লেখকও এ কথা স্বীকার করেছেন।
সুতরাং ইসলামী আন্দোলন নিজের মৌলিক প্রকৃতি অনুসারেই দাবী জানায় যে, তার দাওয়াত আরবের চতুর্সীমায় বন্দী না থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক। সাথে সাথে এটা একটা বাস্তব প্রয়োজন ও বটে যে, ইসলাম আরবের বাইরেও বিস্তৃতি লাভ করুক। অন্যথায় আরবে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটা সরকারের টিকে থাকাই সম্ভব ছিল না। কেননা সেক্ষেত্রে একটা ইসলামী রাষ্ট্রকে চারদিক থেকে অনৈসলামিক রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকতে হতো। বিশেষত রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্য সব সময় আরব ভূখন্ডের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিত। কিছু কিছু আরব ভূখন্ড তাদের দখলে ছিল এবং কতিপয় আরব গোত্রকে তারা কিনে নিয়ে ব্যবহারও করতো। আর রোম সরকারের সাথে তো মদিনার সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
রসূল সা. ইসলামী আন্দলনকে যে দ্রুততার সাথে এগিয়ে নিয়ে যান, তা আমাদের জন্য বিস্ময়কর। মাত্র ১৩ বছরে প্রাথমিক দাওয়াত দিয়ে আন্দোলন পরিচালনাকারী কর্মীবাহিনী তৈরি করার কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন। তারপর কার্যত ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপন করার কাজ সম্পন্ন করেন ৮ বছরে। তারপর নিজ জীবনেই বাকী দুই বছর আশেপাশের রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গুলোর কাছে দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেন।
৬ষ্ঠ হিজরীতে সম্পাদিত হোদায়বিয়ার সন্ধি দেশের ভেতরকার সংঘাত ও সংঘর্ষ গুলোর থেকে তাঁকে বিশ্রাম দিয়ে আরবের বাইরেও দাওয়াতের কাজ সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়। ৭ম হিজরীর পহেলা মুহররম উমরাতুল কাযা সম্পন্ন করার অব্যাবহতি পর রসূল সা. দূতের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর শাসকদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। আজকের যুগে এটা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য মনে হয় যে, রসূল সা অন্যান্য দেশের জনগণের পরিবর্তে শাসকদের ইসলামের দাওয়াত দিয়ে ছিলেন কেন? এর কারণ সুস্পষ্ট। সে যুগে রাজা বাদশাহদের সামনে প্রজাদের আদৌ কোন অধিকার ছিলনা। তাদের এমন কোন মৌলিক স্বাধীনতা ছিলনা, যাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। তাছাড়া ঐ সব রাজা বাদশাহ এই সব সুযোগ দিতে কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলনা যে, ভিন্ন দেশের লোকেরা এসে তাদের সাথে মিলিত হবে এবং তাদেরকে তাদের বর্তমান ধর্ম থেকে বিচ্যুত করবে। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের ধর্মমতের উপরে। তারা ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা নিয়েই দেশ শাসন করতো। তাছাড়া যেখানে শুধু ধর্মের পরিবর্তেন নয়, মানুষের সার্বিক পরিবর্তন কাম্য, মানুষের রুচি, মানদন্ড, মূল্যবোধ সবকিছুই যেখানে পাল্টে যাওয়ার আশা করা হয় এবং ইসলামের দাওয়াত গ্রহনকারীদের মধ্যে যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক মনোভাব সৃষ্টি করত নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী আকাংখা জাগিয়ে তোলা হয়, সেখানে রাজা বাদশাহরা তাদের প্রজাদের মধ্যে নীরবে ইসলাম বিস্তারের সুযোগ দিবে, এটা কিভাবে সম্ভব? সেকালের রাজতান্ত্রিক শাসকরা পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রভু হয়ে বসেছিল এবং তাদের অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়তে পারতো না। এ কারণে রসূল সা. সরাসরি শাসকদের কাছেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন এবং দাওয়াতি চিঠিগুলোতে তাদেরকে তাদের জনগণের প্রতিনিধি আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর জনগণের ভাল মন্দের দ্বায় দায়িত্ব অর্পন করতেন। বিভিন্ন রাজা মহা রাজাকে রসূল সা. সংশ্লিষ্ট জাতির ‘নেতা’ বলে সম্বোধন করতেন। পারস্য সম্রাটকে ও মুয়াওকিসকে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন ‘তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না কর, তবে তোমার সমগ্র জাতির পাপের ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে’।
রাজা বাদশাহদেরকে চিঠি লিখতে গিয়ে এক দিকে তিনি যেমন প্রচলিত রীতি নীতি মেনে চলতেন, অর্থাৎ সীল মারার জন্য আংটি তৈরি করান এবং তাতে “ মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ” শব্দটা খোদাই করান। অপরদিকে তেমনি নিজের স্বতন্ত্র একটা রীতি ও পদ্ধতি চালু করেন। প্রত্যেক চিঠি “ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” দিয়ে শুরু করতেন। প্রেরক হিসেবে নিজের নাম এবং যার নামে চিঠি পাঠাতেন তার নাম লেখাতেন। অতপর নূন্যতম, অত্যন্ত মাপাজোঁখা ও সতর্ক ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরতেন। সেই যুগের প্রেক্ষাপটে যে কুটনৈতিক ভাষা তিনি চিঠির জন্য অবলম্বন করেন,তা রসূল সা. এর মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব আমাদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরে যে, আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। যেমন এই সব চিঠিতে অতি সংক্ষেপে এই বাক্যটি তিনি ব্যবহার করেন যে, “ইসলাম গ্রহণ কর, শান্তি পাবে”। এর আরো একটা অর্থ এই হয় যে, “ আনুগত্য করো, শান্তি পাবে”। শান্তি পাবে কথাটার তাৎপর্য এই যে, এটাই শান্তির একমাত্র পথ বা উপায়। এর অন্য একটা তাৎপর্য এমন যে, তার ভেতরে প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে। অর্থাৎ যদি ইসলাম গ্রহণ না করো বা আনুগত্য না করো তাহলে তোমার বিপদ রয়েছে। মাত্র দুটো শব্দ অথচ তা ব্যাপক অর্থবোধক। অনুরূপভাবে “তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না করো, তাহলে তোমাকে সমগ্র জাতির পাপের ফল ভোগ করতে হবে”। একথাটাও দ্ব্যার্থবোধক। একটা হল ধর্মীয় অর্থ এবং তা এই যে, আল্লাহর কাছে তোমাকেই দায়ী হতে হবে। অপরটি রাজনৈতিক অর্থ এবং সেটি এই যে, এর রাজনৈতিক পরিণাম তুমি ইহকালেই ভোগ করবে। এ ধরণের দ্বার্থবোধক বাক্য রসূল সা. এই জন্য ব্যবহার করতেন না যে, বক্তব্য অস্পষ্ট থেকে যাক এবং উল্টা পাল্টা ব্যাখ্যা করার অবকাশ থেকে যাক (নাউজুবিল্লাহ)। বরং একই বাক্যে একই সাথে উভয় অর্থ বুঝানো হতো। এতো কম শব্দ দ্বারা এতো ব্যাপক অর্থ বোঝানো রসূল সা. এর ‘বালাগাত’ বা ভাষাগত অলংকারিক শ্রেষ্ঠত্বর নিদর্শন। তাছাড়া তিনি প্রত্যেক শাসককে চিঠি লেখার সময় তার ধর্ম এবং তার বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানানসই ভাষা প্রয়োগ করতেন। অর্থাৎ গৎ বাঁধা ভাষা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন না। তাছাড়া প্রত্যেক শাসকের কাছে তিনি সেই দেশের ভাষা জানেন এমন দূত পাঠাতেন। [সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ বানিজ্যোপলক্ষে দেশ বিদেশ সফর করে নানা ভাষা রপ্ত করে রেখেছিলেন। আবার কাউকে কাউকে রসূল সাঃ বিশেষ নির্দেশ দিয়ে বিদেশি ভাষা শিখতে বলতেন।]
এইসব চিঠি প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের দাওয়াত প্রদান। কিন্তু এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রনায়কদের তিনি এই সব চিঠির মাধ্যমে এ কথাও বুঝিয়ে দিতেন যে, আরব তখন আর আগের মতো অরক্ষিত বিচরণ ক্ষেত্র নয়। বরং তা একটা সুসংবদ্ধ সরকারের অধীনে পরিচালিত একটা দেশ, এ সরকার সব ধরণের চ্যালেঞ্জ দিতে ও গ্রহনে সক্ষম। এ সরকার কারো হুমকিতে বা চোখ রাঙ্গানিতে ভয় পায়না। একটা পরাক্রান্ত, চৌকস ও সদাসতর্ক সরকার সেখানে সক্রিয় রয়েছে।
এবার আমি সংক্ষেপে বর্ণনা দিচ্ছি কিভাবে বিভিন্ন বিদেশী শাসকদের নিকট দাওয়াতী চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং তার ফলাফল কি দাঁড়িয়েছে।
১- আমর বিন উমাইয়া যামরীর রা. এর মাধ্যমে আবসিনিয়ার রাজা আসাম (বা আসহামা) বিন আবজার নাজ্জাশীকে রসূল সা. এর লিখিত দাওয়াত নামা পাঠান। চিঠিতে ইতিপূর্বে আবিসিনিয়ার মোহাজেরদের কথা বিশেষত হযরত জাফর তাইয়ারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মোহাজেরদেরকে নিরাপদ রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে। অতপর তাতে স্বয়ং বাদশাহকে ও তাঁর মাধ্যমে রাজার সভাসদদেরকেও ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
নাজ্জাশী আগে থেকেই ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। হযরত জা’ফরের হাতেও তিনি প্রকাশ্য ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত একটি চিঠিও তিনি রসূল সা. এর নিকট প্রেরণ করেন। নিজের ছেলে আরহাকে তিনি দূত বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি একথাও জানালেন যে, রসূল সা. যদি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হতে আদেশ করেন, তবে তিনি হাজির হতে প্রস্তুত। [সম্ভবত ইনি সেই নাজ্জাশী নন, যার সামনে মোহাজেরগণ হাজির হয়েছিলেন, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন এবং রসূল সা. মদিনায় তার গায়েবানা জানাজা পড়িছিলেন। আসাম তাঁর পরে সিংহাসনে আরোহন করেন। যাহোক, এ ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।]
২- আলা বিন হাযরামির মাধ্যমে রসূল সা. ইরান সম্রাটের করদাতা ও বাহরাইনের শাসক মুনযির বিন সাভীকে দাওয়াতনামা পাঠান। মুনযির তো ইসলাম গ্রহণ করলেনই সাথে সাথে তাঁর প্রজাদের একটা বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি জবাবী চিঠিতেও নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানান এবং তাঁর প্রজাদের একাংশ ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন। সেই সাথে একথাও জানান যে, কিছু কিছু প্রজা ইসলাম গ্রহণ করতে চায়না, বরং ইহুদী ও খৃষ্টান থাকতে চায়। মদিনা থেকে আবার চিঠি পাঠানো হয় যে, যারা ইহুদী ও খৃষ্টান থাকতে চায়, তাদেরকে নিজেদের ধর্মে থাকতে দেয়া হবে। তবে তাদেরকে জিযিয়া কর দিতে হবে।
৩- জাফল ও আবদ এরা দুজন আম্মানের বাদশাহ জীফারের ছেলে ছিলেন। আমর ইবনুল আ’সের মাধ্যমে দাওয়াতনামা পাঠানো হয়। আমর ইবনুল আ’স প্রথমে ছোট ভাই আবদের সাথে সাক্ষাত করেন। আবদ এই বিষয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা চালান। তিনি তাঁর কাছ থেকে জানতে পারেন যে, নাজ্জাশী মুসলমান হয়ে গেছেন, তথাপি তার জনগণ তাঁকে রাজত্ব থেকে উৎখাত করেনি এবং বিশপ ও পাদ্রীরাও তাঁকে বাঁধা দিতে পারেনি। এমনকি রোম সম্রাটও এ ঘটনা জানার পর কোন পদক্ষেপও নেননি। বরঞ্চ নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণের পর হিরাক্লিয়াসকে কর দেয়াও বন্ধ করেছে। সে হযরত আমর ইবনুল আসের কাছ থেকে রসূল সা. এর প্রধান প্রধান শিক্ষাও জেনে নেয়। এ আলোচনার পর আবদের মনে ইসলাম গ্রহণের প্রেরণা জন্মে। কিন্তু সে আক্ষেপ করে বলতে লাগলো, আমার বড় ভাইও যদি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হতো এবং আমরা দুজনে একত্রে মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে ভাল হতো। এরপর দরবার অনুষ্ঠিত হল। দরবারে দুই ভাইয়ের উপস্থিতিতেই মদিনার দূত সীল করা চিঠি খুলে দিলেন। উভয় ভাই চিঠি খুলে পড়লো তারপর কয়েকটি প্রশ্ন করা হল। প্রশ্নের জবাবে আমর বললেন, কোরায়েশরা বাধ্য হয়ে রসূল সা. আনগত্য গ্রহণ করেছে। আর রসূল সা. এর দল এমন লোকদের নিয়ে গঠিত, যারা ভাল মতো চিন্তা ভাবনা করে ও বুঝে শুনে রসূল সা. এর পাশে সমবেত হয়েছে। এরপরও জীফার বাদশাহ দ্বিধান্বিত রইল। কিন্তু তার দুই ছেলেই ইসলাম গ্রহণ করলো এবং সেই রাজ্যের বিপুল সংখ্যক প্রজাও।
৪- মুনযির বিন হারেস বিন আবু শিমার দামেস্কের খৃষ্টান শাসক ছিল। মদিনা থেকে সীলাত বিন আমর দাওয়াতী চিঠি নিয়ে যায়। সেও রসূল সা. এর আন্দোলনকে দুনিয়াবী রাজনীতি মনে করে শর্ত দেয় যে, ইসলামী সরকারের অর্ধেক অংশ থাকবে আমার। পরে তার আয়ুষ্কাল দ্রুত কমে আসে। রসূল সা. যখন তার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেলেন তখন বললেন, সে এক ইঞ্চি বা একটা খেজুর পরিমাণ জমি চাইলেও আমি তা দিতে প্রস্তুত নই। ইসলামী রাষ্ট্র যে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তার প্রতি ইঞ্চি পবিত্র আমানত।
৫- জারীহ বিন মিত্তা মুকাওকিস ইস্কান্দারিয়া সহ সমগ্র মিশরের খৃষ্টান রাজা ছিল। রসূল সা. তার দরবারে দূত বানিয়ে পাঠালেন হাতিব ইবনে আবী বালতায়াকে। তিনি চিঠিও পৌঁছালেন এবং কথাও বললেন। তিনি মৌখিক ভাবে যে বক্তব্য রাখলেন, তা এতো নির্ভীক ও বেপরোয়া ছিল যে, তা থেকে বুঝা যায়, রসূল সা. কি ধরণের বলিষ্ঠ চরিত্র মনমানসের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ইসলামের ছাঁচে গ্রঠন করেছিলেন। মুকাওকিসকে সতর্ক করার জন্য হাতেব বলেন, “ এই ভূখন্ডে আগেও এক ব্যক্তি জন্মেছিল, যে আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভূ বলে হুংকার ছেড়েছিল। অবশেষে সে আল্লাহর গজবের শিকার হয়ে ধবংস হয়ে গিয়েছিলো। এ ভূখন্ডের পরবর্তি অধিপতি হিসেবে আপনাদের উচিৎ পূর্ববর্তীদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা। এমনটি হতে দেয়া উচিৎ নয় যে, অন্যেরা আপনাদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ করবে”। তার পর যুক্তি প্রমান দ্বারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে দিয়ে বললেন, “ আমর আপনাদেরকে হযরত ঈসা আ. সঠিক ও আসল ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। এটা কোন নতুন ধর্ম নয়”। মুয়াকয়াকিস ইসলাম গ্রহনে প্রস্তুত না হলেও নবী সা।। এর চিঠিকে যথেষ্ট সন্মান প্রদর্শন করল এবং তাকে হাতির দাঁতের কৌটায় রেখে কোষাগারে সংরক্ষন করলো। তারপর রসূল সা. এর কাছে দুলদুল নামের বিখ্যাত খচ্চর সহ বেশ কিছু উপঢৌকনাদিও পাঠাল। চিঠির জবাবে সে লিখলো, “আমি জানি, শেষ নবীর আগমন এখনো বাকী। তবে আমার ধারণা তিনি সিরিয়ায় জন্ম নেবেন”।
৬-হিরাক্লিয়াস রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের সম্রাট ছিলেন। তার রাজধানী ছিল কনষ্টান্টিনোপল। রসূল সা. দিহয়া বিন খলীফা কালবীকে দাওয়াতী চিঠি দিয়ে তার কাছে প্রেরন করেন। দিহয়া বাইতুল মাকদাসে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন। হিরাক্লিয়াস মদিনার দূতের সন্মানে বিরাট জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠান করলো এবং রসূল সা. সম্পর্কে বহু খুঁটিনাটি বিষয় সে জিজ্ঞেস করলো। তাছাড়া সে আর আদেশ জারী করলো যে, এ অঞ্চলে মক্কার আর কোন ব্যক্তি থেকে থাকলে আমার কাছে আনা হোক। ঘটনাক্রমে এই সময় রসূল সা. এর বিরোধী শিবিরের নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যিক সফরে ওখানে ছিল। তাকে তার সব ক’জন বাণিজ্যিক সাথী সহ দরবারে ডেকে আনা হল। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে বলল, “ আমি আবু সুফিয়ানকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো, সে যদি কোন প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয়, তাহলে তোমরা বলে দিও”। আবু সুফিয়ান বলেছে “আমি যদি আশংকা না করতাম যে, সাথীরা আমার মিথ্যার জারিজুরি ফাঁস করে দেবে, তাহলে আমি এই সুযোগে কিছু মনগড়া কথা বলে দিতাম”। কিন্তু আল্লাহ্‌ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিলেন যে, রসূল সা. সম্পর্কে তাঁর কট্টর দুশমনের মুখ দিয়েও সত্য কথাই বেরুল। হিরাক্লিয়াস রসূল সা. এর জন্ম বৃত্তান্ত, পরিবার, চরিত্র, রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ সাথীদের অবস্থা, তাঁর উন্নতির দ্রুততা, যুদ্ধে মুসলমানদের অবস্থা, ইসলামের শিক্ষা এবং অন্য কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। সকল প্রশ্নের জবাবে আবু সুফিয়ানের দেয়া তথ্য গুলো জেনে হিরাক্লিয়াস বলল, ‘আবু সুফিয়ান তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যক্তি একদিন আমি যে জায়গায় বসে আছি, এ জায়গারও মালিক হবে। আহা! আমি যদি সেই নবীর কাছে হাজির হতে পারতাম এবং তাঁর পা ধুয়ে দিতে পারতাম!” এরপর রসূল সা. এর চিঠি পড়া হল। সভাসদরা এতে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলো। কেননা হিরাক্লিয়াসের মানসিক অবস্থা দেখে তারা আগেই ঘাবরে গিয়েছিলো। তারা মক্কার প্রতিনিধিদেরকে তাড়াতাড়ি বের করে দিলো।
হিরাক্লিয়াসের সাথে কথোপকথনের ফলে স্বয়ং আবু সুফিয়ানের মনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ পড়ে গেল।
৭- খসরু পারভেজ ছিল ইরানের সম্রাট ও অগ্নি উপাসক। রসূল সা. আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. কে তার কাছে দূত বানিয়ে দাওয়াতী চিঠি পাঠালেন। খসরু পারভেজ দাম্ভিকতার আতিশয্যে রসূল সা. এর চিঠি এই বলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো যে, আমাদের একজন প্রজার এমন দুঃসাহস হল কি করে? হতভাগা খসরু জানতোনা আরব জাহান কত বড় বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত এবং সেখানে কত জোরদার আদর্শিক শক্তি বিকশিত হচ্ছে। খসরু পারভেজ তার ইয়ামানস্থ গভর্নর বাযানকে নির্দেশ দিলো, চিঠির লেখককে অবিলম্বে গ্রেফতার করে নিয়ে এসো। বাযান একটা সেনাদল পাঠালো রসূল সা. কে গ্রেফতার করে আনতে। সেনাদল যখন তায়েফে পৌছালো, তখন সেখানকার শীর্ষ নেতারা খুব খুশী হল। তারা ভাবলো এবার তাদের প্রিয় জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার শত্রুর মূলোৎপাটিত (মুহাম্মস সা.) হবে। এই সেনাদল মদিনায় পৌঁছল এবং তার নেতা মুহাম্মদ সা. কে জানালো তারা রসূল সা. কে গ্রেফতার করতে এসেছে পারস্য সম্রাটের নির্দেশক্রমে। রসূল সা. তাদেরকে বললেন, কাল সকালে এসে আবার সাক্ষাত করো। পরদিন সকালে তারা এলে রসূল সা. তাদেরকে জানালেন, “ আজ রাতে আল্লাহ তোমাদের সম্রাটকে তার ছেলের হাতেই হত্যা করিয়েছেন। যাও, খবরটা সত্য কিনা খোঁজ নাও। খবরের সত্যতা এবং রসূল সা. এর শিক্ষা ও চরিত্রের মাহাত্ম্য জানার পর বাযান ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। তার দেখা দেখি দরবার ও এলাকার আর অনেকে ঈমান আনলো।
রসূল সা. পারস্য সম্রাট কর্তৃক তাঁর চিঠি ছিঁড়ে ফেলার খবর শুনে বললেন, ‘সে আসলে নিজের সাম্রাজ্যকেই টুকরো টুকরো করেছে’। মনে হয়, আল্লাহ তায়ালার ফয়সালাই রসূল সা. এর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিলো। কেননা এক মাত্র দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই চার পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সুদৃঢ়, বিশালায়তন ও অত্যন্ত বিলাশ বহুল সাম্রাজ্য ইসলামের কাছে পরাজিত হল। প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ কলহকোন্দলই এই সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ছেড়েছিল।
এছাড়া অন্য যেসব ছোট খাটো রাজ্যের শাসকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো হয়েছিল, তাদের একজন তো ছিল রোম সাম্রাজ্যের গভর্নর ফারওয়া বিন ওমর, যিনি ইসলাম গ্রহণ করার পরিণামে পদ ও প্রাণ দুটোই হারিয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন নাজদের শাসক ছামামা ৬ষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তৃতীয় জন জাবালা গাচ্ছানী ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। চতুর্থজন দুমাতুল জান্দালের শাসক উকাইদার ইসলাম গ্রহণ করেন। ৫ম জন যুল কিলাহ হিময়ারী হিময়ার গোত্রের রাজা ছিলেন। তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবী করতেন এবং প্রজাদেরকে সিজদা করতে বলতেন। অবশেষে ইনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ওমর ফারুকের শাসনামলে রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে দরবেশের জীবন যাপন করার জন্য মদিনায় আসেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের আনন্দে আঠারো হাজার দাসদাসিকে মুক্ত করে দেন।
উপরোক্ত ঘটনাবলি থেকে জানা যায়, ইসলামী দাওয়াতের এই কলমী সংগ্রাম থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেছে এবং তা ইসলামের প্রসার ও বিকাশ সাধনে খুবই সহায়ক হয়েছে। প্রথমত এ দ্বারা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে ইসলামের দাওয়াত একটা আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয়ে বিষয়ে পরিগণিত হল। দ্বিতীয়ত একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষমতাসীন শাসক এই সব চিঠির কল্যানে এমন অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করে, যখন মুসলমানরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই অনগ্রসর ছিল। এ দ্বারা প্রমানিত হয়, ইসলাম একটা সত্য ও স্বাভাবিক ধর্ম। ইসলাম গ্রহনকারী এই ক্ষমতাসীন শাসকদের সাথে সাথে তাদের প্রজারাও ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। রসূল সা. এর চিঠি পেয়েও যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদের মনের ওপরও এক যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল।তা ছাড়া চিঠি প্রেরনের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক যুগের সূচনা হয়, তা দেশের ভেতরেও পরিবেশ অনুকূল করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়। এই অভিযানের সবচেয়ে বড় যে উপকার হয় তা এই যে, মুসলমানদের সামনে শুরু থেকেই একটা সুপরিসর কর্মক্ষেত্র উপস্থিত হয়ে যায় এবং তাদের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা বিরাট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারন করে দেয়া হয়। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, সমগ্র আরবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও মুসলিম মোজাহেদরা ক্ষান্ত হয়নি, ভোগ বিলাসে মত্ত হয়নি, এবং তাদের মনে এ ধারণা জন্মেনি যে, যা কিছু করণীয় ছিল, তা করে ফেলেছি। বরং তাদের আকাংখা ও অভিলাষ আরো বেড়ে গেছে। নিজের সাথীদেরকে দূতিয়ালী কর্মকান্ডে নিযুক্ত করে রসূল সা. তাদেরকে অনাগত দিনের দ্বায় দায়িত্ব বহনের চমৎকার প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলেছিলেন। তারা অজানা অচেনা পরিবেশে, জাঁকজমকপূর্ণ সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং ভাবগম্ভীর শাহী দরবারে উপস্থিত হতেন এবং প্রকাশ্য মজিলিসে আলাপ আলোচনা ও ভাষণ দানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন। তারা সমকালীন শাসক প্রশাসকদের মনস্তত্ব বুঝার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। তারপর তারা যে বিশ্বস্ততা, দৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা, আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি ও সরলতা সহকারে সত্য প্রকাশের জন্য যে দৃপ্ততা ও দুসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে আরো শাণিত করেছে এবং তাদের চরিত্রকে আরো সতেজ ও উজ্জ্বল করেছ।
রসূল সা. সূচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই অসম্পূর্ণ দাওয়াতী অভিযানকে সম্পূর্ণ করার গৌরব লাভ করেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত সাথী গণ এবং তাঁর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত দল।

সর্বশেষ বিক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া

যে কোন বিপ্লব যখন দ্বন্দ্ব সংঘাতের সব কয়টা স্তর অতিক্রম করে এবং প্রাচীন নেতৃত্বের দর্প চূর্ণ করে চূড়ান্ত সাফল্যের স্বর্ণযুগে উপনীত হয়, তখন এই সাফল্যে ঈর্ষাকাতর হয়ে কোন কোন হীনমনা লোক ভেতরে ভেতরেই ক্ষুব্দ হতে থাকে। তারপর সুযোগ পেলেই সর্বশেষ ধৃষ্টতা প্রকাশ করে বিপ্লবের সয়লাবের সামনে বালুর বাঁধ দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইসলামী বিপ্লবও এ ধরণের একটা অনাকাংখিত পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়েছিলো। কোরায়েশ, ইহুদী এবং স্থানীয় নেতৃত্বের শক্তি যখন বিলুপ্ত হল এবং জনগণ ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে লাগল, তখন একটা সর্বশেষ বিক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া সম্পুর্ণ নতুন আকারে দেখা দিল। কিছু লোক ভাবল, “এটা কেমন কথা যে, একজন লোক নবুয়তের দাবী তুলে আত্মপ্রকাশ করলো, গুটি কয়েক লোক তাঁর সমর্থক হল, দ্বন্দ্ব সংঘাত করল এবং তারপর এই লোকটাই সারা আরবের শাসক হয়ে বসলো। আমরাও এই পদ্ধতিটা যাচাই করে দেখলে ক্ষতি কি?” বিশেষত এই লোকগুলো যখন যাকাতের বিপুল সম্পদ মদিনার দিকে যেতে দেখতো, তখন তাদের মনটা লোভাতুর হয়ে উঠত। মুসলমানদের মধ্যে যারা আন্তরিকভাবে নয় বরং নেহাত পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মুসলমান হয়েছে এবং তাদের মনে বিরোধী মনোভাব ধুমায়িত হচ্ছে, তাদেরকে তারা চিনত। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা শেষ খেলাটা খেলবে বলে মনস্থ করলো। তারা একথা ভাল করেই জানত যে, এখন জাহেলী ধ্যান ধারণা ও পৌত্তলিক মতবাদের উপর ভর করে আর কোন আন্দোলন করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহর একত্ব, অহি, নবুয়ত ও আখেরাত সংক্রান্ত আকিদা বিশ্বাস সমগ্র পরিবেশ টাকে পরোপুরিভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তাই তারাও নিজেদের নকল মালে এই সব লেবেল এঁটে সাজিয়ে একটা দোকান খুলে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই বেকুফরা জানতোনা যে, নাজারে কোন নতুন মুদ্রা চালাতে হলে শুধু একটা নকল নকশা ছাপানোই যথেষ্ট নয় এবং সেজন্য খাঁটি ধাতুরও প্রয়োজন। ইসলামের মুদ্রায় যে ধাতু ব্যবহারিত হতো (অর্থাৎ ইসলামের তৈরি জনশক্তি) তাও ছিল স্বত্বই নির্ভেজাল ও খাঁটি (রসূল সা. বলেছেনঃ তোমাদের যারা জাহেলী যুগে ভাল ছিল, ইসলামেও তারাই ভাল)। তদুপরি দশ বিশ বছর ধরে তাকে চুল্লীতে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মরিচামুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু স্বার্থপর লোকেরা সাধারণত সুক্ষদর্শী হয়না। তারা কেবল নিজেদের পছন্দনীয় স্বার্থই দেখে। কোন কিছু অর্জনের পেছনে যে ত্যাগ ও কুরবানী দেয়া হয়, সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করেনা। মোট কথা ইতিহাসের এই চিরসত্যটাই ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও পুনরায় সত্য হয়ে দেখা দিলো যে, প্রত্যেক জনপ্রিয় ও জনকল্যানমুখী আন্দোলন এবং প্রত্যেক মহান ব্যক্তিত্বকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সমাজে নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকেরাই সক্রিয় থাকে। রসূল সা. পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দেয়া এ ধরণের কুচক্রী ষড়যন্ত্রীদের সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন।
১- ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, একটা প্রতিনিধি দলের সাথে জনৈক মুসাইলিমা বিন হাবীব অরফে মুসাইলিমা কাযযাব অর্থাৎ মিথ্যাবাদী মুসাইলিমা মদিনায় এসেছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানীতে জাঁকজমক দেখে তার মধ্যে তীব্র ক্ষমতার মোহ জেগে উঠেছিল। সে রসূল সা. এর কাছে একটা চিঠি লিখে ইসলামী সরকারের ক্ষমতার অংশীদারী চেয়ে বসলো এবং হুমকিও দিল। রসূল সা।। তার দাবী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। এতে অধীর হয়ে সে নবুয়তের দাবী করে বসলো। সে একজন সাহিত্যিক তো ছিলই। কোরআনের আয়াতের বাচনভংগীর অনুকরণ করে মিত্রাক্ষরান্ত শব্দ দিয়ে বাক্য বানিয়ে বানিয়ে সে অশিক্ষিত মরুচারিদের শুনাতো। যেহেতু কিছু লোক এখনো জাহেলিয়াতের সাথে সম্পর্ক রাখতো এবং তারা ইসলামী শিক্ষা দীক্ষায় তখনো তেমন পরিপক্কতা লাভ করেনি, তাছাড়া আঞ্চলিক ও গোত্রীয় বিদ্বেষ ও অহমবোধ তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিল, তাই কিছু না কিছু অনুসারী তার ভাগ্যে জুটেই গেল। তাছাড়া তার মনগড়া ওহিতে নামায মাফ এবং ব্যকভিচার ও জুয়া বৈধ করে দেয়া হয়েছিলো, তাই পাপিষ্ঠ শ্রেনীর লোকেরা তার পাশে ভীড় জমালো। ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার তৈরি করা এই শক্তি হযরত আবু বকরের আমলে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
২-মুসাইলিমার প্রতিবেশী এক মহিলাও নবুয়তের দাবী তুললো। সাজাহ নাম্নী এই মহিলার সাথে মুসাইলিমা সাক্ষাত করে এবং গোপনে আলোচনার মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যোগসাজশ গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে মুসাইলিমার মধ্যেই তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। মুসাইলিমার অশ্লীল সাহিত্য সাজাহকে যৌনতার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরে মুসলমানদের সাথে লড়াইতে মুসাইলিমা নিহত হলে সাজাহ তওবা করে এবং আমরন ইসলামের উপর বহাল থাকে।
৩- বিদায় হজ্জের পর ইয়ামানের উর্বর ও রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ববহ অঞ্চলে আসওয়াদ আনসী নবুয়তের দাবীর মাধ্যমে বিদ্রোহ করে। তার আসল নাম ছিল যুলখিমার আবহালা বিন কা’ব। মাযহাজ গোত্র থেকে সে কিছু অনুসারী পেয়ে যায়। নাজরান এয়ালাকায় ও তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রভাব বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল তার যাদুমন্ত্র ইত্যাদি। ইসলামী সরকারের কিছু বেসরকারী কর্মকর্তা এবং দাওয়াতী কর্মীদেরকে সে হত্যা করায় এবং কতক লোককে সে নিজ এলাকা থেকে বহিষ্কার করে। রসূল সা. পাশ্ববর্তী কর্মকর্তাদেরকে শক্তি সঞ্চয় পুর্বক এই বিদ্রোহ দমন করবার নির্দেশ পাঠালেন। সে জনৈক ইরানী বংশোদ্ভূত মুসলমানকে হত্যা করিয়ে তার সুন্দরী স্ত্রীকে জোর পূর্বক দখল করে। এই মহিলা পরিপক্ক ঈমানদার ছিলেন। তাঁর সাহায্যে ইসলামী সরকার আসওয়াদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। রসূল সা. এর ইন্তেকালের মাত্র দুই এক দিন আগে এই কুচক্রী খতম হয় এবং তার সহযোগীরাও নির্মূল হয়। তবে তার ছড়ানো বিভ্রান্তির প্রভাব হাযরামাওত থেকে তায়েফ পর্যন্ত ছড়ায় এবং হযরত আবু বকরের খেলাফত আমলের প্রথম ভাগেই তার পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভবপর হয়।
৫-আম্মানের শাসক হাওযা বিন আলীর স্থলাভিষিক্ত লাকীত বিন মালেক আযদীর মাথায়ও নানা রকমের গোমরাহীর কীট কিলবিল করতে শুরু করেছিলো।
এই সব অপশক্তি বিভিন্ন একালায় মাথা তুলতে পেরেছিল নিছক আশেপাশের পুরনো জাহেলিয়াত পূজারী, মোনাফেক, অপরাধ প্রবণ, ব্যভিচার, মদ,জুয়া ও সুদের পুরনো ভক্ত, ইসলামের এককেন্দ্রিক শক্তির পরিবর্তে পুরনো গোত্রবাদে ফিরে যেতে ইচ্ছুক, যাকাত দিতে অনিচ্ছুক, মদিনায় যাকাতের সম্পদ যেতে দেখে মনে মনে ক্ষুব্ধ এবং ছোট ছোট নেতৃত্বের মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তিবর্গের আসকারা পেয়ে। এই স্বার্থপর পুরনো পাপীদেরকে এই অপশক্তিগুলো সংঘটিত করেছিল এবং জাহেলিয়াতের মরনোন্মুখ শক্তি আপন আধিপত্য পুনর্বহালের শেষ চেষ্টা চালিয়েছিল।
কিন্তু রসূল সা. এর তৈরি করা নেতৃত্ব অত্যন্ত বিপদজনক পরিস্থিতিতেও কঠোর হস্তে এই সব অপশক্তিকে দমন করে এবং আরবের সকল মানুষকে অটুট শৃংখলার বন্ধনে আবদ্ধ করে।

ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সম্মেলন

হজ্জ হচ্ছে ইসলামের একটা উঁচু মানের এবাদত। যে কা’বা শরীফ ও তার পবিত্র চত্তর ছিল হযরত ইবরাহীমের দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু, যে হারাম শরীফের প্রতিটি অনুপরমানুতে ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত মূল্যবান স্মৃতি খোদিত রয়েছে, যার আকাশে বাতাসে হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. এর দোয়া গুঞ্জরিত হচ্ছে এবং যার সমগ্র পরিবেশে স্বয়ং রসুল সা. এর জীবন ও কর্মের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেই কা’বা শরীফ এই হজ্জের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের বিশ্ব জোড়া কেন্দ্রে পরিণত হল। প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানদের জন্যে সারা জীবনে কমের পক্ষে একবার এই কেন্দ্রে নির্দিষ্ট হজ্জের দিনে হাজির দেয়া, হজ্জের করণীয় কাজ গুলো সম্পন্ন করা হযরত ইবরাহীমের কুরবানীর সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করা, পূর্বতন নবীদের জীবনেতিহাস আলোচনা করা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, সারা বিশ্ব থেকে আগত ইসলামী ভাইবোনদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা এবং সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বাত্মক বিনয়ের সাথে নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপার্দ করা ফরয। হজ্জ ফরয করার এই আদেশ জারী হয় ৯ম হিজরীতে।
রসূল সা. এ বছরই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কে আমীরুল হাজ্জ তথা হজ্জ প্রতিনিধি দলের নেতা বানিয়ে তিনশো সাহাবী সহ মক্কায় পাঠালেন যেন তিনি নিজের নেতৃত্বে হজ্জ সম্পাদন করান। প্রসঙ্গত এই হজ্জ সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় উল্লেখ করছি। কেননা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই এই ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হযরত আবু বকর সিদ্দীককে রা. আমীর বানানোর পাশাপাশি হযরত আলী রা. কেও অন্য একটা দায়িত্ব সোপার্দ করা হয়েছিলো। সেটি হল তিনি যেন সূরা তওবার প্রথম চল্লিশ আয়াত হজ্জের সমাবেশে পড়ে শোনান এবং আল্লাহস নাযিল করা জরুরী ঘোষণাবলী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। প্রথম ঘোষণা ছিল এই যে, যারা সাবেক জাহেলী ও পৌত্তলিক ব্যবস্থার উপর বহাল থেকে রসূল সা. বা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষন করেছিলো, তাদের আরো চার মাস সময় দেয়া হচ্ছে। এই চার মাস পর এই ধরণের সকল চুক্তি আল্লাহর হুকুমে বাতিল হয়ে যাবে।
এই চার মাসের মধ্যে তাদের নিজ নিজ কর্মপন্থা স্থির করে নিতে হবে যে, তারা কি ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করবে, না যুদ্ধ করবে, না ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান হিসেবে বসবাস করবে। অর্থাৎ এখন ইসলামী রাষ্ট্র নিজেদের অভ্যন্তরে স্বাধীন সত্তা বহাল রেখে নিজের দাবী ও চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম নয়, এ ধরণের চুক্তি বাতিল করার জন্যও প্রকাশ্য ঘোষণা জরুরী ছিল। তাছড়া চার মাসে সময় প্রতিপক্ষ কে দেয়া হয়েছিলো, তা যথেষ্ট ছিল। এ সুযোগও দেয়া হয়েছিলো যে, কোন মোশরেক যদি এই সময় মদিনায় ইসলামকে বুঝতে চায়, তবে সে নিরাপদে আসা যাওয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া মোশরেকদের মধ্যে থেকেও যারা সততার সাথে চুক্তি মেনেছিল, তাদেরকে বাড়তি এই সুবিধা দেয়া হয়েছে যে, তাদের চুক্তি চার মাস পর বাতিল হবেনা বরং নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত বহাল থাকবে। আসল চাপ ছিল সেই মোশরেকদের উপর, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা ও যুদ্ধ চালিয়েছে, সংঘর্ষ চালাতে গিয়ে সমস্ত নৈতিক নিয়ম নীতি লংঘন করেছে, বারবার ওয়াদা খেলাফ করেছে রবং মানবতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচারের যাবতীয় রীতি ভংগ করেছে। এরা ছিল সেই সব মোশরেক যারা হকের পথে চলতে মানুষকে বাঁধা দিয়েছে, যারা আল্লাহর দ্বীনের খুঁত ধরার চেষ্টা করেছে, যারা রসূল সা. কে বাড়ী থেকে বিতাড়িত করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং যারা সবসময় প্রথম আক্রমন চালিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ বাধায়।
দ্বিতীয় ঘোষণা ছিল, ভবিষ্যতে আর কোন মোশরেককে কা’বা শরীফের মোতাওয়াল্লী বানানো হবেনা। তৃতীয় ঘোষণা ছিল, ভবিষ্যতে আর কোন মোশরেক হারাম শরীফের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেনা। এ বিষয়ে হযরত আলী রা. রসূল সা. এর পক্ষ থেকে এ কথাও জানালেন যে, এখন থেকে কোন ব্যক্তি কা’বা শরীফে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করতে পারবেনা। চতুর্থ ঘোষণা, আল্লাহর পক্ষ থেকে চারটি নিষিদ্ধ মাস বহাল রাখা হল এবং এ মাস গুলোতে বিন্দু মাত্রও কোন রদবদল করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। কথা প্রসংগে এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, মোশরেকরা যতই অপছন্দ করুক, আল্লাহ তাঁর এই দ্বীন কে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করার জন্যই তাঁর রসূলকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে।
কেউ কেউ হযরত আলী রা. এর এই অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে নানা রকমের আজগুবী ও উদ্ভট কথা বলে থাকে। অথচ ব্যাপার ছিল শুধু এটুকু যে, রসূল সা. হযরত আবু বকর রা. কে আমীর বানানোর মাধ্যমে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন, আর হযরত আলীকে ব্যক্তিগত প্রতিনিধি, ব্যক্তিগত সচিব বা দূত হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঘোষণা দেয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সরকার পরিচালনার বিষয়টি সম্পর্কে যাদের সঠিক ধারণা আগ্রহে, তারা জানেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন না করে উপায়ন্তর থাকে না। সরকারের একজন গভর্নর থাকা সত্বেও কোন বিশেষ প্রয়োজনে আলাদা দুত পাঠাতে হয়।
এবার আমরা সেই বিশাল হজ্জ সমাবেশের বিবরণ দেব, যাতে রসূল সাঃ সশরীরে যগদান করেছিলেন এবং যেখানে ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তির এক সমুদ্র তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতে থাকে। দশম হিজরীতে যখন রসূল সা. হজ্জের সংকল্প করলেন, তখন সকল এলাকায় খবর পৌছানো হল। ইসলামী বিপ্লবের বীর সেনানীদের কাফেলা চারদিক থেকে মদিনায় সমবেত হতে লাগলো। এই সফরে উম্মুল মুমিনীনগনের সকলেই রসূল সা. এর সাথে যান। যুল হুলায়ফা থেকে তিনি এহরাম বাঁধেন এবং এখান থেকেই তিনি সেই ঐতিহাসিক শ্লোগান তোলেন, যা আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়া সকল হাজির অন্তরাত্মা থেকে উত্থিত হয়ে থাকে। এই শ্লোগান হলঃ “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক............”। অর্থাৎ “আমরা হাজির, হে আল্লাহ আমরা হাজির। সকল প্রশংসা তোমার, সকল নিয়ামত তোমার, সমস্ত রাজত্ব তোমার, তোমার কোন শরীক নেই”।
পথিমধ্যে যেখানেই কোন পাহাড়ে ওঠানামা করতে হয়েছে, সকলে সমস্বরে “লাব্বায়েক লাব্বায়েকা”।
মক্কার কাছাকাছি গিয়ে ‘যীতুয়া’ তে তিনি কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি করলেন। তারপর মুসলমানদের এই বিশাল জনসমুদ্রকে সাথে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথমে তাওয়াফ করলেন। তারপর সাফা মারওয়া গেলেন। সেখান থেকে কা’বার দিকে ফিরে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন। ৯ই জিলহজ্জ ওয়াদিয়ে নামেরায় উপস্থিত হলেন। দুপুরের পর আরাফাত ময়দানে উপনীত হলেন। সেখানে পাহাড়ের উপর আরোহন করে ‘কুসওয়া’ নামের উটনীর পিঠের উপর বসে খুতবা দিলেন। চারদিকে মকাবিবররা দাঁড়িয়েছিলেন, যারা প্রতিটি বাক্যের পুনরাবৃত্তি করেছিল। এভাবে রসূল সা. এর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ সমবেত প্রত্যেক ব্যক্তির কানে পৌঁছে যাচ্ছিলো।
আজ রসূল সা. এর মনে এক অভুতপূর্ব অনুভূতি বিরাজ করছিল। আজ তাঁর সারা জীবনের শ্রমের ফসল এক লাখ চুয়াল্লিশ মতান্তরে এক লাখ চব্বিশ হাজার মুসলমান তাঁর সামনে উপস্থিত।

ইসলামী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টা

এই সময় রসূল সাঃ দুটো ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথমটা ৯ই জিলহজ্জ আরাফাতের পাহাড়ের উপর থেকে। দ্বিতীয়টা ১০ই জিলহজ্জ মিনায়। এ দুটি ভাষণের বক্তব্য কিছু কিছু বর্ণনায় একাকার হয়ে গেছে।
এ দুটি ভাষণ একাধিক কারণে অসাধারণ গুরুত্বের অধিকারী। প্রথমত, রসূল সাঃ সবচেয়ে বড় ইসলামী সমাবেশে ভাষণ দেন, এবং এমন সময় যখন তাঁর লাগানো সত্যের কালেমার চারা গাছটি বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়ে ফল দিতে শুরু করেছে। প্রচন্ড বিরোধিতার যুগ অতিক্রম করে এত বড় সাফল্য লাভ স্বয়ং জীবন ও চরিত্রের এক বিরাট পরীক্ষা হয়ে থাকে। এ পরিস্থিতিতে তিনি না হয়ে কোন দুনিয়াদার ব্যক্তি হলে এবং নিছক রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয় অর্জনকারী একজন বিজেতা হলে যাবতীয় ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠতো এবং দম্ভ ও অহংকারে নিজেকে খোদার আসনে অধিষ্ঠিত করে ছাড়তো। রসূল সা. ছাড়া অন্য কোন স্বার্থপর ব্যক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছলে ধার্মিকতার সমস্ত আলখেল্লা দূরে ছুড়ে ফেলতো এবং ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করতো। কিন্তু রসূল সা. কে আগের চেয়েও বেশী বিনয় এবং আগের চেয়েও বেশী আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত যেহেতু রসূল সা. স্বীয় প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এত বড় মুসলিম সমাবেশে তাঁর ভাষণ দিতে পারার এটাই শেষ সুযোগ, তাই এতে তিনি বিদায়ী নির্দেশাবলী সম্বলিত ওসিয়ত পেশ করেছিলেন, যার প্রতিটি শব্দ মূল্যবান। তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের এই পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যাওয়ার পর ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতির নামে কোন বাণী বা কোন মেনিফেষ্টা দেয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। তাই তিনি এ দায়িত্বটা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। চতুর্থত এ ভাষণ দুটো রসূল সা. এর শ্রেষ্ঠ বাগ্মীতার স্বাক্ষর এবং তাঁর সর্বোত্তম অলংকার সমৃদ্ধ ভাষণ সমূহের অন্যতম। এ দ্বারা এই মহান ও পবিত্র ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বকে উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, এই ভাষণ দুটোর একাংশ সুনির্দিষ্ট আভ্যান্তরীণ অবস্থা ও সমস্যাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট, আর এক অংশ আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টা সম্বলিত। মূল বক্তব্যই এই বিভক্তিকে স্পষ্ট করে দেয়।

আরাফাতের ভাষণ

-সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আমরা শুধু তাঁরই প্রশংসা করি। তাঁরই কাছে সাহায্য চাই। তাঁর নিকটই নিজেদের গুণাহখাতা মাফ চাই। তাঁরই কাছে অনুশোচনা পেশ করি। আমরা আমাদের প্রবৃত্তির ক্ষতিকর তৎপরতা ও নিজেদের অন্যায় কর্মকান্ড থেকে তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন, তাকে কেউ বিপদগামী করতে পারেনা। আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত লাভের সুযোগ দেননা, তাকে কেউ সরল ও সঠিক পথে চালাতে পারেনা।
-আমি ঘোষণা করছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সা. তাঁর বান্দা ও রসূল।
-হে আল্লাহর বান্দারা, আমি তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি ও উৎসাহিত করছি।
-আমি কল্যাণময় কথা দ্বারা আমার বক্তব্য শুরু করছি।
-হে জনতা, তোমরা আমার কথাগুলো মনোনিবেশ সহকারে শোন। আমি তোমাদেরকে বুঝিয়ে বলছি। কেননা এ বছরের পর তোমাদের সাথে এই স্থানে আমার আর সাক্ষাত হবে বলে মনে হয়না।
-হে জনমন্ডলি, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের প্রভুর নিকট পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত এ বিধান মেনে চলবে। তোমাদের এই মাস এই শহর এবং তোমাদের এই দিন যেমন পবিত্র ঠিক তেমনি।
-জেনে রেখ, আমি তোমাদের কাছে কথা পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।
-যার হাতে কারো কোন জিনিস আমানত রয়েছে, সে যেন তা তার মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়।
-জাহেলিয়ত যুগের সুদগুলো বাতিল করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাসের সুদ রহিত করলাম।
-জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবী রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমের বিন রবীয়ার খুনের দাবী রহিত করলাম। জাহেলিয়ত যুগের সমস্ত পদ পদবী ও সম্মান বাতিল করা হলো। কেবল কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধায়কের পদ এবং হাজীদেরকে পানি সরবরাহের পদ-এই দুটো পদ বহাল থাকবে।
-ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের বদলা একশো উট। এ ক্ষেত্রে একশো উটের বেশী দাবী করলে তা হবে জাহেলী রীতি।
-হে জনমন্ডলি, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর শয়তান আর আশা করেনা যে এই ভুখন্ডে তার আনুগত্য করা হবে। কিন্তু তোমরা যে গুনাহগুলোকে হালকা মনে কর, তাতে যদি শয়তানের আনুগত্য কর, তবে তাতেও সে খুশী হবে।
-হে জনমন্ডলি, হারাম মাসগুলোর রদবদল করা অধিকতর কুফরি কাজ। এক বছর তাকে হারাম এবং আরেক বছর হালাল গণ্য করে আগ পিছ করে কোন মতে গুণতি পূরণ করার মাধ্যমে কাফেররা আরো বেশী গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।
-নিশ্চয় আবর্তনের পথ ধরে মহাকাল আজ তার সেই প্রারম্ভিক বিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করেছে, যেখানে সে আল্লাহ কর্তৃক আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিনে ছিল। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট মাস সুনিশ্চিতভাবে বারোটাই। যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তখন থেকেই তাঁর অদৃষ্ট লিপিতে মাসের সংখ্যা এভাবেই লেখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চার মাস নিষিদ্ধ। তিনটে মাস ধারাবাহিক-জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররম। আর একটার অবস্থান একাকী অর্থাৎ রজব মাস, যা জমাদিউস সানী ও শাবানের মাঝখানে অবস্থিত।
-জেনে রেখ, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থেকো।
-হে জনতা, তোমাদের নারীদেরকে তোমাদের ওপর কিছু অধিকার দেয়া হয়েছে।
তোমাদেরও তাদের কাছে কিছু অধিকার প্রাপ্য রয়েছে। তোমাদের স্বামীদের শয়নকক্ষে তোমরা ছাড়া আর কাউকে আসতে না দেয়া তোমাদের কর্তব্য। তোমরা পছন্দ করনা এমন কোন ব্যক্তিকে তোমাদের অনুমতি ছাড়া বাড়ীতে ঢুকতে দেয়া তোমাদের স্ত্রীদের পক্ষে অনুচিত। কোন নির্লজ্জ ও অশ্লীল কাজ করা স্ত্রীদের উচিত নয়। যদি তারা তা করে তবে তোমাদেরকে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন যে, তাদের সংশোধনের জন্য তাদের কাছ থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে পার। এরপর তারা অনুগত হয়ে চললে তাদেরকে নিয়মানুযায়ী খোরপোশ দেয়া তোমাদের দায়িত্ব। নিশ্চয়ই মহিলারা তোমাদের অধীন। তারা নিজেদের কল্যাণের জন্য নিজেরা কিছু করতে পারেনা। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে নিজেদের সাথী বানিয়েছে এবং তাদের দেহকে আল্লাহরই আইন অনুসারে ভোগ করে থাক। কাজেই নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা দান কর।
-জেনে রেখ, আমি আমার কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমিও সাক্ষী থেকো।
-হে জনতা, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই ভাই। এক ভাই এর সম্মতি ছাড়া তার সম্পদ অন্য ভাই কর্তৃক গ্রহণ করা বৈধ নয়।
-সাবধান, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমিও সাক্ষী থাকো।
-আমার পরে এই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে তোমরা কাফের সুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিওনা।
-আমি তোমাদের কাছে এমন একটা জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা মেনে চললে তোমরা বিপদগামী হবেনা। সেটি হলো আল্লাহর কিতাব।
-সাবধান, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমিও সাক্ষী থাকো।
-তোমাদের কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। বল, তোমরা কী বলবে? লোকেরা সমস্বরে বলে উঠলো, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং উম্মাতের শুভ কামনায় যা কিছু করা উচিত, তা আপনি করেছেন। সত্যের ওপর থেকে সমস্ত পর্দা তুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর আমানতকে আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।”
-হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক।
-যারা এখানে উপস্থিত আছে, তারা যেন এই কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো বা কিছু উপস্থিত লোকের চেয়ে কিছু অনুপস্থিত লোক এ কথাগুলোকে অধিকতর ভালোভাবে মনে রাখতে পারবে এবং সংরক্ষণ করবে।
-হে জনতা, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য উত্তরাধীকারের স্থায়ী অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এক তৃতীয়াংশের বেশী সম্পত্তি ওসিয়ত করা জায়েজ নয়।
-যার বিছানায় সন্তান জন্ম নেবে সন্তান তারই। আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর।”
-যে ব্যক্তি নিজের পিতা ছাড়া আর কাউকে পিতা বলে মেনে নেবে অথবা যে ক্রীতদাস নিজের মনিব ছাড়া অন্য কাউকে মনিব বলবে, তার ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত! কেয়ামতের দিন তার কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবেনা।
-তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি নেমে আসুক।

মিনার ভাষণ

-হে জনমন্ডলী, আমার পর আর কোন নতুন নবী আসবেনা। তোমাদের পরও কোন নতুন উম্মাত জন্ম নেবেনা। সুতরাং মনোযোগ দিয়ে শোন এবং আপন প্রতিপালকের দাসত্ব কর। পাঁ ওয়াক্ত নামায পড়। রমযানের রোযা রাখ। সম্পদের যাকাত সাগ্রহে দিতে থাক। হজ্জ আদায় কর এবং আপন নেতা ও দায়িত্বশীলদের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা আল্লাহর জান্নাতে যেতে পার।’
আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টো হিসাবে এই দুটি ভাষণে রসূল সা. যা কিছু বর্ণনা করেছেন, তা মানবীয় চিন্তা ও কল্পনার অতীত। বরঞ্চ আর কোন মেনিফেষ্টো কার্যত এই মেনিফেষ্টোর মত এত উঁচুমানের মানুষ তৈরী করতে পারেনি। এতে আল্লাহর একত্বের বিপ্লবী আকীদা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহর দাসত্বও এবাদতকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌল চালিকা শক্তিরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মুসলমানদের জন্য পরস্পরের জানমাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং হত্যাকান্ডের শাস্তি মৃত্যুদন্ড অপরিহার্য করা হয়েছে। সুদখোরীর জাহেলী রীতিকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাগৈসলামিক যুগের প্রতিশোধ ও পাল্টা-প্রতিশোধের অব্যাহত ধারাবাহিকতাকে রহিত করা হয়েছে। জাহেলী যুগের পদমর্যাদা ও খেতাব খতম করা হয়েছে। এতে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করা হয়েছে। নারীদেরকে আল্লাহর আমানত আখ্যায়িত করে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে জরুরী আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর কিতাবকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহর একত্ব ও মানবজাতির পিতার এককত্বের ভিত্তিতে মানবীয় ঐক্যের ধারণা দেয়া হয়েছে। ভৌগলিক ও বংশীয় ভেদাভেদকে নিরর্থক এবং সততা ও খোদাভীতিকে সম্মান ও মহত্বের মানদন্ড বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যখনই এবং পৃথিবীর যে স্থানেই ইসলামী আন্দোলন চলবে এবং ইসলামী ব্যবস্থা চালু হবে, তার ভিত্তি এই অটল ও অটুট মতাদর্শগুলোর ওপরই প্রতিষ্ঠিত হবে। এ মেনিফেষ্টো ইসলামের মৌলিক মেনিফেষ্টো এবং মানবজাতিকে এর দিকে ডাকা যেতে পারে। আর এই মেনিফেষ্টোর বিরুদ্ধে জীবনের যে কাঠামো তৈরী হবে, তা অনৈসলামিক হবে এবং কোন খাঁটি মুসলমান তা গ্রহণ করতে পারেনা। এই মেনিফেষ্টোকে আমরা আমাদের যে কোন নেতৃত্বের তৎপরতা যাচাই করার কষ্টিপাথর বানাতে পারি এবং আমাদের প্রত্যেক সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে এর আলোকে মূল্যায়ন করতে পারি। এ মেনিফেষ্টোর দর্পণে আমরা নিজেদের চেহারাও দেখতে পারি, অন্যান্য অনৈসলামিক সমাজব্যবস্থাকেও দেখতে পারি।
এ হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীর শেষ ভাষণ। এ ভাষণ তিনি আমাদের উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন। এ ভাষণ রসূল সা. এর ওসিয়ত স্বরূপ। এর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরার পর রসূল সা. দরদভরা কন্ঠে বলেছেন, আমি আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এ কথাটা পড়ে আমাদের সাবধান ও সচেতন হয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের এ যাবতকার আচরণে অনুতপ্ত হয়ে এবং অনৈসলামিক ব্যবস্থার দাসত্বের জিঞ্জীর ছুড়ে ফেলে দিয়ে রসূল সা. এর জীবনাদর্শের অনুসারী হওয়া উচিত। যে ব্রত সফল করার জন্য রসূল সা. এত কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন, যে অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কোন নজীর পাওয়া যায়না, সেই ব্রত সফল করতে আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
রসূল সা. সুষ্ঠু ও শান্তভাবে হজ্জ আদায় করলেন। হজ্জ পালনরত সকল মুসলমানের সাথে দেখা সাক্ষাত করলেন। লোকেরা বহু প্রশ্ন করলো। অতঃপর বিদায়ী তওয়াফের মাধ্যমে এই পবিত্র সফর সমাপ্ত করলেন।
এ ছিল ইসলামের পূর্ণতা অর্জনের দৃশ্য। দেড় লাখ মানুষের এই উদ্দীপনায়ময় ও স্বতস্ফুর্ত সমাবেশ যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিল, তা এই যে, ইসলামী আন্দোলন আসল বিজয় অর্জন করেছিল জনমতের যুদ্ধে এবং হৃদয়ের অভ্যন্তরে পরিবর্তন সাধনের সংগ্রামে। আর ভেতরের এই পরিবর্তনই বাইরের গোটা জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছিল।

রসূল সা. এর তীরোধানের পর

এ পর্যন্ত আমরা রসূল সা. এর পরিচালিত আন্দোলনের ফলাফল তুলে ধরলাম। এর পর বেশী দিন অতিবাহিত না হতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। কিন্তু তাঁর প্রশিক্ষিত ও প্রতিপালিত মুসলমানরা এ কাজ অব্যাহত রাখে এবং ইসলামী আন্দোলন দশ পনেরো বছরের মধ্যেই বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
বিদায়ী হজ্জে রসূল সা. যেভাবে অংশগ্রহণ করেন, যেভাবে তিনি আপন সাথীদের সম্বোধন করেন এবং যে ভাষায় তিনি ওসিয়ত করেন ও আবেদন জানান, তা থেকে বুঝা যাচ্ছিল যে, রসূল সা. সামষ্টিকভাবে সকলকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনকালে ‘গাদীরে খুম’ নামক পুস্করিনীর পাশে যাত্রা বিরতির সময় বিশিষ্ট সাথীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো একটা ভাষণ দেন। এ ভাষণে বিদায়ের মনোভাব আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার ভাষাও ছিল এমন যে, শোনলে কান্না এসে যায়। প্রথমে চিরাচরিত রীতি অনুসারে আল্লাহর প্রশংসা করেন। তারপর বলেনঃ
“হে জনমন্ডলী, আমি একজন মানুষ। হয়তো খুব শীগগীরই আমার কাছে আল্লাহর আহ্বায়ক এসে যাবে এবং তার ডাকে সাড়া দেব। আমি দুটো দায়িত্বের বোঝা তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। তার একটা আল্লাহর কিতাব। এতে রয়েছে সঠিক পথের নির্দেশনা, আলো ও হিকমত। এরপর কোরআন সম্পর্কে উদ্দীপনা ও সতর্কতামূলক বেশ কিছু কথা বলেন। তারপর বলেন, দ্বিতীয় বোঝাটি হলো, আমার পরিবারের লোকেরা। আমার পরিবারের লোকদের সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করার আহ্বান জানাই।”
নবীগণকে অতিমানব ও অমানব আখ্যায়িত করে যারা নানা ধরনের গোমরাহীর পথ উন্মুক্ত করেছিল, তাদের সেই সব গোমরাহী দূর করার জন্য তিনি নিজেকে মানুষ বলে আখ্যায়িত করেন। যে নবীগণ শেরকের মূল্যোৎপাটন ও আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেন, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে, অতিরঞ্জকরা সেই নবীদেরকেই আল্লাহর সন্তান আখ্যায়িত করে তাদেরকে আল্লাহর অংশ ও চিরঞ্জীব সত্তা বলে গণ্য করেছে। রসূল সা. নিজের বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসার আগে নিজের সাথীদেরকে এই বলে সতর্ক করেন যে, আমি মানুষ। তাই অন্যান্য মানুষের মত আমার ওপরও আল্লাহর আইন চালু হবে। তারপর তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে কোরআন অনুসরণের নির্দেশ দেন এবং এটাকে একটা দায়িত্বের বোঝা বলে অভিহিত করেন। কেননা রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়গণ তাঁর জীবনের প্রতক্ষ্যদর্শী এবং তাঁর মূল্যবান শিক্ষাসমূহের আমানতদার। এ দিক থেকে তারা উম্মতের জন্য ইসলামী শিক্ষার উৎস। অপর দিকে তাদের জন্য তিনি কোন ধন সম্পদ রেখে যাননি এবং তাদের ভবিষ্যতকে আল্লাহর হাত সোপর্দ করে গেছেন। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, রসূল সা. এর পর তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের ওপর বিরাট গুরুদায়িত্ব বর্তে। কিন্তু তীব্র আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তিনি এ বিষয়ে কোন স্পষ্টোক্তি না করে ইংগিতের মধ্যেই সীমিত রেখেছেন।
এই ভাষণেই অথবা পরবর্তী অন্য কোন ভাষণে রসূল সা. সাধারণ মুসলমান ও সাহাবায়ে কেরামকে আরো একটা কথা একটা অসাধারণ প্রয়োজনের আলোকে বলেছিলেন। ব্যাপারটা ছিল এই যে, হযরত আলীর সাথে যে ক’জন সাহাবীকে ইয়ামানে পাঠানো হয়েছিল, তাদের কোন ব্যাপারে হযরত আলীর সাথে কিছুটা মতভেদের সৃষ্টি হয়ে যায়। আসলে বড় বড় কাজের সময় কখনো কখনো এমন কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, মেজাজের পার্থক্যের সাথে সাথে মতেরও অমিল ঘটে যায়। কখনো কখনো তিক্ত বা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের দরুন অন্তরে অস্থায়ীভাবে হলেও ক্ষোভ বা অসন্তোষ দানা বাধে। মানুষের দ্বারা তৈরী সংগঠন, চাই তা খালেছ ইসলামী কাজের জন্যই সংগঠিত হোক কিংবা তার নেতৃত্বে নবীদের ন্যায় নিষ্কলঙ্ক মানুষই বহাল থাকুক, মানুষের যাবতীয় স্বভাবসুলভ দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকবে- এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। মতপার্থক্য ও আবেগের সংঘাত একটা আপাদমস্তক সৎ,s সত্য নিষ্ঠ, নির্মল ও নিখুঁত সমাজেও দেখা দিতে পারে। এ জন্য বড় বড় কাজ সম্পাদনের জন্য সেই সব মহানুভব, সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল ও উদার লোকদের প্রয়োজন, যারা মতবিরোধ দেখা দেয়া সত্ত্বেও খাপ খাইয়ে চলতে পারে। সাহাবায়ে কেরামের সংগঠনেও কখনো কখনো বিরোধ দেখা দিত। কিন্তু তাদের অসাধারণ সহনশীলতার কারণেই এই বিরোধ সত্ত্বেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকতো। তিক্ততা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও তা হতো সাময়িক। এ ক্ষেত্রেও এ ধরনেরই একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষত হযরত বারীদার মনে বিরোধের প্র্রভাব এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, তিনি রসূল সা. এর কাছে হযরত আলীর বিরুদ্ধে নালিশ করে দিলেন। কিন্তু হযরত আলীর ন্যায় প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভিযোগ সৃষ্টি হওয়া, তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, ব্যক্তিগত মনোকষ্টের রূপ নেয়া এবং তারপর রসূল সা. এর কাছে অভিযোগ আকারে উপস্থাপিত হওয়া কিছুটা জটিল ব্যাপারই ছিল। অভিযোগটা শুনে রসূল সা. ব্যথিত হন এবং চেহারার রং পাল্টে যায়। এই প্রেক্ষাপটে তিনি তার চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে কারো নাম উল্লেখ না করেই বললেন, “আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ, যে আলীর সাথে বন্ধুত্ব রাখে, তুমিও তার সাথে বন্ধুত্ব রাখ। আর যে আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তার সাথে তুমিও শত্রুতা পোষণ কর।”
এ কথা সবার জানা যে, যে আন্দোলনে রসূল সা. যথা সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন, হযরত আলীও তাতে সর্বস্ব উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। একই দাওয়াতের আহ্বায়ক, একই মিশনের পতাকাবাহী, একই চিন্তাধারার অনুসারী এবং একই পথের পথিক, উপরন্তু এত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যে, উভয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্রও ব্যবধান সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এমন দু’জনের একজনকে ভালোবাসা ও অপর জনের প্রতি বিক্ষুদ্ধ থাকা কিভাবে সম্ভব? রসূল সা. ও তার ঘনিষ্ঠতম সাহাবীদের মধ্যে এ ধরনের সম্পর্কই ছিল। আকীদা, আদর্শ ও লক্ষ্যের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গোটা সংগঠন গভীরভাবে আবদ্ধ ছিল। বিশেষত এর প্রথম কাতারের ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে রসূল সা. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করে কাউকে ভালোবাসা ও কারো প্রতি মনোকষ্ট পোষণ করার কোন সুযোগই ছিলনা। রসূল সা. কষ্ট পেয়েছিলেন এজন্য যে, যে দলকে তিনি বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তার মধ্যে যদি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এত দুর্বল হয়ে থাকে, তার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভ পোষণ করা হয় এবং মতেভেদের কারণে ব্যক্তিগত দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তা হলে এই বিশাল লক্ষ্য নিয়ে মুসলমানরা সামনে অগ্রসর হবে কি করে?
এ সময় রসূল সা. দেখতে পাচ্ছিলেন নিজের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিনি এই চিন্তায়ই মগ্ন ছিলেন যে, এখন সমস্ত দায়িত্বের বোঝা এই সংগঠনের কাঁধের ওপরই অর্পিত হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে মুসলমানদেরকে রসূল সা. এর পরিবর্তে নেতৃত্বের এই সারির পেছনেই চলতে হবে, যার ভেতরে রসূল সা. নিজের বিশ্বস্ততম সাথীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং যার প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন। এ কারণে তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সতর্ক করার উদ্দেশ্যে ঐ কথাটা বলেছিলেন। আশ্চর্যর বিষয় যে, কিছু লোক ঐ উক্তির ভেতর থেকেই রসূলের সা. পরবর্তী খলিফা নিয়োগের দর্শন খুঁজে বের করেছে। এটা কিভাবে বের করা হলো, তা আমার বুঝে আসেনা।
এ আলোচনাটা এসে গেল নিতান্তই আনুসংগিকভাবে। নচেত আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই বিষয়টা ফুটিয়ে তোলা যে, সমগ্র বিদায় হজ্বের সফরকালেই রসূল সা. অনুভব করছিলেন যে, এখন তাঁর পরকালের সফর আসন্ন প্রায়। এই অনুভূতির আলোকেই তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও ওসিয়ত করতে থাকেন।
একাদশ হিজরীর সফর মাসের শুরু থেকেই রসূল সা. এর পবিত্র আত্মা আখেরাতের সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। একদিন তিনি ওহুদে চলে গেলেন এবং ওহুদের শহীদদের জন্য সিজদায় গিয়ে দোয়া করলেন। ফিরে এসে পুনরায় নিন্মোক্ত ভাষণ দেনঃ
“হে জনমন্ডলী, আমি তোমাদের আগেই বিদায় নিয়ে যাবো এবং আল্লাহর কাছে তোমাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেব। আল্লাহর কসম, আমি এখানে বসেই হাউজে কাউসার দেখতে পাচ্ছি, আমাকে বিভিন্ন সাম্রাজ্য জয়ের চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। (অর্থাৎ দাওয়াতের ফলে বিভিন্ন রাজ্য বিজিত হবে।) আমি এ আশংকা করিনা যে, তোমরা আমার পর মোশরেক হয়ে যাবে। আমার আশংকা শুধু এই যে, তোমরা পার্থিব স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংঘাতে পড়ে যাবে।”
তারপর মধ্যরাতে বাকী’র গোরস্থানে গিয়ে কবরবাসীর জন্য মাগফেরাত কামনা করেন এবং বলেন, “আমিও শীগগীরই তোমাদের সাথে এসে মিলিত হব।” তারপর একদিন বিশেষভাবে বিশিষ্ট সাথীদেরকে জমায়েত করে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
“হে মুসলমানগণ! তোমাদের অভিনন্দন! আল্লাহ তোমাদের আপন করুণায় অীভিষিক্ত করে রাখুন। তিনি তোমাদের মনের কষ্ট দূর করে দিন। তোমাদেরকে জীবিকা দিন। তোমাদেরকে সাহয্য করুন। তোমাদেরকে উন্নতি দিন। তোমাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিন। আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিচ্ছি, তোমাদেরকে আল্লাহরই তত্ত্বাবধানে সোপর্দ করছি এবং তোমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে সতর্ক হবার আহ্বান জানাই। কেননা আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী। দেখ, আল্লাহর জনপদগুলোতে তাঁর বান্দাদের মধ্যে অহংকার ও দাম্ভিকতার আচরণ করোনা। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও তোমাদেরকে বলেছেনঃ “আখেরাতের সেই গৃহ আমি ঐ সব লোকের জন্যই নির্দিষ্ট করেছি, যারা পৃথিবীতে অহংকার ও অরাজকতা ছড়াবার ইচ্ছা পোষণ করেনা। আর পরকালের সাফল্য তো মুত্তাকীদের জন্যই।” তোমাদের সকলের ওপর এবং ইসলাম গ্রহণ পূর্বক আমার বায়রাতে অন্তর্ভুক্ত লোকদের সকলের ওপর সালাম বর্ষিত হোক।”
বাকী’র কবরস্থান থেকে ফিরে আসার পর মাথায় হালকা ব্যথা শুরু হলো। ২৯শে সফর এক মৃত ব্যক্তির জানাযায় যাওয়া আসা করায় মাথা ব্যথা বেড়ে গেল। রোগের প্রাথমিক হাল্কা অবস্থায় এগারো দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীতে এসে নিজেই নামাযের ইমামতি করতে লাগলেন। রোগ বৃদ্ধির ফলে ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে থাকেন এক সপ্তাহ। এরপর রোগ আরো বৃদ্ধি পেলে অন্য সকল স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে হযরত আয়েশার কক্ষে চলে আসেন।
রোগের দরুন তিল তিল করে মৃত্যু পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন- এরূপ অবস্থায়ও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বের কথা তিনি ভোলেননি। তবুক ও মুতার যুদ্ধের উদ্দেশ্যে তখনো সফল হতে বাকী। সামান্য শৈথিল্য দেখালেই শত্রুরা আসকারা পেয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। তাই এই পরিস্থিতিতেই ২৬শে সফর মুসলমানদেরকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। পরের দিন হযরত উসামা ইবনে যায়েদকে এই অভিযানের সেনাপতি মনোনীত করলেন। তাকে বললেন, “যাও, আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার পিতার শাহাদাতের স্থানে পৌঁছে যাও এবং আল্লাহকে যারা অমান্য করে তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা কর। তিনি নিজ হাতে পতাকা তৈরী করে হযরত বারীদা বিন খুসাইব আসলামীর হাতে দিলেন। একেতো অল্প বয়স্ক, তদুপরি রসূল সা. এর মুক্ত গোলাম ও পালিত পুত্র যায়েদের ছেলে হওয়ার কারণে হযরত উসামার নিযুক্তি নিয়ে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে লাগলো যে, বড় বড় আনসার ও মোহাজের থাকতে এই কিশোরকে কেন সেনাপতি নিয়োগ করা হলো। বিষয়টি রসূল সা. এর কানে গেলে তিনি নিদারুণভাবে মর্মাহত হলেন এবং প্রবল কষ্ট সত্ত্বেও মাথায় পট্টি বেঁধে মসজিদে উপস্থিত হলেন। তারপর গাদীরে খুমের অনুরূপ ভাষণ দিলেন, তিনি বললেনঃ
“আমি শুনতে পেয়েছি, তোমরা উসামা সম্পর্কে নানা কথা বলেছ। ইতিপূর্বে তার বাবাকে সেনাপতি নিয়োগ করা সম্পর্কেও তোমরা আপত্তি তুলেছিলে। অথচ আল্লহর কসম, সে তার যোগ্য ছিল। তারপর তার ছেলেও এ কাজের যোগ্য। যায়েদ বিন হারেসাও আমাদের কাছে সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। আর তার ছেলে উসামাও আমাদের কাছে এখন সবার চেয়ে প্রিয়।”
ইতিপূর্বে (ইন্তিকালের পাঁচ দিন আগে) মাথায় সাত মশক পানি দিয়ে গোসল করেছেন। এই গোছলে শরীরটা একটু হালকা হলে তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তিনি সাহাবীদের সমাবেশে সর্বশেষ ভাষণ দিলেন। বললেনঃ
“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা নবীদের ও পুন্যবান লোকদের কবরকে পূজা করতো। তোমরা এরূপ করোনা। আমার তীরধানের পর আমার কবরকে পূজার জায়গায় পরিণত করোনা। যারা নবীদের কবর পূজা করবে, তাদের ওপর আল্লাহর মারাত্মক গযব নেমে আসা অবধারিত। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমি স্বয়ং এর সাক্ষী।”
তারপর নামায পড়ালেন এবং নামাযের পর আবার বললেনঃ
“আমি তোমাদেরকে আনসারদের সম্পর্কে সাবধান করছি। তারা ছিল আমার দেহের পোশাক এবং আমার পথের সম্বল। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তোমাদের ওপর তাদের অধিকার দেয়া বাকী রয়েছে। অন্যেরা উন্নতি লাভ করবে। কিন্তু আনসাররা যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে। আনসারদের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য তাদের কদর দিও। আর যারা ভুল করে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিও। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে এখতিয়ার দিয়েছিলেন যে, সে ইচ্ছা করলে দুনিয়া ও তার চিত্তবৈভব গ্রহণ করতে পারে, অথবা আল্লাহর কাছে তার জন্য যা কিছু আছে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বান্দা আল্লাহর কাছে তার জন্য নির্ধারিত যা ছিল তাই গ্রহণ করে নিল।”
রুগ্নাবস্থায় রসূল সা. যা কিছুই বলতেন, তাতেই সাধারণভাবে বিদায়ী মনোভাব প্রকাশ পেত। কিন্তু উপরোক্ত ভাষণের শেষ বাক্য কয়টিতে খুবই স্পষ্ট ইংগিত ছিল। হযরত আবু বকর রা. এটা তৎক্ষণাত বুঝে ফেললেন এবং অধীরভাবে কাঁদতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে তিনি নামাযের জামায়াতে হাজির হতেও অক্ষম হয়ে পড়লেন। তখন তিনি হযরত আবু বকর রা. কে নিজের জায়গায় ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। রোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেল। লোকেরা উৎকন্ঠিত হয়ে বারবার মসজিদে নববীর চারপাশে চক্কর দিতে থাকলে রসূল সা. হযরত আলী রা. ও হযরত ফযল বিন আব্বাসের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে এলেন এবং মিম্বরের সর্বনিম্ন ধাপে বসে একেবারেই সর্বশেষ ভাষণটি দিলেন এভাবেঃ
“হে জনমন্ডলী, জানতে পারলাম যে তোমরা আমার মৃত্যুর ভয়ে ভীত। পৃথিবীতে যত নবী এসেছেন, তাদের কেউ কি চিরজীবী হয়েছেন? আল্লাহর কাছে আমাকেও যেতে হবে, তোমাদেরকেও যেতে হবে। আমি ওসিয়ত করছি, প্রথম যারা হিজরত করেছে, তাদের সাথে সদাচরণ কর এবং মোহাজেররাও যেন পরস্পরের সাথে সদাচরণ করে।” এরপর সূরা আল আসর পড়লেন এবং বললেনঃ “সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে চলে। যে কাজে বিলম্ব প্রয়োজন, তাতে তাড়াহুড়ো করোনা। কেউ তাড়াহুড়ো পছন্দ করলেই আল্লাহ তাড়াহুড়ো করেননা। আমি ওসিয়ত করছি যে, আনসারদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। তারা তোমাদের আগেই মদিনাকে নিজেদের মাতৃভূমি পরিণত করেছে এবং ঈমান আনাকে নিজেদের দায়িত্ব গণ্য করেছে। তারা কি তোমাদেরকে তাদের ফসলে শরীক করেনি? তারা কি তোমাদেরকে জায়গা দেয়ার জন্য নিজেদের বাড়ীকে প্রশস্ত করেনি? তারা কি নিজেদের প্রয়োজন উপেক্ষা করেও তোমাদেরকে অগ্রাকিার দিওনা। আমি আগে চলে যাবো। তোমরা পরে এসে আমার সাথে মিলিত হবে। হাউজে কাওসারে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
এই ভাষণগুলোকে বিভিন্ন বর্ণনার বিভিন্ন সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কিন্তু একটি মত এই যে, এই সব বক্তব্য একই ভাষণের অংশ। সম্ভবত এই মতটিই সঠিক।
সোমবার দিন [ইন্তিকালের তারিখ নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কোন রেওয়ায়েতে ১লা,কোন রেওয়ায়েতে ২রা, কোন রেওয়ায়েতে ১২ এবং কোন রেওয়ায়েতে ১৩ ই রবিউল আউয়াল উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তারিখ হচ্ছে ১২ই রবিউল আউয়াল] রসূল সা. এর স্বাস্থ্য শেষ বারের মত একটু স্বাভাবিক হলো। তিনি মেসওয়াক করলেন। পর্দা তুলে সমবেত সাহাবাদেরকে এক নজর দেখলেন এবং মুচকি হাসলেন। এর কয়েক মুহুর্ত পরই তিনবার বললেনঃ
(**********)
সেই সাথে হযরত আয়েশার কোলে মাথা রেখে মহান আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
আজ সেই মহান সত্তা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, যিনি মানব জাতিকে নব জীবন দান করেছিলেন এবং যিনি মানব জাতির কাফেলাকে দস্যুদের কবলমুক্ত করে সঠিক পথে বহাল রাখার জন্য ভয়াবহ কষ্ট সহ্য করেছিলেন অথচ দুনিয়ার জীবনে তার কোন বদলা নেননি।
রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠতম ও সারা জীবনের সাথীদের জন্য এই মর্মান্তিক ঘটনা কতদূর শোকাবহ ছিল, তা কল্পনা করাও দুসাধ্য। যারা রসূল সা. কে এক নজর দেখেও নতুন শক্তি ও প্রেরণা লাভ করতেন, তাদের চোখে আকাশ পৃথিবী নিশ্চয়ই ঘুরপাক খেয়েছিল। তাদের কাছে হয়তো মনে হয়েছিল সমগ্র মানবেতিহাস ওলট পালট হয়ে গেছে। হযরত ওসমান রা. নির্বাক এবং হযরত আলী নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। হযরত ওমর মস্তিস্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস তো শোকাহত হয়ে মারাই গেলেন।
এই ভয়াবহ বিয়োগান্ত ঘটনা এমনিতেও ছিল এক শোকের পাহাড়। তদুপরি এটি সংঘটিত হলো এক চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। একদিকে রোম সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে আগ্রাসনের আশংকা বিরাজ করছিল এবং সে জন্যই উসামার বাহিনী রওনা হচ্ছিল। অপরদিকে ইসলাম ত্যাগ ও যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতির হিড়িক চলছিল। তৃতীয় দিকে ইসলামী আন্দোলন পার্শবর্তী রাজ্যগুলোকে দাওয়াত দেয়ার সাথে সাথে খানিকটা হুমকিও দিয়ে রেখেছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এ সমস্যাও ছিল যে, মোনাফেকির অবদমিত সমস্যাটা পুনরায় মাথা চাড়া দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু রসূল সা. এমন সুষ্ঠ ও নিখুঁতভাবে মুসলমানদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যে, তারা অবিলম্বেই নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত ও অশান্ত মনকে শান্ত করে ফেললো। হতাশা ও অস্থিরতাকে কাটিয়ে বিদায় করে নিজেদের গুরুদায়িত্ব পালনের চিন্তায় মনোনিবেশ করলো। রসূল সা. এর ন্যায় ব্যক্তির ইন্তিকালে শোক পালন করার চাইতে অনেক বেশী গুরু দায়িত্ব তাঁর অনুসারীদের জন্য এই ছিল যে, তারা এই আন্দোলন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থীতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে, যা এরূপ পরিস্থিতিতে সামান্য শৈথিল্য দেখালেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি বহু বছর যাবত সমগ্র আন্দোলনের প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন এবং সকল সাহাবীর পরিপূর্ণ আস্থা ও গভীর ভালোবাসার পাত্র ছিলেন, তাঁর আকস্মিক তীরোধানে সহসাই অত্যন্ত মারাত্মক শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। এই শূণ্যতাকে যথাসময়ে পূরণ না করলে ভয়াবহ পরিণতি দেখা দিতে পারে। রসূল সা. এর হাতে গড়া মুসলিম সংগঠনটি নিজেদের দায়িত্ব সচেতনতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার নজীরবিহীন প্রমাণ এভাবে দিল যে, তৎক্ষণাত এই শূন্যতাকে পূরণ করে ফেললো এবং শৃংখলার বন্ধনকে মোটেই শিথিল হতে দিলনা। রসূল সা. এর স্থলাভিষিক্ত কে হবে, তা নিয়ে কোন দ্বন্দ্বসংঘাত হলোনা, তলোয়ার চালাচালিও হলোনা, কোন হৈ হাঙ্গামা হলোনা, সাকীফায়ে বনু সায়েদা চত্তরে মুসলিম জামায়াতের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ পরামর্শের জন্য বসলেন এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ইসলামের শুরায়ী তথা পরামর্শ ভিত্তিক গণতন্ত্রের আওতায় হযরত আবু বকর সিদ্দিককে প্রথম খলিফা নির্বাচন করা হলো। পরে মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের সাধারণ সমাবেশে সর্বসম্মতভাবে ঐ ফায়সালাকে অনুমোদন করা হলো।
রসূল সা. এর ইন্তিকালের পর রসূলের মহান দাওয়াতী কাজের প্রসার ঘটানো এবং রসূলের সূচিত অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে যে দৃঢ়তা অন্তর্দৃষ্টি ও দক্ষতার পরিচয় হযরত আবু বকর দেন এবং যেভাবে হযরত ওমর, ওসমান, আলী ও নেতৃস্থানীয় অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁর সহযোগিতা করেন, মানবেতিহাসে তার উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যাবে। রসূল সা. এর হাতে গড়া এই মানুষটি প্রমাণ করে দিলেন যে, তিনিই মনু্ষ্যত্বের শ্রেষ্ঠতম নমুনা। নিঃস্বার্থ, সুদক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়ার দিক দিয়ে তার কোন জুড়ি ছিলনা। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও তিনি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলতেন না।
ইতিহাস সাক্ষী যে রসূল সা. এর তৈরী করা এই দল ও তার নেতারা কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামী আন্দোলনকে দুনিয়ার কোণে কোণে পৌঁছে দেন এবং রসূল সা. এর জীবদ্দশায় ও তার পরে এই কাজের গতিতে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায়নি।
হে আল্লাহ, মুহাম্মদের ওপর দরূদ ও সালাম পাঠাও!
পৃথিবীতে আজ ‍যদি মুসলমানদের অস্তিত্ব বজায় থেকে থাকে, তবে তা এই মহান ব্যক্তিত্বের অক্লান্ত পরিশ্রমেরই ফল। সত্য ও ন্যায়ের বাণী যদি আমাদের মনমগজে সক্রিয় হয়ে থাকে, তবে তা এই পবিত্র সত্তার পরিশ্রমেরই ফল। মানব জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য তাঁর কাছে যদি কোন আদর্শ ও কর্মসূচী থেকে থাকে, তাহলে তা মুহাম্মদ সা. এরই সাধনা ও সংগ্রামেরই সুফল। আজ যদি আমাদের বুকে ইসলামী আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের আকাংখা দানা বাঁধে, তবে এই প্রিয় নবীর ত্যাগ তিতীক্ষার পবিত্র স্মৃতির কল্যাণেই দানা বাঁধবে। ইসলামী আন্দোলনের পদ্ধতি ও মহান আল্লাহর প্রেরিত এই পথ প্রদর্শকের বাস্তব প্রশিক্ষণ থেকেই তা জানা সম্ভব। মানব জাতিকে আজ যদি কেউ নৈতিক মূল্যবোধ এবং সাফল্যের শাশ্বত মূলনীতি শিখাতে চায়, তবে সেটা স্বয়ং মুহাম্মদ সা. এর কাছ থেকেই অর্জন করতে হবে। রসূল সা. এর মত দাওয়াত দাতা, শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং নেতা যদি দুনিয়ায় না আসতো, তাহলে এই মুর্খতা ও অজ্ঞানতার ঘোর তমস্যা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করা সম্ভব হতোনা। তাই বলা যায়, রসূলই সা. ছিলেন সমগ্র ইসলামী বিপ্লবের মূল প্রাণশক্তি।
মহানবী সা. আমাদের ও সমগ্র মানব জাতির কল্যাণার্থে নিজেকে যে ভয়ংকর শত্রুতার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন এবং বাতিলের সাথে লড়াই করতে গিয়ে যে প্রাণান্তকর কষ্ট সহ্য করেছেন এবং কোন বিনিময় গ্রহণ ছাড়াই নিজের যথাসর্বস্ব এই পথে বিলিয়ে দিয়েছেন, অতঃপর ইতিহাসের একটা নয়া যুগ, একটা পবিত্র সভ্যতা, ও একটা বিশাল আন্তর্জাতিক জাতি বা উম্মাত সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তার নিত্যনতুন জগত গড়ে তুলেছেন, সেই অসামান্য ও অসাধারণ কীর্তির জন্য আমাদের সমগ্র বিশ্ব মানবতা তার এই মহান বন্ধু ও অনুগ্রাহকের কাছে ঋণী। এত বড় উপকারের বিন্দুমাত্রও বিনিময় দান করতে আমরা অক্ষম। তাই হে মহান আল্লাহ! আমরা তোমারই কাছে আবেদন জানাই, তুমি আমাদের কৃতজ্ঞতার মনোভাবকে কবুল কর এবং তোমার রহমতের সীমাহীন ভান্ডার থেকে আমাদের পক্ষ থেকে এই অসামান্য অবদানের উপযুক্ত বদলা তাঁকে দান কর। রসূল সা. এর আত্মার ওপর রহমত, বরকত, ও শান্তি নাযিল কর, তাঁর মর্যাদা সমুন্নত কর এবং রসূল সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলনকে পুনরায় বিজয় দান কর, বিস্তৃতি দান কর এবং তোমরা আরো অধিক সংখ্যক বান্দাকে ইসলামী বিধানের কল্যাণ ও সুফল দ্বারা উপকৃত ও সমৃদ্ধ কর। তোমার কাছে এই মিনতিও জানাই যে, লেখককে এবং প্রত্যেক মুসলিম বান্দাকে রসূল সা. এর দাওয়াতের পবিত্র আমানত বহন করার তৌফিক দান কর এবং তাকে সমগ্র মানব জাতির নিকট পৌঁছানোর সৌভাগ্য দান কর। রসূল সা. এর চালু করা ইসলামী আন্দোলনকে আরো একবার জীবন্ত ও বাস্তব সত্যে পরিণত কর। রাসূল সা. এর উপস্থাপিত ন্যায় বিচার ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে রসূল সা. এর আরদ্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার সংগ্রামে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালনের সৌভাগ্য আমাদের সবাইকে দান কর। কেননা তাঁর উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এটাই সর্বোত্তম পন্থা।
(*******)

কাজ এখনো অসম্পূর্ণ

এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তিনি আমার মত নগন্য বান্দাকে এই মহান কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন যে, আমি তাঁর এই শ্রেষ্ঠতম বান্দার জীবনী ও জীবনের কীর্তি সমূহের একটা ঝলক পেশ করতে পেরেছি। এই কাজে আমি আমার সেই সুযোগ্য পূর্বসূরীদের কাছে অত্যধিক ঋণী, যারা এ বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থাবলী লিখে গেছেন। এছাড়া এ যুগের দু’জন গবেষক মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এবং ডক্টর হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী এম, এ, পি, এইচ,ডি’র কাছে আমি অত্যধিক ঋণী। এ দু’জনের কাছ থেকেই আমি এমন আন্দোলনমুখী দৃষ্টিভঙ্গী পেয়েছি, যা নবী জীবনীর অনেক নতুন দিক আমার সামনে উন্মোচিত করেছে। আমি আশা করি, এ পুস্তক পড়তে গিয়ে পাঠক কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পাবেন। আমি এই কাজে বিশেষভাবে প্রেরণা ও উৎসাহ যোগানোর জন্য শ্রদ্ধেয় প্রকাশকের কাছেও কৃতজ্ঞ। আল্লাহ এই প্রেরণা ও উদ্দীপনা সঞ্চারকারী বন্ধুদেরকে সকলকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন।
এ যাবত এ কাজটি যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে চলে এসেছে, তা বড়ই শোচনীয়। কতবার কাজ হাতে নিয়েছি, আবার দীর্ঘ বিরতি পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। অনেক সময় মাসের পর মাস এক অক্ষরও লেখা হয়নি। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যে আমাকে বারবার শক্তি ও উৎসাহ যুগিয়েছে। একদিন সহসা মাথায় এই খেয়াল এল, সম্ভবত এটাই আল্লাহর ইচ্ছা যে, যে মহান সত্তার জীবন বৃত্তান্ত দুনিয়ার মানুষের কাছে পেশ করার বাসনা পোষণ করছি, তাঁর অভিজ্ঞতার শতভাগের বা হাজার ভাগের এক ভাগও তো আমার অর্জন করা দরকার। নচেত লেখায় সেই প্রাণস্পন্দন কোথা থেকে আসবে? এই খেয়াল আসার পর ইচ্ছাশক্তি এতটা মজবুত হলো যে, যখনই যেটুকু পেরেছি, কাজ এগিয়ে নিয়েছি। পুস্তকের শেষার্ধে বেশীর ভাগই বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখতে হয়েছে। এ কারণেই আমার আশা যে, আল্লাহ এ কাজটা কবুল করবেন এবং একে আমার মুক্তি ও কল্যাণের উপায় বানাবেন।
প্রস্তাবিত নীল নকশা অনুসারে এ কাজ যতখানি করতে চাই, বর্তমান পুস্তকে সে তুলনায় কাজের অনেক খানি বাকী রয়েছে। সম্ভবত দু’ তিন খন্ডে গিয়ে ঠেকবে। আসলে আপাতত একটি মাত্র দীর্ঘ আলোচনা পেশ করেছি। এটা এ দিক দিয়ে মোটামুটি বিস্তারিত যে, এতে রসূল সা. এর সংগ্রামী জীবনের বিবরণ অনেকাংশে এসে গেছে। তবে কোন কোন দিক দিয়ে এটা সংক্ষিপ্ত। কেননা নবী জীবনের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আভাষও এতে দেয়া হয়েছে। এ জন্য আমি এ আশংকাও করছি যে, কেউ কেউ এ দ্বারা কোন ভুল বুঝাবুঝিতে পড়ে যায় কিনা। এই যে কাজ বাকী রয়েছে, তা জানিয়ে দেয় জরুরী।
অবশিষ্ট কাজ নিম্নরূপঃ
-যে ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে রসূল সা. এর জন্ম হয়েছে তার বিবরণ।
-রসূল সা. এর দাওয়াত ও তাঁর লক্ষ্যের বিশ্লেষণ। তিনি মানব জীবনে কোন্ কোন্ মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। রসূলের দাওয়াতের ধরন ও তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি।
-রসূল সা. এর নেতৃসুলভ প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।
-রসূল সা. এর দাওয়াতের ফলে কি ধরণের মানুষ জন্ম নিয়েছিল?
-নারী সমাজ কিভাবে রসূল সা. এর সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে?
-একটা স্বতন্ত্র খন্ডে রসূল সা. এর সমগ্র সংস্কারমূলক কাজের বিবরণ এমন ভাবে পেশ করার ইচ্ছা আছে, যা দ্বারা আধুনিক যুগে উপকৃত হওয়া যাবে। রসূল সা. যে সব নতুন মূলনীতি, কর্মকুশলতা ও পর্যায়ক্রমিকতার সাথে জীবনের বিভিন্ন দিককে গড়ে তুলেছেন, বিভিন্ন নিবন্ধের মাধ্যমে তা তুলে ধরতে হবে। যেমন খোদায়ী কর্মকৌশলের প্রকাশ, সমাজের নবীন ও প্রবীণদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন, গণচরিত্র গঠন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংস্কার, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, তার স্থীতিশীলতা ও দৃঢ়তা, রাজনৈতিক অবকাঠামোর পুনর্নির্মাণ সমাজ ও সংস্কৃতির পুনর্গঠন, ইসলামী সুবিচার ব্যবস্থার প্রচলন, নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন, এবং অন্যান্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপের তাত্বিক ও বাস্তব বিশ্লেষণ।
-রসূল সা. এর ইসলামী সরকারের প্রতিরক্ষা ও সামরিক তৎপরতা সমূহের বিস্তারিত বিবরণ।
-আপত্তি উল্থাপনকারীদের আপত্তির জবাবে একটা আলাদা খন্ড লেখারও সম্ভাবনা রয়েছে। ঘটনাবলী, ব্যক্তিবর্গ ও গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলোর মতভেদ নিরসনে গবেষক সুলভ দৃষ্টি দান।
-নবীর জীবনী লেখার উৎসসমূহ এবং এ বিষয়ে এ যাবত কৃত কর্মের পর্যালোচনামূলক দৃষ্টি দান।
-এই সাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র প্রস্তুত করার ইচ্ছা আছে, যা সামনে থাকলে ঘটনাবলী বুঝা সহজতর হবে। এ ক্ষেত্রে দেশে বেশ কিছু মূল্যবান কাজ হয়েছে। একে আরো এগিয়ে নেয়ার ইচ্ছা আছে। এমনও হতে পারে যে, রসূল সা. এর জীবনী ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে একটা আলাদা মানচিত্র তৈরী করা হবে। পুস্তকে লিখিত বিভিন্ন তথ্যকে একটা প্রাচীর মানচিত্রে একেত্রিত করার ইচ্ছা আছে।
-এই পুস্তকের অনুবাদ অন্তত ইংরেজী, বাংলা, আরবী ও হিন্দীতে করানোর ইচ্ছা আছে। এভাবে এর উপকারিতা আরো বেড়ে যাবে বলে আশা করা যায়। আল্লাহ যেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার তৌফিক দেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরনাদির সংস্থান ও অনুকুল পরিবেশ বিশেষ রহমত দ্বারা সৃষ্টি করে দেন।

নঈম সিদ্দীকী
মার্চ, ১৯৬০


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি