প্রকাশকের কথা
বিশ্বনন্দিত গবেষক, শিক্ষাবিদ ও চিন্তাবিদ ড. আবদুলহামিদ আবুসুলাইমান রচিত মূল আরবী গ্রন্থ আযমত আল আকল্ আল্ মুসলিম- এর ইংরেজী সংস্করণ Crisis in the Muslim Mind –এর বঙ্গানুবাদ ‘মুসলিম মানসে সংকট’ নামে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দবোধ করছি।
মানব জাতির জন্য একমাত্র নির্দেশিকা হলো ইসলাম। কিন্তু গবেষণা ও চিন্তার ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকালের স্থবিরতা ও পদ্ধতিগত দুর্বলতার উত্তরণ না ঘটায় ইসলাম চলমান বিশ্বে একটি গতিশীল আদর্শ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একদিকে যেমন প্রয়োজন ইসলামের উপস্থাপিত সার্বজনীন সত্য ও সৌন্দর্যের ঝরনা ধারায় আমারেদ রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে পুনর্গঠিত করা; অপরদিকে তেমনি প্রয়োজন মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে সুদুর অতীত থেকে সৃষ্ট স্থবিরতা ও পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোকে গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করে জীবনাদর্শকে আরও গতিশীল করা। সে ক্ষেত্রে ড. আবদুলহামিদ আহমদ আবু সুলায়মানের লেখা উক্ত বইটি পাঠকরেদ মন ও চিন্তার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রসঙ্গত, লেখকের রচিত মূল আরবী গন্থের ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন ‘ইউসুফ তালাল হি-লরেঞ্জা শিরোনামে। এরপর এর ইংরেজি সংস্কারণ হতে বাংলায় অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনাব মো মাহবুবুল হক। তাকে তার কঠোর পরিশ্রমের জন্য জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা। এছাড়া বিআিআইটি’র যে তিনজন ফেলো বইটির সম্পাদনা করেছেন, তাদেরকেও জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। বইটির বাংলাদেশী স্কলার, বইটির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত অসংখ্য স্টাডি সার্কেলের শিক্ষক ও মডারেটর জনাব শাহ আবদুল হান্নান এর অনুবাদ ও সম্পাদনর সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছেন- যা আমাদের জন্যেবিরাট প্রাপ্তি আমরা এজন্য তার কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
ব্যপক পাঠক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিইটর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হলো- যেখানে আমরা চেষ্টা করেছি পূর্বের কিছু ভূলত্রুটি শুধরে নেয়ার, এরপরও বইটিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুটি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। আপনাদের অব্যাহত সহযোগিতা আমাদেরকে আরও সমৃদ্ধ করবে ইনশাআল্লাহ।
এম আবদুল আজিজ
উপ-নির্বাহী পরিচালক

উপক্রমণিকা
এটি স্বীকৃত যে, মুসলিম উম্মাহ এখন সংকটাবর্তের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চারদিকে বিচ্ছিন্নতা ও উপদলীয় কোন্দল, নিজস্ব সত্তার বিনাশ, প্রতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা এবং বর্তমান বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত রাখার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়।
সবাই একমত যে- বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশেষ করে মিশর এবং তুরস্কের সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রামথিক সংকট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মুসলিম উম্মাহ একনায়কতন্ত্র, বৈদেশিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, ব্যবসা- বাণিজ্য, নৈতকি ও সামাজিক ব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং মানবিক বিদ্যার পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। যার কোনটিই উম্মাহর জন্য আশানুরূপ ফল বয়ে আনেনি। বরং উম্মাহ একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
এর অর্থ প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে পরিবর্তন প্রয়োজন উম্মাহর নেতৃবৃন্দ তা নির্ধারিত করতে ব্যবর্থ হয়েছে। বিষয়টির পুরোপুরি বিশ্লেষণ, এর বিভিন্ন দিকের আলোকপাত এবং নিরপেক্ষভাবে উম্মাহর অতীত পদক্ষেপগুলো বিবেচনার পর আমরা নিশ্চিত যে, পরিবর্তনের পদ্ধতি সম্পর্কে উম্মাহর চিন্তাধারায় সংযোগ দরকার। কারণ চিন্থাধারা ঠিক না ভুল- তা কর্ম প্রণালীতে প্রতিফলিত হয়। কেবল মননশীল চিন্তাধারাই সুস্থ পুনর্গঠনে সাহায্য করে এবং সামগ্রিকভাবে গঠনমূলক পরিকল্পনাই উম্মাহকে নিশ্চিত সংকট থেকে মুক্ত হওয়ার পথ নির্দেশ কতে পারে। এটি স্বতঃস্ধি যে, ইসলামই উম্মাহর চিন্তাধারার মূল উৎস এবং ইসলামই সত্য সত্তাকে প্রকাশ করে। সে কারণে এসলামী চিন্তাধারাই উম্মাহর জন্য একমাত্র উপজীব্য- এটি আমরা গভীর বিশ্বাস ও আস্থার সাথে অনুধাবন করতে পারি। উম্মাহর কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন একমাত্র ইসলামী চিন্তাধারার মধ্যে অবর্তিত। উম্মাহ এ শিক্ষা দ্বারা পরিচালিত। এটি নির্দিষ্ট ও বিশিষ্ট পদ্ধতি- যা ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালার মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত।
‘ইসলামী চিন্তা’ একটি সাধারণ শব্দ হওয়ায় এর ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তাই এই শব্দটির একটি সংজ্ঞা আবশ্যক। এই গ্রেন্থে এর একটি সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এর পদ্ধতি নির্ণয় করার চেষ্টাও করা হয়েছে। এ গ্রন্থে প্রথমে ইসলামী চিন্তার সনাতন পদ্ধতির বিশ্লেষণ এবঙ পরবর্তীতে ইসলামের মৌলিক বিষয়াদির উৎস আলোচনা করা হয়েছে। এরপর ঐ পদ্ধতির কার্যকরিতা, বিষয়বস্তু এবং পরিধি নিয়ে আলোচনা, পরিশেষে ইসলামিক ও বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে। এছাড়া লেখক এ বইতে ইসলামের আলোকে সামাজিক বিজ্ঞান ও মানববিদ্যার পরিধি সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন।
গ্রন্থের শেষ দিকে দুটি বিষয়ে আলোচনা করেন তা হলো- ইসলাম ও ইসলামের ভবিষ্যৎ এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ। চূড়ান্ত পর্যায়ে লেখক এই মত প্রকাশ করেছেন যে, উম্মাহর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ইসলামিকরণ- যা উম্মাহর ভবিষ্যত, পরিচিতি, এর উদ্দেশ্য, সংকট উত্তরণ এবং সভ্যতা গঠন ও নবজাগরণের উপায়।
ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন, বিষয়ের মূল অনুধাবন, কোন কিছুকে নির্দিষ্ট না করে সার্বজনীনভাবে দেখা, সমস্যার কারণ উদঘাটন এবং সকল ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার অনুসরণ, চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের যথার্থতা ও সফলতা নিশ্চয়তা বিধান করে যা উম্মাহকে সন্দেহাতীতভাবে সঠিক পথ চলতে সাহায্য করবে। এটিই মূলত এই গ্রন্থ প্রণেতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন লেখক যোগ্যতার চেয়ে চিন্তার বিষয়টির উপর অধিক গুরুত্ত আরোপ করেছেন তবে এ ব্যপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, চিন্তার বিষয়টি মৌলিক এবং মুসলিম মনীষীদের জন্য অত্যনস্ত তাৎপর্যবহ। তাছাড়া এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য বিষয়ের প্রতি কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বরং অন্যান্য বিষয়ের সমাধান তখনই আসবে যখন সকল বিষয়ই ইসলামী চিন্তার ভিত্তিতে মননশীলভাবে বিশ্লেষিত হবে।
চিন্তার সংকট, আরব মানস কাঠামো ও মুসলিম মানসে পুনর্গঠন এবং ইসলামী চিন্তা ও পদ্ধতির উপর ইতোপূর্বে প্রচুর গন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে এই লেখায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। লেখক তার বিশ্লেষণের উম্মাহর সংকট এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক, পদ্ধতিগত ও ঐতিহাসিক দিকগুলোর উপর সরাসরি আলোকপাত করেছেন। অহেতুক বিভিন্ন উপলক্ষ নিয়ে আলোচনা না করে তিনি মূল বিষয় ও সমাস্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এ কারণে অনেক পাঠকের কাছে লেখার ধরন কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু পাঠ শেষে লেখার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মূল ধারণা অনুধাবন করতে কোনো সমস্যাই হবে না। যখন কোন পাঠক গভীর অভিনিবেশের সাথে বইটি পাঠ করবে তখন হৃদয়ঙ্গম করবে যে, তারা কেনো সরস পৌরণিক গল্প বা উপন্যাস পড়ছে। মনে হবে না যে, এটি কোনো কঠিন সাহিত্য। সংক্ষেপে বলা যায়, লেখক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে একজন একনিষ্ঠ মুসলিম হিসেবে ইসলামের দাওয়াহ ও সংগ্রামের বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন।
লেখক একজন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ। তিনি উম্মাহর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, অস্তিত্ব ও ভবিষ্যত নিয়ে সমসময় চিন্তাভাবনা করেন। তিনি এই গ্রন্থে অসংখ্য শব্দ ব্যবহার করেছেন যেগুলোর অগ্রদূত তিনিই। তবে শব্দগুলো সরাসরি মূল বিষয়কে অনুধাবন করার জন্য সহায়ক। এই গ্রন্থটির মূল প্রকাশনা আরবিতে করা হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কিছু বিষয় ইংরেজি অনুবাদে সংযোজন করা হয়েছে। আমরা আশা করি গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে- যা উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামজিক নেতৃত্ব এবং যুব পণ্ডিতদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে। প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন গ্রন্থটি মানবজাতির কল্যাণ নিবেদিত করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি। সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।
ড. তাহা জাবির আল আলওয়ানী
সভাপতি
আইআইআইটি
হার্ডন, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ
জিলহজ্ব ১৩১৪/জুন ১৯৯৩

মুখবন্ধ
(আরবি সংস্করণ হতে)
সকল প্রশংসা নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহর জন্য। হযরত মোহাম্মদ (সা), তার অনুসরণকারী ও বাণীবাহকদের উপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।
এই মুহূর্তে আপনার হাতে যে গ্রন্থটি রয়েছে তা প্রচলিত সাধারণ গ্রন্থ নয়। এটি কোনো সংক্ষিপ্ত সার বা সংকলন জাতীয় কোনো গ্রন্থও নয়, এটি একটি গবেষণ, অনুধ্যান এবং বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ যা আমাকে সারা জীবন আলোড়িত ও আন্দোলিত করেছে।
বিভিন্ন লেখক ও কবির ভাষায় উম্মাহর বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে যা প্রকাশিক হয়েছে একটি শিশু হিসেবে তা আমি সর্বান্তকরণে তা আমি সর্বান্তকরণে অনুধাবন করেছি। যখন আমি মক্কায় বড় হচ্ছিলাম তখন আমার ক্লাসে ও বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তেকে মুসলিম ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় আমার কল্পনায় উন্মুক্ক হয়। আমি উম্মাহর সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তগুলো এবং মুসলিম বীরপুরুষদের সম্পর্কে জানতে পারে। সব সময় তিক্ততা এবং হতাশা আমার হৃদয়কে আধাত করতো। এক পর্যায়ে আার মনে দৃঢ় সংকল্পের জাগরণ হয় যে, সংকট নিরসনের জন্য পরিবর্তন অবশ্যেই প্রয়োজন।
আমার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অন্বেষণের পর আমি নিজে কখনো স্তিমিত হইনি। সবসময় নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি, উম্মাহর পতন ও ব্যর্থতার কারণ কি? আমি সন্তোষজনক উত্তর ছাড়া কোনো কিছু মানতে রাজি ছিলাম না। তাছাড়া নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ইসলামের আদি ও আধুনিক ব্যাখ্যাতে আমার পড়াশোনর দ্বারা আমি সর্বদাই উম্মাহর সংকটের কথা চিন্তা করতাম। এর কারণ খুঁজছি এবং উত্তর খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছি।
আমি কখনও আবেগের. ক্রোধের বা হিংসার দ্বারা বশীভূত হয়নি। উম্মাহর সমস্যাগুলো আমাকে সব সময় পীড়া দিত। সে জন্য আমি আমার সকল বাস্তব অভিজ্ঞতা, আমার সকল শিক্ষা ও কর্ম প্রচেষ্টার আলোকে দিনরাত উম্মাহর ফেলে আসা সোনানী ইতিহাসের কথা চিন্তা করেছি। ঘটনার পর ঘটনাকে একেবারে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছি। যা আমি এই গ্রন্থে লিখেছি তা আমার সরাসরি মনের কথা কোনো সমালোচনা, দোষ খোঁজার বা বিরোধিতা করার জন্য নয়। যা সত্য মনে করেছি তাই লিখেছি।
যখন আমি আপনাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি তখন উম্মাহর মধ্যে লুক্কায়িত সকল ভালো কিছু, এর জোরালো দিকগুলো উপলব্ধি করি। উম্মাহর মধ্যে গভীর বিশ্বাস, ত্যাগ প্রণেতা এবং যথেষ্ট দায়িত্বশীলতাবোধ রয়েছে। সে ব্যাপারে আমি কোনো অজুহাত খুজিনি বরং আমি উম্মাহর পশ্চাতৎপদতার দিকগুলো চিহ্নিত করেছি যাতে এগুলো সমাধান করে সংকট নিরসনের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
আমি উম্মাহর অবদান উপেক্ষা করি না। প্রখ্যাত ব্যক্তি, জ্ঞানী, নেতা, যুবক ও মজাহেদিনের অবদান অস্বীকার করি না, তবে পতনের জন্য উম্মাহর খারাপ দিকগুলো তুলে ধরেছি যাতে সত্য উদ্ঘাটিত হয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
আমি কোনো কিছুর সাথে কোনো কিছুকে মিশিয়ে ফেলার উপার জোর দিচ্ছি না। আমি এই বইয়ে যা লিখেছি বা মতামত দিয়েছি তা আমার চিন্তার ফসল। এর মধ্যে যদি কোনো কিছু ভুল প্রমাণিত হয় তার জন্য আমি ভীত নই। আমার একমাত্র আবেদন যে, পাঠক সমাজ আমার প্রত্যাশার সঙ্গে একমত হয়ে উম্মাহর পতনের মূল উৎস চিন্তা করবেন।
আমি তখনই সবচেয়ে বেশি খুশি হব যখন এই গ্রন্থের বক্তব্যগুলো ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। এটি আমার বিনয়ী ধারণা যে বইটির অধ্যায়ন খুব সহজ হবে না কারণ এর বিষয়বস্তু খুব জটিল এবং যারা এটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, উম্মাহর ইতিহাস, সুন্নাহ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা আছে তারাই আমার বক্তব্য ও যক্তিগুলো বুঝতে পারবে।
আমি আশা করি পাঠকসমাজ ধৈর্য সহকারে আলোকিত বিষয়গুলো পড়বেন। সত্যকে বোঝার জন্য এটি প্রয়োজন। খুব দ্রুত পাতা উল্টালে কেবল বাহ্যিক দিকটাই বোঝা যাবে। যান্ত্রিকভাবে এর শব্দমালা বোঝা যাবে, গভীর ভাবার্থে বোঝা যাবে না। যেহেতু বিষয়বস্তু অতি ব্যাপক ও জটিল সেহেতু প্রত্যেকটি বিষয় গভীরভাবে আলোচনা করা বা ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং বিভিন্ন মতামত অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রধান বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে যাতে মূল বিষয়টি উপেক্ষিত না হয়।
আশা করা যায় উম্মাহর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জগতে এমনকি সামাজিক নেতৃত্বের কাছে বইটি সমাদৃত হবে ও উপকারে আসবে। আমি আশাবাদী যে, বইটি খোলামেলা আলোচনাকে উৎসাহিত করবে এবং গভীর চিন্তা ও অধ্যয়নকে অনুপ্রাণিত করবে।
এই গ্রন্থের মধ্যে এমন কিছ নেই যা কোনো যোগ্য ব্যক্তির পাণ্ডিত্যের প্রচেষ্টাকে নষ্ট বা ক্ষূণ্ণ করবে। উম্মাহর বিশ্বাস, একনিষ্ঠতা ও সংগ্রাম সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অবহিত। এটি সর্বজনবিদিত যে, উম্মাহর ইতিহাস ও ঘটনাবলী পথহারাকে পথ দেখিয়েছে। আর এ বই সেই বন্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ আলোচনায় পৌঁছানোর প্রচেষ্টা মাত্র।
আশা করি উম্মাহর চিন্তাশীল নেতৃবৃন্ত, পণ্ডিতকৃন্দ ও যুবকবৃন্দ এই দাবির মোকাবিলা এবং এ বিষয়ে খোলাখুলি ও সত্যনিষ্ঠভাবে আলোচনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাছাড়া আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, তারা এ ব্যাপারটিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। এটি অবশ্যই সম্পদের প্রাচুর্য, সম্মান, মূল্যবোধ বা আবেগ বা থেকে আসবে না। প্রকৃতপক্ষে, সব কিছুর আগে আমরা যদি আমাদের চিন্তা পথকে সংশোধন না করি তবে কোনো কিছুই পরিবর্তিত হবে না। এটিই আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে সংশোধন আনয়নে সাহায্য করবে এবং তারপর তা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানকে সংশোধন করতে সহায়তা করবে। আর এভাবেই উম্মাহ একদিন নিজেকে পুনর্জাগরিত করতে সক্ষম হবে।
হে প্রভু, আমাদেরকে সৎপথ দেখাও কারণ সত্য উদঘাটিত হলে তা আমরা অনুসরণ করবে এবং আমাদেরকে মিথ্যা পথ সম্পর্কেও সাবধান রাখ যাতে আমরা সে পথ পরিহার করে চলতে পারি। আম আল্লার কাছে আবেদন করব তিনি যেন উম্মহকে সঠিক নির্দেশনা, পথ, সাহয্য ও তওফীক দান করেন। নিশ্চিতভাবে আল্লাহ শ্রবণ করেন এবং যারা বিনীতভাবে তাঁর প্রার্থনা করে তাদেরকে তিনি জবাব দেন।
আবদুলহামিদ আহমদ আবুসুলাইমান
১৪১৩ হিঃ/১৯৯২ খ্রিঃ
হার্ডন, ভার্জিনিয়া, ইউ এস এ

মুখবন্ধ
(ইংরেজি সংস্করণ হতে)
আলোচ্য Crisis in the Muslim Mind গ্রন্থটি আরবি ভাষায় লিখিত মুল গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। এর বিষয়বস্তু সব সময় সহজে অনুসরণযোগ্য নয়, তবুও বর্তমানে মুসলিম সমাজের সংকটগুলো সূল সম্পর্কে মুসলিম বুদ্ধিজীকীড়ণ যে গভীর আলোচনা করেছেন সে সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করাই এ গ্রন্থের লক্ষ্য। এ ধরনের একটি গ্রন্থের হুবহু অনুবাদ করা লেখক ছাড়া অন্য কারো পক্ষে নিঃসন্দেহে কষ্টসাদ্য। ব্যক্তিগতভাবে এ কাজটি করার মতো আমার না ছিল ময় না ছিল সুযোগ। তদুপরি ইউসুফ তালাল ডি-লরেঞ্জো এবং যারা এ বইটি সম্পাদনা এবং নিরীক্ষা করেছেন তাদের সবার সক্ষমতার উপর আমার দৃঢ় আস্থা ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের সম্মিলিত কাজের মাধ্যমে এ গ্রন্থটির মূল বাণী উসস্থিাপিত হয়েছে।
এ অনুবাদটি ঠিক তখনই প্রকাশিক হয় যখন মুসলিম ‍উম্মাহ তাদের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখছে যে, দুই মেরু পৃথিবী ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বসে পড়ছে। যখন ইসলাম বিরোধী শক্তি পৃথিবীর মুসলমানদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছে, যেমন- বসনিয়া, কাশ্রি, কুর্দিস্থান, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, ফিলিপাইনস, বার্মা, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আলজেরিয়াসহ অন্যান্য অনেক স্থানে। এ ধরনের ভয়ঙ্কর অবস্থা মুসলিম উম্মাহর সংকটকেই শুধু বিবর্ধিত করে। এ সব অবস্থার মধ্যে মুসলমানরা যখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তখন কখনো কোনোভাবে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, এসব অস্থিরতার মূল কারণ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, এসব অস্থিরতার মূল কারণ আমাদের নিজেদের অযোগ্যতা ‍ও দুর্বলতা। সম্ভবত প্রাথমিক যুগর মুসলিমদের সাথে তৎপরবর্তী যুগের মসলিমদের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো এ যে, প্রাথমিক যুগের মুসলিমরা ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী। মক্কা বিজয়ের পূর্বে তাওয়াফকালীন সময়ে নবী মুহাম্মদ (সা) এর গতিষ্মান নির্দেশমালা প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা তখনো ভোলেননি।
এ গ্রন্থটি মূলতঃ সংক্ষিপ্তাকারে পদ্ধগিত বিষয়ে কুরআন এবং সুন্নাহর মধ্যে সম্পর্ক, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সুন্নাহর প্রয়োগ এবং উম্মাহর রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের মধ্যকার বিরোধ ও বৈষম্যগুলো তুলে ধরেছে। এ গ্রন্থে যে বিষয়টি বিধৃত হয়েছে তা হলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যখন জনগণকে শাসনের জন্য ক্ষমতা ও শক্তির ব্যবহার করেছে তখন বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ আবেগ ও মানসিক উপায়-উপকরণ দিয়ে তার গতি আনয়নের চেষ্টা করেছেন। এ সমস্ত চাপ মুসলিম মননে স্থবির অবস্থার সৃষ্টি করেছে যা উম্মাহর মানসিকতা ও চরিত্রকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, উম্মাহ কোনো উদ্ভাবন ও সৃজনের নিজস্ব চিন্তা, উদ্যোগ ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
বর্তমান মুহূর্তে উম্মাহকে এ সব সমস্যার স্পষ্টই সমাধান বের করতে হবে এবং তা করতেহ হবে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে ও সততার সাথে। এ ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হলো কুরআন ও সুন্নাহকে বোঝা এবং এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে সার্বিকভাবে বদ্ধমূল কোনো পূর্ব ধারণা ও কুসংস্কারকে অতিক্রম করা। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমাদের এখন প্রধান কাজ হলো- মুসলিম নব প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা ও চেতনার দ্বারা পরিগঠিত করা।
প্রার্থিব পরিবর্তেনের শুভারম্ভের দায়িত্ব সর্বোতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের। এ সব বুদ্ধিজীবীরাই কয়েক শতাব্দীর মনস্তাত্ত্বিক বন্ধ্যাত্ব, চিন্তাধারার আগল থেকে উম্মাহকে বের করে আনবে। তারা উম্মাহর রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করবে এবং রোগ সম্পূর্ণ উপশমের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবে। আর তখনই কেবল মুসলিমরা তওহীদ, খেলাফত এবং ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পন্ন ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সঠিক চিত্র অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। পরিশেষে বলা যায় যে, একবার মুসলিমরা প্রগতি, সাহস, নৈতিকতা অর্জন করতে পারলে তারা শুধু নিজেদের ভাগ্যকেই সমৃদ্ধ করবে না, বরং প্রত্যক্ষভাবে বিশ্ব সভ্যতায় ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
আবদুলহামিদ আহমদ আবুসুলাইমান
১৪১৪ হিঃ/১৯৯৩ খ্রিঃ
হার্ডন, ভার্জিনিয়া, ইউ এস ই


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি