পাঠকদের প্রতি সম্পাদকের নিবেদন
ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবনলেখ্য আমরা এই উদ্দেশ্যেই প্রকাশণার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি- যাতে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীগণ উপলীবচ্ধ করতে পারেন যে, সততা ও নিষ্টার সাথে দেশের শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনা করলে দেশের জনগণ সুখী ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে এবং দেশ সেবার মহান ব্রত গ্রহণ করলে ব্যক্তি জীবনে ভোগ-বিলাস ত্যাগ করতে হয়। তদুপরি পক্ষপাতহীন ও স্বজন প্রীতিমুক্ত মনে দেশর সেবা করে গেলে দেশের আপমর জনসাধারণও তার পিছনে এসে দাঁড়ায়।
খেলাফতে রাশেদীনের পর মুসলিম জাহানের স্বজন-প্রীতি, ব্যক্তিস্বার্থ, অন্যায়-অবিচারের যে অমানিশার অন্ধাকর নেমে এসেছিল ওমর ইবনে আবদুল আজীজ সেই সব অন্ধকারের আবরণ ছিন্ন করে আবার মুসলিম জাহানে নতুন প্রাণ স্পন্দনের সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁর ব্যক্তি জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে। আমরা আজকের দিনেও যতি তাঁর অনুসরণ করি তবে আমরাও তাঁর ন্যায় দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি।
এই গ্রন্থখানি ওমর ইবনে আবদুল আজীজের জীবনীর সবচেয় তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ক্লাশে ইতিহাসের ছাত্রদের জন্যও বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে করি।
মুদ্রণ জনিত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। যদি কোন ভুল-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে আমাদের জানালে পরবর্তী সংস্কারণে সংশোধণ করে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।

গ্রন্থকারের কথা
একদিন পরাক্রমশালী আব্বাসীয় খলীফা মামুনুর রশীদের সামনে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের কথা আলোচিত হল। এই প্রভাবশালীও পরম অনুতাপের সাথে বলেন, ‘বনু উমাইয়ার এ লোকটি আমাদের সকলের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, সত্যিই তা ভোলার নয়।’
বাস্তবিকই হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের মাধ্যমেই সমগ্র বনু উমাইয়া শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদার এক সুউচ্চ আসন লাভ করেছিল। শুধু বনু উমাইয়া কেন? বলতে গেলে সমগ্র মিল্লাত বা জাতিই এ সশ্রদ্ধ মহান মনীষীরি শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা ও কল্যাণ দানে পরিপূর্ণ ছিল। এ কারণেই ঐতিহাসিকগণ যখনই খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তখন তারা শ্রদ্ধার সাথে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের কথা উল্লেখ না করে পারেন না। তারা তাঁর শাসনামলকে খোলাফায়ে রাশেদীনের মতই সম্মান প্রদান করেন।
বর্ণাকারী ইবনে সাদ বলেন, নবী (সা)-এর সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাযিঃ) একদা ওমর ইবনে আবদুল আজীজের পিছনে নামায পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে উঠলেন-
(আরবী*******************)
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর এই যুবক ছাড়া অন্য কারো পিছনে রাসূলুল্লাহ (সা)-নামাযের মত নামাজ আমি আর পড়িনি।
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাযিঃ) যখন তাঁর সম্বন্ধে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, তখনও তিনি খেলাফতের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হননি। তখন তিনি উমাইয়া বংশীয় খলীফা ওয়ালীদের পক্ষ থেকে মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ অথবা একুশ বছর।
যখন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ স্বয়ং খলীফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন যদি হযরত আনাস (রাযিঃ) জীবিত থাকতেন তবে নিশ্চয় তিনি শপথ করে বলতেন- “আমি এই যুবক ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শাসনের মত শাসন আর কোনো শাসনকর্তাকেই দেখিনি।
যদিও তাঁর এই আল্লাহভীরুতা, ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং সত্য নিষ্ঠার ফলে তাঁর নিজ বংশীয় লোকেরা তাঁর পরার্শে শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। তাঁর ব্যক্তিগত খাদেমের ভাষা মতে, যদিও তিনি খেলাফতের পদ গ্রহণ করে নিজেকে নিজেই মহাবিপদে ফেলেছিলেন, যদিও তিনি স্বীয় পরিবার পরিজনের সমস্ত প্রকার ভোগ-বিলসের দ্বার ‍রুদ্ধ করে দিয়েছেন, তথাপি তিনি পৃথিবীর বুকে সোনালী অক্ষরে বাস্তবতার এমন এক চিত্র অংকন করে গেছেন যে, যদি কোনে শাসনকর্তা স্বীয় ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশের পরিবর্তে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ সাধন করতে চায় তবে এটা তার পক্ষে খুব কঠিন সমস্যা নয়।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ একজন রাজতান্ত্রিক শাসনকর্তা ছিলেন। ইসলামের সত্য-সনাতন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনসুরণে তাঁর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, তাঁর পূর্বের এক রাজতান্ত্রিক শাসক তাঁকে খলীফা বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এই ঘোষণাই পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক নির্বাপনে পর্যবসিত হয়েছিল। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ স্বীয় কর্মপ্রবাহ দ্বারা তিনি নিজেকে খলীফাদের নিকটতম করেছিলেন। পূর্ববর্তী খলীফাগণ জনসাধারণের সুখ-সুবিধার জন্য যা করেছিলেন, তিনিও তাই করলেন। খোলাফায়ে রাশেদীন জনগণের প্রয়োজন ও কল্যাণ সাধনের জন্য যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, তিনিও তাঁদের অনুসৃদ নীতিই অনুসরণ করে গিয়েছেন।
ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণে কাউকে ক্ষমা করে না অথবা কারো প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করে না, এটা সুশাসন ও কু-শাসকদের কুশাসনের চুলচেরা সমালোচনা করে থাকে। এই সমালোচনামুখর ইতিহাসও ওমর ইবনে আবদুল আজীজের চরিত্রের চুলচেরা সমালোচনা করেই তাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের কাতারে এনে শামিল করেছে এবং অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, তার শাসনামলও খেলাফতে রাশেদার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজের শাসনামল ছিল খুবইসংক্ষিপ্ত, মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস। এই সামান্য সময় জাতীয় জীবনে একটি মুহূর্ত মাত্র। তথাপি এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই এক পবিত্র আত্মা সকল প্রকার বাড়াবাড়ি, অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-অবিচার সকল কিচুর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়ে এমন আইন-শৃঙ্খলা এবং শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাতে রাজ্যের ‍দুর্বল হতে দুর্বলতর নাগরিকও স্ব-স্ব অধিকারের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
এ পুস্তক সংকলনের একমাত্র কারণ এর বাস্তবতা। আমরা পাঠকদের সামনে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ওমর ইবনে আবদুল আজীজকে পেশ করেছি, যাতে তাঁরা বিচার করতে পারেন যে, তিনি উমাইয়া বংশীয় প্রভাবশালী খলীফা আবদুল মালেকের ভ্রাতুষ্পুত্র, মারওয়ান ইবনুল হাকামের পৌত্র হওয়া সত্ত্বেও জনগণকে যে সীমাহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ দান করেছিলেন তার নজীর ইতিহাসে বিকল। তিনি যখন খলীফা ছিলেন না, তখন তিনি উন্নত মানের খাদ্য গ্রহণ করতেন, উন্নত মানের পোষাক পরিধান করতেন; কিন্তু তিন খোলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই সর্বপ্রকার ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করলেন। তিনি জীবন ধারণের দিক দিয়ে অতি সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসলেন। অতি সাধারণ মানুষ যা খেতো, তিনিও তাই খেতেন, অতি দরিদ্র মানুষ যা পরিধান করত তিনিও তাই পরতেন।
ব্যক্তিগত দিক দিয়ে বিচার-বিবেচনা করলে দেখা যায়, ওমর ইবনে আবদুল আজীজও তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীর অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইতিহাস বিখ্যাত শাহী পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর পিতা আবুদল আজীজ ছিলেন মহা প্রতাপশালী উমাইয়া খলীফা আবদুল মালেকের ভাই। তদুপরি তিনি একাধারে দীর্ঘ বিশ বচর পর্যন্ত মিশরের স্বাধীন শাসনকর্তার পদে অধিষ্টিত থেকে এই পুত্রের সুখ-সুবিধার জন্য কত কিছুই না রেখে গিয়েছেন! কিন্তু তাঁর এই পুত্র খলীফা পদে অধিষ্টিত হয়েই তাঁর সমস্ত সম্পদ সরকারী কোষাগারে সোপর্দ করে দিলেন, এমনকি তাঁর স্ত্রীর যাবতীয় অলংকারাদী পর্যন্ত সরকারী কোষাগারে জমা করে দিলেন।
বর্তমান জগতের এই গণতান্ত্রিক যুগেও এটা ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ একজন রাজতান্ত্রিক শাসক হয়েও জনসাধরণের সুখ-সুবিধার জন্য তিনি নিজেই নিজেকে কিরূপে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতেন এবং তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য কত বড় ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন।
আজকের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ধারক ও বাহকদের নিকট ওমর ইবনে আবদুল আজীজের অনুসৃত শাসনপদ্ধতি যদিও প্রজাতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির মৌলিক শর্ত হিসেবে স্বীকৃত নয়; কিন্তু ইসলাম দুনিয়ার বুকে সমাজ ব্যবস্থার যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল, এটাই ছিল তাঁর মৌলিক ও প্রধান শর্ত যে, দেশের জনগণ যদি অনাহারে, অর্ধাকারে দিন কাটায়, তারা যডিদ উলঙ্গ বা অর্ধালোঙ্গ এবং অভাবক্লিষ্ট থাকে তবে তাদের শাসনকর্তাও তাদের মত অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাবে। জনগণকে দুঃখ-দুর্দশায় রেখে ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেয়ার অধকার শাসনকর্তার নেই।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ যখন থেকে খেলাফতের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন যদি প্রজাসাধারণ ক্ষুধার্ত উলঙ্গ থাকত, তাদের ভাত-কাপড়ের কোন সংস্থান তারা করতে না পারত, তখন ওমর ইবনে আবদুল আজীজও জনগণের কাতারে নেমে আসতেন, তিনিও অনাহারে থাকতেন, তাদের মত পোষাক পরতেন।
তিনি যে ধার্মিকতা অবলম্বন করেছিলেন, খলীফা হওয়ার পর তিনি যে সাদাসিধা, অনাড়ম্বর জীবন যাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তখনকার যুগের চাহিদা অনযায়ীই তিনি তা অবলম্বন করেছিলেন। সেই সময়ের এটাই ছিল সাধারণ চাহিদা। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ জীবনের সর্বপ্রকার সুখ ভোগ জলাঞ্জলি দিয়ে জনগণের সেই চাহিদাই পূরণ করেছিলেন। তিনি যে বিশ্বস্ততার সাথে জনগণের চাহিদা পূরণ করেছিলেন, ইতিহাস তাঁর দ্বিতীয় নজীর পেশ করতে পারেনি।
আমরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, যুগের পরিবর্তন ঘটেছে, জীবন ধারণের মান পরিবর্তন হয়েছে। আজকের জনগণ আর খলীফা ওমরের যযগের জনগণ এক নয়। সেই যুগে মোটর গাড়ী ছিল না, উড়োজাহাজ, রেলগাড়ী, ছিল না আজকের জীবন ধারণের বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক প্রয়োজন। তবুও এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রকৃতপক্ষে এই দুনিয়ার জনসাধারণ বিশেষতঃ আফ্রিকা-এশিয়ার জনগণের জীবন মান আজকের দিনেও সেই যুগ থেকে একটা উন্নত হয়নি, তাদের না আছে মোটর গাড়ী, না আছে উড়োজাহাজে আরোহণ করার সামর্থ। আজকেও তাদের পোষাক টুটা-ফাটা,, তাদের আহার্য সাদাসিধা।
আফ্রিকা-এশিয়ার বহু দেশ এখনও এমন আছে, যেখানকার অধিকাংশ অনাহারে, উলঙ্গ দিন কাটাচ্ছে, যারা সাধারণ ডাল-ভাতেরও ব্যবস্থা করতে পারে না, ইজ্জত-আবরু ঢাকার মত সাধারণ থেকে অতি সাধারণ কাপড়েরও ব্যবস্থা করতে পারে না। সুতরাং, সেই সমস্ত দেশের শাসকগোষ্ঠীকেও জনসাধারণের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য ওমর ইবনে আবদুল আজীজের ন্যায় নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনায়ন করা অপরিহার্য। বিশেষত: যে সব দেশের শাকগোষ্ঠী নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করেন, ইসলামী শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য চিৎকার করেন, তাদের জন্য এরূপ পরিবর্তন আরও অধিক প্রয়োজনীয়।
অবশ্য সময় বাঁচানোর জন্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে স্পর্ক রক্ষা করার জন্য, পারিপার্ষ্বিক জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শাসকগণ উড়োজাহাজ, মোটর গাড়ী ইত্যাদি যানবাহনে আরোহণের অধিকারী, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত জীবন ধারণের মান উন্নত না হয়, যত দিন তারা পেট ভরে খেতে না পায়, ইজ্জত-আব্রু ঢাকার মত প্রয়োজনীয় কাপড়ের এবং মাথা গুজবার মত বাসস্থান করতে না পারে ততদিন শাসকগোষ্ঠীকেও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে জগণের মত খাদ্য খেতে হবে, তাদের মত পোষাক পরতে হবে, তাদের মত বসবাস করতে হবে।
তা না হলে ওমর ইবনে আবদুল আজীজের যুগেও ব্যক্তিগত জীবনে ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ, উন্নত মানের বসবাস, খাওয়া-পরা ইত্যাদির মোটেই অভাব ছিল না। সেই যুগেও অগণিত মানুষ এমন ছিল যারা উন্নত মানের বাহনে আরোহন করত, শাহী প্রাসাদে বাস করত, রেশম বস্ত্র ও অন্যান্য মসৃণ কাপড় পরিধান করত উন্নতমানের আহার্য গ্রহণ করে খুবই আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করত। তাঁর নিজের বংশেও এরূপ লোকের অবাব ছিল না, যারা রাজপ্রাসাদে বাস করে বিভিন্ন প্রকার সুখ ভোগ করে জীবন উপভোগ করত। স্বয়ং খুবই উন্নত মানের জীবন যাপন করতেন।
কিন্তু শাসন ক্ষমতার অধিষ্টিত হয়েই তিনি তাঁর জীবনের গতি সম্পূর্ণরূপেইপরিবর্তন করে দিলেন। কারণ পূর্বে তিনি ছিলেন একটি মাত্র ব্যক্তি এবং ব্যক্তি হিসেবে তার নিজের ধন-সম্পদ দ্বারা পুরোপুরি জীবন উপভোগ করার পূর্ণ অধিকার ছিল্ কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্তির পর তিনি আর এক ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি একাই একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের সমস্ত লোকের দেখা-শুনার ভার তাঁর উপর সোপর্দ হয়েছিল। তাদের সকল প্রয়োজন পূর্ণ করা এবঙ তাদের জীবনের মান উন্নত করার সকল প্রকার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে যে স্বাধীনতা ভোগ করতেন ইসলাম তাঁর সেই আজাদী ছিনিয়ে নিয়েছিল।
অনুরূপ আজকের দিনেও যে কেউ, তার ব্যক্তিগত ধন-দৌলত দ্বারা জীবন উপভোগ করার সম্পূর্ণ অধিকারী। তিনি ব্যক্গিত জীবনে ভাল ভাল কাপড় পরতে, উন্নতমানের বাসস্থানে বাস করতে এবং উপবোগ্য খাদ্য খেতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু জাতির নেতা হিসেবে, জনগণের শাসক হিসেবে তার এই অধিকার নেই। তার ব্যক্তি জীবনে যে সমস্ত বিষয়ে তিনি স্বাধীন ছিলেন তার সেসব স্বাধীনতা থাকবে না। তিনি এখন আর ভাল কাপড়, উন্নত বাসস্থান, উপভোগ্য খাদ্য ইত্যাদির সুযোগ পাবেন না। তার নিজের জীবনকে জনগণের জীবনের সাথে মিলিয়ে একাকার করে দিতে হবে, যেমনভাবে ওমর ইবণে আবদুল আজীজ তাঁর জীবনের গতি সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিয়ে জগণের কাতারে এসে শামিল হয়েছিলেন। তিনি যদি এটা করতে পারেন তবেই তিনি মুসলিম শাসক হিসেবে দাবী করতে পারেন। তা না হলে সে যুগেও আবদুল মালেক, ইয়াজিদ, মারওয়ান, সুলায়মান, হাশেমপ্রমুখ নরপতিগণও নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করেছেন।
ওমর ইবনে আবদুল আজীজ জীবনের গতি পরিবর্তন করে নিজের জন্য যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ বিধান করেছিলেন, আমরা তার কারণ ও যৌক্তিকতা যথাস্থানে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। যা হোক দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের সম্মুখে এ উমাইয়া নরপতির জীবনের সকল দিক তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই আমরা তাঁর জীবনালেখ্য রচনায় মনোনিবেশ করেছি।
প্রকৃতপক্ষে এটা আমাদের কর্তব্য নয়, এটা তাদের কর্তব্য, যারা তাঁর অনুসৃত নীতি অবলম্বন করে দেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করবেন, আর না হয় তা প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের মনগড়া রুচিসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করে জীবন উপভোগ করবেন। এটাই আমাদের কথা।
বিনীত রশীদ আখতার নদভী

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এর বংশ তালিকা
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এর জীবনী আলোচনা করার পূর্বে তাঁর বংশ পরিচয়, তাঁকে সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যে তাঁর পিতা আবদুল আজীজ, মাতা উম্মে আসেম এবং দাদা মারওয়ানের জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এর দাদা মারওয়ান ইবনে হাকাম
মারওয়ান ইবনে হাকাম ইবনে আবুল আছ ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামছ ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে কুসাই।
বংশের দিক দিয়ে মারয়ান ছিলেন কুরাইশ বংশের লোক। তিনি ছিলেন আবদে শামছেন পুত্র ও উমাইয়া ছিলেন পরস্পর বৈমত্রেয় ভাই। ফলে তাদের মাঝে বৈমাতৃক সুলভ আচরণ বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে উমাইয়া হাশিমের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ ভাব পোষণ করতেন। এ হিংসা-বিদ্বেষ তাদের উত্তর পুরুষদের মধ্যেও বংশানুক্রমে চলে আসছিল।
হাশিম ও উমাইয়ার বংশধরগণ তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে একে অন্যের হিংসা-বিদ্বেষের কথা বিস্মৃত হতে পারেনি।
একই পিতামাহের বংশধর হওয়ার পরিণতি এটাই। তা না হলে হর্ব ও আবুল আস দু’জনই ধ্যান-ধারণায় একে অন্যের খুব ঘনিষ্টজন ছিলেন এবং তাদের মধ্যে এ জাতীয় হিংসা-বিদ্বেষ কখনো ছিল না। হরব এবং আবুল আস জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই একে অন্যের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন। তাদের এদু’য়ের ঐক্যের প্রভাব তাদের পূর্বপুরুষ আবু সুফিয়ান, হাকাম ও আফফানের উপরও পড়েছিল। আফফান এবং হাকাম একে অন্যের এতই ঘনিষ্ট ছিল যে, তাদের দু’জনের আশা-আকাঙ্ক্ষাও ছিল এক। তারা তাদের বংশধরগণকেও এ ধ্যান-ধারণার অংশীদা করেছিল। যদিও আফফানের পুত্র ওসমান এবং হাকামের পুত্র মারওয়ান ধ্যান-ধারণায় একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিলেন, তবুও তারা একে অপরকে প্রীতির চোখে দেখতেন।
ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) সেসব সাহাবাদের অন্যতম ছিলেন, যারা ইসলামের প্রথম দিকে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ও চাচা ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাঁকে কঠোর শাস্তি দিত এবং তারা উভয়ে হযরত ওসমান (লা) কে ইচ্ছামত প্রহার করত। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, যখন হাকাম মদীনায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, তখন হযরত ওসামন (রা) তাঁর ব্যক্তিগত ভদ্রতা বা পৈতৃক সম্পর্কের কারণে শুধু তাঁকে নিজগৃহেই আশ্রয়ই দেননি, এমনকি তার চাচা এবং চাচাত ভাইকে তাঁর ধন-সম্পদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশীদার করেছিলেন।
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইবনে সাদ হযরত ওসমান (রা) ও মারওয়ানের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বর্ণনা করে বলেন- হযরত মুহাম্মদ (রা)-এর ইন্তেকালের সময় মারওয়ানের বয়স ছিল আট বছর। তার পিতা হাকামের মৃত্যূ পর্যন্ত তিনিও তার পিতার সাথে মদীনায় বাস করছিলেন। হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে তাঁর চাচা হাকামের মৃত্যু হলে মারওয়ান সবসময় তাঁর চাচত ভাই ওসমান (রা)-এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর প্রধান সচিব। হযরত ওসামন (রা) তাঁকে প্রচুর সম্পদ দান করেছিলেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৫ম খন্ড, পৃঃ ২৪, লন্ডনে মুদ্রিত)
ইনে সাদ আরও বলেন, হযরত ওসামন (রা)-এর সাথে মারওয়ানের এ ঘনিষ্টতার কারণে সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাঁকে কটু কথা বলতেন, ভীরু ও দুর্বল বলতেন; কিন্তু এ ব্যাপারে হযরত ওসামন (রা) কারও কথা শুনতেন না। তিনি সবসময় মারওয়ানকে ভালবাসতেন, তাকে পরম প্রীতির চোখে দেখতেন, এমনকি যখন লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে ঘরে অবরোধ করল, তখন তাদের একটি দল তাঁর নিকট এসে এ প্রস্তাব দিল যে, মারওয়ানকে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন, আমরা তার সাথে বুঝ-পড়া করব।
কিনতু হযরত ওসামান (রা) বিদ্রোহের ভাবমূর্তি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বিদ্রোহীদের শক্তি সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, যদি বিদ্রোহীদের কথা রক্ষানা করেন তবে তাঁর প্রাণ বিপন্ন হবে। এতদসত্ত্বেও তিনি মারওয়ানকে বিদ্রোহীদের হাতে সমর্পণ করেননি।
(আবদুল ফরিদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮০)
তিনি মারওয়ানের প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শন করতে গিয়েই হযরত আলী, হযরত সাদ, হযরত যুবাইর, হযরত তালহা, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম ৯রা) গণের মতো বিশিষ্ট বন্ধু-বান্ধবের প্রিয়ভাজন হতে পারেননি।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবদুর রাব্বিহি বলেন- হযরত ওসমান (রা)-এর উপর মারওয়ানের অসাধারণ প্রভাবই তাঁর শাহাদাতের অন্যতম কারণ ছিল। বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামগণ চাইতেন যাতে খলীফা হযরত ওসমান (রা) মারওয়ানে প্রভাবমুক্ত থাকেন এবং খেলাপতের কাজ পরিচালনায় তিনিও যেন পূর্ববর্তী খলীফাদ্বয়ের মত বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম (রা) গণকে তাঁর পার্শ্বে রাখতে পারেননি। (ইবনে আবদে রাব্বিহি, ৪র্থ খণ্ড, ৯০ পৃ.)
ইবনে আবদে রাব্বিহি আরও বর্ণনা করেন- এ হাকাম রাসূলুল্লাহ (রা) হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর চরম শত্রু ছিল অথচ হযরত ওসামন (লা) তাকে এনে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। (ইবনে আবদে রাব্বিহি ৩য় খণ্ড, ৯০ পৃ.)
হযরত ওসামন এবন আফফান (লা)-এর পিতা এবং হাকামের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, তার প্রভাব হযরত ওসমান (লা) ও মারওয়ানের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত ছিল। হযরত ওসমান (রা) সমস্ত দুনিয়াকেই নিজের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন তবুও মারওয়ানের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেননি।
ইবনে সাদ এ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন- অধিকাংশ লোক হযরত ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করত যে, তিনি মারওয়ান কে তাঁর পার্শ্বে কেন রেখেছেন? এবং কেনইবা তিনি তার কথায় কাজ করেন? লোকেরা দেখত, যে সমস্ত নির্দেশ হযরত ওসমান (রা) দিয়েছেন বলে প্রচারিত হতো কিন্তু অধিকাংশই হযরত ওসমান( (রা) অবগত ছিলেন না। মারওয়ান নিজেই সেগুলি প্রচার করতেন। সে নির্দেশ পত্রে মারওয়ানের ব্যক্দিহ মতামতও থাকত অথচ খলীফা হযরত ওসমান (রা) এটা জানতেনই না। (তাবাবাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, ২৪-২৫পৃ.)
এটাই পরবর্তীতে হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা)-এর পদচ্যুতির ব্যাপারে সরকারী সীলমোহর যুক্ত যে নির্দেশনামা প্রেণ করা হয়েছিল, সেটাও মারওয়ানের পক্ষ থেকেই প্রেণ করা হয়েছিল। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা) তাঁর সঙ্গী সাথীদেরসহ ফিরে এসে যখন হযরত ওসমান (রা)-এর নিকট এর ব্যাখ্যা দাবী করলেন, তখন তিনি এ নির্দেশনামার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এবং শপথ করে বললেন যে, তিনি এ ফরমান লিখেননি এবং প্রেরণও করেননি। এ ফরমান মারওয়ানের নিকটই রক্ষিত ছিল। এতো কিছু জানার পরও হযরত ওসমান (রা) তাকে পদচ্যুত করেননি এবং তার কোনো প্রকার শাস্তিরও ব্যবস্থা করেননি।
মারওয়ানের সাথে হযরত ওসমান (রা)-এর যে প্রীতি-ভালবাসার সম্পর্ক ছিল তা একমুখী ছিল না, বরং মারওয়ানও তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন।
ইবনে সাদ বলেন, বিদ্রোহীরা যখন হযর ওসমান (রা)-এর ঘর অবরোধ করল, তখন মারওয়ান খলীফা হযরত ওসমান (রা)-এর পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ করে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। এক দুর্দান্ত সিপাহী তার পৃষ্ঠদেশ এমন জোরে তরবারী দ্বারা আঘাত করল যে, তিন সওয়ারী থেকে নীচে পড়ে গেলেন। এমন সময় উবাইদ ইবনে রীফা নামক এক ব্যাক্তি ছুরি হাতে তার উরপ ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দিতে উদ্যত হল। তখন ছাকাফী বংশীয় ফাতেমা নাম্নী একজন মহিলা তাকে তিরষ্কার করে বলল, এ লোকটি পূর্বেই ইন্তেকাল করেছে, অনর্থক ছুরিটি নষ্ট করছ কেন?
ইবনে সাদ আরও বলেন- মারওয়ানের পূর্বপূরুষগণ এ মহিলার অপরিসীম অনুগ্রহের কথা কোনদিন বিস্মৃত হয়নি। সে সময় যদি এ মহিরা সে সিপাহীর সামনে অন্তরায় সৃষ্টি না করত তবে সে ব্যক্তি ছুরি দ্বারা তার দেহ থেকে মস্তক আলাদ করে দিত। এ মহিলা শুধু তাকে হত্যা করতেই নিষেধ করেনি, উপরন্তু তাকে উঠিয়ে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছিল।
জঙ্গে-জামালের বা উটের যুদ্ধেল পর মারওয়ানসহ হযরত ওসমান (রা)-এর অন্যান্য গুণমুগ্ধ ও সহানুভূতিশীল লোকেরা যখন পরাজিত হল এবং হযরত আলী (রা) জয়ী হলেন, তখন মারওয়ান হযরত আলী (রা)-এর হাতে বায়আত করে মদীনায় এসে বসবাস করতে লাগলেন।
হযরত আলী (রা) –এর শাহাদত এবং হযরত হাসান (লা)-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের পর যখন আমীরে মুয়াবিয়া (রা) খেলাফতের মসদন দখল করে নিয়ে মারওয়ানকে মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন, তখন যে ভদ্র মহিলা তাকে তার প্রাণ রক্ষা করেছিল এবং তার চিকিৎসার ব্যব্থা করেছিল, তিনি তাকে ও তার বংশধরগণকে পুরস্কৃত করলেন।
হযরত মুয়াবিয়া (রা) কিছুদিন পর মারওয়ানকে মদীনার শাসনকর্তার পদ থেকে বরখাস্ত করে সাঈদ ইবনে আসকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন। তারপর আবার তিনি সাঈদ ইবনে আসকে বরখাস্ত করে মারওয়ানকে সে পদে পুণর্বহাল করলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) মারওয়ানকে তার মৃত্যুর পূর্বে দু’বার এ পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন।
হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর পুত্র ইয়াযিদের রাজত্বকালে যখন মদীনার লোকেরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং যার পরিণতি ইয়াওমে হারারায়, তখন মারওয়ান ইয়াযিদের কর্মচারীগণকে বিশেষভাবে সাহায্য-সহায়তা করেছিল। এতে ইয়যিদ তার কাজে মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তাকে দামেস্কে ডেকে নিয়ে তার কাজের ভয়সী প্রশংসা করেন এবং তাকে তার ব্যক্গিত উপদেষ্ট পদে নিয়োগ দান করলেন। ইয়াযিদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার প্রধান উপদেষ্টা পদেই কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ইয়াযিদের মৃত্যুর পর যখন তার পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠত হলেন তখন তিনি মারওয়ানকে তার এ সম্মানিত পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন।
যেহেতু হযরত মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযিদ খেলাফতের মহান দায়িত্ব পরিচালনা করা পছন্দ করতেন না, কাজেই যুহহাক ইবনে কায়েসের হাতেই সমস্ত সামরিক- বেসামরিক ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযিদ মাত্র তিন মাস তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে রাজকীয় পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি পরলোকের পথে যাত্রা করলেন।
ইবনে সাদ আরও বলেন- যখন হযরত মুয়াবিয় (রা)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিযে আসতে লাগল, তখন মারওয়ান ও তাঁর অন্যান্য উপদেষ্টাগণ তাঁর নিকট আরজ করল যে, আপনার পর খেলাফতের জন্য কারো নাম ঘোষণা করুন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) উত্তর দিলেন, যে বস্তু জীবনে আমাকে সুখী করতে পারেনি, মৃত্যুর পর তার বোঝা বহন করতে যাব কেন? আমি যখন মহান আল্লাহ পাকের দরবারে চলে যাব, তখন তিনি আমাকে অবশ্যই এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে, আমি কাকে আমার পরবর্তী খলীফা নির্বাচন করে এসেছি।
হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাঁর পবর্তী খলীফার জন্য কাউকে মনোনীত করেননি, তবে জনসাধারণ স্বাধীনভাবে তাদের খলীফা নির্বাচন করে তাঁর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুহহাক ইবনে কায়েসকে খেলাফতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন।
যুহহাক ইবনে কায়েস হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিলেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরও (রা) তকন মক্কায় তাঁর স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যুহহাকের মত সিরিয়ার কিছু নেতৃস্থানীয় লোকও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করে মারওয়ান ও তাঁর অন্যান্য উমাইযা নেতারাও দামেস্ক ত্যাগ করে হেজাজে চলে গেল।
তারা তখনও রাস্তায়ই ছিল, ইউনিসিয়া জনপগের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। এমন সময় ইবনে যিয়াদ তার সঙ্গী-সাথীসহ সেখানে এসে পৌঁছল এবং মারওয়ানের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আপনি কোথায় যাওয়ার সংকল্প করেছেন? মারওয়ান উত্তর করল, ইবনে যুবাইর (রা)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করতে মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা করছি।
ইবনে সাদ আরও বলেন, এটা শুনে ইবনে যিয়াদ তাকে তিরস্কার করে বলল-(আরবী****************)
অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ, আপনি আবদে মান্নাফ বংশের একজন বিশিষ্ট নেতা হওয়া সত্ত্বেও ইবন যুবাইরের হাতে বায়আত হতে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন? আল্লাহর কসম! আপনি তো তার থেকেও অধিক যোগ্য ব্যক্তি! (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৩)
এ সেই আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ইয়াজিদের খুশির জন্য যে হযরত ইমাম হুসাইন (রা) কে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। নবী পরিবারের বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল, তাঁদের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করেছিল। তার দৃষিটতে একমাহত্র আবদে মান্নাফের বংশধরদেরই সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। নৈতিক চরিত্র, যোগ্যতা এবং উন্নত ধ্যানধারণার কোন মূল্যই তার কাছে ছিল না। যে তাচ্ছিল্যের সাথে সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর কথা উল্লেখ করেছিল, এর দ্বারাই তার ধ্যান-ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরাম গণের (রা) দুশমন, সৎকর্মশীল লোকদের প্রধান শত্রু যে মারওয়ান, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর মত একজন সাহাবীর পরিবর্তে খেলাফতের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ তাকেই অধিক যোগ্য বলে বিবেচনা করল। অথচ ইমাম হুসাইন (রা) ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর পর আল্লহভীরুতা, পবিত্রতা, উন্নত চরিত্র এবং সার্বিক যোগ্যতার দিক দিয়ে বিচার করলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) ছিলেন তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারা। হযরত যুবাইর (রা)-এর পুত্র বিশ্ব মুসলিম জননী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা)-এর ভগিনা এবঙ ইলামের প্রথম খললীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর দৌহিত্র। যাহোক, মারওয়ান যিয়াদের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, তবে তোমার মতামত কি?
যিয়াদ বলল, আপনি দামেশকে ফিরে গিয়ে স্বীয় খেলাফতের জন্য লোকদের আহ্বান করুন, আমি আপনাকে সর্বাতভাবে সাহায্য করব।
আমর ইবনে সাঈদও তাকে এ কথাই বলল। আমর ইবনে সাঈদ ছিল ইয়ামেনে বসবাসকারী আরব নেতা। ইয়ামেনবাসীগণ তার অনুগত ছিল। সে মারওয়ানকে পরামর্শ দিল যে, ইয়াযিদের বিধবা স্ত্রী, যুকব খালেদের মাতাকে বিবাহ কর, ফ পথের কাঁটা খালেদও দূরে চলে যাবে।
তাদের তিন জনের মধ্যে একট গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হল এবং তারা একই সাথে দামেশকে ফিরে আসল। ইবনে যিয়াদ দামেশকের কারাদিস ফটকে আবতরণ করল এবং যুহহাক ইবনে কায়েসের সাথে সাক্ষাৎ করে তার হাতে চুম্বন করে তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও বংশ গৌরবের ভূয়সী প্রশংসা করল। অবশেসে স্বগৃহে ফিরে আসল। পরের দিন আবার েইবনে কায়েসের দরবারে হাজির হয়ে পূর্বের মতহই তোষামোদ করে ফিরে আসল। তৃতীয় দিন পুনরায় এসে তার সাথে নির্জনে কথা বলল। যিয়াদ বিস্ময় প্রকাশ করে ইবনে কায়েসকে বলল, আপনিও একজন কুরাইশ বংশীয় নেতা, আপনি ইবনে যুবাইর (রা) অপেক্ষা অধিকতর যোগ্য ও জনপ্রিয়। আপনি কি করে ইবনে যুবাইর (রা) কে সমর্থন করেন?
ইবনে যিয়াদ অতীব কৌশলী, মৃদবাক ও একজন বিশিষ্ট বাগ্মী ছিল। যুহহাক ইবনে কায়ে একজন সরল-সোজা সৈনিক ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই ইবনে যিয়াদ তাকে কাঁচের সিড়িতে দাঁড় করিয়ে দিল এবং ইবনে যুবাইর (রা)-এর পরিবর্তে তার নিজের খেলাফতের দাবী করতে তাকে উৎসাহিত করে তুলল। অতিএব যুহহাক ইবনে কায়েস তার কথা অনুযায়ী মানুষের এক সমাবেশে তার হাতে খেলাফতের বায়আত করতে লোকদের আহবান করলেন। কিছু লোক তার হাতে বায়আত করল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যারা ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিল তারা তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করল।
ইবনে যিয়াদের ধূর্তার ফলে যুহহাক ইবনে কায়েসের মত একজন বিশিষ্ট সেনাপতির বিপুল শক্তি এমনিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। এ নরাধম জালেম তাকে আবরও পরামর্শ দিল যে, আপনি দামেশকের শহর ছেড়ে বাইর তাঁবু স্থাপন করে সাধারণ সৈনিক ও নগরবাসীকে আপনার প্রতি আহবান করুন। যুহহাক ইবনে কায়েস তার এ পরামর্শ মেনে দামেশকে নগরী থেকে বের হয়ে ময়দানে এসে তাঁবু স্থাপন করল। অপরদিকে ইবনে যিয়াদ নগরেই অবস্থান করতে লাগল এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিকগণকে মারওয়ানের প্রত আকৃষ্ট ও তরে তুলতে লাগল।
এ সময় মারওয়ান ও উমাইয়া বংশের অন্যান্য লোকেরা তাদমীরে অবস্থান করছিল। ইয়াযিদের যুবক পত্রি খালেদ এবং তার মা আল-জাবিয়ায় অবস্থান করছিল। উবায়দুল্লাহকে ইবনে যিয়াদ মারওয়ানের নিকট একথা বলে দূত প্রেরণ করল যে, বনু উমাইয়াকে সংঘবদ্ধ করে তাদের বায়আত গ্রহণ করে নিন এবং আল-জাবিয়ায় গিয়ে খালেদের মাতাকে বিবাহ করুন।
মারওয়ান ইবনে যিয়াদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে লাগল। সে প্রথমতঃ বনু উমাইয়াদের নিকট থেকে বায়আত গ্রহণ করল। তারপর আল-বাজিয়ারয় গমন করল। এখানে ইয়াযিদের পুত্র খালেদ তার পরম সুহৃদ খালূ হাসসান ইবনে মালেকের তত্ত্বাধানে ছিল। আল-জাবিয়ায় মারওয়ানের আগমনের পূর্বে হাসসান ইয়াযিদির পুত্র খালেদের পক্ষেই খেলাফতের বায়আত করতে লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যখন মারওয়ান আল-জাবিয়ায় িএসে পৌঁছল, তখন হাসসানের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। সে মারওয়ানের প্রভাবে প্রভাবন্বিত হয়ে তার হাতেই বায়আত করল। তার সে বায়আতের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকাপর সমস্ত জনগণ মারওয়ানকে খলীফা হিসেবে স্বীকার করে নিল। এভাবেই হাকাম ইবনে আসের পুত্র মারওয়ানের জন্য খেলাফতের পথ সুগম হয়ে গেল। তিনি খেলাফতের বায়আত গ্রহণ করেই ইয়াযিদের বিধবা স্ত্রী খালিদের মাতাকে বিবাহ করে তার পথের সকল বাধা বিপত্তি দূর করে দিলেন।
ইবনে সাদ বলেন- এদিকে আল-জাবিয়ায় লোকেরা মারওয়ানের হাতে খেলাফরেত বায়আত গ্রহণ করব, অপরদিকে ইবনে যিয়াদ দামেশকে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সে দিনই মারওয়ানের পক্ষে দামেশকবাসীদের বায়আত গ্রহণ করল এবং তাকে লিখে পাঠাল যে, যুহহাক ইবনে কায়েস মারজে রাহাতে অবস্থান করছে সুতরাং আপনি তার দিকেই অগ্রসর হোন।
হাসসান ইবনে মালেক এবং সাঈদ ইবনে আমর তাদের সৈন্য নিয়ে মারওয়াণের সাথে মিলিত হতওয়ার ফলে তাদে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ছয় হাজার। তিনি উক্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে মারজে রাহতের দিক অগ্রসর হলেন। ইবনে যিয়াদও সাত হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মারজে রাহাতে এসে উপস্থিত হল। এভবে মারওয়ানের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল তের হাজার।
অপরদিকে যুহহাক ইবনে কায়েসের সঙ্গে ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী ছিল্ তিনি আহবন করতেই বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে তারা দ্রুতগতিতে সেখানে এসে উপস্থিত হল।
যদিও যুহহাক ইবনে কায়েসের সৈন্য সংখ্যা মারওয়ানের সৈন্যের প্রায় আড়াই গুণ বেশি ছিল, কিন্তু মারওয়ানের সঙ্গে উমাইয়া বংশের সমস্ত লোক জড়িত থাকারয় যুহহাকের সৈন্য বাহিনীর উপর মারওয়ানের একটা বিরাট প্রভাব পড়ে গেল।
ইবনে সাদ বলেন- দীর্ঘ বিশ দিন যাবৎ উভয় বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধের ফলে প্রচুর রক্তপাত হল। অবশেষে এটা ইকটি গোত্রীয় যুদ্ধে পর্যবসিত হয়ে গেল। এক দিকে ইয়ামেনী লোক অপরদিকে কায়েসী লোক।
যুদ্ধের বিশতম দিকেন যুহহাক ইবনে কায়েস তার কয়েকজন বিশিষ্ট সঙ্গী-সাথীসহ নিহত হলেন। ফলে অবশিষ্ট সৈনবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করল।
মারজে রাতের যে ময়দানে এ যুদ্ধ হয়েছিল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই সে দিন বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন কায়েসী বীরগণ নিহত হয়েছিল। ইয়াযিদের অযোগ্যতা এবং তার পুত্রের ভীরুতার কারণে বনু উমাইয়াদের নিকট থেকে নেতৃত্ব ও শাসনের যে সম্মানিত পোষকা অবহৃত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ এবং হাসসান ইবনে মালেক প্রমুখ নেতৃবৃন্দের বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার ফলেই তা পুনরায় তাতের পক্ষেই এসে গেল।
প্রকৃতপক্ষেএটা মারওয়ান ও ইবনে যুবাইর বা যুহহাকের মধ্যে যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল আরবের দু’টি প্রসিদ্ধ যুদ্ধপ্রিয় গোষ্ঠী-কায়সী ও ইয়ামেনীদের পারস্পরিক যুদ্ধ। সৌভাগ্যক্রমে মারওয়ান ইয়ামেনী সৈন্যদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ ও হাসসান ইবনে মালেকের মত চতুর ও তীক্ষ্ণ মেধাবী বন্ধুরা এর দ্বারা তাদের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করেছিল। তখন সৈন্যবাহিনী যদি ইয়ামেনী ও কায়েসী এ দু’শিবিরে বিভক্ত না হত, তাহলে মারওয়ানও সফল হতেন না এবং রাজ সিংহাসন লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
এভাবে মারজে রাহাতে ইয়মেনীদের হাতে কায়েসীদের পরাজয় বনু উমাইয়াদের পতনোন্মুখ রাজপ্রাসাদকে সোজা করে দাঁড় করে দিয়েছিল।
মারওয়ান বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দামেশকে আগমন করল, হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর প্রতিষ্ঠিত সিংহাসনে আরোহন করল এবং ইবনে সাদের ভাষ্য মতে, আমীরে মুয়াবিয়া (রা)-এর ন্যায় সরকারী কোষাগারের দ্বার খুলে দিয়ে সাধারণ, অসাধারণ সর্বস্তরের মানুষেল হৃদয় জয় করে নিল। অত্যন্ত আ্শ্চর্যের বিষয় হল- হযরত ওসামন (রা) আমীরে মুয়াবিয়া (রা) এবং ইয়াযিদের যুগে যে মারওয়ান ধিকৃত ছিল, মদীনার লোকেরা যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করত, সে আজ খলিফার আসনে সমাসীন হল।
মারওয়ান জর্ডানে পৌঁছে স্বয়ং আশ্চার্যান্বিত হয়ে বলেছিলেন, মনে হয় আল্লাহ পাক পূর্ব থেকেই আমর জন্য খেলাফতের সিংহাসন নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।
বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহ পাক তাঁ জন্য পূর্ব থেকেেই খেলাফতের পদ নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ এবং হাসসান ইবনে মালেকের মত সুচতুর, বুদ্ধিমান, উদ্দ্যমশীল অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ তার পার্শ্বে এসেই তার ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছিল।
মারওয়ানকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, তন্মধ্যে তাঁর বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন যুবক পুত্র আবদুল মালেক এবং আবদুল আজীজের ভূমিকাও অত্যন্ন প্রখর ছিল। তাঁর এ পুত্রদ্বয় যদি বলিষ্ঠ, বুদ্ধিসম্পন্ন, সাহসিী ও মেধাবী না হত তবে হয়ত তিনি এরূপ সফলতা অর্জন করতে পারতেন না।
খেলাফত লাভের ছয় বা আট মাস পরেই যখন তার মৃত্যর সময় ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি তর দু’ পুত্রকে একের পর এক করে স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করলেন। আবদুল মালেক বয়সের দিক দিয়ে বড় ছিলেন বলে তাকে প্রথম এবং আবদুল আজীজকে তার পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করলেন। তার মৃত্যুর সময় আবদুল মালেক তার পার্শ্বেই অবস্থানি করছিলেন এবং আবদুল আজীজ যখন মিসরে ছিলেন।
এ মরওয়ানই আবদুল আজীজে পিতা এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর দাদা ছিলেন। (তাবকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৭)

আবদুল আজীজ
ঐতিহাসিকগণ আবদুল আজীজের বড় ভাই এবং মারওয়ানের জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুল মালেককে তার তীক্ষ্ণ মেথা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিত্তার জন্য দ্বিতীয় মুয়াবিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা তাকে সে সময় সকল লোকের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। বাস্তবিকই তিনি দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ছিলেন। তিনিও হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর মত দৃং চরিত্রের অধকারী ছিলেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম এবং রজনৈতিক অভিজ্ঞতার দ্বারা সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে রাজ্যের বুনিয়াদকে শক্তিশালী ও সুসংহত করেছিলেন।
কিন্তু আবদুল আজীজ বয়স, বুদ্ধি ও রাজনীতিতে আবদুল মালেকের চেয়ে ভাল হলেও চরিত্রমাধুর্য, ভদ্রতা, সততা-সাধুতা ও স্বচ্চরিততার অন্যান্য গুণে আবদুল মালেকের চেয়েও অনেক উর্ধ্বে ছিলেন।
আবদুল মালেকের স্বভাব-চরিত্র, কাজ-কর্ম, কথাবার্তা ইত্যাদি দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি মারওয়ান ইবনে হাকামের সুযোগ্য পুত্র। যারা আবদুল আজীজকে দেখেছেন, যারা তাঁর পার্শ্বে অবস্থান করেছেন, তাদের নিকট আবদুল আজীজের বংশ পরিচয় প্রকাশ না করলে, তারা তাঁর সৎ স্বভাব ও অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে তাকে ওমর ফারুক বা আবু বকল (রা) অথবা এ জাতীয় কোন মনীষীর সন্তান বলেই ধারণা করত।
আবদুল আজীজ তার ভাই আবদুল মালেকের চেয়ে শৌর্য-বীর্য ও সাহসিকতার দিক দিয়ে সমান পর্যায়ের ছিলেন না। যখন তিনি তাঁর পিতার সাথে মিসরে অভিযান পরিচালনা করেন, তখন তিনি অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে সেখানকার শাসক ইবনে মাজাদামকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন।
ঐতিহাসিক সুয়ূতী বলেন, মিশরের কিছুসংখ্যক লোকের আমন্ত্রণক্রমে মারওয়ান যখন মিশর আক্রমণ করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন তার পুত্র আবদুল আজীজকে অল্প কিছু সৈন্যসহ জেরুজালেম পাঠালেন। সেখানে মিশরের শাসনকর্তা পূর্ব থেকেই বিরাট এ সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছিলেন।
আবদুল আজীজ তখনও পথিমধ্যে ছিলেন। ইবনে মাজদাম তাঁর অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্যে যুদ্ধপটু সেনাপতি যুবাইর ইবনে কায়েসকে পাঠালো। বাচ্ছাক নামক স্থানে আবদুল আজীজ ও যুবাইরের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
এ যুদ্ধে আবদুল আজীজ অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে শত্রু বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করে তাদের কয়েকজন বিখ্যাত সেনাপতিকে হত্যা করলেন। শত্রু বাহিনী যেভাবে পরাজিত ও পর্যদুস্ত হল, ইবনে মাজদাম ও তার সেনাপতি যুবাইর তা ভাবতেও পারেনি।
আবদুল আজীজের এ অসাধাণ বীরত্বের ফলেই ইবনে মাজদাম মারওয়ানের সাথে একটি প্রদর্শনীমূলক যুদ্ধ করেই সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিল।
মারওয়ানও তার পুত্রের যোগ্যতার সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এ কারণেই তিনি দুই মাস মিশরে অবস্থান করার পর যখন সিরিয়িায় গমন করেই তখন আবদুল আজীজের হাতেই মিশরের শাসনভার অর্পণ করেন।
ঐতিহাসিক ইবনে কাছীর বলেন- ৬৫ হিজরীতে মারওয়ান আবদুল আজীজকে মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তখন মিশরবাসী তাঁর ধ্যান –ধারণা ও চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা উপলীব্ধ কছিল যে, এরূপ চরিত্রবান, দয়ালূ, বিদ্যোৎসাহী দানশীল কোন বাদশাহ ইতোপূর্বে আর মিশরবাসীদের শাসন করেনি। (ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৮)
ইবনে সাদ বলেন- আবদুল আজীজ একজন উচ্চশ্রেণীর আলেম এবং নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ছিলেন আবু হুরায়রা (রা)-এর একজন ছাত্র। তিনি তাঁর নিকট থেকে বেশ কয়েকটি হদাসীও বর্ণনা করেছেন। আবদুল আজীজের ওস্তাদগণের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) এবং ওকবা ইবনে আমের (রা) ছিলেন অন্যতম।
তাবকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫)
ইবনে কাছীর আবদুল আজীজের ওস্তাদগণের আলোচনা শেষে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি একজন নির্ভরযোগ্য হাদীসবিদ ছিলেন। কিন্তু তাঁর হাদীস বর্ণনা সংখ্যায় খুবই কম ছিল। তিনি ছিলেন সব দিক দিয়ে সফল ব্যাক্তিত্ব, তিনি বিনয়-নম্রতা, শালীনতা ও ভদ্রতার সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথাবার্তা বলতেন।

শিক্ষা-দীক্ষা
আবদুল আজীজ মদীনায় জন্মগ্রহণ করে সেখানেই কুরআনসহ অন্যান্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু মিশরে আসর পর তিনি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য করেছিলেন।
আবদুল আজীজের ভাষায় দক্ষতা অর্জন প্রসঙ্গে ইবনে কাছীর একটি সুন্দর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, একবার এক ব্যক্তি তার জামাতার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ নিয়ে আবদুল আজীজের নিকট আগমন করল। আরবীতে জামাতাকে “খাতেন” বলা হয়, কিন্তু সে ব্যক্তি তার এরাবের (স্বরচিহ্ন) উপর খুব জোর দেয়নি, আবদুল আজিজও এরাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন – (আরবী****) (মান খাতিনুকা) অর্থাৎ তোমার জামাতা কে? অতএব সে অভিযোগকারী বিদ্রুপ করে জবাব দিল যে, সাধারণ মানুষকে যে খৎনা করে থাকে আমাকেও সে খৎনা করেছে। এতে আবদুল আজীজ অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। অতঃপর আবদুল আজীজ উপদেষ্টার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে তিনি বললেন, আপনার জিজ্ঞাসা ছিল (মান খাতিনুকা) অর্থাৎ তোমার জামাতা কে? কারণ খাতেনুনেরে অর্থ হল জামাতা। এরপর আবদুল আজীজ কসম করলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ভাষার উপর পুরোপুরি দক্ষতা অর্জন করতে না পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আর প্রাসাদের বাইরে বের হবেন না। অতএব তিনি পূর্ণ আট দিন প্রাসারে ভিতরে থেকে ভাষায় পূর্ণ দখল অর্জন করে যখন বের হলেন, তখন তিনি ছিলেন একজন উচ্চ পর্যায়ের ভাষাবিদ, পণ্ডিত।

জ্ঞান বিস্তার
আবদুল আজীজ শুধু নিজেই পাণ্ডিত্য অর্জন করে ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি তাঁর কর্মচারী, পরিষদ এবং দরবারের অন্যান্য লোকদেরকেও এ বিষয়ে উৎসাহিত করলেন। এমনকি তাঁর কর্মচারীদের মধ্যে ভাষাজ্ঞান ভিত্তিতে বেতন –ভাতা ও পদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিলেন। যার ভাষা ভুল হতো তার বেতন কমিয়ে দিতেন এবং যার ভাষা শুদ্ধ-মার্জিত হতো তাকে পদোন্নতি দিতেন। তাঁর এ কর্মসূচী অত্যন্ত সফলতার সাথেই কার্যকরী হল। সকলেই ভাষা আয়ত্ব করতে আগ্রহী হয়ে উঠল এবং খুব তাড়াতাড়িই তার কর্মচারীদের ভাষা পরিবর্তন হয়ে ত্রুটিমুক্ত হয়ে গেল।
একবার তাঁর একজন বিশিষ্ট কর্মচারী তাঁর সামনে হাজির হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কোন বংশের লোক? সে উত্তর করল- (আরবী********) অর্থাৎ আমি আবদেদ্দার বংশের লোক। এ বাক্যটিকে ব্যাকরণগত ত্রুটি ছিল। তার বলা উচিত ছিল- (আরবী *****)
সে কর্মচারীর ভাষাগত এ ত্রুটির জন্য আবদুল আজীজ তার প্রতি খুব অখুশি হলেন এবং একশত দিনার বেতন কমিয়ে দিলেন। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৭)
আবদুল আজীজ মিশরের আলেম-উলামা ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি তাদের প্রতি যে দয়া-দাক্ষিণ্য ও সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি প্রত্যেকটি শিক্ষিত পরহেযগার লোকেরা মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। শিক্ষা ও জ্ঞানোর আলো বিস্তারের জন্য বেশকিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও খানকাহ নির্মান করেছিলেন, এমনকি তাঁর প্রাসাদটিকেও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত কছিলেন। (ইবনে কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৮)

দানবীর
ইবনে কাছীর আবদুল আজীজকে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় দানশীল বাদশাহ বলে উল্লেখ করেছেন, আর বাস্তবিকপক্ষে তিনি তাই ছিলেন। তিনি শুধু দান-খয়রাতই করতেন না বরং সর্বসাধারণের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করতে কৃষি বিভাগে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেছিলেন, বহু ফলের বাগান তৈরি করেছিলেন। বহু অনাবাদী ভূমি নতুন কৃষকদের মধ্যে বন্দোবস্ত দিয়ে দেশের আর্থিক উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে সমস্ত অনাবাদী ভূমিতে মিশরীয়দের স্বত্ব ছিল না, সে সমস্ত ভূতিতে আরবের কৃষিকার্যে অভিজ্ঞ লোক এনে তাদেরকে বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন। মিশরীয় উপসাগরের উপর নতুন সেতু নির্মাণ, বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণ, মসজিদ নির্মানসহ অসংখ্য জনহিতক অনেক কাজ করেছিলেন। তিনি কায়রো নগরীতে নিজের জন্য একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করে অবশেষে সেটা মাদ্রামসার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন এবং তিনি হালওয়ান নামক স্থানে এসে বসবাস করতেন।

জনসেবা
কায়রোর জামে মসজিদ আজও আবদুল আজীজের স্মৃতি বহন করছে। তিনি পূর্বের মসজিদ ভেঙ্গে দিয়ে এমন এক বিরাট ও সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করলেন যে, সে সময় এরূপ মজিদ দুনিয়ার আর কোথায়ও ছিল না।
দেশের বিশিষ্ট আলেম-ওলামাগণ তাঁর খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন। ছোড়-বড় সকল কাজেই তিনি আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। আবুল কায়ের
আবুল খায়ের মুরছেদ এবং আবদুর রহমান ইবনে মাজরাহ ছিলেন সে সময়কার বিশিষ্ট আলেম। তিনি তাঁদের উভয়কেই তাঁর প্রধান উপদেষ্টার পদে নিয়োগ দান করেছিলেন।
আবদুল আজীজের দানশীলতার কথা কল্প-কানিহীর মত সর্বত্রই আলোজতি হতো। তাঁর বাবুর্চিখানায় প্রতি দুপুর ও সন্ধ্যায় দু’হাজার লোকের খানা রান্না করা হতো। যখন খাওয়ার জন্য দস্তরখানা বিছানো হত, তখন দেখা যেতো যে, মিশরের বিশিষ্ট আলেম-উলামাহস সর্বপ্রকার জ্ঞানী-গুণী লোকেরাই সেখানে খানায় শামিল হয়েছেন।
আবদুল আজীজ প্রতি বছর শীত ও গ্রীষ্মের শুরুতে হাজার হাজার দরিদ্র ও অভাবী-অনাথ লোককে শীত ও গ্রীষ্মের বস্ত্র বিতরণ করতেন। বিধবা, ইয়াতীম ও নিঃস্ব লোকের ভাতার ব্যবস্থা করে অভাবী লোকদের দুঃখ দূর করতেন।

সাহিত্যনুরাগী
কবি-সাহিত্যিকগণ ছিলেন তাঁর নিকট খুবই প্রিয়। বিশেষতঃ কাছীর ও নাছীবকে তিনি যে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ দিয়েছিলেন, অতীতে কেউ কোনো কবিকে এরূপ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন বলে কারো জানা নেই। তিনি যে সমস্ত লোককে মোটা অংকের অর্থ সাহায্য করেছিলেন, তন্মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) অন্যতম ছিলেন। হযরত ইবনে ওমর (রা) ছিলেন তাঁর স্ত্রী উম্মে আসেমের চাচা এবং পুত্র ওমর ইবনে আবদুল আজীজের তত্ত্বাধায়ক ও ওস্তাদ।
ইবনে কাছীর (র) আবদুল আজীজের মৃত্যুর শোকে কাতর হয়ে এ ছোট একটি বাক্য ব্যবহার করেছিলেন- আরবী******************
অর্থাৎ আবদুল আজীজ একজন যোগ্য শাসক ও দয়ালূ-দাতা এবং প্রশংসার পাত্র ছিলেন। (আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৮ম খন্ড, পৃ. ৬৮)

বিবাহ
আবদুল আজীজ জীবনে কয়েকটি বিবাহ করেছিলেন এবং তাঁর কয়েকজন পুত্র সন্তানও ছিল; কিন্তু যে পুত্রের মাধ্যমে বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি লাভ হয়েছিল তিনি ছিলেন এই ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)।

কৃতিত্ব
ইবনে কাছীর আবদুল আজীজের গুনাবলী বর্ণনা করে এটাও বলেছেন যে, তিনি ছিলেন খলীফায়ে রাশেদীনের ওমররের-পিতা।
ইবনে কাছীরের মতে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর মধ্যে যে সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, তা এজন্যই যে, তিনি সর্বদাই স্বীয় পিতার গুণাবলি অর্জন করতে চেষ্টা করতেন।
বাস্তবিকই এ ধারণা অত্যন্ত সঠিক ও যুক্তিযুক্ত, তদুপরি এটাও অস্বকার করা যায় না যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) যে মাতার দুগ্ধ পান করেছিলেন, তিনও ছিলেন একজন অসাধারণ মা।

ওমর ইবনে আবদুল আজীজের মাতা উম্মে আসেম
ইবনে সাদ বলেন- আবদুল আজীজ ইবনে মারওয়ান যখন ওমরের মাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেন, তখন তিন তার সচিবকে ডেকে বললেন, আমর পবিত্র আমদানী থেকে চারশত দিনার সংগ্রহ করুন, আমি পণ্যবান ও উচ্চ ঘরে একটি বিবাহ করতে ইচ্ছা করেছি। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ.৩৪৫)
ইবনুল জাওযিও ইবনে সাদের উদ্বৃতি দিয়ে তার কিতাবে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। (ইবনে জওযি ৫ম খণ্ড)
ইবনুল জাওযি বলেন- এ পূণ্যবান উচ্চ ঘর ছিল হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর বংশ। উম্মে আসেম ছিলেন হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর পুত্র হযরত আসেম (রা)-এর কন্যা। তারপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ থেকে একটি মৌখিক ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। মিশরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল হাকাম এ ঘটনাটি আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াহহাব থেকে বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হল-
হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) তাঁর খেলাফতের সময় দুধে পানি মিশানো নিষেধ করে একটি আদেশ জারি করেছিলেন। এক রাত্রে তিনি মদীনার ওলি-গলি ঘুরে দেখতে বের হলেন। তখন একটি স্ত্রীলোক তার মেয়েকে বলছিল, সকাল হয়ে গেল, তুমি দুধে পানি মিশাও না কেন? বালিকা উত্তর করল, আমি কিভাবে দুধে পানি মিশাব? খলীফঅ ওমর (রা) যে দুধে পানি মিশাতে নিষেধ করেছেন! মা বলল, লোকে পানি মিশায়, তুমিও মিশিয়ে নাও। খলীফা কিভাবে জানবেন? বালিকা বলল, ওমর (রা) যদিও না জানে, কিন্তু ওমরের আল্লাহর নিকট এটা গোপন থাকবে না। খলীফা হযরত ওমর (রা) যে কাজ করতে নিষেধ করেছেন, আমি কখনও তা করব না।
ইবনে আবদুল হাকাম বলেন- খলীফা হযরত ওমর (রা) এ কথোপকথন শুনতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। পরদিন সকালে তিনি তার পুত্র আসেমকে ডেকে এনে বললেন, বৎস! অমুক স্থানে গিয়ে এ বালিকাটির সন্ধান করে আস। তিনি সে বালিকার গুণাবলি বলে দিলেন। আসেম সেখানে গিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন যে, উক্ত বালিকাটি হেলাল গোত্রের কোন একজন বিধবার কন্যা। আসেম ফিরে এসে পিত হযরত ওমর (রা)-এর নিকট বিস্তারিত বর্ণনা করলেন। হযরত ওমর (রা) তাকে এ বালিকাকে বিবাহ করতে নির্দেশ দিয়ে বললেন, হয়তঃ এ বালিকার গর্ভেই এমন এক মনীষী জন্মগ্রহণ করবেন, যার জন্মে সমস্ত আরব গর্ববোধ করবে, যিনি আরবেমর মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং সমস্ত আরবের নেতৃত্ব দিবে।
আসেম এ বালিকাকে বিয়ে করে স্ত্রীরূপে বরণ করে নিলেন। এ বালিকাই পববর্তীকালে মুসলিম জাহানের গৌরব হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর মাতা উম্মে আসেমকে গর্ভে ধারণ করে বিশ্বে অমর হয়ে রয়েছেন। আবদুল আজীজ উম্মে আসেমকে বিবাহ করলেন, তাঁর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করলো ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী শাসক হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)।
ইবনে আবদুল হাকাম এ ঘটনা বর্ণনা করার পর লিখেছেন, মিশরের রাজা আজীজ মিশর হযরত ইউসুফ (রা) কে দেখে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন পরবর্তীকালে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। আর হযরত ওমর ফারুক (র) এ বালিকাকে দেখে মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাও অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
ইবনে আবদুল হাকামের টীকায় এ বালিকার নাম ‘রাইলা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু শায়খুল কবীর মুহিউদ্দীন আল-আরাবী তার নাম ‘কাবীরা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইবনুল জাওযির বর্ণনাও প্রায় একই ধরনের। অবশ্য তার এ বর্ণনাটি কিছুটা ভিন্ন ধরনের এবং প্রসঙ্গে সাথে সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাহল-
তারপর হযরত ওমর (রা) তদীয় খাস খাদে আসলামকে বললেন, সেস্থানে গিয়ে দেখ, যারা এ ধরনের কথোপকথন করেছিল, তারা কে? তাদের কোন পুরুষ লোক আছে কিনা।
আসলাম বলেন, আমি সেস্থানে এসে এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে দেখলাম একটি কুমারী বালিকা এবং তার বিধবা মাতা ছাড়া তাদের সংসারে আর কোন পুরুষ নেই। আমি তাদের এ অবস্থা দেখে হযরত ওমর (রা) –এর নিকট বিস্তারিত বিবরণ দিলাম। তখন খলীফা হযরত ওমর (রা) তদীয় পুত্রগণকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কারও স্ত্রীর প্রয়োজন আছে কি যে, আমি এ বালিকার সাথে তার বিবাহ দিব? আবদুল্লাহ বললেন, আমার স্ত্রী আছে, সুতরাং আমর দ্বিতীয় স্ত্রীর কোন প্রয়োজন নেই। আবদুর রহমানও অনুরূপ উত্তর করলেন। তখন আসেম নিবেনদ করলেন, পিতা! আমার কোন স্ত্রী নেই, আমার নিকট তাকে বিবাহ দিন। তারপর ওমর (র) সে বালিকাকে ডেকে আনালেন এবং আসেমের সাথে তাকে বিবাহ দিলেন।
আমরা এজন্য এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করলাম, যেহেতু এটা পূর্বোক্ত বর্ণানার চেয়ে অধিকসামঞ্জস্যপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত। তদুপরি এটা হযরত ওমর (রা)-এর খাস খাদেম স্বয়ং আসলামের মৌখিক বর্ণনা। মা ও মেয়ের কথোপকথনের সময় আসলামও হযরত ওমর (রা)-এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি তাঁকেই এটা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, আসেমকে দেননি।
এ বালিকা যাকে হযরত ওমর (রা) তার পুত্র বধুরূপে গ্রহণ করলেন, তিনি ছিলেন হেলাল গোত্রের এক বিধবার কন্যা। মা-মেয়ে দুধ বিক্রয় করে জীবিকা চালাতো। সম্পূর্ণ দৈবক্রমেই হযরত ওমর (রা) এ ঘটনার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।
ইবনুল জাওযির বর্ণনা অনুযায়ী এ বালকার গর্ভে আসেমের ঔরসে দু’জন কন্যা জন্মগ্রহণ করেন, তাদের একজনকে আবদুল আজীজ বিবাহ করেন এবং তার গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন হযরত ওমর ইবনুল আবদুল আজীজ (র)।

হযরত ওমর ইবনুল আবদুল আজীজ (র)
জন্ম
ইবনে আবদুল হাকামের বর্ণনা মতে হযরত ওমর ইবনুল আবদুল আজীজ (র) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আবদুল আজীজ যখন এ বিবাহ করেন তাঁর পিতা মারওয়ান তখনও খেলাফতের আসন লাভ করেননি।
প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ আল্লামা নব্বী তাহযীবুল আসমা ওয়াল ফাতে লিখেছেন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) ৬১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মতে ওমর মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনুল হাকামের টীকায় লিখা আছে যে, ওমর ৬৩ হিজরীতে হালওয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর পিতা মিশরের শাসনকর্তা ছিলেন। এ দু’টি কথাই যদি আমরা সঠিক বলে মনে করি, তাহলে আবদুল আজীজের শাসনকাল ৬৫ হিজরীর পরিবর্তে ৬১ হিজরী থেকে শুরু হয়। অথচ সমস্ত ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, মারওয়ান ও আবদুল আজীজ ৬৫ হিজরীতেই মিশর অধিকার করেছিলেন।
ইবনে সাদ ও ইবনে আবদুল হাকাম প্রবণী ঐতিহাসিক। বিশেষতঃ ইবনে আদুল হাকাম ছিলেন মিশরের অধিবাসী। কাজেই তিনিই ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-এ জীবনীর সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য সনদ। তারপরও তাঁর পিতামহ বনী উমাইয়াদের খাস খাদেম ছিলেন। তিন ১৫৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর ইন্তেকালের মাত্র ৫২ বৎসর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদি তিনি ১৬১ হিজরী পর্যন্ত কিছটা জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। তবে তখনও পর্যন্ত মিশরে এরূপ লোকের সাথে তার সাক্ষাৎ লাভ বিচিত্র কিছু নয়, যারা ওমর ইবনুল আজদুল আজীজ (র)-এর শাসনকাল দেখেছেন।
যদিও ইবনে আবদুল হাকাম ওমর ইবনুল আবদুর আজীজ (র)-এর নির্দিষ্ট জন্ম তারিখ লিখেননি, তবে তিনি একথা পরিষ্কর করে উল্লেখ করেছন যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে সেখানকার শিক্ষকগণের নিকটই বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন।
তার ভাষ্যটি হল- (আরবী*********************)
অর্থাৎ ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তিনি যখন কিছুটা বড় হলেন, তখন তাঁর পিতা আবদুল আজীজ মিশরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে আসলেন এবঙ তিনি তাঁর পত্নী উম্মে আসেমকে তাঁর নিকট মিশরে যেতে লিখে পাঠালেন। (ইবনে আবদুল হাকা ১৯ পৃষ্ঠা)
এটা এমন এক ঐতিহাসিক বর্ণনা, যিনি স্বয়ং মিশরের অধিবাসী ছিলেন এবঙ যে শতাব্দীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, পরবর্তী ঐতিহাসিকগণ ইবনে আবদুল হাকামের লিখিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পাননি অথবা যদি পেয়েও থাকেন তবে ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর স্থান নির্দেশ করতে তারা ভুল করেছেন।
ঐতিহাসিক ইবনে সাদ ও সম্পর্কে অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। তিনি মাত্র এ কয়টি কথা দ্বারা ওমর ইমনে আবদুল আজীজ (র)-এর জন্মের কথা উল্লেখ করেছন। (আরব*ি***********************)
অর্থাৎ বর্ণিত আছে যে, ওমর ৬৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এ বৎসরই উম্মুল মমিনীন হযরত মায়মুনা (রা) ইন্তেকাল করেন। এ কথার সম্পর্ক দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইবনে সাদের মতে এটা নির্ভরযোগ্য ছিল যে, ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)- মদীনাকে জন্মগ্রহণ করেছেন। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৫ম, পৃ. ২২৪)
যদি হালওয়ান বা মিশরের অন্য কোন শহরে তাঁর জন্ম হয়েছে বলে মনে করি, তবে স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর জন্ম তারিখ অন্য কোন তারিখ অভতা মেনে নিতে হবে যে, আবদুল তাঁর পিতা মারওয়ানের খেলাফতের পূর্বে এবং তিনি স্বয়ং মিশেরের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করার পূর্বে তাঁর স্ত্রী উম্মে আসেমসহ মদীনা গিয়েছিলেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি