ভূমিকা
ইতিহাস ও সীরাত
জাহিলিয়াত যুগে আরবরা ইতিহাস কি জিনিস, তা জানতো না। ইতিহাস বলতে তাদের কাছে ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জনশ্রুতি। আরব জীবনের স্বভাব +প্রকৃতির বর্ণনাই ছিল সেকালের প্রচলিত ইতিহাসের একমাত্র উপাদান। বাপদাদার বীরত্বগাথা এবং তাদের বদান্যতা, স্বগোত্রের প্রতি আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি পরায়ণতার গৌরবময় কাহিনীতে তা ছিল ভরপুর। বংশ পরম্পরা ও শত্রু মিত্রের পরিচয়মূলক বিবরণে সমৃদ্ধ ছিল সে ইতিহাস। পবিত্র কা’বাঘর ও তার রক্ষকদের, ইতিবৃত্ত, যমযম কূপের উদ্ভব-বৃত্তান্ত, জুরহুম ও কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জীবন কথা, মাআরিবের বাঁধভাঙা প্লাবন ও তার পরিণতিতে সেখানকার অধিবাসীদের শতধাবিচ্ছিন্ন হযে দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী, গণক ও যাজকদের ভবিষ্যদ্বানী ও তাদের ছন্দবদ্ধ গদ্য-কবিতা ইত্যাদি-যার দ্বারা তৎকালীন আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের স্বরূপ জানা যায়- এসবই ছিল আরব জাতির ইতিকথার প্রধান উপজীব্য। যখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলামের পুনরাবির্ভাব ঘটলো, তখনো ঐসব জনশ্রুতিমুলক ইতিকাহিনী মানুষের মুখে মুখে বিবৃত হওয়া অব্যাহত থাকলো। অধিকন্তু ইসলামের প্রতি আহ্বান ও তার পূর্বে পরিলক্ষিত নবুওয়াতে পূর্বাভাস, তাঁর ক্রমবিকাশ ও বয়োপ্রাপ্তি, নবুওয়াতোত্তর জীবন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জীবনের ঘটনাবলী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার আদর্শ জীবনের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন নামধারী মুসলিম, খৃস্টান, ইহুদী ও মুশরিকদের কাহিনী- এসবের মধ্যে আরব কথক ও কহিনীকাররা এক ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী উপকরণ পেয়ে গেল। ফলে এসব নতুন কহিনীও একইভাবে মৌখিক বর্ননার মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।পবিত্র কুরআন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সাহাবাদের কথাবার্তা ঐ নতুন জীবনের এক সুপরিসর দলীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।

পবিত্র কুরআন তো প্রথম থেকেই লিখিত ছিল। কিন্তু মহানবীর (সা) হাদীস দীর্ঘকাল ব্যাপী অলিখিত থাকে তবে লোকেরা এগুলোকে বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য বর্ণনা বলে জানতো। হাদীসকে ব্যাপকভাবে লিখে রাখতে কেউ সাহসই করেনি। হযরত আবু সাঈদ (রা) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “কুরআন ছাড়া আমার কোন কথা লিখো না, যদি লিখে থাক হবে তা নিশ্চিহ্ন করে দাও ”- এই উক্তির কারণেই কেউ লিপিবদ্ধ করতে সাহস পায়নি।

এই নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। কুরআন নাযিল হবার কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি লিখে রাখলে কুরআনের সাথে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে-এরূপ আশংকা ছিল। শুধুমাত্র এই মিশ্রণ এড়ানোর মহান লক্ষ্য সামনে রেখেই যে এই নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিল এবং তা যে কুরআন নাযিলকালের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল, সে কথা না বললেও চলে।

তথাপি উমার ইবনে আবদুল আযীযের শাসনকালের প্রারম্ভ পর্যন্ত ব্যপকভাবে হাদীস প্রনয়নের কাজে হাত দেয়া হয়নি। ৯৯ হিজরী সন থেকে ১০১ হিজরী সন পর্যন্ত তিনি খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। কথিত আছে যে, তিনি হাদীস প্রণয়নের কাজে হাত দেবেন কিনা তা নিয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ইস্তিখারা করেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর তরফ থেকে হাত দেয়া কর্তব্য বলে আভাস পান। ফলে তিনি আবু বাকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে উমার ইবনে হাযামকে হাদীস সংকলনের কাজে নিয়োজিত করেন। আবু বাকর ছিলেন মদীনার গভর্নর ও বিচারক। তিনি ১২০ হি: সন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যেসব হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল, তা তিনি একটি পুস্তকের আকারে লিপিবদ্ধ করে পর্যালোচনার জন্য বিভিন্ন শহরে পাঠান। উমার ইবনে আবদুল আযীয মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব আযযুহরীকেও হাদীস সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি একখানা হাদীস গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।

এরপর থেকে মুসলমানগণ হাদীস সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখেন। তবে সে কাজ কোন বিশেষ বিন্যাস পদ্ধতির অনুস্ারী ছিল না যিনি যেভাবে পরতেন সংগ্রহ করতেন। কেউ বা শরীয়াতের বিধানের কোন বিশেষ পরিচ্ছেদের অধীন একখানা পুস্তকের আকারে লিপিদ্ধ করতেন। এরপর এই পুস্তক প্রণয়নের ধারা এগিয়ে চলে। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, অনেকে হাদীস গ্রস্থের পরিচ্ছেদ বিন্যাস করেছেন এবং সেইসব গ্রন্থ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বৃত্তান্তকে আলাদা করেছেন। এই পর্যায়ে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, ধাত্রীগৃহে তাঁর লালন পালন এবং নবুওয়াতপূর্ব অন্যান্য ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর কৃরাইশদেরকে আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বান জানানো এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁর ও তাঁর সহচরবৃন্দের ওপর পরিচালিত যুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণের ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেইসাথে যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনাবলী সংক্রান্ত হাদীসগুলোরও সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

ঐতিহাসিকগণ অনুসরণ করেছেন ভিন্নতর পন্থা। তাঁরা ইতিহাস বিষয় নিয়ে ব্যাপক গ্রন্থরাজি রচনা করেছন। এর মাধ্যমে তাঁদের ইসলামী ভাবাবেগই প্রতিফলিত হয়েছে- যার কারণে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বে মুসলমানদের জন্য সন্দেহাতীতভাবে অনুকরণীয় আদর্শ ও হিদায়াত প্রাপ্তির উৎসের সন্ধান পেয়েছেন।

 

সীরাত গ্রন্থ রচনায় অগ্রণী মুসলিম ঐতিহাসকগণ
সীরাত গ্রন্থের প্রথম রচয়িতা ছিলেন উরওয়াহ ইবনুয্ যুবাইর ইবনুল ‘আওয়াম (৯২হি:), আব্বান ইবনে উস্মান (১০৫হি:), ওয়াহ্াব ইবনে মুনাববিহ (১১০ হি:), শুরাহবীল ইবনে সা’দ (১২৩হি:),ইবনে শিহাব আয্যুহরী (১২৪ হি:) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র ইবনে হাযাম (১৩৫ হি:)। এদের রচিত গ্রন্থাবলীর প্রায় সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু অংশ বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। তাবাবীর ইতিহাসের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আর ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহর গ্রন্থের একটি অংশ বর্তমানে জার্মানীর হাইডেলবার্গ নগরীতে সংরক্ষিত আছে।

এঁদের পরে ইতিহাস ও সীরাত গ্রস্থের রচয়িতাদের আর একটি দল আবির্ভূত হন।তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ হলেন মূসা ইবনে উকবাহ (১৪১ হি:), মুয়াম্মার ইবনে রাশেদ (১৫০ হি:) ও মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (১৫২ হি:)। এদের পরবর্তী দলের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গ হলেন, যিয়াদ আল বুকায়ী (১৮৩ হি:), ওয়াকেদী যিনি মাগাযী (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধের ইতিহাস) গ্রন্থের রচয়িতা (২০৭ হি:), ইবনে হিশাম (২১৮ হি:) এবং বিখ্যাত তাবাকাত প্রণেতা ইবনে সা’দ (২৩০ হি:)।

সীরাতে ইবনে ইসহাক
উল্লিখিত সীরাত গ্রন্থাবলীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, সর্বাধিক প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে উন্নতমানের গ্রন্থ হলো সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক। [১. “মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে আবদে মানাফের আযাদকৃত দাস। তাঁর দাদা ইয়াসার কুফার পশ্চিমে বারিয়ার দিকে অবস্থিত শহর আইনুত তামারের অন্যতম যুদ্ধবন্দী ছিলেন। হযরত আবু বাক্রের খিলাফতকালে ১২ হিজরী সনে এই শহর মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হলে ইয়াসারকে মদীনায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে ৮৫ হজিরী সনে তাঁর পৌত্র মুহাম্মাদ জন্মগ্রহণ করেন। মদীনাতেই তিনি যৌবন কাটান। অত:পর মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো ভ্রমণে বের হন। ১১৫ হিজরী সনে তিনি ইস্কান্দারিয়া গমন করেন এবং মিসরীয় একদল হাদীসবেত্তার নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ ও বর্ণনা করেন। এরপর তিনি আলজাজিরা, কুফা, রাই, বুহায়রা ও সর্বশেষে বাগদাদ সফর করেন। এখানেই ১৫২ হিজরী সনে তাঁর ইনতিকাল হয়। প্রখ্যাত মনীষী ইবনে আদী তাঁর সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে,“সমসাময়িক বাদশাহদেরকে আজেবাজে পুস্তকাদি প্রণয়নের কাজ থেকে নিবৃত্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সশস্ত্র সংগ্রাম, তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তি ও বিশ্ব সৃষ্টির ইতিহাস রচনার কাজে আত্ননিয়োগ করতে উদ্বুদ্দ করা যদি ইবনে ইসহাকের একমাত্র কৃতিত্বও হতো, তথাপি এ কৃতিত্বে তিনিই অগ্রণী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হতেন।”] এ গ্রন্থ তিনি রচনা করেন আব্বাসী শাসনামলের গোড়ার দিকে। বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার বাগদাদে আব্বাসী শাসক মানসূরের দরবারে প্রবেশ করেন। মানসূরের সামনেই তাঁর পুত্র মাহদী উপবিষ্ট ছিলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি জানো ইনি কে?” ইবনে ইসহাক বললেন, “হাঁ, আমীরুল মুমিনীনের (মানসূর) ছেলে”। তখন মানসূর বললেন, “যাও, ওর জন্য এমন একখানা গ্রন্থ রচনা কর, যাতে আদমের (আ) সৃষ্টি থেকে শুরু কের আজকের দিন পর্যন্ত যবাতীয় ঘটনাবলীর বর্ণনা থাকবে”। তখন ইবনে ইসহাক চলে গেলেন এবং কিছুকালের মধ্যে উক্ত গ্রন্থ রচনা করে মানসূরের নিকট উপস্থপন করলেন। মানসূর বললেন, “ইবনে ইসহাক, তুমি গ্রন্থকে অতি মাত্রায় দীর্ঘ করে ফেলেছো। এখন গ্রন্থখানি সংক্ষিপ্ত করে লিখ”। এরপর ঐ বিশাল গ্রন্থখানি খলীফার কোষাগারে রেখে দেয়া হলো।

সীরাতে ইবনে হিশাম
ইবনে ইসহাকের পর আসেন ইবনে হিশাম। [২.আবু মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম ইবনে আইয়ুব আল হিমইয়ারী। জন্মস্থান বসরা। পরে তিনি মিশরে গমন করেন এবং ইমাম শাফেয়ীর সাথে মিলিত হন। এরপর উভয়ে প্রচুর আরব কাব্যচর্চা করেন। সীরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষিপ্ত সংকলন ছাড়াও ইবনে হিশাম হিমইয়ার গোত্রের রাজন্যবর্গ ও বংশাবলী সম্পর্কেও একখানি গ্রন্থরচনা করেন। তাছাড়া সীরাত সম্পর্কিত দুর্লভ কবিতাসমূহের ব্যাখ্যা করে আরো একটি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। ২১৮ হিজরীসনে ফুসতাত নগরীতে তিনি ইনতিকাল করেন।]তিনি আমাদের জন্য এই সীরাত গ্রন্থকে সংক্ষিপ্ত করে পেশ করেন। এ কাজ তিনি সম্পন্ন করেন ইবনে ইসহাক কর্তৃক মূল গ্রন্থ রচনার প্রায় অর্থ শতাব্দী পরে। ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের এই সংক্ষিপ্ত সার রচনায় তিনি যিয়াদ আল বুকায়ী নামক মাত্র এক ব্যক্তির মধ্যস্থতা গ্রহণ করেন।[৩.হাফেজ আবু মুহাম্মাদ যিয়াদ ইবনে আবদুল মালেক ইবনে আত্তুফাইল আল বুকায়ী আল আমেরী আল কুফী। বনী আমের ইবনে ছা’ছায়ার শাখা বনীল বুকা থেকে উদ্ভূত বলে তিনি বুকায়ী নামে পরিচিত। তিনি বাগদাদ আগমন করেন এবং সেখানে ইবনে ইসহাক থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক অভিযানসমূহের ইতিবৃত্ত এবং মুহাম্মাদ ইবনে সালেম থেকে শরীয়াতের বিধান শিক্ষা ও প্রচার করেন। অত:পর কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেখাসে খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে ১৮৩ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন। ইবনে হিশাম যে তাঁর এই উস্তাদের যথাযথ কদর করতেন, গ্রন্থের শুরুতে উল্লিখিত এই কথা কয়টি তারই প্রমাণ বহন করছে, “আমি সেইসব বিষয় বাদ দিযেছি যার বর্ণনা অনেকের কাছে অপ্রীতিকর লাগবে অথবা যা বুকায়ী নিজের বর্ণনা দ্বারা আমাদের কাছে প্রামাণ্য বলে সাব্যস্ত করেননি।”] ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত ইবনে ইসহাকের মূল গ্রন্থখানি আজকের এই গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুকে অত্যধিক সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত আকারে পেশ করেন। কোন কোন জায়গায় কিছু সংযোজন ও সমালোচনা ও এর অঙ্গীভূত করেন। আবার কখনো অন্যান্য মনীষীর বর্ণনার সাথে ইবনে ইসহাকের বর্ণনার তুলনা বা যাচাই বাছাইও করেছেন। ঐ গ্রন্থের সংকলনে তাঁর অনুসৃত পদ্ধতির কিছু বর্ণনা তিনি গ্রন্থের শুরুতেই দিয়েছেন। এতদসত্তেও আমরা এব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করি না যে, ইবনে হিশাম জূর্ণ সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সাথে ইবনে ইসহাকের গ্রন্থ সংকলন করেছেন। তাথেকে তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি। আর যেখানেই ইবনে ইসহাকের বর্ণনার ত্রুটি তুলে ধরা, কিংবা কোন দুর্বোধ্য বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়া অথবা কোন বর্ণনার বিরেধী অন্য কোন বর্ণনা পেশ করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন, সেখানে ‘ইবনে হিশাম বলেন’ উক্তি দ্বারা তা শুরু করেছেন।

সংক্ষেপকরণই মূলত: তাঁর সীরাত গ্রন্থ সংকলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য তিনি সৃষ্টির আদিকাল থেকে শুরু করে হযরত ইসমাঈলের বংশধরদের ইতিহাস এবং অন্যান্য যেসব কাহিনীর সাথে সীরাতের কোন সম্পর্কই তিনি দেখতে পাননি, তাও বাদ দিয়েছেনে। আর সেইসব কবিতাও তিনি এর অন্তর্ভুক্ত করেননি, যার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করতেন।

যিনি ইবনে হিশামের সংকলন থেকে মূল সীরাত গ্রন্থে’র বিষয়বস্তুর সন্ধান লাভ করতে চেষ্টা করবেন, তিনি তাতে চরম নিষ্ঠ ও পরম বিশ্বস্ততার পরিচয়ই লাভ করবেন- যা সেই প্রচীন যুগের মুসলিম মনীষীদের বৈশিষ্ট্য ছিল।

সীরাতে ইবনে হিশামের মর্যাদা
মূলত: ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থই সীরাত পাঠকদের জন্য প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রধান প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাসে বুৎপত্তিসম্পন্ন খুব কম লোকই এমন ছিলেন যাঁরা ইবনে ইসহাকের সীরাত গ্রন্থ’কে ঐ বিয়য়ের প্রধান পথ-প্রদর্শকরূপে গ্রহণ করেননি। এ সীরাতে ইবনে ইসহাকই প্রাচীনকাল থেকে “সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে জ্ঞানীজনের কাছে পরিচিত। কেননা ইবনে হিশাম এই গ্রন্থের সংকলক ও সংক্ষেপক ছিলেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন,“ইবনে হিশামই ইবনে ইসহাকের সংগৃহীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামরিক ও সাধারণ জীবনেতিহাসসহ গোটা জীবনেতিহাসকে একত্রিত, সংকলিত ও সংক্ষিপ্ত করেছেন।এটাই বর্তমানে সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পাঠক সমাজের হাতে শোভা পাচ্ছ।”

বেশ কিছুসংখ্যক টীকাকার ও ব্যাখ্যাকার সীরাতে ইবনে হিশামের টীকা লিখতে এগিয়ে এসেছিলেন। তন্মধ্যে আবুল কাসেম আবদুর রহমান আস্ সুহাইলীর (৫৮১ হি:) “আর রাউদুল আনফ” নামক টীকাটি খুবই বিস্তারিত ও দীর্ঘ পরিসর।[৪.আবুল কাশেম আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে আলখুসায়মী আস-সুহাইলী আল আন্দালুসী আল মালকী। সুহাইল স্পেনের কোরা এলাকার অস্তর্গত একটি উপত্যকার সাম। তিনি ৫০৮ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ কর্নে এবং সেখানেই বসবাস করেত থাকেন। পরে মরক্কোতেও তিন বছর অতিবাহিত করেন এবং সেখানে ৫৮১ হিজরী সনে ইনতিকাল করেন।] এরপরে যিনি এই গ্রন্থের পর্যলোচনায় মনোযোগী হন, তিনি হলেন আবু যার আল খুশানী।[৫. আবু যার মুসআব ্ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মাসউদ আল জিয়ানী আল খুশানী। স্পেনের খুশাইন নামক গ্রামে এবং কাদায়ার খুশাইন গোত্রের নামানুসারে তিনি খুশানী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি হিজরী ৫৩৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬০৪ সনে ইনতিকাল করেন।] তিনি এই দুর্বোধ্য অংশগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং তার গ্রন্থ ‘র্শাহ সীরাতুন্ নববীয়া’য় কিছু কিছু সমালোচনাও করেন। আর ডক্টর ব্রুনলাহ গ্রন্থখানি প্রকাশ করেন। বদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল আইনী“কাশফুল লিসান ফী শারহে সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে এর ব্যাখ্যা প্রণয়ন সম্পন্ন করেন ৮০৫ হিজরী সনে।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু গ্রন্থাকার এই গ্রস্থের সংক্ষেপকরণের দিকেও মনোযোগী হয়েছেন। তাদের একজন হলেন বুরহানুদ্দীন ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ আল মুরহাল আশ্শাফেয়ী। ‘আযযাখীরা ফী মুখ্তাছারিস্ সীরাহ্” নামে আঠারটি অধ্যায়ে গ্রথিত এই গ্রস্থে তিনি সীরাতে ইবনে হিশামকে শুধু সংক্ষিপ্তই করেননি, বরং কিছু বিষয়ের সংযোজনও করেছেন।৬৬১ হিজরী সনে তিনি এই গ্রন্থ রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। অত:পর ৭১১ হিজরী সনে আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আবদুর রহমান আলওয়াসেতী “মুখতাছার সীরাতে ইবনে হিশাম” নামে আর একটি সংক্ষেপিত গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন।এমনকি কতিপয় গ্রন্থাকার সীরাতে ইবনে হিশামকে কাব্যাকারেও সংকলন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন (১) আবু মুহাম্মাদ আবদুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সাইদ আদ দুমাইরী আদ দাইরিনী, ওফাত ৬০৭ হিজরী, (২)আবু নছর আল ফাতাহ বিন মূসা বিন মুহাম্মাদ আল মাগরিবী, ওফাত ৭৯৩ হিজরী। শেষোক্ত গ্রন্থাকারের রচিত গ্রস্থের নাম “আল ফাতহুল কারীব ফী সীরাতিল হাবীব।” গ্রন্থখানি দশ হাজার পংক্তিতে সংকলিত হয়।

সীরাতে ইবনে হিশামের বক্ষ্যমাণ সংক্ষিপ্ত রূপ
যৌবনের প্রারম্ভে আমি এই গ্রন্থখানা আগাগোড়া পড়বার জন্য বার বার চেষ্টা করতাম কিন্তু এর রচনা পদ্ধতির বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা ঘোর মানসিক পীড়া ও একঘেঁয়েমী সৃষ্টি করতে। ফলে খানিকটা এখান থেকে খানিকটা ওখান থেকে পড়তাম। ভাষার মাধুর্য ও লালিত্য এবং বিষয়বস্তুর মাহাত্ন্যই আমাকে এইসব বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পড়তে আকৃষ্ট করতো। ঐ অংশগুলো আমার কাছে ঊষর মরুভূমিতে পুষ্পকাননের মত উপভোগ্য মনে হতো।

আসলে কুরআন-হাদীস পড়লে মনে যে নিখাদ বন্দেগীর ভাব জাগে ও ঐকান্তিক আনুগত্যবোধ অনুভূত হয় সীরাত বিষয়ক বই-পুস্তক পড়লে আমি ঠিক তেমনি ধরনের অসুভূতি লাভ করতাম। মনে হয়, কি এক অজানা রহস্যের দুর্বার আকর্ষণে আমি বার বার ওটা পড়তে চাইতাম। আমার মরহুম পিতাও সীরাত বিষয়ের একজন গ্রন্থাকার ছিলেন। “তালখিছুদ দুরুসিল আওয়ালিয়াহ ফিস সীরাতিল মুহাম্মাদিয়া” নামে তিনি ত্রিশটি অধ্যায়ে সমাপ্ত একখানা সংক্ষিপ্ত রচনা করেন। দীর্ঘদিন ব্যাপী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওটাই ছিাল একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। বলা বাহুল্য,তৎকালে সীরাত ছিল বিদ্যালয়গুলোর অন্যতম পাঠ্য বিষয়।

এতদসত্বেও সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থখানি আমি আগাগোড়া পড়তে সক্ষম হইনি। আগেই বলেছি যে, রচনা পদ্ধতির বিন্যস্ততার অভাব এবং অসংলগ্ন ও খাপছাড়া বর্ণনা রীতিই এর কারণ। সেখানে একজন সীরাত পাঠকের সমনে হঠাৎ করে এসে গতিরোধ করে দাঁড়ায় বদরের সকল যুদ্ধবন্দীর নাম, বদরের মুসলিম বাহিনীর ব্যবহৃত সমস্ত ঘোড়ার নাম, আনসার ও কুরাইশদের মধ্য থেকে যেসব মুসলিম সৈনিক বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যারা শহীদ হন এবং মুশরিকদের মধ্যে যাঁরা নিহত হয় তাদের সকলের নামের সুদীর্ঘ ফিরিস্তি। অনুরূপভাবে বদর যুদ্ধে যেসব কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছে, পূর্ব-পুরুষের মহিমা কীর্তনমূলক যেসব সংলাপ উচ্চারিত হয়েছে, বংশ পরম্পরা উল্লেখ করে যেসব ভাষণ দেয়া হয়েছে, নিছক শব্দের মায়াজাল বুনে যে লম্বা বুলি আওড়ানো হয়েছে এবং সীরাতের মূল বিষয়ের সাথে সংগতিহীনÑ যদিও তার কাছাকাছি কুরআনের যেসব ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়েছে এর অধিকাংশ সীরাত গ্রন্থে’র প্রচলিত রীতি মুতাবিক বর্ণনা পরম্পরা তথা সনদের উল্লেখ যার গুরুত্ব একমাত্র সমালোচক পন্ডিতদের কাছেই স্বীকৃত, এসব জিনিস পাঠকের সীরাত অধ্যায়নে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়।

এজন্য আমি বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, অধ্যয়নের দারাবাহিকতা বিনষ্ট না করার ব্যবস্থা সম্বলিত ও নবতর আঙ্গিকে শোভিত করে সীরাতের এই নির্যাসটুকু ইপস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। অবশ্য মূল গ্রন্থের আসল বক্তব্য যাতে অবিকৃত থাকে, সে ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেষ্ট থেকেছি, যাতে করে পাঠক তা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারেন ও আসল গ্রন্থ থেকে প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। মূল গ্রন্থের একটি বর্ণও আমি পরিবর্তন করিনি। কেননা গ্রন্থকারের বক্তব্য অবিকলভাবে উপস্থাপন করা যে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা আমি সব সময় মনে রেখেছি। ইবনে হিশামের কথা যথাযথভাবে উদ্ধৃত করা ও সেজন্য কথার শুরুতেই ‘ইবনে হিশাম বলেছেন’ বলে উল্লেখ করার রীতি আমি গ্রহণ করেছি ও তা অব্যাহতভাবে অনুসরণ করেছি। সংকলনের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারেই যেখানে যেমন করা দরকার করেছি। বাদ বাকী সমস্ত ইবনে ইসহাকের বক্তব্য, যা ইবনে হিশাম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যোখানে প্রয়োজন হয়েছে, কেবলমাত্র সেখানে ব্যতীত আর কোথাও আমি বর্ণনাদাতাদের নাম উল্লেখ করিনি, যদিও মূল গ্রন্থে ইবনে ইসহাক অথবা ইবনে হিশাম প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। ইবনে হিশামের সমস্ত উদ্ধৃতিতে আমি শৃঙ্খলার সাথে বিন্যস্ত করার প্রতি যত্নবান থেকেছি, প্রয়োজনবোধে তার কোন কোনটার ব্যাখ্য-বিশ্লেষন করেছি। এ ক্ষেত্রে সীরাত বিশ্লেষকদের বর্ণনা এর্ব বিশ্বস্ত হাদীস গ্রন্থ ও অভিধানের উপর আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে।

যার মূল গ্রন্থ অধ্যয়নের সুযোগ থেকে বঞ্জিত, বক্ষ্যমাণ সংক্ষেপিত সংকলন তাদের পক্ষে ঐ গ্রন্থ পাঠের একটা সহজ পন্থাবিশেষ। এতে করে বর্তমান তরুণ সমাজের সাথে তাদের প্রাচীন ও সুমহান উতরাধিকারের সুষ্ঠু সংযোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে।

পাঠকগণ এই গ্রন্থ মাত্র কয়েকদিনেই পড়ে শেষ করতে পারেন এবং তা থেকে দ্রুততার সাথে মূল্যবান ও কল্যাণকর জ্ঞানার্জনে সক্ষম হতে পারেন। কিন্তু এর স্থলে তাকে যদি মূল গ্রন্থ পাঠ করতে হতো যা বর্তমানে পাঠক মাত্রেরই নাগালের বাইরে তাহলে তাতে তার বহু মাস লেগে যেতো।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই গ্রন্থ দ্বারা সমাজকে উপকৃত করেন। জ্ঞানের রাজ্যে আমার এই ক্ষুদ্র ও নগণ্য প্রচেষ্টা সার্থক হলেই নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টিই আমার এ প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য।

আব্দুস সালাম হারূন

মিসরুল জাদীদাহ্

মধ্য রমজান

১৩৭৪ হিজরী

 

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আদম আলাইহিস্ সালাম পর্যন্ত ঊর্ধতন বংশপরম্পরা
আবু মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম বলেন:

এই গ্রন্থখানিতে আল্লাহর রাসূল হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী আলোচিত হয়েছে। তাঁর উর্ধতন বংশপরম্পরা নিম্নরূপ:

পিতা আবদুল্লাহ, তদীয় পিতা আবদুল মুত্তালিব (আবদুল মুত্তালিবের প্রকৃত নাম শায়বা), তদীয় পিতা হাশিম (হাশিমের প্রকৃত নাম আমর), তদীয় পিতা আবদে মানাফ (আবদে মানাফের প্রকৃত নাম আল মুগীরা) তদীয় পিতা কুসাই (কুসাই-এর প্রকৃত নাম যায়েদ), তদীয় পিতা কিলাব, তদীয় পিতা মুররাহ, তদীয় পিতা কা’ব, তদীয় পিতা লুয়াই, তদীয় পিতা গালেব, তদীয় পিতা ফিহির, তদীয় পিতা মালেক, তদীয় পিতা নাদার, তদীয় পিতা কিনান, তদীয় পিতা খুযাইমা, তদীয় পিতা মুদরিকা (মুদরিকার প্রকৃত নাম আমের), তদীয় পিতা ইলিয়াস, তদীয় পিতা মুদার, তদীয় পিতা নিযার, তদীয় পিতা মা’আদ, তদীয় পিতা আদনান, তদীয় পিতা উদ্, তদীয় পিতা মুকাওয়াম, তদীয় পিতা নাহুর, তদীয় হিতা তাইরাহ্, তদীয় পিতা ইয়’রুব, তদীয় পিতা ইয়াশজুব, তদীয় পিতা নাবেত, তদীয় পিতা ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা তারেহ (তারেহের অপর নাম আযর), তদীয় পিতা নাহুর, তদীয় পিতা সারীগ, তদীয় পিতা রাউ, তদীয় পিতা ফালেখ, তদীয় পিতা উবায়ের, তদীয় পিতা শালেখ, তদীয় পিতা আরফাখশাদ, তদীয় পিতা সাম, তদীয় পিতা নূহ (আলাইহিস সালাম), তদীয় পিতা লামক, তদীয় পিতা মুত্তাওশালাখ, তদীয় পিতা আখ্নুখ (ঐতিহাসিকদের ধারণা, তিনি হযরত ইদ্রিস আলাইহিস্ সালাম), তদীয় পিতা ইয়ারদ, তদীয় পিতা মাহলীল, তদীয় পিতা কাইনান, তদীয় পিতা ইয়নিশ, তদীয় পিতা শীস, তদীয় পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম।

ইবনে হিশাম বলেন,

“ইনশাআল্লাহ এই গ্রন্থ আমি হযরত ইবরাহীমের পুত্র ইসমাঈলের বিবরণ দিয়েই শুরু করবো। অত:পর ইসমাঈলের (আ) ঔরসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব পিতৃপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন এবং যাঁরা সেই সব পিতৃপুরুষের ঔরষজাত সন্তান ছিলেন, পর্যয়ক্রমে তাঁদের বর্ণনা দেব। এভাবে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পর্যন্ত সমস্ত পিতৃপুরুষ ও তাঁদের সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীসমূহ আলোচনা করবো। কিন্তু ইসমাঈলের (আ) যেসব সন্তান হযরত মুহাম্মাদের (সা) পিতৃপুরুষ নন, গ্রন্থের কলেবর সংক্ষিপ্ত ও শুধুমাত্র সীরাত বিয়য়ক বক্তব্যের মধ্যে সীমিত রাখার তাকিদে আমি তাঁদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করবো না। একই ভাবে, গ্রন্থের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখার উদ্দেশ্যে ইবনে ইসহাকের কিছু কিছু বর্ণনা বাদ দেবো যা তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ইবনে ইসহাকের ঐসব বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন উল্লেখ নেই, সে সম্পর্কে কুরআনেও কোন কথা নাযিল হয়নি, কিংবা তা এই গ্রন্থের কোন বক্তব্যের উপলক্ষ, ব্যাখ্যা বা দলীল প্রমাণেরও পর্যায়ে পড়ে না। ইবনে ইসহাকের উল্লেখ করা এমন কিছু কবিতাও আমি বর্জন করেছি, যা কবিতায় পারদর্শীদের কাছে অজ্ঞাত বলে লক্ষ করেছি। এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের কিছু কিছু অরুচিকর ও গণমনে অসন্তোষ উৎপাদনকারী উক্তি এবং বুকায়ী কর্তৃক সমর্থিত নয়, এমন কিছু বিষয়ও আমাকে বাদ দিতে হয়েছে। এ কয়টি জিনিস ছাড়া ইবনে ইসহাকের বাদবাকী সমস্ত তথ্য যতটা বর্ণিত ও স্বীকৃত, ততটা ইনশাআল্লাহ পুরোপুরিভাবে উল্লেখ করবো।”

ইসমাঈল আলাইহিস্ সালামের অধস্তন পুরুষদের বংশক্রম
ইসমাঈল আলাইহিস সালামের ঔরসে ১২ জন পুরুষ সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন: নাবেত, কাইযার, আযরাল, মীশ, মাসমা’, মাশী, দাম, আযর, তীম, ইয়াতুর, নাবাশ ও কাইয়ুম।

নাবেতের ঔরসে ইয়াসজুব, ইয়াসজুবের ঐরসে ইয়া’রুব, ইয়া’রুবের ঔরসে উদ এবং উদের ঔরসে আদনান জন্মগ্রহণ করেন।

আনদানের পর থেকে ইসমাঈলের বংশধরগণ গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আদনানের দু’টি পুত্রসন্তান ছিল : মাআদ ও আক।

আক ইবনে আদনান চলে যান ইয়ামানে এবং সেখানেই তাঁর বংশধররা স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। আক সেখানকার বনু আশয়ার গোত্রে বিয়ে করেন এবং তাদের সাথেই বসবাস করতে থাকেন, ফলে তাদের দেশ ও ভাষা উভয়ই এক হয়ে যায়। বনু আশয়ার গোত্রের ঊর্ধতন পুরুষরা হলো : আশয়ার, তদীয় পিতা নাবাত, তদীয় পিতা উদ, তদীয় পিতা হামাইসা, তদীয় পিতা আমর, তদীয় পিতা উরাইব, তদীয় পিতা ইয়াশজুব, তদীয় পিতা যায়েদ, তদীয় পিতা কাহলান, তদীয় পিতা ইয়াশযুব, তদীয় পিতা ইয়ারুব ও তদীয় পিতা কাহতান।

আদনানের অপর পুত্র মাআদ ইবনে আদনানের চারটি সন্তান জন্মে : নিযার, কুদাআ, কানাস ও ইয়াদ। কুদাইর বংশধর হিমইয়ার ইবনে সাবা পর্যন্ত বেঁচে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে। কিন্তু মাআদ সংক্রান্ত বংশধর বিশেষজ্ঞের মতে, কানাস বিন মাআদের বাদবাকী বংশধর নিশ্চিহ্ন হযে যায়। তবে হিরার বাদশাহ নুমান ইবনে মুনযির তাদেরই বংশধর।

রাবিয়া ইবনে নসরের স্বপ্ন
রাজাদের মধ্যে ইয়ামানের রাবিয়া ইবনে নসর একজন দুর্বল পরাধীন রাজা ছিলেন।একবার তিনি একটা ভয়ংকর সপ্ন দেভে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যান। তাঁর রাজ্যে যত গণক, যাদুকর, আয়েফ [৬. তৎকালে এক ধরনের গণক ছিল যারা পখির ডাক, গতিবিধি ইত্যাদি দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করতো। তাদেরকে বলা হতো আয়েফ।]

বা জ্যোতিষী ছিল তাদের সবাইকে তিনি সমবেত করে বলেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তোমরা আমাকে বলবে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি এবং তার ত’বীরই বা কি?” সমবেত জ্যোতিষীরা বললো, “সপ্নটা আমাদের কাছে বর্ণনা করুন। আমরা তার তাবীর বলবো।” রাজা বললেন, “স্বপ্নটা যদি আমি বলে দিই তাহলে তোমাদের তাবীরে আমি স্বস্তি বা প্রশান্তি লাভ করতে পারবো না। কেননা এই স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা একমাত্র সে-ই করতে সক্ষম যে আমার বলার আগেই স্বপ্ন সম্পর্কেও বলতে সক্ষম।” জ্যোতিষীদের একজন বললো, ‘জাঁহাপনা, যদি এইভাবে স্বপ্নের তা’বীর জানতে চান তাহলে সাতীহ ও শেক্কে ডেকে পাঠান। কারণ তাদের চেয়ে পারদর্শী আর কেউ রনই। আপনি যা জানতে চান তা তারাই বলতে পারবে।”

রাজা ঐ দ’জন ভবিষ্যদ্বক্তাকে ডেকে পাঠালেন। প্রথমে রাজার দরবারে হাজির হলো সাতীহ। রাজা তাকে বললেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তুমি বল আমি কি স্বপ্ন দেখেছি? তুমি যদি স্বপ্নটা সঠিকভাবে বলতে পার তাহলে তার ব্যাখ্যাও সঠিকভাবে করতে পারবে।”

সাতীহ বললো, “বেশ, আমি তাই করবো। আপনি স্বপ্নে দেখেছেন, অন্ধকারের ভেতর থেকে এক টুকরো আগুন বেরিয়ে এসে নিম্নভূমিতে নামলো এবং সেখানে যত প্রাণী ছিল, সবাইকে গ্রাস করলো।”

রাজা বললেন, ‘বাহ্! স্বপ্নটা তো তুমি সঠিকভাবেই বলে দিয়েছ। এখন বলতো এর তাৎপর্য কি?”

সে বললো, “দুই প্রস্তরময় দেশে বিরাজমান সমস্ত সাপের শপথ করে বলছি, আবিসিনিয়াবাসী আপনার ভূখন্ডে প্রবেশ করবে এবং সমগ্র ইয়ামান দখল করে নেবে।”রাজা বললেন, “হে সাতীহ, এটাতো ভীষণ বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার।

এটা কবে ঘটবে? আমার আমলেই, না আমার পরে।?”

সে বললো, “আপনার আমলের কিছু পরে, ষাট বা সত্তর বছরের বেশী অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।” রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “এই ভূখন্ঠ কি চিরকালই তাদের অধিকারে থাকবে, না তাদের জবরদখলের অবসান ঘটবে?” সে বললো, “৭০ বছরের কিছু বেশীকাল উত্তীর্ণ হবার পর তাদের দখলের অবসান ঘটবে? তারপর তারা হয় নিহত হবে নয়তে পালিয়ে যাবে। রাজা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “তাদেরকে কে হত্যা বা বহিষ্কার করবে?” সাতীহ বললো, “তারা নিহত বা বহিষ্কৃত হবে ইরাম ইবনে যীইয়াযানের হাতে। তিনি এডেন থেকে আবির্ভূত হবেন এবং ইয়ামানে তাদের একজনকেও অবশিষ্ট রাখবেন না।”

রাজা বললেন,“ইরামের আধিপত্য কি চিরস্থায়ী হবে না অস্থায়ী?”

সাতীহ বললো, “তাদের আধিপত্য অস্থায়ী হবে।”

রাজা বললেন, ’‘কার হাতে ক্ষমতার অবসান ঘটবে।?”

সাতীহ বললো,“এক পূত:পবিত্র নবীর হাতে। তিনি ঊর্ধজগত থেকে ওহী লাভ করবেন।”

রাজা বললেন, “এ নী কোন বংশোদ্ভূত?”

সাতীহ বললো,“তিনি নাদারের পুত্র মালেকের পুত্র ফিহির, ফিহিরের পুত্র গালেবের বংশ থেকে উদ্ভূত হবেন। তাঁর জাতির তাতে ক্ষমতা থাকবে বিশ্বজগতের বিলুপ্তি ঘটার মুহূর্ত পর্যন্ত।”

রাজা বললেন, “বিশ্বজগতের আবার শেষ আছে নাকি?”

সে বললো,“হ্যাঁ, যেদিন পৃথিবীর প্রথম মানবগন ও শেষ মানবগণ একত্রিত হবে। যারা সৎকর্মশীল তারা সুখী হবে, আর যারা অসৎকর্মশীল তারা দুঃখ ভোগ করবে।”

রাজা বললেন,“তোমার ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্য?”

সে বললো, “হ্যাঁ, রাতের অন্ধকার ও ঊষার আলোর শপথ, সুবিন্যস্ত প্রভাতের শপথ, আমি যা বলেছি তা পুরোপুরি সত্য।”

এরপর শেক এসে পৌঁছলো রাজার দরবারে। সাহীহকে রাজা যা যা বলেছিলেন শেককেও তাই বললেন। কিন্তু সাতীহ যা বলেছে তা তাকে জানতে দিলেন না- তারা উভয়ে একই ধরনের ভবিস্যদ্বাণী করে, না ভিন্ন রকমের, তা দেখবার জন্য তিনি ব্যাপারটা গোপন করলেন।

শেক বললো, “আপনি স্বপ্নে দেখেছেনে, অন্ধকার থেকে এবটি অগ্নিশিখা বেরিয়ে এলো। সেটা একটা পর্বত ও একটা বাগানের মাঝখানে পতিত হলো। অতঃপর সেখানকার সকল প্রণীকে গ্রাস করলো।”

রাজা বুঝতে পারলেন যে, উভয়ের বক্তব্য অভিন্ন। শুধু এতটুকু পার্থক্য যে সাতীহ বলেছিল, টুকরোটা নিম্নভূমিতে নামলো। আর শেক বলেছে, একটি পর্বত ও একটি বাগানের মাঝখানে নামলো। অতঃপর তিনি শেককে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। এবার বল এর তাবীর কি?”

সে বললো,“ দুই পর্বতাকীর্ণ দেশের সমস্ত মানুষের শপথ করে বলছি, আপনার দেশে সুদানীরা আক্রমণ চালাবে এবং সব দুর্বল লোক তাদের অঙ্গুলী হেলনে চলতে বাধ্য হবে। তারা আবইয়ান থেকে নাজরান পর্বত সমগ্র ভূখ-ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।”

রাজা বললেন, “এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার। এ ঘটনা কবে ঘটবে? আমার জীবদ্দশাতেই, না আরো পরে?”

সে বললো, “আপনার পরে বেশ কিছুকাল অতিক্রান্ত হবার পর। এরপর একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তি আপনাদেরকে উদ্ধার করবে এবং হানাদারদেরকে ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে বিতাড়িত করবে।”

রাজা বললেন, “এই পরাক্রমশালী ব্যক্তি কে?”

সে বললো, “একজন যুবক, যিনি নগণ্য বা নীচাশয় নয়। যী-ইয়াযানের বাড়ী থেকে তার অভ্যুদয় ঘটবে। তিনে হানাদারদের একজনকেও ইয়ামানে টিকতে দেবেন না।”

রাজা বললেন, “এই ব্যক্তির শাসন কি চিরস্থায়ী হবে না ক্ষণস্থায়ী?”

শেক বললো একজন প্রেরিত রাসূলের আগমনে তার শাসনের অবসান ঘটবে-যিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, ধার্মিক ও সজ্জনদের সমভিব্যাহারে আসবেন, তাঁর জাতির শাসন চলবে কিয়ামত পর্যন্ত।”

রাজা বললেন, “কিয়ামত কি?”

সে বললো,“যেদিন শাসকদের বিচার হবে, আকাশ থেকে আহ্বান আসবে, সে আহ্বান জীবিত ও মৃত সকলেই শুনতে পাবে। আর নির্দিষ্ট সময়ে সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। সেদিন মিতাচারী লোকদের জন্য হবে সাফল্য ও কল্যাণ।”

রাজা বললেন, “তুমি যা বলেছো তা বি সত্য?”

সে বললো,“হ্যাঁ, আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মধ্যকার সকল সমতল ও অসমতল সব কিছুর রবের শপথ করে বলছি, আমি আপনার কাছে যে ভবিষ্যদ্বাণী করলাম তা সঠিক ও সন্দেহাতীত।”

রাবিয়া এই দুই ভবিষ্যদ্বক্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকে প্রয়োজনীয় পাথেয় দিয়ে ইরাক পাঠিয়ে দিলেন। তারপর পারস্যের তৎকালীন সম্রাট শাপুর ইবনে খুরযাদকে চিঠি লিখে পাঠালেন। শাপুর তাদেরকে হিরাতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আবু কারব হাস্্সান ইবনে তুব্বান আস’আদ কর্তৃক ইয়ামান রাজ্য অধিকার এবং ইয়াসরিব আক্রমণ

রাবিয়ার মৃত্যুর পর সমস্ত ইয়ামানের রাজত্ব বলে যায় আবু কারব হাস্সান ইবনে তুব্বান আস’আদের হাতে। তাঁর পিতা তুব্বান আস’আদ আগে থেকেই পূর্ব দিক দিয়ে মদীনায় (ইয়াসরিব) আসতেন এবং এভাবে মদীনাবাসীদেরকে বিব্রত না করেই সুকৌশলে আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন। সেখানে তিনি নিজের এক পুত্রকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। কিন্তু উক্ত পুত্র সহসা গুপ্তঘাতক কর্তৃক নিহত হয়। এরপর তুব্বান মদীনা ধ্বংস ও তার অধিবাসীদেরকে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়ে আবার সেখানে আসেন। অতঃপর আমর বিন তাল্লার নেতৃত্বে লোকদের একটি দল সংঘবদ্ধ হয়। তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই দলটি এমন ভাব দেখায় যে, তারা যেন দিনের বেলায় তাঁর সাথে যুদ্ধ করে ও রাত্রে আতিথেয়তা করে। তুব্বান তাদের এ আচরণে বিষ্মিত হয়ে বলেন, আশ্চর্য! এ জাতি বাস্তবিক পক্ষেই ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। এভাবে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলো। এমতাবস্থায় একদিন দু’জন ইহুদী পন্ডিত মদীনা ও তার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছ্রা কথা জানতে পেরে তাঁর কাছে আসেন। তারা তাঁকে বললেন,“হে রাজা, এ কাজটি করবেন না আপনি যদি জিদ ধরেন, তাহলেও আপনার সমনে অপ্রতিরোধ্য বাধা আসবে। ফলে আপনি যা চান তা করতে পারবেন না। অথচ আপনি অচিরেই শাস্তি ভোগ করবেন।” রাজা বললেন, “কি আরণে আমি শাস্তি ভোগ করবো?” তারা বললেন, “মদীনা শেষ যামানার নবীর আশ্রয় স্থল। কুরাইশদের দ্বারা তিনি পবিত্র স্থান থেকে বহিস্কৃত হবেন এবং এখানে এসে বসবাস করবেন।”

এ কথা শুনে রাজা নিবৃত্ত হলেন। তাঁর মনে হলো নোক দুটো যথার্থই জ্ঞানী লোক। তাদের কথঅয় রাজা মুগ্ধ হলেন। তিনি মদীনা ত্যাগ করে ঐ পন্ডিতদ্বয়ের ধর্ম গ্রহন করলেন।

তুব্বা তথা তুব্বান আস’আদ ও তাঁর গোত্রর লোকেরা পৌত্তলিক ছিলেন।তিনি ইয়ামানের পথে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উসমান ও আমাজ নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যস্থলে পৌঁছলে হাযাইল ইবনে মুদারাকা গোত্রের কতিপয় লোক তাঁর কাছে বললো,“হে রাজা, আপনি কি এমন এবটি অজানা ঘরের সন্ধান পেতে ইচ্ছুক, যা হীরক, মণিমুক্তা, চুন্নিপান্না প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদে পরিপূর্ণ, অথচ আপনার পূর্ববর্তী রাজারা সে ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল।” রাজা বললেন, “হ্যাঁ, এরকম ঘরের সন্ধান অবশ্যই পেতে চাই।” তারা বললো, ‘মক্কাতে একটি ঘর আছে। মক্কাবাসীরা সেখানে ইবাদাত করে ও তার পাশে নামায পড়ে।”

আসলে বনী হুযাইলের লোকেরা তুব্বানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে েেদয়ার উদ্দেশ্যেই এ পরামর্শ দিয়েছিল। কেননা তারা জানতো, কাবাঘরকে করতলগত করার ইচ্ছে যে রাজাই করেছ এবং তার ওপর আক্রমণ যে-ই চালিয়েছে, সে-ই ধ্বংস হয়েছে।

তুব্বানের ইচ্ছাহলো, বনী হুযাইলের পরামর্শ অনুসারে কাজ করবে। কিন্তু তা করার আগে সেই ইহুদী পন্ডিতদ্বয়ের কাছে দূত পাঠিয়ে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। পন্ডিতদ্বয় বললেন, “আপনাকে ও আপনার সৈন্য সামন্তকে ধ্বংস করাই বনী হুযাইলের ইচ্ছা। পৃথিবীতে আল্লাহর কোন ঘরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নিজের মালিকানায় নিতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। তারা যে পরামর্শ দিয়েছে সে অনুসারে আপনি যদি কাজ করেন তাহলে আপনার ও আপনার সহচরদের সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হতে হবে। এটা অনিবার্য ও অবধারিত।” রাজা বললেন, “তাহলে আমি যখন ঐ ঘরের কাছে যাব তখন আমার কি করা উচিত বলে আপনারা মনে করেন?” তারা বললেন “মক্কাবাসীরা যা করে আপনিও তাই করবেন। ঘরের চারপাশে তাওয়াফ করবেন এবং তার সম্মান ও তাজীম করবেন। তার কাছে থাকাকালে মাথায় চুল কামিয়ে ফেলবেন। যতক্ষণ ঐ ঘরের কাছ থেকে বিদায় না হন ততক্ষণ অত্যন্ত বিনয়াবনত থাকবেন।” রাজা বললেন, “আপনারা এসব করেন না কেন?”তারা বললেন, “খোদার কসম, ওটা আমাদের পিতা ইব্রাহীমের বানানো ঘর। এ ঘর সম্পর্কে আপনাকে আমরা যা যা বলেছি সবই সত্য। তবে ঘরের চারপাশে বহুসংখ্যক মূর্তি স্থাপন করে মক্কাবাসী আমাদের ঐ ঘরের কাছে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ঐ ঘরের কাছে রক্তপাত(নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও) চালু রেখেও তারা আমাদের যাওয়া বন্ধ করেছে। তারা অংশীবাদী ও অপবিত্র।”

তুব্বান ইহুদী আলেমদ্বয়ের উপদেশ মেনে নিলেন এবং তা বাস্তবায়িত করলেন। এরপর হুযাইল গোত্রের সেই লোকদের কাছে গেলেন এবং তাদের হাত পা কেটে দিলেন। অতঃপর মক্কায় গেয়ে পবিত্র কা’বাঘর তাওয়াফ করলেন, তার পাশে পশু জবাই করে কুরবানী আদায় করলেন এবং মাথার চুল কামালেন। এভাবে তিনি ছয়দিন মক্কায় কাটালেন। এ ছয়দিন পশু কুরবানী করে মক্কাবাসীকে খাওয়ানো এবং মধু পান করানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি স্বপ্নে দেখলেন কা’বা শরীফকে তিনি যেন গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করছেন। অতঃপর তিনি খাসফ নামক মোটা কাপড় দিয়ে কা’বায় গিলাফ চড়ালেন।

তিনি আবার স্বপ্ন দেখলেন যে, আরো ভালো কাপড় দিয়ে কা’বাকে গিলাফ পরাচ্ছেন। সুতরাং পরে তিনি মূল্যবান ইয়ামানী কাপড়ে কা’বাকে আবৃত করলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই তুব্বা তথা তুব্বানই প্রথম ব্যক্তি যিনি কা’বা শরীফকে গিলাফ পরিয়েছিলেন এবং কা’বার মুতাওয়াল্লী জুরহুম গোত্রের লোকদেরকে গিলাফ পরানোর অসীয়াত করে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম কা’বা ঘরকে পবিত্র করার (মূর্তি থেকে মুক্ত করা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) নির্দেশ দেন, কা’বার ধারেকাছে যেন তারা রক্তপাত না ঘটায়, মৃতদেহ এবং ঋতুবর্তী মহিলাদের ব্যবহৃত ময়লা বস্ত্রখ- ফেলে না রাখে-এসব ব্যাপারে তিনি সবাইকে সাবধান করে দেন। তিনি কা’বা ঘরের জন্য দরজা তৈরী ও তালাচাবির ব্যবস্থা করেন।

এরপর তুব্বা মক্কা থেকে বেরিয়ে তাঁর সৈন্য সামন্ত ও ইহুদী প-িতদ্বয়কে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করেন। ইয়ামানে পৌঁছে তিনে সেখানকার জনগণকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে তাঁর গৃহীত ধর্মমত গ্রহণের দাওয়াত দেন। ইয়ামান বাসী সুস্পষ্টভাবে জানায় তারা তাদের প্রথামত আগুনের কাছে ফায়সালা চাওয়া ছাড়া ধর্ম ত্যাগ করবে না।

ইয়ামনবাসীরা আগুনের মাধ্যমে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করতো। ঐ আগুন অত্যাচারীকে গ্রাস করতো কিন্তু মযলুমের ক্ষতি করতো না। একদিন ইয়ামনবাসী তাদের প্রতিমাসমূহ ও তাদের ধর্ম পালনের অন্যান্য সরঞ্জামাদি সহকারে এবং ইহুদী প-িতদ্বয় তাদের আসমানী কিতাব কাঁধে ঝুলিয়ে যে স্থান দিয়ে আগুন বেরোয় সেখানে গিয়ে বসলো। আগুন বেরিয়ে প্রথমেই ইয়ামানবাসীদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইয়ামান বাসী তা দেখে ভীত হয়ে পড়লো এবং আগুন থেকে দূরে সরে গেল। উপস্থিত লোকেরা তাদেরকে তিরষ্কার করে ধৈর্যের সাথে যথাস্থানে বসে থাকতে বললো। তারা ধৈর্য ধারণ করে বসতেই আাগুন তাদেরকে ঘেরাও করে ফেললো এবং প্রতিমা ও অন্যান্য ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম পুড়িয়ে ভষ্ম করে দিল। হিমইয়ার গোত্রের যে ক’জন পুরোহিত ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম বহন করছিল তারাও ভষ্মীভ’ত হলো। ফলে হিমইয়ার গোত্র তুব্বানের ধর্মে দীক্ষা নিল। তখন থেকে ইয়ামানে ইহুদী ধর্মের পত্তন হলো।

তুব্বানের পর ইয়ামানের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর ছেলে হাস্সান। তিনি সমগ্র ইয়ামনবাসীকে সাথে নিয়ে সমগ্র আরব ও অনারাব জগত দখল করার অভিপ্রায়ে এক বিজয় অভিযান শুরু করেন। এভাবে বাহরাইন ভূখ-ে পৌঁছলে হিমইয়ার ও অন্যান্য ইয়ামানী গোত্রগুলো তাঁর সাথে আর সামনে এগুতে চাইল না। তারা তাদের স্বদেশ ও পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধাস্ত নিল। তারা ঐ বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী হাস্সানের এক ভাই আমরের কাছে এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বললো,“তুমি তোমার ভাই হাস্সানকে হত্যা কর এবং আমাদের সাথে স্বদেশে ফিরে চল। আমরা তোমাকেই রাজা হিসেবে বরণ করে নেব।” আমর তার বহিনীর লোকজনের সাথে আলোচনা করলে সবাই একমত হলো। কেবল যূ-রুআইন আল হিমইয়ারী এর বিরোধিতা করলো ও হত্যাকা- ঘটাতে নিষেধ করলো। কিন্তু আমর তার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করলো। তখন যূ-রুআইন নিম্নলিখিত কবিতা আবৃতি করলো,

“হুঁশিয়ার! কে আছে নিজের নিদ্রার বিনিময়ে নিদ্রাহীনতাকে বরণ করে নেবে।

যে ব্যক্তি তার সুখময় জীবনকে অব্যাহত রাখে

সে-ই প্রকৃত ভাগ্যবান। কিন্তু

হিমাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আর যূ-রুআইনের জন্য খোদার স্বীকৃত ওজর রইল।”

এই কবিতাটুকু সে ইক টুকরো কাগজে লিখে তাতে সীল মারলো। অতঃপর আমরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, “আমার লেখা এই চিরকুট আপনার কাছে রেখে দিন।” আমর সেটা রেখে দিল। অতঃপর সে তার ভাই হাস্সানকে হত্যা করলো এবং দলবল সাথে নিয়ে ইয়ামানে প্রত্যাবর্তন করলো।

আমর ইবনে তুব্বান ফিরে আসার পর ঘোর অনিদ্রায় আক্রান্ত হলো। রোগ যখন মারাত্নক আকার ধারণ করলো তখন সে চিকিৎসক পাখীর সাহায্যে ভাগ্য গণনাকারী জ্যোতিষী ও ভবিষ্যদ্বক্তাদের ডাকলো এবং তার রোগের রহস্য উদ্ঘাটনে তাদের মতামত চাইলো। একজন বললো, “দেখুন, আপনি যেভাবে নিজের ভাইকে হত্যা করেছেন, এভাবে আপন ভাই বা রক্ত সম্পর্কীয় আপনজনকে যখনই কেউ হত্যা করেছে তাকে এ ধরনের নিদ্রাহীনতহায় ভুগতে হয়েছে।”

একথা শোনা মাত্রই আমর তার ভাই হাস্সানকে হত্যার পরামর্শ দানকারী ইয়ামানের সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হত্যা করতে লাগলো। একে একে তাদের সবাইকে হত্যা করার পর যখন যূ-রুআইনের কাছে এলো তখন সে বললো, “আমার নির্দোষিতার প্রমাণ আপনার কাছেই রয়েছে।” আমর বললো, “সেটা কি?” যূ-রুআইন বললো, “আমার লিখিত এক টুকরো কাগজ যা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম।” তখন আমর সেটা বের করে দেখলো তাতে দু’টি পংক্তি লেখা আছে। সে বুঝতে পারলো যে, যূ-রুআইন তাকে সদুপদেশই দিয়েছিল। তাই সে তাকে হত্যা করলো না।

এরপর আমর মারা গেল। তার মৃত্যুর পর হিমইয়ারী শাসনের ক্ষেত্রে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল এবং তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ঘাড়ের উপর শাসক হয়ে চেপে বমলো লাখনিয়া ইয়াসূফ যূ-শানাতির নামক রাজ পরিবার বহির্ভূত এক ভয়ঙ্কর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি। সে তাদের সম্ভ্রান্ত লোকজনদেরকে হত্যা করলো এবং রাজ পরিবারের লোকজনদের সাথে আমোদ প্রমোদে লিপ্ত হলো।

লাখনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপাবার ছিল সমকাম। হাস্সানের ভাই এবং তুব্বানের ছেলে যূর’আ যু-নাওয়অসকে একদিন সে এই অভিপ্রায়ে ডেকে পাঠালো। হাস্সান নিহত হওয়ার সময় যূর’আ ছিল ছোট বালক। কিছু দিনের মধ্যে সে এক সুঠামদেহী ও বুদ্ধিমান তরুণ যুবকে পরিণত হলো। যূর’আর কাছে লাখনিয়ার বার্তাবাহক এলে সে তার কমতলব বুঝতে পারলো। সে একখানা তীক্ষèধার হালকা ছুরি নিজের পায়ের তলায় জুতার ভেতর লুকিয়ে নিয়ে লাখনিয়ার কাছে গেল। লাখনিয়া নিভৃতে ডেকে নিয়ে যূর’আর ওপর চড়াও হলো। সে সুযোগ বুঝে তৎক্ষণাৎ ছুরি দিয়ে তাকে প্রচ-ভাবে আঘাত করলো। যূর’আ লাখনিয়অকে হত্যা করে জনসাধারণের সামনে এসে সগর্বে নিজের কীর্তি প্রচার করতে লাগলো। এবার জনগণ বললো,“তুমি আমদেরকে এই নরাধমের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছ। সুতরাং আমাদের শাসক হিসেবে তুমিই যোগ্যতম ব্যক্তি।”

হিমইয়ার গোত্র ও সমগ্র ইয়ামানবাসীর সহযোগিতায় যূর’আ যূনাওয়াস তাদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী পরাক্রমশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করলো। যূর’আ ছিলেন হিমইয়ার বংশের সর্বশেষ সম্রাট এবং সে (কুরআনের সূরা বুরূজের) পরিখায় পুরে আগুনে পুড়িয়ে মারার গটনার নায়ক।

ইয়ামানের নাজরান প্রদেশে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রকৃত অনুসারীদের অবশিষ্ট একটি গোষ্ঠী তখনও বেঁচে ছিল। তাঁরা ছিলেন জ্ঞানী-গুণী ও সুদৃঢ় মনেবলের অধিকারী। তাঁদের নেতা ছিলেন আবুদল্লাহ ইবনে সামের। যূ-নাওয়াস তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে ইহুদীবাদ গ্রহণের দাওয়াত দিলো এবং পরিষ্কার বলে দিলো, “হয় ইহুদী হও, নচেৎ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।” সুতরাং তাদের জন্য পরিখা খনন করা হলো। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো এবং অনেককে তরবারি দিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ বিকৃত করা হলো। এভাবে যূ-নাওয়াস প্রায়২০ হাজার লোককে হত্যা করলো।

এই যূ-নাওয়াস ও তার সৈন্য-সামন্তের প্রসঙ্গেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল করেন, “পরিখার জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডলীর নায়কদের ওপর অভিসমাপ্ত। স্মরণ কর যখন তারা পরিখার পাশে বসেছিল, মুমিনদের ওপর তারা যে হত্যালীলা অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত ছিল, সে দৃশ্য উপভোগ করছিল। মুমিনদের বিরুদ্ধে তাদের শুধু এই কারণে আক্রোশ ছিল যে, মহাপরাক্রান্ত, চিরনন্দিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি তারা ঈমান এনেছিল।”

কথিত আছে যে, যূ-নাওয়াসের হাতে নিহত এই মুমিনদলের ইমাম ও অধিনায়ক ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সামের।

 

হাবশীদের দখলে ইয়ামান
যূ-নাওয়াসের অগ্নিকুন্ডে নিহত মুমিনদের একজন কোন রকমে আত্নরক্ষা করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সাবা গোত্রোদ্ভূত দাওস যূ-সুলুবান নামক এই ব্যক্তি আগুনের পরিখা থেকে সুকৌশলে উদ্ধার পেয়ে নিজের ঘোড়ায় চড়ে ঊর্ধশ্বাসে মরুভূমির ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকেন। যূ-নাওয়াসের পশ্চাদ্ধাবনকারী লোকজনের চোখে ধূলো দিয়ে। ছুটতে ছুটতে তিনি রোম সম্রাটের দরবারে উপনীত হন। তিনি উহুদীবাদী যূ-নাওয়াস ও তার সৈন্য সমন্তের হাতে নাজরানবাসী মুমিনদের যে লেমহর্ষক গণহত্যা ও নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিররণ দিয়ে যূ-নাওয়াসের শক্তির বিরুদ্ধে রোম সম্রাটের সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। সম্রাট বলেন, “তোমার দেশ আমার এখান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাই আমি আবসিনিয়ার রাজাকে চিঠি লিখবো। তিনিও আমার ধর্মাবলম্বী। আর তাঁর দেশ তোমার দেশের কাছাকাছি।” সম্রাট আবিসিনিয়ার রাজাকে শুধু সাহায্য করার নির্দেশই নয়, সেই সাথে প্রতিশোধ গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিলেন। হাবশার রাজা নাজাশীর কাছে রোমান সম্রাটের ঐ চিঠি নিয়ে হাজির হলেন দাওস। নাজাশী হাবশা থেকে ৭০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী দাওসের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। বাহিনীর সেনাপতি করা হলো আরিয়াত নামক এক ব্যক্তিকে। তার সহযোগী হিসেবে ঐ বাহিনীতে রইলো আবরাহা আল আশরাম নামক অপর এক ব্যক্তি।

আরিয়াত তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে সমুদ্রপথে ইয়ামানের উপকূলে গিয়ে নামলেন। তার সাথে দাওস যূ-সুলুবানও ছিলেন। খবর পেয়ে যূ-নাওয়াস, হিমইয়ার ও তার অনুগামী অন্যান্য ইয়ামানী গোত্র সমভিব্যাহারে আরিয়াতের সৈন্যদের বাধা দিতে এগিয়ে গেলেন। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই হলো। অবশেষে যূ-নাওয়াস ও তার দলবল পাজয় বরণ করলো। এ অবস্থা দেথে যূ-নাওয়াস তার ঘোড়াকে সমুদ্রের দিকে হাঁকালো। ঘোড়া সমুদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো এবং যূ-নাওয়াসের সলিল সমাধি ঘটলো। এখানেই যূ-নাওয়াস ও তার ইহুদীবাদী শাসনের অবসান ঘটলো। আরিয়াত ইয়ামানে প্রবেশ করে সিংহাসনে আরোহণ করলেন।

আরিয়াত ও আবরাহা দন্দ্ব
আরিয়াত দীর্ঘকাল ইয়ামানের শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। এক সময় আবরাহা তাঁর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তাঁর দাবী ছিল, নাজাশীর প্রতনিধি হিসেবে ইয়ামান শাসনের অধিকার তাঁরই বেশী। হাবশী সৈন্যরা এ প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়লো। দুই দলে যুদ্ধ হবার উপক্রম হলে আবরাহা আরিয়াতকে এই মর্মে বার্তা পাঠালেন, “হাবশীরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলে নিজেরাই ধবংস হযে যাবে,পরিণামে কোন লাভ হবে না। সুতরাং এসো আমরা দু’জনে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হই। আমাদের দু’জনের মধ্যে যে জয়যুক্ত হবে, সমস্ত সৈন্যবাহিনী তার আনুগত্য করবে।”আরিয়াত এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে বললো,“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।” আরিয়াত ও আবরাহার মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো আবারাহা অপেক্ষাকৃত ধার্মিক, মোটা ও বেঁটে এবং আরিয়াত লম্বা, সুদর্শন ও বিশালদেহী ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি অস্ত্র। আবরাহা তাঁর পৃষ্ঠদেশকে রক্ষা করার জন্য তাঁর আতুদাহ নামক ক্রীতদাসকে পিছনের দিকে রাখলেন। আরিয়াত তাঁর তরবারি দ্বারা আবরাহার মাথায় আঘাত করলেন,কিন্তু তা তাঁর মুখম-লের ওপর লাগলো। এতে আবরাহার নাক ও কপালের ভ্রু কেটে গেল এবং ঠোঁট ও চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হলো। একারণেই তাকে আবরাহা আল-আশরাম বা নাক কাটা বলা হয়। এইবার আতুদাহ আবরাহার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে আরিয়াতকে আক্রমণ করে হতৃা করলো। এরপর আরিয়াতের অনুগত হাবশীসৈন্যরা আবরাহার দলে ভিড়ে যায় এবং আবরাহা আবিসিনিয়ার সর্বসম্মত প্রতিনিধিরূপে ইয়ামান শাসন করতে থাকেন।

আসহাবুল ফীলের ঘটনা
অতঃপর আবরাহা সানাতে কুল্লাইস নামে এমন একটি গীর্জা তৈরী করে, তৎকালীন বিশ্বে যার সমতুল ও সদৃশ কোন ঘর ছিল না।[৭.এটাই হলো সেই ঐতিহাসিক গীর্জা, যাকে আবরাহা পবিত্র কা’বার বিকল্প হিসেবে তৈরী করেছিলো। আরবরা কা’বার পরিবর্তে ঐ গীর্জাকে হজ্জের কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করুক, ঐ গীর্জার এলাকার হজ্জকে স্থনান্তরিত করুক এটাই ছিল তার অভিলাষ।]

অতঃপর সে নাজাশীকে পত্র লিখলো, “হে রাজা, আমি আপনার জন্য এমন একটি গীর্জা গড়েছি, যার তুলনা ইতহাসে পাওয়া যায় না। আরবদের হজ্জকে আমি এই গীর্জার এলাকায় স্থনাস্তরিত না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবো না।”নাজাশীর কাছে লেখা আবরাহার এই চিঠির কথা অচিরেই আরবদের জানাজানি হয়ে লেল। তারা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলো।বনী কিনানা গোত্রে রক্তপাত নিষিদ্ধ হওয়ার মাসকে হালাল করণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী একটা গোষ্ঠী। [৮.এই গোষ্ঠীকে বলা হতো নাসায়াহ। জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররম এই তিন মাসকে এক নাগাড়ে রক্তপাতহীন মাস হিসেবে পালন করা আরবদের পক্ষে কষ্টকর ছিল। নরহত্যার মাধ্যমে ডাকাতি লুটতরাজ ইদ্যাদি করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ চলতো। এজন্য এক নাগাড়ে তিন মাস নিষিদ্ধ মাস যাপন তদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিল। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হজ্জ সমাপন করে মিনা থেকে ৮এর বাকী অংশ …. বেরিয়ে লোকজনের সামনে নিম্নরূপ ঘোষণা উচ্চারণ করতো, “আমি সেই ব্যক্তি যার কোন কলংক নেই, যার হুমকির কোন জবাব আসে না এবং যার সিদ্ধান্ত কেউ পাল্টাতে পারে না।” সবাই সমস্বরে বলতো, “আলবৎ! আলবৎ!!” অতঃপর পুনরায় সবাই বলতো, “আমাদের একটা নিষিদ্ধ মাস পিছিয়ে দাও। মুহাররম মাসটা হালাল করে দাও এবং তার বদলে সফর মাস নিষিদ্ধ বলে গণ্য কর।” এটাই নাসা বা হারাম মাসকে মনগড়[ভাবে পিছিয়ে নেয়াপর প্রক্রিয়া। এটা একটা জাহেলী রেওয়াজ এবং সম্পূর্ণ অনৈসলামিক রীতি।-অনুবাদক]

তাদের একজন রগচটা লোক গোপনে গিয়ে আবরাহার ঐ গীর্জায় পয়াখানা করে রেখে আবার নিজের বসতিতে ফিরে এলো।

যথাসময়ে ব্যাপারট আবরাহার কানে গেল। সে লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,

“এই কা-টা কে করলো?” লোকেরা জানালো, “জনৈক আরব এ কাজ করেছে। সে মক্কার কা’বাঘরে হজ্জ আদায়কারীদের দলভুক্ত। আপনি মক্কা থেকে এখানে হজ্জ স্থানান্তর করতে ইচ্ছুকÑ একথা শুনে সে রেগে গিয়ে এ কাজ করেছে। এ দ্বারা সে প্রমাণ করতে চায় যে, এই গীর্জা কা’বার বিকল্প হতে পারে না এবং এটা হজের কেন্দ্র হবার যোগ্য নয়।”

আবরাহা তো রেগেই আগুন। সে শপথ করলো যে, যেমন করেই হোক সে কা’বাকে ধ্বংস করবেই। হাবশীদেরকে সে তার অভিপ্রায় জানালো। হাবশীরা সব রকমের উপকরণ ও সরঞ্জাম দিয়ে তাকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করলো। যথাসময়ে সে একদল হস্তীনিয়ে কা’বা অভিযানে বেরিয়ে পড়লো। আরবরা ব্যাপারটা জানতে পেরে ভীষণ প্রমাদ গুনলে এবং ভীত সন্ত্রন্ত হয়ে পড়লো। আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বাকে আবরাহা ধ্বংস করতে চায় শুনে আরবরা উপলব্ধি করলো যে, হানাদরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা তাদের একান্ত কর্তব্য

ইয়ামানের জনৈক সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী নাগরিক ‘যূ-নফর’ সমগ্র ইয়মানবাসী ও অন্যান্য আরবদেরকে আহ্বান জানালেন কা’বা শরীফকে রক্ষা করার জন্য আরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। যারা তার আহ্বানে সাড়া দিল। তদের নিয়ে যূ-নফর আবারাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর বাহিনী পরাজিত হলেন এবং যূ-নফর বন্দী হলেন। এরপর আবরাহা তার ইস্পিত লক্ষ্যে এগিয়ে গেলো। খাস’য়াম উপজাতীয়দের এলাকায় পৌঁছলে নুফাইল ইবনে হাবীব আল্ খাসয়ামী দু’টি খাসয়ামী গোত্র শাহরান ও নাহিস এবং আরো কয়েকটি সমমনা আরব গোত্রকে সাথে নিয়ে আবরাহার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। যুদ্ধে নুফাইলও সদলবলে পরাজিত ও বন্দী হলেন। আবরাহা নুফাইলকে মুক্তি দিলে সুফাইল তার পথ প্রদর্শক হিসেবে সহযাত্রী হলেন। আবরাহা যখন তায়েফের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছিল, তখন সাকীফ গোত্রের কিছু লোকজন সাথে নিয়ে মাসউদ ইবনে মু’আততিব তার সাথে সাক্ষাৎ করলো এবং তাকে বললো, “হে রাজা, আমরা একান্ত অনুগত গোলাম তুল্য। আপনার বিরোধী নই আমরা। আপনি যে ঘর লক্ষ্য করে চলেছেন, ওটা আমাদের উপাসনার ঘর নয়। আপনি তো চাইছেন মক্কার ঘরে হামলা চালাতে। বেশ আমরা আপনার পথপ্রদর্শক হিসেবে একজন লোক সঙ্গে দিচ্ছি। সে আপনাকে দেখিয়ে দেবে কা’বা ঘর।” আবরাহা তাদের প্রতি প্রীত ও সদয় হলো। তায়েফবাসী তার সাথে আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তি কে মক্কার পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্য পাঠালো। আবরাহা ও তার দলবলকে সাথে নেয়ে মুগাম্মাস[৯.তায়েফগামী পথে মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম।]নামক স্থানে উপনীত হলে আবু রিগাল মারা গেল। পরবর্তীকালে আরববাসী আবু রিগালের কবরে পাথর নিক্ষেপ করতো এবং আজও মুগাম্মাসে তার কবরে লোকেরা পাথর নিক্ষেপ করে থাকে।

আবরাহা মুগাম্মাসে যাত্রাবিরতি করার সময় আসওয়াদ বিন মাকসূদ নামক জনৈক হাবশী নাগরিককে ঘোড়ায় চড়িয়ে মক্কা পরিদর্শনে পাঠায়। আসওয়াদ মক্কা পর্যন্ত যায় এবং ফিরে আসার সময় উপত্যকায় চারনভূমিতে বিচরণশীল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্রের লোকদের গবাদি; পশু ধরে নিয়ে আসে। এইসব গবাদি পশুর মধ্যে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের দুশো উটও ছিল। তিনি ঐ সময় কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও বড় নেতা ছিলেন। গবাদি পশু ধরে নিয়ে আসার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ঐ এলাকার কুরাইশ, কিনানা ও হুযাইল গোত্র আবরাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু নিজেদের অক্ষমতা বুঝতে পেরে তারা সে ইচ্ছা পরিহার করে।

আবরাহা হুনাতাহ আল্ হিমইয়ারীকে মক্কায় পাঠাবার সময় বলে দিল, “প্রথমে মক্কার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ও নেতা যিনি, তাঁকে চিনে নিও। অতঃপর তাঁকে বলো, রাজা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসেননি। এসেছেন শুধু কা’বা ঘরকে ধ্বংস করতে। তোমরা যদি আমাদেরকে একাজে বাধা দিতে কোন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত না হও তাহেল তোমাদের রক্তপাতের কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। তিনি যদি আমার সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক না হয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”

হুনাতাহ মক্কায় প্রবেশ করে খোজ নিয়ে জানতে পারলো, মক্কায় সমচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ও নেতা হলেন আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। সে আবদুল মুত্তালিবের কাছে উপস্থিত হলে এবং রাজা তকে যা বলতে বলেছিলো তা বললো। আবদল মুত্তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, আমরা তার সাথে যুদ্ধ করতে চাইনে এবং সে ক্ষমতাও আমাদের নেই। এটা আল্লাহর পবিত্র ঘর। এটা তাঁর নিজস্ব ঘর ও নিজস্ব সম্ভ্রমের ব্যাপার। আর যদি তিনি বাধা না দেন তবে আমাদের কিছু করার থাকবে না।”

তখন হুনাতাহ বললো, “আপনি আমার সাথে রাজার কাছে চলুন। কারণ তিনি আমাকে আদেশ করেছেন আপনাকে সঙ্গে করে তার কছে নিয়ে যেতে।” আবদুল মুত্তালিব তাঁর এক পুত্রকে সাথে নিয়ে আবরাহার নিকট চললেন। আবরাহার সৈন্যদের কাছে পৌঁছেই তিনি যূ-নফর নম্পর্কে খোঁজ নিলেন, যিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন। বন্দী যূ-নফরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি কললেন, “হে যূ-নফর, আমাদের উপর যে বিপদ নেমে এসেছে, তার প্রতিকারে তোমার দ্বারা কি কোন সাহায্য হতে পারে?” যূ-নফর বললো, “এমন একজন রাজবন্দীর কি-ইবা সাহায্য করার ক্ষমতা থাকতে পারে, যে প্রতি মুহূর্তে প্রহর গুনছে, এই বুঝি তাকে হত্যা করা হয়? আমার বাস্তবিকই তোমাদের এই মুসিবতে তেমন কিছু করার নেই। তবে আনীস নামক একজন মাহুত আছে। সে আমার বন্ধু। তাকে আমি বার্তা পাঠাচ্ছি। তোমার উচ্চ মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে তাকে অবহিত করবো ও রাজার কাছে তুমি যাতে নিজের বক্তব্য পেশ করতে পার সেজন্য তাকে অনুমতি চেয়ে দিতে বলবো। এমনকি সম্ভব হলে সে যাতে তোমার ব্যাপারে সুপারিশও করে, সেজন্য তাকে অনুরোধ করবো।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “এটুকুই যথেষ্ট হবে।” এরপর যূনফর আনীসের নিকট এই বলে বার্তা পাঠালো, “শোনো! আবদুল মুত্তালিব হলেন কুরাইশদের একচ্ছত্র অধিপতি। মক্কার বণিক সমাজের নেতা। উপত্যকাভূমিতে মানুষের এবং পাহাড় পর্বতের বন্য পশুর খাদ্য সরবরাহকারী হিসেবে তিনি পরিচিত। যেসব পশু রাজার হস্তগত হয়েছে, তন্মধ্যে দু’শত উট এই আবদুল মুত্তালিবের। সুতরাং তুমি রাজার সাথে সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করে দাও এবং যতটা পার তাঁর উপকার কর।” আনীস বললো, “ঠিক আছে। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।” আনীস আবরাহাকে বললো, “হে রাজা, কুরাইশদের নেতা আপনার দরবারে উপস্থিত। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান। তিনি মক্কায় বণিকদের দলপতি। তিনি উপত্যকা ভূমিতে যেমন মানুষের আহার করান, তেমনি পর্বত শীর্ষের বন্য পশুর খাদ্য সরবরাহকারী বলেও সুখ্যাত। অনুগ্রহপূর্বক তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে তাঁর দাবী-দাওয়া পেশ করতে দিন।” আবরাহা তাঁকে অনুমতি দিলো।

আবদুল মুত্তালিব ছিলেন সেই সময়কার শ্রেষ্ঠতম সুদর্শন এবং অতি গণ্যমান্য ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। আবরাহা তাঁকে দেখেই মুগ্ধ ও অভিভূত হলো। সে আবদুল মুত্তালিবকে এতখানি সম্মানিত মনে করলো যে, নিজে উচ্চ আসনে বসে তাঁক নীচে বসতে দিতে পারলো না। পক্ষান্তরে হাবশীরা তাঁকে রাজার সাথে একই রাজকীয় আসনে উপবিষ্ট দেখুক, তাও পছন্দ করলো না। অগত্যা আবরাহা স্বীয় রাজকীয় আসন থেকে নেমে নীচের বিছানায় বসলো এবং আবদুল মুত্তালিবকে সেখানে নিজের পাশে বসালো অতপর দোভাষীকে বললো, “তাঁকে বক্তব্য পেশ করতে বলো।” দোভাষী আদেশ পালন করলো। আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমার অনুরোধ, আমার যে দুশো উট রাজার হাতে এসেছে, তা ফেরত দেয়া হোক।” দোভাষী যখন একথা আবরাহাকে জানালো তখন আবরাহা দোভাষীর মাধ্যমে বললো,“তোমাকে প্রথম দৃষ্টিতে যখন দেখেছিলাম তখন অবিভূত হয়েছিলাম কিস্তু এখন তোমার কথা শুনে তোমার প্রতি আমার ভীষণ বীতশ্রদ্ধা জন্মে গেছে। এচা খুবই আশ্চর্যজনক যে, তুমি আমার সাথে আমার হস্তগত দুশো উটের দাবী নিয়ে কথা বলছো। অথচ তোমার ও তোমার বাপদাদার ধর্মের কেন্দ্র যে কা’বাগৃহ, আমরা সেটাকে ধ্বংস করতে এসছি এ কথা জেনেও তুমি সে সম্বন্ধে কিছুই বলছো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি শুধু উটেরই মলিক। কা’বা গৃহের মালিক আর একজন আছন, তিনিই তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।” আবরাহা বললো,“আমার আক্রমণ থেকে তিনি এ ঘরকে ঠেকাতে পারবেন না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন,“ সেটা আপনার আর কা’বা ঘরের মলিকের ব্যাপার।”

আবরাহা আবদুল মুত্তালিবের উট ফিরিয়ে দিলো। আবদুল মুত্তালিব কারাইশদের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে সমস্ত ব্যাপারটা জানালেন। তিনি তাদেরকে মক্কা থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড় পর্বতের গোপন গুহাগুলোতে আশ্রয় নিয়ে আবরাহার সৈন্যদের সম্ভাব্য নির্যাতন থেকে আত্নরক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব নিজে কুরাইশদের একদল লোককে সাথে নিয়ে কা’বার দরজার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর কাছে আবরাহা ও তার সৈন্য সামন্তের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তাঁর সাহায্য কামনা করে দোয়া করতে লাগলেন। আবদুল মুত্তালিব কা’বার চৌকাঠ ধরে বলতে লাগলেন,

“হে আল্লাহ, একজন বান্দাও তার দলবলকে রক্ষা করে থাকে। অতএব তুমি তোমার অনুগত লোকদেরকে রক্ষা কর। ওদের ক্রুশ বলবিক্রম যেন তোমার শক্তির উপর জয়যুক্ত না হয়। আমাদের কিবলাকে তুমি যদি ওদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তাহলে যা খুশি কর!”

এপর আবদুল মুত্তালিব কা’বার দরজার চৌকাঠ ছেড়ে দিলেন এবং তিনি ও তাঁর কুরাইশ সঙ্গীরা পর্বত গুহায় আশ্রয় নিলেন। সেখানে বসে তারা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন আবরাহা মক্কায় ঢুকে কি করে।

পরদিন প্রত্যুষে আবরাহা মক্কায় প্রবেশ করার প্রস্তুতি নেতে লাগলো। তার হস্তী বাহিনী ও সৈন্য বাহিনীকে সুসংহত করলো। তার হাতীর নাম ছিল মাহমুদ। আবরাহার সংকল্প ছিল, প্রথমে কা’বাকে ধ্বংস করবে, অতঃপর ইয়ামান ফিরে যাবে। হস্তী বাহিনীকে মমক্কা অভিমুখে পরিচালিত করলে নুফাইল ইবনে হাবীব এগিয়ে এলো এবং আবরাহার হাতীর পাশে দাঁড়ালো। অতঃপর সে হাতীর কান ধরে বললো, “হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো। নচেত যেখান থেকে এসেছো ভালোয় ভালোয় সেখানে ফিরে যাও। জেনে রেখো তুমি আল্লাহর পবিত্র নগরীতে রয়েছো।” অতঃপর কান ছেড়ে দিতেই হাতী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। নুফাইল হাতীকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে কোন রকমে পাহাঢ়ের ওপর চড়ালো। এরপর অনেক মারধোর করেও হাতীকে ওঠানে সম্ভব হলোনা। অতঃপর তার শুঁড়ের ভেতর আঁকাবাঁকা লাঠি ঢুকিয়ে রক্তাক্ত করে দেয়া হলো যাতে হাতী উঠে দাঁড়ায়। তবুও উঠলোনা। অতঃপর তাকে পেছনের দিকে ইয়ামান অভিমুখে ফিরতি যাত্রা করার জন্য চালিত করা মাত্রই ছুটতে আরম্ভ করলো। সিরিয়ার দিকে চালিত করলেও জোর কদমে চলতে লাগলো। অতঃপর যেই মক্কার দিকে চালিত করা হলো অমনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ঠিক এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রের দিক থেকে এক ধরনের কালো পাখী পাঠালেন। প্রতিটি পাখিীর সাথে তিনটি করে পাথরের নুড়ি ছিল। একটা তার ঠোঁটে আর দুটো দুইপায়ে। পাথরগুলো কলাই ও বুটের মত। যার গায়েই সেগুলো পড়তে লাগলো, সে-ই তৎক্ষণাৎ মরতে লগলো। কিন্তু সবার গায়ে পড়তে পারলোনা। অনেকেই পালিয়ে যেখান থেকে এসেছে সেদিকে ফিরে যেতে লাগলো। লোকেরা রাস্তার যেখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলো। আবরাহার গায়ে একটা গুড়ি পড়তেই সে তৎক্ষনাৎ মারা গেল। ইবনে ইসহাক বলেন,

আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে পাঠানোর পর এই ঘটনাকে কুরাইশদের প্রতি তাঁর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেন। কেননা এর মাধ্যমেই তিনি হাবশীদের পরাধীনতার বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেছিলেন। যাতে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহাল থাকে। আল্লাহ সূরা ফীলে বলেন,

[আরবী ***********]

“তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক হাতীওয়ালাদের সাথে কি রকম আচরণ করেছিলেন? তিনি কি তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেননি? তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী পাঠিয়েছিলেন, যারা তাদের প্রতি কঠিন কংকর নিক্ষেপ করছিলো আর এভাবে তাদেরকে চর্বিত ভূষি বা ঘাসের মত বানিয়ে দিয়েছিলেন।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি