নিযার ইবনে মা’আদের বংশধর
নিযার ইবনে মা’আদের ঔরসে তিনটি পুত্র জন্মগ্রহণকরে : মুদার, রাবিয়া ও আনমার।[১০. ইবনে হিশাম চতুর্থ সন্তান হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘ইয়াদ’কে।]

মুদারের দুই পুত্র : ইলিয়াস ও আইলান

ইলিয়াসের তিন পুত্র : মুদরাকা, তাবেখা, কামা’আ

মুদরাকার দুই পুত্র : খুযাইমা, হুযাইল

খুইযামার চার পুত্র : কিনানা, আসাদ, ইসদাহ ও আল হাউন

কিনানার চার পুত্র : নাদার১১, মালেক, আবদমানাহ, মিলকান

নাদারের দুই পুত্র : মালেক ও ইয়খলুদ

মেিলকের এক পুত্র : ফিহির

ফিহিরের চার পুত্র : গালেব, মুহারিব, হারেস, আসাদ

গালেবের দুই পুত্র : লুয়াই, তাইম

লুয়অইয়ের চার পুত্র : কা’ব, আমের উসামা, ই্ফ

কা’বের তিন পুত্র : র্মুরা, আদী, হুছাইছ

র্মুরার তিন পুত্র : কিলাব, তাইম, ইযাকযাহ

কিলাবের দুই পুত্র : কুসই, যুহরাহ

কুসাই-এর চার পুত্র : আবদ মানাফ, আবদুদ-দার, আবদুল উযযা, আবদ কুসাই

আবদ মানাফের চার পুত্র : হাশিম, আবদ শামস, মুত্তালিব, নাওফেল

 

আবদুল মুত্তালিব বিন হশিমের সন্তান সন্তুতি
ইবনে হিশাম বলেন,

“আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ঔরসে দশ পুত্র ও ছয় কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্ররা হলেনঃ আল-’আব্বাস, হামযা, ’আবদুল্লাহ, আবুতালিব, যুবায়ের, হারেস,

১১.ইবনে হিশামের মতে নাদারের অপর নাম কুরাইশ। তার বংশধরই কুরাইশী বলে খ্যাত। তার বংশোদ্ভূত না হলে কাউকে কুরাইশী বলা চলে না। অন্যেরা বলেন ফিহির ইবনে মালিকের নাম কুরাইশ।

হাজলা, মুকাওয়েম, দিরা, আবু লাহাব (প্রকৃত নাম আবদুল উয্যা)। কন্যাগণ হলেনঃ সাফিয়া, উম্মে হাকিম আল বায়দা, আতিকা, উমায়মা, আরওয়া, বাররাহ।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতামাতা
আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহর ঔরসে এবং ওয়াহাবের কন্যা আমিনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন আদমের (আ) শ্রেষ্ঠতম সন্তান মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব। আল্লাহ তাঁর পরিবার পরিজনদের প্রতি অশেষ শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল করুন।

মাতার দিক থেকে তাঁর বংশ পরম্পরা নিম্নরূপ:

আমিনা বিনতে ওয়াহাব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে যুহরাহ ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে নাদার। আমিনার মাতা বারা বিনতে আবদুল উয্যা ইবনে উসমান ইবনে ‘আবদুদ-দার ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে মালেক ইবনে নাদার।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আদমের (আ) সন্তানদের মধ্যে পিতৃ মাতৃ উভয় কূলের দিক থেকে সম্ভ্রান্ততম, শ্রেষ্ঠতম, উচ্চতম ও মহত্তম।

যমযম কূপ খনন ও তদবিষয়ে সৃষ্ঠ মতবিরোধ
একদিন আবদুল মুত্তালিব পবিত্র কা’বার হাতীমের [১২. অর্থাৎ কা’বার ভিত্তির যে অংশ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু কুরাইশরা তার ওপর আর কোন কিছু নির্মাণ করেনি।]মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন এমন সময়ে স্বপ্নে যমযম কূপ খননের আদেশ পেলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবদুল মুত্তালিবের বর্নলা নিম্নরূপঃ আমি হাতীমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। এমতাবস্থায় এক অচেনা আগন্তুক এলেন এবং আমাকে বললেন, পবিত্র কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ পবিত্র কূপ? আগন্তুক এর কোন জবাব না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পরদিন আমি নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে ঘুমালাম, এ রাতেও সেই আগন্তুক এসে বললেনঃ সংরক্ষিত কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ সংরক্ষিত কূপ? আগন্তুক কোন জবাব না দিয়ে অর্দশ্য হয়ে গেলেন। পরদিন আম উক্ত স্থানে ঘুমাতে গেলাম, সেই আগন্তুক আবার এলেন এবং বললেন : যমযম খনন কর। আমি বললাম : যমযম কি? তিনি বললেন : “যে কূপের পানি কখনো কমে না বা শুকায় না, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক হাজীকে খাবার পানি সরবরাহ করতে পারবে, যা অবস্থিত গোবর ও রক্তের মাঝখানে সাদা ডানাবিশিষ্ট কাকের বাসার নিকটে।” [১৩.কথিত আছে যে, আবদুল মুত্তালিব যখন কূপ খনন করতে উদ্যোগী হলেন তখন তাঁকে খননের যে স্থান নির্দেশ করা হয়েছিল, সেখানে পিঁপড়ের ঢিবি ও কাকের গুহা দেখতে পেলেন। কিস্তু গোবর ও রক্ত দেখতে পেলেন না। ফলে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সহসা সেখানে একটি গাভীকে ছুটে আসতে দেখলেন। এক ব্যক্তি গাভীটি জবাই করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু গাভীটি ছুটে পালিয়ে আসে। লোকটি পিছু পিছু ছুটে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। গাভী শেষ পর্যন্ত মসজিদেহারামের চৌহদ্দির ভেতরে এসে ঢুকে পড়লো। চিহ্নিত স্থানটিতে এসে গাভী দাঁড়ালে লোকটি সেখানেই সেটিকে জবাই করলো। ফলে গাভীর রক্ত ও গোবর বেরিয়ে এল। আবদুল মুত্তালিবের কাছে সমগ্র ব্যাপারটা পরিস্কার হযে গেল এবং তিনি সেখানেই খনন কাজ শুরু করে দিলেন।]

আগন্তুক তাঁর কাছে যখন যমযম কূপের বৈশিষ্ঠ স্পষ্ট করে দিল ও স্থান নির্দিষ্ঠ হলো এবং স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইলো না, তখন পরদিন সকালে পুত্র হারেসকে সাথে করে কোদাল নিয়ে সেখানে গেলেন। হারেস ছাড়া তখন তাঁর আর কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করেনি। যমযম কূপ [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব প্রকৃতপক্ষে যমযম কূপ পুনঃখনন করেন। এই কূপের আবির্ভাব ঘটে সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্বে ১৯১০ সালে, হযরত ইসমাঈলের জন্মের বছরে। হিজরী সাল অনুযায়ী রাসূল (সা) এর জন্মের ২৫৭২ বছর আগে এটির আবির্ভাব ঘটে। পরে এক পর্যায়ে যমযম কূপ শুকিয়ে যায় ও মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এর কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট থাকেনি। আবদুল মুত্তালিবের হাওত পুনঃখনন না হওয়া পর্যন্ত এর সন্ধান কেউ পায়নি। (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃঃ২২,২৩ ও ২৪) ] খননের কাজ এগিয়ে চললো।যখন আবদুল মুত্তালিব সেই প্রস্তরটি দেখতে পেলেন যা থেকে কূপ উৎসারিত হয়েছে তখন আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কুরাইশরা ঐ ধ্বনি শুনে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব যা খুঁজছেন তা পেয়ে গেছেন। সবাই তাঁর কাছে এসে বললো, “হে আদুল মুত্তালিব, ওটা তো আমাদের পিতা ইসমাঈলের কূপ। এতে আমাদেরও হক আছে। আপনি আমাদের কে এই কূপের অংশীদার করুন!” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি তা পারবো না। এ জিনিসটা শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে, তোমাদেরকে নয়।” তারা বললো, “আমাদের সাথে ন্যায় সঙ্গতভাবে ফায়সালা করুন। তা না হলে আমরা চূড়ান্ত বুঝাপড়া না করে আপনাকে ছাড়বো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “বেশ, তাহলে তোমাদের ও আমার মধ্যে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য যাকে খুশী সালিশ মানো। আমি তার ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত।” তারা বললো, “বনু সা’দ গোত্রে হুযাইম নামে এক জ্যোতিষিণী আছে। সে-ই আমাদের সালিশ।” আবদুল মুত্তালিব বনু আবদ মানাফ গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে সেখানে রওনা দিলেন। প্রতিটি কুরাইশ গোত্রের একজন করে লোক গেল তাঁর সাথে। সমগ্র যাত্রাপথটা ছিল মরু অঞ্চণের ভেতর দিয়ে। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এক মরুভুমিতে পৌঁছেতেই আবদুল মুত্তালব ও তাঁর দলের লোকদের পানি ফুরিয়ে গেল। পিপাসায় তাদের এমন শোচনীয় দশা হলো যে, বাঁচার আর কোন আশাই রইলো না। সহগামী কুরাইশ গোত্রগুলোর কাছে তাঁরা খাবার পানি চাইলে তারা দিতে রাজী হলোনা। তারা বললো, “আমরাও মরুভূমিতে আছি। আশংকা হয় আমাদের অবস্থাও তোমাদের মত হতে পারে।”

আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নিষ্ঠুর আচরনে মর্মাহত হয়ে এবং নিজেদের সম্ভাব্য শোচনীয় পরিনতির কথা চিন্তা করে সহযাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে তোমরা মনে কর?” সহযাত্রীরা এক বাক্যে বললো, “আমরা শুধু আপনার মতানুসারে কাজ করবো। আপনি যা ভালো মনে করেন নির্দেশ দিন।” তিনি বললেন, “আমি মনে করি, আমাদের গায়ে এখনো যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে প্রত্যেকে নিজের কবর খুঁড়ে রাখি। অতঃপর যখন একজন মারা যাবে, তখন আমরা যারা জীবিত থাকবো তারা তাকে ঐ কবরে নিক্ষেপ করবো এবং মাটি ঢেকে দেবো। সবার শেষে মাত্র একব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে। গোটা কাফিলার লাশ নষ্ট হওয়ার চেয়ে একটিমাত্র লোকের লাশ নষ্ট হোক, তাও ভালো সবাই একবাক্যে আবদুল মুত্তালিবের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলো এবং সবাই নিজ নিজ কবর খুঁড়লো। অতঃপর পিপাসার দরুন অবধারিত মৃত্যুর অপেক্ষঅয় সবাই বসে প্রহর গুনতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আবদুল মুত্তালিব তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “আল্লাহর কসম, একবারেই নিশ্চেষ্ট বসে বসে কোথাও না গিয়ে এবং জীবন বাঁচানোর কোন অবলম্বন না খুঁজে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কবলে নিজেদেরকে এভাবে সঁপে দেয় ভীষণ কাপুরুষতা। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ কোন স্থানে আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। অতএব, চল, যাত্র শুরু করা যাক।” যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সফরের সহযাত্রী অন্যান্য কুরাইশরা (যারা পানি দিতে অস্বীকার করেছিল) এতক্ষণ তাদের সমস্ত তৎপরতা নিরীক্ষণ করছিল। আবদুল মুত্তালিব সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। যেই সওয়ারী চলতে আরম্ভ করেছ, অমনি তার পায়ের খুরের নীচ থেকে সুপেয় পানির একটি ঝর্ণা নির্গত হলো। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন অতঃপর আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা সওয়ারী থেকে নেমে পানি পান করলেন এবং মশকগুলো পূর্ণ করে পানি ভরে নিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে ডেকে বললেন, “এসো, আল্লাহ আমাদের পানি পান করিয়েছেন।তোমরাও পানি পান করে যাও ও মশক ভরে নিয়ে যাও।” তারা এলো এবং পানি পান করে ও মশক ভরে নিয়ে গেল। অতঃপর তারা বললো, “হে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহর কসম, আমাদের ওপর তোমার প্রাধান্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমরা যমযমের ব্যাপারে আর কখনো তোমার সাথে কলহ করবো না। আমরা বুঝতে পেরেছি, যিনি আজ তোমাকে এই মরুভূমিতে পানি পান করিয়েছেন, তিনিই তোমাকে যমযমের পানি পান করিয়েছেন। অতএব তুমি পুনরায় তোমার পানি পান করানোর মহান কাজে দ্বিধাহীনভাবে নিয়োজিত হও।”

আবদুল মুত্তালিব ফিরে চললেন এবং সেই কাফিলার অন্য সবাই ফিরে চললো। জ্যোতিষিণীর নিকট কেউ গেল না এবং আবদুল মুত্তালিবকেও তার কাছে যাওয়া থেকে সবাই অব্যহতি দিল।

আবদুল মুত্তালিব কর্তৃক তাঁর পুত্রকে কুরবানীর মানত
আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খননের সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মানত করেছিলেন যে, যদি তাঁর দশটি সন্তান জন্মে এবং তারা তাঁর জীবদ্দশায় বয়োপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় তাহলে তিনি একটি সন্তানকে আল্লাহর নামে কা’বার পাশে কুরবানী করবেন। সুতরাং তাঁর পুত্রের সংখ্যা যখন দশটি পূর্ণ হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, তারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবে তখন তিনি তাদের সবাইকে ডেকে একত্র করলেন এবং তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানালেন। অত:পর তাদেরকে ঐ মানত পূরণের আহ্বান জানালেন। পুত্ররা সবাই সম্মতি প্রকাশ করলো। জিজ্ঞেস করলো।, “আমাদের কিভাবে কি করতে হবে?” তিনি বললেন, “তোমরা প্রত্যেকে একটা করে তীর নেবে। অতঃপর তাতে নিজের নাম লিখে আমার কাছে আসবে।” সকলে তাই করলো এবং তার কাছে এলো। আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সাথে নিয়ে ‘হুবাল’ নাম মূর্তির নিকট গেলেন। তখন হুবাল থাকতো কা’বার মধ্যবর্তী একটি গহ্বরের কাছে। এই গহ্বরেই জমা হতো কা’বার নামে উৎসর্গীকৃত যাবতীয় জিনিস।

হুবালের কাছে ৭টি তীর থাকতো। প্রত্যেক তীরেই এক একটা কথা উৎকীর্ণ ছিল। একটা তীরে উৎকীর্ণ ছিল “রক্তপণ।” যখন তাদের ভেতরে “রক্তপণ” কার ওপর বর্তায় (অর্থাৎ আমার হত্যাকারী কে) তা নিয়ে মতবিরোধ ঘটতো, তখন ৭টা তীর টানা হতো। যদি “রক্তপন” উৎকীর্ণ তীর বেরিয়ে আসতো তাহলে যার নাম বেরুতো,তাকেই “রক্তপণ” দিতে হতো। একটা তীরে লেখা ছিল “হাঁ”। যখন কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করা হতো, তখন একই নিয়মে তীরগুলো টানা হতো। যদি ঐ “হা” লেখা তীর বেরুতো তাহলে ইস্পিত কাজ করা হতো। আর একটা তীরে লেখা ছিল “না”। যে কোন কাজের ইচ্ছা নিয়ে তীরগুলো টানা হতো। যদি“না” লেখা তীর বেরিযে আসতো, তাহলে আর সে কাজ তারা করতো না। আর একটা তীরে লেখা ছিল “তোমাদের অন্তর্ভুক্ত বা তোমাদের মধ্য থেকে ” আর একটা তীরে লেখা ছিল “সংযুক্ত” আর একটাতে “তোমাদের বহির্ভূত” আর একটাতে “পানি”। কূপ খনন করতে হলে তারা এই তীর গুলোর মধ্য থেকে একটি টানতো যার মধ্যে এই তীরটিও থাকতো যা ফলাফল বেরুতো সেই অনুসারে কাজ করতো।

তৎকালে আরববাসী যখনই কোন বালকের খাত্না করাতে কিংবা কোন কন্যার বিয়ে দিতে ব্ াকোন মৃতকে দাফন করতে চাইতো অথবা কোন শিশুর জন্ম বৈধ কিনা তা নিয়ে সন্দেহে পড়তো, তখন তাকে ‘হুবাল’ নামক দেবমূর্তির নিকট হাজির করতো এবং সেইসাথে একশো দিরহাম ও একটা বলির উটও নিয়ে যেতো। টাকা ও উট তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে দিত। অতঃপর যার ব্যাপারে নিষ্পত্তি কাম্য, তাকে মূর্তির সামনে হাজির করে বলতো, “হে আমাদের দেবতা, সে অমুকের পুত্র অমুক, তার ব্যাপারে আমরা তোমার নিকট থেকে অমুক বিযযে ফায়সালা কামনা করছি। অতএব তার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত কী, তা আমাদের জানিয়ে দাও।” অতঃপর তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে তারা তীর টানতে বলতো। যদি ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে তারা বুঝতো যে, সংশ্লিষ্ট শিশু বৈধ সন্তান, আর যদি ‘তোমাদের বহির্ভূত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ সন্তান তাদের মিত্র বলে গণ্য হতো। আর যদি ‘সংযুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে সে তাদের মধ্যে ঐ অবস্থাতেই থাকতো; তার বংশমর্যাদা বা মৈত্রী অনির্ধারিতই থেকে যেতো। আর যদি তাদের ইস্পিত অন্য কোন কাজের প্রশ্নে ‘হাঁ’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ কাজ অবিলম্বেই সম্পন্ন করতো। কিন্তু ‘না’ লেখা তীর বেরুলে ঐ বছরের জন্য কাজটি স্থগিত রাখতো। পরবর্তী বছর ঐ কাজ সম্পর্কে একই পন্থায় সমাধান চাইতো। এভাবে তীরের ফায়সালাই ছিল তাদের সকল ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা।

আবদুল মুত্তালিব তীর টানায় নিয়োচিত ব্যক্তিকে বললেন, “আমার এই পুত্রদের ব্যাপারে তীর টেনে দেখুন তো।” তিনি তাকে নিজের মানত সম্পর্কেও অবহিত করলো। আবদুল্লাহ ছিলেন ঐ সময় আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠতম পুত্র। [পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারী হামযা ও আব্বাস (রা) আবদুল্লাহ্রও ছোট ছিলেন।] তিনি ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সর্বাধিক প্রিয় সন্তান। তাই তিনি ব্যগ্রভাবে লক্ষ্য করছিলের যে, তীর আবদুল্লাহকে পাশ কাটিয়ে যায় কি না। পাশ কাটিয়ে গেলেই তো আবদুল্লাহ বেঁচে যান। তীর টানা লোকটি যখন তীর টানতে উদ্যত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব হুবাল দেবতার কাছে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলে দেখা গেল, তীর আবদুল্লাহর নামেই বেরিয়েছে। অলে আবদুল মুত্তালিব এক হাতে আবদল্লাহকে ও অন্য হাতে বড় একটা ছোরা নিযে তাকে জবাই করার উদ্দেশ্যে ইসাফ ও নায়েলার (দেব-দেবী) পাশে গেলেন। আসর জমিয়ে বসা কুরাইশ নেতারা তখন উঠে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে আবদুল মুত্তালিব, ব্যাপার কি?” তিনি তখন উঠে গিয়ে বললেন, “আমার এই ছেলেকে জবাই করবো।” তখন কুরাইশগণ ও তার পুত্ররা একযোগে বলে উঠলো, “উপযুক্ত কারণ ছাড়া কিছেুতেই ওকে জবাই করো না। আর যদি তুমি এভাবে ছেলেকে জবাই করো, তবে অনাগত কাল পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। লোকরো নিজ নিজ সন্তানকে এনে বলি দিতে থাকবে এবং মানব বংশ একে একে নিঃশেষ হয়ে যাবে।” আবদুল্লাহর মামাদের গোত্রীয় জনৈক মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে মাখযুম বললেন, “একেবারে অনন্যোপায় হওয়া ছাড়া এমন কাজে প্রবৃত্ত হয়ো না। যদি আমরা মুক্তিপণ দিয়ে অব্যাহতি দিতে পারি তাহলে আমরা মুক্তিপণ দিতে প্রস্তুত।” পক্ষান্তরে, কুরাইশগণ ও আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা কললো, “তাকে জবাই করো না। বরং ওকে নিয়ে হিজাযে চলে যাও। সেখানে এক মহিলা জ্যোতিষী রয়েছে, তার অধীনে জ্বিন আছে। তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও, কাজটা ঠিক হবে কিনা। এরপর আমরা বাধা দেব না। তুমি স্বাধীনভাবে যা খুশী ক’রো। মহিলা যদি জবাই করতে বলে জবাই করো, আর যদি অন্য কোন উপায় বাৎলে দেয় তাহলে সেটাই গ্রহণ করে নিও।” কুরাইশদের উপদেশটাই মেনে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সহযোগীরা হিজায অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। তাঁরা মদীনায় পৌঁছলেন ও খাইবারে সেই মহিলার সাক্ষাৎ পেলেন। আবদুল মুত্তালিব মহিলাকে তাঁর ও তাঁর পুত্রের সকল বৃত্তান্ত খুলে বললেন। মহিলা বললেন, “তোমরা আজ চলে যাও। আমার অনুগত জিন আসুক, তার কাছ থেকে আমি জেনে নিই”। সবাই মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলেন। বিদায় নিয়ে বেরিয়েই আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করনৈ। পরদিন সকালে আবার সবাই মহিলার কাছে সমবেত হলেন। মহিলা বললেন, “আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জেনেছি। তোমাদের সমাজে মুক্তিপণ কি হারে ধার্য আছে?” তারা জানেিলন, “দশটা উট।” মহিলা বললেন, যাও তোমাদের দেশে ফিরে যাও, অতঃপর তোমাদের সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে মূর্তির নিকট হাজির কর ও ১০টা উট উৎসর্গ কর। অতঃপর উট ও তোমাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাগ্য বিধানের জন্য তীর টানো। যদি তোমাদের লোকের নামের বিপক্ষে তীর বেরোয় তাহলে উট আরো দাও, যতক্ষন তোমাদের মনিব খুশী না হন। আর যদি উটের নাতে বেরোয় তাহলে বুঝবে তোমাদের মনিব সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তোমাদের ব্যক্তিটি অব্যহতি পেয়েছে।”

এরপর সবাই মক্কায় চলে গেল। অতঃপর যখন তারা মহিলার কথা অনুযাী মূর্তির নিকট গিয়ে কর্তব্য সমাধায় প্রস্তুত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন। অতঃপর তারা আবদুল্লাহকে ও সেই সাথে দশটা উটকে যথারীতি হাজির করলো। আবদুল মুত্তালিব হুবালের নিকট দাঁড়িযে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলো। তীর আবদুল্লাহর নমেই বেরুলে তারা আরো দশটা বৃদ্ধি করলো। ফলো উটের সংখ্যা দাঁড়ালো বিশ। আবদুল মুত্তালিব আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে ’লাগলেন। পুনরায় তীর টানা হলো এবং এবারও আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। ফলে আরো দশটি উট বৃদ্ধি করে ত্রিশ করা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে চল্লিশ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন আবদুল মুত্তালিব। এবার ও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে পঞ্চাশ করা হলা এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলো এবং তা আবদুল্লাহর নামে বেরুলো অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা ষাট করার পর একই পন্থায় তীর টানা হলে তখনো আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।আবার দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা সত্তর করার পর একই নিয়মে তীর টানা হলে আবারো হলো। এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো। এরপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা আশি করা হলো এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।অতঃপর আবার দশটা উট বাড়িয়ে নব্বই করা হলে আবার আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে একশো করার পর আবদুল মুত্তালিব একই নিয়মে আল্লাহর নিকট দোয়া করে তীর টানতে বললে এবার উটের নামে তীর বেরুলো। সমবেত কুরাইশগণ ও অন্য সবাই বলে উঠলো, “হে আবদলু মুত্তালিব, তোমার প্রভু এবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন।”

অনেকের মতে আবদুল মুত্তালিব এরপর বললেন, “আমি আরো তিনবার তীর না টেনে ক্ষান্ত হব না।” ফলে আবদূল্লাহ ও উটের নামে তীর টানা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে দোয়া করতে লাগলেন। তীর উটের নামে বেরুলো। এভাবে দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বারেও তীর উটের নামে বেরুলো। অবশেণে ঐ একশো উট কুরবানী করা হলো এবং কুরবানীর পর পশুগুলোকে এমনভাবে ফেলে রাখা হলো যেন কোন মানুষকে তার কাছে যেতে বাধা দেয়া বা ফিরিয়ে দেয়া না হয়।

মহানবীর (স্) আমিনার গর্ভে থাকাকালের ঘটনাবলী
প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গর্ভে আসার পর তাঁর কাছে কোন এক অপরিচিত আগন্তুক আসেন এব্ং তাঁকে বলেন, “তুমি যাকে গর্ভে ধারণ করেছ, তিনি এ যুগের মানব জাতির মহানায়ক। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হবেন তখন তুমি বলবেঃ সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এই শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অতঃপর তার নাম রাখবে মুহাম্মাদ। [১৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে মাত্র তিনজনের এনাম রাখা হযেছে। যথা: (১) কবি ফরাজদাকের দাদার দাদা মুহাম্মাদ ইবনে সুফিয়ান বিন মুজাশি। (২) মুহাম্মাদ ইবনে উহাইহা ইবনে আল জাল্লাহ (৩) মুহাম্মাদ ইবনে হিমরান ইবনে রাবিয়াহ। এ তিনজনের প্রত্যেকের পিতা জানতে পারেন যে, আল্লাহর এক রাসূলের আবির্ভাবের সময় ঘরিয়ে এসেছে এবং তিনি হিজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। লোকমুখে একথা শুনে তাদের প্রত্যকে আকাক্সক্ষা জাগে যে, তিনি যেন তারই সন্তান হন। একবার তারা আসমানী কিতাবের জ্ঞান রাখে এমন এক বাদশাহর কাছে গমন করেন। তিনি তাদেরকে যানান যে, মাহাম্মাদ নামে একজন নবঢর আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। এই সময় তাঁরা বাড়ীতে নিজ নিজ স্ত্রীকে গর্ভবতী দেখে এসেছিলেন। ফলে প্রত্যেকেই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। এই সিধান্ত অনুসারেই তাঁরা তাঁদের তিন ছেলের নাম রেখেছিলেন।

তিনি গর্ভে থাকাকালে আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর ভেতর থেকে এমন একটা আলোকরশ্মি বেরুলো যা দিয়ে তিনি সিরীয় ভূখ-ের বুসরার প্রাসাদসমূহ দেখতে পেলেন।

এরপর তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই অল্পদিনের মধ্যে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেন।

রাসূলুল্লাহর (স) জন্ম
‘আমুল ফীল অর্থাৎ হস্তীবাহিনী নিয়ে আবরাহার কা’বা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে, সেই বছরের রবিউল আউয়াল মানের দ্বাদশ রজনী অতিক্রান্ত হবার শুভ মুহূর্তে সোমবারে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন।

কায়েস ইবনে মাখরামা থেকে বণিৃত, তিনি কলেছেন, “আমি ও রাসূলুল্লাহ (সা) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী”

হাসসান ইবনে সাবিত বলেন,

“আমি তখন সাত আট বছরের বালক হলেও বেশ শক্তিশালী ও লম্বা হয়ে উঠেছি। যা শুনতাম তা বুঝতে পারার ক্ষমতা তখন হয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম জনৈক ইহুদী ইয়াসরিবের (মদীনার) একটা দুর্গের ওপর উঠে উচ্চস্বরে ওহে ইহুদী সমাজ!’ বলে চিৎকার করে উঠলো। লোকেরা তার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললো, “তেমার কি হয়েছে?”আজ রাতে আমাদের জন্মে সেই নক্ষত্র উদিত হয়েছে।”

অতঃপর হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর মা আমিনা তাঁর দাদা আবুদল মুত্তালিবের নিকট এই বলে খবর পাঠালেন যে, “আপনার এক পৌত্র জন্মেছে। আসুন, তাঁকে দেখুন।” আবদুল মুত্তালিব এলেন, এসে তাঁকে দেখলেন। এই সময় আমিনা তাঁর গর্ভকালীন সময়ে দেখা স্বপ্নের কথা, নবজাতক সম্পর্কে যা তাঁকে বলা হয়েছে এবং তাঁর যে নাম রাখতে বলা হয়েছে তা সব জানালেন। অতঃপর আবদুল মুত্তলিব তাঁকে নিয়ে কা’বাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শিশুকে মায়ের কাছে দিয়ে ধাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন। অবশেষে বনু সা’দ ইবনে বাক্রের আবু যুয়াইবের কন্যা হালিমাকে ধাত্রী হিসেবে পাওয়া গেল।

 

হালীমার কথা
হালীমা বর্ননা করেছেন যে, তিনি তাঁর স্বামী ও একটি দুগ্ধপোষ্য পুত্রকে সাথে নিয়ে বনু সা’দের একদল মহিলার সাথে দুধ-শিশুর সন্ধানে বের হন। ঐ মহিলারা সকলেই দুধ-শিশুর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। বছরটি ছিল ঘোর অজন্মার। আমরা একেবারেই সকলেই দুধ-শিশুর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। বছরটি ছিল ঘোর অজন্মার। আমরা একোরেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। আমি একটি সাদা গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সাথে ছিল আমাদের বয়স্ক উটটি। সেটি এক ফোটা দুধও দিচ্ছিল না। আমাদের যে শিশু-সন্তানটি সাথে ছিল ক্ষুধার জ্বালায় সে এত কাঁদছিল যে, তার দরুন আমরা সবাই বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছিলাম। তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করার মত দুধ আমার বুকেও ছিল না, উষ্ট্রীর পালানেও ছিল না। বৃষ্টি ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের আশায় আমর উন্মুখ হযে ছিলাম। এ অবস্থায় আমি নিজের গাধাটার পিঠে চড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। পথ ছিল দীর্ঘ এবং এক নাগাড়ে চলতে চলতে আমাদের গোটা কফিলা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লো। অবশেষে আমরা দুধ-শিশুর খোঁজে মক্কায় উপনীত হলাম। আমাদের প্রত্যেককেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু যখনই বলা হয় যে, তিনি পিতৃহীন, তখন প্রত্যেক্ েঅস্বীকার করে বসে। কারণ আমরা প্রত্যেকেই শিশুর পিতার কাছ থেকে উত্তম পারিতোষিক প্রত্রাশা করতাম। কারণ আমরা প্রত্যেকেই শিশুর পিতার কাছ থেকে উত্তম পারিতোষিক প্রত্যাশা করতাম। আমরা প্রত্যেকেই বলাবলি করতাম, “পিতৃতীন শিশু! শিশুর মা আর দাদা কিইবা পারিতোষিক দিতে পারবে?” এ কারণে আমরা সবাই তাঁকে গ্রহণ করতে অপছন্দ করছিলাম। ইতিমধ্যে আমার সাথে আগত সকল মহিলাই একটা না একটা দুধ-শিশু পেয়ে গেল। পেলাম না শুধু আমি। খালি হাতেই ফিরে যাবো বলে যখন মনন্থির করেছি, তখন আমি আমার স্বামীকে বললাম, “খোদার কসম, এতগুলো সহযাত্রীর সাথে শূন্য হাতে ফিরে যেতে আমার মোটেই ভাল লাগছে না। খোদার কসম, ঐ ইয়াতীম শিশুটার আছে আমি যাবোই এবং ওকেই নেব।” আমার স্বামী বকললেন, “নিতে পার। হয়তো আল্লাহ ওর ভেতরই আমাদের জন্য কল্যাণ রেখেছেন। ”

হালীমা বলেন, অতঃপর আমি গেলাম ও ইয়াতীম শিশুকে নিয়ে এলাম। আমি শুধু অন্য শিশু না পাওয়ার কারণেই তাকে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম তাকে নিয়ে কাফিলার কাছে চলে গেলাম। তাকে যখন কোলে নিলাম তখন আমার স্তন দু’টি দুধে অর্তি হয়ে গেল এবং তা থেকে শিশু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেট ভরে দুধ খেলেন। তার দুধভাইও পেট ভরে দুধ খেলো। অতঃপর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লো। অথচ ইতিপূর্বে তার জ্বালায় আমরা ঘুমাতে পারতাম না। আমার স্বামী আমাদের সেই উষ্ট্রীটার কাছে যেতেই দেখতে পেলেন, সেটির পালানও দাধে ভত্যি। অতঃপর তিনি প্রচুর পরিমানে দুধ দোহন করলেন এবং আমরা দু’জনে তৃপ্ত হয়ে দুধ পান করলাম। এরপর বেশ ভালোভাবেই আমাদের রাতটা কাটলো।

সকাল বেলা আমার স্বামী বললেন, “হালীমা, জেনে রেখো, তুমি এক মহাবল্যাণময় শিশু এনেছ।” আমি বললাম, “বাস্তবিকই আমারও তাই মনে হয়।”

এরপর আমরা রওয়ানা দিলাম। আমি গাধার পিঠে সওয়ার হলাম। আমার গাধা গোটা কাফিলাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো। কাফিলার কারো গাধাই তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হলোনা। আমার সহযাত্রী মহিলারা বরতে লাগলো, “হে আবু যুয়াইবের কল্যা, একটু দাঁড়াও আবং আমাদের জন্য অপেক্ষা কর। এটা কি তোমার সেই গাধা নয় যেটার পিঠে চড়ে তুমি এনছিলে?” আমি তাদেরকে বললাম, “হা্রাঁ, সেইটাই তো।” তারা বললো, “আল্লাহর কসম, এখন এর অবস্থাই পাল্টে গেছে।”

শেষ পর্যন্ত আমরা বনি সা’দ গোত্রে আমাদের নিজ নিজ গৃহে এসে হাজির হলাম। আমাদের ঐ এলাকাটার মত খরাপীড়িত এলাকা দুনিয়ার আর কোথাও ছিল বলে আমার জানা ছিল না। শিশু মাহাম্মাদকে নিয়ে বাড়ী পৌঁছার পরে প্রতিদিন আমাদের ছাগল ভেড়াগুলো খেয়ে পরিতৃপ্ত এবং পালান ভর্তি দুধ নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতো। আমরা তা যথামত দোহন করে পান করতে লাগলাম, অথচ অন্যান্য লোকেরা এক কাতরা দুধ দোহাতে পাতো না। তাদের ছাগল-ভেড়ার পালানে এক ফোঁটা দুধও পেতো না। এমনকি আমাদের গোত্রের লোকেরা রাখাদের বলতে লাগলো, “আবু যুরাইবের কন্যার (হালীমা) রাখল যেখানে মেষ চরায় সেখানে নিয়ে চড়াবে।” রাখালরা আমার (হালীমার) মেষ চড়ানো সত্বেও মেষপাল ক্ষুধার্ত আবস্থায় ফিরে আসতো। এভাবে ক্রমেই আমার সংসার প্রাচুর্য ও সুখ-সমৃদ্ধিমে ভরে উঠতে লাগলো। এ অবস্থার ভেতর দিয়েই দু’বছর অতি বাহিত হলো এবং আমি শিশু মুহাম্মাদের (সা) দুধ ছাড়িয়ে দলাম। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে দ্রুত গতিতে তিনি বড় হতে লাগলেন। দু’বছর বয়স হতেই তিনি বেশ চটপটে ও নাদুসনুদুস বালকে পরিনত হলেন। আমরা তাঁকে তাঁর মার কাছে নিয়ে গেলাম। তবে আমরা তাঁকে আমাদের কাছে রাখতেই বেশী আগ্রহী ছিলাম। আরণ তাঁর আসার পর থেকে আমর াবিপুল কল্যাণের অধিকারী হয়েছিলাম। তাঁর মাকে আমি বললাম, “আপনি যদি এই ছেলেকে আমার কাছে আরো হৃষ্টপুষ্ট হওয়া পর্যন্ত থাকতে দিতেন তাহলেই ভালো হতো। আমার আশংকা হয়, মক্কার রেগ-ব্যাধিতে বা মহামারিতে তিনি আক্রান্ত হতে পারেন।” শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁকে আমাদের সাথে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।

আমরা তাঁকে নিয়ে ফিরে এলাম। এর মাত্র কয়েক মাস পরে একদিন তিনি তাঁর দুধভাই-এর সাথে আমাদের বাড়ীর পেছনের মাঠে মেষ শাবক চরাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর ভাই দৌড়ে এলো এবং আমাকে ও তাঁর পিতাকে বললো,“আমার ঐ কুরাইশী ভাইকে সাদা কাপড় পরিহিত দুটো লোক এসে ধরে শুইেেয় দিয়ে পেট চিরে ফেলেছে এবং পেটের সবকিছু বের করে নাড়াচড়া করছে।”

আমি ও তার পিতা-দুজনেই তাঁকে পড়িয়ে ধরলাম এবং বললাম, “বাবা তোমার কী হয়েছে?” তিনি বললেন, “আমার কাছে সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক এসেছিলো। তারা আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার পেট চিরেছে। তারপর কি যেন একটা জিনিস খুঁজেছে, আমি জানি না তা কী?”

এরপর আমরা মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিয়ে নেজেদের বাড়ীতে ফিরলাম। আমার স্বামী বললেন, “হালীমা, আমার আশংকা, এই ছেলের ওপর কোন কিছুর আছর হয়েছে। কাজেই কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই তাঁকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দাও।”

যথার্থই আমরা তাঁকে কাঁর মার কাছে নিয়ে গেলাম। তাঁর মা বললেন, “ধাত্রী বোন, তুমি তো ওকে কাছে রাখতে খুব উদগ্রীব ছিলে। কি হয়েছে যে, একে নিয়ে এলে?” আমি বললাম, “আল্লাহ আমাকে দু’টি ছেলের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। কোন অঘটন ঘটবে বলে আমার আশংকা হয়। এ নিয়ে আমার চিন্তার অবধি নেই। তাই আপনার ছেলেকে ভালোয় ভালোয় আপনার হাতে তুলে দিলাম।” আমিনা বললেন, “তুমি যা বলছো তা প্রকৃত ঘটনা নয়। আসল ব্যাপারটা কি আমাকে সত্য করে বলো।” এভাকে পুরো ঘটনা খুলে না বলা পর্যন্ত তিনি আমাকে ছাড়লেন না। ঘটনা শুনে আমিনা বললেন, “তুমি কি তাহলে মনে করছো ওকে ভূতে ধরেছ্ ে”আমি বললাম, “হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “ওকে যখন গর্ভে ধারণ করেছি তখন স্বপ্নে দেখি, আমার দেহ থেকে একটা জ্যোতি বেরিয়ে এলো এবং তার প্রভায় সিরীয় ভুখ-ের বুসরার প্রসাদগুলে আলোকিত হয়ে গেল। অতঃপর সে গর্ভে বড় হতে লাগলো। আল্লাহর কসম, এত হালকা ও বহজ গর্ভধারণ আমি আর কখনো দেখিনি। যখন ওকে প্রসব করলাম তখন মটিতে হাত রাখা ও আকাশের দিকে মাথা উঁচু করা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলো। তুমি ওকে রেখে নির্দ্বিধায় চলে যেতে পার।”

বক্ষ বিদারনের ঘটনা
ইবনে ইসহাক বলেন,

সাওর ইবনে ইয়াযীদ কতিপয় বিদ্বান ব্যক্তির নিকট থেকে (আমার ধারণা, একমাত্র খালিদ বিন মা’দান আল কালয়ীর নিকট থেকেই) বর্ণনা করেছেন যে, কতিপয় সাহাবী একরার হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামকে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিজের সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন।” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, শোনো। আমি পিতা ইবরাহীমের দোয়ার ফল এবং ভাই ঈসার সুসংবাদের পরিণতি। আমি গর্ভে আসার পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর মধ্য এথকে একটা জ্যোতি বেরুলো যা দ্বারা সিরিয়ার প্রসাদসমূহ আলোকিত হয়ে গেলো। আর বনু স’দ ইবনে বাক্র গোত্রে আমি ধাত্রীয় ােলে লালিত-পালিত হই। এই সময় একদিন আমার এক দুধভাই-এর সাথে আমেিদর (ধাত্রী মাতা হালীমার) বাড়ীর পেছনে মেষ চরাতে যাই। তখন সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক আমার কাছে আসে। তাদের কাছে একটা সোনার তশতরী ভর্তি বরফ ছিল। তারা আমাকে ধরে আমার পেট চিড়লো। অতঃপর আমার হৃদপি- বের করে তাও চিরলো এবং তা থেকে এক ফোটা কালো জমাট রক্ত বের করে তা ফেলে দিল। তারপর ঐ বরফ দিয়ে আমার পেট ও হৃদপি- ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। অতঃপর তাদের একজন অপরজনকে বললো : মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম) তাঁর উম্মাতের দশজনের সাথে ওজন কর। সে আমাকে পরিমাপ করলো এবং আমি দশজনের চাইতে বেশী হলাম অতঃপর সে আবার বললো : তাঁকে তাঁর উম্মাতের একশে জনের সাথে ওজন কর। আমি একশো জনের চাইতেও বেশী হলাম। অতঃপর সে আবার বললো :তাঁকে তাঁর উম্মাতের এক হাজার জনের সাথে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সাথে ওজন করলে আমি এবারও ওজনে তাদের চাইতে বেশী হলাম। অতঃপর সে বললো : রেখে দাও, আল্লাহর কসম, তাঁকে যদি তাঁর সমগ্র উম্মাতের সাথেও ওজন করা হয় তাহলেও তিনিই তাঁদের সবার চাইতে ওজনে বেশী হবেন।”

দাদার অভিভাবকত্বে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম তাঁর মা আমিন বিনতে ওযাহাব ও দাদা আবদুর মুত্তালিব ইবনে হাশিমের জীবদ্দশায়ও আল্লাহর তদারক ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এই সময় আল্লাহ পতি দ্রুত তাঁর শারীরিক প্রবৃদ্ধি দান করেন, যাতে আল্লাহর ইস্পিত অলৌকিকত্ব তাঁর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যখন তাঁর বয়স হয় ছয় বছর, তখন মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘আবওয়া’ নামক স্থানে তাঁর মাতা ইনতিকাল করেন। সেখানে শিশু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামকে সাথে নিয়ে তিনি বনী আদ ইবনে নাজ্জার গোত্রে মুহাম্মাদের (সা) মামাদের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। মক্কা অভিমুখে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ইনতিকাল করেন। মায়ের ইনতিকালের পর হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম দাদা আবদুল মুত্তালিবের একক তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে থাকেন। আবদুল মুত্তালিবের জন্য কা’বা শরীফের ছায়ায় চাদর বিছানো হতো। আবদুল মুত্তালিব সেখানে উপস্থিত না হওযা পর্যন্ত ঐ চাদরের আশে পাশে বসে থাকতো তাঁর পুত্র পৌত্ররা আবদুল মুত্তালিবের সম্মানার্থে কেই তাঁর ওপর বসতো না। কিন্তু দৃঢ়চেতা কিশোর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম এসেই বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়তেন। তাঁর চাচা তাঁকে ধরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব বলতেন, “তোমরা আমার পৌত্রকে বাধা দিও না। আল্লাহর কসম, সে এক অসাধারন ছেলে।” অতঃপর তাঁকে সাথে নিয়ে চাদরের ওপর বসতেন এবং তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে আদার করতেন। তাঁর সব কাজই তাঁর ভাল লাগতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস আট বছর পূর্ণ হলে আবদুল মুত্তালিব মারা যান। আবরাহার হস্তী বাহিনী নিয়ে কা’বা শরীফ আক্রমণ করার আট বছর পর তিনি মারা যান।

চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্বে
আবদুল মুত্তালিবের তিরোধানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। তৎকালে বনু লেহাব গোত্রের এক ব্যক্তি মানুষের দৈহিক লক্ষণসমূহ দেখে ভাগ্য বিচার করতো। সে যখন মক্কায় আসতো, কুরাইশরা তাদের ছেলেদের নিয়ে তার কাছে ভীড় জমাতো। সে ছেলেদের শরীরের ওপরে নজর বুলিয়ে তাদের ভাগ্য বলতো। অন্যদের সাথে আবু তালিবও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে উক্ত গণকের কাছে গেলেন। গণক তাঁর দিকে তাকালো এবং পরক্ষণেই যেন এবটু ভাবতে আরম্ভ করলো। ক্ষণিকের জন্য সে বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের কথা এড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর বললো, “এই বালককে নিয়ে একটু বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।” আবু তালিব বালক মুহাম্মাদের প্রতি গণকের অধিক মনোযোগ লক্ষ্য করে তাঁকে কৌশলে সরিয়ে দিলেন। এতে গণক বললো, “তোমাদের এ কি কা-! বালকটাকে আমার কাছে আবার নিয়ে এসো। আল্লাহর কসম, এ এক অসাধারণ বালক।”

পাদ্রী বাহীরার ঘটনা
কিছুদিন পরের ঘটনা। আবু তালিব এক কাফিলার সাথে সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন বাণিজ্যোপক্ষে। যাত্রার প্রক্কালে বালক মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লাম) তাঁর সাথে যাওয়ার আবদার করলেন। স্নেবিগলিত চাচা তাঁর আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আমি তাঁকে সাথে নিয়ে যাবো, তাঁকে রেখে আমি কক্ষণও কোথাও যাবো না।”

আবু তালিব তাঁকে সাথে নিয়ে সফরে বেরুলেন। কাফিলা বুসরা এলাকায় পৌঁছলে যাত্রবিরতি করলো। সেখানে ছিলেন বাহীরা নামে এক খৃস্টান পাদ্রী। এক গীর্জায় তিনি থাকতেন। ঈসায়ী ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী। দীর্ঘকাল ব্যাপী ঐ গীর্জায় একখানা আসমানী কিতাব রক্ষিত ছিলো। পুরুষানুক্রমে ঐ জ্ঞানের উরাধিকার চলে আসছিলো। বাহীরর কাছ দিয়ে ইতিপূর্বে তারা প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু তিনি কারো সামনে বেরুতেন না বা কারো সাথে কথা বলতেন না। কিন্তু এই বছর যখন কুরাইশদের কাফিলা আবু তালিব ও বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ ঐ স্থানে বাহীরার গীর্জার পাশে যাত্রাবিরতি করলো তখন বাহীরা তাদের জন্য প্রচুর খাদ্যের ব্যবস্থা করলেন।

কথিত আছে বাহীরা তাঁর গীর্জায় বসেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখতে পান। তিনি কাফিলার এগিয়ে আসার সময় দেখেন যে, সমগ্র কাফিলার মধ্যে একমাত্র বালক মৃহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই আকাশ থেকে একখ- মেঘ ছায়া দিয়ে চলেছে। অতঃপর তারা একটা গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলে মেঘ এবং সেই গাছের ডালপালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঝুঁকে ছায়া দিতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে বাহীরা গীর্জা থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং লোক পাঠিয়ে কাফিলার লোকদেরকে বলে পাঠালেন, “হে কুরাইশ বনিকগণ, আমি আপনাদের জন্য খাওয়ার বন্দোবন্ত করেছি। আপনাদের মধ্যে ছোটবড় দাস বা মনিব সবাইকে এসে খাদ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি।” কুরাইশদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বললো, হে বাহীরা, আজকে আপনি নতুন মহিমায় ম-িত হয়েছেন। ইতপূর্বে আমরা বহুবার আপনার নিকট দিয়ে যাতায়াত কেরছি। কিন্তু কখনো আপনি এরূপ আতিথেয়তা দেখাননি। আজকে আপনার এরূপ করার কারণ কি?” বাহীরা বললেন, “সে কথা ঠিকই। আগে আমি কখনো এরূপ করিনি। তবে আজ আপনারা আমার অতিথি। তাই মনের ইচ্ছা আপনাদের যত্ন করি,আপনাদের জন্য খাবার তৈরী করি এবং আপনার সকলেই খাবার গ্রহণ করুন।”

অতঃপর সকলেই খেতে গেলেন। কিন্তু অল্পবয়স্ক হবার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফিলার বহরের সাথে গাছের ছায়ায় বনে রইলেন। খাওয়ার জন্য সমবেত কুরাইশী বণিকদের সবাইকে ভালভাবে পরখ করে বাহীরা সেই পরিচিত হাব-ভাব ও চালচনের কোন লক্ষণ দেখতে পেলে না, যা বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন। তাই তিনি বললেন, হে কুরাইশী অতিথিবৃন্দদ, আপনাদের কেউই যেন আমার খাবার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না থকেন।” তারা বললেন, “হে বাহীরা, যারা এখনে আসার মত তারা সবাই এসেছেন। শুধুমাত্র একটি বালক কাফিলার বহরে রয়েছে। সে কাফিলার মধে কনিষ্ঠতম।” বাহীরা বললেন, “না, তাঁকে বাদ রাখবেন না। তাঁকেও ডাকুন। সেও আপনাদের সাথে খাবার গ্রহণ করুক।” জনৈক কুরাইশী বললো, “লাত-উয্যার শপথ, আবদুল্লাহ ইবনে আবুদল মুত্তালিবের ছেলে আমাদের সাথে থাকবে অথচ আমাদের সাথে খাবার গ্রহণ করবে না। এটা হতে পারে না। এটা আমাদের জন্য নিন্দনীয় ব্যাপার।” একথা বলেই সে উঠে গিয়ে বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে কোলে করে নিয়ে এলো এবং সবার সাথে খাবারের বৈঠকে বসিয়ে দিলো। এই সময় বাহীরা তাঁর সমগ্র অবয়ব গভীরভাবে দেখতে লাগলেন এবং দেহের বিশিষ্ট নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর বিবরণ তিনি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে পেয়েছেন। সমাগত অতিথিদের সকলের খাওয়া শেষ হলে এবং তারা এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলে বাহীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, “হে বৎস, আমি তোমাক লাত ও উয্যার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, আমি যা জিজ্ঞেস করবো তুমি তার জবাব দেবে।” বাহীরা লাত ও উয্যার দোহাই দিলেন এই জন্য যে, তিনি কুরাইশদেরকে পরস্পর কথাবার্তা বলার সময় ঐ দুই মূর্তির শপথ করতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে লাত-উয্যার দোহাই দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আল্লাহর শপথ, আমি ঐ দুই দেবতাকে সর্বাধিক ঘৃণা করি।” বাহীরা বললেন, “আচ্ছা তবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, যা জিজ্ঞেস করবো তার জবাব দেবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, কি কি জানতে চান বলুন।” অতঃপর বাহীরা তাঁকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। তাঁর ঘুমন্ত অবস্থার কথা, তাঁর দেহের গঠন-প্রকৃতি ও অন্যান্য অবস্থার কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সব প্রশ্নের যা জবাব দিলেন, তা বাহীরার জানা তথ্যের সাথে হুবহু মিলে গেল। তারপর তিনি তাঁর পিঠ দেখলেন। পিঠে দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওয়াতের মোহর অংকিত দেখতে পেলেন। মোহর অবিকল সেই জায়গায় দেখতে পেলেন যেখানে বাহীরার পড়া আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুসারে থাকার কথা ছিল।

এসব করার পরে বাহীরা আবু তালিবকে জিজ্ঞেস করলেন, “বালকটি আপনার কে?” তিনি বললেন, “আমার ছেলে।” বাহীরা বললেন, “সে আপনার ছেলে নয়। এই ছেলের পিতা জীবিত থাকতে পারে না।” আবু তালিব বললেন,“বালকটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।” বাহীরা বললেন, “ওর পিতার কি হয়েছিল?” আবু তালিব বললেন, “এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে।” বাহীরা বললেন, “এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে।” বাহরিা বললেন, “ঠিক, এ রকম হওয়ার কথা। আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গৃহে ফিরে যান। খবরদার, ইয়াহুদীদের থেকে ওকে সাবধানে রাখবেন। আল্লাহর কসম, তারা যদি এই বালককে দেখতে পায় এবং আমি তার যে নিদর্শন দেখে চিনেছি তা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা ওর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে। কেননা আপনার এ ভ্রাতৃষ্পুত্র অচিরেই এক মহা মহামানব হিসাবে আবির্ভূত হবেন।”অতঃপর তাঁকে নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে গেলেন।

ফিজারের যুদ্ধ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিশ বছরের তরুন, তখন ফিজার যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। ফিজার যুদ্ধ নামকরনের কারণ এই যে, এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কিনানা ও কাইস ঈলান গোত্রদ্বয়ের উভয়েই তাদের পরস্পরের নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ লংঘন করেছিল। কুরাইশ ও কিনানার যৌথ বাহিনীর নেতা ছিলেন হারব ইবনে উমাইয়া। দিনের প্রথমাংশে যুদ্ধে কাইস কিনানাকে পরাজিত করে। কিন্তু দিনের মধ্যাহ্ন ভাগে কিনানা জয়ী হয়।[১৫.ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিজার যুদ্ধে কয়েকদিন অংশগ্রহণ করেন। তাঁর চাচারা তাঁকে সঙ্গে করে রণাঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ও বর্শাগুলো প্রতিহত করতাম এবয় তা কুড়িয়ে এনে চাচাদের হাতে তুলে দিতাম।” এটা ছিল সর্বশেষ ফিজার যুদ্ধ। এটি ফিজার আল-বারাদ নামে খ্যাত। ইতপূর্বে আরো তিনটি ফিজার যুদ্ধ সংগটিত হয়েছিল। প্রথমটি কিনানা ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে, দ্বিতীয়টি কুরাইশ ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে এবং তৃতীয়টি কিনানা ও হাওয়াযিন গোত্রের মধ্যে।]

খাদীজা রাদিয়ল্লাহ আনহার সাথে বিয়ে
খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ছিলেন তৎকালীন আরবের একজন সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি লোকজনকে নির্দিষ্ট বেতনে ও লভ্যাংশের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে নিয়োগ করতেন। ব্যবসায়ী গোত্র হিসেবে কুরাইশদের নাম-ডাক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও চারিত্রিক মহত্ত্বের কথা জানতে পেরে তিনি তাঁর কাছে লোক পাঠিয়ে তাঁর পণ্যসামগ্যী নিয়ে সিরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বললেন যে, এজন্য তিনি অন্যদেরকে যা গিয়ে থাকেন তার চেয়ে উত্তম সম্মানী তাঁকে দেবেন। মাইসারাহ নামক এক কিশোরকেও তাঁর সাহায্যের জন্য সঙ্গে দিতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং খাদীজার পণ্য সামগ্রী ও দাস মাইসারাহকে সাথে নিয়ে সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন। অনতিবিলম্বে তিনি সিরিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন।

সিরিয়ায় পৌঁছে তিনি জনৈক ধর্মযাজকের গীর্জার নিকটবর্তী এক গাছের নীচে বিশ্রাম করলেন। ধর্মযাজক মাইসারাহকে জিজ্ঞেস করলেন, “গাছটির নীচে যিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি কে?” মাইসারাহ বললেন, “তিনি হারামের অধিবাসী জনৈক কুরাইশ বংশীয় ব্যক্তি।” ধর্মযাজক কললেন, “এই গাছের নীচে নবী ছাড়া আর কেউ কখনো বিশ্রাম নেয়নি!”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আনীত পণ্য বিক্রি করে দিলেন এবং নতুন কিছু জিনিস ক্রয় করলেন। অতঃপর তিনি মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। পথে যেখানেই দুপুর হয় এবং প্রচ- রৌদ্র ওঠে, মাইসারাহ দেখতে পায় যে, দু’জন ফিরিশতা মুহাম্মাদকে ছায়া দিয়ে রৌদ্র থেকে রক্ষা করেছে এবং তিনি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে এগিয়ে চলেছেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি খাদীজাকে তাঁর ক্রয় করা পণ্যদ্রব্য বুঝিয়ে দিলেন। খাদীজা ঐ মাল বিক্রি করে প্রয় দ্বিগুণ মুনাফা লাভ করলেন। মাইসারাহ খাদীজাকের যাজকের বক্তব্য ও নবীকে (সাঃ) দুই ফিরিশতার ছায়াদানের বিষয় অবহিত কললেন। খাদীজা ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বুদ্ধিমতি ও সম্ভ্রান্ত মহিলা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহত্ত্ব ও সততার সাথে পরিচিত হওয়া তার জন্য একটা অতিরিক্ত সৌভাগ্য রূপে বিবেচিত হলো, যা নিছক আল্লাহর ইচ্ছাক্রমেই তিনি লাভ করলেন। মাইসারাহ কাছে উক্ত অলৌকিক ঘটনার কথা শুনে খাদীজা লোক পাঠিয়ে তাঁকে বললেন, “ভাই, আপনাদের গোত্রের মধ্যে আপনার যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, যে আত্নীয়তার বন্ধন এবং সর্বোপরি আপনার বিশ্বস্ততা, চরিত্রমাধুর্য ও সত্যবাদিতার যে সুনাম রয়েছে, তাতে আমি মুগ্ধ এবং অভিভূত।” এই কথা বলে খাদীজা তাঁকে বিয়ে করার প্রন্তাব দেন। কুরাইশদের মধ্যে খাদীজা ছিলেন সর্বাপেক্ষা অভিজাত বংশীয়া, সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত এবং অতিশয় ধনাঢ্য মহিলা। এ কারণে সম্ভব হলে তাঁর গোত্রের সকলেই তাঁকে বিয়ে করার অভিলাষ পোষণ করতো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার এ প্রস্তাব চাচাদেরকে জানালেন। চাচা হামযা খাদীজার পিতা খুয়াইলিদ ইবনে আসাদের (ইবনে আবদুল উযযা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই) সাথে দেখা করে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলেন এবং বিয়ে সম্পন্ন হলো।[১৬. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মোহরানা হিসেবে খাদীজাকে ২০ টি উট দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম স্ত্রী এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি আর কোন বিয়ে করেননি।]

খাদীজার গর্ভে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একমাত্র ইবরাহীম ছাড়া সব সন্তান জন্মে তাঁরা হলেন : কানিম, তাহির তাইয়েব, যয়নব, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা। কাসিমের নামানুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবুল কাসিম নামেও খ্যাত হন। কাসিম ও তাহির জাহেলিাতের যুগেই মারা যান। কিন্তু মেয়েরা সবাই ইসলামের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে পিতার সাথে হিজরাত করেন।[১৭. বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তাহির ও তাইয়েব দুই ব্যক্তি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো এ দুটোই আবদুল্লাহর উপনাম। তাঁকে এই দুই নেিমই ডাকা হতো।]

 

ওয়ারারা বিন নওফেলের ভাষ্য
খাদীজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উযযা ছিলেন পূর্বতন আসমানী কিতাবে ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন একজন খৃস্টান প-িত। পার্থিব জ্ঞানেও তিনি যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। হযরত খাদিজা মাইসারাহর নিকট থেকে খৃস্টান ধর্মযাজকের যে মন্তব্য শুনেছিলেন এবং মাইসারাহ নিজে দুইজন ফেরেশতা কর্তৃক ভাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছায়াদানের যে দৃশ্য অবলোকন করেছিল তা ওয়ারাকাকে জানালেন। ওয়ারাকা বললেন, “খাদীজা, এ ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে থাকে তাহলে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো যে, মুহাম্মাদ এ যুগের নবী। আমি জানতাম, বর্তমান মানক বংশধরদের কাছে একজন নবীর আগমন আসন্ন হয়ে উঠেছে এবং তাঁর প্রতীক্ষা করা হচ্ছে। এটা সেই নবীরই যুগ।” একথা বলে ওয়ারাকা প্রতীক্ষিত নবীর আগমণ অনেক বিলম্বিত হওয়ায় আক্ষেপ করতেন। অধীর অপেক্ষায় অনেক সময় তিনি বলতেন, “আর কত দেরী হবে!” এবাবে তিনি আক্ষেপ করে নীচের কবিতাটি আবৃত্তি করতেন :

[আরবী ************]

“আমি অত্যন্ত নাছোড়বান্দা হয়ে এমন এবটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে স্মরণ রেখে চলেছি, যা দীর্ঘদিন যাবৎ অনেককে ফুঁপিয়ে কাঁদতে উদ্বুদ্ধ করেছে। (সে বিয়য়টির) অনেক বিবরণের পর নতুন করে খাদীজার কাছ থেকেও বিবরণ (পাওয়া গেল), বস্তুতঃ হে খাদীজা, আমার প্রতীক্ষা খুবই দীর্ঘায়িত হয়ে গেছে। আমার প্রত্যাশা, মক্কার উচ্চভূমি ও নিম্নভূমির মধ্য থেকে তোমার বাস্তব রূপ প্রতিভাত হওয়া দেখতে পাই, যে কথা তুমি ঈসায়ী ধর্মযাজকের বলে জানিয়েছ। বন্তুতঃ ধর্মযাজকদের কথা বিকৃত করা আমি পছন্দ করি না।”

[আরবী ************]

“মুহাম্মাদ অচিরেই আমাদের সরদার ও নেতা হবেন এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীকে তিনি পরাজিত করবেন, আর দেশের সর্বত্র আলো ছড়াবেন, যে আলো দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি জগৎকে তিনি উদ্ভাসিত করে তুলবেন। যারা তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে তাদেরকে তিনি পর্যুদস্ত করবেন আর যারা তাঁর সাথে আপোষকামী হবে তারা হবে বিজয়ী। হায় আফসোস! যখন এসব ঘটনা ঘটবে তখন যদি আমি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে তোমাদের সবার আগে আমিই তাঁর দলভুক্ত হতাম।”

পবিত্র কা’বার পুনর্নিমাণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর তখন কুরাইশগণ পবিত্র কা’বার ভবন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল পবিত্র কা’বার ছাদ তৈরি করা। কেননা ছাদ নির্মাণ না করলে দেয়াল ধসে যাওয়ার আশংকা ছিল। ঐ সময় কা’বার দেয়াল সাড়ে তিন হাতের সামান্য বেশী উঁচু ছিল এবং তাও শুধুমাত্র পাথরের ওপর পাথর সজিয়ে নির্মিত ছিল। কোন গাঁথুনি ছিল না। ঘটনাক্রমে ঐ নময় জনৈক রোমান ব্যবসায়ীর এক ব্যবসায়ীর একখানি জাহাজ সমুদ্রের প্রবাহের সাথে ভেসে জিদ্দার উপকৗলে এন আছড়ে পড়ে এবং ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায। এই জাহাজের তক্তাগুলো কুরাইশরা নিয়ে যায় এবং পবিত্র কাবার ছাদ তৈরীর কাজে ব্যবহার করার জন্য তা ছেঁটেকেচে ঠিকঠাক করে। মক্কায় জনৈক মিসরীয় রাজমিন্ত্রীরও আবির্ভাব ঘটে এবই সময়। পবিত্র কা’বার সংস্কার সাধনে তার দ্বারা কিছু কাজ নেয়া যাবে বলে কুরাইশগণ মনে মনে স্থির করে ফেলে। পবিত্র কা’বা সংলগ্ন কূপ থেকে তখন একটা সাপ প্রতিদিন উঠে আসতো এবং কা’বার দেয়ালের ওপরে বসে রোদ পোহাতো। যে কূপ থেকে সাপটা উঠে আসতো তার মধ্যে কা’বার জন্যপ্রতিদিন উৎসর্গীকৃত জিনিসসমূহ নিক্ষেপ করা হতো। সাপের কারণে কুরাইশগণ আতংকিত ছিল। কেননা সাপটা এমন ভয়ংকর ছিল যে, কেউ তার ধারেও ঘেঁষতে পারতো না। কেউ তার কাছে গেলেই ফনা বিস্তার করে সশব্দে চামড়ায় চামড়া ঘষে মোচড় খেতো এবং মুখ ব্যাদান করতো। এভাবে একদিন সাপটি যথন পবিত্র কা’বার দেয়ালের ওপর রোদ পোহাচ্ছিলো তখন আল্লাহ সেখানে একটা পাখী পাঠালেন। পাখী সাপটাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। তখন কুরাইশগণ আশ্বস্ত হয়ে বরলো : আশা করা যায় যে, আল্লাহ আমাদের ইচ্ছায় সম্মতি দিয়েছেন। আজ আমাদের কাছে একজন প্রীতিভাজন মিস্ত্রী রয়েছে, প্রয়োজনীয় কাঠের যোগাড় হয়ে গেছে। আর সাপের হাত থেকেও আল্লাহ নিষ্কৃতি দিয়েছেন।

অতঃপর তারা কা’বার দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে নির্মণের আয়েজন করলো। এই সময় আবু ওয়াহাব ইবনে আমর ইবনে আয়েয ইবনে ইমরান ইবনে মাখযূম উঠে কা’বার একটা পাথর বিচ্ছিন্ন করে হাতে তুলে নিল। কিন্তু পাথরটি তৎক্ষণাৎ তার হাত থেকে সটকে পড়লো এবং যেখানে তা ছিল সেখানে পুনঃস্থাপিত হলো। এ আশ্চর্য ব্যাপার দেখে সে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা এই কা’বার ভবন র্মিাণে শুধু তোমাদের বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ নিয়েজিত কর। এত ব্যভিচার, সুদ কিংবা উৎপীড়ন দ্বারা অর্জিত সম্পদ ব্যয় করো না।”

অতঃপর কুরাইশগণ কা’বার গৃহনির্মণের কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেল। দরজার অংশ নির্মাণের ভার বনু আবদ মানাফ ও যুহরার ভাগে, রুকনে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মধ্যবর্তী অংশ নির্মাণের ভার বনী মাখযূম গোত্রের ভাগে এবং তাদের সাথে আরো কয়টি কুরাইশ গোত্র যুক্ত হলো, কা’বার মেঝে নির্মাণের ভার বরী জুমাহ ও বনী সাহামের ভাগে, আর হাজরে আসওয়াদ সংলগ্ন অংশ বনী আবদুদদার, বরী কুসাই ও বনী আসাদ ইবনে আবদুল উয্যা ও বনী আদী ইবন কা’বের ভাগে পড়লো।

এবার ভাঙ্গার কাজে হাত দেয়ার পালা কিন্তু এ কাজে হাত দিতে প্রত্যেকেই এক অজানা ভয়ে ভতি হয়ে পড়লো। তখন ওয়ালীদ ইবনুল মুগিিরা ঘোষণা করলো, “ আমিই ভাঙ্গার কাজ শুরু করছি। এই বলে সে কোদাল হাতে নিয়ে জীর্ণ ভবনের এক প্রান্তে গাঁড়িয়ে বরলো, “হে আল্লাহ, তোমার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হইনি এবং আমরা যা করছি তা সদুদ্দেশ্যেই করছি।” অতঃপর রুকনে ইয়ামানী ও বুকনে আসওয়াদের কোণ থেকে খানিকটা ভেঙ্গে ফেললো। পরবর্তী রাত সবাই উৎকণ্ঠার সাথে কাটালো। সবাই কললো, “দেখা যাক, ওয়ালীদের ওপর কোন আপদ আসে কিনা। যদি তেমন কিছু হয় তাহলে ভাঙবো না। বরং যেটুকু ভাঙ্গা হয়েছে তা আবার জুড়ে সাবেক অবস্থায় বহাল করবো। অন্যথায় বুঝবো আল্লাহ আমাদের উদ্যোগে সন্তুষ্ট। অবশিষ্ট অংশও ভেঙ্গে ফেলবো।” ওয়ালীদ পরদিন সকালে স্বাভাবিকভাবে আরদ্ধ কাজে ফিরে এলো। এবং কা’বার দেয়াল ভাঙতে আরম্ভ করলো। তার সাথে অন্যান্য লোকেরাও ভাঙতে লাগলো। এ ভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নির্মিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে থামলো। অতঃপর তারা সবাই উটের পিঠের কূজাকৃতির দুর্লভ সবুজ পাথর সংগ্রহ করতে গেল, যার একটা আর একটার সাথে লেগে থাকে।[১৮. কোন কোন বর্ণনায় বরা হয়েছে, পাথরগুলো বর্শার ফলকের ন্যায় সবুজ।]

অতঃপর কুরাইশ গোত্রগুলো কাবা পুনঃনির্মাণের উদ্দেশ্যে পাথর সংগ্রহ করলো। প্রত্যেক গোত্র আলাদা ভাবে সংগ্রহ করলো ও পুনঃনির্মাণের কাজ সমাধা করলো। হাজরে আসওয়াদের স্থান পর্যন্ত দেয়াল নির্মাণ সম্পন্ন হলে এবার তা যথাস্থানে কে স্থাপন করবে তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হরো। হাজরে আসওয়াদ তুলে নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করার সম্মান লাভের বাসনা প্রত্যেকেরই প্রবল হয়ে উঠলো। এ নিয়ে গোত্রগুলো সংঘবদ্ধ হতে লাগলো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

বর্ণিত আছে যে, ঐ সময় সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রবীণতম ব্যক্তি আবু উমাইয়া ইবনুল মুগীরা নিম্নরূপ আহ্বান জানালেন, “হে কুরাইশগণ, এই পবিত্র মসজিদের দরজা দিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম প্রবেশ করবে, তাকেই তোমরা এই বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব দাও।” সবাই এ প্রস্তাবে সম্মত হলেন। অতঃপর দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠলো, “এতো আমাদের আল আমীন (পরম বিশ্বস্ত) মুহাম্মাদ তাঁর ফায়সালা আমরা মাথা পেতে নেব।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাদমান লোকদের কাছাকাছি গিয়ে উপনীত হলে সবাই তাঁকে তাদের বিবাদের বিয়য়টা জানালে তিনি করলেন, “আমাকে একখানা কাপড় দাও।” কাপড় দেয়া হলে তিনি তা বিছিয়ে হাজরে আসওয়াদ উক্ত কাপড়ের মধ্যস্থলে স্থাপন করে বললেন “প্রত্যেক গোত্রকে এই কাপড়ের চারপাশ ধরতে হবে।” সবাই তা ধরলো ও উঁচু করে যথাস্থানে নিয়ে রাখলো। অতঃপর তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদ তুলে যথাস্থানে রাখলেন ও তার উপর গাঁথুনি দিলেন।

আরব গণক, ইহুদী পুরেহিত ও খৃস্টান ধর্মযাজকদের ভবিষ্যদ্বাণী
ইহুদী পুরেহিত, খৃস্টান ধর্মযাজক ও আরব গণকগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছিলেন যে, তাঁর আগমনের সময় ঘনিয়ে আসছে। ইয়াহুদ ও খৃস্টান যাজক সম্প্রদায় এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তাদের স্ব স্ব আসমানী কিতাবে বর্ণিত শেষ নবী ও তাঁর আবির্ভাবের সময়ের লক্ষণসমূহ বিচার করে এবং তাদের নবীগণ তাঁর সম্পর্কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন তার নিরিখে আর আরব গণকের ভবিষ্যদ্বাণীর উৎস ছিল ফিরিশতাদের কথাবার্তা আড়ি পেতে শ্রবণকারী জিনদের কাছ থেকে পাওয়া খবর। তখনও উল্কাবাণ নিক্ষেপ করে শয়তানদেরকে বিতাড়িত করতেঃআড়িপাতা থেকে নিবৃত্ত করা হতো না। এই শয়তানরা গণক নারী-পুরুষদের কাছে আসতো। ফলে তারা মাঝে মাঝে শেষ নবীর আগমন সম্পর্কে কিছু কিছু পূর্বাভাস দিত। সাধারণ আরবরা এ সব পূর্বাভাসে তেমন কর্ণপাত করতো না। কিন্তু হযরতের আবির্ভাব ঘটার পর এবং আভাস দেয়া লক্ষণগুলো বাস্তবে সংঘঠিত হবার পর সকলেই তা জানতে ও উপলব্ধি করতে পালো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের সময় যখন আসন্ন হয়ে উঠলো তখন শয়তানদের আড়িপাতা বন্ধ করা হলো এবং যেসব ঘাঁটিতে বসে তারা আড়িপাততো সেসব ঘাঁটিতে তাদের আনাগোনা উল্কাবাণ নিক্ষেপ করে বন্ধ করা হলো। এতে জিনরা বুঝতে পারলো যে, এ পদক্ষেপ সৃষ্টিজগতে আল্লাহর কোন বিশেষ প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা বলবৎ করার লক্ষ্যেই গৃহীত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহর (সা) দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
ইবনে হিশাম বলেন,

হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র মাহাম্মাদের পুত্র ইবরাহীম থেকে গুফরার আযাদকৃত দাস উমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক ও চারিত্র্রিক বৈশিষ্ট্যের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

আলী ইবনে আবু তালিব যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করতেন তখনই বলতেন, “তিনি অধিক লম্বা ছিলেন না, আবার খুব বেঁটেও ছিলেন না বরং তিনি উচ্চতায় মধ্যম আকৃতির ছিলেন। তাঁর চুল অত্যধিক কুঞ্চিত ছিল না আবার একবারে অকুঞ্চিতও ছিল না। বরং তা কিঞ্চিত কোঁকড়ানো। তিনি খুব বেশী স্থুল বা মোটা দেহের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর মুখম-ল একেবারে গোলাকার ও ক্ষুদ্র ছিলনা। চোখ দুটো ছিল কালো। লম্বা ভ্রƒ-যুগল, গ্রন্থি’র হাড়গুলো ও দুই স্কন্থের মধ্যবর্তী হাড়টি ছিল উঁচু ও সুস্পষ্ট। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল হালকা লোমে আবৃত। হাত ও পায়েরপাতা ছিল পুষ্ট, চলার সময় পা দাবিয়ে দিতেন না, মনে হতো যেন কোন নিম্ন ভূমিতে নামছেন। কোনদিকে ফিরে তাকালে গোটা শরীর নিয়ে ফিরতেন। তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে নবুওয়াতের সীল বা মোহর লক্ষণীয় ছিল। বস্তুতঃ তিনি ছিলেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ দানশীল, শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক ও মিশুক। প্রথম নজরে তাঁকে দেখে সবাই ঘাবড়ে যেতো।” তাঁর প্রশংসাকারী আলী (রা) বলেন, “তাঁর মত মানুষ তাঁর আগেও দেখিনি পরেও দেখিনি।”

ইনজীলে রাসূলুল্লাহর (সা) বিবরণ
ইবনে ইসহাক বলেন,

হযরহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঈসা আলাইহিস্ সালামের যে বিবরণ ও প্রতিশ্রুতি ঈসার সহচর ইউহান্না কর্তৃক সংকলিত ইনজীলে বর্ণিত হয়েছে যা স্বয়ং ঈসা আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত ওহী অনুসারে লিপিবদ্ধ করিয়েছেন, আমার জানা মতে তা এইঃ

“যে ব্যক্তি আমাকে হিংসা ও ঘৃণা করে, সে স্বয়ং আল্লাহকে ঘৃণা করে। যেসব কাজ আর কেউ কখনো করেনি, তা যদি আমি তোমাদের সামনে করে না দেখাতাম, তাহলে তাদের (অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের ) কোন দোষ হতো না। কিস্তু এখন তারা আল্লাহর নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা ভেবেছে যে, এভাবে তারা আমাকে ও আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে। এসব ঘটেছে এজন্য যাতে খোদায়ী গ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়। বস্তুতঃ তারা অন্যায়ভাবে আমাকে ঘৃণা করেছে। ‘মানহামান্না’Ñযাকে আল্লাহ পাঠাবেন- যদি তোমাদের কাছে আসেন, তবে তিনিই আমার পক্ষে স্ক্ষ্য দেবেন। তিনি আল্লাহর নিকট থেকে আগত পবিত্র আত্না। আর তোমরাও অবশ্যই আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কারণ প্রথম থেকেই তোমরা আমার সঙ্গে আছ। আমি তোমাদের কে এ সমস্ত কথা এজন্য বললাম, যাতে তোমরা অভিযোগ না করতে পার। [১৯.বাইবেল যোহন ১৫:২৩-৩৬ দ্রষ্টব্য।] সুরিয়ানী ভাষায় ‘মুনহামান্না’ অর্থ মুহাম্মাদ। আর রোমান ভাষায় এর প্রতিশব্দ হরো ‘বারাকলিটাস।’

 

নবুওয়াত লাভ
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস যখন চল্লিশ বছর হলো, আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণাস্বরূপ এবং গেটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁরা নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদরেকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সেই অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।

আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন, “আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের সমই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।”

আবদুল মালিক ইবনে উবাইদুল্লাহ বর্ণনা বলেনঃ

আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও মার্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুওয়াতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!” ( হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি সালাম)। এ কথা শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশে-পাশে ডানে-বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিছুদিন কেটে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শুন্তে ও দেখতে থাকলেন। অতঃপর রমযান মাসে তিনি যখন হেরা গুহায় [২০. মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের গুহার নাম হেরা।] অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে পরম সম্মান ও মর্যাদার বাণী বহন করে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এলেন।

উবাইদ ইবনে ‘উমাইর থেকে বর্ণিত আছে যে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এক মাস হেরা গুহায় কাটাতেন। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও এই একইভাবে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে নিভৃত তপস্যায় মগ্ন হতো। প্রতি বছর একটা মাস তিনি এভাবে নির্জনে ইবাদাত করে কাটাতেন। উক্ত মাসে তাঁর কাছে যত দরিদ্র লোকই থাকতো তাদেরকে তিনি খাবার দিতেন। এক মাসের এই নির্জনবাস সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার আগে সর্বপ্রথম কা’বা শরীফে প্রবেশ করে সাতবার বা ততোধিক বার তাওয়াফ করতেন এবং একাজ করার পরই কেবল বাড়ীতে ফিরে আসতেন। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক তাঁকে পরম সম্মানে ভূষিত করার মাসটি অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির বছরের রমযান মাস সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি হেরায় অবস্থানের জন্য রওয়ানা হলেন। অবশেষে সেই মহান রাতটি এলো, যে রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রিসালাত দিয়ে গৌরবান্বিত করলেন। এই সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম তাঁর কাছে আসলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এই অবস্থায় জিবরীল একখ- রেশমী কাপড় নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখ-ে কিছু লেখা ছিল। জিবরীল আমাকে বললেন, “পড়ুন”! আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।”

তখন তিনি আমাকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, আমি ভাবলাম, মরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন!” আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।” তিনি পুনরায় আমাকে সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এবারও চাপের প্রচ-তায় আমার মৃত্যুর আশংকা হলো। আবার তিনি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, “পড়ৃন”! আমি বললাম, “কি পড়বো?” তিনি বললেন, “ইকরা বিসমি রাব্বিকা….। অর্থাৎ পড়ুন আপনার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন, আর আপনার প্রভু সদাশয় অতি। তিনিই কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সেইসব জিনিস শিক্ষ দিয়েছেন যা সে জানতো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এই পর্যন্ত পড়িয়েই জিবরীল থামলে এবং তারপর চলে গেলেন। এরপর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হলো যেন আমি আমার মানসপটে কিছু লিখে নিয়েছি এরপর আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম “ হে মুহাম্মাদ, আপনি আল্লাহর রাসুর এবং আমি জিবরীল।” আমি ওপরে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম. জিবরীল একজন মানুষের আকৃতিত আকাশের দূর দিগন্তে ডানা দু’খানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মাদ আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরীল।” আমি স্তব্ধ হযে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এইরূপ নিশ্চলভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পিছনে সরতে বা সামনে এগুতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। এই সময় খাদীজা আমাকে খুঁজতে লোক পাঠালো। মক্কার উঁচু এলাকায় পৌঁছে তারা আবার খাদীজার কাছে ফিরে গেল। অথচ আমি তখনো ঐ একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর জিবরীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে চললাম। খদীজার কাছে উপনীত হয়ে তার কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম। সে বললো, “হে আবুল কাসিম, আপনি কোথায় ছিলেন? আমি আপনার খোঁজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কার উচ্চভূমিতে আপনাকে খুজে ফিরে এসছে।” আমি যা কিছু দেখেছিলাম সবকিছু খাদীজাকে খুলে বললাম। খাদীজা বললো, “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলেছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

অতঃপর খাদীজা কাপড়-চোপড়ে আবৃত হয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদীজার চাচাতো ভাই। তিনি খ্রস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপ-িত ছিলেন। বিশেষতঃ তাওরাত ও ইনজীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা ও শোনা সমস্ত য়টনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে ওয়ারাকা বলে উছলেন, “কুদ্দূসুন কদ্দূসুন! মহা পবিত্র ফেরেশতা! মহা পবিত্র ফেরেশতা!! আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মাদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন। বস্তুতঃ মুহাম্মাদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। [২১.সুহাইলী বলেনঃ ঈসা (আ) সময়ের ব্যবধানের দিক দিয়ে নিকটতর নবী হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারাকা তার পরিবর্তে মূসার নামোল্লেখ করলেন এই যে, ওয়ারাকা তখন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর খৃস্টানদের মতে হযরত ঈসা (আ) নবী নন। বরং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হয়রত ঈসা (আ) আল্লাহ তায়ালার তিনটি সত্তার একটি যা ঈসার সত্তায় একাকার হয়ে গিয়েছে। খৃস্টানদের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।]তাঁকে বলো, তিনি যেন অবিচল থাকেন।”

খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গিলেন এবং ওয়ারাকা যা বলেছেন তা তাঁকে জানালেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেরা গুহায় মাসব্যাপী ইবাদাত শেষ হলে তিনি মক্কায় ফিরে যথারীতি কা’বার তাওয়াফ করতে শুরু করলেন। এই সময় ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, তুমি যা দেখেছো ও শুনেছো- বলতো।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সমস্ত ঘটনা কললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, “নিশ্চিত জেনো, তুমি এ যুগের মানব জাতির নবী। সেই মহাদূতই তোমার কাছে এসেছিলেন যিনি মূসার কাছেও আসতেন। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমাকে দেশান্তরিত করা হবে এবং তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন জীবিত থাকি তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” অতঃপর ওয়ারাকা তাঁর কাছে মাথা এগিয়ে নিয়ে এলেন এবং তাঁর কপালে চুমু খেলেন। তাওয়াফ সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ী ফিরে গেলেন।

কুরআন নাযিলের সূচনা
পবিত্র রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল শুরু হয়। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন,

“রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানব জাতির জন্য পথনির্দেশক রূপে, হিদায়াতের সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ সহকারে, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে।”

মহান আল্লাহ আরো বলেন.

“আমি এই কুরআন লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। লাইলাতুল কদর কী তা কি তুমি জানো? লাইলাতুল কদর সহস্র মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ফিরিশতাগণ ও জিবরীল অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের ইচ্ছায় ওবং প্রভাত হওয়া পর্যন্ত এ রাত শান্তিময় হয়ে থাকে।”(সূরা কদর)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,

“হা-মীম! সুস্পষ্ট গ্রন্থের শপথ! নিশ্চয়ই এই কিতাবকে আমি একটি কল্যাণময় রজনীতে নাযিল করেছি। নিশ্চিতভাবে নিশ্চিভাবেই আমি সাবধান করতে চেয়েছি। এ ছিল এমন এক রাত, যে রাতে আমার হুকুমে সকল বিষয়ের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফায়সালা করা হয়। আর আমি একজন রাসূল পাঠাতে চাচ্ছিলাম।”(সুরা দুখান)

আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,

“তোমরা যদি আল্লাহর ওপর এবং আমার বান্দার ওপর পৃথকীকরণ ও দুই দলের মুখোমুখী হওয়ার দিনে আমি যা নাযিল করেছি তার ওপর ঈমান এন থাক….” এখানে মুখোমুখী হওয়ার দিন অর্থ বদরের ময়দানে মুশরিকদের ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখোমুখী হওয়ার দিন।

খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদের ইসরাম গ্রহণ
খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনলেন। আল্লাহর কাছ থেকে যে প্রত্যাদেশ তিনি পেলেন তা সত্য বলে মেনে নিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের কাজে তাঁকে সমযোগিতা করলেন। বস্তুতঃ তিনিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেন প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও তাঁকে সত্যরূপে গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।

এভাবে আল্লাহ তাঁর নবীর দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করেন। যখনই অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হতো, কেউ তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করতো ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো, তখন তিনি মর্মাহত হতেন। কিন্তু খাদীজার কাছে গেলেই আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর মনোকষ্ট দূর হয়ে যেতো। খাদীজা তাঁকে সান্ত¦না দিতেন, তাঁর মনের দুঃখ-বেদনা হালকা করে দিতেন, তাঁর দাওয়াতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে স্বীকৃতি দিতেন এবং মানুষের আচরণকে যাতে তিনি হালকাভাবে গ্রহণ করেন, সেজন্য অন্রপ্রণিত করতেন। আল্লাহ তাঁর (খাদীজার) ওপর রহমত নাযিল করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এ কারণে আমি খাদীজাকে জান্নাতে এমন একটি গৃহের সুসংবাদ দিতে আদিষ্ট হয়েছি, যে গৃহ অনুপম কারুকার্যখচিত মুক্তার তৈরী এবং যেখানে কোন হৈ চৈ, দুঃখ-কষ্ট ও অসুস্থতা থাকবে না।”

ওহীর বিরতি
এরপর কিছুদিনের জন্য ওহী বন্ধ থাকে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠলো। এরপর জিবরীল (আ) তাঁর কাছে সূরা ‘আদ্ দুহা’ নিয়ে আবির্ভূত হলেন। যে মহান প্রতিপালক তাঁকে নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করেছেন তিনি ঐ সূরাতে শপথ করে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে ত্যাগ করেননি এবং তাঁর প্রতি বৈরীও হননি। মহান আল্লাহ বলেন, “মধ্যাহ্নের শপথ এবং তিমিরাচ্ছন্ন রজনীর শপথ!

তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেননি এবং পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি বৈরিও হননি।” অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, আর তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণ করার পর পুনরায় ভালোবেসেছেন এমনও হয়নি। “বস্তুতঃ তোমার জন্য পূর্বের অবস্থার চেয়ে পরবর্তী অবস্থাই ভালো।” অর্থাৎ আমার নিকট তোমার প্রত্যাবর্তনের পর তোমার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দুনিয়াতে তোমাকে যা দিয়েছি তার চেয়ে উত্তম। অবশ্যই তিনি তোমাকে অচিরেই এতো পরিমাণে প্রদান করবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ায় সাফল্য ও বিজয় এবং আখিরাতে প্রতিদান। “তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? আর তিনিই তোমাকে দিশেহারা দেখে পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং তোমাকে দরিদ্র অবস্থায় পেয়ে সম্পদশালী করেছেন।” এ আয়াত ক’টিতে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সম্মান এবং তাঁর মাতৃ-পিতৃহীন, সহায়-সম্বলহীন ও দিশেহারা অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি যে করুণা-অনুকম্পা দেখিয়েছেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাঁকে যে শোচনীয় দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। “অতএব তুমি ইয়াতীমের প্রতি ক্রোধ প্রদর্শন করো না এবং সাহায্য প্রার্থনাকারীকে ধমক দিও না।” অর্থাৎ আল্লাহর দুর্বল বান্দাদের ওপর ঐদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করো না এবং নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করোনা। “আর তোমার প্রতিপালকের দেয়া নিয়ামতের কথা প্রচার কর।” অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত প্রপ্তির মাধ্যমে যে অতুলনীয় সম্পদ ও অনুপম মর্যাদা তুমি লাভ করেছ, তার কথা মানুষকে জানাও ও তাদেরকে সেদিকে দাওয়াত দাও।

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি সংগোপনে তাঁর নিকটতম লোকদের মধ্য হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে দীন প্রচারে আত্ননিয়োগ করলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করে স্বয়ং তাঁর ওপর ও সমগ্র মানব জাতির ওপর যে মহা অনুগ্রহ করেছেন তার কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন।

প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী
পুরুষদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনেন, তাঁর সাথে নামায আদায় করেন, এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওহী মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন তাঁরই চাচা আবু তালিবের পুত্র আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর।

হযরত আলীর (রা) ওপর আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ যে তাঁর কল্যাণ চেয়েছিলেন এবং সে জন্য তাঁর উপযোগী ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন, সেটা তাঁর ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায়। কুরাইশদের তখন ঘোর দুর্দিন। বহু সন্তানের পিতা হওয়ায় আবু তালিব নিদারুণ আর্থিক সংকটে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেক চাচা ছিলেন আব্বাস। তিনি ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে সচ্ছলতম ব্যক্তি। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আপনার ভাই আবু তালিব অধিক সন্তানের ভারে জর্জরিত। দেখতেই পাচ্ছেন মানুষ কি ভীষণ দুর্দশায় ভুগছে। আসুন, আমরা তাঁর সন্তান ভার লাঘব করি। তাঁর পুত্রদের মধ্য হ’তে একজনের দায়-দয়িত্ব আমি গ্রহণ করি আর অপর একজনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে দু’টি সন্তানের দায়-দায়িত্ব থেকে তাঁকে রেহাই দেয়া যাবে।”

আব্বাস বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই।”

অতঃপর তাঁরা উভয়ে গিয়ে আবু তালিবকে বললেন, “যতদিন দেশবাসী বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত হচ্ছে না ততদিনের জন্য আমর আপনার সন্তানদের ভার লাঘব করতে চাই।” আবু তালীব বললেন, “তোমরা আকীলকে আমার কাছে রেখে যাও। তারপর যাকে খুশী নিয়ে যাও।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আলীকে নিলেন এবং তাঁকে নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর আব্বস নিলেন জাফরকে এবং তাঁকে তিনি স্বীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। এরপর আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। তাই নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে আলী তাঁর ওপর ঈমান আনলেন ও তাঁকে নবী হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে তাঁর অনুসরন করতে লাগলেন।

কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, নামাযের সময় উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দুর্গম গিরি গুহায় চলে যেতেন, আর তাঁর সাথে আলীও যেতেন। কিন্তু এ কাজটি তাঁর পিতা, চাচা ও গোত্রের সকলের অগোচরে সঙ্গোপনে করতে থাকলেন।সেখানে তাঁরা দু’জনে গিয়ে নিভৃতে নামায পড়তেন এবং সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরতেন। এভাবেই তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন আবু তালিন তাঁদের দুজনকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, এটা আবার কোন দীন (ধর্ম) যার অনুসরণ তুমি করছো?” তিনি বললেন, “চাচা, এটা আল্লাহর দীন, তাঁর ফেরেশতাদের দীন, তাঁর নবী-রাসূলদের দীন। আর বিশেষতঃ আমাদের পিতা ইবরাহীমের দীন। আল্লাহ আমাকে রাসূল বনিয়েছেন এবং এই দীনসহ মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। হে চাচা, আমি যত লোককে এই দীনের শিক্ষা দিয়েছি এবং যত লোককে এই জীবন বিধান গ্রহনের আহ্বান জনিয়েছি তাদের সবলের চাইতে আপনি এই দাওয়াত পাওয়ার অধিক হকদার। আর যত লোক আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করেছে এবং আমাকে কাজে সহযোগিতা করেছে তাদের তুলনায় আপনারই বেশী কর্তব্য এ আহ্বানে সাড়া দেয়া ও সহযোগিতা করা।”

আবু তলিব বললেন, “ভাতিজা, আমি আমার পূর্বপুরুযদের ধর্ম ও রীতিনীতি বর্জন করতে পারি না। তবে আল্লাহর কসম, আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার এ তৎপরতার দরুন তোমাকে কোন অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না।”

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন যালিদ ইবনে হারিস্ ইবনে শুরাহবীল ইবনে কা’ব ইবনে আবদুল উযযা। ইতিপূর্বে খাদীজার ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম ইবনে হিযাম ইবনে খুয়াইলিদ সিরিয়া থেকে যায়িদ ইবনে হারিসাসহ বেশ কযেকজন ক্রীতদাষ নিয়ে আসেন। একদিন তার ফুফু খাদীজা তার কাছে এলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খাদীজার বিয়ে হয়ে গেছে। হাকীম বললেনম, “ফুফু, আপনি এই দাসগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একজনকে পছন্দ করুন। যে ছেলেটিকেই আপনি পছন্দ করবেন তাকেই আমি আপনাকে দিয়ে দেব।” তিনি যায়িদকে পছন্দ করে নিয়ে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার কাছে যায়িদকে দেখে তাকে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা কে উপহার হিসেবে তাকে দিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করলেন। এটা ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের ঘটনা।

এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বাক্র ইবনে আবু কুহাফা। তাঁর আসল নাম আতীক। আর আবু কুহাফার প্রকৃত নাম ছিল উসমান। আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও তাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কুরাইশদের ও তাদের ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁর মত বিচক্ষণ জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান লোক। গোত্রের লোকেরা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পা-িত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। এ জন্য গোত্রের মধ্য থেকে যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতো ও তাঁর নিকট অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল, তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাঁর দাওয়াতে একে একে ইসলাম গ্রহণ করলেন উসমান এবনে আফফান, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। এই পাঁচজন এবং আবু বাক্র, আলূ ও যায়িদ-মোট আটজনই ছিলেন প্রথম মুসলিম। তাঁরাই প্রথম নামায কায়েম করেন ও ইসলামকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন।

এরপর আবু উবইদা ইবনুল জাররাহ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, [২২.আরকামের বাড়ী ছিল সাফা পাহাড়ের ওপর। এই বাড়ীতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হযরত উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশে পৌঁছার পূর্বে পর্যন্ত এভাবে গোপনে অবস্থান ও দাওয়াতের কাজ চলতে থাকে। চল্লিশজন পূর্ণ হবার পর তারা জনসমক্ষে আত্ন প্রকাশ করেন।]

উসমান ইবনে মাযউন এবং তাঁর দুই ভাই কুদামা ও আবুদল্লাহ, উবাইদা ইবনে হারেস, সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর ও তাঁর স্ত্রী উমার উবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা, আসমা বিনতে আবু বাক্র ও আয়িশা বিনতে আবু বাকর (আয়িশা তখন অল্পবয়স্কা বালিকা), খাব্বাব ইবনে আরাত, উমাইর ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মাসউদ ইবনে কারী, সালীত ইবনে আমর, আইয়াশ ইবনে আবু রাবীয়া ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সুলামা, খুনাইস ইবনে হুযাফা, আমের ইবনে রাবীয়া, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর ভ্রাতা আবু আহমদ, জাফর ইবনে আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, হাতেব ইবনে হারেস ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে মুজাল্লাল, তাঁর ভ্রাতা হুতাব ও তাঁর স্ত্রী ফুকাইহা বিনতে ইয়াসার, মা’মার ইবনে হারেস, সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউন, মুত্তালিব ইবনে আযহার ও তাঁর স্ত্রী রামলা বিনতে আবু আউফ, নাহহাম তথা নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ, আমের ইবনে ফুহাইরা, খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস ও তাঁর স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, হাতেব ইবনে আমর, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ইবনে রাবীয়া, ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ, বুকাইর ইবনে আবদে ইয়ালীলের পুত্র খালিদ, আমের, আকেল ও ইয়াস, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও সুহাইব ইবনে সিনান রুমী [২৩.সুহাইব জন্মগতভাবে আরব। তিনি শৈশবে রোমকদের হাতে বন্দী হন এবং তাদের মাঝেই দাস হিসেবে বড় হন। পরে কালব গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁকে ক্রয় করে এন মক্কায় বিক্রয় করে। আদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করেছেন। হাদেিস সাহাইব উসলাম গ্রহণকারী প্রথম রুমবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।] ইসলাম গ্রহণ করেন।

প্রকাশ্য দাওয়াত
এরপর লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। অতঃপর মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তাঁর বাণী উচ্চকণ্ঠে প্রচার করার নির্দেশ দেন এবং আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। নবুওয়াত লাভের পর ইসলামের প্রকাশ্য প্রচার শুরু হবার আগে গোপন প্রবার কাজ তিন বছর ধরে চলে। তখন আল্লাহ এই নির্দেশ দেন,“হে নবী,এখন আপনি উচ্চকণ্ঠে প্রচার শুরু করুন এবং মুশরিকদের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবে না।” তিনি আরো বলেন, “হে নবী, আপনি আপনার নিকট-আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন আর আপনার অনুসারী মু’মিনদের প্রতি অনুকম্পাশীল ও সদয় থাকুন। আর বলুন : আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ নামায পড়ার সময় দুর্গম গিরিগুহায় চলে যেতেন এবং লোকজনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়তেন। একদিন সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের এবটি ক্ষুদ্র দল মক্কার কোন এক পর্বত গুহায় নামায পড়ছেন, এমন সময় মক্কার মুশরিকদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা মুমিনদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসক এই সময় একটা মরা উটের চোয়ালের হাড় দিয়ে প্রচ- জোরে আঘাত হেনে মুশরিকদের একজনের মাথা ফাটিয়ে দেন। ইসলামের জন্য এটাই ছিল রক্তপাতের প্রথম ঘটনা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক প্রকাশ্য দাওয়াত দিলেও যতক্ষণ তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করেননি ততক্ষণ তারা তাঁর থেকে দূরে যায়নি কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখরও হননি। কিন্তু যখন তিনি তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করলেন তখনই তারা তাঁর আন্দোলনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক জিনিস বলে মনে করলো। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে ক্ষেপে উঠলো এবং তাঁর বিরুদ্ধতা ও শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। তবে স্বল্পসংখ্যক লোক যারা তখনো আত্মপ্রকাশ করেননি- ইসলামের খাতিরে এই শত্রুতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর চাচা আবু তালিব পুর্ণ সহানুভূতি ও অনুকম্পা দেখাতে থাকেন। তিনি কুরাইশদের আক্রমণের মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে থাকলেন এবং তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজ অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু কুরাইশরা যখন দেখলো, সম্পর্কচ্ছেদ ও দেব-দেবীর সমলোচনার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রবল আপত্তিকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিন্দুমাত্র পরোয়া করছেন না, অধিকন্তু তাঁর চাচা তাঁকে আশ্রয় দিয়ে চলছেন, কোন মতেই তাঁকে কুরাইশদের হাতে সমর্পণ করছে না; তখন একদিন কুরাইশদের গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সদলবলে আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললো, “হে আবু তালিব আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমতাবস্থায় হয় আপনি তকে এসব থেকে বিরত রাখুন নতুবা তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দিন।” আবু তালিব তাদেরকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদায় করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকলেন ও তাঁর প্রচার-প্রসারের কাজ অব্যাহত রাখলেন। ফলে কুরাইশদের বিদ্বেষ ও আক্রোশ দিন দিন বেড়ে যেতে লাগলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠলো এবং পরস্পরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিতে আরম্ভ করলো।

তাই পুনরায় তারা আবু তালিবের কাছে উপস্থি হয়ে বললো, হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও মুরুব্বী। আমারা আপনাকে গণ্যমান্য ও শ্রদ্ধেয় মনে করি।

আমরা বলেছিলাম, আপনার ভাতিজাকে নিষেধ করুন কিন্তু আপনি তা করলেন না। আল্লাহর কসম, এভাবে আর চলতে দিতে পারি না। সে আমাদের সমলোচনা দেব-দেবীর নিন্দা ও আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাওরানোর যে ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে তা আমরা আর সহ্য করতে পারি না। এখন হয় আপনি তাকে নিবৃত করবেন নচেৎ আমরা আপনাকে সহ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো এবং একপক্ষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আর থামবো না।”

আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ভাতিজা তোমার সম্প্রদায়ের লোকজন আমার কাছে এসে এইসব কথা বলেছে।” এই বলে তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ যা বলেছিলো তা তাঁকে বললেন। তারপর বললেন, “অবস্থা যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তখন তুমি নিজেকে ও আমাকে সামলে চলো। আমার ওপর আমার সাধ্যের বেশী কোন কিছু চাপিয়ে দিও না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, চাচা মত পাল্টে ফেলেছেন, কুরাইশদের মুকাবিলায় তাঁকে একাকী ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন এবং তাঁর সহায়তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “চাচা, আল্লাহর কসম করে বলছি, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এন দেয় এবং তার বিনেময়ে আমাকে এই কাজ ত্যাগ করতে বলে, তবুও আমি এটা ত্যাগ করবো না। আমি ততদিন পর্যন্ত এ কাজ করতে থাকবো, যতদিন না আল্লাহ তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন কিংবা এই কাজ করতে করতে আমি ধ্বংস হয়ে যাই।” এই কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো অতঃপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চলে যেতে উদ্যত হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে আবু তালিব তাঁকে ডেকে বললেন, “হে ভাতিজা, কাছে এসো।” তিনি কাছে গেলেন। আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, ঠিক আছে। তুমি যা বলতে চাও বলতে থাক। আমি কখনো কোন কারণে তোমাকে ওদের কাছে সর্পণ করবো না।”

কুরাইশরা যখন জানতে পারলো যে, আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননাকর অবস্থার মুখে একা ছেড়ে দিতে রাজি নন এবং তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ও শত্রুতা সত্ত্বেও তাঁকে তাহাদের হাতে তুলে না দিতেও অবিচল, তখন তারা উমারাহ ইবনে ওয়ালদি ইবনে মুগীরা নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে নিয়ে গেয়ে বললো, “হে আবু তালিব, এই যুবককে দেখুন, এর নাম উমারাহ ইবনে ওয়ালীদ কুরাইশ গোত্রে এর মত সাহসী, শক্তিমান ও সুদর্শন যুবক আর নেই। একে আপনি পুত্র হিসেকে গ্রহণ করুন। এর বুদ্ধিমত্তা ও সাহায্য-সহোযোগিতা দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পারবেন। আর আপনার ঐ ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনার পূর্বপুরুষের ধর্মের বিরোধিতা করছে, আপনার সম্প্রায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামি ঠাওরাচ্ছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, আমরা তাকে হত্যা করি। একজন মানুষের বিনিময়ে একজন মানুষ আপনি পেয়ে যাচ্ছেন।”

আবু তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার আমার ওপর চপিয়ে দিচ্ছ। আমি কি এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যে, তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে দেবে, আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করবো আর আমার সন্তান তোমাদের হেিত তুলে দেবো, তোমরা তাকে হত্যা করবে? খোদার কসম, জেনে রেখো, এটা কখনো হবে না।”

মুতয়িম ইবনে আদী বললো, “হে আবু তালিব, আপনার সম্প্রদায় আপনার কাছে ন্যয়সঙ্গত প্রস্তাবই দিয়েছে। আপনি নিজেও যা পছন্দ করেন না তা থেকে তারা আপনাকে অব্যাহতি দিতে চাচ্ছে। অথচ মনে হচ্ছে, আপনি তাদের কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন।” আবু তালিব মুতয়িমকে বললেন, “আল্লাহর কসম, তারা আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আসলে তুমি আমাকে অপমানিত করতে বদ্ধপরিকর। এজন্য গোটা সম্প্রদায়কে আমার বিরুদ্ধে লিলিয়ে দিতে চাচ্ছ। এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পার।”

এবার ব্যাপারটা সবার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিল। কুরাইশরা পরস্পরকে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে দিল এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠোর চাপ দিতে লাগলো একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতন থেকে নিরাপদ রইলেন। চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করলেন।

আবু তালিব যখন দেখলেন কুরাইশরা চরম হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে, তখন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করা ও তাঁর প্রতি যে কোন অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন। এই দুই গোত্রের সকলেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলো ও তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। একমাত্র আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত আবু লাহাব সমর্থন দিল না।

কুরআন সম্পর্কে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার মন্তুব্য
প্রবীণ কুরাইশ নেতা ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার কাছে কুরাইশদের একটি দল সমবেত হলো। তখন হজ্জের মওসুম সমাগত। ওয়ালীদ বললো, “হে কুরাইশগণ, হজ্জের মওসুম সমাগত। আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তোমাদের এখানে লোক আসবে। আর মুহাম্মাদের কথা তারা ইতিমধ্যেই শুনেছে। সুতরাং তোমরা তার সম্পর্কে একটি সর্বসম্মত মত স্থির কর। এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে যেন কোন রকম মতানৈক্য না থাকে। একজন একটা বলবে, আরেকজন তার কথা খ-ন করবে এমন যেন না হয়। তাহনে একজনের কথা আরেকজনের কথা দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।”

সবাই বললো, “তাহলে আপনিই একটা মত ঠিক করে দিন। আমরা সবাই সেই মতেরই প্রতিধ্বনি করবো।”ওয়ালীদ বললো, “বলো তোমারাই বলো, আমি শুনি।” সমবেত সবাই বললো, “আমরা বলবো, মাহাম্মাদ একজন গণক।” ওয়ালীদ বললো, “না, সে গণক নয়। আমরা অনেক গণককে দেখেছি। মাহাম্মাদের কথাবার্তা গণকের ছন্দবদ্ধ অস্পষ্ট কথার মত নয়।”

সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, মুহাম্মাদ পাগল।”

ওয়ালীদ বললো, “না, সে পাগলও নয়। আমরা অনেক পাগল দেখেছি, আর পাগলামী কাকে বলে তাও জানি। পাগলের কথাবার্তায় জড়তা ও অস্পষ্টতা থাকে, প্রবল ভাবাবেগের মূর্ছনা এবং সন্দেহ-সংশয়ে তা ভারাক্রান্ত থাকে। কিন্তু মুহাম্মাদের কথায় তা নেই।”

সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে একজন কবি।”

ওয়ালীদ বললো, “না সে কবিও নয়। আমরা সব ধরনের কবিতা সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু মুহাম্মাদের কথা কোন ধরনের কবিতার আওতায় পড়ে না।”

সবাই এবার বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে যাদুকর।” ওয়ালীদ বললো, “সে যাদুকরও নয়। আমরা যাদুকর ও যাদু অনেক দেখেছি। কিন্তু তাদের মত গিরা দেয়া ও গিরায় ফুঁক দেয়ার অভ্যাস মুহাম্মাদের নেই।” সবাই বললো, “তাহলে আপনি কি বলতে চান?”

ওয়ালীদ বললো, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মাহাম্মাদের কথা শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। তার গোড়া অত্যন্ত শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা ফলপ্রসূ। তোমরা যে কথাই বলবে তা মথ্যিা বলে প্রতিপন্ন হবে। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত কথা হবে তাকে যাদুকর বলা। কেনা সে এমনভাবে কথা বলে যা ভাইয়ে ভাইয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে ও আত্মীয়-স্বজনের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে যাদুর মতই কার্যকর। তাই তাকে যথার্থ যাদুই বলা চলে এর প্রভাবে জাতি বাস্তুবিকই বিভেদের শিকার হয়েছে।

এরপর হজ্জের মওসুমে লোকজনের আগমন শুরু হলে কুরাইশরা লোকজনের যাতায়াতের পথে জটলা করে বসে থাকতে লাগলো। আর যখনই কেউ তাদের পাশ দিয়ে যেতো তখনই তাকে বলতো মুহাম্মাদের সংস্পর্শ থেকে যেন সে সাবধান থাকে। আর তাকে তারা মুহাম্মাদের তৎপড়তা সম্পর্কেও অবহিত করতো। এই উপলক্ষে আল্লাহ ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা সম্পর্কে নাযিল করলেন,

“যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি তার সাথে বুঝাপড়ার দায়িত্ব আমার জন্য রেখে দাও। তাকে সৃষ্টি করার পর আমি অনেক সম্পদ দিয়ে সর্বক্ষণ পাশে থাকার মত অনেক পুত্র সন্তান দিয়েছি এবং তার নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছি। এরপরও যাতে তাকে আরো অধিক দান করি সেজন্য সে লালায়িত। তা কক্ষণো হবে না। সে আমার আয়াতসমূহের প্রতি অত্যন্ত বৈরীভাবাপন্ন।”

এরপর যার সাথেই দেখা হয়, তার কাছেই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঐসব কথা বলতে লাগলো। হজ্জের মওসুম শেষে আরবরা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো তখন তাদের মুখে কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গই আলোচিত হতে লাগলো। এভাবে আরবের প্রতিটি জনপদে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়লো।

রাসূলুল্লাহর (সা) ওপর উৎপীড়নের বিবরণ
ক্রমেই কুরাইশরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সহচরদের শত্রুতায় তারা বেসামাল হয়ে উঠলো। তারা মূর্খ ও বখাটে ধরনের লোকদের উস্কিয়ে দিতে লাগলো। এইসব অর্বাচীন তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে গালাগালি এবং নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। তাঁকে কনি, যাদুকর, জ্যোতিষী ও পাগল বলে অপবাদ দিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রসার করার কাজে অবিচল থাকরেন। ক্রমেই তিনি অধিকতর প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দিতে লাগলেন। আরবদের বাতিল রসম রেওয়াজের সমালোচনা, তাদের মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান ও তাদের কুফরী মতবাদের সাথে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদের কথা তাদের কাছে ঘোর আপত্তিকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বলেন-

“একদিন যখন কুরাইশ সরদারগণ হাজরে আসওয়াদের নিকট সমবেত হয়েছে, তখন আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললো, “এই লোকটার ব্যাপারে আমরা যতটা সহিষ্ণুতা দেখিয়েছি তা নজিরবিহীন। সে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে এবং আমাদের দেবদেবীকে গালাগালি করেছে। অত্যন্ত নাজুক ও মারাত্মক ব্যাপারে আমরা তাকে সহ্য করেছি।” এভাবে তাদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকাকালে সহসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখম-লে আমি সে মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। দ্বিতীয়বার যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন তখন তারা আবার শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আমি তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। তৃতীয় বারে তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আবার তারা অনুরূপ মন্তব্য করলে তিনি সেখানে থেমে বললেন, “হে কুরাইশগণ, শোন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার শপথ করে বলছি, আমি তোমাদের সর্বনাশ বয়ে এনেছি (যদি তোমরা ঈমান না আন)।”

তাঁর উক্তিতে জনতা বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে গেল। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্ষণকাল আগেও তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী আক্রোশ ও উস্কানিমূলক কথা বলেছে, সেও যথাসম্ভব মিষ্ট কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শান্ত করতে উদ্যত হলো। এমনকি সি বলতে বাধ্য হলো, “আবুল কাসিম, তুমি যাও। তুমি তো আর নির্বোধ নও।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে গেলেন। পরদিন সবাই একই স্থানে সমবেত হলো। আমিও সেখানে ছিলাম। তখন তারা বলাবলি করতে রাগলো, “দেখলে তো! মহাম্মাদের কতদূর বাড় বেড়েছে এবং সে কতদূর ধৃষ্টতা দেখালো। তোমরা যে কথা একবারেই পছন্দ কর না তা সে তোমাদের মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিল। আর তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। আর যায় কোথায়! সকলে একযোগে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সবাই তাঁকে ঘেরাও করে বলতে থাকলো, “তুমিই তো আমাদের ধর্ম ও দেব-দেবীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলে থাকো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ আমিই ঐসব কথ বলে থাকি।” আমি দেখলাম তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে তাঁর গলার ওপরের চদরের দু’পাশ ধরে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা কতে উদ্যত হয়েছে। সেই মুহূর্তে হযরত আবু বাক্র এগিয়ে গিয়ে বাধা দিলেন। তিনি কেঁদে ফিললেন এবং বললেন, “একটি লোক আল্লাহকে নিজের রব কলে ঘোষনা করেছ, এই কারণে কি তোমরা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে।”

এরপর জনতা সেখান থেকে চলে গেল। সেদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরাইশদের যেরূপ মারাত্মক আক্রমণ দেখেছি, তেমন আর কখনও দেখিনি।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি