নাসীবীনের জ্বিনদের ঘটনা
বনু সাকীফের কাছ থেকে হতাশ হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে চললেন। পথে নাখলা [মক্কা থেকে দুই দিন দুই রাতের দূরত্বে অবস্থিত দুটো উপত্যকার নাম। একটার নাম নাখলাতুল ইয়ামানিয়া, অপরটির নাম নাখলাতুল শামিয়া।] উপত্যকায় পৌঁছে মধ্যরাতে তিনি নামায পড়ছিলেন। এই সময়ে নাসীবীনের সাতজন জ্বিন ঐ স্থান দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত শুনলো। নামায শেষ হ’লে তারা নাসীবীনে [মুসেল থেকে সিরিয়া যাওয়ার পথে আববের একটি শহর বা জনপদ।]ফিরে গিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের কাছে কুরআনের বানী পৌঁছিয়ে দিল- যার প্রতি তারা পথিমধ্যে শোনা মাত্রই ঈমান এনেছিলো। পবিত্র কুরআনের সূরা জ্বিন ও সূরা আহকাফে আল্লাহ এই জিনদের কাহিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বর্ণনা করেছেন। সূরা আহকাফের আয়াত কয়টি হলো, “সেই সময়ের কথা স্মরণ কর যখন আমি তোমার দিকে জ্বিনদের একটি দলকে পরিচালিত করলাম যেন তারা কুরআন শুনতে পারে। তারা সেখানে পৌঁছে পরস্পরকে বললো: ‘তোমরা চুপ করে শোনো’। তাদের কুরআন শোনা শেষ হলে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে সাবধান করতে লাগলো। বললো, ‘হে আমাদের জাতি, আমরা এমন এক গ্রন্থের তিলাওয়াত শুনে এসেছি যা মূসার পরবর্তী সময়ে তাঁর কিতাবের ( তাওরাতের ) সত্যায়নকারী এবং সত্য ও নির্ভুল পথের দিশারী হয়ে নাযিল হয়েছে। হে আমাদের জাতি, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি ঈমান আন তা হলে তিনি তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রেহাই দেবেন।”

সূরা জ্বিনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, “হে নবী, তুমি বল যে, আমাকে ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে একদল জ্বিন কুরআনের বাণী শুনেছে”…. এরূপ সমগ্র সূরাটিই জ্বিনদের সংক্রান্ত আলোচনায় পরিপূর্ণ।

ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে রাসূল্লাহ (সা) সব গোত্রের কাছে হাজির হলেন
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উপস্থিত হলেন। দুর্বল শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক-যারা তাঁর প্রতি আগেই ঈমান এনছিল তারা ছাড়া গোটা কুরাইশ সম্প্রদায়ই তাঁর নিকৃষ্টতম দুশমনে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সময় মক্কায় আগত নানা গোত্রের লোকদের কাছে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহব্বান জানালেন এবং বললেন, “আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত নবী। তোমরা আমাকে সমর্থন করো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করো তা হলে আল্লাহ আমার কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তা তোমাদের কাছে পেশ করবো এবং বিশ্লেষণ করবো।”

রাবিয়া ইবনে আব্বাদ বর্ণনা করেন:

আমি তখন সবেমাত্র যুবক। পিতার সাথে মিনায় গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মক্কার বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন আরব গোত্রের শিবিরসমূহে গিয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিচ্ছিলেন, “হে অমুক অমুকের বংশধর, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমাদেরকে এসব প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা আমাকে সমর্থন কর, আমার প্রতি ঈমান আন এবং আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা কর আর আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিতে পারি।” এই সময় তাঁর পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছিল একজন টেরাচোখা, মাথায় দুটো জটাধারী এবং আদন অঞ্চলের পোশাক পরিহিত একটি লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তাঁর দাওয়াতী বক্তৃতা শেষ করেন,অমনি সে বলে, “হে অমুক অমুকের বংশধর, এই ব্যক্তিটি (মুহাম্মাদ) তোমাদেরকে লাত ও উযযার পূজা ত্যাগ করতে বলছে এবং বনু মালিক ইবনে উকাইশের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বর্জন করতে বলছে। [৩৫.উকাইশ অর্থ অপ্রাপ্ত উট যা যে কোন জিনিস দেখে ভয়ে পালায়। বনু মালিক ইবনে উকাইশ জ্বিনদের একটি গোত্রের নাম।] এক নতুন ও বিভ্রান্তিকর দাবী তুলে মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। তার আহ্বান সে দিকেই। তোমরা তার কথায় কান দিও না এবং তার অনুসরণ করোনা।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছু ধাওয়া করে যে লোকটি তাঁর দাওয়াতকে খ-ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কে?” তিনি বললেন, “সে মুহাম্মাদের চাচা আবু লাহাব আবদুল উযযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব।”

ইবনে ইসহাক হলেন, ইবনে শিহাব যুহরী আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগতভাকে কিন্দা গোত্রের লোকদের প্রতিটি শিবিরে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাদের সরদার মুলাইহ সহ সকলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

তিনি বনু আমের ইবসে সা’সা’য়া গোত্রের লোকদের কাছেও যান, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকেন এবং নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। জবাবে বাইহারা ইবনে ফিরাস নামক এক ব্যক্তি বললো, “আমি যদি এই কুরাইশ যুবককে নিই তা হলে তার সাহায্যে গোটা আরব ভূমি দখল করতে পারবো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর নিম্নরূপ সংলাপ হয়,

বাইহারা: “আচ্ছা, যদি আমরা তোমার আনুগত্য করি ও তোমর কাজে সহায়তা করে অতঃপর আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন, তখন কি আমাদের হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেবে?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: “ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।”

বাইহারা: “তাহলে শুধু তোমার খাতিরে সমগ্র আরব জাতির সামনে আমাদের বুক পেতে দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? তুমি বিজয়ী হলে তো ক্ষমতা চলে যাবে অন্যদের হাতে তোমার এ কাজে আমাদের শরীক হওয়ার কোন দরকার নেই।”

এভাবে বনু আমের গোত্রও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। হজ্জ শেষে লোকদের মক্কা ত্যাগ করে নিজ নিজ এলাকার দিকে যাত্র করলো। বনু আমের গোত্রের লোকজনও নিজ গোত্রের কাছে ফিরে দিয়ে তাদের এক অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে উস্থিত হলো। বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারতেন না। প্রতি বছরই তারা হজ্জ থেকে ফিরে এসে ঐ বৃদ্ধের কাছে যেতো এবং সেখানকার ঘটনাবলী তাকে জানাতো। এ বছরও তারা ফিরে গেলে বৃদ্ধ তাদেরকে তাদের উৎসবের ঘটনাবলী জিজ্ঞেস করলো তারা বললো, “এবার কুরাইশদের এক যুবক আমাদের কাছে এসেছিলো। বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের আরো একজন লোক তার পিছু পিছু এসেছিলো। সেই যুবকের দাবী হলো, সে নবী। সে আমাদের কে অনুরোধ জানিয়েছিলো যে, আমরা যেন তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করি, তার সমর্থন করি এবং তাকে আমাদের এলাকায় নিয়ে আসি।” একথা শুনে বৃদ্ধ তার নিজের মাথার ওপর হাত দু’খানা রাখলেন এবং বললেন, “হে বনী আমের, তোমরা যা হারিয়ে এসছো, তা আবার ফিরে পাওয় যায় কিনা ভেবে দেখো। কারণ ইসমাঈলের বংশধর কখনো নবী হবার মিথ্যা দাবী করেনি। আল্লাহর শপথ, ঐ যুবক যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। তোমরা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে না?”

আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব কলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হানীফা গোত্রের লোকদের সাথেও তাদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করেন, তাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছান এবং তাঁকে সমর্থন দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা সবচেয়ে জঘন্যভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে লাগরেন। হজ্জ কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে মক্কায় কিছু লোক সমবেত হলেই তিনি তাদের কাছে যেতেন। এভাবে প্রত্যেক গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতেন। তাঁর কাছে আগত খোদায়ী রাহমাত ও হিদায়াত গ্রহণ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানাতেন। যে কোন নামকরা ও গণ্যমান্য আরব মক্কায় এসেছে জানতে পারলেই তিনি তার কাছে যেতেন এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।

বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সুয়াইদ ইবনে ছামিত হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কা এসে সে খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দেখা করলেন এবং তাকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন সুহাইল বললো, “তুমি যে বাণী শোনাচ্ছ, তার অনুরূপ কিছু আমার কাছেও আছে।” রাসূলুল্লাহ বললেন,“ তোমার কাছে কি বাণী আছে? ” সে বললো, “লোকমানের বাণী সম্বলিত একখানি পুস্তিকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এই বাণী খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে যে বাণী, তা এর চেয়েও ভাল। তা হলো কুরআন, আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন,এটা হচ্ছে হিদায়াত এবং আলোর উৎস।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুয়াইদকে কুরআন পড়ে শোনালেন। তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সুয়াইদ এ দাওয়াত উপেক্ষা করলো না। সে বললো,“তুমি যে কুরআনের বাণী শোনালে, তা সত্যিই অপূর্ব। ” অতঃপর সুয়াইদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বিদায় হয়ে মদীনায় নিজ গোত্রে ফিরে গেল। এর কিছুকাল পরেই খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। বনু ‘আমর গোত্রের লোকেরা বলতো, “আমাদের বিশ্বাস, সুয়াইদ মুসলমান হিসেবে মারা গেছে। ” মদীনার পার্শ্ববর্তী বুয়াস নামক স্থানে আওস ও খজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তার আগেই সুয়াইদ নিহত হয়েছিল।

মদীনায় ইসলাম বিস্তারের সূচনা
অবশেষে সেই সময়টি এসে উপস্থিত হলো যখন আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়মাল্যে ভূষিত করা, তাঁর নবীকে অধিকতর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং তাঁকে দেয়া প্রতিশ্রুতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবারও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথরীতি হজ্জ উৎসবে আগত লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে ও তাঁকে আপন করে গ্রহণ করার জন্য আরব গোত্রগুলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন। এবার তিনি কিছুসংখ্যক মদীনাবাসীর সাক্ষাত পেলেন। এরা ছিলেন মদীনার খাজরাজ গোত্রের একটি দল। আকাবার [ ৩৬. মক্কা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এটি মক্কা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গা। এখান থেকে পাথর নিক্ষেপ হজ্জের অন্যতম বিধি।] কাছাকাছি এক স্থানে তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। আল্লাহ এই দলটির কল্যান সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই এই ঘটনা ঘটেছিলো। [৩৭. এ ঘটনা ঘটে নবুওয়াতের একাদশ বছরে।] তাদের সাথে দেখা হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কারা? ” তারা বললো,“আমরা খাজরাজ গোত্রের লোক।” তিনি পুনরায় বললেন, “যা ইহুদিদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ আপনারা কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?” তাঁরা বললো, “হ্যাঁ।” তিনি বললেন, “আপনারা একটু বসবেন কি? আমি আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।” তারা বললো, বেশ,বলুন।” এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে দাওয়াত দিলেন, তাদের সামনে ইসলাম পেশ করলেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করে শোনালেন।

আগে থেকেই মহান আল্লাহ তাদের ইসলাম গ্রহণের সহায়ক একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। মদীনায় তাদের আশেপাশে ইহুদীরা বাস করতো। তারা আসমানী কিতাকের অধিকারী ছিলো এবং সেই সুবাদে তাদের কাছে ঐশী জ্ঞান ছিল। খাজরাজ ও অন্যান্য আরব গোত্র ছিল মুশরিক তথা প্রতিমাপূজারী। ইতিপূর্বে এইসব পৌত্তলিক আরবকে আগ্রাসী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে ইহুদীরা তাদের এলাকা দখল করে বসতি স্থপন করে পৌত্তলিক ও ইহুদেিদর মধ্যে যখনই কোন অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভত হতো, তখনই ইহুদীরা পৌত্তলিকদেরকে এই বলো শাসাতো, “এ যুগের নবীর আগমনের সময় আসন্ন হয়ে উঠেছে। ঐ নবী এলে আমরা তাঁর সেতৃত্বে ‘আদ ও ইরাম জাতিকে যেভাবে পাইকারী হত্যা করা হয়েছিল, তোমদেরকে সেইভাবে কচুকাটা করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খাজরাজ গোত্রের দলটির সাথে আলাপ-আলোচনা করলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন তখন তারা এক অপরকে বলতে লাগলো, “আল্লাহর শপথ, ইনিই তো সেই নবী যার কথা বলে ইহুদরিা আমাদেরকে হুমকি দেয় ও শাসায়। এখন ইহুদীদেরকে কিছুতেই আমাদের আগে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দেয় উচিত হবে না।” এইরূপ চিন্তার বশবর্তী হয়ে তারা তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। তারা বললো, “আমরা আমাদের সম্প্রদায়কে এক ভয়ংকর শত্রুর শত্রুতার মুখে অসহায় অবস্থায় রেখে এসেছি। আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের গোটা সম্প্রদায়কেই আপনার সমর্থক করে দেবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে গিয়ে আপনার দাওয়াত তাদের কাছেও তুলে ধরবো। আল্লাহ যদি তাদেরকে আপনার সমর্থক বানিয়ে দেন তা হলে আপনার চেয়ে স্মমানিত ও পরাক্রান্ত আর কেউ থাকবে না।”

এভাবে তারা ঈমান আনা ও ইসলামকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। যতদূর জানা যায়, খাজরাজ গোত্রীয় এই দলটির সদস্য ছিল ছয়জন। মদীনায় পৌঁছে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য গোত্রের কাছে পেশ করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। এভাবে ক্রমে মদীনার প্রতিটি ঘরে ইসলমের দাওয়াত পৌঁছে গেল। এমন একটি বাড়ীও অবশিষ্ট রইলো না, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা আলোচিত হতো না।

আকাবার প্রথম বাইয়াত
পরবর্তী বছর আরো বারো জন হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আসলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইসলাম গ্রহণ পূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করলেন। এই অঙ্গীকার গ্রহণ অনুষ্ঠানকে আকাবার প্রথম বাইয়াত বলা হয়। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো মুসলিম নারীদের বাইয়াত গ্রহণের পদ্ধতিতে যা মক্কা বিজয়ের পরের দিন পুরুষদের বাইয়াত গ্রহণের অব্যবহিত পর সাফা পর্বতের ওপর অনুষ্ঠিত হয়। আকাবার প্রথম বাইয়াত অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পচিালনার নির্দেশ আসার পূর্বে। এ বাইয়াতে অংশ গ্রহণকারেিদর মধ্যে ছিলেন আসআদ ইবনে যুরারা, রাফে ইবনে মালিক, ‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত এবং আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান।

‘উবাদা ইবনুস্ ছামিত বলেন, “আমি আকাবার প্রথম বাইয়াতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম বারোজন পুরুষ। নারীদের বাইয়াতের পদ্ধতিতেই আমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয এবং তাছিল যুদ্ধের নির্দেশ আসার পূর্বেকার ঘটনা। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না, চুরি-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাবো না এবং ন্যায়সঙ্গত ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতা করবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য জান্নাতও রয়েছে। আর এর কোন একটি ভঙ্গ করলে তোমাদের পরিণতি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত থাকবে। ইচ্ছে করলে তিনি শাস্তি দেবেন, ইচ্ছে করলে মাফ করে দেবেন।”

ইবনে ইসাহাক কলেন: মদীনার এই দলটি যখন নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুস’য়াব ইবনে উমাইরকে পাঠিয়ে দিলেন তাদেরকে কুরআন পড়ানো, ইসলাম শিক্ষা দেয়া ও ইসলামী বিধানের তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি মদীনার শিক্ষাগুরুরূপে অভিহিত হতেন। তিনি মদীনার মুসলমানদেরকে নামাযও পড়াতেন। কেননা এক গোত্রের লোক অন্য গোত্রের লোকের ইমামতি করুক এটা আওস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় পছন্দ করতো না।


আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত
কিছুদিন পর মুস’য়াব ইবনে উমাইর মক্কা ফিরলেন। মদীনার কিছু কিছু নওমুসলিম তাঁদের স্বগোত্রীয় পৌত্তলিকদের সাথে হজ্জ উপলক্ষে মক্কা গেলেন। আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা সবাই আকাবায় সমবেত হওয়ার জন্য [৩৮. দশই জিলহজ্জের পরবর্তী তিন দিনকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়। তাশরিক অর্থ চামড়া রৌদ্রে শুকানো। আরবরা এই সময় কুরবানীর পশুর চামড়া শুকাতো।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কথা দিলেন। বলাবাহুল্য আল্লাহর রাসূলের মর্যাদা বৃদ্ধি ও বিজয় দান, ইসলাম মুসলমানদের শক্তিম ব্রদ্ধি এবং অংশীবাদ ও অংশীবাদীদের পতন ঘটাতে আল্লাহর ইপ্সিত মুহূর্তটি সমাগত হলে এই দ্বিতীয় বাইয়াত সম্পন্ন হ।েপ।া।

কা’ব ইবনে মালিক বলেন: আমরা আমাদের গোত্রের মুশরিক হাজীদের সাথে মক্ক অভিমুখে রওনা হলাম। আমরা ততক্ষণে নামায পঢ়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি এবং ইসলামের বিধি –বিধান শিখে নিয়েছি। আমাদের প্রবীণ মুরুব্বী ও গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূরও আমাদের সহযাত্রী। আমরা সফরে রওনা হয়ে মদীনা থেকে বেরুতেই রারা বললো, “শোনো, আমি একটা মত স্থির করেছি, জানি না তোমরা তাতে একমত হবে কিনা।

আমরা বললোম, “সেটা কি?” তিনি বললেন, “আমি ঠিক করেছি, কা’বাকে পেছনে রেখে নামায পড়বো না বরং কা’বার দিকে মুখ করেই নামায পড়বো। ” আমরা তাকে বললাম, “আমরা তো জানি, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিরিয়া অর্থাৎ বাইতুল মাকদাসের দিকে ফিরেই সামায পড়ে থাকেন। আমরা তাঁর বিরোধিতা করতে পারি না।” তিনি বললেন, “তা হলে আমি কা’বা ও বাইতুল

মাকদাস-উভয়ের দিকে মুখ করে নামায পড়বো।” আমরা বললাম, “আমরা কিন্তু তা করবো না।” তাই নামাযের সময় হলে আমরা বাইতুল মাকসাদের দিকে মুখ করে নামায পড়তাম আর তিনি পড়তেন কা’বার দিকে মুখ করে। এভাবে আমরা মক্কায় এসে পৌঁছলাম। তিনি জিদ ধরে এসেছেন তার জন্য আমরা তাকে তিরস্কার করতে করতে এসেছি। কিন্তু তিনি কোনক্রমেই তার জিদ বর্জন করেননি। মক্কায় পৌঁছার পর তিনি আমাকে বললেন, “ভাতিজা, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করবো, সারাপথ আমি যেভাবে নামায পড়েছি, তা ঠিক হলো কিনা” তোমাদের কে যেভাবে আমার বিরুদ্ধে কাজ করতে দেখলাম, তাতে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।”

কা’ব ইবনে মালিক বলেন, “অতঃপর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে বেরুলাম। আমরা তাঁকে চিনতাম না এবং ইতিপূর্বে কথনো তাঁকে দেখিনি। একজন মক্কাবাসীর সাথে দেখা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় আছেন?” সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিন?” আমরা বললাম, ‘না।’ সে বললো, “তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে কি চেন?” আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ।’ আমরা আব্বাসকে আগে থেকেই চিনতাম। তিনি আমাদের এলাকা দিয়ে ব্যবসা উপলক্ষ্যে যাতায়াত করতেন। মক্কাবাসী লোকটি বললো, “মসজিদে হারামে প্রবেশ করে যাঁকে আব্বাসের সাথে বসা দেখবে তিনিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।” আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করে দেখলাম, আব্বাস বসে আছেন আর তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বসে আছেন। আমরা সালাম দিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বসলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এই দুই ব্যক্তিকে চেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি তাদেরকে চিনি। ইনি গোত্রপতি বারা ইবনে মা’রূর। আর ইনি কা’ব ইবনে মালিক।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সম্পর্কে যা বললেন তা আমি ভুলতে পারব না। তিনি বললেন,তিনি বললেন, “কবি কা’ব ইবনে মালিক না কি?” আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন বারা বললেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি এই সফরে বের হওার পূর্বেই আল্লাহ আমাকে ইসলাম গ্রহনের তাওফীক দান করেছেন। এরপর আমি কা’বার দিকে মুখ করে নামায পড়তে লাগলাম। কিন্তু আমার সঙ্গীরা আমার মত অগ্রাহ্য করেছে। এজন্য আমি সংশয়াপন্ন হয়ে পড়েছি। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কোনটা সঠিক মনে করেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি একটা কিবলার দিকে নামায পড়তে। ধৈর্য ধরে সেই কিবলার অনুসরণ করলে ভালো হতো।”

এরপর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিবলাকে মেনে নিলেন এবং আমাদের সাথে বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তে লাগলেন। পরে আমরা হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আকাবায় সাক্ষাতের ওয়াদা করলাম। যেদিন হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শেষ হলো তার পরবর্তী রাতটাই ছিল আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হবার প্রতিশ্রুত রাত। তখন আমাদের সাথে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম আবু জাবির। তিনি ছিলেন অন্যতম সম্মানিত সমাজপতি। তাঁকেও আমরা সাথে নিলাম। কিন্তু আমাদের সাথে কারা আছে আর আমরা কি করতে যাচ্ছি তা আমাদের সহযাত্রী গোত্রীয় মুশরিকদেরকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেইনি। আমরা আবু জাবিরকে বললাম, “হে আবু জাবির, আপনি আমাদের একজন সম্মানিত সরদার। আপনি যে জীবন-পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, তা আমাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্বিত ব্যাপার। আপনি পরকালে দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হন তা আমরা চাই না।” অতঃপর তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং তাঁকে জানালাম যে, আজ আকাবাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের মিলিত হবার কথা রয়েছে। আবু জাবির তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে আকাবার বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি একজন আহ্বায়কে পরিণত হন।

সেই রাতে আমরা আমাদের কওমের লোকদের সাথে কাফিলার মধ্যেই ঘুমালাম। রাত এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেয় ওয়াদা মুতাবিক আকাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। নিশাচর পাখীর মত অতি সন্তর্পণে ও অতি গোপনে বেরিয়ে পড়লাম। পথ চলতে চলতে আমরা আকাবার নিকটবর্তী গিরিবর্তে গিয়ে সমবেত হলাম। আমরা সর্বমোট তিহাত্তর জন লোক জমায়েত হলাম। আমাদের সাথে দুইজন মহিলাও ছিলেন। তাঁরা হলেন মুসাইব বিনতে কা’ব ও আসমা বিনতে আমর ইবনে আদী। [৩৯. ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সময় মহিলাদের হাত স্পর্শ করতেন না। তিনি শুধু মৌখিক অঙ্গীকার নিতেন। তাঁরা অঙ্গীকার করলে তিনি বলতেন, ‘তোমরা যেতে পার। তোমাদের বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছে।’ ]

কা’ব ইবনে মালিক বলেন, আমরা গিরিবর্তে সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক্ষায় রইলাম। অবশেষে তিনি তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছেলন। তখনও আব্বাস ইবলাম গ্রহণ করেননি। তিনি কেবল ভ্রাতস্পুত্রের ঐ গুরুত্বপূর কাজটি প্রত্যক্স করা ও তাঁর নিরপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যই এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বৈঠকে বসলেন, তখন সর্বপ্রথম আব্বাস আমাদের সাথে কথা বললেন। তিনি বললেন, “হে খাজরাজ গোত্রের জনম-ণী মুহাম্মাদ আমাদের মধ্যে কিরূপ মর্যাদার অধিকারী,তা আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। তাঁকে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের জুলুম নির্যাতন থেকে আমরা এ যাবত রক্ষ করেছি। তাঁর সম্প্রদাযের মধ্যে তিনি একটা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে তাঁর সম্প্রদায় ও জন্মভূমিতে তিনি সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকারী। তা সত্ত্বেও আপনাদের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ এবং আপনাদের মধ্যেই তিনি থাকতে কৃতসংকল্প। এখন আপনারা ভেবে দেখুন, তাঁকে আপনারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন তা রক্ষা করতে পারবেন কিনা এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে নিরাপদে রাখতে পারবেন কিনা। তা যদি পারেন তা হলে আপনাদের দায়দায়িত্ব ভালো করে বুঝে নিন। আর যি মনে করেন যে, ভবিষ্যতে আপনারা তাঁকে তাঁর শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবেন এবং সাথে করে নিয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে লাঞ্ছনার মুখে ঠেলে দেবেন, তা হলে এখনই সেই দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। কেননা বর্তমানে তিনি তাঁর স্বজাতির কাছে ও আপর মাতৃভূমিতে সম্মানে ও নিরাপদে আছেন।” আব্বাসের এ কথাগুলো শোনার পর আমরা বললাম, “আপনার কথা আমরা শুনলাম। হে আল্লাহর রাসূল, এখন আপনি বলুন এবং যেমন খুশী অঙ্গীকার নিন!”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে এবার তাঁর কথা বললেন। প্রথমে তিনি কুরআন তিলাওয়াত করলেন, তারপর সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলামের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, “আমি তোমাদের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার চাই যে, তোমরা তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যেভাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকো, আমাকেও সেভাবে রক্ষা করবে।”

তৎক্ষণাৎ বারা ইবনে মা’রূর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ। যে মহান সত্তা আপনাকে নবী করে সত্যদীনসহ পাঠিয়েছে তাঁর শপথ করে বলছে, আমরা স্বজন ও স্ত্রী-সন্তানদের যেভাবে বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকি, আপনাকেও সেভাবে রক্ষা করবো। হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার আনুগত্য করার শপথ গ্রহণ করলাম। আল্লাহর শপথ, আমরা য্দ্ধু ও অস্ত্রের মধ্যেই লালিত পালিত। আমরা পুরুষানুক্রমে যোদ্ধা জাতি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বারার কথা শেষ না হতেই আবুল হাইসাম ইবনে তাইহান বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের সাথে ইহুদীদের মৈত্রী সম্পর্কে রয়েছে এবং আমরা তা ছিন্ন করতে যাচ্ছি। এসব করার পর আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করলে আপনি কি আমভদের ত্যাগ করে নিজ গোত্রে ফিরে যাবেন?” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “আমি বরং তোমাদের জীবন মরণ ও সুখ দুঃখের চিরসঙ্গী হবো, তোমাদের রক্তপাতকে আমি নিজের রক্তপাত বলে গণ্য করবো। আমি চিরকাল তোমাদের থাকবো এবং তোমরা চিরকাল আমার থাকবে। তোমরা যার সাথে যুদ্ধ করবে, আমিও তার সাথে যুদ্ধ করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছিলেন, “তোমাদের মধ্য থেকে বারো জন নকীব বা আহ্বায়ক নির্বাচন করে আমার কাছে পাঠাও যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদের এই অঙ্গীকারে শামিল করে নিতে পারে।” তারা তখন বারো জন আহ্বায়ক নির্বাচন করে। তন্মধ্যে নয় জন ছিল খাজরাজ গোত্রের এবং তিন জন আওস গোত্রের।[৪০. খাজরাজের নয় জন আহ্বায়ক হলেন: আসাদ ইবনে যুরারা, সা’দ ইবনে রাওয়াহা, রাফে’ ইবনে মালিক, বারা ইবনে মা’রূর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম, উবাদা বনে ছামিত, সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমর ইবনে খুরাইস। আর আওস গোত্রের তিন জন ছিলেন: উসাইদ ইবনে হুদাইর, সা’দা ইবনে খাইসামা ও রিফায়া ইবনে মুনযির। ইবনে হিশাম বলেন, বিজ্ঞ ঐতিহাসিকগণ রিফায়ার স্থলে আবুল হাইসাম ইবনে তাইহানকে আহ্বায়ক বলে উল্লেখ করেন।]

যিনি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে হাত রেখে বাইয়াত করেন তিনি বারা ইবনে মা’রূর। পরে তিনি নিজ গোত্রকে ঐ বাইয়াতে শামিল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমাদের এই বাইয়াত অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শয়তান আকাবার পর্বত শীর্ষ থেকে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো যে, ও রকম বিকট চিৎকার আমি আর কখনো শুনিনি। সে চিৎকার করে বলছিলো, “হে মিনাবাসী, মুজাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির সাথে ধর্মদ্রোহীরা যে যোগসাজশ করলো তা কি তোমরা লক্ষ্য করলে না? [৪১.মুজাম্মাম অর্থ ধিকৃত বা নিন্দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মুহাম্মাদের (প্রশংসিত) বিপরীত শব্দ। মুশরিকরা তাঁকে এই নামে ডাকতো। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বলতো সাবি অর্থাৎ সাবি অর্থাৎ ধর্মত্যাগী বা বে-দীন।] ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ হলো আকাবার শয়তান আযেব ইবনে উযাইবের চিৎকার।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা নিজ নিজ কাফিলায় বলে যাও।”

‘আব্বাস এবন উবাদা ইবনে নাদালা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, যে আল্লাহ আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আপনি চাইলে আমরা আগামীকালই মিনায় অবস্থানকারীদের ওপর তরবারী নিয়ে হামলা চালাবো।”

এরপর আমরা গিয়ে শয্যাগ্রহণ করলাম এবং সকাল পর্যন্ত ঘুমালাম। সকাল হতেই কুরাইশদের বিরাট একটি দল আমাদের ঘিরে ধরলো।। তারা বললো, “হে খাজরাজ গোত্রের লোকগণ, আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমরা মুহাম্মাদকে আমাদের মধ্য থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছো এবং আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তার সাথে ষড়যন্ত্র¿ করছো। সত্যি বলতে কি, আরবের আর কোন গোত্রের সাথে যুদ্ধের চেয়ে তোমদের সাথে যুদ্ধ আমাদের কছে সবচেয়ে অপছন্দীয়।” এ কথা শুনে আমাদের যেসব মুশরিক সেখানে ছিল, তারা আল্লাহর শপথ করে করতে লাগলো, “এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রই এখানে হয়নি এবং আমরা তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানি না।”

বস্তুত:তারা সত্য কথাই বলছিল। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানতো না। তারা যখন আল্লাহর শপথ করে কুরাইশদের এসব বলে আশ্বস্ত করছিল তখন আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। এরপর মিনা থেকে লোকজন চলে গেলে কুরাইশরা ব্যাপারটা আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান চালালো। শেষ পর্যন্ত তারা জানতে পারলো যে, ঘটনাটা সত্য। অতঃপর আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের সন্ধানে তারা চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। মক্কার নিকটবর্তী আযাখের নামক স্থাকে তারা সা’দ ইবনে উবাদা, মুনযির ইবনে আমররে সাক্ষাত পেলো। মুনযিরকে তারা ধরতে পারলো না, কেবল সা’দ ধরা পড়লেন। সা’দের চুল ছিল বেশ লম্বা। তারা তাঁকে ধরে উটের রশি দিয়ে দুই হাত ঘাড়ের সাথে এঁটে বাঁধলো। তারপর তাঁকে পিটাতে পিটাতে চুল ধরে টানতে টানতে মক্কায় নিয়ে গেল।

এ সম্পর্কে সা’দ নিজে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নরূপ, আমি তাদের হাতে ধৃত ও বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায কুরাইশদের একটি দল আমার কাছে আসলো। তাদের ভেতরে খুবই উজ্জ্বল ফর্সা, সুন্দর ছিপছিপে লম্বা ও মিষ্টি চেহারার অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষকে দেখলাম। আমি মনে মনে বললাম: এই বিপুল জনতার মধ্যে কারো কাছে যদি ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করা যেতে পারে তা হলে এই ব্যক্তির কাছেই। কিন্তু এ লোকটা আমার কাছে এসে প্রথমেই আমাকে প্রচ- এক থাপ্পড় কষে দিলো। তখন আমি মনে মনে বললাম, এই লোকটার কাছ থেকেই যখন এমন ব্যবহার পেলাম, তখন আর কারো কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার আশা করা যায় না। এভাবে তারা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমি তখন সম্পূর্ণ অসহায়। সহসা জনতার মধ্য হতে এক ব্যক্তি আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললো, “আহ্! কি দুঃখজনক দশা তোমার। আচ্ছা কুরাইশদের ভেতরে কি তোমার জানাশোনা বা লেনদেন আছে এমন একটা লোকও নেই?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আছে। আমি এক সময় যুবাইর ইবনে মুতয়িম ইবনে আদীর বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আশ্রয় দিতাম এবং আমাদের অঞ্চলে কেউ তাদের ওপর যুলুম করতে চাইলে তাদেরকে রক্ষা করতাম। তা ছাড়া হারেস ইবনে হারব ইবনে উমাইয়ার বাণিজ্য প্রতিনিধিদেরকেও সাহায্য করতাম। ”লোকটি বললো, ‘তা হলে ঐ দু’জনের সাম উল্লেখ করে খুব উচ্চস্বরে ধ্বনি দাও। তাদের সাথে তোমার যে সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ কর।” আমি সঙ্গে সঙ্গে ঐ দু’জরের নামে ধ্বনি দিলাম। আর ঐ লোকটি তৎক্ষণাৎ যুাবাইর ও হারেসের সন্ধানে ছুটে গেলো এবং কা’বার সন্নিকটে মসজিদুল হারামের মধ্যে তাদেরকে পেলো।

অতঃপর সে তাদেরকে বললে, “মক্কার অদূরের সমভূমিতে খাজরারের একটা লোককে এই মুহূর্ত ভীষণভাবে পিটানো হচ্ছে। সো মার খাচ্ছে আর তোমরদের দু’জনের নামোল্লেখ করে বলছে যে, তার সাথে নাকি তোমাদের জানাশোনা আছে।”যুবাইর ও হারেস বললো, “লোকটি কে?” সে বললো, ‘সা’দ ইবনে উবাদা।” তারা বললো, “ঠিকই বলেছে। সে আমাদের ব্যবসায়ীদেরকে তাদের এলাকায় গেলে আশ্রয় দিতো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করতো।” অতঃপর উভয়ে এসে সা’দকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করলো। তারপর সা’দ চলে গেলেন।

আকাবার শেষ বাইয়াত ও তার শর্তাবলী
আকাবার শেষ বাইয়াতটি সম্পন্ন হয় আল্লাহর তরফ থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি লাভের পর। তাই যুদ্ধের অঙ্গীকার ছাড়া এই বাইয়াতের শর্তাবলী ছিলো প্রথম বাইয়াতের শর্তাবলীর অনুরূপ। প্রথম বাইয়াত ছিল মক্কা বিজয়ের মহিলাদের বাইয়াতের অনুরূপ। কারণ প্রথম বাইয়াতের সময় আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তাই অনুমতি লাভের পর আকাবার শেষ বাইয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদের নিকট থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, তারা দুনিয়ার সকল কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। তিনি তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অঙ্গীকারের শর্তাবলী আরোপ করেন এবং সেই শর্তাবলী সহ অঙ্গীকার পালন করলে তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে বলে ঘোষণা করেন।

‘উবাদা ইবনে ছামিত (রা) বর্ণনা করেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলাম। সেই অঙ্গীকারের শর্তবলী ছিলো এই: অবস্থা কঠিন কিংবা স্বাভাবিক যা হোক না কেন আমরা সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবো এবং আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করবো না।”

সশস্ত্র যুদ্ধের নির্দেশ লাভ
আকাবার বাইয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধের বা প্রয়োজনে রক্তপাত ঘটানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। তখন পর্যন্ত তাঁকে শুধু আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া, যুলুম নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করা এবং অজ্ঞ লোকদের ক্ষমা করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণকারী যেসব লোককে ঘরবাড়ী ত্যাগ করতে হয়েছিলো, তাদের উপরে কুরাইশরা চরম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিলো। অসহ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ কেউ ইসলাম ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছিলো। কুরাইশরা বেশ কিছু সংখ্যাক ঈমানদারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলো। এভাবে মুসলমানেদের কেউবা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো, কেউবা ইসলাম পরিত্যাগ করেছিল, কেউবা দেশত্যাগ করেছিলো। তাদের তধ্যে অনেকে হাবশায় এবং অনেকে মদীনায় হিজরাত করেছিলো এভাবে সবদিক দিয়েই মুসলমানরা যখন লাঞ্ছিত ও সর্বস্বান্ত, কুরাইশরা খোদাদ্রোহিতার শেষ সীমায় উপনীত এবং তাঁর নবী প্রত্যাখ্যাত, তখনই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা এবং যালিম খোদাদ্রোহীদেরকে পর্যুদস্ত করার অনুমতি দিলেন। উরওয়া ইবনে যুবাইর ও অন্যান্য বর্ণনাকারীদের নিকট থেকে আমি যা জানতে পেরেছি। তদনুসারে আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা ও ঈমানদারদের প্রতিরক্ষার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত বৈধ ঘোষণা করে সর্বপ্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয়, তা হলো-

[আরবী *************]

“যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া গেল। কারণ তারা মাযলুম। বস্তুত: আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করার মত ক্ষমতাশালী। তারা সেই সব লোক, যাদেরকে শুধু ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ এই কথাটুকু বলার কারণে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ঘরবাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেয় হয়েছে। আল্লাহ যদি একদল মানুষকে আরেক দল দিয়ে দমন করার ব্যবস্থ না রাখতেন তাহলে মন্দির, গীর্জা, সব ইবাদাতখানা ও মসজিদসমূহ, যেখানে বেশী করে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়ে থাকে ধ্বংস করে দেয়া হতো। আল্লাহকে যে সাহায্য করবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। বস্তুত: আল্লাহ শক্তিশালী মহা প্রতাপান্বিত। তারা সেই সব লোক যাদের আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা ও সুযোগ দিলেই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ন্যায় ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং অন্যায় ও অসত্যকে প্রতিরোধ করবে। আল্লাহর হাতেই সব কিছুর চূড়ান্ত পরিণতি। (সূরা হজ্জ ৩৯-৪১)

অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের ওপর যুলুম নির্যাতন হওয়ার কারণেই আমি তাদের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ বৈধ করেছি। তারা মানুষের প্রতি কোন অপরাধ বা পাপ করেনি। তারা যখনই বিজয়ী হবে তখনই নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ প্রতিহত করবে। এরপর আল্লাহ আবার নাযিল করেনÑ

[আরবী *************]

“তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যাতে কোন মু’মিনকে আর তার দীন পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা না হয় এবং একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য অবশিষ্ট থাকে।” (সূরা বাকারাহ্) অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাাত বা দাসত্ব করা হয়, অন্য কারো নয়।

মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরাত করার অনুমতি দান
আল্লাহর তরফ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন যুদ্ধের অনুমতি দেয় হলো আর মদীনাবাসীদের উপরোক্ত দলটি ইসলামী বিধানের অনুসরণ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুরসারীদের সর্বত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব মুসলমানকে মদীনায় হিজরাত করে তাদের আনসার ভাইদের কাছে-চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমি ও কিছুসংখ্যক ভাই সংগ্রহ করে দিয়েছেন।” ফলে মুসলমানগণ দলে দলে হিজরাত করতে শুরু করলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরাতের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।

মদীনায় হিজরাতকারী মুসলমানদের বিবরণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কুরাইশ বংশীয় প্রথম মুহাজির ছিলেন বনী মাখযুম গোত্রের আবু সালামা ইবনে আবুদুল আসাদ। আকাবার বাইয়াতের এক বছর আগে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। ইতিপূর্বে তিনি আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে আসেন। এই সময় কুরাইশরা তাঁকে উৎপীড়ন করতে লাগলো। তিনি মদীনাবাসীদের ইসলাম গ্রহনের খবর শুনতে পেলেন। এবং তাঁর সাথে হিজরাত করে চলে গেলেন। আবু সালামার পর আমের ইবনে রাবীয়া এবং মদীনায় তার স্ত্রী লায়লা বিনতে আবু হাসমা মদীনায় হিজরাত করেন। তারপর আবুল্লাহ ইবনে জাহাশ তাঁর পরিবার পরিজন ও ভাই আবদ ইবনে জাহাশকে সাথে নিয়ে হিজরাত করেন। তাঁর ভাইয়ের আর এক নাম ছিলো আবু আহমাদ। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিলো ক্ষীণ। তা সত্ত্বেও তিনি কারো সাহায্য ছাড়াই মক্কার উচ্চ ও সমতল এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি ছেলেন একজন কবি।

এপর উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও আইয়াশ ইবনে আবু রাবিয়া মাখযুমী হিজরাত করে মদীনায় চলে যান। অতঃপর ব্যাপকহারে মুসলমানগণ মদীনায় হিজরাত করতে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরাত
সাহাবীগণ হিজরাত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থেকে গেলেন। এ সময়ে আলী ইবনে আবু তালিব, আবু বাক্র সিদ্দীক ও মুষ্টিমেয় ক’জন সাহাবা ছাড়া আর কেউ মক্কায় ছিলেন না। অন্য যারা ছিলো তারা হয় কাফিরদের হাতে বন্দী ছিল নতুবা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আবু বাকর (রা) প্রায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হিজরাত করার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়ো করো না। হয়তো আল্লাহ তোমাকে একজন সাথী জুটিয়ে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তাঁর হিজরাতের সঙ্গী হন। হযরত আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) এরপর থেকে তাই কামনা করতেন। কুরাইশরা যখন দেখলো যে, অন্যত্র তাদের গোত্রের বাইরের বহু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গীরা তাদের কাছে হিজরাত করে চলে যাচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পারলো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরগন একটা নিরাপদ আবাসভূমি পেয়ে গেছেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেশত্যাগের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেলো। তারা ভাবলো যে, তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেছেন।

এ ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য তারা পরমর্শগৃহ ‘দারুন্ নাদওয়ায়’ সমবেত হলো। এই গৃহটি ছিলো কুসাই ইবনে কিলাবের বাড়ী। কুরাইশরা যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে এখানেই সমবেত হতো। এবার তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর ব্যাপারে কি করা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করতে বসলো। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তারা নির্ধারিত দিনে সেখানে সমবেত হলো। এই দিনকে ‘গণসমাবেশ দিবস’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাদের পরামর্শ গৃহে ঢুকবার পথে ইবলিস কম্বল আচ্ছদিত এক বৃদ্ধের বেশে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে সবাই বললো, “বৃদ্ধ এই লোকটি কে?” সে বললো, “আমি নাজদের অধিবাসী। [৪২.সুহাইলী মতে, শয়তান নিজেকে নাজদবাসী বলে পরিচয় দেয়ার কারণ হলো, কুরাইশরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো যে, তিহামা অঞ্চলের কোন লোককে এই পরামর্শ সভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কেননা তারা মনে করতো, তিহামাবাসী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমর্থক। এজন্য ইবলিস নাজদবাসী বৃদ্ধের রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।]

তোমরা যে উপলক্ষে আজ সমবেত হচ্ছো, তা আমি শুনেছি। তাই তোমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য এসেছি। আশা করি আমার উপদেশ ও পরামর্শ থেকেও তোমরা বঞ্চিত হবে না।”একথা শুনে সবাই তাকে পরম সমাদরে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সে সবার সাথে প্রবেশ করলো। ততক্ষণে কুরাইশদের বড় বড় নেতা ও সরদার ভেতরে আসন গ্রহণ করেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “এই লোকটির তৎপড়তা বর্তমানে কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমরা সবাই তা জান। সে তার বাইরের অনুসারীদের নিয়ে কখন যে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার কোন ঠিক নেই। তার আক্রমণ থেকে আমরা এখন নিরাপদ নই। অতএব, সবাই মিলে তার ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”

সলাপরামর্শ চলতে থাকলো। এক সময় একজন বললো, “তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে কোন অর্গলবদ্ধ কুঠরীতে বন্দী করে রাখ। তারপর ইতিপূর্বে তার মত কবিদের যে পরিণতি হয়েছে তারও সেই পরিণতি অর্থাৎ শোচনীয় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাক। যুহাইব, নাবেগা ও তাদের মত অন্যান্য কবির এই পরিণতি হযেছিল। ” তখন বুড়ো বললো, “না, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তোমরা যদি তাকে বন্দী কর, তা হলে বদ্ধ কুঠরীতে তার বন্দী হওয়ার খবর তার বাইরের অনুসারীদের কানে চলে যাবে। সে অবস্থায় তারা তোমাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতঃপর তাদের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং একদিন তারা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবে। কাজেই তোমাদের এ সদ্ধিান্ত সঠিক নয়। অন্য কোন সিদ্ধান্ত নিতে পার কিনা, ভেবে দেখ।”

এরপর আবার আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। একজন বললো, “আমরা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবো। এরপর তাকে নিয়ে আমাদের আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। সে একাবার আমাদের কাছ থেকে চলে গেলে কোথায় গেলো বা কোথায় থাকলো আমরা তার কোন পরোয়া করবো না। সে চলে গেলে আমরা তার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এরপর আমাদের পারস্পরিক মৈত্রী ও বন্ধুত্ব এবং অন্যান্য ব্যাপারে আমরা নিজেরাই শুধরে স্বাভাবিক করে নিতে পারবো।”

নাজদের বৃদ্ধ বললো, “না, এটাও সঠিক সিদ্ধান্ত হলো না। তোমরা কি তার অনুপম বাচনভঙ্গি, মিষ্ট ভাযা, যুক্তিগ্রাহ্য কথা এবং তথাকথিত ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত মন মগজ আছন্নকারী ব্যাপারগুলো দেখনি? তোমরা যদি এই পদক্ষেপ নাও, তাহলে এমনও হতে পারে যে, সে অন্য কোন আরব গোত্রে গিয়ে হাজির হবে, আর তার মিষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী কথা দিয়ে তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং তারা তার অনুসারী হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের নিয়ে তোমাদের ওপর হামলা চালিয়ে তোমাদের দেশ দখল করে তোমাদের হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে। তোমরা এটা বাদ দিয়ে অন্য কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।”

এবার আবু জাহল বললো, “আমার একটা মত আছে য এতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কারো মাথায় আসেনি।” সবাই বললো, “বলো দেখি, আবুল হাকাম তোমার মত কি।”

সে বললো, “আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন শক্তিশালী সম্ভ্রান্ত যুবক বাছাই করতে হবে। তারপর তাদের প্রত্যেককে আমরা একটা করে ধারালো তরবারী দেবো। ওই যুবকেরা এক যোগে হামলা চালিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করবে। এভাবে আমরা তার থেকে নিস্তার পেতে পারি। আর তারা সবাই মিলে যখন এ কাজটা করবে, তখন মুহাম্মাদের খুনের দায় দায়িত্ব সকল গোত্রের ঘাড়েই কিছু না কিছু পড়বে। ফলে আবদ মানাফ গোষ্ঠী সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে লড়াই করে খুনের প্রতিশোধ নিতে পারবে না। রক্তপণ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে। আমরা সকল গোত্র মিলে তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেবো।”

নাজদের বৃদ্ধ বললো, “এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।”

এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পরামর্শ সভার সমাপ্তি ঘোষনা করা হলো এবং সবাই যার যার বাড়ীতে চলে গেলো।

তৎক্ষণাৎ জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস তাঁকে বললেন, “আপনি প্রতিদিন যে বিছানায় ঘুমান আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।”রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত ঘাতকের দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের দরজায় এসে সমবেত হয়ে ওত পেতে থাকলো। তিনি কখন ঘুমান তার প্রতীক্ষা করতে লাগলো। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর ওপর হামলা চালাবে এই তাদের বাসনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) বললেন, “তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও এবং আমার এই সবুজ হাদরামাউতী চাদর দিয়ে আপাদমস্তক আবৃত করে রাখ। তোমার ওপর তাদের দিক থেকে কোন আঘাত আসবে না, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমাবার সময় ঐ চাদরটি গায়ে জড়িয়ে নিতেন।

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব আল কারযী বলেন, ঘাতক দলে আবু জাহলও ছিলো। ঘাতকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ীর দরজার জাময়েত হলে আবু জাহল তাদেরকে বললো, “ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে যে, তোমরা যদি তার অনুসরণ কর তাহলে তোমাদের আরব ও অনারব সবার জন্য জর্ডানের বাগ বাগিচার মত অসংখ্য বাগ বাগিচা তৈরী করে দেয়া হবে। কিন্তু যদি তার অনুসরণ না কর তা হলে তোমরা ধ্বংস ও নির্মূল হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করে তোমাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে তাদের সামনে আসলেন। তিনি এক মুষ্ঠি ধূলি হাতে নিলেন। অতঃপর আবু জাহলকে লক্ষ্য করে বলতে লগলেন, “হ্যাঁ, আমি এ কথা বলি এবং যাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে তুমিও তাদেরই একজন।” এই সময় আল্লাহ তাদের দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিলেন। ফলে তারা তাঁকে দেখতে পেলো না। তিনি ঐ ধূলি তাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। তিনি তখন সূরা ইয়াসীনের নিন্মোক্ত আয়াতসমূহ পড়ছিলেন-

“ইয়াসীন! জ্ঞানের ভা-ার কুরআনের কসম, নিশ্চয়ই তুমি রাসূল। তুমি সঠিক পথের ওপর আছ। এ কুরআন মহাপরাক্রান্ত করুনাময়ের নাযিল করা, যাতে তুমি এমন একটি জাতিকে সাবধান করে দিতে পার যাদের পূর্বপুরুষদের সাবধান করা হয়নি। পলে তারা অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। তাদের অধিকাংশ লোকই আল্লাহর আযাবের যোগ্য তাই তারা ঈমান আনছে না। আমি তাদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। সেই বেড়িতে তাদের থুতনি পর্যন্ত শ্রংখলিত হয়ে গেছে। এ জন্য তারা মাথা উঁচু করে রয়েছে। আমি তাদের সামনে একটি প্রাচীর এবং পেছনে আরেকটি প্রাচীর দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি। তাই তারা দেখতে পায় না।” এই আয়াত কয়টি পড়তে পড়তে তিনি তাদের প্রত্যেকের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর নিজের ইচ্ছামত একদিক চলে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর বাইরের এক ব্যক্তি তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এখানে কি জন্য অপেক্ষা করছো?” তারা বললো, “আমরা মুহম্মাদের অপেক্ষায় আছি।” সে বললো, “আল্লাহ তোমাদেরকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। মুহাম্মাদ তো তোমাদের সামনে দিয়েই বেরিয়ে গেছে। তোমাদের মাথায় কি রয়েছে, তা কি দেখতে পাচ্ছো না?” তখন প্রত্যেকে মাথায় হাত দিয়ে দেখলো, ধূলিতে মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

অতঃপর তারা গৃহতল্লাশী শরু করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাদর গায়ে দিয়ে আলীকে (রা) বিছানায় শয়িত দেখে বললো, “এই তো মুহাম্মাদ, চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে।” তাই তারা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলো। সকালে আলী (রা) বিছানা থেকে উঠলে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো, “লোকটা তাহলে তো ঠিকই বলেছে যে, মুহাম্মাদ চলে গেছে।”

ইবনে ইসহাক বলেন, আবু বাক্র ছিলেন খুব ধনবান ব্যক্তি। তিনি রাসূলুল্লাহর কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়া করোনা। আল্লাহ হয়তো তোমাকে নিজের কথাই বলেছেন। তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে নিজের বাড়ীতে রেখেছিলেন। হিজরাতের প্রস্তুতিস্বরূপ তিনি এই কাজ করেছিলেন।

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাক্রের বাড়ীতে সকালে হোক বা বিকেলে দিনে অন্ততঃ একবার যেতে ভুলতেন না। সেই দিনটা এসে উপনীত হলো যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মক্কার স্বগোত্রীয়দেরকে ছেড়ে হিজরাত করে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। সেদিন তিনি দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন। ঐ সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখে আবু বাক্র বললেন, “নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে তা না হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় আসতেন না।” তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বাক্রের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা বিনতে আবু বকর ছাড়া আর কেউ ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা এখানে অন্য যারা রয়েছে, তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনার কি হয়েছে? আমাকে বলুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ আমাকে মক্কা থেকে চলে যাওয়ার ও হিজরাত করার অনুমতি দিয়েছেন।” আবু বাক্র বললেন, “আমিও কি সঙ্গে যেতে পারবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, তুমিও সঙ্গে যেতে পারবে?।” আয়িশা (রা) সবলেন, সেদিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও কাঁদতে পারে। আমি আবু বাক্র (রা) কে সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অত:পর আবু কাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।” অতঃপর তারা আবদুল্লাহ ইবনে আরকাতকে পথ দেখিয়ে নেবার জন্য ভাড়া করে সাথে নিলেন। সে ছিলো মুশরিক। উট দুটো তার কাছেই রেখে গেলেন। সে নির্ধারিত সময়ের জন্য উট দুটির দেখাশুনা ও তত্ত্বাবধান করতে থাকলো।

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা ত্যাগের সময় তাঁর মক্কা ত্যাগের কথা শধুমাত্র আলী ইবনে আবু তালিব (রা), আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এবং আবু বাকরের পরিবার পরিজন ছাড়া আর কেউ জানতো না। আলীকে ব্যাপারটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জানিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে মক্কায় কিছুদিন থাকতে বলেছিলেন। মক্কার লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নানা রকমের জিনিস গচ্ছিত রাখতো। যারা কোন জিনিস নিজের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করতো না তারা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমানত রাখতো। কারণ তাঁর সততা ও আমানতদারীর কথা সবার জানা ছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাতের পর ঐ আমানত ফেরত দেয়ার জন্যই তিনি আলীকে (রা) দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাকে মক্কায় আরো কিছুদিন থাকার নির্দেশ দেন।

এবার আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ী থেকে বের হবার পালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবু বাক্রের (রা) কাছে আসলেন। তারপর আবু বাক্রের ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে উভয়ে বের হলেন। অতঃপর তাঁরা মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত ‘সাওর’ পর্বতের একটি গুহার পাশে গিয়ে তার ভেতরে প্রবেশ করলেন। আবু বাকর তাঁর ছেলে ‘আবদুল্লাহকে বলে গেলেন, দিনের বেলায় লোকেরা তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলাবলি করে কিনা, তা যেন সে মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সব কথা জানায়। (মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম ও পরে স্বেচ্ছায় মজুরীর ভিত্তিতে কর্মরত) ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, সে যেন দিনের বেলায় তাঁর মেষপাল চরায়, অতঃপর সেগুলোকে সাওরের ঐ পর্বত গুহার কাছে ছেড়ে দেয় এবং সন্ধ্যার সময় পর্বত গুহায় তাঁদের সাথে দেখা করে। আসমা বিনতে আবু বাক্র প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তাঁদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন। [৪৩. হাসান বসরী (রহঃ) থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ও আবু বাক্র (রা) সাওর পর্বত গুহায় পৌঁছেন রাতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রবেশের আগে আবু বাক্র (রা) গুহায় প্রবেশ করলেন। সেখানে কোন হিং¯্র প্রাণী বা সাপ আছে কিনা তা ভালো করে দেখে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ]আবু বাক্রকে (রা) সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওর পর্বত গুহায় তিনদিন অবস্থান করেন। এদিকে কুরাইশরা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য একশো উট পুরস্কার ঘোষণা করলো। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সারা দিন কুরাইশদের সাথেই মিলেমিশে থাকতেন এবং তাদের সলাপরামর্শ শুনতেন। তারা তাঁদের উভয়ের সম্পর্কে যা যা মন্তব্য করতো তাও শুনতেন। অতঃপর সন্ধ্যার সময় তাঁদের কাছে গিয়ে সারা দিনের যাবতীয় খবর জানাতেন। আর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরা মক্কাবাসীদের পশুপালের সাথেই আবু বাকরের (রা) মেষপাল চরিয়ে বেড়াতো। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সেগুলোকে ‘সাওর’ পর্বতগুহার কাছে নিয়ে ছেড়ে দিতো, তখন তাঁরা উভয়ে মেষের দুধ দোহন করতেন অথবা জবাই করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র সকালে ‘সাওর’ পর্বত গুহা থেকে বেরিয়ে মক্কায় যেতেন তখন আমের ইবনে ফুহাইরা তার মেষপাল নিয়ে পিছু পিছু যেতেন যাতে তার পদচিহ্ন মুছে যায়। এভাবে তিনদিন অতিবাহিত হলে তাদের সম্পর্কে মক্কাবাসীদের হৈ চৈ ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসলো। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আরাকাত নিজে একটি উটে চড়ে রাসূলুল্লাহ ও আবু বাক্রের (রা) উট দুটিকে সাথে নিয়ে সাওর পর্বত গুহায় হাজির হলো। আসমা বিনতে আবু বাকর পথের খাবার নিয়ে তাদের কাছে আসলো। কিন্তু খাবার ঝুলিয়ে বেঁধে দেয়ার মত কোন রশি আনতে সে ভুলে গিয়েছিলো। উভয়ে রওনা হলেন। আসমা খাবার ঝুলানো চেষ্টা করলো, কিন্তু দেখলো কোন রশি নেই। অগত্যা সে নিজের কোমর বন্ধনী খুলে তা ফেড়ে রশি বনিয়ে খাবার বেঁধে ঝুলিয়ে দিলো। এই জন্য আসমা বিনতে আবু বাক্রকে ‘যাতুননিতাকাইন’ দুটি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণীর বলে অভিহিত করা হতো। [৪৪.ইবনে হিশাম বলেন, আমি একাধিক বিজ্ঞজনের কাছে শুনেছি যে, আমাকে যাতুননিতাকাইন অর্থাৎ ‘দুই কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হতো। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, আসমা যখন খাবারের পাত্র বেঁধে ঝুলিয়ে দিতে চাইলো, তখন নিজের বেল্টটি দ্বিখ-িত করলো, একটি দিয়ে তা ঘুরিয়ে বাঁধলো, অপরটি দিয়ে ঝুলালো।]

আবু বাক্র উট দুটোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এনে সবচেয়ে ভালো উটটি তাঁকে দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবার হোক। এতে আরোহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে উট আমার নয় তাতে আমি আরোহণ করবো না।” তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটি আপনার। আপনার উপর আমার পিতামাতা কুরবান হোক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না তবে কত দাম দিয়ে এটি কিনেছো বল।” আবু বাক্র উটের দাম বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি এই দামের বিনিময়ে উটটি নিলাম।” আবু বাক্র বললেন, “উট ও তার দাম উভয়ই আপনাকে দিয়ে দিলাম।”

অতঃপর উভয়ে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ভৃত্য আমের ইবনে ফুহাইরাকে পথিমধ্যে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য পেছনে চড়িয়ে নিলেন।”

আসমা বিনতে আবু বাকর বলেন, আবু বাক্র (রা) ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হয়ে যাওয়ার পর আবু জাহল সহ কুরাইশদের একটি দল আসলো। তারা আবু বাক্রের (রা) দরজার সামনে দাঁড়ালো। আমি তাদের কাছে গেলাম। তারা বললো, “তোমার আব্বা কোথায়? ” আমি বললাম, ‘আব্বা কোথায় জানি না।” সঙ্গে সঙ্গে পাষ- নরাধম আবু জাহল আমার মুখে এমন জোরে থাপ্পর মারলো যে, আমার কানবালাটি ছিটকে পড়ে গেলো।

অতঃপর তারা চলে গেলো। ইতিমধ্যে তিনদিন কেটে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিকে রওয়ানা হয়েছেন তার কোন হদিস পাওয়া গেলো না। হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে এক জিন গান গাইতে গাইতে আসলো। লোকেরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলো না। কিন্তু তার আওয়াজ শুনে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো। দেখতে দেখতে সে মক্কার উচ্চভূমি অতিক্রম করে চলে গেল। সে যে গানটি গাচ্ছিলো তা হলো:

[আরবী *************]

“মানুষের প্রভু আল্লাহ সেই দুই বন্ধুকে সর্বোত্তম পুরস্কার দিক-যারা উম্মে মা’বাদের বাড়ীতে [৪৫. উম্মে মা’বাদের প্রকৃত নাম আতিকা বিনতে খালিদ। সে বনু কা’ব গোত্রের এক মহিলা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘আবু বাক্র, আমের ইবনে ফুইহারা ও আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত এই মহিলার বাড়ীতে যাত্রাবিরতি করেন। তাঁরা এই মহিলার কাছ থেকে কিছু গোশত ও খোরমা ক্রয়ের ইচ্ছা ব্যাক্ত করেন। কিন্তু সেখানে কোনটাই ছিলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে মা’বাদের ঘরের এক কোণে একটা ছাগল দেখতে পেলেন। ছাগলটি দুধ দিতো না। তিনি ঐ মহিলার নিকট ছাগলটির দোহন করার অনুমতি চাইলেন। অতঃপর তিনি হাত দেয়ে তার পালান ধরতেই তা দুধে ভরে উঠলো। এ দৃশ্য দেখে মহিলা তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন]

আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তারা বদান্যতা সহকারে যাত্রাবিরতি করেছে, অতঃপর পুনরায় যাত্রা করেছে। যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের বন্ধু হয়েছে, সে সফলকাম হয়েছে। বনু কা’বের যুবতীটির মুসলিমদের ব্যবস্থা তদারক করার জায়গায় উপস্থিত থাকা ও উপবিষ্ট থাকার জন্য সমগ্র বনু কা’বই অভিনন্দিত হোক।”

তার এ কথা শুনে আমরা বুঝতে পারলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন।”

সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’সাম বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পথে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা তাঁকে পাকড়াও করে আনার বিনিময়ে একশো উষ্ট্রী পুরস্কার ঘোষণা করেন। একদিন আমি নিজ গোত্রের পরামর্শ সভায় বসে আছি আমাদেরই এক ব্যক্তি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। সে বললো, “আল্লাহর শপথ, আমি এই মাত্র তিনজনের একটা দলকে যেতে দেখে আসলাম। আমার মনে হয়, তারা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গী সাথীরাই হবে।” আম তাকে চোখ টিপে চুপ করতে ইশারা করলাম। অতঃপর বললাম, “ওরা অমুক গোত্রের লোকজন। তাদের একটা পশু হারিয়ে গেছে, সেটাই খুঁজে বেড়াচ্ছে।” সে বললো, “হয়তো তাই।”

সে আর কোন কথা বললো না। সেখানে অল্প কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি বাড়ীতে গেলাম এবং ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। আমার ভাগ্য গণনার তীরটিও সাথে নিলাম। তারপর যুদ্ধের পোশাক পরে রওয়ানা হলাম। পথে বেরিয়ে এক জায়গায় গিয়ে তীর দিয়ে ভাগ্য গণনা করলাম। যা আমার একেবারেই অপছন্দ, তীর ঠিক সেই ভবিষ্যদ্বণীই করলো। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদের কোন ক্ষতি হবে না।’ আসলে আমার ইচ্ছা ছিলো তাকে পাকড়াও করে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়ে পুরস্কারের একশো উষ্ট্রী লাভ করা। তাদের পদচিহ্ন ধরে আমি দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে চললাম ঘোড়টি আমাকে নিয়ে যেইমাত্র প্রবল বেগে ছুটতে আরম্ভ করেছে, অমনি সেটি হোঁচট খেলো। আমি ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে ছিটকে রাস্তার ওপর এসে পড়লাম। আমি তখন মনে মনে বললাম,‘ব্যাপার কি!’ আবার ভাগ্য গননার তীর বের করে তা দিয়ে গণনা করলাম। এবারও একই ফল পাওয়া গেলো: ‘তার কোন ক্ষতি হবে না।’ অথচ এরূপ সিদ্ধান্ত আমার কাম্য ছিলো না। আমি তবুও নাছোড়বান্দা।

কিছুতেই থামতে রাজী নই। আবার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে জোরে ঘোড়া হাঁকালাম। মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীরা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেলো এবং তাদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই মুহূর্তে ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। আমি ছিটকে পড়লাম। মনে মনে বললাম ব্যাপার কি! আবার তীর বের করে গণনা করলাম। এবারও অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্ত বেরুলো: ‘তাঁর কোন ক্ষতি হবে না।’ এবারও আমি দমলাম না। তাদেরকে অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম। আবার তাদেরকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। দেখতে পাওয়া মাত্রই ঘোড়া আবার হোঁচট খেলে এবার ঘোড়ার সামনের পা দুটি মাটিতে দেবে গেলো এবং আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। পা দু’খানা টেনে বের করার সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা থেকে কু-লি পাকিয়ে ধোঁয়া বের হতে থাকলো। এবার আমি বুঝতে পারলাম যে, মুহাম্মাদকে আমার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং সে অজেয়। অতঃপর আমি তাদেরকে ডাক দিয়ে বললাম, “আমি জুসামের পুত্র সুরকা। তোমরা একটু থামো, তোমাদের সাথে আমার কথা আছে। আল্লাহর শপথ, তোমাদের ব্যাপারে আমার সংশয় দূর হয়ে গিয়েছে। আমার দিক থেকে কোন অবাঞ্ছিত ব্যাবহার তোমরা পাবে না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে বললেন, “তাকে জিজ্ঞেস করো সে আমাদের কাছে কি চায়?” আমি বললাম, “আমাকে একটা বাণী লিখে দাও। সেই লেখা তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা প্রমাণস্বরূপ থাকবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে কিছু লিখে দিতে বললেন।

আবু বাক্র (রা) একটা হাড়ের ওপর (অথবা কাপড়ের টুকরায় অথবা ভাঙ্গা মৃৎ পাত্রের টুকরায়) একটা বাণী লিখে আমার দিকে ছুড়ে মারলেন। আমি সেই টুকরাটা কুড়িয়ে নিলাম এবং আমার তীরের খাপের মধ্যে পুরে নিয়ে ফিরে আসলাম। এই ঘটনার কথা অতঃপর আর কারো কাছে ব্যক্ত করলাম না। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলেন এবং হুনাইন ও তায়েফ অভিযান সম্পন্ন করলেন, তখন আমি ঐ লেখাটা নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী জো’রানায় তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি আনসারদের একটি সেনাদলের কাছে উপস্থিত হলাম। তারা বর্শা দিয়ে আমাকে মৃদু খোঁচা দিতে দিতে বললো, “ভাগো, ভাগো। কি চাও এখানে?” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তখন উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। আমি যেন এই মুর্হূতেও দেখতে পাচ্ছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চর্বির মত সচ্ছ ও শুভ্র পাদু খানি জিনের পাদানিতে রেখে বসে আছেন। আমি সেই লিখিত টুকরাটি উঁচু করে দেখিয়ে বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটি সেই বস্তু যাতে আপনি একটি বাণী লিখে দিয়েছিলেন। আমি জুসামের পুত্র সুরাকা। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আজ ওয়াদা পালন ও সৌজন্য প্রদর্শনের দিন। কাছে আস।” আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করার মত একটি বিষয় মনে হলে তা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু এখন তা মনে সেই। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজের উটের জন্য পানি দিয়ে চৌবাচ্চা ভরে রাখি। কিন্তু অন্যদের পথহারা উটগুলো এসে তার ওপর চড়াও হয় এবং পানি পান করে ফেলে। এভাবে ঐ সব উটকে পানি পান করাই তা হলে আমার সওয়াব হবে কি? তিনি বললেন, “ যে কোন প্রাণীর চাহিদা পূরণ করলেই সওয়াব হয়।” এরপর আমি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গেলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার সদকার প্রাণী পৌঁছিয়ে দিলাম।

ইবনে ইসহাক বলেন, পথপ্রদর্শক আবদুল্লাহ ইবনে আরকাত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সাথে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে এগিয়ে চললো। অতঃপর উপকূলবর্তী এলাকায় গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে উসফান অঞ্চলের নিম্নভূমি দিয়ে অগ্রসর হয়ে কুদাইদ অতিক্রম করার পর খাররার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর লেকফ্ ও মাদলাজা লেকফ্ অতিক্রম করে মাদলাজ মাহাজ নামক জায়গায় পৌঁছলো। সেখান থেকে মারজাহ মাহাজ, মারজাহ যিল গাদাওয়াইন তারপর বাতন যি কাশর ও জাদাজিদ হয়ে আজরাদ পৌঁছলো। তারপর মাদলাজা তিহিনের শত্রু এলাকা যা-সালাম অতিক্রম করে আবাবিদ ও তারপরে আল-ফাজ্জাহ অতিক্রম করলো।

ইবনে হিশাম বলেন, অতঃপর সে তাদেরকে নিয়ে আরজ নামক স্থাকে উপনীত হলো। তাখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস ইবনে হাজার নামক স্থানে উপনীত হলো। তখন সেখানকার অধিবাসীদের বেশ কিছু লোক সেখানে তাদের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলো। আসলাম গোত্রের আওস হাজার নামক এক ব্যক্তি ইবনুর রিদা নামক তার একটা উটে আরোহণ করিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। মাসউদ ইবনে হুনাইদা নামক তার এক ভৃত্যকেও সে তাঁর সাথে পাঠালো। এরপর পথপ্রদর্শক তাদের উভয়কে নিয়ে আরজ ত্যাগ করলো। রুকুবার ডান দিক দিয়ে সানিয়াতুল আয়ের হয়ে বাতনু রীমে গিয়ে উপনীত হলো। সেখান থেকে সরাসরি কুবায় বনু আমর ইবনে আউফ গোত্রের বসতিতে গিয়ে হাজির হলো। তখন ছিলো রবিউল আউয়াল মাসের বার তারিখের প্রখর রৌদ্র ঝলসানো দুপুর। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে এসে গিয়েছে।


কুবায় উপস্থিতি
আবদুর রহমান ইবনে উয়াইমি ইবনে সায়েদা স্বগোত্রীয় বিপুল সংখ্যাক সাহাবীর এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: আমরা যখন শুনতে পেলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে রওয়ানা হয়েছেন এবং যে কোন দিন মদীনায় পৌঁছতে পারেন বলে আমরা মনে করছিলাম, তখন থেকে প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর আমাদের এলাকার উন্মুক্ত প্রন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতীক্ষা করতাম। সূর্যের উত্তাপ অসহনীয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সরতাম না। যখন আর কোন ছায়া থাকতো না তখন ফিরে যেতাম। তখন ছিলো প্রচ- গরমের মৌসুম। যে দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যি সত্যি এসে পৌঁছলেন, প্রতিদিনের মত সেদিনও আমরা প্রান্তরে বসে অপেক্ষা করছিলাম। সূর্য মাথার ওপর আসার কারণে যখন কোন ছায়া অবশিষ্ট থাকলো না তখন আমরা বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছলেন। একজন ইহুদী সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছিলো। আমরা কিভাবে তাঁর অপেক্ষায় থাকতাম তা সে দেখেছিলো। তাই সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, “হে কায়লার বংশধরগণ, [৪৬. এ কথা দ্বারা সমগ্র আনসারদেরকে বুঝায়। কায়লা তাদের এক খ্যাতনামা পিতামহী ছিলেন।]

তোমাদের সৌভাগ্যের ধন এসে গিয়েছে।”

আমরা একটা খেজুর গাছের ছায়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলাম। তাঁর প্রায় সমবয়সী আবু বাক্র (রা) তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আমাদের অধিকাংশ লোকই তখন পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেনি। তাঁকে দেখার জন্য বিরাট জনতার ভিড় জমলো অথচ কে আবু বাক্র আর কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কেউ বুঝতে পারছিলো না। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরের ওপর থেকে ছায়া সরে গেলো, তখন আবু বাক্র (রা) নিজের চাদর দিয়ে তাঁকে ছায়া দিতে লাগলেন। তখন আমরা সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনতে পারলাম।

ইবনে ইসহাক বলেন, অনেকের মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম কুলসূম ইবনে হিদামের, আবার কারো মতে সা’দ ইবনে খাইসামার মেহমান হন। যারা বলেন, তিনি কুলসূম ইবনে হিদামের মেহমান হয়েছিলেন, তাঁরা বলেন যে, তিনি কুলসূমের বাড়ীতে থাকলেও লোকজনকে সাক্ষাত দানের জন্য অকৃতদার সা’দ ইবনে খাইসামার বাড়ীতে গিয়ে বসতেন। মুহাজিরদের ভেতরে যারা অবিবাহিত তাঁরাও ঐ বাড়ীতেই থাকতেন। আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) মেহমান হন হাবিব ইবনে ইসাফের, মতান্তরে খাবেজা ইবনে যায়িদের।

আলী ইবনে আবু তালিব (রা) মক্কায় তিন দিন অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গচ্ছিত আমানতসমূহ মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেন এবং তারপর হিজরাত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে যান। তিনিও কুলসূম ইবনে হিদামের মেহমান হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুবাতে ইবনে আওফ গোত্রে সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার এই চার দিন অবস্থান করেন। এই সময় তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

মদীনায় উপস্থিতি
অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি শুক্রবার কুবা ত্যাগ করেন। বনু সালেম ইবনে আওফের বস্তিতে গিয়ে তিনি জুমার নামায পড়েন। বাতনুল ওয়াদীর মসজিদে তিনি জুমার নামায আদায় করেন। বাতনুল ওয়াদীর আর এক নাম ওয়াদীয়ে রানুনা। এখানেই তিনি মদীনায় প্রথম জুমার নামায আদায় করলেন।

ইতবান ইবনে মালিক ও আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা সহ বনু সালেম ইবনে আওফের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তাতে খুশী হয়ে আমাদের এখানেই আপনি স্থায়ীভাবে বসবাস করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের উষ্ট্রীকে দেখিয়ে বললেন, “একে তোমরা পথ ছেড়ে দাও। আল্লাহর তরফ থেকে এটির ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার।” সবাই তাই করলো। উষ্ট্রী নিজের ইচ্ছামত চলতে লাগলো। বনু বায়াদা গোত্রের বস্তির নিকট যখন হাজির হলো, তখন যিয়াদ ইবনে লাবীদ ও ফারওয়া ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু বায়াদা গোত্রের একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের এখানে আসুন, আমাদের যে জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে তাঁর মধ্যে এসে বসবাস করুন।” তিনি বললেন, “এই উষ্ট্রীকে তার ইচ্ছামত যেতে দাও। কেননা ওকে যথাস্থানে আমাকে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ” উষ্ট্রীটি চলতে লাগলো। বনু সায়েদার বস্তিতে পৌঁছলে সা’দ ইবনে উবাদা ও মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে বনু সায়েদার একদল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারাও বনু বায়াদা ও বনু সালেমের মত একই অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু বায়াদা ও বনু সালেমকে যে কথা বলেছিলেন বনু সায়েদাকেও তাই বললেন। উষ্ট্রী অগ্রসর হতে লাগলো। যখন সেটি খাযরাজ গোত্রের বনু হারেস পরিবারের বাড়ীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলো, তখন সা’দ ইবনে রাবী, খবেজা ইবনে যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বনু হারেস পরিবারের আরো কিছু লোককে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ আগলে দাঁড়ালো। তারা তাদের পরিবারে অবস্থান করা ও তাদের জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ওপর আস্থা রাখার আমন্ত্রণ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা উষ্ট্রীকে যেতে দাও। কেননা এটি আমাকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট।” সকলে পথ ছেড়ে দিলো এবং উষ্ট্রীটা সামনের দিকে এগিয়ে চললো। চলতে চলতে উষ্ট্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মামাদের পরিবার বনী আদী ইবনে নাজ্জারের বাড়ী অতিক্রম করলো। তখন বনী আদী ইবনে নাজ্জারের কতিপয় লোককে সাথে নিয়ে সালীত ইবনে কায়েস ও আবু সালীত উসাইরা ইবনে আবি খাবিজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনারা আমাদের কাছে আসুন এবং আমাদের যা কিছু জনবল, সহায় সম্বল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, তার ওপর আস্থা রাখুন।” তিনি বললেন, “উষ্ট্রীকে তার খেয়াল খুশীমত যেতে দাও। কারণ ওকে উপযুক্ত স্থানে আমাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” এখানে উল্লেখ থাকে যে, বনী আদী ইবনে নাজ্জারেরই মেয়ে ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের মা সালামা বিনতে আমর।

বনু মালিক ইবনে নাজ্জারের বাসস্থানের কাছে এসে উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। সে যেখানে বসলো সেখানেই পরবর্তীকালে সমজিদে নববীর প্রবেশদ্বার তৈরী হয়। তৎকালে ঐ জায়গাটা ছিলো বনু নাজ্জারের দুটো ইয়াতীম শিশুর খেজুর শুকাবার জায়গা। শিশু দুটো হলো আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইল। তাদের লালন পালন করতো মায়য ইবনে আকরা। উষ্ট্রী হাঁটু গেড়ে বসলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিঠ থেকে নামলেন না। স্থির হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষন পর উষ্ট্রীটি সামান্য কিছুদূর এগিয়ে গেলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও তার লাগাম শক্ত করে ধরে রাখলেন। অতঃপর উষ্ট্রী পিছনের দিকে ফিরে তাকালো এবং পুনরায় তাঁর প্রথম বিরতি স্থানে ফিরে এলা। সেখানে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। এবারে সে নড়াচড়া ও শব্দ করলো। তার বুক ও গলার নিম্নাংশ মাটিতে ঠেকিয়ে দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উষ্ট্রীর পিঠ থেকে নামলেন। আবু আইয়ুব খালিদ ইবনে যায়িদ তাঁর আসবাবপত্র নামিয়ে নিলো এবং নিজের ঘরে নিয়ে রাখলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের মেহমান হলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খেজুর শুকাবার জায়গাটা কার?” মায়ায ইবনে আকরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমরের ছেলে সাহল ও সুহাইলের। ওরা আমার পালিত ইয়াতীম। আমি তাদেরকে সম্মত করিয়ে নেবো। আপনি এখানে মসজিদ তৈরী করুন। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানে মসজিদ নির্মাণে আদিষ্ট হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মসজিদ ও ঘরবাড়ী তৈরী হওয়া পর্যন্ত আবু আইয়ুবের বাড়ী অবস্থান করলেন। এই মসজিদ নির্মাণের কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই যোগদান করেন, যাতে মুসলমানরাও অংশগ্রহণ করার প্রেরণা পায়। ফলে মুহাজির ও আনসারগণ সকলেই ঐ কাজে পূর্ণ আগ্রহের সাথে অংশ নেন। এ সম্পর্কে জনৈক মুসলমান স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন,

“আমরা যদি বসে থাকি আর নবী কাজ করেন, তা হবে আমাদের চরম ভ্রষ্টতার পরিচায়ক। ” মসজিদ নির্মানের সময় মাঝে মাঝেই মুসলমানরা উদ্দীপনার সাথে কবিতা বলতেন। যেমন: “আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। ” আর তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,“আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের গুরুত্ব নেই। হে আল্লাহ, আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।”

মসজিদ ও থাকার ঘর নির্মিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আইয়ুবের বাড়ী থেকে নিজের ঘরে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।

আবু আইয়ুব বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমার বাড়ীতে মেহমান হলেন, তখন তিনি নিচের তলায় থাকতে লাগলেন আর আমি ও আমার স্ত্রী উপরে। আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি উপরের তলায় থাকি আর আপনি নীচের তলায় থাকেন তা আমার কাছে নিতান্ত অপছন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। অতএব আপনি ওপরে থাকুন। আর আমরা নেমে এসে নীচে থাকি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, “আমাদের নীচে থাকাটা আমাদের জন্য এবং যারা আমাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে আসে তাদের জন্য অধিকতর সুবিদাজনক।”

এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচের তলায় এবং আমরা ওপরের তলায় বাস করতে লাগলাম। একবার আমাদের একটা পানি ভর্তি কলসী ভেঙ্গে গেলো। আমাদের একটি মাত্র কম্বল ছিলো আর কোন লেপ বা শীতবস্ত্র ছিলোনা। অগত্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গায়ে তা থেকে পানি পড়বে এবং তাতে তিনি কষ্ট পাবেন এই আশংকায় আমি ও আমার স্ত্রী ঐ কম্বলটা দিয়েই পানি মুছে ফেললাম।

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের জন্য খাবার তৈরী করে পাঠাতাম। তিনি ঐ খাবারের উদ্বৃত্তটুকু ফেরত পাঠালে আমি ও আমর স্ত্রী বরকতের আশায় তাঁর হাত লাগানো জায়গা থেকেই খেয়ে নিতাম। একদিন রাত্রে এইভাবে তাঁর জন্য খাবার পাঠালাম। সেই খাবারে আমরা কিছু পিঁয়াজ বা রসুনও দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফেরত পাঠালেন। আমরা ঐ খাবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত স্পর্শ করার কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। ফলে আমি ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার জন্য আমার বাপ-মা কুরবান হোক। আপনি খাবার ফেরত পাঠালেন অথচ তাতে আপনার হাতের স্পর্শের কোন চিহ্নই দেখলাম না। আপনি যখনই খাবার ফেরত দিতেন, আমি ও আমার স্ত্রী বরকত লাভের জন্য সেই খাবার আপনার হাত লাগানোর জায়গা থেকে খেতাম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি খাবারের মধ্যে অমুক গাছের গন্ধ পেয়েছি। যেহেতু আমাকে অনেকের মুখের কাছে মুখ নিয়ে আলাপ করতে হয়, তাই আমি খাইনি। অবশ্য তোমরা ওটা খেতে পার।” এরপর আমরা ঐ খাবার খেয়ে নিলাম। অতঃপর আর কখনো আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য পিঁয়াজ বা রসুন পাঠাইনি ইবনে ইসহাক বলেন এরপর মুহাজিররা হিজরাত করে একের পর এক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসতে লাগলেন। একমাত্র যারা বন্দী ছিলেন অথবা কঠোর নির্যাতনে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরাই মক্কায় থেকে গেলেন। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার ছাড়া আর সব কয়টি পরিবারেরই অবস্থা এরূপ ছিলো যে, তারা তাদের পরিবারের সব লোক এবং ধন সম্পদ মদীনায় নিয়ে আসতে পারেনি। যে কয়টি পরিবার তাদের সকল সদস্যসহ হিজরাত করতে সক্ষম হয়েছিলো তারা হলো,বনু জুমাহ গোত্রের বনু মাযউন পরিবার, বনু উমাইয়ার মিত্র বনু জাহাশ ইবনে রিয়াব এবং বনু সা’দ ইবনে লাইসের বনু বুকাইর পরিবার যারা বনু কা’বের মিত্র ছিলো। হিজরাতের পর এদের ঘরবাড়ী একেবারেই জনশূন্য ও অর্গলবদ্ধ ছিল।

মদীনাতে ভাষণ দান ও চুক্তি সম্পাদন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় পৌঁছেন এবং পরবর্তী বছর সফর মাস পর্যন্ত মদীনাতেই অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁর জন্য মসজিদ ও ঘর তৈরী করা হয়। উপরন্তু মদীনার আনসারদের এই গোত্রটির (বনু মালিক ইবনে নাজ্জার) ইসলাম গ্রহণের ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একমাত্র খতমা, ওয়াকেদ, ওয়ায়েক ও উমাইয়া এই চারটি পরিবার ছাড়াও আওস গোত্রের একটি গোষ্ঠী পৌত্তলিকতা আঁকড়ে থাকে।

আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান আমর কাছে বর্ণনা করেছেন যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রথম যে ভাষণ দেন তাতে প্রথমে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করেন। তারপর নিম্নবর্ণিত কথাগুলো বলেন:

“হে জনম-লী, তোমরা আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয় কর। জেনে রেখো, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ হয়তো সহসাই মারা যাবে, তার মেষপাল দেখার লোকও থাকবে না। অতঃপর তার রব জিজ্ঞেস করবেন। কোন দোভাষীও সেখানে থাকবে না। তিনি বললেন,‘তোমার কাছে কি আমার রাসূল আসেনি? আমি কি তোমাকে ধন সম্পদ অনুগ্রহ বিতরণ করিনি? তা থেকে তুমি কতটুকু আখিরাতের জন্য পাঠিয়েছো?’ তখন সে ডানে বামে তাকাবে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাবে না। সামনের দিকে তাকাবে। সেখানে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। যে ব্যক্তি নিজেকে দোযখ থেকে রক্ষা করতে পারে, তার নিজেকে রক্ষা করতে যত্নবান হওয়া উচিত তা যদি একটা খোরমার অংশ দিয়েও হয়। যার এটুকু ক্ষমতা সেই তারও উচিত অন্তত ভালো কথা বলে নিজেকে দোযখ থেকে রক্ষা করা। কেননা প্রতিটি ভালো কাজের পুরস্কার দশগুণ থেকে সাতশো গুণ পর্যন্ত দেয়া হয়। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।”

আরেকবার তিনি নিম্নরূপ ভাষণ দেন,

“সকল প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করি ও তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। আমরা তাঁর কাছে প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনা ও খারাপ কাজ থেকে আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করেন তাকে কেউ বিপথগামী করতে পারে না। আর আল্লাহ যার জন্য গুমরাহীর অনুমোদন দান করেন তাকে কেউ সুপথগামী করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক ও লা শরীক। বস্তুত: আল্লাহর কিতাব হলো সর্বোত্তম কথা। যে ব্যক্তির অন্তরে তিনি কুরআনকে আকর্ষণীয় করেছেন এবং যাকে কুফরীতে নিমজ্জিত থাকার পর ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন এবং যে মানুষের কথা বাদ দিয়ে কুরআনকে গ্রহণ করেছে সে সফলকাম। কেননা কুরআনের চেয়ে সুন্দর ও অলংকারম-িত কথা আর নেই। আল্লাহ যা পছন্দ করেন তোমরা তাই পছন্দ কর। আল্লাহকে সমগ্র মন দিয়ে ভালবাস। আল্লাহর বাণী চর্চা ও তাঁর স্মরণে গাফিল হয়ো না এবং মনকে কঠিন হতে দিও না। কেননা আল্লাহ তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টি থেকেই কিছু সংখ্যককে বাছাই করেন। তার আমল থেকেও কিছু আমলকে মনোনীত বলে স্থির করেছেন। তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকেও কিছু সংখ্যাক বান্দাকে মনোনীত করেছেন। তিনি উত্তম কথা পছন্দ করেন। মানুষকে কিছু দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হালাল ও হারাম দুই-ই আছে। অতএব আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করো না। তাঁকে যথার্থভাবে ভয় কর। তোমরা যে সব কথা মুখে বলে থাক তার ভেতরে যে কথা উত্তম তাকে কার্যে পরিণত করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সম্যবাদী হও, আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা গড়ে তোল। আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার লংঘিত হলে তিনি ক্রুদ্ধ হন। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে একটি ঘোঘনাপত্র সম্পাদন করেন। এই দলীলের মাধ্যমে তিনি ইহুদীদের সাথে শাস্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি প্রদান ও গ্রহণ করেন, তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও ধন সম্পদে তাদের মালিকানার স্বীকৃতি দেন এবং তদের সাথে কিছু শর্ত প্রদান ও গ্রহণ করেন। সে ঘোষণাপত্র নিম্নরূপ:

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কুরাইশ ও ইয়াসরিবের মু’মিন মুসলমানগণ এবং পরবর্তীকালে যারা তাদের অনুসারী হয়ে তাদের সাথে শরীক হবে ও একসাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে, তাদের পক্ষ থেকে এ একটি ঘোষণাপত্র। সমগ্র মানব জাতির মধ্যে তারা একটি স্বতস্ত্র উম্মাহ। কুরাইশদের মধ্য থেকে আগত মুহাজিররা তাদের ইসাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণœ থাকবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অটুট থাকবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মু’মিনদের মধ্যে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দীকে মুক্তি দেয়ার বিধান চালু থাকবে। বনু সায়েদাও তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মুমিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া চলবে। বনু হারেস তাদের ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সবেকী ক্ষতিপূরণ দানের নীতি অক্ষুণœ থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে বন্দীকে মুক্তপণের ভিত্তিতে মুক্তি দেয়ার রীতি অব্যাহত থাকবে। আর বনু জুশামও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দী মুক্তির নীতি অক্ষুণœ থাকবে। বনু নাজ্জারও ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে। বনু আমর ইবনে আওফ ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি অব্যাহত থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়া চলবে। বনু নাবীত ইসলাম গ্রহণকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের সাবেকী ক্ষতিপূরণ দানের রীতি চালু থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণ নিয়ে বন্দী মুক্তির নীতি অব্যাহত থাকবে। বনু আওস ইসলাম গ্রহনকালীন অবস্থার ওপর বহাল থাকবে। তাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর মু’মিনদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মুক্তিপণের ভিত্তিতে বন্দীকে মুক্তি দেয়া চলবে। মু’মিনগণ তাদের মধ্যকার ঋণগ্রন্ত ও অধিক সন্তানধারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও মুক্তিপণদানে সঙ্গতভাবে আর্থিক সাহায্য করবে। কোন মু’মিন অন্য মু’মিনের মিত্রের বিরোধিতা করবে না। খোদাভীরু মু’মিনগণ তাদের মধ্যকার বিদ্রোহী, ঘোরতর নির্যাতক, অপরাধী, মুসলিম সমাজের স্বার্থের ক্ষতিকারক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারকের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যাবস্থা নেবে এবং এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে, চাই সে তাদের কারো ছেলেই হোক না কেন। কোন কাফিরের স্বার্থে এক মু’মিন অন্য মু’মিনকে হত্যা করবে না এবং কোন কাফিরকে কোন মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। মুসলিম রাষ্ট্রে অনুগত অমুসলিমের অধিকার সমানভাবে নিরাপদ। একজন নগণ্যতাম অমুসলিমকেও মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তাসহ আশ্রয় দেবে। মু’মিনরা পরস্পরের মিত্র হয়ে থাকবে, তবে অন্যদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। আর ইহুদীদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি আমাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করবে, সে আমদের সমান অধিকার ও সাহায্য লাভ করবে। এ ধরনের লোকদের ওপর কোন যুলুম চলতে দেয়া হবে না এবং তাদের ওপর কাউকে হামলা চালাতে সাহায্য করা হবে না। মু’মিনদের রক্ষাকবচ সবার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। ইসলামের স্বার্থে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলে সেই যুদ্ধে মুসলমান কোন অমুসলমানের সাথে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ছাড়া আপোষরফা করবে না। আমাদের মধ্য হতে প্রতিটা যোদ্ধাদল অন্য যোদ্ধাদলকে অনুসরণ করবে। মুমিনদের একজন অন্যজনকে হত্যা করতে পারবে শুধুমাত্র হত্যার বিনিময়ে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে। খোদাভীরু মু’মিনগণ সর্বশ্রেষ্ঠ ও দৃঢ়তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মদীনার কোন মুশরিক কুরাইশ সম্প্রদায়ের কারো জানমালেরর্ কষক বা জিম্মাদার হতে পারবে না, আর কোন মু’মিনের ক্ষতি সাধনে তাকে প্রশ্রয় দেবে না। যে ব্যক্তি কোন মু’মিনকে মৃত্যুদ- অপরাধ না করা সত্ত্বেও হত্যা করবে এবং তা যথাযথভাবে প্রমাণিত হবে, তাকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হবে। অবশ্য নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে অন্য কোন উপায়ে খুশী করে থাকলে প্রাণদ- হবে না। তবে সর্বাবস্থায় মুমিনরা সকলে ঐ মুসলিম হন্তার বিরুদ্ধে থাকবে এবং তার পক্ষপাতিত্ব করা কোন মুমিনের জন্য হালাল হবে না। এই ঘোষণাপত্রকে মেনে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে অটুট বিশ্বাস রাখে এমন কোন মু’মিনের জন্য ইসলামী বিধানে উদ্ভট জিনিস সংযোজনকারীর সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ নয়। যে ব্যক্তি এ ধরনের লোককে সাহায্য করবে কিংবা আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহর লা’নত এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহর গজব নামবে। তার পক্ষে কোন সুপারিশ বা পণ গ্রহণ করা হবে না। আর তোমরা যখনই কোন বিষয়ে মতবিরেধে লিপ্ত হবে, তখন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হবে।

মু’মিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদের যুদ্ধের রসদ যোগানোতে অংশ নেবে। বনু আওফের ইহুদিরা মু’মিনদের সাথে একই উম্মাতভুক্ত বলে গণ্য হবে, তারা নিজে এবং তাদের মিত্ররাও। কিন্তু মুসলমানরা ও ইহুদীরা সে অবস্থায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। তবে যে ব্যক্তি যুলুম অত্যাচার ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হবে সে কেবল নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসই ডেকে আনবে। বনু নাজ্জারভ্কুত ইহুদীদের অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান। অনুরূপভাবে বনু হারেস, বনু সায়েদা, বনু জুশাম, বনু আওস, বনু সা’লাবা ও বনু শতাইবার ইহুদীদের অধিকার বনু আওফের ইহুদীদের সমান। তবে যুলুম অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত ব্যাক্তি নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের কেবল ধ্বংসই সাধন করবে। সা’লাবার যাবতীয় বাহ্যিক ব্যাপার তাদের ভেতরকার ব্যাপারের সমপর্যায়ে তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতা যেন সাবাইকে পাপাচার থেকে রক্ষা করে। সা’লাবার মিত্রদের অধিকার তাদের নিজেদেরই সমান। ইহুদেিদর আভ্যন্তরীণ ব্যাপার তাদের প্রাণের মতই সম্মানার্হ। তাদের ভেতর থেকে কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ছাড়া মদীনার বাইনে যেতে পারবে না। প্রত্যেকের জেনে রাখা উচিত যে, কোন প্রকারের তর্ক বা জেরা দ্বারা আগুন থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করলো সে নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের ধ্বংসের বিনিময়েই হত্যা করলো। অবশ্য নিহত ব্যক্তি অপরাধী হলে আলাদা কথা। আল্লাহ তায়ালা এ ক্ষেত্রে অধিকতর মহানুভবতা পছন্দ করেন। ইহুদীদের ব্যয়ভার তারা নিজেরাই বহন করবে এবং মুসলামানদের ব্যয়ভারও তারা নিজেরাই বহন করবে। এই ঘোষণাপত্রকে যারা মেনে নিয়েছে তদের কর্তব্য, কোন শরীক যুদ্ধরত থাকলে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা এবং পরস্পরের মধ্যে হিতকামনা, সদুপদেশ ও মহানুভবতার সম্পর্ক থাকবে, কোন পাপা কাজে একজন আর একজনের সাথে শরীক হবে না। নিজের মিত্রের ক্ষতি সাধন এক ভয়ংকর নজিরহীন অপরাধ। মাযলুমকে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য। মু’মিনরা যতদিন যুদ্ধরত থাকবে ততদিন ইহুদীরা তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাবে। [৪৭. অর্থাৎ আল্লাহ ও মুমিনগণের তাদের সহযোগিতা নিতে আপত্তি নেই।] এই ঘোষণাপত্রের শরীকদের জন্য ইয়াসরিবের অভ্যন্তরে ভাগ সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রতিবেশী যদি অপরাধী না হয় এবং ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত না থেকে থাকে তা হলে তার জান, মাল ও ইজ্জত নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের মতই পূর্ণ নিরাপত্তার অধিকারী। কারো বাড়ীর ভেতরে বাড়ীর মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না। এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের মধ্যে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা ঝগড়া কলহ ঘটুক না কেন, তার ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরণাপন্ন হতে হবে। আল্লাহ সর্বাধিক সতর্কতা ও সততার সাথে এই ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন দেখতে আগ্রহী।[৪৮. উল্লেখযোগ্য যে, এই ঘোষণাপত্র যখন গ্রহণ করা হয় তখন জিজিয়া আরোপ করা হয়নি এবং মুসলমানগণ দুর্বল ছিল। সে সময় ইহুদীরা মুসলমানদের পক্ষে যুদ্ধ করলে যুদ্ধলব্ধ সম্পদে ইহুদীদের অংশ থাকতো। এই ঘোষণাপত্রে তাদের জন্য যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল।] জেনে রাখা দরকার যে, কুরাইশ ও তাদের সহযোগীদের আশ্রয় দেয়া চলবে না। ঘেষনাপত্র গ্রহণকারীগণ মদীন আক্রমণকারীকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে। আর যখন সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপনের আহ্বান জানানো হবে তখন তারা আহ্বানকারীর সাথে সন্ধি ও মৈত্রী স্থাপন করবে। এ ধরনের কোন সন্ধি ও মৈত্রীর দিকে তাদেরকে যখন আহ্বান জানানো হবে তখন তা মেনে চলা মু’মিনদের জন্যও বাধ্যতামূলক হবে। তবে যে বা যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকরবে তখন তারা তাদের প্রাপ্য অংশ সেই পক্ষের নিকট থেকে নেবে যে পক্ষ তাদেরকে বাহিনীতে ভর্তি করেছিল। আওসে ইহুদীদের ও তাদের মিত্রদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব এই ঘোষণাপত্র গ্রহণকারীদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের মতই এবং ঘোষণাপত্র সম্পাদনকারীদের কাছ থেকে তারা পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লাভ করতে পাবে। কেউ সততার পথ অবলম্বন করলে তার পূর্বতন পাপাচার ক্ষমার চোখে দেখতে হবে। কেউ খারাপ কাজ করলে তা তার নিজেরই ক্ষতি সাধন করবে। আল্লাহ এই ঘোষণাপত্রের আনুগত্রের ব্যাপারে সর্বধিক সততা ও সত্যবাদিতা দেখতে চান। এই ঘোষণাপত্র কোন অত্যাচারী বা অপরাধীর জন্য রক্ষকবচ নয়। যুলুম কিংবা অপরাধে লিপ্ত না হলে য্দ্ধু থেকে বেরিয়ে যাওয়া কিংবা নিস্ক্রিয় বসে থাকা লোকও মদীনার চৌহদ্দির ভেতরে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি সততা ও খোদাভীতির পথে অবিচল থাকবে, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আশ্রয়দাতা ও সহায়ক থাকবেন।”

আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন
ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আসসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন। তিনি যা বলেননি, তা তার ওপর আরোপ করা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। আমি জানতে পেরেছি যে, তিনি প্রতি দুইজনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি আলী ইবনে আবু তালিবের হাত ধরে বললেন, “এ হলো আমার ভাই।” এভাবে নবীদের সরদার, মুত্তাকীদের নেতা, বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের রাসূল, বিশ্বজাহানে যাঁর কোন জুড়ি নেই- তিনি আর আবু তালিব তনয় আলী (রা) নতুন করে ভ্রাত্র বন্ধনে আব্দধ হলেন। আর আল্লাহ ও রাসূলের সিংহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও যায়িদ ইবনে হারেসার ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপিত হলো। উহুদ যুদ্ধে যাওয়ার প্রক্কালে হামযা অছিয়ত করে গিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত্যু হলে যায়িদ ইবনে হারেসা তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। আবু তালিবের পুত্র জাফর তাইয়ার ও বনু সালামা বংশোদ্ভূত মুয়ায ইবনে জাবাল পরস্পর ভ্রাতৃ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উমার ইবনুল খাত্তাব ও ইতবান ইবনে মালিক পরস্পর ভাই হন। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ ও সা’দ ইবনে মুয়ায, আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও সা’দ ইবনে রাবী, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সালামা ইবনে সুলামা, উসমান ইবনে আফফান ও আওস ইবনে সাবিত, তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ ও কা’ব ইবনে মালিক, সাঈদ ইবনে যায়িদ ও উবাই ইবনে কা’ব, মুসআব ইবনে উমাইর ও আবু আউয়ূব ভালিদ, আবু হুযাফা ইবনে উতবা ইবনে কা’ব, মাসআব ইবনে উমাইর ও আবু আইয়ূব খালিদ, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ও ‘উব্বাদ ইবনে বিশর, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এবং আবু যার গিফারী ও মুনযির ইবনে আমর পরস্পর ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করেন। এছাড়াও হাতিব ইবনে আবু বালতাআ ও উয়াইম ইবনে সায়েদা, সালমান ফারসী ও আবুদ্ দারদা এবং আবু বাক্রের (রা) আযাদকৃত দাস বিরার ও আবু রুয়াইহার মধ্যে ভ্রাতৃ বন্ধন স্থাপিত হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যে সব সাহাবীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন তাদের মধ্যে উল্লিখিত সাহাবীদের নামই আমি জানতে পেরেছি।

আযানের সূচনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় তাঁর মুহাজির ভাইদের সবাইকে কাছে পেয়ে এবং আনসারদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তখন ইসলাম একটি সুসংহত শক্তিতে পরিণত হলো। সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত নামায কায়েমের ব্যবস্থা হলো, যাকাত ও রোযা ফরয হলো এবং অপরাধ দমনের আইন চালু হলো। হালাল হারামের বিধানও কার্যকর হলো। এভাবে ইসলাম তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আনসারদের এই গোত্রটিই ঈমান গ্রহণের পর এখানে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর মুসলমানগণ নামাযের সময় হলেই তাঁর কাছে আপনা থেকেই জমায়েত হতো, ডাকতে হতো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনস্থ করলেন, ইহুদীরা যেমন শিঙ্গা বাজিয়ে নামাযের জন্য লোক জমায়েত করে থাকে তিনিও তেমনি শিঙ্গা বাজানোর ব্যাবস্থা করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাপারটা তাঁর মনঃপূত না হওয়ায় বাদ দিলেন। এরপর ঘণ্টা বাজিয়ে মুসলমানদেরকে নামাযে ডাকায় বিষয়টি চিন্তা করলেন।

এইসব চিন্তাভাবনা চলাকালেই আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ কিভাবে মানুষকে ডেকে জমায়েত করতে হয় তা স্বপ্নে দেখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আজ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, অচেনা একজন লোক সবুজ কাপড় পড়ে এবং একটা ঘণ্টা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকটা আমার কাছ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি তাকে বললাম, ‘ওহে আল্লাহর বান্দা, তুমি কি এই ঘন্টাটা বিক্রি করবে?’ সে বললো, ‘ঘণ্টা দিয়ে তুমি কি করবে?’ আমি বললাম, ‘নামাযের জন্য লোকজনকে ডাকবো।’ সে বললো, ‘তোমাকে এর চেয়ে ভালো জিনিস শিখিয়ে দেবো?’ আমি বললাম, ‘কি জিনিস, বলতো।’ সে বললো, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।” রাসূলুল্লাহকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, “ইনশাআল্লাহ এই স্বপ্ন সত্য। তুমি বিলালকে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়াও। তাকে কথাগুলো শিখিয়ে দাও। সে আযান দিক। কেননা ওর আওয়াজ তোমার আওয়াজের চেয়ে বড়।” বিলাল আযান দিলেন। উমার ঘরে বসে তা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চাদর টানতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ যে স্বপ্ন দেখেছে, আমিও সেই রকম দেখেছি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।”

কতিপয় সাহাবীর রোগাক্রান্ত হওয়ার বিবরণ
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,

মদীনায় জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল সর্বাদিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে এ থেকে ম্ক্তু রেখেছিলেন। আবু বাক্র ও তাঁর দুই ভৃত্য বিলাল ও ‘আমের ইবনে ফুহাইরা একই ঘরে বাস করতেন। তাঁরা সবাই জ্বরে আক্রান্ত হলেন। আমি তাঁদেরকে দেখতে গেলাম। তখনো পর্দার বিধান নাযিল হয়নি। আক্রান্তদের রোগযন্ত্রণা ছিল অবর্ণনীয়। আমি প্রথমে আবু বাকরের (রা) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বা, আপনার কেমন লাগছে?” তিনি একটা কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন,

“প্রত্যেক মানুষ তার আপনজনের কাছে অবস্থান করে। অথচ মৃত্যু তার অতি নিকটেই।”

আমি বুঝতে পারলাম এবং মনে মনে বললাম, “আব্বা নিশ্চয়ই প্রলাপ বকছেন। ’

অতঃপর আমের ইবনে ফুহাইরার কছে গিয়ে বললাম, “আমের, আপনার শরীর কেমন?”

তিনিও কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন, “মৃত্যুর সাদ উপভোগ করার আগেই মৃত্যু লাভ করেছি,

কাপুরুষের মৃত্যু তার মাথার ওপরেই থাকে,

প্রত্যেকটি লোক তার সর্বশক্তি দিয়ে জিহাদ করে, ষাঁড় যেমন শিং দিয়ে নিজের চামড়া বাঁচায়।”

আমি বুঝতে পারলাম, ‘আমের সংজ্ঞা হারিয়ে প্রলাপ বকছেন।

বিলালের জ্বরের প্রকোপ যখন বৃদ্ধি পেতো তিনি বাড়ীর উঠানে গিয়ে শুয়ে পড়তেন।

তারপর উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করে বলতেন,

“আহা! আমি কি একটি রাত ইযখের ও গোলাপের সাহচর্যে ফাখখে কাটাতে পারবো?

আর একটি দিনও কি আমি মাজান্নার [৪৯. ফাখ্খ: মক্কায় বাইরের একটি জায়গার নাম। উযখের : এক ধরনের সুগন্ধী উদ্ভিদের নাম। মাজান্না: মক্কার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত একটি বাজার।] জলাশয়ে নামবার সুযোগ পাবো? আর শামা ও তাফীল পর্বত দুটোকে কি আর একবারও দেখতে পাবো?[৫০. শামা ও তাফীর মক্কার দুটো পাহাড়ের নাম।]

তাঁদের কাছে যা শুনলাম তা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে জানালাম। আমি বললাম, “জ্বরের প্রচ-তায় তাঁরা সবাই প্রলাপ বকছেন। যা বলছেন তা তাঁরা নিজেরাই বুঝেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, আপনি মদীনাকে আমাদের কাছে মক্কার মত বা তার চেয়েও বেশী প্রিয় করে দিন। এখানে যেসব ফসল ফলে তাতে আমাদের জন্য বরকত দিন। এখান থেকে যাবতীয় রোগব্যাধি দূর করে মাহইয়ায়াতে [৫১. মাহইয়ায়া সিরিয়ার হাজীদের ইহরাম বাঁধার জায়াগা জুহফার অপর নাম।] নিয়ে যান।”


হিজরাতের তারিখ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় পৌঁছেন তখন সময় ছিল রৌদ্রতপ্ত দুপুরের প্রাক্কাল। তারিখ ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। এটা নবুওয়াতের ১৩ বছর পরের ঘটনা। অতঃপর রবিউল আউয়াল মাসের বাকী দিনগুলো এবং রবিউস সানী, জামাদিউল আউয়াল, জামাদিউস সানী, রযন, শা’বান, রমাদান, শাওয়াল, যিলকাদ, যিলহাজ্ব ও মুহররমার মাস মদীনাতেই অবস্থান করেন। [অর্থাৎ হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পরে এই সময়ে মদীনার বাইরে কোথাও যাননি: – সম্পাদক]

প্রথম যুদ্ধাভিযান
মদীনা আগমনের ঠিক ১২ মাস পর সফর মাসে তিনি ওয়াদ্দান তথা আবওরা অভিযানে বের হন। কুরাইশ ও বনু দামরা ইবনে বাক্রের সন্ধানে তিনি ওয়াদ্দান পৌঁছেন। সেখানে বনু দামরা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। অতঃপর তিনি কোন রকম ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন না হয়েই নিরাপদে মদীনায় ফিরে আসেন। সফর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলো ও রবিউল আউয়াল মাসের প্রথমাংশ সেখাইেন অতিবাহিত করেন।

উবাইদা ইবনে হারিসের নেতৃত্বে অভিযান
রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে এই যুদ্ধের ঝান্ডা বেঁধেছিলেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অবস্থানের এই সময়েই তিনি উবাইদা ইবনে হারিসকে ৬০ অথবা ৮০ জন লোকের একটি অশ্বারোহী বাহিনীসহ পাঠালেন। তাঁরা সবাই ছিলেন মুহাজির। আসারদের কেউই তাঁদের সাথে ছিলেন না। দলটি সানিয়াতুল মুররায় নিম্নভূমিতে একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছিলে কুরাইশদের বিরাট একটি দলের সম্মুখীন হলো। কিন্তু কোন য্দ্ধু হলো না। কেবল সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস একটি তীর নিক্ষেপ করেন। এটাই ছিল ইসলামী বাহিনীর প্রথম তীর নিক্ষেপ। অতঃপর দলটি ফিরে এলো। মুসলমানরা ছিলো তখন বেশ উদ্দীপ্ত।

সমুদ্র উপকূলের দিকে হামযার নেতৃত্বে অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সময় হামযার (রা) নেতৃত্বে ৩০ জন ঘোরসওয়ার মুহাজিরের একটি দলকে ঈসের দিক দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। এ অভিযানেও কোন আনসারকে পাঠালেন না। এবার মুসলিম বাহিনী আবু জাহলেন নেতৃত্বাধীন মক্কার ৩০০ অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হলো। মাজদী আবনে আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় তখনও কোন সংঘর্ষ ঘটলো না। তিনি উভয় পক্ষকে দূরে সরিয়ে দিলেন। ফলে উভয় বাহিনী পরস্পর থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে গেল। এবারও কোন যুদ্ধ সংঘটিত হলো ন।

বুয়াত অভিযান
রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে বেরিয়ে বুয়াত নামক স্থানে পৌঁছলেন। এখানে গেলেন রিদ্ওয়ার দিক দিয়ে। কোন যুদ্ধ ছাড়াই তিনি মদীনায় ফিরে এলেন। সেখানে তিনি রবিউস সানীর অবশিষ্ট দিনগুলো এবং জমাদিউল উলার প্রথম ভাগ অতিবাহিত করলেন। [৫২. এই অভিযানে যাওয়ার সময় সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউনকে (রা) মদীনায় দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বুয়াত : ইয়াম্বুর নিকটবর্তী জুহাইনা গোত্রের এলাকার একটি পর্বতের নাম। ]

উশাইরা অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় কুরইশদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেন।[ ৫৩. এই সময় আবু সালামা ইবনে আবুদর আসাদকে (রা) মদীনা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।]বনু দীনারের গিরিবর্ত দিয়ে অতঃপর হাবারের মরুভূমির মধ্য দিয়ে বাহিনী নিয়ে ইবনে আযহার উপত্যাকায় পৌঁছে একটি গাছের ছায়ায় যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে নামায পড়লেন। এজন্য সেখানে একটি মসজিদ রয়েছে। সেখানে তাঁর জন্য খাবার তৈরী করা হলে তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। ঐ স্থানে ডেকচি রাখার রাখার জায়াগা এখনো সুস্পষ্ট। তাঁকে সেখানকার ‘মুশতারাব’ নামক ঝর্ণা থেকে পানি পান করানো হলো। অতঃপর তিনি খালায়েক নামক স্থানকে বাম দিকে রেখে যাত্রা শুরু করলেন এবং আবদুল্লাহ গিরিপথ অতিক্রম করলেন। অতঃপর বাম দিকে ঘুরে ইয়ালইয়াল নামক সমভূমিতে পৌঁছে ইয়ালইয়াল ও দাবুয়ার সংযোগস্থলে যাত্রাবিরতি করলেন এবং সেখানকার একটি কুয়া থেকে পানি পান করলেন। অতঃপর ফারশ মিলালের সমভূমির মধ্য দিয়ে চললেন। অবশেষে ইয়ামামের ছোট ছোট পার্বত্য অঞ্চলের পথ পেলেন। অতঃপর সেই পথ ধরে ইয়াম্বুর সমভূমি দিয়ে উশাইরাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। এখনে জামাদিউল উলা এবং জামাদিউস সানীর কয়েকটা দিন অবস্থান করলেন। এখানে বনু মাদলাজ এবং তার বনু দামরা গোত্রীয় মিত্রদেরকে বশ্যতা স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করলেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরে এলেন।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। ৮ জন মুহাজিরের এই বাহিনী হিজাযের খাযযার নামক স্থানে গিয়ে উপনীত হলো। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় ফিরলো।

সাফওয়ান অভিযান: প্রথম বদর অভিযান
উশাইরা অভিযান থেকে ফেরার দশ দিনের কম সময়ের মধ্যে একদিন কুরয ইবনে জাবের ফেহরী মদীনার আশপাশে ছেড়ে দেয়া উট ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়ে বসলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষনাৎ তার পিছু ধাওয়া করলেন। [৫৪. এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবনে হারিসাকে মদীনার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।] তিনি বদর প্রন্তরের একপাশে সাফওয়ান সামক একটি উপত্যকায় পৌঁছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরয ইবনে জাবেরের নাগার পেলেন না। এ ঘটনাকে প্রথম বদর অভিযান বলা হয়। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন এবং জামাদিউস সানী মাসের বাকী দিনগুলো এবং রযব ও শা’বান মাস মদীনাতেই কাটালেন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে সামরিক অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রযব মাসে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের নেতৃত্বে প্রথম বদর অভিযান থেকে প্রত্যাগত মুহাজিরদের ৮ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাহিনী পাঠালেন। তাদের মধ্যে কোন আনসারকে অন্তর্ভুক্ত করলেন না। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশকে একটি পত্র দিয়ে বললেন যে, দুইদিন পথ চলার পর এই পত্রখানা খুলে পড়বে, তার আগে নয়। চিঠি পড়ার পর তাতে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে অনুসারে কাজ করবে এবং সঙ্গীদের কারো উপর কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেবে না।

দুইদিন ধরে পথ চলার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা ছিল, “আমার এই চিঠি যখন তুমি পড়বে, তখুনি রওনা হয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে গিয়ে যাত্রাবিরতি করবে। সেখানে কুরাইশদের জন্য ওত পেতে থাকবে এবং কোন তথ্য পেলে আমাকে জানাবে।”

আবুদল্লাহ ইবনে জাহাশ চিঠিখানা পড়েই বললেন,“আমি মেনে নিলাম ও অনুগত রইলাম। ” অতঃপর সঙ্গীদেরকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নাখলায় গিয়ে কুরাইশদের জন্য ওৎ পেতে থাকতে বলেছেন এবং কোন খবর জানলে তা তাঁকে জানতে বলেছেন। আর এ ব্যাপারে তোমাদের কারো ওপর বাধ্যতামূলক কোন দায়িত্ব চাপাতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি শাহাদাত লাভে ইচ্ছুক থাকে তবে সে যেন যায়। আর যে তা চায় না, সে যেন ফিরে যায়। তবে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন করবো।” একথা বলার পর আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সঙ্গে সবাই রওয়ানা হয়ে গেল। কেউই ফিরে গেল না। তিনি হিজাযে প্রবেশ করলেন। বাহরান নামক স্থানে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গায ওয়ান তাদের উট হারিয়ে ফেললেন। তাঁরা দু’জন ঐ উটকে অনুসরন করে চলছিলেন। ফলে ঐ উট খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে তাঁরা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ থেকে পিছিয়ে পড়লেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর সঙ্গীগণ যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। চলতে চলতে তাঁরা নাখলাতে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। এই সময় তাঁদের নিকট দিয়ে কুরাইশদের একটি কাফিলা কিসমিস চামড়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই সাথে কুরাইশদের অন্যান্য পণ্যদ্রব্যও ছিল। এই দলের মধ্যে আমর ইবনে হাদরামী, উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও তার ভাই নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকাম ইবনে কাইসান ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের দল তাদেরকে দেখে ঘাবড়ে গেলো কেননা তারা তাদের খুব নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলো। উক্কাশা ইবনে মুহসান ওদের কাছে চলে গেলেন। তাঁর মাথা মু-ানো ছিল। তাঁকে দেখে কুরাইশরা আশ্বস্ত হলো। বললো, “এরা স্থানীয় বাসিন্দা। এদের দিক থেকে কোন ভয় নেই।” ওদিকে মুসলমানগণ কুরাইশদের ব্যাপারে পরামর্শে বসলেন। ঐদিন ছির রযব মাসের শেষ দিন। সকলে মত প্রকাশ করলেন যে, আজকে কুরাইশদের এই কাফিলাকে ছেড়ে দিরে এরপরই তারা হারাম শরীফের এলাকায় প্রবেশ করবে এবং আমাদের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে। পক্ষান্তরে আজ যদি তাদেরকে হত্যা করা হয় তাহলে নিষিদ্ধ মাসের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর দোষে দোষী হতে হবে। তাই তারা দ্বিাধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং কুরাইশ কাফিলার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে একমত হলেন যে, যাকে যাবে পারা যায় হত্যা করতে হবে এবং তাদের যার কাছে যা আছে তা নিয়ে নিতে হবে। ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ তামিমী আমর ইবনে হাদরামীকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। আর উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও হাকাম ইবনে কাইসানকে বন্দী করলেন। নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে আত্মরক্ষা করলো। তাকে কিছুতেই ধরা সম্ভব হলো না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ কাফিলার অবশিষ্ট লোক ও বন্দী দুজনকে নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তো তোমাদেরকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করতে বলিনি। ” অতঃপর তিনি কাফিলা ও বন্দীদেরকে আটকে রাখলেন এবং তাদের সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তিতে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ সবার সামনে খাটো ও লা জওয়াব হয়ে গেলেন। তাঁর দলের লোকেরা ভাবলেন তদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। মুসলমানরা এ কাজের জন্য তাদেরকে তিরস্কার করলেন। ওদিকে কুরাইশরা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সহচররা নিষিদ্ধ মাসের পবিত্রতা লংঘন করেছে। তারা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাত ঘটিয়েছে, অন্যের সম্পদ হস্তগত করেছে এবং লোকজনকে বন্দী করেছে।” মক্কাতে যে কয়জন মুসলমান তখনো ছিলেন তাদের একজন জবাব দিলেন, “মুসলমানরা যা করেছে, শা’বান মাসে করেছে। [একথা বলার পেছনে যুক্তি ছিলো যে, রজব মাসের শেষ তারিখের সূর্যাস্তের পর শা’বান মাস শুরু হয়েছিলো।-সম্পাদক]

এই প্রচারনা অভিযান যখন ব্যাপক আকার ধারণ করলো তখন আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এই আয়াত নাযিল করলেন:

[আরবী *************]

“তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বল: এ মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অন্যায়। তবে আল্লাহর কাছে তার চেয়েও বড় অন্যায় হলো

আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখা,কুফরী করা, মসজিদে হারামে যেতে বাধা দেয় এবং মসজিদে হারামের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা। বস্তুতঃনির্যাতনের মাধ্যমে মানুষকে বিপথগামী করা হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ। তারা অবিরতভাবে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত, যাতে করে সাধ্যে কুলালে তোমাদেরকে ধর্মান্তরিত করতে পারে।” (আল বাকারাহ)

অর্থাৎ তোমরা যদি হারাম মাসে হর্তাকা- করেও থাক, তবে তারা তো আল্লাহর পথে চলতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছে, সেইসাথে কুফরীও করেছে এবং মসজিদে হারামে তোমাদেরকে যেতে দেয়নি। আর তোমরা মসজিদুল হারামের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তোমাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তোমাদের একজন কাফিরকে হত্যা করার চাইতে মারাত্মক অপরাধ। আর তারা যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করতো এবং কুফরী ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতো, সেটা হত্যার চেয়েও জঘন্য কাজ। আর এই জঘন্যতম অন্যায় কাজ তারা তোমাদের সাথে অবিরতভাবেই করে চলেছে এবং তা থেকে ফিরছে না বা তাওবাহ করছে না।

কুরআনে যখন এই পথনির্দেশ এলো এবং আল্লাহ মুসলমানদের ভীতি ও দুশ্চিন্তা দূর করে দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আটক কাফিলা ও বন্দীদেরকে সরকারীভাবে গ্রহণ করলেন। কুরাইশরা তাঁর কাছে উসমান ও হাকামকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বার্তা পাঠালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জবাবে এদেরকে জানালেন, “আমাদের দুইজন লোক সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাযওয়ান ফিরে না আসা পর্যন্ত বন্দীদের মুক্তি দেবো না। কেননা তোমাদের দ্বারা ওদের জীবন বিপন্ন হবার আশংকা রয়েছে।”অচিরেই সা’দ ও উতবা ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পণ্যের বিনিময়ে মুক্তি দিলেন। তবে বন্দীদ্বয়ের মধ্যে হাকাম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করেন ও সাচ্চা মুসলিমে পরিণত হন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই থেকে যান। পরে বীরে মাউনার ঘটনায় তিনি শহীদ হন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যায় এবং কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।

কিবলা পরিবর্তন
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের আঠার মাস পর শাবান মাসে কিবলা পরিবর্তন হয়।

বদরের যুদ্ধ
এরপর একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের নেতৃত্বে কুরাইশদের একটি বিরাট কাফিলা সিরিয়ার দিক থেকে এগিয়ে আসছে। সে কাফিলায় কুরাইশদের বহু সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সম্ভার রয়েছে। কাফিলায় মাখরামা ইবনে নওফেল ও আমর ইবনুল ‘আসসহ কুরাইশ বংশোদ্ভূত ৩০ অথবা ৪০ জন লোক রয়েছে। তিনি মুসলমানদেরকে তাদের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “এটা কুরাইশদের কাফিলা। এতে প্রচুর ধন-সম্পদ রয়েছে। তোমরা ওদিকে যাও। হয়তো আল্লাহ ঐসব সম্পদ তোমাদের হস্তগত করে দেবেন।” মুসলমানরা কাফিলাকে ধরার জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেউবা ত্বরিৎ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেউবা একটু শৈথিল্য দেখালেন এবং দেরী করলেন। কারণ তারা ধারণা করতে পারেননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন।

হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। পথচারী যার সাথেই দেখা হলো, তাকে সে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। কেননা সে মুসলমানদের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভীতসন্ত্রন্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত কোন কোন পথচারী তাকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিল যে, মুহাম্মাদ তাঁর সহচরদেরকে তোমার ও তোমার কাফিলার ওপর আক্রমণ চালাতে চলেছে। সুতরাং আবু সুফিয়ান সাবধান হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীকে তৎক্ষণাৎ মজুরীর বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দিল। তাকে বলে দিল, সে যেন কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাদের ধন সম্পদ নিরাপদে নিয়ে আসার জন্য কিছু অস্ত্রসজ্জিত লোক পাঠাতে অনুরোধ করে এবং মুহাম্মাদ যে তার দলবলসহ তাদেরকে আক্রমণ করতে উদ্যত তা তাদেরকে জানায়। দামদাম খুব দ্রুত মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল।

দামদাম মক্কা পৌঁছার তিন দিন আগে আবদুল মুত্তালিব তনয়া আতিকা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভাই আব্বাসকে ব্যাপারটা জানালেন। বললেন, “ভাই, আজ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমার সম্প্রদায়ের ওপর কোন বিপদ মুসিবত এসে পড়বে। কাজেই আমি তোমাকে যা বলছি কাউকে বলো না।”

আব্বাস বললেন, “তুমি স্বপ্নে কী দেখেছো?”

আতিকা বললেন, “দেখলাম, একজন সওয়ার মক্কার পার্শ্ববর্তী সমতল ভুমিতে এসে নামলো। অতঃপর উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘হে কুরাইশগণ, তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে যাও, হুঁশিয়ার!” অতঃপর তার উট তাকে নিয়ে আবু কুবাইস পর্বত শিখরে আরোহণ করলো। অতঃপর আবার চিৎকার করে একই কথা ঘোষণা করলো। তারপর সেখান থেকে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিল। পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে পড়তেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল এবং তার কোন না কোন টুকরো মক্কার প্রত্যেক বাড়ীতে গিয়ে পড়লো।”

আব্বাস বললেন, “এটা গুরুতর স্বপ্ন। তুমি কাউকে এটা বলো না। সম্পূর্ণ গোপন রেখো।”

এরপর আব্বাস বাইরে বেরুতেই তার বন্ধু ওয়ালীদ ইবনে রারিয়ার সাথে তার দেখা হলো। তিনি তাকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত জানালেন এবং তাকে সাবধান করে দিলেন যেন কাউকে না বলে। ওয়ালীদ ব্যাপারটা তার পিতা উতবাকে জানালো। এভাবে কথাটা সমগ্র মক্কায় রটে গেল। কুরাইশরা সকল মহফিল ও বৈঠকে এ নিয়ে আলাপ করতে লাগলো।

আব্বাস বলেন, আমি পরদিন কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে গেলাম। আবু জাহ্ল সেখানে কুরাইশ একদল লোকের সাথে আতিকার স্বপ্ন নিয়ে আলাপ করছিলো। আবু জাহ্ল আমাকে দেখেই বললো, “আব্বাস, তাওয়াফ শেষ করে এ দিকে এসো।” তাওয়াফ শেষে আমি তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। আবু জাহ্ল আমাকে বললো, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, এই মহিলা- নবী কবে তোমাদেরকে এসব কথা বলেছে?”

আমি বললাম, “কিসের কথা?”

আবু জাহ্ল, “আতিকার দেখা সেই স্বপ্নের কথা।”

আমি বললাম, “সে কী স্বপ্ন দেখেছে?”

আবু জাহ্ল, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র, তোমাদের পুরুষরা নবুওয়াতী করতে করতে অবশেষে তোমাদের মহিলারাও দেখছি নবুওয়াতী শুরু করে দিল। আতিকা নাকি স্বপ্নে দেখেছে, কে বলেছে, ‘তিন দিনের মধ্যে তৈরী হয়ে যাও।’ আমরা তোমাদের জন্য তিন দিন অপেক্ষা করবো। যদি কথা সত্য হয় তাহলে তো যা হবার হবে। আর যদি তিন দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও কিছু না ঘটে তাহলে আমরা তোমাদের সম্পর্কে লিখিত ঘোষণা জারী করে দেব যে, আরবে তোমাদের মত মিথ্যাবাদী পরিবার আর নেই।”

আব্বাস বলেন, আবু জাহলের উক্তিতে আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হলাম। বললাম: আতিকা কোন স্বপ্ন দেখেনি। অতঃপর যার যার কাজে চলে গেলাম। বিকালে আবদুল মুত্তালিব পরিবারের প্রত্যেক মহিলা এক এক করে আমার কাছে এসে বললো, “এই পাটিষ্ঠ খবিসটাকে তোমরা কেন এত সহ্য করছো? সে এতদিন আমাদের পুরুষদের যা ইচ্ছে বলেছে। এখন সে আমাদের নারীদেরকেও যা ইচ্ছে বলতে শুরু করেছে। তুমি এসব শুনছো, অথচ তোমার কোন সম্ভ্রমবোধ জাগছে না।” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম আমি ভীষণ বিব্রতবোধ করছি। আমি বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তবে ওকে আমি দেখে নেব। আর একবার বলুক, তখন তোমাদের হয়ে যা করা দরকার, তা আমি করবোই।”

আতিকার স্বপ্নের তৃতীয় দিন পর আমি সেখানে গেলাম। আমি তখন রাগে ও ক্ষোভে ফুঁসছি। ভাবছিলাম, বেটার সাথে যে আচরণ করা দরকার ছিল, ত করতে পারিনি। আবার যদি সুযোগ পাই, তবে যা করতে পারিনি তা এবার করে দেখাবো। আমি মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে তাকে দেখতে পেলাম। আমি তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর অপেক্ষা করতে লাগলাম যে, সেদিন যেসব কথা বলেছে, তার কিছু অংশের পুনরাবৃত্তি করলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। আবু জাহল ছিল হালকা পাতলা গড়নের, কিন্তু তার চাহনি ছির তীক্ষè, ভাষা ছিল তীব্র ধারালো। সহসা সে দ্রুত মসজিদের দরজায় দিকে এগিয়ে এলো। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর অভিশাপ হোক ওর ওপর! ওর কী হয়েছে? ওর সমগ্র সত্তা এমন ভীতসন্ত্রস্ত কেন? তবে কি আমার ভর্ৎসনার ভয়ে? সহসা বুঝতে পারলাম, সে দামদাম ইবনে আমর গিফারীর হাঁকডাক শুনেছে যা আমি তখনো শুনিনি। দামদাম মক্কার মরুভূমিতে এসে তার উটের ওপর বসেই চিৎকার করে বলছে, “হে কুরাইশগণ, মহাবিপদ! মহাবিপদ! তোমাদের ধন সম্পদ আবু সুফিয়ানের কাছে। মুহাম্মাদ তার সহচরদেরকে ঔ সম্পদের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তোমরা তো আর রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্য করতে অগ্রসর হও! সাহায্য করতে অগ্রসর হও!” গিফারী চিৎকার করে এ কথা বলার আগেই উটের নাক কেটে, হাওদা উল্টিয়ে দিয়ে এবং নিজের জামা ছিঁড়ে একটা তেলেসমাতি কা- করে ফেলেছে।

এই ভয়াবহ ঘটনার কারণে আমরা কেউ কারো প্রতি মনোযোগী হতে পারলাম না। লোকজন অতি দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেলো। তারা বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কি মনে করেছে যে, আমরা ইবনুল হাদরামীর কাফিলার মত অসহায়? [৫৫. অর্থাৎ আমর ইবনুল হাদরামী, যাকে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের বাহিনী হত্যা করে। ]কক্ষনো না, এবার তারা অবশ্যই অন্য রকম অভিজ্ঞতা লাভ করবে। সেদিন তারা মাত্র দুইজনের মুকাবিলায় এমন ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছে। তাও এমন ধরনের লোক যে, হয় যুদ্ধের ময়দান থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, নতুবা নিজের জায়গায় অন্যকে পাঠাতে চায়। আর আজ গোটা কুরাইশ গোত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। কুরাইশদের কোন গণ্য মান্য লোক আজ বাদ পড়েনি। কেবলমাত্র আবু লাহাব বাদ পড়েছে এবং তার জায়গায় আসী ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরাকে পাঠিয়েছে।” এই ব্যক্তির নিকট আবু লাহাম চার হাজার দিরহামের পাওনাদর ছিল। সে দারিদ্রের জন্য ঐ ঋণ শোধ করতে পারেনি। সেজন্য এ পাওনা টাকার বিনিময়ে সে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেয় তার স্থলাভিষিক্ত করে।

উমাইয়া ইবনে খালাফও যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ছিল স্থূলদেহী রাশভারী এক বৃদ্ধ। উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তার কাছে এলো। উমাইয়া তখন মসজিদুল হারামে লোকজনের সাথে বসে ছিল। সে তাকে চন্দন কাঠের তৈরী একটা সুগন্ধি দিয়ে বললো, “নাও, তুমি এটি দিয়ে সুবাসিত হও। কারণ তুমি তো মেয়ে মানুষ।” উমাইয়া বললো, “দূর হ’ এখান থেকে! আল্লাহ তোকে কুৎসিত করে দিক।” লজ্জা পেয়ে বুড়ো উমাইয়া অতঃপর যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।

প্রস্তুতি নেয়া সম্পন্ন হলো এবং রণাঙ্গনে যাওয়ার জন্য সবাই বদ্ধ পরিকর হলো। তখন তাদের সাতে বনু বাক্র ইবনে আবদ্ মানাতে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার কথা মনে করে তাঁরা বললো, “আমাদের আশংকা হয় যে, ওরা পেছন দিক থেকে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে।” এ আশংকা তাদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত করে তুলছিল। তখন ইবলিস সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশআম আল মুদলাজীর আকৃতি ধারণ করে তাদে কাছে হাজির হলো। সে বললো, “আমি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক থাকছি যেন কিনানা গোত্র তোমাদের ওপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে।” এ আশ্বাস লাভ করার পর তারা দ্রুতবেগে মক্কা ত্যাগ করলো।

ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তখন রমযান মাসের কয়েকটা দিন অতিবাহিত হয়েছে। তিনি আমর ইবনে উম্মে মাকতুমকে নামায পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত করলেন। মুসআব ইবনে উমাইরের হাতে সাদা পতাকা তুলে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ছিল দুটো কালো পতাকা। তার একটি ছিল আবু তালিব তনয় আলীর নিকট এবং এটির নাম ছিল ঈগল। অপরটি ছিল জনৈক আনসারের নিকট। ঐদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের কাছে সর্বমোট ৭০ টি উট ছিল। তারা পালাক্রমে ঐগুলোতে আরোহণ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আলী ইবনে আবু তালিব ও মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ একটি উটের পিঠে পালাক্রমে আরোহণ করতে লাগলেন। আর হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই ভৃত্য যায়িদ ইবনে হারিসা ও আবু কাবশা আরোহণ করতে লাগলেন আরেকটিতে। আরেকটিতে চড়তে লাগলেন আবু বাক্র, উমার ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা থেকে মক্কার পথ ধরে চলতে লাগলেন এবং মদীনার বাইরের গিরি প্রবেশপথে পৌঁছিলেন। অতঃপর সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আকীক, যুল হুলায়ফা, আওলাতুল জায়েশ, তুরবাম, মালাল, মারইনের গামীছূর হাম্মাম, ইয়ামামের কংকরময় ভূমিতে সাইয়ালা, ফাজ্জুর রাওহা এবং সেখান থেকে শানুকায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে আরকাজ যারিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছলে এক বেদুইনের সাথে দেখা হলো। বেদুইনকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন লোকজন দেখেছে কিনা। কিন্তু তার কাছে কোন খবর পাওয়া গেলো না। সাহাবারা ঐ লোকটাকে বললো, ‘আল্লাহর রাসূলকে সালাম দাও।’ সে বললো, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল আছে নাকি?’ সবাই বললো, হ্যাঁ।’ অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তুমি যদি আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকে তাহলে বলতো আমার এই উষ্ট্রীর পেটে কি আছে?” সালামা ইবেন সুলামা ইবনে ওয়াকশ তাকে বললো, “তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করো না। আমার কাছে এসো, আমি বলছি ওর পেটে কি আছে। তুমি ঐ উষ্ট্রীটার সাথে সঙ্গম করেছিলে। তাই ওর পেটে তোমার ঔরসের একটা ছাগলের বাচ্চা রয়েছে।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে সালামাকে ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর। লোকটার সাথে তুমি অশ্লীল কথা বলছো?” অতঃপর অন্যদিকে মনোযোগ দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাওহার ‘সাজসাজ্’ নামক কূপের নিকট গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। সেখান থেকে আবার রওয়ানা হলেন। কিছুদূর গিয়ে মক্কার পথ ত্যাগ করে ডান দিকের পথ ধরে নাজিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর গন্তব্যন্থল ছিল বদর। বদরের নিকটবর্তী একটি জায়গায় পৌঁছে তিনি রুহকান নামক একটি উপত্যাকা পাড়ি দিলেন। এই উপত্যকাটি নাজিরা ও সাফরা গিরিপথের মধ্যস্থলে অবস্থিত। সেখান থেকে তিনি গিরিপথে গিয়ে উপনীত হলেন। অতঃপর সেখান থেকে নেমে সাফরার নিকট পৌঁছলেন। এখানে পৌঁছে তিনি বাসবাস ইবনে আমর জুহানী ও আদী ইবনে আবু জাগবা জাহানীকে বদর এলাকায় পাঠালেন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও অন্যদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। ঐ দু’জনকে আগে পাঠিয়ে দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন।

পথিমধ্যেই তিনি জানতে পারলেন ও, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফিলাকে রক্ষা করার জন্য সদলবলে মক্কা থেকে যাত্রা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খবর সাহাবাদের জানালেন এবং এ মুহূর্তে তাদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে সকলের সাথে পরামর্শ করলেন। সর্বপ্রথম আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) উঠে দাঁড়ালেন ও তাঁর মতামাত অতি চমৎকারভাকে ব্যক্ত করলেন। এরপর মিকদাদ ইবনে আমর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ আপনাকে যেদিকে বলতে বলেছেন সেদিকে এগিয়ে চলুন। আল্লাহর কসম, বনী ইসরাঈল যেমন মুসাকে (আ) বলেছে, ‘তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে রইলাম’Ñ আমরা সে রকম কথা আপনাকে বলবো না। আমরা বলছি, আপনি ও আপনার রব গিয়ে লড়াই করুন, আমরাও আপনার ও আপনার রবের সহযোগী হয়ে লড়াইতে শরীক আছি। সেই মহান সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সুদূর ইয়ামানের বারকুল গিমাদেও যান, তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে সেখানে যাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকদাদকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সম্বোধন করলেন, “তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও।” আনসারদের এত গুরুত্বদানের কারণ ছিল এই যে, তারা ছিল মুসলমানদের সহায়। তারা যখন আকাবাতে বাইয়াত করেছিলো তখন বলেছিলো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি যত দিন আমাদের আবাসভূমিতে না যাবেন ততদিন আমরা আপনার দায়িত্ব নিতে অপরাগ। যখন আপনি আমাদের কাছে যাবেন তখন আমাদের দায়িত্বে থাকবেন। আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীদেরকে যেভাবে সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করি ঠিক সেইভাবে আপনাকে রক্ষা করবো।” এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশংকা করেছিলেন যে, আনসাররা হয়তো মনে করতে পারে যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলেই কেবল তাদের ওপর তাঁর সাহায্য করার ও তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায়। আনসাররা এরূপ ভেবে থাকতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তাদের আবাসভূমির বাইরে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে যেতে চাইলে তাঁর সাথে যাওয়া তাদের দায়িত্ব নয়। তাই তিনি যখন আনসারদেরকে সম্বোধান করলেন তখন সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বোধ হয় আমাদের মতামত জানতে চাচ্ছেন।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ।” সা’দ বললেন, “আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা পরম সত্য। আর এই প্রত্যয়ের ভিতরেই আমরা আপনার কাছে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, আমরা আপনার নির্দেশ মানবো ও আনুগত্য করবো। হে আল্লাহর রাসূল, তাই আপনি যা ভাল মনে করেন, করুন। আমরা আপনার সাথে আছি। সেই আল্লাহর শপথ যিনি আপনাকে মহাসত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, সামনের এই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আপনি যদি তার অথৈ পানিতে নামেন, আমরাও আপনার সাথে নামবো। আমাদের একটি লোকও আপনাকে ছেড়ে পেছনে থাকবে না। আগামীকাল যদি আপনি আমাদের সাতে নিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হতে চান, ততেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা যুদ্ধে ধৈর্যশীল এবং শত্রুর মুকাবিলায় সংকল্পে অবিচল। আশা করি, আল্লাহ আপনাকে আমাদের এমন তৎপরতা দেখবার সুযোগ দেবেন, যাতে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে। আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করে আমাদের নিয়ে আপনি এগিয়ে চলুন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের বক্তব্য শুনে খুশী হলেন এবং খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। অতঃপর বরলেন, “তোমরা বেরিয়ে পড়। আল্লাহ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দুই কাফিলার যে কোন একটি আমাদের হাতে পরাভূত হবো।[ ৫৬.একটি হলো আবু সুফিয়ান ও আমর ইবনুর আ’স সহ বাণিজ্যিক কাফিলা, অপরটি আবু জাহলের নেতৃত্বে আগত সমর সজ্জায় সজ্জিত সুবিশাল বাহিনী।] আল্লাহর কসম, আমি যেন এখনই কুরাইশদের শোচনীয় মৃত্যু ঘটতে দেখছি।”

অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর প্রান্তরের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলেন। তারপর তিনি নিজে আর একজন সাহাবাকে [৫৭. ইনি আবু বাক্র সিদ্দীক রাদিয়ল্লাহু আনহু।]নিয়ে টহল দিতে বেরুলেন। কিছুদূর গিয়ে জনৈক বৃদ্দ আরবের সাক্ষাত পেলেন। তিনি কুরাইশদের কথা কিছু জানেন কিনা এবং মাহাম্মাদ ও তাঁর সহচরদের সম্পর্কে কোন খবর শুনেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধ বললেন, “তোমরা কারা বল, তা না হলে বলবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমরা যা জানতে চেয়েছি, সেটা আগে বল। তারপর আমরা আমাদের পরিচয় দেবো।” বৃদ্ধ বললেন, “শুনেছি, মুহাম্মাদ ও তাঁর সহচরগণ অমুক দিন যাত্র শুরু করেছেন। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার এখন অমুক জায়গায় থাকার কথা। আর কুরাইশদের সম্পর্কে শুনেছি, তারা অমুক দিন রওয়ানা দিয়েছে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে তার আজ অমুক জায়গায় এসে পৌঁছার কথা।” উভয় দল সত্যি যেখানে উপস্থিত হয়েছে, বৃদ্ধ সেই স্থানের কথাই বললেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কোথা থেকে এসেছো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পানি থেকে। ”বৃদ্ধ বললেন, “পানি থেকে’ অর্থ কি?” ইরাকের পানি থেকে নাকি?

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কছে এলেন রাত্রে তিনি আলী ইবনে আবু তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস সহ একদল সাহাবীকে কুরাইশদের খোঁজ খবর নিতে বদর প্রান্তরের পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে পাঠালেন। সেখানে তাঁরা কুরাইশদের এক পাল পানি পানরত উট দেখতে পেলেন এবং তার মধ্যে বনু হাজ্জাজ গোত্রের ভৃত্য আসলাম ও বনু আস ইবনে সাঈদের ভৃত্য আরীদ আবু ইয়াসারের সাক্ষাত পেলেন। তাঁরা ঐ ভৃত্যদ্বয়কে সাথে নিয়ে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়ছিলেন। তাদেরকে জিজ্ঞস করা হলো, “তোমরা কারা?” তারা বললো, “আমরা কুরাইশদের পানি বহনকারী। তাদের জন্য খাবার পানি নিতে আমাদেররকে পাঠিয়েছে।” মুসলমানগণ তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। তাদের ধারণা ছিল, ওরা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর তাদেরকে প্রহার করা হলো পিটুনীর চোটে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে, তারা আবু সুফিয়ানের লোক। অতঃপর মুসলমানগণ তাদেরকে ছেড়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করে বললেন, “ওরা যখন সত্য বললো তখন তখন ওদের তোমরা প্রহার করলে। আর যখন মিথ্যা বললো তখন ছেড়ে দিলে। এটা তোমাদের কেমন কাজ? ওরা ঠিকই বরেছে। ওরা কুরাইশদের লোক। তোমরা আমাকে কুরাইশদের খবর বল।” তারা বললো,“আল্লাহর কসম, ঐ দূর প্রন্তরে বালুর টিলাটা দেখছেন, ওর অপর পার্শ্বেই তারা রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা সংখ্যায় কত?” আসলাম ও আরীদ বললো, “জানি না।” তিনি বললেন, “প্রতিদিন কয়টা জন্তু জবাই করে?” তারা বললো, “কোন দিন দশটা, কোন দিন নয়টা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে ওদের সংখ্যা নয়শো থেকে হাজারের মধ্যে হবে।”অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, “কুরাইশ নেতাদের মধ্যে কে কে এসেছে?” তারা বললো, ‘উতবা ইবনে রাবীআ, শাইবা ইবনে রাবীআ, আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিযাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারেস ইবনে আমের ইবনে নওফেল, তুয়াইমা ইবনে আদী ইবনে নওফেল, নাদার ইবনে হারেস যাম’আ ইবনে আসওয়াদ, আবু জাহেল ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালাফ, হুজাজের দুই পুত্র নাবীহ ও মুনাব্বিহ, সুহাইল ইবনে আমর এবং আমর ইবনে আব্দ উদ্।” এ বিবরণ নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের সামনে গিয়ে বললেন, “মক্কা তোমাদের নিকট তার কলিজার টুকরাগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

ইতি পূর্বে বাসকাস ইবনে আমর ও আদী ইবনে আবু যাগবা টহল দিতে দিতে বদর প্রান্তরে এসে থামে। তারা জলাশয়ের নিকটবর্তী একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে উট থেকে নামলো এবং একটা মশকে পানি ভরে নিল। মুজদী ইবনে আমর জুহানী তখন জলাশয়োর কিনারে ছিল। জলাশয়ের কাছে আগত লোকদের মধ্যে দুটি বাঁদী ছিল। তাদের একজন অপরজনের কাছে তার প্রাপ্য পরিশোধ করার দাবী জানাতে লাগলো ঋনগ্রস্ত বাঁদীটি বললো,“কাফিলা কাল অথবা পরশুদিনই আসছে। তখন আমি কাফিলার কাজ করে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেবো।” মুজদী বরলো, “তুমি ঠিকই বলেছো।” অতঃপর সে উভয়ের মধ্যে আপোষ করিয়ে দিল। আদী ও বাসবাস একই কথোপকথন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গেল এবং যা শুনেছে তা তাঁকে জানালো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাবধানতা অবলম্বনের জন্য কাফিলাকে পেছনে রেখে আগে আগে এলো। সে জলাশয়ের কাছে গিয়ে মুজদী ইবনে আমরকে জিজ্ঞেস করলো, “কারো আনাগোনা টের পেয়েছো নাকি?” সে বললো, “সন্দেহজনক কাউকে দেখিনে। কেবল দুজন উট সওয়ারকে দেখলাম এই পাহাড়টার কাছে এসে উট থেকে নামলো। তারপর মশকে পানি ভরে চলে গেল।” আবু সুফিয়ান সেই জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে বাসবাস ও আদী উট থেকে নেমেছিলো। সেখানে তাদের উটদ্বয়ের খানিকটা গোবর পেয়ে তা তুলে নিল এবং সেটা ভেঙে ছিন্ন ভিন্ন করলো। তার ভেতর সে কতকগুলো আঁটি পেল। এ আঁটি দেখে সে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা ইয়সরিবের পশুখাদ্য।” সে দ্রুত বেগে তার কাফিলার কাছে ছুটে গেল। কাফিলাকে সে ভিন্ন পথে চালিত করে বদর প্রান্তর বামেরেখে সমুদ্র কিনারে পথ ধরে দ্রুত চলে গেল।

আবু সুফিয়ান যখন নিশ্চিন্ত হলো যে, তার কাফিলাকে সে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে, তখন সে কুরাইশবাহিনীর কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালো, “তোমরা তোমাদের বাণিজ্যিক কাফিলা, তোমাদের লোকজন ও ধন সম্পদকে রক্ষা করার জন্য এসেছো। আল্লাহ ওগুলোকে রক্ষা করেছেন। অতএব তোমরা মক্কায় ফিরে যাও।” জবাবে আবু জাহর বললো, “বদরের মেলা পর্যন্ত না গিয়ে আমরা কিছুতেই ফিরবো না। এখানে তিন দিন থাকবো, পশু জবাই করে ধুমধাম করে খাবারের আয়োজন করবো, মদ খাবো, গায়িাকারা বাদ্য বাজিয়ে গান গাইবে, আরবদেরকে আমাদের অভিযানের কথা ও বাহিনী গড়ে তোলার কাহিনী শোনাবো। এভাবে তাদের মনে আমাদের ভীতি চিরকালের জন্য বদ্দমূল হয়ে যাবে। অতএব মেলায় চলো।” উল্লেখ্য যে, বদরের প্রান্তরে প্রতি বছর একটি মেলা বসতো এবং তা ছিল আরবের নামকরা মেলা।

আতঃপর কুরাইশরা তাদের আয়োজন ও প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলো। তারা বদর প্রান্তুরের অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী মরুময় টিলার অপর পার্শ্বে গিয়ে তাঁবু ফেললো। আল্লাহ প্রবল বৃষ্টি লামালেন। প্রান্তরের মাটি তেমন উষর ছিল না, খানিকটা রসালো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ এতটা বৃষ্টি পেলেন যে,তাঁদের অবস্থানস্তলের মাটি ভিজে গেল। কিন্তু চলাচলে কোন অসুবিধার সৃষ্টি করলোনা। পক্ষান্তুরে কুরাইশদের অবস্থানস্থলের মাটি এত বেশী স্যাঁত সেতে হয়ে গেল যে, তাদের চলাচল অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে আরো বেশী পানি জমা হয়েছে এমন জায়গায় সরিয়ে নিলেন।

হুবাব ইবনে মুনযির বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই জায়গাটা কি আপনি আল্রাহর নির্দেশক্রমেই বাছাই করেছেন যার থেকে আমরা একটুও এদিক ওদিক করতে পারি না? অথবা এটা কি আপানার নিজের রণকৌশলগত অভিমত?” তিনি বললেন, “এটা নেহায়েত একটা রণকৌশল এবং আমার নিজস্ব অভিমত।” হুবাব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ জায়গাটা বাছাই করা ঠিক হয়নি। অতএব সবাইকে নিয়ে এখান থেকে সরে পড়ুন। যেখানে অপেক্ষঅকৃত কম পানি আছে সেখানে তাঁবু ফেলুন। অতঃপর আমরা সেই জায়গার আশে পাশে যে কূপ আছে তা বন্ধ করে দেবো। তার ওপর চৌবাচ্চা তৈরী করে সেটা পানি দিয়ে ভরে রাখবো। অতঃপর শত্রু পক্ষের সাথে লড়াই করবো। ফলে আমরা পর্যাপ্ত খাবার পানি পাবো। কিন্তু ওরা পাবে না। ” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিক বলেছো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে উঠলেন। সামান্য পানি জমা স্থানে এসে তাবু ফেললেন। অতঃপর পানির কূপ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাই করা হলো। অতঃপর কূপের ওপর একটা চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি ভরে রাখা হলো।এবং তাতে পানির পাত্র ফেলে রাখা হলো।

সা’দ ইবনে মু’আয বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদেরকে অনুমতি দিন, আমরা আপনার জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করি, আপনি তার ভেতরে থাকবেন এবং আমরা হবো আপনার বহনকারী। অতঃপর শত্রুর মুকাবিলায় যাবো। আল্লাহ যদি আমাদেরকে বিজয়ী করেন তাহলে আমাদের আশা পূর্ণ হবে। আর যদি তা না হয় তাহলে আপনাকে আমরা বহন করে নিয়ে যাবো। আপনি অন্যান্য মুসলমানের সাথে মিলিত হবেন। হে আল্লাহর নবী, বিপুল সংখ্যক মুসলমান আপনার সাথে শুধু এই জন্য আসতে পারেনি যে, আপনি যুদ্ধে যাবেন তা তারা জানে না। তারা আপনাকে আমাদের চেয়ে কম ভালবাসে না। তারা যদি জানতো যে, আপনি যুদ্ধে যাচ্ছেন তাহলে তারা যুদ্ধে না এসে ক্ষান্ত হতো না। তাদের দিয়ে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করতেন এবং তারা আপনার হিতাকাক্সক্ষী হতো এবং আপনার সহযোগী হয়ে লড়াই করতো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দের কথা শুনে খুশী হলেন, তাঁর প্রশংসা করলেন এবং তাঁর কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য একটা সুরক্ষিত মঞ্চ তৈরী করা হলো এবং তিনি তার মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন।

সকাল বেলা কুরাইশরা বালুর টিলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। তাদেরকে নামতে দেখেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, এই সেই কুরাইশ যারা গর্ব ও অহংকারের সাথে আপনার সাথে বিদ্রোহ ও আপনার রাসূলকে অস্বীকার করে আজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। হে আল্লাহ, আপনি যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন তাঁর সময় সমুপস্থিত। হে আল্লাহ, ওদেরকে আজ সকালেই ধ্বংস করে দিন। ”

সবাই যখন ময়দানে নামলো তখন কুরাইশদের একটি দল সামনে অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তৈরী করা চৌবাচ্চায় এসে উপনীত হলো। এই দলের মধ্যে হাকীম ইবনে হিযামও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “ওদেরকে বাধা দিও না।” বস্তুতঃ ঐ চৌবাচ্চা থেকে যে যে পানি খেয়েছে, সে ঐ দিন নিহত হয়েছে। একমাত্র হাকীম ইবনে হিযাম এর ব্যতিক্রম সে নিহত হয়নি। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ভালো মুসলমানে পরিণত হয়। এই ঘটনাকে সে আজীবন স্মরণ রেখেছিল। এমনকি কখনো দৃঢ়ভাবে কসম করতে হলে বলতো, “সেই মহান সত্তার কসম যিনি আমাকে বদর যুদ্ধের দিন রক্ষা করেছেন।”

মুসলমানগণ শান্ত ও স্থির হলে কুরাইশরা ইমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য পাঠালো। সে যোড়ায় চড়ে বাহিনীর চারপাশ দিয়ে একট চক্কর দিয়ে ফিরে গিয়ে বললো, “তিনশোর সামান্য কিছু বোশী বা কম হতে পারে। তবে আমাকে আর একটু সময় দাও দেখে আসি ওদের কোন গুপ্ত ঘাঁটি বা সাহায্যকারী আছে কিনা।” অতঃপর সে সমস্ত প্রান্তর ঘুরলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। অতঃপর ফিরে গিয়ে বললো, “কোন কিছুই সন্ধান পেলাম না। তবে তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা মরণপণ করে এসেছে। ইয়াসরিবের উষ্ট্রীগুলো সুনিশ্চিত মৃত্যু বহন করে এনেছে। ওরা এমন একটা দল তরবারীই যাদের একমাত্র সহায় ও রক্ষক। আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিত যে, ওদের একজন নিহত হলে তার বদলায় তোমাদের একজন নিহত হবে। তারা কুরাইশদের মধ্য থেকে যখন তাদের সমসংখ্যক মানুষ হত্যা করবে, তখন আর তা আমাদের জন্য সুখবর হবে না। অতএব তোমরা এখনো ভেবে দেখো।”

হাকীমইবনে হিযাম এ কথা শুনে কুরাইশ বাহিনীর লোকদের কাছে গেল। প্রথমে সে উতবা ইবনে রাবীআকে গিয়ে বললো, “হে ওয়ালীদের পিতা, আপনি কুরাইশদের একজন প্রবীণ নেতা। আপনার কথা সবাই মানে। আপনি কি এমন একটা কাজ করতে প্রস্তুত যা করলে অনন্তকাল ধরে আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন?” সে বললো, “হাকীম, তুমি কি বরতে চাচ্ছো?” হাকীম বললো, “আপনি কুরাইশবাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আপনার মিত্র ‘আমর ইবনে হাদরামীর হত্যাকা-ের ব্যাপারটা মিটিয়ে দেবার দায়িত্ব নিন।” উতবা বললো, “তা আমি করতে রাজী। সে ব্যাপারে আমি তোমার কথা রাখবো। হাদরামী আমার মিত্র এবঙ তার রক্তপণ ও আর্থিক ক্ষতি পূরণ করে দিতে আমি প্রস্তুত। তুমি আবু জাহলের কাছে যাও। আমি মনে করি, কুরাইশদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্নে সে ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করবে না।” অতঃপর উতবা ইবনে রাবীআ দাঁড়িয়ে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ ও তার সহযোগীদের সাথে লড়াই করে আমাদের কোন লাভ হবে না। বস্তুতঃ আজ যদি আমরা তাকে হত্যা করতে সক্ষম হইম তা হলেও আমাদের ভেতের কখনো সদ্ভাব জন্মাবে না। একজন আর একজনের মুখ দেখা পছন্দ করবে না। কেননা সে তার চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই কিংবা কোন আত্মীয়ের হত্যাকারী বল চিহ্নিত হবে অতএব, বলো আমরা ফিরে যাই এবং মুহাম্মাদ ও তার অনুচরদের পথ থেকে সরে দাঁড়াই। তাদের ব্যাপারটা আরববাসীর উপর অর্পণ করি। সমগ্র আরববাসী মিলে যদি তাকে হত্যা করে তাহলে তো আমাদের উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হবে। আর যদি তা না করে তাহলে মুহাম্মাদের কাছে আমরা অন্ততঃ নির্দোষ থাকবো।”

হাকীম বলেন, অতঃপর আমি আবু জাহলের কাছে গেলাম, দেখলাম, সে তার যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামে শাণ দিচ্ছে। আমি তাকে বললাম, “হে আবুল হিকাম, উতবা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।” অতঃপর উতবা যা বলেছে তা তাকে জানালাম। সে সঙ্গে বললো, “উতবার মাথা বিগড়ে গেছে। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ তাকে যাদু করেছে। এটা কখ্খনো সম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদের ও মাহাম্মাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমরা ফিরবো না। উতবা যা বলেছে তা তার মনের কথা নয়। যেহেতু মাহাম্মাদ ও তার অনুচররা সংখ্যায় খুবই নগন্য এবং তাদের ভেতরে তার ছেলেও রয়েছে, যুদ্ধ হলে তার ছেলের জীবন বিপন্ন হবে তা ভেবে সে একথা বলেছে।” অতঃপর সে নিহত আমর ইবনে হাদরামীর ভাই আমের ইবনে হাদরামীর কাছে এই মর্মে খবর পাঠালো যে, “তোমার মিত্র ইতবা কুরাইশদেরকে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। অথচ তুমি তোমার প্রতিশোধের সুযোগ নিজের চোখে নাগালের মধ্যে দেখতে পাচ্ছো। সুতরায় তুমি কুরাইশদের তোমার ভাই- এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দাও। ” ‘আমের ইবনে হাদরামী উঠে দাঁড়ালো এবং বুকের কাপড় খুলে ‘হায় আমর! হায় আমর!!’ বলে চিৎকার করে মাতম করতে থাকলো। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। কুরাইশরা রণোন্মাদ হয়ে উঠলো। উতবা যে শুভ উদ্যোগ নিয়েছিল, আমের তা এক নিমিষে নস্যাৎ করে দিল।

আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখযুমী ছিল কুরাইশদের মধ্যে চরম অসৎ ওগুা স্বভাবের লোক। সে তার ঘৃণ্য তৎপরতা শুরু করে দিল। সে ঘোষণা করল। “মুসলমানদের জলাধার থেকে আমি পানি পান করবো। কিংবা তা ভেঙ্গে ফেলবো। এম যদি আমার মৃত্যুও ঘটে, পরোয়া করি না। ” এই বলে সে ময়দানে নামলে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব তার মুখোমুখি হলেন। দুইজনের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলাকালে হামযা আসওয়াদের পায়ে তরবারীর আঘাত করলেন। তার পা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এ সময় সে চৌবাচ্চার কাছেই ছিল। সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল এবং তার পা থেকে ফিনকি দিযে রক্ত ছুটতে লাগলো।সে পুনরায় হামাগুড়ি দিয়ে চৌবাচ্চার দিকে এগুলো এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লো। হামযা তার পিছু ধেয়ে গেলেন এবং চৌবাচ্চার সীমানার ভেতরেই তাকে হত্যা করলেন।

এরপর ময়দানে অবতীর্ণ হলো উতবা ইবন রাবীআ। তার ভাই শাইবা ও ছেলে ওয়ালীদ তার সঙ্গে এলো। কুরাইশদের ব্যুহ ছেড়ে সামনে গিয়ে সে হুংকার দিয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানালে আনসারদের মধ্য হতে তিন যুবক আউফ ও মুয়াওয়েব ইবন হারেস (দুই ভাই) এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা তার মুকাবিলায় এগিয়ে গেলেন। কুরাইশরা বললো “তোমরা কারা?” তাঁরা বললেন, “আমরা আনসার।” তারা বললো, “তোমাদের দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর একজন চিৎকার করে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যারা আমাদে সমকক্ষ, তাদেরকে পাঠাও।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাইদা ইবনে হারেস হামযা ও আলীকে পাঠালেন। তাঁরা গিয়ে নিজ নিজ পরিচয় দিলে প্রতিপক্ষ খুশী হয়ে বললো, “ঠিক আছে। এবার মর্যদাসম্পন্ন প্রতিপক্ষ পাওয়া গেছে।” মুসলিম বাহিনীর সবকনিষ্ঠ মুজাহিদ উতবা ইবনে রাবীআর বিরুদ্ধে, হামযা শাইবার বিরুদ্ধে এবং আলী ওয়ালীদ ইবনে উতবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। হামযা শাইবাকে এবং আলী ওয়লীদকে পাল্টা আঘাত হানার সুযোগও দিলেন না। প্রথম আঘাতেই সাবাড় করে দিলেন। আর উবাইদা ও উতবা উভয়ে একটি করে আঘাত বিনিময় করলো এবং উভয়ে গুরুতরভাবে আহত হলো। হামযা ও আলী (রা) দ্রুত ছুটে দিয়ে নিজ নিজ তরবারী দিয়ে উতবাকে খতম করে দিলেন। অতঃপর তারা উবাইদাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে পৌঁছিয়ে দিলেন।

এরপর উভয় পক্ষ একযোগে পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেল এবং পরস্পরের কাছাকাছি হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহবাদেরকে বলে দিলেন, তিনি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা যেন হামলা না করে। তিনি বললেন, “কুরাইশরা তোমাদের ঘেরাও করে ফেললে তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে হটিয়ে দিও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় মুসলিম বাহিনীকে সারিবদ্ধ করে আবু বাক্র সিদ্দীকসহ তাঁর মঞ্চসদৃশ স্থানে অবস্থান করতে লাগলেন। সেখানে আর কেউ ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি সাহায্য প্রেরণের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “হে আল্লাহ, এই মুষ্টিমেয় মুসলমান যদি আজ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আপনার ইবাদত করার জন্য কেউ থাকবে না।” আবু বাক্র(রা) বরতে লাগলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহ আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অবশ্যই পালন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সময় নিজ মঞ্চের ভেতরে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়রেন। অতঃপর সাহায্য এসে গেছে। এই দেখোনা জিবরীল একটি ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁকিয়ে আসছেন। তাঁর পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে ধূলোর আস্তরণ জমে গেছে।” পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেরিয়ে রণাঙ্গনে গেলেন এবং মুজাহিদগণকে এই বলে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করলেন, “সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি কাফিরদের সাতে ধৈর্য ও নিষ্ঠা সহকারে যুদ্ধ করবে এবং শুধু সামনের দিকে এগুতে থাকবে, কোন অবস্থায় পিছু হটবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।” বনু সালামা গোত্রের উমাইর ইবন হুমাম (রা) হাতে কয়েকটি খোরমা নিয়ে খাচ্ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনেই বললেন, “বাহ! আমার তাহলে জান্নাতে যাওয়ার পথে শাহাদাত লাভ করা ছাড়া তো আর কোন বাধাই নেই দেখছি।” একথা বলেই তিনি হাতের খোরমাগুলো ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং তরবারী নিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি ধুলি হাতে নিয়ে কুরাইশদের দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর এই বলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, “ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যাক।” অতঃপর সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন, “জোর হামলা চালাও।” অল্পক্ষণের মধ্যেই কুরাইশদের চরম পরাজয় ঘটলো। কুরাইশদের বড় বড় নেতাদের অনেকেই নিহত ও বন্দী হলো।

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন সাহাবীদেরকে বলেছিলেন, “আমি জানতে পেরেছি যে,বনু হাশিমের কিছু সংখ্যক লোককে জোর জবরদস্তি করে যুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে। আমাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। কাজেই বনু হাশিমের কেউ তোমাদের সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম কারো সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। কেননা তাকেও জবরদস্তিমূলকভাবে টেনে আনা হয়েছে।” মুসলিম বাহিনীর জনৈক আবু হুযাইফা বললেন, “আমরা আমাদের বাপ-ভাই-পুত্র ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করবো, আর আব্বাসকে কেন ছাড়বো? আমার সামনে পড়লে আমি তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবোই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ কথা শুনলেন তখন উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) ডেকে বললেন, “হে উমার, আল্লাহর রাসূলের চাচার মুখে কি তরবারী দিয়ে আঘাত করা যায়।” উমার বললেন “ইয়া রাসূলুল্লাহ, অনুমতি দিন আমি তরবারী দিয়ে ওর ঘাড়টা কেটে ফেলি। আমি নিশ্চিত যে, আবু হুযাইফা মুনাফিক হয়ে গেছে।” পরবর্তীকালে আব হুযাইফা বলতেন, “বদর যুদ্ধের দিন আমার ঐ কথাটা বলা আমাকে শংকিত করে তুলেছে। শাহাদাত লাভের দ্বারা এর কাফফারা না হওয়া পর্যন্ত আমার এ শংকা দূর হবে না।” পরে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

মুসলমানদের অনেক দুর্যোগের দিনে ফেরেশতারা সাহায্য করেছেন। কিন্তু নিহতদের ভেতরে আবু জাহলের লাশ আছে কিনা খুঁজে দেখার নির্দেশ দিলেন। ইবনে মাসউদ বলেন, আমি তার মস্তক ছিন্ন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা আল্লাহর দুশমন আবু জাহলেন মাথা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সত্যি কি তাই?” আমি বললাম, “আল্লাহর কসম, সত্যি।” ইবনে মাসউদ বলেন, আবু জাহলকে হত্যা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিজ্ঞা ছিল। আমি অতঃপর তার মাথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে রাখলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দের লাশ কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ছাড়া আর সবার লাশ নিক্ষেপ করা হলো। উমাইয়ার লাশ তার সামরিক পোশাকের মধ্যে ফুলে সেঁটে গিয়েছিল। সাহাবীগণ তাকে পেশাক থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে তার গোশত ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে তাঁরা তাকে যেমন ছিল তেমনভাবেই রেখে মাটি ও পাথর চাপা দিলেন। কুয়ার ভিতর নিক্ষেপ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে দাঁড়ালেন। তখন মধ্যরাত। সাহাবীগণ শুনতে পেলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে একে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত সকলের নাম নিয়ে সম্বোধন করে বললেন, “হে কুয়ার অধিবাসী, হে উতবা, শাইবা, উমাইয়া ও আবু জাহল! আল্লাহ তোমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা যথাযথভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবরূপে পেয়েছি।” মুসলমানগণ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, যারা মরে পচে গিয়েছে তাদেরকে আপনি সম্বোধন করছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার কথা তোমরা যেমন শুনতে পাও তারাও তেমনি শুনতে পাচ্ছে। সাড়া দিতে পারছে না।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বাহিনীর কাছে যে গণিমতের মার (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) রয়েছে, তা একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ তা নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হলেন। যারা ঐ সম্পদ সংগ্রহ করেছেন তারা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা।” যারা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছিরেন তাঁরা বললেন, “এ সম্পদ আমাদের পাওনা, কেননা আমরা যদি যুদ্ধ না করতাম তাহলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করার সুযোগ পেতে না, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় আমরা তোমাদের সাথে গণিমত সংগ্রহের কাজে যোগ দিতে পারিনি, ফলে তোমরা এগুলো সংগ্রহ করতে পেরেছো।” শত্রুরা ভিন্ন পথ দিযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমন চালাতে পারে এই আশংকায় যারা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা আমাদের চেয়ে বেশি হকদার নও, শত্রুকে আমরাও বাগে পেয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছা করেছিলাম। আর এইসব মালপত্র সংগ্রহ করতেও আমাদের কোন বাধা ছিল না এবং আমরা সংগ্রহ করতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু শত্রুরা নতুন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে এই আশংকায় আমরা তাঁর পাহারায় নিয়োজিত হই। সুতরাং এই সম্পদে তোমাদের অধিকার আমাদের চেয়ে বেশী নয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে মদীনার উঁচু এলাকায় এবং যায়িদ ইবনে হারিসাকে নিম্ন এলাকায় মুসলমানদের বিজয় সয়বাদ দিয়ে পাঠালেন। অতঃপর তিনি সদলবলে মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে উতবা ইবনে আবু মুরাইত ও নাদার ইবনে হারেসও ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের কাছ থেকে পাওয়া গণিমতের সম্পদও সাথে নিয়ে চললেন। আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব ইবনে আমর ইবনে আউফকে গণিমতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফরা গিরিপথ থেকে বেরিয়ে যখন গিরিপথ ও নাজিয়ার মধ্যবর্তী বালুর পাহাড়ে উপনীত হলেন তখন সেখানে বসে তিনি মুসলমানদের মধ্যে গণিমতের মাল সমভাবে বণ্টন করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। রাওহাতে পৌঁছলে সাখানকার মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের আল্লাহ যে মহাবিজয় দান করেছেন সেজন্য অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। তখন সালামা ইবনে সুলামা (রা) বললেন, “তোমরা কিসের জন্য আমাদেরকে মুবারকবাদ জানাচ্ছ? কতকগুলো ঝানু বৃদ্ধ লোকের সাথেই তো আমরা লড়াই করে এলাম। বন্দী উটের মত তারা হীনবল হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা তাদের জবাই করে দিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন এবং বললেন, “ভাতিজা ওরাই তো হর্তাকর্তা।”

সাফরা গিরিপথে পৌঁছে যুদ্ধবন্দী নাদার বিন হারেসকে হত্যা করা হলো। আবু তালিব তনয় আলী তাকে হত্যা করলেন। অতঃপরে তাঁরা পুনরায় অগ্রসর হলেন। আরকুয যারীয়াতে পৌঁছে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকেও হত্যা করা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলে উকবা বললো, “শিশুদের দেখাশুনার জন্য কে থাকলো, হে মুহাম্মাদ!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে শুধু বললেন, “আগুন!” অতঃপর আসেম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আফলাহ্ আনসারী উকবা ইবনে মুয়াইতাকে হত্যা করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রা করলেন। তিনি যুদ্ধবন্দীদের পৌঁছার একদিন আগেই মদীনায় পৌঁছলেন। যুদ্ধবন্দীরা পৌঁছলে সাহাবাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে রাখা হলো। তারপর তিনি বললেন, “যুদ্ধবন্দীদের প্রতি তোমরা সহানুভূতির মনোভাব রাখবে।”

ওদিকে হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানিময় সংবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম মক্কায় পৌঁছলো। কুরাইশগণ তাদো নিহতদের জন্য বিলাপ করতে লাগলো। তারপর সংযত হয়ে পরস্পরকে বলতে লাগলো, “এমন বিলাপ করো না। মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা জানতে পাররে খুশীতে বগল বাজাবে। আর বন্দীদের খালাস করিয়ে আনতে তাড়াহুড়ো করো না যাতে মুহাম্মাদ ও তার অনুচররা মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কড়াকড়ি করার সুযোগ পায়।” আবদুল মুত্তালিব তনয় আসওয়াদ তার তিন ছেলেকে হারিয়েছিল। ছেলে তিনটি হলো: যামআ, আকীল ও হারেস। তার ইচ্ছা হচ্ছিল ছেলেদের জন্য বিলাপ করতে। এই সময় গভীর রাতে সে এক শোকাহত নারী কণ্ঠের কান্না শুনতে পেল। দৃষ্টিশক্তিহীন আসওয়াদ তার এক গোলামকে বললো, “যাও তো খোঁজ নিয়ে এসো, উচ্চস্বরে বিলাপ করা বৈধ করা হয়েছে কিনা। দেখ, কুরাইশগণ তাদের নিহতদের জন্য কাঁদছে কিনা। তাহলে আমি যামআর জন্য কাঁদবো। কেননা আমার কলিজা পুড়ে গেছে।” গোলাম ফিরে এসে জানালো, “এক মহিলা তার উট হারিয়ে বিলাপ করছে। এ কথা শুনে আসওয়াদ নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করলো, “ঐ মহিলা একটা উটের জন্য এমন করে রাত জেগে কাঁদছে, এ কেমন কথা? আসলে কিন্তু সে জওয়ান উটের জন্য নয় বরং এমন এক পূর্ণিমার চাঁদের জন্য কাঁদছে, যার সৌভাগ্য খুবই সীমিত। সেই পূর্ণিমার চাঁদ যার জন্য বনু হুসাইস, মাখযুম ও আবুল ওয়ালীদের গোত্র ক্রন্দনরত। যদি আমি কাঁদি তাহলে আকীরের জন্য ও বীর কেশরী হারেসের জন্য কাঁদার মানুষ অনেক রয়েছে। সেই অসংখ্য কান্নারত লোকের উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বস্তুত: যামআর কোন জুড়ি নেই।”

অতঃপর কুরাইশগণ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ দিযে খালাস করে আনার আয়োজন করলো। প্রথমে তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুক্ত করার জন্য তাদের সম্মতি নেয়ার পর মুসলমানগণ বললেন, “এবার পণের অর্থ দাও।” মিকরায বললো, “তোমরা সুহাইলের পরিবত্যে আমাকে আটক করে রেখে তাকে ছেড়ে দাও যাতে সে গিয়ে তার পণের অর্থ পাঠিয়ে দিতে পারে।” এ কথায় সম্মত হয়ে তাঁরা সুহাইলকে ছেড়ে দিলেন এবং তার বদলে মিকরাযকে বন্দী করে রাখলেন। তার আগে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে অনুমতি দিন সুহাইলের সামনের দাঁত উপড়ে ফেলি যাতে কথা বলতে তার জিহ্বা বেরিয়ে আসে এবং আপনার বিরুদ্ধে আর কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে না পারে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তার চেহারা বিকৃত করবো না। তাহলে নবী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার চেহারা বিকৃত করে দেবেন।”

যুদ্ধবন্দীদের একজন ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা, তাঁর কন্যা যয়নাবের স্বামী আবুল ‘আস ইবনে রাবী ইবনে আবদুল উয্যা। যয়নাবের ইসলাম গ্রহনের ফলে আবুল আসের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার্যতঃ তাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে সক্ষম ছিলেন না। তাই যয়নাব মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মুশরিক স্বামীর ঘর করতে থাকেন। এই অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরাত করেন। পরে কুরাইশরা বদরের যুদ্ধে গেলে আবুল আসও তাদের সাথে যোগ দেয়। এভাবে সে যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নীত হয়।

অতঃপর মক্কাবাসীরা যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ পাঠাতে লাগলো। যয়নাবও আবুর আ’স ইবনে রাবী’র মুক্তিপণ বাবদ কিছু টাকা ও বিয়ের সময় খাদীজার দেয়া হার পাঠিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারখানি দেখে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। সাহাবীদেরকে তিনি বললেন, “তোমরা যদি ভাল মনে কর তবে যয়নাবের পাঠানো মুক্তিপণ ফেরত দিয়ে তার বন্দীকে মুক্ত করে দিতে পার।” সাহাবীগণ তাকে মুক্তি দিলেন এবং মুক্তিপণ বাবদ পাঠানো টাকা ও হার ফেরত দিলেন।

আবুল ‘আস মক্কায় গিয়ে এবং যয়নাব মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাস করতে লাগলেন। ইসলাম তাদের বিচ্ছেদ ঘটালো। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে আবুল ‘আস ব্যবস্ায় উপলক্ষে সিরিয়া গেল। তার কাছে নিজের ও কুরাইশদের ব্যবসার টাকা আমানত হিসেবে ছিল যা তাকে মূলধন হিসেবে দেয়া হয়েছিল। সে কেনাবেচা সম্পন্ন করার পর যখন প্রত্যাবর্তন করছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেরিত একটি বাহিনী তার পণ্যদ্রব্য কেড়ে নেয় এবং আবুল ’আস পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। সেনাদল যখন রাসূলের কন্যা যয়নাবের নিকট উপস্থিত হয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলো। যয়নাব তাকে আশ্রয় দিলেন। সে তার জিনিসপত্র ফেরত চাইতে এসেছিল। সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায পড়তে গেলেন এবং সাহাবীদের সাথে সামাযে দাঁড়ালেন। তখন যয়নাব নারীদের কক্ষ থেকে চিৎকার করে বললো, “হে জনগণ, শুনে রাখ, আমি আবুল ’আস ইবনে রাবী’কে আশ্রয় দিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফেরানোর পর সবার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “হে মুসলমানগণ, আমি যে কথা শুনতে পেরেছি, তোমরাও কি তা শুনেছো?” সবাই বললো, “হ্যাঁ শুনেছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহর কসম, এই ঘোষণা শুনবার আগে আমি এ ঘটনার কিছুই জানতাম না। চুক্তি অনুসারে যে কোন ব্যক্তি মুসলমানদের নিকট আশ্রয় নিতে পারে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কন্যার কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, “যয়নাব, আবুল আসকে সযতেœ রাখ। কিন্তু সে যে নির্জনে তোমার কাছে না আসে। কেননা তুমি এখন তার জন্য হালাল নও।”

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেন, যে সেনাদলটি আবুল আসের জিনিসপত্র ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কাছে তিনি বার্তা পাঠালেন, “তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি তা তোমরা জান। তোমরা তার কিছু জিনিস হন্তগত করেছো। তোমরা যদি সদয় হয়ে তার জিনিস ফিরিয়ে দাও, তবে তা হবে আমাদের পছন্দনীয়। আর যদি না দিতে চাও ওটা গণিমতের মাল যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। এসব সম্পদের আইনগত অধিকারী তোমরাই।” তাঁরা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা বরং তার জিনিস তাকে ফিরিয়েই দেব।” এরপর কেউ বালতি নিয়ে এলো। কেউ তার পুরনো মশক, কেউ তার চামড়ার পাত্র এবং কেউবা তার ছোট একটা কাঠের হাতল পর্যন্ত ফিরিয়ে দিল। এভাবে তার সব জিনিস সে হুবহু ফেরত পেলো। একটা জিনিসও বাকি রইলো না। পরে সে ঐসব জিনিস মক্কায় নিয়ে গেল এবং কুরাইশদের যার যে জিনিস তা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের আর কারো কোন জিনিস কি ফেরত পেতে বাকী আছে?” তারা বললো, “আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমাদের আর কোন প্রাপ্য ইেন। তুমি আমাদের সাথে একজন সত্যিকার আমানতদর ও মহৎ লোকের ন্যায় আচরণ করেছো।” তখন সে বললো, “তাহলে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমি শুধু এ আশংকায় ইসলাম গ্রহণ করিনি যে, তোমরা হযতো ভাবতে আমি তোমাদের সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই এরূপ করেছি। আল্লাহ যখন এগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাবস্থা করেছেন এবং আমি দায়মুক্ত হয়েছি, তখনই আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম।” অতঃপর আবুল আস (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে আসেন।

বদরের যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যাদের অনুকম্পা প্রদর্শন করে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়েছির তারা হলেন: আবুল আস ইবনে রাবী, মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফী ইবনে আবু রিফায়া এবং আবু আযযা আমর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উসমান। আবু আযযা ছিল দরিদ্র এবং বহু কন্যাদায়গ্রস্ত। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার কি অর্থ সম্পদ আছে তা আপনার জানা। আমি অত্যন্ত অভাবী এবং বহু সন্তানভারে ক্লিষ্ট। অতএব আমাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মুক্তিপণ মাফ করে দিলেন এবং অঙ্গীকার নিলেন যে, সে আর কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। আবু আযযা তার গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় নিন্মোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করে

“রাসূল মুহাম্মাদের নিকট আমার এ বার্তাটি কে পৌঁছিয়ে দেবে?

আপনি সত্য এবং বিশ্ব সম্রাট সকল প্রশংসার অধিকারী।

আপনি সেই ব্যক্তি যিনি সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহব্বান জানান,

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,

আপনি আমাদের পক্ষ থেকে পরম সম্মানিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি,

আপনি যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন, সে চরম হতভাগা,

আর যার সাথে আপোষ করেন সে পরম ভাগ্যবান।”

মুশরিকদের থেকে যে মুক্তিপণ আদায় করা হয় তার পরিমাণ ছিল বন্দিপ্রতি এক হাজার দিরহাম থেকে চার হাজার দিরহাম। তবে বিত্তহীন ব্যক্তিকে অনুকম্পা দেখানো হয় এবং বিনা পণে মুক্তি দেয়া হয়। মোট ৮৩ জন মুহাজির, ১৬১ জন আওস গোত্রীয় আনসার এবং ১৭০ জন খাজরাজ গোত্রীয় আনসার বদর যুদ্ধে অংগ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে গণিমতের অংশ দেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিম সংখ্যা আনাসার ও মুহাজির মিলে তিনশো চৌদ্দ জন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সবাইকে গণিমতের অংশ ও পারিশ্রমিক প্রদান করেন। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই রমযান, শুক্রবার সকাল বেলা।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি