বনু সুলাইম অভিযান
বদর যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সাত দিন অবস্থান করেন। অতঃপর বনু সুলইম গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি নিজেই এতে নেতৃত্ব দেন এবং তাদের কাদর নামক একটি জলাশয় দখল করেন। এখানে কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হননি। মদীনায় শাওয়ালের বাকী দিনগুলো ও পুরো যিলকা’দ মাস কাটান। এই সময়ে তিনি কুরাইশ যুদ্ধবন্দীদের অধিকাংশকে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেন।[৫৮. এই অভিযানে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিবা ইবনে আরকাতা গিফারীকে মদীনার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে যান। কেউ কেউ বলেন, ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান ]

সাওয়ীক অভিযান
জিলহাজ্ব মাসেই আবু সুফিয়ান ইবনে হারব সাওয়ীক অভিযান চালায়। এই বছর মুশরিকরা হজ্ব বাদ দিয়েই যুদ্ধে এসেছিল। কেননা আবু সুফিয়ান এবং কুরাইশদের অন্যান্য লোকেরা বদর থেকে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে মক্কায় ফিরেই প্রতিজ্ঞা করলো যে, মাহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আর একটি হামলা চালিয়ে উপযুক্ত প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গমজনিত অপবিত্রতা দূর করার জন্য গোসলের পানি মাথায় লাগাবো না [৫৯. হজ্ব ও বিয়ে শাদীর মত এই গোসলেরও রেওয়াজ জাহিলিয়াত যুগে ছিল।] এই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য আবু সুফিয়ান দুশো ঘোড় সওয়ার নিয়ে রওনা হলো। নাজদিয়া অতিক্রম করে সে মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত ‘সায়েব’ নামক পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী একটি ঝর্ণার কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলো। অতঃপর রাতের আঁধারে সে বনু নাযীরের হুয়াই ইবনে আখতাবের বাড়ীতে পৌঁছে দরজায় করাঘাত করলো। হুয়াই শংকিত হয়ে দরজা খুলতে অস্বীকার করলো। অগত্যা আবু সাফিয়ান সালাম ইবনে মিশকামের কাছে গেল। এই ব্যক্তি ছিল তৎকালে বনু নাযীরের সরদার এবং তাদের আপৎকালীন সংকট মুকাবিলার জন্য সঞ্চিত তহবিলের সংরক্ষক। আবু সুফিয়ান তার বাড়িতে ঢোকার অনুমতি প্রার্থনা করলে সে অনুমতি দিল। সে তাকে আপ্যায়নও করলো। সালাম তাকে মদীনার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অবহিত করলো। অতঃপর আবু সুফিয়ান রাত থাকতেই তার সহচরদের কাছে চলে গেল। সে কুরাইশ বাহিনীর কিছু লোককে মদীনার পাঠিয়ে দিল। তারা মদীনার পার্শ্ববর্তী উরাইব নামক স্থানে উপনীত হলো। সেখানকার খেজুর বাগানে তারা আগুন জ্বালালো। সেখানে তারা আনসার ও তার জনৈক মিত্রকে তাদের একটি যৌথ কৃষি খামারে পেয়ে হত্যা করলো। তারপর যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মদীনাবাসী তাদের এই কর্মকা- টের পেয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। বাশীর ইবনে আবদুল মুনযিরকে মদীনার দায়িত্বে রেখে গেলেন। ‘কারকারাতুল কাদর’ নামক স্থানে পৌঁছে আবু সুফিয়ান ও তার দলবলের কোন হদিস না পেয়ে ফিরে এলেন। খামারের ভেতরে তাদের ফেলে যাওয়া কিছু জিনিসপত্র দেখতে পেলেন। হালকা হয়ে দ্রুত পালানোর উদ্দেশ্যে তারা ওগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়।[৬০.ক্রুাইশদের ফেলে যাওয়া এই সব জিনিসের মধ্যে বেশীরভাগ ছিল গম বা জবের ছাতুÑ যা দুধ, মধু ও ঘি দিয়ে অথবা পানি দিয়ে খাওয়া যায়। এই ছাতুকে আরবীতে সাওয়ীক বলা হয়। আর এই কারনেই এই অভিযানের নাম হয়েছে ‘সাওয়ীক অভিযান।’] বিনাযুদ্ধে ফিরে আসা হলো বলে মুসলমানরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, এটা কি আমাদের জিহাদ বলে গণ্য হবে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, “হ্যাঁ।”

যূ-আমার অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়ীক অভিযান থেকে ফিরে এসে যিলহাজ্ব মাসের অবশিষ্ট পুরো অথবা প্রায় পুরো সময় মদীনাতে অতিবাহিত করেন। তারপর নাজদের গাতফান গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযানকেই যূ-আার অভিযান বলা হয়। পুরো অথাবা প্রায় সমগ্র সফর মাস তিনি নাজদে অবস্থান করেন। পুরো রবিউল আউয়াল কিংবা অল্প কয়েকদিন বাদে রবিউল আউয়াল মাস মদীনাতেই কাটান।

বাহরানের ফুরু অভিযান
এবার কুরাইশদের বিরুদ্ধে তিনি আর একটি অভিযান পরিচালনা করলেন। তিনি হিজায অতিক্রম করে ফুরু অঞ্চল হয়ে বাহরান পৌঁছেন। সেখানে রবিউস সানী ও জামাদিউল উলা অতিবাহিত করেন। অতঃপর নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

বুন কাইনুকার যুদ্ধ
বনু কাইনুকার মূল ঘটনা ছিল এই যে, জনৈক আরব মহিলা কিছু পণ্যদ্রব্য নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে বিক্রি করে। সেখানে সে এক স্বর্ণকারের দোকানের কাছে বসে। দোকানের লোকেরা মহিলার মুখ খুলতে বলে। কিন্তু মহিলা তা করতে অস্বীকার করে। অতঃপর স্বর্ণকার এই মহিলার পরিধানের কাপড়ের একটা কোণা ধরে তার পিঠের সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা এটা টের পায়নি। ফলে সে উঠে দাঁড়ালে অমনি উলঙ্গ হয়ে যায়। বাজারের লোকেরা তা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে। মহিলা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। জনৈক মুসলমান স্বর্ণকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। স্বর্ণকার ছিল ইহুদী। তাই ইহুদীরাও সংঘবদ্ধ হযে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে। তখন নিহত মুসলমানের পরিবার-পরিজন মুসলমানদের কাছে ফরিয়াদ জানায় তারা ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালালে বনু কাইনুকার সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ বেঁধে যায়।

মদীনার ইহুদীদের মধ্যে বনু কাইনুকাই সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অবরোধ করে অনুকূল শর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। এভাবে আল্লাহর সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নতজানু করলে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবসে সুলুল তাঁর কাছে এসে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথায় কোন উত্তর দিলেন না। সে আবার বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করুণ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্মের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলে তিনি বললেন, “আমাকে ছাড়।” এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর মুখম-ল রক্তিম হয়ে যায়। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, “আরে। আমাকে ছাড় তো।” সে বললো, “না, আমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণের নিশ্চয়তা আগে দিন, তারপর ছাড়বো। বিশ্বাস করুন, চারশো নাঙ্গামাথা যোদ্ধা এবং তিনশো বর্মধারী যোদ্ধা আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষ থেকে নিরাপদ করে দিয়েছে। আর আপনি কিনা একদিনেই তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ছাড়া এক মুহূর্তও নিরাপদ নই”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আচ্ছা, বেশ। ওদেরকে তোমার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।”

এরপর উবাদা ইবনে ছামিত (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হলেন। বনু কাইনুকার সাথে তাঁরও মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তাঁর কোন পরোয়া না করে তিনি তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিলেন এবং তাদের সাথে তার কৃত চুক্তির দায়দায়িত্ব থেকে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের সামনে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করলেন।তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মিত্র ও বন্ধু শুধুমাত্র আল্লাহ, রসূল ও মু’মিনগণ। এসব কাফিরের মৈত্রী থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত।”

উবাদা ইবনে ছামিত ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সম্পর্কেই সূরা মায়িদার নিম্নলিখিত আয়াতগুলো নাযিল হয়,

“হে মুমিনগণ, তোমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের কখনো বন্ধু ও মিত্র হিসেবে গ্রহণ করো না। ওরা পরস্পরের মিত্র। তোমাদের মধ্য হতো যে ব্যক্তি তাদেরকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে সুপথ দেখান না। যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাদেরকে তুমি দেখতে পাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের ব্যাপার নিয়ে ছুটোছুটি করে আর বলে: আমাদের আশংকা হয়, আমাদের ওপর বিপদ-মুসিবত এসে পড়ে কিনা। আল্লাহ তো বিজয় দিতে পারেন কিংবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন। তখন তারা মনের ভেতরে লুকানো ব্যাপার নিয়ে অনুতপ্ত হবে। মুমিনরা বলেঃ এই নাকি কসম খেয়ে লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানো সেই লোকদের অবস্থা যারা বলে যে, তারা তোমাদের সাথেই রয়েছে। তাদের সমস্থ নেক আমল বরবাদ হয়ে গেছে। ফলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ তার দীন ত্যাগ করে, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয় যখন আল্লাহ এমন একটি দলের আবির্ভাব ঘটাবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, যারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কারো নিন্দা বা তিরস্কারের পরোয়া করবো না। এরূপ দৃঢ় হতে পারাটা আল্লাহ অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র অনুগ্রহ বিশেষ। যাকে তিনি দিতে চান, এ অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন। বস্তুত: আল্লাহর সর্বত্র বিরাজিত সর্বজ্ঞ। তোমাদের বন্ধু ও মিত্র তো একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং সেই সব মু’মিন যারা নামাযী, যাকাত দাতা ও আল্লাহর অনুগত। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবে সে আল্লাহর দলভুক্ত হবে এবং তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে থাকে।”

যায়িদ ইবনে হারিসার কারাদা অভিযান
কারাদা নাজদের একটি জলাশয়। এখানে অভিযান পরিচালনার কারণ ছিল এই যে, বদরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুরাইশরা তাদের সিরিয়া যাতায়াতের চিরাচরিত পথে চলাচল বিপদজ্জনক মনে করে ইরাকের পথ ধরে যাতায়াত করা শুরু করলো। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী দল এই পথ দিয়ে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। তাদের সাথে তাদের প্রধান পণ্যদ্রব্য ছিল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য। বনু বাক্র ইবনে ওয়ায়িলের ফুরাত ইবনে হাইয়ান ছিল তাদের ভাড়াটে পথপ্রদশক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কাফিলাকে আক্রমণ করার জন্য যায়িদ ইবনে হারিসাকে পাঠালেন। তিনি কারাদার গিয়ে কাফিলাকে ধরলেন। কাফিলার লোকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলে তিনি পণ্যসম্ভারসহ সমগ্র কাফিলাটিকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলেন।

উহুদ যুদ্ধ
বদর যুদ্ধ থেকে পরাজয়ের কলংক মাথায় নিয়ে কুরাইশ কাফিররা যখন মক্কায় পৌঁছলো এবং আবু সুফিয়ান তার কাফিলা নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল তখন আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবীআ, ইবরিমা ইবনে আবু জাহল ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াসহ কুরাইশদের একটি দলÑ যাদের পিতা, পুত্র কিংবা ভাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, আবু সুফিয়ানের কাছে গেল। আবু সুফিয়ানের ঐ কাফিলায় সেবার যে মুনাফা অর্জিত হয় তা তখনো তর কাছেই ছিল। তারা বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ তোমাদের বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। এবার এই কাফিলার যাবতীয় সম্পদ দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য কর, তাহলে আশা করি আমরা আমাদের হারানো লোকদের উপয্ক্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবো।” সবাই সম্মতি দিল।

অতঃপর আবু সুফিয়ান, তার কাফিলার অন্তর্ভুক্ত অকুরাইশীগণ, বিশেষত: কিনানা গোত্র ও তিহামাবাসীদের মধ্যে যারা কুরাইশদের প্রতি অনুগত ছিল, যুদ্ধে যেতে সম্মাতি দিল, তখন কুরাইশগণও মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। প্রতিহিংসা বৃত্তিকে উস্কিয়ে দেয়ার জন্য এবং যোদ্ধাদের পালানো রোধ করার জন্য কুরাইশরা তাদের কিছু সংখ্যাক মহিলাকেও সঙ্গে নিল। সেনাপতি আবু সুফিয়ান স্বীয় স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাকে, উকরিমা বিন আবু জাহল উম্মে হাকিম বিনতে হারেসকে, হারেস বিন হিশাম ফাতিমা বিনতে ওয়ালীদকে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বারযা বিনতে মাস’উদকে এবং আমর ইবনুল আস বারিতা বিনতে মুনাব্বিহকে সঙ্গে নিল। অতঃপর তারা মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হলো।মদীনার সম্মাুখস্থ উপত্যাকার মুখে অবস্থিত খাল থেকে নির্গত দুইটি ঝর্নার কিনারে বাতনুস সুবখার পাহাড়ের কাছে গিয়ে তাঁবু স্থাপন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ তাদের ঐ স্থানে অবস্থান গ্রহণের কথা শুনতে পেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললেন, “আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম, আমার একটি গরু জবাই করা হয়েছে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যেন ফাটল ধরেছে। আরো দেখলাম, আমি একটা সুরক্ষিত বর্মের ভেতরে হাত ঢুকিয়েছি।[ ৬১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “গরু জবাই এর তাৎপর্য এই যে, আমার কিছু সংখ্যক সাহাবী নিহত হবে। আর আমার তরবারীর ধারালো প্রান্তে যে ফাটল দেখলাম সেটা আমার পরিবারভুক্ত এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার আলামত।”]এই বর্ম দ্বারা আমি মদীনাকে বুঝেছি। তোমরা যদি মনে কর, মদীনায় অবস্থান করবে এবং কুরাইশরা যেখানে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে থাকাকালেই তাদেরকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেবে, তাহলে সেটা করতে পার। তারপরও যদিওরা ওখানেই অবস্থান করে তাহলে সেটা তাদের জন্য খুবই খারাপ অবস্থান বলে প্রমাণিত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে মদীনায় বসেই আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলে মদীনার বাইরে যেতে চাচ্ছিলেন না। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুলেরও মত ছিল অনুরূপ মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার বিপক্ষে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি এবং যাদের জন্য আল্লাহ উহাদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদানের সৌভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তাঁরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, শত্রুর মুকাবিলার জন্য আমাদেরকে মদীনার বাইরে নিয়ে চলুন। ওরা যেন মন করতে না পারে যে, আমরা দুর্বল কিংবা কাপুরুষ হয়ে গেছি।”

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, মদীনাতেই অবস্থান নিন, বাইরে যাবেন না। আল্লাহর কসম,আমরা মদীনার বাইরে গেলেই শত্রুরা আমাদের ক্ষতি বেশী করতে পারবে। আর শত্রুরা যদি মদীনায় প্রবেশ করে আক্রমণ চালায় তাহলে আমরা শত্রুদের অধিকতর বিপর্যয় ঘটাতে পারবো। অতএব হে আল্লাহর রাসূল, কাফিররা যেমন আছে ওদেরকে তেমনি থাকতে দিন। তারা যদি ওখানেই থেকে যায় তাহলে এ জায়গাটা তাদের জন্য জঘন্যতম অবরোধস্থল বলে সাব্যস্ত হবে। আর যদি তারা মদীনায় প্রবেশ করে তাহলে আমাদের পুরুষরা তাদের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে এবং স্ত্রী ও শিশুরা ওপর থেকে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করবে। আর যদি ফিরে যায় তাহলে যেমন এসেছিল তেমনি ফিরে যাবে।” পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেসব মুসলমান মদীনার বাইরে কুরাইশদের সাথে লড়াই করতে আগ্রহী ছিলেন, তারা তাঁদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন। সে দিনটি ছিল জুম’আর দিন। একই দিন মালিক ইবনে আমর নামক জনৈক আনসার ইন্তিকাল করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জানাযা পড়লেন। অতঃপর মুসলিম জনতার সামনে আসলেন। তিনি মদীনায় বসেই কুরাইশদের মুকাবিলা করতে চেয়েছিলেন ভেবে মুসলমানগণ অনুতপ্ত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনার মত পছন্দ করিনি,এটা আমাদের উচিৎ হয়নি। আপনি যদি মদীনাতেই অবস্থান করতে চান তবে তাই করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, তা হয় না, যুদ্ধের পোশাক পরার পর যুদ্ধ না করে তা খুলে ফেলা কোন নবীর পক্ষে শোভা পায় না।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাজার সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হলেন। মদীনা ও উহুদের মধ্যবর্তী শাওত নামক স্থানে পৌঁছার পর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল আলাদা হয়ে গেল। সে বললো, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের কথা শুনলেন, আমার কথা শুনলেন না। হে জনতা, আমি বুঝি না আমরা কিসের জন্য এতগুলো লোক প্রাণ দেবো?”

সে তার গোত্রের মুনাফিক ও সংশয়মান অনুসারীদের সাথে নিয়ে মুসলিম বাহিনী থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তদের পিছু পিছু গেলেন এবং বললেন, “আমি তোমাদেরকে দোহাই দিচ্ছি। তোমাদের মুসলমান ভাইদেরকে এবং আল্লাহর নবীকে উপস্থিত শত্রুর হামলার মুখে ফেলে যেও না।” তারা বললো, “যুদ্ধ হবে মনে করলে তোমাদের রেখে যেতাম না। আমাদের মনে হচ্ছে যুদ্ধ হবে না।” তারা যখন কিছুতেই রণাঙ্গনে ফিরে আসতে রাজী হলো না তখন আবদুল্লাহ বললেন, “হে আল্লাহর দুশমনরা, আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে দিন। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তোমাদের মুখাপেক্ষী রাখবেন না। আল্লাহই তাঁর জন্য যথেষ্ট।”

আনসারগণ বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের ইহুদী মিত্রদের কাছে সাহায্য চাইলে কেমন হয়?” তিনি বললেন, “ওদের দিয়ে কোন কাজ নেই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখলেন। উহুদ পাহাড়ের নিকটবর্তী উপত্যাকায় তিনি অবাস্থান গ্রহণ করলেন। সৈণ্যদেরকে পাহাড়ের নিকটবর্তী প্রান্তে মোতায়েন করলেন এবং পাহাড়কে পেছনে রেখে দাঁড়ালেন। সৈন্যদেরকে বললেন, “আমি যুদ্ধের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ য্দ্ধু শুরু করবে না।” কুরাইশরা ইতোমধ্যে তাদের সমস্ত উট ও ঘোড়া উহুদের অদূরে মুসলমানদের খাল বিধৌত ছামগার ফসল সর্মদ্ধ ভূমিতে ছেড়ে দিয়েছে। এ জন্য যুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম নিষেধাজ্ঞা শুনে জনৈক আনসার বললেন, “আউস ও খাজরাযের ফসলী জমি থেকে আমরা এখনো আমাদের প্রাপ্য অংশ আদায় করিনি। এমতাবস্থায় সেখানে পশু চরানো কিভাবে বরদাশত করা যায়?”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাতশ’ সৈন্যকে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে ৫০ জন সৈন্যের তীরন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি করলেন। তিনি সাদা কাপড় দ্বারা চিহ্নিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, “ঘোড়সওয়ার শত্রুদেরকে তীর বর্ষণ করে তাড়িয়ে দিও। যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি আর পরাজিত হই কোন অবস্থায়ই কাউকে পেছন দিক থেকে আসতে দেবে না। দৃঢ়ভাবে নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকো, যেন তোমার দিক থেকে আমরা আক্রান্ত না হই।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটো বর্ম এক সাথে পরে নিলেন এবং পতাকা দিলেন মুস’আব ইবনে উমাইরের হাতে।

পনর বছর বয়স্ক সামুরা ইবনে জুনদুব ও রাফে ইবনে খাদীজাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন প্রথমে যোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করেননি।পরে অনেক সাহাবী বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, রাফে ভাল তীরন্দাজ।” তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। রাফেকে অনুমতি দিলে আবার অনেকে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সামুরা রাফেকে মল্লাযুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে।” তখন তিনি সামুরাকেও অনুমতি দিলেন। কিন্তু উসামা ইবনে যায়িদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর, যায়িদ ইবনে সাবিত, বারা ইবনে হাযম ও উসাইদ ইবনে যুহাইরকে অনুমতি দেননি। পরে খন্দক যুদ্ধে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়। তখন তাদের বয়স ছিল পনর বছর।

কুরাইশরা তাদের তিন হাজার যোদ্ধাবিশিষ্ট সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করলো। তাদের সাথে দুশো ঘোড়া ছিল। এই ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ডান পাশে খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে এবং বাম পাশে ইকরিমা ইবনে আবু জাহলকে রাখা হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ তরবারী দেখিয়ে বললেন, “এই তরবারীর হক আদায় করতে কে প্রস্তুত আছো?” অনেকেই এগিয়ে গেল। তিনি কাউকেই তরবারী দিলেন না।

আবু দাজানা এগিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ তরবারীর হক কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ তরবারী দিয়ে শত্রুকে এত বেশী আঘাত হানতে হবে যেন তা বাঁকা হয়ে যায়।” আবু দুজানা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ওটা আমি নেব এবং হক আদায় করবো।” তিনি আবু দাজানাকেই তরবারিখানা দিলেন। বস্তুত : আবু দুজানা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর যোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তিনি ভীষণ গর্বিত ভঙ্গীতে চলতেন। তাঁর একটা লাল বন্ধনী ছিল। তা দিয়ে যখন নিজের গায়ে আঘাত করতেন তখন লোকে বুঝতো যে, তিনি এক্ষুণি যুদ্ধে নামবেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে তরবারীটা নেয়ার পর সেই বন্ধনীটা বের করলেন এবং নিজের মাথায় তা দিয়ে আঘাত করলেন। অতঃপর সৈন্যদের ব্যুহের মাঝে হেলে দুলে গর্বিত ভঙ্গীতে চলতে লাগলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “রণাঙ্গন ছাড়া হাঁটা চলার এই ভঙ্গীটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়। ”

ওদিকে আবু সুফিয়ান তার বাহিনীর পতাকাবাহী বনু আবদুদ দারের লোকদেরকে যুদ্ধে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বললো, “হে বনু আবদুদ দার, তোমরা বদরের যুদ্ধে আমাদের পতাকা বহন করেছিলে। কিন্তু সে যুদ্ধে আমাদের কি পরিণতি হয়েছিলো তা দেখেছো। মনে রেখ, সৈন্যদের ওপর পতাকার দিক থেকেই হামলা এসে থাকে। পতাাক যদি নেমে যায় তাহলে সৈন্যরা পর্যুদস্ত হয়। সুতরাং তোমরা হয় পতাকা দৃড়ভাবে ধরে রাখবে নয়তো সরে যাবে। ওটা আমরাই ধরে রাখতে পারবো।” এ কথা শুনে পতাকাবাহীরা পতাকার প্রতি মনোযোগী হলো এবং আব সুফিয়ানের কাছে প্রতিজ্ঞা করে বললো, “আমরা আমাদের অধিনায়কত্ব তোমার কাছে অর্পণ করছি। আগামীকাল যখন আমরা লড়াইয়ে নামবো, তখন দেখে নিও আমরা কেমন লড়াই করি।” আবু সুফিয়ান এই সংকল্পই তাদের মধ্যে সৃস্টি করতে চেয়েছিলো।

পরের দিন লড়াই শুরু হলে উতবার কন্যা হিন্দ তার সহযোগী মহিলাদের সথে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে পুরুষদের পিছু পিছু চলতে লাগলো এবং এই বলে তাদে উত্তেজিত করতে লাগলো:

“চমৎকার, হে বনু আবদুদ্ দার,

চমৎকার তোমাদের তৎপরতা) হে পশ্চাদ্দিকের রক্ষকগণ!

প্রতিটি ধারালো তরবারী দ্বারা আঘাত হানো”

তারা আরো বলছিলো, “যদি ধাবমান থাক, আলিঙ্গন করবো এবং নরম গদি বিছিয়ে দেবো

আর যদি পিছিয়ে যাও

আলাদা হয়ে যাবো,

আমাদের ভালোবাসা পাবে না তোমরা।”

উহুদের যুদ্ধে সাহাবীগণ যাতে পরস্পরকে চিনতে পারে সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে একটা প্রতীক ধ্বনি শিখিয়ে দিলেন, তা হলো, “আমিত, আমিত!” অর্থাৎ মরণ আঘাত হানো। মরণ আঘাত হানো।

ক্রমে যুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করলো। আবু দুজানা এমন অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন যে, যাকেই সামনে পান হত্যা করতে করতে এগিয়ে যান। যুবাইর ইবনুল আওয়াম বলেন, “মুশরিকদের একটা লোক আমাদের কোন সৈনিককে দেখলেই তাকে হত্যা করতে লাগলো। আবু দুজানা ও এই লোকটি পরস্পর কাছাকাছি এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি দোয়া করছিলাম আল্লাহ যেন দু’জনকে একত্রিত করেন। অচিরেই দু’জন মুখোমুখি হলো এবং উভয়ে উভয়কে আঘাত হানতে শুরু করলো। মুশরিক লোকটা আবু দুজানাকে আঘাত করলো। আবু দাজানা তার চামড়ার তৈরী ঢাল দিয়ে আঘাত ফেরালেন। তরবারী ঢালের মধ্যে ঢুকে আটকে রইল। আর আবু দাজানা তাকে পাল্টা আঘাত করে হত্যা করলেন। অতঃপর দেখলাম তিনি হিন্দ বিনতে উতবার মাথার ওপর তরবারী উত্তোলন করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তরবারী নমিয়ে নিলেন। [৬২. আবু দুজানা বলেন: রণাঙ্গনে দেখলাম কে একজন কাফিরদেরকে উস্কিয়ে দিচ্ছে। আমি তার প্রতিরোধে এগিয়ে গেলাম। তরবারী তুলতেই সে আর্ত চিৎকার করে উঠলো। দেখলাম সে একজন স্ত্রীলোক। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবারী দিয়ে একজন নারীকে আঘাত করলে তরবারীর অমর্যাদা হবে মনে করে বিরত রইলাম।]

হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) য্দ্ধু করতে করতে আরতাহ ইবনে আবদ শুরাহবীলকে হত্যা কলেন। সে ছিলো পতাকা বহনকারী দলের অন্যতম সদস্য। পরক্ষণেই তিনি দেখতে পেলেন সিবা ইবনে আবদুল উয্যা তার পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে। তিনি তাকে যুদ্ধের চ্যালেজ্ঞ দিলেন। বললেন, “ওহে হাজামনীর বেটা, আমার সামনে আয়। ” সিবার মা মক্কায় খাতনা করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

যুবাইর ইবনে মতিয়িমের গোলাম ওয়াহশী বলেন, আমি হামযার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখলাম, তিনি স্বীয় তরবারী শত্রুদের দিকে তুলছেন আর চোখের নিমিষেই তাদেরকে সাবাড় করে দিচ্ছেন। সামনের কাউকেই জীবিত ছাড়ছেন না। যুদ্ধ করতে করতে তাঁর সারা দেহ ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে ধূসর বর্ণের উটের মত হয়ে গেছে। এই সময় সিবা ইবনে আবদুল ইযযা আমার সম্মাুখ দিয়ে গিযে হামযার কাছাকাছি হলো। হামজা তাকে দেখে হুংকার ছাড়লেন, “এই হাজামনীর বেটা, আয় আমার কাছে, মজা দেখাই!” এই বলেই তাকে আঘাত হানলেন। কিন্তু তার মাথায় আঘাত লাগলোনা বলে মনে হলো। আমি হামযার প্রতি আমার বর্শা তাক করলাম। লক্ষ্য ঠিক হয়েছে বলে যখন নিশ্চিত হলাম, তখন ছুঁড়ে মারলাম তাঁর প্রতি। বর্শা তাঁর তরপেটে গিয়ে বিদ্ধ হলো এবং দুই উরুর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তিনি এ অবস্থায়ও আমার দিকে এগুলেন। কিন্তু পরক্ষণেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে গেলেন। আমি তাকে খানিকটা সময় দিলাম। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন আমি গিয়ে আমার বর্শা টেনে বের করলাম।

অতঃপর কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ফিরে গেলাম। রণাঙ্গনে আমার হামযাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজন ছিল না। আমি তাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীন হতে পারবো জেনেই তাকে হত্যা করলাম। মক্কা ফিরে যাওয়া মাত্রই আমাকে স্বাধীন করে দেয়া হলো। অতঃপর মক্কাতেই বাস করতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা জয় করলে আমি পালিয়ে তায়েফে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। কিন্তু তায়েফ থেকে একদর প্রতিনিধি ইসলাম গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারলাম না যে, কোথায় যাবো। ভাবলাম, সিরিয়া কিংবা ইয়ামানে চলে যাবো। কেননা সেখানে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। ইতোমধ্যে এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম গ্রহণ করলে এবং কালেমায়ে শাহাদাত পড়লে কাউকেই হত্যা করেন না।” এ কথা শুনে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেলাম। তিনি আমার উপস্থিতিতে এবং তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে সত্য দীনের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। চোখ তুলে একবার আমর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসো। তুমি কিভাবে হামযাকে হত্যা করেছিলে আমাকে বলো।” আমি তাকে ঘটনাটি আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলাম। সব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তুমি কখনো আমর সামনে আসবে না। আমি যেন তোমাকে না দেখি।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন জীবিত ছিলেন আমি তাঁর কাছে গেলেই এক পাশে সরে যেতাম যেন আমার মুখ তিনি দেখতে না পান।

মুস’য়াব ইবনে উমাইর (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করার জন্য বীরোচিতভাবে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। তাঁকে হত্যা করেছিলো ইবনে কিময়া লাইসী। সে মনে করেছিরো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই হত্যা করেছে। তাই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।” মুসয়াব নিহত হরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবের হাতে পতাকা অর্পন করলেন। অতঃপর আলী (রা) ও অন্যান্য মুসলিম বীর শার্দুলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

উহুদের যুদ্ধ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের পতাকাতলে বসলেন। তিনি আলী (রা) কে দূত মারফত নির্দেশ দিলেন যে, “পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও।” আলী এগিয়ে গিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “আমি বিভীষিকার বাবা।” [৬৩.কুরাইশ পক্ষের আবু সা’দ হুংকার দিয়েছিলো, “আমি বিভীষিকা সৃষ্টি কারী। আমার সাথে লড়তে কে প্রস্তুত আছে, আস।” এর জবাবেই আলী (রা) উক্ত হুংকার দেন।] আবু সা’দ এগিয়ে এসে তাকে বললো, “হে বিভীষিকার বাবা, তোমার লড়াই করার শখ আছে নাকি?” আলী বললেন, “হ্যাঁ, আছে।” অতঃপর উভয়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আঘাত ও পাল্টা আঘাত চললো। অবশেষে আলী একটা আঘাত করেই তাকে ধরাশয়ী করে ফেললেন। ধরাশায়ী করেই আলী (রা) সেখান থেকে সরে গেলেন এবং তাকে মরণ আঘাত হানলেন না। আলীকে তাঁর সঙ্গীরা বললেন, “ওকে চূড়ান্ত আঘাত না করে সরে গেলেন কেন?” তিনি জবাব দিলেন, আবু সা’দ আমাকে তার যৌনাঙ্গ দেখিয়েছে। কিন্তু আমার মনে তার প্রতি দয়া ও করুণার সঞ্চার হলো এবং সেই করুনাবশেই আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। তবে বুঝতে পেরেছি যে, স্বয়ং আল্লাহই তাকে হত্যা করেছেন।”

আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহ (রা) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুসাফে ইবনে তালহা ও তাঁর ভাই জুলাস ইবনে তালহাকে হত্যা করেন। উভয়কেই তিনি এক এক করে বর্শা দিযে আঘাত করেন এবং প্রত্যেকে আহত অবস্থায় তার মা সুলাফার কাছে যায় এবং তার কোলে মাথা রাখে। সুলাফা পুত্রকে জিজ্ঞেস করে, “ হে প্রিয় বৎস, তোমাকে কে আহত করলো?” সে জবাব দেয়, “ইবনে আবুল আকলাহ।” তখন সুলাফা মান্নত করে যে, আসিম ইবনে সাবিত ইবনে আবুল আকলাহকে হত্যা করা সম্ভব হলে সে তার মাথা খুলিতে মদ পান করবে।

হানযালা ইবনে আবু আমের গাসীল [ফেরেশতারা তাঁকে গোসল দিয়েছিলেন বলে তাঁকে মরণোত্তর গাসিল উপাধিতে ভূষিত করা হয়।] আবু সুফিয়ানের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এক পর্যায়ে হানযালা আবু সুফিয়ানের ওপর পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। তা দেখে শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ নামক কুরাইশ যোদ্ধা হানযালাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন, “তোমাদের বন্ধু হানযালাকে ফেরেশতারা গেসল করাচ্ছেন। ” পরে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে জানা যায় যে, তাঁর ওপর গোসল ফরয ছিল। জিহাদের ডাক শোনার পর আর গোসল করার অবকাশ পাননি। তৎক্ষণাৎ রণাঙ্গনে চলে যান।

এরপর আল্লাহ মুসলমানদের ওপর সাহায্য নাযিল করেন এবং তাদের সাথে কৃত স্বীয় ওয়াদা পূরণ করেন। ফলে তারা কুরাইশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে হত্যা ও নির্মূল করতে সক্ষম হন। মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের মুখে তিষ্ঠাতে না পেরে কাফিররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং মারাত্মকভাবে পরাজয় বরণ করে।

যুবাইর (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ, আমি উতবা তনয়া হিন্দ ও তার সহচরদেরকে উর্ধশ্বাসে পালাতে দেখেছি। তাদেরকে পাককড়াও থেকে বাঁচানোর জন্য মুশরিকদের কোন বড় বা ছোট দলকে এগুতে দেখলাম না। এভাবে বিজয় যখন ষোলকনায় পূর্ণ হতে চলেছে, তখন সহসা তীরন্দাজ বাহিনী তদের অবস্থান ত্যাগ করে পলায়নরত কুরাইশ বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো এবং আমাদের পেছরেন গিরিপথটাকে খোলা রেখে গেল। আমরা পেছন দিক থেকে আক্রান্ত হলাম। ঠিক এই সময় কে যেন চিৎকার করে বললো, “মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে।” অনন্যোপায় হয়ে আমরা রণাঙ্গনে ফিরে এলাম, আর কুরাইশ বাহিনীও আমাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অথচ আমরা তাদের পতাকাবাহীদেরকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করেছিলাম এবং এতখানি অচল করে দিয়েছিলাম যে, তাদের ভুলু-িত পতকার কাছেও কেউ যেতে পারেনি। অবশেষে আমরাহ বিনতে হারেসিয়া নাম্নী এক মহিলা তা তুলে নিয়ে কুরাইশদের কাছে পৌঁছে দেয়। অতঃপর সেই পতাকাকে কেন্দ্র করে ও সম্বল করে তারা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়।

মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে শুত্রুরা তাদের ভেতরে ঢুকে ব্যাপক আক্রমণ চালালো। ফলে সে দিনটা হয়ে দাঁড়ালো এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা ও পরিশুদ্ধির দিন। বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমানকে আল্লাহ শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করলেন। এমনকি শত্রুরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তিনি শরীরের এক পার্শ্বে একটি আঘাত খেলেন। এতে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গেল এবং তাঁর মুখম-ল ও ঠোঁট আহত হলো। উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস তাঁকে এ আঘাত করেছিলো। তাঁর সমগ্র মুখম-ল রক্তাক্ত হয়ে গেল। তিনি হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বললেন, “যে জাতি তার নবীর মুখম-ল রক্তরঞ্জিত করে সে জাতি কি করে কল্য্যন লাভ করবে? অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকছেন।” আল্লাহ তায়ালা তাঁর এ উক্তির জবাবে নিন্মোক্ত আয়াত নাযিল করলেন:

[আরবী *******]

“(হে নবী!) কোন চূড়ান্ত ফায়সালার ইখতিয়ার তোমার নেই। ইখতিয়ার রয়েছে আল্লাহর হাতে। তিনি তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন, আবার শাস্তিও দিতে পারেন। কেননা তারা যালিম। ”(আলে ইমরান)

আবু সাঈদ খুদরীর (রা) বর্ণনা মতে উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বর্শার আঘাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডান দিকের নিচের দাঁত ভেঙে যায় এবং তাঁর নীচের ঠোঁট আহত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে শিহাব জুহরী তাঁর কপাল জখম করে দেয়। আর ইবনে কুমরা তাঁর চোয়ালের উপরিভাগে আঘাত হানে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিরস্ত্রাণের দুটো অংশ ভেঙে তার চোয়ালের ভেতরে ঢুকে যায়। অতঃপর মুসলমানদেরকে তাদের অজান্তে ফেলে মারার মত জন্য আবু আমের যে গর্ত খুড়ে রেখেছিল তার একটি তে তিনি পড়ে যান। এই সময় আলী (রা) এসে তাঁর হাত ধরেন এবং তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) তাঁকে ওপরে তোলেন। তাঁদের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়াতের সক্ষম হন। আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালিক ইবনে সিনান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের রক্ত চুষে নেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললেন, “আমর রক্ত যার রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়ে গোযখের আগুন তকে স্পর্শ করতে পারবে না।”

মুশরিক বাহিনী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এমন কে আছ, যে আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য জীবন কুরবানী করতে প্রস্তুত? এ কথা শুনে যিয়াদ ইবনে সাকান সহ পাঁচজন আনসার সাহাবী উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিফাজতের জন্য এক একজন করে লড়াই করে শহীদ হতে লাগলেন। সর্বশেষ ব্যক্তি ছিলেন যিয়াদ ইবনে সাকান কিংবা আম্মারা ইবনে ইয়াযীদ ইবনুস সাকান। তিনিও বীর বিক্রমে লড়াই করে গুরুতরভাবে আহত হলেন। ইতিমধ্যে মুসলমানদের একটি দল সেখানে ফিরে এলো এবং উক্ত আহত সাহাবীর পক্ষে লড়াই করে শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে হটিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহত সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন, “ওকে আমার কাছে আনো।” মুসলমানগণ তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলো। তিনি নিজের জানুর ওপর তার মাথা রেখে শোয়ালেন। এই অবস্থাতেই উক্ত সাহাবী ইনতিকাল করলেন।

আবু দুজানা (রা) নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর টিঠে তীর বিদ্ধ হচ্ছিলো আর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে তাঁর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে তাঁর গায়ে বিদ্ধ তীরের সংখ্যা প্রচুর। আ সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিরক্ষার চেষ্টায় তীর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সা’দ বললেন, “আবু দুজানাকে দেখলাম, আমাকে একটার পর একটা তীর দিয়েই চলছেন আর বলছেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতামাতা কুরবান হোক। তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাক।’ এমনকি সময় সময় তিনি ফলকবিহীন তীরও দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘নিক্ষেপ কর।”

পরাজয় ঘটার এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাত লাভের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন কা’ব ইবনে মালিক। কা’ বলেন, “শিরস্ত্রাণের ভেতরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিলো আর তা দেখেই আমি চিনতে পারলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম “হে মুসলমানগণ, সুসংবাদ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে আছেন। তিনি এখানে।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইশারা করে বললেন, “তুমি চুপ থাক।”

মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চেনার পর তাঁকে নিয়ে সবাই পর্বতের ঘাঁটিতে চলে গেলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক, উমার ফারুক, আলী ইবনে আবু তালিব, তালহা ইবন উবাইদাল্লাহ ও যুবাইর ইবনুর আওয়াম সহ একদল মুসলমান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের ঘাঁটিতে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন উবাই ইবনে খালাফ সেখানে পৌঁছলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, এ যাত্রা তুমি প্রাণে বেঁচে গেলেও তোমার নিস্তার নেই।” মসলমানগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ লোকটিকে সহানুভূতি দেখানো কি আমাদের কারো জন্য সঙ্গত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওকে আসতে দাও।” সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে, তিনি হারেস ইবনে সিম্মারের কাছ থেকে বর্শা নিলেন। কোন কোন বর্ণনানুসারে, বর্শা হাতে নেয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ভংয়কর পাঁয়তারা করলেন যে, উট প্রবল জোড়ে নড়ে উঠলে তার পিঠের ওপর বসা বিষাক্ত ভিমরুলের ঝাঁক যেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে যায়; আমরাও ঠিক তেমনি ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে দূরে সটকে পড়লাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার ঘাড়ের ওপর বর্শার আঘাত হানলেন। আঘাত খেয়ে উবাই ইবনে খালাফ তার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো এবং বেশ কয়েকটা গড়াগড়ি খেলো।

ইতিপূর্বে উবাই ইবনে খালাফ মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম সাথে দেখা করে বলতো, “হে মুহাম্মাদ, আমার একটা ঘোড়া আছে। তার নাম ‘আওজ’। তাকে আমি প্রতিদিন এক ফারাক (প্রতি ৪০ কেজি) ভুট্রা খাওয়াই। এই ঘোড়ায় চড়েই আমি তোমাকে হত্যা করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিতেন, “বরং আল্লাহ চাহেতো আমিই তোমাকে হত্যা করবো।”

উবাইয়ের কাঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জখমটি করে দিয়েছিলেন, সেটা তেমন গুরুতর জখম না হলেও তা দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। ঐ অবস্থাতেই সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ আমাকে খুন করেছে।” কুরাইশরা বললো, “আসলে তোমার মন অতিমাত্রায় ঘাবড়ে গেছে। তোমার কোন ভয় নেই।” সে বললো, “মক্কায় থাকাকালেই মুহাম্মাদ আমাকে বলেছিলো: তোমাকে আমিই হত্যা করবো।’ এখন আমার আশংকা হয়, সে যদি আমার প্রতি শুধু থুথুও নিক্ষেপ করে তা হলেও আমি মরে যাবো।” কুরাইশরা তাকে নিয়ে মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে সারেফ নামক স্থানে আল্লাহর এই দুশমনের জীবনলীলা সাঙ্গ হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বত ঘাটির মুখে উপনীত হলে আলী ইবনে আবু তালিব (রা) পানির সন্ধানে বেরুলেন, উহুদের পাশ্ববর্তী জলাশয় বা প্রস্তর ঘেরা হ্রদ ‘মেহরাস’ থেকে মশক ভরে পানি আনলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পান করতে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানিতে একটা দুর্গন্ধ পেয়ে তা পান করলেন না। বরং এ পানি দিয়ে তিনি মুখের রক্ত ধুয়ে ফেললেন এবং কিছুটা মাথায় ঢালতে ঢালতে বললেন, “আল্লাহর নবীর মুখকে যে ব্যক্তি রক্তে রঞ্জিত করেছে সে আল্লাহর ভয়ংকর ক্রোধের শিকার হবে।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্বতের একটি টিলার ওপর আরোহণে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং শুধু দুটি বর্মের সাহায্য নিয়ে শক্তি প্রদর্শন করেছিলেন। টিলায় আরোহণের চেষ্টায় ব্যর্থ হলে তালহা ইবনে উবাইদাল্লাহ (রা) তাঁকে ঘাড়ে করে আরোহণ করালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তালহা রাসূলের প্রতি যে সদাচরণ করলো তাতে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেল।”

উহুদ যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিল বনু সা’লাবা গোত্রের মুখাইরীক। উহুদ যুদ্ধের দিন সে তার স্বগোত্রীয় ইহুদীদেরকে বললো, “হে ইহুদীগণ, তোমরা নিশ্চিতভাবেই জান যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য।” ইহুদীরা বললো, “আজ তো শনিবার।” সে বললো, “তোমাদের জন্য শনিবারের অজুহাত যুক্তিযুক্ত নয়।” অতঃপর সে তরবারী ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করলো। সে বললো, “আমি যদি মারা যাই তাহলে আমার সমস্ত সম্পত্তি মুহাম্মাদের। তিনি ঐ সম্পত্তি যেভাবে খুশী ব্যবহার করবেন। ” অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে গেল এবং তাঁর পক্ষে লড়াই করে নিহত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মুখাইরীক ইহুদীদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।”

আবু হুরাইরা (রা) বলতেন, “তোমারা আমাকে বলে দাও, কে সেই ব্যক্তি যে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ সে নামায পড়েনি?” লোকেরা জবাব দিতে না পেরে জিজ্ঞাস করতো, “কে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি?” তিনি বলতেন, “বনু আবদুল আশহালের উসাইরিম আমর ইবনে সাবিত ইবনে ওয়াকাশ।” হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান বলেন, “আমি মাহমুদ ইবনে আসাদকে জিজ্ঞেস করলাম, “উসাইরিম কি রকম লোক ছিল?” তিনি বললেন “সে আগে ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন উহুদ অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করেন সেদিন সে ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করে ও ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর নিজের তরবারী নিয়ে ছুটতে থাকে এবং রণাঙ্গনে পৌঁছে যায়। সে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করে এবং মারাত্মকভাবে আহত হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে। পরে বনু আবদুল আশহালের লোকেরা রণাঙ্গনে তাদের লোকদের লাশ খুঁজতে গিয়ে তাকে পায়। তারা তাকে চিনতে পেরে পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, উসাইরিম এখান এলো কিভাবে? সেতো ইসলামকে অস্বীকার করতো। তখন সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “হে আমর, তুমি কি কারণে এখানে লড়াই করতে এলে? স্বগোত্রের টানে, না ইসলামের আকর্ষষে?’ সে বললো, ইসলামের আকর্ষণে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আমি ঈমান এনেছি এবং মুসলমান হয়েছি। তরপর তরবারী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলাম এবং যুদ্ধ করে আহত হয়েছি। এর কিছুক্ষণ পরই উসাইরিম তাদের চোখের সামনে মারা গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘটনা শুনে বললেন: সে জান্নাতবাসী।”

আমর ইবনে জামুহ ছিলেন একজন সাংঘাতিক খোঁড়া লোক। তাঁর সিংহের মত চারটি ছেলে ছিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিভিন্ন রণাঙ্গণে লড়াই করতে যেতো।উহুদ যুদ্ধের দিন তারা তাদের পিতা আমরকে আটকিয়ে রাখতে চাইলো। বললো, “আল্লাহ আপনাকে যুদ্ধে যাওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ” আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, “আমার ছেলেরা আমাকে এই যুদ্ধে আপনার সাথে যেতে দিতে চায় না। আল্লাহর কসম, এই খোঁড়া পা নিয়েই আমি জান্নাতে প্রবেশ করার আশা রাখি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ যে তোমাকে জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন সে কথা ঠিকই।” পক্ষান্তরে তাঁর ছেলেদেরকে তিনি বললেন, “তোমাদের পিতাকে যুদ্ধে যেতে বাধা না দিলেও পার। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে শাহাদাত নির্ধারিত রেখেছেন।” অতঃপর আমর উহুদে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। ওদিকে উতবার কন্যা হিন্দ এবং তার সহচরীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিহত সাহাবীদের লাশ বিকৃত করতে শুরু করলো। তাঁদের নাক কান কেটে ফেললো। হিন্দ তা দিয়ে পায়ের খারু বা গুলফ বন্ধনী ও গলার মালা বানালো এবং যুবাইর ইবনে মুতয়িমের গোলাম ওয়াহশীকে সেইসব গুলফবন্ধনী, মালা ও কানের দুল উপহার দিল। সে হামযার কলিজা বের করে চিবালো, কিন্তু গিলতে না পেরে ফেলে দিল।

হালিস ইবনে যাব্বান সেদিন কুরাইশ বাহিনীতে হাবশী সৈন্যদের অধিনায়ক ছিল। সে আবু সফিয়ানের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। দেখলো, আবু সফিয়ান তার বর্শার ফলক দিয়ে হামযার চিবুকে আঘাত করছে আর বলছে, “অবাধ্য কোথাকার। এখন মজাটা আস্বাদন কর”। হালিস, এ দৃশ্র দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। বনু কিনানার লোকেরা কাছেই ছিল। তাদেরকে ডেকে বললো।, “হে বনু কিনানা, কুরাইশ নেতার বা- দেখো। নিজের মৃত চাচাতো ভাইয়ের সাথে কি আচরণ করছে।” আবু সুফিয়ান অপ্রতিভ হয়ে বললো, “কি আপদ, এটা আমার পদঙ্খলন। কাউকে বলো না।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান রণাঙ্গণ থেকে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। রওনা হবার পূর্ব মুহূর্তে সে পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে উচ্চাস্বরে ধ্বনি দিল, “কর্মতৎপর লোকেরা যথার্থ পুরস্কার পেয়েছে। যুদ্ধের জয়পরাপয় পালাক্রমে হয়ে থাকে। একদিন এ পক্ষে, আর একদিন অন্যপক্ষে। হে হুবাল, (মূর্তির নাম) তুমি পরাক্রান্ত হও। অর্থাৎ তোমার ধর্মকে জয়যুক্ত কর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধ্বনির জবাব দেয়ার জন্য উমারকে (রা) নির্দেশ দিয়ে বললেন, “তুমি বল, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোচ্চ। আমরা ও তোমরা সমান নই। আমাদের নিহতরা জান্নাতবাসী আর তোমাদের নিহতরা দেযখবাসী।” উমার যখন এই পাল্টা ধ্বনি দিয়ে আবু সুফিয়ানের জবাব দিলেন, তখন আবু সুফিয়ান বললো, “উমার, একটু এ দিকে এসো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারকে বললেন, “যাও, সে কি বলতে চায় শুনে এসো।” উমার এগিয়ে গেলেন। আবু সুফিয়ান বললো, “হে উমার, তোমাকে আল্লাহর দোহাই। সত্য করে বলো, আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি?” উমর বললেন, “আল্লাহর কসম, না। তিনি এই মুহূর্তেও তোমার কথাবার্তা শুনেছেন।” আবু সুফিয়ান বললা, “তোমাকে আমি ইবনে কুময়ার চেয়ে সৎ ও সত্যবাদী মনে করি।” উল্লেখ্য যে, ইবনে কুময়া কুরাইশদের আছে বলেছিলো, “আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান উমারকে সম্বোধন করে বললো, “তোমাদের নিহতদের কিছু লাশ বিকৃত করা হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমি তা করতে নির্দেশ দেইনি, নিষেধও করিনি। আবার এ কাজে আমি খুশীও নই, অসন্তুষ্টও নই।”

আবু সুফিয়ান রণাঙ্গন ত্যাগ করে যাওয়ার সময় “তোমাদের সাথে আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবার দেখা হবে” বলে যুদ্ধের আগাম চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশক্রমে জনৈক সাহাবী আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দিলেন যে, আগামী বছর তার মুকাবিলা করতে তাঁরাও প্রস্তুত রয়েছেন।

কুরাইশ বাহিনী ময়দান ত্যাগ করে রওয়ানা হয়ে যাবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, ওদের পেছনে পেছনে গিয়ে লক্ষ্য কর, ওরা কোথায় যায় এবং কি করে। তারা যদি অশ্বপালকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায় এবং উটে আরোহণ করে তাহলে বুজতে হবে, তারা মক্কা অভিমুখে চলেছে। আর যদি ঘোড়ায় আরোহণ করে ও উট টেনে নিয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে তারা মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। আল্লাহর শপথ, তারা মদীনা আক্রমণ করতে চাইলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে সৈন্য নিযে হাজির হবো এবং প্রতিরোধ করবো।” আলী (রা) বলেন, “আমি তাদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম,তারা অশ্বপাল দক্ষিন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং উটে চড়ে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেছে।”

এবার মুসলমানগণ নিহতদের সন্ধানে বেরুলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ বিন রাবীর সন্ধান নিয়ে দেখ, সে মৃত, না জীবিত।” এক আনসারী সাহাবা তাঁর খোঁজ করতে লাগলেন। অবশেষে তাঁকে নিহতদের মাঝে মারাত্মকভাবে আহত ও মুমূর্ষু অবস্থায় পেলেন। তাঁকে বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে হুকুম দিয়েছেন তুমি বেঁচে আছ না মারা পড়েছো তা দেখতে।” সা’দ বললেন, আমাকে মৃতই মনে কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানিয়ে বলো: হে আল্লাহর রাসূল, সা’দ ইবনে রাবী আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছে যে, একজন নবীকে তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে যতটা উত্তম পুরস্কার দেয়া সঙ্গত তাই যেন আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে দেন। আর মুসলমানদের নিকট আমার সালাম পৌঁছে দিয়ে বলো: সা’দ ইবনে রাবী বলেছে যে, তোমাদের একটি লোকও জীবিত থাকতে তোমাদের নবীর কাছে যদি দুশমন পৌঁছতে পারে তাহলে আল্লাহর কাছে তোমরা কোন সাফাই দিতে পারবে না।” এ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই সা’দ মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়লেন। অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে সা’দের খবর জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (রা) সন্ধানে বের হলেন। তাঁকে প্রান্তরের মধ্যস্থলে পেলেন। দেখলেন, তার পেট চিরে কলিজা বের করা হয়েছে এবং নাক কান কেটে তাঁর লাশ বিকৃত করা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সাফিয়া যদি দুঃখ না পেতো এবং একটা চিরস্থায়ী রীতির জন্ম হওয়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে আমি হামযাকে এখানেই রেখে চলে যেতাম এবং তার লাশ পশু পক্ষিকে খেতে দিতাম। আল্লাহ যদি আর কোন রণাঙ্গনেও আমাকে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়যুক্তকরে তাহলে আমি তাদের ত্রিশ জনের লাশকে এভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত করবো।” মুসলমানরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিদারুণ মর্মাহত ও চাচার প্রতি পাশবিক আচরণে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত দেখলো, তখন তাঁরাও প্রতিজ্ঞা করলো যে, কোন সময় কুরাইশদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তাদের লাশ এমনভাবে বিকৃত করবে যার কোন নজীর আরবের ইতিহাসে নেই।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের ঐ প্রতিজ্ঞা প্রসঙ্গেই আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন-

[আরবী *******]

“তোমরা যদি কাউকে শাস্তি দাও তাহলে তাদের পক্ষ থেকে যেমন শাস্তি তোমরা পেয়েছিলে তার সমপরিমাণ শাস্তি দাও। আর যদি সহিষ্ণুতার পরিচয় দাও তাহলে (জেনে রাখ) ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। তুমি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর। তেমার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া চাই। তাদের আচরণে মর্মাহত হয়ো না এবং তাদের দুরভিসন্ধিতে মনকে সংকীর্ণ করো না।”

এ আয়াত দুইটির প্রভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের ক্ষমা করলেন এবং লাশ বিকৃত করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বললেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার লাশ একটি চাদরে আবৃত করলেন। তারপর জানাজার নামায আদায় করলেন। তারপর অন্যান্য লাশের পাশে এনে রাখা হলো এবং প্রত্যেকের জন্য তিনি জানাজা পড়লেন। এভাবে হামযার জন্য বাহাত্তর বার জানাজা পড়লেন।

ইবনে ইসহাক বলেন, হামযাকে দেখতে আবদুল মুত্তালিবের কন্যা সাফিয়া এলেন। হামযা ছিলেন তাঁর সহোদর ভাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার পুত্র যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে বললেন, “তুমি তোমার মার সাথে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দাও যেন সে ভাইয়ের এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে না পায়। ” যুবাইর গিয়ে বললেন, “মা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে ফিরে যেতে বলছেন।” সাফিয়া বললেন, !“কেন?” আমার ভাইয়ের লাশ বিকৃত করার কথা আমি শুনেছি। ওটা আল্লাহর পথেই হয়েছে এবং তা আমার জন্য খুশির ব্যাপার। ইনশাআল্লাহ আমি সবর করবো এবং সন্তুষ্ট থাকবো।” যুবাইর বললেন, “আচ্ছা, তাহলে তাকে আসতে দাও।” সাফিয়া এলেন, হামযাকে দেখলেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়লেন ও তাঁর জন্য ক্ষমা প্রর্থনা করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তাঁর লাশ দাফন করা হলো।

মুসলমানদের অনেকে শহীদের লাশ মদীনায় নিয়ে দাফন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে এরূপ করতে নিষেধ করেন এবং যেখানে নিহত হয়েছে সেখানেই দাফন করতে বলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবা এথকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শহীদদের লাশ দেখলেন তখন বললেন, “আমি এঁদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহর পথে যেÑই আহত হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন তাকে পুনর্জীবিত করবেন, তখন তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে রক্তের রং থাকবে রক্তেরই মত আর ঘ্রাণ হবে মৃগনাভির মত। তোমরা দেখ, এদের মধ্যে কে বেশী কুরআন আয়ত্ত করেছিল। অতঃপর সেরূপ ব্যক্তিকে অন্যান্যদের মুখোমুখি রেখে দাফন কর।” অতঃপর এক এক কবরে দুই থেকে তিনজনকে একসাথে দাফন করা হলো।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। এই সময় হামনা বিনতে জাহাশ নাম্নী এক মহিলা তাঁর সাথে দেখা করলেন। তাঁকে প্রথমে তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের শাহাদাতের খবর দেয়া হলে তিনি ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন। এরপর তাঁকে তাঁর মামা হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের খবর দেয়া হলে তিনি পুনরায় ইন্না লিল্লাহ পড়লেন ও ইস্তিগফার করলেন এরপর তাঁকে জানানো হলো যে, তাঁর স্বামী মুসয়াব ইবনে উমাইর শহীদ হয়েছেন, তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন, “এজন্য মেয়ের স্বামী তাঁর কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।” মামা ও ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে তাঁকে অবিচলিত এবং স্বামীর মৃত্যুর খবরে চিৎকার করতে দেখেই তিনি এ কথা বলেন।

এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আবদুল আশহাল ও জাফর পরিবারের আনসারি সাহাবীদের বাড়ীর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন যুদ্ধে নিহত আপনজনদের বিয়োগে ব্যথিত ও শোক সন্তপ্ত পরিবারগুলোর মর্তভেদী কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। এই সময় হামযার কথা মনে করে তিনিও কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “হাময়ার জন্য কোন ক্রন্দসী নেই!” পরে সা’দ ইবনে মুয়ায ও উসাইদ ইবনে হুদায়ের বাড়ীতে ফিরলে তারা তাদের পরিবারের নারীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচার জন্য কাঁদতে ও বিলাপ করতে নির্দেশ দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামযার জন্য ঐসব মহিলার কান্না শুনতে পেয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, মসজিদে বসে তার কাঁদছে। তিনি তাদেরকে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। এখন তোমরা চলে যেতে পার। কেনান তোমরা আমাকে যথেষ্ট সাহনুভূতি দেখিয়েছ।”

বনু দিনারের আরেক মহিলা। তার স্বামী, ভাই ও পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। তাকে তার ঐসব আপনজনের নিহত হওয়ার খবর শোনানো হলে সে নির্বিকারভাবে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কি অবস্থা?” সবাই বললো, “তিনি ভাল। তুমি যেমন পছন্দ কর, তিনি সে রকমই আছেন।”মহিলা বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দেখাও। আমি তাকে দেখে নিই।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখানো হলো। মহিলা দেখেই বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি নিরাপদে আছেন, এটা দেখার পর আমার কাছে অন্য যে কোন মুসিবত নিতান্তই তুচ্ছ।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ীতে পৌছে তরবারীখানা তাঁর কন্যা ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “প্রিয় বেটি, এটা ধুয়ে পরিষ্কার কর। আজ এটি বড় কাজে এসেছে।” আলী ইনে আবু তালিবও তাঁর তরবারী ফাতিমাকে দিয়ে বললেন, “এ তরবারী খানা থেকেও রক্ত ধুয়ে দাও। আল্লাহর শপথ এটি বড় কাজে এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যদি আজ যুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ হযে থাক, তবে জেনে রাখো, সাহল ইবনে হানিফ এবয় আবু দাজানাও তোমার সাথে জিহাদে সর্তনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে।”

উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১ ৫ই শাওয়াল শনিবার।পরদিন ১ ৬ই শাওয়াল রোববার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষক ঘোষণা করে দিলেন যে, শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে। তবে গতকালের যুদ্ধে উপস্থিত থাকেনি এমন কেউ আজ যেতে পারবে না। বরং কাল যারা ছিল তারাই শুধু যেতে পারবে। এ কথা শুনে যাবির ইবনে আবদুল্লাহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আমার সাত বোনকে পাহারা দেয়ার জন্য আমাকে বাড়ীতে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেয়েদের কাছে কোন পুরুষ থাকবে না এমনভাবে তাদের রেখে যাওয়া আমর বা তোমার কারো পক্ষেই সমীচিন হবে না। আর আমি বাড়ী বসে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তোমার জিহাদে যাওয়াকে অগ্রধিকার দেয়াও আমর পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তুমি তোমার বোনদের কাছে থেকে যাও। তাই আমি তাদের কাছে থেকে গিয়েছিলাম।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর পিছু ধাওয়ার অভিযানে তাকেও তাঁর সাথে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এই অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল শুধু শত্রুকে ভয় দেখানো। তাদের পশ্চাদ্ধাবন যে মুসলমানদের শক্তির পরিচায়ক এবং উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয় যে তাদের কিছুমাত্র হতোদ্যম করে দেয়নি, শত্রুকে তা বুুঝিয়ে দেয়ার জন্যই এ অভিযান চালানো হয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরিয়ে মদীনা থেকে আট মাইল দূরে অবস্থিত হামরাউল আসাদ নামক স্থানে উপনীত হলেন। সেখানে সোম, মঙ্গল ও বুধবার পর্যন্ত অবস্থন করার পর মদীনায় ফিরে এলেন। এ সময় মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে। মা’বাদ ইবনে আবি মা’বাদ আল খুযায়ী ছিলেন তখনো মুশরিক। তাঁর গোত্র খুযআর মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতো এবং তিহামা অঞ্চলে তাঁর গোপনীয়তা সংরক্ষণ করতো। আর তিহমায় যা-ই ঘটুক তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করতো। তাঁর কাছে কিছুই গোপন করতো না। মা’বাদের সাথে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা হলো। উহুদের ঘটনা সম্পর্কে সে বললো, “মুহাম্মাদ আপনার যে বিপর্যয় ঘটেছে তাতে আমরা ব্যথিত ও দুঃখিত। আমরা সাবাই কামনা করছিলাম যে, আপনাকে যেন আল্লাহ নিরাপদ রাখেন।” অতঃপর মা’বাদ চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হামরাউল আসাদেই রইলেন। রাওহাতে [৬৪. মুজইনা গোত্রের বাসস্থান এই রাওহা জনপদ হাঁটাপথে মদীনা থেকে দুই দিনের দূরত্বে অবস্থিত। ]গিয়ে মা’বাদের দেখা হলো আবু সুফিয়ার ও তার অনুচরদের সাথে। তরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের ওপর পুনরায় হামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা পরস্পর বলাবলি করছিল, “মুহাম্মাদের সহচরদের প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেকেই তো খতম করেছি, কিন্তু একবারে নিশ্চিহ্ন না করে মক্কায় ফিরে যাচ্ছি। অবশিষ্টদের ওপর বরং আবার হামলা করবো এবং তাদেরকে শেষ করেই তবে ক্ষান্ত হবো।” এই সময় মা’বাদকে দেখে আবু সুফিয়ান বললো, “মা’বাদ, ওদিককার খবর কি?” মা’বাদ বললো, দেখলাম মুহাম্মাদ তার সহচরদের নিয়ে এক বিপুল জনতার সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং তাদের নিয়ে তোমাদের পিছু ধাওয়া করতে ছুটে আসছে। আমি এরূপ জনসমাবেশ আর কখনো দেখিনি। উহুদের যুদ্ধের দিন যারা যুদ্ধে আসেনি এবার তারাও মুহাম্মাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে।

তাদের মধ্যে তোমাদের ওপর এমন ভয়ংকর ক্রোধ ও আক্রোশ দেখলাম, যা আমি আর কখনো দেখিনি।” আবু সুফিয়ান বললো, “বল কি?” মা’বাদ বললো, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি। ওরা হয়তো এক্ষুণি এসে পড়বে। তুমি রওনা হবার আগেই হয়তো ওদের ঘোড়ার মাথা দেখা যাবে।” আমরা তো ওদের অবশিষ্ট লোকগুলোকে সাবাড় করে দেয়ার জন্য পুনরায় হামলা করতে প্রস্তুত হয়েছি।” মা’বাদ বললো, “তাহলে আমি নিষেধ করছি। এ কাজটি করো না। তাদের প্রস্তুতি দেখে আমি একটা কবিতা পর্যন্ত রচনা করে ফেলেছি। আবু সুফিয়ান বললো, “কি কবিতা রচনা করেছো? শোনাও তো দেখি।” মা’বাদ বললো, “কবিতাটি এই:

“তাদের তর্জন-গর্জনে আমার উট তো ভয়ে ভিমরি খাওয়ার যোগাড়

খাট চুলওয়ালা ঘোড়ার পাল যখন যমীনের ওপর সয়লাবের মত বয়ে চললোঃ

দ্রুতবেগে ধেয়ে চললো লম্বালম্বা দৃপ্ত সিংহপুরুষদের নিয়ে রণাঙ্গনে

নিরস্ত্র সিপাহীদের মত তারা টলটলায়মান নতশির নয়।

আমি তৎক্ষনাৎ দৌড়ে পালালাম। ভাবলাম, পৃথিবীটা নুয়ে যাচ্ছে

যখন তার আমাদের দিকে ধেয়ে এল এক অপরজেয় অধিনায়কের সাথে।

আমি বললাম, সেই জনম-লরি পদাঘাতে উপত্যাকা কেঁপে উঠেছে।

পবিত্র হারামের অধিবাসীদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান ও কা-জ্ঞানসম্পন্ন,

তাদেরকে আমি দ্ব্যর্থহনি ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি আহমাদের সেনাবাহিনী থেকে।

অবশ্য তাঁর বাহিনীর মধ্যে কোন ইতরামী নেই।

আসলে আমি যে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছি তার জন্য উপযুক্ত ভাষা নেই।”এ বিবরণ শুনে আবু সুফিয়ান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যুদ্ধযাত্রা থেকে নিবৃত্ত হলো।

বনু আবদুল কায়েসের একটি কাফিলার দেখা হলো আবু সুফিয়ানের সাথে। সে বললো, “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” তারা বললো, “মদীনায়।” আবু সুফিয়ান বললো, “কি উদ্দেশ্যে?” আরা বললো, “খাদ্য আনা নেয়ার উদ্দেশ্যে।” সে বললো, “তোমরা কি মুহাম্মাদের নিকট আমর একটা বার্তা পৌঁছে দেবে? পৌঁছে দিলে আমি আগমীকাল উকাযের বাজারে গিয়ে তোমাদেরকে প্রচুর পরিমাণ কিসমিস দেবো।” তারা বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে সম্মত হলো। সে বললো, “মুহাম্মাদকে বলবে যে, আমরা তার ও তার দলবলের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের অবশিষ্টাংশকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনো হামরাউল আসাদে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে তারা সেখানে দেখা করলো এবং আবু সুফিয়ানের বার্তা তাঁর নিকট পৌঁছিয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে কথা শুনে বললেন, “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকীল! (আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি অতি উত্তম অভিভাবক।)” অতঃপর ঐ এলাকায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে দুশমনের দু’জন চর মুয়াবিয়া ইবনে মুগীরা ইবনে আবুল আস ও আবু ইযযাত যামাহী ধরা পড়লো। শোষোক্ত ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করেছিলেন এবং পরে বিনা মুক্তিপণেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সে বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে হত্যা করবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “মক্কায় গিয়ে তুমি তৃপ্তির সাথে বলবে যে, মুহাম্মাদকে দু’বার ধোঁকা দিয়েছি সে সুযোগ তোমাকে দেয়া হবে না। হে যুবাইর, ওর শিরচ্ছেদ কর।” যুবাইর সঙ্গে সঙ্গে তার শিরচ্ছেদ করলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। মদীনায় আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবনে সুলুল নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রক্তি ছিল। প্রত্যেক জুম’য়ার দিন সে নিজের গোত্রের কাছে নিজের মর্যাদা জাহির করার জন্য একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই জনগণের সামনে ভাষণ দিতে শুরু করতেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলতো, “হে জনম-লী, এই যে আল্লাহর রাসূল তোমাদের সামনে উপস্থিত। তাঁর দ্বারা আল্লাহ তোমাদের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধি করেছেন্ সুতরাং তোমরাও তঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা কর এবং তাঁর কথা শোনো ও মেনে চল।” এই বলেই সে বসে পড়তো। উহুদ যুদ্ধের আগে তার এই ভূমিকায় কেউ আপত্তি করতো না। কিন্তু উহুদ যুদ্ধে সে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং বহু সংখ্যক লোককে যুদ্ধের পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এরপরও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণ দেয়র সময় জুম’য়ার দিন আগের মতই নিজের ভরিক্কী জাহির করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রমংসা করত উঠে দাঁড়ালো। মুসলমানগণ তৎক্ষণাৎ চারদিক থেকে তার কাপড় টেনে ধরলেন আর বললেন, “আল্লাহর দুশমন, বস্। তুই যা করেছিস তাতে তোর মুখে ওসব কথা শোভা পায় না।” তখন সে সমবেত মুসল্লীদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য যে কথাটি বলছিলাম তা যেন খারাপ কথা হয়ে গেল।” মসজিদের দরজায় জনৈক আনসারী সাহাবীর সাথে তার দেখা হলো। তিনি বললেন, “তোমার কি হলো?” সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার চেষ্ট করছিলাম। তাতে তাঁর সহচরগণ আমার ওপর চড়াও হয়ে আমাকে টানতে ও তিরস্কার করতে লাগলো। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজকে গুরুত্ববহ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলাম অথচ সবার কাছে তা খুব খারাপ মনে হলো।”আনসারী সাহাবী বললেন, “যাও, তুমি ফিরে যাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন।” সে বললো, “তিনি আমার জন্য ক্ষমা চাইবেন এটা আমি চাই না।”

ইবনে ইসহাক বলেন, “উহুদ যুদ্ধ ছিল চরম পরীক্ষা ও মুসিবতের দিন। এটা দিয়ে আল্লাহ মু’মিনদের পরীক্ষা ও মুনাফিকদের ছাটাই বাছাই করেন। যারা মুখে ঈমানের দাবী করতো কিন্তু মনে মনে গোপনে কুফরী ধ্যান-ধারণা পোষণ করতো এই দিন তারা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর আল্লাহ তাঁর যেসব প্রিয় বান্দাকে শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন এ দিন তাদেরকে শাহাদাত দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।”


হিজরীর তৃতীয় সন: রাজী সফর
উহুদ যুদ্ধের পর আজাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় থেকে এ দল লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলো। তারা বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনার সহচরদের মধ্য থেকে একটি দলকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যারা আমাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান শিক্ষা দেবে ও কুরআন পড়াবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বুকাইর, আসিম ইবনে সাবিত, খুবাইব ইবনে আদী, যায়িদ ইবনুদ দাসিনা ও অবদুল্লাহ ইবনে তারিককে পাঠিয়ে দিলেন। আমীর মনোনীত করলেন মুরসাদ ইবনে আবু মুরসাদকে। তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। হিজাজের এক প্রান্তে ‘উসফান ও মক্কার মধ্যবর্তী হুদয়ার ওপর অবস্থিত হুযাইল গোত্রের জলাশয় রাজীতে পৌঁছলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকরা হুযাইল গোত্রকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো। সাহাবীগণ তখনও সওয়ারীর পিঠে। দেখলেন, তরবারীধারী লোকজন তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। তাঁরা নিজ নিজ তরবারী নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন কাফিররা বললো, “আল্লাহর কসম, আমরা তোমাদেরকে হত্যা করতে চাই না। আমরা তোমাদের দ্বারা মক্কাবাসীর কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করতে চাই।আল্লাহর কসম করে প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদেরকে হত্যা করবো না।” কিন্তু মুরসাদ ইবন আবু মুরসাদ, খালিদ ইবনে বাকাইর এবং আসিম ইবনে সাবিত বললেন, “আমাদের কোন মুশরিকের প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকারে আস্থা নেই।” আসিম ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন:

“আমার তো দুর্বলতা নেই, কেননা আমি শক্তিমান বর্শাধারী পুরুষ

আমার ধুনক রয়েছে এবং তাতে তীব্র ও তীক্ষè তীর রয়েছে।

শক্ত ও মোটা বর্শার ফলক সে তীরে আঘাত খেয়ে ছিটকে যায়

আসলে মৃত্যুই সত্য, জীবন হলো বাতিল।

আল্লাহ মানুষের জন্য যা নির্ধারিত করে রেখেছেন তা অনিবার্য

আর মানুষ তার অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য।”

অতঃপর তাঁরা কাফিরদের সাথে লড়াই করলেন এবং তিনজনই শাহাদাত বরণ করলেন।

আসিম নিহত হলে হুযাইল গোত্রের লোকজন তার মাথা সুলাফা বিনতে সা’দের নিকট বিক্রি করতে মনস্থ করলো। ঐ মহিলার দুই ছেলে উহুদ যুদ্ধে আসিমের হাত মারা যাওয়ার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে, আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র এ উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা পেলে সে তার খুলিতে মদ পান করবে। হুযাইল গোত্র ও উদ্দেশ্যে আসিমের মাথা আনতে গেলে ভিমরুল ও মৌমাছি তার লাশ ঘিরে রাখায় আনতে পারলো না। তারা বললো, “এখন ওটা এখানেই থাক। বিকাল বেলা ভিমরুল ও মৌমাছি চলে যাবে। তখন আমরা তার মাথা কেটে আনবো।” এই বলে তারা চলে গেল। ইত্যবসরে আল্লাহ ঐ এলাকায় বন্যার তা-ব বইয়ে দিলেন এবং সেই বন্যায় আসিমের লাশ ভেসে উধাও হয়ে গেল।

শাহাদাতের পূর্বে আসিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন কোন মুশরিক স্পর্শ করতে না পারে এবং তিনি নিজেও যেন কোন মুশরিককে স্পর্শ না করেন। কোননা তিনি মুশরিকদেরকে মনে প্রাণে অপবিত্র মনে করতেন ও ঘৃণা করতেন। উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন শুনলেন যে, ভিমরুল ও মৌমাছি ঘিরে রাখার কারণে মুশরিকরা আসিমের লাশ স্পর্শ করতে পারেনি, তখন বললেন, “আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাকে এভাবেই হিফাজত করেন। আসিম তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কোন মুশরিককে তিনি স্পর্শ করবেন না এবং কোন মুশরিককেও তাঁর দেহ স্পর্শ করতে দেবেন না। আল্লাহ তাঁর মৃত্যুর পর তাকে ঠিক তেমনিভাবে রক্ষা করেছেন, যেমন জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন।”

যায়িদ ইবনে দাসিনা, খুবাইব ইবনে আদী ও আবদুল্লাহ ইবনে তারিক এরা তিনজন নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহী হলেন। তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে গ্রেফতারী বরণ করলেন। কাফিররা তাঁদেরকে গ্রেফতার করে বিক্রির জন্য মক্কায় নিয়ে চললো। যাহরান পর্যন্ত পৌঁছলে আবদুল্লাহ ইবনে তারিক হাতের বাঁধন খুলে মুক্ত হলেন এবং তরবারী ধারণ করলেন। কাফিররা তাঁকে ধরতে পারলো না। কিন্তু দূর থেকে পাথর ছুড়ে তাকে শহীদ করলো। যাহরানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

অতঃপর খুবাইব ইবনে আদী ও যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিয়ে তাঁরা মক্কায় উপনীত হলো। কুরাইশদের কাছে হুযাইল গোত্রের দু’জন বন্দী ছিল। তাদের বিনিময়ে তারা ঐ দ্ইু সাহাবীকে কুরাইশদের কাছে বিক্রি করলো। খুবাইবনে কিনলো উকবা ইবনে হারেসের পক্ষে হুজায়ের ইবনে আবু ওহাব, যাতে উকবা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ তাঁকে হত্য করতে পারে। আর যায়িদ ইবনে দাসিনাকে নিল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া স্বীয় পিতা উমাইয়া ইবনে খালফের হত্যার বদলে হত্যা করার জন্য। সাফওয়ান তার গোলাম নাসতাসের সাথে তাঁকে হারাম শরীফের বাইরে তানয়ীমে পাঠিয়ে দিল হত্যার উদ্দেশ্যে। সেখানে আবু সুফিয়ান সহ কুরাইশদের এক বিরাট জনতা যায়িদকে ঘিরে ধরলো। যায়িদকে যখন হত্যা করার জন্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আবু সুফিয়ান বললো, “হে যায়িদ, তোমার বদলে আজ যদি আমরা মুহাম্মাদকে হাতে পাই এবং তাকে হত্যা করি ও তোমাকে তোমার পরিজনের কাছে পাঠিয়ে দিই তাহলে তুমি কি তা পছন্দ করবে?” যায়িদ বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি এতটুকুও পছন্দ করবো না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে আছেন সেখানে থাকা অবস্থাতেই তাঁর গায়ে কাঁটা ফুটবে, তিনি তাতে যন্ত্রণায় ভুগবেন আর আমি নিজের পরিজনের মধ্যে আরামে বসে থাকবো।”

আবু সুফিয়ানের মন্তব্য এই যে, “মুহাম্মাদকে তার সাহাবীরা যেরূপ ভালোবাসতো এমন গভীর ভালোবাসা আর কারো মধ্যে আমি দেখিনি।” এরপর নাসতাস যায়িদকে হত্যা করলো।

হুজাইর ইবনে আবু ওহাবের এ মুক্তিপ্রাপ্ত দাসী মাবিয়া ইতিমধ্যেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, বলেন, খুবাইব আমার কাছেই ছিলেন। তঁকে আমার ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। একদিন তাঁকে দেখলাম, মানুষের মাথার মত বড় একটা আঙ্গুরের থোকা নিয়ে আঙ্গুর খাচ্ছেন। অথচ এ সময় মক্কায় আঙ্গুর ছিল না। তাঁর হত্যার সময় যখন ঘনিয়ে এলো তখন মৃত্যুর প্রস্তুতিস্বরূপ পাক সাফ হবার জন্য আমার কাছে একখানা ক্ষুর চাইলেন। পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে আমি তাকে ক্ষুর আনিয়ে দিলাম। ক্ষুর নিয়ে ঐ ছেলেকে খুবাইবের ঘরে ঢুকতে বললাম। সে ঘরে চলে গেলে সহসা আমার মনে হলো। একি করলাম। সর্বনাশ! এই লোকটি যদি ছেলেটিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় তাহলে কি হবে? সে তো নিজের জীবন নাশের বদলে একজনের জীবন নিয়ে আগাম প্রতিশোধ নিয়ে নেবে। ছেলেটি যখন খুবাইবকে ক্ষুর দিল তখন তিনি বললেন, “তোমার মা তোমাকে এই ক্ষুর নিয়ে আমার কাছে পাঠানোর সময় ভয় পায়নি তো?” এই বলে ছেলেকে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলেন।

এরপর খুবাইবকে কুরাইশরা তানয়ীমে নিয়ে গেল হত্যা করতে। খুবাইব বললেন, “তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে দু’রাকাত নামায পড়তে দাও।”তারা বললো, “ঠিক আছে, পড়।”

তিনি খুব নিখুঁতভাবে দু’রাকাত নামায প্রড়ে নিলেন। অতঃপর কাফিরদের সামনে গিয়ে বললেন, “তোমরা যদি মনে না করতে যে,আমি মরার ভয়ে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী নামায পড়ে সময় কাটাচ্ছি তাহলে আমি আরো কিছুক্ষণ নামায পড়তাম।” বস্তুত: মুসলমানরা যখনই এ ধরনের হত্যরর সম্মুখীন হন তখন দু’রাকাত নামায পড়া তাদের একটা রীতিতে পরণিত হয়েছে এবং খুবাইবই এ রীতির প্রথম প্রচলনকারী অগ্রনায়ক।

অতঃপর কাফিররা তাঁকে একটা কাঠের ওপর চড়িয়ে কষে বাঁধলো। এই সময় খুবাইব নিম্নরূপ দোয়া পড়লেন, “হে আল্লাহ, আমরা আপনার রাসূলের বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। সুতরাং আগামীকাল সকালের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমাদের সাথে যে আচরন করা হলো তার খবর পৌঁছিয়ে দিন। হে আল্লাহ, এই দুশমনদেরকে আপনি গুনে গুনে এক এক করে হত্যা করুন এবং এদের কাউকে ছেড়ে দেবেন না।” অতঃপর তারা খুবাইবকে (রা) হত্যা কররো। আল্লাহ তাঁর ওপর রহমত নাযিল করুন।

আবু সুফিয়ান পুত্র মুয়াবিয়া (রা) বলতেন, “সেদিন খুবাইবের চারপাশে যারা জমায়েত হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের সাথে আমিও ছিলাম। তখন এরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, কারোর ওপর অভিশাপ দেয়া হলে সে যদি তৎক্ষনাৎ কাত হয়ে শুয়ে পড়ে তাহলে এ অভিশাপ থেকে সে বেঁচে যায়।”

জুমাহী গোত্রের সাঈদ ইবনে আমেরকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) সিরিয়ার কোন এব এলাকায় প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। তিনি আকষ্মিকভাবে লোকজনের সামনে মূর্ছা যেতেন। উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) একথা জানানো হলো। তাঁকে জানানো হলো যে, সাঈদের কি যেন হয়েছে। উমার (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সাঈদ, তোমার কি হয়েছে? ” সাঈদ বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন, আমর কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি। তবে আমি খুবাইবে হত্যার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং খুবাইবের বদদোয়া শুনেছিলাম। সেই বদদোয়ার কথা যখনই আমার মনে পড়ে এবং আমি কোন মজলিসে থাকি তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।” পরে উমারের কাছে থেকে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, আসিম ও মুরসাদের দলটি যখন রাজীতে আক্রান্ত হলো তখন সে খবর শুনে মুনাফিকরা মন্তব্য করলো, “ধিক এই ধোঁকা খাওয়া লোকগুলোকে যারা এমন করে মারা পড়লো। তারা বাড়ীতেও থাকলো না, আর তাদের নবীর দাওয়াতও পৌঁছালো না। ”আল্লাহ মুনাফিকদের এ কথাবার্তার জবাবে আয়াত নাযিল করলেন।”

[আরবী *********]

কোন কোন লোক এমন ও আছে যার কথা পার্থিব জীবনে তোমাকে চমৎকৃত করে দেয় র্(অর্থাৎ মুখ দিয়ে ইসলামের চমৎকার বুলি আওয়ায়) এবং তার মনে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহকে সাক্ষী মানে (তার মনের অবস্থা তার মুখের কথার সম্পূর্ণ বিপরীত) অথচ সে ন্যায় ও সত্যের কট্রর দুশমন। (অর্থাৎ তোমার সাথে যখন আলাপ-আলোচনা করে তখন ঘোরতর বিতর্কে লিপ্ত হয়।) আর যখন সে ক্ষমতার অধিকারী হয় তখন পৃথিবীতে অরাজকাত ছড়ায় এবং ফসল ও মানবকুলকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ তার এই ধ্বংসাত্মক বার্যকলাপ পছন্দ করেন না। তাকে যখন আল্লাহকে ভয় করতে বলা হয়, তখন তার আত্মসম্মানবোধ তাকে পাপের পথে আগলে রাখে এ ধরনের লোকের জাহান্নামই যথেষ্ট। আর তা অত্যন্ত খারাপ জায়গা। আবার কেউ কেউ এমনও আছে যে,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (আল্লাহর পথে জিহাদ করতে ও তার হক আদায় করতে গিয়ে) নিজেকে কুরবানী করে দিয়েছে। বস্তুত: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর বড়ই অনুকম্পশীল।” শেষের কথা কয়টিতে রাজী অভিযাত্রী মুসলমানদের কথাই বলা হয়েছে।

এ ঘটনা সম্পকে ঐতিহসিকগণ খুবাইবের কবিতা উদ্বৃত করেছেন। খুবাইব যখন জানতে পারলেন যে, তাঁকে শূলে চড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় হয়েঁেছ তখন এ কবিতাটি বলেন:

“দলগুলো তাদের সকল গোত্রকে আমার চারপাশে একত্রিত করেছে

তারা যতদূর পারে আমার ওপর শত্রুতা জাহির করেছে,

কেননা আমি স্বীয় প্রাণ বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও আপন আদর্শে অবিচল রয়েছি।

তারা তাদের সকল নারী ও সন্তানদেরকে, জমায়েত করেছে,

আর আমাকে দীর্ঘ ও সুরক্ষিত ডালের নিকটবর্তী করা হয়েছে

(শূলে চড়ানোর জন্য)

আমার প্রবাস জীবন ও মর্মবেদনার আকুতি শুধু আল্লাহর কাছেই তুলে ধরছি।

আর শত্রুর দলসমূহ আমার হত্যার জন্য যে আয়োজন করেছে তাও।

অতএব, হে আরশের অধিপতি,আমার বিরুদ্ধে যে কুমতলব আঁটা হয়েছে,

তার ওপর আমাকে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দিন।

শত্রুরা আমার গোশত বিক্রী করে দিয়েছে,

আর সেই সাথেই আমার জীবনের আশার প্রদীপ নিভে গেছে।

তবে সেটা (আসন্ন মৃত্যু ) কেবলমাত্র ইলাহর উদ্দেশ্যেই,

তিনি যদি চান আমার টুকরো টুকরো অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও অশেষ বরকত

দান করতে পারেন,

তারা আমাকে এক ইলাহর বদলে মৃত্যু ও কুফরীর

কোন একটি গ্রহণ করতে বলেছিল।

আমার চোখ সে দুটোকেই অগ্রাহ্য করেছে এবং আমর মন

মোটেই (মৃত্যুভয়ে) ভীত নয়

আমি মৃত্যুর কিছুমাত্র পরোয়া করি না, কেননা আমাকে মরতে হবেই।

আমি শুধু নিস্তার চাই সর্বগ্রাসী জাহান্নামের আগুন থেকে।

আল্লাহর শপথ, আমি কোনই ভয় পাবো না যখন মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবো, আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিহত হয়ে আমি যে দিকেই ঢলে পড়িনা কেন।

আমি শত্রুর সামনে বিন্দুমাত্রও নমনীয়তা দেখাবো না,

প্রকাশ করবো না কোনই অস্থিরতা। কেননা আল্লাহর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন।”

খুবাইবের জন্য শোক প্রকাশ করে হাস্সাস ইবনে সাবিত নিন্মোক্ত কবিতা রচনা ও আবৃত্তি করেণ,

“তোমার চোখের কি হলো যে, অশ্রু থামছেই না (নিজেকে সম্বোধন করে)

বুকের ওপর দিয়ে অবিরত ধারায় গড়িয়ে চলেছে মুক্তার মত

খুবাইবের শোকে-যিনি সেই যুবকদের অন্যতম যারা জেনেছে,

তাঁর (আল্লাহর) সাথে যখন তুমি মিলিত হবে তখন ব্যর্থতা কিংবা

অস্থিরত থাকবে না।

অতএব, হে খুবাইব, তুমি চলে যাও! আল্লাহ তোমাকে উত্তম পুরষ্কার দিন।

তোমারা কি জবাব দেবে যদি নবী তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন (হে কুরাইশরা)

যখন পুণ্যবান ফেরেশতারা চক্রবালে সমবেত থাকবে,

কিসের বদলায় আল্লাহর সাক্ষীকে তোমরা হত্যা করলে?

একজন খোদাদ্রোহী সুবিধাবাদী ও দেশে দেশে উৎপাত সৃষ্টিকারী লোকের বদলায়?

(উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধে হারেসকে খুবাইব (রা) হত্যা করেছিলেন।)

বীরে মাউনার ঘটনা (৪র্থ হিজরী)
শাওয়াল মাসের অবশিষ্ট অংশ, যিলকাদ, যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করলেন। এই বছরের হজ্জ মুশরিকরা বর্জন করেছিল। সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বীরে মাউনার অভিযাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটে উহুদ যুদ্ধের মাত্র চার মাস পর।

ঘটনার পটভূমি হলো, ‘মুলায়িবুল আসিন্নাহ’ (বর্শা খেলায় পারদর্শী) নামে খ্যাত আবু বারা আমের ইবনে মালিক ইবনে জা’ফর রাসূলুল্লাহর সাথে দেখা করতে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। সে ইসলাম গ্রহণও করলো না, ইসলামের বিরুদ্ধেও কিছু বললো না। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি কিছুসংখ্যক সাহাবীকে নাজদবাসীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং তারা তাদেরকে আপনার দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেন, আমার মনে হয়, তাহলে তারা আপনার দ্বীন গ্রহণ করনে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “নাজদবাসী তাদের ক্ষতি করতে পারে বলে আমার আশংকা হয়।” আবু বারা বললেন, “আমি তদের নিরাপত্তার জিম্মাদার। আপনি তাদেরকে পাঠিয়ে দিন। তারা জনগণকে আপনার দ্বীনের দিতে দাওয়াত দিক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছা বাছা চল্লিশজন সুযোগ্য সাহাবীকে বনু সায়েদা গোত্রের বিশিষ্ট সাহাবী মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। মুনযির ‘মুয়ান্নিক লিয়ামুত’ [তাঁকে এ উপাধিদানের কারণ হলো, তিনি শাহাদাত লাভের জন্য দ্রুতগতিতে ধাবমান হন।] (দ্রুত মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী) নামে অভিহিত হতেন। তাঁর সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী হারেস ইবনে ছিম্মা, হারাম ইবনে মিলহান, উরওয়া ইবনে আসমা, নাফে ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারকা ও আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) মুক্ত গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা। তাঁরা রওয়ানা দিয়ে বীরে মাউনাতে গিয়ে অবস্থান করলেন। এই জলাশয়টি বনু আমেরের আবাসভূমি ও বনু সুলাইমের প্রস্তরময় এলাকার মাঝখানে অবস্থিত। উভয় এলাকাই জলাশয়টির নিকটবর্তী হলেও বনু সুলাইমের এলাকা ছিল অধিকতর নিকটবর্তী।

ইসলামের কট্রর দুশমন আমের ইবনে তুফাইলের নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি নিয়ে গেলেন হারাম ইবনে মিলহান (রা)। তিনি যখন তার কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সে চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে হারাম ইবনে মিরহানকে হত্যা করলো। তারপর বাদবাকী সাহাবীদেরকেও খতম করার জন্য সে বনু আমেরের সাহায্য চাইলো। কিন্তু বনু আমের তার অনুরোধ এই বলে প্রত্যাখ্যান করলো যে, “ আমরা বনু বারার প্রতিশ্রƒতি ভঙ্গ করতে চাই না। আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।” আমের অগত্যা সুলাইমের কয়েকটি উপগোত্রের সাহায্য চাইল। তারা সঙ্গে সঙ্গে সম্মত হলো এবং তাদেরকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। সাহাবাগণ তাদেরকে দেখে তরবারী হাতে নিলেন এবং লড়াই করতে করতে শহীদ হলেন। শুধু কা’ব ইবনে যায়িদ রক্ষা পেলেন। কাফিররা তাঁকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যায়। অথচ তিনি বেঁচে ছিলেন। অনেক রক্তপাতের দরুণ দুর্বল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিহতদের স্তূপের মধ্য থেকে প্রাণ নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান এবং পরে খন্দকের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

আক্রান্ত হবার সময় দু’জন সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া দামরী ও জনৈক আনসারী [মুনযির বিন মুহাম্মাদ বিন উকবা। ] সাহাবী কোন কারণে দল থেকে কিছুদূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গীদের বিপদের কথা জানতেন না। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর কতকগুলো পাখী উড়তে দেখে তাঁদের মনে সন্দেহ জাগে। তাঁরা ভাবলেন, পাখীগুলোর ওড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। তাঁরা তাঁদের অবস্থা দেখবার জন্য এগিয়ে গেলেন। দেখলেন সবাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তাঁদের ওপর আক্রমণকারী দলকেও উপস্থিত দেখলেন। আনসারী আমর ইবন উমাইয়াকে বললেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে মনে করেন?” তিনি বললেন, “আমার ইচ্ছা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি এবং সমস্ত ব্যাপার তাঁকে জানাই।” আনসারী বললেন, “যে রণক্ষেত্রে মুনযির ইবনে আমর শহীদ হয়েছেন সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে আমি পালাতে চাই না। আমি নিজে কখনো লোকমুখে হত্যাকা-ের খবর শোনার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না।” অতঃপর তিনি লড়াই করে শহীদ হলেন।

আমর ইবনে উমাইয়াকে কাফিররা আটক ও বন্দী করলো। তিনি মুদার গোত্রের লোক একথা শুনে আমের ইবনে তুফাইল তাঁর কপালের চুল কেটে নিল এবং তাঁর মায়ের একটা দাস মুক্ত করার মানত ছিল মনে করে তাঁকে সেই বাবদে মুক্তি দিল। এরপর আমর ইবনে উমাইয়া মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। মদীনার অনতিদূরে অবস্থিত কারকারাতে পৌঁছলো বনু আমেরের দুই ব্যক্তি এসে তাঁর সাথে একই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে লাগলো। বনু আমেরের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটা নিরাপত্তা ও আনাক্রমণ চুক্তি যে ছিল, সেকথা আমর জানতেন না। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। তিনি একটু অপেক্ষা করলেন। যেই তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো অমনি উভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল, বনু আমের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যাকা- চালিয়েছে এবং সে কারণে বনু আমের থেকে প্রতিশোধ নেয়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট উপনীত হয়ে আমর ইবনে উমাইয়া সমস্ত ঘটনা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যে দু’জনকে হত্যা করেছো, তাদের জন্য আমাকে রক্তপণ (দিয়াত) দিতে হবে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ ঘটনা আবু বারাই ঘটালো। আমি এটা অপছন্দ করেছিলাম এবং শংকিত ছিলাম।” আবু বারা ঘটনা জানতে পেরে খুবই দুঃখিত হলেন। আমের ইবনে তুফাইল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়ে দেয়ার এবং তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের ওপর বিপদ নেমে আসায় আবু বারা ক্ষোভ প্রকাশ করে। নিতদের মধ্যে আমের ইবনে ফুহাইরাও ছিলেন। হিশাম ইবনে উরওয়াহ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমের ইবনে তুফাইল বলতো, “ঐ দলের ভেতরে একটি লোক ছিল যাকে হত্যা অব্যবহিত পর তাঁকে আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে দেখলাম। অবশেষে দেখলাম সে যেন আকাশে উঠে উধাও হয়ে গেছে। কে সেই, লোকটি?” লোকেরা বললো, “সে আমের ইবনে ফুহাইরা।”

বনু নাবীরের বহিষ্কার (চতুর্থ হিজরী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া (রা) কর্তৃক নিহত বনু আমেরের লোক দুটোর জন্য রক্তপণ আদায় করার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে বনু নাযীরের কাছে গেলেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। বনু নাযীর ও বনু আমেরের মধ্যেও অনরূপ চুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বনু নাযীরের কাছে গেলেন তখন তারা তাঁকে স্বাগত জানালো এবং রক্তপণের ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে সম্মত হলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের মাথায় চাপলো এক কুটিল ষড়যন্ত্র। তারা গোপনে সলাপরামর্শ করতে লাগলো কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা যায়। তারা মনে করলো, এমন মোক্ষম সুযোগ আর কখনো পাওয়া যাবে না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা প্রাচীরের পার্শ্বে বসে ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বাক্র, উমার ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম। বনু নাযীরের লোকেরা পরস্পর সলাপরামর্শ করলো। তারা বললো, “কে আছ যে পাশের ঘরের ছাদে উঠে বড় একটা পাথর মুহাম্মাদের ওপর গড়িয়ে দিতে পারবে এবং তার কবল থেকে আমাদেরকে রেহাই দেবে?” বনু নাযীরের এক ব্যক্তি আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা’ব এ কাজের জন্য ছাদের ওপর আরোহণ করলো।

ঠিক এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তাঁর সঙ্গী সাহাবীগণ তখনো টের পাননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় গিয়েছেন। তাঁরা অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন তিনি ফিরছেন না, তখন তাঁরা তাঁর খোঁজে বেরুলেন। পথে এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মদীনা থেকে আসছে। তাঁরা তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধান চাইলেন। সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি।” সাহাবীগণ তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বনু নাবীরের ওপর আক্রমণ করা জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর মুসলমানদেরকে নিয়ে তিনি বনু নাযীরের ওপর আক্রমণ চালালেন। তারা তাদের দুর্গসমূহে আশ্রয় নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে খেজুরের গাছসমূহ কেটে ফেলতে ও তা জ্বলিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তা দেখে বনু নাযীরের লোকেরা দূর থেকে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ, তুমি তো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করতে এবং যে তা করতো তার নিন্দা করতে এখন কেন তুমি খেজুর গাছ কাটছো এবং জ্বালিয়ে দিচ্ছো?”

এই সময় বুন আওফ ইবনে খাযরাজ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি যথা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সুলুল, তার আমানত রক্ষক মালিক ইবনে আবু কাওফাল সুওয়াইদ ও দায়িম বুন নাযীরকে এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে, “তোমারা ভয় পেয়ো না বা আত্মসমর্পণ করো না। আমরা কিছুতেই তোমাদেরকে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হতে দেব না। তারা যদি তোমারেদ সাথে যুদ্ধ করে তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে যাবো।” বনু নাযীর তাদের সাহায্যের অপেক্ষায় থেকে আত্মসমর্পন বা মুকাবিলা কোনটাই করলো না। আর শেষ পর্যন্ত কোন সাহায্যও এলো না। আল্লাহ তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করলো, “রক্তপাত করবেন না। বরং আমাদেরকে বহিষ্কার করুন, আমরা আমাদের সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে যাবো। অস্তাবর সম্পত্তির যতটুকু প্রত্যেকের উট বহন করে নিয়ে যেতে পারে, ততটুকু নিয়ে যাওয়অর অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। বুন নাযীরের প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করা হলো। তারা উটের পিঠে বহনোপযোগী অস্থাবর সম্পদ নিয়ে গেল। এই সময় কেউ কেউ তার ঘরের দরজার ওপরের অংশ ভেঙ্গে উটের পিঠে করে নিয়ে যেতে লাগলো। কতক লোক খাইবারে এবং কতক সিরিয়ায় বলে গেল। যারা খাইবার গিয়েছিলো তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকাইক ও হুয়াই ইবনে আখতাব। খাইবারের অধিবাসীরা তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করলো।

আবু বাকরের পুত্র আবদুল্লহ বলেন, “আবু বাক্র (রা) জানিয়েছিলেন যে, বুন নাযীর তারেদ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোও নিয়ে গিয়েছিলো। দাসীরা তাদের পেছনে থেকে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের মধ্যে উরওয়া ইবনে ওরারদ ’আবাসীর স্ত্রী উম্মে ’আমরও ছিল। সালমা নাম্মী ও মহিলাকে তারা তার স্বামীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল।[ ৬৫. এই মহিলার প্রথমে বিয়ে হয় মুযইনা গোত্রে। উরওয়া ইবনে ওয়ারদ একবার তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লুঠতরাজ করে। সেই সময় এ মহিলাকে সে ধরে নিয়ে যায়। উরওয়া বনু নাযীরের কাছে প্রায়ই আসা যাওয়া করতো এবং তাদের কাছ থেকে ধার কর্জ নিত। আবার কখনো বা নিজের লুঠ করা দ্রব্যাদি বিক্রি করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সে তাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে। তখন তারা উরওয়াকে মদ খওয়ায় এবং কৌশলে তাকে তার কাছ থেকে কিনে নেয়। এই ক্রয় বিক্রয়ে তারা প্রয়োজনীয় সাক্ষীও সংগ্রহ করে। উরওয়া পরবর্তী সময় আক্ষেপ করে এ সম্পর্কে এরূপ কবিতা আবৃত্তি করতো, “আল্লাহর দুশমনরা আমাকে মদ খাইয়ে মিথ্যাচার ও চক্রান্তের মাধ্যমে কাবু করে নিয়েছিল। হায় অদৃষ্ট! কিভাবে আমি এমন প্রস্তাবে রাজী হলাম, যা আমার বিবেক অপছন্দ করে।” ] তারা এত ধুমধাম ও গর্বের সাথে যাচ্ছিলো যে, সে যুগে আর কোন গোত্রকে ও রকম ধুমধাম করতে দেখা যায়নি।”

তারা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রেখে গিয়েছিলো। এই সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিলো। সেটা তিনি যেভাবে খুশী কাজে লাগাতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সম্পত্তি শুধুমাত্র প্রথম হিজরাতকারী সাহাবাদের মধ্যে বণ্টন করেন। আনসারদের সাহল ইবনে হুনাইক ও আবু দুজানা সিমাক ইবনে খারাশা তাদের দারিদ্রের কথা জানালে তাদেরকেও কিছু দান করেন। বনু নাযীরের প্রসঙ্গে সমগ্র সূরা আল হাশর নযিল হয়। আল্লাহ বনু নাযীরের ওপর যে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাসূলকে দিয়ে তাদের ওপর সৈন্য অভিযান পরিচারনা করিয়ে তাদে বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করান, এই সূরায় তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি আহলে কিতাব কাফিরদেরকে (মুসলিম মুজাহিদদের) প্রথম হানাতেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তোমরা ধারণা করতে পারনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ওপর এমনভাবে চড়াও হলেন যে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি। আল্লাহ তাদের মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চর করে দিলেন। (ফলে) তারা তাদের ঘরবাড়ী নিজেদের হাতেও ভেঙ্গেছে আবার মুমিনদের হাত দিয়েও বঙ্গিয়েছে। কেননা তারা নিজেরাই তাদের ঘরের দরজায় উপরের অংশ ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।)

অতএব, হে বুদ্ধিমান লোকেরা, শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ যদি তাদের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত না দিয়ে থাকতেন (যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি প্রতিশোধই বটে) তাহলে দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন (তরবারী দ্বারা), অধিকন্তু তাদের জন্য পরকালে রয়েছে দোজখের শাস্তি (বহিষ্কার ছাড়াও)। তোমরা যেসব সতেজ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো উভয় কাজই আল্লাহর অনুমোদিত এবং তা শুধু নাফরমানদের অপদস্ত করার জন্যই। আর তাদের (বনু নাযীরের) যা কিছু সম্পদ আল্লাহ তাঁর রাসুলের দখলে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা তোমাদের উট ও ঘোড়া দৌড়িয়ে অর্জন করা জিনিস নয়, বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যার ওপর ইচ্ছা পরাক্রান্ত করে দেন। আর আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট জনপদের লোকদের থেকে যে সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ( অর্থাৎ উট, ঘোড়া চালিয়ে যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দখলে এসেছে। তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য, ইয়াতীম মিসকীন ও পথিকের জন্য, যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। আর রাসূল তোমাদের কে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিবৃত্ত করেছেন তা থেকে নিবৃত্ত হও।”

এখানে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের বিধান বর্ণনা করেছেন।

এরপর আল্লাহ বলেন,

“তুমি কি মুনাফিকদের অবস্থা দেখনি, তারা তাদের কুফরীতে লিপ্ত আহলে কিতাব ভাইদেরকে (অর্থাৎ বনু নাযীরকে) বলেঃ তোমাদেরকে যদি বহিষ্কার করা হয় তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবো। আর তোমাদের স্বার্থের ব্যাপারে অন্য কারো কথা কখনো শুনবো না, আর যদি তোমাদের ওপর যুদ্ধ চপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবে। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী। তারা যদি বহিষ্কৃত হয় তবে ঐ মুনাফিকরা কখনো তাদের সাথে বেরিয়ে যাবে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে কখনো সাহায্য করবে না, আর যদি সাহায্য করেও, তবে তারা (শেষ পর্যন্ত ময়দানে টিকবে না বরং মাঝখানেই) রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে। অতঃপর তাদের কাছে আর কোথাও থেকে কোন সাহায্য আসবে না। আসলো তাদের মনে তোমাদের ভয় আল্লাহর ভয়ের চেয়েও বেশী। কেননা তারা একটা নির্বোধের দল। তারা কখনো তোমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারবে না, যদি বা লড়ে তবে সুরক্ষিত জনপদে অথবা দেয়ালের অপর পাশ থেকে ছাড়া নয়। তাদের ভেতরে পারস্পরিক মতবিরোধ খুবই প্রকট। তোমরা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করলেও আসলে তাদের মন বিভেদ-ক্লিষ্ট। কেননা তারা বিবেক বুদ্ধিহীন গোষ্ঠী। তারা সেই জনগোষ্ঠীর মতই যারা, যারা অল্পদিন আগেই কৃতমর্তের ফল ভোগ করেছে। তাছাড়া তাদের জন্য আরো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (অর্থাৎ বনু কুইনুকার মত) তারা শয়তানের মতই, যে শয়তান মানুষকে বলে: কুফরী কর। আর যখনই সে কুফরী করে, অমনি বলে: ‘আমি তোমার ধার ধারি না। আমি তো বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। ’তাদের উভয়্রেই শাস্তি হলো, তারা চিরকার আগুনে পুড়বে। আর ওটাই হলো যালিমদের কর্মফল।”


যাতুর রিকা অভিযান (৪র্থ হিজরী)
বনু নাযীরের ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো রবিউল আউয়াল মাস ও জমাদিউল আউয়ালের একটা অংশ মদীনায় কাটালেন। এরপর নাজদে বনু মাহারিব গাতফানের উপগোত্র বনু সা’লাবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেন।মদীনার শাসনভার অর্পণ করে গেলেন আবু যার গিফারীর ওপর। নাজদে গাতফান গোত্রের আবাসভূমি এলাকা নাখাল পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। এটাই যাতুর রিকা [৬৬. রিকা অর্থ টুকরো কাপড় যা তালি দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই নামকরণের কারণ হলো এই অভিযানে তালি দেয়া পতাকা ব্যবহৃত হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেন, ভূমি অত্যন্ত প্রস্তরময় হওয়ায় সৈন্যগণ পায়ে কাপড়ের টুকরো বেঁধে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে এই নাম হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, যাতুর রিকা একটি গাছের নাম বা ঘটনাস্থল ছিল।] অভিযান। এখানে তিনি গাতফান গোত্রের এক বিরাট সমাবেশের সম্মুখীন হলেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের কাছাকাছি হলো। কিন্তু যুদ্ধ হলো না। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষ পরস্পর সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে প্রস্থান করেন।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন: আমি একটা দুর্বল উটে আরোহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নাখল থেকে রওনা হই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সদলবলে যাত্রা করলেন তখন অন্যান্য সহযাত্রী দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো। আর আমি পেছনে পড়তে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এসে জিজ্ঞোসা করলেন, “হে জাবির, তোমার অবস্থা কি?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পেছনে ফেলেছে।” তিনি বললেন, “উটটি থামাও।” আমি উটটিকে থামালাম, রাসূলুল্লাহও তাঁর উট থামালেন। এবার তিনি বললেন, “তোমার হাতের এই লাঠিটা আমাকে দাও অথাবা কোন একটা গাছ থেকে ডাল কেটে আমাকে লাঠি বানিয়ে দাও।” আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাঠি দিলাম। তিনি ঐ লাঠি দিয়ে আমার উটকে বেশ কয়েকবার গুতা দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, “আরোহণ কর।” আমি আরোহণ করলাম। তখন আমার উটটি এত দ্রুতো চলতে লাগলো যে, রাসূলুল্লাহর উটকেও পেছনে ফেলে যেতে লাগলো।

কথা প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “জাবির, তোমার উটটি কি আমার কাছে বিক্রি করবে?” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল, ওটা আপনাকে বিনামূল্যেই দেব।” তিনি বললেন, “না বিক্রি কর।” আমি বললাম, “কত দাম দেবেন?” তিনি বললেন, “এক দিরহাম।” আমি বললাম, “তাহলে ্আমার লোকসান হবে।” তিনি বললেন, “তা হরে দুই দিরহাম দেব?” আমি বললাম, ‘না।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমাগত দাম বাড়াতে বাড়াতে এক উকিয়া (এক আউন্স) পর্যন্ত বললেন। তখন আমি বললা, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপান এই দামে খুশী তো?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’ আমি বললাম, “তাহলে আপনাকে ওটা দিলাম।” তিনি বললেন, “আমি নিলাম।” অতঃপর বললেন, “জাবির, তুমি বিয়ে করেছো?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “কুমারীকে না বিবাহিতাকে?” আমি বললাম, “বিবাহিতাকে।” তিনি বললেন, “একটা তরুণী বিয়ে কর না কেন? সে তোমার সাথে কৌতুক করতো। আর তুমিও তার সাথে কৌতুক করতে পারতে?” আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা তাঁর সাতটি কন্যা রেখে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এই জন্য আমি একজন বয়স্কা মহিলা বিয়ে করেছি, যে ওদের তত্ত্বাবধান ও লালন পালন করতে পারে।” তিনি বললেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি ঠিকই করেছো।” অতঃপর বললেন, “আমরা যদি সিরার পৌঁছে যাই তাহলে একটি উট জবাই করতে বলবো এবং তা জবাই করা হবে। অতঃপর তোমার স্ত্রীর মেহমানদারীতে একদিন সেখানে কাটাবো। তাকে ইসলামের কথা শোনাবো এবং সে আমাদেরকে বালিশ বিছানা দিয়ে যত্নআদর করবে।” ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের তো বালিশ নেই।” তিনি বললেন, “বালিশ অবশ্যই মিলবে। তুমি সেখানে পৌঁছার পর বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করবে।”

অতঃপর সিরারে [সিরার মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে একটি জায়গা।] পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট জবাই করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জবাই করা হলো। আমরা ঐ উটের গোশত খেয়ে একদিন অতিবাহিত করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধ্যা বেলা বাড়ীতে প্রবেশ করলেন। সেইসাথে আমরাও প্রবেশ করলাম। স্ত্রীকে সব ঘটনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যা যা বলেছেন তা জানালাম। স্ত্রী তা শুনে বললো, “আমার সিদ্ধান্ত শুনে নাও, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা শুনবো ও মানবো।”

সকাল বেলা আমি উটের মাথা ধরে টেনে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং তাঁর থাকার ঘরের দরজার সামনে বেঁধে রাখলাম। অতঃপর আমি মসজিদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে গিয়ে বসলাম। মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটটি দেখে বললেন, “এটা কি?” উপস্থিত জনতা বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এই উট জাবির নিয়ে এসেছে।” তিনি বললেন, “জাবির কোথায়?” সবাই আমাকে ডেকে তাঁর নিকট হাজির করলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভাহিজা, এ উট তুমি নিয়ে যাও। এটা তোমার উট।” অতঃপর বিলালকে ডেকে বললেন, “জাবিরকে নিয়ে যাও এবং এই উটের মূল্য বাবদ এক উকিয়া দাও।” আমি বিলালের সাথে গেলাম। আমাকে তিনি এক উকিয়ার কিছু বেশী দিলেন। আল্লাহর কসম, উটটি এভাবে বরাবরই আমার সমৃদ্ধি সাধন করে আসছিল এবং আমার বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে বাড়ীতে তার গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করা হতো। নাজদের প্রস্তরপূর্ণ রণাঙ্গন থেকে ফিরবার পথে তার সাথে যে ঘটনা ঘটে, এটা সেই মর্যাদারই সর্বশেষ প্রতিফলন।

জাবির (রা) আরো বলেন, যাতুর রিকা অভিাযান শেষে নাখল থেকে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রওনা হলাম। এই সময় একজন মুসলমান জনৈক মুশরিকের স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে রণাঙ্গন থেকে প্রস্থান করলেন। তার স্বামী বাড়ীতে ফিরলো, ইতিপূর্বে সে অনুপস্থিত ছিলো। সে যখন তার স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর শুনলো তখন কসম খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলো যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের একজনকে অন্ততঃ হত্যা না করে সে ক্ষান্ত হবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লারেম পদচিহ্ন অনুসরন করে চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি করলেন। অতঃপর বললেন, “আজ সারারাত জেগে কে আমাদের পাহারা দিতে প্রস্তুত আছে?” একজন মুহাজির ও একজন আনসারী রাজী হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পাহাড়ের গুহার মুখে পাহারায় নিয়োগ কররেন। সাহাবীদ্বয় নিজেদের মধ্যে আপোষে রাতটি এভাবে ভাগ করে নিলেন যে, রাতের প্রথম ভাগ পাহারা দেবেন আনসারী এবং শেষের ভাগ মুহাজির। সেই অনুসারে মুহাজির প্রথম রাত ঘুমালেন আর আনসারী দাঁড়িয়ে নামায পড়া শুরু করলেন।

মুশরিক ঘাতক গভীর রাতে সোখানে এসে উপনীত হলো। নামায আদায়রত আনসারীকে দেখে সে বুঝতে পারলো যে, তিনি মুসলমানদের পাহারাদার। তৎক্ষনাৎ সে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর সে ঐ তীর দেহ থেকে টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি অবিচলিত রইলেন এবং নামায অব্যহত রাখলেন। এরপর সে আরো একটা তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেটিও তাঁর দেহ ভেদ করলো। অতঃপর ঘাতক তাও দেহ থেকে টেনে বের করলো এবং নিজের কাছে রেখে দিল। তা সত্ত্বেও তিনি নামাযে অবিচল রইলেন। অতঃপর সে তৃতীয় তীর নিক্ষেপ করলো। এই তীরও ওই সাহাবীর দেহ ভেদ করলো। ঘাতক তা টেনে বের করে নিজের কাছে রেখে দিল। এবার তিনি রুকু ও সিজদা করে নামায শেষ করলেন এবং তাঁর সঙ্গীকে জাগালেন। তাঁকে বললেন, “উঠে বস। ঘাতক আমাকে জখম করে অচল করে ফেলেছে।” সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘাতক উভয়কে দেখে বুঝলো যে, তাঁরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে সাবধান হয়ে গেছে। তাই সে পালিয়ে গেল।

মুহাজির সাহাবী আনসারীর রক্তাক্ত দেহ দেখে বরলেন, “সুবাহানাল্লাহ! আপনি আমাকে প্রথম তীরের আঘাতেই জাগালেন না কেন?” আনসারী সাহাবী বললেন, “আমি নামাযে একটি সূরা পড়ছিলাম। সূরাটি শেষ না কের নামায ভঙ্গ করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। কিন্তু শত্রু অব্যাহতভাবে তীর নিক্ষেপ করতো থাকায় আমি রুকু সিজদা করে আপনাকে ডাকলাম। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবো এই আশংকা যদি না থাকতো তাহলে আমি খুন না হওয়া পর্যন্ত নামায় ভঙ্গ করতাম না।”

ইবনে ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ যাতুর রিকা অভিযান শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রজবের শেষ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।

দ্বিতীয় বদর অভিযান (৪র্থ হিজরী সন)
আবু সুফিয়ানের চ্যালেঞ্জের সময় ঘনিয়ে আসায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা’বান মাসে আবার বদর অভিযানে বেরুলেন[৬৭.উল্লেখ্য যে, এ সময় তিনি আনসারী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সুুলুলকে মদীনার শাসনভার দিয়ে যান।]এবং সেখানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে তিনি আবু সুফিয়ানের অপেক্ষায় আটটি রজনী অতিবহিত করলেন। ওদিকে আবু সুফিয়ান মক্কাবাসীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে মাজনা গিয়ে যাত্রাবিরতি করলো। সে যাহরান হয়ে এখানে উপনীত হয়। তারপর মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সে বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমাদের জন্য যুদ্ধ করা কেবল ভাল ফসল ফলার বছরেই শোভা পায়, যখন তোমরা তোমাদের গাছপালার তত্ত্বাবধান করতে পারবে এবং দুধ পান করতে পারবে। কিন্তু এটা তো অজন্মার বছর। আমি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরাও ফিরে চলো।” তার কথায় লোকেরা ফিরে গেল। মক্কাবাসী তাদেরকে ‘ছাতুখোর বাহিনী’ নামে অভিহিত করে। তারা বলতো, “তোমরা তো শুধু ছাতু খেতে লড়াইয়ে গিয়েছিলে।”

ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায় বদরের প্রন্তরে বসে প্রহর গুনতে লাগলেন এই সময় মাখশা ইবনে আমর দামরী তাঁর কাছে এলো। ওয়াদ্দান অভিযানে এই ব্যক্তিই বনু দামরা গোত্রের পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে সন্ধি করেছিলো। সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, আপনি কুরাইশদের মুকাবিলা করতে এই জলাশয়ের পাশে এসেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “সত্যিই তাই হে বুন দামরার ভাই! এ অবস্থা দেখেও তুমি যদি চাও তবে তোমাদের সাথে আমাদের যে সন্ধি রয়েছে তা প্রত্যাহার করে যুদ্ধ করতে আমরা প্রস্তুত। যুদ্ধের মাধ্যমেই আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিন তা চাইলে তাতে আমাদের অমত নেই।” সে বললো, “না, হে মুহাম্মাদ, আল্লাহর শপথ, আমাদের তাতে কোন প্রয়োজন নেই।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই সময় মা’বাদ ইবনে আবু মা’বাদ আল খুযায়ী তাঁর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলো। সি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপস্থিত দেখতে পেয়ে নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে দ্রুত উট হাঁকিয়ে চলে গেল।

“(আমার উট) মুহাম্মাদের ও মদীনার কালো কিসমিস সদৃশ খেজুরের সান্নিধ্যের প্রতি বিতৃষ্ণ। সে ছুটে চলেছে তার বাপের পুরানো রসম রেওয়াজের প্রতি অনুগত হয়ে। কুদাইদের জলাশয়ে আজকে এবং দাজনাদের জলাশয়ে কালকে বিকালের মধ্যে তাকে পৌঁছে যেতেই হবে।[কুদাইদ মক্কার নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম।]

আর সাহাবী আবদুল্লাহ রাওয়াহা আবু সুফিয়ানের অনুপস্থিতিকে লক্ষ্য করে নিন্মোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন,

“আবু সুফিয়ানের সাথে বদর প্রান্তরে মুখোমুখি হবার জন্য আমরা ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু তার ওয়াদার সত্যতা পেলাম না এবং সে ওয়াদা রক্ষাকারী নয়। কসম করে বলছি, তুমি যদি ওয়াদা রক্ষা করতে (হে আবু সুফিয়ান) ও আমাদের মুখোমুখি হতে তাহলে ধিকৃত ও তিরস্কৃত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হতে এবং মিত্রদেরকেও হাতছাড়া করে ফেলতে। এই বদর প্রান্তরেই আমরা উতবা ও তার ছেলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেলে গিয়েছি। আবু জাহলের লাশও এখানে রেখে গিয়েছি। তোমরা আল্লাহর রাসূলকে অমান্য করলে! তোমাদের ধর্মমত এবং তোমাদের কুৎসিত ও বিভ্রান্তিকর কর্মকা-কে ধিক! তোমরা আমাকে যতই ভর্ৎসনা করো, তবুও বলবো, রাসূলুল্লাহর জন্য আমার ধন-জন সবই কুরবানকৃত। আমরা তাঁর অনুগত। তাঁকে ছাড়া কাউকে কোন অঙ্গীকার দিই না। তিনি আমাদের জন্য অন্ধকার রাতের দিশারী ধ্রুব নক্ষত্র।”

দুমাতুল জান্দাল অভিযান (৫ম হিজরী: রবিউল আউয়াল)
বদরের দ্বিতীয় অভিযানের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে যান এবং সেখানে একমাস অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের শেষ পর্যন্ত অবস্থান করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ বর্জন করে। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনা আগমনের চতুর্থ বছর। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুমাতুল জান্দালে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে কোন সংঘর্ষ তো হয়ইনি, এমনকি তাঁকে সে স্থান পর্যন্ত যেতেও হয়নি। তিনি মদীনায় ফিরে এসে সেখানেই বছরের বাকী সময় কাটিয়ে দেন।

খন্দক যুদ্ধ (৫ম হিজরী, শাওয়াল)
পঞ্চম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের পটভূমি হলো, বন নাযীর ও বনু ওয়াইরের ইহুদীদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কা গিয়ে কুরাইশদেরকে মদীনার ওপর হামলা চালিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আহ্বান জানায় এবং এ কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এই দলের মধ্যে উল্লোখযোগ্য লোক ছিল বনু নাযীর গোত্রের সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, হুয়াই ইবনে আখতাব, কিনানা ইবনে আবুল হুকাইক এবং ওয়াইল গোত্রের হাওয়া ইবনে কায়েস ও আবু আম্মার। তারা আরবের বহু সংখ্যক গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে প্ররোচিত করে। কুরাইশরা তাদেরকে বললো, “ইহুদীগণ, তোমরা প্রথম কিতাবের অধিকারী। আমাদের সাথে মুহাম্মাদের যে বিষয় নিয়ে মতভেদ, তা তোমরা ভাল করেই জান্ োতোমরাই বলো আমাদের ধর্ম ভাল না মুহাম্মাদের ধর্ম ভাল?” তারা বললো, “তোমাদের ধর্ম মুহাম্মাদের ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তোমরা সত্যের নিশানাবাহী!”

তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার এই আয়াতগুলো নাযিল করেন,

“তুমি কি সেই কিতাবধারীকে দেখোনি যারা মূর্তি ও খোদাদ্রোহী শক্তিকে মানে এবং কাফিরদেরকে মু’মিনদের চেয়ে বেশী সুপথপ্রাপ্ত অভিহিত করে। তারাই আল্লাহর অভিশাপগ্রস্ত। আর যারা আল্লাহর অভিশপ্ত তাদের কোন সাহায্যকারী কখনো মিলবে না। তাদের কি আল্লাহর রাজত্বে কোন অংশ আছে যে তারা মানুষকে তা থেকে কণামাত্রও দেবে না। নাকি তারা মানুষকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ প্রদান করেছেন অর্থাৎ নবুওয়াত তার ব্যাপারে হিংসা করে? আমি ইবরাহীমের বংশধরকে তো কিতাব ও তত্ত্বজ্ঞান দান করেছি এবং তাদেরকে বিরাট রাজত্ব দিয়েছি। তাদের কেউ কেউ তার ওপর ঈমান এনেছে আবার কেউ কেউ তা গ্রহণ করতে মনুষকে বাধা দিয়েছে। তাদের জ্বালানোর জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।”

ইহুদীরা যখন কুরাইশদের সম্পর্ক এরূপ কথা বললো তখন তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। অধিকন্তু তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হামলা চালানোর আমন্ত্রণ জানালো তখন তারা তাতে একমত হলো এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। পরে ঐসব ইহুদী গাতফান গোত্রের কাছে গেল এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানালো। তাদের সাথে নিজেদের অংশ নেয়ার আশ্বাস তারা দিল। তাদেরকে জানালো যে, কুরাইশরাও তাদের সাথে একমত হয়ে আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত হয়েছে।

যথাসময়ে কুরাইশ বাহিনী ও তাদের দলপতি আবু সুফিয়ান যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লো। গাতফানও বেরুলো বনু ফাজারা ও তার দলপতি উয়াইনা ইবনে হিসনকে সাথে নিয়ে। আর বুন মুররাকে সাথে নিয়ে হারেস ইবনে আওফ ইবনে আবু হারেসা ও আসজা গোত্রসে সাথে নিয়ে তার দলপতি মিসআর ইবনে রুযাইরা রওনা হলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই যুদ্ধপ্রস্তুতির কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ মদীনার চারপাশে খন্দক বা পরিখা খনন করালেন। মুসলমানরা যাতে সওয়াবের আশায় এই কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজ হাতে পরিখা খননের কাজ করেন। তাঁর সাথে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে খননের কাঝে যোগ দেয়। তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ অবিশ্রান্তভাবে এই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কেবল কিছুসংখ্যক মুনাফিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের থেকে দূরে থাকে। তারা নানা রকমের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কাজে ফাঁকি দিতে ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অজ্ঞাতসারে ও বিনা অনুমতিতে চুপিসারে বাড়ী চলে যেতে থাকে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের মধ্যে কারো যদি মারাত্মক অসুবিধাও দেখা দিত এবং অনিবার্য প্রয়োজনে নিজ পরিবার পরিজনের কাছে যাওয়ার দরকার পড়তো তা হলেও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যথারীতি জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যেতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথেই তারা এসে অবশিষ্ট কাজে শরীক হতো। এভাবে তারা পুণ্যকর্মে আগ্রহ ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতো। আল্লাহ তায়ারা এসব মু’মিনের প্রসঙ্গে সূরা নুরের এ আয়াত ক’টি নাযিল করেন:

“মু’মিন তারাই Ñ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে রত থাকলেও তাঁর অনুমতি না নিয়ে কোথাও যায় না। যারা তোমার কাছে অনুমতি চায় তারাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করে। হে নবী, তারা (মু’মিনরা) তোমার কাছে তাদের কোন ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তুমি তাদেরকে ইচ্ছা হলে অনুমতি দিও এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল।”

মুসলমানদের মধ্যে যারা নিষ্ঠাবান, সৎকর্মের প্রতি আগ্রহী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত, তাদেরকে লক্ষ্য করেই এই আয়াত কয়টি নাযিল হয়।

যেসব মুনাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুমতি না নিয়েই চুপে চুপে চলে যেতো তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরো বলেনÑ

“তোমাদের প্রতি রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের পরস্পরকে আহ্বান করার মত মনে করো না। আল্লাহ তোমাদের এইসব লোককে ভালভাবেই জানেন যারা আড়ালে আবডালে চুপে চুপে সরে পড়ে। রাসূলের হুকুম অমান্যকারীদের এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত যে, তাদের ওপর যে কোন মুহূর্তে মুসিবত কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত হতে পারে। মনে রেখো, আসমান ও যমীনের সবকিছুই আল্লাহর। তোমরা কে সত্যের অনুসারী আর কে মিথ্যার অনুসারী তা তিনি ভালভাবেই অবহিত। আর যেদিন তাঁর কাছে তারা ফিরে যাবে সেদিন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্ক জানিয়ে দেবেন। বস্তুত: আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।” (সূরা নূর আয়াত-৬৪)

এই আয়াত ক’টিতে রাসূলের অনুমতি না নিয়ে তাঁর নির্দেশিক কাজ থেকে গোপনে সরে পড়া মুনাফিকদের বিবরণ দেয়া হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিখা খনন সম্পন্ন করতেই কুরাইশরা কিনানা গোত্র, তিহামার অধিবাসী ও তাদের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন মিলিয়ে সর্বমোট দশহাজার যোদ্ধা নিয়ে এসে পৌঁছলো। তারা রুমা নামক স্থানে জুরুফ ও জুগাবার মধ্যবর্তী মুজতামাউল আসইয়ালে শিবির স্থাপন করলো। গাতফান গোত্রের লোকেরাও তাদের নাজদবাসী মিত্রদের নিয়ে হাজির হলো। তারা উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে ‘সালা’ নামক পাহাড়কে পেছনে রেখে মুসলিম বাহিনীকে মোতায়েন করলেন। তাঁর ও শত্রুদের মাঝে থাকলো পরিখা। শিশু ও নারীদেরকে তিনি আগে ভাগেই দুর্গের মধ্যে রেখে আসার ব্যবস্থা করেন।

আল্লাহর দুশমন বনু নাযীর গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইযার কা’ব ইবনে আসাদের কাছে গেল। বনু কুরাইযার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আপোষ ও অনাগ্রাসন চুক্তির সংগঠক ছিল এই কা’ব ইবনে আসাদ। সে বনু কুরাইযার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরেক শান্তির অঙ্গীকার দেয় ও চুক্তি সম্পাদন করে। কা’ব ভেতরে বসেই হুয়াইয়ের আগমন টের পেয়ে তার মুখের ওপর দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। হুয়াই দরজা খুলতে বললে সে দরজা খুলতে অস্বীকার করে। হুয়াই পুনরায় দরজা খুলতে অনুরোধ কররে কা’ব বললো, “ধিক তোমাকে হুয়াই, তুমি একটা অলক্ষুণে লোক। আমি মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ এবং সে চুক্তি আমি ভঙ্গ করবো না। আমি মুহাম্মাদের আচরণে প্রতিশ্রুতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার পরিচয়ই পেয়েছি।”

হুয়াই বললো, “কি হলো! দরজাটা একটু খোল না। আমি তোমার সাথে কিছু আলাপ করবো।” কা’ব বললো, “আমি দরজা খুলতে পারবো না।” হুয়াই বললো, “তোমার খাদ্য গ্রহণ করবো মনে করেই তুমি দরজা বন্ধ করেছো।” এ কথায় কা’ব অপ্রস্তুত হয়ে গেল এবং দরজা খুলে দিল। অতঃপর সে বললো, “আমি তোমার জন্য এ যুগের শ্রেষ্ঠ গৌরব এবং উত্তাল তরঙ্গময় সমুদ্র এনে হাজির করেছি। নেতা ও সরদারসহ সমস্ত কুরাইশ বাহিনীকে আমি জড়ো করেছি এবং তাদেরকে রুমা অঞ্চলের মুজতামাউর আসইয়ালে এনে হাজির করেছি। অপরদিকে গোটা গাতফান গোত্রকেও তাদের নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ উহুদের পার্শ্ববর্তী ‘জাম্ব নাকমা’য় এনে দাঁড় করিয়েছি। তারা সবাই আমার সাথে এ মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদেরকে নিশ্চিহ্ন না করে ক্ষান্ত হবে না।” কা’ব বললো, “তুমি বরং আমার মুখে চুনকালি মাখানোর আয়োজনই করেছো। তুমি এমন মেঘমালা সমবেত করছো যা বৃষ্টি বর্ষণ করে পানিশূন্য হয়েছে। এখন তার শুধু তর্জন গর্জন সার। তার দেয়ার মত কিছুই নেই। অতএব, হে হুয়াই, ধিক্ তোমাকে! আমাকে উত্যক্ত করো না। যেমন আছি থাকতে দাও। মুহাম্মাদ আমার সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। সে শুধু সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতারই পরিচয় দিয়েছে।” তথাপি হুয়াই নাছোড়বান্দা হয়ে কা’বের সাথে লেগে রইলো। সে তার ঘারের ওপর হাত রেখে নাড়তে থাকলো এবং অবশেষে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলো। সে তার নিকট থেকে অঙ্গীকার আদায় করতে সক্ষম হলো। সে বললো যে, কুরাইশ ও গাতফান যদি মুহাম্মাদকে হত্যা না করেই ফিরে যায় তাহলে সে কা’বের সাথে তার দুর্গে অবস্থান করবে এবং উভয়ে পরস্পরের সুখ দুঃখের সম অংসীদার হবে। এভাবে কা’ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি ভঙ্গ করলো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি আওস গোত্রের তৎকালীন নেতা সা’দ ইবনে মুয়ায ইবনে নু’মান (রা), খাযরাজের নেতা সা’দ ইবনে উবাদা ইবনে দুলাইম (রা), আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা) ও খাওয়াত ইবনে যুবাইরকে (রা) পাঠালেন। তাদেরকে বলে দিলেন, “তোমরা গিয়ে দেখো, যে খবরটা পেয়েছি তা সত্য কিনা। যদি সত্য হয় তাহলে ফিরে এসে সংকেতমূলক ধ্বনি দিয়ে আমাকে জানাবে। প্রকাশ্যে বরে সাধারণ মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দিওনা। আর যদি তারা চুক্তির অনুগত থাকে তাহরে ফিরে এসে সে কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে।”

তারা গিয়ে দেখলেন কা’ব ও হুয়াই এবং তাদের সাঙ্গ পাঙ্গরা যে রকম জানা গিয়েছিলো তার চেয়েও জঘন্য মনোভাব পোষণ করছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে। তারা বললো, “রাসূলুল্লাহ আবার কে? মুহাম্মাদের সাথে কোন চুক্তি বা অঙ্গীকার নেই।” একথা শুনে সা’দ ইবনে মুয়ায (রা) তাদের তিরষ্কার করলেন।

জবাবে তারাও তাকে পাল্টা তিরস্কার করলো। বস্তুত: সা’দ ইবনে মু’য়ায একটু চড়া মেজাজের লোক ছিলেন। সা’দ ইবনে উবাদা তাকে বললেন, “তিরস্কার বাদ দিন। আমাদের ও তাদের মধ্যে যে চুক্তি রয়েছে, তা তিরস্করের চেয়ে অনেক বেশী।” এরপর উভয় নেতা ও তাদের সঙ্গীদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, “আজাল ও কারা।” অর্থাৎ আজাল ও কারার লোকেরা সাহাবী খুবাইব ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) প্রতি রাজী’তে যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো, এরাও সেই পথ ধরেছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার। হে মুসলমানগণ! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো।”

এই সময় মুসলমানদের ওপর আপতিত দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। তাদের মধ্যে ভীতি প্রবল হয়ে উঠলো। চারদিক থেকে চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকলো। মুসলিম দলভুক্ত মুনাফিকদের মুনাফেকীও প্রকাশ পেতে আরম্ভ করলো। মুআত্তিব ইবনে কুশাইর তো বলেই ফেললো, “মুহাম্মাদ আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারর্স ও রোম সা¤্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাবো। অথচ আজ অবস্থা এই যে, আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছিনা।” আওস ইবনে কায়যী বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের বাড়ী-ঘর তথা পরিবার পরিজন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। (অর্খাৎ তাদেরই গোত্রের কিছুসংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে হুমকি এসছে।) অতএব আমাদেরকে বাড়ীতে ফিরে যেতে দিন। কেননা আমাদের বাড়ী-ঘর মদীনার বাইরে অবস্থিত।” এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুশরিকরা বিশ দিনের বেশী এবং একমাসের কম সময় পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করলেন। দুইপক্ষের মধ্যে তীর নিক্ষেপ ও অবরোধ ছাড়া আর কোন রকম যুদ্ধ হয়নি।

মুসলমানদের (অবরোধ দীর্ঘায়িত হওয়ার দরুন) দুঃখ-কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাতফান গোত্রের দুইজন নেতা উয়াইনা ইবনে হিসন ও হারেস ইবনে আওফের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালেন যে, তারা যদি তাদের লোকজন নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের (রা) বিরওদ্ধে এই অবরোধ ত্যাগ করে চলে যায় তাহলে তিনি তাদেরকে মদীনার পুরা উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ দেবেন। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও গাতফানীদের মধ্যে সন্ধি হলো এবং সন্ধির দলিল লেখা হলো। কেবল স্বাক্ষর দান ও সিদ্ধান্ত চূড়ান্তকরণের কাজটা বাকী রইলো। তবে লেনদেনের ব্যাপারে উভয় পক্ষের দরকাষাকষি ও সম্মতি দানের কাজটা চূড়ান্ত করা হলো। অবশিষ্ট কাজটুকু করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে মু’য়ায ও সা’দ ইবনে উবাদাকে (রা) ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদেরকে বিষয়টা অবহিত করলেন এবং পরামর্শ চাইলেন। উভয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এটা কি আমাদের কল্যাণার্থে আপনার প্রস্তাব, না আল্লাহ আপনাকে এজন্য নির্দেশ দিয়েছেন যা আমাদের করতেই হবে?” তিনি বললেন, “এটা আমার নিজের উদ্যোগ। কারণ আমি দেখছি গোটা আরব ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমাদের ওপর সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে এবং সবদিক দিয়ে তোমাদের ওপর দুর্লংঘ্য অবরোধ আরোপ করেছে। তাই যতটা পারা যায় আমি তাদের শক্তি চূর্ণ করতে চাচ্ছি।

সা’দ ইবনে মুয়ায বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইতিপূর্বে আমরা এবং এসব লোক শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিলাম। তখন আমরা আল্লাহকে চিনতাম না এবং আল্লাহর ইবাদাতও করতাম না। সে সময় তারা মেহমানদারীর অথবা বিক্রয়ের সূত্রে ছাড়া আমাদের একটা খোরমাও খেতে পারেনি। আর আজ আল্লাহ যখন আমাদেরকে ইসলামের গৌরব ও সম্মানে ভূষিত করেছেন, সত্যের পথে চালিত করেছেন, তখন তাদেরকে আমাদের ধন-সম্পদ দিতে হবে? আল্লাহর কসম, আমাদের এ সবের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কসম, তরবারীর আঘাত ছাড়া তাদেরকে আমরা আর কিছুই দেবো না। এভাবেই আল্লাহ তাদের ও আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাহলে এ ব্যাপারে তোমার মতই মেনে নিলাম।” এরপর সা’দ ইবনে মুয়ায চুক্তিপত্র খানা হাতে নিয়ে সমস্ত লেখা মুছে ফেললেন। এরপর তিনি বললেন, “ওরা যা পারে করুক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ শত্রুর অবরোধের ভেতরে অবস্থান করতে লাগলেন। কোন যুদ্ধই হলো না। অবশ্য আমর ইবনে উদ, ইকরিমা ইবনে আবু জাহল, হুবাইরা ইবনে আবু ওয়াহাব ও দিরার ইবনে খাত্তাব প্রমুখ কতিপয় কুরাইশ অশ্বরোহী যুদ্ধ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলো। তারা ঘোড়ায় চড়ে বুন কিনানার কাছে এসে বললো, “হে বনু কিনানা, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আজ দেখবে যুদ্ধে কারা বেশী পারদর্শী।” অতঃপর তারা দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গেল এবং পরিখার কিনারে থামলো। পরিখা দেখে তারা হতবাক হয়ে বললো, “আল্লাহর কসম, এটা এমন একটা যুদ্ধ কৌশল আরবরা কখনো উদ্ভবন করতে পারেনি।”[৬৮. ইবনে হিশাম বলেন, কথিত আছে যে, সালমান ফারসী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।]

অতঃপর পরিখার সবচেয়ে কম প্রশস্ত জায়গা দেখে তারা পরিখা পার হলো। ঘোড়ায় চড়ে তারা সালা পর্বত ও পরিখার মধ্যবর্তী মুসলমানদের অবস্থানে যেয়ে হাজির হয়। আলী (রা) কতিপয় মুসলমানকে সাথে নিয়ে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং যে উন্মুক্ত স্থানটি দিয়ে কাফিররা ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছিল সেখানেই তাদের গতিরোধ করে দাঁড়ান। অশ্বারোহীরা তাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে।

‘আমর ইবনে আব্দ উদ বদর যুদ্ধে আহত হয়ে এতটা অচল হয়ে গিয়েছিল যে, উহুদ যুদ্ধে হাজির হতে পারেনি। সে নিজের মর্যাদা জাহির করার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ প্রতীক দ্বারা নিজেকে চিহ্নিত করে এসেছিল। সে এসেই হুংকার দিল, “কে লড়াই করবে আমার সাথে?” আলী (রা) তার সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “হে আমর, তুমি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিলে যে, কুরাইশদের কোন লোক তোমাকে যে কোন দুইটি কাজের একটির দিকে দাওয়াত দেবে, তুমি তা গ্রহণ করবে। সত্য কিনা?” সে বললো, ‘হ্যাঁ!’ আলী (রা) বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”

সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি।”

সে বললো, ‘এতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।’ আলী বললেন, “তাহলে আমি তোমাকে যুদ্ধের দাওয়াত দিচ্ছি।” সে বললো, “তা ভাতিজা, আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই না।” আলী (রা) বললেন, “কিন্তু আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাই।” একথা শুনে আমর উত্তেজিত হলো। সে ঘোড়ার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রথমে ঘোড়াকে হত্যা করলো এবং তার মুখে আঘাত করলো। অতঃপর আলীর (রা) দিকে এগিয়ে এলো। উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হলো। অবশেষে আলী (রা) তাকে হত্যা করলেন।

এরপর তার ঘোড়সওয়ার দলটি পরাজিত হয়ে পরিখা পেরিয়ে পালিয়ে গেল। আমর নিহত হওয়ায় হতাশ হয়ে আবু জাহল তনয় ইকরিমা বর্শা ফেলে পালালো। তা দেখে মুসলিম কবি হাস্সান ইবনে সাবিত বললেন:

“সে পালিয়ে গেল এবং আমাদের জন্য তার বর্শা ফেলে রেখে গেল।

হে ইকরিমা, তুমি এমন ভান করেছো যেন (যুদ্ধ) করোনি।

তুমি নর উটপাখির মত উর্ধশ্বাসে পালিয়েছো।

ভাবখানা এই যে তুমি যেন রাস্তা থেকেই আলাদা হয়েছো

তুমি আপোষের মনোভাব নিয়ে একটুও পেছনে ফেরনি।

(তোমার পালানো দেখে) তোমার পিঠ বলে মনে হচ্ছিলো।”

খন্দক ও বনু কুরাইযার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের সংকেতধ্বনি ছিল “হুম, লা-ইউনছারুন।” অর্থাৎ শত্রুপক্ষের পরাজয় অবধারিত। শত্রুদের শক্তি ও পরাক্রম এবং অতিমাত্রায় সংখ্যাধিক্যের চাপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণকে প্রচ- ভয় ও ত্রাসের মধ্যে রণাঙ্গনে টিকে থাকতে হয়েছিলো।

অবশেষে নাঈম ইবনে মাস’উদ এসে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমার গোত্র এ কথা জানে না। এখন আপনি আমাকে প্রয়োজনীয় যে কোন নির্দেশ দিন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাদের মধ্যে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে শত্রুপক্ষের বিশ্বাসভাজন। তুমি যদি পার, আমাদের পক্ষ হয়ে শত্রুদের পর্যুদস্ত করো। য্দ্ধু তো কৌশলেরই নামান্তর।”

নাঈম ইবনে মাস’উদ বনু কুরাইযা গোত্রের কাছে গেলেন। জাহিলী যুগে তিনি তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তিনি তদেরকে বললেন, “হে বুন করাইযা, আমি তোমাদের কত ভালবাসি তা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা আছে। বিশেষ করে তোমাদের সাথে আমার যে নিখাদ সম্পর্ক রয়েছে, তা তোমাদের অজানা নয়।” তারা বললো, “হ্যাঁ, এ সত্য। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ ছিল না।” তখন তিনি বললেন, “কুরাইশ ও গাতফানের অবস্থা তোমাদের থেকে স্বতন্ত্র। এ শহর তোমাদেরই শহর। এখানে তোমাদের স্ত্রী, সন্তান ও ধন-সম্পদ রয়েছে। এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কুরাইশ ও গাতফান মুহাম্মাদ ও তাঁর সাহাবীদের সাথে লড়তে এসেছে। তোমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছো। অথচ তাদের আবাসভূমি, ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন অন্যত্র রয়েছে। সুতরাং তারা তোমাদের মত অবস্থায় নেই। তারা যদি এখানে স্বার্থ দেখতে পায় তাহলে তারা তা নেবেই। আর যদি না পায় তবে নিজেদের আবাসভূমিতে চলে যাবে। তখন তোমরা এই শহরে একাকী মুহাম্মাদের সম্মুখীন হবে। সে অবস্থায় তার বিরুদ্ধে তোমরা টিকতে পারবে না। অতএব মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে হলে আগে কুরাইশদের মধ্য হতে কতিপয় নেতাকে জিম্মি হিসেবে হাতে নাও। তারা তোমাদের হাতে জামানত হিসেবে থাকবে। তখন তোমরা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তোমরা মুহাম্মাদের সাথে লড়াই করা তোমাদের ঠিক হবে না।” তারা বললো, “তুমি ঠিক পরামর্শ দিয়েছো।”

এপর তিনি কুরাইশদের কাছে গিয়ে আবু সুফিয়ান ও তার সহযোগী কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বললেন, “তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, আমি তোমাদের পরম হিতাকাক্সক্ষী এবং মুহাম্মাদের ঘোর বিরোধী। আমি একটা খবর শুনেছি। সেটা তোমাদেরকে জানানো আমার কর্তব্য ও তোমাদের হিত কামনার দাবী। কথাটা তোমারা কারো কাছে প্রকাশ করো না।”

নাইম বললেন, “তাহলে শোন। ইহুদীরা মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীদের সাথে তাদের সম্পাদিত চুক্তি লংঘন করে অনুতপ্ত হয়েছে। তারা মুহাম্মাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে যে, আমরা যা করেছি তার জন্য অনুতপ্ত। এখন আমরা যদি কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের নেতৃস্থানীয় কিছু লোককে পাকড়াও করে তোমার কাছে হস্তান্তর করি আর তুমি তাদের হত্যা করো তাহলে কি তুমি আমাদের প্রতি খুশী হবে? এরপর আমরা তোমার সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশ ও গাতফানের অবশিষ্ট সবাইকে খতম করবো।’ একথায় মুহাম্মাদ রাজী হয়েছে।” নাঈম আবু সুফিয়ানকে আরো বললেন, “ইহুদীরা যদি তোমাদের কতিপয় লোককে জিম্মী রাখতে চায় তা হলে খবরদার একটি লোকও তাদের হাতে সমর্পণ করো না।”

এরপর নাঈম গাতফানীদের কাছে গিয়ে বললেন, “হে বনু গাতফান, তোমরাই আমার স্বগোত্র ও আপনজন। তোমরা আমার কাছে সবার চাইতে প্রিয়। মনে হয়, আমার বিরুদ্ধে তোমাদের কোন অভিযোগ নেই।” তারা বললো, “তুমি সত্য বলেছো। তোমার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই।” নাঈম বললেন, “তাহলে আমি যে খবর দিচ্ছি তা কাউকে জানতে দিওনা।” তারা বললো, “ঠিক আছে। তোমার কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা হচে।” নাঈম তখন তাদেরকে অবিকল কুরাইশদের কাছে যা বলেছেন তারই পুনরাবৃত্তি করলেন এবং জিম্মীর প্রশ্নে কুরাইশদের কাছে য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন গাতফানীদের কাছেও তাই উচ্চারণ করলেন।

পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসের শনিবারের পূর্বরাত্রের ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূলের সপক্ষে গোটা পরিস্থিতির মোড় পরিবর্তন করে দিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও গাতফান গোত্রের নেতৃবৃন্দ ইকরিমা ইবনে আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশ ও গাতফানীদের একটি দল পাঠালো বনু কুরাইযার কাছে। তারা গিয়ে বনু কুরাইযাকে বললো, “আমরা আর তিষ্ঠাতে পারছি না। আমাদের উট-ঘোড়া সব মারা যাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমরা মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করে চূড়ান্ত একটা ফায়সালা করে নিতে চাই।” তারা বললো, “আজ শনিবার। এই দিন আমরা কিছুই করি না। ইতিপূর্বে আমাদের কিছু লোক শনিবারে একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলো। তার ফলে যে পরিণতি হয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নয়। তাছাড়া আমরা তোমাদের সহযোগিতা করার জন্য মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে তোমরা যদি তোমাদের কিছু লোককে আমাদের হাতে নিরাপত্তার রক্ষাকবচ হিসেবে জিম্মী রাখো তাহলে তোমাদের সহযোগিতা করতে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি। আমাদের আশংকা হয় যে, যুদ্ধে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা যুদ্ধ অব্যাহত রাখা কঠিন মনে করলে তোমরা আমাদের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে মুহাম্মাদের মুঠোর মধ্যে অসহায়ভাবে রেখে নিজ দেশে ফিরে যাবে। অথচ মুহাম্মাদের মুকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই।”

বনু কুরাইযার এই জবাব নিয়ে প্রতিনিধিদল যখন ফিরলো তখন কুরাইশ ও গাতফানীরা পরস্পরকে বললো, “নাঈম ইবনে মাসউদ আমাদেরকে যে খবর দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। অতএব বনু কুরাইযাকে জানিয়ে দেয়া হোক যে, আমরা তোমাদের কাছে একজন লোকও জিম্মী হিসেবে সমর্পণ করতে রাজী নই। যুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকেতো এসে যুদ্ধ করো।” কুরাইশ ও গাতফানীদের এ জবাব নিয়ে পুনরায় বনু কুরাইযার কাছে দূত গেলে বনু কুরাইযার নেতারা পরস্পরকে বললো, “দেখরে তো নাঈম যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। কুরাইশ ও গাতফানীরা শুধু যুদ্ধই চায়। আমাদের ভালোমন্দ নিয়ে তাদের কোন মাতাব্যাথা নেই। তারা যদি লাভবান হয় তাহলে তো তাদেরই স্বার্থ উদ্ধার হলো। অন্যথায় তারা আমাদেরকে মুহম্মাদের হাতে অসহায়ভাবে রেখে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে।”

কাজেই তার কুরাইশ ও গাতফানীদের জানিয়ে দিল যে, “যতক্ষণ না তোমরা আমাদের হাতে জিম্মী না দেবে ততক্ষণ আমরা তোমাদের সহযোগী হয়ে মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ করবো না।” এভাবে তারা গাতফান ও কুরাইশদের প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করলো এবং শত্রুদের ভেতরে আল্লাহ কোন্দল সৃষ্টি করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করে দিলেন। তদুপরি সেই প্রচ- শীতের রাতে আল্লাহ তাদের ওপর অত্যন্ত ঠন্ডা বাতাস প্রবাহিত করলেন। সে বাতাস তাদের তাঁবু ফেলে দিল এবং রান্নার আসবাবপত্র তছনছ করে দিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাদের এই কোন্দল ও বিভেদের খবর পৌঁছলে তিনি সাহাবী হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে রাতের বেলা শত্রুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠালেন।

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযী থেকে বর্ণিত। জনৈক কুফাবাসী সাহাবী হুযাইফা ইবনে ইয়ামানকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন ও তাঁর সাহচর্যে থেকেছেন?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সে বললো, “আপনারা তাঁর সাথে কি রকম ব্যবহার করতেন।” হুযাইফা বললেন, “আমরা তাঁর জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করতাম।” কুফাবাসী লোকটি বললো, “খোদার কসম, আমরা যদি তাঁকে জীবিত পেতাম তাহলে তাঁকে মাটিতে হেঁটে চলতে দিতাম না, বরং ঘাড়ে চড়িয়ে রাখতাম।” হুযাইফা (রা) বললেন, ভাতিজা, শোনো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমরা পরিখায় ছিলাম। তিনি রাতের একাংশ নামায পড়ে কাটালেন। পরে তিনি আামাদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছ যে শত্রুদের গতিবিধির খোঁজ নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে? আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, সে যেন জান্নাতে আমার সাথী হয়!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজ সেরে ফিরে আসার শর্ত আরোপ করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে কেউ-ভয়, শীত ও ক্ষুধার দরুন যাওয়ার শক্তি পাচ্ছিলো না। কেউ যখন প্রস্তুত হলো না তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডাকলেন। ফলে আমাকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই হলো। তিনি বললেন, “হে হুযাইফা, যাও শত্রুদের ভেতরে যাও, তারপর দেখো তারা কি করছে। আমাদের কাছে ফিরে এসে তুমি কোন কিছু ঘটিয়ে বসোনা যেন।”

এরপর আমি গেলাম এবং সন্তপর্ণে শত্রু বাহিণীর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখনো আল্লাহর অদৃশ্য সেন্যরা তাদেরকে হেস্তনেস্ত করে চলেছেক। তাদের তাঁবু ও রান্নার হাঁড়ি পাতিল সবই ল-ভ- হয়ে গেছে এবং আগুন নিভে গেছে।

তখন আবু সুফিয়ান তাদের বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা প্রত্যেকে নিজের আশেপাশে খেয়াল করে দেখো, অন্য কেউ আছে কিনা।” একথা শোনার পর আমিই প্রথম পার্শ্ববর্তী লোকের গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কে?” সে বললো, “অমুকের ছেলে অমুক।”[৬৯. শরহুল মাওয়াহেরে বর্ণিত হয়েছে: হুযাইফা বলেন, “আমার ডানপাশে যে ব্যক্তি বসেছিল, তার হাতের ওপর হাত রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, ‘আমি আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবিয়া।’ তারপর বামপাশে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বললো, আমি আমর ইবনুল আস।”]

পরে আবু সুফিয়ান বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা যে স্থানে অবস্থান করছো সে স্থান আর অবস্থানের যোগ্য নেই। আমাদের উট-ঘোড়াগুলো মরে গেছে। আর বনু কুরাইযা আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে। আমরা যা অপছন্দ করি তারা তাই করেছে। প্রচ- ঝড় বাতাসে আমাদের কি দশা হয়েছে তা দেখতেই পাচ্ছ। আমাদের রান্নার সাজ-সরঞ্জাম, তাঁবু ইত্যাদি ল-ভ- হয়ে গেছে। এমনকি আগুনও নিভে গেছে। অতএব তোমরা সবাই নিজ বাড়ী অভিমুখে যাত্রা করো। আমি রওনা হচ্ছি।”

একথা বলেই সে তার উটের দিকে এগিয়ে গেল। উটটি ছিল বাঁধা। সে সেটির পিঠে উঠে বসলো। অতঃপর সেটিকে আঘাত করলো। তিনবার আঘাত করার পর সেটি লাফিয়ে উঠলো। উটটার বাঁধন খুললেও সেটি দাঁড়িয়েই ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে নির্দেশ না দিতেন যে, “ফিরে না আসা পর্যন্ত কোন কিছু ঘটিয়ে বসবে না” তাহলে আমি ইচ্ছা করলেই তাকে হত্যা করতে পারতাম।

হুযাইফা বললেন, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গেলাম। তখন তিনি একটি ইয়ামানী কম্বল গায়ে জড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। নামাযের মধ্যেই তিনি আমাকে দেখে পায়ের কাছে টেনে নিলেন এবং কম্বলের একাংশ আমার গায়ের উপর তুলে দিলেন। এই অবস্থায়ই তিনি রুকু ও সিজদা করলেন। সালাম ফিরানোর পর আমি তাঁকে শত্রুদের সব খবর জানালাম।

গাতফানীরা কুরাইশদের ফিরে যাওয়ার কথা জানতে পেরে স্বদেশ ভূমির পথে রওনা হলো। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানগণ পরিখা ত্যাগ করে মদীনায় চলে গেলেন এবং অস্ত্র রেখে দিলেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি