বনু কুরাইযা অভিযান (৫ম হিজরী)
জুহরের সময় জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তাঁর মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত জীনধারী খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘হ্যাঁ।’ জিবরীল বললেন, “কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। আর আপনিও রণাঙ্গন থেকে মুসলমানদের দাবীতেই ফিরছেন! হে মুহাম্মাদ আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।”

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়ে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের পুত্র আলীকে (রা) নিজের পতাকা নিয়ে বনু কুরাইযার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী (রা) রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একটা যঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। এসব শুনে তিনি ফিরে চললেন, পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোন কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে দেখলে তারা ঐ ধরনের কিছুই বলতো না।” অতঃপর তিনি বনু কুরাইযার দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে বললেন, “হে বানরের ভাইয়েরা, আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন তো? তাঁর শাস্তি ভোগ করছো তো?” তারা বললো, “হে আবুল কাসিম, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রচলিত ডাক নাম) তোমার তো কিছুই অজানা নেই।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য কুরআনে তাঁদেরকে তিরস্কার করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।

কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের লোকজন স্বদেশ অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইযার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো, “হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যে কোন একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো, “মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানÑসন্তিতির জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।” তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।” সে বললো, “এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সাবইকে হত্যা করি। তারপর তরবারী নিয়ে মুহাম্মাদ ও তঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুল করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।” সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?” কা’ব বললো, “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবতঃ মুহম্মাদ ও তাঁর সাহবীগণ আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চন্ত থাকবে। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।” তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।” কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারা জীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”

তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, “আপনি আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

আবু লুবাবা বলেন, “আমি তৎক্ষনাৎ উপলব্ধি করলাম যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে বসেছি।”[৭০. বনু কুরাইযাকে অবরোধ করা হলো তারা নিজেদের ধ্বংস অনিবার্য মনে করে শাস ইবনে কায়েসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালো। সে গিয়ে তাঁর কাছে বনু নাযীরকে যে শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে সেই শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়ার সুপারিশ করলো অর্থাৎ শুধুমাত্র সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী ও উটের পিঠে যতটা মালপত্র নেয়া যায়, তাই নিয়ে যেতে দেয়া। আর অবশিষ্ট সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তারা রেখে যাবে। অস্ত্রশস্ত্র আদৌ নেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনৃরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সে বললো, “তাহলে শুধু আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে বিতাড়িত করে দিন। উটের পিঠে করে মালপত্র মোটেই নিতে চাই না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাঁর ফায়সালা মেনে নেয়ার ওপরই গুরুত্ব দিলেন। শাস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জবাব নিয়েই ফিরে গেল। (জারফানী প্রণীত শরহুল মাওয়াহেব) শরহুল মাওয়াহেযে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, প্রাণভিক্ষার অনুরোধ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাখ্যান করায় আবু লুবাবা মনে করেছিলেন যে, বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিলে তাদেরকে হত্যাই করবেন। তাই তাদেরকে ইংগিতে সেই বিষয়টাই অবহিত করেন।]আবু লুবাবা পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে বললেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তাকে মুক্ত করতে পারি না।”

উম্মে সালামা (রা) বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “জানাতে পার।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” উল্লেখ্য যে, তখনো পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি।

এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেক মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযরের নামাযে যাওয়ার সময় তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন।

ইবনে হিশাম বলেন, আবু লুবাবা ছ’দিন খুঁটির সাথে আবদ্ধ ছিলেন। প্রত্যেক নামাযের সময় তাঁর স্ত্রী এসে নামাযের জন্য বাঁধন খুলে দিত। তারপর আবার খুঁটির কাছে এসে তিনি নিজেকে বেঁধে নিতেন।

পরদিন সকাল বেলা বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আওস গোত্রের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইযা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মুকাবিলায় তারা আমাদের সহায়তা করে থাকে। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানাই আছে।” বনু কুরাইযার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কাইনুকা গোত্রকে অবরোধ করেছিলেন। তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। তারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাদের প্রাণভিক্ষা চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করেছিলেন। আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আওস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ ইবনে মুয়াযকে আমি সালিশ নিযুক্ত করলাম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে মুয়াযকে জনৈক মুসলমানের স্ত্রী রুফাইদার নিকট মসজিদে নববীর একটা তাঁবুতে রেখেছিলেন। এই মহিলা আহতদের চিকিৎসা এবং আর্ত মুসলমানদের সেবা করতেন। সা’দ খন্দক যুদ্ধে তীরের আঘাতে আহত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বললেন, “সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ যাতে সে আমার কাছেই থাকে এবং আমি তার খোঁজ খবর নিতে ও সেবা-যত্ন করতে পারি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে সালিশ নিয়োগ করলে তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল। গাধার পিঠে তারা চামড়ার গদি স্থাপন করেছিল। তিনি ছিলেন খুব মোটাসোটা সুদর্শন পুরুষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বলতে থাকে, “হে সা’দ, তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করো। তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছেন এই জন্য যাতে তুমি তাদের প্রতি সহৃদয় আচরণ কর।” তারা খুব বেশী অনুনয় বিনয় করছে দেখে তিনি বললেন, “সা’দের জন্য সময় এসেছে সে যেন আল্লাহর দ্বীরেন ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কা না করে।” একথা যারা তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কেউ কেউ বনু আবদুল আশহালের বস্তিতে ফিরে গেল। তখন বনু কুরাইযার কিছু লোক তাদের কাছে এলো। সা’দ তাদের কাছে পৌঁছার আগেই তারা তাদের কাছে সবকিছু শুনে নিজেদের মৃত্যু অবধারিত মনে করে কাঁদতে লাগলো।[৭১. “সা’দের জন্য সময় এসেছে, সে যেন আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কার না করে”- সাদের এই উক্তি শুনে তারা বুঝলো যে, তিনি হয়তো তাদের হত্যার রায় দেবেন। তাই মৃত্যুর আগেই নিশ্চিত মৃত্যুর আভাস পেয়ে তারা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল।]

সা’দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” তখন কুরাইশরা ও মুহাজিরগণ বলতে লাগলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নির্দেশ ও কেবল আনাসারদের জন্য।” আনসারগণ বললেন, “এ নির্দেশ সবার জন্য।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।” সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবেÑতোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” সা’দ অবশ্য শ্রদ্ধাবশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা উল্লেখ করলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইযার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”

এরপর বনু কুরাইযার সবাইকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে এনে মদীনার কাইস বিনতে হারিসার বাড়ীতে আটক করে রাখা হলো। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বাজারে গেলেনÑযেখানে আজও মদীনার বাজার অবস্থিত। এক দলে ভাগ করে আনলেন এবং ঐ সব পরিখার ভেতরে তাদেরকে হত্যা করা হলো। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাব এবং বনু কুরাইযার গোত্রপতি কা’ব ইবনে আসাদকেও হত্যা করা হলো। তাদের সংখ্যা ছিল সর্বমোট ছয় বা সাত শ’। যারা তাদের সংখ্যা আরো বেশী মনে করেন তাদের মতে তাদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় শ’য়ের মধ্যে। তাদেরকে যখন দলে দলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তারা গোত্রপতি কা’ব ইবন আসাদকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হে কা’ব, আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে বলে আপনি মনে করেন?” কা’ব বললো, “তোমরা কি কিছুই বুঝ না? দেখছো না, যে ডেকে নিচ্ছে সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার? দেখছো না তোমাদের যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম, সবাইকে হত্যা করা হবে।”

এভাবে এক এক করে সবাইকে হত্যা করা হলো।

ইসলামের জঘন্যতম দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাবকে আনা হলো। তার গায়ে গোলাপী রংয়ের একটা পোশাক ছিল। সে এর সব জায়গায় ছোট ছোট করে ছিঁড়ে রেখেছিলো যাতে তা কেড়ে নেয়া না হয়। তার দু’হাত রশি দিয়ে ঘাড়ের সাথে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে বললো, “তোমার শত্রুতা করে আমি কখনোই অনুতপ্ত হইনি। তবে আল্লাহকে যে ত্যাগ করে তাকে পর্যুদস্ত হতেই হয়।” এরপর সে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললো, হে জনম-লী, আল্লাহর হুকুম অলংঘনীয়। বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ ভাগ্যলিপি ও মহা হত্যাকা- নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।” এ কথাগুলো বলে সে বসে পড়লো এবং এরপর তার শিরচ্ছেদ করা হলো।

উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদিয়ল্লাহু আনহা বলেন, বনু কুরাইযার একজন মহিলা ছাড়া আর কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। সেই মহিলাটি আমার কাছে নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তার গোত্রের লোক নিহত হচ্ছিলো। সহসা জনৈক ঘোষক উচ্চস্বরে বলল, “সে কি? তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, “আমাকে হত্যা করা হবে।” আমি বললাম “অমুক মহিলা কোথায়?” একথা শুনে সে বললো, এই তো আমি।” “কেন?” সে বললো, “একটা কা- ঘটিয়েছি সে জন্য।” এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং হত্যা করা হলো।[৭২. ইবনে হিশাম বলেন, এই মহিলাই যাঁতার পাথর ছুঁড়ে সাহাবা খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে হত্যা করেছিলো।]

আয়িশা (রা) বলতেন, “সেই মহিলাটির কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার এই ভেবে বিস্ময় লাগে যে, সে নিহত হবে জেনেও প্রফুল্লচিত্তে ও হাসিখুশীতে ডুবে ছিল।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আতিয়া কুরাযী বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন কিশোর। আমাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।”

আইয়ুব ইবনে আবদুর রহমান বলেন, সালমা বিনতে কায়েস নাম্নী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈকা খালাÑ যিনি তাঁর সাথে উভয় কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন এবং মহিলাদের বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেছিলেনÑ রাসূলুল্লাহর নিকট রিফায়া ইবনে সামুয়েল কুরাযীর জীবন রক্ষার আবেদন করেন। তিনি বলেন, “রিফায়া নামায পড়া ও উটের গোশত খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন ও তাঁর জীবন রক্ষা করেছিল। এই লোকটি (রিফায়া) প্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং সালমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলে। সে আগে থেকেই সালমার পরিবারকে চিনতো। এভাবে সালমা রিফায়ার জীবন রক্ষা করেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন। তারপর সা’দ ইবনে যায়িদ আনসারীকে বনু করাইযার কিছু সংখ্যক দাসদাসীকে দিয়ে নাজদ পাঠিয়ে দেন। তাদের বিনিময়ে তিনি সেখানে থেকে মুসলমানদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়া খরিদ করে আনেন।

বনু কুরাইযার মহিলাদের মধ্য থেকে রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য মনোনীত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকাল পর্যন্ত সে তাঁর মালিকানায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে করে পর্দার আড়ালে নেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল, তার চেয়ে বরং আমাকে আপনি দাসী হিসেবে আশ্রয় দেন। এটা আমার ও আপনার উভয়ের জন্যই অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট হবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা মতই কাজ করলেন তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করার সময় সে ইসলাম গ্রহণের ঘোর বিরোধিতা করেছিল এবং ইহুদী ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে দূরে রইলেন এবং মর্মাহত হলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের সাথে বৈঠকে আছেন এমন সময় পিছনের দিকে জুতার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই সালাবা ইবনে সাইয়া আমাকে রায়হানার ইসলাম গ্রহণের খবর দিতে আসছে। ” সত্যই সালাবা এলেন এবং জানালেন, রায়হানা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমে তিনি খুশী হলেন।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে খন্দক যুদ্ধ ও বনু কুরাইযার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিভাবে মুসলমানগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের ওপর কি অপার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং কিভাবে তিনি তাদেরকে সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করে উভয় যুদ্ধে বিজয় দান করেছেন, তা বর্ণনা করেছেন। অথচ তার আগে মুনাফিকরা অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, বিশাল এক বাহিনী তোমাদের ওপর চড়াও হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেন তা স্মরণ কর। তখন আমি তাদের ওপর প্রচ- ঝটিকা এবং এমন এক সেনাবাহিনী (ফিরিশতা) পাঠিয়েছিলাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমাদের কার্যকলাপও আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তারা যখন সবদিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ চালালো, যখন অনেকের চোখ ভয়ে বিষ্ফোরিত ও প্রাণ কণ্ঠনালীতে উপনীত হলো এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকমের ধারণা করতে লাগলে তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়া হলো। মুনাফিক ও অসুস্থ মনের লোকেরা বলছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের একটা দল বললো: হে ইয়াসরিববাসীগণ, তোমাদের এখন অবস্থানের অবকাশ নেই, কাজেই ফিরে যাও। তখন তাদের কোন কোন দল নবীর কাছে এই বলে অনুমতি চাচ্ছিলো যে, আমাদের পরিবার পরিজন বিপদের সম্মুখীন। আসলে তা বিপদের সম্মুখীন ছিল না। তারা শুধু পালাবার বাহানা খুঁজছিল।”

আওস ইবনে কায়যী ও তার সমমনাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়।

“যদি (মদীনার) সকল দিক দিয়ে শত্রু ঢুকে পড়তো এবং তাদেরকে ফিৎনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থাৎ শিরক করার আহ্বান জানানো হতো তাহলে তারা অবশ্যই তা করতো। এরূপ করতে তারা কদাচিৎ দ্বিধা করতো। ইতিপূর্বে তারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলো যে, রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে না। আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। ( এই বনু সালামা ও বনু হারেসা গোত্রদ্বয় উহুদ যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করার পর ওয়াদা করেছিল যে, আর কখনো তার এরূপ কাজ করবে না। সেই ওয়াদার কথা আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেনÑ যা তারা আপনা থেকেই করেছিল।) হে নবী, তুমি বল, মৃত্যু বা হত্যা থেকে পালিয়ে তোমাদের কোন লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জীবনকে ভোগ করার সুযোগ পাবে মাত্র। বল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করা কিংবা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আল্লাহর সে সিদ্ধান্ত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই তার অভিভাবক বা সহায় হিসেবে পাবে না। তোমাদের মধ্যে কারা বাধা সৃষ্টিকারী এবং কারাই বা তাদের ভাইদেরকে বলে, ‘আমাদের সাথে এসো’। এসব মুনাফিকরা খুব কমই যুদ্ধে যেয়ে থাকে। (অর্থাৎ আত্মরক্ষা ও দায় সারার প্রয়োজন ছাড়া) শুধুমাত্র তোমাদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করাই তাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধ যখন সমাগত হয় তখন তাদেরকে তুমি দেখবে, তোমার দিকে ভয়ে এমনভাবে তাকাবে, মুমূর্ষ চেতনাহীন ব্যক্তির চোখ যেমন মৃত্যুর ভয়ে ঘুরতে থাকে। তারপর বিপদ কেটে গেলে তারা গণিমতের সম্পদের লোভে উচ্ছাসিত ভাষায় তোমাদের কাছে গিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াবে। (অর্থাৎ এমন সব কথা বলবে যা তোমরা পছন্দ করো না। কেনান তারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং কোন সওয়াবও পাবে না। তাই মৃত্যুকে তার ঠিক তেমনি ভয় পায় যেমন ভয় পায় মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যারা বিশ্বাসী নয় তারা)। তারা ঈমান আনেনি ফলে আল্লাহ তাদের সকল সৎকাজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুতঃ এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ কাজ। তারা মনে করে, দলগুলো (অর্থাৎ হানাদার কুরাইশ ও গাতফান ) চলে যায়নি। আর যদি তারা পুনরায় হামলা করে বসে তাহলে তারা মরুভূমির বুকে বেদুঈনের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের খোঁজÑখবর নিতে থাকবে, আর তোমাদের মধ্যে থাকলেও তারা খুব কমই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো।”

এরপর আল্লাহ মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোামাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসীদের জন্য।” [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে থেকে কিংবা তার মর্যাদা থেকে স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট যারা তাদের জন্য নয়] এরপর মু’মিনদের সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরীক্ষাকে স্বীকার করে নেয়ার ও মেনে নেয়ার যে মনোভাব তাদের রয়েছে, তার উল্লেখ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “মু’মিনরা যে সময় হানাদার দলগুলোকে দেখলো তখন বললো: এ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেয়া প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতি তাদের ঈমানকে ও আত্মনিবেদনকেই বাড়িয়ে দেয়।” (অর্থাৎ বিপদে ধৈর্য, অদৃষ্টের আছে আত্মসমর্পণ এবং সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব)।

“অনেক মু’মিন আছে যারা আল্লাহর কাছে দেয়া অংগীকার পূরণ করেছে। তাদের কেউ তো কর্তব্য সমাধান করে ফেলেছে। (অর্থাৎ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন, যেমন বদর ও উহুদের শহীদগণ) আবার কেউ কেউ প্রতীক্ষমান আছে। (অর্থাৎ আল্লাহর সাহয্যের জন্য এবং রাসূল ও সাহাবীগণ যা করে গেছেন তা করার জন্য তারা এতে আদৌ কোন পরিবর্তন সাধন করেনি। (অর্থাৎ কোন সন্দেহ-সংশয় বা সংকোচ পোষণ করেননি কিংবা বিকল্প পথ খোঁজেননি) আল্লাহ তায়ালা সত্যনিষ্ঠদেরকে তাদের সত্যনিষ্ঠার পুরষ্কার দেবেন এবং ইচ্ছা করলে মুনাফিকদের আযাব দেবেন, কিংবা মাফ করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আর আল্লাহ কাফিরদেরকে (অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফানীদেরকে) তাদের ক্রোধ ও আক্রোশসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোন কল্যাণই তাদের ভাগ্যে জোটেনি। মু’মিনদের হয়ে লড়াই করা জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কেননা তিনি তো শক্তিমান পরক্রমশালী। আহলে কিতাবদের যে গোষ্ঠটি (অর্থাৎ বনু কুরাইযা) তাদের সাহয্য করেছিল আল্লাহ তাদের সুরক্ষিত জায়গাগুলো থেকে তাদেরকে বের করে এনেছেন এবং তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাদের একাংশকে হত্যা ও অপরাংশকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছো। (অর্থাৎ পুরুষদের হত্যা করেছো এবং নারী শিশুদের বন্দী বানিয়েছ।) আর আল্লাহ তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী, ধন-সম্পদ এবং যে জায়গা আদৌ পায়ে মাড়াওনি (অর্থাৎ খাইবার) সে জায়গাও তোমাদের অধিকারভুক্ত করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।”

বনু কুতাইবার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সা’দ ইবনে মুয়াযের জখমটির হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং তিনি শাহাদাত লাভ করেন।

হাসান বাসরী (রাহ) বলেন, সা’দ খুব মোটাসোটা ও ভারী লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর লাশ বহনকারীরা তাঁকে অস্বাভাবিক রকম হালকা বোধ করে। তখন মুনাফিকদের কেউ কেউ বললো, সা’দ তো খুব ভারী ছিলেন। অথচ আমরা এত হালকা লাশ আর দেখিনি।”একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হালকা মনে হয়েছে তার কারণ এই যে, তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে তোমরা ছাড়াও অনেকে ছিল (অর্থাৎ ফেরেশতা)। আল্লাহর কসম, সা’দের রূহ পেয়ে ফেরেশতারা উল্লাসিত ও আনন্দিত হয়েছে। তার ইনতিকালে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে।”

খন্দক যুদ্ধে তিনজন মুশরিক নিহত হয়েছিল। মুনাব্বিহ ইবনে উসমান তাদের একজন। সে তীরবিদ্ধ হয় এবং আহত অবস্থায় মক্কায় গিয়ে মারা যায়। আর একজন বনু মুখযুমের নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ। সে খন্দক ডিঙ্গিয়ে এসেছিল। ধরা পড়ে নিতহ হয়। সে তীরবিদ্ধ। তার লাশ মুসলমানদের অধিকারে ছিল। মুশরিকরা তার লাশ কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার লাশ বা তার মূল্য দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তার লাশ দিয়ে দেয়া হলো। তৃতীয় ব্যক্তি ছিল বনু আমের গোত্রের আমর ইবনে আব্দ উদ। আলী ইবনে আবু তালিব (রা) তাকে হত্যা করেন।

বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযানে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে যাঁতার পাথর ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বললেন, “খাল্লাদ দু’জন শহীদের সওয়াব পাবে।” সাহাবী আবু সিনান মারা যান বনু কুরাইযাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ করার সময়। তাঁকে বনু কুরাইযার গোরস্থানে দাফন করা হয়। খন্দকের দু’পাশে সেনা সমাবেশের অবসান ঘটলে এবং কাফিররা পরিখা ত্যাগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এরপর কুরাইশরা আর কখনো তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে না বরং এরপর তোমরাই তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।”

বস্তুত তারপর কুরাইশ পক্ষ থেকে মুসলমানদের ওপর আর কোন আক্রমণ হয়নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে মক্কা বিজয়ের সুযোগ দেন।

বুন লিহইয়ান অভিযান
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুলহাজ্জ, মুহাররম, সফর, রবিউল আউয়াল ও রবিউস সানী এই ক’মাস মদীনায় অবস্থান করেন। বনু কুরাইযা বিজয়ের পর ৬ষ্ঠ মাসে জামাদিউল উলাতে তিনি বনু লিহইয়ান অভিযানে বের হন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল রাজীর অধিবাসিদের কাছে খুবাইব ইবনে আদী ও তাঁর সঙ্গীদের (রা) ফেরত চাওয়া। তিনি এমনভাবে বের হন যে, মনে হচ্ছিল তিনি সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করেছেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাজীবাসীর ওপর আক্রমণ চালানো।

মদীনা থেকে বের হয়ে তিনি মদীনার পার্শ্ববর্তী পাহাড় গুরাব হয়ে সিরিয়াগামী রাস্তা ধরে প্রথমে মাখীদ, তারপর বাতরা গমন করেন। সেখানে বাম দিকে মোড় নিয়ে মদীনার অদূরবর্তী সমভূমি ‘বীনে’র ওপর দিয়ে ইয়ামাম পর্বতমালা অতিক্রম করে মক্কাগামী রাস্তা ধরে অগ্রসর হলেন। এরপর ক্ষিপ্রগতিতে বনু লিহ্ইয়ানের আবাসভূমি ‘গুরান’ পৌছেন। গুরান হলো আমাজ ও উসফানের মধ্যবর্তী সমভূমি যা ‘সায়া’ নামক অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। গুরান গিয়ে দেখলেন, তারা আগেভাগেই সাবধান হয়ে নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেছ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরানে শিবির স্থাপন করলেন। তাঁর অতর্কিত আক্রমণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, “আমরা যদি উসফানে শিবির স্থাপন করি তাহলে মক্কাবাসী মনে করবে আমরা মক্কা যাচ্ছি।” অতঃপর তিনি দু’শ ঘোড়সওয়ার সাহাবীকে সাথে নিয়ে উসফানে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর দু’জন ঘোড়সওয়ারকে পাঠালেন। তারা কুরাউল গুমাইম পর্যন্ত পৌঁছলো। তারার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বহিনী নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, প্রত্যাবর্তনকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী এবং আমাদের প্রতিপালকের প্রশংকারী। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই সফরের দুঃখ-কষ্ট থেকে এবং পরিবার পরিজন ও ধনÑসম্পদের ক্ষতি থেকে।”


যী কারাদ অভিযান
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অল্প কয়েকদিন কাটালেন। সহসা উয়াইনা ইবনে হাসান ফযারী গাতফানীদের কতিপয় ঘোড় সওয়ারকে সাথে নিয়ে মদীনার অদূরে গাবা নামক স্থানে বিচরণরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গাভীন দুধেল উটগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তা লুট করে নেয়। এই লুণ্ঠত উটগুলোর সাথে বনী গিফার গোত্রের এক ব্যক্তি এবং তার স্ত্রীও ছিল। তারা লোকটিকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে সহ উটগুলো নিয়ে যায়।

এই লুণ্ঠনের ব্যাপারটা সর্বপ্রথম জানতে পারেন সালামা ইবনে আমর ইবনে আকওয়া। তিনি তালহা ইবনে আবদুল্লাহর গোলামকে সাথে নিয়ে তীর ধনুক সজ্জিত হয়ে গাবাতে গিয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিল একটা ঘোড়া। তিনি সানিয়াতুল ওয়াদা পাহাড়ের এক কিনারে গিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “বাচাঁও।” অতঃপর তাদেরকে অনুসরণ করে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গেলেন। হিংস শ্বাপদ যেমন শিকারের পেছনে ছোটে তিনি ঠিক তেমনিভাবে ছুটলেন। ছুটতে ছুটতে তাদেরকে ধরে ফেললেন এবং তাদেরকে লক্ষ্য করে তীর ছুরতে শুরু করলেন। প্রতিটা তীর নিক্ষেপকালে তিনি বলছিলেন, “এই লও, আমি আকওয়ার পুত্র। আজকে পাপিষ্টদেরকে খতম করার দিন।” লুণ্ঠনকারীরা যেই তাকে ধাওয়া করে অমনি তিনি সরে পড়েন এবং পরক্ষণেই আবার বেরিয়ে মুকাবিলা করতে এগিয়ে যান। এভাবে তিনি সুযোগ পেলেই তীর নিক্ষেপ করেন আর বলেন, “লও, আমি আকওয়া বেটা। আজকে পাপিষ্ঠদের খতম করার দিন।” ওদিকে লুণ্ঠনকারীরা আর্তনাদ করতে থাকে, “লোকটা দিনের প্রথমভাগেই আমাদের ওপর এমন কঠোর হয়ে উঠলো।”

সালামার চিৎকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ণগোচর হলো। তিনি চিৎকার করে ঘোষণা করলেন, “বিপদ! বিপদ!” সঙ্গে সঙ্গে বিপুলসংখ্যক সাহাবী পিঠে সওয়ার হয়ে তাঁর কাছে সমবেত হতে লাগলেন। প্রথমে মিকদাদ ইবনে আমর, তারপর আব্বাদ ইবনে বিশর, তার একে একে সা’দ ইবনে যায়িদ, উসায়েদ বিন যুহাইর, উক্কাশা ইবনে মুহসান, মুহরিদ ইবনে নাদালা, আবু কাতাদাহ হারেস ইবনে রাবয়ী ও আবু আইয়াশ তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে যায়িদের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, “লুণ্ঠনকারীদের ধাওয়া করে যেতে থাক। আমি পরে আরো লোক পাঠাচ্ছি।” সা’দ- এর বাহিনী পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের ধরে ফেললো। প্রথমেই আবু কাতাদাহ হাবীব ইবনে উয়াইনাকে হত্যা করে নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলেন এবং তারপর গিয়ে নিজের দলের লোকদের সাথে যোগ দিলেন।

কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং একদল মুসলমানকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে হাবীবকে আবু কাতাদাহ চাদরে জড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলেন। সঙ্গী সাহাবীগণ ইন্নালিল্লাহ পড়ে বলতেন, “কি সর্বনাশ! আবু কাতাদাহ নিহত হয়েছে?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, এ আবু কাতাদাহ নয়। আবু কাতাদার হাতে এ লোকটি নিহত হয়েছে। তবে সে তাকে নিজের চাদরে জড়িয়ে রেখেছে যাতে তোমরা বুঝতে পারো যে, এ তারই সঙ্গী।” উক্কাশা ইবনে মুহসান লুণ্ঠনকারীদের দু’জন- আওবার ও তার পুত্র আমরকে ধরে একসাথেই হত্যা করলেন। তারা একই উটে চড়ে যাচ্ছিল। কিছুসংখ্যাক লুণ্ঠিত উটও তাঁরা পুনরুদ্ধার করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যূ-কারাদের পাহাড়ের কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। এরপর বাদবাকী মুসলমানগণ তার কাছে কাটালেন। সালাম ইবনুল আকওয়া বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে যদি একশ’ লোক দিয়ে পাঠান আমি বাদবাকী উটগুলো ছিনিয়ে আনতে এবং লুণ্ঠনকারীদের ধরতে পারবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তারা এখন গাতফানের লোকদের কাছে রাত্রের আহার গ্রহণ করছে।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের মধ্যে প্রতি একশ’ জনে একটা উট বিতরণ করলেন এবং তা খেয়েই তাঁরা দিন অতিবাহিত করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে আসলেন।

গিফারীর স্ত্রীর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি উটে আরোহণ করে তাঁর কাছে উপনীত হলো এবং তার স্বামীর মৃত্যুর খবর জানালো। তারপর বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি মানত করেছি যে, যদি আমি এই উটের পিঠে চড়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাই তাহলে এটা আল্লাহর নামে জবাই করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “উটটাকে তুমি খুবই খারাপ প্রতিদান দিতে চেয়েছো। আল্লাহ তোমাকে তার পিঠে চড়িয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, আর তুমি কিনা তাকে জবাই করতে চাও! আল্লাহর নাফরমানীর ব্যাপারে কোন মানত চলে না। তুমি যার মালিক নও, তা দিয়ে মনত পূরণ করা চলে না। এটা আমার উট। তুমি নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যাও। আল্লাহ তাতেই তোমার কল্যাণ করবেন।”

বনু মুসতালিকের অভিযান
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাদিউস সানীর অবশিষ্টাংশ এবং রযব মাস মদীনায় অতিবাহিত করলেন। তারপর ৬ষ্ঠ হিজরীর শা’বান মাসে খাজায়া গোত্রের বনু মুস্তালিক শাখার বিরুদ্ধে অভিযান চালান।

এক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে পারলেন যে, বুন মুসতালিক গোত্র তাঁর সৈন্য সমাবেশ করছে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হারেস ইবনে আবু দিরার যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যতম স্ত্রী জুয়াইরিয়ার পিতা। এ খবর পেয়েই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্য সামন্ত নিয়ে তাদের মুকাবিলায় বেরুলেন। মুরাইসী নামক ঝর্ণার কিনারে তাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হলো। আল্লাহ বনু মুস্তালিককে পরাজিত করলেন। তাদের বহু লোক নিহত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্তান, নারী ও সম্পদ গণীমত হিসেবে গণ্য করলেন।

বনু কালব ইবনে আওফ গোত্রের হিশাব ইবনে সুবাবা নামক জনৈক মুসলিম এতে নিহত হলেন। তাঁকে শত্রুপক্ষীয় মনে করে উবাদা ইবনে সমিতের (রা) দলভুক্ত জনৈক আনসারী সাহাবী ভুলক্রমে হত্যা করেন।

ঝর্ণার কিনারে অবস্থানকালেই মুসলমানদের মধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটলো। জাহজাহ ইবনে মাসউদ নামক বনু গিফারের এক ব্যক্তিকে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর ঘোড়া রাখার জন্য মজুর হিসাবে নিয়োগ করেন। পানি নিয়ে সিনান ইবনে আবার জুহানীর সাথে তার ঝগড়া হয় এবং ক্রমে ঝগড়া মারামারিতে রূপান্তরিত হয়। তখন জুহানী চিৎকার করে ডাকলো “হে আনসারগণ, বাঁচাও।” জাহজাহও চিৎকার করে বললো, “হে মুহাজিরগণ, আমাকে বাঁচাও।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তখন তার গোত্রের একদল লোকের সাথে অবস্থান করছিল। কিশোর যায়িদ ইবনে আরকামও সেই দলের মধ্যে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই চিৎকার শুনে উত্তেজিত হয়ে বললো, তারা কি শেষ পর্যন্ত এমন কান্ড ঘটালো? ওরাতো আমাদের মাঝে থেকেই দল ভারী করে অহমিকায় মেতে উঠেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের ও মুহজিরদের অবস্থা সেই প্রবাদ বাক্যের মতই গড়াচ্ছে যে, ‘নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাসোটা বানাও, দেখবে একদিন সে তোমাকেই কেটে খাবে।’ আল্লাহর কসম, এবার যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।” তারপর তার স্বগোত্রীয়দের বলতে লাগলো, “তোমার নিজেদের কি সর্বনাশ করেছ, এখন দেখ। ওদেরকে এ দেশে ঠাঁই দিয়েছো। তোমাদের সম্পদের ভাগ দিয়েছো। ওদের প্রতি অমন বদান্যতা যদি না দেখাতে তাহলে ওরা অন্যত্র যেতে বাধ্য হতো।”

যায়িদ ইবনে আরকাম এসব কথাবার্তা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। এ সময় তিনি সবেমাত্র শত্রুকে পরাস্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তিনি যখন এই খবর শুনলেন তখন তার কাছে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দিন তাকে যমের ঘরে পাঠাক।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উমার আমি যদি তা করি তাহলে লোকেরা বলবে যে,মুহাম্মাদ নিজেই তার সহচরদের হত্যা করছে। তা করা যায় না। তবে তুমি এখনই এখান থেকে রওনা হবার নির্দেশ জানিয়ে দাও।” যে সময় এ নির্দেশ দেয়া হলো সে সময় সাধারণত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও রওনা হতেন না। তথাপি সবাই রওনা হলো।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল যখন জানতে পারলো যে যায়িদ ইবনে আরকাম তার কথাগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন, তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে গিয়ে কসম খেয়ে বলতে লাগলো, “যায়িদ যা বলেছে, আমি সেসব কথা বলিনি।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যেহেতু স্বগোত্রে খুবই সম্মানিত লোক বলে গণ্য হতে তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যেসব আনসারী সাহাবী ছিলেন তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, যায়িদ হয়তো ভুল শুনেছে এবং সে যা বলেছে তা হয়তো পুরোপুরি মনে রাখতে পারেনি।” এভাবে তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতি একটু সৌজন্য দেখালেন এবং তাকে বাঁচিয়ে দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওনা হলেন, তাঁর সাথে উসায়েদ ইবনে হুদাইস দেখা করলেন। তাঁকে সালাম ও অভিবাদন পূর্বক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি বড়ই অসুবিধাজনক সময়ে যাত্রা করেছেন। সাধারণত এরকম সময়ে আপনি কোথাও যাত্রা করেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের সঙ্গী লোকটি কি বলেছে তা শোননি?” তিনি বললেন, “কোন্ সঙ্গী?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।” উসায়েদ বললেন, “সে কি বলেছে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার ধারণা, সে যদি মদীনায় ফিরে যেতে পারে তাহলে সবলরা দুর্বলদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে।” উসায়েদ বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ইচ্ছা করলে তাকে আমরা বের করে দিতে পারি। সত্যই সে অত্যন্ত হীন ও নীচ। আর আপনি পরাক্রান্ত।” তিনি আরো বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, তার প্রতি একটু নমনীয় হোন। আল্লাহর কসম, আপনাকে আল্লাহ আমাদের এমন সময় এসে দিয়েছেন যখন তার গোত্র তাকে মুকুট পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই সে মনে করে, আপনি তার থেকে একটা রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে একদিন একরাত ধরে পথ চললেন। পথে প্রচ- রৌদ্রে তাদের অসহনীয় কষ্ট হতে লাগলো। তাই এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। লোকেরা মাটিতে নামতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। আগের দিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কথায় লোকদের ভেতর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল তা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে দেয়ার জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে অসময়ে যাত্রা করেছিলেন। বিশ্রাম শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় সদলবলে যাত্রা শুরু করলেন। হিজাজের মধ্য দিয়ে যাত্রাকালে তিনি একটি ঝর্ণার কাছ যাত্রাবিরতি করলেন। সে স্থানটার নাম বাক্য়া। সেখান থেকে পুনরায় যখন যাত্রা শুরু হলো তখন মুসলমানদের উপর দিয়ে হঠাৎ একটা কষ্টদায়ক ভীতিপ্রদ বাতাস বয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ বাতাসকে তোমরা ভয় পেয়ো না। একটা মস্তবড় কাফিরের মৃত্যু ঘটেছে। সে জন্যই এ বাতাস।” মদীনায় ফিরে দেখেন বনু কাইনুকা গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি রিফায়া ইবনে যায়িদ ঐ দিনই মারা গেছে। সে ছিল মুনাফিকদের আশ্রয়স্থল তথা কুমন্ত্রণাদাতা।

কুরআন শরীফের সূরা মুনাফিকুন ্আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মত লোকদের সম্পর্কেই যায়িদ ইবনে আরকামের কানে হাত রেখে বললেন, “এই ব্যক্তি তার কানের সাহায্যে আল্লাহর ওয়াদা পালন করেছে।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদুল্লাহ তার পিতার ব্যাপারটা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি শুনেছি, আপনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে তার বৈরী কথাবার্তার জন্য হত্যা করতে ইচ্ছুক। যদি সত্যিই আপনি ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তাহলে আমাকে নির্দেশ দিন আমি তার মাথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দিই। আল্লাহর কসম, খাযরাজ গোত্র জানে যে, ঐ গোত্রে আমার চেয়ে পিতৃভক্ত লোক আর নেই। আমার আশংকা হয় যে, আপনি আমার পিতাকে হত্যার জন্য কাউকে নির্দেশ দেবেন। আর সে তাকে হত্যা করবে, তখন আমার পিতৃহত্নাকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে হয়তো আমার প্রবৃত্তি কুপ্ররোচনা দিয়ে আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলবে। ফলে তাকে হত্যা করে আমি জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবো। কেননা সেক্ষেত্রে আমি একজন কাফিরের বদলায় একজন মু’মিনকে হত্যার দায়ে দোষী হবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না সে যতদিন আমাদের সাথে থাকে ততদিন তার প্রতি আমরা নমনীয় থাকবো এবং ভালো ব্যবহার করবো।”

এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখনই কোন অঘটন ঘটাতো, তার গোত্রের লোকেরাই তাকে শায়েস্তা করতো। তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করতো এবং পাকড়াও করতো। এই অবস্থা জেনে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) বললেন, “উমার, পরিস্থির পরিবর্তনটা দেখছো তো? তুমি যেদিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলে সেদিন যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো। কিন্তু আজ যদি তাকে হত্যার নির্দেশ দিই তাহলে সেদিন যারা নাক সিটকাতো তারাই আজ তাকে হত্যা করবে।” উমার (রা) বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি জানি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্তের চাইতে অধিক কল্যাণকর।”

যে মুসলমানকে উবাইদা ইবনে সামিত (রা) শত্রুর লোক সন্দেহে ভুলবশতঃ হত্যা করেছিলেন, সেই হিসাম ইবনে সুবাবার ভাই মিকইয়াস ইবনে সুবাবা একদিন মক্কা থেকে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে নিজের ভাইয়ের খুনের পণ দাবী করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তপণ দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। মিকইয়াস নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করেছিলো। রক্তপণ পাওয়ার পর সে অল্প কিছুদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অবস্থান করে। তারপর একদিন তার ভ্রাতৃহন্তাকে হত্যা করে ইসলাম ত্যাগ করে মক্কা চলে যায়।

ওইদিন বনু মুসতালিকের বহুলোক নিহত হয়েছিল। [৭৩. ইবনে হিশাম বলেন, বনু মুসতালিকের যুদ্ধে মুসলমানদের শ্লোগান ছিল, “হে সাহায্যপ্রাপ্ত, হত্যা কর, হত্যা কর।”] আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) হাতে মালিক ও তার পুত্রসহ বনু মুসতালিকের দু’জন লোক নিহতক হয়। আর আবদুর রহমান ইবনে আওফ হত্যা করেন অশ্বারোহী আহমার বা উহাইমিরকে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন অনেক যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক করেন। তাদেরকে তিনি মুসলমানদের মধ্যে দাসদাসীরীপে বণ্টন করে দেন। এইসব যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে একজন ছিলেন বনু মুসতালিকের গোত্রপতি হারেস ইবনে আবু দিরার দুহিতা জুয়াইরিয়া যিনি পরবর্তীকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন।

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আবহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু মুসতালিকে যুদ্ধবন্দীদেরকে বণ্টন করলে জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস সাবিত ইবনে কায়েসের ভাগে অথবা তার এক চাচাতো ভাইয়ের ভাগে পড়েন। জুয়াইরিয়া তৎক্ষণাৎ মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তিলাভের উদ্যেগ নেন। তিনি ছিলেন খুবই লাবণ্যময়ী মিষ্টি মেয়ে।

তাঁকে যেই দেখতো সে-ই মুগ্ধ হয়ে যেতো। জুয়াইরিয়া মুক্তি লাভের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সাহায্য কামনা করেন। তাঁকে আমার ঘরের দরজায় দাঁড়তে দেখেই আমি তাঁকে খারাপ মনে করি। আমি বুঝতে পারলাম যে, তাঁর যে মনোহর রূপ আমি দেখছি তা নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টি এড়াবে না। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি হারেস ইবনে আবু দিরারের কন্যা। আমার পিতা গোত্রের সরদার। আমি কি বিপদে পড়েছি তা আপনার অজানা নয়। আমি সাবিত ইবনে কায়েস Ñ অথবা তার চাচাতো ভাইয়ের ভাগে পড়েছি। আমার মুক্তিপণ আদায়ে আপনার সাহায্য কামনা করছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি যদি তোমার জন্য আরো ভালো কিছুর ব্যবস্থা করি?” তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, সেটা কি?” তিনি বললেন, “আমি তোমার পক্ষ হতে মুক্তিপণ আদায় করে দিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো।” জুয়াইরিয়া বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, “আমি এতে রাজী আছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি তাই করলাম।”মুসলমানগণ যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুয়াইরিয়াকে বিয়ে করেছেন তখন তাঁরা তাঁদের হাতে বন্দী বনু মুসতালিকের সব লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয় বিবেচনা করে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এভাবে বনু মুস্তালিকের একশ’ বন্দী শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জুয়াইরিয়ার বিয়ে হওয়ার কারণে মুক্তিলাভ করলো। সত্যি বলতে কি নিজ গোত্রের জন্য জুয়াইরিয়ার চেয়ে কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে এমন কোন মহিলার কথা আমার জানা নেই।

ইয়াজীদ ইবনে রোমান বলেন, বনু মুসতালিক গোত্র ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ালীদ ইবনে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকে তাদের কাছে প্রেরণ করেন। তাঁর আগমনের খবর শুনে গোত্রের বহু অশ্বারোহী তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলো। এদিকে ওয়ালীদ এসব দেখে ভয় পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গিয়ে বললেন যে, গোত্রের লোকেরা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে এবং তাদের দেয় যাকাত আনতে দেয়নি। এতে মুসলমানগণ বনু মুসতালিককে আক্রমণ করার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক এই সময় বনু মুস্তালিকের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি আমাদের কাছে দূত পাঠিয়েছেন শুনে আমরা তাকে অভ্যর্থনা করতে এবং আমাদের দেয় যাকাত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ত্বরিত গতিতে ফিরে এলেন। পরে শুনলাম, তিনি আপনাকে বলেছেন যে, আমরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলাম। আল্লাহর কসম, আমরা সে জন্য আসিনি।” এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ সূরা হুজুরাতের এ আয়াত দু’টি নাযিল করেন।

“হে মুমিনগণ, তোমাদের কাছে কোন ফাসিক ব্যক্তি কোন খবর নিয়ে এলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখো যাতে অজান্তে কোন গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হ’য়ে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও। আর জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রয়েছেন। তিনি যদি অনেক ব্যাপারে তোমাদের মত অনুসরণ করেন তাহলে তোমরা মুসিবতে পড়ে যাবে। ……….”

এই সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আয়িশা (রা) ও ছিলেন। তাঁকে নিয়ে তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করছিলেন, তখন মদীনার কাছাকাছি এক জায়গায় এলে একদল মুসলমান আয়িশার (রা) ওপর অপবাদ করে বসে।

৬ষ্ঠ হিজরী সনে বনু মুসতালিক অভিযানকালে অপবাদের ঘটনা
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই সফরে যেতেন, তখনই কোন স্ত্রী তাঁর সাথে যাবেন তা নিয়ে লটারী করতেন। যার নামে লটারী উঠতো তিনি তাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বনু মুসতালিক অভিযানকালেও তিনি যথারীতি লটারী করলেন এবং তাতে আমার নাম উঠলো। তাই তিনি আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন।

তৎকাল মেয়েদের মধ্যে স্বল্পহারের প্রচলন ছিল। তাই শরীরের গোশত স্ফীত হয়ে ওজন বেড়ে যেতো না। সফরকালে আমার উট যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে আমি হাওদায় বসতাম। লোকজন এসে হাওদা উঠিয়ে পিঠে স্থাপন করতো এবং তা রশি দিয়ে উটের পিঠে বেঁধে দিতো। এরপর যাত্রা শুরু হতো।

বনু মুসতালিক অভিযান শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাবর্তনকালে মদীনার নিকটে এসে এক জায়গায় একরাত কাটালেন। তারপর আবার যাত্রার ঘোষণা হলে সদলবলে যাত্রা শুরু হলো। এই সময় আমি প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার গলায় একটা ইয়ামানী মুক্তার মালা ছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরে আসার পর আমি দেখলাম যে, সেই হার আমার গলায় নেই। কখন যে তা পরে গেছে আমি মোটেই টের পাইনি। অগত্যা আমি তা খুঁজতে আবার কাফিলা থেকে বেরিয়ে যেখানে প্রকৃতির ডাকে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। ইতিমধ্যে কাফিলা যাত্রার আয়োজন করলো। আমি হারটি খুঁজে পেলাম। যারা আমার উটের হাওদা উঠায় তারা ্আমার উটের কাছে এসে যথারীতি হুদাটা উঠিয়ে দিল। ততক্ষণে তাদের যাত্রার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তারা যখন হাওদা উঠালো, তখন ভাবলো আমি যথারীতি হাওদার ভেতরেই আছি। তাই তারা হাওদা উঠিয়ে তা উটের সাথে বেঁধে দিল। আমার হাওদার অবস্থান সম্পর্কে তাদের মোটেই সন্দেহ হলো না। তারপর তারা উট হাঁকিয়ে যাত্রা করলো। আমি হার কুড়িয়ে নিয়ে যখন কাফিলায় রাত্রি যাপন স্থানে ফিরে এলাম তখন ময়দান ফাঁকা। সেখানে কেউ নেই। সমগ্র কাফিলা রওনা হয়ে গেছে। অনন্যোপায় হয়ে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঐ স্থানেই শুয়ে রইলাম। ভাবলাম আমার অনুপস্থিতি দেখলে তারা অবশ্যই আমার খোঁজে ফিরে আসবে। আমি তখনো শুয়ে আছি। দেখলাম সাফওয়ান ইবনে মুয়াল্লাল সুলামী আমার কাছ দিয়ে যাচ্ছে। সেও কোন প্রয়োজনে কাফিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সে কাফিলার সাথে রাত যাপনও করেনি। দূর থেকে আমাকে দেখে সে এগিয়ে এলো এবং আমার আছে এসে দাঁড়ালো। পর্দার হুকুম নাযিল হবার আগে সে আমাকে দেখেছিল। সে আমাকে দেখেই বলে উঠলো, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এ যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী।” আমি তখনো কাপড়ে আবৃত। সে বললো, “আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি কিভাবে পেছনে পড়লেন?” আমি তার সাথে কোন কথা বললাম না। অতঃপর সে উট এগিয়ে দিয়ে বললো, “আরোহণ করুন।” সে একটু দূরে সরে গেল। আমি উটের পিঠে সওয়ার হলাম। আর সে উটের মাথা ধরে কাফিলার দিকে দ্রুত এগিয়ে চললো। এবাবে সকাল হলো। লোকজন এক জায়গায় বিশ্রাম করছিলো। এমন সময় সে আমাকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে হাজির হলো। এই দৃশ্য দেখেই অপবাদ আরোপকারীরা অপবাদ রটালো। মুসলমানদের মধ্যে তা নিয়ে চাঞ্চল্য ও হুলস্থ’ল পড়ে গেল। কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারলাম না। মদীনায় পৌঁছেই আমি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি তখনো ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি না। কথাটা ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আমার পিতা-মাতার কানেও গেল। তাঁরাও আমাকে এর বিন্দুবিসর্গ জানতে গিলেন না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলাম। আমার প্রতি আগের মত সহৃদয় ব্যবহার তাঁর কমে গেল। কখনো অসুস্থ হলে তিনি আমাকে আদর সোহাগ করতেন। কিন্তু এবারের অসুস্থতায় তিনি তা করলেন না। এটা আমার কাছে খুব ভাল লাগলো না। আমার পরিচর্যার জন্য আমার মা কাছে ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে তিনি আমার কাছে এসে শুধু বলতেন, “কেমন আছ?” এর বেশি একটা কথাও তিনি বলতেন না। এতে আমি খুবই মনোকষ্ট পোহাচ্ছিলাম। তাঁর এ নিরস ও হৃদয়হীন আচরণ দেখে একদিন আমি তাঁকে বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি আমার মার কাছে চলে যাই। তিনি আমার পরিচর্যা করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়ে বললেন, “যেতে পার, কোন বাধা নেই।”

আমি মার কাছে চলে গেলাম। তখনো আমি রটনা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। বিশ দিনেরও বেশি রোগে ভুগে আমি জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেলাম।

আমরা ছিলাম আরব। অনারবদের মত আমাদের বাড়ীতে পায়খানা বানাতাম না। এসব আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। আমরা নারীরা খোলা ময়দানে গভীর রাত্রে গিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতাম। আমি কোন এক রাত্রে আবদুল মুত্তালিব তনয় আবু রেহেমার কন্যা উম্মে মিসতাহর সাথে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গিয়েছিলাম। আমার সাথে চলতে গিয়ে এই মহিলা হঠাৎ নিজের গায়ের কম্বলে পা জড়িয়ে হোঁচট খেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “কপাল পুড়–ক মিস্তাহর।” আমি বললাম, “ছি! ছি! এ আপনি কি বলেছেন, এমন একজন মুহাজিরের নামে এমন কথাÑ যিনি বদরের যুদ্ধে শরীক হয়েছেন?” তিনি বললেন, “ওহে আবু বাক্রের মেয়ে, তুমি কি ওর ব্যাপারে কিছু শোন নি?” আমি বললাম, “কিসের ব্যাপার?” তখন তিনি আমাকে রটিত অপবাদের কথা জানালেন। আমি বললাম, “এ রটনায় কি মিসতাহও যোগ দিয়েছিল?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, ও ছিল।”

আয়েশা বলেন: একথা শোনার পর আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। ঘরে ফিরে এলাম এবং কাঁদতে লাগলাম। কান্নার চোটে আমার কলিজা বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মাকে বললাম, “আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। লোকেরা যা বলার তাতো বলেছেই। কিন্তু আপনি যে তাঁর বিন্দুমাত্রও আমাকে জানালেন না। ব্যাপার কি?” মা বললেন, “মা, ব্যাপারটা তুমি হালকাভাবে নাও। কোন মেয়ে যদি সুন্দরী হয়ে এবং তার স্বামী যতি তাকে খুব ভালবাসে আর তার যদি সতিনও থাকে, তাহলে পুরুষ এবং স্ত্রী নির্বিশেষে সবাই তাকে পেয়ে বসে। তার বিরুদ্ধে এন্তার রটনায় লিপ্ত হয়।”

ইতিমধ্যে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। এই ভাষনের কথাও আমি জানতাম না। তিনি ভাষনের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর বললেন, “হে লোকজন! কিছু লোক আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিচ্ছে? তাদের ব্যাপারে অসত্য কথা বলছে. অথচ আমি আমার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে ভাল ছাড়া মন্দ কিছু জানি না। আর এমন একটি লোক সম্পর্কে অপবাদ রটানো হচ্ছে যার সম্পর্কেও আমি ভাল ধারণা পোষণ করি। আমার অনুপস্থিতিতে সে কখনো আমার ঘরে প্রবেশ করে না।”

আয়িশা বলেন: এই অপবাদ রটনার প্রধান ও নেপথ্য নায়ক ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল। খাযরাজ গোত্রের কিছু লোকও তার সহযোগী ছিল। মিসতাহ ও হামনা বিনতে জাহাশ (উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিনতে জাহাশের বোন) যেটুকু বলেছিল ঐ মুনাফিক দল তাকে অতিরঞ্জিত করে তুলেছে। হামনার বোন যায়নাব বিনতে জাহাশ রাসূলুল্লাহ অন্যতমা স্ত্রী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র যায়নাবকে আমার সমান মর্যাদা দিতেন। অথচ যায়নাব আমার সম্পর্কে একটিও খারাপ কথা বলেননি। আল্লাহ তাকে সততার উচ্চতম মানে বহাল রেখেছিলেন। কেমল হামনা বিনতে জাহাশই অপবাদ রটনায় অংশগ্রহণ করে। এমনকি সে তার বোনের জন্য আমার সাথে বাকবিত-াও করতো। তার এ আচরণে আমি খুবই বিব্রত ছিলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত ভাষণ দিলে উসায়েদ ইবনে হুদায়ের বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, অপবাদ আরোপকারীরা যদি আওস গোত্রের লোক হয় তাহলে আমরাই তাদের শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি খযরাজের লোক হয় তাহলে আমাদেরকে আপনি যে নির্দেশ দিতে চান, দিন। আল্লাহর শপথ, এ ধরনের লোকেরা হত্যার যোগ্য।” সাদ ইবনে উবাদকে ভাল লোক বলেন মনে হতো। একথা শুনে সে বললো, “মিথ্যা কথা, আমরা তাদেরকে হত্যা করবো না। তারা খাযরাজ গোত্রের লোক, তাই তুমি এ কথা বলছো। তোমার গোত্রের লোক হলে একথা বলতে না।” উসায়েদ বললেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। আসলে তুমি একজন মুনাফিক। তাই মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো।”

আয়িশা (রা) বলেন: এরপর দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল। আওস ও খাযরাজ ্ও দুই গোত্রে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ারও আশংকা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে আলী (রা) ও উসামা ইবনে যায়িদকে (রা) ডেকে পরামর্শ করলেন। উসামা আমার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার স্ত্রী? তার সম্পর্কে আমি ভাল ছাড়া কিছু জানি না। এটা একটা মিথ্যা ও অলীক অপবাদ।” আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, স্ত্রীলোকের অভাব নেই। আপনি ইচ্ছা করলে একজন স্ত্রীর হলে আর এক স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারেন। তবে দাসীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। সে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবে।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশার পরিচারিকা বারীরাকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য ডাকলেন। সে এলে আলী (রা) তাকে ভীষণভাবে প্রহার করলেন। তারপর বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সত্য কথা বলবি।” বারীরা বললো. “আল্লাহর শপথ! আয়িশাকে আমি সচ্চরিত্র বলেন জানি। তার মধ্যে কোন দোষই আমি দেখতে পাইনি। তবে শুধু এতটুকুই পেয়েছি যে, আমি গম পিষে আটা বানিয়ে আয়িশাকে তা হিফাজত করতে বলি। কিন্তু কখনো কখনো সে আটার কথা ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ছাগল এসে তা খেয়ে ফেলে।”

আয়িশা (রা) বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তখন আমার পিতামাতা আমার কাছেই বসেছিলেন। আমার কাছে তখন জনৈকা আনসারী মহিলা উপবিষ্টা। আমি কাঁদছিলাম আর আমার সাথে এ মহিলাও কাঁদছিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে বসে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, “আয়িশা, লোকেরা যা বলেছে সে ধরনের কোন খারাপ আজ যদি করে থাক তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওবাহ কবুল করে থাকেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটুকু শুনতেই আমার অশ্রু থেমে গেল। তাঁর উপস্থিতি যেন আমি আর অনুভবই করতে পারলাম না। পিতামাতা আমার পক্ষ থেকে তাঁকে জবাব দেবেন বলে আশা করছিলাম। কিন্তু তাঁরা কোন কথাই বললেন না। আল্লাহর শপথ, আমি নিজেকে কখনো এতটা মর্যাদাবান বলে ভাবিনি যে, আল্লাহ আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত নাযিল করবেন, যা মসজিদে মসজিদে তিলাওয়াত করা হবে এবং নামাযে পড়া হবে। আমি শুধু এতটুকুই আশা করছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে কিছু দেখানো হবে যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আমার ওপর আরোপিত অপবাদ খ-ন করে দেবেন। কেননা আল্লাহ তো জানেন না যে আমি নির্দোষ। স্বপ্ন না হোক, মামুলীভাবে একটা খবর হয়তো আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দেবেন। কিন্তু কুরআনে অঙ্গীভূত যে ওহী, আমার হয়তো সম্পর্কে তা নাযিল হবে তা নাযিল হবে আল্লাহর কসম, আমি নিজেকে এতটা মর্যাদাবান কখনো ভাবিনি।

পিতামাতাকে নিরুত্তর দেখে আমি তাঁদেরকে বললাম, “আপনারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোন জবাব দিলেন না?” তাঁরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, জবাব দেবার মত কোন কিছু আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।” বস্তুত সেই দিনগুলোতে আবু বাকরের (রা) পরিবার যেরূপ সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, অতবড় সংকটে আর কোন পরিবার কখনো পড়েছে বলে আমার জানা নেই।

পিতামাতাকে আমার ব্যাপারে নীরব থাকতে দেখে আমার গ-দেশ পুনরায় চোখের পানিতে ভভসতে লাগলো এবং আমি কাঁদতে লাগলাম। আমি বললামি, “আল্লাহর শপথ! আপনি যে গুনাহর কথা বলছেন সেজন্য আমি কখনো তাওবাহ করবো না। আমি জানি, লোকেরা যা রটিয়ে বেড়াচ্ছে তা যদি স্বীকার করি তাহলে এমন বিষয় স্বীকার করে নেয়া হবে যা আমার দ্বারা আদৌ সংঘটিত হয়নি। স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষী যে, আমি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর আমি যদি তা অস্বীকার করি তাহলে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না।” আয়িশা বলেন: অতঃপর আমি ইয়াকুব আলাইহিস সাল্লামের নাম স্মরণ করতে চেষ্ট করলাম। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। অগত্যা বললাম, “ইউসুফ আলাইহিস সাল্লামের পিতা যে কথা বলেছিলেন আমি সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করবোÑ ‘পূর্ণ ধৈর্য অবলম্বনই সুন্দর পন্থা।’ তোমরা যা বর্ণনা করছো সে ব্যাপারে আল্লাহই (আমার) একমাত্র সহায়।” এ কথা বলার পরই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহীর লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠলো। তাঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো এবং তাঁর মাথার নিচে বালিশ দিয়ে রেখে দেয়া হলো। আমি দৃশ্য দেখে সম্পূর্ণ নির্বিকার, বেপরোয়া ও নির্ভীক রইলাম। আমি জানতাম যে, আমি নির্দোষ। আল্লাহ আমার ওপর যুলুম করতে পারেন না। পক্ষান্তরে আমার পিতা মাতার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। যদি ওহীর দ্বারা রটিত অপবাদটি সত্য বলে ঘোষিত হয়, সেই ভয়ে তাঁদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো।

আয়িশা (রা) বলেন: কিছুক্ষণ পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাভাবিক হয়ে বসলেন। সেই প্রচ- শীতের দিনেও তাঁর গা দিয়ে মুক্তার দানার মত ঘাম পড়ছিলো। তিনি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “আয়িশা তোমার জন্য সুসংবাদ! আল্লাহ তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেছেন।” আমি বললাম, “আল্লাহর শোকর ও প্রশংসা।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে গিয়ে মুসলিম জনগণকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিলেন এবং কুরআনের যে আয়াতগুলো ঐ ব্যাপরে নাযিল হয়েছে তা তাদের পড়ে শোনালেন। তারপর মিসতাহ ইবনে উসামা, হাসসান ইবনে সাবিত ও হামনা বিনতে জাহাশের ক্ষেত্রে অপবাদ রটনার শাস্তি কার্যকর করলেন। কারণ তারা এই অপবাদের অন্যতম রটনাকারী ছিলেন।

ইবনে ইসহাক বনু নাজ্জারের কিছু লোকের উদ্ধৃতি দিযে বলেনঃ

আবু আইযুুব খালিদ ইবনে যায়িদকে তার স্ত্রী উম্মে আইয়ুব বলেছিলেন, “আয়িশা সম্পর্কে যা রটানো হচ্ছে, তুমি কি তা শুনেছো?” আবু আইয়ুব বললেন, “হ্যাঁ, শুনেছি। সে তো মিথ্যা কথা। উম্মে আইয়ুব, এ রকম কাজ কি তুমি করতে পারতে?” উম্মে আইয়ুব বললেন, “কখনো না।” আবু আইয়ুব বললেন, “আল্লাহর শপথ, আয়িশা তো নিঃসন্দেহে তোমার চেয়েও ভালো।”

আয়িশা বলেন: কুরআনে এই অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে যে কয়টি আয়াত নাযিল হয়, তার কয়েকটি এই, “যারা এই মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছে তারা তোমাদেরই একটি গোষ্ঠী। এ ঘটনাকে তোমরা নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না। আসলে এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। এই গোষ্ঠীর মধ্যে যে যেটুকু পাপ করেছে তার ফল সেই ভোগ করবে। আর তাদের মধ্যে যে এই অপকর্মের বেশীরভাগ দায়িত্ব নিয়েছে তার জন্য তো বিরাট আযাব রয়েছে।” (এ আয়াতে হাসসান ইবনে সামিত ও তাঁর সহযোগীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা অপবাদ রটনায় অংশ নিয়েছিলেন।) “তোমরা যখন কথাটা শুনেছিলে তখন মু’মিন স্ত্রী পুরুষেরা নিজেদেরই লোক সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলো না কেন? (অর্থাৎ আবু আইয়ুব ও তার স্ত্রীর মত) যখন তোমরা মুখ থেকে মুখে কথাটা গ্রহণ করছিলো এবং যা জানো না তাই রটিয়ে বেড়াচ্ছিলে, আর এসে একটা হালকা জিনিস মনে করছিলে। অথচ আল্লাহর কাছে তা ছিল একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।”

আয়িশা (রা) ও তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের সম্পর্কে এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর আবু বাক্র (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, মিসতাহ যখন এমন জঘন্য অপবাদ আয়িশার বিরুদ্ধে রটিয়েছে তখন তার ভরণ-পোষণের ভার আমি আর বহন করবো না এবং তার বিন্দুমাত্রও উপকার করবো না। ” উল্লেখ্য যে, মিসতাহ তার একজন দরিদ্র আত্মীয় ছিল এবং তিনি তার ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্বাহ করতেন।

আবু বাক্রের এই প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে নাযিল হলো, “তোমাদের মধ্যে যারা সচ্ছল ও অনুগ্রাহক তারা যেন আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র ও আল্লাহর পথে হিজরাতকারীদের প্রতি বদান্যতা না দেখানোর প্রতিজ্ঞা না করে। তারা যেন ক্ষমা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমদেরকে ক্ষমা করুন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।” আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াত শুনে তৎক্ষণাৎ বললেন, “হ্যাঁ, আমি চাই আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।” ্অতঃপর তিনি মিসতাহর ভরণ-পোষণের ভার পুনরায় গ্রহণ করেন এবং আর কখনো এ দায়িত্ব ত্যাগ করবেন না বলে শপথ নেন।

ইবনে ইসহাক বলেন: আয়িশার (রা) প্রতি অপবাদ আরোপের জন্য হাসসান ইবনে সাবিতের যে শাস্তি হয় মুসলমানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি সে সম্পর্কে নিম্নরূপ কবিতা আবৃত্তি করেন,

“হাসসান সমুচিত শাস্তি পেয়েছে। আর হামনা এবং মিসতাহও।

কেননা তার অশ্লীল কথা বলেছিল।

তাদের নবীর মহিষী সম্পর্কে আনুমানিক উক্তি করে এবং তাঁকে দুশ্চিন্তগ্রস্ত করে

তারা আরশ অধিপতির ক্রোধের শিকার হয়েছিল।

তারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছিল, চিরস্থায়ী গ্লানিকর অপপ্রচারণাকে গুরুত্ব

দিয়ে চারদিকে ছড়িয়েছিল এবং অপমানিত করেছিল।

(ফলে) রটনাকারীদের ওপর শাস্তির দ- মুষলধারে

বৃষ্টি বর্ষণের মত বর্ষিত হতে লাগলো।”

হুদাইবিয়ার ঘটনা (৬ষ্ঠ হিজরী সন)

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় রমযান ও শাওয়াল মাস অতিবাহিত করলেন। যুলকাদাহ মাসে উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। কোন যুদ্ধ করার অভিসন্ধি তাঁর ছিল না। [৭৪. ইবনে হিশামের মতে, এই সময় মদীনার শাসনভার অর্পণ করা হয় নামীলা ইবনে আবদুল্লাহ লাইসীর ওপর।] মদীনার অধিবাসী সাধারণ আরব এবং আশপাশের মরুচারী বেদুইনদেরকেও তিনি তাঁর সফরসঙ্গী করে নিলেন। তিনি আশংকা করছিলেন যে, কুরাইশরা চিরাচরিত পন্থায় তাঁকে হয় আল্লাহর ঘর যিয়ারতে বাধা দেবে, অথাবা যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসবে। এ আশংকার কারণে যারা সফরসঙ্গী হতে চেয়েছিল তাদের অনেকেই যাত্রা স্থগিত রাখলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদবাকী আরব, মুহাজির ও আনাসারদের নিয়ে যাত্রা করলেন। সঙ্গে কুরবানীর উটের বহরও নিয়ে চললেন এবং উমরার ইহরাম বেঁধে নিলেন।[৭৫. ৭০ টি উট সঙ্গে নিয়েছিলেন। উমরা যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৭০০। প্রতি দশজনের জন্য একটি উট নেয়া হয়েছিল।] যাতে কুরাইশরা তাঁর তরফ থেকে যুদ্ধের আশংকা না করে এবং তিনি যে শুধুমাত্র আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়েছেন বুঝতে পারে।

তিনি মক্কার কাছাকাছি উসফানে পৌঁছলে তাঁর সাথে বিশর ইবনে সুফিয়ান কা’বীর দেখা হলো। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, নিকটেই কুরাইশ বাহিনী সমবেত হয়েছে। তারা আপনার যাত্রার কথা শুনে বিরাট উটের বহর নিয়ে আপনার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা আগেই যুতুয়াতে সমবেত হয়েছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে, আপনাকে কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে তারা কুরাউল গামীমে [৭৬.যুতুয়া মক্কার নিকটবর্তী একটি জায়গা। কুরাউল গামীম উসফান থেকে ৮ মাইল আগে অবস্থিত একটি উপত্যকা।] এগিয়ে এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ধিক কুরাইশদেরকে! জঙ্গী মনোভাব তাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমাকে গোটা আরববাসীর সাথে একটু বুঝাপড়া করার সুযোগ দিলে ওদের অসুবিধা কোথায়? আরবরা যদি আমাকে পর্যুদস্ত করে তাহলে তাতে কুরাইশদের মনষ্কামনাই পূর্ণ হবে। আর যদি আল্লাহ আমাকে আরবদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করেন তাহলে সবাই ইসলামে আশ্রয় পাবে। যদি তারা ইসলাম কবুল নাও করে তা হলেও তারা আরো অধিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে। কুরাইশরা ভেবেছে কি? আল্লাহর কসম, শেষ পর্যন্ত জিহাদ করে যাবোÑ হয় এ বিধান জয়যুক্ত হবে, না হয় আমি শেষ হয়ে যাবো।”

অতঃপর তিনি বললেন, “এমন কেউ কি আছ যে আমাদেরকে কুরাইশরা যে পথে সমবেত হয়েছে তা থেকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারবে।” অতঃপর সেই ব্যক্তি দুর্গম পার্বত্য পথ দিয়ে তাদের নিয়ে গেল। এ অভিযানটা মুসলমানদের জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। অবশেষে তারা উপত্যকার প্রান্তে সমভূমিতে গিয়ে উপনীত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানগলকে বললেন, তোমরা বল, “আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাওবা করি।” সবাই তাই বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এই কথাটাই মূসা (আ) বনী ইসরাঈলদের বলতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা তা বলতে রাজী হয়নি।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে ডান দিকে জামজের ভিতর দিয়ে সানিয়াতুল মুরার অভিমুখে মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত হুদাইবিয়ার উপত্যকায় গিয়ে উপনীত হবার নির্দেশ দিলেন। মুসলিম বাহিনী নির্দেশ মুতাবিক যাত্রা করলো। কুরাইশদের অগ্রবর্তী ঘোড়সাওয়ার দল ভিন্নদিক থেকে মুসলিম সেনাদলের অগ্রাভিযান লক্ষ্য করে বিদ্যুগ বেগে কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে সানিয়াতুল মুরারে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানেই তাঁর উট থেমে গেল। লোকেরা বললো, “উট থেমে গেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উট থামেনি এবং থামা তার রীতি নয়। তবে যে জিনিস আবরাহার হস্তিবাহিনীকে থামিয়ে রেখেছিল, সেই জিনিসই ওকে মক্কা যাত্রা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে। আজকে কুরাইশরা আমাকে রক্তের বন্ধনের দোহাই দিয়ে যে প্রস্তাবই দেবে আমি তা মেনে নেব।” অতঃপর তিনি সহযাত্রীদের যাত্রাবিরতি করতে বললেন। সবাই বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এখানে মোটেই পানি নেই। কিভাবে আমরা এখানে যাত্রাবিরতি করবো?” তিনি একটি তীর বের করে একজন সাহাবীর হাতে দিয়ে একটি শুকনো কুয়ার ভেতরে তা নিক্ষেপ করতে বললেন। তিনি তীর নিক্ষেপ করলে কুয়া পানিতে ভরে উঠলো এবং মুসলমানরা সেখানে যাত্রাবিরতি করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করলে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা খাযায়া গোত্রের কয়েকজন লোকজন তাঁর কাছে এলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাপ আলোচনা করলো। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন?” তিনি জানালেন, তিনি কোন যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্যে আসেননি। বরং শুধু পবিত্র কা’বার যিয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এসেছেন। তিনি বিশর বিন আবু সুফিয়ানকে যেকথা বলেছিলেন তাদেরকও তাই বললেন। তারা ফিরে গিয়ে কুরাইশদের বললো, “হে কুরাইশগণ, তোমরা মুহাম্মাদের ব্যাপারে খুবই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক। আসলে তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি। কা’বাঘর যিয়ারত করতে এসেছেন মাত্র।”

একথা শুনে কুরাইরা তাদের ওপর উল্টো দোষারোপ করলো এবং অপ্রীতিকর কথাবার্তা শুনিয়ে দিল। তারা বললো, “যদি সে যুদ্ধ করতে না এসে থাকুক তবুও তাকে আমরা কখনো জবরদস্তিমূলকভাবে মক্কায় প্রবেশ করতে দেব না। সাধারণ আরবরাও একথা জানে যে, মক্কাবাসী কখনো কাউকে এ শহরে জোরপূর্বক ঢুকতে দেয়নি।”

খাযায়া গোত্রের মুসলমান ও মুশরিক নির্বিশেষে সকলেই ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের পরম হিতাকাংখী ও তাঁর সকল গোপনীয় বিষয়ের সংরক্ষক। মক্কায় যাই ঘটুক তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তা গোপন করতো না।

কুরইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মিকরায ইবনে হাফ্স ইবনে আখইয়াফকে পাঠালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিকরাযকে আসতে দেখে দূর থেকেই মন্তব্য করলেন, “এ লোকটি বিশ্বাসঘাতক।” সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে আলাপ আলোচনা করলে তিনি বুুদাইল ও তার সঙ্গীদের যা বলেছিলেন, মিকরাযকেও তাই বললেন। সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তাই জানালো।

এরপর কুরাইশরা হুলাইস ইবনে আলকামা অথবা ইবনে যাবানকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পাঠালো। তাকে দেখেই তিনি মন্তব্য করলেন, “এ লোকটি একটি খোদাভক্ত জাতির সদস্য। আমদের কুরবানীর পশুগুলো তার সামনে নিয়ে দেখিয়ে দাও।” হুলাইস যখন দেখলো, কুরবানীর চিহ্ন বহনকারী বিশাল উটের পাল তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে এবং দীর্ঘদিন কুরবানীর জায়গায় পৌঁছতে না পারার কারণে ওগুলোর গায়ের পশম ঝরে পড়েছে তখন সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে যা দেখেছে তা বর্ণনা করলো। কুরবানীর পশুগুলো দেখে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উমরার উদ্দেশ্যেই এসেছেন সে ব্যাপারে তার আর কোন সন্দেহই রইল না এবং সেজন্য তাঁর সাথে দেখা করে জিজ্ঞসাবাদ করার প্রয়োজনই বোধ করলো না। তার কথা শুনে কুরাইশরা বললো, “তুমি চুপ করে বস। তুমি মূর্খ বেদুইন, কি বুঝবে?” একথা শুনে সে রেগে গেল। সে বললো “হে কুরাইশগণ! এ ধরনের কার্যকলাপের জন্য আমরা তোমাদের সাথে জোটবদ্ধ হইনি এবং এর জন্য তোমাদের সাথে চুক্তিও সম্পাদন করিনি। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর যিয়ারত ও তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য এসেছে তাকে কি বাধা দেয়া হবে? আমি শপথ করে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, মুহাম্মাদ যে প্রবিত্র উদ্দেশ্যে এসেছে তা যদি তাকে করে যেতে না দাও তাহলে গোত্রের সকল লোককে নিয়ে আমি একযোগে তোমাদের ত্যাগ করে চলে যাবো।” তার বললো,“হুল্লাইস, একটু থামো! আমাদের একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে দাও।”

এরপর কুরাইশরা উরওয়াহ ইবনে মাসউদ সাকাফীকে রাসূলুল্লাহর নিকট পাঠালো। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে বসে পড়লো। বললো, “হে মুহাম্মাদ, তুমি কি তোমার আপনজনদের জব্দ করার জন্য এই বিরাট জনতাকে জমায়েত করেছ? তবে জেনে রেখো, কুরাইশরাও তাদের দুর্বল উটের বহর নিয়ে সিংহের বেশ ধারণ করে মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তোমাকে বলপ্রয়োগে নগরে ঢুকতে কখনোই দেবে না। আল্লাহর শপথ, অতি শীগ্রই এইসব লোক তোমাকে একাকী রেখে আলাদা হয়ে যাবে।” আবু বাক্র সিদ্দিক (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে বসে এসব কথা শুনছিলেন। তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেন, “তুই গিয়ে লাতের অংগ চাট। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছেড়ে চলে যাবো ভেবেছিস?” উরওয়াহ বললো, “এই লোকটি কে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ হচ্ছে আবু কুহাফার পুত্র। ” উরওয়াহ আবু বাক্রকে (রা) লক্ষ্য করে বললো, “এক সময় তুমি আমার উপকার করেছিলে তা নাহলে আজ তুমি যে কথা বললে তার প্রতিশোধ নিতাম। সেই উপকারের বদলায় এটা ছেড়ে দিলাম।” এরপর উরওয়াহ কথা বলতে বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়ি নাড়াচাড়া করতে লাগলো। এই সময় মুগীরা ইবনে শ’বা (রা) তরবারী হাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উরওয়াহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাড়িতে হাত দিলেই মুগীরা তরবারী দিয়ে তার হাতে টোকা দেন আর বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে হাত দিও না। নচেৎ এই তরবারী তোমার ঘাড়ে পড়বে।” উরওয়াহ বললো, “ধিক তোমাকে। কি কর্কশ ও কঠিন হৃদয় তুমি।“ এ দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। উরওয়াহ জিজ্ঞেস করলো, “হে মুহাম্মাদ, এ লোকটা কে?” তিনি বললেন, “সে তোমার ভাতিজা মুগীরা ইবনে শু’বা।” (মুগীরা ও উরওয়াহ উভয়েই বনু সাকীফ গোত্র থেবে উদ্ভুত) উরওয়াহ বললো, “রে নিমকহারাম, এই সেদিনই তো আমি তোর কত বড় উপকারটা করলাম।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উরওয়ার সাথে কথাবার্তা বললেন। তাকে জানালেন যে, তিনি যুদ্ধ করতে আসেননি।[৭৭.ইবনে হিশাম বলেন, মুগীরা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বনু সাকীফের বনু মালিক পরিবারের ১৩ জন লোককে খুন করেছিলেন। ফরে উভয় পবিারের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন বনু মালিককে ১৩টি মুক্তিপণ দিয়ে মুদীরাকে অব্যাহতি লাভে সাহায্য করে এবং উভয় পরিবারের মধ্যে আপোষরফার ব্যবস্থা করে। এখানে উরওয়া সেই ঘটনার দিকেই ইংগিত দিয়েছে।]

উরওয়াহ ইবনে মাসউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বিদায় নিল। সে দেখে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা তাঁকে কত ভক্তি ও তা’যীম করে। তিনি অযু করলে অযুর পানি নেয়ার জন্য, থু থু ফেললে তা নেয়ার জন্য এবং চুল পড়লে তা পাওয়ার জন্য সবাই প্রতিযোগিতা ও কাড়াকাড়ি করে। কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে সে বললো, “হে কুরাইশগণ! আমি পারস্য সম্রাট কিসরাকে, রোম সম্রাট সিজারকে এবং আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজাশীকে তাদের সমকালো রাজকীয় পরিবেশে দেখেছি। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদকে তাঁর সাহাবীরা যেরূপ ভক্তিশ্রদ্ধ করে তেমন আর কোন রাজাকে আমি প্রজাদের এরূপ ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র হতে দেখিনি। কোন কিছুর বিনিময়েই তারা মুহাম্মাদকে শত্রুর মুখে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে প্রস্তুত নয়। এমতবস্থায় তোমরা যা ভালো মনে কর করতে পার।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খিরাস উমাইয়া খাযারীকে মক্কায় কুরাইশদের কাছে পাঠালেন। তাঁকে নিজের উট সালাবের ওপর চড়িয়ে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠালেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটটিকে হত্যা করে খিরাসকে (রা) হত্যা করতে উদ্যত হলো। কিন্তু বিভিন্ন গোত্রের কিছু লোক মিলে তাঁকে রক্ষা করে ও মুক্ত করে দেয়। পরে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসেন।

এরপর তিনি উমার ইবনুর খাত্তাবকে (রা) তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য মক্কায় কুরাইশ নেতাদের কাছে পাঠাতে মনস্থ করলেন। কিন্তু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, কুরাইশদের হাতে আমার প্রাণ যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বনু আদী ইবনে কা’বের এমন কোন লোক মক্কায় নেই যে, আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। আর আমি যে কুরাইশদের কেমন কট্রর দুশমন তা তারা ভাল করেই জানে। আপনি বরং উসমান ইবনে আফফানকে (রা) পাঠিয়ে দিন। তিনি মক্কাবাসীর জন্য আমার চেয়ে অনেক বেশী প্রভাবশালী।” তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমানকে (রা) পাঠালেন, যেন তিনি মক্কাবাসীকে বুঝিয়ে দিতে পারেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্যে আসেননি বরং উমরাহ করতে এসেছেন। উসমান (রা) চলে গেলেন। সেখানে প্রবেশের পর আবান ইবনে সাঈদের সাথে তাঁর দেখা হলো। আবান তাঁকে আশ্রয় দিল। ফরে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হলেন। উসমান (রা) আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতাদের সাথে দেখা করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্তা পৌঁছিয়ে দেন। তারা উসমানকে বললো, “দেখ উসমান, তুমি যদি কা’বা তাওয়াফ করতে চাও তবে তাওয়াফ করে নাও। ” উসমান বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ না করা পর্যন্ত আমি করবো না।” কুরাইশরা উসমানকে (রা) আটক করে রাখে। ওদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানরা শুনলেন যে, উসমান (রা) শহীদ হয়েছেন।

বাইআতুর রিদওয়ান
ইবনে ইসহাক বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মুূহূর্তে শুনলেন যে, উসমান (রা) নিতহ হয়েছেন, সে মুহুর্তেই বললেন, “কুরাইশদের সাথে লড়াই না করে স্থান ত্যাগ করবো না।” তিনি মুসলমানদেরকে লড়াইয়ের জন্য প্রতিজ্ঞা করালেন। এটাই বাই’আতুর রিদওয়ান। এ বাই’আত সম্পন্ন হয়েছিল একটি বৃক্ষের নীচে। সাধারণ মুসলমানরা বলতেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান কুরবানী করা শপথ গ্রহণ করেছিলেন।” তবে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলতেন যে, এটা জান কুরবানীর বাই’আত ছিল না।” তবে আমরা যেন পালিয়ে না যাই সেজন্য বাই’আত গ্রহণ করা হয়েছিল।”[৭৮.ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন যে, আবু সিনান আল আসাদী (রা) সর্বপ্রথম বাই’আত করেন।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মুসলমানকে শপথ গ্রহণ করান। এক ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ বাই’আত থেকে বাদ পড়েনি। বাদপড়া এই ব্যক্তির নাম জাদ্দ ইবনে কায়েস। সে ছিল বনু সালামা গোত্রের লোক। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলতেন, ‘উটের বগলের ভিতর লুকিয়ে এই ব্যক্তি বাই’আত থেকে বাদ থাকে। তার সেই লুকানোর দৃশ্য আমার চোখে একনো ভাসছে।”

অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিতভাবে জানলেন যে, উসমানের (রা) নিহত হওয়ার খবর ভুল।

শান্তি চুক্তি বা হুদাইবিয়ার সন্ধি
কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুহাইল ইবনে আমরকে পাঠালো। তারা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আপোষ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠালো। এই আপোষরফার একমাত্র লক্ষ্য হবে মুহাম্মাদ যেন অবশ্যই এ বছরের মত মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যায়। আরবরা যেন কখনো বলতে না পারে যে, মুহাম্মাদ কুরাইশদের ওপর শক্তিপ্রয়োগ করে মক্কায় প্রবেশ করেছে।

সুহাইল ইবেন আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের কাছে এলো। তাকে আসতে দেখে তিনি বললেন, “ এ লোকটিকে তখনই পাঠানো হয়েছে যখন কুরাইশরা নিশ্চয়ই সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” সুহাইল এসে খুব লম্বা আলাপ জুড়ে দিল। তারপর সন্ধির ব্যাপারে উভয়পক্ষে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলো।

সন্ধি চুক্তির সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে লিখিত রুপ নিতে শুধু বাকী, এই সময় উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু বাকরের (রা) নিকট ছুটে গিয়ে বললেন, “ হে আবু বাক্র, তিনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” আবু বাক্র বললেন “হ্যা”। উমার বললেন, “আমরা কি মুসলমান নই?” আবু বাক্র বললেন, “অবশ্যই।” ইমার বললেন, “কুরাইশরা কি মুশরিক নয়?” আবু বাক্র বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন, “তাহলে কিসের জন্য আমরা আমাদের দীনের ব্যাপারে এভাবে নতিস্বীকার বরতে যাচ্ছি?” আবু বাক্র বললেন “উমার, তার আনুগত্য কর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।” উমার বললেন “আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রাসূল।”

তারপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আল্লাহর রাসূল নন?” তিনি বললেন “হ্যা।” উমার বললেন, “ওরা কি মুশরিক নয়?” তিনি বললেন, “হ্যা।” উমার আবারো বললেন “তাহলে কি কারণে আমরা আমাদের দীনের প্র¤েœ এই অবমাননা বরদাশত করতে যাচ্ছি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। তার নির্দেশ আমি কখনো লংঘন করবো না। আর তিনি আমাকে কখনো বিপথগামী করনে না।”

পরবর্তীকালে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “আমি সেদিনের সেই ভ্রান্ত আচরণের জন্য সারাজীবন সাদকা, নামায রোযা ও গোলাম আযাদ করার মাধ্যমে কাফফারা গেয়ার চেষ্টা চালিয়েছি। আমার কথাগুলোর খারাপ পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য আমি এমব করেছি। অবশেষে আমার আশার সঞ্চার হয়েছে যে, আমি ভাল ফল পাবো।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) ডেকে বললেন “লেখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।” সুহাইল বললো, “এটা আমার অজানা কথা। তুমি বরং লেখ, বিসমিকা আল্লাহুম্মা।” ( হে আল্লাহ, মোতার নামে।) অতঃপর তিনি বললেন “লেখ, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহাইল ইবনে আমরের সাথে নিম্নলিখিত মর্মে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন।” একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সুহাইল ইবনে আমর বলে উঠলো “আমি যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূল বলেই মানতাম তাহলে তো তোমার সাথে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতাম না। শুধু তোমার নাম ও পিতার নাম লেখ।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহ ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, তাই লেখ। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিম্নলিখিত মর্মে আমরের পুত্র সুহাইলের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। তারা উভয়ে একমত হয়েছে যে, দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই দশ বছর জনগণ পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করবে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সব রকমের আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে। ুকরাইশদের কোন লোক তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুহাম্মাদের নিকট এলে তিনি তাকে ফেরত পাঠাবেন। আর মুহাম্মাদের সাহাবাদের কেউ কুরাইশদের কাছে আসলে কুরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। আমাদের এই চুক্তি কখনো লংঘিত হবে না। উভয় পক্খ আন্তরিকভাবে ও পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে তা মেনে চলবে। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে না কেউ গোপন পাচারের কাজে লিপ্ত হবে না। মুহাম্মাদ অথবা কুরাইশ যে কোন পক্ষের সাথে যে কেউ এ চুক্তিতে অংশগ্রঞন বা নতুন চুক্তি করতে চাইলে অবাধে তা করতে পারবে।” এই ধারা ঘেষিত হওয়া মাত্র বনু খাযরা গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের সাথে এবং বনু বাক্র কুরাইশদের সাথে তদক্ষনাৎ মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করলো। সন্ধি চুক্তিতে আরো লিপিবদ্ধ করা হলো, “তুমি (মুহাম্মদ) এ বছর আমাদের শহর মক্কায় প্রবেশ না করে ফিরে যাবে। আগামী বছর আমরা তোমার জন্য মক্কার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে অন্যত্র চলে যাবো। তুমি অবাধে প্রবেশ করবে এবং তোমার সাথীদের নিয়ে তিনদিন মক্কায় অবস্থান করবে। কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে নিতে পারবে। তরবারী ছাড়া ঢুকবার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সুহাইল ইবনে আমরের তত্ত্বাবধানে যখন এই সন্ধিচুক্ িলিপিবদ্ধি করা হচ্ছিল ঠিক সেই সময় সুহাইল ইবনে আমরের পুত্র আবু জানদাল শৃংখলিত অবস্থায় সেখানে এসে হাজির হলো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি নিকট পালিয়ে এসেছেন। এ সময় ঐ স্থানে রাসূলুল্লাহ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন না। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের দেখা স্বপ্নে যে বিজয়ের ইংগিত ছিল সে ব্যাপারে তারা সংশয়য়বিষ্ট হয়ে পড়ছিলেন। তাই তারা সন্ধি চুক্তিতে এ বছর (উমরা ছাড়াই) ফিরে যাওয়ার ধারা সন্নিবেশিত হতে দেখে এবং রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা বরদাশত করতে ও মেনে নিতে দেখে মহা বিপাকে পড়ে যান এবং প্রায় পথভ্রষ্ট হবার উপক্রম হন। ওদিকে আবু জানদালকে দেখে সুহাইল ইবনে আমর বেসামাল হয়ে তার তুখে প্রচন্ড এক চপেটাঘাত করলো এবং তার বুকের কাপড় টেনে ধরলো। সে তখন বলছিল, “হে মুহাম্মাদ, আবু জানদাল আসার আগেই তোমার ও আমার মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে কথা সত্য।” অতঃপর সে আবু জানদালকে বুকের কাপড় ধরে প্রবল জোড়ে টানতে লাগলো মক্কায় ফেরত পাঠানোর জন্য। আর আবু জানদাল উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো “হে মুসলমানগণ, আমাকে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যারা নির্যাতন করছে সেই কুরাইশদের কাছেই কি আমাকে য়েরত পাঠানো হবে?” তার এ আর্তচিৎকারে মুসলসমানদের ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বললেন “হ আবু জানদাল, তুমি সবর কর এবং নিজের অবস্থার ওপর সন্তুষ্ট থাক। তুমি ও তোমার মত যেসব অসহায় ও নির্যাতিত মুসলমান তোমার সাতে মক্কায় রয়েছে, আল্লাহ তাদের মুক্তির জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিবেন। আমরা কুরাইশদের সাথে একটা সন্ধি ও শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছি। এ ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী মেনে আমরা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমরা তাদেরকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবো না।”

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আবু জানদালের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন “হে আবু জানদাল, সবর কর। ওরা তো মুশরিক। ওদের সবার রক্ত কুকুরের রক্তের সমতুল্য।” উমার (রা) একথা বলার পাশাপাশি আবু জানদালের কাছে নিজের তরবারী এগিয়ে গিচ্ছিলেন। তিনি বলেন আমি আশা করছিলাম যে, আবু জানদাল তরবারী নিয়ে তার পিতাকে হত্যা করে ফেলুক। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত তার পিতার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যাপারটা ওখানেই থেকে যায়।

দলীলটি লেখার কাজ শেষ হলে মুসলমান ও মুশরিক উভয় পক্ষের অনেকে এর সাক্ষী হলেন। সাক্ষীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা), উমার ইবনুল খাত্তাব (রা), আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা), আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল ইবনে আমর,, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, মাহমুদ ইবনে মাসলাম, মিকরায ইবনে হাফস ও আলি ইবনে আবু তালিব (রা)। মিকরায তখনো মুশরিক ছিল। আর আলী (রা) ছিলেন দলীলের লেখক।

কুরবানীর উটগুলোকে কিভাবে কুরবানী করে ইহরাম মুক্ত হওয়া যায় সে মস্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম চিন্তিত ছিলেন। তখনো তিনি ইহরাম অবস্থায় নামায আদায় করছিলেন। চুক্তি সই হয়ে গেলে তিনি নিজের কুরবানীর পশুটা কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সব সাহাবীও কুরবানী করে মাথা মুন্ডন করলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা অভিমেুখে যাত্রা করলেন। মক্কা ও মদীনার মাঝখানে থাকতেই সূরা আল ফাতহ্ নায়িল হলোঃ

“হে নবী, আমি তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয়ের উদ্বোধন করেছি, যেন আল্লাহ তোমার আগের ও পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন তোমার ওপর তার নিয়ামত পূর্ণ করেন এবং তোমাকে নির্ভুল পথে চালিত করেন।”

আল্লাহ আরো বলেন “আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বাপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি স্বাপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই নিরাপদে ও নির্ভয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে নিরাপদে মাথার চুল মুন্ডিয়ে ও ছেঁটে নির্ভিকচিত্তে প্রবেশ করবে। সে (আল্লাহর রাসূল) সেই জিনিস অবগত হয়েছে যা তোমরা অবগত হওনি। ঐ ঘটনার (হুদাইবয়ার সন্ধির) পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।”

যুহরী বলেন: পূর্বে ইসলামের যতগুলো বিজয় অর্জিত হয়েছে তার মধ্যে এটিই (হুদাইবিয়ার সন্ধি) ছিল সবচেয়ে বড় বিজয়। আগে মানুষ বিপক্ষের মুখোমুখি হলেই যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কিন্তু সন্ধি হলে যুদ্ধের অবসান ঘটলো আর তার ফলশ্রুতিতে লোকজন পরস্পরের সাথে নির্ভয়ে মেলামেশা ও আলাপ আলোচন করার সুযোগ পেল। ফলে ইসলাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। এ সময়ে এমন অবস্থা হলো যে সামান্য কান্ডজ্ঞান ছিলো এমন ব্যক্তির সাথে ইসলাম সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করলেই সে ইসলাম গ্রহণ করতো। সন্ধি পরবর্তী দুই বছরে যারা ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা সন্ধি পূর্ব ইসলাম গ্রহণকারীদের মোট সংখ্যার চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশী। [৭৯.ইবনে হিশাম বলেন, যুহরীর এ উক্তির সপক্ষে প্রমান এই যে, রাসূলুল্লাহ হুদাইবয়োতে গিয়েছিলেন ১৪০০ মুসলামানকে সঙ্গে নিয়ে। এর মাত্র দু’বছর পরে তিনি যখন মক্কা বিজয়ে যান তখন তার সাথে ছিল দশ হাজার মুসলমান।]

 

খাইবার বিজয়: ৭ম হিজরীর মুহাররাম মাস
হুদাইবিয়া থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় যিলহাজ্জ ও মুহাররাম মাসের কিছু অংশ অতিবাহিত করেন। মুশরিকরা এ বছর হজ্জ করেনি। মুহাররামের শেষাংশে তিনি খাইবার অভিযানে বের হন।

আবু মুয়াত্তাব ইবনে আমর (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার পৌছে সাহাবীদের বললেন “থামো।” তাদের মদ্যে আমিও ছিলাম। এরপর বললেন “হ আল্লাহ, আসমান যমীন ও তার মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর অদিপতি, সব শয়তান এবং তারা যত লোককে গুমরাহ করেছে তাদেরও সর্বময় মালিক এবং বাতাস ও তার চালিত, বাহিত ও উৎক্ষিপ্ত জিনিসসমূহের নিরংকুশ প্রভু, আমরা আপনার কাছে এই জনপদ তার, অধিবাসীদের পক্ষ থেকে সব রকমের অকল্যাণ থেকে আনার আশ্রয় প্রার্থনা কির। আল্লাহর নামে তোমরা এগিয়ে যাও।” তিনি প্রতিটি জনপদে প্রবেশকালেই এ কথা গুলো বলতেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম সকাল বেলা ছাড়া কোন জনগোষ্ঠির ওপর আক্রমণ করতেন না। সেখানে আযান শুনলে থেমে যেতেন। আযান না শুনলে আক্রমণ চালাতেন। আমরা রাতের বেলা খাইবারে পৌছে যাত্রাবিরতি করলাম। কিন্তু কোন আযান শুনতে পেলেন না। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়ে যাত্রা করলেন। আমি আবু তালহার পেছনে সওয়অর হয়েছিলাম। আমার পা রাষূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের পা স্পর্শ করছিল। সকাল বেলা খাইবারের শ্রমিকরা কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে দিনের কাজে বেরুচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনিকে দেখে তারা সবিস্ময়ে বলে উঠলো, “সর্বনাশ! মুহাম্মাদ তার বাহিনীসহ হাজির হয়েছে দেখছি”- বলেই তারা পালিয়ে পেছনে ফিরে যেতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবার! খাইবারের পতন ঘটেছে। আমরা কোন জনপদে আগমন করলেই তার অধিবাসীর সকাল বেলাটা দুর্ভাগ্যময় হয়ে ওঠে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম মদীনা থেকে খাইবার যাওয়ার সময় ই’স্র পাহাড়ের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। এজন্য সেখানে একটা মসজিদ তৈরী করা হয়। এরপর যান ‘সাহাবা’র মথ্য দিয়ে। তারপর তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে রাজী উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করেন। এখানে তিনি খাইবারবাসী ও গাতফানীদের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন াতে গাতফানীরা খাইবারবাসীদের সাহায্য করতে না পারে। তারা সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খাইবারের ইয়াহুদীদের সাহায্য করতো।

গাতফানীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথা শুনে একদল যোদ্ধা সংগ্রহ করে খাইবারের ইয়াহুদীদের শক্তিবৃদ্ধি করতে অগ্রসর হলো। কিছুদুর গেলেই পেছনে ফেলে আসা তাদের পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের ওপর আপতিত একটা বিপদের শেঅরগোল শুনতে পেল। তারা ভাবলো, মুসলমানরা হয়তো তাদের পরিবার পরিজনের ওপর ভিন্ন দিক থেকে গিয়ে চড়াাও হয়েছে। তাই ফিরে গিয়ে তারা নিজ নিজ পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত হলো এবং খাইবারবাসী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুকাবিলার জন্য ছেড়ে দিল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রমান্বয়ে খাইবারের ইয়াহুদীদের ধন সম্পদ ও দুর্গসমূহ এক এক করে দখল করতে লাগলেন। তিনি সর্বপ্রথম তাদের ‘নায়েম’ দুর্গ জয় করেন। এখানে সাহাবী মাহমুদ ইবনে মাসলামা শহীদ হন। তাঁর ওপর গম পিষা যাঝতার পাট ছুড়ে মারা হলে তিনি শহীদ হন। এরপর আবুল হুকাইকের দুর্গ ‘কামূস’ বিজিত হয়। সেখানে থেকে তিনি কিছুসংখ্যক ইয়াহুদীকে আটক করেন। তাদের মধ্যে হুয়াই ইবেন আখতাবের কন্যা সাফিয়া অন্যতম। সে কিনানা ইবনে রাবীর স্ত্রী ছিল। তার দু’জন চাচাতো বোনও গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন। দাহইয়া ইবন খালীফা কালবী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সাফিয়াকে চেয়েছিলেন। তিনি সাফিয়অকে নিজের জন্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বলে দাহইয়াকে তার চাচাতো বোনকে দিয়ে দেন। ক্রমে খাইবারের গ্রেফতারকৃত লোকদেরকে সাহাবীদের সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

এক এক করে খাইবারের কিল্লাগুলো এবং তাদের ধনসম্পদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হস্তগত হচ্ছিল। কেবল ওয়াতীহ ও সুলালিম নামক কিল্লা দুটি দখল করা তখনও বাকী ছিল। সবশেষে তিনি এ দুটি কিল্লা জয় করেন। এ দুটিকে তিনি দশদিনের অধিক সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন।

ইয়াহুদ নেতা মরারহাব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুকাবিলায় এগিয়ে এস একটি রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটি হলোঃ

“সমগ্র খাইবার জানে যে, আমি মারহাব। (অর্থাৎ খুব প্রতাপশালী)

অস্ত্র দিয়ে আঘঅত করতে পারদর্শী, অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী বীর।

কখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই আবার কখনো শক্ত আঘাত করি।

শার্দুলেরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে দেয়ৈ আসে তখন আমার ধারে কাছেও

কেউ ঘেঁষতে পারে না।”

সে চ্যালেঞ্জ করলো,, “এসো আমার সাথে দ্বান্ধ যুদ্দ করতে কে প্রস্তুত আছ?” কা’ব ইবনে

মালিক (রা) রণসংগীত আবুত্তি করেই তার জবাবে বললেন,

“খইবার জানে যে আমি কা’ব। আমি দুঃখ দুর্দশা ঘুচাই, সাহসী ও অনমনীয়।

যখন যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন যুদ্ধের পর যুদ্ধই চলতে থাকে।

আমার আছে বিজলীর আলোকচ্ছটার মত ধারালো তরবারীটা।

আমরা তোমাদেরকে পদদলিত করবো যাতে সব জটিলতার অবসান ঘটে।

এতে আমরা পুরস্কৃত হবো অথবা আমাদের কাছে

প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ চলে আসবে! (সে সম্পদ আসবে) বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে

এবং তাতে কোন তিরস্কারের অবকাশ থাকবে না।”

রাসূলুল্লাহ বললেন, “এই লোকটির সাথে কে লড়তে প্রস্তুত আছে?” মুহাম্মাাদ ইবনে

মাসলামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার সাথে লড়তে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ লড়াকু। আমি ওর থেকে স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই। গতকাল সে আমার ভাইকে (মাহমুদ ইবনে মাসলামা) হত্যা করেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “যাও। হে আল্লাহ, মারহাবকে পর্যুদস্ত করতে ওকে সাহায্য কর।” অতঃপর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও মারহাবকে মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। একটি পুরনো বৃক্ষ তাদের মাঝখানে আড় হয়ে দঁড়ালো। উভয়ে পালাক্রমে ঐ গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে লাগলো। এক সময় মারহাবের তরবারী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ঢালে আটকে গেল। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলাম তরবারীর আঘাতে মরহাবকে হ্যা করলেন।

মারহাব নিহত হলে তার ভাই ইয়াসার হুংকার দিয়ে এগিয়ে এলা। হিশাম ইবনে উরওয়অর মতানুসারে যুবাইর ইবনুল আওয়াম তার সাথে বুঝতে গেলেন। একথা শুনে তাঁর মাতা সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব জিজ্ঞেস করলেন,, হে আল্লাহর রাসুল আমার পুত্র কি নিহত হবে?” তিনি বললেন “না, তোমার পুত্র ইনশায়াল্লাহ ইয়াসারকে হত্যা করবে।” যুবাই্র সিত্যি সত্যিই ইয়াসারকে হতা করলেন।

সালামা ইবনে আমর ইবনে আকওয়অ বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারে কোন একটি দুর্গ অধিকার করার জন্য আবু বাক্র সিদ্দীককে (রা) পতাকা দিয়ে পাঠালেন। তিনি যুদ্ধ কররেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি করেও তিবি দুর্গ জয় করতে না পেরে ফিরে এলেন। পরদিন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) পাঠালেন। তিনিও তুমুল যুদ্ধ করলেন। কিন্তু অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কাল সকালে আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তার হাতেই দুর্গ জয় করাবেন। তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে কখনো পালাবার মত লোক না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লাম আলীকে (রা) ডাকলেন। তিনি তখন চক্ষুরোগে ভুগছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চোখে থু থু দিলেন এবং বললেন, “এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও। আল্লাহ যতক্ষণ তোমার হাতে বিজয় না দেন ততক্ষণ লড়াই করে যাও।”

সালামা বলেনঃ তিনি এগিয়ে গেলেন। শত্রুকে কাবু করার মত প্রচন্ড বলবীর্য ও পরাক্রম ছিল তাঁর। তিনি শুধু হেলেদুলে পায়তারা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। আমরা তাঁর পেছনে তাঁর অনুসরণ করছিলাম। তিনি কিল্লার নীচে একটা পাথর স্ত’পের মধ্যে পতাকা স্থাপন করলেন। ওপর থেকে একজন ইয়াহুদী তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আবু তালিবের পুত্র আলী।” ইয়াহুদী বললো “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।” অবশেষে আলীর হাতইে বিজয় দান করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবারবাসীকে তাদের দুই দুর্গ ওয়াতীহ ও সুলালিমে অবরোধ করলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই তখন তারা তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খাইবার থেকে তাদেরকে বহিস্কার করার প্রস্তাব দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মেনে নিলেন ও প্রাণভিক্ষঅ দিলেন। ইতিপূর্বেই তিনি তাদের আশঙ্কা আন্ নাতাহাহ ও আল কুতাইবার ভূমিসহ সমস্ত স্থাবর অস্থঅবর সম্পদ এবং ঐ দুটি দুর্গ ছাড়া সকল দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ফদাকবাসী সমস্ত খবর জানতে পারলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে বিতাড়িত করণ এবং জমিজমা ও ধনসম্পদ হস্তগত করার অনুরোধ জানালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে যারা এই অনুরোধ নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়েছিল তাদের মধ্যে মুহাইসা ইবনে মাসউদ ছিলো অন্যতম। সে ছিল বনু হারেসার লোক। খাইবারবসী এই ব্যবস্থা প্রথমে মেনে নেয়। কিন্তু পরে অনুরোধ করে যে আমাদেরকে বহিস্কার না করে অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে জমি চাষের কাজে নিয়োজিত করুন। তারা যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলে যে এখানকার জমিজমা আমরাই ভাল আবাদ করতে সক্শস এবং এ কাজে আমরাই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এ প্রস্তাব মঞ্জুর করে তাদের সাথে আপোষরফা করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার আমাদের থাকবে। ফাদাকবাসীও এই শর্তে তাঁর সাথে আপোষ করলো। এভাবে খাইবার মুসলামানদের যৌথ সম্পদ এবং ফাদাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হলো। কেননা ফাদাক জয় করতে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন পড়েনি।

এসব আপোষরফার পর রাসূলুল্লাহ সাল্ল াল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঠিক তখনই সাল্লাম ইবনে মুসকামের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারেস তাঁকে একটি ভুনা বকরী উপহার দিল। ভুনা ছাগলটি পাঠানোর আগে সে জিজ্ঞেস করে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামা বকরীর কোন্ অংশ খেতে বেশী পছন্দ করেন?” তাকে জানানো হলো যে, তিনি উরু বা রানের গোশত বেশী পছন্দ করেন। তখন সে উরুতে বেশী করে বিষ মিশিয়ে দেয়। অতঃপর পুরো ছাগলটিকে সে বিষাক্ত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে আসে। তা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এক টুকরো গোশত চিবালেন কিন্তু গিললেন না। সাহাবী বিশর ইবনে বারা ইবনে মা’রুরও তাঁর সাথে বসে খাচ্ছিলেন। বিশরও এক টুকরো গোশত মুখে নিয়ে চিবালেন। তিনি গেলে ফেললেন। কিন্তু সরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উগরিয়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, “এই হড্ডিটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তা বিষাক্ত।” অতঃপর তিনি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। সে স্বীকারোক্তি করলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এমন কাজ কেন করলে?” সে বললো, “আপনি আমার কওমের সাথে কি আচরণ করেছেন তা আপনার জানা আছে। আমি ভাবলাম আপনাকে এভাবে বিষ খাওয়াবো। আপনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে আপনার হাত থেকে উদ্দার পাবো আর যদি নবী হয়ে থাকেন হাহলে তো আপনাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) সাবধান করে দেয় হবে।” এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু বিশর যে টুকরাটি খেয়েছিলেন তাতেই তিনি মারা গেলেন। খাইবার বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াদিউল কুরাতে চলে গেলেন। সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকদিন অবরোধ করে রাখেলেন, অতঃপর মদীনা চলে গেলেন।

খাইবার কিংবা পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফিয়ার সাথে বাসর রাত কাটান। আনাস ইবনে মালিকের (রা) মা উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান সাফিয়াকে বধূর বেশে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গম্বুজ সর্দশ একটি তাঁবুতে তাকে নিয়ে বাসর রাত যাপন করলেন। এদিকে আবু ইয়ুর খালিদ ইবনে যায়িদ (রা) উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে সারারাত জেগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহ ওয়াসাল্লামাকে পাহারা দিলেন। সারারাত তিনি তাঁবু গ্রহের চারপাশে টহল দেন। সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্যাপার কি আবু আইয়ূব। তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই মহিলার পক্ষ থেকে আপনা রওপর কোন বিপদ আস এই আশংকায় আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। কেননা তার পিতা, স্বামী ও গোত্রের অন্যান্য লোকজনকে আপনি হত্যা করিয়েছেন। তাছাড়া সে সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই তার দিক থেকে আপনার ওপর বিপদের আশংকা করেছিলাম।” অনেকে বলেন: একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, আবু আইয়ূব যেভাবে সারারাত আমারহিফাজতে নিয়োজিত ছিল তেমনি আপনিও তাকে হিফাজত করুন।”

খাইবার থেকে ফেরার পথে এক জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম যাত্রাবিরতি করেন। শেষ রাতে তিনি বললেন, “আমরা যাতে এখন ঘুমাতে পারি সেজন্য ফজরের সময় আমাদের ডেকে দেয়ার দায়িত্ব কে নিতে পারে?” বিলাল (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ দায়িত্ব নিতে পারি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহগামী মুসলমানগণ যাত্রাবিরতি করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন্ রাতে বিলাল (রা) নামায পড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ নামায পড়ার পর তিনি উটের গায়ে হেলান দিয়ে প্রভাত হবার প্রতীক্ষায় বসে রইলেন। এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ও মুসলিম মুজাহিদগন যথাসময়ে ঘুম থেকে জাগতে সক্ষম হলেন না। তপ্ত রোদের পরশ লাগার সাথে সাথেই তাদের ঘুম ভাংলো। প্রথমেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম জেগে উঠলেন। উঠেই তিনি বিলালকে (রা) বললেন, “বিলাল, মুমি আজ এ কি করলে?” তিনি বললেন “হে আল্লাহর রাসূল, যে ঘুমে আপনাকে ধরেছিল সেই ঘুমের কাছে আমিও পরাভূত হয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছো।” এরপর তিনি নিজের উট নিয়ে অল্প কিছুদুর এগিয়ে গেলেন। অতঃপর উট থামিয়ে তিনি অযু করলেন। সাহাবাগণও অযু করলেন। তারপর বিলালকে নামায শুরু করার জন্য ইকামাত দিতে বললেন। তিনি ইকামাত বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে নামায পড়লেন। নামায শেষে তিনি সাহাবীদের দিকে ফিরে বললেন, “তোমরা কখনো নামায পড়েতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই পড়ে নেবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম কর।”

খাইবার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম ইবনে লুকাইম আবাসীকে (রা) খাইবারের যাবতীয় মুরগী ও গ্রহপালিত প্রাণী পুষতে দিয়েছিলেন। সফর মাসে খাইবার বিজয় সম্পন্ন হয়। ইবনে লুকাইম খাইবার সম্পর্কে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যা নিম্নরুপঃ

“এক দুরুন্ত দুঃসাহসী সাদা বেশধারী সেনাদল পরিবেষ্টিত নবী কর্তৃক

নাতা আক্রান্ত হলো,

নাতাবাসী যখন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো

এবং আসলাম ও গিফার গোত্রদ্বয়ও তার মাঝে বিছিন্ন হলো

তখন তারা নিশ্চিত হলো পরাজয় সম্পর্কে।

বনু আমর ইবনে জুরআর লোকেরা প্রভাতকালেই দেখতে পেল,

আশ্ শ্কা এর অধিবাসী দিনের বেলাতেই ঘোর অন্ধকারে পতিত হয়েছে।

তার সমগ্র সমভ’মি জুড়ে দৌড়ে গেছে ধ্বংস ও মৃত্যু।

প্রত্যুষে চিৎকারকারী মোরগগুলো ছাড়া কোন কিছুকেই তা অবশিষ্ট রাখেনি।

আর প্রতিটি দুর্গকে অধিকার করেছে আবদ্ আশহাল

কিংবা বনু নাজ্জারের আশ্বারোহীগণ।

[আশ আলহাল ও বনু নাজ্জার আনসারদের দুটো গোত্রের নাম।]

আর মুহাজির যারা শিরস্ত্রাণের ওপর দিয়ে তাদের কপালকে উন্মুক্ত করেছে-

যারা পালানোর কথা চিন্তাও করতে পারে না।

আমি জানতাম, মুহাম্মদ অবশ্যই জয়লাভ করবে এবং

যুগ যুগ ধরে সেখানে অবস্থান করবে।

সেই দিনের চিৎকারে হুংকারে ইহুদীদের চোখে খুলে গেছে।”

 

জাফর ইবন আবু তালিবের আবিসিনিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন
ইবনে হিশাম বলেনঃ

শা’বী জানিয়েছেন যে, আবু তালিব তনয় জা’ফর খাইবার বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে আসেন। তিনি তাঁর কপালে চুমু খেলেন এবং আলিঙ্গন করে বললেন, “আজ আমি খাইবার বিজয়ে বেশিী খুশি না জা’ফরের প্রত্যাবর্তনে বেশী খুশী তা নির্ণয় করতে পারিছি না।” ইবনে ইসহাক বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে যারা আবিসিনিয়াতে থেকে গিয়েছিলেন তাদেরকে আনতে নাজাশীর নিকট আমর ইবন উমাইয়া দামারীকে পাঠানো হয়। তিনি তাদেরকে দু’খানা জাহাজে করে নিয়ে আসেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদন করার পর খাইবারে অবস্থান করছিলেন। সেখানে যেসব সাহাবী প্রবাস জীবন কাটাচ্ছিলেন তাঁরা হলেন বনু হাশিম ইবনে আবদ্ মানাফ গোষ্ঠির জাফর ইবনে আবু তালিব, তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস খাস’য়ামিয়া, আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে জন্মগ্রহণকারী পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর। বনু আবদ্ শামস ইবনে আবদ্ মানাফ গোষ্ঠির খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে উমাইয়া, তার স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, পুত্র সাঈদ ও কন্যা আমাহ্- উভয়ে আবিসিনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। খালিদের ভাই আমর, পরবতীকালে উমার ইবনুল খাত্তাব নিয়োজিত ইসলামী বাইতুল মালের কোষাধ্যক্ষ মুয়াইকীব ইবনে আকু ফাতিমা, এবং আবু মুস আশআরী। বনু আসাদ ইবনে আবদুল উযযার- আসাওয়াদ ইবনে নাওফেল ইবনে খুয়াইলদ।

বনু আবদুদ দার ইবনে কুসাইয়ের- জাহাম ইবনে কায়েস।

বনু যুহরা আমের ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে মাসউদ।

বনু তায়েম ইবনে মারেরের- হারেস ইবনে খালিদ ইবনে সাখার।

বনু জুমাহ ইবনে আমরের-উসমান ইবনে রবীয়া ইবনে উহ্যান।

বনু সাহম ইবনে আমরের- মাহমিয়া ইবনে আল জাযা।

বনু আদী ইবনে কা’বের – মা’মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সাদলাহ।

বনু আমের ইবনে লুয়াই এর- আবু হাতিম ইবনে আমর ও মালিক ইবনে রাবীয়া।

বনু হারেস ইবনে ফিহির ইবনে মালিকের – হারিস ইবনে আবদুল কায়েস ইবনে লাকীত।

সেখানে অবস্থানকারী যেসব মুসলমান ইনতিকাল করেন তাঁদের স্ত্রীদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে চলে আসেন। নাজাশী সর্বমোট ১৬ জন পুরুষকে আমর ইবনে দামারীর সাথে দুইখানা জাহাজে করে পাঠিয়ে দেন। আবিসিনিয়ার প্রবাসী মুসলামদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে প্রত্যাবর্তন করেননি বরং তার পরে এসেছেন এবং যাদেরকে নাজাশী এই দুই জাহাজে পাঠাননি- তাদের মধ্যে সর্বমোট পুরুষের সংখ্যা ছিল ৩৪ জন।


উমরাতুল কাযাঃ ৭ম হিজরী সনঃ জিলকাদ মাস
খাইবার থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় রবিউল আউয়াল থেকে শাওয়াল মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন সামরিক অভিযানে নিজে গমন করেন অথবা অন্য সাহাবীদের পাঠান।

এরপর যুলকা’দা মাসে তিনি আগের বছরের পরিত্যক্ত উমরার কাযা আদায় করার জন্য মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন্ আগের বছর এই মাসেই মুশরিকরা তাঁতে পথিমধ্যে বাধা দেয় ও উমরা বাদ দিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য করে। ঐ একই সফরে আগের বছর যেসব মুসলিম তাঁর সহচরবুন্দ অত্যন্ত অভাব অনটন ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালতিপাত করছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ কুরাইশরা রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের দেখবার জন্র তাদের সম্মিলন গ্রহ ‘দারুন্ নাদওয়া’তে কারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর চাদর ডান বগলের নীচে ও বাম কাঁধের ওপর পেচিয়ে পরলেন এবং ডান হাত উঁচু করে ডান বগল ফাঁক করে বললেন, “আজকে যে ব্যক্তি নিজেকে শক্তিমান বলে জাহির করবে আল্লাহ তার ওপর রহমত করবেন।” একথা বলার পর তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন্ অতঃপর তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ জোরে জোরে বীরোচিত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। কা’বা ঘরের আড়ালে গিয়ে কুরাইশদের দৃষ্টির অন্তরালে গেলে রুকনে ইয়ামনী চুম্বন করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেছটে রুকনে আসওয়াদে পৌছে এক চক্কর সমাপ্ত করলেন। অতঃপর আগের মত বীরোচিত ভঙ্গিতে জোরে জোরে হাঁটলেন। এভাবে তিন চক্কর দিলেন এবং বাকী চক্করগুলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে সম্পন্ন করলেন।

এই সফরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মাইমুনা বিনতে হারিসকে (রা) বিয়ে করেন। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) এই বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনদিন মক্কায় অবস্থান করলেন। তৃতীয় দিন হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উযযার নেদৃত্বে কুরাইশদের কয়েকজন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তোমরা মক্কায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অতএব তুমি মক্কা ত্যাগ কর।” [৮০. অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তিতে নির্ধারিত মেয়াদ ৩ দিন।]

কুরাইশরা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এখানে তোমাদের উপস্থিতিতে আমি যদি বিয়ে সম্পন্ন করি এবং তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করি আর তোমরা তাতে যোগ দাও তাহলে ক্ষতি কি?” তারা বললো “তোমার খাবারে আ,াদের প্রয়োজন নেই। তমি চলে যাও।”

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ত্যাপ করলেন। নিজের ভৃত্য আবু রাফেকে তিনি মাইমুনার (রা) দেখালোমানর জন্য রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তানয়ীমের নিকটবর্তী সারেফ পৌছেলেন। আবু রায়ে মাইমুনাকে (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহইমুনার (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাইমুনার (রা) সাথে বাসর রাত পাপন করলেন এবং পরে মদীনায় ফিরে গেলেন। ইবনে হিশাম বলেনঃ আবু উবাইদার বর্ণনা মতে এই সফর শেষেই আয়াত নাযিল হয়, “আল্লাহ তাঁর রাসূলুরে স্বাপ্ন সত্যে পরিনত করেছেন। (স্বপ্নে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে) তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারমে নিরাপদে ও নির্ভিকভাবে শাথা মুন্ডিয়ে বা চুল ছেঁেট প্রবেশ করবে। তোমরা যা জানতে পারনি আল্লাহর রাসূল তা জেনেছেন। অতঃপর তার অব্যবহিত পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।” (আল ফাতহ, শেষ রুকু)

মুতার যুদ্ধঃ ৮ম হিজরী সনঃ জামাদিউল উলা
যুহাজ্জের বাকী অংশ এবং রবিউস্ সানী পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই কাটালেন। এ বৎসর মুশরিকরা হজ্জে নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধান করলো। যায়িদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে জামাদিউল আউয়াল মাসে তিনি মুসলমানদের একটি বাহিনীকে সিরিয়া অভিানে পাঠান। এই বাহিনী মূতা নামক স্থানে যুদ্ধের সম্মীখীন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল যে, যায়িদ যদি শহীদ কিংবা আহত হন তাহলে জাফর এবং জাফর শহীদ কিংবা আহত হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা সেনাপতির দায়িত্ব নিয়োজিত হবেন।

তিন হাজার মুসলমান যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। মুসলমানগণ তাদের বিদায় ও সালাম জানাতে এলে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা কেঁদে ফেললেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি বললেন “দুনিয়ার মোহে কিংবা তোমাদের মায়ায় কাঁদছি না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওাসালাল্লামকে কুরআনের একটি আাত পড়তে শুনেছি। সে আয়াতে দোযখের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ

“তোদমাদের প্রত্যেককে ঐ জাহান্নামের কাছে আসতে হবে। এটা তোমার প্রতিপালকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ (মরিয়ম) আমি বুঝতে পারছি না জাহান্নামের পার্শ্বে যাওয়ার পর আমি কিবাবে তা থেকে উদ্ধার পাবো?” মুসলমানগণ তাঁকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের সঙ্গী হোন! তেনি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের বাছে সহী সালামতে ফিরিয়ে আনুন।”

জবাবে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“আমি পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আর কামনা করছি যেন

(কাফিরদের) রক্তক্ষয়কারী ব্যপিক আঘাত হানতে সক্ষম হই।

অথবা আমার (রক্ত) পিপাসু হাত দিয়ে বর্শার এমন আাঘাত হানতে পারি

যা (শত্রুকে) দ্রুত মৃত্যুর মুখে নিক্ষিপ্ত করবে ও তার কলিজা ও নাড়িভুঁড়ি

ছিন্নভিন্ন করে দেবে।

যেন আমার কবরের কাছে দেিয় অতিক্রমকারীরা বলতে পার যে, এই ব্যক্তিকে

আল্লাহ হিদায়াতের পথে চালিত করে গাজী বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সে

সুপথে চালিত হয়েছিল।”

অতঃপর বাহিনী রওনা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের সাথে কিছুদুর গেলেন, কিছুদুর গিয়ে তিনি তাদেরকে বিদায় দিয়ে যখন ফিরে এলেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“যে (মহান) ব্যক্তিকে বিদায় জানালাম,

আল্লাহ সেই শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও সর্বোত্তম বিদায়কারীকে খেজুরের বীথিতে সুখে শান্তিতে রাখুন।” অতঃপর মুসলিম বাহিনী যাত্রা শুরু করলো। শামের (সিরিয়া) মায়ান নামক স্থানে পৌছে তারা যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে তারা জানতে পারলেন যে,, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে বালকা এলাকার মায়াব নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেছে। লাখাম, জুযাম, বাহরা ও বালী গোত্রের আরো এক লাখ লোক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বালী গোত্রের এক ব্যক্তি এবং ইরাশ গোত্রের আর একজনস তার সহকর্মী। তার নাম মালিক ইবনে রাফেলা। মুসলিম বাহিনী এসব খবর জেনে মায়ানে দু’দিন অবস্থান করলো এবং তাদের করনীয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলো। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পত্র পাঠিয়ে শত্রুর লোক লস্করের সংখ্যা জানাবেন। তিনি হয় আরো সৈন্য পাঠিয়ে তাদের সাহায্য করবেন, নচেত যা ভাল মনে করেন নির্দেশ দেবেন এবং সেই মুতাবিক তারা কাজ করবেন।

আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করে বললেন, “হে মুসলিমগণ! আজ তোমরা যা অপছন্দ করছ সেটাই তোমরা কামনা করছিলে। আর তা হলো শাহাদাত। আমরা সংখ্যা-শক্তি বা সংখ্যধিক্যের জোরে লড়াই করি না। যে জীবনব্যবস্থার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন তার জন্য আমরা লড়াই করি। অতএব এগিয়ে যাও, বিজয় বা শাহাদাত এ দুটো উত্তম জিনিসের যেকোন একটা অবশ্যই আমাদের জন্য নির্ধারিত আছে।”

মুসলমানগণ সবাই বললেন, “আল্লাহর শপথ, ইবনে রাওয়াহা হক কথা বলেছে।”

অতঃপর মুসলমানগণ অগ্রসর হলেন। বালকা সীমান্তের কাছে পৌছতেই তারা হিরাক্লিয়াসের সম্মিলিত রোমক ও আরব বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। বালকার সেই স্থানটির নাম মাশারিফ। শত্রুরা নিকটবর্তী হলো। মুসলমানরা একদিকে সরে গিয়ে মৃতা নামক একটি গ্রামে অবস্থান নিলেন্ বাহিনীর দক্ষিণ ভাগে বনু উযরাব কুতবা ইবনে কাতাদাকে (রা) এবং বাম অংশে আনসারী উবায়া ইবনে মালিককে (রা) দায়িত্ব দিয়ে মুসলমানগণ রণপ্রস্তুতি নিলেন। অতঃপর উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। প্রধান সেনাপতি যায়িদ ইবনে হারিসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা বহন করে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তারপর পতাকা হাতে নিলেন জাফর ইবনে আবু তালিব। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়ার পা কেটে ফেললেন এবং যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। শাহাদাত বরণের প্রাক্কালে তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ

“আহ! কি চমৎকার জান্নাত এবং তার সান্নিধ্য লাভ!

জান্নাত যেমন অতি উত্তম ও পবিত্র, তার পানীয়ও তেমনি।

রোমকদের আযাব ঘনিয়ে এসেছে, তারা কাফির এবং

আমার তুলনায় লনেক নিকৃষ্ট যদিও তাদের আঘাত খেয়েছি।”

ইবনে হিশাম বলেনঃ

নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি জানতে পেরেছি যে, জাফর ইবনে আবু তালিব প্রথমে ডান হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। শত্রুর তরবারীতে ডান হাত কাটা গেলে বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। সে হাতও কাটা গেল। তখন তিনি তা দুই ডানা াদয়ে চেপে ধরলেন্ এরপর শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরণ করলেন। আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল তেত্রিশ বছর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে দুইখানা ডানা দেন যা দিয়ে তিনি যেখানে খুশী উড়ে বেড়াতে থাকেন। কথিত আছে যে, একজন রোমক সৈন্য তাঁকে তরবারীর আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছিল।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ জা’ফর শহীদ হওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরলেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে লড়াইতে অংশ নেবেন কিনা ভাবতে ও কিছুটা ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। অতঃপর স্বগতভাবে বললেন,

“কসম খেয়ে বলছি, হে ইবনে রাওয়অহা, এই ময়দানে তোমাকে নামতেই হবে,

হয় তোমাকে নমাতেই হবে নচেত তোমাকে তা অপছন্দ করতে হবে।

সকল মানুষ যদি রণহংিকার দিয়ে জমায়েত হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে

কান্নার রোলও পড়ে থাকে,

তোমাকে কেন জান্নাত সম্পর্কে নিস্পৃহ দেখছি?

সুখে শান্তিতে অনেকদিন তো কাটিয়ে দিয়েছো,

অথচ তুমি তো আসলে একটি পুরনো পাত্রে

এক ফোটা পানি ছাড়া আর কিছুই ছিলে না।

হে আমার আত্মা, আজ যদি নিহত না হও তাহলেও তোমাকে

একদিন মরতে হবে।

এটা (রণাঙ্গন) মৃত্যুর ঘর যাতে তুমি প্রবেশ করেছো।

তুমি এ যাবত যা চেয়েছো পেয়েছো।

এখন যদি ঐ দু’জনের মত (যয়িদ ও জাফর) কাজ কর

তাহলে সঠিক পথে চালিত হবে।”

অতঃপর তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই এক চুকরো হাড্ডি জড়িত গোশত এনে তাঁকে দিয়ে বললেন “নাও, এটা খেয়ে একটু শক্তি অর্জন কর। কেননা তুমি এই ক’দিনে অত্যধিক কষ্ট করেছো।” তিনি গোশতের টুকরোটা নিয়ে দাঁত দিয়ে কিছুটা ছিড়ে নিয়েছেন এমন সময় এক পাশে লোকজনের ভীষণ মারামারি হুড়োহুড়ির শব্দ শুনতে পেলেন। তখন তিনি বললেন “আমি বেঁচে থাকতে?” তিনি গোশতের টুকরোটা ছুড়ে ফেললেন। তরবারী হাতে অগ্রসর হলেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

এরপর বনু আজলান গোত্রের সাবিত ইবনে আকরাম পতাকা হাতে নিলেন। তিনি বললেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সর্বসম্মতভাবে একজন সেনাপতি বানাও।” সবাই বললো “আপনিই আমাদের সেনাপতি।” তিনি বললেন, “আমি এ দয়িত্ব পালনে সক্ষম নই।” তখন মুসলমানগণ খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে সেনাপতি বানালেন। তিনি পতাকা হাতে নিয়ে বীর বিক্রমে লড়াই করতে লাগলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে একবার এক কিনারে চলে যান আবার এগিয়ে আসেন। এভাবে লড়াই চালাতে লাগলেন। একবার তিনি যেই এক কিনারে গিয়েছেন অমনি রোমক বাহিনীও কিনারে চলে গেল এবং রণেভঙ্গ দিল। পরে তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীকে নিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। বর্নিত আছে যে, মুসলিম বাহিনী যখন শত্রু কর্তক আক্রান্ত হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “যয়িদ ইবনে হারিসা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে। এরপর জা’ফর পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। এতে আনসারদের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তারা ভাবলেন, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার একটা অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে হয়তো। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “জাফরের পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর বললেন “আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, এই তিনজনকে জান্নাতে সোনার পালংকে আরোহণ করানো হয়েছে। আমি দেখলাম আবদুল্লাহ৯ ইবনে রাওয়াহার পালংক খানিকটা বাঁকা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি কারণে হয়ে?ে আমাকে জবাব গেওয়া হলো যে, যায়িদ ও জা’ফর মুহুর্তে মাত্র বিলম্ব না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”

খালিদ লোক লস্কর নিয়ে মদীনায় ফিরে চললেন। মদীনার নিকটবর্তী হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাধারণ মুসলমানরা তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন। বিশেষত শিশু ও বালক-বালিকারা অধিকতর দ্রুতগতিতে দৌড়ে এগুতে লাগলো। রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়ে মুসলিম জনসাধারণের সাথে এগিয়ে চলেছেন। তিনি বললেন, “তোমরা শিশুদেরকে নিজ নিজ সওয়ারীর পিঠে তুলে নাও। আর জাফরের ছেলেকে আমার কাছে দাও। আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আনা হলো। তিনি তাকে সওয়ারীর ওপর নিজের সামনে বসালেন।

এ সময় মদীনার মুসলমানগণ এই বাহিনীর দিকে মাটি ছুড়ে মারছিল আর বলছিল, “ওহে পলাতকের দল! তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদে গিয়ে পালিয়েছো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলরেন, “না তারা ভাগেন। বরং তারা নতুন করে হামলা চালবে ইনশাআল্লাহ।”

এই সময় হাস্সান ইবনে সাবিতের কবিতা শুনে মূতার যুদ্ধ-ফেরত সাহাবীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবিতাটির মর্ম নিম্নরুপঃ

“মদীনাতে আমি কাটিয়াছি অপেক্ষকৃত কষ্টদায়ক রজনী

সকল মানুষ যখন ঘুমিয়েছে তখন আমি ঘুমাতে পারিনি।

বন্ধুর স্মুতি আমার চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছে,

বস্তুতঃ স্মৃতিই হলো কান্নার প্রধান উদ্দীপক।

সত্যিই বন্ধুকে হারানো একটা বিরাট পরীক্ষ,

তবে অনেক মহৎ ব্যক্তি আছেন যারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে

ধৈর্য ধারণ করেন।

সর্বোত্তম মুসলমানদের দেখলাম একের পর এক দলে দলে

যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাদের পরপরই ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উত্তর পুরুষগণ।

মূতায় একের পর এক শাহাদাত বরণকারী এই লোকদেরকে

আল্লাহ কখনো নৈকট্য লাভে বঞ্চিত করবেন না,

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলো দুই ডানাধারী জাফর,

যায়িদ ও আবদুল্লাহ। বস্তুতঃ মৃত্যুর কারণগুয/েলা ছিল বড়ই ভয়াবহ।

একদা সকালে তারা মু’মিনদের নিয়ে যুদ্ধে যাত্রা করলো জনৈক ভাগ্যবান

ব্যক্তি ছিল তাদের অধিনায়ক।

বনু হাশিম গোষ্ঠির মধ্যে যিনি পূর্নিমার চা^ঁদের মত দীপ্ত,

যুলুমকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন যেই দুঃসাহসী বীর।

তারপর তিনি প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন রণাঙ্গনের পরাজেয় পৌত্তলিকের ওপর।

অবশেষে এক সময় তিনি বেসালভাবে নুয়ে পড়ে গেলেন।

আর শহীদদের দলভুক্ত হলেন যার পুরস্কার জান্নাত

এবং সবুজ নিবিড় কাননসমুহ।

আমরা জা’ফরের মদ্যে লক্ষ্য করতাম মুহাম্মাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য এবং

নির্দেশ প্রদানের বেলায় সুদৃড় অধিনায়কত্ব।

বনু হশিম বংশে মর্যাদা ও পৌরবের স্তম্ভ এখনো বিদ্যমান।

তারা ইসলামের পর্বত সদৃশ আর তাদের সহচরগণ

সেই সৌম্য দর্শন মহৎ সজ্জনদের মদ্যে রয়েছেন জা’ফর, আলী,

সর্বজনমন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হামযা, আব্বাস ও আকীল।

বস্তুতঃ চন্দন বৃক্ষের যেখানেই নিংড়ানো হোক সেখান থেকে

চন্দনের (অর্থাৎ সুগন্ধিযুক্ত) নির্যাসই বেরুতে বাধ্য।

(অর্থাৎ বনু হামিমের বংশের যে পরিবারেই কোন সন্তান ভুমিষ্ঠ হোক

সে উল্লিখিত সন্তানদের মতই হবে। উক্ত বংশের যে পরিবারেই

সে জন্মলাভ করুক না কেন।)

কোন কঠিন সমস্যায় যখন লোকেরা নিরুপায় ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে,

তখন তাদের দ্বারাই সংকটের সুরাহা হয়।

তাঁরা সব আল্লহর আপনজন, তাঁদের ওপর আল্লাহ

তাঁর বিধান নাযিল করেছেন এবং

তাঁদের কাছেই সুরক্ষিত রয়েছে সেই পবিত্র গ্রন্থ।”


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি