মক্কা বিজয়ঃ ৮ম হিজরী, রমাযান মাস
মূতার যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাদিউস সানী ও রজব মাস মদীনায় অবস্থান করেন।

এই সময় বনু বকর বনু খুযায়া গোত্রের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের কারণ ছিল ইসলাম আগমণের পূর্বে বনু হাদরামী গোত্রের মালিক ইবনে আব্বাদ নামক এক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে খুযায়া গোত্রের বসতিস্থল অতিক্রম করার সময় তাদের লোকেরা তাকে হত্যা করে এবং তার কাছে যা কিছু ছিল ছিনিয়ে নেয়। এর ফলে বুন বকর জনৈক খুযায়ীর ওপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধে খুযায়া গোত্র ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে বনু বকরের একাংশ বনু দায়েলের সরদার আসওয়াদের তিন সন্তান সালমা, কুলসুম ও যুয়াইবকে হারাম শরীফের সীমানার কাছে হত্যা করে। কেননা আসওয়াদ ছিল হাদরামীর তি¤্র। এই বিষয় নিয়ে বনু বকর ও বনু খযায়ার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলে আসছি। ইসলামের অব্যুদয় ঘটার ফলে উভয় গোত্রের এই উত্তেজনা স্তিমিত হয় এবং তাদের মনোযোগ চলে যায় ইসলামের দিকে। কুরাইশগণ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধিতে একটি শর্ত ছিল এ যে, কোন তৃতীয় পক্ষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা কুরাইশদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করতে পারবে। তদনুযায়ী বনু বকর কুরাইশদের এবং বনু খযায়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিত্রতার ঘোষণা করে।

চুক্তি সম্পাদিত হওয়অর পর বনু বকরের শাখা বনু দায়েল বনু খযায়ার দ্বারা আসওয়াদের উক্ত তিন সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করে। তাই বনু দায়েল পরিবারের প্রধান নাওফেল ইবনে মুয়াবিয়া প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। উল্লেখ্য যে, এই লোকটির গোটা বনু বকরের ওপর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। একদিন রাত্রে খুযায়া গোত্রের লোকেরা তাদের নিজস্ব ঝর্ণা ওয়াতীরে আবস্থানকালে নাওফেল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তিলে খুযয়ীদের একজনকে হত্যা করলো। আর যায় কোথায়। উভয় গোত্র অন্যান্য গোত্রের সাথে দল পাকিয়ে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। কুরাইশরা এই সময় বনু বকরকে অন্ত্র দিল এবং তাদের সহযোগিতায় কুরাইশদের অনেকেই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে খযায়ীদের সাথে যুদ্ধ করলো। গিশেহারা হয়ে খুযায়া গোত্র মসজিদুল হারামের নিষিদ্ধ গন্ডীর মধ্যে আশ্রয় নিল। নাওফেলের নেতৃত্বে প্রতিহিংসাপরায়ণ দায়েল গোত্রের লোকেরা তাদের ধাওয়া করে হারাম শরীফ পর্যন্ত এলো। বনু বকরের লোকেরা নাওফেলকে বললো “হে নওফেল, এবার থামো। আমরা এখন হারাম শরীফের অভ্যন্তরে আছি। খোদাকে ভয় কর।”

তখন নাওফেল একটা সাংঘাতিক কথা বলে বসলো। সে বললো, “আজকে তার কোন ইলাহ বা প্রভু নেই। হে বনু বকর, তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তোমরা তো হারাম শরীফে চুরি করতেও কুণ্ঠিত হও না। (উল্লেখ্য যে কা’বা শরীফের সোনার তৈরী বহু মূল্যবান মূর্তি চুরি করার অভিযোগ কুরাইশদের বিরুদ্ধে ছিল।) এখন এখানে প্রতিশোধ নিতে কুণ্ঠিত হও কেন?” ইতিপূর্বে ওয়অতীর ঝর্ণার কাছে রাতের আঁধারে ‘মুনাব্বিহ’ নামক জনৈক দুর্বলচিত্ত খুযারীকে হত্যা করেও তাদের পিপাসা মেটেনি। মুনাব্বিহ তামীম ইবনে আসাদ নামক তার গোত্রের অপর এক ব্যক্তিকে সাথে করে বেরিয়েছিল। মুনাব্বিহ বললো “হ তামীম, তুমি নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর। আমি তো মরতেই যাচ্ছি। তারা আমাকে হয় হত্যা করবে নয় ছেড়ে দেবে।” তামীম সেখান থেকে পালিয়ে গেল আর তারা মুনাব্বিহকে হত্যা করলো।

খুযায়ার লোকেরা মক্কায় তাদের এক মিত্র বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাবেক এক গোলাম রাফের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও বনু বকর ও কুরাইশদের মিলিত আক্রমণে খুযায়ার অনেকেই প্রাণ হারায়। এভঅবে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লামের মিত্র বনু খুযায়াকে হারাম শরীফের নিষিদ্ধ স্থানে হত্যা করে হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। এরপর আমর ইবনে সালেম খুযায়ী ও বনু কা’বের এক ব্যক্তি মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের সাতে সাক্ষাত করে সব ঘটনা বিবৃত করে। এই ঘটনা ছিল মক্কা বিজয়ের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদে লোকজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে ছিলেন তখন সে সেখানে গিয়ে উপনীত হয় এবং একটি কবিতা আবৃত্তি করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। কবিতাটির মর্ম এই:

“হে প্রভু! আমি মুহাম্মাদের নিকট আমাদের পিতা ও তাঁর পিতার পুরানো মৈত্রীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ও তা কার্যকরী করার অনুরোধ জানাই। তোমরা সন্তান ছিলো। আর আমরা পিতা ছিলাম। সেখানে আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তা ত্যাগ করিনি। আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমাদেরকেত অবিলম্বে সাহায্য কর। আর আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান কর যেন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন যিনি (চুক্তি থেকে) বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। তাকে যদি আবমাননা করা হয় তাহলে তাঁর মুখে কলংক লেপন করা হবে। তিনি রয়েছেন এমন একটি বাহিনীর সঙ্গে যা সমুদ্্েরর মত ফেনারাশি নিয়ে প্রবাহিত। জেনে রাখ) কুরাইশরা তোমার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারা তোমার সন্ধি লংঘন করেছে এবং কাদা নামক স্থানে আমার জন্য গুপ্ত ঘাঝটি স্থাপন করেছে। তারা সংখ্যায় অল্প ও শক্তিতে অপেক্ষাকৃত হীনবল। তারা আল ওয়াতীরে গোপন রাত্রি যাপন করেছে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাহিনী শুনে বললেন, “ হে আমর, তোমাকে সাহায্য করা হবে।” এর অব্যবহিত পর তিনি আকাশে এক খন্ড মেঘ দেখে বললেন, “এই মেঘখন্ডটিই বনু কা’বের সাহায্যের সূচনা করবে।”

এরপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা বনু খুযায়ার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তাঁকে তাদের বিপদ মুসিবতের কথা এবং কুরাইশরা বনু বকরকে তহাদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার কথা অবহিত করলো। অতঃপর মক্কায় ফিরে গেল। তার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে জানালেন “তোমরা ধরে নিতে পার যে, আবু সুফিয়অন তোমেদের কাছে এসেছে এবং সন্ধি চুক্তি অলংঘনীয় করা ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে।”

বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা ও তার সাথীরা মক্কায় ফিরে যাওয়ার সময় উসফানে আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের সাথে তাদের সাক্ষাত হলো। কুরইশরা তাকে রাসূলুল্লাহর নিকট সন্ধি চুক্তিকে অলংঘনীয় ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য াফিয়েছে। কেননা তারা বনু খুযায়ার সাথে যে আচরণ করেছে তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “বুদাইল, তুমি কোথা থেকে আসছো।” সে ধারণা করেছিল যে বুদাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের কাছেই গিয়েছিল। বুদাইল জবাব দিল, “এই এলাকায় বনু খুযায়ার লোকদের সাথে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম।” আবু সুফিয়অন বললো “তুমি মাহাম্মাদরে কাছে যাওনি?” সে বললো ‘না।’ বুদাইল মক্কা চলে গেলে আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট থামানোর জায়গায় গিয়ে তার গোবর পরীক্ষা করলো। গোবরের মধ্যে খেজুরের আটি দেখে বললো, “নিশ্চয়ই বুদাইল মুহাম্মাদের নিকট গিয়েছিল।” খেজুরের আটিকে সে তার মদীনায় যাওয়ার আলামত হিসেবে গণ্য করলো।

তারপর আবু সুফিয়ান রওনা হয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছে নিজের কন্যা উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার কাছে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বসার উপক্রম করতেই উম্মে হবীবা বিছানা গুেিয় ফেললেন। তা দেখে আবু সুফিয়ান বললে, “হে আমার কন্যা তুমি কি আমাকে ঐ বিছানায় বসার যোগ্য মনে করনি?” উম্মে হাবীবা বললেন, “ওটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের বিছানা। আর আপনি একজন মুশরিক, অপবিত্র। আমি চাই না যে, আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বনে।” আবু সুফিয়ান বললো “হ আমার কন্যা, আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার তুমি খারাপ হয়ে গিয়েছো।”

আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলো এবং কথা বললো। কিন্তু তিনি তার কোন কথার জবাব দিলেন না। অতঃপর সে আবু বাকরের (রা) নিকট গিয়ে এ মর্মে অনুরোধ করলো যাতে তিনি রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার সম্পর্কে সুপারিশ করেন। আবু বাক্র (রা) এ অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।

অতঃপর সে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) নিকট গিয়ে অনুরুপ অনুরোধ করলো। উমার বললেন “কি বলছ্!ো আমি তোমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামের নিকট সুপারিশ করবো? আমি যদি ছোট ছাড়া কোন সহযোগী না পাই তবুও তোমার সাথে লড়াই করবো?”

এরপর সে আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) নিকট গেল। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতিমা (রা) ছিলেন। তাঁর সামনে শিশু হাসান (রা) হামাগুড়ি দিচ্ছিলো। সে বললো, “হে আলি তুমি আমার প্রতি সর্বাধিক দয়ালু। আমি তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে। ব্যার্থ হয়ে ফিলে যেতে চাই না। কাজেই তুমি আমার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সুপারিশ কর।” তিনি বললেন, “ধিক তোমাকে হে আবু সুফিয়অন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প গ্রহণ করেছেন, আমরা সে সম্পর্কে তাঁর সাথে কথা বলতে অক্ষম।”

অনন্যোপায় হয়ে আবু সুফিয়ান ফাতিমার (রা) দিেিক তাকালো। বললো, “হে মুহাম্মদের কন্যা।! তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার এই শিশু পুত্র লোকজনকে রক্ষা করার নির্দেশ দেবে আর তার ফলে সে চেরকালের জন্য আরবের নেতা হয়ে থাকবে?” ফাতিমা (রা) বললেন, “আমার ঐ ছেলে লোকজনকে রক্ষ করার যোগ্য হয়নি। তাচাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না।”

আবু সুফিয়ান বললো, “হে আলী! আমি দেখছি পরিস্থিিিত আমার প্রতিকূল। এখন আমাকে একটা সদুপদেশ দাও।” আলী (রা) বললেন, “তোমার উপকারে আসবে এমন কোন উপদেশ আমার জানা নেই। তবে তুমি তো বনু কিনানা গোত্রের নেতা। তুমি যাও, লোকজনকে রক্ষা কর। অতঃপর তোমার জন্মস্থানে অবস্থান করতে থাক।” সে বললো, “এতে আমার শেষ রক্ষা হবে তো?” আলী (রা) বললেন, “তা আমার মনে হয় ন্ াতবে এ ছাড়া তোমার জন্য আর কোন উপায়ও দেখছি না।” অতঃপর আবু সুফিয়ান মসজিদে গিয়ে ঘোষণা করলো “হে জনতা! আমি সকল মক্কাবাসীর রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি।” এই বলেই সে উটে চড়ে প্রস্থান করলো। কুরাইশদের কাছে গেলে তারা জিজ্ঞোস করলো, “কি করে এসেছো?” সে সে বললো, “মাহাম্মাদের কাছে গিয়ে কথা বললাম। সে কোন কথারই জবাব দিব না। তারপর আবু বাকরের কাছে গেলাম। সেও কোন আশাপ্রদ কথা বললো না। তারপর গেলাম উমারের কাছে। তাকে সবচেয়ে কট্রর দুশমন পেলাম। তারপর আলীর সাথে দেখা করতে গেলাম। তাকে সবার টাইতে নমনীয় মনে হলো। আলী আমাকে একটা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। সে কাজ আমি করেছি। জানি না তাতে কিছু হবে কি না।”

সবাই বললো, “আলী তোমাকে কি করতে বলেছে?” আবু সুফিয়ান বললো সে আমাকে বলেছিল মক্কাবাসীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে। সেটা আমি ঘোষণাদিয়ে এসেছি।” জনতা বললো, “মুহাম্মদ কি তোমাকে এ কাজ করার অনুমতি দিয়েছে?” সে বললো ‘না।’ জনতা বললো “তাহলে আলী তোমার সাথে তামাশা করেছে মাত্র। এ তোমার কোন উপকারে আসবে না।” সে বললো, “কিন্তু এছাড়া আমার কোন গত্যন্তুর ছিল না।”

রাসূলুল্লাহা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সকল মুসলমান এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। আবু বাক্র (রা) তাঁর কন্যা আয়িশার (রা) কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি জিনিসপত্র গোছগাছ করভেন। তা দেখে তিনি বললেন, “হে আয়িশা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন?” আয়িশা (রা) বললেন, “হাঁ আব্বা আপনিও প্রস্তুতি নিন।” আবু বাক্র বললেন, “তিনি কোথায় যেতে মনস্থ করেছেন বলে মনে কর।” আয়িশা বললেন, “জানি না।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সুষ্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করতে যাচ্ছেন। তিনি তাদেরকে সফরের জন্য তৈরী হতে বললেন। তিনি আরও বললেন,!“হে আল্লাহ! কুরাইশদের থেকে আমাদের প্রস্তুতির যাবতীয় খবর গোপন রাখুন যাতে আমরা তাদের ওপর আকস্মিকভাবে গিয়ে চড়াও হতে পারি।” মুসলমানগণ অল্পক্ষনের মাধ্যেই তৈরী হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন এমনস সময় সাহাবী হাতিব ইবনে আবু বালতায় (রা) জনৈক মহিলার মাধ্যমে কুরাইশদের কাছে একটা চিঠি পাফিয়ে দিলেন। চিঠিতে জানিয়ে দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে যাওয়ার আয়োজন করেছেন। মহিলা চিঠিটা তার খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে রওয়ানা হলো। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাতিবের কারসাজির রহস্য ফাঁস করে দিলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, তোমরা পথিমধ্যে সেই মহিলাকে পাকড়রও করবে এবং তার কাছে থেকে হাতিবের চিঠি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে- যাতে হাতীব মক্কাবাসীকে আমাদের অভিযান প্রস্তুতির সব খবর জানিয়ে সাবধান করে দেয়েছে।” তাঁরা উভয়ে রওনা হয়ে গেলেন এবং খলীফা নামক স্থানে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। তারা তাকে উট থেকে নামিয়ে তার উটের হাওদার মধ্যে চিঠির সন্ধান করলেন। কিন্তু পেলেন না। আলী (রা) বললেন “আল্লাহর কসম্ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মিথ্যা হতে পারে না এবং আমরাও মিথ্যা বলছি না। এই চিঠি বের করে দাও, নচেত আমরা তোমার দেহ তল্লাশী করবো।”

মহিলা যখন দেখলো আলী (রা) নাছোড়বান্দা, তখন সে বললো, তুমি অন্য দিকে মুখ ফিরাও।” তিনি মুখ ফিরালেন। মহিলা নিজের খোঁপা খুলৈ চিঠি বের করলো। আলী (রা) ও যাবাইর (রা) চিঠি নিয়ে রাসূলুল্লাহর দরবারে উপস্থিত হলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতিবকে ডেকে তার চিঠি পাঠানোর কারন জিজ্ঞেস করলেন। হাতিব বললেন, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি আমার ঈমানে বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন আসেনি। মক্কায় আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। অথচ কুরাইশদের মধ্যে আমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়েছে। তাই এভাবে আমি তাদের সহানুভুতি লাভ করতে চেয়েছি।”

উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে মুনাফেকী করেছে। আমাকে অনুমতি দিন তার ঘাড় কেটে ফেলি।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে উমার, তোমার তো জানা নেই। এমনও তো হতে পারে যে আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরকে বদরের দিন বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যাখুশী কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।”

আল্লাহ তায়ালা হাতিব সম্পর্কে সুরা মুমতাহিনায় আয়াত নাযিল করলেন: “হে মুমিনগণ! যারা আমার ও তোমাদের শত্রু তাদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা দেখিয়ে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়ো না। ……… ইবরাহীম ও তার সহচরদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। সে তার জাতিকে বলেছিলো, আমরা তোমাদের ও আল্লাহ ছাড়া আর যাদের তোমরা দাসত্ব করছো- পরোয়া করি না। আমরা তোমাদের সম্পর্ককে অস্বীকার করলাম। আর আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতার উদ্ভব হয়েছে যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহকে মা’বুদ বলে মেনে নাও।”

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হলেন। এ সময় আবু বুরহুম গিফারীকে মদীনায় তাঁর খলিফা নিয়োগ কররৈন। রমযানের দশ দনি অতিবাহিত হবার পর তিনি যাত্রা করলেন। তিনি নিজে এবং মুসলমানগণ সকলেই রোযা রাখলেন। উসফান ও আমাদের মধ্যবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে পৌছলে সকলে ইফতার করলেন।

এখান থেকে দশ হাজার মুসলমানকে সাথে নিয়ে তিনি আবার রওনা করলেন এবং মাররুয যাহরানে পৌছে যাত্রাবিরতি করলেন। পথিমধ্যে বনু সুলাইমের সাতশ মতান্তরে এক হাজার ও বনও মুযাইনার এক হাজার লোক তাঁর সাথে যোগ দিল। এ সময় আরবে এমন কোন গোত্র ছিল না যার বেশ কিছু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি। মুহাজির ও আনসারদের সকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং কোন একজনও পিছপা হননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরোনে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। তখনো পর্যন্ত কুরাইশরা তাঁর যাত্রা বা তিনি কি করতে যাচ্ছেন তা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেননি। ঐ সময় এক রাতে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করতে বের হলো। পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) সালুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করেছিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ইবনে মুগীরা পথিমধ্যে (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী) নাইফুল উকাব নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে উপনীত হলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাল্লামের সাক্ষাতপ্রার্থী হলে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনা রচাচাতো ভাই ও শ্যালক এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ ওদের দিয়ে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার চাচাতো ভাই তো আমাকে অপমান করেছে। আর আমার শ্যালক (আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া উম্মে সালামার সৎ ভাই) মক্কায় অবস্থানকালে আমার চরম বিরোধীত করেছে।”

তারা যখন উভয়ে এই জবাব পেলো তকন আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস বললো “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে সাক্ষাত করার সুযোগ না দেন তাহলে আমি আমার এই ছেলে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে একদিকে চলে যাবো এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মরবো।”

একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন বিগলিত হলো। তিনি অনুমতি দিলেন। তখন তার াউভয়ে তাঁর কাছে গেলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইতিপূর্বে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক যেসব কবিতা আবৃত্তি করেছেন তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। ইসলাম প্রহণ করার পর নতুন কবিতা আবৃত্তি করলেন? এ কবিতার মর্ম নিম্ন রুপঃ

“আমি যেদিন সেনাপতি হয়ে লড়াই করবো, মুহাম্মাদের বাহিনী

মুশরিক বাহিনীর ওপর অবশ্যই জয়যুক্ত হবে।

(মুশরিক বাহিনী) রাতের আঁধারে দিশেহারা যাত্রীর মত।

আজ আমার পালা এসেছে যখন আমি হিদায়াত লাভ করেছি।

আমাকে সেই হিদায়াতকারী হিদায়াত করেছে, বদলে দিয়েছে

এবং আমাকে আল্লাহর সাহচর্য পৌছিয়ে দিয়েছে

যাকে আমি (একদিন) দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

সেদিন আমি মুহাম্মাদের মাঝে আন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং

তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে রণপাঁয়তারা করেছিলাম,

আর আমাকে মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ডাকা হচ্ছিলো

যদিও আমি তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট হইনি।

তিনি যে পথে চলছিলেন সে পথেই চলতে থাকলেন-মুশরিকদের

খেয়াল খুশী মুতাবিক কথা বললেন না

যদিও তিনি বিশুদ্ধ মতের অধিকারী হিসেবে কথা বলছিলেন

তথাপি তাঁকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করা হয়েছিল।

যতক্ষন আমি হিদায়াত পাইনি ততক্ষণ প্রত্যেকে বৈঠকে তাদেরকে (মুশরিকদেরকে)

খুশী করতে চেয়েছিলাম এবং (মুসলিম) জনতার সাথে সংযুক্ত হইনি।

সুতরাং বনু সাকীফকে বলে দাও, আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না।

বনু সাীফকে বলে দাও, আমাকে নয় অন্য কাউকে ভীতি প্রদর্শন করুক।

কেননা আমি সেই বাহিনীর ভেতরে ছিলাম না যে বাহিনী

জনপদকে আক্রমণ করেছিল

এবং সে আক্রমণ আমার জিহ্বা কিংবা হাতের দ্বারা সংঘটিত হয়নি।

সে বাহিনীতে ছিল দূরাঞ্চল থেকে আগত গোত্রসমূহ যে এবং

সাহাম ও সুরদাদ থেকে আগত অচেনা যোদ্ধারা।”

কথিত আছে যে, তিনি যখন কবিতার এই অংশটি আবৃত্তি করছিলেন, “আমাকে আল্লাহর সাহচর্যে পৌছিয়ে দিয়েছে সেই ব্যক্তি যাকে আমি বহু দূরে তড়িয়ে দিয়েছিলাম” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুক চাপড়ে বলেছিলেন, তুমিই তো আমাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরানে যাত্রাবিরতি করলে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব প্রমাদ গুলেন। তিনি বুঝলেন যে কুরাইশরা যদি স্ব উদ্যোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্রামের কাছে এসে সন্ধি না করে এবং তিনি যদি জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেন তাহলে কুরাইশরা চিরতরে নির্মুল হয়ে যাবে।

আব্বাস (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরটিতে আরোহণ করে আরাক নামক স্থানে এস খোঁজ করতে লাগলাম কোন কাঠুরিয়া, দুধওয়ালা কিংবা আর কোন লোক মক্কায় যায় কিনা। তাহলে বলবো মক্কাবাসীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের খবর দিতে যাতে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করার আগে তাঁর কাছে এসে সন্ধি করে।

আমি এই অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার কথাবার্তা শুনতে পেলাম। তারা উভয়ে কথাবার্তা বলছিল। আবু সুফিয়ান বলছিল “গতরাত্রে আমি যে রকম আগুন দেখলাম এমন আগুন আর কখনো দেখিনি এবং এত বড় বাহিনীও আর কখনো দেখিনি।” বুদাইল বলছিল, “এটা নিশ্চয়ই খুযায়া গোত্রের বাহিনী। তারা নিশ্চয়ই যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়েছে।” আবু সুফিয়ান জবাব দিল, “খুযায়ার এত প্রতাপ ও জনবল নেই যে, এত আগুন জ্বালাবে এবং এত বড় বাহিনীর সমাবেশ ঘটাবে।” আমি আবু সুফিয়ানের কন্ঠস্বর চিনতে পেরে বললাম, “ওহে আবু সুফিয়ান।” সে বললো “কে আব্বাস নাকি?” আমি বললাম, ‘হাঁ।’ সে বললো “খবর কি?” আমি বললাম, “তুমি জান না? এই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী। আল্লাহর শপথ! কুরাইশদের জবীন বিপন্ন।” সে বললো “তাহলে এখন উপায় কি?” আমি বললাম,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাকে হাতে পান তাহলে খুন করে ফেলবেন। অতএব এই খচ্চরের পেছনে ওঠো। আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে নিয়ে গিয়ে তোমার জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।”

অতঃপর সে আমার পেছনে চড়ে বসলো। আর তার সঙ্গীদ্বায় ফিরে গেল। আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আমি মুসলিম বাহিনীর এক এক অগ্নিকুন্ডের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই বলিেছলো, “এ কে?” কিন্তু একবার নজর বুলিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরে আমাকে আরোহী দেখে প্রত্যেকেই শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমার পেছনে যে আবু সুফিয়ান রয়েছে তা কেউ লক্ষ্য করছিল না।

উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সামনে দিয়ে যখন অতিক্রম করলাম তখন তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। পেছনে আবু সুফিয়ানকে বসা দেখে বললেন, “আল্লাহর শত্রু আবু সুফিয়ান! আল্লাহর শুকরিয়া যে, কোন চুক্তি ছাড়াই তোমকে আমাদের হস্তগত করে গিয়েছেন।” একথা বলেই তিনি দৌড়ে চললেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। এদিকে আমিও দ্রুত ছুটলাম। উমার ও খচ্চর কেউই তেমন দ্রুতগামী ছিল না। তথাপি খচ্চর একটু আগে গেল। খচ্চর থেকে নেমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের নিকট গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে উমার (রা) ও গেলেন সেখানে। তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই যে আবু সুফিয়ান। আল্লাহ ওকে অনায়াসেই জুটিয়ে দিয়েছেন। ওর সাথে আমাদের কোন চুক্তিও হয়নি। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিন ওর গর্দান উড়িযে দিই।”

আমি বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি।” অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসলাম এবং তার মাথা আকর্ষণ করে বললাম, “আল্লাহর কসম, আজ রাতে ওকে আমি ছাড়া কারো সাথে একা থাকতে দেব না।”

উমার (রা) আবু সুফিয়ান সম্পর্কে অনেক কথা বলতে লাগলেন। তা শুনে আমি বললাম, “চুপ কর, উমার! আবু সুফিয়ান বনু কা’ব গোত্রের লোক হলে (বনু কা’ব উমার (রা) এর গোত্র) তুমি এ রকম বলতে না। বনু আবদ মানাফের লোক বলেই তুমি এ রকম বলছো।”

উমার বললেন, “আব্বাস! আপনি এ রকশ কথা বলবেন না। আমার পিতা যদি ইসলাম গ্রহন করতেই তবে তাঁর ইসলামের চাইতে আপনার ইসলাম গ্রহণ আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আবু সুফিয়ানকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

আমি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে গেলাম। রাত্রে সে আমার কাছে থাকলো। সকাল বেলা তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক তোমাকে। আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই একথা মেনে নেয়ার সময় কি তোমার এখনো হয়নি?” সে বললো, “আপনার উদারতা, মহত্ত্ব, স্বজনবাৎসল্য অতুলনীয়। আমার ধারণা, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ যদি থাকতো তাহলে এতদিনে আমাকে সাহায্য করতো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক্ তোমাকে! আমি যে আল্লাহর রাসূল, তা কি এখন পর্যন্ত তুমি উপলদ্ধি করনি?” আবু সুফিয়ান বললো, “আপনার জন্য আমার মাতাপিতা উৎসর্গ হোক! আপনি এত উদার সহনশীল এবং আত্মীয় সমাদরকারী যে, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না। তবে আপনার রাসূল হওয়া সম্পর্কে আমার একনো কিছু দ্বিাধা-সংশয় রয়েছে।” আব্বাস তখন বললেন, “ধিক তোমাকে! ইসলাম গ্রহণ কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। নচেত এক্ষুণি তোমার গর্দান মারা হবে।”

আবু সুফিয়ান সত্যের সাক্ষ্য দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর আব্বাস (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু সুফিয়ান একটু মর্যাদা লোভী। কাজেই তাকে গৌরবজনক একটা কিছু দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্ইাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিজের বাড়ীর দরজা বন্ধ করে রাখবে সেম নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি সমজিদুল হারামে প্রবেশ করবে তাকেও কিছু বলা হবে না।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট থেকে বের হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, তাকে উপত্যকার কিনারে পাহাড়ের মাথায় গিরিপথে একটু থমিয়ে রাখো। আল্লাহর সৈনিকরা তার সামনে দিয়ে যাক এবং সে তাদেরকে দেখুক।” আব্বাস বলেন, এরপর আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জায়গার কথা বলেছিলেন সেই গিরিপথে তাকে থামিয়ে রাখলাম। এরপর বিভিন্ন গোত্র নিজ নিজ পতাকার পেছনে সারিবদ্ধভাবে রওনা হলো। যখনই একটা গোত্র তার সামনে দিয়ে যায়, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, “হে আব্বাস! এরা কারা?” আমি বলি, “এরা বনু সুলাইম অথবা বনু মুযাইনা অথবা অমুক গোত্র, তমুক গোত্র।” আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ এদের সাথে আমার কোন তুলনাই হয়না।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিজের সবুজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। [৮১. এই বাহিনীকে সবুজ বাহিনী বলা হয় এই জন্য যে, এতে লোহা নির্মিত জিনিসের সমাবেশ ঘটেছিল সর্বাধিক পরিমাণ। (ইবনে হিশাম)] এতে মুহাজির ও আনসারদের সমাবেশ ঘটেছিল। এ বাহিনীতে লোহার ধারালো অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। আবু সুফিয়ান বললো, “সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! হে আব্বাস এর কার?” আমি বললাম “এ বাহিনীতে রয়েছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর সাথে আছেন মহাজির ও আনসরাগণ। সে বললো, “এ বাহিনীর মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহর শপথ, হে আব্বাস! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র আগামীকাল এক বিরাট সা¤্রাজ্যের অধিপতি হতে যাচ্ছেন।” আমি বললাম, “হে আবু সুফিয়ান! এটা কোন রাজকীয় ব্যাপার নয়। এটা নবুয়াতের প্রতাপ।” সে বললো, “তাহলে এটা কতই না চমৎকার।” আমি বললাম, “তুমি তাড়াতাড়ি কুরাইশদের কাছে চলে যাও।” আবু সুফিয়ান মক্কা গিয়ে ঘোষণা করে দিল, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মদ এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছে যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। এখন আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে যে আশ্রয় নেবে তার ভয় নেই।”

এই সময় উতবার কন্যা হিন্দ আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে তার গোঁফ টেনে ধরে বললো, “হে কুরাইশগন, এই মোটা পেটুককে হত্যা কর। জাতির নেতৃত্বের মর্যাদায় থেকে সে কলংকিত হয়েছে।”

আবু সুফিয়ান বললো, “তোমাদের বিপর্যয় সম্পর্কে সাবধান হও। এই মহিলার কথায় তোমরা বিপথগামী হয়ো না। তোমাদের ওপর এক অপ্রতিরোধ্য বাহিনী সমাপত। এমতাবস্থায় আমার বাড়ীতে যে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে।”

সবাই বললো, “তোর ওপর অভিসম্পাত! তোর বাড়ী আমাদের কি কাজে আসবে?” আবু সুফিয়ান বললো, “ যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে এবং যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থকবে।”

লোকেরা সবাই যার যার বাড়ীতে অথবা মসজিদুল হারামে চলে গেল।

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) যিতুয়ার পৌছে লাল ইয়ামানী কাপড় দিয়ে পাগড়ী বাধলেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহের ফলে যে বিজয় লাভ করতে চলেছেন তার জন্য মাথা নীচু করে চলতে লাগলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি মাথা এত নীচু করেছিলেন যে তাঁর দাড়ি উটের দেহ স্পর্শ করছিল।

আসমা বিনতে আবু বাক্র (রা) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সা) যখন যিতুয়াতে থামলেন তখন আবু কুহায়া (আবু বাকরের (রা) পিতা) তার এক অল্প বয়ষ্কা কন্যাকে বললেন, “আমাকে আকু কুবাইস পাহাড়ের ওপর নিয়ে চল।’ আবু কুহাফা তখন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়েটি তাকে পাহাড়ের ওপর নিয়ে গেল। তখন আবু কাহাফা তাঁর কন্যাকে বললেন, “ তুমি কি দেখছো?” সে বললো, “একটা বিরাট সনসমাবেশ দেখতে পাচ্ছি।” তিনি বললেন, “ঐ তো সেই বাহিনী।” মেয়েটি বললো, “আরো দেখতে পাচ্ছি এক ব্যক্তি ঐ জনসমাবেশের সামনে একবার আগে আর একবার পেছনে ছুটছে।” তিনি বললেন, “তিনি ঐ বাহিনীল অধিনায়ক।” মেয়েটি বললো, “এবার জনসমাবেশটি বিচ্ছিন্ন হয়েছে।” আবু কুহাফা বললেন, “তাহলে বাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।” এবার আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ী নিয়ে চল। মেয়েটি তাঁকে নিয়ে পাহাড় থেকে নামলো।। আবু কুহাফা বাড়ী পৌছার আগেই বাহিনী তাঁর কাছে পৌছে গেল। মেয়েটির গলায় একটি রুপার হার ছিল, কে একজন তা ছিনিয়ে নিল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌছে সমজিদুল হারামে প্রবেশ করলে আবু বাক্র (রা) তার পিতাকে নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে বললেন, “এই বৃদ্ধকে ঘরে রেখে এলে না কেন?” আমিই তার কাছে যেতাম।”

আবু বাক্র (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার যাওয়ার চাইতে তাঁর আসাই অধিকতর শোভনীয়।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সামনে বসালেন। অতঃপর তাঁর বুকে তাহ বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন।” তঃক্ষনাঃ আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর আবু বাক্র তাঁকে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। এ সময় আবু কুহাফার মাথায় ‘সাগামা’ নামক সাদা এক ধরনের গুল্ম জড়ানো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাঁর চুল থেকে এটা সরিয়ে দাও।”

অতঃপর আবু বাক্র তাঁর বোনের হাত ধরলেন। বললেন, “আল্লাহর কসম, আমার বোনের জন্য আজ ইসলামই গলার হার?” এর জবাবে কেউ কিছু বললো না। আবু বাক্র বললেন, “হে আদরের বোন! তোমার হার হারিয়ে যাওয়াতে মনে কষ্ট নিও না।”

মক্কা বিজয় ও তায়েফের যুদ্ধে দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ মুহাজিরদের জন্য ‘বনু আবদুর রহমান’ খাযরাজ গোত্রের জন্য ‘বনু আবদুল্লাহ’ এবং আওসের ‘বনু উবাইদুল্লাহ’ সাংকেতিক নাম রেখেছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশের নির্দেশ দেন তখন মুকলিম অধিনায়কগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, “হামলা না চালানো হলে কারো সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না।” কেবল কয়েকজন লোকরে নাম উল্লেখ করে বলেন যে, “এর কা’বার গিলাফের মধ্যে লুকিয়ে থকালেও তাদেরকে হত্যা করবে।” এদের একজন বনু আমেরের আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ। এই ব্যক্তি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে ওহী লেখক হিসেবে নিয়োজিত হয়। তারপর পুনরায় ইসলাম ত্যাগ করে মুশরিকহয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে যায়। এ জন্য রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাত তাকে হত্যা করাা নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পালিয়ে তার দুধভাই উসমান ইবনে আফফানের কাছে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কলে। উসমান (রা) তাকে লুকিয়ে রাখেন। পরে মক্কার অবস্থ াস্বাভাবিক এবং জনগণ শান্ত হয়ে আসলে তিনি তাকে রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লেেমর নিকট হাজির করেন। উসমান (রা) তার প্রাণের নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম কোন জবাব না দিয়ে দীর্ঘ নীরবতা পালন করেন। অতঃপর বলেন “আচ্ছা।” পরে উসমান (রা) চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি চুপ ছিলাম যাতে তোমরা কেউ তাকে হত্যা করার সুযোগ পাও।” আনসারী সাহাবাদের একজন বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে একটু ইংগিত দিলে পারতেন।” তিনি বলরেন, “কোন নবী ইংগীত দিয়ে মানুষ হত্যা করায় নসা।” [৮২.ইবনে হিশাম বলেন, এই ব্যক্তি পরে আবার ইসলাম গ্রহন করেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর খিলাফত আমলে তাকে সরকারী কাজে নিয়োজিত করেন। পরে তৃতীয় খলিফা উসমান (রা) তাঁকে সরকারী কাজের দায়িত্ব দেন।]

দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল বনু তামীম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল। তাকে হত্যার নির্দেশ প্রদানের কারণ ছিল, সে যখন মুসলমান ছিল তখন তাকে অপর এক ব্যক্তির সাথে যাকাত আদায় করতে পাঠানো হয়। তার সাথে একজন মুসলমান খাদেমও ছিল। পথিমধ্যে এক জায়গায় তারা যাত্রাবিরতি কলে। এই সময়ে সে ভৃত্যকে একটি ছাগল জবাই করে খাবার তৈরী করতে বলে। কিন্তু ভৃত্যটি খাবার তৈরী না করে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সে তাকে হত্যা করে ইসলাম ত্যাপ করে মুশরিক হয়ে যায়।

তার দ’জন দাসী ছিল। তারা রাসুলূল্লাহ সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক গান গাইত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে খাতালকে তার দুই দাসীসহ তহ্যার নির্দেশ দেন।

আর একজন হলো ‘হুয়াইরিস ইবনে সুকাইজ’। সে মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহকে উত্যক্ত করতো।

আর একজন মিকইয়াস ইবনে লুবাবা। একজন আনসারি সাহাবা ভুলক্রমে তার ভাইকে হত্যা করলে মিকইয়াস উক্ত আনসারীকে হত্যা করে। অতঃপর মুশরিক হয়ে কুরাইশদের কাছে চলে যায়। একজন্য তিনি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।

আর একজন হলো বনু আবদুল মুত্তালিবের আবাদকৃত দাসী সারা। সেও মক্কায় অবস্থানকালে রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামকে উত্যক্ত করতো।

আর একজন আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা।

ইকরিমা ইয়ামানে পালিয়ে যায় এবং তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতে হারেস ইসলাম গ্রহণ করে। উম্মে হাকীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্াইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইকরিমার নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে নিরাপত্তা দেন। তখন সে ইকরিমাসে ইয়ামান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। পরে ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করে।

আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল ও মিকইয়াসকে হত্যা করা হয। তবে আবদুল্লাহর দাসীদ্বয়ের একজনকে হত্যা করা হয়। অপরজন পালিয়ে যায়। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। সারাকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে। আলী (রা) হয়াইরিসকে হত্যা করেন।

আবু তালিবের কন্যা উম্মে হনী (রা) বলেনঃ মক্কা বিজয়ের প্রক্কালে বনু মাথযুম গোত্রের আমার দুই দবের পালিয়ে এসে আমার কাছে আশ্রয় নেয়। উম্মে হানীয় স্বামী ছিল মাখযুম গোত্রের হুবাইয়া ইবনে আবু ওয়াহাব। উম্মে হনী বর্ণনা করেনঃ তারা আমার কাছে আসার সাথে সাথে আমার ভাই আলী ইবেন আবু তালিব (রা) আমার কাছে এসে বললেন “আমি ওদেরকে হত্যা করবো।” আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি তখন গোসল করছিলেন। গোসলের পাত্রে খামীর করা আটা লেগেছিল। ফাতিমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দিলেন। গোসল সম্পন্ন করে তিনি আট রাকাআত যুহার নামায পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোশ আমদেদ হে উম্মে হানী! তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো, আমিও তাকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছো আমিও তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। কাজেই আলী যেন তাদেরকে হত্যা না করে।”

সাফিয়া বিনতে শাইবা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং লোকজন শান্ত হলে তিনি সওয়ারীতে আরোহণ করে কা’বা শরীফে গিয়ে তাওয়াফ করলেন। এই সময় তিনি এক প্রান্ত বাঁকা একটি লাঠি দিয়ে ইশারা করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তওয়াফ শেষ করে তিনি উসমান ইবনে তালহাকে ডেকে তার নিকট থেকে কা’বার চাবি নিলেন। দরজা খুলে দেয় হলে তিনি কা’বার ভেতরে প্রবেশ করলৈন। সেখানে কাঠের তৈরী একটি কবুতরের মূর্তি দেখতে পেলেন। তিনি তা ভেঙ্গে ছুড়ে ফেললেন। অতঃপর তিনি কা’বার দরজার ওপর দন্ডায়মান হলেন। লোকেরা এ সময় তাঁর পক্ষ থেকে প্রাণের নিরাপত্তা লাভের নিমিত্তে সমজিদুল হারামে আশ্রয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল।]

ইবনে ইসহাক বলেন: আমি বিশ্বস্ত লোকদের নিকট শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার গরজার ওপর দাঁড়িয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ

“আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও লা-শরীক। তিনি তাঁর ওয়াদা পালন করেছেন, স্বীয় বান্দাকে বিজয়ী করেছেন এবং তিনি কাফিরদের সংগঠিত দলগুলোকে পরাস্ত করেছেন। শুনে রাখ, অতীতের যে কোন রক্ত, সম্পদ বা অর্থের দাবী আমার এই পায়ের তলায় দলিত করলাম। (অর্থাৎ রহিত করলাম) তবে কা’বায় সেবা এবং হাজীদের আপ্যায়নের রীতি চালু থাকবে। শুনে রাখ, ভুলক্রমে হত্যা ইচ্ছাকৃত হত্যার কাছাকাছি। চাই তা লাঠি দ্বারা হোক কিংবা ছড়ি দ্বারা হোক। এর জন্য চল্লিশটা গাভীন উটসহ একশত উট দিয়াত দিতে হবে। হে কুরাইশরা তোমাদের জাহিলিয়াতের আভিজাত্য এবং পূর্বপুরুষদের নামে বড়াই করার প্রথা আল্লাহ রহিত করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদমের সন্তান এবং আতম মাটির তৈরী।” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলৈন,

“হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। শুধুমাত্র পরিচিতির সুবিধার জন্য তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠিতে বিভক্ত করেছি। আসলে তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু সে-ই আল্øাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানার্হ।” (হুজারাত) অতঃপর তিনি আরো বললেন, “হে কুরাইশগণ, তোমরা আমার কাছে কি ধরনের আচরণ প্রত্যাাশা কর?” সবাই বললো, “উত্তম আচরণ। কেননা তুমি আমাদের এক মহান ভ্রাতা এবং এক মহান ভ্রাতার পুত্র।”

তিনি বললেন, “যাও, তোমরা সকলে মুক্ত, স্বাধীন।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে বসলেন। তাঁর কাছে আলী ইবনে আবু তালিব এলন। তাঁর হাতে ছিল কা’বার চাবি। তিিন বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, হাজীদের আপ্যায়নের সাথে কা’বার দ্বার রক্ষকের দায়িত্বও আমাদের হাতে নিয়ে নিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উসমান ইবেন তালহা কোথায়?” উসমানকে ডাকা হলো। তিনি বললেন, “হে উসমান! এই নাও তোমার চাবি। আজকের দিন সৌজন্য ও সহৃদয়তা প্রদর্শনের দিন।”

ইবনে হিশাম বলেনঃ কিছুসংখ্যক জ্ঞানী রোকের নিকট থেকে আমি জানতে পেরেছি যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে ফিরিশতা ও অন্যান্য অনেক কিছুর প্রতিকৃতি দেখতে পেলেন। এমনকি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতিকৃতি দেখতে পেলৈন। তার হাতে রয়েছে ভালমন্দ নির্ধারণের তীর সমূহ। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর অভিশাপ হোক মুশরিকদের ওপর। আমাদের প্রবীনতম মুরব্বীকে ভালমন্দ নির্ধারনের তীর বানিয়ে ছেড়েছে। কোথায় ইবরাহীম আর কোথায় এসব?” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “ ইবরাহীম ইহুদীও ছিলেন না খৃষ্টানও না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। তিনি মুশরিকও ছিলেন না।”

অতঃপর ঐসব প্রতিকৃতি বিনষ্ট করার নির্দেশ দিলেন এবং তা বিনষ্ট করা হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলালকে (রা) সাথে নিয়ে কা’বার ভেতর প্রবেশ করেন। তাঁকে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। তখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আত্তাব ইবনে উসাইদ এবং হারেস ইবনে হিশাম কা’বার আঙিনায় উপবিষ্ট। আত্তাব ইবনে উসাইদ বললো, “ভাগ্যিস আল্লাহ (আমার পিতা) উসাইদকে সসম্মানে আগেভাগে সরিয়ে নিয়েছেন। তা না হলে আজ এই আযান শুনে সে এমন কিছু কথা বলে বসতো যা তার ক্রোধেরও উদ্রেক করতো।” হারেস ইবনে হিশাম বললো, “আমি যদি মনে করতাম সে (মুহাম্মাদ) হক পথে চলছে তাহলে আমি তার অনুসরণ করতাম।” আবু সুফিয়ান বরলো, “আমি কিছুই বলবো না। একটা কথাও যদি বলি তাহলে এই পাথরের টকরোগুলোও তা ফাঁস করে দেবে।”

এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে এলন। তিনি বললেন, “তোমরা যা বলাবলি করেছো আমি তা শুনেছি।” হারেস ও আত্তাব বললো, “আমরা সাকষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। আমাদের কাছে যারা ছিল তাদের কেউই তো এ কথা আপনাকে জানায়নি। কাজেই এ কথা আপনাকে জানানোর জন্য আমাদের কোন সঙ্গীকেই দোষারোপ করতে পারি না।” (তাই এটা নিশ্চয়ই আল্লাহ জানিয়েছেন এবং আল্লাহর রাসূল হলেই সেটা সম্ভব।)

ইবনে হিশাম বলেনঃ

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন স্বীয় সওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কায় প্রবেম করে সবার আগে কা’বা শরীফ তাওয়অফ কররৈন। তখনো কা’বার চারপাশে সীসা দিয়ে সংরক্ষিত মূর্তিসমূহ বিরাজ করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি ুদয়ে মূর্তিগুলোর দিকে ইংগিত করে বললেন, “সত্য এসেছে এবং বাতিল উৎখাত হয়েছে। বস্তুতঃ বাতিল উৎখাত হওয়ারই যোগ্য।” একথা বলে যে মূর্তিটার দিকেই তিনি ইশারা করতে লাগলেন, তা চিৎ বা উপুড় হয়ে যেতে লাগলো। এভাবে এক একে সবক’টা মূর্তিই ধরাশায়ী হলো।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র আমাকে জানিয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কা’বার তাওয়াফ করছিলেন তখন ফুজালা ইবেন উমাইর লাইসী তাকে হত্যা করার ফন্দি আঁটে। এই ফন্দি নিয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হলেই তিন বললেন, “কে,, ফুজালা নাকি” সে বললো “হাঁ।” হে আল্লাহর রাসূল।” তিনি বললেন, “তুমি মনে মনে কি ভাবছিলে?” সে বললো, “কিছুই না, আমি আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে বললেন, “আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর।” অতঃপর তার বুকের ওপর নিজের হাত রাখলেন। তাতে তার মন শান্ত হলো। পরবর্তীকালে ফুজালা বলতো, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মুহুর্তে আমার বুকের ওপর থেকে হাত তুলে নিলেন তখন থেকে পৃথিবীতে কোন জিনিস আমর কাছে তাঁর চাইতে প্রিয় বলে মনে হয়নি।”

ফুজালা আরো বলেনঃ এরপর আমি নিজ পরিবারের কাছে চললাম। যাওয়ার সময় এমন এক মহিলার কাছ দিয়ে গেলাম যার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে বললো, “এসো আমরা গল্প করি।” আমি বললাম, ‘না।’

এ প্রসঙ্গে ফুজালা নিম্নরুপ কবিতা আবৃত্তি করেন,

“মহিলাটি আমাকে কথা বলতে ডাকলো। আমি বললাম, আল্লাহ ও ইসলাম তোমার আহ্বানে সাড়া দিতে নিষেধ করেন। তুমি যদি বিজয়ের দিন মুহাম্মাদ ও তাঁর বাহিনীকে দেখতে – যেদিন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চ’র্ণবিচর্ণ করা হচ্ছিলো, তাহলে দেখতে যে, আল্লাহর দ্বীন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং শিরক অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।”

ইবনে ইসসাক বলেনঃ মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন কর্বমোট দশ হাকার মুসলমান। তম্মধ্যে বনু সুলাইম গোত্রের সাতশ মতান্তরে এক হাজার, বনু গিফার ও বনু আসলামের চার, মুফাইনার এক হাজার তিন জন, আর অবশিষ্ট সবাই কুরাইশ ও আনসার, তাদের মিত্র এবং তামীম, কাইস ও আদাস গোত্রত্রয় সহ আরব গোত্রসমূহের লোস।

মক্কা বিজয়ের দিন সম্পর্কে রচিত প্রসিদ্ধ কবিতা হলো হাসসান ইবনে সাবিত আনসারীর কবিতাঃ

“যাতুল আসাবি ও জিওয়া থেকে আযরা পর্যন্ত গোটা এলাকা উকাড় হয়ে গেছে। জিওয়ার ঘরবাড়ী বিরান হয়ে গেছে। বনু হাশহাশ গোত্রের এলাকা এখন উষর মরুভুমি। প্রবল বাতাস তার চি‎হ্ন মুছে দেয় এবং আকাশ সেখানে বারি বর্ষণ করে না। ইতির্পূবে সেখানে একজন ইপকারী বন্ধু ছিল, ঐ এলাকার শ্যামল বনানীতে উট মেষ চরে বেড়াতো। সেসব স্মৃতিচারণ এখন থাক। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, রাত গভীর হয়ে এল আমার ঘুম আসে না। এর কারন সেই আলুলায়িত কুন্তলা (এলোমেলো বিশৃঙখল অবস্থা) যা তাকে জাপটে ধরেছিল, ফলে তার মনের শান্তি ঘুঁচাবার উপায় নেই। যেন বাইতুব বা’সের গুপ্ত বস্তু মধু ও পানি তার সাথে মিশানো হতো। একদিন যখন পানীয় বস্তুসমূহের পর্যালোচনা হবে, তখন দেখা যাবে, ঐগুলো উৎকৃষ্ট সুপেয় বস্তু এবং উৎসর্গীকৃত। তাকে তিরষ্কারের অধিকার দেবো যদি আমরা তিরষ্কারযোগ্য কোন কাজ করি-চাই তা গালাগাল বা প্রহার পর্যন্ত গিয়ে পড়াক। আমরা সেই সব পানীয় পান করবো ফলে তাৎক্ষনিকভাবে আমরা রাজা বাদশাহে পরিণত হবো, পরিনত হবো সেই সিংহে- যা কোন কিচুর সম্মুখীন হতে ভয় পায় না। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, যা ধুলা উড়িয়ে ছোটে এবং যার গন্তব্য হলো কা’দা (মক্কার উচ্চভ’মি), জানি না তোমরা তা দেখেছো কিনা। যে বাহিনী লাগাম নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় (কে আগে সওয়ার হবে সে জন্য) যা অতিশয় আগ্রহী এবং যার ষাড়ের ওপর রক্তপিপাসার বর্শা রয়েছে। আমাদের ঘোড়াগুলো অতি দ্রুতবেগে ছোটে। মহিলারা ওড়না গিয়েও তাকে হাঁকিয়ে নিতে পারে। তোমরা যদি আমাদের বাধা না দাও তা’হলে আমরা উমরা করবো- অবশ্য বিজয় অবধারিত হয়ে আছে এবং সমস্ত পর্দা ছিন্ন হয়ে গেছে। (অর্থাৎ বিজয়ের সুষ্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে) অন্যথায় ববিষ্যতের কোন যুদ্ধের জন্য অন্বেষা কর। আল্লাহর দূত জিবরীল আমাদের মধ্যে রয়েছেন। তিনি পরম পবিত্র আত্মা- যার সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহ বলেন যে, এমন এক বান্দাকে আমি পাঠিয়েছি যিনি বিপদ আপদে উকারী হক কথা বলে থাকেন। আমি তার কাযৃকলাপের সাক্ষী। তোমরা তাকে মেনে নাও। কিন্তু তোমরা (হে মক্কাবাসী০ জবাব দিলে, আমরা তাকে মানবো না, মানবার কোন ইরাদা আমাদের নেই। আল্লাহ আরো বললেন, আমি আনসার বাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তাদের লক্ষ্য হলো যুদ্ধ। আমাদের কিছু না কিছু মুকাবিলা করতে হয়-কখনো গালাগলি, কখনো যুদ্ধ, কখনো তিরষ্কার। যারা তিরষ্কার বা গালাগালি করে তাদেরকে ছন্দায়িত বাষায় দাঁতভাঙ্গা জবাব দিই, আর যারা আমাদের রক্তপাতে লিপ্ত হয় তাদের ওপর আঘাত হানি। আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দাও (আমাদের মক্কায়) প্রবেশ আসন্ন। আর এটা ষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের তরবারী তোমাকে গোলাম বানিয়ে ছেড়েছে এবং আবদুদ দার গোত্রের সরদারদেরকে দাস বানিয়ে ছেড়েছে। তুমি মুহাম্মাদকে গালাগালি করেছো। আর আমি তার জবাব দিয়েছি এবং আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান রয়েছে। তুমি এক পরম কল্যানময় পরোপকারী ও একনিষ্ঠ সত্যপন্থী গালাগলি করেছো। যিনি আল্লাহর পরম বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পূর্ণ করা যার জীবন ব্রত। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলকে গালাগাল করে আর যে ব্যক্তি তাঁর প্রশংসা করে ও সাহায্য করে সে কি সমান হতে পারে? বস্তুত আমার পিতা, দাদা এবং আমার সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুহাম্মাদের সম্ভ্রমকে তোমাদের হাত থেকে রক্ষ করবো। আমার জিহ্বা অকাট্য এবং নির্দোষ। আমার সমুদ্রকে কোন বালতি দিয়ে কলুষিত করা সম্ভব নয়।”২৮২


হুনাইনের যুদ্ধ: ৮ম হিজরী
হাওয়াবিন গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা বিজয়ের কথা শুনে মালিক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হলো। হাওয়াবিনের সাথে বনু সাকীফ, বনু নাসর, বনু জুশাম ও বনু স’দের সকলে ও বনু হিলালের স্বাল্পসংখ্যক লোকও সংঘবদ্ধ হলো। বনু সা’দ ও বনু হিলালের এই মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া বনু কায়েসের আর কেউ এই সেনা সমাবেশে অংশগ্রহন করেনি।

বনু জাশাম গোত্রে দুরাইদ ইবনে সাম্মা একজন প্রবীণ লোক ছিল। সে যুদ্ধ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিল। যুদ্ধের পরামর্শ দেয়া ছাড়া তার আর কোন কিছু করার ছিল না। বনু সাকীফের দু’জন সরদার ছিল। তাদের মিত্রদের মধ্যে ছিল কারেব ইবনে আসওয়অদ আর বনু মালিকের ছিল যুলখিমার সুবাই ইবনে হারেস এবং তার ভাই আহমার ইবনে হারেস। তবে মালিক ইবনে আওফ নাসারী ছিল গোটা বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক। মালিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে তার বাহিনীর লোকদের প্র্রত্যেকে নিজ নিজ স্ত্রী সন্তান ও অস্থাবর সম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে বাধ্য করলো। আমতাস উপত্যকায় পৌছলে তার কাছে দুরাইদ ইবনে সাম্মা সহ বিপুল জনতা সমবেত হলো। দুরাইদ আওতাস ইপত্যকায় পৌছে তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কোন জায় গা?” সবাই বললো, ‘আওতাস’। সে বললো, ‘হ্যা, এটা যুদ্ধের উপযুক্ত জায়গা বটে। বেশী উচুও না প্রস্তরময়ও না, আবার খুব বেশী নরমও না। তবে উট, ছাগল ও গাধার ডাক, আর শিশুদের কান্নাকাটি শুনতে পাচ্ছি কেন?” সবাই বললো, “মালিক ইবনে আওফ তার বাহিনীর লোকদের সাথে তাদের ধনসম্পদ ও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে।” সে বললো, “মালিক কোথায়?” মালিককে ডেকে আনা হলো। দুরাইদ বললো, “ওহে মালিক, তুমি নিজ গোত্রের পরিচালক ও নেতা। আজকের দিনের পরেও কত দিন আসবে তার শেষ নেই। এখানে উট, গাধা ও ছাগলের ডাক ও শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কেন?” মালিক বললো, “আমি লোকজনের সাথে তাদের পরিবার পরিজন ও সহায়-সম্পদও নিয়ে এসেছি।” দুরাইদ বললো, ‘কেন?’ মালিক বললো, “প্রত্যেকের পেছনে তার পরিবার পরিজন ও সহায় সম্পদ থাকবে এবং তাদেরকে রক্ষা করারা জন্য সে প্রাণপণে লড়াই করবে। রণাঙ্গন ছেড়ে কেউ পালবে না।” দুরাইদ মালিকের যুক্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো, “আসলে তুমি দেখছি মেষ পালকের মতই (বুদ্ধি রাখ, সেনানায়কের মত নয়)। যে পরাজিত হয়, তার কি আর কোন কিছুতে লাভ হয়? যুদ্ধে যদি পরাজয় ঘটে তাহলে নিজের বিপর্যয়ের সাথে সাথে নিজের পরিবার পরিজন এবং ধন সম্পদও গোল্লায় যাবে।”

দুরাইদ পুনরায় বললো, “বনু কাব ও বনও কিলাবের খবর কি?” মালিক বললো, “তাদের কেউ যুদ্ধে আসেনি।” দুরাইদ বললো, ‘তাহলে তো আসল লড়াকু বীর সিপাহীরাই আসেনি। আজ যদি সত্যিকার বিজয় ও পৌরব লাভের সুযোগ থাকতো তাহলে বনু কাব ও কিলাব অবশ্যই আসতো। আমার মনে হয়, বনু কাব ও কিলাব যেটা করেছে, তোমাদের তা অনুসরণ করা উচিত ছিল। আচ্ছা তোমাদের সাথে উল্লেখযোগ্য যোদ্ধাাদের কে কে এসেছে?” লোকেরা বললো “আমর ইবনে আমের ও আওফ ইবনে আমের।” দুরাইদ বললো, “ওরা দুর্বল যোদ্ধা, ওদের দিয়ে কোন লাভও হবে না, ক্ষতিও হবে না। হে মালিক শোন, হাওয়াযিন গোত্রকে শত্রুর মুখে নিক্ষেপ করে তুমি কোন ভাল কাজ করনি। তাদেরকে তাদের নিজ নিজ নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দাও। তারপর এই মুসলমানদের সাথে তোমার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে লাড়াই কর। তুমি যদি জয়লাভ কর তাহলে পরে এস তারা তোমার সাথে যোগ দেবে। আর যদি হেরে যাও তাহলে অন্ততঃ তোমার লোকদের পরিবার পরিজন ও ধনসম্পদ রক্ষা পাবে।” মালিক বললো, “না এটা আমি করবো না। তুমি নিজে যেমন বুড়ো হয়েছ, তোমার বুদ্ধিও তেমনি জরা ব্যধিগ্রস্ত হয়েছে। হে হাওয়াযিন জনতা, তোমারা হয় আমার আনুগত্য করবে নতুবা আমি এই তরবারী নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে একাই লড়ে যাবো।” আসলে দুরাইদের কথা মত কাজ করে তার খ্যাতি বা তার বুদ্ধিমত্তার সুনাম হোক এটা মালিকের মনঃপুত ছিল না। সমবেত যোদ্ধারা মালিকের আনুগত্য করার অঙ্গীকার করলো। দুরাইদ বললো, “আমি আজকের এ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজী নই।” সে কবিতার ছন্দে বললোঃ

“হায়! আমি যদি এ যুদ্ধের সময় তরুণ থাকতাম

তাহলে হরেক রকমের রণকৌশল দেখাতাম। বিরাটকায়

পাহাড়ী ছাগল সদৃশ লম্বা চুলওয়ালা বাহিনী পরিচালনা করতাম।”

অতঃপর মালিক বললো, “মুসলিম বাহিনীকে দেখা মাত্রই তরবারী খাপমুক্ত করে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

হাওয়াযিনের এই রণপ্রস্তুতির কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে আবু হাদরাদ আসলামীকে কৌশলে তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে আনতে পাঠালেন। আবদুল্লাহ তাদের ভেতরে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাওয়াযিনের মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সময় তাঁকে জানানো হলো যে, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছে অনেক অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম রয়েছে। সাফওয়ান তখনও মুশরিক। তার কাছে লোক পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদি ধার চাইলেন শত্রর সাথে লড়াই করার জন্য। সাফওয়অন জিজ্ঞেস করলো, “মুহাম্মাদ, তুমি এগুলো কেড়ে নিচ্ছো নাকি?” রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, ধার নিচ্ছি এবং গ্যারান্টি দিচ্ছি যে,, এগুলো তোমাকে ফেরত দেয়া হবে।” সে বললো, “আমার আপত্তি নেই।” অতঃপর সে একশট বর্ম ও তার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অস্ত্র ধার দিল। কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ঐসব অস্ত্র পরিবহণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানান এবং সে যথাযথভাবে তারও ব্যবস্থা করে।

পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের মধ্য থেকে দুই হাজার এবং মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর সাথে মদীনা থেকে আগত দশ হাজার সাহাবীসহ মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হলেন। এই সময় অবশিষ্ট মক্কাবাসীর জন্য তিনি আত্তাব ইবনে উসাইদকে মক্কার শাসক নিযুক্ত করেন এবং নিজে সসৈন্যে হাওয়াযিনের মুকাবিলায় অগ্রসর হন।

হারেস ইবনে মালিক থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইন অভিযানে বের হলাম। আমরা সবেমাত্র জাহিলিয়াত থেকে মুক্ত হয়েছি এবং জাহিলিয়াতের রসম রেওাজকে তখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারিনি। যাতু আনওয়াত নামক একটা বিরাটকায় সবুজ পতেজ গাছ ছিল। কুরাইশ কাফিরগণ এবং অন্যান্য আরবরা প্রতিবছর ঐ গাছের কাছে আসতো, গাছের ডালে অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রেখে একদিন তার ছায়ায় অবস্থান করতো এবং সেখানে জন্তু জবাই করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইেিন যাওয়অর পথে একটা বড় গাছ দেখে আমরা বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! কাফিরদের যেমন যাতু আনওয়াত আছে, তেমনি আমাদেরও একটা যাতু আনওয়াত গ্রহণ করুন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবর, মূসার (আ) জাতি তাঁকে যেমন বলেছিল, কাফিরদের যেমন দেবদেবী আছে আমাদের জন্যও তেমনি একজন দেবতা গ্রহণ করুন,-তোমাদের এ উক্তিটাও তেমনি। এগুলো পুরনো প্রথা। তোমরা প্রচীন প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাচ্ছো।”

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেন, আমরা হুনাইন প্রান্তরের কাছাকাছি এলাম,, এবং তিহামার একটি প্রশস্ত পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে নেমে চলতে লাগলাম। তখনো ভোরের আলো দেখা দেয়নি। শত্রু সেনারা আমাদের আগেই ঐ উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং সংকীর্ন দুর্গম গিরিগুহায় ও তার আশেপাশে লুকিয়ে আমাদের জন্য ওত পেতে ছিল। তারা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষমান ছিল। আমরা সম্পূন্য নিঃশংকচিত্তে গিরিপথ দিয়ে নেমে চলেছি- এই সময় হঠাৎ তারা একযোগে আমাদের ওপর প্রচন্ড হামলা চালালো। হামলার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে আমাদের লোকেরা যে যেদিকে পারলো উঠিপড়ি করে ছুটে পালাতে লাগলো এবং একজন আর একজনের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না। কারো দিকে কারো বিন্দুমাত্র লক্ষ্য করার যেন ফুরসত নেই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান দিকে সরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “হে সৈনিকরা! তোমরা কোথায় যাচ্ছো? আমার কাছে এসো। আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। কিসের জন্য উটের ওপর উপ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে?” কিন্তু স্বল্পসংখ্যক মুহাজির, আনসার ও পরিবারভুক্ত লোক ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে কেউ থাকলো না। সবাই চলে গেল।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ মুসলিম বাহিনীর লোকেরা নণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের কাছে অবস্থানকারী মক্কার কিছু পাষন্ড প্রকৃতির লোক পরাজয় অবশ্যম্ভাবী মনে করে নানা রকম কথাবার্তা চলতে লাগলো। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব বললো, “সমুদ্রের উপকূল পর্যন্ত গেলেও এদের পরাজয় শেষ হবে না।” লটারী, ভাগ্য গণণা ও জুয়া খেলার কাজে ব্যবহার্য তীর তখনো আবু সুফিয়ানের কাছেই ছিল।

জাবালা ইবনে হাম্বল চিৎকার করে বললো, আজ মুহাম্মাদের যাদুর ক্ষমতা শেষ হলো।” শাইবা উসমান বললো, “ঐ দিন আমি স্থির করলাম যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করে কুরাইশদের সমস্ত খুনের বদলা নেব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি যেই রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হয়েছি, অমনি কি একটা ভয়ংকর বন্তু আমার সামনে এসে আড় হয়ে দাঁড়ালো, তা আমার মনকে আছন্ন করে ফেললো এবং তাকে হত্যা করতে পারলাম না। আমি উপলদ্ধি করতে পারলাম যে, তাঁকে আঘাত করা আমার সাধ্যাতীত।”

মক্কাবাসীদের একজন আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইনের পথে মক্কা ত্যাপ করার পরপরই আল্লাহর সৈনিকদের বিপুল সংখ্যা দেখে তিনি বলেছিলন, “আজকে আর যাই হোক, সংখ্যা স্বল্পতার কারণে আমরা পরজায় বরণ করবো না।”

আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর সাদা খচ্চরটির লাগাম ধরে বলেছিলাম। আমি খুব মোটাসোটা ও বুলন্দ কণ্ঠের অধিকারী ছিলাম। ভীতসন্ত্রত হয়ে মুসলিম সৈনিকদের উর্ধশ্বাসে ছুটতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে লোকেরা, আমি তোমাদেরকে কারো প্রতি ফিরে তাকাতে দেখছি না!” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “আব্বাস! চিৎকার করে এভাবে যাক দাওঃ হে আনসারগণ! ওহে বাবুল বৃক্ষের নীচে অংগীকারদাতাগণ!”

আমি আদেশ অনুসারে ডাকতে লাগলে প্রত্যেকে লাব্বায়েক বলে সাড়া দিতে লাগলো। এই সময় অশ্বারোহী সাহাবীদের কেউ কেউ ছুটন্ত ও পলায়নরত উটের গতি ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে বর্ম দিয়ে তার ষ্কন্ধে আঘাত করেন। তাতেও ফিরতে না পেরে অস্ত্র িেনয়ে উট থেকে নেমে আসেন এবং উচকে ছেড়ে দেন। অতঃপর যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে এগিয়ে যান এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট পৌছে যান। এভাবে একশ জনের মত সাহাবী জমায়েত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলেন।

প্রথমে “হে আনসারগণ” বলে ডাকা হতে থাকে। পরে শুধু “হে খাযরাজ” বলে ডাকা শুরু হয়। কেননা খাবরাজ রণাঙ্গনে দৃঢ়চিত্ত বলে আরবদের কাছে সুপরিচিত ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাযরাজের বহিনী নিয়ে এগুতে থাকেন। তারপর রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, প্রচন্ড সংঘর্ষ চলছে। তা দেখে বললেন,“এবার রণাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।”

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ

হাওয়াবিন গোত্রীয় সেনাপতি উটের ওপর সওয়ার হয়ে লাড়াই করছিল। এই সময় আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও জনৈক আনসার তার দিকে ধেয়ে গেলেন এবং তার উটের পায়ে আঘাত করলেন। উট পিছনে ভর করে বসে পড়লো। তখন আনসারী সেনাপতিকে আঘাত হাঁটুর নীচ থেকে তার পা কেটে ফেললেন। সে তৎক্ষনাৎ নীচে পড়ে গেল। এই সময় যুদ্ধ অভংকর রুপ ধারণ করলো এবং এর গতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। মুসলমানগণ পরাজয়ের অবস্থা থেকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে সারিবদ্ধ যুদ্ধবন্দী না আসা পর্যন্ত তা শেষ হলো না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ারন ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তলিবের দিকে তাকালেন। তিনি সেদিন অথ্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলিম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম দেখলেন, তিনি তার খচ্চরের লাগাম ধরে রেখেছেন। তা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে?” তিনি জবাব দিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার ভাই।”

আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রান্তরের এক দিকে উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহানকে তার স্বামী আবু তালহার সাথে দেখাতে পেলেন। তিনি কোমর পেট একটা চাদর দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন। পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে আবু তালহা তখন তাঁর গর্তে। আবু তালহা উট তাঁর সাথে রয়েছে এবং উট ছুটে যাবে এই ভয়ে তার নাকের চুলের রশি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উম্মে সুলাইম নাকি?” তিনি বললেন, “হ্যা”, হে আল্লাহর রাসুল, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি যেভাবে হামলাকারী শত্রুদেরকে হত্যা করছেন সেভাবে যারা আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যায় তাদেরকেও হত্যা করুন। কেননা তারা হত্যার যোগ্য।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,, “হে উম্মে সুলাইম। এ জন্য কি আল্লাহই যথেষ্ট নন?” তখন উম্মে সুলাইামের কাছে একটা খনজর ছিল। আবু তালহা বললেন, “হে উম্মে সুলাইম, খনজর কি জন্য।” উম্মে সুলাইম বললেন, “এটা রেখেছি এ জন্য যে, কোন মুশরিক আমার দিকে এগিয়ে আসতে দুঃসাহস দেখাে ল এ দ্বারা তার পেট ফেড়ে ফেলবো।” আবু তালহা বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, চোখের ব্যধি নিয়েও উম্মে সুলাইম কি বলছে শুনেছেন?”

আবু কাতাদাহ (রা) বর্ণনা করেনঃ হুনাইন যুদ্ধের দিন আমি দেখলাম একজন মুশরিক ও একজন মুসলমান পরস্পরের সাথে যুঝছে। এই সময় আর একজন মুশরিক ঐ মুশরিককে সাহায়ের জন্য এগিয়ে এল। তখন আমি তার পওর আক্রমণ চালিয়ে তরবারীর আঘাতে তার হাত কেটে ফেললাম। আর হাত দিয়ে সে আমাকে জাপ্টে ধরলো। সে আমাকে কিছুতেই ছাড়ছিলো না বরং মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই সে অধিক রক্তপাতে দুর্বল হয়ে না পড়লে আমাকে সে মেরেই ফেলতো। সে পড়ে গেলে আমি তাকে হত্যা করলাম। অতঃপর চারদিকে যে যুদ্ধ চলছিল সেজন্য তার দিকে আমি আর ভ্রুক্ষেপ করতে পারিনি। এই সময় জনৈক মক্কাবাসী এস তার জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করবে তার যাবতীয় জিনিস হত্যাকারী পাবে।” আমি বললাম, “ইয় রাসূলাল্লাহ, আমি একজনকে হত্যা করেছি। তার অনেক জিনিসপত্র ছিল। পরে যুদ্ধের প্রচন্ডতায় আমি আর তার দিকে লক্ষ্য করতে পারিনি। তার জিনিষপত্র কে নিয়েছে জানি না।” মক্কাবাসী একজন বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আবু কাতাদার কথা সত্য। ঐ নিহত ব্যিক্তির যাবতীয় জিনিসপত্র আমার কাছে রয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে ওকে আমার সাথে আপোষ করিয়ে দিন।” আবু বাক্র সিদ্দিক (রা) বললেন, “আল্লাহর কসম এ জিনিসপত্রের ব্যাপারে আপোষ বলবে না। তুমি আল্লাহর এক সিংহের কাছে মতলব স্দি করতে এসেছ- যে আল্লাহর দঈনের জন্য লাগাই করে? আর তুমি কিনা তার যুদ্ধলদ্ধ জিনিসে ভাগ বসাতে চাও?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আবু বাক্র ঠিকই বলেছে। তুমি আবু কাতাদাকে জিনিসগুলো ফিরিয়ে দাও।”

আবু কাতাদাহ বলেনঃ অতৎপর আমি ঐ সব জিনিসপত্র সেই মক্কাবাসী লোকটির কাছ থেকে আদায় করে বিক্রি করলাম। আর তার মূল্য দিয়ে ছোট একটা খেজুরের বাগান নিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনে আমার মালিকানাভুক্ত প্রথম সম্পদ।

ইবনে ইসহাক বলেন: হাওয়াযিনরা পরাজিত হওয়ার পর হিসাব নিয়ে দেখতে পেল যে, সাকীফের বনু মালিক গোত্রেরই সবাদিক প্রানহানি ঘটেছে। এ গোত্রের সত্তর জন লোক যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রাবীয়া ইবনে হারেস ইবনে হাবীব। এ গোত্রের সেনাপতি ছিল যুলখিমাল। সে নিতহ হলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ সেনাপতি হয় এবং সেও নিহত এয়। এ যুদ্ধে মুশরিকদের শোচনীয় পরাজয় ঘটার পর তারা মালিক ইবনে আওফ সহ তায়েফ চলে যায়। এদের কিছু সৈন্য আওতাসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করতে থাকে। আর কিছু সংখ্যক নাখলার দিকে চলে যায়। নাখলার দিকে যারা গিয়েছিল তাদের মধ্যে সাকীফের বনু গিয়ারা উপগোত্র ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করলো না। মুশরিক বাহিনীর যে অংশটি আওতাসের দিকে যায় তাদের পিছু ধাওয়া করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আমের আশয়ারীকে পাঠান। সেখানে তিনি কিচুয পরাজিত সৈন্যকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দেন।

একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে আবু আমের আশয়ারী শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর তাঁর চাচাতো ভাই আবু মূসা আশয়ারী সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় লাভ করেন এবং মুশরিকরা পরাজিত হয়।

পরাজয়ের মুখে মালিক ইবনে আওফ স্বগোত্রীয় একদল অশ্বারোহী নিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় অবস্থান করেন। তাদেরকে তিনি বলেন, “দুর্বল লোকেরা চলে যাক। অতঃপর শক্তিশালী লোকেরা আসবে। ততক্ষণ তোমরা এখানে অপেক্ষা কর।” দুর্বল পরাজিত সৈন্যরা চলে যাওয়া পর্যন্ত সে সেখানে অবস্থান করলো।

খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেন। তার লাশের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপুল লোক সমাগম দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “এখানে কি হয়েছে?” সকলে বললো, “খালিদ ইবনে ওয়ালীদ এক মহিলাকে হত্যা করেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক সহচরকে বললেন, “খালিদের সাথে গিয়ে দেখা কর এবং বল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে শিশু, মহিলা, অথবা দিন মজুর ও দাস দাসীকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন বলেছিলেন, “বনু সা’দ ইবনে বকরের বিজাদকে যদি পাও তবে তাকে পালাতে দিও না।” সে একটা বড় অপরাধ করেছিল। মুসলমানগণ তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হন এবং তাকে সপরিবারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধবোন শায়মা বিনতে হারেসকেও নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে তার সাথে কিছু রূঢ় ব্যবহার করা হয়। তখন সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার দুধবোন।” তিনি বললেন, “তার প্রমাণ কি?” সে বললো, “যখন আমি আপনাকে আমার উরুর ওপর তুলেছিলাম তখন আপনি আমার পিঠে কামড় দিয়েছিলেন। সেই চি‎হ্ন টি এখনো আছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামড়ের চি‎হ্নটি দেখে চিনতে পারলেন। তিনি নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে সসম্মানে বসতে দিলেন এবং বললেন, তুমি যদি আমার কাছে থাকা পছন্দ কর তাহলে সসম্মানে থাকতে পার। আর যদি পছন্দ কর যে, তোমাকে কিছু উপঢৌকন দিই এবং তুমি নিজ গোত্রে ফিরে যাবে তাহলে তাও করতে পার।” সে বললো, “আমাকে যা দিতে চান দিয়ে আমার গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনেক কিছু দিয়ে তার কওমের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বনু সাদের বর্ণনা অনুসারে তিনি তাকে মাকস্থল নামক একটি দাস এবং তার একটি দাসী উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলেন। শায়মা পরে ঐ দাসদাসীকে পরস্পরে সাথে বিয়ে দেন এবং তাদের বংশধারা বহুদিন পযন্ত তাদের মধ্যে চলতে থাকে।

ইবনে হিশাম বলেনঃ

আল্লাহ তায়ালা হুনাইন যুদ্ধ সম্পর্কে এ আয়াত কয়টি নাযিল করেন,

“আল্লাহ তোমাদেরকে অনেকগুলো রণাঙ্গনে সাহায্য করেছেন। হুনাইনের যুদ্ধের দিনেও করেছেন-যখন তোমরা নিজ সংখ্যাধিক্যের কারণে গর্বিত হয়েছিলে। কিন্তু সে সাংখ্যাধিক্যে তোমাদের কোন লাভ হয়নি। সেদিন বিশাল পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং তোমরা পালিয়েছিলে। তারপর আল্লাহ শান্তি ও স্বস্তি আনেন তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের প্রতি। আর তার এমন বাহিনী পাঠান যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ কাফিরদেরকে এভাবে শাস্তি দেন। বস্তুত: কাফিরদের সমুচিত শাস্তি এটাই।” (আত্ তাওবাহ)

ইবনে ইসহাক বলেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হুনাইনের সমস্ত যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধলব্ধ অর্থ এনে রাখা হয়। মাসউদ ইবনে আমও গিফারীকে গণীমত তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে গনীমত ও যুদ্ধবন্দীদেরকে জি’রানা নামক স্থানে রাখা হয়।

তায়েফ যুদ্ধ: ৮ম হিজরী সন
বনু সাকীফের পরাজিত বাহিনী তায়েফে গিয়ে নগরীর দ্বার রুদ্ধ করে দেয় এবং পুনরায় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। উরওয়া ইবনে মাসউদ ও গাইলান ইবনে সালামা হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে অংশ নেননি। তারা জুরাশে ট্যাংক, কামান ও দবুর জাতীয় যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।

হুনাইনের বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানে বেরুলেন। এই অভিযান সম্পর্কে কা’ব ইবনে মালিক একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তার অর্থ হলো- “তিহামা ও খাইবার থেকে আমরা সকল সংশয় দূর করে তরবারীকে বিশ্রাম দিয়েছিলাম। তরবারীগুলোকে আমরা দাওস অথবা সাকীফের যে কোন একটি বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছিলাম। আর সেসব তরবারী যদি কতা বলতো তবে চূড়ান্ত কথাই বলমো। সে তরবারী যদি তোমরা তোমাদের বাসস্থানের আঙ্গিনায় দেখতে না পাও, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের কেউ (তোমাদেরকে) রক্ষা করতে চাইলেও তার প্রতি আমি মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন হয়ো না। আমরা (তোমাদের) ঘরের ছাদগুলোকে ভেঙ্গে ওয়াজ্জের প্রান্তরে নিয়ে যাবো। ফলে তোমাদের ঘরবাড়ী বিরান হয়ে যাবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে নাখলা ইয়ামনিয়াতে, তারপর কাব্নে, তারপর মুলাইহে, তারপর সেখান থেকে লিয়া এলাকার বুহরাতুর রুগাতে গিয়ে উপনীত হলেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করিয়ে তাতে নামায পড়লেন। এরপর দাইকা নামক রাস্তা দিয়ে নাখাবে গিয়ে বনু সাকীফের এক ব্যক্তির জমির কাছে ‘ছাদেরা’ নামক কুল গাছের নীচে যাত্রাবিরতি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই লোকটির চরমপত্র দিলেন যে, “এই জায়গা খালি করে দিয়ে সরে যাও, নচেৎ আমরা তোমার দেয়াল ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেবো।” লোকটি বেরিয়ে যেতে অস্বীকার করলে তিনি তার দেয়াল ভেঙ্গে দিলেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার যাত্রা শুরু করলেন। তায়েফের কাছাকাছি গিয়ে তাঁবু স্থাপন করে সৈন্যদের নিয়ে তাতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এইখানে কতিপয় সাহাবী তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের সৈন্যরা তায়েফের দেয়ালের পাশেই অবস্থান নিয়েছিলেন, তাই নগরের ভেতর থেকে তায়েফবাসীদের নিক্ষিপ্ত তীর তাঁদের ওপর এসে পড়েছিল। তায়েফবাসীরা শহরের দরজা এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল যে, মুসলমানগণ তার ভেতরে ঢুকতে পারলো না। তীরবিদ্ধ হয়ে কতিপয় সাহাবী শাহাদত বরণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা বাহিনীকে নিয়ে নগরীর সেই স্থানে স্থাপন করলেন যেখানে আজ তায়েফের সমজিদ অবস্থিত। তিনি তায়েফবাসীকে অবরোধ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভিযানে উম্মে সালামা (রা) সহ দুজন স্ত্রী সহগামিনী হয়েছিলেন। তাঁদের জন্য তিনি গম্বুজ আকৃতির দু’টি ঘর নির্মাণ করে দিলেন। সেই ঘরের মাঝে তিনি নামায আদায় করেন। অতঃপর তিনি সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। বনু সাকীফ ইসলাম গ্রহণ করলে আমর ইবনে উমাইয়া (রা) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায পড়ার জায়গাফ মসজিদ তৈরী করেন। এই মর্মে জনশ্রুতি আছে যে, ঐ মসজিদে একটি যোদ্¦া দল থাকতো। প্রতিদিনই তাদের রণহুংকার ও তর্জন গর্জন শোনা যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীকে অবরোধ করে তীর ধনুক দ্বারা তুমুল যুদ্ধ করলেন। [৮৩. ইবনে হিশাম বলেছেন,, এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামান ব্যবহার করেন। তায়েফবাসীর বিরুদ্ধে তিনি যে কামান ব্যবহার করেন সেটাই ইসলামের প্রথম কামান।]

তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য যে দিনটি নির্ধারিত করা হয়েছিল সে দিন সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল সাহাবী একটি ট্যাংকের নীচে ঢুকলেন, অতঃপর তা নিয়ে তায়েফের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সংঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হলেন। বনু সাকীফ গোত্রের লোকরা তাদের ওপর আগুনে পোড়ানো লোহার শেল নিক্ষেপ করতে লাগলো। এতে সাহাবীগণ ট্যাংকের নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন। আর যিনিই বের হন তিনিই সাকীফের তীরে বিদ্ধ হন। এভাবে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান শহীদ হন। এই পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাকীফের বাগান কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ তা কেটে ফেলতে শুরু করলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সাকীফের অবরোধ চলাকলে একদিন আবু বাক্র সিদ্দীক (রা) কে বললেন, “হে আবু বাক্র, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমাকে এক পেয়ালা ঘি উপহার দেয়া হয়েছে। একটা মোরগ এসে ঠোকরাতে ঠোকরাতে পেয়ালার ঘি টুকু ফেলে দিল।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আমার মনে হয়, আজ আপনি বনু সাকীফকে পরাজিত করতে পারবেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমার ধারণাও তাই।”

একদিন উসমান ইবনে মাযউনের স্ত্রী খুয়াইলা বিনতে হাকীম (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ যদি আপনাকে তায়েফবাসীর ওপর বিজয় দান করেন তাহলে বনু সাকীফের সবচেয়ে অলংকার সাজ্জিতা মহিলা বাদিয়া বিনতে গীলান অথবা ফারেগা বিনতে আকীলের অলংকার আমাকে দেবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “আমাকে যদি বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি না দেওয়া হয় তা হলেও?” খুয়াইলা একথা শুনে চলে গেলেন এবং উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রা) কথাটা জানালেন। উমার (রা) তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, খুয়াইলা যে কথা আমাকে জানালো তা কি আপনি বলেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হ্যা’। উমার (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বনু সাকীফের ব্যাপারে অনুমতি কি আপনি পাননি?” তিনি বললেন, ‘না।’ উমার বললেন, “তাহলে কি আমি এখন মুসলমানদেরকে এ স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হাঁ।’ উমার (রা) তখন মুসরিম বাহিনীকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। যাত্রা শুরু হলে সাঈদ ইবনে উবাইদ আওরাজ দিলেন, “বনু সাকীফ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেলো।” উয়াইনা ইবনে হিসন বললেন, “হাঁ, আপন মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে (রয়ে গেলা)।” জনৈক সাহাবী বললেন, “হে উয়াইনা! মুশরিকরা আল্লাহর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করলো আর তমি তাদের প্রশংসা করছো? অথচ তুমি এসছো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে লড়াই করতে। ধিক্ তোমাকে।” তিনি বললেন, “আসলে আমি তোমদের পক্ষে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো সে জন্য আসিনি। আমি এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, মুহাম্মাদ তায়েফ জয় করলে আমি বনু সাকীফের একটা মেয়েকে হস্তগত করবো যাতে সেই মেয়রে গর্ভে আমার একটা পুত্র জন্ম নেয়। কারণ বনু সাকীফ অত্যন্ত তীক্ষè মেধার অধিকারী।”

অবরোধ চলাকালে তায়েফের কিছু সংখ্যক দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট আসে এবং ইসলাম গ্রহণ কলে। তিনি তাদের সবাইকে মুক্ত করে দেন। পরবর্তী সময়ে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের কেউ কেউ ঐ দাসদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করে। আবেদনকারীদের মধ্যে হারেস ইবনে কালদা চিলেন অন্যতম। তিনি তাদের ‘না’ সূচক জবাব দেন এবং বলেন, “ওরা আল্লাহর মুক্ত বান্দা। ওদেরকে আবার আমি দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে পারি না।”

মোট বারোজন সাহাবী তায়েফে শাহাদাত বরণ করেন। তন্মধ্যে সাতজন কুরাইশ, চারজন আনসার এবং একজন বনু লাইস গোত্রের।

যুদ্ধ ও অবরোধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ ত্যাগ করলে বুজাইর ইবনে যুহাইর তায়েফ ও হুনাইনের বর্ণনা দিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন যার মর্ম হলো-

“হুনাইনের প্রান্তরে সমবেত হওয়ার দিনে, আওতাসে সমবেত হওয়ার প্রভাত কালে এবং বিদ্যুত চমকানের দিন শেষেক্তটি সম্ভবতঃ তায়েফ) তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। প্রতারণার মাধ্যমে হাওয়াযিন তার জনতাকে সমবেত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা নীড়ভ্রষ্ট শতধঅ বিভক্ত পাখীর মত হলো। আমাদের কোন অবস্থান গ্রহণকেই তারা বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। পেরেছে শুধু তাদের প্রাচীর ও খন্দকের ভেতরটা ঠেকিয়ে রাখতে। তায়েফবাসী যাতে বেরিয়ে আসে সেজন্য চেষ্ট করলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ করে তারা তাদের ঘরে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকলো। তারা অনুতপ্ত হয়ে একদিন ফিরে যাবে সেই বিশালকায় বাহিনীর কাছে- যে বাহিনী মৃত্যুর দীপ্ত গৌরবে উদ্ভাসিত-যে বাহিনীর সমাবেশে সবুজ আভা পরিস্ফুট। (নাজাদের) হাযান পর্বতে যদি তাকে চালিত করা হয় তবে সে পর্বত নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যাবে। বনের সিংহরা কাঁটাযুক্ত ঘাসের ওপর দিয়ে যেভাবে চলে আমরা সেইভাবে চলি। যেন আমরা দ্রুতগামী ঘোড়া, যা চলার পথে কখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আবার মিলিত হয়। সব রকমের যুদ্ধবর্মই আমরা পরে থাকি। এসব বর্মই আমাদের দুর্গের কাজ করে- যেমন অগভীর কুয়ার ভেতরে পুঞ্জিভূত বাতাস বেরিয়ে গেলে তা দুর্গের মত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বর্মগুলো এত দীর্ঘ যে তা আমাদের জুতা স্পর্শ করে এবং তা দাউদ (আ) এবং হীরার বাদশাহ আমর ইবনে হিন্দের তৈরী বর্মের মত সুনির্মিত।”

হাওয়াযিনের জমিজমা
যুদ্ধবন্দী, তাদের কিছুসংখ্যক লোককে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য উপঢৌকন দান এবং কিচু লোককে পুরস্কার প্রদানের বিবরণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণ হাওয়াযিনের বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে সাথে নিয়ে তায়েফ থেকে জিরনাতে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। ইতিপূর্বে সাকীফের অবরোধ ত্যাগ করে তাদের থেকে চলে যাওয়ার সময় একজন সাহাবী তাঁতে বনু সাকীফের বজন্য বদদোয়া করতে বলেন। জবাবে তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! সাকীফকে হিদায়াত দান কর ও আমার কাছে হাজির কর।”

হাওয়াযিনের একটি প্রতিনিধদল জিরানাতে এসে তাঁর সাথে দেখা করলো। তকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হাওয়াযিনের গোত্রের ছয় হাজার শিশু ও নালি যুদ্ধবন্দী ছিল। আর উচ ও বকরীর সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি। প্রতিনিধিরা বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও আত্মীয়-স্বজন। আমাদের ওপর কি ভয়াবহ বিপদ আপতিত তা আপনার অজানা নেই। অতএবআমাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করুন। আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।”

হাওয়যিনের এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো। তার অব্যবহিত পর বনু সা’দ ইবনে বকরের এর একজন উঠে দাঁড়ালো। এ ব্যক্তি হলো যুহাইর ওরফে আবু সুরাদ। সে বললো, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, যুদ্ধবন্দীদের ভেতর আপনার ফুফু, খালা ও আপনার লালন-পালনকারিণীরাই রয়েছে। [৮৪. লালন পালনকারিণী বলতে দুগ্ধ-দাত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের দুধমাতা হালিমা এই বনু সা’দ গোত্রেরই মহিলা ছিলেন এবং তা হাওয়াযিনেরই একটি শাখা।] আমরা যদি হারেস ইবনে আবু শিমার অথবা নুমান ইবনে মুনযিরকে দুধ খাওয়াতাম এবং তারা যদি আজ আপনার জায়গায় অধিষ্ঠিত হতো হাতলে তারাও আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতো। আপনি তো তাদের চেয়েও উত্তম।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা তোমাদের সম্পদ এবং স্ত্রী ও শিশুদের মধ্যে কোনটিকে অগ্রধিকার দিতে চাও?” তারা বললো, “আপনি যদি দুটোর একটাই নিতে বলেন তাহলে আমাদের শিশু ও মহিলাদেরকেই ফিরিয়ে দিন।” তিনি বললেন, “যেসব মহিলা ও শিশু আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীর কাছে আছে তাদেরকে আমি দিয়ে দিচ্ছি। আর বাদবাকীদের জন্য তোমরা যোহরের নামাযের সময় জমায়াতে হাজির হও। তখন মুসলমানদের সবার কাছে এই বলে আবেদন জানাবে যে, ‘আমরা আমাদের স্ত্রী ও শিশুদের ফেরত চাই। যারা মুলমানদের কাছে রয়েছে তাদের জনস্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করছি তিনি যেন মুসলমানদেরকে সুপারিশ করেন আর যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট রয়েছে তাদের জন্য মুসলমানদেরকে অনুরোধ করছি তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করেন।’ তখন আমি আমার কাছে যারা রয়েছে তাদেরকে ফেরত দেব এবং মুসলমানদেরকে অনুরোধ করবো যেন তারাও ফেরত দেয়।”

যোহরের নামাযের সময় হাওয়াযিন ও বনু সা’দের প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশমত কাজ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সামনে ঘোষণা করলেন, “সঙ্গে সঙ্গে মুহাজির ও আনসারগণও বললেন, “আমাদের কাছে যারা আছে আমরা তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কাছে সমর্পণ করলাম।” কেবল আকরা ইবনে হারেস নিজের ও বনু তামীমের, উয়াইদা ইবনে হিসন নিজের ও বনু ফাজারের এবং আব্বাস ইবনে মিরদাস নিজের ও বনু সুলাইমের পক্ষ থেকে এ আবেদনে সাড়া দিলো না। কিন্তু বনু সুলাইম আব্বাসকে অগ্রাহ্য করে বললো, “ আমাদের যার কাছে যত নালী ও শিশু আছে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে অর্পণ করলাম।: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা নিজ নিজ অধিকার ত্যাগ করতে চাও না তাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, এরপর সর্বপ্রথমে যে যুদ্ধবন্দী আমার হস্তগত হবে তা থেকে তাদের প্রত্যেককে একটির বদলে ছয়টি করে দেবো। কাজেই এদের শিশু ও নারী ফেরত দাও।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম হাওয়াযিনের প্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করলেন, “মালিক ইবে ন আওফের খবর কি?” তারা বললো, “সে তায়েফে বনু সাকীফের সাথে রয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন, “মালিকেেক তোমরা জানিয়ে দাও, সে যদি মুসলমান হয়ে আমার কাছে হাজির হয় তাহলে আমি তাকে তার সমস্ত সম্পদ ও বন্দী লোকদেরকে ফেরত দেবো এবং আরো একশো উট দেবো।” মালিকের আশংকা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্তাব বনু সাকীফ জানতে পারলে তারা তাকে আটক করবে। তাই সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করলো। সে পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় একটি উটকে তার বাহন হিসেবে প্রস্তুত করে রাখলো। অতঃপর তায়েফ থেকে গভীর াতে একটি ঘোড়ায় চড়ে ঐ উটের কাছে পৌছলো। অতঃপর সেই উটের পিঠে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলো। কিরানা অথবা মক্কায় তাঁর সাথে মিলিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সকল বন্দী ও সম্পদ ফেরত দিলেন এবং একশোটি উটও দিলেন। সে ইসলাম গ্রহণ করলো এবং নিষ্ঠাবান মুসমলমানের পরিণত হলো। অতঃপর মালিক ইবনে আওফ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় একটি কবিতা আবৃত্তি করলো। কবিতাটি নিম্নরুপঃ

“সমগ্র মানব সমাজে আমি মুহাম্মাদের সমতুল্য কোন মানুষ দেখিনি, বা শুনিনি।

সে কাউকে কোন কিছু দেয়অর প্রতিশ্রুতি দিলে তা যথাযথভাবে রক্ষা করে

এবং বিপুল পরিমাণে দান করে

উপরূন্ত তুমি যদি চাও

তবে সে আগামীকাল কি ঘটবে তাও বলে দিতে পারে।

যখন বড় বড় গোত্রতিরা নিজ নিজ বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সহ পালিয়ে গেছে

এবং অত্রন্ত তীক্ষèধার তরবারীও আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত হয়েছে

ধূলিধূসরিত রণাঙ্গনে তখনো সে শাবকদের পাহারায় নিযোজিত ও

ঘাঁটিতে ওত পেতে থাকা হিংসের মহ অবিচল।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মালিক ইবনে আওফকে তার স্বগোত্রীয় মুসলমানদের এবং বনু সুমালা, বনু সালেমা ও বনু কাহম গোত্রের মুসলমানদের আমীর নিযুক্ত করেন। মালিক এইসব মুসলমানদের সাথে নিয়ে বনু সাকীফের বিরুদ্ধে অব্যাহত লাড়াই চালাতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বশীভূত করেন। বনু সাীফের কবি আবু মিহজান খেদোক্তি করে কবিতা আবৃত্তি করে,

“একদিন শত্রুরা আমাদেরকে ভয় করে চলতো। অথচ

আজ কিনা বনু সালেম আমাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

সকল সম্পর্কের পবিত্রতা লংঘন ও ওয়াদা ভঙ্গ কলে

মালিক তাদের সহযোগিতায় আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। এমনকি

আমাদের বাড়ীঘরের ওপরে চড়াও হয়ে বসেছে।

অথচ আমাদেরই প্রতিশোধ নেয়ার কথা ছিল।”

অতঃপর মুসলমানদের মধ্যে অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফাই (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) তথা উট ও ছাগলের ভাগ দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। পীড়াপীড়ি করতে করতে তারা তাঁকে একটি গাছের নীচে নিয়ে গেলে গাছে তাঁর চাদর আচকে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা আমার চাদরখানা দাও। আল্লাহর কসম, তিহামার বৃক্ষরাজির মত বিপুল সম্পদও যদি থাকতো তাহলে আমি তা তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। আমার ভেতরে কৃপণতা, ভীরুতা ও মিথ্যার লেমমাত্রও তোমরা দেকতে পেতে না।” অতঃপর তিনি তার উটের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার ঘাড়ের ওপর থেকে একটা চুল হাতে নিয়ে তা দেখিয়ে বললেন “হে মুসলিম জনতা, আল্লাহর কসম, তোমাদের ফাই থেকে-এমনকি এই পশমগাছি থেকেও আমার প্রাপ্য এক পঞ্চমাংশের বেশী নয়। অথচ সেই এক পঞ্চমাংশেও আমি তোমাদেরকেই দিয়ে দিয়েছি। সুতরাং যদি কেউ এই সম্পদ থেকে একটা সুঁই ও সুতাও নিয়ে থাক তবে তা ফিরিয়ে দাও। মনে রেখ, যে ব্যক্তি খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিন ঐ খিয়ানত তার জন্য আগুনের রূপ নেবে এবং চরম অপমান ও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

জনৈক আনসারী তার উটের হাওদার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ সেলাই করার জন্য কিছু পশমের সুতা নিয়েছিলেন তিনি তা ফেরত দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ এ থেকে আমার প্রাপ্য অংশ তোমাকে দিলাম।” তিনি বললেন, “আপনি খিয়ানত সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তাতে আমার এ জিনিসের মোটেই প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তা ফেরত দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন জয় করার উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় লোকদের সম্পদ প্রদান করেন। নিম্নলিখিত ব্যক্দিদেরকে তিনি একশ’টি করে উট দেন: আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া, হাকীম ইবনে হিযাম, হারেস ইবনে কালদা, হারেস ইবনে হিশা, সুহায়েল ইবনে আমর, হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উয্যা, আলা ইবন জারিয়া, উয়াইনা ইবনে হিসন, আকরা ইবনে হারেস, মালিক ইবনে আওফ ও সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া।

নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে একশ’র কম উট প্রদান করেন ৎ মাখরামা ইবনে রাওয়াল যুহরী উমাইর ইবনে ওয়াহাব আল-জুমাহী, হিশাম ইবনে আমর ও আমর ইবনে লুয়াই। আর সাঈদ ইবনে ইয়ারবু ও সাহমীকে পঞ্চাশটি করে উট দেন।

আব্বাস ইবনে মিরদাসকে দেন পঞ্চাশটিরও কম। সে রাগান্বিত হয়। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিরস্কার করে নিচের কবিতাংশ আবৃত্তি করে,

“এগুলো আমার ছিনিয়ে নেয় দ্রব্য ছিল। আমি অশ্¦ শাবকের পিঠে সওয়ার হয়ে সমতল ভূমির জনপদে হামলা চালিয়ে এগুলো পেয়েছিলাম। নিজের গোত্রের লোকদের ঘুম থেকে জাগিয়ে রেখে ছিনিয়ে এনেছিলাম যেন তারা না ঘুমায়। কিন্তু তারা ঘমিয়ে পড়েছিল আর আমি একা জেগে ছিলাম। উয়াইনা ও আকরা যা পারেনি আমি ও আমার ঘোড়া সেই সম্পদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে আমি একজন দক্ষ লড়াকু। কিন্তু আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে দেযা হয়নি। তবে একবোরে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবল কয়েকটি ছোট উট আমাকে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর চারটি পা এখনো তেমন লম্বা হয়নি। হিসন এবং হারেস (একশো উট প্রাপ্ত উয়াইনা ও আকরার পিতা) আমার পিতার (মিরদাসের) চেয়ে সমাজে বেশি প্রতিপত্তিশালী ছিল না। আর আমি নিজেও ওদের দুজনের চেয়ে নগণ্য নই। আজ আপনি যাকে অপমানিত করলেন সে আর কখনো সম্মানিত হবে না।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণকে নির্দেশ দিলেন, “যাও, ওকে আরো কিছু দিয়ে খুশী কর এবং তার মুখ বন্ধ কর।” সাহাবাগণ তাকে আরো কিছুসংখ্যক উট গিয়ে খুশী করলেন।

আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রের নেতাদের প্রতি এরূপ বদান্যতা প্রদর্শন করায় এবং আনসারগণকে কিছুই না দেয়ায় তারা খুবাই অসন্তুষ্ট হন এবং কেউ কেউ আপত্তিকর কথাবার্তা বলা শুরু করেন। এমনকি কেউ কেউ বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আপনজনদেরকে খুশী করেছেন।” এ সময় সা’দ ইবনে উবাদা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি গনীমতের সম্পদ যেভাবে বিলিবন্টন করলেন তাতে আনসারগণ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। আপনি এসব সম্পদ নিজের গোত্র কুরাইশ ও অন্যান্যদের মধ্যে বন্টন করলেন। অথচ আনসারদের কিছু দিলেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে সা’দ! তোমার নিজের মনোভাব কি?” তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আমার গোষ্ঠীর একজন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে তোমার গোষ্ঠীকে এখানে হাজির কর।”

সা’দ আনসারদেরকে সেখানে জমায়েত করলেন। কিছুসংখ্যক মুহাজিরও সেখানে এসে হাজির হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন। এরপর আবার কিছুসংখ্যক মুহাজির আসতে চাইলে তিনি আর অনুমতি দিলেন না। এভাবে ঐ সকল আনসার সমবেত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের াকছে গেলেন। প্রথমে তিনি যথাযথভাবে আল্লাহর প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন, “হে আনসারগণ, তোমাদের পক্ষ থেকে কিচু আপত্তিকর কথা উচ্চারিত হতে শুনেছি এবং আমার ওপর তোমরা ক্ষুব্ধ ও ক্রুব্ধ হয়েছো বলে জানতে পেরেছি। বলতো আমি যখন তোমাদের কাছে আসি তখন কি তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ কি তোমদেরকে হিদায়াত দান করেননি? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদের সচ্ছল করেননি? তোমরা কি পরস্পরের শত্রু ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ কি তোমাদেরকে পরস্পরের কাছে প্রিয় করে দেননি?” তারা বললেন, “হা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহ করেছেন।” তিনি আরো বললেন, “হে আনসারগণ, তোমরা জবাব দাও না কেন?” তারা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনাকে কি জবাব দেবো? আল্লাহর রাসূলই আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অনুগ্রহ করেছেন।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা বলতে পার যে, তুমি আমাদের কাছে এসেছিলে এমন অবস্থায় যখন কেউ তোমার প্রতি ঈমান আনেনি, আমরাই কেবল ঈমান এনছিলাম। সবাই তোমাকে নির্যাতন করেচিল শুধু আমরাই তোমাকে সাহায্য করেছিলাম, তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল আমরাই তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, তুমি অসহায় অবস্থায় আমাদের কাছে এসেছিলে আমরা তোমাকে আপনজন করে নিয়েছিলাম। এ কথাগুলো বললে তোমাদের মোটোই মিথ্যা বলা হেব না। এবং সবাই তার সত্যতা স্বীকার করবে। হে আনসারগণ, দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের জন্য তোমরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে গেলে? এক শ্রেনীর লোককে আমি আগেই আস্থাবান ছিলাম এটা কি তোমাদের পছন্দ হয়নি? হে আনসারগণ, তোমরা কি এতে খুশী নও যে, লোকেরা উট ও বকরী নিয়ে চলে যাক, আর তোমরা তার বদলে আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে যাও? যে আল্লাহর হাতে মাহুম্মাদের প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, আমাকে যদি হিজরাত করে আসতে না হতো, তাহলে আমি তোমাদেরই মত আকজন আনসার হতাম। সবাই যদি একপথে চলে আর আনসাররা যদি ভিন্ন পথে চলে আমি আনসারদের পথ ধরেই চলবো। হে আল্লাহ! তুমি আনসারদের প্রতি রহমত বর্ষণ কর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং সন্তানদের বংশধরের ওপরও রহমত বর্ষণ কর।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ভাষনে আনসার সাহাবীগণ এত কাঁদলেন যে, দাড়ি পর্যন্ত সিক্ত হয়ে গেল। তারা সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের ভাগে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়েই সন্তুষ্ট এবং তাতেই গৌরবান্বিত।’

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। মুসলমানরাও যে যার কাজে চলে গেল।

জি’রানা থেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) উমরা পালন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাব ইবনে উসাইদকে সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং আত্তাব মুসলমানদের সাথে নিয়ে ৮ম হিজরী সনে হজ্জ পালন করেন।

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আালাইহি ওয়াসাল্লাম জি’রানা থেকে উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। মাররুয যাহরানের নিকটবর্তী মাজান্নাতে বিজয়লব্দ অবশিষ্ট সম্পদ সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিলেন। উমরা সমাপন করে তিনি মদীনা চলে গেলেন এবং আত্তাব ইবনে উসাইদকে (রা) সাময়িকভাবে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন। মুসলিম জনগণকে ইসলামের বিস্তারিত বিধান ও কুরআন শিক্ষ দেয়ার উদ্দেশ্যে আত্তাবের সাথে মুয়ায ইবনে জাবালকেও (রা) রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বিজয়লব্ধ অবশিষ্ট সম্পদ সাথে করে মদীনায় নিয়ে গেলেন। তিনি এই উমরা সম্পন্ন করেন যুলকাদা মাসে। তাই তাঁর মদীনা গমন সংঘটিত হয়েছিল যুলকা’দার শেষায়শ অথবা যুল-হাজ্জের প্রথমাংশে। ইবনে ইসহাক বলেন, আরবদের প্রচলিত নিয়মেই সে বছরের হজ্জ সম্পন্ন হয়। আত্তাব (রা) মুসলমানদের সঙ্গে হ্জ্জ পালন করেন। [৮৫. ইবনে হিশাম বলেন, যায়িদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাবকে মক্কার শাসক হিসেবে নিয়োগ করার পর তাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা দেন। তিনি একদিন মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “এক দিরহাম ভাতা পেয়েও যার তৃপ্তি হয় না আল্লাহ তাকে কখনো তৃপ্ত করবেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দৈনিক এক দিরহাম করে ভাতা ঠিক করে দিয়েছেন। আমি এখন কারো মুখাপেক্ষী নই।”] এটা ছিল ৮ম হিজরী সন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর থেকে তথা যুলকা’দা মাস থেকে নিয়ে নবম হিজরী সনের রমযান পর্যন্ত তায়েফবাসী শিরক ও ইসলাম বিরোধিতায় অবিচল থাকে।


তায়েফ ত্যাগের পর কা’ব ইবনে যুহাইরের ইসলাম গ্রহণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর বুজাইর ইবনে যুহাইর তার ভাই স্বনির্বাচিত বিশিষ্ট কবি কা’ব ইবনে যুহাইরকে চিঠি মারফত জানায় যে, “মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করতো তাদের অনেককে তিনি হত্যা করেছেন। কুরাইশ কবিদের মধ্যে ইবনে যাবয়ারী ও হুবাইরা প্রমুখ পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। তুমি যদি বাঁচতে চাও তবে কালবিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হও। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে ও তাওবাহ করে তাঁর কাছে আসে তিনি তাঁকে হত্যা করেন না। আর যদি তা না কর তবে দুনিয়ার যেখানে নিরাপদ মনে কর সেখানে গিয়ে আশ্রয় নাও।”

ইতিপূর্বে কা’ব এক কবিতায় বলেছিল,

“বুজাইয়ের কাছে আমার এই বার্তা পৌছিয়ে দাও, আমি যা বলেছি তা গ্রহণ করতে কি তোমার প্রবৃত্তি হয়. আর যদি তা গ্রহণ না কর তাহলে আমাকে আনাও, অন্য কোন্ জিনিসের প্রতি তুমি আগ্রহী? তুমি সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা আমি তাঁর পিতামাতার মধ্যে দেখিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদের) এবং তুমি তোমার পিতামাতার মধ্যেও দেখনি? আমার কথা যদি ুতমি গ্রহণ না করা তাহলে আমি দুঃখ করবো না এবং তুমি ভুল করে ক্ষতিপ্রস্ত হলেও আর শুধরে দেব না। বিশ্বস্ত মানুষটি তোমকে সেই বিশেষ স্বভাব চরিত্র গড়ার উদ্দেশ্যে নতুন পানীয় পান করিয়েছে।”

কা’ব এই কবিতাটি বুজাইরের নিকট পাঠায় এবং বুজাইর তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে পড়ে শোনায়। তিনি যখন শুনলেন, “বিশ্বস্ত মানুষটি তোমাকে নতুন পানীয় পান করিয়েছে” তখন বলনে, “কা’ব মিথ্যাবাদী হলেও এ কথাটা সত্য বলেছে। আমিই সেই বিশ্বস্ত মানুষ।”

পুনরায় যখন আবৃত্তি করা হলো, “(তুমি কি) সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা তার মাতাপিতার মধ্যে তুমি দেখনি” তখন রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ, সে তার পিতামাতার মধ্যে এ চরিত্র দেখেনি।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ বুজাইরের চিঠি পেয়ে কা’ব চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। প্রাণের ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। তার আশেপাশে তার শত্রুভাবাপন্ন যারা ছিল তারা তাকে আরো ভীত এবং সন্ত্রস্ত করার জন্য বলতে লাগলো,!“কা’বের মরণ আসন্ন।” অনন্যোপায় হয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের প্রশংসা করে একটা কবিতা লিখলো। এই কবিতায় সে তার নিজের ভীতি এবং তার শত্রুদের কর্তৃক তাকে সন্ত্রস্ত করার কথা উল্লেখ করলো। অতঃপর সে মদীনায় চলে গেল। সেখানে তার পূর্ব পরিচিত জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে গিয়ে উঠলো। অতঃপর সে ব্যক্তি কা’বকে নিয়ে ফজরের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের নিকট চলে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতে নামায পড়লো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইংগিত করে কা’বকে বললো,, “তিনিই রাসূলুল্লাহ। তুমি তাছর কাছে গিয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর।” কা’ব তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ্অলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁকে চিনতেন না। কা’ব বললো, “ ইয়া রাসূলুল্লাহ, কা’ব ইবনে যুহাইর তাওবাহ করে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে হাজির করি তাহলে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হঁ^া।” তখন সে বললে “ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর।” এই সময় জনৈক আনসার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে অনুমতি দিন, আল্লাহর এই দুশমনকে হত্যা করি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও। সে তাওবাহ করে এবং শিরক ত্যাগ করে এসেছে।” ঐ আনসারীর ব্যবহারে কা’ব সমগ্র আনসারদের প্রতি রাগান্বিত হয়। অবশ্য মুহাজিরগণ তাকে কোন অপ্রীতিকর কথা বলেননি। সে একটি কবিতা লেভে। কবিতাটি এরূপ -

“ (আমার স্ত্রী) সুয়াদ আমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে আমার মন ভেঙ্গে গেছে। আমি আজ অপমানিত এবং শৃংখলিত। তার পদানুসরণ করায় আমার কোন ণাল হয়নি। …. শুনেছি, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তথাপি, আমি আল্লাহর রাসূলের ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি। একটু সবুর করুন! যে আল্লাহ আপনাকে উপদেশ সমৃদ্ধ কুরআনের ঐশ্বর্য দান করেছেন তিনি যেন আপনাকে ন্যায়পথে পরিচালনা করেন। কুচক্রীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না। যদিও আমি বেফাঁস কথা অনেক বলে থাকি, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি আজ এমন (নাজুক) অবস্থানে আছি সেখানে বসে যা যা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি তা শুনলে হাতিও আতংকে অস্থির হয়ে যেত। অবশ্য তাকে আল্লাহর রাসূল যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে নিরাপত্তা দেন তাহলে আলাদা কথা। এ যাবত আমি রাতের আঁধারে ঊষর মরুপ্রান্তর দিয়ে ঘুড়ে বিড়িয়েছি। অবশেষে আমি আমার হাত দিয়েছি সেই ব্যক্তির হাতে যিনি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম এবং যার কথা একমাত্র হক কথা। সে হাত আমি আর ফিরিয়ে আনবো না। বস্তুতঃ আমি যখন তাঁর সাথে কথা বলি এবং যখন আমাকে বলা হলো, ‘তুমি অভিযুক্ত ও (বহু অঘটনের জন্য) দায়ী’, তখন তিনি আামার কাছে ‘ইশরে’র নিবিড় অরণ্যের সিংহের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন- যে সিংহ অন্য দুটি সিংহকে মানুষের গোশত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, একটি পর্বতের চূড়ায় দিকে যখন সে লাফ দেয় তখন সেই চূড়া জয় না করে সে ছাড়ে না, ‘জাও’ অঞ্চলের বন্য হিং¯্র জন্তুগুলো তার ভয়ে পালায় এবং মানুষেরা দল বেঁধেও তার এলাকায় চলাফেরা করার সাহস পায় না। তার এলাকায় শুধু এমন লোকই যেতে পারে যে নির্ভরযোগ্য এবং সে রক্তাক্ত অস্ত্র ও পুরনো ছেড়া পোশাকে চলতে পারে। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য পথের দিশারী এক উজ্জ্বল জ্যোতি এবং আল্লাহর এক অপরাজেয় তরবারী। কুরাইশদের একদল লোক যখন মক্কায় তার প্রতি ঈমান আনলো, তখন তাদের কেউ কেউ মু’মিনদের বললো, ‘দূর হয়ে যাও।’ তারা দুল হয়ে গেল বটে। তবে তারা (কুরাইশরা) সেই সমস্ত বীরদের মুকাবিলায় নিরস্ত্র ও অসহায় গয়ে গেল-যারা যুদ্ধের সময় অটুট সুদীর্ঘ সাদা বর্ম পরিধান করে থঅকে- যারা বিজয়ী হলেও উল্লঅসে ফেটে পড়ে না। (কেননা সেটা তাদের অভ্যঅসগত) আর পরাজিত হলেও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে না। (কেননা তারা জানে জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং পরবর্তীতে তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী) তারা শ্বেতকায় উটের মত স্থির শান্ত পদক্ষেপে চলে, কালেঅ খাটো লোকগুলো যখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় তখন তারা যুদ্ধ করেই আত্মরক্ষা কলে। আঘাত পড়লে তাদের বুকেই পড়ে। (পিঠে পড়ে না) কেননা তারা মৃত্যুর ভয়ে পালায় না। (বরং সামনে এগিয়ে যায় এবং শত্রুর আঘাতকে বুক পেতে গ্রহণ করে ও প্রতিরোধ করে)।”

আসেম বিন উমার ইবনে কাতাহাদ থেকে বর্ণিত। কা’ব যখন বললো, “কালো খাটো লোকগুলো যখন পালিয়ে যায়” তখন তার ওপর আসসারগণ রেগে যান। কেননা এ কথঅটা সে আমাদের আনসারদের উদ্দেশ্যেই বলেছিল। কারণ আমাদের একজন তার সাথে দুর্ব্যহার করেছিল। পরে আনসারদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সে আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং তাঁর দক্ষিণ হস্তের ভুমিকা পালনের প্রশংসা করে।

সে কবিতাটি এই-

“যে ব্যক্তি জীবনকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করতে চায় সে যেন পুণ্যবান আনসারদের সঙ্গ ত্যাগ না করে। মহত্ত্ব ও মহানুভবতা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। তাই তারা হলেন শ্রেষ্ঠ মানবদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কেবল বর্ম দিয়ে তীর বর্শাকে বলে আনেন। তাদের বর্মগুলো বর্শার মতই- কোন অংশে তা থেকে কম নয়। আগুনের অংগারের মত লাল ও তীক্ষèদৃষ্টি চোখ দিয়ে তারা তাকান। যুদ্ধের সম্মুখীন হলে মৃত্যুর জন্য তারা আপন প্রাণ নবীর হাতে সঁপে দেন। মু’মিনদের ধর্মকে তারা উত্তোলিত তরবারী ও বর্শা দিয়ে রক্ষা করেন। কাফিরদের রক্ত দিয়ে তারা পবিত্রতা লাভ করেন এবং একে তারা পুণ্যব্রত বলে বিবেচনা করেন। খিফয়ার গভীর অরণ্যে ঘাড়মোটা শিকারী সিংহেরা যেমন যুদ্ধের অনুশীলন করে তারাও তেমনি রণদক্ষতা রপ্ত করেন। তারা যখন হামলাকরীর প্রতিরোধ করেন তখন তাকে সম্পূর্নরুপে থামিয়ে দেন। আলী ইবনে মাসউদ মাজেন গাছছানীকে তারা বদরের যুদ্ধে এমন আঘাত করেন যে, সমগ্র বনু নিযার তাতে শায়েস্ত হয় ও বশ্যতা স্বীকার কলে। সকল গোত্র যদি আনসারদের সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তা জানতো তাহলে আমার চরম বিরোধী যারা তারাও ব্যাপারটা স্বীকার করতো। তারা এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা চরম দুর্ভিক্ষের সময়ও রাত্রিকালে আগত অীতথিদের প্রতি বদান্যতা প্রদর্শন করে। তারা গাছছানের এমন এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক, যাদের আভিজাত্যে কোন ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না।”

নিজের স্ত্রী সুরাদ সম্পর্কিত কবিতাটি আবৃত্তি করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ কবিতায় তোমার আনসারদের প্রশংসা করা উচিত ছিল। কেননা তারা তার উপযুক্ত বটে।” তখন কা’ব এই শেষোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ইবনে হিশাম আরো বলেছেন যে, কা’ব তার স্ত্রী সায়াদকে নিয়ে শুরু করা কবিতাটি মসজিদে নববীতে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়ে শুনিয়েছিল।

তাবুক যুদ্ধ: রযব, নবম হিজরী সন
এরপর যুলহাজ্জ থেকে রযব মাস পযন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করেন এবং পরে মুসলমানগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুত হতে বলেন। যুহরী, ইয়াযীদ ইবনে রোমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র, আসেম ইবনে জামর প্রমুখ ঐতিহাসিক তাবুক অভিযানের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সে সময় মুসলমানদের জন্য সময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। একদিকে ছিল গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপ। অন্যদিকে দেশে চলছিল দুর্ভিক্ষ। যাদের কিছু ফল জন্মেছে তা একেবারে পেকে গিয়েছিল। লোকেরা তাদের ফল সংগ্রহ করা এবং ছায়াশীতল জায়গায় অবস্থান করার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঠিক এমন সময় বাইরে যাওয়া কারো মনঃপূত ছিল না। অধিকাংশ অীভযানে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সামান্য কছিু আভাস ইংগিত দিতেন। জানিয়ে দিতেন যে, যেদিকে রওয়ানা হচ্ছি আসল গন্তব্য তা থেকে আলাদ। কিন্তু তাবুক অভিযানের বেলায় সর্ম্পূর্ণ ভিন্ন রকম ব্যাপার ঘটলো। এক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলের কথা সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিলেন। কেননা গন্তব্যস্থান ছিল অনেক দূরের, সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং শত্রুর সংখ্যাধিক্যও ছিল গুরুতর পর্যায়ের। তাই লোকেরা যাতে অভিযানের জন্য যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে সেজন্য আগেভাগে তিনি সবকিছুই জানিয়ে দিলেন। তিনি মুসলমানগণকে প্রস্তুত হতে বললেন এবং জানালেন যে, এবার মুকাবিলা রোম সম্রাটের সাতে। এই প্রস্তুতি চলাকালে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সালামা গোত্রের জাদ্দ ইবনে কায়েসকে বললেন, “হে জাদ্দ, এ বছর রোমানদের সাথে লড়তে তুমি কি প্রস্তুত?” সে বললো, “হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে (পাপের) ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করার চাইতে আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দেবেন কি? আল্লাহর কসম, আমার গোত্রের লোকেরা জানে যে, আমি নারীদের প্রতি যতখানি দুর্বল, অতটা খুব কম লোকই আছে। রোমান মেয়েদের দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না বলে আমার আশংকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে আর মাথা ঘামালেন না। তিনি বললেন, “তোমাকে অনুমতি দিলাম।” জাদ্দ ইবনে কায়েস সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী ********]

“তাদের মধ্যে কেই কেউ বলে, ‘আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দিন, ফিতনার মধ্যে ফেবেন না।’ জেনে রেখো, তারা ফিতানার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েই আছে। জাহান্নাম নাফরমানদের ঘেরাও করেই রেখেছে।” অর্থাৎ সে রোমান নারীদের প্রতি আসক্ত হবার আশংকা বোধ করেছিল। আসলে সে আশংকা তার ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে না গিয়ে এবং নিজের স্বার্থকে অগ্রধিকার দিয়ে সে বরং আরো বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে। তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।

মুনাফিকরা একে অপরকে বললো, “এত প্রচন্ড গরমে তোরা সফরে যেও না।” তারা এভাবে জিহাদ থেকে ফিরে থাকতে সচেষ্ট ছিল ও সত্যের পথে দ্বিধা-সংশয়ে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সম্পর্কে নাযিল করলেন-

“তারা বললো, গরমের মধ্যে সফরে যেও না। (হে নবী) তুমি বলে দাও, দোযখের আগুন সর্বাধিক গরম। তারা যদি তা বুঝতো (তাহলে এমন কথা বলতো না) অতএব তারা যেন কম হাসে এবং বেশী কাদে। তাদের অপকর্মের শাস্তি তাদের পেতেই হবে।”

ইবনে ইসহাক বলেনঃ

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের আয়েঅজন চালাতে লাগলেন এবং মুসলিম জনগণকে দ্রুত গ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বললেন। বিত্তবান মুসলমানগণকে তিনি সওয়ারীর পশু, টাকা-পয়সা ও রসদপত্র ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্য করতে উৎসাহিত করতে লাগলেন। ধনী মুসলমানগণ অনেক সাহায্য দিলেন এবং আল্লঅহর সুন্তুষ্টিকেই তারা যথেষ্ট মনে করতে লাগলেন। উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আন্হু এই সময় সকলের চাইতে বেশী দান করেন। [৮৬. ইবনে হিশাম বলেছেন, তাবুক অভিযাত্রী অভাব পীড়িত মুসলিম জন্য তিনি এক হাজার দিনার দান করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত খুশী হন যে, তিনি দোয়া করেন, “হে আল্লাহ! তুমি উসমানের ওপর সন্তুষ্ট হও। আমি তার ওপর সন্তুষ্ট।”]

আনসার ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে সাতজন মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সওয়ারী জানোয়ার চাইলেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সওয়ারীর বাহন সরবরাহ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ফলে তারা জিহাদে যেতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান। ইতিহাসে এরা ‘বাকাউন’ অর্থাৎ ক্রন্দনকারী নামে পরিচিত। এরা হলেন: বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সালেম ইবনে উমাইর, বনু হারেসার উলবা ইবনে যায়িদ, বনু মাজেনের আবু লায়লা আবদুর রহমান, বনু সালমার আমর ইবনে হুমাম ও আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল মুযানী। কেউ কেউ বলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর, বনু ওয়াফেকের হারমী ইবনে আবদুল্লাহ এবং বুন ফাজারার ইরবাদ ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহুম।

বর্ণিত আছে যে, এদের মধ্যে দু’জন আবু লায়লা আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহ বিন মুগাফফালকে কাঁদতে দেখে ইবনে ইয়ামীন ইবনে উমাইর জিজ্ঞেস করেন, “ তোমরা কাঁদছ কেন?” তারা বললেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলাম তাবুক অভিযানে যাওয়ার জন্য সওয়ারী চাইতে। কিন্তু তিনি দিতে পারেননি। আমাদের কাছেও এমন কিছু নেই যা দ্বারা তাঁর সাথে অভিযানে যেতে পারি।” তখন ইবনে ইয়ামীন তাদেরকে একটা উট এবং কিছু খোরমা দিলেন। তাঁরা ঐ সওয়ারীতে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অভিযানে চলে গেলেন। বেদুইন মুসলমানদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে নানা রকম ওপর পেশ করে এবং অভিযানে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাদেরকে অনুমতি দেননি। কারো কারো মতে তারা ছিল বনু গিফার গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সফর শুরু হলো। কিছুসংখ্যক নিষ্ঠাবান ও খালিছ মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অীভযানে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। তাদের ঈমান সম্পর্কে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। কেবল সংকল্পের দৃঢ়তা দেখাতে না পারাই ছিল তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ। মদীনার উপকণ্ঠে অবস্থিত পার্বত্য পথ সানিয়াতুল ওয়াদাতে তিনি সেনাবাহিনী চালিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার অধীনস্থ লোকদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে সানিয়াতুল ওয়াদা’র নীচ দিয়ে যে পথ জুবাব পর্বতের দিকে গিয়েছে সেই পথে চালিত করলো। অনেকের মতে, এই বাহিনেিত বিপুল সংখ্যক লোক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার সহযাত্রী মুনাফিক ও সংশয়বাদীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্য রেখে গেলেন। তাঁকে তিনি পরিবার-পরিজনের সাথে থাকতে বললেন। মুনাফিকরা তাঁকে কেন্দ্র করে নানা রকমের অপবাদ রটনা করলো। তারা বলতে লাগলো যে, আলীকে অলস মনে করে তার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে রেখে গিয়েছেন। মুনাফিকদের এইসব কথা শুনে আলী (রা) অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন। তিনি তখন মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে জুরফ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন- যেখানে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও মদীনার আরো অনেকের জমিজমা ছিল। আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, মুনাফিকরা মনে করেছে যে, আপনি আমাকে অলস মনে করে আমার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য রেখে এসেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, “তারা মিথ্যা বলেছে। আমি তোমাকে আমার ও তোমার পরিবা-পরিজনের দেখাশুনার জন্য রেখে এসেছি। হে আলী! মূসা (আ) হারুন (আ) কে যে পর্যায়ে রেখেছিলেন তোমাকে যদি আমি সেই পর্যায়ে রাখি তাহলে তুমি কি খুশী নও? কেননা আমার পরে আর কেউ নবী হবে না।” একথা শোনার পর আলী (রা) মদীনায় ফিরে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানেব রওনা হয়ে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তাবুক অভিযানে রওনা হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর আবু খাইসামা (রা) তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে এলেন। দেখলেন, তাঁর দুই স্ত্রী বাগানের ভেতরে নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করছে। উভয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে। তিনি এসে তাঁবুর দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তার দুই স্ত্রীর প্রতি নজর দিলেন এবং তাঁর আরাম-আয়েশের জন্য তারা যে ব্যবস্থা করে রেখেছে তাও দেখলেন। তখন সংগতভাবে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোদ, বাতাস ও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন আর আবু খাইসামা কিনা ঠান্ডা ছায়ার সুন্দরী নারীর সাহচর্যে নিজ ভুমি ও সহায়-সম্পদের ভেতরে বসে তৈরী খাদ্য খাবে? এটা কখনো ঠিক হবে না। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের কারো তাঁবুতে ঢুকবো না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে জিহাদী সাজে সজ্জিত করে দাও।” তারা তাঁর সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁর উট এগিয়ে দেয়া হলো। আবু খাইসামা রওয়ানা হলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে দ্রুত ছুটলেন। তিনি তাঁবুতে অবস্থান নেওয়ার পর আবু খাইসামা সেখানে উপনীত হলেন। পথিমধ্যে অপর এক সাহাবা উমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহী আবু খাইসামার সঙ্গী হলেন। তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানে অংশগ্রহন করতে যাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়ে যখন তাবুকের কাছাকাছি হয়েছেন তখন আবু খাইসামা উমাইরকে বললেন, “আমি একটা গুনাহ করে ফেলেছি। কাজেই তুমি একটু আমার পেছনে পড়লে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। আমাকে আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে পৌছতে দাও।”

তাবুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছাকাছি পৌছলে সাহাবীগণ তাঁকে দেখে বললেন, “একজন উষ্ট্রচালক এদিকে এগিয়ে আসছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সম্ভবতঃ আবু খাইসামা।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু খাইসামাই তো।” কাছে এসে উট থেকে নেমে আবু খাইসামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু খাইসামা, তুমি উপযুক্ত কাজই করেছো।” [৮৭. মূল শব্দটি হলো [আরবী ***] (আওলা লাকা) পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে তাফসীরকারগণের কেউ কেউ এর এরূপ অর্থও করেছেন, ‘তুমি ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়েছিলে।’ তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ প্রথম অর্থটাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ ‘তুমি তোমার উপযুক্ত কাজই করেছ।’] অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মোবারকবাদ দিলেন ও তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে সমৃদ্ধ জাতির বাসস্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম সেখানে স্বল্প যাত্রাবিরতি করেন। কোন কোন সাহাবী সেখানকার কূয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাবধান করে দেন যে, এখানকার পানি কেউ পান করো না এবং তা দিয়ে অযু করো না। এখঅনকার পানি দিয়ে কেউ আটা বানিয়ে থাকলে তা ঘোড়াকে খেতে দাও তোমরা খেয়ো না। রাতে এখঅনে কেউ একাকী বের হয়ো না। প্রায় সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মেনে চললেন। কেবল বনু সায়েদা গোত্রের দুইজন একাকী রাতে বের হয়েছিলেন। একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এবং অপরজন তার হারানো উটের সন্ধানে। যিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন তিনি যে স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন সেখানেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। আর যিনি উটের সন্ধানে বেরুলেন তিনি প্রবল বাতাসে উড়ে গিয়ে ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যাপারটা জানানো হলে তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে একাকী বেরুতে নিষেধ করিনি?” অতঃপর যে ব্যক্তি পায়খানা করতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দোয়া করলেন এতে তিনি সুস্থ হয়ে উছলেন। আর যিনি ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তাকে তাই গোত্রের লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা ফিরে যাওয়ার পর তাঁর কাছে পৌছিয়ে দেন।

পরদিন সকালে দেখা গেল, কাফিলায় কারো কাছে এক ফোটা পানিও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ একখন্ড মেঘ পাঠিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং তাতে সকলের প্রয়েঅজন পূর্ণ হলো। সবাই পরবর্তী সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করেও রাখলেন।

তাবুক যাওয়ার পথে আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উট হারিয়ে গেল। সাহাবীগণ উট খুঁজতে বেরুলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উমার ইবনে হাযম নামে আকাবার বাইয়াতে ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী জনৈক সাবাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু আমরের বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি। তাঁর দলে ভেতরে যায়িদ ইবনে লুছাইত নামক বনু কাইনুকা গোত্রের জনৈক মুনাফিক ছিল।

উমারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত থাকাবাস্থায় তাঁর দলবলের কাছে বসে উক্ত যায়িদ ইবনে লুছাইত বললো, “আচ্ছা, মুহাম্মাদ তো দাবী করেন যে, তিনি নবী এবং তিনি তোমাদেরকে আকাশের খবর জানা। তিনি এতটুকু জানেন না যে, তাঁর উট কোথায়? ঠিক সেই মুর্হুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারার (রা) উপস্থিতিতেই বললেন, “একজন লোক বলছে যে, মুহাম্মাদ নিজেকে নবী বলে দাবী করে থাকেন এবং তোমাদেরকে আসমানের খবরাদি জানা, তিনি কেন তাঁর উট কোথায় তা জানেন না? আল্লাহর কসম, আল্লাহ যেটুকু আমাকে জানিয়েছেন সেইটুকু ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আল্লাহ আমাকে উটের সন্ধান দিয়েছেন। এই উপত্যকার ভেতরেই তা অমুক জায়গায় রয়েছে। একটি গাছের সাথে তার লাগাম আটকে গেছে। তোমরা গিয়ে উটটাকে নিয়ে এস।” সাহাবীগণ গিয়ে উট ধরে আনলেন। অতঃপর উমারা (রা) তাঁর দলবলের কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইমাত্র আমাদের কাছে এক বিস্ময়কর খবর জানালেন। আমাদের বাহিনীর মধ্যে কে নাকি এরূপ কথা বলেছে এবং আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন।” এই বলে তিনি যায়িদ ইবনে লুছাইতের কথঅ বলেছে ব্যক্ত করলেন। তখন উমারার (রা) দলের একজন যিনি দলের অভ্যন্তরেই ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট যাননি- বললেন, “আল্লাহর কসম, যায়িদই এ কথা বলেছে।” তখন উমারা (রা) যায়িদের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ঘাড়ে আঘঅত করে বললেন, “হে আল্লাহর বান্দারা, আমার কাছে এস। আমার কাফিলায় একটা সাপ লুকিয়ে আছে, আমি তা জানতেও পারিনি। হে আল্লাহর দুশমন, বেরিয়ে যা আমার কাফিলা থেকে। আমার সাথে আর থাকিস না।”

বর্ণিত আছে যে, এরপর যায়িদ তাওবাহ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মৃত্যুকাল পর্যন্তই যায়িদ মুনাফেকী অব্যাহত রাখঅর দায়ে অভিযুক্ত ছিল।

যাত্রাপথে মাঝে মাঝে দুই একজন মুসরিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। মুসলমানগণ এ ধরনের কোন লোকের ফিরে যাওয়ার কথা জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “যেতে দাও। যদি তার মধ্যে সত্যপ্রীতি থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ আবার তাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। অন্যথায় আল্লাহ তার সাহচর্য থেকে তোমাদেরকে অব্যাহতি দিলেন। ভালই হলো।” এক সময় বলা হলো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু যারও পিছিয়ে গেছে। তাঁর উট তাকে পিছিয়ে দিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পিছিয়ে যায় তো যাক। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে তোমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে মনে করবে আল্লাহ তোমাদেরকে তার হাত থেকে রেহাই গিয়েছেন।: আবু যার (রা) তাঁর উটকে দ্রুত চালানের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হলো না। অগত্যা তিনি নিজের সাজ-সরঞ্জাম ও রসদপত্র ঘাড়ে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদানুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলে তিনি তাঁর সাথে এসে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একাকী হেঁটে আসতে দেখে বললেন, “আল্লাহ আবু যারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। সে একাই চলে, একাই মরবে এবং পুনরায় একাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, উসমান (রা) তাঁর খিলাফাতকালে যখন আবু যারকে (রা) রাবয়াতে নির্বাসিত করেন তখন সেখানে তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী ও ভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি তাঁদেরকে এই বলে অছীয়ত করেন যে “আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে গোসল ও কাফন দিয়ে রাস্তার ওপর রেখে দিও। অতঃপর সর্বপ্রথম যে কাফিলা তোমাদের কাছ দিয়ে যাবে, তাকে বলবে, এই লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার। তাঁকে দাফন করতে তোমরা আমাদের সাহায্য কর।” মৃত্যুর পরে স্ত্রী ও ভৃত্য অছীয়ত মুতাবিক কাজ কররেন এবং তাঁর লাশ রাস্তার ওপর রেখে দিলেন। এই সময় ইরাক থেকে একদল উমরাহ যাত্রীর সাথে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যাচ্ছিলেন। দলটি রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লাশটি দেখে থমকে দাঁড়ালো। অল্পের জন্য তা দলের উটের পাদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। ভৃত্যটি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার (রা)। তাঁকে দাফন করতে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন, তুমি একই চল, একাই মরবে এবং একাই পুররুজ্জীবিত হবে।” অতঃপর তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা নেমে তাঁকে দাফন করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক পৌছলে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রোবা তাঁর কাছে হাজির হয়ে জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করলো। অনুরুপভাবে জাবরা আজরুহর অধিবাসীরাও এসে জিযিা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিম্নরুপ সন্ধিপত্র লিখে দিলেনঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের তারফ থেকে ইউহান্না ইবনে রোবা ও আয়ালাবাসীর জন্য এবং তাদের সকল নৌ ও স্থল যানসমূহের জন্য নিরাপত্তা ঘোষনা করা যাচ্ছে। তাদের জন এবং তাদের সহযোগী সিরিয়া, ইয়ামান ও সাগররবাসীর নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রাসূল পূর্ণ দয়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যদি কেউ এই সন্থির বরখেলাফ কিছু করে তবে সে তার অর্থবিত্ত বলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে না। যে যার ক্ষতি সাধন করবে, তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। তারা যে কোন জলাশয়ের পানি ব্যবহার করতে পারবে এবং যে কোন নৌ ও স্থল পথে চলাচল করতে পারবে। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না।”

দুমার শাসনকর্তা উকায়দের – এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক খালিদ ইবনে ওয়ালদীকে প্রেরণ

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দের ইবনে আবদুল মালিকের নিকট প্রেণ করলেন। উকায়দের কান্দা গোত্রের একজন খৃষ্টান ছিল এবং সেখানকার বাদশাহ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদকে বলে দিলেন, “তুমি গিয়ে দেখবে উকায়দের গরু শিকার করছে।”

গ্রীষ্মের জ্যোৎ¯œা রাতে উকায়দের যখন ছাদের ওপর স্ত্রীসহ বসেছিল, তখন খালিদ তার দুর্গের দৃষ্টি সীমার ভেতরে পৌছে গেলেন। একটি বন্য গরু ঐ সময় উকায়দেরের প্রসাদের দরজায় শিং গিলে গুতোতে লাগলো। তার স্ত্রী বললো, “এমন গরু আর কখনো দেখেছো?” সে বললো, ‘না’। স্ত্রী বললো, “তাহলে এমন শিকার হাতছাড়া করা কি উচিত?” সে বললো, “কখখনো না।” এই বলেই সে নীচে নামালো এবং ঘোড়ায় সওয়ার হলো। সে নিজে এবং তার ভাই হাসানসহ পরিবারের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে শিকারের পছেনে ছুটলো। বাইরে বেরিয়েই তারা সালূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীর হাতে ধরা পড়লো। উকায়দেরের ভাই হাসান মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হলো। তার পরিধানে ছিল স্বর্ণের জরিদার একটি রেশমী জামা। খালিদ (রা) সেটা খুলে নিলেন এবং নিজে মদীনায় যাওয়ার আগেই একজনকে দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।

আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, উকায়দেরের জামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছানো হয়েে আমি তা দেখেিেছ। মুসলমানগণ তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বিস্মিত হচ্ছিল দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এইটে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছ? আল্লাহর কসম, জান্নাত সা’দ ইবনে মু’য়াযের জন্য যে রুমাল রয়েছে তা এর চেয়েও ভাল।”

ইবনে ইসহাক বলেন, খালিদ উকায়দেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তাকে প্রাণের নিরাপত্তা দিয়ে জিযিয়ার বিনিময়ে সন্ধি করলেন এবং মুক্ত করে দিলেন। সে তার এলাকায় ফিরে গেল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম তাবুক থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলেন না। বরং সেখানেই দশদিন অবস্থান করলেন। তারপর মদীনায় ফিরে এলন। পথিমধ্যেওয়াদিউল মুশাককাক উপত্যকায় একটা ক্ষুদ্র পাহাড়ী ঝর্ণা ছিল। তার পানি দ্বারা বড়জোর দুই বা তিনজন পথিকের পিপাসা নিবৃত্ত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আগে যারা ঐ উপত্যকায় পৌছবে, তারা যেন আমরা না আসা পর্যন্ত পানি পান না করে অপেক্ষ কের।” কিন্তু সবার আগে একদলমুনাফিক সেখানে পৌছে এবং সেখানে যেটুকু পানি ছিল তা পান করে ফেরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌছে দেখলেন একটু পানিও নেই। তিনি বললেন, “আমাদের আগে কে এখানে এসেছে?” তাকে জানানো হলো যে, অমুক অমুক প্রথমে সেখানে এসেছে। তিনি বললেন, “আমি তো নিষেধ করেছিলাম যে,, আমি এসে পৌছার আগে কেউ পানি পান করবে না।” অতঃপর তিনি ঐ মুনাফিকদের অভিশাপ ও বদদোয়া করেন। তারপর তিনি সওয়ারী থেকে নেমে পাহাড়ের পাদদেশে হাত রাখলেন। তৎক্ষনাৎ আল্লাহর ইচ্ছায় বিপুল পরিমাণ পানি গড়িয়ে পড়তে থাকলো। অতঃপর সেখান থেকে পানি পান কররেন, পাহাড়ের ঐ স্থানটায় হাত বুলালেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মত প্রবল গর্জনে পানির ফোয়ারা ছুটলো। লোকেরা তৃপ্ত পানি পান ও অন্যান্য প্রয়েঅজন পূর্ন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যদি দীর্ঘ আয়ু পাও তাহলে ভবিষ্যতে এই উপত্যকার খ্যতি শুনতে পাবে এবং এই পানি উপত্যকার আশপাশের এলাকাকে উর্বর করে তুলবে।”

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ আবু রুহাম গিফারীর ভ্রাতুষ্পুত্র থেকে ইবনে উকায়মা লায়সী এবং লায়সী থেকে ইবনে শিহাব যুহরী বর্ণনা করেছেন যে,, আবু রুহাম কুলসুম ইবনে হুসাইন যিনি ‘বাইয়াতুল রিদওয়ান’ এ অংশগ্রহণকারী অন্যতম সাহাবী ছিলেন, বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাবুক অভিযানে যোগদান করেছিলাম। তাঁর সাথে সফর করছিলাম। একদিন রাতে যখন তাবুকের পার্শ্ববর্মী আখদার অতিক্রম করছিলাম তখন আল্লাহ আমাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। যেহেতু আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের ওসয়ারীর একেবারে নিকটবর্তী ছিল এবং দুটো কাছাকাছি হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ে আমার সওয়ারীর আঘাত লাগতে পারে এই আশংকায় আমি জেগে থাকতে এবং আমার সওয়ারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। এই অবস্থায় পথিমধ্যে রাতের একাংশে আমার ঘুম অদম্য হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারীর সাথে গায়ে গায়ে লেগে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘উহ’ শব্দে আমি জেগে উঠলাম। বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তিনি বললেন, “চলতে থাক।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু গিফারের কে কে অভিযানে আসেনি তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন আর আমি তার জবাবে যেসব লোক আসেনি তাদের নাম বলতে লাগলাম। তিনি বললেন, “পাতলা দাড়ি ও ভ্রুওয়ালা লম্বা লালচে বর্নের লোকগুলোর খবর কি?” আমি তাঁকে তাদের না আসার কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘সবলদেহী খর্বাকার কালো লোকগুলো কি করেছে?” আমি বললাম, “আমাদের মধ্যে এ ধরনের কাউকে আমি দেখছি না।” তিনি বললেন, “হিজাযের গিফার ও আসলামের বসতি এলাকয় যাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে?” আমি তাদের কথা বনু গিফারের প্রসঙ্গেই স্মরণ করতে চেষ্টা করেচিলাম। কিন্তু মনে পড়েনি। অবশেষে আমার মনে পড়লো যে, তারা বনু আসলামের একটা গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যারা আমাদের মিত্র ছিল।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারা অন্ততঃ নিজেদের একটা উট দিয়ে একজন সক্ষম যোদ্ধাকে আল্লাহর পথে জিহাদে আসতে সাহায্য করতে পারতো। এতে তাদের কোন বাধা ছিল না। আমার সঙ্গীদের ভেতরে আর যে যাই করুক, কুরাইশ মুহাজির, আনসার, বনু গিফার ও বনু আসলামের লোকদের আমার সাথে না আসা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক।

নবম হিজরীর রমযান মাসে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদলের আগমন ও ইসলাম গ্রহণ
ইবনে ইসহাক বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে আসেন এবং সেই মাসেই তাঁর কাছে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই প্রতিনিধিদল আগমনের পটভূমি এই যে, ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তায়েফ থেকে ফিরে আসেন তখন উরওয়া ইবনে মাকউদ সাকাফী তাঁর পিছু পিছু আসেন। মদীনায় পৌছারআগেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হন এবং ইসলাম গ্রহন করেন। অতঃপর তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওরা তোমাকে হত্যা করবে।” তিনি বনু সাকীফ গোত্রের গোঁয়ার্তুমি ও একগুয়েমীর কথা জানতেন। তিনি এও জানতেন যে, তারা নিজস্ব কোন লোকের দাওয়াত অগ্রাহ্য করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু উরওয়া বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের কাছে নবজাতক শিশুর চেয়েও প্রিয়।”

তিনি প্রকৃতই তাদের কাছে অনুরূপ প্রিয় ও মান্যগণ্য ছিলেন। অনন্তর তিনি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। তাঁর আশা ছিল গোত্রের মধ্যে তাঁর যতখালিন মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তাতে কেউ হয়তো তাঁর বিরোধিতা করবে না। তিনি নিজ গোত্রের ছাদের ওপর থেকে গোত্রের লোকদেরকে যথাযথভাবে দাওয়াত দিয়ে ও নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানিয়ে যখন তাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন চারদিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা হয়। একটি তীর তাকে আঘাত করে এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

বনু মালিকের মতে তাকে হত্যা করে বনু সালেম ইবনে মালিকের আওস ইবনে আওফ এবং তার মিত্রদের মতে তাকে হত্যা করে বনু আত্তাব ইবনে মালিকের ওয়াহাব ইবনে জাবের। (বনু সালেম ও বনু আত্তাব বনু সাকীফের শাখা বনু মালিকভুক্ত পরিবার)। উরওয়া আহত হওয়ার পর তাকে বলা হয়, “আপনার হত্যা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?” তিনি বলেন, “এটা আল্লাহর তরফ থেকে আমার জন্য এক পরম সম্মান ও গৌরব। আল্লাহ নিজেই আমাকে শাহাদাতের এই গৌরবে ভূষিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এই স্থান থেকে ফিরে যাওয়অর আগে তাঁর সাথে আগত যেসব মুজাহিদ শাহাদাত লাভ করেছেন, তাদের থেকে আমার মর্যাদা মোটেই বেশী নয়। কাজেই আমাকে তোমরা তাদের কাছেই দাফন করো।”

কথিত আছে যে, উরওয়াহ ইবনে মাসউদের শাহাদাতের খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করেন, “সূরা ইয়াসীনে যে মুজাহিদের শাহাদাতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে উরওয়া তার সাথে তুলনীয়।”

উরওয়াকে হত্যা করার পর এক মাস বনু সাকীফ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর তারা একটি পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হলো। তারা স্থির কররো যে,, চারপাশের গোটা আরব জাতি যেখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে সেখানে বনু সাকীফ একাকী তাদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সক্ষম নয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা স্থির করলো যে, পূর্বে যেমন তারা উরওয়াকে পাঠিয়েছিল তেমনি এবার আর একজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা উরওয়অ ইবনে মাসউদের সমবয়সী জনৈক আবদ ইয়ালীল ইবনে আমরের সাথে আলাপ করলো এবং তাকে বনু সাকীফের প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে ফিরে আসবে তখন বনু সাকীফ উরওয়ারর সাথে যে আচরণ করেছে তার সাথেও অনুরূপ আচরণ করবে। সে বললো, “আমার সাথে যদি আরো কয়েকজন লোক পাঠাও তাহলে আমি রাজী আছি, অন্যথায় নয়।” অবশেষে তারা ঠিক করলো যে, আব্দ ইয়ালীদের সাথে মিত্র গোত্রগুলো থেকে দু’জন এবং বনু মালিক থেকে তিনজন- সর্বমোট ছয়জনকে পাঠাবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা আব্দ ইয়ালীলের সাথে বনু মুয়াত্তাব পরিবারের হাকাম ইবনে আমর ও শুরাহবীল ইবনে গাইলানকে এবং বনু মালিক গোত্র থেকে বনু ইয়াসার পরিবারের উসমান ইবনে আবুল আসকে, বনু সালেম পরিবার থেকে আওস ইবনে আওফকে এবং বনু হারেস পরিবারের নুমায়ের ইবনে খারাশকে পাঠালো। আবদ ইয়ালীল দলনেতা হিসেবে তাদের নিয়ে রওনা হলো। সে উরওয়া বিন মাসমউদের ভাগ্য বরণের ঝুঁকি মুক্ত হবার অভিপ্রায়েই এই লোকদের সাথে নিল যাতে প্রত্যেকে তায়েফে ফিরে নিজ নিজ গোষ্ঠীকে এতে জড়িত করতে পারে।

প্রতিনিধিদল মদীনার নিকটবর্তী হলে একটি ঝর্ণার পাশে সাহাবাগণের কেউ কেউ উট চরানো সময় মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) দেখতে পেলো। ঐ উটগুলো পালাক্রমে চরানোর দায়িত্ব সাহাবীদের মধ্যেই ভাগ করা ছিল এবং ঐ সময়কার পালা ছিল মুগীরার। তাদের সাথে সাক্ষাত হওয়ার পর মুগীরা উটগুলোকে বনু সাকীফের প্রতিনিধিদের কাছে রেখেই ছুটে গেলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের আগমনের সুসংবাদ শোনানোর জন্য। মুগীরা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করার আগে আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) সাথে দেখা হেরা। তিনি তাকে জানালেন যে, বনু সাকীফের প্রতিনিধিরা ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে। তবে তারা চাফ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন তাদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেন এবং তাদের ধন-সম্পদ, জমিজমা ও অধিবাসীদের নিরাপত্তা চিশ্চিত করে একটা অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন। আবু বকর (রা) মুগীরাকে (রা) বলরেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর নামে অনুরোধ করছি, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে আমাকে আগে যেতে দাও এবং এ বিষয়ে তাঁর সাথে আমাকে আলোচনা করতে দাও।” মুগীরা (রা) এতে সম্মত হলেন। আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলেন এবং তাঁকে ঐ প্রতিনিধি দলের কথা জানারৈন। তারপর মুগীরা (রা) স্বগোত্রীয় বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। [উল্লেখ্য যে, মুগীরা (রা) বনু সাকীফ বংশোদ্ভুত ছিলেন]। দুপুর বেলা তিনি তাদের সাথে বিশ্রাম করেই কাটিয়ে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামী অভিবাদন জানানোর রীতি শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু সাক্ষাতের সময় তারা জাহিলী রীতি অনুসারেই অভিবাদন জানালো।

প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলে মসজিদে নববীর এক পাশে তাদের অবস্থানের জন্য একটি ঘর ঠিক করে দেয়া হয়। বনু সাকীফের জন্য একটি অঙ্গীকার পত্র লোকানো পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রতিনিধিদলের মধ্যে মত বিনিময় হয় খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আসের মাধ্যমে এবং এই খারিদই অঙ্গীকার পত্র লিখে দেন। এই সময়ে অঙ্গীকার পত্র লেখানো ও প্রতিনিধিদলের ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে আসা খাদ্যদ্রব্যও প্রথমে খারিদ না খেলে প্রতিনিধিদলের লোকজন খায়েনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা দাবী করে তার মধ্যে একটি ছিল, ‘তগিয়া’ অর্থাৎ লাভের পূজা অব্যাহত রাখতে দিতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে তা ভাঙ্গা চলবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তারা মেয়াদ কমিয়ে এক বছর করে। তাও প্রত্যাখ্যান করা হলে তারা কমাতে কমাতে এক মাসে নামিয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাও প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিনিধিদল এই দাবীর যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তাছিল এই যে, তারা তাদের গোত্রের অর্বাচীন শ্রেনী, তরুণ বংশধর ও নারীদের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে চান এবং গোত্রের লোকেরা ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার আগে মূর্তি ধ্বংস করার শাদ্যমে তাদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি কার তাদের মনঃপূত ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুতেই এ দাবী মানলেন না। তিনি বরং জোর দিয়ে বললেন যে, তিনি অবিলম্বে ঐ মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) পাঠাবেন। তারা এ দাবীও করেছিল যে, তিনি যেন তাদে নামায পড়তে এবং মূর্তিগুলোকে তাদের নিজ হাতে ভাঙ্গতে বাধ্য না করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফ সাফ বলে দিলেন যে,, নামায ছাড়া ইসলাম হতে পারে না তবে তোমাদের হাত দিয়ে মূর্তি ভাঙ্গতে বাধ্য করে হবে না। প্রতিনিধিদল নামাযকে মেনে নেয় ‘অবমাননাকর’ বলে মন্তব্য করেও তা মেনে নিতে সম্মত হলো।

অতঃপর তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য অঙ্গীকারনামা লিখে দিলেন। তারপর তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন উসমান ইবনে আসকে। তিনি ছিলেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য এবং কুরআন ও ইসলাম শিখতে অপেক্ষাকৃত বেশী আগ্রহী ছিলেন। আবু বাক্র (রা) তার সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে উসমানই ইসলাম বুঝতে ও কুরআন শিখতে অধিকতর মনে হয়েছে।”

দায়িত্ব সমাপনান্তে প্রতিনিধিদল যখন তায়েফ অভিমুখে রওনা হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) মূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের সাথেই পাঠিয়ে দিলেন। তারা উভয়ে প্রতিনিধিদলের সাথে রওনা হয়ে গেলেন। তায়েফের উপকণ্ঠে পৌছে মুগীরা (রা) আবু সুফিয়ানকে (রা) আগে পাঠাতে চাইলেন। আবু সুফিয়ান তা অস্বীকার করে বললেন, “তুমি তোমার গোত্রের লোকদের সাথে আগে গিয়ে দেখা কর।” আবু সুফিয়ান ‘যুল হুদুম’ নামক জলাশয়ের কাছে থেকে গেলেন আর মুগীরা শহরে প্রবেশ করেই কোদাল নিয়ে লাভ ও অন্যান্য মূর্তি ভাঙ্গার জন্য তাদের ওপর চড়াও হলেন। মুগীরার (রা) গোতও বনু মুয়াত্তাব তাকে সহায়তা করলো এবং তা এই আশংকায় যে, তার পরিণতি যেন উরওয়া ইবনে মাসউদের মত না হয়। ওদিকে বনু সাকীফের মহিলারা মূর্তির জন্য মাতমকরতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। তারা বলতে লাগলো,

“রক্ষকের জন্য তোমরা কাঁদ [৮৮.মুশরিকরা লাতকে ‘দাফফা’ অর্থাৎ রক্ষক নামে অভিহি করতো। কেননা তারা বিশ্বাস করতো যে, লাত তাদেরকে শত্রু ও আপদ থেকে রক্ষা করে।] নিমকহারামেরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। [৮৯.অর্থাৎ বনু সাকীফের লোকেরা তাদের রক্ষকের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছে এবং তাকে ধ্বংস হওয়ার জন্য মগীরার হাতে সোপর্দ করে চলে গেছে।]

তারা এর জন্য ভালো করে যুদ্ধও করলো না।” [৯০. অর্থাৎ রক্ষককে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করতে আসা উচিত ছিল। কিন্তু কেউ সেজন্য এগিয়ে এলো না।]

অতঃপর মুগীরা যখন লাতকে কুঠার দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন তখন আবু সুফিয়ান “আহা! আহা!” করতে লাগলেন।

লাতকে ধ্বংস করার পর মুগীরা মন্দিরের সমস্ত ধনরত্ন সংগ্রহ করে আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠালেন। এই ধনরতেœর মধ্যে ছিল বিপুল পরিমাণ সোনা ও রেশমী দ্রব্যাদি।

উরওয়া ইবনে মাসউদ শহীদ হওয়ার পর তার ছেলে আবু মুলাইহ ও ভ্রাতুষ্পুত্র কারেব ইবনে আসওয়াদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে এবং বনু সাকীফের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদেরকে চিরতরে ত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। এটা হচ্ছে ইয়ালীল প্রতিনিধিদলের আগমনেরও আগের ঘটনা। আবু মুলাইহ ও কারেব ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “তোমরা যাকে খুশী অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ কর।” তারা বললেন, “আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, তোমাদের মামা আবু সুফিয়ানকেও?” তারা বললেন, ‘হা’। পরে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুগীরা ও আবু সুফিয়ানকে লাভ ধ্বংস করতে পাঠালে আবু মুলাইহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, লাতর মন্দির থেকে যে ধনরত্ন উদ্ধার করা হবে তা থেকে আমার পিতার ঋণ শেঅধ করে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলে কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আসওয়াদের ঋণও শোধ করে দিন।”উল্লেখ্য যে, উরওয়া ও আসওয়াদ আপন ভাই ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আসওয়াদ মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে।”কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি একজন মুসরিম আত্মীয়কে অর্থাৎ আমাকে সাহায্য করুন। কেননা ঋণ আমার ঘাড়েই চেপে আছে এবং আমিই সাহায্য চাইছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলেন এবং আবু সুফিয়ানকে বলে দিলেন, “লাভের ধনরত্ন থেকে উরওয়া ও আসওয়অদের ঋণ শোধ করে দিও।” মুগীরা ধনরত্ন আবু সুফিয়ানের কাছে দেয়ার সময় তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লামের নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিলেন। আবু সুফিয়ান উরওয়া ও আসওয়াদের ঋণ শোধ করে দিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সাকীফের জন্য যে অংগীকারনামা লিখে দিলেন তা নিম্নরুপঃ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মু’মিনদের প্রতি। ওয়াজ্জের (তায়েফের একটি জায়গা) কষ্টময় বৃক্ষরাজি কাটা নিষিদ্ধ। যে ব্যক্তি এ আদেশ লংঘন করবে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তাকে পাকড়াও করে নবী মুহাম্মাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশ। এ ঘোষণাপত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর নির্দেশে খালিদ ইবনে সাঈদ কর্তৃক লিখিত। কেউ যেন এ ঘোষণাপত্র লংঘন না করে। লংঘন করলে তা নিজের জন্য শাস্তি ডেকে আনারই নামান্তর হবে। কেননা এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশেই লিখিত।”

নবম হিজরী সালকে ‘প্রতিনিধিদল আগমনের বছর’ হিসেবে আখ্যায়িতকরণ। সূরা আন নাছর এই বছরই নাযিল হয়

ইবনে ইসহাক বলেন: মক্কা ও তাবুক বিজয়, বনু সাকীফের ইসলাম গ্রহণ ও আনুগত্যের শপথ প্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চারদিক থেকে আরবদের প্রতিনিধিদল আসতে শুরু করে।

আরবরা বলতে গেলে একমাত্র কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় ছিল। তারাই ছিল আরবদের নেতা ও দিশারী। তারা ছিল কা’বা শরীফ ও মসজিদুল হারামের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক এবং ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীমের (আ) অবিসম্বাদিত উত্তরপুরুষ। আরবের কেউ তা অস্বীকার করতো না। অথচ এই কুরাইশরাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগেছিল। মক্কা বিজয়ের সাথে সাথে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নত হলো এবং ইসলামের বশ্যত স্বীকার করলো। তখন আরবরা বুঝলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জয়যাত্রা রোধ করে ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে এমন ক্ষমতা তাদের নেই্ তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলো। চারদিক থেকে তাঁর কাছে লোকজন আসতে ও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। এ কথাটাই আল্লাহ তা’আলা সূরা নাছরে এভাবে বলেছেন-

[আরবী *******]

“আল্লাহর সাহায্র ও বিজয় যখন এসে গেছে এবং তুমি দেখছো যে, লোক দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে, তখন প্রশংসা সহ তোমার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তার কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।”

বনু তামীমের প্রতিনিধিদলের আগমন ও সূরা হুজুরাত নাযিল
আরব গোত্রসমূহ থেকে প্রতিনিধিদল আগমন শুরু হলে সর্বাগ্রে উতারিদ বিন হাকেব তামিমীর নেতৃত্বে বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই দলে বনু তামীমের নেতৃস্থানীয় লোকজনও ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকরা ইবনে হারেস, বনু মা’দের যাবারকান ইবনে বদর ও আমর ইবনে আহতাম এবং হাবহাব ইবনে ইয়াযীদ। এছাড়া নুয়াইম ইবনে ইয়াযীদ, কায়েস ইবনে হারেস, কায়েস ইবনে আসেম ও উযাইনা ইবনে হিসনও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইতিপূর্বে মক্কা বিজয় এবং হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে আকরা ইবনে হারেস ও উয়াইরা ইবনে হিসন অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা দু’জন বনু তামীমের প্রতিনিধিদলেও যোগ দেন। বনু তামীমের এই প্রতিনিধিদল মসজিদে নববীর কাছে এসে বাড়ীর বাইরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উচ্চস্বরে এই বলে ডকতে শুরু করে, “হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে আসুন এবং আমাদের সাতে দেখা করুন।” তাদের এই চিৎকার ও হাঁকডাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কষ্টকর হলো। তারা বললো, “আমরা এসেছি আপনার কাচে আমাদের গৌরবোজ্জল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে। তাই আমাদের প্রধান বক্তা ও কবিকে কথা বলার অনুমতি দিন।” তিনি অনুমতি দিলেন। তখন উতারিদ ইবনে হাজ্জেব বলতে লাগলো, “সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাদের ওপর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং একমাত্র তিনিই এর ক্ষমতা রাখেন। যিনি আমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন এবং আমাদেরকে বিপুল ধন সম্পদে ও ঐশ্বর্য্যে সমৃদ্ধ করেছেন। যার দ্বারা আমরা বদান্যতার পরিচয় দিয়ে থাকি। যিনি আমাদেরকে সমগ্র প্রাচ্যবাসীর মধ্যে সর্বাধিক জনবল ও ধনবলের অধিকারী করেছেন। আমাদের সমকক্ষ আর কেউ আছে কি? আমরাই কি তাদের নেতা এবং সবচেযে অভিজাত নই? আভিজাত্য ও কৌলিন্যে যে আমাদের সমকক্ষতার দাবী করে সে নিজ শেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিক। আমরা ইচ্ছা করলে আরো অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিয়ে বেশী বাগাড়ম্বর করতে আমরা লজ্জাবোধ কলি। আমাদের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা সুপরিচিত। আপনাদেরকে আমাদের মত আত্মপরিচয়মূলক বক্তব্য পেশ করা এবং আরো ভালো বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দানের জন্যই এসব কথা বললাম।”

এ পর্যন্ত বলেই উতারিদ বসলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিত ইবনে সায়েসকে (রা) বললেন, “ওঠো এবং তার ভাষনের জবাব দাও।”

সাবিত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“সেই মহান আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা, আসমান ও যমীনে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর করেছেন, তাঁর জ্ঞানের পরিধি তাঁর কর্তৃত্বের পরিমন্ডল জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া কখনো কোন জিনিষের উদ্ভব ও আবির্ভাব ঘটে না, আমাদের মধ্যে রাজা বাদশাহর আবির্ভাব তাঁরই অনুগ্রহের ফল। আপন অনুগ্রহের বশেই তিনি আপন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠতম বংশীয়, আভিজাত্যে ও অতুলনীয় সাত্যবাদিতার গুণে ভূষিত ব্যক্তিকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। অতঃপর তাঁর ওপর স্বীয় গ্রন্থ নাযিল করেছেন, তাঁকে সমগ্র মানব জাতির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেছেন, একমাত্র তিনিই সমগ্র বিশ্বজগতের মধ্যে আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিরূপে গণ্য হয়েছেন। অতঃপর মানুষকে তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন, ফলে তাঁর স্বগোত্র ও আপনজনের মধ্র থেকে মুহাজিরগণ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেছেন- যারা সবার চাইতে কুলীন, সবার চাইতে সম্ভ্রান্ত ও মর্যাাদাশীল, সবার চাইতে সৎকর্মশীল। যারা সর্বপ্রথম রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল তারা আমরাই। সুতরাং আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ সাহায্যকারী এবং তাঁর রাসূলের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী। যারা ঈমান আনে না তাদের সাথে আমরা যুদ্ধ করি; যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে তাদের জানমাল আমাদের হাত থেকে নিরাপদ, আর যে কুফরী করে তাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের ভিত্তিতেই আমরা সংগ্রামে লিপ্ত হই। সে সংগ্রামের কোন শেষ নেই। তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য বৈধ। একথা বলেই আমি নিজের জন্য এবং সকল মুসলমান নারী পুরুষের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। আস্সালামু আলাইকুম।”

অতঃপর যাবারকান ইবনে বদর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন। কবিতাটির মর্ম এইঃ

“আমরাই সম্মানিত। কোন গোত্র আমাদের সমকক্ষ নয়। রাজা বাদশাহ আমাদের মধ্যেই বিরাজমান এবং আমাদের উদ্যোগেই তাবত উপাসনালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কত গোত্রকে আমরা বলপূর্বক লুণ্ঠন করেছি তার শেষ নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের মান মর্যাদা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে। দুর্ভিক্ষের সময়ও আমাদের লোকের ভূনা গোশত আহার করায়। মেঘ যখন মানুষের আকাঙ্খা মুতাবিক বৃষ্টি বর্ষন করে না তখন রাত্রিকালে পথিকেরা সব জায়গা থেকেই আমাদের কাছে ছুটে আসে আর আমরা তাদের খাবারের আয়োজন করি। তখন আমরা বড় বড় উট জবাই করি এবং মেহমানদের পেট ভরে খাওয়অই। এটাই আমাদের মজ্জাগত রীতি। যখনই তুমি দেখবে যে, আমরা কোন গোত্রের কাছে গিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের গর্ব প্রকাশ করছি, তখনই দেখতে পারেব যে, তারা আমাদের অনুসারী হয়ে যাচ্ছে আর তাদের মাথা অবনমিত হয়ে আসছে। সুতরাং আজ যে ব্যক্তি আমাদের সামনে তার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরবে, তার বর্ণনায় আমরা নতুন জ্ঞান লাভ করবো এবং আমাদের প্রতিনিধিদল ফিরে গেলে সে তথ্য প্রচারিত হবে। আমরা কারো শ্রেষ্ঠত্বের মানতে রাজী নই। তবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কেউ অস্বীকার করবে না। এভাবেই আমরা গৌরব ও গর্বে অজেয়।”

হাসসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু তামীমের কবির জবাব দেওয়ার জন্য তলব করলেন। তিনি এসে কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন। সে কবিতায় মর্ম নিম্নরুপঃ

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন তখন আমাদের মধ্যে তাঁকে পছন্দকারী ও অপছন্দকারী উভয় রকমের লোক থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করেছি। আমাদের বসতিতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে আমরা তাঁকে তরবারী সজ্জিত হয়ে সকল জালিম ও আগ্রাসীর হাত থেকে রক্ষা করেছি। তিনি এক সম্মাানিত গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন- যা (সিরিয়ার) জারিয়াতুল জাওলানের সন্নিহিত অপরিচিত লোকদের মধ্যে অবস্থিত। প্রাচীন মহত্ত্ব, আভিজাত্য এবং রাজকীয় সম্মান ও কঠিন মুসিবত সহ্য করার মত গৌরব আর কিছুতে নেই।”

হাসসান বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছেই আমি প্রতিনিধিদ দলের কবি যে কবিতা আবৃত্তি করেছিল হুবহু তার ছন্দ অনুকরন করে পাল্টা কবিতা আবৃত্তি করলাম। যাবারকান তার কবিতা আবৃত্তি সম্পন্ন করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসানকে বললেন, “হে হাসসান! যাবারকানের কবিতার জবাব দাও।” হাসসান দাঁড়িয়ে জবাবী কবিতা আবৃত্তি করলেন। কবিতার মর্ম নিম্নরুপ:

“কুরাইশ বংশের নেতৃবৃন্দমানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপিত করেছেন। খোদাভীতি যাদের জীবনের গোপন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং যারা ন্যায় ও সততাকে অনুকরণ করে তারা সকলেই তাদের ওপর খুশী। তারা কুরাইশী নেতৃবৃন্দ। এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা যুদ্ধরত হলে শত্রুকে পর্যুদস্ত করে দেন অথবা (নিদেনপক্ষে) নিজের গোষ্ঠীর (মু’মিনদের)কল্যাণ সাধনের চেষ্ট করেন এবং কল্যাণ সাধন করেন। এটা তাদের কোন নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বস্তুতঃ চরিত্রের যা কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য তাই খারাপ। তাদের পরে জনগণের মধ্যে আর যদি কোন বিজয়ীর আগমন ঘটে তা’হলে এ রকম প্রত্যেক বিজয়ী তাদের নগন্যতম বিজয়ীদের চেয়েও নগণ্যতর। তারা যদি কোথাও দুর্বলতা দেখিয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ সেখানে কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম নয়। আর সকল মানুষ যেখানে কৃতিত্ব দেখায় সেখানে তারা কোন দুর্বলতা দেখায় না। তারা যদি সাধারণ মাুনষের সাথে প্রতিযোগিতা করে কিংবা অভিজাত ও মর্যাদাশীলদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করে তাবে তারাই অগ্রগামী হয়ে থাকে। তারা এমন নিস্কলুষতার উল্লোখ করা হয়। তারা কোনম অপবিত্রতায় জড়িত হয় না এবং কোন লোভ লালসা তাদেরকে হীনতায় পতিত করে না। প্রতিবেশীর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনে তারা কার্পন্য করে না এবং কোন তুচ্ছ জিনিসের প্রতি তারা মোহাবিষ্ট হয় না। আমরা যখন কো গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করি তখন তা গোপন রাখি না এবং বুনো গরুর তম গোপনে হিং¯্রতায় মত্ত হই না। যুদ্ধ যখন আমাদের ওপর আগ্রাসী মুষ্ঠি উত্তোলন করে এবং নিরীহ মানুষ যখন তার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তখন আমরা তাকে বাগে আনি ও বশীভূত করি। তারা (কুরাইশ নেতৃবৃন্দ) শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে পারলে গর্বিত হয় না এবং নিজেরা পরাজিত হলেও হতাশ ও ভীত হয় না। তারা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে লড়াইতে লিপ্ত থাকে তখন তাদের অবস্থা হিলয়ার জঙ্গলের সেই সিংহের মত যার পায়ের কবজিতে শিকল পরানো সম্ভব নয়। তারা স্বোচ্ছায় যা দেয় তাই গ্রহণ কর। আর ক্রোধবশে যা দিতে চায় না তা নিতে চেয়ো না। তাদের সাথে যুদ্ধ করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও তিক্ত। অতএব তাদের শত্রুতা পরিত্যাগ কর। যখন অন্যান্য লোকেরা দলে দলে বিক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের প্রকৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তখনও আল্লাহর রাসূলকে তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধা করে। আমার একাত্মতা বোধকারী মন তাদের প্রতি আমার প্রশংসা উৎসর্গ করেছে, যে কোন মানুষের জিহ্বাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ লোকগণ গুরুত্ব সহকারে অথবা ঠাট্রাচ্ছলে যাই বলুক না কেন- তারাই [মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীরা] সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী।”

কবিতা ও পাল্টা কবিতা পাঠের এই পালা শেষ হওয়ার পর আগন্তুক প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শুভেচ্ছামূলক প্রচুর উপঢৌকন দিলেন। প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসার সময় আমর ইবনে আহতাম নামক এক অল্পবয়স্ক যুবককে উটের কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছিল। কায়েস ইবনে আসেম তার প্রতি কিছুটা ক্রুব্ধ ছিল। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের এক ব্যক্তিকে সওয়ারী কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তবে সে অল্পবস্ক তরুণ।” সে তার ব্যাপারটা একটু হালকা করে দিতে চাচ্ছিল এবং তাকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই- এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও অন্যান্যদের মত উপঢৌকন দিলেন। কায়েসের এ কথা জানতে পেরে আমর ইবনে আহতাম তাকে তিরস্কার করে কবিতা আবৃত্তি করলো-

“তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার নিন্দা করেছিস, কিন্তু মিথ্যা বলেছিস আর আমার ক্ষতিও করতে পারিসনি।

আমরা তোদের ওপর সর্বাত্মকভাবে প্রভুত্ব করেছি। অথচ তোদের প্রভুত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পথে।”

ইবনে ইসহাক বলেন, এই প্রতিনিধিদল সম্পর্কেই সূরা হুজুরাতের এই আয়াত নাযিল হয়-

[আরবী *******]

“হে রাসূল! যারা আপনাকে বাড়ীর বাইরে পর্দার আড়ালে থেকে হাঁকডাক করে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (হুজুরাহ)

বনু আমেরের প্রতিনিধি আমের ইবনে তুফাইল ও আরবাদ ইবনে কায়েসের ঘটনা

বনু আমেরের তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল এল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তারা হলো আমের ইবনে তুফাইল, আরবাদ ইবনে কায়েস ও জাব্বার ইবনে সালামী। এরা ছিল গোত্রের সবচেয়ে কুচক্রী সরদার। আমের ইবনে তুফা।ীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে এক মারাত্মক চক্রান্ত এঁটে এসেছিল। ইতিপূর্বে তাঁর গোত্রের লোকজন- দেশের অধিকাংশ লোকে ইসলাম গ্রহণ করছে- এই যুক্তি দেখিয়ে তাকেও মুসলমান হবার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে বলে, “আমি শপথ নিয়েছি। সমগ্র আরব জাতি আমার নেতৃত্ব মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি থামবো না। আজ কিনা কুরাইশ গোত্রের এই তরুণের নেতৃত্ব আমি মেনে নেব।” আমের আরবাদকে বললো, “আমরা দু’জনে যখন মুহাম্মাদের সাথে দেখা করতে যাবো তখন দু’জনে দু’দিকে বসবো। মুহাম্মাদ যখন আমার সাথে কথা বলতে আমার দিকে মুখ ফেরাবে ঠিক তখনই তুমি তাঁকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে।”

অতঃপর প্রতিনিধিদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করলো। আমের বলতে লাগলো, “হে মুহাম্মাদ, আমাকে একটু নির্জনে কথা বরার সুযোগ দাও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যতক্ষণ এক আল্লাহর ওপর ঈমান না আনবে ততক্ষণ সে সুযোগ দেব না।” আমের আরবাদকে সুযোগ দেয়ার জন্য বার বার ঐ একই কথা বলতে লাগলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কিচুতেই তার সাথে নির্জনে কথা বলতে রাজী হলেন না তখন সে প্রতিনিধিদল নিয়ে সটকান দিল। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল, “দেখে নিও, আমি বিরাট এক বাহিনী নিয়ে তোমার ওপর হামলা চালাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে আমের ইবনে তুফাইল থেকে রক্ষা কর।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমের আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ, ধিক্ তোমাকে, যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তার কি করলে? আল্লাহর কসম, প্রথিবীতে আমি তোমাকেই সবচেয়ে বীর পুরুষ মনে করতাম এবং তোমাকেই সবচেয়ে বেশী ভয় করে চলতাম। আজ থেকে আর তোমাকে ভয় করােবা না।” আরবাদ বললো, “তোর সর্বনাশ হোক! তাড়াহুড়া করিসনে। আমাকে যা করতে বলেছিলি তা করতে উদ্যত হয়েই দেখি, আমার সামনে তুই ছাড়া আর কেউ নেই। সে অবস্থায় কোপ দিলে তো ঘাড়েই পড়তো। শেষ পর্যন্ত তোকেই আমি কোপ দেব নাকি?”

অতঃপর তারা নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে আল্লাহ আমের ইবনে তুফাইলের ঘাড়ে প্লেগ দিলেন। বনু সালুলেল এক মহিলার বাড়ীতে গিয়ে সে ঐ প্লেগেই মারা গেল। মৃত্যুকালে সে বিলাপ করে বলতে লাগলো, “হে বনু আমের। আমাকে কি শেষ পর্যন্ত উটের গলগন্ডতেই ঘরলো আর তাও বনু সালুলের এক মহিলার বাড়িতে?” [৯১. বনু সালুল আরবদের মধ্যে অত্যন্ত কাপুরুষ ও হীনমনা গোত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। কবি সামাওয়াল বলেন, “আমরা এমন এক গোষ্ঠী যারা হত্যাকে বনু আমের ও বনু সালুলেল মত লজ্জাকর মনে করি না।”] আমেরকে সমাধিস্থ করে তার সঙ্গীরা বনু আমেরের বসতিতে দুটো ছাগল নিয়ে হাজির হলো। প্রতিনিধিদের গোত্রের লোকেরা আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ! তোমরা কি করে এলে?” সে বললো, “কিছুই না। সে (মুহাম্মাদ) আমাদেরকে এমন এক সত্তার ইবাদাত করার আহ্বান জানিয়েছে যাকে নাগালে পেলে আমি তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করতাম।” এ কথা বলার এক বা দুই দিন পর আরবাদ তার উট নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সহসা আল্লাহ তার ওপর আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করে উট সহ আরবাদকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলেন। আরবাদ ছিল কবি লাবীদের ভাই। সে আরবাদের মৃত্যুতে নিম্নরূপ শোকগাথা রচনা করে:

“মৃত্যু কাউকেই ছেড়ে দেয়না, স্নেময় পিতাকেও না।

আরবাদের ওপর একমাত্র মৃত্যুরই আশংকা করতাম- আকাশ থেকে কোন দুর্যোগ

কিংবা সিংহের আক্রমণের আশংকা করতাম না।

অতএব, হে চক্ষু, আরবাদের জন্য অশ্রুবর্ষণ করোনা কেন?

যখন আমরা নারী পুরুষ সকলেই কঠিন দুঃখ কষ্টের ভেতররে কাল কাটাচ্ছিলাম

তখন তারা সবাই যদি চিৎকার করতো আরবাদ তার পরোয়া করতো না।

আর তারা যদি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো তবে

সেক্ষেত্রেও আরবাদ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতো।

সে একজন মিষ্টভাষী বুদ্ধিমান এবং ন¤্র হৃদয় মানুষ।

সেই সাথে তার মধ্যে তিক্ততাও ছিল।

বৃক্ষরাজি যখন শীতকালে উজাড় হয়ে যায়, এবং পুনরায় তা যখন ফলাদায়ক ও

তরতাজা হয় এবং অবশিষ্ট আশাপ্রদ জিনিসগুলো দেখা দেয়,

(অর্থাৎ দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং পরে আবার দেশে ফসল উৎপন্ন

হওয়ার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়।) তখন সে (আরবাদ)

জঙ্গলের হিংস্র সিংহের চেয়েও বরিত্ব এবং অভ্যস্ত সূক্ষদর্শিতা পরিচয় দিত)।

তার শোকে আহত মাতমকারিনীরা মাতম করছে, যেন তরুণ হরিণীরা

ঊষর মরুভূমিতে (নিষ্ফল রোদন করছে।) দুর্যোগের দিনটাতে

সেই বীর অশ্বারোহীর বজ্রঘাতে মৃত্যু আমাকে মর্মাহত করেছে।

সে ছিনতাই করতো আবার লুণ্ঠিত ব্যক্তি যদি তার কাছে আসতো তাহলে তাকে

ক্ষতিপূরণ দিত, ইচ্ছা হলে (লুণ্ঠিত জিনিস) ফিরিয়ে দিত।

তার অনেক অভাব থাকা সত্ত্বেও উদ্ভিদ উৎপাদন করে থাকে।

প্রস্তরময় অঞ্চলের অধিবাসীরা মাত্রই ভাগ্যাহত তা

তাদের জনসংখ্যা যতই বেশী হোক না কেন।

কখনো তারা একটু সমৃদ্ধশালী হলেও পরক্ষণেই আবার তাদের কপালে

নেমে আসে দারিদ্র। তারা সংখ্যায় অধিক হলেও ধ্বংস ও

বিনাশের কবলে পড়ার জন্যই হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি