ইসলামী অর্থব্যবস্থা
এ দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থব্যবস্থার মাঝখানে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা কায়েম করে। এ অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে –ঃ ব্যক্তিকে অবশ্য তার পরিপূর্ণ স্বাভাবিক ও ব্যক্তিগত অধিকার দান করতে হবে এবং সঙ্গে ধন-বণ্টনের ভারসাম্যও বিনষ্ট হতে পারবে না। ইসলামী অর্থব্যবস্থা একদিকে ব্যক্তিকে ব্যক্তি মালিকানার অধিকার ও নিজের ধন-সম্পদ ইচ্ছামতো ব্যয়-ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করে এবং অন্যদিকে ভিতর থাকে এসব অধিকার ও ক্ষমতার উপর কিছু নৈতিক বিধি-নিষেধআরোপ করে এবং বার থেকে এগুলোকে কতিপয় আইনের শৃঙ্খলে বেঁধে দেয়। এর ফলে কোনো স্থানে সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরনাদির অস্বাভাবিক কেন্দ্রীভূত হবার সম্ভবনা বিলুপ্ত হয়। ধন ও উৎপাদন উপকরনাদি হামেশা আবর্তিত হতে থাকে এবং এ আবর্তন এমনভাবে চলতে থাকে যার ফলে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তা থেকে নিজের উপযোগী অংশটুকু লাভ করতে পারে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম তার নিজেস্ব স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সংগঠন কায়েম করে। ইসলামের এ অর্থনৈতিক সংগঠনের প্রাণসত্তা, নীতি ও কর্মপদ্ধতি পুজিবাদ ও কম্যুনিস্ট ব্যবস্থা থাকে সম্পূর্ণ আলাদা।

ইসলামের অর্থনৈতিক আদর্শের সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ অর্থনৈতিক জীবনের প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সকল ব্যক্তির সমষ্টিগত স্বার্থ পরস্পরের সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। তাই উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ ও বিরোধের পরিবর্তে সমঝোতা ও সহযোগিতা বর্তমান থাকা উচিত। ব্যক্তি যদি সামষ্টিক স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালিয়ে সমাজের সম্পদ নিজের নিকট কেন্দ্রীভূত করে এবং তা আটকে রাখার বা ব্যয় করার ব্যাপারে নিছক নিজের ব্যক্তি স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রাখে তাহলে এর ফলে কেবলমাত্র সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেরও এ ক্ষতির শিকার হবে। অনুরূপভাবে সমাজ ব্যবস্থা যদি এমনভাবে গঠিত হয়ে থাকে যেখানে সমাজের স্বার্থে ব্যক্তি স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয় তাহলে সেখানে শুধু ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্থ বরং শেষ পর্যায়ে গিয়ে এর ক্ষতি সমাজকেও স্পর্শ করবে। কাজেই ব্যাক্তির সমৃদ্ধির মধ্যেই সমাজের কল্যাণ এবং সমাজের সমৃদ্ধির মধ্যেই ব্যাক্তির কল্যাণ। এ সংগে সমাজের ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে স্বার্থপরতা ও সহানুভুতির ভারসাম্য রক্ষিত হওয়ার ওপরই উভয়ের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের সামর্থ অনুযায়ী ধন উপার্জন করতে পারে কিন্তু তার উপার্জিত সম্পদে অন্যের অধিকারও থাকবে। প্রত্যেক ব্যাক্তি নিজের সম্পদের বিনিময়ে অন্যের নিকট থেকে মুনাফা অর্জন করবে এবং অন্যকেও তার নিকট থেকে মুনাফা অর্জনের সুযোগ দেবে। এ মুনাফা বন্টন ও অর্থ আবর্তনের ধারাবাহিকতা জারী রাখার জন্য নিছক ব্যাক্তিদের হৃদয় অভ্যন্তরে কতিপয় নৈতিক গুণাবলী সৃষ্টি করে দেয়া যথেষ্ট হবে না বরং এ সংগে সমাজে এমন আইন প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যার সাহায্যে অর্থ উপার্জন ও ব্যয় ব্যাবস্থাকে যথাযথ নির্ভুল ও ভারসাম্য পূর্ণ পদ্ধতিতে পরিচালিত করা যায়। এর অধীনে কাউকে ক্ষতিকর উপায়ে অর্থ উপার্জনের অধিকার দেয়া যাবে না। যে অর্থ ও সম্পদ বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়েছে তাও এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকবে না বরং তা ব্যায়িত ও দ্রুত আবর্তিত হতে থাকবে।

এ মতাদর্শের উপর যে অর্থনৈতিক সংগঠনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তার উদ্দেশ্য যেমন এক দিকে কতিপয় ব্যাক্তিকে কোটিপতি বানিয়ে অবশিষ্ঠ সবাইকে অভুক্ত রাখা নয় তেমনি অন্যদিকে কাউকেও কোটিপতি হতে না দিয়ে জোরপূর্বক সবাইকে তাদের স্বাভাবিক তারতম্য সত্বেও সমান অবস্থায় আসতে বাধ্য করাও তার উদ্দেশ্য নয়। এ উভয় প্রান্তিক অবস্থায় মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে ইসলামী অর্থব্যবস্থা কেবলমাত্র সকল ব্যাক্তির অর্থনৈতিক প্র্যয়োজন পূর্ন করতে চায়। যদি প্রত্যেক ব্যাক্তি অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে নিজের স্বাভাবিক সীমার মধ্যে অবস্থান করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে, অতপর নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা ও পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার প্রতি দৃষ্টি রাখে তাহলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে সমাজে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয় তার কোনো সম্ভবনাই দেখায় যায় না। কারণ এ অর্থব্যবস্থা কোনো ব্যক্তিকে কোটিপতি হতে বাধা না দিলেও এর আওতাধীনে কোনো কোটিপতির সম্পদ তার হাজার হাজার ভাইয়ের আনাহারে দিন যাপন করার কারণে পরিণত হয় না। অন্যদিকে এ অর্থব্যবস্থা অবশ্যি আল্লাহর সৃষ্ট সম্পদ থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অংশ দিতে চায় না। কিন্তু এজন্য ব্যক্তির নিজের অর্থোপার্জনের শক্তি ও যোগ্যতার উপর সে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করে না।

 

ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও তার মূলনীতি
পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ইসলাম যে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মতাদর্শ অবলম্বন করেছে তার ভিত্তিতে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সে নৈতিক শক্তি ও আইন উভয়ের সাহায্য নিয়েছে। নৈতিক শিক্ষার সাহায্যে সে সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির মন-মানসকে এ ব্যবস্থার স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য করার জন্য তৈরী করে। অন্যদিকে আইনের বলে তাদের ওপর এমন সব বিধি-নিষেধ আরোপ করে যার ফলে তারা এ ব্যবস্থার চৌহদ্দীর মধ্যে নিজেদেরকে আটকে রাখতে বাধ্য করে এবং এর সুদৃঢ় প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হয় না। এ নৈতিক বিধি-বিধান ও আইনসমূহ হচ্ছে ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভ। এগুলো এবং এই ব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করার জন্য এ সবের বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

একঃ উপার্জন মাধ্যমে বৈধ-অবৈধের পার্থক্য
এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হচ্ছে, ইসলাম তার অনুসারীদেরকে অর্থ উপার্জন করার অবাধ সুযোগ দেয় না। বরং উপার্জনের পন্থা ও উপায়ের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ ও অবৈধতার পার্থক্য সৃষ্টি করে। এ পার্থক্যের একটা মূলনীতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, ধন উপার্জনের যেসব পন্থা ও উপায় অবলম্বিত হলে এক ব্যক্তির লাভ ও অন্য ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের ক্ষতি হয় তা সবই অবৈধ। অন্যদিকে যেসব উপায় অবলম্বন করলে ধন-উপার্জন প্রচেষ্টার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ন্যায়সংগত সুফল ভোগ করতে পারে তা সবই বৈধ। এ মূলনীতিটে কুরআন মজীদে নিম্নোক্তভাবে বিবৃত হয়েছেঃ

(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)

“হে ঈমানদার গন! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না। তবে পারস্পরিক সম্মতি অনুযায়ী ব্যবসায়িক লেনদেন করেতে পারো। আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে (অথবা পরস্পর পরস্পরকে) ধ্বংস করো না। আল্লাহ তোমাদের অবস্থার প্রতি করুণাশীল। যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করে যুলুম সহকারে এরূপ করবে তাকে আমি অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করবো। -(সূরা আন নিসাঃ ২৯-৩০)

এ আয়াতে পারস্পরিক লেনদেনকে ব্যবসায় বলা হয়েছে। পারস্পরিক সম্মতিকে এর সাথে শর্ত হিসেবে সংযুক্ত করে এমন সব লেনদেনকে অবৈধ গণ্য করা হয়েছে যার মধ্যে চাপ সৃষ্টি ও প্রতারণার কোনো উপকরণ থাকে অথবা এমন কোনা চালবাজী থাকে যা দ্বিতীয় পক্ষ জানতে পারলে এ লেনদেনে নিজের সম্মতি প্রকাশে কোনো দিনই প্রস্তুত হবে না। এরপর আরো জোর দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, “তোমরা পরস্পরকে ধ্বংস করো না।” এর দুটি অর্থ হতে পারে। এ দুটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, তোমরা একে অন্যকে ধ্বংস করো না এবং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি নিজের লাভের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে সে যেন তার রক্তপান করে এবং পরিণামে সে এভাবে নিজের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করে।

এ নীতিগত নির্দেশটি ছাড়াও কুরআনের বিভিন্ন স্থানে অর্থ উপার্জনের নিন্মোক্ত পদ্বতিগুলোকে হারাম গণ্য করা হয়েছেঃ

O উৎকোচ (আল বাকারা ১৮৮ আয়াত)।

O ব্যক্তি সমষ্টি নির্বিশেষে সবার সম্পদ আত্মসাৎ (আল বাকারা ২৮৩ ও আলে ইমরান ১৬১ আয়াত)।

O চুরি (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত)।

O এতিমের অর্থ অন্যায়ভাবে তসরুফ (আন নেসা ১০ আয়াত)।

O ওজনে কম করা (আল মুতাফফিফীন ৩ আয়াত)।

O চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহের ব্যবসায় (আন নূর ১৯ আয়াত)।

O বেশ্যাবৃত্তি ও দেহ বিক্রয় লব্ধ অর্থ (আন নূর ২, ৩৩ আয়াত)।

O মদ উৎপাদন, মদের ব্যবসায় ও মদ পরিবহন (আলা মায়েদা ৯ আয়াত)।

O জুয়া ও এমন সব উপায়-উপকরণ যেগুলোর মাধ্যমে নিছক ঘটনাচক্রে ও ভাগ্যক্রমে একদল লোকের সম্পদ অন্য একদল লোকের নিকট স্থানান্তরিত হয় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।

O মূর্তিগড়া, মূর্তি বিক্রয় ও মূর্তি উপাসনালয়ের সেবা (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।

O ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষির ব্যবসায় (আল মায়েদা ৯০ আয়াত)।

O সুদ খাওয়া (আল বাকারা ২৭৫, ২৭৮ থেকে ২৮০ এবং আলে ইমরান ১৩০ আয়াত)।

দুইঃ ধন সঞ্চয়ের নিষেধাজ্ঞা
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ হচ্ছে এই যে, বৈধ উপায়ে যে ধন উপার্জন করা হবে তা পূঞ্জীভূত করে রাখা যাবে না। কারণ এর ফলে ধনের আবর্তন বন্ধ হয়ে যায় এবং ধন-বন্টনে ভারসাম্য থাকে না। যে ব্যক্তি ধন সঞ্চয় করে রাশীকৃত ও পুঞ্জীভূত করে রাখে সে নিজে যে কেবল মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তাই নয় বরং মূলত সে সমগ্র মানব সমাজের বিরুদ্ধে একটি জঘন্যতম অপরাধ করে। এর ফল তার নিজের জন্যও খারাপ হয়। এজন্য কুরআন কার্পণ্য এবং কারুনের ন্যায় সম্পদ কুক্ষিগত ও পুঞ্জীভূত করে রাখার কঠোর বিরোধিতা করেছে। কুরআন বলেঃ

(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“যারা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে, তারা যেন একথা মনে না করে যে, তাদের এ কাজ তাদের জন্য মঙ্গলজনক বরং প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর।” -(সূরা আলে ইমরানঃ ১৮০ আয়াত)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“যারা স্বর্ণ-রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং আল্লাহ পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও।” – (সূরা আত তাওবাঃ ৩৪)

একথা পুঁজিবাদের ভিত্তিতে আঘাত হানে। উদ্বৃত্ত অর্থ জমা করে রাখা এবং জমাকৃত অর্থ আরো অধিক পরিমাণ অর্থ সংগ্রহে খাটানো — এটাই হচ্ছে পুঁজিবাদের মূল কথা। কিন্তু ইসলাম আদতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমা করে রাখা পছন্দ করে না।

তিনঃ অর্থ ব্যয় করার নির্দেশ
সঞ্চয় করার পরিবর্তে ইসলাম অর্থ ব্যয় করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু ব্যয় করার অর্থ বিলাসিতা ও আয়েশ-আরামের জীবনযাপন করে দু’হাতে অর্থ লুটানো নয়। বরং ব্যয় করার ক্ষেত্রে আল্লাহর পথের শর্ত আরোপ করে। অর্থাৎ সমাজের কোনো ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকে সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর পথে ব্যয়।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে যে, তারা কি ব্যয় করবে? তাদেরকে বলে দাও, যা তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত (তাই ব্যয় করো)।” – (সূরা আল বাকারা ২১৯ )

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“আর সদ্ব্যবহার করো নিজের মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজন, অভাবী-মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, নিজের মোলাকাতি বন্ধুবর্গ, মুসাফির ও মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সাথে। – (সূরা আন নিসাঃ ৩৬)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)

“তাদের অর্থ সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার আছে।” – (সূরা আয যারিয়াতঃ ১৯)

এখানে ইসলাম ও পুঁজিবাদের দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়।

বিত্তবান মনে করে, অর্থ ব্যয় করলে দরিদ্র হয়ে যাবে এবং সঞ্চয় করলে বিত্তশালী হবে। কিন্তু ইসলাম বলে, অর্থ ব্যয় করলে কমে যাবে না বরং বরকত ও বৃদ্ধি হবে।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যের ন্যায় লজ্জাকর কাজের হুকুম দেয় কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট মাগফেরাত ও অতিরিক্ত দানের ওয়াদা করেন।” – ( সূরা আল বাকারাঃ ২৬৮)

বিত্তবান মনে করে কোনো কিছু ব্যয় করা হলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, তা নষ্ট হয়ে যায়নি বরং তার সর্বোত্তম লাভ তোমাদের নিকট ফিরে আসবে।

(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“সৎকাজে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তা তোমরা পুরোপুরি ফেরত পাবে এবং তোমাদের ওপর কোনোক্রমেই যুলুম করা হবে না।” -( সূরা আল বাকারাঃ ২৭২)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“যারা আমার প্রদত্ত রেজেক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তারা এমন একটি ব্যবসায়ের আশা রাখে, যাতে কোনাক্রমেই লোকসানের সম্ভবনা নেই। আল্লাহ তাদেরকে এর বিনিময়ে পুরোপুরি ফল প্রদান করবেন বরং মেহেরবানী করে তাদেরকে কিছু বেশী দান করবেন।” – (সূরা আল ফাতিরঃ ২৯-৩০)

বিত্তবান মনে করে, সম্পদ আহরণ করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করলে সম্পদ বেড়ে যায়। কিন্তু ইসলাম বলে, না, সুদের মাধ্যমে বরং সম্পদ কমে যায়। সৎকাজে অর্থ নিয়োগ করলেই সম্পদ বেড়ে যায়।

(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“আল্লাহ সুদ নির্মূল করেন ও দান-সাদকাকে প্রতিপালন ও ক্রমবৃদ্ধি করেন”। -(সূরা আল বাকারাঃ ২৭৬)

(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“তোমরা এই যে সুদ দাও মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির আশায়, জেনে রাখো, আল্লাহর নিকট তা কখনো বৃদ্ধি লাভ করে না। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাকাত বাবদ যে অর্থ দান করে থাকো একমাত্র তার মধ্যেই ক্রমবৃদ্ধি হয়ে থাকে।” -সূরা আর রূমঃ৩৯)

পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী এটি আর একটি নতুন মতবাদ। ব্যয় করলে অর্থ বেড়ে যাবে এবং ব্যয়িত অর্থ কেবল নষ্টই হবে না বরং কিছুটা অতিরিক্ত লাভ ও কল্যাণসহ পূর্ণ মাত্রায় ফিরে আসবে, অন্যদিকে সুদী ব্যবসায় অর্থ বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থ হ্রাস ও লোকসানের সূচনা করবে এবং যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে অর্থ হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে – এ মতবাদটি আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভূত ও বিস্ময়কর মনে হবে। শ্রোতা মনে করে সম্ভবত এগুলো নিছক আখেরাতের সওয়াবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। নিসন্দেহে আখেরাতের সওয়াবের সাথে এসব কথার সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটিই আসল গুরুত্বের অধিকারী। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ দুনিয়াতেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ মতাদর্শটি একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ধন সঞ্চয় করে সুদী ব্যবসায়ে নিয়োগ করার অবশ্যম্ভাবী ফল স্বরূপ চতুর্দিক থেকে ধন আহরিত হয়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে চলে আসবে। সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা প্রতিদিন কমে যেতে থাকবে। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসায় সর্বত্র মন্দাভাব দেখা দেবে। জাতীয় অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌছে যাবে। অবশেষে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যার ফলে পুঁজিপতিরাও নিজেদের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অর্থ উপার্জনের কাজে লাগাবার সুযোগ পাবে না।১

[টিকা ১. রসুলে করীম (স) নিম্নোক্ত হাদিসটিতে একথার প্রতি ইংগিত করেছেনঃ

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

অর্থাৎ “সুদের পরিমান যত বেশিই হোক না কেন অবশেষে তা কম হতে বাধ্য।”

বিপরীত পক্ষে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করলে এবং যাকাত ও সদকা দান করলে পরিণামে জাতির সকল ব্যক্তির হাতে এ সম্পদ ছড়িয়ে পড়ে, প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট ক্রয়-ক্ষমতার অধিকারী হয়, শিল্পোৎপাদন বেড়ে যায়, সবুজ ক্ষেতগুলো শস্যে ভরে ওঠে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়, হয় তো কেউ লাখপতি-কোটিপতি হয় না কিন্তু সবার অবস্থা সচ্ছল হয় এবং পরিবারই হয় সমৃদ্ধশালী। এ শুভ পরিনাম সম্পন্ন অর্থনৈতিক মতাদর্শটির সত্যতা যাঁচাই করতে হলে আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।২

[টিকা – ২. এ গ্রন্থ প্রণয়নের সময় আমেরিকাতে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।]

সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার কারনে সেখানে ধন বন্টনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং শিল্প ও বাণিজ্যের মন্দাভাব জাতির অর্থনৈতিক জীবনকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে। এর তুলনায় ইসলামী যুগের প্রথম দিকের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যখন সেখানে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি এমন পর্যায় পৌছে যায় যার ফলে লোকেরা যাকাত গ্রহীতাদেরকে খুঁজে বেড়াতো কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান পাওয়া যেত না। এমন একজন লোকের সন্ধান পাওয়া যেত না যে, নিজেই যাকাত দেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা অর্জন করেনি। এ দু’টি অবস্থাকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে আল্লাহ সুদকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সাদকাকে ক্রমোন্নতি ও ক্রমবৃদ্ধি দান করেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।

ইসলাম পুঁজিবাদী মানসিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক মানসিকতা সৃষ্টি করে। পুঁজিপতি একথা কল্পনাই করতে পারে না যে, সুদ ছাড়া এক ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ আর এক ব্যক্তিকে কেমন করে দিতে পারে। সে অর্থ ঋণ দিয়ে তার বিনিময়ে কেবল সুদই আদায় করে না, বরং নিজের মূলধন ও তার সুদ আদায় করার জন্য ঋণগ্রহীতার বস্ত্র ও গৃহের আসবাবপত্রাদি পর্যন্ত ক্রোক করে নেয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, অভাবীকে কেবল ঋণ দিলে হবেনা বরং তার আর্থিক অনটন যদি বেশি থাকে তাহলে তার নিকট কড়া তাগাদা করা যাবেনা, এমনকি ঋণ আদায়ের ক্ষমতা না থাকলে তাকে মাফ করে দিতে হবে।

(আরবী টেক্সট —————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“ঋণ গ্রহীতা যদি অত্যধিক অনটন পীড়িত হয় তাহলে তার অবস্থা স্বচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দাও আর যদি তাকে মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য উত্তম। যদি তোমরা কিছু জ্ঞান রাখতে, তাহলে এর কল্যাণকারিতা উপলব্ধি করতে পারতে।” – (সুরা বাকারা: ২৮০)

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পারস্পরিক সাহায্যের অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রথমে পারস্পরিক সাহায্য সমিতির তহবিলে অর্থ দাখিল করে আপনাকে তার সদস্য হতে হবে, তারপর আপনার যদি কখনো অর্থের প্রয়োজন হয়, তাহলে সমিতি বাজারে প্রচলিত সাধারন সুদের হারের তুলনায় কিছু কম হারে আপনাকে সুদী ঋণ দেবে। যদি আপনার কাছে অর্থ না থাকে তাহলে পারস্পরিক সাহায্য সমিতি থেকে আপনি কোনই সাহায্য পেতে পারেন না। বিপরীত পক্ষে ইসলাম যে পারস্পরিক সাহায্যের পরিকল্পনা রাখে তা হচ্ছে এই যে, অর্থ ও সামর্থবান লোকেরা প্রয়োজনের সময় কেবল তাদের কম সামর্থবান ভাইদেরকে ঋণ দেবেনা বরং তাদের ঋণ আদায় করার ব্যাপারেও সামর্থ অনুযায়ে তাদেরকে সাহায্য করবে। তাই ‘আলগারেমীনা’ অর্থাৎ ঋণগ্রস্তদের ঋণ আদায় করে দেয়াকেও যাকাতের অন্যতম ব্যয় ক্ষেত্র হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

পুঁজিপতি কখনো সৎপথে কোনো অর্থ ব্যয় করলে নেহাত লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই তা করে থাকে। কারন এ সংকীর্ণচেতা ব্যক্তি মনে করে যে, এ অর্থ ব্যয়ের বিনিময়ে কমপক্ষে সুনাম ও সুখ্যাতি তার অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু ইসলাম বলে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা উচিত নয় এবং প্রকাশ্যে বা গোপনে যা-ই ব্যয় করা হোক না কেন অবিলম্বে কোনো না কোনো আকারে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্য এর পিছনে যেন না থাকে। বরং কাজের পরিণতির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। এ দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত যতদুর দৃষ্টি প্রসারিত করা যাবে সর্বত্রই দেখা যাবে এ ব্যয়িত অর্থ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং একের পর এক মুনাফা দিয়েই চলছে।

“যে ব্যক্তি লোক দেখাবার উদ্দেশ্যে নিজের অর্থ ব্যয় করে তার এ কাজকে এমন একটি প্রস্তর খন্ডের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যার উপর ছিল মাটির আস্তরণ, সে এ মাটির মধ্যে বীজ বপন করেছিল কিন্তু পানির একটি প্রবাহ আসলো এবং সমস্ত মাটি ধুয়ে নিয়ে চলে গেল। আর যে ব্যক্তি নিজের নিয়ত ঠিক রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করে তার এ কাজকে এমন একটি উৎকৃষ্ট জমির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে একটি উদ্যান রচনা করা হয়েছে, বৃষ্টি হলে সেখানে দ্বিগুন ফল উৎপন্ন হয় আর বৃষ্টি না হলে নিছক ছোটখাটো একটি স্রোতধারা তার জন্য যথেষ্ট।” – (সুরা আল বাকারা: ৩৬ রুকু)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————– আরবী টেক্সট)

“যদি প্রকাশ্যে সাদকা দাও তাও ভালো কিন্তু যদি গোপনে দাও এবং দরিদ্রদের নিকট পৌঁছিয়ে দাও, তাহলে এটিই উত্তম হবে।” – (সুরা আল বাকারা: ২৭১)

পুঁজিপতি যদি কখনো সৎকাজে কোনো অর্থ ব্যয় করে তাহলে তার পিছনে তার হৃদয়িক আবেগ ও সদিচ্ছা থাকে না বরং অনিচ্ছাকৃতভাবেই করে থাকে এবং এজন্য সে সবচেয়ে নিকৃষ্টমানের সম্পদ ব্যয় করে, তারপর নিজের শাণিত বাক্যবাণে বিদ্ধ করে অর্থ গ্রহীতার অর্ধেক প্রাণ বের করে নেয়। বিপরীত পক্ষে ইসলাম সবচেয়ে ভালো সম্পদ ব্যয় করার এবং ব্যয় করার পর নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ না করা এমন কি প্রতিদানে কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এ আশাও পোষণ না করার শিক্ষা দেয়।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“তোমরা যাকিছু উপার্জন করেছ আর যাকিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করো, যেন বাছাই করে নিকৃষ্টতর বস্তু ব্যয় করো না।” – (সুরা আল বাকারা: ২৬৭)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“অনুগ্রহ প্রকাশ করে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের সদকাসমূহ ধ্বংস করো না।” – (সুরা আল বাকারা: ২৬৪)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“আর তারা আল্লাহর প্রতি ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মিসকিন, এতিম ও কয়েদীকে আহার করায় এবং বলে, আমরা তোমাদেরকে খাওয়াচ্ছি আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, (এজন্য) আমরা তোমাদের নিকট থেকে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রত্যাশী নই।” – (সুরা দাহর : ৮-৯)

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দু’টি মানসিকতার মধ্যে যে বিপুল ব্যবধান দেখা যাচ্ছে এ প্রশ্ন না হয় বাদই দিলাম। তবুও আমার বক্তব্য হচ্ছে, নিছক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও কল্যাণ ও ক্ষতির এ দু’টি মতাদর্শের মধ্যে কোনটি অধিক শক্তিশালী, নিরেট ও সুদূরপ্রসারী ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর নির্ভুল। অতপর কল্যাণ ও ক্ষতি প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে আমি ইসলামের যে আদর্শ তুলে ধরেছি সেসব সামনে রেখে ইসলাম কোনো অবস্থায় সুদী কারবারকে বৈধ গণ্য করতে পারে, একথা চিন্তা করার কোনো অবকাশ আছে কি?

চার: যাকাত
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম যে দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করেছে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, ধন একস্থানে পুঞ্জিভূত ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকতে পারবে না; ইসলামী সমাজের যে কয়জন লোক তাদের উচ্চতর যোগ্যতা ও সৌভাগ্যের কারনে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আহরন করেছে ইসলাম চায় তারা যেন এ সম্পদ পুঞ্জিভূত করে না রাখে বরং এগুলো ব্যয় করে এবং এমন সব ক্ষেত্রে ব্যয় করে যেখান থেকে ধনের আবর্তনের ফলে সমাজের স্বল্পবিত্ত ভোগীরাও যথেষ্ট অংশ লাভ করতে সক্ষম হবে। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম একদিকে উন্নত নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং উৎসাহ দান ও ভীতি প্রদর্শনের শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে দানশীলতা ও যথার্থ পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এভাবে লোকেরা নিজেদের মনের স্বাভাবিক ইচ্ছা-আকাংখা অনুযায়ী ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকে খারাপ জানবে এবং তা ব্যয় করতে উৎসাহী ও আগ্রহী হবে। অন্যদিকে ইসলাম এমন সব আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে বদান্যতার এ শিক্ষা সত্ত্বেও নিজেদের অসৎ মনোবৃত্তির কারনে যেসব লোক সম্পদ আহরণ করতে ও পুঞ্জিভূত করে রাখতে অভ্যস্ত হয় অথবা যাদের নিকট কোনো না কোনভাবে সম্পদ সঞ্চিত হয়ে যায়, তাদের সম্পদ থেকে সমাজের কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কমপক্ষে একটি অংশ অবশ্যই কেটে নেয়া হবে। একেই যাকাত বলা হয়। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এ যাকাতকে অত্যধিক গুরুত্ব দান করা হয়েছে, এমনকি একে ইসলামের একটি মূল স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নামাজের পরে এ যাকাতের ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে: যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করে, যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার ঐ সম্পদ হালাল হতে পারে না।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————- আরবী টেক্সট)

“(হে নবী!) তাদের ধন-সম্পদ থেকে একটি সাদকা গ্রহণ করো, যা ঐ ধন-সম্পদকে পাক-পবিত্র ও হালাল করে দেবে।” – (সুরা তাওবা: ১০৩)

এখানে ‘একটি সাদকা’ শব্দটি থেকে সাদকার একটি বিশেষ পরিমান বুঝা যায়। এ সঙ্গে রসূলে করীম (স)-কে এটি আদায় করার নির্দেশ দেয়ার ফলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সাধারণ স্বেচ্ছা প্রদত্ত সাদকা থেকে আলাদা এটি একটি ওয়াজিব ও ফরজ সাদকা অর্থাৎ যাকাত এবং বিত্তশালী লোকদের নিকট থেকে এ সাদকাটি অবশ্যই আদায় করতে হবে। কাজেই এ নির্দেশ অনুযায়ী রসূলে করীম (স) বিভিন্ন প্রকার সম্পদের জন্য নেসাবের ( যে সর্বনিম্ন পরিমানের ওপর যাকাত অপরিহার্য) একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। অতপর নেসাব পরিমাণ বা তদুর্ধ বিভিন্ন প্রকার সম্পদের উপর যাকাতের বিভিন্ন হার নির্ধারণ করেছেন সোনা, রূপা ও নগদ টাকা-পয়সার ওপর শতকরা আড়াই ভাগ এবং কৃষি উৎপাদনের ওপর সেচ ব্যবস্থার আওতাধীন জমি হলে শতকরা ৫ ভাগ ও সেচ ব্যবস্থার আওতা বহির্ভূত জমি হলে শতকরা ১০ ভাগ, ব্যবসায় পণ্যের উপর শতকরা আড়াই ভাগ, খনিজ দ্রব্যাদি (নিজস্ব মালিকানাধীন) ও গুপ্ত ধনের উপর শতকরা ২০ ভাগ যাকাত ধার্য করেছেন। এভাবে ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত গবাদি পশু প্রভৃতি চতুস্পদ প্রাণীর ওপর বিভিন্ন হারে যাকাত ধার্য করেছেন।

আয়াতের শেষ শব্দটি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিত্তশালী ব্যক্তির নিকট যে অর্থ সম্পদ সঞ্চিত হয় ইসলামের দৃষ্টিতে তা অপবিত্র এবং তার মালিক তা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বিশেষ পরিমাণ আল্লাহর পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। ‘আল্লাহর পথে’ শব্দটির অর্থ কি? আল্লাহ কারোর মুখাপেক্ষী নন। তাঁর অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন নেই, তিনি অভাবীও নন। কাজেই তাঁর পথ বলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, বিত্তশালীদের সম্পদ ব্যয় করে জাতির দরিদ্র ও অভাবী লোকদেরকে সচ্ছল করার চেষ্টা করতে হবে এবং এমন সব কল্যানমূলক কাজে এ সম্পদ নিয়োগ করতে হবে- যা থেকে সমগ্র জাতি লাভবান হতে পারবে।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“মূলত সাদকা-যাকাত হচ্ছে ফকির¬¬¬¬¬১ ও মিককিনদের২ জন্য এবং তাদের জন্য যাদেরকে সাদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত করা হয়,তাদের জন্য যাদের হৃদয়কে শক্তিশালী করার প্রয়োজন হয়৩,লোকদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য,ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য এবং মুসাফিরদের ৪ জন্য।” (সূরা আত তাওবাঃ ৬০)

[টিকা:১.ফকির এমন সব লোকদেরকে বলা হয় যারা নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে কম অন্ন সংস্থান করার কারণে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী।-(লিসানুন আবর)

টিকা:২.মিসকিনের সংজ্ঞা বর্ণনা করে হযরত ওমর (রা) বলেছেন: যারা অর্থ উপার্জন করতে পারে না অথবা অর্থ উপার্জনের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে যে দরিদ্র শিশু এখনো অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা রাখে না এবং যেসব বেকার ও রুগ্নব্যক্তি সাময়িকভাবে উপার্জনের যোগ্যতা বঞ্চিত তারা সবাই মিসকিন।

টিকা:৩.এ দলের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে এমন সব নও-মুসলিম যারা কুফর থেকে ইসলামে প্রবেশ করার কারণে সংকটে জর্জরিত।

টিকা:৪.মুসাফির ব্যক্তির গৃহে সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও সফর অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়লে অবশ্যই যাকাত গ্রহণের হকদার।]

এটিই মুসলমানদের কো-অপারেটিভ সোসাইটি, তাদের ইনস্যুরেন্স কোম্পানী এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডও। এখান থেকেই মুসলিম সমাজের বেকারদেরকে সাহায্য করা হয়। তাদের অক্ষম,বিকলাংগ,রুগ্ন,এতিম,বিধবা ও কর্মহীনদেরকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিপালন করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে,এ বস্তুটি মুসলমানদেরকে ভবিষ্যৎ অন্ন সংস্থানের চিন্তা থেকে সম্পুর্ণরূপে মুক্ত করে। এর সহজ-সরল নীতি হচ্ছে,আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান কাজেই সে অন্যকে সাহায্য করবে,আগামীকাল যখন সে অভাবী হয়ে পড়বে তখন অন্যরা তাকে সাহায্য করবে। দরিদ্র হয়ে পড়লে আমার অবস্থা কি হবে,একথা চিন্তা করার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। মরে গেলে স্ত্রী ও ছেলে-পেলেদের কি অবস্থা হবে? কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে,পীড়িত হয়ে পড়লে ঘর-বাড়ীতে আগুন লেগে গেলে, বন্যা কবলিত হয়ে পড়লে, দেউলিয়া হয়ে গেলে তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে এবং এসব বিপদের হাত থেকে উদ্ধারের কি উপায় হবে-এসব চিন্তা করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। সফর অবস্থায় টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেলে জীবিকা নির্বাহের কি উপায় হবে? একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই এ সমস্ত চিন্তা থেকে মানুষকে চিরন্তন মুক্তি দান করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের একজন সদস্যের কাজ কেবল এতটুকুই থাকে যে, সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ- সম্পদের একটি অংশ আল্লাহর ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে জমা দিয়ে বীমা করে নেবে। প্রকৃতপক্ষে এ সময় এ অর্থের তার কোনো প্রয়োজন নেই। এ অর্থ এখন যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাজে লাগবে। কাল যখন তার বা তার সন্তান-সন্ততিদের প্রয়োজন দেখা দেবে তখন কেবল তার নিজের প্রদত্ত সম্পদই নয় বরং তার চাইতে অনেক বেশী সম্পদ ফেরত পাবে।

এখানে আবার দেখা যায়, পুঁজিবাদ ও ইসলামের নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে পরিপূর্ন বৈপরীত্য। পুঁজিবাদের দাবী হচ্ছে, অর্থ সঞ্চয় করতে হবে এবং তার পরিমাণ বাড়াবার জন্য সুদ নিতে হবে। যার ফলে এ নালা দিয়ে গড়িয়ে আশে-পাশের লোকদের সবার টাকা-পয়সা এ পুকুরে এসে পড়বে। বিপরীত পক্ষে ইসলাম নির্দেশ দেয়, প্রথমত টাকা-পয়সা জমা করে বা আটকে রাখা যাবে না আর যদি কখনো জমা হয়ে যায় তাহলে এ পুকুর থেকে নালা কেটে দিতে হবে,যাতে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষেতগুলোতে পানি পৌঁছে যায় এবং আশেপাশের সমস্ত জমি তরতাজা ও সবুজে শ্যামলে ভরে উঠে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধন আবদ্ধ ও জমাটবদ্ধ হয়ে থাকে কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় তা মুক্ত, স্বাধীন ও অবাধ গতিশীল। পুঁজিবাদের পুকুর থেকে পানি নিতে হলে প্রথমে আপনার পানি সেখানে অবশ্যই থাকতে হবে, নয় তো এক কাতরা পানি আপনি সেখান থেকে পেতে পারেন না। কিন্তু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার পুকুরের নিয়ম হচ্ছে এই যে, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকবে সে তার বাড়তি পানি ঐ পুকুরে ঢেলে দিয়ে যাবে এবং যার পানির প্রয়োজন হবে সে ওখান থেকে নিয়ে যাবে। বলাবাহুল্য মৌলিকত্ব ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে এ দুই বিপরীতধর্মী মতাদর্শকে একত্রিত করা কোনো ক্রমেই সম্ভবপর নয়। কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ ধরনের বিপরীতধর্মী মতাদর্শের একত্র সমাবেশের কথা কল্পনাই করতে পারে না।

পাঁচঃ মীরাসী আইন
নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনের অর্থ ব্যয়, আল্লাহর পথে ব্যয় ও যাকাত আদায় করার পরও যে অর্থ-সম্পদ কোনো একস্থানে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে তাকে বিকেন্দ্রীভূত করার জন্য ইসলাম আর একটি পন্থা অবলম্বন করেছে। একে বলা হয় মীরাসী আইন। এ আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি অর্থ-সম্পদ রেখে মৃত্যুবরণ করবে তা যতো কম বা বেশী হোক না কেন, তা কেটে টুকরো টুকরো করা হবে এবং নিকট-দূরের সকল আত্মীয়ের মধ্যে ক্রমানুসারে বন্টন করা হবে। যদি এমন কোনো ব্যক্তি থাকে, যার কোনো ওয়ারিস নেই তাহলে তাকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করার অধিকার দানের পরিবর্তের তার সম্পদ মুসলমানদের বায়তুলমালে জমা করে দিতে হবে। তাহলে সমগ্র জাতি এ থেকে লাভবান হতে পারবে। মীরাস বণ্টনের এ আইনের অস্তিত্ব একমাত্র ইসলামেই দেখা যায়, অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় এর অস্তিত্ব নেই। অন্যান্য অর্থব্যবস্থা এ ব্যাপারে যে নীতি নির্ধারণ করেছে তা হচ্ছে, এক ব্যক্তি যে অর্থ সঞ্চিত করে রেখে যায় তার মৃত্যুর পর তা এক বা একাধিক ব্যক্তির নিকট কেন্দ্রীভূত থাকে।১ কিন্তু ইসলাম অর্থ কেন্দ্রীভুত করার পরিবর্তে তার বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতি, এর ফলে অর্থের আবর্তন সহজতর হয়।

[টিকা:১. জ্যেষ্ঠ পুত্রের স্থলাভিষেক (Primogeniture) এবং একান্নবর্তী পরিবার (Joint Family System) প্রথা এ নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।]

ছয়: গনীমত লব্ধ সম্পদ ও বিজিত সম্পত্তি বণ্টন
এ ক্ষেত্রেও ইসলাম একই দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী। যুদ্ধে সেনাবাহিনী যে গনীমতের অর্থ (শত্রুপক্ষের পরিত্যক্ত সম্পদ) হস্তগত করে সে সম্পর্কে ইসলাম একটি বিশিষ্ট আইন প্রণয়ন করেছে। এ অর্থ-সম্পদ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়। চারভাগ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় এবং অবিশিষ্ট এক ভাগ সাধারণ জাতীয় কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেয়া হয়।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“জেনে রাখো, গনীমত হিসেবে তোমরা যাকিছু হস্তগত করো তার এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে আল্লাহ, তার রাসূল, রাসূলের নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।” – (সূরা আল আনফাল: ৪১)

আল্লাহ ও রসূলের অংশ বলে এমন সব কাজকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো আল্লাহ ও রসূলের নির্দেশের আওতাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে দেয়া হয়েছে।

যাকাতে রসূলের নিকটাত্মীয়দের কোন অংশ ছিল না বলে এখানে তাদের অংশ রাখা হয়েছে।

অতপর এ পঞ্চমাংশে আরো তিন শ্রেণীর অংশ বিশেষভাবে রক্ষিত হয়েছে। জাতির এতিম শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে জীবন সংগ্রামের অংশ নেয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য এতে তাদের অংশ রক্ষিত হয়েছে। মিসকিনদের অংশ রাখা হয়েছে-বিধবা মহিলা, বিকলাঙ্গ, অক্ষম, রুগ্ন ও অভাবী প্রভৃতি যার অন্তর্ভুক্ত। আর রাখা হয়েছে ইবনুস সাবীল অর্থাৎ মুসাফিদের অংশ। নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে ইসলাম মুসলামানদের মধ্যে মুসাফিরকে আপ্যায়ন করার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এ সঙ্গে যাকাত, সাদকা ও যুদ্ধলব্ধ গনীমতের সম্পদেও তার অংশ রেখেছে। এ ব্যবস্থার কারণে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বানিজ্য, ভ্রমণ-পর্যটন, শিক্ষা-অধ্যয়ন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী পরিদর্শন ও অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য যাতায়াত সহজতর হয়েছে।

যুদ্ধের ফলে ইসলামী রাষ্ট্র যেসব সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয় ইসলাম সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন রাখার বিধান দিয়েছে।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“জনপদের অধিবাসীদের নিকট থেকে আল্লাহ, ‘ফায়’ (বিনা যুদ্ধে শত্রুপক্ষের যেসব সম্পদ হস্তগত হয়) হিসেবে যা কিছু দান করেছেন তা আল্লাহ, তার রাসূল, রসূলের নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য, যাতে এগুলো কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়। ……..আর এর মধ্যে অভাবী মুহাজিরদেরও অংশ রয়েছে, যাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ী ও সহায় সম্পদ থেকে বেদখল করে নির্বাসিত করা হয়েছে। ……..আর তাদের অংশ রয়েছে যারা মুহাজিরদের আসার আগে মদীনায় ঈমান এনেছিল। …….আর তাদের ভবিষ্যত আগমনকারী বংশধরদেরও অংশ রয়েছে।” -(সুরা আল হাশর:৭-১০)

এ আয়াতগুলোতে কেবলমাত্র ‘ফায়’ লব্ধ অর্থের ব্যয় ক্ষেত্রগুলোর বিশদ বর্ণনা করা হয়নি বরং এই সঙ্গে যে উদ্দেশ্যে ইসলাম ফায়লব্ধ অর্থ-সম্পদ বণ্টন তথা সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে সেদিকেও সুস্পষ্ট ইংগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়। কুরআন মজীদ ছোট একটি বাক্যের মধ্যে যে বিষয়বস্তু বর্ণনা করেছে সেটিই হচ্ছে সমগ্র ইসলামী অর্থব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর।

সাতঃ মিতব্যয়ীতার নির্দেশ
ইসলাম একদিকে ধন-সম্পদ সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে আবর্তন করার ও ধনীদের সম্পদ থেকে নির্ধনদের অংশ লাভ করার ব্যবস্থা করেছে, অন্যদিকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থ ও সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হবার নির্দেশ দিয়েছে। এভাবে অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি কখনো প্রান্তিকতার আশ্রয় নিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে না। এ ক্ষেত্রে কুরআনের মৌলিক শিক্ষা হচ্ছেঃ

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“আর নিজের হাত না একেবারে গলায় বেঁধে রাখো আর না একেবারে তাকে খুলে দাও, যার ফলে পরবর্তীকালে আক্ষেপ করে বসে থাকার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।”-(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৯)

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“আর আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দারা যখন ব্যয় করে,অমিতব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করবে না বরং এ দুটির মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করে।”-(সূরা আল ফুরকানঃ৬৭)

এ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজের আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে থেকেই অর্থ ব্যয় করে। তার অর্থ ব্যয় যেন কখনো এমন পর্যায়ে না পৌঁছায় যার ফলে তা তার আয়ের অংককে ছাড়িয়ে যায় এবং নিজের আজেবাজে খরচের জন্য তাকে অন্যের দ্বারে হাত পাততে হয় অথবা অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হয় এবং যাথার্থ প্রয়োজন ছাড়াই অন্যের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। অতপর গায়ের জোরে সে ঋণদাতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ফিরবে অথবা ঋণ আদায় করার জন্য নিজের সব রকমের অর্থনৈতিক উপকরণ ব্যবহার করে অবশেষে ফতুর হয়ে ফকির ও মিসকিনদের খাতায় নিজের নাম লেখাবে। আবার সে যেন নিজের অর্থনৈতিক সামর্থের তুলনায় অনেক কম খরচ করার মতো কার্পণ্যও না দেখায়। নিজের আয় ও অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণের সীমার মধ্যে থেকে ব্যয় করার অর্থ এ নয় যে, সে ভালো আয়-উপার্জন করলে নিজের সব টাকা-পয়সা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আয়েশ-আরাম ও ভোগ বিলাসীতায় উড়িয়ে দেবে আর অন্যদিকে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীরা চরম সংকটের মধ্যে দিন যাপন করবে। এ ধরনের স্বার্থান্ধ ব্যয় বাহুল্যকে ইসলাম অমিতব্যয়িতার মধ্যে গন্য করেছে।

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“নিজের নিকটাত্মীয়কে তার অধিকার পৌছিয়ে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরকেও তাদের অধিকার দান করো। বাজে খরচ করো না। যারা অযথা ও বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রব-প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ না-ফরমান।” -(সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৬-২৭)

ইসলাম এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নৈতিক শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং এ সঙ্গে কার্পণ্য ও অমিতব্যয়িতার চূড়ান্ত অবস্থা প্রতিরোধের জন্য আইনও প্রণয়ন করেছে। ধন বণ্টনের ভারসাম্য বিনষ্টকারী সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। জুয়াকে হারাম ঘোষণা করেছে। মদ্যপান ও ব্যভিচারের পথ রোধ করেছে। অনর্থক ফুর্তিবাজী, তামাশা ও কৌতুকের এমন ব্যয়বহুল অভ্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, যেগুলোর অনিবার্য পরিণতি অর্থ ও সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সঙ্গীতের স্বাভাবিক প্রবণতাকে এমন পর্যায়ে উপনীত হতে দেয়নি যেখানে সঙ্গীত প্রিয়তা ও সঙ্গীতের মধ্যে ঐকান্তিক মগ্নতা মানুষের মধ্যে বহুবিধ নৈতিক ও আত্মিক ত্রুটি সৃষ্টির সাথে সাথে তার অর্থনৈতিক জীবনেও বিপর্যয় ও বিশৃংখলা সৃষ্টির কারণ হয়। সৌন্দর্য পিপাসার স্বাভাবিক প্রবণতাকেও একটি সীমার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত করে। বহু মূল্য, পরিচ্ছদ, হীরা ও মণি-মানিক্যের অলংকার, সোনা ও রূপার তৈজস পত্রাদি, চিত্র ও ভাস্কর মূর্তি সম্পর্কে রসূলে করীম (সা)-এর যে নির্দেশাবলী বিধৃত হয়েছে তার মধ্যে বহুতর কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এ সমস্ত কল্যাণের মধ্যে একটি মহত্তর কল্যাণ হচ্ছে এই যে, যে ধন-সম্পদ বহুসংখ্যক দরিদ্র ও অভাবী ভাইদের জীবনের নিম্নতম অপরিহার্য প্রয়োজনাদি পূর্ণ করতে পারে এবং তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে দিতে পারে, তাকে নিছক নিজের দেহ ও গৃহ সজ্জায় ব্যয় করা সৌন্দর্যপ্রীতি নয় বরং নিকৃষ্ট পর্যায়ের হৃদয়হীনতা ও স্বার্থপরতার পরিচায়ক।

মোটকথা ইসলাম একদিকে নৈতিক শিক্ষা ও অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট আইন-কানুনের মাধ্যমে মানুষকে সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়। এ অনাড়ম্বর জীবনে মানুষের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা সীমানা কোনোক্রমেই এতটা ব্যাপকতর হতে পারে না, যার ফলে মধ্যম মানের আয়-উপার্জনের সংসার চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং নিজের স্বাভাবিক সীমার বাইরে গিয়ে তাকে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে হবে অথবা যদি সে মধ্যম মানের অধিক আয় করতে সমর্থ হয়, তাহলে নিজের উপার্জিত সমস্ত অর্থ-সম্পদ নিজেই ভোগ করবে এবং নিজের অপারগ ভাইদের সাহায্য করবে না, যারা মধ্যম মানের কম উপার্জন করে থাকে।

একটি প্রশ্ন
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ইসলামের সমগ্র অর্থব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এ আলোচনাটি পড়ার ও বারবার বিশ্লেষণ করার পর বিবেচনা করুন এ ব্যবস্থার কোনখানে সুদকে বসানো যায়? এ ব্যবস্থার যথার্থ প্রাণবস্তু, এর গঠনাকৃতি, এর বিভিন্ন অংশ ও তাদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্ক এবং এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করে বলুন, এর মধ্যে সুদী লেন-দেনের কোনো অবকাশ বা প্রয়োজন আছে কি? এখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনো স্থান বা প্রয়োজন আছে কি? এসব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই নেতিবাচক হতে বাধ্য। তাহলে এ ক্ষেত্রে পুর্নবার গভীর দৃষ্টিতে আলোচনাটি পর্যালোচনা করে বলুন, এর মধ্যে নৈতিক, তমদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোথাও কোনো ত্রুটি দেখা যায় কি? নৈতিকতা ও তমদ্দুনের উন্নততর নীতি ও আদর্শের কথা না হয় বাদই দিলেন। যদি মনে করেন, মানুষের জীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী, তাহলে আসুন, নির্ভেজাল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূলনীতি ও বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়ের মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে কি? যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে এর মধ্যে কি এমন কোনো সংশোধনী পেশ করা যায়, যা গ্রহণ না করলে এ ব্যবস্থা অসম্পূর্ন বা ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে? এর চেয়ে উন্নততর এমন কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পেশ করা যেতে পারে কি, যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার অধিকার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এর চেয়েও অধিক নির্ভুল ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণের সমান সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে এর চেয়ে উন্নত পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে? যদি এটিও সম্ভবপর না হয় এবং আমরা বিশ্বাস করি, এটি কোনোক্রমেই সম্ভবপর হতে পারে না, তাহলে আপনার মতে বুদ্ধি-বিবেচনা কি একথাই দাবী করে যে, নিজের দুর্বলতার কারণে দুনিয়ার এ সর্বোত্তম অর্থব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে আপনি দুনিয়ার নিকৃষ্টতম, সর্বাধিক ভ্রান্তিপূর্ণ ও ফলাফলের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ধ্বংসকর অর্থব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? উপরন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর আপনি লজ্জিতও হবেন না, নিজের বিবেককে পাপের বোঝা বইতেও প্রস্তুত করবেন না এবং পাপকে পুণ্য, ফাসেকি ও সীমালংঘনকে আনুগত্য গণ্য করার জন্য কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের মনগড়া ব্যাখ্যা করতে থাকবেন এবং ভ্রান্ত অর্থব্যবস্থার যাবতীয় গলিত নীতি ইসলামের পবিত্র-পরিচ্ছন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জুড়ে দেবার চেষ্টা করবেন, এ ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি, প্রাণসত্তা ও প্রকৃতির সাথে ঐ বস্তুগুলোর যতই বৈসাদৃশ্য থাক না কেন আপনি তার কোনো পরোয়াই করবেন না। প্রথমে আপনি ডাক্তার প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্র ফেলে দেন, তার বিধৃত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মাবলী অবহেলা ও অস্বীকার করেন, যেসব বস্তু-বিষয় থেকে তিনি সতর্ক থাকতে ও আত্মরক্ষা করতে বলেছেন সেগুলো থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেন না। অবশেষে যখন রোগ বেড়ে যায় এবং মৃত্যু নিকটবর্তী হয় তখন আবার ঐ ডাক্তারকেই বলতে থাকেন, যে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র আমাকে রোগগ্রস্ত করেছে আপনি নিজের হাতে আমাকে সে ব্যবস্থাপত্রটি লিখে দেন, যেসব অনিয়ম, অনাচার ও অখাদ্য আমার সর্বনাশ করেছে আপনি আমাকে সেগুলোর অনুমতি দেন, যে বস্তুটিকে আপনি হলাহল গণ্য করেছিলেন সেটিকে আবেহায়াত বলে ঘোষণা করে দেন। মূলত এটি চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

_ _ _ _ _ _ _ _


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি