প্রকাশকের কথা
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত্রি আমাদের ইতিহাসের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এর প্রেক্ষাপর এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সৃষ্টি করেছে এক নতুন ইতিহাস এবং জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। কিন্তু এর সঠিক ইতিহস এবং ২৫শে মার্চের আগের ও পরের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নতুন প্রজন্মের কাছে খুজ স্পষ্ট নয়। জাতীয় জীবনের অতীত ইতিহাসের ঘটনাবলীকে সঠিকভাবে পরিবেশন না করা হলে তা জাতির জন্যই ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।

রাজণৈতিক উত্থান, পতন ও পট পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী যথাযথভাবে উপস্থাপন না করা আত্ম প্রবঞ্চনারই শামিল। ইতিহাস কখনো বচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়। এ এক ধারাবাহিক এবং প্রবাহমান বিষয়বস্তু। আর ইতিহাসের নিরপেক্ষ উপস্থাপনা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষ করে যারা ইতিহাসের অংশ বা ইতিহাস সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান রাখেন তাদের জন্য এ কাজ আরো কঠিন। জাতি ঐ বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে কিভাবে সাড়া দিয়েছিল বা তখনকার পরিস্থিতিতে রাজনীর চালচিত্র এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কি ছিল পরবর্তী সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবস্থান করে তার চুলচেরা মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে এক জটিল ব্যাপার। ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবার পর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্ত। আর এ কারণেই সঠিকক ঘটনা অনেক সময় তলে পড়ে যায়। ঘটনার পেছনে যে ঘটনা থাকে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার অবকাশ অনেকের থাকে না। বিশিষ্ট লেখক এবং সাংবাদিক জনাব আবুল আসাদ দলিল প্রাণের ভিত্তিতে ২৫শে মার্চের আগের ও পরের ঘটনাবলী উপস্থানের কষ্টকর প্রয়াস চালিয়েছেন। যথাসম্ভব নিরপেক্ষ দৃষ্টিাতেই তিনি ঐ সময়কার একটি বাস্তব চিত্র অংকনের চেষ্টা করেছেন। তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন তা বিজ্ঞ পাঠক পাঠিকাগণই বিচার করবেন। আধুনিক প্রকাশনী পাঠক পাঠিকার জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টির মানসেই ‘২৫শে মার্চের আগে ও পরে’ গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। একথা বলারই অপেক্ষা রাখে না যে একটি নির্ভুল ও সুন্দর গ্রন্শথ উপহার দেয়া কত কঠিন। তদুপরি আমাদের আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে এ গ্রন্থটি প্রকাশনার সাথে জড়িত সকলের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

ভূমিকা
গতকাল যা ঘটলো, তা আজকের ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস ক্যামেরার ছবি নয়, কিংবা নয় ঘটনার ধারা বিবরণী। ঘটনার পেছনে যে ঘটনা থাকে তাও ইতিহাসের অংগ। তাই মনে হয় সব লেখার মধ্যে ইতিহাস লেখার কাজ সবচেয়ে কঠিন। আমি পেশায় সাংবাদিক। কোনো ইতিহাস লেখায় হাত দেব, তা কোনো দিন ভাবিনি। না ভাবলেও তা হয়ে গেল। লেখা সবসময় পরিকল্পনার পথ ধরে চলে না, এটাই তার প্রমাণ।

জাতীয় জীবনের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৯৭১ সাল। এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে এ বছর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয়। জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায় এ মহা ঘটনা। এ মহা ঘটনার ইতিহাস আমি এখানে লিখিনি। সে এক বিরাট কাজ। আমি মাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে চেষ্টা করেছি। প্রশ্ন দুটো হলো, কোন্ পটভূমিতে স্বাধিকারের আন্দোলন রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হলো এবং জাতীয় জীবনের সে মহা ঘটনায় কেন জাতি একমত হয়ে এক কাঁতারে দাঁড়াতে পারেনি।

প্রশ্ন দুটির উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে আমি যা লিখেছি, তা বিভিন্ন সংবাদ পত্র ও গ্রন্থের বিবরণী এবং অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির উক্তির সমাহার মাত্র। সেই সময়ের একজন কর্মজীবী সাংবাদিক হিসেবে যা দেখেছি, যা অনুভব করেছি, তাও আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। মানুষ অবশ্যই ক্যামেরা নয়, মানুষ মানুষই। ইচ্ছা, আবেগ বিশিষ্ট জীবন্ত সত্তা সে। এ সীমাবদ্ধতার কথা আমার সামনে ছিল। ইতিহাস বর্ণনায় আমি তাই চেষ্টা করেছি ঘটনাকে অনুসরণ করতে, ঘটনা আমাকে অনুসরণ করেনি। গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতি এক সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে পারলো না কেন- এ প্রশ্নের আলোচনায় একজন সাধারণ দর্শকের অবস্থান থেকে গোটা বিষয়কে আমি দেখেছি।

ইতিহাস কারো ইচ্ছা বা আবেগের অধীন নয়। কিংবা কোনো গ্রুপ বা মহলও একে কুক্ষিগত করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে ইতিহাসের নামে খেয়াল খুশীর চর্চা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেই এটা বেশী হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক যাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা’ রচনার প্রবণতা অভিহিত করেছেন। তবে আমি হতাশ নই। এখন যা কিছু হচ্ছে তা সবই ইতিহাসের কাঁচামাল। এসব কাঁচামাল পরখ করেই লিখিত হবে ইতিহাস। আমি এ গ্রন্থে আমার ইতিহাস বর্ণনায় প্রাপ্ত কাঁচামাল নাড়াচাড়া করে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের কাছে কিছু কথা রাখতে চেষ্টা করেছি।

আবুল আসাদ

ঢাকা ২৭শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৯০


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি