লেখকের কথা
ইসলামী আন্দোলন এদেশে যতই এগিয়ে চলেছে, ততই এক শ্রেণীর লোক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ওলামায়ে কেরামের ব্যাপারে বেসামাল হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ ও যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্যে আলেম সমাজের সংগ্রামী অতীতকে তারা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছে। ঐসকল লোক নির্লজ্জের মতো বলে বেড়াচ্ছে যে, “আলেমরা এ যাবত কোথায় ছিলেন? তারাই আমাদের উন্নতি-প্রগতির পথে অন্তরায়”।

ওলামায়ে কেরামের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে আসা আজাদীর বদৌলতে যেসব লোক আজ বাড়ী-গাড়ীর অধিকারী হয়ে নিঃস্বার্থ সমাজসেবক আলেমদের বিরুদ্ধে এহেন অজ্ঞতাপূর্ণ উক্তি করে, মূলতঃ তাদের জবাব হিসেবেই এ বইখানা লিখতে শুরু করি; কিন্তু প্রয়োজনের তাকিদে দ্রুত প্রকাশের খাতিরে এবং কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় অনেক মহৎ সংগ্রামী জীবন সম্পর্কেও বইটিতে আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ইসলাম ও আজাদী আন্দোলনের এমন অসংখ্য বীর মোজাহিদ আলেমের কথাও জানা যায়, যাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যাবলী হাতের কাছে না পাওয়ায় সংক্ষিপ্তাকারেও তাদের সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যায়নি।

অধীনের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যা কিছু পরিবেশিত হয়েছে, তাতে যদি কোনোরূপ তত্ত্ব ও তথ্যগত ভুল-ভ্রান্তি কারও নজরে পড়ে কিংবা কোনো মহৎ জীবনের তথ্য কারও জানা থাকে, সে ব্যাপারে অবহিত করলে কৃতার্থের সঙ্গে তা গ্রহণ করব এবং পরবর্তী সংস্করণে তা যোগ করতে চেষ্টা করব। পুস্তকখানা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে তাদের ত্যাগী পূর্বসূরীদের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলুক –এটাই আল্লাহর কাছে দোয়া রইল।

পরিশেষে অসংখ্য শ্রদ্ধা ও শুকরিয়া আমার মোহতারাম বুজর্গ উস্তাদ হযরত মওলানা নুর মোহাম্মদ আজমী সাহেবের প্রতি যার সংস্পর্শ ও মূল্যবান উপদেশাবলী আমাকে এ জাতীয় কাজে যথেষ্ট সাহায্যও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

-লেখক ২০শে জুলই ১৯৭০

 

প্রকাশকের কথা
আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের ভূমিকা কি ছিল –এ সম্পর্কে উর্দু ভাষায় অসংখ্য বই-পুস্তক থাকলেও বাংলা ভাষাভাষী পাঠক মহল দীর্ঘ দিন থেকে এ জাতীয় বই-পুস্তকের অভাব অনুভব করে আসছেন। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট মওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী সাহেব “আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা” বইখানা লেখার ফলে আমাদের দীর্ঘ দিনের একটি অভাব অনেকটা পূরণ হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বই খানা সংক্ষিপ্ত হলেও ইংরেজদের দিল্লী দখলের পর থেকে ১৯৪৭ সালের আগষ্ট পর্যন্ত এক নজরে আলেমদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের একটি মোটামুটি চিত্র পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে।

গ্রন্থখানার বিষয় বস্তুর গুরুত্বের প্রেক্ষিতেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত “ইতিহাস অনুসন্ধান সিরিজ” ৫ম খণ্ডের ৫০ পৃষ্ঠা থেকে ৮৭ পৃষ্ঠায় “মুসলিম লীগ রাজনীতিঃ কয়েকটি প্রশ্নের বিশ্রেষণ” প্রবন্ধের লেখক অমালেন্দু দে স্থানে স্থানে “আজাদী আন্দেলনে আলেম সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা”র বহু বরাত দিয়েছেন।

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীবৃন্দ বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসা ছাত্র যাদের একটি অংশ মাঝখানে রাজনীতি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে বইখানা যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। বইটির গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য করে আমরা এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করলাম।

পাঠক সমাজে বহু সমাদৃত এই বইখানা পুনঃপ্রকাশের পর জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও আলেম সমাজের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে অর্জিত স্বাধীন দেশে ৪৭ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস সম্বলিত লেখকের আরেকখানা গ্রন্থ প্রকাশের আশা রইল।

-প্রকাশক

অভিমত
[এক]

মহানবী (সাঃ)-এর যুগ থেকে নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ভূখণ্ডের খোদা-বিমুখ শাসক ও রাষ্ট্রশক্তির দাসত্ব-নিগঢ় থেকে মানবতাকে আজাদ করার জন্যে মুসলমানগণ যে সংগ্রাম করে আসছে, সেটাই প্রকৃত আজাদী সংগ্রাম। এ সংগ্রামে তারা জয়যুক্তও হয়েছে। সার বিশ্বে এক সময় শত শত বছর ধরে তাদেরই প্রভাব প্রতিপত্তি অধিক ছিল। কিন্তু শাসকদের অনেকের আদর্শচ্যুতি, ভোগবিলাস, আত্মবিলাস ও লোভলালসা হেতু এ জাতি তার শাসক সুলভ মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকটা খুইয়ে বসে। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম ভূখণ্ড ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায়। দীর্ঘ নির্যাতনের পর মুসলমানদের মধ্যে পরিশেষে দেখা দেয় আত্মজাগৃতি-ফিরে আসে সম্বিত। তারা ইংরেজ শক্তির অত্যাচার, উৎপীড়ন, জেল-জুলুম, ফাঁসিকে এতটুকুও পরোয়া না করে ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন এমনকি নিজেদের জীবন কোরবান করেও পরিচালনা করেছেন মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক আন্দোলন ও সংগ্রাম।

পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে খ্রীষ্টীয় আঠার শতকের প্রথম হতে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আলেম সমাজ ইংরেজ ও তাদের দোসর শিখ-হিন্দু নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছেন, তা এ দেশে ইসলামী মূল্যবোধের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক আন্দোলনেরই এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ছিল।

এ অধ্যায়ে ইংরেজদের অমানুষিক জুলুম সীমাহীন উৎপীড়ন বেপরোয়া ফাঁসীদান এবং হিন্দুদের মুসলিম-নিধন যজ্ঞকে বিন্দুমাত্রও পরোয়া না করে যে মহান নেতৃবৃন্দ পাক-ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত হতে আরম্ভ করে পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং প্রায় দু’শ বছর অবিরাম সংগ্রামের পর ঈপ্সিত আজাদী হাসিল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে যথাক্রমে সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরলভী, ইসমাইল শহীদ দেহলভী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, হাজী শহীদ তিতুমীর (নেসার আলী), মওলানা বেলায়েত আলী, মওলানা ইয়াহহিয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা মুহাম্মদ হোসাইন আজিমাবাদী, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী, শায়খুল হিন্দু মওলানা মাহমুদুল হাসান, মওলানা শাববীর আহমদ ওসমানী, মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মওলানা আজাদ সোবহানী, মওলানা হাসরাৎ মুহানী, মওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মওলানা আবদুল্লাহিল কাফী, পীর দুদু মিঞা, পীর বাদশাহ মিঞা, মওলানা রুহুল আমীন, ফুরফুরার পীর মওলানা আবুবকর সিদ্দিক, শর্শিনার পীর মওলানা নেছারুদ্দীন সাহেব, মওলানা আবদুল হামীদ খান ভাষানী প্রমুখ আরেমের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। আর এ অধ্যায়ের শেষ প্রান্তে এসে, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগ হতে যে বহু ইংরেজী শিক্ষিত মুসলিম নেতা এ সংগ্রামে শরীক হয়ে একে অধিকতর জোরদার করে তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে সামীহুলমূলক, মওলানা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা মওলভী এ কে ফজলুল হক, হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়।

আজাদী আন্দোলনে “আলেম সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা” –পুস্তিকায় বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক মওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী ইসলামী রাষ্ট্রের পুনঃ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে কিঞ্চিৎ আভাস মাত্র দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় এ আন্দোলনের কোন বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য ইতিহাস আজও রচিত হয়নি বলে লেখকের এ প্রাথমিক প্রচেষ্টা সীমিত হলেও প্রকৃতির দিক দিয়ে যেমন মৌলিক, তেমনি অবদানের দিক থেকে প্রথম সারির। বিষয় ও বিন্যাসের কোথাও ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও, পুস্তিকাখানি ইসলামী জনতার দৃষ্টিপথে তাদের শ্রদ্ধাভাজন নায়েবে নবী ওলামায়ে কেরামের চিরন্তন সংগ্রামের একটি দিক তুলে ধরবে বলেই আমার বিশ্বাস।

ইতি–

মুহাম্মদ আবদুল রাজ্জাক

[প্রধান অধ্যক্ষ] রিসার্চ একাডেমী,

ফরিদাবাদ, ঢাকা-৪

১০ই জুলাই ১৯৭০ইং

অভিমত
[দুই]

আলেমগণ নবী রাসূলদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী। এ উত্তরাধিকার বিষয়-সম্পদের নয় –আল্লাহ প্রদত্ত জীন বিধানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগ্রাম-সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ আন্দোলনের। নবী-রাসূলগণ যেভাবে মানব জাতিকে মানুষের গোলামী, জুলুম, নিপীড়ন, শোষণ থেকে আজাদ করার জন্যে সংগ্রাম করেছেন, তাদেরকে আল্লাহর নিরপেক্ষ ইনসাফপূর্ণ আইন ও শাসন বিধান অনুসরণের আহবান জানিয়ে তাদের উভয় জাহানের ইনসাফপূর্ণ আইন ও শাসন বিধান অনুসরণের আহবান জানিয়ে তাদের উভয় জাহাদের মুক্তিপথ দেখিয়ে গেছেন, আলেমগণের এই উত্তরাধিকার দায়িত্বও একমাত্র এ পন্থায়ই সম্পাদিত হতে পারে। -এ ছাড়া অন্য কোন পন্থায় নয়। যুগে যুগে নবী-রসূলদের খাঁটি ওয়ারিছ তথা উত্তরাধিকারীরা ঐ একই পন্থায়ই তাদের উক্ত ওরাছাতের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁরা নিজেদের কার্যাবলী দ্বারা আজকের ন্যায় এমনভাবে সমাজের সামনে ইসলামকে তুলে ধরেননি যাতে মনে হতো, ইসলাম শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই পালনীয় বিষয়, -মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসায় শিক্ষিতদের সাথে রাষ্ট্র, সমাজ, দেশরক্ষা, যুদ্ধক্ষেত্র ও শিল্প কারখানায় কর্মরত মেহনতী মানুষ, দেশগড়া ও জাতীয় সমস্যাবলীর নেই কোনো সম্পর্ক।

বলাবাহুল্য, মুসলিম সমাজে ‘ওরাছাতুল আম্বিয়া’ বা নবীদের উত্তরাধিকারীদের এই অনুভূতি যখনই আলেমদের মধ্য থেকে লোপ পায় এবং জনসাধারণ মেহরাব-মিম্বর থেকে নামাজ-রোজা কয়েকটি বিশেষ আনুষ্ঠানিক ইবাদতের ব্যাপারেই শুধু ইমামদের ইমামতী বা নেতৃত্ব পেলেও তাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পেটের সমস্যা, আবাসিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে কোরআন-নির্দেশিত সমাধানের ইমামতি বা নেতৃত্ব থেকে তারা বঞ্চিত হয়, তখনই মানুষ ঐ সকল ব্যাপারে শূন্যতা পূরণের খেয়ালে বিদেশী ও বিজাতীয় মতাদর্শের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের এই পথভ্রষ্টতার জন্যে মূলতঃ কারা দায়ী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের সমাজ এই বিভ্রান্তিরই শিকার।

সুপরিচিত লেখক ও সাংবাদিক মওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী এই উপমহাদেশে যে সব মহান সংগ্রামী আলেম যথার্থ ‘ওরাছাতুল আম্বিয়া’ হিসাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং স্বাধীন ও শোষণহীন ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েমের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে গেছেন, তাদের সংগ্রামী জীবনের বিস্মৃত সেই দিকটিকে সামনে তুলে ধরেছেন। এর ফলে সংক্ষিপ্তাকারে হলেও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আমাদের সামনে আসলো। ইসলামী আন্দোলনের সাথে সক্রিয় সংশ্লিষ্টতার কারণে লেখক নিজেও ইসলামের সংগ্রামী ভাবধারায় বিশ্বাসী। এ বইটির বিন্যাসে তার ছাপ সুস্পষ্ট। লেখকের এ বইটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদেশের আজাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের আন্দোলন ও সংগ্রামকে তিনি মোগল পতন যুগে শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তাধারা থেকে নিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকতার সঙ্গে পাঠক সমীপে তুলে ধরেছেন।

বইখানা সংক্ষিপ্ত হলেও একদিকে যেমন তা ঐতিহ্যবিস্মৃত এক শ্রেণীর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক ও আধুনিক শিক্ষিত যুবকের সামনে “আলেমরা এতদিন কোথঅয় ছিলেন?” –তার সন্ধান দেবে, তেমনি আজকের ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী তরুণ সমাজ, বিশেষ করে ওলামা ও মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে নিজেদের ঐতিহ্য চেতনায় করে তুলবে উজ্জীবিত। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখিত এ বইটির আমি বহুল প্রচার কামনা করি।

-আবদুল মান্নান তালিব

বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও

সম্পাদক –মাসিক পৃথিবী, ঢাকা

তাং ১/৭/৭০ ইং

প্রপ্

প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ
একটি জাতির জীবন অতীতের কীর্তি-কলাপ, শৌর্যবীর্য তার অগ্রগতির পথে আলোর দিশারীরূপে কাজ করে। জাতির আত্ম-প্রতিষ্ঠার সাধনা ও সংগ্রামে অতীত দিনের স্মৃতি যোগায় প্রেরনা। নিজেদের সংগ্রামী অতীতকে চেনা ও জানার জন্য তাই জাতীয় জীবনে ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম। যে জাতি নিজ ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, তাকে পদে পদেই হতে হয় পরাশ্রয়ী। বিজাতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাবধারার শিকারে পরিণত হয়ে ডোর-কাটা ঘুড়ির মতোই মহাশূন্যে ঘুরপাক থেকে হয় তাকে। উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের ইতিহাস এই ভূ-খণ্ডের মুসলমানদের একটি গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস। তৎকালীন মুসলিম শিক্ষিত ব্যক্তি তথা আলেম সমাজই এ আন্দোলনের সূচনা করেন। এবং পুরোভাগে থেকৈ ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এককভাবে এর নেতৃত্ব দেন। তারপরও উপমহাদেশে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাতে সক্রিয়ভাবে তাঁরা জড়িত থাকেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, এক শ্রেণীর লোক নানানভাবে আমাদের বংশধরদেরেকে সেই গৌরবময় ইতিহাস থেকে অন্ধকারে রাখতে চায়।

উপমহাদেশের আজাদ আন্দোলনে এই ভূ-খণ্ডের আলেম সমাজের কি ভূমিকা ছিল, এটা নিয়ে দেশ বিভাগের দীর্ঘ দিন পর কিছু লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, সত্যি কি ব্যাপারটি এমন যে, এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে এটা প্রমাণ করতে হবে? কেননা যে বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট, সেটি কাউকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য হেজাক লাইটের ব্যবস্থা করা বা কারুর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার দরকার হয় না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাই করতে হচ্ছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে পাকিস্তানের কর্ণধারগণ দেশকে সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সকল দিক থেকে এমন চরম বিভ্রান্তির পথে নিয়ে গিয়েছেন, যার ফলে মুসলিম যুবকদের মনে একথা বদ্ধমূল থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় যে, অবিভক্ত ভারতের আলেমগণই ছিলেন উপমহাদেশের মুক্তি-আন্দোলনের পুরোধা, তাঁরাই প্রথমে মুসলমানদের যাবতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী করতে গিয়ে ইংরেজ শাসকদের হাতে অকথ্য জুলুম-নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছিলেন, দ্বীপান্তরে হয়েছিলেন নির্বাসিত। তাঁরাই আঘাতের পর আঘাত খেয়েও সফলতার দুর্জয় আকংখা নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারংবার অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। আর এমনিভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে অক্ষুন্ন রেখেছিলেন ইসলামী প্রেরণা, ইসলাশী শিক্ষা ও সংস্কৃতিবোধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালের মূল প্রতিশ্রুতি ইষলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার কথা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ায় দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাংবাদিকতা-প্রচার মাধ্যম যাবতীয় বাহনের বদৌলতে এমন সব যুবকও সৃষ্টি হয়েছে, যারা আজ ক্ষেত্র বিশেষে স্পষ্টরূপে একথা বলতে দ্বিধা করে না যে, আলেম সমাজই আমাদের সর্বনাশের মূল –এ সমাজের জন্য আলেমদের কোন দান নেই। শুধু তারাই নয়, যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি একমাত্র আলেমদের একক সংগ্রামে রচিত হয়েছিল, এমন কি এর সৃষ্টিতেও অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যে সব আলেমের বিরাট অবদান রয়েছে, সেই দেশের শাসন-মসনদে সমাসীন বিলাস জীবন উপভোগকারী কোন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে পর্যন্ত নির্লজ্জের মতো আলেমদের সমালোচনা করতে দেখা যায়। যদিও শত চিৎকার সত্ত্বেও জাতির নিঃস্বার্থ সেবক আলেমদের জীবন-মান উন্নত করার ব্যাপারে তাদের কোনরূপ মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি।

একটি ষড়যন্ত্র
আজ প্রায় আড়াই যুগ পরেও [১৯৭০ইং] ঐ সকল সংগ্রামী আলেমের জীবনী সহ আমাদের জাতীয় ইতিহাস রচিত হতে পারলোনা কেন? হবে কিনা বলার উপায় নেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও এর পটভূমি রচনাকারী হিসাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে ও পত্র-পত্রিকায় যে সকল ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্য খুটিনাটি বিষয় সহ বিস্তারিত আলোচিত হয়ে থাকে, তন্মধ্যে গুটি কয়েক আলেম ছাড়া অধিকাংশের ব্যাপারে সরকারী পর্যায়ে কেন উপযুক্ত বই-পুস্তক রচিত ও ব্যাপকভাবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে চর্চা হলো না? এটা কি কোন ষড়যন্ত্রের ফল? অবিভক্ত ভারতের নিগৃহীত ও নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তির দিশারী এ সকল ওলাময়ে কেরামের সংগ্রামী জীবন আমাদের যুব-সমাজের সামনে যথাযথ বিদ্যমান থাকলে কিছুতেই আজ এ রূপ প্রশ্ন দেখা দিতে পারতো না, যার ফলে আলেম সমাজের একটি বিরাট অংশও আজ নিজেদের অগ্রপথিকদের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে বিস্মৃত হতো না এবং এদেশ সম্পূর্ণরূপে নিছক বস্তুবাদী শিক্ষিতদের খপ্পরে পড়ে বর্তমানের ন্যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অশান্তি দেখা দিতনা। জাতিকেও আদর্শিক সংঘাতের সম্মুখীন হতে হতো না। স্মরণ রাখা দরকার যে, জাতির শ্রদ্ধেয় পূর্বসূরীদের প্রতি এই অবজ্ঞত পারে।

সব চাইতে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, মুক্তি-সংগ্রামের অগ্রনায়কদের মধ্যেও নিদেন পক্ষে যে কয়েকজন আলেমের নাম ভারত-বিভাগের পর বিশেষভাবে আলোচিত হতে দেখা গেছে, তাদের সম্পর্কে কলম ধরতেও আমাদের আধুনিক লেখকগণ তেমন উদারতার পরিচয় দিতে পারছেন না। উপমহাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সার্বিক স্বার্থরক্ষার জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী নেতা মরহুম মওলানা শাববীর আহমদ ওসমানী সম্পর্কেতো কিছু লেখা হয় না বল্লেই চলে, এমনকি উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃত শহীদে বালাকোট সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরলভী ও তাঁর ত্যাগী সংপিসাথীদের সম্পর্কে লিখতে গিয়েও যেন তাদের কলম এগুতে চায় না। তাঁরই শিষ্য বাংলার শহীদ তিতুমীর অর্থাৎ মওলানা হাজী নেছার আলী যে, ‘মওলানা’ ছিলেন এবং তদানীন্তন কালের একজন ত্যাগী মোজাহেদ ছিলেন, তাঁর এই পরিচয়টি দিতে তাঁরা কার্পণ্য দেখান। অথচ বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের এই আলেম নেতা বাংলার মুসলমান নিয়ে একমাত্র ইসলামের খাতিরে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইংরেজদের সঙ্গে বীরের ন্যায় সংগ্রাম করে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর সংগ্রামী জীবনকে আমাদের সামনে যেভাবে তুলে ধরা হয়, তাতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ, আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী এ যুগের কোনো নেতার ছবিই ভেসে ওঠে। এথেকে এটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এদেশে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সক্রিয়। এই মহলটি ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধকে নষ্ট করার জন্যে যেভাবে অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, তেমনিভাবে ভবিষ্যত বংশধর বিশেষ করে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী যুবকবৃন্দ বিশেষ করে আলেম সমাজও যাতে তাদের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকে, সেই চেষ্টায় তারা নিয়োজিত। অন্যথায় এর কি যুক্তি থাকতে পারে যে, এ পথের সামান্যতম দানও যাদের রয়েছে, তাদের জীবন কাহিনীও তারা যেখানে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় লিখতে পারেন, সেক্ষেত্রে উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের পটভূমি রচনাকারী ও মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণকারী বিশিষ্ট আলেম নেতাগণ তাদের লেখায় স্থান পান না?

এই লুকু চুরিরর মতলব যদি হয় ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করা, এর খেসারত সুদূর ভবিষ্যতে একদিন নিজেদেরকে তো দিতে হবেই –গোটা দেশবাসীকেও দিতে হবে।

সব চাইতে অধিক দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এপথের সর্বস্বীকৃত নেতাদেরকে আজ বিকৃতভাবে আধুনিক তরুণদের সামনে পেশ করার আত্মঘাতি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একথা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পঞ্চাশের দশকের টেক্সট বুক বোর্ডের একটি ইতিহাস পুস্তকে উপমহাদেশের মুসলমানদের জাতীয় চেতনার উৎস সাইয়েদ আহমদ বেরলভী সম্পর্কে এই নির্লজ্জ ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করা হয় যে, তিনি নাকি “সীমান্তবর্তী শিখদিগকে বিব্রত রাখিয়া ইংরেজদের অধিকারকে সুরক্ষিত করিয়াছিলেন”। শুধু তাই নয়, তাঁর মোজাহেদ বাহিনীর সদস্যগণ নাকি “লুটতরাজ (দস্যুবৃত্তি) করে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ সংগ্রহ করিতেন”। এছাড়া তাঁর সংগঠন নাকি ছিলো –“শান্তিভঙ্গকারী দল”। এ থেকে কি এটাই প্রতীয়মান হয়না যে, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অযোগ্যতার সুযোগ নিয়ে তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় শুরু থেকেই ইসলাম বিরোধী ইঁদুরেরা জেঁকে বসেছিল, যারা তলে তলে সুকৌশলে ইসলাম বিরোধী শিষ্য এ দেশে তৈরীতে নিয়োজিত ছিল।

উক্ত আন্দোলনে বাংলাদেশ থেকে যে সকল মুক্তিযোদ্ধা অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাদের নিয়ে আজ আমরা এতদিন যেখানে দলমত নির্বিশেষ সকলে গর্ব করে আসছি এবং এই গোটা বালাকোট আন্দোলনও এসব সংগ্রামী মোজাহেদের প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ৪৭-এর আজাদী আন্দোলন করেছি এবং এখনও যাবতীয় অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি, তাদের সম্পর্কে যদি দেশের অগণিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ ছাত্রকে এরূপ ভ্রান্ত ধারণা দেয়া হয়, তাহলে একে শুধু নিজস্ব ইতিহাসই নয় দস্তুর মতো এদেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গোষ্ঠী বিশেষের ষড়যন্ত্র বলা র্ছাড়া উপায় থাকে কি?

শুধু তাই নয়, টেক্সট বুক বোর্ডের উক্ত পুস্তকটির অপর এক স্থানে ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রদূত মহামনীষী দার্শনিক ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকেও কটাক্ষ করতে বাদ দেয়া হয়নি। পুস্তকটিতে তাঁর সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করা হয় যে, “আহমদ শাহ আবদালীর দিল্লী আক্রমণের পিছনে তৎকালীন ধর্মীয় নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহর আমন্ত্রণই কার্যত দায়ী। তিনি মারাঠা ও শিখ প্রাধান্য সহ্য করিতে পারিতেন না”। অথচ এ কথা ইতিহাস পাঠক মাত্রেরই জানার কথা যে, গাজী আবদালী ঐ সময় মুসলমানদের জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে তাদেরকে শিখ-মারাঠাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যেই এসেছিলেন এবং ঐতিহাসিক পানিপথের সর্বশেষ যুদ্ধে মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে মুসলমানদেরকে বিজয়ের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। শাহ সাবেহের অভিপ্রায়ে যেই মুহুর্তে মোগল প্রশাসনের আমীরুল উমারা নজীবুদ্দৌলা আবদালীকে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন, সে সময় শিখ-মারাঠাদের তরবারীর আঘাতে মুসলমানরা খান খান হচ্ছিল, তাদের জানমালের ছিলনা কোন নিরাপত্তা। তাছাড়া মহাপ্রাণ আহমদ শাহ আবদালী যে ক্ষমতার লিপ্সা নিয়ে যে এ ডাকে সাড়া দেননি তার বড় প্রমাণ হলো, যুদ্ধজয়ের পরক্ষণেই দিল্লীর শাসকদের হাতে তিনি ক্ষমতা চেড়ে দিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

যা হোক, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলাম বিরোধী ছদ্মবেশী মুনাফিকদের এ সব অশুভ তৎপরতা লক্ষ্য করেই দীর্ঘ দিন থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার কথা চিন্তা করে আসছি। কিন্তু তার পূর্বেই সংক্ষিপ্তাকারে উপমহাদেশের আলেমদের সম্পর্কে একখানা ছোট্ট বইয়ের মাধ্যমে তাদের সমাজের সামনে তুলে ধরার জন্যে কিছু সমাজ দরদী মুরব্বীর পক্ষ থেকে তাগিদ আসে। বইখানা সংক্ষিপ্ত হলেও উপমহাদেশে ইষলামী রেনেঁসা থেকে ৪৭-এ স্বতন্ত্র ‘মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা’ পর্যন্ত এতে আলেমদের তৎপরতার একটি যোগসূত্র সুস্পষ্টরূপে পাঠক সমীপে ফুটে উঠবে। আশা করি, বই খানা দ্বারা সমাজের বিশেষ করে নানান বিভ্রান্তির শিকারে নিপতিত এক শ্রেণরি ছাত্র সমাজের মনে আলেম সমাজের অতীত সংক্রান্ত বিভ্রান্তির অপনোদন ঘটবে। এদ্বারা আজাদী ও ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী মোজাহিদদের ত্যাগী জীবনের কিছুমাত্র যদি নতুন বংশধরদের জীবনে রেখাপাত করে এবং বিভ্রান্তির বেড়াজাল মুক্ত হয়ে দেশে একটি জনকল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা ইসলামী আন্দোলনকে সাফল্য মণ্ডিত করতে এগিয়ে আসেন, তা হলে নিজের পরিশ্রম কিছুটা হলেও স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।

-লেখক

সূরা ফাতিহা

بِسمِ اللَّهِ الرَّحمٰنِ الرَّحيمِ

الحَمدُ لِلَّهِ رَبِّ العٰلَمينَ

الرَّحمٰنِ الرَّحيمِ

مٰلِكِ يَومِ الدّينِ

إِيّاكَ نَعبُدُ وَإِيّاكَ نَستَعينُ

اهدِنَا الصِّرٰطَ المُستَقيمَ

صِرٰطَ الَّذينَ أَنعَمتَ عَلَيهِم غَيرِ المَغضوبِ عَلَيهِم وَلَا الضّالّينَ

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

প্রাক-ইংরেজ আমলের ভারত
আজাদী আন্দোলনের সূচনা সম্পর্কিত আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই গোলামীর যুগ ও তার পটভূমি সম্পর্কে একটি জিজ্ঞাসা জাগে। এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে গিয়ে ইতিহাস থেকে আমরা এটাই জানতে পারি যে, তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত-ভিত্তিক ইসলামী জীবনধারা থেকে বিচ্যুতির ফলে যেমন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানরা দুর্বল ও বিদেশী দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি হিমালয়ান উপমহাদেশেও তারা মোগলপতন যুগে প্রথমে শিখ-মারাঠা কর্তৃক পির্যস্ত ও পরে ইংরেজদের দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের পর থেকেই উপমহাদেশের মুসলমানদের শাসন ক্ষমতায় পতনের সূচনা ঘটে। আওরঙ্গজেবের তিরোধানের পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে যারা দিল্লীর মসনদে আসীন হয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বল শাসক। ধর্মীয়, চিন্তাগত, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বন্ধ্যাত্ব এবং পতন দেখা দিয়েছিলো তা রোধ করার মতো ক্ষমতা তাদের মোটেই ছিল না”। কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগণ নিজেদেরকে নামেমাত্র দিল্লীর অধীন বলে প্রকাশ করলেও কার্যতঃ ঐসব আঞ্চলিক শাসক স্বাধীন শাসনকর্তা হিসাবেই সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ শাসন করতেন।

উপমহাদেশের মুসলিম শাসন ক্ষমতার এ দুর্বলতা লক্ষ্য করেই বণিক হিসাবে আগত ইংরেজরা এদেশের শাসক হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরিণামে, ঘরের ইঁদুরদের কারণে পলাশীযুদ্ধে ইংরেজদের হাতে মুসলমানদের বিপর্যয় ঘটে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করে। এভাবে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের যুদ্ধে বাংলা দখল করার মধ্য দিয়েই ইংরেজদের সেই স্বপ্নসাধ পূর্ণ হতে থাকলো। পলাশী যুদ্ধের পর দিল্লী কেন্দ্রকে লক্ষ্যস্থল স্থির করে তারা ধীরে ধীরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। একের পর এক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন মুসলিম অমুসলিম শাসকদের স্বাধীন রাজ্যগুলোকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করলো।

১৭৯৯ খৃঃ শাহওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ এবং ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতাযুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ মহীশূরের বীর সুলতান টিপুকে ইংরেজরা পরাজিত ও হত্যা করলো। সর্বশেষ সম্রাট শাহ আলমকে জায়গীর হিসাবে লাল কেল্লা ছেড়ৈ দিয়ে ১৮০৫ খৃঃ দিল্লী হস্তগত করে ইংরেজরা সমগ্র ভারতে নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করলো।

কয়েকটি জিজ্ঞাসা

ইতিহাসের কোন ঘটনাই সম্পর্কহীন নয়। কার্যকারণ পরম্পরার ফলেই ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়। বস্তুতঃ এ কারণেই দেখা যায়, বাংলা পাক-ভারত উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের সাথে ১৭৫৭, ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবীল পরস্পর ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত। সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের প্রথম উত্তরাধিকারীদের যুগ থেকে এ জাতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিয়োগান্ত ঘটনা তাদের জন্য প্রথম বাস্তব ও বেদনাদায়ক আঘাত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। তার পরবর্তী কালে ১৮৫৭ ও ১৯৪৭ সালের ঘটনাদ্বয় ছিল উপমহাদেশে মুসলিম পুনর্জাগরণের বাস্তব ফলশ্রুতি।

কিন্তু এই পুনর্জাগরণ কার চিন্তার ফসল ছিল? উপমহাদেশে ইসলামী রেঁনেসার বীজ মুসলমানদের চিন্তা ও মগজে কে বপন করেন? হতোদ্যম পরাজিত মুসলিম জাতি এ চেতনা ও অনুপ্রেরণা কোত্থেকে পেয়েছিলো, যদ্দরুন ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ইংরেজ রাজ-শক্তির বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্যে রুখে দাঁড়িয়েছিল? তার পূর্বে ১৮৩১ সালে কোন অনুপ্রেরণা তাদের বালাকোটের রণাঙ্গণে ছুটে যেতে পাগল করে তুলেছিলো এবং কোন যাদুপ্রেরণা এই রণক্লান্ত ভগ্নহৃদয়ের মুসলমানদেরকে পুনরায় বলবীর্য ও শক্তি-সাহসে উজ্জীবিত করে ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের শেষ বিজয়ের আগ পর্যন্ত সংগ্রামে অটল রেখেছিলো? –এ সব বিষয় আজ ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা ও তরুণ সমাজের কাছে তুলে ধরার সময় এসেছে। সময় এসেছে অবিভক্ত ভারতকে দ্বিখন্ডিত করে মুসলমানরা কোন দুঃখে উপমহাদেশে নিজেদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাধ্য হয়েছিল। যার একাংশ পরে স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে গঠিত হয়। এজন্যে সৃষ্ট আন্দোলনের সঠিক পটভূমি জাতির সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরা এবং এরই আলোকে সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে ভ্রান্তি সৃষ্টিকারী ফাঁস করা একান্ত্র প্রয়োজন।

অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র নিরাশার কালছায়া নেমে এলো
আলেমগণই আজাদী আন্দোলনে এগিয়ে এলেন

কোনো জীবনের ত্যাগ, শ্রমসাধনা ও সংগ্রাম ছাড়া আসে না। বিশেষ করে জাতীয় জীবনের সফলতার ক্ষেত্রেতো কোনো অবস্থাতেই নয়। তেমনিভাবে ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশের আজাদীও বিচ্ছিন্ন কোনো আন্দোলনের ফলে আসেনি। তার পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ত্যাগ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ত্যাগ-সংগ্রামই ধীরে ধীরে গোটা অবিভক্ত ভারতের আজাদীর পথকে প্রশস্ত করেছিলো। আর পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, সেই সংগ্রামের পুরোভাবে ছিলেন তৎকালীন মুসলিম সমাজের শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ আলেম সমাজই।

১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ইংরেজরা দিল্লীর শাসক সম্রাট শাহ আলমকে লাল-কেল্লা, এলাহাবাদ ও গাজীপুরের জায়গীর ছেড়ে দেয়। কিন্তু উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ক্ষমতার শেষবিন্দুটি পর্যন্ত মুছে দেয়ার পূর্বেই ইংরেজগণ সমগ্র ভারতে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। সারা দেশে আলেম ও গায়ের আলেম সুধী সমাজের মধ্যে প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেয়ার সাহস এমন কারও ছিল না যে, -বিদেশীর শাসনাধীন ভারত হচ্ছে ‘দারুল হরব’ যেখানে জেহাদ করা প্রতিটি খাঁটি মুসলমানের কর্তব্য। সর্বত্র নৈরাশ্যের কাল ছাড়া ঘনীভূত হয়ে এসেছিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন সকল শ্রেণীর মুসলমান। ইংরেজগণ উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ়তর করার জন্য এবং পাশ্চাত্য শাসকজাতি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যমুখী ও হীনমনা করে গড়ে তোলার জন্যে গভীর পরিকল্পনায় নিয়োজিত ছিলো। তারা অমুসলিম এবং মুসলমানদের থেকেও কিছু সংখ্যক লোককে ইতিমধ্যেই হাত করে নিয়েছিল। মুসলমান জাতির জন্যে ঐ সময়টি ছিল এক কঠিন পরীক্ষার।

মওলানা শাহ আবদুল আজীজের বিপ্লবী ফতওয়া

ঠিক এ সময়ই ‘ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনে’র প্রধান নেতা ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী এক বিপ্লবী ফতওয়া প্রচার করে এই হতোদ্যম জাতিকে পথের সন্ধান দেন এবং তাদেরকে ইসলামের জেহাদী প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হবার আহবান জানান। শাহ আবদুল আজীজ তাঁর পিতা মহামনীষী ও ইসলামী রেনেঁসার উদগাতা হযরত শাহ ওয়ালী-উল্লাহ দেহলভীর তিরোধানের পর (১৭৬৭ খৃঃ) থেকে দিল্লীর রহিমিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ওয়ালীউল্লাহ চিন্তাধারার প্রচার, জনসংগঠন প্রভৃতির মাধ্যমে “তারগীবে মুহাম্মদী” নামে ইসলামী পুনর্জাগরণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই নির্ভীক মোজাহিদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ফতোয়ার মাধ্যমে ঘোষণা করলেন যে, -

“এখানে (ভারতে) অবাধে খৃষ্টান অফিসারদের শাসন চলছে, আর তাদের শাসন চলার অর্থই হলো, -তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণ বিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স, ওশর, ব্যবসায়গণ্য, চোর-ডাকাত-দমনবিধি, মোকদ্দমার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রভৃতিকে (যেমন –সিভিল, ফৌজ, পুলিশ বিভাগ, দীওয়ানী ও ফৌজদারী, কাস্টমস ডিউটি ইত্যাদিতে) নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যাপারে ভারতীয়দের কোনই অধিকার নেই। অবশ্য এটা ঠিক যে, জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ, আজান, গরু জবাই –এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিধানে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে না। কিন্তু এগুলোতো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা; যে সব বিষয় উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং স্বাধীনতার মূল (যেমন –মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমূহ বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা খতম করে দেয়া হয়েছে। এমন কি মুসলমান হোক কি হিন্দু-পাসপোর্ট ও পারমিট ব্যতীত কাউকে শহরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দানও দেশের স্বার্থে কিংবা জনগণের নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থেই দেওয়া হচ্ছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন সুজাউল-মুলক, বেলায়েতী বেগম প্রমুখ ইংরেজদের অনুমতি ছাড়া বাইর থেকে প্রবেশ করতে পারছেন না। দিল্লি থেকে কলকাতা পর্যন্ত তাদেরই আমলদারী চলছে। অবশ্য হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার সরাসরি নাছারাদের আইন সেখানে চালু নেই। কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরই ‘দারুল হরবের-ই হুকুম বর্তায়”। -ফতওয়ায়ে আজীজী (ফারসী), ১৭ পৃঃ মুজতাবীয়া প্রেস।

এ ভাবে শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী অন্য একটি ফতওয়ার মাধ্যমে ভারতকে ‘দারুল হরব’ “শত্রুদেশ” বলে ঘোষণা করেন। ফতওয়ার ভাষায় ‘দারুল হরব’ পরিভাষা ব্যবহারের মূল লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক ও স্বাধীন সংগ্রামের আলো প্রজ্জ্বলিত করা। যার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, -“আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা খৃষ্টানদের হাতে, তারা ধর্মীয় মূল্যবোধকে হরণ করেছে। কাজেই প্রতিটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হলো বিদেশী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে এখন থেকে নানানভাবে সংগ্রাম করা এবং লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখা”।

ইসলাম বিরোধী ফতওয়ার প্রতিক্রিয়া

সাধারণ মুসলমানগণ এযাবত ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতাপের সামনে নিজেদেরকে অসহায় মনে করতেন এবং নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। এ ফতওয়া প্রকাশের পরই মুসলমানরা কর্জনীতি নির্ধারণের পথ খুঁজে পায়। শাহ আবদুল আজীজ দেহলভীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও তাঁর বিশিষ্ট ছাত্রবৃন্দ দ্বারা উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর মুসলমানদের নিকট এই বিপ্লবী ফতোয়ার বাণী প্রচারিত হয়। আর এমনিভাবে মুসলমানদের মনে ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদী ভাব জাগ্রত হতে থাকে।

পরবর্তীকালে দেখা যায়, শাহ আবদুল আজীজেরই শিষ্য সাইয়েদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে এবং তাঁর জামাতা মওলানা আবদুল হাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র মওলানা ইসমাইল শহীদের সেনাপতিত্বে (আনুঃ ১৮১৭ খৃঃ) বিরাট মোজাহেদ বাহিনী গঠিত হয়। এই মোজাহেদ বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ছিলো খাটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী (শিখ ও ইংরেজ)দের বিরুদ্ধে জেহাদ করা। তাঁরা এ উদ্দেশ্য পূর্ব-ভারত কিংবা দক্ষিণ অথবা উত্তর ভারতে কোন স্থানে নিরাপদ মনে না করে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পেশোয়ার-কাশ্মীর এলাকায় নিজেদের কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের এ আন্দোলন ও সংগ্রামে উপমহাদেশের পূর্ব সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ, (কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, মোমেনশাহ প্রভৃতি) থেকেও মুসলমানরা যোগদান করেছিল।

বাংলাদেশে সাড়া জাগলো

শাহ আবদুল আজীজের এই ইসলামী আন্দোলন ও উক্ত ফতওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশেও বিপুল সাড়া জেগেছিলো। যার ফলে ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে এখানে ফরিদপুরের জাহী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলনের নামে এক শক্তিশালী ইসলামী আন্দোলন গড়ে ওঠে। তার সামান্য কিছুদিন পরেই মোজাহেদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাংলার মওলানা তীতুমীর (হাজী সাইয়েদ নেসার আলী) ও তাঁর সঙ্গীরা এখানে বহু স্থানে ইংরেজদের সংগে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। মওলানা তিতুমীর ছিলেন ‘শহীদে বালাকোট’ সাইয়েদ আহমদ শহীদের একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি ১৮৩১ খৃঃ সাইয়েদ সাহেব যে সালে বালাকোটে শাহাদাত বরণ করেন ঐ সালেই ইংরেজ দোসরদের সংগে জেহাদে শহীদ হন।

ফরায়েজী আন্দোলনের শেষের দিকে মওলানা কারামত আলী জৈনপুরীও সাইয়েদ আহমদ শহীদের শিষ্য হিসাবে বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শ প্রচারে বিরাট কাজ করেন। বাংলা দেশে মুসলমানদের জীবন থেকে হিন্দুয়ানী তথা বিজাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব দূরীকরণ ও এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে মওলানা আলী জৈনপুরীর অসামান্য দান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মূলতঃ এ কারণেই এখনও বাংলার প্রতিটি মানুষ “হাদিয়ে বাঙ্গাল” মওলানা কারামত আীল জৈনপুরীকে অতি ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করে।

সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর আন্দোলন

মোজাহেদ বাহিনীর নেতা সাইয়েদ আহমদ শহীদ জেহাদের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে তাঁর শত শত কর্মীকে নিয়ে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে পবিত্র হজ্জ পালনের লক্ষ্যে মক্কা শরীফ গমন করেন। ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে ফিরে তিনি ইসলামী আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁর দলের প্রতিটি মোজাহিদকে তিনি ইসলামের সোনালী যুগের আন্দোলনের কর্মী সাহাবীদের আদর্শে গঠন করতে চেষ্টা করেন। তাদের রাত্রদিনের কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো ভোরে প্রচারকার্য, দিবা ভাগে দৈনিক কঠোর পরিশ্রম, রাত্রির একাংশে তাহাজ্জুদ ও ইবাদতে জাগরণ –এসব ছিলো এই খোদাভক্তদের দৈনন্দিন সাধারণ কর্মসূচী। ইসলামের খাঁটি গণতান্ত্রিক নিয়মে তারা মসজিদ চত্বরে মেঝেয় সকলে সম্মিলিতভাবে খানাপিনা করতেন।

প্রস্তুতি পর্বে সাইয়েদ সাহেব দেশের প্রভাবশালী মুসলমানদের সাথেও যোগাযোগ করেন। নবাব সোলায়মান জা’কে লিখিত তাঁর একটি পত্র পাওয়া যায়। ঐ পত্র থেকে তাঁর আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। পত্রটি হলো –“আমাদের দুর্ভাগ্য, হিন্দুস্থান কিছুকাল হয় খৃষ্টানদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম নিপীড়ন শুরু করেছে। বেদআ’তে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী আচার-আচরণ ও চালচলন প্রায় উঠে যাচ্ছে। এসব দেখে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। আমি জেহাদ অথবা হিজরত করতে মনস্থির করেছি”।

সাইয়েদ আহমদের নেতৃত্বে সেনারা এগিয়ে চল্লো

সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী বেশ হৃদয়ঙ্গম করছিলেন এবং বারবার প্রচার করছিলেন যে, প্রকৃত মুসলিম সমাজ সংগঠন করতে হলে শক্তি ও রাজ্য প্রতিষ্ঠার দরকার। তিনি এই উদ্দেশ্য সীমান্তে কাজ শুরু করেন যে, আন্দোলনের কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে শত্রু থেকে দূরে একটি স্বাধীন এলাকার দরকার। তাছাড়া তিনি ভেবেছিলেন, সীমান্তের যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলো তাঁর সহায়খ হবে।

এভাবে অবিভক্ত ভারতের সর্বত্র জেহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা শেষ করে সাইয়েদ আহমদ ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে রায়বেরিলী ত্যাগ করেন। সাইয়েদ সাহেবের সঙ্গে এ সময় মোহাজিদের সংখ্যা ছিলো ১২ হাজার; অল্প দিনের মধ্যেই তা এক লক্ষে উন্নীত হয়। তারা গজনী কাবুল ও পেশোয়ারেরপথে নওশেরায় হাজির হলে পর শিখদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। উল্লেখ্য, শিখগণ ঐ সময় রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে আধিপত্য বিস্তার করে মুসলমানদের উপর অকথ্য জুলুম অত্যাচার চালাচ্ছিল। এ অত্যাচারের পেছনে ইংরেজদেরও উস্কানি ছিলো। যা হোক, উক্ত সংঘর্ষে মাত্র ৯ শত মোহাজিদের সাথে বিপুল সংখ্যক শিখ সৈন্য পরাজয় বরণ করলো। সারা সীমান্ত প্রদেশ মুজাহিদদের প্রশংসা মুখর হয়ে উঠলো। কিছুদিন পর শের সিংহ ও জনৈক ফরাসী জেনারেলের অধীন প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্য পুনরায় মুজাহিদদের মোকাবেলা করতে আসে। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী এগিয়ে আসলে শিখরা পনজতারে পিছু হটে যায় এবং সেখান থেকে খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। মুজাহিদদের এই বিরাট সাফল্য জনগণের উপর মস্তবড় প্রভাব বিস্তার করে।

পেশোয়ার অধিকার

পেশোয়ারবাসী সাইয়েদ আহমদকে সামগ্রিকভাবে শিখদের উপর হামলা করতে আবহান জানায়। ঐ সময় গরহিমাজির দশ হাজার যুদ্ধপ্রিয় লোক সরওয়ার জা’য় অধীন সাইয়েদ সাহেবকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। মোজাহিদদের সংখ্যা তখন সর্বমোট এক লক্ষ্যে উপনীত হয়। এদিকে রণজিৎ সিংহ কতিপয় মুসলিম সরদারকে হাত করার জন্যে মুক্ত হস্তে অর্থ বিলি শুরু করলো এবং আর নানাভাবে তাদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা চালালো। শেষ পর্যন্ত মোজাহিদ বাহিনীকে তিনটি শক্তির মোকাবেলা করতে হলো –শিখ, পেশোয়ারের বিশ্বাসঘাতক সর্দারবৃন্দ এবং খুবী খাঁ। বালাকোটের লড়াইর সবগুলোতেই শিখরা মুজাহিদদের হাতে পরাজিত হয়। সাইয়েদ সাহেবের এক পত্র থেকে জানা যায় যে, শেষ পর্যায়ে মোজাহিদদের সংখ্যা ৩ লক্ষ্যে গিয়ে উপনীত হয়েছিল। সাইয়েদ সাহেব ও তাঁর বাহিনী, রণজিৎ সিংহের সুশিক্ষিত খালসা বাহিনীকে পরাজিত করে পেশোয়ার অধিকার করে নেন (১৮৩০ খৃঃ)।

ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

অতঃপর তিনি কাশ্মীরে প্রধান ঘাটি স্থাপন করতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু আম্বের পায়েন্দা খাঁ বাধা দিতে চেষ্টা করলে মোজাহিদ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ শাহ ইসামইল আম্ব অধিকার করেন এবং সেখানে প্রধান ঘাটি স্থাপন করেন। আম্ব থেকে মর্দান পর্যন্ত বিশাল এলাকায় তাঁর অধিকার স্বীকৃত হলো। সাইয়েদ আহমদ সেখানে ইসলামী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করলেন। তিনি অধিকৃত এলাকায় মওলানা সাইয়েদ মযহার আলীকে কাজী (বিচারক) নিযুক্ত করলেন এবং প্রশাসনিক দায়িত্বভার অর্পণ করলেন কাবুলের আমীর দোস্ত মুহাম্মদের ভ্রাতা সুলতান মুহাম্মদের উপর।

 

ইংরেজ ও বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রঃ শাহাদাতে বালাকোট
নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সাইয়েদ আহমদ পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজ কবলিত সাবেক ‘দারুল ইসলাম ভারত’ পুনরুদ্ধারের জন্যে আরও অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, কিন্তু অপর দিকেও যুদ্ধে পরাজিত রণজিৎ সিংহ প্রতিশোধ গ্রহণে তৈরী হচ্ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে রণজিৎ শঠতার আশ্রয় নিলেন। অর্থের লোভ দেখিয়ে সীমান্তের পাঠান ও উপজাতীয়দেরকে সাইয়েদ আহমদের দলছাড়া করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন। সাইয়েদ আহমদ ছিলেন কুসংস্কার-বিরোধী। ফলে এ সব পাঠান ও উপজাতীয় লোকদের কেউ কেউ অর্থ লোভে বা কুসংস্কার বশতঃ অকপটে এ আন্দোলনকে গ্রহণ করতে পারেনি। অপর দিকে ইংরেজরাও এই উদীয়মান শক্তি সম্পর্কে ছিলো শঙ্কিত। তারা ঐ সময় ভারতের ঐ অঞ্চল নিয়ে তত মাথা না ঘামালেও শিখদের দ্বারা মুজাহিদদের নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মোজাহিদ বাহিনী এবার দ্বিমুখী ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়ে পড়লো। উপজাতীয় অনেক পাঠান সরদার শিখদের অর্থলোভ সম্বরণ করতে না পেরে সাইয়েদ আহমদের দল ত্যাগ করলো। অপর দিকে উপজাতীয়দের অনেকে সাইয়েদ আহমদের কুসংস্কার বিরোধী কাজে তাঁর প্রতি অহেতুক অশান্ত হয়ে পড়ে। তারা যেসব বেদআত কাজে লিপ্ত ছিল, মোজাহিদ নেতা সে সবের বিরুদ্ধাচরণ করতেন। কিন্তু তাতেও সংগ্রামী সাইয়েধ আমদ হতোদ্দম না হয়ে ন্যায় ও সত্যের কাজকে সমুন্নত রাখতে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করতে থাকলেন। যুগপৎভাবে বেদআত শির্কের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে যেতে লাগলেন। অনেকের মতে কৌশল গত কারণেই সাইয়েদ সাহেবের ঐ সময় এ থেকে বিরত থাকা সঙ্গত ছিল। কিন্তু তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে নিজের কাজ করেই যান। অতঃপর বিশ্বাস ঘাতকরাসহ প্রতিপক্ষ বাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাতেও তিনি ভীত না হয়ে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বালাকোট নামক স্থানে শিখদের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ও মওলানা শাহ ইসমাইল দেহলভী শাহাদাত বরণ করেন। -(১৮৩১ খৃঃ)

বালাকোটের মুক্তিযোদ্ধারা দমে যাননি
মওলানা বেলায়েত আলী ও মওলানা এনায়েত আলীর আন্দোলন

বালাকোট যুদ্ধে মোজাহিদ বাহিনীর নেতৃবৃন্দের শাহাদাত বরণের পর তাঁদের অনেকেই সীমান্তের ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় (আস্তানা-শিবির) সাইয়েধ সাহেবের বিশ্বস্ত খলীফাদের নেতৃত্বে সমবেত হন। উল্লেখ্য যে, সাইয়েদ সাহেব তাঁর শাহাদাতের পূর্বে নিজেই বালাকোটের রণাঙ্গণ থেকে তাঁর বিশিষ্ট খলীফা মওলানা বেলায়েত আলী আজীমাবাদীকে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের উপকরণ সংগ্রমের কাজে নিয়োজিত থাকতে পাঠিয়েছিলেন। বালাকোটের মর্মান্তিক খবর প্রাপ্তির সময় মওলানা বেলায়েত আলী ছিলেন হায়দ্রাবাদে। এ ছাড়া ঐ সময় সাইয়েদ সাহেবের অপর যে একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন, তিনি হলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী। তিনি বালাকোট ঘটনার সময় মোজাহেদ রিক্রুটিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন মাদ্রাজে। আজাদী সংগ্রামের মহা নায়কের শাহাদাতের খবরে সাময়িখ ভাবে তাঁরা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলেও হতোদ্দম হননি।

এ ঘটনার পর মওলানা বেলায়েত আলী তাবলীগ ও জেহাদের নতুন কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। তাঁর ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলা দেশে পাঠান। মওলানা জয়নুল আবেদীন ও মওলানা মুহাম্মদ আলী হায়দ্রাবাদে কাজ করে যান। এ ভাবে অন্যান্য সহচর ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে তিনি ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন। মওলানা বেলায়েত আলী পাটনায় দু’বছর অবস্থানের পর অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকল্পে মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে হজ্জ সমাধা করে ইয়ামত, নজদ, আসীয়, মাসকাত, হাজরামাউত প্রভৃতি রাজ্য সফর করে প্রায় দু’বছর পর কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সফর করে ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে সাথে করে পাটনা চলে যান। বিদেশ সফর প্রত্যাগত মওলানা বেলায়েত আলী দ্বিতীয় বার জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলার পরিবর্তে ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় প্রেরণ করেন। মওলানা এনায়েত শিখ প্রধান গোলাব সিংহের সংঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ তিন বছর কাল স্থায়ী থাকে। এ দিকে মওলানা বেলায়েত আলী তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মওলানা ফরহাত হোসাইনকে পাটনাস্থ কেন্দ্রে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে তিনি মওলানা ফাইয়াজ আলী, মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা আকবর প্রমুখকে নিয়ে বালাকোটে যুদ্ধরত মওলানা এনায়েত আলীর সঙ্গে মিলিত হন। মওলানা বেলায়েত আলী সেখানে গিয়ে পৌঁছুলে তাঁকেই আমীর নিযুক্ত করে ইংরেজ দোসরদের বিরুদ্ধে জেহাদ চলতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বাধীনও দীর্ঘ দেড় বছর বালাকোট কেন্দ্রিক জেহাদ চলে এবং বহু এলাকা বিজিত হয়।

ইংরেজ সরকারের হস্তক্ষেপ

এ অবস্থা দেখে ইংরেজ সরকার প্রমাণ গুনল যে, শিখদের পরাজিত করেই মোজাহিদগণ তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। তাই শিখদের সাথে পূর্বে সম্পাদিত এক সামরিক চুক্তির ছুতা ধরে ইংরেজরা মওলানা বেলায়েত আলীকে এক নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে, শিখ প্রধান গোলাব সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে ইংরেজ সরকার তাদের সঙ্গেই যুদ্ধ বলে বিবেচনা করে। এর কয়েক দিন পরেই ইংরেজ সরকার মোজাহিদদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনী প্রেরণ করে এবং তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। ইংরেজগণ মোজাহিদ বাহিনীর বড় পৃষ্ঠপোষক সীমান্তের সাইয়েদ জামেন শাহ ও অন্যান্য স্থানীয় বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিকে অর্থলোভ দেখিয়ে ও নানান কৌশলে হাত করে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরায়। এতে নানা চক্রান্তের শিকার হয়ে মুজাহিদরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আর্থিক উপকরণ সরবরাহ ও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। মুজাহিদদের শক্তি ও অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হয়। পরিশেষে এক পর্যায়ে মোজাহিদদের গ্রেফতার করা হয় এবং মুজাহিদ নেতা মওলানা এনায়েত আলী পুনরায় বাংলাদেশে তাবলীগ ও সাংগঠনিক কাজে চলে আসেন। সাময়িকভাবে একশো মুজাহিদ সোয়াতে আত্মগোপন করে থেকে যান।

পুনরায় জেহাদ

দু’বছর পর ছাড়া পেয়ে মওলানা বেলায়েত আলী পুনরায় বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ভ্রাতা মওলানা এনায়েত আলী ও অন্যান্য অনুগামী মোজাহিদদের নিয়ে আবার ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় গিয়ে পৌঁছেন। সাইয়েদ আকবর শাহ ও অন্যান্য মোজাহিদ তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকেও মোজাহিদগণ এখানে আসতে শুরু করেন। মওলানা এনায়েত আলীর সেনাপতিত্বে ইংরেজ তাবেদার আম্বের শাসনকর্তার সঙ্গে পুনঃরায় জিহাদ শুরু হয়। ঐ সময়ই (১২৬৯ হিঃ) মওলানা বেলায়েত আলীর ইন্তেকাল হয় এবং তাঁর স্থানে মওলানা এনায়েত আলী আমীর নিযুক্ত হন। কিন্তু তীব্র প্রতিকূলতা সৃষ্টি হওয়ায় সীমান্ত এলাকায় মুজাহিদদের জেহাদী তৎপরতা শেষের দিকে বন্ধ হয়ে গেলেও মুজাহিদ সংগঠনটি বহাল থেকে যায়।

১৮৫৭ সালের বিপ্লবের সময় বৃটিশ ভারতের বাইরে সীমান্তের ইয়াগিস্তানে মোজাহিদদের নেতৃত্বে ছিল মওলানা এনায়েত আলীর হাতে এবং ভারতের অভ্যন্তরে এ বিপ্লবের মূল নেতৃত্ব দেন ভারতস্থ মোজাহিদ নেতা মওলানা ইয়াহইয়া আলী। মওলানা ইয়াহইয়া আলী ঐ সময় পাটনাস্থ মোজাহেদ কেন্দ্র থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে জেহাদের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর পরোক্ষ নেতৃত্বেই গোটা ভারতের অভ্যন্তরে মোজাহিদদের আন্দোলনে ৫৭-র বিপ্লব প্রচণ্ডরূপ ধারণ করে।

১৮৫৮ খৃঃ মওলানা এনায়েত আলীর ইন্তেকালের পর সীমান্তে জেহাদরত মোজাহিদদের নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে মওলানা আবদুল্লাহ, মওলানা আবদুল করীম (১৯১৫ খৃঃ ফেব্রুয়ারী) ও মওলানা নেয়ামতুল্লাহ। উল্লেখ্য যে, মওলানা আবদুল করীম পর্যন্তই মওলানা এনায়েত আলী ও বেলায়েত আলীর প্রত্যক্ষ ট্রেনিং প্রাপ্ত মোজাহিদদের যুগ ছিল। মওলানা নেয়ামতুল্লাহ ১৯১৫ খৃঃ ফেব্রুয়ারী মাসে আন্দোলনের আমীর বা নেতা নিযুক্ত হন। অনেকের মতে তিনিই ছিলেন মোজাহিদ আন্দোলনের শেষ আমীর। ভারত বিভাগ পর্যন্ত মোজাহিদদের এ আন্দোলন টিকে ছিল। তবে উপমহাদেশ স্বাধীন হবার পর এ আন্দোলনের একদিকের আবশ্যকতা বাকি না থাকলেও আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এদেশ ইসলামী হুকুমাত কায়েমের আবশ্যকতা ফুরায়নি বলে তারা দলের মধ্য হতে পরেও একের পর একজনকে আমীর নিযুক্ত করে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্পগত পূর্ব ঐতিহ্য বজায় রাখেন। শোনা যায়, এরপর মওলানা রহমতুল্লাহ পর্যায়ক্রমে আমীর নিযুক্ত হন।

বলা বাহুল্য,সীমান্তকে কেন্দ্র করে পরিচালিত আলেমদের এই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য বৃটিশ ভারতের শাসকদেরকে বাজেটের এক বিরাট অংশ ব্যয় করতে হতো। মওলানা ইয়াহইয়া আলীর নেতৃত্বাধীনে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রচণ্ডতা কি ছিল, তা বিস্তারিত জাতার জন্য এ আন্দোলনের ঘোর বিরোধী স্যার উইলিয়াম হান্টারের “দি ইন্ডিয়ান মুসলমান” গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য। মুসলিম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও হান্টার সাহেবের পক্ষে এসব বাস্তব ঘটনাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি

বালাকোটের সাময়িক ব্যর্থতা নেতৃবৃন্দের শাহাদাত ও পরবর্তী পর্যায়ে মোজাহিদ বাহিনীর উপর ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও এই সংগ্রামী বাহিনীর কর্মীরা নিশ্চুপ বসে থাকেননি। তাঁরা বিভিন্নভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা-আদর্শ প্রচার ও ইংরেজ বিরোধী ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। শাহ আবদুল আজীজ কর্তৃক প্রচারিত সেই ‘দারুল হরবের ফতওয়া’ এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁর অনুসারীগণ কর্তৃক স্বল্পকালস্থায়ী ‘ইসলামী রাষ্ট্র গঠন’ ও ‘বালাকোটের লড়াই’ এবং উক্ত লড়াইয়ের পর কর্মীদের বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে ইংরেজ-বিরোধী ভাব জাগ্রত করা –এই সব কিছুই ঐতিহাসিক ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছে –যার সূচনা করেছিলেন শূকরের চর্বিমিশ্রিত বন্দুকের টোটা ব্যবহার ইত্যাদিকে উলক্ষ্য করে বেরাকটুরের মুসলিম সৈনিকগণ। এ বিপ্লবকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করলেও মূলতঃ সেটাই ছিলো হিমালয়ান উপমহাদেশে প্রথম বলিষ্ঠ আজাদী আন্দোলন এবং অবিভক্ত ভারত থেকৈ ইংরেজদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে তাদের প্রতি এক প্রচণ্ড আঘাত।

কিন্তু ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, এক শ্রেণীর লোকের বিশ্বাসঘাতকতা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, অনৈক্য ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের এ বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ বিপ্লবের নায়ক ছিলেন একমাত্র মুসলিম আলেম সমাজই, যা কোনো কোনো হিন্দু নেতা ও ইংরেজ লেখক হান্টারও তথ্যাবলী সহকারে লিখে গেছেন।

বিপ্লবে জড়িত শত শত আলেমের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা

মওলানা এনায়েত আলী, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী, মওলানা সাখাওয়াত আলী, সাইয়েদ আহমদ তাহের, শাহ মাযহার আলী, চট্টগ্রামের সুফী নূর মুহাম্মদ, মোমেনশাহীর শেখ গোলাম আলী, কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ, সাইয়েদ মুহাম্মদ ইয়াকুব, শেখ হামদানী, মওলভী ওয়াজুদ্দীন, মওলানা নেজামুদ্দীন দেহলভী, সাইয়েধ নাসের আলী, মিয়া ইহসান উল্লাহ, শেখ মুয়াজ্জেম, হাকীম মুগীসুদ্দীন, মুনাওয়ার খান, সাইয়েদ মুরতজা হোসাইন, মওলানা মুহাম্মদ আলী দেহলভী, মওলানা ফসীত গাজীপুরী, সাইয়েদ আবদুল বাকী, মওলানা আবদুল হাই, মওলানা মুফতি এনায়েত আহমদ, শাহ আহমদ সাঈদ, ঢাকার মওঃ আজীমুদ্দীন, কুমিল্লার মওলানা আশেকুল্লাহ ও বরিশালের মওঃ আমীনুদ্দীন।

মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী ও মওলানা খায়রাবাদী বিপ্লবের ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত হন। এ দণ্ডাদেশ শুনে তাঁরা ‘সাক্ষাত জান্নাতে পৌঁছার সুযোগ লাভে’ আনন্দ প্রকাশ করায় ইংরেজ সরকার তাদেরকে সুযোগ থেকে ‘বঞ্চিত’ করার উদ্দেশ্যে আন্দামানে নির্বাসিত করেন।

আলেমদের বিপ্লব উত্তর ভূমিকা

১৮৫৭ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর গোটা উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে সবচাইতে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে। হিন্দুরা ইতিপূর্বেই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি ও মুসলিম বিদ্বেষ হেতু ইংরেজদের চাটুকারিতায় লেগে গিয়েছিল। ইংরেজদের আশঙ্কা ছিলো একমাত্র সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকেই –যাদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব তাদেরকে মুসলমানদের ব্যাপারে অধিক সতর্ক করে দেয়। তাই মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের ন্যায় তাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনও সংকীর্ণ ও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে –যাবতীয় অধিকার থেকে তাদের করা হয় বঞ্চিত। ইংরেজগণ বিপ্লবের জন্যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই দায়ী করে তাদেরই ওপর জুলুম-নির্যাতনের চরম স্টিম রোলার চালাতে থাকে। বিপ্লবের নায়ক আলেমগণ ও সাধারণ মুসলমান এজন্যেই ইংরেজদের রোষাণলে পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেন, কেউ মাল্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন, কেউ দীর্ঘকাল যাবত কারা-অন্তরালে আঁধার কক্ষে তিলে তিলে ক্ষয় হন। (১৮৬৩-৬৭ খৃঃ)। বস্তুত এ রোষানল প্রশমিত করার জন্যেই স্যার সাইয়েদ বিদ্রোহের অন্য রকম ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা করেন।

এবার আন্দোলন দু’ধারায় চলতে থাকে
স্থানে স্থানে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বালাকোট আন্দোলনে মোজাহিদগণ সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেননি। একদিকে তাঁরা সীমান্তে ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপর দিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর ও সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে পূর্ব থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূলে কাজ চলতে থাকে। তাঁরা সতর্কতার সহিত সে কাজ চালিয়ে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম ও ধর্মীয় সভাসমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কাজ করতেন। এ সঙ্গে খুব সন্তর্পণে জিহাদী প্রচারণা ও ইসলামী জাগরণকে উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

দারুল উলুম দেওবন্দ সহ অগণিত প্রতিষ্ঠাত কায়েম হলো

বস্তুতঃ সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই আমরা বিশ্ব বিখ্যাত উচ্চ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষা ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যতের জন্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তরকালে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ও ‘খেলাফত আন্দোলন’কে উপলক্ষ্য করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাক্সিতান নামক যে রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়, এই প্রত্যেকটি কাজেই ঐ সব প্রতিষ্ঠানের অপরিসীম অবদান রয়েছে।

বালাকোট ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন ছিল না

বালাকোট কেন্দ্রিক সংগ্রাম আর ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোন আন্দোলন ছিল না। বরং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর প্রেরণায় তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মওলানা ইসমাইল শহীদ দেহলভী ও মওলানা আবদুল হাই প্রমুখ ইসলাশী আন্দোলনের বীর সিপাহীগণ যেই আপোষহীন সংগ্রাম করেছিলেন, এটা ছিলো সেই আন্দোলনেরই পরিশিষ্ট। এ সব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে যে সুমহান লক্ষ্য আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অমূল্য জীবন আহুতি দিতে হয়েছিল, উপমহাদেশের মুসলমানগণ কায়েদে আজম মুহাম্মদ আল জিন্নাহ, মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ও মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবানের মধ্যে তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিল। কায়েদে আজম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে একাধিকবার ঘোষণা করেছেন যে, “পাকিস্তানের আদর্শ হবে একমাত্র ইসলাম। চৌদ্দশো বছর পূর্বেই আল কুরআন আমাদের শাসনতন্ত্র তৈরী হয়ে আছে”।

দারুল উলুম দেওবন্দ ও আজাদী আন্দোলন

পূর্বেকার আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে শিখ ও ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত শহীদানে বালাকোটের আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হয়। সাথে সাথে একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মাঝখানে এ আন্দোলন দু’টি স্থানকে কেন্দ্র ককের তার লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। একটি ইয়াগিস্তান অপরটি দারুল উলুম দেওবন্দ। অবশ্য দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও এর অনুসারী পাক-ভারতে কাওমী মাদ্রাসা নামে যে সব অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিশেষ করে বাংলাদেশের দ্বীতি প্রতিষ্ঠান সমূহের শিক্ষা-নীতিতে বালাকোটের সেই আদর্শিক চেতনা ও সে অনুযায়ী সমাজে নেতৃত্ব গড়ে তোলার উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম কি পরিমাণ উপযোগী তা পর্যালোচনার বিষয়। তবে ৪৭-এর আজাদী হাসিলের পর বিগত দিনগুলোতে এই প্রেরণা যে রকম থাকার দরকার ছিল, সে রকম না থাকলেও একথা নিশ্চিতরূপে বলা চলে যে, এখন আবার সেই সংগ্রামী ভাবধারা ঘুমন্ত দ্বীতি মাদ্রাসাগুলোতে জাগ্রত হয়ে উঠেছে। মাঝখানে তা কিছুকাল স্তিমিত থাকায় বাতিল শক্তিসমূহ সে সুযোগ আমাদের সমাজ জীবনের সর্বস্তরে যথেষ্ট শিকড় বিস্তার করে ফেলেছে –সেটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। কিছুটা অপ্রিয় হলেও প্রসঙ্গটি এ জন্যে টানা হলো যে, বালাকোটের সেই প্রেরণাই যদি সামগ্রিকভাবে এদেশের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানসমূহে এতদিন কার্যকর থাকতো আর এ সবের শিক্ষানীতি বাতিলের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলায় যোগ্য আলেম নেতৃত্ব তৈরীতে সহায়ক হত, তাহলে আজ সমাজচিত্র ভিন্নতর হতো। বরং সব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে যে অসংখ্য ওলামা প্রতি বছর বের হয়ে আসেন, তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে বঞ্চিত। তাদের অনুপস্থিতেই ভোগবাদী ইংরেজ জীবনধারার অনুসারীদের নেতৃত্বের পরিণতি হিসাবে আমাদের সমাজ আজ উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে।

যা হোক, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা ও একে কেন্দ্র করে কিভাবে আন্দোলন ধাপে ধাপে অগ্রসর হলো এবং এর সঙ্গে পরে অন্যান্য শক্তি যোগ করে কিভাবে আজাদী সংগ্রামকে শেষ মঞ্জিল পর্যন্ত নিয়ে পৌঁছালো –এ পর্যায়ে আমরা সেই সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনার প্রয়াস পাবো।

আন্দোলনের কয়েকটি পর্যায়

ইসলামী রেনেসাঁর মূল উদগাতা মহামনীষী ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী শোষণ-হীন খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ইসলামী আন্দোলনের চিন্তা করেছিলেন, সে আন্দোলনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথম পর্যায়ঃ শাহ ওয়ালিউল্লাহর তিরোধানের পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী থেকে নিয়ে বালাকোট প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও মওলানা ইসমাইল শহীদের শাহাদাৎ পর্যন্ত (সন ১৮৩১ খৃঃ)। দ্বিতীয় পর্যায়ঃ বালাকোট থেকে নিয়ে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়ঃ ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৬৬/৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ কেন্দ্রীক আন্দোলন পর্যন্ত। চতুর্থ পর্যায়ঃ দেওবন্দ থেকে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়তের মধ্য দিয়ে আজাদী হাসিল পর্যন্ত। পঞ্চম পর্যায়ঃ হচ্ছে আজাদী হাসিল থেকে বর্তমানের বাংলা-পাক-ভারতে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন। বস্তুতঃ এদেশকে একটি শোষণমুক্ত ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর ইসলামী আন্দোলনেরই লক্ষ্যাভিসারী এক দুর্বিনিত আন্দোলন যা সর্বপ্রথম বালাকোটকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, বালাকোটে ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী নেতাদের শাহাদাতের পর শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে উপমহাদেশে ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হয়। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পূর্বেই মওলানা শাহ ইসহাক আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে তাঁর ভ্রাতা মওলানা এয়াকুবকে নিয়ে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সফর করেন। বিশেষ করে তিনি তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কায় চলে যান। আর এমনিভাবে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল এবার মক্কায় স্থানান্তরিত হয়। -(শাহ ওয়ালীউল্লাহ কী সিয়াসী যিন্দেগী)।

ঐ সময় মক্কা-মদীনা তুর্কী খেলাফতের অধীন ছিল বলে তিনি ভারতীয় মুসলমানদেরকে ইংরেজ কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তুরস্ক পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এ দিকে দিল্লীতে ইসলামী আন্দোলনের সাক্ষান নেতৃত্ব দানের উদ্দেশ্যে মওলানা শাহ ইসহাক দিল্লী কলেজের প্রধান শিক্ষক মওলানা মামলুকুল আলীর সভাপতিত্বে মওলানা কুতুবউদ্দীন দেহলভী, মওলানা মুজাফফর হোসাইন কাসুলকী ও মওলানা আবদুল গণী মোজাদ্দেদীর সমন্বয়ে একটি কর্মপরিষধ গঠন করে যান। এই কমিটি মক্কায় অবস্থানরত মওলানা ইসহাকের ইঙ্গিত ও নির্দেশনায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ পরিচালনা করতে থাকে। ওয়ালিউল্লাহ আন্দোরনের এই কর্মপরিষদ শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তাধারা ও বালাকোটের প্রেরণা নিয়ে দুর্বার গতিতে কাজ করে যায়। বস্তুতঃ শাহ ইসহাক দেহলভীর চিন্তা এবং এই পরিষদের নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা মাফিকই পরবর্তী পর্যায়ে ওয়ালীউল্লাহ চিন্তাধারা প্রচারের বাস্তব কর্মক্ষেত্র হিসাবে ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মওলানা ইসহাব দেহলভীল নির্দেশেই পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা মামলুকুল আলীর পরিবর্তে হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (রহঃ) উক্ত কর্মপরিষদের প্রধান নেতা নিয়োজিত হন। এ পরিষদের কাজ ছিল শিক্ষামূলক ও মুসলমানদের মাঝে জেহাদী চেতনা সৃষ্টি। হাজী এমদাদুল্লাহ সাহেব প্রধান নেতা হলেও বিশিষ্ট বুযর্গ মওলানা আবদুল গণী মুজাদ্দেদী এ পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকেন।

রণাঙ্গনে তিন বুযর্গ

শেষ পর্যন্ত আলেমদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনই বালাকোটে ফেরত অন্যতম মুজাহিদ নেতা মওলানা ইয়াহইয়অ আলীর পরোক্ষ নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে গণঅভ্যত্থানের রূপ নেয়। হাদী এমদাদুল্লাহ তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের কাজ বন্টন করে দেন এবং নিজেও স্বশরীরে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৮৫৭ সালের আজাদী বিপ্লবের সময় থানাভবন ফ্রন্টে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। -(হায়াতে মাদানী)

থানাভবন ফ্রন্টে তাঁর সঙ্গে যেসব মর্দে মুসলমান ও সংগ্রামী আলেম জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তন্মধ্যে হাজী এমদাদুল্লাহর সহকর্মী শিষ্য হযরত মওলানা কাসেম নানুতবী, হযরত মওলানা রশীদ আহমদ গংগোহী প্রমুখ আলেমের থানাভবনে এসে সমবেত হয়। এখানে তারা জেহাদে একের পর এক স্থান দখল করে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। তাঁরা থানাভবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ থেকে ইংরেজসৈনিকদের বিতাড়িত করে মুক্ত অঞ্চল কায়েম করেন। তারপর জিলা ছাহারান পুরের অভ্যন্তরে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি অধিকার করতে সমর্থ হন। কিন্তু বালাকোটের ন্যায় এবারও এই ইসলামী আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে তাদের পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়। এখানকার জেহাদে হাজী এমদাদুল্লাহ ছিলে ‘আমীরে মোজাহেদীন’ বা মুজাহিদদের প্রদান উপদেষ্টা। হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী ছিলেন প্রধান সেনাপতি এবং হযরত মওলানা রশিদ আহমদ গংগোহী প্রধান বিচারক। তাঁরা যে দক্ষতা ও রণ-কৌশলসহকারে এই জেহাদ পরিচালনা করেছিলেন, সেই সংগ্রামী স্মৃতি আমাদের জন্য চিরদিন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

ফাঁসিকাষ্ঠে ২৮ হাজার মুসলমান ও সাত শহ আলেমের শাহাদাত বরণ

জেহাদে মুসলমানরা পরাজিত হলো। উপমহাদেশের মুসলমান পূর্বাপেক্ষা অধিকতর শক্তভাবে বাঁধা পড়লো ইংরেজদের দাসত্বের জিঞ্জিরে। থানাভবনের এলাকাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করা হলো্। বিচারের কোনরূপ অপেক্ষা না করে ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও প্রকাশ্য রাস্তায় নির্মমভাবে মুসলমানদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। উচ্চপদস্থ ইংরেজ অফিসারদের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, এই সেক্টরে ২৭/২৮ হাজার মুসলমানকে বিনা বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং প্রায় সাতশো বিশিষ্ট আলেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। এছাড়া বহু ওলামা ও বুযর্গানে দ্বীন আন্দামান প্রভৃতি দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছেন। তাঁরা দেশবাসী ও আত্মীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিদারুন দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছেন। মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী, মওলানা মুফতী এনায়েত আলী এবং শাহ আহমদ সাঈদ ১৮৫৭ সালের ‘বিপ্লব ষড়যন্ত্র মামলায়’ দণ্ডিত হন। প্রথম দু’জন মুজাহিদকে উক্ত ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্থ করে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আন্দমানে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাঁরা জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। -(হায়াতে মাদানী)

বলা বাহুল্য, শুধু থানাভবন এলাকায় যেই বিপুল সংখ্যক মুসলমান ও আলেম শহীদ হয়েছেন, সে হিসাবে গোটা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কি পরিমাণ মুসলমান ও আলেম ওলামাকে শহীদ করা হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। (এক পরিসংখ্যান মোতাবেক আজাদী হাসিল পর্যন্ত ২০ লক্ষ্য মুসলমান এই মুক্তি সংগ্রামে দুশমনদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন)।

এ জেহাদে থানাভবন ফ্রন্টে মওলানা কাসেম নানতুবীর মস্তকে গুলির আঘাত লেগেছিল কিন্তু তা মারাত্মক ছিল না বলে কোনপ্রকার তিনি রক্ষা পেয়ে যান। মওলানা রশীদ আহমদ গংগোহী এই মুক্তি সংগ্রামের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণাবদ্ধ ছিলেন। হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী এবং হাজী এমদাদুল্লাহর বিরুদ্ধেও গ্রেফতার পরওয়ানা জারি হয়েছিল। মওলানা নানতুবী বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থে প্রথম তিন দিন আত্মগোপন করে থাকলেও পরে তিনি দিব্বি রাস্তা-ঘাটে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। কেউ তাঁকে সতর্ক করতে গেলে তিনি উক্তি করতেন যে, প্রিয় নবী ‘হিরা’ গুহার মধ্যে কাফেরদের নিকট থেকে মাত্র তিনদিন আত্মগোপন করে ছিলেন, কাজেই আমি তার বেশী করতে রাজি নই। তাতে যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হোকনা কেন আমি হাসিমুখে তা বরণ করে নেবো। আল্লাহর মর্জি, তিনদিন পরেই তাঁর উপর থেকে গ্রেফতারী ওয়ারেন্ট তুলে নেয়া হয়।

১৮৫৭ সালের ইংরেজ বিরোধী গনজেহাদের মূলে ছিল ইসলাশী চেতনা। আর তার অন্যতম নায়ক ছিলেন উক্ত তিন বুজর্গ। কিন্তু আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতের এবং উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শকে উজ্জীবিত রাখার স্বার্থে কিভাবে তাঁরা বেঁচে গেলেন, তা সত্যই এক বিস্ময়কর ঘটনা।

হাজী ইমদাদুল্লাহর মক্কায় হিজরত

হাজী ইমদাদুল্লাহর বিরুদ্ধে যখন কঠোরভাবে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়, তখন ঐ পরিস্থিতিতে পাল্টা জেহাদের কোনো সুযোগ নেই দেখে তিনি হিজরত করা সমীচীন মনে করেন এবং পবিত্র মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন।

কিন্তু চতুর্দিকে বিনা কারণে ধর-পাকড়, এদিক-সেদিক গ্রেফতারী পরোয়ানা, তাই তিন সতর্কতার সঙ্গে চরতে লাগলেন। যাত্রা পথে বহুস্থানে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েও অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়ে যান। পাটনা, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধু-পাঞ্জাব প্রভৃতি এলাকা হয়ে তিনি মক্কা শরীফে গিয়ে পৌঁছেন। স্থানাভাবে তাঁর যাতায়াতকালের অলৌকিক ঘটনাসমূহের এখানে বর্ণনা দান সম্ভব হলো না। -(নকশে হায়াত)

দারুল উলূম দেওবন্দ

১৮৫৭ সালের গোলযোগের সময় যখন ইংজের সরাসরি দিল্লীকে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে নিলো এবং সম্রাটদের নামে মাত্র আধিপত্যটুকুও খতম করে দিল, তখন ওয়ালিউল্লাহ আন্দোরনের সক্রিয় নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব হাজী এমদাদুল্লাহর সহকর্মী শিষ্যদের উপর অর্পিত হলো। তাঁরা মক্কায় অবস্থানরত প্রধান পৃষ্ঠপোষখ হাজী ইমদাদুল্লাহর নির্দেশে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে এ আন্দোলনের ধারাকে আক্রমণমূলক না করে প্রতিরক্ষামূলক করার দিকে মনযোগী হলেন। এ উদ্দেশ্যে ওয়ালিউল্লাহ আন্দোরনের কর্মপরিষদ দিল্লীস্থ ওয়ালিউল্লাহর রহীমিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নমুনায় একটি ইসলামী শিক্ষা ও প্রচারকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এ সঙ্গে তাঁরা এও সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দিল্লতে ইংরেজদের নাকের ডগার উপর থেকে এ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল বাইরে নিয়ে যেতে হবে। মওলান কাসেম নানতুবী অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে এ উদ্দেশ্যে স্থান ও প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের ব্যাপারে তাঁরা চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।

অবশেষে দিল্লীর পতনের নয় বছর পর ১৮৬৬ খৃঃ (১২৮৩ হিঃ) দেওবন্দ মওলানা কাসেম নানতুবীর প্রচেষ্টায় প্রস্তাবিত ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। দেওবন্দ দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর তাঁরই প্রচেষ্টায় ছাহারানপুরে এর আরেকটি শাখা উদ্বোধন করা হয়। এমনিভাবে অল্পদিনের মধ্যেই আরও প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হবার পর ইসলামী আন্দোলনের এসব বীর মোজাহেদদেরই একজন গিয়ে যখন হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে মক্কায় এই সুসংবাদ প্রদান করলেন যে, হুযুর, আমরা দেওবন্দে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছি –এর জন্যে দোয়া করবেন। এ কথা শুনে হাজী সাহেব স্বানন্দে বলে উঠলেনঃ “সোবহানাল্লাহ! আপনারা মাদ্রাসা কয়েম করেছেন? আপনি কি জানেন গভীর রাত্রে কি পরিমাণ মস্তক এজন্যে সিজদায় পড়ে থাকে? আজ বহুদিন যাবতন এ উদ্দেশ্যে আমরা দোয়া করে আসছি যেন আল্লাহ পাক ভারতবর্ষে ইসলাম রক্ষার একটি ব্যবস্থা করেন। এই মাদ্রাসাটি মূলতঃ সে সব বিনিদ্র রজনীর দোয়ারই ফল বিশেষ। দেওবন্দের মাটির জন্যে এটা কতইনা সৌভাগ্যের বিষয় যে, তার বুকে এই মহৎ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি স্থাপিন হলো”।

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম শিক্ষক ছিলেন মোল্লা মাহমুদ সাহেব আর প্রথম ছাত্র ছিলেন (হযরত মওলানা) মাহমুদুল হাসান। আর যেই বুযর্গ সর্বপ্রথম এর প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন, তিনি হলেন হযরত মওলান ইয়াকুব। তিনি পূর্বে আজমীর বা অন্য কোনো এক স্থানে ইসলামী শিক্ষাদানের কাজে রত ছিলেন। হযরত মওলানা ইয়াকুব ছিলেন মওলানা ইসহাক সাহেব কর্তৃক গঠিত ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এককালের সভাপতি মওলানা মামলুকুল আলী সাহেবের পুত্র। মওলানা মামলূকুল আলীর শিক্ষকের (মওলানা রশীদুদ্দীন) শিক্ষক ছিলেন হযরত মওলানা শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী।

মওলানা কাসেম নানতুবী ও মওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী মওলানা মামলুকুল আলীর নিকট কিতাব অধ্যয়ন করেন এবং শাহ আবদুল গনীর নিকট হাদীস অধ্যয়ণ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, মওলানা মামলূকুল আলী ছিলেন মওলানা ইয়াকুব সাহেব এবং স্যার সাইয়েধ আহমদের উস্তাদ। কিন্তু একই শিক্ষকের ছাত্র হলেও রাজনীতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাইয়েদের চিন্তাধারা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। ৫৭-ব্লিবের পর তিনি ইংজের সরকারের প্রত্যক্ষ বিরোধীতা করতেন না। বরং কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতিতে তিনি ইংরেজী শিক্ষার অনুকূলে মতপোষণ করেন। মওলানা নানতুবীর সঙ্গে তাঁর মতের গড়মিল দেখা দেয়। সেই মতবিরোধই পরে দেওবন্দ-আলীগড় বিরোধিতার রূপ নেয়।

প্রথম অধ্যক্ষ

দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হযরত হাজী সাইয়েদ আবেদ হোসাইন। উল্লেখ্য যে, হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী যদিও দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিন্তু তিনি কোনো দিন এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বা অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেননি। মওলানা সাইয়েদ আবেদ হোসাইনের পরে মওলানা শাহ রফীউদ্দিন দারুল উলুমের অধ্যক্ষ ছিলেন।

দারুল উলূমের প্রথম পরিচালনা কমিটি

১। হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী

২। হাদী আবেদ হোসাইন

৩। মওলানা মাহতাব আলী দেওবন্দী

৪। মওলানা জুলফিকার আলী দেওবন্দী (হযরত শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের পিতা)

৫। মওলানা ফজলুর রহমান দেওবন্দী

৬। শায়েখ নেহাল আহমদ দেওবন্দী

৭। মুনশী ফযলে হক দেওবন্দী

প্রথম অবসর প্রাপ্ত ছাত্রবৃন্দ

১। শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান

২। মওলানা আবদুল হক

৩। মওলানা ফখরুল হাসান গংগূহী

৪। মওলানা ফৎহে মুহাম্মদ থানভী

৫। মওলানা আবদুল্লাহ জালালাবাদী

 

সংগ্রামী নেতা শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান
দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম হেডমুদার্রিস ছিলেন হযরত মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহেব। তারপর এই পদে দায়িত্ব পালন করে হযরত মওলানা সাইয়েদ আহমদ দেহলভী। অতঃপর শায়খুল হিন্দ হযরত মওলানা মাহমুদুল হাসান দারুল উলুমের হেড মুদার্রিস নিয়োজিত হন। (১২০৮-১২৩৩ হিঃ)। শায়খুল হিন্দ সংগ্রামী নেতা মওলানা কাসেম নানতুবী ও রশিদ আহমদ গংগুহীর শিষ্য ছিলেন বলে তিনি দেওবন্দ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষকতার জীবনেও দেখা গেছে যে, তিনি শুধু প্রতিক্রিয়াযুক্ত, নির্লিপ্ত গতিহীন তাকওয়া-পরহেযগারীর উপদেশ, তালিম বা শিক্ষা-প্রশিক্ষণই দিতেন না বরং তাঁর তরবিয়তের জন্যে তারা হয়ে উঠতো উদ্বেলিত। এ কারণেই তাঁর শিষ্যরা ছিলেন উপমহাদেশের রাজনৈতিক গগণের এক একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

শায়খুল হিন্দ-এর বিশিষ্ট শিষ্যবৃন্দ

১। আজাদী আন্দোলনের বীর সেনানী মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (মোহাদেদ্স ও হেড মোদর্রিস দারুল উলুম দেওবন্দ, সভাপতি জমইয়তে ওলামায়ে হিন্দ)।

২। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিস্ধী

৩। মওলানা সাইয়েদ আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি

৪। মওলানা মুফত কেফায়াতুল্লাহ (সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে হিন্দ)

৫। মওলানা মুহাম্মদ মিঞা ওরফে (মওলানা মনসুর আনসারী)

৬। মওলানা হাবীবুর রহমান (সাবেক মোহতামিম দারুল উলূম দেওবন্দ)

৭। আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী (শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ ও হেড মুদার্রিস দারুল উলুম দেওবন্দ, শায়খুল ইসলাম পাকিস্তান ও সভাপতি জমইয়তে ওলাময়ে ইসলাম।)

৮। শায়খুল আদব ওয়াল ফিকহ, মওলানা মুহাম্মদ ইযায আলী, দারুল উলূম দেওবন্দ।

৯। মওলানা ফখরুদ্দীন আহমদ (শায়খুল হাদীস জামেয়ায়ে কাসেমিয়া, মুরাদাবাদ)।

১০। মওলানা ইবরাহীন বিলইয়াবী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ)

১১। মওলানা আবদুস সামী (অধ্যাপক দারুল উলুম দেওবন্দ)

১২। মওলানা আহমদ আলী (মুহতামিম আঞ্জুমানে খুদ্দামুদ্দীন শীরিনওয়ালা, লাহোর।

১৩। মওলানা মুহাম্মদ সাদেক করাচী, প্রমুখ।

ইংরেজ সরকারের উৎখাতের জন্যে ইরান ও আফগানিস্তানের সাহায্য কামনা
ভারত থেকে ইংরেজ সরকারকে উৎখাত আন্দোলনে মওলানা মাহমুদুল হাসান যে ত্যাগ ও সংগ্রাম করেছেন, তা শুধু উপমহাদেশের আলেম সমাজ বা সাধারণ মুসলমানই নয় বরং বিশ্বের মুক্তিকামী যে কোনো মানুষের জন্যে চিরদিন অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করবে। তিনি এ উদ্দেশ্যে ইরান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের শাসকদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এসব ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ ও উপজাতীয় পাঠানদের মধ্যে তিনি জিহাদী ভাব সৃষ্টি করেন এবং সম্মিলিতভাবে ইংরেজদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সাবেক মুসলিম শাসিত ভারতকে তার স্বাধীন ‘ইসলামী হিন্দুস্থান’ পরিচয়ে ফিরিয়ে নেয়ার আন্দোলন চালান। শায়খুল-হিন্দ এ উদ্দেশ্যে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে প্রেরণ করেছিলেন। উপজাতীয় পাঠানগণ এবং আফগান শাসকের নিকট আর নিজে তুরস্ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে হেজাজ গমন করেন। তুর্কী খেলাফতের অধীন তৎকালীন হেজাজের তুর্কী শাসক গালিব পাশা ও তুরস্কের সেনাবাহিনী প্রধান আনওয়ার পাশার সঙ্গে মওলানা মাহমুদুল হাসান সাক্ষাত করেন এবং আন্দোলনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেন।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তদানীন্তন আরব শাসক শরীফ হোসাইন ইংরেজদের উস্কানীতে তুরস্ক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেন। শরীফ হোসাইন ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে হেজাজেও ইংরেজ শক্তির দৌরাত্ম চলে। এ দিকে বৃটিশ সরকারও শায়খুল হিন্দের ইংরেজ সরকার উচ্ছেদ আন্দোলন চলে। এ দিকে বৃটিশ সরকারও শায়খুল হিন্দের ইংরেজ সরকার উচ্ছেদ আন্দোলন সম্পর্কে অবগত হয়। ইংরেজগণ তাদের তাবেদার আরব শাসক শরীফ হোসাইনের দ্বারা শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করেন (১৯১৬) ইং। ফলে প্রায় ৫ বছর পর্যন্ত মাল্টাদ্বীপে তাঁকে গ্লানিকর নির্বাসন জীবন যাপন করতে হয়। সেই নির্যাতনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও মর্মস্পর্শী। মাল্টাদ্বীপ থেকে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর (১৯২০ খৃষ্টাব্দের ১২ই মার্চ) ভারতে ফিরে আসেন এবং খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে আবার সংগ্রামে লিপ্ত হন। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে ইংরেজ সরকার ভারত থেকে বহিষ্কার করেন। শায়খুল-হিন্দের সঙ্গে এ আন্দোলনে আলীগড়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিপ্লবী ব্যক্তিগণও জড়িত ছিলেন। যেমন মওলানা মুহাম্মদ আলী ও উক্টর মোখতার আহমদ আনসারী প্রমুখ

শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদশ তথা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে যে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন, সেই সংস্থাটির নাম ছিল “জমিয়তে আনছারুল্লাহ”। এ সংস্থার বিপ্লবী পরিষদকে ‘আজাদ হিন্দ মিশন’ও বলা হতো। এর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মওলানা হাজী তোরঙ্গজয়ী, মওলানা লুৎফুর রহমান, মওলানা ফযলে রাব্বী, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী। এ সময় তাঁর অন্যতম ছাত্র ও পরবর্তীকালের শায়খুল হিন্দ মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী পবিত্র মদীনা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। শায়খুল হিন্দের দরবার থেকে ইলমে হাদীস ও রুহানিয়াত তথা আত্মিক পরিশুদ্ধির অনুশীলনের সাথে সাথে এই বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করে যান। উল্লেখ্য, মওলানা মাদানীও তাঁর শায়েখ ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে মক্কায় বন্দী হয়ে মাল্টাদ্বীপে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন।

মাল্টা দ্বীপে নির্বাসন ও তার পূর্বে মক্কায় বন্দী হবার বিস্তারিত বিবরণ দান এখানে সম্ভব না হলেও তিনি যে কি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের কি পন্থা চিন্তা করেছিলেন ও কখন মক্কা গিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।

শায়খুল হিন্দের ইংরেজখেদা আন্দোলনের পরিকল্পনা

উক্ত পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে ইংরেজ বলয়ের বাইরে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ‘ইয়াগিস্তান’ এলাকায় ‘আযাদ হিন্দ মিশনে’র কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে জেহাদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহ ইত্যাদি সর্বপ্রকার আয়োজন চলতে থাকে।

তখনই ইউরোপের কতিপয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুর্কী খিলাফতের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি এলাকা আক্রমণ করে এবং ইংরেজগণ তুর্কী সরকারের দু’টি যুদ্ধ জাহাজ আটক করে ফেলে। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ভারত সহ সমগ্র মুসলিম জাহানে নতুন করে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিক্ষোভ বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

এসব অবাঞ্ছিত কারণে তুর্কী সরকারও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে বৃটেন, রাশিয়া প্রমুখ শক্তিবর্গ তুর্কী খেলাফতের উপর বিভিন্ন দিক হতে চতুর্মূখী আক্রমণ করে বসে। ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে ভূপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে মুছে ফেলাই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য।

দেওবন্দী মোজাহেদগণ ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন

এহেন সংকট কালে হযরত শায়খুল হিন্দ ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা হতে বিপ্লব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেন। তিনি মওলানা হাজী তোরঙ্গযয়ীর নেতৃত্বে ইয়াগিস্তান কেন্দ্র থেকে বৃটিশ সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুজাহিদগণ বীরবিক্রমে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুক্তি-যোদ্ধাদের আক্রমণে ইংরেজ শক্তি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে। তাতে বহু ইংরেজ সৈনিক হতাহত হয়। কিন্তু কুচক্রী ইংরেজগোষ্ঠী মুজাহিদের দুর্দমনীয় আক্রমণের ঝক্কি সামলাতে না পেরে একদিকে কতিপয় স্বার্থপর ভাড়াটিয়া শিক্ষিতকে হাত করে নেয়, অপরদিকে সরকারী তল্পীবাহক জনৈক মওলভীর দ্বারা জেহাদের বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কাবুলের বাদশাহ আমীর হাবীবুল্লাহ খানকে প্রচুর অর্থ ও নানান প্রলোভনে তার দ্বারা ইংরেজরা কাবুল সীমান্তের উক্ত জেহাধী আন্দোলনকে বানচাল করে দিতে প্রয়াস পায়।

এই মহাবিপর্যয় ও সংকট মুহুর্তে বিপ্লবীগণ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাই হিজরী ১৩৩৩ সনে শায়খুল হিন্দ হিজাজ অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু ইংরেজদের কড়া দৃষ্টি এড়িয়ে বাইরে সফর করা তাঁর পক্ষে মুশকিল ছিল। তবুও তিনি আল্লাহর প্রতি ভরসা করে রওয়ানা হন। কিন্তু সে খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় শায়খুল হিন্দের বিদেশ সফর করা হলে বিশৃংখলার সম্ভাবনা রয়েছে ভেবে বোম্বাই ঘাটে স্টীমারে আরোহণকালে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেয়। ইউ পি সরকার বোম্বাইয়ের গভর্ণরের নিকট এই মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু বার্তা পৌঁছার পূর্বেই জাহাজ ছেড়ে দেয়া হয়।

যাহোক, হিজাজের তুর্কী প্রতিনিধি গালিব পাশার মাধ্যমে আরবের উক্ত এলাকার তুর্কী কর্মকর্তা জামাল পাশা ও সেনাবাহিনী প্রধান আনোয়ার পাশার সঙ্গে শায়খুল হিন্দের চুক্তি হয় যে, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার স্বাক্ষরিত প্রতিশ্রুতি অনুরোধপত্র ও নির্দেশাবলী ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তিনি নিজে যে কোন প্রকারে হোক সংগ্রামের ঘাটি ইয়াগিস্তানে চলে যাবেন। সেখান থেকে ভারতে ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পূর্ণোদ্যমে সক্রিয়ভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চালানো হবে। তুর্কী কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটির নাম ছিলো ‘গালিব নামা’। রাওলেট এ্যাক্ট কমিটির রিপোর্টে সেই চুক্তির সংগ্রামী ভূমিকার বিশেষ অংশ হলোঃ

“হে ভারতবাসী! এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মুসলমানগণ সর্ব প্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আল্লাহর অনুগ্রহে তুর্কী সেনাবাহিনী এবং মুজাহিদগণ সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। সুতরাং হে মুসলমান, তোমরা যে ইংরেজ শক্তির লৌহজলে আবদ্ধ রয়েচো, সংঘবদ্ধভাবে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা ও সামর্থ্য নিয়ে পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে আসো। দেওবন্দ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মওলানা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে একমত হয়ে তাকে আমরা ঐ বিষয়ে পরামর্শ দান করেছি; ধন, জন ও সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সমর উপকরণ দ্বারা তাঁর সহযোগীতা করো। এতে কিছুমাত্র ইতস্তঃত করো না”।

কিন্তু এ পরিকল্পনা নিয়ে মওলানা মাহমুদুল হাসান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন ঠিক এমন সময় (১৯১৬ খৃঃ) ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে মক্কার ইংরেজ-তাবেদার শাসক শরীফ হোসাইনের দ্বারা তাঁকে গ্রেফতার করে। শরীফ হোসাইনের সমর্থনসূচক বক্তব্য এবং “আরবদেশ শাসনকারী তুর্কী খলীফা ও তুর্কীগণ কাফের ও খেলাফতের অযোগ্য” এই মর্মে লিখিত একটি ফতওয়ায় দস্তখত করতে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। তিনি ঘৃনা ভরে তাতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর তাঁর শিষ্য মওলানা মাদানীসহ কতিপয় বিপ্লবী আলেমকে গ্রেফতার করে মাল্টা দ্বীপে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল তুরস্কের স্তাম্বুলে। মক্কা-মদীনা ছিল তুরস্ক খেলাফতের অধীন আরব প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত। শরীফ হোসাইন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন।

রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি
অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ভারত স্বাধীন করা এবং এখানে পুনরায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ভিত্তিতে আন্দোরন পরিচালিত হয়। শাহ আবদুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী থেকে শুরু করে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান পর্যণ্ত কয়েকটি বিপ্লব ঘটে যায়। বাংলা-পাক-ভারতের আলেম সমাজই ছিলেন এসব বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা। ১৮৩১ খৃঃ বালাকোট জেহাদ ও ১৮৫৭ সালের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বিপ্লবী আলেমগণ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে একান্ত গোপনীয় ভাবে এ আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যান। শত্রুপক্ষ প্রথম এর কিচুই টের পায়নি। ফলে ইংরেজ সরকারকে বহু ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা মুজাহেদ বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হতে হয়। এখাতে ইংরেজ সরকারের বহু কোটি টাকা ব্যয় হয় এবং ক্ষয় হয় অসংখ্য সৈন্য। ইংরেজগণ নির্বিঘ্নে টিকে থাকতে পারে এমন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে তারা বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে এসব বিপ্লবের মূলড তথ্য উদঘাটন ও এর মূলোচ্ছেদের লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এটাই হচ্ছে রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি।

১৯১৩ খৃষ্টাব্দে উক্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করতে সক্ষম হয়। কমিটি মওলানা শায়খুলহিন্দের আনছারুল্লাহ’ সংস্থার বিপ্লবী শাখা “আজাদ হিন্দ মিশন” আন্দোলনের অনেক ঘটনারই তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। যে কয়টি বিষয়ের আবিস্কার করেছে তাও অসম্পূর্ণ। তাতে আলেমগণ ও তাদের বিপ্লবী সহকর্মীদের কর্মতৎপরতা এবং রাজনীতি ও যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে যে অদম্য সাহস ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের কাছে অবাকই মনে হবে। মনে করার কারণও রয়েছে, কেননা ঐ সকল সংগ্রামী আলেমের শিষ্য-শাগরিদদের অনুসৃত নীতিকে সেই সংগ্রামী ভাবধারার যথাযথ প্রতিফলন তারা মাঝ-খানে দীর্ঘ দিন দেখতে পায়িনি। যাহোক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও পরিবেশে লালিত শিক্ষিত কতিপয় যুবক তাতে হতবাক হলেও একথা সত্য যে, বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রসমূহের কর্মকর্তা এবং ঐ সকল দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কুটনীতিকরা বিদেশ সম্পর্কে রাজনীতি, সমরনীতি, রাজ্য পরিচালিনায় অগাধ জ্ঞান ও দক্ষতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের “আজাদ হিন্দ মিশনের” দুর্দমনীয় সতর্কতাপূর্ণ আন্দোলনের নামে বৃটিশ সরকার যে আতঙ্কিত থাকতো, তাদের লেখকদের লেখাই তার বড় প্রমাণ।

অবিভক্ত ভারতের আলেম সমাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কিরূপ বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ইউলিয়াম হান্টার লিখিত ‘আওয়ার ইণ্ডিয়ান মুসলমান’ গ্রন্থে তাঁর আক্ষেপ থেকেও সেটা আঁচ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে এই-

“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারত গর্ভর্ণমেন্ট যদি পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্র আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী ভারতে আলেমদের কঠোর হস্তে দমন করতো, তা হলে ভারত গভর্ণমেন্টকে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মোজাহিদ আলেমদের আক্রমণের ফলে এত দুঃখ ভোগ করতে হতোনা। কতিপয় প্রসিদ্ধ আলেমকে গ্রেফতার করা হলে আম্বালা ঘাটিতে আমাদের এক সহস্র সৈন্য হতাহত হতো না এবং লক্ষ লক্ষ পাউণ্ড অর্থও বেঁচে যেতো। এমন কি উক্ত লড়াইর পরও যদি কঠোর হস্তে আলেমদেরকে দমন করা হতো, তবে অন্ততঃ পক্ষে ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে কালাপাহাড় অভিযান হতে রক্ষা পাওয়ার আশা ছিল”।

এমনিভাবে শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ বিপ্লবী আলেমের ইংরেজ-খেদা আন্দোলন ও ষড়যন্ত্রের বিবরণ তাদের লেখায় প্রকাশ পায়। ঐ সকল বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে ভারতীয় মুক্তি যোদ্ধাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। ইংরেজ সরকারের ফাইলে তাকে ‘রেশমী রুমালের চিঠি’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, ইংরেজ বিরোধী পরিকল্পনা সম্বলিত লেখা চিঠিটি রেশমী কাপড়ে লেখা ছিল। তাতে-

“ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ আছে এবং ভারতের মুসলমানদের পূর্ণোদ্যমে অগ্রসর হয়ে বৃটিশ হুকুমতকে উচ্ছেদ করার কথাও ছিল। “উক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে মওলভী ওবায়দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তার সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে। মওলভী ওবায়দুল্লাহ পূর্বে শিখ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রথমতঃ ছাহারনপুর জিলার অন্তর্গত দেওবন্দে মুসলমানদের ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে ফাজেল ডিগ্রী লাভ করেন এবং কতিপয় মওলভীকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালনার পক্ষে তাঁর মতাবলম্বী করে তোলেন। তন্মধ্যে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন প্রধান নায়ক। মওলভী ওবায়দুল্লাহ একান্ত ইচ্ছা ছিল, দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের সহযোগিতায় সারা ভারতে ইসলামী হুকুমাতের প্রেরণা জাগ্রত করে মুসলমানদেরকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুক করা”।

বস্তুতঃ এসব কারণেই বৃটিশ ভারতের মুসলমান তাদের প্রিয় সংগ্রামী নেতা শায়খুলহিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানকে কেন্দ্র করে রণোন্মাদনা-মূলক গান গেয়ে গেয়ে কুখ্যাত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিম যুবসমাজের উষ্ণ রক্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করতো। সেদিন কেবল সিন্ধু, মাদ্রাজ, ইউ পিতের নয় বাংলার পথে-ঘাটে, গঞ্জে-বাজারে, বন্দরেও এই ধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যেতো যে, -

“মুসলমানের শেখুল হিন্দ আছে মাল্টাতে,

চল খেলাফত উদ্ধারে মুসলমানী যেতে বসেছে”।

যাহোক, এই সিংহদিল মহান সংগ্রামী নেতা মাল্টার কারাজীবন শেষে ভারতে এসে যখন খেলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাঁর কারাক্লান্ত দেহ অধিক পরিশ্রম হেতু আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য এই দুর্বলতা নিয়েও তিনি আন্দোলন করে যান। এমনকি তাঁর জীবদ্দশাতেই যখন অসহযোগ আন্দোলন দেখা দেয়, তখনও তাঁকে মওলানা আবুল কালাম আজাদের অনুরোধে দুর্বল শরীর নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লীর বিখ্যাত “জামায়ায়ে মিল্লিয়া’র দ্বারোদঘাটন করতে দেখা যায়। কিন্তু বার্ধক্যপীড়ার মধ্যে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের দরুণ শেষ পর্যন্ত তাঁর শরীর বেশীদিন টিকেনি। ১৯২০ সালে মওলানা মাহমুদুল হাসান সংগ্রামরত ভারতীয় মুসলমানদেরশোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করলেন।

 

সংগ্রামী নেতা মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী
শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসানের ইন্তেকালের পর ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে দেওবন্দ বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতে মুসলমানদের নেতৃত্ব দানে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে মওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) ও মওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানীর ত্যাগ ও সংগ্রাম অপরিসীম। উভয়ই ছিলেন মওলানা মাহমুদুল হাসানের যোগ্য সহকর্মী শিষ্য। মওলানা মাদানী মহান সংগ্রামী উস্তাদের আদর্শ এবং দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তাঁর গোটা জীবনকে দ্বীন ও মিল্লাতের স্বার্থে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মীরীর (রহঃ) পর ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান অধ্যাপক নিয়োজিত হন। এক কালের অবিভক্ত ভারতের আলেমদের সংগ্রামী প্রতিষ্ঠাত ‘জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের’ও তিনি সভাপতি ছিলেন (১৯২৩ খৃঃ)। মওলানা মাদানী অসহযোগ আন্দোলন সহ অখণ্ড ভারতের পূর্ণ আজাদী পর্যণ্ত হিমালয়ের মতো অটলভাবে আনাচে কানাচে বহুবার সফর করেন। মওলানা মাদানীকে কয়েকবার ইংরেজ সরকার জেলে আবদ্ধ রেখে তাঁর প্রতি অকথ্য জুলুম নির্যাতন চালায়।

 

খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন

খেলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন সরকারী অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সরকার পরিচালিত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সব শূন্য হতে শুরু করলো। অসহযোগ আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য মওলানা মাদানী যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌবরজনক অধ্যায় হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকবে। তিনি ‘রিসালা-এ তরকে মুয়ালাত’ নামে একখানা তথ্য ও যুক্তির্পূণ পুস্তিকা রচনা করে ইংরেজদের ব্যাপারে উত্তেজিত ভারতবাসীর জেহাদী আগুনকে অধিক প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। পুস্তকটি এতই আলোড়ন সৃষ্টি করিছিল যে, শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়। তাতে মওলানা মাদানী যুক্তি প্রমাণ ও শরীয়তের হুকুম-আহকামের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, বৃটিশ শক্তি তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তি-কেন্দ্র তুর্কী খেলাফতের মূলোৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর। যারা মিসর, হেজাজ বিশেষতঃ মক্কা-মদীনা ভূমির উপর নানা ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে নির্যাতন ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, যারা আরব জাহাদের বিষফোঁড়া ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা মুসলিম জাহানের মেরুদণ্ড তুরস্ক সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা ইসলামী শরীয়ত বিরোধীই নয়, মানবতা বিরোধীও বটে। বলাবাহুল্য, মওলানার এই পুস্তক বৃটিশ-ভারতে ইংরেজদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে তোলে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি