লেখকঃ আল্লামা ইকবাল

লেখক পরিচিতি

আল্লামা ইকবাল

কবি-দার্শনিক আল্লামা ইকবালের ১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ইকবালের বাবা নূর মোহাম্মদ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা ছিলেন একজন পুণ্যবতী এবং দ্বীনদার মহিলা। শৈশবে তিনি তার জন্মস্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোটেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। বালক বয়সে তিনি কোরআন পড়া শেখেন। পড়ালেখার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্ব শেষ করে তিনি শিয়ালকোটের স্কটস মিশন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি প্রচলিত জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ফার্সি এবং আরবি ভাষাও শেখেন। শামসুল উলামা সাইয়্যেদ হাসানের কাছে তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষা ছাড়াও উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করেন। শামসুল উলামা ছিলেন তার বাবার বন্ধু। তার সহচর্যে ইকবাল কবিতা সম্পর্কে এতোই ভালো ধারণা অর্জন করেন যে, মাত্র ১৮/২০ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার সেই যুবক বয়সের কবিতা অগ্রজ উর্দু কবি-সাহিত্যিকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। তারা ইকবালের কবিতার প্রশংসা করেন।
ইকবালের চিন্তা-চেতনা ছিল বৈষয়িক চিন্তার অনেক ঊর্ধ্বে। তাই তিনি বাবার ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার না নিয়ে পড়ালেখার জন্য চলে যান লাহোরে। প্রফেসর ফারিদানীর মতে, ইকবাল বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে তার ওপর এমন এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে যে, তার উচিত ওই দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করা। তিনি শিয়ালকোটকে এই কাজের জন্যে ক্ষুদ্র মনে করেন, তাই লাহোরে চলে যান এবং সেখানকার সরকারি কলেজে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি অর্জনে আত্মনিয়োগ করেন।
তিনি আরো উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইসলাম গবেষক প্রফেসর টমাস আর্নল্ডের কাছে যান। দর্শনের ব্যাপারে কবি ইকবালের দৃষ্টিশীলতা, প্রেম এবং চিন্তার উৎকর্ষ এতো গভীর ছিল যে, স্বয়ং তার শিক্ষক আর্নল্ড এক সময় বলেন এই ছাত্র শিক্ষককে গবেষক এবং গবেষককে মহাপণ্ডিত বানিয়ে ছাড়বে। ১৯০৫ সালে ইকবাল ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। সেখানে ইরান বিশেষজ্ঞ দুই জন মধ্যপ্রাচ্যবিদের সাথে তার পরিচয় হয়। একজন হলেন এডওয়ার্ড ব্রাউন এবং অপরজন নিকলসন। এই দুই শিক্ষকের সাথে উঠাবসার সুবাদে ফার্সি সাহিত্য সম্পর্কে তার ভালো একটা ধারণা জন্মে। ফার্সি কবিতা পাঠের জন্যেও তার কণ্ঠ পরিপক্ব হয় এবং সম্ভবত এ সময়টাতেই তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা-চেতনা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার প্রেরণা পান। ইকবাল এখানে দর্শন এবং আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা শেষ করে দর্শনের ওপর চুড়ান্তভাবে পড়ালেখার জন্য জার্মানিতে যান।
ইউরোপে কয়েক বছর কাটানোর ফলে ইকবাল প্লেটো থেকে বার্গস পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের সাথে পরিচিত হন। তবে পাশ্চাত্য দর্শন তাকে তুষ্ট করতে পারেনি। পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি সমাধান অযোগ্য বহু বিষয় দেখতে পান। এ সময় তিনি পাশ্চাত্যের মতবাদগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন এবং তার নিজস্ব চিন্তাদর্শন ইসলামী আদর্শকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন অগ্রগতি বা দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার সুযোগ পান। এই প্রচেষ্টারই সোনালী ফসল হলো ‘দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স অব পারসিয়া’ বা পারস্যে অধিবিদ্যার উন্নয়ন নামক গ্রন্থটি। এটি ছিল তার একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্র বা থিসিসটি তিনি জমা দিয়েছিলেন মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে। ঐ ইউনিভার্সিটি তাকে এই থিসিসের জন্যে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল। থিসিসটি প্রকাশিত হয় লন্ডনে। সেই থেকে ইকবাল ইউরোপীয় সাহিত্যিক, রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে প্রাচ্যের দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
ইকবালকে তার এই থিসিস বা অভিসন্দর্ভটি তৈরি করার প্রয়োজনে বহু ফার্সি বই পড়তে হয়। বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতা, দর্শন, নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ফার্সি বই পড়েন। আর এসব বই পড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ফার্সি ভাষার সাথে তার পরিচয়টা নিবিড় হয়। এরপর তিনি ফার্সি ভাষার বই-পুস্তক প্রায় নিয়মিতই পড়তেন। এই পড়ালেখা বা পরিচিতির প্রভাবে তার আধ্যাত্মিকতা বা দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষা উপযোগী হয়ে উঠেছিল। এ জন্যেই আল্লামা ইকবাল তার বহু গ্রন্থ ফার্সি ভাষায় লিখেছেন।
রচনাবলী : ইকবাল গদ্য-পদ্য উভয় রচনাতেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি ছিলেন কবি ও লেখক। তিনি লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। অর্থনীতির মতো জটিল বিষয় থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিকতার মতো বিমূর্ত বিষয় পর্যন্ত উঠে এসেছে তার লেখায়। গ্রন্থ রচনা ছাড়াও তিনি বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে তৈরি করতে হয়েছে বিবৃতি, দিতে হয়েছে সাক্ষাৎকার। ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও পণ্ডিতদের সাথে আজীবন চিঠিপত্র বিনিময় করেছেন তিনি। আল্লামা ইকবাল তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রচনা করেন মাত্র ২৪টি কবিতা। তাও এর অধিকাংশই তার বন্ধু ‘মাখজান’ সম্পাদক আব্দুল কাদিরের অনুরোধে। কবি-জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ইকবালের উপর উর্দু কবি ‘দাগ’-এর প্রভাব ছিল প্রবল। পরবর্তীতে ‘কবি গালিব’ ও ‘কবি হালী’-এর প্রভাবে গতানুগতিকা ছেড়ে তার কবিতা সম্পূর্ণ নতুন খাতে প্রবাহিত হয়। আল্লামা ইকবাল সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে লাহোরে ‘আঞ্জুমানে হিমায়াতে ইসলাম’-এর বার্ষিক সভায় কবিতা পাঠ করেন। কবিতার শিরোনাম ছিল ‘নালায়ে ইয়াতিম’ (অনাথের আর্তনাদ)। ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে একই সংগঠনের বার্ষিক সভায় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী খÐকাব্য ‘শিকওয়া’ পাঠ করেন। এর প্রভাবে আল্লামা ইকবালের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় ব্যাপকভাবে। এরই পরেই তিনি রচনা করেন আরেকটি যুগান্তকারী খণ্ড কাব্য ‘জাওয়াবে শিকওয়া’। এরপর একে রচনা করতে থাকেন একের পর এক কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমেই পাওয়া যায় তার চিন্তা-ধারার প্রকৃত পরিচয়। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থাবলী হচ্ছেঃ
(১) ইলমুল ইকতিসাদ : অর্থনীতির উপর লেখা উর্দুভাষার প্রথম পুস্তক। তিনি এটি লাহোর সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক থাকাকালীন সময়ে রচনা করেন।
(২) তারিখ-ই-হিন্দ : বইটির মূল কপির সন্ধান পাওয়া যায় না এখন। এর একটি সংস্করণ অমৃতসর থেকে প্রকাশিত হয়।
(৩) আসরার-ই-খুদী : আল্লাামা ইকবালের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে এই আসরার-ই-খুদী। এটি ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বই প্রকাশের পর সাড়া পড়ে যায় সর্বত্র। কিন্তু সূফী তরীকার অনুসারীরা এই পুস্তক প্রকাশকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে গ্রহণ করেননি। কেননা ইকবাল এই গ্রন্থে সূফী কবি হাফিজ শিরাজীর তীব্র সমালোচনা করে ৩৫টি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তেজনা এতই চরম আকার ধারণ করেছিল যে, ইকবালের চিন্তাধারার সমালোচনা করে খান বাহাদুর পীরজাদা মোজাফফর আহমদ ‘ফজলে রাজ-ই-বেখুদী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেন। ইকবাল পরবর্তী সংস্করণে উল্লেখিত ৩৫টি কবিতা বাদ দিয়ে দেন। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ আরএ নিকলসন ১৯২০ সালে এর ইংরেজি তরজমা করেন প্রকাশ করেন।
(৪) রমুযে বেখূদী : আসরার-ই-খূদীরই ক্রম সম্প্রসারিত এই সংকলনটি ১৯১৮ সালে রমুযে বেখুদী নামে প্রকাশিত হয়। আর্থার জন আর্বারী এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
(৫) পায়াম-ই-মাশারিক : এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৩। এ সমযয়ে ইকবাল কবি হিসেবে অর্জন করেছেন সর্বজন স্বীকৃতি। তার কবিতা এগিয়ে যায় পূর্ণ-পরিণতির দিকে। তিনি এ কাব্যে পাশ্চাত্য দর্শনের পাশাপাশি প্রাচ্যের কোরআনী চিন্তার ফসলকেও তুলে আনেন। এই কাব্যটি গ্যাটের চিন্তাধারার অনুসরণে রচনা করেন। এতে মোট আশিটি কবিতা সংকলিত হয়েছে।
(৬) বাঙ্গ-ই-দারা : ইকবালের কবি জীবনের শুরু উর্দু কবিতার হাত ধরে। আর এই কাব্যটি উর্দু কবিতা সংকলন। উর্দুতেই তিনি রচনা করেছিলেন তার শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক এবং জনচিত্তে আগুন ধরানো কবিতাসমূহ। ১৯২৪ সালে তিনি বাঙ্গ-ই-দারা নামে এ সকল উর্দু কবিতার সংকলনটি প্রকাশ করেন। এ কাব্যের কবিতাগুলো দেশাত্মবোধক, প্রকৃতি প্রীতি ও ইসলামী অনুভ‚তি এই তিনটি অংশে বিভক্ত।
(৭) যবুর-ই-আযম : ইকবালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফার্সি কবিতা সংকলন যবুর-ই-আযম। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। এর দুটি অংশের প্রথম অংশে কবিতা ও গীত এবং দ্বিতীয় অংশের নাম গুলশান-ই-রাজ-ই-জাদীদ।
লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া এবং আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর কবি ইকবাল লাহোরে ফিরে যান এবং লাহোর কলেজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯১১ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি যেমন প্রচুর লেখালেখি করেন, তেমনি প্রচুর পড়াশোনাও করেন। মামলা সংক্রান্ত ফাইলপত্রাদি এবং আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। ফলে বাধ্য হয়েই তার দেশের রাজনৈতিক সমস্যা ও সংকট নিয়ে তাকে লড়তে হয়। এভাবে তিনি ভারত, ইউরোপ এবং আমেরিকায় খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব ওঠে। ১৯৩৩ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। ওই সাদামাটা জীবনযাপনের মধ্যদিয়েই ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল এ মনীষী মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি দেন।

ঠিকানা