লেখকঃ অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী

লেখক পরিচিতি

অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী

অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরীর বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু দিক

সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী এক জীবন্ত ইতিহাস। ইসলামী শিক্ষার প্রচলন ও শরিয়াভিত্তিক সমাজ গঠনে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি একাধারে নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী, শিরক ও বিদআতবিরোধী আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তা ও শিক্ষাবিস্তারের সফলতম অগ্রনায়ক এবং ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স জগতে ইসলামী শরিয়া প্রতিষ্ঠার অন্যতম চিন্তাসরবরাহকারী। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই ইসলামী চিন্তাবিদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের বহু প্রতিষ্ঠানের সফল প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নরসিংদীর জামেয়া কাসেমিয়া এবং বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আলোকিত প্রতিষ্ঠানের।

জন্মঃ

বিচক্ষণ আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মানুষটির আদি বসতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপাঞ্চল ভোলায়। ১৯৪৫ সনের ৩ মার্চ তারিখে বরিশালের ভোলা জেলার বোরহানুদ্দিন থানার সৈয়দ আওলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পিতা মাওলানা সাইয়্যেদ আবু জাফর আব্দুল্লাহ ছিলেন একজন খ্যাতনামা আলেম। তাঁর দাদার নাম হযরত মাওলানা মুফতি আব্দুল হাদী। তাঁর মহিয়সী মাতা ফাতেমা খাতুন ও নানা প্রখ্যাত আলেম আবেদ আলহাজ্ব মকবুল আহমেদ।

পারিবারিক ঐতিহ্যঃ

তাঁর পরিবারের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ও গৌরবজনক পরিচিতি। তাঁর পরিবারের উর্ধ্বতন পুরুষ প্রিয় নবী হযরত মুহাম¥দ (সা.) এর বংশধর। একারণেই তাঁর নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দটি যোগ করা হয়।

শৈশবঃ

অত্যন্ত দ্বীনি পরিবেশে আল্লামা জাফরীর শৈশব অতিবাহিত হয় । তাঁর পিতা ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার আলেম। পিতার তত্ত্বাবধানে ছোটকাল থেকেই তিনি ইলম ও আমলের উপর বেড়ে উঠেন।

তাঁর পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, জমিদার আগা বাখের খানের সময় একটি আরব পরিবার ‘বোরহান উদ্দিন’ নামক দ্বীপাঞ্চলে আগমন করেন। তখন জমিদার সাহেব তাদেরকে পূর্ব ও পশ্চিমে দু’টি দ্বীপ লাখেরাজ করে দেন। সেই আরব পরিবারের প্রধান ছিলেন সৈয়দ আওলিয়া, তাঁর নামানুসারেই এ দু’টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত গ্রামের নাম দেয়া হয় ‘সৈয়দ আওলিয়া’।

তাঁর সম্মানিত পিতা মাওলানা আবু জাফর আব্দুল্লাহ ছিলেন স্থানীয় মির্জাকালু ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। আবেদ জাহেদ ও প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হিসেবে এলাকায় তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল।

তাঁর দাদা মাওলানা মুফতি আবদুল হাদী ছিলেন ফুরফুরার প্রথম পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সাহেবের খলিফা। কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে তিনি সেকালে গোল্ডমেডেল পেয়ে টাইটেল পাশ করেছিলেন।

তাঁর নানা-বাড়ি ছিল ভোলা জেলার তজুমুদ্দিন থানার মহাদেবপুর গ্রামে। তাঁর নানাও একজন প্রখ্যাত আলেম ও আবেদ ছিলেন। তৎকালীন নোয়াখালীর কলাগাছিয়া পীর সাহেবের খলীফা ছিলেন তিনি।

কৈশোরঃ

আল্লামা জাফরীর বাবা মাওলানা আবু জাফর আব্দুল্লাহ ছিলেন তাঁর দাদার প্রতিষ্ঠিত ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ এবং প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। তাঁর বাবার কাছে বহু আলেম প্রতিনিয়ত আসা যাওয়া করতেন। তিনি সেসব আলেমদের খেদমত করবার স্থায়ী সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর দাদা মাওলানা মুফতি আবদুল হাদীও ছিলেন প্রসিদ্ধ আলেম এবং সেই এলাকার প্রসিদ্ধ পীর। তাঁর কাছে বহু আলেম ও মুত্তাকী লোকদের আগমন ঘটত। আল্লামা জাফরী শিশু ও কিশোর বয়সে আন্তরিকভাবে তাঁদের সেবা-যত্ন করতেন। বিনিময়ে এসব মানুষের কাছ থেকে তিনি পেতেন অকৃত্রিম স্নেহ আদর আর হৃদয় নিংড়ানো দোয়া।

বাল্য ও কৈশোর বয়সের কয়েকটি ঘটনাঃ

বাল্য বয়সে তিনি পরহেজগার, মুত্তাকী, পীর, আলেমে দ্বীন ও উস্তাদদের সেবা করার সুযোগ পান। তাঁর পিতা ও দাদার কারণে তিনি এই সুযোগ পেয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর দাদার কাছে আসতেন সৈয়দ মাওঃ আব্দুল গণি মাদানী। জাফরী সাহেবের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। একবার আল্লামা আবদুল গণি মাদানী তাঁর দাদার কাছে এলে জাফরী সাহেব তাঁর অনেক খেদমত করেন। মাদানী সাহেব খুশি হয়ে তাঁর জন্যে দোয়া করে বলেন-

“কামাল তুম কামাল বন যাও ”

এই সৈয়দ আবদুল গণি মাদানী ছিলেন রাসূল (সা.) এর মায়ের বংশের লোক। তিনি একজন বিশ্বখ্যাত ক্বারী ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে সহীহ শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা দিতেন তিনি। জাফরী সাহেবের দাদার সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। একারণে প্রায়ই তিনি তাঁর নানার বাড়িতে আসতেন। সে সুবাদে আল্লামা জাফরী এই মহান মানুষটির সাহচর্য পাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। সৈয়দ আবদুল গণী মাদানী মসজিদে নববীতে নামাজ পড়াতেন। তাঁর নামে মসজিদে নববীর একটি দরজার নামও রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর ছাত্র ক্বারী আবদুল মজিদও মসজিদে নববীতে নামাজ পড়াতেন। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম তিনিই উদ্বোধন করেন। শেষ বয়সে তিনি বাংলার সবুজ মাটিতেই মৃত্যুবরণ করেন, তবে সৌদি সরকার তাঁকে দাফন করেন মদিনার পবিত্র মাটিতে।

কিশোর বয়স থেকেই কামালুদ্দীন জাফরী একজন একনিষ্ঠ নামাজি ছিলেন। শুধু নিজেই নামাজ পড়তেন- তা নয়, বরং এলাকার অন্যসব বাল্যবন্ধুদের নিয়েও নামাজ আদায় করতে যেতেন তিনি। সমাজের সবাইকে নামাজি মুত্তাকি মানুষে পরিণত করবার লক্ষ্যে কিশোর বয়সেই তিনি “নামাজ কায়েম পরিষদ” গঠন করেন। প্রতিদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে কিশোর বন্ধুদের নিয়ে সুর করে গান গেয়ে নামাজের প্রতি আহবান করত এই দল। গান ছিল এরকম:

“উঠ মুমিন মুসলমান সময় যায় যে বইয়া

পরকালে কি জব দিবা নামাজ অ লাগিয়া।”

বাল্যশিক্ষাঃ

বাল্যকাল থেকেই আল্লামা জাফরী তুখোর মেধাবী ও প্রচণ্ড সাহসী ছিলেন। গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে দাদার প্রতিষ্ঠিত মির্জাকালু ইসলামিয়া সিনিয়ার ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হন। তখনও মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁর বাবা অধ্যক্ষ আবু জাফর আব্দুল্লাহ।

কুমরাদী সিনিয়র মাদরাসায় উচ্চশিক্ষাঃ

উনিশ শতকে পূর্ব বাংলার সেরা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নরসিংদীর শিবপুরস্থ কুমরাদী দারুল উলুম সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। উচ্চ শিক্ষার জন্য আল্লামা জাফরী ১৯৫৬ সনে অত্র মাদরাসায় ভর্তি হন। বাল্য বয়সে এত দূরে তাঁর মন টিকে নি বলে বাধ্য হয়ে অল্পদিনের ব্যবধানেই উস্তাদদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি পুনরায় বাবার প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসেন এবং ১৯৫৮ সনে কৃতিত্বের সাথে দাখিল পাশ করেন।

আবারো কুমরাদী মাদরাসায়:

ভারতবর্ষের সেরা ইসলামী বিদ্যাপিঠ কুমরাদী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে চার বৎসর অধ্যয়ন করে ১৯৬২ সনে তিনি আলিম পাশ করেন। অতপর ফাজিল শ্রেণীতে দুই বৎসর অধ্যয়ন করেও কুমরাদী মাদরাসা থেকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা দেয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। পরীক্ষার কিছুদিন পূর্বে তাকে ফিরে যেতে হয় নিজ বাড়িতে। অবশেষে মির্জাকালু ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা থেকে ১৯৬৪ সনে ফাজিল পরীক্ষা দেন এবং কৃতিত্বের সাথে কৃতকার্য হন।

ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি:

ফাজিল পাশ করে তিনি ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং কিছু দিন অধ্যয়ন করবার পর নিয়মিত ক্লাশ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

জমিয়তে এত্তেহাদুল ওলামায় যোগ দান:

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংকটময় প্রেক্ষাপটের কারণে তিনি জমিয়তে এত্তেহাদুল ওলামায় যোগ দেন। তখন এত্তেহাদুল ওলামার প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওলানা আবদুল আলী এম পি। উল্লেখ্য, মাওলানা আব্দুল আলী ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ সাহেবের বাবা। ১৯৬৭-৬৮ সনে আল্লামা জাফরী এই সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ছাত্র বয়স থেকেই উর্দু ও বাংলা ভাষায় তার অসাধারণ বাগ্মিতা থাকায় তিনি নেতৃত্বে বেশ সুনাম কুড়ান।

রেডিও পাকিস্তান ‘ঢাকা সেন্টারে’ নিয়োগ লাভ:

রেডিও পাকিস্তানে তখন “আমাদের জিন্দেগী” নামের একটি ইসলামী অনুষ্ঠান পরিবেশিত হতো। এই অনুষ্ঠানে কুরআন ও হাদিসের আলোকে নিয়মিত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পেশ করার জন্যে তিনি ঢাকা সেন্টারে নিয়োগ পান।

ইমাম ও খতীব হিসেবে নিয়োগ লাভ:

রেডিও পাকিস্তানে তার যুগোপযোগী ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। এসময় মিরপুর বায়তুল মুশাররফ মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তাকে মসজিদটির ইমাম ও খতীব করার প্রস্তাব দেয়া হয়। রাজি হয়ে যান তিনি। মসজিদকেন্দ্রিক নানামুখী দ্বীনি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।

ঢাকা আলিয়া মাদরাসা ত্যাগ:

নানামুখী ব্যস্ততার কারণে ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে পারেন নি তিনি। বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে ক্লাস চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়লে একসময় ঢাকা আলিয়া মাদরাসা ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

সেকেন্ড মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োগ লাভ:

গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানায় অবস্থিত দুর্বাটি মদিনাতুল উলুম আলিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুস সালাম সাহেব ২২০ টাকা বেতনে মাওলানা জাফরীকে সেকেন্ড মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ দেন। দুই বছর সেখানে মুহাদ্দিস হিসেবে অধ্যাপনা করেন তিনি।

 

প্রথম শ্রেণীতে কামিল পাশঃ

দুর্বাটি আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস থাকাকালে একই মাদরাসা থেকে ১৯৭৩ সনে কামিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে হাদীস বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ করেন তিনি। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি উস্তাদদের খেদমত ছিল তাঁর নেশা।

সুবক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ:

কুমরাদী মাদরাসায় ছাত্র থাকাকালেই মাওলানা জাফরী নরসিংদীবাসীর কাছে সুবক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দুর্বাটি মাদরাসায় মুহাদ্দিস পদে যোগদানের পর থেকে তার আলোচনা আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। কুরআন-সুন্নাহর দলিল সহযোগে যুক্তিপ্রমাণনির্ভর আলোচনার জন্য নরসিংদীবাসীর মাঝে তাঁর ভক্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার সুনাম-সুখ্যাতি।

নরসিংদী আগমনের আহবান:

সুবক্তা ও একজন যোগ্য আলেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করার সুবাদে নরসিংদীর স্থানীয় গুণীজন তাঁকে তাদের মাঝে নিয়ে আসবার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭৬ সনে একদল ইসলামপ্রেমী মানুষ তাকে নরসিংদী আসবার আমন্ত্রণ জানান। সেটি ছিল ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণ।

জামেয়া প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন:

বিজ্ঞ এই আলেমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নরসিংদীর প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত সুধীমহল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন- সর্ব জনাব রুস্তম আলী আশরাফি, আসহাব উদ্দীন ভূঁইয়া (মধু ভূঞা), মৌলানা মোঃ জালাল উদ্দীন, আব্দুর রহমান ভূঁইয়া, তায়েব উদ্দীন ভূঁঞা, মৌলভী তাফাজ্জল হোসেন, এ, কে, এম জয়নাল আবেদীন, তোতা মিয়া, শমসের আলী, শামসুদ্দীন ভূঁঞা, সাহাবুদ্দীন মিয়া, মোঃ বদরুজ্জামান, পোস্ট মাস্টার, মাওলানা ফজলুল হক প্রমুখ। এসব বিদগ্ধ গুণীজন আল্লামা জাফরীর কাছে একটি আধুনিক মানের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার আবেদন রাখেন। জাফরী সাহেব তাদের এ প্রস্তাবকে ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করেন এবং আন্তরিকতার সাথে একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবার প্রতিশ্রুতি দেন।

জামেয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম সভা:

জামেয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম সভাটি নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দী মোড় (বর্তমানে বায়তুল আমান) জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ১৩৮০ সালের ২৩ পৌষ তারিখে নরসিংদীর পূর্বোল্লিখিত সুধীজন সেই সভায় অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে একটি অর্গানাইজিং কমিটি গঠিত হয়; এর সভাপতি হন জনাব রুস্তম আলী আশরাফী এবং সেক্রেটারি হন মাওলানা জালাল উদ্দিন। মাওলানা জাফরী কমিটির সদস্য থাকেন।

মূলত এই সভাটিই ছিল জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে জামেয়া প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে একদল আল্লাহমুখী মানুষের মহান উদ্দেশ্যের যাত্রা আরম্ভ হয়।

মাওলানা জাফরীকে সেক্রেটারি নিয়োগ:

৪ আগস্ট ১৯৭৬ তারিখে অর্গানাইজিং কমিটির নবম বৈঠক আহ্বান করা হয়। সভায় তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব মাওলানা জালাল উদ্দিন বিভিন্ন কাজে তার কর্মব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন জনাব মাস্টার বশির উদ্দিন মাওলানা জাফরীকে সেক্রেটারী করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং জনাব শমসের আলী সাহেব সেই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সর্বসম্মতি ক্রমে মাওলানা জাফরী কমিটির সেক্রেটারী হিসেবে মনোনীত হন। শুধু তাই নয়, সেদিন থেকে জামেয়া প্রতিষ্ঠার যাবতীয় কর্মকাণ্ড সকলের অনুরোধক্রমে সেক্রেটারির কাঁধে অর্পিত হয়।

শুরু হলো স্বপ্নের পথচলা :

জামেয়া কাসেমিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর কাঁধে অর্পিত হওয়ার পর তিনি তা আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন। মাওলানা জাফরীর পরিবারের খরচ মিটানোর জন্য অধ্যক্ষ হিসেবে তার বেতন মাসিক ৫০০ টাকা ধার্য করা হয়। জনাব আসাবুদ্দিন মধু ভূঞা সাহেব এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জামেয়া কাসেমিয়াকে একটি আদর্শ আবাসিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দৃপ্ত পায়ে যাত্রা শুরু করেন আল্লামা জাফরী। তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

হজ্বে গমনঃ

জামেয়া প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বৎসরের মাথায় ১৯৭৭ সালে মাদরাসার পরিচালনা কমিটি অধ্যক্ষ জাফরীকে হজ্জে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল জামেয়ার উন্নয়ন। হজ্জ্বে পাঠাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তাই কমিটির সম্মানিত সদস্যগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নরসিংদী বাজার থেকে তখন প্রায় ১৬০০০/=(ষোল হাজার টাকা) উত্তোলন করে আল্লামা জাফরীকে হজ্জ্বে পাঠানো হয়।

রাবেতা আলম আল ইসলামীতে আবেদন:

আল্লামা জাফরী হজ্জ্বে গিয়ে ক্বাবাকে সামনে রেখে মহান প্রভুর দরবারে তাওহীদের মশাল হিসেবে জামেয়াকে কবুল করার প্রার্থনা করেন। পাশাপাশি জামেয়ার অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘবের জন্যে “রাবেতা আলম আল ইসলামী”তে একটি আবেদন দাখিল করেন। মাত্র এক বছর পর রাবেতার পক্ষ থেকে জামেয়ার অনুকূলে ১২,০০,০০০/= (বারো লক্ষ টাকা) প্রেরিত হয়। তখনকার যুগে এটা ছিল এক রাজ্য পাওয়ার আনন্দ। প্রদত্ত অর্থ থেকে ৯,০০,০০০/= (নয় লক্ষ টাকা) দিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া নামের বিশাল এক শিক্ষা ইমারত তৈরি করা হয়। আর অবশিষ্ট ৩,০০,০০০/= (তিন লক্ষ টাকা) দিয়ে গাবগাছসহ পশ্চিমের ঈদগাহের জায়গা ক্রয় করা হয়।

মহামান্য সৌদি রাষ্ট্রদূতের আগমন:

জামেয়া প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৭৮ সনের ৫ এপ্রিল অধ্যক্ষ কামালুদ্দীন জাফরী তৎকালীন মহামান্য সৌদি রাষ্ট্রদূতকে জামেয়ার বার্ষিক মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

মক্কার কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি:

ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতীব। তিনি জামেয়ার বার্ষিক মাহফিলে এসে ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয় দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। আল্লামা জাফরীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেখে তিনি তাঁকে মক্কা কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পরামর্শ এবং এব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন।

রেডিও জেদ্দায় নিয়মিত আলোচক হিসেবে নিয়োগ লাভ:

মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি রেডিও জেদ্দায় নিয়মিতভাবে সাওয়াল-জওয়াব কথিকা, দারসুল কুরআন ও দারসুল হাদিস পেশ করতেন।

ক্বাবার মালিকের কাছে আরাধনা:

হজ্জের সময় ও মক্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আল্লামা জাফরী ক্বাবাকে সামনে নিয়ে প্রায়শই দীর্ঘ সিজদায় মহান প্রভুর দরবারে আরাধনা করতেন তাঁর হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।

দ্বীনের টানে দেশে প্রত্যাবর্তন:

মক্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই বৎসর অধ্যয়নশেষে জামেয়ার পরিচালনা ও তাওহীদের বাণী প্রচারের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে আল্লামা জাফরীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন মহামান্য সৌদি রাষ্ট্রদূত শেখ ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খাতিব ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরামগণ।

সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতী আব্দুল্লাহ বিন বাজ এর প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ :

সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার পর তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। এক পর্যায়ে তিনি সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী আব্দুল্লাহ বিন বাজ এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।

 


দা’য়ী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রণ:

জামেয়া কাসেমিয়ার অধ্যক্ষ এবং দা’য়ী হিসেবে সারা দেশে সুনাম ছড়িয়ে পড়লে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তার প্রতি আমন্ত্রণ আসতে থাকে। সে থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামের প্রসারে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের নানান দিক-দিগন্তে। বর্তমানে ইসলামের এই ক্রান্তিলগ্নে তাঁর দাওয়াতি মিশন এখন সারা পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি তার এই দাওয়াতি মিশনে অসাধারণ গতি এনেছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ সফর করেছেন তিনি। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশে বহুবার সফর হয়েছে তাঁর।

ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় বিভিন্ন দেশে আল্লামা জাফরী:

ইউরোপ:

ইউরোপে সফরে গেলেই সেখানকার ‘চ্যানেল এস’-সহ বিভিন্ন চ্যানেল এবং কমিউনিটি ও ম্যানচেস্টার রেডিও তাঁর আলোচনা প্রচার করে।

ইউরোপে মসজিদ নির্মাণ:

ইউরোপের সর্ববৃহৎ মসজিদ নির্মাণে বিশেষ অবদান রাখেন আল্লামা জাফরী। ইউরোপ অবস্থানকালে তিনি সেখানে ইমামতি করেন, খুৎবা দেন এবং ঈদের সময় ঈদের সালাত পড়ান। এছাড়াও তিনি ইউরোপের আল-আমিন কমার্শিয়াল ইসলামিক বিনিয়োগ সংস্থার শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান। ইস্ট লন্ডনের সবচেয়ে বড় মসজিদের চেয়ারম্যানও তিনি।

অস্ট্রিয়ায় মসজিদ নির্মাণ:

অস্ট্রিয়ায় সফরকালে তিনি সেখানে একটি সুদৃশ্য মসজিদ নির্মাণ করেন এবং উক্ত মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে তারই ছাত্র মাওলানা মোঃ রফিকুল ইসলাম আল- মাদানীকে নিযুক্ত করেন।

কানাডার টরেন্টো মহানগরীতে ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা:

প্রথমবারের মতো কানাডার টরেন্টো মহানগরীতে ইসলামের দায়ী হিসেবে এক কনফারেন্সে সফরে গেলে সেখানকার ইসলামপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ সেখানে একটি ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানায়। সকলের সার্বিক সহযোগিতায় তিনি “ইসলামিক সেন্টার অফ টরেন্টো” প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে তিনি উত্তর আমেরিকায় ইসলামের প্রসারে এক অবিস্মরণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন; যা যুগ যুগ ধরে সেই অঞ্চলের মুসলিমদের সত্যের পথ দেখাবে ইনশাআল্লাহ।

 

সুদমুক্ত অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আল্লামা জাফরীর অবদানঃ

দেশ বিদেশে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি বাংলাদেশে সুদমুক্ত অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন আল্লামা জাফরী। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শরিয়া এডভাইজারি কাউন্সিল’র ‘সদস্য সচিব’ হিসেবে দীর্ঘ দিন গুরুত্বপূর্ণ দিক নিদের্শনা দান করে সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় ইসলামী ব্যাংককে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

শিক্ষা ব্যবস্থায় আল্লামা জাফরীর অবদান:

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড; উন্নয়নের চাবিকাঠি; একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। জাতি গঠনে শিক্ষার রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত- সে ব্যাপারে আল্লামা জাফরী গভীর চিন্তা করে থাকেন। ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার সুসমন্বয় সাধন এবং তার বাস্তব প্রতিফলনের লক্ষ্যে তিনি জামেয়া কাসেমিয়ার পাশাপাশি আরো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। ঢাকায় উত্তরায় তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘হলি ক্রিসেন্ট স্কুল’। ব্রিটিশ কাউন্সিলের কারিকুলামের সাথে ইসলামি শিক্ষার সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে এটি একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। তাঁর দীর্ঘলালিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও বাস্তবায়িত হয়েছে। ঢাকার গোপীবাগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’। শিক্ষার অসাধারণ বিশেষত্বের কারণে অল্পদিনের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইসলাম ও সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির পাঠদানের পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামি দাওয়াহর প্রসার ও জনহিতকর কর্মসূচিও গ্রহণ করে আসছে।

সমাপনীঃ

সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী কোন ব্যক্তি নয় বরং গৌরবদীপ্ত জীবন্ত ইতিহাসের নাম। জামেয়া পরিবারের পক্ষ থেকে এ মহান আলোকিত ব্যক্তির দীর্ঘ নেক হায়াত কামনা করছি। পাশাপাশি মহান রবের দরবারে পার্থনা করছি, তিনি যেন তাঁর জীবনের সকল নেক আমলগুলো কবুল করেন, ছাইয়্যেয়াতগুলো মাফ করেন এবং পরকালে সর্বোচ্চ মাক্বাম দান করেন। আমীন॥

————————— মোঃ রুহুল আমীন

সিনিয়র শিক্ষক (আই.সি.টি)

সাবেক ছাত্র, জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদরাসা, নরসিংদী।

e-mail : [email protected]

http://jameaquasemia.edu.bd/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%80/

ঠিকানা