লেখকঃ জিয়াউর রহমান

লেখক পরিচিতি

জিয়াউর রহমান

জিয়াউর রহমান (১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ৩০ মে ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগনের উপর হামলা করার পর তিনি তার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দি করে বিদ্রোহ করেন এবং স্বশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হন।


প্রাথমিক জীবন
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম ও শৈশবে তার ডাক নাম ছিলো কমল। তার পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তার পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। ভারতবর্ষ বিভাগের পর তার পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান। তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

পাকিস্তানে সামরিক পেশাজীবন
১৯৫৩ সালে তিনি কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন সুদক্ষ প্যারাট্রুপার ও কমান্ডো হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। করাচীতে দুই বছর চাকুরি করার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ঐ সময়ই ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের বালিকা, খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বসূচক পুরস্কার লাভ করে, জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিল এদের অন্যতম। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে[৪]। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত পদক লাভ করে। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান। এবং কয়েক মাস বৃটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন।[৩] ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায়। সে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ চলে যান আত্মগোপনে। জনগণ তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন এবং ২৬শে মার্চ পরে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।


জনসভায় বক্তব্যরত জিয়া
মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তারা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন  এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী,রাঙ্গামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেণী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। তিনি সেনা-ছাত্র-যুব সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই তিনটি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক  হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের  ও জেড-ফোর্সের  কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশে সামরিক পেশাজীবন
স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়োগ করা হয় যে ব্রিগেডের সদস্যরা তারই অধীনে ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। '৭২ এর জুন মাসে তিনি কর্নেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ (উপসেনাপ্রধান) নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ঐ বছরের অক্টোবরে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল করেন এবং নিজেও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবী গ্রহণ করেন।

শেখ মুজিব হত্যা ও পরবর্তী সময়
১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হবার ১০ দিন পর জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন।  ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের  পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপরে ঐ বছরের ২৫শে আগষ্ট জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মী স্টাফ নিযুক্ত হন। ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয় যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার কারনে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় এবং জিয়ার প্রতি অবিচার করায় ক্ষুদ্ধ সেনাসদস্যরা ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং জিয়াউর রহমানকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে । ঐ দিন সকালেই পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় শেরে বাংলা নগরে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে ক্ষুব্ধ জোয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম,কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম নিহত হয় ।

রাষ্ট্রপতি জিয়া

এই নিবন্ধের যাচাইযোগ্যতার জন্য অতিরিক্ত তথ্যসূত্র প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র সংযোজন করে নিবন্ধটির মান উন্নয়নে সহায়তা করুন। তথসূত্রবিহীন বিষয়বস্তুসমূহ পরিবর্তন করা হতে পারে এবং অপসারণ করাও হতে পারে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান থাকাকালে জিয়া এই গাড়িটি ব্যবহার করতেন।


১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন, ১৯৭৬ সালে কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাঁকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন করা হয় ১৯৭৬ সালে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন, ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম এঁর উত্তরসূরি হিসেবে ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন,[কখন?]

“ I will make politics difficult for the politicians. ”


১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেন। ২ জনের মনোনয়নপত্র বাছাই –এ বাদ পড়ায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ৯ জন। ১ জন আপীল দাখিল করায় ও তাঁর আপীল গৃহীত হওয়ায় এবং কোন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ১০ জন ছিল। এরপর জিয়াউর রহমান মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ

জিয়াউর রহমান এবং স্ত্রী খালেদা জিয়া, ১৯৭৯
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব প্রদান করে তা জনপ্রিয় করে তোলেন। বাংলাদেশে বহু সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের মতের ও ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠী বাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাই জিয়া মনে করেন যে, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ত্ব আরোপ করেন এবং এই ধারণা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে শক্তিশালী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান।

আইন শৃঙ্খলা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান দেশে শান্তি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করেন। পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে তিনি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। ‍সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থার মাধ্যমে ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পেশাগত শৃঙ্খলা উন্নয়নের কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তাদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেন। ‍সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট সফল হলেও জিয়াউর রহমানকে বেশ কয়েকটি সেনা-বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মোকাবেলা করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়ে তাঁকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং অবাধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান যত দ্রুত সম্ভব রাজনীতির গণতন্ত্রায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এইভাবে, তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে নিয়োজিত থাকেন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

এই অনুচ্ছেদটিতে কোনো উৎস বা তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করা হয়নি। দয়া করে উপযুক্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র থেকে উৎস প্রদান করে এই অনুচ্ছেদটির মানোন্নয়নে সাহায্য করুন। তথসূত্রবিহীন বিষয়বস্তুসমূহ পরিবর্তন করা হতে পারে এবং অপসারণ করাও হতে পারে।
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন (Chairperson)। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এর প্রথম মহাসচিব ছিলেন। জিয়ার এই দলে বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ সকল স্তরের লোক ছিলেন। বিএনপির সব থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিয়োগ পদ্ধতি। প্রায় ৪৫% সদস্য শুধুমাত্র রাজনীতিতে নতুন ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন তরুণ। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যদের নাম এবং ১৯শে সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গঠন করার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮শে আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে আব্দুল মালেক উকিল এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি ও মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।

জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:

সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান।
জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া।
দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব।
সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান।
গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন।
গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা।
হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ।
২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ।
নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ।
কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ।
যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ।
ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন।
তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ।
তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি।
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে 'সার্ক' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ।
বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ।
জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন।
শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরপরই জিয়াউর রহমান দলের কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে কর্মশালা আয়োজনের উদ্যোগ নেন, যার মাধ্যমে দলের কর্মীদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, দলের আদর্শ, সাংগঠনিক নিয়ম-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হত।

১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এরকম একটি কর্মশালা উদ্বোধনকালে তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন,

“ কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনওই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছে। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ”


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ভারত সহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার দুটি মূল দিক ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা [৫] । জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ার আওতায় আরও ছিল বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ, যে সম্পর্কে স্বাধীনতার পর থেকেই শৈতল্য বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুবিধা ও উপকারিতা বাংলাদেশ আজও পুরোমাত্রায় উপভোগ করছে, কেননা বর্তমানে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মস্থলে পরিণত হয়েছে তার রূপরেখা জিয়াই রচনা করে গিয়েছিলেন [২৭] । এক্ষেত্রে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের সাথে স্থাপিত সম্পর্ক অনেকটা অর্থনৈতিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র [২৮] ও চীনের [২৯] সাথে স্থাপিত সম্পর্কে সামরিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলোও প্রাসঙ্গিক ছিল। বিশেষ করে চীনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পূণর্গঠনের কাজ অনেকটা তরান্বিত করেছিলেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রাগারের দিকে তাকালে সেই সত্যই প্রতিফলিত হয়। সামরিক পূণর্গঠনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সাথে উন্নত কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে জিয়া রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা বিমানের আধুনিকীকরণও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন [৩০] । এছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে শক্তিশালী জাপানকে হারিয়ে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত [৩১] হয়।

প্রাথমিক ভাবে এসব সংস্কার বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারতের সাথে সামান্য দূরত্ব সৃষ্টির ইঙ্গিত বহন করলেও জিয়াউর রহমান যে আঞ্চলিক সহায়তাকে গুরুত্ব দিতেন সেই সত্যের প্রতিফলন ঘটে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) গঠনে তাঁর উদ্যোগ ও অবদানের মধ্য দিয়ে। যেহেতু ভারত সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ কূটনৈতিক নৈকট্য ভারতের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারত। চীনের সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্যস্থাপিত সুসম্পর্কও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ [৩২] । কিন্তু জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে আঞ্চলিক প্রতিযোগীতার বদলে সহযোগীতা স্থাপিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে যার ফলে বাংলাদেশ সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হবে। এই লক্ষ্যে তিনি সার্কের রূপরেখা রচনা করেন যা পরে ১৯৮৫ সালে বাস্তবে রূপ নেয় ও প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ক।

মৃত্যু

জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে — তিনি সেনাবাহিনীতে তার বিরোধিতাকারীদের নিপীড়ন করতেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তবে জিয়া অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন। অনেক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। বিপদের সমূহ সম্ভবনা জেনেও জিয়া চট্টগ্রামের স্থানীয় সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে ঘঠিত কলহ থামানোর জন্য ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখানে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে থাকেন। তারপর ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ্যাধিক মানুষ সমবেত হয় [৩৩][৩৪] ।


জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স
অবস্থান শেরে বাংলানগর, বাংলাদেশ


সমালোচনা ও কৃতিত্ব
রণনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদদের কাছে সমাদৃত ও স্বীকৃত।[৩৫] তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা বিতর্কিত। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারকার্য বন্ধ করার জন্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের অনুমোদিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়ার দ্বারা তাঁর আমলে বৈধকরণ করা হয়। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন শেখ মুজিবুর রহমানের কতিপয় হত্যাকারীকে বিদেশে প্রেরণ করা হয়। ঢাকা হাইকোর্ট এক রায়ে জিয়ার সামরিক শাসনসহ ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকে "বেআইনী ও অসাংবিধানিক" বলে ঘোষণা করে। জিয়ার সামরিক আইন ও আদেশ, অভ্যূত্থান থেকে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ এবং ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত গণভোট সংবিধানবিরোধী বলে ঘোষিত হয় এবং আদালতের রায়বলে ইনডেমনিটি আধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। শেখ মুজিবের আমলের শেষের দিকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা দমন এবং বাকশাল (মুজিবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একদলীয় শাসন) রহিতকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে পুনরায় প্রতিষ্ঠার জন্য জিয়াকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। অপরপক্ষে, জিয়া তাঁর বিরোধীদের দমন করার জন্য সমালোচিত হন।[৩৬] জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দাবী করা হয় অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা নিহত অথবা গুম হন। [৩৭] ১৯৭৭ সালের অক্টবারের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়।[৩৮] তবু অর্থনীতি পুনঃনির্মাণ করার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার গ্রহণের জন্য জিয়াকে কৃতিত্ব দেয়া হয়। তাঁর ইসলামিক মনোভাব তাঁকে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন এনে দেয়। তাঁর জাতীয়তাবাদী দর্শন অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয় যারা ভারত ও সোভিয়েতপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। মুজিবের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাখান করে জিয়া বাংলাদেশে ইসলামিক রাজনীতি চালু করেন এবং মুসলিম জাতিসমূহের সহযোগিতা সংস্থায় বাংলাদেশকে তুলে ধরেন যা সাধারণ জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। তবু অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, এসব ব্যবস্থা বাংলাদেশের অনেক উপজাতিয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন ও বিরুদ্ধাচরণ করে যা ভবিষ্যতের বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক ও উপজাতিক দ্বন্দ্বকে ত্বরান্বিত করে।যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কেবল জিয়াকে একা এসব কার্যক্রমের জন্য দায়ি করা যায় না।[৩৯] জিয়া যে সাধারণ ও বিলাসবিহীন জীবনযাপন করতেন তা সর্বজনস্বীকৃত।

ঠিকানা