ভূমি ব্যবস্থা
ইসলামী অর্থনীতিতে জমির গুরুত্ব

মানুসের সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য- খাদ্য ও শিল্পপণ্যের কাঁচামাল- জমি হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে- তাই মানুষের জীবনের নানাবিধ ও অপরিসীম গুরুত্ব কেহই অস্বীকার করিতে পারে না।

ভূমির গুরুত্ব কুরআন মজীদে নিম্নলিখিত আয়াতসমূহ হইতে বিশেষভাবেব প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

আমি তোমাদিগকে পৃথিবীর বুজে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি এবং তাহাতেই তোমাদের জন্য জীবিকা-নির্বাহের যাবতীয় উপাদান সৃষ্টি করিয়াছি।….

অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

আল্লাহ তা’আলাই জমিকে তোমাদের জীবিকা উপার্জনের জন্য নম্র ও অনুকূল (চাষযোগ্য ও উৎপাদনী শক্তিপূর্ণ) করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। তোমরা উহার বিভিন্ন পথে চলাফিরা (শ্রম) করিয়অ জীবিকা উপার্জন কর এবং তাহা হইতে আল্লাহর দেওয়া রিযিক গ্রহণ কর।

সূরা ‘আল-বাকারা’র একটি আয়াতে আল্লাত তা’আলা বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

হে ঈমানদারগণ, তোমাদের সদুপায়ে উপার্জিত সম্পদ ব্যয় কর: এবং তোমাদিগকে জমি হইতে আমি যাহা কিছু উৎপাদন করিয়া দেই, তাহা হইতেও (আল্লাহর পথে) খরচ কর।

প্রথমোল্লিখিত আয়াত হইতে জানা যায় যে, আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই দুনিয়অয় বসবাস করিবার সুযোগ দিয়াছেন এবং এই পার্থিব জীবন সুষ্ঠুরূপে যাপন করার জন্য অপরিহার্য জীবিকার ব্যবস্থাও তিনি এই পৃথিবীতেই করিয়া দিয়াছেন।

দ্বিতীয় আয়াত হইতে সুষ্পষ্টরূপে এই তথ্য জানিতে পারা যাইতেছে যে, মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় জীবিকা প্রধানতঃ এই পৃথিবীর ভূমি হইতে লাভ করিতে হইবে। এই ভূীম হইতে প্রয়োজনীয় জীবিকা প্রধানতঃ এই পৃথিবীর ভূমি হইতে লাভ করিতে হইবে। এই ভূীম হইতে প্রয়োজনীয় দ্রব্য লাভ করিবার জন্য উহার ব্যাপক অনুসন্ধান চালাইতে হইবে এবং যে যে উপায়ে তাহা হইতে জীবিকা সংগ্রহ করা সম্ভব, সেই সেই উপায়ে তাহা হইতে ফসল ও দ্রব্য সম্ভার সংগ্রহ করিতে হইবে, এই বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ও গবেষণা চালাইতে হইবে। মাটির পরতে-পরতে জীবিকার যে অশেষ সম্ভাবনাময় গোপন ভান্ডার লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকাইয়া রহিয়াছে, তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।

শেণোব্ক আয়াতে বিশেষ করিয়া ঈমানদার লোকের জন্য ভূমি-ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি মৌলিক নির্দেশ উল্লেখিত হইয়াছে। প্রথ এই যে, ঈমানদার লোকগণ সাধারণভাবে যাহা কিছু উপার্জন করিবে, তাহাকে অবশ্যই পবিত্র, নির্মল এবং সকল নিষিদ্ধ উপায়-মুক্ত হইতে হইবে। দ্বিতীয়, তাহার উপর এবং ভূমি হইতে উৎপন্ন জীবিকার উপর একদিকে সৃষ্টিকর্তার এবং অন্য দিকে সৃষ্ট মানুষের অধিকার রহিয়াছে। এই উভয প্রকারের অধিকার যথাযথরূপে আদায় করা প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য এবং তৃতীয় এই যে, এইভাবে তাহারা যাহা কিছুই উপার্জন করিবে, সীমিত মালিকানা কৃর্তৃত্ব সহকারে তাহা ভোগ ও ব্যবহার করারও তাহাদের পূর্ণ অধিকার রহিয়াছে।

জমির মালিকানা

আল্লাহ তা’আলা সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা এবং একচ্ছত্র মালিক। কিন্তু তাহার এই মালিকানা যে তাঁহার নিজের ভোগ-ব্যবহারের জন্য নয়, তাহ সর্বজনবিদিত। আল্লাহ তা’আলা নিখিল বিশ্বভূবনকে নিজ ইচ্ছায় ও নিজ শক্তির বলেই সৃষ্টি করিয়াছেন: কিন্তু সৃষ্ট জগতের এই অফুরন্ত দ্রব্য-সামগ্রীর কোন একটিও আল্লাহর ভোগ ও ব্যবহারের জন্য দরকার হয় না। তিনি সকল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে, কোন অভাব ও আবশ্যকতাই তাঁহাতে স্পর্শ করিতে পারে না, তাঁহার সীমাহীন নিরংকুশ ক্ষমতা কেহ সংকুচিত করিতে সক্ষম নয়। বস্তুত তিনি এই সব কিছুই মানুষের কল্যাণের জন্য- মানুষেরই ভোগ-ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন। অতএব নিখিল জাহানের সৃষ্টি, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ এবং মানুষের ভোগ-ব্যবহারের নিয়ম-পদ্ধতি প্রণয়নের নিরংকুশ অধিকার প্রয়োগের দিক-দিয়াই আল্লাহর নিরংকুশ মালিকানা স্বীকৃত ও কার্যকর হইবে। আর এইজন্যই মানুষ আল্লাহর দেওয়া বিধান ও পদ্ধতি অনুযায়ী পৃথিবী ভোগ ও ব্যবহার করিয়াছে কিনা, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাঁহার চূড়ান্ত ও পূংখানুপুংখ হিসাব গ্রহণ করিবেন। এই ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা সম্পূর্ণরূপে একক এবং অংশীদারহীন। বস্তুত আল্লাহর তাওহীদী মালিকানার প্রকৃত অর্থ ইহাই। এই কথাই ঘোষণা করা হইয়াছে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে:

(আরবী**********)

সেই আল্লাহ তা’আলাই প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করিয়াছেন এবং অতঃপর উহার ব্যবহার ও প্রয়োগের জন্য বিধান ও ব্যবস্তাও দান করিয়াছেন।

সমগ্র পৃথিবী এবং ইহাতে যাহা কিছু আছে, তাহা সবই আল্লাহ তা’আলা মানুষের ভোগ ও ব্যবহারের জন্য, মানুষেরই কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন।

(আরবী**********)

জমি ও পৃথিবীর বুকে যাহা কিছু রহিয়াছে, আল্লাহ তা’আলা তাহা সবই-হে মানুষ, তোমাদেরই জন্য ‍সৃষ্টি করিয়াছেন।

আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি এই জমি ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি বস্তুই মানুষের ভোগ ও ব্যবহারে জন্য নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা আমরা উক্ত আয়াত হইতে নিঃসন্দেহে জানিত পারি। মানুষ উহা কিভাবে করায়ত্ব করবে এবং কোন নীত ও নিয়মে তাহা ভোগ ও ব্যবহার করিবে, তাহার মূলনীতিও আল্লাহ তা’আলাই দান করিয়াছেন। কুরআন মজীদে সূরা আ’রাফের নিম্নলিখিত আয়অতে তাহার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়অ যায়:

(আরবী**********)

জমি আল্লাহ তা’আলার, তাঁহার বান্দাদের মধ্য হইতে তিনি যাহাকে ইচ্ছা উহার উত্তরাধিকার দান করেন।

মন রাখিতে হইবে যে, আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা তাঁহারই বিরচিত নিয়মের মূল কথা। অতএব পৃথিবীর ও ভূমির প্রকৃত মালিক আল্লাহ নিজে হইলেও উহার উত্তরাধিকার আল্লাহর দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী মানুষেরই জন্য নির্দিষ্ট। মানুষ আল্লাহর বিধান অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন উৎপাদক শক্তি ও দ্রব্য-সম্পদ উপার্জন করিবে, করায়ত্ব করিবে এবং ভোগ ও ব্যবহার করিবে। ইহাই হইতেছে আল্লাহর ‘মালিকানা’র অধীন মানুষের ‘মালিকানা’র ব্যবহারিক তাৎপর্য। আল্লাহর মালিকানা সম্পর্কে এই মৌলিক আলোচনার ফলে এ কথা সুস্পষ্ট হইয়াছে যে,

(আরবী**********) (পৃথিবী আল্লাহর) (আরবী**********)(পৃথিবীকে আল্লাহ সমগ্র জীবের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন এবং (আরবী**********) ‘আকাশ এবং পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে, তাহা সবই আল্লাহর- প্রভৃতি আয়াত হইতে ‘জাতীয় মালিকানা’র মার্কসীয় মতবাদ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করা এবং ‘জমির মালিক আল্লাহ- কোন ব্যক্তি নয়’ বলিযঅ দেশের যাবতীয় জমিক্ষেত রাষ্ট্রের- আর প্রকৃত পক্ষে ক্ষমতাসীন মুষ্টিমেয় শাসন-কর্তৃপক্ষের নিরংকুশ কর্তৃত্বে সমর্পণ করা সম্পূর্ণ নীতি। তদুপরি এই ভুল নীতিকে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা-হিসাবে পেশ করা ইসলামের উপর কুঠারাঘাত ভিন্ন আর কিছুই নয়।

মানব-সমাজে অর্থনীতির দিক দিয়া ভূীমর যতখানি গুরুত্ব রহিয়াছে, উহার ভোগ ও ব্যবহারের নিয়ম-নীতি-নির্ধারণ করার ব্যাপারে পৃথিবীর মানুষ ততখানি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। এই জন্যই দেখা যায়, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মতবাদ- অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের ভূীম-ব্যবস্থা চালু রহিয়াছে। ইংলন্ড ও ইউরোপের অন্যান্য কয়েকটি দেশে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে জমির নিরঙ্কুষ মালিকানা –অধিকার দান করা হইয়াছিল; জমি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের হর্তাকর্তা ছিল তাহারা নিজেরাই। রাষ্ট্র বা দেশের কোটি কোটি জনসাধারণ- কাহারোই কোন অধিকার তাহাতে স্বীকৃত ছিল না। জমির মালিক-জায়গীরদারগণ- কৃষক চাষীদিগকে অল্প-অল্প জমি চাষ করিবার জন্য দিত, চাষীরা তাহাতে যে যে ফসল ফলাইত তাহার অর্ধকেরও বেশী অংশ জমির মালিক জায়গীরদারকে এবং গির্জাকে আদায় করিয়া দিত।নিজেদের ভাগে খুব কম অংশই অবশিষ্ট থাকিত। প্রকৃতপক্ষে তাহারা ছিল ভূমিদাস আর জায়গীরদারগণ ছিল তাহাদের প্রভু ও মালিক। অতঃপর ইউরোপের ভূমি-ব্যবস্থার বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। তখন ভূমির কৃষি-প্রণালীতে নতুন পদ্ধতি প্রযুক্ত হয় এবং উহর ফলে কৃষি-উৎপন্ন ফসল পূর্বাপেক্ষা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। ইহা দেখিয়া সেকালের বড়বড় পুঁজিমালিকগণ স্বাভাবিকভাবেই ভূমি দখল করিতে শুরু করে। কৃষি-ব্যবস্থায় এই মৌলিক পরিবর্তনের করণে ছোট-ছোট ভুমিচাষীগণ কৃষিক্ষেত হইতে উৎখাত হইতে আরম্ভ করে। তাহাদের ক্ষুদ্র-ক্ষ্রু জমি জমিদারগণ ক্রয় করিয়া কিংবা বলপূর্বক দখল করিয়া করায়ত্ব করিতে শুরু করে এবং বিরাট আকারে জমি চাষ করিয়া তাহা হইতে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করিতে থাকে। ক্ষুদ্র কৃষকগণ জমি হইতে সম্পূর্ণরূপে বহ্চিত হইয়া শিল্পায়িত শহরের দিকে ধাবিত হয়, বেতার শ্রমিক হিসাবে শিল্প-কারখানার সম্মুখে আসিয়া ভীড় জমাইতে থাক। ভূমির এই সামন্তবাদী-ব্যবস্থায় সমাজের ভূমিহীন মানুষ তথা বিরাট সমাজকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হইয়াছে। মানুষের সমষ্টিগত স্বার্থকে ভূমির উপর হইতে উচ্ছেদ করা হইয়াছে।

এই পুঁজিবাদী ভূমি ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দেখা দিয়াছে সমাজতান্ত্রিক ভূমি-নীতি। ইহার মূল দর্শনে বলা হইয়াছে যে, জমির মালিকানা কোন ব্যক্ত বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, সমগ্র সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক হইবে রাষ্ট্র। দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে পরিশ্রম করিয়া কেবলমাত্র কাজ করিয়াই রুজীরোজগার করিতে হইবে। ইহাতে জমির মালিকানা হইতে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করিয়া তাহাকে রাষ্ট্রের দাসানুদাসে পরিণত করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

কিন্তু এই উভয় প্রকার ভূমি ব্যবস্থাই অস্বাভাবিক, অমানুষিক ও বঞ্চনামূলক। প্রথম প্রকার ব্যবস্থায় সমাজ ও জাতি বঞ্চিত এবং দ্বিতীয় প্রকার ব্যবস্থায় ব্যক্তি-মানুষ শুধু বঞ্চিত নয়, নিপীড়িত এবং শোষিতও।…… আর সত্য কথা এই যে, মনুষ্যত্ব ও মানবতা এই উভয় ধরনের সমাজ হইতে একেবারে নির্বাসিত।

ব্যক্তিকে ভূমির একচ্ছত্র মালিক করিয়া দেওয়ার জায়গীরদারী-জমিদারী ব্যবস্থার বাস্তব অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত ও মর্মান্তিক। অনুরূপভাবে ব্যক্তির অধিকার হিইতে উহা কাড়িয়া লইয়া একান্তভঅবে রাষ্ট্রের নিরংকুশ কর্তৃত্বে সোপর্দ করিয়া দেওয়অর রুশীয় ও চীনা অভিজ্ঞতা আরো অধিক অমানুষিক ও হৃদয়বিদারক। এই কারণে ইসলাম এই উভয় প্রকার ভূমি নীতিকেই অস্বীকার করিয়াছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি ভূমির মালিক হইতে পারে যদিও নিরংকুশ মালিকানা সে কিছুতেই লাভ করিতে পারে না। তদ্রুপ ভূমির উপর সমাজ ও সমষ্টির অধিকারও ইসলাম স্বীকার করিয়াছে, কিন্তু তাহাও সীমাহীন ও সর্বগ্রাসী নয়, নয় ব্যক্তি-স্বার্থবিরোধী। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ভূমিনীতির দুই সীমান্তের মধ্যবর্তী পথ দিয়া চলিয়াছে ইসলামের ভূমিনীতি। ইসলম আল্লাহ প্রদত্ত আইনের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন ও সীমাবদ্ধ ইখতিয়ারের পরিবেশে ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করিয়াছে। তাহাতে ব্যক্তির স্বেচ্ছাচার-জুলুম, শোষণ ও বঞ্চনামূলক নীতি গ্রহণ করার বিন্দুমাত্র অধিকার নাই। কৃষক-চাষীকে ক্রীতদাসের ন্যায় খাটাইবারও অধিকার রাষ্ট্রকে দেওয়া হয় নাই। ইসলামের ভূমিনীতিতে চাষাবাদ করিবে, উহার উপর সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অংশ নির্দিষ্ট রহিয়াছে, তাহা সে রীতিমত জাতীয বায়তুলমাল-এ আদায় করিতে থাকিবে। কোন ভূমিমালিক নিজে জমি চাষ করিতে সমর্থ না হইলে বা করিতে না চাহিলে সে তাহা অন্য একজনের দ্বারা চাষ করাইবে। কারণ ‘লঙল যাহার, জমি তাহার’ দাবি ইসলামী অর্থনীতির নয়, এই দাবি বা মুলনীতি ঘোষিত হইয়াছে একমাত্র মার্কসীয় দর্শনে এবং চীন ও সোভিযেত রাশিয়ায়। (যদিও কার্যতঃ তাহাও শ্লোগানমাত্র, যাহার বাস্তব রূপ কোথাও দেখা যায় না।) কাজেই জমির মালিক হওয়ার জন্য বা ভোগাধিকার লাভ করার জন্য প্রত্যেককেই নিজের হাতে চাষ করিতে হইবে- ইসলামী অর্থনীতি এন কোন শর্ত আরোপ করে নাই।

কিন্তু দেশের সমস্ত জমিই যদি ব্যক্তির মালিকানা ও ভোগাধিকার ছাড়িয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সার্বজনীন রাষ্ট্রীয় কাজ ও সামষ্টিক প্রয়োজন পূর্ণ করা নানাভঅবে ব্যাহত হইতে পারে। এইজন্য ইসলামী অর্থনীতি ভূমিহীন লোকদের মধ্যে তাহা বন্টন করা সম্ভব হয়। এতদ্ব্যতীত অসংখ্য রাষ্ট্রীয় নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়েঅজনীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্তৃত্বাধীন জায়গা-জমি থাকিতে পারে- থাকা আবশ্যক। এই সব জমিকে মসজিদের সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে। সরকারী অফিসাদির স্থান, চারণভূমি, পার্ক, রাজপথ, পানিপথ, রেললাইন, সাধারণ ক্রীড়ার স্থান এবং জলাশয় প্রভৃতির জমি ইসলামী হুকুমতে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন থাকিবে। এই সব জমির উপর কোন নাগরিকেরই ব্যক্তিগত নিরংকুশ মালিকান স্বীকৃত হইতে পারে না। তাহাতে দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের ব্যবহারাধিকার সমানভাবে স্বীকৃত হইবে। কুরআন, হাদীস, ইসলামের ইতিহাস, নবী করীম (স)-এর নিজস্ব কার্যক্রম এবং খুলাফায়ে রাশেদুনের ভূমিনীতি হইতে আমরা এই তত্ত্বই জানিতে পারি।[শাহ অলীউল্লাহ দিহলভী লিখিয়াছেন: (আরবী************)

‘পূর্বে’ যেমন বলিয়াছি, সমস্ত ধনসম্পদই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর মালিকানা। উহাতে প্রকৃত পক্ষেই কোন মানুষের অধিকার নাই। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা যখন উহা হইতে জনগণের উপকৃত হওয়ার অধিকার স্বীকার করিয়াছেন তখন উহাতে বিরোধের সৃষ্টি হইল। ফলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা এই করা হয় যে, উহাতে অধিকার প্রয়োগ করিতে গিয়া অপর কাহারো ক্ষতি সাধন করিতে পারিবে না।”]

ভূমি ভোগাধিকার লাভের ইসলামী নীতি

ইসলামের ভূমি-নীতিতে জমির মালিকানা লাভ। ও ভোগ দখলের দৃষ্টিতে জমিকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হইয়াছে।

প্রথমতঃ আবাদ ও মালিকানাধীন জমি। কেহ না কেহ উহা আবার করিয়া উহাতে বসবাস কিংবা কৃষিকাজ ইত্যাদি কোন-না-কোন ‍উপায়ে উহা ভোগ দখল করিতেছে। এই জমি উহার মালিরেই অধিকারভুক্ত থাকিবে। মালিকের বৈধ অনুমতি ব্যতীত এই জমিকে অপর কেহ ভোগ ব্যবহার করিতে কিংবা উহার কোন অংশ দখল করিতে পারিবে না। তবে রাষ্ট্র ও জাতির বৃহত্তর কোন কল্যাণের প্রশ্ন উঠিলে তখন ব্যাপারটি ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচনা করিতে হইবে।

দ্বিতীয়তঃ কাহারো মালিকানাভুক্ত জমি হওয়া সত্ত্বেও উহা অনাবাদি পড়িয়া রহিয়াছে। উহাতে পানি সেচ করা হয় না, আগাছা-পরগাছা বা জঙ্গল পরিষ্কার করা হয় না, চাষাবাদ করা হয় না, উহা বসবাসের কাজেও ব্যবহার করা হয় না।

এই মজিও মালিকেরই অধিকারভুক্ত থাকিবে। মালিক উহা অন্যান্য জমির ন্যায় বিক্রয় করিতে পারিবে এবং উহাতে উত্তরাধিকার আইন কার্যকর হইবে।

তৃতীয়তঃ জনগণের সাধারণ কল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট জমি। এক গ্রামবাসীর গৃহপালিত পশুর জন্য নির্দিষ্ট চারণভূমি কিংবা কাষ্ট আহরণ ক্ষেত্র অথবা মসজিদ, ঈদগাহ বা কবরস্থান প্রভৃতি সার্বজনীন কাজের জন্য নির্দিষ্ট জমি এই পর্যায়ে গণ্য।

কোন এক ব্যক্তি এই জমির মালিক হইবে না; বরং ইহা ব্যবহার করার ও ইহা হইতে উপকৃত হওয়ার অধিকার সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকিবে।

চতুর্থত: অনাবাদী ও পরিত্যক্ত জমি। উহার কোন মালিক নাই, উহা কেহই ভোগদখল করিতেছে না। এই পর্যায়ের জমি-জায়গাকে ইসলামী অর্থনীতির পরি।ভাণায় (*****) ‘আল মারওয়াত’ বলা হয়।এই জমির পরিচয় দান প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

ইহা জনপদের বাহিরে অবস্থিত এমন জমি, যাহার কেহই মালিক নাই, উহার উপর কাহারো একচেটিয়া অধিকার স্বীকৃত হইবে না।

যে জমিতে সাধারণ মানুষে জন্য প্রয়োজনীয় কোন পদার্থের খনি থাকিবে, উহাতে সর্বসাধরণের ভোগাধিকার স্বীকৃত হইবে, যতকনষণ না কাহাকেও বিশেষভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হইবে।

অনাবাদী জমি আবাদ করার অর্থ হইল: জমিতে বন-জঙ্গল ও আগাছা পরগাছা থাকিলে উহা কাটিয়া সাফ করা, পানি না থাকিলে উহাতে কিংবা পানিতে ডুবিয়া থাকিলে উহা হইতে পানি সিঞ্চন করা, উহাতে চাষাবাদ করা ও ফসল ফলানো; কিংবা উহাতে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা; অথবা উহাকে যে কোন প্রকারে ব্যবহারের উপযোগী করিয়া তোলা।

আল্লামা মাওয়ার্দী লিখিয়াছেন: জমি আবাদ করার ব্যাপারটি দেশ চলতি প্রথা অনুযায়ী স্বীকৃত হইবে। কেননা নবী করীম (স) তাঁহার বাণীতে এ জন্য কোন বিশেষ পদ্ধতির উল্লেখ করেন নাই। উহাকে দেশ চলতি প্রথার উপরই ছাড়িয়া দিয়াছেন।

জমির মালিকানা লভ]

কোন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম কায়েম হওয়া এবং ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর করার সময় সংশ্লিষ্ট দেশের জমিক্ষেতের সাধারণতঃ কয়েকটি অবস্থা থাকিতে পারে, যথা-

১. অনাবাদী পড়োজমি- এখানে যাহার উপর কাহারো মালিকানা স্থাপিত হয় নাই। (নূতন চরাভূমি বন-জঙ্গল বা পরিত্যক্ত জমি) কিংবা যাহার মালিক মৃত বা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, উত্তরাধিকারী কেহ নাই।

২. মুসলমানদের ভোগাধিকারভুক্ত জমি.

৩. অমুসলিমরে ভোগাধিকারভূক্ত জমি এবং

৪. যেসব জমি-জায়গাকে পূর্বেই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে নির্দিষ্ট করা হইয়াছে- ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় এইরূপ জমিকে বলা হয় খালেছাহ। (****)

ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়অর পর শোষেক্ত প্রকার জমি পূর্বানুরূপ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনই থাকিবে। রাষ্ট্র তাহা নিজস্ব কাজে ব্যবহার করিবে কিংবা তৎলব্ধ অর্থ সরকারী কাজে ব্যয় করিবে।

প্রথমোক্ত প্রকার জমি-জায়গা আবাদ ও চাষোপযোগী করিয়া উহাতে ফসল উৎপাদনের জন্য ভূমিহীন লোকদের মধ্যে সুবিচারমূলক নীতি অনুযায়ী বন্টন করিতে হইবে। ইমাম আবূ ইউসুফ (র) ‘কিতাবুল খারাজ’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

অনাবাদী, অনুর্বর, মালিকহীন ও উত্তরাধিকারহীন জমি-জায়গা এবং যে জমিতে কেহ চাষাবাদ ও ফসল ফলানোর কাজ করে না তাহা ইসলামী রাষ্ট্রের উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়া রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্র। এই ব্যাপারে সকল মুসলমানের সাধারণ ও নির্বিশেষ অধিকার স্বীকার করিতে এবং সর্বসাধারণের কল্যাণ-সাধনকেই নীতি হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে।

অর্থাৎ এই জমি এমনভাবে বন্টন করিতে হইবে, যেন এই বন্টনের ফলে জনগণের কল্যাণেই সাধিত হয়, কোনরূপ ক্ষতি বা অমঙ্গল যেন কাহারও না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখিয়াই এই জমির বন্টনকার্য সম্পন্ন করিতে হইবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেন: ‘নবী করীম (স) মদীনায় হিজরত করিয়া আসিলে পরে এখানকার সকল শুষ্ক, মৃত, অনাবাদী ও পড়ো-জমি সুনিয়মিতভাবে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিয়াছিলেন।

এইভাবে একজন নাগরিক যে জমি লাভ করিবে এবং উহাকে আবাদ ও চাষোপযোগী করিয়া লইবে, সে ব্যক্তি ঐ জমির ‘মালিক’ বিবেচিত হইবে।

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসে নবী করীম (স)-এর ইরশাদ উল্লেখিত হইয়াছে:

(আরবী**********)

যে ব্যক্তি কোন মালিকহীন জমি আবাদ করিয়া লইবে, সে-ই উহার ভোগাধিকার ও মালিকানা লাভ করিবে।

‘আবু দাউদ’ নামক হাদীস গ্রন্থে একজন সাহাবীর এই উক্তি উল্লেখ করা হইয়াছে:

(আরবী**********)

আমি সাক্ষ্য দিতেছি, হযরত নবী করীম (স) চূড়ান্ত ফয়সালা করিয়া দিয়াছেন যে, জমি-জায়গা সবকিছু আল্লাহর এবং মানুষ তাহারই দাস, অতএব যে ব্যক্তি অনাবাদী জমি চাষোপযোগী ও উৎপাদনক্ষম করিয়া তুলিবে উহার মালিকানা লাভে সে-ই অগ্রাধিকার পাইবে।

তৃতীয় প্রকার জমি: অমুসলিমদের অধিকারভূক্ত জমির অবস্থা সাধারণতঃ তিন প্রকার হইতে পারে। অমুসলিমদের জমির এই প্রকারভেদ তাহাদের রাজনৈতিক মর্যাদা অনুযায়ীই নির্ধারিত হইবে; তাহা এইরূপ:

(ক) অমুসলিম বাসিন্দারা মুসলিমদের সহিত মুকাবিলা করিয়া যুদ্ধ সংগ্রাম করিয়া শেষ পর্যন্ত যদি পরাজয় স্বীকার করিতে বাধ্য হয় অথবা মুসলমানদের সহিত কৃত সন্ধিচুক্তি ভংগ করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং মুসলমানগণ শক্তি প্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে পরাভূত করে, তবে অমুসলিমগণ রাজনৈতিক দিকদিয়া ‘জিম্মী’-‘শক্তি প্রয়োগের ফলে পরাজিত ও বশ্যতা স্বীকারকারী অমুসিলম’ হওয়ার মর্যাদা পাইবে। অনুরূপভাবে তাহাদের ধন-সম্পত্তি ও জায়গা-জমি গণিমতের সম্পদ বা ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারী সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হইবে। অতঃপর ইসলামী রাষ্ট্র উহার বিলিব্যবস্থা, চাষাবাদ ও বন্দোবস্তের জন্য ইচ্ছা করিলে মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিতে পারে। আবার উহার চাষাবাদের কাজ উহার প্রাচীন চাষীদের দ্বারা নির্দিষ্ট শর্ত অনুসারে সম্পন্ন করার ব্যবস্থাও করা যাইতে পারে। কিন্তু মূলত সেই প্রাচীন ভূম্যাধিকারীরা উহার মালিক থাকিবে না। হযরত নবী করীম (স) খায়বর এলাকায় কার্যত এই নীতিরই প্রয়োগ করিয়াছেন। [(আরবী*********)]

নবী করীম (স) মদীনায় হিজরাত করার পর তথাকার ইয়াহুদীদের সহিত ‘যুদ্ধ নয়- শত্রুতাও নয়” –এর চুক্তি করিয়াছিলেন। কিন্তু ইয়াহুদীদের মধ্যে ‘বনু কায়নূকা’ গোত্র ইহা লংঘন করে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে। অতঃপর তাহারা ইসলামী সৈন্যবাহিনী কর্তৃক আবদ্ধ হইয়া আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। নবী করীম (স) তাহাদের সকল ধন-সম্পত্তি গণীমতের মাল হিসাবে মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেন। ‘বনী নজীর’ গোত্রও এই একই অপরাধের অপরাধী ছিল, ক্রমাগতভাবে পঞ্চদশ দিবস পর্যন্ত তাহারা অবরুদ্ধ থাকিয়া পরাজয় স্বীকার করে। অতঃপর তাহাদিগকে সকল নগদ সম্পদ ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাণ লইয়া দেশ ত্যাগ করিয়া যাইবার অনুমতি দেওয়া হয়। তাহারা যুদ্ধ করে নাই বলিয়া তাহাদের যাবতীয় জায়গা জমি বিনা যুদ্ধেই নবী করীম (স)-এর হস্তগত হয়। ফলে তাহা সবই একান্তভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হয়। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে এই কথাই বলিয়াছেন:

(আরবী*********)

আল্লাহ তা’আলা তাহার রাসূলকে তাহাদের (বনু নজীর) হইতে যাহাকিছু অর্জন করাইয়া দিয়াছেন, তাহা তাঁহারই। কারণ, তাহা অর্জন করিবার জন্য তোমাদিগকে ঘোড়া ও উট দোড়াইয়া যুদ্ধ করিতে হয় নাই। কিন্তু আল্লাহ তাহার রাসুলগণকে নিজ ইচ্ছামতই অন্যের উপর আধিপত্য দান করেন। -আল-হাশর: ৬

অতঃপর নবী করীম (স) এই সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেন। দুইজন সাহাবীর কঠিন দারিদ্রের কথা জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে বিশেষ অংশ দান করিয়াছিলেন।

হযরত উমর ফারূক (রা) বলিয়াছেন- বনু নজীরের ধন-সম্পত্তি আল্লাহ তা’আলা তাঁহার রাসূলকে বিনা যুদ্ধেই দান করিয়াছিলেন। সেই জন্য মুসলমানদের কোনরূপ যুদ্ধ বা কষ্ট স্বীকার করিতে হয় নাই। অতএব তাহা খালেসভঅবে নবী করীম (স)-এর প্রাপ্য। তাহা হইতে তিনি তাহার নিজের বাৎসরিক প্রয়োজন পূরণ করিতেন এবং যাহা উদ্ধৃত্ত থাকিত, তাহাদ্বারা মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় কাজ, বিশেষ করিয়া সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম খরিদ কার কাজ সম্পন্ন করিতেন। [***১]

অন্য কথায় এই সম্পত্তি সবই ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারী মালিকানা বলিয়া ঘোষিত এবং বায়তুলমালে সঞ্চিত হইয়াছিল। নবী করীম (স) কে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে উহা জনগণের মধ্যে বন্টন করার দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল মাত্র। কায়রো ও খরতুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফারুক কলেজের শিক্ষক ডঃ জাকারিয়া বুয়ুমী লিখিয়াছেন: বনু নজীর গোত্রের অস্থাবর মাল-সম্পদ দরিদ্র আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করিয়াছেন। মহাজিরদের তীব্র প্রয়োজনের কারণে তাহাদিগকে ৩৫ অংশ দেওয়া হয়। কিন্তু জমি ও তাহাতে যেসব বৃক্ষরাজি বা ফসল ছিল তাহা বন্টন করা হয় না বরং তাহা সরকারী ব্যবস্থাপনায় রাখা এবং তাহা দিয়া দরিদ্র ইয়অতীম ও মিসকীনদের ব্যাপক সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা হয়।[(আরবী*********)]

বনু কুরাইযা নবী করীমের সহিত কৃত সন্ধিচুক্তি লংঘন করিয়া কাফির শত্রুদের সহিত গোপন রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছিল। নবী করীম (স) তাহাদিগকে অবরুদ্ধ করিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাহাদের ধন-সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে তাহারেদ রসদের হিস্‌সা অনুযায়ী বন্টন করা হইয়াছিল।

ইসলামের ভূমিনীতি নির্ধারণের ব্যাপারে খায়বরের ঘটনার বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে। ৭ম হিজরী সনে খায়বরবাসীদের সহিত মুসলমানদের যুদ্ধ হয় এবং পরে তাহাদের সহিত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সমগ্র খায়বরে বিশাল উর্বর ভূমির উপর ইসলামী রাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি বর্ণনায় প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম (স) খায়বরের সমস্ত জমি খেজুর গাছ অর্ধেক ফল ও ফসল সরকারকে দেওয়ার শর্তে চাষাবাদকারীদের হাতে ন্যাস্ত করিয়াছিলেন। যাতা তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করিতেন। [(আরবী*********)]

(ক) নবী করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে এই সমগ্র এলাকাকে ছত্রিশটি খন্ডে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেকটি খন্ডের সহিত এক শতটি অংশ যুক্ত করেন। তন্মধ্য হইতে আবারো খন্ড (মোট সম্পত্তির অর্ধেক) রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন-পূরণ ও সামষ্টিক দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দিষ্ট করা হইয়াছিল। অবশিষ্ট আঠারো খন্ড মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে এমনভাবে বন্টন করিয়অ দেওয়া হইয়াছিল যে, উহার প্রত্যেকটি খন্ডেরিই অংশীদার হইয়াছিল একশত লোক। নবী করীম (স) তাঁহার নিজ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ইহা হইতেই একটি অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন।

(খ) যেসব অমুসলিম জাতি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া- কোন জোরজবরদস্তি ও বাধ্যবাধকতা ব্যতীতই- ইসলামী রাষ্ট্রের সহিত সন্ধি করিবে, ইসলামী রাষ্ট্র ঠিক চুক্তি অনুসারেই তাহাদের সকল অধিকার রক্ষা করিবে। তাহাদের নিজস্ব জমি-জায়গা তাহাদেরই ভোগ-দখল থাকিবে। তাহারা চুক্তি অনুসারেই ইসলামী রাষ্ট্রকে দেয় কর রীতিমতই আদায় করিতে থাকিবে।

খায়বর বিজয়ের পর ‘ফিদাক’ নামক স্থানের অধিবাসীগণ নবী করীম (স)-এর সহিত সন্ধি করিবার জন্য নিজেদের পক্ষ হইতে উদ্যোগী হইয়াছিল এবং তাহাদের জমি-ক্ষেতের উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ইসলামী রাষ্ট্রকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়াছিল। নবী করীম (স) তাহাদের আবেদনক্রমেই তাহাদের সহিত সন্ধি করেন। ফিদাক-এর জমি লোকদের মধ্যে বন্টন করা হয় নাই, অধিবাসিদের হাতেই উহা রাখিয়া দেওয়া হয়।[কিতাবুল খারাজ, ইয়াহইয়অ ইবনে আদম, বন্দ ১০০, ৩৯ পৃঃ] ফিদাক এলাক হইতে যাহা আয় হইত, তাহা রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যয় করা হইত, যদিও ফিদাকের অধিবাসীগণই এইসব জমি-জায়গার আসল দখলদার ছিল। তাহাদের নিকট হইতে ঐ সব জমি কাড়িয়া লওয়া হয় নাই। অবশ্য হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতকালে বিশেষ কারণে তাহাদিগকে নির্বাসিত করা হয় এবং ন্যায্য মূল্যর বিনিময়ে তাহাদের জমি-জায়গা রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে খরিদ করা হয়। সরকার পক্ষ হইতে ভূমিক্রয়ের ইহা এক প্রাচীন রীতি।[বুখারী, ২য় জিঃ ৫৭৬ পৃঃ]

‘তাইমা’ নামক স্থানের অধিবাসীগণও নিজের আগ্রহ-উৎসাহে নবী করীম (স)-এর সহিত সন্ধি করিতে অগ্রসর হয়। ফলে তাহারা তাহাদের নিজ স্বাক্ষরিক হয়।[আহকামে সুলতানিয়া, ফতুহল বুলদান, ৪৮ পৃঃ]

মক্কা বিজয়ের পর নবী করীম (স)-এর অনুসৃত ভূমিনীতিও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মক্কা জয় করার পর উহার প্রাচীন বাসিন্দা মুহাজিরগণ নিজেদের জন্মভূীমতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁহাদের হিজরাত পূর্বকালীন মালিকানা অনুযায়ী প্রত্যেকেই নিজ নিজ জমি-জায়গার উপর পনরাধিকার লাভ করেন। কারণ মক্কানগর মূলত বিনা যুদ্ধেই বিজিত হইয়াছিল।

নাজরান এলাকার খৃস্টানগণও ইসলামী রাষ্ট্রের সহিত সন্ধি করিয়াছিল। চুক্তি হইয়াছিল যে, তাহাদের জান-মাল, জমি-জায়গা, ধর্মবিশ্বাস ও জাতীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবকিছুরই নিরাপত্তা থাকিবে। তাহারা এই নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ লাভের বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্রকে ‘জিযিয়া’দিবে। তাহাদের এই সন্ধিচুক্তি প্রথম খিলাফতকাল পর্যন্ত বহাল তাকে কিন্তু দ্বিতীয় খলীফার আমলে নাজরানের খৃষ্টানগণ প্রকাশ্যভাবে সুদী কারবার করিতে আরম্ভ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাহাদের কর্মতৎপরতা অত্যন্ত তীব্র হইয়া দেখা দেয়। এই কারণে হযরত উমর (রা) তাহাদিগকে নির্বাসিত করেন এবং তাহাদের যাবতীয় ভূ-সম্পত্তির মূল্য ধার্য করিয়া তাহা আদায় করিয়া দেন। অন্য কথায় রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে তাহাদের বিত্ত-সম্পত্তি খরিদ করিয়া লওয়া হয়। ইহার বিনিময়ে সিরীয়া ও ইরাক হইতে তাহাদিগকে চাষাবাদের জন্য জমি দান করা হয়।[বুখারী, ফতুহুল বুলদান, ৭৭ পৃঃ।]

ইয়ামনের আধীবাসীগণও নবী করীম (স)-এর সহিত সন্ধি-চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছিল। নবী করীম (স) এই চুক্তি লিখিয়া দিয়াছিলেন যে, তাহারা ইসলাম গ্রহণ করিলে তাহাদের ধন-সম্পদ, জায়গা-জমি ও গচ্ছিত-প্রোথিত ঐশ্বসর্যের উপর ইসলামী রাষ্ট্র কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিবে না। অবশ্য ইসলামী রাষ্ট্রের ধার্যকৃত অন্যান্য দেয় এবং সকলকেই যথারীতি আদায় করিতে হইবে। [আহকামে সুলতানীয়া।]

(গ) যেসব অমুসলিম ভূমি-মালিক মুসলমানদের সহিত যুদ্ধ করিয়া নিহত হয়, কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র হইতে পালাইয়া চলিয়া চলিয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত উহার মালিক ও অধিকারী বা উত্তরাধিকারী কেহই অবশিষ্ট থাকে না, এইসব জমি-জায়গা বিজয়ী মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হইবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র তাহা জনগণের মধ্যে পূর্ণবন্টন করিবে। হযরত উমর (রা) এই নীতিই অবলম্বন করিয়াছিলেন। এ সম্পর্কে ইমাম আবূ ইউসুফ (রা) লিখিয়াছেন:

(আরবী*********)

যে সব জমি কিস্‌রা, কিসরার বংশাবলী এবং যুদ্ধ নিহত ও পালাইয়া দেশ ত্যাগ করিয়া যাওয়া লোকদের মালিকানাভুক্ত ছিল, হযরত উমর (রা) তাহা সবই রাষ্ট্রায়ত্ত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত করিয়া লইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত যেসব জমি পানির নীচে ডুবিয়াছিল এবং সমস্ত ডাকঘর ও তৎসংলগ্ন জমি-জায়গাও তিনি সরকারে বাজেয়াপ্ত করিয়া লইয়াছিলেন। পরে তিনি এই সব জমি-জায়গা জনগণের মধ্যে চাষাবাদের জন্য বন্টন করিয়া দিয়াছিলেন।

বাংলাদেশ ভূ-খন্ড হইতে অমুসলিম দেশত্যাগীদের ভূ-সম্পত্তির ব্যাপারে এই নীতি পূর্ণভাবে প্রযোজ্য এবং এই দলীলের ভিত্তিতে তাহা সব রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে গণ্য হইবে।

ইমাম আবূ ইউসুফের বর্ণনা হইতে জানা যায়, হযরত উমরের খিলাফত আমলে এই ধরনের সরকারায়ত্ব জমি-জায়গা হইতে আয়ের পরিমাণ ৪০ লক্ষ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল।

মোট কথা, স্বয়ং নবী করীম (স)-এর দশ বৎসরকালীন মাদানী জিন্দেগীতে প্রায় দশলক্ষ্য বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকা-গড়ে দৈনিক দুই শত পঁচাত্তর বর্গমাইল অঞ্চল-ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। তাহাতে নবী করীম (স)-এর ভূমিনীতি এই ছিল যে, যেসব ভূমি যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগের পর হস্তগত হইয়াছিল, তাহা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হইত। অতঃপর উহার একাংশ সরাসরি ভূমিহীন লোকদের মধ্যে বন্টন করা হইত। এইরূপে যেসব অঞ্চল বিনা-যুদ্ধ করায়ত্ব হইত, তাহাও ‘খালেস’ নামে অভিহিত হইয়া খালেসভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে বিবেচিত হইত। কিন্তু যে সব অঞ্চলের অধীবাসীগণ ইসলাম গ্রহণ করিত এবং নিজেদের এলাকাকে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন করিয়া লইত অথবা যেসব অমুসলিম ‘জিযিয়া’ দেওয়ার শর্তে ইসলামী রাষ্ট্রের সহিত সন্ধি করিত, তাহাদের জমিক্ষেতের উপর ইসলামী রাষ্ট্র মাত্রই হস্তক্ষেপ করিত না। বরং ইসলামী রাষ্ট্র তাহাদের প্রত্যেকেরই মালিকানার পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিত এবং তাহার বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র তাহাদের নিকট হইতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘কর’ বা ‘খারাজ’ আদায় করিত মাত্র। এতদ্ব্যাতীত মালিকহীন সম্পত্তি যাহা কিছুই হস্তগত হইয়াছিল, নবী করীম (স) রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই তাহা বিভিন্ন সাহাবীকে তাঁহাদের কৃতিত্বপূর্ণ ইসলামী অবদান ও বৃহত্তর জাতীয় খেদমতের জন্য পুরষ্কারস্বরূপ দান করিয়াছেন। ইসলামী অর্থনীতির প্রাচীন পরিভাষায় ইহাকে (***) ‘জায়গীর দান’ বলা হয়। বলাবাহুল্য, বর্তমান জায়গীরদারী ও সামন্তবাদী ভূমিনীতির সহিত ইহার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক বা সামঞ্জস্য নাই।

নবী করীম (স)-এর পর প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রা) নবী করীমের ভূমি নীতিকেই বহাল রাখেন এবং কার্যতঃ তিনি তাঁহারই অনুসরণ করিয়া চলেন। তিনিও ভূমিহীন লোকদের মধ্যে মালিকহীন জমি বন্টন করিয়াছিলেন।[কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবাইদ] তাঁহার খিলাফতকালে মুর্তাগণ ইসলামের অনুমাসন মানিয়া চলিতে অস্বীকার করে। ফলে খলীফা তাহাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন এবং তাহাদিগকে পরাজিত করিয়া তাহাদের যাবতীয় বিত্ত-সম্পত্তি খিলাফতের কর্তৃত্বাধীন করিয়া লন। তাহাদের অনেক জমিকেই রাষ্ট্রীয় চারণভূমিতে পরিণত করা হয়। [তারিখ-ই-তাবারী] হযরত খালিদ বিন অলিদ প্রবল যুদ্ধের পর ইরাক জয় করেন। তখন ইরাকের জমি-ক্ষেত বিজয়ী সৈনিকের মধ্যে বন্টন করার দাবি উথাপিত হয। কিন্তু হযরত আবূ বকর (রা) তাহা না করিয়া ইরারেক বিরাট এলাকাকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলিয়া ঘোষণা করেন এবং উহার চাষাবাদের কাজ উহার পুরাতন ভোগদখলকারীদের উপরই ন্যস্ত করেন। তাহারা জমি চাষাবাদ করিত এবং ইসলামের খিলাফতকে ‘জিযিয়া ও ‘খারাজ’ (ভূমিরাজস্ব) আদায় করিয়া দিত। যদিও পরবর্তী যুগে অবস্থার পরিবর্তন হওয়অর সঙ্গে-সঙ্গেই এই নীতিরও পরিবর্তন হইয়াছিল।

দ্বিতীয় খলীফার ভূমি-নীতি

হযরত উমর ফরুক (রা)-এর খলীফা নিযুক্ত হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পর সিরীয়া জয় করা হয়। প্রবল যুদ্ধের পর সিরীয়বাসীগণ মুসলমানদের সহিত সন্ধি করিতে বাধ্য হয়। তাহারা একদিকে ‘জিযিয়’ এবং অন্য দিকে ‘খারাজ’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া সন্ধিচিুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মুসলমানগণ তাহাদের জান ও মালের পূর্ণ নিরাপত্তা দান করেন।

হযরত উমর (রা) প্রথমে এই এলাকার জায়গা-জমি বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কোন কোন সাহাবীর সহিত এ সম্পর্কে তিনি পরামর্শ করেন। কিন্তু সকলেই তাঁহাকে এই কাজ হইতে বিরত থাকিতে অনুরোধ করেন। তাঁহারা প্রশন করেন; “আজ সিরিয়ার এই বিরাট অঞ্চল বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিলে এবং উত্তরাধকার আইন বলে বংশানুক্রমিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হইলে রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথা হইতে আসিবে?” শেষ পর্যন্ত এই সমস্ত এলাকা উহার মূল ভোদগখলকারীদের হস্তেই ন্যস্ত রাখিয়া তাহাদের নিকট হইতে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা করা হইল। রাজস্ব বাবদ আদায়কৃত অর্থ সর্বসাধারণের কল্যাণে বিনিয়োগ করার অধিকৃত এলাকার উপর পরোক্ষভাবে সব নাগরিকেরই অধিকার স্থাপিত হইল। সরকারী ব্যবস্থায় জমি-জায়গাকে সাধারণ জনমানবের কল্যাণে পরিচালনা করার ইহাই হইতেছে উত্তম ও আদর্শ দৃষ্টান্ত।

হিজরী ১৬ সনে ইরাক-অন্তর্ভুক্ত ‘সওয়াদ’ নামক স্থান অধিকার করা হয়। সওয়াদের বিলিব্যবস্থা সম্পর্কেও হযরত উমর ফারুক (রা) সাহাবাদের সহিত পরামর্শ করেন। তিনি তাহার নিজের মত প্রকাশ করার প্রসঙ্গে বলেন যে, রাষ্ট্রের সার্বজনীন ও সামগ্রিক দায়িত্ব এবং জরুরী কার্যবলী সুষ্ঠুরূপে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য অধিকৃত সমগ্র ভূমি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলিয়া নির্ধারণ করা অপরিহার্য। অন্যথায় বায়তুলমাল শুন্য হইয়া যাইবে; দেশরক্ষা, অভ্যন্তরীণ শাসন-শৃংখলা ও জনগণের অভাব-অনটন পূরণ করার ঘোষিত দায়িত্ব পালন প্রভৃতি সামগ্রিক কাজ সাংঘাতিকরূপে ব্যাহত হইবে। অতঃপর তিনি তাঁহার মতের সমর্থনে নিম্নোদ্ধৃত আয়াত পাঠ করেন:

(আরবী*********)

জনপদের অধিবাসীদের বিত্ত-সম্পত্তি হইতে আল্লাহ তা’আলা তাঁহার রাসূলকে যাহা কিছুই দান করিয়াছেন, তাহা হইতে আল্লাহ, তাঁহার রাসুল, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন ও সম্বলহীন পথিকগণ অংশ লাভ করিবে। এইভাবে সম্পদ বন্টন করা হইলে ধন-সম্পদ তোমাদের কেবলমাত্র ধনীদেরই কুক্ষিগত হইয়া থাকিবে না; কাজেই রাসূর তোমাদের যাহা কিছু দান করেন, তোমরা তাহাই গ্রহণ কর। আর যাহা হইতে তিনি তোমাদিগকে বিরত রাখেন, তাহা হইতে তোমরাও বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় করিয়া চল, কারণ আল্লাহ কঠোর শাস্তিদানকারী।’

অর্থাৎ এইভাবে যে সব ধন-সম্পত্তি ইসলামী রাষ্ট্রের করায়ত্ত্ব হইবে, তাহা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবেই গণ্য হইবে। তাহা বিজয়ীদের মধ্যে বন্টন করিয়া জায়গীরদারী বা সামন্তবাদের সৃষ্টি করা যাইবে না। আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করার অর্থ এই যে, রাষ্ট্র-ই উহার বিলিব্যবস্থা করিবে, পারস্পরিক কৃষিনীতি অনুযায়ী লোকদের দ্বারা উহার চাষ করাইবে এবং উৎপন্ন ফসল হইতে রাষ্ট্র উহার প্রাপ্য অংশ (Right) আদায় করিয়া লইবে। এই সম্পর্কে ইমাম আবূ ইউসুফ (র) লিখিয়াছেন:

(আরবী*********)

হযরত উমর (রা) এই সমস্ত জমিকে তৎকালীন ও অনাগত মুসলমানদের জন্য ছাড়িয়া ও রাখিয়া দিলেন এবং ইহাকেই তিনি উত্তম নীতি বলিয়া ঘোষণা করিলেন।

হযরত উমর (রা) ইরাক বিজয়ী হযরত সায়াদকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন: যেসব অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গিয়াছে তাহা জনসাধরণের মধ্যে বন্টন করিয়া দাও, কিন্তু জমি ও খাল ইত্যাদি স্থাপর সম্পত্তি মুসলিম জনগণের সম্মিলিত মালিকানা সম্পদরূপে অক্ষুন্ন ও অবন্টিত রাখ। কেননা উহা যদি বর্তমান সময়ের লোকদের মধ্যে বন্টন করা হয়, তাহা হইলে অনাগত মানুষের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না।

হযরত উমর (রা)-এর এই ভূমিনীতি সাহাবাদের পরামর্শ পরিষদ এক বাক্যে গ্রহণ ও সমর্থন করে এবং এই নীতি অনুযায়ী তখন কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা হয়।

সারকথা

হযরত নবী করীম (স) এবং প্রথম ও প্রধান দুই খলীফার গৃহীত ভূমি নীতির সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক আলোচনা হইতে আমরা নিম্নলিখিত মূলনীতিসমূহ লাভ করিতে পারি:

১. অমুসলিমদের যুদ্ধ-পরাজিত হওয়ার পর যে ধন-সম্পত্তি ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত হইবে, বিজয়ী সৈনিকদের মধ্যে উহার একটি বিরাট অংশ বন্টন করা যাইতে পারে। আর অবশিষ্ট অংশ রাষ্ট্রের নিজ তত্ত্বাবধানেই থাকিবে। খায়বরে এই নীতিই কার্যকর করা হইয়াছিল।

২. কোনরূপ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সশস্ত্র আক্রমণ-ব্যতীত যাহা ইসলামী রাষ্ট্রের হস্তগত হইবে, তাহা ‘খালেসা’ হইা একান্তভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হইবে। রাষ্ট্র নিজ ক্ষমতায় সর্বসাধারণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া উহার বিলিব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত করিবে। বনউ নজীর গোত্রের সম্পত্তিতে এই মূলনীীতই আরোপিত হইয়াছিল।

৩. যুদ্ধের পূর্বেই সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হইলে অমুসলিমদের যাবতীয় ধন-সম্পত্তি তাহাদেরই অীধকারভূক্ত থাকিবে, উহার উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাইবে না। রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে তাহাদের প্রতি নিয়মতন্ত্র অনুযায়ী যাহা কিছু ধার্য হইবে, তাহা তাহারা আদায় করিতে অবশ্যই বাধ্য থাকিবে। ফিদাক, তাইমা ইত্যাদি এলাকার ক্ষেত্রে এই নীতিই গৃহীত হইয়াছিল।

৪. যেসব অমুসলিম ভূমি-মালিক মুসলমানদের সহিত যুদ্ধ করিয়া নিহত হইবে, তাহাদের জমি এবং যেসব জমির কোন মালিক বা উত্তরাধিকারী নাই অথবা যেসব অমুসলিম দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবে তাহাদের সব জমি-জায়গা রাষ্ট্রায়ত্ত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত হইবে।

৫. মুসলমানদের ভোগাধিকারভুক্ত ভূমি সম্পর্কে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসরামী রাষ্ট্রের কি নীতি হইবে, তাহাও উপরোক্ত ঐতিহাসিক আলোচনা হইতে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। মুসলমানগণ নূতন ইসরামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিলে এবং অমুসলমানগণ ইসলাম গ্রহণ করিলে উভয় অবস্থাতেই তাহাদের যাবতীয় সম্পত্তি তাহাদেরই তত্ত্বাবধানে ও মালিকানার অধীনে থাকিবে। ইসলামী রাষ্ট্র ইহাদের কাহারো ন্যায়সংগত ও বৈধ উপায়ে অর্জিত মালিকানার উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিবে না। তাহাদের উপর ইসলামের সামাজিক ও সামগ্রিক অধিকার হিসাবে যাহা কিছু ধার্য হইবে, তাহা তাহাদের অবশ্যই আদায় করিতে হইবে।

কিন্তু এই সময় কাহারো মালিকানার বৈধতা, সততা ও মৌলিকতা সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং কাহারো মালিকানা অন্যায় ও জুলুম ভিত্তিক হওয়ার কথা বলিয়া যদি চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাহা হইলে ইসলামী রাষ্ট্র এ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করিবে। তদন্তের পর যাহার মালিকানা ও দখলীসত্ব অবৈধ প্রমাণিত হইবে, তাহা হয় উহার প্রকৃত মালিকের নিকট প্রত্যর্পণ করা হইবে, কিংবা ইসলামী হুকমত তাহা রাষ্ট্রয়ত্ব করিয়া লইবে।

এই ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্রের সম্মুখে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ (রা)-এর কর্মাদর্শই উজ্জ্বলতম নিদর্শন হইবে। তাঁহার গৃহীত পন্থা অনুসারে ইসলামী রাষ্ট্র এই ধরনের সকল প্রকার জমীদারী-জায়গীরদারীকে রাষ্ট্রয়ত্ব করিতে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করিবে না।

ইসলামী অর্থনীতিতে ভূমিস্বত্তের স্বরূপ

প্রসঙ্গত ইসলামী অর্থনীতিতে ভূমিস্বত্বের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক, কুরআন, হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস আলোচনা করলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী অর্থনীতিতে মাত্র এক প্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত হইয়াছে। জমিদারী, জায়গীরদারী বা তালুকদারী ও হাওলাদারী প্রভৃতি কর আদায়কারী মধ্যস্বত্বের কোন অবকাশের ইসলামী অর্থনীতিতে স্বীকৃত হয় নাই। এই সব স্বত্ব মূলত পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। মূল জমির সহিত এই স্বত্তাধিকারীদের কোন নিকট সম্পর্ক থাকে না। সরকারের সহিত খুব নিম্নতম হারে কর দানের প্রতিশ্রুতিতে এক একটি বিরাট এলাকার উপর তাহাদের একচ্ছত্র প্রভূত্ব স্থাপিত হয় এবং জমির মালিক চাষীদের নিকট হইতে নিজেদের ইচ্ছামত হারে কর আদায় করে। কৃষক বা ভূমি মালিক জমি হইতে কিছু লাভ করুক আর নাই করুক; বন্যায়, প্রতিকুল আবহাওয়ায বা পংগপালের দুর্ধর্ষ আক্রমণের ফলে সমস্ত শস্য ধ্বংস হইয়া গেলও বাৎসরিক দেয় খাজনা মাত্রই ক্ষমা করা হয় না। কাজেই ইসরামী অর্থনীতি এইরূপ জমিদারী বা নিছক খাজনা আদায়কারী মধ্যস্বত্ব কিছুতেই বরদাশত করিতে পারে না।

ইসলাম এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছে যে, এক ব্যক্তি কিছু পরিমাণ জমির মালিক হইতে পারে। এই ‘কিছু’র কোনরূপ পরিমাণ বা সংখ্যা ইসলাম নির্ধারিত করে নাই। কারণ একজন ভূমি-মালিকের উপর ইসলাম এত বেশী বাধ্যবাধকতা আরোপ করে যে, তাহাতে কাহারও পক্ষেই এলাকার সমস্ত বা অধিকাংশ জমিক্ষেত গ্রাস করিয়া লওয়া সম্ভব নয়। কাজেই উহার কোন প্রান্তিকহ পরিমাণ নির্ধারণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে বাতুলতা, অনুরূপভাবে তাহা অস্বাভাবিকও বটে।

ভূমি-মালিক নিম্নলিখিত উপায় ও পন্থায় ভূমি ভোগ ও ব্যবহার করিতে পারে:

(ক) ভূমি মালিক নিজে তাহার ভূমি চাষ করিবে।

(খ) নিজে চাষ করিতে না পারিলে বা না করিলে কিংবা নিজে যে পরিমাণ চাষ করিতে পারে, তাহার বেশী জমি থাকিলে অপরের দ্বারা তাহা চাষ করা হইবে; অথবা চাষের কাজে অন্য লোকের সাহায্য গ্রহণ করিবে।

অপরের দ্বারা চাষ করাইবার তিনটি উপায় হইতে পারে:

(১) কোন দিন-মজুরের দ্বারা নিজের তত্তাবধানে জমি চাষ করাইবে; (২) উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেওয়া শর্তে কাহাকেও উহা চাষ করিতে দিবে। এবং (৩) প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাহাকেও এক বৎসর এক ফসলের জন্য উহার ভোগাধিকার দান করিবে।

(গ) নিজের ভোগ ও ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন না হইলে- অন্য কথায় প্রয়োজনতিরিক্ত জমি থাকিলে- তাহা অন্য কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও ভোগদখল করিতে দিবে।

ইসলামী অর্থনীতি অনুযায়ী ভূমিস্বত্বের প্রয়োগ উল্লিখিত যে কোন পন্থায়ই সংগত বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।

ভূমি-মালিকের নিজেই যে জমি সাছ করা উচিৎ, তাহা নিম্নলিখিত হাদীস হইতে নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারা যায়। হরত নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

যাহার জমি রহিয়াছে, তাহার নিজেরই উহা চাষাবাদ করা এবং তাহাতে কৃষি করা কর্তব্য।

পারস্পরিক কৃষি নীতি

কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি, ভূমিস্বত্ব ভোগ করার কেবল এই একটিমাত্র পন্থাই সংগত বলিয়া ঘোষণা করে নাই। কোন লোক নিজে জমি চাষ করিতে না পারিলে- যেমন জমির মালিক যদি বৃদ্ধ, পংগু, শিশু বা স্ত্রীলোক হয়, কিংবা নিজে চাষ করিতে না চাহিলে, সে অন্যের দ্বারা তাহা চাষ করাইতে পারে। নবী করীম (স) অন্য একটি হাদীসে ইরশা করিয়াছেন:

(আরবী**********)

যাহার অতিরিক্ত জমি আছে, তাহা হয় সে নিজে চাষ করিবে, না হয় সে তাহার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাইবে বা তাহাকে চাষ করিতে দিবে।

অপর এক হাদীসের ভাষায়: (আরবী**********)

সেই জমি নিজেরা চাষ কর কিংবা অন্যদের দ্বরা চাষ করাও।

এই পর্যায়ে রাফে ইবনে খাদী (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীসও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

তিনজন লোক কৃষিকাজ করে। এক, যাহার নিজের জমি আছে; সে নিজে উহা চাষাবাদ করিবে। দ্বিতীয়, যাহাকে জমি চাষ করিবার জন্য দান করা হইবে, সে তাহাই চাষাবাদ করিবে যাহা তাহাকে দেওয়া হইয়াছে এবং তৃতীয়, যে লোক নগদ টাকার বিনিময়ে জমি কেরায়া বা ইজারা লইয়াছে।

বস্তুত অপরের দ্বারা ভূমি চাষ করানো ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে কিছুমাত্র নাজায়েয বা শোষণমূলক ব্যবস্থা নহে। সম্প্রতি এই যে ধুয়া উঠিয়াছে- লাঙ্গল যাহার জমি তাহার, ‘যে নিজ হাতে জমি চাষ করিবে না, জমির ফসলের উপর তাহার কোন অধিকার নাই’ এবং এইসব শ্লোগানের মাধ্যমে যে নূতন ভূমিনীতি প্রচার করা হইতেছে, তাহা আর যাহাই হউক, ইসলামী ভূমিনীতি যে নয়, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। অপরের দ্বারা জমি চাষ করাইবার কাজ স্বয়ং নবী করীম (স) এবং তাঁহার অসংখ্য সাহাবী করিয়াছেন।

খায়বর বিজয়ের ইতিহাস উপরে সংক্ষেপে আলোচিত হইয়াছে। তাহা হইতে একথা জানা গিয়াছে যে, নবী করীম (স) খায়বরে বিজিত বিরাট এলাকার অর্ধেক জমি রাষ্ট্রায়ত্ব করিয়াছিলেন এবং বাকি অর্ধেক বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিয়াছিলেন। মুজাহিদগণ নিজ নিজ অংশের মালিক ও দখলদার হইয়াছিলেন। অতঃপর এই উভয় ধরণের জমিকে খায়বরের বংশানুক্রমিক কৃষক (ইয়াহুদী)-দের নিকট পারস্পরিক ভূমি চাষের (****) শর্তে সোপর্দ করা হয়। নবী করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে তাহাদের সহিত সমস্ত ফসলের অর্ধেক দানের শর্তে ভূমি চাষের চুক্তি করিয়াছিলেন:

(আরবী**********)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলিয়াছেন: নবী করীম (স) খায়বারবাসীদের সহিত অর্ধেক ফসল দানের শর্তে ভূমি-চাষের চুক্তি করিয়াছিলেন।[এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর ইহাম তিরমিযী লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

নবী করীম (স) –এর সাহাবীদের অনেকেই এই হাদীস অনুযায়ী আমল করিয়াছেন। তাঁহারা অর্ধেক, তিন ভাগের এক ভাগ কিংবা চার ভাগের এক ভাগ ফসলের বিনিময়ে পারস্পরিক কৃষি কাজ করায় কোন দোষ দেখিতে পাইতেন না।]

হযরত উমর ফারূক (রা) খায়বরে প্রাপ্ত তাঁহার নিজের অংশের জমি এই পারস্পরিক কৃষিনীতি (*****) অনুসারেই ভোগ করিয়াছিলেন।

ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, খায়বরের যে সব জমি বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করা হইয়াছিল, তাঁহারা প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ অংশের মালিক ছিলেন। ইতিহাস হইতে জানা যায়, তাঁহাদের প্রত্যেকের অংশের জমির সীমানাও নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। অথচ কোন মুজাহিদই নিজ অংশের জমি নিজে চাষ করন নাই। বরং এই সমস্ত জমিই তথাকার চাষী ইয়াহুদীদিগকে অর্ধেক ফসল দানের শর্তে চাষ করিতে দিয়াছিলেন।

শুধু খায়বরের ব্যাপারই নয়, হিজরতের পরে আনসারগণ যখন নিজেদের জায়গাজিমি মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেওয়ার প্রস্তাব করিয়াছিলেন, তখন স্বয়ং নবী করীম (স)-এ তাহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। অতঃপর আনসারগণ মুহাজিরদের সহিত ‘পারস্পরিক কৃষিনীতি(****) অনুসারে কাজ করার চুক্তি করেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বুখারী শরীফ এই হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে:

(আরবী**********)

আনসারগণ নবী করীম (স)-কে বলিলেন- আমাদের খেজুরের বাগান আমাদের ও মুহাজির ভাইদের মধ্যে বন্টন করিয়া দেন। নবী করীম (স) বলিলেন ‘না’। অতঃপর আনসারগণ মুহাজিরদিগকে বলিলেন- আপনারা আমাদের জমি-ক্ষেতে কাজ ও শ্রম করুন, আমরা আপনাদিগকে ফসলের অংশ দান করিব। এই কথায় মুহাজিরদের রাযী হইলেন।

‘পারস্পরিক কৃষিনীতি অনুযায়ী ভূমি চাষ করার প্রথা ইসলামী রাষ্ট্র মদীনায় বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। ইমাম বাকের (র) হইতে বুখারী শরীফে বর্ণিত হইয়াছে তিনি বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

ফসলের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক চতুর্থাংশের বিনিময়ে জমি চাষ করার কাজ করিত না- মদীনায় মুহাজিরদের এমন কোন পরিবারই ছিল না।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

তিনি নবী করীম (স) এবং হযরত আবূ বকর, উমর ও উসমান (রা)-এর আমলে তিন ভাগের এক ভাগ কিংবা চার ভাগের এক ভাগ ফসলের বিনিময়ে জমি কেরায়া দিয়াছেন। এখন পর্যন্ত তিনি এই নিয়মেই চাষাবাদের কাজ করাইতেছেন।

হযরত হাসান বসরী (তাবেয়ী) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

ইহাতে কোনই দোষ নাই যে, দুইজনের মধ্যে একজনের জমি হইবে এবং উভয়েই উহা হইতে ফসল ফলাইবার জন্য অর্থ ব্যয় করিবে, (কিংবা শ্রম করিবে) আর উহাতে যে ফসল ফলিবৈ, তাহাতে উভয়ই সমান অংশীদার হইবে।

তিনি আরো বলিয়াছেন, ‘ইমাম জুহরীও ইহা সংগত এবং জায়েয বলিয়া রায় প্রকাশ করিয়াছেন।

তাহাবী (****) নামক বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ কালীব-বিন ওয়ায়েল হইতে বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ বিন ওয়ায়েলকে জিজ্ঞাসা করিলেন।

(আরবী**********)

এক ব্যক্তি আমার নিকট আসিল, তাহার নিকট জমি এবং উহার সেচের জন্য জলাশয় আছে; কিন্তু তাহার বীজ ও গরু বা কৃষিযন্ত্র নাই। আমি তাহার জমি অর্ধেক ফসল দেওয়ার বিনিময়ে গ্রহণ করিলাম এবং নিজের বীজ ও গরু দিয়া কৃষিকার্য সম্পন্ন করিলাম। অবশেষে উহার ফসল আমরা উভয়ই আধা-আধি ভাগ করিয়া লইলাম। (এইকাজ সংগত হইল কিনা জিজ্ঞাসা করা হইল) উত্তরে হযরত আবদুল্লাহ বলিলেন (*****) ‘উত্তম’।

বস্তুত ফসলের কোন নির্দিষ্ট অংশের ভিত্তিতে পারস্পরিক কৃষিকাজ সম্পূর্ণ জায়েয। তবে ইহাতে কোন এক পক্ষের উপরই কোনরূপ জুলুম হইতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

পাস্পরিক কৃষিকাজকে নবী করীম (স) নিষিদ্ধ করেন নাই; বরং তিনি পরস্পরের প্রতি দয়াবান ও সহানুভূতি সম্পন্ন হইবার নির্দেশ দিয়াছেন।

উপরের দীর্ঘ আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে জানা গেল যে, পারস্পরিক কৃষিনীতি (****) ইসলামে সম্পূর্ণরূপে জায়েয। ফিকাহ শাস্ত্রের ইমামগণ ইহাকে সমর্থন করিয়াছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রা) হইতে এ সম্পর্কে নিষেধ ও নেতিবাচক যে উক্তি করিয়াছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রা) হইতে এ সম্পর্কে নিষেধ ও নেতিবাচক যে উক্তি বিভিন্ন কিতাবে উল্লিখিত হইয়াছে তাহা তাঁহার সাধারণ নীতি নয়। তিনি কেবল ইরাকের শস্য-শ্যামল উর্বর ভূমির ক্ষেত্রেই পারস্পরিক কৃষিনীতিকে সমর্থন করেন নাই। তাহার কারণ এই যে, তিনি নীতিগতভাবেই ইহাকে সংগত মনে করিতেন না বরং ইহার প্রকৃত কারণ এই যে, উল্লিখিত ভূমিগুলি রাষ্ট্রয় সম্পত্তি ছিল না। সেখানকার জিম্মিদের মালিকানার জমি ছিল, তাহা অনিশ্চিত ছিল এবং সে সম্পর্কে বিশেষ মতভেদ দেখা দিয়াছিল। কাজেই তাহা কোন ব্যক্তির পক্ষে খরীদ করা এবং অপরের দ্বারা চাষ করানোকে তিনি সমর্থন করিতে পারেন নাই। অন্যথায় মূলত অপরের দ্বারা জমি চাষ করানোকে তিনি কখনই নিষিদ্ধ বলিয়া মত প্রকাশ করেন নাই।

দ্বিতীয় কথা এইরূপ কৃষিনীতি হযরত নবী করীমের (স) সময় হইতেই খুলাফঅয়ে রাশেদুনের কাল পর্যন্ত দ্বিধা-সংকোচহীনভাবে সকল মুসলমানের মধ্যেই প্রচলিত ছিল কেহই এইরূপ কাজকে নিষিদ্ধ মনে করেন নাই। কাজেই আজ ইহা নিষিদ্ধ হওয়ার কোনই কারণ থাকিতে পারে না। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

যে নিয়মে রাসূলে করীম (স) খুলাফায়ে রাশেদুন এবং সাহাবায়ে কিরাম ভূমির ব্যবস্থা করিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহে ও পুরাপুরিভাবে সুবিচারপূর্ণ ব্যবস্থা। উহা জায়েয হওয়ার কোনই সন্দেইহ থাকিতে পারে না।

ইবনে আবূ লাইলা, আবূ ইউসুফ, মুহাম্মদ সকল মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ –ইমাম আহমাদ, ইবনে খুজাইমা, ইবনে শুরাইহ প্রমুখ ফিকাহবিদগণ বলিয়াছেন: ‘পারস্পরিক জমি সেচ ও পারস্পরিক কৃষিকাজ সমবেতভাবে সম্পন্ন করা যেমন জায়েয, অনুরূপভাবে এককভাবেও ইহা করা জায়েয। খায়বর সংক্রান্ত হাদীসের বাহিত্য তাৎপর্য হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় এবং ইহাই সর্বজন গ্রহীত নীতি। খায়বরে পারস্পরিক কৃষিনীতি জায়েয হইয়াছিল শুধু পানি সেচের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে, এইরূপ দাবি করা কিছুতেই সংগত হইতে পারে না বরং উহা হইতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, স্বতন্ত্রভাবেও পারস্পরিক কৃষিনীতি সম্পূর্ণ জায়েয।

ফিকাহবিদদের মতে নিম্নলিীখত চারভাবে পারস্পরিক কৃষিকার্য জায়েয:

(ক) জমি ও বীজ জমি-মালিক দিবে এবং কৃষিযন্ত্র ও শ্রম দিবে চাষী।

(খ) জমি, কৃষি-যন্ত্র ও বীজ সবই দিবে জমি-মালিক আর চাষী শুধু শ্রম করিবে ও ফসল ফলাইবে।

(গ) জমি-মালিক শুধু জমি দিবে এবং অন্যান্য সবকিছু দিবে চাষী।

(ঘ) জমি ও কৃষি যন্ত্র জমির মালিক দিবে এবং বীজ ও শ্রম দিবে চাষী।[(আরবী**********)]

শেষোক্ত ধরনের পারস্পরিক কৃষিকার্য সম্পর্কে কোন কোন ফিকাহবিদ আপত্তি জানাইলে ইমাম আবূ ইউসুফ উহাকে বৈধ ঘোষণা করিয়াছেন।

তৃতীয় কথা, ইসলামী অর্থনীতি ব্যক্তি-মালিকানার ব্যাপারে জমি বা নগদ টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট করিয়া দেয় নাই। সংগত উপায়ে এক জনের হাতে যত পরিমাণ জমিরই সমাবেশ হউক না কেন, ইসলাম তাহা নিষেধ করে নাই। এই জমি সে নিজে চাষ করিবে, অপরকে ফসলের নির্দিষ্ট ভাগের বিনিময়ে চাষ করিতে দিবে, নগদ মজুরী দিয়া দিন মজুরের দ্বারা জমিতে কাজ করাইবে ফসল উৎপন্ন করিবে, অথবা নগদ টাকা লইয়া অপরকে এক ফসলের বা এক বৎসরের জন্য চাষ করিতে দিবে-ইসলামী কৃষিনীতিতে ইহার প্রত্যেকটি পন্থাই সংগত, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই পর্যায়ে ইসলামের অর্থনীতি বিশারদ ও সর্বজনমান্য মনীষীদের মতও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

বস্তুত ইসলামী অর্থনীতি যখন বৃদ্ধ, পংগু, অন্ধ, শিশু এবং স্ত্রীলোক- যাহারা নিজ হাতে জমি চাষ করিতে পারে না তাহাদিগকেও জমির মালিক হওয়ার অধিকার দেয়, তখন অন্যের দ্বারা ভূমি চাষ না করাইতে পারিলে তহারা মালিকানা কিরূপে কার্যকর হইবে? তাহারা নিজেদের জমি নিজেরা চাষ করিতে পারে না শুধু এতটুকু কারণে তাহাদের মালিকানা কাড়িয়া লইতে হইবে?….. ইসলাম তাহা কিছুতেই বরদাশ তততরিতে পারে না।

স্বর্ণ রৌপ্য বা নগদ টাকার বিনিময়ে একজনকে জমি চাষ করিতে দেওয়া বা অন্যের জমি চাষ করিবার জন্য গ্রহণ করায় কোনই বাধা নাই। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

শুন্য জমি স্বর্ণ রৌপ্যের (নগদ টাকা) বিনিময়ে ইজারা লওয়া তোমাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা

ইহা হইতে সকল জমি নগদ মূল্যে ভাড়ায় দেওয়া ও নেওয়া জায়েয প্রমাণিত হয়।

সহী মুসলিম শরীফে উল্লেখিত হইয়াছে, হিঞ্জিলা ইবনে কায়সুল আনসারী বলেন:

(আরবী**********)

আমি রাফে’ ইবনে খাদীস(রা)-কে সোনা-চাঁদির (নগদ টাকার) বিনিময়ে জমি ভাড়ায় লওয়া বা দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন: ‘তাহাতে কোন দোষ নাই’।

অপর এক হাদীসে বলা হইয়াছে, জমি কেরায়া লাগানোকে লোকেরা খুব মন্দ কাজ মনে করিতেছে বলিয়া যখন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) শুনিতে পাইলেন, তখন তিনি বললেন:

(আরবী**********)

নবী করীম (স) তো বলিয়াছেন যে, তোমাদের একজন তাহার ভাইতে চাষের জন্য জমি দেয় না কেন? কিন্তু তিনি জমি ভাড়ায় লাগাইতে তো নিষেধ করেন নাই।

ইসলামী সমাজে যুগ যুগ ধরিয়া এইসব পদ্ধতিতেই জমি চাষ করার কাজ চলিয়া আসিতেছে। কিন্তু পতনযুগের সূচনায় এবং বর্তমানের পতন যুগের চূড়ান্ত পর্যায়ে আসিয়া এক শ্রেণীর জাতীয়করণবাদী কর্তৃক এই সব পন্থাকেই অসংগত প্রমাণ করিবার চেষ্টা চালাইয়াছে। সাধারণতঃ তাহারা এই জন্য মার্কসসীয় যুক্তিধারারই আশ্রয় লইয়া থাকে। কিন্তু তাহারা এতটুকু লক্ষ্য করে না যে, মার্কস যে শোষণ ও বঞ্চনার তান্ডব নৃত্য দেখিয়া অন্যান্য উৎপাদন উপায়ের সঙ্গে সঙ্গ জমিরও ব্যক্তিগত মালিকানাকে অস্বীকার করিয়াছেন, তাহা জায়গীরদারী, জমিদারী সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী সমাজেই সম্ভব- মার্কস-ও এইসব সমাজেই তাহা দেখিয়াছিলেন। কিন্তু ইসলামের সুবিচারপূর্ণ অর্থনীতিতে- তথা ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রে- অনুরূপে শোষণ ও বঞ্চনার কোন অবকাশ থাকিতে পারে না। তথায় অপরর জমি চাষ করিয়া কোন চাষী সমস্ত ফসল মালিকের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া শুন্য হস্তে বাড়ি ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয় না, মোটা অংশ সে নিজের ঘরে নিশ্চয়ই লইয়া যাইতে পারে। আর তাহাতেও তাহার মৌলিক প্রয়োজন পূর্ণ না হইলে ইসলামী রাষ্ট্র তাহা পরিপূরণের জন্য দায়ী থাকে। কাজেই মার্কসীয় মতবাদের ভিত্তিই এখানে বর্তমান তাকিবে না এবং জমির ব্যক্তিগত মালিকানা ও পারস্পরিক কৃষিনীতিকেও নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দিবে না।

সম্পত্তির জাতীয়করণবাদীরা কেবল মার্কসীয় দর্শন পেশ করিয়াই ক্ষান্ত হয় না, দু-একটি হাদীসও যে তাহারা নিজেদের দাবির অনুকূলে পেশ করে না, এমন নয়। যথা হযরত রফে ইবনে খাদীস-বর্ণিত নিম্নলিখিত হাদীসটি:

(আরবী**********)

রাসূলে করীম (স) আমাদের একটি উপকারী কাজ হইতে বিরত থাকিতে বলিয়াছেন। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে কাহারো জমি থাকিলে তাহা উৎপন্ন ফসলের অংশ বা নগদ টাকার বিনিময়ে অপরকে চাষ করিতে দিতে নিষেধ করিয়াছেন।

কিন্তু এই হাদীসটি উহার বর্তমান শব্দসমূহ সহকরে কিছুতেই গ্রহণ করা যাইতে পারে না। কারণ উল্লিখিত হাদীসটি একে দীর্ঘ ও বিস্তারিত হাদীসের একটি অংশ মাত্র। কাজেই উহাকে উহার মুল হাদীসের সহিত মিলাইয়া দেখিতে হইবে। সেই পূর্ণ হাদীসটি এইরূপ: হিঞ্জিলা ইবনে কায়সুল আনসারী বলেন, ‘আমি রাফে’ ইবনে খাদীস (রা)-কে “সোনা-চাদির” বিনিময়ে জমি ভাড়া দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন, ‘ইহাতে কোন দোষ নাই।’ অতঃপর তিনি আরো বলেন:

(আরবী**********)

আসল ব্যাপর এই যে, নবী করীম (স)-এর প্রাথমিক সময়ে লোকেরা খালের তীরে অবস্থিত জমির বিশেষ কোন অংশে যে ফসল জন্মিবে, উহার অংশ দেওয়ার বিনিময়ে অপরকে জমি চাষ করিতে দিত- ভূমি চাষ করিতে দেওয়ার ইহাই ছিল তখন সাধারণ নিয়ম। কিন্তু পরিনামে উহার এই অংশের ফসল নষ্ট হইয়া যাইত। ফলে চাষী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইত এবং নিজ শ্রমের ফল হইতে বঞ্চিত হইত। এই জন্য নবী করীম (স) এই কাজ হইতে মুসলমানদিগকে বিরত থাকিতে আদেশ করিয়াছেন।

পূর্ণ হাদীসটি হইতে জানা গেল যে, অপরের দ্বরা জমি চাষ করানোকে নবী করীম (স) নিষিদ্ধ করেন নাই; বরং আরবের তৎকালীন প্রচলিত অবিচার ও শোষণমূল শর্তে চাষ করানোকে তিনি নিষেধ করিয়াছিলেন মাত্র। কারণ এইরূপ শর্তে উভয়ের মধ্যে একজনের লোকসান হওয়া নিশ্চিত ছিল। এই কারণে ইহা সুদের অন্তর্ভুক্ত হইয়া পড়িতেছিল ও শোষণের কারণ হইয়াছিল।

এতদ্বীত রাফে’ ইবনে খদীজের বিভিন্নভাবে বর্ণিত ‘নিষেধ বাণী’ই মূলত সত্য নহে। কারণ হযরত রাফে’ নবী করীমের নিকট যখন এই নিষেধবাণী শুনিয়াছিলেন তখন আসলে সাধারণভাবে এই কাজকেই নিষিদ্ধ করা হয় নাই; বরং বিশেষ অবস্থার দরুনই নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল। ইহাতে প্রমাণ এই যে, আবূ দাউদ ইবনে মাজাহ্‌ ও নাসায়ী গ্রন্থে ওরওয়া কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে, হযরত যায়দ বিন সাবিত (রা) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

‘আল্লাহ রাফে’কে ক্ষমা করুন। আল্লাহর শপথ, এই নিষেধমূলক হাদীস সম্পর্কে রাফে অপেক্ষা আমিই অধিক ভাল জানি। কারণ, প্রকৃত ব্যাপার এই ছিল যে, দুই ব্যক্তি (জমি লইয়া)পরস্পর রক্তারক্তি করিয়া নবী করীমের খিদমতে হাজির হইয়াছিল, ইহা দেখিয়া (এবং সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়া) তিনি বলিলেন: ‘ইহাই যদি তোমাদের অবস্থা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তোমরা জমি’ কেরায়া’ দেওয়া বন্ধ করিয়া দাও’ কিন্তু রাফে’ পূর্বের কথা কিছুতেই শুনিতে পান নাই। তিনি শুধু শেষ কথাটি ‘জমি কেরায়া দেওয়া বন্ধ করিয়া দাও’ শুনিতে পাইয়াছিলেন।

স্বয়ং হযরত রাফে’র নিম্ন লিখিত কথা হইতেও ইহাই প্রমাণিত হয় যে, তদানীন্তন আরব-সমাজের প্রচলিত ভুল ও জুলুম-মূলক রীতির কারণেই নবী করীম (স) উক্ত ভুল পন্থায় জমির চাষাবাদ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। রাফে’ ইবনে খাদীজ বলেন:

(আরবী**********)

আমরা মদীনার অধিকাংশ অধিবাসী কৃষিজীবি ছিলাম, আমাদের কেহ যখন জমি কেরায়া দিত, তখন সে বলিত, জমির এই খন্ডের ফসল আমার আর ঐ খন্ডের ফসল তোমার। কিন্তু অনৈক সময় দেখা যাইত যে, ঐ জমির একখন্ডে হয়ত ফসল জন্মিয়াছে; আর অপর খন্ডে কিছুই জন্মে নাই। তখন নবী করীম (স) এইভাবে জমি চাষ করিতে নিষেধ করিলেন।

কাজেই এই নিষেধমূলক হাদীস মূলতঃ একটি বিশেষ অবস্থা বা অবাঞ্ছনীয় ঘটনার সহিত সংশ্লিষ্ট- উহা সাধারণ নিষেধ নয়।

কিন্তু এক শ্রেণীর ‘চিন্তাশীল’ লোক হাদীসের আগাগোড়া কিছুই না জানিয়া বা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করিয়া, পূর্বাপর সম্পর্কহীনভাবে মধ্যখান হইতে একটু লইয়া নিজেদের মনগড়া মতবাদের প্রমাণস্বরূপ উহাই পেশ করিতে চেষ্টা করেন। তাঁহাদের মতে ষষ্ঠ শতাবঈতে ইসলামের বিরাট বৈপ্লবিক অভ্যত্থান হইয়াছিল শুধু জমিদার ও জোতদারদের নিকট হইতে জমি কাড়িয়া লইয়া ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করিয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই কথা যে আদৌ সত্যভিত্তিক নয়, কুরআন হাদীস এবং ইসলামের ইতিহাস হইতেও প্রমাণিত নয়, তাহা ইসলামভিত্তিহক প্রত্যেক ব্যক্তিই বুঝিতে পারেন।

সরকার পর্যায়ে জমি বন্টন

এই আলোচনার শেষ ভাগে সরকারী পর্যায়ে জমি বন্টন সম্পর্কে আরো কয়েকটি জরুরী কথা বলা আবশ্যক।

সরকারী পর্যায়ে কেবলমাত্র সেই সব জমিই বন্টন করা যাইতে পারে যাহার কোন ব্যক্তিই মালিক নয় এবং তাহা বন্টন করা যাইবে কেবল সেই সব ভূমিহীন বা স্বল্প ভূমি মালিক লোকদের মধ্যে যাহারা উহা আবাদ ও চাষোপযোগী করিয়া তুলিতে এবং উহা হইতে ফসল ফলাইতে ইচ্ছুক ও সক্ষম বিবেচিত হইবে। উপরন্তু উহা নির্দিষ্ট মিয়াদের মধ্যে আবাদ করার শর্তেই দেওয়া যাইতে পারে। এই শর্তের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হইয়াচে। এই মিয়াদ শেষ হইয়া যাওয়ার পর্বে যদি তাহা আবার করা সম্ভব না হইয়া থাক তাহা হইলে উহা সরকারের নিকট প্রত্যার্পিত হইবে এবং সরকার উহা অপর লোকদের মধ্যে পূণর্বন্টন করিবে।

নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে জমি বন্টনের নিয়ম পুরামাত্রায় প্রচলিত ছিল।

এই জমি বন্টনের ব্যাপারে জরুরী শর্ত হইল:

(ক) সেই জমি কোন রাগরিকের মালিকানাভুক্ত হইবে না।

(খ) উহা সাধারণ জন-মানুষের কল্যাণের সহিত সম্পর্কিত হইবে না। এ ধরনের কোন জমি বিশেষ কোন নাগরিককে ব্যক্তিগতভাবে মালিকানা হিসাবে দান করার সরকারের কোন অধিকা নাই। এবং

(গ) এই জমি এমন হইবে না যেখানে সাধারণ জন-মানবের জন্য অপরিহার্য কোন ধাতু বা সম্পদের খনি অবস্থিত। এইরূপ হইলে সেই জমি ব্যক্তিগতভাবে কাহাকেও দেওয়া যাইবে না।

এই তিন প্রকারের জমি ছাড়া অন্যা্য সকল প্রকার জমিই সরকার যাহাকে ইচ্ছা ভোগ দখলের জন্র দান করিতে পারে। কিন্তু তাহাও খাতির, প্রীতি, আত্মীয়তা, ঘুষ-রিশওয়াত, সুপারিশ ও ধরপাকড়ে বা দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কাহাকেও দেওয়া যাইতে পারে না। বরং এই জমি বন্টনের ব্যাপারেও শহর-নগর উন্নয়ন, অধিক ফসল ফলাও ও সাধারণ জনমানুষের কল্যাণ হইতে হইবে আসল লক্ষ্য।

নবী করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলে জমি বন্টন নীতি

আরবদেশে যখন ইসলাম প্রতিষ্টিত হয়, তখন সেখানকার জমি জায়গার তিনটি অবস্থা ছিল। অবস্থা তিনটি নিম্নরূপ:

(১) বহু পরিমাণ জমি ছিল ব্যক্তিদের মালিকানাভুক্ত,.

(২) এমন অনেক জমিই ছিল, যাহার কেহ মালিক ছিলনা এবং

(৩) গৃহপালিত পশুর সাধারণ চারণভূমিরূপে নির্দিষ্ট ছিল অনেক জমি।

নবী করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সর্ব প্রথম মৃত, পড়ো ও মালকবিহীন অনাবাদী জমি আবাদ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করিলেন: ‘এই মৃত জমি যে আবাদ করিবে সে উহার মালিক হইবে।’ লোকেরা তখন সাধ্যানুসারে জমি আবাদ করিবার ও উহার মালিক হইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিয়া গেল। এইভঅবে বহু লোকের মধ্যে মালিকবিহীন জমি বন্টন করা হইল। (আবূ দায়ূদ)

নবী করীম (স)-এর অন্তর্ধানের পর প্রথম পর্যায়ে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সহিত ইসলামী রাষ্ট্রের সংঘর্ষ এবং যুদ্ধ হয়। ইহার ফলে ‍মুসলমানরা বিজয়ী হইয়া এই দুই রাষ্ট্রের বিশাল অঞ্চল দখল করিয়া লয়। ইসলামী রাষ্ট্রের দখলকৃত এই বিশাল জমি-জায়গার কেহই মালিক ছিল না। হয় উহার মালিক যুদ্ধে নিহত হইয়াছে, না হয় উহা আসলেই কাহারও মালিকানা ভুক্ত ছিল না বরং পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সরকারায়ত্ব জমি-জায়গা ছিল এবং তাহাই ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে আসিয়াছিল।

এই সময়ই ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফাগণ এই সব জমি-জায়গা আবাদ ও ভোগদখল করার জন্য এমন লোকদের মধ্যে বন্টন করিলেন যাহারা উহা আবাদ করিতে ও উহাতে ফসল ফলাইতে সক্ষম বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল।

ইসরামী রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি বন্টনের ইহাই হইল মূল সূত্র। ইহা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক সুফল দান করিয়াছিল।

এই সকল ভূমিবন্টন শরীয়াতি বিধান পুরাপুরি অনুসৃত হইয়াছে। ইসলামের ফিকাহবিদগণ পূর্বোল্লিখিত শর্তের ভিত্তিতে ভূমিবন্টনকে পুরাপুরি সমর্থন করিয়াছেন ও জায়েয বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।

হযরত উমহর ফারূক (রা) গভর্ণর হযরত আবূ মুসা আশয়ারীকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন:

(আরবী**********)

যদি উহা জিজিয়ার জমি না হয় এবং এমন জমিও না হয় যেখানে জিজিয়ার জমির জন্য পানি প্রবাহিত হয়, তবে কেবল সেই জমিই সরকারী পর্যায়ে জনগণের মধ্যে বন্‌টন করিতে পার।

ইহা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, কেবলমাত্র ব্যক্তি-মালিক বিহীন জমিই সরকারী পর্যায়ে বন্টন করা যাইতে পারে। আর এইরূপ জমি পূর্ণবন্টন সরকারী পর্যায়েই হইতে পারিবে। (আরবী**********)

কাজী আবুল হাসকান আল-মাঅদী লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

সরকারী পর্যায়ে জমি বন্টনকার্য কেবলমাত্র সেই সব জমির মধ্যেই সীমাবদ্ধ যাহা সরকারের দখলীভুক্ত রহিয়াছে এবং যাহাতে সরকারী নির্দেশ কার্যকর হইতে পারে। কিন্তু যে সব জমির নির্দিষ্ট মালিক রহিয়াছে এবং যে সব জমির দকলকার অন্যদের হইতে পৃথকহ অধিকার পাইয়াছে সে সব জমি সম্পর্কে সরকার বিনা কারণে কোন নূতন নীতি গ্রহণ করিতে পাড়ে না।

সরকারী পর্যায়ে জমি বন্টনের ইহাই মৌলিক বিধান। অতএব সাধারণভাবেও কোন সামষ্টিক কল্যাণের উদ্দেশ্য ব্যতীতই খামকেয়ালীর বশবর্তী হইয়া ভূম্যাধিকারীদের উৎখাত করিয়া দিয়া উহাকে নিজস্ব লোকগের মধ্যে অথবা অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে পুনর্বন্টন করা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট জুলুম।

এই পর্য়ায়ে এ কথাও বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে যে, সরকারীভাবে যে জমি জনগণের মধ্যে বন্টন করা হইবে, উহার দ্বারা কোনরূপ সামন্তবাদী বা জায়গীরদারী প্রথা রচনা করা চলিবে না, যাহার পক্ষে যত পরিমাণ জমি ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার মধ্যে সামলানো, চাষাবাদ ও ফসল ফলানো সম্ভব হইবে বলিয়া বিবেচিত হইবে, তাহাকে ততখানি জমিই দেওয়া যাইবে। উহার অধিক পরিমাণ কাহাকেও দেওয়া যাইবে না। কাহাকেও যদি আবাদ অসাধ্য পরিমাণ জমি দেওয়া হয় যাহার ফলে বহু চাষেচ্ছু বা ভূমি-শ্রমিক বঞ্চিত থাকিয়া যাইতে পারে; কিংবা জমি-মালিক যদি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ করিতে অসমর্থ হয়, তাহা হইলে সে জমি সরকারী তহবিলে ফেরত লইতে ও এই কাজে সক্ষত। উপযোগী লোকদের মধ্যে বন্টন করিতে হইবে।হযরত বিলাল ইবনুল হারেস (রা)-কে নবী করীম (স) প্রচুর জমি নিজে আবাদ করার উদ্দেশ্যে দিয়াছিলেন। হযরত উমর ফারূক (রা) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর তাঁহাকে ডাকিয়া বলিলেন: রাসূলে করীম (স) আপনাকে অনেক জমি দিয়াছিলেন। তাহার পরিমাণ এত বেশী যে, আপনি নিজে তাহা চাষাবাদ করিয়া পুরামাত্রায় ব্যবস্থা করিতে পারিতেছেন না। অতঃপর বলিলেন:

(আরবী**********)

আপনি বিবেচনা করিয়া দেখুন। যে পরিমাণ জমি আপনি নিজে চাষাবাদ করিতে সক্ষম হইবেন, সেই পমিাণই আপনি নিজের নিকট রাখুন। আর যাহা সামলাইতে পারিবেন না কিংবা যে পরিমাণ জমির ব্যবস্থাপনা কর আপনার সাধ্যাতীতত, তাহা আমাদের (রাষ্ট্রের) নিকট ফেরত দিন, আমরা উহা অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করিয়া দিব।

হযরত বিলাল জমি ফেরত দিতে রাযী হওয়া সত্ত্বেও তাঁহার সাধ্যাতীত পরিমাণে হযরত উমর (রা) ফেরত লইলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে পুনর্বন্টন করিলেন। [(আরবী**********)]

এইরূপ ভুমি বন্টনের কাজ স্বয়ং নবী করী (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের আমলদারীতেও সুসম্পন্ন হইয়াছে। এইরূপ ভূমি বন্টনের পশ্চাতে দুইটি উদ্দেশ্যই নিহিত ছিল। একটি হইল ভূমিহীন লোকদিগকে চাষাবাদের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের সুযোগ দিন ও তাহাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার প্রতিবিধান এবং দ্বিতীয় হইল সেনাবাহিনীর মধ্যে যাহারা প্রশংসামূলক কার্যক্রম সম্পাদন করিয়াছে, তাহাদের এই বিরাট কাজের পুরষ্কার দান। আর এই উভয়বিধ উদ্দেশ্যের পশ্চাতেও অনাবাদি ও অনুন্নত জমিকে আবাদ ও চাষোপযোগী বানানো ও তাহাতে ফসল ফলাইয়া জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধন ছিল আসল লক্ষ্য।

তখন নিম্নোক্ত তিন প্রকারের জমিই বন্টন করা হইয়াছে:

(ক) যে সব জমির কেহ মালিক নাই, যদিও তাহা অনাবাদি ও পড়ো জমি।

(খ) যাহা শহর, নগর ও গ্রামবাসীর সাধারণ ও সামষ্টিক প্রয়োজনে আসে না।

(গ) যাহাতে সাধারণ মানুসের জন্য অপরিহার্য কোন ধাতু বা খনিজ পদার্থ অবস্থিত নহে।

এইরূপ জমি রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ যাহাকে ইচ্ছা দান করিতে পারে। অবশ্য সে দানের পশ্চাতে দেশ ও দেশবাসীর সাধারণ কল্যাণিই লক্ষ্যরূপে নিহিত থাকিতে হইবে, নির্বিচারে বা অবিবেচনা সহকারে তাহা বলা চলিবে না।

ইমাম আবূ ইউসুফ লিখিয়াছেন: এই পর্যায়ে জমি- যাহা আবাদ নয়, যাহার কেহ মালিক নাই, তাহা – বন্টন না করয়া অকেজো ফেলিয়া রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে কিছুতেই উচিত হইতে পারে না। কেননা, আবাদ করার ফলে যেমন প্রয়োজনীয় বিপুল খাদ্য ফসল লাভ করা যাইতে পারে, তেমনি সরকারের আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পাইতে পারে। এই পর্যায়ে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের একটি ফরমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁহার গভর্ণরদের প্রতি নির্দেশ দিয়াছিলেন:

তোমাদের হাতে যেসব সরকারী জমি জায়গা রহিয়াছে তাহা অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে পারস্পরিক চাষের নিয়ম অনুযায়ী জনগণকে চাষ করিতে দাও। ইহাতে যদি উহার চাষাবাদ না হয়, তাহা হইলে এক-তৃতীয়াংশের বিনিময়ে (তিন ভাগের এক ভাগ সরকার পাইবে এবং দুই ভঅগ পাইবে চাষী) তাহা চাষ করিতে তাও। আর এ শর্তে যদি কেহ জমি চাষ করিতে প্রস্তুত না হয়, তাহা হইলে দশ ভাগের এক ভাগ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে চাষ করিতে দিতে পার। ইহাতেও যদি জমি চাষ না হয় তাহা হইলে কোনরূপ বিনিময় না লইয়া এমনিই চাষ করিতে দাও। এই ভাবেই কেহ চাষ করিতে না চাহিলে উহার চাষাবাদ করার জন্য বায়তুলমার হইতে অর্থ ব্যয় কর এবং কোন জমিই তোমরা বেকার থাকিতে দিবে না।

ভূমি উন্নয়ন ও বন্টন

রাষ্ট্র সরকারের দখলে যে সব মালিকহীন পড়োজমি থাকে, সরকার তাহা ভূমিহীন জনগণের মধ্যে বন্টন করিবে। ইসলামী অর্থনীতির ইহা এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নীতি। স্বয়ং রাসূলে করীম (স) এই ধরনর জমি জনগণের মধ্যে বন্টন করিয়াছেন, তাহা পূর্বে বিস্তারিত আলোচিত হইয়াছে। নিম্নোক্ত হাদীসটি এই প্রসংগে উল্লেখযোগ্য:

(আরবী**********)

নবী করীম (স) বিলাল ইবনে হারেস নামক এক ব্যক্তিকে কাবলিয়া এলাকার উচ্চ ও নিম্ন এলাকার খনি এবং কুদসের চাষযোগ্য জমিসমূহ দান করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কোন মুসলমানের হক অপরকে দেন নাই।

কাবলীয়া ও কুদস এলাকা মুসলিম মুজাহিদদের অধিকৃত এলাকা। এই এলাকার খনি ও চাষযোগ্য জমি রাসূলে করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বিলাল ইবনুল হারেসকে দান করিয়াছিলেন। এই সব খনি ও জমির কেহ মালিক ছিল না। কাজেই রাষ্ট্র সরকারের পক্ষেতাহা বন্টন করা খুবই সংগত কাহ। আল্লামা শওকানী উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

এই পর্যায়ের হাদীসসমূহ হইতে প্রমাণিত হয় যে, নবী করীম ও তাঁহার পর ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানদের পক্ষে জনগণের মধ্যে খনি বন্টন করাও সম্পূর্ণ জায়েয কাজ।

(আরবী**********)

বস্তুত ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান পড়ো, মালিকবিহীন ও দখলহীন জমি লোকদের মধ্যে বন্টন করিতে পারে।

এইভঅবে যখন কোন জমি বা খনি কাহাকেও বন্টন করিয়া দেওয়া হয়, আর যদি তাহাতে দখল লইয়া চাষাবাদর কাজ করে এবং উহাকে চাষযোগ্য ও ফসল দাত্রী বানাইয়া লয়, তখন সে উহর মালিক হইবে এবং তাহার মালিকানা কখনই হরণ করা যাইবে না।

আর যদি কোন জমি বা খনি এইভাবে বন্টন করনা হয় এবং পরে লক্ষ্য করা যায় যে, তাহা হইতে বিনা পরিশ্রমে উৎপাদন করা সম্ভব, তাহা হইলে উহা প্রত্যাহার করিতে হইবে। কেননা উহার ফল তো সহজলভ্য এবং সাধারণ মানুষের জন্য অধিক প্রয়োজনীয়। কাজেই যে-ই উহা প্রথম দখল করিবে, সে-ই উহার ভোগাধিকার পাইবে। কাহেো পক্ষে উহার একচ্ছত্রভাবে মালিক হইয়া বসা এবং সাধারণ মানুষকে উহার ভোগ ও ব্যবহজার হইতে বঞ্চিত করার কোন অধিকার নাই।

খনি যদি স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও ভূমি গর্ভস্থ কোন ধাতুর হয়, যাহা মাটি ও পাথরের সঙ্গে মিশ্রিত হইয়অ থাকে এবং যাহা কঠিন ও কঠোর শ্রম ব্যতীত উত্তোলন ও পরিশোধন করা সম্ভব হয় না, তাহলে উহা কাহাকেও দান করা যাইতে পারে। তবে সে উহার নিরংকুশ মালিক হইয়া বসিতে পারিবে।

এই ধরনের খনি কাহাকেও দান করা হইলে দানপ্রাপ্ত ব্যক্তি উত্তোলেন ও পরিশোধন কার্য বন্ধ রাখিতে পারিবে না। কেননা তাহার ফলে উহার অভাবে সাধারণ মানুষের বিশেষ অসুবিধা হওয়ার আশংকা রহিয়াছে। তাহাকে উহা দান করা হইয়াছে উহাতে কাজ করার উদ্দেশ্যে এবং যত দিন তাহার পক্ষে সম্ভব সে উহাতে করিয়া যাইবে। যদি সে উহাতে কাজ বন্ধ করে, তখন উক্ত খনি তাহার অধিকার হইতে মুক্তি ও নিষ্কৃতি লাভ করিবে। ইমাম শাফেয়ীর ইহার মত।

হাদীসের শেষ অংশ (আরবী**********) ‘তাহাকে কোন মুসলিমের অধিকার দিয়া দেওয়া হয় নাই’ –ইহা হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, কেহ যদি একবার কোন জমির মালিণক হয়, তাহার পর সে উহাকে বেকার ফেলিয়া রাখে, কিংবা সে জমি হইতে সে অনুপস্থিত থাকে তবে প্রথম দান ও আবাদ করার কারণেই তাহার মালিকানা স্থায়ী হইবে না।

ধন-বিনিময়

ইসরামের সুবিচারপূর্ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ অর্থনীতিতে ধন-উৎপাদনের প্রধান দুইটি উৎসের (Source) আলোচনার পর ধন-বিনিময় সম্পর্কেও আলোকপাত করা আবশ্যক। যদিও প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যই শ্রম ও মেহনতের সাহায্যে ধন-উৎপাদন করিয়া থাকে; কিন্তু অনেক সময়ই নিজ শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য ব্যবহার করিয়া সরাসরিভাবে উহা হইতে উপকৃত হওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না; বরং সেইজন্য নিজের উৎপন্ন দ্রব্রের সহিত অপরের উৎপন্ন দ্রব্যের বিনিময় করিয়া লওয়া অপরিহার্য হইয়া পড়ে।

মানুষ স্বভাবতই অপরের মুখাপেক্ষী, কোন মানুষই-অন্য নিরপেক্ষ হইয়া, অপরের শ্রমের সাহায্যনা লইয়া বাঁচিতে পারে না। অনুরূপভাবে একটি দেশেযে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকে, অন্যদেশে উহার অপরিহার্য প্রয়োজন থাকার সঙ্গে সঙ্গ তথায় তাহা দুর্লভ হইতে পারে। কাজেই লোকদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য পাস্পরিক সম্পদ বিনিময় যতখানি আবশ্যক বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক পণ্যবিনেময়ও অনুরূপভাবে আবশ্যক। বস্তুত, কর্মবন্টনের উন্নতির ফলে ধন-বিনিময়ে ক্ষেত্রও অধিকতর প্রশস্ত হইতে পারে।

ধন-বিনিময় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে কুরআন শরীফের এই মূল নির্দেশ সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করিয়া লইতে হইবে:

(আরবী**********)

হে ঈমানদারগণ, তোমরা বাতিল উপায়ে পরস্পরের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করিও না; বরং পারস্পরিক সন্তোষভিত্তিক ব্যবসায়ের মাধ্যমেই তোমাদের সম্পদের লেন-দেন হওয়া আবশ্যক; এবং তোমরা আত্বমহত্যা বা আত্মধ্বংস করিও না।

আয়াতে উল্লেখিত ‘বাতিল উপায়ে’ বলিতে সত্য-বিরোধী তথা শরীয়ত ও নৈতকতার দিক দিয়া অন্যায়- এমন সকল পন্থাই বুঝায়। আর লেনদেন অর্থ- পরস্পরের স্বার্থ ও মুনাফার বিনিময় ব্যবসায়, বাণিজ্য, শিল্প ও কৃষির ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির পয়োজন পূরণের জন্য শ্রম করে, এবং সে তাহাকে পারিশ্রমিক দেয়। ইসলামী সমাজের সকল প্রকার লেন-দেন এইভাবেই হওয়া আবশ্যক। পারস্পরিক ব্যবসায় অর্থাৎ লেন-দেন কোনরূপ অন্যায় পাচে পড়িয়া কিংবা প্রতারণা ও ধোঁকায় পড়িয়া সম্পন্ন হওয়া কোন ক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়। ঘুষ এবং সুদ-ভিত্তিক লেন-দেনে পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও সম্মতি রহিয়াছে বলিয়া বাহ্যত মনে হইলেও প্রকৃত পক্ষে ইহা জবরদস্তিমূলক; অনিচ্ছা-সত্ত্বেও তাহা হইয়া থাকে। কোন লোকই সন্তুষ্টি চিত্তে ঘুষ বা সুদ দিতে প্রস্তুত হইতে পারে না; বরং বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীন চাপে পড়িয়াই মানুষ ইহা করিতে বাধ্য হয়্ জুয়ার ক্ষেত্রেও বাহ্য দৃষ্টিতে সন্তুষ্টি রহিয়াছে বলিয়াই মনে হয়; কিন্তু উহাতে প্রত্যেক ব্যক্তিই হারিবার জন্য নয়, জিতিবার প্রচুর অর্থ লাভ করার গোপন আশা লইয়াই খেলায় মাতিয়া উঠে। ধোঁকা-প্রতারণার ক্ষেত্রেও উভয়ই প্রথমতঃ রাযী হয় বটে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এ ব্যাপারে পরাজিত পক্ষের রাযী হওয়ার কোনই কারণ থাকিতে পারে না।

আয়াতের শেষ বাক্যাংশ ‘তোমরা আত্মহত্যা বা আত্মধ্বংস করিও না’ হইতে ইহাই সুস্পষ্টরূপে বুঝা যায় যে, উক্ত নিষিদ্ধ পন্থায় লেন-দেন বা ধন-বিনিময় করা আত্মহত্যা বা আত্মধ্বংসেরই শামিল। উক্তরূপে লেন-দেন ব্যক্তিগতভাবে একটি জাতিকে নিশ্চিরূরে ধ্বংসের করাল গ্রাসে নিক্ষেপ করে।

অতএব নিজের পণ্যদ্রব্যকে অপরের পণ্যদ্রব্যের সাহিত পারস্পরকি সদিচ্ছা ও আগ্রতের ভিত্তিতে বিনিময় করিয়া লওয়াই ইসলাম অর্থনীতিতে ধন-বিনিময়ের মূল কথা।

ধন-বিনিময়ের প্রাচনি পদধতি হইতেছে একটি পণ্যের পরিবর্তে অন্য একটি পণ্য গ্রহণ করা। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি ধন-বিনিময়ের ক্ষেত্রে মুদ্রা প্রবর্তনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। খায়বরের শাসনকরাতা মদীনায় আসিয়া নবী করীম (স)-এর সম্মুকে খুব উৎকৃষ্ট খেজুর পেশ করিলে পর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন; ‘খায়বর এলাকায় সাধারণ এই প্রকার খেজুরই কি উৎপন্ন হইয়া থাকে? উত্তরে শাসনকর্তা বলিলেন: সাধারণত এইরূপ খেজর সর্বত্র ফলে না। এইজন্য আমরা এই ধরনের এক সের খেজুর সাধারণ ও নিম্নশ্রেণীর দুই সের খেজুরের বিনিময়ে খরীদ করিয়া থাকি।’ নবী করীম (স) ইহা শুনিয়া বললেন:

(আরবী**********)

এইরূপ করিও না, বরং সাধারণ খেজুর মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রয় কর এবং উৎকৃষ্ট খেজর মুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় কর।[বুখারী, ১ম খণ্ড, ২৯৩ পৃঃ]

বস্তুত পণ্য-দ্রব্যের মুল্য মুদ্রার মানদন্ডেই সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। ‘বার্টর’ বা পণ্য-বিনিময়ের প্রাচনি রীতিতে অন্যান্য অনেক প্রকার বাস্তব অসুবিধা ছাড়াও পণ্যদ্রব্যের সঠিক মুল্য নির্ধারণ অসম্ভব হওয়াও একটি উল্লেখযোগ্য ‍অসুবিধা, সন্দেহ নাই। পরন্তু একই জাতীয় বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে গুণগত পার্থক্রের ‍দরুণ বেশী ও কম পরিমাণের সহিত বিনিময় হইলে তাহাতে সুদ হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে। এই জন্যেই নবী করীম (স) এই ধরনের পণ্য-বিনিময় সম্পর্কে বলিয়াছেন: ইহাতে সুদ। নবী করীম (স)-এর সমীপে হযরত বিলাল (রা) কিছু পরিমাণ খেজুর উপঢৌকন-স্বরূপ পেশ করিলে পর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন- “ইহা কোথা হইতে আনা হইয়াছে?” উত্তরে বেলাল (রা) বলিলেন: “আমাদে দুই ‘ছা’ (আরবীয় পরিমাণ- এক ‘ছা’ দুই সেরের সমান) নিকৃষ্ট খেজুর বিনিময়ে এক ‘ছা’ ভাল খেজুর আনিয়াছি, শুধু আপনার সম্মুখে পেশ করার উদ্দেশ্যে। নবী করম (ক) এই কথা শুনিয়া বিশেষ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করিয়া চলিলেন: “ইহা স্পষ্টরূপে সুদ, এইরূপ বিনিময় করিও না। এইরূপ বিনিময়ের প্রয়োজন অনুভূত হইলে নিকৃষ্ট খেজর অন্য কোন দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রয় করিয়া, সে দ্রব্রের বিনিময়ে ভাল খেজুর ক্রয় করিও। (বুখারী)

ধন-বিনিময় ভুল পন্থা

ইসলামী অর্থনীতিতে একচেটিয়া ব্যবসায়-প্রথা সাধারণভাবে সমর্থিত নহে। ইসলাম পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়কে যথাসম্ভব বাধা-বিমুক্ত ও সর্বসাধারণের সমান অধিকারের আওতায় আনিয়অ দেওয়ার পক্ষপাতী। অতএব কেহ ‍যদি কোন পণ্যদ্রব্যের সমগ্রটা অন্যান্য সকলের অজ্ঞাত খরীদ করিয়া লয় এবং নিজের একাধিকারবুক্ত করিয়া নিজ ইচ্ছামতই উহার মুল্য নির্ধারণ করে কিংবা উহা যাহাদের প্রয়েঅজন, তাঁহাদের কাহারো নিকট অত্যধিক চড়া দামে বিক্রয় করে আর অনেক লোককেই তাহা হইতে বঞ্চিত রাখে, তবে ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে ইহা মারাত্মক অপরাধ হিসাবে গ ণ্য হইবে- ইসলামী সমাজে এইরূপ সেচ্ছাচার কিছুতেই বরদাশত করা যাইবে না। কারণ প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্রের একচেটিয়া অধিকার স্বীকৃত হইলে অসংখ্য মানুষের জীন অচল হইয়া পড়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে।

ঠিক এই জন্যই, পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে কোনরূপ ধোঁকা প্রতারণা বা শটতায় প্রশ্রয় দেওয়াকেও ইসলামী অর্থনীতি কখনই বরদাশ্‌ত করিতে পারে না। যে সব ক্রয়-বিক্রয়ে লোকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রহিয়াছে অথবা যাহাতে এক পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও অপর পক্ষের নিশ্চিতরূপে লাভবান হওয়অ অবধারিত, ইসলামী অর্থনীতিতে তাহাও সুষ্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। কারণ এইরূপ ক্রয়-বিক্রয়ে ইসলামী সমাজের ঐক্যভিত্তি চূর্ণ এবং ইনসাফের নীতি লংঘিত হওয়অ অবশ্যম্ভাবী

পণ্যদ্রব্য-পরিমাপে অসাধুতা

পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে সঠিক পরিমাপ না করা- ক্রেতাকে ওজনে কম দেওয়া কিংবা নিজ হাতে বেশী ওজন করিয়া লওয়া ইলামী অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে:

(আরবী**********)

যাহারা ওজরে কম দেয়- পরের জিনিস ওজন করিয়া নিলে তখন পুরাপুরই গ্রহণ করে; কিন্তু ফরকে যখন ওজন করিয়া দেয়, তখন উহার পরিমাণ কম দেয়- ইহারা নিশ্চিতরূপে ধ্বংস হইবে।

বলা বাহুল্য, এই ‘ধ্বংস’ কেবল পারলৌকিকই নহে, ইহকালীনও বটে এবং কেবল নৈতিকই নহে, অর্থনীতির দিক দিয়া-জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ইহা দ্বারা মারাত্মক ধ্বংস টানিয়া আনা হয়- এই জন্যই কুরআন মজীদে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে:

(আরবী**********)

পণ্যদ্রব্যের ওজন পূর্ণ কর, ওজরে কম দানকারী হইও না। সঠিক দাড়িপাল্লায় ওজন কর, লোকদিগকে পরিমাণে কম বা নিকৃষ্ট কিংবা দোষযুক্ত দ্রব্র দিও না। এবং পৃথিবীতে বিপর্যয়কারী হইয়া বিপর্যয় করিয়া বেড়াইও না।

পণ্যদ্রব্যের পরিচয় দান কিংবা গুণ বর্ণনার ব্যাপারে মিথ্রা উক্তি করা, ভুল প্রচারণা করা, অথবা পরিষ্কার মিথ্যা কথা বলিয়া ক্রেতাকে প্রতারিত করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কেননা ইহাতে জনগণ পারস্পরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটা অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে।

কোন এক দোকানে শস্যস্তুপর উপরিভাগ শুষ্ক এবং নিম্নভাগ সিক্ত দেখিয়া নবী করীম (স) বলিয়াছিলেন:

(আরবী**********)

তুমি ভিজা শস্য উপরে রাখিতেছ না কেন?…. তাহা রাখিলে করিদ্দারগণ উহার প্রকৃত অবস্থা দেখিয়াই ক্রয় করিত- প্রতারিত হইত না। বস্তুত যে লোক আমাদিগকে প্রতারিত করে সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না। (মুসলিম, তিরমিযী) [এই হাদীস অনুযায়ী ব্যবসায়ে কোনরূপ প্রতারণা করা সম্পূর্ণ হারাম। ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

আবূ হুরায়রা বর্ণিত এই হাদীটি সহীহ। বিশেষজ্ঞগণ এই হাদীস অনুযায়ী আমল করেন। তাঁহারা ব্যবসায়ে ধোঁকাবাজীকে ঘৃণা করেন এবং বলিয়াছেন: ব্যবসায়ে ধোঁকাবাজী সুস্পষ্ট হারাম।]

অর্থাৎ সে আমার উপস্থাপিত হেদায়েত অনুযায়ী চলে না, আমার দেওয়া জ্ঞান ও কর্মপন্থা গ্রহণ কর না এবং আমার আদর্শ অনুসরণ করে না।

ইসলাম সমাজে ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি লংঘন করা একটা মারাত্মক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপরাধ। যে লোক অপরাধে লিপ্ত বা অভ্যস্ত তাহাকে ব্যবায় চালাইবার অনুমতি দেওয়া যায় না। দেওয়া হইয়অ থাকিলে তাহা বাতিল করিতে হইবে, ইহাই ইসলামের বিধান। (আরবী**********)

লাভের আশায় পণ্য মওজুদ

অস্বাভাবিকভাবে অধিক মুনাফা লুটিবার লোভে ব্যবসায়ীগণ সাধারণ সুলভ পণ্য বিপুল পরিমাণে খরীদ করিয়া সঞ্চয় করিয়া রাখে। ফলে বাজারে দুষ্প্রপ্যতার দরুন উহার চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য তীব্র গতিতে ঊর্ধ্বগামী হইয়া থাকে। ইহার পরিণামে তাহা জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সীমার বাহিরে চলিয়া যায় এবং দেশে হাহাকার পড়িয়া যায়। হয়তবা অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে মানুষের মৃত্যুমুখে ঢলিয়া পড়ার উপক্রম হয়। তখন ‍মুনাফা শিকারীদল নিজেরদের ইচ্ছামত দর নির্ধারণ করে এবং পশ্চাৎদ্বার হইতে বিক্রয় করিতে শুরু করে। আর কোন প্রকার ভয় না থাকিলে প্রকাশ্য ভাবেই এই অনাচার অনুষ্ঠিত হয়। ফলে জনগণের পক্ষে এইরূপ পণ্য সংগ্রহ করা প্রায়ই অসম্ভব হয়। আর সংগ্রহ করা গেলেও সেজন্য অস্বাভাবিক মূল্য দিয়া জনগণকে সর্বস্বান্ত হইতে হয়। ইসলামী অর্থনীতি এই ধরনের Hoarding অদৌ সমর্থন করে না। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

পণ্যদ্রব্য আটক করিয়া অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী নিঃসন্দেহে অপরাধী।

(আরবী**********)

অধিক মূল্যে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে খাদ্যপণ্য আটক করিয়া রাখিতে নবী করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।

হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করিয়াছেন: (আরবী**********)

যে ব্যক্তি অতিরিক্ত চড়া দামের আশায় চল্লিশ দিন যাবত খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করিয়া আটকাইয়া রাখিবে, আল্লহর সঙ্গে তাহার এবং তাহার সহিত আল্লাহর সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যাইবে।

হযরত আবূ আমামা রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

যে লোক চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যপণ্য আটক করিয়া রাখে অতঃপর যদি তাহা সম্পূর্ণ দানও করিয়া দেয়, তবুও তাহার এই আটক করিয়া রাখার গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত হইবে না।

অতএব অত্যধিক মুনাফা লুটিবার আশায়, খাদ্যপণ্য আটক করিয়া রাখা ইসলামী শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম। [(আরবী**********)]

খাদ্যদ্রব্য আটক করিয়া যাহারা অত্যধিক মুনাফা লুটিতে চাহে তাহাদের মনস্তত্ব সম্পর্কে নবী করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেন:

(আরবী**********)

খাদ্য শস্য আটককারী ব্যক্তির মনোবৃত্তি অত্যন্ত বীভৎস ও কুটিল। খাদ্য-দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাইলে তাহারা চিন্তিত হইয়া পড়ে আর তাহা বৃদ্ধি পাইলে তাহারা আনন্দে মাতিয়া উঠে।

অতএব যে সব উপায়ে অবাধ ক্রয়-বিক্রয় ও ধন বিনিময় ব্যাহত হয়, ক্ষুণ্ণ হয়, ইসলামী অর্থনীতিতে তাহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ব্যবসায়ীগণ যদি পণ্যদ্রব্য আটক করিয়া অধিক মুনাফা লুটিবার চেষ্টা করে তবল ইসলামী রাষ্ট্র সে ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করিতে বাধ্য এবং তাহাদিগকে যথোপযুক্ত শাস্তি দিয়া এই কাজ হইতে বিরত রাখার এবং আটককৃত খাদ্যপণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করার কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা উহার কর্তব্য।[নববী (আরবী**********)]

পণ্য মওজুদ করণ পর্যায়ে এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, যদি কোন লোক নিজের জমির ফসল হইতে নিজের ও পরিবারবর্গের সম্বাৎসরিক প্রয়োজন পূরণ ও ব্যয় নির্বাহের জন্য খাদ্য ফসল সঞ্চয় করিয়া রাখে, তবে তাহাতে কোন দোষ হইবে না। একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমম নববী লিখিয়াছেন:

(আরবী**********)

আলোচ্য হাদীস হইতে সম্বাৎসরিক খাদ্য এবং পরিবারের লোকজনের খোরাকী জমা করিয়া রাখা সাধারণ অবস্থায় জায়েয বলিয়া প্রমাণিত হয়। বস্তুত মানুষ তাহা নিজের জমি-ক্ষেত হইতে যে ফসল লাভ করে তাহা হইতে প্রয়োজন পরিমাণ সঞ্চয় করিয়া রাখা জায়েয- এই বিষয়ে ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ সম্পূর্ণ একমত। নবী করীম (স)-এর জন্য এইভাবে সম্বাৎসরিক খাদ্য সংগ্রহ করিয়া রাখা হইত।[(আরবী**********)]

ইহার পর তিনি লিখিয়াছেন, ‘যদি কেহ বাহার হইতে খাদ্য ক্রয় করিয়া পরিবারবর্গের সম্বাৎসরিক খাদ্য সংগ্রহ করিয়া রাখিতে চাহে, তবে ব্যাপারটি স্বতন্ত্রভাবে বিবেচ্য। সেই সময় যদি দেশের খাদ্য সংকট অবস্থা বিরাজ করে, তবে তাহা জায়েয হইবে না। এইরূপ অবস্থা যদি কিছু দিন বা এক মাস কালের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করিয়া রাখা হয়, আর তাহার দরুন যদি সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হইয়া পড়ার আশংকা না হয় তবে তাহা জায়েয হইবে। আর প্রাচুর্যকালে এক বৎসর কিংবা ততোধিক সময়ের জন্য খাদ্য খরীদ করিয়া রাখাও জায়েয হইবে।[(আরবী**********)]

পরন্তু ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ষড়যন্ত্র বা কোন প্রকার কুটিল কারসাজীর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাইয়অ জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সীমা লংঘন করিলে ইসলামী রাষ্ট্র দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করিয়া দিবে। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় কোন জরুরী কারণ ব্যতীত-দ্রব্য-মূল্য নির্ধারণের অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রের নাই। অতএব নিতান্ত স্বাভাবিক কারণে দ্রব্যমূল্য ‍বৃদ্ধি পাইলে উহার দর বাঁধিয়া দেওয়া যাইবে না। নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায় একবার অনুরূপ অবস্থার উদ্ভব হইয়াছিল। সাহাবায়ে কিরাম দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলিয়াছিলেন:

(আরবী**********)

খাদ্যমূল্য নির্ধারণকারী হইতেছেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। তিনিই ইহার মূল্য হ্রাস করেন। কারণ রুজীর মালিক তিনিই, উহার মূল্য নির্ধারণ করন এবং আমি আল্লাহর সহিত এইভঅবে সাক্ষাৎ করিতে আশা পোষণ করি যে, তোমাদের কাহারো রক্তপাত বা মাল-সম্পদ হরণের জুলুম করিয়াছি বলিয়া সেদিন আমার প্রতি কেহ দাবি তুলিবে না।

ইহার কারণ এই যে, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ মূলত ক্রেতা ও বিক্রেতার ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত করার ব্যাপার। অতএব নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা তাহাদের থাকা উচিত। অন্যথায় তাহাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারর উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ হইয়া পড়ে। তবে এই ব্যাপারে কাহারো উপর কোন প্রকার জুলুম হইলে কিংবা প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের ব্যাপারে জনগণকে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হইলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে। কেননা তখন ব্যাপারটি আর ব্যক্তিগত না থাকিয়া সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়।[এই পর্যায়ে যে কয়টি হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহার দৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষ ও সচ্ছল অবস্থা এই দুইয়ের মাঝে সাধারণত কোন পার্থক্য করা যায় না। তবে ইমাম শাফেয়ী বলিয়াছেন,দুর্ভিক্ষ বা স্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়া দিলে তখন দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করিয়া দেওয়া জায়েয। রাসূলে করীমের উপরোক্ত হাদীস হইতেও এই কথাই প্রমাণিত হয়। তাহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে,সাধারণ অবস্থায় দ্রব্যমুল্য নির্ধারণ করিয়া জুলুম। কিন্তু কোন অবস্থায় তাহা না করার দরুন যদি জনসাধারণের উপর জুলুম হইতে থাকে, তবে তখন তাহা না করাই বরং অতি বড় জুলূম।]

এসলামী অর্থনীতি সমগ্র ব্যাপারে নিছক ব্যক্তিগত ও নিছক পারিবারিক ব্যাপারের উপর সামাজিক ও জাতীয় স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়া থাকে। এই জন্যই, যে সব ব্যবসায়ে একদিকে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বিপুল স্বার্থ লাভ হয় আর অপর দিকে তাহাতে সাধীত হয় সামগ্রিক বা সামাজিক ক্ষতি, নৈতিক চরিত্র হয় বিনষ্ট- ইসলামী অর্থনীতি তাহা আদৌ বরদাশ্‌ত করে না।

ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কে ইসলামী অর্থনীতি অবাধ ও উদার নীতি পোষণ করে। এই ব্যাপারে কোনরূপ অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা ইসলাম সমর্থন করে না।– তাহা ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী অথবা রাষ্ট্র- যাহার দিক হইতেই হউক না কেন। এই কারণেই আন্তর্জাতিক ব্যাবসায় বাণিজ্যের জন্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা করিয়া দেওয়া, স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথ উন্মুক্ত করিয়া দেওয়া; প্রয়োজন-অনুযায়ী খাল ও নদী খনন করাও ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হইয়াছে। হযরত উমর ফারূক (রা) মিশরে খাল খনন করিয়াছিলেন তাহার ফলে মিশর ও মদীনার মধ্যে অবাধ বাণিজ্যের সুবিধা হইয়াছিল এবং উভয় দেশে দ্রব্যমূল্য একই স্তরে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। দ্বিতীয় খলীফা এই জন্য অনেক পাকা সড়কও নির্মাণ করিয়াছিলেন। কিন্তু এ-কথা ভুলিয়া গেলেও চলিবে না যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার আশংকা হইলে রাষ্ট্র রক্ষার জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনানুযায়ী অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রত্যাহার করিতে হইবে।

পণ্যের সরবরাহ ও পরিবেশনের পরিমাণ এবং উহার গতিধারার যে নিকটতম সম্পর্ক রহিয়াছে উহার মূল্যমান নির্ধারণের সহিত, তাহা অর্থনীতিবিদ মাত্রেরই জানা আছে। কোন নির্দিষ্ট সময়ে একটি পণ্যের সরবরহ পরিমাণ অত্যধিক বৃদ্ধি পাইলে উহার মূল্য অনিবার্যরূপে হ্রাস পাইবে। পক্ষান্তরে উক্ত পণ্যের সরবরাহ কম হইলে উহার মুল্য নিশ্চিতরূপে উর্ধ্বমুখী হইবে। কিন্তু এই মূলনীতি অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হইতে পারে। ইমাম আবূ ইউসুফের মত, একটি পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ কম হইলেও উহার সস্তা হওয়া এবং উহার প্রাচুর্য সত্ত্বেও দাম পড়া হওয়া অসম্ভব বা বিচিত্র নয়।

কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও বাজারে পণ্যমূল্যের সামঞ্জস্য বিধান করা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য। এখানে যেমন ইচ্ছামত অধিক মূল্য গ্রহণের অধিকার কাহাকেও দেওয়া হয় না; অনুরূপভাবে উহার ন্যায্য মূল্যেল অনেক কমে বিক্রয় করিয়া ব্যবসায়ের একচেটিয়া অধিকার(Monopoly) সৃষ্টি করার সুযোগ কাহাকেও দেওয়া যাইতে পারে না। হযরত উমর (র) একজন লোককে সাধারণ বাজার দর অপেক্ষা কম মূল্যে ‘মুনাক্কা’ বিক্রয় করিতে দেখিয়া বলিয়াছিলেন- ‘হয়-প্রচলিত মূল্যে বিক্রয় কর; অন্যথায় আমাদের বাজার হইতে চলিয়া যাও’। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক) কারণ, একজন ব্যবসায়ী পণ্য মূল্য অন্যায় ভাবে হ্রাস করিয়া দিলে সকল খরিদ্দারকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করিয়া লইতে চাহিলে ব্যবসায়ের গোটা বাজারটাই নষ্ট হইয়া যায় এবং তাহাতে অন্য ব্যবসায়ীদের ভীষণ ক্ষতি হয়। ফলে জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়।

রেশনিং প্রথা

উপরে বলা হয়েছে, ইসলামী অর্থনীতি দেশবাসীকে প্রয়োজনীয় পণ্য দ্র্রব্যের স্বাধীনতা ও অবাধ ক্রয়-বিক্রয় করার অধিকার দিয়াছে। বিশেষ কোন কারণ- কোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব না হইলে এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করা ইসলামী অর্থনীতির আদর্শসম্মত নয়। কিন্তু বাস্তবিকই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হইলে এবং অবাধ ক্রয়-বিক্রয় করা অপরিহার্য বোধ হইলে তাহা নিশ্চয় করিতে হইবে। অস্বাভাবিত পরিস্থিতির পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ, সর্বাত্মক প্লাবন ও যুদ্ধবিগ্রহই বিশেষভাবে উল্লেখ্য। ইহার কোন একটির দরুন জরুরী অবস্থার সৃষ্টি হইলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কিছুমাত্র পশ্চাদপদ হইবে না। ইসলামী রাষ্ট্র তখন গোটা অর্থনীতির উপর পূর্ণ কন্ট্রোল প্রবর্তন করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিবে না। বিশেষ করিয়া খাদ্যদ্রব ও মানুষের জীবন-যাত্রা নির্বাহের পক্ষে অপরিহার্য অন্যান্য দ্রব্য কন্ট্রোল করিবে এবং রেশনিং ব্যবস্থা চালু করিবে। নবী করীম (স)-এর সময় তাঁহার প্রেরিত এক সৈন্যবাহিনীতে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় সেনাধ্যক্ষ হযরত আবূ উবাইদাহ (রা) সৈনিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থার প্রবর্তন করিয়াছিলেন। অনুরূপ একটি বাহিনী সমুদ্রোপকূলে প্রেরিত হইয়াছিল হযরত জাবির ইব্‌নে আবদুল্লাহ (রা)-এর নেতৃত্বে। পথিমধ্যে ইহাদরে খাদ্যদ্রব্যের যে খাদ্যদ্রব্য অবশিষ্ট ছিল, তাহা একস্থানে স্তূপীকৃত করিবার জন্য সেনাপতি নির্দেশ দিয়াছিলেন, এবং তাহা দৈনিক নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ অনুযায়ী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। (বুখারী)

স্বয়ং নবী করীম (স)-এর জীবনেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল এবং তিনিও চৌদ্দশত লোকের নিকট অবশিষ্ট খাদ্যদ্রব্য একত্রিত করিয়া উহা সকলের মধ্যে নিয়মিতরূপে বন্টন করিয়াছিলেন। (মুসলিম শরীফ)

হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতের সময় (১৮হিঃ) মদীনায় একবার ভীষণ ‍দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। তখন বহু পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনার পর চতুর্দিক হইতে খাদ্যশস্য সংগহ করা হইয়াছিল এবং তাহা প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুসারে বন্টন করার জন্য রেশনকার্ড ইচ্যু করা হইয়াছিল।

ধন-বিনিময়ের বিবিধ ব্যবস্থাঃ মুদ্রা

পূর্বেই বলা হইয়াছে, মানব-সভ্যতার প্রথম অধ্যায়ে পণ্যদ্রব্যের পারস্পরিক বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিল; কিন্তু জীবনের এই প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর সভ্যতার বিবর্তিত ও উন্নততর পর্যায়ে ইহার জন্য কোন-না-কোন মাধ্যমের ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হইয়া দেখা দেয়। ইসলামের ইতিহাসেও অনুরূপ ঘটনারই পুণরাবৃত্তি হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্মিত মুদ্রার সাধারণ ব্যবহার শুরু হইয়াছিল। অধ্যাপক জিভেন্সের ভাষায়, মুদ্রা বলা হয় ধাতুনির্মিত এমন কতকগুলি টুকরোকে, যাহার ওজন ও অকৃত্তিমতা উহার উপর অঙ্কিত নক্‌সা দ্বারাই প্রমাণি হয়।[অধ্যাপক জিভেঞ্জ: Mechanism of Exchange; Chapter VII]

মুদ্রার গুরুত্ব

নবী করীম (স)-এর অর্থনৈতিক কার্যক্রক গভীরভাবে পর্যালোচনা করিলে মনে হয়, তিনি পণ্যদ্রব্যের পারস্পরিক বিনিময়ে পরিবর্তে মুদ্রার মাধ্যমে বিনিময় কার্য সম্পাদনের প্রথা চালু করিবার পক্ষপাতী ছিলেন। ইসলামী অর্থনীতি এবং শরীয়াতী বিধানে যাকাত, দেন-মহর প্রভৃতিক যাহা কিছুর আদেশ করা হইয়াছে, তাহা পণ্যের পরিবরর্তে মুদ্রা দ্বারাই আদায় করা হয়। খারাজ, জিজিয়া ও শুল্ক ইত্যাদিরও মুদ্রায় আদায় করা ভিন্ন উপায় নাই। এতদ্ব্যতীত মজুরী, পারস্পরিক ব্যবসায় কিংবা একজনের মূলথনে অপরের ব্যবসায় পরিচালনাও ইহারই সাহায্যে সম্ভব। ইসলামী অর্থনীতিতে মুদ্রার গুরুত্ব ইহা হইতে অনুধাবন করা যায়।

এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই মুদ্রা প্রস্তুত করা, উহার মূল্য নির্ধারণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উহার প্রবর্তন করার অধিকার একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রেরই রহিয়াছে। রাষ্ট্রীয় সনদ ব্যতীত কোন মুদ্রাই জনগণের মধ্যে চালু এবং পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হইতে পারে না।

উপরন্তু প্রয়োজন অনুভূত হইলে ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে কাগজের নোটও ব্যবহার করা যাইতে পারে। হযরত উমর ফারূক (রা) প্রয়োজন দৃষ্টে চর্মনির্মিত ‘নোট’ ব্যবহার করিয়াছিলেন।[আলকাত্তানী: কিতাবুল তারাতীবুল ইদারিয়া, ১ম খণ্ড]

ইসলামের প্রথম অধ্যায়ে নোটের পরিবর্তে আর একটি জিনিস ববহার করা হইত। কোন ব্যক্তি বহুদূর পথে ভ্রমণোদ্দেশ্যে যাত্রা করিলে সে স্বর্ণ-রৌপ্যের ন্যায় ভারী মুদ্রা সঙ্গে না নিয়া তাহা হইতে অত্যধিক মূল্যে হীরা-জহরত খরীদ করিয়া লইয়া যাইত এবং লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়া তাহা বিক্রয় করিয়া সেই দেশের প্রচলিত নগদ মুদ্রা লাভ করিত। [জর্জি জায়দান: তারীকুত তামাদ্দুনিল ইসলামী ৫ম খণ্ড]

বর্তমান কালের লোক ব্যাংকের নোট বা চেক নিয়া অনুরূপ সুবিধা লাভ করিয়া থাকে।

আন্তর্জাকি মুদ্রা

বর্তামনে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময় ব্যবসায়ী-পদ্ধতিতে চলিতেছে। যাহার বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়, তাহারা বিনিময় ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে তাহা গ্রহণ করে এবং সে জন্য তাহাদিগকে রীতিমত বাট্টা দিতে হয়।

কিন্তু ইসলামী অর্থনীতি এই ধরনের বিনিময় প্রথাকে অসংগত ঘোষণা করিয়াছে এবং এইরূপ বিনিময়ের মাধ্যমে ‘বাট্টা’ বাবদ যাহা কিছু নেওয়অ হয়, তাহাকে সুদ বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। কেবল ক্রেডিট এক্সচেঞ্জ-ই সুদ হয় না, নগদ আদান-প্রদানের সময়ও যাহা কিছু ‘বাট্টা’ দেওয়া-নেওয়া হয় তাহাও সুদই হইয়া থাকে।

নবী করীম (স)-এর বাণী হইতে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে পারা যায় যে, এক দেশের মুদ্রা মুল্য যদি অন্যান দেমের মুদ্রা-মূল্যের সমান হয়, তবে এই উভয় দেশের মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময় সমান পরিমাণেও নগদ-আদান-প্রদানেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। নবী করীম (স) বলিয়াছেন:

(আরবী**********)

একটি স্বর্ণ মুদ্রাকে দুইটি স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে এবং একটি ধাতবব মুদ্রাকে দুইটি ধাবত মুদ্রার বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় করিও না।[(আরবী**********)]

অন্য একটি হাদীসে আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিনিময়-হার স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হইয়াছে এ ভাষায়:

(আরবী**********)

স্বর্ণ মুদ্রা স্বর্ণ মুদ্রার সহিত এবং ধাতব মুদ্রা ধাতব মুদ্রার সহিতই বিনিময় করা যাইতে পারে; কিন্তু তাহাতে কোনরূপ কম-বেশী করা যাইবে না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা-বিনিময়ের বর্তমান পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ পারদর্শী অর্থনীতিবিদগণই উল্লিখিত হাদীস দুইটির প্রকৃত তাৎপর্য় অনুধাবন করিতে পারেন। সাধারণত এক দেশের স্বর্ণ বা রোপ্য মুদ্রার সহিতই বিনিময় হয়; কিন্তু এক দেশের মুদ্রার বিনিময় অপর দেশের মুদ্রার গ্রহণ করার পক্ষপাতী। বস্তুত বর্তমান আন্তর্জাতিক মুদ্রা-বিনিময়ের সমস্যা বিনিময়-গোলক-ধাঁধার দরুন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্য বর্তমান সময় অত্যন্ত জটিল হইয়া দেখা দিয়াছে। এমতাবস্থায় বিশ্বনবীর এই চির সত্য বাণীর ভিত্তিতে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্র যদি নিজ নিজ স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রার মান ওজন সমান করিয়া লইত এবং বাট্টা দেওয়া-নেওয়অর প্রথা চিরতরে বন্ধ করিয়া দিত, তবে বিশ্বের মানবসমাজ নানাবিধ অসুবিধা হইতে রক্ষা পাইত, ব্যবসায়-বাণিজ্য অবাধ হইত; প্রাচুর্য ও দারিদ্রের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হইত। অনুরূপভাবে একটি বিশ্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথও অনেকখানি উন্মুক্ত ও সুগম হইত।

মুদ্রা জাল প্রতিরোধ

ইসলামে মুদ্রা জাল করা কঠিন অপরাধ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। ইহা সমাজ-শৃঙ্খলা ও সামাজিক অর্থনৈতিক বিনাশ এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বানচার করার চেষ্টার সমপর্যায়ভুক্ত অপরাধ। এই কারণে যে কোন প্রকার মুদ্রা চুর্ণ বা নষ্ট করাও নিষিদ্ধ হইয়াছে:

(আরবী**********)

মুসলমানের জাতীয মুদ্রা চূর্ণ (বা নষ্ট) করিতে নবী করীম (স) নিষেদ করিয়াছেন। -আবূ দাউদ

প্রতিশ্রুতি-পত্র (Letter of credit)

নগদ টাকার পরিবর্তে ‘ক্রেডিট’ নোটের মাধ্যমেও অনেক সময় পণ্য দ্রব্যের বিনিময় কিংবা শ্রমের মজুরীর আদান-প্রদান করা যায়। বর্তামন যুগে যখন ক্রেতা এক স্থানে এবং বিক্রেতা বহু দূরবর্তী অন্য এক দেশে থাকিয়াও পারস্পরিক ক্রয়-বিক্রয় করিতেছে এবং ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাইতেছে তখন ইহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

‘ক্রেডিটে’র সংজ্ঞা প্রদান করিয়া অধ্যাপক ‘লক’ বলিয়াছেন- ‘এক সীমাবদ্ধ সময়ে মুদ্রা আদায় করার আশাই হইতেছে ক্রেডিকের মূল কথা। ভবিষ্যতে টাকা আদায় করার প্রতিশ্রুতিতে হুন্ডি, চেক, সরকারী প্রমিসরী নোট, ব্যাংকের জারী করা নোট এবং পোস্টাল অর্ডার ও মানি অর্ডার ইত্যদিই ক্রেডিটের বিভিন্ন রূপ।’ ডঃ থমাস্‌-এর কথায় ক্রেডিট নোট মূলত নগদ টাকারই বিকল্প।[Element of Economics] ইহার বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহার সাহায্যে ব্যাপকভাবে বিনিময়কার্য সম্পন্ন করা সহজ এবং ঋণ-আদায় করাও প্রভূত সুবিধা হইয়া থাকে।

‘প্রমিসরি নোট, ইস্যু করার প্রথা ইসলামের প্রথম যুগে প্রচলিত ছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) মক্কা নগরে ইরাকগামী লোকদের নিকট হইতে টাকা গ্রহণ করিতেন। এবং সে সম্পর্কে তাঁহার ভ্রাতা ইরাকের গভর্ণর মুছয়ীব বিন জুবাইর (রা)-কে লিখিয়া পাঠাইতেন, লোকেরা তাহার নিকট হইতে এই টাকা আদায় করয়া লইত।(আবূ দাঊদ)

আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এক শহরে ব্যবসায়দিগকে পণ্য দিতেন, এবং অন্য এক শহরে উহার মূল্য গ্রহণ করিতেন। হযরত ইমাম হাসান (রা) হিজাজে লোকদের নিকট হইতে টাকা গ্রহণ করিতেন এবং ইরাকে তাহা আদয় করিতেন; কিংবা ইরাকে টাকা গ্রহণ করিতেন এবং হিজাজে তাহা প্রত্যাবর্তন করিতেন।

মোট কথা, হুন্ডির মারফত উল্লিখিতরূপে টাকার আদান-প্রদান করা ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে নাজায়েয নহে।[মনে রাখিতে হইবে, ইহা একই প্রশাসন অধীন রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে হুন্ডীর ব্যবহার সম্পর্কে কথা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে হুন্ডীর কারবার চোরাচালানের পর্যয়ে গণ্য এবং নিষিদ্ধ।] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-কে ‘হুন্ডি’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন: ‘ইহাতে কোন দোষ নাই।’ হযরত আলী (রা)-র মতও ইহাই ছিল।

ফকীর ইবনে সিরীন সম্পর্কে বলা হইয়াছে: (আরবী**********)

হুন্ডি-ব্যবহারে তিনি কোনরূপ দোষ মনে করিতেন না। অবশ্য যদি তাহা প্রচলিত নির্দোষ নিয়মে ব্যবহার করা হয়।

হযরত আলী (রা) বলিয়াছেন: (আরবী**********)

মদীনায় পণ্য দিয়া আফ্রিকায় তাহা (বা উহার মূল) গ্রহণ করায় কোন রূপ দোষ নাই।

বস্তুত এই কাজে কোনরূপ সুদ না লইয়া কমিশন বা খরচ-বাবদ কিছু গ্রহণ করিলে তাহা না জায়েয হওয়ার কোনই কারণ নাই। ব্যাংক, পোষ্ট অফিস প্রভৃতি সরকারী সিকিউরিটি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মারফতে এক শহর হইতে অন্য শহরে পণ্য-দ্রব্য কিংবা নগদ টাকা স্থানান্তর করা এবং প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক মজুরী (Establishment Expenditure) বাবদ নির্দিষ্ট-হারে কমিশন লওয়া কোন রূপেই অসঙ্গত হইতে পারে না। অবশ্য তাহাতে সুদের প্রথা থাকিলে কিংবা এক দেশ হইতে অন্য দেশে প্রেরণ করার জন্য ‘বাট্টা’ গ্রহণ করিলে তাহা কোন মতেই জায়েয হইতে পারে না।

হাওয়ালা (Novation)

ক’র টাকা পাওনা আছে খ’র নিকট কিন্তু ক নিজে গ’র নিকট ঋণী। এখন এই তিনজনই পরস্পর মিলিয়া সিদ্ধান্ত করিলৈ যে, গ ক’র নিকট এবং ক খ’র নিকট হইতে টাকা আদায় না করিয়া গ খ’র নিকট হইতে টাকা আদায় করিয়া লইবে। অর্থনীতির পরিভাষায় ইহাকে Novation বলা হয়।

একাধিক লোকের মধ্যে একই প্রকার বা একই পরিমাণের ঋণ-আদায় করার ইহা অতি সহজ পন্থা, সন্দেহ নাই। ইহা হুন্ডিরন একটি স্বতন্ত্ররূপ। জার্মান প্রাচ্যবিদ ফন্‌ ক্রেমার বলেন, ‘হাওয়ালা’ সম্পর্কে ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ যে গভীর আলোচনা করিয়াছেন, তাহা মুসলমানদের উন্নত ব্যবসায়ী কার্যক্রমের পরিচয় দেয়। ইসলামী অর্থনীতিতে ঋণ-আদায় করার ব্যাপারে এইরূপ ‘হাওয়ালা’ সম্পূর্ণরূপে সংগত।

বিশেষত আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-সংক্রান্ত ঋণ-আদায় করার ব্যাপারে ‘হাওয়ালা’র (Novation) বিশেষ গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহা ‘ফরেন বিল অব একচেঞ্জে’র স্থলাভিষিক্ত বা বিকল্প হইতে পারে এবং শুধু আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেই নয়, বহির্বাণিজ্যেও ইহা দ্বারা অনক সুবিধা ও পারস্পরিক ঋণ আদায় অনেকখানি সহজ হয়।

চেক

প্রমিসরী নোট হিসাবে বর্তমান সময় চেক-এর যথেষ্ট প্রচলন হইয়াছে। চেক মূলত ব্যাংক-মালিকদের নামে একটি নির্দেশনামা মাত্র, তাহাতে লিখিত পরিমাণ টাকা চাহিবা-মাত্রই চেক-বাহককে আদায় করিয়া দেওয়ার নির্দেশ থাকে।

কাজেই নগদ আদায় করার পরিবর্তে ‘টাকা আদায়ের নির্দেশনামা’ বা চেকের সাহায্যে লেন-দেন করা কোনরূপেই অসংগত হইতে পারে না। ইসলামী অর্থনীতির প্রাথমিক যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে নিঃসন্দেহে জানিতে পারা যায় যে, সাহাবায়ে কিরামের যুগেই ‘চেক’ এর ব্যবহার শুরু হইয়াছিল। বস্তুত দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা)-এর সময়ই ইহার ব্যাপক প্রচলন হয়।[তারীখই ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড।] মোট কথা চেক ব্যবহারে কোনরূপ আপত্তি থাকিবার কথা নয়। ইহার সাহায্যে ধন-বিনিময় কার্য বিপুল পরিমাণে সম্পন্ন হওয়া খুবই সহজ হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি