উকবা ইবন আমের আল জুহানী রা:

নাম উকবা, ডাক নাম আবু আমর, পিতা আমের। বনু জুহানা গোত্রের লোক। হযরত রাসূলে কারীম সা: যখন মদীনায় আসেন, উকবা তখন মদীনা থেকে বহু দূরে ছাগলের রাখালী করছিলেন। রাসূল সা: এর আগমন সংবাদ মদীনার অলি গলি ও তার আশ পাশের মরু ভূমি ও মরুদ্যানে ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল সা: এর সাথে উকবার প্রথম সাক্ষাত কিভাবে ঘটে তা উকবার মুখেই শোনা যাক:
‘রাসূল সা: যখন মদীনায় এলেন আমি তখন মদীনার বাইরে আমার ছাগল চড়াচ্ছিলাম। খবরটি আমার কাছে পৌঁছার পর আমি সব কিছু ছেড়ে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য চলে আসি। রাসূল সা: এর খিদমতে হাজির হয়ে আমি আরজ করলাম: ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমাকে বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) করাবেন কি? তিনি আমার পরিচয় জানতে জিজ্ঞেস করেন: তুমি কে? বললাম: উকবা ইবন আমের আল জুহানী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: মুরুবাসী বেদুঈনদের বাইয়াত অথবা হিজরাতের বাইয়াত এর কোনটি তোমার অধিক প্রিয়? আমি বললাম: হিজরাতের বাইয়াত। অত:পর তিনি আমাকে সেই বিষয়ের উপর বাইয়াত করালেন যার উপর মুহাজিরদের বাইয়াত করাতেন। রাসূলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াতের পর আমি এক রাত তার সাথে কাটিয়ে আবার মরূভূমিতে আমার ছাগলের কাছে ফিরে গেলাম।
আমরা ছিলাম বারো জন মুসলমান। আমরা মদীনা থেকে দূরে ছাগল চড়াতাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বললো: একদিন পর পর আমরা যদি রাসূলুল্লাহর সা: কাছে হাজির ‍হয়ে দ্বীনের কথা না শিখি এবং তার উপর যা নাযিল হয় তা না জানি তাহলে আমাদেরে জীবনে কোন কল্যাণ নেই। প্রতিদিন আমাদের মধ্য থেকে একজন পালাক্রমে মদীনায়যাবে এবং তার ছাগল অন্যরা চড়াবে। আমি বললাম: তোমরা পালা করে একজন যাও এবং তার ছাগলগুলির জিম্মাদারি আমি নিলাম। কারও কাছে আমার ছাগলগুলি রেখে মদীনায় যেতে আমি ইচ্ছুক ছিলাম না।
আমার সঙ্গীরা পালা করে মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা: দরবারে যেতে লাগলো, আর আমি তাদের ছাগলের পাল চড়াতে লাগলাম। তারা ফিরে এলে তারা যা কিছু শুনে বা শিখে আসতো আমি তাদের কাছে শুনে তা শিখে নিতাম। এভাবে কিছুদিন চললো। এর মধ্যে আমার মনে এ অনুভূতি জাগলো: তোমার সর্বনাশ হোক! ছাগলের জন্য তুমি রাসুলুল্লাহর সা: সুহবত বা সাহচর্য এবং সরাসরি তার মুখ নি:সৃত বাণী শোনার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছো! এই অনুভূতির পর আমি আমার ছাগল ফেলে রাসুলুল্লাহর সা: পাশে মসজিদে নববীতে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে মদীনার দিকে চললাম।
আমি মদীনায় পৌঁছলাম। মসজিদে নববীতে ‍হাজির হয়ে সর্ব প্রথম শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি বলছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি পূর্ণরূপে ওজু করবে সে তার সকল গুনাহ থেকে এমনভাবে পবিত্র হবে যেমনটি সে ছিল তার মা তাকে যেদিন জন্ম দিয়েছিল।’ কথাটি আমার খুবই ভালো লাগলো। উমার ইবনুল খাত্তাব তখন বললেন: তুমি যদি প্রথম কথাটি শুনতে আরও খুশি হতে। আমি তাকে কথাটি পুনরায় বলার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনি বললেন; রাসূল ‍সা: বলেছেন: ‘আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরিক না করে কেউ যদি মারা যায় আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের সবগুলি দরযা খুলে দেন। জান্নাতের আটটি দরযা। সে এর যে কোনটি দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে।’ এমন সময় রাসূল সা: আমাদের মধ্যে উপস্থিত হলেন। আমি তার সামনাসামনি বসলাম। তিনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কয়েকবার এমনটি করলেন। চতুর্থবার আমি আরজ করলাম: হে আল্লাহর নবী, আমার মা বাবা আপনার প্রতি উতসর্গ হোক! আমার দিক থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কেন? এবার তিনি আমার প্রতি মনোযোগী বলে বললেন: একজন তোমার সর্বাধিক প্রিয় না বারোজন? (হায়াতুস সাহাবা-৩/২১৪-১৫,সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা-৪/১৪৪)।
রাসূলুল্লাহর সাথে উকবা সর্ব প্রথম উহুদে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়েন। এরপর রাসূলুল্লাহর সা: জীবদ্দশায় সংঘটিত সকল যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের রা: খিলাফতকালে তিনি একজন মুজাহিদ হিসেবে সিরিয়া অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। দিমাশক জয়ের দিনে তিনি তীর নিক্ষেপে অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। দিমাশক বিজয়ের পর সেনাপতি আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রা: তাকে মদীনায় পাঠান খলীফাকে এ সংবাদ দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তিনি মাত্র আট দিনে এক জুমআ থেকে অন্য জুমআর মধ্যে রাতদিন বিরামহীন চলার পর মদীনায় খলীফার কাছে সংবাদটি পৌঁছান। সিফফীন যুদ্ধে তিনি হযরত আমীর মুআবিয়া রা: এর পক্ষে অংশ গ্রহণ করেন। মিসর জয়ের পর হযরত মুআবিয়া রা: তাকে এক সময় তথাকার ওয়ালী বা শাসক নিয়োগ করেন। আবু আমর আল কিন্দী বলেন: মুআবিয়া তাকে মিসরের খারাজ (রাজস্ব) আদায় ও নামাযের ইমামতির দায়িত্ব অর্পণ করেন। পরে যখন তাকে অপসারণের ইচ্ছা করেন, তখন তিনি উকবাকে রোডস্ আক্রমণের নির্দেশ দেন। উকবা তখন রোডসের পথে অগ্রসর হচ্ছেন তখনই তিনি নিজের স্থলে মাসলামার নিযুক্তির কথা শুনতে পেলেন। তখন তিনি মন্তব্য করেন: দূরে পাঠিয়ে তারপর অপসারণ? এটা হিজরী ৪৭ সনের কথা। বরখাস্তের পর তিনি অভিযান থেকে ‍হাত গুটিয়ে নেন। হযরত উকবার মৃত্যু সন সম্পর্কে মতভেদ আছে। সঠিক বর্ণনামতে হযরত মুআবিয়ার রা: খিলাফতকালে হিজরী ৫৮ সনে মিসরে ইনতিকাল করেন। তাকে বর্তমান কায়রোর দক্ষিণ দিকে ‘মুয়াত্তাম’ পাহাড়ের পাদদেশে দাফন করা হয়। (আল ইসাবা-৩/৪৮৯) তাজকিরাতুল হুফফাজ-১/৪৩)।
জ্ঞান ও মর্যাদার দিক দিয়ে হযরত উকবা ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। কুরআন, হাদীস, ফিকাহ, ফারায়েজ ও কাব্য ছিল তার এক বিশেষ স্থান। আল্লামা জাহাবী বলেন, তিনি ছিলেন একাধারে ফকীহ, আল্লামাহ, আল্লাহর কিতাবের ক্বারী, ফারায়েজ শাস্ত্রের তত্বজ্ঞানী, প্রাঞ্জলভাষী ও উঁচু দরের এক কবি।’ (তাজকিরাতুল হুফফাজ ১/৪৩)।
পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত শিক্ষার প্রতি ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। দারুণ আবেগ ও আগ্রহের সাথে তিনি কুরআন পাকের তিলাওয়াত শিক্ষা করতেন। কোন কোন সূরা তিনি খোদ রাসূলুল্লাহর সা: নিকটেই শিখেছেন। একবার তিনি রাসূল সা: এর পায়ের ওপর পড়ে নিবেদন করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমাকে সূরা হুদ ও সূরা ইউসুফ একটু শিখিয়ে দিন। এ প্রবল আগ্রহই তাকে একজন বিখ্যাত ক্বারী বানিয়ে দেয়।
তিনি ছিলেন সুমধুর কন্ঠের অধিকারী। সুললিত কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। গভীর রাতে যখন নিরবতা নেমে আসতো, তিনি হৃদয়গ্রাহী কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন। রাসূল সা: এর সাহাবীরা কান লাগিয়ে সে তিলাওয়াত শুনতেন। আল্লাহর ভয়ে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে পড়তো এবং চোখ সজল হয়ে উঠতো। খলীফা হযরত উমার রা: একবার তাকে বলেন: ‘উকবা, আমাদের কিছু কুরআন ‍শুনাও। উকবা তিলাওয়াত শুরু করলেন। সে তিলাওয়াত শুনে উমার রা: কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন, চোখের পানিতে ‍তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। হযরত উকবা নিজ হাতে পবিত্র কুরআনের একটি সংকলন তৈরী করেন। হিজরী নবম শতক পর্যন্ত মিসরের ‘জামে উকবা ইবন আমের’ নামক মসজিদে এ কপিটি সংরক্ষিত ছিল। কপিটির শেষে লেখা ছিল ‘এটি উকবা ইবন আমের আল জুহানী লিখেছেন।’ এটা ছিল পৃথিবীতে প্রাপ্ত কুরআনের প্রাচীনতম কপি। কিন্তু হতভাগা মুসলিম জাতি আরও অনেক কিছুর মত এই মূল্যবান সম্পদটিও হারিয়েছে। (তাহজীবুত তাহজীব-৭/২৪৩, সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা-৪/১৪৮-৪৯, মুহাজিরিন-২/২৩৬)
রাসূলুল্লাহ সা: এর হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি একেবারে পিছিয়ে নন। তার বর্ণিত হাদীসের সর্বমোট সংখ্যা পঞ্চান্ন। তার মধ্যে সাতটি মুত্তাফাক আলাইহি এবং একটি বুখারী ও সাতটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বহু বড় বড় সাহাবী দীর্ঘপথ ভ্রমণ করে তার কাছে হাদীস শুনার জন্য আসতেন। হযরত আবু আইউব কেবল একটিমাত্র হাদীস শুনার জন্য মদীনা থেকে মিসরে যান এবং হাদীসটি শুনেই আবার মদীনার দিকে যাত্রা করেন। হিবরুল উম্মাহ হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসও রা: তার নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন। তাছাড়া বহু বিখ্যাত তাবেয়ী তার জ্ঞান ভান্ডার থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। ইবন আসাকির ইবরাহীম ইবন আবদির রহমান ইবন আউফ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন: আল্লাহর কসম, মৃত্যুর পূর্বে উমার ইবনুল খাত্তাব লোক পাঠিয়ে রাসুলুল্লাহর সা: সাহাবী- আবদুল্লাহ ইবন হুজাফা, আবুদ দারদা, আবু যার ও উকবা ইবন আমেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে ডেকে এনে বলেন: তোমরা রাসূলুল্লাহ থেকে এত যে হাদীস বর্ণনা কর- এগুলি কী? তারা বললেন: আপনি কি আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেন? তিনি বললেন: না। তবে তোমরা আমার কাছে থাকবে। যতদিন আমি জীবিত আছি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। উমার যতদিন বেঁচে ছিলেন তাকে ছেড়ে তারা দূরে কোথাও যাননি। (হায়াতুস সাহাবা-৩/২৪০-৪১)
ফিকাহ শাস্ত্রেও হযরত উকবার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। দ্বীনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত জ্ঞান তথা: খিতাবাহ (বক্তৃতা-ভাষণ), কবিতা ইত্যাদিতে তার ছিল বিরাট দখল। উকবা রা: যদিও একজন উঁচু দরের সাহাবী ছিলেন, তথাপি দ্বীনী দায়িত্ব পালণে ভীষণ ভয় পেতেন। তিনি এক সময় মিসরে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন, তবে পরে ইমামতি এড়িয়ে চলতেন। আবু আলী হামাদানী বলেন: একবার এক সফরে লোকেরা তাকে বলে, যেহেতু আপনি রাসূলুল্লাহর সা: সাহাবী, আপনি নামায পড়াবেন। বললেন: না। আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি, যদি কোন ব্যক্তি ইমামতি করে এবং সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নামায পড়ায়, ইমাম ও মুকতাদী উভয়ের জন্য সওয়াব আছে। আর যদি কোন ত্রুটি হয় তাহলে ইমামকে জবাবদিহি করতে হবে এবং মুকতাদির কোন দায়-দায়িত্ব নেই।
হযরত রাসূলে কারীমের সা: সেবা করা ছিল তার একমাত্র হবি। সফরে, তিনি প্রায়ই রাসূলুল্লাহর সা: খচ্চর ‘আশ শুহবা’র লাগাম ধরে টেনে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। এই সেবা ও সাহচর্যকালে তিনি দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। তিনি বর্ণনা করেছেন: একবার আমি এক সফরে রাসূলুল্লাহর সা: সঙ্গী ছিলাম। আমি রাসূলুল্লাহর বাহন টেনে নিয়ে চলছি এমন সময় তিনি বললেন: উকবা, আমি কি তোমাকে পাঠযোগ্য দুটি উত্তম সূরার কথা বলবো? আমি আরজ করলাম: বলুন। তিনি বললেন: সূরা দুটি হলো: কুল আউযুবি রাব্বিল ফালাক ও কুল আউযুবি রাব্বিন নাস।
তিনি রাসূলকে সা: এতই সম্মান করতেন যে, তার বাহনের ওপর বসাও বে আদবী বলে মনে করতেন। একবার তিনি সফরে নির্ধারিত খিদমতের দায়িত্ব পালন করছেন, এমন সময় রাসূল সা: সওয়ারী পশুটি থামিয়ে বসিয়ে দেন। সওয়ারীর পিঠ থেকে নেমে এসে তিনি বলেন: উকবা, তুমি বাহনের পিঠে সওয়ার হও। উকবা বললেন: সুবহানাল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনার বাহনে সওয়ার হব? রাসূল সা: আবারও নির্দেশ দিলেন। উকবা একই উত্তর দিলেন। অবশেষে বারবার পীড়াপীড়ির পর আদেশ পালনার্থে উকবা বাহনের পিঠে উঠে বসেন, আর রাসূল সা: পশুর লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চলতেন। এ কারণে তাকে রাদীফু রাসুলিল্লাহ-(রাসূলুল্লাহর বাহনের পিছনে আরোহণকারী বলে ডাকা হতো)। মানুষের দোষ গোপন করা ছিল উকবার বিশেষ গুণ। কারও কোন দোষ প্রচার করাকে তিনি খুবই নিন্দনীয় মনে করতেন। একবার তার সেক্রেটারী এসে বললো, আমাদের প্রতিবেশী লোকগুলি মদ পান করছে। তিনি বললেন: করতে দাও, কাউকে বলো না। সেক্রেটারী বললো: আমি পুলিশকে খবর দেই। তিনি বললেন: খুবই পরিতাপের বিষয়! এড়িয়ে যাও। আমি রাসূলুল্লাহকে সা: বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কারও কোন দোষ গোপন করলো সে যেন একটি মৃতকে জীবিত করলো। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪২৩)।
সামরিক বিদ্যা বিশেষত: তীরন্দাযীর প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। এ বিদ্যা অর্জনের জন্য তিনি অন্যদেরকেও উতসাহিত করতেন। ‍একবার খালিদ ইবনুল ওয়ালীদকে ডেকে তিনি বলেন: ‘আমি রাসুলুল্লাহকে সা: বলতে শুনেছি, আল্লাহ একটি তীরের বিনিময়ে তিনজনকে জান্নাত দান করবেন-তীরটির প্রস্তুতকারী, আল্লাহর রাস্তায় তীরটি বহনকারী ও তীরটির নিক্ষেপকারী। তিনি এ কথাও বলেছেন: সকল প্রকার খেলা ধূলার মধ্যে মাত্র তিনটি খেলা জায়েয- তীরন্দাযী, অশ্বারোহন প্রশিক্ষণ এবং নিজ স্ত্রীর সাথে হাসি তামাশা। যে ব্যক্তি তীর নিক্ষেপ বিদ্যা অর্জন করে ভুলে গেছে সে মূলত: একটি বিরাট সম্পদ হারিয়েছে।’ (মুসনাদু ইমাম আহমাদ-৪/১৪৮) তিনি যুদ্ধের বহু অস্ত্র শস্ত্র জমা করেন। মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির খোঁজ নিয়ে দেখা গেল তার ঘরে সত্তরের চেয়ে কিছু বেশি ধনুক রয়েছে। আর সেই ধনুকগুলির সাথে বেশ কিছু তীর ও ফলা। সবগুলিই তিনি আল্লাহর রাস্তায় দান করে যান। (সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা-৪/১৫০-৫১)।
হযরত উকবা রা: ছিলেন সচ্ছল ব্যক্তি। তার চাকর বাকরও ছিল। তা সত্তেও নিজের সব কাজ নিজ হাতে করতেন।
হযরত উকবা রা: মিসরে অন্তিম রোগ শয্যায়। এ অবস্থায় সন্তানদের ডেকে এই উপদেশটি দান করেন: ‘আমার সন্তানেরা! আমি তোমাদের তিনটি কাজ থেকে নিষেধ করছি, ভালো করে স্মরণ রেখ। ১) নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও নিকট থেকে রাসূল সা: এর হাদীস গ্রহণ করো না। ২) আবা (সামনে খোলা ঢিলে ঢালা মোটা জুব্বা) পরলেও কখনও ঋণগ্রস্ত হয়ো না। ৩) তোমরা কবিতা লিখবে না। কারণ তাতে তোমাদের অন্তর কুরআন ছেড়ে সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (হায়াতুস সাহাবা-৩/২০১)।
মোট কথা, ছাগলের রাখাল হযরত উকবার মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল রাসূল সা: এর স্বল্পকালীন সাহচর্যে তার সেই প্রতিভার চরম বিকাশ ঘটে। উত্তরকালে তিনি সাহাবাদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, শ্রেষ্ঠ কারী, শ্রেষ্ঠ বিজয়ী সেনাপতি ও শ্রেষ্ঠ শাসকে পরিণত হন। যখন তিনি ছাগলের রাখালী ছেড়ে রাসূলুল্লাহর সা: খিদমতে হাজির হন তখন তিনি ঘুনাক্ষরেও এ কথা জানতেন না যে, একদিন তিনি দিমাশক বিজয়ী বাহিনীর অগ্র সৈনিক হবেন এবং দিমাশকের ‘বাবে তুমায়’ তার একটি বাড়ী হবে। যে দিন তিনি মদীনায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন সেদিন তার মনে একবারও এ কথা উদয় হয়নি যে, একদিন তিনি মিসর বিজয়ের অন্যতম নেতা, তথাকার ওয়ালী হবেন এবং কায়রোর ‘মুকাত্তাম’ পাহাড়ে তার একটি বাড়ী হবে। ইসলাম তার সুপ্ত প্রতিভার এমন বিকাশ ঘটায় যে তিনি ছাগলের রাখালী থেকে এত কিছু হন।

আবু বারযাহ আল আসলামী রা:

আবু বারযাহর আসল নামের ব্যাপারে রিজাল শাস্ত্রবিদদের যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য মতানুসারে নাদলা ইবন উবাইদ তার নাম এবং আবু বারযাহ কুনিয়াত বা উপনাম। (আল ইসাবা-৪/১৯)
মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমান হওয়ার পর কাফিরদের সাথে যত সংঘর্ষ হয়েছে তার সবগুলিতে তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা: সাথে ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলে কারীম সা: তার চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দেন। তবে শত্রুতা ও বিদ্রোহের সীমা লংঘনকারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারীকে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল। আবদুর রহমান ইবন খাতাল ছিল এমনি একজন। এ ব্যক্তি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার এক মুসলমান দাসকে হত্যা করে ইসলামী দণ্ড ‘কিসাস’ থেকে বাঁচার জন্য ‘মুরতাদ’ (ইসলাম ত্যাগ) হয়ে মক্কায় পালিয়ে ‍যায়। তার ছিল দুটি দাসী। তারা মক্কার বাজারে মুহাম্মাদের সা: নিন্দাসূচক গীত গেয়ে বেড়াতো। মক্কা বিজয়ের দিন কোন উপায় না দেখে নরাধম ইবন খাতাল নিরাপত্তার আশায় কাবার গিলাফ আঁকড়ে ধরে পড়ে ‍থাকলো। সাহাবীরা রাসূল সা: কে বললেন: ইবন খাতাল কাবার গিলাফের আশ্রয়ে আছে। রাসূল সা: তাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ লাভের সাথে সাথে আবু বারযাহ ছুটে গিয়ে তাকে হত্যা করেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ; সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪১০)
হযরত রাসূলে পাকের সা: জীবদ্দশা পর্যন্ত আবু বারযাহ মদীনায় বসবাসরত ছিলেন। হযরত উমারের রা: খিলাফতকালে তিনি বসরার বাসিন্দা হন। সিফফীন যুদ্ধে হযরত আলীর রা: পক্ষে এবং নাহরাওয়ানে খারেজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ‍খুরাসান অভিযানে তিনি ছিলেন একজন মুজাহিদ।
হযরত আবু বারযাহর রা: মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। কারও মতে হিজরী ৬০, আবার কারও মতে হিজরী ৬৫ সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। দ্বিতীয় মতটি অধিকতর সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, মারওয়ান ও আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের রা: সংঘর্ষের সময় পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন এবং তিনি বলতেন, তারা সব দুনিয়ার ঝগড়া বিবাদ করছে। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪০৭)। তিনি মৃত্যুকালে একমাত্র ছেলে মুগীরাকে রেখে যান।
হযরত আবু বারযাহ রা: হযরত রাসূলে কারীম সা: এর দীর্ঘ সাহচর্যের সুযোগ পেয়েছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা: হাদীসের একটি নির্ভরযোগ্য সংখ্যা তিনি স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৬৪। তার মধ্যে ২৭টি মুত্তাফাক আলাইহি। দুটি বুখারী ও চারটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবু বারযাহর রা: স্বভাবে যুহদের একটা ভাব বিদ্যমান ছিল। তিনি দামী কাপড় পরতেন না এবং ঘোড়ায়ও সওয়ার হতেন না। গেরুয়া রঙ্গের দু খানি কাপড় দিয়ে সতর ঢেকে চলতেন। তারই এক সমসাময়িক সাহাবী আয়িজ ইবন উমার। তিনি যেমন মূল্যবান কাপড় পরতেন তেমনি ঘোড়ায়ও সওয়ার হতেন। এক ব্যক্তি তাদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হযরত আয়িজের নিকট এসে বললো: আপনি আবু বারযাহকে দেখুন, তিনি পোশাক আশাকে আপনার বিরোধিতা করেন। আপনি দামী ‘খুয’ কাপড় পরেন, ঘোড়ায় চড়েন। আর তিনি এ দুটি জিনিসই পরিহার করেন। কিন্তু সাহাবীদের ভাতৃত্ব ছিল বাহ্যিক পোশাক আশাক ও চালচলন থেকেও অতি গভীর ও দৃঢ়। হযরত আয়িজ লোকটিকে জবাব দেন: আল্লাহ আবু বারযাহর ওপর রহম করুন। আজ আমাদের মধ্যে তার সমপর্যায়ের আর কে আছে? লোকটি হতাশ হয়ে সেখান থেকে আবু বারযাহর নিকট গেল এবং তাকে বললো: আপনি আয়িজকে একটু দেখুন। আপনার চালচলন তার পসন্দ নয়। তিনি ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে ঘুরে বেড়ান, মূল্যবান ‘খুয’ কাপড় তার দেহে শোভা পায়। কিন্তু লোকটি এখানেও একই জবাব পেল। আবু বারযাহ লোকটিকে বললেন: আল্লাহ আয়িজের ওপর রহম করুন। আমাদের মধ্যে তার সমমর্যাদার আর কে আছে?
একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীককে রা: একটা শক্ত কথা বলে ফেলে। সংগে সংগে আবু বারযাহ বলে উঠলেন: আমি কি তার গর্দান উড়িয়ে দেব? আবু বকর রা: তাকে ধমক দিয়ে বললেন: রাসূলুল্লাহর সা: পর আর কারও ক্ষেত্রে এতটুকু অপরাধের শাস্তি বৈধ নয়। (কানযুল উম্মাল-২/১৬১, হায়াতুস সাহাবা-২/৬৩৮)
গরীব দু:খীর সেবা করা ছিল আবু বারযাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ফকীর মিসকীনকে আহার করাতেন। ‍হাসান ইবন হাকীম তার মা নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন।
আবু বারযাহ বিধবা, ইয়াতিম ও মিসকীনদের সকালে এবং সন্ধ্যায় ‘সারীদ’ (আরবদের এক প্রকার প্রিয় খাদ্য) আহার করাতেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/১৯৪-৯৫)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: সম্পর্কে কোন প্রকার বিদ্রুপ বা হাসি কৌতুক তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের ‘হাউজে কাউসার’ সম্পর্কে কিছু জানার বাসনা হলো। তিনি লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন ‘হাউজে কাউসার’ সম্পর্কে কে বলতে পারবে? লোকেরা আবু বারযাহর রা: কথা বললো। উবাইদুল্লাহ তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি গেলেন। তাকে আসতে দেখে উবাইদুল্লাহ বিদ্রুপের সুরে বললো: এই সেই তোমাদের মুহাম্মাদী? অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাবে আবু বারযাহ জবাব দিলেন, আল্লাহর শুকরিয়া! আমি এমন এক যুগে বেঁচে আছি যখন সাহাবিয়্যাতের (সাহচর্যের) মর্যাদাকে হেয় চোখে দেখা হয়। এ কথা বলতে বলতে অত্যন্ত রুষ্টভাবে তিনি আসন গ্রহণ করেন। উবাইদুল্লাহ প্রশ্নটি উত্থাপন করলেন, জবাবে আবু বারযাহ বললেন: যে ব্যক্তি হাউজে কাওসার অস্বীকার করবে সে তার ধারে কাছেও যেতে পারবে না এবং আল্লাহ তাকে তার থেকে পানও করাবেন না।’ এ কথা বলে তিনি উঠে চলে আসেন।
হযরত আবু বারযাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: এক যুদ্ধে (মতান্তরে খাইবার) আমরা মুশরিক বাহিনীকে হামলা করে তাদের রুটি তৈরীর সাজ সরঞ্জাম থেকে দূরে তাড়িয়ে দেই। তারপর আমরা সেগুলি দখল করে খেতে শুরু করি। জাহিলী যুগে আমরা শুনতাম, যারা সাদা রুটি খায় তারা মোটা হয়ে যায়। তাদের পরিত্যক্ত রুটি খাওয়ার পর আমাদের কেউ কেউ তার নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে যে সে মোটা হয়েছে কি না। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩২৩) এ ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় সাহাবায়ে কিরাম সাদা মিহি আটা সাধারণত ব্যবহার করতেন না।

ফাদল ইবন আব্বাস রা:

নাম ফাদল, ডাক নাম আবু মুহাম্মাদ। পিতা প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব রা: এবং মাতা লুবাবা বিনতুল হারেস আল হিলালিয়্যাহ। রাসূল সা: এর চাচাতো ভাই। পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। এ কারণে পিতা আব্বাসকে ডাকা হতো আবুল ফাদলের পিতা বলে এবং ‍মাতা লুবাবাকে বলা হতো উম্মুল ফাদল বা ফাদলের মা।
বদর যুদ্ধের পূর্বেই পরিবারের অন্যদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন ; কিন্তু মক্কার কাফিরদের ভয়ে প্রকাশ করেননি। মক্কা বিজয়ের অল্প কিছুদিন পূর্বে পিতা হযরত আব্বাস ও ছোট ভাই আবদুল্লাহর রা: সাথে মদীনায় হিজরাত করেন। হিজরাতের সময় তার বয়স ছিল তের বছর এবং আবদুল্লাহর বয়স আট বছর। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৭৩) তিনি মদীনায় হিজরাতের পর সর্ব প্রথম মক্কা অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। অত:পর হুনাইন অভিযানেও যোগদান করেন। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়ে পালাতে শুরু করে তখনও তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা: সাথে ময়দানে অটল থাকেন। বিদায় হজ্জে তিনি রাসূলুল্লাহর সা: সাথে একই বাহনে বসা ছিলেন। এ কারণে সেই দিন থেকে তিনি ‘রাদিফুর রাসূল’ উপাধিতে ভূষিত হন। এই সময় খাইসাম গোত্রের এক যুবক ও এক সুন্দরী যুবতী রাসূলুল্লাহর সা: নিকট হজ্জের বিভিন্ন মাসয়ালা জিজ্ঞেস করতে আসে। হজ্জের সময় মহিলাদের মুখে নেকাব দেওয়া যেহেতু জায়েয নয়, এ কারণে মহিলাটির মুখ খোলা ছিল। ফাদল ছিলেন সুদর্শন নওজোয়ান। মহিলাটি তার দিকে আড় চোখে ‍তাকাতে থাকে এবং ফাদলও তাকে দেখতে থাকেন, হযরত রাসূলে কারীম সা: কয়েকবার ফাদলের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। রাসূল সা: বললেন: আজ যে ব্যক্তি স্বীয় চোখ, কান ও জিহবা সংযত রাখতে পারবে তার সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (ইবন সা’দ-৪/৩৭, আল ইসাবা-৩/২০৮) এবং বুখারী শরীফে বাবু হজ্জিল মারয়াতে অধ্যায়ে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।)
মিনায় পাথর নিক্ষেপের সময় চাদর উঁচু করে ধরে তিনি রাসূল সা: কে ছায়াদান করেন। মদীনায় রাসূল সা: তাকে বিয়ে দেন এবং নিজেই তার দেন মোহর পরিশোধ করেন।
হযরত ফাদল রা: রাসূলুল্লাহর সা: পার্থিব জীবনের সর্বশেষ খিদমাতের সুযোগ লাভে ধন্য হন। অন্তিম রোগশয্যায় রাসূল সা: সর্বশেষ ভাষণ দান করেন। এ ভাষণ দেওয়ার জন্য যে দুজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে তিনি ঘর থেকে বের হন তাদের একজন ফাদল। আর রাসূল সা: যে ভাষণ দেবেন এ কথাটিও ফাদল জনগণের মধ্যে ঘোষণা করেন। (আল ইসাবা-৩/২০৮) রাসূলুল্লাহর সা: ইনতিকালের পর যে কজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি পবিত্র দেহ গোসল দেওয়ার সুযোগ লাভ করেন ফাদল রা: তাদের অন্যতম। হযরত আলী রা: গোসল করান, ফাদল পানি ঢেলে দেন, রাসূল সা: কাপড় ধরে রাখেন এবং আউস ইবন খাওলী নামক এক আনসারী পানি এগিয়ে দেন। (আল ইসতীয়াব, হায়াতুস সাহাবা-২/৩৪১)। ওয়াকিদী বলেন: হযরত ফাদল হযরত উমারের খিলাফতকালে আমওয়াসের প্লেগের মহামারিতে মারা যান। আবার অনেকে বলেছেন, হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে আজনদাইন অথবা ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, হিজরী ১৫ সনে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তার মৃত্যুসন সম্পর্কে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ইমাম বুখারী আজনাদাইনের মতটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। (আল ইসাবা-৩/২০৯)।
হযরত ফাদল রা: হতে ২৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবন আব্বাস ও আবু হুরাইরার মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও তার থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া কুরাইব, কুসাম ইবন আব্বাস, আব্বাস ইবন উবাইদিল্লাহ, রাবীয়া ইবন হারেস, উমাইর, আবু সাঈদ, সুলাইমান ইবন ইয়াসার, শাবী, আতা ইবন আবী রিবাহ প্রমূখ তাবেয়ী তার নিকট থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন। (আল ইসাবা-৩/২০৯)।

তুলাইব ইবন উমাইর রা:

নাম তুলাইব, ডাকনাম আবু আদী। পিতা উমাইর ইবন ওয়াহাব, মাতা রাসুলুল্লাহর (মা) ফুফু আরওয়া বিনতু আবদুল মুত্তালিব। কুরাইশ বংশের বনী আবদী শাখার সন্তান। (আনসাবুল আশরাফ-১/৮৮)।
হযরত তুলাইবের জন্ম ও ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ইসলামের সূচনা পর্বেই যে তিনি এক কাফিলায় শরিক হন সে কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইতিহাসে বর্ণিত কিছু কিছু ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়, তার মামাতো ভাই মুহাম্মাদ ও তার দ্বীনের প্রতি ছিল তার সীমাহীন ভক্তি ও ভালোবাসা। রাসূল সা: প্রতি কুরাইশদের বৈরী আচরণে তুলাইব ছিলেন সব সময় ক্রুব্ধ। রাসূল সা: এর প্রতি কুরাইশদের রূঢ় আচরণের কঠিন জবাবও তিনি মাঝে মাঝে দিতেন। আর এসব কাজে তার নেককার মা তাকে সব সময় সমর্থন জানাতেন।
আল হারেস আত তাঈমী বলেন, রাসূল সা: মক্কার দারুল আরকাম বা আরকামের গৃহে অবস্থানকালে ‘তুলাইব’ ইবন উমাইর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর সেখান থেকে বের হয়ে সোজা মা আরওয়া বিনতু আবদুল মুত্তালিবের নিকট উপস্থিত হন। মাকে বলেন: মা, আমি মুহাম্মাদের অনুসরণ করেছি, আল্লাহর নিকট নিজেকে সমপর্ণ করেছি। মা বললেন: তোমার সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন তোমার মামার ছেলে। পুরুষদের যে শক্তি ও ক্ষমতা আছে আমার তা থাকলে আমি অবশ্যই মানুষের হাত থেকে তাকে বাঁচাতাম। তুলাইব বললেন: মা, ইসলাম গ্রহণ করে তার অনুসারী হতে আপনার সামনে কিসের বাধা? আপনার ভাই হামযা, তিনি তো ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মা বললেন: আমার অন্য বোনেরা কি করে, আমি সেই প্রতীক্ষায় আছি। আমি তাদের সাথে সাথেই থাকবো।
তুলাইব বললেন: যতক্ষণ আপনি তার নিকট গিয়ে তাকে সালাম করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর সাক্ষ্য না দেবেন, আমি ততক্ষণ আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দুআ করতে থাকবো। সন্তানের এই অনুরোধ ভাগ্যবতী মা প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি ঘোষণা করলেন: আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বা প্রেরিত বান্দা। এই দিন থেকে তিনি তার যবান দ্বারা রাসূলুলুল্লাহকে সা: সব রকম সহায়তা করতে শুরু করেন এবং পুত্র তুলাইবকে সর্ব অবস্থায় রাসূলুল্লাহর সা: পাশে দাড়ানোর নির্দেশ দেন। (তাবাকাত-৩/১২৩, আল ইসাবা-২ ২৩৩-২৩৪)।
মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তারা নানাভাবে কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত হন। একদিন তুলাইব ও হাতেব ইবন আমর মক্কার ‘আজ ইয়াদে আসগার’ এলাকায় নামায আদায় করছেন। মক্কার ততকালীন চরম দুই সন্ত্রাসী ইবনুল আসদা ও ইবনুল গায়তালা তা দেখে ফেলে। তারা তুলাইব ও হাতেবের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে আক্রমণ চালায়। হাতেব ও তুলাইব প্রায় এক ঘন্টা যাবত সে আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং প্রাণ বাঁচিয়ে কোন রকমে পালিয়ে যান। (আনসাবুল আশরাফ-১/১১৭)।
মক্কার উকবা ইবন আবী মুয়াইত ছিল রাসুলুল্লাহর সা: চরম দুশমন। তাছাড়া সে ছিল অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির। নানাভাবে সে রাসুলুল্লাহকে সা: কষ্ট দিত। একদিন সে এক ঝুড়ি ময়লা নিয়ে এসে রাসুলুল্লাহর সা: বাড়ীর দরযায় ফেলতে শুরু করে। ব্যাপারটি তুলাইবের নজরে পড়ে। তিনি ছুটে গিয়ে উকবার হাত থেকে ঝুড়িটি ছিনিয়ে নিয়ে তার দুটি কান মলে দেন। উকবা খুব ক্ষেপে গিয়ে তুলাইবের পিছু পিছু তার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ জানায় এই বলে: তুমি কি দেখনা, তোমার ছেলে মুহাম্মাদের পক্ষ নিয়েছে?আব্দুল মুত্তালিবের ভাগ্যবতী মেয়ে জবাব দিলেন: আচ্ছা তুমিই বল, তার পক্ষ নেওয়ার জন্য তুলাইবের চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত ব্যক্তি আর কে আছে? মুহাম্মাদ তো তার মামাত ভাই। আমাদের অর্থ কড়ি, জীবন সবই তো মুহাম্মাদের জন্য নিবেদিত। তারপর তিনি একটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। যার অর্থ: তুলাইব ‍তার মামাতো ভাইকে সাহায্য করেছে, সে তার রক্ত ও অর্থের ব্যাপারে সমবেদনা জানিয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এই উকবা বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হয় এবং রাসূল সা: বিশেষ নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪৭)।
হযরত তুলাইব রা: ইসলাম গ্রহণের পর বেশ কিছুদিন কুরাইশদের সকল অত্যাচার নিপীড়ন প্রতিরোধ করে মক্কায় অবস্থান করেন। কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা চরম রূপ ধারণ করে এবং মক্কায় টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন হাবশাগামী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থানের পর মক্কাবাসীদের সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছে, এমন একটি গুজব শুনে যারা হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে আসেন তাদের মধ্যে তুলাইবও ছিলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩২৪, ৩৬৬)।
হাবশা থেকে ফিরে কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করেন। তারপর আবার মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন সালামা আল আজলানীর অতিথি হন। রাসুল সা: মুনজির ইবন আমর আস সায়েদীর সাথে তার মুওয়াখাত বা ইসলামী ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।
মুহাম্মাদ ইবন উমারের বর্ণনা মতে হযরত তুলাইব বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। তাবারী বলেন: বদর যুদ্ধে তার যোগদানের ব্যাপারটি প্রমাণিত সত্য। অবশ্য মূসা ইবন উকবা, মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ও আবূ মাশার বদর যুদ্ধে যারা যোগদান করেন তাদের নামের তালিকায় তুলাইবের নামটি উল্লেখ করেননি। (তাবাকাত-৩/১২৩)
বদর যুদ্ধের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার কর্মকান্ডের আর কোন তথ্য সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায়, তার মত এমন তেজোদীপ্ত পুরুষ কখনও চুপ করে বসে ‍থাকতে পারেন না। আমরণ সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
হিজরী ১৩ সনে জামাদিউল উলা মাসে আজনাদাইন যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তবে মুসয়াব ইবন আবদিল্লাহ বলেন: তিনি ইয়ারমুক যুদ্ধে শহীদ হন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তিনি কোন সন্তানাদি রেখে যাননি। (তাবাকাত-৩/১২৪, আল ইসতীয়াব)।

সাওবান ইবন নাজদাহ রা:

নাম সাওবান, পিতার নাম নাজদাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু আবদিল্রাহ। ইয়ামানের প্রসিদ্ধ হিময়ার গোত্রের সন্তান। (আসাহ হুস সিয়ার-৫৯৯) কোন কারণে তিনি দাসে পরিণত হন। হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে খরীদ করেন এবং পরে আযাদ করে দেন। আযাদ করার সময় তিনি সাওবানকে বলেন, ইচ্ছা করলে তুমি স্বগোত্রীয় লোকদের কাছে চলে যেতে পার অথবা আমার সাথে থাকতে পার। আমার সাথে থাকলে আমার পরিবারের সদস্য বলে গণ্য হবে। সাওবান নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার চেয়ে রাসূলুল্লাহর সা: সাহচর্যে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন।
হযরত রাসূলে কারীমের ওফাতের পর অল্প কিছুদিন তিনি মদীনায় ছিলেন। রাসূল সা: ছাড়া মদীনা তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তিনি মদীনা ছেড়ে শামের ‘রামলা’ নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। মিসর অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং ‘রামলা’ ছেড়ে ‘হিমসে’ বসতি স্থাপন করেন। এই হিমসে হিজরী ৫৪ সনে তিনি ইনতিকাল করেন।
হযরত সাওবান ছিলেন রাসুল সা: এর বিশেষ খাদেম। ভেতর বাহির সর্ব অবস্থায় তিনি রাসূল সা: সঙ্গ লাভের সুযোগ পান। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে ‘উলুমে নববী’ বা নবীর জ্ঞান সমূহে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তার থেকে রাসুল সা: এর ১২৭টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি হাদীস হিফজ বা মুখস্থ করার সাথে সাথে প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বও পালন করতেন। আল্লামাহ ইবন আবদিল ‍বার বলেছেন, সাওবান সেই সব লোকদের একজন যারা হাদীস মুখস্থ করণের সাথে সাথে তার প্রচারের কাজও করেছেন।
হযরত সাওবানের প্রচুর হাদীস মুখস্থ থাকায় অসংখ্য লোক তা শোনার জন্য তার নিকট আসতো। একবার লোকেরা তার নিকট হাদীস শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন: কোন মুসলমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি সিজদাহ করলে আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন এবং তার গোনাহ সমূহও মাফ করে দেন। (মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল-৫/২৭৬)।
হযরত সাওবানের যুগের প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ অন্যদের নিকট থেকে শ্রুত তাদের হাদীস সমূহের সত্যাসত্য তার নিকট থেকে যাচাই করতেন। সা’দান ইবন তালহার মত উচু স্তরের একজন হাদীস বিশারদ হযরত আবুদ দারদার রা: নিকট থেকে একটি হাদীস শোনেন এবং তার সত্যাসত্য যাচাই করেন হযরত সাওবানের নিকট থেকে। হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর তিনি মদীনার অন্যতম মুজতাহিদ সাহাবী হিসাবে পরিগণিত হন। (আলামুল মুওয়াক্কিরীন -১/১৫)।
হযরত সাওবানের ছাত্রদের গন্ডিও ‍সুপ্রশস্ত। সা’দান ইবন তালহা, রাশেদ ইবন সাদ, জুবাইর ইবন নুদাইর, আব্দুর রহমান ইবন গানাম, আবু ইদরীস প্রমূখ ছিলেন তার উল্লেখযোগ্য ছাত্র।
হযরত রাসূলে কারীমের সা: প্রতি তার এত বেশি ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল যে, রাসুলুল্লাহর সা: প্রতি বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ পায় এমন কোন একটি শব্দও তিনি অমুসলিমের মুখ থেকে শুনে সহ্য করতে পারতেন না। একবার এক ইয়াহুদী রাসুল সা: এর নিকট এসে বললো: আসসালামু আলাইকা ইয়া মুহাম্মাদ। সাথে সাথে সাওবান ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি সেই ইয়াহুদীকে এমন জোরে এক ধাক্কা দিলেন যে বেচারা পড়তে পড়তে কোন রকম টাল সামলাল। লোকটি একটু স্থির হয়ে তার এত রাগের কারণ কি তা জানতে চাইলো। সাওবান বললেন: তুমি কেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’ না বলে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বললে? লোকটি বললো, এতে এমন কি অপরাধ হয়েছে? আমি তার খান্দানী নামই উচ্চারণ করেছি। রাসুল সা: তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, হা, আমার খান্দানী নাম মুহাম্মাদ।
নবুওয়াতের সম্মান তো বিরাট ব্যাপার। রাসুল সা: এর সাথে তার যে গোলামী বা দাসত্বের সম্পর্ক ছিল তাও যদি কেউ উপেক্ষা বা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতো, তিনি তাকে সতর্ক করে দিতেন। হিমসে অবস্থান কালে একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হিমসের ততকালীন ওয়ালী আবদুল্লাহ ইবন কারাত ইযদী যখন তাকে দেখতে এলেন না, তখন তিনি একটি চিঠিতে লিখলেন: যদি মূসা ও ঈসার দাস তোমার এখানে থাকতো, তুমি তার অসুস্থতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বা দেখতে যেতে। এই চিঠি পেয়ে ওয়ালী এমন ব্যস্ততার সাথে বাড়ী থেকে বের হন যে, লোকেরা মনে করে নিশ্চয় বিরাট কোন কিছু ঘটেছে। এ অবস্থায় তিনি হযরত সাওবানের বাড়ী পৌঁছেন এবং দীর্ঘক্ষণ তার পাশে বসে থাকেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা: এর নির্দেশ পালনের ব্যাপারে তিনি এত বেশি সচেতন ছিলেন যে, একবার যে নির্দেশ তিনি রাসুল সা: থেকে লাভ করেছেন আজীবন তা পালন করেছেন এবং কোন নির্দেশ অমান্য করার বিন্দুমাত্র আশংকা থাকে এমন কাজ তিনি কখনও করেননি। তাবারানী আবু উমামা রা: থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: রাসুল সা: বললেন: কে বাইয়াত করবে? সাওবান বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা তো বাইয়াত করেছি। রাসূল সা: বললেন: কারও কাছে কোন কিছু চাইবে না- এ কথার উপর বাইয়াত। সাওবান বললেন: কিসের জন্য ইয়া রাসুলুল্লাহ! বললেন: জান্নাতের জন্য। সাওবান্ এ কথার উপর বাইয়াত করলেন। আবু উমামা বলেন: আমি তাকে মক্কায় মানুষের ভিড়ের মধ্যে সওয়ারী অবস্থায় দেখেছি। এ অবস্থায় তার হাত থেকে চাবুকটি পড়ে যায়। সম্ভবত: তা এক ব্যক্তির ঘাড়ের উপর পড়ে এবং সে চাবুকটি ধরে ফেলে। অত:পর সে তা সাওবানের হাতে তুলে দিতে চায়; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ না করে বাহন থেকে নেমে এসে নিজ হাতে তুলে নেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/২৪২)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা: বললেন: মানুষের কাছে সাওয়াল করবে না, এ নিশ্চয়তা যে আমাকে দেবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এ কথা শুনে সাওবান বলে উঠলেন: আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এরপর তিনি কারও কাছে কিছু চাইতেন না। (আল ইসাবা-১/২০৪)।
ইউসুফ ইবন আবদিল হামীদ বর্ণনা করেছেন। সাওবান আমাকে বলেছেন, একবার রাসূল সা: তার আহল বা পরিবারবর্গের জন্য দুআ করলেন। আমি বললাম, আমিও তো আহলি বাইতের (আপনার পরিবারবর্গের) অন্তর্গত। তৃতীয়বার তিনি বললেন: হা, তুমি আমার পরিবারের অন্তর্গত। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কোন বন্ধ দরযায় না দাড়াবে অথবা কোন আমীরের কাছে কিছু চাইতে না যাবে। (আল ইসাবা-১/২০৪)।
এই সব নির্দেশের পর তিনি জীবনে আর কখনও কারও নিকট কোন কিছু চাননি বলে ইতিহাসে জানা যায়।

আমর ইবন আবাসা রা:

তার নাম আমর, আবু নাজীহ কুনিয়াত বা ডাকনাম। পিতা ‍আবাসা ইবন আমের এবং মাতা রামলা বিনতুল ওয়াকীয়া। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবুযার আল গিফারীর রা: বৈপিত্রীয় ভাই। (আল ইসাবা-৩/৫)।
জীবনের প্রথম থেকেই আমর ছিলেন সত প্রকৃতির লোক। জাহিলী যুগে যখন গোটা আরব মূর্তি পূজায় লিপ্ত তখনও তিনি এ কাজকে ঘৃণা এবং মূর্তি পূজারীদের পথভ্রষ্ট বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে ইসলামের চতুর্থ ব্যক্তি অথবা ইসলামের এক চতুর্থাংশ বলে দাবী করতেন। তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, আপনি কিসের ভিত্তিতে এ দাবী করেন? তিনি বললেন: জাহিলী যুগে আমি মানুষকে পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করতাম। মূর্তির কোন গুরুত্ব আমার কাছে ছিল না। আমি জানতাম, এগুলি যেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না, তেমনি কোন উপকারও করতে পারে না। কারণ, তারা পাথরের মূর্তির পূজা করতো। এ সময় আমি একজন আহলি কিতাব বা ঐশী ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট সর্বোত্তম দ্বীন সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন: মক্কায় এক ব্যক্তির আবির্ভাব হবে। তিনি নিজ কাওমের ইলাহ বা উপাস্য পরিত্যাগ করে অন্য ইলাহর দিকে মানুষকে আহবান জানাবেন। তিনিই সর্বোত্তম দ্বীন নিয়ে আসবেন। তুমি তার আবির্ভাবের কথা শুনতে পেলে তাকে অনুসরণ করবে।
আমর বলেন, এমন সময় আমি মক্কা থেকে একটি সংবাদ পেলাম। মক্কায় নতুন কোন ঘটনা ঘটেছে কি না-এ কথা আমি কারও কাছে জিজ্ঞেস করতে সাহস পেলাম না। অবশেষে পশুর পিঠে সওয়ার হয়ে আমি মক্কায় পৌঁছলাম। সেখানে এক আরোহীকে প্রশ্ন করলে সে বললো: এখানে এমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যে তার কাওম বা স্বজাতীয় ইলাহকে ঘৃণা করে। আমি গোপনে রাসূল সা: সাথে সাক্ষাত করলাম। কারণ, তখন তার স্বজাতীয় লোকেরা চরমভাবে তার বিরোধিতা করছে। অন্য একটি বর্ণনা মতে রাসূল সা: সাথে আমরের এ সাক্ষাত হয় উকাজ মেলায়। প্রথম সাক্ষাতে তাদের কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ: আমর প্রশ্ন করেন: আপনি কে?
-আমি আল্লাহর নবী।
-আল্লাহ কি আপনাকে পাঠিয়েছেন?
-হাঁ।
-কি কি জিনিস সহকারে পাঠিয়েছেন?
-আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করবে, তার সাথে কোন কিছু শরিক করবে না, মূর্তি ভেঙ্গে ফেলবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখবে।
- কেউ কি এ দাওয়াত কবুল করেছে?
-হাঁ, একজন আযাদ, একজন দাস।
আমর বলেন, সে দুজন হলেন আবু বকর ও বিলাল। অত:পর আমার আরজ করেন, আমাকেও আল্লাহর উপাসকদের মধ্যে শরীক করে নিন। আমি আপনারই সাথে থাকবো। রাসূল সা: বললেন, যখন চারদিক থেকে আমার বিরোধিতা চলছে তখন কিভাবে তুমি আমার সাথে থাকবে? এখন তোমার স্বদেশ ভূমিতে ফিরে যাও। যখন আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে শুরু করি তখন আমার নিকট চলে এসো। আমর বলেন এভাবে আমি ইসলাম গ্রহণ করি এবং নিজেকে ইসলামের এক চতুর্থ হিসেবে দেখতে পাই। (আল ইসাবা-৩/৬, হায়াতুস সাহাবা-১/৭১-৭২)।
রাসুল সা: এর নির্দেশমত আমর ইসলাম গ্রহণ করে স্বগোত্রে ফিরে যান। তবে মক্কায় যাতায়াতকারীদের মাধ্যমে সব সময় রাসুলুল্লাহর সা: খোঁজ খবর রাখতেন। রাসূল সা: মদীনায় হিজরাতের পর ইয়াসরিব বা মদীনার কিছু লোক আমরের গোত্রে আসে। তিনি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, মক্কা থেকে যে লোকটি মদীনায় এসেছেন, তার অবস্থা কি? তারা বললো, দলে দলে লোক তার দিকে ছুটে আসছে। তার স্বজাতি তো তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল; কিন্তু পারেনি। এখন তিনি মদীনায়।
তাদের কাছে এই খবর পেয়ে আমর মদীনায় রওয়ানা হয়ে গেলেন। মদীনায় রাসুল সা: এর নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের পরিচয় দিলে তিনি বললেন: হাঁ, তোমাকে আমি চিনেছি, মক্কায় তুমি আমার সাথে দেখা করেছিলে। তখন থেকে আমর মদীনায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।
হযরত আমরের মদীনায় আগমনের সময় সম্পর্কে মতভেদ আছে। একটি মতে তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে মদীনায় আসেন এবং বদরে অংশগ্রহণ করেন। তবে প্রসিদ্ধ মতে তিনি খাইবার যুদ্ধের পরে এবং মক্কা বিজয়ের পূর্বে মদীনায় আসেন। (আল ইসাবা-৩/৫)।
বদর, উহুদ, হুদাইবিয়া, খাইবার সহ বিভিন্ন যুদ্ধ তার স্বদেশ থাকাকালেই শেষ হয়ে যায়। মক্কা বিজয় অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। তায়িফ অভিযানেও যে তিনি শরিক ছিলেন, এমন বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন। তায়িফ অবরোধকালে হযরত রাসূলে কারীম সা: বললেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একটি তীর নিক্ষেপ করবে, তার জন্য জান্নাতের একটি দরযা খুলে যাবে। এই সুসংবাদ শুনে আমি ১৬টি তীর নিক্ষেপ করি। তায়িফ অভিযানের পর আর কোন যুদ্ধে তার তার যোগদানের কথা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি আরও কিছু যুদ্ধে যোগদান করেন। হযরত আমর ইবন আবাসার রা: মৃত্যুর সময়কাল সঠিকভাবে জানা যায় না। সীরাত বিশেষজ্ঞরা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলেছেন, তিনি খলীফা হযরত উসমানের রা: খিলাফতের শেষ দিকে মৃত্যু বরণ করেছেন। সুতরাং ‘আল ইসাবা ফী তাময়ী যিস সাহাবা’ গ্রন্থকার আল্লামা ইবন হাজার আল ‘আসকালানী’ শুধু এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে-যেহেতু আলী-মুআবিয়ার রা: দ্বন্দ্ব এবং আমীর মুআবিয়ার খিলাফতকালে কোথাও তাকে দেখা যায় না- উসমানী খিলাফতের শেষদিকে তার মৃত্যুকাল উল্লেখ করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৬) কিন্তু মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের এক বর্ণনায় জানা যায়, আমীর মুআবিয়া রা: ও রোমানদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমীর মুআবিয়া রা: রোমানদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারতেন না। কিন্তু হযরত মুআবিয়া রা: পরিকল্পনা করেন, তার বাহিনী রোমানদের সীমান্তে পৌঁছে যাবে, আর এদিকে চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। অত:পর তার বাহিনী সাথে সাথে হামলা চালিয়ে দেবে। এ সময় আমর ইবন আবাসা চিতকার করে বলে বেড়াতেন, অঙ্গীকার পূর্ণ কর, ধোকা দিওনা। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি আমীর মুআবিয়ার খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কিন্তু যদি ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থকারের মতটি সত্য ধরা হয়, তাহলে এই ঘটনাটি ছিল উসমানী খিলাফতকালের, যখন হযরত মুআবিয়া রা: শামের গভর্ণর ছিলেন। তখনও রোমানদের সাথে তার সংঘর্ষ হয়েছিল।
হযরত আমর ইবন আবাসা রা: রাসূলুল্লাহর সা: মুহাব্বত বা সাহচর্যের খুব বেশি সুযোগ পাননি। তবে যতটুকু পেয়েছেন তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। আমরা তার প্রমাণ পাই মদীনায় রাসুল সা: এর সাথে প্রথম সাক্ষাতে। তিনি আরজ করেন- আল্লিমনী মা আল্লামাকাল্লাহু- আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন তার কিছু আমাকেও শিখিয়ে দিন। এ কারণে এত কম সময়ের সাহচর্য সত্ত্বেও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে তার বর্ণিত মোট ৪৮টি হাদীস দেখা যায়।
সাহাবীদের মধ্যে ইবন মাসউদ, আবু উমামা আল বাহিলী,সাহল ইবন সাদ, এবং তাবেঈদের মধ্যে শুরাহবীল ইবন সামাত, সাদান ইবন আবী তালহা, সুলাইম ইবন আমের, আবদুর রহমান ইবন আমের, জুবাইর ইবন নাফীর, আবু সালাম ও অন্যরা তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৫)।
আবু নুঈম কাবের মাওলা বা আযাদকৃত দাস থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: একদিন আমর ইবন আবাসা পশু চড়াতে গেলেন। আমি তার খোঁজে দুপুরে বের হলাম। আমি দেখতে পেলাম, আমর একস্থানে ঘুমিয়ে আছেন এবং একখানি মেঘ তার ওপর ছায়া দিচ্ছে। আমি তাকে জাগালাম। তিনি জেগে আমাকে বললেন, এই ব্যাপারটি আমার ও তোমার মধ্যে গোপন থাকুক। অন্য কারও নিকট প্রকাশ করলে তোমার ভালো হবে না। আমি তার জীবদ্দশায় এ কথা কারও নিকট বলিনি। (আল ইসাবা-৩/৬)

ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা রা:

নাম ওয়ালীদ, পিতা ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা। কুরাইশ গোত্রের বনী মাখযুম শাখার সন্তান। প্রখ্যাত সাহাবী ও সেনানায়ক হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও হিশাম ইবনুল ওয়ালীদের ভাই। একটি বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হিশামের সহোদর ও খালিদের বৈমাত্রীয় ভাই। হযরত রাসূলে কারীমের সা: মক্কী জীবনে ওয়ালীদ ইসলাম গ্রহণ করেননি। এ সময় মুসলমানদের সাথে তার আচরণ কেমন ছিল, সীরাত গ্রন্থাবলীতে সে সম্পর্কে তেমন কিছু উল্লেখ নেই। তবে দেখা যায়, মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ মতান্তরে সুলাইত ইবন কায়েসের সা: হাতে বন্দী হন। (আনসাবুল আশরাফ-১/৩০২)।
ওয়ালীদের অন্য দুই ভাই খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও হিশাম ইবনুল ওয়ালীদ তাকে ছাড়িয়ে নিতে আসেন। আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ দাবী করেন। এতে মোটা অংকের অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে খালিদ দ্বিধার ভাব প্রকাশ করেন। এতে হিশাম খুব রেগে গিয়ে খালিদকে বলেন: তোমার কি, তুমি তো আর তার ভাই নও? আবদুল্লাহ যদি এর চেয়েও বেশি দাবী করে তবুও তাকে মুক্ত করতে হবে। ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন: ওয়ালীদ ‍তার কাওমের ধর্মের ওপর থাকা অবস্থায় বন্দী হন এবং চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে মুক্তিলাভ করেন। অন্য একটি বর্ণনা মতে, হযরত রাসূলে কারীম সা: ওয়ালীদের মুক্তির বিনিময়ে তার পিতার ঢাল, বর্ম ও তরবারী দাবী করেন। তার ভাইয়েরা সেই দাবী পূরণ করে তাকে মুক্ত করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/২১০)
ওয়ালীদ মুক্তি পেয়ে ভাইদের সাথে মক্কার পথে যাত্রা করলেন। যুল হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছার পর ভাইদের নিকট থেকে পালিয়ে আবার মদীনায় রাসূল সা: এর নিকট ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ভাইয়েরা ফিরে এসে আবার তার সাথে দেখা করে বলেন, যদি তোমার মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা ছিল, তাহলে মুক্তিপণ দেওয়ার পূর্বে হলে না কেন? শুধু শুধু পিতার স্মৃতিচিহ্নগুলি নষ্ট করলে। ওয়ালীদ তাদেরকে বলেন, অন্য কুরাইশদের মত আমিও মুক্তিপণ প্রদান করে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম। মুক্তির পূর্বে আমি ইসলামের ঘোষণা এ জন্য দেইনি যে, যাতে কুরাইশরা এমন কথা বলতে না পারে, আমি ফিদিয়া বা মুক্তিপণ দেওয়ার ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছি।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ভাইদের সাথে আবার মক্কার পথে যাত্রা করেন। পথে তার ভাইয়েরা তো তেমন কিছু বললো না। কিন্তু মক্কায় পৌঁছে অন্যান্য অত্যাচারিত মুসলমানদের মত ‍তাকেও বন্দী করলো এবং তার মত অন্য বন্দী-আইয়াশ ইবন রাবীয়া, হিশাম ইবনুল আস, সালামা ইবন হিশাম প্রমূখের সাথে এক ঘরে আটক করলো।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এসব বন্দীদের ওপর কুরাইশরা অমানুষিক নির্যাতন চালাতো। তাদের হত্যারও হুমকি দেয়া হতো।
কালবী বলেন: যাদের কোন গোত্রীয় শক্তি বা জনবল ছিল না এমন একটি দূর্বল সম্প্রদায়কে ইসলাম গ্রহণের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদের অনেকে দ্বীন ত্যাগ করেছে, অভিজাত ঘরের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে পরীক্ষায় সম্মুখীন হয়েছে। যেমন: সালামা ইবন হিশাম ইবনুল মুগীরা, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা, আইয়াশ ইবন রাবীয়া প্রমূখ। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৯)।
ইবন ইসহাক বলেন, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ ইবন মুগীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, বনু মাখযুমের একদল লোক তার ভাই হিশাম ইবন ওয়ালীদ ইবন মুগীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, বনু মাখযুমের একদল লোক তার ভাই হিশাম ইবন ওয়ালীদ ইবন মুগীরার নিকট যায় এবং ওয়ালীদকে হত্যার জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার আবদার জানায়। তাদের যুক্তি ছিল, তাকে হত্যা করলে অন্যদের ব্যাপারে তারা নিরাপদ হতে পারবে। হিশাম তাদের সেই আবদার অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। তিনি আরও হুমকি দেন, কেউ তার ভাই ওয়ালীদকে হত্যা করলে তিনি তাদের সর্বাধিক মর্যাদাবান এক ব্যক্তিকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেবেন। এই চরম হুমকির মুখে তারা ওয়ালীদকে হত্যার আশা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩২১)।
বদর যুদ্ধের পূর্বে হযরত রাসূলে কারীম সা: আইয়াশ ইবন রাবীয়া, সালামা ইবন হিশাম, হিশাম ইবন আস প্রমূখের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন। বদর যুদ্ধের পর ওয়ালীদ বন্দী হয়ে তাদের সাথে যুক্ত হলে রাসুল সা: তার নাম ধরেও দুআ করতে লাগলেন। বাযযার আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা: নামাযে সালাম ফিরানোর পর মাথা উঁচু করলেন এবং কিবলামূখী অবস্থায় বললেন: হে আল্লাহ, তুমি সালামা ইবন হিশাম, আইয়াশ ইবন রাবীয়া, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ এবং ঐ সকল দূর্বল মুসলমানকে মুক্তি দাও যারা কোন কৌশল অবলম্বনে অক্ষম এবং যাদের কোন পন্থা জানা নেই। অন্য একটি বর্ণনা মতে রাসুল সা: সালাতুল ফজরে এই দুআ করতেন। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৪৮)।
বেশ কিছুদিন তার বন্দী দশায় কাটে। একদিন সুযোগ বুঝে তিনি মদীনায় পালিয়ে আসেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: তার কাছে আইয়াশ ও ‍সালামার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। ওয়ালীদ বলেন, তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। একটি বেড়ী দুজনের পায়ে লাগানো হয়েছে। হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে বললেন: তুমি আবার মক্কায় যাও। সেখানকার এক কর্মকার ইসলাম গ্রহণ করেছে। প্রথমে তার ওখানে গিয়ে ওঠো। তারপর গোপনে আইয়াশ ও সালামার সাথে দেখা করে বল, তুমি আমার প্রতিনিধি, আমার সাথে চলো।
রাসূল সা: এর নির্দেশ মত ওয়ালীদ মক্কায় পৌঁছলেন এবং আইয়াশ ও সালামার সাথে দেখা করে রাসূল সা: এর বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দিলেন। পরিকল্পনা মত তারা মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ তাদের পিছু ধাওয়া করেন; কিন্তু ধরতে ব্যর্থ হয়ে মক্কায় ফিরে যান।
এদিকে ওয়ালীদ তার সঙ্গীদ্বয় সহ একটানা ভ্রমণ ও অজানা শংকায় ক্লান্তিতে অসাড় হয়ে পড়ছিলেন। এই সময় কবিতার একটি শ্লোক বারবার তার মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল: ‘ওহে আমার চরণ যুগল! আমাকে আমার কাওমের নিকট পৌঁছে দাও। আজকের এ দিনটির পর আর কখনও তুমি অলস দেখতে পাবে না।’
আজবাস নামক স্থানে তিনি পড়ে গেলে একটি অঙ্গুলি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তিনি আহত অঙ্গুলিটিকে উদ্দেশ্য করে একটি শ্লোক আওড়াতে থাকেন: ‘ওহে, তুমি একটি অঙ্গুলি ছাড়া আর কিছু নও, যা থেকে রক্ত ঝরেছে।
যা কিছু তুমি লাভ করেছ, তা সবই আল্লাহর রাস্তায়। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০৯-১০)
হুদাইবিয়ার ‍চুক্তি অনুযায়ী হযরত রাসূলে কারীম সা: হিজরী সপ্তম সনে বিগত বছরের কাজা উমরা আদায় করতে মক্কায় যান। ওয়ালীদ এ সময় রাসূল সা: এর সফরসঙ্গী ছিলেন। তখনও তার ভাই খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ইসলাম গ্রহণ করেননি। এ সম্পর্কে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ বলেন: হুদাইবিয়ার সন্ধির পর আমি যখন দারুণ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছি, তখন হিজরী ৭ম সনে যুল কাদাহ মাসে হযরত রাসূলে কারীম সা: ‘উমরাতুল কাযা’ আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তাদের কারও সামনে পড়তে হয় এই আশংকায় আমি আত্মগোপন করে থাকলাম। তাদের কারও সাথে আমার দেখা হলো না। আমার ভাই ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ এই সফরে রাসূল সা: এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি আমাকে খুঁজে না পেয়ে আমাকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠির বিষয়বস্তু নিম্নরূপ: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। অত:পর ইসলামের ব্যাপারে আপনার এমন বিরূপ মনোভাব পোষণের কারণে আপনাকে আমার খুব আশ্চর্য মানুষ বলে মনে হয়েছে। অথচ আপনি একজন বড় বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তি। আপনার মত কোন ব্যক্তি কি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে? রাসূল সা: আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন: খালিদ কোথায়? আমি বলেছি: শিগগিরই আল্লাহ তাকে নিয়ে আসবেন। তিনি তখন বললেন: তার মত ব্যক্তি কি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে? তার বুদ্ধি ও চেষ্টা যদি মুসলমানদের পক্ষে হতো, তাহলে তা তার কল্যাণ বয়ে আনতো এবং আমি তাকে অন্যদের চেয়ে বেশী মর্যাদা দিতাম। ভাই, যে ভালো কাজ আপনার হাতছাড়া হয়ে গেছে, এখনই আপনি এসে তাতে শরিক হউন।” মূলত: এই চিঠি পেয়ে হযরত খালিদ ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং অল্পদিনের মধ্যে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬০), উসুদুল গাবা-৫/৯৩)।
হযরত ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদের মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি বর্ণনা মতে তিনি আইয়াশ ও সালামাকে মুক্ত করে মদীনায় ফিরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। এই বর্ণনা মতে, মদীনায় পৌঁছে তিনি সরাসরি রাসূল সা: এর নিকট হাজির হয়ে বলেন: ইয়া রাসূল সা: আমি মৃত, আপনার পরিত্যক্ত একটু কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দিন। অত:পর তিনি মারা যান এবং রাসূল সা: স্বীয় কাপড় দিয়ে তাকে কাফন দেন। (আল ইসাবা-৩/৬৪০, আনসাবুল আশরাফ-১/২১০-২১১)।
কিন্তু উপরোক্ত বর্ণনা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ, একাধিক বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হিজরী ৭ম সনে রাসূল সা: এর সাথে ‘উমরাতুল কাযা’ আদায়ে শরিক ছিলেন। আল্লামা ইবন আবদিলবার লিখেছেন: আর এ কথা সঠিক যে, তিনি ‘উমরাতুল কাযায়’ রাসূল সা: এর সাথে অংশ গ্রহণ করেন। আর উমরাতুল কাযা হিজরী ৭ম সনের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে প্রথম বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় ‘উমরাতুল কাযা’র দুই বছর পূর্বে হিজরী ৫ম সনে তার ওফাত হয়।
তাছাড়া ওয়াকিদী বলেছেন: কেউ কেউ মনে করেন, ওয়ালীদ মক্কা থেকে পালিয়ে আবু বাসীরের দলের সাথে যোগ দেন। উল্লেখ্য যে, এই আবু বাসীর হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মদীনায় আসেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ‍তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান। কিন্তু পথিমধ্যে তার এক সঙ্গীকে হত্যা করে আবার মদীনায় রাসূল সা: এর নিকট ফিরে আসেন। তিনি আবু বাসীরকে মদীনা ত্যাগের নির্দেশ দেন। আবু বাসীর মদীনা ত্যাগ করে লোহিত সাগরের উপকূল এলাকায় চলে যান। এরপর মক্কার আরও কিছু নও মুসলিম যুবক তার সাথে যোগ দেন। তারা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলা আক্রমণ করে লুটপাট করতেন। ফলে কুরাইশদের ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। অত:পর কুরাইশরা অনন্যোপায় হয়ে এই দলটিকে মদীনায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাসূল ‍সা:কে অনুরোধ জানায়। রাসূল সা: তাদেরকে মদীনায় ডেকে পাঠান। (আনসাবুল আশরাফ-১/২১০-২১১)।
তবে বালাযুরী এই বর্ণনাকে সঠিক বলে মনে করেননি। যাই হউক হিজরী অষ্টম সনের পরে যে তিনি জীবিত ছিলেন এমন কোন প্রমাণ সীরাত গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায় না।
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা ছিলেন ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদের চাচাতো বোন। ওয়ালীদের মৃত্যুর পর তিনি রাসূল সা:কে বললেন: ইয়া রাসূল সা:। সে বিদেশ বিভূয়ে মারা গেছে। তার জন্য শোক প্রকাশের কেউ এখানে নেই। রাসূল সা: তাকে শোক প্রকাশের অনুমতি দান করেন। উম্মু সালামা রাসূল সা: এর অনুমতি পেয়ে খাবার তৈরী করেন এবং পাড়ার অন্য মহিলাদের ডেকে ‍আনেন। হযরত উম্মু সালামা রা: একটি মরসিয়া বা শোকগাথা আবৃত্তি করতে শুরু করেন। তার দুটি শ্লোক নিম্নরূপ:
‘ওহে চোখ, তুমি ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ ইবন মুগীরার জন্য কাঁদ। আমাদের মধ্যে সে ছিল খরার সময় বৃষ্টি ও রহমত স্বরূপ। নামকাম ও গৌরবে সে ছিল তার পিতার মত। সে তার গোত্রের জন্য একাই যথেষ্ট।’
হযরত রাসূলে কারীম সা: মরসিয়াটি শোনার সাথে সাথে বলে উঠলেন: উম্মু সালামা, এ কথা না বলে বরং বল: মৃত্যু যন্ত্রনা সত্যই আসবে। আর এ থেকেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছো। (সূরা কাফ-১৯)। (আনসাবুল আশরাফ-১/২১০-২১১) (আল ইসাবা-৩/৬৪০)।
ইবন হিশাম বলেন: মুজাহিদের সূত্রে আমার নিকট পৌঁছেছে। তিনি বলেছেন সূরা ফাতহ এর নিম্নের আয়াতটি ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ, সালামা ইবন হিশাম, আইয়াশ ইবন রাবীয়া, আবু জান্দাল ইবন সুহাইল ও তাদের মত আর যারা ছিলেন তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে: ‘তোমাদেরকে যুদ্ধের আদেশ দেওয়া হতো, যদি ‍না এমন কিছু মুমিন নর ও নারী থাকতো, যাদেরকে তোমরা জাননা। তোমরা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পদদলিত করতে। ফলে, তাদের কারণে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে।’
(সূরা আল ফাতহ-২৫) (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩২১)।

সালামা ইবন হিশাম রা:

নাম সালামা, ডাক নাম আবু হাশেম। পিতা হিশাম ইবন মুগীরা এবং মাতা দাবায়া বিনতু আমের। ইসলামের ঘোরতর শত্রু আবু জাহলের ভাই।
ড: মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ সালামার মা দাবায়া বিনতু আমেরের জাহিলী জীবনের এক চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। হাইসাম ও ইবনুল কালবী বর্ণনা করেছেন: মুত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া ইবন আব্বাসকে বলেছেন: দাবায়া বিনতু আমের ছিলেন হাওজা ইবন আলীর স্ত্রী। হাওজা মারা গেলে দাবায়া উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেন। অত:পর তিনি পিতৃ গোত্রে ফিরে আসেন। সেখানে আবদুল্লাহ ইবন জুদয়ান আত তাইমী দাবায়ার পিতার নিকট তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। তার পিতা রাজী হন এবং আবদুল্লাহর সাথে তাকে বিয়ে দেন।
এদিকে দাবায়ার পিতা বলেন,আমি তো তাকে ইবন জুদয়ানের সাথে বিয়ে দিয়েছি। হুযন তখন শপথ করে বলে, দাবায়া যদি ইবন জুদয়ানের কাছে যায় তাহলে আমি তার স্বামীর সামনেই তাকে হত্যা করবো।
দাবায়ার পিতা ঘটনাটি ইবন জুদয়ানকে জানালেন। ইবন জুদয়ানও পাল্টা জানিয়ে দিলেন, যদি তিনি দাবায়ার চাচাতো ভাইয়ের দাবী অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে উকাজ মেলায় তার বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগের ঝান্ডা উত্তোলন করা হবে। দাবায়ার পিতা তার চাচাতো ভাইয়ের নিকট বিষয়টি বর্ণনা করলে সে নমনীয় হয়ে যায় এবং তার দাবী প্রত্যাহার করে নেয়। দাবায়াকে ইবন জুদয়ানের নিকট পাঠানো হলো। আল্লাহর মর্জি যতদিন ছিল, তিনি সেখানে থাকলেন। দাবায়া ছিলেন অতি সুন্দরী যুবতী। ইবন জুদয়ানের সাথে দাম্পত্য জীবন চলাকালে একদিন মক্কায় কাবার তাওয়াফ করছিলেন, এ সময় হিশাম ইবন মুগীরার নজরে পড়লেন। দাবায়ার রূপে হিশাম মুগ্ধ হলেন। কাবার চত্বরে তারা কিছুক্ষণ কথা বললেন, এক পর্যায়ে হিশাম বললেন: দাবায়া! এই রূপ ও যৌবন নিয়ে তুমি একজন বৃদ্ধের ঘর করছো? তার নিকট থেকে তালাক নিতে পারলে আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
ঘরে ফিরে দাবায়া স্বামী ইবন জুদয়ানকে বললেন: আমি একজন যুবতী নারী, আর তুমি এক বৃদ্ধ। ইবন জুদয়ান বললেন: এ কথা কেন? আমি জানতে পেরেছি, তাওয়াফের সময় হিশাম তোমার সাথে কথা বলেছে। তুমি হিশামকে বিয়ে করবে না- যতক্ষণ তুমি আমার কাছে এ অঙ্গীকার না করছো, আমি তোমাকে তালাক দিচ্ছি না। তোমাকে আরও অঙ্গীকার করতে হবে, যদি তাকে বিয়ে কর তাহলে তুমি আমার এই শর্তগুলি পূরণ করবে: ১. উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করবে, ২. এতগুলি উট কুরবানী করবে, ৩. এত পরিমাণ পশমের সূতা কাটবে।
দাবায়া এই শর্তের কথা হিশামকে ‍জানালেন। হিশাম বললেন: প্রথম শর্তটির ব্যাপারে আমি কুরাইশদের সাথে আলোচনা করে কাবার চত্বর সম্পূর্ণ ফাকা করে দেব। তুমি শেষ রাতে অন্ধকারে একাকী উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ সেরে নেবে। কেউ দেখার সুযোগ পাবে না। আর তোমার পক্ষ থেকে উট আমি কুরবানী করে দেব। আর সূতা কাটার ব্যাপারটি, তা এটা কোন ধর্ম নয়। কুরাইশরা এটা তৈরী করেছে। আমার প্রতিবেশী মহিলারা তোমার পক্ষ থেকে এ কাজটি করে দেবে। হিশামের প্রতিশ্রুতি পেয়ে দাবায়া স্বামী ইবন জুদয়ানকে বলেন, আমি তোমার শর্তে রাজী। হিশামকে বিয়ে করলে তোমার এ শর্ত সমূহ পূরণ করবো। এভাবে ইবন জুদয়ানের নিকট থেকে তালাক নিয়ে দাবায়া হিশামকে বিয়ে করেন। হিশাম কুরাইশদের সাথে কথা বলে কাবার চত্তর খালি করে দিলে দাবায়া উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করেন। কালবী বলেন: মুত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া বলেছেন: আমি তখন এক বালক। মসজিদের একটি দরযা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিলাম। দেখলাম, দাবায়া কাপড় খুলে ফেললো। এভাবে এক সপ্তাহ ধরে সে একটি শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে ‍তাওয়াফ করলো। অন্য শর্ত দুটিও হিশাম পূরণ করেন। এই হিশামের ঔরষে দাবায়ার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন সালামা ইবন হিশাম। উত্তরকালে এই সালামা হলেন পরীক্ষিত উত্তম মুসলমান। হিশামের সাথে দাম্পত্য জীবন চলাকালে দাবায়ার পূর্ব স্বামী আবদুল্লাহ ইবন জুদয়ান মারা যান। তার ‍মৃত্যুর খবর শুনে দাবায়া মন্তব্য করেন: তিনি ছিলেন একজন আরব রমণীর এক চমতকার স্বামী। এর কিছুদিন পর হিশাম মারা গেলে দাবায়া বিধবা হন।
পরবর্তীকালে দাবায়া ইসলাম গ্রহণ করেন। এদিকে পুত্র সালামাও বড় হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: সালামার নিকট তার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সালামা তার মায়ের সাথে পরামর্শ করে তার মধ্যে অনীহার ভাব লক্ষ্য করে রাসূল সা: কে জানান। রাসূল সা: ও প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। (ড. হামীদুল্লাহ সম্পাদিত আনসাবুল আশরাফ-১, টীকা নং-৩, পৃ. ৪৬০-৪৬১)।
মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই সালামা ইসলাম গ্রহণ করেন। হাবশায় হিজরাত করেন। কিছুদিন সেখানে থাকার পর আরও অনেক মুহাজিরদের সাথে তিনিও মক্কায় ফিরে আসেন। অনেকেই আবার হাবশায় ফিরে যান। সালামাও যেতে চান, কিন্তু আবু জাহল তাকে বাধা দেয়। তার উপর অত্যাচার শুরু হয়। তাকে অনাহারে রাখা হয় এবং মারপিটও চলতে থাকে। তবে তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তখন পর্যন্ত ইসলাম তেমন শক্তি অর্জন করতে পারেনি। রাসূল সা: ও কোন রকম সাহায্য করতে সক্ষম ছিলেন না। তবে নামাযের পর সালামা ও তার মত নির্যাতিতদের জন্য এই বলে দুআ করতেন: হে আল্লাহ, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ, সালামা ইবন হিশাম ও আয়্যাশ ইবন রাবীয়াকে মক্কার মুশরিকদের কঠোরতা থেকে মুক্তি দাও। ওয়ালীদের জীবনীতে সালামার মুক্তি ও মদীনা হিজরাতের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি মক্কায় কাফিরদের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় বদর যুদ্ধ শেষ হয়। বদর যুদ্ধের পর, মতান্তরে খন্দক যুদ্ধের পর তিনি মদীনায় আসেন। মদীনায় আসার পর সংঘটিত সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুতার যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে যারা ময়দান থেকে পালিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তিনিও একজন। এই লজ্জা ও অনুশোচনায় পরবর্তী জীবনে তিনি ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় ছেড়ে দেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামা থেকে ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন। তিনি সালামা ইবন হিশামের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, সালামার হয়েছে কি, আমি তাকে রাসূলুল্লাহ সা: ও মুসলমানদের সাথে নামাযের জামায়াতে শামিল হতে দেখিনে কেন? সালামার স্ত্রী বললেন: আল্লাহর কসম, তিনি বের হতেই পারেন না। বের হলেই মানুষ তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলতে থাকে-ইয়া ফুররার, ফারারতুম ফী সাবীলিল্লাহ, ওহে পলাতক, আল্লাহর রাস্তা থেকে তোমরা পালিয়েছো। এ কারণে তিনি বাড়ীতেই থাকেন, বাইরে কোথাও যান না। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৮২-৮৩)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে ‘কাররার’ বা প্রচণ্ড আক্রমণকারী বলে সম্বোধন করতেন। (আল ইসাবা-২/৬৯)।
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের রা: খিলাফতকালে তিনি শাম বা সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এই অভিযানের এক পর্যায়ে হযরত উমারের খিলাফতকালে হিজরী ১৪ সনের মুহাররম মাসে সংঘটিত ‘মারজে সফর’ বা ‘মারজে রোম’ নামক যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। তবে উরওয়া মূসা ইবন উকবা, আবু যারয়া আদ দিমাশকীর মতে তিনি আজনাদাইন যুদ্ধে শহীদ হন। (আল ইসাবা-২৬৯)।
সালামার মা দাবায়া একটি কবিতায় বলেছেন: হে সম্মানিত কাবার প্রভূ: কোন দুশ্চিন্তা নেই। সালামাকে প্রতিটি শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী কর। অনিশ্চিত কর্মকান্ডে তার দুটি হাত, যার একটি প্রকাশ পায় এবং অন্যটি দানশীল। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০৮)।

আমের ইবন রাবীয়া রা:

নাম আমের, কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ এবং পিতা রাবীয়া। তার খান্দান হযরত উমারের রা: পিতা খাত্তাব এর ‍হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ ছিল। খাত্তাব তাকে এত ভালোবাসতেন যে, তাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। এ কারণে প্রথম জীবনে আমের ইবনুল খাত্তাব (খাত্তাবের পুত্র আমের) নামে পরিচিত হন। কিন্তু কুরআন যখন প্রথা বাতিল করে প্রত্যেক মানুষকে তার জন্মদাতা পিতার নামে পরিচয় গ্রহণের নির্দেশ দেয়, তখন হযরত আমেরও খাত্তাবের পরিবর্তে নিজের জন্মদাতা পিতা রাবীয়ার নামে পরিচিত হন।
উল্লিখিত সম্পর্কের কারণে হযরত আমের ও হযরত উমারের মধ্যে শেষ জীবন পর্যন্ত অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। হযরত উমারের ‘বাইতুল মাকদাস’ সফরের সময় হযরত আমের তার সফরসঙ্গী ছিলেন। যে বছর হযরত উসমানকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে হযরত উমার হজ্জে যান, সঙ্গে আমেরও ছিলেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়ার পূর্বে ইসলামের সেই সূচনাপর্বে রাসূলুল্লাহর সা: আহবানে সাড়া দিয়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, হযরত আমের সেই সৌভাগ্যবানদেরই একজন। শিরক ও তাওহীদের সংঘাত সংঘর্ষ এবং কাফিরদের যুলুম নির্যাতনে তিনিও শান্তিতে মক্কায় বসবাস করতে পারেননি। তিনি স্ত্রী হযরত লায়লাকে সংগে করে শান্তিও নিরাপত্তার সন্ধানে দুইবার ‍হাবশায় হিজরাত করেন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেছেন: আমেরের স্ত্রী বলেন: আমরা হাবশায় হিজরাতের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমের কোন প্রয়োজনে বাড়ীর বাইরে যান। এমন সময় উমার আমার সামনে এসে দাড়ায়। তখনও সে শিরকের ওপর। আমরা তার হাতে নিগৃহীত হতাম। উমার আমাকে বললো: আবদুল্লাহর মা, এ কি! তোমাদের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি? বললাম: হাঁ, আমরা আল্লাহর এক যমীন হতে অন্য যমীনের দিকে যাব। তোমরা আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছ, আমাদের ওপর যুলুম করেছো। দেখা যাক, আল্লাহ কোন উপায় বের করে দেন কি না। উমার বললো: আল্লাহ তোমাদের দিনটি মঙ্গলময় করুন। আমেরের স্ত্রী বলেন: আমি সেদিন উমারকে এত নরম দেখলাম যা আর কখনও দেখিনি।উমার চলে গেল। আমাদের দেশত্যাগে সে অত্যন্ত কষ্ট পায়। আমের বাড়ী ফিরলে আমি তাকে বললাম: আবদুল্লাহর বাপ, এই মাত্র তুমি যদি উমারের বিষন্নতা ও আমাদের প্রতি তার দরদ দেখতে! আমের বললেন: তুমি তার ইসলাম গ্রহণের আশা করছো? বললাম: হাঁ। তিনি বললেন: খাত্তাবের গাধা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে, তবে তুমি যাকে দেখেছো সে ইসলাম গ্রহণ করবে না। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৫৬)।
হযরত আমের রা: হাবশা থেকে মক্কায় ফিরে এসে সস্ত্রীক আবার মদীনায় হিজরাত করেন। ইবন ইসহাক বলেন: মুহাজিরদের মধ্যে সাবু সালামার পর সর্বপ্রথম মদীনায় আসেন আমের ইবন রাবীয়া ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৬৩)। অনেকের মতে এটা সঠিক নয়। তার পূর্বে আরও কতিপয় ব্যক্তি মদীনায় পৌঁছেন। তবে এ কথা সত্য যে, তার স্ত্রী হযরত লায়লা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতকারী প্রথম মহিলা।
বদর, উহুদ, খন্দক সহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসুল সা: সংগে ছিলেন। তাছাড়া ছোট ছোট অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। জীবন বাজি রেখে আল্লাহর বাণী বা কালেমা প্রচারের দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করেন। স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইবন আমেরের কাছে প্রায়ই নিজের গৌরবজনক কর্মকান্ডের কথা গর্বের সাথে বর্ণনা করতেন। একবার কথা প্রসঙ্গে বলেন: রাসুল সা: আমাদেরকে অভিযানে পাঠাতেন। দারিদ্রের কারণে পাথেয় হিসেবে সামান্য কিছু খেজুর দিতেন। প্রথম প্রথম আমরা এক এক মুট করে পেতাম, ‍তারপর কমতে কমতে একটি মাত্র খেজুরে এসে ঠেকতো। হযরত আবদুল্লাহ বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করেন: একটা খেজুরে কিভাবে চলতো? জবাবে তিনি বললেন: প্রিয় বৎস! এমনটি বলো না। যখন খেজুর শেষ হয়ে যেত, তখন আমরা এই একটি খেজুরের জন্যও কাতর হয়ে পড়তাম।
হযরত উসমানের খিলাফতের শেষ দিকে যখন ফিতনা ও আত্মকলহ চরমরূপ ধারণ করে তখন হযরত আমের রা: নির্জন বাস গ্রহণ করেন। রাত দিন সব সময় রোযা, নামায ও ইবাদাতে মাশগুল থাকতেন। একদা গভীর রাত পর্যন্ত ইবাদাতে মগ্ন ছিলেন, এ অবস্থায় একটু তন্দ্রাভাব আসে। তিনি স্বপ্নে দেখেন, কেউ যেন তাকে বলছেন, ‘উঠো, আল্লাহর কাছে দুআ কর, তিনি যেন তোমাকে এই ফিতনা থেকে বাঁচান- যিনি তার অন্য নেক বান্দাদের রক্ষা করেছেন।’ হযরত আমের সংগে সংগে উঠে বসেন। এই ঘটনার পর তার নির্জনতা অবলম্বন ও ইবাদাতের মাত্রা আরও বেড়ে ‍যায়। এরপর থেকে কেউ আর তাকে ঘর থেকে বের হতে দেখেনি। এ অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হযরত উসমানের শাহাদাতের কয়েকদিন পর ইনতিকাল করেন। অতিরিক্ত নির্জনতা অবলম্বনের জন্য কেউ জানতে পারেনি তিনি কবে অসুস্থ হন এবং কবেই বা মৃত্যুবরণ করেন। হঠাত তার জানাযা দেখে লোকেরা অবাক হয়ে যায়।
মুসয়াব ইবন যুবাইর বলেন: আমের হিজরী ৩২ সনে মারা যান। আবু উবাইদার মতে তার মৃত্যুসন হিজরী ৩৭ হিজরী সন। ওয়াকিদী বলেন, হযরত উসমানের শাহাদাতের অল্প কিছুদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। (আল ইসাবা-২/ ২৪৯)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার, আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর, আবু উমামা ইবন সাহল প্রমূখের সূত্রে তিনি রাসূল সা: এর হাদীস বর্ণনা করেছেন যা বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
আমের ইবন রাবীয়া থেকে বর্ণিত। আরবের এক ব্যক্তি তার নিকট আসে। আমের তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন। লোকটি সে কথা রাসূল সা: এর কাছে বর্ণনা করে। সে আবার ফিরে এসে আমেরকে বলে, আমি রাসূল সা: এর কাছে এমন একটি উপত্যাকার মালিকানা চেয়েছি, যার থেকে উত্তম উপত্যকা আরবে দ্বিতীয়টি নেই। আমি ইচ্ছা করেছি তার কিছু অংশ আপনাকে দান করবো। যা আপনার ও আপনার পরবর্তী প্রজন্মের কাজে আসবে। আমের বললেন: তোমার ঐ জমির কোন প্রয়োজন আমার নেই। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে কুরআনের এ আয়াতটি নাযিল হয়: মানুষের হিসাব নিকাশ নিকটবর্তী হয়েছে অথচ এখনও তারা অমনোযোগী হয়ে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। (সূরা আল আম্বিয়া-১) আমের বলেন, এ আয়াত আমাদেরকে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ করে তোলে। (আল ইসাবা-২/২৫১-৫২)।

উসমান ইবন তালহা রা:

নাম উসমান, পিতার নাম তালহা ইবন আবী তালহা এবং মাতার নাম উম্মু সাঈদ সালামা। মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আমর শাখার সন্তান। জাহিলী যুগে পবিত্র কাবার হাজেব বা তত্ত্বাবধায়ক ও চাবির রক্ষক ছিলেন। ইসলামী যুগেও এ দায়িত্ব পালন করেন। (উসুদুল গাবা-৩/৩৭২)।
উসমান ইবন তালহার পিতা তালহা, তিন ভাই মুসাফি, কিলাব ও হারেস এবং তার চাচা উসমান ইবন আবী তালহা উহুদ যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। তার পিতা তালহা হযরত আলীর রা: সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আলী রা: তরবারির এক আঘাতে তাকে জাহান্নামে পৌঁছে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম ১ম খন্ড, টীকা নং-৩, পৃ. ৪৭০)।
উসমান ইবন তালহার ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কায় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার উতপীড়নে শরীক হতেন কি না সে সম্পর্কেও ইতিহাসে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। একটি ঘটনা জানা যায়, হযরত মুসয়াব ইবন উমাইর রা: মক্কায় দারুল আরকামে গোপনে ইসলাম গ্রহণের পর চুপে চুপে নামায আদায় করতেন। একদিন উসমান ইবনে তালহা তা দেখে ফেলেন এবং তার মা ও গোত্রের কানে পৌঁছে দেন। ফলে তারা মুসয়াবকে বন্দী করে তার ওপর নির্যাতন চালায়। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩০১)।
হযরত উম্মু সালামার রা: মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞরা উসমান ইবন তালহার নামটি বারবার উচ্চারণ করেছেন। ঘটনাটি সংক্ষেপে এই রকম: হযরত উম্মু সালামা সা: যখন মক্কার কুরাইশদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে স্বামী আবু সালামার রা: সাথে মিলিত হওয়ার জন্য একাকী মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে মক্কার অদূরে তানয়ীমে পৌঁছেন, তখন এই উসমান ইবন তালহা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন: আবু উমাইয়্যার মেয়ে, কোন দিকে যাবে? তিনি বললেন: মদীনায় স্বামীর কাছে। উসমান বললেন: তোমার সাথে আর কেউ নেই? উম্মু সালামা বললেন: আমার এই ছোট্ট শিশু সালামা বললেন, আমার এই ছোট্ট শিশু সালামা ছাড়া আর কেউ নেই। অত:পর উসমান উম্মু সালামার উটের রশি ধরে টেনে চলতে লাগলেন এবং মদীনার উপকন্ঠে কুবার বনী আমর ইবন আউফের পল্লীতে পৌছে উম্মু সালামাকে বললেন: আল্লাহর নামে প্রবেশ কর, তোমার স্বামী এখানে আছে। এ কথা বলে উসমান আবার মক্কার পথ ধরেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৯-৭০)
হযরত উম্মু সালামা রা: যখন মদীনায় হিজরত করেন, উসমান তখনও অমুসলিম।
উসমান ইবন তালহার ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। কোন মতে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়, কোন মতে হিজরী ৮ম সনে আবার কোন মতে মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, তিনি মক্কা বিজয়ের পূর্বে হিজরী অষ্টম সনে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও হযরত আমর ইবনুল আসের সাথে মদীনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন মনে মনে বললাম: রাসূল সা: এর কাছে যাব কার সাথে? বিষয়টি নিয়ে সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যার সাথে আলোচনা করলাম। সে আমার প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বললো, কেউ আমার সাথে না থাকলেও আমি কক্ষনও তার অনুসারী হবো না। এর আমি ইকরামা ইবন আবী জাহলের নিকট গিয়ে একই কথা বললাম। সেও সাফওয়ানের মত জবাব দিল। তারপর আমি উসমান ইবন তালহার সাথে দেখা করে বললাম: আমাদের অবস্থা তো এখন সেই খেকশিয়ালের মত যে একটি গর্তের মধ্যে আছে, আর সেই গর্তে পানি ঢালা হচ্ছে। এক সময় অবশ্যই তাকে বের হয়ে আসতে হবে। উসমান আমার কথা বুঝতে পেরে সায় দিল এবং আমার মত একই ইচ্ছা প্রকাশ করলো। আমি বললাম: আগামী কাল ভোরেই আমি মদীনার পথে রওয়ানা হচ্ছি। অত:পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল ভোরে আমরা পৃথকভাবে মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে ইয়াজুজ নামক স্থানে পৌঁছবো এবং সেখান থেকে এক সাথে যাত্রা করবো। কেউ আগে পৌঁছলে অন্যের জন্য অপেক্ষা করবো। প্রভাত হওয়ার পূর্বেই আমরা ‘ইয়াজুজ’ পৌঁছে যাত্রা শুরু করলাম। ‘হাদ্দা’ ‍নামক স্থানে পৌঁছে আমর ইবনুল আসের সাথে আমাদের দেখা হলো। আলাপ করে জানা গেল তিনিও একই উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। তারপর আমরা তিনজন এক সাথে মদীনায় পৌঁছে রাসূল সা: এর খিদমতে হাজির হই। প্রথমে আমি, তারপর উসমান ও আমর রাসূলুল্লাহর সা: হাতে বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ করি। সে ছিল অষ্টম হিজরীর সফর মাস। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬১-৬২, কবি আবদুল্লাহ ইবন যাবয়ারী তালহার ইসলাম গ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে সে সময় একটি কাসীদা রচনা করেছিলেন। তার কিছু অংশ হিবন হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে সংকলন করেছেন (সীরাত-২/২৭৮)। অন্য একটি বর্ণনামতে, উসমান হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং খালিদ ও আমরের সাথে মদীনায় যান। (আল ইসাবা-৩/৪৬০)। অপর দিকে মক্কা বিজয় সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা: এর নিকট থেকে উসমান কাবার চাবি লাভ করার পর সেই দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। এতে বাহ্যত: প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, মক্কা বিজয়ের পর একজন অমুসলিমের হাতে রাসূল সা: কাবার চাবি তুলে দিতে পারেন কি? চাবি দেওয়ার ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন হচ্ছে, মক্কা বিজয়ের পূর্বেও কাবার চাবি ছিল উসমানের নিকট। মক্কা বিজয়ের পূর্বে একজন মুসলমানের হাতে কাবার চাবি থাকবে, আর কুরাইশরা তা মেনে নেবে, এ কি সম্ভব? এ সব প্রশ্নের সমাধান এ ভাবে হতে পারে, তিনি খালিদ ও আমরের সাথে পূর্বেই মদীনায় গিয়ে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে মক্কায় চলে আসেন? কিন্তু মক্কার লোকেরা তা হয়তো জানতো না। (আসাহহুস সিয়ার-৩০৪-৩০৬)।
জাহিলী যুগ থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত কাবার তত্বাবধান ও চাবি রক্ষকের দায়িত্ব উসমানের ওপর ন্যাস্ত ছিলো। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত রাসূলে কারীম সা: কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য তার নিকট চাবি চাইলেন। তিনি বাড়ীতে গিয়ে তার মায়ের নিকট চাবি চাইলে তিনি দিতে অস্বীকার করেন। সম্ভবত: তখনও উসমানের মা ইসলাম গ্রহণ করেননি। উসমান কোষমুক্ত তরবারি উঁচু করে ধরে মাকে জবরদস্তি চাবি এনে নিয়ে হযরত রাসূলে কারীমের হাতে অর্পণ করেন। রাসূল সা: দরজা খুলে কাবার ভেতরে প্রবেশ করেন। উসমানও সংগে ছিলেন। দরযা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর কাবা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করার পর রাসূল সা: বের হয়ে আসেন। অত:পর রাসূল সা: মসজিদে বসলেন। আলী রা: কাবার চাবিটি হাতে নিয়ে এসে দাড়িয়ে আরজ করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, চাবিটি আমাদের দায়িত্বে অর্পণ করুন। সিকায়াহ ও হিজাবাহ (হাজীদের পানি পান ও কাবার রক্ষণাবেক্ষণ) উভয় দায়িত্ব এখন থেকে বনু হাশিমের হাতে দান করুন।
সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, সে দিন আববাস ইবনুল আব্দুল মুত্তালিব কাবার চাবিটি হস্তগত করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন এবং তাকে সমর্থন করেছিল বনু হাশিমের আরও কিছু লোক। সিকায়াহ বা পানি পান করানোর দায়িত্ব পূর্ব থেকেই আব্বাসের ওপর ন্যস্ত ছিল।
বনু হাশিমের এ দাবীর মুখে হযরত রাসূলে কারীম সা: বললেন: উসমান ইবন তালহা কোথায়? উসমানকে ডাকা হলে রাসূল সা: তার হাতে মতান্তরে উসমান ও তার চাচাতো ভাই শাইবার হাতে চাবিটি দিয়ে বললেন: এই তোমার চাবি। এখন থেকে এই চাবি চিরদিনের জন্য তোমাদের হাতে থাকবে। কেউ তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সে হবে অত্যাচারী। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৪১১-১২)
ইবন সাদ লিখেছেন: কাবার চাবি পূর্ব থেকেই উসমান ইবন তালহার দায়িত্বে ছিল। তিনি প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার কাবার দরজা খুলতেন। একবার রাসূল সা: তাকে ভিন্ন এক দিন দরযা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত শক্তভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাসূল সা: সেদিন বলেছিলেন, ওহে উসমান এমন একদিন আসবে যখন এ চাবি আমারই আয়ত্বে থাকবে এবং আমি যাকে ইচ্ছা তাকেই অর্পণ করবো। উসমান বলেছিলেন: সম্ভবত: সেদিন গোটা কুরাইশ বংশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। রাসূল সা: তার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেন: না, বরং সেই দিনটি হবে কুরাইশদের প্রকৃত ইযযত ও সম্মানের দিন। তাই মক্কা বিজয়ের দিন উসমান যখন রাসূলুল্লাহর সা: হাত থেকে চাবিটি নিয়ে চলে যাচিছলেন তখন তিনি উসমানকে পুনরায় ডেকে অতীতের সেই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। উসমান তখন বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল।
আজও কাবার চাবি মক্কার শাইবী গোত্রের লোকের হাতে বিদ্যমান। এই শাইবী গোত্র হযরত উসমান ইবন তালহার রা: চাচাতো ভাই শাইবা ইবন উসমান ইবন আবী তালহার বংশধর। এই শাইবা ইবন উসমান হুনাইন যুদ্ধের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। তার পিতা উসমান ইবন আবী তালহা উহুদ যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। আর তার মা উহুদ যুদেধ শাহাদত বরণকারী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুসআব ইবন উমাইরের বোন উম্মু জামীল হিন্দা বিনতু উমাইর। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর একটি বর্ণনা মতে হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা বিজয়ের দিন কাবার চাবিটি শাইবা ও উসমান উভয়ের হাতে এক সাথে অর্পণ করেন। চাবিটি তখন উসমান ইবন তালহা ইবন আবী তালহার হাতে থাকে। তার মৃত্যুর পর উসমানের চাচাতো ভাই শাইবা ইবন উসমান ইবন আবী তালহা গ্রহণ করেন। তখন থেকে তার অধ:স্তন পুরুষদের হাতে কাবার চাবি বিদ্যমান। (আসাহুস সিয়ার, পৃ. ৩০৫)।
মক্কা বিজয়ের পর হযরত উসমান ইবন তালহা মদীনায় চলে যান এবং রাসূল সা: এর জীবদ্দশা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। রাসূলুল্লাহর সা: ইনতিকালের পর কাবার চাবি রক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য্ আবার মক্কায় ফিরে যান এবং এখানে হিজরী ৪২ সনে ইনতিকাল করেন। অবশ্য অন্য একটি বর্ণনামতে তিনি খলীফা হযরত উমারের রা: খিলাফতকালের প্রথম দিকে আজনাদাইনের যুদেধ শাহাদত বরণ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১, টীকা-৩, পৃ. ৪৭০)।
হযরত উসমান ইবন তালহার শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও উন্নত নৈতিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় হযরত উম্মু সালামার হিজরাতের ঘটনার মধ্যে। হযরত উম্মু সালামা তার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, তার চেয়ে অধিকতর কোন ভদ্র লোক আমি আরবে আর কখনও দেখিনি। যখন তিনি আমাকে সংগে নিয়ে কোন মানযিলে পৌঁছতেন, আমার নামার জন্য উট বসিয়ে দূরে সরে যেতেন। আমি উটের হাওদা থেকে নেমে একটু দুরে সরে গেলে তিনি আবার ফিরে এসে উটটি গাছের সাথে বাধতেন এবং আমার নিকট থেকে একটু দূরে কোন গাছের তলায় ‍শুয়ে পড়তেন। আবার যাত্রার সময় হলে উট প্রস্তুত করে আমার কাছাকাছি নিয়ে এসে তিনি সরে যেতেন এবং বলতেন; উটে আরোহন কর। আমি উটের পিঠে ঠিকমত বসার পর তিনি ফিরে আসতেন এবং লাগামটি ধরে নিয়ে চলা শুরু করতেন। এভাবে তিনি আমাকে মদীনায় পৌঁছে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৬৯-৭০) (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৫৮-৩৫৯) এই ছিল হযরত উসমান ইবন তালহার রা: ইসলাম পূর্ব জীবনে নৈতিকতার বাস্তব রূপ।

হাজ্জাজ ইবন ইলাত রা:

নাম হাজ্জাজ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু কিলাব, মতান্তরে আবু মুহাম্মাদ ও আবু আবদুল্লাহ। পিতা ইলাত ইবন খালিদ। বনী সুলাইম গোত্রের সন্তান।
ইবন সাদ বলেন, রাসূল সা: যখন খাইবারে তখন তিনি তার খিদমতে ‍হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর মদীনায় বসতি স্থাপন করেন। ইবন শিহাব থেকে বর্ণিত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা: নবুওয়াত সত্য বলে স্বীকার করে তার কাছে লোক পাঠান। (আল ইসাবা-১/৩১৩)।
তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি চমকপ্রদ কাহিনী ইতিহাসে দেখা যায়। ইবন আব আদ দুনিয়া ‘হাওয়াতিফুল জিন’ গ্রন্থে এবং ইবন আসাকির ওয়াসিলা ইবনুল আসকা রা: থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: হাজ্জাজের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ছিল এমন। তিনি একটি কাফিলার সাথে মক্কায় যাচ্ছেন। একটি নির্জন ভীতিজনক উপত্যকায় রাত হলে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হাজ্জাজের সঙ্গী সাথীরা তাকে অনুরোধ করে বলে! আবু কিলাব, তুমিরাত জেগে বসে বসে তোমার নিজের ও সঙ্গীদের জন্য নিরাপত্তা ‍কামনা করতে থাক। হাজ্জাজ পাহারাদারীর দায়িত্ব নিয়ে জেগে জেগে নিম্নোক্ত কথাগুলি জপতে থাকেন:
উয়িজু নাফসী ওয়া উয়িজু সাহবী,
মিন কুল্লি জিন্নিয়্যিন বিহাজান নাকবি,
হাত্তা আউবা ‍সালেমান ওয়া রাকবী।
আমি আমার নিজের ও আমার সঙ্গীদের জন্য পানাহ চাই, এই গিরিপথের সকল জিন থেকে, যাতে আমি ও আমার কাফিলা নিরাপদে ফিরে যেতে পারি।
তিনি উপরোক্ত কথাগুলি জপছেন। এমন সময় অদৃশ্য থেকে কারও কন্ঠে কুরআনের নিম্নের ‍আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনতে পান:
ওহে জিন ও মানবজাতি! আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, অতিক্রম কর! কিন্তু তোমরা তা পারবে না শক্তি ছাড়া।- সূরা আর রাহমান-৩৩।
তারা মক্কায় পৌঁছে কুরাইশদের মজলিসে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। কুরাইশরা বলে: আবু কিলাব, তুমিও তো দেখছি বে দ্বীন হয়ে গিয়েছ। এতো সেই বানী যা মুহাম্মাদের ধারণা মতে তার ওপর নাযিল হয়। জবাবে হাজ্জাজ বলেন: আল্লাহর কসম, আমি ও আমার সঙ্গীরা এই বাণীই শুনতে পেয়েছি। তাদের এ আলোচনার মাঝখানে আসী ইবন ওয়ালিল উপস্থিত হয়। লোকেরা তাকে বলে: আবু হিশাম, এই আবু কিলাব কি বলছে, শুনেছ? বিষয়টি সে জানতে চাইলে লোকেরা তাকে অবহিত করে। সবকিছু শুনে সে বলে : এতে অবাক হওয়ার কি আছে? তারা যার কাছ থেকে শুনেছে, সেই মুহাম্মাদের ওপর ভর করে তার মুখ দিয়ে বলে থাকে। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৭৬-৭৭)।
হাজ্জাজের সহধর্মিণী তখনও মক্কায় বসবাস করেন। তার সকল সম্পদও সেখানে। ইসলাম গ্রহণের পর এসব সহায় সম্পদ মদীনায় সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যথায় তার ইসলাম গ্রহণের কথা কুরাইশরা জানতে পেলে সব হাতিয়ে নেবে। তার সম্পর্কে মক্কাবাসী পৌত্তলিকরাও সন্দিহান ছিল। তার অর্থ সম্পদ সহজে মক্কা থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভবও ছিল না। এ কারণে হাজ্জাজ মক্কা গিয়ে গুজব ছড়িয়ে দেন যে, খাইবারে মুহাম্মাদ সা: পরাজিত হয়েছে।
মুহুর্তের মধ্যে খবরটি সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। মক্কার মুশরিকদের এভাবে খুশী করে তিনি বললেন: মুহাম্মাদের সা: সকল আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে। আমার বাসনা, অন্য ব্যবসায়ীদের পৌঁছার পূর্বেই আমি সেগুলি খরিদ করি। মক্কার বিভিন্ন লোকের নিকট আমার বহু অর্থ কড়ি পাওনা আছে। তোমরা একটু চেষ্টা করলে সহজে আদায় হতে পারে। মক্কাবাসীরা এই ভাল কাজটির জন্য কোমর বেধে লেগে গেল। তারা চেষ্টা তদবীর করে তার পাওনা অর্থ আদায় করে দিল। রাসূল সা: এর সম্মানিত চাচা হযরত আব্বাস রা: তখন মক্কায়। তিনি নিজের বাড়ীতে বসে সব কিছু শুনছেন। তিনি এত ব্যাথা পেলেন যে, খবরের সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ঘর থেকেও বের হলেন না। তিনি একটি ছেলের মাধ্যমে হাজ্জাজকে ডেকে পাঠালেন। হাজ্জাজ গেলে এবং আব্বাসকে রা: আসল কথা খুলে বললেন। তিনি বললেন: আমার বকেয়া আদায়ের জন্য আমি এ কথা ছড়িয়েছি। আমি নিজেই ইসলাম গ্রহণ করেছি। মক্কাবাসীরা জানতে পেলে আমার প্রাপ্য এক কপর্দকও দেবে না। আল্লাহর ইচ্ছায় রাসুল সা: নিরাপদেই আছেন। খাইবারে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয়েছে এবং রাসূল সা: খাইবারের নেতা হুয়াই ইবন আখতারের কন্যাকে বিয়ে করে তার সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন। আমি কুরাইশদের ক্ষমতার আওতা থেকে বের হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত এই গোপন তথ্য কারও নিকট প্রকাশ করবেন না।
অঙ্গীকার অনুযায়ী হযরত আব্বাস রা: তিনদিন সম্পূর্ণ চুপ থাকলেন। চতুর্থ দিন যখন নিশ্চিত হলেন যে, হাজ্জাজ মক্কাবাসীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে, তখন তিনি পোশাক পাল্টে হাজ্জাজের বাড়ী গেলেন এবং তার স্ত্রীর নিকট আসল ঘটনা প্রকাশ করলেন। তারপর তিনি কাবার চত্বরে আসলেন। সেখানে আগে থেকে এই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। তিনি লোকদের বললেন: মুহাম্মাদ সা: খাইবার জয় করেছেন এবং হুয়াই ইবন আখতারের কন্যা এখন তার স্ত্রী। বনী আবী হাকীক তথা ইয়াসরিবের নেতৃবৃন্দের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজ্জাজ তোমাদের ধোকা দিয়ে তার অর্থ সম্পদ নিয়ে চম্পট দিয়েছে। লোকেরা প্রশ্ন করলো, আপনি কার কাছে এসব কথা শুনলেন? বললো: হাজ্জাজের কাছে। লোকেরা হাজ্জাজের স্ত্রীর নিকট জিজ্ঞেস করলে তিনিও সমর্থন করলেন। পঞ্চম দিনে মদীনা থেকেও খবর এসে গেল। কিন্তু এখন তাদের করণীয় কিছুই নেই। শিকার তাদের নাগালের বাইরে। তারা চুপ হয়ে গেল। (ইবন সাদ-৪/২, পৃ. ১৪-১৫)
খাইবার যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পূর্বে হাজ্জাজ ইসলাম গ্রহণ করেন। এ যুদ্ধেই তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগ দেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি মদীনার বাইরে ছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে মদীনায় ডেকে পাঠান। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ রা: এক হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে বনী সুলাইমের পথে মক্কায় প্রবেশ করেন। এই বাহিনীতে আব্বাস ইবন মিরদাস, খুফাফ ইবন নুদবাহ ও হাজ্জাজ ইবন ইলাত- এ তিনজন তিনটি পতাকা বহন করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৬৭)।
হাজ্জাজ ছিলেন ধনী ব্যক্তি। তিনি মক্কা থেকে তার সকল সম্পদ সরিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছিলেন। মদীনায় তিনি নিজের জন্য একটি বাড়ী ও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। (আল ইসাবা-৩২৭)
তার মৃত্যুকাল সম্পর্কে দুটি বর্ণনা আছে। একটি মতে তিনি হযরত উমার ফারুকের রা: খিলাফতকালের প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেন। আর অন্য একটি মতে তিনি হযরত আলী রা: ও আয়িশার মধ্যে সংঘটিত উটের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। প্রথম বর্ণনাটি অধিকতর নির্ভরযোগ্য। উটের যুদ্ধে হাজ্জাজ নন বরং তার ছেলে শহীদ হন।

কুদামাহ ইবন মাজউন রা:

নাম কুদামাহ, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু উমার। পিতা মাজউন ইবন হাবীব এবং মা সুখাইলা বিনতুল আনবাস। (টীকা : সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৫৩)।
কুরাইশ বংশের বনী জুমাহ শাখার সন্তান। হযরত উমারের বোন সাফিয়্যা বিনতুল খাত্তাব তার স্ত্রী।
হযরত কুদামাহ ইসলামের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের রা: আহবানে যে সকল ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন উসমান ইবন মাজউন ও তার অন্য দুই ভাই কুদামাহ ও আবদুল্লাহ অন্যতম। তিনি দুই হিজরাতের অধিকারী। ইসলাম গ্রহণের পর অন্য দুই ভায়ের সাথে প্রথমে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন। অত:পর মক্কাবাসীরা সকলে ইসলামের দীক্ষা নিয়েছে এমন একটি মিথ্যা গুজব শুনে অনেকে হাবশা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই প্রত্যাবর্তনকারীদের মধ্যে কুদামাহও ছিলেন। সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৬৭)।
হযরত কুদামাহ হাবশা থেকে ফিরে মক্কায় বসবাস করতে থাকেন। বদর যুদ্ধের পূর্বে আবার মদীনায় হিজরাত করেন এবং বদরে যোগদান করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তারপর উহুদ,খন্দক সহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
খলীফা হযরত উমার রা: কুদামাহকে বাহরাইনের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। এই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাকালেই তিন মদ পানের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং তার ওপর মদ পানের নির্ধারিত শাস্তি বা ‘হদ’ জারি করা হয়। তিনি হযরত উমারের ‍সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন নি এবং বদরী সাহাবী হিসাবে তার আত্মপক্ষ সমর্থন বিশ্বাসযোগ্য হলেও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে হযরত উমারের নিকট তার অপরাধ প্রমাণ হয়ে যায়। এ জন্য খলীফা তার ওপর ‘হদ’ জারী করেন। ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, একবার বনু আবদি কায়সের সরদার ‘জারুদ’ খলীফা উমারের নিকট উপস্থিত হয়ে কুদামাহর বিরুদ্ধে মদ পানের অভিযোগ দায়ের করেন। খলীফা জারুদকে বললেন, তুমি ছাড়া এ ঘটনার আর কোন স্বাক্ষী আছে কি? জারুদ হযরত আবু হুরাইরাকে রা: সাক্ষী মানলেন। উমার রা: আবু হুরাইরাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। আবু হুরাইরা বললেন, তিনি কুদামাহকে কখনও মদ পান করতে দেখেননি, তবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বমি করতে দেখেছেন। উমার রা: বললেন, শুধু এ সাক্ষ্যে অপরাধ প্রমাণ হয় না। আরও অনুসন্ধানের জন্য তিনি কুদামাহকে বাহরাইন থেকে মদীনায় ডেকে পাঠালেন। কুদামাহ মদীনায় পৌঁছলেন। জারুদ আবারও খলীফার নিকট তার ওপর ‘হদ’ জারী করার দাবী জানালো। উমার রা: তাকে বললেন তুমি সাক্ষী না বাদী? জারুদ বললো, সাক্ষী। খলীফা বললেন, তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করেছো, এখন চুপ থাক। অত:পর জারুদ আবারও খলীফার নিকট ‘হদ’ জারির ‍তাকিদ দিল। তার এই বাড়াবাড়ির ‍কারণে হযরত উমারের মনে সন্দেহ দেখা দিল। তিনি জারুদকে বললেন: তোমার জিহবা সংযত রাখ, অন্যথায় তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। প্রত্যুত্তরে জারুদ খলীফাকে বললো, উমার, আপনার চাচাতো ভাই মদ পান করেছে আর আপনি উল্টো আমাকে শাসাচ্ছেন- এ তো কোন ইনসাফের কথা নয়। এ পর্যায়ে হযরত আবু হুরাইরা রা: খলীফাকে বললেন, ইয়া আমীরুল মুমিনীন, আমাদের সাক্ষ্যের ব্যাপারে আপনি সংশয় পোষণ করলে কুদামাহর স্ত্রী তথা ওয়ালীদের মেয়ে হিন্দাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। উমার রা: তাকে ডেকে পাঠান। তিনিও স্বামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।
এবার উমারের রা: আদল ও ইনসাফ বা সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতা উথলে উঠলো। তিনি কুদামাহকে বললেন, কুদামাহ, শাস্তি গ্রহণের জন্য তৈরী হয়ে যাও। জবাবে কুদামাহ বললেন, তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী যদি ধরেও নেওয়া যায় আমি মদ পান করেছি, তবুও আমার ওপর ‘হদ’ জারী করার কোন অধিকার আপনার নেই। উমার রা: প্রশ্ন করলেন, কেন? কুদামাহ পবিত্র কুরআনের সূরা মায়িদাহর ১১ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করে শুনান। আল্লাহ বলছেন: যারা ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ বা সতকাজ করেছে, তারা যা খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন পাপ নেই। যখন তারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, ঈমান এনেছে এবং আমলে সালেহ করেছে। (সূরা মায়িদা-১১)।
উমার রা: বললেন, কুদামাহ তুমি আয়াতটির অর্থ বিকৃত করছো। তুমি আল্লাহকে ভয় করলে অবশ্যই হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকতে। হযরত কুদামাহ তখন অসুস্থ ছিলেন। এ কারণে খলীফা অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কিছুদিনের জন্য ‘হদ’ জারি বা শাস্তিদান মূলতবী রাখেন। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর ‘হদ’ মূলতবী রাখা উমারের জন্য ছিল অসহনীয়। তিনি দ্বিতীয়বার সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। এবারও সকলে ‘হদ’ মূলতবী রাখার পক্ষে মত ব্যক্ত করলেন। কিন্তু খলীফা উমার বললেন: আমি আল্লাহর সাথে মিলিত হই, আর তার বোঝা আমার কাঁধে চাপুক, এ অবস্থার চেয়ে সে চাবুকের নিচে মৃত্যুবরণ করুক- এটাই আমার অধিক কাম্য। তিনি আর দেরী করলেন না। কুদামাহর অসুস্থতার মধ্যেই তার ওপর হদ জারি করেন এবং তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
এ ঘটনার কিছুদিন পর দুজন আবার এক সাথে হজ্জ আদায় করেন। মদীনায় ফেরার পথে উমার রা: এক স্থানে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে কুদামাহর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নির্দেশ লাভ করেন। ঘুম থেকে জেগেই তিনি কুদামাহকে ডেকে পাঠান। কিন্তু কুদামাহ আসতে অস্বীকৃতি জানান। উমার রা: দ্বিতীয়বার লোক পাঠিয়ে বলেন, স্বেচ্ছায় না এলে জোর করে ধরে আনা হবে। কুদামাহ আসলেন। খলীফাই প্রথম আলোচনার সূচনা করলেন। অত:পর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর একমাত্র কুদামাহ ছাড়া আর কোন বদরী সাহাবী মদ পানের অভিযোগে সাজা প্রাপ্ত হননি। (আল ইসাবা-৩/২২৯)।
হযরত কুদামাহর রা: মৃত্যুসন সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। প্রসিদ্ধমতে তিনি হযরত আলীর রা: খিলাফতকালে হিজরী ৩৬ সনে ৬৮ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। অন্য একটি মতে তার মৃত্যুসন ৫৬ হিজরী।

হিশাম ইবনুল আস রা:

নাম হিশাম, কুনিয়াত বা ডাক নাম আবুল আস ও আবু মুতী। ইবন হিব্বান বলেন: জাহিলী যুগে হিশামের কুনিয়াত ছিল আবুল আস অর্থাত অবাধ্যের পিতা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা: তা পরিবর্তন করে রাখেন আবু মুতী- অনুগতের পিতা। (আল ইসাবা-২/৬০৪) তার পিতা আল আস ইবন ওয়ায়িল। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। মিসর বিজয়ী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আসের ছোট ভাই।
সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য বয়সের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে না। হিশাম আমর অপেক্ষা ছোট হলেও বড় ভাইয়ের চেয়ে অধিকতর সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। আমর যখন পৌত্তলিকতার অন্ধকারে হাবুডুব খাচ্ছেন, হিশামের ললাট তখন ইসলামের নূর ঝলক দিচেছ। মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি তা কবুল করেন এবং মক্কাবাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুহাজিরদের একটি কাফিলার সাথে হাবশায় চলে যান। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর এই মিথ্যা গুজব শুনেন যে, মক্কাবাসীরা ইসলাম কবুল করেছে, তখন অনেকের সাথে তিনিও মক্কায় ফিরে আসেন। এখান থেকে আবার মদীনায় হিজরাতের পরিকল্পনা করেন; কিন্তু তার পিতা ও খান্দানের লোকদের হাতে বন্দী হন।
এ সম্পর্কে উমার ইবনুল খাত্তাবের বর্ণনা বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে পাওয়া যায়। তিনি বলেন: ‘আমরা মদীনায় হিজরাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। আমি আইয়াশ ইবন রাবীয়া ও হিশাম ইবনুল আস- এ তিনজন মক্কা থেকে ছয় মাইল দূরে ‘তানদুব’ উপত্যকায় বনী গিফারের ‘উদাত’ নামক কূপের নিকট এই অঙ্গীকার করলাম আমাদের প্রত্যেকেই আগামীকাল সকালে এখানে উপস্থিত হবে। কেউ ব্যর্থ হলে অবশ্যই সে বন্দী হবে। আমি ও আইয়াশ সময়মত হাজির হলাম; কিন্তু হিশাম বন্দী হয়ে অত্যাচারিত হলো। আমরা মদীনায় পৌঁছে কুবার বনী আমর ইবন আওফের অতিথি হলাম। এদিকে আইয়াশকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবু জাহল ইবন হিশাম ও হারিস ইবন হিশাম মদীনায় এলো। তারা দুজন ছিল আইয়াশের চাচাতো ভাই এবং সকলেই একই মায়ের সন্তান। রাসূল সা: তখন মক্কায়। তারা আইয়াশকে বললো, তোমার মা শপথ করেছে, তোমাকে না দেখে চুলে চিরুণী দেবে না, রোদ থেকে ছায়াতেও যাবে না। তুমি ফিরে চল। আইয়াশের অন্তর মায়ের জন্য নরম হয়ে গেল।
উমার বলেন: আমি তাকে বারবার অনুরোধ করলাম তাদের সাথে ফিরে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইয়াশ তাদের সাথে মক্কার দিকে যাত্রা করলো। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা আইয়াশকে বেধে ফেলে এবং অত্যাচার করতে করতে মক্কায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে বন্দী করে রাখা হয়।
উমার বলেন, আমরা তখন মদীনায় বলাবলি করতাম যারা এভাবে নিজেদেরকে বিপদের সম্মুখীন করেছে আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন না। অত:পর রাসূল সা: মদীনায় আসলেন এবং কুরআনের এ আয়াত নাযিল হলো:
বল হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়োনা। আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
উমার বলে: আমি আয়াতটি লিখে গোপনে মক্কায় হিশামের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। হিশাম বলেন, আমি সে আয়াতটি মক্কার ‘যী-তুওয়া’ নামক স্থানে বসে পাঠ করতাম; কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। অবশেষে তা বুঝার তাওফীক দানের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলাম। তারপর আমি বুঝলাম এ ‍আয়াত আমাদের শানে নাযিল হয়েছে। অত:পর আমি মদীনায় রাসূল সা: এর নিকট পৌঁছলাম। (হায়াতুস সাহাবা-১/৩৪৫-৪৬) সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৭৪-৪৭৬) আল ইসাবা-৩/৬০৪)।
ইবন হিশাম বলেন: আমার বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, মদীনায় একদিন রাসূল সা: বললেন: আইয়াশ ইবন রাবীয়া ও হিশাম ইবনুল আসের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে কে আমাকে সাহায্য করতে পারে? ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাদের ব্যাপারে আমি ‍আপনাকে সাহায্য করবো। অত:পর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। গোপনে মক্কায় প্রবেশ করে তিনি এক মহিলাকে দেখলেন, খাবার নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন: আল্লাহর বান্দী, কোথায় যাচ্ছ? সে বললো: আমি যাচ্ছি এই দুই বন্দীর কাছে। অর্থাত আইয়াশ ও হিশামের কাছে। ওয়ালীদ মহিলাকে অনুসরণ করে বন্দীশালাটি চিনে নিলেন। তাদেরকে একটি ছাদবিহীন ঘরে বেধে রাখা হয়েছিল। তখন রাত হলো, ওয়ালীদ দেওয়াল টপকে তাদের কাছে পৌঁছে গেলেন এবং একটি পাথরের সাহায্যে তাদের বাধন কেটে দিলেন। তারপর তিন জন এক সাথে বেরিয়ে ওয়ালীদের উটে সওয়ার হয়ে মদীনায় পালিয়ে আসেন। তাদের একমাত্র বহান উটটি হোচট খেলে ওয়ালীদের একটি আংগুল আহত হয়ে রক্ত রঞ্জিত হয়। তিনি স্বীয় অঙ্গুলিকে উদ্দেশ্য করে এই শ্লোকটি আবৃত্তি করেন: ‘ হাল আনতি ইল্লা উসবুয়িন দামাইতি ওয়া ফী সাবীলিল্লাহি মা লাকীতি।
ওহে, তুমি একটি অঙ্গুলি ছাড়া আর তো কিছু নও, যা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। তোমার যা কিছু হয়েছে, তাতো আল্লাহর রাস্তায়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১ ৪৭৬)
বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধ মক্কায় হিশামের বন্দী দশায় শেষ হয়। খন্দক যুদ্ধের পর তিনি মদীনায় আসেন। খন্দকের পর কাফিরদের সাথে যতগুলি যুদ্ধ হয়েছে, সবগুলিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ওয়াকিদী বলেন, মক্কা বিজয়ের পূর্বে রমযান মাসে রাসুলুল্লাহ সা: হিশামকে এক অভিযানে পাঠান। (আল ইসাবা-৩/৬০৪)
সেনা পরিচালনা, বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন এসব ছিল হিশামের খান্দানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ পরিবারের সন্তানেরা তরবারির ছায়াতলেই বেড়ে ওঠতো। রাসূল সা: এর ওফাতের পর হযরত আবুবকরের খিলাফতকালে তার এ বৈশিষ্টের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় জানা যায় প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা: তাকে নুঈম ইবন আবদুল্লাহ ও অন্য কতিপয় ব্যক্তি সাথে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য তার দরবারে পাঠান। এ প্রসঙ্গে হিশাম বলেন: কয়েক ব্যক্তির সাথে আমাকে হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠানো হয়। আমরা ‘গুতা’ বা দিমাশকে পৌঁছে জাবালা ইবন আয়হাম আল গাসসানীর বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। আমাদের সাথে কথা বলার জন্য তিনি একজন দূত পাঠালেন। আমরা বললাম: আমাদেরকে সম্রাটের কাছে পাঠানো হয়েছে, আমরা কোন দূতের সাথে কথা বলবো না। অনুমতি দিলে আমরা তারই সাথে কথা বলবো। অবশেষে জাবালা আমাদেরকে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
জাবালা আমাদেরকে বললেন: আপনাদের বক্তব্য কী? হিশাম বলেন, আমি তার সামনে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরি। তখন তার ও সভাষদবৃন্দের পরিধানে ছিল কালো পোশাক। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের পরিধানে এ পোশাক কেন? তিনি বললেন: আমরা এ পোশাক পরেছি এবং শপথ করেছি, শাম থেকে তোমাদের তাড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এগুলি খুলবো না। আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আপনার এই সিংহাসন এবং আপনাদের সম্রাটের সাম্রাজ্য ইনশা আল্লাহ আমরা ছিনিয়ে নেব। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সা: এমনই ভবিষ্যত বাণী করেছেন। জাবালা বললেন: আপনারা নন; বরং তারাই এর উপযুক্ত যারা দিনে সিয়াম সাধনা করে এবং রাতে ইবাদাতে দন্ডায়মান থাকে। আপনাদের সিয়াম কেমন? আমি আমাদের সিয়ামের পরিচিতি তুলে ধরলাম। তখন জাবালার চেহারা কালো হয়ে গেল। অত:পর তিনি একজন দূত সহ আমাদেরকে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠিয়ে দিলেন।
হিশাম বলেন: আমরা দূতের সাথে চলতে লাগলাম। যখন আমরা নগরের নিকটবর্তী হলাম, আমাদের সাথের দূতটি বললো: আপনাদের এই সওয়ারী পশু সম্রাটের নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। ‍আপনারা চাইলে আমি আপনাদের জন্য তুর্কী ঘোড়া ও খচ্চরের ব্যবস্থা করতে পারবো। আমরা বললাম: আমাদের এই পশুর ওপর সওয়ার হওয়া ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় আমরা শহরে প্রবেশ করবো না। আমাদের অনমনীয়তার কথা সম্রাটকে জানানো হলে তিনি আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমরা তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে সম্রাটের কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম।
এভাবে হিশাম ইবনুল আস ও তার সঙ্গীরা যখন রাজ দরবারের বাইরে নিজ নিজ পশুর পিঠ থেকে নামছিলেন তখন সম্রাট তাদেরকে তাকিয়ে দেখছিলেন। তারা যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করছিলেন, বাতাসে আন্দোলিত খেজুর গাছের পাতার মত তারা কাঁপছিল। সম্রাট লোক মারফত তাদের জানিয়ে দেন যে, এভাবে জোরে জোরে দ্বীন প্রচারের অধিকার তাদের নেই। তারা সম্রাটের কাছে গেলেন।
সম্রাট সিংহাসনে এবং রোমান সমরবিশারদরা নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। সম্রাট হাসিমুখে তাদের বললেন: আপনারা নিজেদের মধ্যে যেভাবে সালাম ও সম্ভাষণ বিনিময় করেন, সেইভাবে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন না কেন? সম্রাটের পাশেই বসা ছিল একজন প্রাঞ্জল আরবী ভাষী। তারা বললেন: আমাদের সম্ভাষণ আপনার জন্য বৈধ নয়; আর আপনাদের সম্ভাষণও আমাদের মুখে উচ্চারণ আমাদের জন্য উচিত নয়। সম্রাট প্রশ্ন করলেন: আপনারা নিজেদের মধ্যে এবং আপনাদের বাদশাহকে কিভাবে সম্ভাষণ জানান? তারা বললেন: আসসালামু আলাইকা। সম্রাট আবার প্রশ্ন করেন: আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য কি? তারা বলেন: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুওয়া আল্লাহু আকবার- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অত:পর তারা সম্রাটের নিকট দ্বীন ইসলামের বিভিন্ন বিষয় যথা-সালাত, সাওম, হজ্জ,যাকাত ইত্যাদির পরিচয় তুলে ধরেন। এই প্রতিনিধি দল সম্রাটের অতিথি হিসাবে তিন দিন তার নিকট অবস্থান করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে এই দাওয়াতী মিশনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। (আল ইসাবা-২/ ৪৭১)। হায়াতুস সাহাবা-১/২০৪, ৪০৫, ৩/৫৫৭-৫৬২) অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবারে তাবলীগী মিশন নিয়ে যিনি গিয়েছিলেন তিনি এ হিশাম নন, তিনি অন্য আর এক হিশাম।(‍আল ইসাবা-৩/৭০৪)।
খলীফা হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে দু একটি সংঘর্ষের পর রোমানরা আজনাদাইনে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। হিজরী ১৩ সনের জুমাদা আল উলা মাসে সংঘর্ষ শুরু হয়। ওয়াকিদী উম্মু বকর বিনতুল মিসওয়ারের সূত্রে উল্লেখ করেছেন: এ যুদ্ধে হিশাম যখন কিছু মুসলিম সৈনিকের মধ্যে পলায়নী মনোবৃত্তি লক্ষ্য করলেন, স্বীয় মুখাবরণ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শত্রু ব্যুহের মাঝ বরাবর এগিয়ে গেলেন এবং চিতকার করে বলতে থাকলেন: ওহে মুসলিম সৈনিকবৃন্দ, আমি হিশাম ইবনুল আস। তোমরা আমার সাথে এসো। তোমরা জান্নাত থেকে পালাচ্ছ?
এই খতনাবিহীন লোকেরা তোমাদের তরবারির সামনে টিকে থাকতে পারে না। হিশামের সাথে যোগ দিয়ে মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। রোমান বাহিনী একটি সংকীর্ণ পথের মুখে জমা হয়। পথের বিপরীত দিক থেকে হিশাম আক্রমণ চালান। রোমানরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করে এবং তার লাশের ওপর দিয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম সৈন্যরা সেখানে পৌঁছে তার পেষা লাশটি পদদলিত হওয়ার ভয়ে শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করতে ইতস্তত: করতে লাগলো। তখন তার বড় ভাই আমর রা: এসে বললেন: ওহে লোক সকল, আল্লাহ তাকে শাহাদাত দান করেছেন, তার রুহটি উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তার দেহটি এখানে পড়ে আছে। অত:পর মুসলিম সৈন্যরা তার লাশের ওপর দিয়ে সংকীর্ণ পথটি অতিক্রম করে শত্রু বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। আমর ইবনুল আস রা: সেই ছড়ানো ছিটানো লাশ একত্রিত করে দাফন করেন। (আল ইসাবা-৩/৬০৪)।
তবে ইবনুল মোবারকের মতে তিনি খলীফা ‍উমারের যুগে ইয়ারমুক যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। (আল ইসতীয়াব, টীকা আল ইসাবা-৩/৫৯৩-৫৯৫)
হিশাম ইবনুল আস তার ভাই আমর ইবনুল আস অপেক্ষা বয়সে ছোট হলেও বড় ভাইয়ের চেয়ে বেশি নেককার ছিলেন। হিশামের শাহাদাতের পর একবার কতিপয় কুরাইশ ব্যক্তি খানায়ে কাবার পেছনে বসে তাদের দুই ভাইয়ের সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এমন সময় তারা আমরকে তাওয়াফরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাকে প্রশ্ন করলো: আপনাদের দুজনের মধ্যে কে উত্তম- আপনি না আপনার ভাই হিশাম? তিনি বললেন: আমার ও তার পক্ষ থেকে আমি বলছি। তার মা হাশেম ইবনুল মুগীরার মেয়ে, আর আমার মা একজন দাসী। আমাদের পিতা আমার চেয়ে ‍তাকে বেশী ভালোবাসতেন। আর প্রত্যেক পিতার তার সন্তানের ব্যাপারে দুরদৃষ্টির কথা তো তোমাদের জানা আছে। আমরা দুজন ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করেছি, সব সময় সে আমাকে পরাজিত করেছে। আমি ও সে দুজনেই যুদ্ধে যোগদান করি এবং সারারাত দুজনই শাহাদাত লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করি। আল্লাহ তার দুআ কবুল করলেন এবং ‍আমার দুআ ব্যর্থ হলো। (আল ইসাবা-১/৬০৪)
হযরত রাসূলে কারীম সা: তাদের দুই ভাইয়ের ঈমানী দৃঢ়তার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন: আসের দুই পুত্র হিশাম ও আমর মুমিন।।
হিশামের শাহাদতের খবর শুনে হযরত উমার ফারুক রা: মন্তব্য করেছিলেন: আল্লাহ তার ওপর রহমত নাযিল করুন। তিনি ইসলামের একজন উত্তম সেব ছিলেন।
যূ-শিমালাইন উমাইন ইবন আবদি আমর রা:।
আসল নাম উমাইর, ডাক নাম আবু মুহাম্মাদ, লকব বা উপাধি যূ -শিমালাইন। পিতার নাম আবদু আমর। খুযায়া গোত্রের সন্তান। তিনি সকল কাজ দু হাত দিয়ে করতেন বলে যূ -শিমালাইন দুখানি দক্ষিণ হস্তের অধিকারী তার উপাধিতে পরিণত হন। তার পিতা আবদু আমর ইবন নাদলা মক্কায় এসে আবদ ইবন হারেস ইবন নাদলা ইবন যাহবার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যান। আবদ নিজ কন্যা নুম বিনতু আবদকে তার সাথে বিয়ে দেন। তারই গর্ভে পুত্র যূ-শিমালাইন ও কন্যা রায়তা জন্ম গ্রহণ করেন। (তাবাকাত ইবন সাদ-৩/১৬৭)।
উল্লেখ্য যে, সীরাত গ্রন্থ সমূহে যূ-শিমালাইন অর্থাত দুখানি ডান হাতের অধিকারী এবং যুল ইয়াদাইন বা দুখানি হাতের অধিকারী এ দুটি লকব বা উপাধি বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদ্বয়ের কথা পাওয়া যায়। এ দুটি উপাধি কি একই ব্যক্তির না ভিন্ন দু ব্যক্তির এ সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতের অমিল দেখা যায়। অধিকাংশের মতে উপাধি দুটি একই ব্যক্তির যেমন: ইবন সা’দ তার তাবাকাতে শিরোনাম দিয়েছেন- যূল ইয়াদাইন ওয়া ইউকালু যূ আশ শিমালাইন অর্থাত যুল ইয়াদাইন এবং তাকেই যু আশ শিমালাইন বলা হয়। (তাবাকাত-৩/১৬৭)।
কিন্তু তাদের এ মত অনেকের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে মূলত: তারা ভিন্ন দু ব্যক্তি। হাদীদের দ্বারাও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যুল ইয়াদাইন নামক ব্যক্তির একটি ঘটনা বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুল সা: চার রাকয়াতের স্থলে দুই রাকয়াত নামায আদায় করে সালাম ফিরান। সাহাবীরা তো সবাই হতভম্ব। কিন্তু কেউ কোন প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না। যুল ইয়াদাইন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। তিনি জিজ্ঞেস করে বসলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! নামায কি কম করে দেওয়া হয়েছে না কি আপনি ভুল করেছেন? রাসুল সা: সাহাবীদের নিকট তার কথার সত্যতা যাচাই করলেন। সবাই যুল ইয়াদাইনকে সমর্থন করে বললেন: আপনি দুই রাকয়াতই আদায় করছেন। সত্যতা যাচাইর পর তিনি বাকী দু রাকায়াত আদায়ের শেষে সহু সিজদাহ করেন। (বুখারী: আযান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: ইমামের সন্দেহ হলে তিনি কি মুকতাদিদের কথা গ্রহণ করবেন?)
উপরোক্ত হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরাইরা রা:। তিনি হিজরী সপ্তম সনে খাইবার যুদ্ধের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। অন্যদিকে যু শিমালাইন তারপ পাঁচ বছর পূর্বে বদর যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। সুতরাং যুল ইয়াদাইনও যু শিমালাইন একই ব্যক্তি হতে পারেন না। তাছাড়া দুজনের নামেও পার্থক্য আছে। একজনের নাম খিরবাক ও অন্যজনের নাম উমাইর। (সিয়ারুস সাহাব, মুহাজিরিন-২/৩২৭)। আবু উমার বলেন: বদরে যূ শিমালাইন শহীদ হন তিনি যুল ইয়াদাইন নন। (আল ইসাবা-৩/৩৩)।
হযরত যু-শিমালাইন কখন এবং কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইসলাম গ্রহণের পর মদীনায় হিজরাত করে হযরত সাদ ইবন খাইসামার অতিথি হন। রাসূল সা: ইয়াযীদ ইবন ‍হারেসের সাথে তার মুওয়াখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্টা করে দেন। ইসলাম গ্রহণের পর খুব বেশি দিন তিনি বাঁচেননি। মদীনায় আসার পর তিনি ও তার দ্বীনি ভাই ইয়াযীদ মহান বদর যুদ্ধে যোগদান করেন। এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিনি কাফির আবু উসামা যুহাইর ইবন মুআবিয়া আল জুশামীর হাতে শহীদ হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ত্রিশ বছর। তার দ্বীনী ভাই ইয়াযীদ ও এ যুদ্ধে শহীদ হন। (তাবাকাত: ৩/১৬৮, আনসাবুল আশরাফ-১/২৯৫)।

মুআইকিব ইবন আবী ফাতিমা রা:

মুআইকিব ছিলেন দাওস গোত্রের সন্তান। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি দাসে পরিণত হয়ে মক্কার সাঈদ ইবনুল আসের নিকট উপনীত হন। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০০)।
অন্য একটি বর্ণনামতে তিনি আযদ গোত্রের সন্তান এবং মক্কার বনী আবদি শামসের হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশাগামী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। হাবশা থেকে খাইবার যুদ্ধের সময় মদীনায় আসেন। একটি বর্ননামতে তিনি আবু মূসা আশআরীর সাথে মক্কা থেকে মদীনায় আসেন এবং খাইবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় তার বদর যুদ্ধ ও বাইয়াতে রিদওয়ানে যোগদানের কথা পাওয়া যায় এই বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, তিনি খাইবার যুদ্ধের পূর্বে মদীনায় আসেন। তাদের মতে তিনি হাবশায় হিজরাত করেননি। তবে ওয়াকিদী বলেন: যারা বলে তিনি হাবশায় হিজরাত করেছিলেন, আমি তাদের কাছে শুনেছি, ‍মুআইকীব হাবশা থেকে জাফর ইবন আবী তালিবের সাথে সরাসরি মদীনায় চলে যান। (আনসাবুল আশরাফ-১/ ২০০)।
তবে এ কথা সঠিক যে তিনি খাইবার যুদ্ধের পর মদীনায় আসেন। বদর ও খাইবারে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ইবন সাদও তাকে ঐ সকল সাহাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন যারা সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করলেও বদরে যোগদানের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
হযরত রাসূলে কারীমের জীবদ্দশায় নবুওয়াতের ‘খাতাম’ বা মোহর তারই দায়িত্বে থাকতো। এ কারণে রাসূল সা: ওফাতের পর হযরত আবু বকর ও হযরত উমার রা: তাকে বিশেষ সম্মান দেখাতেন। উপরোক্ত দুজনের খিলাফতকালে অর্থ বিষয়ক সকল কর্মকান্ড দেখাশুনা ও বাইতুল মালের রক্ষকের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।
খলীফা হযরত উমার সা: তাকে খুব ভালোবাসতেন। শেষ বয়সে তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। খলীফা তার চিকিৎসার সব রকম চেষ্ঠা করেন। কোথাও কোন ভাল চিকিৎসকের সন্ধান পেলে তাদেরকে ডেকে তিনি তার চিকিৎসা করাতেন। কিন্তু কোন উপকার হয়নি। তবে ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা দূর হয়। মানুষ সাধারণত কুষ্ঠ রোগীদের সাথে ওঠা বসা ও পানাহার পরিহার করে চলে; কিন্তু হযরত উমার রা: তাকে সংগে নিয়ে একই দস্তরখানে খেতে বসতেন। একবার খলীফা উমার রা: ও তার সঙ্গীদের রাতের খাবার দেওয়া হলো। খলীফা ঘর থেকে বেরিয়ে মুআইকিব ইবন আবী ফাতিমাকে তাদের সাথে খাবারের জন্য ডাকলেন। উপস্থিত লোকেরা ভীত হয়ে পড়লো। উমার রা: মুআইকিবকে বললেন: তুমি আমার কাছে বস। আল্লাহর কসম, তোমার ছাড়া এ রোগ অন্য কারও হলে আমি তার সাথে এক থালায় খেতাম না। তুমি তোমার দিক থেকে খুশীম খাও। মুআইকিব তাদের সাথে বসে এক থালায় আহার করেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪৫৮)। অন্য একটি বর্ণনামতে উমার বলেন: সে যদি রাসূলুল্লাহর সাহাবী না হতো আমি তার সাথে খেতাম না। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০০)।
খলীফা হযরত উমারের রা: পর খলীফা হযরত উসমান রা: তার প্রতি একই রকম আচরণ করতে থাকেন। রাসূল সা: মোহর শেষ পর্যন্ত তারই জিম্মায় ছিল। এ মোহরটি তারই হাত থেকে ‘বীরে মাউনা’ বা মাউনা নামক কূপে পড়ে যায়। যে বছর মোহরটি পড়ে যায় সেই বছরের শেষ দিকে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। বালাজুরী বলেন: খলীফা উসমানের যুগে যে বছর আফ্রিকা অভিযান চালানো হয় সেই বছর তিনি ইনতিকাল করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/২০০)
ইতিহাসে মুহাম্মাদ ইবন মুয়াইকিব নামে তার এক পুত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি তার পিতা মুআইকিব থেকে হাদীসও বর্ণনা করেছেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি এমন কোন বিশেষ ব্যক্তি ছিলেন না। তবে লেখাপড়ায় তার দক্ষতা ছিল। হযরত উমার রা: যখন নিজের সম্পত্তি ওয়াক্বফ করেন তখন সেই ওয়াকফ নামাটি মুআইকিব রচনা করেন। রাসূলুল্লাহর সা: হাদীসেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। হাদীস গ্রন্থসমূহে তার থেকে বর্ণিত বেশ কিছু হাদীস পাওয়া যায়। তার মধ্যে দুটি মুত্তাফাক আলাইহি অর্থাত বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন এবং একটি ইমাম মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

আবান ইবন সাঈদ ইবনুল আস রা:

হযরত আবানের পিতার নাম আবু উহায়হা সাঈদ ইবনুল আস এবং মাতার নাম হিন্দা বিনতু মুগীরা। তার বংশের উপরের দিকের পঞ্চম পুরুষ আবদ মান্নাফে গিয়ে রাসূল সা: এর নসবের সাথে তার নসব মিলিত হয়েছে। (উসুদুল গাবা-১/৩৫)
তার পিতা সাঈদ ছিল কুরাইশদের এক মর্যাদাবান ব্যক্তি। সে হিজরী ২য় অথবা ৩য় সনে কাফির অবস্থায় তায়িফে মারা যায় এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪২.৩৬৮)।
তার কয়েকজন সুযোগ্য পুত্র ছিলেন। ইসলামের সূচনা পর্বেই তাদের মধ্যে খালিদ ও আমর ইসলাম গ্রহণ করে হাবশায় হিজরাত করেন। (আল ইসাবা-১/১৩)।
আবান তার অন্য দুই ভাই উবাইদা ও আল আসের সাথে পৌত্তলিক থেকে গেলেন। তার দুই ভাই খালিদ ও আমরের ইসলাম গ্রহণে দারুণ ব্যাথা পান। সে ব্যাথার প্রকাশ ঘটেছে তার রচিত একটি কাসীদায়। তার একটি শ্লোক নিম্নরূপ:
হায়! দ্বীনের ক্ষেত্রে আমর ও খালিদ যে মিথ্যারোপ করেছে, জারীবার মৃত লোকগুলি যদি তা দেখতো! (আল ইসাবা-১/১৩) (উসুদুল গাবা-১/৩৫)।
আবান তার অন্য দুই ভাইয়ের সাথে মিলে রাসূল সা: ও মুসলমানদের বিরোধিতা করতে থাকেন। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে লড়বার জন্য উবাইদা ও আল আসের সাথে মক্কা থেকে বের হলেন। উবাইদা ও আল আস মুসলমানদের হাতে শোচনীয় ভাবে নিহত হলো। আবান কোন রকমে প্রাণ নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন।
আবানের ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কিত একটি ঘটনার কথা ইবন হিশাম উল্লেখ করেছেন: ইসলাম পূর্ব যুগে রাসূল সা: তার কয়েকজন কন্যাকে মক্কার কুরাইশ যুবকদের সাথে বিয়ে দেন। কুরাইশদের সাথে রাসূল সা: সংঘাত শুরু হলে কুরাইশ নেতারা রাসূল সা: এর জামাতাদের নিকট তার কন্যাদের তালাক দেওয়ার আবেদন জানায়। রাসূল সা: এর কন্যা রুকাইয়া ছিলেন উতবা ইবন আবী লাহাবের স্ত্রী। কুরাইশরা উতবাকে বললো: তুমি মুহাম্মাদের কন্যাকে তালাক দাও। সে এই শর্তে রাজী হলো যে, যদি তারা আবান ইবন সাঈদের মেয়ে অথবা সাঈদ ইবন আসের মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দিতে পারে তাহলে সে রুকাইয়াকে তালাক দেবে। তারা উতবার দাবী মেনে নিয়ে সাঈদ ইবন আসের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে রুকাইয়াকে তার নিকট থেকে ছাড়িয়ে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-৬২৫)।
হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে হযরত রাসূলে কারীম সা: তার পয়গাম সহ হযরত উসমানকে রা: মক্কার কুরাইশদের নিকট পাঠালেন। উসমান রা: ‘বালদাহ’ উপত্যাকা দিয়ে মক্কার দিকে যাচ্ছেন। কুরাইশরা তাকে জিজ্ঞেস করলো: কোথায় যাও? উসমান তাদেরকে সেই কথাই বললেন যা তাকে রাসূল সা: বলে দিয়েছিলেন। এমন সময় আবান ইবন সাঈদ কুরাইশদের মধ্য থেকে এগিয়ে এসে উসমানকে স্বাগতম জানালেন। উসমানের সাথে তার আগে থেকেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। আবান নিজের ঘোড়াটিকে প্রস্তুত করে তার পিঠে উসমানকে উঠালেন এবং তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। অত:পর আবান উসমানকে মক্কায় নিয়ে আসেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৫৬)।
উসমান আবানের বাড়ীতে আসার পর আবান তাকে বলেন: আপনার পোশাকের এ অবস্থা কেন? উসমানের জামা ছিল হাঁটু ও গোঁড়ালির মাঝামাঝি পর্যন্ত। আবান আরও বলেন: আপনার কাওমের লোকদের মত জামা লম্বা করেন না কেন? উসমান বললেন: আমাদের নবী এভাবে জামা পরেন। আবান বলেন: আপনি কাবা ‍তাওয়াফ করুন। উসমান বললেন: আমাদের নবী কোন কাজ না করা পর্যন্ত আমরা তা করতে পারি না। আমরা শুধু তার পদাংক অনুসরণ করে থাকি। (হায়াতুস সাহাবা-২/৩৫৮-৫৯) আল ইসতীয়াব-৩৫, সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩১৫)।
আবান যদিও দীর্ঘকাল যাবত ইসলাম ও ইসলামের নবীর প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন, তবুও এ সময় সত্যের সন্ধান থেকে মোটেও বিরত থাকেননি। এ সময় তিনি বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট রাসূল সা: এর নবুওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। তখনকার দিনে শাম বা সিরিয়া ছিল জ্ঞানী-গুণী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কেন্দ্র। ব্যবসার কাজে আবানের সেখানে যাতায়াত ছিল। একবার তিনি সেখানকার এক খৃস্টান ‘রাহিব’কে কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমি হিজাযের কুরাইশ গোত্রের সন্তান। এই গোত্রের এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি বলে দাবী করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ আমাকেও ঈসা ও মূসার মত নবী করে পাঠিয়েছেন। রাহিব লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। আবান বললেন: লোকটির নাম মুহাম্মাদ। রাহিব আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী একজন নবীর আত্মপ্রকাশের বয়স, বংশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করলেন। তার বক্তব্য শুনে আবান বললেন: এগুলির সবই তো সেই লোকটির মধ্যে বিদ্যমান। রাহিব তখন বললেন: আল্লাহর কসম, তাহলে সেই ব্যক্তি সমগ্র আরবের ওপর আধিপত্য বিস্তারের পর সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করবেন। তুমি যখন ফিরে যাবে, আল্লাহর এই নেক বান্দার নিকট আমার সালাম পৌঁছে দেবে। শামের এই রাহিব বা পাদ্রীর নাম ‘ইয়াক্কা’। এবার যখন আবান শাম থেকে ফিরলেন তখন তার পূর্বের রূপ আর নেই। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতার শক্তি তার শেষ হয়ে গেছে। (উসুদুল গাবা-১/৩৫, আল ইসাবা-১/১৩)।
পিতৃ পুরুষের ধর্মের কথা চিন্তা করে এবং সমবয়সীদের নিন্দা ও বিদ্রুপের কথা ভেবে আবান কিছুদিন সম্পূর্ণ চুপ থাকলেন। কিন্তু সত্যের প্রতি যে আবেগ তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, তা তিনি দীর্ঘদিন দমন করে রাখতে সক্ষম হলেন না। এদিকে তার ভাই আমর ও খালিদ হাবশা থেকে ফিরে আবানের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। অত:পর তিনি খাইবার যুদ্ধের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরাত করেন। তারা তিন ভাই একত্রে রাসূল সা: এর সাথে খাইবার অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-১/১৩)।
অন্য একটি বর্ণনা মতে আবান মদীনায় পৌঁছার পর হযরত রাসূলে কারীম সা: একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর আমীর বানিয়ে তাকে নাজদের দিকে পাঠিয়ে দেন। এ অভিযানে সফল হয়ে যখন তিনি মদীনায় ফিরে আসেন তখন খাইবার বিজয় শেয় হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় হাবশার অন্যান্য মুহাজিরদের সংগে করে হযরত আবু হুরাইরা মদীনায় আসেন। তারা দুজন এক সাথে রাসূল সা: এর নিকট যান। রাসূল সা: খাইবারে গণীমতের মাল থেকে কিছু অংশ তাদেরকে দেন। নাজদ অভিযান ছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট অভিযানে ইমারাত বা নেতৃত্ব তিনি রাসূলুল্লাহর সা: নিকট থেকে লাভ করেন।
হযরত আবান হযরত রাসূলে কারীমের সা: সাথে তায়িফ অভিযানে অংশ গ্রহণ করেন। হযরত আবু সিদ্দীক রা: তায়িফে আবানের পিতার কবরটি দেখে বলে ওঠেন: এই কবরের অধিবাসীর প্রতি আল্লাহর লানাত বা অভিসম্পাত। সে ছিল আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী। আবান ও তার ভাই আমর সাথে সাথে আবু বকরের কথার প্রতিবাদ করে তার পিতা আবু কুহাফার কিছু নিন্দা করেন। তখন রাসূল সা: বললেন: তোমরা মৃতদের গালি দিওনা। মৃতদের গালি দিলে জীবিতদের কষ্ট দেওয়া হয়। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৪২, ৩৬৮)
হযরত রাসূলে কারীম সা: আবানকে হযরত আলা ইবনুল হাদরামীর স্থলে বাহরাইনের শাসক নিয়োগ করেন। রাসূল সা: এর ইনতিকাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। রাসূল সা: এর ওফাতের খবর শুনে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। (ইসতীয়াব-১/৩৫)।
হযরত আবান রাসূল সা: এর (সাকাতিব বা লেখকের দায়িত্বও পালন করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/৫৩২)।
রাসূল সা: ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর রা: খলীফা নির্বাচিত হলেন। তার হাতে গণ বাইয়াত শেষ হওয়ার পরও যে কজন কুরাইশ ব্যক্তি কিছুদিন যাবত বাইয়াত থেকে বিরত থাকেন, আবান তাদের একজন। বনী হাশেমের লোকেরা বাইয়াত গ্রহণ করলে তার আপত্তি দূর হয় এবং তিনি বাইয়াত করেন।
খলীফা হযরত আবু বকর রা: রাসূল সা: এর নিয়োগকৃত কোন শাসক বা কর্মচারীকে অপসারণ করেননি। আবানও ছিলেন রাসূল সা: কর্তৃক নিযুক্ত একজন শাসক। আবানকে তার দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার জন্য আবু বকর রা: অনুরোধ করেন। কিন্তু আবান খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কোন কোন বর্ণনায় জানা যায়, খলীফার বার বার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ইয়ামানের শাসনকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ইবন সাদ বর্ণনা করেন: আবান যখন খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তখন হযরত উমার রা: একদিন আবানকে বললেন: ইমাম বা নেতার অনুমতি ছাড়া এভাবে কর্মস্থল ত্যাগ করা তো তার উচিত হয়নি। এখন আবার তার নির্দেশে সেখানে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আবান বললেন: আল্লাহর কসম! রাসূল সা: এর পরে আমি আর কারও জন্য কাজ করবো না। যদি করতাম তাহলে আবু বকরের মর্যাদা, তার ইসলামে অগ্রগামিতা ইত্যাদি কারণে তার ‘আমেল’ বা কর্মচারী হতাম। অগত্যা আবু বকর রা: বাহরাইনে আর কাকে পাঠানো যায় সে বিষয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। উসমান সা: বসলেন: যেহেতু তার পূর্বে আলা ইবনুল হাদরামী সেখানে ছিলেন, তাই তাকেই সেখানো পাঠানো হোক। উমার বললেন: আবানকেই সেখানে আবার যেতে বাধ্য করা হোক। কিন্তু আবু বকর রা: তা করতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন; যে ব্যক্তি বলে আমি রাসূলুল্লাহর সা: পরে আর কারও কাজ করবো না তাকে আমি বাধ্য করতে পারিনে। অত:পর আলা ইবনুল হাদরামীকে বাহরাইনের শাসক নিয়োগ করেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৫৯)।
হযরত আবানের মৃত্যুর সময়কাল সম্পর্কে সীরাত বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানামত দেখা যায়। মূসা ইবন উকবা ও অধিকাংশ বংশবিদ্যা বিশারদদের মতে হযরত আবু বকরের খিলাফতকালের শেষ দিকে হিজরী ১৩ সনে আজনাদাইনের যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ইবন ইসহাকের মতে তিনি ইয়ারমুক যুদ্ধে এবং অন্য কিছু লোকের মতে ‘মারজুস সাফারের দিন শাহাদাত লাভ করেন। আবার অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, তিনি খলীফা উসমানের খিলাফতকালে হি: ২৭ সনে মারা যান এবং তারই তত্বাবধানে হযরত যায়িদ ইবন সাবিত মাসহাফে উসমানী সংকলন করেন। তবে প্রথমোক্ত মতটি সঠিক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আমর ইবন উমাইয়া রা:

নাম আমর কুনিয়াত বা ডাক নাম আবু উমাইয়া। পিতার নাম উমাইয়া। বনী কিনানা গোত্রের সন্তান। ইবন হিশাম তাকে রাসূলুল্লাহর সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির কাছাকাছি সময়ের জাহিলী আরবের একজন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরূপে উল্লেখ করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২০৪,২০৭)। তিনি বদর ও উহুদ যুদ্ধে মক্কার পৌত্তলিকদের পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। উহুদের পরই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় হিজরাত করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর সর্ব প্রথম বীরে মাউনা এর ঘটনায় অংশ গ্রহণ করেন। ঘটনাটি ছিল এই রকম: উহুদ যুদ্ধের পর চতুর্থ মাসে নাজদের বনী কিলাব গোত্রের সরদার আবু বারা আমের ইবন মালেক ইবন জাফর মুলায়িবুল আসিন্নাহ মদীনায় হযরত রাসূলে কারীমের সা: খিদমতে হাজির হয়। রাসূল সা: তার নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। সে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি না করে বললো: আপনি যদি ‍নাজদবাসী কিলাব গোত্রের নিকট আপনার কিছু সংগী পাঠাতেন তাহলে তারা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতো। রাসূল সা: বললেন: নাজদীদের ব্যাপারে আমার শংকা হয়। কিন্তু আবু বারা প্রেরিত দলটির নিরাপত্তা পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করায় রাসূল সা: মুনজির ইবন্ আমেরের নেতৃত্বে চল্লিশ মতান্তরে সত্তর জনের একটি দল পাঠিয়ে দেন। তারা ‘বীরেমাউনা’ নামক স্থানে পৌঁছে তাবু ফেলে অবস্থান করতে থাকেন এবং ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত রাসূল সা: এর পত্রটি হারাম ইবন মালজানের মাধ্যমে আমের ইবন তুফাইলের নিকট পৌঁছে দেন।
আমের ইবন তুফাইল দূত হারামকে হত্যা করে এবং আসিয়্যা, রা’ল, জাকওয়ান প্রভৃতি গোত্রে মুসলিম দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দ্রুত বেরিয়ে পড়ার ঘোষণা দেয়। তারা সমবেত হয়। এদিকে ‍হারামের ফিরতে দেরী দেখে মুসলমানরা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। কিছু দূর যেতেই তারা রা’ল,জাকওয়ান প্রভৃতি গোত্রের মুখোমুখি হয়। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মুসলিম দলটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে সকলকে হত্যা করে। একমাত্র আমর ইবন উমাইয়া প্রাণে রক্ষা পান। তিনি শত্রু বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তাকে আমের ইবন তুফাইলের সামনে আনা হলো। যখন সে জানতে পেল আমর ইবন উমাইয়া মুদার গোত্রের লোক তখন তাকে এই কথা বলে ছেড়ে দিল যে, আমার মার একটি দাস মুক্ত করার মান্নত ছিল। তবে অপমানের চিহ্ন সরূপ তার মাথার সামনের দিকের চুল কেটে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৮৪,১৮৫)।
এই বীরে মাউনার ঘটনায় প্রখ্যাত সাহাবী আমের ইবন ফুহাইরাও শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আমর ইবন উমাইয়াকে বন্দী করে যখন আমের ইবন তুফাইলের সামনে আনা হলো তখন সে আমের ইবন ফুহাইরার লাশের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল: এই লোকটি কে? আমর ইবন উমাইয়া বললেন: আমের ইবন ফুহাইরা। তখন আমের ইবন তুফাইল বলেছিল: আমি দেখলাম, সে নিহত হওয়ার পর তার লাশ শূন্যে আকাশের দিকে বহুদূর উঠে গেল, তারপর আবার তা নেমে এল। (হায়াতুসসাহাবা-৩/৫৯৫)
আমর ইবন উমাইয়া বীরে মাউনার শত্রুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে মদীনার দিকে চলার পথে যখন ‘কারকারা’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন বিপরীত দিক থেকে আগত দুজন লোকের সাথে তার দেখা হয়। তিনি যে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন লোক দুটিও সেখানে এসে বসলো। তাদের সাথে আলাপ পরিচয়ে আমর ইবন উমাইয়া যখন জানতে পেলেন তারা বনী আমের গোত্রের লোক তখন তিনি চুপ থাকলেন। তারা ঘুমিয়ে পড়লে আমর তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে দুজনকেই হত্যা করেন। তিনি মনে করেছিলেন, বনী আমের ‍রাসূল সা: এর সাহাবীদের সাথে যে আচরণ করেছে, এটা তার একটা বদলা হবে। আমর মদীনায় পৌঁছে রাসূল সা: এর নিকট ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি বলেছিলেন: আমর, তুমি এমনটি দুটি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছ যে, আমাকে অবশ্যই তাদের দিয়াত বা রক্তমূল্য আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার পূর্বেই বনী আমেরের সাথে রাসূল সা: এর চুক্তি হয়েছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/১৮৬) অত:পর রাসূল সা: তাদের দিয়াত আদায় করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৫৬৪)।
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে হযরত রাসূলে কারীম সা: আমর ইবন উমাইয়্যাকে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একটি পত্র সহকারে হাবশা যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই পত্রে রাসূল সা: নাজ্জাশীকে হাবশায় অবস্থিত মুহাজিরদের আতিথেয়তার সুপারিশ করেন্ এবং হযরত উম্মু হাবীবা বিনতু আবী ‍সুফিয়ান, যিনি তখনও পর্যন্ত হাবশার মুহাজিরদের সাথে সেখানে অবস্থান করছিলেন- তার সাথে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠান। উল্লেখ্য যে, উম্মু ‍হাবীবা ছিলেন উবাইদুল্লাহ ইবন ‍জাহাশের স্ত্রী। প্রথম ভাগে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করে স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে স্বামী উবাইদুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করে খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই দাওয়াতপত্র পেয়ে নাজ্জাশী হযরত জাফর ইবন আবী তালিবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হযরত রাসূলুল্লাহর সা: পত্রের জবাবে একটি পত্র লিখেন। এই পত্রে তার ইসলাম গ্রহণ, রাসূল সা:এর প্রতি সালাম, মুহাজিরদের প্রতি আতিথেয়তা ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ ছিল। রাসূল সা: পত্র অনুসারে তার পক্ষ থেকে নাজ্জাশী নিজেই উম্মু হাবীবাকে বিয়ের পয়গাম দেন। তিনি নিজেই রাসূলুল্লাহর উকিন হন এবং বিয়ের পর রাসূলুল্লাহর সা: পক্ষ থেকে চারশো দীনার মোহর আদায় করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২২৪, ৩২৪)। (হায়াতুস সাহাবা-১/ ১৫৮, ৩/৫৯৬-৯৭)।
এই আমর ইবন উমাইয়া যখন রাসূল সা: এর দূত হিসেবে নাজ্জাশীর নিকট পৌঁছেন তখন সেখানে তৎকালীন ইসলামের চরম দুশমন আমর ইবনুল আস ও উপস্থিত ছিল। সে আমর ইবন উমাইয়াকে তার হাতে অর্পণের জন্য নাজ্জাশীর নিকট আবদার জানায় যাতে সে তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারে এবং কুরাইশদের নিকট নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/২৭৬-৭৭)।
হাবশায় যে সকল মুহাজির অবস্থান করছিলেন, দুটো জাহাজে করে আমর ইবন উমাইয়া তাদেরকে নিয়ে খাইবার যুদ্ধের সময় মদীনায় পৌঁছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৫৯)।
হাবশার এই দৌত্যগিরি শেষে মদীনায় ফেরার পর আবু সুফইয়ানের এক এক দুষ্কর্মের প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার ওপর। ঘটনাটি এই : আবু সুফইয়ান রাসূল সা: কে হত্যার জন্য কিছু লোককে উতসাহিত করে। এক ব্যক্তি এই দায়িত্ব্ কাঁধে নেয় এবং আবু সুফইয়ান তাকে প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে। সে মদীনায় আসে এবং সরাসরি মসজিদে রাসূল সা: এর নিকট পৌঁছে। রাসূল সা: তার উদ্দেশ্য জেনে ফেলেন। তিনি লোকটিকে দেখিয়েবলেন, সে কোন ধান্ধায় এসেছে। লোকটি রাসূল সা: এর ওপর প্রায় আক্রমণ করতে বসেছিল, ঠিক সে সময় হঠাত হযরত উসাইদ ইবন হুদাইর রা: তাকে পাজা করে ধরে ফেলেন। লোকটির কাপড়ের নীচ থেকে একটি খঞ্জর বেরিয়ে পড়ে। অপরাধ প্রকাশ্য ছিল, কোন সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু রাহমাতুল লিল আলামীন তাকে মাফ করে দেন। সে আবু সুফইয়ানের পুরো ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়।
যেহেতু এই ঘটনার মূল নায়ক আবু সুফইয়ান এবং তারই জন্য মক্কার কুরাইশ ও মদীনাবাসীদের মধ্যে সর্বক্ষণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকে এ কারণে হযরত রাসূলে কারীম সা: আমর ইবন উমাইয়া ও সালামা ইবন আসলাম মতান্তরে জাব্বার ইবন সাখার আল আনসারীকে এক গোপন অভিযানে মক্কায় পাঠান। তিনি তাদেরকে নির্দেশ দেন, যদি সুযোগ হয় তাহলে এই অশান্তির মূলনায়ককে চির দিনের জন্য দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে।
আমর ও সালামা গোপনে মক্কায় পৌঁছলেন, কিন্তু মুআবিয়া কাবার তাওয়াফ করা অবস্থায় তাদেরকে দেখে ফেলেন। কুরাইশদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল। তারা বলাবলি করলো, তাদের আগমন নি:সন্দেহে বিনা কারণে নয়। নিশ্চয় তারা কিছু একটা অঘটন ঘটাবে। এদিকে আমর ও সালামা যখন দেখলেন, তাদের আগমনের বিষয়টি কুরাইশদের মধ্য জানাজানি হয়ে গেছে, তখন তারা মক্কার বাইরে চলে যান। পথে উবাইদুল্লাহ ইবন মালিক এবং বনী হুজাইলের এক ব্যক্তির সাক্ষাত পান। আমর উবাইদুল্লাহকে এবং সালামা দ্বিতীয় লোকটিকে হত্যা করেন।
এদিকে কুরাইশরা তাদের সন্ধানে মক্কার চারদিকে গোয়েন্দা ছড়িয়ে দেয়। আমরও সালামা এমন দুই গোয়েন্দার দেখা পেলেন। তারা গোয়েন্দা দুজনের একজনকে হত্যা করেন এবং অন্যজনকে বন্দী করে মদীনায় রাসূলুল্লাহর সা: নিকট নিয়ে আসেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/ ৬৩৩-৩৪)।
আহমাদ ও ‍তাবারানীর এক বর্ণনায় জানা যায়, খুবাইব বিন আদী মক্কার কাফিরদের হাতে শহীদ হন এবং তার লাশ একটি কাঠের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। হযরত রাসূলে কারীম সা: খুবাইবের লাশ আনার জন্য গোপন মিশন মক্কায় পাঠান। তিনি গোপনে মক্কায় পৌঁছে কাঠ বেয়ে উঠে রশি কেটে দেন এবং খুবাইবের লাশ মাটিতে পড়ে যায়। এমন সময় কুরাইশরা টের পেয়ে তাকে ধাওয়া করে এবং তিনি লাশ ফেলে পালিয়ে যান। অবশ্য অন্য বর্ণনায় জানা যায়, মিকদাদ ইবন আসওয়াদ ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম এ দায়িত্বে ‍নিয়োজিত হয়েছিলেন এবং তারাই এ অভিযান চালান। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৯৬,৯৭)।
হযরত রাসূলে কারীমের সা: ইনতিকালের পর হযরত আমর ইবন উমাইয়া দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তার পরবর্তী জীবনের বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হযরত আমীর মুআবিয়ার রা: শাসনকালে হিজরী ৬০ সনের পূর্বে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। হাদীসের গ্রন্থ সমূহে আমর ইবন উমাইয়া থেকে বর্ণিত বিশটি হাদীস পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ, জাফর, ফাদল, যাবারকান,শাবী, আবু সালামা ইবন আবদির রহমান,আবু কিলাবা, জুরমী এবং আবুল মুহাজির তার উল্লেখযোগ্য ছাত্র।
তিনি ছিলেন ততকালীন আরবের অন্যতম বীর ও সাহসী ব্যক্তি। এ কারণে রাসূল সা: দু:সাহসিক অভিযানগুলির দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করতেন। মৃত্যুকালে জাফর, আবদুল্লাহ ও ফাদল নামে তিন ছেলে রেখে যান।

মিসতাহ ইবন উসাসা রা:

প্রকৃত নাম আউফ, ডাক নাম আবু আব্বাদ, এবং লকব বা উপাধি মিসতাহ। পিতা উসাসা ইবন আব্বাদ এবং মা হযরত আবু বকরের খালা মতান্তরে খালাত বোন। মাতা পিতা দুজনেই ইসলামের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল ইসাবা-৩/৪০৮)
মিসতাহ ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সা: তার ও যায়েদ ইবন মুযায়্যিনের মধ্যে ভাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। তার হিজরাতের সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানা যায় না। তবে তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বেই হিজরাত করে মদীনায় চলে যান এবং বদর যুদ্ধে তার যোগদানের কথা ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থ সমূহে পাওয়া যায়। বনী মুসতালিক যুদ্ধে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে, ইফক, বা উম্মুল মুমিনীন আয়িশার রা: প্রতি অপবাদের ঘটনাটি ঘটে। মুনাফিকরা যখন অপবাদটি ছড়িয়ে দেয় তখন তাতে কিছু নিষ্ঠাবান মুমিন সাহাবীও জড়িয়ে পড়েন। মিসতাহ এই দলেরই একজন।
‘ওয়াকিয়া ই ইফক’ নামে প্রসিদ্ধ ঘটনাটির প্রতি পবিত্র কুরআনের সূরা নূর এর ১১ নং আয়াত সহ কয়েকটি আয়াতে ইংগিত করা হয়েছে। সংক্ষেপে ঘটনাটি এই: উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা: বনু মুসতালিকের যুদ্ধে (৬ হিজরী) রাসূলুল্লাহর সা: সংগে ছিলেন। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পথে তারা এক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। আয়িশা রা: শিবির হতে কিছু দূরে বাহ্যক্রিয়া সম্পাদনের জন্য যান। তখন তার গলার হারটি সেখানে পড়ে গেলে তিনি তা খুঁজতে থাকেন। এদিকে তার হাওদা পর্দায় ঘেরা থাকায় তিনি ভেতরে আছেন মনে করে কাফিলা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে যায়। পশ্চাতবর্তী রক্ষী সাফওয়ান রা: তাকে দেখতে পেয়ে নিজের উটের পিঠে উঠিয়ে নেন এবং উটের রশি ধরে পায়ে হেটে কাফিলার সাথে মিলিত হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক সরদার ‍আবদুল্লাহ ইবন উবাই নানা অপবাদ ছড়াতে থাকে। সূরা নূরের আয়াতগুলিতে আয়িশার রা: পবিত্রতার ঘোষণা করা হয় এবং অপবাদ রটনাকারীদের কঠোর শাস্তির কথা ব্যক্ত করা হয়।
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে মিসতা ঘটনাটি তার মায়ের কাছে বর্ণনা করেন। মিসতাহর মা আবার একদিন রাতে কোন কাজে আয়িশার রা: বাড়ীতে যান। আয়িশা তখন পিতৃগৃহে মায়ের কাছে। ততকালীন আবরে বাড়ীতে পেশাব পায়খানার স্থায়ী কোন জায়গা নির্দিষ্ট থাকতো না। মেয়েরা সাধারণত: রাতে বাড়ীর বাইরে মরু ভূমিতে গিয়ে বাহ্যক্রিয়া সম্পন্ন করতো। আয়িশা রা: মিসতার মাকে সংগে করে বাড়ীর বাইরে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করতে যান। পথে মিসতাহর মা নিজের আঁচলে জড়িয়ে হোঁচট খান। হোচট খাওয়ার পর আরবের প্রথা অনুযায়ী তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ‘মিসতাহর ধ্বংস হোক।’ এতে আয়িশা আপত্তি জানিয়ে বলেন, একজন মুহাজির মুসলমান, যিনি বদরে যুদ্ধ করেছেন তাকে এভাবে বদদুআ করছেন? মিসতাহর মা তখন বললেন: আবু বকরের মেয়ে, তুমি কি কিছু শোননি? তখন মিসতার মা তাকে পুরো ঘটনা বলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৯৯-৩০০) (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৮৭)।
দরিদ্র মিসতাহ ছিলেন হযরত আবু বকরের রা: খালাত ভাই। আবু বকর রা: সব সময় তার সাথে ভালো ব্যবহার ও আর্থিক সাহায্য করতেন। যখন তিনি ‘ইফক’ এর ঘটনার সাথে মিসতাহর জড়িত থাকার কথা জানতে পারলেন এবং কুরআন তাদের প্রচারণাকে মিথ্যা অপবাদ হিসেবে ঘোষণা করলো তখন আবু বকর মিসতাহকে সাহায্য দান বন্ধ করে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, এখন থেকে আমি মিসতাহর জন্য এক কপর্দকও ব্যয় করবো না। তখন সূরা নূরের নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়: ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয় ও স্বজন অভাবগ্রস্থকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহ ত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দেবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাওনা যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা নূর-২২)।
আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত আবু বকর রা: আবার আগের মত সাহায্য দিতে শুরু করেন। বুখারী ও মুসলিমে আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। (আল ইসাবা-৩/৪০৮)।
তবে যেহেতু একজন সতী সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপের ঘটনায় তিনি জড়িত হয়ে পড়েছিলেন এবং কুরআনও তাদের জন্য নিম্নোক্ত শাস্তির বিধান ঘোষণা করেছিল: যারা সতী সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি কশাঘাত করবে।’ (সূরা নূর-৪) এ কারণে অন্যদের সাথে তাকেও এ শাস্তি দান করা হয়। মিসতার সাথে আর যে কজন নিষ্ঠাবান বিখ্যাত ‍সাহাবী শাস্তি ভোগ করেন তারা হলেন- হযরত হাসসান বিন সাবিত ও উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের বোন হামনা বিনতু জাহাশ রা:। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩০২)। (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৯০)।
আমাদের স্মরণ রাখতেহবে, হযরত মিসতাহর রা: মত যে সকল নিষ্ঠাবান সাহাবী ‘ইফক’ এর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা নিতান্তই মুনাফিকদের প্রচারণার শিকার হয়েছিলেন। অন্যথায় হযরত মিসতাহর রা: মত ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এতে জড়িয়ে পড়তে পারেন না। তাছাড়া তারা তাওবাহ করেছেন এবং শাস্তিও মাথা পেতে নিয়েছেন। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা:, আবু বকর রা:, তথা গোটা মুসলিম উম্মাহ তাদের ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তাদের প্রতি কোন রকম বিদ্বেষ পোষণ করা ঈমানের পরিপন্থী কাজ হবে। হযরত মিসতাহর রা: সবচেয়ে বড় পরিচয় হযরত আয়িশার রা: মন্তব্যে ফুটে উঠেছে। তিনি প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী, গৃহত্যাগী মুহাজির এবং বদর যুদ্ধের একজন মুজাহিদ। আর এদের প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের কত আয়াতই না নাযিল হয়েছে।
হযরত মিসতাহ কখন ইনতিকাল করেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। একটি মতে হিজরী ৩৪ সনে হযরত উসমানের খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল করেন। অপর একটি মতে হিজরী ৩৭ সনে সিফফীনে হযরত আলী রা: এর পক্ষে যুদ্ধ করার পর সেই বছর মারা যান। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। (উসুদুল গাবা-৪/ ৩৫৫, আল ইসাবা-৩/৪০৮, তাবাকাত-৩/৫২)।

মারসাদ ইবন আবী মারসাদ আল গানাবী রা:

মারসাদের পিতার নাম আবু মারসাদ কান্নায ইবন হুসাইন। মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বেই পিতা পুত্র উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বদর যুদ্ধের পূর্বেই হিজরাত করে মদীনায় চলে যান। মারসাদ মক্কায় হামযা ইবন আবদিল মুত্তালিবের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন এবং মদীনায় হিজরাতের পর রাসূল সা: তাকে প্রখ্যাত আনসারী ‍সাহাবী উবাদা ইবন সামিতের ভাই আউস ইবন সামিতের সাথে মুওয়াখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। (তাবাকাত-৩/৪৮. আল ইসাবা-৩/৩৯৮)
হযরত মারসাদ ও পিতা আবু মারসাদ কান্নায বদর যুদ্ধের বীরযোদ্ধা। এ যুদ্ধে মারসাদ ‘সাবাল’ নামক একটি ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হয়ে রাসূলুল্লাহর সা: পাশপাশি অত্যন্ত বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। উহুদ যুদ্ধেও তিনি যোগদান করেন। (তাবাকাত-৩/৪৮, সীরাতু ইবন হিশাম-১/৬৬৬)।
জাহিলী যুগে মক্কার ‘ইনাক’ নাম্নী এক পতিতার সাথে মারসাদের সম্পর্ক ছিল। ইসলামে ব্যভিচার নিষিদ্ধ হওয়ার পর তিনি সেই পতিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সাহসী, সে জন্য যে সকল মুসলমান মক্কায় কাফিরদের হাতে বন্দী অবস্থায় নির্যাতন ভোগ করতো রাসূল সা: তাদেরকে মক্কা থেকে গোপনে মদীনায় নিয়ে আসার দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেন। এ উদ্দেশ্যে একবার তিনি মক্কায় যান। রাতটি ছিল চন্দ্রলোকিত। তিনি চুপিসারে মক্কার একটি গলি দিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় তার সেই পুরাতন প্রেয়সী ‘ইনাক’ তাকে দেখে ফেলে এবং ডাক দেয়। তিনি থেমে যান। সে অত্যন্ত মিষ্টি মধুর ভঙ্গিতে স্বাগতম জানায় এবং সেই রাতটি তার সাথে কাটাবার প্রলোভন দেয়। মারসাদ বলেন, ‘ইনাক, আল্লাহ এখন ব্যভিচার নিষিদ্ধ করেছেন। তার এমন নিরস উত্তরে ইনাক দারুণ চোট পায়। সে তখন প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মানুষকে মারসাদের আগমনের কথা জানিয়ে দেয়। আটজন লোক তাকে ধাওয়া করে। তিনি একটি নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে পড়েন। শত্রুরা তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেলে তিনি গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে সোজা মদীনার পথ ধরেন। মদীনায় পৌঁছে রাসুলুল্লাহর নিকট উপস্থিত হয়ে ‍আরজ করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইনাকের সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিন। রাসূল সা: কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। এর পরই সূরা নূরের এ আয়াতটি নাযিল হয়:
‘ ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যাভচারী নারী অথবা মুশরিক নারীকে বিয়ে করবে এবং ব্যভিচারী পুরুষ অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করবে। বিশ্বাসীদের জন্য এগুলি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। (সূরা নূর: ২)
উদাল ও কা-রা গোত্রের কতিপয় লোক উহুদ যুদ্ধের পর মদীনায় আসে। তারা রাসূলুল্লাহর সা: দরবারে হাজির হয়ে আরজ করে, আমাদের গোত্রের কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে, আপনি আমাদের সাথে এমন কিছু লোক পাঠান যারা তাদেরকে দ্বীন ও কুরআন শিক্ষা দিতে পারে। ইবন ইসহাকের বর্ণনা মতে, ‍নবী করীম সা: মারসাদ ইবন আবী মারসাদের রা: নেতৃত্বে ছয় ব্যক্তিকে পাঠান। তবে বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে আসিম ইবন সাবিতের নেতৃত্বে রাসূল সা: দশ ব্যক্তিকে পাঠান। তাদের মধ্যে মারসাদও একজন। দলটি যখন বনু হুজাইলের জলাশয় ‘রাজী’ নামক স্থানে পৌঁছে তখন উদাল ও কা-রার লোকগুলি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চিতকার শুরু করে দেয়। বনু হুজাইলের লোকেরা কোষমুক্ত তরবারি হাতে ছুটে এসে দলটিকে ঘিরে ফেলে। সাহাবায়ে কিরাম ঘোড়ার ওপর ‍সাওয়ার ছিলেন। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু বনু হুজাইল বললো: আমরা তোমাদের হত্যা করতে চাইনে। তোমাদের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের নিকট থেকে শুধু কিছু অর্থ আদায় করা আমাদের উদ্দেশ্যে। তোমরা নিজেরাই আমাদের কাছে চলে এস, আমরা অঙ্গিকার করছি।
মারসাদ, খালিদ ও আসিম বললেন, আমরা মুশরিকদের অঙ্গিকারে বিশ্বাস করি না। এ কথা বলে তারা যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। অন্য দিকে তাদের অপর তিন সাথী খুবাইব, যায়িদ ও আবদুল্লাহ ইবন তারিক একটু বিনয়ী ভাব দেখিয়ে তাদের হাতে ধরা দেন। যখন শত্রু পক্ষ তাদের হাত পা বাঁধতে শুরু করে তখন আবদুল্লাহ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এটা হলো তোমাদের প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা। তারা আবদুল্লাহকে ‘জাহরান’ নাম স্থানে পাথর মেরে শহীদ করে। অত:পর তারা খুবাইব ও যায়িদকে নিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়। কুরাইশদের হাতে বনু হুজাইলের দুই ব্যক্তি বন্দী ছিল। তারা এদের দুজনের বিনিময়ে তাদের দুজনকে ছাড়িয়ে নেয়। উকবা ইবন হারিস ইবন আমির তার পিতা হারিসের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য খুবাইবকে গ্রহণ করে। হযরত খুবাইব রা: বদর যুদ্ধে হারিসকে হত্যা করেন। অন্যদিকে সাফওয়ান ইবন উমাইয়া তার পিতা উমাইয়া ইবন খালাফের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যায়িদকে হাতে নেয়। এ ভাবে কুরাইশদের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হয়ে তারা দুজনই অত্যন্ত অসহায় ও নির্মম ভাবে মক্কায় শাহাদত বরণ করেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে ‘ওয়াকিতু ইউম আল রাজী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইবন সাদ বলেন, ‘রাজী’ এর এই ঘটনাটি ঘটে রাসূল ‍সা: এর মদীনায় হিজরাতের ছত্রিশ মাসের মাথায় সফর মাসে। (তাবাকাত-৩/৪৮)।
আসাহুস সীয়ার-১৬০), সীরাতু ইবন হিশাম-১৬৯-১৭৪)।
হযরত মারসাদ রা: এর যোগ্যতা ও মর্যাদার জন্য এই ঘটনাই যথেষ্ট যে, খোদ রাসূলে কারীম সা: তাকে দ্বীনের মুআল্লিম বা শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যেহেতু হযরত রাসূলে কারীমের সা: জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন সেহেতু তার ইলমী যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ হয়নি। তবুও হাদীসের গ্রন্থ সমূহ তার থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে একেবারে শূন্য নয়। আহমাদ ইবন সিনান আল কাত্তান তার মুসনাদে ইমাম বাগাবী ও হাকেম তাদের মুসতাদরিকে এবং তাবারানী তার ‘আওসাতে’ মারসাদ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল ইসাবা-৩/৩৯৮)।

আবু আহমাদ ইবন জাহাশ রা:

আসল নাম আবদ মতান্তরে আবদুল্লাহ, ডাকনাম আবু আহমাদ। পিতা জাহশ ইবন রিয়াব এবং মাতা উমাইমা বিনতু আবদিল মুত্তালিব। একদিকে রাসূলুল্লাহ সা: এর ফুফাতো ভাই, অন্যদিকে রাসুল সা: এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের আপন ভাই। (আনসাবুল আশরাফ-১/৮৮, আল ইসাবা-৪/৩)।
মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা: ইসলামী দাওয়াতের সূচনা পর্বে আহমাদ তার অন্য দুই ভাই- আবদুল্লাহ ও উবায়দুল্লাহর সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় রাসূলুল্লাহ সা: হযরত আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বেই তাদের ইসলাম গ্রহণের কাজটি সম্পন্ন হয়। বালাযুরী বলেছেন, তার অন্য দুই ভাই আবদুল্লাহ ও উবাদুল্লাহ হাবশায় হিজরাত করলেও তিনি হাবশায় হিজরাত করেননি। তিনি আরও বলেছেন, যে সব বর্ণনায় তার হাবশায় হিজরাতের কথা পাওয়া যায় তা সবই ভিত্তিহীন। (আনসাবুল আশরাফ-১/১৯৯)।
ইবন ইসহাক আবু আহমাদের পরিচয় ও মদীনায় হিজরাত সম্পর্কে বলেন: আবু সালামার পর সর্ব প্রথম যারা মদীনায় আসেন, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজ পরিবার এবং অন্য এক ভাই- আবু আহমাদকেও সংগে নিয়ে আসেন। এই আবু আহমাদ এক অন্ধ ব্যক্তি। তিনি মক্কার উঁচু নীচু ভূমিতে কারও সাহায্য ছাড়া ঘুরে বেড়াতেন। আবু সুফইয়ানের কন্যা ‘ফারয়া’ তার স্ত্রী। আর তার মা আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা উমাইমা।
তারা ঘর বাড়ী ছেড়ে মদীনায় চলে এলে একদিন ‍উতবা ইবন রাবীয়া, আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিব ও আবু জাহল ইবন হিশাম তাদের পরিত্যক্ত বাড়ীর পাশ দিয়ে মক্কার উঁচু ভূমির দিকে যাচ্ছিল। উতবা খালি বাড়ীটির দিকে ইঙ্গিত করে কবি আবু দুওয়াদ আল ইয়াদীর একটি কবিতার শ্লোক আওড়িয়ে আফসুসের সুরে বলে: বনী জাহাশের বাড়িটি একেবারেই খালি হয়ে গেল। আবু জাহল তার জবাবে বললো: এতো আমাদের ভায়ের ছেলের কাজেরই পরিণাম। সে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে, আমাদের সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে আমাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।...। মদীনায় কুবার বনী আমর ইবন আওফের পল্লীতে আবু সালামা ইবন আবদিল আসাদ, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ ও আবু আহমাদ বসবাস করতেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৭০-৪৭২)।
মদীনায় পৌঁছে প্রথমত: তিনি হযরত মুবাশশির ইবন আবদিল মুনজিরের অতিথি হন। মক্কায় একদল লোকের সার্বক্ষণিক কাজ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানো এবং মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া। এই দলটির প্রধান ছিল দুই ব্যক্তি: আবু সুফইয়ান ও আবু জাহল। আবু আহমাদ আগে ভাগে হিজরাত করে তাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সরাসরি তাদের অত্যাচার থেকে বেঁচে যান। তবে আবু সুফইয়ান তাদের পরিত্যক্ত বাড়ীটি অন্যায়ভাবে আমর ইবন আলাকামার নিকট বিক্রি করে দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৯৯)
সম্ভবত আবু সুফইয়ানের মেয়ে ‘ফারয়া’ ছিল এই বাড়ীর পুত্রবধূ, সেই অধিকারে সে বাড়িটি বিক্রি করে। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৫০০)। হিজরী ৮ম সনে মক্কা বিজয়ের পর আবু আহমাদ তাদের বাড়ীর প্রসঙ্গটি রাসূল সা: এর নিকট উত্থাপন করেন। লোকেরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে: আবু আহমাদ, আল্লাহর পথে যা তোমরা হারিয়েছ, এখন ‍তা আবার দাবী কর- রাসূল সা: পছন্দ করেননা। অন্য একটি বর্ণনা মতে আবু আহমাদের দাবীর পর হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত উসমানের রা: মাধ্যমে তাকে কিছু বলে পাঠান। হযরত উসমান রা: সে কথা তাকে কানে কানে বলেন। তারপর মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বাড়ী সম্পর্কে আর একটি কথাও তিনি উচ্চারণ করেননি। পরে তার সন্তানদের কাছে জানা গেছে হযরত রাসূলে কারীম সা: তাকে বাড়ীর দাবী ত্যাগ করতে বলেন এবং বিনিময়ে তাকে জান্নাতে একটি প্রাসাদের সুসংবাদ দান করেন।
তবে তিনি আবু সুফইয়ানের উদ্দেশ্যে একটি জ্বালাময়ী কবিতা রচনা করেন। তার কয়েকটি পংক্তি নিম্নরূপ: তোমরা আবু সুফইয়ানকে বলে দাও, সে যা করেছে তার পরিণাম লজ্জা ও অনুশোচনা। তুমি চাচতো ভাইদের বাড়ী বিক্রি করে নিজের ঋণ পরিশোধ করেছ।
মানুষের রব আল্লাহর নামে আমি শক্ত কসম করেছি। যাও, নিয়ে যাও, যা, আমি সেই অর্থ তোমার গলায় কবুতরের গলার মালার মতো মালা বানিয়ে দিলাম, (যা আর কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না বা বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না)। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/ ৬৪৪)।
রাসূল সা: আযাদকৃত দাস যায়িদ ইবন হারিসার সাথে হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশের বিবাহ বিচ্ছেদ হলে আবু আহমাদই তাকে রাসূল সা: এর সাথে বিয়ে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৬৪৪) হযরত আবু আহমাদ মদীনায় ইনতিকাল করেন। (আনসাবুল আশরাফ-১/ ১৯৯)।
তবে তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ আছে। ইবনুল আসীর দৃঢ়ভাবে বলেছেন: তিনি বোন যয়নাব বিনতু জাহাশের পরে মারা গেছেন। অর্থাত হিজরী ২০ সনের পরে। কারণ হযরত যয়নাব মারা যান হি: ২০ সনে। ইবন ‍হাজার এ মত সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, এমন বর্ণনাও তো আছে যে, আবু আহমাদের মৃত্যুর পর তার বোন যয়নাব কিছু খোশবু আনিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেন। বুখারী ও মুসলিমে যয়নাব বিনতু উম্মু সালামা থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন: আমি যয়নাব বিনতু জাহাশের এক ভায়ের মৃত্যুর সময় যয়নাবের ঘরে যাই। তিনি কিছু খোশবু আনিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেন। ইবন হাজার বলেন, ‍এটা আবু আহমাদের মৃত্যুর সময়ের ঘটনা হবে। কারণ যয়নাবের অন্য দুই ভাই আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর সা: জীবদ্দশায় উহুদে শহীদ হন এবং উবায়দুল্লাহ মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী অবস্থায় হাবশায় মৃত্যুবরণ করে। তার স্ত্রী উম্মু হাবীবাকে রাসূল সা: বিয়ে করেন। (আল ইসাবা-৪/৪)।

আমর ইবন সাঈদ ইবনুল আস রা:

আমরের ডাক নাম আবু উকবা। পিতা সাঈদ ইবনুল আস। কুরাইশ বংশের উমাইয়া শাখার সন্তান। মা বনী মাখযুমের কন্যা। আমর হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের ফুফাতো ভাই। (উসুদুল গাবা-৪/১০৬)। (আল ইসাবা-২/৫৩৯)।
সাঈদ ইবনুল আসের ৫ ছেলে- খালিদ, আবান, সাঈদ, আবদুল্লাহ, ও আমর। আগে পরে তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। যুবাইর ইবন বাককার বলেন: সাঈদ ইবনুল আসের ছেলে আবু উহায়হা সাঈদ ইবন সাঈদ তায়িফ অবরোধের সময় শাহাদাত বরণ করেন। আবদুল্লাহ ইবন সাঈদের পূর্ব নাম ছিল হাকাম। রাসূল সা: তা পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ রাখেন। আমর ইবন ‍সাঈদ আজনাদাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। খালিদ অত:পর আমর ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবন ইসহাক বলেন, আমরের কোন সন্তানাদি ছিল না। সাঈদ ইবনুল আসের অন্য ছেলে আবান সব শেষে শেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। ভাইদের বিশেষত: খালিদ ও আমরের ইসলাম গ্রহণে আবান দারুন ক্ষুব্দ হন। খালিদ, আমর ও আবান তিনজনই কবি ছিলেন। আবার তার দুই ভাই খালিদ ও আমর ইসলাম গ্রহণ করার পর তিরষ্কার করে একটি কবিতা লিখেন। খালিদ ও আমর কবিতায় তার জবাবও দেন। আল ইসাবা, সীরাতু ইবন হিশাম, উসুদুল গাবা প্রভৃতি গ্রন্থে সেই কবিতার কিছু অংশ সংকলিত হয়েছে। আবান তার ভাইদের তিরষ্কার করে যে কবিতাটি রচনা করেন তার একটি পংক্তি এই রকম: ‘হায়! আমর ও খালিদ দ্বীনের (ধর্ম) ব্যাপারে যে কেমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে তা যদি ‘জাবীরা’র মৃত ব্যক্তি দেখতো!
তাদের পিতা সাঈদ ইবনুল আস ‘জাবীরা’ নামক স্থানে সমাহিত ছিল। এখানে সেই দিকেই ইংগিত করা হয়েছে। আমর কবিতায় জবাব দেন। তার একটি পংক্তি এমন: এখন ঐ মৃতদের কথা ছেড়ে দাও, যারা তাদের পথে চলে গেছেন। এখন সেই সত্যের দিকে এস যার সত্য হওয়াটা একেই সুস্পষ্ট। (আল ইসাবা-২/৫৩৯)। সীরাতু ইবন হিশাম-২/৩৬০)।
খালিদ ইবন সাঈদের হাবশায় হিজরাতের দুই বছর পর হাবশাগামী দ্বিতীয় দলটির সাথে আমর ইবন সাঈদ স্ত্রী ফাতিমা বিনতু সাফওয়ান সহ হাবশায় হিজরাত করেন। ফাতিমা বিনতু সাফওয়ান হাবশায় ইনতিকাল করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/ ৩৬০)। আর আমর হাবশা থেকে মুসলিম কাফিলার সাথে জাহাজ যোগে খাইবার যুদ্ধের সময় মদীনায় পৌঁছেন। মদীনায় আসার পর মক্কা বিজয় সহ হুনাইন, তায়িফ, তাবুক, প্রভৃতি অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর সা: সাথে যোগ দেন।
হযরত রাসূলে কারীম সা: সাঈদের তিন ছেলে আবান, খালিদ ও আমরকে তিন অঞ্চলের শাসক নিয়োগ করেন। খালিদ ইয়ামন, আবান বাহরাইন এবং আমর মদীনার পশ্চিম অঞ্চল তথা তাবুক, খাইবার, ফিদাক ইত্যাদির শাসক ছিলেন। তারা সকলে রাসূলুল্লাহর সা: ইনতিকাল পর্যন্ত অতি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: এর ওফাতের পর তারা মদীনায় চলে আসেন। হযরত আবু বকর রা: খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সকলকে তাদের পূর্ব পদে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন: শাসন কাজ পরিচালনার জন্য আপনাদের থেকে অধিকতর হকদার ব্যক্তি আমি আর কাউকে দেখি না। (আল ইসাবা-২/৫৩৯)।
কিন্তু সাঈদ ইবনুল আসের ছেলেরা খলীফার এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে: আমরা রাসূল সা: এর পরে আর কারও আমিন বা শাসক হব না।
হযরত আবু বকর খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর সিরিয়ায় রোমানদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিশিষ্ট সাহাবীদের একটি বৈঠকে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও মতামত গ্রহণ করা হয়। একে একে সবাই মত প্রকাশ করছেন, আবার অনেকে নীরব রয়েছেন। এক সময় হযরত উমার রা: সকলকে উতসাহিত করার উদ্দেশ্যে বলেন: যদি আশু ফল লাভের সম্ভাবনা দেখা যেত অথবা সফর নিকটবর্তী হতো, শুধু তাহলেই কি আপনারা বেরুতেন? উমারের রা: এ বক্তব্যে আমর ইবন সাঈদ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, আপনি মুনাফিকদের সম্পর্কে প্রয়োগকৃত দৃষ্টান্ত আমাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেন? আপনি নিজে চুপ করে বসে আছেন কেন? আপনিই প্রথম শুরু করুন না। এ পর্যায়ে উমারের সাথে তার বেশ কথা কাটাকাটি হয়। অত:পর খলীফা আবু বকর রা: বলেন, আসলে উমারের বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো আপনাদেরকে অনুপ্রাণিত ও উতসাহিত করা। সাথে সাথে আমরের ভাই খালিদ উঠে দাড়ান এবং খলীফার বক্তব্য সমর্থন করে এক ভাষণ দেন। এ ভাবে বিষয়টির মীমাংসা হয়। (হায়াতুস সাহাবা-১৪৪০)
শাসনকর্তার পদ প্রত্যাখ্যান করে আমর একজন সাধারণ মুজাহিদ হিসাবে সিরিয়া অভিযানে যোগদেন। হিজরী ১৩ সনে আজনাদাইনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। মুসলিম বাহিনীর একটু দূর্বলতা দেখলেই তিনি চিতকার করে নানা ভাবে মনোবল দৃঢ় করার চেষ্ঠা করেন। একবার অত্যন্ত আবেগের সাথে বলেন, যুদ্ধের ময়দানে আমি আমার সাথীদের দূর্বলতা মোটেই দেখতে পারিনে। এখন আমি নিজেই ঢুকে পড়বো। এ কথা বলে তিনি শত্রু বাহিনীর মধ্যভাগের ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে চলে যান এবং অত্যন্ত দু:সাহসের সাথে লড়তে লড়তে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের শেষে তার লাশ কুড়িয়ে দেখা গেল অসংখ্য আঘাতে সারা দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। গুণে দেখা গেল মোট ত্রিশটি চিহ্ন। অবশ্য ইবন ইসহাক ও মূসা ইবন উকবার মতে আমর ‘মারজ আস সাফার’ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। (আল ইসাবা-২/৫৩৯)।

ওয়াকিদ ইবন আবদিল্লাহ রা:

নাম ওয়াকিদ, পিতা আবদুল্লাহ। বনী তামিম গোত্রের হানজালী ইয়ারবূয়ী শাখার সন্তান। জাহিলী যুগে খাত্তাব ইবন নুফাইলের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। (তাবাকাত-৩/৩৯০, আল ইসাবা -৩/৬২৮)।
মক্কায় ইসলামী দাওয়াতের সূচনালগ্নে হযরত রাসূলে কারীম সা: হযরত আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বেই ওয়াকিদ ইসলাম গ্রহণ করেন। হিজরাতের নির্দেশ আসার পর তিনি মদীনায় হিজরাত করেন এবং হযরত রিফায়া ইবন আবদিল মুনজিরের অতিথি হন। মদীনায় রাসূল সা: বিশর ইবন বারা ইবন মারুর এর সাথে তার মুওয়াখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক কায়েম করে দেন। (তাবাকাত-৩/৩৯০)।
হযরত রাসূলে কারীম সা: মদীনায় হিজরাতের সতেরতম মাসটি ছিল রজব মাস। এ মাসে তিনি কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের নেতৃত্বে ১২ মতান্তরে ৯ সদস্যের একটি বাহিনীকে ‘নাখলায়’ পাঠান। এতে ওয়াকিদ ইবন আবদিল্লাহও ছিলেন। তারা নাখলায় পৌঁছে ওঁত পেতে আছেন। এমন সময় কুরাইশদের একটি ছোট্ট বাণিজ্য কাফিলা দৃষ্টিগোচর হয়। দিনটি ছিল রজবের একেবারে শেষ দিন। আর রজব মাসটি আরবে যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ চার মাসের একটি। সুতরাং এ সময় আক্রমণ করা যাবে কি না, এ বিষয়ে মুসলিম বাহিনীর সদস্যরা পরামর্শ করেন। অবশেষে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ওয়াকিদ ইবন আবদিল্লাহ রা: তীর নিক্ষেপ করেন। সেই নিক্ষিপ্ত তীরে শত্রুপক্ষের আমর ইবনুল হাদরামী নিহত হয় এবং উসমান ও হাকাম নামে দুই ব্যক্তি বন্দী হয়।
যেহেতু রক্তপাতের ঘটনাটি সংঘটিত হয় হারাম মাসে এ কারণে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সা: ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ধরণের প্রচারণা চালাতে থাকে। তারা বলে, মুহাম্মাদ সা: ও তার অনুসারীরা কি আবহমান কাল ধরে মেনে আসা হারাম মাসগুলির পবিত্রতা মানে না? এমনকি রাসূল সা: নিজেও ঘটনাটি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি বাহিনীর লোকদের ডেকে বললেন, আমি তো তোমাদের যুদ্ধের অনুমতি দেইনি, তবে কেন তোমরা যুদ্ধ করলে? এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা আল বাকারার নীচের আয়াতটি নাযিল হয়:
‘হে মুহাম্মাদ, মুশরিকরা তোমার নিকট ‘হারাম’ মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তুমি তাদেরকে বলে দাও এ মাসে যুদ্ধ করা বড় পাপের কাজ। কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর কুফুরী করা, মানুষকে মসজিদে হারামে ইবাদাত করা থেকে বিরত রাখা এবং সেখান থেকে তার অধিবাসীদের বের করে দেওয়া আল্লাহর নিকট এ মাসে যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর পাপ কাজ। আর অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ। (সূরা ‍বাকারা-২১৭)।’
(আল ইসাবা-৩/৬২৮), আসাহুস সীয়ার-১২৮)।
যাই হোক, আমর ইবনুল হাজরামী একজন মুসলমানের হাতে নিহত প্রথম কাফির, উসমান ও হাকাম ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দুই কয়েদি এবং কুরাইশ কাফিলার নিকট থেকে প্রাপ্ত জিনিস ইসলামের প্রথম গণীমত। (আসাহুস সীয়ার-১২৮)।
এই ঘটনার পর বনী ইয়ারবু গর্ব করে বলে বেড়াতো আমাদেরই একজন ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম একজন মুশরিককে হত্যা করেছে। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব কাব্য করে বলতেন: ‘নাখলায় আমরা আমাদের তীরগুলিকে ইবনুল হাদরামীর রক্ত পান করিয়েছি, যখন ওয়াকিদ যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। (আল ইসাবা-৩/৬২৮)
নাখলার পর বদর, উহুদ, খন্দক সহ সকল যুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমারের খিলাফতকালের প্রথম দিকে তিনি ইনতিকাল করেন। তার কোন সন্তানাদি ছিল ‍না। হাদীসের গ্রন্থ সমূহে তার থেকে বর্ণিত দুই/একটি হাদীস দেখা যায়।

আবদুল্লাহ ইবন মাখরামা রা:

পুরো নাম আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ, পিতা মাখরামা ইবন আবদিল উযযা এবং মাতা বাহসানা বিনতু সাফওয়ান। কুরাইশ বংশের আমেরী শাখার সন্তান। (আল ইসাবা-২/৩৬৫)।
ইসলামী দাওয়াতের সূচনা লগ্নে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন। জাফর ইবন আবী তালিবের রা: সাথে হাবশাগামী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। সেখান থেকে সরাসরি মদীনায় চলে যায় এবং হযরত কুলসুম ইবন হিদামের বাড়ীতে অতিথি হন। হরযত রাসূলে কারীম সা: ফারওয়া ইবন আমর আল বায়াদীর রা: সাথে তার দ্বীনী ভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। মদীনায় আসার পর সর্ব প্রথম বদর যুদ্ধে যোগদান করে বদরী সাহাবী হওয়ার মহা সম্মান অর্জন করেন। তখন তার বয়স ত্রিশ বছর। বদরের পর, উহুদ সহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসূল সা: এর সাথে যোগ দেন।
হযরত আবদুল্লাহর রা: শাহাদাত লাভের এত তীব্র বাসনা ছিলো যে, দেহের প্রতিটি লোম রক্ত রঞ্জিত করার জন্য সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। তিনি দুআ করতেন: হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিওনা, যতক্ষণ না আমার দেহের প্রতিটি জোড়া আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। তার এ দুআ কবুল হয় এবং অনতিবিলম্বে সে সুযোগও এসে যায়।
হযরত আবু বকর সিদ্দীকের সা: খিলাফতকালে রিদ্দা বা ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে তিনি একজন মুজাহিদ হিসেবে যোগ দেন। মুরতাদদের বিরুদ্ধে তিনি এত নির্মম ভাবে যুদ্ধ করেন যে, তার সারা দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। পবিত্র রমজান মাস। তিনি সাওম পালন করছিলেন। সূর্যাস্তের সময় যখন তারও জীবন সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাখরামা রা: খোঁজ নিতে এসেছেন। আবদুল্লাহ ইবন মাখরামা রা: তাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার জন্যও একটু পানি আনুন না। পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখেন তার প্রাণহীন দেহটি পড়ে আছে। তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র একচল্লিশ বছর। (আল ইসাবা-২/৩৬৫)।
ইলম, আমল, তাকওয়া ও পরহেযগারীর দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উসুদুল গাবা গ্রন্থকার লিখেছেন, তিনি ছিলেন মাহাত্মের অধিকারী একজন আবেদ ব্যক্তি।


তথ্যসূত্র:
১. ইবন সা’দ: তাবাকাত
২. ইবন হাজার আসকিলানী: আল ইসাবা
৩. ইবন হাজার আসকিলানী: তাহজীব আত তাহজীব
৪. ইবন আসীর: উসুদুল গাবা
৫. ইবন আসীর: তাজরীদ আসমা আস সাহাবা
৬. আল বালাজুরী: আনসাবুল আশরাফ
৭. আজ জাহাবী: তাজকিরাতুল হুফফাজ
৮. আজ জাহাবী: তারীখুল ইসলাম
৯. ইবন কাসীর: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া
১০. ইবন আসাকির: আত তারীখুল কাবীর
১১. আয যিরিকলী: আল আলাম
১২. আল কুরতুবী: আল ইসতীয়াব (আল ইসাবার পার্শ্বটীকা)
১৩. ইবন হিশাম: আস সীরাহ
১৪. তাবারী: তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক
১৫. মাওলানা ইউসুফ কানধালুবী: হায়াতুস সাহাবা
১৬. মুঈনুদ্দীন আহমাদ নাদবী: মুহাজিরীন
১৭. ড. আব্দুর রহমান রাফত আল বাশা:- সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা
১৮. খালিদ মুহাম্মাদ খালিদ: রিজালুন হাওলার রাসূল
১৯. মুহাম্মাদ খিদরী বেক: তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়্যা
২০. দায়িরা -ই-মাআরিফ-ই- ইসলামিয়্যা (উর্দু)
২১. হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থ।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি