হানজালা ইবন আবী ’আমির (রা)
নাম হানজালা, লকব বা উপাধি ‘গাসীলুল মালায়িকা’ ও তাকী। মদীনার আউস গোত্রের ‘আমর ইবন’ আউফ শাখার সন্তান। পিতার নাম আবু ’আমির ’আমর, মতান্তরে ’আবদু ’আমর, মাতার নাম জানা যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, তিনি খাযরাজ নেতা মুনাফিক ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাইয়ের বোন ছিলেন। হানজালার জন্ম ও কৈশোর সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
হানজালার পিতা আবূ ’আমির ছিলেন আউস গোত্রের একজন সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেই জাহিলী আরবে দ্বীনে হানীফের একজন বিশ্বাসী হিসেবে তিনি নবুওয়াত, রিসালা, কিয়ামাত ইত্যাদি বিশ্বাস করতেন। এই ধর্মীয় বিশ্বাস তাঁকে ‘রুহবানিয়্যাত’ (বৈরাগ্য)- এর দিকে নিয়ে যায় এবং সব রকম পার্থিব নেতৃত্ব ছেড়ে ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্জন করেন। জীবনের এক পর্যায়ে গেরুয়া বসন পরিধান করে নির্জনবাস অবলম্বন করেন। একারণে তিনি ‘রাহিব’ (বৈরাগী) হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। (আল-ইসাবা- ১/৩৬১)
এদিকে রাসূলে কারীম সা. নবুওয়াত লাভ করেন এবং মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি স্থাপন করেন। এতে আবু ’আমির ও ’আবদুল্লাহ ইবন উবাই উভয়ের নেতৃত্বে ভাটা পড়ে। ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাই মুনাফিকী (দ্বিমুখী) নীতি অবলম্বন করে মদীনাতেই বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু আবূ ’আমির ততখানি ধৈর্যধরণ করতে পারেননি। তিনি মদীনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। উহুদ যুদ্ধে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে মদীনা আক্রমণে আসেন। একারণে হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁকে ‘ফাসিক’ নামে অভিহিত করেন।
যুদ্ধ শেষে তিনি মক্কায় ফিরে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। হিজরী অষ্টম সনে মুসলমানদের দ্বারা মক্কা বিজিত হলে আল্লাহর যমীন তাঁর জন্য আবার সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তিনি মক্কা ছেড়ে রোমান সম্রাট হিরাকলের দরবারে পৌঁছেন এবং সেখানেই হিজরী দশ সনে মারা যান।
এই তো ছিল আবূ ’আমিরের কুফরী বা অবিশ্বাসের চরম অবস্থা। অপর দিকে তাঁর ছেলে হযরত হানজালার ঈমানী মজবুতীর চরম অবস্থাও লক্ষ্যণীয়। তিনি ইসলাম কবুল করে আবেদন জানানঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি নির্দেশ দিলে আমি আমার পিতা আবূ ’আমিরকে হত্যা করতাম। কিন্তু রাসূল সা. তাঁর এ আবেদন মঞ্জুর করেননি। মুনাফিক সরদার ’আবদুল্লাহ ইবন ’উবাইর ছেলে হযরত ’আবদুল্লাহ রা. তাঁর পিতার ব্যাপারেও অনুরূপ আবেদন জানিয়েছিলেন এবং রাসূল সা. তাঁকেও একইভাবে নিবৃত্ত করেছিলেন।
হযরত হানজালা বদর যুদ্ধে যোগ দেন নি। এর কারণ জানা যায় না। তবে উহুদ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল তাঁর ইসলামী জীবনের প্রথম ও শেষ যুদ্ধ।
তিনি স্ত্রী উপগত হয়ে ঘরে শুয়ে আছেন। এমন সময় ঘোষকের কণ্ঠ কানে গেলঃ ‘এক্ষুনি জিহাদে বের হতে হবে।’ জিহাদের ডাক শুনে ‘তাহারাতের’ (পবিত্রতা) গোসলের কথা ভুলে গেলেন। সেই অশুচি অবস্থায় কোষমুক্ত তরবারি হাতে উহুদের প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। তিনি কুরাইশ নেতা আবু সুফইয়ান ইবন হারবের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। তাকে কাবু করে তরবারির আঘাত করবেন, ঠিক সেই সময় নিকট থেকে শাদ্দাদ ইবন আসওয়াদ আল-লায়সী দেখে ফেলে এবং দ্রুত হানজালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তরবারির এক আঘাতে তাঁর মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। অনেকে বলেছেন, আবূ সুফইয়ান ও শাদ্দাদ দু’জনে একযোগে তাঁকে হত্যা করেন। তবে ‘রাওদুল আন্ফ’ গ্রন্থকার নাফে’ ইবন আবী নু’ঈম- মাওলা জা’উনা ইবন শা’উবকে হানজালার ঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৫, ১২৩)
বদর যুদ্ধে আবূ সুফইয়ানের পুত্র ‘হানজালা’ মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়। তাই উহুদে এই হানজালাকে হত্যার পর সে মন্তব্য করেঃ ‘হানজালার পরিবর্তে হানজালা।’
হযরত হানজালা রা. নামাক অবস্থায় শহীদ হন। শাহাদাতের পর ফিরিশতারা তাঁকে গোসল দেয়। তাই দেখে হযরত রাসূলে কারীম সা. সাহাবীদের বললেন, তোমরা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস কর তো ব্যাপার কি? হিশাম ইবন ’উরওয়া বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. হানজালার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ হানজালার ব্যাপারটি কি? স্ত্রী বললেনঃ হানজালা নাপাক ছিল। আমি তাঁর মাথার একাংশ মাত্র ধুইয়েছি, এমন সময় জিহাদের ডাক তাঁর কানে গেল। গোসল অসম্পূর্ণ রেখেই সেই অবস্থায় বেরিয়ে গেলেন এবং শাহাদাত বরণ করলেন। একথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ এই জন্য আমিক ফিরিশতাদেরকে তাঁকে গোসল দিতে দেখেছি। (আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবার টীকা- ১/২৮১; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪৪) আর এখান থেকৈই ‘গাসীলুল মালায়িকা’ (ফিরিশতাকুল কর্তৃক গোসলকৃত) লকব বা উপাধিতে ভূষিত হন।
হযরত হানজালা মৃত্যুর সময় ’আবদুল্লাহ নামে এক ছেলে রেখে যান। হযরত রাসুলে কারীমের সা. মদীনায় আগমনের পর এই ’আবদুল্লাহর জন্ম হয় এবং রাসূলে কারীমের সা. ওফাতের সময় তাঁর বয়স হয় মাত্র সাত-আট বছর। পরিণত বয়সে তিনি পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী বলে নিজেকে প্রমাণ করেন। উমাইয়্যা শাসক ইয়াযিদ ইবন মু’য়াবিয়ার কলঙ্কজনক কর্মকান্ডের প্রতিবাদে তাঁর প্রতি কৃত ‘বাই’য়াত’ (আনুগত্যের অঙ্গীকার) প্রত্যাখ্যান তিনি হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন যুবায়রের রা. প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ইয়াযীদের বাহিনী মদীনা আক্রমণ করে। হযরত ’আবদুল্লাহ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মদীনাবাসীদের সাথে নিয়ে নিজেই সেনাপতি হিসেবে আক্রমণকারীদের বাধা দেন। অসংখ্য মদীনাবাসী শাহাদাত বরণ করেন। একের পর এক হযরত ’আবদুল্লাহর আট পুত্র ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য হযরত ’আবদুল্লাহ স্বচক্ষে অবলোকন করেন। অবশেষে তিনি নিজেই অগ্রসর হন। উহুদে শাহাদাতপ্রাপ্ত পিতার রক্তরঞ্জিত পোশাক পরে তিনি শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শাহাদাত বরণ করেন। এ ছিল হিজরী ৬৩ সনের জ্বিলহজ্জ মাসের ঘটনা।
হযরত হানজালার পিতা ‘ফাসিক’ ছিলেন। আর এই ‘ফাসিক’ পিতার সন্তান হানজালা ‘তাকী’ (আল্লাহ ভীরু) উপাধি লাভ করেন। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে তিনি কত উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ইবন ’আসাকির বর্ণনা করেছেন, খলীফা ’উমার যখন লোকদের ভাতার ব্যবস্থা করেন তখন হানজালার ছেলে ’আবদুল্লাহর জন্য দুই হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। হযরত তালহা তাঁর ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে খলীফার নিকট নিয়ে গেলেন। খলীফা তাঁর জন্য কিছু কম অংক নির্ধারণ করলেন। তালহা বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন। আপনি এই আনসারীকে আমার ভাতীজার চেয়ে বেশি দিলেন? খলীফা বললেনঃ হ্যাঁ। কারণ, তাঁর পিতা হানজালাকে আমি উহুদে অসির নীচে এমনভাবে হারিয়ে যেতে দেখেছি যেমন একটি উট হারিয়ে যায়। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২১৮)
একবার আনসারদের দুই গোত্র- আউস ও খাযরাজ নিজেদের গৌরব ও সম্মানের কথা বর্ণনা করছিল। তারা নিজ নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম উচ্চারণ করল। আউস গোত্র সর্বপ্রথম উচ্চারণ করল হানজালা ইবন আবী আমিরের পুণ্যময় নামটি। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। একবার আউস গোত্রের লোকেরা গর্ব করে বললঃ আমাদের আছে হানজালা- যাঁকে ফিরিশতারা গোসল দিয়েছেন; আসিম ইবন সাবিত- আল্লাহ যাঁর দেহ মৌমাছি ও ভীমরুলের দ্বারা মুশরিকদের হাত থেকে হিফাজত করেছিলেন; খুযায়মা ইবন সাবিত- যাঁর একার সাক্ষ্য দুইজনের সাক্ষ্যের সমান; আর আছে সা’দ ইবন ’উবাদা- যার মৃত্যুতে আল্লাহর ’আরশ কেঁপে উঠেছিল।
(দ্রঃ আল-ইসাবা- ১/৩৬১, আল-ইসতীয়াবঃ আল-ইসাবা টীকা- ১/২৮০-২৮২, সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৭৫, ১২৩)

উবাই ইবন কা’ব আল-আনসারী (রা)
নাম উবাই, ডাকনাম আবূল মুনজির ও আবুত তুফাইল। (আল-আ’লাম- ১/৭৮; আল-ইসাবা- ১/১৯) সায়্যিদুল কুররা, সায়্যিদুল আনসার প্রভৃতি তাঁর লকব বা উপাধি। মদীনার খাযরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার সন্তান। পিতার নাম কা’ব ইবন কাইস, মাতার নাম সুহাইলা। তিনি বনী ’আদী ইবন নাজ্জারের কন্যা এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ তালহা আল-আনসারীর ফুফু। সুতরাং উবাই, আবূ তালহার ফুফাতো ভাই। উবাইর আবুল মুনজির কুনিয়াতটি খোদ রাসূল সা. দান করেন এবং দ্বিতীয় কুনিয়াতটি হযরত ’উমার রা. তাঁর ছেলে তুফাইলের নাম অনুসারে আবুত তুফাইল রাখেন। তাঁর জন্মের সঠিক সন-তারিখ জানা যায় না।
হযরত উবাইয়ের প্রথম জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে হযরত আনাস ইবন মালিকের বর্ণনায় এতটুকু জানা যায় যে, ইসলাম-পূর্ব জীবনে তিনি মদ পানে আসক্ত ছিলেন। হযরত আবু তালহার মদ পানের আড্ডার তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাঁকে মদীনার অন্যতম ইয়াহুদী ধর্মগুরু বলে গণ্য করা হতো। প্রাচীন আসমানী কিতাব সমূহেও তাঁর জ্ঞান ছিল সে যুগে লেখা-পড়ার তেমন প্রচলন ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি লিখতে পড়তে জানতেন। এ কারণে ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন এবং কুরআনের অন্যতম লেখকে পরিণত হন। (আল-আ’লাম- ১/৭৮)
মদীনায় ইয়াহুদীদের যথেষ্ট ধর্মীয় প্রভাব ছিল। ইসলাম-পূর্ব জীবনে তিনি তাওরাতসহ অন্যান্য যে সকল ধর্মীয় গ্রন্থ পড়েছিলেন, মূলতঃ সেই জ্ঞানই তাঁকে ইসলামের দিকে টেনে আনে। যে সকল মদীনাবাসী মক্কায় গিয়ে সর্বশেষ আকাবায় রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাই’য়াত করেন তিনিও তাঁদের একজন। আর এখান থেকেই তাঁর ইসলামী জীবনের সূচনা। (আল-ইসাবা- ১/১৯)
হিজরাতের পর হযরত রাসূলে কারীম সা. ’আশারা মুবাশ্শারার অন্যতম সদস্য হযরত সা’ঈদ ইবন যায়িদের সাথে উবাইয়ের মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৫০৫) বালাজুরীর মতে, তালহা ইবন ’উবাইদুল্লাহর সাথে তাঁর ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৭১) রাসূল সা. মদীনায় আগমনের পর হযরত আবু আইউব আল-আনসারীর বাড়ীতে অতিথি হন। তবে একটি বর্ণনা মতে, তাঁর বাহন উটনীটি উবাই ইবন কা’বের বাড়ীতে থঅকে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৬৭)
হযরত উবাই বদর থেকে নিয়ে তায়িফ অভিযান পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে যোগদান করেন। (আল-ইসাবা- ১/১৯, আল-আ’লাম- ১/৭৮) কুরাইশরা বদরে পরাজিত হয়ে মক্কায় ফিরে প্রতিশোধ নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দেয়। উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে মক্কায় অবস্থানকারী রাসূলুল্লাহর সা. চাচা হযরত ’আব্বাস ইবন ’আবদুল মুত্তালিব গোপনে বনী গিফার গোত্রের এক লোকের মাধ্যমে একটি পত্র রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান। সেই পত্রে তিনি কুরাইশদের সকল গতিবিধি রাসূলকে সা. অবহিত করেন। লোকটি মদীনার উপকণ্ঠে কুবায় পত্রখানি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট হস্তান্তর করেন। রাসূলসা. পত্রখানা সেখানে উবাই ইবন কা’বের দ্বারা পাঠ করিয়ে শোনেন এবং পত্রের বিষয় গোপন রাখার নির্দেশ দেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩১৪) এই উহুদ যুদ্ধে শত্রু পক্ষের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে তিনি আহত হন। হযরত রাসূল সা. তাঁর চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসক পাঠান। চিকিৎসক তাঁর রগ কেটে সেই স্থানে সেঁক দেয়।
উহুদ যুদ্ধের শেষে হযরত রাসূলে কারীম সা. আহত-নিহতদের খোঁজ-খবর নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ একজন সা’দ ইবন রাবী’র খোঁজ নাও তো। একজন আনসারী সাহাবী তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় শহীদদের লাশের স্তূপ থেকে খুঁজে বের করেন। কোন কোন বর্ণনা মতে এই আনসারী সাহাবী হলেন উবাই ইবন কা’ব। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৯৫)
খন্দক যুদ্ধের প্রক্কালে মক্কার কুরাইশ নেতা আবূ সুফইয়ান, আবূ উসামা আল-জাশামীর মারফত একটি চিঠি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠান। সেই চিঠিও রাসূল সা. উবাইয়ের দ্বারা পাঠ করান। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৭০) তেমনিভাবে হিজরী ২য় সনের রজব মাসে রাসূল সা. ’আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ আল-আসাদীর নেতৃত্বে একটি বাহিনী নাখলা অভিমুখে পাঠান। যাত্রাকালে তিনি ’আবদুল্লাহর হাতে একটি সীলকৃত চিঠি দিয়ে বলেনঃ ‘দুই রাত একাধারে চলার পর চিঠিটি খুলে পাঠ করবে এবং এর নির্দেশ মত কাজ করবে।’ রাসূল সা. এই চিঠিটি উবাইয়ের দ্বারা লেখান। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৩৭১)
হিজরী ৯ম সনে যাকাত ফরজ হলে রাসূল সা. আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ করেন। তিনি উবাইকে বালী, ’আজরা এব্ং বনী সা’দ গোত্রে যাকাত আদায়কারী হিসেবে পাঠান। তিনি অত্যন্ত দ্বীনদারী ও সততার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। একবার এক জনবসতিতে গেলেন যাকাত আদায় করতে। নিয়ম অনুযায়ী এক ব্যক্তি তার সকল গবাদিপশু উবাইয়ের সামনে হাজির করে যাতে তিনি যেটা ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারেন। উবাই উটের পাল থেকে দুই বছরের একটি বাচ্চা গ্রহণ করেন। যাকাত দানকারী বললেনঃ এতটুকু বাচ্চা নিয়ে কি হবে? এতো দুধও দেয় না, আরোহণেরও উপযোগী নয়। আপনি যদি নিতে চান এই মোটা তাজা উটনীটি নিন। উবাই বললেনঃ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশের বিপরীত আমি কিছুই করতে পারি না। মদীনা তো এখান থেকে খুব বেশি দূর না, তুমি আমার সাথে চলো, বিষয়টি আমরা রাসূলকে সা. জানাই। তিনি যা বলবেন, আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করবো। লোকটি রাজী হলো। সে তার উটনী নিয়ে উবাইয়ের সাথে মদীনায় উপস্থিত হলো। তাদের কথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ এই যদি তোমার ইচ্ছা হয় তাহলে উটনী দাও, গ্রহণ করা হবে। আল্লাহ তোমাকে এই প্রতিদান দিবেন। লোকটি সন্তুষ্টচিত্তে উটনীটি দান করে বাড়ী ফিরে গেল। (মুসনাদ- ৫/১৪২, কানযুল ’উম্মাল- ৩/৩০৯, হায়াতুস সাহাবা- ১/১৫১)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় পবিত্র কুরআনের সংগ্রহ ও সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু হয়। সাহাবা-ই-কিরামের যে দলটির ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়, উবাই ছিলেন তাঁদের নেতা। তিনি কুরআনের শব্দাবলী উচ্চারণ করতে, আর অন্যরা লিখতেন। এই দলীটর সকলেই ছিলেন উঁচু স্তরের ’আলিম। এই কারণে মাঝে মধ্যে কোন কোন আয়াত সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হতো। যখন সূরা আত-তাওবার ১২৭ নং আয়াতটি লেখা হয় তখন দলের অন্য সদস্যরা বললেন, এই আয়াতটি সর্বশেষ নাযিল হয়েছে। হযরত উবাই বললেনঃ না। রাসূল সা. এর পরে আরও দু’টি আয়াত আমাকে শিখিয়েছিলেন। সূরা আল-তাওবার ১২৮ নং আয়াতটি সর্বশেষ নাযিল হয়েছে। (মুসনাদ- ৫/১৩৪)
হযরত আবু বকরের রা. ইনতিকালের পর হযরত ’উমার রা. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি তাঁর খিলাফতকালে অসংখ্য জনকল্যাণ ও সংস্কারমূলক কাজের প্রবর্তন করেন। মজলিসে শূরা তার মধ্যে একটি। বিশিষ্ট মুহাজির ও আনসার ব্যক্তিবৃন্দের সমন্বয়ে এাই মজলিস গঠিত হয়। খাযরাজ গোত্রের প্রতিনিধি হিসেবে উবাই এই মজলিসের সদস্য ছিলেন। (কানযুল উম্মাল- ৩/১৩)
হযরত ’উমারের খিলাফতকালের গোটা সময়টা তিনি মদীনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে কাটান। বেশীর ভাগ সময় অধ্যয়ন ও শিক্ষাদানে ব্যয় করেন। যখন মজলিসে শূরার অধিবেশন বসতো বা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থিত হতো খলীফা ’উমার রা. তাঁর যুক্তি ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন।
হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালের পুরো সময়টা তিনি ‘ইফতার’ পদে আসীন ছিলেন। এছাড়া অন্য কোন পদ তিনি লাভ করেননি। একবার ’উমারকে রা. জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমাকে কোন এক স্থানের ওয়ালী (শাসক) নিযুক্ত করেন না কেন? ’উমার রা. বললেনঃ আমি আপনার দ্বীনকে দুনিয়ার দ্বারা কলুষিত হতে দেখতে চাই না। (কানযুল ’উম্মাল- ৩/১২৩) হযরত ’উমার রা. যখন তারাবীহর নামায জামা’য়াতের সাথে আদায়ের প্রচলন করেন তখন উবাইকে ইমাম মনোনীত করেন। (বুখারীঃ কিতাবু সালাতিত তারাবীহ) ’উমার যেমন তাঁকে সম্মান করতেন তেমনি ভয়ও করতেন। তাঁর কাছে ফাতওয়া চাইতেন।
খলীফা ’উমারের রা. বাইতুল মাকদাস সফরে উবাই তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। খলীফার ঐতিহাসিক জাবিয়া ভাষণের সময় উপস্থিত ছিলেন। বাইতুল মাকদাসের অধিবাসীদের সাথে হযরত ’উমার রা. যে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন তার লেখন ছিলেন হযরত উবাই। (আল-আ’লাম- ১/৭৮; সিফাতুল সাফওয়া- ১/১৮৮)
’উমারের পর হযরত ’উসমানের রা. সময় খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত ও উচ্চারণে বিভিন্নতা ছড়িয়ে পড়ে। খলীফা ’উসমান রা. শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি এই বিভিন্নতা দূর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি শ্রেষ্ঠ ক্বারীদের ডেকে পৃথকভাবে তাঁদের তিলাওয়াত শুনলেন। ’উবাই ইবন কা’ব, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস এবং মু’য়াজ ইবন জাবাল- প্রত্যেকেরই উচ্চারণে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, সকল মুসলমানকে একই উচ্চারণের কুরআনের ওপর ঐক্যবদ্ধ করতে চাই।
সেই সময় কুরাইশ ও আনসারদের মধ্যে ১২ ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুরআনে দক্ষ ছিলেন। খলীফা ’উসমান এই ১২ জনের ওপর এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। আর এই পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব দান করেন উবাই উবন কা’বকে। তিনি শব্দাবলী উচ্চারণ করতেন, যায়িদ ইবন সাবিত লিখতেন। আজ পৃথিবীতে যে কুরআন বিদ্যমান তা মূলতঃ হযরত উবাইয়ের পাঠের অনুলিপি। (কানযুল উম্মাল- ১/২৮২, ২৮৩)
হযরত উবাইয়ের মৃত্যু সন নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হযরত ’উসমানের রা. খিলাফতকালে হিজরী ৩৯ সনের এক জুম’আর দিনে তিনি ইনতিকাল করেন। হযরত ’উসমান তাঁর জানাযার নামায পড়ান এবং মদীনায় দাফন করা হয়। হাইসাম ইবন ’আদী ও অন্যদের মতে তিনি হিজরী ১৯ সনে মদীনায় মারা যান। আর ওয়াকিদী, মুহাম্মদ ইবন ’আবদুল্লাহ প্রমুখের মতে তাঁর মৃত্যু হয় হিজরী ২২ সনে। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৭; শাজারাতুজ জাহাব- ১/৩১) তবে বিভিন্ন বর্ণনা মাধ্যমে খলীফা ’উসমানের খিলফতকালে বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাঁর শরীক হওয়ার কথা জানা যায়। অতএব হিজরী ৩৯ সনে তাঁর মৃত্যুর মতটি সঠিক বলে মনে হয়।
হযরত সন্তানদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে যে সকল সন্তানদের নাম জানা যায় তারা হলেনঃ ১. তুফাইল, ২. মুহাম্মাদ, ৩. রাবী’, ৪. উম্মু ’উমার। প্রথমোক্ত দুইজন হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবদ্দশায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর ডাকনাম উম্মু তুফাইল। তিনি সাহাবিয়্যা ছিলেন। হাদীস বর্ণনা কারী মহিলা সাহাবীদের নামের তালিকায় তাঁর নামটিও দেখা যায়।
হযরত উবাইয়ের দৈহিক গঠন ছিল মধ্যম আকৃতির হালকা পাতলা ধরণের। গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল গৌর বর্ণের বার্ধ্বক্যে মাথার চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু খিযাব লাগাতেন না। (আল-ইসাবা- ১/১৯; আল-আ’লাম- ১/৭৮; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৭) স্বভাব ছিল একটু সৌখিন প্রকৃতির। বাড়ীতে গদীর ওপর বসতেন। ঘরের দেওয়ালে আয়না লাগিয়েছিলেন এবং সেইদিকে মুখ করে নিয়মিত চিরুনী করতেন। একটু রুক্ষ প্রকৃতির ছিলেন। সাধারণঃ স্বভাববিরোধী কোন কথা শুনলেই রেগে যেতেন। হযরত ’উমারের স্বভাবও ছিল একই রকম। এই কারণে মাঝে মাঝে তাদের দুইজনের মধ্যে ঝগড়াহয়ে যেত। বিভিন্ন বর্ণনায় এমন বহু ঝগড়ার কথা জানা যায়।
একবার হযরত উবাই একব্যক্তিকে একটি আয়াত শেখালেন। হযরত ’উমার রা. লেকটির মুখে আয়াতটির পাঠ শুনে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এ পাঠ কার কাছে শিখেছ? লোকটি উবাইয়ের নাম বললো। হযরত ’উমার লোকটিকে সংগে করে উবাইয়ের বাড়ীতে উপস্থিত হন এবং আয়াতটি সম্পর্কে জানতে চান। ’উবাই বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে এভাবেই শিখেছি। হযরত ’উমার আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শিখেছেন? উবাই বললেনঃ হাঁ। হযরত ’উমার রা. প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তির করেন। এবার উবাই ক্ষেপে যান। তিনি বলেনঃ আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা’য়ালা এই আয়াতটি জিবরীলের আ. মাধ্যমে মুহাম্মাদের সা. অন্তকরণে নাযিল করেন। এই ব্যাপারে খাত্তাব ও তাঁর ছেলের সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এ কথা শুনে হযরত ’উমার রা. কানে হাত দিয়ে তাকবীর পড়তে পড়তে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যান। (কানযুল ’উম্মাল- ১/২৮৭)
হযরত হাসান থেকে বর্ণিত! উবাই ইবন কা’বের একটি আয়াতের তিলাওয়াতের সাথে ’উমার ইবন খাত্তাব দ্বিমত পোষণ করলেন। উবাই তাঁকে বললেনঃ আপনি যখন বাকী’র বাজারে কেনা-বেচা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন আমি তখন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে আয়াতটি শুনেছি। ’উমার বললেনঃ সত্যি কথা বলেছেন। কে সত্য বলে আমি শুধু তাই পরীক্ষা করতে চেয়েছি। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছেঃ উবাই সূরা আল-মায়িদার ১০৭ নং আয়াতটি তিলাওয়াত করলে ’উমার বললেনঃ মিথ্যা বলছেন। উবাই বললেনঃ আপনি অধিকতর মিথ্যাবাদী। এক ব্যক্তি বললোঃ আপনি আমীরুল মুমিনীনকে মিথ্যাবাদী বললেন? উবাই বললেনঃ আমি আমীরুল মুমিনীনকে তোমার থেকে বেশী সম্মান করি; কিন্তু তাঁকে আমি কিতাবুল্লাহর তাসদীক বা প্রত্যায়নের ব্যাপারে মিথ্যাবাদী বলেছি। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশের ব্যাপারে আমি তাঁকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করিনি। (কানযুল ’উম্মাল ১/২৮৫; হায়াতুস সাহাবা- ১/৭৪)
হযরত আবূ দারদা রা. একবার শামের অধিবাসীদের বিরাট একটি দলকে কুরআন শিখানোর জন্য মদীনায় নিয়ে আসেন। তারা হযরত উবাইয়ের নিকট কুরআন শিখেন। একদিন তাদেরই একজন হযরত ’উমারের সামনে কুরআন পাঠ করেন। ’উমার তার ভুল ধরেন। লোকটি বলে, আমাকে তো উবাই এভাবে শিখিয়েছেন। ’উমার তার সংগে একজন লোক দিয়ে বলেনঃ যাও, উবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। তারা উবাইয়ের বাড়ীতে গিয়ে দেখেন তিনি উটকে খাবার দিচ্ছেন। তারা বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন আপনাকে ডেকেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজে? তারা ঘটনাটি খুলে বললো। তিনি তাদের ওপর ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বললেনঃ তোমরা কি ক্ষ্যান্ত দিবে না? রাগের চোটে সেই উটের খাবার হাতে নিয়েই ’উমারের কাছে ছুটে যান। উমার তাঁর ও যায়িদ ইবন সাবিতের নিকট থেকে আয়াতটি শোনেন। দুইজনের পাঠে কিছু তারতম্য ছিল। হযরত ’উমার যায়িদের পাঠ সমর্থন করেন। এতে উবাই ক্ষেপে গিয়ে বলেনঃ আল্লাহর কসম! ’উমার! আপনার ভালো জানা আছে, আমি যখন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অন্দরে থাকতাম আর আপনার তখন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আজ আমার সাথে এমন আচরণ করছেন। আল্লাহর কসম! আপনি যদি বলেন, আমি ঘরেই বসে থাকবো। আমরণ কারও সাথে কথা বলবো না, কাউকে কুরআনও শিখাবো না। ’উমার বললেনঃ না, এমন করবেন না। আল্লাহ আপনাকে যে ইলম দান করেছেন, আপনি অতি আগ্রহের সাথে তা শিখাতে থাকুন। (কানযুল ’উম্মাল- ১/২৮৫)
স্বভাবগতভাবেই হযরত উবাই ছিলেন একটু স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। একবার হযরত ইবন আব্বাস রা. মদীনার একটি গলি দিয়ে কুরআনের একটি তিলাওয়াত করতে করতে যাচ্ছেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন, পিছন থেকে কেউ যেন তাঁকে ডাকছে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখেন, ’উমার। কাছে এসে ইবন ’আব্বাসকে বললেনঃ তুমি আমার দাসকে সংগে নিয়ে উবাই ইবন কা’বের নিকট যাবে এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করবে যে, তিনি কি অমুক আয়াতটি এভাবে পড়েছেন? ইবন আব্বাস উবাইয়ের গৃহে পৌঁছলেন এবং পরপরই ’উমারও সেখানে হাজির হলেন। অনুমতি নিয়ে তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করলেন। উবাই তখন দেওয়ালের দিকে মুখ করে মাথার চুল ঠিক করছিলেন। ’উমারকে গদীর ওপর বসানো হলো। উবাইয়ের পিছ ছিল ’উমারের দিকে এবং সেই অবস্থায়ই বসে থাকলেন, পিছনে তাকালেন না। কিছুক্ষণ পর বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন, স্বাগত! আমার সংগে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে না অন্য কোন প্রয়োজন এসেছেন? ’উমার বললেনঃ একটি কাজে এসেছি। অতঃপর একটি আয়াত তিলাওয়াত করে বলেন- এর উচ্চারণ তো খুব কঠিন। উবাই বললেনঃ আমি কুরআন তাঁর নিকট থেকেই শিখেছি, যিনি জিবরীলের নিকট থেকে শিখেছিলেন। এ তো খুব সহজ ও কোমল। ’উমার বললেনঃ আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।
হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালে একবার একটি বাগিচা নিয়ে খলীফা ও উবাইয়ের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হলো। উবাই কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ করলেন, আপনার খিলাফতকালে এমন কর্ম? ’উমার বললেনঃ আমি তো এমনটি চাইনি। মুসলমানদের মধ্যে যার কাছে ইচ্ছা, আপনি বিচার চাইতে পারেন। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। উবাই বিচারক মানলেন যায়িদ ইবন সাবিতকে রা.। ’উমার রাজী হলেন। হযরত যায়িদের এজলাসে মুকাদ্দামার শুনানীর দিন ধার্য হলো। নির্ধারিত দিনে খলীফাতুল মুসলিমীন এজলাসে হাজির হলেন। তিনি উবাইয়ের দাবী অস্বীকার করলেন এবং উবাইকে লক্ষ্য করে বললেনঃ আপনি ভুলে গেছেন, একটু চিন্তা করে মনে করার চেষ্টা করুন। উবাই বললেনঃ এখন আমার কিছুই স্মরণের আসছেন। তখন হযরত ’উমার ঘটনাটির পূর্ণ চিত্র উবাইয়ের সামনে তুলে ধরেন। বিচারক যায়িদ উবাইকে বললেন, আপনার কোন প্রমাণ আছে কি? তিনি বললেন, না। যায়িদ বললেনঃ তাহলে আপনি আমীরুল মুমিনীনকে কসম দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। (কানযুল ’উম্মাল- ৩/১৮১-১৮৪; হায়াতুস সাহাবা- ১/৯৪)
একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট এসে বললো, অমুক তার পিতার স্ত্রীর (সৎমা) সাথে সহবাস করে। উবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেনঃ আমি এমন ব্যক্তির গর্দান উড়িয়ে দিতাম। একথা শুনে রাসূল সা. একটু মৃদু হেসে বললেনঃ উবাই কতই না আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। তবে আমি তাঁর চেয়েও বেশী আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী। আর আল্লাহ আমার চেয়েও বেশী আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৬৩৮)
হযরত উবাই ইবন কা’বের পবিত্র জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত জ্ঞান চর্চার জন্য নিবেদিত ছিল। মদীনার আনসার-মুহাজিরগণ যখন ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত থাকতো, হযরত উবাই তখন মসজিদে নববীতে কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পঠন-পাঠনে সময় অতিবাহিত করতেন। আনসারদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বড় কোন ‘আলিম’ কেউ ছিলেন না। আর কুরআন বুঝার দক্ষতা এবং হিফ্জ ও কিরআতে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বজন স্বীকৃত। খোদ রাসূলে কারীম সা. মাঝে মাঝে তাঁর নিকট থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন।
ইসলামী জ্ঞান ছাড়া প্রাচীন আসমানী কিতাবের জ্ঞানেও ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। তাওরাত ও ইন্জীলের আলিম ছিলেন। অতীতের আসমানী গ্রন্থসমূহে রাসূল সা. সম্পর্কে যে সকল ভবিষ্যদ্বাণী ও সুসংবাদ ছিল সে বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর এই পান্ডিত্যের কারণে হযরত ফারুকে আজম তাঁকে খুবই সমীহ ও সম্মান করতেন। এমন কি তিনি নিজেই বিভিন্ন মাসয়ালার সমাধান জানার জন্য সময়-অসময়ে তাঁর গৃহে যেতেন।
ইসলামের ইতিহাসে গভীর জ্ঞান ও অসাধারণ মনীষার জন্য হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস রা. ‘হিবরুল উম্মাত’ নামে খ্যাত। তিনিও হযরত উবাইয়ের হালকা-ই-দারসে উপস্থিত হওয়াকে গৌরবজনক বলে মনে করতেন। তাঁর এই ফজীলাত ও মর্যাদা ছিল নবীর সা. নিকট থেকে অর্জিত জ্ঞানের কারণেই। তিনি নবীর সা. নিকট থেকে এত বেশী পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যে, অন্য কারও নিকট জ্ঞানের জন্য যাওয়ার প্রয়োজন তাঁর ছিল না। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে একমাত্র আবুবকর রা. ছাড়া তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না।
হযরত উবাই রা. বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তবে বিশেষভাবে কুরআন, তাফসীর, শানে নুযুল, নাসিখ-মানসুখ, হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে ছিলেন ইমাম ও মুজতাহিদ। একজন মুজতাহিদ বা গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতেন। একদিন রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলতো কুরআনের শ্রেষ্ঠতম আয়াত কোনটি? বললেনঃ আয়াতুল কুরসী। রাসূল সা. দারুণ খুশী হলেন এবং বললেনঃ উবাই, এই ইলম্ তোমাকে খুশী করুক।
উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় তিনি কুরআনের আয়াত নিয়ে কতখানি চিন্তা-ভাবনা করতেন। একবার এক ব্যক্তি উবাইকে বললো, আমাকে কিছু নসীহত বা উপদেশ দান করুন। তিনি বললেনঃ কুরআনকে পথের দিশারী মানবে, তার বিধি-নিষেধ ও সিদ্ধান্ত সমূহের ওপর রাজী থাকবে। হযরত রাসূলে কারীম সা. তোমাদের জন্য এই জিনিসটিই রেখে গেছেন। তাতে আছে তোমাদের ও তোমার পূর্ববর্তীদের কথা এবং যা কিছু তোমার পরে হবে, সব কিছুই। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৭; হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৮)
উল্লেখিত মতামত দ্বারা উবাই মূলতঃ এই কথাগুলিই প্রকাশ করেছেনঃ
১. কুরআন ইসলামের পূর্ণ জীবন বিধান।
২. কুরআন মুসলমানদের সর্বোত্তম জীবন বিধান।
৩. কুরআনের সকল কাহিনী ও বর্ণনা শিক্ষা ও উপদেশমূলক।
৪. এতে সকল জাতি-গোষ্ঠীর মোটামুটি আলোচনা এসেছে।
কোন ব্যক্তি যদি এইভাবে কুরআনকে দেখে তাহলে তাঁর জ্ঞানের পরিধি যে কত বিস্তৃত, গভীর ও সূক্ষ্ণ হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই হযরত উবাই কুরআনের সাথে অস্বাভাবিক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাসূল সা. মদীনায় আগমনের পর অহী লেখার সর্বপ্রথম গৌরব তিনিই অর্জন করে। (আল-ইসাবা- ১/১৭) তখন থেকেই তাঁর মধ্যে কুরআন হিফ্জ করার প্রবণতা দেখা দেয়। যতটুকু কুরআন অবতর্ণি হতো তিনি হিফ্জ করে ফেলতেন। এভাবে রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় সমগ্র কুরআন হিফ্জ শেষ করেন। আনসারদের যে পাঁচ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ কুরআন হিফ্জ করেন তাদের মধ্যে উবাইয়ের স্থঅন ছিল সর্বোচ্চে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৯৫) মদীনার খাযরাজ গোত্রের লোকেরা গর্ব করে বলতোঃ আমাদের গোত্রের চার ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় সমগ্র কুরআন সংগ্রহ করেনি। তাদের অন্যতম হলেন উবাই ইবন কা’ব। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৯৫)
হযরত উবাই পবিত্র কুরআনের প্রতিটি হরফ রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মুখ থেকে শুনে হিফ্জ করেন। রাসূলও সা. অত্যাধিক আগ্রহ দেখে তাঁর শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেন। রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা ও ভীতির কারণে অনেক বিশিষ্ট সাহাবী অনেক সময় তাঁর কাছে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতেন; কিন্তু উবাই নিঃসংকোচে যা ইচ্ছা তাই প্রশ্ন করতেন। তাঁর এই আগ্রহের কারণ রাসূলও সা. মাঝে মাঝে প্রশ্ন করার আগেই তাঁকে অনেক কথা বলে দিতেন। একবার তাঁকে বললেনঃ আমি তোমাকে এমন একটি সূরার কথা বলছি, তাওরাত ও ইনজীলে যার সমকক্ষ কোন কিছু নেই। এমন কি কুরআনেও এর মত দ্বিতীয়টি নেই। এতটুকু বলে তিনি অন্য কথায় চলে গেলেন। উবাই বলেন, আমার ধারণা ছিল তিনি বলে দিবেন; কিন্তু তা না বলে বাড়ী যাওয়ার জন্য উঠে পড়লেন। আমি পিছনে পিছনে চললাম। এক সময় তিনি আমার হাত মুট করে ধরে কথা বলতে আরম্ভ করলেন এবং বাড়ীর দরজা পর্যন্ত পৌঁছলেন। তখন আমি সেই সূরাটির নাম বলার জন্য ’আরজ করলাম। তিনি সূরাটির নাম আমাকে বলে দিলেন। (মুসনাদ- ৫/১১৪)
একবার হযরত রাসূলে কারীম সা. ফজরের নামায পড়ালেন এবং একটি আয়াত ভুলে বাদ পড়ে গেল। হযরত উবাই মাঝখানে নামাযে শরীক হন। নামায শেষে রাসূল সা. প্রশ্ন করলেন, তোমাদের কেউ কি আমার কিরআতের প্রতি মনোযোগী ছিলে? লোকেরা কেউ কোন জবাব দিল না। তিনি আবার জানতে চাইলেন, উবাই ইবন কা’ব আছ কি? হযরত উবাই ততোক্ষণে বাকী নামায শেষ করেছেন। তিনি বলে উঠলেন, আপনি অমুক আয়াতটি পাঠ করেননি। আয়াতটি কি ‘মানসুখ’ (রহিত) হয়েছে নাকি আপনি পড়তে ভুলে গেছেন? রাসূল সা. বললেনঃ মানসুখ হয়নি, আমি পড়তে ভুলে গেছি। আমি জানতাম তুমি ছাড়া আর কেউ হয়তো এইদিকে মনোযোগী হবে না। (মুসনাদ- ৫/১২৩, ১৪৪)
উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোন বিষয় হযরত উবাইয়ের বোধগম্য না হলে অন্য সাহাবীদের মত চুপ থাকতেন না; বরং বিষয়টি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে আলোচনা করতেন এবং বুঝে আসার পরই উঠতেন। একবার মসজিদে ববীতে হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ রা. একটি আয়াত পাঠ করলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন হুজায়ল গোত্রের লোক, এ কারণে তাঁর উচ্চারণে একটু ভিন্নতা ছিল। হযরত উবাই তাঁর পাঠ শুনে প্রশ্ন করেনঃ আপনি এই আয়াত কার কাছে শিখেছেন? আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আয়াতটির পাঠ এভাবে শিখেছি। ’আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বললেনঃ আমাকেও তো রাসূল সা. শিখিয়েছেন। উবাই বলেন, সেই সময় আমার অন্তরে ভ্রান্ত ধারণার প্রবাহ বয়ে যেতে লাগলো। আমি ইবন মাস’উদকে সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হয়ে ’আরজ করলামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার ও তাঁর কুরআন পাঠে তারতম্য দেখা দিয়েছে। রাসূল সা. আমার পাঠ শুনলেন এবং বললেনঃ তুমি ঠিক পড়েছ। তারপর ইবন মাস’উদের পাঠ শুনে বললেনঃ তুমিও ফিক পড়েছ। আমি হাত দিয়ে ইশারা করে বললামঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! দুইজনের পাঠই সঠিক হয় কি করে?’ এতক্ষণে হযরত উবাই ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন। রাসূলসা. এ অবস্থা দেখে তাঁর বুকের ওপর হাত রেখে বললেনঃ ‘হে আল্লাহ! উবায়ের সংশয় দূর করে দাও।’ পবিত্র হাতের স্পর্শে তাঁর হৃদয়ে পূর্ণ প্রত্যয় নেমে আসে।
কিরায়াত শাস্ত্রে হযরত উবাই ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ। এই বিষয়ে তিনি এত পারদর্শী ছিলেন যে, স্বয়ং রাসূল সা. তাঁর প্রশংসা করেছেন। সাহাবা-ই-কিরামের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তির বিশেষত্ব রাসূল সা. নিজে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেইসব মহান ব্যক্তির একজন হযরত উবাই। তাঁর সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আকরাহুম উবাই’- তাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্বারী উবাই। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৬) মাসরূক থেকে বর্ণিত, রাসূল সা বলেছেনঃ তোমরা ইবন মাস’উদ, উবাই ইবন কা’ব, মু’য়াজ ইবন জাবাল ও সালিম মাওলা আবী হুজায়ফা- এই চারজনের নিকট থেকে কুরআনের জ্ঞান অর্জন করবে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/২৬৪)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর হযরত ’উমার রা. উবাই সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. এসব বাণী অনেকবার মানুষকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেন। একবার মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেনঃ উবাই সবচেয়ে বড় ক্বারী। সিরিয়া সফরের সময় ‘জাবিয়া’ নামক স্থানের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি আর একবার বলেনঃ তোমাদের কেউ কুরআন শিখতে চাইলে সে যেন উবাইয়ের কাছে আসে। (মুসনাদ- ৫/১২৩; হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০১) হযরত ’উমার তাঁকে সায়্যিদুল মুসলিমীন নামে আখ্যায়িত করেছেন। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৯; তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৭; আল-ইসাবা- ১/১৯)
হযরত রাসূলে কারীম সা. নিজে উবাইকে কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতেন। যে বছর তিনি ইনতিকাল করেন সে বছরও উবাইকে কুরআন শোনান। আর একথাও বলেন যে, জিবরীল আমাকে বলেছেন, আমি যেন উবাইকে কুরআন শুনাই।
যখনই কুরআনের যে আয়াতটি বা সূরাটি নাযিল হতো রাসূল সা. উবাইকে পাঠ করে শোনাতেন। শুধু তাই নয়, মুখস্ত করিয়ে দিতেন। যখন সূরা ‘আল-বায়্যিনাহ’ নাযিল হয় তখন তিনি উবাইকে ডেকে বলেন, আল্লাহ তোমাকে কুরআন শিখানোর জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। উবাই তখন খুশীর আতিশয্যে কেঁদে ফেলেন। (আল-ইসাবা- ১/১৯) আবদুর রহমান ইবন আবী আবযা নামক উবাইয়ের এক ছাত্র উস্তাদের এই ঘটনা অবগত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আবুল মুনজির! সম্ভবতঃ সেই সময় আপনি বিশেষ পুলক ও আনন্দ অনুভব করেছিলেন? উবাই বললেনঃ কেন করবো না? একথা বলে তিনি সূরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতটি পাঠ করেন। (মুসনাদ- ৪/১১৩) কিরায়াত শাস্ত্রে তাঁর পারদর্শিতার কারণে বিশেষ এক ধরণের কিরায়াত সেখানে তাঁর নাম চালু হয় এবং ‘কিরায়াতে উবাই’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বিশেষতঃ দিমাশ্কবাসীদের মধ্যে তা বেশী প্রচলিত ছিল।
হযরত উবাইয়ের জীবদ্দশায় তাঁর কিরায়াত সারা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে গৃহীত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। কারণ অনেক মানসূখ (রহিত) আয়াত তাঁর পাঠে বিদ্যমান ছিল। আর এ জন্য হযরত ’উমার রা. তাঁর মর্যাদা উচ্চ কণ্ঠে স্বীকার করা সত্ত্বেও বহুবার বহু ক্ষেত্রে উবাইয়ের সাথে কুরআন পাঠের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বার বার বলেছেন, উবাই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী কুরআন জানেন। তা সত্ত্বেও কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদেরকে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে হয়েছে। তিনি দাবী করে থাকেন, সবকিছুই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে শিখেছেন। তাঁর দাবী অবশ্যই সত্য। কিন্তু যখন দেখা যায় বহু আয়াত মানসূখ (রহিত) হয়েছে অথচ তিনি তা জানেন না, তখন তাঁর কিরায়াতের ওপর আমরা কেমন করে অটল থাকতে পারি? (মুসনাদ- ৫/১১৩)
তবে পরবর্তীকালে তিনি সংশোধন হয়ে যান। হযরত ’উসমানের খিলাফতকালে যখন কুরআন সংকলন করা হয় তখন মানসূখ আয়াতের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। তখন উবাইয়ের কিরায়াত সর্বজন স্বীকৃতি লাভ করে এবং সমগ্র মুসলিম খিলাফতে চালু হয়। (দ্রঃ সীয়ারে আনসার- ১/১৬২-৬৩)
হযরত উবাই রা. মৃত্যুর সময় তাঁর কিরায়াত শাস্ত্রে দুইজন যোগ্য উত্তরসূরী রেখে যান যাঁরা বিশ্ব মুসলিমের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁরা হলেনঃ হযরত আবূ হুরাইরা ও হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস রা.। পরবর্তীকালে বিখ্যাত সাত ক্বারীর মধ্যে নাফে ’ইবন কাসীর মাক্কীর সনদ আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাসের মাধ্যমে হযরত উবাই ইবন কা’বে গিয়ে মিলিত হয়েছে।
সেকালে হযরত উবাইয়েল ‘মাদরাসাতুল কিরায়াহ’ (কিরায়াত শাস্ত্রের শিক্ষালয়) একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। আরব, রোম, শাম এবং ইসলামী খিলাফতের নানা অঞ্চলের ছাত্ররা মদীনায় এসে তাঁর শিক্ষালয়ে কিরায়াত শিখতো। বহু বড় বড় সাহাবী দূর-দূরান্ত থেকে উৎসাহী লোকদের সাথে করে মদীনায় নিয়ে আসতেন এবং উবাইয়ের মাদরাসায় ভর্তি করে দিতেন। হযরত ’উমার তাঁর খিলাফতকালে হযরত আবূ দারদা আল-আনসারীকে রা. লোকদের কুরআন শিক্ষাদানের জন্য শামে পাঠান। তিনি ছিলেন সেই পাঁচ রত্নের অন্যতম যাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় গোটা কুরআন হিফ্জ করেন। তা সত্ত্বেও তিনি উবাইয়ের কিরায়াতের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। একবার হযরত ’উমারের খিলাফতকালে শামবাসীদের একটি দল সংগে নিয়ে তিনি মদীনায় উবাইয়ের নিকট আসেন। তাঁর নিকট তাঁদের সাথে তিনি নিজেও কুরআন পড়েন।
ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যাপারে হযরত উবাইয়ের যদিও বিশেষ আগ্রহ ছিল, তবে মেজায ছিল এক্টু উগ্র। এই কারণে তাঁর ধৈর্য খুব শিগগিরই ক্রোধে পরিণত হন। তিনি ক্ষেপে যান এই ভয়ে ছাত্ররা প্রশ্ন করতে ভয় পেত। হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদের ছাত্র যার ইবন জা’য়শ, যিনি হযরত উবাইয়ের ছাত্র হওয়ার গৌরবও অর্জন করেন- একদিন তাঁকে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করেন, কিন্তু সাহস পাননি। একদিন এভাবে ভূমিকা দিয়ে একটি প্রশ্ন করেনঃ ‘আমার প্রতি একটু অনুগ্রহের দৃষ্টি দিন। আমি আপনার নিকট থেকে ইলম হাসিল করতে চাই।’ উবাই বললেনঃ হুঁ, সম্ভবতঃ তোমার ইচ্ছা, কুরআনের কোন আয়াত যেন জিজ্ঞাসা থেকে বাকী না থাকে।
এই কারণে তাঁর মজলিস অর্থহীন প্রশ্ন থেকে মুক্ত থাকতো। তিনি সম্ভাব্য কোন সমস্যার উত্তর দিতেন না; বরং অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। একদিন তাঁর ছাত্র পখ্যাত তাবে’ঈ মাসরূক এমন একটি পশ্ন করলে বললেনঃ এমনও কি আছে? মাসরূক বললেনঃ না। তিনি বললেনঃ তাহলে অপেক্ষা কর। যখন তেমন অবস্থা হয় তখন তোমার জন্য ইজতিহাদের কষ্ট স্বীকার করা যাবে। তবে যুক্তি সঙ্গত প্রশ্ন করা হলে তিনি খুশী হতেন।
জুনদুব ইবন ’আবদুল্লাহ আল-বাজালী বলেনঃ আমি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে মদীনায় গেলাম, রাসূলুল্লাহর সা. মসজিদে উপস্থিত হয়ে দেখলাম লোকেরা বিভিন্ন স্থানে হালকা করে বসে আলোচনা করছে। আমি একটি হালকার কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলাম তার মধ্যস্থলে একজন বিমর্ষ লোক, পরনে তার দুই প্রস্থ কাপড়। তিনি যেন এই মাত্র সফর থেকে এসেছেন। আমি তাঁকে বলতে শুনলামঃ ‘ক্ষমতাসীন শাসকরা ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের প্রতি আমার কোন সমবেদনা নেই।’ আমি বসলাম। তিনি কিছু কথা বলার পর চলে গেলেন। আমি মানুষের নিকট জিজ্ঞেস করলামঃ ইনি কে? তারা বললোঃ ইনি সায়্যিদুল মুসলিমীন উবাই ইবন কা’ব। আমি পিছনে পিছনে তাঁর বাড়ীতে গেলাম। বাড়ীটি অতি সাধারণ ভাঙ্গাচোরা। তিনি যেন দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার প্রতি উদাসীন এক সাধক। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে প্রশ্ন করলেনঃ কোথা থেকে আসা হয়েছে? বললামঃ ইরাক থেকে তিনি বললেনঃ লোকেরা আমাকে খুব বেশী প্রশ্ন করে। একথা শুনে আমি একটু ক্ষুণ্ন হলাম। আর কথা না বাড়িয়ে সোজা আমার বাহনের দিকে যেতে যেতে হাত উঁচিয়ে বলতে লাগলামঃ হে আল্লাহ আমি তোমার কাছে অভিযোগ পেশ করছি। আমরা অর্থ-কড়ি খরচ করে, দৈহিক ক্লেশ-ভোগ করে, বাহন ছুটিয়ে ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে আলিমদের নিকট যাই, আর তাঁর কিনা আমাদের সাথে রূঢ় ব্যবহার করেন। আমার একথা শুনে উবাই কেঁদে ফেলেন এবং আমাকে খুশী করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেনঃ ‘যদি তুমি আমাকে জুম’আর দিন পর্যন্ত সময় দাও তাহলে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে আমি যা শুনেছি তার কিছু তোমাদের শোনাবো। এ ব্যাপারে কারো কোন সমালোচনার পরোয়া করবো না।’ আমি ফিরে এসে জুম’আ বারের অপেক্ষা করতে লাগলাম। বৃহস্পতিবার কোন প্রয়োজনে আমি বের হয়ে দেখি মদীনার সব অলি-গলি লোকে লোকারণ্য। আমি মানুষকে জিজ্ঞেস করলামঃ কী ব্যাপার? লোকেরা অবাক হয়ে বললোঃ মনে হচ্ছে আপনি বিদেশী। বললামঃ হাঁ। তখন তারা বললো। সায়্যিদুল মুসলিমীন উবাই ইবন কা’বের ইনতিকাল হয়েছে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২০৬)
হযরত উবাইয়ের জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ, তবে গাম্ভীর্যপূর্ণ। বাড়ীর ভিতরে এবং বাইরে উভয় স্থানে গদীর ওপর বসতেন, আর ছাত্ররা বসতেন সাধারণ সারিতে। মজলিসে আসা এবং মজলিস থেকে যাওয়ার সময় তাঁর সম্মানে ছাত্ররা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। সে যুগে এই নিয়ম ছিল সম্পূর্ণ নতুন। একবার সুলায়ম ইবন হানজালা কোন একটি মাসয়ালা জানার জন্য উবাইয়ের নিকট আসলেন। যখন উবাই উঠলেন তখন ছাত্ররা তাঁর পিছনে চলতে শুরু করলো। হযরত ’উমার এ অবস্থা দেখে খুব অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেনঃ এটা আপনার জন্য ফিত্না এবং তাদের জন্য অপমান। (কানযুল ’উম্মাল- ৮/৬১; হায়াতুস সাহাবা- ১/৬৯৮)
প্রথম জীবনে তিনি ছাত্রদের নিকট থেকে হাদীয়া তোহফা গ্রহণ করতেন। হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবনকালে একবার তুফাইল ইবন ’আমর আদ-দাওসীকে কুরআন শিখিয়েছিলেন। তিনি একটি ধনুক হাদীয়া দেন। উবাই ধনুকটি কাঁধে ঝুলিয়ে রাসূলুল্লাহর সা খিদমতে হাজির হন। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করেনঃ এটা কোথায় পেয়েছ? বললেনঃ একজন ছাত্রের হাদীয়া। রাসূল সা. বললেনঃ তাকে ফিরিয়ে দাও। ভবিষ্যতে এমন হাদীয়া থেকে দূরে থাকবে।
আর একবার একজন ছাত্র কাপড় হাদীয়া দেয়। সেবারও একই অবস্থা দেখা দেয়। এই কারণে পরবর্তীকালে কোন রকম হাদীয়া তোহফা গ্রহণ করতেন না। শামের লোকেরা যখন তাঁর নিকট কুরআন শিখতে আসে, তখন তারা মদীনার কাতিবদের (লেখক) দ্বারা কুরআন লিখিয়েও নিত। বিনিময়ে তারা লেখকদের আহার করিয়ে পরিতুষ্ট করতো। কিন্তু হযরত উবাই কোন দিন তাদের কোন খাবারে হাত দেননি। হযরত ’উমার রা. একদিন তাঁকে প্রশ্ন করেন, শামীদের খাবার কেমন? তিনি বলেনঃ আমি তাদের খাবার খাইনা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৪১)
কিরায়াত শিক্ষাদানের সময় হরফের যথাযথ উচ্চারণের প্রতি জোর দিতেন। এতে মদীনা ও তার আশে-পাশের লোকদের তেমন অসুবিধা হতো না। তবে মরু-বেদুঈন ও অন্য দেশের অধিবাসী, যারা আরবী বর্ণ-ধ্বনির বিশুদ্ধ উচ্চারণ জানতো না তাদের নিয়ে কঠিন সমস্যায় পড়তেন। অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে এই সমস্যার সমাধান করতেন। হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবদ্দশায় এক ইরানীকে তিনি কুরআন শিখাতেন। যখন আদ-দুখানের ৪৩ নং আয়াত ‘ইন্না শাজারাতুজ যাকুম, তা’য়ামুল আছীম’ পর্যন্ত পৌঁছেন তখন লোকটির ‘আছীম’ শব্দের উচ্চারণে বিভ্রাট দেখা দেয়। হযরত উবাই উচ্চারণ করে ‘আছীম’ আর লোকটি উচ্চারণ করে ‘ইয়াতীম’। একদিন উবাই তাকে শব্দটির উচ্চারণ মশ্ক করাচ্ছেন, এমন সময় রাসূল সা. সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি উবাইয়ের অস্থিরতা ও দুঃশ্চিন্তা দেখে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি ইরানী লোকটিকে প্রথমে বলেনঃ বল, ‘তা’য়ামুজ জালিম’। লোকটি পরিষ্কারভাবে তা উচ্চারণ করলো। তখন তিনি উবাইকে বললেনঃ প্রথমে তার জিহ্বা ঠিক কর এবং তাকে বর্ণ-ধ্বনির উচ্চারণ শিখাও। আল্লাহ তোমাকে প্রতিদান দিবেন।
হযরত উবাই রা. রাসূলুল্লাহর সা. নিকট যতটুকু কুরআন পড়তেন, ঘরে ফিরে তা লিখে রাখতেন। কিরায়াত শাস্ত্রের ইতিহাসে এই কুরআনই ‘মাসহাফে উবাই’ নামে প্রসিদ্ধ। এই মাসহাফ হযরত ’উসমানের রা. খিলাফতকাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এই মাসহাফের খ্যাতি ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। হযরত উবাইয়ের ইনতিকালের পর তাঁর পুত্র মুহাম্মাদ মদীনায় বসবাস করতেন। একবার ইরাক থেকে কিছু লোক তাঁর নিকট এসে বললো, আমরা আপনার পিতার মাসহাফ শরীফ দেখার জন্য এসেছি। তিনি বললেনঃ তা তো আমাদের নিকট নেই, খলীফা উসমান তা নিয়ে নিয়েছিলেন।
হযরত উবাই ছিলেন কুরআনের মুফাস্সির (ভাষ্যকার) সাহাবীদের অন্যতম। এই শাস্ত্রের বড় একটি অংশ তাঁর থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবূ জা’ফর আর রামী তার বর্ণনাকারী। মাত্র তিনটি মাধ্যমে এই সনদ হযরত উবাই পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই শাস্ত্রে হযরত উবাইয়ের বহু ছাত্র ছিল। তাফসীরের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁদের বর্ণনা ছড়িয়ে রয়েছে। তবে তার সিংহভাগ আবুল আলীয়্যার মাধ্যমে আমাদের নিকট পৌঁছেছে। এই আবুল আলীয়্যার ছাত্র রাবী ইবন আনাস। ইমাম তিরমিযীর সনদের ধারাবাহিকতা এই রাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে। উবাইয়ের তাফসীরের বর্ণনাসমূহ ইবন জারীর ও ইবন আবী হাতেম প্রচুর পরিমাণে নকল করেছেন। হাকেম তাঁর মুসতাদরাকে এবং ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে কিছু বর্ণনা সংকলন করেছেন।
তাফসীর শাস্ত্রে হযরত উবাই থেকে দুই রকম রিওয়ায়াত (বর্ণনা) আছে। ১. তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. যে সকল প্রশ্ন করেন এবং রাসূল সা. তার যে সকল জবাব দেন, তাই। ২. এমন সব তাফসীর যা খোদ উবাইয়ের প্রতি আরোপ করা হয়েছে। প্রথম প্রকারের তাফসীর, যেহেতু তা রাসূল সা. থেকে বর্ণিত হয়েছে এ কারণে তা ঈমান ও ইয়াকীনের স্তরে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকারের তাফসীর হচ্ছে হযরত উবাইয়ের মতামত ও সিদ্ধান্তের সমষ্টি। তার কোনটিকে তাফসীরুল কুরআন বিল কুরআন (কুরআনের দ্বারা কুরআনের তাফসীর)- এর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, কোনটিকে সমকালীন চিন্তা-বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে, আবার কোনটিতে ইহুদী বর্ণনার প্রভাব পড়েছ্ আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এ সবের উর্ধে উঠে একজন মুজতাহিদের মত নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মূলতঃ এটাই তাঁর তাফসীর শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ অবদান। শানে নুযূল বিষয়ে তাঁর থেকে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। তাফসীরের বিভিন্ন গ্রন্থে তা ছড়িয়ে রয়েছে।
সাহাবা-ই-কিরামের মধ্যে যাঁদেরকে হাদীসের বিশেষজ্ঞ বলা হয় উবাই ইবন কা’ব তাঁদের অন্যতম। আল্লামা জাহাবী বলেছেনঃ উবাই ছিলেন সেই সকল ব্যক্তির একজন যাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে হাদীসের বিরাট এক অংশ শুনেছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/১৬) এই কারণে আলিম সাহাবীদের মধ্যে যাঁদের নিজস্ব হালকা-ইদারস ছিল তাঁরাও উবাইয়ের হালকা-ই-দারসে শরীক হওয়াকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করতেন। আর এই কারণে তাঁর হালকা-ই-দারসে তাবে’ঈদের চেয়ে সাহাবীদের সমাবেশ ঘটতো বেশী। হযরত ’উমার ইবনুল খাত্তাব, আবূ আইউব আল-আনসারী, উবাদাহ ইবন সামিত, আবূ হুরাইরা, আবূ মূসা আল-আশ’য়ারী, আনাস ইবন মালিক, ’আবদুল্লাহ ইবন ’আব্বাস, সাহল ইবন সা’দ, সুলায়মান ইবন সুরাদ রা. প্রমুখের মত উঁচু স্তরের সাহাবীরা উবাইয়ের দারসে বসাকে গৌরবের বিষয় মনে করতেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ- ১/১৭) তাঁর দারসের নির্দিষ্ট সময় ছিল। তবে তাঁর জ্ঞান ভান্ডার সবার জন্য সর্বক্ষণ উন্মুক্ত ছিল। যখন তিনি নামাযের জন্য মসজিদে নববীতে আসতেন তখন কেউ কিছু জানতে চাইলে মাহরূম করতেন না।
কায়স ইবন ’আববাদ সাহাবীদের দীদার লাভে ধন্য হওয়ার জন্য একবার মদীনায় আসেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ ‘আমি মদীনায় উবাই ইবন কা’ব অপেক্ষা অধিকতর বড় কোন ’আলিম পাইনি। নামাযের সময় হলে মানুষ সমবেত হলো। জনগণের মধ্যে হযরত ’উমারও ছিলেন। হযরত উবাই কোন একটি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষাদানের প্রয়োজন অনুভব করলেন। নামায শেষে তিনি দাঁড়ালেন এবং সমবেত জনমন্ডলীর নিকট রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস পৌঁছলেন। জনতা অত্যন্ত আগ্রহ ও আবেগের সাথে নীরবে তাঁর কথা শুনছিল।’ হযরত উবাইয়ের এমন সম্মান ও মর্যাদা দেখে কায়স আজীবন মুগ্ধ ছিলেন।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে হযরত উবাই ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ও সতর্ক। এ কারণে জীবনে বিরাট এক অংশ রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্যে কাটালেও খুব বেশী হাদীস তিনি বর্ণনা করেননি। ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাঁর বর্ণিত ১৬৪ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল-আ’লাম- ১/৭৮)
সাহাবা-ই-কিরামের মধ্যে যাঁদের ইজতিহাদ ও ইসতিম্বাতের যোগ্যতা ছিল, উবাই তাঁদের অন্যতম। হযরত রাসূলে কারীমের সা. জীবনকালেই তিনি ফাতওয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। হযরত আবূ বকরের রা. খিলাফত কালেও সিদ্ধান্তদানকারী ফকীহদের মধ্যে গণ্য ছিলেন। বিন সা’দ বর্ণনা করেনঃ আবূ বকর রা. কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যাঁরা চিন্তাশীল ও সিদ্ধান্তদানকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁদের সাথে পরামর্শ করতেন। এই সকল ব্যক্তির একজন ছিলেন উবাই ইবন কা’ব। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৫) হযরত ’উমার ও হযরত ’উসমানের খিলাফতকালেও তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইবন সা’দ, সাহল ইবন আবী খায়সামা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহর সা. যুগে তিনজন মুহাজির ও তিনজন আনসার ফাতওয়া দিতেন। তাঁরা হলেনঃ ’উমার, ’উসমান, আলী, উবাই, মু’য়াজ ও যায়িদ ইবন সাবিত। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৫৪)
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা বিষয়ে তাঁর নিকট ফাতওয়া চাওয়া হতো। এই ফাতওয়া তলবকারীদের মধ্যে সম্মানিত সাহাবা-ই-কিরামও থাকতেন। সুমরাহ্ ইব জুনদুব ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সাহাবী। তিনি নামাযে তাকবীর ও সূরা পাঠের পর একটু দেরী করতেন। লোকেরা আপত্তি জানালো। তিনি হযরত উবাইকে লিখলেন, এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য আমাকে অবহিত করুন, আমি ভুলে গেছি। হযরত উবাই সংক্ষিপ্ত জবাব লিখে পাঠান। তাতে তিনি বলেনঃ আপনার পদ্ধতি শরীয়াত অনুসারী। আপত্তি উত্থাপনকারীরা ভুল করছে। (কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৫১)
তাঁর ইজতিহাদের পদ্ধতি ছিল, প্রথমে কুরআনের আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা, তারপর সেই বিষয়ে হাদীসের সন্ধান করা। আর যখন কোন বিষয়ে কুরআন হাদীস সম্পটর্কে কিছু না পেতেন তখন কিয়াস বা অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
হযরত ’উমারের নিকট এক মহিলা এসে দাবী করলো যে, সে যখন গর্ভবতী তখন তার স্বামী মারা গেছে। এখন সে সন্তান প্রসব করেছে; কিন্তু ‘ইদ্দতের সময় সীমা পূর্ণ হয়নি, এ বিষয়ে সে খলীফার মতামত চাইলো। খলীফা ’উমার বললেনঃ ’ইদ্দতের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মহিলা উঠে উবাই ইবন কা’বের নিকট গেল এবং ’উমারের নিকট তার যাওয়া, ফাতওয়া জিজ্ঞেস করা ইত্যাদি তাঁকে অবহিত করলো। উবাই বললেনঃ তুমি ’উমারের কাছে আবার যাও এবং তাঁকে বল, উবাই বলেছেনঃ মহিলার ’ইদ্দত পূর্ণ হয়ে হালাল হয়ে গেছে। যদি তিনি আমার কথা জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলবে, আমি এখানে বসে আছি, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাবে। মহিলা ’উমারের নিকট ফিরে গেল। ’উমার রা. উবাইকে ডেকে পাঠালেন। তিনি হাজির হলে ’উমার জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি একথা কিভাবে বললেন এবং কোথায় পেলেন? তিনিবললেনঃ কুরআনে পেয়েছি। এই বলে তিনি সূরা আত-তালাকের ৪ নং আয়াত- ‘ওয়া উলাতিল আহমালি আজালুহুন্না আন ইয়াদা’না হামলাহুন্না-’ পাঠ করেন। তারপর বলেন, যে গর্ভবতী মহিলা বিধবা হবে সেও এই বিধানের অন্তর্গত। তাছাড়া রাসূল সা. থেকে এ সম্পর্কে একটি হাদীসও শুনেছি। হযরত ’উমার মহিলাকে বললেনঃ উবাইয়ের কথা শোন। (কানযুল ’উম্মাল- ৫/১৬৬)
রাসূলুল্লাহর সা. চাচা হযরত ’আব্বাসের রা. বাড়ীটি ছিল মসজিদে নববীর সংলগ্ন। হযরত ’উমার রা. যখন মসজিদ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি ’আব্বাসকে রা. বলেন, মসজিদ বানাতে হবে, বাড়ীটি বিক্রী করে দিন। ’আব্বাস বললেন, না, আমি বিক্রী করবো না। ’উমার বললেন, তাহলে বাড়ীটি মসজিদের অনুকূলে হিবা (দান) করে দিন। এ প্রস্তাবেও তিনি রাজী হলেন না। ’উমার তখনবরলেনঃ তাহলে আপনি নিজে মসজিদটি সম্প্রসারণ করে দিন এবং আপনার বাড়ীটিও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন। ’আব্বাস রাজী হলেন না। ’উমার রা. বললেনঃ এই তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি আপনাকে মানতে হবে। অবশেষে দু’জনই উবাই ইবন কা’বকে শালিস মানলেন। তিনি ’উমারকে রা. প্রশ্ন করলেনঃ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারও জিনিস কেড়ে নেওয়ার অধিকার আপনি কোথায় পেলেন? ’উমার জানতে চাইলেন, এ বিধান কুরআন না হাদীসে পেয়েছেন? বললেনঃ হাদীসে। তারপর বলেনঃ হযতে সুলাইমান বাইতুল মাকদাসের প্রাচীর নির্মাণ করেন। প্রাচীরের একাংশ অন্যের জমিতে নির্মিত হয় এবং তা ধ্বসে পড়ে। অতঃপর হযরত সুলাইমানের নিকট ওহী আসে যে, জমির মালিকের অনুমতি নিয়ে তা পুনঃনির্মাণ করবে। একথা শুনে হযরত ’উমার চুপ হয়ে যান। এই ঘটনার পর হযরত ’আব্বাস স্বেচ্ছঅয় মসজিদের জন্য বাড়ীটি দান করেন। (হায়াতুস সাহাব- ১/৯৪, ৯৫)
সুওয়ায়দ ইবন গাফলা, যায়িদ ইবন সুজান ও সুলাইমান ইবন রাবী’য়ার সাথে কোন এক অভিযানে যান। পথে ‘উজায়ব’ নামক স্থানে একটি চাবুক পড়ে থাকতে দেখে উঠিয়ে নেন। তাঁর অপর সঙ্গীদ্বয় বললেন, আপনি ওটা ফেলে দিন। তিনি ফেললেন না। এই ঘটনার কিছু দিন পর সুওয়ায়দ হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে মদীনায় যাত্রা বিরতি করে হযরত উবাইয়ের নিকট যান এবং চাবুকের ঘটনা বর্ণনা করেন। উবাই বললেন; আমার জীবনে একবার এমন ঘটনা ঘটেছিল। রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় একবার আমি একশো দীনার পথে পাই। তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, এক বছর পর্যন্ত মানুষকে জানাতে থাকবে। একবছর পূর্ণ হলে বললেন, দীনারের পরিমাণ, থলির অবস্থা সব ভালোভাবে মনে রেখে আরও এক বছর অপেক্ষা করবে। এর মধ্যে প্রমাণসহ কেউ উপস্থিত হলে তাকে দেবে। অন্যথায় তুমি মালিক হবে।
হযরত ’উমার রা. একবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন যে, তিনি মানুষকে ‘তামাত্তু’ হজ্জ আদায় করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করবেন। উবাই তাঁকে বললেন, এমন নিষেধাজ্ঞা জারির কোন ইখতিয়ার আপনার নেই।
হযরত উবাই ‘কিরায়াত খালফাল ইমাম’ (ইমামের পিছনে কিরায়াত পাঠ)- এর প্রবক্তা ছিলেন। তবে তার রূপ ছিল এমনঃ যুহর ও ’আসরের ফরয নামাযে ইমামের পিছনে কিরায়াত পাঠ করতেন। একবার ’আবদুল্লাহ ইবন হুজায়ল তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ইমামের পিছনে কিয়ারাত পড়েন? বললেনঃ হাঁ। (কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৫৪) তিনি সূরা আল-আ’রাফের ২০৪ নং আয়াত ‘ওয়া ইজা কুরিয়াল কুরআন ফাসতামি’উ লাহু ওয়া আনসিতু-’ যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শোন এবং চুপ থাক- এর বাহ্যিক অর্থের ওপর ’আমল করতেন। যুহর ও আসরে ইমাম যখন চুপে চুপে কিরায়াত পড়েন তখন তো শোনার প্রশ্ন আসেনা। সুতরাং তাঁ রমতে যে নামাযে ইমাম জোরে কিরায়াত পাঠ করবেন সেখানে মুক্তাদী চুপ করে শুনবেন। আর যেখানে ইমাম চুপে চুপে পাঠ করবেন সেখানে মুক্তাদীও কিরায়াত পাঠ করবেন।
একবার এক ব্যক্তি মসজিদে একটি হারানো জিনিসের ব্যাপারে হৈ চৈ করছিল। হযরত উবাই রেগে গেলেন। লোকটি বললো, আমি তো অশ্লীল কিছু বলছিনে। উবাই বললেন, অশ্লীল না হলেও এটা মসজিদের আদবের খেলাফ। (কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৫০)
আর একবার রাসূল সা. জুম’আর খুতবা দিলেন এবং সূরা বারায়াত থেকে পাঠ করলেন। এই সূরাটি হযরত আবূ দারদা ও আবূ জারের রা. জানা ছিল না। তাঁরা খুতবার মধ্যেই ইশারায় উবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, এই সূরাটি কবে নাযিল হয়েছে, আমাদের তো জানা নেই? উবাইও ইশারায় তাদেরকে চুপ থাকতে বললেন। নামায শেষে তিনজনই নিজ নিজ বাড়ীতে ফেরার জন্য রওয়ানা হচ্ছেন, তখন অন্য দু’জন উবাইকে বললেন, আপনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কেন? উবাই বললেনঃ আজ আপনাদের নামায নষ্ট হয়ে গেছে, আর তাও একটি অহেতুক কারণে। এমন কথা শুনে তাঁরা হযরত রাসূল কারীমের সা. নিকট হাজির হলেন এবং বললেনঃ উবাই আমাদেরকে এমন কথা বলেছেন। তিনি বললেনঃ সে ঠিক কথাই বলেছে। (কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৫৫)
ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে হযরত উবাই বলতেন, তিন রকম লোকের জন্য তিন রকম হুকুম আছে। কিছু লোক দুররা ও রজম উভয় প্রকার শাস্তির যোগ্য। কিছু লোক শুধু রজম এবং কিছু শুধু দুররার শাস্তি লাভের উপযুক্ত। যে বৃদ্ধ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ব্যভিচার করে তাকে উভয় শাস্তি দিতে হবে। আর যে যুবক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ব্যভিচার করে তাকে শুধু রজম করতে হবে। যে যুবকের স্ত্রী নেই সে ব্যভিচার করলে তাকে শুধু দুররা লাগাতে হবে।
নাবীজ (খেজুরের শরবত) হালাল হওয়া সম্পর্কে সকল ’আলিম প্রায় একমত। তবে উবাই থেকে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, নাবীজের মধ্যে এমন কী দেখেছ? পানি, ছাতুর শরবত, দুধ ইত্যাদি পান কর। প্রশ্নকারী বললো, মনে হচ্ছে আপনি নাবীজ পানের সমর্থক নন। তিনি বললেন, মদ পান আমি কিভাবে সমর্থন করতে পারি?
এভাবে বিভিন্ন মাসয়ালা সম্পর্কে হযরত উবাইয়ের মতামত গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে ফকীহ সাহাবীদের মধ্যে তাঁর যে উঁচু মর্যাদ ছিল সে সম্পর্কে স্পষ্টধারণা লাভ করা যায়।
হযরত উবাই লিখতে-পড়তে জানতেন। এ করণে ওহীর বেশীর ভাগ আয়াত তিনিই লিখতেন। হযরত রাসূলে কারীমের সা. মদীনা আগমণের পর ওহী লেখার প্রথম গৌরব তিনিই লাভ করেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫৩১) সে যুগে কোন লেখা বা কুরআনের শেষে লেখকের নাম লেখার রেওয়াজ ছিল না। হযরত উবাই সর্বপ্রথম নাম লেখার প্রচলন করেন। পরে অন্যরা তাঁর অনুসরণ করে।
সকল প্রকার বিদ’য়াত থেকে দূরে থাকা, সত্য প্রকাশের সৎ সাহস- এ জাতীয় গুণাবলী হযরত উবাইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে বিদ্যমান ছিল। আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি প্রবল উৎসাহ- আবেগ তাঁর মধ্যে রূহানিয়্যাতের চরম বিকাশ সাধন করেছিল। গভীর রাতে মানুষ যখন আরাম-আয়েশে বিছানায় গা এলিয়ে দিত, তিনি তখন ঘরের এক কোণে বিনীতভাবে আল্লাহর ইবাদাতে মাশগুল থাকতেন, মুখে আল্লাহর কালাম জারী থাকতো এবং চোখ থেকে অশ্রুর ধারা প্রবাহিত হতো। তিন রাতে কুরআন খতম করতেন। রাতের এক অংশ দরূদ ও সালাম পেশের মাধ্যমে অতিবাহিত হতো।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি তাঁর ভালোবাসা এত প্রবল ছিল যে ’উস্তুনে হান্নানা’র একাংশ তাবারুক হিসেবে বাড়ীতে রেখে দেন এবং উইপোকায় খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত তাঁর বাড়ীতেই ছিল।
সব ধরণের বিদ’য়াত থেকে এত দূরে থাকতেন যে, রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র সময়ে যে কথা বা কাজ হয়নি তা বলা বা করাকে তিনি খুব খারাপ মনে করতেন। হযরত ’উমার রা তাঁর খিলাফতকালে একদিন মসজিদে নববীতে এসে দেখলেন লোকেরা পৃথকভাবে যার যার মত তারাবীহর নামায পড়ছে। ’উমার জামায়াতবদ্ধ করতে চাইলেন। তিনি উবাইকে বললেনঃ আমি আপনাকে ইমাম নিযুক্ত করতে চাই, আপনি তারাবীহ্র নামায পড়াবেন। উবাই বললেনঃ যে কাজ আগে করিনি এখন তা কিভাবে করি? ’উমার রা. বললেন, আমি তা জানি। তবে এ কোন খারাপ কাজ নয়। (কানযুল ’উম্মাল- ৪/২৪৮; হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৪৯)
একবার এক ব্যক্তি হযরত রাসূলে কারীমকে সা. প্রশ্ন করলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই আমরা মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ি বা নানাবিধ কষ্ট ভোগ করি, কি কোন সাওয়াব আছে? রাসূল সা. বললেনঃ এতে গুণাহ্র কাফ্ফারা হয়ে যায়। সেখানে হযরত উবাই উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন, ছোট ছোট বিপদ-মুসীবতও কি গুণাহ্র কাফ্ফারা হয়? বললেনঃ একটি কাঁটা ফুটলেও তা কাফ্ফারা হয়। তখন ঈমানী আবেগে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে যায়; হায়! সব সময় যদি আমার দেহে জ্বর লেগে থাকতো, আর তা সত্ত্বেও আমি হজ্জ ’উমরা আদায়ে সক্ষম হতাম এবং জিহাদে গমন ও জামায়অতে নামায আদায়ের যোগ্য থাকতাম। আল্লাহ পাক তাঁর এই দু’আ কবুল করেন। তারপর থেকে যত দিন জীবিত ছিলেন, শরীরে সব সময় জ্বর থাকতো। (কানযুল ’উম্মাল- ২/১৫৩; আল-ইসাবা- ১/২০; হায়াতুস সাহাবা- ১/৫০২-৩)
আল্লাহর ভয়ে, শেষ বিচার দিনের ভয়ে, সব সময় তিনি কাঁদতেন। কুরআন পাঠের সময় ভীষণ ভীত হয়ে পড়তেন। বিশেষতঃ সূরা আল-আনয়ামের ৬৫ নং আয়াত ও পরবর্তী আযাবের আয়াতগুলি যখন পাঠ করতেন তখন তাঁর শঙ্কা ও ভয়ের সীমা থাকতো না। (রিজালুন হাওলার রাসূল- ৪৯৮)
ইসলামী খিলাফতের সীমা যখন বিস্তার লাভ করে এবং সাধারণ মুসলমানরা বিভিন্ন অঞ্চলের ওয়ালী বা শাসকদের অহেতুক তোয়াজ খাতির করে চলতে থাক তখন তিনি বলতেনঃ কা’বার প্রভুর নামে শপথ। তারা ধ্বংস হয়েছে। তারা ধ্বংস হয়েছে। অন্যদেরকে তারা ধ্বংস করেছে। তাদের জন্য আমার কোন দুঃখ নেই। আমার দুঃখ তাদের জন্য, যাদের তারা সর্বনাশ করেছে। (রিজালুন হাওলার রাসুল- ৪৯৮)
হযরত উবাই বলতেনঃ মুমিনের চারটি বৈশিষ্ঠ্যঃ ১. বিপদে ধৈর্যধারণ করে, ২. কোন কিছু পেলে আল্লাহর শোক করে, ৩. যখন কথা বলে, সত্য বলে, ৪. যখন বিচার করে, ন্যায়-নীতির সাথে বিচার করে। তিনি আরও বলতেন, মুমিনের জীবন পাঁচটি নূর বা জ্যোতির মধ্যে বিবর্তিত হয়। ১. তার কথা নূর, ২. তার ইলম বা জ্ঞান নূর, ৩. কবরে সে নূরের মধ্যে অবস্থান করবে, ৪. কবর থেকে সে নূরের মধ্যে উঠবে এবং ৫. কিয়ামতের দিন নূরের দিকেই তার শেষ যাত্রা হবে। অপর দিকে একজন কাফিরের জীবন পাঁচটি অন্ধকারের মধ্যে বিবর্তিত হয়। ১. তার কথা অন্ধকার, ২. তার আমল অন্ধকার, ৩. তার কবর অন্ধকার, ৪. কবর থেকে উঠবে অন্ধকারে এবং ৫. কিয়ামতের দিন তার শেষ যাত্রা হবে অন্ধকারের দিকে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫১৮)
জীনের সাথে হযরত উবাইয়ের একটি ঘটনার কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। খেজুর শুকানোর জন্য হযরত উবাইয়ের একটি উঠোন ছিল। সেখানে খেজুর নেড়ে দেওয়া ছিল। তিনি মাঝে মাঝে সেখানে আসতেন। একদিন খেজুরে ঘাটতি লক্ষ্য করে রাতে পাহারা দিলেন। হঠাৎ অন্ধকারে একজন যুবকের মত একটি প্রাণী দেখতে পেলেন। তিনি তাকে সালাম দিলেন। সে সালামের জবাব দিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে তুমি? সে বললোঃ জীন। তিনি বললেনঃ তোমার একটি হাত দাও তো। সে হাত বাড়িয়ে দিল। তিনি হাত ধরলেন এবং তাঁর মনে হলো, সেটা যেন কুকুরের হাত এবং তার লোম কুকুরের লোমের মত। তিনি বললেনঃ জীবনের সৃষ্টি কি এমনই? আমার তো ধারণা ছিল তারা আরও শক্তিশালী। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি যা করেছ, তার কারণ কি? সে জবাব দিলঃ আমরা জেনেছি, আপনি সাদাকা (দান) করতে ভালোবাসেন। তাই আমরা এই খেজুর থেকে কিছু গ্রহণ করতে চেয়েছি। তিনি জীনকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের হাত থেকে আমাদের নিরাপত্তা কিসে? সে বললোঃ সূরা বাকারার আয়াতুল কুরসীতে। কেউ সন্ধ্যায় পড়ে ঘুমালে সকাল পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে; আর কেউ সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে। পরদিন সকালে হযরত উবাই রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে রাতের ঘটনা খুলে বললেন। রাসূল সা. সবকিছু শুনে বললেন” এই খবীসটি (পাপাত্মাটি) সত্যি কথা বলেছে। নাসাঈ, হাকেম, তাবারানী প্রভৃতি গ্রন্থে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৯০)
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। একদিন উবাই ইবন কা’ব প্রতিজ্ঞা করলেনঃ আজ আমি মসজিদের এমন নামায আদায় করবো এবং আল্লাহর এমন প্রশংসা করবো যা আর কেউ কোন দিন করেনি। তিনি মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করে যেই না আল্লাহর প্রশংসার জন্য বসেছেন অমনি পিছন দিকে জোরে জোরে কাউকে হামদ পাঠ করতে শুনতে পেলেন। তিনি ঘটনাটি রাসুলকে সা. জানালেন। রাসুল সা. বললেন, এই হামদের পাঠন ছিলেন জিবরীল আ.। (দ্রঃ হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪১)
ইবন ’আব্বাসের বর্ণনা করেন। একবার ’উমার ইবন আল-খাত্তাব আমাদেরকে কোথাও বের হতে বললেন। আমরা পথ চলছি। আমি ও উবাই এক সময় কাফিলার একটু পিছনে পড়ে গেলাম। এমন সময় আকাশে একটু মেঘ দেখা গেল। উবাই দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ! এই মেঘের কষ্ট আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিন। আমরা মেঘের কষ্ট থেকে বেঁচে গেলাম। আমরা কাফিলার সাথে মিলিত হলে ’উমার জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরাও কি আমাদের মত কষ্ট পেয়েছ? আমি বললামঃ আবুল মুনজির (উবাই) মেঘের কষ্ট থেকে আমাদেরকে রেহাই দেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করেছিল। ’উমার বললেনঃ আমাদের জন্যও একটু দু’আ করলে না কেন? (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৬৫৮)

আনাস ইবন মালিক (রা)
আনাস ইবন মালিক ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী, খাদিমে রাসূল, ইমাম, মুফতী, মু’য়াল্লিমে কুরআন, মুহাদ্দিস, খ্যাতিমান রাবী, আনসারী, খাযরাজী ও মাদানী। কুনিয়াত আবু সুমামা ও আবু হামযা। খাদিমু রাসূলিল্লাহ লকব বা উপাধি। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়া- ৩/৪০২, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) আনাস বলতেনঃ আমি ‘হামযা’ নামক এক প্রকার সব্জী খুটতাম, তাই দেখে রাসুল সা. আদর করে আমাকে ডাকেনঃ ‘ইয়া আবা হামযা’। সে দিন থেকে এটাই আমার কুনিয়াত বা ডাকনাম হয়ে যায়। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১) ইয়াসরিবের (আল-ইসাবা- ১/৭১) বিখ্যাত খাযরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরাতের দশ বছর পূর্বে ৬১২ খ্রীস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করে। (আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, আল-ইসাবা- ১/৭১) এই গোত্রটি ছিল আনসারদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত। আনাসের পিতা মালিক ইবন নাদর এবং মাতা উম্মু সুলাইম সাহলা বিনতু মিলহান আল-আনসারিয়্যা। উম্মু সুলাইম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. খালা হতেন। রাসূলুল্লাহর সা. দাদা আবদুল মুত্তালিবের মা সালমা বিনতু ’আমর-এর নসব ’আমির ইবন গানাম- এ গিয়ে আনাসের মার বংশের সাথে মিলিত হয়েছে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭, আসাহহুস সীয়াব- ৬০৬)
উম্মু সুলাইমের আসল নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। যেমনঃ সাহলা, রুমাইলা, রুমাইসা, সুলাইকা, আল-ফায়সা ইত্যাদি। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৪০)
আনাসের চাচা আনাস ইবন নাদর উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। কাফিররা কেটে কুটে তাঁর দেহ বিকৃত করে ফেলেছিল। তাঁর দেহে মোট আশিটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তাঁর এক বোন ছাড়া আর কেউ সে লাশ সনাক্ত করতে পারেনি। আনাস বলতেন, আমার এই চাচা আনাসের নামেই আমার নাম রাখা হয়েছিল। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৮৩, হায়াতুস সাহাবা- ১/৫০৪, ৫০৫) আনাসের মামা হারাম ইবন মিলহান বি’রে মা’উনার দুঃখজনক ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
আনাসের বয়স যখন আট/নয় বছর তখন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করে। এ কারণে তাঁর পিতা ক্ষোভ ও ঘৃণায় শামে চলে যায় এবং সেখানে কুফরী অবস্থায় মারা যায়। মা আবু তালহাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। আবু তালহা ছিলেন খাযরাজ গোত্রের একজন বিত্তশালী ব্যক্তি। মা বালক আনাসকেও সাথে করে আবু তালহার বাড়ীতে নিয়ে যান। আনাস এখানেই প্রতিপালিত হন।
আবু তালহার সাথে তাঁর মার বিয়ে সম্পর্কে আনাস বর্ণনা করেছেনঃ আবু তালহা যখন উম্মু সুলাইমকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। উম্মু সুলাইম বললেনঃ আবু তালহা, তুমি কি জাননা, যে ইলাহ-র ইবাদাত তুমি কর তা মাটি দিয়ে তৈরী? বললেনঃ হাঁ, তা জানি। উম্মু সুলাইম আরও বললেনঃ একটি গাছের ইবাদাত করতে তোমার লজ্জা হয় না? তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তোমাকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই এবং তোমার কাছে কোনমোহরের দাবীও আমার থাকবে না। ‘আমি ভেবে দেখবো’- এ কথা বলে আবু তালহা উঠে গেলেন। পরে ফিরে এসে তিনি উচ্চারণ করলেনঃ ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তখন উম্মু সুলাইম ছেলে আনাসকে ডেকে বললেনঃ আনাস, তুমি আবু তালহার বিয়ের কাজটি সমাধা কর। আনাস তাঁর মাকে আবু তালহার সাথে বিয়ে দিলেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/১৯৫, ১৯৬)
মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আবু তালহার বাড়ীতে মদ পানের আসর বসতো। বালক আনাস সেই আসরে সাকীর দায়িত্ব পালন করতেন এবং নিজেও মদের অভ্যাস করতেন। এই বালককে মদ পান থেকে বিরত রাখার কেউ ছিল না। (মুসনাদ- ৩/১৮১)
আনাসের বয়স যখন আট/নয় বছর তখন মদীনায় ইসলামের প্রচার শুরু হয়ে যায়। ইসলাম কবুলের ব্যাপারে বনু নাজ্জার গোত্র সবার আগে ভাগেই ছিল। এই খান্দানের বেশীর ভাগ সদস্য রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় আসার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আনাসের মা উম্মু সুলাইম ও তৃতীয় আকাবার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে উম্মু সুলাইম ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁর স্বামী অর্থাৎ আনাসের পিতা স্ত্রী ও সন্তান ত্যাগ করে শামে চলে যায়। স্বামী পরিত্যক্তা উম্মু সুলাইম আবু তালহাকে বিয়ে করতে রাজী হন এই শর্তে যে, তিনিও ইসলাম গ্রহণ করবেন। এভাবে উম্মে সুলাইমের চেষ্টায় আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করে মক্কায় যান এবং তৃতীয় ’আকাবায় শরীক হয়ে রাসূলুল্লাহর হাতে সা. বাইয়াতের গৌরব অর্জন করেন। এভাবে আনাসের বাড়ী ঈমানের আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। তাঁর জান্নাতী মা উম্মু সুলাইম ইসলামের এক আলোক বর্তিকা, আর তাঁর স্বামী দ্বীনের এক নিবেদিত প্রাণ কর্মী। এমনই এক আশ্রয়ে আনাস বেড়ে ওঠেন।
আনাস যখন দশ বছরের বালক তখন হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনায় আসেন। আনাসের বয়স অল্প হলেও তিনি খুবই উৎসাহী ছিলেন। রাসুল সা. যখন কুবা থেকে মদীনার দিকে আসছিলেন, সমবয়সী ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে পথের পাশে দাঁড়িয়ে আনাসও স্বাগত সংগীত গেয়েছিলেন, তাঁরা ছুটে ছুটে ‘রাসূলুল্লাহ এসেছেন, মুহাম্মাদ এসেছেন’- বলে মদীনাবাসীদের ঘরে ঘরে রাসূলুল্লাহর সা. আগমন বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। এক সময় রাসূলুল্লাহর সা. পাশ থেকে ভীড় একটু কম হলে আনাস তাঁর চেহারা মুবারকে প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং সাহাবিয়্যাতের মর্যাদা লাভে ধন্য হন।
হযরত রাসূলে কারীম সা. যখন মদীনায় আসেন প্রসিদ্ধ মতে আনাসের বয়স তখন দশ বছর। রাসুল সা. একটু স্থির হওয়ার পর আনাসের মা একদিন তাঁর হাত ধরে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে যান। এ সম্পর্কে আনাস বলেনঃ আমার মা আমার হাত ধরে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে গিয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আনসারদের প্রত্যেক নারী-পুরুষ আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছে। আমি তো তেমন কিছু দিতে পারছিনে। আমার এই ছেলেটি আছে, সে লিখতে জানে। এখনও সে বালেগ হয়নি। আপনি একেই গ্রহণ করুন। সে আপনার খিদমাত করবে। সেই দিন থেকে আমি একাধারে দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করেছিল। এর মধ্যে কখনও তিনি আমাকে মারেননি, গালি দেননি, বকাঝকা করেননি এবং মুখও কালো করেননি। তিনি সর্বপ্রথম আমাকে এই অসীয়াতটি করেনঃ ছেলে, তুমি আমার গোপন কথা গোপন রাখবে। তা হলেই তুমি ঈমানদার হবে। আমার মা এবং রাসূলুল্লাহর সা. সহধর্মিনীগণ কখনও আমার কাছে রাসূলে সা. গোপন কথা জিজ্ঞেস করলে, বলিনি। আমি তাঁর কোন গোপন কথা কারও কাছে প্রকাশ করিনি। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আবু তালহা তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে যান। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১, আনসাবুল আশরাফ- ১/৫০৬, আল-ইসাবা- ১/৭১)
হযরত আনাস রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তাঁর খিদমাতের দায়িত্ব পালন করেন। এ জন্য তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। ফজর নামাযের পূর্বেই তিনি রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাতে হাজির হয়ে দুপুরে বাড়ী ফিরতেন। কিছুক্ষণ পর আবার আসতেন এবং আসরের নামায আদায় করে বাড়ী ফিরতেন। আনাসের মহল্লায় একটি মসজিদ ছিল, সেখানে মুসল্লীরা তাঁর অপেক্ষায় থাকতো। তাঁকে দেখে তারা আসরের নামাযে দাঁড়াতো। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/২২২)
উপরোক্ত সময় ছাড়াও তিনি সব সময় রাসূলুল্লাহর সা. যে কোন নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। যখনই প্রয়োজন পড়তো রাসূলুল্লাহর সা. ডাকে সাড়া দিতেন। এক দিনের ঘটনা, তিনি রাসূলুল্লাহর সা. প্রয়োজনীয় কাজ সেরে দুপুরে বাড়ীর দিকে চলেছেন। পথে দেখলেন, তাঁরই সমবয়সী ছেলেরা খেলছে। তাঁর কাছে খেলাটি ভালো লাগলো। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন তাদের খেলা দেখতে। কিছুক্ষণ পর দেখলেন, রাসূল সা. তাদের দিকে আসছেন। তিনি এসে প্রথমে ছেলেদের সালাম দিলেন, তারপর আনাসের হাতটি ধরে তাঁকে কোন কাজে পাঠালেন। আর রাসূল সা. তাঁর অপেক্ষায় একটি দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। আনাস কাজ সেরে ফিরে এলে রাসুল সা. বাড়ীর দিকে ফিরলেন, আর তিনি চললেন বাড়ীর দিকে। ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় তাঁর মা জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরী হলো কেন? তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. একটি গোপন কাজে গিয়েছিলাম। এই জন্য ফিরতে দেরী হয়েছে। মা মনে করলেন, ছেলে হয়তো সত্য গোপন করছে, এই জন্য জানতে চাইলেনঃ কী কাজ? আনাস জবাব দিলেন একটি গোপন কথা, কাউকে বলা যাবেনা। মা বললেনঃ তাহলে গোপনই রাখ কারও কাছে প্রকাশ করোনা। আনাস আজীবন এ সত্য গোপন রেখেছেন। একবার তাঁর বিশিস্ট ছাত্র সাবিত যখন সেই কথাটি জানতে চাইলেন তখন তিনি বললেন, কথাটি কাউকে জানালে তোমাকেই জানাতাম। কিন্তু আমি তা কাউকে বলবো না। (আল-ফাতহুর রাব্বাবী মা’য়া বুলুগুল আমানী- ২২/২০৪, হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৪৩, ২/৫০৩)
হযরত আনাস সব সময় রাসূলুল্লাহর সা. সংগে থাকতেন। আবাসে-প্রবাসে, ভিতরে-বাহিরে কোন বিশেষ স্থান বা সময় তাঁর জন্য নির্ধারিত ছিলনা। হিজাবের আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি স্বাধীনভাবে রাসূলুল্লাহর সা. গৃহে যাতায়াত করতেন। আনাস বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহর সা. গৃহে আসতাম এবং অন্দর মহলে আযওয়াজে মুতাহ্হারাতদের কাছেও যেতাম। একদিন আমি অন্দরে প্রবেশ করতে যাব, এমন সময় রাসূল সা. ডাকলেনঃ আনাস, পিছিয়ে এস। হিজাবের আয়াত নাযিল হয়ে গেছে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪) আনাস আরও বলেনঃ আমি যে দিন বালেগ হলাম, রাসূলকে সা. সে কথা জানালাম। তিনি বললেনঃ এখন থেকে অনুমতি ছাড়া মেয়েদের কাছে যাবেনা। আনাস বলেনঃ সেই দিনটির মত কঠিন দিন আমার জীবনে আর আসেনি। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪)
একদিন ফজরের নামাযের পূর্বে রাসূল সা. বললেন, আজ রোযা রাখার ইচ্ছা করেছি, আমাকে কিছু খাবার দাও। আনাস খুব তাড়াতাড়ি কিছু খুরমা ও পানি হাজির করেন। রাসুল সা. তাই দিয়ে সেহরী সেরে ফজরের নামাযের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। (মুসনাদ- ৩/১৯৭) ওয়াকিদী বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. খাদিমদের মধ্যে যাঁরা তাঁর দরজা থেকে দূরে যেত না তাঁদের মধ্যে আনাস একজন। আবু হুরাইরা রা. বলতেনঃ আমি তো মনে করতাম আনাস রাসূলুল্লাহর সা. দাস। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৮৫)
হযরত রাসূলে কারীম সা. মদীনায় এসে আবু আইউব আল আনসারীর রা. অতিথি হন। সেই সময় তিনি আনাসের পিতা মালিক ইবন নাদরের কুয়োর পানি সবচেয়ে বেশী তৃপ্তি সহকারে পান করতেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. আবু আইউবের বাড়ী থেকে নিজের বাড়ীতে চলে গেলে আনাস সেই কুয়োর পানি রাসূলুল্লাহর সা. জন্য বয়ে নিয়ে আসতেন। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৫৩৫)
হযরত আনাস অত্যন্ত নিপুণতার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. সকল কাজ সম্পাদন করতেন। আনুগত্যের মাধ্যমে সর্বক্ষণ তাঁকে খুশী রাখতেন। তিনি নিজেই বলেনঃ আমি দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাত করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কক্ষণও আমার ওপর নারাজ হননি। আমার কোন কাজের জন্য কক্ষণও বলেননিঃ এ কাজটি তুমি কেন করলে? আর আমি কোন কাজ করিনি সে জন্যও তিনি প্রশ্ন করেননিঃ কাজটি তুমি কেন করনি? অথবা তুমি ভুল করেছ বা যা করেছ, খুবই খারাপ করেছ- এমন কথাও আমার কোন ভুলের জন্য তিনি বলেননি। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪, ৫০৬) এভাবে আনাস রাসূলুল্লাহর সা. অন্তরে এক বিশেষ স্থান দখল করেন। রাসুল সা. স্নেহভরে কখনও ‘ছেলে’ আবার কখনও ‘উনাইস’ বলে ডাকতেন। তিনি মাঝে মধ্যে আনাসদের বাড়ীতে যেতেন, আহার করতেন, দুপুরের সময় হলে বিশ্রাম নিতেন, নামায আদায় করতেন এবং আনাসের জন্য দু’আও করতেন। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীস মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। (আল-ফাতহুর রাব্বানী-২২/২০৩)
আনাস বলেনঃ একদিন আবু তালহা আমার মা উম্মু সুলাইমকে বললেন, আমি যেন রাসূলুল্লাহর সা. কণ্ঠস্বর একটু দুর্বল শুনতে পেলাম। মনে হলো তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি? মা বললেনঃ আছে। তিনি কয়েক টুকরো রুটি আমার কাপড়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাঠালেন। আমাকে দেখেই রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ আবু তালহা পাঠিয়েছে? বললামঃ হাঁ। বললেনঃ খাবার? বললামঃ হাঁ। রাসূলসা. সাথের লোকদের বললেনঃ তোমরা ওঠো। তাঁরা চললেন, আমিও তাদের আগে আগে চললাম। আবু তালহা সকলকে দেখে স্ত্রীকে ডেকে বললেনঃ উম্মু সুলাইম, দেখ, রাসূল সা. লোকজন সংগে করে চলে এসেছেন। সবাইকে খেতে দেওয়ার মত খাবার তো নেই। উম্মু সুলাইম বললেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. সে কথা ভালোই জানেন। আবু তালহা অতিথিদের নিয়ে বসালেন। রাসূল সা. ঘরে ঢুকে বললেনঃ যা আছে নিয়ে এসো। সামান্য খাবার ছিল, তাই হাজির করা হলো। তিনি বললেনঃ প্রথম দশজনকে আসতে বল। দশ জন ঢুকে পেট ভরে খেয়ে বের হয়ে গেল। তারপর আর দশ জন। এ ভাবে মোট সত্তু জন লোক পেট ভরে সেই খাবার খেয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৯৪)
আনাস আরও বলেন, আমার মা উম্মু সুলাইমের আবু তালহার পক্ষের আবু ’উমাইর নামে একটি ছোট ছেলে ছিল। রাসুল সা. আমাদের বাড়ীতে এলে তার সাথে একটু রসিকতা করতেন। একদিন দেখলেন আবু ’উমাইর মুখ ভার করে বসে আছে। রাসুল সা. বললেনঃ আবু ’উমাইর এমন মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন? মা বললেনঃ তার খেলার সাথ ‘নুগাইর’ টি মারা গেছে। তখন থেকে রাসুল সা. তাঁকে দেখলে কাব্যি করে বলতেনঃ ‘ইয়া আবা ’উমাইর- মা ফা’য়ালান নুগাইর’- ওহে আবু ’উমাইর, তোমার নুগাইরটি কি করলো? উল্লেখ্য যে, ‘নুগাইর’ লাল ঠোঁট বিশিষ্ট চড়ুই- এর মত এক প্রকার ছোট্ট পাখী। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৩৯, হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৭০, ৫৭১)
আনাসদের বাড়ীতে রাসূলুল্লাহর সা. ওপর কুরআনের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। রাসুল সা. ওহী নাযিলের সময় ঘেমে যেতেন আর তাঁরা সেই ঘাম সংরক্ষণ করতেন। আনাস বলেনঃ একদিন দুপুরে রাসুল সা. আমাদের বাড়ীতে এসে বিশ্রাম নিলেন এবং ঘেমে গেলেন। আমার মা একটি বোতল এনে সেই ঘাম ভরতে লাগলেন। রাসুল সা. জেগে উঠে বললেনঃ ’উম্মু সুলাইম, একি করছো? মা বললেনঃ আপনার এই ঘাম আমাদের জন্য সুগন্ধি। আনাস বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সুগন্ধি থেকে অধিকতর সুগন্ধিযুক্ত মিশ্ক অথবা আম্বর আমার জীবনে আর শুকিনি। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪, ১৪৫)
আমরা আগেই বলেছি, আনাসের কল্যাণময়ী মা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. খালা। তিনি অন্তর দিয়ে তাঁকে ভালোবাসতেন, ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। আর রাসূলও সা. তাঁর কথা কখনও বিস্মৃত হননি। এই সম্মানিত মহিলাকে রাসূল সা. জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন। (দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা (উর্দু)- ৩/৪০২) খাইবার যুদ্ধে হযরত সাফিয়্যা রা. বন্দী হলেন এবং রাসুল সা. তাঁকে শাদী করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সাফিয়্যাকে উম্মু সুলাইমের নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তিনিই বিয়ের সকল ব্যবস্থা সম্পদেন করলেন। এ সম্পর্কে ইবন ইসহাক বলেনঃ খাইবারে অথবা খাইবার থেকে ফেরার পথে হযরত সাফিয়্যার সাথে রাসূলুল্লাহর সা. শাদী মুবারাক অনুষ্ঠিত হয়। আনাসের মা উম্মু সুলাইম তাঁর সাজানো, চুল বাঁধা ইত্যাদি যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৩৯, ৩৪০, আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৪৩)
এমনিভাবে হযরত যয়নাবের সাথে যখন রাসূলুল্লাহর সা. বিয়ে হয় তখনও উম্মু সুলাইম কিছু খাবার তৈরী করে পাঠান। রাসুল সা. সাহাবীদের দা’ওয়াত দিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করে সেই খাবার পরিবেশন করেন। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/১৬৩)
এই সব বৈশিষ্ট্যই আনাসকে নবী খান্দানের একজন সদস্যে পরিণত করে। রাসুল সা. মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে হালকা মিযাজ হয়ে যেতেন। এই যেমন তাঁকে ডাকলেন ‘আবু হামযা’ বলে। একবার তো ডাকলেন ‘ইয়া জাল উজনাইন’- ওহে দুই কান ওয়ালা বলে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭)
আমরা পূর্বেই দেখেছি, রাসূলুল্লাহর সা. সাথে আনাসের কত গভীর সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্কে কারণেই ঘরে-বাইরে, আবাসে-প্রবাসে সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. সংগে থাকতেন। যুদ্ধের ময়দানেও সেই সংগ ত্যাগ করেননি। বদর যুদ্ধের সময় আনাসের বয়স এমন কিছু হয়নি। মাত্র বারো বছর। তাসত্ত্বেও মুসলিম মুজাহিদদের পাশাপাশি যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেবা ও সৈনিকদের সাজ-সরঞ্জাম ও মাল-সামান দেখার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বয়স অতি অল্প থাকার কারণে তাঁর এ যুদ্ধে যোগদান সম্পর্কে পরবর্তীকালে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। একবার তো সংশয়ের সুরে এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেই বসেঃ আপনি কি বদরে হাজির ছিলেন? জবাব দিলেনঃ আমি কিভাবে গায়ের হাজির থাকতে পারি? (আল-ইসাবা- ১/৭১, দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
বদরের এক বছর পর উহুদ যুদ্ধ হয়। তখনও আনাস অল্প বয়স্ক। হিজরী ষষ্ঠ সনে হুদাইবিয়ায় বাইয়াতে শাজারার গৌরব অর্জন করেন। তখন তাঁর বয়স ষোল বছর। যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। হিজরী সপ্তম সনে রাসূল সা. ’উমরাতুল কাদা (কাজা ’উমরাহ) আদায় করেন। আনাস সংগে ছিলেন। এ বছরই খাইবার বিজিত হয়। এই অভিযানে আনাস আবু তালহার সাথে উটের পিঠে সাওয়ার ছিলেন। এক পর্যায়ে বিজয়ীর বেশে হযরত রাসূলে কারীম সা. খাইবারে প্রবেশ করছিলেন তখন আনাস তাঁর এত নিকটে ছিলেন যে তাঁর পা রাসূলে সা. পবিত্র পা স্পর্শ করে। এর ফলে রাসূলুল্লাহর সা. ইযার হাঁটুর ওপরে উঠে যায় এবং তা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। (মুসনাদ- ৩/১০২) এরপর মক্কা বিজয়, তায়িফ ও হুনাইন অভিযানে যোগ দেন। সর্বশেষ হিজরী দশ সনে বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে ছিলেন।
আনাস বলেনঃ হুনাইন যুদ্ধের দিন আবু তালহা হাসতে হাসতে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট গিয়ে বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি দেখেছেন, উম্মু সুলাইমের হাতে খঞ্জর? রাসুল সা. বললেনঃ উম্মু সুলাইম খঞ্জর দিয়ে কি করবে? জবাব দিলেনঃ কেউ আমার দিকে এগিয়ে এলে এটা দিয়ে আমি আঘাত করবো। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৯৭)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. অভিযানের সংখ্যা ছিল ২৬ অথবা ২৭ টি। তবে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এমন অভিযানের সংখ্যা মাত্র ৯টি। যেমনঃ বদর, উহুদ, খন্দক, কুরায়জা, মুসতালিক, খাইবার, হুনাইন ও তায়িফ। আনাস এর সব ক’টিতে উপস্থিত ছিলেন। এক ব্যক্তি আনাসের ছেলে মূসাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার সম্মানিত পিতা কতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেনঃ আটটি যুদ্ধে। সম্ভবতঃ বদর যুদ্ধটি বাদ দিয়েছিলেন। তার কারণ এই হতে পারে যে, সে সময় জিহাদে যাওয়ার যে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল, আনাস তার চেয়ে ছোট ছিলেন।
হযরত রাসূলে কারীমের সা. ইনতিকালের পর হযরত আবু বকর রা. খলীফা হলেন। এ সময় ভন্ড নবীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধে আনাসের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৫৩৭) খলীফা আনাসকে বাহরাইনে ‘আমিলে সাদাকা’র পদে নিয়োগ দান করতে চান। এ ব্যাপারে ’উমারের পরামর্শ চাইলে তিনি বলেনঃ আনাস বুদ্ধিমান ও লেখাপড়া জানা মানুষ। তার জন্য যে খিদমতের প্রস্তাব আপনি করেছেন আমি তা সমর্থন করি। খলীফা আনাসকে ডেকে পাঠান এবং আমিলে সাদাকার দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে বাহরাইনে পাঠিয়ে দেন। (বুখারী, কিতাবুয যাকাত, আল-ইসাবা- ১/৭২) তিনি যখন বাহরাইন থেকে ফিরে আসেন তখন আবু বকর রা. আর নেই। তাঁর স্থলে ’উমার রা. খলীফা। তিনি বাহরাইন থেকে আনীত অর্থ থেকে চার হাজার দিরহাম আনাসকে দান করেন। আনাস বলেনঃ আমি সেই অর্থ পেয়ে মদীনাবাসীদের মধ্যে একজন অধিক অর্থশালী ব্যক্তি হয়ে যাই। (হায়াতুস সাহাবা- ২/২২)
আনাস আরও বলেনঃ আবু বকরের রা. মৃত্যুর পর ’উমার খিলাফতের দায়িত্বভার হাতে নিলে আমি মদীনায় এসে তাঁকে বললামঃ দেখি, আপনার হাতটি একটু বাড়িয়ে দিন। যে কথার ওপর আপনার পূর্ববর্তী বন্ধুর হাতে আপনি বাই’য়াত করেছিলেন সেই কথার ওপর আমি আপনার হাতে বাই’য়াত করবো। এভাবে তিনি ’উমারের রা. হাতে বাই’য়াত করেন। (হায়াতুস সাহাবা- ১/২৫৮)
খলীফা হযরত আবু বকর রা. ইয়ামনবাসীদের উদ্দেশ্যে লেখা একটি পত্রসহ আনাসকে ইয়ামনেও পাঠান। সেই পত্রে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বেরিয়ে পড়ার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানান। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৪৪১, ৪৪২)
হযরত মুগীরা ইবন শু’বা রা. বসরার গভর্ণর ছিলেন। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে হযরত আবু বাকরার রা. নেতৃত্বে এক মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপিত হয়। (দ্রঃ আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৯০-৪৯২) খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁকে বরখাস্ত করে আবু মূসা আল-আশ’য়ারীকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেন। ঘটনার তদন্তের জন্য তাঁর সহকারী হিসাবে আরও চার ব্যক্তিকে বসরায় পাঠান। তারা হলেন, ১. আনাস ইবন মালিক, ২. আনাসের ভাই আল-বারা’ ইবন মালিক, ৩. ইমরান ইবনুল হুসাইন, ৪. আবু নাজীদ আল-খুযা’ঈ। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৯১)
এই বসরা শহরে হযরত আনাস স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। খলীফা ’উমার রা. যাঁদের ওপর এখানকার ফিকাহ ও ফাতওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁদের মধ্যে আনাস একজন। জীবনের বাকী অংশ তিনি এই বসরা শহরেই কাটিয়ে দেন। এখানে ফিকাহ ও ফাতওয়ার দায়িত্ব পালন ছাড়াও যখন যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে তিনি দক্ষতার সাথে তা পালন করেন। এই সময় পরিচালিত সকল অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ‘তুসতার’ অভিযানে পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। তুসতার বিজিত হয় এবং পারস্য সেনাপতি হুমুযানকে সপরিবারে বন্দী করে মুসলিম সেনাপতি আবু মূসা আল-আশয়ারীর রা. সামনে হাজির করা হয়। হযরত আবু মূসা রা. তিনশো সদস্যের একটি বাহিনীর হিফাজতে হুরমুযানকে মদীনায় খলীফার দরবারে পাঠিয়ে দেন। আনাস রা. ছিলেন এ বাহিনীর আমীর এবং তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এভাবে দীর্ঘদিন পর প্রিয় জন্মভূমির যিয়ারত লাভের সুযোগ পান। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৬৬, দায়িরা-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০২)
কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করার পর আনাস আবার বসরায় ফিরে গেলেন। হিজরী ২৩ সনের জ্বিলহজ্জ মাসে হযরত ’উমার রা. শাহাদাত বরণ করলে হযরত ’উসমান রা. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। তাঁর খিলাফতের প্রথম কয়টি বছর খুবই শান্ত ছিল। তবে কিছুকাল পরে নানারকম ফিত্না ও অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চতুর্দিকে স্বার্থন্বেষী, হাঙ্গামাবাজ লোকেরা বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দেয় এবং তারা মদীনা অভিমুখে যাত্রা করে।
তখনও কিন্তু ইসলামী খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে এমন বহু ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা কোন রকম বিদ্রোহ ও হুমকির পরোয়া করতেন না। সুতরাং মাজলুম খলীফার আর্ত চিৎকার সর্বপ্রথম এই সত্যের সৈনিকদের কাছে পৌঁছে। তাঁরা তাঁর সাহায্যের জন্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান।
ইরাকের রাজধানী বসরাতেও এমন লোকের অভাব ছিলনা। এমন ভয়াবহ অবস্থার খবর যখন সেখানে পৌঁছলো তখন আনাস ইবন মালিক, ’ইমরান ইবন হুসাইনসহ বহু বিশিস্ট ব্যক্তি দ্বীনের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁরা বক্তৃতা-ভাষণের দ্বারা গোটা বসরাকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁদের সাহায্য মদীনায় পৌঁছার পূর্বেই বিদ্রোহীদের হাতে খলীফা ’উসমান রা. শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ’উসমানের রা. পর হযরত আলী রা. খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। ছয় মাস যেতে না যেতেই তাঁর বিরুদ্ধে এক মস্ত বড় ফিত্না এই বসরাতেই মাথা তুলে দাঁড়ায়। আর তাতে বিশিস্ট সাহাবা-ই-কিরামও জড়িয়ে পড়েন। বসরা ছিল আনাসের আবাস স্থল। সেখানে তার বিশেষ প্রভাবও চিল। কিন্তু তিনি সকল আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। যতদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত না হয়, তিনি আরও বহু বিশিষ্ট সাহাবীর মত নির্জনতা অবলম্বন করেন। এ কারণে, হযরত আলী ও হযরত ’আয়িশার রা. উটের য্রুদ্ধ, যা এই বসরার অনতি দুরে সংঘটিত হয়- তাতে কোন পক্ষে আনাসের রা. কোন ভূমিকা দেখা যায় না। এসব ঘটনায় তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকেন।
হযরত ’আলীর রা. খিলাফতের পরেও হযরত আনাস বহুদিন জীবিত ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে নানা রকম দৃশ্য ও অবস্থা অবলোকন করেন; কিন্তু সব সময় নির্জনতাকে প্রাধান্য দান করেন। কোন অবস্থাতেই নিজেকে জাহির করা তিনি মোটেই পছন্দ করেননি। তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী উমাইয়্যা শাসকদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারেননি। খলীফা আবদুল মালিকের সময় উমাইয়্যা সাম্রাজ্যের পূর্ব অঞ্চলের গভর্ণর ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। অত্যাচারী ও নিপীড়ক হিসেবে ইতিহাসে তিনি খ্যাতিমান। একবার তিনি বসরায় এসে আনাসকে ডেকে শাসান এবং জনগণের মাঝে হেয় করার জন্য তাঁর ঘাড়ে ছাপ মেরে দেন। ওয়াকিদী ইসহাক ইবন ইয়াযীদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ আমি এই ছাপ মারা অবস্থায় আনাসকে দেখেছি। (আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা- ১/৭২)
হাজ্জাজ ধারণা করেছিলেন, আনাস রাজনৈতিক বাতাস বুঝে কাজ করেন। তাই আনাসকে দেখেই তিনি বলে ওঠেনঃ ওহে খবীস! এটা একটা চালবাজি। আপনি মুখতার আস-সাকাফীর সাথেও থাকেন, আবার কখনও থাকেন ইবনুল আশয়াসের সাথে। আমি আপনাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি। এমন কঠিন মুহূর্তেও আনাস নিজেকে আয়ত্বে রাখেন। শান্তভাবে তিনি বলেনঃ আল্লাহ আমীরকে সাহায্য করুন। আপনার শাস্তি কার জন্য? বললেনঃ আপনার জন্য। হযরত আনাস চুপচাপ বাড়ী ফিরে এলেন এবং খলীফা ’আবদুল মালিকের নিকট হাজ্জাজের আচরণের বিবরণ দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে দিলেন। চিঠি পড়ে ’আবদুল মালিক রাগে ফেটে পলেন। সাথে সাথে তিনি হাজ্জাজকে লিখলেন, তুমি খুব তাড়াতাড়ি আনাসের বাড়ীতে গিয়ে ক্ষমা চাও, নইলে তোমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করা হবে। খলীফার চিঠি পেয়ে হাজ্জাজ তাঁর পরিষদবর্গসহ আনাসের খিদমতে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আনাসের নিকট আরও আবেদন জানান, তিনি যে হাজ্জাজকে ক্ষমা করেছেন, সেই কথা যেন খলীফাকে একটু জানিয়ে দেন। আনাস তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন এবং সেই মর্মে একটি চিঠি দিমাশ্কে পাঠিয়ে দেন। মূলতঃ ফিত্না ও বিশৃঙ্খলার ভয়ে আনাস এমন কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করেন। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৮, আল-ফাতহুর রাব্বানী মা’য়া বুলুগিল আমানী- ২২/২০৫, হায়াতুস সাহাবা- ২/৬৪৭, ৬৪৮)
হযরত ’আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের রা. কর্তৃত্বের সময় হযরত আনাস কিছুদিনের জন্য বসরার ইমাম ছিলেন। খলীফা ওয়ালিদ ইবন ’আবদিল মালিকের সময় তিনি একবার দিমাশকে যান। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৩৯) তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি প্রথমে দিমাশকে যান এবং সেখান থেকে বসরায় পৌঁছেন। (আল-আ’লাম- ১/৩৬৫)
হযরত আনাসের মৃত্যু সন ও মৃত্যুর সময় বয়স সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে হিজরী ৯৩ সনে মৃত্যুবরণ করেন এবং তখন তাঁর বয়স হয়েছিল এক শো বছরের উর্দ্ধে। কারণ, হিজরাতের পূর্বে তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। (তাহজীবুল আসমা- ১/১২৮, আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫, উসুদুল গাবা- ১/১২৮) মৃত্যুর পূর্বে তিনি কয়েক মাস অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। দেখার জন্য ভক্ত-অনুরক্তদের ভীড় লেগেই থাকতো। দূর থেকে দলে দলে মানুষ তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আসতো। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তাঁর একান্ত শাগরিদ সাবিত নাবানীকে বলেন, আমার জিহবার নীচে রাসূলুল্লাহর সা. একটি পবিত্র চুল রেখে দাও। পবিত্র চুল রাখা হলো। এ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেই অবস্থায় দাফন করা হয়। রাসূলুল্লাহর সা. একটি লাঠি ছিল তাঁর কাছে। মৃত্যুর পূর্বে লাঠিটি কবরে তাঁর সাথে দাফনের নির্দেশ দিয়ে যান। সে নির্দেশ পালন করা হয়। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮, আল-ইসাবা- ১/৭১, আল-ইসতীয়াব- ১/৭৩) ইবন কুতায়বা ‘আল-মা’য়ারিফ’ গ্রন্থে বলেন, বসরার তিন ব্যক্তির প্রত্যেকেই এক শোন বছর জীবন পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেনঃ আনাস ইবন মালিক, আবু বাকরাহ্ ও খীলফা ইবন বদর রা.। (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/১২৮)
হযরত আনাস ছিলেন দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণকারী বসরার শেষ সাহাবী। সম্ভবতঃ একমাত্র আবুত তুফাইল রা. ছাড়া তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন সাহাবী জীবিত ছিলেন না। (আল-ইসাবা- ১/৭১, আল-আ’লাম- ১/৩৬৫, আল-ইসতী’য়াবঃ আল-ইসাবা- ১/৭৩) অবশ্য আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ’ গ্রন্থে বলেনঃ ‘কানা (আনাস) আখিরাস সাহাবাতি মাওতান’- আনাস মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবী।’ সাহাবীদের মধ্যে দুনিয়া থেকে তিনিই সর্বশেষ বিদায় নেন। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪) হযরত আনাস নিজেও শেষ জীবনে বলতেনঃ কিলাতাইন বা দুই কিবলার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেছেন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৫)
পরিবারের সদস্য, ছাত্র ও ভক্তবৃন্দ ছাড়াও আশ-পাশের লোকেরা তাঁর জানাযায় শরীক হন। কুতন ইবন মুদরিক আল-কিলাবী জানাযার নামায পড়ান। বসরার উপকণ্ঠে ‘তিফ্’ নামক স্থানে তাঁর বাসস্থানেরে পাশেই কবর দেওয়া হয়। (উসুদুল গাবা- ১/১২৯)
হযরত আনাসের মৃত্যুতে গোটা মুসলিম উম্মাহ দারুণ শোকাকিভূত হয়ে পড়েছিল। বাস্তবেও তেমন হওয়ার কথা। কারণ, রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীরা এক এক করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মাত্র দুই ব্যক্তি যাঁদেরকে দেখে মানুষ প্রশান্তি লাভ করতো, তাঁদের একজন চলে গেলেন।
হযরত আনাসের ইনতিকালের পর ‘মাওরিক’ নামক এক তাবঈ ব্যক্তি আফসোস করে বলেনঃ ‘আল-ইউয়াম জাহাবা নিসফুল ’ইলম- আজ অর্ধেক ’ইলম (জ্ঞান) চলে গেল।’ লোকেরা প্রশ্ন করলোঃ তা কেমন করে? বললেনঃ আমার কাছে একজন প্রবৃত্তির অনুসারী লোক আসতো। সে যখন হাদীসের বিরোধীতা করতো, আমি তাঁকে আনাসের নিকট নিয়ে যেতাম। আনাস তাঁকে হাদীস শুনিয়ে নিশ্চিন্ত করতেন। এখন কার কাছে যাব? (তাহজীবুল আসমা ওয়াল লুগাত- ১/১২৮, তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১)
আনসার সম্প্রদায়ের মধ্যে হযরত আনাসের সন্তান সন্ততির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশী। আর এটা হয়েছিল হযরত রাসূলে কারীমের সা. দু’আর বরকতে। এ সম্পর্কে আনাস বলেনঃ একদিন রাসুলসা. উম্মু সুলাইমের (আনাসের মা) বাড়ীতে এলেন। উম্মু সুলাইম খুরমা ও ঘি খেতে দিলেন। কিন্তু রাসুল সা. সে দিন সাওম পালন করছিলেন। তিনি বললেনঃ এগুলি নিয়ে যাও এবং খুরমার পাত্রে খুরমা ও ঘিয়ের পাত্রে ঘি রেখে দাও। তারপর তিনি উঠে ঘরের এক কোণে গিয়ে দুই রাকা’য়াত নামায আদায় করেন। আমরাও তাঁর সাথে নামায আদায় করলাম। তারপর তিনি উম্মু সুলাইম ও তাঁর পরিবারের কল্যাণ কামনা করে দু’আ করলেন। উম্মু সুলাইম ’আরজ করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কিছু নিশেষ নিবেদন আছে। তিনি জানতে চাইলেনঃ কী? বললেনঃ এই আপনার খাদিম আনাস। আনাস বলেনঃ তারপর রাসূল সা. আমার জন্য এমন দু’আ করলেন যে, দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণই বাদ দিলেন না। শেষের দিকে তিনি বলেনঃ ‘হে আল্লাহ আনাসের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে সমৃদ্ধি দান কর এবং তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাও।’ আনাস বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. যে তিনটি জিনিসের জন্য দু’আ করেছিলেন, তার দুইটি আমি পেয়ে গেছি এবং বাকী একটি (জান্নাত) অপেক্ষায় আছি। আনাস আরও বলতেনঃ ‘আজ আনসারদের মধ্যে আমার চেয়ে বেশী সম্পদশালী ব্যক্তি আর কেউ নেই।’ ঐতিহাসিকরা বলছেন, রাসূলুল্লাহর সা. এই দু’আর পূর্বে একটি মাত্র আংটি ছাড়া তিনি কোন সোনা বা রূপোর মালিক ছিলেন না। এভাবে রাসুল সা. আনাস ও তাঁর পরিবারের কল্যাণ চেয়ে বহুবার দু’আ করেছেন। (আল-ফাতহুর রাব্বানী- মা’য়া বুলুগিল আমানী- ২২/২০৩, আল-ইসাবা- ১/৭২, তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪২, ১৪৩)
মৃত্যুকালে হযরত আনাস মোট ৮২ (বিরাশি) জন ছেলে মেয়ে-রেখে যান। তাদের মধ্যে ৮০ (আশি) জন ছেলে এবং হাফসা ও উম্মু ’আমর নামে দুই মেয়ে। তাছাড়া নাতি-নাতনীর সংখ্যা ছিল আরও অনেকে। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮) খলীফা ইবন খাইয়্যাত বলেনঃ আনাস যখন মারা যান তখন তাঁর চারটি বাড়ী। একটি বসরার জামে মসজিদের সামনে, একটি ইসতাফনুস গলিতে এবং একটি বসরা থেকে দুই ফারসাখ দূরে। তাছাড়া আরও একটি বাড়ী ছিল। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪১)
সন্তানদের প্রতি ছিল হযরত আনাসের দারুণ স্নেহ-মমতা। সব সময় যে তিনি বাড়ীতে থাকতেন- এই স্নেহ-মমতার প্রাবাল্যও তার একটি কারণ। ছেলে-মেয়েদের নিজেই শিক্ষা দিতেন। মেয়েদেরও হালকায়ে দারসে বসার অনুমতি ছিল। তাঁর কয়েকটি ছেলে হাদীস শাস্ত্রের শায়খ ও ইমাম রূপে স্বীকৃত হন। তাবঈদের তাবকায় (শ্রণী) তাদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। হযরত আনাসই তাদেরকে গড়ে তোলেন।
হযরত আনাস ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দাজ। সন্তানদেরও এর অনুশীলন করাতেন। ছেলেরা প্রথমে নিশানা ঠিক করে তীর ছুড়তো। তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি ছুড়তেন এবং সঠিকভাবে তা লক্ষ্যভেদ করতো। তীর ছোড়ার অনুশীলনী সেই প্রাচীন জাহিলিয়্যাতের সময় থেকেই আনসারদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। একথা তাবারী উল্লেখ করেছেন। (উসুদুল গাবা- ১/১২৮)
হযরত আনাসের পরিপূর্ণ হুলিয়া বা অবয়ব জানা যায় না। এতটুকু জানা যায় যে, তিনি মধ্যম আকৃতির সুদর্শন ব্যক্তি ছিলেন। চুল-দাড়িতে মেহেন্দীর খিযাব লাগাতেন। হাতে সব সময় হলুদ বর্ণের ‘খালুক’ নামক এক রকম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। ‘উসুদুল গাবা’ গ্রন্থকার বলেনঃ সিংহের ছবি অঙ্কিত একটি আংটি হাতে পরতেন। ছোট বেলায় মাথায় একটা জটা ছিল। রাসুল সা. যখন মাথায় হাত দিতেন, সেই জটা স্পর্শ করতেন। পরে সেটি কেটে ফেলার ইচ্ছা করলে মা বললেনঃ রাসূল সা. এটি স্পর্শ করেছেন, সুতরাং কেটো না। (উসুদুল গাবা- ১/১২৭, ১২৮) মাথায় পাগড়ী বাঁধতেন।
তিনি ছিলেন দারুণ সৌখিন ও পরিচ্ছন্ন প্রকৃতির একজন মার্জিত রুচির মানুষ। দুনিয়ার বিত্ত-বৈভবও তাঁর অনুকূলে সাড়া দেয়। এ কারণে তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। অতি যত্নে একটি উদ্যান তৈরী করেছিলেন, তাতে বছরে দুইবার ফল আসতো। সেখানে একটি ফুল ছিল যা মিশকের মত সুগন্ধি ছড়াতো। (আল-ইসাবা- ১/৭১)
তিনি বসরার দুই ফারসাখ (মাইল) দূরে ‘তিফ’ নামক স্থানে একটি বাড়ী বানিয়ে বসবাস করতেন। এতে বুঝা যায়, নগর জীবনের চেয়ে পল্লীতে বাস করা বেশী পসন্দ করতেন। ভালো খাবার খেতেন। খাবার তালিকায় সব সময় রুটি ও শুরবা থাকতো। তিনি উদার প্রকৃতির ছিলেন। আহারের সময় ছাত্র বা অন্য কেউ কাছে থাকলে, আহারে শরীক করাতেন। সকালে নাশতা করতেন এবং তিন অথবা পাঁচটি খেজুর খেতেন। কথা খুব কম বলতেন। প্রয়োজন হলে কথা তিনবার করে বলতেন। কারও বাড়ীতে ঢুকবার আগে তিনবার অনুমতি চাইতেন। (মুসনাদ- ৩/১২৮, ১৮০, ২২১, ২৩২) আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে কিছু না কিছু খাবার তাদের সামনে উপস্থিত করতেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কিছু লোক তাঁকে দেখতে আসে। তিনি দাসীকে ডেকে বললেনঃ রুটির সামান্য একটি টুকরো হলেও আমার বন্ধুদের জন্য নিয়ে এসো। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ উত্তম নৈতিকতা জান্নাতের কাজ। (হায়াতুস সাহাবা- ২/১৮২)
তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র প্রকৃতির ছিলেন। মানুষের সাথে উদারভাবে মিশতেন। ছাত্রদের সাথেও ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। প্রায়ই বলতেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সময় আমরা বসা থাকতাম, তিনি আসতেন; কিন্তু তাঁর সম্মানে আমরা কেউই উঠে দাঁড়াতাম না। অথচ রাসূলুল্লাহর সা. চেয়ে অধিকতর প্রিয় আমাদের আর কে হতে পারে? এর কারণ, রাসূল সা. এ সব কৃত্রিমতা একটু পসন্দ করতেন না।
সবরের গুণটি তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিল। তিনি যে পর্যায়ের লোক ছিলেন, মুসলমানদের অন্তরে তার প্রতি যে ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল, হযরত রাসূলে কারীম সা. তাঁর যে মর্যাদার কথা বলেছেন এবং খোদ রাসূলুল্লাহর সা. যে নৈকট্য তিনি লাভ করেছিলেন তাতে প্রতিটি মানুষ তাঁকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখতো। তাঁর ছাত্র প্রখ্যাত তাবঈ সাবিত নাবানী ভক্তি ও শ্রদ্ধার আতিশয্যে হযরত আনাসের দুই চোখের মাঝখানে চুমু দিতেন। একবার আনাস আবুল ’আলিয়্যাকে একটি সেব দিলেন। সেবটি হাতে নিয়ে তিনি শুকতে, চুমু খেতে ও মুখে ঘষতে লাগলেন। তারপর বললেনঃ এই সেবে এমন হাতের স্পর্শ লেগেছে যে হাত রাসূলের সা. পবিত্র হাত স্পর্শ করেছে। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৪) কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও উমাইয়্যা শাসকদের অনেকের কাছে এর কোন গুরুত্বই ছিল না। এসব স্বেচ্ছাচারী দুষ্টমতিদের নেতা ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। তাঁর উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। হযরত আনাস তখন চরম ধৈর্য অবলম্বন করেন। তিনি ছাড়া অন্য কারও সাথে এমন আচরণ করা হলে বসরায় আগুন জ্বলে যেত। তিনি কোন্ নীতি অবলম্বন করে এত ধৈর্য ধারণ করতেন? এর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর নিজের কথার মধ্যে। তিনি বলতেনঃ মুহাম্মাদের সা, বিশিষ্ট সাহাবীরা আমাদেরকে বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের আমীরদেরকে গালাগালি করবেনা, তাঁদেরকে ধোকা দেবে না এবং তাঁদের অবাধ্য হবে না। আল্লাহকে ভয় করবে ও ধৈর্য ধারণ করবে। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৭২)
ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভয়-ডর শূণ্য দুঃসাহসী। খুব দৌড়াতে পারতেন। একবার ‘মাররুজ জাহরান’ নামক স্থানে একটি খরগোশ তাড়া করে ধরে ফেলেন। অথচ তাঁর সমবয়সী ছেলেরা খরগোশটির পিছনে ধাওয়া করে ফিরে আসে। বড় হয়ে নিপুণ অশ্বারোহী ও দক্ষ তীরন্দাজ হন।
হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা বিপুল। তাঁদের মধ্যে আবার এমন একদল আছেন যাঁরা বর্ণনার ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি বলে বিবেচিত। আনাস ছিলেন এই দলেরই একজন। তাঁর বর্ণনা সমূহ বিশ্লেষণ করলে নীচের মূলনীতিগুলি পাওয়া যায়ঃ
১. হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দারুণ সতর্কতা অবলম্বন। মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে এসেছেঃ ‘আনাস ইবন মালিক হাদীস বর্ণনার সময় ভীত হয়ে পড়তেন। বর্ণনার শেষে বলতেনঃ এই রকম অথবা এই যেমনটি রাসূল সা. বলেছেন’ মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনার শেষে যে বলে থাকেন- ‘আও কামা কালা-অথবা যেমন তিনি বলেছেন’- এবং আজকের যুগ পর্যন্ত যে ধারাটি অব্যাহত রয়েছেন, তার প্রচলন হযরত আনাস থেকে। (তারীখে ইবন ’আসাকির- ৩/১৪৮)
২. যে হাদীস বুঝতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তিনি তা বর্ণনা করেননি।
৩. যে সকল হাদীস তিনি সাহাবীদের নিকট থেকে এবং যেগুলি খোদ রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনেছিলেন এই দুই প্রকারের মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে কোন জ্ঞানের সেবা বা খিদমাত হলো সেই জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার ঘটানো, হযরত আনাস এ ক্ষেত্রে কোন সাহাবী থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। সারাটি জীবন তিনি অভিনিবেশ সহকারে ইলমে হাদীসের প্রচার-প্রসারে অতিবাহিত করেন। তিনি হাদীস শিক্ষা দানের আওতা থেকে কক্ষণও বাইরে যাননি। যে যুগে তাঁর সমসাময়িক সাহাবা যুদ্ধ-বিদ্রহে ব্যস্ত ছিলেন তখনও রাসূলুল্লাহর সা. এই খাদিম দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে বসরার জামে মসজিদে বসে মানুষকে হাদীস শোনাতেন।
তাঁর জ্ঞানের প্রসারতা তাঁর শাগরিদদের সংখ্যা দ্বারাই অনুমান করা যায়। তাঁর হালকায়ে দারসে মক্কা, মদীনা, কূফা, বসরা, সিরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রের সমাবেশ ঘটতো তাঁর সন্তান সংখ্যার মত ছাত্র সংখ্যাও অগণিত। হযরত আনাস হযরত রাসূলে কারীম সা. থেকে এবং বিশিস্ট সাহাবীদের নিকট থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। প্রায় এক শো রাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মোট ২২৮৬ (দুই হাজার দুই শো ছিয়াশি)। মুত্তাফাক আলাইহি- ১৮০, বুখারী এককভাবে ৮০ এবং মুসলিম এককভাবে ৭০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর ছেলে এবং নাতীদের থেকেও বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বসরার বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু ’উমাইর ’আবদুল কাবীল ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন হাফ্স ইবন হিশাম (২৯১ হিঃ) তাঁরই বংশধর। (দারিয়া-ই-মা’য়ারিফ ইসলামিয়্যা- ৩/৪০১) অবশ্য তাঁর বর্ণিত মুত্তাফাক আলাইহি হাদীসের ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন- ১৬৮, আবার কেউ বলেছেন- ১২৮। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫, তাহজীবুল আসমা- ১/১২৭)
হযরত আনাস প্রথমতঃ রাসূলে পাকের সা. সাহচার্যে থেকে ইল্ম হাসিল করেন। রাসূলে সা. ওফাতের পর যে সকল সাহাবীর নিকট থেকে হাদীস শোনেন তারা হলেনঃ উবাই ইবন কা’ব, ’আবদুর রহমান ইবন ’আউফ, ’আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ, আবু জার, আবু তালহা, মু’য়াজ ইবন জাবাল, ’উবাদাহ্ ইবনুস সামিত, ’আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, সাবিত ইবন কায়েস, মালিক ইবন সা’সা’, উম্মু সুলাইম (তাঁর মা), উম্মু হারাম (তাঁর খালা), উম্মুল ফাদল (হযরত ’আব্বাসের স্ত্রী), আবু বকর, ’উমার, ’উসমান রা. প্রমুখ। (তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৪)
হযরত আনাসের ছাত্র ও শাগরিদদের নামে তালিকা অনেক দীর্ঘ। তাঁর মধ্যে হাদীস শাস্ত্রে যাঁরা বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন এখানে তাঁদের কয়েকজন জনের নাম উল্লেখ করা গেলঃ হাসান বসরী, ইবন শিহাব যুহরী, সুলাইমান তায়মী, আবু কিলাবা, ইসহাক ইবন আবী তালহা, আবু বকর ইবন ’আবদিল্লাহ মুযানী, কাতাদাহ, সাবিত নাবানী, হুমাইদ আতত্বাবীল, সুমামাহ্ ইবন ’আবদিল্লাহ, (আনাসের পৌত্র) জা’দ, আবু ’উসমান, মুহাম্মাদ ইবন সীরীন আনসারী, আনাস ইবন সীরীন আযহারী, ইয়াহইয়া ইবন সা’ঈদ আনসারী, রাবী’য়াতুর রায়, সা’ঈদ ইবন জুবাইর এবং সুলাইমান ওয়ারদান রাহিমাহুমুল্লাহ। (তাজহকিরাতুল হুফ্ফাজ- ১/৪৫)
ইলমে হাদীসের মত ফিকাহ শাস্ত্রেও হযরত আনাসের পান্ডিত্য ছিল। ফকীহ সাহাবীদেরকে তিনটি তাবকা বা স্তরে ভাগ করা হয়। আনাসের স্থান দ্বিতীয় স্তরে। তাঁর ইজতিহাদ ও ফাতওয়াসমূহ সংকলিত হলে একটি স্বতন্ত্র পুস্তকের রূপ লাভ করতে পারে। হযরত ’উমার রা. ফকীহ সাহাবীদের একটি দলের সাথে তাঁকে বসরায় পাঠান। ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে?
সাহাবীদের যুগে শিক্ষাদান সাধারণতঃ হালকা-ই-দারসের মধ্যেই সীমিত ছিল। হযরত আনাসও এই হালকার পদ্ধতিতেই দারস দিতেন। কোন ছাত্র প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিতেন। তাঁর দারসের এ ধরণের সাওয়াল-জাওয়াবের একটি সংকলন আছে। এখানে কয়েকটি মাসয়ালা উদ্ধৃত হলো যার মাধ্যমে তাঁর ইজতিহাদ পদ্ধতি, সূক্ষ্ণদৃষ্টি, স্বচ্ছ বোধশক্তি, সঠিক সিদ্ধান্ত ইত্যাদির একটা ধরণা লাভ করা যেতে পারে।
বিশেষ কয়েকটি বরতনে নাবীজ (আংগুর বা খেজুরের রস) পান করা মাকরূহ। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম একমত। হযরত আনাস স্পষ্ট করে তার কারণগুলির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
একবার কাতাদাহ জিজ্ঞেস করলেন, ঘড়া বা কলসে কি নাবীজ বানানো যায়? আনাস বললেনঃ যদিও রাসূলে কারীম সা. এ সম্পর্কে কোন মত প্রকাশ করে যাননি, তবুও আমি মাকরুহ মনে করি। কারণ, যে জিনিসের হারাম বা হালাল হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ আছে, তাতে হারাম হওয়ার দিকটিই প্রাধান্য পাবে।
একবার মুখতার ইবন ফিলফিল জানতে চাইলেন, কোন্ কোন্ পাত্রে নাবীজ পান করা উচিত নয়? বললেন, যাতে নেশা হয় তা সবই হারাম। মুখতার বললেন, কাঁচ অথবা আলকাতরার পাত্রে কি পান করা যায়? বললেনঃ হাঁ। আবার প্রশ্ন করা হলোঃ মানুষ যে মাকরূহ মনে করে? বললেনঃ যাতে সন্দেহ হয় তা পরিহার কর। তারপর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হলোঃ নেশা হয় এমন জিনিস তো হারাম; কিন্তু এক দুই ঢোক পানে আপত্তি কি? আনাস বললেনঃ যে জিনিসের বেশী পরিমাণ নেশা সৃষ্টি করে তার অল্প পরিমাণও হারাম। দেখ-আংগুর, খুরমা, গম, যব ইত্যাদি থেকে মদ তৈরী হয়। তার মধ্যে যে জিনিসে নেশা সৃষ্টি হয় তা মদ হয়ে যায়।
হযরত আনাস যদিও সুন্দরভাবে এই মাসয়ালাটি বর্ণনা করেছেন; তবুও এর আরও একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। হযরত রাসূলে কারীম সা. পান ও পানীয় সম্পর্কে যে বিধি-বিধান দান করেছেন সংক্ষেপে তা নিম্নরূপঃ
১. প্রত্যেক শরাব বা পানীয় যা নেশা সৃষ্টি করে তা হারাম। সাহীহাইনে হযরত ’আয়িশা রা. থেকে এ হাদীস বর্নিত হয়েছে।
২. প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই খমর এবং প্রত্যেক খমর (মদ) হারাম। ইবন ’উমার রা. থেকে সাহীহ মুসলিমে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
৩. ‘যে সব জিনিসের বেশী পান করলে নেশা হয় তার অল্প একটুও হারাম।’ (সুনানু ইবন ’উমার)। এর মধ্যে প্রথম হাদীসটির মর্ম হলো, যে সকল পানীয়ের মধ্যে নেশা বা মাদকতা এসে যায় তা হারাম। দ্বিতীয়টির অর্থ হলো, প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই খমর, আর প্রত্যেক খমরই হারাম। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই দাঁড়ায়; প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই হারাম। তৃতীয়টির অর্থ হলোঃ যে সব জিনিসের বেশী পান করলে নেশা হয় তার অর্প একটুও হারাম। হযরত আনাস রা. তাঁর উপরোক্ত জবাবে এই কথাটিই বলেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো বিশেষ কয়েকটি পাত্রে নাবীজ পান করতে নিষেধ করা হয়েছে কেন? এর প্রকৃত রহস্য এই যে, আধুনিক বিশ্ব মদ তৈরী ও সংরক্ষণের জন্য সুন্দর কাঁচের যে সব পাত্র আবিষ্কার করেছে, তৎকালীন আরবে তা ছিলনা। সেখানে সাধারণভাবে লাউ-এর খোল ও সুরাহী বোতলের কাজ দিত। অথবা এ জাতীয় আরও কয়েকটি পাত্র ছিল যা প্রাকৃতিক ফল শুকিয়ে ও সাফ করে মদের কাজে ব্যবহার করা হতো। ঐ সব পাত্রে মদ রাখলে স্বাভাবিকভাবেই তাতে মদের ক্রিয়া পড়তো, আর তা ধোয়ার পরেও দূর হতো না। ইসলামের প্রথম যুগে যখন মদ হারাম হয় তখন এইসব পাত্রের ব্যবহার হারাম হওয়ার প্রকৃত রহস্য এটাই। অবশ্য পরবর্তীকালে এ জাতীয় পাত্র যাতে মদ রাখা হয়নি, তার ব্যবহার জায়েয হতে পারে। কিন্তু হিজরী প্রথম শতকের ঈমানী চেতায় উজ্জীবিত মুসলমানরা ধারণা করে যে, ঐ সব পাত্র ব্যবহার করলে শরাব পানের কথা নতুন করে মানুষের স্মরণ হতে পারে।
একবার এক ব্যক্তি হযরত আনাসকে প্রশ্ন করলোঃ রাসূল সা. কি জুতো পরে নামায আদায় করতেন? বললেনঃ হাঁ। জুতো পরে নামায আদায় করা যায়। তবে শর্ত হলেো পাক হতে হবে, নাজাসাত থেকে পরিষ্কার হতে হবে। কেউ নতুন জুতো পরে নামায পড়লে ক্ষতি নেই।
একবার ইয়াহইয়া ইবন ইয়াযীদ হান্নায়ী প্রশ্ন করলেনঃ নামাযে কখন কসর করা উচিত? বললেনঃ আমি যখন কুফা যেতাম, তখন কসর করতাম। আর রাসূল সা. তিন মাইল বা তিন ফারসাখ পথ চলার পর কসর করেছিলেন। হযরত আনাসের কথার অর্থ এই নয় যে, তিন মাইল সফর করলেই কসর করতে হবে। বরং প্রকৃত ঘটনা হলো, রাসূল সা. মক্কার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পথে সর্বপ্রথম জুলহুলায়ফা নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন। সাহীহ বর্ণনা মতে, তা মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। আর এ জন্যই তিনি সেখানে কসর আদায় করেন।
মুখতার ইবন ফিলফিল একবার প্রশ্ন করলেনঃ অসুস্থ ব্যক্তি কিভাবে নামায আদায় করবে? আনাস বললেনঃ বসে বসে।
’আবদুর রহমান ইবন দারদান এবং তাঁর সাথে আরও কিছু লোক মদীনায় আনাসের কাছে আসলেন। আনাস জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা কি ’আসরের নামায আদায় করেছ? তাঁরা বললেনঃ হাঁ। তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করলোঃ রাসূল সা. ’আসরের নামায পড়তেন কোন সময়? বললেনঃ সূর্য তখনও উজ্জ্বল ও উপরে থাকতো।
একবার তিনি একটি জানাযার নামায পড়ালেন। জানাযাটি ছিল পুরুষের। এজন্য মাইয়্যেতের মাথা বরাবর দাঁড়ালেন। একবার এক মহিলার জানাযা আনা হলো। এবার তিনি কোমর সোজা দাঁড়ালেন। ’আল ইবন যিয়াদ ’আদাদীও সেই নামাযে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দুইটি জানাযায় দুই রকম দাড়ানোর কারণ জানতে চাইলেন। আনাস বললেনঃ রাসূল সা. এমনটিই করতেন। ‘আলা’ সমবেত লোকদের বললেনঃ ওহে, তোমরা কথাটি মনে রেখ।
একবার এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলোঃ হযরত ’উমার রা. রুকু’র পরে কুনুত পড়েছিলেন? বললেনঃ হাঁ। রাসূল সা. ও পড়েছিলেন। তবে এটা হযরত আনাসের নিজস্ব মতামত। কারণ, সাহীহ হাদীস দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, রাসূল সা. এবং সাধারণভাবে প্রায় সকল সাহাবা ‘বিতর’ নামাযে রুকু’র পূর্বে কুনুত পড়তেন। এই মাসয়ালায় ইমাম শাফে’ঈ হযরত আনাসের অনুসারী। তিনি নিজের মতের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি হাদীস গ্রহণ করেছেন। হাদীসটি হলো, হযরত ’আলীও রুকু’র পরে কুনুত পড়তেন। কিন্তু হাদীসটি মুনকাতা’ ও দুর্বল সনদ বিশিষ্ট।
তাছাড়া ইবন মুনজির ‘আল-আশরাফ’ গ্রন্থে লিখেছেন, আনাস এবং অমুক অমুক সাহাবী থেকে বর্ণিত যে সকল হাদীস আমার কাছে পৌঁছেছে, তার প্রত্যেকটিতে রুকু’র পূর্বে কুনুত পড়ার কথা এসেছে। আর এটাই সঠিক। কারণ, সাহীহ মুসলিম গ্রন্থে আনাস থেকে যে সকল রিওয়ায়াত এসেছে তাতে এ্ মিাসয়ালার স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ’আসিম হযরত আনাসকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কুনুত রুকু’র পূর্বে না পরে পড়া উচিত? বললেনঃ রুকু’র পূর্বে। ’আসিম বললেনঃ মানুষের তো ধারণা রাসূল সা. রুকু’র পরে পড়তেন। আনাস বললেনঃ সে একটা সাময়িক ঘটনা। কয়েকটি গোত্র মুরতাদ হয়ে যায় এবং বেশ কিছু সাহাবাকে হত্যা করে। এজন্য হযরত রাসূলে কারীম সা. একমাস রুকু’র পরে কুনুত পড়ে তাদের ওপর বদ দু’আ করেছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/১০০, ১১২, ১১৮, ১২৬, ১২৯, ২০৪, ২০৯)
উল্লেখিত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম হযরত আনাস কেমন সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারী ছিলেন। তাঁর ইজতিহাদী মাসয়ালার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, তা অন্যান্য সাহাবার ইজতিহাদের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এজন্য তা সঠিক। (দ্রঃ সীয়ারে আনসার- ১/১৩৭-১৪২)
হযরত আনাসের চারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্যকে আরও শোভা দান করেছিল, হুব্বে রাসূল, ইত্তেবা-ই-সুন্নাত, আমর বিল মা’রূফ ও হক কথা বলা- এগুলিই হলো সেই বৈশিষ্ঠ্য। হযরত রাসূলে কারীমের সা. প্রতি তাঁর ভালোবাসার চিত্র তো আমরা তুলে ধরেছি। তিনি যখন মাত্র দশ বছরের এক অবুঝ বালক তখনই রাসূলে সা. প্রতি এত গভীর মুহাব্বত যে, প্রতিদিন প্রত্যুষে রাসূলের সা. দীদার লাভে তাঁর চোখ দুটি ধন্য হতো। সেই সুবহে সাদিকের পূর্বে রাতের অন্ধকারে উম্মু সুলাইমের এই ছেলে শয্যা ত্যাগ করে তাঁর হাবীবের অজুর পানির বন্দোবস্ত করার জন্য মসজিদে নববীর পথ ধরতেন। যৌবনে তাঁর এই ভালোবাসার কোন সীমা ছিল না। রাসূলুল্লাহর সা. একটিমাত্র দৃষ্টি আনাসের জন্য চরম আনন্দ ও প্রশান্তি বয়ে নিয়ে আসতো। রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর যদিও তিনি বাহ্যতঃ তাঁর দীদার থেকে বঞ্চিত হন, তবুও প্রায়ই স্বপ্নে তাঁর দীদার লাভে ধন্য হতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে কাঁদতে মানুষের কাছে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. কথা যখন তিনি স্মরণ করতেন তখন বড় অস্থির ও কাতর হয়ে পড়তেন। একদিন রাসূলুল্লাহর সা. চেহারা মুবারক ও দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন শুধু উদাস চাহনিতে রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশার সেই সৌভাগ্যে ভরা দিনগুলির কথা স্মরণ করতে লাগলেন। তিনি যখন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতের কথা বলতেন, তখন দেখা যেত অকস্মাৎ তাঁর মধ্যে ভাবান্তর ঘটে গেছে। অবলীলাক্রমে মুখ থেকে বেরিয়ে পড়েছেঃ কিয়ামতের দিন আমি যখন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে উপস্থিত হবো তখন বলবো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার সেই নিকৃষ্ট খাদিম আনাস উপস্থিত।
হযরত আনাসের প্রতিটি মজলিস হযরত রাসূলে কারীমের সা. ঘটনাবলী স্মরণে ভরপুর থাকতো। নবুওয়াতের সময়কালের ঘটনাবলী ছাত্র ও ভক্তদের কাছে বর্ণনা করতেন। এই বর্ণনার মধ্যেই অন্তরে এটা প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতেন এবং তাতে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। তিনি বাড়ী ফিরে যেতেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. যে সকল জিনিস তাঁর কাছে ছিল তা বের করে বার বার দেখতেন এবং মনকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁর ছাত্রদের সকলের মধ্যে এই রাসূল-প্রেমের প্রভাব পড়েছিল। সাবিত ছিলেন হযরত আনাসের অন্যতম ছাত্র। তিনি একেবারেই উস্তাদের রংগে রংগিত ছিলেন। তিনি উস্তাদের নিকট সব সময় নবুওয়াতী যুগ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন। একদিন প্রশ্ন করলেন, আপনি কি হযরতের পবিত্র হাত স্পর্শ করেছেন? আনাস বললেনঃ হাঁ। অথবা তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. হাত অপেক্ষা অধিকতর কোমল হাত আর কক্ষণও স্পর্শ করিনি। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪) একথা শুনে সাবিতের অন্তরে প্রেমের আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি উস্তাদকে বললেনঃ আপনার হাতটি একটু বাড়িয়ে দিন, একটু চুমু দিই।
প্রকৃত ভালোবাসার দাবী হলো প্রিয়জনের প্রতিটি জিনিস ও আচরণই পছন্দ করা। হযরত আনাস তা করতেন। তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনাও একথা প্রমাণ করে। আনাস বলেনঃ একবার এক দর্জি রাসূলকে সা. আহারের দা’ওয়াত দিল। আমিও সাথে গেলাম। যবের রুটি এবং শুকনো গোশত ও লাউ-এর তরকারি উপস্থিত করা হলো। আমি দেখলাম, রাসূল সা. বেছে বেছে লাউ খাচ্ছেন। সেইদিন থেকে আমি লাউ খেতে ভালোবাসি। (হায়াতুস-সাহাবা- ২/১৯০)
আনাস বলেন, একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে সা. জিজ্ঞেস করলোঃ কিয়ামত কখন হবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেনঃ তুমি তার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ? লোকটি বললোঃ কিছুই না। তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মুহাব্বত করি। রাসুল সা. বললেনঃ তুমি যাদের ভালোবাস তাদের সাথেই থাকবে। আনাস বলেনঃ সেদিন রাসূলুল্লাহর সা. এ কথায় আমরা দারুণ খুশী হয়েছিলাম। আমি- নবী সা., আবু বকর ও উমারকে ভালোবাসি এবং আশা করি ভালোবাসার বিনিময়ে আমি তাঁদের সাথেই থাকবো। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৩১৮)
কালিমা তাওহীদের পর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন নামায। হযরত রাসূলে কারীম সা. যে খুশু’- খুদু’ (ভয় ও বিনয়) ও আদবের সাথে নামায আদায় করতেন সাহাবীরাও সেই পদ্ধতি অনুসরণের চেষ্টা করতেন। বহু সাহাবীর নামায তো ছিল প্রায় রাসূলে পাকের সা. নামাযের কাছাকাছি। তবে রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে আনাসের নামাযের সাদৃশ্য ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। একবার তো হযরত আবু হুরাইরা রা. আনাসকে রা. নামায পড়তে দেখে বলেছিলেন, আমি ইবন উম্মে সুলাইমের (আনাস) নামায অপেক্ষা রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ আর কারও নামায দেখিনি।
নামায ছাড়াও রাসূলুল্লাহর সা. প্রতিটি কথা ও কাজ সাহাবায়ে কিরামের সামনে ছিল। হযরত আনাস দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর সা. সার্বক্ষণিক খাদেম ছিলেন। এই সময় কালে রাসূলুল্লাহর সা. কোন কাজ আনাসের নিকট গোপন থাকতে পারে না। রাসূল সা. যা কিছু বলতেন অথবা ’আমলের মাধ্যমে যা প্রতিষ্ঠিত করতেন তার সবই আনাস স্মৃতিতে ধরে রাখতেন এবং সেই অনুযায়ী ’আমল করতেন। একবার খলিফার আমন্ত্রণে তিনি দিমাশকে গেলেন। ফেরার পথে ‘আইনুত তামার’ নামক স্থানে যাত্রা বিরতির ইচ্ছা করলেন। ছাত্র ও ভক্তদের কাছে সে খবর পৌঁছে গেল। তারা নির্ধারিত দিনে উক্ত স্থানে সমবেত হলো, লোকালয়ের বাইরে একটি বিস্তীর্ণ ময়দানের মধ্য দিয়ে তাঁর উট এগিয়ে আসছিল। তখন ছিল নামাযের সময়। লোকেরা দেখলো, তিনি উটের পিঠে নামাযরত; কিন্তু উটটি কিবলামুখী নয়। ছাত্ররা বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করলেনঃ আপনি এ কেমনভাবে নামায আদায় করছিলেন? হযরত আনাস বললেনঃ আমি যদি রাসূলুল্লাহকে সা. এভাবে নামায আদায় করতে না দেখতাম, কক্ষণও আদায় করতাম না।
একবার ইবরাহীম ইবন রাবীয়া’ হযরত আনাসের নিকট আসলেন। হযরত আনাস একখানা কাপড়ের একপাশ পরে অন্য পাশ গায়ে জড়িয়ে নামাযে মশগুল ছিলেন। নামায শেষ হলে ইবরাহীম জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনি এভাবে এক কাপড়ে নামায পড়েন? আনাস বললেনঃ হাঁ, আমি এভাবে রাসুলকে সা. নামায পড়তে দেখেছিলাম। উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে কারীম সা. জীবেনের সর্বশেষ নামায- যে নামায হযরত আবু বকরের রা. পিছনে পড়েছিলেন, তা এক কাপড়েই ছিল। (মুসনাদ- ৩/১৫৯)
হযরত রাসূলে কারীমের সা. পবিত্র জীবনের প্রতিটি আচরণ ও পদক্ষেপ ছিল হযরত আনাসের জীবন পথের দিশারী। ফরজ ছাড়াও ওয়াজিব ও সুন্নাত সমূহেও রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন তাঁর আদর্শ। তিনি ছোট-বড় সকলকে সালাম করতেন। সব সময় অজু অবস্থায় থাকতেন। তিনি বলতেন, আমাকে রাসুল সা. বলেছেনঃ আনাস, তুমি যখন ঘর থেকে বের হবে, তারপর যার সাথে দেখা হবে, সকলকে সালাম করবে। এতে তোমার নেকী বা মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে। আর সম্ভব হলে সব সময় অজু অবস্থায় থাকবে। কারণ, তুমি জান না তোমার মৃত্যু কখন আসবে। (আনসাবুল আশরাফ- ১/৪৬৪)
প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তির জন্য কুরবানী প্রয়োজন। হযরত আনাস ছিলেন একজন বিত্তশালী রয়িস বা নেতা। যতগুলি জানোয়ার ইচ্ছা, কুরবানী করতে পারতেন। কিন্তু ‘খায়রুল কুরূন’- সর্বোত্তম যুগের লোকদের নিকট নাম-কামের চেয়ে রাসূলের সা. পায়রুবী ও অনুসরণ ছিল সব কিছুর উর্দ্ধে। সে যুগের লোকেরা খ্যাতির জন্য; বরং সাওয়াবের জন্যই কুরবানী করতেন। হযরত রাসূলে কারীম সা. দুইটি পশু কুরবানী করতেন, এই জন্য হযরত আনাসও দুইটিই করতেন।
উমাইয়্যা শাসন আমলে হযরত ’উমার ইবন ’আবদিল ’আযীয র. যুবরাজ থাকাকালে একবার মদীনার গভর্ণর ছিলেন। যেহেতু শাহী খান্দানের সদস্য ছিলেন, এ কারণে জাতীয় জীবনের অনেক কিছুই তাঁর জানা ছিল না। সে যুগের প্রচলন অনুযায়ী নিজেই নামাযের ইমামতি করতেন এবং মাঝে মধ্যে কিছু ভুল-ত্রুটিও হয়ে যেত। হযরত আনাস প্রায়ই তাঁর ভুল ধরিয়ে দিতেন। তিনি একবার হযরত আনাসকে বললেন, আপনি এভাবে আমার বিরোধীতা করেন কেন? হযরত আনাস বললেনঃ আমি যেভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. নামায পড়তে দেখেছি আপনি যদি সেইভাবে নামায পড়ান তাহলে আমি সন্তুষ্ট হবো। অন্যথায় আপনার পিছনে নামায আদায় করবো না। হযরত ’উমার ইবন ’আবদিল ’আযীয ছিলেন বুদ্ধিমান ও সৎ স্বভাব- বিশিষ্ট ব্যক্তি। হযরত আনাসের কথায় তিনি প্রভাবিত হলেন। তিনি আনাসকে উস্তাদ হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিছুদিন তাঁর সাহচর্য ও শিক্ষার প্রভাবে তিনি এমন সুন্দর নামায পড়াতে লাগলেন যে, খোদ আনাসই বলতে লাগলেন, এই ছেলের নামাযের চেয়ে আর কারও নামায রাসূলুল্লাহর সা. নামাযের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১৩৩, ১৩৪)
একবার খলীফা ’আবদুল মালিক হযরত আনাসসহ আরও চল্লিশজন আনসারী ব্যক্তিকে দিমাশ্কে ডেকে পাঠান। সেখান থেকে ফেরার পথে ‘ফাজ্জুন নাকাহ’ নামক স্থানে পৌঁছলে আসর নামাযের সময় হয়ে যায়। যেহেতু সফর তখনও শেষ হয়নি, এই কারণে হযরত আনাস দুই রাকা’য়াত নামায পড়ান (কসর করেন)। তবে কিছু লোক আরও দুই রাকা’য়াত পড়ে চার রাকা’য়াত পুরো করেন। একথা হযরত আনাস জানতে পেরে দারুণ ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, আল্লাহ যখন কসরের অনুমতি দিয়েছেন তখন এ সুবিধা গ্রহণ করবে না কেন? আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, এমন একটি সময় আসবে যখন মানুষ দ্বীনের ব্যাপারে অহেতুক বাড়াবাড়ি করবে। আসলে তারা দ্বীনের প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে থাকবে গাফিল।
সত্যকথা বলা এবং সত্যকে পছন্দ করা ছিল হযরত আনাসের চরিত্রের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। খিলাফতে রাশেদার প্রথম দুই খলীফার পর এমন অনেক যুবক সরকারের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয় যারা ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল। এজন্য তাদের অনেক কাজই কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী হতো। যে সাহাবায়ে কিরাম জীবনের বিনিময়ে ইসলাম খরীদ করেছিলেন তাঁরা এটা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁরা ভয়-ভীতির উর্ধ্বে উঠে সব সময় সত্য কথাটি স্পষ্টভাবে বলে দিতেন। হযরত আনাস রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর দীর্ঘ দিন জীবিত ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনে বহু স্বৈরাচারী শাসকের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন যারা প্রকাশ্যে শরীয়াতের প্রতি অবহেলা করতো। হযরত আনাস এ অবস্থায় চুপ থাকেননি। তিনি প্রকাশ্যে জনসমাবেশে তাদের সতর্ক করে দিতেন।
ইয়াযীদের সময়ে আবদুল্লাহ ইবন যিয়াদ ছিলেন ইরাকের গভর্ণর। তাঁর নির্দেশে হযরত ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাথা সামনে আনা হলে তিনি হাতের ছড়িটি দিয়ে হযরত হুসাইনের চোখে টোকা দিয়ে তাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু অশালীন কটাক্ষ করেন। হযরত আনাস নিজেকে আর সম্বরণ করতে পারলেন না। ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ এই চেহারা রাসূলুল্লাহর সা. চেহারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
উমাইয়্যা রাজবংশের বিখ্যাত স্বৈরাচারী গভর্ণর হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ আস-সাকাফী নিজের ছেলেকে বসরার কাজী নিয়োগ করতে চায়। হাদীস শরীফে বিচারক অথবা আমীরের পদের আকাঙক্ষা হবার নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তাই হযরত আনাস হাজ্জাজের এই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে বলেনঃ এমনটি করতে রাসূল সা. নিষেধ করেছেন।
উমাইয়্যা শাসকদের আর এক আমীর হাকাম ইবন আইউব। তাঁর নৃশংসতা মানুষের সীমা অতিক্রম করে জীব-জন্তু পর্যন্ত পৌঁছে যায়। একবার হযরত আনাস তাঁর বাড়ীতে গিয়ে দেখেন, মুরগীর পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে তীরের নিশানা বানানো হচ্ছে। তীর লাগলে মুরগীটি ছটফট করছে। হযরত আনাস এ দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হলেন এবং মানুষকে তাদের এ কাজের জন্য ধিক্কার দিলেন। (সাহীহ মুসলিম- ২/১৫৮)
একবার কিছু লোক জুহরের নামায আদায় করে হযরত আনাসের সাক্ষাতের জন্য আসে। তিনি তখন চাকরের নিকট অজুর পানি চাইলেন। লোকেরা জানতে চাইলো, এ কোন নামাযের প্রস্তুতি? বললেনঃ ’আসর নামাযের। এক ব্যক্তি বললোঃ আমরা তো এখনই ‘জুহর’ পড়ে এলাম। হযরত আনাস আমীর উমরাহের দ্বীনের প্রতি উদাসীনতা এবং জনগণের দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখে দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি বললেনঃ এ তো হবে মুনাফিকদের নামায। মানুষ বেকার বসে থাকবে, তবুও নামাযের জন্য উঠবে না। যখন সূর্য অস্ত যেতে থাকবে তখন খুব তাড়াতাড়ি মোরগের মত চারটি ঠোকর মেরে দেবে। সেই ঠোকরে আল্লাহর স্মরণ থাকবে অতি অল্পই।
প্রকৃত দ্বীনদারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘আমর বিল মা’রূফ’- সৎ কাজের আদেশ দান করা। আর এজন্যই কুরআন মজীদে উম্মাতে মুসলিমাকে সর্বোত্তম উম্মাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। হযরত আনাসের মধ্যে এই গুণটির বিশেষ বিকাশ ঘটেছিল। একবার ’উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের একটি মজলিসে হাউজে কাওসার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। উবাইদুল্লাহ এর বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। একথা হযরত আনাসের কানে গেল। তিনি সরাসরি উবাইদুল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেনঃ তোমার এখানে কি ‘হাউজে কাওসার’ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা হয়েছিল? বললেনঃ হাঁ। কেন, রাসূল সা. কি এ সম্পর্কে কিছু বলেছেন? হযরত আনাস রা. হাউজে কাওসার সম্পর্কে রাসূলের সা. হাদীস তাঁকে শুনিয়ে ফিরে আসেন।
হযরত মুস’য়াব ইবন ’উমাইর রা. একজন আনসারী ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের রিপোর্ট পেলেন। এই অপরাধের জন্য তিনি লোকটিকে পাকড়াও করার চিন্তা করলেন। লোকেরা হযরত আনাসকে কথাটি জানালেন। তিনি সোজা মুস’য়াবের কাছে গিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. আনসারদের প্রতি ভালো ব্যবহার করার জন্য আমীরদের অসীয়াত করেছেন। তাদের ভালো লোকদের সাথে উত্তম আচরণ এবং খারাপ লোকদের ক্ষমা করতে বলেছেন। এই হাদীস শুনা মাত্র মুস’য়াব ইবন ’উমাইর রা. খাট থেকে নীচে নেমে এসে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. আদেশের স্থান আমার চোখের ওপর। আমি লোকটিকে ছেড়ে দিচ্ছি।
সাবিত আন-নাবানী বলেনঃ একদিন আমি বসরার ‘যাবিয়া’ নামক স্থানে আনাসের সঙ্গে চলছিলাম। এমন সময় আজান শোনা গেল। সাথে সাথে আনাস মন্থর গতিতে চলতে শুরু করলেন এবং এভাবে আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
তুমি কি বলতে পার কেন আমি এভাবে হেঁটে মসজিদে এলাম? তারপর নিজেই বললেনঃ নামাযের জন্য আমার পদক্ষেপ যাতে বেশী হয়, সেই জন্য। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/১০৪)
হযরত আনাস ’ইলম হাসিলের চেয়ে অর্জিত ’ইলম অনুযায়ী ’আমলের ওপর বেশী জোর দিতেন। তিনি বলতেনঃ যত ইচ্ছা ’ইলম বা জ্ঞান হাসিল কর। তবে আল্লাহর কসম, ’আমল না করলে সে সব ’ইলমের প্রতিদান দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলতেনঃ প্রকৃত ’আলেমের কাজ বুঝাও সেই অনুযায়ী কাজ করা। আর মূর্খদের কাজ শুধু বর্ণনা করা। (হায়াতুস সাহাবা- ৩/২৪১, ২৪৪)
তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সুন্নাতের প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব দিতেন। এ সম্পর্কে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হাদীস বর্ণনা করেছেন। রাসূল সা. বলেছেনঃ যে আমার সুন্নাত ছেড়ে দেবে সে আমার উম্মাতের কেউ নয়। তিনি আরও বলেছেনঃ যে আমার সুন্নাত অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত। (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩৫)
হযরত আনাস রা. রাসূলুল্লাহর সা. ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করেছিলেন, যেমনঃ জুতো, একটি চাদর, একটি পিয়ালা, তাঁবুর কয়েকটি খুঁটি ইত্যাদি। আনাস বলতেনঃ আমার মা উম্মু সুলাইম মৃত্যুকালে আমার জন্য রেখে যান রাসূলুল্লাহর সা. একটি চাদর, একটি পিয়ালা যাতে তিনি পানি পান করতেন, তাঁবুর কয়েকটি খুঁটি এবং একটি শীলা যা ওপর আমার মা রাসূলুল্লাহর সা. ঘাম মিশিয়ে সুগন্ধি পিষতেন। (তারিখে ইবন আসাকির- ৩/১৪৪, ১৪৫)
এভাবে হযরত আনাস ইবন মালিক রা. সম্পর্কে টুকরো টুকরো তথ্য হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থ সমূহে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা খুবই চমকপ্রদ এবং মুসলিম সমাজের জন্য কল্যাণকরও বটে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি