ধনীর দুলাল ওজ্জা হলেন নিঃস্ব
আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগের কথা। আরবে তখন ধবী গরিব সব ধরনের লোকই বাস করত। সে সময়ের এক ধনী লোকের কাহিনী বলি। শোন তা হলে।

লোকটির নাম ছিল ওজ্জা। তবে ইসলাম কবুল করে তার নাম হয়ে গেল আবদুল্লাহ (রা)। মহানবী (সা)-এর সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম সাহাবী ছিলেন তিনি। ওজ্জা ছিলেন পিতা-মাতার অতি আদরের সন্তান। তাঁর পরিবারের ছিল অঢেল সম্পদ ও বিত্ত-বৈভব। তাদের কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। ফলে ওজ্জার শৈশব ও কৈশোর বেশ আরাম-আয়াসের মধ্যেই কেটেছিল। বয়স হলে মা-বাবা তাঁকে বিয়ে করান। এক ধনীর দুলালীদের সাথে ওজ্জার বিয়ে হলো।

আরবে সময়টা তখন খুব এটা ভালো যাচ্ছিল না। মানুষ তার প্রভুকে ভুলে গিয়ে মূর্তির পূজা করত। নানা রকম কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল আরবের মানুষ। আরবের অধিকাংশ মানুষ ছিল পৌত্তলিক। আরব সমাজের মানুষের স্বভাব-চরিত্রও তেমন ভালো ছিল না। তারা মারামারি হানাহানি নিয়ে মেতে থাকত। এমন সময় কঠিন সময়ে আরবে আল্লাহতাআলা তাঁর পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে পাঠালেন। তিনি মানুষকে কল্যাণ ও মুক্তির পথে ডাকছিলেন। পুরোদমে তখন চলছে দীনের কাজ, ইসলাম প্রচারের দাওয়াত। মহানবী (সা)-এর দাওয়াত অনেকেই কবুল করে নিচ্ছিল। বহু খোদার গোলামী ছেড়ে মানুষ এক আল্লাহকে মেনে চলতে আগ্রহী হলো। ধীরে ধীরে এ দাওয়াত মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওজ্জার কাছেও গিয়ে পৌঁছল ইসলামের বাণী। ইসলামের সৌন্দর্য ওজ্জাকে আকৃষ্ট করল। রাসূল (সা)-এর মুখে এক আল্লাহর কথা ওজ্জার মনকে নাড়া দিল। তাই তিনি ইসলাম কবুল করে মুসলমান হলেন।

তবে তাঁর ইসলাম কবুরের বিষয়টি সহজ ছিল না। সেই সময়ে ওজ্জার বাবা জীবিক ছিলেন না। মা আর পিতৃব্য ছিলেন তাঁর অভিভাবক। ইসলাম গ্রহণ করে ওজ্জা তাঁর পিতৃব্যকে এ খবর জানালেন। তিনি একথাও বললেন,

: চাচা! আমি তোমাকে এক মহাসত্যের খবর দিচ্ছি। তোমাকে আল্লাহর কথা বলছি। তিনিই আমাদের স্রষ্টা এবং আসল প্রভু। আর আবদুল্লাহর পুত্র হযরত মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। তিনি সত্য নবী। আমি তাঁর কথা মেনে নিয়েছি। তুমিও তাঁর কথা মেনে নাও। ইসলাম কবুল করে মুসলমান হও।

ওজ্জার পিতৃব্য ইসলামকে বিশ্বাস করত না। এটা তার কাছে ছিল অসহ্য। সে আল্লাহর নবীকে ঘৃণার চোখে দেখত। তাঁর কথাবার্তাকে সে অমূলক বলে উড়িয়ে দিত। তাই ভ্রাতুষ্পুত্রের কথায় পিতৃব্য অবাক হলো। তার মুখে মুহাম্মদের কথা শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। প্রচণ্ড রাগে পিতৃব্য ছটফট করতে লাগল। পারে না ওজ্জাকে মেরে ফেলবে। চাচার এ অবস্থা দেখে ওজ্জা ভয় পেয়ে গেলেন।

পিতৃব্য এবার হুঙ্কার ছেড়ে বলল,

: দেখ ওজ্জা! তুই এতিম। তোকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো দেখি। তোকে আমি অতিশয় পছন্দ করি। বলি শোন, তুই আমার অবাধ্য হবি না। আমাদের ধর্ম ছেড়ে তুই মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করতে পারিস না। এ ধর্ম সত্য নয়। এ নতুন ধর্ম তোকে ত্যাগ করতে হবে। নইলে তোর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না।

ওজ্জা চাচার কথা অবাক হয়ে শুনলেন। তবে তাঁর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। এতে চাচা আরও ক্ষিপ্ত হলো। সে আবারও বলতে লাগল, ‘শোন ওজ্জা! তুই বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে নাস্তিক হয়ে গেছিস। তুই যদি নতুন ধর্ম না ছাড়িস, তা হলে আমার সম্পত্তির এক কপর্দখও তোকে দেব না।

ওজ্জা চাচার শেষ কথা শুনে ঠিকই চমকে উঠলেন। ক্ষণিকের জন্য তিনি ভয়ও পেলেন। তবে তাঁর এই ভয় নিমিষেই কেটে গেল। তিনি মনকে শক্ত করলেন। তারপর অতি দৃঢ়তার সাথে চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

: দেখুন চাচা! আমি সত্যকে খুঁজে পেয়েছি। এটাই আমার কাছে বড় সম্পদ। আপনার সম্পত্তির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনি আমার চাচা বটে। আপনি আমার গুরুজন। তবে বলি চাচা, আমি যে সম্পদ পেয়েছি তা আমার কাছে সবচেয়ে বড়। ইসলামই আামর বড় সম্পদ। তাই আপনার সম্পদের আমার কোন প্রয়োজন নেই।

পিতৃব্যের মুখের ওপর সত্যকে সাহসের সাথে উচ্চারণ করেই ওজ্জা ক্ষান্ত হলেন না। তিনি সাথে সাথে তাঁর গায়ের দামি পোশাক খুলে ফেলে দিলেন। এসব কিছু তাঁর কাছে অসত্য ও অসহ্য বলে মনে হলো। এবার তিনি বিধবা মায়ের কাছে ছুটে গেলেন। মাকে বললেন,

: শোন মা! আমি ইসলাম কবুল করেছি। এটাই আমার জীবন। আমি তোমাদরে এসব ঐশ্বর্য ও আরাম-আয়েষ চাই না। তোমাদের সম্পদেও আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি সবকিছু ত্যাগ করলাম। আমার গায়ের দামি পোশাকও ছেড়ে দিলাম। পার যদি গায়ে দেয়ার মতো আমাকে সামান্য এক টুকরো কাপড় দাও।

শত হলেও তো মা। মা ওজ্জার ধর্মকে পছন্দ না করলেও বুকের ধন ছেলেকে ফেলতে পারেন না। তাই ওজ্জার অবস্থা দেখে মা মনে কষ্ট পেলেন। হাতের কাছে মা ভালো কোনো পোশাক পেলেন না। পিতার আমলের একটা জীর্ণ কম্বল ছিল সেখানে। মা সেটাই পুত্রের হাতে তুলে দিল। ওজ্জা আর কী করবেন! ছেঁড়া কম্বল নিয়ে এটাকে দুই টুকরো করলেন। একখণ্ড গায়ে জড়িয়ে নিলেন আর একখণ্ড পরিধান করলেন। এরপর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মহানবী (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে ছুটে চললেন তিনি। নবী (সা) তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। তাই অনেক কষ্ট স্বীকার করে ওজ্জাকে দীর্ঘপথ চলতে হলো। অবশেষে ওজ্জা একসময় মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। ওজ্জা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন মহানবী (সা) মসজিদে আছেন। তাই তিনি নবী (সা)-এর অপেক্ষায় মসজিদের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর তাঁর। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন আবদুল ওজ্জা। হঠাৎ তিনি মহানবী (সা)-এর চোখে পড়ে গেলেন। ওজ্জার মনের অবস্থা বুঝতে আল্লাহর নবীর অসুবিধা হলো না। তিনি ওজ্জাকে কাছে ডেকে আনলেন। তারপর কথার ছলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওজ্জা না?

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন নবীজি, আমি ওজ্জা। আপনার দীনের সেবক। মহানবী (সা) বললেন: তুমি ওজ্জা ছিলে। তবে আজ থেকে তুমি আর ওজ্জা নও। তুমি আল্লাহর দাস আবদুল্লাহ। তোমার আর কোনো ভয় নেই। যাও, তুমি আসহাবে সুফফার লোকদের সাথে গিয়ে মিলিত হও। তাদের জামাতে শামিল হও। আর আমার নিকট এ মসজিদেই তুমি থাকবে।

মহানবী (সা)-এর কথা শুনে ওজ্জা যারপরনাই খুশী হলেন। তাঁর সব দুঃখ-ব্যাথা যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল। সে যে আজ গর্বিত। যে সত্যের সন্ধানে সে সবকিছু ছেড়েছে সেই সত্যের মানুষকে এখন সে কাছে পেয়েছে। তাই তাঁর আনন্দ আর কে দেখে! ওজ্জার চোখেমুখে সত্যের আলো যেন ঝলমল করে উঠল। তাঁর বুক ভরে গেল সুখের সীমাহীন আবেশে। আর সেই খুশির ঝিলিক যেন ছড়িয়ে পড়ল মদীনার আকাশে বাতাসে।

ব ল তে পা রো?

১। ওজ্জা কে ছিলেন? তাঁর পারিবারিক অবস্থা কেমন ছিল?

২। ইসলাম গ্রহণ করে ওজ্জা চাচাকে কী বললেন?

৩। চাচা ওজ্জাকে কী বলে হুঁশিয়ার করেছিলেন?

৪। অবশেষে ওজ্জা কী করলেন?


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি