মজলিসে আসন গ্রহণ
****************************************

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ তোমাদের কেহ যেন তাহার ভাইকে তাহার আসন হইতে উঠাইয়া দিয়া পরে নিজেই সেই আসন গ্রহণ না করে।

(বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)

ব্যাখ্যাঃ সামাজিক জীবনে বহু সংখ্যক লোকের একত্রিত হওয়ার ও আসন গ্রহণের ব্যাপারে সাধারণত সংঘটিত হইয়া থাকে। এই রূপ মজলিস অনুষ্ঠান ও উহাতে আসন গ্রহণের ব্যাপারটি বাহ্যদৃষ্টিতে খুবই সামান্য মনে হইলেও ইসলামের দৃষ্টিতে ইহার গুরুত্ব কিছু মাত্র কম নহে। প্রকৃত পক্ষে বহু সংখ্যক লোকের একত্র সমাবেশ ও আসন গ্রহণের মাধ্যমেই সামাজিক জীবন গড়ীয়া উঠে। এই সব ক্ষেত্রে আসন গ্রহণের ব্যাপারটি লইয়া পরস্পর মনোমালিন্যের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নহে। এই কারণে নবী করীম (স) সুস্থ শালীনতাপূর্ণ সমাজ জীবন গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্যে বিশেষ হেদায়াত দানের প্রয়োজন বোধ করিয়াছেন।

হাদীসটিতে ব্যবহৃত শব্দের বিশেষ মাহাত্ম্য রহিয়াছে। মনে করা যাইতে পারে, মজলিস যথারীতি বসিয়অ গিয়াছে। উপস্থিত লোকদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করিয়াছে। এমন সময় একজন মান্যবর ব্যক্তি উপস্থিত হইয়াছে কিন্তু তাহার বসিবার মত কোন আসন শূণ্য নাই। তখন সাধারণত এই ঘটে যে, আসীন লোকদের মধ্য হইতে একজনকে তাহার আসন হইতে তুলিয়া দিয়া সেই আসনে নবাগত ব্যক্তির বসিবার ব্যবস্থা করা হইল। এই পর্যায়েই নবী করীম (স)-এর আলোচ্য কথাটি প্রযোজ্য। তাঁহার কথার মর্ম হইল, যে লোক পূর্বেই উপস্থিত হইয়া একটি আসন গ্রহণ করিয়াছে, সে তো তাহার দ্বীনী ভাই। কেননা এই সমাজ একই দ্বীনের ধারক ও অনুসারীদের সমন্বয়ে গঠিত। এইরূপ প্রযোজ্য। তাঁহার কথার মর্ম হইল, যে লোক পূর্বেই উপস্থিত হইয়া একটি আসন গ্রহণ করিয়াছে, সে তো তাহার দ্বীনী ভাই। কেননা এই সমাজ একই দ্বীনের ধারক ও অনুসারীদের সমন্বয়ে গঠিত। এইরূপ অবস্থায় সেই দ্বীনী ভাইকে তাহার আসন হইতে তুলিয়া দেওয়া ও সেই আসন অপর এক দ্বীনী ভাইদ্বারা অলংকৃত হওয়া কিছুতেই শোভন হইতে পারে না। কেননা প্রথমতঃ যাহাকে তাহার আসন হইতে তুলিয়া দেওয়া হইল, সে মূলত কোন অপরাধ করে নাই, যাহার জন্য তাহাকে এই শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে। দ্বিতীয়তঃ একজনকে তুলিয়া দিয়া সেই আসনে আর একজনকে বসানোর বাহ্যত অর্থ এই দাঁড়ায় যে, প্রথম ব্যক্তির তুলণায় দ্বিতীয় ব্যক্তি সমাধিক সম্মানার্হ। কিন্তু এইরূপ পার্থক্য সৃষ্টির কোন ভিত্তি নাই। ইহারা দুইজন একই দ্বীনের ধারক ও অনুসারী হওয়ার দিকদিয়া উভয়ই সমান মান-মর্যাদার অধিকারী-সমান সম্মানার্হ। অকারণে একজনকে অপর জনের উপর প্রাধান্য ও অধিকার মর্যাদা দানে একজনের মনে আত্মসম্মান বোধ জনিত দুঃখ ও অপমান বোধ এবং অপরজনের মনে আত্মম্ভরিতা জাগ্রত হইতে পারে। আর মন-মানসিকতার দিক দিয়া এইরূপ পার্থক্য সৃষ্টির ফলে সমাজ জীবনের একাত্মতার পক্ষে খুবই মারাত্মক হইয়া থাকে। এই জন্যই নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ এই ভাইকে তাহার আসন হইতে তুলিয়া দিয়া সেই আসন অপর ভাইর গ্রহণ করা কিছুতেই উচিত হইতে পারে না।

ইমাম নববী লিখিয়াছেন, এই রূপ আসন গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম। অতএব মসজিদে বা অন্যত্র জুময়ার দিনে কিংবা অন্য কোন সময় যে ব্যক্তি প্রথমেই কোন আসন গ্রহণ করিয়া বসিয়াছে, সেই আসনে বসিয়া থাকার জন্য অন্যান্য সকলের তুলনায় সেই লোকই বেশী অধিকারী। অপর কাহারও জন্য সেই আসনের উপর কোন অধিকার থাকিতে পারে না। অন্য লোকের জন্য এই পূর্বদখল করা আসনে বসা হারাম। বিশেষজ্ঞগণ মনে করিয়াছেন, কোন লেঅক যদি মসজিদে বসিয়া ফতোয়অ দান অথবা কুরআন শিক্ষাদান কিংবা শরীয়াতের ইলম শিক্ষা দানের জন্য কোন স্থান নির্দিষ্ট করিয়া থাকে, সেই স্থানটি সেই লোকের জন্য নির্দিষ্টই থাকিবে। উহা কোন সময় শূণ্য পাইয়া অপর কেহ উহাতে বসিতে পারিবে না।এই পর্যায়ে মুল্লা আলী আল-ক্কারী প্রশ্ন তুলিয়াছেন যে, মসজিদে সকলেরই অধিকার সমান, কেহ নিজের জন্য কোন একটি স্থানকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিয়া লইতে পারে না। ইহা হাদীস হইতে প্রমাণিত। এই কথা পূর্বোক্ত মতের বিপরীত। এই কারণে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে।

ইমাম তিরমিযী এই হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর উল্লেখ করিয়াছেনঃ

****************************************

হযরত ইবনে উমরের জন্য কোন লোক দাঁড়াইয়া নিজের আসনে বসিবার জন্য আহবান করিলে তিনি তাহাতে কখনই বসিতেন না।

এই কথাটি হযরত ইবনে উমরের ‘আমল’ বা আচরণ প্রকাশ করিতেছে। আর মূল হাদীসটি বর্ণনাকারীও হইতেছেন হযরত ইবনে উমর। তাঁহার এই ‘আমল’ বা আচরণের উল্লেখে হাদীসটির একটি বিশেষ তাৎপর্য বুঝিতে পারা যায়। আর তাহা এই যে, কোন আসনে আসীন ব্যক্তি কাহারও জন্য নিজের আসন ছাড়িয়অ দিতে চাহিলেও তাহা কাহারও গ্রহণ করা উচিত নয়। সে এইরূপ সৌজন্য প্রদর্শন করিলে উহার জওয়াবে সেই আসন গ্রহণ করিতে রাযী না হইয়াই সৌজন্য প্রদর্শন করিতে হইবে।

ইবনে আবূ জুমরা বলিয়াছেনঃ এই হাদীসটি সাধারণভাবে সর্বপ্রকার মজলিসেই প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। তবে বিশেষ ভাবে ইহা প্রযোজ্য সর্বপ্রকার মুবাহ ধরনের মজলিসে। সাধারণভাবে শাসকদের আহবানে অনুষ্ঠিত মজলিস, শিক্ষাকেন্দ্র, সভা-সমিতির বৈঠক- এই সবই ইহার মধ্যে শামিল। অপর দিকে বিশেষভাবে প্রযোজ্য হইতেছে যেসব মজলিস বিশেষ ব্যবস্থার অধীন অনুষ্ঠিত হয় তাহা। যেমন কেহ নিজের বাড়ীতে বিবাহ বা অলীমা ইত্যাদির জন্য বিশেষ ভাবে আহুত মজলিসসমূহ। এ ছাড়া এমন কিছু মজলিসও হইয়া থাকে, যেখানে লোকেরা উঠে, বসে, দাঁড়ায়, আসে ও যায়। এইসব ক্ষেত্রে কাহারও জন্য বিশেষ কোন আসন নির্দিষ্ট থাকে না। কেহ নির্দিষ্টও করিতে পারে না।

ইবনে জুমরা আরও বলিয়াছেনঃ এইরূপ আসন গ্রহণ নিষিদ্ধ হওয়ার মূলে এই এই যুক্তি রহিয়াছে যে, ইহাতে একজন মুসলমানের অধিকার ও মযাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার সমূহ আশংকা রহিয়াছে। অথচ ইহা অবাঞ্ছনীয়। সেই সঙ্গে এই নিষেধ দ্বারা মানুষের মধ্যে বিনয় ও সৌজন্য জাগ্রত করিতে চাওয়া হইয়াছে। কেননা সমাজের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুতা-ভালবাসা সৃষ্টির জন্য এইরূপ বিনয় ও সৌজন্য অপরিহার্য। ।উপরন্তু ******** ‘মুবাহ ব্যাপার সমূহে সমস্ত মানুষ সমান-সমান অধিকার ও মর্যাদা সম্পন্ন’। কাজেই কোন লোক যদি তাহার কোন অধিকারের জিনিস সর্বাগ্রে দখল করিয়া থাকে তবে সেই উহার অধিকারী। আর কেহ কোন জিনিস অধিকার ছাড়াই দল করিয়া লইলে উহাকে বলা হয় ‘গচব’- অপহরণ। আর ‘গচব’ বা অপহরণ সম্পূর্ণ হারাম। অবস্থা বিশেষে কখনও উহা মাকরূহ- মাকরূহ তাহরীম হয়। আর কখনও সম্পূর্ণ হারাম।

বুখারীর বর্ণনায় হযরত ইবনে উমরের আমল সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

কোন লোক নিজের আমল ছাড়িয়া দাঁড়াইবে আর সেই খানে তিনি বসিবেন, ইহা ইবনে উমর অপছন্দ করিতেন।

অপছন্দ করিতেন অর্থ মাকরূহ মনে করিতেন। ইমাম নবীর মতে ইহা তাঁহার অতিরিক্ত তাকওয়ার প্রকাশ। কেননা কোন লোক নিজে ইচ্ছা করিয়া সন্তুষ্ট চিত্তে কাহারও জন্য নিজের আসন ছাড়িয়া দিলে তাহাতে তাহার বসা হারাম হয় না। তবে যেহেতু যে লেঅক নিজের আসন ছাড়িয়া দিতেছে সে খুশী হইয়া ছাড়িতেছে, না ভয়ে কিংবা লজ্জায় ছাড়িতেছে তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। এই কারনে তিনি এই আশংকার দ্বারও চিরতরে বন্ধ করিয়া দেওয়া সমীচীন মনে করিয়াছেন।অথবা তিনি মনে করিয়াছেন, কেন কোন নৈকট্যের জন্য নিজের অধিকার ছাড়িয়া দিলে তাহাও কোন পছন্দনীয় ব্যাপার হয় না।

হযরত ইবনে উমর (রা) হইতে আর একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহাতে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের নিকট তাঁহার মজলিরেদ আসিল। তখন অপর এক ব্যক্তি তাহার জন্য নিজের আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল। নবাগত লোকটি সেই ছাড়িয়া দেওয়া আসনে বসিবার জন্য যাইতে লাগিল। তখন রাসূলে করীম (স) তাহাকে নিষেধ করিলেন।

(আবূ দায়ূদ)

এই হাদীসটি হইতে রাসূলে করীম (স)-এর পূর্বোদ্ধৃত মৌলিক কথার বাস্তব আমালের সমর্থন পাওয়া গেল। ফলে এই ব্যাপারটি সর্বোবভাবে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা উল্লেখ্য। কেহ মজলিসের মধ্যে কোন আসন দখল করিয়া বসিয়াছে। এই সময় প্রয়োজনের কারণে সে উঠিয়া গেলে সে যখন ফিরিয়া আসিবে তখন সেই আসনে বসার অধিকার তাহারই অগ্রগণ্য হইবে। রাসূলে করীম (স) স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেনঃ

****************************************

ব্যক্তি তাহার দখল করা আসন ফিরিয়া পাওয়ার সর্বাধিক অধিকারী। যদি সে তাহার কোন প্রয়োজনে আসন ছাড়িয়া বাহির হইয়া গিয়অ পুনরায় ফিরিয়অ আসে তবে সে তাহার পূর্বদখলকৃত আসনে বসিবার অধিকার অন্যদের অপেক্ষা তাহার বেশী।

ইমাম নববী লিখিয়াছেন, মসজিদ বা অন্য যে কোন স্থানে নামায বা অন্য যে কাজের জন্যই বসিয়া থাকুক না কেন, পরে সে যদি উহা পুনরায় ফিরিয়া আসার উদ্দেশ্যে ত্যাগ করে যেমন অজু করা বা এই ধরনের কোন হালকা কাজের উদ্দেশ্যে বলিয়া যায় এবং পরমুহূর্তে ফিরিয়অ আসে তাহা হইল সেই আসনে তাহার বিশেষ অধিকার বাতিল হইয়া যাইবে না। সেই সেখানে- অন্তত সেই সময়কার নামাযের বা যে কাজের জন্য বসা হইয়াছে সেই কাজ সুসম্পন্ন হওয়া পর্যন্তের জন্য অন্যদের তুলনায় তাহার অধিকার বেশী হইবে। এই অবসরে যদি কেহ সেই আসনটি দখল করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার উঠিয়া সেই লোকের জন্য আসন খালী করিয়া দিতে বাধ্য হইবে। প্রথম ব্যক্তি ফিরিয়া আসিলে দ্বিতীয় ব্যক্তির আসন ছাড়িয়া দেওয়া কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে ওয়াজিব। কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। এই মত ইমাম মালিকের। তবে প্রথম কথাই অধিক সহীহ। এই পর্যায়ে উপরোক্ত হাদীসটিই হইতেছে বিভিন্ন মতের ভিত্তি ও দলীল। বস্তুত আসন গ্রহণ লইয়া লোকদের মধ্যে যে মতবিরোধ বা ঝগড়া-ঝাটির সৃষ্টি হইতে পারে, এই হাদীসটির ভিত্তিতেই তাহার মীমাংসা হইতে পারে। পরন্তু এই হাদীসটির ব্যাপার প্রয়োগ ও প্রয়োগক্ষেত্র সম্প্রসারণের ভিত্তি বহু প্রকারের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ-বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসা হওয়া সম্ভব। এই মত প্রকাশ করিয়াছেন ইমাম মাআর্দি। আর ইমাম কুরতুবী বলিয়াছেন, সাধারণ বিশেষজ্ঞদের মত হইল, এই হাদীসটির সিদ্ধান্ত মানিয়া লওয়া ওয়াজিব নয়।

ইমাম তিরমিযী লিখিয়াছেন, এই পর্যায়ের হাদীস হযরত আবূ বাকারাতা, হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতেও বর্ণিত হইয়াছে। আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসটি ইমাম বুখারী তাঁহার আল-আদাবুল মুফরাদ এবং ইমাম আহমাদ তাঁহার মুসনাদে উদ্ধৃত করিয়াছেন। মুসলিম, আবূ দায়ূদ ও ইবনে মাজাহ গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত হাদীসটির ভাষা এইঃ

****************************************

যে লোক তাহার আসন হইতে উঠিয়া গিয়া পুনরায় ফিরিয়া আসে, সে সেই আসনে বসার ব্যাপারে বেশী অধিকারী।

দুইজন লোক পাশাপাশি বসা থাকিলে তাহাদের মাঝখানে বসা সমীচীন কিনা, এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ দুই ব্যক্তির মাঝখানে সেই দুইজনের অনুমতি ব্যতীত বসা কোন ব্যক্তির জন্য হালাল নয়।

(মুসনাদে আহমাদ, আবূ দায়ূদ, তিরমিযী)

ইহার কারণ সুস্পষ।ট। দুইজন লোক হয়ত বিশেষ কোন কথা বলার উদ্দেশ্যে কিংবা পারস্পরিক বন্ধুতা একাত্মতা নিবিড় হওয়ার কারণে একত্রে ও পাশাপাশি আসন গ্রহণ করিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় কোন তৃতীয় ব্যক্তি আসিয়া যদি তাহাদের দুইজনের মাঝখানে বসিয়া পড়ে, তাহা হইলে তাহাদের এই বসার উদ্দেশ্যই পণ্ড হইয়া যায় বা বসার কারণ ব্যাহত হয়। ফলে তাহাদের মনে দুঃখ ও অসন্তোষ জাগিয়া উঠিতে পারে। আর সুষ্ঠু সমাজ জীবনের পক্ষে ইহা কোন ক্রমেই বাঞ্ছনীয় বা কল্যাণবহ হইতে পারে না।

(***********)

সম্মান দেখানোর জন্য দাঁড়ানো
****************************************

হযরত মুয়াবিয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে লোক পুলক অনুভব করে এই কাজের যে, লোকেরা তাহার সম্মানার্থে দাঁড়াইবে, সে যেন জাহান্নামে নিজের আশ্রয় স্থল বানাইয়া লয়।

(তিরমিযী, আবু দায়ূদ, ইবনে মাজাহ)

ব্যাখ্যাঃ হাদীসের মূল বক্তব্য সুস্পষ্ট। মানুষ মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রকাশ করিবে, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সম্মান প্রদর্শনের জন্য যদি দাঁড়ানো হয় এবং সেই দাঁড়ানোয় কেহ যদি নিজের পুলক ও আনন্দ বা গৌরব বোধ করে, তবে সে লোকদের উপর নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছুক গণ্য হইবে। স্পষ্ট মনে হইবে, লোকেরা তাহাকে প্রভু বা মনিব মনে করুক, ইহাই সে চায়। আর এইরূপ মনোভাবই অত্যন্ত মারাত্মক। এই গৌরব বোধই মানুষকে জাহান্নামে লইয়া যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। হাদীসের ভাষা হইতে বোঝা যায় যে, এই ব্যক্তি নিজের গৌরব বোধের কারণেই জাহান্নামে যাইতে বাধ্য হইবে এবং সে জন্য সেই দায়ী।

আবূ দায়ূদের অপর একটি বর্ণনায় ***** এর পরিবর্তে ****** উদ্ধৃত হইয়াছে। ইহার অর্থ, যে ভালবাসে বা পছন্দ করে। উভয় শব্দের মূল ভাব অভিন্ন। আর ***** অর্থ ‘সে যেন ব্যবস্থা করিয়া লয়’। ইহা নির্দেশমূলক। কিন্তু মূল তাৎপর্য সংবাদ মূলক। ইহার অর্থঃ

****************************************

যে লোক তাহার সম্মানার্থে অন্য লোকদের দাঁড়ানোর পুলক অনুভব করে তাহার পক্ষে জাহান্নামে তাহার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া ওয়াজিব হইয়া পড়িবে।

প্রথমোক্ত মূল হাদীসটি একটি উপলক্ষে হযরত মুয়াবিয়া (রা) বর্ণনা করিয়াছেন। তাহা হইল, হযরত মুয়াবিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলে তথায় আসন গাড়িয়া বসা হযরত আবদুল্লাহ ইবনুজ্জুবাইর ও হযরত ছাফওয়ান (রা) তাঁহার সম্মানার্থে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ইহা দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ ******** ‘তোমরা দুইজন বসিয়া যাও’। কেননা নবী করীম (স) এইরূপ বলিয়াছেন। ইহাতে মনে হয় কাহারও সম্মানার্থে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ, তাহা বোধ হয় এই সাহাবীদ্বয়ের জানা ছিল না বলিয়াই তাঁহারা দাঁড়াইয়া ছিলেন। কিন্তু হাফেয ইবনুল হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ ********* আবদুল্লাহ ইবনুজ্জুবাইর (রা) দাঁড়ান নাই, এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ সম্পুর্ণ একমত। আবূ দায়ূদ গ্রন্হে উদ্ধৃত অন্যান্য হাদীস সমূহ হইতেও এই কথাই প্রমাণিত হয়।

এই সম্পর্কে হযরত আনাস (রা) হইতে বর্নিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

সাহাবীদের নিকট রাসূলে করীম (স) অপেক্ষা অধিক প্রিয় ব্যক্তি আর কেহ ছিল না। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি যখন দৃশ্যমান হইতেন ও তাঁহারা তাঁহাকে দেখিতে পাইতেন, তখন তাঁহারা দাঁড়াইতেন না। কেননা তাঁহারা জানিতেন যে, নবী করীম (স) ইহা খুবই অপছন্দ করেন।

এইরূপ দাঁড়ানোকে নবী করীম (স) পছন্দ করিতেন না; এই কথা হইতে মনে হইতে পারে যে, ইহা তাঁহার ব্যক্তিগত অপছন্দের বর্ণনা। হযরত মুহাম্মদ (স) যে উন্নত আদর্শ চরিত্রের ব্যক্তি ছিলেন, তাহাতে ইহাই স্বাভাবিক গুণ হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এই পর্যায়ে প্রথমোদ্ধৃত হাদীস হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইহা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। ইহার সহিত ইসলামের মৌল আকীদা ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার সহিত গভীর সম্পর্ক রহিয়াছে। কেননা এই রূপ দাঁড়াইয়া যাহার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হইবে তাহার মনে পুলক অনুভূত হইতে পারে। আর পুলক অনুভূত হইলে অতি সহজেই মনে করা যায় যে, সে নিজেকে খুব সামান্য নগণ্য ব্যক্তি মনে করিতেছে না, মনে করিতেছে অসামান্য অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আর এইরূপ মনে করাই ইসলামের তওহীদী আকীদার সম্পূর্ণ পরিপন্হী।

হযরত আনাস বর্ণিত এই হাদীসটিতে একদিকে যেমন নবী করীম (স)-এর মনোভংগী জানা যায় তেমিন জানা যায় সাহাবীগণের আমলের বিবরণ। বস্তুত ইহাই তওহীনী আকীদার ভিত্তিতে গঠিত আদর্শ ইসলামী সমাজের বিশেষত্ব।

হযরত আবূ ইমামাতা (রা) বর্ণিত ও আবূ দায়ূদ ইবনে মাজাহ গ্রন্হদ্বয়ে উদ্ধৃত অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

রাসূল করীম (স) একখানি লাঠিল উপর ভর করিয়া ঘর হইতে বাহির হইলেন। তখন আমরা তাঁহার জন্য দাঁড়াইয়া গেলাম। ইহা দেখিয়া তিনি বলিলেনঃ তোমরা দাঁড়াইও না যেমন করিয়া অনারব লোকেরা পরস্পরের সম্মানার্থে দাঁড়াইয়া থাকে।

রাসুলে করীম (স) সাধারণত লাঠিহাতে চলাফিরা করিতেন না। কিন্তু হাদীসটিতে বলা হইয়াছে, তিনি লাঠির উপর ভর করিয়া বাহির হইলেন। ইহাতে মনে করা যাইতে পারে যে, এই সময় লাঠি হাতে লওয়ার ও উহার উপর ভর করার কোন দৈহিক কারণ ঘটিয়াছিল। হয়ত তিনি এই সময় অসুস্থ ছিলেন।

এই হাদীসটিতে সম্মানার্থে দাঁড়ানো সম্পর্কে স্পষ্ট নিষেধবাণী উচ্চারিত হইয়াছে। পর পর উদ্ধৃত তিনটি হাদীস হইতে যাহা জানা গেল, তাহাতে কাহারও সম্মানার্থে দাঁড়ানো প্রথমে ব্যক্তিগত অপছন্দের ব্যাপার, দ্বিতীয় পর্যায়ে উহার সমাজিক প্রচলন- অর্থাৎ না দাঁড়ানোটাই মুসলি সমাজের সাধারণ রেওয়াজ। আর তৃতীয় পর্যায়ে ইহা আইন।

কিন্তু ফিকাহর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মতে উপনীত হইয়াছেন। ইমাম নববী প্রমুখ প্রখ্যাত হাদীসবিদগণ বলিয়াছেন, কাহাকেও দেখিয়া দাঁড়াইয়া যাওয়া জায়েয। শায়খ আবু আবদুল্লাহ ইবনুল হাজ্জ আল-মালেকী প্রমুখ ইহা করিতে নিষেধ করিয়াছেন। ইমাম নববী **** গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ সেই ব্যক্তি আগমনে দাঁড়াইয়া সম্মান দেখানো মুস্তাহাব, যাঁহার জ্ঞানগত যোগ্যতা-মর্যাদা, কোন মহান কাজের দরুন বিশেষ সম্মান বা বেলায়েত রহিয়াছে। এই রূপ দাঁড়ানোটা প্রদর্শন মূলক বা বড় মনে করার কারণে নয়, ইহা নিছক ভাল কাজ, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ মাত্র। আর এই ভাবধারায় কাহারও জন্য দাঁড়ানোর প্রচলণ প্রাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া ইমাম নববী দাবি করিয়াছেন। এই মতের বড় সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী বর্নিত রাসূলে করীম (স)-এর একটি কথায়। কুরাইজার অধিবাসীরা হযরত সায়াদ ইবনে আবূ অক্কাচের হুকুমে নামিয়া গেল। তখন নবী করীম (স) হযরত সায়াদ (রা) কে ডাকিয় পাঠাইলেন। তিনি আসিলে নবী করীম (স) বলিলেন ********** ‘তোমরা তোমাদের সরদারের জন্য দাঁড়াও’। ইহাতে সম্মানিত ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানোর নির্দেশ পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার জওয়াবে বলা হইয়াছে, রাসুলে করীমের এই নির্দেশ এমন বিষয়ে যাহাতে কোন বিরোধ নাই। কেননা কয়েকটি বর্ণনা হইতে জানা যায়, হযরত সায়াদ অসুস্থ ছিলেন। তিনি তাঁহার জন্তুযানে সওয়ার হইয়া আসিয়া ছিলেন। এই সময় রাসূলে করীম (স) সাহাবীদের বলিলেনঃ ‘তোমরা আগাইয়া গিয়া তোমাদের এই সরদারকে তুলিয়া আন’। জন্তুযানের উপর হইতে তাঁহাকে নামাইয়া আনার জন্য এই নির্দেশ ছিল। আর এই রূপ অবস্থায় সবসময়ই সমাজের লোকদের জন্য ইহা বিশেশ কর্তব্য হইয়া পড়ে। ইহার সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আবূ সায়ীদ (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীসে। তাহাতে তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

হযরত সায়াদ যখন উপস্থিত হইলেন, তখন নবী করীম (স) উপস্থিত লোকদিগকে বলিলেনঃ তোমরা আগাইয়া গিয়া তোমাদের সরদারকে নামাইয়া আনো।

এই হাদীসটির সনদ উত্তম। ইহার ফলে কাহারও প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য দাঁড়ানোর আলোচ্য ব্যাপারটি সন্দেহপূর্ণ দাঁড়ায় এবং বুঝা যায় যে, রাসুলে করীমের এই নির্দেশে সম্মান প্রদর্শনের ভাব নাই। আছে সমাজিক কর্তব্য পালনের নির্দেশ।

হযরত কায়াব ইবনে মালিক (রা)-এর তওবা সংক্রান্ত ঘটনার বিবরণে তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ দাঁড়াইয়া দৌড়াইয়া আসিলেন ও আমার সহিত মুসাফিহা করিলেন ও আমাকে মুবারকবাদ দিলেন।

ইমাম নববী এই বর্ণনার ভিত্তিতে বলিতে চাহেন যে, কাহারও সম্মানার্থে দাঁড়ানো কিছু মাত্র নাজায়েয নয়। কিনউত এই যুক্তি খুব বলিষ্ঠ ও অকাট্য নয়। কেননা হযরত তালহা (রা) দাঁড়াইয়াছিলেন হযরত কায়াবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাঁহাকে মুবারকবাদ দেওয়ার জন্য। তাঁহার সহিত মুসাফিহা করার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়তঃ উপস্থিত সাহাবী গণের মধ্য হইতে তিনি একাকীই কাজটি করিয়াছিলেন। নবী করীম (স) নিজে দাঁড়াইয়াছেন বা দাঁড়াইবার জন্য তিনি আদেশ করিয়াছেন, হইতেই প্রমাণিত হয় নাই। বিশেষত হযরত তালহা একাকী এই কাজ করিয়াছে এই কারণে যে, হযরত কায়অবের সহিত তাঁহার বিশেষ বন্ধুতা ও ভালবাসা ছিল। আর যাহার সহিত যতটা ভালবাসা ও বন্ধুতা হইবে, উহার বাহ্যিক প্রকাশও সেই অনুপাতে হইবে ইহা স্বাভাবিক কথা। কিন্তু সালাম এইরূপ নহে। তাহা তো পরিচিত অপরিচিত সকলকেই দিতে হইবে।

হযরত আয়েশা (রা) বলিয়াছেনঃ

****************************************

হযরত ফাতিমার অপেক্ষা সর্বদিক দিয়া রাসূলে করীমের সহিত সাদৃশ্য রক্ষাকারী আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। তিনি যখন নবী করীমের ঘরে প্রবেশ করিতে তখন নবী করীম (স) দাঁড়াইয়া যাইতেন ও তাঁহার হাত ধরিতেন, হাতে স্নেহের চুম্বন করিতেন এবং নিজের আসনে তাঁহাকে বসাইতেন। পক্ষান্তরে রাসুলে করীম (স) যখন তাঁহার ঘরে উপস্থিত হইতেন, তখন তিনি (ফাতিমা) দাঁড়াইয়া যাইতেন, তাঁহারহাত ধরিতেন, হাতে বাৎসল্যের চুম্বন করিতেন এবং নিজের আসনে তাঁহাকে বসাইতেন।

ইমাম নববী তাঁহার মতের সমর্থনে এই হাদীসটিও উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার জওয়াবে বলা হইয়াছে, নবী করীম (স) ও হযরত ফাতিমার, পরস্পরের জন্য এই দাঁড়ানোর মুল বিশেষ কারণও থাকিতে পারে। উভয়ের ঘরের ছোটত্ব ও সংকীর্ণতা ও বসার স্থানের অভাব সর্বজন বিদিত। একজন আর একজনকে বসাইবার উদ্দেশ্যে নিজের আসন ত্যাগ করা ও সেজন্য দাঁড়ানো ছাড়া কোন উপায়ই ছিল না হয়ত। কিন্তু তাহাতে এখানে আলোচ্য ও বিরোধীয় বিষয়ে কোন দলীল পাওয়া যাইতে পারে না।

একবার রাসুলে করীম (স)-এর দুধ-পিতা ও দুধ-মাতা আসিলে তিনি তাঁহাদিগকে নিজের নিকটে চাদরের উপরে বসাইলেন। অতঃপর দুধ-ভাই আসিয়া উপস্থিত হইলে নবী করীম (স) দাঁড়াইলন ও তাঁহাকে নিজের আসনে বসাইলেন। আবূ দায়ূদ উমর ইবনুস সায়েব (রা) এই বিবরণ বর্ণনা করিয়াছেন। আলোচ্য দাঁড়ানোর পক্ষে ইহাকেও একটি দলীল হিসাবে উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাদ্বারা প্রকৃত পক্ষে তাহা প্রমাণিত হয় না। কেননা সম্মানার্থে দাঁড়ানো যদি জায়েযই হইত, তাহা হইলে নবী করীম (স) তাঁহার দুধ-পিতা দুধ-মাতার জন্য দাঁড়াইতেন, তাঁহাদের পরিবর্তে দুধ-ভাইয়ের জন্য দাঁড়ানোর কোন প্রশ্নই উঠে না। হযরত দাঁড়াইয়া ছিলেন এই জন্য যে, বসার স্থান কিংবা চাদরের প্রশস্ততা সৃষ্টির জন্য এই রূপ দাঁড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। উপরন্তু মুহাদ্দিস ইবনুল মুনযির বলিয়াছেন, এই বর্ণনাটি ****-অতএব ইহাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যায় না।

ফিকাহবিদগণ এই সমস্ত হাদীস সামনে রাখিয়া মীমাংসা হিসাবে বলিয়াছেনঃ হযরত আনাস বর্নিত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয যে, কাহাকেও দেখিয়া দাঁড়াইয়া যাওয়া মাকরূহ। হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে জানা যায় যে, ইহা জায়েয। ইহা নিছক ভদ্রতা ও একজনের মানবিক মর্যাদা বোধের প্রকাশ মাত্র। তবে কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে তুলিয়া আনার উদ্দেশ্যে উঠিয়া যাওয়া বা বিদেশ হইতে আগত ব্যক্তির জন্য দাঁড়ানো, কিংবা কেহ কোন নিয়মাত লাভ করিয়াছে বলিয়া তাহাকে মুবারকবাদ দেওয়ার জন্য দাঁড়ানো অথবা বসার স্থানে প্রশস্ততা সৃষ্টির জন্য দাড়ানো সর্ব সম্মত ভাবে জায়েয। এই হিসাবে কাহারও জন্য দাঁড়ানোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়- যেমন এই মাত্র বলা হইল। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী ইহাকেচার পর্যায়ের রাখিয়া বলিয়াছেনঃ কাহারও জন্য দাঁড়াইলে তাহার মনে অহংকারবোধ জাগে এই রূপ দাঁড়ানো নিষিদ্ধ। কাহারও মনে এইরূপ ভাব জাগিবার আশংকা থাকিলে তাহার জন্য দাঁড়ানো মাকরূহ। এই দুইটি পর্যায়ে শাসক, ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য। নিছক ভদ্রতা ও সৌজন্যমূলক ভাবে দাঁড়াইলে তাহা জায়েয। কাহারও বিদেশ হইতে আগমন বা প্রত্যাগমনের সংবাদ পাইয়া আনন্দ ও খুশীর দরুন দাঁড়ানো মুস্তাহাব।

(**************)

স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা
মোঁচ কাটা, দাড়ি রাখা, নাভির নিচের পশম মুন্ডন

****************************************

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হইতে বর্নিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন, হযরত রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ পাঁচটি কাজ স্বাভাবিক পর্যায়ের। তাহা হইল, লৌহ ব্যবহার, খাতনা, করণ, গোঁফ কাটা, বগলের পশম উৎপাটন এবং নখ কাটা।

(বুখারী, মুসলিম, আবূ দায়ূদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)

ব্যাখ্যাঃ হাদীসটির শুরুর বাক্যাংশ ********* পাঁচ কাজ স্বাভাবিক পর্যায়ের। এর অর্থ, এই পাঁচটি কাজ স্বাভাবিকভাবেই এবং সকলেরই করা কর্তব্য। ‘স্বাভাবিক পর্যায়ের’ বলিতে বুঝানো হইয়াছেঃ এই পাঁচটি কাজ সুন্নাত- স্থায়ী রীতি। এই সুন্নাত বা স্থায়ী রীতি হইতেছে নবী রাসূলগণের। দুনিয়ায় মানব জাতিকে কল্যাণময় আদর্শ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নিকট হইতে যত নবী রাসূলের আগমন হইয়াছে, তাঁহারা সকলেই এই কাজ কয়টি যেমন নিজেরা করিতেন, তেমনিই তাঁহারা সকলেই এই কাজ পাঁচটি করার শিক্ষা দিয়াছেন। করার জন্য তাকীদ করিয়াছেন। আর এই নবী রাসূলগণকে- তাঁহাদের উপস্থাপিত আদর্শ, রীতি-নীতি ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ মানিয়া চলা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষেরই কর্তব্য। ইহা অতীব প্রাচীনকাল হইতে চলিয়া আসা রীতি। খোদার অবতীর্ণ সমস্ত শরীয়াতেই এই রীতির কথা বলা হইয়াছে ও ইহা পালন করার তাকীদ করা হইয়াছে। ফলে ইহা মানব-প্রকৃতি সম্মত কাজ রূপে মানব সমাজে আদিম কাল হইতেই এই কাজগুলি মানুষ করিয়া আসিতেছে। বিশেষ করিয়া এই কাজ পাঁচটি মুসলিশ সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।

সর্বপ্রথম বলা হইয়াছে ********** ইহার শাব্দিক অর্থ লৌহ ব্যবহার। ইহা ইংগিত মূলক শব্দ। ইহার অর্থ, নাভির নিম্নদিকে গজানো পশম কামানোর জন্য লৌহ-লৌহ নির্মিত ক্ষুর কেশ মুন্ডনের অস্ত্র ব্যবহার করা। ইহা সুন্নাত, নবী রাসূলগনেল অবলম্বিত ও অনুসৃত রীতি। পুরুষাংশের ও স্ত্রী অংগের চতুর্পাশে গজানো পশম নিখুঁতভাবে কামাইয়া রাখাই ইহার লক্ষ্য। নিম্নাংগে পিছনে-সম্মুখে যত পশমই গজায়, সবই কামাইতে হইবে। ইহা বয়স্ক পুরুষ ও নারীর উভয়ের কর্তব্য।

দ্বিতীয় বলা হইয়াছে, পুরুষাংগের খাতনা করা। আল্লামা মা-অর্দী খাতনা করার অর্থ বলিয়াছেনঃ

****************************************

পুরুষাংগের অগ্রভাগ আচ্ছাদন করিয়া চর্ম কাটিয়া ফেলা।

ইহা কাটিয়া ফেলিয়া পুরুষাংগকে সম্পূর্ণ আচ্ছাদন বোঝা মুক্ত করাই ইহার উদ্দেশ্য। ইহা এমনভাবে কাটিতে হইবে যে,ন পুরুষাংগের উপর এক বিন্দু অতিরিক্ত চর্ম থাকিতে পা পারে ও পুরুষাংগটি সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়া উঠে। স্ত্রীলোকদের যৌন অংগের উপরিভাগে যে চর্ম উচ্চ হইয়া দাঁড়ায়, তাহা কর্তন করাও ইহারই অন্তুর্ভক্ত। তবে ইহা তদানীন্তন মদীনীয় সমাজে কিছুটা প্রচলিত থাকিলেও ইহা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয় নাই উম্মে আতীয়া (রা) বর্ণনা করিয়াছেনঃ

****************************************

মদীনায় একটি মেয়ে লোক স্ত্রী অংগের খাতনা করার কাজ করিত। নবী করীম (স) তাহাকে বলিলেন, বেশী বাড়াবাড়ি করিও না। কেননা ভুলিও না যে স্ত্রী অংগের এই অংশটি যৌন স্বাদ আস্বাদনে অধিকতর সহায়ক।

মুহাদ্দিস আবূ দায়ূদের মতে এই হাদীসটি খুব শক্তিশালী সনদ সম্পন্ন নয়। ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ এই কথার সমর্থনে হযরত আনাস (রা) ও হযরত উম্মে আইমান (রা) হইতে হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।

কিন্তু এই খাতনা করার কাজটি কখন-কোন বয়সে করা দরকার? এই বিষয়ে বিভিন্ন মত থাকিলেও অধিকাংশ ফিকাহবিদ এই মত দিয়াছেন যে, ইহার জন্য কোন সময় বা বয়স কা নির্দিষ্ট নয়। ছোট্ট বয়সেই করাতেই হইবে, তাহা ওয়াজিব নয়। এই মতের সমর্থনে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত অপর একটি হাদীস উদ্ধৃত করা হইয়াছে। নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

****************************************

মহান আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহমী (আ) তাঁহার আশী বৎসর বয়স হইয়া যাওয়ার পর খাতনা করাইয়াচেন।

তবে শাফেয়ী মাযহাবের মত হইলঃ

****************************************

অভিভাবকের কর্তব্য হইল সন্তানদের অল্প বয়স থাকা কালেই এবং পূর্ণ বয়স্কতা প্রাপ্তির পুর্বেই খাতনা করানো।

কিন্তু ইহার বিপরীত মত প্রমাণকারী হাদীসও উদ্ধৃত হইয়াছে। বুখারী গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে জিজ্ঞাসা করা হইলঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের সময় আপনি কাহার মত ছিলেন?

জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ

****************************************

তখন আমার খাতনা করানো হইয়াছিল। আর তখনকার সময় লোকেরা বালকের পুর্ণ বয়স্কতা প্রাপ্তির পূর্বে খাতনা করিত না।

এই মতের সমর্থনে ইহাও বলা হইয়াছে যে, দশ বৎসর বয়সের পূর্বে খাতনা করানো হারাম। কিন্তু ইহা আদৌ সত্য নয়। কেননা হাদীস বর্ণিত হইয়াছেঃ

****************************************

নবী করীম (স) হযরত হাসান ও হুসাইন (রা)-এর খাতনা করাইয়াছিলেন তাহাদের জন্মের সপ্তম দিনে।

ইমাম নববী এই প্রেক্ষিতে লিখিয়াছেনঃ

****************************************

শিশুর জন্মের সপ্তম দিন খাতনা করানোই শ্রেয় বলিয়া মনে করি।

ইহার পর প্রশ্ন উঠিয়াছে, খাতনা করানো ওয়াজিব না সুন্নাত? ইবনুল হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ ইমাম শাফেয়ী ও বিপুল সংখ্যক ফিকাহবিদ মত দিয়াছেন যে খাতনা করানো ওয়াজিব। প্রাচীন ফিকাহবিদদের মধ্যে আতা-ও এই মত দিয়াছেন। তিনি এতদূর বলিয়াছেনঃ

****************************************

কোন বড় বয়সের লোকও যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবুও তাহার খাতনা না করানো হইলে তাহার ইসলাম গ্রহণই পুর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ হইতে পারে না।

ইমাম আহমাদ ও মালিকী মাযহাবের কোন কোন ফকীহও এই মত প্রকাশ করিয়াছেন। ইমাম আবূ হানীফা বলিয়াছেনঃ খাতনা করানো ওয়াজিব- ফরয নয়। তাঁহার অপর একটি মত হইল, ইহা সুন্নাত। এমন সুন্নাত যাহা না করা হইলে গুনাহগার হইতে হইবে। স্ত্রীলোকদের খতনা করানো ইমাম শাফেয়ীর মতে ওয়াজিব নহে।

তবে খাতনা করানো ওয়াজিব বলিয়া যে সব হাদীসের ভিত্তিতে মত প্রকাশ করা হইয়াছে, তন্মধ্যে একটি হাদীসও সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। ইমাম শাওকানী এই পর্যায়ের হাদীস সমূহ পর্যালোচনা করিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেনঃ

****************************************

সত্য কথা এই যে, ওয়াজিব প্রমাণকারী কোন নির্ভূল দলীলই পাওয়া যায় নাই। তবে সর্বপ্রকার সন্দেহমুক্ত ও প্রত্যয় পুর্ণ করা হইল, ইহা সুন্নাত।

তৃতীয় কাজ হইল গোঁফ কাটা। অর্থাৎ গোঁফ কাটিয়া ছোঁট করিয়া রাখাই স্বভাব সম্মত, নবী রাসূল কর্তৃক পালিত এবং আদিম কাল হইতে চলিয়া আসা নিয়ম। ইহার বিপরীত- অর্থাৎ লম্বা ও বড় মোচ রাখা যেমন স্বভাব নিয়ম বহির্ভুত, চরম অসভ্যতা, বর্বরতা, জঘন্য, তেমনি, পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতার দিকদিয়অ অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক কাজ। লম্বা ও বড় মোচে ময়লা আবর্জনা পুঞ্জীভূত হইয়া থাকা অবধারিত। মুখের উপরিভাগে এই জংগল রক্ষা করা অত্যন্ত হীন মানসিকতার প্রমাণ। মুখাবয়বের সূচিতা সুশ্রীতার পক্ষেও বড় প্রতিবন্ধক। নবী করীম (স) নিজে নিয়মতি মোচ কাটিয়া ছোট করিয়া রাখিতেন। এই ব্যাপারে অত্যন্ত তাকীদী ভাষায় নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

****************************************

যে লোক তাহার মোচ কাটিয়া ছোট করিয়া রাখে না, সে আমার মধ্য হইতে নয়।

অর্থাৎ সে আমার রীতি-নীতি সংস্কৃতির অনুসারী নয়।

অপর একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

আল্লাহর দোস্ত হযরত ইবরাহীম (আ) এই কাজ নিয়মিত করিতেন।

ইহা হইতে বুঝা গেল মূলত ইহা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রবর্তিত ও অনুসৃত রীতি। হযরত মুহাম্মদ (স) ও এই রীতি অনুসরণক করিয়াছেন এবং সমস্ত উম্মতের জন্য ইহা করা কর্তব্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। অন্যথায় সে যেমন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারী গণ্য হইবেনা, তেমনি হইবে না আল্লাহর দোস্ত হযরত ইবরাহীম (আ)-এর অনুসরণকারী।

চতুর্থ বলা হইয়াছে, বগলের পশম উৎপাটন করার কথা। আসলে চলিত রীতি হইল বগল কামানো। কেননা উৎপাটনে কষ্ট হওয়ার আশংকা। ইমাম শাফেয়ী বগল কামাইতেন। তিনি বলিয়াছেনঃ আমি জানি, বগলের উৎপাটন করাই সুন্নাত। কিন্তু উহাতে যে ব্যথা হয়, আমি তাহা সহ্য করিতে পারি না। অবশ্য উৎপাটনের অভ্যাগ হইলে পারে আর ব্যথা অনুভূত হয় না বলিয়া ইমাম গাজ্জালী মত প্রকাশ করিয়াছেন। মোট কথা কামানো বা উৎপাটন যাহাই করা হউক, তাহাতেই সুন্নাত পালন হইবে। কেননা এই স্থানে বেশী পশম জমা হইলে ময়লা জমিয়া যায় ও দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়- ইহা নিঃসন্দেহ।

আর পঞ্চম হইল, নখ কাটা। কাঁচা বা সাদা নখের উপর বাড়তি অংশ কাটিয়অ ফেলা নবীর সুন্নাত। কেননা ইহাতেও নানাবিধ ময়লা আবর্জনা জমে। আর হাত দিয়াই খাদ্য গ্রহণের সময় বাড়তি নখে জমা ময়লা আহার্যের সঙ্গে পেটে চলিয়া যায়। এই কাণে নখ কাটা একটা অপরিহার্য স্থায়ী রীতি।

হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ দশটি কাজ স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতার জন্য জরুরী। তাহা হইলঃ মোট কর্তন করা দাড়ি বৃদ্ধি করা, মিসওয়াক করা, নাক পানি দিয়া ধৌত করা, নখ কাটা, গ্রন্হীগুলি ভাল করিয়া ধৌত করা, বগলের পশম উৎপাটিত করা, নাভির নিম্নাংশের পশম মুণ্ডন করা, পানি দিয়া শৌচ করা ও কুলি করা।

(তিরমিযী, বুখারী, আবূ দায়ূদ, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী)

এই হাদসটি মোট দশটি কাজের কথা বলা হইয়াছে। ইহাতে পূর্ববতী হাদীসের অতিরিক্ত পাঁচটি কাজ শামিল করা হইয়াছে। সেই অতিরিক্ত পাঁচটি কাজ হইল দাড়ি বৃদ্ধি করা, মিসওয়াক করা, নাসারন্ধ্র ধৌত করা, হাত ও পায়ের গ্রন্হীগুলি মর্দন করিয়া ধোয়া, পানি দিয়া শৌচ করা ও কুলি করা। এই পাঁচটি ও দশ সংখ্যার মধ্যে মৌলিক ভাবে কোন বিরোধ বা পার্থক্য নাই। ইহার তাৎপর্য এই যে, রাসূলে করীশ (স) সর্বপ্রথম মাত্র পাঁচটি কাজের কথা বলিয়াছেন এবং পরে অতিরিক্ত আরও পাঁচটির কথা বলিয়াছেন। অথবা বলা যায়, স্থান বিশেষ এক এক স্থানে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে এক একটি কথা বলা হইয়াছে। কেননা এই সাংস্কৃতিক মূল্য সম্পন্ন কার্যাবলী বিশেষ কোন সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। সহজে কথা বুঝাইবার ও স্মরন করিয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যেও এই সংখ্যার উল্লেখ হইতে পারে।

‘দাড়ি বৃদ্ধি করা’ অর্থ দাড়ি লম্বা করা, বড় করিয়া রাখা এবং মোচের মত ছোট করিয়া না কাটা। হাদীসের শব্দটি হইল ***** ইহার অর্থ ছাড়িয়া দেওয়া, বৃদ্ধি করা ও বেশী করিয়া দেওয়া।

অপর একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর উক্তি হইলঃ

****************************************

মোচ কাটিয়অ ফেল এবং দাড়ি বৃদ্ধি কর।

এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হইতে বর্ণিত হাদসের ভাষা হইলঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়াছেন মোচ কর্তন করিতে ও দাড়ি ছড়িয়া দিতে।

এই বিষয়ে বর্ণিত মোট পাঁচটি বর্ণনায় পাঁচটি বিভিন্ন শব্দ উদ্ধৃত হইয়াছে। সে শব্দ সমূহ হইলঃ ********* এই সব কয়টি শব্দের অর্থ হইল ‘দাঁড়িকে উহার নিজ অবস্থায় ছাড়িয়া দেওয়া। আর ইহার বিপরীত অর্থ হইল, দাড়ি আদৌ এবং কিছুমাত্রও না কাটা।

কিন্তু আমার ইবনে শুয়াইব তাঁহার পিতা শুয়াইব হইতে এবং তিনি তাঁহার পিতা হইতে বর্ণনা করিয়াছেনঃ

****************************************

নবী করীম (স) তাঁহার দাড়ির দৈর্ঘ প্রস্থ হইত কর্তন করিতেন।

ইমাম তিরমিযী বলিয়াছেন, এই হাদীসটি **** অর্থাৎ হাদীসটি যয়ীফ। কেননা এই সনদটির নির্ভরতা হইতেছে উমর ইবনে হারুন নামক বর্ণনাকারীর উপর। কিন্তু বর্ণনাকারী হিসাবে এই লোকটি অ-নির্ভর যোগ্য। ইবনুল হাজর আল-আসকালানী উমর ইবনে হারুন সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

****************************************

এই লোকটির বর্ণিত হাদীস সমূহের মর্ধে এই হাদীসটিই গ্রহণ অযোগ্য।

ফিকাহবিদদের মধ্য হইতে বহু লোক প্রথমোদ্ধৃত হাদসৈর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন এবং দাড়ির দৈর্ঘ প্রস্ত- কোন একটি দিক দিয়াও কিছু অংশ কর্তন করা মাকরূহ বলিয়াছেন। তবে কেহ কেহ এই দ্বিতীয় উদ্ধৃত হাদীসটর ভিত্তিতে মত দিয়াচেন যে, এক মুঠির বেশী হইলে এই বাড়তি অংশ কাটিয়া ফেলা যাইবে।

এই কথার সমর্থনে বলা হইয়াছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) দৈর্ঘ-প্রস্ত হইতে দাড়ি কর্তনের কাজ করিয়াছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা) ও ইহা করিয়াছেন বলিয়া বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত জাবির (রা) হইতে উত্তম সনদে বর্নিত হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************

আমরা হ্জ্জ ও উমরা ছাড়া অন্যান্য সময় দাড়ির বৃদ্ধি পাওয়া অংশ ছাড়িয়া দিতাম।

এই কথাটির অর্থ হজ্ব ও উমরা কালে তিনি ইহা ছাড়িয়া দিতেন না, কাঠিয়া ফেলিতেন। ইহাতে হযরত ইবনে উমর সম্পর্কে উপরে উদ্ধত কথারই সমর্থন রহিয়াছে।

প্রশ্ন উঠিয়াচে, দাড়ির কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট আছে কি? ইহার জওয়াব এই যে, বহু সংখ্যক ফিকাহবিদ এক মুষ্ঠির অধিক কাটিয়া ক্ষান্ত হইতেন। হাসান বছরী বলিয়াছেনঃ

****************************************

দাড়ির দৈর্ঘ্য প্রস্থ হইতে কাটিয়া ফেলা যাইবে যদি কৃদৃশ্য ও জঘন্য রূপ হয়।

দুনিয়ার বহু লোক সে কালেও যেমন একারেও তেমন দাড়ি মুন্ডন করে কিংবা দাড়ি কাটিয়া ছোট করিয়া কবুতরের লেজের মত করিয়া রাখে। ইহা হইতে এই সব হাদীসে নিষেধ করা হইয়াছে।

ফিকাহবিদ আতা বলিয়াছেন, কেহ যদি তাহার দাড়ি ছাড়িয়া দেয় এবং উহার কোন দিক দিয়া কোন অংশ না কাটে, তাহা হইলে উহা এমন কুদৃশ্য ও জঘন্য রূপ হইবে, যাহাতে সে তামাসা ও বিদ্রুপের পাত্র হইয়া পড়িবে। তিনি উপরে উদ্ধৃত আমর ইবনে শুয়াইব বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতেই এই মত প্রকাশ করিয়ানে। কাজী ইয়ায বলিয়াছেনঃ

****************************************

দাড়ি কামানো, কর্তন ও দৈর্ঘ-প্রস্ত বৃদ্দি পাওয়া অংশ ফেলাইয়া দেওয়া সাধারণতঃ মাকরূহ। তবে যদি খুব বড় হইয়া যায়, তাহা হইলে উহার দৈর্ঘ- প্রস্থ হইতে ছাঁটিয়া ফেলা উত্তম বরং খুব বড় দাড়ি রাখার দুর্নাম হওয়ার আশংকা, মেযন উহাকে খুব ছোট করায়ও এই আশংকা রহিয়াছে।

এই ব্যাপারে উপমহাদেশের আহলি হাদসি মুহাদ্দিসগণের মতের লোক দাড়ি একেবারেই না কাটা, না ছাটা, না কামানোর মত পোষণ করেন। তাঁহারা আমর ইবনে শুয়াইব বর্ণিত হাদীস কে দুর্বল বর্ণনা বলিয়া মনে করেন। অতএব ফিকাহবিদ আতার কথাও তাঁহারা সমর্থন করেন না। আর এক মুষ্ঠি পরিমাণ রাখার বিষয়েও তাঁহারা একমত নহেন। কেননা হাদীসের বিচারে সম্পূর্ণ ও অকর্তিত ভাবে দাড়ি রাখিয়া দেওয়া হাদীস মরফূ, সহীহ সনদে বর্নিত। আর হযরত ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা (রা) সম্পর্কে উপরে উদ্ধৃত কথা সাহাবদের আমর ***** পর্যায়ের। আর প্রথম ধরনের হাদীস দ্বিতীয় ধরনের হাদসের উপর অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য সব সময়ই।

(**************)

নাভির নিম্নস্থ পশন কামানো

মোচ ও নখ কাটা সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বিশেষ তাকীদ করিয়াছেন। এই কাজের জন্য সময়-মিয়াদ-নির্ধরণ পর্যায়ে বর্ণনা করা হইয়াছেঃ

****************************************

রাসূলে করীম (স) মুসলমাদের জন্য নখ ও মোচ ও কাটা ও নাভির নিম্নদেশস্থ পশম কামানোর সময় নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। চল্লিশ রাত্র।

অর্থাৎ বেশীর পক্ষে চল্লিশ দিনে এক বার এই কাজ অবশ্যই করিতে হইবে। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, এই কাজ কয়টি করার জন্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে। ইহার আসল অর্থ, যখন এই গুলি স্বাভাবিক সীমা লংঘন করিবে, যখনই ইহা বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয় মনে হইবে, তখনই এই কাজ করিতে হইবে।

এই পর্যায়ে একটি হাদীসে বলা হইয়াছেঃ

****************************************

রাসুলে করীম (স) প্রতি শুক্রবার দিন তাঁহার নখ ও মোচ কাটা পছন্দ করিতেন।

এই হাদীসটি মুরসাল। আবূ জা’ফর আল বাক্কের তাবেয়ী সাহাবীর নাম ছাড়াই সরাসরি রাসুলে করীম (স) সম্পর্কে এই কথা বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস অবশ্য ইহার সমর্থনে পাওয়া যায়, কিন্তু উহার সনদ দুর্বল। কামাইয়া ফেলা চুলও কাটিয়া ফেলা নখ কি দাফন করিতে হইবে? এই পর্যায়ে রাসুলে করীম (স) হইতে কোন বর্ণনা কি প্রমাণিত হইয়াছে/? ইহার জওয়াবে বলা যায়, রাসূলে করীম (স)-এর একটি কথা এই ভাসায় বর্ণিত হইয়াছেঃ

****************************************

তোমরা তোমাদের বাড়তি নখ কাটিয়া ফেল, কর্তিত জিনিসগুলি মাটিতে পুতিয়া ফেল এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়াস্থান গুলি ডলিয়া মাড়িয়া পরিস্কার করিয়া রাখ।

কিন্তু হাদীস বিশারদদের মতে এই হাদীসটির সনদ শক্তিশালী নয়। তবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইহা করিতেন বলিয়া ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা) উল্লেখ করিয়াছেন।

বস্তুত স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা পর্যায়ে উপরে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের যাহা কিছু বলা হইয়াছে, ইসলামী সাংস্কৃতির মূল্যবোধের দৃষ্টিতে উহার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী এবং কোন মুসলমানের পক্ষেই এই কথার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি