হাদীস গ্রন্হ সংকলন
পূর্বের আলোচনা হইতে প্রমাণিত হইয়াছে, প্রথম পর্যায়েই রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্হাকারে সংকলিত হইতে পারে নাই। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর হাদীস তাঁহার সাহাবী ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের যুগে গ্রন্হকারে সংকলিত ও সুসংবদ্ধ ছিল না।[********************]

ইসলামের প্রথম পর্যায়েই হাদীস গ্রন্হসমূহ সংকলিত না হওয়ার মূলে কয়েকটি যুক্তিসংগত কারণ রহিয়াছে। প্রথমত, পূর্বে যেমন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে, সাহাবায়ে কিরাম তীব্র স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শ্রবণ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের মুখস্থ হইয়া যাইত, উহা লিখিয়া লওয়ার কোন প্রয়োজন সাধারণভাবে ও স্বভাবতই তাঁহারা মনে করিতেন না।

দ্বিতীয়ত, লিখিবার শক্তি তাঁহাদের অনেকেরই ছিল না। তখন লিখন শিল্পের প্রচলনও পরবর্তীকালের ন্যায় ব্যাপক ছিল না, উহা সাধারণ জনপ্রিয়তাও তখন লাভ করিতে পারে নাই।

তৃতীয়ত, নবী করীম (স) নিজেই প্রথম পর্যায়ে হাদীস লিখিতে নিষেধ করিয়াছেলেন বলিয়া হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রতি সকল সাহাবীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতে পারে নাই।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এই সম্পর্কে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্যঃ

******************************************************

নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই হাদীসসমূহ সংগৃহীত ও সংকলিত হওয়া বাহ্য দৃষ্টিতে যদিও উত্তম ছিল, কিন্তু কুরআনের অনুরূপ হাদীসেরও সংকলিত হওয়া এবং ঠিক কুরআনের মতই হাদীসেরও সংরক্ষিত হওয়া বোধ হয় আল্লাহরই মর্জি ছিল না।[ফায়জুলবারী শরহে বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৮।]

এইসব কথাই হইল হাদীস গ্রন্হ সংকলনের উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা ও যত্ন গ্রহণ সম্পর্কে। অন্যথায় হাদীসের হিফাযত ও উহাকে বিলীন হইয়া যাওয়ার হাত হইতে রক্ষা করার ব্যাপারে রাসূলে করীমরে যুগ হইতে সাহাবাও তাবেয়ীনের যুগ পর্যন্ত উহার প্রতি কখনই এবং কিছু মাত্র কম গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।

সেই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশিয়া যাওয়ার আশংকা দূরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেমন সাহাবায়ে কিরাম হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার দিকে লক্ষ্য দিয়াছেন, অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের সময় হইতেই হাদীস সংকলন ও গ্রন্হাকারে উহাকে সুসংবদ্ধকরণের কাজও পূর্ণ মাত্রায়ই সম্পন্ন করা হইয়াছে।

তবে সাহাবীদের যুগে হাদীসকে গ্রন্হাকারে সংকলিত করিয়া লওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে অনুভূত ছিল না। কেননা তখন সাহাবিগণ নিজেরাই রাসূলের হাদীসের ধারক ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে প্রয়োজন দেখা দিলেই জনগণ সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হইতেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানিয়া লইয়া সকল ব্যাপারের মীমাংসা করিয়া লইতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে রাসূলে করীমের ফরমান কি, তাহাও নিঃসন্দেহভাবে সাহাবাদের নিকট হইতে জানিতে পারা যাইত। কিন্তু সাহাবাগণ যখন এক এক করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাএত লাগিলেন তখন সাধারণ মুসলমানও যেমন হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রয়োজন বোধ করেন, তেমনি হাদীসের অবশিষ্ট ধারক সাহাবীগণও উহাকে সংকলিত করিয়া চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া রাখিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করিতে থাকেন।

তাবেয়ী যুগে সাহাবায়ে কিরামের বিদ্যমানতা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহা হযতর আনাস (রা)-এর ইন্তেকালের পর মুরেক নামক জনৈক তাবেয়ীর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আজ অর্ধেক ইলম – হাদীস – দুনিয়া হইতে চলিয়া গেল।

এই কথার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

সাহাবীদের যুগে কোন অসদুদ্দেশ্যসম্পন্ন ব্যক্তি হাদীস সম্পর্কে আমাদের বিরোধিতা কিংবা মতবিরোধ করিলে আমরা বলিতামঃ যে লোক এই হাদীস স্বয়ং রাসূলের নিকট শ্রবণ করিয়াছেন তাঁহার নিকট চল ( ও ইহার সত্যতা যাঁচাই করিয়া লও)।[********************]

এই কারণেই সাহাবাদের কাফেলার শেষ অন্তর্ধান শুরু হওয়ার পূর্বেই হাদীসি সংকলনের ও হাদীসকে গ্রন্হবন্ধ করিয়া উহাকে চির দিনের তরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে ও তীব্রতা সহকারে অনুভূত হইতে শুরু করে। নবুয়্যাত- উত্তর যুগে এই পর্যায়ে একসঙ্গে পেশ করা আবশ্যক। এখানে প্রথমে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হইব। অতঃপর পরবর্তীকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হইবে।


খুলাফায়ে রাশেদুন ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন
নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদীন ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পরিচালনা ও যাবতীয় দ্বীনি কার্যাবলীর দায়িত্বগ্রহণ করেন। এই সময় ইসলামের অপরিহার্য দ্বিতীয় স্তর- ইলমে হাদীস- সম্পর্কে তাঁহাদের চেষ্টা- যত্নের কোনই ক্রটি ছিল না। এখানে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক খলীফার হাদীস সংক্রান্ত খিদমত সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)

প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নিজে পাঁচশত হাদীসের এক সংকলন তৈয়ার করিয়াছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষভাগে তিনি নিজেই তাহা বিনষ্ট করিয়া ফেলেন। ইহার কারণস্বরূপ মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, হাদীসসময়হ সংকলন করার পর তিনি মোটেই স্বস্তি লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার মনে কয়েক প্রকার ভয়ের সঞ্চার হয়। তিনি এজন্য বিশেষ ভাবিত হইয়া পড়েন যে, তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্যে একটি কথা- একটি শব্দও যদি রাসূলে করীমের মূল বাণীর বিন্দুমাত্রও বিপরীত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে রাসূলের কঠোর সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁহাকে জাহান্নামের ইন্ধন হইতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, তাঁহার মনে এই ভয়ও জাগ্রত হইল যে, তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হকে মুসলিম জনগণ যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়া বসে কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের বর্ণিত ও সংকলিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তাহা হইলেও মুসলমানদের পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কারণ হইবে। তাহার ফলে হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ ও অগ্রগতি ব্যাহত হইতে পারে। এই সব চিন্তার ফলেই তিনি তাহা নষ্ট করিয়া ফেলেন।[কিন্তু আল্লামা যাহবী হযরত আবূ বকর কর্তৃক তাঁহার নিজেরই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ বিনষ্ট করিয়া দেওয়ার বর্ণনাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করেন নাই।]

ব্যাপারটিকে আমরা যতই গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করিয়া দেখি না কেন, ইহাতে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক অবস্থার পরিণাম বলা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও হযরত আবূ বকর (রা) হাদীস সংকলন করিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তিনি নিজেও কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীস হইতেছে ইমাম সয়ূতীর মতে ১৪২টি । এই হাদীসসমূহ হাদীসের কোন কোন গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে তাহাও তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার এত কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার মূলেও যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। ইমাম সয়ূতী এ বিষয়ে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার কারণ এই যে, হাদীসে প্রচার ও তাবেয়ীন কর্তৃক উহা শ্রবণ করা শিক্ষা ও সংরক্ষণ করার কাজ শুরু করার পূর্বেই তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া যায়।[********************]

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ প্রসংগে ইমাম সয়ূতী উপরিউক্ত গ্রন্হের অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে সনদ সম্পন্ন হাদীস খুব কম সংখ্যক বর্ণিত হইয়াছে। কেননা হযরতের ইন্তেকালের পর তাঁহার আয়ুষ্কাল খুবই অল্প ছিল ও তাঁহার মৃত্যু খুব তাড়াতাড়িই সংঘটিত হইয়াছিল। অন্যথায় তিনি যদি দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিতেন তাহা হইলে তাঁহার নিকট হইতে বহু সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত করিতেন। তিনি যতদিন বাঁচিয়াছিলেন, ততদিন সাহাবাদের কেহই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কেননা সমস্ত ব্যাপারে তাঁহারা সমানভাবেই শরীক ছিলেন। যাহা তাঁহাদের অজ্ঞতা ছিল কেবল তাহাই তাঁহারা নিকট হইত বর্ণনা করিতেন।[********************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীও এই কথাই লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সাহাবাগণ হযরত আবূ বকরের সূত্রে খুব বেশী হাদীস বর্ণনা কার জন্য প্রয়োজনশীল ছিলেন না। কেননা অধিক সংখ্যক হাদীস তাঁহারা নিজেরাই রাসূলের মুখে শুনিয়াছিলেন।[********************]

এতদ্ব্যতীত হযতর আবূ বকর (রা) হযরতের অন্তর্ধানের পর মাত্র আড়াই বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। এই আড়াইটি বৎসর তাঁহার খিলাফাতের কঠিন দায়িত্ব পালন ও ভীষণ প্রতিকূল ঝড়-ঝাপটার মধ্যে অতিবাহিত হয়। ফলে এই সময়ে অন্যন্য দীর্ঘায়ূসম্পন্ন সাহাবায়ে কিরামের মত হাদীস বর্ণনার নিরবচ্ছিন্ন অবসর ও অনুকুল পরিবেশও তিনি পান পান নাই।

উপরন্তু মুসলমাদের সহিত পরামর্শ করিয়া যাবতীয় দায়িত্ব পালন করাই ছিল তাঁহার এই সময়কার বড় কাজ। ইসলামী খিলাফতের প্রকৃত গণতন্ত্রিক ও পরামর্শভিত্তিক হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি সামাজিক, রাষ্ট্রিয় ও সামগ্রিক ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহাবীদের সহিত পরামর্শ করিয়া এবং কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মীমাংসা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াই কাজ করা হইত।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) খিলাফতের যাবতীয় কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে কুরআন মজীদের পরে-পরেই হাদীসের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি যে ভাষণ দিয়াছিলেন, তাহাতেই তিনি কুরআনের পরে পরেই হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করিয়াছিলেন। বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে লোকগণ! আমাকে তোমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বানানো হইয়াছে। অথচ আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। কিন্তু কুরআন নাযিল হইয়াছে এবং নবী করীম (স) তাঁহার সুন্নাত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে এই উভয় জিনিসের শিক্ষা দান করিয়াছেন, আর আমরা তাহা শিখিয়া লইয়াছি।[********************]

খিলাফতের কাজের ক্ষেত্রেও বাস্তবভাবেই তিনি কুরআনের পরেই হাদীসের উৎস হইতে নির্দেশ ও বিধান লাভ করিতেন। প্রমাণ্য গ্রন্হাবলীতে তাঁহার এই নীতির কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকরের নিকট যখন মীমাংসা যোগ্য কোন ব্যাপার উপস্থিত হইত তখন তিনি প্রথমত আল্লাহর কিতাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন। তাহাতে যদি ফায়সালা করার ভিত্তি খুঁজিয়া পাইতেন, তবে উহার ভিত্তিতে লোকদের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিতেন। আর কুরআনে কিছু নাই পাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলের সুন্নাত যদি কিছু জানা যাইত, তবে উহার ভিত্তিতে মীমাংসা করিয়া দিতেন।[সুনানে দারেমী, ২৩ পৃঃ ********************]

হযরতের ইন্তেকালের পর যতগুলি সামগ্রিক ব্যাপারেই মতভেদ দেখা দিয়াছে হযরত আবূ বকর (রা) তাহার প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাপারেই মীমাংসা করিয়াছেন রাসূলে করীমের হাদীস পেশ করিয়া এবং তাঁহার উপস্থাপিত হাদীস সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল মতভেদ খতম করিয়া দিয়াছে। হযরতের ইন্তেকালের পর সকীফায়ে বণী সায়েদায় সাহাবীদের মধ্যে প্রথম জটিল প্রশ্ন দেখা দেয়- খলীফা কে হইবে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছিল যে, এই বিষয়ে কোন মীমাংসা করাই তখন অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। তখন হযরত আবূ বকর (রা) দাড়াইয়া রাসূলে করীম (স)-এর একটি হাদীস পেশ করিলেন এবং বলিলেনঃ

******************************************************

ইমাম ও খলীফা কুরায়েশদের মধ্য হইতে হইবে।

সেই সঙ্গে রাসূলের এই কুরায়শ বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে।[********************]

এই হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকল সাহাবী ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়া লইলেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ নির্বিাবাদে সম্পন্ন হয়।

নবী করীম (স)-কে কোথায় দাফন করা হইবে, তাহা লইয়া যখন মতবিরোধ দেখা দিল, তখন হযরত আবূ বকর (র) সিদ্দীক (রা) হাদীস পেশ করিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট একটি কথা শুনিয়াছিলাম, যাহা আমি ভুলিয়া যাই নাই। তিনি বলিয়াছিলেনঃ আল্লাহ তাঁহার নবীর জান কবজ করেন সেই স্থানে, যেখানে তাঁহাকে দাফন করা কর্তব্য হয়।

অতঃপর বলিলেনঃ******************************************************

অতএব তোমরাও রাসূলে করীম (স)- কে তাঁহার মৃত্যুশয্যার স্থানেই দাফন কর।[শামায়েলে তিরমিযী, পৃষ্ঠা ৩০ ******************** মুয়াত্তা মালিক, পৃষ্ঠা ৮০।]

হযরত আয়েশা (রা) প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকরের নিকট নবী করীমের সম্পত্তি হইতে অংশ লাভের দাবি করিলেন। তখন হযরত আবূ বকর (রা) নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমরা কাহাকেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানাই না। যাহা কিছু রাখিয়া যাই, তাহা সবই আল্লাহর পথে দান। কাজেই মুহাম্মদের বংশধর বায়তুলমাল হইতে জীবিকা গ্রহণ করিবে।

অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আল্লাহর শপথ, রাসূলকে আমি যে যে কাজ করিতে দেখিয়াছি আমি তাহা প্রত্যেকটিই কার্যে পরিণত করিব, একটিও ছাড়িয়া দিব না।

এই হাদীস বর্ণনার উপস্থিত ফল এত ত্বরান্বিত দেখা দেয় যে, হাদীসের বর্ণনাকারী শেষ ভাগে বলেনঃ

******************************************************

অতঃপর হযরত ফাতিমা মীরাসের দাবি পরিত্যাগ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলেন নাই।[বুখারী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠ ৯৯৫-৯৬।]

পক্ষান্তরে তিনি যখন রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে জানিতে পরিলেন যে, দাদীর মীরাস রহিয়াছে, তখন হাদীস অনুযায়ী তাঁহার জন্য মিরাসের ফয়সালা করিয়া দিতে এতটুকুও বিলম্ব করিলেন না। প্রথমত দাদী যখন মিরাসের দাবি করেন, তখন তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমার জন্য আল্লাহর কিতাবে মীরাসের কোন অংশ নির্দিষ্ট হয় নাই। রাসূলের আদর্শে (হাদীস)-ও তোমার জন্য কোন অংশ নির্দিষ্ট হইয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। অতএব, তুমি চলিয়া যাও। আমি লোকদের নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়া পরে তোমাকে জানাইব।

অতঃপর তিনি একদিন সাহাবীদের নিকট এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা দাড়াঁইয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট উপস্থিত ছিলাম, তিনি দাদীর জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। আমি নিজ চক্ষে দেখিয়াছে।

হযরত আবূ বকর (রা)-এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত এই হাদীস সম্পন্ধে নিঃসন্দেহে হইবার জন্য ও ইহার প্রামাণ্যতাকে বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

তোমার সঙ্গে এই কথার সাক্ষী আর কেহ আছে?

তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম (রা) দাঁড়াইয়া সাক্ষ্য দান করিলেন ও হযরত মুগীরার কথার সমর্থন করিলেন। [********************] অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) ইহা মানিয়া লইতে একটু দ্বিদা করিলেন না।

তবে একথা সত্য যে, হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর (রা) বিশেষ কড়াকড়ি করিতেন। বিশেষভাবে ও অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে যখন রাসূলের কোন হাদীস প্রমাণিত হইত, তখন তিনি উহার সম্মুখে মাথা নত করিয়া দিতেন। দাদীর মীরাস সংক্রান্ত এইমাত্র উল্লেখিত ঘটনা হইতেই ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। পরন্তু কোন হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত নিঃসন্দেহ ও নিশ্চিত না হইতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতেন না।[********************]

হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণে হযরত আবূ বকরই সর্ব প্রথম বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন।[********************]

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত আনাস (রা)-কে যখন বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তখন তিনি যাকাতের হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত এক বিস্তারিত দস্তাবেজ লিখিয়া তাঁহার সঙ্গে পাঠাইয়া দেন। এই বিস্তারিত দস্তাবেজের শুরুতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

দয়াবান করুণাময় আল্লাহর নামে।– ইহা যাকাতের ফরয হওয়া সংক্রান্ত দস্তাবেজ। রাসূলে করীম (স) মুসলমানদের জন্য ইহা ফরয করিয়াছেন এবং আল্লাহ তাঁহার রাসূলকে এই নির্দেশ দিয়াছেন।[********************]

হযরত উমর ফারূক (রা)

দ্বিতীয় খলীফা হযতর উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের পরই ছিল সুন্নাহ বা হাদীসের রাসূলের স্থানে। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের শাসকদের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে উহার ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশ দিয়াছিলেন।

ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপবতর করিয়া তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা কায়েম করেন। প্রখ্যাত সাহাবিগণকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছিলেন। এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল,হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) ও হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা)-কে বসরা প্রদেশে এবং হযরত উবাদা ইবনে সামিত ও হযরত আবুদ দারদা (রা) কে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন। [********************] আরজান ইবনে আবূ হালাকে এই উদ্দেশ্যেই মিসর পাঠাইয়াছিলেন।[********************]

হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা) কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া তখায় গমন করেন ও সেখানকার মুসলমানগণকে সম্বোধন করিয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে হযরত উমর (রা) তোমাদের নিকট এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছেন যে, আমি তোমাদিগকে আল্লাহর কিতাব ও তোমাদের নবীর সুন্নাত-হাদীস শিক্ষা দিব।[********************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-কেও তিনি কূফায় হাদীস ও কুরআনের শিক্ষাদাতা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করার জন কূফাবাসীদিগকে আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

আল্লামা খাজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কূফায় অবস্থান করিলেন। সেখানকার লোকেরা তাঁহার নিকট রাসূল (স)-এর হাদীস শিক্ষা করিতেন। তিনি ছিলেন তাঁহাদের শিক্ষক ও বিচারপতি।[********************]

হযরত উমর (রা) হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে প্রথম খলীফার মত খুবই কঠোর নীতি অবলম্বন করিতেন। হযরত আবূ মুসা আশ’আরী (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনি তাঁহাকে (আবূ মুসাকে) কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

দলীল পেশ কর, নতুবা আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিব।

পরে তাঁহার কথার সমর্থনে অপর এক সাহাবীকে যখন সাক্ষী হিসাবে পেশ করা হইল, তখন তিনি আশ্বস্ত হইলেন।[********************]

আল্লামা যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসদের জন্য দৃঢ় ও মজবুত নীতি অবলম্বনের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন।[********************]

হযরত আবূ মুসা তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সপক্ষে আর একজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলেন। তাহার পরই হযরত উমর (রা) তাহা কবুল করিলেন। ইহিা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

কোন হাদীসস যখন অন্তত দুইজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী বর্ণনা করেন, তখন তাহা একজনের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক প্রামাণ্য, শক্তিশালী ও অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য হয়। এই হাদীস বর্ণনার বহু সংখ্যক সূত্র লাভ করার জন্যও ইহা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ইহার ফলে হাদীস ‘সাধারণ ধারণার’ (********************) পর্যায় হইতে নিঃসন্দেহ ইলমের (নির্ভূল ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান) পর্যায়ে উন্নীত হইতে পারে।[********************]

হযরত উবায় ইবনে কা’ব একটি হাদীস বর্ণনা করিলে হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি যে হাদীস বর্ণনা করিলেন, তাহার সত্যতা সম্পর্কে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ পেশ করিতে হইবে।[********************]

হযরত উবায় আনসারদের মধ্য হইতে কয়েকজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলে খলীফা বলিলেনঃ

******************************************************

আমি আপনার প্রতি কোন সন্দেহ করি নাই, হাদীসকে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই আমি আপনার নিকট প্রমাণের দাবি করিয়াছিলাম।[********************]

হযরত উমর ফারূকের সময়ই সরকারী পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হাদীস সম্পদ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উহাকে সুসংবদ্ধ করিয়া লওয়ার প্রশ্ন সর্বপ্রথম উত্থাপিত হয়। হযতর উমর (রা) নিজেই এই বিরাট কাজ সম্পন্ন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীর সহিত পরামর্শও করিয়াছিলেন। মুসলমানরা তাঁহাকে ইহার অনুকূলেই পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু পরে তাঁহার নিজের মনেই এই সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ইহা করা সমীচীন হইবে কিনা? তিনি প্রায় একমাস কাল পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা ও ইস্তেখারা করিতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই একদিন বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমাদের নিকট হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলিয়াছিলাম, একথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হইল, তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাব লোকেরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করিয়াছিল, ফলে তাহারা তাহাই আঁকড়িয়া ধরিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশ্রিত করিব না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।

বস্তুত সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ পাইয়া লোকেরা হয়ত উহাতে এতখানি মনোনিবেশ করিয়া বসিবে যে, কুরআন শরীফকেও তাহারা ভুলিয়া যাইবে, লোকদের নিকট উহার গুরুত্ব নগণ্য হইয়া পড়িবে ও কেবলমাত্র হাদীসকে ভিত্তি করিয়াই তাহারা চলিতে চাহিবে, কেবলমাত্র এই আশংকায়ই হযরত উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কাজ করেন নাই। অন্যথায় ইহাকে তিনি কোন নাজায়েয কাজ নিশ্চয়ই মনে করিতেন না। তাঁহার এই আশংকা কতখানি যুক্তিসংগত ছিল, তাহা পরবর্তীকালের অবস্থার দৃষ্টিতে বিচার করিলেই বুঝিতে পারা যায়।[********************] এই ধরণের সতর্কতাবম্বনের ফলেই আজ মুসলিম মিল্লাত কুরআন মজীদকে প্রথম এবং হাদীসকে উহার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্ব দিতে শিখিয়াছে। এইরূপ সতর্কতা অবলম্বিত না হইলে মুসলমানদের নিকটই হযরত কুরআন মজীদের স্থান প্রথম ও মুখ্য না হইয়া গৌণ হইয়া পড়িত, যেমন হইয়াছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিকট তাহাদের ধর্মগ্রন্হ।

হযরত উসমান (রা)

হযরত উসমান (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক হাদীসই তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার কারণ প্রদর্শন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে রাসূলের অধিক হাদীস সংরক্ষণকারী আমি নহি, এই কারণটি আমাকে রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা হইতে বিরত রাখে নাই। বরং হাদীস বর্ণনা হইতে বিরত থাকার কারণ এই যে, আমি নিজেই রাসূল করীম (স)-কে এই কথা বলিতে শুনিয়াছি বলিয়া সাক্ষ্য দিয়েছি যে, রাসূল যাহা বলেন নাই তাহা যদি কেহ তাঁহার উপর আরোপ করে তবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।[********************]

হযরত আলী (রা)

যে কয়জন সাহাবী নিজেদের হাতে রাসূলের নিকট শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন, হযরত আলী (রা) তাঁহাদের অন্যতম।তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস রাসূলের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছিলেন। এই হাদীস সমষ্টির তিনি নাম দিয়াছিলেন ‘সহীফা’। ইহাকে ভাঁজ করিয়া তিনি তাঁহার তলোয়ারের খাপের মধ্যে সযত্নে রাখিয়া দিয়াছিলেন। ইহাতে ব্যবহারিক ও কাজকর্ম সংক্রান্ত হুকুম আহকামের কয়েকটি হাদীস লিখিত ছিল।[সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম ও কিতাবূল ই’তেসাম, মুসনাদে আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭০৯।]

পরবর্তীকালে এই সহীফাখানিকে তিনি হযরত উসমানের নিকট পাঠাইয়া দেন হাদীসের একখানি লিখিত দস্তাবেজ হিসাবে। তাঁহার পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফীয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে আমার পিতা এই বলিয়া পাঠাইয়া দিলেন যে, এই কিতাবখানি লইয়া খলীফা উসমান (রা)- এর নিকট যাও। ইহাতে সদকা ও যাকাত সম্পর্কে রাসূলে করীমের ফরমান লিখিত রহিয়াছে।[********************]

উপরিউক্ত আলোচনা হইত প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হাদীস প্রচারিত হইয়াছে, উহা শিক্ষাদানের কাজ পূর্ণ মাত্রায় চলিয়াছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার-আচারে উহা আইনের অন্যতম ভিত্তি হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছে। খণ্ডভাবে বিভিন্ন লোকদের দ্বারা উহা লিখিত এবং সংগৃহীতও হইয়াছে। কিন্তু হাদীস যথাযথভাবে গ্রন্হকারে সংকলিত হয় নাই। তখন পর্যন্ত তাহা বহু তাবেয়ী তাহাদের নিকট হইতে উহা শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়া বহু লোকের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু হাদীস যথারীতি গ্রন্হকারে সংকলনের কাজ এই পর্যায়ে কেহ করিয়াছেন- ইতিহাসে ইহার কোন নজীর পাওয়া যায় না। এইভাবেই ইসলামী ইতিহাসের প্রায় একটি শতাব্দীকাল অতিক্রম হয়। হিজরী প্রথম শতকের শেষভাগে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে এবং হাদীস সংকলনের ব্যাপারে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ও হাদীস সংকলন

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ৯৯ হিজরী সনে খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই হাদীসের বিরাট বিক্ষিপ্ত সম্পদ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, ইসলামী জীবন যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্য হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। অনতিবিলম্বে ইহার সংকলন ও পূর্ণ সংরক্ষিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে এই সম্পদ হইতে গোটা উম্মতের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা। সাহাবায়ে কিরামের প্রায় সকলেই দুনিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন। তাঁহাদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত তাবেয়ীদেরও অধিক সংখ্যক লোক তাহাদেরই অনুগামী হইয়াছেন। এখনও যাহারা জীবিত আছেন, তাঁহারা আরও দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিবেন- তাহার নিশ্চয়তা কিছু নাই। অতএব অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন এবং উহাকে সুবিন্যাস্তকরণ একন্তই আবশ্যক।

অতঃপর তিনি ইসলামী রাজ্যের কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ভাষায় ফরমান লিখিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীমের হাদীসের প্রতি অনতিবিলম্বে দৃষ্টি দাও এবং তাহা সংগ্রহ ও সংকলন করিতে শুরু কর।[]

মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাযমকেও নিম্নোক্ত মর্মে এক ফরমান লিখিয়া পাঠানঃ

******************************************************

রাসূলের হাদীস, তাঁহার সুন্নাত কিংবা হযরত উমরের বাণী অথবা অনুরূপ যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্য লিখিয়া লও। কেননা আমি ইলমে হাদীসের ধারকদের অন্তর্ধান ও হাদীস সম্পদের বিলুপ্তির আশংকা বোধ করিতেছি।[********************]

******************************************************

আর হাদীসে- রাসূল ছাড়া আর কিছুই যেন গ্রহণ করা না হয়। লোকেনা যে এই ইলমে হাদীসকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। হাদীস শিক্ষাদানের জন্য যেন মজলিস অনুষ্ঠিত হয়, যাহারা জানে না, তাহারা যেন শিখিয়া লইতে পারে। কেননা ইলম গোপন করা হইলেই তাহা বিনাশপ্রাপ্ত হয়।[******************** বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ২০।]

ইমাম দারেমী আবদুল্লাহ ইবনে দীনার-এর জাবানীতে এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের যেসব হাদীস তোমার নিকট প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তাহা এবং হযরত উমরের হাদীসসমূহ আমার নিকট লিখিয়া পাঠাও। কেননা আমি ইলমে হাদীস বিনষ্ট ও হাদীসবিদদের বিলীন হইয়া যাওয়ার আশংকা বোধ করিতেছি।[********************]

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ উমর ইবনে আবদুল আযীযের ফরমানের আর একটি অংশেরও উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার উদ্ধৃত অংশটুকু এইরূপঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আবূ বকর ইবেন হাযমকে উমরা বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া তাহার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।[********************]

ইবনে সায়াদের বর্ণনা হইতে ইহাও জানা যায় যে, উমর ইবনে আবদুল আযীয হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া পাঠাইতে বলিয়াছেন। আর উমরা বিনতে আবদুর রহমানের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া পাঠাইবার জন্য এই কারণেই তাকিদ করিয়াছিলেন। কেননা মুসলমানের আকাইদ ও ব্যবহরিক জীবনের জন্য জরুরী হুকুম-আহকাম হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহেই বিশেষভাবে উল্লেখিত হইয়াছে।[********************] আর এই উমরা হযরত আয়েশা (রা)-এর ক্রোড়েই লালিত পালিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হাদীসের শিক্ষা পূর্ণমাত্রায় লাভ করিয়াছিলেন। উমর ইবনে আবদুল আজীজ নিজেই তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আয়েশার বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে উমরা অপেক্ষা বড় আলিম আর কেহ অবশিষ্ট নাই।[********************]

ইমাম জুহরীও তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি তাহাকে হাদীস জ্ঞানের এক অফুরন্ত সমুদ্রের মত পাইয়াছি।[********************]

ইমাম মালিক বলিয়াছেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয আবু বকর ইবনে হাজমকে উমরা বিনতে আবদুর রহমানের সঙ্গে সঙ্গে কাসেম ইবনে মুহাম্মদ বর্ণিত হাদীসও লিখিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

এই কাসেম কে ছিলেন? ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার পিতা নিহত হইলে তিনি তাঁহার ফুফু-আম্মা হযরত আয়েশার ক্রোড়ে লালিত-পালিত হন এবং তাঁহার নিকট দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।[********************]

ইবনে হাব্বান এই কাসেম সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কাসিম তাবেয়ী এবং তাঁহার যামানার লোকদের মধ্যে হাদীস ও দ্বীনের জ্ঞানের দিক দিয়া সর্বোত্তম ও সর্দার ব্যক্তি ছিলেন।[********************]

আবূ বকর ইবনে হযম সম্পর্কে পূর্বে বলা হইয়াছে যে, তিনি মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন। সেই সঙ্গে বিচারপতির দায়িত্বও তাঁহাকেই পালন করিতে হইত। তিনি তদানীন্তন মদীনার একজন প্রধান ফকীহ ছিলেন। ইসলামী আইন-কানুনে তাঁহার অতুলনীয় পারদর্শিতা ছিল। পূর্বোক্ত উমরা বিনতে আবদুর রহমানের নিকট হযরত আয়েশা বর্ণিত যাবতীয় হাদীস পূর্বেই লিপিবদ্ধ করিয়া নিজের নিকট রাখিয়া দিয়াছিলেন। উমরা তাহার আপন খালা হইতেন।[********************]

কাযী আবূ বকর খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের আদেশানুক্রমে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও হাদীসের কয়েকখানী খণ্ড গ্রন্হ সংকলন করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু খলীফার ইন্তেকালের পূর্বে তাহা ‘দারুল খিলাফতে’ পৌঁছানো সম্ভবপর হইয়া উঠে নাই। এ সম্পর্কে আল্লামা সুয়ূতী ইবনে আবদুল বার লিখিত ‘আত-তামহীদ’ গ্রন্হের সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে হাযম কয়েক খণ্ড হাদীস- গ্রন্হ সংকলন করেন; কিন্তু তাহা খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিকট পাঠাইয়া দেওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

কিন্তু অতঃপর এই হাদীস- সংকলনসমূহের পরিণাম কি হইল? এই সম্পর্কে ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ আমি এই হাদীস গ্রন্হসমূহ সম্পর্কে কাযী আবূ বকরের পুত্র আবদুল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ ******************** তাহা সব বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে।[********************] কিন্তু ইহা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা খলীফা ইন্তেকাল করিয়া গিয়াছেন বলিয়াই সরকারী ব্যবস্থাপনায় তৈয়ার করা হাদীস সংকলনসমূহ বিনষ্ট হইয়া যাইবে, তাহার রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থাই হইবে না- এমন কথা হইতে পারে না। নিশ্চয়ই উহা জনগণের নিকট রক্ষিত ছিল এবং পরবর্তীকালে উহার ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে হাদীসের প্রচার করা হইয়াছে।

কোন কোন বর্ণনা হইতে এ কথা জানা যায় যে, খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয মদীনায় আবু বকর ইবনে হাযম ছাড়া সালেম ইবনে আবদুল্লাহকেও হাদীস সংগ্রহ করিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন। আল্লামা সুয়ূতী ইমাম জুহুরীর সূত্রে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয সালেম ইবনে আবদুল্লাহকে হযরত উমরের যাকাত ও সদকা সম্পর্কে রীতিনীতি লিখিয়া পাঠাইবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন।[********************]

ইমাম সুয়ুতী সালেম সম্পর্কে অতঃপর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সালেম যে বিষয়ে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা তিনি পুরাপুরি লিখিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি (সালেম) তাঁহাকে ইহাও লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, হযরত উমর (রা) তাঁহার আমলেও তদানীন্তন লোকদের মধ্যে অনুরূপ কাজ করেন তবে আপনি আল্লাহর নিকট উমর ফারূক হইতেও উত্তম ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত ও পরিগণিত হইবেন।[********************]

এই সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আনসারী বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয যখন খলীফা নির্বাচিত হইলেন, তখন তিনি মদীনায় রাসূলে করীমের ও হযরত উমরের যাকাত ইত্যাদি সংক্রান্ত লিখিত দস্তাবেজ সংগ্রহের জন্য তাকীদ কারিয়া পাঠাইলেন। পরে আমর ইবনে হাযমের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের লিখিত বস্তাবেজ এবং হযরত উমরের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের অনুরূপ লিখিত দস্তাবেজ পাওয়া গেল।[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।[********************]

ইমাম জুহরী সম্পর্কে উমর ইবনে আবদুল আযীয নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত ও হাদীস সম্পর্কে যুহরী অপেক্ষা বড় আলিম বিগত কালের আর একজনও বাঁচিয়া নাই।[********************]

এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী (র) নিজেই বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আমাদিগকে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করার জন্য আদেশ করিলেন। এই আদেশ পাইয়া আমরা হাদীসের বিরাট গ্রন্হ লিখিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিলাম। অতঃপর তিনি নিজেই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশে এক-একখানি গ্রন্হ পাঠাইয়া দিলেন।[********************]

সংগৃহীত হাদীস সম্পদ যে কিছুমাত্র বিনষ্ট হয় নাই, এই কথা হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।

ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম যিনি হাদীস সংকলন করেন, তিনি হইলেন ইবনে শিহাব যুহরী।[********************]

ইমাম আবদুল আযীয দারাওয়ার্দী নামক অপর এক মনীষীও এই কথারই সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংকলনও উহা লিপিবদ্ধকরণের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন ইবনে শিহাব যুহরী।[********************]

ইমাম যুহরী এই গৌরবের দাবি করিয়া নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার পূর্বে ইলমে হাদীস আর কেহ সংকলিত করেন নাই।[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয কেবল হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করণেরই নির্দেশ দেন নাই, বরং সর্বত্র উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্যও তিনি সুস্পষ্ট ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।

অপর একজন শাসনকর্তার নামে নিম্নোক্ত ভাষায় এক ফরমান প্রেরিত হইয়াছিলঃ

******************************************************

হাদীসবিদ ও বিদ্বান লোকদিগকে আদেশ করুন, তাঁহারা যেন মসজিদে মসজিদে হাদীসের শিক্ষাদান ও উহার ব্যাপক প্রচার করেন। কেননা হাদীসের জ্ঞান প্রায় বিলীন হইয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে।[********************]

উপরিউক্ত উদ্ধৃতি ও ঐতিহাসিক দলীল- প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথায় কোনই সন্দেহ থাকে না যে, উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাদীস-সংগ্রহ সম্পর্কিত ফরমান বিশেষ একটি মাত্র স্থানে প্রেরিত হয় নাই, বরং ইসলামী রাজ্যের সর্বত্রই এই ফরমান পাঠানো হইয়াছিল এবং উহার ফলে সর্বত্রই হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের অভিযান সুষ্ঠুভাবে শুরু হইয়া গিয়াছিল। এই অভিযানের অনিবার্য ফলস্বরূপ সর্বত্রই হাদীস সংকলিত হয়। সেই সময় জীবিত প্রায় সকল হাদীসবিদই হাদীস সংকলনের মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের সংকলিত বিরাট বিপুল সম্পদ মুসলিম সমাজের নিকট চিরকালের অমূল্য ধনরূপে গণ্য ও সংরক্ষিত হইয়া রহিয়াছে।

উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) অন্য লোকদিগকে আদেশ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি নিজেও হাদীস লিখিয়া লইবার কাজ শুরু করিয়াছিলেন, এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও হযরত আনাস হইতে হাদীস বর্ণনাকারী আবূ কালাবা [********************] বলিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয একদা জুহরের নামাযের জন্য মসজিদে আসিলে আমরা তাঁহার হাতে কিছু কাগজ দেখিতে পাইলাম। পরে আসরের নামাযের জন্য বাহির হইয়া আসিলেও তাঁহার সহিত সেই কাগজই দেখিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ হে আমীরুল মুমিনীন! এই লিখিত জিনিসটি কি? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ আওন ইবনে আবদুল্লাহ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, উহা আমার খুব পছন্দ হইয়াছে, আমি তাহা লিখিয়া লইয়াছি। তাহার মধ্যে এই হাদীসটিও রহিয়াছে।[********************]

ইমাম যুহরীর পরবর্তী সময়ে যাঁহারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে হাদীস সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মনীষিগণ উল্লেখযোগ্যঃ

মক্কা শরীফে ইবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); মদীনায় ইবনে ইসহাক (১৫১ হিঃ) ও ইমাম মালিক (১৭৯ হিঃ); বসরায় রুবাই ইবনে সুবাইহ (১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা (১৫৬ হিঃ) ও হাম্মাদ ইবনে সালমা (১৭৬ হিঃ); কূফায় সুফিয়ান আস-সওরী (১৬১ হিঃ); সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ী (১৫৬ হিঃ); ওয়াসত-এ হুশাইম (১৮৮ হিঃ); ইয়েমেন মা’মার (১৫৩ হিঃ); এবং খোরাসানে জরীর ইবনে আবদুল হামীদ (১৮৮ হিঃ); আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রা) (১৮১ হিঃ)।[********************]

উপরে প্রত্যেক নামের সঙ্গে উল্লিখিত সন তারিখ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, তাঁহারা সকলেই সমসাময়িক ও প্রায় একই যুগের লোক ছিলেন এবং একই সময়ের বিভিন্ন স্থানে থাকিয়া রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস সম্পদ সংগ্রহ ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন। কাজেই এই ব্যাপারে তাঁহাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে এই কাজ করিয়াছেন, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলার উপায় নাই। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী তাঁহাদের মধ্যে অগ্র-পরের একটি বিন্যাস কায়েম করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেন রুবাই ইবনে সুবাইহ ও সাদ ইবনে আবূ আরূবা এবং তাঁহাদের ছাড়া আরো কেহ কেহ। তাঁহারা হাদীসের প্রত্যেকটি অধ্যায়কে স্বতন্ত্রভাবে গ্রন্হাবদ্ধ করিতেন।[********************]

এই পর্যায়ে ইমাম মকহুলের নামও উল্লেখযোগ্য। কেননা তিনি গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ার পূর্বেই ‘কিতাবুস সুনান’ নামে হাদীসের একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

কূফা নগরে ইমাম শা’বী একই বিষয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একই স্থানে সন্নিবদ্ধ করার কাজে সর্বপ্রথম হাত দেন।[********************] প্রথমত তিনি হাদীস লিখন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু কেবলমাত্র খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনে আবদুল আযীযের নির্দেশ পাইয়াই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন শুরু করেন। কেননা তিনি কূফা প্রদেশে উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিযুক্ত বিচারপতি ছিলেন।[********************]

আল্লামা সুয়ূতী ইবনে হাজর আসকালানী হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

একই বিষয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্র সংকলন করার কাজ সর্বপ্রথম করেন ইমাম শা’বী। কেননা তাঁহার সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি ‘ইহা তালাক সম্পর্কে এক বিরাট অধ্যায়’ বলিয়া উহাতে বহু সংখ্যক হাদীস একত্রে লিখিয়াদিয়াছেন।[********************]

ইমাম শা’বী ২২ হিজরী সনে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের খিলাফত আমলে জন্মগ্রহণ করেন, আর ইন্তেকাল করেন ১০৪ হিজরীতে। ইমাম মকহুলের ইন্তেকাল হয় ১৩৪ সনে। আর ইমাম যুহরীও এই ১২৩, ১২৪ কিংবা ১২৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। এই হিসাবের ভিত্তিতে বলা যায়, হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইমাম মকহুল প্রথম ব্যক্তি।

কিন্তু বিশেষভাবে বিচার করিলে এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিতে হয় যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন মদীনার হাদীসবিদগণ- আবূ বকর ইবনে হাজম, সালেম ও ইমাম যুহরী প্রমুখ। আর অধ্যায় ভিত্তিতে হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন কূফার মুহাদ্দিসগণ- ইমাম শা’বী ও অন্যান্য।[********************]

উমাইয়া বংশের ‘খলীফায়ে রাশেদা’ উমর ইবনে আবদুল আযীয হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশিী দিন জীবিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁহার এই ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ তরংগায়িত হইয়িা উঠিয়াছিল, তাহা অতঃপর কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ইমাম যুহরীরর পরবর্তী মনীষী ও হাদীসবিদগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে পূর্ণমাত্রায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। অতঃপর এই কাজ পূর্ণোদ্যমে চলিতে থাকে।


হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন
উমর ইবনে আবদুল আযীয ১০১ হিজরীর ২৫শে রজব ইন্তেকাল করেন। তাঁহার খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বৎসর পাঁচ মাস। ইমাম শা’বী ইমাম যুহরী, ইমাম মকহুল দেমাশকী ও কাযী আবূ বকর ইবনে হাযমের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী তাঁহারই খিলাফতকালের অমর অবদান। প্রথম হিজরী শতকের মধ্যেই এই গ্রন্হাবলীর সংকলন কার্য সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল।

প্রথম হিজরী শতকে এই পর্যায়ে যতটুকু কাজ সম্পন্ন হইয়াছিল, পরিমাণে ও আকারে তাহা বিরাট কিছু না হইলেও উহার ফলে যে হাদীস গ্রন্হ-সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছিল, তাহা অনস্বীকার্য। ফলে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম হইতেই এই কাজ যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন হইতে শুরু করে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র রাসূল (স)- এর কথা ও কাজ সম্পর্কিত হাদীসই নহে, সাহাবায়ে কিরামের কথা, ফতোয়া, তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীসভিত্তিক বিভিন্ন ফতোয়া এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাঁহাদের কথাবার্তা ও নসীহতের বাণী পর্যন্ত এই যুগের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হইবার সুযোগ লাভ করে।

কিতাবুল আ’সর

তাবেয়ী যুগের মুহাদ্দিসদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী স্বীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লইয়া পরবর্তীকালের হাদীসানুধ্যায়ীদের নিকট পৌঁছায় নাই। এই দিক দিয়া আমাদের নিকট বিরাজমান কেবলমাত্র একখানি গ্রন্হেরই নাম করা যাইতে পারে এবং তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার। ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর সময়ে প্রতিষ্ঠিত [********************] কূফার জামে মসজিদের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষাগুরু নিযুক্ত হইয়া একদিকে যেমন ‘ইলমে ফিকাহ’র ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরদিকে সেই সঙ্গেই তিনি রাসূল (স)-এর আদেশ-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের ও একটি সংকলন নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত হাদীস সমূহের সমন্বয়ে রচনা করেন। এই গ্রন্হেরই নাম হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’। দুনিয়ার মুসলিম জাতির নিকট ইহা অপেক্ষা প্রাচীনতম হাদীস গ্রন্হ সম্ভবত আর একখানিও বর্তমান নাই। অথবা বলা যায়, মুসলিম উম্মতের নিকট মওজুদ হাদীস গ্রন্হাবলীর মধ্যে ইহাই সর্বাধিক প্রাচীন হাদীস-গ্রন্হ। ইমাম আবূ হানীফার পূর্বে হাদীস সংগ্রহকারিগণ কর্তৃক যেন-তেনভাবে হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করার কাজই হইয়াছিল। ঠিক গ্রন্হ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্হই বিরচিত হয় নাই। ইমাম শা’বী একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে একত্র করিয়া একখানি গ্রন্হের রূপ দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা মাত্র কয়েকটি অধ্যায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, ইহার বেশী কিছু করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এই কাজ অতঃপর আর অগ্রসরও হইতে পারে নাই। এই কারণে হাদীসসমূহকে পরিচ্ছেদ (কিতাব) ও অধ্যায় (বাব) হিসাবে, গ্রন্হ প্রণয়নের ধারা ও পদ্ধতি অনুসারে সুসংকলিত করার কাজ তখন পর্যন্তও অসম্পন্নই রহিয়া গিয়াছিল। ইমাম আবূ হানীফা (র) ‘কিতাবুল আ’সার’ প্রণয়ন করিয়া এই দায়িত্ব বিশেষ যোগ্যতা ও বিজ্ঞতা সহকারেই পালন করিয়াছিলেন। হাফেজ সুয়ূতী ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বিশেষ একটি কীর্তি-যাহাতে তিনি একক, তাহা এই যে, তিনিই সর্বপ্রথম ইলমে শরীয়াতকে সুসংবদ্ধ করিয়াছেন এবং উহাকে অধ্যায় হিসাবে সংকলিত করিয়াছেন। ইমাম মলিক (র) ‘মুয়াত্তা’ প্রণয়নে তাহারই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে সময়ের দিক দিয়া কেহই অতিক্রম করিয়া যাইতে পারেন নাই।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীস-গ্রন্হ বর্তমান। আর তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’; ইহা তাঁদের নিকট হইতে মুহাম্মদ ইবনে হাসান বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আলাউদ্দিন ‘কাশানী’ এই কিতাবের উল্লেখ করিয়াছেন ******************** ইমাম আবূ হানীফা (র) সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া।[********************]

‘কিতাবুল আ’সার’ নামক হাদীসগ্রন্হখানি প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও ছাঁটাই-বাছাই করিয়াছেন। সদরুল আয়িম্মা মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী তাঁহার গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) চল্লিশ সহস্র হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া ‘কিতাবুল আ’সার’-এর এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[******************** এখানে হাদীসের যে সংখ্যা বলা হইয়াছে, তাহা হাদীসের আলাদা আলাদা সংখ্যা নহে; বরং হাদীসের সূত্র মাও এবং এক-একটি হাদীসের বহু সংখ্যক সূত্র হইতে পারে।]

হাদীস চয়ন ও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে তাঁহার এই অসামান্য সতর্কতার কথা সকল হাদীস-পারদর্শী ব্যক্তিই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম ওকী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক যেরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছে, তদ্রুপ আর কাহারও দ্বারা অবলম্বিত হয় নাই।[ঐ, এখানে উল্লেখ্য, হাদীসের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান হাদীস যাচাই, পরখ ও বাছাই-ছাঁটাই শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************************** আল্লাহর নামের শপথ, মুসলিম উম্মত বা জাতির নিকট আল্লাহ ও রাসূলের নিকট হইতে পাওয়া সমস্ত ইলম-এর ক্ষেত্রে অধিক বড় আলিমরূপে স্বীকৃত।]

ঠিক এই কারণেই মনে হয় মুহাদ্দিমগণ ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সমালোচনা করিতে গিয়া তাঁহাকে ******************** ‘হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত কঠোর ও কড়া লোক’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন এবং এই কারণেই তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হইতে পারে নাই। ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুন ইহার কারণ বর্ণনা প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ এই যে, তিনি হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে কঠোর নৈতিক শর্ত আরোপ করিতেন।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংগ্রহীত হাদীসের বিপুলতা ও উহা সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করা সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর হইতে একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট কয়েক সিন্দুক ভর্তি লিখিত হাদীস-সম্পদ মজুদ রহিয়াছে। কিন্তু আমি তাহা হইতে অতি অর্প সংখ্যকই প্রকাশ ও বর্ণনা করিয়াছি, যাহা লোকদের ব্যবহারিক জীবনের উপকার দিবে।[********************]

অন্যান্য হাদীস গ্রন্হের ন্যায় ‘কিতাবুল আ’সার’-এর ‘নুসখা’ (অনুলিপি) রহিয়াছে। এই কারণে তাহা এক-একজন ছাত্রের নামেই প্রখ্যাত হইয়াছে। অন্যথায় মূল গ্রন্হ ইমাম আবূ হানীফারই সংকলিত একখানি মাত্র হাদীসগ্রন্হ। এই ‘নুসখা’ প্রকাশকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখযোগ্যঃ

১. ইমাম যুফার ইবনুল হুযাইলঃ এই সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

আহমদ ইবনে বকর যুফার ইবনুল হুযাইলের ছাত্র আবূ ওহাবের নিকট হইতে আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

২. ইমাম আবূ ইউসুফ ইবনে আবূ ইউসুফঃ তাঁহার সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে তাঁহার সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার পিতার সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা একখানি বিরাট আকারের গ্রন্হ।[কাজী আতহার মূবারকপুরী (বো’ই হইতে প্রকাশিত ‘আল বালাগ’ পত্রিাকর সম্পাদক) লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফার ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার ছাত্ররা অন্য লোকদের নিকট বর্ণনা করিয়াছেন এবং বর্ণনা করার সময় তাঁহারা নিজেরাও ইহাতে অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। এই কারণে মূল গ্রন্হখানি বিভিন্ন ছাত্রের নামে জনগণের মধ্যে পরিচিত হইয়াছে। অন্যথায় মুলগ্রন্হ ইমাম আবূ হানিফা (র)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্হ।********************]

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীঃ তাঁহার তৈরী করা সংকলনটিই প্রসিদ্ধ এবং ইহাই বর্তমান ভূলক্রমে ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া পরিচিত।

৪. ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ লু’লুয়ীঃ ইবনে হাজার আসাকালানী (র) ইহার সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবেন ইবরাহীমের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ‘কিতাবুল আ’সার’ মুহাম্মদ ইবনে শুজা তাহার ওস্তাদ হাসান ইবনে যিয়াদের সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]

মুয়াত্তা ইমাম মালিক

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’-এর পরে পরেই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ হিসাবে আমরা দেখিতে পাই ইমাম মালিক (র)-এর সংকলিত ‘মুয়াত্তা’।

কিতাবুল আ’সার ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র)-এর মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত গ্রন্হে হিজায, ইরাক, সিরিয়াও মুসলিম জাহানের অন্যান্য হাদীস-বর্ণনাকারী লোকদের বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে; কিন্তু ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ রহিয়াছে কেবলমাত্র মদীনায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীস। কেননা ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে পূর্ববর্তী আলোচনা হইতে আমরা দেখিয়াছি যে, তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার বাহিরে কখনো সফরে গমন করেন নাই।

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের ধারা এইভাবে সাজানো হইয়াছে যে, প্রথমে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস- কথা বা কাজের বিবরণ উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহার পর উহাতে সাহাবায়ে কিরামের কথা এবং তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীস ভিত্তিক ফতোয়াসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে।[********************]

ইমাম মালিক (র) হাদীসের এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন আব্বাসী খলীফা আল- মনসুর –এর আদেশক্রমে। মুহাম্মদ আবূ যাহু নামক এ যুগের একজন মিসরীয় গ্রন্হ-প্রণেতা লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর আল-মনসূর ইমাম মালিক (র)- কে ডাকিয়া বলিলেনঃ তিনি যেন তাঁহার নিজের নিকট প্রমাণিত ও সহীহরূপে সাব্যস্ত হাদীসসমূহ সংকলন ও একখানি গ্রন্হাকারে তাহা প্রণয়ন করেন এবং উহাকে যেন তিনি লোকদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার জন্য নির্দিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন করেন এবং উহার নাম নির্দিষ্ট করেন- ‘আল-মুয়াত্তা’।[********************]

ইমমা মালিক (র) এই গ্রন্হখানি প্রণয়নের অপরিসীম শ্রম-মেহনত ও অমলিন ধৈর্য ও অধ্যবসায় নিয়োগ করিয়াছিলেন। ইমাম সুয়ূতী ইবনুল হুবাব-এর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক (র) প্রথমে একলক্ষ বর্ণনা করেন। তাহা হইতে দশ হাজার হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ সংকলন করেন। অতঃপর তিনি উহাকে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যাঁচাই করিতে থাকেন। সাহাবীদের আ’সার ও অন্যান্য খবর-এর ভিত্তিতেও উহার পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত উহাতে মাত্র পাঁচশত হাদীস সন্নিবেশিত করেন।[********************]

ইমাম সুয়ূতী আতীক ইবনে ইয়াকুবের সুত্রে নিম্নোক্ত বর্ণনাও উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক প্রায় দশ সহস্র হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ রচনা করেন। অতঃপর তিনি উহার প্রত্যেক বৎসর দৃষ্টি দিতে ও যাঁচাই করিতে এবং উহা হইতে হাদীস প্রত্যাহার করিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বর্তমান আকারে উহা পূর্ণ পরিণীত লাভ করে।[********************]

এই গ্রন্হ প্রণয়ন চূড়ান্তভাবে সম্পূর্ণ করিতে ইমাম মালিকের পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর সময় লাগিয়াছে। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেন, ইমাম মালিক এই গ্রন্হখানি প্রণয়নে পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি উহাকে যাঁচাই ও ছাঁটাই করিতেছিলেন এবং উহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত, নির্ভূল ও শৃংখলিত করিতে ব্যস্ত ছিলেন।[********************]

এই গ্রন্হের নামকরণ সম্পর্কে ইমাম মালিক নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার এই কিতাবখানা আমি মদীনায় বসবাসকারী সত্তর জন ফিকাহবিদ-এর সম্মুখে পেশ করিয়াছি। তাঁহারা প্রত্যেকেই উহার জন্য আমাকে উপদেশ দিয়াছেন। এই কারণে আমি উহার নাম রাখিয়াছি ‘মুয়াত্তা’।[********************]

উপরে ইবনুল হুবাবের সূত্রে উল্লেখিত ইমাম সুয়ূতীর উদ্ধতি হইতে জানা গিয়াছে যে, ইমাম মালিক দশ হাজার হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া মাত্র পাঁচশত হাদীস তাঁহার গ্রন্হে রাখিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে মোট কতটি হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা যায় না। এই সম্পর্কে ইমাম সয়ূতীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়। তিনি আবূ বকর আল- আবরাহীর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

মুয়াত্তা গ্রন্হে রাসূলে করীম (স), সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে এক হাজার সাতশত বিশটি।[********************]

ইহার মধ্যে সঠিকরূপে সনদযুক্ত হাদীস হইতেছে মাত্র তিনশত, ‘মুরসাল’ হাদীস হইতেছে ২২২টি, ‘মওকুফ’ হইতেছে ৬১৬টি এবং তাবেয়ীদের উক্তি হইতেছে ২৮৫টি। [********************] ইমাম হাযম (র) বলেনঃ

******************************************************

আমি ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের হাদীসসমূহ গণনা করিয়াছি। ফলে উহাতে আমি পাইয়াছি ‘মুসনাদ’ হাদীস পাঁচশতের কিছু বেশী প্রায় তিনশত হাদীস ‘মরসাল’। এতদ্ব্যতীত উহাতে প্রায় সত্তরটি হাদীস এমনও আছে, যাহার অনুসরণ করা ইমাম মালিক (র) পরিহার করিয়াছিলেন।[********************]

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের নোসখা অসংখ্য। তন্মধ্যে তিনশত ‘নোসখা’ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই নোসখাসমূহে সন্নিবেশিত হাদীসের সংখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান- কোনটিতে অপেক্ষাকৃত বেশী, আর কোনটিতে কম হাদীস রহিয়াছে। ইমাম সুয়ুতী ইহার তিনটি নোসখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। নোসখা তিনটি এইঃ

১. ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া লাইসী আন্দালুসীকৃত নোসখাঃ তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে সরাসরিভাবে শেষ তিনটি অধ্যায় বাদে সম্পূর্ণ ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শবণ করিয়াছিলেন।

২. আবূ মুসয়িব আহমদ ইবনে আবূ বকর আল কাসিম কৃতঃ তিনি মদীনার বিচারপতি ছিলেন এবং তাঁহার তৈরী করা নোসখাই ইমাম মালিক (র)-কে সর্বশেষে শুনানো হয়। ইহাতে অপর নোসখার তুলনায় প্রায় একশতটি হাদীস বেশী রহিয়াছে।

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী কৃতঃ তিনি যেমন ইমাম আবু হানীফা (র)-এর নিকট ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করিয়াছেন, অনুরুপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হাইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন।[********************]
ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শ্রবণ করিয়া প্রায় এক হাজার ব্যক্তি উহার বর্ণনা করিয়াছেন।[********************] ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তদানীন্তন ইসলামী সমাজে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ যথাযথ মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। জনগণ উহাকে সাদরে গ্রহন করিয়াছিল এবং মদীনার অধিবাসী ইমাম মালিক (র)-এর নিকট সরাসরিভাবে উহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করার উদ্দেশ্যে গোটা মুসলিম জাহানের জনতা ভীড় জমাইয়াছিল। বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস এই কারণেই মনে করেন যে, তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত নবী করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম মালিক (র) সম্পর্কেই সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। হাদীসটি এই- নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সেই সময় খুব দূরে নয়, যখন জনগণ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে উষ্ট্রপৃষ্ঠে সাওয়ার হইয়া দূর দূর দেশ সফর করিবে; কিন্তু তাহারা মদীনায় অবস্থানকারী ‘আলেম’ অপেক্ষা অধিক বিজ্ঞ অন্য কাহাকেও কোথাও পাইবে না।[********************]

ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলিয়াছেন যে, এই হাদীসে উক্ত ‘আলেম’ হইতেছেন ইমাম মালিক (র)।[তিরমিযী, হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত।]

‘মুয়াত্তা’ ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন ও ইহাকে এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ মনে করিতেন। তাঁহার এই সম্পর্কিত নিম্নোদ্ধৃত উক্তি সর্বজনবিদিত। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাবের পর ইমাম মালিক (র) সংকলিত হাদীসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্হ দুনিয়ার বুকে আর একখানিও নাই।[********************]

তাঁহার এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায়ও বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

কুরআনের অধিকতর নিকটবর্তী কিতাব ইমাম মালিক (র)-এর কিতাব অপেক্ষা আর একখানিও পৃথিবীর বুকে রচিত হয় নাই।[********************]

পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ জারয়া মুয়াত্তা মালিক (র) সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এতখানি আস্থা ও নির্ভরতা অপর কোন কিতাবের উপর স্থাপিত হয় নাই।[********************]

ইমাম মালিক সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হ এতই জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল যে, তদানীন্তন আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মনসুর হ্জ্জ উপলক্ষে মদীনায় গমন করিলে তিনি ইমাম মালিক (র)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি সংকল্প করিয়াছি যে, আপনার সংকলিত হাদীস গ্রন্হখনির অসংখ্য অনুলিপি তৈয়ার করাইয়া প্রত্যেক মুসলিম শহরেও নগরে এক-একখানি করিয়া পাঠাইয়া দিব ও সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে আদেশ করিব। এবং উহাকে ছাড়িয়া অপর কোন গ্রন্হের দিকে মনোযোগ না দিতে বলিব।

এই কথা শ্রবণের পর ইমাম মালিক (র)-এর মনে আনন্দ ও স্ফূর্তির বন্যা প্রবাহিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-ইহা মোটেই পছন্দ করিতে ও মানিয়া লইতে পারিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি এইরূপ কাজ করিবেন না। কেননা লোকরেদ নিকট পূর্বেই শরীয়াতের বহু কথা পৌঁছিয়া গিয়াছে। তাহারা বহু হাদীস শ্রবণ করিয়াছে, বহু হাদীস তাহারা বর্ণনা ও করিয়াছে এবং লোকেরা প্রথমেই যাহা কিছু পাইয়াছে, তাহাই তাহারা গ্রহণ করিয়া লইয়াছে, তদানুযায়ী তাহারা আমল শুরু করিয়া দিয়াছে। অতএব প্রত্যেক শহর ও অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের জন্য যাহাই গ্রহণ করিয়াছে তদানুযায়ীই তাহাদিগকে আমল করিতে দিন।[********************]

অতঃপর বাদশাহ হারুন-অর-রশীদও ‘মুয়াত্তা’ মালিক (র) সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি উহাকে কা’বা ঘরের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখার ও তদানুযায়ী আমল করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-এর নিকট ইহার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

না, আপনি এইরূপ করিবেন না। কেননা রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে খুঁটিনাটি ব্যাপারে মত-পার্থক্য রহিয়াছে, তাঁহারা বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। আর তাহারা সকলেই সঠিক পথে পরিচালিত।[********************]

ইসলামের বিরাট ও ব্যাপক জীবন-ব্যবস্থার খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতভেদ হওয়া অতি স্বাভাবিক। ইহার পথ বন্ধ করিয়া দিয়া সকল মানুষকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট একটি মতের অনুসারী করিতে চেষ্টা করা ও সেজন্য রাজ-ক্ষমতার ব্যবহার করা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না। বরং ইসলামী বিধানভিত্তিক সকল (খুঁটিনাটি) মতকেই- তাহা বাহ্যত যতই পরস্পর-বিরোধী মনে হউক না কেন, সত্য ও সঠিক বলিয়া স্বীকার করাই হইতেছে ইসলামের নীতি। ইমাম মালিক (র)-এর উপরোক্ত উক্তি হইতেও এই কথা প্রমাণিত হয়। ইমাম মালিক (র)-এর এই নীতি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত ও ইনসাফপূর্ণ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইমাম ইবনে আবদুল বার (র) এই নীতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সমঝদার লোকদের জন্য ইহা এক অতি ইনসাফপূর্ণ নীতি, সন্দেহ নাই।[********************]

ফিকাহর খুঁটিনাটি মাসলা লইয়া যাঁহারা সীমালংঘনকারী গোঁড়ামীতে লিপ্ত রহিয়াছেন ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিজস্ব একটি বিশেষ মতকে জোরপূর্বক অন্যান্য মানুষের মাথায় চাপাইয়া দিবার জন্য অনমনীয়, ইমাম মালিক (র)- এর উপরোক্ত ভূমিকায় তাঁহাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিহিত রহিয়াছে।

জামে সুফিয়ান সওরী (র)

ঠিক এই সময়ই ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ‘আল-জামে’ নামে প্রণয়ন করেন। সুফিয়ান সওরী (র) ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অনুষ্ঠিত দারসের মজলিসে রীতিমত হাযির থাকিতেন এবং তাঁহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করিতেন। কিন্তু ফিকাহ তিনি গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম আবূ হানীফার বিশিষ্ট ছাত্র আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে। আলী ইবনে মসহর ছিলেন ফিকাহ ও হাদীস উভয়েরই বিশিষ্ট সুদক্ষ আলিম। তাঁহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাদীস ও ফিকাহ- উভয়েরই পরদর্শী ছিলেন।[********************]

ইমাম সাওরী তাঁহারই সাহায্য ও সহযোগীতা লইয়া তাঁহার জামে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম ইয়াযীদ ইবনে হারূন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুফিয়ান সওরী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ফিকাহ গ্রহণ করিতেন আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে এবং তাঁহারই সাহায্য এবং তাঁহার সহিত আলাপ-আলোচনা করিয়াই তিনি তাঁহার ‘জামে’ নামক হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]

এককালে সুফিয়ান সওরীর এই ‘আল-জামে’ কিতাখানি হাদীসবিদদের নিকট বড়ই প্রিয় ও বহুল পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। ইমাম বুখারী (র) সর্বপ্রথম যেসব হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছেন, তন্মধ্যে এই ‘আল-জামে’ গ্রন্হ অন্যতম।

ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (র)-এর নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছিলঃ

******************************************************

গ্রন্হদ্বয়ের মদ্যে কোনখানি অধিকতর উত্তম, ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ না সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’?

তিনি অবশ্য জওয়াবে ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’কে উত্তম কিতাব বলিয়াছিলেন।[********************] কিন্তু ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী (সুনান প্রণেতা) ইহা হইতে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই পর্যায়ে লোকেরা যত গ্রন্হই প্রণয়ন করিয়াছেন, সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’ তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম গ্রন্হ।[********************]

উপরে এই সময় পর্যন্ত সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকখানির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ কর হইয়াছে, কিন্তু এই শতকের বিস্তারিত ইতিহাস প্রমাণ যে, এই সময়ে কেবলমাত্র এই কয়েকখানি গ্রন্হই সংকলিত হয় নাই। বরং এতদ্ব্যতীত আরো কয়েকখানি হাদীস-গ্রন্হ সংকলিত হইয়াছে। কিন্তু সেই গ্রন্হসমূহ উপরোল্লিখিত গ্রন্হ কয়খানি হইতে সরাসরি ও বিশেষ সাহায্য গ্রহণের মারফতেই সংকলিত হইয়াছে বলিয়া উহাদের সবিশেষ উল্লেখ করা হয় না।

এই সময় দুইজন গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ মুহাদ্দিসের আবির্ভব ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁহাদের দুইজনেরই নাম আবূ হাফস এবং তাঁহারা হইতেছেন পিতা ও পুত্র। পিতা-পুত্রের একই নাম হওয়ার কারণে তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করার উদ্দেশ্যে পিতাকে আবূ হাফস কবীর (বড়) এবং পুত্রকে আবূ হাফস সগীর (ছোট) বলিয়া সম্ভোধন করা হয়। এইযুগে ইলমে হাদীসের প্রচার ও প্রসারকার্যে এই দুইজনের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁহারা বুখারার প্রদান মুহাদ্দিসদের মধ্যে গন্য এবং তাঁহাদের প্রচেষ্টায়ই বুখারার সমস্ত এলাকায় ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে, ঘরে ঘরে উহার চর্চা, শিক্ষা ও আলোচনা শুরু হয়। হাফেজ সাময়নী আূ হাফস কবীর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার নিকট হইতে এত লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহার সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়।[********************]

বস্তুত বুখারার প্রতিটি গ্রামে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়াছিল। খাইজাখীজ নামক গ্রামেও তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ইলমে হাদীসের চর্চায় নিযুক্ত ছিল।[********************]

ইমাম আবূ হাফস ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের নিকট হইতে ইলমে হাদীস ও ফিকাহ শিক্ষা করেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হাফস কবীর ইমাম মুহাম্মদের প্রধান ছাত্রদের মধ্যে গণ্য ছিলেন এবং বুখারার হানাফী আলিমদের নের্তৃত্বের তিনিই ছিলেন শেষ স্তম্ভ।[********************]

ইসলামের ইতিহাসে ইহা এমন এক পর্যায়ে, যখন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ও ইতিহাস-ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গ্রন্হ-প্রণয়নের কাজ সম্পাদিত হয়। ঐতিহাসিক সুয়ূতী লিখিয়াছেনঃ এই সময় ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিকের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত ও দীক্ষিত অসংখ্য লোক ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র স্থাপন করিয়া উহার ব্যাপাক শিক্ষাদান ও প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আবূ হানীফার ছাত্রদের প্রকৃত সংখ্যা কত হাফেয আবদুল কাদের কুরায়শীর নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনা হইতে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে প্রায় চার সহস্র ব্যক্তি হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কীয় তাঁহার মত বর্ণনা ওপ্রচার করিয়াছেন।[********************]

ইমাম হাজেজুদ্দীন ইবনুল বাযযায কুরদারী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর বিপুল সংখ্যক ও মুসলিম জাহানের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ছাত্রদের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করিয়াছেন। উহার শিরোনামায় নিম্নোদ্ধৃত কথা লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার শহরে-শহরে বিক্ষিপ্ত ঐসব লোক, যাঁহারা ইমাম আবূ হানীফার নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহ বর্ণনা করিয়াছেন।

অতঃপর তিনি তদানীন্তন মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি উল্লেখযোগ্য প্রদেশ, শহর, নগর, ও গ্রামের নাম লিখিয়া তথায় ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর কোন কোন ছাত্র হাদীস ও ফিকাহ প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষা লাভের পর যেসব মনীষী স্বাধীন ও নিজস্বভাবে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহদের সম্পর্কে ইমাম তাহাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর যেসব ছাত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহারা হইতেছেন, চল্লিশজন। তাঁহাদের প্রথম পর্যায়ের দশজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ ইমাম আবূ ইউসুফ, ইযুফার, ইমাম দাউদ-আত্তায়ী, ইমাম আসাদ ইবনে আমর, ইমাম ইউসুফ ইবন খালিদ সিমতী, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবেন আবূ যায়েদা। আর এই শেষোক্ত ব্যক্তি তো ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের লেখক হইয়া কাজ করিয়াছেন।[********************]

তাঁহারা সকলেই খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম হাসান ইবেন যিয়াদও এই পর্যায়েরই একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি ইবনে জুরাইজ-এর নিকট হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইবনে জুরইজের নিকট হইতে বারো হাজার হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলাম। এই হাদীসসমূহ ফিকাহবিদদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।[********************]

মোটকথা, ইমাম যুহরীর অব্যবহিত পর হইতেই হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এক দুই কূলপ্লাবী সয়লাব প্রবাহিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই এই কাজ আরম্ভ হইয়া যায়। এই সময়কার অন্যান্য গ্রন্হ প্রণেতা হইতেছেনঃ

মক্কায় এবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); ইবনে ইসহাক (১৫২ হিঃ); মদীনায় সায়ীদ ইবনে আবূ আরুজা (১৫৬ হিঃ); রুবাই ইবনে দুবাই (১৬০ হিঃ) ও মালিক ইবনে আনাস (‌১৭৯ হিঃ) বসরায় হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (১৭৬ হিঃ) ও ইবনে আরূবা; কুফায় সুফিয়ান সওরী (১৬১ হিঃ) সিরিয়ায় আবূ আমর আওযায়ী (১৫৬ হিঃ) ওয়াসতে হুশাইম (১৮৮ হিঃ); লাইস ও ইবনে লাহইয়া’ খুরাসানে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১ হিঃ) ইয়ামেনে মা’মর (১৫৩ হিঃ) রায় শহরে জরীর ইবনে আবদুল হামিদ (১৮৮ হিঃ) তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।[********************]

তাঁহারা সকলেই প্রায় একই যুগের লোক এবং সমমাময়িক; দ্বিতীয় হিজরী শতকের তাঁহারা শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ।[********************] আর তাঁহাদেরই অবিশ্রান্ত সাধনা ও আন্তরিক গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ গবেষণা ও যাচাই পরীক্ষা চালনার ফলেই হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিতে ইলমে ফিকাহদের বিরাট প্রাসাদ রচিত হয়।

অনুরূপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণও মুসলিত জাহানের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ছড়াইয়া পড়েন। তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানে নিযুক্ত হইয়াছেন এমন লোকের সংখ্যা কত? খতীব বাগদাদী বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বলিয়াছেন ৯৩; কিন্তু হাফেয কাযী ইয়ায লিখিয়াছেনঃ এক হাজার তিন শতেরও অধিক।[********************]

ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৫ হিঃ); আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম (মৃঃ ১৯১ হিঃ) ও আশহুব (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুদক্ষ ওউচ্চমানের গ্রন্হ রচয়িতা ছিলেন। হাফেজ যাহবী বলিয়াছেন, ইবনে ওহাব এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বর্ণনা করিতেন। আর তাঁহার সংকলিত গ্রন্হাবলীতে এক লক্ষ বিশ হাজার হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************] ইবনুল কাসেমও হাদীসের হাফেজ ছিলেন এবং ইমাম মালিক (র)-এর ‘ফিকহ’ যাঁহারা বর্ণনা ও প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে তিনি প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।[********************]

উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা হইতে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই হাদীসের অসংখ্য সংকলন তৈয়ার হইয়া সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। সেই সঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণ হাদীসের বিপুল জ্ঞান-সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া গোটা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। উহার প্রচার ও শিক্ষাদানের ব্রতে আত্মনিয়েঅগ করিয়াছিলেন।


হিজরী তৃতীয় শতকে হাদীস চর্চা
হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীস পূর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি, অগ্রগতি, প্রসারতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। এই হাদীস একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহার এক-একটি বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়।

এই শতকের মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীসের সন্ধানে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করেন; মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রে খুঁজিয়া আঁতি-পাতি করিয়া ছাড়েন। এক-একটি শহর, এক-একটি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছিয়া বিক্ষিপ্ত হাদীসসমূহকে এক করেন। পূর্ণ সনদ সম্পন্ন হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেন। সন্দ ও বর্ণনা সূত্রের ধারাবাহিকতা এবং উহার বিশুদ্ধতার উপর পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন। এই প্রয়োজনে ‘আসমা-উর-রিজাল’ এর স্বতন্ত্র জ্ঞান-বিভাগ হিসেবে সংকলিত ও বিরচিত হয়। হাদীস যাচাই-পরীক্ষা, ছাঁটাই-বাছাই ও সত্য মিথ্যা নির্ধারণের সূক্ষ্ম তত্ত্ব একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে। প্রখ্যাত ‘সিহাহসিত্তাহ’ (ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্হ)-ও এই শতকেই সংকলিত হয়।

এই শতকে একদিকে যেমন হাদীস সংগ্রহ, সংকলন, গ্রন্হ প্রণয়ন ও হাদীস-সম্পর্কিত জরুরী জ্ঞানের অপূর্ব উদ্ভাবন হয়, অপরদিকে মুসলিম জনগণের মধ্যে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার অদম্য উৎসাহ এবং বিপুল আগ্রহ ও পরিলক্ষিত হয়। এক-একজন হাদীস শিক্ষাদাতার সম্মুখে দশ দশ হাজার ছাত্র হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে সমবেত হইত ও আসন গ্রহণ করিত। হাফেয যাহবী অষ্টম পর্যায়েরএকশত ত্রিশজন মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহাদেরই সমপর্যায়ের বড় এক জামা’আত হাফেযে হাদীস- এর কথা উল্লেখ করিলাম না।এই সময় এক-একটা দরসে হাদীসের বৈঠক দশ হাজার কিংবা ততোধিক দোয়াতএকত্র হইত। লোকেরা রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস লিপিবদ্ধ করিতেন এবং এইরূপ মর্যাদা সহকারেই তাঁহারা ইহার প্রতি পূর্ণ লক্ষ্য দিতেন। তাহাদের মধ্যে দুইশত লোক ছিলেন হাদীসের ইমাম। তাঁহারা যেমন হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়ার যোগ্য ছিলেন, তেমনি তাঁহারা প্রকাশ্যভাবে ফতোয়া দেওয়ার কাজও শুরু করিয়াছেন।[********************]

উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে যে দশ সহস্র ছাত্র উপস্থিত থাকার কথা বলা হইয়াছে, তাহা অতি সাধারণ ও প্রাথমিক পর্যায়ের হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র সম্পর্কেই প্রযোজ্য হইতে পারে। কেননা হাদীসের বড় ও বিশিষ্ট ইমাম এবং হাফেযদের দরসের মজলিসে ইহাপেক্ষাও বহুগুণ বেশী- এক লক্ষ পর্যন্ত হাদীস শিক্ষার্থী সমবেত হইত এরূপ উল্লেখ পাওযা যায়। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ছাত্র ইমাম হাফেজ আবুল হাসান আলী ইবনে আসেম ওয়াস্তীর দরসে হাদীসের মজলিসে ত্রিশ সহস্রাধিক ছাত্র একত্র হইত।[********************]

হাসান ইবনে আসিমের হাদীস শিক্ষা লাভের পশ্চাতে এক ঘটনার উল্লেক করা হয়। তাঁহার পিতা তাঁহাকে এক লক্ষ মুদ্রা দিয়া বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

তুমি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাত্রা কর; অন্তত এক লক্ষ হাদীস শিক্ষা করিয়া না আসা পর্যন্ত আমি তোমার মুখ দেখিতে চাই না।

অতঃপর তিনি বিদেশে চলিয়া যান ও হাদীস শিক্ষার এতদূর ব্যুৎপত্তি লাথ করেন যে, শেষ পর্যন্ত হাদীস-পারদর্শিতার প্রতীক হিসাবে ‘মুসনাদুল ইরাক’ ও ‘আল-ইমামুল হাফেজ’ প্রভৃতি খেতাব লাভ করিয়া পিতার নিকট প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতেও হাদীস শিক্ষা করিয়াছিলেন।[********************]

তাঁহারই পুত্র ইমাম আবূ হুসাইন আসিম ইবনে আলী ওয়াস্তী (মৃঃ ২১২ হিঃ) ইমাম বুখারীর ওস্তাদ। বুখারী শরীফে তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। তাঁহার সম্পর্কে হাফেয যাহবী লিখিয়াছেনঃ

তিনি বাগদাদে উপস্থিত হইয়া হাদীস লিখাইতে শুরু করিলেন।ফলে তাঁহার নিকট শিক্ষার্থী জনতার এক বিরাট ভীড় জমা হইয়া গেল।[********************]

আবূল হুসাইন ইবনুল মুবারক (র) বলেনঃ তাঁহার দরসের মজলিসে লক্ষাধিক লোক জমায়েত হইত। হারূন নামক এক ব্যক্তি খেজুর গাছের মাথায় উঠিয়া দূর দূর পর্যন্ত তায়হার আওয়াজ পৌঁছাইবার কাজ করিতেন। এই মজলিসে লোকের সংখ্যা অনুমান করিয়া বুঝা গেল যে, এক লক্ষ বিশ হাজারের কম হইবে না।[********************]

ইয়াযীদ ইবেন হারূন ইমাম আজম আবূ হানীফার অপর একজন ছাত্র। তিনি হাদীসের একজন বিশেষজ্ঞ ও বিপুল সংখ্যক হাদীসের হাফেয ছিলেন। তিনি বাগদাদে হাদীসের দরস দিতেন। তাঁহার দরসের মজলিসৈ সত্তর হাজার ছাত্র সমবেত হইত।[********************]

বাগদাদের প্রসিদ্ধ ‘হাফেযে হাদীস’ সূলায়মান ইবনে হারব (মৃঃ ২২৪ হিঃ)। তাঁহার দরসের বৈঠকে চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী উপস্থিত হইত। বাদশাহ মামুনের প্রাসাদের সন্নিকটে একটি উচ্চ মিম্বর নির্মাণ করা হইয়াছিল। সুলায়মান উহার উপর আসন গ্রহণ করিয়া হাদীসের দারস দিতেন। বাদশাহ ও রাজন্যবর্গ ছাড়াও বিপুল সংখ্যক জনতা মজলিসে উপস্থিত থাকিতেন।[********************]

‘সুনান’ প্রণেতা হাফেজ আবূ মুসলিম কাজী (মৃঃ ২৯২ হিঃ) যখন বাগদাদের ‘গামান’ চকে হাদীস লিখাইবার মজলিস অনুষ্ঠান করিতেন, তখন এত বিপুল জনতা সমবেত হইত যে, সাত ব্যক্তিকে পরস্পরের সাহায্যে বহু দুরবর্তী লোকদের নিকটে আবূ মুসলিমের মুখ-নিসৃত কথা পৌঁছাইবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইত। মজলিস শেষ হইয়া যাওয়ার পর একবার কেবলমাত্র দোয়াত-কলম সহ লিখিয়া লইবার উদ্দেশ্যে আগত লোকদের সংখ্যা গণনা করিয়া দেখা গেল যে, তাহারাই ছিল অন্যূন্য চল্লিশ হাজার। আর যাহারা শুধু শ্রবণের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাদের সংখ্যা ছিল অগণিত।[********************]

হাফেজ জাফর ফরইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) বাগদাদের ‘মানার’ রাজপথে দরসে হাদীসের যে মজলিস করিয়াছিলেন,তাহাতে কমপক্ষে ত্রিশ সহস্র জনতা উপস্থিত হইয়াছিল।[********************]

ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী যখন কূফা নগরে হাদীসের দরস দিতেন তখন জনতার ভীড়ে নগরীর রাজপথ বন্ধ হইয়া যাইত।[********************]

ইমাম ইবন মাজাহ (র)-এর ওস্তাদ হাফেয আবূ বকর ইবনেস আবূ শায়বাহ এবং তাঁহার ভ্রাতা উসামান ইবনে আবূ শায়বাহ উভয়েই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহাদের হাদীসের দরসেও অন্যূন্য ত্রিশ সহস্র লোক একত্র হইত।[********************]

বস্তুত তৃতীয় হিজরী শতকে হাদীস শিক্ষালাভের জন্য ইসলামী জনতার মনে যে কি বিপুল উৎসাহ এবং উদগ্র পিপাসা বিদ্যমান ছিল, তাহা পূর্বোল্লেখিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী হইতে সুস্পষ্টরূপে ধারণা করা চলে। উপরন্তু এই যুগে হাদীসে পারদর্শী ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানকারী লোক যে মুসলিম জাহানে কত ছিলেন, তাহার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নহে। ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী লিখিয়াছেনঃ ‘তৃতীয় শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে ইবরাহীম ফরাহীদী (মৃঃ ২২২ হিঃ) প্রায় এক হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; কিন্তু এইজন্য তাঁহার নিজ শহরের বাহিরে বিদেশ সফর করার কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নাই।[********************]

এই কারণে এই যুগের মুহাদ্দিসগণের উস্তাদের সংখ্যা বিপুল ও অত্যাধিকই। এক একজন মুহাদ্দিসের উস্তাদের সংখ্যা সহস্রাধিক হইয়াছে। অনেকে আবার চার হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করিয়াছিলেন। ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘আমি চার হাজার মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছি। তন্মধ্যে মাত্র এক হাজার মুহাদ্দিসের সনদে আমি হাদীস বর্ণনা করিয়াছি।[********************]

হাফেয শামুসুদ্দীন যাহবী তাঁহার গ্রন্হ তাযকিরাতুল হুফফাজ-এ নবম পর্যায়ের একশত ছয়জন হাদীসের হাফেয সম্পর্কে আলোচনা করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই যুগে এবং ইহার কাছাকাছি সময়ে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস পারদর্শী বহু সংখ্যক ইমাম বর্তমান ছিলেন। আমি তাঁহাদের একদশমাংশেরও এখানে উল্লেখ করিতে পারিলাম না। আমার লিখিত ইতিহাস গ্রন্হে তাঁহাদের অধিকাংশেরই উল্লেক করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম বুখারীও এই তৃতীয় শতকেই শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এক হাজার আশি জন উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছি। তাঁহাদের প্রেত্যেকেই বড় বড় মুহাদ্দিস ছিলেন।[********************]


তৃতীয় শতকের হাদীস সমৃদ্ধ শহর
তৃতীয় হিজরী শতকে ইলমে হাদীসের অপূর্ব উৎকর্ষ সাধিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি বড় বড় শহরেই তখন- শহর হইতে দূরবর্তী গ্রামে পর্যন্ত হাদীসের ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদান হইতেছিল। তন্মধ্যে কতকগুলি শহর ছিল হাদীসের সর্বাপেক্ষা বড় কেন্দ্র। তথায় স্থানয়ভাবে যেমন বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিস হাদীস প্রচার করিতেন, অনুরূপভাবে হাদীস অনুসন্ধানকারী ও সংগ্রহক মুহাদ্দিসগণ এই সব শহরে আগমন করিয়া হাদীস শ্রবণ করিতেন ও তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া লইতেন। এই সময় মুহাদ্দিসগণ হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যেসব শহর ও স্থান পরিভ্রমন করিয়াছেন, সে সবের সংখ্যঅ অন্যূন পঞ্চাশ হইবে। হাফেয যাহবী এই শহর ও স্থানসমূহের নাম এবং উহাদের বিবরণ উল্লেখ করিয়া একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্হ রচনা করিয়াছেন। উহার নাম হইলঃ

********************- হাদীস- সমৃদ্ধ শহরসমূহ।

এই হাদীস-কেন্দ্রসমূহের মধ্যে কয়েকটি শহর আবার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই গুলির নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক ইমাম ইবনে তায়মিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই হাদীস-কেন্দ্রসমূহের মধ্যে কয়েকটি শহর আবার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই গুলির নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক ইমাম ইবনে তায়মিয়া লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মক্কা-মদীনা, কূফা-বসরা ও সিরিয়া – এই পাঁচটি শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীট; এইসব শহর হইতেই নবীর প্রচারিত জ্ঞান- ঈমান, কুরআন ও শরীয়াত সম্পর্কিত ইলম-এর ফল্গুধারা উৎসারিত হইয়াছে।[********************]

আমরা এখানে এই পাচঁটি শহর সম্পর্কে বিবরণ পেশ করিতে চাহি।

মদীনা

মদীনা বিশ্বনবীর কর্মজীবনের শেষ ভাগের কেন্দ্রস্থান দারুল হিজরাত; নবুয়্যাতী ইলম- এর আকর ও উৎস হইবার গৌরব কেবলমাত্র এই শহরের ভাগ্যলিপি। এ কারণে এই শহরের অপর নাম হইতেছে দারুস-সুন্নাত এবং ইহা যে খুবই উপযুক্ত নাম তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।[********************] নবী করীম (স)-এর সময় হইতে হযরত আলী (রা)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত ইহাই ছিল সমগ্র মসলিম জাহানের জ্ঞান ও কর্মের কেন্দ্রস্থল। উত্তরকালে ইমাম মালিক (র)-এর সময় পর্যন্ত ইহার এই মর্যাদা অক্ষুণ্ন ছিল। শেষ পর্যন্ত এই শহরের অধিবাসী ছিলেন নাফে; ইবরাহীম ইবনে সায়াদ; সুলায়মান ইবনে বিলাল ও ইসমাঈল ইবনে জাফর। [********************] তাঁহাদেরও পরে ছিলেন হাফেয আবূ মুসয়িব যুহরী, হাফেয ইবরাহীম ইবনুল মুসযির এবং হাফেয ইসহাক ইবনে মুসা আল-আনাসারী।

হাফেয আবূ মুসয়িব যুহরী সম্পর্কে হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য একজন হাদীস বর্ণনাকারী, মদীনাবাসীদের জন্য হাদীসের উস্তাদ, বিচারপতি এবং মুহাদ্দিস।[********************]

তিনি ১৫০ হিরজী সনে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং ২৪২ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। ইমাম নাসায়ী ব্যতীত সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচজন প্রণেতারই তিনি ওস্তাদ ছিলেন।

হাফেজ ইবরাহীম সম্পর্কে যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম বড় মুহাদ্দিস এবং নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী।

তিনি ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসায়ীর উস্তাদ ছিলেন। হিজরী ২৩৬ সনে মদীনায় ইন্তেকাল করেন।[********************] হাফেজ ইসহাক সম্পর্কে যাহবী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ফিকাহবিদ, হাদসের হাফেজ এবং নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী।

তিনি ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাযাহর হাদসের ওস্তাদ ছিলেন। ২৪৪ সনে তাঁহার ইন্তেকাল হয়।[********************]

এই তিনজনই হাদীসের বড় হাফেজ ও উস্তাদ ছিলেন। তাঁহাদের ছাড়াও বাকর ইবনে আবদুল ওহহাব মাদানী (মৃঃ ২৫০ হিঃ) হাসান ইবনে দাউদ (মৃঃ ২৪৭ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে উবায়দ মাদানী উল্লেখযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন।

মক্কা

এই শহরেই রাসূলে করীম (স)-এর প্রতি ওহী নাযিল হইতে শুরু হইয়াছিল। এখানেই তাঁহাকে নবী ও রাসূলরূপে নিয়োজত নিয়োজিত করা হয়। অতঃপর নবী করীম (স) দীর্ঘ তেরোটি বৎসর প্রাণন্তকর সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়া এই শহরেই অতিবাহিত করিয়াছেন। সাহাবীদের যুগে এখানে ইলমে হাদীসের চর্চা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। সাহাবীদের শেষ যুগ এবং তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের আমলে এখানে বিশিষ্ট মুহাদ্দিসের আবাসকেন্দ্র ছিল। মুজাহিদ, আতা, সায়ীদ ইবনে যুবাইর, ইবনে আবূ মূলাইকা এখানেই বসবার করিতেন ও হাদীস লিক্ষাদানের কাজ করিয়াছেন। উত্তরকালে এখানে আবদুল্লাহ ইবনে আবূ নযীহ, ইবনে কাসিম, হানযালা ইবনে উয়াইনা, আবূ সুফিয়ান, ইবনে জুরাইজ এবং মুসলিম জঞ্জী, ফুযায়ল ইবনে উয়াইন, আবূ আবদুর রহমান মূকরী, আজরাকী, হুমাইদী ও সায়ীদ ইবনে মনসুর প্রমুখ খ্যাতনামা মুহাদ্দিস বসবাস করেন।[********************]

তৃতীয় হিজরী শতকে মক্কা শহরে ইলমে হাদীসের চর্চা যদিও মদীনার মত ব্যাপক ছিল না, তথাপি হাদীস প্রদীপ তখনো তথায় প্রজ্বলিত ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই শতকে তথায় বেশ কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস জীবিত থাকিয়া হাদীস শিক্ষাদান ও প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ

১। হাফেজ হালওয়ানী ইমাম আবূ মুহাম্মদ হাসান ইবন আলী ইবনে মুহাম্মদুল খাল্লাল। শেষ জীবন তিনি মক্কাতেই অতিবাহিত করেন। তিনি ‘মুহাদ্দিসে মক্কা’ নামে প্রখ্যাত হইয়াছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাদীসের গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন এবং এজন্য বহু কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করিয়াছেন।

ইবনে আদী উল্লেখ করিয়াছেন যে, তিনি ‘কিতাবুস সুনান’ নামে হাদীসের একাখানি গ্রন্হ সংকলন করিয়াছিলেন। ২৪২ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

২। হাফেজ যুবায়র ইবনে বাক্কার- আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ বকর কুরায়শী। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে আলোচনা শুরু করিয়াছেন এই বলিয়াঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম, হাফেজ, নসব বিশেষজ্ঞ ও মক্কার বিচারপতি।

তিনি ইমাম ইবনে মাজাহর ওস্তাদ। ২৫৬ হিজরীতে তিনি মক্কাতেই ইন্তেকাল করেন।[********************]

৩। হাফেয সালাম ইবনে শুবাইব- আবূ আবদুর রহমান আল-হুজুরী আল-মাসময়ী। আসলে তিনি ছিলেন নিশাপুরের অধিবাসী। পরে তিনি স্থায়ীভাবে মক্কায় বসবাস শুরু করেন। আবূ নয়ীম ইসফাহানী তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ

******************************************************

তিনি অন্যতম নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী, বহু ইমাম ও প্রথম পর্যায়ের লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।

হাকেম লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি মক্কাবাসীদের মুহাদ্দিস, তাঁহার সততা ও ইলমের গভীরতা সম্পর্কে সকলেই একমত।

তিনি ২৪৬ হিজরী সনে ইন্তোকল করেন।[********************]

৪। হাফেজ ইয়াকুব ইবনে হুমাইদ- প্রথমে মদীনার বাসিন্দা ছিলেন, পরে মক্কায় বসবাস করিতে থাকেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসের ইমাম, পারদর্শী মুহাদ্দিস, মদীনার আলিম, মক্কায় অবস্থানকারী।

ইমাম বুখারী তাঁহার ছাত্র। ২৪১ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।

এই চারজন ছিলেন হাদীসের হাফেজ। এতদ্ব্যতীত হাদীসের শিক্ষক শায়খ ছিলেন অনেক।

কূফা

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ কূফা নগরের হাদীস-জ্ঞানমূলক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

গাছের তলায় মৃত্যুর জন্য বায়’আত গ্রহণকারী তিনশতজন সাহাবী ও বদর যুদ্ধে যোগদানকারীদের মধ্য হইতে সত্তরজন সাহাবী এই কূফা নগরে অবস্থান করিতেন।[********************]

কিন্তু হাফেজ আবূ বাশর দুলাবী কাতাদা হইতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

কূফা নগরে নবী করীম (স)-এর এক হাজার পঞ্চাশজন সাহাবী আগমন করেন। এতদ্ব্যতীত বদর যুদ্ধে যোগদানকারীদের মধ্য হইতে চব্বিশজন সাহাবীও আগমন করিয়াছিলেন।[********************]

এই শহরে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান ও চর্চা হইত। ইবনে শীরীন তাবেয়ী বলেনঃ

******************************************************

আমি যখন কূফা আগমন করি, তখন সেখানে চার হাজার হাদীস শিক্ষার্থী শিক্ষায় নিয়োজিত ছিল।[********************]

হাদীসের অধ্যায়ভিত্তিক সংকলন এই শহরেই সর্বপ্রথম শুরু হয়। সহীহ হাদীসের প্রথম সমষ্টি এইখানেই গ্রন্হাবদ্ধ হয়। ইমাম আবূ হানীফা (র) এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন বলিয়া হাদীসের ভিত্তিতে ফিকাহর জন্ম ও উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছিল এই শহরের পরিবেশের মধ্যে। এই শহরে হাদীসের হাফেজ আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বা বসবার করিতেন। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ বকর হাদীসের হাফেজ, অতুলনীয়, দৃষ্টান্তহীন ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী এবং বিশেষ দক্ষতারসম্পন্ন ব্যক্তি।[********************]

ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাঊদ ও ইবনে মাজাহ তাঁহার বিশিষ্ট ছাত্র ও শাগরিদ। তাঁহাদের হাদীস গ্রন্হসমূহে তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত বহুসংখ্যক হাদীস সন্নিবেশিত রহিয়াছে।[********************] ইমাম আবূ জুরয়া তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে আবূ শায়বা অপেক্ষা হাদীসের অধিক মুখস্থকারী আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।[********************]

তিনি ২৩৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তিনি তাঁহার সংকলিত কয়েকটি গ্রন্হ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রাখিয়া গিয়াছেন।

শায়খূল ইসলাম আশাজ্জ আবূ সায়াদ আবদুল্লাহও এই শহেই বাস করিতেন। তাঁহারই নিকট হইতে আবূ বকর ইবনে আবূ দাঊদ এক মাসে ত্রিশ সহস্র হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলেন। ইমাম ইবনে মাজাহও তাঁহার গ্রন্হে তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত বহু হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। আল্লামা যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আশাজ্জ হাদীসের ইমাম, মুসলামনদের নেতা, হাদীসের হাফেজ, কুফার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, কুরআনের তাফসীর ও অন্যান্য গ্রন্হাবলীর রচয়িতা।

সিহাহ সিত্তার সব কয়জন প্রণেতাই হাদীসে তাঁহার ছাত্র। তিনি ২৪৭ হিজরী সনে নব্বই বছরেরও বেশী বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাদীসের হাফেজ উসমান ইবনে আবূ শায়াবাহও এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। তিনি উপরোল্লিখিত আবূ বকর ইবন আবূ শায়বার বড় ভাই। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি তাঁহার ভাই আবূ বকরের মতই একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ ও হাদীসের ইমাম।[********************]

‘দুররাতুল ইরাক’ (ইরাক-শিরোমণি) হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে নুমাইর কূফারই অধিবাসী ছিলেন। আলী ইবনুল হুসাইন ইবনুল যুনাইদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘তিনি ছিলেন জ্ঞান, বুদ্ধি, সুন্নাত ও পরহেযগার সমন্বয়, কূফা নগরে তাঁহার কোন দৃষ্টান্ত দেখিতে পাই নাই।[********************]

ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ইমাম আবূ দাঊদ ও ইবনে মাজা প্রমুখ সিহাহ প্রণেতাগণ তাঁহার ছাত্র। মুসলিম শরীফে তাঁহার সূত্রে ৫৩৬টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে মাজা গ্রন্হেও তাঁহার নিকট হইতে বহু হাদীস গৃহীত ও উল্লিখিত হইয়াছে।[********************]

আবু কুরাইব, মুহাদ্দিসে-কূফা কূফা নগরের প্রখ্যাত হাদীসের হাফেজ ছিলেন। সিহাহ-সিত্তাহ প্রণয়নকারী সব কয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র ছিলেন। ইবনে উকদাহ ইলমে হাদীসে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি বলিয়াছেনঃ কূফা নগরে আবূ কুরাইব হইতে তিন লক্ষ হাদীস প্রচারিত হইয়াছে। কেবল মূসরা ইবনে ইসহাকই তাঁহার নিকট হইতে এক লক্ষ হাদীস গ্রহণ করিয়াছিলেন। বুখারী শরীফে তাঁহার সূত্রে ৭৫টি এবং মুসলিম শরীফে ৫০০ টি হাদীস গৃহীত হইয়াছে। তিনি ২৪৩ হিজরী সনে প্রায় ৮৭ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন।[********************]

শায়খুল কূফা হান্নাদও কূফারই একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহা উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন এবং হাদীসের ইলম ও তাকওয়ায় তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিয়াছেন। সিহাহ সিত্তার সব কয়জন প্রণেতাই তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছেন। তিনি ২৪৩ সনে ৯‌‌১ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাফেজ ওলীদ ইবনে শুজা কূফার বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র ছিলেন। ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ তাঁহার নিকট সিহাহ- নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সূত্রে বর্ণিত এক লক্ষ হাদীস সংগৃহীত ছিল। হাফেজ যাহবী তাহাকে ******************** ‘হাদীসের বড় হাফেজ ও সত্যপ্রিয় মুহাদ্দিস’ বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। তিনি ২৪৩ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

হাফেজ হারূন ইবনে ইসহাক আল-হামদানী কূফার মুহাদ্দিসদের একজন ছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ প্রমুখ গ্রন্হ প্রণেতাদের ওত্তাদ। তিনি ২৫৮ সনে ইন্তোকল করেন।[********************]

এই কয়জন শ্রেষ্ট ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ছাড়াও হাদীসজ্ঞানে বহু ধারক, শিক্ষক ও প্রচারক তৃতীয় শতকে কূফা নগরে অবস্থান করিতেছিলেন। সিহাহ-সিত্তার কোন কোন কিতাবে বিশেষ করিয়া ইবনে মাজাহ শরীফে তাঁহাদের নিকট হইতে বহু হাদীস গ্রহণ করা হইয়াছে।

বসরা

হিজরী তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই শহর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে পরিগণিত ছিল। প্রথম দিকে হযরত আবূ মুসা আশআরী হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন, হযরত ইবনে আব্বাস ও আরো বহু সংখ্যক সাহাবী এই শহরে বসবাস করিতেন। সর্বশেষ হযরত আনাস (রা)-ও এইখানে আসিয়া বসবাস শুরু করিয়াছিলেন। তাবেয়ীদের মধ্যে হাসানুল-বসরী, ইবনে শীরীন, আবূল আলীয়া এবং তাঁহাদের পরে কাতাদাহ, আইয়ূব, সাবেতুল বানানী, ইউনুস, ইবনে আউন আর তাঁহাদের পরে হাম্মাদ ইবনে সালমাহ, হাম্মাদ ইবনে যায়দ এবং তাঁহাদের ছাত্র মুহাদ্দিসগণ এই শহরেই জীবন অতিবাহিত করেন।[********************]

বসরা নগরে এত বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিসের সমাবেশ হইয়াছিল যে, হাফেজ মুসলিম ইবনে ইবরাহীম বসরী বলেনঃ

******************************************************

আমি আটশত হাদীসের ওস্তাদের নিকট হইতে হাদীস লিখিয়াছি অথচ সেজন্য আমাকে একটি পুল ও পার হইতে হয় নাই।[********************]

তৃতীয় শতক পর্যন্ত বসরায় হাদীসের যেসব হাফেজ ও উস্তাদ বর্তমান ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রধান কয়েকজনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। হাফেজ তহহান- হাসান ইবনে মুদরাক ইবনে বশীর আস-সদূসী। তিনি ইমাম বূখারী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহর উস্তাদ। তাঁহার সম্পর্কে ইবনে আদী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি বসরা নগরের বিশিষ্ট হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম ছিলেন।[********************]

২। হাফেজ যায়দ ইবনে আখজাম- আবূ তালিব তায়ী আল-বসরী। ইমাম মুসলিম ব্যতীত সিহাহ- সিত্তাহ প্রণেতা অপর কয়জন মুহাদ্দিসেরই তিনি উস্তাদ ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে— ‘হাদীসের হাফেজ ও ইমাম’ বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন।[********************]

৩। হাফেজ আব্বাস আনরবী। আল্লামা যাহভী তাঁহাকে – ******************** হাদীসের লব্ধপ্রতিষ্ঠ হাফেজ এবং ইমাম বলিয়া উল্লেখ করিাছেন। সিহাহ-সিত্তাহ প্রণেতাগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও নিজ নিজ গ্রন্হে উদ্ধৃত করিয়াছেন।[********************]

৪। হাফেজ আব্বাস বুহরানী ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আবূ হাবীব আল বসরী। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে ******************** বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, তিনি হাদীসের উচ্চতম সূত্র ও হাদীস সম্পর্কে গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। অকীহ ইবনুল জাররাহ, ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাত্তান, সুফিয়া ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন। তিনি যখন বুহরান হইতে হামদান আগমন করেন তখন তিনি নিজস্ব বহু সংখ্যক হাদীস সংকলন হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হামাদান, বাগদাদ ও ইসফাহান প্রভৃতি স্থানসমূহে তিনি হাদীস শিক্ষা দিতেন। তিন ২৫৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

৫। হাফেজ বিদয়া আবদুল্লাহ ইবনে ইসহাক আবূ মুহাম্মদ আল জাওহারী। তিনি ইমাম আবূ হানীফার প্রখ্যাত ছাত্র। ইমাম আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবেন মাজাহ- তাঁহারা সকলেই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তিনি ছিলেন হাদীসের একজন বিখ্যাত হাফেজ। ২৫৮ হিজরী সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৬। হাফেজ আকাবা ইবনে মুকাররম ইবনে আফলাহ হাদীসের বিখ্যাত হাফেজ ছিলেন।[********************] ইমাম মুসলিম, আবূ দাঊদ , তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ হাদীসে তাঁহার প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন। ২৪৩ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৭। হাফেজ উমর ইবনে শিবাহ ইবনে উবাইদাহ আল-বসরী। হাফেজ যাহবীর ভাষায় তিনি ছিলেন ******************** হাদীসের বড় হাফেজ, বড় বিজ্ঞ আলিম, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। ইবনে মাজাহ হাদীসে তাঁহার বিশিষ্ট ছাত্র ছিলেন। ২৬২ সনে ৮৯ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

৮। হাফেজ আমার ইবনে আলী ফাল্লাস। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেন ******************** হাদীসের বড় হাফেজ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। হাদীসে সিহাহ-সিত্তাহ প্রণেতা সব কয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। ২৪৯ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

৯। ইমাম আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে বাশার ইবনে উসমান আল বসরী। সিহাহ-সিত্তাহ সংকলক সবকয়জন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। তিনি ২৫২ সনে ইন্তেকাল করেন। বুখারী শরীফে ২০৫ ও মুসলিম শরীফে ৪০৬টি হাদীস তাঁহার নিকট হইতে গৃহীত হইয়াছে।[********************]

১০। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনুল মুসান্না। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। হাফেজ যাহবী তাঁহাকে ******************** হাদীসের হাফেজ, অকাট্য প্রামাণ্য মর্যাদাসম্পন্ন ও বসরার মুহাদ্দিস বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি সিহাহ-সিত্তাহ গ্রন্হাবলীর সবকয়জন মুহাদ্দিসেরই উস্তাদ। বুখারী শরীফে তাঁহার বর্ণিত ১০৩ ও সহীহ মুসলিম-এ ৭০০টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। ইবনে মাজাহ গ্রন্হে তাঁহার নিকট হইতে বহু হাদীস গ্রহণ করা হইয়াছে।[********************]

১১। হাফেজ মুহাম্মদ বুহরানী- আবূ আবদুল্লাহ ইবনে মা’মর আল বসরী। তিনি হাদীসের প্রখ্যাত হাফেজ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। সিহাহ-সিত্তাহর সংকলক সকলেই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেলেন।[********************]

১২। হাফেজ নসর ইবনে আল- আবূ আমর আল-আযদী আল বসরী। তিনি সিহাহ-সিত্তাহর সবকয়জন গ্রন্হ প্রণতারই উস্তাদ ছিলেন। খলীফা মুস্তায়ীন বিল্লাহ তাঁহাকে বিচারপতির পদে নিয়োগ করিতে চাহিলে তিনি আল্লাহর নিকট কাতর কণ্ঠে দোয়া করিলেনঃ

******************************************************

হে আল্লাহ ! তোমার নিকট আমার জন্য কোন কল্যাণ থাকিলে, আমাকে তোমার নিকট লইয়া যাও।

আল্লাহ তাঁহার দোয়া কবুল করিলেন। তিনি দোয়া করিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন, আর জাগ্রত হইলেন না। ২৫০ হিজরী রবিউল আউয়াল মাসের এই ঘটনা।[********************]

১৩। হাফেজ ইয়াহইয়া ইবনে হাকীম আবূ সায়ীদ আল বসরী। ইবনে মাজাহ শরীফে তাঁহার বর্ণিত বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ- এই তিনজন তাঁহার ছাত্র। তাঁহাকে ******************** নির্ভরযোগ্য ও সতর্ক হাফেজে হাদীন বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে।[********************]

এই শতকে তাঁহাদের ছাড়া আরো বহু খ্যাতনামা মুহাদ্দিস বসরা নগরে বর্তমান ছিলেন।

বাগদাদ

আব্বাসী বাদশাহদের শাসন আমলে বাগদাদ শহর মুসলমানদের তাহযীব তমদ্দুন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান কেন্দ্র ছিল। হাফেজ নিশাপুরী এই শহর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই শহর হাদীস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র, এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ সুধী ব্যক্তি বসবাস করিতেন।[********************]

বাগদাদে কোন সাহাবীর ইন্তেকাল হইয়াছে বলিয়া জানা যায় নাই। তবে তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের এক বড় জামাআত এখানে বসবাস করিয়াছেন এবং এই শহরেই তাঁহারা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন।[********************] এই শহরে বেশ কয়েকজন বড় বড় হাদীসবিদ অবস্থান করিতেন, ইমাম আবূ ইউসুফ (র) তাঁহাদের অন্যতম। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সর্বপ্রথম তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা শুরু করেন।[********************]

ইমাম আসাদ ইবনে আমরও একজন বড় হাদীসবিদ এবং তিনি এই শহরে অবস্থান করিতেন। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ******************************************************

‘রায় শহরের অধিবাসীদের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (র)-র পরে ইমাম আসাদ অপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীসের ধারক আর কেহ ছিল না।[********************]

বাগদাদে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান ও চর্চা হইত। এক-একজন মুহাদ্দিসের সম্মুখে হাজার হাজার ছাত্র হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে সমবেত হইত।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন।[********************] ইমাম আবূ সওর (মৃঃ ২৪০ হিঃ), ইমাম দাউদ যাহেরী (মৃঃ ২৭০ হিঃ) ও ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জরীর তাবেরী (মৃতঃ ৩১০ হিঃ) বাগদাদেরই অধিবাসী ছিলেন। ইমাম তাবারীর বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর এই শহরেই লিখিত হয়।[********************]

দামেশক

দামেশক উমাইয়া খলীফাদের রাজধানী, সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত এক সভ্যতামণ্ডিত শহর। সিরিয়ায় এক সময় দশ সহস্র সাহাবী অবস্থান করিতেন। ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সিরিয়ায় দশ সহস্র লোক এমন ছিলেন, যহাদের চক্ষু রাসূলে করীম (স)-কে দর্শনলাভে ধন্য হইয়াছিলেন।[********************]

পূর্বে এক স্থানে উল্লেক করা হইয়াছে, হযরত উমর ফারুক (রা) তাঁহার খিলাফতকালে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল, উবাদাহ ইবনুস সামিত এবং আরো কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবীকে কুরআন ও হাদীসের ব্যাপক প্রচার ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন। সিরিয়ায় জনগণ প্রথমত তাহাদের নিকট হইতেই কুরআন ও হাদীস শিক্ষা লাভ করেন এবং-

******************************************************

তাহাদের নিকট ও সূত্র হইতেই সমগ্র মুসলমানের নিকট কুরআন ও হাদীসের ইলম পৌঁছায়।[********************]

উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিক –এর শাসনকালে দামেশকে ইসলামী ইলমের ব্যাপক চর্চা হইত। তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের সময়ও এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ বর্তমান ছিলেন। হাফেজ যাহবী এই কথার উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

দামেশক কুরআন-হাদীস ও ফিকাহর কেন্দ্রস্থল। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম হিজরী শতকে এখানে ইলমে হাদীসের চর্চা অনেকখানি হ্রাস পায়।[********************]

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদ ইমাম আওযায়ী এই শহরেরই অধিবাসী ছিলেন। হিশাম ও দহীম নামক দুইজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস এখানে ছিলেন, তাঁহারা ব্যাপকভাবে হাদীসের দরস দিতেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (র) এইসব দরসে শরীক হইয়াছেন এবং এখান হইতে তিনি বহু সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইমাম বুখারী, আবূ দাউদ ও নাসায়ীও তাঁহার ছাত্র। ২৪৫ হিজরী সনে হাফেজ দহীম ইন্তেকাল করেন এবং হিশাম দামেশকে ইন্তেকাল করেন।

আফ্রিকায় হাদীস চর্চা

মিসর

মিসর হাদীস চর্চা ও শিক্ষা প্রচারের দিক দিয়া এই যুগে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এখানে অন্যূন তিনশত সাহাবী আগমন করিয়াছেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট জামা’আত এখানে আসিয়া ব্যাপকভাবে বসবাস শুরু করেন। তাবেয়ীদেন যুগে এখানে হাদীসের চর্চা হয়। পরে আমর ইবনুল হারিস, ইহাহইয়া ইবনে আয়ুব, হায়াত ইবন শুরাইহ, লইস ইবনে সাআদ ও ইবনে লাহইয়ার যুগে হাদীস চর্চা পূর্বাপেক্ষা অধিক ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করে। ইবনে ওহাব, ইমাম শাফেয়ী, ইবনুল কাসেম এবং তাঁহাদের শাগরিদদের সময় পর্যন্ত এই চর্চা চলিতে থাকে।[********************]

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয খলীফা নির্বাচিত হইয়া মিসরে হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দানের জন্য ইয়াযীদ ইবনে আবূ হুবাইবকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিনিই সেখানকার লোকদিগকে হাদীস ও ফিকাহর সহিত পরিচিত ও উহার শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তোলেন। হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ূতী ইয়াযীদ ইবনে আবূ হুবাইব সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনিই মিসরে সর্বপ্রথম হাদীসের প্রকাশ ও প্রচার করেন এবং হালাল-হারামের মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেন। তাঁহার পূর্বে সেখানকার লোক পরকাল সম্পর্কে উৎসাহদান, যুদ্ধ ও ফিতনা সম্পর্কিত হাদীসই বর্ণনা ও আলোচনা করিত।[********************]

এই যুগে মিসরে কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস বর্তমান ছিলেন। তন্মধ্যে কয়েকজনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ

১। হারমালা (জন্মঃ ১৬২ হিঃ মৃঃ ২৪৩ হিঃ)। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেন যে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে ওহাবের নিকট হইতে প্রায় এক লক্ষ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র। আল্লামা তুজুদ্দীন সুবকী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিশিষ্ট হাদীসবিদ ও ইমাম ছিলেন।

২। রবী মুরাদী। মিসরের বড় মুহাদ্দিস ছিলেন (জন্মঃ ১৭৪ হিঃ মৃঃ ২৭০ হিঃ)। হাফেজ যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি ছিলেন হাদীসের হাফেজ, ইমাম এবং মিসর অঞ্চলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস।

ইমাম আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ তাঁহার ছাত্র ছিলেন। খলীলী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী ও সর্বসম্মত মুহাদ্দিস।[********************]

৩। হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে রিমাহ ইবনে মুহাজির। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। ইমাম মুসলিম ও ইবনে মাজাহ ইলমে হাদীসে তাঁহার ছাত্র। ইবনে ইউনুস তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুহাদ্দিস।

ইমাম বুখারী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। সহীহ মুসলিমে তাঁহার বর্ণিত ১৬১ টি হাদীস স্থান পাইয়াছে। সুনানে ইবনে মাজাহ কিতাবেও তাঁহার বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

৪। হাফেজ ইয়াহইয়া ইবনে সারেহ আল-কুরায়শী। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন।

এতদ্ব্যতীত মিসর এলাকা ও আফ্রিকার অন্যান্য স্থানেও ব্যাপকভাবে হাদীস শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের কাজ চলে। প্রায় সকল স্থানেই দক্ষ ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন মুহাদ্দিসহণ এই মহান ব্রতে নিযুক্ত ছিলেন।


তৃতীয় হিজরী শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস
তৃতীয় শতকে সারা মুসলিম জাহানে সমাধিক খ্যাতিসম্পন্ন অগাধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কয়েকজন মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে। হাদীস সমৃদ্ধ ও স্থান ও শহরসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই বিশিষ্ট হাদীসবিদদের সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা একান্তই আবশ্যক। অন্যথায় এই শতকের হাদীসের ব্যাপক প্রসারতা ও অপূর্ব উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সম্যক ধারণা করা সম্ভব হইবে না। এই পর্যায়ে যে কয়জন মুহাদ্দিসের নাম বিশেষভাব উল্লেখযোগ্য, তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) আলী ইবনুল মাদানী (২) ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (৩) আবূ জুরয়া-আর-রাযী (৪) আবূ হাতেম আর-রাযী (৫) মুহাম্মদ ইবনে জরীর আততাবারী (৬) ইবনে খুযাইমা (৭) মুহাম্মদ ইবনে সাআদ (৮) ইসহাজ ইবনে রাহওয়াই (৯) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)।

আলী ইবনুল মাদীনী (র)

আলী ইবনুল মাদীনী একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। হাদীস শিক্ষায় যাঁহারা তাঁহার উস্তাদ ছিলেন, তাঁহাদের তালিকা দীর্ঘ। তাহা দেখিলে সহজেই ধারণা করা যায় যে, তিনি হাদীস শিক্ষায় অদম্য উৎসাহে দেশ-দেশান্তর পরিভ্রমণ করিয়াছেন।মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, কূফা প্রভৃতি হাদীসকেন্দ্র ও হাদীস- সমৃদ্ধ শহরসমূহ ঘুরিয়া তিনি রাসূল (স)-এর হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। ইয়েমেন শহরে তিনি এই উদ্দেশ্যেই একাধিক্রমে তিন বৎসর কাল অতিবাহিত করেন। কিন্তু ইয়েমেনে অবস্থানের সময় তিনি হাদীসের প্রাথমিক ছাত্র ছিলেন না, বরং ইহার পূর্বেই তিনি হাদীসের এক বিরাট সম্পদ স্বীয় বক্ষে ধারণা করিয়া লইয়াছিলেন।[********************] তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাফর, হাম্মাদ ইবনে যায়দ, আবূ দাউদ তায়ালিসী ও সাঈদ ইবনে আমের প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।

হাদীস গ্রহনের ব্যাপারে তিনি অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি উব্বাদ ইবনে সুহাইব নামক একজন বর্ণনাকারী সূত্রে ত্রিশ হাজার হাদীস সংগ্রহ করিয়াছিলেন; কিন্তু পরে তাঁহার সত্যবাদিতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ায় তিনি উহা সবই প্রত্যাখ্যান ও আগ্রাহ্য করিলেন।[********************]

তিনি একজন দক্ষগ্রন্হ প্রণেতা ছিলেন, হাদীস সম্পর্কিত ইলমের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইতিপূর্বে অপর কোন মুহাদ্দিসই এইসব বিষয়ে কোন গ্রন্হ রচনা করেন নাই।[********************]

তিনি ১৬১ হিজরী সনে বসরা নগরে জন্মলাভ করেন এবং হিজরী ২৩৪ সনে ইন্তেকাল করন।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (র)

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন ইলমে হাদীসের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পরই তিনি হাদীস শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেন এবং সে জন্য তিনি স্বীয় জান ও মাল সবকিছু অকাতরে উৎসর্গ করেন। তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত এক লক্ষ মুদ্রা তিনি এই হাদীস শিক্ষার কাজে ব্যয় করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এতই দরিদ্র ও নিঃস্ব হইয়া পড়েন যে, পায়ের জুতা সংগ্রহ করাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেনঃ (ক) আবদুস সালাম ইবনে হারব (খ) আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (গ) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদুল কাত্তান (ঘ) অকী ইবনে জাররাহ (ঙ) আবদুর রহমান ইবন মাহদী (চ) সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (ছ) হিশাম ইবনে ইউসুফ এবং আরো অনেক।[********************]

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন হাদীস শুধুমাত্র শ্রবণ করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না, সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়াও রাখিতেন। আলী ইবনে মাদানী বলেনঃ ইবনে মুয়ীন মত হাদীস লিখিয়া লইয়াছেন, তত আর কেহ লিখেন নাই। ইবনে মুয়ীন নিজেই বলিয়াছেনঃ

আমি নিজের হাতে লক্ষ লক্ষ হাদীস শ্রবণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছি। তিনি যে কেবল লিখিয়া লইতেন তাহাই নয়, প্রত্যেকটি হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া সে সম্পর্কে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করিতেন, উহার যথাথর্ততা যাচাই ও পরীক্ষা করিতেন।[********************]

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন যেটিকে হাদীস মনে করন না, তানা মূলত হাদীসই নহে।

তিনি ২৩৩ হিজরী সনে মদীনা শরীফে ইন্তেকাল করেন।[********************] হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানে তাঁহার অপূর্ব অবদান সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হইবে।

আবূ জুরয়া আর-রাযী (র)

আবূ জুররা হাদসের একজন বিখ্যাত হাফেজ ছিলেন। ইমাম আবূ দাউদ ছাড়া সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচজন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। তাঁহার সম্পর্কে হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ জুরয়া স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও মেধাশক্তি, ইসলামী ইলম, দ্বীন পালন ও সহীহ আমলের দিক দিয়া অতুলনীয় ছিলেন।[********************]

আবূ জুরয়া ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, জযীরা, খোরাসান ও মিসর পরিভ্রমণ করিয়াছেন। তিনি একলক্ষ সনদের হাদীস লিখিয়াছিলেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের সাক্ষ্য এইঃ

******************************************************

তিনি সাত লক্ষ হাদীস মুখস্ত রাখিতেন।[********************]

আবূ জুরয়া ২০০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]

আবূ হাতেম আর-রাযী (র)

ইমাম আবূ হাতেম আর-রাযী হাদীসের বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইমাম বুখারীর সমপর্যায়ের মুহাদ্দিস। ১৯৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ২০৯ হিজরীতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে বহির্গত হন। তিনি এই সফরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিয়াছিলেরন। তিনি বাহরাইন হইতে মিসর, মিসর হইতে রমলা, রমলা হইতে দামেশক, এবং সেখান হইতে তরসুম পদব্রজে সফর করিয়াছেন। অতঃপর হিমস প্রত্যাবর্তন করিয়া মক্কায় উপনীত হন। সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া ইরাকে পৌঁছেন। এই দীর্ঘ সফর যখন তিনি সমাপ্ত করেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ২০ বৎসর। তিনি তাঁহার পুত্র আবদুর রহমানকে একবার বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে প্রিয় পুত্র! আমি হাদীসের সন্ধানে পায়ে হাটিয়া হাজার ফার্লং-এর বেশী পথ অতিক্রম করিয়াছি।[********************]

ইরাকে পৌঁছিয়া বসরা শহরে তিনি আটমাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এখানে নিদারুন অর্থাভাবে পতিত হওয়ার কারণে তিনি স্বীয় ব্যবহার্য পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত বিক্রয় করিতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত উপবাস থাকিতে বাধ্য হন। কিন্তু এই কঠিন দারিদ্র ও নিদারুণ নিঃস্বতায় প্রপীড়িত হইয়াও তিনি হাদীস শিক্ষার কাজ অব্যাহতভাবে করিয়া গিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়াই তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত হাদীসের এক প্রখ্যাত হাফেজ ও বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ইমাম হওয়ার মর্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হন।[********************]

মুহাম্মদ ইবনে জরীর আত-তাবারী (র)

ইবনে জরীর প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ ও কুরআন মজীদের তাফসীর লেখক। তিনি ২২৪ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম তিরমিযী ও নাসায়ী পর্যায়ের মুহাদ্দিস রূপে গণ্য। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদদের নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা সংগ্রহ করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বড় বড় মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে আহমদ ইবনে কামেল, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ শাফেয়ী ও মাখলাদ ইবনে জাফর প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ উল্লেখযোগ্য। ইবনে জরীর তাফসীর, হাদীস ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বিরাট বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।তিনি হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন বলিয়া ইবনে কাসীর উল্লেখ করিয়াছেন। হিজরী ৩১০ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]

ইবনে খুযাইমা (র)

তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর ইবনে খুযাইমা নিশাপুরী। তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি রায়, বাগদাদ, বসরা, কূফা, সিরিয়া, জযীয়া, মিসর ও ওয়াসত প্রভৃতি স্থানসমূহ সফর করেন এবং বহু সংখ্যক খ্যাতনামা হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন। তাঁহার ওস্তাদের মধ্যে ইসহাক ইবনে রাহওয়াই ও মুহাম্মদ ইবনে হুমাইদ আর-রাযী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ ও সংকল্পপরায়ণ ছিলেন। ইমাম দারে কুতনী তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে খুযাইমা হাদীসের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ইমাম ছিলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। তাঁহার কোন তুলনা পাওয়া যায় না।

তিনি হাদীস ও দ্বীনি মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হিজরী ৩১১ সনে তাঁহার ইন্তেকাল হয়।[********************]

মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (র)

ইবনে সায়াদ একজন বড় ঐতিহাসিক ও জীবনীকার হিসাবে প্রসিদ্ধ হইলেও তিনি তৃতীয় হিজরী শতকের একজন বড় মুহাদ্দিসি ছিলেন। তিনি বসরা শহরে ১৬৮হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। বসরার বড় মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ করেন। অতঃপর কূফা, ওয়াসত, বাগদাদ, মক্কা-মদীনা, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসর ও মুসলিম জাহানের অন্যান্য বড় বড় শহর-নগর সফর করিয়া বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও শিক্ষা করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বহু খ্যাতিমান মুহাদ্দিস হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তিনি বিপুল ইলমের অধিকারী ছিলেন। বহু সংখ্যক গ্রন্হের প্রণেতা ছিলেন। তাঁহার গ্রন্হাবলী ছিল হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ক।[********************]

ইবনে সায়াদ হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট বড়ই প্রিয় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি তদানীন্তন সমাজের কোন ফিতনায় লিপ্ত হন নাই। ফলে তাঁহার পক্ষে ইলম বিস্তার ও প্রসারতার জন্য এবং পূর্ববর্তী ইলমকে পরবর্তীকালের মানব সমাজের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হইয়াছে।[********************]

ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (র)

ইসহাক তাবে-তাবেয়ীন যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের নিকট হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁহার অল্প বয়স এই পথের প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়। অতঃপর তিনি হাদীস শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্রের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়েন। এই কেন্দ্রসমূহ একটি হইতে অন্যটি শতসহস্র মাইলি দূরে অবস্থিত ছিল। ইবনে রাহওয়াই এই দূরাতিক্রম্য পথে পর্যটন শুরু করেন এবং বড় বড় হাদীসবিদ মনীষীদের নিকট হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। মুসলিম জাহানের যেসব প্রদেশে এই হাদীস কেন্দ্রসমূহ অবস্থিত ছিল, তন্মধ্যে ইরাক, হিজায, ইয়েমেন, মক্কা ও সিরিয়া উল্লেখযোগ্য। ইহার এক-একটি শহরে শত শত হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র বিরাজিত ছিল। ইমাম ইসহাক এই সবের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই উপস্থিত হইয়াছেন এবং হাদীস সম্পদ শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।

এই চেষ্টা-সাধনাকে দ্বিগুণ কার্যকর ও কল্যাণময় করিয়া দিয়াছিল তাঁহার অনন্যসাধারণ তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি। অসংখ্য হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। কয়েক সহস্র হাদীস তিনি ছাত্রদিগকে মুখস্থ শুনাইতে ও তাহাদিগকে লিখাইয়া দিতেন। এইজন্য তাঁহাকে কখনো কিতাব দেখিতে হইত না। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যাহা কিছু শুনি, তাহা সই মুখস্থ করিয়া লই এবং যাহা মুখস্থ করি, তাহা আর কখনো ভুলিয়া যাই না।

তিনি ১৬১ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন ও হিঃ ২৩৮ সনে নিশাপুরে ৭৭ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল কারেন।[********************]

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ইলমে হাদীসে এক অনন্য সাধারণ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ও সুদক্ষ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ১৬৪ হিজরী সনে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি ইমাম আবূ ইউসুফের মজলিসে শরীক হইতে শুরু করেন। পরে হিঃ ১৮৭ সনে তিনি হাদীস শিক্ষায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসিলম জাহানের সবকয়টি শহর ও অঞ্চল সফর করিয়াছেন।

প্রথমে বাগদাদের মুহাদ্দিসদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা করিতে শুর করেন। এই পর্যায়ে তাঁহার হাদীসের উস্তাদ হইতেছেন হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবূ হাযেম (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)। তাঁহার খিদমতে তিনি একদিক্রমে চার বৎসর পর্যন্ত অব্স্থান করেন- ১৬ বৎসর বয়স হইতে ২০ বৎসর পর্যন্ত, (১৭৯-১৮৩হিঃ)।[********************] এই সময়ে তিনি বাগদাদের অপর একজন মুহাদ্দিস উমাইর ইবনে আবদুল্লাহ ইবেন খালিদ হইতে যথেষ্ট সংখক হাদীস শ্রবণ করেন। আবদুর বহমান ইবনে মাহাদী ও আবূ বকর ইবনে আইয়াশ নামক অপর দুইজন মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন বলিয়া উল্লেক করা হইয়াছে।[********************]

১৮৬ হিঃ সনে তিনি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে বসরা গমন করেন,তারপর হিজায উপস্থিত হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন ও কূফা শহরেও গমন করেন। বসরা শহরে তিনি পরপর পাঁচবার উপস্থিত হন। কোন কোন বার তখায় তিনি ক্রমাগতভাবে তিন মাস করিয়া অবস্থান করেন। হিজাযেএ তিনি পাচঁবার গমন করিয়াছেন। বিদেশে এইসব সফরের মূলে তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করা। বস্তুতপক্ষে এই সময়কার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।[********************]

ইমাম আহমদ হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের অভিযানে প্রথম হইতেই একটি নীতি পালন করিয়া চলিতেন। তাহা হইতেছে হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উহাকে লিখিয়া লওয়া। তিনি তাঁহার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভর করিতেন না। বরং যাহাই শুনিতে পাইতেন তাহাই কাগজের উপর লিখিয়া লওয়া ছিল তাঁহার স্থায়ীভাবে অনুসৃত নীতি।[********************]

তাঁহার শ্রুত হাদীসসমূহ তাঁহার সম্পূর্ণ মুখস্থই থাকিত, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি কোন হাদীস স্বীয় পাণ্ডুলিপি না দেখিয়া কখনো বর্ণনা করিতেন না। কেহ কোন হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে- তাহা স্মরণ ও মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও স্বীয় কিতাব খুলিয়া উহার সন্ধান করিতেন ও পরে তাহা সম্মুখে পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি যখন কাহাকেও হাদীস লিখাইতেন তখন হাদীস লিখিত হওয়ার পর তাঁহাকে বলিতেনঃ যাহা লিখিয়াছ, তাহা পড়িয়া শুনাও। ইহার মূলে তাঁহার লক্ষ্য থাকিত যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দে যেন কোনরূপ পার্থক্য হইতে না পারে।[********************]

এই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম শাফেয়ী, আবদুর রাযযাক অকী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম শাফেয়ী হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ের ব্যাপারে ইমাম আহমদের উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভর করিতেন। তাঁহাকে তিনি বলিয়াই রাখিয়াছেনঃ

******************************************************

হে আবূ আবদুল্লাহ ! আপনার দৃষ্টিতে যখনই কোন সহীহ হাদীস পৌঁছিবে আপনি তাহা আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। আমি উহার ভিত্তিতে আমার ফিকাহর মাযহাব ঠিক করিব।[********************]

ইমাম আহমদ ২৩১ হিজরী সনে বাগদাদ নগরে ইন্তেকাল করেন।[********************]


মুসনাদ প্রণয়ন
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথম ভাগেই মুসনাদ নামে হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ‘মুসনাদ’ বলা হয় কোন ধরনের গ্রন্হকে?

******************************************************

মুহাদ্দিস এক একজন সাহাবীর প্রসঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সমস্ত হাদীসকে এক সঙ্গে উল্লেখ করেন, তাহা সহীহ কি সহীহ নয় তাহার কোন পার্থক্য করেন না এবং হাদীসসমূহের বিষয়বস্তুও হয় সম্পূর্ণ বিভিন্ন। এই ধরনের গ্রন্হেই মুসনাদ বলা হয়।[********************]

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মুহাদ্দিস হযরত আবূ বকর (রা)-এর নাম উল্লেখ করেন। অতঃপর তাঁহার নিকট হইতে বিভিন্ন বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হইয়াছে ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে এই মুহাদ্দিস পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তাহার সমস্ত হাদীসই এক স্থানে লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহার পর হযরত উমর (রা)-এর নাম আসিল এবং তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত যাবতীয় হাদীসকে এক স্থানে ও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেক করা হইল। এইভাবে সকল সাহাবীর নামের পরে তাঁহার বর্ণিত ও বিভিন্ন সনদের সূত্রে গ্রন্হাকারে প্রাপ্ত সমস্ত হাদীসই একস্থানে সংকলিত করা হইল।[********************] তৃতীয় শতকের শুরুতে এই ধরনের হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত মুসনাদ গ্রন্হসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ (১) মুসনাদে উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসা (মৃঃ ২১৩ হিঃ), (২)মুসনাদুল হুমাইদী (মৃঃ ২১৯ হিঃ), (৩) মুসনাদে মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ (মৃঃ ২২৮ হিঃ), (৪) মুসনাদ ইসহাক ইবনে রাওয়াই (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), (৫) মুসনাদ উসমান ইবনে আবূ শায়বাহ (মৃঃ ২৩৯ হিঃ), (৬) মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৩১ হিঃ), (৭) মুসনাদ ইবনে হুমাইদ (মৃঃ ২৪৯ হিঃ), (৮) আল-মুসনাদুল কবীর- ইয়াকুব ইবনে শায়বাহ (মৃঃ ২৬২ হিঃ), (৯) মুসনাদ মুহাম্মদ ইবনে মাহদী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), (১০) আল-মুসনাদুল কবীর- বাকী ইবনে মাখলাদুল কুরতাবী (মৃঃ ২৭২ হিঃ), (১১) মুসনাদ আবূ দায়ূদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)।

কিন্তু হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এই পদ্ধতি দোষমুক্ত নয়। ইহাতে হাদীসের সত্যতা, সনদের বিশ্বস্ততা ও উহার মর্যাদা সস্পষ্ট ধারণা করা কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এইরূপ হাদীস হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু মঙ্গল নিহিত আছে তাহা অস্বীকার করা যায় না। ইহার ফলে প্রথমতঃ রাসূলে করীম (স)- এর হাদীসসমূহ অন্যান্য বর্ণনা হইতে আলাদাভাবে পাঠ করার সুযোগ হয়। দ্বিতীয়ত একজন সাহাবীর নিকট হইতে কতজন লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা স্পষ্টভাবে জানা যায়। এমনও হইতে পারে যে, একটি হাদীসের বিশেষ কোন সনদ সূত্র হয়তো দুর্বল; কিন্তু উহারই অপর এক বর্ণনা সূত্র হয়তো নির্দোষ ও গ্রহণযোগ্য। পরিণামে এই দূর্বল সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিও নির্ভরযোগ্য সূত্রে সমর্থনে সহীহরূপে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে।[********************]

তবে একথাও মনে করা যায় না যে, মুসনাদ-প্রণেতা মুহাদ্দিসগণ হাদীস নামে যাহাই পাইয়াছেন, নিতান্ত অন্ধের ন্যায় কিংবা ‘অন্ধকারে কাষ্ঠ সংগ্রহকারীর’ মত তাহাই সাহাবীর নামের সঙ্গে যুক্ত করিয়া দিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ ধারণা করাই ভিত্তিহীন এবং অনুচিত। কেননা তাঁহারা প্রত্যেকটি হাদীসের যথার্থতা প্রাণপণে যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। সেইজন্য গভীর সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁহারা দেশের পর দেশ সফর করিয়াছেন এবং তাঁহাদের সমগ্র জীবন উহার সংগ্রহ যাঁচাই-পরীক্ষা ও ছাটাই-বাছাই করার কঠিন ও কঠোরতম কাজের মধ্যে দিয়াই অতিবাহিত করিয়াছেন। মুসনাদ গ্রন্হের এমন অনেক প্রণেতাই আছেন, যাঁহারা মূল হাদীসের ও উহার সনদের যথাযথ যাচাই না করিয়া একটি হাদীসও গ্রহণ করেন নাই। অনেক মুসনাদ গ্রন্হে আবার ফিকাহ প্রণয়ন রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক সাহাবীর হাদীসসমূহকে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে বাকী ইবনে মাখলাদ প্রণীত আল মুসনাদুল কবীর-এর নাম উল্লেখ্য। আবার কেহ কেহ প্রত্যেকটি হাদীসকে বিভিন্ন বর্ণনা সূত্র ও বিভিন্ন বর্ণনাকারীর উল্লেখসহ সজ্জিত করিয়াছেন।[********************]

এই পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

শেষ পর্যন্ত হাদীসের কোন কোন ইমামের ইচ্ছা হইল কেবলমাত্র নবী করীম (স) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ স্বতন্ত্র করিয়া গ্রন্হবদ্ধ করার । এই সময় উবাইদুল্লাহই বনে মুসা আবসী কূফী, মুসাদ্দাদ ইবনে মাসারহাদ বরসীফ, আসাদ ইবনে মুসা উমাভী ও মিসরে অবস্থানকারী নয়ীম ইবনে হাম্মাদ খাজায় এক-একখানি করিয়া মুসনাদ প্রণয়ন করেন। তাঁহাদের পরবর্তীকালীন হাদীসের ইমামগণও তাঁহাদেরই পদাংক অনুসরণ করিয়া চলিলেন। হাদীসের হাফেজগণের একজন ইমামও এমন পাওয়া যাইবে না যিনি তাঁহার সংগৃহীত হাদীসসমূহকে ‘মুসনাদ’ গ্রন্হ প্রণয়ন রীতিতে গ্রন্হাবদ্ধ করেন নাই। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, উসমান ইবনে আবূ শায়াবাহ এবং তাঁহাদের ন্যায় অন্যান্য বড় মুহাদ্দিসগণও এই রীতি অবলম্বন করিয়াছেন। এবং কোন কোন হাদীস সংকলক অধ্যায়-সংযোজন এব‌ং মুসনাদ-নীতি উভয়কেই অনুসরণ করিয়া হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন- যেমন আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বাহ।[********************]

পূর্বে যেমন বলা হইয়াছে, অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন এবং মুসনাদ রীতি অনুযায়ী হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রহিয়াছে। অধ্যায় হিসাবে গ্রন্হ প্রণয়ন হয় বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে হাদীস সজ্জায়ন, এক এক বিষয়ের হাদীস এক একটি অধ্যায়ে সজ্জিত করা। যেমন নামায সম্পর্কিত হাদীস এক অধ্যায়ে, রোযা সম্পর্কিত হাদীস রোযার অ্ধ্যায়ে, তাকওয়া পরহিযগারী সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসূমহ স্বতন্ত্র এক অধ্যায়ে সংযোজিত করা। পক্ষান্তরে মুসনাদ প্রণয়ন রীতি এই হয় যে, প্রত্যেক সাহাবীর বর্ণিত সমস্ত হাদীস বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রিত করা- তাহা নামায সম্পর্কে হউক, রোযা সম্পর্কে হউক, কি তাকওয়া পরহেযগারী সম্পর্কিত হাদীসই হউক না কেন। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হইতে যত হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে, তাহা যে কোন বিষয় সম্পর্কেই হউক না কেন একত্রিক করিয়া ‘মুসনাদে আবূ বকর সিদ্দীকি’ শিরোনামের অধীন লিপিবদ্ধ করা মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি। এই উভয় রীতির মধ্যে পার্থক্য কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রামাণ্যতার দৃষ্টিতে বিচার করিলেও এই উভয় রীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হইবে। অধ্যায় রীতিতে সংকলিত হাদীস-গ্রন্হের প্রথমে থাকে সেইসব বর্ণনা যাহা আকীদা বা আমলের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। এইজন্য তাঁহারা সাধারণ প্রমাণ ও দলীল হিসাবে উল্লেখযোগ্য হাদীসসমূহই সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে একত্রিত করেন, ইহার বর্ণনাকারী যে সাহাবীই হউন না কেন। কিন্তু মুসনাদ প্রণেতাদের একমাত্র কাজ হইতেছে সকল প্রকার হাদীসসমূহ সংগ্রহ, সন্নিবিষ্ট ও একত্রিত করিয়া দেওয়া। এই কারণে মূল হাদীস সহীহ কি অসহীহ তাহার বিচার না করিয়াই তাঁহারা হাদীসসমূহ একত্র করিয়া দেন।

অধ্যায় ও মুসনাদ রীতির মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী উভয় রীতিতে হাদীস সংযোজিত করা ও উহার শিরোনাম নির্ধারণের কায়দা দেখাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেনঃ ‘মুসনাদ’ রীতিতে হাদীস সংগ্রহ করা হইলে শিরোনাম এইরূপ হইবেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক কর্তৃক নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত সমস্ত হাদীস বর্ণনা বা উল্লেখ।

এবং ইহার অধীন হযরত আবূ বকর কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীসই উদ্ধৃত হইবে।

ইহার পর দ্বিতীয় শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

কায়স ইবনে আবূ হাযেম হযরত আবূ বকর (রা) হইতে যেসব হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন তাহার উল্লেখ।

এইখানে গ্রন্হকারকে এমন সমস্ত হাদীসই উল্লেখ করিতে হয়, যাহা কায়সের সূত্রে হযরত আবূ বকর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে। তাহা সহীহ কি অসহীহ সে বিচার করার প্রয়োজন হয় না।

কিন্তু অধ্যায় হিসাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করা হইলে প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম বিষয়বস্তুর দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন তখন শিরোনাম হইবেঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (স) হইবে তাহারাত নামায কিংবা ইবাদতের অপর কোন বিষয়ে যাহা সহীহরূপে প্রমাণিত ও বর্ণিত হইয়াছে, তাহার উল্লেখ।[********************]

এই পার্থক্য প্রদর্শন প্রসঙ্গে ইবনে হাজার আসকালানী অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

অধ্যায় হিসাবে, হাদীস- গ্রন্হ প্রণয়নের রীতি এই যে, তাহাতে কেবল সেই সব বর্ণনার উল্লেখ করা হইবে, যাহা প্রমাণ বা দলীল হইবার যোগ্য। পক্ষান্তরে যাঁহারা মুসনাদ প্রণয়ন করেন, তাঁহাদের পদ্ধতি আলাদা হয়। কেননা তাঁহাদের আসল উদ্দেশ্যই হয় কেবলমাত্র হাদীসের বর্ণনাসমূহ সন্নিবেশিত করিয়া দেওয়া।[********************]

মুসনাদ গ্রন্হসমূহ মূলতঃ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহের এক বিরাট স্তুপ। তাহা হইতে হাদসের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা করা খুব সহজ হয়। এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের উদ্দেশ্যই হয় এক এক সূত্রে বর্ণিত সমস্ত হাদীস একত্রিত করা, যেন বর্ণিত কোন হাদীসই অসংকলিত থাকিয়া না যায়। সহীহ গায়ের-সহীহ নির্বিশেষে সমস্ত বর্ণিত হাদীস যখন একত্রিত ও এক স্থানে সংকলিত পাওয়া যায় তখন প্রত্যেকটি হাদীস বিজ্ঞানে পারদর্শী ও সূক্ষ্ম বিচারক সমালোচক সমালোচনার কষ্টিপাথরে প্রত্যেকটি বর্ণনাকে যাঁচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন এবং কোন হাদীসটি সহীহস কোনটি নয়, কোন সূত্রটি নির্দোষ, কোনটি দোষমুক্ত, তাহা বিচার করিতে পারেন। এমনকি এক একটি হাদীস কতবার এবং কোন কোন সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে তাহার মধ্যে কোন কোন সূত্রে কি কি শব্দে হাদীসটি বর্ণিত হইয়াছে, আর কোন সূত্রের কি অবস্থা, এই সব কিছু নির্ধারণ করা এই ‘মুসনাদ’ গ্রন্হের ভিত্তিতেই সম্ভব এবং সহজ।

মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী লিখিয়াছেনঃ

ইসলামে এই মুসনাদ গ্রন্হসমূহে যাহা গ্রন্হাবন্ধ হইয়াছে, তাহাতে সাহাবাদের বর্ণিত হাদীসসমূহই সংযোজিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে বর্ণনা সূত্রসমূহ নির্ভরযোগ্য আছে, আর দোষমুক্তও রহিয়াছে। যেমন, উবাইদুল্লাহ ইবনে মুসার মুসনাদ এবং আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে দাউদ তায়ালিসীর মুসনাদ। বস্তুত ইসলামে এই দুইজন মুহাদ্দিসই সর্বপ্রথম বর্ণনাকারী ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়ন শুরু করেন। [কাহারো মতে সর্বপ্রথম মুসনাদ রচনা করেন দাউদ তায়ালিসী [********************] এই দুইজনের পরে আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম হানযালী, আবূ খায়সামা, জুহাইর ইবনে হারব ও উবায়দুল্লাহ ইবনে উমর কাওয়ারীরী মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। অতঃপর ব্যক্তির ভিত্তিতে মুসনাদ প্রণয়নের কাজ বহু হইয়াছে। আর এইভাবে হাদীস সংযোজনে দোষযুক্ত ও নির্দোষ হাদীস-সূত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই।[********************]

হাকেম মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগা করিয়াছেন। সব কয়খানি মুসনাদ গ্রন্হ সম্পর্কে তিনি এইরূপ ধারণা প্রকাশ করিয়াছেন, অবশ্য অধিকংশ গ্রন্হই যে এই পর্যায়ের, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু সব কয়টি মুসনাদ গ্রন্হ এই দোষে দোষী নহে। কোন কোন মুসনাদ-প্রণেতা হাদীস চয়নে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া স্বীয় গ্রন্হে সংযোজিত করিয়াছেন, তাহা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যেমন আল্লামা সুয়ুতী ইসহাক ইবনে রাহওয়াই সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আবূ জুরয়া আর-রাযী যেমন উল্লেখ করিয়াছেন, ইসহাক যে সাহাবীর বর্ণিত যে হাদীস উত্তম ও গ্রহনযোগ্য কেবল তাহাই সেই সাহাবীর নামে উল্লেখ করিয়াছেন।[********************]

মুসান্নাফ আবূ বকর ইবনে শায়বাহ

এই পর্যায়ে ইমাম আবূ বকর ইবনে শায়বার হাদীস গ্রন্হাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার সংকলিত ‘মুসনাদ’ ও মুসন্নাফ’ তৃতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্হ। ‘মুসান্নাফ’ এক অতুলনীয় গ্রন্হ বলিয়া মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা তাঁহাদের দৃষ্টিতে এক গৌরবের বস্তুও বটে। হাফেজ ইবনে কাসীর এতদূর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসান্নাফ’ এমনই একখানি গ্রন্হ যে, এইরূপ একখানি গ্রন্হ কেহ কখনো সংকলন করেন নাই, না ইহার পূর্বৈ না ইহার পরে।[********************]

হাফেজ ইবনে হাজম আন্দালূসী ইহাকে ‘মূয়াত্তা ইমাম মালিক’ হইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন গ্রন্হ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।[********************] বস্তুত সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ- সিহাহ সিত্তার এই প্রখ্যাত গ্রন্হত্রয়ে ‘মুয়াত্তা’ অপেক্ষা বেশী হাদীস আবূ বকর ইবনে শায়বার এই ‘মুসান্নাফ’ হইতে গ্রহণ করা হইয়াছে।

এই গ্রন্হ কেবলমাত্র ‘আহকাম’ সম্পর্কিত হাদীস গৃহীত হইয়াছে- যাহা হইতে ফিকাহর কোন না কোন মাসায়ালা প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাহাতে যেমন বিশেষ কোন ফিকাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় নাই, তেমনি কোনটির প্রতি অধিক গুরুত্বও আরোপ করা হয় নাই। বরং হিজায ও ইরাক অঞ্চলের হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট যত হাদীসই পাওযা গিয়াছে তাহা সবই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নীতিতে এই গ্রন্হে গ্রহণ করা হইয়াছে। ফলে এই গ্রন্হ হইতে প্রত্যেক ফিকাহবিদই নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে নিজের মত গ্রহণ ও উহার অনুকূলে হাদীসের ভিত্তি বা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারেন।

এই গ্রন্হের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহাতে প্রত্যেকটি ‘হাদীস নববী’র সঙ্গে সঙ্গে সাহাবা ও তাবেয়ীনের কথা ও ফতোয়াও উদ্ধৃত হইয়াছে। ফলে প্রত্যেকটি হাদীস সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের কি মত ছিল, তাহা সহজেই জানা যাইতে পারে। ‘কাশফুজ্জুনুন’ প্রণেতা এই গ্রন্হ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইহা এক বিরাট গ্রন্হ। ইহাতে তাবেয়ীদের ফতোয়া, সাহাবীদের বানী ও রাসূল (স)- এর হাদীসসমূহ মুহাদ্দিসদের রীতি অনুযায়ী সনদ সহকারে সন্নিবেশিত করা হইয়াছে এবং ফিকাহর কিতাব সংকলনের ধারা অনুযায়ী ইহার অধ্যায় ও পরিচ্ছেদসমূহ সজ্জিত করা হইয়াছে।[********************]

ইবনে আবূ শায়বার বিশিষ্টি ছাত্র শায়খুল ইসলাম বাকী ইবনে মাখলাদ যখন এই গ্রন্হখানা লইয়া আন্দালুসিয়া গমন করেন, তখন কোন মহলে ইহার বিরোধিতা করিলেও তথাকার শাসনকর্তা মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান ইহার আদ্যোপান্ত শ্রবণ করেন এবং রাজকীয় গ্রন্হালয়ের ভারপ্রাপ্তকে এই বলিয়া নির্দেশ দিলেনঃ

******************************************************

ইহা, এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্হ যে, আমাদের গ্রন্হালয়ে ইহার বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। অতএব উহার অনুলিপি গ্রহণের ব্যবস্থা কর।[********************]

মুসনাদ ইমাম আহমদ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলিত হাদীস গ্রন্হ- মুসনাদ আহমদ- এই শতকের এক বিরাট ও অপূর্ব অতুলনীয় গ্রন্হ। ইহাকে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বকোষ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। পূর্ববতী ও পরবর্তীকালের সকল পর্যায়ের মুহাদ্দিসগণ ইহার অসাধারণ মূল্য ও গুরুত্ব উদাত্ত কণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ বুখারী-মুসলিম-এর পরে হাদীসরে সর্বাধিক সমন্বাকারী ও বিশুদ্বতমগ্রন্হ। মুসলমানের ব্যবহারিক জীবনের দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সমস্ত হাদীস এই বিরাট গ্রন্হে সংকলিত ও লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে।[********************]

ইমাম আহমদ (র) দীর্ঘদিনের অপরিসীম ও অবিশ্রান্ত সাধনা ও অভিনিবেশের ফলে এই গ্রন্হখানি প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি হাদীস অধ্যায়নকাল হইতেই হাদীস মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়া লইতে শুরু করেন। বয়সের হিসাবে তাঁহার এই কাজ শুরু হয় তখন, যখন তাঁহার বয়স মাত্র ১৬ বৎসর।[********************] অতঃপর সমস্ত জীবন ভরিয়া তিনি কেবলমাত্র এই কাজই করিয়াছেন। তাহার জীবনের লক্ষ্য এই হাদীস গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে ব্যাপক ও সমস্ত প্রয়োজনীয় হাদীসের আকর করিয়া তোলার দিকে। হাদীসসমূহ তিনি আলাদা আলাদা পৃষ্ঠায় লিখিয়া রাখিতেন। শেষ পর্যন্ত উহা এক বিরাট গ্রন্হের পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হয়।

কিন্তু ইমাম আহমদের চরম বাসনা ও সাধনা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাহাঁর আয়ূষ্কাল খতম হইয়া যায়। তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শ্রবণ করিয়াই সর্বপ্রথম যে কাজ করিলেন তাহা এই যে, তাঁহার সন্তান ও পরিবারের লোকজনকে একত্রিত করিয়া হাদীসের এই বিরাট সংকলনটি আদ্যোপান্ত পাছ করিয়া শুনাইয়া দিলেন এবং উহাকে স্বতন্ত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে লিখিয়া দেন। কিন্তু ইমাম আহমদ (র) তাঁহার সারা জীবনের সাধনার ফলে সংকলিত হাদীসসমূহকে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া গ্রন্হাকারে সজ্জিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া যাইতে পারেন নাই।[********************]

শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুসনাদ আহমদ যদিও এই মহান সম্মানিত ইমামের সংকলিত হাদীসগ্রন্হ, কিন্তু উহাতে দুইজন লোক পরে আরও অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। একজন তাঁহার পুত্র আবদুল্লাহ এবং অপরজন আবদুল্লাহ হইতে এই গ্রন্হের বর্ণনাকারী আবূ বকর আল-কাতিয়ী।[********************]

এই গ্রন্হে মোট কত হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, এ সম্পর্কে মুহাদ্দিস ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুসনাদে আহমদ’ গ্রন্হে মূলত ত্রিশ হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে। আর তাঁহার পুত্রের সংযোজনের ফলে শেয় পর্যন্ত উহার সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে চল্লিশ হাজার হাদীস।[********************]

কেহ কেহ বলিয়াছেন, ইহার মোট হাদীসের সংখ্যা হইতেছে চল্লিশ হাজার, কিন্তু পুনারবৃত্তি বাদ দিলে ইহার সংখ্যা দাঁড়ায় ত্রিশ হাজার।[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে ঠিক মুসনাদ রীতিতে সংকলিত করিয়াছেন। তিনি এক-একজন সাহাবী (রা)-এর নাম উল্লেখ করিয়াছেন। তাহার পর সেই সাহাবী কর্তৃক নবী করীম (স)-এর যত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পর পর উল্লেখ করিয়াছেন। এই হাদীসসমূহের উল্লেখ শেষ হইয়া গেলে তিনি অপর এক সাহাবী এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। তিনি ইহাকে বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে সজ্জিত করেন নাই। ফলে ইহাতে হদ সম্পর্কে উদ্ধৃত একটি হাদীসের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যাইবে ইবাদত ও পরকালের ভয় সম্পর্কিত হাদীস।[********************]

এই গ্রন্হে মাত্র আঠারখানি মুসনাদ উল্লেক করা হইয়াছে। প্রথমে জান্নাতের সসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মুসনাদ উল্লেখ করা হইয়াছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আহলে বায়ত-এর মুসনাদ, তৃতীয় পর্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, চতুর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের মুসনাদ, পঞ্চম আবদুল্লাহই ইবনে আমর ও আবূ মারমাসা, ষষ্ঠ হযরত আব্বাস, সপ্তম আবূ হুরায়রার মুসনাদ, অষ্টম আনাস ইবনে মালিক, নবম আবূ সাঈদ খুদরীর মুসনাদ, দশম জবির ইবনে আবদুল্লাহর মুসনাদ, একাদশ মক্কী সাহাবীদের মুসনাদ, দ্বাদশ মাদানী সাহাবীদের মুসনাদ, ত্রয়োদশ সুফফার অধিবাসী সাহাবী চতুর্দশ বসরার অধিবাসী সাহাবী, পঞ্চাদশ সিরিয়ার অধিবাসী সাহাবী, ষোড়শ আনাসর ও সপ্তাদশ হযরত আয়েশার মুসনাদ- মোটামুটি মুসনাদ গ্রন্হখানি একশত বাহাত্তর অংশে বিভক্ত।[********************]

ইমাম আহমদ এই গ্রন্হখানিকে সহীহ হাদীসসমূহের এক অতুলনীয় আকররূপে সজ্জিত করিতে চাহিয়াছিলেন। হাদীস চর্চকারীদের মধ্যে কোন হাদীস সম্পর্কে মতবিরোধের সৃষ্টি হইলে এই গ্রন্হই যেন উহার চূড়ান্ত মীমাংসাকারী হইতে পারে; হাদীসসমূহের সনদ সম্পর্কে ইহা এক নির্ভরযোগ্য দস্তাবেজ হইতে পারে, ইহাই ছিল তাঁহার ঐকান্তিক কামনা।

ইমাম আহমদের পুত্র আবদুল্লাহ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেনঃ

******************************************************

আপনি গ্রন্হ প্রণয়ন অপছন্দ করেন কেন? অথচ আপনি নিজেই মুসনাদ গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন?

ইহার জওয়াবে ইমাম আহমদ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি এই গ্রন্হখানিকে ‘ইমাম’ স্বরূপ প্রণয়ন করিয়াছি। লোকদের মধ্যে যখন রাসূলে করীম (স)-এর কোন সুন্নাত বা হাদীস সম্পর্কে মতভেদ হইবে তখন যেন তাহারা ইহার নিকট হইতে চূড়ান্ত মীমাংসা লাভ করিতে পার।[********************]

ইমাম আহমদের ভ্রাতুস্পুত্র হাম্বল ইবনে ইসহাক বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার সম্মানিত চাচা ইমাম আহমদ (র) আমাকে ও তাঁহার দুই পুত্র সালেহ ও আবদুল্লাহকে একত্রিত করিয়া আমাদের সম্মুখে এই মুসনাদ গ্রন্হখানি আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া শুনাইয়াছেন। আমাদের ব্যতীত অপর কেহ গ্রন্হখানি তাঁহার মুখে সম্পর্ণ শ্রবণ করিতে পারে নাই। তিনি আমাদিগকে বলিয়াছেন, ‘এই গ্রন্হখানিকে আমি সাড়ে সাত লক্ষেরও অধিক সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া সংকলিত ও প্রণয়ন করিয়াছি। রাসূলে করীম (স)-এর যে হাদীস সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ হইবে, সেই হাদীস পাওয়ার জন্যই তোমরা এই কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর (অর্থাৎ সেই হাদীসটি এই কিতাবে তালাশ ও সন্ধান কর)। ইহাতে যদি তাহা পাওয়া যায়, তবে তো ভালই, আর পাওয়া না গেলে উহাকে প্রামাণ্য বা প্রতিষ্ঠিত হাদীস মনে করা যাইবে না।[********************]

উপরিউক্ত দীর্ঘ উদ্ধৃতির শেষাংশে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উক্তিটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ। ইমাম যাহবী ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদের এই কথাটি সাধারণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণীয়। অন্যথায় মুসলিম, বুখারী, সুনান গ্রনহাবলী ও অন্যান্য জুজ গ্রন্হে আমরা এমন সব সহীহ হাদীস পাই, যাহা মুসনাদ গ্রন্হে নাই।[********************]

হাফেজ শামসুদ্দিন জজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) তাঁহার এই কথা দ্বারা হাদীসসমূহের মূলের দিকেই ইশারা করিতে চাহিয়াছেন। আর ইহা সত্য কথা। কেননা সম্ভবত এমন কোন হাদীসই নাই, যাহার ‘মূল’এই মুসনাদ গ্রন্হে উল্লিখিত হয় নাই।[********************]

ইমাম আহমদ সংকলিত হাদীস গ্রন্হখানি এই উচ্চ মর্যাদাই লাভ করিতে পারিত; কিন্তু তিনি নিজে ইহার সংকলন কার্য সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়া বহু সহীহ হাদীস এবং বহু সংখ্যক সাহাবীর বর্ণনা ইহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে নাই। হাফেজ ইবনে কাসীর এই সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ (র) সংকলিত এই মুসনাদ গ্রন্হখানি হাদীস বর্ণনা সূত্রের বিপুলতাও রচনাসৌকর্যে অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও ইহা হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সম্পূর্ণ বাদ পড়িয়া গিয়াছে। বরং বলা হয় যে, প্রায় দুইশত সাহাবীর বর্ণিত কোন হাদীসই ইহাতে উদ্ধৃত হয় নাই, অথচ বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হে তাঁহাদের বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************]

কিন্তু এইসব সত্ত্বেও মুসনাদে আহমদের বৈশিষ্ট্য কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। উহাতে যে স্বকপোলকল্পিত নিজস্ব রচিত ও অমুলক একটি হাদীসও নাই, তাহা সর্বসম্মত সত্য। ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখিয়াছেন, এই ধরনের একটি হাদীসও মুসনাদ গ্রন্হে নাই।[********************] পরন্তু সহীহ হাদীসসমূহের এতবড় সমষি।ট দ্বিতীয়টি নাই। হাফেজ নূরুদ্দীন হায়সামী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সহহি হাদীস হিসাবে মুসনাদে আহমদ অপর হাদীস গ্রন্হসমূহের তুলনায় অধিকতর সহীহ।[********************]

ইমাম আহমদ তাঁহার নিজের মানদণ্ডে ওযন করিয়া হাদীসসূহ সংকলন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আহমদ তাঁহার গ্রন্হে স্বীয় শর্তানুযায়ী বিশেষ সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করিবেন না বলিয়া সিদ্ধা্ন্ত করিয়াছিলেন।[********************]

পূর্বেই বলিয়াছি, ইমাম আহমদ নিজের জীবনে এই গ্রন্হখানিকে সর্বতোভাবে সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারেন নাই। এই কারণে ইহাতে ইমামপূ্রত আবদুল্লাহ এবং হাফেজ আবূ বকর আল-কাতীয়ী কর্তৃক সংযোজিত বহু হাদীস পরিদৃষ্ট হইতেছে।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এই বিরাট গ্রন্হখানির পূর্ণ সম্পাদনা এবং অধ্যায় ও বিষয়বস্তু দৃষ্টিতে পূনর্বিন্যাস করিয়াছেন। সম্প্রতি উহার বৃহদায়তন ২১ খণ্ডগ্রন্হ মিসর হইতে ‘ফতহুল রব্বানী’ নামে প্রকাশিত হইয়াছে এবং উহার সহিত তাঁহারই কৃত বিশদ ‘শারহ’ বুলুগুল আমানী’ নামে শামিল রহিয়াছে। আমাদের মতে বর্তমানে ইহা এক বিরাট তুলনাহীন হাদীস সম্পদ।

আহমদুল বান্না মুসনাদের হাদীসসমূহ সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

‘মুসনাদ’ গ্রন্হের হাদীস সমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া আমি দেখিলাম যে, ইহাতে মোট ছয় প্রকারের হাদীস রহিয়াছে। প্রথম আবূ আবদুর রহমান আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ বর্ণিত হাদীস, যাহা তিনি স্বয়ং ইমামের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। মূলত ইহাই মুসনাদে আহমদ এবং ইহা বর্তমান গ্রন্হের চার ভাগের তিন ভাগ।

দ্বিতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ ইমাম আহমদ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন। ইহার সংখ্যা অত্যন্ত কম।

তৃতীয়, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতা ছাড়া অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়াছেন, তাহা যাওয়ায়িদে আবদুল্লাহ’ বা ‘আদুল্লাহ সংযোজন’ নামে পিরিচিত। এই হাদীসের সংখ্যা বিপুল।

চতৃর্থ, যেসব হাদীষ আবদুল্লাহ নিজে তাঁহার পিতার সম্মুখে পাঠ করিয়াছেন ও তাঁহাকে শুনাইয়াছেন; কিন্তু তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে শুনেন নাই- ইহার সংখ্যাও কম।

পঞ্চম, যেসব হাদীস আবদুল্লাহ তাঁহার পিতার নিকট পাঠ করেন নাই, তাঁহা নিকট হইতে শুনিতেও পান নাই, বরং যাহা তিনি তাঁহার পিতার গ্রন্হে তাঁহার পিতার স্বতস্ত লিখিত অবস্থায় পাইয়াছেন- ইহার সংখ্যাও কম।

ষষ্ঠ, যেসব হাদীস প্রখ্যাত ও সর্ব জনমান্য মুহাদ্দিস হাফেজ আবূ বকর আল কাতায়ী কর্তৃক আবদুল্লাহ এবং তাঁহার পিতা ইমাম আহমদ ব্যতীত অপরাপর মুহাদ্দিসের নিকট হইতে বর্ণনা করিয়াছেন-ইহার সংখ্যা সর্বাপেক্ষা কম।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি