ধর্মীয় জীবন
আল্লাহ, রাসূল সা., কুরআন ও আখিরাতে বিশ্বাস ইত্যাদিকে ধর্মীয় বিষয় অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুসলমানের জীবনে দুনিয়ার যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা ঐসব বিশ্বাসের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় বলে তাদের ধর্মীয় জীবন দুনিয়ার অন্যান্য দিক থেকে আলাদা নয়। নামায-রোযা বাস্তব জীবনকে আল্লাহর মর্জিমতো চলার যোগ্য বানায়। নামায-রোযা হিন্দু ধর্মের পূজা ও উপবাসের মতো বাস্তব জীবন থেকে সম্পর্কহীন নয়।

খ্রিস্টানরা ‘গড’কে বিশ্বাস করে, যিশুখ্রিস্টকে গডের পুত্র বলে মনে করে, রবিবারে গির্জায় উপাসনা করে। তাদের এসব ধর্মীয় বিষয়ের সাথে তাদের বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ঐসব ধর্মীয় বিষয়ের কোনো প্রভাব নেই। তাদের ধর্মীয় জীবন তাদের দুনিয়াদারী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

হিন্দুরা ভগবানে বিশ্বাস করে, দেব-দেবীর পূজা করে, মন্দিরে উপাসনা করে। কিন্তু তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশ শাসনের সাথে ঐসব ধর্মীয় কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।

ইসলাম ঐ জাতীয় কোনো ধর্ম নয়। তাই মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের গোটা জীবনকে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকা অনুযায়ী পরিচালনা করার তাগিদ দেয়। তাদের নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যাপন করার অভ্যাস শিক্ষা দেয়।

মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনকে বিশেষ যত্নের সাথে উন্নত করা দরকার; যাতে তাদের বাস্তব জীবন তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী চলে এবং নামায-রোযা তাদের দুনিয়ার জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে।

তাই মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে যা যা করা উচিত তা উল্লেখ করছিঃ

১. ছোট বয়সেই কুরআন শুদ্ধ উচ্চারণে পড়া শিখতে হবে।

২. মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআতের সাথে আদায়ের অভ্যাস করতে হবে। বড়রা নামাযে যাওয়ার সময় যেন ছোটদেরকে আদর করে সাথে নিয়ে যায়।

৩. প্রতিদিন ফজরের পর কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে এবং যতটুকু সম্ভব কুরআন বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।

৪. নামাযের পর দোয়া কবুল হয়ে ‍থাকে। তাই অল্প সময় হলেও পিতা-মাতা ও সন্তানদের জন্য দোয়া করতে হবে।

৫. সামান্য লেখাপড়া জানলেও ইসলামী বই সব সময় সাথে রাখতে হবে, যাতে যখনই সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়, ইসলামের জ্ঞান বাড়ানো যায়। আসলে মুসলিমের জীবনে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ইসলাম সম্পর্কে বেশি বেশি জানা।

৬. কোন্‌টা করা উচিত, কোন্‌টা করা উচিত নয়, তা বোঝার যোগ্যতা বিবেকের আছে। তাই বিবেকের বিরুদ্ধে চলবে না- এ ফায়সালা করতে পারলে নিজেকে মন্দ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, পাপ কী? তিনি এ প্রশ্নের জবাব একবার দিলেন এভাবে- ‘‘তোমার বিবেকে যা খট্‌কা লাগে তা-ই গুনাহ।’’ আরেকজনকে এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস কর’। তাই বিবেকের শক্তি বাড়াতে হবে। বিবেকের বিরুদ্ধে চলতে থাকলে বিবেক দুর্বল হতে থাকে। আর বিবেকের কথামতো চলতে থাকলে বিবেক শক্তিশালী হয়। বিবেকই রূহ ও আসল মানুষ।

৭. মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার আলেম শিক্ষকের সাথে মহব্বতের সম্পর্ক রাখতে হবে। তাহলে দীনের কথা যা জানা নেই, তাদের কাছ থেকে তা জানা সহজ হবে।

৮. আয়-রোজগার হালাল পথে তালাশ করতে হবে। রাসূল সা. বলেছেন, হারাম আয়ের দ্বারা শরীরে যতটুকু রক্ত-মাংস হয় তা দোযখে যাবে। এর মানে হলো হারাম খেলে দোযখে যেতে হবে। এ বিষয়টা মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হবে।

৯. ঈমান, ইলম ও আমলের চর্চা করে এমন কোনো সংগঠন এলাকায় থাকলে এর সাথে মিলে কাজ করতে হবে। একের বেশি সংগঠন থাকলে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে যেটা বেশি ভালো মনে হয় এর সাথেই কাজ করতে হবে। কারণ ইসলামী সংগঠন করা ফরয।

১০. শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করতে হবে। এর দ্বারা আল্লাহর সাথে মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেষ রাতের দোয়া বেশি কবুল হয়। শেষ রাতে সবাই যখন ঘুমায় তখন আল্লাহ ডাকতে থাকেন- ‘‘কে আছ আমাকে ডাক, সাড়া দেব; কে আছে গুনাহ মাফ চাও, মাফ করে দেব।’’ এভাবে আল্লাহর সাথে এমন সম্পর্ক হয় যে, সব সময় তাঁরই উপর ভরসা করে ঈমানী শক্তি বাড়ানো যায়।

শেষরাতে আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়ার সেরা সময় ও সুযোগ রয়েছে। দুনিয়া ও আখিরাতেও সবকিছু শুধু তাঁর কাছেই চাইতে থাকলে অন্য কারো সাহায্যের দরকার হয় না। তাঁর দরবারে মন খুলে সব বলা যায়। শেষরাতে গুনাহ মাফ চেয়ে কাঁদতে যে মজা পাওয়া যায় তা মনে তৃপ্তি দেয়। সূরা ফাতিহায় إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ পড়া হয়। এর মানে ‘‘শুধু তোমারই গোলামি করি, আর শুধু তোমারই সাহায্য চাই।’’ আল্লাহর শেখানো এ কথা অনুযায়ী শুধু তাঁরই নিকট হাত পেতে রাখলে দুনিয়া ও আখিরাতের সব কল্যাণ পাওয়ার আশা করা যায়।

তাওবা
আরবী ‘তাওবা’ শব্দটির অর্থ হলো ফিরে আসা। মানুষ যখন বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তখন সে গুনাহ করে। আর গুনাহ করলে সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। যে পরিমাণ গুনাহ করা হয় আল্লাহর সাথে সে পরিমাণ দূরত্বই সৃষ্টি হয়।

যেমন- ছেলে পিতার হুকুম অমান্য করলে সে নিজেই টের পায় যে, সে পিতা থেকে দূরে সরে গেছে। তখন সে বাবার সামনে আসতে সাহস পায় না, পালিয়ে থাকার চেষ্টা করে। যদি সে সাহস করে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বা তার পায়ে ধরে কেঁদে কেঁদে মাফ চায় এবং আর কখনও এমন করবে না বলে ওয়াদা করে, তাহলে ঐ দূরত্ব আর বাকি থাকে না। পিতা তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন, তার চোখ মুছে দেন এবং ছেলে অবাধ্য হওয়ায় তার মনে যে রাগ ছিল তা চলে যায়। এমন কি এরপর থেকে অনুতপ্ত ছেলের প্রতি তার স্নেহ আগের চেয়েও বেড়ে যায়।

এ উদাহরণ থেকেই তাওবা’র অর্থ সহজে বোঝা যায়। তাওবা মানে আল্লাহর কাছে ফিরে আসা। তিনটি কাজ মিলে তাওবা পূর্ণ হয়ঃ

১. যখনই কোনো গুনাহের কাজ হয়ে যায় তখন আর দেরি না করে অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে। আফসোস করতে হবে (হায় হায়! আমি এটা কী করলাম?) এবং আল্লাহর নিকট লজ্জিত হতে হবে।

২. কাতরভাবে চোখের পানি ফেলে কৃত গুনাহর জন্য মাফ চাইতে হবে।

৩. আর কখনও এমন কাজ করব না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আবার গুনাহ হয়ে গেলে আবার তাওবা করতে হবে এবং নিজের উপর কিছু জরিমানাও ধার্য করতে হবে। যেমন- কয়েক রাকাআত নফল নামায, কিছু নফল রোযা ও আল্লাহর পথে কিছু খরচ করা। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে তিনি নিষেধ করেছেন। যত বড় গুনাহ-ই হয়ে যাক, হতাশ না হয়ে অনবরত তাওবা করতে হবে। আল্লাহ মানুষের নিকট এ দাবি করেননি যে, কোনো সময়ই যেন তোমাদের থেকে কোনো গুনাহ না হয়। কারণ, নবী ছাড়া সবারই গুনাহ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ যা চান তাহলো গুনাহ হওয়ার সাথে সাথেই যেন তাওবা করা হয়। রাসূল সা. স্বয়ং রোজ ৭০ বার গুনাহ মাফ চেয়েছেন। অথচ তাঁর কোনো গুনাহ-ই ছিল না।

সামাজিক জীবন
শহরে হোক আর গ্রামেই হোক, মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে বসবাস করে। এ রকম কতক বাড়ি মিলে কাছাকাছি যারা থাকে, তাদের এলাকাকে শহরে মহল্লা বলে, গ্রামে বলে পাড়া। শহরে কয়েকটি মহল্লা মিলে একটি ওয়ার্ড গঠিত হয়। গ্রামেও কয়েকটি গ্রাম মিলে ইউনিয়নের একেকটি ওয়ার্ড হিসেবে গণ্য হয়।

যারা কাছাকাছি এলাকায় থাকে, চলাফেরা করতে ও হাট-বাজারে যেতে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, এসব পরিচিত মহলকেই সমাজ বলা যায়। মুসলিম সমাজের কেন্দ্র হলো মসজিদ। মুসলমানরা যে এলাকায় বসবাস করে সেখানে জামাআতে নামায আদায় করার জন্য অবশ্যই মসজিদ তৈরি করা হয়। শহরে প্রতি মহল্লায়ই মসজিদ দেখা যায়। বড় গ্রাম হলে এক গ্রামে একাধিক মসজিদও থাকে।

একটি মসজিদে যতটুকু এলাকার লোক জুমুআর নামাযে একত্র হয়, তাদেরকে ঐ মসজিদের ভিত্তিতে একটি সমাজ হিসেবে গণ্য করা যায়। মুসলিম সমাজের কেন্দ্র মসজিদ হওয়াই স্বাভাবিক। মুসলিমদের সমাজজীবনের বিধি-বিধান কেমন তা আলোচনা করছিঃ

১. ঐ সমাজের এলাকায় যারা থাকে তাদের মধ্যে পুরুষদের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাআতে আদায় করা উচিত। অন্তত জুমুআর নামাযে হাজির হওয়া জরুরি। জুমুআর নামাযে মহিলাদের ব্যবস্থা থাকলে তারা সপ্তাহে একদিন ইসলামের কিছু কথা শিখতে পারবে। সমাজের সবাই সবার সাথে মেলামেশা করলে একে অপরের সাথে আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নামায এ সুযোগই এনে দেয়।

২. যারা নিয়মিত নামাযে আসে তাদের কেউ যদি এক দিন না আসে তাহলে তার খোঁজ নেওয়া উচিত। হয়ত অসুখ হয়েছে। রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তাকে সাহস দেওয়া সওয়াবের কাজ বলে রাসূল সা. বলেছেন। মসজিদে রোগীর জন্য দোআ করার নিয়ম চালু থাকা উচিত।

৩. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যে পেট ভরে খায়, আর তার প্রতিবেশী ভুখা থাকে সে ঈমানদার নয়।’’ এর দ্বারা জানা গেল, প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর রাখা ঈমানী দায়িত্ব। গরীবদের সাহায্যের জন্য মসজিদ কমিটি একটা তহবিল গড়ে তুলতে পারে। মসজিদ এলাকার সমাজে তা থেকে সাহায্য দিলে ঐ ঈমানী দায়িত্ব পালন করা সহজ হয়। কুরআনে বারবার ‘‘নামায কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর’’ কথাটি একসাথে বলা হয়েছে। নামাযের সাথে যাকাতের কথা বলার মধ্যে ইশারা পাওয়া যায় যে, মসজিদ কমিটির ঐ তহবিলে যাকাতও নেওয়া যেতে পারে; যাতে গরীবদেরকে সাহায্য করা যায়।

৪. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘তোমরা যদি কাউকে কোনো মন্দ কাজ করতে দেখ, তাহলে ক্ষমতা থাকলে হাত দিয়ে তা বন্ধ কর। এ ক্ষমতা না থাকলে মুখে বলে বুঝিয়ে ঐ কাজ থেকে তাকে ফেরাও। যদি এ ক্ষমতাও না থাকে তাহলে মনে মনে ঐ কাজটিকে বন্ধ করার চিন্তা-ভাবনা কর। এটুকু করা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের প্রমাণ।’’

সমাজে খারাপ কাজ অল্প লোকেই করে। কেউ বাধা না দিলে ঐ কাজ বাড়তে থাকে। সমাজকে মন্দ কাজ থেকে রক্ষা করা সবারই ঈমানী দায়িত্ব। যারা মন্দ কাজ পছন্দ করে না, তারা মন্দ কাজের বিরুদ্ধে একজোট হলে তা সহজেই বন্ধ করা যায়।

মসজিদের ইমাম ও মসজিদ কমিটি মুসল্লীদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচাতে পারে।

৫. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যারা বড়দের সম্মান করে না ও ছোটদের আদর করে না তারা আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।’’ সমাজের পরিবেশকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার জন্য এ অভ্যাস সবার মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে। যে বয়সে বড় তার সাথে সম্মানজনক ভাষায় কথা বলতে হবে ও তাকে আগে সালাম দিতে হবে। আর যে বয়সে ছোট তার সাথে স্নেহের ভাষায় কথা বলতে হবে। সামাজিক আদব-কায়দা সমাজের সবার মধ্যে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৬. মানুষের দোষ তালাশ করে বেড়ানোর বদ অভ্যাস সমাজকে কলুষিত করে। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করাকে কুরআনের ভাষায় ‘গীবত’ বলে। সূরা আল হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে গীবত বা পরনিন্দাকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ঐ সূরার ১১ নং আয়াতে একে অপরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে ও মন্দ নামে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে। এসব অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এ জাতীয় লোককে এ থেকে বিরত করা জরুরি।

৭. যেকোনো কারণেই হোক, সমাজে ঝগড়া-বিবাদ হতেই পারে। সূরা হুজুরাতের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা কঠোর হুকুম দিয়েছেন যে, বিবাদ দেখা দিলে এর মীমাংসা করতে হবে। বিবাদ বাড়তে দিলে দু’পক্ষে দু’দল জোটে যেতে পারে। মীমাংসা করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে, একপক্ষ বাড়াবাড়ি করছে, তাহলে জোর করে তাদেরকে থামিয়ে দিতে হবে। এতে বোঝা গেল, সমাজকে সংগঠিত অবস্থায় থাকতে হবে, যাতে বিবাদ লাগলে মীমাংসা করা সম্ভব হয়।

বিভিন্ন কারণে সমাজের কিছু লোককে অন্য সবাই মুরব্বি হিসেবে মানে। তারাই সমাজে বিচার-আচার করে। মসজিদ কমিটিও এ কাজটি করতে পারে। মুরব্বি ধরনের লোকেরা যদি মসজিদে নামাযে যায়, তাহলে তারাই তো কমিটির মধ্যে শামিল থাকবে।

গ্রামাঞ্চলে আজকাল ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতারা বিচার-মীমাংসার দায়িত্ব পালন করেন। ঝগড়া-বিবাদই সমাজের শান্তি বিনষ্ট করে। তাই ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসার সুবন্দোবস্ত থাকা খুবই জরুরি। তাহলে আদালতে মামলা-মোকদ্দমা অনেক কমে যাবে।

কুরআন ও হাদীস থেকে সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য যে ক’টি বিধি-বিধান উপরে তুলে ধরা হয়েছে, এসব যত মূল্যবানই হোক, এর কোনোটাই আপনা-আপনি সমাজে চালু হতে পারে না। এর জন্য যাদের দায়িত্ব পালন করা কর্তব্য, তারা হলেন- মসজিদের ইমাম, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারী ও মেম্বারগণ, মুরব্বি হিসেবে যারা গণ্য এবং ইউনিয়নের নির্বাচিত নেতাগণ।

এসব দায়িত্বশীলের কারো না কারো গোপন সমর্থন ছাড়া সমাজবিরোধী কোনো মন্দ কাজ চালু থাকতে পারে না। তাই সমাজকে সুন্দর শান্তিময় ও সুস্থ রাখতে হলে দায়িত্বশীলদের কেউ যাতে মন্দ কাজের পক্ষ হয়ে না যায়, সেদিকে অন্য দায়িত্বশীলদের কড়া নজর রাখতে হবে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হলে কেউ এর কুফল থেকে বাঁচতে পারবে না। তাই সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

 

রাজনৈতিক জীবন
রাজনীতি মানে রাজ্য বা রাষ্ট্র সম্পর্কীয় বিষয়। একটা দেশের শাসন এমনিতেই চলে না। প্রত্যেক দেশেই গভর্নমেন্ট বা সরকার দেশ পরিচালনা করে। কীভাবে দেশ চলবে- এ ব্যাপারে যেসব বিষয়ে চর্চা করা হয়, সেসবকেই রাজনীতি বলা হয়। বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে জনগণ ভোটের মাধ্যমে যে দলকে ক্ষমতায় বসায়, সে দলই দেশটি শাসন করে।

রাজনৈতিক দলগুলো যা কিছু করে, সেসবকেই রাজনীতি বলা হয়। রাজনৈতিক দল ভালো হলে তাদের কাজে জনগণ খুশি হয়, আর খারাপ হলে তাদের কাজে বিরক্ত হয়। ভোটের সময় টের পাওয়া যায়, জনগণ কোন্‌ দলকে বেশি পছন্দ করে।

এককালে রাজা-বাদশাহরা দেশ শাসন করত। হয়তো ‘রাজা’ শব্দ থেকেই ‘রাজনীতি’ শব্দ গঠিত। তবে রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, নীতির রাজাই হলো রাজনীতি। যেমন- রাজহাঁস মানে রাজার হাঁস নয়, হাঁসের রাজা।

নীতি মানে নিয়ম। দেশ কোন্‌ নিয়মে চলবে এর ফায়সালা করে রাজনীতি। এমনকি দেশে কোন্‌ কোন্‌ নীতি থাকবে আর কোন্‌ কোন্‌ নীতি থাকবে না, তা-ও রাজনীতিই বিদ্ধান্ত নেয়। তাই রাজনীতিই হলো নীতির রাজা। সকল নীতির উপরেই রাজনীতির অবস্থান।

মুসলিম জাতির রাজনীতি
যারা মুসলিম তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.-কে সকল বিষয়েই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার হুকুম দিয়েছেন। রাসূল সা.-ই একমাত্র আদর্শ নেতা। তিনি যেভাবে রাজনীতি করেছেন সেভাবেই মুসলমানদের রাজনীতি করা কর্তব্য। রাসূল সা. মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করে ১০ বছার ঐ রাষ্ট্র শাসন করেছেন। তিনিই ইসলামী সরকারের প্রধান ছিলেন। তিনি রাসূল হিসেবে যে নীতিতে শাসন করেছেন, সে নীতিতে শাসন করাই মুসলিম জাতির জন্য ফরয। মুসলিমদেরকে সব কাজই আল্লাহর হুকুম ও রাসূল সা.-এর তরীকা অনুযায়ী করতে হবে। তাই মুসলিম শাসকদের রাসূল সা.-এর নীতি অনুযায়ীই রাজনীতি করা কর্তব্য।

সূরা আন্‌ নিসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে যে নীতিতে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, তা তিনি স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন। ঐ আয়াতের অনুবাদ হলোঃ

‘‘হে ঐ সব লোক, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহকে মেনে চল এবং রাসূলকে মেনে চল। আর তোমাদের মধ্যে যাদের হুকুম দেওয়ার অধিকার আছে, তাদেরকেও (মেনে চল)। তারপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং শেষ প্রতিফলের দিক দিয়েও এটাই ভালো।’’

এ আয়াতটিতে মুসলমানদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল দিকের জন্যই বিধান দেওয়া হয়েছে। এ আয়াত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য মোট ৬ টি মূলনীতি পাওয়া যায়ঃ

১. এ রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকারকে সবসময় আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো রকম আপত্তি করার অধিকার কারো নেই।

২. রাসূল সা. যে নিয়মে শাসন করেছেন, সে নিয়মেই সরকারকে সকল দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ব্যাপারেও কোনো আপত্তি করা চলবে না।

৩. সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের উপর যেসব হুকুম জারি হয়, তা-ও সবাইকে মানতে হবে। তবে আল্লাহ ও রাসূলের ব্যাপারে আপত্তি করার অধিকার না থাকলেও সরকারের হুকুমের ব্যাপারে জনগণের আপত্তি করার অধিকার আছে।

৪. কেউ যদি সরকারের কোনো হুকুমকে আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের তরীকাবিরোধী মনে করে, তাহলে নির্দিষ্ট বিশেষ আদালতে আপত্তি জানাতে পারবে। আদালতে উভয় পক্ষের কথা শুনে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী যে রায় দেবে তা সবাইকে মেনে নিতে হবে।

নামাযে যেমন ইমাম সাহেবের কোনো ভুল হলে মুক্তাদীকে ভুল সংশোধনের জন্য আল্লাহু আকবার বা সুবহানাল্লাহ বলে আপত্তি জানাতে হয় (একে লুকমা দেওয়া বলা হয়), তেমনি সরকারের কোনো ভুল দেখলেও আদালতে আপত্তি জানাতে হবে।

আমরা যে ইমামের পেছনে নামায আদায় করি, তিনি আসল ইমাম নন। আসল ইমাম রাসূল সা.। তিনি যে নিয়মে নামায আদায় করেছেন, সব ইমামকে ঠিক ঐভাবেই নামায আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে ইমাম ভুল করলে ইমামকে সংশোধন করতে হবে। তেমনি ইসলামী-রাষ্ট্রের সরকারকে রাসূল সা.-এর নিয়মেই দেশ শাসন করতে হবে। কারণ, আসল শাসক রাসূল সা.-ই।

নামাযে ইমাম ভুল করলে তাকে ধমক দিয়ে বা রাগ দেখিয়ে বা গালমন্দ বলে সংশোধন করার শিক্ষা রাসূল সা. দেননি। অত্যন্ত ভদ্র ও সভ্য নিয়ম শেখানো হয়েছে। তেমনিভাবে সরকার ভুল করলে সভ্য ভাষায় আদালতকে জানাতে হবে। জনগণকে জানানোও দূষণীয় নয়। কুরআন ও হাদীসের যুক্তি দেখিয়ে ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। অভদ্র ভাষায় আপত্তি জানানোর দরকার কী? গাল-মন্দই বা করতে হবে কেন?

৫. ঐ আয়াতে থেকে আরো জানা গেল, সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর জন্য এমন আদালত থাকতে হবে, যা সরকারের অধীন নয়। সরকারের অধীন আদালত সরকারের মতের বিরুদ্ধে রায় দিতে সাহস করবে না। এতে প্রমাণ হলো যে, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখার বিধান কুরআনই দিয়েছে।

৬. ঐ আয়াত থেকে এ বিধানও পাওয়া যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের মূল শাসক মুসলমানদের মধ্য থেকেই হতে হবে। মুমিনদেরকে ডেকে বলা হয়েছে, ‘‘তোমাদের মধ্যে যাদের হুকুম দেওয়ার অধিকার আছে, তাদেরকেও মেনে চল।’’ ইসলামী রাষ্ট্র যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক শাসন করতে হয়, সেহেতু কুরআন-হাদীসে বিশ্বাসী ও জ্ঞানী লোকদের উপরই এ দায়িত্ব দিতে হবে। যেকোনো সাধারণ মুসলমান এ দায়িত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।

তবে ইসলামী রাষ্ট্রে যেসব দায়িত্ব পালনে কুরআন-হাদীসে জ্ঞানী হওয়া জরুরি নয়, সেসব বড় পদে অমুসলিম নাগরিকদেরও নিয়োগ করা যায়।

ইসলামী সরকারের ৪ দফা কর্মসূচি
আল্লাহ তাআলা সূরা আল হাজ্জ-এর ৪১ নং আয়াতে মুসলিম শাসকদেরকে ৪ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। এ কর্মসূচি যে সরকার ঠিকমতো পালন করে, সে সরকারই আল্লাহ তাআলার নিকট ইসলামী সরকার হিসেবে গণ্য। আয়াতটির অনুবাদ নিম্নরূপঃ

‘‘তারাই ঐসব লোক, যাদেরকে যদি আমি দুনিয়াতে ক্ষমতায় বসাই, তাহলে তারা নামায কায়েম করে, যাকাত চালু করে, ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর সকল বিষয়ের শেষ ফল আল্লাহরই হাতে।’’

১. ইসলামী সরকারের পয়লা কাজ হলো, দেশে নামায কায়েম করা। এর আগে নামাযের আলোচনায় সূরা আনকাবূতের ৪৫ নং আয়াতে ও সূরা তোয়াহার ১৪ নং আয়াতে নামাযের যে উদ্দেশ্য বলা হয়েছে তাতে বোঝা গেল, নামায চরিত্রকে উন্নত বানায়। এ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, জনগণের চরিত্র গঠন করাই ইসলামী সরকারের পয়লা দায়িত্ব। সরকারের পয়লা কাজই হলো মানুষকে ভালো ও নেককার বানানো।

সরকারিভাবে নামায কায়েমের দায়িত্ব পালন করলে-

ক. সকল সরকারি অফিসে নিয়মিত জামাআতে নামাযের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল মুসলমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জামাআতে শরীক হতে হবে।

খ. সরকারি হুকুমের ফলে দেশে সকল প্রতিষ্ঠানে জামাআতে নামাযের সুব্যবস্থা থাকবে।

গ. জামাআতে নামায আদায় করার জন্য সব স্থানে মসজিদ তৈরী হবে।

ঘ. ছোট বয়স থেকে সকল মুসলিম ছেলেমেয়েকে শুদ্ধভাবে নামায শেখানোর সুব্যবস্থা করতে হবে।

ঙ. নামায যে শুধু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয় এবং নামাযের উদ্দেশ্য যে উন্নত চরিত্র গঠন করা, সে বিষয়ে সবাই সচেতন হবে।

চ. এমন পরিবেশ গড়ে উঠবে, সবাই নিয়মিত জামাআতে হাজির হওয়ার জন্য তৎপর হবে।

ছ. মুসলমানদের উন্নত চরিত্র দেখে অমুসলিমরাও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে। কারণ, সকল মানুষই উন্নত চরিত্রের প্রশংসা করে।

চরিত্রের গুরুত্ব
মানুষের আসল পরিচয়ই হলো নৈতিক জীব। যে বিবেকের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করে না, সে-ই ভালো মানুষ। যে সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা যত বেশি, সেখানে অশান্তি তত কম। যদি সমাজে চুরি-ডাকাতি না থাকে, কেউ কাউকে ঠকাতে চেষ্টা না করে, কেউ কারো ক্ষতি না করে, তাহলে সেখানে সবাই শান্তিতে থাকবে।

সরকারের প্রথম দায়িত্ব হলো, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েম করা। দেশের মানুষ যদি চরিত্রবান হয় তাহলে সরকারের এ দায়িত্ব পালন সবচেয়ে সহজ হয়। এজন্য ইসলামী সরকারের এ মহান দায়িত্ব পালনের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো জনগণের চরিত্র গঠন করা। তাই নামায কায়েম করা ইসলামী সরকারের ৪ দফা কর্মসূচির পয়লা দফা।

২. ইসলামী সরকারের দ্বিতীয় দফার কাজ হলো, যাকাতব্যবস্থা চালু করা। মদীনায় ইসলামী সরকার কায়েম হওয়ার আগে যাকাতের হুকুমই আসেনি। কারণ, যাকাতের যে উদ্দেশ্য, তা ইসলামী সরকার ছাড়া পূরণ হতে পারে না। রাসূল সা. ও প্রথম চার খলীফা যাকাতব্যবস্থা চালু করে দেশের সব মানুষের অভাব দূর করেছেন। কোনো না কোনো কারণে যাদের ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির খরচ যোগাড় করা সম্ভব হয় না, তাদের এ অভাব দূর করার দায়িত্ব সরকারের। এ দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই যাকাত ফরয করা হয়েছে। যাদের উপর যাকাত ফরয, তাদের কাছ থেকে সরকার যাকাত উসুল করবে এবং যাদের যাকাত পাওয়ার হক রয়েছে, তাদের কাছে যাকাতের টাকা পৌঁছিয়ে দেবে। তাহলে দেশে কেউ ভাত, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।

৩. ইসলামী সরকারের তৃতীয় দফার কাজ হলো, জনগণকে ভালো কাজ করার হুকুম দিতে থাকা। যারা ওয়াজ করেন, তারা জনগণকে ভালো কাজ করার উপদেশ দিতে পারেন; কিন্তু ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দেয় এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সহজেই তা চালু হতে পারে। যেসব কাজ মানুষের জন্য উপকারী ও যা করলে জনগণের সুখ-শান্তি বাড়ে সেসব কাজ দেশে চালু করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তাহলে জনগণ উৎসাহের সাথে ঐসব কাজে শরীক হবে।

জনগণের মধ্যে শিক্ষা ব্যপক প্রসার, স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা, যাতায়াতব্যবস্থা সহজ ও উন্নত করা, সকলকে এমন সব কাজ শেখার সুযোগ দান করা, যাতে সবাই আয়-রোজগার করতে পারে এবং কাউকেই বেকার থাকতে না হয়। এমন সব কাজ, যা যুবকদের চরিত্র উন্নত করাতে সহায়ক হয় ইত্যাদি।

৪. ইসলামী সরকারের চতুর্থ দফার কাজ হলো, সব রকম মন্দ কাজ বন্ধ করা। যেসব কাজ নৈতিকতাবিরোধী, যা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে, যা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, যা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে- এ জাতীয় কোনো কাজ যাতে দেশে চালু হতে না পারে, সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কোথাও এ ধরণের কোনো কাজ হচ্ছে বলে জানার সাথে সাথে তা বন্ধ করতে হবে।

যারা ওয়াজ করেন তারা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিতে পারেন। কিন্তু মন্দ কাজ বন্ধ করা বা যারা করে তাদেরকে নিষেধ করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ কাজ সরকারকেই পালন করতে হবে।

কতক লোক এমনও আছে, যারা ধর্মের নামে এমন কিছু রসম-রেওয়াজ চালু করে, যা শরীআতের বিচারে শির্‌ক ও বিদআত হিসেবে গণ্য এবং কুরআন-হাদীসে এসবের পক্ষে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই; বরং এসব কুরআন-হাদীসবিরোধী। ধর্মীয় ব্যবসা হিসেবেই এসব চালু থাকে। এ সবের মাধ্যমে কতক লোক জনগণ থেকে অন্যায়ভাবে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। হকপন্থি আলেকমগণ এসবের বিরুদ্ধে যত ওয়াজ-নসীহতই করেন, তাতে এসব বন্ধ হয় না। কারণ, আলেম নামধারী ধর্ম-ব্যবসায়ীরাই অশিক্ষিত জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ঐসব কাজে শরীক করে। এসব মন্দ কাজ ইসলামী সরকার ছাড়া কারো পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। রাসূলের জন্মভূমি সৌদি আরবে পর্যন্ত এ জাতীয় অনেক শির্‌ক ও বিদআতী কাজ চালু ছিল। বাদশাহ আবদুল আযীয আল সউদের সরকার ঐসব থেকে দেশকে পবিত্র করেন। মদীনার ‘জান্নাতুল বাকী’ নামক কবরস্থানে বড় বড় সাহাবীগণের কবর পাকা করে মাজার-পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সৌদি সরকার সেসব ভেঙে রাসূল সা. এর হুকুম চালু করেন।

বর্তমান যুগে বিশ্বের সরকারগুলোর অবস্থা
মাত্র অল্প কয়েকটি মুসলিম দেশ ছাড়া দুনিয়ার সব দেশেই, এমনকি মুসলিম দেশেও সরকারিভাবে পবিত্র কুরআনে দেওয়া ঐ ৪ দফার কোনো দফার কাজ চালু নেই; বরং সরকারী সাহায্যেই বহু মন্দ কাজ সব দেশে ব্যাপকভাবে চালু আছে। সরকারি টেলিভিশনেও চরিত্র ধ্বংসকারী বেহায়াপনা বেড়েই চলছে। তাই অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা কমার কোনো কারণ নেই।

শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যোগ্য লোক তৈরী করা হচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে সৎলোক হিসেবে গড়ে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। সততা তো এমনিতেই পয়দা হতে পারে না। এর জন্য বিশেষ চেষ্টা করতে হয়। যেমন-বিনা চেষ্টায় বাগান তৈরী হয় না। জঙ্গল আপনা-আপনিই গজাতে পারে।

যোগ্যতার সাথে যদি সততা শিক্ষার ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে যেগ্য অসৎ লোকই তৈরী হতে থাকবে। যেগ্য লোক যদি অসৎ হয়, তাহলে সে যোগ্যতার সাথেই অসৎ কাজ করবে। বাস্তবে এটাই হচ্ছে। আমাদের দেশ অশিক্ষিত লোকেরা চালাচ্ছে না। শিক্ষিত যোগ্য লোকেরাই উপর থেকে নিচ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থা চালাচ্ছে। দুর্নীতিতে সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশ ১৯৯৯ সাল থেকেই এক নম্বর আসন দখল করে আছে। এর জন্য কি অশিক্ষিতরা দায়ী?

তাই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইলে চরিত্রবান জাতি হিসেবে জনগণকে গড়ে তুলতে হবে। আর এটা সরকারকেই করতে হবে। ইসলামী সরকার কায়েম না হলে এবং কুরআনে ঘোষিত ৪ দফা অনুযায়ী দেশকে গড়ে না তুললে জনগণ সুখ-শান্তির মুখ কোনো দিন দেখতে পাবে না।

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার ১০ টি মূলনীতি
রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে ইসলাম যে বিধান দিয়েছে, এর ১০ টি মূলনীতির ৬ টি সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত থেকে পাওয়া। এ ৬ টির আলোচনা আগেই করেছি। এখানে ঐ ৬ টিকে সংক্ষেপে উল্লেখ করে বাকি ৪ টি একসাথে পেশ করছিঃ

১. আল্লাহর প্রভুত্ব বা সার্বভৌমত্ব- আইন রচনার আসল ক্ষমতা আল্লাহর। আল্লাহর আইনের অধীনেই অন্য সব আইন তৈরী করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন রচনা করা চলবে না।

২. রাসূল সা. এর নেতৃত্ব- যারাই সরকারি ক্ষমতায় থাকুন, তাদেরকে রাসূল সা. যেভাবে শাসন করেছেন সেভাবে শাসন করতে হবে।

৩. ঈমানদার, সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন- সরকারি ক্ষমতা এমন লোকদের হাতে থাকা দরকার, যারা রাসূল সা. ও চার খলীফার আদর্শ ও নীতি মেনে চলার যোগ্য এবং মেনে চলতে সচেষ্ট।

৪. সরকারের ভুল ধরার অধিকার- সরকার আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূল সা.-এর নেতৃত্ব ঠিকমতো মেনে চলছে কি না, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব সবার। প্রয়োজন হলে আপত্তি করার অধিকার জনগণের আছে বলে সরকারকে স্বীকার করতে হবে।

৫. স্বাধীন আদালত- সরকারের বিরুদ্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রায় দেওয়ার ক্ষমতা আদালতের হাতে থাকতে হবে।

৬. সরকারকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে।

৭. সরকারের মনগড়া হুকুম জারি করার কোনো অধিকার নেই। কুরআন ও সুন্নাহকে সকল হুকুমের মূল ভিত্তি মনে করতে হবে। এমন কোনো হুকুম জারি করা চলবে না, যা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী।

৮. আইনের শাসন কায়েম করতে হবে- শাসকদের মনগড়া শাসন নয়, তাদের প্রতিটি কাজ আইন মোতাবেক হতে হবে। আইনের চোখে সব নাগরিক সমান। মুসলিম ও অমুসলিম, শাসক ও জনগণ সবাই একই আইনের অধীন। আইনের নাগালের বাইরে কেউ নয়।

৯. মৌলিক-মানবিক অধিকার থেকে কোনো নাগরিক বঞ্চিত থাকবে না। জান ও মালের নিরাপত্তা, ইজ্জতের নিরাপত্তা, ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষালাভের অধিকার সকল নাগরিকেরই রয়েছে। মানুষ হিসেবে সম্মানের সাথে জীবননযাপনের সুযোগ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই অবশ্যই পালন করতে হবে।

১০. আদালতে আইনের বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা চলবে না। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কারে সাথে অপরাধীর মতো আচরণ করা যাবে না।

ইসলামী রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল
ইসলামী রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল থাকা দূষণীয় নয়। তবে সকল রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যে একই হতে হবে। দেশকে সঠিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালনা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে যে দলকে ক্ষমতায় বসায়, সে দলই শাসন করবে। সরকারের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করার উদ্দেশ্যে যেকোনো দল চেষ্টা করতে পারে। এটাও পবিত্র দায়িত্ব। তবে ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে।

নামাযে ইমামকে সংশোধন করার জন্য যে ভদ্র ও সভ্য নিয়ম রয়েছে, সরকারের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও সে নীতি চালু থাকা জরুরি। বিরোধীদলীয় রাজনীতির নামে যে নোংরামি, অসভ্যতা ও জঘন্য জৎপরতা দেখা যায়- এ জাতীয় রাজনীতি ইসলামী রাষ্ট্রে থাকার কথা নয়।

ইসলামী সরকারকে নির্বাচিত হতে হবে
রাসূল সা. দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার আগে কাউকে তাঁর খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করেননি। হযরত আবু বকর রা., ওমর রা., ওসমান রা. ও আলী রা. নিজেরা চেষ্টা করে খলীফা হননি। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁরা নির্বাচিত ছিলেন।

বর্তমানে নির্বাচনের যে চমৎকার নিয়ম দুনিয়ায় চালু চালু হয়েছে, ঠিক এ নিয়মে না হলেও তাঁরা অবশ্যই নির্বাচিত হয়েই খলীফার আসন গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁরা কেউ অনির্বাচিত শাসক ছিলেন না। তাঁদের কেউ শক্তিবলে ক্ষমতা দখল করেননি। তাঁদের সবাই বাছাই করা সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে সরকারি দায়িত্ব পালন করতেন।

মজলিসে শূরা
আল্লাহর নিকট থেকে রাসূল সা. যে ওহী পেতেন, সে অনুযায়ীই সরকারি দায়িত্ব পালন করতেন। এ সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানের ১৫৯ নং আয়াতে তাঁকে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করার আদেশ দিয়েছেন। যেসব ব্যাপার ওহীর মাধ্যমে কোনো আদেশ পেতেন না, সেসব বিষয়ে রাসূল সা. সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতেন।

পরামর্শ শব্দের আরবী হলো ‘শূরা’। যাদের সাথে পরামর্শ করতেন তাদেরকেই একসাথে মজলিসে শূরা বলা হয়। আধুনিক ভাষায় আইন সভা বা আইনপরিষদ বলা যায়। ইংরেজিতে পার্লামেন্ট বলা হয়। বাংলাদেশে ‘জাতীয় সংসদ’ বলে। এর মেম্বারগণকে এমপি বলা হয়। এমপিগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত।

ইসলামী সরকারের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত মজলিসে শূরা প্রয়োজন। এর সদস্যগণ জনগণের পক্ষ থেকে সরকারি দায়িত্ব পালন করবেন।

সরকার কাঠামো
সরকারের আকার বা কাঠামো যে রকমই হোক, যদি ইসলামী রাষ্ট্রব্যস্থার ১০ টি নীতি চালু থাকে তাহলে ঐ সরকারকেই ইসলামী সরকার বলা যায়।

দুনিয়ায় এ পর্যন্ত কয়েকটি আকার বা কাঠামোর সরকার চালু হয়েছেঃ

১. রাজতন্ত্র বা বংশগত বাদশাহী। কোনো এক বংশের লোক দেশের ক্ষমতায় বসল। ঐ বংশের নেতা রাজা বা বাদশাহ হিসেবে দেশ শাসন করল। এরপর ঐ বংশেরই রাজত্ব অনেক দিন চলল। এখনও (২০০৬ সাল) এ জাতীয় সরকার কতক দেশে চালু আছে।

রাসূল সা. ও প্রথম চার খলীফা এ জাতীয় সরকার কাঠামো চালু করেননি। অথচ ইসলামী সরকারের আদর্ তাঁরাই। তাই রাজতন্ত্র ইসলামী সরকারের সঠিক কাঠামো হতে পারে না।

২. সামরিক সরকার। সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত। বিদেশী আক্রমণ থেকে দেশকে হেফাজত করার জন্য তাদের হাতেই যুদ্ধের সকল সরঞ্জাম থাকে। তাই তারা যদি দেশ শাসনের ক্ষমতা দখল করতে চায়, তাহলে সহজেই সরকারি ক্ষমতায় বসতে পারে। ইসলামী সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে। সামরিক বাহিনী দেশ রক্ষার জন্য নিযুক্ত, দেশ-শাসনের জন্য নির্বাচিত নয়। তাই এটাও ইসলামী সরকারের জন্য উপযোগী নয়।

৩. গণতান্ত্রিক সরকার। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই গণতান্ত্রিক। বর্তমানে দু’ধরণের গণতান্ত্রিক সরকার দুনিয়ায় চালু আছে।

ক. প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার (Presidential Form of Govt.)। এ সরকার কাঠামোতে একই ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (আমেরিকা) ছাড়া এ জাতীয় সরকার কোনো দেশে গণতান্ত্রিক মানে চালু নেই। যেখানেই এ কাঠামো চালু হয়েছে, সেখানেই এক ব্যক্তির শাসন বা একনায়কত্ব কায়েম হয়েছে। তাই এ জাতীয় কাঠামোও ইসলামী সরকারের জন্য সঠিক নয়।

খ. সংসদীয় পদ্ধতির সরকার (Parliamentary Form of Govt.)। এ পদ্ধতি সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে চালু হয় এবং বর্তমানে যত দেশে মোটামুটি গণতান্ত্রিক সরকার চালু আছে, সবক’টি দেশেই এ পদ্ধতির সরকার কায়েম আছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে এ পদ্ধতির সরকারই চলছে। এতে নির্বাচিত সংসদ (পার্লামেন্ট) দেশ শাসন করে। সংসদে যে দলের এমপি’র সংখ্যা বেশি, সে দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রীই সরকারপ্রমাণ। এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব আরেকজনের হাতে থাকে। এ কাঠামো অনুযায়ী ইসলামী সরকার চলতে পারে।

ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার
আল্লাহ তাআলা মানুষকে ইচ্ছা ও চেষ্টার স্বাধীন ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষকে ইসলাম কবুল করতে বাধ্য করার ক্ষমতা নবীকেও দেওয়া হয়নি। ঈমান আনা মনের ব্যাপার। মনের উপর জোর চলে না। তাই জোর করে মুসলমান বানানোর চেষ্টা করতে আল্লাহ নিজেই নিষেধ করেছেন।

রাসূল সা. ও চার আদর্শ খলীফার শাসনকালে ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমও ছিল। তাদের ব্যাপারে যে নীতি তখন চালু ছিল তা খুবই ইনসাফপূর্ণ। সেসব হলোঃ

১. তারা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। এ ব্যাপারে তাদেরকে বাধা দেওয়ার কারো অধিকার নেই।

২. নাগরিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

৩. আদালতে বিচারের বেলায় একই আইন সবার উপর সমানভাবে চালু থাকবে।

৪. বিবাহ, তালাক, সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে কোনো ধর্মের লোক যদি তাদের ধর্মের নিয়ম পালন করতে চায়, তাহলে তাদেরকে এ সুযোগ দেওয়া হবে।

নির্বাচন পদ্ধতি
কোন্‌ নিয়মে নির্বাচন হতে হবে- এ বিষয়ে ইসলাম নির্দিষ্ট কোনো বিধান চাপিয়ে দেয়নি। প্রথম ও চতুর্থ খলীফা একই নিয়মে নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলীফা আরও দু’রকম নিয়মে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে বোঝা গেল, কোনো বিশেষ নিয়মেই নির্বাচন হতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই; তবে অবশ্যই ইসলামে নির্বাচন হতে হবে।

নির্বাচনের উদ্দেশ্য এটাই যে, জনগণ যেন স্বাধীনভাবে তাদের রায় জানানোর সুযোগ পায়। জোর করে ব্যালট-বাক্স দখল করে নিলে, জাল ভোট দিলেন, ভোট গণনার সময় কারচুপি করলে নির্বাচনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। যাতে জনগণের স্বাধীন মত অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পায়, সে ব্যবস্থা করার জন্য যা করা জরুরি তা হলোঃ

১. ভোটারদের তালিকা সঠিকভাবে তৈরী করতে হবে।

২. জালভোট বন্ধ করার জন্য ফটোসহ প্রত্যেক ভোটারের পরিচয়পত্রের (আইডেনটিটি কার্ড) ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, সে কমিশনকে সরকারের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে।

৪. যে রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করে, নির্বাচনের সময় ঐ দলীয় সরকার বহাল থাকলে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় না বলে বাংলাদেশে একটা নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। একে ‘কেয়ার-টেকার সরকার’ (Care Taker Govt.) বলা হয়। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন নির্দলীয় অরাজনৈতিক কেয়ার-টেকার সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় মোটামুটি ভালো হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনে টাকার খেলা চলার কারণে নির্বাচন সম্পূর্ণ সন্তোষজনক হয়নি।

৫. ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে বিশেষ করে জার্মানি ও তুরস্কের মতো বড় দেশে এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে, যা টাকার খেলা বন্ধ করতে পারে। ঐ নিয়মে কোনো প্রার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে ভোট না দিয়ে দলকে ভোট দেওয়া হয়। ভোট গণনার পর যে দল যত ভোট পায়, সে অনুপাতে সংসদে আসন পায়। ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রার্থীর কোনো এলাকা নির্দিষ্ট থাকে না। তাই কোনো প্রর্থী এলাকায় টাকার জোরে বেশি ভোট যোগাড়ের চেষ্টা করে না। আমাদের দেশে এ পদ্ধতি চালূ হলে নির্বাচন আরও সুষ্ঠু হবে। এ পদ্ধতির নাম ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ (Proportional Representation)।

ইসলামে ভোটের গুরুত্ব
ভোট (VOTE) ইংরেজি শব্দ। এ অর্থ হলো রায় দেওয়া, সমর্থন করা, মত প্রকাশ করা, সম্মতি দান করা।

আমরা অনেক জায়গায়ই ভোট দেই। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বার ও স্কুল-মাদরাসা, ক্লাব-সমিতি প্রভৃতির কমিটি নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোট হলো জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ভোট দেওয়া।

ভোট দেওয়ার মানে কী? যে ভোট দেয় তার কী দায়িত্ব? যাকে ভোট দেওয়া হয় তার দায়িত্বই বা কী? যাকে ভোট দেওয়া হয় তার ভালো ও মন্দ কাজের জন্য কি ভোটদাতা দায়ী হবে? এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে একটি সহজ উদাহরণ দিচ্ছিঃ

কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি ইউনিয়নের এলাকা ধরা হয়। ইউনিয়নের জনগণের সেবা করার জন্য ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করা হয়। ইউনিয়ন কাউন্সিলের একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন মেম্বার থাকেন। ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর তারা ভোটার হয়। চেয়ারম্যান ও মেম্বার কারা হবে, তা নির্বাচনের মাধ্যমে ফায়সালা করা হয়। যারা বেশি ভোট পায়, তারা ইউনিয়নের নেতা হিসেবে গণ্য হয়।

ইউনিয়ান কাউন্সিলের দায়িত্ব কী- ইউনিয়নের জনগণ যাতে আরামে চলাফেরা করতে পারে, সেজন্য রাস্তা বানাবে; বৃষ্টির পানি যাতে খালে-বিলে চলে যায় এবং পানি জমে গিয়ে জনগণের চলাফেরায় যাতে অসুবিধা না হয় সে ব্যবস্থা করবে। ইউনিয়নে যাতে চুরি-ডাকাতি না হয় সেজন্য চৌকিদার দিয়ে পাহারা দেওয়াবে। ঝগড়া-ফাসাদ ও মারামারি যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে এবং ঝগড়া লাগলে আপস করিয়ে দেবে। এভাবে অনেক রকমের কাজ করার দায়িত্ব রয়েছে।

ইউনিয়ন কাউন্সিলকে স্থানীয় সরকার বলা হয়। এর অর্থ হলো ইউনিয়নের এলাকায় ইউনিয়ন কাউন্সিলই জাতীয় সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের সেবা করবে, যাতে সবাই সুখে-শান্তিতে ও মিলে-মিশে বসবাস করতে পারে।

গ্রামের স্থানীয় সরকারকে ইউনিয়ন কাউন্সিল বলে। শহরের স্থানীয় সরকারকে মিউনিসিপ্যালিটি বা পৌরসভা বলে। জেলা-শহর, উপজেলা-শহর এমনকি বড় কোনো বাজারেও পৌরসভা থাকে। বিভাগীয় শহরের স্থানীয় সরকারকে কর্পোরেশন বলে। যেমন-ঢাকা, চট্টপগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট বরিশাল। সকল স্থানীয় সরকারই সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়।

নির্বাচনে যারা ভোট পাওয়ার জন্য দাঁড়ায় তাদের মধ্যে এমন লোকও থাকতে পারে, যাকে জনগণ ভালো লোক মনে করে না; কিন্তু তার ধনবল ও জনবল থাকায় বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে যায়। কোনো অসৎ লোক যদি চেয়ারম্যান ও মেম্বার হয় তাহলে ক্ষমতা হাতে পেয়ে জনগণের সেবা করর বদলে নিজের স্বার্থ হাসিল করে। ইউনিয়নের উন্নয়নের জন্য সরকার যে টাকা-পয়সা দেয় তা থেকে অসৎ লোকটি টাকা মেরে দেয়। নির্বাচনের সময় যে টাকা সে খরচ করেছে, এরচেয়ে বেশি টাকা দুর্নীতি করে কামাই করে নেয়। ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঘুষ খেয়ে অবিচার করে। ক্ষমতার দাপটে কারো কারো উপর যুলুমও করতে পারে।

তাই ভোটদাতাদেরকে এ বিষয়ে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে- যাতে সৎ, চরিত্রবান ও যোগ্য লোক নির্বাচিত হয় এবং কোনো অসৎ লোক পাস করতে না পারে। যদি কোনো অসৎ লোক নির্বাচিত হয় তাহলে সে যত গুনাহের কাজ করবে আখিরাতে এর সমান শাস্তি তারাও ভোগ করবে, যাদের ভোটে সে পাস করেছে। আর যদি সৎ লোক পাস করে তাহলে সে যত ভালো কাজ করবে এর সওয়াব তারাও পারে, যারা তাকে ভোট দিয়েছে।

তাহলে দেখা গেল, নির্বাচনে ভোট দেওয়াটা খেল-তামাশার ব্যাপার নয়। এটা এক বিরাট পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে জনগণ সেবা পেয়ে দুনিয়ায় সুখ পাবে এবং ভোটদাতারা আখিরাতে পুরস্কার পাবে। এ কারণেই ইসলামী শরীআতে ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিরাট দায়িত্বপূর্ণ বিষয়।

এখন ভেবে দেখুন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্ব কত বেশি। যারা এমপি নির্বাচিত হন তারা সৎ হলে গোটা জাতি তার খিদমত পেয়ে সুখী হবে এবং ভোটদাতারা সওয়াব পাবে। আর যদি অসৎ লোক এমপি হয়ে মন্ত্রী হয় তাহলে সে জনগণ ও দেশের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। যাদের ভোটে এমন লোক পাস করবে, তাদের দশা আখিরাতে কী হতে পারে, তা হিসাব করে দেখুন।

তাই ভোট এক বিরাট আমানত। সৎ লোককে ভোট না দিলে এ মহান আমানত রক্ষা করা যাবে না। ভোট একটি মূল্যবান অধিকার। এর হেফাজত করতে হলে সৎ লোককে ভোট দিতে হবে। ভোট একটি নৈতিক দায়িত্ব। অসৎ লোককে ভোট দিলে এ দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে পেতে হবে। ভোট একটি বড় ক্ষমতা। কয়েকটি ভোট বেশি পেয়েও কেউ নির্বাচনে জিতে যায়। এ ক্ষমতা এমনভাবে ব্যবহার করা দরকার, যাতে আল্লাহ খুশি হন।

যদি আপনারা চান, বাংলাদেশে কুরআনের আইন চালু হোক এবং রাসূল সা. যেভাবে দেশ শাসন করেছেন সে রকমের শাসন কায়েম হোক তাহলে এমন সব দলকেই ভোট দিতে হবে, যারা আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। দেশের সরকার কায়েমের বিরাট ক্ষমতাটুকু জনগণেরই হাতে। তাদের ভোটেই দুর্নীতিবাজ সরকার কায়েম হয়। তাদের ভোটেই ইসলামী সরকারও কায়েম হওয়া সম্ভব। এসব কথা বিবেচনা করলে ভোট যে ইসলামের দৃষ্টিতে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই বোঝা যায়। যদি কেউ দুনিয়ার স্বার্থে বা টাকা-পয়সার বিনিময়ে কোনো অসৎ লোককে ভোট দেয় তাহলে কবিরা গুনাহ হবে; আর যদি কেউ আল্লাহকে খুশি করার উদ্দেশ্যে কোনো সৎ লোককে ভোট দেয় তাহলে তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি