সুদ হারাম কেন

১ -নেতিবাচক দিক
ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও তার ভিত্তিসমূহের মধ্যে চারটি বিষয় মৌলিক গুরুত্বের অধিকারীঃ

এক: কতিপয় সীমা ও নিয়ন্ত্রণ সহকারে স্বাধীন অর্থনীতি,

দুই: যাকাতের অপরিহার্যতা,

তিন: উত্তরাধিকার আইন ও

চার: সুদ নিষিদ্ধকরণ।

নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদের ধ্বংসকারিতা এবং কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের অপকীর্তি যাদের সম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে তারা বর্তমানে উপরোল্লিখিত চারটি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে প্রথমটিকে নীতিগতভাবে সত্য বলে মেনে নিতে শুরু করেছেন। অবশ্য এর বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে মনে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু আমি আশা করি আমার “ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ” ও “ভূমির মালিকানা বিধান” গ্রন্থ দু’টি পাঠ করলে তারা এ প্রশ্নগুলোর জবাবও পেয়ে যাবেন।

যাকাতকে কেন ফরয করা হয়েছে এ বিষয়টি বর্তমানে দুনিয়ার সম্মুখে অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ পর্যন্ত কমিউনিজম, ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সামাজিক ইনস্যুরেন্সের যে ব্যাপক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছে যাকাত তার চেয়ে অনেক ব্যাপক আকারে সামাজিক ইনস্যুরেন্স ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, একথা কোনো চিন্তাশীল, বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকের নিকট অবিদিত নেই। কিন্তু যাকাতের বিস্তারিত বিধান না জানার কারণে এখানেও কিছু সংকট দেখা দেয়। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থায় যাকাত ও খুমুসকে (গনীমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ) কিভাবে সংস্থাপিত করা যেতে পারে, এ ব্যাপারে মানুষের মনে বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য ইনশাআল্লাহ যাকাতের বিধানসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তকারে একটি পুস্তিকা লেখার চেষ্টা করবো।

উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে দুনিয়ার অন্যান্য উত্তরাধিকার আইন থেকে আলাদা হয়ে ইসলাম যে পথ অবলম্বন করেছে পূর্বে তার কারণ ও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিকাংশ লোক অনবহিত ছিল এবং তারা এর বিরুদ্ধে নানান প্রশ্ন উত্থাপন করতো। কিন্তু বর্তমানে ক্রমান্বয়ে সারা দুনিয়া এদিকে ধাবিত হচ্ছে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট সমাজ ব্যবস্থাও ইসলামের এ উত্তরাধিকার আইনের অংশবিশেষ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।

[ টিকা: হালে সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্তরাধিকার আইনের সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও পালিত পুত্রকে উত্তরাধিকারী গণ্য করা হয়েছে। উপরন্তু এজন্য যে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, নিজের অভাবী নিকটাত্মীয় ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেও পরিত্যক্ত সম্পত্তি বণ্টন করার অসিয়াত করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আত্মীয়দের অধিকারকে অগ্রাধিকার দান করা হয়েছে। এ সংগে এমন অসিয়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে যার মধ্যে নাবালক সন্তান বা দরিদ্র আত্মীয়দেরকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য কার্যকর থাকে। এ আইন দৃষ্টে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ‘কমিউনিষ্ট প্রগতিবাদীরা’ ১৯৪৫ সালে এমন একটি আইনের দিকে পশ্চদপসরণ করেছে যা ৬২৫ সালে প্রণীত হয়েছিল। ]

কিন্তু এ নকশার চতুর্থ অংশটি অনুধাবন করা আধুনিক যুগের মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত শতাব্দীগুলোতে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানুষের মনে এ বদ্ধমূল ধারণ সৃষ্টি করেছে যে, সুদকে নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে হারাম গণ্য করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে সুদবিহীন ঋণ দান করা একটি নৈতিক সুবিধা দান ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ধর্ম সুদকে হারাম গণ্য করে মানুষের প্রতি অযথা বাড়াবাড়ি করেছে। অন্যথায় ন্যায়ত সুদ সম্পূর্ণ যুক্তিসংগত এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তা কেবল আপত্তিহীনই নয় বরং কার্যত উপকারী ও অপরিহার্য। এ ভ্রান্ত মতবাদটির স্বপক্ষে জোরেশোরে প্রচার অভিযান চালানোর ফলে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যাবতীয় ত্রুটির প্রতি সবার দৃষ্টি পড়েছে কিন্তু তার এ বৃহত্তম মৌলিক ত্রুটিটি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট ও সমাজতন্ত্রীরাও নিজেদের দেশে বৃটেন ও আমেরিকার ন্যায় সযত্নে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এ বৃহত্তম ও কেন্দ্রীয় অনিষ্টকর বস্তুটি লালন করে চলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যেখানে মুসলমানদের সুদের প্রধানমত শত্রু হওয়া উচিত ছিল সেখানে তারা পাশ্চাত্যের এ বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আমাদের পরাজিত মানসিকতার অধিকারী মুসলিম ভাইদের মনে সাধারণভাবে সুদ সর্ম্পকে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যয় নির্বাহের জন্য ঋণ গ্রহণ করে একমাত্র তাদের নিকট থেকে সুদ নেয়া আপত্তিকর হতে পারে। আর ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করার জন্য যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তার উপর সুদ ধার্য করা সম্পূর্ণ বৈধ, যুক্তিসংগত ও হালাল এবং দ্বীন, নৈতিকতা, বুদ্ধি, বিবেক ও অর্থ বিজ্ঞানের নীতি অনুসারে এতে কোনো দোষ থাকতে পারে না। উপরন্তু এ ব্যাপারে এমন একটা সুধারণা পোষণ করা হয় যার ফলে পুরাতন আমলের বেনিয়া ও মহাজনদের সুদের কারবার থেকে আধুনিক ব্যাংকিং-কে আলাদা মনে করা হয় এবং এসব ব্যাংকের ‘পরিচ্ছন্ন’ ব্যবসায়কে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও পবিত্র মনে করে এর সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করাকে বৈধ গণ্য করা হয়। এজন্য বর্তমানে সুদের শরীয়াত নির্ধারিত সংজ্ঞা বদলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কুরআনে যে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আধুনিক ব্যাংকের সুদ তার আওতাভুক্ত নয়। এ সমস্ত বিভ্রান্তিকর গোলক ধাঁধাঁ পেরিয়ে যারা বাইরে আসতে পেরেছেন তাদের পক্ষেও সুদকে আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর আধুনিক অর্থব্যবস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমার পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করবো।

সুদের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা
সুদ কি যথার্থই একটি যুক্তিসংগত বিষয়? কোনো ব্যক্তি ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের উপর সুদ দাবী করলে তাকে কি বুদ্ধিসম্মত বলা যেতে পারে এবং তার এ দাবীটি কি ন্যায়সংগত বলে বিবেচিত হবার যোগ্য। কোনো ব্যক্তি একজনের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করলে সে ঋণ বাবদ গৃহীত আসল অর্থ ফেরত দেবার সাথে সাথে তাকে কিছু সুদও প্রদান করবে এটা কি ইনসাফের দাবী? সর্বপ্রথম এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়া উচিত। এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হয়ে গেলে আমাদের আলোচনার অর্ধেক বিষয় আপনা-আপনি মীমাংসিত হয়ে যাবে। কারণ সুদ একটি যুক্তিসংগত বিষয় বলে বিবেচিত হলে সুদ হারাম হবার ব্যাপারটি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়বে। আর যদি বুদ্ধি ও ইনসাফের দৃষ্টিতে সুদ যুক্তিসংগত প্রমাণিত না হয়, তাহলে মানব সমাজে এ অযৌক্তিক বিষয়টিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন কোথায়-এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।

প্রথম ব্যাখ্যা
এ প্রশ্নের জবাবে আমরা সর্বপ্রথম যে যুক্তিটির সম্মুখীন হই তা হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজের সঞ্চিত ধন-সম্পদ অন্যকে ঋণ দেয় সে বিপদ বরণ করে, ত্যাগ স্বীকার করে, নিজের প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে অন্যের প্রয়োজন পূর্ণ করে এবং যে সম্পদ থেকে সে নিজে উপকৃত হতে পারতো তা অন্যের হাতে সোপর্দ করে। ঋণ গ্রহীতা নিজের কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করলে তাকে অবশ্যি ঐ সম্পদের ভাড়া আদায় করা উচিত। যেমন বাড়ী, গাড়ী বা আসবাবপত্রের ভাড়া আদায় করা হয়ে থাকে। ঋণদাতা নিজের শ্রমোপার্জিত অর্থ নিজে ব্যবহার না করে তাকে প্রদান করে যে বিপদ বরণ করে নিয়েছে এ ভাড়া তার বিনিময় হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। আর ঋণগ্রহীতা এ অর্থ কোনো মুনাফা সৃষ্টিকারী কাজে খাটাবার জন্য গ্রহণ করে থাকলে ঋণদাতা অবশ্যি তার নিকট সুদ দাবী করার অধিকার রাখবে। ঋণগ্রহীতা যেখানে অন্যের অর্থ থেকে লাভবান হচ্ছে সেখানে ঋণদাতা ঐ লাভের ন্যায্য অংশ পাবে না কেন?

ঋণদাতা নিজের অর্থ অন্যেও হাতে সোপর্দ করার ব্যাপারে বিপদ বরণ করে নেয় এবং ত্যাগ স্বীকার করে, একথা সত্য কিন্তু এ বিপদ বরণ ও ত্যাগ স্বীকারের মূল্য হিসেবে বছরে, ছ’ মাসে বা মাসে শতকরা পাঁচ বা দশ ভাগ আদায় করার যৌক্তিকতা কোথায়? বিপদ বরণ করে নেয়ার কারণে সে যুক্তিসংগতভাবে যে অধিকার লাভ করে তা হচ্ছে, সে ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে কোনো জিনিস বন্ধক স্বরূপ রেখে দিতে পারে বা তার নিকট থেকে জামানত তলব করতে পারে। এসব কিছুতে সম্মত না হলে তার আদতে বিপদ বরণ না করা এবং ঋণদানে অস্বীকার করা উচিত। কিন্তু বিপদ কোনো ব্যবসায় পণ্য নয়, যার কোনো মূল্য দান করা যেতে পারে বা কোনো গৃহ, আসবাবপত্র ও যানবাহন নয়, যার কোনো ভাড়া আদায় করা যেতে পারে। অবশ্য ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, ব্যবসায়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্তই তা ত্যাগ বলে গণ্য হতে পারে। ত্যাগ স্বীকারের উদ্দেশ্য থাকলে যথার্থ ত্যাগ স্বীকারই করা উচিত এবং এ নৈতিক কাজটির নৈতিক লাভের উপরই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি বিনিময় ও পারিশ্রমিকের প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে ত্যাগের কথা না উঠনোই সংগত বরং সরাসরি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে জানাতে হবে যে, ঋণের ব্যাপারে আসল অর্থের বাইরে মাসিক বা বার্ষিক সে যে আর একটি অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে তার অধিকারী সে হলো কিসের ভিত্তিতে?

এটা কি তার ক্ষতিপূরণ? কিন্তু সে ঋণ বাবদ যে অর্থ দিয়েছে তা ছিল তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত। সে নিজেও এ অর্থটি ব্যবহার করছিল না। কাজেই এখানে আসলে কোনো ক্ষতি অনুষ্ঠিত হয়নি এবং এ ঋণদানের জন্য কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারীও সে হতে পাওে না।

এটা কি ভাড়া বাবদ প্রাপ্য অর্থ? কিন্তু ভাড়া এমন সব জিনিসের হয়ে থাকে যেগুলোকে ভাড়াটের উপযোগী ও তার জন্য ব্যবহারযোগ্য করার জন্য মানুষ নিজের সময়, অর্থ ও শ্রম নিয়োজিত করে। ভাড়াটের ব্যবহারের কারণে সেগুলো নষ্ট হয়, ভেঙ্গে-চুরে যায়, যার ফলে সেগুলোর মূল্য কমে যেতে থাকে। ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেমন, আসবাবপত্র, গৃহ ও যানবাহনের ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা যথার্থ এবং এ বস্তুগুলোর ভাড়া আদায় করাও যুক্তিসংগত কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা যথার্থ নয়, যেমন গম, ফল ইত্যাদি এবং টাকা-পয়সাও এ একই গোত্রভুক্ত। কারণ টাকা-পয়সা নিছক বস্তু ও সেবা ক্রয় করার একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই এসব বস্তুর ভাড়ার প্রসঙ্গ অর্থহীন।

কোনো ঋণদাতা বড়জোর এতটুকু বলতে পারেঃ আমার নিজের অর্থ থেকে আমি অন্যকে লাভবান হবার সুযোগ দিচ্ছি, কাজেই এ লাভে আমারও অংশ রয়েছে। এটা অবশ্যি যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে অভাবী ও বুভুক্ষ ব্যক্তি নিজের অভুক্ত সন্তানদের পেটে দু’মুঠো আহার যোগাবার জন্য আপনার নিকট থেকে ৫০ টাকা হাওলাত নিয়েছে সে কি সত্যিই ঐ টাকা থেকে এমনভাবে ‘লাভবান’ হচ্ছে যার ফলে আপনি তা থেকে নিজের অংশ হিসেবে মাসে মাসে শতকরা ২ টাকা বা ৫ টাকা হারে পাওয়ার অধিকারী হতে পারেন? লাভবান সে অবশ্যি হচ্ছে এবং তাকে এ সুযোগটি নিসন্দেহে আপনিই দিয়েছেন কিন্তু বুদ্ধি-বিবেক, ইনসাফ, অর্থনীতি বিজ্ঞান, ব্যবসায় নীতি কিসের দৃষ্টিতে এ লাভ বা লাভবান হবার সুযোগকে এমন পর্যায়ে আনা যেতে পারে যার ফলে আপনি তার একটি আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে পারেন? ঋণগ্রহীতার বিপদ যতই কঠিন হবে এ মূল্যও ততই বাড়তে থাকবে, তার বিপদকাল যত দীর্ঘ হতে থাকবে আপনার প্রদত্ত এ ‘লাভবান হবার সুযোগের’ মূল্যও তত মাস ও বার্ষিক হারে বাড়তে থাকবে? একজন অভাবী ও বিপদগ্রস্তকে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থদান করার মত বিরাট হৃদয়বত্তার অধিকারী যদি আপনি না হয়ে থাকেন তাহলে আপনার ঐ অর্থ তার নিকট থেকে ফেরত পাবার ব্যপারে সর্বপ্রকারে নিশ্চিন্ত হয়ে নিন তারপরই তাকে ঐ অর্থ ঋণ দিন। এটাই আপনার জন্য যুক্তিসঙ্গত পন্থা। আর যদি ঋণ দিতেও আপনার মন সায় না দেয় তাহলে তাকে কোনো প্রকারে সাহায্য করবেন না, এও একটা যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু কোনো ব্যক্তির বিপদ-দুঃখ-কষ্ট আপনার জন্য মুনাফা সংগ্রহের সুযোগরূপে গণ্য হবে এবং অভুক্ত পেট ও মৃত্যু পথযাত্রী রোগী আপনার জন্য অর্থ খাটাবার (Investment) ক্ষেত্রে বিবেচিত হবে; উপরন্তু মানুষের বিপদ বাড়ার সংগে সংগে আপনার লাভের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে থাকবে এটা কোন্ ধরনের যুক্তিসঙ্গত ব্যবসা?

‘লাভবান হওয়ার সুযোগ দেওয়া’ যদি কোনো অবস্থায় কোনো আর্থিক মূল্যের অধিকারী হয় তাহলে তা কেবলমাত্র এমন এক অবস্থায় হতে পারে যখন অর্থ গ্রহণকারী তা কোনো ব্যবসায়ে খাটায়। এ অবস্থায় অর্থদানকারী একথা বলার অধিকার রাখে যে, তার অর্থ থেকে অন্য ব্যক্তি যে লাভ কুড়াচ্ছে তার মধ্যে তার ন্যায্য অংশ রয়েছে এবং এ অংশ তার পাওয়া উচিত। কিন্তু বলাবাহুল্য পুঁজি একাকী কোনো মুনাফা সৃষ্টির যোগ্যতা রাখে না। মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা তার সাথে যুক্ত হলে তবেই সে মুনাফা দানের যোগ্যতা অর্জন করে। আবার মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা তার সাথে যুক্ত হবার সাথে সাথেই সে মুনাফা দান করতে শুরু করে না বরং মুনাফা দানের জন্য তার একটি মেয়াদের প্রয়োজন হয়। উপরন্তু তার মুনাফা দান নিশ্চিতও নয়। সেখানে ক্ষতি ও দেউলিয়া হবার সম্ভাবনাও থাকে। আর লাভজনক হবার ক্ষেত্রেও কোন্ সময় কি পরিমাণ মুনাফা দেবে তা পূর্বাহ্নে বলাও সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে মানুষের শ্রম ও যোগ্যতা যখন পর্যন্ত ঐ অর্থের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেনি তখন থেকেই বা কেমন করে অর্থদানকারীর মুনাফা শুরু হয়ে যেতে পারে? উপরন্তু মুনাফার হার ও পরিমাণও বা কেমন করে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে, যখন পুঁজির সাথে মানুষের মেহনত ও যোগ্যতার মিলনে মুনাফা সৃষ্টি নিশ্চিত নয় এবং কি পরিমাণ মুনাফা সৃষ্টি হবে তাও জানা নেই?

যে ব্যক্তি নিজের অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ কোনো মুনাফা সৃষ্টিকারী কাজে লাগাতে চায় তার শ্রম বিনিয়োগকারীদের সাথে অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করা এবং একটি স্থিরীকৃত হার অনুযায়ী লাভ ও লোকসানের অংশীদার হওয়া উচিত, এ ক্ষেত্রে এটিই একমাত্র যুক্তিসংগত পদ্ধতি হতে পারে। বিপরীত পক্ষে আমি যদি এক ব্যক্তির ব্যবসায়ে অংশীদার হবার পরিবর্তে তাকে একশো টাকা ঋণ দিয়ে থাকি এবং তাকে বলি, যেহেতু তুমি এ অর্থ থেকে লাভবান হবে তাই আমার টাকা যতদিন তোমার ব্যবসায়ে খাটবে ততদিন পর্যন্ত তুমি প্রতিমাসে আমাকে এক টাকা হারে মুনাফা দিতে থাকবে, এটা কোন্ ধরনের যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ পুঁজির পিছনে পরিশ্রম খাটিয়ে তা থেকে মুনাফা অর্জিত হতে শুরু না হয় ততক্ষণ সেখানে কোন্ ধরনের সঞ্চিত মুনাফা থাকে যা থেকে আমি নিজের অংশ দাবি করার অধিকার রাখি? যদি ঐ ব্যক্তি তার ব্যবসায়ের লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাহলে কোন্ বিবেক ও ইনসাফের প্রেক্ষিতে আমি তার নিকট থেকে মাসিক মুনাফা আদায় করার অধিকার রাখতে পারি? যদি তার মুনাফা মাসিক এক টাকার চেয়ে কম হয় তাহলে আমার মাসিক এক টাকা আদায় করার কি অধিকার আছে? আর তার সমগ্র মুনাফাই যদি হয় এক টাকা তাহলে এ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সারা মাস নিজের সময়, শ্রম, যোগ্যতা, বুদ্ধি, সামর্থ ও নিজের ব্যক্তিগত পুঁজি সবকিছু খাটালো সে কিছুই পেলো না অথচ আমি কেবলমাত্র একশো টাকা তাকে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম কিন্তু মুনাফার সবটুকু আমি লুটেপুটে নিয়ে গেলাম, এটা কোন্ ধরনের ইনসাফ? কলুর বলদও যদি সারাদিন ঘানি টানে তাহলে কলুর নিকট কমপক্ষে সে নিজের আহার চাইবার দাবী রাখে, কিন্তু এ সুদী ঋণ মানুষকে এমন এক বলদে পরিণত করে যে কলুর জন্য সারাদিন ঘানি টানবে কিন্তু আহার তাকে বাইরে কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে হবে।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে, কোনো ব্যবসায়ী ব্যক্তির মুনাফা ঐ নির্ধারিত অর্থের চাইতে বেশী হয়, যা ঋণদাতা সুদের আকারে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, তাহলেও বুদ্ধিবৃত্তি, ইনসাফ, ব্যবসায় নীতি ও অর্থনৈতিক রীতিনীতি কোনো কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে একথা যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করা যেতে পাওে না যে, যারা আসল উৎপাদনকারী, যারা সমাজের প্রয়োজন প্রস্তুত ও সংগ্রহ করার জন্য নিজেদের সময় ব্যয় করে, পরিশ্রম করে, মস্তিষ্ক পরিচালনা করে এবং নিজেদের শরীর ও মস্তিষ্কের সমুদয় শক্তি ব্যবহার করে তাদের সবার লাভ সংশয়যুক্ত ও অনির্দিষ্ট থেকে যাবে, কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ ঋণ দিয়েছে একমাত্র তার লাভ নিশ্চিত ও নির্ধারিত হবে। তাদের সবার জন্য ক্ষতির আশংকা রয়েছে কিন্তু তার জন্য রয়েছে লাভের গ্যারান্টি। সবার লাভের হার বাজারের দামের সাথে উঠানামা করে কিন্তু সে একাই এমন এক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে নিজের জন্য লাভের যে অংক নির্ধারণ করে নিয়েছে মাসের পর মাস বছরের পর বছর তা কোনো প্রকার রদবদল ছাড়াই যথানিয়মে পেয়ে যেতে থাকে।*

[* এখানে অবশ্যি আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে যে, তাহলে টাকার বিনিময়ে জমি বর্গা দেয়াকে কেমন করে বৈধ গণ্য করা যায়? তার অবস্থা ও সুদের সমপর্যায়ভুক্ত। কিন্তু এ আপত্তি আসলে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় যারা আগাম টাকা নির্ধারিত করে জমি বর্গা দেয়। যেমন বিঘে প্রতি ২০ টাকা বা একর প্রতি ৫০ টাকা হিসেবে নির্ধারিত করে নেয়াকে যারা বৈধ গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে এ আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে। আমি এ নীতির সমর্থক নই। আমি নিজেও একে সুদের সাথে সামঞ্জস্যশীল মনে করি। কাজেই এ আপত্তির জবাব দেয়া আমার দায়িত্ব নয়। এ ব্যাপারে আমার নীতি হচ্ছে, জমির মালিক ও কৃষকের মধ্যে ভাগ-চাষের সম্পর্কই যথার্থ। অর্থাৎ উৎপন্ন শস্যের কত অংশ কৃষকের ও কত অংশ জমি-মালিকের সে ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে একটি চুক্তি অনুষ্ঠিত হবে। যৌথ কারবারের অংশীদারিত্বের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এ ধরনটিকে আমি বৈধ মনে করি। আর জমির ভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে যে অবস্থাটিকে আমি বৈধ মনে করি আমার ‘ভূমির মালিকানা বিধান’ গ্রন্থে তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। তার বিরুদ্ধে এ আপত্তি উত্থাপিত হয় না।]

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা
এ সমালোচনা থেকে একটি কথা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ সুদকে একটি যুক্তিসঙ্গত বস্তু গণ্য করার জন্য প্রথম পর্যায়ে যেসব যুক্তিকে যথেষ্ট মনে করা হয় একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সেগুলোর দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যে ঋণ গ্রহন করা হয় তার উপর সুদ আরোপ করার স্বপক্ষে কোনো বুদ্ধিসম্মত যুক্তিই থাকতে পারে না। এমনকি সুদের সমর্থকগণও এ দুর্বল মামলাটির ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে যে ঋণ গ্রহণ করা হয় তার ব্যাপারেও সুদ সমর্থকদের সম্মুখে এ জটিল প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ সুদকে মূলত কোন্ বস্তুর মূল্য মনে করা হচ্ছে? ঋণদাতা নিজের অর্থের সাথে ঋণগ্রহীতাকে এমন কি বাস্তব সত্ত্বামূলক (Substential) জিনিস দেয় যার একটি আর্থিক মূল্যও থাকে এবং মাসের পর মাস বছরের পর বছর যে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঐ মূল্য লাভ করার অধিকারী হয়? এ জিনিসটি চিহ্নিত করার জন্য সুদ সমর্থকগণকে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়তে হয়েছে।

একদল বলে সে জিনিসটি হচ্ছে ‘লাভবান হবার সুযোগ’। কিন্তু উপরের পর্যালোচনা থেকে আপনি বুঝতে পেরেছেন এ ‘সুযোগ’ কোন নির্দিষ্ট, নিশ্চিত ও নিত্যকার বুদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যের স্বত্ব সৃষ্টি করে না বরং এটি এমন এক অবস্থায় আনুপাতিক লাভের স্বত্ব দান করে যখন প্রকৃতপক্ষে ঋণ গ্রহণকারী লাভের মুখ দেখে।

দ্বিতীয় দল সামান্য হেরফের করে বলে, সে জিনিসটি হচ্ছে ‘অবকাশ’ ঋণদাতা নিজের অর্থের সাথে এ ‘অবকাশ’ ব্যবহারের জন্য ঋণগ্রহীতাকে দান করে। এ অবকাশের একটি মূল্য রয়েছে এবং এটি দীর্ঘ ও দীর্ঘতর হবার সাথে সাথে এর মূল্যও বেড়ে যেতে থাকে। কোনো ব্যক্তি যেদিন থেকে অর্থ নিয়ে কাজে লাগায় সেদিন থেকে শুরু করে যেদিন ঐ অর্থের সাহায্যে প্রস্তুত দ্রব্য বাজারে পৌঁছে যায় এবং মূল্য আনে ঐদিন পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত ব্যবসায়ীর নিকট থেকে অর্থ ফেরত নেয়া হয় তাহলে আদতে তার ব্যবসা চলতে পারে না। কাজেই যে ব্যক্তি অর্থ ঋণ নিয়ে ব্যবসায় খাটাচ্ছে তার নিকট এ সময়টি অবশ্যি একটি মূল্য রাখে এবং সে এ মূল্য থেকে লাভবান হচ্ছে। কাজেই অর্থদানকারীও লাভের অংশ পাবে না কেন? আবার এ সময়ের কমবেশীর কারণে ঋণগ্রহীতার লাভের সম্ভাবনাও কমবেশী হতে থাকে। কাজেই সময়ের দীর্ঘতা ও স্বল্পতার ভিত্তিতে ঋণদাতা এর মূল্য নির্ধারণ করবে কেন?

কিন্তু এখানেও আবার ঐ একই প্রশ্ন দেখা দেয়। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অর্থ দাতার নিকট থেকে ব্যবসায় খাটাবার জন্য অর্থ নিচ্ছে সে নিশ্চিতরূপে ব্যবসায় লাভ করবে, ক্ষতি করবে না-একথা সে কেমন করে জানালো? উপরন্তু তার লাভও নিশ্চিতরূপে শতকরা একটি নির্দিষ্ট হারে হতে থাকবে কাজেই তা থেকে অর্থদানকারীকে অবশ্যই শতকরা একটি নির্দিষ্ট হারে অংশ আদায় করা উচিত-একথাই বা সে জানলো কেমন করে? এছাড়া যে সময় সে ঋণগ্রহীতাকে নিজের অর্থ ব্যবহারের অবকাশ দিচ্ছে ঐ সময় প্রতি বছর ও প্রতিমাসে নিশ্চিতরূপে একটি বিশেষ পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হবে কাজেই এর একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক বা মাসিক মূল্য স্থিরিকৃত হওয়া উচিত-এ হিসেব জানার জন্য কোন ধরনের যন্ত্রই বা তার নিকট আছে তা আমাদের অবশ্যই জানা উচিত? সুদ সমর্থকদের নিকট এ প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক ও সংগত জবাব নেই। কাজেই আবার সে আগের কথায়ই ফিরে আসতে হয়। অর্থাৎ ব্যবসায়িক ব্যাপারে যদি কোনো জিনিস যুক্তিসঙ্গত হয়ে থাকে তাহলে তা হচ্ছে একমাত্র লাভ ও লোকসানের ভিত্তিতে অংশিদারিত্ব, নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট হারে যে সুদ চাপিয়ে দেয়া হয় তা নয়।

তৃতীয় ব্যাখ্যা
আর একদল বলে, মুনাফা অর্জন হচ্ছে অর্থের নিজস্ব গুণ। কাজেই কোনো ব্যক্তি যখন অন্যের সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার করে তখন ঐ অর্থই এমন অধিকার সৃষ্টি করে যার ফলে অর্থদাতা সুদ চাইতে পারে এবং ঋণগৃহীতা তা আদায় করতে বাধ্য। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন ও সংগ্রহে সাহায্য করার শক্তি অর্থের রয়েছে। অর্থের সাহায্যে যে পরিমাণ দ্রব্য উৎপন্ন হয় তার সাহায্য ব্যতিরেকে সে পরিমাণ উৎপন্ন হতে পারে না। অর্থের সাহায্যে উন্নত ধরনের দ্রব্যাদি বেশী পরিমাণে তৈরী হয় এবং তা অধিক মূল্যে বাজারে বিক্রি হয় অন্যথায় দ্রব্যও কম উৎপন্ন হয়, তার মানও হয় নিম্নমুখী এবং বাজারে ভালো দামে বিক্রিও হয় না। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, মুনাফা অর্জনের গুণ অর্থের মধ্যে সন্নিহিত রয়েছে। কাজেই কেবল অর্থের ব্যবহারই অর্থদাতার জন্য সুদ লাভের অধিকার সৃষ্টি করে।

কিন্তু অর্থ মুনাফা দানের নিজস্ব গুণে গুণান্বিত প্রথমত এ দাবীটিই দ্ব্যর্থহীনভাবে ভ্রান্ত। যখন কোনো ব্যক্তি অর্থ নিয়ে কোনো ফলদায়ক কাজে লাগায় একমাত্র তখনই তার মধ্যে এ শক্তি সৃষ্টি হয়। একমাত্র তখনই একথা বলা যেতে পারে যে, অর্থগ্রহণকারী ব্যক্তি যেহেতু অর্থ ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করছে কাজেই এ মুনাফা থেকে অর্থদাতাকে অংশ দেয়া উচিত। কিন্তু যে ব্যক্তি রুগীর চিকিৎসা বা মৃতের কাফন-দাফনের অর্থ গ্রহণ করে তার এ অর্থ কোন্ ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য সৃষ্টি করে, যা থেকে ঋণদাতা অংশগ্রহণ করতে পারে?

উপরন্তু মুনাফাজনক কাজে যে অর্থ লাগানো হয় তা সব ক্ষেত্রেই নিশ্চিতরূপে অধিক মূল্য দান করে না। কাজেই মুনাফাদান অর্থের নিজস্ব গুণ এ দাবী অর্থহীন। অনেক সময় কোনো কাজে বেশী অর্থ লাগানো হয় কিন্তু এর ফলে মুনাফা বাড়ার পরিবর্তে কমে যায়। এমনকি অবশেষে তাতে লোকসান দেখা দেয়। আজকাল কিছুদিন পর পর ব্যবসা জগতে যে অচলাবস্থার (CRISIS) সৃষ্টি হচ্ছে এর কারণ স্বরূপ একথাই বলা যায় যে, পূঁজিপতিরা নিজেদের ব্যবসায়ে যখন অজস্র অর্থ ঢেলে দিতে থাকে এবং উৎপাদন বেড়ে যেতে থাকে তখন দাম কমতে থাকে, ফলে উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে দাম এত বেশী কমে যেতে থাকে যে, পুঁজি বিনিয়োগে কোনো প্রকার লাভের সম্ভাবনা থাকে না।

এছাড়াও পুঁজির মধ্যে মুনাফাদানের কোনো শক্তি যদি থেকে থাকে তাহলে তা বাস্তব রূপ লাভ করার জন্য আরো কয়েকটি জিনিসের উপর নির্ভরশীল হয়। যেমন পুঁজি ব্যবহারকারীদের পরিশ্রম, যোগ্যতা, বুদ্ধি-বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা, ব্যবহারকালীন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার আনুকূল্য এবং সমকালীন বিপদ আপদ থেকে নিরাপত্তা লাভ। এ বিষয়গুলো এবং এ ধরনের আরো বহু বিষয় মুনাফাদানের পূর্বশর্ত। এ গুলোর মধ্য থেকে কোনো একটি শর্ত না পাওয়া গেলে অনেক সময় পুঁজির সমস্ত মুনাফাদানের ক্ষমতাই শেষ হয়ে যায় বরং উলটো লোকসানও দেখা যায়। কিন্তু সুদী ব্যবসায়ে পুঁজি দানকারী ব্যক্তি এসব শর্ত পূর্ণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে না এবং একথাও স্বীকার করে না যে, ঐ শর্তগুলোর কোনোটির অনুপস্থিতির কারণে তার পুঁজি মুনাফাদানে অক্ষম হলে সে সুদ গ্রহণ করবে না। সে বরং উলটো দাবী করে, তার পুঁজি ব্যবহার করলেই সে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ লাভের অধিকারী হয়। তার পুঁজি বাস্তবে কোনো প্রকার মুনাফা লাভে সক্ষম হোক বা না হোক তার এ অধিকারে কোনো পার্থক্য সূচিত হবে না।

অবশেষে যদি একথা মেনেও নেয়া যায় যে, পূঁজির মধ্যে মুনাফা দান করার ক্ষমতা রয়েছে, যার ভিত্তিতে পুঁজিদানকারী মুনাফার অংশীদার হবার অধিকার লাভ করে তাহলেও প্রশ্ন দেখা দেয়, আপনার নিকট এমন কোন্ হিসেব আছে যার ভিত্তিতে আপনি বর্তমানে পুঁজির মুনাফাদান করার ক্ষমতা নির্দিষ্ট করতে পারেন এবং যারা পুঁজি বিনিয়োগ করে সেই ভিত্তিতে তাদের সুদের হার নির্ধারিত করতে পারেন? আর বর্তমান সময়ের জন্য কোনো হিসেবের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা সম্ভবপর বলে যদি মেনে নেয়া হয় তাহলেও আমরা একথা বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষম যে, ১৯৪৯ সালে যে পুঁজিপতি কোনো ব্যবসা সংস্থাকে ১০ বছর মেয়াদে এবং অন্য একটি সংস্থাকে ২০ বছর মেয়াদে তৎকালীন প্রচলিত হারে সুদী ঋণ দিয়েছিলেন তিনি কিসের ভিত্তিতে একথা জানতে পেরেছিলেন যে, পরবর্তী ১০ ও ২০ বছরে পুঁজির মুনাফা দানের ক্ষমতা অবশ্যই ঐ ১৯৪৯ সালের পর্যায়েই থাকবে? বিশেষ করে যখন ১৯৫৯ সালে বাজারে সুদের হার ১৯৪৯ সালের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ১৯৬৯ সনে তার থেকেও আলাদা হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি একটি সংস্থার সাথে দশ বছরের এবং অন্য একটি সংস্থার সাথে বিশ বছরের চুক্তি করে তাদের নিকট থেকে ১৯৪৯ সনের হার অনুযায়ী নিজের পুঁজির সম্ভাব্য মুনাফার অংশ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন তাকে আমরা কোন্ যুক্তির ভিত্তিতে এ অধিকার দান করবো?

চতুর্থ ব্যাখ্যা
সর্বশেষ ব্যাখ্যায় একটু বেশী বুদ্ধি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দূরের ও ভবিষ্যতের লাভ ও আনন্দের উপর নিকটেরও উপস্থিত লাভ, আনন্দ, স্বাদ ও তৃপ্তিকে অগ্রাধিকার দান করে। ভবিষ্যত যতই দূরবর্তী হয় তার লাভ ও স্বাদ ততই সংশয়পূর্ণ হয় এবং সে অনুপাতে মানুষের দৃষ্টিতে তার মূল্যও কমে যায়। এ নিকটবর্তীর অগ্রাধিকার ও দূরবর্তীর পিছিয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমনঃ

একঃ ভবিষ্যত অন্ধকারের গর্ভে জীবন অনিশ্চিত। কাজেই ভবিষ্যতের লাভ সংশয়পূর্ণ। এর কোনো চিত্রও মানুষের চিন্তাজগতে সুস্পষ্ট নয়। বিপরীত পক্ষে আজকের নগদ লাভ নিশ্চিত। মানুষ স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষও করছে।

দুইঃ যে ব্যক্তি বর্তমানে কোনো বিষয়ের অভাব অনুভব করছে বর্তমানে তা পূর্ণ হওয়া ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পূর্ণ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান বিবেচিত হবে, যখন হতে পারে সে ঐ বিষয়ের অভাব অনুভব করবে না বা হয়তো অনুভব করতেও পারে।

তিনঃ যে অর্থ বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে তা কার্যত প্রয়োজনীয় ও কার্যোপযোগী। এ প্রেক্ষিতে তা ঐ অর্থের উপর অগ্রাধিকার রাখে যা আগামীতে কোনো সময় অর্জিত হবে।

এ সমস্ত কারণে আজকের নগদ লাভ ভবিষ্যতের অনিশ্চিত লাভের উপর অগ্রাধিকার রাখে। কাজেই যে ব্যক্তি আজ কিছু অর্থ ঋণ নিচ্ছে তা অনিবার্যরূপে আগামীকাল সে ঋণদাতাকে যে অর্থ আদায় করবে তার চেয়ে বেশী মূল্যের অধিকারী। ঐ বাড়তি মূল্যটুকুই হচ্ছে সুদ। ঋণ দেবার সময় ঋণদাতা তাকে যে অর্থ দিয়েছিল, আদায় করার সময় বাড়তি মূল্য স্বরূপ ঐ সুদ আসল অর্থের সাথে মিশে তার সমান মূল্যে পৌঁছিয়ে দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ বিষয়টিকে নিম্নোক্তরূপে অনুধাবন করা যায়ঃ এক ব্যক্তি মহাজনের নিকট গিয়ে একশো টাকা ঋণ চাইলো। মহাজন তার সাথে চুক্তি করলো যে, আজ সে যে ১০০ টাকা দিচ্ছে এক বছর পর এর পরিবর্তে তাকে ১০৩ টাকা দিতে হবে। এ ব্যাপারে আসলে বর্তমানের ১০০ টাকার বিনিময় হচ্ছে ভবিষ্যতের ১০৩ টাকার সাথে। বর্তমানের অর্থ ও ভবিষ্যতের অর্থের মনস্তাতিক (অর্থনৈতিক নয়) মূল্যের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যায় তা এ বাড়তি ৩ টাকার সমান। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ৩ টাকা এক বছর পর আদায়কৃত ১০০ টাকার সাথে যুক্ত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার মূল ঋণ প্রদান কালে ঋণদাতা প্রদত্ত ১০০ টাকার সমান হবে না।

যে সতর্কতা ও বুদ্ধিমত্তা সহকারে এ ব্যাখ্য করা হয়েছে তার তারিফ না করে পারা যায় না। কিন্তু এখানে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মনস্তাত্তিক মূল্যের যে পার্থক্য বর্ণনা করা হয়েছে তা আসলে একটি বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

সত্যিই কি মানব প্রকৃতি বর্তমানকে ভবিষ্যতের তুলনায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে? তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে অধিকাংশ লোক তাদের সমস্ত উপার্জন আজই ব্যয় করা সংগত মনে করে না কেন? বরং তার একটি অংশ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা পছন্দ করে কেন? সম্ভবত শতকরা একজন লোকও আপনি পাবেন না যে ভবিষ্যতের চিন্তা শিকেয় তুলে রেখে বর্তমানের আয়েশ-আরাম ও স্বাদ-আহলাদ পূরণ করার জন্য সমুদয় অর্থ দু’হাতে খরচ করাকে অগ্রাধিকার দেবে। অন্ততপক্ষে শতকরা ৯৯জন লোকের অবস্থা এই যে, তারা আজকের প্রয়োজন অপূর্ণ রেখে আগামীকালের জন্য কিছু না কিছু সঞ্চয় করে রাখতে চায়। কারণ ভবিষ্যতে যে সব ঘটনা সংঘটিত হবে এবং মানুষকে যে সব প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে হবে তম্মধ্যে অনেক সম্ভাব্য ঘটনা ও প্রয়োজনের কাল্পনিক চিত্র মানুষের মানস চোখে ভাসতে থাকে। বর্তমানে সে যে পয়োজন মিটিয়ে চলছে ও যে অবস্থার সাথে কোনো না কোনোক্রমে যুঝছে সেগুলোর চেয়ে ঐ সম্ভাব্য ঘটনা ও প্রয়োজনগুলো তার নিকট অনেক বেশী বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রতীয়মান হয়। উপরন্তু বর্তমানেও মানুষ যেসব প্রচেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যাচ্ছে এগুলোরও উদ্দেশ্য তার নিজের উন্নততর ও অধিকতর ভালো ভবিষ্যত ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে? মানুষ আগামী দিনে ভালোভাবে জীবন যাপন করার উদ্দেশ্যেই তো আজ শ্রম-মেহনত করে যাচ্ছে। এমন কোনো নিরেট বোকার সন্ধান পাওয়ারও কষ্টকর হবে যে নিজের ভবিষ্যতকে শ্রীহীন ও দুঃখ-দারিদ্র পর্যুদস্ত অথবা কমপক্ষে বর্তমানের তুলনায় শ্রীহীন করার বিনিময়ে নিজের বর্তমানকে সুখী-সমৃদ্ধিশালী করা পছন্দ করবে। মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে মানুষ এমনটি করতে পারে অথবা কোনো সাময়িক ইচ্ছ-কামনার আবেগে অভিভূত হয়ে এহেন পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভবপর কিন্তু ভেবে-চিন্তে, বিচার-বিবেচনা করে কেউ এ কাজ করতে পারে না, অন্তুত একে নির্ভুল ও যুক্তিসংগত বিবেচনা করতে পারে না।

মানুষ বর্তমানের নিশ্চয়তার বিনিময়ে ভবিষ্যতের ক্ষতি বরদাশত করে নেয়। কিছুক্ষণের জন্য এ দাবীর যথার্থতা স্বীকার করে নিলেও এ দাবীর ভিত্তিতে যে কথা প্রমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা কোনোক্রমেই যথার্থ প্রমাণিত হয় না। ঋণ গ্রহণ কালে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তাতে বর্তমানের ১০০ টাকার দাম এক বছর পরের ১০৩ টাকার সমান ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু আজ এক বছর পর ঋণগ্রহীতা যখন ঋণ আদায় করতে গেলো তখন প্রকৃত অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? এখন বর্তমানের ১০৩ টাকা অতীতের ১০০ টাকার সমান হয়ে গেছে। আর যদি প্রথম বছর ঋণগ্রহীতা ঋণ আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে দ্বিতীয় বছরের শেষে দু’ বছর আগের ১০০ টাকার দাম বর্তমানের ১০৬ টাকার সমান হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে অর্থের মূল্য ও মান নিরুপণের ক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এ অনুপাত কি যথার্থ ও নির্ভুল? সত্যিই কি অতীত যতই পুরাতন হতে থাকে বর্তমানের তুলনায় তার দাম ততই বাড়তে থাকে? সত্যিই কি অতীতের প্রয়োজনগুলোর পূর্ণতা এতবেশী মূল্যবান যার ফলে দীর্ঘকাল পূর্বে আপনি যে অর্থ পেয়েছিলেন এবং যা খরচ করার পর বিস্তৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তা কালের প্রতিটি মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে বর্তমানের অর্থের চেয়ে বেশী মূল্যবান হয়ে যাচ্ছে,এমনকি একশো টাকা খরচ করার পর যদি পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে তার দাম হবে আড়াইশো টাকার সমান?

ন্যায়সঙ্গত সুদের হার
বুদ্ধি ও ন্যায়নীতির দিক থেকে সুদকে বৈধ ও সংগত প্রমাণ করার জন্য সর্বসাকুল্যে উপরোক্ত যুক্তিগুলোই পেশ করা হয়। আমাদের ইতিপূর্বেকার আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে,যুক্তির সাথে এ নাপাক বস্তুটির কোনো দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। সুদ দেয়া-নেয়ার স্বপক্ষে কোনো শক্তিশালী যুক্তিও পেশ করা যেতে পারে না। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এমনিতর একটি অযৌক্তিক বস্তুকে পাশ্চাত্যের পন্ডিত-প্রবর ও চিন্তাশীলগণ সম্পূর্ণ স্বীকৃত ও সুস্পষ্ট বস্তু হিসেবে গণ্য করে নিয়েছেন এবং সুদের যৌক্তিকতাকে যেন একটি স্থিরীকৃত ও সর্বজন স্বীকৃত সত্য মনে করে সমস্ত আলোচনা সুদের ন্যায়সঙ্গত হার নির্ধারণের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন। আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে সুদ সম্পর্কিত আলোচনার কোথাও সুদ দেয়া-নেয়ার যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতার প্রসঙ্গ দেখা যাবে না বরং সুদের অমুক হারটি অযৌক্তিক ও সীমাতিরিক্ত কাজেই তা আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য এবং অমুক হারটি ন্যায়সঙ্গত কাজেই তা গ্রহণযোগ্য এ বিতর্কের মধ্যেই সমস্ত আলোচনা আবর্তিত।

কিন্তু সত্যিই কি কোন ন্যায়সঙ্গত হার আছে? যে বস্তুটির নিজের ন্যায়সঙ্গত হবার কোন প্রমাণ নেই তার হার যুক্তিসঙ্গত না অযৌক্তিক এ প্রসঙ্গ অবতারণার অবকাশ কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য আমরা এ আলোচনা না হয় স্থগিতই রাখলাম। এ প্রশ্ন বাদ দিয়ে আমরা মাত্র এতটুকু জানতে চাই, সুদের স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত হার কোনটি? কোন হারের ন্যায়সঙ্গত ও অন্যায় হবার মাপকাঠি কি? সত্যিই কি বিশ্বজোড়া সুদী ব্যবসায়ে কোনো যুক্তিসঙ্গত (Rational) ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে?

এ প্রশ্নের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি দুনিয়ায় ন্যায়সঙ্গত সুদের হার নামক কোনো জিনিসের অস্তিত্বই কোনোদিন ছিল না। বিভিন্ন হারকে বিভিন্ন যুগে ন্যায়সঙ্গত গণ্য করা হয়েছে এবং পরে আবার সেগুলোকেই অন্যায় ও অসঙ্গত ঘোষণা করা হয়েছে। বরং একই যুগে বিভিন্ন স্থানের ন্যায়সঙ্গত হারের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ হিন্দু অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের বর্ণনা অনুযায়ী প্রাচীন হিন্দুযুগে বছরে শতকরা ১৫ থেকে ৬০ ভাগ সুদ ন্যায়সঙ্গত মনে করা হতো এবং বিপদাশংকা অত্যধিক বলে এ হার আরও বাড়ানো যেতো। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় করদ রাজ্যগুলো একদিকে নিজেদের দেশীয় মহাজনবৃন্দ ও অন্যদিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকারের সাথে যে আর্থিক লেনদেন করতো তাতে সাধারণত বার্ষিক শতকরা ৪৮ ভাগ সুদের হারের প্রচলন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে (১৯১৪-১৮) ভারত সরকার বার্ষিক শতকরা সাড়ে ৬ ভাগ সুদের ভিত্তিতে যুদ্ধ ঋণ লাভ করেছিল। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর মধ্যবর্তী সময়ে সমবায় সমিতিগুলোর সাধারণ সুদের হার ছিল শতকরা ১২ থেকে ১৫ ভাগ। ১৯৩০ ও ১৯৪০ এর আমলে দেশের আদালতগুলো বার্ষিক শতকরা ৯ ভাগের কাছাকাছি সুদকে ন্যায়সঙ্গত গণ্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ডিসকাউন্ট রেট বার্ষিক শতকরা ৩ ভাগ নির্ধারিত হয়েছিল এবং সমগ্র যুদ্ধকালে এ হার বর্তমান ছিল বরং শতকরা পৌনে তিন ভাগ সুদেও ভারত সরকার ঋণ লাভ করেছিল।

এতো গেলো আমাদের উপমহাদেশের অবস্থা। ইউরোপের দিকে তাকালে সেখানেও প্রায় একই ধরণের চিত্র দেখা যাবে। ষোল শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে শতকরা ১০ ভাগ সুদের হারকে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত গণ্য করা হয়েছিল। ১৯২০ সালের কাছাকাছি সময়ে ইউরোপের অনেক সেন্ট্রাল ব্যাংক শতকরা ৮/৯ ভাগ সুদ নির্ধারণ করতো। এ আমলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (LEAGUE OF NATIONS) মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যে ঋণ লাভ করেছিল,তার হারও ছিল অনুরূপ। কিন্তু আজ আমেরিকা ও ইউরোপের কোনো ব্যাক্তির নিকট সুদের এ হারের কথা বললে সে চীৎকার করে বলতে থাকবে,এটা সুদ নয়,লুটতরাজ। আজ যেদিকে তাকান শতকরা আড়াই ও ৩ ভাগ সুদের পসরা দেখতে পাবেন। শতকরা ৪ ভাগ হচ্ছে আজকের সর্বোচ্চ হার। আবার কোনো কোনো অবস্থায় ১ ও ১/২ বা ১/৪ ভাগ সুদও দেখা যায়। কিন্তু অন্যদিকে দরিদ্র জনসাধারণকে সুদী ঋণদানকারী মহাজনদের জন্য ইংল্যান্ড ১৯২৭ সালে মানি ল্যান্ডারস এ্যাক্টের মাধ্যমে শতকরা ৪৮ ভাগ সুদ বৈধ গণ্য করেছে। আমেরিকার আদালতগুলো সুদখোর মহাজনদের জন্য বার্ষিক শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ সুদ গ্রহণ করার অনুমতি দান করেছে। এখন আপনি নিজেই বলুন, এর মধ্যে কোন হারটি স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত?

আর একটু অগ্রসর হয়ে আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই,সত্যিই কি সুদের কোনো স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত হার হতে পারে? এ প্রশ্নটি পর্যালোচনা করলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে,সুদের হার কেবলমাত্র এমন অবস্থায় সঙ্গতভাবে নির্ধারিত হতে পারে, যখন ঋণগ্রহীতা তার ঋণলব্ধ অর্থ থেকে যে মুনাফা অর্জন করে, তার মূল্য নির্ধারিত থাকতো (বা করা যেতো)। যেমন এক বছর পর্যন্ত ১০০ টাকা ব্যবহার করলে – তা থেকে ২৫ টাকার ন্যায় মুনাফা লাভ করা যায়,একথা যদি নির্ধারিত হয়ে যায়, তাহলে এ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় যে, যে ব্যক্তির অর্থ সারাটা বছর ব্যবহার করে এ মুনাফা অর্জিত হলো সে এ মুনাফা থেকে ৫ টাকা বা আড়াই টাকা অথবা সোয়া এক টাকা পাওয়ার স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রাখে। কিন্তু বলাবাহুল্য, এভাবে যে অর্থ ব্যবহার করা হয়, তার মুনাফা কোনোদিন নির্ধারিত হয়নি এবং হতেও পারে না। উপরন্তু বাজারে সুদের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কখনো ঋণগ্রহীতা ঋণলব্ধ অর্থ থেকে কি পরিমাণ মুনাফা লাভ করছে, এমনকি কোনো মুনাফা লাভ করবে কিনা,সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয় না। এক্ষেত্রে কার্যত যা কিছু হয় তা হচ্ছে,মহাজনী ব্যবসায়ে ঋণগ্রহীতার অলসতার প্রেক্ষিতে ঋণের মূল্য নির্ধারিত হয়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সুদের বাজারে অন্যতর ভিত্তিতে সুদের হারের উঠানামা হতে থাকে। বুদ্ধি,যুক্তি ও ন্যায়নীতির সাথে এর কোনো দূরতম সম্পর্কও থাকে না।

মহাজনী ব্যবসায়ে একজন মহাজন সাধারণত দেখে, যে ব্যক্তি ঋণ নিতে এসেছে, সে কত গরীব, ঋণ না পেলে তার দুঃখ ও দুর্দশা কি পরিমাণ বাড়বে? সাধারণত এসবের ভিত্তিতে সে তার সুদের হার পেশ করে। যদি সে কম গরীব হয়, কম টাকা চায় এবং তাকে বাহ্যত বেশী পেরেশান ও চিন্তাকুল না দেখায়। তাহলে তার সুদের হার হবে কম। বিপরীত পক্ষে সে যতই দুর্দশাগ্রস্ত ও বেশী অভাবী হবে,ততই তার সুদের হার বাড়তে থাকবে। এমনকি,কোনো অর্ধাহারে অনাহারে দিন যাপনকারী ব্যক্তির পুত্র যদি কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলে তার জন্য সুদের হার শতকরা চার-পাঁচশো তো পৌঁছে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক বা বিস্ময়কর নয়। এ ধরণের অবস্থায় সুদের স্বাভাবিক হার প্রায়ই এ ধরণের হয়ে থাকে। এর একটি চরমতম দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে ১৯৪৭ সালে অমৃতসর ষ্টেশনের একটি ঘটনায়। ঐ বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভীতিপ্রদ দিনগুলোতে একদা অমৃতসর ষ্টেশনে জনৈক শিখ একজন মুসলমানের নিকট থেকে এক গ্লাস পানির স্বাভাবিক মূল্য হিসেবে ৩০০ টাকা আদায় করে। কারণ ঐ মুসলমানের পুত্র পিপাসায় মরে যাচ্ছিল এবং কোনো মুসলমান শরণার্থীর পক্ষে ট্রেন থেকে নিচে নেমে পানি আরহণ করা সম্ভবপর ছিল না।

মহাজনী ব্যবসায় ছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য বাজারে সুদের হার নির্ধারণ ও তা কমবেশী করার ব্যাপারে যেসব ভিত্তির আশ্রয় নেয়া হয়, সেগুলো সম্পর্কে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণ দু’টি ভিন্ন মতের অনুসারী।

একদল বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের নীতিই হচ্ছে এর ভিত্তি। যখন অর্থ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কম হয় ও ঋণ দেয়ার মতো অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন সুদের হার নেমে যায়। এভাবে সুদের হার অনেক বেশী কমে গেলে লোকেরা একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে এবং বেশী সংখ্যক লোক ঋণ নিতে এগিয়ে আসে। অতপর যখন অর্থের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং ঋণ দেয়ার মতো অর্থের পরিমাণ কমে যেতে থাকে, তখন সুদের হার বাড়তে থাকে, অবশেষে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যার ফলে ঋণ গ্রহণের চাহিদা খতম হয়ে যায়।

এর অর্থ কি? পুঁজিপতি সোজাসুজি ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসায়ে অংশীদার হয় না এবং তার যথার্থ মুনাফার ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণেও তৎপর হয় না। বিপরীতপক্ষে সে এ ক্ষেত্রে আন্দাজ-অনুমান করে দেখে, এ ব্যবসায়ে ব্যবসায়ী কি পরিমাণ মুনাফা অর্জন করবে, সে প্রেক্ষিতে সে নিজের সুদ নির্ধারণ করে এবং মনে করে, এ নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ তার পাওয়া উচিত। অন্যদিকে ব্যবসায়ীও আন্দাজ-অনুমান করে দেখে যে, পুঁজিপতির নিকট থেকে সে যে অর্থ নিচ্ছে, তা থেকে সর্বাধিক কি পরিমাণ মুনাফা লাভ করা সম্ভব হবে, কাজেই সে প্রেক্ষিতে সে একটি বিশিষ্ট পরিমাণের অধিক সুদকে অসংগত মনে করে। উভয় পক্ষই আন্দাজ-অনুমানের (SPECULATION) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। পুঁজিপতি হামেশা ব্যবসায়ে মুনাফার অংক বেশী করেই ধরে আর ব্যবসায়ী লাভের সাথে সাথে লোকসানের আশংকাও সামনে রাখে। এ কারণে উভয়ের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। ব্যবসায়ী যখন মুনাফা লাভের আশায় পুঁজি বিনিয়োগ করতে চায় পুঁজিপতি তখন নিজের পুঁজির দাম বাড়াতে থাকে। এভাবে দাম বাড়াতে বাড়াতে অবশেষে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যখন এ ধরণের চড়া সুদে অর্থ ঋণ নিয়ে কোনো ব্যবসায় খাটালে তাতে কোনো প্রকারেই মুনাফার সম্ভাবনা থাকে না। এ পর্যায়ে পৌঁছে পুঁজি বিনিয়োগের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং অর্থনৈতিক উন্নতির গতিধারায় অকস্মাৎ ভাটা পড়ে। অতপর যখন সমগ্র ব্যবসায় জগত পরিপূর্ণ মন্দাভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং পুঁজিপতি নিজের ধ্বংস প্রত্যক্ষ করতে থাকে, তখন সে সুদের হার এতদূর কমিয়ে দেয়, যার ফলে ঐ হারে অর্থ বিনিয়োগে ব্যবসায়ী লাভের আশা করে। এ সময় শিল্প-বাণিজ্যের বাজারে পুনর্বার অর্থ সমাগম হতে থাকে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, পুঁজি ও ব্যবসায়ের মধ্যে যদি ন্যায়সঙ্গত শর্তে অংশীদারীত্বমূলক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি সুসামঞ্জস্য পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। কিন্তু আইন যখন পুঁজিপতির জন্য সুদের ভিত্তিতে ঋণদান করার পথ প্রশস্ত করলো, তখন পুঁজি ও ব্যবসায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে জুয়াড়ি মনোবৃত্তির অনুপ্রবেশ ঘটলো এবং এমন জুয়াড়ি পদ্ধতিতে সুদের হার উঠানামা করতে থাকলো, যার ফলে সারা দুনিয়ার অর্থনৈতিক জীবনে একটা চিরস্থায়ী অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো।

দ্বিতীয় দলটি নিম্নোক্তভাবে সুদের হারের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে। তাদের বক্তব্য হলোঃ পুঁজিপতি যখন পুঁজি নিজের কাজে লাগানো অধিক পছন্দ করে, তখন সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, আবার যখন তার এ ইচ্ছায় ভাটা পড়ে, তখন সুদের হারও কমে যায়। তবে পুঁজিপতি নগদ অর্থ তার নিজের কাছে রাখাকে অগ্রাধিকার দেয় কেন? এর জবাবে তারা বিভিন্ন কারণ দর্শায়। নিজের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনের খাতে কিছু অর্থ রাখার প্রয়োজন হয়। আবার আকস্মিক প্রয়োজন ও অপ্রত্যাশিত অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যও কিছু অর্থ সংরক্ষিত রাখতে হয়। যেমন ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোনো অস্বাভাবিক খরচ অথবা হঠাৎ সুবিধাজনক সওদার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। এ দু’টি কারণ ছাড়া তৃতীয় একটি এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই যে, ভবিষ্যতে কোনোদিন যখন দাম হবার জন্য পুঁজিপতি তার নিকট যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা সঞ্চিত রাখতে চায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারণে অর্থকে নিজের ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য পুঁজিপতির মনে যে আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হয়, তা কি বাড়ে-কমে? সুদের হার উঠানামা করার সময় কি তার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়?

এর জবাবে তারা বলেঃ অবশ্যি বিভিন্ন ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কখনো এ আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, ফলে পুঁজিপতি সুদের হার বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যেতে থাকে। আবার কখনো এ আকাঙ্ক্ষা কমে যায়, তখন পুঁজিপতি সুদের হার কমিয়ে দেয়, ফলে শিল্প-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে লোকেরা বেশী করে ঋণ নিতে থাকে।

এ মনোহর যুক্তি ও ব্যাখ্যাটির অন্তরালে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে, ঘরোয়া প্রয়োজন বা ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক প্রয়োজন স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক সব ধরণের অবস্থায় পুঁজিপতি নিজের জন্য যে পরিমাণ পুঁজিকে ব্যবহার উপযোগী রাখতে চায় তার পরিমাণ হতে পারে বড়জোর শতকরা পাঁচ ভাগ। কাজেই প্রথম কারণ দুটিকে অযথা গুরুত্ব দেয়ার কোনো অর্থ হয় না। পুঁজিপতি যে কারণে নিজের শতকরা ৯৫ ভাগ পুঁজিকে কখনো সিন্দুকে ভরে রেখে আবার কখনো ঋণ দেয়ার জন্য বাজারে ছাড়ে, তা অবশ্যি তৃতীয় একটি কারণ। এ কারণটি বিশ্লেষণ করলে যে সত্য উপলব্ধি হয়, তা হচ্ছে, পুঁজিপতি নিজের দেশ ও জাতির অবস্থাকে অত্যন্ত স্বার্থপরতার দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকে। এ সময় নিজের স্বার্থ চরিতার্থতার কিছু লক্ষণ তার সম্মুখে পরিস্ফুট হয়ে উঠলে তার ভিত্তিতে সে এমন সব অস্ত্র নিজের কাছে সর্বদা প্রস্তুত রাখতে চায়, যেগুলোর সাহায্যে সমাজের বিভিন্ন সঙ্কট, সমস্যা ও বিপদ-আপদকে ব্যবহার করে সেগুলো থেকে অবৈধ সুবিধা ভোগ করা যায় এবং সমাজের উদ্বেগ –আকুলতা বৃদ্ধি করে নিজের সমৃদ্ধি ও স্বচ্ছলতা বাড়ানো সম্ভব হয়। এজন্য জীবন-জুয়ায় একটা বড় রকমের দাঁও মারার উদ্দেশ্যে সে পুঁজি নিজের জন্য আটক রাখে, সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে অর্থের প্রবাহ হঠাৎ বন্ধ করে দেয় এবং সমাজের জন্য ডেকে আনে এক মহাবিপদ যাকে মন্দা (Depression) বলা হয়ে থাকে। অতঃপর যখন সে দেখে, এ পথে তার পক্ষে হারাম উপায়ে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব তা সে করে ফেলেছে এবং এভাবে অর্থ উপার্জন তার পক্ষে আর কোনভাবেই সম্ভব নয় বরং এখন তার ক্ষতির পালা শুরু হয়ে যাবে, তখন তার নীচ মনের অভ্যন্তরে অর্থকে নিজের জন্য ব্যবহার উপযোগী রাখার ইচ্ছা নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং কম সুদের লোভ দেখিয়ে সে ব্যবসায়ীদেরকে তার নিকট অর্থ সম্পদ কাজে লাগাবার জন্য ব্যাপকভাবে আহবান জানায়।

আধুনিক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ সুদের হারের এই দুইটি কারণই দেখিয়ে থাকেন। অবশ্য স্ব স্ব পরিমণ্ডলে এই দুইটি কারণই যথার্থ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর মধ্যে যে কারণটিই যথার্থ হোক না কেন, তা থেকে সুদের ন্যায়সংগত ও স্বাভাবিক হার নির্ধারিত হয় বা হতে পারে কেমন করে? এক্ষেত্রে হয় আমাদেরকে বুদ্ধি, জ্ঞান, ন্যায়্যানুগতা ও স্বাভাবিকতার অর্থ ও ধারণা বদলাতে হবে, নতুবা একথা মেনে নিতে হবে যে, সুদ জিনিসটি নিজেই যে ধরণের অন্যায় তার হারও তার চেয়ে বেশি অন্যায় ও অসংগত কারণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় ও ওঠানামা করে।

সুদের অর্থনৈতিক লাভ ও তার প্রয়োজন
সুদ সমর্থকগণ সুদকে একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন এবং ধারণা পোষণ করেছেন যে, এর সাহায্য ব্যতিরেকে আমরা অনেক কিছু অর্থনৈতিক লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাই। এ দাবীর সমর্থনে যেসব যুক্তি পেশ করা হয়, সেগুলোর সারাংশ নিচে প্রদত্ত হলোঃ

একঃ অর্থনীতির সমস্ত কাজ-কারবার পুঁজি সংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। আর নিজেদের প্রয়োজনের ও আশা-আকাঙ্ক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং আয়ের সমগ্র অংশকে নিজেদের জন্য ব্যয় না করে কিছু অংশ সঞ্চয় করা ছাড়া এ পুঁজি সংগ্রহ সম্ভবপর নয়। পুঁজি সংগ্রহের এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। কিন্তু কোনো ব্যাক্তি যদি তার ইচ্ছা-বাসনা ত্যাগ করার ও আত্মসংযমের কোনো প্রতিদান না পায়, তাহলে সে নিজের প্রয়োজন অপূর্ণ রাখতে ও সম্পদের স্বল্প ব্যবহার করতে উদ্যোগী হবে কেন? এ সুদই তার সেই প্রতিদান। এরই আশায় বুক বেঁধে মানুষ অর্থ বাঁচাতে ও সঞ্চয় করতে প্রবৃত্ত হয়। কাজেই এ সুদকে হারাম গণ্য করা হলে আসলে উদ্বৃত্ত অর্থ সংরক্ষণের পথই রুদ্ধ হয়ে যাবে। অথচ এটিই হচ্ছে পুঁজি সংগ্রহ ও সরবরাহের আসল মাধ্যম।

দুইঃ সকল মানুষের জন্য নিজের সঞ্চিত সম্পদ সুদের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে খাটাবার পথ উন্মুক্ত থাকাই অর্থনৈতিক কায়-কারবারের দিকে পুঁজি প্রবাহিত হওয়ার সহজতর উপায়। এভাবে সুদের লোভেই তারা অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে, আবার সুদের লালসাই তাদেরকে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ অযথা জমা না রেখে উৎপাদনশীল করার জন্য ব্যবসায়ীর হাতে সোপর্দ করে একটি নির্ধারিত হার অনুযায়ি সুদ আদায় করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ দুয়ারটি বন্ধ করার অর্থ হবে কেবল মাত্র পুঁজি সঞ্চয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা শক্তিরই বিলুপ্তি নয় বরং সামান্য যা কিছু সংগৃহীত হবে তাও ব্যবসায়ে খাটানো যাবে না।

তিনঃ সুদ কেবল পুঁজি সংগ্রহ করে তাকে ব্যবসায়ের দিকে টেনে আনে না বরং তার অলাভজনক ও অনুপকারী ব্যবহারের পথরোধ করে। আর সুদের হার এমন একটি বস্তু যা সর্বোত্তম পদ্ধতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন প্রস্তাবিত ব্যবসায়ের মধ্য থেকে সবচেয়ে লাভজনক ও মুনাফাদায়ক ব্যবসায়ে পুঁজি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে। এছাড়া দ্বিতীয় এমন কোনো ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়নি যা বিভিন্ন কার্যকর পরিকল্পনার মধ্য থেকে লাভজনক অলাভজনক থেকে এবং অধিক লাভজনককে কম লাভজনক থেকে আলাদা করে অধিক লাভজনকের দিকে পুঁজিকে পরিচালিত করতে পারে। কাজেই সুদের বিলোপ সাধনের ফলে প্রথমত লোকদের অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে পুঁজি ব্যবহার করতে দেখা যাবে, অতঃপর লাভ-ক্ষতির বাছ বিচার না করে লাভজনক-অলাভজনক সব রকম কাজে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকবে।

চারঃ ঋণ মানুষের জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজনের অংগীভূত। ব্যক্তির নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এর প্রয়োজন দেখা দেয়, ব্যবসায়ী প্রায়ই এর মুখাপেক্ষী থাকে এবং সরকারী কাজ-কর্মও এর সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। নিছক দান-খয়রাত হিসেবে এত ব্যাপকভাবে ও বিপুলাকারে ঋণ সরবরাহ করা কেমন করে সম্ভব? যদি পুঁজিপতিদেরকে সুদের লোভ দেখানো না হয় এবং মূলধনের সাথে সাথে সুদটাও তারা নিয়মিতভাবে পেতে থাকবে, এ নিশ্চয়তা তাদেরকে দান না করা হয় তাহলে তারা খুব কমই ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। এভাবে ঋণ দেয়া বন্ধ হয়ে গেলে সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এক দরিদ্র ব্যক্তি নিজের দুঃসময়ে মহাজনের নিকট থেকে ঋণ লাভ করে। এক্ষেত্রে সুদের লোভ না থাকলে তার আত্মীয়ের লাশ বিনা কাফনে-দাফনে পড়ে থাকবে এবং কেউ তার দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে না। এক ব্যবসায়ী নিজের দৈন্য ও সংকটকালে প্রয়োজনের সাথে সাথেই সুদে ঋণ লাভ করে এবং এভাবে তার কাজ চলতে থাকে। এ দুয়ারটি বন্ধ হয়ে গেলে কতবার যে সে দেউলিয়া হবে তা কল্পনাই করা যায় না। রাষ্ট্রের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়। সুদী ঋণের সাহায্যেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। অন্যথায় প্রতিদিন তাকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দান করবে এমন দাতা হাতেম কোথায় পাওয়া যাবে?

সুদ কি যথার্থই প্রয়োজনীয় ও উপকারী?
এবার আমরা উপরোল্লিখিত লাভ ও প্রয়োজনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো, এগুলো যথার্থই লাভ ও প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত কিনা অথবা নিছক শয়তানী প্রতারণা।

এ ব্যপারে প্রথম ভুল ধারণা হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনের জন্য ব্যক্তির স্বল্প ব্যয় ও অর্থ সঞ্চয়কে একটি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক বিষয় মনে করা হয়েছে। অথচ আসল ব্যাপার এর সম্পূর্ণ উল্টো। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল অন্যত্র প্রোথিত রয়েছে। মানুষের একটি দল সমষ্টিগতভাবে জীবনযাপনের যেসব উপকরণ তৈরী করতে থাকবে তা অতি দ্রুত বিক্রি হতে থাকবে, এর ফলে পণ্য উৎপাদন ও বাজারের চাহিদা পূরণের কাজ চক্রাকারে ভারসাম্য বজায় রেখে দ্রুততার সাথে চলতে থাকবে। এভাবেই অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে। এ অবস্থা কেবল তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন লোকেরা সাধারণভাবে অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা ও কর্মরত অবস্থায় যে পরিমাণ ধনসম্পদ তাদের অংশে আসে তা ব্যয় করতে অভ্যস্ত হয় এবং এতটা প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়, যার ফলে তাদের নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা হয়ে গেলে দলের অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবান লোকদের নিকত তা স্থানান্তর করে, ফলে তারাও অনায়াসে প্রচুর পরিমাণে নিজেদের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে এখানে যা শিখানো হচ্ছে তা হচ্ছে এই যে, যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ পৌঁছে গেছে তাকে কৃপণতা অবলম্বন করতে হবে (যাকে আত্মসংযম ও ইচ্ছা-বাসনার কুরবানী প্রভৃতি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে) নিজের সংগত প্রয়োজনের একটা বড় অংশ পূর্ণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বেশী বেশী করে অর্থ সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আসলে এর ফলে একটি বড় রকমের ক্ষতি হবে। তাহচ্ছে এই যে, বর্তমানে বাজারে যে পণ্য মওযুদ রয়েছে তার একটি বড় অংশ অবিক্রীত থেকে যাবে। কারণ যাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই ক্রয় ক্ষমতা কম ছিল তারা অক্ষমতার কারণে অনেক পণ্য কিনতে পারেনি আর যারা প্রয়োজন পরিমাণ পণ্য কিনতে পারত তারা সক্ষমতা সত্ত্বেও উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশ ক্রয় করেনি। আবার যাদের নিকট প্রয়োজনের চাইতে বেশী ক্রয়ক্ষমতার পৌঁছে গিয়েছিল তারা তা অন্যের নিকট স্থানান্তর করার পরিবর্তে নিজের নিকট আটক রেখেছিল। এখন যদি প্রতিটি অর্থনৈতিক আবর্তনের ক্ষেত্রে এ ধারা অব্যাহত থাকে এবং প্রয়োজন পরিমাণ ও প্রয়োজনের অধিক পরিমাণ ক্রয় ক্ষমতার অধিকারীরা নিজেদের এ ক্ষমতার বৃহত্তর অংশ উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-ব্যবহার না করে এবং কম ক্রয় ক্ষমতার অধিকারীদেরকেও না দেয় বরং একে আটক করে সঞ্চয় করতে থাকে তাহলে এর ফলে প্রতিটি আবর্তনে দলের অর্থনৈতিক উৎপাদনের বিরাট অংশ অবিক্রীত থেকে যেতে থাকবে। পণ্যের চাহিদা কম হবার কারণে উপার্জনও কমে যাবে। উপার্জন কম হলে আমদানীও কমে যাবে। আর আমদানী কম হয়ে গেলে ব্যবসায় পণ্যের চাহিদা আরো বেশী কমে যেতে থাকবে। এভাবে কয়েক ব্যাক্তির অর্থ সঞ্চয় প্রবণতা বহু ব্যক্তির অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণে পরিণত হবে। অবশেষে এ অবস্থা ঐ অর্থ সঞ্চয়কারীদের জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। কারণ যে অর্থের সাহায্যে উৎপন্নজাত দ্রব্যাদি কেনার পরিবর্তে সে তাকে যক্ষেরধনের মতো আগলিয়ে রেখাছে এবং তিলে তিলে বাড়িয়ে চলছে পণ্যদ্রব্য তৈরী করার জন্য, অবশেষে ঐ পণ্যদ্রব্য তৈরী হলে তা কিনবে কে?

এ বিষটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে বুঝা যাবে, যে সমস্ত কারণে ব্যক্তি নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় না করে সঞ্চয় করে রাখতে উদ্যোগী হয় সে কারণগুলো দূর করাই হচ্ছে আসল অর্থনৈতিক প্রয়োজন। সমগ্র সমাজের অর্থনৈতিক কল্যাণার্থে একদিকে এমন ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যার ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দুঃসময়ে আর্থিক সাহায্য লাভ করতে পারে; এভাবে লোকেরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ জমা করার প্রয়োজন অনুভব করবে না, অন্যদিকে সঞ্চিত অর্থের উপর যাকাত আরোপ করতে হবে, এর ফলে মানুষের মধ্যে অর্থ জমা করার প্রবণতা কমে যাবে। এরপরও যে অর্থ-সম্পদ সঞ্চিত হতে থাকবে তা থেকে অবশ্যই অর্থের আবর্তনে যারা কম অংশ পেয়েছে তাদেরকে একটি অংশ দিতে হবে। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে এখানে সুদের লোভ দেখিয়ে মানুষের প্রকৃতিগত কার্পণ্যকে উস্কানী দেয়া হচ্ছে এবং যারা কৃপণ নয় তাদেরকেও অর্থ ব্যয় করার পরিবর্তে সঞ্চয়ের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর এ ভুল পদ্ধতিতে সামষ্টিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যে পুঁজি একত্রিত হয় তাকে অর্থ উৎপাদনকারী ব্যবসায়ের দিকে আনা হলেও সুদের ভিত্তিতে আনা হয়। সামষ্টিক স্বার্থের উপরে এটি দ্বিতীয় দফা অত্যাচার। এ সঞ্চিত অর্থ যদি এমন এক শর্তে ব্যবসায়ে খাটানো হত যেখানে অর্জিত মুনাফার হার অনুযায়ী পুঁজিপতিও তার অংশ লাভ করতো তাহলেও কোনো প্রশ্ন ছিলনা। কিন্তু এ সঞ্চিত অর্থ এমন এক শর্তে বাজারে ছাড়া হচ্ছে যার ফলে ব্যবসায়ে লাভ হোক বা না হোক এবং কম মুনাফা বা বেশী মুনাফা-তাতে পুঁজিপতির কিছু আসে যায় না, সে তার নির্ধারিত হার অনুযায়ী মুনাফা অবশ্যি পেতে থাকবে। এভাবে সামষ্টিক অর্থব্যবস্থাকে দুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। একদিকে টাকা উপার্জন করে তা ব্যয় না করার ও জমা করে রাখার ক্ষতি এবং অন্যদিকে যে টাকা জমা করে রাখা হয়েছিল তা সামষ্টিক অর্থব্যবস্থার সাথে যুক্ত হলেও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায় শামিল না হয়ে ঋণ আকারে সমগ্র সমাজের শিল্প ও ব্যবসায়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে এবং প্রচলিত আইন তাকে নিশ্চিত মুনাফার জামানত দান করেছে। এ ভ্রান্ত ব্যবস্থাপনা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যার ফলে সমাজের বিপুলসংখ্যক লোক তাদের ক্রয়ক্ষমতা সামগ্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যাদি ক্রয়ের কাজে ব্যবহার করার পরিবর্তে তা সঞ্চিত করে ক্রমান্বয়ে সুদ ভিত্তিক ঋণের আকারে সমাজের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতি সমাজকে মহাসংকটের সম্মুখীন করেছে। প্রতি মুর্হূতে তার সুদ ও ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে। যে ক্ষেত্রে বাজারে তার উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কম,ক্রেতার সংখ্যা কম,লাখো লাখো কোটি কোটি লোক নিজেদের অক্ষমতা ও অর্থ না থাকার দরুন তা কিনতে পারছে না। আবার হাজার হাজার লোক নিজেদের ক্রয়ক্ষমতাকে বেশী সুদে ঋণ দেয়ার জন্য সঞ্চিত রেখে তা কেনার ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে,সে ক্ষেত্রে এ বর্ধিত ঋণ ও সুদ সে কিভাবে আদায় করবে?

সুদের উপকারিতা ও লাভজনক দিক সর্ম্পকে বলা হয়ে থাকে, এর চাপে ব্যবসায়ী পুঁজির যত্রতত্র অযথা ও অলাভজনক ব্যবহার না করে অধিকতর লাভজনক কাজে তা ব্যবহার করে। বলা হয়ে থাকে সুদের হার তার অলৌকিক ক্ষমতার সাহায্যে নীরবে ব্যবসায়ের পথ নির্দেশ করার মহাদায়িত্ব পালন করে এবং এরি বদৌলতইে পুঁজি তার চলার সম্ভাব্য সকল পথের মধ্য থেকে ছাঁটাই-বাছাই করে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করে। কিন্তু এ সুন্দর কথার পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিলে এর আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে সুদের প্রথম কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে,তার বদৌলতে উপকার ও লাভ এর সমস্ত ব্যাখ্যাই পরিত্যক্ত হয়েছে এবং ঐ শব্দগুলোর কেবল একটিমাত্র অর্থই রয়ে গেছে,তা হচ্ছে ‘অর্থনৈতিক উপকার’ ও ‘বস্তুগত লাভ’। এভাবে পুঁজি বিরাট একাগ্রতা লাভে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে অর্থনৈতিক লাভ ছাড়া অন্য ধরনের লাভের পথেও পুঁজির আনাগোনা হতো। কিন্তু এখন তার লক্ষ্য একটি মাত্র পথের দিকে। অর্থাৎ যে পথে অর্থনৈতিক লাভ ও সুবিধা নিশ্চিত একমাত্র সে পথেই তার গতি নিয়ন্ত্রিত। অতপর তার দ্বিতীয় কৃতিত্ব হচ্ছে যে, সমাজের লাভ বা স্বার্থোদ্বার নয় বরং কেবলমাত্র পুঁজিপতির লাভ ও সীমিত স্বার্থোদ্ধারকেই সে পুঁজির লাভজনক ব্যবহারের মানদন্ডে পরিণত করেছ। পুঁজির হার স্থির করে দেয় যে,পুঁজি এমন একটি কাজে ব্যবহৃত হবে যা পুঁজিপতিকে বার্ষিক শতকরা ৬ বা এর চেয়ে বেশী হারে মুনাফা দিতে সক্ষম। এর চেয়ে কম মুনাফাদানকারী কোনো কাজে পুঁজি খাটানোর কোনো যৌক্তিকতাই নেই। এখন মনে করুন,পুঁজির সামনে দুটো পরিকল্পনা পেশ করা হলো। একটা পরিকল্পনা হলো এমন কতকগুলো আবাসিক গৃহ নির্মানের, যেগুলো আরামদায়ক হবার সাথে সাথে গরীব লোকেরা কম ভাড়ায় নিতে পারবে। দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি হলো একটি বিরাট জাঁকালো প্রোক্ষাগৃহ নির্মাণের। প্রথম পরিকল্পনাটি শতকরা ৬ ভাগের কম মুনাফাদানের আশা দেয় আর দ্বিতীয়টি দেয় এর চেয়ে বেশী। অন্য কোনো অবস্থায় অজ্ঞতাবশত প্রথম পরিকল্পনাটির দিকে পুঁজির প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা ছিল বা অন্তত:পক্ষে এ দুটোর মধ্যে কোনটার দিকে সে ঝুঁকবে তা নিয়ে তাকে যথেষ্ঠ সংশয় দোলায় দুলতে হতো। কিন্তু সুদের হারের এমনি মাহাত্ম যে তার নির্দেশে পুঁজি কোনো প্রকার দ্বিধা না করে সুড়সুড় করে দ্বিতীয় পরিকল্পনার দিকে অগ্রসর হয় এবং প্রথম পরিকল্পনাটিকে নির্দয়ভাবে পিছনে নিক্ষেপ করে। তার দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। উপরন্তু সুদের হার ব্যবসায়ীকে এমনভাবে বাধ্য করে যার ফলে সে নিজের মুনাফাকে সমসময় পুঁজিপতি নির্ধারিত মুনাফার সীমারেখা থেকে উচ্চে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এজন্য সে যে কোন নৈতিকতা বিরোধী পদ্ধতি অবলম্বন করতে কুন্ঠিত হয় না। যেমন, মনে করুন এক ব্যক্তি একটি চলচ্চিত্র কোম্পানী গঠন করলো। এ কোম্পানীতে সে যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করেছে তার সুদের হার হচ্ছে বছরে শতকরা ৬ ভাগ। এ ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যি এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যার ফলে তার লাভের হার ঐ শতকরা ৬ ভাগের চেয়ে বেশী হয়। নৈতিক পবিত্রতার অধিকারী ও তত্ত্ব-জ্ঞান সমৃদ্ধ নির্মাণে যদি তার এ উদ্দেশ্য সফল না হয় তাহলে অবশ্যি সে উলংগ ও অশ্লীল চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হবে এবং এমনভাবে এর বিজ্ঞাপন ছড়াতে ও প্রপাগান্ডা করতে থাকে যার ফলে মানুষ আবেগে ফেটে পড়বে এবং যৌন উত্তেজনার প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হয়ে হাজার হাজার লাখো লাখো মানুষ পেক্ষাগৃহের দিকে ছুটবে।

সুদের সাহায্য ছাড়া যেসব লাভ ও উপকার সাধিত হওয়ার কোনো উপায় নেই সেগুলোর আসল চেহারা উপরে বিবৃত হলো। এখন সুদের সাহায্য ছাড়া যেসব প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই সেগুলোর কিছু বিশ্লেষণ আমরা করতে চাই। নিসন্দেহে ঋণ মানুষের জীবনের অপিরিহার্য প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের নিজের ব্যক্তিগত অভাব পূরণে ঋণের প্রয়োজন হয় আবার শিল্প,ব্যবসায়,কৃষি প্রভৃতি কাজ-কারবারেও সবসময় এর প্রয়োজন দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রসহ সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এর মুখাপেক্ষী থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা ঠিক নয় যে, সুদ ছাড়া ঋণ সংগ্রহ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আসলে সুদকে আইনসংগত গন্য করার কারণে ব্যক্তি থেকে নিয়ে রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল পর্যায়ে সুদ ছাড়া এক পয়সাও ঋণ লাভ করা কারোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সুদকে হারাম গণ্য করে অর্থনীতির সাথে সাথে ইসলাম নির্দেশিত নৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করলে আজই দেখা যাবে ব্যক্তিগত অভাব, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক প্রয়োজনের সকল ক্ষেত্রে সুদ বিহীন ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বরং অনেক ক্ষেত্রে দানও পাওয়া যাবে। ইসলাম কার্যত এর প্রমাণ পেশ করেছে। শত শত বছর ধরে মুসলমান সমাজ সুদ ছাড়াই উত্তম পদ্ধতিতে নিজেদের সমস্ত অর্থনৈতিক কাজ-কারবার চালিয়ে এসেছে। সুদ ব্যবস্থা লাঞ্ছিত আজকের এ ঘৃণিত যুগের পূর্বে মুসলমান সমাজ কোনদিন কল্পনাই করতে পারত না যে, সুদ বিহীন ঋণ লাভ করা কোনোক্রমেই সম্ভব না হওয়ার কারণে কোনো মুসলমানের লাশ কাফন-দাফন করা হয়নি বা ব্যবসায়িক প্রয়োজন অনুযায়ী কর্জে হাসানা না পাওয়ার কারণে মুসলমানদের শিল্প-ঋণ দিতে রাজী না হওয়ায় কোনো মুসলিম সরকার কল্যাণমূলক কাজে বা জিহাদে অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয়নি। কাজেই কর্জে হাসানার পরিকল্পনা কার্যকর করার যোগ্য নয় এবং ঋণের সমগ্র প্রাসাদটিই সুদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, দাবী কোনো প্রকার যুক্তি ভিত্তিক প্রতিবাদের মুখাপেক্ষী নয়। আমরা নিজেদের শত শত বছরের কার্যধারার মাধ্যমে একে ভ্রান্ত প্রমাণ করে এসেছি।

আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যত সুদ বিহীন ঋণ লাভের জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বিত হবে তা আমাদের এ অধ্যায়ের আলোচনা বহির্ভূত বিষয়। পরবর্তী এক অধ্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

———–

 

২-ইতিবাচক দিক
আগের অধ্যায়ে আমরা যে আলোচনা করেছি তা থেকে প্রমান হয়েছে যে, সুদ যুক্তি ও ন্যায়সংগত নয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই উপরন্তু এর মধ্যে যথার্থ লাভ ও উপকারের কোনো অংশও নেই। কিন্তু শুধুমাত্র এ নেতিবাচক কারণগুলোর ভিত্তিতে সুদ হারাম ঘোষিত হয়নি। বরং সুদ হারাম হবার আসল কারন হচ্ছে এই যে, এটি চূড়ান্তভাবে ক্ষতিকর এবং অনেক দিক দিয়ে অনেক বেশী ক্ষতিকর।

এ অধ্যায়ে আমরা এর প্রতিটি ক্ষতিকর দিকের বিস্তারিত পর্যালোচনা করবো। আমাদের এ আলোচনার পর ইনশাআল্লাহ কোনো বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এ নাপাক বস্তুটির হারাম হওয়া সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।

সুদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি
প্রথমে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিতে বিচার করা যাক। কারণ নৈতিকতা ও আত্মিক অনুভুতিই মানবতার মূল প্রাণশক্তি। মানবতার এ প্রাণশক্তির পক্ষে ক্ষতিকর যে কোনো বস্তুই অন্যদিক দিয়ে যতই লাভজনক হোক না কেন তা পরিত্যাজ্য। এখন সুদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অর্থ সঞ্চয়ের আকাঙ্খা থেকে শুরু করে সুদী ব্যবসায়ের বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত সমগ্র মানসিক কাঠিন্য ও অর্থ পূজার পারদর্শিতার প্রভাবাধীনে পরিচালিত হয় এবং ব্যবসায়ে মানুষ যত এগিয়ে যেতে থাকে এ পারদর্শিতা ততই তার মধ্যে বিকাশ লাভ করতে থাকে। বিপরীতপক্ষে যাকাতও সাদকার সংকল্প করা থেকে শুরু করে একে কার্যকর করা পর্যন্ত সমগ্র মানসিক কর্মকান্ড দানশীলতা, ত্যাগ, সহানুভূতি, ঔদার্য, উন্নতি মনন ও সদিচ্ছপুষ্ট গুণাবলীর প্রভাবাধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং এ পদ্ধতিতে অনবরত কাজ করতে থাকলে এ গুণগুলো মানুষের মধ্যে বিকাশ লাভ করতে থাকে। দুনিয়ায় কি এমন কোনো মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে যে ঐ দু’ধরনের নৈতিক গুণাবলীর মধ্যে প্রথমগুলোকে খারাপ ও শেষেরগুলোকে ভালো বলে স্বীকার করবে না?

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতি
এবার সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বিচার করা যাক। সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলে প্রত্যেক ব্যক্তি সহজেই বুঝতে পারবে যে, যে সমাজের লোকেরা পারস্পরিক স্বার্থ সিদ্ধির ভিত্তিতে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, নিজের ব্যক্তি স্বার্থ উদ্বার ও ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া কেউ অপরের কোনো কাজে আসে না, একজনের অভাব অন্যজনের মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেয় এবং বিত্তশালী শ্রেণীর স্বার্থ বিত্তহীন শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিকূল হয়, সে সমাজ কোনদিন সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হতে পারে না। তার অংশগুলো হামেশা বিশৃংখলা ও বিক্ষিপ্ততার শিকার হতে থাকবে। এ পরিস্থিতির সাথে অন্যান্য কারন এসে যুক্ত হলে এ ধরনের সমাজের বিভিন্ন অংশের পরস্পর সংঘর্ষশীল হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। বিপরীত পক্ষে যে সমাজের সামগ্রিক ব্যবস্থা পারস্পরিক সহানুভুতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, যার ব্যক্তিবর্গ পরস্পরের সাথে দানশীলতা ও ঔদার্যপূর্ণ ব্যবহার করে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যের প্রভাব ও প্রয়োজনের সময় প্রশস্ত হৃদয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবং বিত্তবানরা বিত্তহীনদের সাথে সহানুভুতিপূর্ণ সহযোগিতা বা কমপক্ষে ন্যায়ানুগ সাহায্যের পথ অবলম্বন করে, সেখানে পরস্পরের মধ্যে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা, কল্যাণাকাঙ্খা ও অন্তরঙ্গতা বিকাশ লাভ করবে। এ ধরনের সমাজের বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ও পরস্পরের পরিপূরক হবে। সেখানে অভ্যন্তরীন বিবাদ ও সংঘর্ষ সৃষ্টির কোনো সুযোগ থাকবে না। সেখানে পারস্পরিক সহযোগিতা ও মঙ্গলাকাঙ্খার কারণে উন্নতির গতি প্রথম সমাজের তুলনায় অনেক বেশী দ্রুত হবে।

অনুরূপ অবস্থা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হবে। একটি জাতি অন্য জাতির সাথে দানশীলতা, ঔদার্য ও সহানুভুতিপূর্ণ ব্যবহার করবে এবং তার বিপদের সময় নিতান্ত অন্তরঙ্গতা সহকারে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে। এ অবস্থায় অন্য পক্ষ থেকে এর জবাবে প্রেম-প্রীতি, কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক কল্যাণ কামনা ছাড়া অন্য কিছুই প্রকাশ সম্ভব নয়। বিপরীত পক্ষে একই জাতি যদি তার প্রতিবেশী জাতির প্রতি ব্যবহারে স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণমনতার পরিচয় দেয় এবং তার বিপদকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে লাভবান হতে চায়,তাহলে হয়তো তা থেকে অর্থনৈতিক লাভ বিপুল পরিমানে অর্জনে সক্ষম হবে কিন্তু এরপর এ ধরনের ‘শাইলক’ প্রকৃতির প্রতিবেশীর প্রতি ঐ জাতির মনে কোনো আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও কল্যাণাঙ্খার অনুভূতি জাগরুক থাকবে না। বেশী দিনের কথা নয়,বিগত বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকার নিকট থেকে বৃটেন একটি বড় অংকের ঋণ নিয়েছিল। BRETTON WOOD AGREEMENT নামে তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বৃটেন তার ধনাঢ্য মিত্র ও যুদ্ধক্ষেত্রের সহযোগী আমেরিকার নিকট থেকে সুদমুক্ত ঋণ চাচ্ছিল। কিন্তু আমেরিকা সুদ ছাড়তে রাজী হয়নি। কাজেই নিজের সমস্ত অক্ষমতা সত্ত্বেও বৃটেন সুদ দিতে রাজী হয়। ইংরেজ জাতির উপর এর যা প্রভাব পড়ে তা সমকালীন ইংরেজ কূটনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের বক্তৃতা, বিবৃতি ও রচনাবলী থেকে সুস্পষ্টরূপে অনুমান করা যায়। প্রখ্যাত অর্থনীতি বিশারদ লর্ডকনেজ আঞ্জাহানী বৃটেনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারটিকে চূড়ান্ত করেন। চুক্তি সম্পন্ন করার পরে দেশে ফিরে বৃটিশ পার্লামেন্টে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ “আমেরিকা আমাদেরকে সুদমুক্ত ঋণ দিতে রাজী হয়নি এ দু:খ আমি সারা জীবন ভুলবো না।” মি: উইনষ্টন চার্চিলের ন্যায় আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম বন্ধুও বলেনঃ “আমাদের সাথে যে বেনিয়াসুলভ আচরন করা হয়েছে তার গভীরে আমি অনেক বিপদাশংকা দেখতে পাচ্ছি। সত্য বলতে কি আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর এর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব পড়েছে।” তদানিন্তন অর্থমন্ত্রী ডঃ ডাল্টন এ চুক্তিটিকে অনুমোদন লাভের জন্য পার্লামেন্টে পেশ করে বলেনঃ “যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় আমরা এ ভারি বোঝা মাথায় নিয়ে বের হচ্ছি। আমরা একই উদ্দেশ্য যে অসাধারণ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে এসেছি এটি তার চমৎকার ও অদ্ভুত প্রতিদান। ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকগনই আমাদের এই মজার পুরস্কারটি সম্পর্কে যথার্থ মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। ——–আমরা কর্জে হাসানা দানের আবেদন জানিয়েছিলাম কিন্তু জবাবে বলা হয়, এটা কার্যকর রাজনীতি নয়।”

সুদের এ স্বাভাবিক প্রভাব ও এর অনিবার্য মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া সবসময় সব অবস্থায় প্রকাশ হতে থাকবে। এক জাতি অন্য জাতিকে বা এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে সুদভিত্তিক ঋণ দিলে সর্বাবস্থায় এ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। ইংল্যান্ডের লোকেরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সুদী লেনদেনকে কোনো খারাপ কাজ বলে মেনে নিতে রাজী ছিল না এবং আজও রাজী নয়। আপনি কোনো ইংরেজকে সুদমুক্ত ঋণের কথা বললে সে তখনই জবাব দিয়ে বসবে,“জনাব এটা কার্যকর ব্যবসায়ের (PRACTICAL BUSINESS) নিয়ম নয়।” অথচ তার জাতীয় বিপদের দিনে তারই এক বন্ধু দেশ যখন তার সাথে ঐ একই কার্যকর ব্যবসায়ের পদ্ধতি অবলম্বন করে তখন প্রত্যেকটি ইংরেজ চীৎকার করে ওঠে। সুদ মনের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এবং সম্পর্ক খারাপ করে, এ সত্যের সপক্ষে তারাই সারা দুনিয়ার সামনে সাক্ষ্য প্রদান করেছে।

আর্থিক ক্ষতি
এবার এর অর্থনৈতিক দিকের আলোচনায় আসা যাক। অর্থনৈতিক জীবনের যেসব বিষয় কোনো না কোনোভাবে ঋণের সাথে জড়িত সুদও সেসব বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। ঋণ বিভিন্ন প্রকারেরঃ

একঃ অভাবী লোকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যে ঋণ নিয়ে থাকে।

দুইঃ ব্যবসায়ী,শিল্পপতি ও চাষীরা নিজেদের লাভজনক কাজে খাটাবার জন্য যে ঋণ নেয়।

তিনঃ সরকার নিজের দেশবাসীর জন্য যে ঋণ নিয়ে থাকে। এ ঋণ হয় বিভিন্ন প্রকৃতির। এর মধ্যে কোনো কোনো ঋণ অলাভজনক কাজে ব্যবহার করার জন্য গ্রহণ করা হয়। যেমন,খাল-খনন,রেলপথ ও সড়ক নির্মাণ, পানি, বিদ্যুৎ পরিকল্পনা কার্যকর করণ প্রভৃতি।

চারঃ সরকার নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করে।

সুদ আরোপিত হবার পর এগুলোর প্রত্যেকটি কোন ধরনের ক্ষতির অবতারনা করে পৃথক পৃথক আলোচনার সাহায্যে তা আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

অভাবী ব্যক্তিদের ঋণ
মহাজনী ব্যবসায়ে (Money Lending Business) সবচেয়ে বেশী সুদের লেনদেন হয়। এ আপদটি কেবল এ হিমালয়ান উপমহাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বব্যপী এর প্রসার। দুনিয়ার কোনো দেশ এ আপদমুক্ত নেই। এর কারন হচ্ছে এই যে, দুনিয়ার কোথাও দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের জন্য জরুরী প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সহজ ঋণ লাভের কোনো ব্যবস্থা নেই। সুদমুক্ত ঋণ না হলেও অন্ততঃপক্ষে ব্যবসায়িক সুদের হারে ঋণ লাভের কোনো ব্যবস্থা কোথাও নেই। সরকার এ বিষয়টিকে নিজের দায়িত্ব বহির্ভূত মনে করে। সমাজ এর প্রয়োজন অনুভব করে না। ব্যংকে লাখো লাখো কোটি কোটি টাকার কারবারে হাত দেয়। তাছাড়া কোনো স্বল্প আয় সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে নিজের কোনো আকস্মিক প্রয়োজনের জন্য ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে ঋণ গ্রহণ করাও সহজসাধ্য নয়। এসব কারণে সব দেশের লোকেরা নিজেদের চরম দুর্দিনে এমনসব মহাজনের নিকট থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয় যাদেরকে তারা নিজেদের ধারে কাছে শকুনির ন্যায় নিরন্তর শিকারের সন্ধানে ঘোরাফেরা করতে দেখে। এ মহাজনী ব্যবসায়ে সুদের হর এতবেশী যার ফলে একবার যে ব্যক্তি এ জালে পা দিয়েছে তার পক্ষে আর নিজেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে দাদা যে ঋণ নিয়েছিল তা উত্তরাধিকার সূত্রে তার নাতিদের ঘাড়ে গিয়ে চেপে বসে এবং আসলের কয়েকগুন বেশী সুদ আদায় করার পরও আসল ঋণের পাহাড় পূর্ববৎ বুকের ওপর চেপে বসে থাকে। অতপর অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়,ঋণগ্রহীতা কিছুকাল যদি সুদ আদায়ের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তাহলে আরোপিত সুদের অংককে আসলের অন্তর্ভুক্ত করে ঐ মহাজন নিজের আসল ও সুদ আদায় করার জন্য ঐ ব্যক্তিকে বর্ধিত সুদের হারে আর একটি বড় ঋণ দেয়, ফলে ঐ দরিদ্র ব্যক্তি আগের চেয়ে আরো বড় ঋণের বোঝার চাপে পিষ্ট হতে থাকে। ইংল্যান্ডে এ মহাজনী ব্যবসায় সর্বনিম্ন সুদের হার বছরে শতকরা ৪৮ এবং আইনের জোরে এ সুদ আদায় করা হয়। কিন্তু বাজারে এ সুদের সাধারন হার প্রচলিত এবং যার মাধ্যমে সেখানকার কাজ-কারবার চলছে তা হচ্ছে বছরে শতকরা ২৫০ থেকে ৪০০ ভাগ। এছাড়াও বছরে শতকরা বার তেরশো পর্যন্ত সুদের দৃষ্টান্তও পাওয়া গেছে। আমেরিকার মহাজনদের সুদের হার বছরে শতকরা ৩০ থেকে ৬০ পর্যন্ত কিন্তু তাদের সাধারন কাজ-কারবার চলে বার্ষিক শতকরা ১০০ থেকে ২৬০ হারে। অনেক সময় এ হার শতকরা ৪৮০-তেও পৌঁছে যায়। আমাদের এ উপমহাদেশে অত্যন্ত সদাশয় মহাজনরা বার্ষিক শতকরা ৪৮ ভাগ সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। অন্যথায় সুদের সাধারণ হার হচ্ছে বার্ষিক শতকরা ৭৫ এবং তা অনেক সময় শতকরা ১৫০-এ পৌঁছে যায় বরং শতকরা ৩০০ থেকে ৩৫০ এর দৃষ্টান্তও পাওয়া গেছে।

প্রত্যেক দেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বিরাট অংশ এ মহবিপদজালে নিজেদেরকে মারাত্মকভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। এর ফলে স্বল্প আয়ের লোকদের উপার্জনের বৃহত্তর অংশ মহাজনের সিন্দুকে চলে যাচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সামান্য রুজি রোজগার তারা করে তার থেকে সুদ আদায় করার পর দু’বেলা দু’মুঠো পেট ভরে আহার করার মতো পয়সা তাদের হাতে অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থা কেবল তাদের চরিত্র নষ্ট করে ক্ষান্ত হয় না,তাদেরকে অপরাধ প্রবণতার দিকেও ঠেলে দেয়,তাদের জীবনযাপনের মান নিম্নমুখী করে এবং সন্তানদের নিম্নমানের শিক্ষা দিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। উপরন্তু এর একটি মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এই যে,চিরন্তন দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী। দেশের সাধারণ কর্মজীবীদের কর্মশক্তি ও যোগ্যতা অনেকাংশে কমিয়ে দেয় এবং যখন তারা নিজেদের মেহনতের ফল অন্যদের ভোগ করতে দেখে তখন নিজেদের কাজে তাদের আগ্রহ ও মনযোগ কমে যায়। এ প্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাচ্ছে সুদী ব্যবসায় কেবল একটি যুলুমই নয় বরং একই সঙ্গে এর মধ্যে সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার জন্য বিপুল ক্ষতি নিহিত রয়েছে। এটাকে চরম নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই বলা যেতে পারে না যে,জাতির যারা আসল উৎপাদক এবং যারা নিজেদের শ্রম-মেহনত বিপুল ধন-ঐশর্য ও সম্পদ সৃষ্টি করে জাতিকে সামষ্টিক সমৃদ্ধির দ্বারে এনে পৌঁছে দিয়েছে জাতি তাদের গায়ে অনেকগুলো জোঁক বসিয়ে দিয়েছে। এ জোঁকগুলো রক্ত চুষে তাদেরকে নিস্তেজ করে ফেলেছে। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবে কত কর্ম-ঘন্টার ক্ষতি হয় এবং এর ফলে দেশের উৎপাদন কি পরিমানে কমে যায় তার হিসেব লাগিয়ে এ বিপুল পরিমাণ ক্ষতির পথরোধ করার জন্য মশা নিধনযঞ্জ শুরু করা হয়। কিন্তু সুদখোর মহাজনরা দেশের লাখো লাখো কর্মী বাহিনীকে কি পরিমাণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত,পেরেশান ও মনমরা করে দিচ্ছে,তাদের কর্মপ্রেরনাকে নিস্তেজ করে কি পরিমান কর্মশক্তি ক্ষয় করছে এবং দেশের উৎপাদনের উপর এর কি প্রভাব পড়েছে তার হিসেব লাগানো হচ্ছে না। বরং উল্টো ঐ মাহজনদের হাত শক্তিশালী করা হচ্ছে। দেশের বিপুল পরিমাণ কর্ম ঘাটতি ও উৎপাদন হ্রাসের নায়ক মহাজনদেরকে নির্মূল করার পরিবর্তে ঋণগ্রস্তদেরকে পাকড়াও করা হচ্ছে এবং মহাজনরা তাদের দেহ থেকে যে রক্ত শুঁষে নিতে পারছিল না দেশের আদালতগুলো তা তাদের দেহ থেকে নিংড়িয়ে নিয়ে মাহজনদের হাতে সোপর্দ করে দিচ্ছে।

এর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে এই যে,এভাবে সুদখোর মহাজনরা দরিদ্র শ্রেণীর অবশিষ্ট ক্রয়শক্তিও ছিনিয়ে নেয়। অবশ্যি পূর্বেই লাখো লাখো লোকের বেকারত্ব ও কোটি কোটি লোকের অকিঞ্চিৎ আয় দেশের শিল্প ব্যবসায়ের উন্নতির পথে বাধার পাহাড় তৈরী করে রেখে ছিল। তদুপরি সচ্ছল পরিবারকে খরচ না করার পথ দেখানো হয়েছে বরং বেশী বেশী সম্পদ জমা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যবসা-বানিজ্য আর এক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সর্বোপরি লাখো লাখো কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমিক-মজুররা নিজেদের অকিঞ্চিৎ বেতন ও পারিশ্রমিকের আকারে যে সামান্য ক্রয়শক্তির অধিকারী হয় তাকেও তারা নিজেদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ে ব্যয় করতে পারছে না। বরং তার একটি বড় অংশ মহাজনরা ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং তার সাহায্যে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র কেনার পরিবর্তে সমাজের মাথায় অতিরিক্ত সুদী ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার জন্য তাকে ব্যবহার করছে। হিসাব করে দেখুন,দুনিয়ার ৫ কোটি লোক যদি মাহজনদের জালে জড়িয়ে পড়ে থাকে এবং তারা গড়পড়তায় মাসে ১০ টাকা করে সুদ আদায় করতে থাকে তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে প্রতি মাসে ৫০ কোটি টাকার পণ্য অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে এবং এ বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎপাদন যন্ত্রের দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে প্রতি মাসে অতিরিক্ত সুদী ঋণ সৃষ্টির কাজে ব্যয়িত হচ্ছে।*

[*উল্লেখযোগ্য ১৯৪৫ সালে বিভাগপূর্ব বৃটিশ ভারতের এক হিসাব মতে দেশে মহাজনী ঋণের পরিমাণ ছিল কমপক্ষে দশশো কোটি টাকা। এতো মাত্র একটা দেশের অবস্থা। এ থেকে সারা দুনিয়ায় এ ধরনের ঋণের পরিমাণ এবং ঐ ঋণ বাবদ মহাজনদের ঘরে যে পরিমাণ সুদ পৌঁছেছে তা আন্দাজ করা যেতে পারে।]

বাণিজ্যিক ঋণ
এবার আমরা শিল্প ব্যবসায় ও অন্যান্য লাভজনক উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণে সুদ বৈধকরণের ক্ষতি পর্যালোচনা করতে চাই। শিল্প, ব্যবসায়, কৃষি ও অন্যান্য সমস্ত অর্থনৈতিক কাজ-কারবার পরিচালনার যেসব লোক অংশগ্রহণ করে তাদের সবার স্বার্থ ও আগ্রহ ঐসব কারবারের উন্নতি বিধানে নিয়োজিত হওয়া উচিত। এসব কারবারের লোকসান তাদের সবার লোকসান হিসেবে বিবেচিত হতে হবে, তবেই তারা এর বিপদ থেকে বাঁচার সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাবে। আবার এগুলোর লাভ তাদের সবার লাভ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে, তবেই তারা এর উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করবে। এ কারণে ব্যবসায়ে যারা নিজেদের দৈহিক শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি ব্যবহার করছে না বরং শুধুমাত্র পুঁজি সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করছে তাদের ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ এমন পর্যায়ে হতে হবে যাতে করে তারা ব্যবসায়ের ভাল-মন্দের সাথে জড়িত থাকতে পারে এবং তার উন্নতি বিধানেও তাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে পরিপূর্ণ আগ্রহশীল থাকে। কিন্তু সুদ আইনসংগত ঘোষিত হবার পর পুঁজি মালিকদের জন্য শরীক বা অংশীদার হিসেবে ব্যবসায়ে পুঁজি খাটাবার পরিবর্তে ঋণদাতা হিসেবে ব্যবসায়কে পুঁজি ঋণ দিয়ে তা থেকে একটি নির্ধারিত হারে নিজের মুনাফা আদায় করার পথ প্রশস্ত হয়ে গেছে। এভাবে সমাজের অর্থনৈতিক কার্যক্ষেত্রে এমন একজন অসাধারণ ও অস্বাভাবিক কর্মীর আগমন ঘটেছে, যে উৎপাদন কাজে রত অন্যান্য সকল কর্মীর বিপরীতপক্ষে এ সমগ্র কাজের ভালো-মন্দ ও লাভ-ক্ষতির প্রতি কোনো প্রকার আগ্রহশীল হয় না। এ কাজে লোকসান হতে থাকলে সবার জন্য বিপদ দেখা দেয় কিন্তু তার জন্য লাভের গ্যারান্টি রয়ে গেছে। কাজেই সবাই লোকসান বন্ধ করার চেষ্টা করবে কিন্তু ব্যবসাটি পুরোপুরি দেউলিয়া না হওয়া পর্যন্ত সে চিন্তিত হবে না। ব্যবসা যখন লোকসানের খাতে চলবে তখন সে তাকে রক্ষা করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না বরং নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে নিজের প্রদত্ত টেনে নেতে চাইবে। অনুরূপভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়াবার ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষভাবে সে মোটেই আগ্রহশীল হবে না। কারণ তার মুনাফা সর্বাবস্থায় নির্ধারিত রয়েছে। কাজেই এ কাজের উন্নতি ও সাফল্য বিধানে সে মাথা ঘামাবে কেন? মোটকথা সমগ্র সমাজের লাভ লোকসানের কোনরূপ তোয়াক্কা না করে এ অদ্ভূত ধরনের অর্থনৈতিক কমিটি একা আলাদা বসে নিজের পুঁজিকে ভাড়ায় খাটাতে থাকে এবং নির্ঝঞ্ঝাটে নিজের নির্ধারিত ভাড়া আদায় করতে থাকে।

এ ভুল পদ্ধতির ফলে পুঁজি ও ব্যবসায়ের মধ্যে সখ্যতা ও সহানুভূতিপূর্ণ সহযেগিতার পরিবর্তে নিকৃষ্ট ধরনের স্বার্থপরতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে যারা অর্থ সঞ্চার করার ও উৎপাদিত পণ্য কাজে লাগাবার ক্ষমতা রাখে তারা নিজেরা ঐ সমস্ত অর্থ কোন ব্যবসায়ে খাটায় না, অথবা কোন ব্যবসায়ীর সাথে ব্যবসায়ে অংশীদারও হয় না বরং তারা নিজেদের অর্থাদি একটি নির্ধারিত মুনাফার জামানত সহকারে ঋণ হিসেবে ব্যবসায়ে খাটাতে চায়। আবার এ নির্ধারিত মুনাফার ব্যাপারেও তারা সর্বাধিক পরিমাণের প্রত্যাশা করে। এর বহুবিধ ক্ষতির মধ্য থেকে নীচে কয়েকটি সুষ্পষ্ট ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হলোঃ

একঃ নিছক সুদের হার বাড়ার অপেক্ষায় পুঁজির একটি বিরাট অংশ আবার অনেক সময় বৃহত্তম অংশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। ব্যবহারযোগ্য উপকরণের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাকে কোন লাভজনক কাজে খাটানো হয় না। রুজি-রোজগারের সন্ধানে বহু লোক হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদাও বাজারে যথেষ্ট থাকে, এতদসত্ত্বেও উপকরণাদি ব্যবহার করা হয় না, বেকার লোকদের কাজে লাগানো হয় না এবং বাজারে যথার্থ চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহও করা হয় না। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে এই যে, পুঁজিপতি যে হারে সুদ নিয়ে লাভবান হতে চায় তা পাওয়ার কোনো আশা না থাকার কারণে সে অর্থ ঋণ দিতে প্রস্তুত হয় না।

দুইঃ অধিক সুদের হার এমন একটি লোভনীয় বস্তু যার ফলে পুঁজিপতি শ্রেণী ব্যবসায়ের দিকে পুঁজির প্রবাহকে ব্যবসায়ের যথার্থ প্রয়োজন ও স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী নয় বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কখনো বাড়াতে, কমাতে, আবার কখনো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে থাকে। এর ফলে বিপুল পরিমান ক্ষতি সাধিত হয় তা একটি দৃষ্টান্ত থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। মনে করুন, কোন পানি সেচ কেন্দ্রের মালিক কৃষি ক্ষেত্রের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পানি ছাড়তে ও বন্ধ করতে রাজি নন। বরং তিনি পানি ছাড়ার ও বন্ধ করার জন্য নিজস্ব একটি বিধান তৈরী করেছেন। তার বিধান হচ্ছে যখন পানির প্রয়োজন থাকবে না তখন তিনি অত্যন্ত সস্তা দামে প্রচুর পানি ছাড়বেন আর যখনই ক্ষেতে পানির চাহিদা বেড়ে যাবে তখনই তিনি পানির দামও বাড়াতে থাকবেন, অবশেষে পানির দাম এতবেশী বাড়িয়ে দেবেন যার ফলে ঐ দামে ক্ষেতে পানি সিঞ্চন করা মোটেই লাভজনক বিবেচিত হবে না। এ পানি সেচ কেন্দ্রের মালিক কৃষকদের ও সারা দেশের খাদ্য ব্যবস্থার যে ক্ষতি সাধন করলেন অত্যাধিক সুদের লোভে পুঁজি মালিকগণ দেশের সমগ্র অর্থব্যবস্থায় অনুরূপ ক্ষতির পথ উন্মুক্ত করেন।

তিনঃ সুদ ও সুদের হারের বদৌলতে ব্যবসা-বানিজ্য শিল্প ব্যবস্থা স্বাভাবিক নিয়মে ও স্বচ্ছন্দ গতিতে চলার পরিবর্তে এমন এক ব্যবসায়িক চক্করে (Trade Cycle) পড়ে যায় ফলে তা বার বার মন্দার শিকারে পরিণত হয়। আগের আলোচনায় এ বিষয়টির উপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। তাই এখানে এর জের টানার কোন প্রয়োজন নেই।

চারঃ যেসব কাজে সাধারণ মানুষের লাভ ও সাধারণের স্বার্থে যেগুলো অত্যন্ত জরুরী কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যেগুলো বাজারের প্রচলিত হারের সুদের মোটেই লাভজনক নয়, পুঁজি সেসব কাজের দিকে অগ্রসর হতেও রাজী হয় না। বিপরীত পক্ষে যেসব কাজ অপ্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও অধিক লাভজনক, পুঁজি সেসব কাজের দিকে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে সে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সব রকমের উপায় অবলম্বন করে সুদের হারের চেয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য ব্যবসায়ীকে বাধ্য করে। এ ক্ষতিটির ব্যাখ্যাও আমরা ইতিপূর্বে করে এসেছি তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করার কোন প্রয়োজন নেই।

পাঁচঃ পুঁজিপতি দীর্ঘমেয়াদী ঋণে পুঁজি খাটাতে অনিচ্ছুক। কারণ একদিকে সে সাট্টাবাজীর জন্য বেশ বড় অংকের পুঁজি সবসময় নিজের কাছে জমা রাখতে চায় আবার অন্যদিকে সে মনে করে যদি ভবিষ্যতে কখনো সুদের হার বেশ বেড়ে যায় তাহলে কম সুদে তার বেশী টাকা আটক হয়ে যাওয়ায় সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে শিল্প মালিকগণও নিজেদের সমস্ত কাজ-কারবারে সংকীর্ণমনা ও স্বল্পোদ্যমের পরিচয় দিতে বাধ্য হয় এবং স্থায়ী কল্যাণ ও উন্নতি বিধানার্থে কিছু করার পরিবর্তে কেবলমাত্র চালু কাজটি সম্পন্ন করতেই প্রয়াসী হয়। যেমন এধরনের স্বল্প মেয়াদী পুঁজি নিয়ে তাদের পক্ষে নিজেদের শিল্প-কারখানার জন্য অত্যাধুনিক মেশিন ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বড় অংকের অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। বরং তারা পুরানো মেশিনগুলোই ঝালাই করে কোনোরকমে ভাল মন্দ দ্রব্যসামগ্রী বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়। এভাবে তারা ঋণ ও সুদ আদায় করতে এবং এ সংগে নিজেদের জন্য কিছু মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবে। অনুরূপভাবে স্বল্পমেয়াদী ঋণের বদৌলতেই বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে দেখে সংগে সংগেই কারখানার মালিক পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও উৎপাদনের গতি অপরিবর্তিত রাখার সাহস করে না। কারণ সে ভয় করে বাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে সে দেউলিয়ার প্রান্তদেশে পৌঁছে যাবে।

ছয়ঃ বৃহৎ শিল্প ও ব্যবসায় পরিকল্পনার জন্য যে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ পাওয়া যায় সেগুলোর উপর নির্ধারিত বিশেষ সুদের হারও অনেক বড় বড় ক্ষতির সম্মুখীন করে। সাধারণত দশ, বিশ বা তিরিশ বছরের জন্য এধরনের ঋন নেয়া হয়। শুরুতেই এ সমগ্র সময়ের জন্য সুদের একটি বার্ষিক হার নির্ধারিত হয়। এ হার নির্ধারন করার সময় আগামী দশ, বিশ বা তিরিশ বছরের দ্রব্য মূল্যের ওঠা-নামা কোথা গিয়ে ঠেকবে এবং ঋণগ্রহীতার মুনাফার সম্ভাবনা কি পরিমাণ কম-বেশী হবে বা আদৌ কোন মুনাফাই হবে কিনা, সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয় না এবং এ ব্যাপারে উভয় পক্ষের পূর্বাহ্নেই কোন জ্ঞানের অধিকারী না হলে সেদিকে দৃষ্টি রাখাও সম্ভবপর নয়। মনে করুন ১৯৪৯ সালে এক ব্যক্তি ২০ বছরের জন্য শতকরা ৭ ভাগ সুদে একটি বড় অংকের ঋণ লাভ করলো এবং ঐ ঋণলব্ধ অর্থের সাহায্যে একটি বড় কাজ শুরু করলো। এখন সে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ঐ হিসেবে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আসল টাকার কিস্তি ও সুদ আদায় করতে বাধ্য। চুক্তি সাধিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে কিন্তু যদি ১৯৫৫ সালে পৌঁছতে পৌঁছতে দ্রব্যমুল্য কমে গিয়ে আগের মূল্যের অর্ধেকে এসে ঠেকে তাহলে এর অর্থ দাড়াবে যতক্ষণ চুক্তি শুরুর সময়ের তুলনায় ঐ সময় দ্বিগুণ পণ্য বিক্রি সম্ভব না হয় ততক্ষণ আসলের কিস্তি ও সুদ আদায় করা সম্ভব হবে না। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ দেখা যাবে, ঐ চড়া মূল্যের যুগে এ ধরনের অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা দেউলিয়া হয়ে গেছে। অথবা দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দূষিতকারী অবৈধ কাজ-কর্ম শুরু করেছে। এ ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে যে কোন স্বাভাবিক বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি নিসঃন্দেহ হবেন যে, বিভিন্ন যুগে ওঠা-নামাকারী দ্রব্যমূল্যের মধ্যে ঋণদাতা পুঁজিপতির এমন কোন মুনাফা যা সব যুগে সমান থাকে ন্যায়নীতি ও অর্থনীতির দৃষ্টিতে কোনক্রমে যথার্থ হতে পারে না এবং তাকে সামগ্রিক সমৃদ্ধির সহায়কও প্রমাণ করা যেতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও কি এমন কোন কথা শুনা গেছে যে, কোন কোম্পানি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের ঠিকে নিয়ে এমন কোন চুক্তি করেছে যাতে বলা হয়েছেঃ আগামী তিরিশ বা বিশ বছর পর্যন্ত একই দামে সে ঐ দ্রব্যটি সরবরাহ করবে? কোন দীর্ঘমেয়াদী পণ্য ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে যদি এটা সম্ভব না হয়ে থাকে তাহলে একমাত্র সুদী ঋণদাতা পুঁজিপতির স্বার্থে এটা সম্ভব হবে কেমন করে? কোন নীতির ভিত্তিতে ঐ পুঁজিপতি সুদীর্ঘ কয়েক বছরের জন্য নিজের ঋণের মূল্য পূর্বাহ্নেই নির্ধারণ করবে এবং বছরের পর বছর ঐ একই মূ্ল্য আদায় করে যেতে থাকবে?

রাষ্ট্রের বেসরকারী ঋণ
বিভিন্ন দেশের সরকার রাষ্ট্রের নিজস্ব প্রয়োজনে নিজের দেশের জনগণের নিকট থেকে যেসব ঋণ নেয় এবার তার আলোচনায় আসা যাক। এর মধ্যে এক ধরনের ঋণ অলাভজনক কাজে লাগানো হয়।

প্রথম ধরনের ঋণের সুদ অভাবী লোকদের নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য গৃহীত ঋণের সুদের সমপর্যায়ভুক্ত। বরং একে তার চেয়েও নিকৃষ্ট পর্যায়ভুক্ত বলা যেতে পারে। এ সুদের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, সমাজ যে ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে, যাকে লালন-পালন করেছে, অর্থোপার্জনের যোগ্যতাসম্পন্ন করেছ, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে এবং নিজের তমদ্দুনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যার শান্তিতে বসবাস করার ও কাজ-কারবার চালাবার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে নিরন্তর সেবা করে যাচ্ছে, সে ব্যক্তি এহেন সমাজের আর্থিক লাভ বিমুক্ত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সবার সাথে সাথে তার নিজের স্বার্থও যেসব প্রয়োজন পূর্ণ হবার সাতে জড়িত—সুদমুক্ত ঋণদান করতে প্রস্তুত হচ্ছে না। সে নিজেই তার প্রতিপালনকারী সমাজকে বলছে, তুমি ঐ অর্থের সাহায্যে মুনাফা অর্জন করা বা না কর, আম নিজের অর্থের এ বিশেষ পরিমাণ মুনাফা প্রতি বছর অবশ্যি নিতে থাকবো।

জাতি যখন যুদ্ধের সম্মুখীন হয় এবং সবার সাথে সাথে জাতির ঐ পুঁজিপতি ব্যক্তির ধন, প্রাণ ও মান-সম্মান সংরক্ষণের প্রশ্নও দেখা দেয় তখন এ বিষয়টি আরো বেশী জটিল আকার ধারণ করে। এ সময় জাতীয় অর্থ ভান্ডার থেকে যা কিছু ব্যয় করা হয় তা কোন ব্যবসায়ে খাটানো হয় না বরং অগ্নিকুন্ডেই নিক্ষেপ করা হয়। তাতে মুনাফার প্রশ্নই ওঠে না। এমন একটি কাজে এ বিরাট ব্যয় সাধিত হয় যার সাফল্য ও অসাফল্যের উপর সমগ্র জাতির সাথে সাথে তার নিজের জীবন-মৃত্যুও নির্ভরশীল। এ কাজে জাতির অন্যান্য লোকেরা নিজেদের ধন-প্রাণ-সময়-শ্রম সবকিছুই ঢেলে দেয়। তাদের একজনও প্রশ্ন উঠায় না যে, জাতির প্রতিরক্ষায় সে যে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে তাতে সে বার্ষিক কত হারে মুনাফা পাবে? কিন্তু সমগ্র জাতির মধ্যে পুঁজিপতিই নিজেদের ধন-সম্পদ দেয়ার পূর্বে এ শর্ত আরোপ করে যে, তাকে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দিতে হবে এবং জাতির সমস্ত সদস্যরা মিলে যতদিন পর্যন্ত তার প্রদত্ত আসল অর্থ আদায় করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত তাকে এ মুনাফা আদায় করে যেতে হবে, তাতে একশো বছর লেগে গেলেও তার দাবীর একটু্ও নড়চড় হবে না। এ সংগে যেসব লোক দেশ, জাতি ও ঐ পুঁজিপতিকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের হাত-পা কাটিয়েছে বা নিজেদের বাপ, ভাই ও স্বামীকে হারিয়েছে তাদের পকেট থেকেও মুনাফার অংশ আসতে হবে।*

[* এ প্রসংগে উল্লেখ করা যায়, ইংলণ্ডের বর্তমান অধিবাসীদের পূর্বপুরুষরা আজ থেকে সোয়াশো বছর পূর্বে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করেছিল এবং সে যুদ্ধে ইংরেজ পূঁজিপতিরা যে যুদ্ধঋণ দিয়েছিল আজও ইংরেজরা তার সুদ আদায় করে যাচ্ছে। ১৮৬১-৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ব্যয় বাবদ যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল আমেরিকানরা আজ পর্যন্ত তার চারগুণ অর্থ আদায় করেছে এবং এখনো তাদেরকে একশো কোটি ডলার সুদ হিসাবে আদায় করতে হয়।]

- প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের একটি শ্রেনীকে এভাবে সুদ খাইয়ে মোটা করার যৌক্তিকতা কোথায়? তাদেরকে কি শেয়াল-কুকুরের ন্যায় বিষপান করিয়ে মেরে ফেলা উচিত নয়?

দ্বিতীয় প্রকারের ঋণটি সাধারণ লোকেরা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেয় তা থেকে আলাদা প্রকৃতির নয়। কাজেই ইতিপূর্বে ব্যবসায়িক ঋণের সুদের বিরুদ্ধে আমরা যে আপত্তি উত্থাপন করেছি তার সবগুলোই এখানে উত্থাপিত হয়। সাধারণত বিভিন্ন দেশের সরকার লাভজনক কাজে লাগাবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নেয়। কিন্তু কোন সরকার একটি নির্দিষ্ট হারে সুদে ঋণ নেয়ার সময় একথা জানতে পারে না যে, আগামী দশ-বিশ বছরে দেশের আভ্যন্তরীন অবস্থা কি রূপ পরিগ্রহ করবে ও আর্ন্তজাতিক অবস্থা কোন দিকে মোড় নেবে এবং এ সংগে যে কাজে ব্যয় করার জন্য এ সুদী ঋণ নেয়া হচ্ছে তাতে কি পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হবে। সাধারণত দেখা গেছে এসব ক্ষেত্রে সরকারের অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সুদের হারের চেয়ে বেশী হওয়া তো দুরের কথা সমপরিমাণ মুনাফা অর্জনও সম্ভবপর হয় না। এটিই বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকটের অন্যতম কারণ এবং এরি কারণে বিভিন্ন লাভজনক পরিকল্পনায় অতিরিক্ত পুঁজি লাগানো দুরে থাক অতীতের ঋণের আসল টাকা ও তার সুদ আদায় করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

উপরন্তু এখানেও সে একই অবস্থার সৃষ্টি হয় যেদিকে আমরা বার বার ইংগিত করেছি। অর্থাৎ বাজারের সুদের হার এমন একটি সীমা নির্ধারন করে দেয় যার ফলে কোনো কম মুনাফাজনক কাজে জনগণের জন্য তা যতই ভালো ও প্রয়োজনীয় হোক না কেন পুঁজি খাটানো সম্ভবপর হয় না। অনাবাদী এলাকায় বসতি স্থাপন, অনাবাদী জমিকে কৃষি কাজের উপযোগী করা, অনুর্বর জমিকে উর্বর করা, শুষ্ক জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করা, গ্রামীণ এলাকায় পথ, ঘাট, আলো ও স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা করা, স্বল্প বেতনভুক কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্য রক্ষাকারী গৃহাদি নির্মাণ এবং এ ধরনের আরো বিভিন্ন কাজ যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন এবং সেগুলো না হলে জাতির যতই ক্ষতি হোক না কেন, যতক্ষন না সেগুলো থেকে প্রচলিত সুদের হারের সমপরিমাণ বা তারচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জিত হবার সম্ভাবনা থাকে ততক্ষন কোন সরকার সেসব প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত হয় না।

উপরন্তু এ ধরনের যেসব কাজে সুদী ঋণ নিয়ে পুঁজি খাটানো হয় সেগুলোর ব্যাপারে আসল পরিস্থিতি হচ্ছে এই যে, সরকার এ পর্যায়ের সমস্ত সুদের বোঝা জনগনের মাথায় চাপিয়ে দেয়। ট্যাক্সের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির পকেট থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদের টাকা বের করা হয় এবং বছরের পর বছর লাখো লাখো টাকা জমিয়ে দীর্ঘকাল অবধি পুঁজিপতিদেরকে যোগান দেয়া হয়।

মনে করুন আজ পাঁচ কোটি টাকার একটি পানি সেচ প্রকল্প কার্যকরী করা হলো। বার্ষিক শতকরা ৬ টাকা সুদে এ পুঁজি সংগ্রহ করা হয়েছে। এ হিসেবে সরকারকে বছরে ৩০ লাখ টাকা সুদ আদায় করতে হবে। বলা বাহুল্য এ বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকার কোথাও থেকে মাটি খুঁড়ে বের করে আনবে না। বরং যেসব চাষী ও কৃষি সেচ প্রকল্প থেকে লাভবান হবে সরকার তাদের মাথায় এ বোঝাটি চাপিয়ে দেবে। প্রত্যেক চাষীর উপর যেসব কর লাগানো হবে তার উপর এ সুদের অংশও থাকবে। চাষীও এ সুদ নিজের পকেট থেকে আদায় করবে না বরং সে উৎপাদিত ফসলের দাম থেকে এ সুদের অর্থ উসুল করবে। এভাবে পরোক্ষভাবে যেসব ব্যক্তি শস্য ব্যবহার করবে তাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে এ সুদ আদায় করা হবে। প্রত্যেক দারিদ্র পীড়িত ও অনাহারে ক্লিষ্ট ব্যক্তির ভাতের বাসন থেকে অন্ততঃপক্ষে এক মুটো ভাত কেড়ে নেয়া হবে এবং তা পুঁজিপতির বিরাট উদরে ঢেলে দেয়া হবে যেহেতু বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা সুদের ভিত্তিতে সে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দিয়েছিল। এ ঋণ আদায় করতে যদি সরকারের ৫০ বছর লেগে যায় তাহলেও সে গরীবদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে ধনীদের পকেট ভারী করার এ দায়িত্ব অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে পালন করে যেতে থাকবে।

এ কর্মপদ্ধতি সামাজিক অর্থব্যবস্থায় ধনের প্রবাহকে নির্ধনদের দিক থেকে ধনীদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। অথচ সমাজের কল্যাণার্থে তাকে ধনীদের দিক থেকে নির্ধনদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত ছিল। সরকার মুনাফাজনক ঋণে যে সুদ আদায় করে কেবল তার মধ্যে এ ক্ষতি নিহিত নেই বরং সাধারণ ব্যবসায়ী সমাজ সুদী ঋণের সাহায্যে যেসব ব্যবসায় চালায় তার প্রত্যেকটির মধ্যেও এ ক্ষতি রয়েছে। বলা বাহুল্য কোন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কৃষক পুঁজিপতিকে প্রদেয় সুদ নিজের পকেট থেকে আদায় করে না। তারা সবাই নিজেদের পণ্যের দামের উপর বোঝাটি চাপায়। এভাবে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে এক পয়সা দু’ পয়সা চাঁদা উঠিয়ে লাখপতি ও কোটিপতিদের ঝুলিতে ঢেলে দেয়। এ উল্টো ব্যবস্থায় দেশের সবচেয়ে বড় ধনাঢ্য মহাজনই সবচেয়ে বেশি ‘সাহায্য’ লাভের অধিকারী। আবার এ সাহায্য দানের দায়িত্ব যেসব ব্যক্তির উপর সবচেয়ে বেশী বর্তায় তারা হচ্ছে দেশের দরিদ্রতম শ্রেণী যারা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যৎসামান্য রোজগার করে আনে কিন্তু দেশের সবচেয়ে বেশী ‘করুণার পাত্র’ কোটিপতির ‘অধিকার’ তা থেকে বের করে নেয়ার আগে তাদের সারাদিনের অভুক্ত সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয়া তাদের জন্য হারাম গণ্য হয়েছে।

বৈদেশিক ঋণ
দেশের বাইরের মহাজনদের নিকট থেকে রাষ্ট্রীয় সরকার যে ঋণ গ্রহণ করে সর্বশেষে তার আলোচনায় আসছি। এ ধরনের ঋণ সাধারণত বড় বড় অংকের হয়ে থাকে। অনেক সময় তা দশ বিশ কোটির মাত্রা পেরিয়ে একশো কোটি ও হাজার কোটির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দেশ কোন অস্বাভাবিক সংকটাবর্তে নিপতিত হলে, দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান এ সংকট ও বিপদ থেকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রমাণিত না হলে দেশীয় সরকার এ ঋণ গ্রহণ করে। আবার কখনো অতিরিক্ত লোভের বশবর্তী হয়ে এ কৌশল অবলম্বন করা হয়। মনে করা হয় উন্নয়নমূলক প্রকল্পসমূহকে বড় অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করলে স্বল্প সময়ে দেশের উপায়-উপকরণ বৃদ্ধি পাবে। এসব ঋণে সাধারণত সুদের হার শতকরা ৬/৭ থেকে ৯/১০ পর্যন্ত হয়। এ হারে একশো কোটি টাকার সুদ বছরে কয়েক কোটি টাকা হয়। আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক বাজারের শেঠ ও মহাজনরা নিজেদের সরকারের মধ্যস্থতায় এ পুঁজি ঋণ দেয় এবং এ জন্য জামানত হিসেবে ঋণ গ্রহীতা দেশের কোনো একটি শুল্ক; যেমন নগর শুল্ক, তামাক, চিনি, লবণ বা অন্য কোন খাতের আয়কে বন্ধক রাখা হয়।

এ ধরনের সুদী ঋণ যেসব ক্ষতি সাধন করে পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা সেগুলোর উল্লেখ করেছি। ব্যক্তিগত ঋণ, ব্যবসায়িক ঋণ ও সরকারের আভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে এমন কোন ক্ষতিকর দিক নেই ঐসব আন্তর্জাতিক ঋণের সুদের মধ্যে যার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। কাজেই এখানে ঐসব ক্ষতির পুনরুল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ জাতীয় ঋণের মধ্যে ঐগুলো ছাড়া আর একটি ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এ ক্ষতিটি পূর্বালোচিত ক্ষতিগুলোর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ। এ ক্ষতিটি হচ্ছে, এ আর্ন্তজাতিক ঋণগুলোর কারণে সমগ্র জাতির আর্থিক মর্যাদা বিনষ্ট ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক অবস্থার উপর এর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অতপর এর বদৌলতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে শত্রুতার বীজ উপ্ত হয়। অবশেষে বিপদগ্রস্থ জাতির যুব সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে চরমপন্থী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন গ্রহণ করতে থাকে এবং একটি রক্তাক্ত বিপ্লব ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মধ্যে নিজের জাতির দুর্দশা ও বিপদ নিরসনের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

বলা বাহুল্য নিজেদের সংকট নিরসন ও প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যে জাতির অর্থনৈতিক উপকরণ পূর্বেই যথেষ্ট ছিল না সে কেমন করে প্রতি বছর আসলের কিস্তিসহ পঞ্চাশ ষাট লাখ বা এক কোটি দু’ কোটি টাকা কেবলমাত্র সুদের খাতে আদায় করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে? বিশেষ করে যখন তার আয়ের উৎসগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি বড় ও অধিক মুনাফাদায়ক উৎসকে পূর্বেই জামানত রাখা হয়েছে এবং তার চাদর আগের চেয়ে অনেক বেশী সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে এসব ক্ষেত্রে নিজের সংকটের নিরসনের জন্য যেসব জাতি বড় বড় সুদী ঋণ গ্রহন করেছে তাদের অতি অল্প সংখ্যকই সফলকাম হতে দেখা গেছে। বিপরীতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরং দেখা গেছে, এ ঋণ তার সংকট বৃদ্ধিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, ঋণের কিস্তি ও সুদ আদায় করার জন্য তাদের নিজেদের দেশবাসীর উপর অত্যাধিক করভার চাপিয়ে দিতে হয়েছে এবং অনেক দিক দিয়ে ব্যয় কমাতে হয়েছে। এর ফলে একদিকে জাতির সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায়। কারণ তারা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তার বিনিময়ে যা পায় তা ঐ ব্যয়ের সমতুল্য হয় না। অন্য দিকে নিজের দেশের লোকদের মাথায় এতবড় বোঝা চাপিয়ে দিয়েও সরকারের পক্ষে ঋণের কিস্তি ও সুদ নিয়মিত আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে। অতপর ঋণগ্রহীতা দেশের পক্ষ থেকে ঋণ আদায়ে যখন অনবরত শৈথিল্য দেখা দেয় তখন বৈদেশিক ঋণদাতারা তার বিরুদ্ধে বেঈমানী, অসদুদ্দেশ্য ও ঋণের অর্থ ফাঁকি দেয়ার অসৎ মনোভাব ও চক্রান্তের অভিযোগ আনে। তাদের ইংগিতে তাদের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে এ দরিদ্র দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হয়, কটুক্তি করা হয়। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উপনীত হলে ঐ দেশের সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এবং নিজের পুঁজিপতিদের পক্ষাবলম্বন করে ঋণগ্রহীতা দেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না বরং তার সমস্যা ও সংকট থেকে অবৈধভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করে। ঋণগ্রস্ত দেশের সরকার জনসাধারণের উপর করভার আরো অধিক বাড়িয়ে এবং অধিকতর ব্যয় সংকুলান করে কোনো প্রকারে দ্রুত এ ফাঁদ থেকে বের হবার চেষ্টা করে। কিন্তু দেশবাসীর উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। অনবরত ও নিত্যকার অর্থনৈতিক বোঝা ও আর্থিক দুর্দশা তাদের মন-মেজাজ তিক্ত করে তোলে। বৈদেশিক ঋণদাতাদের কটূক্তি ও রাজনৈতিক চাপ এ তিক্ততা আরো বাড়িয়ে তোলে। নিজের দেশের ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং দূরদর্শী নেতাদেরকে ত্যাগ করে চরমপন্থী রাজনৈতিক জুয়াড়ীদের পেছনে সারিবদ্ধ হয়। এ চরমপন্থী জুয়াড়ীরা এক কথায় সমস্ত ঋণ অস্বীকার করে ময়দানে নেমে আসে এবং চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে থাকেঃ আমরা কারোর ঋণের কোন ধার ধারি না, কারো দাবী মানতে আমরা প্রস্তুত নই ক্ষমতা থাকলে আমাদের নিকট থেকে ঋণ আদায় করে নিয়ে যাও।

এ পর্যায়ে সুদের ধ্বংসকারিতা ও সর্বনাশা প্রভাব চরমে পৌঁছে যায়। এরপরও কি কোন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি সুদের চরম হারাম হবার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করতে পারে? সুদের এ ধ্বংসকারিতা ও ভয়াবহ পরিণাম প্রত্যক্ষ করার পরও কি কোন ব্যক্তি রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিম্মোক্ত

(আরবী টেক্সট ————————————————————————— আরবী টেক্সট)

“সুদ এমন একটি গোনাহ যে, একে সত্তরটি ভাগে বিভক্ত করলে সবচয়ে হালকা অংশটিও নিজের মায়ের সাথে যিনা করার সমান শামিল”। – (ইবনে মাজা, বায়হাকি)

———-


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি