পরিশিষ্ট: এক
বাণিজ্যিক ঋণ বৈধ কিনা?
(পাকিস্তান সরকারের ভূতপূর্ব অডিটর জেনারেল জনাব সাইয়েদ ইয়াকুব শাহ এবং গ্রন্থাকারের মধ্যে এ সম্পর্কে পত্র বিনিময়ের বিবরণ।)

প্রথম পত্র

প্রশ্ন: আমি আপনার সুদ গ্রন্থখানি মনোযোগ সহকারে পড়েছি। পড়ার পর আমার মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে এবং বহু চেষ্টা করেও তার কোনো সন্তোষজনক জবাব খুঁজে পাইনি, তাই আপনাকে বিরক্ত করছি। আশাকরি দয়া করে আপনি আমার প্রশ্নগুলো সমাধান করে দেবেন।

এক: আপনি আপনার গ্রন্থের প্রথম খন্ডে (উর্দূ ৩য় সংস্করণ পৃঃ ৩৫) প্রাক ইসলামী যুগের সুদের যে দৃষ্টান্তগুলো দিয়েছেন, তা থেকে সে যুগে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করা হতো কিনা, একথা সুস্পষ্ট হয় না। আমি যতটা জানতে পেরেছি অন্তত ইউরোপে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণের রীতি অনেক পরে শুরু হয়েছে। এর পূর্বে ব্যবসা করা হতো ব্যক্তিগত পুঁজি দিয়ে অথবা কার্যকরী অংশীদার (WORKING PARTNER) হিসেবে। আপনি কি এমন কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারেন, যার থেকে আরবে তৎকালে ব্যবসা সংক্রান্ত সুদ প্রচলিত ছিল কিনা তা জানা যেতে পারে?

দুই: এ খন্ডেরই উর্দূ ১৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ****** -এর হাদীসগুলো সুদ নিষিদ্ধকারী কুরআনের আয়াত (সূরা আল বাকারা ) নাযিল হওয়ার পূর্বে বর্ণিত। এ থেকে এ সিদ্ধান্ত করা কি সঙ্গত হবে যে, ****** কুরআনে বর্ণিত হারাম ও শাস্তির লক্ষ্য নয়? অথবা স্যার সাইয়েদ আহমদের ভাষায় এই যে, প্রকৃতপক্ষে অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার এবং এটা ঐ সুদের ব্যাখ্যার মধ্যে শামিল নয়, যার উল্লেখ উপরোক্ত আয়াতে রয়েছে?

আশাকরি এ সবের জবাব দানে কৃতার্থ করবেন।

জবাব

অবশ্য একথা কোনো গ্রন্থে বিশদভাবে তো বলা হয়নি যে, আরবের প্রাগ ইসলামী যুগে ব্যবসায়ে সুদ প্রচলিত ছিল। কিন্তু একথা উল্লেখিত অবশ্যিই আছে যে, মদীনার কৃষিজীবী লোক ইয়াহুদী পুঁজিপতিদের নিকট থেকে সুদী ঋণ গ্রহণ করতো। ইয়াহুদীদের মধ্যেও পারস্পরিক সুদী লেনদেন প্রচলিত ছিল। উপরন্তু কুরাইশগণ – যাদের পেশা ছিল প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য সুদী লেনদেন করতো শুধুমাত্র অভাবী লোকদেরই প্রয়োজন পূরণের জন্যে অনিবার্যরূপে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হতো না, বরঞ্চ কৃষিজীবী লোকদেরকেও তাদের কৃষি কাজের জন্যে এবং ব্যবসায়ীগণের ব্যবসার জন্যে এর প্রয়োজন হতো। আর এটা কোনো নতুন পদ্ধতি নয়, বরঞ্চ আবহমানকাল থেকে এ চলে আসছে। এ প্রথাটি ক্রমোন্নতির ভেতর দিয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। প্রাচীন প্রথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত লেনদেনের মধ্যে সীমিত। আধুনিক প্রথার পার্থক্য এই হয়েছে যে, ঋণ দ্বারা বৃহৎ আকারে মূলধন জমা করে তা ব্যবসায় বিনিয়োগ করার প্রথা প্রবর্তিত হয়েছে।

****** সংক্রান্ত হাদীসসমূহ সূরা আল বাকারায় সুদ নিষিদ্ধকারী আয়াত নাযিল হবার পূর্বেকার তা বটেই। কিন্তু তা সূরা আলে ইমরানের আয়াতের পরবর্তীকালের। সূরা আলে ইমরানের আয়াতে কুরআনের এ উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে দেয় যে, সুদ একটি অন্যায়-অনাচার যার উচ্ছেদ বাঞ্ছনীয়। নবী করীম (স) এজন্য পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক ব্যাপারে এমন সব সংস্কার সাধন করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয় ****। এসব হাদীসে সুস্পষ্টরূপে ’রিবা’ (সুদ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং নিষিদ্ধকরণের শব্দাবলী স্বয়ং হারাম ঘোষণা করার কথাই বুঝায়। অবশ্যি এটা ঠিক যে, কুরআনে যে সুদ হারাম করার কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে ঋণ সংক্রান্ত সুদ, হাতে হাতে লেনদেনের সুদ নয়। ফকীহগণ এ ব্যাখ্যাও করেছেন যে, **** ঠিকই সুদ নয় যা কুরআনে হারাম করা হয়েছে। বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে সুদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে পূর্ব প্রস্তুতি মাত্র।

দ্বিতীয় পত্র

প্রশ্ন: আপনি যেমন বিশদভাবে আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন, তাতে পুনর্বার আপনাকে বিরক্ত করার সাহস পাচ্ছি।

কুরআন মজীদে সুদ সম্পর্কে যেমন কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে, এমনটি সম্ভবত অন্য কোনো পাপ কাজের জন্যে বলা হয়নি। এজন্য আমার ক্ষুদ্র ধারণামতে আলেমদের উচিত এ ব্যাপারে কিয়াস করে কোনো সিদ্ধান্ত না করা এবং সুদের কোনো প্রকার সম্পর্কে যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, নবীর যমানায় তা প্রচলিত ছিল, ততক্ষণ তাকে রিবার মধ্যে শামিল না করা। আপনার পত্রে একথা জানতে পারা যায় যে, আপনি ব্যবসায় ক্ষেত্রে সুদের বিদ্যমান থাকার কিয়াস নিম্নের কারণগুলোর ভিত্তিতে করেছেন :

এক: মদীনায় কৃষিজীবী লোকেরা ইয়াহুদী পুঁজিপতিদের নিকট থেকে সুদে ঋণ গ্রহণ করতো। আমার বিনীত নিবেদন এই যে, এ ধরনের ঋণকে বাণিজ্যিক ঋণ বলা ঠিক হবে না। এ ধরনের ঋণ অভাবগ্রস্ত লোকেরাই গ্রহণ করতো। কৃষির জন্যে বাণিজ্যিক ঋণ আধুনিক যুগের উদ্ভাবন। যখন থেকে বৃহৎ আকারে কৃষি এবং তার জন্যে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকে বড় বড় জমির মালিকগণ বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। প্রাচীনযুগে কৃষিজীবী লোকদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ গ্রহণ করতে হতো এবং তা গ্রহণ করতো প্রয়োজন পূরণের জন্যে।

দুই: স্বয়ং ইয়াহুদীদের মধ্যেও পারস্পরিক সুদী লেনদেন হতো, তা থেকে একথা বলা যায় না যে, তাদের এ ঋণ ব্যবসার জন্যে নেয়া হতো। আরবের ইয়াহুদীরা ছিল অধিকাংশ কৃষিজীবী অথবা সুদী মহাজন। যেমন, ইউরোপেও বহুকাল যাবৎ তাই ছিল। সম্ভবত আরবের ইয়াহুদী সুদী মহাজনেরা গরীব-ধনী নির্বিশেষে উভয় শ্রেণীর লোকেরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কারণে টাকা ঋণ দিয়ে তাদের সুদী ব্যবসা চালাতো।

তিন: কুরাইশগণ অধিকাংশ ব্যবসাজীবী ছিল এবং তারাও পরস্পর সুদী লেনদেন করতো। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য এই যে, কুরাইশদের মধ্যে সুদী লেনদেনের যে দৃষ্টান্ত আমার নজরে পড়েছে, তার থেকে একথা সুস্পষ্ট করে বলা যায় না যে, আলোচ্য ঋণ তারা ব্যবসার জন্যে গ্রহণ করতো। এমন কোনো দৃষ্টান্ত যদি আপনার জানা থাকে, তাহলে দয়া করে আমাকে অবহিত করবেন। তৎকালে ব্যবসা ব্যক্তিগত পুঁজিতে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে করা হতো। কুরাইশরা যে ব্যবসায়ী কাফেলা বাইরে পাঠাতো তাতে সব রকম লোক অংশ গ্রহণ করতে পারতো। বলা হয় যে, এক দীনার, অর্ধ দীনার দিয়েও শামিল হওয়া যেতো, বলাবাহুল্য এ ধরনের ব্যবসার জন্যে ঋণ করার কোনো দরকারই হবার কথা নয়। যেমন আমি বলেছি যে, ব্যবসা সংক্রান্ত ঋণ ইউরোপে বহু পরে প্রচলিত হয় এবং পঞ্চম ও দশম শতাব্দীর মধ্যে এর প্রচলন সেখানে ছিল না। অবশ্যি এ অবস্থা যে আরবেও ছিল তা এর থেকে বলা যায় না। কিন্তু আমি প্রয়োজন বোধ করছি যে, আরবে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুদ বিদ্যমান ছিল – একথা মেনে নেয়ার পূর্বে এ বিষয়ে ভালো করেই যাঁচাই করা দরকার। আরব এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ নবীর যমানার অবস্থার বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ব্যবসা সংক্রান্ত সুদ সম্পর্কে তাদের নীরবতার দ্বারা এটা কি অনুমান করা যায় না যে, সে সময়ে এ ধরনের সুদের মোটেই প্রচলন ছিল না? বিশেষ করে ব্যবসা পদ্ধতি যখন এরূপ ছিল যে, তাতে সর্ব শ্রেণীর আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন লোক শামিল হতে পারতো।

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সূরা আল বাকারা ১৭৬-১৭৭ আয়াতের ব্যাখ্যা হয়তো আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি ’রিবা’ অর্থে সেই সুদ বুঝিয়েছেন যা কোনো অভাবগ্রস্ত লোকের নিকট থেকে নেয়া হয়। আলেমগণ এবং মুফাসসিরগণের আর কেউ কি এ অর্থ গ্রহণ করেছেন? যদি এ অর্থের সাথে অন্যান্য বুজর্গানে দ্বীন একমত হন তাহলে একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধানই হয়ে যায়।

জবাব

আমি আপনার এ ধারণার সাথে একমত যে, কুরআনে যে বিষয়ের হারাম হওয়া সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করা হয়নি, তাকে ঠিক ঐ বিষয়ের পর্যায়ভুক্ত করা উচিত হবে না, যার হারাম হওয়া সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে। কিন্তু সুদের ব্যাপারে আপনি এ নীতির প্রয়োগ যেভাবে করেছেন, তা আমার মতে সঠিক নয়। আপনার প্রমাণের বুনিয়াদ দুটো জিনিসের উপর। প্রথম হচ্ছে এই যে, ঋণ সম্পর্কিত সুদের অর্থ তাই গ্রহণ করতে হবে যা নবীর যমানায় প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয়, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সুদ যেহেতু তখন প্রচলিত ছিল না এবং দরিদ্র অভাবগ্রস্ত লোকেই সুদে ঋণ গ্রহণ করতো, সে জন্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর সুদই কুরআনে বর্ণিত হারাম সুদের পর্যায়ে পড়ে এবং প্রথমটি হারাম বহির্ভূত। আপনার এ দুটো সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। প্রথমটি ভুল হবার কারণ এই যে, কুরআন শুধুমাত্র ঐসব বিষয়েরই নির্দেশ দিতে আসেনি, যা কুরআন নাযিলের সময় আরবে তথা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ কুরআন এসেছিল এমন সব মূলনীতি বর্ণনা করার জন্যে, যা কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল ব্যাপারে বৈধ-অবৈধ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে পার। যদি একথা স্বীকার করা না হয়, তাহলে কুরআনের শাশ্বত ও বিশ্বজনীন পথ প্রদর্শক হবার কোনো অর্থই হয় না। অধিকন্তু ব্যাপার শুধু সুদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। এক ব্যক্তি এহেন অবস্থায় বলতে পারে, কুরআন যে পানীয় হারাম ঘোষণা করে, তার থেকে পানীয় বস্তুর শুধু সেই প্রকারই বুঝতে হবে, যা সে সময়ে আরবে তৈরী হতো। কুরআন যে চুরি হারাম ঘোষণা করে তাহলো ঠিক ঐ পন্থায় চুরি করা যা তখন আরবে ব্যবহৃত হতো। প্রকৃতপক্ষে যা হারাম করা হয়েছে তাহলো পানীয় (শরাব) এবং চুরি কার্যের মূল বিষয়টি তৎকালে প্রচলিত, তার প্রকার ও পদ্ধতি নয়। এভাবে মূলবস্তু সুদ হারাম করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে এই যে, ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার নিকট হতে আসলের উপরে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করার শর্ত আরোপ করে। এ অতিরিক্ত গ্রহণের শর্তটি যে কোনো প্রকার ঋণের সাথে থাকুক না কেনো, তার উপরে কুরআনের নিষিদ্ধকরণ নির্দেশ প্রযোজ্য হবে। কুরআন মূল সুদ বস্তুটিকে হারাম করেছে এবং কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কোনো ব্যক্তি দারিদ্র ও অভাবের জন্যে ব্যক্তিগত প্রয়োজনের উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করলে তার নিকট সুদ গ্রহণ করা হারাম।

আপনার দ্বিতীয় যুক্তিটি এজন্য ঠিক নয় যে, প্রথমত, বানিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের শুধু এ ধরনটাই আধুনিক যে, ব্যবসার জন্যে প্রাথমিক পুঁজি ঋণের মাধ্যমে জমা করা হয়। নতুবা ব্যবসা চলাকালীন ব্যবসায়ীদের পারষ্পারিক ঋণের লেনদেন অথবা সুদী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে কোনো ব্যবসা সংক্রান্ত প্রয়োজন পূরণ করার প্রচলন তো অবহমান কাল থেকে সারা দুনিয়ায় ছিল এবং তা যে আধুনিক উদ্ভাবন বলে কোনো নজীর খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্যে অব্যবসায়সূলভ ঋণ গ্রহণের এ একটি মাত্র পন্থাই ছিল যে, কেউ চিকিৎসার জন্যে ঔষধ-পত্রের প্রয়োজনবোধ করলো অথবা ক্ষুধানিবৃত্তির জন্যে তার চাল-ডালের দরকার হলো এবং এর জন্যে কোনো অবস্হাপন্ন লোকের নিকট থেকে কিছু টাকা ঋণ করলো, এছাড়া আরও অনেক পরিস্থিতি এমন দেখা যায় যে, অভাব না থাকা সত্ত্বেও মানুষ ঋণ করে নিজের প্রয়োজন মেটায়। যেমন ধরুন ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদীতে খরচ করবে অথবা বাড়ীঘর তৈরী করবে। এ ধরনের ঋণ গ্রহণ সব দেশে সব যুগেই হয়ে থাকে। ঋণ গ্রহণের এরুপ বিভিন্ন পন্থার মধ্যে আপনি কোন্ কোন্‌টিকে সুদ হারাম করার আওতাবহির্ভূত রাখবেন এবং কোন্ কোন্‌টিকে হারামের মধ্যে শামিল করবেন? এর জন্যে কোন্ মূলনীতিইবা অবলম্বন করবেন? আর কুরআনের কোন্ শব্দাবলীর দ্বারা এ মূলনীতি নির্ধারণ করবেন?

জাহেলিয়াতের যুগ অথবা ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যবসা সংক্রান্ত রীতি-পদ্ধতিতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদ এবং বানিজ্যের বাইরের সুদের বিশদ বর্ণনা পাওয়া না যাবার কারন হচ্ছে এই যে, ঐ সময়ে এ পার্থক্য করণের কোনো ধারণাই বিদ্যমান ছিল না এবং এ ধরনের কোনো পরিভাষাও সৃষ্টি হয়নি। সে সময়ের লোকের দৃষ্টিতে ঋণ বলতে সব ধরনের ঋণই বুঝাতো। তা সে ঋণ অভাবগ্রস্থ গ্রহণ করুক অথবা ধনী, ব্যক্তিগত প্রয়োজন অথবা ব্যবসার জন্যে। এজন্য তারা শুধুমাত্র ঋণের ব্যাপারটি এবং তার জন্যে সুদের লেনদেনের কথাই বলতো। তার বিশদ ব্যাখ্যায় তারা যেতো না।

মাওলানা আজাদের আসল উদ্দেশ্য তা ছিল না, যা আপনি বুঝে নিয়েছেন। তিনি তাঁর ব্যাখ্যায় একথাই সুষ্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন যে, নৈতিক দিক দিয়ে সুদ কতখানি মারাত্মক। কিন্তু তাঁর কথার অভিপ্রায়ের ধারা একথা প্রকাশ পায় না যে, সুদ বলতে শুধুমাত্র সেই সুদ যা আদায় করা হয় কোনো অভাবী ব্যক্তিকে তার অভাব পূরণের জন্যে টাকা ঋণ দিয়ে।

মাওলানা আজাদের ব্যাখ্যার যে মর্ম আপনি গ্রহণ করছেন, তা কুরআনের বক্তব্যেও অতিরিক্ত এবং সুদ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত কুরআনের এ নির্দেশ অভাবগ্রস্থের জন্যে প্রযোজ্য। একথা মুফাসসির ও ফকীহগণের মধ্যে কেউ বলেননি।

এ ব্যাপারে ভালো হতো, যদি আপনি আমার তাফসীর ‘তাফহীমুল কুরআন’ (সূরা আল বাকারা টীকা ৩১৫-৩২৪) পড়ে দেখতেন।–(তর্জুমানুল কুরআন জমাদিউল উখ্‌রা : ১৩৭৬ হি:, মার্চ ১৯৫৭)

তৃতীয় পত্র

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন যে, আমার প্রমাণের ভিত্তি দুটো। প্রথম এই যে, ‘রিবা’ বলতে ঋণের সেই পন্থা বুঝতে হবে, যা ছিল নবীন যামানায় প্রচলিত। দ্বিতীয় হচ্ছে এই যে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন যেহেতু সে সময়ে ছিল না সে জন্যে এ ধরনের ‘রিবা’ (সুদ) কুরআনের নিষিদ্ধকরণের (হারাম) আওতায় পড়ে না। আপনি আমার দুটি যুক্তি সঠিক মনে করেন না। কিন্তু একথা আসে আপনার সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং (উর্দূ) গ্রন্থের ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আলোচনা থেকে। আপনি বলেছেন, “কুরআন যে বাড়তি প্রাপ্য হারাম বলে, তা এক বিশেষ ধরনের বাড়তি। এজন্য কুরআন তাকে ‘রিবা’ বলে অভিহিত করেছে। আরববাসীদের ভাষায় ইসলামের পূর্বেও লেনদেনের একটা বিশেষ ধরনকেও এ পারিভাষিক নামে স্মরণ করা হতো। ——-এবং যেহেতু ‘রিবা’ একটা বিশেষ ধরনের বাড়তির (অতিরিক্ত প্রাপ্য) নাম ছিল এবং তা ছিল সর্বজন পরিচিত, সে জন্যে কুরআন মজীদে তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।————-”

তারপর কিছু ঐতিহ্যের উল্লেখ করে জাহেলিয়াতের যুগের সুদের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তারপর লিখেছেন, “ব্যবসা-বানিজ্যের এসব পদ্ধতি আরবে প্রচলিত ছিল। এসবকে আরববাসী তাদের ভাষায় বলতো ‘রিবা’ এ হলো সেই বস্তু যা কুরআনে হারাম করা হয়েছে।

আমি আগেই বলেছি যে, আপনার গ্রন্থে এবং অন্যান্য গ্রন্থে ‘রিবার’ যে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে, তার থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, আরববাসী ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো এবং আরবে যদি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন না থেকে থাকে, তাহলে আপনার নিজের যুক্তি অনুযায়ী তা ‘রিবার’ পর্যায়ে পড়ে না। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমার যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে মেহেরবানী করে আমাকে অবহিত করবেন। ওলামায়ে কেরামও স্বীকার করেছেন যে, ‘রিবা’ সেই বাড়তি প্রাপ্যকে বলা হতো, যা তখনকার দিনে আরবে প্রচলিত ছিল এবং ‘রিবা’ নামে অভিহিত করা হতো।

এখন কথা হলো এই যে, আরব জাহেলিয়াতের যুগে সত্যিকারভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদ মোটেই প্রচলন ছিল কিনা। এ বিষয়ে আপনি বলেছেন যে, একথা বিশদভাবে কোনো বই-কেতাবে লিখা নেই। তাই আমি আরজ করেছিলাম এমন এক সাংঘাতিক বিষয়ে, যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তির বিধান করে রেখেছেন, কোনো কিয়াস অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করা ঠিক হবে না। বরঞ্চ যথাসম্ভব প্রকৃত ব্যাপার জানতে হবে। আমি আরও আরজ করেছিলাম এ এক ঐতিহাসিক সত্য যে, পঞ্চম এবং দশম শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের প্রচলন ছিল না। এ বিষয়ে আমি বিভিন্ন গ্রন্থের উল্লেখ করতে পারি। উপরন্তু যেসব বই-পুস্তক আমার দেখা সম্ভব হয়েছে, তার থেকে জানতে পেরেছি যে, ঐ সময়ে আরবে ব্যক্তিগত মূলধনে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে ব্যবসা করা হতো। ব্যবসা সম্পর্কে যতই আলোচনা আমার নজরে পড়েছে, তাতে কোথাও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের উল্লেখ নেই। আমি আশা করেছিলাম যে, আপনি আপনার গভীর জ্ঞান ও ব্যাপক অধ্যয়নের দ্বারা আমাকে এমন কোনো গ্রন্থের সন্ধান দেবেন, যার থেকে এ বিষয়ে আমি পূর্বে বলেছি, গ্রন্থকারগণ নবীর যমানার অবস্থা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কোথাও একথার উল্লেখ নেই যে, লোকেরা ঋণ করে ব্যবসা করতো। কুরাইশগণ ছিল ব্যবসায়ী। হযরত আব্বাস (রা.) সুদের উপর টাকা ঋণ দেবেন। কিন্তু কাকে? খেজুর উৎপন্নকারীদেরকে। ব্যবসায়ীদের কোনো শ্রেণী সুদের উপর কাউকে ঋণ দিয়ে থাকলে, তা দিয়েছেন কৃষিজীবীকে। এর থেকে কি এ ধারণা করা যায় না যে, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সুদ তখন বিদ্যমান ছিল না।

আপনি প্রশ্ন করেছেন যে, ঋণের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে কোন্ কোনটিকে সুদ নিষিদ্ধকরনের হুকুম থেকে বাদ দেয়া যাবে এবং কোন্ কোনটিকে শামিল করা যাবে। যে যে ধরনের সুদ জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত ছিল, তা সবই হারাম হবে। যতদুর আমি বুঝতে পেরেছি, সে সময় মানুষ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে এবং নিরুপায় হয়ে ঋণ করতো। মহাজনগণ এরুপ ঋণ গ্রহণকারীদেরকে সর্বস্বান্ত করতো এবং তাদেরকে রক্ষা করা প্রয়োজন ছিল বলে ‘রিবা’ হারাম করা হয়েছে। এ ধরনের সুদের যতই কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হোক, তা হবে ন্যায়সংগত এবং সুদখোরদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলে তাও হবে যথার্থ। পক্ষান্তরে যেসব ঋণগ্রহণকারী তাদের গৃহীত ঋণ লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে তাদের ঋণের উপর সুদ জায়েয হওয়া উচিত। এ ধরনের সুদদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই লাভবান হয়। আপনি দেখতে পাবেন যে, অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী অংশীদার হিসেবে ব্যবসা করার চেয়ে, ঋণ করে ব্যবসা করা লোকে পসন্দ করে। আমি বুঝতে পারি না যে, ওলামায়ে কেরাম এ ধরনের সুদকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো কঠোর শাস্তিমূলক অপরাধ বলেন কেন? ইসলামী ফিকাহ অনুযায়ি অপরাধ এবং তার শাস্তির মধ্যে কি সামঞ্জস্য থাকা উচিত নয়? এ ধরনের সুদের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হয়, তাহলো এই যে, এর দ্বারা এমন এক শ্রেণীর লোক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যারা উপার্জন করে বিনা পরিশ্রমে। একথা তো তাদের বিরুদ্ধেও বলা যেতে পারে যারা বড় বড় জমিদারী ও গাড়ী-বাড়ীর মালিক। তারা বিনা পরিশ্রমে শুধু জীবীকা নির্বাহই করে না, বরঞ্চ বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করে। ইসলাম যদি এ ধরনের অমিতচারী ভোগবিলাসীদেরকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদগ্রহনকারী কেনই বা শাস্তির যোগ্য হবে?

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদের বিরুদ্ধে আরও বলা হয় যে, সুদে ঋণগ্রহীতা তার কারবারে যতই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ঋণদাতা লাভবানই হবে, একথা বহুলাংশে সত্য। কিন্তু একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ব্যবসার জন্যে সুদে টাকা এজন্য নেয়া হয় যে, ঋণগ্রহীতা এ সুদের হার থেকে কয়েকগুণ বেশী মুনাফার আশা করে এবং অধিকাংশ সময়ে তা পূর্ণ হয়। নতুবা বানিজ্যিক ঋনের এতোটা প্রসার হতো না। এ ধরনের ঋণদাতা বছরে অল্প পরিমান কিছু পেয়ে থাকে এবং তার বিনিময়ে ঋণগ্রহীতা তার চেয়ে কয়েকগুন বেশী মুনাফা করে। অবশ্যি কখনো কখনো তার লোকসানও হয়। এ ধরনের ঝুঁকি (RISK) নিয়ে কাজ করাতো ব্যবসা-বাণিজ্যের সাধারণ নীতি। এ এমন কিছু নয় এবং এমন কোনো অমংগলও আনয়ন করে না যার জন্যে ‘রিবার’ মতো অপরাধের শাস্তি আরোপিত হতে পারে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানমতে সুদের লাভজনক ও অলাভজনক বিষয়ের মধ্যে তারতম্য হওয়া উচিত এবং প্রথমটি জায়েয ও দ্বিতীয়টি নাজায়েয হওয়া উচিত।

আপনি একথাও বলেছেন, “সে যুগের লোকের দৃষ্টিতে ঋণ বলতে প্রত্যেক প্রকারের ঋণই ছিল। তা সে ঋণ অভাবগ্রস্থ করুক অথবা অবস্থাপন্ন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নেয়া হোক অথবা ব্যবসার জন্যে।” এর জন্যে কি কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারেন? বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে বাণিজ্যিক সুদের প্রচলন দুনিয়ায় হয়েছে এবং লোক এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই তাদের জন্যে মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ ধারণা পোষণ করার যে এমন এক সময় ছিল যখন বাণিজ্যিক ‍সুদ ছিল না। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ব্যবসা সংক্রান্ত সুদের লেনদেন অন্তত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নবীর আগমনের সময় প্রচলিত ছিল না। -(এর জবাব পরিশিষ্ট : দুই দ্র:)

আমি আপনাকে আরও একটু বিরক্ত করতে চাই। তার তিনটি কারণ। এক হচ্ছে এই যে, লাখো লাখো মুসলমান বানিজ্যিক সুদের লেনদেন করছে। কারণ এ প্রতিযোগিতার যুগে ব্যবসা ক্ষেত্রে যদি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রাখতে হয়, তাহলে তাদের জন্যে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি জানি যে, আপনি একথা স্বীকার করেন না। আপনি এর বিকল্প পন্থার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু আমি সবিনয়ে নিবেদন করব যে, আমাদের বর্তমানকালের মানসিক ও নৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তা কার্যকর করা যাবে না। যে নৈতিক মান আমরা আমাদের স্বধর্মীদের কাছে আশা করি তার জন্যে প্রয়োজন একজন নবীর। কিন্তু ইসলামে আর কোনো নবী আগমনের সম্ভাবনা নেই। তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মতে আলেম সমাজের উচিত ধর্মের তামাদ্দুনিক ও সামাজিক ব্যাপারে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কঠোরতা না করা এবং আল্লাহ তায়ালার একথা……………আরবী লেখা………… স্মরণ করা। উপরন্তু এ এক সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি যে, যে জিনিস আইনত নিষিদ্ধ তার অমংগল মংগল থেকে অধিক। যেমন আল্লাহ তায়ালা শরাব ও জুয়ার ব্যাপারে এরশাদ করেছেন ………….আরবী লেখা……………. বাণিজ্যিক সুদ কতিপয় লোকের জন্যে কোনো কোনো সময়ে ক্ষতিকারক হয়। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, অধিকাংশ সময় তা লাভজনক হয় এবং তার লাভ ক্ষতি থেকে অনেক বেশী হয়। তাই এটা নিষিদ্ধ না হওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, আজকাল সামরিক প্রয়োজনে এত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় যে, যুদ্ধের সময় ঋণ করা ব্যতীত উপায় থাকে না। এ সত্য অস্বীকার করা যায় না।

তৃতীয় কারণটি আমার ব্যক্তিগত। আমি সরকারী চাকুরী করা কালে জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ডে স্বেচ্ছায় আমার বেতন থেকে টাকা কেটে রাখতাম। তার থেকে একটা মোটা অংকের সুদ আমার নামে জমা হয়েছে যা আমি আলাদা করে রেখেছি। আমি জানতে চাই এ সুদ জায়েয, না জায়েয। এ বিষয়ে আপনি আমাকে দয়া করে জানাবেন। যদি নাজায়েয হয় তাহলে এ টাকা কোন্ কাজে ব্যয় করবো? অভাবগ্রস্থদের অভাব মোচনে তা ব্যয় করা যাবে কি? আমার এ টাকাটা হালাল কি হারাম তা জানার জন্যে অশেষ চেষ্টার ফলে বহু বই-পুস্তকও পড়েছি। কিন্তু কয়েকটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। সমাধানের জন্যে তা আপনার কাছে পেশ করার সাহস করছি। এ ব্যাপারে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে মাফ চাইছি। মনের দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই। কিন্তু এ পত্রের জবাবের পর আপনাকে আর বিরক্ত করব না।

জবাব

আমি আগেও বলেছি এবং এখনো বলছি যে ঋণ দেবার পর আসলের উপরে যে বাড়তি বা অতিরিক্ত গ্রহণকে আরবে ‘রিবা’ বলা হতো, কুরআন তাকেই হারাম করেছে। কিন্তু একে আপনি যে অর্থে নিচ্ছেন তা হচ্ছে এই যে, ঋন দেয়ার যে প্রকার পদ্ধতি সে সময়ে আরবে প্রচলিত ছিল, কুরআন শুধুমাত্র তার মধ্যেই আসল থেকে অতিরিক্ত নেয়া হারাম করেছে। অথচ সকল ফকীহগণের সাথে একমত হয়ে আমি ঋণদানের প্রকার পদ্ধতির নয়, বরঞ্চ অতিরিক্ত গ্রহনের প্রকার পদ্ধতি থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি।

এটাকে একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্পস্ট করতে চাই। কুরআন নাযিলের সময় আরবে পরিভাষা হিসেবে ‘খমর’ (***) শব্দটি আঙুর থেকে নিঃসৃত শরাবের জন্যে ব্যবহৃত হতো। সে সময় অন্য পন্থায় যেসব শরাব তৈরি হতো তাকেও পরোক্ষভাবে এ শব্দ দ্বারা বুঝানো হতো। যা হোক, যখন কুরআনে তার হারাম হবার নির্দেশ এলো, তখন কেউ তার এ অর্থ গ্রহণ করেনি যে, এ হারামের নির্দেশ শুধুমাত্র ঐ ধরনের শরাবের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ এ অর্থই গ্রহন করা হতো যে, এসব বস্তুর মধ্যে যে গুণটি ছিল সকলের মধ্যে সাধারণ (COMMON) অর্থাৎ মাদকতার গুণ, হারাম করার নির্দেশটি ছিল তারই উপর প্রযোজ্য। আর এ গুণটি (মাদকতা) যে ধরনের পানীয় অথবা খাদ্যের মধ্যে পাওয়া যাবে, তা হারামের আওতায় পড়বে।

অনুরূপভাবে আরবে ঋণেরও কয়েকটি প্রকার পদ্ধতি ছিল। এ সবের মধ্যে যে বিষয়টি ছিল সাধারণ (COMMON) তাহলো এই যে, লেনদেনের শর্তে একথার উল্লেখ থাকা যে, আসলের উপর অতিরিক্ত কিছু আদায় যোগ্য হবে। আরববাসী একেই বলত ‘রিবা’। কুরআনে যখন ‘রিবা’ হারাম হবার হুকুম এলো, তখন কেউ তার এ অর্থ গ্রহণ করেনি যে, এ হুকুম শুধুমাত্র ঐ ধরনের ঋণ সম্পর্কে, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সকল ফকীহগণ এ অর্থই গ্রহণ করেছেন যে, আসলে অতিরিক্ত যা দাবী করা হবে তাই হারাম—ঋণের ধরন বা প্রকার পদ্ধতি যাই হোক না কেন। এ দিকেই কুরআন ইংগিত করেছে:

(************************)

“যদি তোমরা তওবা কর, তাহলে তোমাদের আসল মাল ফিরে পাবার হকদার হবে।” – (সূরা আল বাকারাঃ ২৭৯)

এর থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, আসলের উপরে অতিরিক্ত নেয়াটাই ‘রিবা’। আর এটাকে কুরআন হারাম করেছে। যদি ঋণের কোনো প্রকার

পদ্ধতিতে অতিরিক্ত গ্রহণকে হারাম করার উদ্দেশ্য থাকতো, তাহলে কোনো না কোনো প্রকারে সে উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেয়া হতো। যেমন, একথা বলা হতো, অভাবগ্রস্তদেরকে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত নিও না।

আপনি অভাবগস্তের উল্লেখ কুরআনে কোথাও পাচ্ছেন না, তা আমদানী করছেন বাহির থেকে এবং এ শর্ত বাড়াবার জন্যে যে যুক্তি পেশ করেছেন তাতে সাংঘাতিক নীতিগত ত্রুটি এই হচ্ছে যে, শুধু সুদই নয়, কুরআনের যাবতীয় নির্দেশাবলী ঐসব অবস্থা ও লেনদেনের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। উপরন্তু এ যুক্তির দ্বারা আপনি একটা বিরাট ঝুঁকিও (RISK) টেনে আনছেন। আপনি এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পেশ করতে পারছেন না যে, ঐ সময়ে লোকে ঋণ করে ব্যবসা করতো না। আর একথারও কোনো প্রমাণ নেই যে, ব্যবসা করা কালীন কোনো ব্যবসায়ী অন্য কোনো ব্যবসায়ী অথবা সুদী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতো না। এ দুটো ধারণা আপনার সৃষ্টি হয়েছে মধ্যযুগীয় ইউরোপ সম্পর্কে সাধারণ ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে। তা হচ্ছে এই যে, সে সময়ে ব্যবসা চলতো ব্যক্তিগত পুঁজি দিয়ে অথবা কার্যকরী অংশীদার হিসেবে। বানিজ্যিক সুদের প্রচলন অনেক পরে হয়েছে। এ ধরনের ঐতিহাসিক বর্ণনা যার দ্বারা একটা সাধারণ অবস্থার চিত্র পেশ করা হয়েছে—একথা প্রমাণ করা যায়না যে, ঐ সময়ে আর কোনো পন্থার প্রচলন মোটেও ছিল না।

আমি পূর্বে বলেছি যে, লোক প্রত্যেক ধরনের ঋণকে ঋণই বলতো, তা সে ঋণ অভাবগ্রস্ত নিক অথবা অবস্থাপন্ন, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অথবা ব্যবসার জন্যে। এ হচ্ছে আমার ধারণা এবং এর বুনিয়াদ হচ্ছে এই যে, আমার দৃষ্টিতে অতীতের কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঋণের প্রকারভেদ বর্ণনা করা হয়নি, ঋণগ্রহণকারীর অবস্থা ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, মানুষ সকল যুগেই বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ঋণগ্রহণ করে থাকতো। আর ঋণগ্রহণ শুধু অভাবীদের মধ্যেই সীমিত থাকতো না।

এখানে এ আলোচনা নিস্প্রয়োজন যে, মুনাফা এবং স্বার্থের জন্যে ঋণে সুদ গ্রহণ কেন হারাম হওয়া উচিত। এ বিষয় পূর্বে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে।

আমার মতে প্রভিডেণ্ট ফাণ্ডের উপরে সুদের যে অংক আপনার জমা হয়েছে, তা আপনি নিজের জন্য ব্যয় করবেন না। এর হারাম হওয়া সম্পর্কে যদি নিশ্চিত নাও হন, তবুও এ-তো সন্দেহযুক্ত বটেই। যার পবিত্র হবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপনার মতো একজন ভাল মানুষের তার থেকে লাভবান হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে আপনি যখন এ টাকার মুখাপেক্ষী নন। বরঞ্চ উত্তম কাজ এই হবে যে, এর দ্বারা আপনি একটি তহবিল গঠন করে

বিনা সুদে অভাবগ্রস্তদেরকে ঋণ দেবেন। আমার মনে হয়, অন্যান্য লোকের মধ্যে যাদের এ ধরনের সুদী অংক জমা হয়েছে, ভবিষ্যতে হবে, তারাও সন্তুষ্টচিত্তে আপনার এ তহবিলে তাদের উপরোক্ত টাকা জমা দেবে। এভাবে উপরোক্ত উদ্দেশ্যে একটা মোটা রকমের পুঁজি জমা হবে।–(তর্জুমানুল কুরআন, শাবান-রমজান : ১৩৭৬ হিঃ জুনঃ ১৮৫৭)

চতুর্থ পত্র

প্রশ্ন: জুন সংখ্যার তর্জু্মানুল কুরআনে বাণিজ্যিক সুদ সম্পর্কে আমার এবং আপনার উত্তরের নকল ছাপিয়েছে। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না বলে ওয়াদা করা সত্ত্বেও আর একটু বিশদ ব্যাখ্যার জন্যে অনুরোধ করছি।

এক: আপনি লিখেছেন এভাবে আরবে ঋণের লেনদেনের বিভিন্ন পন্থা প্রচলিত ছিল। এসবের মধ্যে এ ছিল একটি সাধারণ বস্তু যে, লেনদেনের বিবরণীতে আসলের উপরে অতিরিক্ত দেয় একটি অংক শামিল থাকতো। আর এটাকেই আরববাসী ‘রিবা’ নামে অভিহিত করতো। এর থেকে একথা প্রকাশ পায় যে, আপনি প্রচলিত প্রকার ঋণ থেকে অতিরিক্ত গ্রহণেয় প্রকার নির্ধারিত করেছেন এবং আমার চেষ্টাও তাই ছিল। এর জন্যে প্রয়োজন আরব জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত ঋণের সকল প্রকার একত্র করা এবং দেখা যে, এদের সকলের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বস্তু কোনটি। আপনার নিকটে সে বস্তুটি লেনদেনের বিবরণীতে আসলের উপরে অতিরিক্ত কিছু আদায়ের শর্ত শামিল থাকা। আমার নিবেদন এই যে, আর একটি বস্তু ছিল সাধারণ (COMMON) এবং তা হচ্ছে ঋণগ্রহীতার অভাব-অনটনের জন্যে তার উপর নাজায়েয শর্ত আরোপ করা অথবা অন্য কথায় তার উপর অন্যায়-অত্যাচারের সম্ভাবনা, ঋণের যত প্রকার দৃষ্টান্ত আপনি আপনার ‘সুদ’ গ্রন্থে পেশ করেছেন তার সবগুলোর মধ্যে এ সম্ভাবনা বিদ্যমান। অতএব সবের মধ্যে বিদ্যমান এই সাধারণ বিষয়টি (অন্যায়-অত্যাচার) ‘রিবার’ সংজ্ঞার অন্তর্ভূক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। নতুবা ‘রিবা’ শব্দের সংজ্ঞা পূর্ণ হয়না। এ জবরদস্তিমূলক অত্যাচারের সম্ভাবনা সকল অলাভজনক (NON-PRODUCTIVE) ও ভোগ্য (CONSUMPTION) ঋণের বৈশিষ্ট্য এবং সম্ভবত সুদ হারাম হবার এটাই কারণ। কিন্তু যদি একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সেই যুগে আরববাসী লাভজনক কাজেও সুদে টাকা ঋণ করতো তাহলে আমার ধারণা হবে ভুল। যেহেতু আরব জাহেলিয়াতের যুগে এ ধরনের ঋণ প্রথার অনুসন্ধান করে ও ব্যর্থ হয়েছি। সে জন্য আমি আপনাকে বিরক্ত করছি এবং আশা করি আপনাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আমাকে জানাবেন, সে যুগে লাভজনক ঋণগ্রহনের প্রথা প্রচলিত ছিল কিনা। আপনি যত প্রকার ঋণ গ্রহনের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন তার মধ্যে একটি মাত্র এমন যা ব্যবসার সাথে কিছুটা সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ কাতাদার সেই বর্ণনা যাতে বলা হয়েছেঃ “কোনো ব্যক্তি কারো কাছে কোনো জিনিস বিক্রি করলো এবং মূল্য পরিশোধ করার জন্যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে অবকাশ দিল। সময় উত্তীর্ণ হলো কিন্তু ক্রেতা মুল্য পরিশোধ করলো না। তখন বিক্রেতা পুনরায় কিছু সময় পর্যন্ত অবকাশ দিল এবং মুল্য বাড়িয়ে দিল।”

চিন্তা করে দেখুন এ অতিরিক্ত মুল্য কখন চাপানো হতো। যখন সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে অক্ষম হতো এবং ঋণদাতা ইচ্ছামতো শর্ত ঋণগ্রহীতার দ্বারা স্বীকার করিয়ে নিতে পারতো। অর্থাৎ এতে জবরদস্তি ও যুলুম অত্যাচারের সম্ভাবনা থাকতো।১ [১. একথা নিঃসন্দেহে ভুল। পাইকারী ব্যবসায় এ কোনো অসাধারণ ব্যপার নয় যে, একজন পাইকারী বিক্রেতা কোন খুচরা বিক্রেতা পুরাতন গ্রাহককে কিছু মাল বাকি দিল এবং মুল্য পরিশোধের জন্যে বিনা সুদে দু এক মাসের অবকাশ দিল। এ সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে অপারগ হলে সুদের উপর আরও কিছু কালের অবকাশ দেয়। এ অবস্থায় সময়মতো মূল্য পরিশোধ না করলে খুচরা বিক্রেতা অনিবার্যরূপে অনাহারে থাকে না যে, তার উপর সুদ আরোপ করলে বিশেষ ধরনের যুলুম হয়, যা শাহ সাহেব মনে করেন।]

দুইঃ আপনি শরাবের (***) দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন যে, তার নিষিদ্ধকরণ আদেশের কেউ এর অর্থ গ্রহণ করেনি যে, সে সময়ে আরবে যে ধরনের শরাব প্রচলিত ছিল শুধু তাই হারাম করা হয়েছে। বরঞ্চ সকলে এটাই বুঝতো যে, এ সবের মধ্যে যে বস্তু বা গুণটি সাধারণ অর্থাৎ মাদকতার গুণ, তাই আসলে হারাম। আমার কথা এই যে, এরূপ রিবার ক্ষতিকারক হবার গুণটি সকলের মধ্যে সাধারণ মনে করতে হবে এবং তাই হবে হারাম। এখন সুদের যেসব প্রকার ক্ষতিকারক নয়, তা রিবার মধ্যে শামিল্ করা ঠিক হবে না।

তিনঃ সূরা আল বাকারার আয়াতঃ (**************) থেকে আপনি যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, আসলের উপর অতিরিক্ত গ্রহণ করছি ‘রিবা’। কারণ ঋণের কিছু শ্রেণী বিশেষে যদি এ অতিরিক্ত গ্রহণ হারাম করা উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আকার-ইংগিতে তা বলে দেয়া হতো। যেমন বলা হতো, ‘অভাবগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত কিছু নিওনা।’ এ আয়াতকে যদি তার পূর্ব থেকে পড়েন তাহলে গোটা নির্দেশ হচ্ছেঃ

(***************)

“যারা ঈমান এনেছো তারা জেনে রেখে দাওঃ তোমরা ভয় কর আল্লাহকে এবং সুদের যা কিছু অবশিষ্ট আছে (আদায় করার) তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা সত্যি-সত্যি ঈমান এনে থাক। যদি তোমরা তা না কর, অর্থাৎ সুদের বকেয়া ছেড়ে না দাও, তাহলে তৈরী থাক, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। এখনো যদি তওবা কর (এবং সুদ ছেড়ে দাও) তাহলে আসল ফেরত পাবার হকদার হবে। যুলুম তোমরা করো না, তাহলে তোমাদের উপর ও যুলুম করা হবেনা।” -(সূরা আল বাকারাঃ ২৭৮-২৭৯)

এ নির্দেশাবলী ঐ অতিরিক্তটুকু ছেড়ে দেয়ার জন্যে, যা সে সময়ে ঋণ-দাতাগণ খাতকের কাছে পাওনা ছিল। এ জন্য তার সম্পর্ক অনিবার্যভাবে সেই ধরনের ঋণের সাথেই ছিল।

চারঃ আপনি ঠিকই বলেছেন যে, আপনার নিকটে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই যে, সে সময়ে এমন কোনো ব্যক্তি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতো। অথবা ব্যবসাকালীন কোনো ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীর কাছে কিংবা কোনো সুদী মহাজনের কাছে ঋণ যে করতো না তারও কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আমি আমার পূর্বের পত্রগুলোতে যেসব সুত্রের উল্লেখ করেছি তার থেকে স্পষ্টই এ ধারণা জন্মে যে, যে সময়ে এ ধরনের ঋণের প্রচলন ছিল না। আমার দৃষ্টিভংগী এই যে, সুদগ্রহণকারীর জন্যে যেরূপ কঠোর শাস্তি নির্ধারিত করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত গ্রহণের কোনো প্রকারকে ‘রিবার’ মধ্যে শামিল করা উচিত হবে না, যতক্ষণ না এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, নবী করীম (স)-এর যমানায় তা ‘রিবার’ মধ্যে শামিল ছিল। পক্ষান্তরে আপনার দৃষ্টিভংগী মনে হয় এই যে, ধারণার ভিত্তিতে একে ‘রিবার’ মধ্যে গণ্য মনে করা উচিত। আর যতক্ষন পর্যন্ত না একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এ ধরনের অতিরিক্ত গ্রহণের প্রচলন তখন ছিল না, ততক্ষণ তাকে ‘রিবার’ বহির্ভূত মনে করা চলবে না। সতর্কতা ও ধর্মভীরুতার জন্যে আপনি এ দৃষ্টিভংগী পোষণ করেন। কিন্তু আমার ভয় হয়, আপনার এ সতর্কতা পার্থিব ক্ষতির পরেও পারলৌকিক ক্ষতির কারণ না হয়। বর্তমান দুনিয়ায় বানিজ্যিক সুদ ব্যতীত চলবার উপায় নেই। যে জাতি এর থেকে দূরে সরে থাকবে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সে জাতি অন্যান্য জাতির তুলনায় হীন দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এ ধরনের হীনতার প্রভাব যে তার আজাদীর উপরও পড়তে পারে তা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় এটা চান না যে, মুসলমান পদানত হয়ে থাক। সূরা আল মায়েদার (**************) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আপনি আপনার তাফহীমুল কুরআনে বলেছেনঃ ”এ আয়াতে দুটো বিষয়ে এরশাদ করা হয়েছে। এক ইচ্ছে এই যে, তোমরা স্বয়ং হালাল-হারাম নির্ধারণের মালিক-মোক্তার হয়ে যেয়ো না। হালাল ঐ বস্তু যা আল্লাহ হালাল করেছেন এবং হারাম উহাই যা তিনি হারারম করেছেন।” উপরন্তু আপনি ১০৪নং টীকায় বলেছেন যে, রসূলে করীম (স) প্রত্যেক মুসলমানকে তার নিজের উপরে কঠোরতা আরোপ করতে নিষেধ করেছেন। এজন্য এটা কি সংগত হবে না যে, যতক্ষন না প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বাণিজ্যিক সুদও (PRODUCTIVE INTEREST) ’রিবার’ মধ্যে শামিল, তা শুধু ধারণার বশীভূত হয়ে হারাম বলে গণ্য করা চলবে না?

পাঁচঃ প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে যে সুদের টাকা আমি পেয়েছিলাম, অল্পদিন পরেই তা আমার এক বন্ধু ঋণ হিসেবে নিয়েছেন এবং এখনো ফেরত দেননি। ফেরত পাবার পর তা ইনশাআল্লাহ আপনার পরামর্শ অনুযায়ী নিজের জন্যে ব্যয় করবো না।

ছয়ঃ একটি অপ্রাসংগিক কথা আপনাকে বলতে চাই। আল্লাহ তায়ালা মদ ও জুয়া সম্পর্কে এরশাদ করেছেনঃ ( আরবী টেক্স্ট)-এর অর্থ আপনি করেছেন ”তার ক্ষতি লাভ থেকে অনেক বেশী।” অভিধান গ্রন্থগুলোতে (*************) শব্দের অর্থ ’ক্ষতি’ কোথাও দেখতে পাইনি। আমার অনুরোধ আপনার এ অর্থের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ গ্রন্থের উল্লেখ করলে কৃতার্থ হবো।

জবাব

আপনি যে বিষয়গুলোর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে আমি বলতে চাই যে, আপনি আর একবার নতুন করে আসল প্রশ্নটি বুঝবার চেষ্টা করুন। আসল প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, কুরআন যে ’রিবা’ হারাম করেছে, তার তাৎপর্য কি অথবা অন্য কথায় বলতে গেলে তার হারাম হবার কারণ কি। তা কি এই যে, একজন তার আসলের উপরে অতিরিক্ত করে অথবা তা কি এই যে, সে অপরের অভাব-অনটনের সুযোগে অবৈধভাবে লাভবান হয়? আমি প্রথমটিকে ’রিবার’ তাৎপর্য ও হারাম হবার কারণ মনে করি। তার প্রমাণ সংক্ষেপে এইঃ

একঃ কুরআন যে বস্তুকে হারাম ঘোষণা করেছে, তার জন্য যে পরিপূর্ণ শব্দ ’ আর রিবা’ (************) ব্যবহার করছে। আরবী অভিধান অনুযায়ী তার অর্থ শুধু আধিক্য। অভাবগ্রস্তের নিকট থেকে অধিক নেয়া এ শব্দের অর্থের অন্তুর্ভুক্ত নয়। অভাবহীন সচ্ছল ব্যক্তিকে ঋণ দিয়ে অথবা কোনো লাভজনক উদ্দেশ্যে ঋণ দিয়ে অধিক ফেরত নিলেও আভিধানিক দিক দিয়ে এ আধিক্যের উপর ’আর রিবা’ (*******) শব্দটি প্রযোজ্য হবে।

দুইঃ কুরআন স্বয়ং ’রিবার’ শব্দকে এমন কোনো বাগধারা সংজ্ঞার দ্বারা সীমিত করে না। যার থেকে বুঝা যায় যে, সে ঐ ’রিবাকে’ হারাম করতে চায়, যা কোনো অভাকগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে আদায় করা হয় এবং ঐ ’রিবাকে’ হারামের আওতার বাইরে রাখতে চায়, যা অভাবহীন লোককে অথবা লাভজনক কাজে ঋণ দিয়ে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে আদায় করা হয়।

তিনঃ আরববাসী ঋণের উপর মুনাফা এবং ব্যবসার মুনাফাকে সমান মনে করতো। তারা বলতো (*******) ’ব্যবসাতো সুদের মতোই’। কুরআন উভয় প্রকার মুনাফার পার্থক্য নির্ণয় করে পরিস্কার করে দিয়েছে যে, ব্যবসার মুনাফা হালাল এবং ঋণের মুনাফা হারাম। এর থেকে একথা পরিস্কার হয়ে গেল যে, মুনাফা লাভের জন্যে ব্যবসা ও ব্যবসার অংশীদার হওয়ার পথ উন্মুক্ত আছে। কিন্তু ঋণের আকারে টাকা খাটিয়ে মুনাফা করার পথ বন্ধ।

চারঃ কুরআন (**********) (তোমাদেও আসলটুকু ফেরত পাবার অধিকার আছে) বলে, একথাও পরিস্কার করে দিয়েছে যে, ঋণদাতা শুধু অতটুকু পাবার হকদার, যতটুকু সে দিয়েছে। তার অতিরিক্ত নেয়ার হকদার সে নয়। এখানে এ ব্যাপারেও কোন ইংগিত নেই যে, যাকে কোনো লাভজনক কাজে মাল বা টাকা দেয়া হবে, তার কাছ থেকে আসলের উপরে কিছু অতিরিক্ত নেয়ার অধিকার দাতার থাকবে।

পাঁচঃ অভিধান এবং কুরআনের পর প্রমাণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সুন্নাহ, যার থেকে আল্লাহ তায়ালার হুকুমের অভিপ্রায় জানা যায়। এখানেও আমরা দেখছি যে, শুধু আধিক্যকে নিষিদ্ধকরণ আদেশের কারণ বলা হয়েছে। সে আধিক্য নয় যা আদায় করা হয় কোনো অভাবগ্রস্তকে ঋণ দিয়ে। হাদীসে পরিস্কার বলা হয়েছে (***********)

”যে সকল ঋণ মুনাফা আকর্ষণ তা সুদের কারণগুলোর মধ্যে একটি (বায়হাকি) এবং ************”প্রত্যেক ঋণ দ্বারা যে মুনাফা লাভ করা হয় তা রিবা বা সুদ (মুসনাদে হারিস বিন উসামা)।” ১ [১. কেউ কেউ এ হাদীসটির সত্যতার প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন। তাদের যুক্তি এই যে, তার সনদ (রাবী পরস্পরা) দুর্বল। কিন্তু যে মূলনীতি এ হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, সকল ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে তা মেনে নিয়েছেন। বর্ণনার দিক দিয়ে তার সনদ দুর্বল হলেও এ সর্বস্বীকৃিত হাদীসের বিষয়বস্তুকে জোরদার করে দেয়।]

ছয়ঃ ঋণের উপরে গৃহীত সুদ হারাম করেই নবী (স) ক্ষান্ত হননি। বরঞ্চ নগদ আদান-প্রদান ব্যাপারেও একই প্রকার বস্তুও বিনিময়ে অতিরিক্ত গ্রহণ হারাম করেছেন। আর এ সত্য কথা যে, এতে অভাবগ্রস্ততার কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। এর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, নবী (স) আল্লাহ তায়ালার আদেশের যে অভিপ্রায় উপলব্ধি করেছিলেন তা নিশ্চিতরূপে এই ছিল যে, ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত গ্রহণকে তিনি হারাম করতে চান। উক্ত প্রবণতা বন্ধ করার জন্যে নবী (স) নগদ লেনদেনের মধ্যেও অতিরিক্ত গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছেন।

সাতঃ মুসলিম জাতির ফকীহগণ সর্বসম্মতিক্রমে এ আদেশের অভিপ্রায় এই বুঝেছিলেন যে, ঋণের ব্যাপাওে আসলের উপরে অতিরিক্ত যা কিছুই নেয়া হোক না কেন, তা হারাম। ঋণগ্রহণকারী তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্যে সে ঋণগ্রহণ করুক অথবা কোনো লাভজনক কাজে তা বিনিয়োগ করুক তাতে কিছু আসে যায় না।

(***********)

”শরীয়তের পরিভাষায় ’রিবার (সুদ) অর্থ হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় ব্যতীত আসলের উপর অতিরিক্ত গ্রহণ।”-(নেহায়া, ইবনে কাছির)

এ সংজ্ঞা অনুযায়ী সকল ফকীহগন ঐ ধরনের মুনাফা গ্রহণকে হারাম বলে অভিহিত করেন, যা ঋণদাতা গ্রহীতার নিকট থেকে গ্রহণ করে।

এ কারণগুলোকে উপেক্ষা করে আপনি বলেছেন যে, শুধুমাত্র ঐসব ঋণের উপরে সুদ হারাম হবে যা কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তার অভাব পূরণের জন্যে নিয়ে থাকে এবং লাভজনক কাজে খাটাবার জন্যে যে ঋণ নেয়া হয় তার উপর সুদ হারাম হবে না। যার উপর ভিত্তি করে আপনি এসব কথা বলছেন, তাহলো এই যে, আপনার মতে কুরআন নাযিল হবার সময় আরবে শুধু প্রথম প্রকারের ঋণেরই প্রচলন ছিল এবং দ্বিতীয় প্রকারের ঋণের প্রচলন দুনিয়ার অনেক পরে হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি নি¤œলিখিত প্রশ্নগুলোর বিশদ ও সন্তোষজনক জবাব দিয়েছেন, ততক্ষন আপনার এ অভিমত মেনে নেয়া যেতে পারে না।

একঃ আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল ঋণসমূহের মধ্যে লাভজনক ও অলাভজনক ঋণের পার্থক্য নির্ণয় কওে সুস্পষ্টভাবে অথবা আকরে-ইংগিতেও কি সুদের অবৈধতা প্রথম প্রকারের মধ্যে সীমিত করেছেন এবং দ্বিতীয় প্রকারকে অবৈধতা বা হারামের বহির্ভূত করে রেখেছেন? যদি তা করে থাকেন, তাহলে তার প্রমাণ থাকতে হবে। কারণ হারামের নির্দেশ যিনি দিয়েছেন, হারাম বহির্ভুত করার অধিকারও তাঁর। তাঁর কোনোরূপ ইংগিত ব্যতিরেকে হালাল-হারামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কোনো অধিকার আমাদের অথবা আপনার নেই। এ ব্যাপারে আপনি সম্ভবত এ যুক্তিই দেখাবেন যে, যেহেতু সে সময়ে শুধুমাত্র অলাভজনক ঋণের উপরে সুদ গ্রহণ করার প্রচলন ছিল সে জন্যে আল্লাহ তায়ালার হারাম করার নির্দেশ তা সাথেই সম্পর্কিত বুঝতে হবে। কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত না একথা ধরে নেয়া যায় যে, মানবীয় ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জ্ঞান শুধু কুরআন নাযিলের সময়ে প্রচলিত ব্যাপার পর্যন্তই সীমিত ছিল এবং ভবিষ্যতে কি কি ঘটবে সে সম্পর্কে তাঁদের কোনো জ্ঞান ছিল না, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার এ যুক্তি চলতে পারে না। উপরন্তু বলতে হয় যে, ইসলাম শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়-কাল পর্যন্তই পথপ্রদর্শন করতে পারে। শাশ্বত পথপ্রদর্শক নয়। আপনার যুক্তির মূলে যদি এরূপ ধারণা করা না হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, লেনদেন ও কায়কারবারের সে সব প্রকার পদ্ধতিও আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত ছিল যা পরবর্তীকালে সংঘটিত হবে। আপনি যখন একথা মেনে নেবেন, তখন তার সাথে একথাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা যদি এই হতো যে, তিনি সুদের অবৈধতা শুধুমাত্র অলাজনক ঋণের উপরেই সীমাবদ্ধ রাখবেন। তাহলে তিনি কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই তাঁর সে ইচ্ছা প্রকাশ করতেন এবং তাঁর রসূলও এ ইচ্ছাকে এতটা সুস্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, সুদের অবৈধতার নির্দেশ সকল প্রকার ঋণের উপর প্রযোজ্য হতে পারতো না।

দুইঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, আরবে শুধু যে অভাবগ্রস্ত লোকই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করতো এবং কেউ ব্যবসার জন্যে অথবা কোনো লাভজনক কাজে খাটাবার জন্যে ঋণ নিত না এর কোনো প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে? পৃথিবীতে লাভজনক কাজের জন্যে ঋণ করে পুঁজি সংগ্রহ করার রীতি অনেক পরে প্রচলিত হয়েছে–শুধু একথা এমন সিদ্ধান্ত করার জন্যে যথেষ্ট প্রমাণ নয় যে, প্রথমে কোনো ব্যক্তি ব্যবসা করার পূর্বে অথবা ব্যবসা চলাকালীন অবস্থায় কখনো ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করতো না। আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসা করতে বসেছেন। আল্লাহ তায়ালার একটি নির্দেশ থেকে কোনো কিছুকে বহির্ভূত করে রাখা সহজ কাজ নয়। এর জন্যে আপনি যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী যুক্তির প্রয়োজন। একথা প্রমাণ করার দায়িত্ব আমাদের নয় যে, আরবের লোক সে সময়ে ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো। বরঞ্চ একথা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনার যে, সে সময়ে ব্যবসার জন্যে কেউ ঋণ গ্রহণ করতো না। এটা এজন্য যে, ব্যতিক্রমের দাবী আপনি করছেন। তার জন্যে আপনি আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের কোনো ইংগিত অথবা ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করছেন না। বরঞ্চ আপনার যুক্তির ভিত্তি হচ্ছে এই যে, আরবে সে সময়ে ’রিবা’ বা সুদ শুধু অলাভজনক কাজের উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের উপরেই প্রযোজ্য হতো।

এখন আমি আপনার উত্থাপিত বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছি। ’রিবা’র মর্ম নির্ধারণ করতে এবং তা হারাম করার কারণ অবগত হবার জন্যে আমরা শুধু সেসব কায়কারবারের প্রকার পদ্ধতির উপরেই নির্ভর করছি না যা তখন আরবে প্রচলিত ছিল। বরঞ্চ ভাষাতত্ত্ব, কুরআনের বর্ণনা, হাদীস, মুসলিম ফকীহগণের ব্যাখ্যা হচ্ছে তার প্রকৃত উৎস। উপরন্তু আর একটি জিনিস এ ব্যাপারে সাহায্য করে এবং তা হচ্ছে এই যে, সে সময় যেসব ব্যাপারে ’রিবা’ প্রযোজ্য হতো, তার মধ্যে সর্ব সাধারণের কল্যানে জন্যে কিছু আছে কিনা তা অবগত হওয়া যাক।

আপনি বলেছেন যে, তাদের মধ্যে সাধারণ বস্তু শুধু আসলের উপরে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করাই ছিল না, বরঞ্চ এই সাধারণ বস্তুটি ছিল এই যে, এ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হতো অভাবগ্রস্তদেরকে তাদের প্রয়োজনে ঋণদান করে। কিন্তু প্রথমত খোদার নির্দেশের কারণ নির্ধারণ করার জন্যে এটাকে নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না যে, না কুরআন এর দিকে কোনো ইংগিত করেছে আর না সুন্নাতে এমন কোনো বস্তু পাওয়া যায়, যার উপর নির্ভর করে এরূপ ধরে নেয়া যেতে পারে যে, শুধু অভাবগ্রস্তদের নিকট থেকে অতিরিক্ত নেয়াটাই হারাম হবার কারণ। দ্বিতীয়ত আমরা স্বীকার করি না যে, সে সময়ে ঋণ গ্রহণের ব্যাপার শুধু ঐ ধরনেই সীমাবদ্ধ ছিল। আরবদের ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে আমাদের বিশদভাবে জানা নেই যে, ঋণের পুঁজিতে তখন ব্যবসা চলতো, না ব্যবসায়ে মোটেই ঋণের কোনো লেশমাত্র ছিল না। এজন্য কোনো বিবরণের উপর আমরা এবং আপনি আমাদের আলোচনার ভিত্তিস্থাপন করতে পারি না। কিন্তু এ এক সাধারণ জ্ঞানের কথা এবং দুনিয়ার সাধারণ ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তিই একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, ব্যবসায় ঋণের পুঁজিকে ভিত্তিরূপে ব্যবহার করার প্রথা পরবর্তীকালে শুরু হলেও ব্যবসায়ীদের কারবার চলাকালে একে অপরের নিকট থেকে এবং মহাজনের নিকট থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন পূর্বেও হতো। তাছাড়া খুচড়া ব্যবসায়ী পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে বাকীতে মাল পূর্বেও নিতো। আরববাসীদের সম্পর্কে এধরনের কোনো লিখিত বিবরণ বিদ্যমান না থাকলেও, দুনিয়ার অন্যান্য দেশ সম্পর্কে এ ধরনের বিবরণ কুরআন নাযিলের শত শত, হাজার বছর পুর্বেরও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এ দাবী করা যেতে পারে না যে, পুর্বের যুগে ব্যবসা সংক্রান্ত কারবার ঋণের উপাদান থেকে একেবারে মুক্ত থাকতো। ১[বিশদ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট দুই দ্রষ্টব্য]

আপনার ধারণা এই যে, সুদের ব্যাপারে ক্ষতিকর সাধারণ গুন শুধু অভাবগ্রস্থ লোককে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য ঋণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে উৎপীড়নমূলক হারে সুদ নির্ধারণ করা। কিন্তু আমাদের কাছে এই একটি মাত্র ক্ষতিকারক সাধারণ গুন এতে নেই। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু টাকা ঋণ দিয়ে নিজেদের জন্য একটি নির্দিষ্ট লাভের নিশ্চয়তা লাভ করবে-এটাও একটি ক্ষতিকারক গুন। আর যে সকল লোক এ টাকার সাহায্য নিজের শ্রম, যোগ্যতা মস্তিষ্ক খাটিয়ে মুনাফা লাভের চেষ্টা করবে, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট মুনাফা তো দূরের কথা, কোন মুনাফা লাভেরই নিশ্চয়তা থাকবে না। কুরআন মজীদ যে নিয়ম বলে দেয় তা হচ্ছে এই যে, ঋণ হিসেবে যদি তুমি কাউকে কিছু মাল দাও, তাহলে আসলের উপর অতিরক্ত কিছু নেয়ার অধিকার তোমার নেই, আর যদি ব্যবসায় মুনাফা লাভ করতে চাও, তাহলে সোজাসোজিভাবে স্বয়ং সরাসরি ব্যবসা কর, অথবা ব্যবসায় অংশীদার হয়ে যাও। কুরআনের এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইসলামে অংশীদারিত্ব জায়েজ এবং সুদ নাজায়েজ করা হয়েছে।

(আরবী*******) (সুদের যার কিছু বাকি আছে তা ছেড়ে দাও) এর দ্বারা আপনি যে যুক্তি দিয়েছেন, তা ঠিক নয়। এ শুধু সে সময়ের জন্যে একটি সাময়িক নির্দেশ ছিল না। বরঞ্চ কুরআনের অন্যান্য নির্দেশাবলীর ন্যায় এ ছিল এক চিরন্তন বিধান। যখন এবং যেখানেই কোনো ব্যক্তি ঈমান আনবে, তার উপর এ বিধান প্রযোজ্য হবে। কারো কাছে তার প্রদত্ত ঋণের যদি সুদ পাওনা থাকে, তাহলে তার দাবি ছেড়ে দিতে হবে এবং নিজের দেয়া মূলধন ফেরত পাবার উপরই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। উপরন্তু এ আয়াতের দ্বারা আপনার যুক্তি প্রদর্শন আপনার এ দাবীর উপর প্রতিষ্ঠিত যে, সে সময়ের সকল প্রকারের ঋণ ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদ থেকে মুক্ত ছিল। এ দাবী স্বয়ং প্রমাণ সাপেক্ষ। একে কি করে প্রমাণ রূপে উপস্থাপিত করা যেতে পারে? যে ধরণের ঋণের কথা আপনি বার বার উল্লেখ করেছেন, তা শুধু ব্যক্তিগত ধরণের ঋণই হতে পারতো। তার মধ্যে এ সম্ভাবনাও আছে যে, একজন ছোট ব্যবসায়ী কোনো বড় ব্যবসায়ীর নিকট থেকে ধারে মাল নিয়ে যেতো এবং বড় ব্যবসায়ী তার মালের আসল মুল্যের উপরে সুদও নির্ধারিত করে দিত। তারপর সে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে না পারলে, সে (বড় ব্যবসায়ী) মাল গ্রহীতাকে অধিক অবকাশ দিয়ে সুদের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতো। এ ধরনের সুদের বকেয়া (আরবী.*******) এর হুকুমের আওতায় পড়ে। আপনার কাছে এমন কি প্রমাণ আছে যে, ঐ বকেয়াগুলোর মধ্যে এ ধরণের বকেয়া শামিল ছিল না?

আমার মতে বাণিজ্যিক সুদের হুকুম ‘রিবা’র অধীনে আনা না আনার ভিত্তি যদি শুধু ধারণার উপরেই হয় (যদিও প্রকৃত তা নয়) তথাপি ধারণার উপরে ভিত্তি করে একটি সম্ভাব্য হারামকে হালাল করে দেয়া, তাকে হারাম বলে স্বীকার করে নিয়ে তার থেকে দূরে সরে থাকার চেয়ে অধিকতর বিপজ্জনক। হাদীসের নির্দেশ অতি সুস্পষ্ট যে, (আরবী*******)

-সুদ ছেড়ে দাও এবং সে বস্তুও ছেড়ে দাও, যার মধ্যে সুদ আছে বলে সন্দেহ হয়। এ কথা আমি শুধু আপনার ঐ কথার উত্তরে বলছি যে, বাণিজ্যিক সুদ হারাম করার ভিত্তি শুধু ধারণা মাত্র। নতুবা এই যে, অকাট্য হারাম এবং এর হারাম হবার ভিত্তি শুধুমাত্র যে ধারণা নয়, বরঞ্চ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশ, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

আমি এ কথা জানতে পেরে আনন্দিত হয়েছি যে, আপনি নিজে আপনার প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের ব্যাপারে আমার পরামর্শ মেনে নিয়েছেন। আশা করা যায় যে, অন্ততপক্ষে আপনি সন্দেহজনক মাল দ্বারা উপকৃত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন। খোদা করুন, আপনি অপরের জন্যে একে হালাল করার চিন্তা পরিত্যাগ করবেন এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে আপনার যে অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা লাভ হয়েছে, তাকে একটি সুদহীন অর্থনীতি গঠন করার জন্যে ব্যবহার করবেন।

আপনার শেষ প্রশ্নের জবাব এই যে, আমি (আরবী****) শব্দের অর্থ (আরবী******) (লাভ) শব্দের মুকাবিলায় গোনাহের পরিবর্তে ক্ষতি অর্থ করেছি। ভাষার দিক দিয়ে এটা ভুলও নয়। কারণ (আরবী****) শব্দের প্রকৃত অর্থ বাঞ্ছিত মঙ্গল লাভে অক্ষম হওয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে আরববাসীগণ বলে থাকে (আরবী*******)-ঊটনি মন্থর গতি হয়েছে। যে দ্রুতগতি তাঁর থেকে আশা করা হয়েছিল তাতে সে অক্ষমতা দেখিয়েছে।-( তর্জুমানুল কুরআন-মহররম-সফর, ১৩৭৭ হিঃ অক্টোবর- নভেম্বর, ১৯৫৭ খৃঃ)

———–

পরিশিষ্টঃ দুই

ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থার প্রশ্নমালা ও তার জবাব
(১৯৬০ সালের প্রথম দিকে লাহোরের ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে সুদ সম্পর্কিত কতকগুলো গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন আলোচিত হয়। এ উদ্দেশ্যে সংস্থা একটি প্রশ্নমালা প্রণয়ন করে, যার মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সন্নিবিশিত ছিল। এ প্রশ্নমালা এবং গ্রন্থকার কর্তৃক প্রদত্ত জবাব এখানে লিপিবদ্ধ করা হলো।)

প্রশ্নমালা

একঃ আরবে নবী (স)- এর যমানায় ঋণের আদান প্রদান কিভাবে হতো?

দুইঃ ‘রিবা’ (আরবী****) শব্দের অর্থ কি?

তিনঃ ‘রিবা’ এবং রাবাহ (লাভ)- এর মধ্যে পার্থক্য।

চারঃ ‘রিবা’তে ঋণদাতা শর্ত নির্ধারিত করে এবং ব্যাংকের সুদে (BANK INTRREST) ঋণগ্রহীতা শর্ত পেস করে।

পাঁচঃ বায়-এ-সালাম (আরবী******) ও ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদের ( COMMERCIAL INTEREST) এর মধ্যে পার্থক্য কি? এক ব্যক্তি দশ সের দুগ্ধ প্রদানকারিণী একটি মহিষ অপর এক ব্যক্তিকে দিয়ে বলল, এর দুধের মধ্যে পাঁচ সের করে আমাকে দিতে থাকবে। এ যদি জায়েয হয়, তাহলে এর এবং লাভের উপর টাকা ঋণ দেয়ার মধ্যে পার্থক্য কি?

ছয়ঃ সমশ্রেণীর বস্তুর বিনিময় সমশ্রেণীর আধিক্যসহ কেন নাজায়েয, যখন আধিক্যসহ অসমশ্রেণীর বস্তুর বিনিময় জায়েয?

সাতঃ ব্যবসায়ে উভয় পক্ষের সম্মতি অপরিহার্য কিনা? কারো কারো মতে উভয় পক্ষের সম্মতির অভাবই সুদ সৃষ্টি করে। ক্ষতির কোনো প্রশ্নই ঊঠে না। সুদ হারাম হওয়ার ভিত্তি কি এই যে, এতে এক পক্ষের উপর যুলুম করা হয়? ব্যবসায় সংক্রান্ত সুদে কোনো পক্ষের উপরই যুলুম হয় না। যদি একথা ঠিক হয় যে, কোনো পক্ষের উপরই যুলুম হয় না, তাহলে ব্যাংকের সুদ ‘রিবা’র আওতায় কিভাবে পড়ে?

আটঃ (ক) শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাধারন অংশ

(খ) তাঁর অগ্রগণ্য অংশ (PREFERENCE SHARES)

(গ) ব্যাংকের ফিকস্‌ট ডিপোজিট।

(ঘ) ব্যাংকের দায়পত্র (LETTER OF CREDIT) খোলা, তার বিভিন্নতা। যদি লেটার অব ক্রেডিটের ভিত্তিতে ব্যবসায়ের জন্যে ঋণ গ্রহণ অবৈধ হয়, তাহলে এর জন্যে বৈধ পন্থা কি হতে পারে, যাতে করে ব্যবসার ব্যবস্থাপনায় কোনো অসুবিধা বা ক্ষতি না হয়?

(ঙ) হাউজ বিল্ডিং, ফিনান্স কর্পোরেশন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কর্পোরেশন।

(চ) সরকারের ঋণ-আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক, যদি এসব অবৈধ হয় তাহলে দেশের শাসনতন্ত্র পরিচালনার বিকল্প ব্যবস্থা কি হতে পারে?

জবাবঃ প্রথম প্রশ্ন

প্রথম প্রশ্নে কতকগুলো ব্যাখ্যামূলক বিষয় রয়েছে তা নিম্নরূপঃ

একঃ কুরআন নাযিলের সময় ব্যবসা, শিল্প, কৃষি ও রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যে ঋণের আদান-প্রদান দুনিয়ায় প্রচলিত ছিল কিনা?

দুইঃ এসব ঋণের উপর সুদ গ্রহণ করা হতো কিনা?

তিনঃ এসব উদ্দেশ্যে ঋণের আদান-প্রদান ছিল একথা আরববাসীদের পুরোপুরি জানা ছিল কিনা?

চারঃ এ ধরণের ঋণ আসলের উপর অতিরিক্ত যা কিছু নেয়া হতো তাঁর জন্যে কি ‘রিবা’র পরিভাষা ব্যবহৃত হতো, না তার জন্যে অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করা হতো?

এ ব্যাখ্যামূলক বিষয়াদির আলোচনা করার পুর্বে প্রাক-ইসলামী যুগের আরবের অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং বহির্জগতের সাথে তার সম্পর্ক কি ছিল তা আমাদেরকে দেখতে হবে, যাতে করে এ ভুল ধারণা রয়ে না যায় যে, আরব পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ মাত্র ছিল, যার অধিবাসীবৃন্দ তাদের উপত্যকা ও মরুভূমির বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো আভাসই রাখতো না।

প্রাচীন ইতিহাসের যেসব উপাদান বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান আছে, তার থেকে একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, সে যুগে চীন, ভারত, প্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর এবং অনুরূপভাবে পুর্ব আফ্রিকার যত ব্যবসা-বাণিজ্য মিসর, সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, রোম ও গ্রীসের সাথে চলতো তার সবই আরবের মধ্যস্থতায়ই হতো, এসব ব্যবসা-বাণিজ্যর তিনটি বড় বড় পথ ছিল, একঃ ইরান থেকে স্থল পথে ইরান ও সিরিয়া হয়ে, দুইঃ পারস্য উপসাগর থেকে সমুদ্র পথে। এ পথের সমুদয় পণ্যদ্রব্য আরবের পুর্ব উপকূলে অবতরণ করতো। এবং দুমাতুল জন্দল অথবা তাদমুর (PALMYRA) হয়ে অগ্রসর হতো। তিনঃ তৃতীয় পথ ছিল ভারত মহাসাগর দিয়ে। এ পথে যাতায়াতকারী যাবতীয় পণ্যদ্রব্য হাদারামাওত ও ইয়ামান হয়ে অতিক্রম করতো। এ তিনটি পথেই আরবগণ বসবাস করতো। স্বয়ং আরববাসীগণ এক দিক থেকে পণ্য খরিদ করে অন্যদিকে গিয়ে বিক্রি করতো। পরিবহণের কাজও সমাধা করতো তারাই। উপরন্তু নিজেদের এলাকা দিয়ে অতিক্রমকারী বাণিজ্য বহর বা কাফেলার নিকট থেকে মোটা কর আদায় করে তাদের নিরাপদে যাতায়াতের দায়িত্বও তারা গ্রহণ করতো। এ তিন উপায়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে সর্বদা তাদের গভীর সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। খৃষ্টপুর্ব ২৭০০ সাল থেকে ইয়ামান ও মিশরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সুপষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। খৃষ্টপুর্ব ১৭০০ সালে বণি ঈসরাঈলের বাণিজ্যে বহরের তৎপরতার বিবরণ তওরাতে পাওয়া যায়। উত্তর হেজাজে মাদ্য়ান এবং দেদানের ব্যবসা-বাণিজ্য খৃষ্টের দেড় হাজার বছর পুর্ব থেকে কয়েক শতাব্দী পর পর্যন্ত চলতো বলে জানা যায়। হযরত সুলায়মান (আ) এবং হযরত দাঊদ (আ) এর যমানা (খৃঃ পূঃ ১০০০) থেকে ইয়ামানের সাবায়ী গোত্র এবং তাদের পরে হোমায়রী গোত্র খৃষ্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছিল। হযরত ঈসা (আ) এর নিকটবর্তী সময়কালে ফিলিস্তিনের ইয়াহূদীগণ আরবদেশে এসে ইয়াস্‌রিব, খয়বর, ওয়াদিউল কুরা (বর্তমান আলউলা), তাইমা এবং তাবুকে বসবাস শুরু করে, তাদের স্থায়ী সম্পর্ক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক – সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরের সাথে অক্ষুন্ন থাকে। সিরিয়া ও মিশর থেকে খাদ্যশস্য এবং মদ আরবে আমদানীর কাজ ইয়াহুদীগণই করতো। পঞ্চম খৃষ্টীয় শতাব্দী থেকে কুরাইশগণ আরবের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিকতর অংশ গ্রহণ শুরু করে এবং নবী (স)-এর যমানা পর্যন্ত একদিকে ইয়ামান ও আবিসিনিয়ার সাথে এবং অপরদিকে ইরাক, মিশর ও সিরিয়ার সাথে তাদের বিরাট আকারে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। পুর্ব আরবে ইরানের যত ব্যবসা-বাণিজ্য ইয়ামানের সাথে চলতো, তার বৃহত্তর অংশ হীরা থেকে ইয়ামামা ( বর্তমান রিয়াদ) এবং অতঃপর বনী তামীমের এলাকা অতিক্রম করে নাজরান এবং ইয়ামামা পর্যন্ত পৌছাতো। শত শত বৎসরের এ ধরণের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার পর এ কথা মনে করা সম্পুর্ণ অসংগত হবে যে, বহির্বিশ্বের এসব দেশে যে আর্থিক লেনদেন ও বাণিজ্যিক প্রথা প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আরববাসীগণ অজ্ঞ ছিল।

এসব বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও চতুষ্পার্শস্থ সুসভ্য জগতের সাথে আরববাসীদের গভীর সম্পর্ক ছিল। খৃষ্টপুর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তর হেজাজে তাইমা নামক স্থানটিকে বাবেলের বাদশাহ নেবুনিদুস (NABONIDUS) তার গ্রীষ্মাবাসে পরিণত করেন। এটা কি করে সম্ভব যে, বাবেলে যে অর্থনৈতিক আইন-কানুন ও রীতিনীতি প্রচলিত ছিল, সে সম্পর্কে হেজাজের লোক অবহিত ছিল না? খৃষ্টপুর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে নবী করীম (স)-এর সময়-কাল পর্যন্ত প্রথমত পেট্রার (PETRA)নাবতী রাষ্ট্র, তারপর তাদমুরের সিরীয় রাষ্ট্র এবং পরবর্তীকালে হীরা ও গাস্‌সানের রাষ্ট্রদয় ইরাক থেকে মিশর সীমান্ত পর্যন্ত এবং হেজাজ ও নজদ সীমান্ত থেকে আলজিরিয়া ও সিরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব রাষ্ট্রের একদিকে গ্রীস ও রোমের সাথে এবং অপরদিকে ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। তারপর বংশগত সম্পর্কের ভিত্তিতে আরবের অভ্যন্তরীণ গোত্রগুলোও তাদের সাথে ব্যাপক সম্পর্ক রাখতো। মদীনার আনসারগণ এবং গাস্‌সানের শাসক একই বংশভুক্ত এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল। নবী করীম (স)- এর সময়ে স্বয়ং তাঁর কবি হাসান বিন সাবিত গাস্‌সানের শাসনকর্তাদের নিকটে যাতায়াত করতেন। হীরার শাসকদের সাথে কুরাইশদের অতি ঘনিষ্ঠতা ছিল। এমন কি কুরাইশদের লোকেরা তাদের কাছেই লেখা-পড়া শিক্ষা করে। হীরা থেকেই তারা আরবী লিখন পদ্ধতি শিক্ষা করেছিল যা পরবর্তীকালে কুফী লিখন পদ্ধতি নামে পরিচিত। এখন কিভাবে এ কথা বিশ্বাস করা যায় যে, এসব সম্পর্ক সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এরা গ্রীস, রোম, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিষযাদির সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল।

উপরন্তু আরবের সকল এলাকায় শায়খ, সম্ভ্রান্ত ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিকটে বহুসংখ্যক রোমীয়, গ্রীক এবং ইরানী ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী থাকতো। ইরান ও রোমীয়দের মধ্যে যুদ্ধে উভয় পক্ষের যুদ্ধবন্দীকে গোলামে পরিণত করা হতো। এদের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বহুসংখ্যক ক্রীতদাসকে খোলা বাজারে বিক্রি করা হতো এবং আরব এ দাসব্যবসায়ের বিরাট বাজারগুলোর অন্যতম বাজার ছিল। এসব ক্রীতদাসের মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিত সুসভ্য লোকও থাকতো। তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী এবং শিল্প ব্যবসায়ীও থাকতো। আরবের শায়খ এবং ব্যবসায়ীগণ এদের দ্বারা বহু কাজ করিয়ে নিতো। মক্কা, তায়েফ, ইয়াসরিব এবং অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতে এ ধরণের বহু ক্রীতদাস বসবাস করতো। তারা কারিগর হিসেবে এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রে কর্মী হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবা করতো। অতএব এ কি করে সম্ভব যে, এসব অধীন কর্মচারীদের মাহ্যমে আরব ব্যবসায়ীদের কানে একথা কখনো পৌছায়নি যে, পার্শ্ববর্তী দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো রীতি-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল?

এর সাথে আরবদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের আর একটি দিকও লক্ষ্য করা প্রয়োজন। আরব কোনো কালেই খাদ্যর দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পুর্ণ ছিল না এবং সেখানে এমন কোনো শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি, যার দ্বারা সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেশের মধ্যে থেকেই সংগ্রহ করা যেতো। এ দেশে খাদ্য ও শিল্পজাত দ্রব্যাদি সর্বদা বহির্দেশ থেকে আমদানী করা হতো। এমন কি পরিধাণের বস্ত্রাদি পর্যন্ত বাইরে থেকে আনা হতো। নবী করীম (স)-এর নিকটবর্তী কালে এ আমদানী ব্যবসায় দু শ্রেণির লোকের হাতে ছিল। এক. কুরাইশ ও সাকীফ এবং দুই. ইয়াহুদী। কিন্তু এরা মাল আমদানী করে কেবল মাত্র পাইকারী বিক্রি করতো। দেশের অভ্যন্তরে ছোট ছোট পল্লী ও গোত্রগুলোর মধ্যে খুচরা বিক্রির কাজ তাদের ছিল না। তা সম্ভবও ছিল না। আর গোত্রগুলো কখনোও এটা পছন্দ করতো না যে, ব্যবসায় যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কেবল তারাই ভোগ করবে এবং তাদের আপন লোকদের এ ব্যবসায় ইজারাদারীতে প্রবেশ করার কোনোই পথ থাকবে না। এজন্য পাইকারী বিক্রেতা হিসেবে তারা দেশের অভ্যন্তরে খুচরা বিক্রেতা ব্যবসায়ীদের কাছে লাখো লাখো টাকার মাল বিক্রি করত। এসবের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ধারেও বিক্রি করা হতো। সম্ভবত দুনিয়ার কোথাও পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে নগদ লেনদেনের প্রথা প্রচলিত ছিল না। এ লেনদেনে ধার দেয়া-নেয়া ছিল একেবারে অপরিহার্য যার থেকে গত্যন্তর ছিল না। যদি এরূপ দাবী করা হয় যে, শুধু আরবেই লেনদেন নগদ নগদ প্রদানের শর্তেই হতো এবং বাকী বা ঋণের কোনো রীতিই ছিল না, তাহলে জ্ঞান-বিবেকের দিক দিয়ে তা গ্রহণযোগ্যে হতে পারে না। ইতিহাসের নিরিখেও তা হবে ভুল, যে বিষয়ে আমি সামনে আলোচনা করব।

এখন আমি পুর্বের উল্লিখিত ব্যাখ্যায় আসছি।

একথা ইতিহাস থেকে প্রমাণিত আছে যে, প্রাচীন কালে ঋণ শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই নেয়া হতো না। বরঞ্চ ব্যবসা, শিল্প ও কৃষির উদ্দেশ্যেও এ ঋণের প্রথা প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রগুলোও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ গ্রহণ করতো। এ দাবি ভিত্তিহীন যে, প্রাচীন জগতে ঋণের লেনদেন শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত প্রয়োজনেই হতো। একথাও প্রমাণিত আছে যে, ঋণের উপরে আসল থেকে অতিরিক্ত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অথবা মাল গ্রহণের প্রথাও ছিল। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অথবা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে গৃহীত ঋণের মধ্যে কোনো তারতম্য না করে এ অতিরিক্ত গ্রহণের প্রথা সকল ব্যাপারে প্রচলিত ছিল।

ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার (১৯৪৬) ‘ব্যাংক’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, বাবেল এবং মিসরের মন্দিরগুলো শুধুমাত্র উপাসনালয়ই ছিল না, ব্যাংকও ছিল। বাবেলের পুরাতাত্ত্বিক কীর্তির মধ্যে যেসব মাটির তক্তি বা টাইল পাওয়া গেছে, তার থেকে জানা যায় যে, জমির মালিক তার চাষের পুর্বে কৃষি কাজের জন্য এসব মন্দির থেকে টাকা ঋণ নিতো এবং ফসল কাটার পর সুদসহ এ ঋণ পরিশোধ করতো। এ মহাজনী সুদী ব্যবস্থা খৃস্টপুর্ব ২০০০ সালেও বিদ্যমান ছিল। খৃস্টপুর্ব ৫৭৫ সালে বাবেলে ইজিবি (IGIBI)নামক ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল জানা যায়। এ ব্যাংক জমির মালিকদের কৃষির উদ্দেশ্যে ঋণ দান করতো। এ ব্যাংক লোকের কাছ থেকে টাকা জমা রেখে তার সুদ দিত। মনে রাখতে হবে এ সে সময়ের কথা যখন হেজাজের তাইমা শহর বাবেল সরকারের গ্রীষ্মবাস ছিল। দ্যল্‌ দুরান্ত তার (A HISTORY OF CIVILIZATION ) গ্রন্থে বাবেল সম্পর্কে বলেন, “দেশের আইন অনুযায়ী নগদ টাকার ঋণের উপরে শতকরা বিশ টাকা হারে এবং শতকরা ৩৩ ভাগ বার্ষিক দ্রব্য হিসেবে ঋণের সুদ নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো শক্তিশালী বংশ বংশানুক্রমে সুদী মহাজনী কারবার করতো। তারা শিল্পজীবী লোকদেরকেও সুদে ঋণ দিত। তাছাড়া মন্দিরের পুরোহিতগণ ফসল প্রস্তুতির জন্যে জমির মালিকদের ঋণ দিত।”

এ গ্রন্থকার আরও বলেনঃ

“একটি মহামারির মতো বিস্তারলাভকারী সুদখোরী ব্যবস্থা আমাদের শিল্পের মতো, বাবেলের শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও জটিল ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুষ্টি সাধনের পরিবর্তে নিঃশেষিত করে ফেলতো। বাবেলের সভ্যতা ছিল আসলে একটি বাণিজ্যিক সভ্যতা। সেসব প্রাচীন কীর্তিসমূহ থেকে যত প্রকার তথ্য বর্তমানে পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই ছিল ব্যবসা সংক্রান্ত ধরনের যথা, বিক্রি, ঋণ, ঠিকা, অংশিদারী, দালালী, বিনিময়, একরার নামা, তমসুক এবং এ জাতীয় আরও অনেক কিছু।”১[ ১ম খন্ড, পৃঃ ২২৮-২২৯]

আসিরিয়ার অবস্থাও ভিন্নতর ছিল না। খৃষ্টপুর্ব ৭ম শতাব্দীতে সিনাকারীবের সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে দ্যল দুরান্ত বলেনঃ “ব্যক্তিগত কারবারকারী মহাজনগণ শিল্প ও ব্যবসায়কে কিছু পরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ করে দিত এবং এর জন্যে বার্ষিক শতকরা ২৫ টাকা হারে সুদ আদায় করতো।”২[প্রথম খন্ড পৃঃ ২৭৪]

গ্রীস সম্পর্কে ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার ব্যাংক শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, খৃষ্টপুর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে যেখানে ব্যাংক প্রথার যথারীতি ব্যবস্থাপনা চালু ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ব্যবস্থাপনায় এমনও এক ধরণের ব্যাংক ছিল যা লোকের কাছ থেকে আমানত স্বরূপ সম্পদ গচ্ছিত রাখতো এবং তার জন্যে সুদ প্রদান করতো।

দ্যল্‌ দুরান্ত বলেন যে, খৃষ্টপুর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ডেলফির অ্যাপোলো মন্দির সমগ্র গ্রীক সাম্রাজ্যের আন্তর্জাতিক ব্যাংক ছিল। তার থেকে লোকজন এবং রাষ্ট্রসমূহ একটা পরিমিত হারে সুদসহ ঋণ গ্রহণ করতো। এভাবে বেসরকারী পোদ্দার শতকরা বার থেকে ত্রিশ পর্যন্ত হারে সুদে ব্যবসায়ীদেরকে ঋণ দিতো। গ্রীকগণ এ প্রথা নিকট প্রাচ্যের (বাবেল, মিশর ও ইরাক) নিকট থেকে শিক্ষা করে এবং পরবর্তীকালে গ্রীস থেকে রোম এ প্রথা শিক্ষা করে। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে কতকগুলো বড় বড় বেসরকারী ব্যাংক গ্রীসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার মাধ্যমে এথেন্সের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করে।১[ঐ পৃঃ ২৬২-২৬৩]

তারপর রোমীয় যুগ শুরু হয়। দ্যল্‌ দুরান্ত বলেনঃ

“খৃষ্টপুর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী রোমের ব্যাংক ব্যবস্থা উন্নতির শীর্ষস্থানে উপনীত হয়েছিল। মহাজন লোকের আমানত গ্রহণ করতো এবং তার জন্যে সুদ দিত। কারবারে নিজের মূল্ধনের সাথে অন্যর মূলধনও বিনিয়োগ করা হতো ২.[তৃতীয় খন্ড পৃঃ ৮৮]। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোম সাম্রাজ্যর প্রত্যেক অংশে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকিং- এর অন্যান্য কাজের সাথে লোকের আমানত রেখে সুদ দেয়া হতো এবং অর্থ ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করা হতো। এ কারবার অধিকাংশ গ্রীক এবং সিরিয়দের হাতে ছিল। গলে (GALL) তো সিরিয়াবাসী ও মহাজন সমার্থবোধক শব্দ হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে সরকারী ধনাগারও জমির মালিকদেরকে ফসল জামিনের উপরে সুদে ঋণ দিত। আগষ্টাসের সময় সুদের হার শতকরা চার টাকা হারে নেমে আসে। তার মৃত্যুর পর সুদের হার শতকরা চয় টাকা এবং কনষ্ট্যানটাইনের সময় শতকরা বার টাকা পর্যন্ত বর্ধিত হয়।”৩.[তৃতীয় খন্ড পৃঃ ২৩১-২৩৬]। এ প্রথম শতাব্দী সম্পর্কে ব্যারন (BARON) তার A RELIGIOUS AND SOCIAL HISTORY OF THE JEWS নামক গ্রন্থে বলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার ইয়াহুদী ব্যাংক মালিক আলেকজান্ডার এবং ডিমষ্ট্রীউস ইয়াহুদীয়ার বাদশাহ প্রথম এগ্রিপাকে দু লাখ দিরহাম (প্রায় ত্রিশ হাজার ডলার) ঋণ দিয়াছিল।৪.[ব্যারণ ১ম খন্ড পৃঃ ২৬১]

নবী মুহাম্মদ (স)- এর নিকটতম সময়ে অর্থাৎ তার জন্মের পাঁচ বছর পুর্বে, রোম সম্রাট জাষ্টিনিয়ানের মৃত্যু হয়। এ সম্রাটের রাজত্বকালে সমগ্র বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে আইন করে জমির মালিক ও কৃষকদের গৃহীত ঋণে শতকরা চার, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণে ছয়, ব্যবসা ও শিল্প সংক্রান্ত ঋণে আট এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য সংক্রান্ত ঋণে বারো টাকা হারে সুদ নির্ধারিত করা হয়। এ আইন জাষ্টিনিয়ানের মৃত্যুর পরও কিছুকাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বলবৎ ছিল। ১.[দ্যল্‌ দুরান্ত ৪র্থ খন্ড পৃঃ ১২০, ৩৩৬, গীবন DECLINE AND FALL OF THE RO-MAN EMPIRE ২য় খন্ড পৃঃ ৭১৬]। এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, যে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে এ সুদ প্রথা চালু ছিল, তার সীমান্ত উত্তর হেজাজের সাথে মিলিত হয়েছিল। সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিসরের সমগ্র এলাকা ছিল এ সাম্রাজ্যের অধীন। কুরাইশ বণিকগণ সেসব এলাকার ব্যবসা কেন্দ্রে সর্বদা আনাগোনা করতো। স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (স) বাল্যকাল থেকে নবুয়াত পর্যন্ত সময়-কাল বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে এসব ব্যবসা কেন্দ্রে যাতায়াত করতেন। একথা কি করে মনে করা যেতে পারে যে, কুরাইশ বণিকগণ এবং স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (স) এসব বাজারের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন করা কালে কিছুতেই জানতে পারেননি যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ব্যবসা, কৃষি এবং শিল্পের জন্যে ঋণ আদান-প্রদানের প্রথা প্রচলিত আছে এবং আইনগতভাবে তার জন্যে সুদের হার নির্ধারিত আছে।২.[হেজাজ থেকে কুরাইশের যে কাফেলা ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যেতো তাদের জারীজুরী ও জাকজমকের ধরণ এর থেকে বুঝা যায় যে, বদর যুদ্ধের সময় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যে কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করছিল, তার সাথেই আড়াই হাজার উট ছিল। মনে রাখতে হবে যে, এত বড় কাফেলা নিয়ে যারা গিয়েছিল তাদের সংখ্যা অন্ততপক্ষে দু’আড়াই হাজারের কম হতে পারে না। এখন এ কি ধারণা করা যেতে পারে যে, যেখানে একটি শহরের এত সংখ্যক লোক অন্য দেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য গমন করে তারা এ বিষয়ে মোটেই ওয়াকিবহাল থাকবে না যে, সে দেশে অর্থনৈতিক লেনদেনের কি নিয়ম-নীতি প্রচলিত ছিল?]

ঠিক নবী মুহাম্মদ (স) এর সময়ে রোম এবং ইরানের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল, যার উল্লেখ কুরআন মাজীদে সূরা রোমে রয়েছে। এ যুদ্ধে যখন হিরাক্লিয়াস খসরু পারভেজের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান চালান, তখন তার সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাকে গীর্জাসমূহের সঞ্চিত অর্থ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল। ৩.[Cambridge Economic History of Europe-Vol, 2,P.90(Gibbon Decline and Fall of the Roman Empire Vol. 2, P.791]. যে মহাযুদ্ধ ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত আরবের সমগ্র উত্তরাঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, যাতে ইরানের জয়-জয়কার চারদিকে আলোচনার বস্তু হয়ে পড়েছিল এবং যে যুদ্ধে রোমের পতনোন্মুখ প্রাসাদকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করার পর রোম সম্রাট হঠাৎ খসরুর বিরুদ্ধে বিস্ময়কর অভিযান পরিচালনা করেন। যার ফলে সাসানীর রাজধানী মাদায়েন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, সে যুদ্ধের কথা আরববাসীদের কাছে গোপন থাকবে এবং রোম সম্রাট যে গীর্জাসমূহের কাছ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করেছিলেন, তাও তাদের অজানা থাকবে — এ কথা কি করে বিশ্বাস করা যায়? অগ্নি উপাসকদের হাত থেকে খৃষ্টধর্মকে রক্ষা করার জন্যে এবং শুধু বায়তুল মাকদাসই নয়, পবিত্র ক্রুশকে মুশরিকদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করার জন্যে যুদ্ধ করতে হবে; আর গীর্জার পাদ্রীগণ এ মহৎ কাজের জন্যে সুদে অর্থ ঋণ দেবে, এমন অদ্ভুত ঘটনা লোকের অগোচরে কি করে থাতে পারে? অথচ তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে ছিল দুটো সাম্রাজ্যের যুদ্ধের ফলাফলের উপর। বিশেষ করে কুরাইশগণ তো এ ব্যাপারে অনবহিত থাকতেই পারে না। কারণ সূরা আর রূম নাযিল হবার পর এ রোম-ইরান যুদ্ধের ব্যাপারে হযরত আবু বকর ও কুরাইশ সরদারদের মধ্যে বাজী ধরা হয়েছিল।

এ পর্যন্ত আমি যা কিছু বলেছি তার থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, মধ্য প্রাচ্যের অর্থনৈতিক, তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের সাথে অতি প্রাচীনকাল থেকে আরববাসীদের ঘণিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ ভুখন্ডে আড়াই হাজার বছর থেকে ব্যবসা, শিল্প, কৃষি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে ঋণের লেনদেন এবং তার জন্যে সুদ আদায় করার যে রীতি প্রচলিত ছিল, এ সম্পর্কে আরববাসীদের অনবহিত থাকা এবং কোনোরূপ প্রভাবিত না হবার ধারনাই করা যেতে পারে না।

এখন নবী (স)- এর সময়ের অর্থনৈতিক কারবারের প্রতি লক্ষ্য করুন। আমি পুর্বে বলেছি যে, আরব দেশে খাদ্য এবং মদ প্রধানত ইয়াহুদীগণ আমদানী করতো। অন্যান্য দ্রব্যাদির অধিকাংশ মক্কা ও তায়েফের ব্যবসায়ীগণ বহির্দেশ থেকে আমদানী করতো। আমি এ কথাও বলেছি যে, কুরাইশ সাকিফ এবং ইয়াহুদদের ব্যবসা ছিল পাইকারী। দেশের অভ্যন্তরে খুচরা ব্যবসা করতো অন্য লোক। তারা পাইকারী বিক্রেতাদের কাছ থেকে মাল খরিদ করে নিয়ে যেতো। আমি এ কথাও বলেছি যে, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে নগদ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় দুনিয়ার কোথাও ছিল না। আরবেও তা ছিল না। তারপর নবী করীম (স) এর নিকটবর্তী সময়ে তফসীরকারগণ ‘রিবার’ আয়াতের যে তফসীর করেছেন, তার প্রতিও লক্ষ্য করুন।

(আরবী********)- এ আয়াতের তফসীরে যাহ্‌হাক বলেনঃ

-(আরবী*************)

এটা ছিল সেই সুদ যার মাধ্যমে লোক জাহেলিয়াতের যুগে কেনা-বেচা করতো। কাতাদা বলেনঃ

(আরবী***************)

“জাহেলিয়াতের যুগে সুদ এই ছিল যে, একজন অন্য জনের কাছে মাত্র বিক্রি করতো এবং মূল্য পরিশোধের একটি তারিখ নির্ধারিত করতো। সময় অতিক্রম করলো কিন্তু ক্রেতার মূল্য পরিশোধ করার মতো টাকা হলো না। তখন বিক্রেতা তার উপরে অতিরিক্ত টাকা চাপিয়ে দিত এবং সময় আরও বাড়িয়ে দিত।”১

[এর থেকে একথাও জানতে পারা যায় যে, মূল্য আদায়ের প্রথম যে অবকাশ দেয়া হয় তার জন্যে কোনো সুদ আরোপ করা হতো না। অবশ্যই প্রথম মেয়াদ শেষ হবার পর মূল্য পরিশোধ না করলে দ্বিতীয়বার অবকাশ দিয়ে মূল্যের উপর সুদ চাপিয়ে দেয়া হতো। সমাজে সাধারণত বড় ব্যবসায়ী ছোট ব্যবসায়ীদেরকে তার গ্রাহক করে রাখার উদ্দেশ্যে এ ধরণের সুযোগ দিয়ে থাকতো। ক্ষুধার্ত খরিদদারকে এ ধরণের সুযোগ-সুবিধা কোথাও দেয়া হতো না।] –ইবনে জারীর

সুদ্দী বলেনঃ

(আরবী*************)

এ আয়াতটি আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব এবং বনী মুগীরার জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। এরা উভয়ে জাহেলিয়াতের যিগে ব্যবসার অংশীদার ছিলেন। তারা সাকীফ গোত্রের বনী আমরের লোকের মধ্যে সুদী ঋণে মাল দিয়ে রেখেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাদের বিরাট পুঁজি সুদে লাগানো ছিল।২.[ইবনে জারীর পৃঃ ৭১]

এসব বর্ণণা থেকে জানতে পারা যায় যে,খুচরা বিক্রেতাদেরকে মাল ধারে বিক্রি করে তার উপর সুদ আরোপ করা হতো। আরও জানা যায় যে,এ বাণিজ্যিক সুদের জন্যে ‘রিবার’ পরিভাষাই ব্যবহার করা হতো এবং ‘রিবা’ শুধুমাত্র সেই ঋণের সুদের জন্যে ব্যবহৃত হতো,যা নিরেট ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্যে নেয়া হতো।

অতপর বুখারীতে সাতটি স্থানে১.[বুখারী-কিতাবুয যাকাত, কিতাবুশ শুরুত, কিতাবুল ইস্তিকরায, কিতাবুল কিফালা, কিতাবুল লুকতা, কিতাবুল ইস্তিযান এবং কিতাবুল বুযু।] এবং নাসায়ীর২.[নাসায়ী- কিতাবুল লুকতা] এক স্থানে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ বর্ণণা লিপিবদ্ধ আছে যে,নবী(স)বলেনঃ বনী ইসরাইলের এক ব্যক্তি অন্য এক ব্যক্তির নিকট থেকে ব্যবসার জন্যে এক হাজার দীনার ঋণ গ্রহণ করে।৩.[এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, রেওয়াতে ‘ব্যবসার জন্যে’ কথাটি নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটি কয়েকটি কারণে ভুল। প্রথম কথা এই যে, রেওয়ায়েতে ঋণের জন্যে (আরবী****)ক্রিয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ হচ্ছে টাকা অগ্রিম দাদনের সম অর্থবোধক। এ অর্থ অধিকাংশই ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যপারের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। তারপর ঋণ সে এক হাজার দীনার (প্রায় দশ হাজার টাকা) নিয়েছিল। এটা সত্য কথা যে, এত টাকা অনাহার দূর করার জন্যে নেয়া হয়নি। অথবা কাফনের অভাবে মুর্দা দাফন করা হচ্ছে না। অতএব তার জন্যে এক হাজার দীনার ঋণ নেয়া হচ্ছে, ব্যাপার তাও না। তাছাড়া এ টাকা নিয়ে সে সমুদ্র যাত্রা করেছিল। সেখানে সে এত টাকা রোজগার করলো যে, কাঠের মধ্যে ছিদ্র করে এক হাজার দীনার ঋণদাতার উদ্দেশ্যে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। অতপর বাড়ী পৌছে অতিরিক্ত এক হাজার দীনার নিয়ে ঋণদাতার কাছে উপস্থিত হলো। এর থেকে একথাই কি প্রমাণিত হয় না যে, সে বিলাসিতার জন্যে নয়, বরঞ্চ ব্যবসার জন্যেই ঋণ গ্রহণ করেছিল?] তারপর বলে আমার ও তোমার মধ্যে আল্লাহ্ সাক্ষী এবং তিনিই জামিন।

অতপর সে সমুদ্র যাত্রাই বেরিয়ে পড়লো। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ করার পর জাহাজের অভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে না এবং ঋণ পরিশোধের মুদ্দত শেষ হয়ে যায়। তখন সে এক খন্ড কাঠের মধ্যে একটা ছিদ্র করে তার মধ্যে এক হাজার দীনার রাখলো। ঋণদাতার নামে একখানি পত্র লিখে কাষ্ঠখন্ডের মধ্যে দিয়ে মুখ বন্ধ করলো। তারপর তা সমুদ্রে নিক্ষেপ করে এই বলে খোদার কাছে দোয়া করলোঃ হে খোদা আমি তোমাকেই সাক্ষী এবং জামিন রেখে সেই ব্যক্তির নিকট থেকে দীনার ঋণ নিয়েছিলাম। তুমিই এখন এ অর্থ তার কাছে পৌঁছিয়ে দাও।

আল্লাহ্র কুদরত এই ছিল যে,একদিন ঋণদাতা সমুদ্র তীরে দণ্ডায়মান অবস্থায় এক খন্ড কাষ্ঠ তার কাছে আসতে দেখলো। সে তা উঠিয়ে তার জন্যে ঋণ গ্রহীতার পত্র এবং এক হাজার দীনার পেয়ে গেল।

পরে ঋণগ্রহীতা বাড়ী পৌছে আবার এক হাজার দীনার নিয়ে ঋণদাতার নিকট উপস্থিত হলো। কিন্তু ঋণদাতা সে এক হাজার দীনার নিতে অস্বীকার করে বললো— আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি।

এ বর্ণণা একথারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে,ব্যবসার জন্যে ঋণ গ্রহণের ধারণা সে সময়ে আরববাসীদের কাছে অপরিজ্ঞাত ছিল না।

ইবনে মাজাহ১.[আবওয়াবু ত্তিজারাত, বাবু হুসনিল কাযা।] এবং নাসায়ীতে২.[কিতাবুল বুযু বাবু ইস্তিকরায।] বর্ণিত আছে যে, হুনাইন যুদ্ধের সময় নবী (স) আবদুল্লাহ বিন রাবিয়া মাখযুমীর নিকট থেকে ত্রিশ অথবা চল্লিশ হাজার দিরহাম ঋণ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর সে ঋণ পরিশধ করেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ গ্রহণের এ এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

জনৈক বন্ধু আরও দুটো ঘটনার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার নিকট আমি কৃতজ্ঞ। প্রথম ঘটনা এই যে, হিন্দ বিন ওতবা একবার হযরত ওমর (রা)-এর নিকট থেকে বায়তুলমালের চার হাজার টাকা (সম্ভবত দিরহাম) ব্যবসার জন্যে ঋণ নিয়েছিলেন।৩.[তারিখে তাবারী-হি ২৩ সনের ঘটনা। শিরোনাম-“তার চরিত্র সম্পর্কে পুর্বে বলা হয়নি এমন কতকগুলো ঘটনা।”]

দ্বিতীয় ঘটনাটিও হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফত কালের। তা হচ্ছে এই যে, বসরার গভর্নর হযরত আবু মূসা আশয়ারী হযরত ওমর (রা)-এর দু পুত্র আবদুল্লাহ এবং ওবায়দুল্লাহ ব্যবসা করার জন্যে বায়তুলমাল থেকে টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। অতপর হযরত ওমর (রা) তা জানতে পেরে এটাকে আপত্তিজনক বলে ঘোষনা করেন এবং আসলসহ গোটা মুনাফা ছেলেদের নিকট দাবী করেন। অবশেষে লোকের পরামর্শে এ ঋণকে ঋণের পরিবর্তে কিরাজ (অংশিদারিত্ত) ঘোষনা করে মুনাফার অর্ধেক আদায় করা হয়। ৪.[ঘটনাটি বিবৃত হয়েছে মুয়াত্তায় কিতাবুল খিরাজে ওমর বিন খাত্তাবের চরিত্র শীর্ষক অধ্যায়ে।]

এ দুটো ঘটনাই জাহেলিয়াতের যুগের অতি নিকটবর্তী সময়ের। আরবে নবম হিজরী পর্যন্ত সুদী কারবার চালু ছিল। সুদ বন্ধ হবার দশ বারো বছর পরের এ ঘটনাগুলো। এটা ঠিক যে এত অল্প সময়ের মধ্যে ধারণা বদলে যেতে পারে না। অতএব এসব ঘটনা থেকে এ কথাই প্রমানিত হয় যে, ঋণের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করে ব্যবসা করার ধারণা জাহেলিয়াতের যুগেও বিদ্যমান ছিল। ৫.[এ সম্পর্কে একথা বলা যেতে পারে না, “এমন অনেক ধারনা আছে যা ইসলামের আগমনের পর সৃষ্টি হয়েছে এবং তা জাহেলিয়াতের সময় বিদ্যমান ছিল না। এভাবে এ নতুন ধারনাটিও ইসলামের পরবর্তী কালের।” যদি এমন কথা কেউ বলে, তাহলে আমরা তাকে বলবো, বেশ ভালো কথা। এটা ইসলামোত্তর কালেরই সৃষ্টি। তর্কের স্থলে এ কথা মেনে নিলাম। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঋণের দ্বারা পুঁজি সংগ্রহ করে ব্যবসা করার প্রথা হযরত ওমর (রা) এর সময়ে শুরু হয়েছিল এবং তারপর, যেমন আমি আগে বলেছি, হযরত ইমাম আবু হানিফার সময় পর্যন্ত অবস্থা এতদুর গড়ালো যে, একমাত্র ইমাম সাহেবের ব্যবসাতেই পাঁচ কোটি টাকার পুঁজি ঋণ করে বিনিয়োগ করা ছিল। এখন প্রশ্ন এই যে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আয়েম্মামায়ে মুজতাহেদীন(মুজতাহিদ ইমামগণ) মোট কথা কারো মাথায় একথা কেন এলো না যে, কুরআনের উদ্দেশ্য তো শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের উপর সুদ হারাম করা— লাভজনক কাজে গৃহীত ঋণের উপর সুদ হারাম নয়?]

এখন প্রশ্ন এই যে, ইসলামী যুগের ঐতিহাসিকগণ, মুহাদ্দিস ও তাফসীরকারকগণ ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের পৃথক পৃথক সুস্পষ্ট বর্ণনা কেন করেননি। পরিষ্কার কথা এই যে, তাদের নিকটে ঋণ যে কোন উদ্দেশ্যেই গৃহীত হোক না কেন, তাকে ঋণ বলেই বিবেচনা করা হতো। এবং এর উপর গৃহীত সুদের পজিশনও তাদের দৃষ্টিতে ছিল অভিন্ন। তাঁরা এরূপ কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজনই বোধ করেননি যে, অনাহারক্লিষ্ট মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে ঋণ গ্রহণ করতো। আর না বিশেষ করে এরূপ কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করেছেন যে, ব্যবসার জন্যে লোক ঋণ করতো। এসব ব্যাপারে চুলচেরা বিশদ বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যায়, যার প্রকৃত অবস্থা জানার জন্যে তৎকালীন দুনিয়ার অবস্থা সামনে রেখেই আরবের অবস্থা দেখা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ঋণের মধ্যে তাদের উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে পার্থক্য নির্ণয় করে এক উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের উপর সুদ জায়েয এবং অন্য উদ্দেশ্যে গৃহীত ঋণের সুদ নাজায়েজ হবার ধারণা সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর পুর্বে দুনিয়ার কোথাও বিদ্যমান ছিল।১.[ Henry Pirene Economic And Social History of Medieval Europe) (English Translation) IV, Edition Butler, London 1949, P.140]। সে সময় পর্যন্ত ইয়াহূদী ধর্ম, খৃষ্টান ধর্ম এবং ইসলামের সকল ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ এবং অনুরূপভাবে নৈতিকতার নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, প্রত্যেক প্রকার ঋণের উপর সুদ হারাম।

এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, ইসলামপুর্ব যুগে এটা সম্ভবই ছিল না যে, মানুষ ঋণ করা পুঁজি দিয়ে ব্যবসা করতে পারতো। কারণ দেশে নিয়মতান্ত্রিক কোনো সরকারই ছিল না। চারিদিকে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করতো। বাণিজ্যিক বহরগুলোকে মোটামোটা ট্যাক্স দিয়ে বিভিন্ন গোত্রের এলাকা অতিক্রম করতে হতো এরূপ সংকটপূর্ণ অবস্থার জন্যে সুদের হার শতকরা তিন চারশত টাকায় পৌছেছিল। এমতাবস্থায় ঋণ করে পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করা কিছুতেই লাভজনক হতে পারতো না। কিন্তু ঐতিহাসিক অবস্থার সাথে এ অবাস্তব কল্পনার কোনো মিল নেই। এ নিছক একটি কল্পনা মাত্র যা ইতিহাসকে উপেক্ষা করে— এ ধারণার বশবর্তী হয়ে করা হয়েছে যে, আরবে যখন কোনো নিয়মতান্ত্রিক সরকার বা শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল না এবং চারিদিকে অরাজকতা ছড়িয়ে ছিল, তখন নিশ্চয় তার পরিমাণ তাই হবে। অথচ ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জ থেকে এ কথা জানা যায় যে, ইসলামের নিকটবর্তী সময়ে ইরান ও রোমের ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহাদি ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এবং পুর্ব আফ্রিকার সাথে রোম সাম্রাজ্যের যত প্রকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তার মধ্যস্থতা করতো আরব বণিকগণ। বিশেষ করে ইয়ামানের উপরে ইরানের আধিপত্য বিস্তারের পর রোমীয়দের জন্যে প্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় প্রাচ্যের সমুদয় পণ্যদ্রব্য পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগরে অবস্থিত আরবদের বন্দরসমূহে গিয়ে পৌঁছতো। সেখান থেকে মক্কা হয়ে রোম সাম্রাজ্যে পৌঁছত। এমনি ভাবে রোম সাম্রাজ্যের যাবতীয় পণ্যদ্রব্য কুরাইশদেরই কাফেলা মক্কায় নিয়ে আসতো; অতপর ঐসব বন্দরে পৌছিয়ে দিত, যেখানে প্রাচ্যের বণিকগণ খরিদ করতে আসতো। O’LEARY বলেন যে, সে সময়ে মক্কা ব্যাংকিং কার্যের কেন্দ্র হয়ে পড়েছিল। সেখানে দূরবর্তী দেশের জন্যে টাকা আদান-প্রদান হতো। বলতে গেলে মক্কা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের বাজার হয়ে পড়েছিল।

Mecca had become a Banking centre where payments could be made to many distant lands, and a clearing house of international commerce.১.[Arabia before Mohammod, P.182.]

অবস্থা যদি তাই হতো, যা ধারণা করা হয়েছে, তাহলে এ সমৃদ্ধিশালী ব্যবসা-বাণিজ্য কিভাবে চলতো। অর্থনৈতিক রীতিনীতির মোটামোটি জ্ঞান একথা বুঝবার জন্যে যথেষ্ট যে, যেখানে নিরাপত্তার অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এতটা ব্যয়বহুল ও শংকাপুর্ণ। যার ফলে বাণিজ্যিক সুদের হার শতকরা তিন চারশ টাকায় পৌছে যায়, সেখানে অবশ্যই পণ্যদ্রব্যের ক্রয়মূল্য এতটা বেড়ে যাওয়া উচিত যে, বৈদেশিক বাজারে তা নিয়ে গিয়ে মুনাফাসহ বিক্রি করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। তাহলে এত বর্ধিত মূল্যে খরিদ করা মাল মিসর, সিরিয়ার বাজারে কিভাবে বিক্রি হতো? যেসব অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা আরবে তৎকালে বিদ্যমান ছিল বলে বলা হয়, সেসব থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য সেসব গোত্রই করতো, যারা স্বয়ং ছিল শক্তিশালী। বড় বড় গোত্রের সাথে যারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, সুদে লাখো লাখো টাকার মালপত্র গোত্রসমূহের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বহুসংখ্যক লোককে যারা ব্যবসাসূত্রে বেঁধে রেখেছিল এবং গোত্রীয় সরদারগণকে সব রকমের বিলাস দ্রব্যাদি সরবরাহ করে যারা তাদের বিরাট প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তাছাড়া স্বয়ং গোত্রগুলোর আপন আপন স্বার্থেও এটা দাবী করতো যে, বহির্দেশ থেকে আমদানীকৃত জীবন-যাপনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথা— খাদ্যশস্য, কাপড় প্রভৃতি তাদের নিকটে পৌঁছুক। এজন্য এসব শক্তিশালী গোত্রসমূহ যখন দু আড়াই হাজার উটসহ তাদের বাণিজ্য বহর নিয়ে আরবের পথ দিয়ে চলতো, তখন তাদেরকে তেমন মোটা ট্যাক্স দিতে হতো না। অথবা বিপদাপদ থেকে রক্ষার জন্যে এতটা অধিক ব্যয়ও করতে হতো না যে, পণ্যদ্রব্যের মূল্য লোকের ক্রয় ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতো। বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়াও, আরব দেশের বিভিন্ন অংশে প্রতিবছর বিশটি কেন্দ্রীয় স্থানে নিয়মিত মেলা বসতো। এ সবের বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। আরবের প্রত্যেক স্থান থেকে বহু কাফেলা এসে এসব মেলায় বেচা-কেনা করতো। এসব কাফেলার কোনো কোনোটিতে রোম, ইরান, চীন ও ভারতের ব্যবসায়ীও থাকতো। ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে গণকদের এই যে ক্রমাগত যাতায়াত তা কি করে সম্ভব হতো, যদি আরবের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতটা খারাপ হতো, যতোটা ধারণা করা হয়েছে। ঐতিহাসিকগণ কুরাইশদের ব্যবসা সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, তারা শতকরা একশত ভাগই লাভ করতো। এ ধরণের লাভজনক ব্যবসার জন্যে সুদী ঋণে পুঁজি না পাওয়া এবং সুদের হার শতকরা তিন চার শত হওয়া এক অবোধগম্য ব্যাপার। এ দাবীর অনুকূলে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণও নেই যে, সত্যি সত্যিই আরবে সুদের হার এতটা বেড়ে গিয়েছিল।

জবাবঃ দ্বিতীয় প্রশ্ন

‘রিবা’ (আরবী******) শব্দের অর্থ আরবী ভাষায় আধিক্য, অতিরক্ত, বাড়তি প্রভৃতি। কিন্তু ‘রিবা’ দ্বারা পারিভাষিক দিক দিয়ে যা বুঝায় তা কুরআনেরই নিম্ন শব্দগুলির দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ঃ

(আরবী**********)

“সুদের যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা ছেড়ে দাও — যদি তুমি তওবা কর, তাহলে তুমি মূলধন পাবার হকদার হবে ——আর যদি (ঋণগ্রহণকারী) অভাবগ্রস্ত অপারগ হয়, তাহলে তার সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও।”-(সুরা আল বাকারাঃ ২৭৮ -৮০)

একথাগুলোর দ্বারা বুঝা যায় যে, রিবার এ বিধান ঋণের সাথে সংশ্লিষ্ট আর ঋণে আসলের অতিরক্ত যা কিছু দাবী করা হবে তা হবে ‘রিবা’ সুদ যা ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কুরআন একথা বলেও রিবার মর্ম সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে (আরবী********) আল্লাহ্‌ ব্যবসা(বেচা-কেনা) হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয় যে, সুদে মূলধন ঋণ দিয়ে যা কিছু তার চেয়ে বেশী গ্রহণ করা হয়, তা ঐ মুনাফা থেকে পৃথক যা ব্যবসা ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য থেকে বেশী লাভ করা যায়। অন্য কথায় রিবা হচ্ছে মালের সেই আধিক্য যা ব্যবসার পদ্ধতিতে লাভ করা হয় না। এর উপর ভিত্তি করে মুহাদ্দিশগণ, ফকীহ ও তফসীরকারকগণ এ বিষয়ে একমত যে, কুরআনে সেই রিবাকে হারাম করা হয়েছে, যা ঋণের ব্যাপারে আসলের অতিরক্ত দাবী করা হয়।

প্রথম প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস থেকে প্রমাণ করা হয়েছে যে, কুরআন নাযিলের সময় আরববাসী এ বিষয়ে সম্পুর্ণ অবগত ছিল যে, ঋণের আদান-প্রদান শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই হয় না, বরঞ্চ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এবং জাতীয় উদ্দেশ্যেও হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কুরআন রিবা হারাম করার নির্দেশ দিতে গিয়ে এমন কোনো ইংগিত করেনি যার থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে ঋণসমূহের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং সুদ হারাম করার নির্দেশ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের জন্যে নির্দিষ্ট। আর লাভজনক কাজের উদ্দেশ্যে যে ঋণ দেয়া যায় তার উপর সুদ হালাল। ইসলামের ফকীহগণ প্রথম হিজরী শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত এ মূল নীতির উপর একমত এ (আরবী************) “যে ঋণের সাথে মুনাফা লাভ করা হয়, তাহলো ‘রিবা’ সুদ।” কিছুদুন পুর্ব পর্যন্ত ফকীহগণের এ সর্বসম্মত রায়ের সাথে মতবিরোধ করার কোনো একটি দৃষ্টান্তও ফেকাহর ইতিহাস থেকে প্রমাণ করা যাবে না।

জবাবঃ তৃতীয় প্রশ্ন

আরবী****(সুদ) এবং আরবী ***(লাভ) শব্দদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, ঋণে মাল দিয়ে আসল থেকে অতিরিক্ত গ্রহণ করার নাম হলো রিবা (**)। পক্ষান্তরে আরবী***(রাবাহ) শব্দের অর্থ হলো ব্যবসায়ে নিয়োজিত পুঁজি বা ক্রয়মূল্যর অধিক মূল্যে বিক্রয়ের মাধ্যমে লাভ করা। এর বিপরীত, ক্রয় মূল্য থেকে কমে কোনো পণ্য বিক্রি করাকে ক্ষতি বলা হয়। লিসানুল আরবে (আরবী****) শব্দের অর্থ বলা হয়েছে নিম্নরূপঃ

(আরবী*********)

ব্যবসায়ে লব্ধ অতিরক্ত সম্পদ যা অর্থকে (আরবী******) ও (আরবী*****) বলা হয়। ব্যবসায়ী ব্যবসার লাভ করলে আরববাসী বলে (আরবী********) (তার ব্যবসা লাভযুক্ত হয়েছে) অর্থাৎ সে লাভবান হয়েছে। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেনঃ (আরবী*********) (তারা ব্যবসায় লাভবান হয়নি)।

ইমাম রাগেব (র)-এর মুফরাদাত গ্রন্থে আছেঃ

(আরবী**********)

ক্রয়-বিক্রয়ের যে আধিক্য লাভ হয় তাহলো (আরবী***)(লাভ)।

স্বয়ং কুরআন মাজীদ ‘রিবা’ (সুদ) এবং ব্যবসার মুনাফার মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছে। আরবের কাফেরগণ সুদ হারাম হবার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে বলতোঃ (আরবী*********) (ব্যবসা তো সুদের মতোই) অর্থাৎ ব্যবসায়ে আসল ক্রয়মূল্য থেকে অধিক যে বিক্রয় মূল্য আদায় করা হয়, সেতো ঋণ দিয়ে আসল মূলধন থেকে অধিক টাকা নেয়ার মতোই। কুরআন এর জবাবে বলে দিয়েছেঃ (আরবী**********) (আল্লাহ্‌ কেনা-বেচা হালাল করেছেন এবং সুদ করেছেন হারাম)। অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের আকারে সম্পদে যে আধিক্য হয়, তা এক বস্তু এবং ঋণের আকারে আধিক্য আর এক বস্তু। একটিকে আল্লাহ হালাল করেছেন এবং অন্যটিকে হারাম করেছেন। কেউ মুনাফা করতে চাইলে নিজে ব্যবসা করে অথবা অন্য কারো সাথে ব্যবসায় অংশীদার হয়ে মুনাফা করার পথ তার জন্যে উন্মুক্ত আছে। কিন্তু ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করার পথ বন্ধ।

জবাবঃ চতুর্থ প্রশ্ন

‘রিবার’ (সুদ) সংজ্ঞা এইঃ ঋণের ব্যাপারে আসল থেকে অতিরিক্ত যাকিছু আদান প্রদানের শর্ত হিসেবে আদায় করা হবে তাকেই বলে ‘রিবা’ বা সুদ। এ সংজ্ঞায় এ প্রশ্ন অবান্তর যে, এ ‘রিবা’ ঋণদাতা দাবী করেছে অথবা ঋণগ্রহীতা স্বেচ্ছায় দিতে চেয়েছে। এ প্রশ্ন সুদের আইনসংগত সংজ্ঞার উপর কোনো ক্রিয়া করে না এবং কুরআন অথবা নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে এ বিষয়ে এমন কোনো ইংগিতও পাওয়া যাবে না যে, ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে সুদ দিতে চাইলে তা সুদে পরিণত হওয়া এবং হারাম হবার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য সূচিত হবে। তাছাড়া দুনিয়ার এমন কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি নেই এবং ছিলও না যে, বিনা সুদে ঋণ লাভ করার সুযোগ পেয়েও স্বেচ্ছায় সুদ প্রদানের শর্ত পেশ করবে। ঋণগ্রহীতার পক্ষ থেকে এ ধরণের শর্ত একমাত্র তখনই উপস্থাপিত হতে পারে, যদি কোথাও তার বিনা সুদে ঋণ লাভের আশা না থাকে। সে জন্যে সুদের সংজ্ঞায় এ প্রশ্নের প্রভাব না থাকাই বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু প্রাচীনকালে এবং আজও ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমানত রক্ষার হিসেবে রক্ষিত টাকার সুদ এজন্য পেশ করা হয় যাতে করে লোকে এ সুদের প্রলোভনে তাদের সঞ্চিত টাকা ব্যাংকে জমা দিতে পারে, অতপর ব্যাংকে যাতে কম হারে সুদে গৃহীত টাকা উচ্চ হারে ঋণ দিয়ে লাভবান হতে পারে। এভাবে সুদ প্রদানের আগ্রহ যদি সুদ প্রদানকারীর পক্ষ থেকেই হয় তাহলে সুদ হারাম হবার প্রশ্নে তা বিবেচনাযোগ্য হবার কি সংগত কারণ থাকতে পারে? আমানতী টাকার উপর সুদ দেয়া হয়। তা প্রকৃতপক্ষে এই যে, তা সেই সুদেরই একটা অংশ যা সেই আমানতী টাকা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, ব্যবসার উদ্দেশ্যে এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঋণ দিয়ে আদায় করা হয়। এটা তো ঐ ধরনের অংশ যেমন কোনো ব্যক্তি কারো নিকট থেকে সিঁদ কাটা অস্ত্রপাতি সংগ্রহ করলো তার একটা অংশ ঐ ব্যাক্তিকে দিল, যার কাছ থেকে সে সিঁদ অস্ত্রপাতি নিয়েছিল। এ অংশ এ যুক্তির বলে জায়েয হতে পারে না যে, অংশ প্রদানকারী স্বেচ্ছায় তা দিয়েছে এবং গ্রহণকারী বলপুর্বক তা আদায় করেনি।

জবাবঃ পঞ্চম প্রশ্ন

আরবী****** (বায়-এ-সালাম) এমন এক ধরণের ব্যবসা যা অগ্রিম সওদা করার একটি পদ্ধতি। অর্থাৎ এক ব্যক্তি অন্য এক জনের নিকট থেকে আজ এক বস্তু খরিদ করে তার মূল্য দিয়ে দিল। তারপর একটি সময় নির্ধারিত করে দিল যে, নির্ধারিত সময়ে বিক্রেতা তাকে সে মাল দিবে। যেমন ধরুন, আমি একজনের কাছ থেকে আজ একশ’ থান কাপড় খরিদ করছি এবং তার মূল্যও পরিশোধ করছি। এ শর্তে যে, চার মাস পর সেই থান আমি নিব। এ ক্রয়-বিক্রয়ে চারটি জিনিস অপরিহার্য। একঃ মালের মূল্য সওদা করার আগেই দিতে হবে। দুইঃ মালের গুণাগুণ(QUALITY) সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা যেন ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে, যা পরে বিতর্কের সূত্রপাত করতে পারে। তিনঃ মালের পরিমাণ ওজন, মাপ অথবা সংখ্যা ইত্যাদি যেন সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা হয়। চারঃ মাল ক্রেতার নিকট হস্তান্তর করার সময় নির্ধারিত থাকবে। এর মধ্যেও যেন কোনো অস্পষ্টতা না থাকে, যা পরে বিতর্কমূলক হয়ে দাঁড়ায়। এ সওদার জন্যে যে অগ্রিম মূল্য দেয়া হয়, তাকে কখনো ঋণের পর্যায়ভুক্ত করা যাবে না। বরঞ্চ তা ঠিক সেই রকম যেমন কোনো ক্রেতা লেনদেনে নগদ মূল্য প্রদান করে। ফিকাহ্‌ শাস্ত্রে তার নাম (আরবী***) বা মূল্য, ঋণ নয়। নির্ধারিত সময়ে মাল হস্তান্তর না করা বা অন্য কোনো কারণে এ সওদা বাতিল হলে ক্রেতাকে শুধু আসল মূল্যই ফেরত দেয়া হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুর হকদার সে হয় না। এতে এবং সাধারণ কেনা-বেচায় এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই যে, সাধারণ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা বিক্রেতার নিকট থেকে মাল সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে নেয়। আর (আরবী*****) (বায়-এ-সালামে) এ মাল হস্তগত করার জন্যে ভবিষ্যতে একটি দিন-তারিখ নির্ধারিত করে দেয়। এ ব্যাপারটিকে ঋণ এবং সুদের সংগে জড়িত করার কোনোই সংগত কারণ আমি বুঝতে পারলাম না।

প্রশ্নে মহিষের যে দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে তা হয়েছে তা বায়- এ- সালামের নয় বরঞ্চ অংশীদারিত্বের একটা দিক বা পদ্ধতি। অর্থাৎ মহিষ এক ব্যক্তির,অন্য ব্যক্তি তা নিয়ে কাজ করে এবং দুধ উভয়ের মধ্যে ভাগ করা হয়।


জবাবঃ ষস্ঠ প্রশ্ন

একই জাতীয় বস্তুর নগদ নগদ বিনিময়ে অধিক নেয়া হারাম করার উদ্দেশ্যে ইবনে কাইয়েম এবং অন্যান্যগণ যা বলেছেন, তা হচ্ছে আসলে উপায়ের পথ বন্ধ করা। অর্থাৎ আসল হারাম তো ঋণের সুদ। কিন্তু অধিক গ্রহণের মানসিকতা রুদ্ধ করার

জন্যে একই জাতীয় বস্তুর নগদ বিনিময়ের সময় অধিক নেয়াকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ সত্য কথা যে,একই জাতীয় বস্তু যেমন চাউলের বিনিময় শুধুমাত্র এ অবস্থায় করা যায় যখন একটি উৎকৃষ্ট এবং অন্যটি নিকৃষ্ট হয়। শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্যে এই যে,উৎকৃষ্ট ধরনের এক সের চাউলের বিনিময় নিকৃষ্ট ধরনের সোয়াসের চাউলের দ্বারা করা যাবে না। তা উভয়ের বাজার দরের পার্থক্য যেমনই হোক না কেন। বরঞ্চ এক ব্যক্তি তার চাউল টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে অন্য চাউল টাকা দিয়েই খরিদ করবে। সরাসরি চাউলের সাথে আধিক্যসহ চাউলের বিনিময় সুদখুরীর মূল মানসিকতারই পরিপোষণ করে এবং শরীয়ত প্রণেতা (বিধানদাতা) এরই মূলোচ্ছেদ করতে চান। এ প্রসংগে একথা উল্লেখ যে, ফকীহগণের মধ্যে সুদের প্রশ্নে যত মতভেদ হয়েছে, তা শুধু ‘রিবাল ফজলের’ ব্যাপারেই। কারণ তার হারাম হবার হুকুম নবী করীম (স)-এর শেষ সময়ে দিয়েছিলেন এবং কাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় এ হুকুমগুলো কার্যকর করার উপায়-পদ্ধতি সুস্পষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু ঋণের সুদ সম্পর্কে কথা এই যে, তার অবৈধতা এরা নির্দেশাবলী সম্পর্কে ফকীহগণের মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্যমত ছিল। এ বিষয়টি পরিষ্কার এবং এতে কোনোই জটিলতা নেই।

জবাবঃ সপ্তম প্রশ্ন

ব্যবসায়ে উভয় পক্ষের সম্মতি অপরিহার্য। কিন্তু এ সম্মতি ব্যবসা হালাল হবারও কারণ নয় এবং সম্মতির অভাবে সুদ হারাম তাও নয়। কুরআনে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, সুদ এ জন্য হারাম যে, সুদদাতা তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেয়, যদিও দুনিয়ার কোথাও কেউ স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টিচিত্তে সুদ দেয় না। বিনা সুদে ঋণ পাবার সম্ভাবনা থাকলে কেউ ঋণের জন্যে সুদ দিত না। কিন্তু এ বস্তুর হারাম হবার ব্যাপারে সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্নই অবান্তর। কারণ কুরআন নিরুংকুশভাবে ঐ প্রকার ঋণকে হারাম ঘোষণা করে যাতে আসলের অতিরিক্ত আদায় শর্ত শামিল থাকে। এ শর্ত উভয় পক্ষের সম্মতিতে অথবা অন্য যে কোন প্রকারেই ঠিক হোক না কেন,তাতে কিছু আসে যায় না। এখন কথা হচ্ছে এই যে,বলা হচ্ছে সুদী ঋণ হারাম হবার আসল কারণ অত্যাচার বা জুলুম এবং যে ঋণে সুদ আদায় করতে কোন অত্যাচার হয়না,তা হালাল হওয়া উচিত। এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে,কুরআনের শব্দাবলী থেকে একথা মনে করার কোনো সুযোগই নেই যে,যুলুম আসলে সুদ হারাম হবার কারণ। আর এই যুলুম শব্দের অর্থ আপনি যা খুশী করবেন,তারও উপায় নেই। কুরআন যেখানে এ হারামের কারণ বর্ণনা করছে। সেখানে নিজেই যুলুমের মর্মও সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে। তা হচ্ছে এইঃ

(আরবী*********)

“হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ঐ সমস্ত সুদ ছেড়ে দাও যা এখনো লোকের কাছে অবশিষ্ট আছে। যদি তোমরা মুমিন হও——আর যদি তোমার তওবা কর তাহলে শুধু আসল গ্রহণ করার অধিকার তোমাদের আছে। না তোমরা যুলুম কর আর তোমাদের উপর যুলুম করা হয়”-(সূরা বাকারা: ২৭৮-৭৯)

এখানে দুটো যুলুমের কথা বলা হয়েছে। এক যা ঋণ দাতার ঋণগ্রহীতার উপর করে। দুই যা ঋণগ্রহীতা ঋণদাতার উপর করে; আয়াতের পুর্বাপর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টরুপে জানা যায় যে,ঋণদাতার উপর ঋণ গ্রহীতার যুলুম হচ্ছে–

ঋণদাতার প্রদত্ত আসলটুকুও পরিশোধ না করা ঠিক অনুরূপভাবে ঋণগ্রহীতার উপর ঋণদাতার যুলুম হচ্ছে আসলের উপর অতিরিক্ত দাবী করা। এভাবে কুরআন এখানে সেই যুলুমের অর্থ স্বয়ং নির্দিষ্ট করে বলে দিচ্ছে যা ঋণের ব্যাপারে

ঋণদাতা ও গ্রহীতা একে অপরের উপর করে থাকে। এ অর্থের দিক দিয়ে ইনসাফ এই যে,ঋণদাতা গ্রহীতার কাছ থেকে শুধুমাত্র আসল ফেরত নিবে। আর যুলুম হলো আসলের উপরে অতিরিক্ত আদায় করা। কুরআনের এ পুর্বাপর বক্তব্য অর্থের দিক দিয়ে ততই সুস্পষ্ট যে,ইবনে আব্বাস (রা) এবং ইবনে জায়েদ (রা) থেকে আরম্ভ করে বিগত শতাব্দীর শওকানী ও আলুসী পর্জন্ত সকল তাফসীরকারকগণ এ অর্থই গ্রহণ করেছেন। এ সুদীর্ঘ কালের মধ্যে এমন একজন তাফসীরকার ও পাওয়া যাবেনা। যিনি কুরআন থেকে যুলুমকে সুদ হারাম হবার কারন বলে গ্রহণ করেছেন। আর যুলুমের অর্থ বাইরের কোথাও থেকে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। একটি বাক্যে তার পুর্বাপর বক্তব্য থেকে যে অর্থ প্রকাশ পায় তা উপেক্ষা করে নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোনো অর্থ যোগ করে দেয়া নীতিগতভাবে সর্ম্পূর্ণ ভুল।

এ প্রশ্ন প্রসংগে দাবী করা হচ্ছে যে, বাণিজ্যিক সুদে কোনো পক্ষের উপরেই যুলুম হয় না। একথা আমরা স্বীকার করি না। একজন তার পুঁজি ঋণ নিয়ে নির্দিষ্ট মুনাফা লাভের নিশ্চয়তা লাভ করবে,কিন্তু যারা ব্যবসার জন্যে সময়, শ্রম এবং মস্তিষ্ক খরচ করবে তাদের জন্যে মুনাফা লাভের আদৌ কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না। বরঞ্চ ব্যবসায় ক্ষতি হলেও ঋণদাতাকে সুদসহ আসল পরিশোধ করবে। এটা কি কম যুলুম? সকল বিপদের ঝুঁকি নিবে যারা পরিশ্রম ও কাজ করবে তাদের ঘাড়ে আর মুনাফা লুটবে পুঁজি সরবরাহকারী। এটা কি করে ইনসাফ হতে পারে? এজন্য সুদ সর্বাবস্থায়ই যুলুম,তা সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের উপরে। ইনসাফ এই যে, আপনি যদি ঋণ দেন, তাহলে শুধু আসল ফেরত পাবার নিশ্চয়তা আপনার থাকতে হবে। আর যদি আপনি ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে একজন অংশীদার হিসেবে বিনিয়োগ করুন।

জবাবঃ অষ্টম প্রশ্ন

এ প্রশ্নের জবাব আমি আমার গ্রন্থ ‘সুদের সংস্কারের কার্যকরী পন্থা’ শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে দিয়েছি। এখানে সংক্ষেপে জবাব দিচ্ছিঃ

(ক) শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সাধারণ অংশ সম্পূর্ণ জায়েয কিন্তু শর্ত এই যে, সে সবের ব্যবসা হারাম ধরনের না হয়।

(খ) প্রাধান্যমূলক অংশে (PREFERENCE SHARES) নির্দিষ্ট মুনাফার নিশ্চয়তা থাকে বলে তা সুদের সংজ্ঞায় পড়ে এবং তা নাজায়েয।

(গ) ব্যাংকের নির্দিষ্ট আমানত (FIXED DEPOSITE) সম্পর্কে দু রকম পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যারা শুধু নিরাপত্তার জন্যে তাদের টাকা জমা রাখতে চায় এবং নিজের টাকা কোনো কারবারে লাগাতে ইচ্ছুক নয়,তাদের টাকা ব্যাংক আমানত রাখার পরিবর্তে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করবে,ব্যবসায় খাটিয়ে মুনাফা লাভ করবে এবং আসল টাকা নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দেয়ার নিশ্চয়তা দিবে।

যারা তাদের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসায় লাগাতে চায়,তাদের টাকা আমানত রাখার পরিবর্তে ব্যাংক তাদের সাথে একটা সাধারণ অংশীদারিত্বের চুক্তি করবে। এ ধরনের সমস্ত টাকা ব্যাংকের আওতায় পড়ে এমন বিভিন্ন প্রকারের ব্যবসা, শিল্প, কুষি এবং অন্যান্য কাজে বিনিয়োগ করবে। অতপর এ সামগ্রিক কারবারে যা মুনাফা হবে,তা একটি নির্ধারিত অনুপাতে ঐসব লোকের মধ্যে এমনভাবে ভাগ করে দেবে ব্যাংকের অংশীদারদের মধ্যে যেমনভাবে ভাগ করা হয়।

(ঘ)ব্যাংকের ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার বিভিন্ন উপায় আছে। শরীয়ত অনুযায়ী তাদের অবস্থাও আলাদা ধরনের। যেখানে ব্যাংকের শুধু একটি সার্টিফিকেট দেয়া দরকার যে,অমুক ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য,সেখানে ব্যাংক বৈধভাবেই তার অফিস খরচ বাবদ গ্রহণ করবে,সেখানে সুদ আরোপ তার উচিত হবে না। তার পরিবর্তে বিভিন্ন বৈধ পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ব্যাংকের চলতি হিসেবে (CURRENT ACCOUNT)ব্যবসায়ীদের যে টাকা থাকে,তার কোনো সুদ দেয়া উচিত হবেনা। বরঞ্চ হিসেব রাখার জন্যে পারিশ্রমিক নেয়া যাবে এবং এসব টাকা স্বল্প মেয়াদী ঋণের আকারে বিনা সুদে ব্যবসায়ীদেরকে দেয়া উচিত। এ ধরনের ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক কোনো সুদ গ্রহণ করবে না। অবশ্যি অফিস খরচের জন্যে তাদের কাছ থেকে ফিস নিতে পারে।

(ঙ) সরকার স্বয়ং অথবা তার প্রভাবাধীন যত প্রতিষ্ঠান কায়েম করবে তার থেকে সুদ উপাদার দূরীভূত হওয়া উচিত। এর পরিবর্তে সামান্য মনোযোগ দিয়ে এবং চিন্তা-গবেষণা করে অন্য পন্থা আবিষ্কার করা যেতে পারে যা বৈধ এবং লাভজনক হয়। এ ধরনের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটি সার্বিক আলোচনা এখানে কয়েকটি কথায় সম্ভব নয়। প্রথমত, প্রয়োজন হচ্ছে হারাম বস্তুকে হারাম বলে স্বীকার করা। তার থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছা থাকা চাই। তারপর প্রতিটি কর্পোরেশনের জন্যে একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে যে,কর্পোরেশনের সকল কাজের উপর দৃষ্টি রাখবে এবং দেখবে যে,কোথায় কোথায় তার বিভিন্ন কাজ-কর্ম হারাম পন্থায় কলুষিত হচ্ছে। আর এটাও দেখবে যে,তার বিকল্প কি হতে পারে যা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েয,কার্যকর এবং লাভজনক হয়। পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত পথে আমরা যে চলতে অভ্যস্ত হয়ে এসেছি,সেই পথেই চক্ষু বন্ধ করে চলতে চাই এবং সকল প্রচেষ্টা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করেছি যে,কোনো প্রকারে এ পথ আমাদের জন্যে বৈধ করে দেয়া হোক। সর্বপ্রথম আমাদের এ মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের আরাম প্রিয়তা আমাদেরকে অনুমতি দেয় না যে, আমরা চিন্তাভাবনা ও পরিশ্রম করে কোনো নতুন পথ আবিষ্কার করি। দুর্ভাগ্যের বিষয় অন্ধ অনুকরণের ব্যাধি গোটাজাতিকে সংক্রমিত করে রেখেছে। এ ব্যাধি থেকে কি জুব্বাধারী আর কি সুটবুট পরিধানকারী কেউই আরোগ্য লাভ করছে না।

(চ) দেশের অভ্যণ্তর থেকে গৃহীত সরকারী ঋণের সুদ দেয়া যাবে না। এর পরিবর্তে সরকারের যেসব পরিকল্পনার অধীন ঋণের মূলধন খাটানো হয়,সেগুলোকে একটি মূলনীতির উপর সংগঠিত করতে হবে এবং তার যে মুনাফা হবে,তার থেকে একটা নির্ধারিত অনুপাতে মুনাফা ঐসব লোকের মধ্যে বন্টন করতে হবে যাদের পুঁজি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর যে সময়ের জন্যে তাদের টাকা নেয়া হয়েছিল তার মেয়াদ শেষ হবার পর আসল টাকা ফেরত দিলে,মুনাফা লাভে তাদের অংশীদারিত্ব আপনা আপনি শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থার প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরাট পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না। নির্দিষ্ট হারে সুদে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়, তা পরিবর্তন করে শুধু লাভের অনুপাতের অংশীদারিত্বের রৃপ দিতে হবে।

বিদেশ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়,সে বিষয়টি বেশ জটিল। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব ঋণের যাঁচাই-পর্যালোচনা বিশদভাবে করা না হয়েছে,ততক্ষণ এদের ধরন কি হবে এবং এসব ব্যাপারে অবৈধতা থেকে বাঁচার জন্যে কতদূর কি করা যেতে পারে,তা বলা যায় না। অবশ্যি নীতিগত দিক দেয় যে কথা আমি বলতে পারি তা এই যে,আমাদের সকল মনোযোগ ও প্রচেষ্টা দেশের অভ্যন্তর থেকে সুদ দুর করার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। আর বাইরের দেশগুলোর সাথে সূদী লেনদেন থেকে বাঁচার কোনো উপায় যতদিন না থাকবে,ততদিন এ বিপদ বরদাশত করতে হবে। আমাদের ক্ষমতার সীমা যতটুকু পর্যন্ত,ততটুকু পর্যন্তই খোদার কাছে দায়ী। সে সীমা পর্যন্ত যদি আমরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে পারি,তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে কিছু করলে তার জন্যে ক্ষমা পাবার আশা করতে পারি।–(তর্জমানুল কুরআন মে-জুন-১৯৬০)

———


পরিশিষ্টঃ তিন
সুদ সমস্যা ও দারুল হরব
জনাব মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী মরহুম
(সুদ সম্পর্কে আলেমদের একটি দল আলোচনার এদিকটি ও তুলে ধরেছেন যে ভারত হচ্ছে দারুল হরব এবং দারুল হরবে হরবী অমুসলিমদের নিকট থেকে সুদ নেয়া জায়েয। জনাব গিলানী সাহেব নিম্নের প্রবন্ধে এদিকটা জোরালো ভাষায় তুলে ধরেছেন। পাঠকদের অবগতির জন্য তা আমরা এখানে উদ্ধৃত করেছি। পরবর্তী অধ্যায়ে এর পূর্ণ সমালোচনা আমরা করেছি। তবে কতকগুলো বিষয়ের জবাব যথাস্থানে পাদটিকায় দিয়েছি। এ আলোচনা পাঠ করার সময় মনে রাখতে হবে যে, এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ আমলে-১৯৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে।

অনৈসলামিক শক্তি কর্তৃক অধিকৃত দেশ সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী
এ দেশ দুই ধরনের হতে পারে। এক হতে পারে এই যে, এদেশে ইসলামী হুকুমত কখনো কায়েম হয়নি অথবা হয়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দিতার ফলে এদেশে অনৈসলামী শক্তির অধিকার স্থাপিত হয়েছে। প্রথম অবস্থায়তো এরূপ দেশের অনৈসলামী অধিকারভুক্ত ও অমুসলিম রাজ্য হওয়া সম্মন্ধে কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা। অনৈসলামী রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র কে বলতে পারে? কিন্তু আলোচনা একটু অন্যভাবে শুরু হচ্ছে।

আব্বাসীয় রাষ্টের প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ এবং ফেকাহ প্রনেতা ইমাম শায়বানী এ সম্পর্কে নিম্ন ফতোয়া দিয়েছেন:

(আরবী**********)

দারুল ইসলামে কুফরী আইন জারি হলেই তা দারুল কুফর হয়ে যায়। ফতওয়ায়ে আলমগীরিতে অনৈসলামী আইন জারীর ব্যাখ্যা নিম্নরূপ করা হয়েছে:

(আরবী**********)

অর্থাৎ প্রকাশ্য ভাবে সেই দেশে যদি ইসলামী আইন অনুসারে বিচার-শাসন না হয়।

এর অর্থ এই যে,যে দেশে আল্লাহ তায়ালার কালাম এবং শেষ নবী (স)- এর নির্দেশাবলী থেকে গৃহীত আইন কার্যকর না থাকে,সে দেশই হচ্ছে অনৈসলামী দেশ এবং সে রাষ্ট্রকে অনৈসলামী মনে করতে হবে। সে দেশে আদৌ কোনো আইন নেই,অথবা থাকলে ও তা অনৈসলামী জনমস্তিস্ক ও অনৈসলামী সূত্র প্রসূত আইন। মোটকথা,যে দেশ থেকে ইসলামী রাষ্টের আইন-কানুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং যেখানে অনৈসলামী আইনজারী হয়েছে,না তা আর ইসলামী দেশ থাকে, আর না সে রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র মনে করা যেতে পারে। এ হলো একটি মোটামুটি ব্যাখ্যা। ইমাম শ্রেষ্ঠ আবু হানিফা (র) অধিকতর বিশদভাবে অনৈসলামী রাষ্টের প্রকৃত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ করেছেন:

(আরবী********)

“তিনটি শর্ত ব্যতীত দারুল ইসলাম দারুল কুফর হয়না। প্রথমত যদি কুফরী আইন সেখানে জারী হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যদি সে দেশ কোনো দারুল কুফরের সাথে মিলিত হয়ে যায়। তৃতীয়ত, যদি সে দেশে মুসলমান অথবা জিম্মী পূর্বের মত নিরাপত্তার সাথে বাস করতে না পারে।”

এখন দুনিয়ার অধিকাংশ স্থানেই অনৈসলামী রাষ্ট্র রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রকৃত অবস্থা আমার জানা নেই এবং তাদের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমার নিকটে শরীয়তের কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ও নেই। কিন্তু ভারত ১.[বিভাগ পূর্ব ভারত] আমাদের নিকট বর্তমান রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ এদেশকেই ধরা যাক এবং দেখা যাক যে,ইমাম আবু হানিফা (র) অনৈসলামী রাষ্টের যে আইনানুগ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা এদেশের উপর কতটা প্রযোজ্য।

এতো জানা কথা যে,এদেশে শরীয়তের আইন নয়,বরঞ্চ ব্রিটিশ আইন-কানুন ও শাসন প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ এবং নবী (স)-এর হাদীস থেকে যে ইসলামী আইন প্রণীত হয়, তা এখানে আদৌ প্রতিষ্ঠিত নেই। বরঞ্চ অনৈসলামী মন-মস্তিস্ক (তা সে এক জনের হোক অথবা অনেকের,ভারতীয়ের হোক বা অভারতীয়ের)প্রসূত আইন-কানুন এদেশে জারী আছে। এ দিক দিয়ে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইমাম সাহেবের উপরোক্ত সংজ্ঞার প্রথম কথা অনৈসলামী আইনের বাস্তবায়ন—সর্বতোভাবে এদেশের উপর প্রযোজ্য।

এভাবে দ্বিতীয় শর্ত ও যে এদেশের উপর প্রযোজ্য তাতে কে সন্দেহ পোষণ করতে পারে? ভৌগলিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে কে না জানে যে,ভারতের সীমান্তের অধিকাংশই অনৈসলামী দেশ ও রাষ্টের সাথে মিলিত হয়ে আছে। এমন ভাবে মিলিত যে,উভয়ের মধ্যস্থলে কোনো ইসলামী দেশ নেই। আলমগীরিতে আছে:

(আরবী**************)

“সংযুক্ত না হবার অর্থ এই যে, দারুল কুফর এবং দারুল ইসলামের মধ্যে কোনো ইসলামী শহর না থাকে (শামী থেকে বর্ণিত).”

এদেশের উত্তর এবং পূর্ব দিক তো স্থলসীমান্ত দ্বারা সীমিত। এখন রইলো সমুদ্র সীমান্ত। এ সম্পর্কে কথা এই যে, প্রথমত, আপাত দৃষ্ঠিতে গোটা সমুদ্রের উপর অনৈসলামী শক্তির পূর্ণ অধিকার বিদ্যমান। এমনকি এদের অনুমতি ব্যতিরেকে এসব সমুদ্রে আর কেউ তাদের জাহাজ চালাতে পারেনা। আর যদি এরূপ নয় বলে ও ধরে নেয়া যায়, তথাপি স্থলের সংযোগই তো শর্ত পূরণ করার জন্য যথেষ্ট। উপরন্তু ইসলামী ফকীহগণের সমুদ্র সম্পর্কে ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

(আরবী*********)

লবণাক্ত সমুদ্র অনৈসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হবে ১.[ ইসলামী ফকীহগণ একথা এমন এককালে বলেছিলেন, যখন সমুদ্রে জলদস্যুদের চরম উত্পাত চলছিল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নৌ শক্তি তখন এতটা প্রবল ছিল না যে,সামুদ্রিক পথে পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। এটাকে একটা সাধারণ এবং স্থায়ী নির্দেশরূপে গণ্য করা কিছুতেই ঠিক হবেনা। আজ যদি সমুদ্রের উপরে কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়,যেমন বৃটিশের আছে, তাহলে কেন আমরা তা হাতছাড়া করে পানিকে দারুল হরবের সাথে সংযুক্ত করবো।-(মওদুদী)]

মোট কথা যেভাবেই চিন্তা করুননা কেন,এ শর্তের ব্যাখ্যায় ও কোনো অস্পষ্টতা নেই। ইমাম সাহেবের উদেশ্য এই ছিল যে, যদি চারিদিক থেকে ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত কোনো দেশে অনৈসলামী রাষ্ট্র অধিকার লাভ করে,তাহলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়না এবং এমন মনে করা যায় না যে, সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন। ফকীহগণ এর বিশদ ব্যাখ্যাও করেছেন। সামনে একটি প্রশ্নের আলোচনায় তার কিছুটা আসবে।

এখন তৃতীয় শর্তের কথা। এ কথা সত্য যে, বিভিন্ন আইন ও দন্ড বিধির অধীনে অন্যান্য জাতির সাথে মুসলমানদেরকে ও ফাঁসী দেয়া হয়। আর এ বিষয়ে আদৌ লক্ষ্য করা হয়না যে, ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে এ ব্যক্তি প্রাণদন্ডের যোগ্য কিনা। এভাবে এখানকার বিচারালয়গুলো বর্তমান আইন অনুযায়ী মুসলমানদের সম্পদ অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে এবং এ বিষয়ে লক্ষ্য করা হচ্ছে না যে ইসলামী আইন অনুযায়ী সে ব্যক্তির সম্পদ অন্যকে দেয়া যায়না। আদালত থেকে প্রতিদিন লাখলাখো কোটিকোটি টাকা সুদের ডিক্রী জারী করা হচ্ছে। শুধুমাত্র সুদ কেন, অসংখ্য এমন বিষয় আছে যেখানে ইসলামী আইন অনুযায়ী একজন মানুষের সম্পদ নিরাপদ ও সুরক্ষিত মনে করা হয়। কিন্তু দেশের আইন এ সম্পদের হকদার অন্যকে বানিয়ে দেয়।

এতো গেল জান ও মালের নিরাপত্তার অবস্থা। এখন মান-সম্মানের নিরাপত্তার অবস্থা দেখুন। মুসলমানদের জেল, দীপান্তর,জরিমানা, বেত্রদন্ড প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার দন্ড বিভিন্ন আইনের ধারানুসারে দেয়া হয়। কিন্তু সে সময়ে এটা কি লক্ষ্য করা হয় যে,এসব ব্যক্তির মান-সম্মান ইসলামী আইন অনুসারে ভুলুন্ঠিত হবার যোগ্য ছিল কি? আমি একথা বলতে চাইনা যে,ভারতে মুসলমানদের নিরাপত্তা নেই। কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, তাদের ইসলামী নিরাপত্তা নেই। কারণ স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (র)নিপারত্তার নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করেছেনঃ

(আরবী********)

“সেই নিরাপত্তা যা মুসলমানদের আইন অনুযায়ী হয়।”

আলমগীরিতে এর ব্যাখ্যা বিশদভাবে করা হয়েছে:

(আরবী*********)

“অনৈসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে মুসলমানদের ইসলামের কারণে এবং জিম্মীদের দায়িত্বের চুক্তির কারনে যে নিরাপত্তা ছিল, তা আর নেই।”

প্রকৃত ব্যাপার ও তাই যে,যে দেশে অনৈসলামী শক্তির শাসন কায়েম হয়েছে এবং যে দেশে অনৈসলামী আইন চালু হয়েছে তাকে ইসলামী রাষ্ট্র হবার দাবি করা হাস্যকর মনে হয়। অন্যের দেশকে এবং অন্যের সরকারকে ইসলামী দেশ মনে করার অনুমতি মুসলমানদেরকে দুনিয়ার কোন সরকার দিতে পারে?

ইসলামী ফকীহগন কখনো কখনো এদেশ কে দারুল হরব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সম্ভবত এর থেকেই ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার এই, পূর্ববর্তী ওলামায়ে ইসলাম অধিকাংশ এ ধরনের দেশ সম্পর্কে দারুল ইসলামের বিপরীত দারুল কুফরের পরিভাষা ব্যাবহার করেছেন। এক্ষণি ‘বাদায়ে’ প্রণেতার উক্তির উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। তিনি তাঁর গ্রন্থে সাধারণত দারুল কুফরের পরিভাষা ব্যবহার করেছেন,যার সহজ সরল অর্থ হচ্ছে–যেখানে ইসলামী শাসন নেই। যেখানে ইসলামী শাসন থাকবেনা যে দেশ মুসলমানদের হস্তগত হবেনা, তাকে কি মুসলমানগণ মুসলমানদের সরকার এবং মুসলমানদের দেশ বলবে?

এ হলো প্রথম প্রশ্নের জবাব। এখন দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি।

অনৈসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের জীবন পদ্ধতি
ইসলাম মুসলমানদের স্বাধীন বলে মনে করে এবং স্বাধীনতাকে স্বাভাবিক ও খোদা প্রদত্ত অধিকার বলে স্বীকার করে। সাময়িক ভাবে যদি কোনো মুসলমানদের অনৈসলামী রাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস করার প্রয়োজন হয়, তাহলে সে রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সাথে তার সম্পর্কের ধরনটা কি হবে—এ সম্পর্কে ইসলামী ফকীহগণ ইসলামী আইনের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। বলতে গেলে আইনের দিক দিয়ে তার উপায় একটি এই যে, সেই মুসলমান সে রাষ্ট্রের সাথে একটা চুক্তি করবে যে,সে সেই রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলবে। অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থী কিছু করবেনা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এরূপ মুসলমানকে নিরাপত্তা মুসলমান বলে। কুরআন পাকে চুক্তি সম্পর্কে সাধারণ নিয়ম এইঃ

(আরবী*********)

“যারা তাদের আমানত ও তাদের ওয়াদা-চুক্তির রক্ষনাবেক্ষণ করে।”

(আরবী****)- চুক্তি পূরণ করে।-(সুরা মায়েদাঃ ১)

ইসলাম চুক্তিকে একটা বিরাট দায়িত্ব বলে ঘোষণা করেছে এবং তার জন্যে জবাবদিহি অপরিহার্য। এত হলো সাধারণ চুক্তি সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা। আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট আইন মুসলমানদের উপর নির্ধারিত করা হয়েছেঃ

(আরবী*********)

“যেসব মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছ এবং তারা সে চুক্তির কোনো অংশই লংঘন করেনি এবং তোমাদের মুকাবিলায় অন্য কাউকে সাহায্য করেনি, এমতাবস্থায় তাদের চুক্তি পূরণ কর।”-(সুরা তাওবাঃ ৪)

কোনো চুক্তি না থাকলে অথবা অপরজাতি চুক্তি ভংগ করলে তার জন্য কি করতে হবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই।এখানে ‘চুক্তি আইনের’ শুধু সেই ধারাটি আলোচনা করা হচ্ছে যার ভিত্তিতে চুক্তি পালন করা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হয়ে যায়। যে মুসলমান চুক্তি ভঙ্গ করবে তার পরিণাম কি হবে সে বিষয়ে নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ

“চুক্তি ভঙ্গকারীদের জন্য কিয়ামতের দনে একটা নিশান উড়ানো হবে এবং বলা হবে এ অমুক ব্যক্তির চুক্তি ভঙ্গের নিশান।”

অপর এক বর্ণনায় আছেঃ

“চুক্তি ভঙ্গকারীদের দেহের বিশিষ্ট স্থানে একটি নিশান প্রোথিত করা হবে। এ দ্বারাই কিয়ামতের দিনে তার পরিচয় পাওয়া যাবে।”

নবী (সাঃ) যখন সেনাবাহিনীকে বিদায় দিতেন তখন এরূপ উপদেশ দিতেনঃ

“তোমরা বিশ্বাস ভঙ্গ এবং চুক্তি ভংগ কিছুতেই করবে না।”

এজন্য ইসলামের আলেম সমাজ ‘চুক্তি ভংগ’কে সমবেতভাবে হারাম ফতোয়া দিয়েছেনঃ

“চুক্তি ভংগ সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।”

মুসলমানদের অতুলনীয় শান্তি প্রিয়তাঃ

‘চুক্তি আইন’এর তথ্য অবগত হবার পর যে মুসলমান কোনো অনৈসলামী রাষ্ট্রের সাথে শান্তি চুক্তি করে, তদানুযায়ী ‘নিরাপত্তা প্রাপ্ত (বা মুস্তামান)’ ব্যক্তি হিসেবে বসবাস করতে থাকে, তার দায়িত্ব যে কতটা কঠিন তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হেদায়া গ্রন্থে আছেঃ

“কোনো মুসলমান যখন কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন তার জন্যে সেখানকার অধিবাসীদের জান ও মালে হস্তক্ষেপ করা তার জন্যে জায়েয হবে না। কারণ, (চুক্তির মাধ্যমে) সে এরূপ না করার নিশ্চয়তা দান করেছে এবং শান্তি চুক্তির পর এটা হয়ে পড়ে তার বিরাট দায়িত্ব।”

একথার অর্থ এই যে, যখন কোনো রাষ্ট্রের সাথে কোনো মুসলমান চুক্তি করার পর সেই দেশে যখন সে প্রবেশ করে, তখন ঐ রাষ্ট্র অপরের জান-মাল রক্ষার জন্যে যেসব আইন-কানুন জারী করেছে, তা ভঙ্গ করা তার জন্যে একেবারে নাযায়েয। সে অনৈসলামী রাষ্ট্র যেসব কার্যকলাপকে আইন বিরুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা করার কারণে সে শুধু আইনগত অপরাধীই হবে না, বরং চুক্তি আইন অনুযায়ী সে চুক্তি ভঙ্গের দায়ে অপরাধী হবে। কুরআন, হাদীস এবং সর্বসম্মত ফতোয়া অনুযায়ী যে কাজ হারাম করা হয়েছে, তা করে সে গোনাহগার হবে। কে আছে যে, তার ধর্মে অপর জাতির আইন-কানুন মেনে চলাকে এতোটা প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণ করতে পারে? মুসলমানদের প্রতি শান্তি ভঙ্গের অভিযোগ করা হয়ে থাকে। কিন্তু লোকদের জানা নেই যে, তাদের চেয়ে অধিকতর শান্তিপ্রিয় ও আইনের প্রতি আনুগত্যশীল জাতি দুনিয়াতে আর নেই। পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত আছেঃ

“উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো দল নিরাপত্তার অধিকতর অধিকারী, যদি তোমরা জানো (তো বলো)।”-(সুরা আন আমঃ ৮১)

কতিপয় আলেম সম্ভবত এর উপর ভিত্তি করে ফতোয়া দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ডাকযোগে চিঠি দেয়ার সময় নির্ধারিত ওজনের বেশীর জন্য অতিরিক্ত ডাকটিকেত লাগায় না, বা যে ব্যক্তি বিনা ভাড়ায় নির্ধারিত ওজনের বেশী মাল রেলে বহন করে, সে শুধু দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীই অপরাধী হয় না, বরং আল্লাহর ও তার আপন ধর্মেরও নিকট অপরাধী।

আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
এখানে আইন সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের বিশদ ব্যাখা প্রয়োজন। সাধারণত তা উপলব্ধি না করার জন্যে বিভিন্ন প্রকার ভুল ধারণার প্রচলন আছে। সম্ভবত অন্যান্য আইন সম্পর্কেও এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ইসলামী আইন এ প্রশ্নটি উত্থাপন করেছে। বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে একে অন্যের প্রতি আক্রমণ চালায়। এক জাতি অন্য জাতির জান-মাল, ধন-সম্পত্তি ও অধিকৃত দেশের উপর আক্রম্পণ করে। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয় যে, এ আক্রমণ বৈধ কই অবৈধ এবং বৈধ হলে কি উপায়ে? বরং এই সময়ে আমাদের প্রশ্ন এই যে, এক জাতি অন্য জাতির সম্পদের উপর যে আধিপত্য লাভ করলো তা কি সঙ্গত হলো? অর্থাৎ আইনত ও ধর্মত কি দখলদার জাতি তার মালিক হয়ে গেলো? মনে করুন, কোনো যুদ্ধে ইংরেজ-জার্মান অথবা অন্য কোনো জাতির সম্পদ লাভ করার পর তা মুসলমানদের কাছে বিক্রি করতে চায়। সাধারণত সে সময়ে আইনের প্রতি আনুগত্যশীল একজন পাকা দ্বীনদার মুসলমানের জন্যে এ প্রশ্নের সমাধান প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অন্য জাতির জন্যে এ বিষয়ে কোনো মাথা ব্যাথা হোক বাঁ না হোক, একজন মুসলমান কোনো অধিকারকে ততক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়সঙ্গত মনে করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আইন তার ন্যায়সঙ্গত হবার ফতোয়া না দিয়েছে। তার জন্যে অপরিহার্য যে, সে তার শরীয়তের কাছে জানতে চাইবে যে, ইংরেজ-জার্মানবাসী সে সম্পদের মালিক হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে, তাহলে তার বিক্রি করা এবং আমাদের খরিদ করা ও খরিদ করে নিজের কাজে লাগানো ন্যায়সঙ্গত হবে। কিন্তু ইংরেজ যদি নিজেই অন্যায়ভাবে মালিক হয়ে থাকে, তাহলে তার বিক্রি করার অধিকার নেই। আর তার যদি বিক্রি করার অধিকার না থাকে, তাহলে আমি তা খরিদ করার পর কিরূপে তার মলিক হবো। মোটকথা, আন্তর্জাতিক আইনের এ একটা বড় মজার প্রশ্ন। ইসলামী ফকীহগণ এ সম্পর্কে তাঁদের গ্রন্থে অধ্যায় সন্নিবেশিত করেছেন এবং খুঁটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সারকথা এই যে, এ প্রশ্নের কয়েকটি উপায় আছে। সেগুলো হচ্ছেঃ

একঃ তা হচ্ছে এই যে, কোনো অমুসলিম জাতির ১.[মনে রাখতে হবে যে, আমি অমুসলিম বলতে তাদেরকে বুঝিয়েছি যার মুসলমান নয় এবং কোনো ইসলামী রাষ্ট্র তাদের জান-মালের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি] সম্পদ এভাবে দখল করা হলে ইসলাম এ দখলের পর দখলকারীকে ঐ সম্পদের ন্যায়সঙ্গত মালিক ঘোষণা করে। ফতহুল কাদীরেতে উল্লিখিত আছে যেঃ

“যদি তুরস্কের কাফেরগণ ইউরোপের কাফেরগণের উপর বিজয়ী হয় এবং তাদেরকে বন্দী করে তাদের ধন সম্পদ লুণ্ঠণ করে নেয়, তাহলে তারা তার মালিক হয়ে যাবে।” (-ফতহুল কাদীরঃ ৩য় খণ্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা)

দুইঃ কোনো অমুসলিম জাতি কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের উপর পূর্ণ আধিপত্য লাভ করলো। এমতাবস্থায় ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ও ইমাম আবু হানিফা প্রমুখ ইমামগণের ফতোয়া নিম্মরূপঃ

“আর যদি কাফেরগণ, খোদা না খাস্তা, আমাদের সম্পদ দখল করে বসে এবং তা তাদের নিজ দেশে নিয়ে যায়, তাহলে তারা তার অধিকারী হবে।” (-হেদায়া)

সুতরাং এমতাবস্থায় শুধু অমুসলিমই যে অমুসলিমদের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত মালিক হয়ে যাবে তা নয়, বরং যদি মুসলমানদের সম্পদের উপরে কাফেরগণও পূর্ণ অধিকার লাভ করে, তাহলে ইসলাম এ অধিকারকেও সঙ্গত বলে স্বীকার করে নিয়ে কাফেরদেরকে এ সম্পদের মালিক মনে করে। এটা কি ইসলামের অসঙ্গত আচরণ?

রক্ষিত ও অরক্ষিত সম্পদ এবং তার বৈধতা ও অবৈধতা
যেহেতু শেষোক্ত প্রশ্নে অন্যান্য ইমামগণের সাথে ইমাম শাফেয়ী (র) দ্বিমত পোষণ করেছেন, সে জন্যে ইসলামী ফকীহগণ কুরআন, হাদীস এবং বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সুত্র থেকে এ আইনটির খাঁটি ইসলামী আইন হওয়া সম্পর্কে অত্যন্ত সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করেছেন। কিন্তু প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়ে যায় বলে তা উদ্ধৃত করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে শুধু কুরআন হাদিস থেকে গৃহীত আইনগত সমালোচনারই উল্লেখ করছিঃ

“বৈধ মালের উপর কাফেরদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এজন্য এ অধিকার মালিকানার কারণ হবে।”

এর অর্থ এই যে, মুসলমানদের সম্পদ মুসলমানদের জন্যে তো নিসন্দেহে রক্ষিত। অপর কোনো মুসলমানের সম্পদ অন্যায় ভাবে গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্যে নিষিদ্ধ। কিন্তু অপর জাতির জন্যে এ আইন চলে না। তাদের জন্য তো এ বৈধ হবে। শামী গ্রন্থে আছেঃ

“কারণ সম্পদের নিরাপত্তা তো একটি ইসলামী আইন। অনৈসলামী দেশের বাসিন্দাগণ এ আইনের আওতায় পড়ে না। এজন্য মুসলমানের সম্পদ তাদের জন্যে রক্ষিত নয়। অর্থাৎ তা তাদের জন্যে বৈধ। অতএব তারা তার মালিক হয়ে যাবে।” (–শামীঃ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৭)

এখন স্বাভাবিকভাবেই তৃতীয় উপায়টি সামনে এসে যায়। তা এই যে, এভাবে যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম দেশ ও সম্পদের উপর অধিকার লাভ করে, তাহলে সে তার মালিক হবে কিনা? এ আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি অনুযায়ী এর জবাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যদি অমুসলমান মুসলমানের সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারে তাহলে ধর্ম, দ্বীন, নৈতিকতা ও আইনের দিক দিয়ে এ অধিকার মুসলমানের কেনো হবে না? বাদায়েতে বলা হয়েছেঃ

“অর্থাৎ যে অমুসলমানের জান ও মালের দায়িত্ব কোনো ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহণ করেনি, তার সম্পদ বৈধ। কারণ এ ধরণের অমুসলমানের সম্পদ রক্ষিত নয়।”

কি আশ্চর্যের কথা এই যে, যে জাতি নিজেদের জান ও মালের দায়িত্ব মুসলমানদের উপর অর্পণ করেনি, ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্ব যারা অস্বীকার করে, তাহলে ইসলাম তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করবে না তো কি করবে? তুমি যদি আল্লাহ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন কর তো আল্লাহ কেন তোমার জান-মালের দাতিত্ব গ্রহণে অস্বীকার করবে না? এজন্য কুরআনে উল্লিখিত আছেঃ

“মুশরিকদের দায়িত্ব থেকে আল্লাহ মুক্ত।” (–সুরা আত তাওবাঃ ৩)

দুনিয়ার সকল জাতিই যখন সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে মুসলমানদের জান-মাল ও রাষ্ট্র দখল করে নেয় তখন এছাড়া আর কোনো উপায় হতে পারে কি? কুরআন যেমন স্বয়ং বলেছেঃ

“তারা যদি তোমাদের উপর বিজয়ী হয়, তাহলে তারা তোমাদের শত্রু হয়ে যায়, তোমাদের উপর অত্যাচার করে ও কটূ ভাষা প্রয়োগ করে। তারা তো এটাই চায় যে, তোমরাও কাফের হয়ে যাও” (–সুরা মুমতাহিনাঃ ২)

এ কুরআনের সাক্ষ্য এবং প্রকৃত ঘটনার পরও যদি মুসলমানদের ধর্ম তাদেরকে এ অনুমতি না দিত, তাহলে তা কি অন্যায়? কুরআন অতপর এ নির্দেশ দেয়ঃ

“আহলে কেতাবদের মধ্যে যারে আল্লাহ এবং আখিরাতের উপর ঈমান আনে না এবং আল্লাহ ও তার রাসুল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না এবং যারা সত্য দ্বীনকে তাদের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে না, তাদের সাথে যুদ্ধ কর।” (-সুরা আত তাওবাঃ ২৯)

তাহলে কি তাদের কল্যাণ ইসলামী ফকিহগণ কর্তৃক আলোচিত নীতি বহির্ভূত অর্থাৎ মুসলমানদের রাষ্ট্র ও সম্পদ যেরূপ অমুসলিমদের জন্যে স্বয়ং ইসলামী আইন অনুযায়ী বৈধ হবে তদ্রূপ তারা এবং তাদের সম্পদও আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের শরীয়ত ও আইন অনুযায়ী বৈধ হবে। যদি মুসলমান তার উপর অধিকার লাভ করে তাহলে তারা তার সত্যিকার মালিক হবে এবং তা সকল প্রকার ব্যয় ও হস্তান্তরের অধিকার লাভ করবে।১.[সম্পর্কচ্ছেদ ও যুদ্ধ শুধু সেই সব অমুসলিমদের সাথে যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধরত। কিন্তু যেসব অমুসলমান মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে না এবং যারা জিম্মীও নয় তাদের জন্য এ বিধান নয়; এরূপ মনে করা কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক। (আরবী*******) এ বাক্যে আল্লাহ্‌ তায়ালা বেসামরিক বাণিজ্যিক কাফেলারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিনা? সাহাবাগণের ইচ্ছাও তাই ছিল। এমন করা যদি হারাম হতো, তাহলে কুরআনে এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ে আবু বসীর সাহাবী এবং তাঁর বন্ধুদের জীবিকা নির্বাহ বেসামরিক বাণিজ্যিক কাফেলার অরক্ষিত সম্পদ দ্বারাই হতো, আবু যরও এক সময় এসব সম্পদই ভক্ষণ করতেন। মোটকথা সামরিক হোক অথবা বেসামরিক, আমীরের অনুমতি থাকুক বা না থাকুক, জিম্মী নয় এমন কাফেরের প্রাণ ও সম্পদ হালাল। আবু বকর জাসসান তার তাফসীরে বলেনঃ

(আরবী********) ফকীহগণের মধ্যে এমন কাউকে আমরা জানি না, যিনি যেসব মুশরিক আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করা ছেড়ে দিয়েছে, তাদের সংগে যুদ্ধ করতে নিষেধ করেন। সত্যিই মুসলিমের একটি হাদীস আছেঃ

(আরবী********) রসূলুল্লাহ (স) বলেন, তোমরা যে গ্রাম বা জনপদের উপরেই বিজয়ী হবে, তা তোমরা ভাগ করে নিবে- এতে তোমাদের অংশ আছে। আর আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূল যে গ্রাম বা জনপদ গনীমত স্বরূপ তোমাদেরকে দিয়েছেন, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্‌ ও তার রসূলের জন্যে এবং অবশিষ্ট তোমাদের। কাযী এযায এর ব্যাখ্যায় বলেন, গ্রাম অর্থ যা মুসলমানগণ ঘোড়া অথবা বাহন দ্বারা জয় করেনি। বরঞ্চ সেখানকার অধিবাসী গ্রাম ত্যাগ করে চলে গেছে ও সন্ধি করেছে। এতে ‘ফাই’-এর মতো তাদের অংশ থাকবে। -(গিলানী)

মাওলানা মওদূদীর মন্তব্যঃ- মাওলানার এখানে একটা বড় ভুল হয়েছে। তিনি যুদ্ধরত(Belligerent) এবং যারা যুদ্ধরত নয় (Non-beligerent) – এ দু এর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা ভুলে গেছেন। যুদ্ধরত তো সে জাতি যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। এ জাতির কোন ব্যক্তি বা দল কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত (Combatant) থাকুক বা না থাকুক, সর্বাবস্থায় তার সম্পদ বৈধ। আমরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাগুলো আটক করতে পারি। তাদের লোকজন আমাদের হাতের মধ্যে এলে তাদেরকে ধরে ফেলবো। এবং তাদের সম্পদ হস্তগত করবো। মাওলানা গিলানী যতগুলো দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তা সবই এই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। কিন্তু যে জাতি আমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নয়, তাদের সাথে চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, তাদের সম্পদ আমাদের জন্য বৈধ নয়। কুরআনে এ সম্পর্কে বিশদভাবে বলা হয়েছেঃ

আরবী*********) “আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করেনি- (মুমতাহিনাঃ ৮)।” এটা বিবেক ও ইনসাফের কথা। নতুবা মুসলমানদের জন্যে নিরংকুশভাবে যদি জিম্মী নয় এমন অমুসলিমদের সম্পদ বৈধ হতো, যেমন মাওলানার বিবরণে জানা যায়, তাহলে বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে মুসলিম জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি(আরবী******) হবার পরিবর্তে একটি লুণ্ঠনকারী জাতি বলে গণ্য হবে। অপর জাতির উপর দস্যুবৃত্তি করাই তাদের জীবিকা বলে গণ্য করা হবে এবং তাদের অস্তিত্ব পৃথিবীর জন্য এক সাধারণ বিপদ হয়ে পড়বে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, অমুসলিম যদি মুসলমানদের সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করে তার মালিক হতে পারে, তাহলে মুসলমান তাদের সম্পদ অধিকার করার অনুমতি লাভ করবে না কেন? প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারটিও যুদ্ধাবস্থার সাথে সম্পর্কিত। শান্তির সময়ে ইসলাম স্বীয় প্রজাদেরকে যুদ্ধে লিপ্ত নয় এমন জাতির উপর দস্যুবৃত্তি করার অনুমতি দেয় না। তবে হ্যাঁ অন্য জাতির লোক যদি মুসলমানদের উপর দস্যুবৃত্তি শুরু করে, তাহলে তাদের মধ্যে এবং মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হবে মুসলমানদের জন্যে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ বৈধ হয়ে যাবে। কুরআনে যেখানে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে একথা বলা হয়েছে (আরবী*******) অন্যায়ের সূচনা তাদের পক্ষ থেকে হয়েছে। সুতরাং মুসলমান লুণ্ঠন ও গ্রাস করার কাজ প্রথমে শুরু করবে না। বরঞ্চ সূত্রপাত যখন তাদের পক্ষ থেকে হবে, তখন চুক্তি অবস্থায় (আরবী*******) (তাদের দিকে তা সমানভাবে প্রত্যার্পণ করা) এ বিধানের উপরে এবং পূর্ব থেকে কোন চুক্তি না হয়ে থাকলে যুদ্ধ ঘোষণার উপরে কাজ করতে হবে। অতপর গোটা জাতি যুদ্ধরত বলে গণ্য করা হবে এবং তাদের জান ও মাল বৈধ হয়ে যাবে।]

মূল আলোচ্য বিষয়ে প্রত্যাবর্তন
মোটকথা আসল আলোচ্য বিষয় এই ছিল যে, অনৈসলামী দেশে একজন মুসলমানের জীবন পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত এবং সেখানকার আধিবাসীদের সাথে তার সম্পর্কের ধরনটা কিরূপ হবে? মাঝখানে অন্য একটি প্রশ্নের প্রসংগ এসে গেছে।

কথা তো অতি সাধারণ ছিল। কিন্তু ভুল ধারণা অপনোদনের জন্যে আমাকে আলোচ্য বিষয় থেকে একটু দূরে যেতে হয়েছিল। এখন আমি আমার আসল বক্তব্যের দিকে ফিরে আসছি। আমি বলছি যে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে যে দেশে সে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা গ্রহণ করে প্রবেশ করেছে সে দেশের প্রচলিত আইন পুরোপুরি মেনে চলা। কারো জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর হস্তক্ষেপ করে প্রচলিত আইন ভংগ করা হবে বিশ্বাসঘাতকতা আর বিশ্বাসঘাতকতা করা কুরআন-হাদীস ও সর্বসম্মত মতানু্যায়ী হারাম। মোটকথা, প্রচলিত আইন মেনে চলা তার ধর্মীয় কর্তব্য। আমি বলছি যে, দেশের আইন পরিপন্থী ডাকের খামে বিনা টিকেটে আধা আনা পর্যন্ত ওজন বৃদ্ধি করা এবং রেলে মাল পাঠানোর ব্যাপারে নির্দিষ্ট ওজনের ওপর বিনা ভাড়ায় এক পোয়া ওজন বৃদ্ধি করা জায়েয নয়। এ কারণেই মুসলমান অপেক্ষা অধিকতর শান্তি প্রিয় জাতি ধর্মের দিক দিয়ে আর কেউ হতে পারে না।

কিন্তু প্রশ্ন তখনই উঠে, যখন ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে একটি কাজ নাজায়েয হয়। যেমন ধরুন, সুদের বিষয়টি। সুদের মাধ্যমে অপরের অর্থ গ্রহণ করা ইসলামের লিখিতরূপে হারাম। শুধু জনসাধারণই এ কাজ করতে পারে না, বরঞ্চ সরকারও বিরাট আকারে বিভিন্ন উপায়ে সুদী লেনদেন করে। এ অবস্থাতে মুসলমানদের কি করা উচিত? একথা ঠিক যে, এ অবস্থায় যদি নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান সুদের মাধ্যমে সে দেশের অমুসলিম অধিবাসীদের সম্পদ লাভ করে, তাহলে চুক্তিভংগ, আইন ভংগ অথবা বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে সে অপরাধী হবে না। এ দিক দিয়ে ধর্মত সে চুক্তি আইনে কোনোমতেই অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবে না।

এখন আলোচ্য এই যে, সে কি অন্যের কাছ থেকে এমন কোন সম্পদ হস্তগত করেছে যা দেশের আইন অনুযায়ী বৈধ হলেও ধর্ম ও আল্লাহ্‌ নিষিদ্ধ করেছেন? অথবা অন্য কথায় সে এমন সম্পদ হস্তগত করেছে যা আইনত না হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ, বরঞ্চ রক্ষিত। একটু আগেই আমরা জানতে পারলাম যে, শরীয়ত (ইসলামী আইন) অনুযায়ী এ ধরণের সম্পদ মুসলমানদের জন্য অরক্ষিত এবং বৈধ।১.[যদি মাওলানার এ আইনের ব্যাখ্যা মেনে নেয়া যায়, তাহলে তার অর্থ এই হবে যে, ভারতে কোন অমুসলিমের ধন-সম্পদ যদি লুণ্ঠন করা হয়, চুরি, ঘুষ অথবা আত্মসাৎ করে হস্তগত করা যায়, তাহলে এসব কাজ যে মুসলমান করবে, সে শুধু দেশের আইন অনুযায়ী অপরাধী হবে। আর ধর্মের দিক দিয়ে তাকে গোনাহগার মনে করা হলেও শুধু এ কারণে যে, সে চুক্তি আইনের বিপরীত কাজ করেছে। তাকে এজন্য গোনাহগার মনে করা হবে না যে, সে ঐসব কাজ করেছেন যা ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। উপরন্তু যদি কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে কোন মুসলিম নারী বেশ্যাবৃত্তি করে এবং অমুসলিমদের নিকট থেকে দেহ ব্যবসার বিনিময়ে (নাউজুবিল্লাহ) মূল্য গ্রহণ করে, তাহলে এ বেশ্যাবৃত্তি লব্ধ অর্থ তার জন্যে হালাল ও পবিত্র হবে। কারণ অমুসলিম রাষ্ট্রের আইন তার এ পেশাকে বৈধ মনে করে এবং এ বেশ্যাবৃত্তির জন্যে তাকে লাইসেন্সও প্রদান করে। অতএব সে চুক্তি আইন ভংগের অপরাধে অপরাধী হবে না এবং ইসলামী শরীয়ত যখন জিম্মী নয় এমন কাফেরের সম্পদ বৈধ বলে ঘোষণা করে, যে কোন উপায়েই সে সম্পদ হস্তগত করা হোক না কেন-তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতেও সে হারাম ভক্ষণের অপরাধে অপরাধী হবে না। সম্ভবত মাওলানা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন না। কিন্তু তাঁর যুক্তি প্রদর্শনের ধরণ থেকে এ সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয়।-(মওদূদী) ]

অতপর একজন মুসলমানের করণীয় কি হতে পারে? কুরআন এবং ধর্ম যাকে অরক্ষিত এবং বৈধ বলছে, সে কি আপন ধর্মের বিরোধিতা করে তাকে রক্ষিত ও অবৈধ বলবে? এ এক অবোধগম্য ব্যাপার যে, যে সম্পদকে আইন নাজায়েয বলছে না এবং শরীয়তও হারাম বলছে না, বরঞ্চ তা হস্তগত করার আদেশ করছে, হতভাগ্য মুসলমান সে জায়েযকে নাজায়েয এবং হালালকে হারাম কিরূপে করবে? সে কি রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে অথবা শরীয়তের নির্দেশ ভংগ করবে? এর পরে মুসলমানদের জন্য কোন আশ্রয়স্থল আছে কি?

ইসলামী আইনের এ সংকটজনক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী শরীয়তের সবচেয়ে সতর্ক এবং কিছুসংখ্যক লোকের মত কঠোর ইমাম, ইমামকুল শিরমনী, ধার্মিক প্রবর, তাবেয়ী ও মুজতাহিদ ইমাম আবু হানিফ (র)-এর ফতোয়া ইমাম মুহাম্মদ সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার ‘সিয়ারে কবীর’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেনঃ

(আরবী********)

“যখন মুসলমান নিরাপত্তা চুক্তি করে দারুল হরবে১.[দারুল হরবের অর্থ হলো সেই অমুসলিম রাষ্ট্র যা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধরত, যার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের কোন চুক্তি নেই এবং যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকগণ যুদ্ধাবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ বাণিজ্যের অনুমতিপত্র নিয়ে (Safe conducts of trade Licenses) যুদ্ধের সাথে সম্পর্কহীন (Non-hostile intercourses) এমন কাজ কারবারের জন্যে গমনকারী হানাফী আইনের এ ধারাকে এখন দারুল কুফরের প্রতি আরোপিত করা যায় না। যেখানে মুসলমানদের একটি দল যুদ্ধরত ও নিরাপ্ততাপ্রাপ্ত হিসেবে নয়, বরঞ্চ সে দেশের প্রজা বা নাগরিক হিসাবে বসবাস করে এর আপন সাধ্যমত ব্যক্তিগত আইন মেনে চলার অধিকার থাকে। মাওলানার দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক ভ্রান্তি এই যে, তিনি প্রত্যেক গায়ের জিম্মী কাফেরকে যুদ্ধরত (শত্রু) এবং প্রত্যেক অনধিকৃত দেশকেই দারুল হরব (Enemy country) মনে করেছেন। ইসলামের আন্তর্জাতিক আইনের এটা সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা। অমুসলিমদের জান ও মাল শুধু মাত্র যুদ্ধাবস্থায় বৈধ হয় এবং তাও ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে সে অমুসলিম রাষ্ট্রের মুসলমান প্রজাদের জন্যে নয়, যে রাষ্ট্রকে আপনি হারবী যুদ্ধরত বলেছেন। হানাফী আইনের উদ্দেশ্য শুধু ততটুকু যে, যখন কোন মুসলমান নিরাপত্তা নিয়ে শত্রু দেশে যায়, তখন সে সেখানে অবৈধ চুক্তিতেও ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। দুটো কারণে এ অনুমতি দেয়া হয়। এক এই যে, দুশমনদের সম্পদ আসলে বৈধ। তা বলপূর্বক কেড়ে নেয়া যখন বৈধ। তা বলপূর্বক কেড়ে নেয়া বৈধ, তখন অবৈধ চুক্তি অনুসারে তো অধিকতর জায়েয হওয়া উচিত। দ্বিতীয় কারণ এই যে, যুদ্ধের অবস্থা একটি জরুরী অবস্থা (Emergency) এবং জরুরী অবস্থায় হামার হালাল হয়ে যায়।- (মওদূদী)] প্রবেশ করে তখন সেখানকার অমুসলিম অধিবাসীদের সম্মতিক্রমে যে কোন উপায়ে তাদের সম্পদ হস্তগত করলে তাতে কোন দোষ হবেনা। ২.[এ শব্দগুলোর সাধারণ অর্থবোধ হওয়াটা চিন্তার বিষয়। যদিও ইমাম মুহাম্মদ (র) এরূপ বলেছেন, কিন্তু তা বিনা শর্তে মেনে নেয়া যেতে পারে না। নতুবা মুসলমান দারুল হরবে গিয়ে মদের ব্যবসা করলে, বেশ্যালয় খুলে দিলে অথবা কোন মুসলিম নারী দেহব্যবসা করলে তা জায়েয হবে।-(মওদূদী)] কারণ সে চুক্তি ভংগ না করেই একটি বৈধ বস্তু গ্রহণ করেছে। অতএব এ সম্পদ বা বস্তু তার জন্যে হালাল এবং পবিত্র হবে।”

একথা সুস্পষ্ট যে, এ ফতোয়া এ অন্ধকার যুগের নয় যখন মুসলমান একটি বিজিত জাতি। যে সময়ে ইমাম (র) সাহেব শরীয়ত থেকে আইনের এ ধারাটি রচনা করেছিলেন, তখন কেউ ধারণাই করতে পারেনি যে, মুসলমানদের কাজকর্মে, আকীদা-বিশ্বাসে ও আচার-আচরণে এতটা অবনতি ঘটবে যা ইউরোপের রূপ নিয়ে হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়বে।১.[সম্ভবত ইমাম আবু হানিফা (র)-এর ধারণা ছিলো না যে, যে বিধান তিনি শত্রু দেশে নিরাপত্তা সহকারে গমকারী ব্যবসায়ী অথবা ভ্রমণকারীদের জন্যে দিয়েছিলেন, তা অমুসলিম রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কোটি কোটি মুসলমানদের উপর প্রযোজ্য হবে যারা মুসলিম রাষ্ট্রে এতটুকু স্বাধীনতা অবশ্যই ভোগ করে যাতে তাঁরা ইসলামের অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক বিধান মেনে চলতে পারে। ইমাম সাহেব যে আইন বর্ণনা করেছেন তা শুধু এমন দারুল হরব (যুদ্ধরত দেশ) সম্পর্কে, যেখানে দারুল ইসলামের কোন মুসলমান ব্যবসার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তাসহ গ্রহণ করে। তার এ উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না যে, মুসলমান যেখানে অমুসলিম রাষ্ট্রের অধীনে বিরাট সংখ্যায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে সেখানে তাঁরা ইসলামের অর্থনৈতিক আইন থেকে বেপরোয়া থাকবে এবং যেসব অর্থনৈতিক লেনদেন ইসলাম হারাম করেছে, তা সেখানে কথা যেতে পারে। এখানে বরঞ্চ মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে যথাসম্ভব অনৈসলামিক অরথব্যবস্থা থেকে দূরে থাকা এবং প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের সামগ্রিক শক্তি নিয়োজিত করা। কিন্তু মাওলানা (গিলানী) যেভাবে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা করেছেন, তার মূল এই হবে যে ভারতের কয়েক কোটি মুসলমান নিজেদের জাতীয় শক্তি দেশের অর্থনৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংস্কার সাধনে নিয়োজিত করার পরিবর্তে স্বয়ং এ ভ্রান্ত ব্যবস্থায় মিশে একাকার হয়ে যাবে। – (মওদূদী)] এমন কি মহৎ লোকগণ দাস জাতিকে দাসত্বের খোয়াড়ের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্যে নিজেদের উত্তরাধিকার গওসী ও কুতুবী উত্তরাধিকারে এমন সব বাঘ ছেড়ে দিয়েছেন, যারা সবার উপর অনুগ্রহ করলেও যাদের কর্তব্য ছিল ইবাদত করা তাদের জন্যে কোন অনুগ্রহ নেই এবং কোথাও নেই।

ফকীহগণ যখন এ বিষয়টির উল্লেখ করেন। যেমন ধরুন কোন মুসলিম দেশের উপর অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন মাঝখানে (আরবী*******) (খোদা না করুক, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র কাছে মুসলমানদের এমন দুর্ভাগ্য থেকে আশ্রয় চাই) বাক্যটি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ এমনটি মনে করতেও তাঁরা ঘাবড়িয়ে যেতেন।

এমতাবস্থায় মনে করা যেতে পারে যে, ইমাম আযম কোনো সময়ে প্রয়োজনের সামনে নয়, বরঞ্চ শরীয়তের কঠোর বাধ্য-বাধকতার সামনে মাথা নত করেছেন। আর প্রকৃত ব্যাপার এই যে, শুধু কুরআনই নয় বরঞ্চ নবী মুস্তফা (স) থেকেও প্রামান্য সূত্রে এ ফতোয়ার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আবু বকর সিদ্দিক (রা) রোম-ইরান যুদ্ধের সময় কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর জোর দিয়ে একটি অনৈসলামিক সমাজে অর্থাৎ মক্কা শহরে (তখনও মক্কা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়নি) কুরাইশদের নিকট এই বলে বাজি রেখেছিলেন যে, কুরাআনের ভবিষ্যৎবাণীই সত্যে পরিণত হবে এবং তা যখন সত্যে পরিণত হল, তখন স্বয়ং নবি করীম (সঃ) ঐ বাজির উট নিতে আদেশ দেন এবং তা ওয়ারিশদের নিকট থেকে আদায়ও করা হয়েছিল-(তিরমিযি)। ১.[তিরমিযিতে এইসব বিষয়ের বিশদ বিবরন রয়েছে যে,এ বাজি তখন ধরা হয়েছিল, যখন বাজি হারাম হওয়ার নির্দেশ জারি হয়নি। ইবনে জারিরের তাফসীরেও এর বিশদ বিবরন আছে।তাফসীরে বায়্জাবিতে আছে যে,হজরত আবু বকর (রা)এর বাজির মাল উবাই বিন খালফের নিকট থেকে নিয়ে নবীর খেদমতে পেশ করেন। নবী তা সদকা করে দিতে বলেন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে,এ মাল ছিল মাকরূহ। দুশমনের কাছ থেকে নেয়া হল বটে। কিন্তু নিজের জন্য তা ব্যবহার করা সমীচীন মনে করা হল না।-(মওদুদী)]

ইসলামী ফকিহগণ এই ঘটনা থেকে এই আইনের সত্যতা ঘোষণা করেন। নতুবা এই কথা সুস্পষ্ট যে, এ ধরনের বাজি রাখা সুস্পষ্ট জুয়া-যার হারাম হওয়া কুরআন থেকে প্রমাণিত আছে।

দারুল হরবে সুদ হালাল নয় ‘ফাই’ হালাল
লোকের মধ্যে এই এক অদ্ভুত কথা প্রচলিত আছে যে,অনৈসলামিক রাষ্ট্রে সুদ হালাল হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসল সমস্যা বুঝতে এ ব্যাখ্যাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। নতুবা এই মাসয়ালাটির বুনিয়াদ কুরআনের যে আইনটি, তদনুযায়ী এই কথা বলা ভুল যে, যে জিনিস একদা হারাম ছিল তা হালাল হয়ে গেছে। অথচ ব্যাপার এইযে, যে জিনিস বরাবর হালাল ছিল তাই হালাল হয়েছে আল্লাহ যে বস্তুকে হালাল ও পবিত্র ঘোষনা করেছেন ইমাম আজম তাকেই পবিত্র বলেছেন। নতুবা একজন মুসলমানের কি অধিকার আছে যে, যে বস্তুকে কুরআন হারাম করেছে তাকে নিজের খেয়াল খুশি মত অথবা সাধারন আনুমানিক তথ্যের উপর নির্ভর করে হালাল করে দিবে? বিশেষ করে এমন এক ব্যক্তি যে ‘খবরে ওয়াহিদ’ (এক ব্যক্তির বর্ননা) এ নির্ভর করে কুরআনের সিদ্ধান্তের উপর কিছু বাড়িয়ে দেয়া কিছুতে জায়েজ মনে করে না। এজন্য আরবি (আরবী*******) (প্রচলিত আইনের বৈধকৃত যে কোনো পন্থায় সে মাল পাওয়া যাক না কেন) এ সাধারন নীতি ছাড়াও ইমাম আবু হানিফা শুধু সুদকেই নয় বরঞ্চ জুয়ার ওইসব পন্থায়ও সম্পদ লাভ বৈধ বলেছেন যা প্রচলিত আইনে বৈধ নয়। দৃষ্টান্তসরূপ জীবন বিমার কথাই ধরা যাক। ২.[হানাফি ফেকাহ মতে দারুল হরবের যেসব বিধান যুদ্ধ সম্পর্কিত তা ভারতের উপর আরোপ করে মাওলানা মারাত্তক ভুল করেছেন।তার অর্থ এই দাড়ায় যে,ভারতে জুয়া,ফটকাবাজি,লটারি,ঘোড় দৌড় প্রভৃতির মাধ্যমেও মুসলমান অর্থ উপার্জন করতে পারে আর এই লব্ধ অর্থ তার জন্য পবিত্র।এর উপরে যদি ফতোয়া হয়ে হয়,তাহলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মুসলমান অমুসলমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না এবং অর্থনৈতিক জীবনে ভারতের সকল মুসলমানঅমুসলমান হয়ে পড়বে। আসল ভুল এইযে,মাওলানা এমন প্রত্যেক অমুসলমানের সম্পদ বৈধ মনে করেছেন যার কোনো দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহন করেনি।অথচ এইরূপ ধারনার পেছনে কুরআন ও হাদিসের কোনো সমর্থন নেই।দ্বিতীয় ভুল এই যে,ইসলামী পরিভাষায়,যে দারুল কুফর দারুল হারব নয়,তাকে তিনি দারুল হরব বলছেন।এটা শুধু অপব্যাখ্যাই নয়।বরঞ্চ পরিনামের দিক দিয়ে মুসলমানদের জন্য জাতীয় জীবনে জন্য ধংসাত্মকও বটে।ভারত নিসন্দেহে সে সময় দারুল হরব ছিল,যখন ইংরেজ সরকার এখানে ইসলামী রাষ্ট্র বিনাশ সাধনের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সে সময়ে মুসলমানদের কর্তব্য (ফরজ)ছিল,ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া অথবা অকৃত্কার্জ হওয়ার পর এখান থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে যাওয়া।কিন্তু যখন তারা পরাজিত হল,এখানে ইংরেজ সরকার প্রতিষ্ঠিত হল এবং মুসলমানগন তাদের ব্যক্তিগত আইন পালন করার স্বাধীনতাসহ এখানে বসবাস করা স্বীকার করে নিল,তখন এই দেশ আর দারুল হরব রইল না।বরঞ্চ এমন এক দারুল কুফর হয়ে গেল, যেখানে মুসলমানগন নাগরিক হিসেবে বসবাস করে এবং দেশীয় আইনের নির্ধারিত সীমা রেখার মধ্যে নিজেরদের ধর্ম-কর্ম মেনে চলার স্বাধীনতা ভোগ করে।এমন দেশকে দারুল হরব বলে ঘোষনা করা এবং দারুল হরবে মুসলমানদের জন্য নিছক জরুরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে সেসব এখানে প্রয়োগ করা ইসলামী আইনের মূলনীতির সম্পুর্ন পরিপন্থী ও অত্যন্ত বিপদজনকও। আর পরিনাম ফল এই হবে যে,অ দেশে ইসলামী আইন মেনে চলার যে যৎকিঞ্চিত অধিকার রয়েছে,তা তারা নিজেরাই ছেড়ে দেবে।শরিয়তের যে অবশিস্ট সীমারেখাটুকু তাদের জাতীয় সত্তাকে রক্ষা করে চলেছে,তাও আর টিকে থাকবে না।ফলে মুসলমান অনৈসলামিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে মিশে যাবে।যাদের কোনো সামাজিক ও সামগ্রিক শক্তি নেই এবং যারা চারদিক থেকে দুশমন কর্তৃক পরিবেষ্টিত, মুসলিম জাতির এরূপ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদেরকে অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় ইসলাম তার আইনের কঠোরতা শিতিল করে কিছু সুযোগ-সুবিধা দান করে।তার সাথে এই আদেশও দেয় যে, এ অবস্থায় তারা যেন নিশ্চিন্তে বসে না থাকে,বরঞ্চ যত শীগ্রই সম্ভব দারুল ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। মাওলানা এই সুযোগ-সুবিধাগুলোকে এমন এক জাতির জন্য সাধারন করে দিচ্ছে যারা সংখ্যায় কয়েক কোটি এবং এ দেশের স্থায়ী অধিবাসী।দারুল হরবের বিধান এই জাতির জন্য কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। ইসলামী বিধানগুলোতে যেগুলো যত বেশী পরিমানে সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করাই শুধু তাদের উচিত নয় বরঞ্চ তাদের উচিত দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে রুপান্তরিত করার জন্য সকল শক্তি নিয়োগ করা। -(মওদূদী)] আলেম সমাজের মতে এই হচ্ছে জুয়া, আর সুদের এক সংমিশ্রিত রূপ। কিন্তু সিয়ারে কবিরে ইমাম মুহাম্মদ আজমের বরাত দিয়ে বলেনঃ

(আরবী*******)

যদি অমুসলিমদের কাছ থেকে জুয়ার মাধ্যমে সম্পদ লাভ করা হয়, তাহলে তার সবটুকুই তার জন্য হালাল ও পবিত্র হবে।

সুদের খ্যাতির কারনে সম্ভবত ঈমাম মাকহুলের সেই মুরসাল হাদিস যা এই মাসালার সমর্থনে পেশ করা। মাকহুল মুহাদ্দিসগণের মতে একজন নির্ভরযোগ্য রাবী।তার বর্ণিত হাদিসটি এইঃ

(আরবী********)

“নবী করীম (স) বলেন যে, হরবী অমুসলমান ও মুসলমানের মধ্যে দাস বলে কিছু নেই।“

লোক এর কি অর্থ গ্রহন করে জানি না। নতুবা প্রকাশ্য শব্দ গুলার দ্বারা যা কিছু বুঝতে পারা যায় তাহচ্ছে এই যে, একজন মুসলমান ও জিম্মি নয় এমন একজন অমুসলমানের মধ্যে যদি সুদের লেন-দেন হয়, তাহলে তা সুদ হবে না। বরঞ্চ কুরআনের বৈধতা আইন অনুযায়ী এ মাল মুসলমানের জন্য হালাল ও পবিত্র।

মোটকথা, ইসলামী শরিয়ত,কুরআন,হাদিস ও সাহাবাগণের কার্যকলাপ অনুযায়ী এ এমন একটি সুস্পষ্ট আইন যা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। লোক মাকহুলের মুরসাল হাদিসটির বিশ্বস্থতা ও অবিশ্বস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উথাপন করে। অথচ এই সব তো (প্রসংগটির) সমর্থনে পেশ করা হয়। নতুবা ব্যাপার এই যে, এই ধরনের সম্পদের হালাল হবার বিধানতো কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লামা ইবনে হুমাম ঠিকই বলেছেনঃ

(আরবী********)

“পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ব্যাপার এই দাড়ায় যে,মাক্হুলের বর্ননা যদি উদ্বৃত না-ই হয়,তথাপি উপরে বর্ণিত চিন্তা-ধারা এর অনুমতি দেয়।”-(ফতহুল কাদির খঃ ৭ পৃষ্ঠা ১৭৮)

‘বাদাএ’ -র গ্রন্থাগারের উপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানিফা (র) এর মতের সঠিক ব্যাখ্যা নিন্মরূপ করেছেন:- (আরবী********)

“এর উপর ভিত্তি করে এই ফতোয়া যে, যদি কোনো মুসলমান অথবা জিম্মি দারুল হরবে শান্তি চুক্তি সহকারে প্রবেশ করে এবং কোনো অমুসলিমের সাথে সুদের কারবার করে অথবা এমন কোনো কারবার করলো যা ইসলামী আইন অনুযায়ী অবৈধ,তাহলে সে কারবার জায়েজ হবে।”

‘ফাই’ ও ‘ফাও’-এর পরিভাষা
এজন্য আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান মতে এধরনের সকল উপার্জিত অর্থ বা সম্পদ যা অনৈসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানদের হস্ত গত হয়,তাকে সুদ জুয়া প্রভৃতি নাম অভিহিত করার পরিবর্তে তার একটি বিশিষ্ট নাম ‘ফাই’ রাখা যেতে পারে।

যার অর্থ এই যে, সে অর্থ বা সম্পদ কোনো প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ ব্যতিরেকেই অন্য জাতির নিকট থেকে শান্তিপুর্ন উপায়ে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মুসলমানদের হস্তগত হয়। ১.[শামি গ্রন্থে আছেঃ

(আরবী********)

“যুদ্ধ না করে এবং বল প্রয়োগ না করে যাকিছুই তাদের (অমুসলমানদের) কাছ থেকে নেয়া হবে,যেমন,কর অথবা সন্ধির টাকা, তা গনিমতের মাল ও হবে না এবং ‘ফাই’ ও হবে না। কিন্তু তার উপরে ফাই-এর বিধান বর্তাবে।”

ফতহুল কাদিরে আছেঃ

(আরবী********)

“কাষ্ঠ সংগ্রহ করা এবং মাছ শিকার করা যেমনি জায়েজ, তেমনি এই ধরনের উপার্জিত মালও জায়েজ।”

সুবুলুস সালাম গ্রন্থে ‘ফাই’ এর সংজ্ঞা নিম্ন রূপ বর্ননা করা হয়েছেঃ

(আরবী*******)

“যুদ্ধবিগ্রহাদী ও জিহাদ না করেই মুসলমানগন কাফেরদের নিকট থেকে যে সম্পদ লাভ করে,তাহলো ‘ফাই’।”

বনী নজিরের ভূসম্পত্তি সম্পর্কে কুরআন বলেঃ

(আরবী********)

“যার জন্যে ঘোড়া এবং উটের সাহায্যে তোমরা চেস্টা-চরিত্র করনি।”

সমস্ত হাদিস গ্রন্থেই আছে যে, এই ফাই-এর অর্থ দ্বারাই নবী পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যয় বির্বাহ করা হতো। -(গিলানি) ] আমার মনে পড়ছে যে, হিন্দিতে ‘ফাও’ বলে একটি শব্দ আছে যার যার উচ্চারন প্রায়ই ‘ফাই’ এর মতো। আর সম্ভবত কিছুটা অর্থ সেই অর্থই প্রকাশ করে। বিশিষ্ট লোকেরাতো এইসব উপার্জনকে ফাই-এর উপার্জনই বলবে।কিন্তু সাধারন লোক (আরবী) অক্ষর উচ্চারন করতে না পারলে ‘ফাও’ বলবে। এ পরিভাষা নির্ধারন করার একটা বিশেষ প্রয়োজন ও আছে। কারন কতিপয় নির্ভরযোগ্য মুসলমানের পক্ষ থেকে এই মাসয়ালাটির ব্যপারে কিছু আশংকা প্রকাশ করা হয়। তাদের ধারনা এই যে, যদি এই মাসয়ালাটি ঘোষনা করা হয়, তাহলে সম্ভবত দীর্ঘদিন পরে মুসলমানগন এই কথা ভুলেই যাবে যে, সুদ, জুয়া, প্রভৃতি দ্বারা উপার্জন শরিয়তে হারাম ছিল কিনা। এজন্য আমার ধারনা এইযে, এসব লব্ধ অর্থের নাম ‘ফাই’ রাখা হোক। এই শব্দ দ্বারা বিজাতীয়দের সাথে মুসলমানদের কি সম্পর্ক তা তাদের স্বরন হবে। আর অনৈসলামিক রাষ্ট্রের সাথে শান্তি চুক্তি পুরন করা শরিয়ত অনুযায়ী কতটা বাধ্যতামূলক,সেটাও তাদের স্মরণ হবে। ১.[কুরআনের পরিভাষায় ‘ফাই’ শুধু মাত্র সেই মালকে বুঝায় যা যুদ্ধরত জাতির নিকট থেকে অস্ত্রের সহায্য ব্যতিরেকেই লাভ করা যায়।সুরায়ে হাশর পড়ে যান।দেখবেন যে, সমস্ত প্রসংগই যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কিত।বনি নজিরের উপর আক্রমন চালানো হলো।অস্ত্র ধারনের পূর্বেই তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নির্বাসনদন্ড মেনে নেয়।অ অবস্থায় যে ধন-সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয় তাকেই ‘ফাই’ বলে।শান্তির সময়ে যুদ্ধরত নয় এমন অমুসলিমদের নিকট থেকে সুদ,জুয়া,ফটকাবাজারী এবং অন্যান্য অনৈসলামিক পন্থায় উপার্জিত সম্পদের উপর ‘ফাই’ এর পরিভাষা কেন প্রয়োগ করা হবে?আর যদি একে ‘ফাই’ই বলা হয়, তাহলে জাতির ব্যক্তিগন একজন একজন করে পৃথকভাবে তা কি করে ভোগ করতে পারে?’ফাই’-এর সম্পদ সম্পর্কে কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে যে,তা সরকারী ট্রেজারিতে জমা করতে হবে এবং তা ব্যয়িত হবে ইসলামের সাধারন কল্যাণ মূলক কাজে :

(আরবী*******) “যা কিছুই (এসব জনপদের কাছ থেকে থেকে নিয়ে) আল্লাহ তার রাসুলকে দিচ্ছে,তা আল্লাহ,তার রাসুল,নিকট আত্মীয়দের, এতিম-মিসকিন এবং মুসাফিরদের জন্য।”-(হাশর-৭) (মওদূদী)] মোটকথা যেসব কারবারী লেনদেনে আল্লাহ নারাজ না এবং অপরদিকে আইন অক্ষুন্ন। সরকার সন্তুষ্ট,অর্থ দানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ে সন্তুষ্ট, সেসব অবলম্বনে মুসলমানদের কোনো কিছুর ভয় করা উচিত নয়।


‘ফাই’ অস্বীকার করা জাতীয় অপরাধ
সত্য কথা এইযে, মুসলমানদের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু সংখ্যক পুঁজির মালিক ও সল্প সম্পদের মালিক যে হালাল বস্তু ইমাম আবু হানিফা (র)-এর ভাষায় পবিত্র উপার্জন, যাকে আমি ‘ফাই’ বা ‘ফাও’ বলে অভিহিত করেছি এবং যে সম্পর্কে কুরআনের হালাল হওয়ার সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে, তা গ্রহন না করে জাতীয় অপরাধ ও জাতীয় আত্মহত্যা করছে। মুসলমানদের যে মূলধন ব্যাংকে রক্ষিত আছে তার লাখো লাখো টাকার ‘ফাই’ যে অমুসলিম শক্তি বৃদ্ধির কারনে এবং মুসলমানদের জন্য অর্থনৈতিক পথ পরিবর্তন হলে সমস্ত ধনই যে অকেজো হয়ে যায়, তা কেনা জানে। উপরন্তু এইকথাও শুনা যায় যে, মুসলমানদের এই ফাই- এর আমদানি থেকেই তাদেরই শিশু, নারী ও দরিদ্রগনকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স)-এর শিবির থেকে টেনে টেনে অন্যদের শিবিরে ভর্তি করা হয়।

(আরবী********)

“তোমরা ঈমান এনেছ বলে তোমাদের রাসুলকে এবং তোমাদরকে বহিস্কৃত করে দেবে”- প্রকাশ্যে এ আয়াতই কার্যকর করা হচ্ছে।

এটা আপন জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয় তো আর কি? ১ ১.[ সুদের টাকা ব্যাংকে ছেড়ে দিলে তার দ্বারা কাফেরদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়, একথা চন্তিাকরে সতর্ক আলেমগণ এ ফতোয়া দিয়েছেন যে, ব্যাংক থেকে সুদ নিয়ে সে অর্থ গরীব মুসলমানদেরকে সদকা হিসেবে দিতে হবে অথবা মুসলমানদের কোনো কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে হবে। এ ফতোয়া অত্যন্ত ন্যায়সংগত। ফেকাহ গ্রন্থে নিষিদ্ধ মাল সম্পর্কে এরূপ ফতোয়া আছে যে, যদি তা বাধ্য হয়ে অথবা অন্য কোনো বিশেষ কারণে নেয়া হয়; তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। অতএব যে ক্ষিতির উল্লেখ মাওলানা করছেন তার থেকে বাঁচার জন্যে এর কোনো প্রয়োজন নেই যে, সুদকে ‘ফাই’ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করতে হবে।- (মওদূদী)] আফসোস! মুসলমানদেরই চাঁদির ছুরি দিয়ে মুসলমানদেরকেই যবেহ করা কে জায়েয করে দিল? খোদা কি দেখছেন না? নবী (স) র্পযন্ত কি এ সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছে না জগদ্বাসী! দেখ, মুহাম্মদ (সা) এর উম্মতকে সুদের জালে আবদ্ধ করে ইউরোপ, প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের লোক মনের আনন্দে শিকার করছে। সুদ দাও অথবা ক্ষতে খামার দাও, ভূ-সম্পত্তি দাও অথবা ঘরবাড়ী দাও। নতুবা আরবের উম্মী নবী (সা)- এর আস্তানা ত্যাগ কর। এসব মোহরের দাবার ছকের উপর কেমন বেদনাদায়ক বাজি খেলা হচ্ছে।


ব্যাংকের সুদ
সত্য কথা এই যে, ব্যাংক হলো প্রধানত সুদখোরদের আইনসম্মত কতকগুলো কমিটির নাম। কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা কাজের কর্মচারীগণ যদি এমন না হয়, যার থেকে মুসলমানদেরকে নিবৃত্ত করা হয়নি, তাহলে কারবার সে কমিটির সদস্যদের না হয়ে হবে একটি কোম্পানীর সাথে যে মানুষকে সুদে টাকা ঋণ দেয়। অতএব মুসলমানদের এমন পবিত্র ‘ফাই’ অস্বীকার করার কি কারণ হতে পারে? কোম্পানী কি কাজ করে? কাকে ঋণ দেয়? কার নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করে? এ হচ্ছে তার নিজস্ব কারবার এবং একটি নতুন চুক্তি যার সাথে ঐ কারবারের কোনই সম্পর্ক নেই যা একজন মুসলমান ব্যাংকের মালিকদের সাথে করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের যে ধারাগুলো ইসলামী আইনের দিক দিয়ে দেখা হয়েছে সেগুলো সামনে রাখার পর ব্যাংক মালিকদের কারবার যার সাথেই হোক না কেন, তা সংগত হয়ে যায়। এখন চিন্তা করে দেখুন। ২.[ ব্যাংকের সুদ নিষিদ্ধ হবার একটি কারণ এই যে, যে টাকা আমরা ব্যাংকে রাখি। ব্যাংক কতৃপক্ষ তা সমুদয় অন্যান্য কারবারের সাথে সুদী ঋণের কারবারেও লাগায়। যাদের এ সুদী ঋণ দেয়া হয় তাদের মধ্যে মুসলিম অমুসলিম সবই থাকে। এভাবে যে সুদ আমরা ব্যাংক থেকে পাই, তা শুধু অমুসলমানদের পকেট থেকেই আসে না বরঞ্চ মুসলমানদের পকেট থেকেও। অন্য কথায় আমরা মুসলমানদের কাছ থেকে সরাসরি সুদ খাই না খাই ব্যাংকের মাধ্যমে। মাওলানা এ প্রশ্নকে এই বলে উড়িয়ে দেন যে, হরবী ব্যাংকার আমাদের আমানতের টাকা যখন কোন মুসলমানকে ঋণ দিয়ে তার সুদ আদায় করে তখন বলতে গেলে আমরা হরবীর মাল হস্তগত করলাম যা আমাদের জন্যে হালাল। এই প্রশ্ন এই রয়ে গেল যে যখন এই অমুসলিম হরবী স্বয়ং আমাদের প্রদত্ত অস্ত্রেই মুসলমানদেরকে জবাই করে এবং তাদের গোশত থেকে কিছুটা আমাদেরকেও খেতে দেয়, তখন আমরা আমাদের অস্ত্র তাকে দেই কেন? মাওলানা এদিকে খেয়াল করেননি।- (মওদূদী) ]

হ্যাঁ, আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি এবং সবসময়েই বলব যে, যারা এরূপ করে তারা আপন দেশের স্বার্থে করছে না। দেশবাসীর, দেশের মজুর ও গরীব দুঃখীদের ভাল করছে না। কিন্তু যারা দেশের রক্ষক, যে সরকারের উপর দেশবাসীর রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। তারাই যখন এসব বিষয়কে দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নের উপায় মনে করে এবং স্বয়ং দেশবাসীও এরূপই মনে করে, তখন দেশের আনুগত্যের প্রশ্নে কি মুসলমান আপন জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে?১ [এ মাসয়ালাই মাতৃভুমির আনুগত্যের বা বিশ্বাসঘাতকতার আদৌ কোন প্রশ্ন উঠে না|ঈমানদাররা সুদী কাজ হতে এ জন্য ফিরে থাকে যে আল্লাহ ইহাকে হারাম করে দিয়েছেন। আপনি এই প্রতিবন্ধকতাকে উঠায়ে নিয়ে যান দেখবেন আর কোন প্রমানের প্রয়োজন হবে না। সীমান্তের পাঠানদের মত হিন্দুস্থানের মুসলমানরাও সুদ গ্রহনের ব্যাপারে মাড়ওয়ারীদের থেকে দশ কদম অগ্রসর হয়ে যাবে|-(মওদুদী)] অথচ স্বদেশের কথা ছেড়ে দিলেও পারিবারিক অধিকারের ব্যাপারে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা তাদের জন্য হারাম। কুরআনের সাধারন ঘোষনাঃ

“তোমাদের আত্মীয়স্বজন ও সন্তানাদী কিয়ামতের দিনে কোন কাজে আসবেনা। আল্লাহ তোমাদের ফায়সালা করবেন। এবং তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ দেখছেন। (সূরা মুমতাহিনাঃ ৩)

একথা ঠিক যে, আমাদের ধৈয্যশীল হতে বলা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধৈর্যশীল হতে বলা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করাই আমাদের জন্য শ্রেয়ঃ কিন্তু ধৈর্য ধারনের নীতির সাথে সমান প্রতিশোধের নীতিও কি কুরআন শিক্ষা দেয়নি?

“আর যদি তোমাদের উপর অত্যাচার করা হয় তাহলে তোমরাও ততটুকু করো যতটুকু তোমাদের উপর করা হয়েছে। আর যদি ধৈর্যধারণ করো তাহলে ধৈর্যশীলদের জন্য মংগল।- (সুরা আল নাহলঃ ১২৬)

কিন্তু ধৈর্যের কোন শেষ আছে কি? ধৈর্যের কোন সীমা আছে কি? যিনি ধৈয্যের শিক্ষা দিয়েছেন তিনি তো বলেছেনঃ

“আপন হাতে নিজেদের ধবংস টেনে এনো না”-(সূরা আল বাকারাঃ ১৯৫)

কন্সটান্টান্টিনোপলে মাটির তলায় শায়িত ইউরোপের গাজী আবু আইয়ুব আনসারী শব্দের যে ব্যাখা করেছেন, শুধু সাধারন নয়, বিশিষ্ট ব্যাক্তিগনও কি ভুলে গেছেন?

‘ফাই’ গ্রহন না করা জাতীয় অপরাধ
চিন্তাশীলগন বলেন যে, ফাই গ্রহন না করা শুধু আপন জাতির প্রতি নয়, বরঞ্ছ দেশবাসীর প্রতিও শত্রুতা করা। বিষ ভক্ষণকারীকে বিষ ভক্ষণ করতে দেখে শুধু মনে মনে দুঃখ করাই কি সত্যিকারের সহানুভুতি প্রদর্শন? অথবা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার হাত থেকে বিষ কেড়ে নেয়া প্রকৃত মংগলাকাঙ্ক্ষা? ১.[বিষ কেড়ে নেয়া অব্যশই শুভাকাংক্ষের পরিচয়|কিন্তু কেড়ে নিয়ে নিজে তা ভক্ষন করা এবং অতপর এ বিষকে স্বর্ণ ভস্ম মনে করা শুভাকাংক্ষাও নয় এবং বুদ্ধিমত্তাও নয়। -(মওদুদী)]

“তোমাদের মাঝে কেউ যদি কাউকে মন্দ কাজ করতে দেখে তাহলে সে আপন হাত দিয়ে তা ঠেকিয়ে রাখবে। যদি তা না করতে পারে তাহলে সে মুখ দিয়ে বাধা দিব। যদি তা না করতে পারে, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ধৃণা করবে। আর তা হচ্ছে দুর্বলতম ঈমান। ”

হাদীসের সমস্ত গ্রন্থে এসব পড়া হয়ে থাকে। কিন্তু তথাপি ঈমানের দুর্বলতার বৃত্ত থেকে বাইরে আসার আর সাহস কারও হয় না। বিশেষ করে যখন এর ক্ষমতা থাকে। দেশের সরকার যদি তোমাদের সহযোগিতা করে এবং দেশবাসী এ ব্যাপারে তোমাদের সাথে একমত হয়, তাহলে বল এরপর আর কোন আপত্তি থাকতে পারে কি? যে অপরের গন্ডে চপেটাঘাত করে তার নিজের গন্ডে চপেটাঘাত না পড়া পর্যন্ত সেকি তার অপরাধের পরিনাম ২.[হিন্দু, ইয়াহুদি, ঈসায়ী সকলেই একে অপরকে চপেটাঘাত করছে এবং শতাব্দির পর শতাব্দী চলে আসছে। কিন্তু এ আঘাতের আস্বাদ গ্রহন করা ও করানো সত্তেও এর প্রতিক্রিয়া ও পরিনাম তারা বুঝতে পারছে না। তাহলে কেমন করে আশা করা যেতে পারে যে, মুসলমানদের কয়েকটি মৃদু চপেটাঘাত তাদেরকে এমন সচেতন করে দিবে যে, তারা এ অপরাধ থেকে বিরত থাকবে? মাওলানা সম্ভবত মনে করেছেন যে, সুদ প্রদানকারী শুধু মুসলমান এবং অমুসলিমগন শুধু সুদ গ্রহন করে, দেয় না। এজন্য তার ধারনা এই যে, মুসলমান যখন সুদ খাওয়া শুরু করবে তখন অমুসলমান সুদখোর ঘাবড়ে যায় এবং অবশেষে ভারত গভর্নমেন্ট সুদের লেনদেন আইনত নিষিদ্ধ করে দিবে। কিন্তু ব্যাপার তা নয়, সমস্ত অমুসলিম সম্প্রদায় সুদ গ্রহণও করে এবং প্রদানও করে। মুসলমান তাদের কাছ থেকে সুদ নিয়ে নতুন কোন আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্য তারা এক এক নতুন আস্বাদ নিশ্চয় গ্রহন করবে এবং তা সম্ভবত তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়ে ‘ফাও’এবং ‘অ-ফাও’ এর পার্থক্য ভুলিয়ে দিবে। অতঃপর মনে রাখতে হবে যে, মুসলমান এতো পুঁজিপতিও নয় যে, তারা সুদ নেওয়া শুরু করলে মাড়ওয়ারী ও সুদ মহাজনগ দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং সকলে পরাজয় স্বীকার করে সুদ নিষিদ্ধকরনের জন্য উঠেপড়ে লাগবে। -(মওদুদী)] বুঝতে পারবে? যদি তা না পারা যায়, তাহলে তারা হতভাগ্য- দরিদ্র লোকদের কোমল চামড়াকে তাদের আংগুলের শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্র বানাবে। অতএব চিন্তা করুন।

হতে পারে যে, যে চপেটাঘাত আজ মুসলমানদের দেয়া হচ্ছে, তার অনুভুতি যখন অন্যেরও হবে, তখন সম্ভবত সরকার এ লেনদেন আইনত নিষিদ্ধ করবে। যদি তারা এমন করে, তাহলে এ আইন পালনের জন্য সর্বাগ্রে তাদের মস্তক অবনত হবে, যারা নবী (স) এর উম্মত এবং দুনিয়ায় সর্বোত্তম চরিত্রের প্রতিফলন যাদের কাজ। তখন ধর্মত আমরা অপরাধী হবো যদি আমরা আইন না মেনে চলি। আর সরকারও যদি কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করে, তাহলে আপনি কি আশ্চর্য হবেন যে, যে দুঃখ মুসলমানগন পেয়েছে, তা যদি অন্যান্যরাও পায় তাহলে দেশবাসী গলা ফাটানো ওয়াজের কোনোই পরোয়া করবে না। যেমন, লিখনীর মাধ্যমে বক্তৃতার প্রতি তারা উপহাস করে আসছে। ১.[তাদের উপহাস ও অট্রহাসি তখনো বন্ধ হবে না বরঞ্জ আরও বেড়ে যাবে। তারা বলবে যে, অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইসলামের কোন নীতি যে চলতে পারে না, এটাই প্রমানিত হচ্ছে এবং সুদের নিষিদ্ধকরন বাস্তব জগতে সম্পূর্ন অচল। তালাক, উত্তরাধিকার, বিধবা বিবাহ প্রভৃতি মাসগুলোতে তারা যেসব ধর্মীয় আইনের সংশোধনী পাশ করেছে, তার যেমন আপনি প্রতিবাদ করেন, তেমনি তারাও ইসলামের দুর্বলতা প্রকাশ করা জন্যে সুদের ব্যাপারে আপনার পরিবর্তিত মতবাদকে একটা প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করবে। -(মওদুদী)] যদি তারা অগ্রসর হয় এসব কারবার রহিত করার জন্য কোন চুক্তি করে, তাহলে আল্লাহ কি মুসলমানদেরকে এ অনুমতি দেয়নি? যেমনঃ

এ ধরনের চুক্তিকে সর্বপ্রথম স্বাক্ষর তারা করবে। দুনিয়ায় মানব জাতির মঙ্গলের জন্য যাদের আবির্ভাব হয়েছিল, এসব কারবারকে অন্তরের সাথে আমরা খারাপ মনে করব, একথা মুখে বারবার বলব সরকারের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট করব এবং দেশবাসীকেও বলব। এ যাবত যেভাবে বলেছি, ভবিষ্যতেও বলবো এবং জোরগলায় বলবো এবং অবিরাম বলতেই থাকব। আমাদেরকে দেশান্তরিত করতে এবং গৃহ হতে বহিষ্কার করতে তারা যতোই পীড়াপীড়ি করুক না কেন, আমরা তাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা হ্রাস করব না। আর এ মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে মুখ থেকে অগ্রসর হয়ে হাত দিয়েও আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করব।

এ আল্লাহর বিধান ১.[(ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধাদান) আল্লাহর এ বিধান পালনের এ পন্থাতে বড়ই অদ্ভুত যে, যে মন্দ কাজ থেকে অপরকে আমরা বিরত রাখতে চাই, আমরা তার মধ্যেই লিপ্ত হয়ে পড়বো। যেমন ধরুন, কোন ব্যক্তি মদ পান করে দাংগা-ফাসাদ শুরু করে দিল। তারপর অনেক বুঝানোর পরও যখন সে মদ পান ছাড়লো না তখন আমরা নিজেরাও তার মত মদ খেয়ে দাংগা-ফাসাদ করে তাকে বলব, দেখ, মদ খাওয়া কত দুঃখজনক পরিণামঃ এখন তাহলে আমাদের সাথে চুক্তি কর যে না তুমি মদ খাবে, আর না আমরা খাব। তা যদি না হয় তবে মনে রেখো আমরা তোমার চেয়ে বেশী করে মদ খেয়ে ও দাংগা করে দেখিয়ে দিব। এ ধরনের নছিহতের দ্বারা মদ পরিত্যাগ করার চুক্তি হয়তো হবে না। তবে হবে এই যে, শরাবখানায় ধার্মিককে দেখে পাঁড় মদখোরেরা জ্বয়ধ্বনী করবে এবং চীৎকার করে বলবে, “শরাবীর দলে শায়েখকে খোশ আমদেদ জানাই।”-(মওদূদী)] পালনের জন্যে আমাকে পয়দা করা হয়েছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত না দেশবাসী ও প্রতিবেশীগণ এর অপকারীতা সম্পর্কে একমত হয়েছে ততোক্ষণ আমরা এ নির্দেশ পালন করে চলব। ভগ্ন হুদয় এবাবেই জোড়া লাগে এবং একদিন তা ইনশাআল্লাহ জোড়া লাগবে।

ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের বিধান
প্রসঙ্গ শেষ করার আগে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কথা থেকে যাচ্ছে। তা কি করেই বা ছাড়া যায়? ইসলামী আইন যখন আমাদের হাত ধরে পথ দেখাবার জন্য প্রস্তুত, তখন প্রশ্ন জাগে যে, যেসব ইসলামী দেশে শরীয়তের আইন কোন না কোন কারণে রহিত হয়ে গেছে, সেখানে কি করা যায়? সেখানকার শাসক ও রাজা-বাদশা তো মুসলমান বটে। শামী গ্রন্থে এ সম্পর্কে ফতোয়া আছে যে, এসব দেশের মুসলমান শাসকগণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি ইসলামী আইন জারী না করে, তাহলে এসব দেশ দারুল ইসলামই থাকবে।

“এর থেকে জানা গেল যে, সিরিয়ার তায়মুল্লাহ নামক পার্বত্য এলাকা জাবালে দুরুজ এবং তার অধীন অন্যান্য শহরগুলো সবই দারুল ইসলাম। কেননা যদিও সেখানে দুরুজ অথবা ঈসায়ীদের শাসন চলে, সেখানকার প্রশাসক ও বিচারক তাদেরই ধর্মাবলম্বী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের গালি দেয়, তথাপি তারা ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন। তারা চতুর্দিক থেকে মুসলিম রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। যখনই মুসলিম শাসনকর্তা ইচ্ছা করবেন, তখনই সেখানে ইসলামী আইন চালু করতে পারবেন।”

এর দ্বারা প্রচলিত হয় যে, যেসব দেশে মুসলিম শাসকগণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইসলামী আইন প্রবর্তন করতে অক্ষম, তারা আর দারুল ইসলাম থাকতে পারেনা।১.[মনে হচ্ছে মাওলানা একথা বলতে চান যে, ভারতের মুসলিম রাজ্যগুলোও দারুল হরবের সংজ্ঞায় পড়ে এবং সে সবের অমুসলিম প্রজাবৃন্দও হরবী যাদের সম্পদ হালাল। এ ধরনের ইজতিহাদের অন্তত হানাফী পিকায় কোন অবকাশ নেই। ফকীহগণের বিশদ ব্যাখ্যার জন্যে তাহাবী কর্তৃক দুররুল মুখতারের টীকা দ্রষ্টব্যঃ

(আরবী********)

“যে রাষ্ট্রে ইসলামী আইন ও শির্কের আইন প্রচলিত তা দারুল হরব নয়।”

ফাতওয়ায়ে বায্যায়াতে আছেঃ “যদি দারুল হরবের শকল শর্তই পাওয়া যায়, তাহলে তো দারুল হরব হবে। আর যদি দলিল শর্তসমূহ মধ্যে গরমিল দেখা যায়, তাহলে তা আগের মতোই থাকবে অথবা নিরাপত্তার জন্যে দারুল ইসলাম হবে।”

খাজানাতুল মুফতীন গ্রন্থে আছেঃ

(আরবী**********)

“যেসব কারণে দারুল ইসলাম হয়, তার সবগুলো বাতিল না হলে দারুল ইসলাম দারুল হরবে পরিণত হয় না। সুতরাং ইসলামের কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকলেই তা দারুল ইসলামের পক্ষেই গণ্য হবে।”

এসব ব্যাখ্যঅর পর কে বলতে পারে যে, হায়দরাবাদ, ভূপাল, জুনাগড় প্রভৃতি রাজ্যসমূহ দারুল হরব হয়ে গেছে এবং তার অমুসলিম প্রজাগণ হরবী। মাওলানা সম্ভবত জানেন যে, ইসলামী ফিকাহ অনুযায়ী দারুল হরব দারুল ইবাদাতের অপর নাম। এখানে ইসলামী আইনের অধিকাংশ কানুনই প্রয়োজনের তাকীদে শিথিল করে দেয়া হয়। এ সাময়িক শিথিলতা যদি স্থায়ী করে দেয়া হয়, তাহলে মুসলমানদের মুসলমান থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেমন ধরুন, লর্ড ওয়েলেসলূর বাধ্যতামূলক মিত্রতায় শরীক হবার থেকে আলেমহণ যদি হায়দারাবাদকে দারুল হরব ঘোষনা করে দারুল ইবাদাত বানিয়ে দিতেন, তাহলে একশ ছত্রিশ বছরের মধ্যে এ রাজ্যের মুসলমান এতটা বিকৃত হয়ে পড়তো যে, মুসলমান দেশের কোন ব্যক্তি তাদেরকে মুসলমান বলে চিনতেই পারতো না।–(মওদূদী)] অবশ্য আল্লাহই এ সম্পর্কে ভাল জানেন।

এ ধরনের অনৈসলামিক রাষ্ট্রে জুমা, ঈদ, ইত্যাদি কিভাবে হতে পারে তাও শামী গ্রন্থে আছেঃ

(আরবী*********)

“যেসব শহরে কাফেরদের পক্ষ থেকেই মুসরিম শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়, সেখানে জুমা ও ঈদ জায়েয। সে রাজ্যে কর আদায় করা ও বিধবা বিবাহ দেয়া জায়েয।”

কিন্তু যে অনৈসলামিক রাষ্ট্রে সরকারের স্বীকৃত কোন মুসলিম শাসক না থাকে, সে সম্পর্কে নির্দেশ হচ্ছেঃ

(আরবী*********)

“যে রাষ্ট্রে শাসক কাফের সেখানে মুসলমানদের জুমা ও ঈদ জায়েয। তারা পরস্পরের পরামর্শ করে কাজী নিযুক্ত করবে। কিন্তু তাদের কর্তব্য হবে মুসলিম শাসনকর্তা দাবী করা।”


মাওলানার দ্বিতীয় প্রবন্ধ
(মাওলানা গিলানীর উপরোক্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পর কোনো কোন আলেম যে প্রতিবাদ জানান তার জবাবে মাওলানা নিম্নের প্রবন্ধটি লিখেন-সংকলক।)

একঃ বিষয়টির ব্যাখ্যায় কিছু অসতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে যার জন্যে ভুল বুঝাবুঝির আশংকা আছে। লিখা হয়েছে যে, অনৈসলামী রাষ্ট্রে সুদ আর সুদ থাকে না ইত্যাদি। তার অর্থ দাঁড়ায় যে, হানাফী ফিকাহ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে- সে মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম- এ ধরনের কারবার জায়েয এবং তাদের ধন-সম্পদ রক্ষিত ও হালাল হয়ে যায়। অথচ বলার উদ্দেশ্য তা নয়। বরঞ্চ এ বিধান শুধু অমুসলিম জাতি যথা ইয়াহুদী, নাসারা, অগ্নি উপাসক, হিন্দু প্রভৃতির জন্যে নির্দিষ্ট যাদের দায়িত্ব কোনো ইসলামী রাষ্ট্র গ্রহণ করেনি। আমি আমার দাবীর সমর্থনে ইমাম মুহম্মদের সিয়ারে কবীরের বিখ্যাত ফতোয়া উদ্ধৃত করেছি। চূড়ান্ত নিশ্চয়তার জন্যে এ আইনের নিম্নলিখিত ধারা উদ্ধৃত করছিঃ

(আরবী********)

“এ কারবার যদি দুজন মুসলমানের মধ্যে হয়, যারা নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে দারুল হরবে বসবাস করে, অথবা যদি তারা কয়েদী হয়ে, তাহলে তা বাতিল ও পরিত্যক্ত হবে। কারণ তারা উভয়েই সর্বত্র ইসলামী আইন মেনে চলার জন্যে দায়ী।”১.[এর দ্বারা শুধু এতটুকু প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক অপর রাষ্ট্রে একে অপরের কাছ থেকে সুদ নিতে পারবে না। কিন্তু দারুল ইসলামের নাগরিকদের মধ্যে কোনো মুসলমান যদি নিরাপত্তা সহ দারুল হরবে যায়, তাহলে সে দারুল হরবের মুসলিম অধিবাসীর কাছ থেকে সুদ নিতে পারবে। কেননা হানাফী ফেকাহের মতে কাফের হরবীর মতো ঐ মুসলমানের সম্পদও রক্ষিত নয়। যাহরুর রায়েতে আছেঃ

(আরবী***********)

“দারুল হরবে যে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং হিজরত করেনি সে আবু হানিফার মতে হরবী সমতুল্য। কারণ তাঁর মাল অরক্ষিত। সুতরাং তার কাছ থেকে সুদ নেয়া মুসলিমের জন্য জায়েয।”

এ দিক দিয়ে মাওলানার ব্যাক্যা অনুযায়ী যদি ভারত দারুল হরব হয়, তাহলে সীমান্তের পাঠানদের জন্যে ভারতে শুধু হিন্দুর নিকট থেকে নয়। বরঞ্চ মুসলমানের নিকট থেকে সুদ নেয়াও হালাল ও পবিত্র হবে। শুধু তাই নয়, বরঞ্চ তারা এখানে মুসলমানদের সাথে জুয়াও খেলতে পারে এবং হারাম জিনিস তাদরে কাছে বিক্রী করতে পারে।–(মওদূদী)]

কয়েদী অথবা বন্দীর জন্যে ফেকাহর দৃষ্টিতে এমন প্রয়োজন যে, তাকে জেলখানায় থাকতে হবে। কিন্তু কোন দেশে বিনা অনুমতিতে বা পাসপোর্টে যেতে পারে না।– এমর প্রত্যেক ব্যক্তিই বন্দি।২.[বন্দীর সংজ্ঞা যদি মাত্র এতটুকু হয়, তাহলে ভারতের সকল মুসলসানই নিরাপত্তাপ্রাপ্ত নয়, বরঞ্চ বন্দী বলেই পরিগণিত হবে। আর যুদ্ধ বন্দীদের জন্যে দেশের আইন মেনে চলাও অপরিহার্য নয়। সে চুরী, হত্যা এবং ঘুষ প্রদানের কাজ করতে পারে।] যথাসময়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

দুইঃ দ্বিতীয় কথা এই যে, নিসন্দেহে আমি তাড়াহুড়ার মধ্যে এ প্রবন্ধ লিখেছি এবং প্রকাশিত হবার আগে কারো সাথে পরামর্শও করতে পারিনি। আমার এ ত্রুটি আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আমি যেসব চিন্তা ও ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে এ প্রবন্ধ লিখেছিলাম তা সর্বজ্ঞ আল্লাহ তায়ালা অবগত আছেন। এছাড়া বিষয়টির বুনিয়াদ যেসব ক্ষেত্রের উপর তাহলো দুটি। এক. ভারত দারুল কুফর, দ্বিতীয়. দারুল কুফরে অবৈধ উপায়ে অরক্ষিত সম্পদ ইসলাম অনুযায়ী হালাল। এ দুটোর মধ্যে প্রথমটি সম্পর্কে আমি ভারতের অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য আলেম, মনীষী, ও ধর্মভীরু, ব্যক্তিগণকে একমত পেয়েছি। অবশ্য দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে ঐ সকল প্রসিদ্ধ আলেমের সাথে বিশদভাবে আলোচনা করতে পারিনি, যাঁদের নাম আপনি উল্লেখ করেছেন এবং যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আমার ওস্তাদ এবং ওস্তাদ শ্রেণীর। শুধু মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অভিমত আমি জানতে পেরেছি।

তিনি এ মাসয়ালাটির ব্যাপারে হানাফি ফেকাহর এসব খুঁটিনাটি সম্পর্কে নিশ্চিত নন। তিনি ফতোয়া ও তাফসীরে দ্বিতীয়টির নির্ভুল হওয়া সম্পর্কে হাদিস থেকে এবং নীতিগতভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু যতদূর আমার জানা আছে, ইমাম আবু হানিফা (র)-এর অভিমতকেই আমি কুরআন ও সুন্নাহর সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ পেয়েছি। ইমাম সাহেব উপলব্ধি করেছেন যে, (আরবী******) (নিজেদেরকে হত্যা করো না)-এর প্রকাশ্য বিধান শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নতুবা জিহাদের বিধান অর্থহীন হয়ে পড়ে। এভাবে, (আরবী******) (তোমাদের ধন-সম্পদ নিজেদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না) এবং তারই উপ-তপসীল (আরবী******) (সুদ খেয়ো না)-এর প্রকাশ্য সাধারণ বিধান শুধু মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট। ১.[মাওলানার একথায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, রক্তের সম্মান, অর্থ-উপার্জনে হালাল-হারামের পার্তক্য এবং সুদের অবৈধতা প্রভৃতি সবকিছুই মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যেই সীমিত। ইসলামের গণ্ডির বাইরে অমুসলিমদের রক্তের না কোনো মর্যাদা আছে, আর না তাদের সাথে আর্থিক লেনদেনে হালাল-হারামের ভেদাভেদ। এর চেয়ে ইসলামী আইনের অপব্যাখ্যা আর কিছু হতে পারে না।

কুরআনে এরশাদ করা হয়েছেঃ

(আরবী**********)

“আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা হারাম করেছেন হক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে তা হত্যা করো না।” এ আয়াত অনুযায়ী, প্রত্যেক মানুষের জীবন সম্মানযোগ্য। তা হত্যা করা বৈধ একমাত্র তখনই হতে পারে যদি ‘হকের’ উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। জিহাদের সময় এ হারাম হকের জন্যে হালাল হয়ে যায়, যেমন ধারা ‘কিসাসে’ স্বয়ং মুসলমানের খুদ হালাল হয়ে যায়। যদি নীতিগতভাবে ইসলাম কাফের গায়ের জিম্মীকে ‘হরবী’ ঘোষনা করে থাকে, তাহলে তার অর্থ এই নয় যে, ইমাম এবং জামায়াত থেকে আলাদা হয়ে প্রতিটি মুসলমান প্রতিটি গায়ের জিম্মী কাফেরকে যখন খুশী তখন হত্যা করে ‘হক’ কায়েম করবে এবং ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করবে। যদি এমন হয় তাহলে একজন মুসলমান ও একজন রক্ত পিপাসু দস্যুর (Anarchist) মধ্যে কি পার্থক্য থাকে? এমনিভাবে অর্থ ইপার্চন এবং ব্যয়ের যে পন্থাসমূহ ইসলাম হারাম করেছে, তা সবই অকাট্য হারাম। এর মধ্যে এ ধরনের কোনো পার্থক্য হতে পারে না যে, মুসলমানদের নিকট থেকে সম্পদ গ্রহণের যে পন্থা হারাম, কাফেরের নিকট থেকে সম্পদ গ্রহণের সেই পন্থা হালাল। আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*********)

“তোমাদের মাল তোমরা তোমাদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে ভক্ষণ করো না এবং অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদের কিছুটা লাভ করার জন্যে বিচারকের কাছে (মিথ্যা) মামলা দায়ের করো না। অথচ তোমরা জান (যে এ মামলা অন্যায়ভাবে করা হচ্ছে)।”-(সূরা আল বাকারাঃ ১৮৮)

(আরবী***********)

“আল্লাহ কেনা-বেচা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।”

এবং আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*********)

“নিশ্চয় মদ, জুয়া, দেবমূর্তি, তীরের সাহায্যে জুয়া প্রভৃতি অপবিত্র কাজ এবং শয়তানের কাজের মধ্যে শামিল।”-(সূরা আল মায়েদাঃ ৯০)

এসব বিধানের মধ্যে কোনটিকে শুধুমাত্র মুসলমানদের কায়-কারবারের সাথে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে? মুসলমানদের রীতিনীতি যদি এই হয় যে, মদকে হারামও বলবে, ওদিকে অমুসলিমদের কাছে তা বিক্রিও করবে, জুয়া হারাম বলবে আর অমুসলিম জাতির সাথে জুয়া খেলবে, শূকর হারামও বরবে, শূকর ভক্ষণকারীদের কাছে কা বিক্রিএ করবে, একদিকে সুদ হারাম হবার কথা বক্তৃতার মাধ্যমে বলে বেড়াবে, আর অন্যদিক থেকে অমুসলিম জাতির সাথে সুদী লেনদেনকে হালাল এবং পবিত্র বলবে, তাহলে দীন ইলাম একটি হাস্যষ্পদ বস্ততে পরিণত হবে এবং কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি এমন ধর্ম গ্রহণ করতে অগ্রসর হবে না। দুঃখের বিষয় এই যে, মাওলানা এ ধরনের অপব্যাখ্যঅকে ইমাম আবু হানিফার উপর আরোপ করেছেন। অথচ এসব সাধারণ বিধানের মধ্যে তিনি যে ব্যতিক্রম নির্ধারণ করেছেন, তা শুধু বিশেষভাবে সামরিক প্রয়োজনে শুধু ওদের জন্যে যারা যুদ্ধে লিপ্ত। এর উদ্দেশ্য এটা কথনই নয় যে, মুসলমানদের সকল জনপদগুলো স্থায়ীভাবে অপর জাতির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে হালাল হারামের পার্থক্য মিটিয়ে দেবে এবং বংশানুক্রমে এই হারামখুরীতে জীবন কাটিয়ে দেবে।–(মওদূদী)]

বিশেষ করে যখন নিষিদ্ধ মালের বিধান নিষিদ্ধ জ্ঞাপক শব্দে (আরবী****) শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা

হয়েছে, তখন সে আইন হত্যা আইনের ব্যাপকতার চেয়ে আরও

অধিকতর নির্দিষ্ট হয়ে গেল। এ সত্য কথা যে, সুদের বিধানটি বড় কঠোর। কুরআন এক ব্যক্তির হত্যাকে মানব জাতির হত্যার সমতুল্য বলে বর্ণনা করেছে যার শাস্তিস্বরূপ চিরকাল জাহান্নামের অগ্নির ভীতি প্রদশূন করা হয়েছে। কিন্তু কে জানে না যে, এ কঠোর আইনের একটা দিক [ইমাম আবু হানিফা (র)-এর মতে থাহলো সম্পত সম্পর্কিত।] বড় সওয়াবের বলে উল্লেখ করা হয়েছে?

ইমাম সাহেবই বা করবেন কি? কুরআনে বলা হয়েছেঃ

(আরবী************)

“আল্লাহ তোমাদেরকে বহু গণিমতের মালের ওয়াদা করেছেন যা তোমরা পাবে।-(সূরা আল ফাতহঃ ২০)”

এর অর্থ কি এই যে, এসব সম্পদ মুসলমানগণ খরিদ করে নিবে? অথবা তা কি উত্তরাধিকার সুত্রে পাবে, না তাদেরকে কেউ ‘হেবা’ করে দেবে?

তারপর বলপ্রয়োগ নয়,বিনা বলপ্রয়োগেই যে সম্পদ পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে বিধান এই যে,তা এমন বস্তু যেমনঃ

(আরবী***********)

“আল্লাহ তাঁর রসূলকে তাদের নিকট থেকে ‘ দান করেছেন যা কিছু হিসেবে ‘ফাই’ তাঁর জন্যে তোমরা উট অথবা ঘোড়া (যুদ্ধের আকারে) ব্যবহার করনি। আল্লাহ তাঁর রাসুলগণকে যাদর উপর ইচ্ছা করেন বিজয়ী করে দেন।“ –(সুরা আল হাশরঃ ৬)

শুধু যুদ্ধকালেই এ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। বরঞ্চ সকলেরই জানা আছে যেঃ

(আরবী***********)

“যখন আল্লাহ তায়ালা দুটো দলর মধ্যে একটি সম্পর্কে এ ওয়াদা করেছিলেন যে, এ তোমাদের জন্য।’

কে না জানে যে এ দুটো দলের মধ্যে আল্লাহ ঐ দলটির ওয়াদা করে ছিল যা (আরবী**) অর্থাৎ বানিজ্য কাফেলা ছিলো? কি ওয়াদা করেছিলেন? তাই এ (আরবী*****)অর্থাৎ তা তোমাদের জন্য।ব্যবসা বানিজ্য ‘হেবা’ দান,সদকাখয়রাত অথবা অন্য কোনো উপায়ে কি তা হস্তগত করার জন্যে মুসুলমানদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল?১.[এ কাফেলা ছিল একটি যুদ্ধরত জাতির,যদিও কাফেলাটি যুদ্ধ করছিল না। শত্রুর বানিজ্যে বাধা সৃষ্টি করা,তাদের বানিজ্য জাহাজ অথবা কাফেলা আটক করা,তাদের ধন-সম্পদ হস্তগত করা যুদ্ধ আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ জায়েয। রসূলুল্লাহ (স) এর সময়ে একমাত্র যুদ্ধের অবস্থা ব্যতীত অন্য সময়ে গায়ের জিম্মী কাফেরদের রক্ত ও মাল হালাল করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেক মুসুলমানকে এ অধিকার দেয়া হয়েছে যে,যেখানে যে গায়েব জিম্মীকে পাওয়া যাবে সেখানেই তাকে লুন্ঠন করা হবে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত মাওলানার জানা থাকলে তা পেশ করুন। – মওদুদী]

মুসুলমানদের জন্যে সম্পদ লাভের এই পন্থাই যদি নির্ধারণ করে দেয়া হয়,তাহলে তাকি অবৈধ পন্থা এবং ****র অন্তর্ভুক্ত হবে না? বুখারীতে আছে যে হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী,সাহাবী আবু বাসীর (রা)-

কে যখন মদিনায় থাকার অনুমতি দেয়া হলোনা, তখন তিনি করেকজন সংগী সাথীসহ সমুদ্র তীরে অবস্থান করতে লাগলেন। তার কাজ কি ছিলো? ইমাম বুখারী বর্ণনা করেনঃ

(আরবী*************)

“আল্লাহর কসম যখনই তারা শুনতেন যে, কুরাইশদের কোনো বানিজ্য কাফেলা সিরিয়ার দিকে যাচ্ছে, তখন তা আক্রমন করতেন,কাফেলার লোকদের হত্যা করতেন এবং তাদের ধন সম্পদ হস্তগত করতেন”

এর চেয়ে অধিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি? কুরআনে তো শুধু (**) কাফেলার ওয়াদা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে তো বাস্তবে পরিণত করা হয়েছে। এ বিধান কি হানাফী ফিকাহর,না কুরআনে প্রকাশ্য দলিলের দাবী? আশ্চর্য কথা এই যে,ইমাম সাহেব যে আইনের অধীনে এ ধারা প্রণয়ন করলেন (অর্থাৎ গণিমতের আইন) তা নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত অনুসারে শুধু মুসুলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট মনে করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকে বলে যে যদি সুদের কারবার অন্য জাতির সাথে জায়েয হতো, তাহলে ইয়াহুদীদের সম্পর্কে কুরআনে কেন বলা হয়েছেঃ *********আরবী()’

“এবং ইয়াহুদীদের সুদ নেয়ার কারনে, অথচ তা নিতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং লোকের মাল তাদের অবৈধভাবে ভক্ষণ করার কারনে”।

যখন ইয়াহুদীদের জন্যে গনিমতই হারাম ছিল,তখন কি কারনে তাদের জন্যে সুদ জায়েজ হবে?১.[ইয়াহুদূদের জন্যে গনিমত হালাল হোক বা না হোক,কিন্তু ফাই হওয়াতে কোনো সন্দেহ নাই। কুরআন একথার সাক্ষী— একটা গোটা দেশ আল্লাহ তাদের দেবার ওয়াদা করেছিলেন। একথা সুস্পষ্ট যে, সমুদয় মাল তাদের জন্যে ফাই হবে। নতুবা বলুন প্রতিশ্রুতি দেশের মালের উপর তাদের অধিকার কি করে জায়েয হলো? ক্রয়-বিক্রয়, সদকা অথবা দান তো ছিল না।- (মওদুদী)]

আর যখন এটা প্রমানিত হবে যে,তারা শুধু এমন লোকের সাথে কারবার করতো যারা ইয়াহুদী নয়,তখনই একথা বলা যাবে।২.[এর প্রমানের প্রয়োজন কী? কুরআন তো সাধারনভাবে ******** বলা হয়েছে। আপনার নিজের বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী যখন ******** বলা হয়নি, তখন তাঁর অর্থ এই হয় যে, তারা ইয়াহুদী অ-ইয়াহুদী সকলের নিকট সুদ খেতো, যেমন ধারা আজ পর্যন্ত খেয়ে আসছে।]]মওদুদী মাওলানা শিবলী তাঁর সীরাত গ্রন্থে আবু দাউদের বর্ণনা বারবার উল্লেখ করছেন। তাঁর থেকে ভুল ধারনা পোষন করা উচিত হবে না। কেননা এ কঠোরগপ্ত ভিত্তি হলো ‘গলুল'(বন্টনের পূর্বেই গনীমতের মাল আত্নসাত করা)। হযরত সামরাহ বিন জুন্দব কাবুলের যুদ্ধে এর বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। আবু লবীদ বর্ণনা করেন- আমরা কাবুলে যুদ্ধে সামরাহ বিন জুন্দবের সাথী ছিলাম। গণিমতের মাল হস্তগত হবার সাথে সাথে লোকে তা লুট করা শুরু করলো। হযরত সামরাহ (রা) বক্তৃতা বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে বললেন,আমি নবী (স) এর নিকট শুনেছি,তিনি আত্নসাত করতে নিষেধ করেছেন। তারপর সকলে লুন্ঠিত মাল ফিরিয়ে দিল। অতপর শরীয়ত অনুযায়ী তিনি (জুন্দব) বন্টন করে দিলেন (জমাউলফাওয়ায়েদ)। এতে একথা নেই যে,আসল মালিকদের ফেরত দেওয়া হল। বরঞ্চ বন্টনের পূর্বে আত্নসাত করতে নিষেধ করা হয়। যাকে বলা হয় গুলুল।

“রিবার’বিধান কখন নাযিল হয়েছিল এ বিষয়ে মতভেদ আছে। (আরবী********) অনেক পূর্বে নাযিল হয়েছিলো। কিন্তু একে মদের মো ্রেরণা মূলক নির্দেশ মনে করা যেতে পারে। অতপর সুদের খুঁটিনাটি হারাম কার্যকর করা হয়েছিল সপ্ত হিজরী থেকে। ইমাম মালেরকের মুয়াত্তায় আছে,রসূলুল্লাহ (স) খয়বরে চাঁদির একটি পাত্র বিক্রির ব্যাপারে বলেন,তোমরা উভয়ে সুদী কারবার করেছ। অতপর তা ফেরত দিল।

এর থেকে প্রমানিত হ্য় যে,দারুল ইসলামের এ বিধান সপ্তম হিজরী থেকে কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু সমগ্র আরবে কখন কার্যকর হয়েছিল? সকলেই জানেন যে,মক্কা বিজয়ের সময়ে নয়,বরঞ্চ বিদায় হজ্জে জাহেলিয়াত যুগের সুদ বন্ধের ঘোষনা নবী (স) এর পক্ষ থেকে করা হয়েছিলো। এর থেকে কি একথা জানা যায় যে, যে দেশে ইসলামী শাসন কায়েম হয়নি,সেখানে সুদী লেনদেন সে ধরনের হতে পারে না; যেমন হয় ইসলামী শাসন কায়েম হবার পর। ১.[এর থেকে শুধু এতটুকু প্রমানিত হয় যে,মুসুলমানদের কোন দেশে সুদী কারবার বন্ধের সাধারন নির্দেশ একমাত্র তখনি জারী হতে পারে। যখন তারা সে দেশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার পর অমুসলিমদের প্রতিও তাদের বিধান সমূহ প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে। প্রত্যেক বিজ্ঞ ব্যাক্তিই বুঝতে পারেন যে,কোনো দেশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে সেখানে আইন কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নবী (স) এর নিকটে কি করে এ আশা করা যেতে পারে যে,জাহেলিয়াত যুগে সুদী লেনদেনকারীরা তাঁর অধীনতা স্বীকার করার পূর্বেই সে সুদ বন্ধের ঘোষনা করবেন? অবশ্য যারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন অরথ্যাত মুসুলমান হয়েছিলেন,তাদেরকে তিনি সুদী লেনদেন করতে নিষেধ করেছিলেন, সমগ্র আরব দেশে সুদী কারবার বন্ধ হবার পূর্বেই। -(মওদুদী)] নতুবা,হযরত আব্বাস (রা) তো বিদায় হজ্জের পূর্বেই মুসলমান হয়েছিলেন এবং অন্তত পক্ষে তার সুদ বিদায় হজ্জ বন্ধ হবার পরিবর্তে সপ্তম হিজরীর আগেই বন্ধ হওয়া উচিত ছিলো।২.[হযরত আব্বাস (রা) সম্পর্কে জানা যায় যে,তিনি ইসলাম গ্রহন করার মক্কায় ফিরে যান এবং মুসলমান হবার পরও সেখানে তিনি সুদী কারবার করতেন এটা নবী (স) এর জানা ছিল না।(ইমাম সারাখসীর কিতাবুল মাবসুত ১৪;৫৭ দ্রঃ)নবী (স) কখন তা জানতে পারেন তা বলা যায়না মোটকথা বিদায় হজ্জের সময় যখন আল্লাহর নির্দেশে সুদ নিদ্ধ করার সাধারণ ঘোষণা করেন, তখন সকলের সাথে হযরত আব্বাস (রা)- এর বকেয়া সুদও রহিত করা হয়। এ ঘটণা অকাট্যরুপে প্রমাণ করে না যে, রসুলুল্লাহ (স) আব্বাস (রা) সুদী কারবার জায়েজ রেখেছিলেন।] -(মওদুদী) আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কতিপয় মুসলিম মনীষী বিদায় হজ্জের রেওয়ায়েতের প্রতি সন্দেহ পোষন করে বলেন যে,যদি অমুসলিমগনের নিকট সুদ নেয়া জায়েজ হতো,তাহলে ইসলাম পূর্ব যে বকেয়া সুদ ছিল,তা শরীয়াতের বিধানদাতা কেন রহিত করলেন?

নিশ্চিতরূপে সমস্যা যদি এই হতো যে,শুধু সুদের চুক্তি দ্বারাই সুদের অধিকারী সুদখোর হয়ে যায়,তাহলে প্রশ্ন হতে পারতো যে,একটি প্রতিষ্ঠিত অধিকার রহিত করার অর্থ কী হতে পারে? কিন্তু সমস্যার ভিত্তি এটা নয় যে,সুদের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। অতএব বৈধতার বিধান বলবৎ থাকবে। দেশ যখন ইসলামী হয়ে যাবে,তখন অরক্ষিত সম্পদ রক্ষিত হয়ে যাবে। তারপর এ রক্ষিতকে কীভাবে অরক্ষিত বলা যাবে?১.[ আর এই কারনেই,নাজরানবাসী ইসলামী রাষ্টের আনুগত্য স্বীকার করার পর এ সুদী কারবার বন্ধ করার নির্দেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। কারন তাদের দায়িত্ব গ্রহনের চুক্তির পর তাদের সম্পদ রক্ষিত হয়ে গিয়েছিল।

লোক জিজ্ঞাসা করে যে,সাহাবায়ে কেরামের কার্যপ্রানালীর দ্বারা এমন কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া জানতে পারা যায় কি যে,তাঁরা অমুসলিমদের সাথে সুদের কোনো বিশেষ কারবার করেছেন? তার জবাবে ইমাম মুহাম্মদ তাঁর সিয়ারে কবীর গ্রন্থে হযরত আব্বাস (রা) কার্যকলাপ বর্ণনা করেছে,তিনি বলেন, হযরত আব্বাস (রা) মক্কা বিজয়ের পূর্বে এ সুদী কারবারের জন্যে মদীনা থেকে মক্কায় যেতেন এবং তখন পর্যন্ত মক্কা দারুল ইসলামে পরিণত হয়নি।১.[মনে করুন,হযরত আব্বাস (রা) -এর সুদী কাওরবার সম্পর্কে নবী (স) পরিজ্ঞাত ছিলেন,তথাপি মক্কা বিজয়ের পূর্বে পর্যন্ত মক্কা ও তার চতুষ্পারশের সকল গোত্রগুলো মুসুলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মক্কা বিজয়ের পর যদিও মক্কা ইসলামি রাষ্ট্রের মধ্যে শামিল হয়েছিল,তথাপি তাঁর পার্সবর্তী অঞ্চলসমূহের যে সকল মুশরিক বাস করতো তাদের সাথে যুদ্ধ চলছিল। এ দৃষ্টান্ত বড়জোর একথা প্রমানের জন্যে পেশ করা যেতে পারে যে, যুদ্ধাবস্থায় দুশমনের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কাজ চলতে পারে।]-(মওদুদী) এরূপ হাদীসে আছে যে,হযরত আবু বকর (রা) সুদের নয়,জুয়ার কারবার করেছেন এবং বদর যুদ্ধের পর জুয়া লব্দ অর্থ গ্রহন করেন। একথা বলা মুস্কিল যে,তাঁর এ কাজ জুয়ার বিধান নাযিল হওয়ার পূর্বে হয়েছিল২.[এ ‘কাজের অর্থ কি?এর দুতো অংশ—এক,বাজী ধরা। দ্বিতীয়, বাজীর মাল আদায় করা। প্রথম অংশতো নিশ্চয়ই জুয়া হারাম হবার পূর্বেকার। কেননা তাহলো হিজরতের ছয় বছর পূর্বেকার ঘটনা। আজ জুয়া হারাম হবার আয়াত নাযিল হয় হিযরতের পর। এখন রইলো দ্বিতীয় অংশ অরথ্যাত বাজীর উট আদায় করা। এগুলো বদর যুদ্ধের পরের ঘটনা। সম্ভবত জুয়া হারামের বিধান নাযিল হবার পরে রা হয়েছিল। কিন্তু একথার কি জবাব আছে যে, নবী করীম (স) এ মাল আবু বকর (রা) -এর ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে সদকা করে দেয়ার নির্দেশ দেন।] (মওদুদী) কারন একথা ঠিক যে, ইরান রোমের নিকটে পরাজিত হয় সেই সময়ে,যখন কুরাইশগন মসুলমানদের হাতে পরাজিত হয়। এ বাজীর ব্যাপারে হযরত আবু বকর এর প্রতিপক্ষ ছিল উমাইয়া বিন খালফ যে বদর যুদ্ধে নিহত হয়। বাজী ধরা হয়েছিলো একশ উটের। হযরত আবু বকর (রা) নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশদের নিকটে বাজীর উট দাবী করলে তা মেনে নেয়া হয়। তারপর আবু বকর (রা) একশ উট নিয়ে মদীনায় প্রতাবর্তন করেন। একথা ঠিক যে,বদর যুদ্ধের কত পরে এই বাজীর উট আদায় করা হয়েছিল তা সঠিক ভাবে জানা নেই। কিন্তু এটা ধারনার অতীত যে,শোকাবিভূত ও বিক্ষুদ্ধ কুরাইশদের বদরের পরেই এতটা সুবিচার করবে যে,যে বাজী ধরেছিল তাঁর নিকটে নয় বরঞ্চ তাঁর উত্তরাধিকারীর নিকট থেকে একশ উট আদায় করে হযরত আবু বকর কে দিবে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে যে,এ বিষয়ে যদি সিন্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে হুদাবিয়ার সন্ধির পরে হয়ে থাকবে। আর এ কথা সর্বজন স্বিকৃত যে মদ ও জুয়া হারামের বিধান নাজিল হয়েছিল ওহোদ যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে। বুখারী থেকে এ কথা প্রমানিত। অতএব বাজীর উট আদায়ের ঘটনা জুয়া হারামের বিধান নাযিলের পরে সংঘটিত হয়েছে বলেই অধিকতর ধারনা করা যায়। ঐতিহাসিক নিরিখে যদি এ ঘটনার অনুসন্ধান কারো অভিপ্রেত হয়,তাহলে মাওলানা শিবলী নোমানীর সিরাতুন্নবী গ্রন্থ থেকে আমার বর্ণনা সত্যতা যাচাই করতে পারেন,বিশেষ করে আরবী ভাষায় যাদের দক্ষতা নাই। মোটকথা সাহাবীদের জীবন চরিত ও কথায় যদি এ নাও থাকে,তবে কি সাহাবীদের কথা থেকে নবী (স) -এর কাজ নয় বরঞ্চ আইন সম্পর্কিত বানী কী অধিকতর শক্তিশালী হবেনা যার বর্ণনাকরী স্য়ং আবু হানিফা (র)? ইমাম শাফেয়ী কাযী আবু ইউসুফের মধ্যস্থতায় ইমাম আবু হানিফা (র) থেকে বর্ণনা করেন

(আরবী**********)

“মকহুল থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী (স) বলেন, মুসলিম ও হরবীর মধ্যে সুদ হয় না।”

আমি স্বীকার করি যে, এ রেওয়ায়েত মুরসাল। কিন্তু সাহাবীদের কথা অনুসন্ধানকারীদের জন্যে মুরসাল হাদীস কি যথেষ্ট নয়? আশ্চর্য কথা এই যে, ইবনে সাদ অথবা ইসাবা থেকে যদি সাহাবীর কোন উদ্ধৃত করা হয় তাহলে লোকে তার মর্যাদা দেয়। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা নিজ বিশ্বাস মতে একটি মরফু-মুরসাল কওলী হাদীস পেশ করলে তা শুধু মুরসাল বলে উড়িয়ে দিতে চায়। এ রেওয়ায়েত সম্পর্কে একথাও বলা হয় যে, এ খবরে ওয়াহেদ। এর দ্বারা কুরআনে সমর্থন নির্দিষ্ট করা জায়েয নয়। কিন্তু কুরআনের সমর্থনও কি এর দ্বারা পাওয়া যায় না? এর মর্যাদা বা গুরুত্ব কি সাহাবাদের কথার সমানও নয়? সম্ভবত এ ব্যাখ্যার পর, এ মাসয়ালাটি শুধু হানাফী ফেকাহর রয়ে যায় না। মোটের উপর আমি আরও বিশদ আলোচনা করতাম, কিন্তু এখন তার সময় নেই। এখন একটু তাদের অপেক্ষায় রয়েছি যারা আবু হানিফা (র)-এর ফতোয়াকে এ মাসয়ালার সাথে মিশ্রিত করতে চায়।

এরপর শাহ্‌ আবদুল আজীজ দেহলভী (র) তাঁর ফতোয়াসমূহের মধ্যে একাধিক স্থানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ফতোয়া প্রকাশ করেছেন। যদি তাঁর ফতোয়ার উপর কথা বলা চলে, তাহলে ভারতে কারো কাছে হাদীসের সূত্র সংরক্ষিত থাকতে পারে? জমিয়তুল ওলামার মুখপত্র আল জমিয়তেও এর ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। দেওবন্দ দারুল উলমের মুফতী সাহেব যে কোন কারণেই হোক ব্যাংকের সুদ গ্রহণ করার ফতোয়া দিয়েছেন। হারাম মাল দিয়ে সদকা করার অনুমতি কে দিতে পারে? যতদূর আমার ধারণা এদের নিকটেও এ মাসায়ালার ব্যাপকতা বিদ্যমান ছিল। অন্তত আমি তাঁদের এ ফতোয়ার কারণ নির্ণয়ে অক্ষম। মাওলানা আবদুল হাই মরহুম তাঁর ফতোয়ায় যদি ভারতের বিশ্লেষণ করেননি, তথাপি দারুল কুফরে এ বস্তু জায়েয হবার কথা বলেছেন এবং বারবার বলেছেন। বেরেলী এবং বাদাউনের আলেমগণেরও এ ব্যাপারে আমার জ্ঞানমতে কোনো মতভেদ নেই। এতদসত্ত্বেও আমি আমার প্রবন্ধে ফতোয়ার রূপ দেইনি, বিষয়টির বিশ্লেষণ করে ফতোয়া দিয়েছি। আলেমগণকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, ভারতে এ মাসয়ালা কার্যকর করার সময় এসেছে কিনা।

কিন্তু সত্য কথা বলতে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ সন্দেহের কারণে, যা আপনি উত্থাপন করেছেন, এসব লিখতে ইতস্তত করছিলাম। কিন্তু কি বলব, কোন অত্যাচার-অবিচার শেষ পর্যন্ত আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে লিখনি ধরতে বাধ্য করেছিল। মুসলমানদেরকে জ্বালানো হলো, লুট করা হলো ধ্বংস করা হলো এবং এখনো হচ্ছে।১.[পরবর্তী পর্যায়ে মাওলানা নিজেই তাঁর একথার জবাব দিয়েছেন।- (মওদূদী)] আমি এসব দেখে দেখে অধীর হয়ে পড়েছিলাম। কোনো উপায়ন্তর না দেখে অর্থনৈতিক আত্মরক্ষা অথবা অর্থনৈতিক আক্রমণের পথই সামনে ছিল। তাই পেশ করলাম এবং এ জন্য আমি এর নাম রেখেছি ‘ফাই’। শামী গ্রন্থে এর খুঁটিনাটি বিবরণ আছেঃ (আরবী*********)

“বিনা যুদ্ধে অথবা বিনা বলপ্রয়োগে তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় যেমন, সন্ধিসূত্র প্রাপ্ত মাল। গনীমত নয়, ‘ফাই’ও নয়। তবে তার বিধান ‘ফাই’-এর বিধানের অনুরূপ।”

অতএব যার বিধান হলো ফাই-এর। তাকে ফাই বললে দোষ কি? আর অনুমতি হলে কি বলতে পারি যে অত্যাচারের ভয়ে কি বিবাহ ত্যাগ করার ফতোয়া দেয়া যেতে পারে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমান যে পরস্পর গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলো, তা কি যুদ্ধনীতির ফলোশ্রুতি? সত্য সত্যই কি এ আশংকা আছে?

কিন্তু এতদসহ আমি ঐসব মৌলভীদেরকে অবশ্যই ভয় করি যারা ইসলামী শাসনের অবসানের পর ছোটখাটো ব্যাপারে কুফরী ফতোয়া দিয়ে বিবাহ বাতিল ও সন্তানের অবৈধতার হুকুম জারী করে। এ অবস্থায় এটাই সম্ভব যে, প্রত্যেক মুসলমান অপরের কুফরী ফতোয়া নিয়ে পরস্পর এমন কুকর্ম শুরু করবে যা অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের জন্যে জাহান্নামের আযাবের কারণ হবে। কিন্তু কত ভালো হতো, যদি এ ফতোয়াকে বাস্তব রূপ দেবার জন্যে এসব আলেম এসব ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকতেন। নতুবা প্রত্যেকে তার নিয়তের জন্যে দায়ী হবে।

(আরবী*********)

“প্রত্যেক মানুষের জন্যে তাই হবে সে যার নিয়ত করে, অর্থাৎ কার্যের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টির জন্যে হিজরত করবে, যে হিজরত করবে পার্থিব স্বার্থের জন্যে অথবা কোন নারীর জন্যে, তারা প্রত্যেকে তাই পাবে যার জন্য সে হিজরত করেছে।”

নামাযও তো জাহান্নামের চাবিকাঠি হতে পারে। এমনিভাবে যদি ফতোয়া বাজি করে লোক একে অপরের ঘাড় ভাঙে, তাহলে এ কারণে কি জিহাদ আইন হারাম করার ফতোয়াটি সঠিক হবে?

আর একটি সন্দেহ আছে তা হচ্ছে এই যে, সেভিংস ব্যাংক নয়, সাধারণ ব্যাংক এবং কো-অপারেটিভ ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে কিছু মুসলমানও আছে এ অবস্থায় কি করা যায়? একথা ঠিক যে, লোক যাদের সাথে ব্যাংকের লেনদেন করে এমনসব কর্মচারী সাধারণতঃ অমুসলিম হয়ে থাকে। কিন্তু মালিকদের মধ্যে যখন মুসলমানও আছে তখন কাজের উপায় কি হতে পারে?

এ ব্যাপারে আলেম সমাজ চিন্তা করলে কত ভালো হতো! শাসকদের জন্য বৈধ বিষয়গুলোর ব্যাপারে ফকীহগণ কি বলেছেন? শুধু একটি মাসয়ালা সম্পর্কে আলেমদেরকে সজাগ করে দিতে চাই। সুদ বন্ধ করার জন্যে তাঁরা মাদক নিবারনী সমিতির মতো জোরদার আন্দোলন করবেন। নতুবা অন্ততপক্ষে আইনানুগ পন্থায় এতটুকু করবেন যতোটুকু করেছে ‘গো-রক্ষা’ সমিতি। হয় তো সরকার এদিকে দৃষ্টি দিবেন অথবা দেশবাসী কিছু মেহেরবানী করবেন। এমনও হতে পারে যে, কুরবানীর পশুকে (মুসলমান) কুরবানী করার দ্বারাই সুদের মীমাংসা হয়ে যাবে। নতুবা পুঁজিপতি মুসলমানদেরকে কোন আইনানুগ ব্যবস্থাপনার অধীন এ কাজের জন্যে উৎসাহিত করতে হবে যে, যে আচরণ অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে করে তারাও (মুসলমানগণও) অন্যের সংগে অনুরূপ আচরণ করবে।

(আরবী*********)

“যারা তোমাদের উপর অত্যাচার করে, তোমরাও তাদের উপর ততটা অত্যাচার কর যতটা তারা তোমাদের উপর করেছে।”- (বাকারাঃ ১৯৪)

উদ্দেশ্য শুধু এতটুকুই। নতুবা যারা পেটপূজা ও ধন লিপ্সার জন্যে এ মাসয়ালার বৈধতার চিন্তায় এতটা উন্মত্ত হয়ে পড়েছেন যে, সত্য-মিথ্যা যে কোনো পন্থায় কুরআনের একটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত বিধান রদ করার জন্যে বদ্ধপরিকর। তাদের জেনে রাখা উচিত যে, ইসলামের বুনিয়াদ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধন-সম্পদ নয়। বরঞ্চ যিনি দারিদ্রকে গৌরব মনে করতেন সেই মহান নবীই ইসলামের বুনিয়াদ বা স্তম্ভ কায়েম করেছেন। তাহলো এই যে, সকল মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঈমানের উপর নির্ভরশীল। (আরবী********) (তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ)-এর প্রতিশ্রুতি (আরবী*******) (যদি তোমরা ঈমানদার হও)-এ নীতির শর্তাধীন। ধনবান ও বিত্তশালী এখন যারা আছে, তারা আগেও ছিল। তখনো কুরআনের এ পথনির্দেশই ছিলঃ

(আরবী************)

“তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদেরকে যেন মুগ্ধ না করে। আল্লাহ তায়ালা এসবের দ্বারা দুনিয়ায় তাদেরকে আযাবে লিপ্ত করতে চান এবং তাদের প্রাণ জরাজীর্ণ অবস্থায় কাফের হয়ে (দেহ থেকে) বহির্গত হবে।”- (সূরা আত তাওবাঃ ৮৫)

এর মধ্যে এখনো আমাদের জন্য শক্তি নিহিত আছে। আমাদের মতো উম্মতকে কেন স্বয়ং নবী (স)-কেই আদেশ করা হয়েছেঃ-

(আরবী*********)

“(হে নবী) তাদের দিকে বিস্ময় বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিও না যাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে নানাবিধ সম্পদ দিয়ে ভূষিত করেছি। তোমার প্রভু তোমাকে যে রেজেক দান করেছেন তাই তোমার জন্য উৎকৃষ্ট এবং স্থায়ী।”

আজ যারা ইউরোপের (বাতিল) খোদাদেরকে দেখে চিৎকার করে বলছে, আমাদেরও এরূপ খোদা থাকা দরকার। তাদেরকে একথা বলে দেয়া দরকার, যাঁর উম্মতের জন্যে তোমরা কাঁদছ, তিনিই কসম করে বলেছেনঃ

(আরবী********)

“খোদার কসম আমি তোমাদের জন্যে দারিদ্রের ভয় করি না। কিন্তু আমি ভয় করি তোমাদের ঐরূপ পার্থিব ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের যা দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে। তারপর তারা যেমন এ সবের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা- প্রতিযোগিতা করেছিল তোমরাও তাই না কর। আর এসব ঐশ্বর্য ও প্রতিযোগিতা তাদেরকে যেমন আল্লাহ থেকে ভুলিয়ে রেখেছিল, তেমনি তোমাদেরকে যেন না রাখে।”-(বুখারী)

তোমরা বলছো যে, মুসলমানদের কাছে অর্থ নেই, ভালো পোশাক পরিচ্ছদ নেই, এটা নেই, সেটা নেই। কিন্তু মুসলমানদের অস্তিত্বের সার্থকতা যাঁর জন্যে, তিনি বলেন, ওরে পাগল! তোমরা খবরই রাখ না।

বুখারীতে আছেঃ-

(আরবী*********)

“দীনার-দিরহাম তথা অর্থ-সম্পদের মালিক, জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধানকারী, চাকচিক্যময় হোব্বা-জোব্বা পরিধানকারী-সকলেই ধ্বংস হয়েছে।”

তোমরা বল যে, দরিদ্র জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তোমরা যাঁর উম্মত তিনি বলেন, বিত্তশালী ধ্বংস হয়েছে। এখন তোমরা বল, আমরা কার কথা শুনব? সত্য কথা এই যে, যে জাতির মধ্যে দারিদ্রের হাহাকার আছে তারা যখন সুদ খেলো এবং পেট ভরে খেলো, তের বছরের মধ্যে বাইশ টাকাকে বাইশ লাখে পরিণত করলো, তাদের দারিদ্রের মর্সিয়া গাইবার জন্যে লোকদের অভাব নেই। যে জাতি সুদের ময়দানে অগ্রগামী, তাদের সকলেই কি পেট ভরে খেতে পায়? মাথা পিছু তিন পয়সা আয় কোন জাতির? তাদের কথা ছেড়ে দিলেও, সরকারের সাহায্যে যারা সুদ খায় তাদের মজুরদের দুরবস্থা কি সংবাদপত্রে তোমাদের নজরে পরে না? নবী মুস্তফা (স) সত্যিই বলেছেনঃ

(আরবী******)

“আদম সন্তানদের কাছে যদি দুটো উপত্যকাপূর্ণ সম্পদ থাকতো, তবু তারা তৃতীয় একটির জন্যে ব্যস্ত হয়ে পরতো। আর মানব সন্তানের পেট (বা চোখ) মাটি ছাড়া আর কিছু দিয়ে পূর্ণ করা যাবে না।”-(বুখারী)

(আরবী******)

“সুতরাং অল্পে তুষ্টির জন্যে মনজিল ত্যাগ করা যায় না। হে রাষ্ট্র চালক! দাঁড়াও, এ পথের (সম্পদ লাভের) শেষ নেই।”

আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মুসলমানদের জন্যে যে সুর ঝংকৃত হয়েছিল তাই যথেষ্টঃ (আরবী*******)

“হে খোদা! আখেরাতের আরাম আয়েশ ছাড়া আর আমাদের জন্যে কিছুই চাই না।”

- (তরজুমানুল কুরআন-শাবান-রমযান-১৩৫৫ হিজরী, নভেম্বর-ডিসেম্বর-১৯৭৬ খৃঃ)
সমালোচনা
(সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী)

মাওলানা মানাযের আহসান গিলানী সাহেবের মতের সাথে যে যে বিষয়ে আমি একমত হতে পারিনি,তা সংক্ষেপে টীকায় সন্নিবেশিত করেছি। কিন্তু যে মৌলিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মাওলানা তার যুক্তি প্রদর্শন করেছেন,তার উপরে আলকপাত করার জন্যে নিছক ইশারা ইঙ্গিত যথেষ্ট নয়। তাই এ বিশদ আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি।

নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে মাওলানা তাঁর যুক্তি পেশ করেছেনঃ

মাওলানার যুক্তির সংক্ষিপ্ত সার
একঃ তাঁর দাবী এই যে,নিছক সুদ হারামের বিধানই নয়,বরঞ্চ সকল অবৈধ চুক্তি ও নাজায়েয অর্থনৈতিক উপায় –উপাদন হারাম করার বিধান দুজন মুসলমানের পারস্পরিক লেনদেনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। তার অর্থ এই যে,অমুসলিম জাতির সাথে যেসব আর্থিক কারবার হবে তাতে হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের কোন ভেদাভেদই থাকবে না।

দুইঃ তার মতে জিম্মি নয় এমন মুসলমানের রক্ত ও সম্পদ শরীয়তে হালাল করা হয়েছে। অতএব এ ধরনের অমুসলিমদের ধনসম্পদ যেভাবেই নেয়া হোক,তা জায়েয।তা সুদ হোক, জুয়া হোক অথবা তাদের কাছে মদ, শুকরের মাংস মৃত জীব প্রভৃতি বিক্রি করা হোক না কেন। অথবা ন্যান্য এমন কোন পন্তা অবলম্বন করা হোক যা মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে হারাম করা হয়েছে। মুসলমানগন যেভাবেই তাদের সমপদ হস্তগত করুক না কেন তা মালে গণিমত বা ‘ফাই’ বলে বিবেচিত হবে। আর তা হবে তাদের জন্য হালাল ও পবিত্র।

তিনঃ তাঁর মতে ইসলামী রাষ্ট্র নয় এমন প্রত্যেকটি দেশই দারুল হরব এবং তার অমুসলিম অধিবাসী দারুল হরবী। তিনি দারুল কুফরকে দারুল হরবের এবং কাফের গায়েব জিম্মিকে হরবীর সম অর্থবোধক মনে করেন। এজন্য তার নিকটে যেসব যেসব দেশে অমুসলিম শাসক অধিষ্ঠিত আছে টা সত্যিকার অর্থে দারুল হরব আর সেখানে চিরকাল মুসলমানদের জন্যে সেসব বিধানই জারী থাকা উচিত যা দারুল হরব সম্পর্কে ফেকাহর গ্রন্থসমুহে বর্ণিত আছে।

চারঃ পূর্ববর্তী ফকিহগন দারুল হরবের যে সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। মাওলানার মতে তা ভারতের বেলায় খাটে।আর এ দেশের মুসলমানদের পজিশন ফেকাহের দৃষ্টিতে ‘নিরাপত্তাপ্রাপ্ত’– এর ন্যায়। অন্য কথায় মুসলমান এ দারুল হরবে এ অবস্থায় বসবাস করে যেন তারা এখানকার হারবি শাসকদের কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ করেছে

পাচঃ ‘নিরাপত্তাপ্রাপ্তদের’ সম্পর্কে ইসলামি আইন হচ্ছে এই যে, তারা যে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লাভ করে বসবাস করছে, সে রাষ্ট্রের কোন আইন লংঘন করতে পারবে না। অতএব মাওলানার মতে ভারতের মুসলমানদের জন্য অনৈসলামী রাষ্ট্রের আইনের আনুগ্য এতাটা অপরিহার্য যে চুল পরিমানে তা অমান্য করলে জাহেননামের যোগ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু ইসলামের অধিকাংশ নির্দেশ ও আইন পালনের ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার কারণ এই যে, তারা দারুল হারবে বসবাস করে। হত্যা, ধ্বংসাত্মক কাজ, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ, শঠতা এবং এ ধরনের অন্যান্য পন্থায় হরবি কাফেরদের ক্ষতি সাধন করা এবং তাদের সম্পদ হস্তগত করা মুসলমানদের জন্যে এ জন্য নাজায়েজ যে, দেশীয় আইন তা অন্যায় বলে ঘোষণা করে। এজন্য নয় যে, এ কাজগুলো ইসলামী শরীয়তে হারাম। কারণ তামাদ্দুন, অর্থনীতি এবং নৈতিকতার অধিকাংশ ব্যাপারে ভারত ভূমিতে ইসলামী শরীয়ত ততদিন পর্যন্ত মানসুখ থাকবে যতদিন এখানে অনৈসলামিক রাষ্ট্র কায়েম থাকবে। এখন শরীয়তের আইনের মধ্যে শুধুমাত্র চুক্তি আইন এখানে মুসলমানদের পালনীয় এবং তার দৃষ্টিতে লেনদেন ও জীবিকা অর্জনের জেসব উপায়- উপাদান শরীয়ত হারাম করেছে, কিন্তু দেশীয় আইন হালাল করেছে, তার সবই আইনগত হালাল এবং শরীয়তের দিক দিয়েও হালাল। তার জন্যে দুনিয়াতেও কোনো শাস্তি নেই এবং আখিরাতেও নেই কোনো জবাবদিহি।

বর্ণিত যুক্তিসমূহের উপর সামগ্রিক মন্তব্য
আমার মতে এর একটি কথাও ঠিক নয়। যে হানাফি আইনের প্রতিনিধি হিসাবে মাওলানা যেসব কথা বলেছেন, সে আইনও এসব সমর্থন করে না। এ প্রবন্ধে মাওলানা ইসলামী আইনের যে চিত্র এঁকেছেন, তা শুধু ভ্রান্তিই নয়, কুৎসিতও বটে। এসব দেখে মুসলমান সম্পর্কে কেউ কখনোই কোনো ভাল ধারণা পোষণ করতে পারেনা। যদি কোনো অজ্ঞ ব্যক্তি এ চিত্র দেখে তাহলে সে ইসলামকে দুনিয়ার মধ্যে একটি অতি নিকৃষ্ট ধর্ম এবং মুসলমানদেরকে একটি মারাত্মক জাতি মনে করবে। অতঃপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে যে অমুসলিম রাষ্ট্রের আইন–কানুন এসব নিরাপত্তা প্রাপ্তদের হাত থেকে অন্যান্য জাতির জান-মাল, ইজ্জত-আবরু সংরক্ষিত করে রেখেছে। অন্যদিক দিয়ে যদি শরীয়তের এ ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে ভারতের মুসলমানগন এ দেশে বসবাস শুরু করে তাহলে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাদের ভিতর ইসলামের নামটুকুও বাকী থাকবে না। আল্লাহ না করুন, যদি অমুসলিম শাসনের প্রথম থেকেই ভারতের এসব মূলনীতির উপরে কাজ করা হত, তাহলে আজ যতটুকু ইসলামিয়াত মুসলমানদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাও দেখা যেতো না। বিগত দেড়শ বছরে ভারতের মুসলমান একেবারে বিকৃত হয়ে পড়তো। এটা অবশ্যই হতে পারত যে, তাদের বিষয়-সম্পত্তির একটা অংশ সংরক্ষিত থাকতো এবং তাদের মধ্যে মাড়োয়ারি, বেনিয়া ও শেঠদের মত একটা শ্রেণীর উদ্ভব হতো।

একথা বলার উদ্দেশ্য কক্ষনো এই নয় যে মাওলানা স্বেচ্ছায় ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি ইসলামী আইন যেভাবে বুঝেছেন তিনি ইসলামী আইন যেভাবে বুঝেছেন, পরিপূর্ন ঈমানদারী ও সদিচ্ছাসহ,ঠিক তেমনি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমার আপত্তি তার বর্ণিত মর্ম ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে। ইসলামী আইন যতুকু আমি অধ্যয়ন করেছি, তার আলোকেই একথা বলার সাহস করছি যে, বিশেষ করে উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো সম্পর্কে মাওলানা শরীয়তের মূলনীতি ও বিষয়সমূহ ঠিকমত বুঝতে পারেননি। এ ভুল ধারনার দুটো কারণ অনুমান করা যেতে পারে।

প্রথমঃ যে সময়ে মুজতাহিদ ঈমামগণ ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক আইন (CONSTITUTIONAL LAW) ও আন্তর্জাতিক আচরণ সম্পর্কে কিতাব ও সুন্নাহর হেদায়াত অনুযায়ী এবং স্বীয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে এসব বিধান প্রণয়ন করেছিলেন, সে সময়ে এসব ফকিহগন শুধু কুরআন-হাদিস -ফেকাহর শিক্ষাদাতাই ছিলেন না, বরঞ্চ তারাই ছিলেন রাষ্ট্রের আইণ সম্পর্কে পরামর্শদাতা এবং বিচারালয়গুলোর প্রধান বিচারক। ইসলামী রাষ্ট্রের দৈনন্দিন শাসনতান্ন্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সম্মুখীন হতো। তখন এসব মনীষীদের মতামত গ্রহন করা হতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধের বিভিন্ন রুপ প্রকাশ পেতো এবং তার থেকে যে আইনগত সমস্যার উদ্ভব হতো,তার মীমাংসা এসব মনীষীগণই করতেন। তারা তাদের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবে যেসব আইন সংক্রান্ত পরিভাষা ও বাক্য ব্যবহার করতেন তার মর্ম শুধু শাব্দিক ব্যাখ্যার উপরই সীমিত ছিলনা। বরঞ্চ তার প্রকৃত ব্যাখ্যা সেসব অবস্থা ও পরিস্থিতি, যার উপর এসব পরিভাষা ও বাক্য প্রযোজ্য হতো। অথবা যদি কোনো পরিভাষা ও বাক্যে অস্পষ্টতা রয়ে যেতো,অথবা একই বিষয়ের বিভিন্ন স্তরে একই পরিভাষা ব্যবহৃত হতো এবং প্রকাশ শব্দের স্তরসমূহের পার্থক্য নির্ণয়কারী কিছু থাকতো না, অথবা ব্যাপক অর্থে একটি শব্দ বলা হতো এবং শুধু অবস্থাভেদে তার বিভিন্ন অর্থের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হতো তাহলে এর দ্বারা বাস্তবে আইন প্রয়োগ ও ব্যবহারে কোন অনিষ্ট ঘটবার আশংকা থাকতো না। এ আশংক ও ছিলনা যে, কোন আইনজ্ঞ ব্যক্তি নিছক শব্দগুলো সুস্পষ্ট না হবার কারণে কোন বিধানকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার উপর প্রয়োগ করবে। এজন্য যে, সে সময়ে ইসলামী আইনের পরিভাষা এবং বিশেষ আইন সংক্রান্ত বাক্যগুলোর মর্যাদা ছিল তৎকালে প্রচলিত মুদ্রার মত। বাস্তব জগতে তার প্রচলন ছিল না। এদের মর্ম উপলব্ধি করতে, যথাস্থানে ব্যবহার করতে ও প্রত্যেকটির সঠিক সংজ্ঞা জানতে কোনোই অসুবিধাই ছিলনা। প্রত্যেক আইনজ্ঞ ব্যক্তিকে দিবা-রাত্রি পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে ঐসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো যাতে এ ভাষা প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু এখন কিছুকাল যাবত সে অবস্থা আর নেই। শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী ও ন্তর্জাতিক ব্যাপারের সাথে কার্যত আলেমদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ বিলুপ্ত হয়েছে এবং যেসব রাষ্ট্র এখনো আছে সেখানেও এসব সমস্যা শরীয়তের আলেমদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ব্যবহারিক জগতে ইসলামী আইনের পরিভাষা ও বাক্যগুলোর ব্যবহার বহুকাল যাবত বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রাচীন ঐতিহাসিক মুদ্রায় পরিনত হয়েছে। এখন তার মূল্যের আর সে অবস্থা নেই যে, প্রচলিত থাকার কারণে বাজারে সবার কাছে সে এক পরিচিত বস্তু। কিন্তু তার পুরাতন বাজার দর ( MARKET VALUE ) জানার জন্যে পুরানো নথি –পত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কা এবং বর্তমান যুগের কার্যকরী অবস্থার উপর অনুমান ক সে সময়ের প্রকৃত অবস্থা বুঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এ কারণেই রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সম্পর্কে ইসলামী ফিকাহর বিধানগুলোর উপলব্ধি করা, বিবাহ, উত্তরাধিকার আইন প্রভৃতির তুলনায় অধিকতর কষ্টকর।১.[এর একটি মজার দৃষ্টান্ত মাওলানার প্রবন্ধে উপরে বর্ণিত হয়েছে। শামী গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিধানের উল্লেখ করেছেন যে, গতা সমুদ্র চিরকালের জন্যে অনৈসলামিক রাষ্ট্রের অধিকারে থাকবে। যে সময়ে প্রথম প্রথম কোনো মুজতাহিদ একথা বলেন, তখনকার অবস্থার প্রেক্ষিতে তা হয়ত ঠিক ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালের লোকেরা যখন একথা কোনো কিতাবে লিখিত আকারে দেখলো, তখন অন্ধ অনুকরন করে তাকে ইসলামী আইনের একই স্থায়ী সিদ্ধান্ত মনে করলো। অথচ সমুদ্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্বন্ধের বৃহত্তম উপায়। কোন রাষ্ট্রই বিশ্বব্যাপী প্রভাব ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না, সমুদ্রের উপর যদি তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হয়। ইসলামী ফিকাহর অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা যদি মাদ্রাসাগুলো পর্যন্ত সীমিত না হতো, আলেমদের বাস্তব সম্পর্কে যদি দুনিয়ার রাজনীতির সাথে হতো, তাহলে তারা অনুভব করতেন যে, সমুদ্র কাফেরদের অধিকারে ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্যে স্থলেই আবদ্ধ থাকার সিদ্ধান্ত করা কত মারাত্মক ভুল।] কারণ এখন তার শুধু শব্দগুলো রয়ে গেছে। গ্রন্থের মুল পঠিতব্যও শাব্দিক এবং তার ব্যাখ্যাও শাব্দিক।

দ্বিতীয়ঃ যার দিকে স্বয়ং মাওলানা ইংগিত করেছেন, বিগত এক দেড় শতাব্দী যাবত মুসলমানদের উপরে যে আর্থিক দুর্গতি নেমে এসেছে, যেভাবে দেখতে দেখতে তাদের কোটি কোটি টাকার বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে,এবং যেভাবে মুসলমানদের সচ্ছল পরিবার-গুলো অন্নের ভিখারী হয়ে পড়েছে, তা দেখে দেখে প্রত্যেক দরদী মুসলমানের মতো মাওলানার হৃদয়ও দুঃখে ভেঙে পড়েছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখেছেন শরীয়তে এ বিপদের কোন সমাধান খুজে বের করা যায় কিনা। এ অনুপ্রেরণার দ্বারা বশীভূত হয়ে অধিক ক্ষেত্রে তাদের লিখনী ভারসাম্য এবং ফকীহসুলভ সতর্কতা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। যেমন ধরুন তাদের সিদ্ধান্ত যে ভারতে সুদ না নেয়া গুনাহ। অথবা তাদের এ বিবৃতি যে ‘অবৈধ চুক্তির’ অবৈধতার যাবতীয় বিধান শুধুমাত্র মুসলমানদের পারস্পারিক কায়কারবার পর্যন্তই সীমিত। ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা দেখলে কোন মুসলমানের হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় না? আর কে চায়না যে, তারা এ দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভ করুক? এ বিষয়ে আমাদের ও তাদের মধ্যে তিল পরিমান মতানৈক্য নেই। রাজী নই যে কিন্তু আমি একথা স্বীকার করত ভারতের মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতন হয়েছে, পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ ভাবে সুদ না খাবার কারণে। আর এঅবস্থার পরিবর্তন সুদ হালাল হবার উপর নির্ভরশীল। উপরন্তু আমি মানতে রাজী নই যে, সুদের অবৈধতা সামান্যতম পরিমানেও মুসলমানদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতিবন্ধক। যে ব্যক্তি (আরবী********) (আল্লাহ সুদ ধ্বংস করেন ও সদকা বর্ধিত করে দেন)- এর উপর ঈমান রাখে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর এ বাণীকে জীবিকা ও পরকাল উভয়ের মধ্যে এক অটল সত্য বলে জানে, তার মনে এধরনের কোন সন্দেহের উদ্রেক হওয়া উচিত নয়। মাওলানা চিন্তা করলেন তার কাছে এসত্য উদ্ঘাটিত হবে যে, মুসলমানদের অর্থনৈতিক অধঃপতনের প্রকৃত কারণ সুদ না খাওয়া নয়। বরঞ্চ প্রকৃত কারণ হচ্ছে সুদ দেয়া, যাকাত দিতে অবহেলা করা এবং ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারে রহিত করে দেয়া। যেসব পাপের শাস্তি মুসলমানদের ভগ করতে হচ্ছে তা হচ্ছে এই। তারা যদি এ পাপের উপর অবিচল থাকে এবং তার উপরে সুদখোরীর পাপ যোগ করা হয়, তাহলে কতিপয় লোক হয়তো বিত্তশালী হবে এবং কিছু সরলচেতা মুসলমান প্রতারিত হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিক দিক দিয়ে জাতির আর্থিক অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা, তাদের পারস্পারিক ভালবাসা, সৌহার্দ,দয়া-দাক্ষিণ্য, সাহায্য, সহানুভুতি প্রভৃতির চরম অধঃপতন ঘটবে। এমনকি তাদের জাতীয়তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আপনি সুদের নাম ‘ফাও’ রাখুন অথবা ‘মায়েদাতুম মিনাস সামায়ে’-_আকাশ থেকে অবতীর্ণ খাদ্যপূর্ণ (দস্তরখান) বলুন,তাতে করে তাঁর আসল তত্ত্ব ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্টে চুল পরিমাণ পার্থক্য সূচিত হবে না। সুদ তাঁর প্রকৃতিগত দিক দিয়ে যাকাতের বিপরীত এবং এর মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতিতে কোনো রাষ্ট্রের দারুল হরব অথবা দারুল ইসলাম হওয়াতে কোনোই পার্থক্য হয় না। এ কিছুতেই সম্ভব নয় যে, একই অর্থনৈতিক জীবনে এ দুটো (সুদ ও যাকাত) একত্র হতে পারে। এক মানসিকতা হচ্ছে টাকা গণনা করাতে, গণনা করে করে তা জমা করে রাখাতে, সপ্তাহ ও মাসের হিসেবে তা বাড়াতে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধির হিসেব করতে আনন্দ লাভ করা। দ্বিতীয় মানসিকতা আনন্দ লাভ করে-_মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকা অর্জন করতে, অর্জন করে তা নিজে খেতে ও অপরকে খাওয়াতে এবং আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতে। কোনো বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি কি ধারণা করতে পারে যে, এ উভয় মানসিকতা একই মন-মস্তিষ্কে একত্র হতে পারে? একি কখনো আশা করা যেতে পারে যে, যখন কোনো মুসলমান সুদে টাকা খাটাতে লাগবে এবং মাঝে-মধ্যে তাঁর বুদ্ধির প্রতি নজর রাখতে মজা পাবে, তারপর তাঁর পকেট থেকে যাকাত ও সদকার জন্যে একটি পয়সাও বেরুবে? এর পরেও কি কোনো মুসলমান কোনো মুসলমানকে কর্জে হাসানা (বিনা সুদে কর্জ) দেয়া সহ্য করবে? এরপরে মুসলমানদের অবস্থা কি সেই জাতির মতো হবে না যাদের সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********)

“অতঃপর তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, প্রস্তরের ন্যায় অথবা তাঁর চেয়েও কঠিন এবং তোমরা নিশ্চয় তাদেরকে জীবন ধারনে মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা লোভী দেখতে পাবে।”

কয়েকজন কারুণ এবং শাইলক সৃষ্টি করার জন্যে গোটা জাতি কেন আত্নহত্যা করবে? আর এ আত্নহত্যা জায়েয প্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ ও রাসূলের(সঃ) বিধানের কেন অপব্যাখ্যা করা হবে? তারপর ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ)এর মত মনীষীকে এ কাজের অংশীদার কেন করা হবে?

তারপর আমি বলতে চাই যে, দুনিয়ার মধ্যে মুসলমানই এমন এক জাতি যারা বিগত তেরশ বছর ধরে পুজিবাদী অর্থনীতির বিরোধিতা করে আসছে এবং যারা কার্যত এ ভ্রান্ত ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদের জন্যে চেষ্টা করছে। যে বস্তু চিরদিনের জন্যে এ জাতিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শত্রু হিসেবে অবিচল রেখেছে এবং তাঁর মধ্যে মিশে যাওয়া থেকে থেকে রক্ষা করেছে তাহলো যাকাতের অপরিহার্যতা এবং সুদের অবৈধতা। সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিষ্ট এবং নিহিলিষ্ট সকলেই পুজিবাদীর সাথে আপোষ করতে পারে, কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত এ দুটো প্রতিবন্ধকতা কায়েম আছে, মুসলমান কখনো তাঁর সাথে আপোষ করতে পারে না। এ কারণেই ঐসব জাতি পুঁজিবাদে মিশে একাকার হয়ে গেছে, যাদের ধর্ম সুদ খেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু মুসলমানগণ তেরশ বছর ধরে এ মুকাবিলায় অটল হয়ে আছে। এখন যখন দুনিয়াবাসীগণ চক্ষু খুলেছে এবং তারা এ ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদের জন্যে দলে দলে একত্র হচ্ছে, তখন এ কেমন দুর্ভাগ্যের কথা যে, মুসলমান এ সংগ্রাম থেকে পশ্চাৎপদ হবে এবং আপন হাতে নিজ দুর্গের সুদৃঢ় গম্বুজগুলো ধ্বংস কর এপুজিবাদের দিকে সন্ধির হস্ত প্রসারিত করবে?

এ প্রয়োজনীয় ভূমিকার পর এখন আমরা আইনগত আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি।

অবৈধ চুক্তি কি শুধু মুসলমানদের মধ্যেই নিষিদ্ধ?
মাওলানার প্রথম দাবীর ভিত্তি এই যে, কুরআন মজিদের যেখানে জীবিকার্জনের অবৈধ উপায়সমূহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে (আরবী***) (তোমাদের মধ্যে) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর অর্থ এই যে, মুসলমান পরস্পরে অবৈধ চুক্তিতে কোনো কারবার করবে না। বলা হচ্ছেঃ

(আরবী********)

“হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের মধ্যে অবৈধ উপায়ে তোমাদের মাল ভক্ষণ করো না। তবে তোমাদের উভয়ের সম্মতিক্রমে ব্যবসা করতে পারো।”- (সূরা আন নিসাঃ ২৯)

এখন একথা ঠিক যে, সুদও ধন অর্জনের অবৈধ পন্থাগুলোর একটি। এজন্য কুরআনে বলা হয়েছে যে, (আরবী*********) (আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন) – এ যদিও প্রকাশ্য শব্দের দিক দিয়ে সাধারন বিধান, কিন্তু এটা যে মূল বিধানের শাখা তাঁর সাথে একেও তাঁর অনুসরণে শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা উচিৎ। এর সমর্থনে পাওয়া যায় মকহুলের বর্ণিত হাদীস থেকেঃ (আরবী********) অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিম হরবীর মধ্যে আধিক্যের শর্তে যে লেনদেন হবে তাঁর উপরে ‘সুদ’ শব্দ আরোপ করা যাবে না। অন্য কথায় (***) এর অর্থ এই যে, গায়ের জিম্মী কাফেরের নিকট হতে যে সুদ নেয়া হবে তা মোটেই সুদ নয়। তাহলে তা হারাম কি করে হলো?

এ হলো মাওলানার যুক্তির সারাংশ। এ বিষয়ে প্রথম এবং মৌলিক ভুল এই যে, কুরআনের উদ্দেশ্যের প্রতি প্রতি লক্ষ্য না রেখে শুধু বাহ্যিক শব্দগুলো থেকে মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। কুরআনের সাধারণ বর্ণনাভংগী এই যে, সে নৈতিকতা ও আচার-আচারণ সম্পর্কে যত উপদেশ দেয় তা সব মুমিনদের উদ্দেশ্যেই দেয় এবং বলে তোমরা এরূপ করো অথবা এরূপ করো না। এ বর্ণনাভংগীর মধ্যে অন্যান্য তাৎপর্যও রয়েছে যার আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। এখানে শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, এ ধরনের বাচনভংগীতে নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যত নির্দেশ দিয়েছেন ফকীহগণের মধ্যে কেউই সেগুলোকে শুধুমাত্র মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলেননি। কেউ একথা বলেননি যে, দুজন মুসলমানের মধ্যে যে জিনিস হারাম, তাই মুসলমান এবং অমুসলমানের মধ্যে হালাল অথবা মুস্তাহাব। এমন হলে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী তামাদ্দুনিক আইনের মূল উৎপাটিত হবে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী*******)

অর্থাৎ এর অর্থ কি এরূপ মনে করা হবে যে, মুসলমান শুধু মুসলমানের নিকটেই মিথ্যা কসম করবে না? আর অমুসলিমদের বেলায় মিথ্যা কসম করতে কোনো দোষ নেই?

আল্লাহ বলেনঃ

(আরবী******)

অর্থাৎ এর অর্থ কি এই যে, মুসলমান কি শুধু ঐসব আমানতের রক্ষণাবেক্ষণ করবে যা মুসলমানের সাথে সম্পর্কিত? আর কাফেরের গচ্ছিত আমানত অবাধে খেয়ানত করা যাবে?

আল্লাহ আরও বলেনঃ

(আরবী******)

অর্থাৎ এর ব্যাখ্যা কি এই হবে যে, মুসলমানের পরিবর্তে কোনো কাফের যদি কোনো মুসলমানকে বিশ্বাস করে বিনা লেখা-পড়ায় তাঁর কাছে কিছু মাল জমা রাখে,তাহলে তাকে ‘ফাও’ মনে করে আত্নসাৎ করা যাবে?

(আরবী*******)

তাহলে কি এসব নির্দেশ বা বিধান শুধু কি মুসলমানদের পারস্পরিক ব্যাপারসমূহের জন্যে? কাফেরের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করা অথবা সত্য সাক্ষ্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অথবা দলিল-পত্রের অমুসলিম লেখক ও সাক্ষ্য দাতাকে ভয় দেখানো প্রভৃতি কি জায়েয কাজ?

এরপর যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলঃ

(আরবী*******)

এর থেকে কি এটা বলা যেতে পারে যে, অন্য জাতির মধ্যে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার ছড়ানো মুসলমানদের জন্যে জায়েয? (সুরা নূর)

(আরবী********)

এর কি এ ব্যাখ্যা করা হবে যে, কাফের নারীদের বিরুদ্ধে প্রাণ খুলে মিথ্যা অপবাদ রটানো যাবে?(নুর-২৩)

(আরবী*********)

এর অর্থ কি এই হবে যে, কাফের নারীদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করা এবং তাদের উপার্জনের অর্থ ভোগ করা জায়েয? এধরনে ব্যাখ্যা করে প্যারিসে সরকারী লাইসেন্স গ্রহণ করে কোনো বেশ্যালয় খোলা কি মুসলমানের জন্য হালাল হবে?(নুর-৩৩)

(আরবী*********)

শুধু মুসলমানদের গীবত করা নাজায়েয — উপরোক্ত আয়াতের কি এরূপ ব্যাখ্যা করা যাবে? কাফেরদের বদনাম করাতে কি কোনো দোষ নেই?- (হুজরাত-১২)

যদি এ মূলনীতির ভিত্তিতে কুরআন সুন্নাহর বিধানের ব্যাখ্যা করা হয় এবং মুসলমান তা মানতে শুরু করে তাহলে অনুমান করুন যে, এ জাতির কি পরিনাম হতে পারে।

যদি ধরেই নেয়া যায় যে, (আরবী********) এর বিধান মুসলমানদের পারস্পরিক ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ, আর এ নীতি অন্যান্য বিধানগুলোতে প্রযোজ্য হবে না, তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, জিম্মী কাফেরদেরকে সুদী লেনদেন করতে নিষেধ কেন করা হয়েছে? আর নবী বা কেন অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে এমন চুক্তি করলেন যে, তাদেরকে সুদী কারবার ছেড়ে দিতে হবে। নতুবা চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। ফেকাহর গ্রন্থগুলোতে এ কথাই বা কেন বলা হলো যে, যদি কোনো হরবী কাফের নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে আসে তাহলে তাঁর সঙ্গে সুদের লেনদেন করা হারাম?

এখন রইলো (আরবী ********) হাদীসটি। এ সম্পর্কে কথা এই যে, প্রথমত, ‘হরবী’ শব্দের অর্থ শুধু গায়ের জিম্মী কাফের নয়। বরঞ্চ যুদ্ধরত জাতির এক ব্যক্তি। হানাফী ফকীহগণের ব্যাখ্যা দ্বারা তা সামনে প্রমাণ করা হবে।

দ্বিতীয়ত,(আরবী***) এর এ অর্থ নয় যে, হরবী কাফের থেকে যে সুদ নেয়া যাবে, তা সুদই নয়। বরঞ্চ তাঁর অর্থ এই যে, যদিও তা আকৃতি ও প্রকৃতিতে সুদ, কিন্তু তাকে আইনে হারাম হওয়া থেকে ব্যাতিক্রম করা হয়েছে এবং তা এমন এক বস্তু যেন তা সুদই নয়। নতুবা কোনো সুদ সম্পর্কে একথা বলা যে, তা সুদই নয়, এমন অর্থহীন বেহুদা কথা যে তা নবী (সঃ) এর প্রতি আরোপিত করাকে আমি গোনাহ মনে করি। এ অত্যন্ত যুক্তিসংগত কথা যে, কোনো বিশেষ অবস্থায় সুদকে শাস্তি ও অবৈধতা থেকে ব্যাতিক্রম করে রাখা হবে, যেমন স্বয়ং কুরআনে অনিবার্য কারণে মৃত জীব, শূকর এবং এরূপ অন্যান্য হারাম জিনিস খাওয়া ব্যতিক্রম করেছেন। কিন্তু এ এক অত্যন্ত অযৌক্তিক কথা যে, সুদের প্রকৃতি হুবহু রইলো। আর তাকে আমরা কোথাও সুদ বলে আখ্যায়িত করবো এবং অন্যস্থানে তার সুদ হওয়াটাই অস্বীকার করবো। এভাবে তো প্রতিটি হারাম কাজকে নাম পরিবর্তন করে হালাল করা যেতে পারে। খেয়াল খুশী মতো যে কোনো খিয়ানতকে বলে দিলেই হলো যে, এ খিয়ানতই নয়। যে মিথ্যাকে জায়েয করতে হবে, তা শুধু বলে দিলেই হবে মিথ্যা শব্দটি এর উপর প্রযোজ্য নয়। কোনো গীবত, অশ্লীলতা ও হারামখোরীর প্রতি মন আকৃষ্ট হলে, তাঁর নামটা পরিবর্তন করে মনে করুন যে, তাঁর প্রকৃতি বদলে গেছে। আল্লাহর রসূল তাঁর উম্মতকে এ ধরনের শাব্দিক ছলনা শিক্ষা দিবেন এ তাঁর মর্যাদার পরিপন্থী।

তৃতীয়ত, এ হাদীসটিতে যে বিধান বর্ণিত হয়েছে, তা একটি অনুমতি ও সুযোগ মাত্র, তাকে মুসলমানের সাধারন কর্মপদ্ধতি বানানো উদ্দেশ্য নয়। এ হাদীসটি কোন পর্যায়ের তা আলোচনা করা আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কারণ হাদীস গ্রহণ ও বর্জন করার ব্যাপারে ফকীহগণের নীতি মুহাদ্দিসগণের নীতি থেকে আলাদা। ইমাম আযম ও ইমাম মুহাম্মদ (রঃ)- এর মতো মুজতাহিদগণ যে হাদীসকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন, তাকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করা ঠিক হবে না। কিন্তু সংক্ষিপ্ত, অস্পষ্ট ও বিতর্কিত খবরে ওয়াহেদকে১.[একথা উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না যে, ইমাম আবু ইউসুফ,ইমাম শাফেয়ী,ইমাম মালেক,ইমাম আহমদ এবং অধিকাংশ মুহাদ্দিস এ রেওয়াতকে বর্জন করেছেন।] এতটা ফলাও করাও ঠিক নয় যে, কুরআন, হাদিস ও সাহাবীদের কার্যকলাপের সর্বসম্মত সাক্ষ্য একদিকে আর অপরদিকে রাখতে হবে এ হাদীসটি এবং এ হাদীসটির ব্যাখ্যা ঐসবের সাথে সামঞ্জস্যশীল করার পরিবর্তে, ঐগুলোকে হাদীসটির ছাঁচে ঢালবার চেষ্টা করত হবে। কুরআন এবং সমস্ত সহীহ হাদীসগুলোতে ‘রিবা’কে হারাম বলা হয়েছে। তার অর্থ এই যে, মুসলমানগণ পরস্পরেও এর লেনদেন করতে পারবে না এবং অন্য জাতির সাথেও এ কারবার জায়েয হবে না। রাসুলুল্লাহ (সঃ) নাজরানবাসীদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন তাঁর থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, মুসলমানগণ শুধু নিজেরাই সুদী লেনদেন থেকে বিরত থাকবে না। বরঞ্চ যে সকল অমুসলিমদের উপর তাদের ক্ষমতা চলে তাদেরকেও জোর করে এ কাজ থেকে বিরত রাখবে। সুদ হারাম হবার পর এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি যে, নবীর অজ্ঞাতসারে বা তাঁর অনুমতিতে কোনো মুসলমান কোনো জিম্মী অথবা গায়ের জিম্মী কাফেরের সাথে সুদী কারবার করেছে। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও এর কোনো নজীর পেশ করা যাবে না। শুধু সুদের ব্যাপারই নয়, অবৈধ চুক্তিসমূহের মধ্যে এমন একটিও নেই যার হারাম হবার বিধান নাযিল হবার পর তা সম্পাদন করার জন্যে নবী (সঃ)কাউকে অনুমতি দিয়েছেন। দৃষ্টিভংগী ও নীতির দিক দিয়ে যারা হরবী তারা তো দূরের কথা, যারা কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তারা ঠিক যুদ্ধের সময় নবী (সঃ)এর সাথে একটি অবৈধ চুক্তির উপরে কাজ করতে চাইলো এবং মোটা টাকা দিতে চাইলো, কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন।১.[এ ঘটনা ঘটে খন্দকের যুদ্ধের সময়।বর্ণনা করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)।মুশরেকদের এক সম্ভ্রান্ত লোকের লাশ খন্দকে পড়ে যায়।তারা মুসলমানদেরকে টাকা দিয়ে সে লাশ খরিদ করতে চায়।নবী (সঃ)কে একথা জানানো হলে তিনি এরূপ করতে নিষেধ করেন।(ইমাম আবু ইউসুফের কেতাবুল খেরাজ-দ্রষ্টব্য)এর থেকে জানা গেছে যে,যুদ্ধের সময় দুশমনের সাথে অবৈধ চুক্তির উপর কারবার করার অনুমতি যদি দেয়া হয়ে থাকে,তথাপি তা ছিল অপছন্দনীয়।চরম অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া এরূপ চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করা মুসলমানদের মর্যাদার খেলাপ।হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)এর সাথে জড়িত ঘটনা থেকেও একথার প্রমাণ মেলে।জুয়া হারাম হবার পূর্বে তিনি মক্কায় মুশরেকদের সাথে একটি বাজি ধরেছিলেন।এ বাজির টাকা তিনি এমন সময়ে নিয়েছিলেন,যখন মুশরেকদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল।শুধু সাময়িকভাবে যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল।কিছু নবী(সঃ) এ টাকাও হালাল ও পবিত্র করেননি।সে জন্যে তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ)কে বাজির মাল সদকা করে দিতে বলেন।]

একদিকে রয়েছে কুরআনের আয়াত, নবীর বিভিন্ন সহীহ হাদীস, নবী (সঃ)এর জামানার প্রমাণিত কার্যকলাপ, যার থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের শুধু সুদই নয়, যাবতীয় অবৈধ চুক্তি নিরংকুশভাবে নাজায়েয এবং এতে মুসলিম অমুসলিম অথবা হরবী ও জিম্মীর কোনো পার্থক্য নেই। অপর দিকে রয়েছে একটি মুরসাল হাদীস যা এ সবের মতের বিরুদ্ধ হরবী এবং মুসলমানের শুধু লেনদেন হালাল বলছে। আপনি এ হাদীসটির প্রতি এতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তাঁর উপর ভিত্তি শুধু সুদই নয়, যাবতীয় অবৈধ চুক্তি সকল গায়ের জিম্মী কাফেরের সাথে সাধারনভাবে হালাল করে দিয়েছেন। আমি তাকে সঠিক মনে করে শুধু এতটুকু অবকাশ বের করতে পারি যে, যুদ্ধের অনিবার্য জরুরী অবস্থায় যদি কোনো মুসলমান দুশমনের নিকট থেকে সুদ গ্রহন করে অথবা অবৈধ চুক্তির উপর কারবার করে তাহলে তাঁর জন্যে জবাবদিহি করতে হবে না।

এ শুধুমাত্র একটি অনুমতি যার সুযোগ কোনো উন্নত ধরনের মুসলমান কখনো গ্রহণ করেনি। ইসলামের আত্মসম্মানবোধ এটাই দাবী করে যে, মুসলমান যেন কোনো অবস্থাতেই অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ গ্রহণে আগ্রহান্বিত না হয়। বিশেষ করে কাফের এবং দুশমনদের বিরুদ্ধে তো তাদের জাতীয় চরিত্রের মহত্ব অধিকতর শান-শাওকতের সাথে প্রকাশ করা উচিত। কারণ মুসলমানের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে তীর-ধনুকের যুদ্ধ নয়- আদর্শ ও চরিত্রের যুদ্ধ। তার উদ্দেশ্য সম্পদ ও ভূখন্ড অর্জন করা নয়, বরঞ্চ সে চায় দুনিয়ায় তাঁর আদর্শের প্রচার ও প্রসার করতে। যদি সে তাঁর চারিত্রিক মহত্বই হারিয়ে ফেলে এবং যে আদর্শ প্রচারের জন্যে সে দাড়িয়েছিল, তা যদি স্বহস্তে সে ধ্বংস করে তাহলে অপর জাতির উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব রইলো কোথায়? কিসের ভিত্তিতে সে অন্যের উপর জয়ী হবে এবং কোন শক্তি বলে সে অন্যের হৃদয়-মন জয় করবে?

দারুল হরবের আলোচনা
এখন আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নটির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। তা হচ্ছে এই যে, দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের পার্থক্যের ভিত্তিতে সুদ এবং যাবতীয় অবৈধ চুক্তির বিধানসমূহের পার্থক্য কি। আর একথারই বা মূলতত্ত্ব কি যে, সকল গায়ের জিম্মী কাফেরের রক্ত ও সম্পদ বৈধ, অতএব সকল সম্ভাব্য উপায়ে তাদের সম্পদ হস্তগত করা জায়েয? এ ফতোয়ার জন্যে শরীয়তে কতটুকু অবকাশ আছে যে, যে কোনো রাষ্ট্রের উপর যে কোনো অর্থে দারুল হরবের পরিভাষা প্রয়োগ করা যাবে। সেখানকার অধিবাসীদের উপর চিরকাল সেসব বিধান জারী হওয়া উচিৎ যা দারুল হরবের সাথে সম্পর্কিত।

ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগ
এ ব্যাপারে একথা মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, শরীয়ত তহা ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগ আছেঃ

একঃ বিশ্বাসমূলক আইন। এ সকল মুসলমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

দুইঃ শাসনতান্ত্রিক আইন। এ শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

তিনঃ আন্তর্জাতিক আইন। সঠিক অর্থে বৈদেশিক সম্পর্কের আইন।

এ মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের সম্পর্কে আলোচনা করে। আমাদের ফেকাহর গ্রন্থগুলোতে এ আইনগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে প্রণয়ন করা হয়নি। তাদেরকে পৃথক পৃথক নামেও অভিহিত করা হয়নি। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে এমন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যার থেকে স্বভাবিকভাবে তিনটি পৃথক পৃথক পথে ইসলামী আইনের ক্রমবিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে যে মহান ইসলামী শাস্ত্রবিদের আইন সম্পর্কিত দূরদর্শিতা এবং ফেকাহ শাস্ত্রের সূক্ষ জ্ঞান সর্বাধিক পরিমানে এসব ইঙ্গিত করতে পেরেছে ও তাঁর ভিত্তিতে এ তিনটি বিভাগের সীমারেখার সঠিক পার্থক্য নির্ণয় করেছে এবং জটিল জটিল সমস্যায় এ পার্থক্য অক্ষুন্ন রেখেছে, তিনিই হলেন ইমাম আবু হানিফা (রঃ)। ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে কাউকেই এ ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ দেখা যায় না। এমনকি ইমাম আবু ইউসুফের মতো দূরদর্শী ফকীহও তাঁর স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। ইমাম আযমের গভীর পান্ডিত্যের একটি নগন্য প্রমাণ এই যে, বারোশ বছর পূর্বে তিনি কুরআন হাদীস মন্থন করে শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইনের যে বিধানগুলো রচনা করেন, বর্তমান জগতের আইন সম্পর্কিত চিন্তাধারার ক্রমবিকাশ তাঁর থেকে এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। বরঞ্চ অধিকতর সত্য কথা এই যে, আসলে এ ক্রমবিকাশ হয়েছিল সেইরূপরেখার উপরেই যা বারোশ বছর পূর্বে কুফার জনৈক বস্ত্র ব্যবসায়ী অংকিত করেছিলেন। আধুনিক যুগের আইন-কানুনে হানাফী মতাদর্শের তুলনায় বাহ্যত যে ক্রমোন্নতি পরিলক্ষিত হয়, তা কিয়দাংশ তামাদ্দুনিক অবস্থার পরিবর্তন ও বহুলাংশে আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের ফলশ্রুতি। তথাপি নীতিগত দিক দিয়ে আধুনিক যুগের আইন-কানুন বহুলাংশে হানাফী ফেকাহরই চর্বিত-চর্বন। এসব অধ্যায়নের দ্বারা হানাফী ফেকাহ অনুধাবন করা বড় সহজ হয়।

 

বিশ্বাসমুলক আইন
আকীদাহ-বিশ্বাসমূলক আইন অনুযায়ী পৃথিবী দুটো জাতিতে বিভক্ত-ইসলাম ও কুফর। সমস্ত মুসলমান এক জাতি এবং সমস্ত কাফের মিলে অন্য জাতি। ইসলাম অবলম্বনকারী সকলে ইসলামী জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত এবং ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সকলেই একে অপরের উপর অধিকার রাখে।

(আরবী*******)

“তারপর যদি তারা কুফর থেকে তওবা করে নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।”-(সূরা তওবাঃ ১১)

মুসলমানের জান-মাল ইজ্জত-আবরু সবকিছুই মুসলমানের জন্যে হারাম।

(আরবী******)

“তোমাদের জন্যে একে অপরের খুন, মাল ও ইজ্জত হারাম (বিদায় হজ্জ)।”

ইসলামে যাবতীয় বিধান মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের ওয়াজিব, তা সে দুনিয়ার যে কোনো স্থানেই থাকুক না কেন, যা কিছু ফরজ করা হয়েছে, তা সকলের জন্যে। যা কিছু হালাল করা হয়েছে তা সকলের জন্যে এবং যা কিছু হারাম করা হয়েছে, তা সকলের জন্যে। কারণ প্রত্যেক বিধানের লক্ষ্যই হলো (আরবী*****) তারা যারা ঈমান এনেছে। কোনো অবস্থা ও স্থানের শর্ত তাতে নেই।

পক্ষান্তরে, কুফর একটি অন্য জাতি। যাদের সাথে আমাদের মতভেদ হলো আদর্শ, বিশ্বাস ও জাতীয়তার।১.[প্রকাশ থাকে যে, এখানে আমরা জাতীয়তা, শব্দটি বংশীয় ও ভৌগলিক জাতীয়তার অর্থে বলছি না, বরঞ্চ বলছি কৃষ্টিগত জাতীয়তার স্বার্থে। কৃষ্টিগত জাতীয়তার উপরেই ইসলাম তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জাতীয়তার প্রাসাদ নির্মাণ করে। এক মায়ের দুটো সন্তান জন্মগতভাবে এক জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত।এক মহল্লার দুজন বাসিন্দা ভৌগলিক দিক দিয়ে এক জাতীয়তার লোক। কিন্তু তাদের একজন যদি মুসলমান এবং অন্যজন কাফের হয়,তাহলে তাদের কৃষ্টিগত জাতীয়তা হবে পৃথক পৃথক এবং আদর্শ ও নীতির দিক দিয়ে এমন এক মতানৈক্য সৃষ্টি হয়, যার আলোচনা আমরা এখানে করতে চাই।] মূলত তাদের ও আমাদের মধ্যে সংগ্রাম হচ্ছে এ মতভেদের ভিত্তিতে। তবে যদি সন্ধি, চুক্তি অথবা দায়িত্ব গ্রহনের কোনো অবস্থা দাঁড়ায়, তাহলে সেটা হবে এর ব্যতিক্রম। অতএব ইসলাম ও কুফর, মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে সন্ধি আসল বস্তু নয়, আসল বস্তু যুদ্ধ এবং সন্ধি সাময়িকভাবে তারপর এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এ যুদ্ধ বাস্তব নয়। চিন্তা ও আদর্শমূলক। তাঁর অর্থ এই যে, যতোক্ষন পর্যন্ত আমাদের ও তাদের জাতীয়তা আলাদা এবং আমাদের উভয়ের আদর্শ পরস্পর সংঘর্ষশীল, ততোক্ষন আমাদের এবং তাদের মধ্যে সত্যিকার এবং স্থায়ী সন্ধি ও বন্ধুত্ব হতে পারে না।

(আরবী*******)

“হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কাফেরদের বলেন, তোমাদের সাথে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদগণের তোমরা ইবাদত কর তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছি এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্যে শত্রুতা হয়ে গেল। যতোক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছো।” (মুমতাহিনাঃ ৪)

এ বিষয়টিকে নবী করীম (সঃ) একটি সংক্ষিপ্ত হাদীসে পরিপূর্ণরূপে বর্ননা করেনঃ

(আরবী******)

“আমাদের আদেশ করা হয়েছে যে, আমি লোকের সাথে ততোক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম করি, যতোক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দাহ ও রসূল এবং যতোক্ষণ না আমাদের কেবলার দিকে মুখ করে। আমাদের যবেহ করা পশু খায় এবং আমাদের মতো নামায পড়ে। তারা যখন এরুপ করবে, তখন আমাদের জন্যে তাদের খুন ও মাল হারাম হয়ে যাবে। তবে হকের জন্যে কোনো প্রাণ হত্যা করলে সে অন্য কথা। এরপর তাদের অধিকার তাই হবে যা মুসলমানদের এবং সেসব দায়িত্বই আরোপিত হবে যা মুসলমানদের উপর।”(আবু দাউদ মুশরিকদের সাথে সংগ্রাম সম্পর্কিত অধ্যায়)

এ বিশ্বাসমূলক আইনের দৃষ্টিতে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে চিরন্তনের সংগ্রাম। কিন্তু এ সংগ্রাম নিছক চিন্তাধারামূলক (THEORETICAL) প্রত্যেক কাফের হরবী (ENEMY)। কিন্তু এ অর্থে যে, যতোক্ষণ আমাদের ও তাদের জাতীয়তা পৃথক ততোক্ষণ তাদের সঙ্গে সংগ্রামের ভিত্তি বর্তমান থাকবে। প্রতিটি দারুল কুফরই দারুল হরব। কিন্তু তাঁর অর্থ শুধু এই যে, যতোক্ষণ তা দারুল কুফর থাকবে ততোক্ষণ তা যুদ্ধের ক্ষেত্র থাকবে। অথবা অন্য কথায় যুদ্ধাবস্থার সামগ্রিক বিলুপ্তি হতে পারে জাতীয়তার বিভিন্নতা দূর হবার পর। এ আইন শুধু একটি মতবাদ এবং মৌলিক নীতি সুস্পষ্ট করে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেছে। যার উপর তাদের বাস্তব কর্ম্পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত। এখন রইলো অধিকার ও দায়িত্ব এবং যুদ্ধ সন্ধির বাস্তব সমস্যাবলী। তা এ আইনের সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই। তার সম্পর্ক হলো শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথে।


শাসনতান্ত্রিক আইন
শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিতে ইসলাম দুনিয়াকে দু ভাগে বিভক্ত করে। একটি দারুল ইসলাম, অন্যটি দারুল কুফর। দারুল ইসলাম ঐ অঞ্চলকে বলে যেখানে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং যেখানে কার্যত ইসলামী আইন প্রবর্তিত। অথবা শাসকদের মধ্যে এতটা শক্তি-সামর্থ থাকবে যাতে করে তারা এ আইন বাস্তবায়িত করতে পারে।১.[দারুল ইসলামের এ সংজ্ঞার কিছুটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে সত্যিকার অর্থে দারুল ইসলাম সেই অঞ্চলকে বলে, যেখানে ইসলাম একটি জীবন বিধান হিসেবে শাসন পরিচালনা করবে এবং যেখানে ইসলামী আইন দেশের আইন হিসেবে চালু থাকবে। কিন্তু যদি কখনো এমন অবস্থা হয় যে, কোনো দেশে শাসন ক্ষমতা থাকে মুসলমানদেরই হাতে, কিন্তু তারা ইসলামের পরিবর্তে অন্য কোনো জীবন বিধান কায়েম করে এবং ইসলামী আইনের পরিবর্তে অন্য কোনো আইন প্রবর্তন করতে থাকে, তাহলে ইসলামী শাস্ত্রবিদগণ (ফকীহ) নৈরাশ্য পোষণ করে হঠাত করে সে দেশকে দারুল কুফর হবার ঘোষণা করা সংগত মনে করেন না। যতোক্ষণ পর্যন্ত না মুসলমানগন ইসলাম থেকে তাদের নাম মাত্র সম্পর্কও ছিন্ন করে, ততোক্ষণ সে দেশকে ক্ষমতাসীন দারুল ইসলাম বলেই তারা অভিহিত করতে থাকেন। ফকীহগণের এ সতর্কতাপূর্ণ কর্মপদ্ধতি এজন্য যে, মুসলমানদের কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আদর্শ ও আইন-কানুনের দিক দিয়ে অমুসলমান হওয়া অনিবার্যরূপে দুটো কারনের মধ্যে কোনো একটি কারনেই হতে পারে। এক হচ্ছে এই যে, দেশের মুসলমান অধিবাসীগণ রীতিমত ইসলামের অনুসারী এবং তারই আনুগত্যে জীবনযাপন করার ইচ্ছা রাখে। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে, একটি পথভ্রষ্ট দল ক্ষমতাসীন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় কারণ এই যে, দেশের জনগণের মধ্যে সাধারণভাবে অজ্ঞতা ও গোমরাহী প্রসার লাভ করেছে এবং তাদের মর্যী অনুযারী সে পথভ্রষ্ট দলটি ক্ষমতা লাভ করেছে যারা অনৈসলামী পন্থায় জাতীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে। প্রথম অবস্থার ব্যাপারেতো আশা করা যায় যে, মুসলিম জনগণের ইসলামী অনুভূতি শেষ পর্যন্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং ঐ দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত করবে যারা ইসলামের গৃহে কুফরের কাজ চালাচ্ছে। এজন্য এমন কোনো কারন নেই যার জন্যে এ গৃহকে নিজেরাই কুফরের গৃহ বলে বসবো। অবশ্যি দ্বিতীয় অবস্থাটি নৈরাশ্যজনক বটে। কিন্তু যে জাতি অজ্ঞতা ও গোমরাহী সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ইসলামের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এবং যারা এতটা বিগড়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ইসলামকেই নিজেদের ধর্ম মনে করে, তাদের সম্পর্কেও আমরা এতটা নিরাশ হতে পারি না যে, সত্যিকার ইসলামের দিকে তাদের প্রত্যাবর্তন করার সকল আশা নির্মূল হয়ে গেছে। অতএব তাদের গৃহকেও আমরা দারুল কুফর বলবো না। বরঞ্চ দারুল ইসলামই বলতে থাকবো। কিন্তু একথা ভালো করে উপলব্ধি করা উচিত যে, বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামী আইনের সম্পর্ক শুধুমাত্র সেই দারুল ইসলামের সাথে যা কার্যত দারুল ইসলাম। এখন কথা রইলো তথাকথিত দারুল ইসলাম সম্পর্কে যে স্বয়ং ইসলাম থেকে তার আইনগত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ইসলাম তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সেরূপ শাসন্তান্ত্রিক অধিকার দিতে প্রস্তুত নয়, যা শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে নির্দিষ্ট।] পক্ষান্তরে যেখানে মুসলমানদের শাসন নেই এবং ইসলামী আইনও চালু নেই, তাহলো দারুল কুফর। এ হলো ঠিক সেরূপ যেমন ঐসব দেশ যেখানে ইংরেজ শাসন চলছে সেগুলোকে বৃটিশ অঞ্চল বলা হবে এবং যেসব এলাকা এর সীমারেখার বাইরে তাকে বলা হবে অন্য অঞ্চল। ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী বিধানসমূহ শুধু তাদের উপর প্রয়োগ করতে পারে যারা তার আপন সীমার (JURISDICTION) মধ্যে বাস করে। এভাবে সে রাষ্ট্র শুধু সেসব সম্পদ, মান-সম্মান ও জীবন রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে যা তার ক্ষমতার অথবা অধিকৃত অঞ্চলের (TERRITORY) গন্ডির মধ্যে হবে। এ সীমারেখার বাইরে কোনো কিছুর রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব তার নয়।এ আইন অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণাধীন প্রতিটি জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষিত। তা সে মুসলমান হোক অথবা অমুসলমানের। পক্ষান্তরে দারুল কুফরে অবস্থানকারী প্রতিটি জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম অরক্ষিত যার রক্ষণাবেক্ষোণকারী ইসলামী রাষ্ট্র নয়, তা সে জীবন, সম্পদ ইত্যাদি মুসলমানের হোক অথবা অমুসলমানের। অরক্ষিত শুধু এতটুকু অর্থে যে, যদি তার জীবন, ধন-সম্পদ ও মান-সম্ভ্রম কোনো প্রকার আক্রান্ত হয়, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ এ কাজ তার কর্মসীমার বাইরে সংঘটিত হয়েছে। এ কাজ আল্লাহর কাছে গোনাহ বলে বিবেচিত হবে কিনা এবং তার জন্যে জবাবদিহি করতে হবে কিনা, সে হলো অন্য কথা। অতএব কোনো কিছুর অরক্ষিত হবার অর্থ এই নয় যে, তা হালাল হবে, আর না তার অরক্ষিত হবার অর্থ এভাবে গ্রহন করা হবে যে, তার কোনো ক্ষতিসাধন করা অথবা তা অধিকার করে নেয়া আল্লাহর কাছে জায়েয ও হালাল। এভাবে শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এরূপ কোনো কাজকে জায়েয মনে করা হয় যা দারুল কুফরে সংঘটিত হয়েছে, তাহলে তার অর্থ শুধু এতটুকু হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্র তাতে বাধা দেবে না, এর জন্য কোনো শাস্তিও দেবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এ হারাম কাজের জন্যে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবে না।

এখানে বিশ্বাসমূলক আইন ও শাসনতান্ত্রিক আইন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাসমূলক আইন যে মুসলমানকে ভাই বলে এবং যার জান ও মালকে হারাম বলে গন্য করে, সে শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিতে অরক্ষিত। কারণ সে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতায় বাইরে থাকে। আবার যে কাফেরকে বিশ্বাসমূলক আইন দুশমন মনে করে, শাসনতান্ত্রিক আইন তাকে রক্ষিত বলে গন্য করে এজন্য যে, সে ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষনে এসে গেছে। বিশ্বাসমূলক আইন যে কাজকে কঠিন গোনাহ ও অপরাধ বলে গন্য করে, শাসনতান্ত্রিক আইন তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। কারণ তা তাঁর শাসন আওতার বাইরে। উভয়ের মধ্যে প্রকাশ্য পার্থক্য এই যে, বিশ্বাসমূলক আইনের সম্পর্ক আখেরাতের সাথে এবং শাসনতান্ত্রিক আইনের সম্পর্ক দুনিয়া এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির সাথে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ব্যতীত অন্যান্য সকল ইমামগণ কম-বেশী এ উভয় আইনকে মিশ্রিত করে ফেলেছেন এবং তারা এর সীমারেখাগুলোর পুরোপুরি পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেননি। কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এ জটিল বিষয়টির ব্যাখ্যা করছিঃ

একঃ মনে করুন একজন মুসলিম ব্যবসায়ী নিরাপত্তা নিয়ে দারুল হরবে গেল এবং সেখান থেকে কিছু মাল চুরি করে আনলো। এ কাজ বিশ্বাসমূলক আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ সে ব্যক্তি চুক্তি ভংগ করেছে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক আইন সে ব্যক্তিকে উক্ত চোরাই মালের বৈধ মালিক মনে করে এবং তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাস করে না।-(হেদায়া)

দুইঃ মনে করুন, দারুল ইসলামের কোনো নাগরিক দারুল হরবে বন্দী ছিল। সে কারাগার থেকে পলায়ন করলো অথবা তাকে ছেড়ে দেয়া হলো। এখন সে ওখানে চুরি করুক, মদ্য পান করুক অথবা ব্যভিচার করুক; শাসনতান্ত্রিক আইন অনুযায়ী সে অভিযুক্ত হবার যোগ্য নয়। -(বাহরুর রায়েক)

অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র না তাঁর হাত কেটে দেবে, না মদ্যপান ও ব্যভিচারের জন্যে কোনো শাস্তি দেবে, আর না হত্যার জন্যে কিসাস জারী করবে।১.[.প্রকাশ থাকে যে, দারুল ইসলামের যেসব নাগরিক বিদেশে গিয়ে কোনো অপরাধ এবং চরিত্রহীনতার কাজ করে, দারুল ইসলাম সরকার অবশ্যই তাদেরকে অভিযুক্ত করতে পারে যে, তারা তাদের অপকর্মের দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের উপর কলংক লেপন করেছে। এজন্যেও অভিযুক্ত করতে পারে যে, তারা তাদের অপকর্মের দ্বারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপন রাষ্ট্রের জন্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু দারুল ইসলামের আওতার বাইরে যেসব অপরাধ, যথা চুরি, হত্যা ইত্যাদি, সে করেছে তাঁর জন্যে কোনো মামলা দায়ের করা হবে না।] কিন্তু বিশ্বাসমূলক আইনে সে আল্লাহর কাছে গোনাহগার হবে।

তিনঃ মনে করুন, এক ব্যক্তি দারুল হরবে মুসলমান হলো। অতঃপর সেখান থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এলো না। বিশ্বাসমূলক আইনে সে মুসলমান ভাই হয়ে গেছে। তাঁর খুন ও মাল হারাম হয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু সে ইসলামী রাষ্ট্রের আওতার বাইরে, সে জন্যে শাসনতান্ত্রিক আইনে তাঁর কোনো কিছুই রক্ষিত নয়। একটি দুশমন রাজ্যের নাগরিকের মতোই তাঁর অবস্থা হবে। যদি কোনো মুসলমান দারুল ইসলামের বাইরে তাকে হত্যা করে, তাহলে ইসলামী আদালত তার উপর কিসাস গ্রহণ করবেনা। সে ব্যাক্তি স্বেচ্ছায় অবশ্যি কাফফারা দিয়ে দিতে পারে। এরূপ যদি কোনো মুসলমান তার নিকটে সুদ নেয় অথবা কোনো অবৈধ উপায়ে তার মাল হস্তগত করে, তাহলে শাসনতান্ত্রিক আইনে সে অভিযুক্ত হবার যোগ্য হবে না। কারণ তার মাল অরক্ষিত। এ ব্যাপারে ফকীহগণের ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণঃ

(আরবী*******)

“যদি দারুল হরবের কোনো লোক মুসলমান হয় এবং হিজরত করে দারুল ইসলামে আসার আগে যদি কোনো মুসলমান অনিচ্ছাবশত কতল করে, তাহলে তাকে কাফফারা দিতে হবে — বিনিময়ে রক্ত দিতে হবে না। ইমলাতে এ বিষয়ে আবু হানিফা (রঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাকে কাফফারাও দিতে হবে না। কারণ কাফফারা ওয়াজিব হয় খুনের মূল্য হিসেবে, হত্যা হারাম হওয়া হিসেবে নয়। আর খুনের মূল্য তখনই মাত্র নির্ধারিত হয়, যখন তা দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন হয়।”

(আরবী*********)

“ এবং আমাদের পূর্ববর্তী বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে হিজরত না করে দারুল হরবের অধিবাসী হয়ে গেল, তার খুনের কোনো মূল্য নেই। ১.[এর অর্থ এই যে, যে মুসলমান কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষনে নেই, বরঞ্চ তার আওতার বাইরে থাকে, তার খুনের যতই মূল্য হোক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে তার আইনানুগ মূল্য কিছুই নেই। সে বিপন্ন হলে ইসলামী রাষ্ট্র তার কোনো প্রতিকার করতে পারে না। কাকে কেউ হত্যা করলে তাহলে তার কিসাস অথবা রক্তের বিনিময়ে আদায় করে দেয়ার কোনো দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নেই। তার মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর কেউ অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করলে, সে অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের দায়িত্বও ইসলামী রাষ্ট্রের নয়। কিন্তু এতসব কিছু আইনের দিক দিয়ে,নতুবা আকীদাহ-বিশ্বাসের দিক দিয়ে তো মুসলমানের জান-মাল, ইজ্জত –আবরু দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক মূল্যবান এবং দারুল ইসলামের মুসলমানদের দীনি মর্যাদার দাবী এই যে, তারা দারুল কুফরের মুসলমানদের যতটা সাহায্য করতে পারে, তা করবে।] ……………… এরই ভিত্তিতে আমাদের আলেমগণ (হানাফী) এ ধরনের মুসলমানকে হরবীর মতোই মনে করেছে। অর্থাৎ তার সম্পদ হস্তগতকারীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই — এ দিক দিয়ে তার মাল হরবীর মালের ন্যায় এবং এরই ভিত্তিতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) তার সাথে সেভাবে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ বলেছেন যেভাবে হরবীদের সাথে বৈধ। অর্থাৎ দারুল হরবে এক দিরহামকে দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করা। “

(আরবী*******)

“হাসান ইবনে সালেহ বলেন, দারুল হরবের কোনো বাসিন্দা ইসলাম গ্রহন করার পর সেখানেই রয়ে গেল, অথচ তার হিজরতের সামর্থ ছিল, তাহলে তার মর্যাদা একজন মুসলমানের মত নয়।১.[বর্তমান যুগে ‘হিজরত সামর্থ’ — এ বিধানের সাথে আর একটি শর্ত লাগাতে হবে। তা হচ্ছে এই যে, দারুল ইসলামে মুহাজিরদের আগমনের দ্বার উন্মুক্ত থাকতে হবে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা থাকতে হবে যে, সাধারণ দারুল হরব ও দারুল কুফর থেকে এবং বিশিষ্ট কোনো দারুল হরব ও দারুল কুফর থেকে মুসলমানগণ ইসলামী রাষ্ট্রে চলে আসুক। এ অবস্থায় সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হিজরত করবে না, তাদের সাথে দারুল ইসলামের মুসলমান সকল দিক দিয়ে সেই আচরণই করবে যা সি দারুল হরব বা দারুল কুফরের বাসিন্দার সাথে করবে। আর যারা হিজরত করতে অপারগ, শাসনতান্ত্রিক দিক দিয়ে তাদের কোনো অধিকার না থাকলেও তাদের সাথে একেবারে অমুসলিমের মতো আচরণ করা যাবে না। বরঞ্চ সেনাবাহিনীর লোকদেরকে এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হবে যে, যুদ্ধের সময় যতটা সম্ভব তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে। সন্ধির অবস্থায়ও তাদের সাথে অধিকতর সহানুভুতিপূর্ণ আচরন করতে থাকবে। কিন্তু যদি দারুল ইসলামের সরকারের পক্ষ থেকে যদি বাইরের মুসলমানদের হিজরত করার আহ্ববান জানানো না হয়, আর হিজরতের জন্যে দ্বার উন্মুক্ত না হয়, তাহলে এ অবস্থায় বাইরের মুসলমানদের উপর হাসান ইবনে সালেহের একথা প্রযোজ্য হবে না যে, হিজরতের সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যারা হিজরত করবে না তাদের মর্যাদা মুসলমানদের মতো নয়। অবশ্যি শাসনতান্ত্রিক আইনের এ নীতি সর্বত্র অটল থাকবে যে, যেসব মুসলমান দারুল ইসলামের নাগরিক নয় এবং তার আওতার বাইরে তাদের জান-মাল ইজ্জত-আবরুর দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নয়।] তার জান-মাল সম্পর্কে সেই বিধান, যা একজন দারুল হরবের অধিবাসীর জন্যে রয়েছে।”-(আহকামুল কুরআন)

(আরবী********)

“কোনো হরবী যদি দারুল হরবে মুসলমান হয় এবং কোনো মুসলমান তাকে স্বেচ্ছায় অথবা ভুল বশত হত্যা করে এবং তার ওয়ারিশগণ দারুল হরবে বর্তমান থাকলেও হত্যাকারীকে কিছুই দিতে হবে না। ভুলবশত হত্যা করে থাকলে শুধু কাফফারা দিবে।”- (হেদায়া)

(আরবী********)

“যে ব্যক্তি দারুল হরবে মুসলমান হয়ে হিজরত করবে না, আবু হানিফা (র)-এর মতে তার মর্যাদা হরবীর ন্যায়। কারণ তাঁর মতে তার মাল অরক্ষিত।”-(বাহরুর রায়েক)

চার: মনে করুন একজন মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গেল। তারপর সেখানে সে কোনো হরবীর নিকট হতে কর্জ গ্রহণ করলো, অথবা তার মাল আত্মসাত করলো। অতপর সে দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করলো এবং উক্ত হরবীও নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে এলো। এখানে ঐ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী সে কর্জ অথবা আত্মসাত করা মালের জন্যে দারুল ইসলামের আদালতে দাবী করতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্রে তাকে এক পয়সাও ফেরত দিতে বলবে না। এরূপ যদি দারুল হরবী মুসলমান থেকে গৃহীত কর্জ মেরে দেয় অথবা তার মাল আত্মসাত করে এবং অতপর সে হরবী নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে আসে, তথাপি ইসলামী আদালত সে হরবীর উক্ত মুসলমানের কোনো প্রতিকার করতে পারবে না। – (জামেউস সাগীর ইমাম মুহাম্মদ)

পাঁচ: পিতা যদি থাকে দারুল ইসলামে এবং তার নাবালেগ সন্তানগণ থাকে দারুল হরবে, তাহলে সেই সন্তানগণের উপর থেকে পিতার অভিভাবকত্ব বিলুপ্ত হবে। এরূপ যদি সম্পদের মালিক থাকে দারুল ইসলামে এবং তার সম্পদ থাকে দারুল হরবে, তাহলে মালিকের জীবন রক্ষিত হবে, কিন্তু সম্পদ রক্ষিত হবে না।-(ফতহুল কাদীর ৪ : ২৫৫)

ছয়: দারুল ইসলামের নাগরিকদের দুজন মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গিয়ে একজন অপরজনকে হত্যা করলো। অতপর হত্যাকারী দারুল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করলে তার থেকে কিসাস নেয়া হবে না। হেদায়ার গ্রন্থকার এর যে কারণ বর্ণনা করেছে তা প্রণিধানযোগ্য:

(আরবী********)

“তার উপর কিসাস এজন্য ওয়াজিব নয় যে, রক্ষনাবেক্ষণ ব্যতিরেকে কিসাস ওয়াজিব হয় না এবং ইমাম ও মুসলিম জামায়াত ব্যতিরেকে রক্ষনাবেক্ষণ হয় না। আর এ ব্যবস্থা দারুল হরবে নেই।”

সাত: দারুল ইসলামের নাগরিকদের দুজন মুসলমান দারুল হরবে বন্দী ছিল। তাদের একজন অপরজনকে হত্যা করলো। অথবা কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে গিয়ে সেখানে কোনো বন্দী মুসলমানকে হত্যা করলো। উভয় অবস্থাতেই হত্যাকারীর জন্যে কিসাসও নেই, খুনের বিনিময়ও নেই। আল্লামা ইবনে হামাম যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আরো অর্থপূর্ণ।

(আরবী********)

“ইমাম আবু হানিফা (র) – এর মতে হত্যাকারীর জন্যে পার্থিব কোনো বিধান নেই। তবে ভুলবশত হত্যা করলে কাফফারা দিবে। স্বেচ্ছায় হত্যা করলেও কাফফারা দিতে হবে না, তবে আখিরাতে শাস্তির যোগ্য হবে। —- কিসাস ও রক্তের বিনিময় প্রযোজ্য না হবার কারণ এই যে, বন্দী হবার জন্যে সে আইনে হরবের অধীন হয়েছে। ————- তার অবস্থা সেই মুসলমানের মতই হয়েছে যে আমাদের রাষ্ট্রে হিজরত করেনি। এ কারনে তার পার্থিব রক্ষণ-ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে।” – (ফতহুল কাদীর ৪র্থ খ: পৃ: ৪৫১)

এ দৃষ্টান্তগুলোর দ্বারা বিশ্বাসমূলক আইন এবং শাসনতান্ত্রিক আইনের পার্থক্য কতখানি সুস্পষ্ট হয়েছে তা লক্ষ্য করুন। বিশ্বাসমূলক আইন মুসলমানদেরকে এক জাতি এবং কাফেরদেরকে অন্য জাতি গণ্য করে। তার দাবী এই যে, মুসলমানদের জান-মাল ইজ্জত কাফেরদের জান-মাল ইজ্জতের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক আইন এ বিশ্বজনীন বিভাগের পরিবর্তে নিজের শাসনের গন্ডিকে (JURISDICTION) ভৌগলিক গন্ডিতে (TERRITORIAL LIMITS) সীমিত করে। ইসলামী রাষ্ট্রের গন্ডির মধ্যে অবস্থিত জান-মাল ইত্যাদি ‘রক্ষিত’ তা মুসলমানের হোক অথবা অমুসলমানের। কারণ রাষ্ট্রীয় আইন তার রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সীমারেখার বাইরে যা কিছু আছে তা ‘অরক্ষিত’, তা মুসলমানের হোক বা অমুসলমানের। ইসলামী রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে কেউ চুরি করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে, হত্যা করলে কিসাস অথবা রক্তপণ আদায় করা হবে। অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করলে তা ফেরত দেওয়ানো হবে। আর এ সীমারেখার বাইরে কোনো মুসলমান অথবা জিম্মি এসব কাজ করলে তা আমাদের আইনে অপরাধ বিবেচিত হলেও অপর অঞ্চলে আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি না, এমন কি আমাদের অঞ্চলে ফিরে এলেও। কারন অপরাধ এমন এক অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে যেখানকার নিরাপত্তা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব আমাদের নয়। কিন্তু এ যা কিছু তাহলো পার্থিব দিক দিয়ে। ইসলামী সীমারেখার বাইরে যে গোনাহ করা হবে তা, পার্থিব শাসন সীমার বাইরে হবার কারনে পার্থিব শাস্তিযোগ্য হবে না; কিন্তু আল্লাহর নিকট শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না। কারণ আল্লাহর শাসন সীমারেখা ভৌগলিক সীমারেখার ঊর্ধে (ULTRA TERRITORIAL)। তিনি যা কিছু হারাম করেছেন তা সর্বত্রই হারাম।

এ ইমাম আবু হানিফা (র) -এর স্বকপোলকম্পিত আইন নয়। বরঞ্চ তা কুরআন-হাদীস থেকেই গৃহীত। কুরআন একদিকে যেমন বলে:

(আরবী********)

“যদি তারা নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হয়ে যায়” এবং

(আরবী********)

“এবং যে স্বেচ্ছায় কোনো মুমেনকে হত্যা করে তার শাস্তি হচ্ছে চিরন্তনের জাহান্নাম,” অপর দিকে সেই কুরআনই ইসলামী সীমারেখার মধ্যে অবস্থানকারী মুসলমান এবং অপর অঞ্চলে অবস্থানকারী মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যও বলে দেয়। উল্লিখিত প্রথম ধরনের স্বেচ্ছায় হত্যাকারীদের জন্যে কাফফারাও আছে, রক্তপণও আছে। আর দ্বিতীয় ধরনের হত্যাকারীদের জন্যে শুধু কাফফারা।১ [১. ********* আরবী ******** -এর অর্থ এই যে, অমুসলিম এলাকায় অবস্থানকারী মুসলমান যদি এমন এক দলভুক্ত হয়, যাদের সাথে রক্তপণ সম্পর্কে মুসলমানদের চুক্তি হয়েছে, তাহলে যেভাবে সে দলের একজন অমুসলিমের রক্তপণ দেয়া হবে। সেভাবে তার একজন মুসলমানেরও দেয়া হবে। অতএব এ রক্তপণ চুক্তির ভিত্তিতে, ইসলামী রক্ষণ-ব্যবস্থার ভিত্তিতে নয়।-(সুরা অন নিসা: ১৩ রুকু দ্রষ্টব্য)]

নবী করীম (স) উসমা ইবনে জায়েদকে একটি অভিযানের অধিনায়ক করে ‘হারাকাত’ অভিমুখে পাঠান। সেখানে একজন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করে আত্মরক্ষা করতে চাইলো কিন্তু মুসলমানগণ তাকে হত্যা করলো। একথা নবী করীম (স) জানতে পেরে উসামাকে বার বার বলেন: আরবী *********** (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর মুকাবেলায় কিয়ামতে তোমাকে কোন জিনিস রক্ষা করবে?) কিন্তু এ নিহত ব্যক্তির রক্তপণ আদায় করার হুকুম দেননি।২ [২. আবু দাউদ অধ্যায়: আরবী *************] এমনিভাবে অপর এক ঘটনায় ইসলামী গন্ডির বাইরে অবস্থানকারী কিছু মুসলমানকে হত্যা করা হলে নবী করীম (স) বলেন:

(আরবী********)

যেসব মুসলমান মুশরেকদের মধ্যে বাস করে তাদের কোনো দায়িত্ব আমার উপর নেই।১ [১. আবু দাউদ কিতাবুল জিহাদ উক্ত অধ্যায়।

এ দ্বিতীয় ঘটনায় নবী করীম (স) হত্যাকারীদের অর্ধেক রক্তপণ দেওয়ান। সম্ভবত তাঁর এ সিদ্ধান্ত ওই আয়াত নাজিলের পূর্বেকার যাতে নিহত ব্যক্তির রক্তপণ বাতিল করা হয়েছিল।] কুরআনও এ ধরনের মুসলমানদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবার ঘোষণা করেছে:

(আরবী********)

“এবং যারা ঈমান এনেছে বটে, কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে আসেনি তাদের উপর তোমাদের অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই যতক্ষণ না তারা হিজরত করে এসে যায়।” ২ – (সুরা আনফাল:৭২) [২. এ আয়াতটি ইসলামের শাসনতান্ত্রিক আইনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এতে এ মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘অভিভাবকত্বের’ সম্পর্ক শুধু সেসব মুসলমানদের সাথে হবে যারা দারুল ইসলামের অধিবাসী অথবা বাইরে থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসেছে। এখন রইলো ঐসব মুসলমান যারা দারুল ইসলামের বাইরে বাস করে অথবা দারুল ইসলামে এলেও হিজরত করে নয়–দারুল কুফরের নাগরিক হিসেবে — তাদের এবং দারুল ইসলামবাসীর মধ্যে অভিভাবকত্বের কোনই সম্পর্ক নেই। ***** আরবী ******* শব্দটি আরবি ভাষায় সমর্থন-সহানুভুতি, সাহায্য, পৃষ্ঠপোষকতা, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা অভিভাবকত্ব এবং অনুরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ আয়াতের পূর্বাপর প্রসঙ্গে সুস্পষ্টরূপে সে সম্পর্কই বুঝানো হয়েছে, যা কোনো রাষ্ট্রের স্বীয় নাগরিকদের সাথে, নাগরিকদের তাদের রাষ্ট্রের সাথে এবং নাগরিকদের পরস্পরের সাথে হয়ে থাকে। অতএব এ আয়াত দারুল ইসলাম বহির্ভূত মুসলমানদেরকে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সত্বেও সে রাজনৈতিক ও তামাদ্দুনিক সম্পর্ক থেকে ছিন্ন করে দিছে। এর থেকে ব্যাপক আইনগত সূত্র বা সিদ্ধান্ত আবিষ্কৃত হয়। ফিকাহর বিস্তারিত গ্রন্থসমূহে তা পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, এ অভিভাবকত্বহীনতার কারণেই দারুল ইসলাম এবং দারুল কুফরের মুসলমান পরস্পর বিয়ে-শাদী করতে পারে না। একে অপরের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। একে অপরের আইনগত অলী (GURDIAN) হতে পারে না। ইসলামী রাষ্ট্র কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে এমন কোনো মুসলমানকে নিয়োগ করতে পারে না, যে দারুল কুফরের সাথে তার নাগরিকত্ব ছিন্ন করেনি।]

এভাবে স্বয়ং কুরআন ও হাদীস পার্থিব রক্ষণ-ব্যবস্থাকে পারলৌকিক রক্ষণ-ব্যবস্থা থেকে পৃথক করে দিয়েছে এবং উভয়ের সীমারেখা বলে দিয়েছে। সকল ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে শুধুমাত্র ইমাম আবু হানিফা (র)-ই এ নাজুক এবং জটিল আইন সম্পর্কিত বিষয়টিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ খ্যাতনামা মুজতাহিদগণও এ দু ধরনের রক্ষণ-

ব্যবস্থার মধ্যে পুরোপুরি পার্থক্য করতে পারেননি। ধরুন, যদি দারুল কুফরে মুসলিম নাগরিকদের একজন অন্য একজনকে খুন করে, তাহলে এসব ইমামগণের মতে খুনীর নিকট থেকে কিসাস গ্রহণ করা হবে। কারণ সে এমন এক ব্যক্তিকে খুন করেছে যে ছিল ইসলামে রক্ষিত।১ [১. জামেউস সগীর ও ফতোয়া–কাযী খান দ্রষ্টব্য।] অতএব এত বড় বড় ইমামগণ যখন এ মাসলায় বিভ্রান্ত হয়েছে, তখন অসম্ভব নয় যে, হানাফী ফেকাহর পরবর্তীকালের ব্যাখ্যাকারীগণও ইমাম আবু হানিফা (র) এর কথা বুঝতে ভুল করে থাকবেন।

দারুল হরব ও দারুল কুফরের পারিভাষিক পার্থক্য
ইমাম আযম সম্পর্কে প্রামাণ্য সূত্রে জানতে পেরেছি যে, উপরে যতগুলো বিষয় বর্ণিত হয়েছে তাতে এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ে তিনি দারুল হরবের পরিবর্তে দারুল কুফরের পরিভাষাই ব্যবহার করেছেন। কারণ শাসনতান্ত্রিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে দারুল ইসলামের প্রতিপক্ষ, অমুসলিম এলাকা বা বৈদেশিক এলাকা (FOREIGN TERRITORY) অর্থে দারুল কুফরই হতে পারে। হরব ও গায়ের হরবের এখানে কোনো কথাই নেই। যেসব দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সন্ধিসুত্রে আবদ্ধ তারাও দারুল কুফর। উপরে যেসব বিধান বর্ণিত হয়েছে তা এসব দেশের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু যেহেতু ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের সন্নিহিত সকল দারুল কুফর সাধারণত দারুল হরবই থাকত, সে জন্যে পরবর্তী ফকীহগণ দারুল কুফরকে একেবারে দারুল হরবের সমার্থবোধক মনে করেন এবং এ দুটো পরিভাষার সুক্ষ্ম আইনগত পার্থক্য উপেক্ষা করে বসেন। এভাবে ইমাম আবু হানিফা (র)-এর কথায় কোথাও আমরা এমন কোনো শব্দ পাইনি যার থেকে প্রমান হয় যে, তিনি ‘অরক্ষিতকে’ বৈধ অর্থে গ্রহণ করেছেন। তিনি ইসলামী সীমারেখার বহির্ভূত বস্তুগুলোকে অরক্ষিত বলাই যথেষ্ট মনে করতেন। এসব বস্তুসমূহের উপর হস্তক্ষেপকারীদের জন্যে শুধু এতটুকু বলতেন ***** আরবী ****** অথবা ******* আরবী ****** ইত্যাদি। অর্থাৎ তাকে অভিযুক্ত করা হবে না অথবা তার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো বিচার করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালের ফকীহগণ অধিকাংশ স্থলে ‘অরক্ষিত হওয়া’ এবং বৈধতাকে একত্রে মিশ্রিত করে ফেলেছেন। তার ফলে এ ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী সীমারেখার বাইরে যতই নিষিদ্ধ ও অবৈধ কাজ করা হোক, সরকার যেমন তার জন্যে অভিযুক্ত করবে না, আল্লাহতায়ালাও ধরবেন না। অথচ এ দুটো জিনিস কিন্তু একেবারে আলাদা। আপনি ভারতে কারো মাল চুরি করুন, তারপর এটা ঠিক যে আফগানিস্তানের আদালতে আপনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে না। দারুল ইসলামের আইনে আপনি দায়িত্বমুক্ত। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, আল্লাহর আদালতেও আপনি বেঁচে যাবেন?

এখন আপনি বুঝতে পারেন যে, ফেকাহর বইগুলোতে দারুল হরবে সুদ, জুয়া এবং অন্যান্য অবৈধ চুক্তি এজন্য বৈধ করা হয়েছে যে, হরবীর জন্য রক্ষণ ব্যবস্থা (PROTECTION) নেই। এর দুটো দিক আছেঃ

একটি এই যে, ‘দারুল হরব’ অর্থে শুধু অমুসলিম এলাকা বুঝাবে। এ দিক দিয়ে এ বিষয়টি শাসনতান্ত্রিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট। তার ধরন এই যে, হরবীর (অমুসলিম এলাকার নাগরিক এ অর্থে) ধন-সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যেহেতু আমরা গ্রহণ করিনি, সে জন্য আমাদের কর্মসীমার বাইরে আমাদের রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি সে হরবীর কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে অথবা জুয়া খেলে কিংবা অন্য কোনো অবৈধ পন্থায় সম্পদ লাভ করে আমাদের এলাকায় এসে যায়, তাহলে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করবো না, দ্বীন ও আকীদাহ- বিশ্বাসের দিক দিয়ে সে অপরাধী হোক বা না হোক।

দ্বিতীয়টি এই যে, দারুল হরব বলতে এমন এক দেশ বুঝাবে যার সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে অর্থাৎ শত্রু দেশ(ENEMY COUNTRY)। এ দিক দিয়ে এ বিষয়টি বৈদেশিক সম্পর্কের আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট যার বিবরণ সামনে দেওয়া হচ্ছে।

বৈদেশিক সম্পর্কের আইন
ইসলামী আইনের এ শাখা এমন সব লোকের জান-মালের আইনগত আলোচনা করে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখার বাইরে অবস্থান করে। এর বিশদ আলোচনার পূর্বে কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

ফেকাহের পরিভাষায় *** শব্দটি প্রায় ইংরেজী (TERRITORY) শব্দের অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে ভূখন্ডে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে বলে দারুল ইসলাম। যেসব এলাকা এর সীমারেখার বাইরে হয়, তাকে বলা হয় দারুল কুফর অথবা দারুল হরব। বৈদেশিক সম্পর্কের আইন পুরোপুরি সেসব সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করে, যা ভৌগলিক পার্থক্য অথবা উভয়বিধ রাষ্ট্রের বিভিন্নতার কারণে মানুষের জান-মাল সম্পর্কে উদ্ভূত হয়।

আমি পূর্বেই বলেছি যে, বিশ্বাসের দিক দিয়ে তো সকল মুসলমান ইসলামী জাতীয়তার নাগরিক। কিন্তু আইনের এ শাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে তিন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে। এক, যারা দারুল ইসলামের নাগরিক। দুই, যারা দারুল কুফর অথবা দারুল হরবের নাগরিক। তিন, নাগরিক তো দারুল ইসলামের। কিন্তু নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হিসেবে সাময়িকভাবে দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে গিয়ে তথাকার বাসিন্দা হয়। এদের অধিকার ও দায়িত্ব পৃথক পৃথক নির্ধারণ করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে কাফের যদিও সকলেই বিশ্বাসের দিক দিয়ে ইসলামী জাতীয়তা বহির্ভূত, তথাপি আইনের দিক দিয়ে তাদেরকেও অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়েছে।

একঃ যারা জন্মগতভাবে জিম্মী-(NATURAL BORN SUBJECTS) অথবা জিজিয়া ধার্য করার পরে জিম্মি করা হয়েছে (NATVRAL LISED SUBJECTS)।

দুইঃ যারা দারুল ইসলামের নাগরিক নয়। নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে এসে বসবাস করে-(DOMICILED ALICEN)।

তিনঃ যারা দারুল কুফর অথবা দারুল হরবের নাগরিক। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যতিরেকেই দারুল ইসলামে প্রবেশ করে।

চারঃ যারা আপন আপন রাষ্ট্রেই বসবাস করে। এ চতুর্থ শ্রেনীর অমুসলমানগণেরও আবার কয়েক শ্রেণী আছে।

(ক) যাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তিও নেই, শত্রুতাও নেই।

(খ) যাদের সাথে মুসলমানদের শত্রুতা আছে।

এভাবে ভূখন্ডের (TERRITORY) সীমারেখার দিক দিয়ে মানুষ এবং সম্পদের মর্যাদায় যে পার্থক্য, তদনুযায়ী তাদের মধ্যে বিধানেরও পার্থক্য অনিবার্য। তাকে সামনে রেখেই ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব পার্থক্যের প্রতি লক্ষ্য না রেখে যদি শুধুমাত্র আইনের ভাষাগত শব্দের অনুসরণ করা হয়, তাহলে শুধু সুদের বিষয়েই নয় অধিকাংশ ফেকাহর মাসলায় এমন সব ভুল হয়ে পড়বে যার ফলে আইন বিকৃত হয়ে পড়বে এবং আপন উদ্দেশ্যের বিপরীত তা ব্যবহৃত হতে থাকবে।

এ প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার পর, আমরা ঐসব প্রশ্নের দিকে মনোযোগ দিতে চাই যে, দারুল ইসলাম প্রকৃতপক্ষে কোন এলাকাকে বলা হবে, তাঁর শ্রেণী বিন্যাস কিরূপ এবং প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে কিরূপ বিধান হবে। হরবীদের শ্রেণী কত এবং শ্রেণী হিসেবে জীবন ও ধন-সম্পদের ধরনটাও কিভাবে বদলে যায়।


অমুসলিমদের শ্রেনী বিভাগ
অমুসলিমদের যে শ্রেণী বিভাগ উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের জিম্মীদের সম্পর্কে তো সকলেরই জানা আছে যে, মদ, শূকরের মাংস, নিষিদ্ধ ব্যক্তিদের সাথে বিবাহ এবং আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর ইবাদত উপাসনা ছাড়া, অন্যান্য ব্যাপারে তাদের অবস্থা মুসলমানদের মতোই। ইসলামের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আইন (LAWS OF THE LAND) তাদের উপর প্রযোজ্য হবে। যেসব বিষয় থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখা হয়, তাদেরকেও সেসব থেকে বিরত রাখা হবে। জান-মাল, ইজ্জত-আবরু রক্ষার অধিকার তাদের থাকবে, যেমন মুসলমানদের থাকবে। নিরাপত্তাপ্রাপ্ত অমুসলিমদের ব্যাপারেও জিম্মীদের থেকে পৃথক নয়। কারণ তাদের উপরেও ইসলামী রাষ্ট্রের বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে এবং দারুল ইসলামে থাকার কারণে তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের অধিকার থাকবে। এদেরকে বাদ দিলে, শুধু সেসব অমুসলিমদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে যারা দারুল কুফরে বসবাস করে।

একঃ করদাতা— যেসব অমুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রকে কর দেয় এবং নিজেদের দেশে যারা কুফরী বিধান জারী করার স্বাধীনতা রাখে, তাদের দেশ যদিও দারুল কুফর, কিন্তু দারুল হরব নয়। কারণ মুসলমানগণ যখন কর নিয়ে তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছে তখন তাদের হরবীয়ত (হরবী হওয়া) বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কুরআনে আছেঃ

(আরবী********)

“যদি তারা যুদ্ধ থেকে বিরত হয় এবং সন্ধির প্রস্তাব পেশ করে তাহলে আল্লাহ তাদের প্রতি হস্তক্ষেপ করার পথ তোমাদের জন্যে খোলা রাখেনি।”

এর ভিত্তিতে ফকীহগণ বলেন যে, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

(আরবী********)

“যদি তাদের সাথে এ বিষয়ে সন্ধি হয়ে থাকে যে, তারা প্রতি বছর একশ গোলাম দিবে, আর এ একশ গোলাম যদি তাদের দলের হয় অথবা তাদের সন্তান-সন্ততি হয়, তাহলে তা নেয়া দুরস্ত হবে না। কারণ, সন্ধি তাদের সম্পূর্ন দলের উপর বর্তাবে। তারা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত এবং নিরাপত্তা প্রাপ্তকে গোলাম বানানো জায়েয হবে না।”

- (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৮৮)

(আরবী********)

“যদি তাদের কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো দারুল হরবে বসবাস করে এবং ইসলামী সেনাবাহিনী সেখানে প্রবেশ করে তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কারণ তারা মুসলমানদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত।” – (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৮৯)

(আরবী********)

“মুসলমানদের কোনো দল যদি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের লোককে গোলাম বানায়, তাহলে মুসলমানদের জন্যে সেসব গোলাম খরিদ করা নাজায়েয হবে। খরিদ করলে তা বাতিল হয়ে যাবে। কারণ তারা মুসলমানদের নিরাপত্তার অধীন ছিল।”

– (আল মাবসুত ইমাম সারাখসী-খন্ড ১০০, পৃঃ৯৭)

এ ধরনের অমুসলিমগণ যদিও দৃষ্টিভংগীর দিক দিয়ে হরবীই থাকে।১ [১. (আরবী********)

কারন তারা এ সন্ধি ও চুক্তির জন্যে ইসলামী বিধান মানতে বাধ্য নয়। এজন্য তারা হরবীত্বের গন্ডি থেকে বের হতে পারে না। -(আল মাবসুত-১ পৃঃ ৮৮)]

কিন্তু তাদের সম্পদ বৈধ নয় এবং তাদের সংগে অবৈধ চুক্তির কোনো কারবার করা যেতে পারে না, তারা সুদখোর হোক না কেন। কিন্তু তারা যদি নিজেদের ভূখন্ডে না থাকে এবং এমন এক ভূখন্ডে থাকে যেখানে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে, তথাপি তাদের সাথে অবৈধ চুক্তির কারবার করা মুসলমানদের জন্যে জায়েয হবে না।

দুইঃ চুক্তিবদ্ধ— যেসব অমুসলিমদের সাথে দারুল ইসলামের চুক্তি হয়েছে তাদের সম্পর্কে কুরআন বলেঃ

(আরবী********)

“যেসব মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তি সম্পাদিত করেছ এবং তারা তোমাদের সাথে চুক্তি পালনে ত্রুটি করেনি, আর না তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেছে, তাহলে চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত তাদের চুক্তি পূরণ করো।” –(সূরা আত তাওবাঃ ৪)

(আরবী********)

“যতোক্ষণ তারা চুক্তিতে অবিচল থাকে, তোমরাও তাই থাক।”

–(সূরা আত তাওবাঃ ৪)

“এবং যেসব মুসলমান দারুল কুফরে থাকে, তারা যদি দীনের সত্যতার ভিত্তিতে তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে, তাহলে তাদের সাহায্য কর। কিন্তু এমন কোনো দলের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করো না যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি হয়েছে।”

–(সুরা আল আনফালঃ ৭২)

(আরবী********)

“যদি নিহত ব্যক্তি এমন এক দলের লোক হয়, যাদের এবং তোমাদের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তাহলে তাঁর ওয়ারিশদেরকে রক্তপণ দিতে হবে।”

-(সূরা আন নিসা ৯২)

এ আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, চুক্তিকারী কাফের যদিও মতবাদের দিক দিয়ে হরবী এবং তাদের দেশকে দারুল হরব বলা যেতে পারে, কিন্তু যতোদিন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র তাদের সাথে চুক্তির সম্পর্ক বজায় রাখবে ততোদিন তাদের খুন ও মাল বৈধ হবে না এবং তাদের জান-মালের উপর হস্তক্ষেপ করা শরীয়তে নিষিদ্ধ। যদি কোনো মুসলমান তাদেরকে খুন করে তাহলে রক্তপণ দিতে হবে। তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতএব তাদের সম্পদ যখন বৈধ নয়, তখন তাদের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কারবার কিরূপে করা যাবে? কারণ তার বৈধতা তো বৈধতার ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত।

তিনঃ বিশ্বাসঘাতক — যেসব কাফের চুক্তি সূত্রে আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও শত্রুতাচরণ করে তাদের সম্পর্ক কুরআন বলেঃ

(আরবী********)

“যদি তোমরা কোনো জাতির পক্ষ থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা কর তাহলে সমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের চুক্তি তাদের উপর নিক্ষেপ কর।”১ –(সূরা আল আনফালঃ ৫৮) [১. অর্থাৎ প্রকাশ্যভাবে চুক্তি ভংগের ঘোষণা তাদেরকে শুনিয়ে দাও, যাতে করে চুক্তি যে আর বলবৎ নেই একথা জানতে তারা এবং তোমরা যেন সমান হয়ে যাও।]

ইমাম শ্রেষ্ঠ সারাখসী এ মাসয়ালাটির ধরন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ

(আরবী********)

“(এ অবস্থায় চুক্তি ভংগ করা জায়েয), তবে চুক্তি ভংগ যেন সমতার ভিত্তিতে হয়। অর্থাৎ তোমাদের মতো তারাও যেন জানতে পারে যে, তোমরা চুক্তি বাতিল বলে ঘোষনা করেছ। এ বিধানের অর্থ আমরা এই বুঝি যে, চুক্তি ভংগের ঘোষণা ব্যতীত তাদের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ হবে না”-(মাবসুত খৃঃ ১০০, পৃ ৮৭)

এ আয়াত এবং তাঁর উপরোক্ত ব্যাখ্যা একথাই প্রকাশ করে যে, চুক্তি সম্পাদনকারী দল যদিও বিশ্বাসঘাতকতা করে তথাপি যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে তাদের জান ও মাল বৈধ হবে না।২ [২. এ বিধানের শুধুমাত্র সেই অবস্থাই ব্যতিক্রম হবে যখন চুক্তি সম্পাদনকারী জাতি ঘোষণা করে তাদের চুক্তি ভংগ করেছে, প্রকাশ্যে আমাদের অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ করেছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। এমতাবস্থায় আমাদের অধিকার থাকবে ঘোষণা ব্যতিরেকে যুদ্ধ করার। নবী করীম (স)-এর একটি পদক্ষেপকে ফকীহগণ প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেন। ঘটনাটি এই যে, করাইশগণ যখন বনী খুযায়ার ব্যাপারে হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রকাশ্যে ভংগ করে, তখন নবী (সঃ) চুক্তি বাতিল ঘোষণার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। বরঞ্চ কোনো প্রকার খবর না দিয়েই মক্কা আক্রমণ করেন। কিন্ত এই দৃষ্টান্তের সুযোগ গ্রহণ করতে হলে প্রয়োজন হবে, যেসব অবস্থা ও পরিস্থিতিতে নবী (স) চুক্তি বাতিল ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করেননি, তা সামনে রাখা এবং যে পদ্ধতি এ অবস্থায় তিনি গ্রহণ করেছিলেন তা অনুসরণ করা। প্রথমত, কুরাইশদের চুক্তি ভংগ এতই সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য ছিল যে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই ছিল না। স্বয়ং কুরাইশগণ একথা স্বীকার করে যে, তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগ করা হয়েছিল। এজন্য তারা নতুন করে চুক্তি করার জন্যে আবু সুফিয়ানকে মদীনা পাঠায়। এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তাদের মতেও চুক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল না। তবে চুক্তি ভংগকারী জাতির পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগের স্বীকৃতি নিতে হবে এমন কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্যি চুক্তি ভংগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

দ্বিতীয়ত,তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভংগ হবার পর নবী করিম (সঃ) প্রকাশ্যে, আকারে-ইংগিতে অথবা পরোক্ষভাবে এমন কিছু করেননি যার থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, চুক্তি ভংগ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কুরাইশদের একটি চুক্তিবদ্ধ জাতি মনে করেন এবং তাদের সাথে চুক্তির সম্পর্ক এখনো বিদ্যমান আছে। সর্বসম্মত বর্ণনা এই যে, আবু সুফিয়ান মদীনায় এসে যখন নতুন করে চুক্তির আবেদন করে, নবী করীম (সঃ) তখন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তৃতীয়ত, কুরাইশদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ তিনি স্বয়ং নেন এবং প্রকাশ্যে নেন। তার কার্যকলাপে ধোঁকা-প্রতারনার কোনো লেশমাত্র ছিল না যে, তিনি বাইরে চুক্তির কথা বলেন এবং গোপনে যুদ্ধের পন্থা অবলম্বন করেন। এ হচ্ছে এ ব্যাপারে নবীর একটি উতকৃষ্ট আদর্শ।অতএব কুরআন মজিদের নির্দেশ ****** এর থেকে সরে গিয়ে যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, তাহলে ঠিক সেই অবস্থায় এবং সেইভাবে, যে অবস্থায় এবং যেভাবে নবী করীম (সঃ)পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।]

চারঃ অচুক্তিবদ্ধ জাতি— অচুক্তিবদ্ধ ঐসব কাফেরদের বলা হয়, যাদের সাথে কোনো চুক্তি হয়নি। এ এমন এক অবস্থা যাকে সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুদ্ধের অগ্রগামী বলা হয়। কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসানের (RUPTURE OF DEPLOMATIC RELATIONS) প্রকৃত অর্থ এই যে, উভয় জাতি এখন পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। এমন অবস্থায় যদি এক জাতি অন্য জাতির লোক হত্যা করে, অথবা লুন্ঠন করে তাহলে রক্তপণ অথবা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এ অর্থে বলা যায় যে, উভয় জাতির জন্যে পরস্পরের জান ও মাল বৈধ। কিন্ত কোনো সভ্য রাষ্ট্রই দস্তুরমতো যুদ্ধ ঘোষণা না করে কোনো মানব গোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত করা, ধন-সম্পদ লুন্ঠন করা পছন্দ করতে পারে না। এ ব্যাপারে ইসলামী বিধান হচ্ছে এইঃ

(আরবী********)

“যদি মুসলমানগণ দাওয়াত১ [১ ‘দাওয়াত’ অর্থ এই যে তাদেরকে এই বলে চরমপত্র (Ultimatum) দিতে হবে যে, তোমরা সন্ধি বা চুক্তি কর, জিযিয়া দাও অথবা মুসলমান হয়ে আমাদের জাতির মধ্যে শামিল হয়ে যাও। এ তিনটি শর্তের মধ্যে যদি একটিও গ্রহণ না কর, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।] ব্যতিরেকে যুদ্ধ করে তাহলে গোনাহগার হবে। কিন্তু এতে যে ধন-প্রাণ বিনষ্ট হয় তাঁর জন্যে হানাফী মতে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না।”

-(মাবসুত খঃ১০, পৃঃ১৩)

ইমাম শাফেয়ী বলেন যে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে। ততোক্ষণ তাদের জান-মালের বৈধতা বলবত থাকবে। কিন্তু হানাফীগণ বলেনঃ

(আরবী********)

“যে রক্ষণ-ব্যবস্থার ভিত্তিতে তাদের জান-মালের মূল্য নির্ধারিত হয়, তাতো দারুল ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণের অধীনে হবার কারণে। আর এ জিনিস তাদের সপক্ষে নেই।——– বৈধতার জন্যে চরমপত্র দেয়াটা অবশ্যই শর্ত। তা ব্যতিরেকে বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কিন্তু হত্যার অবৈধতার জন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এমন কথা বলা যায় না।”

-(মাবসুত খঃ১০, পৃঃ ৩০-৩১)

এর থেকে জানা গেল যে, যেসব হরবী কাফের জিম্মী নয়, যাদের সাথে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি, যাদের আবাস ভূমি আমাদের আবাসভূমি থেকে পৃথক, যাদের রক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের আইন স্বীকার করে না, তাদের জান-মাল ততোক্ষণ পর্যন্ত বৈধ হবে না, যতোক্ষণ না চরমপত্র দেয়া হয় এবং তাদের সাথে আমাদের রীতিমত যুদ্ধ শুরু না হয়। নবী করীম (সঃ) এ বিষরে হযরত মায়ায ইবনে জাবালকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা প্রনিধানযোগ্যঃ

(আরবী********)

“তাদের সাথে যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তাদেরকে চরমপত্র দিয়েছ। অতপর যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে তথাপি যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তারা প্রথমে অগ্রসর হয়। যদি তারা প্রথমে অগ্রসর হয়, তথাপি যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ না তারা তোমাদের কাউকে হত্যা করে। অতপর সে নিহত ব্যক্তিকে দেখিয়ে তাদেকে বলবে এর চেয়ে কোনো ভাল কিছু তোমরা করতে পারতে না? হে মায়ায এতখানি ধৈর্যের শিক্ষা এজন্য দেয়া হচ্ছে যে, যদি আল্লাহ তোমার দ্বারা কাউকে হেদায়েত করেন, তাহলে সমস্ত প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সম্পদ তোমার হস্তগত হওয়া থেকে তা হবে অতি উত্তম।”

পাচঃ যুদ্ধরত কাফেরগণ— এখন শুধু সেসব কাফেরদের কথা বলা যাক, যারা প্রত্যক্ষ মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। প্রকৃত হরবী এরাই, এদের আবাস ভূমিকে — বৈদেশিক সম্পর্কের আইনে- দারুল হরব বলে। তাদের জান-মাল বৈধ। তাদেরদে হত্যা করা, গ্রেফতার করা, লুন্ঠন করা প্রভৃতি শরীয়ত জায়েয বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাই বলে সকল হরবীর হরবীত্ব(ENEMY CHARACTER) এক রকম নয়, আর না হরবীর সকল সম্পদ একই বিধানের অধীন। হরবী কাফেরদের নারী, শিশু, রুগ্ন, বৃদ্ধ, পংগু প্রভৃতি যদিও হরবী, কিন্তু শরীয়ত তাদেরকে বৈধ বলেনি। বরঞ্চ হত্যার বৈধতা শুধুমাত্র যুদ্ধকারী (COMBATANTS) পর্যন্ত সীমিত রেখেছে।

(আরবী********)

“হত্যা শুধু তাকেই করা যাবে, যে আমাদের সাথে যুদ্ধ করছে। কারণ আল্লাহ **** বলেছেন। আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী মুকাবিলা (যুদ্ধ) দু পক্ষ থেকে হয়, এক পক্ষ থেকে নয়।”

-(মাবসুত খঃ ১, পৃঃ ৬৪)

এভাবে হরবীদের মালের মধ্যেও শরীয়ত শ্রেণী পার্থক্য করে দিয়েছে এবং প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে পৃথক পৃথক বিধান রয়েছে।

হরবীদের সম্পদের শ্রেণী বিভাগ ও তার বিধান
যেসব ধন-সম্পদ ও বিষয়-সম্পত্তি দুশমন এলাকায় পাওয়া যাবে, তার সবটাই নীতিগতভাবে বৈধ (CONFISCABLE)। কিন্তু শরীয়তে ইসলামী সেগুলোকে দু ভাগে বিভক্ত করছে— গনীমত ও ফাই।

গনিমতঃ ঐ সকল অস্থাবর সম্পদ (MOVEABLE PROPERTIES) যা যুদ্ধের সময় ইসলামী সেনাবাহিনী অস্ত্রবলে হস্তগত করে, তাহলো গনিমতের মাল। তার এক-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের এবং ৫.৪ অংশ ঐসব সৈনিকদের যারা তা হস্তগত করেছে। ইমাম আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খেরাজ গ্রন্থে গনিমতের সংজ্ঞা নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী********)

“ঐ সমস্ত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ যা মুসলমানগ্ণ মুশরেক সৈনিকদের নিকট থেকে হস্তগত করেছে এবং যা কিছু হস্তগত করেছে তাদের সাজ-সরঞ্জাম, অস্থশস্ত্র এবং পশুর মধ্যে (অর্থাৎ অস্থাবর সম্পদ)।”

এর থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, গনিমত শুধুমাত্র ঐসব সম্পদকে বুঝাবে যা (১)অস্থাবর (২) যুদ্ধকালীন অবস্থায় (WAR LIKE OPERATIONS) (৩) শত্রু পক্ষের সৈন্য থেকে হস্তগত করা হবে। সৈনিকদের আওতার বাইরে সাধারণ বেসামরিক জনপদ লুন্ঠন করে বেড়ানো শরীয়তের দৃষ্টিতে দুরস্ত নয়। যদিও দারুল হরবের যাবতীয় সম্পদ বৈধ এবং যদি কেউ বেসামরিক লোকের সম্পদের হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তার ক্ষতিপুরণ দিতে হবে না এবং লুন্ঠিত দ্রব্যাদি ফেরত দিতে হবে না, তথাপি এ ধরনের লুটতরাজ বাঞ্চনীয় নয়। মুসলিম বাহিনীর অধিনায়ক তার সেনাবাহিনীকে এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখবে। কারণ নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী********)

“যে ব্যক্তি অহংকার বশত নিজের ক্ষমতা ও বীরত্ব দেখাবার জন্যে এবং খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে, নেতার অবাধ্যতা করে এবং দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করে, তার সওয়াব লাভ করাতো দূরের কথা, সে তার কাজের সমান পারিশ্রমিক নিয়েও (আল্লাহর দরবারে) ফিরতে পারবে না।”

ফাইঃ দ্বিতীয় প্রকারের ঐসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে হস্তগত করা হয়নি, বরঞ্চ বিজয় লাভের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকারে আসে, ইসলামী পরিভাষায় তাকে ‘ফাই’ নামে অবিহিত করা হয়। এ সম্পদ বিজিত শত্রুর জনগণের হোক অথবা শত্রু রাষ্ট্রের সম্পদ হোক। গনিমত থেকে এ সম্পূর্ণ এক পৃথক বস্তু।

(আরবী********)

“শত্রুসেনাদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়া মালে গনিমত এক বস্তু আর দুশমনের জনপদ থেকে অধিকৃত ‘ফাই’ এর মাল আর এক বস্তু। উভয়ের বিধান পৃথক পৃথক।”

-(কিতাবুল খেরাজ পৃঃ ৩৮)

সূরা হাশরে এ বিষরে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে, এ ‘ফাই’ কোনো ব্যক্তির মালিকানায় দেয়া হবে না। তা বায়তুলমালে জমা থাকবে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়িত হবে।

(আরবী********)

“আল্লাহ তাদের নিকট থেকে তাঁর রসূলকে ‘ফাই’ হিসেবে যা দান করেছেন তা অর্জন করার জন্যে তোমরা উট এবং ঘোড়া পরিচালনা করনি, অর্থাৎ যুদ্ধ করনি।” –(সূরা হাশরঃ ৬)

এছাড়া ‘ফাই’ শব্দের আর কোনো অর্থ হতে পারে না। লোকে ইচ্ছামত ‘ফাই’ লাভ করে নিজের ব্যবহারে লাগিয়েছে, ফেকাহর গ্রন্থে এমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও **** (মুসলমানদের জন্যে ‘ফাই’) ********(‘ফাই’ মুসলমানদের বায়তুলমালে রাখা হয়) ******(মুসলিম দলের জন্য ‘ফাই’) প্রভৃতি কথাগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে মনে হয় যে, পূর্ববর্তী শাস্ত্রবিদগণ শুধু ঐসব ‘ফাই’ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিলেন যা মুসলিম দলের মালিকানায় হতো এবং তা থাকতো রাষ্ট্রের আয়ত্তাধীন।

গনীমত ও লুণ্ঠিত দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য
শরীয়তের গনীমত লাভ করার অধিকার শুধু তাদেরকে দেয়া হয়েছে যারা ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাধীন এবং যাদেরকে মুসলিমগণের নেতা বা ইমাম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমতি দিয়েছে। নতুবা যদি মুসলিম জনসাধারণ ব্যক্তিগত ভাবে অথবা দলবদ্ধ হয়ে ইচ্ছামতো লুটতরাজ করা শুরু করে তাহলে তারা লুণ্ঠনকারী বলে গণ্য হবে। তাদের গনীমত, গনীমত না হয়ে হবে লুটের মাল। এজন্য তার মধ্য থেকে এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর অংশ গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য তা তাদের কাছেই থাকতে দেয়া হবে। কারণ দুশমনকে তা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।

فان كان دخول القوم الذين لامنعة لهم بغير اذن الامام علي سبيل التلصص فلا خمس فيما اصابوا عندنا ولكن من اصاب منهم شيأ فهوله خاصة-

(আরবী********)

“ইমামের সাহায্য ও অনুমতি ব্যতিরেকে এমন কোনো লোক যদি শত্রু এলাকায় দায়িত্বহীনের ন্যায় প্রবেশ করে সম্পদ লুণ্ঠন করে, তাহলে আমাদের মতে তার থেকে এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণ করা হবে না। বরঞ্চ তা হবে তাদেরই জন্যে নির্দিষ্ট।”- (আল মাবসুত খঃ পৃঃ ৭৪)

আল্লামা সারাখসী এর যা কারণ বর্ণনা করেছেন তা নিম্নরূপঃ

والمعني مل بينا ان الغنيمة اسم لمال مصاب باشرف الجهات وهو ان يكون فيه اعلاء كلمة الله تعالي واعزاز الدين ولهذا جعل الخمس منه لله تعالي وهذا المعني لايحصل فيما ياخذه الواحد علي سبيل التلصص فيتمحض فعله اكتسابا للمال-(ايضاص 74 )

(আরবী********)

“আসল কথা হলো এই, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি যে, গনীমত এমন মালকে বলা হবে যা অতিমাত্রায় পাক এবং সম্মানিত উপায়ে হস্তগত করা হয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, তাতে আল্লাহর বাণী সমুন্নত করা এবং দীনকে মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। এজন্য তার মধ্যে এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত করা হয়েছে। এ মর্যাদা সে মালের হতে পারে যা চোরের মতো হস্তগত করা হয়েছে, কারণ তার উদ্দেশ্য তো শুধু সম্পদ অর্জন করা।”-(আল মাবসুত, পৃঃ৭৪)

দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইমাম সারাখসী এমন একটি হাদীস পেশ করেন যার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, মুশরেকগন একটি মুসিলম বালককে ধরে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর সে তাদের হাত থেকে পালিয়ে আসে এবং আসার সময়ে কিছু ছাগল ধরে নিয়ে আসে। নবী করীম (স) এ ছাগলগুলো তার কাছেই রাখতে দিলেন এবং তার কাছ থেকে এক পঞ্চমাংশ গ্রহন করলেন না। মুগীরাহ বিন শোবা (রা) এর ঘটনা থেকে্ও এ বিষয়ের সর্মথন পা্ওয়া যায়। তিনি তাঁর সাথীদের মাল লুট করে নিয়ে মদীনায় হাজীর হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যখন তাঁর লুটের মাল হুজুর (স)-এর খেদমতে পেশ করলেন তখন তিনি বললেন- “তোমার ইসলাম কবুল করা হলো, কিন্তু মাল কবুল করা হবে না।”

দারুল হরবে কাফেরদের মালিকানার অধিকার
গনীমতের উপরে তৃতীয় বাধা-নিষেধ এই আরোপ করা হয়েছে যে, গনীমত লাভকারীরা যতদিন দারুল হরবে অবস্থান করবে, ততোদিন তারা গনীমতের মাল ব্যবহার করতে পারবেন না। ব্যতিক্রম শুধু পানাহারের সামগ্রী এবং পশুর খাদ্য। অর্থাৎ যুদ্ধ চলাকালীন যত পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য ও পশু খাদ্য মুসলিম সেনাবাহিনীর হস্তগত হবে, তার থেকে প্রত্যেক মুজাহিদ তার প্রয়োজন পরিমাণ দ্রব্যাদি প্রহণ করতে পারে। এতদ্ব্যতীত সমুদয় গনীমতের মাল সেনাধ্যক্ষের নিকট জমা দিতে হবে। গনিমত লাভকারীদেরকে দারুল ইসলাম অভিমুখে রওনা করে না দেয়া পর্যন্ত তাদের মধ্যে গনীমতের মাল বন্টন করা যাবে না। তার কারণ এই যে, হানাফীদের মতে যতোদিন পর্যন্ত গনীমতের মাল দারুল হরবে থাকবে ততোদিন তার উপর গনীমত লাভকারীদের মালিকানা বর্তাবে না। ইমাম শাফেয়ী (র) এর অভিমত তার বিপরীত। তিনি বলেন যে, হরবী যুদ্ধকারীদের মাল বৈধ। এজন্য যখনই মুসলিম মুজাহিদগন তা অধিকার করবে, তখনই তারা তার মালিক হয়ে পড়বে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (র) এবং তার সহকর্মীগণ বলেন যে, এ মালিকানা দুর্বল। গনীমত যদিও আমদের কিন্তু ভূখন্ড তো তাদের। যতোক্ষণ পর্যন্ত মাল তাদের ভূখন্ড থেকে আমাদের ভূখন্ডে স্থানান্তরিত না হয়েছে, ততোক্ষণ আমরা পুরোপুরি তার মালিক হতে পারি না। অতএব পরিপূর্ণ মালিকানার জন্যে শুধুমাত্র্র অধিকার লাভই (OCCUPATION) যতেষ্ট নয়। ইমাম সারাখসী এ বিষয়ে হানাফী মতের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ করেনঃ

فاما عندنا الحق يشبت بنفس الاخذ ويتاكد بالاحراز وتيمكن بالقسمة كحق الشفيع يشبت بالبيع ويتم الملك بالاخذ وما دام الحق

ضعيفا لا تجوز القسمة………بالاخذ يملك الارضي كما يفلك الاموال ثم لايتاكد الحق في الارض التي نزلوا فيها اذا لم يصيروها دار الاسلام-

“আমাদের মতে দখল দ্বারা শুধু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, দারুল ইসলামে নিয়ে যাবার পর অধিকার সুদৃঢ় হয় এবং গনীমত বন্টনের পর অধিকার পূর্ণ হয়। এর দৃষ্টান্ত হলো প্রতিবেশীর হকের মতো। বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিবেশীর হক প্রমাণিত হয়, দাবীর দ্বারা সে হক মজবুত হয় এবং দখলের দ্বারা হক পরিপূর্ণ হয়। অতএব যতোক্ষণ হক বা অধিকার দুর্বল থাকে, বন্টন জায়েয হয় না। — যেমন ধারা অস্থাবর সম্পত্তির উপর দখলের দ্বারা মালিকানা প্রমাণিত হয়, তেমনি জমিজমা তথা স্থাবর সম্পত্তির উপর দখল দ্বারা মলিকানা প্রমাণিত হয়। কিন্তু যে ভূখন্ডে মুসলিম সৈন্য প্রবেশ করে, তার উপর তাদের অধিকার ততোক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত যতোক্ষণ না তা দারুল ইসলামে শামিল করে নেয়া হয়।”

-(আল মাবসুত খঃ১, পৃঃ৩৩)

এ ব্যাখ্যা দ্বারা প্রমানিত হয় যে, শুধুমাত্র গনীমতই নয়, বরঞ্চ ফাই ব্যবহরের অধিকারও ইসলামী রাষ্ট্রের ততোক্ষণ পর্যন্ত হয় না, যতোক্ষণ দখলকৃত অঞ্চলকে (OCCUPIED TERRITORY) দারুল ইসলামে পরিণত করা না হয়েছে। অথবা আধুনিক পরিভাষায় দখলকৃত এলাকাকে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত (ANNEXATION) করার যথরীতি ঘোষণা করা না হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) এর কার্যপদ্ধতি এর সমর্থন করে। মকহুল বলেনঃ

ماقسم رسول الله صلي الله عليه وسلم الغناؤم الا في دار الاسلام-

“নবী করীম (সাঃ) গনীমতের মাল দারুল ইসলাম ব্যতীত অন্য কোথাও বন্টন করেননি।”

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক এবং কালবী বলেন যে, নবী করীম (সাঃ) হোনায়েনের গনীমত প্রত্যাবর্তন কালে জিয়িররানা নামক স্থানে বন্টন করে ছিলেন। এ স্থানটি ছিল দারুল ইসলাম সীমান্তে অবস্থিত। পথে বেদুইন আরবগন গনীমত বন্টনের জন্যে এতো পীড়াপীড়ি করে যে, নবী করীম (সাঃ) অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েন যে, তার গায়ের চাদর ছিড়ে যায়। কিন্তু এতটা হৈচৈ সত্ত্বেও দারুল ইসলাম সীমান্তে না পৌছা পর্যন্ত তিনি মালে গনীমতের একটি দানাও বন্টন করেননি।

আল্লাহর নবীর এ কার্যপ্রণালী এবং ইসলামী শাস্ত্রবিদগণের ব্যাখ্যা চিন্তা- ভাবনা করে দেখুন, এর কারণ এ ছাড়া আর কিছুই মনে না যে, ইসলামী আইন যেভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অধিকৃত অঞ্চলের উপরে মুসলমানদের মালিকানার অধিকার স্বীকার করে, তেমনিভাবে অধিকৃত অনৈসলামী অঞ্চলের উপর হারবীদের পর্যন্ত মালিকানা অধিকার স্বীকার করে। যদিও যুদ্ধ তাদের সম্পদ আমাদের জন্যে বৈধ করে দেয়, তথাপি এ বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করার জন্যে শরীয়ত সাধারণ ও শর্তহীন কোনো অনুমতি দেয় না। বরঞ্চ তাদের মালিকানা থেকে আমাদের মালিকানায় হস্তান্তরের জন্যে সম্পদ স্থানান্তরের কিছু আইনানুগ পন্থা নির্ধারিত করে দিয়েছে। তা এমন যে তার মধ্যে কাফেরদের ও আমাদের মধ্যে সমতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হানাফী আইন বলে যে, আমরা তাদের সম্পদের মালিক তখনই হতে পারি যখন রীতিমতো যুদ্ধের সাহায্যে তা হস্তগত করে আমাদের ভুখন্ডে (ইসলামী রাষ্ট্রে) নিয়ে আসবো। এভাবে যুদ্ধে তারা আমাদের সম্পদ হস্তগত করে, তাদের ভূখন্ডে নিয়ে গেলে, তারাও এসবের মালিক হয়ে যাবে। তাদের ভুখন্ডে তাদের মালিকানার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের কর্তব্য।

এ ব্যাপারে ফকীহগণের অধিকতর ব্যাখ্যা প্রনিধানযোগ্যঃ

نفس الاخذ سبب لملك المال اذا تم بالاحراز وبيننا وبينهم مساوات في اسباب اصابة الدميا بل حظهم اوفر من حظنا لان الدنيا لهم ولانه لامقصود لهم في هذه الاخذ سوي اكتساب المال ونحن لانقصد بالاخذ اكتساب المال-

“সম্পদ হস্তগত করার পর যখন তা স্বীয় ভূখন্ডে পৌছিয়ে দেয়া হলো তখন সে সম্পদের উপর পূর্ণ মালিকানার কারণ হয়ে গেলে। ইহলৌকিক সম্পদ লাভের ব্যাপারে আমাদের ও কাফেরদের পূর্ণ সমতা বিদ্যমান। বরঞ্চ ইহলৌকিক ব্যাপারে আমাদের অপেক্ষা তাদের অংশ কিছুটা বেশী। কারণ তাদের জন্যে তো শুধু দুনিয়া এবং সম্পদ অর্জন করা ব্যতিত তাদের জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। পক্ষান্তরে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য সম্পদ অর্জন নয়।”- (আল মাবসুত খঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৫৩)

واذا دخل المسلم دار الحرب بامان وله قي ايديهم جارية ماسورة كرهت له غصبها ووطيها لانهم ملكوها عليه والتحقت بساؤر املاكهم-

“কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে প্রবেশ করলো এবং সেখানে সে তার দাসীকে হাতের নাগালে পেলো, এমতাবস্থায় তার দাসীকে হস্তগত এবং তার সাথে সহবাস করা তার জায়েয হবে না। কারণ কাফেরগন এখন তার মালিক এবং সে তাদের মালিকানার অধীন।”-(ঐ পৃঃ ৬৫)

ولو خرج الينا بامان ومعه ذالك المال فانه لايتعرض له فيه-(ايضا ص 63)

”যদি কোনো হরবী কাফের নিরাপত্তাসহ আমাদের রাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং তার কাছে যদি আমাদের নিকট থেকে লুণ্ঠিত মাল পাওয়া যায়, তাহলে তা আমরা তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারি না।”- (ঐ পৃঃ ৬৩)

فان غلب العدو على مال المسلمين فاحرزوه وهناك مسلم تاجر مستامن حل له يشتريه منهم فياكل الطعام من ذالك وبطاء الجلرة لانهم ملكوها بالاحراز فا لتحقت بساؤر املاكهم وهذا بخلاف مالو دخل اليهم تاجر بامان فسرق منهم جارية واخجها لم يحل المسلم ان يشتريها منه لانه احرزها عى سبيل الغدر وهو مامور بردها عليهم فيما بينه وبين ربه وان كان لايجبره الامام على ذالك-(ايضاص 31)

“যদি দুশমন মুসলমানদের মাল হস্তগত করার পর তা আপন আবাসভুমিতে নিয়ে যায় আর সেখানে যদি নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো ব্যবসায়ী মুসলমান থাকে তাহলে সে মাল খরিদ করা ও ব্যবহার করা তার হালাল হবে। সে দুশমনের নিকট থেকে খরিদ করা দাসীর সাথে সহবাসও করতে পারে, কারণ আপন ভূখন্ডে নিয়ে যাবার পর সে ওসব মালের মালিক হয়ে গেছে এবং সবকিছুই এখন তার মালিকানাধীন। পক্ষান্তরে যদি কোনো ব্যবসায়ী নিরাপত্তসহ দারুল হরবে যায় এবং তাদের অধিকার থেকে কোনো দাসীকে চুরি করে নিয়ে দারুল ইসলামে আসে, তাহলে সে দাসী খরিদ করা মুসলমানের জন্যে হালাল হবে না। কেননা সে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে এনেছে। আল্লাহ ও তার মধ্যে যে সম্পর্ক তার জন্যে তাকে সে দাসী ফেরত দিতে হবে। অবশ্য ইমাম তাকে ফেরত দিতে বাধ্য করবে না।”- (ঐ পৃঃ৬১)

এ কর্মপদ্ধতি ঠিক হাদীসেরই অনুরূপ। মক্কা বিজয়ের দিনে হযরত আলী (রাঃ) নবী করীম (স)-কে অনুরোধ করে বললেন, হিজরতের আগে আপনি যে বাড়ীতে ছিলেন, সেখানে গিয়ে উঠে পড়ুন না কেন?” নবী করীম (সাঃ) বললেন, هل ترك لنا عقيل من ربع “আকীল কি আমাদের জন্যে কিছু ছেড়ে দিয়েছে?

তার অর্থ এই যে, নবী করীম (স) যখন তা ছেড়ে দিয়ে চলে যান, তখন আকীল ইবনে আবি তালেব তা দখল করে। তখন তাঁর মালিকানা চলে যায় এবং আকীলের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন যদিও তিনি মক্কা জয় করেছেন, তথাপি তিনি তাঁর পূর্ববর্তী মালিকানার ভিত্তিতে সে বাড়ী নিজের বলে ঘোষণা করতে অস্বীকার করেন।


পূর্ববর্তী আলোচনার সংক্ষিপ্তসার
এসব আইগত ব্যাখ্যা সামনে রইলো। এসবের উপর মনোনিবেশ করলে নিম্ন সিদ্ধান্তে পৌছা যায়ঃ

একঃ দারুল হরব যদি সাধারণভাবে দারুল কুফর (FOREIGN TERRITORY) অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তার সম্পদ বৈধ (مباح) (**আরবী**) নয়, বরঞ্চ ‘অরক্ষিত’। রক্ষণহীনতার ফল শুধু এতটুকু যে, ইসলামী রাষ্ট্র সে ভূখন্ডে কোনো জান-মালের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে দায়ী নয়। সেখানে যদি কোনো মুসলমান মুসলমান অথবা অমুসলিমের জান-মালের ক্ষতি করে, কিংবা তার মলিকানা থেকে কোনো কিছু অবৈধ উপায়ে হস্তগত করে তাহলে সেটা হবে তার এবং আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপার। ইসলামী রাষ্ট্র এতে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।

দুইঃ দারুল হরব যদি এমন কাফেরদের আবাসভূমি বুঝায় যাদের জান ও মাল বৈধ, তাহলে এ অর্থে প্রত্যেক দারুল কুফর দারুল হরব নয়। বরঞ্চ শুধু মাত্র সেই অঞ্চলই দারুল হরব যার সাথে দারুল ইসলামের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ চলছে। এ বিশেষ ধরনের দারুল কুফর ব্যতীত অন্য দারুল কুফরের অধিবাসীর জান-মাল বৈধ নয় যদিও তারা জিম্মী না হয় এবং তাদের জান ও মাল অরক্ষিত হয়।

তিনঃ যে দেশের সাথে মুসলমানদের কার্যত যুদ্ধ চলছে, তাদের জান ও মাল সাধারণভাবে এমন বৈধ নয় যে, প্রত্যেকে সেখানে লুটতরাজ করার ও কাফেরদের সম্পদ দখল করার স্বাধীনতা রাখে। বরঞ্চ তার জন্যে কিছু শর্ত ও বাধা-নিষেধ আছেঃ

(ক) মুসলমানদের নেতা রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সে দেশকে দারুল হরব বলে অভিহিত করবে এবং

(খ) সেখানে যারা যুদ্ধ করবে তাদের জন্যে ইমামের অনুমতি ও সাহায্য থাকতে হবে।

চারঃ গনীমত সেসব স্থাবর সম্পদকে বলা হয়, যা শুধু সেনাদের সাথে যুদ্ধ করে হস্তগত করা হয়। অন্য কথায়, যা সম্মানজনক পন্থায় অর্জন করা হয় এবং যাতে দীনের মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। এ মালের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর। অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয়িত হবে।

পাঁচঃ ‘ফাই’ ঐসব স্থাবর অবস্থার সম্পদকে বলে যা বিজয় লাভের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের দখলে আসে। খেরাজ, সন্ধিসূত্রে লব্ধ মাল প্রভৃতিও ফাই-এর অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু এর সবটাই ইসলামী রাষ্ট্রের মালিকানা ভুক্ত সম্পদ এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের মালিকানা অধিকার এতে থাকবে না।

ছয়ঃ ‘ফাই’ এবং গনীমতের মালের উপর বিজয়ীদের পূর্ন মালিকানা অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন তা দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে স্থানান্তরিত করা হয়। অথবা দারুল হরবকে দারুল ইসলামে পরিণত করা হয়। এর পূর্বে সেসব মাল ব্যবহার করা ও তা কাজে লাগানো মাকরূহ।

সাতঃ ইসলামী আইন – হরবী কাফেরদের মালের উপর তাদের মালিকানা অধিকার স্বীকার করে। তাদের মালিকানা থেকে মুসলমানদের মালিকানায় বৈধ উপায়ে হস্তান্তর সেভাবে হতে পারে, যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রসূল হালাল করেছেন। অর্থাৎ ক্রয়, সন্ধি অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে।

আবাস ভুমির বিভিন্নতার কারণে মুসলমানেদের শ্রেনীর বিভাগ

এসব বিষয়ের সঠিক তত্ত্ব জানার পর এখন একটি দৃষ্টিভংগীও লক্ষ্য করুন যে, ইসলামী আইন অনুযায়ী আবাস ভূমির বিভিন্নতার দিক দিয়ে স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে কি কি বিভিন্নতা দেখা যায়। এ ব্যাপারে সমগ্র আইনের ভিত্তি নিম্ন আয়াত ও হাদীসগুলো উপর প্রতিষ্ঠিতঃ

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يُہَاجِرُواْ مَا لَكُم مِّن وَلَـٰيَتِہِم مِّن شَىۡءٍ حَتَّىٰ يُہَاجِرُواْ‌ۚ

“যারা ঈমান এনেছে বটে, কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে আসেনি, তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই, যতোক্ষণ না দারুল কুফর থেকে দরুল ইসলামে হিজরত করে।”-(সূরা আনফালঃ ৭২)

فَلَا تَتَّخِذُواْ مِنۡہُمۡ أَوۡلِيَآءَ حَتَّىٰ يُہَاجِرُواْ فِى سَبِيلِ

(আরবী********)

“তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, যতোক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে।”-(সূরা আন-নিসাঃ ৮৯)

وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَـًٔ۬ا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬ وَدِيَةٌ۬ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦۤ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْ‌ۚ فَإِن كَانَ مِن قَوۡمٍ عَدُوٍّ۬ لَّكُمۡ وَهُوَ مُؤۡمِنٌ۬ فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬‌ۖ وَإِن ڪَانَ مِن قَوۡمِۭ بَيۡنَڪُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَـٰقٌ۬ فَدِيَةٌ۬ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ وَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٍ۬ مُّؤۡمِنَةٍ۬‌

(আরবী********)

“(১) যে কেউ কোনো মুসলমানকে ভুলবশত হত্যা করে, তাকে একটি মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে রক্তপণ দিতে হবে। তবে ওয়ারিশগণ যদি সদকা হিসেবে রক্তপণ ছেড়ে দেয়, তাহলে তা দিতে হবে না। (২) এবং যদি নিহত ব্যক্তি এমন দলের হয় যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা আছে এবং যদি সে মুসলমান হয়, তাহলে শুধু একটি মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে। (৩) এবং যদি সে এমন দলের হয়, যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি হয়েছে, তাহলে তার ওয়ারেশদেরকে রক্তপণ দিতে হবে এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করে দিতে হবে।”-(সূরা আন নিসাঃ ৯২(

قال النبى صلى الله عليه و سلم انا برى‘ من كل مسلم اقام بين اظهر النشكين- وعن النلى صلى الله عليه وسلم ايضا من اقام مع المشركين فقد برءت منه الذمة او قال لاذمة له-

“নবী করীম (সাঃ) বলেন, আমি১ [১. আমি শদ্বটি তিনি রসূল হিসেবে বলেননি, বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে। তার অর্থ হলো এই যে, এ ধরনের কোনো মুসলমানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের নয়।] ঐ মুসলমানের দায়িত্ব থেকে মুক্ত, যে মুশরেকদের মধ্যে থাকে। তিনি অন্যভাবেও বলেন, যে মুশরেকদের মধ্যে থাকে তার থেকে আমি দায়িত্বমুক্ত। অথবা তার জন্যে কোনো দায়িত্ব নেই।”

আবু দাউদের কিতাবুল জিহাদ অধ্যায়ে আছে, যখন নবী করীম (স) কাউকে সেনাধক্ষ্য করে পাঠাতেন, তখন তিনি তাকে অন্যান্য উপদেশের সাথে এ উপদেশও দিতেনঃ

ادعهم الى الاسلام بان اجايوك باقبل منهم وكف عنهم- ثم ادعهم الى الرحول من دارهم الى دار المهاجرين واعلمهم انهم ان فعلوا ذالك ان لهم ماللمهاجرين وان عليهم ما على المهاجرين فان ابوا واختاروا دارهم فاعلمهم انهم يكونون كاعراب المسلمين يجرى عليهم حكم الله الذى كان يجرى على المؤمنين ولايكون لهم فى الئ والغنيمة نصيب الا ان يجاهدوا مع المسلمين

“তাদেরকে প্রথমে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবে। যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। তারপর তাদেরকে আপন আবাসভূমি ত্যাগ করে দারুল ইসলামে আসতে বলবে। একথাও বলবে যে, দারুল ইসলামে এলে তাদের সেসব অধিকার মিলবে যা মুহাজেরগণ পেয়ে থাকে। আর যেসব দায়িত্ব মুহাজেরগণের উপরে অর্পিত হয় তা তাদের উপরেও হবে। যদি তারা অস্বীকার করে এবং নিজেদের আবাস ভূমিতেই থাকতে চায়, তাহলে তাদেরকে জনিয়ে দিবে যে তাদের অবস্থা মুসলিম বেদুঈনদের মতোই হবে। মুসলিমদের মতো তাদের উপর আল্লাহর বিধি নিষেধ জারী হবে। কিন্তু ফাই এবং গনিমতের কোনো অংশ তারা পাবে না। তবে পাবে যদি মুসলমানদের সাথে মিলে জিহাদ করে।”

এসব আয়াত ও হদিীস থেকে হানাফী ফকীহগণ যে বিধান বের করেছে তা সংক্ষেপে বর্ণনা করছি।

একঃ দারুল ইসলামের মুসলমান

যে সকল জীবন ও ধন-সম্পদ দারুল ইসলামের গন্ডির ভিতর হবে, ইসলামী রাষ্ট্রের১ [১. প্রাথমিক যুগে যখন সকল মুসলিম অধিকৃত এলাকা একই রাষ্ট্রের অধীন ছিল, তখন দারুল ইসলাম বলতে মুসলিম খলিফার রাষ্ট্রীয় সীমাকেই বুঝাতো। কিন্তু ইসলামী আইনের ভিত্তি যে সব মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত তা এমন যে, যখন দারুল ইসলাম খন্ড-বিখন্ড হয়ে বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়লো, তখন আপনা-আপনি রাষ্ট্র মন্ডলের (Commonwealth) ধারণা সৃষ্টি হলো। এ ধারণা অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম অধিকৃত এলাকা, তা সে দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তেই হোক আর যে কোনো শাসকের অধীন হোক, সর্বাবস্থায় দারুল ইসলামের অংগ, অংশ। আর প্রত্যেকে মুসলমান, সে যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, দারুল ইসলামে প্রবেশ করার সাথে সাথে তার নাগরিক হয়ে পড়ে। অতপর সে সকল নাগরিক অধিকার (Rights of Citizenship) লাভ করে, এ শর্তে যে সে কোনো দারুল কুফরের সাথে নাগরিকত্বের সম্পর্ক বজায় না রাখে। বর্তমান ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ এ নীতি মেনে চলুক আর নাই চলুক, ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে কোনো মুসলমান কোনো ইসলামী রাষ্টে বিদেশী (Foreigner) নয়। একজন আফগানের অধিকার ও দায়িত্ব তুরস্কে এবং ইরানে তাই হবে, যা স্বয়ং আফগানিস্থানে হয়ে থাকে এবং একজন মুসলমানের এ প্রয়োজন হওয়া উচিত নয় যে, যদি সে একটি ইসলামী রাষ্ট্র থেকে অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে যায়, তাহলে সেখানে নাগরিকত্ব লাভের জন্য তাকে কৃত্রিম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। প্রত্যেক মুসলমান দারুল ইসলামের জন্মগত নাগরিক।] দায়িত্ব শুধু তার রক্ষণাবেক্ষন করা। যেসব মুসলমান দারুল ইসলামের নাগরিক হবে, ইসলামের যাবতীয় আইন দীনের দিক দিয়েই নয় বরঞ্চ পার্থিব দিক দিয়েও তাদের উপর প্রযোজ্য হবে এবং তারাই পুরোপুরি বিধানগুলো মেনে চলবে। এ নীতি ইসলামী আইনের মৌল ও প্রধান নীতিগুলোর মধ্যে একটি। এর থেকে অনেক শাখা-প্রশাখা বা ধারা-উপধারা বিস্তার লাভ করেছে।

একঃ এ নীতির ভিত্তিতেই এ বিধান যে জান-মাল-ইজ্জতের রক্ষণ ব্যবস্থা শুধু সেসব মুসলমান ভোগ করবে, যারা দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন। তাদের ছাড়া অন্যান্য মুসলমানদের রক্ষণ-ব্যবস্থা শুধুমাত্র দীনি ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠিত রক্ষন-ব্যবস্থা নয়, যার ভিত্তিতে শরীয়তের বিচার অপরিহার্য হয়। ইমাম সারখসী বলেনঃ

العصة المقومة تكون بالاحراز- (المبسوط ج 10 ص 30)

“প্রতিষ্ঠিত রক্ষণ-ব্যবস্থা শাসন কার্যের মাধ্যমে হয়।” -(আল মাবসুত খঃ ১০, পৃঃ ৩০)

والعصمة بالاحراز والاحرذ بالدار لابالدين- (ايضا ص 35)

“রক্ষণ-ব্যবস্থা শাসন-ব্যবস্থার দ্বারা হয়। আর শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র দ্বারা হয়, দ্বীনের দ্বারা নয়।” -(ঐ পৃঃ৫৩)

দুইঃ এ নীতি অনুযায়ী এ বিধানও নির্ণীত হয় যে, ইসলামী আইন যেসব কাজ হারাম করেছে তার থেকে দীনের দিক দিয়ে ও বিচার-শাসনের দিক দিয়ে দারুল ইসলামের মুসলমানদেরকে বিরত রাখতে হবে। কিন্তু যেসব মুসলমান দারুল ইসলামে নেই, তাদের বিষয়টি তাদের এবং আল্লাহর মধ্যে। অন্তরে দীনের প্রতি মর্যাদাবোধ থাকে তো নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকবে, নতুবা যা খুশী করবে। কারণ তাদের উপর বিধান কার্যকর করার ক্ষমতা ইসলমের নেই।

তিনঃ এ নীতি থেকে এ মাসয়ালাও বের হয় যে, যেসব জান-মাল দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন তা সব রক্ষিত, অতএব শরীয়তি বিধান ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে তাদের সাথে শত্রুতা করার অনুমতি দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে মুসলিম অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। প্রত্যেক ব্যক্তিকে শত্রুতা করা থেকে বিরত রাখা হবে যে ইসলামী বিধানের অনুসারী হয়েছে, সে মুসলিমের সাথে শত্রুতা করুক বা অমুসলিমদের সাথে। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জান ও মালের রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে, যে দারুল ইসলামের রক্ষণাধীন তা সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক।

দারুল ইসলামে কোনো মুসলমান মুসলমান থেকে, মুসলমান জিম্মী থেকে, জিম্মী মুসলমান থেকে, জিম্মী জিম্মী থেকে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী অন্য নিরাপত্তাপ্রাপ্ত থেকে সুদ অথবা কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করতে পারবে না; কারণ সকলের সম্পদ লোকের জন্যে রক্ষিত। একমাত্র ইসলামী আইনের বৈধ উপায়ে সে সম্পদ লাভ করা যায়।

(আরবী********)

“হরবী ব্যবসায়ীগণ যদি নিরাপত্তাসহ দারুল ইসলামে প্রবেশ করে এবং সেখানে তাদের কেউ দুই দিরহাম দিয়ে এক দিরহাম খরিদ করে। তাহলে তার অনুমতি দেওয়া হবে না। যা মুসলমানদের মধ্যে বৈধ, শুধু এমন কারবারের অনুমতিই দেয়া হবে। জিম্মীর ব্যপারেও তাই। কারণ তাদের প্রত্যেকের সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষিত।“-(আল মাবসুত খঃ ১৪, পৃঃ ৫৮)

এভাবে যদি কোনো কাফের দারুল কুফর থেকে দারুল ইসলামে আসে, অথবা দারুল হরব থেকে কোনো হরবী নিরাপত্তাসহ ইসলামী রাষ্ট্রে প্রবেশ করে। তাহলে তার নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করা অথবা কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয হবে না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা তার জান ও মাল রক্ষিত করে দিয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের প্রদত্ত নিরাপত্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু যদি কোনো হরবী নিরাপত্তা ব্যতিরেকে দারুল ইসলামে আসে তাহলে তাকে আটক করা, তার সম্পদ লুট করা, তাকে হত্যা করা এবং অবৈধ চুক্তিতে তার সাথে কারবার করা সবই ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে জায়েয। কারণ তার রক্ত ও সম্পদ বৈধ। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ তার সাথে কোনো অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয মনে করেন না। বিস্তারিত আলোচনা সামনে করা হবে।

দুইঃ দারুল কুফর ও দারুল হরবে নিরাপত্তা প্রাপ্ত মুসলমান-

দারুল ইসলামের কোনো নাগরিক যদি নিরাপত্তাসহ সাময়ীকভাবে দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে যায়, তাকে ইসলামী পরিভাষায় বলে ‘মুস্তামান’ (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত)। এ ব্যক্তি যদিও ইসলামী রাষ্ট্রের আওতার (JURISDICTION) বাইরে যাবার কারণে আমাদের রাষ্ট্রের আইনের ধরা-ছোয়ার বাইরে থাকে। কিন্তু তথাপি কতকটা ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাধীন সে থাকে এবং ইস্ললামী আইন পালনের দায়িত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয় না। হেদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ

(আরবী********)

“দারুল ইসলামের যে রক্ষণ-ব্যবস্থা বা রক্ষাকবচ, তা সাময়ীকভাবে নিরাপত্তাসহ অন্যত্র গমনে বাতিল হয় না।“

-(কিতাবুস সিয়ার মুস্তামান অধ্যায়)।

এ নীতি অনুযায়ী নিন্মলিখিত শরীয়তের মাসয়ালা বের হয়ঃ

একঃ যে দারুল কুফরের সাথে দারুল ইসলামের চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেখানে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমানের জন্য অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা জায়েয নয়। কারণ সেখাকার কাফেরদের জীবন ও ধন-সম্পদ বৈধ নয়। আর এ সবের বৈধতার কারণেই যখন অবৈধ চুক্তি বৈধ হয় তখন এ বৈধতা না থাকার কারণে আপনা আপনি সেটার বৈধতাও নষ্ট হয়ে যায়।

দুইঃ যদি কোনো মুসলমান এ ধরণের দারুল কুফরে অবৈধ চুক্তিতে কারবার করে, বিস্বাসঘাতকতা করে অথবা লুটপাট ও চুরি করে কোনো কিছু নিয়ে আসে, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তার উপর কোনো মামলা দায়ের করবে না কিংবা তাকে ক্ষতিপূরণও (এ শুধু সে অবস্থায় হতে পারে যদি চুক্তিতে এ ধরনের কোনো শর্ত না থাকে। অর্থাৎ ইসলামী আইনের অধীনে মাত্র কার্যের ভিত্তিতে সে মুসলমানকে অভিযুক্ত করা যাবে না। শুধু সন্ধির শর্ত অনুসারেই তাকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে অথবা ঐ সবের ভিত্তিতে-যে সম্বন্ধে পূর্বে ইংগিত করা হয়েছে) দিতে হবে না। অবশ্যি দীনের দিক দিয়ে তাকে ঐসব শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হবে।

তিনঃ দারুল হরবে নিরাপত্তাসহ যে ব্যক্তি প্রবেশ করে তার জন্য অবৈধ চুক্তি বাদে অন্যান্য সমুদয় ব্যপারে হানাফী ফেকাহর এসব বিধানই রয়েছে।

(আরবী********)

কোনো ব্যবসায়ী যদি নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে যায় এবং সেখান থেকে কোনো দাসী চুরি করে নিয়ে আসে —- তাহলে তার এবং আল্লাহর মধ্যস্থিত সম্পর্কের ভিত্তিতে সে উক্ত দাসীকে ফেরত দেবার জন্যে আদিষ্ট, কিন্তু ইমাম তাকে এরুপ করতে বাধ্য করবে না। -(আল মাবসুত ১ :৬১)

(আরবী********)

যদি কোনো মুসলমান নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে প্রবেশ করে, তাদের কাছে ঋণ গ্রহন করে কিংবা সে তাদের মাল লুট করে বা তারাই তার মাল লুট করে, তাহলে দারুল ইসলামে এর কোনো মীমাংসা করা যাবে না —— নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তি স্বয়ং তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন সে যে বিশ্বাসঘাতকতা করলো তা ইমামের চুক্তি অনুযায়ী করেনি, সে নিজস্ব চুক্তিতে বিশ্বাস ভংগ করেছে। সে জন্যে তাকে ফেরত দেবার কথা বলা হবে-কিন্তু বাধ্য করা হবে না। (ঐ পৃঃ ৯৫)

(ইমাম আবু ইউসুফ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ তিনি মুসলমানকে সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পালনে বাধ্য বলে মনে করেন) যদি কোনো নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরবে কাউকে হত্যা করে, অথবা কারো মালের ক্ষতি করে, তাহলে দারুল ইসলামে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না। অবশ্যি দীনের দিক দিয়ে তার এরুপ করা নাজায়েয।

(আরবী********)

“দীনের দিকে একজন নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলিমের বিশ্বাসভংগ করা অবাঞ্ছিত। কারণ বিশ্বাসভংগ করা হারাম।“-(ঐ পৃঃ ৯৬)

কোনো নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরব থেকে কোনো কিছু অন্যায়ভাবে অথবা চুরি করে নিয়ে এলে তা মুসলমানদের জন্যে খরিদ করা মাকরুহ। কিন্তু খরিদ করে ফেললে, সে খরিদ বাতিল ঘোষণা হবে না। কারণ আইনত ক্রয়-বিক্রয়ে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যেহেতু মূলত এ মাল অন্যায়ভাবে অর্জিত, সে জন্যে দীনের খ্যাতিরে তা ফেরত দিতে সে আদিষ্ট।

চারঃ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান দারুল হরবে হরবীদের কাছে সুদ নিতে পারে, জুয়া খেলতে পারে, মদ শূকরের মাংস, মৃত জীব তাদের কাছে বিক্রি করতে পারে এবং হরবীদের সম্মতিতে সকল উপায় তাদের মাল গ্রহন করতে পারে। এ হলো ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর অভিমত। ইমাম আবু ইউসুফ (র) এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। ইমাম সারাখসী প্রথমোক্ত ইমামদ্বয়ের যুক্তির যে উদ্ধৃতি দেন তা প্রণিধানযোগ্য।

নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে দারুল হরবে সুদের উপর নগদ অথবা ধারে কারাবার করা, মদ, শূকরের মাংস ও মৃত জীব তাদের কাছে বিক্রি করা ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে জায়েয। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ (র) নাজায়েয বলেছেন। তাঁর যুক্তি এই যে, মুসলমান যেখানেই থাক, ইসলামের বিধান মেনে চলতে বাধ্য, আর ইসলামী বিধানই এ ধরনের কাজ হারাম করেছে। লক্ষ্য করার বিষয় যে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবী যদি আমাদের রাষ্ট্রে এমন কাজ করে তা জায়েয হবে না। অতএব এখানে যখন নাজায়েয তখন দারুল হরবেও নাজায়েয হওয়া উচিত। প্রথমোক্ত ইমামদ্বয় বলেন যে, এতো শত্রুর মাল তার সম্মতিতে নেয়া হয়েছে। আর মূলে এই রয়েছে যে, তাদের সম্পদ আমাদের জন্য মুবাহ (বৈধ)। নিরাপত্তাপ্রাপ্ত এতটুকু দায়িত্ব নিয়েছিল যে, সে কোনো আত্মসাৎ করবে না। কিন্তু যখন সে চুক্তির মাধ্যমে তার সম্মতিতে এ মাল লাভ করেছে, তখন সে তো বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ থেকে বেঁচে গেল এবং অবৈধতা থেকে এমনভাবে রক্ষা পেল যে, এ মাল চুক্তি হিসেবে নয় বরঞ্চ বৈধতার ভিত্তিতে নিয়েছে। এখন রইল দারুল ইসলামে নিরাপত্তাপ্রাপ্ত হরবীর ব্যাপার। এ হলো পৃথক ব্যাপার, কারণ নিরাপত্তার কারণে তার মাল রক্ষিত হয়ে গেছে। এজন্য বৈধতার ভিত্তিতে নেয়া যাবে না। -(আল মাবসুত ১ পৃঃ ৯৫)

ইমাম আবু হানিফা (র) বলেন যে, দারুল হরববাসীদের মাল লুন্ঠন করা বা কেড়ে নেয়া যখন মুসলমানদের জন্যে হালাল, তখন তাদের সম্মতিক্রমে তা নেয়া অনেকগুণে ভাল হওয়া উচিত। অর্থাৎ ইসলামী সেনাবাহিনীর আওতার বাইরে অবস্থানকারীদের জন্যে কোনো নিরাপত্তা নেই। অতএব মুসলমানদের জন্য সকল সম্ভাব্য উপায়ে তাদের সম্পদ হস্তগত করা জায়েয। -(আল মাসবুত খঃ ১, পৃঃ ১৩৮)

ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেন, মুসলমান যেহেতু দারুল ইসলামের অধিবাসী, এজন্যে ইসলামের বিধান অনুযায়ী সকল স্থানেই তাদের জন্যে সুদ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তার কাজের এ ব্যাখ্যা ঠিক নয় যে, সে কাফেরের মাল তার সম্মতিক্রমে নিচ্ছে। বরঞ্চ সে প্রকৃতপক্ষে সেই মাল ঐ বিশেষ ধরনের কারবারের ভিত্তিতে নিচ্ছে। কারণ সেই বিশেষ ধরনের কারবার (অর্থাৎ অবৈধ চুক্তি) যদি না হয়, তাহলে কাফের অন্য কোনো পদ্ধতিতে তার মাল দিতে রাজী হবে। যদি দারুল হরবে এরূপ করা জায়েয হয়, তাহলে মুসলমানদের মধ্যে দারুল ইসলামেও এ ধরনের কারবার করা জায়েয হবে যে, একজন এক দিরহামের বিনিময়ে দুই দিরহাম নিবে এবং দ্বিতীয় দিরহামটিকে হেবা বলে অভিহিত করবে। -(আল মাসবুত খঃ ১৪, পৃঃ ৫৮)

আমাদের উদ্দেশ্য হলো উভয় মতবাদের বিচার বিশ্লেষণ করা। আমরা শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (র)-এর উপরিউক্ত কথা থেকে এবং আমাদের উপরে উদ্ধৃত তাঁর মযহাবের অন্যান্য মাসয়ালাগুলো থেকে পাঁচটি বিষয় সুস্পষ্টরূপে প্রমানিত হয়ঃ

প্রথমতঃ এ কারবার শুধু সেই মুসলমানের অন্য জায়েয যে দারুল ইসলামের নাগরিক এবং নিরাপত্তাসহ দারুল হরবে যায়।

দ্বিতীয়তঃ এ কারবার শুধু হরবী কাফেরদের সাথে করা যেতে পারে, তাদের জীবন ও সম্পদ বৈধ।

তৃতীয়তঃ এভাবে যে মাল নেয়া হবে তা গনিমত হবে না। কারণ তা সদুপায়ে অর্জিত নয়, এতে দীনের কোনো মর্যাদা বৃদ্ধি হয় না এবং এতে এক পঞ্চমাংশ নির্ধারিত হয় না। এ নিছক সম্পদ উপার্জন। এভাবে এটা ‘ফাই’ও হবে না। কারণ ‘ফাই’ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন। এ মাল সে ব্যক্তি নিজে গ্রহণ করে- বাইতুল মালে জমা দেয় না।

চতুর্থতঃ এভাবে কাফেরদের মাল নেয়া শুধু আইনগত অনুমতির পর্যায়ভুক্ত। বরঞ্চ বৈধতার শেষ সীমার উপর প্রতিষ্ঠিত। তার আইনগত দিক শুধু এতটুকু যে, যদি মুসলমান এমন করে তাহলে ইমাম সাহেবের মতে দীনের দিক দিয়ে মাল ফিরিয়ে দেবার ফতোয়া দেয়া যাবে না। পক্ষান্তরে আত্মসাৎ করা মাল যদিও বিচার বিভাগ থেকে ফেরত দিতে বাধ্য করা হবে না, দীনের দিক দিয়ে ফেরত দেবার নির্দেশ দেয়া হবে।

পঞ্চমতঃ নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমান যেভাবে দারুল হরবের কাফেরদের সাথে অবৈধ চুক্তিতে কারবার করতে পারে, তদ্রুপ সে সেখানকার মুসলমানদের সাথেও এরুপ করতে পারে। কারণ তাদের মালও বৈধ। এর প্রমাণ পূর্বে আমরা দিয়েছি। পরেও এ বিষয়ে আলোচনা করবো।

তিনঃ দারুল কুফর এবং দারুল হরবের মুসলমান নাগরিক-

যেসব মুসলমান দারুল কুফরে বাস করে এবং দারুল ইসলামে হিজরত করে না, তারা ইসলামের রক্ষণ ব্যবস্থার বহির্ভূত। যদিও ইসলামের যাবতীয় বিধান এবং হালাল-হারাম মেনে চলা তাদের জন্য ধর্মত অপরিহার্য, কিন্তু ইসলাম তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত। নবী করীম (স) বলেন, গনিমত এবং ফাই-এ তাদের কোনো অংশ নেই। এ বিষয়ে হাদীসে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পার্থিব দিক দিয়ে তাদের জান ও মাল অরক্ষিত। কারণ প্রতিষ্ঠিত রক্ষণ-ব্যবস্থা তাদের জন্যে নেই।

যদি এরুপ মুসলমান হরবী সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, তাহলে তার জান ও মাল বৈধ হবে। এজন্য তার হত্যাকারীর উপর কিসাস তো দূরের কথা রক্তপণও আরোপিত হবে না। এমন কি কোনো ক্ষেত্রে কাফফারা পর্যন্ত দিতে হবে না। এ ব্যপারে ফকীহগণের কিছু মন্তব্য আমরা হুবহু উদ্ধৃত করছি যাতে করে দারুল হরবের মুসলমান নাগরিকদের আইনগত পজিশন বুঝতে পারা যাবে:

(আরবী********)

“যে মুসলমান হবার পর হিজরত না করে দারুল হরবেই বাস করে, তার খুনের কোনো মূল্য নেই… আমাদের সাথীগণ তাকে হরবীর পর্যায়ভুক্ত করেছে। এজন্য যে, তার মালের ক্ষতি করলে তার কোনো ক্ষতিপূরণ নেই… তার মাল এ দিক দিয়ে হরবীর মালের ন্যায়। এজন্য আবু হানিফা (র) তার সাথে ক্রয়-বিক্রয় সেসব পন্হা জায়েয রেখেছেন যা হরবীদের সাথে জায়েয। অর্থাৎ দারুল হরবে এক দিরহাম দুই দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করা – যার অর্থ সুদ”।

-(আহকামুল কুরআন লিল যাচ্ছাছ ও আল হানাফী খঃ ২, পৃঃ ২৯৭)

(আরবী********)

যে দারুল হরবে থাকে সে যেন দারুল ইসলামবাসীদের জন্য মৃতের ন্যায়”। -(আল মাসবুত খঃ ১০, পৃঃ ৬৪)

(আরবী********)

“যদি হরববাসী মুসলমান শিশুদেরকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে তাহলে তাদেরকে তীরের লক্ষ্য বানাতে কোনো দোষ নেই, যদিও তীর নিক্ষেপকারী জানতে পারে যে মুসলমানকেই তার লক্ষ্য বানানো হচ্ছে। এর জন্যে তাকে কাফ্ফারা এবং রক্তপণ কিছুই দিতে হবে না”। – (ঐ পৃঃ ৯৫)

(আরবী********)

“দারুল হরবে কোনো হরবী মুসলমান হবার পর সে দেশ যদি মুসলমানগণ জয় করে, তাহলে তার ধন-সম্পদ, তার ক্রীতদাস এবং তার নাবালেগ শিশুদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু তার স্থাবর সম্পত্তি মুসলমানদের গণিমত হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ হচ্ছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (র) এর অভিমত। কিন্তু আবু ইউসুফ (র) বলেন, দয়াপরবেশ হয়ে তার অস্থাবর সম্পত্তিও তার অধিকারে থাকতে দেয়া হবে”। – (ঐ পৃঃ ৬৬)

“[ইমাম আবু হানিফা বলেন], দারুল হরবে কোনো ব্যক্তি তার ক্রীতদাসীর সাথে অথবা আপন স্ত্রীর সাথে সহবাস করাকেও আমি মাকরূহ মনে করি, এ আশংকায় যে সেখানে তার কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। কারণ মুসলমানদের জন্যে দারুল হরবকে তার আবাসস্থল বানানো নিষিদ্ধ। কারণ যদি সে তার সন্তানকে ছেড়ে চলে আসে তাহলে তার সন্তান মুশরিকদের আচার আচরণ গ্রহণ করবে”।

এ প্রসংগে শেষ কথা আমি আশংকার সাথে বলতে চাই এবং তা হচ্ছে এই যে, ইমাম আযম (র) এর মতে দারুল হরবের মুসলমান অধিবাসীদের পরস্পরে সুদ খাওয়া মাকরূহ। কিন্তু তারা যদি এমন কাজ করে তাহলে বাধা দেয়া যাবে না। ইমামম মুহাম্মদ (র) এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তার যুক্তি এই যে, এ দুজন মুসলমানের মাল গ্রহণ দ্বারা মালিকানা থেকে রক্ষিত (অর্থাৎ একজন মুসলমানের মালের উপর আর একজন মুসলমানের শুধু এ কারণে হতে পারে না যে, সে যে কোনো উপায়ে সে মাল তার কাছ থেকে নিয়েছে)। মুসলমান এ দেশ জয় করার পরও যখন তাদের মাল গণিমত বলে অভিহিত করে না, তখন এদুজনের কি অধিকার থাকতে পারে, একে অপরের মাল গণিমত হিসেবে গ্রহণ করার? কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (র) তাঁর মতের স্বপক্ষে যে আইনগত যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, তা থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন আইনগত বিষয়ের জটিল ও সূক্ষ পার্থক্য অনুধাবন করতে ইমাম সাহেবের ফেকাহ শাস্ত্রের জ্ঞান কত গভীর এবং ব্যাপক ছিল। আমরা তাঁর বর্ণনা হুবহু উদ্ধৃতি করছি, যার দ্বারা আইনের মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি বলেনঃ

(আরবী********)

“দারুল ইসলামের রক্ষাণাধীনে আসার পূর্বে নিছক ইসলামের দ্বারা যে রক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা শুধু ইমামের অধিকারে, কিন্তু তা বিধানে নেই। দেখছেন না, যদি এ দুজন মুসলমানের মধ্যে একজন অন্যজনের মাল অথবা জান বিনষ্ট করে তাহলে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না? অথচ এরূপ করলে সে গোনাহগার হবে? কথা আসলে এই যে, বিধান অনুযায়ী রক্ষণ ব্যবস্থা শুধু দারুল ইসলামের আওতার মধ্যে হলেই প্রমাণিত হয়। আর এ রক্ষণ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের কারণে, দ্বীনের কারণে নয়। দ্বীন তো শরীয়তের অধিকারের দিক দিয়ে শুধু তাদেরকেই বাধা দেয় যারা তার উপর বিশ্বাস রাখে। আর যারা বিশ্বাস রাখে না তাদেরকে বাধা দেয় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র শক্তির মাধ্যমে মানুষের রক্ষা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধেও করা হয়, যারা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং যারা শ্রদ্ধাশীল নয় তাদের বিরুদ্ধেও। অতএব গোনাহ হবার কারণে যে রক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ভিত্তিতে আমরা বলেছিলাম যে, তার গৃহীত সম্পদ ফেরত দেবার নির্দেশ দেয়া হবে না। কারণ এদের মধ্যে প্রত্যেকেই যখন এক অপরের সম্পদ হস্তগত করে তখন শুধু হস্তগত করার কারণেই তার মালিক হয়ে যায়”।

এখানে ইমাম সাহেব ইসলামী আইনের তিনটি বিভাগের প্রতিই ইংগিত করেছেন। বিশ্বাসমূলক আইনের দিক দিয়ে মুসলমানের সম্পদ রক্ষিত, তা সে দারুল ইসলাম, দারুল কুফর অথবা দারুল হরবে হোক না কেন। আর এ রক্ষণ ব্যবস্থার ফল এই যে, এর ভিত্তিতে আল্লাহর নিষিদ্ধ পন্হায় সম্পদ গ্রহণকারী গোনাহগার হবে। শাসনতান্ত্রিক আইন অনুযায়ী দারুল ইসলামে অবস্থানকারী কাফেরের মালের যে রক্ষণ ব্যবস্থা আছে, দারুল কুফরে অবস্থানকারী মুসলমানদের জন্য নেই। এজন্য দারুল কুফরের অন্য কোনো মুসলমান যদি তা অবৈধ উপায়ে গ্রহণ করে আল্লাহর নিকট সে গোনাহগার হবে। কিন্তু দুনিয়ার উপর কোনো ইসলামী বিধান জারী হবে না। বৈদেশিক সম্পর্কের আইনের দৃষ্টিতে কাফেরদের মধ্যে অবস্থানকারী মুসলমান স্বীয় তামাদ্দুনিক অধিকার ও দায়িত্বের দিক দিয়ে সেসব কাফেরদেরই অবস্থার অংশীদার। এজন্য সেও এভাবে শুধু গ্রহণ করার দ্বারাই মালের মালিক হয়ে যাবে। — যেভাবে স্বয়ং কাফের মালিক হয়। অতএব এর ভিত্তিতে যদি দারুল কুফরে মুসলমান মুসলমানের নিকট থেকে সুদ গ্রহণ করে, অথবা মুসলমান কাফের থেকে বা কাফের মুসলমান থেকে সুদ গ্রহণ কর, তাহলে তারা তো এসব মালের মালিক হয়ে যাবে এবং তাদের সে মাল ফেরত দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হবে না। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, সুদ গ্রহণকারী ও সুদদাতা মুসলমান গোনাহগার হবে না।

শেষ কথা
এ পর্যন্ত আমরা ইসলামী আইনের যে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করলাম, তার দ্বারা মাওলানা মানাযের আহসান গিলানীর যুক্তির বুনিয়াদ একেবারে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। এর থেকে প্রমাণ হয় যেঃ

একঃ সকল গায়েরে জিম্মী কাফেরের জীবন ও ধন-সম্পদ বৈধ নয়। বৈধ শুধু ঐসব কাফেরের সম্পদ যারা যুদ্ধে লিপ্ত। অতএব সুদ গ্রহণ করা এবং অবৈধ চুক্তিতে কারবার করা যদি জায়েয হয়, তাহলে শুধুমাত্র যুদ্ধরত কাফেরদের সাথে। আর এসব করার অধিকার শুধু সেসব মুসলমানদের যারা দারুল ইসলামের নাগরিক, যাদের নেতা কোনো দারুল কুফরকে দারুল হরব ঘোষণা করেছে এবং যারা নিরাপত্তাসহ ব্যবসা প্রভৃতির জন্যে দারুল হরবে প্রবেশ করেছে।

দুইঃ এক তো দারুল কুফর সর্ববস্থায় দারুল হরব হয় না। আর যদি বিশ্বাসমূলক আইন অনুযায়ী তাকে দারুল হরব মনে করা হয়, তথাপি তার অনেক শ্রেণী বিভাগ আছে এবং প্রত্যেক শ্রেনীর বিধান পৃথক পৃথক। যাবতীয় অনৈসালামী রাষ্ট্রকে একই অর্থে দারুল হরব মনে করা এবং বিশেষ যুদ্ধাবস্থায় যেসব বিধান জারী করা হয়, তা যদি সর্বদা সেখানে জারি করা হয়, তহালে তা শুধু ইসলামী আইনের প্রাণ শক্তিরই পরিপন্হী হবে না, বরঞ্চ তা হবে সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলীর পরিপন্হি এবং তার পরিনাম হবে অত্যান্ত ভয়াবহ। জানমালের বৈধতার ভিত্তিতে যেসব খুটিঁনাটি বিধান বের করা হয়, তা শুধু ততক্ষণ পর্যন্তই বলবৎ থাকতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত দারুল কুফরের সাথে যুদ্ধাবস্থা বলবৎ থাকে। অতএব সমুদয় বিধান স্বয়ং দারুল হরবে মুসলমানদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরঞ্চ এমন দারুল ইসলামের নাগরিকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যা দারুল হরবের সাথে যুদ্ধে জড়িত।

তিনঃ ভারত (অবিভক্ত ভারত) সাধারণ অর্থে তখন থেকে দারুল কুফর হয়ে গেছে যখন থেকে এখানে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটেছে। যে সময়ে শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভী (র) সুদ জায়েয হওয়ার ফতোয়া দিয়েছিলেন। তখন প্রকৃতপক্ষে এ ভারত ভারতীয় মুসলমানদের জন্য দারুল হরব ছিল। কারণ ইংরেজ জাতি মুসলম শাসন বিলুপ্ত করার জন্য যুদ্ধ করছিল। যখন মুসলিম শাসন পরিপূর্ণরূপে বিলুপ্ত হলো এবং ভারতীয় মুসলমান ইংরেজের গোলামী স্বীকার করে নিল, তখন ইহা তাদের জন্যে আর দারুল হরব রইলো না। এক সময়ে ইহা ছিল আফগানিস্তানের মুসলমানদের জন্য দারুল হরব এবং এক সময়ে তুরস্কের মুসলমানদের জন্যে দারুল হরব। কিন্তু এখন ইহা সমুদয় মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য দারুস সুলেহ (সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ রাষ্ট্র)। এজন্য মুসলমান রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে কেউ এখানে সুদ গ্রহণ করার এবং অবৈধ চুক্তিতে কারবার করার অধিকার রাখে না। অবশ্যি সীমান্তের কতিপয় স্বাধীন গোত্র একে দারুল হরব মনে করতে পারে এবং যদি তারা অবৈধ চুক্তিতে কারবার করে তাহলে হানাফী আইন মতে তাদের কাজকে জায়েয বলা যেতে পারে। কিন্তু এ শুধু আইনগত বৈধতা। আল্লাহর দৃষ্টিতে সে মুসলমান কখনো বাঞ্চিত হতে পারে না, যে একদিকে নিজেকে মুসলমানও বলে অপর দিকে সুদ, মদ্যপান, জুয়া, শুকরের মাংস এবং মৃত জীবের ব্যবসাকে ইসলামে বৈধ বলে অন্য জাতির সামনে প্রচার করে বেড়ায়। তার দৃষ্টান্ত এমন – যেমন ধরুন, কোনো ব্যক্তি তার ঋণগ্রস্থ ভাইকে গ্রেফতার করিয়ে জেলে পাঠায় – একথা জানা সত্বেও যে তার হাতে কিছুই নেই এবং ফলে তার সন্তান সন্তুতি অনাহরে মারা যাবে। আপনি বলতে পারেন যে, ঋণদাতার এমন করার অধিকার আছে এবং সে যা কিছু করছে তা সে আইনের আওতার মধ্যেই করেছে। কিন্তু একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, এ হলো আইনগত বৈধতার শেষ সীমা এবং যে মানুষ আইনের শেষ সীমায় অবস্থান করে সে প্রায়ই পশুর চেয়েও অধম হয়ে পড়ে।

চারঃ ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থা কখনো এমন নয় যার জন্য ফেকাহ এর ভাষায় ‘নিরাপত্তা প্রাপ্ত’ শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। নিরাপত্তাপ্রাপ্তের জন্যে প্রথম শর্ত এই যে, তাকে দারুল ইসলামের নাগরিক হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, দারুল হরবে তার অবস্থান স্বল্প সময়ের জন্য হতে হবে। হানাফী আইন মতে নিরাপত্তাপ্রপ্ত হরবীর জন্যে দারুল ইসলামে থাকার অনুর্ধ মুদ্দত এক বছর অথবা তার বেশী। এরপর নাগরিকত্ব পরিবর্তন আইন (LAW OF NATURALISATION) অনুযায়ী তাকে জিম্মীতে পরিণত করা হয়। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, নিরাপত্তাপ্রাপ্ত মুসলমানের জন্যে দারুল হরবে অবস্থানের মুদ্দত দু’এক বছরের বেশী হতে পারে না। ইসলামী শরীয়ত মুসলমানদেরকে জিম্মী বানাতে অত্যান্ত আগ্রহান্বিত। ইসলাম কখনো এ অনুমতি দেয় না যে, কোনো ব্যক্তি দারুল হরবকে তার আপন আবাসভুমি বানিয়ে সেখানে বংশানুক্রমে সন্তান-সন্তুতি উৎপাদন করুক এবং নিরাপত্তপ্রাপ্তের ন্যায় জীবন যাপন করুক। এটা যখন কোনো ব্যক্তির পক্ষে জায়েয নয়, কোটি কোটি মুসলিম জনতার জন্যে কি করে জায়েয হতে পারে যে, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিরাপত্তপ্রাপ্তের জীবনযাপন করবে? যেসব বৈধতার সুযোগ-সুবিধা ‘নিরাপত্তপ্রাপ্তির’ অবস্থার জন্যে সাময়িকভাবে সামরিক প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের দেয়া হয়েছিল তা একদিকে গ্রহণ করবে এবং অপরদিকে সেসব বাধা নিষেধ নিজেদের উপর আরোপ করবে যা সাময়িকভাবে নিরাপত্তাপ্রাপ্তক ইসলামী আইনের বাধা নিষেধ থেকে মুক্ত করে কাফেরদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করে। এ কি করে হতে পারে?

পাঁচঃ ভারতীয় মুসলমানদের সত্যিকারের আইনানুগ পজিশন এই যে, তারা এমন এক জাতি যাদের উপর কাফেরগণ বিজয়ী হয়েছে। এককালে তাদের যে আবাসভূমি ছিল দারুল ইসলাম তা এখন দারুল কুফর হয়ে পড়েছে। কিন্তু দারুল ইসলামের কিছু নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে। তাদের কর্তব্য এই যে, তারা কোনো দারুল ইসলামে স্থানান্তরিত হবে। এ যদি তাদের পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে এ দেশে কখনো ইসলামের যেসব নিদর্শন অবশিষ্ট আছে, কঠোরতার সাথে তার রক্ষনাবেক্ষন করবে এবং তাদের সম্ভাব্য সকল শক্তি প্রয়োগ করে পুনর্বার এ দেশকে দারুল ইসলাম বানাবার চেষ্টা করবে। কুফরী বিধানের অধীনে তারা যে জীবন যাপন করছে, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস একটি গোনাহ। যা কিছু ইসলামী নির্দশনাবলী অবশিষ্ট আছে তা সব মিটিয়ে দিয়ে এ গোনাহকে অধিকতর বর্ধিত করা্ কি তাদের অভিপ্রায়?

তরজামানুল কুরআন, রমযান ১৩৫৫ হিজরী

ডিসেম্বর ১৯৩৬ খৃঃ ও জিলকদ ১৩৫৫ হিজরী

ফেব্রুয়ারী ১৯৩৭ খৃঃ

— সমাপ্ত —-


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি