প্রাথমিক আলোচনা
[রাষ্ট্র ও সরকার তথা প্রশাসন ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা- রাসূলে কারীম (স) ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের প্রথম প্রতিষ্টাতা- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূলে করীম (স)- এর তৎপরতা- রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইসলামেরই ঐকান্তিক দাবি-রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের কারণ- রাষ্ট্রের অপ্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে চারটি মত- কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের রূপরেখা- অত্যাচারী সরকার- সরকারের প্রতি জনগণের কর্তব্য।]

………………

রাষ্ট্র ও সরকারের তথা প্রশাসন ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান সময় দুনিয়ার মুসলমানদের মনে-মগজে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কামনা-বাসনা প্রবল হয়ে উঠেছে। যে দেশেই মুসলমান বাস করে, তারা যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা ও ইসলামী প্রশাসন ব্যবস্থা কার্যকর করার লক্ষ্যে প্রাণ-মন দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সেজন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ তাঁদের নিকট অপরিহার্য বিবেচিত হয়েছে, সে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে তাঁরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হচ্ছে না।

বস্তুত সাধারণভাবে মানব জীবনে এবঙ বিশেষভাবে মুসলিম সমাজে একটি রাষ্ট্র- তথা প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারেনা। এ প্রয়োজনীয়তা বোধ কেবল আধুনিক কালেরই সৃষ্ট নয়, প্রাচীনতম কাল থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা সর্বস্তরের মানুষের নিকট তীব্রভাবে অনুভূত। প্রাচীন ইতিহাসের দার্শনিক চিন্তাবিদগণও এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ও গভীর চিন্তা, বিবেচনা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন।

এ্যারিষ্টটল প্রাচীনকালের একজন উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেছেনঃ

রাষ্ট্র একটি স্বভাবগত কার্যক্রম। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক। যে মানুষ সমাজ-বহির্ভূত জীবন যাপন করে, যার জীবন কোন নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন নয়- নিঃসন্দেহে বলা যায়, সে হয় মানবেতর জীব, না হয় মানব-প্রজাতি ঊর্ধ্ব কোন সত্তা, যার মধ্যে মানবীয় প্রকৃতির কোন অস্তিত্ব নেই। [রাজনীতি]

প্লেটোও প্রাচীন প্রখ্যাত দার্শনিকদের একজন। তিনি মনে করেনঃ

রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনতা ব্যতিরেকে উন্নত মানের জীবন লাভ করা কোন ব্যক্তির পক্ষে অকল্পনীয়। কেননা মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে রাজনীতি- তথা রাষ্ট্রীয় তৎপরতার দিকে। মানুষ তার এ স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে কখনো মুক্ত হতে পারে না।[গণপ্রজাতন্ত্র]

ইতিহাস-দার্শনিক আল্লামা ইবনে খালদূন মানব-সমাজের অপরিহার্য প্রয়োজনের দৃষ্টিতেই রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অকাট্য যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণিত করেছেন। আর এই দৃষ্টিতেই তিনি দার্শনিক পরিভাষায় বলেছেনঃ ‌‌‌‘মানুষ স্বভাবতই সামাজীক’। শেষ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্র ও সরকার উদ্ভাবনের পক্ষে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। [ইবনে খালদুনের ইতিহাসের ভূমিকা]

একালের চিন্তাবিদগণও এ ব্যাপারে কোন উপেক্ষাই প্রদর্শন করেননি।

সারওয়াত বদাভী লিখেছেনঃ

রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রথম কাঠামোই হচ্ছে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। বরং সমাজের প্রত্যেক রাজনৈতিক সংগঠন-সংস্থাই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অপরিহার্য করে তোলে। অনেকে তো রাজনীতির বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় চিন্তায় খুঁজে বেড়িয়েছেন এবং রাষ্ট্র ব্যতিত সামষ্টিক রাজনীতির কোন পরিচয় মেনে নিতে তাঁরা প্রস্তুত নন। [ আন নাজমুস সিয়াসিয়াহ]

ইসলাম অকাট্য দলীলের ভিত্তিত মানব জীবনে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক বলে পেশ করেছেন। স্বয়ং রাসূলে করীম (স)- এর জীবন বৃত্তান্তে সেই প্রয়োজনীয়তাকে অত্যধিক প্রকট করে তুলেছে। রাসূলে করীম (স)-এর জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই এ ব্যাপারের যাবতীয় শোবাহ্-সন্দেহ মতই উবে যেতে বাধ্য হয়।

রাসূলে করীম (স) ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা
রাসূলে করীম (স)-এর জীবনেতিহাস অধ্যয়ন করলেই জানতে পারা যায়, তিনি মদীনায় উপস্থিত হয়েই একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। একজন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্র পরিচালকের ন্যায় তিনি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। তিনি যুদ্ধকালে একটি সুসংবদ্ধ সৈন্যবাহিনী গঠন করেছেন। বিভিন্ন গোত্রপতি বা রাষ্ট্র-প্রধানদের সাথে নানা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছেন। অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুরূপে গড়ে তুলেছেন ও পরিচালনা করেছেন। সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এক-একটি সুসংগঠিত সমাজ পরিচালনার জন্য যা যা করা অপরিহার্য, তিনি তার প্রত্যেকটি কাজই সুষ্ঠুরূপে আঞ্জাম দিয়ছেন। বিচার বিভাগ সুসংগঠিত করে তার সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নির্মিত মসজিদই ছিল এই সমস্ত কাজের কেন্দ্রস্থান। রাষ্ট্র-প্রধান হিসেবে তিনি যাবতীয় দায়িত্ব এই মসজিদেই পালন করেছেন। রাষ্টীয় ফরমান জারি করেছেন। বিভিন্ন গোত্র প্রধান ও রাষ্ট্র-প্রধানের নিকট রাষ্ট্রীয় পত্রাদিও প্রেরণ করেছেন। সে পত্রাদি যেমন আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট পাঠিয়েছেন, তেমনি তার বাইরের ব্যক্তিদের নিকটও।

তিনি যে রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেছিলেন, তিনি নিজেই সে রাষ্ট্রটি ক্রমাগতভাবে দশটি বছর পর্যন্ত পরিচালনা করেছ্নে। তাঁর অন্তর্ধানের পরও শুধু টিকে থাকে তা-ই নয়, ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয় ও পর্যায়ে পর্যায়ে উত্তরোত্তর উন্নতি-অগ্রগতিও লাভ করে-প্রবল শক্তি ও ক্ষমতাও অর্জন করে। ফলে তার রূপায়ণ সম্পূর্ণতা পায়-যদিো তার নিজের হাতেই তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল।

রাসূলে করীম (স)-এর জীবনেতিহাস বিশ্লেষণ করলেই জানতে পারা যায়, তিনি নবুয়্যত লাভ করার পরই একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্টা ও সরকার গঠনের জন্য চেষ্টানুবর্তী হয়েছিলেন। কার্যত তিনি তা করেছিলেনও। তবে তা দুটি পর্যায়ে সুসম্পন্ন হয়। তার প্রথম পয়ায় ছিল মক্কায় এবং দ্বিতীয় পর্যায় মদীনা তাইয়্যেবায়।

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসুৱেল করিম (স)- এর তৎপরতা
মক্কায় নবু্য়্যাত লাভের পরবর্তীকালে তাঁর দাওয়াত প্রকাশ্যভাবে লোকদের নিকট পৌছাবার জন্য আদিষ্ট না হওয়া কালে –বলা যায়-একটি গোপন দল গড়ে তুলেছিলেন (অনেকেই হয়ত এ ব্যাখ্যা পছন্দ করবেন না)। তখন তিনি তাঁর উপস্থাপিত আদর্শের ভিত্তিতে আদর্শবাদী ব্যক্তি গঠনের কাজ সমাধা করেছেন। সেই পর্যায়ে ঈমান গ্রহণকারী লোকদের পরস্পরে গভীর যোগাযোগ ও অত্যন্ত প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। অত্যন্ত গোপনে তাদের পরস্পরে দেখা-সাক্ষাৎ ও ইসলামী জ্ঞান শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। আরকাম (রা)-এর ঘরই ছিল সেই সময়ের গোপন মিলনকেন্দ্র। পড়ে তাঁর প্রতি যখন [আরবি………] ‘‌তোমাকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে তা তুমি চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে দাও’, নাযিল হল, তখন তিনি বিভিন্ন গোত্র প্রধান ও মক্কায় বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সরদারকে আহবান জানালেন দ্বীন ইসলাম গ্রহন করার জন্যএবং তার গঠিত দলে শামিল হয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি ঘোষিত আল্লাহর হুকুমাত কায়েম করার লক্ষ্যে নানা দিক থেকে মক্কায় আসা কোন কোন প্রতিনিধি দলের বায়’আত গ্রহন করলেন এবং তাঁর এই মহান লক্ষ্যে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানালেন। এভাবে আকাবা’র প্রথম ও দ্বিতীয় ‘বায়’আত’সম্পন্ন হয়।[আরবি………] পরে তিনি মদীনায় হিজরাত করতে গেলেন। সেখানে স্বাধীন-উন্মুক্ত পরিবেশে ইসলামী সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রথমে তিনি মুজাহির ও আনসার-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। তা-ই ছিল ইসলামী সমাজ-সংস্থার প্রথম প্রতিষ্ঠা। আর মসজিদ কায়েম করলেন মুসলিম উম্মতের একত্রিত হওয়ার কেন্দ্র হিসেবে। এই মসজিদে যেমন জামা’আতের সাথে সালাত কায়েম করা হতো, তেমনি ইসলমী সমাজ রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া হত।

এতদ্ব্যতীত তিনি একিট ইসলামী রাষ্টের পক্ষে করণীয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পন্ন করেন। এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি বড় বড় কাজের উল্লেক করা যাচ্ছেঃ

১. তিনি তাঁর সাহাবী ও মদীনায় বসবাসকারি ইয়াহুদী প্রভৃতি গোত্র বা জনগোষ্ঠীর সাথে এত্বের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে তা-ই ইসলামী হুকুমতের ‘প্রথম লিখিত সংবিধান’ নামে পরিচিত ও খ্যাত। (এ সংবিধানের ধারাসমূহ পরে উল্লেক করা হবে।)

২. তিনি এ মসজিদ থেকেই সেনাবাহিনী ও সামরিক গোষ্ঠী উপদ্ধীপের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেছেন। তিনি মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ কারার সিদ্ধন্ত করেছেন এবং কার্যত তা করেছেনও। তিনি রোমনদের বিরুদ্ধে লরাই করেছেন। শত্রুদের ভীত-সস্ত্রস্ত করার নান পন্থা অবলম্বন করেছেন। ঐতিহাসিকগণের হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে যে, রাসুল করীম (স) তাঁর মদীনায় জিন্দেগীর দশটি বছরে আশিটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।

৩.মদীনায় স্থিতি লাভ এবং মক্কার দিক থেকে আক্রমণের ভয় তিরোহিত হলে উপদ্ধীপের বাইরের দিকে লক্ষ্য নিবদ্ধ করেছেন। যে যে,এলাকায় দাওয়াত তখন পর্যন্ত পৌছেনি, সেই সা এলকায় দ্ধীনের তওহীদী দাওয়াত পৌছাবার ব্যবস্থা করলে। এমন পদক্ষেপ গ্রহন করলেন, যার ফলে নিকট দূরের সকল লোকের নিকট এই দাওয়াত পৌছে যায়। তিনি বিভিন্ন গোত্রপতি, রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসকদের নিকট সরাসরি পত্র পাঠিয়ে তওহীদী দাওয়াত কবুলের বলিষ্ঠ আহবান জানালেন।তাঁর এ প্রতিষ্ঠিত হুকুমাতে ইলাহীয়ার অধীন শামিল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিলেন। তিনি পত্র পাঠালে রোমান সম্রাট কাইজারের নিকট। মিসরের কিবতী প্রধান মুকাউকাসের নিকট। হাবশার বাদশাহ নাজাশীর নিকট। এ ছাড়া সিরিয়া ও ইয়ামনের বড় বড় নেতা ও রাজন্যবর্গের নিকট, গোত্রপতি ও রাজা-বাদশাহদের নিকটও অনুরূপ পত্র পাঠালেন। তাদের অনেকের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হলো, সামরিক ও রাজনৈতিক মৈত্রী স্থাপিত হলো, অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়ীক আদান প্রধানের ব্যবস্থা সাব্যস্ত করা হলো।

আজাদ ও আম্মানের রাজার নামে লিখত পত্রে তিনি যা লিখেছিলেন, তা এখানে উদ্ধৃত কারা হচ্ছেঃ[ আরাবি লেখা….]

মহা দয়াময় ও অসীম করুণাশীল আল্লাহর নামে। শান্তি বর্ষিত হোক তার উপর, যে ইসলামের হেদায়েতকে অনুসরণ করেছে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে ইসলামের আহবান অনুযায়ী আহবান করছি। তোমরা দু ‘জন ইসলাম কবুল কর, তাহলে দু ‘জনই রক্ষা পেয়ে যাবে। আমি সমগ্র মানবতার প্রতি আল্লাহর রাসুল. যেন আমি সব জীবনধারী মানুষকেই পরকাল সম্পর্কে সতর্ক করতে পারি এবং কাফিরদে সম্পর্কে চুড়ান্ত কথা তাদের উপর বাস্তবায়িত হয়। তোমরা দু ‘জন যদি ইসলামকে স্বীকার করে নাও তাহলে আমিই তোমাদেরকে ক্ষমতাসীন করে দেব, আর তোমরা যদি ইসলামকে মেনে নিতেই অস্বীকার কর, তাহলে তোমাদের দু জনের রাজত্ব তোমাদের হাত থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আর আমার অশ্ব তোমাদের দু ‘জনার আঙ্গিনায় উপস্থিত হবে ও দখল করে নেবে এবং তোমাদের দু ‘জনার দেশের উপর আমার নবুয়্যাত প্রকাশিত, বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে [ আরবি টীকা]

আরব উপদ্ধীপেরই এক অঞ্চলের শাসক রাফা ‘আত ইবনে জায়দ আল-জ্বজামীকে লিখিত পত্রে এইরূপ লেখা হয়েছিলঃ[ আরবি লেখা…….]

বিছমিল্লাহহির রাহমানির রাহীম, আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ (স) পক্ষ থেকে রাফা ‘আ ইবনে জায়দের প্রতি! আমি সেই ব্যাক্তি, যাকে সাধারণভাবে তার সমস্ত জনগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছে, তাদের প্রতিও যারা তাদের মধ্যে শামিল হবে। তিনি তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন। লোকদের মধ্যে থেকে যারই সে দায়াত কবুল করবে, সে আল্লাহ দল ও রাসূলের দলের মধ্যে গণ্য হবে। আর যে তা গ্রহণ করতে পশ্চাদপদ হবে, তার জন্য মাত্র দুই মাসের নিরাপত্তা। [ আরবী টীকা]

নাজরান-এর বিশপের নিকট প্রেরিত পত্রে লিখিত হয়েছিলঃ [ আরবী…………]

ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের আল্লাহর নামে- আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের নিকট থেকে নাজরানের বিশপের নিকট এই পত্র প্রেরিত হল। তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ কর। আমি আল্লাহর হামদ করছি তোমাদের নিকট, যিনি ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ইলাহ্। অতঃপর, আমি বান্দাদের দাসত্ব পরিহার করে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার জন্য তোমাদেরকে আহবান জানাচ্ছি। তোমাদেরকে আহবান জানাচ্ছি বান্দাদের বন্ধুত্ব-কতৃত্ব-পৃষ্ঠপোষকতা পরিহার করে আল্লাহর বন্ধুত্ব-কতৃত্ব-পৃষ্টপোষকতা মেনে নেয়ার জন্য। তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তোমাদেরকে জিযিয়া দিতে রাযী হতে হবে। আর তা দিতেও অস্বীকার করলে আমি তোমাদেরকে যুদ্ধের আগাম জানান দিচ্ছি….শান্তি….।

৪. রাসূলে করীম (স) রাষ্ট্রীয় দূত ো রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের ও বড় বড় রাজন্যবর্গের নিকট পাঠিয়েছেন। এ পর্যায়ে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেনঃ এভাবে দূত পাঠানো ও চিঠিপত্র প্রেরণ তদানীন্তন সময়ের প্রেক্ষিতে এক সম্পূর্ণ অভিনব কূটনৈতিক কার্যক্রম ছিল। বরং সত্য কথা হচ্ছে ইসলামই এ ক্ষেত্রে এরূপ কার্যক্রম সর্বপ্রথম শুরু করেছে।

রাসূলে করীম (স) বিচারপতি নিয়োজিত করেছিলেন, বিভিন্ন এলাকায় শাসক নিয়েঅগ করেছিলেন। তিনি তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক ও পলিসিগত কার্যসূচীও প্রদান করেছিলেন। তাদেরকে ইসলামী বিধান ও আইন-কানুনের ব্যাপক শিক্ষাদান করছিলেন। ইসলাম উপস্থাপিত নৈতিক আদর্শ ও রীতিনীতি সম্পর্কে-যা কুরআনের মৌল শিক্ষা- তাদেরকে পূর্ণ মাত্রায় অবহিত করেছিলেন। যাকাত ও অন্যান্য সরকারী করসমূহ আদায় করা ও তা পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের মধ্যে যথাযথ বন্টনের নিয়মাদি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তুলেছিলেন। এক কথায় যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্বে বসিয়েছিলেন। লোকদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার, তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের এবং জুলুম ও সীমালঙ্ঘনমূলক কার্যক্রমের বিচার পদ্ধতি শিক্ষাদান করেছিলেন।

এ পর্যায়ে চূড়ান্ত কথা হচ্ছে, আধুনিক কালের রাষ্ট্রনেতা ও শাসক-কর্তৃপক্ষকে প্রতিষ্ঠানগতভাবে যে যে কাজ করতে হয়, নবী করীম স. সেই সব কাজই করেছেন। কিন্তু তা তিনি করেছেন নিজের ইচ্ছা মত নয়, বরং আল্লাহ তাআলার হেদায়েত ও নির্দেশ অনুযায়ী। তিনি যেমন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতেন, প্রয়োজনে পদচ্যূতও করতেন। বিভিন্ন লোকদের নিকট পত্র প্রেরণো করতেন। চুক্তি স্বাক্ষর করতেন। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ইসলামী কল্যাণের দৃষ্টিতে, সামষ্টিক কল্যাণের জন্য এবং রাষ্ট্রশক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

কুরআন মজীদের সূরা আল-আনফাল, আত-তাওবা ও সূরা মুহাম্মদ গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অধ্যয়ন করলেই লক্ষ্য করা যায়, তাতে ইসলামী হুকুমাতের রাজনৈতিক কর্মধারা ও কার্যসূচী, দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদির মৌল নীতিসমূহ উপস্থাপিত হয়েছে। সূরা আল-মায়েদায়ও এ পর্যায়ের বহু বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। অনৈসলামী সমাজ-সমষ্টির সাথে কার্যক্রমের নীতি, জিহাদ, প্রতিরক্ষা ও ইসলামী ঐক্য একত্ব রক্ষার যাবতীয় বিধান বলে দেয়া হয়েছে। কেননা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্টিত ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এসব বিধান একান্ত অপরিহার্য। কুরআন মজীদে ইসলামী রাষ্ট্র সংক্রান্ত সকল প্রয়োজনীয় বিধান দেয়া হয়েছে, কুরআনের একনিষ্ঠ কোন পাঠকই অস্বীকার করতে পারবেন না। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, রাসূল করীম (স)-ই হচ্ছে প্রথম ইসলামী হুকুমাতের প্রতিষ্টাতা। আর তিনি যে রাষ্ট্র ও হুকুমাতের ব্যবস্থা কার্যকর করেছিলেন তা যেমন সর্বোত্তম, তেমনি তা-ই দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

একালে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনেক রূপান্তর ঘটেছে, তার মূল কান্ড থেকে অনেক নতুন শাখা-প্রশাখাও উদ্ভাবিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্টান সম্পূর্ণ নতুন গড়ে উঠেছে। কিন্তু রাসূলে করীম সা. প্রতিষ্টিত সরকারযন্ত্র ও প্রতিষ্টান আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থারই প্রতিভূ, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সেই সময়ের প্রয়োজনের দৃষ্টিতে কোন ক্ষেত্রেই একবিন্দু কমতি ছিলনা তাতে।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইসলামেরই ঐকান্তিক দাবি
এই সব কথা নবী জীবন-চরিত ছাড়াও সীরাতে ইবনে হিশাম, তারীখে তাবারী, জজরীর তারীখুল কামিল, সূফীদের আল-ইরশাদ ও আরবেলীর কাশফুল গুম্মাহ প্রভৃতি প্রাচীন ও আধুনিক কালে লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নিঃসন্দেহে জানা যায়।

এছাড়া মূল দ্বীন-ইসলামের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করলেও জানা যায় যে, ইসলামের মৌল বিধান ও নিয়ম-পদ্ধতি এই ধরনেরই এক পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। অন্যথায় তা কখনই বাস্তবায়িত হতে পারে না। দুটি দিক দিয়ে তার বিবেচনা করা চলেঃ

প্রথমঃ ইসলাম কুরআন-সুন্নাতের অকাট্য্ দলীলের ভিত্তিতে ইসলামের অনুসারী ও বিশ্বাসীদের ঐক্য ও একাত্মতা একান্তই অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছে। তাদের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, পরস্পর সম্পর্কহীন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়া ও পরস্পর মতপার্থক্যে লিপ্ত হওয়ার থেকে অত্যন্ত বলিষ্ঠতা সহকারে নিষেধ করেছে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে একথা সকলেরই জানা হয়ে আছে যে, ইসলামের ভিত্তি দুটি কালেমার উপর প্রতিষ্ঠিতঃ তওহীদের কালেমা (ঐক্যের বাণী) ও কালেমা’র তওহীদ (বানীর একতা)। কুরআন মজীদ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেঃ [ আরবী……………….]

জেনে রাখবে, এটাই আমার সুদৃঢ় ঋজু পথ। অতএব তোমরা সকলে এ পথ অনুসরণ করেই চলতে থাক। নানা পথ (তোমাদের সম্মুখে উন্মুক্ত; কিন্তু) তোমরা তা অনুসরণ করো না। করতে গেলে সে পথসমূহ তোমাদেরকে এই সঠিক দৃঢ় পথকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রদর্শিত পথ-ই অনুসরণ করবার নির্দেশ দিয়েছেন এই আশায় যে, তোমরা সেই বিভিন্ন পথ থেকে বাঁচতে পারবে।

বলেছেনঃ [আরবী………………]

তোমরা সকলে মিলিত হয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধর আল্লাহর রজ্জু এবং তোমরা পরস্পর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে না। আর তোমরা সকেল তোমাদের প্রতি আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, তোমরা যখর পরস্পরের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ-ই তোমদের দিনগুলিকে পরস্পর মিলিত ও প্রীতিপূর্ণ করে দিয়েছিলেন। ফলে তোমরা তাঁরই মহা অনুগ্রহে পরস্পর ভাই হয়ে গিয়েছিলে।

বলেছেনঃ [আরবী…………….]

আর আল্লাহই তাদের দিলসমূহের মধ্যে বন্ধুত্ব-প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। হে নবী! তুমি যুদ দুনিয়ার সব কিছু ব্যয়ও কর, তবু তাদের দিলসমূহের মধ্যে সেই মিল ও প্রীতি সৃষ্টি করতে পারবেনা, কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে সেই প্রীতি-বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বস্তুত তিনিই সর্বজয়ী মহাশক্তিমান সুবিজ্ঞানী।

এসব আয়াতে দুটি কথা স্টষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। একটি এই যে, মুসলমানরা পূর্বে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ও প্রীতি-বন্ধুত্ব সম্পন্ন ছিলনা, আল্লাহ তা’আলাই তা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এটা আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়।

আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আল্লাহ মুসলমানদের দিলে এই প্রেম-প্রীতি বন্ধুত্ব জাগিয়ে দিয়েছেন তাঁর বিধানের ভিত্তিতে। এই বিধানের প্রতি সকলের গভীর ঈমান গ্রহণের ফলেই তা সম্ভবপর হয়েছে। তা কোন বস্তুগত জিনিসের বা অর্থ সম্পদ ব্যয়ের ফলে হয়নি। সারা দুনিয়ার সকল সম্পদ ব্যয় করেও নবী সা. নিজে তা সৃষ্টি করতে পারতেন না। আল্লাহর সে বিধান হচ্ছে তওহীদের বিধান। আর তা-ই ইসলামের সারকথা-তা-ই ইসলামের চরম লক্ষ্য।

এক কথায় ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম উম্মতের ঐক্য ও একাত্মতা।

এ কথারই ব্যাখ্যা করে নবী করীম স. নিজের ভাষায় বলেছেনঃ [আরবী……………]

একজন মু’মিনের সাথে অপর মু’মিনের সম্পর্কের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সীসাঢালা সূদৃঢ় প্রাচীরের মত। একজন অপর জনকে শক্ত ও দৃঢ় করে।

মুসলমানদের এ ঐক্যবদ্ধ সামষ্টিক জীবন দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত রাখা আবশ্যক। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে রাসূলে করীম স. বলেছেনঃ [আরবী……….]

তোমরা যখন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ, তখন যদি কোন লোক তোমাদের অসিকে চূর্ণ করতে কিংবা তোমদের সংঘবদ্ধতাকে ছিন্ন ভিন্ন করতে চেষ্টিত হয়, তাহলে তোমরা সকলে মিলে তাকে হত্যা কর।

কুরআন ও হাদীস ইসলামের এই মৌল উৎস উম্মতে মুসলিমার যে ঐক্য ও একাত্মতা বলিষ্ঠ তাকীদ করছে, নিজেদের মধ্যে পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধতা ও গভীর একাত্মতা সৃষ্টি করার জোর তাকীদ জানাচ্ছে, কোনক্রমেই প্রতিষ্ঠিত ঐক্য ও একাত্মতা চূর্ণ করতে বা চূর্ণ করার সুযোগ দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি কোন লোক সেই ঐক্য কে চূর্ণ করার চেষ্টা করলে তাকে সকলে মিলে হত্যা করতে পর্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা বাস্তবে কি করে সম্ভব হতে পারে? সকলেই স্বীকার করবেন যে, তা সম্ভব হতেপারে কেবলমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে। অন্যথায় এ কাজ কখনই বাস্তবে সম্ভব হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব বিভিন্ন লোকের মধ্যে মতের ঐক্য সৃষ্টি করা ইসলামী আদর্শ সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ইসলামী রাষ্ট্রই পারে সকল নাগরিকের সমান মানের কল্যাণ বিধানের মাধ্যমে তাদের মধ্যৈ পরম একাত্মতা সৃষ্টি করতে, পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করতে, বিভ্রান্ত ও বিচ্ছিন্নতাকারীকে ঐক্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে ও পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্টিত করতে।

মোটকথা, রাষ্ট্রই হচ্ছে ঐক্য সৃষ্টিকারী, ঐক্য রক্ষাকারী, ঐক্য বিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধকারী, পারস্পরিক মতবিরোধ ও পার্থ্যক্য বিদূরণকারী।

দ্বিতীয়ঃ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অধিকার, অর্থনৈতিক ন্যায্যা প্রাপ্য পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ইসলামের আইন-বিধানসমূহ অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলেও বোঝা যায় যে, এ সবের প্রকৃতিই একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দাবিদার।

ইসলাম জিহাদের আহবান জানিয়েছে, প্রতিরক্ষার পূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণের স্পষ্ট বলিষ্ঠ নির্দেষ দিয়েছে, হদ্দসমূহ কার্যকর করার হুকুম দিয়েছে, অপরাধের শাস্তি বিধান করেছে ো তা প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করার হুকুম দিয়েছে অপরাধীদের উপর, মজলুমের প্রতি ইনসাফ করার আহবান জানিয়েছে, জালিমকে প্রতিরোধ করতে বলেছে এবং অর্থ ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ বিধানও উপস্থাপিত করেছে।

এ সবের প্রতি লক্ষ্য দিলে এতে আর কোনই সংশয় থাতে পারে না যে, আল্লাহ তা’আলা এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে বলেছেন, যা এই সব আইন-বিধান-নির্দেশ পুরাপুরি ও যথাযথভাবে কার্যকর করবে।

কেননা ইসলাম তো অন্তঃসারশূণ্য দোয়া-তাবিজ বা দাবি-দাওয়ার ধর্ম নয়। বিউগল বাজানো বা নিছক ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় কতগুলি সওয়াব কামাই করার বিধান নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগতভাবেই নিজের ঘরে বা উপাসনালয়ে পালন করার কোন ধর্ম নয়। ইসলাম তো এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অধিকার প্রতিষ্টার বিধান-সে অধিকার ব্যক্তির যেমন, তেমনি সমষ্টিরও। তা ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। এই পর্যায়ে যে সব আইন-কানুন ও বিধি-বিধান এসেছে, তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, এ সবের রচয়িতা ও নাযিলকারী মহান আল্লাহ তাঁর ও তাঁর বিধানের প্রতি ঈমানদার লোকদের জন্য এ সবের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সক্ষম ও শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার নির্দেশ দিয়েছেন। যেহেতু এ ধরনের আইন বিধান দেয়া ও তার বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় রাষ্ট্র। তাই রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার নির্দেশ না দেয়া খুবই হাস্যকর ব্যাপার, যা আল্লাহ সম্পর্কে প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কাউকে গাছ কাটতে বলা অথচ গাছ কাটার জন্য একমাত্র হাতিয়ার কুঠার না দেয়ার মত বোকামী দুনিয়ার মানুষ করলেও করতে পারে, কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে তা ভাবাও যায়না।

বস্তুত সৃষ্টিলোকের জীবন ও স্থিতি যে কয়টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, আদেশ ও নিষেধ হচ্ছে তন্মধ্যে প্রধান বিষয়। আদেশ, যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ [আরবী………]

হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহবানের সাড়া দাও যখন তোমাদেরকে তোমাদের জীবনদায়িনী বিষয়ের দিকে ডাকবেন।

এ আহবান তো আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ ও নিষেধের পর্যবসিত।

বলেছেনঃ [আরবী……..]

হে বুদ্ধিমান লোকেরা! কিসাসে তোমাদের জীবন নিহিত।

এ আয়াতে ভালো কাজের আদেশ হত্যাকারীর কিসাস প্রতিবিম্বিত, যা জীবনের উৎস।

এসব আয়াত দ্বারা যদি আল্লাহর আদেশ-নিষেধই জীবনের উৎস প্রমাণিত হয়, তাহলে জনগণের জন্য এমন একজন সর্বজনমান্য ইমামের প্রয়োজন, যে এই আদেশ ও নিষেধের বিধান বাস্তবে কার্যকর করবে, ‘হদ্দ’ সমূহ কায়েম করবে, শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বন্টন করবে। এমন কাজেই জনগণের কল্যাণ নিহিত। আর যাবতীয় ক্ষতিকর জিনিস ও কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে। এ কারণে ‘আমর বিল মারূফ’ মানব সমসাজের স্থিতির অন্যতম উপায় সাব্যস্ত হয়েছে। কেননা এসব না হলে কোন লোকই দুষ্কৃতি থেকে বিরত হবে না। বিপর্যয় বন্ধ হবে না। ব্যবস্থাপনাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর তাহলে জনগণের ধ্বংস হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইসলামের যাবতীয় হুকুম-আহকাম যে বাস্তবায়িত হওয়ার লক্ষ্যেই বিধিবদ্ধ হয়েছে, তা চিন্তা করলেই একথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা প্রমাাণে ইসলাম উপস্থাপিত অকাট্য দলীলসমূহ যে কত, তা গুণে শেষ করা যাবে না। সহজেই বোঝা যায়, একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও তার একজন পরিচালক ব্যতীত কোন জনসমষ্টিই চলতে পারে না-বাঁচতে পারে না। বিশেষ করে দ্বীন-ইসলামের আইন-বিধানসমূহ একটি রাষ্ট্র ছাড়া কিছুতেই এবং কোনক্রমেই বাস্তবায়িত হতে পারে না। মহান স্রষ্টা তা খুব ভালোভাবেই জানতেন বলেই মানব সমাজে রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করেছেন এবং সে রাষ্ট্রের সুষ্ঠুরূপে চলবার জন্য প্রয়োজনীয় আইন-বিধানও দিয়েছেন। ফলে সে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ লোকদের জীবন পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি সে নজসমষ্টির উপর শত্রর আক্রমণকে প্রতিহত করা, ওদেরকে বৈদেশিক বিজাতীয় শক্তির গোলামী থেকে রক্ষা করাও সম্ভবপর হচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব এত বেশী যে, রাসূলে করীম সা.-এর হাদীসে একটি জনসমষ্টির কল্যাণ ও অকল্যাণ-সুষ্ঠুতা ও বিপর্যয় একান্তভাবে নির্ভরশীল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছেঃ [আরবী………..]

আমার উম্মতের মধ্যে দুটি শ্রেণী এমন যে, তারা ঠিক হলে গোটা উম্মত ঠিক হয়ে যাবে আর তারাই বিপর্যস্ত হলে গোটা উম্মত বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। জিজ্ঞাসা করা হলোঃ তারা কারা হে রাসূল! বললেনঃ তারা ফিকহবিদ ও প্রশাসকবৃন্দ। [আরবী টীকা]

বস্তুত মানুষের বিশেষ করে সামষ্টিক জীবনে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা বিবেক-বুদ্ধি ও শরীয়াত উভয়ের দৃষ্টিতেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিক বিচারেও মানব সমাজের বিকাশে কোন একটি সময় অতীতে ছিল না …ভবিষ্যতেও থাকতে পারে না যখন রাষ্ট্র ও সরকারের কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না বা হবে না। কাজেই তার প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আরও দীর্ঘ ও বিস্তারিত কোন আলোচনার আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না।

রাষ্ট্র ও সরকারের এ গুরুত্ব প্র প্রয়োজনীয়তাই ইসলামের মনীষীবৃন্দের উপর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে, তাঁরা তার রূপরেখা, কার্যপদ্ধতি, নিয়মনীত বিশেষত বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করে লোকদের সম্মুখে উপস্থাপিত করবেন এবং কাল ও সময়ের প্রতিটি অধ্যায়ে তা সেই সব রূপরেখা, পদ্ধতি-নিয়ম-নীত ও বিশেষত্ব-বৈশিষ্ট্য সহকারে প্রতিষ্ঠিতি করার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালাবেন।

রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কারণ
এতদসত্ত্বেও দু’ধরনের লোক সমাজ-জীবনে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে। এক, যারা নীতিগতভাবেই রাষ্ট্র-সরকারের পক্ষপাতী নয়। এরা হচ্ছে কার্লকার্ক্স ও তার মতের লোকেরা।

দুই, যারা নিছক মনস্তাত্ত্বিক কারণে তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না। এরা আবার তিন ভাগে বিভক্ত।

বস্তুত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা মূলত কোন মতবিরোধের বিষয় ছিল না – এ ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টিরও কোন কারণ ছিল না। কেননা পূর্বে যেমন দেখিয়েছি ও প্রমাণ করেছি, মানব জীবনের প্রকৃত সৌভাগ্য, সভ্যতার অগ্রগতি স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা এরই উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু লোক- সংখ্যায় তার যত কম-ই হোক- রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে একটা বিভীষিকা মনে করে। তার অস্তিত্বকেই ভয় পায় ও তার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিতে রাযী হয় না। কেউ কেউ আবার এ-ও বলতে চায় যে, হ্যাঁ, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা আছে বটে; তবে বিশেষ বিশেষ সময়ে মাত্র। সর্বসময়ে নয়, স্থানীয়ভাবেও নয়। চিরন্তনও নয়।

রাষ্ট্রের অপ্রয়োজনীয়তার চারটি মত
এ মতের লোক চার ভাগে বিভক্ত।

প্রথম ভাগের লোক, কার্লমার্ক্স ও তার অনুসারীরা। তাদের মধ্যে রাষ্ট্র সরকারের প্রয়োজনীয়তা শুধু ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষন সমাজে শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম চলতে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যকার অর্থনৈতিক সমস্যাবলী দূরীভূত হয়ে যাবে- প্রকৃত কমিউনিজম যখন প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন কোন রাষ্ট্র বা সরকারের প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে এ মতের কোন যৌক্তিকতাই নেই।

কেননা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা কতগুলি বস্তুগত সমস্যা ও কার্যকারণের উপরই নির্ভরশীল নয়। নিছক অর্থনৈতিক কারণেই তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতব্য নয়। শ্রেণীগত পার্থক্য দ্বন্দ্ব ও বিরোধ নিঃশেষ করার জন্যই তার প্রয়োজনীয়তা, এমন কথাও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। শ্রেণী-দ্বন্দ্ব নিঃশেষ হয়ে গেলেই রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে, এ কথার সমর্থনে অকাট্য কোন যুক্তিই পেশ করা যেতে পারে না। এসব বস্তুগত কারণ ছাড়াও নৈতিক ও স্বাভাবিক ভাবধারাগত এমন অনেক কারণই আছে, যা মানব-সমষ্টির জন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠাকে একান্তই অপরিহার্য করে তোলে। দ্বিতীয় ভাগের লোক হচ্ছে তারা, যারা প্রাচীনকালীন নৈরাজ্য ও শাসনহীন অবস্থাকেই পছন্দ কারে নিজেদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। কেউ তাদের উপর শাসনকার্য চালাক, তাদের তৎপরতা ও কাজকর্মের উপর কোনরূপ বিধি-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হোক, তা তারা আদৌ পছন্দ করে না। শুধু তাই নয়, তা তারা রীতিমত ভয় পায়। কেননা তাতে পাকরাও হওয়ার কারণ ঘটে, নানা প্রকারের শাস্তি ও দণ্ড ভোগ করতে বাধ্য হওয়ার মত অবস্থাও দেখা দিতে পারে। এ কারণে তারা রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধতা কারে, যেমন তাদের মনে যখন যা করার ইচ্ছা জাগবে তাই করার তারা অবাধ ও নিবির্ঘ্ন সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। কেউ যেন তাদের নিকট কোন কাজের জন্য কৈফিয়ত চাইতে না পারে, কেউ তাদেরকে কোন কাজের জন্য শাস্তি দিতে না পারে। তারা নিজেদের ইচ্ছা মত বা কল্যাণ চিন্তায় যা-ই করবে বা করতে চাইবে, তার পথে যেন কোন প্রতিবন্ধকতা দেখা না দেয়। তাদের জোর-প্রয়োগ ও ছিনতাই কাজ কেউ বাধা দিতে না পারে।তৃতীয় হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠী, য়ারা রাষ্ট্র- সরকারের নিকট থেকে কেবল শাসন ও শোষন, রুঢ়তা, নির্যাতন-নিষ্পষণ, স্বৈরতান্ত্রিকতা ও শক্তিমানদের পক্ষপাতিত্বই দেখতে পেয়েছে চিরকাল। যা সকল কালের দুর্বলদের উপর চরম অত্যাচারই চালিয়েছে, তাদের- মৌলিক মানবিক অধিকারও হরণ করেছে, তাদের তাজা-তপ্ত রক্ত নির্মমভাবে শুষেঁ নিয়েছে, তাদের কল্যাণের সকল পথ ও উপয় সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের মানবিক মর্যাদাটুকুকেও পদদলিত ও ধুলি-লুণ্ঠিত করেছে।

এসব লোকের সম্মুকে রাষ্ট্র ও সরকারের নাম উচ্চারণ করলেই তারা সেই বিভীষিকায় সন্ত্রস্ত ও কম্পিত হয়ে উঠে, বিচার ও শাসনের নাম সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ও নির্যাতনে ভরপুর কারাগারের কথা স্নরণ করে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে, যা তারা সর্বত্র দাঁরিয়ে থাকতে ও তাদেরকে গ্রাস করার-জন্য মুখ ব্যাবদান করে থাকতে দেখতে পায়। এ কারণে তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা সরকার-প্রশাসনকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। তার নাম শুনতে ও তারা প্রস্তুত নয়। তা না থাকলে নতুন করে প্রতিষ্টিত হোক,তা তারা চায় না,বরং সবচাইতে বেশি আতংকিত হয়ে উঠে। জুলুম,স্বৈরতন্ত্র ও নির্মমতা কোন্ মানুষ-ই বা পছন্দ করতে পারে!

তবে সে সাথে এই কথাও সত্য যে, এই লোকদেরকে যদি ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের মানবিক কল্যাণময় আদর্শের কথা,জনগণের অব্যাহত খেদমতের কথা সাধারন মানুষের প্রয়োজনপূর্ণ ন্যায়পরতা সরকারে পুরিপূরণ করার,নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মধ্যে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার কথা যখন বলা হবে তখন এই লোকেরা হয়তো এমন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্টার পক্ষে রায় দেবে এবং সেজন্য চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম করতে কিছু মাত্র নিস্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারেনা। চতুর্থ হচ্ছে সেসব লোক, যারা নিরংকুশ ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষপাতী, যারা সে স্বাধীনতা কোন সীমার মধ্যে সীমাবদ্ব হোক, কোন প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সংকোচিত হোক, তা চায় না। এরা মনে করে রাস্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ব্যক্তি-স্বাধনিতা-এ দুটি পরস্পর বিরোধী –একটি ক্ষেত্র। এ দুটি কখনোই একত্রিত হতে পারে না। কেননা রাষ্ট্র ও সরকার ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ও সংকোচিত করবে, তাতে তাদের কোনই সন্দেহ নেই।

স্পষ্ট মনে হচ্ছে, মানুষের উপযোগী ব্যক্তি-স্বাধীনতা-মানুষের জন্য যা একান্তই প্রয়োজন-আর বন্য স্বাধীনতা

এ দুটিকে এই লোকেরা এক করে দেখেছে। এই দুটির মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্যের কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়।

বন্য স্বাধীনতা বলতে বোঝায় যেখানে কোন বিবেকেসম্মত নিয়ম-নীতিরও নিয়ন্ত্রন থাকবে না। সকলের অধিকার রক্ষার রক্ষার জন্য কোন আইনের বালাই থাকবে না। মানুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য কোন সীমাই চিহ্নিত হবে না। বনে-জঙ্গলে যেমন পশুকুল যা ইচ্ছা তাই করে-করতে পারে, যার শক্তি অন্যদের তুলনায় বেশী, তারাই কর্তৃত্ব স্বীকৃত, অন্য কথায় might is right- এর নীতি, যার আক্রমণের ক্ষমতা বেশী, যে অন্যদের অপেক্ষা বেশী জোরে হুংকার চালাতে পারে, দাপট দেখাতে পারে, রোষ ও আক্রোশ প্রকাশ করতে পারে, অন্যান্য সবাই তার ভয়েতেই কম্পমান।

কিন্তু এ স্বাধীনতা বনে-জঙ্গলে থাকলও-সেখানে শোভা পেলেও-মানব সমাজে তা কখনই শোভন হতে পারে না-বাঞ্ছনীয়ও নয়। মানুষের জন্য যে স্বাধীনতা কাম্য তা অবশ্যই আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সে জন্য সচেতনভাবে গৃহীত কিছু নিয়ম-নীতি থাকতে হবে। এমন কিছু মৌল মূল্যমান (values) থাকতে হবে, যা মানুষের মধ্যে নিহিত স্বাভাবিক শক্তি ও প্রতিভার বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি সাধন করবে। মানবীয় গুণ-গরিমা পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হবে ও নির্ভুল কল্যাণময় দিকে পরিচালিত হবে। সম্ভাব্য সম্পূর্ণতা কোন দিকেই কারোর নাগালের বাইরে থাকবে না। এরূপ এক স্বাধীনতা বিবেকসম্মত ও যুক্তিসম্মত নিয়ম-নীতি ভিত্তিক হওয়া ছাড়া পাওয়ার কল্পনাও করা যায় না। অন্য কথায়, মানুষের জন্য নির্ভুল ও শোভন স্বধীনতা তাই পারে, যার দুরু ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে নিহত স্বাভাবিক যোগ্যতা কর্মক্ষমতা বিকাশ লাভের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য পাবে। তাহলেই তা স্বাভাবিকতার পর্যায় থেকে বাস্তবাতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত তা পূর্ণত্বের মাত্রায় পৌছে যাওয়ার সম্ভাব্য পথ নির্দেশ লাভ করতে পারবে।

কিন্তু এই বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি লাভ অরাজক পরিবেশে পাওয়া যেতে পারে না। সেজন্য কিছু শর্ত ও প্রবৃদ্ধি লাভ অরাজক পরিবেশে পাওয়া যেতে পারে না। সেজন্য কিছু শর্ত ও সীমা একান্তই অপরিহার্য। উপযুক্ত কতিপয় নিয়ম-নীতিই সেই শর্তে ও সীমা একান্তই অপরিহার্য। উপযুক্ত কতিপয় নিয়ম-নীতিই সেই শর্তের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। তার বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি নিষিদ্ধ করবে বা তার পথ বন্ধ করে দেবে, এমন কথা তো নয়।

প্রকৃত ও শোভন ব্যক্তি-স্বাধীনতা হচ্ছে, মানুষ একটি বিশ্বাস গ্রহণ করবে, তার কর্মের মাধ্যমে সে বিশ্বাসকে বাস্তবায়িত করার অবাধ সুযোগ পাবে। তাও হবে তখন যখন ব্যক্তি অজ্ঞাত-মুর্খতার অন্ধকার থেকে বের হয়ে নির্ভল জ্ঞান ও সমঝ্-বুঝের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশের মধ্যে এসে যেতে পারবে। তাও হবে তখন যখন ব্যক্তি অজ্ঞাত-মুর্খতার অন্ধকার থেকে বের হয়ে নির্ভুল জ্ঞান ও সমঝ্-বু্ঝের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশের মধ্যে এসে যেতে পারবে। তাহলেই সে স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করে একদিকে স্বীয় বিশ্বাসকে সত্যতা, যথার্থতা ও একনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবে, আর সেই সাথে তার স্বভাবগত কর্মপ্রতিভা ও দক্ষতাকে বিকশিত ও প্রবৃদ্ধ করতে সমর্থ হবে। আর মানুষ যে এভাবেই পূর্ণত্ব অর্জন করতে পারে, পারে জীবনের সাথর্কতা লাভ করতে, তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। বস্তুত মানুষের জন্য এই স্বাধীনতাই কাম্য।

তবে মানব সমাজের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, অন্ধ জাতীয়কাবোধ প্রসূত রাষ্ট্র সরকার উপরে বর্ণিত শোভন স্বাধীনতাকে পর্যুদস্ত করে। যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে কঠিনভাবে আষ্টেপৃষ্ট বেঁধে রাখে।কিন্তু ইসলাম উপস্থাপিত রাষ্ট্র- সরকার কখনই তা করে না। ইসলামী সরকার বা তার প্রশাসাক জনগণের উপর কেবলমাত্র সে সব আদেশ-নিষেধই কারযত করে, যা মানুষ ও বিশ্বলোকের মহান স্রষ্টা মানুষর সাবির্ক কল্যাণের দৃষ্টিতেই নাযিল করেছেন। সে সরকার বা প্রশাসক নিজ ইচ্ছামত কোন কাজের আদেশও করে না,কোন কাজ করতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করে না। করার অধিকার সেখানে কাউকেই দেয়া হয় না। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সামগ্রিকভাবে গোটা মানবতার জন্যই কল্যাণকর, তা যে মানুষের পূর্ণত্ব বিধান করে, মানুষেরস স্বভাব নিহত প্রতিভা ও কর্মক্ষমতাকে বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি দান করে, মানুষের জন্য সার্বিকভাবে যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতির প্রতিরোধ করে ও মানুষকে উত্তরোত্ত উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, তাতে কারোর কি একবিন্দু সংশয় থাকতে পারে?

বস্তুত, ইসলামের মানুষের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উদাত্ত কন্ঠে প্রকাশ করেছে, কিন্তু সে রাষ্ট্র ও সরকার নিশ্চয়ই তা নয় যার কিছুটা আভাষ এই মাত্র দেয়া হল। ইসলামের উপস্থাপিত রাষ্ট্র ও সরকারের কিছু রূপরেখা কুরআন মজীদের আয়াতের ভিত্তিতে এখানে পেশ করা হচ্ছে।

কুরআনের দৃষ্টিতে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের রূপরেখা

কুরআনের ঘোষণানুযায়ী ইসলামী প্রশাসক কেবল জনসমষ্টির লাগামের ধারকই হয় না-লাগাম ধরে যেমন ইচ্ছামত অশ্ব বা উট চালানো হয়, প্রশাসক মানুষকে সেদিকেই চালিয়ে নেবে। নিজ ইচ্ছামত প্রদত্ত আদেশ-নিষেধ মানতে মানুষকে বাধ্য করবে, স্বীয় নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিতকরণ ও প্রভাত্বের লালসা চরিতার্থ করবে, তা কখনই হতে পারে না। সে তো হবে অত্যন্ত কঠিন দায়িত্বশীল, দুর্বহ কর্তব্য বোঝা নিজের মাথায় ধারণকারী। কুরআন বলেছেঃ(আরবি)

ইসলামী রাষ্টের কর্তা ও প্রশাসক যাদেরকে আমরা বানাই, তারা সালাত ব্যবস্থা কায়েম করে, যাকাত আদায় বন্টনের ব্যবস্থা কার্যকর করে, কেবল মাত্র ভাল ও কল্যাণকর কাজের আদেশ করে ও যাবতীয় অকল্যাণকর ও ক্ষতিকর কাজ করতে নিষেধ করে।

এ আয়াতটি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তা ও কর্মচারীদের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হচ্ছেঃ

১. সালাত কায়েম করা-ব্যপকভাবে সালাত আদায়ের মাধ্যমে গোটা সমাজকে সর্বকল্যাণের আঁধার মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে দেয়া।

২. যাকাত আদায় ও বন্টনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এরই ভিত্তিতে সমাজ-সমষ্টির জৈবিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ ও সুসংবদ্ধকরণের কাজ করবে।

৩. কল্যাণময় কার্যাবলীর প্রকাশ ও প্রচার ও সামষ্টির কল্যাণের প্রতিষ্ঠা।

৪.সকল প্রকারের অকল্যাণকর, ক্ষতিকর, অনিষ্টকারি, বিপর্যয় ও বিকৃতি উদ্ভাবক কার্যাবলী নিষিদ্ধকরণ, জুলুম, নিপীড়ন, শোষণ ও মিথ্যার অপনোদন করা। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা।

এইরূপ একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে সর্বমানুষের স্বভাবসম্মত যোগ্যতা-প্রতিভার স্ফূরণ, বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি বিধানের সহায়তাকারি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাকারী, চিন্তা-বিশ্বাস ও জ্ঞানগত শক্তি-দক্ষতার প্রাচুর্য দানকারী- সামাজিক, রাজনৈক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-সকল পর্যায়ে সম্ভাব্য সকল উৎকৃষ্ঠ ও উন্নতি বিধানকারী, সে ব্যাপারে কারোর একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে কি?

ইসলাম যদি এইরূপ একটি রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহব্বান জানিয়ে থাকে, তাহলে সেজন্য ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে কি? এরূপ একটি রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সাধন যে আদৌ সম্ভব নয়, মানুষের প্রকৃত ও ন্যায্য অধিকারসমূহ পেয়ে জীবন ধন্য করার একমাত্র উপায় যে এইরূপ একটি রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠিত করা, তা অস্বীকার করার সাধ্য কার আছে?

ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা হতে পারে সেই ব্যক্তির, যার মধ্যে এই তিনটি গুণ অবশ্যম্ভাবীরূপে বর্তমান রয়েছেঃ

-তাকওয়া পরহেযগারী, যা তাকে আল্লাহর না-ফরমানী থেকে বিরত রাখবে;

এমন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, যা তার উদ্রিক্ত ক্রোধ ও রোষ-অসন্তোষকে দমন ও নিয়ন্ত্রন করবে;

-এমন দয়ার্দ্র নেতৃত্ব গুণ, যা তাকে সাধারণ মানুষের জন্য পিতৃতুল্য স্নেহ-বাৎসল্য সদা আপ্লুত করে রাখবে।

সন্দেহ নেই অতীব উত্তম জিনিস হচ্ছে সে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও কতৃত্ব, যা একজন গ্রহণ করবে তার যোগ্যতা দক্ষতার ভিত্তিতে । আর তা অত্যন্ত খারাপ জিনিস হচ্ছে তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে। আর তা অত্যন্ত খারাপ জিনিস হচ্ছে তার জন্য, যে তা গ্রহণ করবে তার কোন যোগ্যতা ও অধিকার ব্যতিরেকে। কিয়ামতের দিন তা তার জন্য লজ্জা ও অনুতাপেরই কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

মূলত রাষ্টীয় নেতৃত্ব একটি অতি বড় আমানতের ব্যাপার। তবে কিয়ামতের দিন তাই-ই বড় অনুতাপ ও লজ্জার কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। অবশ্য কেউ যদি সে দায়িত্ব পূর্ণ যোগ্যতা ও একনিষ্ঠতা সহকারে পালন করে তাহলে ভিন্ন কথা।

“একজন ন্যায়বাদী সুবিচারক রাষ্ট্রনেতার সাধারণ মানুষের কল্যাণে একদিন কাজ করা একজন ইবাদতকারীর একশত বছর ইবাদত করার সম্মান।

তুমি যখন কোন কঠিন দায়িত্বপূর্ণ কাজের সম্মুখীন হবে, তখন বেশী বেশী করে আল্লাহর স্মরণ কর। তুমি যখন জাতীয় সম্পদ বন্টন করবে, তখনও আল্লাহকে মুহূর্তের জন্যও ভুলে যেও না। আর যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, কোন বিচার্য বিষয়ে রায় দেবে, তখন অবশ্যই তোমার রব্বকে স্মরণ করবে। [ কিতাবুল আমওয়াল; হাফেজ আবু উবাইদ সালাম ইবনুল কাসেম রচিত থেকে এসব হাদীস গৃহীত : পৃঃ ১০]

রাসূলে করীম (স) এইসব-এবং এ ধরনের আরও বহু জ্ঞানপূর্ণ কথা দ্বারা তাঁর সাহাবীগণকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি এই শিক্ষাও দিয়েছেনঃ

রাসূলে করীম (স) এইসব- এবং এ ধরনের আরও বহু জ্ঞনপূর্ণ কথা দ্ধারা তাঁর সাহাবীগণকে শিক্ষা ও প্রশিক্ণ দিয়েছেন। তিনি এই শিক্ষাও দিয়েছেনঃ

তোমাদের প্রত্যেকেই রাখালের ন্যায় দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে ও জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হবে। জনগণের শাসনকার্যের দায়িত্বশলি জগণের উপর রাখালের ন্যায় দায়িত্বশীল, তাকে তাদের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। প্রত্যেক ব্যাক্তিই তার পরিবারবর্গ সম্পর্কে দায়িত্বশীল ।তাকেও তাদের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘর সংসারের জন্য ও তার সন্তানের জন্য দায়িত্বশীল। তাকেও সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।….তোমরা সকলেই মনে রাখবে, তোমরা প্রত্যেই এবং সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককে- এবং সকলকে-ই সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে। [ কিতাবুল আমওয়াল; হাফেজ আবু উবাইদ সালাম ইবনুল কাসেম রচিত থেকে এসব হাদীস গৃহীত : পৃঃ ১০]

হয়রত আলী (রা) ইলামী প্রশসকেন গুণ- পরিচিতি পর্যায়ে বলেছেনঃ

জনগণের উপর শাসকের অধিকার এবং শাসকের উপর জনগণের অধিকারসমূহ মহান আল্লাহ তা‘আলা নিজেই ধার্য ও সুচিহ্নিত করে দিয়েছেন। প্রত্যেকেরই কর্তব্য রয়েছে অপর প্রত্যেকের জন্য একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা হিসেবে এবং তা তাদেরই কল্যাণের জন্য। তাদের দ্বীনের সম্মান ও শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে। বস্তুত জনগণের কল্যাণ হতে পারে না শাসকদের কল্যাণ ব্যতীত; শাসকদেরও কল্যাণ হতে পারে না জনগণের দৃঢ় স্থিতি ব্যতীত। জনগণ যদি শাসকের প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করে, শাসকও যদি জনগণের অধীকার যথাযথ রক্ষা করে, তাহলে সকলেরই অধিকার পারস্পরিকভাবে আদায় হয়ে যায়। দ্বীনের পথ ও পন্থাসমূহ যথাযথ কার্যকর হয়। সুবিচার ও ন্যায়পরতার দন্ড যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকট হতে পারে। তার উপর ভিত্তি করে সুষ্ঠু নিয়ম-নীতিসমূহ সুচারুরূপে চালু হতে পারে। তার ফলে গোটা সময়ই কল্যাণময় হয়ে উঠবে। রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতি জনগণের কাম্য হবে। শত্রুদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে। জনগণের নিকট শাসক যদি জনগণের ব্যাপারে ভুল নীতি গ্রহণ করে বসে, তাহলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণসমূহ প্রকট হয়ে পড়বে। দ্বীন পালনে চরম দুর্নীতি ও নীতি লংঘনমূলক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। চিরন্তন কল্যাণময় আদর্শ পদদলিত হবে। তখন মানুষ নফসের খাহেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করবে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ-হুকুম-আহকাম অকার্যকর হয়ে পড়বে। তখন মানুষের মধ্যে অশান্তি বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। তখন কোন পরম সত্য বাতিল হয়ে গেলেও লোকেরা খারাপ মনে করবে না। কোন বড় বাতিল কাজ দেখেও মানুষ সতর্ক সক্রিয় হয়ে উঠবে না। এরূপ অবস্থায় নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা অপদস্ত ও অপমানিত হবে, সমাজের চরিত্রহীন দুষ্কৃতিপরায়ণ ব্যক্তিরা সম্মান ও শক্তির অধিকারী হয়ে বসবে। তখন আল্লাহর বান্দাগণের পক্ষে আল্লাহর আদেশ পালন দুষ্কর হয়ে পড়বে। [ আরবী টীকা]

হযরত আলী রা. তাঁর অপর এক ভাষণে শাসক ও শাসিতের মধকার মিলিত অধিকারসমূহের কথা বলে প্রকাশ করেছেনঃ [আরবী………………………]

এ দৃষ্টিতে অধিকারের দিক দিয়ে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে আইনের সম্মুখে সকলেই সমান ও সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন। সামাজিক ও প্রতিফলপূর্ণ সমস্ত কাজের দায়িত্ব জনগণের অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা- জনগণের মধ্যেরই একজন ব্যক্তির মত, জনগণও তেমনি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করা। এভাবে রাসূলে করীম সা.-এর এই প্রখ্যাত কথাটির বাস্তবতা সম্ভবপর হয়ঃ [ আরবী……….]

সত্যের সমীপে সমস্ত মানুষ সর্বতোভাবে সমান।

চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (র) যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁবুতে বসে নিজের জুতায় তালি লাগাচ্ছিলেন। তিনি তখন হযরত ইবনে আব্বাস (র)-কে জিজ্ঞেস করলেন- বলতে পারেনম, এই জুতার কি মূল্য? তিনি বললেনঃ এর কোন মূল্য নেই। তখন হযরত আলী (র) বললেনঃ [আরবী……….]

আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, তোমাদের এই রাষ্ট্রীয় তায়িত্বের তুলনায় এই জুতাই আমার নিকট অধিকতর প্রিয়। তবে আমি যদি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও বাতিলকে প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।

বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র দর্শনের দৃষ্টিতে শাসকের দিল জনগণের প্রতি দয়ালু ও অনুকম্পা সমৃদ্ধ হতে হবে। তাদের প্রতি সব সময় কল্যাণকামী হতে হবে। হিংস্র জন্তু যেমন তার শিকার নিয়ে খেলা করে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে চিড়ে-ফেঁড়ে খেয়ে ফেলে, শাসকদের কখনই সে রকম হওয়া উচিত নয়।

এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমার মূল আলোচ্য বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে বলতে চাই, রাষ্ট্র ও সরকার- বিশেষ করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার কথা শুনে যারা ভয় পায়, তারা আসলে ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের কল্যাণমুখী ও সুবিচার প্রতিষ্ঠাকামী ভাবধারা ও লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এ-ও হতে পারেযে, যারা নীতিহীন আদর্শ বিবর্জিত উচ্ছৃংখল জীবন যাপনের পক্ষপাতী, তারা জেনে বুঝে ইচ্ছা করেই এ ধরণের রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধতা করে।

ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার কেবল দেশবাসী মুসলিমদের জন্যই ন্যায়বিচার ও ইনসাফের ব্যবস্থা করে না, বিধর্মীদের প্রতিও তার ন্যায়নিষ্ঠা ও সুবিচারের একবিন্দু ব্যতিক্রম হয় না। ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষই এই রাষ্ট্রের অধীন পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা সহকারে নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করার সুযোগ পেতে পারে। ধর্ম ও মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে অধিকার আদায়ে কোন তারতম্যকে একবিন্দু স্থান দেয়া হয় না। এই পর্যায়ে ইসলামী শাসন প্রশাসনের ইতিহাসই অকাট্য প্রমাণ। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকেরা যে ধরনের শাসন-প্রশাসনের অধীন জীবন যাপন করছিল, তা থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যেই তারা ইসলামী প্রশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ইসলামী প্রশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ইসলামের বিজয়ের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মুসলমানদের নেতৃত্বের অধীনতা তারা নিজেরাই সাগ্রহে গ্রহণ করেছে। কেননা তারা মুসলিম শাসকদের হৃদয় মনে নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য যে দয়া অকুকম্পার নিশ্চিত সন্ধান পেয়েছে, তা তাদের বর্তমান শাসকদের নিকট কখনই পায়নি, কোন দিন তা পাবে বলেও তাদের মনে কোন আশাবাদ ছিল না।

এই পর্যায়ে প্রমাণ হিসেবে ‘মদীনার সনদ’ নামে বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধানের উল্লেখ করতে চাই। নবী করীম (স) মদীনায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার পর মুসলিম ও অমুসলিম-ইয়াহুদি ইত্যাদির সাথে এক রাষ্ট্রের অধীণ বসবাসের জন্য একটি দলীল তৈরী করেন। তাতে সংশ্লিষ্ট সকলেরই ন্যায়সঙ্গত অধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। এই দলীলের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখানে তুলে দেয়া হচ্ছেঃ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- ইহা আল্লাহর রাসূল নবী মুহাম্মদ (স) ও (হুরাইরা বংশের) মু’মিন-মুসলিম এবং মদীনাবাসীদের মধ্যে এক লিখিত চুক্তি। যারা তাদের সাথে পরে মিলিত হয়েছে ও তাদের সাথে মিলিত হয়ে জিহাদ করেছে তারা এর মধ্যে শামিল ও গণ্য। এরা অন্যান্য মানুষ থেকে পৃথক এক উম্মত।

এরপর ইসলামী কবীলাসমূহের এবঙ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব এবং দুর্বলের সহায়তা ও সুবিচার ইনসাফ ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখের পর এমন কতগুলি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে যা সর্বসাধারণ মুসলিমের সাথে সংশ্লিষ্ট। অতঃপর লিখিত হয়েছেঃ

মু’মিন মু’মিনের সাথে কত বন্ধুত্ব ভঙ্গ করবেনা, কারোর সাথে কৃত চুক্তির বিরুদ্ধতা করবে না। মু’মিন মুত্তাকীগণ ঐক্যবদ্ধ- তাদেরই কারোর সন্তানের বিরুদ্ধে হলেও…….. ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে যে লোক আমাদের অনুসরণ করবে, তাকে সাহায্য করা হবে, কোনরূপ জুলুমের শিকার তারা হবে না, তাদের বিরুদ্ধে অন্যদেরও সাহায্য সহযোগিতা করা হবে না।

বনু আওফ-এর ইয়াহুদীরা মু’মিনদের সাথে এক উম্মত। ইয়াহুদীরা তাদের ধর্ম পালন করবে, মুসলমানরা পালন করবে তাদের দ্বীন। প্রত্যেকে নিজ নিজ চুক্তিবদ্ধ লোকদের সাথে চুক্তি রক্ষার জন্য তারাই দায়ী হবে। তবে কেউ জুলুম করলে ও অপরাধ করলে সে নিজেকে- নিজের পরিবারবর্গকেই বিপদে ফেলবে।

ইয়াহুদিদের ব্যয়াদি তারা নিজেরাই বহন করবে, মুসলমানদের ব্যয় মুসলমানরাই বহন করবে। এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষরকারী কোন পক্ষের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধ করলে তাদের পারস্পরিক সাহায্যদান অবশ্য কর্তব্য হবে। আর তাদের পরস্পরে হবে কল্যাণ কামনা, উপদেশ দান, পারস্পরিক উপকার সাধন- কোনরূপ পাপ বা অপরাধ ব্যতীত। [আরবী টীকা]

মদীনায় স্বাক্ষরিত এই সনদের সারকথাঃ

১. মুসলমানদের বিভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের এক ও অভিন্ন উম্মতে পরিণত করা হয়েছে।

২. দিয়ত ও রক্তমূল্যের ব্যাপারে কুরাইশ বংশের মুহাজিরদিগকে তাদের চিরন্তন রীতি-নীতি ও অভ্যাসের উপর বহাল রাখার ঘোষণা হয়েছে, অবশ্য পরে ‘হদ্দ’ ও দিয়তকে একটি বিশেষ ধরনের ফরয করে দেয়ার ফলে তা নাকচ হয়ে যায়।

৩. মুহাজিরদের কোন লোক মুশরিকদের হাতে বন্দী হলে তার জন্য বিনিময় মূল্য নিয়ে তাকে তাদের নিকট থেকে মুক্ত করনের দায়িত্ব মুহাজিরদেরই বহন করতে হবে।

৪. সমগ্র জনগোষ্ঠী ও গোত্র ইনসাফপূর্ণ ও প্রচলিন নীতিতে বন্দী বিনিময় মূল্য দেয়ার দায়িত্বশীলতা ঘোষিত হয়েছে।

৫. যেসব গোত্রের নাম সনদে লিখিত হয়েছে, তাদেরকে তাদের নিজস্ব আদত-অভ্যাসের উপর বহাল রাখা হয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীই তার সাহায্যকারীর বিনিময় মূল্য দিতে বাধ্য হবে।

৬. বিনিময় মূল্য আদায় করার দরুন যে মু’মিন ব্যক্তি ঋণে ভারাক্রান্ত হবে, তার সাহায্যে সকল মু’মিনকে এগিয়ে আসতে হবে।

৭. বিদ্রোহ, জুলুম সকল ক্ষেত্রে ও ব্যাপারেই অস্বীকার করা এবঙ যে তা করবে তাকে প্রতিরোধ করা- কারোর নিজের বংশধর হলেও। তারা এর ব্যতিক্রম করলে তারা সকলেই সেজন্য দায়ী হবে।

৮. মু’মিন কাফিরকে হত্যা করলে তার কোন প্রতিশোধ নেয়া যাবে না, তবে শুধু দিয়ত বা রক্তমূল্যই করা হবে।

৯. মুসলমানরা নিকটবর্তী যাকেই চাইবে মজুরির বিনিময়ে কাজে নিযুক্ত করতে পারবে।

১০. কুরাইশ মুশরিকদের কোন ধন-মাল কিংবা রক্তমূল্য দেয়ার কোন অনুমতিই নেই।

১১. কোন মু’মিনের বিনা কারণে হত্যাকারীকে দণ্ডিত হতে হবে। তবে নিহতের অভিভাবক-উত্তরাধিকারীরা দিয়ত গ্রহণ করে দাবি ছেড়ে দিতে রাযী হলে সে দিয়ত অবশ্যই গ্রহণীয় হবে।

১২ ইসলামে নতুন নীতি প্রবর্তন বা সংযোগকারীদের সাহায্য করা কিছুতেই ক্ষমা করা হবে না। তাদের অবশ্যই প্রতিরোধ করা হবে।

১৩. মুসলমানদের পরস্পরে কিংবা মুসলমান ও ইয়াহুদীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব- ঝগড়া-বিবাদ ও সমস্যাসমূহ নবী করীম (স) নিজেই মীমাংসা করবেন।

১৪. ইয়াহুদীরা নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা পর্যায়ের সাধারণ অধিকারসমূহ লাভ করবে। তবে এই যে, তারা মুসলমানদের সহযোগীতা করবে, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করবে না।

১৫. প্রতিবেশীর সাথে আপন জনের মতই আচরণ করতে হবে। কোনরূপ ক্ষতি বা পাপাচরণ করতে পারবে না। মদীনা চুক্তির কতিপয় বড় বড় ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারা এখানে উদ্ধৃত করা হলো। [আরবী টীকা]

রাসূলে করীম (স)-এর জীবনে ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী অমুসলিমদের প্রতি সদাচারণ প্রদর্শনেরই এটা নিয়ম ছিল না। কেবল তাঁর জীবন-কালের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর পরও ইসলামী রাষ্ট্রে এরূপ সদাচারই কার্যকর হয়েছে, এটা ইসলামী রাষ্ট্রের নীতি।

ইসলামী রাষ্ট্রে শাসক ও শাসিতের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও পার্থক্যহীনতা চিরকালই রক্ষিত হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই তা হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই তা হয়েছে, কোন বিশেষ ক্ষেত্রে নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিচার বিভাগের কথা অনায়াসেই উল্লেখ করা যায়।

হযরত আলী (র)-র খিলাফত কালের ঘটনা। তাঁর নিজের বর্মটি হারিয়ে যায় এবং পরে তা একজন খৃষ্টানের নিকট দেখতে পাওয়া যায়। সে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র। তিনি ইচ্ছা করলে নিজে বা অন্য লোকদের দ্বারা সেটি সহজেই নিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু না, তিনি তা করেন নি। তিনি নিজে একজন বিচারকের নিকট উপস্থিত হলেন নিজের দাবি পেশ করার উদ্দেশ্যে। এই বিচারক ছিলেন শুরাইহ্। মামলা দয়ের করার পর বিচার কক্ষে বিচারকের সম্মুখে বাদী ও বিবাদী উভয়ই উপস্থিত হয়। বাদী হযরত আলী (র) বললেনঃ বিবাদীর নিকট যে বর্মটি রয়েছে ওটি আসলে আমার। আমি তা বিক্রয় করিনি, তাকে দানও করিনি।

বিচারক বিবাদীকে তার বক্তব্য বলার জন্য আদেশ করলেন। বিবাদী বললঃ না, বর্ম আমার। তবে আমীরুল মু’মিনীন মিথ্যাবাদী, তাও বলবনা। এই সময় বিচারপতি হযরত আলী (র) সহাস্যে জবাব দিলেন, না, আমার নিকট কোন সাক্ষ্য বা প্রমাণ নেই।

অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে, সাক্ষী হিসেবে তিনি তাঁর ক্রীতদাস কুম্বরকে পেশ করেছিলেন। কিন্তু মনিবের পক্ষে তারই ক্রীতদাসের সাক্ষ্য সুবিচারের নীতিতে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিচারপতি সে সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিচারক রায় দেন যে, এই বর্মটি খৃষ্টান ব্যক্তিরই।

অতঃপর লোকটি বর্মটি গ্রহণ করে চলে যেতে লাগল। হযরত আলী (র) নীরবে শুধু তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু লোকটি কয়েক পা চলে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এ-ই নবী রাসূল গণের বিচার পদ্ধতি। আমীরুল মু’মিনীন আমাকে বিচারকের নিকট নিয়ে চলুন। তিনি পুনরায় বিচার করবেন।

অতঃপর বললঃ আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, এ বর্মটি আমীরুল মু’মিনীনেরই। আমি পূর্বে মিথ্যা বলেছি।

ইসলামের এ দৃষ্টান্তহীন ন্যায়বিচার দেখে লোকটি পরবর্তীকালে ইসলাম কবুল করে এবঙ একজন দুঃসাহসী বীর যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। [আরবী টীকা]

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (র)-এর খিলাফতকালে এক ইয়াহুদি হযরত আলী (র)-র সাথে বিবাদ করে খলীফাতুল মুসলিমীনের দরবারে মামলা দায়ের করল।

খলীফার দরবারে বাদী-বিবাদী দু’জনই উপস্থিত। হযরত উমর ফারুক (র) বললেন, ‘হে আবুল হাসান! আপনি উঠে আপনার অপর পক্ষের পাশে সমান মর্যাদার স্থান গ্রহণ করুন’।

এ কথা শুনে হযরত আলী (র)-র হয়ত আপমানিত বোধ হলো, মুখাবয়বে তার চিহ্ন প্রকট হয়ে দেখা দিল। তখন খলীফাতুল মুসলিমীন বললেনঃ ‘হে আবুল হাসান (আলী), আপনাকে আপনার বিপক্ষ ইয়াহুদী ব্যক্তির পাশে স্থান নিতে বলায় আপনার হয়ত খুব খারাপ লেগেছে। তখন হযরত আলী (র) বললেনঃ না, না, তা কখ্খনই নয়। আমার খারাপ লেগেছে শুধু এতটুকু যে, আপনি আমাকে আমার নিজের নাম ধরে না ডেকে আমার উপনাম আবুল হাসান বলে সম্বোধন করেছেন। এ ব্যাপারে আপনি আমার ও আমার বিরুদ্ধ পক্ষ সমান মর্যাদায় রাখেন নি, পূর্ণ সমতা রক্ষা করেননি। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিম-ইয়াহুদী-খৃষ্টান ইত্যাদি সকলেই সস্পূর্ণভাবে সমান ও অভিন্ন। [ আরবী টীকা]

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (র) একদা এক বৃদ্ধ অন্ধ ব্যক্তিকে লোকদের নিকট ভিক্ষা চাইতে দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ লোকটি কে? বলা হলো, একজন খৃষ্টান ব্যক্তি। তিনি বললেনঃ ‘লোকটির যৌবন ও কর্মক্ষমতার কালে তো তাকে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সে যখন বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে পড়েছে, তখন তাকে ভিক্ষা করে রুজী রোজগার করার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে! এটা আদৌ সুবিচার নীতি হতে পারে না। বায়তুলমাল থেকে তার যাবতীয় রুজির ব্যবস্থা করা হোক’।

একটি বর্ণনায় হযরত আলী (র)-র খিলাফতকালেও এই রকম একটি ঘটনার ও খলীফার পক্ষ থেকে লোকটির জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা করার কথা বর্ণিত হয়েছে।

এই পর্যয়ে নীতি ও আদর্শের দিক দিয়ে সর্বপ্রথম কুরআনের বিধান উল্লেক্য। কুরআন মজীদ অমুসলিমদের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করার এবং তাদের প্রতি পূর্ণ সহৃদয়তা ও সুবিচার রক্ষা করার অনুমতি এবং নির্দেশ দিয়েছে। এ পর্যায়ে কুরআন মজীদের আয়াত হচ্ছেঃ [আরবী……………..]

যেসব লোক দ্বীনের ব্যাপারে তোমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বহিষ্কৃতও করেনি, তাদের সাথে তোমরা কল্যাণময় ব্যবহার করবে ও সুবিচার নীতি কার্যকর করবে- তা থেকে আল্লাহ তোমাদেরকে বিন্দুমাত্রও নিষেধ করছেন না। তোমাদেরকে নিষেধ করছেন সেসব লোকদের ক্ষেত্রে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে দ্বীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বহিষ্কৃত করেছে ও তোমাদেরকে বহিষ্কৃত করবার জন্য শক্তি প্রদর্শন করেছে, প্রস্তুতি নিয়েছে, তাদের সাথে তোমরা কোনরূপ বন্ধুত্ব পোষণ করবে না। বস্তুত যারাই এই ধরনের লোকদের সাথে কোনরূপ বন্ধুত্ব পোষণ করবে, তারাই জালিম লোক।

এ আয়াত অনুযায়ী মুসলমাদের প্রকৃত শত্রু তারা, যারা দ্বীনের ব্যাপারে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করেছে, মুসলমানদের তাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত করেছে অথবা বহিষ্কৃত করার জন্য রীতিমত পাঁয়তারা করেছে, দাপট দেখিয়েছে ও প্রস্তুতি নিয়েছে! অতএব এই শত্র ভাবাপন্ন লোকদের সাথে মুসলমানরা কোনরূপ বন্ধুত্ব করতে পারে না। এইরূপ লোক –যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দ্বীনের কারণে যুদ্ধ কারণে যুদ্ধ করেছে ও নানাভাবে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে, ক্ষতি করতে চেয়েছে, তারা কখনই মুসলমানদের বন্ধু গণ্য হতে পারে না, তাদের সাথে কোন মুসলমান একবিন্দু বন্ধুত্ব পোষণ করবে, তারা জালিম বলে গণ্য হবে। অতএব তাদের সাথে মুসলমানদের কোনরূপ শুভ আচরণ বা কোনরূপ ন্যায়বিচার করার কোন প্রশ্নই উঠনে পারে না।

পক্ষান্তরে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দ্বীনের ব্যাপার নিয়ে যুদ্ধ করেনি, তাদের ঘর-বাড়ী থেকে তাদের বহিষ্কৃতও করেনি, তারা প্রকাশ্য শত্রু রূপে চিহ্নিত হবে না। অতএব তাদের প্রতি শুভ আচরণ গ্রহণ করা –সর্বোপরি পূর্ণ মাত্রার সুবিচার করা কিছুমাত্র নিষিদ্ধ নয়। বস্তুত অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের আচার-আচরণ কি হবে, তার জন্য একটি সুষ্ঠু ও চিরস্থায়ী মানদণ্ড এ আয়াতটি আমাদের সম্মুখে পেশ করেছে। আর সে মানদণ্ড হচ্ছে, যারাই মুসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। আর যারা মুসলমানদের সাথে শত্রুতার আচরণ করবে, তারা মুসলমানদের শত্রুরূপে চিহ্নিত হবে।

এই আয়াতটির বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায় নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটিতে!

ইরশাদ হয়েছেঃ [আরবী…………..]

হে ঈমানদার ব্যক্তিগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদের ছাড়া অন্য কারোর সাথেই আন্তরিক গোপন বন্ধুত্ব গ্রহণ বা পোষন করবে না। তারা তোমাদের অসুবিধা-বিপদ কালের সুযোগ নিতে বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করবে না। যাতে তোমাদের ক্ষতি বা বিপদ হতে পারে, তা-ই ওদের কাম্য। তাদের মনের প্রতিহিংসা ও শত্রুতা তাদের মুখ থেকেই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। আর যা তাদের মনে এখনও অপ্রকাশিত –প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে, তা তো তার চাইতেও অনেক বড়, তীব্রতর।

আমরা তোমাদেরকে সুম্পষ্ট হেদায়েত দিলাম। তোমরা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে তা বুঝতে পারলে (কখনই এ হেদায়েতের বিপরীত আচরণ গ্রহণ করবে না)।

অর্থাৎ যে সব লোক মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করে, মুসলমানদেরকে নানাভাবে কষ্ট দেয়, নির্যাতন করে এবং মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়ার লক্ষ্যে মুশরিকদের সাথে সহযোগিতা করে, কুরআন মজীদ তাদের প্রতি কোনরূপ দয়া-দাক্ষিণ্যের আচরণ করতে, তাদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব করতে এবঙ তাদের প্রতি সুবিচার করতে নির্দেশ দেয়নি। বরঙ তা করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাসের পৃষ্ঠার উপর দৃষ্টিপাত করলেই দেখা যাবে, ইসলামের হুকুমানের ন্যায়পরতা, সুবিচার ও নিরপেক্ষতাই অমুসলিম খৃষ্টান ও ইয়াহুদী ইত্যাদি জাতি ইসলামী হুকুমাতের অধীন জীবন যাপন করাকে তাদের স্বধর্মীয় শাসকদের অধীন জীবন-যাপন করার তুলনায় অধিক অগ্রাধিকার দিয়েছিল। কেননা তারা নিজেদের চোক্ষেই ইসলাম ও মুসলিম সমাজের পরম দয়াশীলতা ও নিরপেক্ষ সুবিচার দেখতে পেয়েছিল। তাদের স্বধর্মীয় শাসকদের অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তারা ইসলামী হুকুমাতের অধীনে বসবাস করা অধিক নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ বলে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করত।

প্রখ্যাত ও প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ ‘ফুতুহুল-বুলদান’ লেখক বালাযুরী এই পর্যায়ে লিখেছেনঃ [আরবী………..]

হিরাক্লিয়াস যখন মুসলমানদের উপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করল ও ‘ইয়ারমুক’ নামক স্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পৌঁছল, তখন মুসলমানরা ইতিপূর্বে দখল করা ‘হিমস’–এর অধিবাসীদের নিকট থেকে গৃহীত ‘খারাজ’ ফিরিয়ে দিলেন। বললেনঃ এক্ষণে আমরা তোমাদের সাহায্য করতে ও তোমাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব প্রলন করতে পারছি না। এখন তোমরা নিজেরাই নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ কর।

এই কথা শুনে ‘হিমস’-এর অধিবাসী অমুসলিমরা বললেনঃ [আরবী…………..]

পূর্বে আমাদের স্বধর্মীয় লোকদের শাসনাধীন যে ভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলাম তার তুলনায় তোমাদের শাসন-কর্তৃত্বের অধীন থাকা আমাদের নিকট অধিক শ্রেয় ও প্রিয়। আমরা তোমাদের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে হিরাক্লিয়াসের মুকাবিলা করব এবং ‘হিমস’ যাতে সে দখল করতে না পারে তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এই সময় ইয়াহুদীরাও দাড়িয়ে বললঃ [আরবী………..]

তওরাতের নামে কসম খেয়ে বলছি, হিরাক্লিয়াস কখখনই হিমস নগরে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষন না তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে করে পরাজিত হই। অতঃপর তারা নগর-প্রাচীর-দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয় ও তার পাহারাদারী করতে শুরু করে। [ আরবী টীকা]

ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের সাথে সন্ধিক্রমে যে সব নগর মুসলমানদের দখলে আসে সেখানকার অধিবাসীরাও ঠিক এই নীতিতেই কাজ করেছে। তারা মনে করত –বলতোও যে, রোমানরা বিজয়ী হলে আমরা আবার আবহমানকাল থেকে চলে আসা নির্যাতন-নিষ্পেষণের মধ্যে পড়ে যাব। মুসলমানদের একজন লোক বেঁচে থাকতেও আমরা সে অবস্থা ফিরে আসতে দেব না।

পরে আল্লাহ যখন কাটিরদের পরাজিত করলেন ও মুসলমানদের বিজয়ী করলেন, তারা অমুসলমানদের শহর-নগরসমূহে কোনরূপ যুদ্ধ বা রক্তপাত ব্যতীতই দখল করে নিয়েছিলেন এবঙ অধিবাসীরা রীতিমত ‘খারাজ’ দিতে শুরু করে। [আরবী টীকা]

ইসলাম ও মুসলমানদের বিজয় ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এত বেশী, যা গুণেও শেষ করা যাবে না।

খৃষ্টানরা যখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে মুসলমানদের অংশীদার হয়েছিল, তখনকার ইসলামের ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের উদারতা এক বিস্ময়কর পর্যায় পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল। ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিমদের প্রতি যে কত উদার তা সে সব ঘটনা থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়।

ইসলামের বিচারনীতি ও ইসলামে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার পর্যায়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।

অত্যাচারী সরকার
‘গভর্নমেন্ট’ বা সরকার-এর নাম শুনলেই কিছু লোকের চোখের সম্মুখে অত্যাচারী সরকার ও শাসকদের ভয়াবহ ও বীভৎস চেহারা ভেসে উঠতে পারে, তা কিছুমাত্র বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। কেননা বিশেষ করে প্রাচ্য দেশীয় নগরিকগণ সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন-নিষ্পেষণ নিতান্ত অসহায়ভাবে ভোগ করে দীর্ঘকাল পর্যন্ত। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়’ কথাটিতে যা বোঝায়, এক্ষেত্রেও তা পুরাপুরি প্রযোজ্য। কেননা তারা অসহায় নাগরিকদের প্রতি কোনরূপ দয়া অনুগ্রহ দেখাতে দেখতে পায়নি, তারা দেখেছে কিভাবে সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলোকে দুর্বল পেয়ে তাদের উপর অমানবিকভাবে পীড়ন চালানো হয়েছে, তাদের দেহের শেষ রক্তবিন্দুও শুষে নিয়েছে। লুটে নিয়েছে তাদের ঘর-বাড়ি, ভাঙ্গা-চোড়া হাড়ি-পাতিলও। তাদের উপর দাপট চালাবার জন্য তারা তাদেরই মত অন্যান্য শক্তিধর অত্যাচারী লোকদের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলেছে, যেন এই নিপীড়িত অসহায় লোকগুলি কারোর নিকট ফরিয়াদও না জানাতে পারে।

কিন্তু ইসলাম এই ধরনের কোন অত্যাচারী নির্মম সরকার কখনই গঠন করেনি। বরং ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত সরকার তো সর্বোত্তম, সর্বাধিক মানবতাবাদী ও সর্বাধিক কল্যাণকামী হয়ে থাকে, ইতিহাসে তা-ই হয়েছে। সে সরকার সর্বক্ষণ জনগণের পক্ষে কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত রয়েছে, জনগণকে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত রাখতে চেষ্টারত হয়েছে। সর্বোপরি, মহান আল্লাহর দেয়া সুবিচারক আইনসমূহই জনগণের উপর জারি করেছে, নিজেদের মনগড়াভাবে রচিত আইন নয়।

বস্তুত এ ধরনের সরকার ও প্রশাসনের একটি মাত্র লক্ষ্যই হতে পারে। আর তা হচ্ছে জনগণের নিঃস্বার্থ খেদমত, জনগণের অধিকারসমূহ যথাযথ আদায় করা, তাদের মান-মর্যাদা রক্ষা করা, তাদের ইজ্জত-আবরুর হেফাযত করা, তাদের সৌভাগ্য রচনা করা। ফলে এ ধরনের সরকার ও প্রশাসনের ভিত্তি কেবল যমীনের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় না, হয় জনগনের হৃদয় ফলকের উপর। আর তার শিক্ড় জনগণের মাংসের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ও রক্তের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়।

আসলে কেবলমাত্র ইসলামই পারে একটি ন্যায়নিষ্ঠ সুবিচারকারী ও নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য কল্যাণকর একটি সরকার গঠন করতে। মিসরের শাসনকর্তা মালিক আশতারকে লক্ষ্য করে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা) লিখেছেনঃ

প্রয়োজনশীল লোকদের জন্য তুমি একটা সময় নির্দিষ্ট রাখবে, যেন তারা তোমাকে পুরোপুরি পায়। তুমি তাদের নিয়ে সাধারণ ও খোলা বৈঠক করবে। তখন তুমি তোমার স্রষ্টা আল্লাহর নিকট বিনয়াবনত হয়ে থাকবে। তোমার সৈন্যবাহিনীকে তখন তাদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তোমরা পাহারাদার পুলিশ ইত্যাদিকেও দূরে সরিয়ে দেবে, যেন তারা তোমার সাথে প্রাণখোলা কথা-বার্তা বলতে পারে এবং এই কথা-বলায় কোনরূপ বাধাগ্রস্ত না হয়। [আরবী টীকা]

ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বাদী সুবিচারক শাসক হচ্ছে সে, যে জনগণের সুখে সুখী ও জনগণের দুঃখে দুঃখিত হয়। সে কখনই সুরক্ষিত দুর্ভেদ্য পাহারা প্রাচীর বেষ্টিত হয়ে থাকবে না। জনগণ রসাতলে ভেসে যাবে আর সে সুখের নিদ্রায় অচেতন হয়ে থাকবে, তা অন্তত ইসলামী শাসক সম্পর্কে চিন্তাই করা যায় না।

অথবা সে নিজের সুখ-শান্তি-উর্ধ্বগতি (Promotion) নিয়েই চিন্তামগ্ন হয়ে থাকবে, জনগণের কল্যাণের চিন্তা করবে না, তাও অকল্পনীয়।

ইসলাম রাষ্ট্রের পরিচালক বা কোন পর্যায়ের প্রশাসক হওয়ার জন্য যেসব শর্ত আরোপ করেছে, যেসব দায়িত্ব ও কঠিন কর্তব্যের কথা বলেছে, আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তা চিন্তাও করতে পারে না। তাকে তার যাবতীয় কাজে-কর্মে ইসলামী আইন-বিধানকে অনুসরণ করে চলতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। কোন একটি ক্ষেত্রে বা কোন একটি মুহুর্তেও তাকে জনগণের ব্যাপারে গাফিল হতে দেয় না ইসলাম। বরং প্রতিটি মুহুর্তে তাকে এ কাজেই অতিবাহিত করতে হবে। তা করলেই ইসলামের দৃষ্টিতে সে যোগ্য শাসক বিবেচিত হতে পারবে। পক্ষান্তরে যে শাসক স্বীয় গদি রক্ষার চিন্তায় দিন-রাত মশগুল থাকে, জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটন দূর করার জন্য কোন চিন্তা-ভাবনা করে না, কোন বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, ইসলামের দৃষ্টিতে সে কোন পর্যায়েরই শাসক হতে পারে না।

সরকারের প্রতি জনগণের কর্তব্য
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলামী সরকার ও প্রশাসন জনগণের সর্বাত্মক কল্যাণ সাধনের কঠিন দায়িত্বে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই নিযুক্ত হয়ে থাকে এবং এসব দায়িত্ব পালনে তা একান্তই বাধ্য। মানবতাকে পূর্ণত্বের উচ্চতম শিখরে পৌছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই তাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অতএব এরূপ একটি ইসলামী সরকার ও প্রশাসন গড়ে তোলা মুসলিম উম্মতের জন্য একান্তই কর্তব্য। এরূপ একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে কোনরূপ মতপার্থক্যের সৃষ্টি না করা, তা গড়ে তোলার পর তার সাথে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং তার প্রতি কোনরূপ বিশ্বাসঘাতকতা না করা জনগণের সেই কর্তব্যেরই অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী…………]

হে মুসলমানগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই বিধানই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যার হুকুম তিনি নূহকে দিয়েছিলেন, আর যা –হে নবী! এখন তোমার প্রতি ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি, আর যার হেদায়েত আমরা ইবরাহীম-মূসা-ঈসাকে দিয়েছিলাম এই তাকীদ সহকারে যে, এই দ্বীনকে তোমরা কায়েম কর এবং এ ব্যাপারে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যেও না।

এ আয়াত স্পষ্ট করে বলেছে যে, দ্বীন কায়েমের কাজকে বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে [আরবী টীকা]

অন্য কথায়ঃ দ্বীনকে কায়েম –প্রতিষ্ঠিত রাখো অর্থাৎ স্থায়ী, ধারাবাহিক –অব্যাহত সুরক্ষিত দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত রাখো অর্থাৎ স্থায়ী, ধারাবাহিক –অব্যাহত সুরক্ষিত দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, কোনরূপ মতপার্থক্য নেই, কোন অস্থিরতা নেই। [আরবী টীকা]

বস্তুত এ আয়াতটিতে দ্বীন কায়েম করার যে নির্দেশ নবী-রাসূলগণকে দেয়া হয়েছে, তা শুধু দ্বীনের কতিপয় আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক বিধানের প্রচার দ্বারাই পালিত হয় না, সে জন্য দ্বীন-ইসলামকে চিন্তা-বিশ্বাস মতবাদ-মতাদর্শ, সংস্কৃতি-সভ্যতা, আইন-শাসন রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণ মাত্রায় প্রতিষ্টিত ও কার্যকর করারই নির্দেশ রয়েছে এবং সেভাবেই তা পালন করতে হবে।– (তাফহীমুল কুরআন, আবুল ‘আলা মওদুদী, ৫ম খণ্ড পৃঃ ৪৯২)

এরূপ একটি সরকার গড়ে তোলা, প্রতিষ্টিত করা যেমন কর্তব্য, তেমনিভাবে রক্ষা করা ও তার কল্যান বিধানে সক্রিয় তৎপরতা অবলম্বন মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। কেননা উপরোদ্ধৃত আয়াতে (আরবী…) এর একটি অর্থ যেমন দ্বীন কায়েম কর, তেমনি তার অপর একটি অর্থ হচ্ছে ‘দ্বীন কায়েম রাখো’। অর্থাৎ যেখানে তা কায়েম নেই সেখানে তাকে কায়েম ও প্রতিষ্ঠা রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।

একটি হাদীসের বর্ণনায় রাসূলে করীম (স)- এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ

[আরবী…] দ্বীন হচ্ছে ঐকান্তিক ও নিঃস্বার্থ কল্যাণ কামনা।

জিজ্ঞাসা করা হলোঃ কল্যাণ কামনা কার জন্য হে রাসূল? বললেনঃ

তা আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, রাষ্ট্রনেতাগণের জন্য এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য। -(কিতাবুল আওছাল; পৃঃ ৯)

হযরত আলী (র) বলেছেনঃ [আরবী………………]

রাষ্ট্রনেতার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আলঐলাহর নায়িল করা বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা, তার নিকট সোপর্দ করা আমানতের হক আদায় করা। রাষ্ট্রনেতা যদি তা করে তাহলে তার কথা শোনা, তার আনুগত্য করা এবং সে আহবান করলে তাতে সাড়া দেয়া জনগণের কর্তব্য।

বস্তুত ইসলামী হুকুমাত যদি তার দায়িত্বসমূহ ইসলামী বিধান অনুযায়ী পালন করে এবং মুসলিম জনগণ যুদ সরকারের প্রতি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে তথায় সুবিচার ও ন্যায়পরত পূর্ণ মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হবে, শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজিত হবে, সার্বিক কল্যাণের প্রস্রবণ প্রবাহিত হবে, সমগ্র দেশে সৌভাগ্য ও উন্নতি উৎকর্ষ ক্রমবৃদ্ধিমান হবে। আর তা-তো মানুষের কাম্য অতি স্বাভাবিকভাবে।

দুনিয়ার বিভিন্ন ধরনের সাময়িক বিপ্লব কিংবা অস্ত্রশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোন দেশের কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং তারপরই নিজেকে দেশের কর্তৃত্বের ধারক ও জনগণের রাজা বা বাদশাহ বলে ঘোষণা দেয়, তখন সে সেই দেশের রাজা বা নিরংকুশ বাদশাহ হয়ে বসেছে বলে প্রতিপন্ন হয়। তখন তার বিরুদ্ধতাকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে কঠিন-কঠোর শাস্তি দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। সে কেবল নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হয় না, সে সর্বসাধারণকে জানিয়ে দেয় যে, অতঃপর দেশে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলতে থাকবে এবং তার মৃত্যুর পর তার সন্তানরাই এই রাজক্ষমতার অধিকারী হবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি