শু’রা
[কুরআন ও শুরা-হাদীস ও শু’রা-শুরায় মতপার্থক্য-রাসূলে করীম (স)-এর নীতি-জরুরী সংযোজন-যুক্তিসংঙ্গত স্বাধীনতার নিরাপত্তা-স্বাধীনতা কি-স্বাধীনতার কয়েকটি দিক, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, চিন্তা-বিশ্বাসের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা-সমালোচনার অধিকার- নাগনিরক-স্বাধীনতা।]

ইসলামী রাষ্টের যাবতীয় কার্যক্রম জনমতের ভিত্তিতে চালানো হয়। কুরআন ও সুন্নাতে বিধৃত আইনসমুহকে ধারাবদ্বকরণ (codification) থেকে শুরু করে তার প্রয়োগ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সকল পর্যায়ে জনমত জানার সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নামাযের ইমাম নিয়োগ, সময় নির্ধারণ ও মসজিদের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে পারিবারিক খুটিনাটি কাজ এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবনের সকল পর্যায়ে পরামর্শ করার একটি নীতি অনুসরণের বলেষ্ট তাকিদ রয়েছে। ফলে কোন ক্ষেত্রেই যাতে স্বৈরতান্ত্রিক প্রচলন হতে না পারে, সেই দিকেই প্রবল লক্ষ্য আরোপিত হয়েছে। কোন পর্যায়েই যেন এক ব্যক্তির মর্জীমত চলতে লোকেরা বাধ্য না হয়। মানবতিহাসের যে অধ্যায়ে নিরংকুশ স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচন্ড হয়ে চলেছিল, যখন মানুষের কোন অধিকার ছিল না কথা বলার, মত জানাবার, ইসালাম সেই সময়ই দুনিয়ার সর্বব্যপারে এই পরামর্শ দেয়ার ও নেয়ার ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। কুরআন মজীদের একটি পূর্ণ সূরার নামই রাখা হয়েছে ‘আশ-শু’রা’-অর্থাৎ পরামর্শ। কুরআনী বিধানে লোকদের মতের কি গুরুত্ব, তা এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।

কুরআন ও শু’রা
কুরআন মজীদে ইসলামী সমাজের পরিচিতিস্বরুপ বলা হয়েছে, সেখানে সব কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে চলে, নিজেদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে, নিজেদের মধ্যে মতবিনেময়ের মাধ্যমে। ইসলামী সমাজের লোকদের গুণ পরিচিতি স্বরূপ সূরা আশ-শু’রা’ তেই বলা হয়েছেঃ [আরবি………….]

(আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কালকারী লোক তারা) যারা বড় বড় গুনাহ ও নির্লজ্জতার যাবতীয় কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকে, আর ক্রোধ হলে তা ক্ষমা করে দেয়; যারা নিজেদের রব্ব-এর হুকুম পালন করে-আহব্বানে সাড়া দেয়, সালাত কায়েম করে আর নিজেদের সামষ্টিক ব্যাপারাদি পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় বিনিয়োগ করে।

এ আয়াত ইসলামী সমাজের লোকদের জন্য নিজেদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পন্নকরণে ও নিজেদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে পারস্পরিক পরামর্শ করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। প্রত্যকটি ব্যাপারেই সংশ্লিষ্ট লোকদের মত প্রকাশের সযোগ দান ও উত্তম মতটি গ্রহণের নীতি অনুসরণ জরুরী করে দিয়েছে। জীবন-জীবিকা আহরণ ও উৎপাদন এবং জীবন-ধারা গ্রহণেও তাই করা কর্তব্য বলে ঘোষিত হয়েছে। সামষ্টিক তথা জাতীয় আদর্শ নির্ধারণে ও কার্যসূচী গ্রহণে জনগণের মত অবশ্যই জানতে হবে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেরও জনমত উপেক্ষা করা চলবে না। উন্নয়নমূলক কার্যসূচী ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে জনগণকে মত জানাবার সুযোগ দিতে হবে। প্রতিরক্ষামূলক কার্যসূচী, সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা ছাড়াও যাবতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি গ্রহণ ও পলিসি নির্ধারণে জনমত গ্রহণকে অপরিহার্য করে দেয়া হয়েছে। অন্যথায় ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যাবে না, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করাও সম্ভব হবে না। সর্বোপরি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মারাত্নক কুফল থেকে সমাজকে বাচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।

পরামর্শ করার গুরুত্ব এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, নবী করীম (স) আল্লাহর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সব ব্যাপার সরাসরী ওহী লাভ করেন এবং মা’সুম, তা সত্বেও তাকেও আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেনঃ [আরবি………………….]

এবং হে নবী! আপনি লোকদের (সাহাবীগণের) সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর আপনি যে সংকল্প গ্রহণ করবেন, তা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেই ফেলুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ নিঃসন্দেহে তাওয়াক্কুলকারী লোকদের পছন্দ করেন, ভালোবাসেন।

বস্তুত নবী করীম (স) তার নবুয়্যাতের কার্যাবলী সম্পাদনে ও অন্যান্য যাবতীয় সামীষ্টিক ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রা)-এর সাথে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ করেছেন।

অবশ্য যেসব ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে সুস্পষ্ট বিধান পেয়েছেন, সেসব ক্ষেত্রে কারোর সাথে পরামর্শ করার প্রশ্ন উঠে না- তার প্রয়োজনেও পড়ে না। কিন্তু যেসব ব্যাপারে আল্লাহর নিকট থেকে সস্পষ্ট বিধান বা কার্যপদ্ধতি আসেনি, ততে তিনি পরামর্শ করেছেন। বদর যুদ্ধ কালে তিনি সাহাবায়ে কিরামের সাথে পরামর্শ করেছেন, ইতিহাসের গ্রন্হাবলিতে তার উল্লেখ রয়েছে। তিনি সাহাবীগণকে একত্রিত করে বলেছিলেনঃ [আরবী……………………..]

হে লোকেরা, আসন্ন যুদ্ধে সম্পর্কে তোমাকে পরামর্শ দাও। তখন সাহবায়ে কিরাম পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে ও প্রাণ খুলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। শেষ পযর্ন্ত তিনি আনসারদের দেয়া মতকেই গ্রহন করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্য সমাবেশ করার স্থান নির্ধারণেও সাহাবীগণ যথাযথ মত জানিয়েছিলেন। [আরবী টীকা……………….]

হাদীস ও শু ‘রা
শু ‘রার কথা কেবল কুরআনেই বলা হয়েছে, তা নয়। এই পর্যায়ে এত বিপুল সংখ্যক হাদীসের উল্লেখ হয়েছে যা গুণে শেষ করা যাবে না। এখানে কিছু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হচ্ছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

[আরবী**************************]

যখন তোমাদের শাসক ও কর্মকর্তাগণ হবে তোমাদের মধ্যের সর্বোত্তম ব্যক্তিরা, তোমাদের ধনশালী লোকেরা হবে তোমাদের মধ্যে অধিক দানশীল এবং তোমাদের সমষ্টিক ব্যাপারাদিত পরামর্শ গ্রহণ ব্যবস্থা কার্যকর হবে, তখন জীবনে বেঁচে থাকা মৃত্যুর তুলনায় উত্তম হবে (আর এর বিপরীত হলে- পরামর্শ দেয়া নেয়ার ব্যবস্থা কার্যকরা থাকবে না, তখন মৃত্যুই জীবনের তুলনায় উত্তম)। তিনি বলেছেনঃ [আরবী***************]

বুদ্ধিমান লোকের নিকট তোমরা পথ-নির্দেশ চাও। তার পথ-নিদের্শ অমান্য করো না। তাহলে তোমরা লজ্জিত-দুঃখিত হবে। [আরবী**************************]

পারস্পরিক পরামর্শ অপেক্ষা অধিক দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য নীতি আর কিছু হতে পারে না। আর সব কাজে গভীর চিন্তা- ভাবনার মত বুদ্ধিমত্তোও কিছু হতে পারে না। ‘বুদ্ধিমত্তো’ বলতে কি বঝোয়, নিজ্ঞাসা করা হলে নবী করীম (স) বললেনেঃ [আরবী*************************]

মত দেয়ার যোগ্য লোকদের সাথে পরামর্শ করা এবং তাদের কথামত কাজ করাই হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা।

হযরত আলী (রা) তাঁর পুত্র মহাম্মদ ইবনুল হানফীয়াকে বলেছিলেনঃ লোকদের মত পরস্পরের সাথে মিলিয়ে নেবে। তম্মধ্যে যে মতটি অধীক ঠিক মনে হবে, তা-ই গ্রহণ করবে। রাসুলে আকরাম (স) বলেছেনঃ [আরবী******]

যার নিকট পরামর্শ চাওয়া হবে, সে হবে একজন আমানতদার- পরম দায়িত্বশীল। তার নিকট পরামর্শ চাওয়া সে এমন পরামর্শ দেবে, যা সে নিজের জন্য করতে প্রস্তুত। [আরবী*********************]

তোমাদের কেউ যদি তার ভাইর নিকট পরামর্শ চায়, তাহলে অবশ্যই পরামর্শ দেবে। বলেছেনঃ [আরবী********]

যে পরামর্শ গ্রহণ করে কাজ করল, সে কখনই লজ্জিত হবে না। [আরবী***************]

যে লোক তার ভাইর নিকট পরামর্শ চাইল, সে যদি না বুঝে-শুনে খারাপ পরামর্শ দেয়, তাহলে বুঝতে হবে যে,বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আমানতে খিয়ানত করেছে। [আরবী**************]

পরামর্শ গ্রহণ না করে কোন ব্যক্তিই চলতে পারে না। [আরবী*****************]

যে ব্যক্তি কোন কাজ করার ইচ্ছা করল, পরে সেই বিষয়ে সে পরামর্শ-ও করল এবং তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, সে সর্বোত্তম পন্হায় কাজ করল। নবী করীম (স)-এর প্রতি ‘পরামর্শ কর’ বলে আল্লাহর নির্দেশ নাঝিল হওয়ার পর তিনি বলেছিলেনঃ [আরবী****************]

মনে রাখবে, আল্লাহর এবং তাঁর রাসূল পরামর্শ করার মুখাপেক্ষী নন। তা সত্ত্বেও পরামর্শের এ বিধান আল্লাহ নাযিল করেছেন আমার উম্মতের প্রতি রহমত স্বরূপ। অতএব যে লোক পরামর্শ করবে, সে সঠিক পথ কখনই হারাবে না। আর যে লোক পরামর্শ করবে না সে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাবে না।

[উদ্ধত হাদীসসূহ সিহাহ সিত্তার কিতাব রয়েছে। এখানে আল-হুকুমাতুল ইসলামীয়ার [ আরবী….] থেকে উদ্ধৃত করা হলো ]

শু ‘রার মতপার্থক্য
এপর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে, পরামর্শ সংস্থার সদস্যগণ যদি রায় প্রদানে মতভেদ করে বসে- বিভিন্ন লোক বিভিন্ন পরামর্শ দেয়. তখন এই মত-বৈষম্য কি করে মুকাবিলা করা যাবে?… কোনটা গ্রহণ করা হবে, আর কোনটা বাদ দিতে হবে?

এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রচলিত ও সঠিক পন্হা এই হতে পারে যে, যে মতটি ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং অধিকাংশ লোকের দেয়া। তবে এই নীতি অনুসৃত হবে সেখানে, যেখানে প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেউ নেই। এইরূপ অবস্থয় অধিকাংশ লোকের ইসলামসম্মত মত গ্রহণ না করে কোন উপায় থাকে না। কিন্তু যদি পূর্ণ মাত্রার যোগ্যতাসম্পন্ন দায়িত্বশীল জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ও নিয়োজিত থাকে, তাহলে সে এই ব্যাপারে পূর্ণ দখল দিতে পারে-যা কুরআন ও সুন্নাতের নিকটবর্তী সেই মতটি সে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গোঘোষনা করতে পারে এই শর্তে যে, তা কুরআন ও সুন্নাত-তথা ইসলামের মৌল ভাবধারার পরিপন্হী হবে না।

যদি উভয় মত-ই ইসলামের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়, কুরআন ও সন্নাতের সম্মানের দলীলভিত্তিক হয়, তাহলে দুটির যে কোন একটি মত গ্রহন করার প্রধান ব্যক্তির অধিকার রয়েছে।

কেননা রাসুলে করীম (স)-কে দেয়া আল্লাহর নির্দেশে দু‘টি তত্ত্ব নিহত রয়েছে। একটি হচ্ছে-নবী করীম (স)-কে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ, তাদের মত জানতে চেষ্টা করার হুকুম। অতএব পরামর্শ করা ও বিভিন্ন মত সম্মুখে আসা প্রমাণ করে যে, সংশ্লিষ্ট জনগণ চিন্তা ও মতের অধিকারীও; চিন্তার উর্বরতাই প্রমানিত হয় তাতে এবং সেসব মতের ভিত্তিতে কাজ করলে নেশ্চয়ই সুন্দর ও নির্ভল সুফল পাওয়া যাবে-ঠিক যেমন বেদ্যুতবাহী তারসমুহের সংঘর্ষে বা সমন্বয়ে আলো স্ফূরিত হয়ে উঠে। এই কারণেই প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির কর্তব্য সংশ্লিষ্ট লোকদের সাথে পরামর্শ করা। কেবল নিজের মতের ভিত্তিতে কাজ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার স্বৈরতান্ত্রিক পন্হা সম্পূর্ণ পরিহার করে চলা।

দ্বিতীয়, ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রধান ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রধানদের কর্তব্য হচ্ছে পরামর্শ করা, বিভিন্ন মত ও রায় শ্রবণ করা-মতের বিভিন্ন দিককে ওলট-পালট করে আলোচনা-পর্যালোচনা ও চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা ও গভীর সূক্ষ্ণভাবে বিচার-বিবেচনার পর সার্বিক দৃষ্টিতে যে মত সর্বোত্তম বিবেচিত হবে, তাই গ্রহণ করা। তারপর [আরবি……]‘তুমি যখন সংকল্পবদ্ধ হবে’ পরামর্শ গ্রহণ ও সর্বোত্তম মত গ্রহণের সিদ্ধান্তের পর, তখন [আরবি…….] আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা’ সহকারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আল্লাহ তোমায় সাহায্য করবে ও নির্ভুল কাজের তওফীক দান করবেন। সমস্যার সমাধান সহজতর হবে।

রাসূল (স)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ যখন তুমি সংকল্পবদ্ধ হবে এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, আসলে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও ক্ষমতা স্বয়ং রাসূলে করীম (স) এর-যদিও তা পরামর্শের পর।

রাসূলে করীম (স)-এর নীতি
এর অপর একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে এবং তা হচ্ছে, জনগণের কাজ হচ্ছে, রাসূল (স) পরামর্শ চাইলে সাধ্যমত সর্বোত্তম ও নির্ভল মত জানিয়ে দেয়া, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নবীর নিজের। নাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানেরও সেই দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে।

নবী করীম (স) সাধারণভাবে কেবর সংখ্যাগরিষ্টের মত মেনে নিয়েছেন-তার দৃষ্টান্ত খুব পাওয়া যায় না। বরং লোকদের মত জেনে নেয়ার পর তিনি প্রায় নিজস্ব সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। উদ্ধৃত আয়াতের শেষাংশ থেকে প্রতিভাত হয় যে, লোকদের পরামর্শ জেনে নেয়ার পর তিনি যে মতটিকে অধিক সঠেক, অধিক কল্যাণকর মনে করেছেন, সেটাই গ্রহণ করেছেন, সেই মতটি বেশীর ভাগ লোকের, কি কম সংখ্যাক লোকের সে দিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করেননি। তাই ইসলামী রাষ্ট্রের ও সমাজে পরামর্শের বিধান তো রয়েছে, কিন্তু পাশ্চাত্যের ধর্মহীন গণতন্ত্রের নীতি majority must be granted সংখ্যাধিক্যের মত অবশ্যই গৃহীত হতে হবে- ইসলামে নিঃশর্তভাব তা গৃহীত হয়নি।

নবী করীম (স) বদর যুদ্ধ কালে সাহাবায়ে কিরামের মজলিস করেছেন।বিশদ আলোচনা হয়েছে। হযরত আবূ বকর ও উমর (রা) নিজ মত প্রকাশ করেছেন। শেষে হযরত মিকদাদ ইবনে আমর (রা) দাড়িয়ে বললেনঃ

‘হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হোন। আমরা আপনার সঙ্গেই রয়েছে। বনী ইসরাইলীরা তাদের নবীকে যেমন বলেছিলঃ আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা তো এখানেই আসন গেড়ে বসলাম- আসরা তেসন কথা নিশ্চয়ই বলব না। বরং বলবঃ ‘আপনি ও আপনার রব অগ্রসর হোন, আমরা আপনাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছি’।

রাসূলে করীম (স) এই মতটিকে খুবই পছন্দ করেছেন, তিনি তাঁর জন্য দোয়া করেছেন।

ওহোদ যুদ্ধকালে কুরাইশরা মদীনার উপকণ্ঠে পৌছে গেছে জানতে পেরে তিনি সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। প্রশ্ন রাখলেনঃ মদীনার মধ্যে থেকেই যুদ্ধ করা হবে, না বাইরে গিয়ে মুকাবিলা করা হবে? সাহাবীগণ উভয় দিকেই মত দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলে করীম (স) তাঁদের মতকেই পছন্দ করলেন ও সিদ্ধান্ত করলেন, যাদের মত ছিল মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে।

আহযাব যুদ্ধকালেও পরামর্শ করতে গিয়ে রাসূলে করীম (স) বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতের সম্মুখীন হলেন। শেষে হযরত সালমান ফারসী (রা) র মত গ্রহণ করে মদীনা নগরের বাইরে পরিখা খনন করলেন। হযরত সালমান (রা) একাই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং রাসূলে করীম (স) তাঁর দেয়া পরামর্শ গ্রহণ করতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করলেন না, যদিও পরিখা খনন করে শত্রু বাহিনির অগ্রগতি রোধ করার পদ্ধতি আরবদের মূলতই জানা ছিল না।

সেই পরিখা যুদ্ধকালীন আর-ও একটি ঘটনা। ইসলামী বাহিনী খাদ্যাভাবে ভীষণ কষ্ঠের মধ্যে পড়ে গেছে। রাসূলে করীম (স) গাতফান কবীলার সরদার উয়াইনা বিন হাচন ও হারিস ইবনে আউফের নিকট লোক পাঠিয়ে মদীনার এক-তৃতীয়াংশ ফল ও ফসল দেয়ার শর্তে যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদের চলে যাওয়ার জন্য সন্ধি করলেন এবং এ ব্যাপারে একটি দস্তাবেজ লিপিবদ্ধ করলেন যদিও কোন লোককে সাক্ষী রাখা হয়নি। এটা ঠিক ‘সন্ধি’ ধরনেরও কিছু ছিল না। রাসূলে করীম (স) যখন এ বিষয়টি চূড়ান্ত করার ইচ্ছা করলেন, তখন তিনি হযরত সায়াদ ইবনে মুয়ায ও সায়াদ ইবনে উবাদা (রা)-কে বিষয়টি জানালেন এবং তাঁদের পরামর্শ চাইলেন। তাঁরা শুনে বললেনঃ হে রাসূল! এ ব্যাপারে কি আমরা যা পছন্দ করব, তাই করতে পারব, না আল্লাহ আপনাকে এই কাজ করার জন্য আদেশ করেছেন? তিনি বললেন-না, আল্লাহ কোন আদেশ নাযিল করেন নি, আমিই চিন্তা করেছি এই কাজ করার। তখন তাঁরা বললেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা ও মুশরিক জাতি ছিলাম। আল্লাহকে জানতামও না, তাঁর ইবাদতও আমরা করতাম না। এক্ষণে আপনার দৌলতে আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এই সময় ওদের সাথে এইরূপ চুক্তি করা কিছুতেই শোভণ হবে না। নবী করীম (স) তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং চুক্তির ইচ্ছা পরিত্যাগ করলেন।

তায়েফ যুদ্ধকালেও পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপার ঘটেছিল। তায়েফ যাত্রাপথে একটি দুর্গ দেখা গেল। নবী করীম (স) সঙ্গীদের নিয়ে তথায় অবতরণ করলেন। ইতিমধ্যে হুবাব ইবনুল মুনযির (রা) উপস্থিত হয়ে বললেনঃ আমরা দুর্গের নিকটে পৌছে গেছি। এখন আল্লাহর নির্দেশ কিছু থাকলে আমরা তা-ই করব। অন্যথায় এই দুর্গা আক্রমণে বিলম্ব করাই শ্রেয়ঃ মনে করি।

রাসূলে করীম (স) তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করলেন।

উপরোদ্ধৃত শেষের দুইটি পরামর্শর ব্যাপারে বিবেচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে-এই উভয় ক্ষেত্রেই নবী করীম (স) কর্মক্ষেত্রে বিবেচিত সর্বোত্তম, সর্বাধিক সত্য ও অধিক কল্যাণকর পন্হা গ্রহণের নীতি অবলম্বন করেছেন। এসব ক্ষেত্রে নবী করীম (স) কোন মত গ্রহণ ও কোন মত বর্জনে সংখ্যাগুরু (majority) সংখ্যালঘুর (minority)-র উপর ভিত্তি করে করেননি। বরং তিনি সকলেরই বক্তব্য শুনতেন, তবে তাঁর নিকট যে মতটি অধিক যথার্থ ও সঠিক বিবেচিত হয়েছে, সেটাই তিনি গ্রহণ করেছেন, সেটি বেশী সংখ্যক লোকের মত, না কম সংখ্যক লোকের-সেটা হিসেব করেননি।

কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নতর অবস্থা লক্ষ্যব করা গেছে। সঙ্গের সমস্ত সাহাবী মক্কার কাফিরদের সাথে কোনরূপ সন্ধি করার মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সন্ধি করলেন ও তাকে কার্যকর করলেন।

এক্ষেত্রে অধিক প্রকট ঘটনা হচ্ছে-হযরত উসমা ইবনে জায়দ (রা)-কে নিজ হাতে পতাকা দিয়ে বললেনঃ

[আরবি……………]

তুমি রওয়ানা হয়ে যাবে সেখানে, যেখানে তোমার পিতা শহীদ হয়েছে এবং সেই স্থানের লোকদেরকে অশ্ব-ক্ষুরে নিষ্পেষিত করবে। আমি তোমাকে এই বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলাম।

অথচ বড় বড় সাহাবী এই পদক্ষেপ মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। তারা হযরত উসমা (রা) কে সেনাপতি বানানোর বিরুদ্ধে মত জানিয়েছিলেন। কিন্তু নবী করীম (স) কারোর কথাই শুনেন নি, কারোর বিরুদ্ধতারও পরোয়া করেন নি। সাহাবায়ে কিরামের বিপরীত মতও তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে একবিন্দু টলাতে পারে নি। তিনি সাহাবায়ে কিরামের বিরূপ মত ও ক্ষোভের টের পেয়ে মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেনঃ “হে জনগণ! উসামাকে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যাপারে তোমাদের অ-মতের কথা আমার নিকট পৌছেছে! তোমরা পূর্বেও তার পিতা জায়েদকে সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের বিরোধীতা করেছিলে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, সে সেনাধ্যক্ষ হওয়ার সম্পূর্ণ যোগ্য ছিল, তার পুত্রও যোগ্য”।

এই সব ঘটনা থেকে পরামর্শ গ্রহণের ব্যাপারে নবী করীম (স)-এর এই নীতিরই সন্ধান মেলে যে, নেতা পরামর্শ চাইবে, সংশ্লিষ্ট লোকেরা পরামর্শ দেবেও। কিন্তু গ্রহণ করবে তা, যা তার নিকট অধিক সঠিক ও কল্যাণকর বিবেচিত হবে। অধিকাংশ লোকের মত গ্রহণ করতে সে বাধ্য নয়। তবে কোন সময় অধিকাংশের মতও গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমন করে নবী করীম (স) ওহোদের যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাই করেছিলেন।

তবে মজলিসে শু’রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ দানের ব্যাপারটি নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্যান্য পর্যায়ের নেতা নির্বাচনের ব্যাপারের মত নয়।এই শেষোক্ত ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতই গৃহীত হবে। অন্যথায় বিরোধ ও মতপার্থক্য গোটা সমাজকেই অচল করে দেবে। তাই অধীকাংশ লোকের সমর্থনে নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারাদিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় সেই নেতা অধিকাংশ লোকের মত গ্রহণে সব সময়ই বাধ্য হতে পারে না। নেতা যদি মনে করে-অধিকাংশ লোকের মত বাস্তবতার কিংবা কুরআন ও সুন্নাহর সামগ্রিক ভাবধারার সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন নয়, তাহলে তখন যা অধিক সত্য বলে বিবেচিত হবে সেই মত-তা বেশী সংখ্যকের হোক, কি কম সংখ্যকের-গ্রহণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত করবে ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

এই নীতিই কুরআনের বিধান ও রাসূলের সুন্নাতের সাথে অধিক সামঞ্জ্যস্যশীল বলেই মনে হয়।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি