দ্বিতীয় ভাগ
প্রথম অধ্যায়
‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস’-এর প্রথম ভাগে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে বাংলায় তথা ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের প্রথম আগমণ থেকে শুরু করে তাদের সাড়ে পাঁচ শতাধিক বৎসরব্যাপী (১৩০২-১৭৫৭ খৃঃ) বাংলা শাসনের ইতিহাস। অতঃপর এ ভূখন্ডে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত থেকে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসহ আইন (Government of India Act. 1935) কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস।
এখন এ ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগে আলোচনা করতে চাই ১৯৩৫ সালের উপরিউক্ত আইনের প্রয়োগকাল থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস।
ভারত বিভাগের কতিপয় ব্যক্তির নিকটে দুর্ভাগ্যজনক বিবেচিন হলেও এ ছিল এক অনিবার্য ও স্বাভাবিক বাস্তবতা। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম অধিবাসীর উপর মুষ্টিমেয় মুসলমানের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা হাজার বারোশ’ বছর চলেছে, এ দীর্ঘ সময়ে মুসলমান অমুসলমান পাশাপাশি শান্তি ও সৌহার্দের সাথে একত্রে বসবাস করেছে, তারা বিংশ শতাব্দীর মাঝখানে এসে আর একত্রে থাকতে পারলোনা কেন? এর সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের অবশ্যই জানা দরকার। ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার পর থেকে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু ও ব্রিটিশের আচরণের ধারাবাহিক ইতিহাস, বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতে কংগ্রেসের আড়াই বছরের কুশাসন রিপেক্ষ দৃষ্টিবভংগীসহ আলোচনা করলে এ সত্যে উপনীত হওয়া যাবে যে, ভারত বিভাগ চিল এক অনিবার্য ও স্বাভাবিক বাস্তবতা।
পঁয়ত্রিশের ভারত শাসন আইন কার্যকর হওয়ার ফলে প্রদেশগুলিতে সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস সাতটি হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশে অন্য দলের সহযোগিতা ব্যতীতই সরকার গঠন করতে সমর্থ হয় এবং ক্ষমতামর্দমত্ত হয়ে মুসলমানদের সাথে এমন অমানবিক আচরণ শুরু করে যার দরুন মুসলমাগণ এ উপমহাদেশে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন মনে করতে থাকে। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে, দেশের সর্বত্র লোমহর্ষক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং মুসলমানদের জান-মাল ইজ্জৎ-আবরু লুণ্ঠিত হতে থাকে। পরিস্থিতি অবশেষে এমন একদিকে মোড় নেয় যেদিক থেকে প্রত্যাবর্তনের আর কোনই উপায় ছিলনা। ভারত দুটি পৃথক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ বিভক্তির পশ্চাতে ছিল ভারতীয় মুসলমানদের অদম্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শ, স্বতন্ত্র জাতীয়তার ধারণা, নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং এসবসহ জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির প্রবল আশংকা। এক পক্ষ চাইছিল অপর পক্ষকে গোলাম বানিয়ে রাখতে অন্যথায় তাদেরকে ভারতের বুক থেকে নির্মূল করতে। অপর পক্ষ চাইছিল আত্মমর্যাদা ও সকল অধিকারসহ বেঁচে থাকতে। ইতিহাসের নিরপেক্ষ আলেচনায় আশা করি এ সত্য প্রমাণিত হবে।

ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ (Govt. of India Act, 1935)
এ আইনটি ১৯৩৭ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়। ভারতীয় ফেডারেশন সম্পর্কিত আইনের দ্বিতীয় অংশটি কার্যকর হয়নি। কারণ নির্দিষ্ট সংখ্যক ভারতীয় দেশীয় রাজ্য ফেডারেশন মেনে নিতে পারেনি বলে তা কার্যকর হয়নি।
এই আইনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এ সর্বপ্রথম প্রদেশগুলোকে আইনানুগ পৃথক অস্তিত্ব দান করা। সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক প্রদেশের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে এই সর্বপ্রথম পূর্ণ প্রাদেশিক মর্যাদা দান করা হয়। ভোটদাতার সম্পদের অনুপাত হ্রাস করতঃ ভোটার সংখ্যা বর্ধিত করা হয়।
আইন অনুযায়ী প্রত্যেক প্রদেশে একটি করে মন্ত্রী পরিষদ থাকবে এবং গভর্ণর তার সুপারিশ মেনে চলবেন। তবে তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলে আপন বিবেক অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। দ্বৈতশাসন বিলুপ্ত করা হয়। প্রদেশে ব্রিটিশ মডেলের একটি করে মন্ত্রীসভা থাকবে যার পরামর্শ অনুসারে গভর্ণর তাঁর কার্য সম্পাদন করবেন।

প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন
প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন সম্পন্ন হয় ১৯৩৭ এর ফেব্রুয়ারী ও মার্চে। ১৯৩৬ সালের শেষভাগে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করে। উভয় মেনিফেস্টোর সামাজিক পলিসি ছিল একই রকমের। রাজনৈতিক ইস্যুতেও কেউ একে অপর থেকে বেশী দূরে অবস্থান করছিল না। কিন্তু দটি বিষয়ে উভয়ের মধ্যে বিরাট মত পার্থক্য ছিল। একটি এই যে, মুসলিম লীগ ওয়াদাবদ্ধ ছিল উর্দু ভাষা ও বর্ণমালার সংরক্ষণ এবং সমৃদ্ধি সাধন করতে। পক্ষান্তরে কংগ্রেস বদ্ধপরিকর ছিল হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে। দ্বিতীয়তঃ মুসলিম লীগ অটল ছিল পৃথক নির্বাচনের উপর। কিন্তু কংগ্রেস ছিল তার চরম বিরোধী। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস পৃথক নির্বাচন মেনে নিয়ে মুসলিম লীগের সাথে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যা লাখনো চুক্তি নামে খ্যাত ছিল। অনেক কংগ্রেস নেতা লাখনো চুক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং এটাকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের সেতুবন্ধন মনে করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস এ চুক্তি অমান্য করে পৃথক নির্বাচনের বিরোধিতা শুরু করে। অবশ্যি কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারত বিভাগ পর্যন্ত পৃথক নির্বাচন বলবৎ থাকে।
হিন্দু-মুসলিম মিলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কোন কথা মুসলিম লীগ মেনিফেস্টোতে ছিলনা। বরঞ্চ তাদে চিল সহযোগিতার সুস্পষ্ট আহবান। কংগ্রেস মুসলিম লীগের এ সহযোগিতার আহবান ঔদ্ধত্য সহকারে প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের দাবী ছিল যে, সকল ভারতবাসী এক জাতি এবং ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কংগ্রেস। কিন্তু ১৯৩৭ সালের নির্বাচন তার এ দাবী মিথ্যা প্রমাণিত করে।
নির্বাচনের যে ফল প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় সর্বমোট ১৭৭১টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে মাত্র ৭০৬ টি যা অর্ধেকেরও কম। মুসলিম আসনের অধিকাংশ লাভ করে স্যার ফজলে হোসেনের পাঞ্জাব ইউনিয়নিষ্ট পার্টি। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত অসংগঠিত ছিল বলে ৪৮২ টি আসনের মধ্যে ১০২টি লাব করে। কিন্তু কংগ্রেস হিন্দুমুসলিম উভয়ের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসাবে কয়টি মুসলিম আসনে বিজয়ী হয়? ৫৮ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয় মাত্র ২৬টি আসনে। পাঞ্জাবে সর্বমোট ১৭৫ আসনের মধ্যে ১৮ এবং বাংলায় ২৫০ এর মধ্যে ৬০ আসন লাভ করে।
(The Struggle for Pakistan.I.H. Qureshi). Return showing the seult in election in India, Nov.1937)
মোট সাড়ে তিন কোটি ভোটের মধ্যে কংগ্রেস প্রায় দেড় কোটি ভোট লাভ করে। অতএব ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
ইউপিতে কংগ্রেস টিকেটে মাত্র একজন মুসলমান নির্বাচিত হন। তিনি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনী এলাকা থেকে যুক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভাপতি –একজন মুসলমান নির্বাচনে পরাজিত হন। -(The Struggle for Pakistan.I.H. Qureshi)
দেশের এগারোটি প্রদেশের মধ্যে ছয়টিতে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। সে ছয়টি হলো –বোম্বাই, মাদ্রাজ, ইউ, পি,সি, পি, বিহার ও উড়িষ্যা। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে বহু চেষ্টা করেও যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান প্রার্থী সংগ্রহ করতে পারেনি। উপরোক্ত ছয়টি প্রদেশের তিনটিতে বোম্বাই, সিপি (মধ্য প্রদেশ) প্র উড়িষ্যা –কংগ্রেস মনোনিত কোন মুসলমান প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেননি।
নতুন প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্ণরগণ প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠান এবং মন্ত্রীসভা সীমান্ত প্রদেশ এবং আসাম –এ পাঁচটি প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় এবং পয়লা এপ্রিল থেকে স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট হিসাবে কাজ শুরু করে। অবশিষ্ট ছয়টি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে –যতোক্ষণ না গভর্ণরগণ সংবিধান অনুযায়ী তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার নিশ্চয়তা দান করেন। এধরনের নিশ্চয়তা দানে গভর্ণরগণ অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। অতঃপর যেসব দল বা গুপের প্রতিনিধিগণ মন্ত্রীসভা গঠনে ইচ্ছুক তাঁদেরকে নিয়ে অন্তবর্তী মন্ত্রীসভা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুসলমানদের নেতৃত্বে বোম্বাই, বিহার ও ইউপিতে অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রীসভা গঠিত হয় এবং কতিপয় মুসলিম লীগ সদস্যকেও মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়া হয়। কিন্তু এসবকে ‘মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা’ নাম দেয়া হয়নি।

রক্ষাকবচ প্রশ্নে অচলাবস্থা সৃষ্টি
ভারত শাসন আইন ১৯৩৫-এর অধীনে প্রদেশের গভর্ণরগণকে যে নির্দেশনামা প্রদান করা হয় তাতে তাঁদের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে আইনে যে রক্ষাকবচের (Safeguard) নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখাই গভর্ণরগণের বিশেষ দায়িত্ব।
বলা হয়েছেঃ
The instrumemts of Instructions issued to the Governors under the Government of India Act. 1935. Placed some special responsibilities on the provincial heads. These inclided the ‘Safeguarding of all the legitimate interests of minorities as requiring him to secure in general, thea those racial or religious communities for the members of which special representation is accorded in the legislature and thlose classes of the people committed to his charge who, whether in account of the smallness of their number, or their lack of educational or material advantages or from any other cause, cannot as yet fully rely for their welfare upon joint political action in the legislature, shall not suffer, or have reasonable cause to fear neglect or oppression.
উপরোক্ত আইনে সব ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সকল বৈধ স্বার্থ সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। তাদের স্বার্থ যাতে সংরক্ষিত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে প্রাদেশিক গভর্ণরগণকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়।
জাতিগত ও ধর্মীয় এমন কতিপয় সম্প্রদায় আছে যাদের সদস্যদের জন্যে আইনসভায় বিশেষ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে, গভর্ণরের তত্ত্বাবধানে ও বৈষয়িক সুযোগ সুবিধা না থাকার কারণে অথবা অন্য কোন কারণে তাদের কল্যাণের জন্যে আইনসভায় গৃহীত যুক্ত রাজনৈতিক পদক্ষেপের উপর এখনো পুরোপুরি আস্থা পোষণ করতে পারেনা –এসব সম্প্রদায় ও শ্রেণী কোনরূপ দুর্গতি ভোগ করবে না অথবা অবহেলিত অথবা উৎপীড়িত হওয়ার কোন কারণ থাকবে না। এভাবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব গভর্ণরদের উপরে অর্পিত হয়।
ভারতের সংখ্যালঘু বলতে প্রধানতঃ মুসলমানদেরকেই বলা হয় এবং তারা তাদের সকল প্রকার স্বার্থ সংরক্ষণ তথা রক্ষাকবচের জন্যে দীর্ঘকাল যাবত সংগ্রাম করে আসছে।
এ উপমহাদেশ কয়েকটি জাতির আবাসভূমি ছিল এবং তাদের মধ্যে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুও ছিল। এ বাস্তবতা কংগ্রেস স্বীকার করতোনা। সংগ্রেস দাবী করতো সকল ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন মাত্র একটি এবং তা হলো কংগ্রেস। মিঃ গান্ধী News Chronicle এর প্রতিনিধির কাছে বলেন, এখানে একটি মাত্র দল আছে যে কল্যাণ করতে পারে এবং তা হলো কংগ্রেস। কংগ্রেস ব্যতীত অন্য কোন দল মেনে নেব না।
তিনি আরও বলেন, তোমরা যে নামেই ডাক, ভারতে একটি মাত্র দলই হতে পারে, এবং তা হচ্ছে কংগ্রেস –(Muslim Separatism in India, A. Hamid, p.217)
জওহরলাল নেহরুর মনোভাবও চিল অনুরূপ। তিনি বলেন, একটি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও আবিষ্কার করা যাবে না যে ভারতে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েল অস্তিত্ব আছে। দেশে মাত্র দুটি দল আছে –কংগ্রেস এবং সরকার। আর যারা আছে তাদেরকে আমাদের কর্মপদ্ধতি মেনে নিয়ে আমাদের সাথে থাকতে হবে। যারা আমাদের সাথে নেই –তারা আমাদের বিরোধী।
পন্ডিত নেহরুর উপরোক্ত ফ্যাসিবাদী মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।- Muslim Separatism in India, A. Hamid.
সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা ১৯৩৫ সালের আইনে রয়েছে এবং প্রাদেশিক গভর্ণরগণকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাতে সংখ্যালঘুদের স্বার্ত ক্ষুণ্ণ না হয়। কিন্তু পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কথায় এ দেশে সংখ্যালঘু বলে কোন বস্তুর অস্তিত্বই যখন নেই, তখন কংগ্রেসের মতে গভর্ণরদের বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রয়োজনও নেই। এর সুস্পষ্ট অর্থ হলো এই যে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে মোটেই রাজী নয়। এ কারণেই কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে রাখে।
অবশেষে ভাইসরয় লর্ড লিলিথগোর সাথে কংগ্রেসের একটা আপস নিষ্পত্তি হয়ে যায় যার ভিত্তিতে ৭ই জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কংগ্রেসকে মন্ত্রীসভা গঠনের অনুমতি দান করার প্রস্তাব গ্রহণ করে।
ভাইসরয়ের পক্ষ থেকে গোপনে পূর্ণ নিশ্চয়তা লাভের পর কংগ্রেস সকল মান-অভিমান ত্যাগ করে ১৯৩৭ এর জুলাই মাসে সাতটি প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করে। ১৯৩৮ সালে আসামের প্রধানমন্ত্রী স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ এস্তেফা দান করায় আসামে গোপীনাত বারদলই কর্তৃক কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। যে সকল প্রদেশে মুসলমানদের স্বার্থ পদদলিত হতে থাকে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

নির্বাচনের ফলাফল
কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর মুসলিম ভারতে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পূর্বে সাইত্রিশ সালের শুরু থেকেই যেসব প্রদেশে সরকার গঠিত হয় তাদের অবস্থা কি ছিল, তা একবার আলোচনা করা যাক।

বাংলা
নির্বাচনের পর বাংলার আইনসভার দলীয় অবস্থার চিল নিম্নরূপঃ
কংগ্রেস ৫৪
অকংগ্রেসী হিন্দু ৪২
স্বতন্ত্র মুসলমান ৪৩
মুসলিম লীগ ৪০
অন্যান্য মুসলমান ৩৮
ইউরোপিয়ান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ৩১
নির্দলীয় মুসলমান ২
মোট >>> ২৫০
মুসলিম লীগ নন, এমন মুসলমানদের মধ্যে কৃষক প্রজা পার্টির সদস্য ছিল ৩৫। এ দলের নেতা ছিলেন মৌলভী এ কে ফজলুল হক (শেরে বাংলা)। এখানে কোয়ালিশন ব্যতীত মন্ত্রীসভা গঠনের অন্য কোন পথ ছিলনা। অতএব ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে, মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, তফসিলী সম্প্রদায় (Scheduled Castes) এবং স্বতন্ত্র অথবা অকংগ্রেসীয় বর্ণ হিন্দুদের নিয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, যার নেতা ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি দশ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করেন যার মধ্যে পাঁচজন মুসলমান এবং পাঁচজন হিন্দু ছিলেন।
উল্লেখ্য নির্বাচনের পর তেসরা ফেব্রুয়ারী মুন্সীগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনাব ফজলুল হক তাঁর দলের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী কৃষক প্রজা পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটি উক্ত দলের নেতৃবৃন্দের সাথে মুসলিম লীগের নুতন সংবিধান কার্যকর করার উদ্দেশ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তা অনুমোদন করে। ৬ই মার্চ জনাব ফজলুল হক মন্ত্রীসভা গঠনে সম্মত হন।কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরোধে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগদান করেন। অতঃপর তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপত গ্রহণ করেন।
ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা নির্বিবাদে কাজ করতে পারেনি। কারণ কংগ্রেস পদে পদে এ মন্ত্রীসভার চরম বিরোদিতা করে। কিন্তু তার সুফল এই হয় যে, যে পরিমাণে বিরোধিতা হয় সেই পরিমাণে সংসদের ভেতরে ও বাইরে মুসলিম ঐক্য সংহত ও সুদৃঢ় হয়।
কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হওয়ার পর কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৮৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে লাখনোতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অধিবেশনে তিনি যোগদান করে ঘোষণা করেন যে, তাঁর দলের সদস্যগণ মুসলিম লীগে যোগদান করবেন। তাঁর মন্ত্রীসভায় খাজা নাজিমুদ্দীন ও হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী স্থান পেয়েছিলেন।
ফজলুল হক সাহেবের সাড়ে চার বছরের প্রধানমন্ত্রীত্ব তাঁর জীবনে এবং অবিভক্ত বাংলার মুসলিম রাজনৈতিক শক্তিতে এক নব জোয়ার এনে দেয়। তাঁর মন্ত্রীসভা জনগণের মধ্যে বিরাট আশার সঞ্চার এবং মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তাদের এতদিনের হীনমন্যতা দূরীভূত হয় এবং হিন্দুদেরকে তারা সমকক্ষ মনে করে। সংসদে ফজলুল হক-সুহরাওয়ার্দীর ভাষন, প্রতিপক্ষের কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দান এবং তাঁদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কংগ্রেস ও হিন্দু সহাসভা নেতৃবৃন্দের তুলনায় অধিকতর উচ্চমানের ছিল। তাঁদের প্রাণশক্তি ও প্রজ্ঞা, জ্ঞানবুদ্ধির প্রখরতা, অনর্গল বাগ্মিতা ও সাংগঠনিক যোগ্যতা এবং কঠোর পরিশ্রম ও ধীশক্তির দ্বারা তাঁরা সংসদে হিন্দু সদস্যদের উপর তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।
বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যে নবজীবনের সঞ্চার হয় তা সংসদ ভবনের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমিত ছিলনা। মানবীয় কর্মশীলতার সকল ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংগঠন, সাহিত্য, শিল্প, সাংবাদিকতা, খেলাধূলা প্রভৃতিতে তা দৃষ্টিগোচর হলো। মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী জীবন্ত সংগঠনে পরিণত হচ্ছিল এবং মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন জীবন ও আস্থার সঞ্চার করছিল।
প্রায় এক শতাব্দী যাবত যে বাংলা সাহিত্যের উপর হিন্দু কবি সাহিত্যিক তাঁদের প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলেন, সাহিত্য গগনে কাজী নজরুল ইসলামের উদয়ের ফলে তার অবসান ঘটে। তিনি শুধু একাকী নন, কবি জসিম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, বেনজীর আহমদ প্রমুখের কাব্যজগতে অমর অবদানও অনস্বীকার্য। সংগীত সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের মনমাতানো সুরে গাওয়া ইসলামী, মুর্শেদী ভাটিয়ালী সংগীত মুসলমানদের মনে ইসলামী প্রেরণা সঞ্চার করে।
এ মুসলিম নবজাগরণে নতুন মুসলিম প্রেসের উত্থান বিরাট অবদান রেখেছে। সাংবাদিকতার জগতে কোলকাতা থেকে কতিপয় মাসিক ও সাপ্তাহিক প্রকাশিত হলেও নিয়মিত কোন দৈনিক পত্রিকা ছিলনা। ১৯৩৬ সালে মওলানা আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ প্রকাশিত করে মুসলমান জাতির বিরাট খেদমত আঞ্জাম দেন এবং ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রীসভাবে সক্রিয় সমর্থন দান করেন। এ সমেয় আবদুল করিম গজনবী কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক স্টার অব ইন্ডিয়া এবং খাজা নূরুদ্দীন কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক মর্নিং নিউজ মুসলমানদের আশা আকাংখার প্রতিনিধিত্ব করে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রীসভা –(১৯৩৭-১৯৪১) বাংলার সংসদীয় সরকারের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এ সময়ে তিনি বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশগুলোতে সফর করে মুসলিম লীগ সংগঠিত করেন এবং একে একটি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে লাখনোতে, ১৯৩৮ সালে করাচীতে এবং ১৯৩৯ সালে কটকে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনগুলোতে ভাষণ দান করেন। ১৯৪০ সালে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে ২২, ২৩ ও ২৪ মার্চ মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার ২৩শে মার্চের অধিবেশনে তিনি ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন।
ফজলুল হক এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম জাতির উন্নতি অগ্রগতির চাকিকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। এ কারণেই তিনি তাঁর কোয়ালিশন মন্ত্রীসভায় নিজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলমানদের উন্নতির জন্যে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেন। যথা লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ (মহিলা কলেজ), কোলকাতা; ইডেন গার্লস কলেজ, ঢাকা; কৃষি কলেজ (তেজগাঁ, ঢাকা); ফজলুল হক মুসলিম হল, ঢাকা; ফজলুল হক কলেজ, চাখার, বরিশাল।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব-ঔদ্ধত্য তিনি কিছুটা খর্ব করতে চেয়েছিলেন। এ চিল প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের এক সুরক্ষিত বিদ্যামন্দির। হিন্দু রেনেসাঁর এবং বাংলায় হিন্দুর বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এ ছিল এক বিরাট দুর্দমনীয় প্রতিষ্ঠান যা প্রবেশিকা এবং মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতো। অতএব উচ্চশিক্ষার উপর তার প্রভাব ছিল শিক্ষামন্ত্রী ও তাঁর বিভাগ অপেক্ষা অনেক বেশী। এ প্রভাব থেকে পরীক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্যে তিনি সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড গঠনের উদ্দেশ্যে আইন পরিষদে একটি বিল উত্থাপনের চেষ্টা করেন। ফলে গোটা হিন্দু সম্প্রদায় ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে এবং পারস্পরিক সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে উক্ত প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯০৫ সালের বংগভংগের পর একন প্রচন্ড বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। ১৯৪০ সালে কোলকাতায় স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো এক বিদ্বজ্জন ব্যক্তির সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র প্রদেশ থেকে প্রায় দশ হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বার্ধক্যজনিত পীড়ায় ভুগছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি উক্ত সম্মেলনে তাঁর নাম ও মর্যাদা ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করেন। সম্মেলনে তিনি যে বাণী পাঠান তার শেষাংশে বলেনঃ
আমার বার্ধক্য এবং স্বাস্থ্য আমাকে সম্মেলনে যোগদানে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু যে বিপদ আমাদের প্রদেশের সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতি হুকমি সৃষ্টি করেছে, তা আমাকে ভয়ানক বিচলিত করেছে। সে জন্যে আমি আমার রোগশয্যা থেকে সম্মেলনে একটি কথা না পাঠিয়ে পারলাম না।
হিন্দুদের চরম বিরোধিতার কারণে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড গঠনের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা কার্যকর করা হয়নি।
তবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেরে বাংলা ফজলুল হক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণযে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা এই যে, প্রদেশের সকল সরকারী শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হিন্দু ও পঞ্চাশ ভাগ মুসলমান লাভ করবে। সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রে হিন্দুদের চিরাপরিত একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলমানদের প্রতি যে চরম অবিচার করা হচ্ছিল, উপরোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে মুসলমান শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে জীবন ক্ষেত্রে বিরাট আশা ও আনন্দের সঞ্চার হয়। মুসলমান জাতির জন্যে এ ছিল এক বিরাট খেদমত।

পাঞ্জাব
যে কয়টি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হতে পারেনি তার মধ্যে ছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু ও আসাম। নির্বাচনের ফলে পাঞ্জাবের দলীয় অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ
কংগ্রেস ১৮
অকংগ্রেস হিন্দু ও শিখ ৩৬
মুসলিম লীগ ২
অন্যান্য মুসলিম ৪
ইউনিয়নিষ্ট ৮৮
নির্দলীয় ২৭
মোট >>>১৭৫

পরে আটজন সদস্য ইউনিয়নিস্ট পার্টিতে যোগদান করার ফলে এ দলে মোট সদস্য সংখ্যা হয় ৯৬। খালসা ন্যাশনালিস্ট শিখ দলও স্যার সেকেন্দার হায়াতের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং এ সুযোগে তিনি মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ১৯৪২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর মালিক খিজির হায়াত খান প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৪৫ সালে সকল প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রীসভা বলবৎ থাকে।

সিন্ধু
সিন্ধু প্রদেশের দলীয় অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ
কংগ্রেস ৮
অকংগ্রেসী হিন্দু ১৪
মুসলিম স্বতন্ত্র ৯
অন্যান্য মুসলমান ৭
সিন্ধু ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি ১৮
নির্দলীয় ৪
মোট >>> ৬০

এখানে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় গোঁজামিল দিয়ে মন্ত্রীসভঅ গঠন করতে হয়। ফলে কোনটাই স্থিতিশীল হতে পারেনি। ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়েই এখানে মন্ত্রীসভাগুলো চলতে থাকে। প্রথমে স্যার গোলাম হোসেন হেদায়েতুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পরে আল্লাহ বখশ ও মীর বন্দে আলী খানের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীত্বের পালাবদল হতে থাকে।

আসাম
দলীয় অবস্থান এখানে নিম্নরূপ
কংগ্রেস ৩২
অকংগ্রেসীয় হিন্দু ৯
মুসলিম স্বতন্ত্র ৩০
নির্দলীয় ৩৩
সর্বমোট >>> ১০৮

এখানেও কোন স্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারেনি। স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর এস্তেফা দান করেন। অতঃপর গভর্ণরের আমন্ত্রণে কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বারদলই মন্ত্রীসভা গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সকল মন্ত্রীসভার সাথে গোপীনাথ মন্ত্রীসভাও পদত্যাগ করে। অতঃপর পুনরায় স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ মন্ত্রীসভা গঠনের সুযোগ পান। কিন্তু ১৯৪১ সালের শেষভাগে তাঁর মন্ত্রীত্বের পতন ঘটে এবং গভর্নর ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের ৯৩ ধারার বলে প্রদেশের শাসনভার নিজহস্তে গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা
এখন স্বল্পকালীন শাসিত প্রদেশগুলোর হালহাকিকত পর্যালোচনা করে দেখা যাক মুসলমানদের প্রতি তাদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আচরণ করা হয়।
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের জণ্যে গভর্ণরগণকে আইন অনুযায়ী যে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তা প্রয়োগ না করার নিশ্চয়তা না দিলে কংগ্রেস সরকার গঠনে সম্মত হবে না। অর্থাৎ তাদের পরিস্কার কথা এইযে, সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে তারা মোটেই রাজী নয়। ভারত শাসনে বৃটিশ পলিসির মর্মকথা এই যে, কংগ্রেস তথা ভারতীয় হিন্দু জাতিকে যে কোন মূল্যে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। মুসলিম স্বার্থ পদদলিত করে হিন্দুদেরকে তুষ্ট করার দৃষ্টান্ত অতীতে বহু দেখা গেছে। এবারেও ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো কংগ্রেসকে সরকার গঠনে সম্মত করার জন্যে গোপনে এ নিশ্চয়তা দান করেন যে, গভর্ণরগণ তাঁদের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না যা ১৯৩৫ সালের আইনে তাঁদেরকে দেয়া হয়েছে। এ নিশ্চয়তা দানের পরই কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠনে রাজী হয়।
সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করে এবং সকল প্রাদেশিক দলীয় নীতি পুরোপুরি কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মাদ্রাজে কংগ্রেস ৭৪টি আসন লাভ করে এবং রাজা গোপালাচারিয়া মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বোম্বাইয়ে কংগ্রেস মাত্র ৪৮টি আসন লাভে সমর্থ হয়।অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি সমমনা দল নিয়ে বি.জে.খের (B.J. Kher) মন্ত্রীসভা গঠন করেন। বোম্বাইয়ে কংগ্রেস মাত্র ৪৮টি আসন লাভে সমর্থ হয়। অন্যান্য ছোটখাটো কয়েকটি সমমনা দল নিয়ে বি.জে. খের (B.J. Kher) মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
যুক্তপ্রদেশে শতকরা ৫৯ আসন কংগ্রেস লাভ করে এবং জিবি প্যান্ট প্রধানমন্ত্রী হন। বিহারে শতকরা ৬২ আসন লাভ ক’রে শ্রকৃষ্ণ সিনহা সরকার গঠন করেন। মধ্যপ্রদেশে শতকরা ৬৩ আসন লাভের পর ডাঃ কারে এবং পরবর্তীকালে শুকলা প্রধানমন্ত্রী হন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস শতকরা মাত্র ৩৮ আসন পেলেও ডাঃ খান সরকার গঠন করেন।
উড়িষ্যার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। কংগ্রেস মন্তীসভার পূর্বে পার্লাকিবেদীর মহারাজা চার মাসের জন্যে (এপ্রিল-জুলাই) স্বল্পকালীন সরকার গঠন করেন। বিশ্বনাথ দাস জুলাই ১৯৩৭ পর্যন্ত কংগ্রেস মন্ত্রীসভা পরিচালনা করেন। কংগ্রেস মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পর গভর্নর শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ এর শেষভাগে গোদাবরী মিশ্রর নেতৃত্বে কতিপয় সংসদ সদস্য কংগ্রেস হাই কমান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং পার্লাকিবেদীর মহারাজাকে মন্ত্রীসভা গঠনে সহায়তা করেন। মহারাজা তিনজনকে নিয়ে –তিনি স্বয়ং, মিশ্র এবং একজন মুসলমান মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কংগ্রেস হাই কমান্ডের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও মন্ত্রীসভা কাজ চালিয়ে যায়।

প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস শাসন
ভারতের এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সীমান্ত প্রদেশসহ সাতটিতে কংগ্রেসের প্রায় আড়াই বছরের শাসন (জুলাই ১৯৩৭ থেকে অক্টোবর ১৯৩৯) হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের এক অতি বেদনাদায়ক ইতিহাস। এসব প্রদেশে সকল ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল কংগ্রেসের হাতে। এ ক্ষমতার ব্যবহার কংগ্রেস কিভাবে করেছিল এবং তা রাজনৈতিক ও সাংবিদানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে কি অশুভ পরিনাম ডেকে এনেছিল তা-ই এখন আলোচনা করে দেখা যাক।

কোয়ালিশন সরকার গঠনে অস্বীকৃতি
সাইত্রিশ সালের নির্বাচনের পর পরই মুসলিম লীগ সভাপতি মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক বিবৃতিতে বলেনঃ
সংবিধান এবং মুসলিম লীগ পলিসি আমাদেরকে অন্যান্য দলের স্বার্থে সহযোগিতা করতে বাধা দেয় না। আমরা যে কোন দলের সাথে সহযোগিতা করতে পারি আইনসভার ভেতরেও এবং বাইরেও।
কিছু সংখ্যক কংগ্রেসপন্থীসহ সকলেই এ আশা পোষণ করছিলেন যে, হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠিত হবে। কিন্তু মুসলিম লীগের সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করতে কংগ্রেসের অস্বীকৃতি এ আশা ফলবতী হতে দেয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ যুক্ত প্রদেশের অবস্থা এখানে বর্ণনা করা যেতে পারে। এখানে আইন সভায় মোট ২২৮ আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্যে ৬৪ আসন ছিল। তার মধ্যে কংগ্রেস লাভ করে একটি, মুসলিম লীগ ২৬, স্বতন্ত্র মুসলমান ২৮ এবং জাতীয় কৃষি দল ৯। এখানে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোয়ালিশন গঠনের বিষয় নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয়। অবশেষে কংগ্রেস হাই কমান্ডের অন্যতম সদস্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে জানিয়ে দেন কোন কোন শর্তে প্রাদেমিক সরকারগুলোতে মুসলিম লীগ যোগদান করতে পারে। শর্তগুলো নিম্নরূপঃ
১। ইউপি আইন পরিষদে মুসলিম লীগ কোন পৃথক দল হিসাবে কাজ করবে না।
২। ইউপি আইন পরিষদের বর্তমান মুসলিম লীগ দল কংগ্রেসের অংশ হিসাবে পরিগণিত হবে, কংগ্রেস পার্টির সদস্য হিসাবে তারা পার্টির অন্যান্য সদস্যদের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। পার্টির আলোচনায় অংশগ্রহণের অধিকারও তাদের থাকবে। পার্টির আলোচনায় অংশগ্রহণের অধিকারও তাদের থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। প্রত্যেক সদস্যের একটি মাত্র ভোট দানের অধিকার থাকবে।
৩। আইন পরিষদের সদস্যদের জন্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে নীতি নির্ধারণ করবে এবং যেসব নির্দেশ দিবে, তা কংগ্রেস সদস্যগণ এবং এসব সদস্য মেনে চলবেন।
৪। ইউপি এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বোর্ড ভেঙ্গে দিতে হবে। ভবিষ্যতে কোন উপ-নির্বাচনে সে বোর্ড কোন প্রার্থী দিতে পারবে না। কোন আসন শূন্য হলে, কংগ্রেস যাকে নির্বাচনের জন্যে প্রার্থী মনোনিত করবে তাকেই সমর্থন করতে হবে।
৫। মন্ত্রীসভার সদস্যপদ এবং আইন সভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত যদি কংগ্রেস করে, তাহলে সে সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ থেকে আগত সদস্যগণ মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন।
কংগ্রেস হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগকে প্রদত্ত উপরোক্ত শর্তগুলো ছিল হাস্যকর ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ফ্যাসিবাদী মানসিকতার পরিচায়ক। সামান্যতম আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা দল উপরোক্ত শর্তগুলোর কোন একটিও গ্রহণ করতে পারতো না। কারণ তা হতো আত্মঘাতী।
কংগ্রেসের এ অবিবেচনাপ্রসূত ঔদ্ধত্যের কারণ নির্ণয় করা মোটেই কষ্টকর নয়। মিঃ গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু ভারতে একমাত্র কংগ্রেস ব্যতীত অন্য দলের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী ছিলেন না। এ দেশে কোন হিন্দু-মুসলিম সমস্যা আছে –একথাও তাঁরা স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। জওহরলাল নেহরু ১২ই মে, ১৯৩৭ সালে চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে বলেন যে, তাঁর বিশ্বাস ভারতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটি শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, জমিদার ও পুঁজিপতিদের মধ্যে সীমিত, যাঁরা এমন এক সমস্যা সৃষ্টি করছেন যা জনগণ স্বীকার করেনা। আইনসভার ভেতরে মুসলমানদের একটা আলাদা দল থাকবে এমন ধারণার প্রতি তিনি বিদ্রুপ বান নিক্ষেপ করেন।
কংগ্রেস ঘোষিত নীতি অনুযায়ী নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের প্রতি আহবান জানানো হয় মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্যে নিজেদের দল ভেঙ্গে দিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করতে। যুক্ত প্রদেশে হাফেজ মুহাম্মদ ইব্রাহীম এবং বোম্বাইয়ে এম, ওয়াই, নূরী কংগ্রেস শপথনামায় স্বাক্ষর করে কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন। উড়িষ্যায় কোন মুসলমানকে মন্ত্রীসভায় নেয়া হয়নি। মধ্য প্রদেশে জনৈক শরীফকে নেয়া হলেও পরবর্তীকালে তাঁকে সরিয়ে একজন হিন্দু নেয়া হয়।
কংগ্রেস প্রধান প্রদেশগুলোতে কোয়ালিশন সরকারের তো কোন প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু অকংগ্রেস প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসকে কোয়ালিশনে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির পথ করে দেয়া হয়। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৩৮ সালে কোলকাতা মুসলিম লীগ সম্মেলনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেন, কংগ্রেস বারবার এই বলে চাপ সৃষ্টি করছিল যে মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিমন সরকার গঠন করলে তা হবে অধিকতর স্থিতিশীল। সিন্ধুতে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের (Communal Award) বদৌলতে হিন্দুরা যে কৌশলগত সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিলেন, তার ফলে সিন্ধু আইন পরিষদে মুসলিম লীগ দল গঠনে তাঁরা বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অকংগ্রেস মন্ত্রীসভা কংগ্রেসের খপ্পরে পড়ে অপসারিত হয়।কংগ্রেস চাচ্ছিল অন্যান্য সকল দল ভেঙ্গে দিয়ে দেশের একমাত্র দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে। কংগ্রেস ‘একদেশ-একদল-এক নেতার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এ নেতৃত্ব ছিল মিঃ গান্ধীর হাতে। সখল কংগ্রেস সরকার প্রতিটি নীতি নির্ধারণে গান্ধীর শরণাপন্ন হতো এবং তাঁর নির্দেশ বেদবাক্যের মতো মেনে নিত। কোন সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হোক, গভর্ণরের সাথে কোন দ্বন্দ্ব-কলহ হোক, অথবা সাধারণ কোন নীতি পলিসি গ্রহণের বিষয় হোক, কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোর প্রধানমন্ত্রীগণ তাঁর (গান্ধীজির) শরণাপন্ন হতেন নির্দেশ-উপদেশ লাভের উদ্দেশ্যে। মিঃ গান্ধী ভাসরয়ের সাথে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনা করতেন। কিন্তু নিজেকে দেখাতেন একজন নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসাবে। কংগ্রেসের উপর তাঁর একনায়কসূলক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রকাশিত থাকলেও কংগ্রেসের সদস্য তালিকায় তাঁর নাম ছিলনা। তাঁর জনৈক গুণগ্রাহী শেঠ গোবিন্দ দাস বলেন, কংগ্রেসীদের নিকটে গান্ধীর পদমর্যাদা ছিল ফ্যাসিস্টদের নিকটে মুসোলিনির, নাৎসীদের নিকেট হিটলারের এবং কমিউনিষ্টদের নিকটে স্টালিনের পদমর্যাদার মতোই (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid p.218)
কংগ্রেসের মধ্যে সংসদীয় মানসিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে –কংগ্রেসের এ দাবী ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। কারণ কংগ্রেসী মন্ত্রীগণ না নির্বাচকমন্ডলীর কাছে, আর না আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন।তাঁরা ছিলেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বশংবদ প্রজার ন্যায়। মধ্য প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ খারের এবং কোলকাতার সুভাস চন্দ্র বোসের সাথে কংগ্রেস হাই কমান্ডের আচরণ তার একনায়কত্বই প্রমাণ করে।
সুভাস চন্দ্র বোস ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছরেও তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিদ্বতা করে যথারীতি নির্বাচিত হন। কতিপয় কংগ্রেস নেতা তাঁর পদপ্রার্থিতার বিরোধিতা করেন এবং নির্ভাচনে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। অনেকের ধারনা মিঃ গান্ধীজির পরাজয় মনে করা হয়। কংগ্রেসের কার্যকরী সংসদের সদস্যগণ একযোগে পদত্যাগ করেন। অবশেষে গান্ধীকে খুশী রাখার জন্যে কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতিকে অপসারিত করা হয়।

কংগ্রেস শাসন এবং মুসলমান
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মন্ত্রীসভার শাসন মুসলমানদের জন্যে চিল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। এসব প্রদেশে মুসলিম লীগকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠনে কংগ্রেসের অস্বীকৃতি মুসলমানদের জন্যে ছিল সাবধান বাণী। কিন্তু বাস্তবে কংগ্রেস যখন এসব প্রদেশে তাদের পরিকল্পিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করে, তখন মুসলমাগণ যা ভয় করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশী দুর্বিষহ অব্স্থার সম্মুখীন হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সভ্যতা সংস্কৃতি বিলুপ্তির চরম আশংকা দেখা দেয় এবং সামাজিক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকেও পরিকল্পিতভাতে তাদেরকে অপসারিত করার অভিযান শুরু হয়। এমনকি কংগ্রেস শাসনের অধীন তাদের জানমাল ইজ্জত আবরুও একেবারে লুণ্ঠিত হতে থাকে।
কংগ্রেস সরকার ও হিন্দু জনসাধারণের যেসব আচরণ মুসলমানদের ধর্মীয় ভাবাবেগ মারাত্মকভাবে আহত করে তা হলো –‘বন্দে মাতরাম’ সংগীত, নামাজের আজানে বাধা দান, নামাজরত অবস্থায় নামাজীদের উপর আক্রমণ, মসজিদের সম্মুখ দিয়ে বাদ্যসহ শোভাযাত্রা পরিচালনা, গরুর গোশত নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি।
আইনসভার দৈনিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রাক্কালে মুসলমানদের বাধাদাদ সত্ত্বেও অনিবার্যরূপে ‘বন্দে মাতরাম’ সংগীত গাওয়া হতো। বংকিম চন্দ্র চ্যাটার্জি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘আনন্দ মঠ’ নামজ উপন্যাসে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের রণধ্বনি হিসাবে ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত রচনা করেন। ১৯০৫ সালের পর হিন্দুদের ‘বংগভংগ রদ’ আন্দোলনে বন্দে মাতরম ‘জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়। এ গানের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা।
যেসব মুষ্টিমেয় মুসলমান সরকারী চাকুরীতে ছিলেন তাঁদের মানসম্মান ও প্রভাবপ্রতিপত্তি শুদু ক্ষুণ্ণই করা হলো না, বরঞ্চ তাঁদের চাকুরীর মেয়াদকাল হুমকির সম্মুখীন করা হলো। বহু ঘটনার মধ্যে দৃষ্টান্তস্বরূপ একটির উল্লেখ একানে করা যেতে পারে। মধ্য প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎকারে একথা বলেন যে, তাঁর মন্ত্রীসভা প্রদেশের একমাত্র মুসলমান বেসামরিক জেলা অফিসারের চাকুরী স্থায়ীকরণের বিষয়টির চরম বিরোধিতা করে। এর একমাত্র কারণ ছিল এই যে তিনি ছিলেন একজন মুসলমান।
মুসলিম জনসাধারণ তাদের হিন্দু প্রতিবেশী এবং প্রশাসনযন্ত্রের চরম স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে পড়েছিল। মধ্য প্রদেশের কোন কোন বস্তিতে মুসলমানদের ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং মুসলিম মহিলাদের ইজ্জত আবরু লুণ্ঠন করা হয়। একটি গ্রামের দেড়শ’ জন পুরুষ মুসলমানকে হত্যার অভিযোগে কয়েকদিন যাবত পানাহারের সুযোগ ব্যতীত থানায় আবদ্ধ রাখা হয়, নানাভাবে অপমানিত ও নির্যাতিত করা হয়। পরে কোর্ট তাঁদেরকে বেকসুর মুক্তি দান করে। মধ্য প্রদেশের মন্ত্রীগণ কোর্টে অভিযুক্ত মুসলমানদের বিচার চলাকালে (in sub judice cases) মতামত ব্যক্ত করতেন –যার ফলে বিচারকগণ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতেন। নাগপুর হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি মামলার রায়ে নির্ভিক চিত্তে একথা বলেন যে, পুলিশ, কংগ্রেস নেতা, ম্যাজিস্ট্রেট, হাকিম এবং মন্ত্রী একযোগে নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিমঞ্চের দিকে ঠেলে দিত। এসব হতভাগ্যদের মুসলমান হওয়অ ছাড়া আর কোন অপরাধ ছিলনা। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid p.122)
কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে মুসলমানগণ যে নানানভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিলেন, তার প্রতিকার কল্পে ২০শে মার্চ, ১৯৩৮ এ অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পীরপুরের রাজা সাইয়েদ মুহাম্মদ মাহদীকে সভাপতি করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি উক্ত বছরের ১৫ই নভেম্বর তার পূর্ণাংগ রিপোর্ট পেশ করে। ব্যক্তিগতভাবে সরেজমিনে তদন্ত করেই এ রিপোর্ট পেশ করা হয়।
পরবর্তী বছরের মার্ট মাসে শরীফ রিপোর্ট নামে আর একটি রিপোর্ট নামে আর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিহার প্রদেশে মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতনের কাহিনী বর্ণিত হয় এ রিপোর্টে। কংগ্রেস সরকারগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগপূর্ণ আর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে। এ রিপোর্টের প্রণেতা ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক।
এ তিনটি তথ্যপূর্ণ ও মূল্যবান দলিলপত্র এবং সমসাময়িক মুসলমান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাবলীর ফাইল কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলোর অগণতান্ত্রিক ও মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার বিরুদ্ধে মুসলমানদের অভিযোগের মৌলিক উপকরণ ও মালমশলা উপস্থাপন করে। যেহেতু কংগ্রেস শাসনের স্বাভাবিক মেজাজ প্রকৃতি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ধারণা-মতবাদকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল এবং অখন্ড ভারতের মতাদর্শ তেকে মুসলমাদেরকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, সেজন্যে তদন্ত রিপোর্টে উদঘাটিত তথ্যের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করার এবং তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে।

পীরপুর রিপোর্ট
পীরপুর রিপোর্টে নিম্ন বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হয়েছেঃ
১। কংগ্রেস সরকার সংখ্যালঘুদের (মুসলমানদের) ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দানে ব্যর্থ হয়েছে।
২। কংগ্রেস একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িত সংগঠন বলে প্রমাণিত।
৩। ক্ষমতামদমত্ত কংগ্রেসের রুদ্ধদ্বার নীতি (Closed door policy) অবলম্বন এবং কোয়ালিশন সরকার গঠনে অস্বীকৃতি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটিয়েছে।
৪। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদের ধারণা অনুযায়ী সংখ্যাগুরুর শাসন ও অবিচার উৎপীড়ন থেকে অধিকতর উৎপীড়ন আর কিছু হতে পারেনা।
৫। মুসলিম লীগের কাছে অত্যন্ত অবমাননাকর প্রস্তাব পেশঃ যেমন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি ভেঙ্গে দাও, আইনসভায় লীগদল ভেঙ্গে দিয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে কংগ্রেস শপথনামায় স্বাক্ষর কর, ইত্যাদি।
৬। মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গণসংযোগ আন্দোলন (Mass Contact Movement) এবং কতিপয় মুসলমানকে নানভাবে খরিদ করে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লাগানো এবং
৭। কংগ্রেস শাসনাধীন প্রদেশগুলোতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং মুসলমানদের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি।

ফজলুল হক সাহেবের বিবৃতি
কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর পদত্যাগের পর পরই বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব এ, কে, ফজলুল হক যে বিবৃতি দান করেন তা একটি প্রচারপত্রের আকারে পুনঃ প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেনঃ
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস মারমুখো হিন্দুদেরকে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের জন্যে মাঠে নামিয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর কংগ্রেস তার ইচ্ছা ও সংকল্প চাপিয়ে দেয়ার জন্যে এ কাজ শুরু করেছে। কংগ্রেস কি চায়? চায় যে, গোমাতা সংরক্ষিত হোক, মুসলমানদেরকে গোমাংস ভক্ষণ করতে দেয়া যাবেনা। মুসলমানদের ধর্মকে অবনত ও দমিত করে রাখতে হবে। কারণ এটা হিন্দুদের দেশ নয়?
তারপর শুরু হলো আযানের উপর বাধা নিষেধ। মসজিদে নামাযীদের উপর আক্রমণ। নামাযের সময়ে মসজিদের সম্মুখ দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে মিছিল পরিচালনা। দুঃখজনক ঘটনা পাল্টা দুঃখজনক ঘটনা ডেকে আনবে এতে আশ্চর্যের কি আছে?
তারপর বিবৃতিতে বিহারে সংঘটিত বাহাত্তরটি, যুক্ত প্রদেশে তেত্রিশ এবং মধ্য প্রদেশের কতকগুলি দুর্ঘটনার উল্লেখ্য করা হয়। কোন মুসলমান কোথাও একটি গরু কুবানীর জন্যে জবাই করলে মুসলমানদের হত্যা করা হয়, তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং মুসলিম নারী ও শিশুর উপর নির্যাতন চালানো হয়। এসবের কোন প্রতিকার করা হয় না। ফলে সংখ্যালঘু মুসলমানগণ বড়ো দুঃসহ জীবন যাপন করতে থাকে।
কংগ্রেস শাসনের অধীন মুসলমানদের চরদ দুর্দশা বর্ণনা করে জনাব ফজলুল হক যে বিবৃতি দেন, হিন্দু পত্রিকাগুলো তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। বরঞ্চ মুসলমানদের বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগ ফলাও করে প্রকাশ করতে থাকে। (I.H. Qureshi –The Struggle for Pakistan, A. Hamid –Muslim Separatism in India))
শিক্ষার অংগনেও মুসলমানদের উপর চরম অন্যায় অবিচার শুরু হয়েছিল যার জন্যে মুসলিম সুধীবৃন্দ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ শাসন আমলে মুসলমানগণ শিক্ষা ক্ষেত্রে খুবই পশ্চাদপদ ছিলেন যার জন্যে তাঁদেরকে নানান অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো। কংগ্রেস শাসন আমলে তাদের শিক্ষানীতি তাদেরকে দারুণভাবে শংকিত ও বিচলিত করে। ১৯৩৮ সালের শেষভাগে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিলভারত মুসলিম এডুকেশনাল কনফরেন্সে (All India Muslim Educational Confernc e) ৫২-তম অধিবেশনে নবাব কামাল ইয়ার জং বাহাদুরের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
উদ্দেশ্য ছিল ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা পুংখানুপুংখরূপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা এবং মুসলিম শিক্ষার একটি স্কীম তৈরী করা যাতে তাদের সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যাবলী সংরক্ষিত হয়। বাংলার আইন পরিষদের স্পীকার এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার স্যার আজিজুল হকের নেতৃত্বে একটি সাব কমিটি গঠিত হয়। সাব কমিটি সঠিক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থান সফর করেন এবং ১৯৪২ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। বিদ্যামন্দিরগুলোতে যে ওয়ার্ধা স্কীম অব এডুকেশন চালু করা হয়েছিল, রিপোর্টে তার তীব্র সমালোচনা করা হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশে এ এক জঘন্য আকার ধারণ করে। মুসলমানদের চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী এ আইনসভায় একটি বিল পেশ করা হয়। সকল মুসলিম সদস্য এবং ডাঃ খারে সহ কতিপয় হিন্দু সদস্য বিরোধিতা করেন। সকল বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিলটি পাশ করা হয়।
এ ব্যবস্থার অধীনে যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচিত হবে। মুসলিম স্কুলগুলোর জন্যে কোন বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মিঃ গান্ধীর প্রতিকৃতির সামনে হিন্দুদের পূজা অর্চনার ভংগীতে কৃতাঞ্জলীপুটে দাঁড়াতে হতো এবং তাঁর (মিঃ গান্ধীর) বন্দনা গাইতে হোত। এ মূল পরিকল্পনা –ওয়ার্ধা স্কীম ছিল গান্ধীমানসিকতার সৃষ্টি। শিশুদের মনে হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারা অংকিত করা এবং হিন্দু পৌরাণিক মনীষীদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার মনোভাব সৃষ্টি করা। এভাবে মুসলমানদেরকে তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও পরস্পরাগত ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই ছিল এ শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য। কংগ্রেস শিক্ষা ব্যবস্থার মূলনীতি ছাড়াও এর কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ও মুসলমানদের মদ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বোম্বে প্রদেশে স্কুলগুলোতে বহু নতুন প্রাথমিক পাঠ্য পুস্তক থেকেই পাঠ্যতালিকা তৈরী করতেন। মুসলমানদের প্রবল আপত্তি ছিল এই যে, এসব পুস্তকে হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির প্রশংসা করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র হিন্দুয়ানি শব্দমালা ব্যবহার করা হয়েছে।
বোম্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে যে, এ ধরনের প্রাথমিক পাঠ্য পুস্তক প্রণয়নের দ্বারা কংগ্রেস মুসলমানদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ রেখে এবং তাদের কচিকাঁচা মনকে হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির ভাবধারার উদ্বুদ্ধ করে ভারতে মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়।
বোম্বে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মুসলমান সদস্যগণ প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকগুলো প্রত্যাহার করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করলে তা প্রত্যখ্যান করা হয়। প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সদস্যগণ অধিবেশন থেকে ‘ওয়াক আউট’ করেন। কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর পদত্যাগের পর, উর্দু টেক্সট বুক কমিটি পুনরায় উক্ত পাঠ্য পুস্তকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তা পাঠের উপযোগী নয় বলে রিপোর্ট দেন এবং তার ফলে সেগুলো অনুমোদিত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
(Times of India, dt.11 and 26 July and 14 December, 1939)
উপমহাদেশের এগারোটির মধ্যে সাতটি প্রদেশে আড়াই বছরের কংগ্রেস শাসন একথাই প্রমাণ করে যে এখানে কংগ্রেস শাসনের অধীনে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসহ অস্তিত্বই মুছে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে মিঃ জিন্নাহ বলেন, কংগ্রেস সমগ্র উপমহাদেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যে কেউ ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়কালের ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণ করলে তিনি দেখতে পাবেন যে, কংগ্রেসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এ দেশ থেকে অন্য সকল সংগঠন নির্মূল করে একটি অতি নিকৃষ্ট ধরনের ফ্যাসিবাদী সংগঠন কায়েম করা। এমতাবস্তায় ভারতে একটি সংসদীয় সরকার পরিচালনা করা অসম্ভব। এখানে গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে হিন্দুরাজ। এ অবস্থা মুসলমানগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। [Jamiluddin Ammed (Ed) –Some Recent Speeches & Writtings of Mr. Jinnah (Lahore, 1952]
কংগ্রেস মন্ত্রীসভাগুলোর মুসলিম বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে নিরপেক্ষ মহলও মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেন যে, এখানে সংখ্যাগুরুর শাসনে মুসলমানদের আশংকা অমূলক নয়। জনৈক ভারতীয় খৃষ্টানের মতে কংগ্রেস হচ্ছে জার্মানীর নাৎসী পার্টির ভারতীয় সংস্করণ। (Rev. Pitt Banarjee –Letter of Manchester Guardian, 18 August, 1942; I.H. Qureshi –The Struggle for Pakistan)

বিভিন্ন পত্রিকার অভিমত
কংগ্রেসের সাতটি প্রদেশে সরকার গঠনের ফলে হিন্দু জাতীয়তা কেমন উগ্ররূপ ধারণ করে ও সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বৃদ্ধি পায় সে সম্পর্কে কোলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা লেখেঃ প্রত্যেক ভারতপ্রেমিক বিচলিত হবেন এই দেখে যে, প্রাদেশিক অটোনমি স্থাপিত হওয়ার দরুন কী ভয়ানক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইকনমিস্ট পত্রিকা মন্তব্য কনের, প্রদেশগুলোকে সরাসরি দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায় -মুসলিম ভারত ও কংগ্রেস ভারত। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একজন প্রাক্তন সম্পাদক বলেছিলেন, হ্নিদু মুসলিম বিরোধ কেবল ধর্মীয় কারণে নয়, জীবনধারায় দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ানক পার্থক্য রয়েছে। সংগ্রেসী প্রাদেশিক সরকারগুলো সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির নির্দেশে শাসন চালাতে থাকে। এজন্যে এমন সার্বিক কংগ্রেসী প্রতাপের অভিব্যক্তিতে বৃটেনের কংগ্রেস সমর্থকগণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। কংগ্রেসের হিন্দুকরণ নীতি, বন্দে মাতরম সংগীত ও গান্ধীর প্রতিকৃতি পূজা শিক্ষাংগনে প্রবর্তন প্রভৃতি সহজেই প্রমাণ করে যে নতুন শাসন ব্যবস্থার পুরোপুরি হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। (The British Achivement in India: A Survey, Rawlinson; p.214; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ২৮৭)
হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ অন্য কোন সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে মুসলমানদের কিছুতেই বরদাশত করতে রাজী নয়। যার কারণে ভারতে হিন্দু-মুসলিম মিলন সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে মুসলমানগণ মোটেই দায়ী নন। মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হিন্দুভারত সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে তিনি ছিলেন হিন্দু মুসলিম মিলনের অগ্রদূত? তিনি বহু বছর ধরে এ মিলনের জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিরাশ হয়ে ভারতভূমি ত্যাগ করেন এবং আর কোন দিন ভারতে আসবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু পরে তাঁকে মুসলমানের ন্যায্যা দাবী ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের লক্ষ্যে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়।
হিন্দু মুসলিম মিলন তো দূরের কথা হিন্দুদের চরম মুসলিম-বিদ্দেষের কারণে ১৯২০ সাল থেকে আট বছর সাম্প্রদায়িক দাংগায় সারা দেশ জর্জরিত হয়। ১৯২৩ সালে ১১টি, ১৯২৪ সালে ১৮টি, ১৯২৫ সালে ১৬টি, ১৯২৬ সালে ৩৫টি এবং ১৯২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩১টি বিরাট দাংগা অনুষ্ঠিত হয়। ফোর্ট নাইটলী রিভিউতে জনৈক ইংরেজ লেখেন, হিন্দু ও মুসলমানের মিলন পৃথিবীর আরও অনেক অসম্ভব জিনিসের মতো একটা অসম্ভব ব্যাপার। এশিয়াটিক রিভিউ পত্রিকায় জনৈক প্রাট্রিক ফ্যাগান লেখেন, পরাধীন ভারতের মুসলমানদের দুটি পথ খোলা আছে –হয় হিন্দু জাতিতে লীন হয়ে যাওয়া, না হয় দৈহিক শক্তি বলে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করা। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ-২৮৬)
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাংগা-হাংগামা কোন বছরই বন্ধ থাকেনি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে এসব দাংগা সংঘটিত হয়। একথাও সত্য যে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় এসব দাংগার উদ্যোক্ত এবং তারাই মূলতঃ দায়ী। কিন্তু মিঃ গান্ধী চোখ বন্ধ করে সকল ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরকে দায়ী করেছেন। ফলে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আড়াই বছরের কংগ্রেসী শাসনে যে হিন্দু রামরাজ্যের নমুনা স্থাপিত হয়েছিল এবং মুসলমানদের ভাগ্যে যে চরম দুর্দশা নেমে এসেছিল তার কিঞ্চিৎ আলোচনা উপরে করা হয়েছে। এ সময়ে, ১৯৩৮ সালে সুভাসচন্দ্র বোস কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁকে অন্যান্যের তুলনায় খানিকটা উদারচেতা মনে করা হতো। তাঁর সাতে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দীর্ঘ পত্র বিনিময় হয়। কায়েদে আজম বারবার মিঃ সুভাসচন্দ্র বোসকে একথা বলেন যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একত্রে মিলিত হয়ে সকল বিবাদ ও মতপার্থক্যের মীমাংসা করা হোক। কায়েদে আজম কংগ্রেস মুসলিম লীগ তথা হিন্দু মুসলিম মিলনের সর্বশেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু সুভাস বোস কায়েদে আজমের পত্রের জবাবে বলেনঃ
লীগের সাথে আলাপ আলোচনার ব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটির করার আর কিছু নেই। (Muslim Political Thiught the Ages 1562-1947-G.Allana Moqbul, Lahore, p-242)
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৮ সালে পাটনায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেনঃ
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ চান যে মুসলমান ভারতে হিন্দুরাজ শর্তহীনভাবে মেনে নিক। ….আপনারা অবশ্যই জানেন যে কংগ্রেস ফ্যাসিবাদী প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম সমঝোতার সকল পথ রুদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, ভারতে চারটি শক্তি ক্রিয়াশীল- (১) ব্রিটিশ, (২) ভারতীয় রাজ্যের শাসকবৃন্দ, (৩) হিন্দু এবং (৪) মুসলমান। কংগ্রেস পত্র-পত্রিকা যতোই ফলাও করে প্রকাশ করুক না কেন; দুপুরে বিকেলে ও রাতে তাদের সংস্করণ বের করুন এবং কংগ্রেস নেতারা যতোই গলাবাজি করুন যে, কংগ্রেস একটি জাতীয় সংগঠন, আমি বলি তা মোটেই সত্য নয়। এ একটা হিন্দু সংগঠন ব্যতীত কিছু নয়। এটাই সত্য কথা এবং কংগ্রেস নেতারা তা ভালো করে জানেন। এতে কয়েকজন মাত্র –কয়েকজন বিভ্রান্ত ও পতভ্রষ্ট –কয়েকজন মুসলমান খারাপ মতলবে সংশ্লিষ্ট থাকলেই তা জাতীয় সংগঠন হয় না, হতে পারে না। কংগ্রেস প্রধানতঃ একটি হিন্দু সংগঠন এবং আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি কেউ তা অস্বীকার করুক দেখি। আমি জিজ্ঞেস করি কংগ্রেস কি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে?
শ্রোতাগণ সমস্বরে জবাব দেন –না, না, না।
আমি জিজ্ঞেস করি –কংগ্রেস কি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে? তফসিলী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে? অব্রাহ্মণদের প্রতিনিধিত্ব করে? জনগণ প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে সমস্বরে বলে না, না, না।
তিনি আরও বলেন, কংগ্রেস সখল হিন্দুরাও প্রতিনিধিত্ব করেনা। হিন্দু মহাসভা-লিবারাল ফেডারেশন –এদেরও প্রতিনিধিত্ব করেনা। তবে নিঃসন্দেহে কংগ্রেস একটি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। এছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি বলেন, দেশের জন্যে দুর্ভাগ্য যে, কংগ্রেস হাইকমান্ড অন্যান্য সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি নির্মূল করে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠানর জন্যে একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
কায়েদে আজম অতঃপর একটি একটি করে কংগ্রেসের ভূমিকার উল্লেখ করে প্রমাণ করেন যে, কংগ্রেস জাতীয় সংগঠন নয়। তিনি বলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে কি করে? জাতীয়তাবাদের ভান করলেও ‘বন্দে মাতরম’ দিয়ে কাজ শুরু করে। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় সংগীত নয়।
ততাপি তা জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয় এবং অন্যান্যদের উপরও চাপিয়ে দেয়া হয়। এ শুধু তাদের দলীয় সমাবেশেই গাওয়া হয় না। বরঞ্চ সরকারী ও মিউনিসিপাল স্কুলগুলোতেও তা গাইতে সকলকে বাধ্য করা হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তা গাইতে অনুমতি দিক না দিক, ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় সংগীত হিসাবে অবশ্যই মুসলমানদের মেনে নিতে হবে। এ হচ্ছে পৌত্তলিকতা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেককারী স্তুতিগান।
তিনি বলেন, তারপর কংগ্রেস পতাকার কথাই ধরা যাক। এ ভারতের সর্বজনস্বীকৃত জাতীয় পতাকা নয়। তথাপি তার প্রতি প্রত্যেক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে এবং তা সরকারী বেসরকারী সকল গৃহে উত্তোলন করতে হবে। মুসলমানরা এ নিয়ে যতোই আপত্তি করুক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না। কংগ্রেস পতাকা ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে অবশ্যই উত্তোলন করতে হবে এবং মুসলমানদের উপর তা জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে। অতঃপর তিনি হিন্দী হিন্দুস্থানী স্কীম সম্পর্কে বলেন যে, উর্দুকে দাবিয়ে রাখা ও তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য।

ওয়ার্ধা শিক্ষা প্রকল্প
মিঃ গান্ধীর সকপোলকল্পিত ওয়ার্ধা শিক্ষা প্রকল্পের (Warda Scheme of Education) ভয়াবহ পরিণাম উপরের আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে।
কায়েদে আজন তাঁর ভাষণে বলেনঃ আজকাল হিন্দু মানসিকতা ও দৃষ্টিভংগী সতর্কতার সাথে পরিপুষ্ট করা হচ্ছে এবং মুসলমানদেরকে তাদের দৈনন্দিন জীবনে হিন্দু আদর্শ ও ভাবধারা অবলম্বনে বাধ্য করা হচ্ছে। মুসলমানরা কি কোথাও এ ধরনের কোন কিছু করছে? কোথাও কি তারা হিন্দুদের উপর মুসলিম সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে? বরঞ্চ মুসলমানদের উপর হিন্দু সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে তারা সামান্য প্রতিবাদ ধ্বনি করলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাদেরকে বলা হয় শান্তি বিনষ্টকারী এবং সঙ্গে সঙ্গেই স্বৈরাচারী সরকারী প্রশাসন যন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে পড়ে। বিহারে সংঘীটত ঘটনাবলীর কথাই ধরুন না কেন, কংগ্রেস সরকারের অধীন কাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানা হয়েছে? মুসলমানদের। কাদের বিরুদ্ধে দমননীতি অবলম্বন করা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে এবং কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে? মুসলমানদের বিরুদ্ধেই এসব কিছু করা হয়েছে। কিন্তু এমন একটি দৃষ্টান্তও কি কেউ পেশ করতে পারে যে মুসলিম লীগ অথবা কোন মুসলমান মুসলিম-সংস্কৃতি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে? (Creation of Pakistan, Justice Syed Shameem Hossain Kadir, pp.139-143)

তৃতীয় অধ্যায়
মুসলিম লীগ-কংগ্রেস আলোচনা
উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কংগ্রেসের সাথে সমঝোতায় আসার বহু চেষ্টা করা হয়। এতদুদ্দেশ্যে কংগ্রেস সভাপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের সাতে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কয়েক দফা বৈঠক হয়। কিন্তু এসব বৈঠকে কোন লাভ হয়নি। সর্বশেষ উভয় নেতার পক্ষ থেকে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়, তাতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সকল দলের নিকট গ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কল্পে যে প্রচেষ্টা চালানো হয় তা অবশেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে তাঁরা দুঃখিত।
আটত্রিশের শুরুতে জিন্নাহ-গান্ধীর মধ্যে পত্র বিনিময় হয়। উভয় দলের মধ্যে যে মৌলিক মতপার্থক্য ছিল, তা এ পত্র বিনিময়ের দ্বারা সুস্পষ্ট হয়। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তেসরা মার্চ ১৯৩৮ মিঃ গান্ধীর নিকটে যে পত্র লেখেন, তাতে দুটি বাক্যে তিনি তাঁর আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মুসলিম লীগকে ভারতের মুসলমানদের একমাত্র নির্ভরশীল ও প্রতিনিধি মূলক দল হিসাবে মেনে নিন এবং অপর দিকে আপনি কংগ্রেস ও সারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করুন। একমাত্র এর ভিত্তিতে আমরা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারি এবং অগ্রগতির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে পারি। জবাবে মিঃ গান্ধী ৮ই মার্চ বলেন, যে অর্তে আপনি বলেছেন, সে অর্থে আমি কংগ্রেস অথবা হিন্দু কোনটারই প্রতিনিধিত্ব করি না। তবে সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছার জন্যে আমি হিন্দুদের প্রতি আমার নৈতিক প্রভাব খাটাব। (The full Text of Jinnah-Gandhiletters in Durlab Singh, pp.16-32. The Struggle for Pakistan- I.H Quershi, p.109)
মিঃ গান্ধীর উপরোক্ত জবাবে কোন সত্যতা ও আন্তরিকতা ছিলনা। কোন একটি সংগঠনের ঘোষিত নীতি-পলিসি যাই হোক না কেন, তার সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায় তার বাস্তব কার্যকলাপ ও আচার আচরণে। কংগ্রেস যে পরিপূর্ণ একটি হিন্দু সংগঠন ছিল তা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। কংগ্রেসের আচার আচরণে সর্বদা হিন্দু চেতনা ও স্বার্থেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ভারতে খেলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের সহযোগিতার কারণে কারো মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সে সহযোগিতায় তোস আন্তরিকতা ছিলনা। তাতে দুরভিসন্ধিই লুকায়িত ছিল, গান্ধীজির নিজের উক্তিই তার প্রমাণ। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, খেলাফত আমাদের দুজনের নিকট কেন্দ্রীয় বিষয় –মুহাম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম। আর আমার নিকট হচ্ছে খেলাফতের জন্যে জীবনপাত করে আমি গো-নিরাপত্তা নিঃসংশয় করছি। অর্থাৎ Jinnah & Gandh, p.61; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ-পৃঃ ১৬৮)
নিজউ ক্রনিকল-এর প্রতিনিধির কাছে মিঃ গান্ধী বলেন, এখানে একটি মাত্র দল আছে যা উন্নতি ও কল্যাণ করতে পারে। আর তা হলো কংগ্রেস। কংগ্রেস ব্যতীত আর অন্য কোন দল আমি মেনে নিতে রাজী না।
তিনি আরো বলেন, যে কোন মন্দ নামেই ডাকুক, ভারতে একটি মাত্র দল আছে এবং তা হলো কংগ্রেস। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid, p.217)
কায়েদে আজম পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর সাথেও পত্র বিনিময় করেন। উল্লেখ্য যে, প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর নির্বাচনের পর পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন, দেশে মাত্র দুটি দল আছে –কংগ্রেস এবং সরকার। আর যারা আছে তাদেরকে অবশ্যই কংগ্রেসের কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যারা আমাদের সাথে নেই, তারা আমাদের বিরোধী। (Muslim Separatism in India, Abdul Hamid, p.217)
জওহরলাল নেহরুর ফ্যাসীবাদী মনমানসিকতা জানা সত্ত্বেও কায়েদে আজম উভয় দলের মধ্যে একটা আপোষ নিষ্পত্তির জন্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পন্ডিত নেহরু ৬ই এপ্রিল (১৯৩৮) তারিখে লিকিত দীর্ঘ পত্রে কায়েদে আজমের সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস ‘বন্দে মাতরম’ সংগীত ত্যাগ করতে রাজী নয়। কারণ একটা জাতীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কিছু করা সংগত হবে না। কংগ্রেস পতাকা ব্যবহারেও তো কারো কোন আপত্তি দেখিনা। মুসলিম লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সংগঠন বিধায় তার সাথে আমরা সে ধরনের আচরণই করি। অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলোকেও উপেক্ষা করা যায় না। অতএব মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র সংগঠন হিসাবে স্বীকার করার প্রশ্নই ওঠেনা।
পত্রে তিনি আরও বলেন, কংগ্রেস উর্দুকে খর্ব করার কোন চেষ্টা করছে, অথবা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তা আমার জানা নেই। কে এসব করছে? তিনি আরও বলেন, কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা বলতে কি বুঝায় তা আমার জানা নেই।
তাঁর কথায় সহজ সরল অর্থ এই যে, প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগ অথবা অন্য কোন দলের সাথে ক্ষমতার অংশীদরিত্বে কংগ্রেস কিছুতেই রাজি নয়, এ কথায় সে অটল। পত্রের শেষে নেহরু বলেন, কোন চুক্তি বা সমঝোতা এবং এ ধরনের কোন কিছু ব্যক্তিগতভাবে আমি পছন্দ করি না।
সুভাসচন্দ্র বোস ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধী-নেহরুর সাথে পত্রালাপে ব্যর্থতার পর কায়েদে আজম সুভাস বোসের সাথে পত্র বিনিময় করেন। মে মাসে কায়েদে আজম মিঃ বোসের লিখিত পত্র আলেচনার জন্যে মুসলিম লীগ কার্যকরী পরিষদে পেশ করেন। এর উপর যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে বলা হয় যে, হিন্দু মুসলিম মতবিরোধের মীমাংসা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কংগ্রেসের সাথে কোন আলোচনা করতে মুসলিম লীগ রাজি নয় যতোক্ষণ না মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের আস্থাভাজন এবং প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসাবে মেনে নেয়া হবে। তদনুযায়ী কায়েদে আজম মিঃ বোসের নিকটে দুসরা আগষ্ট লিখিত পত্রে বলেন,
লাখনোতে ১৯১৬ সালে যে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের আস্থাভাজন ও প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসাবে মেনে নেয়া হয়। সে সময় থেকে ১৯৩৫ সালে জিন্নাহ-রাজেন্দ্রপ্রসাদ আলোচনা পর্যন্ত এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যেসব মুসলমান কংগ্রেসে আছে, তাঁরা ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনা। মুসলিম লীগের এ কথাও জানা নেই যে, কোন মুসলিম রাজনৈতিক দল ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের দাবী করেছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এর এক বিস্ময়কর জবাব আসে। অর্থাৎ মুসলিম লীগের কোন দাবীই কংগ্রেস মানতে রারিজ নয়। (The Struggle for Pakistan, I.H. Qureshi, pp.107-112)
কংগ্রেস-মুসলিম লীগের আলাপ আলোচনা ও পত্র বিনিময়ের ফলে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যা অতি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমতঃ কংগ্রেসী মন্ত্রীসভাগুলোর বিরুদ্ধে অত্যাচার অবিচারের অভিযোগ কংগ্রেস অস্বীকার করে। দ্বিতীয়তঃ কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম সমস্যাকে কোন সমস্যাই মনে করেনা। তার মতে এ এক সাময়িক ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস। সময়ের পরিবর্তনে তা বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত হবে। তৃতীয়তঃ কংগ্রেসের দাবী এই যে, তা সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। কংগ্রেসন একমাত্র অকৃত্রিম জাতীয় সংগঠন যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতিনিধিত্ব করে। অনেক মুসলিম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে সমর্থণ করে। শুধুমাত্র মুসলিম লীগ দূরে অবস্থার করছে। আর কত দিন তারা এভাবে থাকবে? হয়তো সত্বরই কংগ্রেসের সাথে ভিড়ে যাবে। অতএব মুসলিম লীগের দাবীর প্রতি গুরুত্বদানের প্রয়োজন কি?
কংগ্রেসের উপরোক্ত দৃষ্টিভংগী মুসলিম লীগের মধ্যে স্বভাবতঃই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং মুসলিম লীগকে ঐক্যবদ্ধ, সংহত ও শক্তিশালী করে। এ দীর্ঘ আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয় যে কংগ্রেস হিন্দু ভারতের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে দাবিয়ে রাখাই শুধু তার উদ্দেশ্য নয়, তাদেরকে নির্মূল করাও তার উদ্দেশ্য। বাল গংগাধর তিলকের আন্দোলন, স্বামী শ্রদ্ধানন্দের শুদ্ধি আন্দোলন, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসনভার রাজনৈতিক দর্শনের একই লক্ষ্য ছিল এবং তা হলো মুসলমানদেরকে দমিত ও বশীভূত করে রাখা অথবা নির্মূল করে হিন্দু রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
উল্লেখ্য ১৯০৬ সালে বংগভংগ রদ আন্দোলন চলাকালীন সারা ভঅরতে হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ‘শিবাজী উৎসব’ পালন করা হয়। সকল হিন্দু সমাজ নেতা, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাব্রতী এ উৎসবে সানন্দে যোগদান করেন। এ উপলক্ষে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিবাজী উৎসব’ লিখে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন কর্মে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেন এবং ‘শুভশঙ্খনাদে জয়তু শিবাজী’ উচ্চারণ করে এ ধ্যানমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেনঃ
ধ্বজা ধরি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-
দরিদ্রের বল।
এক ধর্মরাজ্য হবে ‘এ ভারতে’ এ মহাবচন
করিব সম্বল।

রাজনীতি ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন অংগাংগীরূপে মিশে গেল। ধর্মীয় বোধের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় রাজনীতিকে গণআন্দোলনে রূপায়িত করার চেষ্টা হলো।
(B.B. Misra The Indian Class Their Giowth). আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেল আগে ‘দি টাইমসের’ সংবাদদাতা স্যার ভ্যালেন্টাইন চিরলকে তাঁর এক মুসলমান বন্ধু বলেন, তিলক, তাঁর অনুসারিগণ এবং পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদীগণকে প্রকাশ্যে বলাবলি করতে শুনা যায় যে, অতীতে স্পেন থেকে যেভাবে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হয়, ঠিক তেমনি ভারত থেকে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করা হবে। স্যার ওয়াণ্টার লরেন্সও অনুরূপ কথা বলেন। তিনি ছিলেন ভাইসরয় কার্জনের স্টাফ সদস্য। তিনি ইদোরের মহারাজা স্যার প্রতাপ সিংকেও অনুরূপ মনোভাব ব্যক্ত করতে শুনেন। তিনি বলেনঃ তিনি পূর্বে তাঁর এ ঘৃণার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারিনি। লর্ড কার্জন আমার এবং আমার স্ত্রীর সম্মানে শিমলার আগমন করেন। ডিনার দিয়েছিলেন তাতে যোগদানের জন্যে স্যার প্রতাপও শিমলা আগমন করেন। ডিনার শেষে স্যার প্রতাপ রাত দুটো পর্যন্ত তাঁর আশাআকাংখা ও অভিলাষ সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। তাঁর অভিলাষের মধ্যে একটি হলো ভারতে বুক থেকে মুসলমাদেরকে নির্মূল করা।
...তিনি ভালো ইংরেজী জানতেন, বহু জাতির সাথে মিশেছেন, ছিলেন বিশ্বজনীন সভ্যতার বিশ্বাসী। কিন্তু তাঁর মহৎ হৃদয়ের তলায় চিল মুসলমানদের জন্যে দুরপনৈয় ঘৃণা।
(Sir Walter Lawrence: The India We Served, p.209; Abdul Hamid: Muslim Separatism in India, pp.83-84)
নিরপেক্ষ মন নিয়ে যিনিই উপমহাদেশের হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের চুলচেরা বিশ্লেষণে সক্ষম হয়েছেন, তাঁর কাছে মুসলমানদের সম্পর্কে উক্ত হিন্দু মানসিকতাই ধরা পড়েছে। তাই এশিয়াটিক রিভিউ পত্রিকায় প্যাট্রিক ফ্যাগান তাঁর এক লিখিত প্রবন্ধে বলেন, পরাধীন ভারতে মুসলমানের দুটি মাত্র পথ খোলা আছে, একটি হিন্দু তাতিতে লীন হয়ে যাওয়া অন্যটি দৈহিক শক্তি বলে ভারতের কোন কোন অঞ্চলে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সৃষ্টি করা। অবশেষে ভারতের দশ কোটি মুসলমানের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ সংগ্রাব ব্যতীত উপায়ান্তর রইলোনা।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি