ত্রয়োদশ অধ্যায়
গণপরিষদ
জুলাই ১৯৪৬-এর শেষে গণপরিষদের ২৯৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। নয়টি আসন ব্যতীত সকল সাধারণ আসনে কংগ্রেস জয়ী হয় এবং পাঁচটি আসন ব্যতীত সকল মুসলিম আসনে লীগ জয়ী হয় এবং পাঁচটি আসন ব্যতীত সকল মুসলিম আসনে লীগ জয়ী হয়। গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৬ হওয়ার কথা। কিন্তু লীগ এতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি একে বৈধ বলে স্বীকার করতে রাজী না যতোক্ষণ না কেবিনেট মিশনের ১৬ই মে’র বিবৃতির ১৯ অনুচ্ছেদের মুসলিম লীগ কর্তৃক ব্যাখ্যা কংগ্রেস মেনে নিয়েছে। এ ব্যাখ্যা মেনে নেয়ার জন্য ভাইসরয় কংগ্রেসকে অনুরোধ করেন। এ অনুরোধের পুরস্কার এভাবে দেয়া হলো যে গান্ধী ও নেহরু বাইসরয়কে অপসারণের জন্যে বৃটিশ সরকারের নিকটে তারবার্তা ও পত্র প্রেরণ করেন। উপায়ান্তর না দেখে ভাইসরয় কেবিনেট মিশন পরিকল্পনার অধীন গণপরিষদে যোগদানের জন্য ২০ শে নবেম্বর আমন্ত্রণ জানান। সংগে সংগেই জিন্নাহ এটাকে মারাত্মক ধরনের ভুল পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ভাইসরয় ভয়ংকর পরিস্থিতি ও তার বাস্তবতা উলব্ধি করতে ব্যর্থ হন এবং কংগ্রেসকে খুশী করার চেষ্টা করছেন। ৯ই ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে কোন লীগ প্রতিনিধি যোগদান করেন নি।
এরূপ পরিস্থিতিতে শেষ চেষ্টা করার উদ্দেশ্যে বৃটিশ সরকার দুজন কংগ্রেস এবং দুজন লীগ নেতাকে লন্ডন আমন্ত্রণ জানান। ভাইসরয়ের পরামর্শক্রমে একজন শিখ প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানান হয়।
দুসরা ডিসেম্বর ১৯৮৭ লর্ড ওয়াভেল নেহরু জিন্নাহ লিয়াকত আলী খান এবং বলদেব সিং সহ লন্ডন যাত্রা করেন। চারদিন যাবত আলাপ আলোচনা চলে।
কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্য কেবিনেট মিশনের ১৬ই মে’র বিবৃতির ব্যাখ্যা নিয়ে অর্থাৎ প্রদেশগুলোর গ্রুপিং নিয়ে। কেবিনেট মিশন স্বয়ং সে ব্যাখ্যাই করে যা মুসলিম লীগের ব্যাখ্যা। কিন্তু নেহরু এ ব্যাখ্যা কিছুতেই মেনে নিতে রাজী হন না। চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
কংগ্রেসের একগুঁয়েমি ও হঠকারিতার কারণে কোন আপোস মীমাংসা না হওয়ায় ৬ই ডিসেম্বর বৃটিশ সরকার এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সর্বসম্মত কার্যধারার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত ব্যতীত গণপরিষদের সাফল্য আশা করা যায় না। গণপরিষদ যদি এমন কোন সংবিধান রচনা করে যার রচনাকালে ভারতবাসীর বিরাট সংখ্যক লোকের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই, তাহলে বৃটিশ সরকার এ ধরনের কোন সংবিধান অনিচ্ছুক জনগোষ্ঠীর উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিতে পারেনা।
সরকারের উপরোক্ত বিবৃতি এবং কেবিনেট মিশনের ২৫শে মে’র বিবৃতি কংগ্রেসের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। নেহরু ও বলদেব সিং গণপরিষদে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী আরও কিছুদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। লন্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিন্নাহ বলেন, কংগ্রেস যদি ১৬ মে প্রকাশিত বিবৃতির বৃটিশ সরকারের ব্যাখ্যা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মেনে নেয়, তাহলে লীগ কাউন্সিলকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাব। লন্ডনের এক বক্তৃতায় জিন্নাহ দেখিয়ে দেন যে পাকিস্তানের জনসংখ্যা পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রের জনসংখ্যা অপেক্ষা অধিক। আমরা ভারতের তিন চুতর্থাংশের উপর কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিচ্ছি। পাকিস্তান মেনে নিতে কংগ্রেসের আপত্তি এ জন্যে যে তারা সমগ্র ভারত চায়। তাহলে আমরা আর থাকি কোথায়? এখন সমস্যা এই যে, বৃটিশ সরকার কি তাদের বেয়নেটের বলে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠেত কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান? তা যদি হয় তাহলে বলব তোরা তোমাদের মানসম্ভ্রম, ন্যায়পরতা ও সুবিচার ও সাধু আচরনের সর্বশেষ কণাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। [Some Recent Writings of Mr. Jinnah, Vol 2-ed. By Jamiluddin Ahmad, (Lahore, Muhammad Ashraf 1947) –pp.496-508; Chowdhury Mohammad Ali The Emergence of Pakistan, pp.91-92)।
একদিকে ভারতে কংগ্রেস তীব্র কণ্ঠে দাবী করতে থাকে যে লীগ গণপরিষদে যোগদান না করলে তাদেরকে অন্তবর্তী সরকার থেকে বহিস্কার করা হোক, অপরদিকে বৃটিশ সরকারের ৬ই ডিসেম্বরের ঘোষণা অদূর ভবিষ্যতে এক নতুন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ইংগিত বহন করে।
কেবিটেন মিষন সেক্রেটারিয়েটের সাথে সংশ্লিষ্ট ই, ডব্লিউ, আর লুম্বী বলেন, বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম ঘোষণা যে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিহার করা হবে। ক্রিপস প্রস্তাবের পর এটাই ছিল প্রথম সরকারী ঘোষণা যার মধ্যে কোন না কোন প্রকারে পাকিস্তানের ইংগি আভার ছিল। হাউস অব কমন্সে ভাষণ দানকালে ক্রিপস সরকারী ঘোষণার শেষ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, গণপরিষদে যোগদানের জন্যে লীগকে যদি সম্মত করা না যায়, তাহলে দেশের যে সব অঞ্চলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুুলোকে কোন সিদ্ধান্ত দ্বারা বাধ্য করা যাবেনা। (E.W.R. Lumby, op.cit, p.129; I.H. Wuershi The Struggle for Pakistan, pp.184-
এখন একটা প্রশ্ন রহইলো এবং তা এই যে কংগ্রেস লীগকে সরকার থেকে বহিস্কার করে দেয়ার দাবীতে এতো অনমনীয় কেন। এর কারণ কয়েকটি। অন্তর্বর্তী সরকারকে কংগ্রেস জাতীয় সরকার বলে অভিহিত করতো এবং এর দায়িত্ব ছিল সামষ্টিক। নেহরুকে এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনে রকা হতো। বৃটেনেও কংগ্রেসপন্থী ও বামপন্থী প্রেসগুলো একই সুরে একই গীত গাইতো। যেমন, দি নিউ স্টেটস ম্যান –এ সরকারকে সামষ্টিক দায়িত্বসম্পন্ন একটি কেবিনেট বলে অভিহিত করে যার প্রধানমন্ত্রী নেহরু –(7 September 1946)। ভারতে মাউন্ট ব্যাটেনের চীফ অব ষ্টাফ লর্ড ইসমে নেহরুকে ডেপুটি প্রাইম মিনিষ্টার বলে উল্লেখ করেন –(The Memories of General the Lord Ismay, London, 1960,p.418)। তার উক্তি ছিল অত্যন্ত হাস্যকর। কারণ নেহরুD y. Prime Minister হলে ভাইসরয় কি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন?
লীগ কাউন্সিলারগণ নেহরুকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন একনকি নন-লীগ ব্লকের প্রধানও না। জিন্নাহ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ভাইসরয়ের একজেকিউটিভ কাউন্সিল ব্যতীত আর কিছু ছিলনা। রাজনৈতিক দিক দিয়ে এটাকে পুনর্গঠিত করা হয়। ভাইসরয় তার বিশেষ ক্ষমতাসহ ছিলেন এর প্রধান। নেহরু শুধুমাত্র কাউন্সিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার কাজ ছিল ভাইসরয়ের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র সভাপতিত্ব করা। কাউন্সিলারদের অধিক কোন ক্ষমতা ও মর্যাদা তাঁর ছিলনা।
এতে নেহরুর অহমিকা ক্ষতবিক্ষত হয় যার জন্যে লীগকে বহিস্কারের অন্যায় আবদার করতে থাকেন। (I.H.Quershi: The Struggle for Pakistan, pp.282-283)।

চতুর্দশ অধ্যায়
মাউন্টব্যাটেন মিশন
নতুন বছর, ১৯৪৭-এর প্রারম্ভে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে কেন্দ্রে একটি অন্তবর্তী সরকার অথবা ভাইসরয়ের একজেকিউটিভ কাউন্সিল রয়েছে যেখানে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বিরাট মতপার্থক্যসহ অবস্থান করছে। ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৬ থেকে গণপরিষদের অধিবেশন চলছে যা লীগ বয়কট করে চলেছে। তার ফলে কংগ্রেস লীগকে ভাইসরয়ের কাউন্সিল থেকে বহিস্কারের দাবী জানাচ্ছে। ১৩ই ফেব্রুয়ারী নেহরু ভাইসরয়কে পত্র দ্বারা লীগকে বহিস্কারের দাবী জানান। ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্যাটেল হুমকি প্রদর্শন করে বলেন, লীগ সরকার থেকে বেরিয়ে না গেলে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার ত্যাগ করবে। (The Indian Annual Register 1847, vol,1 p.35; I.H. Quershi The Struggle for Pakistan; p.287)।
এরূপ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ২০শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭ প্রধানমন্ত্রী এটলী একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি আর দীর্ঘায়িত হতে দেয়া যায় না। বৃটিশ সরকার পরিস্কার বলে দিতে চান যে, জুন মাসের ভেতরেই দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করবে। পূর্ণ প্রতিনিধিত্বশীল গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মত শাসনতন্ত্র এ সময়ের মধ্যে প্রণীত না হলে, সরকার বিবেচনা করবে বৃটিশ ভারতে ক্ষমতা কার কাছে যথাসময়ে হস্তান্তর করা হবে –বৃটিম ভারতে কোন ধরনের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অথবা বর্তমান কোন উপায়ে যা অত্যন্ত যুক্তিসংগত বিবেচিত হবে এবং যা ভারতীয় জনগণের স্বার্থের অনুকূল হবে।
বিবৃতির শেষে এ কথাও ঘোষনা করা হয় যে ওয়াভেলের স্থলে এডমিরাল দি ভাইকাউন্ট ম্যাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করা হচ্ছে।
চারদিন পর ভারত সচিব হাউস অব লর্ডস –এ ঘোষণা করেন যে, এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ভারতের দায়িত্বশীল মহলের পরামর্শে। আর উদ্দেশ্য ছিল একটি চাপ সৃষ্টি করা যাতে ভারতীয় দলগুলো একটা সমঝোতায় পৌঁছে।
এখানে ভারতের দায়িত্বশীল মহল বলতে যে গান্ধী নেহরুকে বুঝানো হয়েছে এবং সমঝোতা বলতে কংগ্রেসের দাবী লীগকে মেনে নেয়া বুঝানো হয়েছে তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
ভারতের রাজনৈতিক চরম মুহুর্তে লর্ড ওয়াভেলকে কেন অপসারণ করা হলো তা জানার ঔৎসুক্য পাঠকবর্গের অবশ্যই থাকতে পারে। কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল একটী যতো কথাই বলুন, কংগ্রেসকে বিশেষ করে গান্ধী ও নেহরুকে খুশী করার জন্যই যে ওয়াভেলের শাস্তি হলো, কতিপয় ঘটনা তার সাক্ষ্য বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী ও তাঁর কেবিনেটের সাথে লর্ড ওয়াভেলের কি কোন চরম মতপার্থক্য হয়েছিল যার মূল্য ওয়াভেলকে দিতে হয়? এর কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এর কারণ অন্য কিছু। তাই অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
উল্লেখ্য যে লর্ড ওয়াবেল প্রথমে কংগ্রেসের অতি প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৬ এর জুনে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে চাইলে ওয়াভেল বাধা দেন। পরে আবার তিনি কংগ্রেসকে সরকার গঠনের অনুমতি দেন লীগকে বাদ দিয়েই। পূর্বে তিনি বেশ দৃঢ়তার সাথে এ কথা বলেন যে ভারতের ভৌগলিক ঐক্য বা অখন্ডতা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যার জন্য লীগ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরবর্তীকালে ভাইসরয়-কংগ্রেস সম্পর্কে উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। কোলকাতার রক্তক্ষয়ী দাংগারপর কংগ্রেস ভাইসরয়কে বলেছিল, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদত্ত অধিকার ক্ষুণ্ণ করে হলেও বাংলার লীগ মন্ত্রীসভা ভেঙে দিতে। ভাইসরয় তাদে রাজী হননি। এর ফলে তিনি কংগ্রেসের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। তারপর লীগ কাউন্সিলারদেরকে ভাইসরয়ের Executive Council থেকে বহিষ্কার করার বার বার দাবী জানানোরপরও যখন ভাইসরয় তা মানতে অস্বীকার করলেন তখন সম্পর্কে ভাঙন চূড়ান্তে পৌঁছলো। তারপর ভাইসরয়কে অপসারণের জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে গান্ধীর তারবার্তা ও পত্রাদি প্রেরণ এবং একই উদ্দেশ্যে বৃটেনে নেহরুর বন্ধুবান্ধবকে তাঁর পত্র প্রেরণ; ভারত সচিব এ সবকেই বলেছেন ‘ভারতের দায়িত্বশীল মহলের পরামর্শে’। ওয়াভেলের অপসারণে এবং মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয় হিসাবে ভারত আগমনে নেহরু অত্যন্ত আনন্দিত হন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ২২শে মার্চ দিল্লী পৌঁছেন। তায়র নিয়োগ কংগ্রেসকে উল্লসিত করে। পূর্ব থেকেই নেহরুর সাথে তার সম্পর্ক ছিল। ভারতে তিনি কোন অপরিচিত লোক ছিলেন না। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিত্র বাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার। সে কারণে তাঁকে বার বার ভারতে আসতে হতো যা ছিল যুদ্ধের অপারেশন বেস (Base for operation)। দুবচল পূর্বে মালয়ে নেহরুর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁরা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে তিনি যে কংগ্রেস ভক্ত ছিলেন তা জানা যায়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা লর্ড ইসমে ভয় করছিলেন যে –মাউন্টব্যাটেনকে হিন্দুভক্ত এবং মুসলিম লীগ বিদ্বেষী হিসাবে গ্রহণ করা হবে। (Cempbell-Johnson, Allan: Mission with Mountbatten, p.23; Abdul Hamid Muslim Separatism in India, p.239)।
নিয়মমাফিক ভাইসরয় স্টাফের অতিরিক্ত একটি ব্যক্তিগত সেক্রেটারিয়েট গঠনের অনুমতি মাউন্টব্যাটেনকে দেয়া হয়। সেটা চিল তাঁর ‘কিচেন কেবিনেট’। তাঁর সাফল্যের মূলে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন ভি.পি. মেনন। ভাইসরয় তাঁকে তাঁর নীতিনির্ধারণী পরিমন্ডলে টেনে এনেছিলেন। ভদ্রলোক ১৯৪২ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সাংবিধানিক পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করে আসছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক যোগ্যতার সাথে রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তিনি ছিলেন প্যাটেলের শরণাগত। তাঁর নিজের লিখিত গ্রন্থ The Transfer fo Power, Calcutta, 1957’ পাঠে পরিস্কার জানা যায় যে তিনি ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সেক্রেটারিয়েট সংশ্লিষ্ট হওয়ার পূর্বেও সর্বদা লীগের বিরুদ্ধেই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এখন তিনি শাসনদন্ডের পেছনে এক বিরাট শক্তি হয়ে পড়লেন।
-(Abdul Hamid Muslim Separatism in India, p.239)।
মাউন্টব্যাটেন ইংলন্ড থেকে সযত্নে ও সাবধানতা সহকারে তাঁর স্টাফের লোক বেছে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লর্ড ইসমে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চার্চিলের ব্যক্তিগত সাধারণ উপদেষ্টা ছিলেন। আরও ছিলেন এরিক সিভিল, লর্ড উইনিংডনের প্রাক্তন প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং ৬ষ্ঠ জর্জের এসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারী, এ দুজন ছিলেন ভাইসরয়ের সাধারণ ও বেসামরিক দিকের প্রধান উপদেষ্টা এবং লর্ড ইসমে ছিলেন চীফ অব স্টাফ। ভি, পি, মেনন ছিলেন সাংবিধানিক পরামর্শদাতা। প্রায়ই স্টাফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। প্রথমতঃ মাঝে মাঝে মেননকে বৈঠকে ডাকা হতো। পরে প্রত্যেক বৈঠকে তাঁকে ডাকা হতো। ভাইসরয় এবং অন্যান্য সকলের জানা ছিল যে মেনন ছিলেন সকল প্যাটেলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। এর ফলে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আভ্যন্তরীণ সকল গোপন তথ্যই শুধু প্যাটেল জানতেন না, বরঞ্চ তাঁর এ মুখপাত্রকে দিয়ে তিনি ভাইসরয়ের পলিসি প্রভাবিত করতেন। মেননের স্থলে কোন মুসলমান যদি হতেন এবং তিনি জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন, তাহলে ভাইসরয় এবং কংগ্রেস কারো পক্ষ থেকেই তাঁকে বরদাশত করা হতোনা। এঁদের নিকটে মুসলিম লীগ তথা ভারতের মুসলমান সুবিচার আশা করতে পারতো কি?

তেসরা জুন পরিকল্পনার ক্রমবিকাশ
কেবিটেন মিশন পরিকল্পনার ভিত্তিতে অখন্ড ভারতের জন্য সর্বসম্মত সমাধান প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে ভাইসরয় নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বারতে পৌঁছার পর ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভংগী লক্ষ্য করার পর সর্বসম্মত সমাধান এবং অখন্ড ভারতো কোন সম্ভাবনা দেখা যায় না। অতএব প্রধানমন্ত্রীর ২০শে ফেব্রুয়ারীর ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পনা তৈরীর প্রতি ভাইসরয় মনোনিবেশ করেন।
তিনি তাঁর পরামর্শদাতাগণের সাথে পরামর্শের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। তার ভিত্তি হলো প্রদেশগুলোর হাতে, অথবা সেসব প্রদেশগুলোর কনফেডারেশনের হাতে যারা বাস্তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে দলবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত করবে –তাদের হাতে ক্ষমতা ও অধিকার হস্তান্তর করা হবে। ১ই এপ্রিল ইসমে পরিকল্পনার খসড়া মেননকে দেন তার সংশোধনীসহ সময়সূচী তৈরীর জন্য। মেনন আদেশ পালন করেন এবং সেই সাথে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, এ একটি মন্দ পরিকল্পনা এবং এ কার্যকর হবে না। গভর্ণরদের সম্মেলনে চূড়ান্ত পরিকল্পনা পেশ করা হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। দুসরা মে লর্ড ইসমে এবং জর্জ এবেল হোয়াইট হলের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনাটি নিয়ে লন্ডনে রওয়ানা হন। ভাইসরয়ে আশা করছিলেন যে ১০ই মের ভেতরে অনুমোদন পেয়ে যাবেন এবং ১৭ই মে দলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য একত্রে মিলিত হওয়ার আবেদন জানাবেন।
অতঃপর মাউন্টব্যাটেন স্যার এরিক সিভিল ও মেননসহ শিশলা গমন করেন। এখানে মেনন ভাইসরয়ের সাথে নিরিবিল কথা বলার সুযোগ পান এবং লন্ডনে প্রেরিত পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, এ কার্যকর হবেনা। মেননের সকল যুক্তি শুনার পূর্বে হঠাৎ নেহরু এবং কৃষ্ণ মেনন ভাইসরয়ের সাথে থাকার জন্য ৮ই মে শিমলা পৌঁছেন। ভাইসরয় মেননকে নেহরুর সাথে কথা বলতে বলেন। ৯ইমে মেনন নেহরুকে বলেন, ডমিনিয়ন স্টেটাসের ভিত্তিতে ক্ষমতা দুটি ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে –প্রদেশগুলো তা তাদের কনফেডারেশনের কাছে নয়। ১০ই মে ভাইসরয় নেহরু, মেনন ও স্যার এরিক সিভিলকে নিয়ে পরিকল্পনাটির উপর আলোচনা করেন যা কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ভারত সরকারের রেকর্ডের অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়।
ঐদিনই লন্ডন থেকে অনুমোদিত পরিকল্পনা ভাইসরের হস্তাগত হয় অবশ্য কিছু সংশোধনীসহ। ডিনারের পর ভাইসরয়ে নেহরুকে ডেকে পরিকল্পনাটি দেখান যা অনুমোদিত হয়ে এসেছে। পরিকল্পনাটি পড়ার পর নেহেরু ভয়ানক রেগে গিয়ে বলেন, আমি, কংগ্রেস এবং ভারত –কারো কছেই এ গ্রহণযোগ্য নয়।
মাউন্টব্যাটেন ১১ই মে মেননকে ডেকে নেহরুর প্রতিক্রিয়া তাঁকে জানান এবং বলেন যে এখন কি করা যায়। মেনন বলেন, ৯ই এবং ১০ই মে আমার যে পরিকল্পনা কার্যকর করার ফলে দেশ বহু ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং আমার পরিকল্পনা ভারতের অত্যাবশ্যক ঐক্য বজায় রাখবে। আর যেসব অঞ্চল ভারতের অংশ হিসাবে থাকতে ইচ্ছুক নয় তাদেরকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে।
তড়িঘড়ি স্টাফ মিটিং আহবান করা হয় এবং নেহরুকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভাইসরয় নেহরুকে জিজ্ঞাস করেন যে মেননের পরিকল্পনা তিনি অনুমোদন করেন কিনা। তা দেখার পর নেহরু অনুমোদন করেন।
অতঃপর ভাইসরয় ১৪ই মে দিল্লী প্রত্যাবর্তণ করেন এবং ১৮ই মে লন্ডন যাত্রা করেন পরিকল্পনাটি অনুমোদনের উদ্দেশ্যে কেবিনেটকে সম্মত করার জন্য। লর্ড ইসমে এবং জর্জ এবেল মেননের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। ভাইসরয় জোর দিয়ে বলেন, বৃটিশ সরকার এ পরিকল্পনা অনুমোদন না করলে আমি পদত্যাগ করব। কেবিনেট পরিকল্পনাটির একটি ‘কমা’ পর্যন্ত পরিবর্তন না করে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুমোদন করেন। ভাইসরয় বিজয়ীর বেশে ৩১ মে তাঁর দলসহ ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।
এখন এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, যে পরিকল্পনাটি ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ত্বরান্বিত করে এশিয়া ও পৃথিবীর মানটিত্রে একটি পরিবর্তন সূচিত করতে যাচ্ছে, তা তৈরী হলো ভাইসরয়ের একজন কংগ্রেসভক্ত হিন্দু উপদেষ্টার দ্বারা এবং নেহরু ও কৃষ্ণ মেননের সহযোগিতায়। দেশ ও দেশেল কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের এ পরিকল্পনা নিয়ে ভাইসরয় একমান যাবত তাঁর মুষ্টিমেয় প্রিয়জন নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন, কিন্তু তার কোন এক পর্যায়ে একটি বারের জন্য্যও জিন্নাহকে ডাকা হলোনা। এর দ্বারা মাউন্টব্যাটেন তথা বৃটিশ সরকারের অতি সংকীর্ণ ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতাই পরিস্ফুট হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় তা চিরদিন অংকিত থাকবে।

একটি প্রশ্ন যা মনকে আলোড়িত করে
ভারত বিভাগের পরিকল্পনা বৃটিশ সরকার কর্তৃক চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। তেসরা জুন তা সরকারীভাবে ঘোষণা করা হবে। পরিকল্পনাটি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পূর্বেই তার প্রতি নেহরু তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। এখন প্রশ্ন এই যে এটা কি করে সম্ভব হলো? কংগ্রেস, হিন্দুভারত ও তার প্রধান মুখপাত্র গান্ধী, নেহরু ও প্যাটেল কিভাবে ভারতমাতার অংগচ্ছেদে রাজী হলেন? তাঁরা কি অখন্ড ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার বহুদিনের সোনারী স্বপ্ন পরিহার করলেন?
জেনালের টুকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোভাবের উপর আলোকপাত করে বলেন-
অবশেষে তারা বল্লেন, আচ্ছা, মুসলিম লীগ যদি পাকিস্তান পেতে চায়, তা ঠিক আছে পেতে দাও। আমরা তাদের অঞ্চলের একটি ইঞ্চি কেটে কেটে নিয়ে নেব যাতে মনে হবে যে আর তা টিকে থাকবে না এবং যতোটুকু তাকবে তা আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চালানো যাবে না। (Sir Francis Tuker: White Memory Server, London, Cassel, 1950, p.257; Choudhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, p.123)।
প্যাটেল ১৯৪৯ সালে ভারতের গণপরিষদে যে ভাষণ দেন, তা টুকারের উপরোক্ত মন্তব্যের যথার্থতাই ব্য্কত কের। প্যাটেল তাঁর ভাষণে বলেন, আমি সর্বশেষ উপায় হিসাবে দেশবিভাগে সম্মত হই, যখন আমরা সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। মিঃ জিন্নাহ কাটছাট করা পাকিস্তান চাননি কখনো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই তাঁকে গিলতে হলো। (Quoted in Kewnl L. Panjabi, The Indemiable Sardar, Bombay, Bharatiya Vidya Bhaban, 1962, p. 124; Choudhury Mohammad Ali-Ibid, p.123)।
কংগ্রেসের দেশবিভাগ মেনে নেয়াটা ছিল একটা কৌশলগত পদক্ষেপ। কিন্তু লক্ষ্যস্থল অপরিবর্তিত ছিল; এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন-
১। হিন্দুস্তান বা ইন্ডিয়ান ইউনিয়নকে ভারতে বৃটিশ সরকারের উত্তরাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পাকিস্তানকে মনে করা হবে যে কিছু অঞ্চলসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
২। পাকিস্তানের সাথে যেসব এলাকা সংশ্লিষ্ট করা হতে তা হবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং তা পূর্ব বাংলা, পম্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের বাইরে থাকবে। ফলে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে পরিবেষ্টিত করে রাখা হবে।
৩। সময়, উপায় উপাদান, সামরিক-বেসামরিক জনশক্তি ও মাল মশলা থেকে পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে যাতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারে।
৪। পাকিস্তান যাতে টিকে থাকতে না পারে তার জন্যে যা কিছু করা দরকার তা করা হবে। (কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত ছিলেন যে পাকিস্তান বেশী দিন টিকে থাকতে পারবেন। এজন্যে তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংস করার চেষ্টা করা)।
এসব হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে হিন্দুভারতের প্রয়োজন ছিল বৃটিশের সাহায্য যারা গোটা বেসামরিক প্রশাসন ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতো। বিদায়ের প্রাক্কালে মাউন্টব্যাটেন-র‌্যাডক্লিফ সহ গোটা প্রশাসন হিন্দুভারতের স্বার্থে কাজ করেছে যা পরে উল্লেখ করা হবে।
-(Chudhury Mohammad Ali: The Emergence of Pakistan, pp.123-24)।

পঞ্চম অধ্যায়
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া
ভারতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। বাংলার এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক আইনসভাকে নির্দেশ দেয়া হয় যেন তারা প্রত্যেক দুই দুই ভাগে মিলিত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকে নিয়ে এক ভাগ এবং অবশিষ্ট আর এক ভাগ। প্রত্যেক আইনসভার দুটি অংশের সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বসবেন এবং তাঁদেরকে এ অধিকার দেয়া হবে যে, তাঁর প্রদেশের বিভাগ চান কি চান না। যে কোন অংশের সরল সংখ্যাগুরু (Simple majority) যদি বিভাগের সপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে বিভাগ কার্যকর হবে। বিভাগরে সিদ্ধান্তের পর আইনসভার প্রত্যেক অংশ যে এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে তাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করবে, না নতুন গণপরিষদে। এ সিদ্ধান্ত হওয়ার পর গভর্ণর জেনারেল একটি ‘বাউন্ডারী কমিশন’ নিয়োগ করবেন পাঞ্জাবের দু’অংশের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। তা করা হবে মুসলিম ও অমুসলিম একত্রে লাগানো (Contiguous) সংখ্যাগুরু এলাকা নির্ণয়ের ভিত্তিতে। কমিশনকে অন্যান্য কারণ বিবেচনারও পরামর্শ দেয়া হয়। অনুরূপ নির্দেশ বেঙল বাউন্ডারী কমিশনকেও দেয়া হয়।
সিন্ধু আইনসভার ইউরোপিয়ান সদস্যগণ ব্যতীত অন্যান্যগণ একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা বর্তমান গণপরিষদে –না নতুন পরিষদে যোগদান করবেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট গ্রহণ করা হবে যে, সেদেশের ভোটারগণ কোন গণপরিষদে যোগদান করবে।
এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ বেলুচিস্তানকেও দেয়া হবে। বাংলা প্রদেশ বিভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আসামের সিলেট জেলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর ফলে সিদ্ধান্ত হবে যে তারা আসামের অংশ হিসাবে সিলেটকে পেতে চায়, না পূর্ব বাংলার সাথে মিলিত হতে চায়। নতুন প্রদেশের সাথে মিলিত হতে চাইলে ‘বাউন্ডারী কমিশন’ সীমানা চিহ্নিত করবে।
পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে নিম্নলিখিত ভিত্তিতে গণপরিষদের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেঃ

প্রদেশ সাধারণ আসন মুসলিম শিখ মোট
সিলেট জেলা ১ ২ ০ ৩
পশ্চিম বংগ ১৫ ৪ ০ ১৯
পূর্ব বংগ ১২ ২৯ ০ ৪১
পশ্চিম পাঞ্জাব ৩ ১২ ২ ১৭
পূর্ব পাঞ্জাব ৬ ৪ ২ ১২

বৃটিশ সরকার জুন ১৯৪৮ এর পূর্বেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক বিধায় পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনেই আইন পাশ করা হবে যাতে এ বছরেই ‘ডমিনিয়ন স্টেটাস’-এর ভিত্তিতে একটি বা দুটি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।
ভাইসরায় দুসরা জুন সাত নেতার এক আলোচনা সভা আহবান করেন। তাঁরা হলেন নেহরু, প্যাটেল, কৃপালনী, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, আবদুর রব নিশতার এবং বলদেব সিং। পরিকল্পনাটি তাঁদের কাছে পেশ করা হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। মাউন্টব্যাটেন গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে একথা ব’লে তাঁকে সম্মত করার চেষ্টা করেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিকল্পনাটি অতি উত্তম। যদিও গান্ধী পরিকল্পনাটি বৃটেনে প্রেরণের পূর্বেই সমর্থন করেন, এখন তিনি বিরোধিতা করছেন –শুধু পৃথিবী এবং লীগকে ধোকা দেয়ার জন্যে।
তেসরা জুন পরিকল্পনাটি সারা দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করা হয়। ভাইসরয় ৪ঠা জুন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে প্রতিটি পর্যায়ে ও মুহুর্তে তিনি নেতৃবৃন্দের হাত ধরাধরি করে কাজ করেছেন। সেজন্য পরিকল্পনাটি তাঁদের ক্ষোভ অথবা বিস্ময়ের কারণ হয়নি।
বিশ্ববাসীকে ধোকা দেয়ার জন্য এমন নিরেট মিথ্যা কথা বলতে তাঁর মতো দায়িত্বশীলের বিবেকে বাধেনি। পরিকল্পনাটি তাঁর স্টাফ সদস্যবৃন্দ, পরিকল্পনা প্রণেতা ভিপি মেনন এবং নেহরু ব্যতীত আর কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতেন না। লীগের কাছেও তা গোপন রাখা হয়েছিল।
যাহোক উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরীক্ষামূলক তারিখ নির্ধারিত হয়।
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ১৪ই জুন মিলিত হয় এবং পরিকল্পনা মেনে নেয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে।সেই সাথে ভারত বিভাগ সম্পর্কে জোর দিয়ে একথা বলেন যে, ভূগোল, পর্বতমালা ও সমুদ্র ভারতের যে আকার আকৃতি নির্মাণ করে দিয়েছে, যেমনটি সে আছে, কোন মানবীয় সংস্থা তা পরিবর্তণ করতে পারেনা এবং তার চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ণয়ের পথে প্রতিবন্ধক হতে পারেনা। কমিটি বিশ্বাস করে যে যখন বর্তমান ভাবাবেগ প্রশমিত হবে, তখন ভারতের সমস্যাসমূহ তার যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচিত হবে এবং দ্বিজাতিত্বের ভ্রান্ত মতবাদ কলংকিত ও পরিত্যক্ত হবে। আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি নিশ্চিত যে বিভাগটি হবে ক্ষণস্থানয়ী। হিন্দু মহাসভা বলে, ভারত এক ও অবিভাজ্য এবং যতোক্ষণ না বিচ্ছিন্ন এলাকাসমূহ ভারত ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত করা হবে, ততোক্ষণ কোন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
ভবিষ্যতে ভারত এক ও অখন্ড হবে এ আশা বিভিন্ন হিন্দু নেতা, গ্রন্থকার এবং পত্রপত্রিকা পোষণ করতেন এবং বিভাগের পূর্বে, বিভাগের সময়ে এবংপরে সে আশা ব্যক্ত করেছেন। ১৫ই আগষ্ট গান্ধী বলেন, আমি নিশ্চিত যে এমন এক সময় আসবে যখন এ বিভাগ পরিত্যক্ত হবে। কংগ্রেস মুখপত্র ‘দি হিন্দুস্তান টাইমস’ও তার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে উক্তরূপ আশা ব্যক্ত করে। বিবাগ পরিকল্পনা প্রণেতা মেনন স্বয়ং বলেন, আগষ্ট ১৯৪৭ এর উদ্দেশ্য এ ছিলনা যে, দেড় শতাধিক বছর যাবত যে বন্ধনে ভারত বাঁধা আছে তা ছিন্ন করা হবে। হিন্দুদের মধ্যে এ এক সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, পাকিস্তান বেশী দিন টিকে থাকবেনা এবং কংগ্রেসের অধীনে ভারত একটি অখন্ড ভারতে পরিণত হবে –(Economist, 17 May 1947; Sunday Times 1 June 1947; Manchester Guardian 15 Auh. 1947, Round Table Sept. 1947 p.370; Guy Wint The British in Asia-p.179; I.H. Quershi The Struggle for Pakistan, pp.195-96)।
এসব বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া থেকে এ কথাই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু ভারত মনে প্রাণে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ থেকে এ কথা লেখার সময় পর্যন্ত (অক্টোবর ১৯৯৩) হিন্দুভারত সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান নামের সমগ্র ভূখন্ড গ্রাম করে অখন্ড ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। ১৯৪৭-পূর্ব ভারতের ভৌগলিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করার কথা এখন বিভিন্ন সেমিনার জনসভায় প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে ভারতের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসত অত্যন্ত জোরদার করা হয়েছে।

বড়োলাটগিরি নিয়ে ক্যানভাসিং ও বিতর্ক
ভারতের এ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ও ভাইসরয় কুঠির প্রত্যেকেই এ ধারণা পোষণ করতেন যে দুটি নতুন ডমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল একই ব্যক্তি হবেন এবং তিনি মাউন্টব্যাটেন।
কয়েকদিন পূর্বে জিন্নাহ বলেছিলেন, দুটি ডমিনিয়নের গভর্ণর জেনারেলের উপরে একজন সুপার গভর্ণর জেনারেল হওয়া উচিত। এ ধারণা সম্ভবত এ জন্যে করা হয়েছিল যে বিভাগ সম্পর্কিত প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীসহ সহজে সম্পন্ন করা হবে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন এর বিরোধিতা করেন এবং হোয়াইট হল মাউন্টব্যাটেনকে সমর্থন করে।
নেহরু যখন মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্ণর জেনারেল হওয়ার প্রস্তাব দেন তখন তিনি নেহরু ও প্যাটেলকে বলেন যে তিনি অনুরূপ প্রস্তাবের আশা মুসলিম লীগ থেকেও করেন।
মাউন্টব্যাটেন বহু চেষ্টা করেও জিন্নাহকে সম্মত করাতে পারলেন না।
দুসরা জুলাই জিন্নাহ তাঁকে জানিয়ে দেন যে তিনি স্বয়ং পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হওয়ার সিদ্ধান্ত করেছেন। তারপরও মাউন্টব্যাটেন আশা ত্যাগ করেন নি। তিনি ভূপালের নবাবকে দিয়েও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মাউন্টব্যাটেন এতে তাঁর আত্মসম্মানে বিরাট আঘাত পান। তবে এ কথা সত্য যে মাউন্টব্যাটেনকে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল করা হলে তিনি হতেন পাকিস্তানের ভারতীয় গভর্ণর জেনারেল। জিন্নাহ দেশকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। (I.H. Wureshi: The Struggle for Pakistan, pp.296-300)।

জুন ৩ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
বেঙল আইনসভার অধিবেশন ২০শে জুলাই অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২৬-৯০ ভোটে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর অমুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সদস্যগণ ৫৮-২১ ভোটে প্রদেশ বিভাগের এবং বর্তমান গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করেন। পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সগস্যগণ ১০৬-৩৫ ভোটে প্রদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে এবং সেই সাথে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করে। অতঃপর প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সদস্যগণ ৬৯-২৭ ভোটে প্রদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে রায় দান করেন।পক্ষান্তরে হিন্দু সংখ্যাগুরু এলাকার বিভাগের বিরুদ্ধে রায় দান করেন। পক্ষান্তরে হিন্দু সংখ্যাগুরু এলকার সদস্যগণ ৫০-২২ ভোটে বিভাগের পক্ষে এবং ভারতীয় গণপরিষদে যোগদানের পক্ষে রায় দান করেন।
সিন্ধু আইনসভা ২৬শে জুন মিলিত হয় এবং ৩০-২০ ভোটে নতুন গণপরিসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করে। বেলুচিস্তানে শাহী জির্গার এবং কোয়েটা পৌরসভার সেবরকারী সদস্যগণ মিলিত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করেন।
অপরদিকে জুলাইয়ের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত সিলেটের গণভোটে বিপুল সংখ্যাগুরু ভোটার আসাম থেকে পৃথক হয়ে পূর্ব বাংলার যোগদানের সপক্ষে ভোটদান করেন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গণভোটের শর্ত ছিল এই যে, ভোটারগণ ভারতীয় গণপরিষদে যোগদানের অথবা নতুন গণপরিষদে যোগদানের সমক্ষে ভোট দেবেন। আবদুল গাফফার খান দাবী করেন যে, ভোটারদের স্বাধীন পাখতুনিস্তানের সপক্ষে ভোটদানের সুযোগ দেয়া হোক। গান্ধী ও নেহরু আবদুল গাফফার খানের দাবী সমর্থন করেন। ভাইসরয় এই বলে দাবীটি নাকচ করেন যে ৩ জুন পরিকল্পনায় যে কার্যবিধি সন্নিবেশিত করা হয়েছে তা উভয় দলের সম্মতি ব্যতিরেকে পরিবর্তন করা যাবেনা। জিন্নাহ এ পরিবর্তন মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। গাফফার খান তাঁর অনুসারীদের ভোটদানে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। তার পরেও ২৮৯, ২৪৪ ভোট নতুন গণপরিষদের পক্ষে এবং মাত্র ২৮৭৪ ভোট ভারতীয় গণপরিষদের পক্ষে প্রদত্ত হয়।
প্রধানমন্ত্রী এটলী ভারত স্বাধীনতা বিল হাউস অব কমন্সে ৪ঠা জুলাই পেশ করেন। ১৫ই জুলাই হাউস অব কমন্সে এবং ১৬ই জুলাই হাউস অব লর্ডসে তা গৃহীত হয়। বিলটি ১৮ই জুলাই রাজকীয় সম্মতি লাভ করে। অতঃপর ভারত ও পাকিস্তানের জন্য ২০শে জুলাই পৃথক পৃথক দুটি প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট কায়েম হয়।
বিগত সাত বছরের সংগ্রাসের ফসল হিসাবে পাকিস্তান নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। এ ধরনের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম।
পাকিস্তান কায়েম হলো বটে, কিন্তু কংগ্রেস, হিন্দুভারত ও বৃটিশ সরকার এর চরম বিরোধিতা করে যখন ব্যর্থ হয়, তখন হঠাৎ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কাটছাঁট করা (Truncated Pakistan) এক পাকিস্তানে সম্মত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনাটি তৈরী হয় একজন কংগ্রেসপন্থী হিন্দু অফিসার কর্তৃক। এ বিষয়ে জিন্নাহকে একেবারে অন্ধকারে রাখা হয়। ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে হস্তান্তরের মাত্র আড়াই মাস পূর্বে পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় যেন মুসলিম লীগ কোন চিন্তাভাবনা করার কোন অবকাশ না পায়। এটা ঠিক যেন ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ শত্রু শিবির আক্রমণ করার মতো। কাটছাট করা পাকিস্তানকে আরও সংকুচিত করে বাউন্ডারী কমিশন। পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য অনেক মুসলিম মেজরিটি এলাকা বলপূর্বক ভারতভুক্ত করা হয়। উপরন্তু বিভাগের পর পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকেও তাকে ষোল আনা বঞ্চিত করা হয়। সম্ভবতঃ এটা ছিল পাকিস্তান দাবী করার অপরাধের আর্থিক দন্ড। কংগ্রেস ও বৃটিশের ষড়যন্ত্রে এসব করা হয়েছিল যাতে পাকিস্তান কিছু সময়ের জন্যও টিকে থাকতে না পারে।
তারপর পাকিস্তান দাবীর মূল কারণ চিল এই যে হিন্দু সংখ্যাগুরুর কাছে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করলে মুসলমানদের জানমাল ইজ্জৎ আবরুই বিপন্ন হবে না, তাদের জাতিসত্তাকেই নির্মূল করা হবে। চল্লিশের পূর্বে হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে আড়াই বছরের কংগ্রেসী শাসন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
কিন্তু ভারত বিভাগের পরও ভারতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ বন্ধ করা হয়নি। খুনের দরিয়া সাঁতার দিয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নরনারী, শিশু সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়।
পাকিস্তান সরকারের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনাব আলতাফ গওহর বলেন-
দিল্লীতে হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার পূর্বেই আমি করাচী পৌঁছে যাই। ….সীমান্ত অতিক্রম করে আগমনকারী মজলুম আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল এবং ব্যাপক গণহত্যার লোকহর্ষক কাহিনী প্রত্যেককে অধিকতর জাতীয় খেদমতে বাধ্য করছিল। (পাকিস্তানের একটি দৈনিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ)।
আলতাফ গওহর ভারতের রাজধানী স্বয়ং দিল্লীতে হত্যাকান্ডের ইংগিত করেছেন। দিল্লীর বিভিন্ন স্থানে লোমহর্ষক হত্যাকান্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে মিঃ গান্ধী অনশন ব্রত পালন করতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েও তা বন্ধ করতে পারেন নি।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেনঃ
গান্ধীজি তাঁর অনশন ভাঙার শর্তগুলো বলতে থাকেন। তা হলোঃ
১। হিন্দু ও শিখদের পক্ষ থেকে মুসলামনদের আক্রমণ করা এক্ষুণি বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তারা ভাইয়ের মতো একত্রে বাস করতে পারবে।
২। হিন্দু ও শিখকে এ নিশ্চয়তা দানে সকল চেষ্টা করতে হবে যেন কোন একজন মুসলমানও জানমালের নিরাপত্তার অভাবে ভারত থেকে চলে না যায়।
৩। চলন্ত রেলগাড়িতে মুসলমানদের উপর যে হামলা করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে এবং যে সকল হিন্দু ও মিখ হামলা চালাচ্ছে তাদেরকে অচিরেই বিরত রাখতে হবে।
৪। যেসব মুসলমান নিজামুদ্দীন আউলিয়া, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী এবং নাসিরুদ্দীন চেরাগ দেহলীর দরগার আশে পাশে বসবাস করতো তাঁরা বাতিঘর ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদেরকে তাদের বস্তীসমূহে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করতে হবে।
৫। কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর দরগাহ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। অবশ্যি সরকার এসব মেরামত করে দিতে পারে। কিন্তু হিন্দু এবং শিখদেরকেই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এ কাজ করতে হবে।
৬। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এই যে মনের পরিবর্তন দরকার। শর্তগুলো পূরণ অপেক্ষা এর গুরুত্ব অধিক। হিন্দু ও শিখ নেতাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে যাতে এ কারণে আর অনমন করতে না হয়। অতঃপর গান্ধীজি বলেন –এটা আমার শেষ অনশন হোক। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.238)।
মাওলানা আজাদ বলেনঃ
দেশ বিভাগের পর পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে। এক শ্রেণীর হিন্দু হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবা সংঘের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে বলা শুরু করে যে গান্ধীজি হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করছেন। এ বিসয়ে প্রচার পত্রও বিতরণ করা হয়। একটি প্রচার পত্রে বলা হয়, গান্ধীজি যদি তাঁর নীতি পরিবর্তন না করেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.২৪০-২৪১)।
অবশেষে গান্ধীকে ৩০শে জানুয়ারী ১৯৪৮ জীবন দিতে হলো। মাওলানা আজাদ বলেন আমি পুনরায় বিড়লা হাউসে গেলাম এবং ফটক বন্ধ দেখে অবাক হলাম। হাজার হাজার লোক ভিড় করে আছে দেখলাম। আমি বুঝলাম ব্যাপার কি। গাড়ি থেকে নেমে তাঁর ঘরের দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ দেখলাম। একজন কাঁচের জানালা দিয়ে আমাকে দেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন। একজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বল্লেন, গান্ধীজি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। দেখলাম তিনি মেঝের উপর শায়িত। চেহারা বিবর্ণ, চক্ষু বন্ধ তাঁর দুই পৌত্র তাঁর পা ধরে কাঁদছে। আমি স্বপ্নের মতো শুনলাম গান্ধীজি মৃত। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.১৪১-৪২)।
দেশ বিভাগের পর কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে লক্ষাধিক মুসলি স্বাধীন ভারতে নিহত, তাদের বহু মসজিদ ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে কাউকে অনশন করতে দেখা যায়নি। তবে কেউ এ সাহস করলে তাঁকে গান্ধীজির ভাগ্যই বরণ করতে হতো। স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের সপক্ষে কথা বলাকে বিরাট অপরাধ মনে করা হয়। হত্যাকান্ডে শতসহস্র মুসলমান নরনারী ও শিশু নিহত হয়, তাদের দোকানপাট, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা হয়। কিন্তু হত্যাকারী খুঁজে বের করে তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা সরকার করেন না, বা করতে পারেন না। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করার পর অপরাধীদের শাস্তি দেয়া ত দূরের কথা, তাদের হাতেই ভারত সরকারকে জিম্মী হয়ে থাকতে হয়েছে। এসব যে হবে তা নিশ্চিত বুঝতে পেরেই মুসলমানদের পৃথক ও স্বাধীন আবাসভূমির দাবী করতে হয়। বস্তুতঃ হিন্দুজাতি ও নেতৃবৃন্দের চরম মুসলিম বিদ্বেষই পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছে।

ষষ্ঠদশ অধ্যায়

উপসংহার
এ ইতিহাসের শেষ ভাগে সংক্ষেপে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসও লিখতে হয়েছে। কারণ এ আন্দোলনের সাথে বাংলার মুসলমান ওতপ্রোত সম্পৃক্ত ছিলেন। তদুপরি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করার মর্যাদা লাভ করেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম দরদী কৃতী সন্তান ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী মওলভী আবুল কাসেম ফজলুল হক (শেরে বাংলা)। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ থাকলেও এ আন্দোলনে বাংলার মুসলমানদের অবদান ছিল সর্বাধিক।
উনিশ শ’পাঁচ সালের ২০শে জুলাই বংগবিভাগের ঘোষনা এবং ১৬ই অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করণ বাংলা এবং সমগ্র ভারতের হিন্দুজাতিকে অতিশয় ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং বংগভংগ রদের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে এব বংগভংগ রদের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন মুসলমানদের মধ্যে এক নবচেতনার জোয়ার সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসত্তার প্রেরণা জাগ্রত করে। এর ফলে ১৯০৬ সালে ঢাকায় উপমহাদেশের মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধি দল শিমলার বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ ক’রে –মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি বিধায় তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রচলনের দাবী জানালে তা মেনে নেয়া হয়। ১৯০৯ সালে সম্পাদিত মলেমিন্টু রিফরমসে পৃথক নির্বাচন প্রথার প্রতি স্বীকৃতি দান করা হয়। ফলে এ এক সাংবিদানিক ডকুমেন্টে পরিণত হয়।
দেশ বিভাগের পর কোন কোন মহল থেকে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, পাকিস্তান দাবীর পশ্চাতে কি শুদু সাময়িক ভাবাবেগ সক্রিয় ছিল, না এর কারণ ছিল শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। অথবা কংগ্রেসের বৈরিসুলভ আচরণের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুসলমানগণ পাকিস্তান দাবী করেন?
এর কোন একটিও পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কারণ ছিলনা। ভাবাবেগ ত অবশ্যই চিল। এ ভাবাবেগই মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছার জীবন বিলিয়ে দিতে উদ্ধুদ্ধ করে। কিন্তু এ ভাবাবেগ কোন সাময়িক ও অর্থহীন ভাবাবেগ ছিলনা। নিছক ভাবাবেগ এতোবড়ো ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটাতে পারেনা। গান্ধী, অনেক হিন্দুনেতা ও পত্রপত্রিকা এ ধরনের মন্তব্য করেছেন যে মুসলমানদের এ সাময়িক ভাবাবেগ প্রশমিত হলে পুনরায় তারা অখন্ড ভারতভুক্ত হয়ে যাবেন। চার যুগের অধিক কাল অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন পাকিস্তানকামী মুসলমানদের ভাবাবেগ কণামাত্র প্রশমিত হয়নি, তখন একথা সত্য যে তাদের ভাবাবেগ কোন সাময়িক বস্তু ছিলনা। এ ভাবাবেগ সৃষ্টির পেচনে একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল।
যে মহান উদ্দেশ্যে পাকিস্তান দাবী ও আন্দোলন করা হয়, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মার্চ ১৯৪০ এ অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেনঃ
It is extremely dofficult why our Hidnu friends fail to understand the real nature of Islam and Hinduism. They are not religious in stricy sence of the word, but are, in fact, different and distinct social orders. It is a dreame that the Hindus and Muslims can ever evolve a common nationality, and this misconception of one Indian nation has gone far beyond the limits, and will lead India to destruction, If we fail to revise our nations in time. The Hindus and Muslims belong to two dofferent religious philosophies, social customs and Iiterature. They neither intermarry nor interdine together, and indeed they belong to two different civilizations. Which are based mainly on conflicting ideas and conceptions. Their aspect on life and of life are different. It is puite clear that Hindus and Musslamans derive their aspirations from diffirent and they have different espisodes. Very often the hero of one in a foe of the other and like wise their victories and defeats overlap. To yoke together two such nations under a singh atate, one as a numerical minority and the other as a majority, must lead to growing discontent and the final destruction of any fabric that may be built up for the government of such a state –(Ideological Foundations of Pakistan by Dr. Waheed Qurashy,pp.96-97)।
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ভাষণে এ সত্যটিই তুলে ধরেছেন যে, হিন্দু ও মুসলমান বহু দিক দিয়ে দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি এবং তাদেরকে একত্রে বেঁধে দিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব ও অবাস্তব। এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ভারত বিভক্ত হয়েছে।
কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্পূর্ণ পৃথক ও বিপরীতমুখী জাতিসত্তা –এ তত্ত্ব কি জিন্নাহ বা মুসলমানদের কোন নতুন আবিস্কার? এর সঠিক জবাবের উপরই এ কথা নির্ভর করবে যে পাকিস্তান কোন ভাবাবেগ ও উত্তেজনা বশে অথবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দাবী করা হয়েছিল।

ইসলামী জীবনব্যবস্থা
উপরোক্ত প্রশ্নের সঠিক জবাব পেতে হলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রসূলগণ ইসলামের যে সঠিক ধারণা পেশ করেছেন, তা এই যে, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় শুধুমাত্র কতিপয় আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়। ইসলাম হচ্ছে আল্রাহর নাযিল করা মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর সুন্নাতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পূর্ণাংগ জীবন বিধান।
ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা বর্তমানকালে দুনিয়ায় প্রচলিত সেদিক দিয়ে ইসলাম একটি ধর্ম থেকে অনেক বেশী কিছু। এ নিছক স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের নাম নয়। ইসলামের ধর্মীয় ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। ঈমান আকীদাহ থেকে শুরু করে এবাদত এবং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের উপর এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। ইসলামে নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি আছে, ইতিহাস ঐতিহ্য আছে, নিজস্ব নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে। আছে আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, পারিবারিক ও শিক্ষাব্যবস্থা, আছে নিজস্ব যুদ্দ ও সন্ধিনীতি এবং বৈদেশিক ব্যবস্থা। একটি বৃক্ষের মূল, শাখাপ্রশাখা, পত্র পল্লব ও ফুলফলের মধ্যে যেমন অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক, তেমনি এসব ব্যবস্থাও পরস্পর অবিচ্ছিন্ন ও ওতপ্রোত জড়িত।
প্রকৃত পক্ষে ইসলাম মানব জাতির জন্যে দুনিয়ায় সার্থক জীবন যাপন করার এক পূর্ণাংগ জীবন বিধান। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সার্থক জীবনযাপনের পদ্ধতি ইসলাম শিক্ষা দেয়। এ কারণে ইসলামের ধর্মীয় ধারণা অন্যান্য ধর্মের ধারণা থেকে একেবারে পৃথক।
ইসলামের ঐতিহাসিক ধারণা অনুযায়ী এ সত্য দ্বীন (ইসলাম) সর্বপ্রথম হযরত আদম (আ) এর উপর আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নাযিল হয়। আর হযরত আদম (আ) ছিলেন প্রথম মানুষ। তাঁর থেকেই মানব বংশ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন থেকেই এ দ্বীনে হক –ইসলাম দুনিয়ায় প্রচলিত। তাঁর পর যুগে যুগে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে নবী-রসূল আগমন করে দ্বীনে হকের দাওয়াত পেশ করতে থাকেন। সর্বশেষে নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা) দ্বারা ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে।

ইসলামে জাতীয়তার ধারণা
এ দ্বীন ও ব্যবস্থাকে যারা মনেপ্রাণে মেনে নেয় তাদেরকে ‘মুমেন’ বলা হয়, আর যারা একে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে ‘কাফের’ বলা হয়। মুমেন ও কাফের উভয়ে কখনো এক হতে পারেনা। প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ) কে দুনিয়ায় পাঠাবার সময় আল্লাহতায়ালা যে নির্দেশ দেন তা এইঃ
“আমি বল্লাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। তারপর আমার নিকথ থেকে যে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছাবে, যারা আমার সে বিধান মেনে চলবে তাদের জন্যে চিন্তাভাবনার কোন কারণ থাকবেনা। আর যারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ-নিষেধ প্রত্যাখ্যান করবে তারা হবে নিশ্চিতরূপে জাহান্নামী এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল (সূরা বাকারাহঃ ৩৮-৩৯)।
কুরআন পাকের উপরোক্ত আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, হেদায়েতে ইলাহী মানুষকে দুটি দলে বা দুটি জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছে –একটি মুমেন, অন্যটি কাফের। এ বিভক্তি দুনিয়ায় মানব জীবনের প্রথম দিনেই করে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক নবী তাঁর যুদে এ বিভক্তি অক্ষুন্ণ রাখেন। হযরত শুয়াইব (আ) এ দুটি দলকে দুটি পৃথক মিল্লাত বা জাতি বলে ব্যাখ্যা করেন। যেমনঃ ‘তাদের সরদার মাতব্বরগণ যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে গর্বিত ছিল তাকে বল্লো, হে শুয়াইব! আমরা তোমাকে ও তোমার প্রতি ঈমানদার লোকদেরকে এ জনপদ থেকে বের করে দেব –অন্যথায় তোমাদেরকে আমাদের মিল্লাতে ফিরে আসতে হবে। শুয়াইব জবাব দিল, আমাদেরকে কি জোর করে ফিরিয়ে আনাহবে -আমরা যদি রাজী নাও হই?
আমরা খোদার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী হবো যদি তোমাদের মিল্লাতে ফিরে আসি যখন আল্লাহ এর থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান করেছেন।
-(সূরা আ’রাফ: ৮৯-৯০)
এ আয়াত থেকেও এ কথা সুস্পষ্ট যে, হযরত শুয়াইব (আ) এর যুগেও মুসলমানদের মিল্লাত পৃথক ছিল এবং কাফেরদের মিল্লাত পৃতক। এই বিভক্তিকরণ এবং এই পরিভাষা উম্মতে মুহাম্মদীতেও প্রচলিত আছে এবং আজ পর্যন্ত তা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইসলামে জাতীয়তার ধারণা বিশ্বজনীন। যে কোন দেশ ও জাতির কোন ব্যক্তি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করার পর দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করে এবং ইসলামী জাতীয়তার সমান অংশীদার হয়ে যায়। ইসলামে ঈমান আকীদার প্রতি স্বীকৃতিই জাতীয়তা অর্জনের জন্য যথেষ্ট। জাতীয়তা লাভের ব্যাপারে দুনিয়ার অন্যান্য জাতির পন্থাপদ্ধতি থেকে ইসলামের পন্থাপদ্ধতি ভিন্নতর। ইহুদী জাতীয়তা লাভের জন্য ইহুদী আকীদার সাথে ইহুদী বংশোদ্ভূত হওয়া জরুরী। হিন্দু জাতীয়তা লাভের জন্য হ্নিদু পূজাঅর্চনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংমগ্রহণই যথেষ্ট।

স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা
ইসলামের সর্বব্যাপী জীবন বিধান ও স্বতন্ত্র জাতীয়তার যুক্তিসংগত দাবী এই যে, এর জন্য একটা স্বাধীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হতে হবে –যেখানে ইসলামের আদেশ নিষেধগুলো মেনে চলা যাবে। কিন্তু পরাধীনতার জীবনযাপন করতে হলে সেখানে অধিকাংশ হুকুম পালন সম্ভব নয়।
তের বছর মক্কায় মুশরিকদের নিয়ন্ত্রিত সমাজে জীবনযাপন করার পর নবী আকরাম (সা) যখন মদীনার অনুকূল পরিবেশে পৌঁছেন, তখন সেখানে তিনি ইসলামী সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কায়েম করেন। তিনি ছিলেন এ রাষ্ট্রের পরিচালক। সেখানে তিনি পরিপূর্ণ রূপে ইসলামী বিধান জারী করেন। তারপর আল্লাহতায়ালা নিম্নের আয়াত নাযিল করেনঃ
‘তোমাদের জন্যে দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম’।
দ্বীন তার পরিপূর্ণতা লাভ করলো তখন যখন তার পরিপূর্ণতা, বাস্তবায়ন ও প্রচার প্রসারের জন্য একটা পৃতক আবাসভূমি পাওয়া গেল এবং একটা স্বাধীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো।
‘পাকিস্তান’ শব্দটি কোন ভৌগলিক অঞ্চল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, এ ব্যবহৃত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র অর্থে। এই অর্থেই আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ‘প্রথম পাকিস্তান’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেনঃ
আল্লাহতায়ালা কুদরাতের হস্ত অবশেষে রসূল মকবুল (সা) এর ঐতিহাসিক হিজরতের মাধ্যমে মদীনায় এক ধরনের ‘পাকিস্তান’ কায়েম করে দেয়।
(খুৎবায়ে ওসমানী, আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী পৃঃ ১৪০; তারিখে নযরিয়ায়ে পাকিস্তান, অধ্যাপক মুহাম্মদ সালিম, পৃ: ৩১)।
লাহোর প্রস্তাবে যে একটি স্বাধীন আবাসভূমির দাবী করা হয়েছিল তার নাম পাকিস্তান বলা হয়নি। এ নামটি চৌদুরী রহমত আলী পছন্দ করেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৯১৫ সালে ‘বজমে শিবরী’ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন –উত্তর ভারত ‘মুসলিম’ এবং একে আমরা ‘মুসলিম’ রাখব। শুধু তাই নয়। একে আমরা একটি মুসলিম রাষ্ট্র বানাবো। এ আমরা তখনই করতে পারব যখন আমরা এবং আমাদের এ উত্তরাঞ্চল ভারতীয় হওয়া থেকে বিরত থাকব। এ হচ্ছে তার পূর্বশর্ত। যতো শীগগির আমরা ভারতীয়তাবাদ পরিহার করব ততোই ভালো আমাদের এবং ইসলামের জন্য (Chudhury Rahmat Ali: p.172; I.H. Qureshi: The Struggle for Pakistan. Pp.115-116)।
চৌদুরী রহমত আলীও প্রথমে পাকিস্তান নাম ব্যবহার করেননি। তিনি মুসলিম বা ইসলামী রাষ্ট্রের কথাই বলেছেন।
ইতিহাসে আলোচনা করলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয় যে, পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল হিজরী ৯৩, রজব মাসে (৭১২ খৃঃ) যখন ইমাদুদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাসিম, সতেরো বছরের সিপাহসালার দেবল বন্দরে (বর্তমান করাচী) অবতরণ করেন, রাজা দাহিরের কারাগার থেকে মজলুম মুসলমান নারীশিশুদের মুক্ত করেন এবং সেখানে প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। কায়েদে আজম বলেন, পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় তখন, যখন প্রথম মুসলমান সিন্ধুর মাটিতে পদার্পণ করেন যা ছিল ভারতে ইসলামের প্রবেশদ্বার।
দেবলের পর নিরন (বর্তমান হায়দারাবাদ) এবং তারপর সেহওয়ান ইসলামী পতাকার কাছে মাথানত করে। ১০ই রমজান রাওর দুর্গ দখল করা হয় এবং যুদ্ধে রাজা দাহির পরাজিত ও নিহত হন। পরে ব্রাহ্মণাবাদ (বর্তমান সংঘর) এবংআলওয়ার বিজিত হয়। ৯৬ হিজরী সনে মুলতান আত্মসমর্পণ করে এবং উত্তর ভারত স্বেচ্ছায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার প্রস্তুত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুহাম্মদ বিন কাসিককে দামেশকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি তাঁর অধীন অঞ্চগুলোতে সত্যিকার ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। এ ব্যব্সথা হ্নিদু এবং বৌদ্ধদেরকে এতোটা মুগ্ধ করে যে, তাদের বিরাট সংখ্যক লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে (Justice Syed Shameem Husain Kadri: Creation of Pakistan, pp-1-2)।

ইসলামের সহজাত বৈশিষ্ট্য
ইসলামের সহজাত বৈশিষ্ট্য এই যে মুসলমান এক ও লা শারীক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো বশ্যতা, প্রভুত্ত কর্তৃত্ব, আইন শাসন মানতে পারেনা। ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান এবং এর মূলনীতি মানব জীবনের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দিক পরিবেষ্টন করে রাখে। রাষ্ট্র ও ধর্মকে একে অপর থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কালেমায়ে তাইয়েবার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও রসূলের (সা) নেতৃত্ব মেনে নেয়া হয়েছে।

উপমহাদেশে ইসলামী আইন-শাসন প্রতিষ্ঠা
মুহাম্মদ বিন কামিস শুধু এ উপমহাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না। বরঞ্চ তিনি ছিলেন ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রদূত। যে সভ্যতা-সংস্কৃতির বৃক্ষ তিনি রোপন করেন তা কালক্রমে বর্ধিত ও বিকশিত হতে থাকে এবং সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইসলামী পতাকা উড্ডীয়মান হয়। মুসলমান বিজয়ীর বেশে ভারতে আগমন করতে থাকেন। তাঁদের সাথে আসেন সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী। এসব শাসকদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে অনেকেই ভালো মুসলমান ছিলেন না, এবং অনেক দরবেশ প্রকৃতির লোকও ছিলেন। তবে মুসলিম শাসন আমলে আগাগোড়া দেশে ইসলামী আইন প্রচলিত ছিল।
কিন্তু মুসলিম শাসনের অবসানের পর ইসলামী আইনের স্থলে প্রবর্তিত হলো পাশ্চাত্যের মানব রচিত আইন; ইন্ডিয়ান সিভিল এন্ড ক্রিমিনাল কোডস অব প্রসিজিয়র এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোড প্রবর্তন করা হলো। এভাবে মুসলমানগণ শুধু রাজ্যহারাই হলেননা, ইসলামী তথা আল্লাহর আইনের পরিবর্তে তাদের উপর কুফরী আইন চাপিয়ে দেয়া হলো। কিভাবে তাদের জীবন জীবিকার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হলো, তাদের বহু লাখেরাজ ভূসম্পদ কেড়ে নেয়া হলো, তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করা হলো –এ গ্রন্থে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
রেডিও পাকিস্তানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মাওলানা মওদূদী পাকিস্তানের আদর্শিক পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
যদি আমাদের আলোচনাকে ‘পাকিস্তান আন্দোলন’ শব্দগুলো এবং পরিভাষা পর্যন্ত সীমিত রেখে কথা বলি, তাহলে এ বিষয়টির প্রতি মোটেই সুবিচার করা হবেনা। কারণ একটা জিনিস হলো পাকিস্তানের শব্দ ও পরিভাষা এবং অন্যটি হলো এমন এক উদ্দেশ্য যা এ উপমহাদেশের মুসলমানদের সামনে সুদীর্ঘ কাল থেকে ছিল এবং মুসলমানগণ অবশেষে তাকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিল যাতে তারা এ পরিভাষার সাথে একটা দেশও লাভ করার সংগ্রাম করতে পারে। এ লক্ষ্য তখনই ভারতীয় মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যখন এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। তারা তখন অনুবব করেছিল যে, যেহেতু তারা জগত এবং জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ দৃষ্টিভংগি পোষণ করে এবং তারা একটা বিমেষ সভ্যতার অনুসারী, সেজন্য নিজেদের জাতীয় সত্তা তারা তখনই অক্ষুণ্ণ রাখতেপারে, যখন শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে। শাসন ক্ষমতা অমুসলমানদের হাতে চলে গেলে তারা এ দেশে মুসলমানদের চাহে চলে গেলে তারা এ দেশে মুসলমানদের জীবন যাপন করতে পারবেনা এবং মুসলমান হিসাবে তাদের কোন জীবনই থাকবে না। এ অনুভূতি ভারতে মুসলিম শাসনের পতনের পরই তাদের মধ্যেই সৃষ্টি হতে থাকে। আর এ অনুভূতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে।
কখনো এ অনুভূতি এভাবে আত্মপ্রকাশ করে যে, হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী এবং হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ এক জেহাদী আন্দোলন নিয়ে আবির্ভূত হন। তাঁরা ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের জন্য নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দেন। এ অনুভূতি আবার কখনো এ রূপ ধারণ করে যে, স্থানে স্থানে দ্বীনী মাদ্রাসা কায়েম করা হয় যাতে মুসলমানগণ তাদের দ্বীন ভুলে গিয়ে ইউরোপ থেকে আমদানীকৃত খোদাহীন সভ্যতা এবং ধর্মহীন চিন্তাধারা ও মতবাদের প্রবল প্লাবনে ভেসে না যায়।
তারপর দ্বিতীয় পর্যায় এভাবে শুরু হয় যে, ইংরেজ শাসন এখানে পাকাপোক্ত হয়ে পড়ে এবং এদেশে ক্রমশঃ ঐ ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কাজ তারা শুরু করে, যে ধরনে তাদের আপন দেশে শাসন ব্যবস্থা চলছিল। তাদের জাতীয়তা ও গণতন্দ্রের ধারণা ছিল এই যে, ইংলন্ডের সকল অধিবাসী এক জাতি এবং তাদের মেধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অধিকার স্বীকৃত। এ গণতান্ত্রিক মূলনীতি ইংরেজরা ভারতেও চালু করতে চায়। তাদের মতে ভারতের সকল অধিবাসীও এক জাতি এবং তাদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসননীতি চলতে পারে। এটাই মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করে যে, যদি এখানে সংখ্যাগুরু দলের সরকার কায়েম হয় তাহলে এখানে মুসলমানদেরকে চিরদিন সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে হবে এবং তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জাতীয় সত্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ সে সরকারের অধীনে মুসলমানগণ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন আইন রচনা করতে পারবেনা। সরকারের ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তাদের কোন অধিকার থাকবেনা। অন্য কথায়, মুসলমানগণ তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবন দর্শন বাস্তবায়িত করতে পারবেনা। বরঞ্চ একটা অনৈসলামী সভ্যতা ও জীবনদর্শন তাদের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হবে।
মাওলানা বলেন, এ ছিল সেই অবস্থা যা ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জের রূপ নিয়ে মুসলমানদের সামনে দেখা দেয়। এর জবাব পেতে মুসলমানদের সুদীর্ঘ সময় কেটে যায়। সুদীর্ঘকাল ধরে তারা এ কঠিন প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করতে থাকে যে, এমন এক শাসন ব্যবস্থার যেখানে ভারতের অধিবাসীদেরকে এক জাতি ধরে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন পদ্ধতি চালু করা হবে, সেখানে সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার কি রূপ হতে পারে। এ নিরাপত্তা লাভের ধরন এবং তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়ন করা হয়। এক পর্যায়ে এ উদ্দেশ্যে পৃথক নির্ভাচন প্রথার দাবী করা হয় (শিমলা প্রতিনিধি, ১৯০৬)। তারপর তার ভিত্তিতে লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমঝোতা হয় (লাখনো চুক্তি, ১৯১৬)। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন প্রস্তাবাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। ক্রমশঃ মুসলমানগণ বুঝতে পারে যে, এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোন আইনগত নিরাপত্তা তাদের কোনই কাজে আসবে না। এ কথা তারা স্পষ্ট অনুভব করলো তখন, যখন ১৯৩৭ সালে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসের শাসন কায়েম হয়। সে সময়ে মুসলমানদের এ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় যে, এ উপমহাদেশে সংখ্যাগুরু দলের সরকার হওয়া এবং তাদের অধীনে মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিসাবে বসবাস করার অর্থ এই যে, ক্রমশঃ তাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়া। এ অভিজ্ঞতা লাভের পর মুসলমানগণ এভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন যে, এখন পর্যন্ত এ সমস্যাটির যেদিক দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা চলে আসছিল তা অর্থহীন ও অবাস্তব।
মাওলানা বলেন, সে সময়ে মুসলমানদেরকে বার বার এ নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছিল যে ভারতের মুসলিম-অমুসলিম মিলে এক জাতি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তারা কোন দিন এক জাতি ছিল না এবং হতেও পারেনা। মুসলমান যখন থেকে এ দেশে এসে বসবাস করতে থাকে তখন থেকে তাঁরা অমুসলিমদের সাথে কখনো এক জাতি হিসাবে বসবাস করেনি। ….এক জাতি হলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এ ছুতমার্গ ব্যাধি কোথা থেকে এলো? তাদের জাতীয় নায়ক (National heroes) আলাদা আলাদা কেন? তাদের অনুপ্রেরণা ও আবেগ অনুভূতির উৎস বিভিন্ন কেন? এক জাতি হলে হিন্দুদের থেকে পৃথক জাতি হেয় তারা কি করে বাস করতে পারতো? অতএব এ এক পরম সত্য যে, তারা এক জাতি কখনো ছিল না এবং কোন সময়ের জন্য হতেও পারেনা। এখন একটা অবাস্তব কল্পনা (Hypithesis) বলপূর্বক মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে। এ যে কার্যকর ও ফলদায়ক হতে পারেনা তা কংগ্রেসের কয়েকটি প্রদেশে সরকার কায়েম হওয়ার পর (১৯৩৭-৩৯) দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে গেল। যারা হিন্দু মুসলমান মিলে এক জাতির ঘোষণা দিচ্ছিল তারা স্বয়ং তাদের কার্যকলাপ দ্বারা একথা প্রমাণ করলো যে, হিন্দু মুসলিম এক জাতি নয়। বরঞ্চ এ ছিল একটা বিরাট রাজনৈতিক প্রতারনা যার দ্বারা তারা মুসলমাদেরকে এক গোলাম জাতিতে পরিণত করে রাখতে চেয়েছিল।
মাওলানা বলেনঃ
এ ছিল এমন এক সময় যখন আমি ১৯৩৭ সালে আমার সে প্রবন্ধগুরো লেখা শুরু করি যার দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করি যে, আপনারা একটি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অধীনে থেকে …..নিজের জাতীয় অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন না। ……তখন আমি গভীরভাবে অনুভব করলাম যে, কোন প্রকার আইনানুগ নিশ্চয়তা দান মুসলমানদেরকে বাঁচাতে পারবেনা। এ জন্যে এ ছাড়া গত্যন্তর নেই যে, এ উপমহাদেশে মুসলমানদের নিরাপত্তার অন্য উপায় চিন্তা করতে হবে। আমার নিকটে বিকল্প পন্থা এই ছিল এবং তা আমি সুস্পষ্ট করে পেশ করলাম যে, সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে জাতীয় স্বাতন্ত্রবোধ পরিপূর্ণরূপে জাগ্রত করা হোক যার দ্বারা তারা তাদের আপন পরিচয় জানতে পারবে। তারা জানতে পারবে তাদের জীবনের মূলনীতি কি, তারা কিভাবে অন্য জাতি থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি বরঞ্চ এম মিল্লাত এবং তাদের এ জাতীয় স্বাতন্ত্রবোধ জাগ্রত রাখার পন্থা কি। সে সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনাও হয়নি। সে সময়ে সর্বপ্রথম করার কাজ এই চিল যে, যেমনি আমি বলেছি, মুসলমানদেরকে সেই এক জাতীয়তার বেড়াজাল থেকে কি করে বাঁচানো যায় যা তাদের চারদিকে ছড়ানো হচ্ছিল। -[মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা প্রমাণ করে মাওলানা ‘মাসয়ালায়ে কাওমিয়াত’ নামে যে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তার ফলে মুসলমানদের মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা বদ্ধমূল হয়।]
মাওলানা আরও বলেন, যখন মুসলমানদের মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে, তাদের মধ্যে এ প্রয়োজনের অনুভূতিও বাড়তে থাকে যে, পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করা হোক। এভাবে পাকিস্তান আন্দোলন এক রীতিমত এবং সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে। এ পরিস্থিতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়। এক এই যে, যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগুরু তাদের একটি অপরটি থেকে বহুদূরে অবস্থিত। কোন বস্তু ইসলাম ছাড়া আর কিছু নয় এবং হতেও পারেনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন এই ছিল যে, ভারতের বৃহৎ অংশে মুসলমান সংখ্যালঘু। যদি গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হয় তাহলে অনিবার্যরূপে সেখানে মুসলমানদেরকে সংখ্যাগুরুর গোলামি অবলম্বন করতে হবে। এ অবস্থায় তাদের নিরাপত্তার কি উপায় হবে? এ প্রশ্নের কোন সুস্পষ্ট জবাব ছিল না। কিন্তু এর থেকে এ সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদেরকে যে ধ্যান-ধারণা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করে এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তা কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাবেগ ছিলনা। বরঞ্চ তা ছিল একটা নির্ভেজাল দ্বীনী আবেগ অনুরাগ। নতুবা মাদ্রাজ, বোম্বাই, সিপি, ইউ,পি প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের পাকিস্তান হাসিলের জন্য সংগ্রাম করার কোনই কারণ থাককে পারেনা। তারা কখনো এ আশা করতে পারেনি যে, তাদের এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হবে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, পরবর্তীকালে যেসব অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো সেসব অঞ্চলে পাকিস্তান আন্দোলন এতোটা জোরদার হয়নি যতোটা হয়েছে মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে। এর কারণ এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, একমাত্র ইসলামী আবেগ অনুভূতিই ছিল এ আন্দোলনের প্রেরণাদায়ক শক্তি। মুসলমাদের এ পূর্ণ অনুভূতি ছিল যে, তাদের পরিণাম যা কিছুই হোক না কেন, তাদের কুরবানী দ্বারা অন্ততঃপক্ষে ইসলামের নামে একটা রাষ্ট্র ত অস্তিত্ব লাভ করবে যেখানে ইসলামের বানী সমুন্নত হবে এবং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবে কায়েম হবে। এটাই ছিল সেই আবেগ অনুরাগ যা এ শ্লোগানে রূপায়িত হয়েছিল –“পাকিস্তানের উৎস কি –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। এ এমন এক শ্লোগান ছিল যা শুনে মুসলিম পতংগের মতো পাকিস্তান আন্দোলনের আগুন ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর এমন বিরাট সংখ্যক লোক পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে যে, বড়োজোর শতকরা দু’একজন মুসলমান মাত্র দ্বিমত পোষণ করে। আমার নিকটে পাকিস্তান আন্দোলনের দুটি মাত্র বুনিয়াদ ছিল। একটি এই যে, আমরা দুনিয়ার অন্য কোন জাতির অংশ নই, বরঞ্চ একটি স্বতন্ত্র জাতি। আর অন্য কোন জাতির সাথে মিলিত হয়ে কোন মিশ্র জাতীয়তাও বানাতে পারিনা। দ্বিতীয়তঃ আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি আমাদের দ্বীন। এ ছাড়া আমাদের জাতীয়তার অন্য কোন ভিত্তি নেই। আমার কাছে পাকিস্তান দর্শনের এই একমাত্র অর্থ।
-(একটি ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার। রেডিও পাকিস্তান এ সাক্ষাৎ টেপ করে এবং পাঁর বছর পর ১৯৮০ সালে তা লিপিবদ্ধ ও প্রকাশিত হয়।)
এখন এ কথা দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, নিছক কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে অথবা সাময়িক ভাবাবেগে পরিচালিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করা হয়নি। আন্দোলনের ভাবাবেগ ত অবশ্য ছিল। কিন্তু সে ভাবাবেগের উৎস চিল মুসলমানদের ঈমান ও আকীদাহ বিশ্বাস যার সূচনা হয়েছিল মানব জাতির সৃষ্টির সাথে সাথেই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর দ্বিজাতিততত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে বেল জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে। প্রচারকগণ এতোটা কল্পনাবিলাসী যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে ধরে নিয়ে উপমহাদেশকে ১৯৪৭ পূর্ব ভৌগলিক অবস্থায় রূপান্তরিত করার আন্দোলন করছে।
একদিকে ভারতে ও কাশ্মীরে মুসলিম নিধনযজ্ঞ পূর্ণমাত্রায় চলছে, মসজিদ ধ্বংস করে মন্দির নির্মান করা হচ্ছে, অপরদিকে একজাতীয়তার মিথ্যা ও প্রতারণামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে অতীতেও যেমন তাদের এ ধরণের প্রচারণা কোন কাজে লাগেনি, ভবিষ্যতেও লাগবেনা।
বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, হিন্দুগণ উপমহাদেশে মুসলমানদের কয়েক শ’বছরের শাসনের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে তাদেরেক তাদের গোলাম বানিয়ে রেখে অথবা নির্মূল করে। তার জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এভাবে যে মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে, তাদের নারীজাতিকে অবাদে ভোগ করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হিন্দু সাহিত্যিকগণ তাঁদের সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার করে হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলেছেন। এ ব্যাপারে হিন্দুজাতি ও বৃটিশ সরকার একে অপরের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, হিন্দুদের সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতা ব্যতীত এ দেশে যেমন ইংরেজদের মসনদ পাকাপোক্ত হতে পারতো না ঠিক তেমনি ইংরেজদের আশীর্বাদ ব্যতীত হিন্দুগণ মুসলমানদের প্রতি অমানবিক ও পৈশাচিক আচরণ করতে পারতো না। সর্বশেষে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া মুসলমানদেরকে অন্ধকারে রেখে যেভাবে তড়িঘড়ি প্রণয়ন করা হলো, পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত করে পাকিস্তানকে ক্ষুদ্রতর ও সংকুচিত করা হলো এবং যেভাবে সীমানা চিহ্নিতকরণে মুসলমানদের প্রতি চরম অবিচার করা হলো, এর দ্বারা হিন্দুদেরকে খুশী করে বৃটিশ সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের বহুদিনের পুঞ্জিভূত বিদ্বেষের প্রতিশোধ নিলেন। উপরন্তু পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য গুরুদাসপুর জেলাকে হঠাৎ দুদিন পর ভারতভুক্ত করে দিয়ে কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব সংঘাতের বীজ বপন করা হলো। বিভক্ত বাংলার সীমানা নির্ধারণেও অনুরূপ অবিচার করা হয়েছে।
এ ইতিহাস এখানেই শেষ হচ্ছে। যে প্রেক্ষাপটে এবং যে দৃষ্টিকোণ থেকে এ ইতিহাস লেখা হয়েছে, আমরা বিশ্বাস অধিকতর সুন্দর করে লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের অভাব সমাজে নেই। নতুন প্রজন্মকে তাদের অতীত ইতিহাসের সঠিক জ্ঞানদান করে মুসলিম জাতিসত্তার মধ্যে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে –চিন্তাশীলগণ এগিয়ে আসবেন এ আবেদন রেখে আমার লেখার ইতি টানছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


তথ্যসূত্রঃ

১। মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, মাওলানা আকরাম খাঁ।
২। তোহফাতুল মুজাহেদীন, শেখ যয়নুদ্দীন।
৩। ইস্টার্ণ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ার, চট্টগ্রাম। নীল কমিশন রিপোর্ট-১৮৬১।
৪। রিয়াযুল সালাতীন, গোলাম হোসেন সলিমী। তাবাকাতে নাসিরী।
৫। History of Bengal, স্যার যদুনাথ সরকার।
৬। বাংলার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দোপাধ্যয়।
৭। বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, দীনেশ চন্দ্র সেন।
৮। বাংলা সাহিত্যের কথা, মাওলানা আকরাম খাঁ।
৯। Hussain Shahi Bengal, M.R. Tarafdar.
১০। British Policy and the Muslims in Bengal, A.R. Mallick.
১১। মহানির্ভাণতন্ত্র, ৪র্থ ও ৫ম উল্লাস।
১২। সিরাজউদ্দৌলার পতন, ডঃ মোহর আলী।
১৩। Census of India Report, 1911 A.D. হিলের ইতিহাস, ১ম ও ২য় খন্ড।
১৪। মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদূদ।
১৫। Muslim Struggle for Freedom in India, Muinuddin Ahmad Khan.
১৬। Calcutta Review, 1850, 1913 এবং বিভিন্ন ইস্যু।
১৭। The Indian Mussalmans, W.W. Hunter, Bangladesh Edition 1975.
১৮। The History, Antiquities, Topography & Statistics of Eastern India M. Martin, London-1938, Vol-2.
১৯। Calcutta Christian Observer, July 1832, November 1855.
২০। The Discovery of India, Pandit Jawaherlal Nehru.
২১। Oxford History of India.
২২। The Life of Charles Lord Metcalfe.
২৩। বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, রমেশচন্দ্র মজুমদার।
২৪। রবীন্দ্র রচনাবলী, শতবার্ষিকী সংস্করণ।
২৫। The GreatDivide,H.V.Hodson.
২৬। Survey of Indian History, কে এম পান্নিকর।
২৭। বড়বাবু, সৈয়দমুজতবা আলী।
২৮। শতাব্দী পরিক্রমা, ডঃ হাসান জামান সম্পাদিত।
২৯। Bengali Muslim Public Opinion as reflected in the Bengali Press-1901-1930, Mustafa Nuril Islam.
৩০। রাজসিংহ; কপাল কুণ্ডলা; আনন্দমঠ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়।
৩১। বঙ্কিম রচনাবলী, ষষ্ঠ প্রকাশ, ১৩৮২। নবযুগের বাংলা, বিপিনচন্দ্র পাল।
৩২। মাসিক ‘ইসলাম প্রচারক’, জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, ১৩১৪।
৩৩। Times of India, July 1925, July & December 1918.
৩৪। সাপ্তাহিক ‘সুলতান’, রিয়াজুদ্দীন আহমদ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, (১৯২৩)
৩৫। Indian Sedition Committee Report 1918.
৩৬। The Indian Middle Class: Their Growth, B.B. Misra
৩৭। Jinnah and Gandhi, S.K. Majumdar.
৩৮। Muslim Separatism in India, A. Hamid.
৩৯। ‘দাস্তানে জুলুম’, সেক্রেটারী, মালাবার হিন্দু সহায়তা সভা কর্তৃক প্রকাশিত, অমৃতশহর, ১৯২২, ‘মালাবার কি খুনী দাস্তান’ পুস্তিকা।
৪০। political India, Cumming.
৪১। সিয়াসতে মিল্লিয়া, মুহাম্মদ আমীন যুবেরী।
৪২। The Bengali Muslims & English Education, M. Fazlur Rahman.
৪৩। Appendix to Chahar Darvesh, I.F. Smith.
৪৪। Education in Muslim India, S.M. Jaffar, 1935.
৪৫। Promotion in Muslim India During Muhammadan Rule, N.N.Law
৪৬। Economic History of India, R.C.Dutt
৪৭। On the Education of the People of India, C.E Trevalyan.
৪৮। Review of Buchanan’s Treaties, Sharp.
৪৯। Report of Bengal Provincial Committee, Education Commission.
৫০। Life and Letters of Lord Macaulay, Trevelyan, vol-1.
৫১। Vernacular Education in Bengal, H.A. Stark.
৫২। Macaulay’s Minutes in Education in India, Woodrow, 1862.
৫৩। Life and Letters of Lord Macaulay, Trevalyan, vol-1.
৫৪। Select Committee Report, House of Commons, 1831-32.
৫৫। An Advanced History of India, John Marshall.
৫৬। Board’s Collection 909, এবং বিভিন্ন ইস্যু।
৫৭। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস, সজনীকান্ত দাস।
৫৮। বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যয়।
৫৯। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, আবু জাফর।
৬০। Journal of Asiatic Society of Bengal, Dr. James Wise, vol-LXIII, 1894
৬১। সংবাদপত্রে সেকালের কথা, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয়।
৬২। Encyclopedia of Islam, vol-2.
৬৩। শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী।
৬৪। Bengal Criminal Judical Consultations, 1832.
৬৫। Colvin’s Report, J.R. Colvin.
৬৬। ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ।
৬৭। সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের।
৬৮। তাওয়ারিখ-ই-আজীব, (‘আন্দামান বন্দীর আত্মকাহিনী’) মওলানা জাফর থানেশ্বরী।
৬৯। সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ।
৭০। Modern Religious Movement in India, Faepuhar.
৭১। আমাদের মুক্তিসংগ্রাস, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ।
৭২। Some Personal Experience, Sir-Fuller Bampfylde.
৭৩। Indian Politics Since the Mutiny, C.Y. Chintamoni.
৭৪। History of the Indian Mutiny, Con. J.B. Mallcson.
৭৫। Partition of Bengal, A.R. Mallik.
৭৬। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, ডঃ এম, এ, রহিম।
৭৭। India of Today, Sardar Ali Khan, Bombay, 1908.
৭৮। Iqbal: Selected Writings and Speeches.
৭৯। বংগভংগের ইতিহাস, ইবনে রায়হান।
৮০। নেশনস ইন মেকিং, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি।
৮১। The Autobiography of an Unknuwn Indian, N.C. Chudhury.
৮২। Indian Problems, S.M.Mitra.
৮৩। The Times, Weekly Edition, London, বিভিন্ন সংখ্যা।
৮৪। সংবাদ ভাস্কর, কলকাতা, জুন ১৮৫৭।
৮৫। Glimpses of Old Dhaka.
৮৬। The India We Served, Sir Walter Lawence, London 1928.
৮৭। History of Freedom Movement, Dr. Moyenal Huq.
৮৮। একটি জীবন, একটি চিন্তাধারা, একটি আন্দোলন (উর্দু),আবুল আফাক।
৮৯। The Struggle for Pakistan, Istiap Husain Qureshi.
৯০। Some Recent Speeches & Writtings of Mr. Jinnah, Lahore, 1952.
৯১। The British Acheivement in India: A Survey, Rawlingson.
৯২। Muslim Political Thought through the Ages 1562-1947, G. Allama Mopbul Academy, Lahore.
৯৩। Creation of Pakistan, Justice Syed Shameem Hussain Kadir.
৯৪। Full Text of Jinnah-Handhi Letters, Durlab Singh.
৯৫। History of Bengal, Benoy Ghosh.
৯৬। আরামগানে হেজায, আল্লামা ইকবাল।
৯৭। Evolution of Pakistan, Syed Sharifuddin Pirzada, Lahore 1963.
৯৮। Hindu-Muslim Ittehad par Khulakhat Mahatma Gandhi Ke Nam-Muhammad Abdul Qadir Bilgrami, Aligarh 192.
৯৯। The Muslim Community of the Indo-Pakistan Sub-continent-I.H Qureshi.
১০০। The Making of Pakistan, Richars Symonds.
১০১। India Wins freedom, Maulana Abul Kalam Azad.
১০২। The Emergence of Pakistan, Choudhuty Muhammad Ali.
১০৩। Cabunet Mission and after, Muhammad Ashraf.
১০৪। Mohatma Gandhi: The Last Phase, Pyarelal, vol-1.
১০৫। Pakistan, lan Steshens, (‘Statesman’ পত্রিকার সম্পাদক)।
১০৬। Leonard Moseley.
১০৭। The Transfer of Power in India, E.W.R. Lumby.
১০৮। While Memory Serves, Sir Francis Tuker.
১০৯। The Memories of General the Lord Ismay.
১১০। The Indian Annual Register 1947, এবং বিভিন্ন ইস্যু।
১১১। Mission with Mountbatten, Coampbell Johnson, Allan.
১১২। Economist, May 1947, Sunday Times, June 1947, Manchester Guardian, August 1947, Round Table, Sep, 1947.
১১৩। The British in Asia Guy Eint.
১১৪। Ideological Foundations of Pakistan, Dr. Waheen Qurashy.
১১৫। খুতবাতে ওসমানী, আল্লামা শাব্বীর আহমদ ওসমানী।
১১৬। তারিখে নযরিয়ায়ে পাকিস্তান, অধ্যাপক মুহাম্মদ সালিম।
১১৭। মাওলানা মওদূদীর রেডিও সাক্ষাৎকার যা পরে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
ঢাকা

 


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি