ইসলামী সংগঠনের সংহতি
একটা ইসলামী সংগঠনের সূচনা করা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু একে সঠিক মিজাজে পরিচালনা করা এবং এর সংহতি সংরক্ষণ করা বড়োই কঠিন। কখনো কখনো দেখা যায় সংগঠনের সাথে জড়িত কিছু লোক ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকা পালন করছে।
প্রথমে এদেরকে সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের পরিবর্তে আংশিক আনুগত্য করতে দেখা যায়। কিছুকাল পর এরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আরো কিছুকাল পর দেখা যায় এরা গীবাতের মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তাদের এই ভূমিকা সংগঠনের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর।
যারা এই ধরনের ভূমিকা পালন করে তাদের মন-মানসিকতা বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রধানতঃ নিম্নোক্ত কারণগুলো তাদের অবাঞ্চিত আচরণের জন্য দায়ীঃ
(১) ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্য সম্পর্কে অস্পষ্টতা
ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী কেবল আল্লাহর সন্তোষ অর্জনকেই তার জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য বানিয়ে নেয়ার কথা। রিদওয়ানুল্লাহ বা আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে তার চিন্তাধারা ও কর্মপ্রবাহ। এই মৌল লক্ষ্য যদি ভালোভাবে মন-মগজে স্থান না পায় তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কোন লক্ষ্য সেই স্থান দখল করে নেয়। আর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও সেই লক্ষ্য অর্জিত না হতে দেখলে সে অস্থির হয়ে ওঠে নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই। এই মানসিকতা অস্থিরতা থেকে জন্ম নেয়া অসন্তোষ যা ক্রমশঃ তার চিন্তাধারা ও কর্মধারাকে প্রভাবিত করে।
(২) ইসলামী সংগঠনের বৈশিষ্টগুলো সম্পর্কে অপূর্ণাংগ ধারণা
ইসলামী সংগঠন আর অন্যান্য সংগঠনগুলোর মাঝে আকাশ-পাতালের পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী সংগঠনের নিজস্ব কতগুলো বৈশিষ্ট রয়েছে। এর নেতৃত্ব কাঠামো, নির্বাচন পদ্ধতি, আনুগত্য নীতি, পরামর্শ পদ্ধতি, ইহতিসাব পদ্ধতি প্রভৃতি সম্পর্কে কর্মীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে কর্মী সমাজ অংগনে যেসব সংগঠন দেখে থাকে অথবা সে যেই সংগঠন থেকে এসেছে সেটির বৈশিষ্টের আলোকে এই সংগঠনকেও বিচার করতে চাইবে। এতে করে যারা এই সংগঠনের বৈশিষ্টগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে তাদের চিন্তা আর এই কর্মীর চিন্তার মধ্যে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয়। চিন্তার এই দূরত্ব সংগঠনের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়।
(৩) ইসলামী আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সংশয়
ইসলামী আন্দোলনের একটি বিশেষ কর্মপদ্ধতি রয়েছে। জোর করে মানুষের ঘাড়ে সওয়াব হওয়া এই আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নয়। এই আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের আগে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন আনতে চায়। আবার ব্যক্তির চিন্তাজগতে পরিবর্তন না এনে তার ব্যক্তিগত জীবনে কোন ফলপ্রসূ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী আন্দোলনের মৌলিক কাজই হচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা থেকে জাহেলী ধ্যান ধারণাগুলোর মূলোৎপাটন করে সেখানে ইসলামী ধ্যান ধারণা রোপণ করা। ব্যক্তির চিন্তাক্ষেত্রে ইসলামী ধ্যান ধারণার চারা যতোই বড়ো হতে থাকে তার কর্মপ্রবাহেও পরিবর্তন সূচিত হয় আনুপাতিক হারে। এভাবে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর নিরালস প্রচেষ্টার ফলে সমাজে ইসলামী জীবন বিধান প্রচলনের চাহিদা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলনের গণভিত্তি রচিত হয়। তখন একটি প্রবল আন্দোলন সৃষ্টি করে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা যায়।
ইসলামী আন্দোলনের এই স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতির সাথে ভালোভাবে পরিচিতি না থাকলে একজন কর্মী ডানে বাঁয়ে কর্মরত বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তখন তার নিকট ইসলামী সংগঠনের অনুসৃত কর্মকৌশল অপ্রতুল মনে হয়। আন্দোলনের কর্মপদ্ধতির নির্ভুলতা সম্পর্কে তার মনে সংশয় সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় সংগঠনের অনুসৃত ধারার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
(৪) বিপদ মুসিবাত সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভংগির অভাব
ইসলামদ্রোহীদের ওপর বিপদ মুসিবাত আসে আযাবরূপে। আর মুমিনদের উপর তা আসে পরীক্ষারূপে।
চলার পথের বিভিন্ন মোড়ে ইসলামী সংগঠনকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় অনেকগুলো বিকল্প সামনে থাকে। যেই বিকল্পটি সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হয় সেটিই হয় সংগঠনের সিদ্ধান্ত। সংগঠন জেনে বুঝে কোনদিন কোন কম উত্তম বিকল্পকে সিদ্ধান্তের ভিত্তি বানায় না। কিন্তু সব সময় সর্বোত্তম বিকল্প বেছে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকলেই সংগঠনের ওপর কোন বিপদ মুসিবাত আসবে না এমন ধারণা করা মস্ত বড়ো ভুল।
বিপদ মুসবাত আল্লাহর সিদ্ধান্তক্রমে আসে। তাঁর অনুমোদন ছাড়া কোন ব্যক্তি, দল বা জাতির ওপর বিপদ মুসিবাত আসতে পারে না। বিপদ মুসিবাত চাপাবার আগেই তিনি সেই ব্যক্তি, দল বা জাতির সাথে পরামর্শ করে তা থেকে ইসলামী সংগঠনের ওপর যখন কোন বিপদ মুসিবাত আসে তাকে আযাব মনে না করে পরীক্ষা মনে করা প্রত্যেক কর্মীর কর্তব্য।
বিপদ মুসিবাত সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি কর্মীকে বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত করে। চিন্তার বিভ্রান্তি কর্মীকে সংগঠনের স্রোতধারা থেকে ক্রমশঃ দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
(৫) অগ্রাধিকার নির্ধারণে অক্ষমতা
ইসলামী সংগঠন নানামুখী কাজ করে থাকে। বার কর্মীদেরও এক একজনের এক এক ধরনের কাজের প্রতি বেশী আগ্রহ থাকে। কিন্তু যার যেই কাজের প্রতি বেহী ঝোঁক সে যদি মনে করে যে এই কাজটিকেই সংগঠন অগ্রাধিকার দেয়া উচিত তাহলে সমস্যার উদ্ভব না হয়ে পারে না। সাহিত্যামোদী কর্মী সাহিত্যচর্চাকে, শিল্পীনুরাগী কর্মী শিল্প চর্চাকে, ক্রিড়ানুরাগী কর্মী ক্রিড়াকে, রাজনীতি প্রিয় কর্মী রাজনীতি চর্চাকে অগ্রাধিকার দেবার চাপ দিতে থাকলে সংগঠনের সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রের কাজের গুরুত্ব সংগঠনের সামনে তুলে ধরবে। এটা অন্যায় নয় বরং এটাই হওয়া উচিত। তবে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে সনহহঠন যেই কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দেয় প্রত্যেক কর্মী সেগুলোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। নিজস্ব পছন্দনীয় ক্ষেত্রে সংগঠনের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিতে অগ্রাধিকার না পাওয়ায় খুঁতখুঁত করা ঠিক নয়। মনে এই ধরনের খুঁতখুঁতি থাকলে সমাগ্রইক কাজের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব হয় না।
(৬) মানসিক ভারসাম্যহীনতা
মানসিক ভাসাম্যহীনতা কর্মীকে সংগঠনের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ভারসাম্যহীনতার অনেকগুলো লক্ষণ আছে। এখানে কয়েকটি প্রধান লক্ষণ উল্লেখ করা হলোঃ
(ক) ত্বরা প্রবণতা
অতি শিগগিরি কাজের ফল পাওয়ার আকাংখা কর্মীর মনে দারুন অস্থিরতা সৃষ্টি করে। যেই কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে ফল পাওয়ার জন্য কর্মী উদগ্রীব হয়েওঠে।
(খ) অতি আশা
ভালভাবে পরিচিত না হওয়া পর্যন্ত কর্মী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে তাঁর মনের কোঠায় নিজেই একটি ভাবমূর্তি রচনা করে নেয়। মনে মনে সে তাদেরকে অতি মানবের স্থান দেয়। পরিচিত হবার পর সে দেখতে পায় তারা অতি মানবও নয়, অসাধারণ মানুষও নয়। তখন সে হতাশ হয়। কল্পিত মানুষটিকে পরিত্যাগ করে বাস্তব মানুষটিকে গ্রহণ করলে সমস্যা হয় না। সমস্যা সৃষ্টি হয়ত তখন যখন বাস্তব মানুষটিকে পরিত্যাগ করে কল্পিত মানুষটিকে গ্রহণ করা হয়।
(গ) চরম পন্থার প্রতি ঝোঁক
চরম মনোভাবাপন্ন কর্মী কোন সমকর্মীর সামান্য ভুল-ভ্রান্তিকেও বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। যেই কোন ভুল-ভ্রান্তির সে কঠোর প্রতিবিধানের পক্ষপাতী। তদুপরি বিরোধীদের মুকাবিলায় হিকমাত পূর্ণ কোন কর্মপদ্ধতি তার ভালো লাগে না। গরম ও চরম ধরনের কোন কিছু না হলে তাঁর পছন্দই হয় না।
(ঘ) অহংকার
অহংকারী ব্যক্তি আত্মপূজারী হয়ে তাকে। সে অন্যদেরকে হেয় জ্ঞান করে। নিজের চিন্তাশক্তি ও যোগ্যতা নিয়ে তার বড়ো গর্ব। অন্যদের সাথে খাপ খাওয়ানো তার প্রায়ই হয়ে ওঠে না।
(ঙ) অভিমান
কিছু সংখ্যক কর্মী আছে যারা সামান্যতেই অভিমান করে বসে। সহকর্মী বা নেতার উক্তি বা ব্যবহারে তারা অভিমান করে কাজ কর্ম ছেড়ে দেয়।
এই হচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীনতার কিছু লক্ষণ। মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি সামষ্টিক কর্মকান্ডের ডিফেকটিভ কল-কব্জার ভূমিকা পালন করে থাকে।
(৭) মুখোশ-পরা দুশমনদের ভূমিকা
সংগঠনের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক দুশমন সংগঠনের সাথে জড়িত হতে পারে। এই ধরনের লোকেরা সংগঠনের ভেতরে অহেতুক নানা ধরনের প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়, ভিত্তিহীন কথা প্রচার করে ও সংগঠনের অনুসৃত পলিসি সমূহের সমালোচনা করতে থাকে। তারা সংগঠনের নেতাদের সম্পর্কে কর্মীদের মনে অশ্রদ্ধা ও অনাস্থার ভাব সৃষ্টির জোর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
প্রধানতঃ এই সাতটি কারণে সংগঠনের সংহতি হুমকির সম্মুখীন হয়। সংহতি বিনাশনে এগুলো রোগ জীবাণুর মতো কাজ করে। এসব জীবাণু যাতে সংগঠন দেহে প্রবেশ করতে না পারে অথবা প্রবেশ করলেও গোড়াতেই যারা চিকিৎসা করা যায় সেই দিকে সংগঠন পরিচালকদের বিশেষ দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি